1

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



প্রকাশিত হলো ঋতবাক প্রথম বর্ষ, অষ্টম সংখ্যা। Coincidentally, এ মাসেরই ৮ তারিখে ছিলো “আন্তর্জাতিক নারীদিবস”। আজ থেকে ১০৫ বছর আগে, ১৯১০ সালে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রীদ্বয় লুইজে জিয়েৎস ও ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে নারী শ্রমিকের সমান পারিশ্রমিকের দাবীতে ডেনমার্কের কোপনহেগেন-এ যে সম্মেলনের সূচনা, আজ তার তাৎপর্য অনেক ব্যপকতা লাভ করেছে। ৮ই মার্চ দিনটিকে এখন সমাজের সর্বস্তরে নারীর সমানাধিকার দাবীর উদযাপন দিবস হিসেবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। ইউনেস্কোর ‘নারী দিবস’ পালনের আহ্বানের উদ্দেশ্যই হলো নারী সচেতনতা বৃদ্ধি। বছর-ব্যাপী নানান অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে সেই কর্মসূচী বজায় থাকে। তারই অংশ হিসাবে ঋতবাক অষ্টম সংখ্যার মূল উপজীব্য বিষয় চেতনায় প্রাধান্য পেয়েছে ‘নারী’। 

শতাব্দী প্রাচীন এই স্মারক দিবসটির ইতিহাস সকলের জানা। সে নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু যে কোনো একটি বিশেষ বিষয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে একটি দিবস চিহ্নিত করা এবং সেটিকে যুগপৎ নিষ্ঠা ও উত্তেজনার সঙ্গে পালন করার অর্থই হলো বিষয়টি সম্বন্ধে ব্যপক সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়াস ও প্রয়োজনীয়তা। আর এই প্রয়োজনীয়তার মধ্যেই কোথায় যেন নিহিত রয়েছে পুরুষের প্রচ্ছন্ন অহংকার। পৃথিবীতে ‘পুরুষ দিবস’ পালনের প্রয়োজনীয়তা তো কই অনুভূত হচ্ছে না এমন ব্যপক ভাবে? এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলতেই আমার এক প্রকৃত অর্থে প্রগতিশীল, মুক্ত মন, সুরসিক পুরুষ বন্ধু বললেন, যে Risk নেবে, সে তো Advantage নেবেই, Madam ! একদম Primitive Age-এর কথা ভাবো, যখন নারী নিজেই গুহার নিরাপত্তা বেছে নিয়েছিলো প্রতিনিয়ত হিংস্র বন্য প্রাণীর সঙ্গে সংঘর্ষের চাইতে, যে দায়িত্বটা পুরুষকেই নিতে হয়েছিলো। পশুর রাজত্বে সেটা হয়না, তাই সেখানে Chauvinism ও নেই। 

আত্মপ্রত্যয়ে টান পড়লো। তবে কি প্রগতির চরম সীমায় দাঁড়িয়েও সেই গুহামানবীর সঙ্গে আমার আসলে পার্থক্য শুধুই সাজ পোষাক আর ‘Whatsapp / Facebook-জ্ঞান’-এ? সমাজতত্ত্ববিদরা কি বলছেন? একটু খুঁজতে গিয়ে হাতে এলো The Millennium Development Goals Report, 2012 –সহ আরো বেশ কিছু রিপোর্ট । তা, কি বলছে MDG -সহ এই রিপোর্টগুলি? অজানা কোনো তথ্য নয়। একবার চোখ বুলিয়ে নিই প্রসঙ্গিক কিছু পরিসংখ্যান-এ। 

এই রিপোর্ট অনুযায়ী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য তথ্য হোলো, নারীর সামগ্রিক প্রগতি, অর্থাৎ শিক্ষায়, অর্থনৈতিক স্বাধীনতায়, রাজনৈতিক ক্ষমতায় এবং সমাজে স্বয়ংসম্পূর্ণ মানবাধিকারে প্রতিষ্ঠিত হবার ক্ষেত্রে প্রধান বাধাই হোলো নারীর নিরাপত্তাহীনতা, যা তাকে কাঙ্খিত লক্ষ্যের চরম সীমায় পৌঁছতে দিচ্ছেনা। 

শিক্ষাক্ষেত্র থেকেই শুরু করা যাক। রিপোর্ট বলছে, আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতেও প্রাথমিক স্তরে ছেলেদের তুলনার মেয়েদের enrollment লক্ষ্যনীয় ভাবে বিষম – অর্থাৎ কম, যদিও সাফল্যের হার আশ্চর্যজনক ভাবে ঠিক উল্টো, অর্থাৎ ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সাফল্য অনেক বেশী। Secondary লেভেলে এই পরিসংখ্যান আরো ভয়ানক। এই পর্যায়ে মেয়েদের আরো কম নথিভুক্তিকরণের সূচকগুলি যথাক্রমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আপেক্ষিক অপ্রতুলতা জনিত কারণে বাসা থেকে দূরত্ব – ফলে সেই কিশোরী কন্যার নিরাপত্তাহীনতা, সমাজ ও স্বজনের বিপ্রতীপ পীড়ন ও বাল্য বিবাহের প্রবণতা এবং সবচেয়ে মর্মান্তিক কারণ হোল – “ Bad Investment Theory ” ।

কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও চিত্রটা পৃথক নয়। Vulnerable Employment –এ পুরুষের তুলনায় নারীর অংশগ্রহণ সামগ্রিক ভাবে সারা বিশ্বেই অপেক্ষাকৃত বেশী। প্রাসঙ্গিক কিছু পরিসংখ্যানঃ-
২০১১এ উত্তর আফ্রিকায় Ratio-টা ৪৪:২২, পশ্চিম এশিয়ায় যেটা ৪১:২২, আর সাব সাহারান আফ্রিকায় ৮৫:৬৯। যুগপৎ অকল্পনীয় এবং মর্মান্তিক।

চাষের কাজে সাহায্য, গ্রামাঞ্চলে দূর দূরান্ত থেকে গৃহস্থলীর কাজের প্রয়োজনে জল সংগ্রহ করা, ইঁট ভাটায় সাহায্যকারী হিসাবে কাজ করার মতো অজস্র কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছেলেদের তুলনায় ৬৫% বেশী। অথচ বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কর্মসংস্থানের প্রয়াসে একই শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কর্ম দক্ষতা সম্পন্ন একজন নারী পারিশ্রমিক এবং দায়িত্বশীল পদাধিকার লাভে এখনো অনেকটাই পিছিয়ে পুরুষদের তুলনায়। সামগ্রিক সামাজিক সুরক্ষা লাভের অভাবে উচ্চকোটির স্বনিযুক্তি প্রকল্পেও মেয়েদের অংশগ্রহণ দুঃখজনক ভাবে কম। আন্তর্জাতিক স্তরে Top Level Occupation ও Senior Management Position-এ মেয়েদের অধিকার এখনো মাত্র ২৫% । সমাজের অন্যান্য স্তরে মেয়েদের বহুল চর্চিত বঞ্চনার বিবরণে আর নাই গেলাম!

আচ্ছা, বলুন তো, পরিসংখ্যান গুলি ছাড়া কোন্‌ তথ্যটা আমাদের অজানা? স্পষ্টতঃই, সমগ্র মানবজাতির অগ্রগতির নিরিখে নারীজাতির অগ্রগতির হার মোটেই সমানুপাতিক নয়, এ কথা অনঃস্বীকার্য। আসলে নারীর এই সামগ্রিক অনগ্রসরতায় পুরুষের অবদানও কিছু কম নয়। লক্ষ্যনীয়, “পুরুষ” সিংহটি কিন্তু তার সঙ্গিনীটিকে কোনোও অবস্থাতেই Spare করে না। আর এদিকে পুরুষ “সিংহ”-টি আবার তাঁর সঙ্গিনীটিকে Spare না করে নিতান্তই পারেন না। আসলে, গলদটা একেবারে গোড়াতেই। 

সচেতনতা বেড়েছে, নিঃসন্দেহে। কিন্তু, সচেতনতা বাড়ার অর্থ কি শুধুই জ্ঞান সংগ্রহ, মোমবাতি মিছিল, অবস্থান ধর্মঘট, বিক্ষোভ প্রদর্শন আর ফেসবুক-ট্যুইটারে পাতা ভরানো? এখনো যদি ঘুম না ভাঙ্গে, তাবে আর কবে? আমার সন্তানকে কোন্‌ মুল্যবোধ, কোন্‌ বাসযোগ্য পৃথিবীর উত্তরাধিকার দিয়ে যাবো, সে কথা ভাবার সময় কি এখনো আসে নি? আর শুধু ভেবে ভেবে বসে থাকাই বা কেন? আসুন না, হাতে হাত মিলিয়ে সক্রিয় প্রয়াস ও সদ্‌ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে সম্মার্জনাকে জীবনচর্চার প্রাসঙ্গিক অন্তরঙ্গ সঙ্গী করে তুলি !! আলাদা করে নারী বা পুরুষ নয়, সসম্মানে মানুষ হিসাবে মিলে মিশে ভালো থাকা কি নিতান্তই অসম্ভব?!

আপনাদের সাধু ভাবোন্মেষের সোচ্চার প্রকাশে নিরন্তর সমৃদ্ধ হোক ঋতবাক

শুভেচ্ছান্তে,

সুস্মিতা বসু সিং 




1 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ অমৃত অধিকারী

Posted in



প্রচ্ছদ নিবন্ধ





নার্যায়ণ

অমৃত অধিকারী



গত ৮ই মার্চ, রবিবার, গিন্নির বিধান অনুযায়ী গৃহস্থালীর সব দায়িত্ব আমার ছিলো। দোকান-বাজার, ছেলেমেয়েকে পড়ানোর মতন সাধারণ পুরুষজনোচিত রবিবাসরীয় কর্মগুলি ছাড়াও রান্না, ঘর গোছানো, কাজের মেয়ে, দুধওয়ালা, ধোপা, ইত্যাদিকে ধমকধামক দেওয়া জাতীয় গুরুদায়িত্বগুলিও আমাকেই পালন করতে হয় সেদিন। কারণ? ওই দিন ছিলো নারীদিবস।



আধুনিক বাঙালির বারো মাসের পাঁচ তেরোং পঁয়ষট্টি পার্বণের নবতম সংযোজনগুলির অন্যতম এই উৎসবটি আমাদের মতন শান্তশিষ্ট‌-পত্নীনিষ্ঠ-সুযোগ-পেলেই-হই-পাপিষ্ঠ ভদ্রলোকদের জন্য বেশ সরেস। আমরা বাঙালিরা আবহমান কাল ধরে শক্তিমতী মহীয়সীদের ভক্ত। আমাদের শস্যশ্যামলা দেশে তাই দেবতাদের চাইতে দেবীদের রমরমা চিরকাল বেশি। কালী-দুর্গা-জগদ্ধাত্রী-সরস্বতীর মাতৃভক্ত সন্তান আমরা। তাই নারী দিবসে আমরা যে উৎফুল্ল হয়ে উঠবো, তাতে আর আশ্চর্য কি? সেই সঙ্গে আছে বামপন্থার প্রতি আমাদের দীর্ঘ আনুগত্য ও ভরসা। 



প্রসঙ্গত, আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রথমবার পালিত হয় নিউ ইয়র্ক শহরে, ১৯০৯ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি, সোশ্যালিস্ট পার্টি অফ অ্যামেরিকার তত্ত্বাবধানে। ১৯১০ সালের অগস্ট মাসে ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহ্যাগেনে আয়োজিত হয় সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের একটি মহিলা সম্মেলন। সেখানে সমাজবাদী নেত্রীদ্বয় লুইজে জিয়েৎস (LuiseZietz)ও ক্লারা জেটকিন (Clara Zetkin) প্রস্তাব করেন একটি আন্তর্জাতিক নারী দিবস প্রবর্তন করার। তারপর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে পূর্ব ইওরোপের বিভিন্ন দেশের বামপন্থীরা, বিশেষত মহিলারা, নারীস্বাধীনতা ও নারীদের আর্থসামাজিক অধিকার নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যান। এরই মধ্যে ১৯১৪ সালে প্রথমবার ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়। কেন সেই দিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিলো, তার কোনও নির্দিষ্ট কারণ পাওয়া যায় না। সেদিন কোথাও কোনও প্রতিবাদ মিছিল বা সম্মেলনেরও কোনও খবর নেই ইতিহাসের কাছে। সম্ভবত রবিবার ছিলো বলেই ওই দিনটি নির্ধারিত হয়েছিলো। কি জানি, হয়তো এবারের মতন সেদিনও পত্নীভক্ত পতিকুল গৃহস্থালির সব দায়িত্ব অসমসাহসিকতায় কাঁধে তুলে নিয়ে স্ত্রীদের কিটি পার্টিতে পাঠিয়েছিলেন...! কিন্তু সে যাই হোক, ঘটনা হলো তার পর থেকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের জন্য ওই দিনটিই নির্দিষ্ট হয়ে যায়।

মোট কথা, নারীভক্তি এবং বামানুরাগ মিলিয়ে আমরা বাঙালিরা নারীদিবস পালনে যারপরনাই আগ্রহী। কিন্তু বাদবাকি ভারতবর্ষ? একটু ভাবনার বিষয়। দেশটা যে বেশ দ্রূতগতিতে বিবর্তিত এবং পরিবর্তিত হচ্ছে, সে কথা বলা বাহুল্য। একটা সময় পর্যন্ত, এই কিছুদিন আগে অবধিও, আমাদের মতন হ্রস্ববুদ্ধি আশাবাদীদের মনে হচ্ছিলো যে পরিবর্তনের অগ্রভাগটা সম্মুখস্থিত। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ এই রকম একটা সন্দেহ মনের ভিতর দানা বাঁধতে আরম্ভ করেছে, যে সেটা আসলে পশ্চাৎমুখীও হতে পারে! ধর্মের ধ্বজা যত উড়ছে, সন্দেহটা তত বেশি গেড়ে বসছে আমাদের দুর্বল, অবিশ্বাসী মনের ভিতর। তার উপর আবার সরকার বাহাদুর আমাদের নৈতিক চরিত্রশুদ্ধির জন্য নানারকম নিষেধাজ্ঞা জারি করতে আরম্ভ করেছেন। সদুদ্দেশ্য নিশ্চয়ই। কিন্তু তাতে করে নিজেদের বিচারবুদ্ধি-বিবেচনার উপর ভরসা যে আমাদের ক্রমে তলানিতে এসে ঠেকছে, সেইটাই সবিশেষ চিন্তার বিষয়।

এবং সমস্যার মূলটাও সেইখানে। নিয়ম-কানুন, বিধি-নিষেধের আধিক্য সেখানেই, যেখানে ব্যক্তির বিবেচনা ও মূল্যবোধের উপর সমাজের ভরসা কম। ভারতবর্ষের মতন দেশে, যেখানে প্রকৃত মুক্তমনা, শিক্ষিত মানুষ খুঁজতে গিয়ে জীবাশ্মবিজ্ঞানের অবতারণা করতে হয়, সেখানে এই শিব ঠাকুরের আপন দেশ মার্কা সমস্যাটা যে সহজে যাবে না, সে কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু সেই সমস্যা নিবারণ করতে করতে দেশের নারীর যে হাঁড়ির হাল হচ্ছে, একবিংশ শতাব্দীর বয়ঃসন্ধিতে দাঁড়িয়ে সেটা মেনে নেওয়া মুশকিল।

ভারতীয় নারীর হাঁড়ির হাল অবশ্য আজকের কথা নয়। যতই বেদে গার্গী-মৈত্রেয়ীদের নাম থাকুক, তাঁরা যে নিতান্তই ব্যতিক্রমী ছিলেন, তাই নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। হাতে গোনা এই কয়েকজন ছাড়া আর ক’জন নারী সুমহান বৈদিক সভ্যতার লিঙ্গসাম্যের(gender equality) জয়গান গাইতেন, গুণতে গেলে বোধহয় এক হাতের কড়ই যথেষ্ট হবে। পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারের কথা যদি ছেড়েও দেওয়া যায়, গুরুগৃহে বাস করে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটুকু লাভ করার সুযোগ আর্য রমণীদের কোনওকালে ছিলো, এমন প্রমাণও পাওয়া যায় না। উদারচেতা ব্রাহ্মণ ঋষিদের কন্যারা বা পত্নীরা তাঁদের পিতাঠাকুর বা স্বামীদেবতাদের কাছ থেকে যতটুকু শিক্ষা লাভ করতেন, তাতেই তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হতো। সে যুগে পুত্রের গুরুত্ব যে কি অপরিসীম ছিলো, মনুসংহিতার ‘‘পুত্রার্থে প্রিয়তে ভার্যা’’ থেকেই তা পরিস্ফুট। পু্ত্রহস্তের পিণ্ডলাভ না করলে পুন্নাম নরকে ঠাঁই হতো বৈদিক আর্য পিতাদের! মাতাদের কথা জানি না। অথর্ববেদের প্রান্তিক কোনও সূক্তে উল্লেখ থাকলেও থাকতে পারে। অধমের পড়াশোনা অদ্দূর নয়।

তবে বৈদিক যুগে নারীদের প্রেম-ট্রেম করার অধিকার পুরোদস্তুর ছিলো। নিজেরা নিজেদের সঙ্গী নির্বাচন করতে পারতেন অবাধে। সঙ্গমও যাচনা করতে পারতেন তেমন তেমন তাড়না হলে। সে সবের নজির ছড়িয়ে আছে বেদ-পুরাণ-মহাকাব্যের পাতায় পাতায়। অধুনা যাঁরা সনাতন ভারতীয় কৃষ্টিরক্ষার মহান দায়িত্ব আপন স্কন্ধে স্থাপন করে ভ্যালেন্টাইন দিবস জাতীয় অর্বাচীন উৎসবগুলিকে উৎখাত করার প্রবল প্রচেষ্টায় প্রায় শহীদ হতেও রাজি, তাঁরা যদি জানতেন যে প্রাচীন ভারতে বসন্তোৎসবের দিন নারীপুরুষের মিলন ও সঙ্গমে কোনও বিধিনিষেধ থাকতো না, এমন কি পরস্পর পূর্বপরিচিতি না থাকলেও নয়, তবে হয়তো তাঁরা ভ্যালেন্টাইন দিবসের নির্দোষ, নেহাতই চন্দ্রাহত ছেলেমেয়েগুলিকে অব্যহতি দিতেন। প্রসঙ্গত, সম্রাট আকবর তাঁর রাজত্বকালে এই বসন্তোৎসবের পুনর্প্রবর্তন করেন। কিন্তু ততদিনে এ দেশের যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। পর্দানশীন হাসীনা আর অবগুন্ঠিতা সুন্দরীদের দিয়ে আর যাই হোক, বসন্তোৎসব হয় না!

কিন্তু নারীদিবসের আলোচনায় নেমে একটু ফাঁক পেয়েই কেমন সরসরিয়ে সরস মাধুরীর দিকে এগিয়ে চলেছি! পুরুষের মন, আর কি! ওই... সুযোগ পেলেই হই ...! সে যাই হোক, এই সেদিন এক বিদ্বান বন্ধু দুঃখ করছিলেন, কেন নারীদের জন্য আলাদা সুরক্ষা, সংরক্ষণের ব্যবস্থা লাগবে? নারীরা কি অনুন্নত জাতি নাকি? তাতে এক রসিক বন্ধু বললেন, অনুন্নত না হলেও, বিপন্ন তো বটেই! যে দেশের পুরুষকে বোঝানোর প্রয়োজন হয় যে নারীধর্ষণ তার জন্মসিদ্ধ অধিকারের মধ্যে পড়ে না, সে দেশে নারীকে বিপন্ন ছাড়া আর কি বলা যাবে? আরেক মহিলা বন্ধু প্রশ্ন করলেন, যে দেশের নারীরাই স্বয়ং বলেন, ধর্ষণের প্রধান কারণ নাকি মেয়েদের খাটো পোষাক পরে পুরুষবন্ধুদের সঙ্গে বেলেল্লাপনা করা, সে দেশে নারীর ন্যূণতম দৈহিক সুরক্ষার অধিকার কে সুরক্ষিত রাখবে?

সদুত্তর দেওয়া গেলো না। সত্যিই তো, নগরকোটাল থেকে আরম্ভ করে মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত সবাই মেয়েদের সাবধানে থাকার উপদেশ দিচ্ছেন। হিতোপদেশ নিঃসন্দেহে। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন যেন পায়ে জুতো না পরে চামড়ার আস্তরণ দিয়ে মাটি ঢাকার চেষ্টার মতন। বা হয়তো এক্ষেত্রে সেটাই সমস্যার সমাধান। আমাদের অল্পবুদ্ধিতে মালুম দিচ্ছে না। হয়তো আমাদের মেয়ে-বোনেদেরই আরও সতর্ক, আরও অবগুন্ঠিত হতে হবে আধুনিক ভারতবর্ষে সসম্মানে বাঁচার জন্য। যেমন সৌদি আরবে বা ইরানে বা সিরিয়ায় হয়। হয়তো আমাদেরও শহরগুলির পথে পথে আর ক’বছর পর বেত্রহস্ত ধর্মপুলিশ দেখা যাবে, যারা সরকার অনুমোদিত মাপজোকের বাইরে পোষাক পরিহিতা মহিলাদের দেখলেই সপাসপ বেত্রপ্রদান করবেন!

অথচ আমাদের সরকার বাহাদুর কিন্তু নারীক্ষমতায়ন(woman empowerment)-এ সম্পূর্ণ বিশ্বাসী। মহিলাদের জন্য সরকারি চাকরি থেকে আরম্ভ করে বিধানসভার আসন পর্যন্ত সংরক্ষণে তৎপর আমাদের সুমহান সরকার। চারদিকে নারীসন্তানের সমাধিকার নিয়ে সোচ্চার ঘোষণা, নারীজাগরণের জিগির। তাহলে আজকের নারীর কিংকর্তব্য?

কঠিন প্রশ্ন। কারণ পুরুষের যা প্রধান কর্তব্য, অর্থাৎ নিজের শিক্ষা ও কর্মজীবনকে প্রতিষ্ঠিত ও সুরক্ষিত করা এবং পরিবার প্রতিপালন করা, সেই সব কিছু আজ নারীরও কর্তব্য। সে সব কর্তব্য পালন না করলে লিঙ্গসাম্যের দুর্ভাগ্যজনক প্রতিযোগিতায় অবধারিত ভাবেই পিছিয়ে পড়বে নারী, যেমনটা চিরকাল পড়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে নারীর আরও কিছু অতিরিক্ত কর্তব্যও আছে। অন্তত সমাজচেতনায় আছে। গৃহস্থালীর কাজ এবং সন্তান জনন ও পালন সেই অতিরিক্ত কর্তব্যগুলির মধ্যে মুখ্য। সে সব সামলে নিজের পেশায় সম্পূর্ণ মনোনিবেশ ও আত্মনিয়োগ করার সুযোগ আমাদের সমাজে কম নারীই পান। তবে সংখ্যাটা বাড়ছে, এটাই যা আশার কথা।

অন্তত গত বছর অবধি পরিসংখ্যান সেইরকমই বলছে। কিন্তু মুশকিল হলো, এর মধ্যে আবার মহান হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণ হয়েছে। গৈরিকধারী মহাপুরুষরা বিধান দিয়েছেন, হিন্দু নারীর নাকি জীবনের চরম সার্থকতা গৃহকর্ম সম্পাদনে, এবং সেই সম্পাদনার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ নাকি অন্তত পক্ষে চারটি সন্তান উৎপাদন করা! সনাতন ধর্মের যা সব থেকে বড় মন্ত্র, অর্থাৎ ‘‘সবই বেদে বলা আছে’’কে পাথেয় করে আমরা সগৌরবে পশ্চাৎমুখে অগ্রসর হয়ে চলেছি, এবং সে আগ্রাসনে এক বিরাট সংখ্যক শিক্ষিত মানুষের উৎসাহ বিস্ময়কর!


তবু আমরা, নারীভক্ত বাঙালিরা এবং আমাদের মতন দুর্বলচিত্ত আর যাঁরা আছেন, এই আশায় বুক বাঁধবো যে খুব শিগগিরি একদিন আমাদের নারীরা সমাজ ও অর্থনীতি পরিচালনার দায়িত্বখানি নিজস্কন্ধে উত্তোলন করবেন। নিঃসন্দেহে সেদিন সন্ত্রাসবাদ বা আন্তর্জাতিক শত্রুতা ও যুদ্ধের মতন সভ্যতাজনিত রোগগুলির থেকে পৃথিবীর মুক্তি ঘটবে... এবং আমরা, পুরুষরা, মনের আনন্দে সারাদিন ঘরকন্না সামলে বিকেলের দিকটা ফ্রেশ-ট্রেশ হয়ে বেরোবো পাপী(puppy… kitty-র সম্ভাব্য পুং)পার্টির উদ্দশ্যে। উফ্‌! ভেবেই অনাবিল আনন্দ হচ্ছে!

2 comments:

0

বিশেষ প্রবন্ধঃ কেয়া মুখোপাধ্যায়

Posted in


বিশেষ প্রবন্ধ


নির্ভয় আকাশ আর আলোর খোঁজে
কেয়া মুখোপাধ্যায়



আরো একটা আন্তর্জাতিক নারীদিবস চলে গেল।

নারীর অধিকারের দাবিতে শুরু হওয়া এই সংগ্রামের বয়স দাঁড়ালো একশো পাঁচ। ১৯১১ তে জার্মান সোশালিস্ট দলের নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে এর সূচনা। ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক নারীবর্ষে দাবি উঠল ৮ই মার্চ-কে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দেবার। উন্নয়ন, শান্তি ও সমতার ভিত্তিতে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করার লক্ষ্য নিয়ে এই দিনটিকে স্বীকৃতি দিল রাষ্ট্রসঙ্ঘ। বিশ্ব নারী আন্দোলনের দাবি মেনে নিয়ে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ১৯৭৫-৮৫ এর দশকটিকে আন্তর্জাতিক নারী দশক ঘোষণা করল। প্রথম স্বীকৃতির পর থেকে আজ পর্যন্ত নানা ‘থিম’ নিয়ে আন্তর্জাতিক নারীদিবস পালন করা হয়ে চলেছে। কখনো ক্ষুধা, দারিদ্র আর অশিক্ষার বিরুদ্ধে জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি বা লিঙ্গসমতার দাবিতে আবার কখনো বা হিংসার বিরুদ্ধে লিঙ্গসমতার দাবিতে গোটা বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আহ্বান।

১৯৯৫ সালে বেজিং-এ আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রকাশ করল নারী অধিকার সংক্রান্ত একটি ঘোষণাপত্র। নারীদের বিশ্বব্যাপী অধিকারহীনতার কথাই আবারো স্পষ্ট হল সেই ঘোষণাপত্রে। তার প্রতিকার হিসেবে নানা কর্মসূচীও ঘোষিত হল। কিন্তু যখন ভাবতে বসি, গত একশো পাঁচ বছর-ব্যাপী এই সুদীর্ঘ মানবিক আন্দোলনের ফল কী হয়েছে বা কতটুকু করা গেছে, তখন সত্যি চমকে উঠতে হয়। অধিকারের দাবিতে এমন চূড়ান্ত ফলাফল-হীন দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলন বোধহয় আর দ্বিতীয়টি নেই! একুশ শতকের প্রায় দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও, আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক- সবদিকেই বিশ্বের বেশিরভাগ জায়গায় মেয়েরা আজও তীব্র বৈষম্য আর নির্যাতনের শিকার। নারীর ক্ষমতায়নের কথা ঘোষিত হলেও তার বাস্তব রূপায়নে তেমন উদ্যোগী নয় অধিকাংশ দেশ। এবছর বেজিং-এর সেই ঘোষণাপত্র প্রকাশের কুড়ি বছর পূর্তি। এই কুড়ি বছরে কিছু কাজ হলেও, এখনো অনেক পথ চলার বাকি। সেই পথও সুগম নয়, অনেক ফাঁক রয়ে গেছে। সেই ফাঁকগুলোকে ভরাতে চেয়েই এবার রাষ্ট্রসঙ্ঘের থিম:

“Empowering Women, Empowering Humanity: Picture it!” 

বলা হচ্ছে:

"Planet 50-50 by 2030. Step it up for Gender Equality"

অনেকে প্রশ্ন তোলেন, তথাকথিত আধুনিক আর প্রগতিশীল হয়েও বছরের মাত্র একটি দিনকে নারীদিবস হিসেবে চিহ্নিত করায় কিসের গৌরব! এই সংরক্ষণে তো একজন নারীর মধ্যে তীব্রভাবে বেঁচে থাকা ‘মানুষ’ সত্ত্বাটির চূড়ান্ত অবমাননা! নারীদিবস কি আজও প্রাসঙ্গিক? উত্তরে বলতে হয়, অবশ্যই! বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে নারী সমাজের বৃহত্তর অংশ আজও নির্যাতন, বঞ্চনা আর শোষণে বিপর্যস্ত। অধিকাংশ সমাজ ব্যবস্থা পুরুষ প্রধান। সামাজিক বিধিনি‍‌ষেধই হোক কিংবা পারিবারিক নিয়ন্ত্রণ- সবই পুরুষদের হাতে। তাই পরিবারের পুরুষ সদস্যের ওপরেই নির্ভর করে থাকতে হয় বেশিরভাগ নারীকে। এর ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই আছে, তবে তা সংখ্যাতত্ত্বের হিসেবে এতই অপ্রতুল যে তাকে গণ্য করা যায় না। অনেক সময়, মেয়ে-সন্তানের জন্ম দেওয়াটাই অপরাধ! যদি বা কষ্টেসৃষ্টে ভ্রূণ অবস্থায় আবর্জনায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার থেকে বেঁচে যায়, তবু সে নেহাতই ‘মেয়ে’ একজন, মানুষ নয় মোটেই। কবিতা সিংহ লিখেছিলেন, ‘মেয়েদের মাথার বাইরের দিকটা নিয়েই সকলের আগ্রহ, মাথার ভিতরটা নিয়ে কারোর কোনও মাথাব্যথা নেই।’ ছোট্ট থেকে একটি মেয়েকে শেখানো হয় সাবধান হতে, বাইরে জুজু কি হুলো বসে আছে। অসাবধান হলেই ধরে নিয়ে যাবে। বলা হয়, ঘরেই সে নিরাপদ, বাইরে ভয়৷‌ সিমোন দি বুভ্যারের কথায়,

‘মেয়েরা নারী হয়ে জন্মায় না, তাদের নারী হিসাবে গড়ে তোলা হয়।’

নিরাপত্তার আশ্বাস তাকে কেউ দেয় না- না পরিবার, না সমাজ, না রাষ্ট্র!

রাষ্ট্রসঙ্ঘ বলছেন আর পনেরো বছরের মধ্যেই এ বিশ্বে সমতা আনার লক্ষ্যে, লিঙ্গবৈষম্য দূর করে নারী-পুরুষ ৫০-৫০ করতে পদক্ষেপ নিতে।

কিন্তু কী করে দূর হবে এই লিঙ্গবৈষম্য? আন্তর্জাতিক নারীদিবসের ঠিক চারদিন আগে এক ঘন্টার তথ্যচিত্রে সমাজের ভয়ঙ্কর এক বাস্তব উঠে এল যে! লেসলি উডউইন-এর তথ্যচিত্র “ইন্ডিয়া’জ ডটার” দেখিয়ে দিল আমাদের দেশে শুধু পুরুষই নারীকে ধর্ষণ করে না, সমাজও করে, উঠতে-বসতে। দেখিয়ে দিল, পুরুষদের সাত খুন মাফ। কিন্তু সন্ধ্যে নামার আগেই হাঁস-মুরগির খোয়াঁড়ে ফেরার মতই মেয়েদের ঢুকে পড়তে হবে অন্দরে। নাহলে ওই হাঁস-মুরগির মতই ‘অন্ধকারে’ হারিয়ে যাওয়াতে অস্বাভাবিক কিচ্ছু নেই।

ঘন্টাখানেকের ওই তথ্যচিত্রটা দেখতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। চোখের সামনে ১৬ই ডিসেম্বর, ২০১২-র ভয়ানক নৃশংসতার মুহূর্তগুলোর সাজেস্টিভ অভিনয় দেখা বা ‘নির্ভয়া’ জ্যোতি সিং-এর অসহায় বাবা-মা-র অনুভূতি শোনা বড় যন্ত্রণার। সেইসঙ্গে তীব্র ক্ষোভ আর ঘৃণা তৈরি হচ্ছিল মনে, যখন শুনছিলাম মেয়েদের উচিত-অনুচিত থেকে শুরু করে তার গোটা অস্তিত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দিচ্ছিলেন তথাকথিত কিছু ‘শিক্ষিত’ পুরুষ। সমাজের সামনে ধরা তথ্যচিত্রের এই আয়না দেখিয়ে দিল আমাদের চারপাশে মানুষের চেহারায় ঘুরে বেড়ায় কত বিকৃত মানসিক রোগী।

অনুতাপহীন, নির্বিকার মুখে ধর্ষক মুকেশ সিং বলেছে,

‘ধর্ষণে মেয়েদের দোষই বেশি’, ‘ভদ্রঘরের মেয়ে রাত নয়টার পরে বাড়ির বাইরে থাকে না' ‘ধর্ষণের সময় বাধা দিয়ে মেয়েটা ভুল করেছে', ‘ওর চুপচাপ থাকলে আমরা ‘কাজ সেরে’ওকে ফেলে রেখে চলে যেতাম’, ‘মেয়েটাকে ‘শিক্ষা’ দিতে চেয়েছিল বলে শরীরের ভেতর থেকে ছিঁড়ে বের করে আনা অন্ত্রের টুকরো কাপড়ে মুড়ে রাস্তায় ফেলে দিয়েছিল আমার ভাই’, ‘আমাদের যদি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তা হলে এর পর কেউ ধর্ষণ করলে মেয়েটাকে আর বাঁচিয়ে রাখবে না। একেবারে প্রাণে মেরে ফেলবে!’

আর আইনজীবীরা কী বললেন? আইনজীবী এ পি সিং বললেন,

“আমার মেয়ে বা বোন যদি বিয়ের আগে কোনও সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে, তা হলে তাকে আমার বাগানবাড়িতে নিয়ে গিয়ে সব আত্মীয়স্বজনের সামনে গায়ে পেট্রোল ঢেলে জ্বালিয়ে দেব,” “সন্ধ্যে সাতটার পর মেয়েদের রাস্তায় বেরোনো উচিত নয়। খুব দরকারে বেরোলেও বাবা, কাকা কি জ্যাঠার মত আত্মীয়েরসঙ্গে। তা নাহলে ছেলেরা ভুল করলে কিছু বলা উচিত নয়!”

আইনজীবী এম এল শর্মা জানালেন,

“lady should not be put on road like food! ‘খাদ্য’ হিসেবে নারীদের রাস্তায় ছেড়ে দিলে তো পুরুষদের উত্তেজনা হবেই।”

ড্রাইভার মুকেশ কি ‘শিক্ষিত’ আইনজীবী সিং আর শর্মা তো একা নয়। অনেক পুরুষের, অনেক তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ পুরুষের মনে চেপে রাখা আসল কথাটা এরা বলে দিয়েছে। এটা দেখে ক’জন পুরুষ উপলব্ধি করবেন যে তাঁদের চিন্তাধারা ভুল, তা জানি না। তবে আশঙ্কা হয়- অনেকেই হয়তো এইসব বক্তব্যগুলোর সঙ্গে সহমত হবেন! 

আর শুধু এঁরা কেন? পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও ধর্ষণ বেড়ে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি দেখাতে গিয়ে অবলীলায় বলেছিলেন, ‘‘জনসংখ্যা বেড়েছে, ধর্ষণ তো বাড়বেই''৷ আমরা কি তা ভুলে গেছি? ভারতের পুলিশ মেয়েদের রাতে ঘর থেকে না বেরোনোর উপদেশ আর ‘শোভন' পোশাক পরার পরামর্শ দিয়েছেন- তা-ও কি মনে নেই আমাদের? মনে নেই কি পুরুষ-মনে পরিবর্তন আনতে চেয়ে নরেন্দ্র মোদীকে স্বাধীনতা দিবসে বলতে হয়েছিল,

‘‘মেয়েদের বাইরে যেতে বাধা দেওয়ার বদলে বাবা-মায়েদের উচিত নিজেদের ছেলেদের উপর নজর রাখা৷”

স্বাধীন একটি দেশে মেয়েদের অবস্থা বুঝতে তারপরও কি আর কিছু বাকি থাকে?

২০১২-র ১৬ই ডিসেম্বরে দিল্লি গণধর্ষণের পরে দিল্লি আর দেশের অন্যান্য শহর দেখেছিল এক অভূতপূর্ব জনজাগরণ। দেশ জুড়ে সেই আন্দোলনকে জিইয়ে রেখে নারীসুরক্ষার দাবির পাশাপাশি ধর্ষক ও নারী-অত্যাচারীর কড়া শাস্তির দাবি করা হয়েছিল। রাষ্ট্রকে যত দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করা হয়েছিল। ২০১৪-র ২০শে সেপ্টেম্বর আমরা দেখেছি আমাদের ছাত্রদের জাগরণ। যাদবপুরে নির্যাতিত মেয়েটির পাশে দাঁড়াল শুধু কলকাতা শহর নয়, সারা দেশের ছাত্ররা। আবার এটাও বাস্তব যে নির্ভয়ার নৃশংস ঘটনায় দেশ জুড়ে প্রতিবাদের প্রবল চাপেও কামদুনির অপরাজিতা বা মধ্যমগ্রামের কিশোরীর বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারটুকু রক্ষা পায়নি৷‌ ধর্ষণের শিকার হয়ে ‘অপরাধ’ করেছিল মধ্যমগ্রামের কিশোরীটি৷‌ বাড়িওয়ালা নির্দেশ দিয়েছিল তাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে, ওই ‘অপরাধ’-এর পরে আর তাকে পাড়ায় থাকতে দেওয়া যায় না৷‌ তাই আগুনে পুড়তে পুড়তে সে বলেছিল,

‘মা আর বাঁচতে চাই না৷‌ তুমিও পুড়ে মরে যাও৷‌ তুমিও তো মেয়ে!’

এ কোথায়, কোন সমাজে আছি আমরা?

প্রশ্নটা সহজ, উত্তরটাও জানা। এ সেই সমাজ, যেখানে কোন নারী ধর্ষণের অভিযোগ জানালে তার কথার যাবতীয় সত্যতা প্রমাণের দায় একমাত্র সেই নারীর ওপরেই বর্তায় (যদিও সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান এর বিপরীত বিন্দুতে)। সেই সমাজ, যেখানে খুব সহজে কেবল নারীটিকেই ‘খারাপ’ কিংবা ‘নষ্ট’ বিশেষণে দেগে দেওয়া যায়! এ সেই সমাজ, যেখানে ধর্ষকের চরমতম অপরাধও বড় সহজে পাল্টে গিয়ে হয়ে দাঁড়ায় ধর্ষিতার লজ্জা! সেই সমাজ, যেখানে শুধু পুরুষরাই নন, অনেক নারীও 

ধর্ষিতার পেশা, জীবনযাত্রার ধরণ, পোশাক-আশাক-এর অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ ইত্যাদি করে থাকেন সোৎসাহে আর শেষ অবধি ধর্ষিতা নারীটিকেই অনায়াসে দোষী সাব্যস্ত করেন। যশোধরা রায়চৌধুরি-র একটি কবিতা সেই সমাজের আয়না হয়ে উঠেছে:

“‘যাই বল, ওটা তুমি একটুও কি এনজয় করোনি?'
এরকমই ভাবে ওরা, পুরুষেরা। অথবা নারীরা?
‘যাক বাবা বেঁচে গেছি, তাছাড়া যে সেজেগুজে তুমি
বিদঘুটে পোষাক পরে চরতে গেছ আদাড়ে বাদাড়ে
কামকুক্কুরী হবে, নইলে কেউ পড়ে ঐসব
লোকের পাল্লায়? ছি ছি! পারছি না কী বেহায়া ভাবতেই!’
-------
হে ধর্ষিতা, তুমি জান, শরীর কোথায় শেষ হয়
কোথা থেকে শুরু হয় অদ্ভুত, দ্বিতীয় অপমান...”

এই সমাজকে পাল্টাতে হবে। শুধু প্রতিবাদী মিছিল আর মোমবাতির শোক-জ্ঞাপন নয়, আরো বড় আর নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে বোধ আর চেতনা-সম্পন্ন প্রতিটি সাধারণ মানুষকেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নারী-হিংসার বিরুদ্ধে, সমাজের সর্বস্তরে মেয়েদের সার্বিক অসম্মানের বিরুদ্ধে একটা অরাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা বড় দরকার এখন। আমরা যে দেবী-র পুজো করি অনেক বাহুল্যে আর আড়ম্বরে, তিনি নারী, পুরাণমতে আদি শক্তি। অথচ সেই দেবীর প্রতিমূর্তি নারীদের শ্রদ্ধা করতে পারি না। তাই লড়াইটা নিজের সঙ্গেও বটে। সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আমাদেরই রুখে দাঁড়াতে হবে। সেইসঙ্গে ঘরে নারীর অবহেলা আর বাইরে নারীর লাঞ্ছনার নিদারুণ অবস্থাটা পাল্টাতে গেলে নারীদেরও নিজেদের অন্তরের শক্তি উপলব্ধি করতে হবে। নিজেদের অধিকার আর মর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ নিতে হবে, শিক্ষিত আর স্বাবলম্বী হতে হবে। এটা ১৪২১। আজ থেকে অনেক বছর আগে, ১৩৩৩-র প্রবাসী পত্রিকার এক সংখ্যায় লেখা হয়েছিল-

‘আত্মরক্ষার সামর্থ্য থাকা নারীদের রক্ষণের সর্বোৎকৃষ্ট ও একান্ত আবশ্যক উপায়।’

পুতুলের মতো জীবনযাপন করলে বিদ্যা-বুদ্ধির ঘাটতি এবং শারীরিক অক্ষমতা আমাদের গ্রাস করবে৷‌ ‘নারী’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন-

“মেয়েদের জীবনে আজ সকল দিক থেকেই স্বতই তার তটের সীমা দূরে চলে যাচ্ছে। নদী উঠছে মহানদী হয়ে।...কালের প্রভাবে মেয়েদের জীবনের ক্ষেত্র এই-যে স্বতই প্রসারিত হয়ে চলেছে, এই-যে মুক্তসংসারের জগতে মেয়েরা আপনিই এসে পড়ছে, এতে করে আত্মরক্ষা এবং আত্মসম্মানের জন্যে তাদের বিশেষ করে বুদ্ধির চর্চা, বিদ্যার চর্চা, একান্ত আবশ্যক হয়ে উঠল।”

আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক আর জরুরি কথাগুলো!

আমাদের সকলের মনে রাখা দরকার ভারতে আর সেইসঙ্গে গোটা বিশ্বজুড়ে একটা যুদ্ধ চলছে। নারীহিংসার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। দেশ আর সমাজ নারীর প্রাপ্য মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে না পারলে এ যুদ্ধের বিরাম নেই। এই যুদ্ধটা জিততেই হবে। কথায় কথায় আমরা নিজেদেরকে বড় বড় তকমা দিই- আমরা প্রগতিশীল, আমরা সংবেদনশীল। সেটা অন্তত একবার সত্যি করার চেষ্টা করি! চলুন না, আন্তর্জাতিক নারীদিবসে নারীর প্রাপ্য মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করার শপথ করি সবাই মিলে! ঘরের মেয়েটিকে খুঁজে দিই নির্ভয় আকাশ আর নিশ্চিন্ত আলোটুকু!

0 comments:

2

প্রবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ



অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



[প্রাক্‌ কথন – আমি গবেষক নই, উনিশ শতকের বাংলার সামাজিক বিন্যাস ও বিবর্তন জানা আমার এক আগ্রহের যায়গা । সেই আগ্রহ থেকে ইতিহাসের তথ্য ঘেঁটে সেই সময়কার সমাজের ছবি ও এক বারাঙ্গনা কন্যার আলোয় ফেরার সংগ্রামের কাহিনী তুলে আনতে চেয়েছি ]

পুরুষতান্ত্রিক আমাদের সমাজে নারীর অবস্থান কোথায় সেই প্রশ্নে পুরুষ দোদুল্যমান সেই বেদ-পুরাণের কাল থেকেই । নারী ‘নরকের দ্বার’ আবার সে শক্তি রূপিণী । তার বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণের অধিকার নেই কিন্তু দৈব আরাধনার সমস্ত উপচার করবেন নারী । অসুর নিধনে প্রবল শক্তিধর দেবতারা স্মরণ নেন দেবী দূর্গার । কিন্তু অসুর নিধনে তার যাবতীয় প্রহরণ পুরুষ দেবকুল প্রদত্ত । তুমি দেবী বটে কিন্তু তোমার শক্তির উৎস আমরা পুরুষ দেবকুলই । ভাবখানা এই ।

মাত্র দুশো বছর আগেকার কথা । নারী নিপীড়নে সমাজের তেমন কোন হেলদোল থাকতো না । কারণ নারী নিপীড়নের নানান বন্দোবস্ত তখনকার সমাজই অনুমোদন করতো । কুলিন হওয়ার গৌরবে বহু বিবাহ, একাধিক উপ-পত্নী রাখা, বেশ্যালয় গমন তখনকার বাঙালির আভিজাত্য বলেই মান্য হ’ত । দুশ’ বছর আগে মধ্যবিত্ত বাঙালি জীবনে নৈতিকতার বালাই ছিলনা । পরের একশ’ বছরে বাঙালির সমাজ প্রভুত এগিয়েছে, শিক্ষার প্রসার হয়েছে, নারী সচেতনতা বেড়েছে চোখে পড়ার মতো । বিশ শতকের গোড়াতেই নারীর প্রতিবাদী কন্ঠ শুনতে পেয়েছি । ধর্মই যে নারীকে বেঁধে রেখেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তার যাবতীয় অবমাননার ঢাল হিসাবে, সে কথাও উচ্চারিত হতে শুরু করেছে । তারপর সমাজ অনেক এগিয়েছে, কিন্তু নারীদের প্রতি সমাজের মনোভঙ্গির কিছুমাত্র বদল হয়নি । ইতিহাসের সুদীর্ঘ পথচলায় কত পরিবর্তন হয়ে গেছে – হয়ে চলেছে নিয়ত । আমাদের সমাজ ও পরিবারের কাঠামোয় কত বদল হয়ে গিয়েছে, পরিবারের বন্ধন শিথিল হয়েছে, আমাদের মূল্যবোধগুলির কত রূপান্তর ঘটে গিয়েছে, কিন্তু নারীর প্রতি সমাজের মনোভাবের বিষয়টি সেই এক সনাতনী বিশ্বাসের অচলায়তনে বন্দি । নারী পুরুষের আশ্রিতা, পুরুষের ভোগ্য সামগ্রী, লিঙ্গ-বৈষম্যের কারণে সে যেন এক আলাদা প্রজাতি । পিতৃপ্রধান যৌথ পরিবার ভেঙে এখন অনু পরিবার, কিন্তু সেখানেও আধুনিক সমাজ কতটুকু স্বাধীনতা দিতে সম্মত নারীকে ? স্ত্রী তার পুরুষ স্বামীর আশ্রিতা – এ ভিন্ন অন্যকিছুই পুরুষ ভাবে না । সমাজ তাকে অন্য কিছু ভাবতে শেখায় না । নারী নিজেও এই ভাবনার অচলায়তনে বন্দি, ধর্মের বাঁধন তাকে অন্য কিছু ভাবতে দেয় না ।

উনিশ শতকের চেয়ে অনেক পরিবর্তন হয়েছে সত্য । উনিশ শতকে যখন অনভিজাত নারী অন্দর মহল থেকে বাইরে বেরিয়েছিলেন কাজের সন্ধানে, সমাজের চোখে তারা ছিল কুল কলঙ্কিনী । যাদের শ্রমশক্তির ওপর দাঁড়িয়েছিল সেকালের হিন্দু সমাজ, তারা হয়ে গিয়েছিলেন গণিকালয়ের মালিকদের শিকার আর নতুন গজিয়ে ওঠা বড়লোকদের গৃহ পরিচারিকা । এ যুগে শিক্ষিত মহিলারা অনেক উচ্চ ও প্রশাসনিক দায়িত্বে কিংবা ব্যবসা বানিজ্যের ক্ষেত্রে সাফল্যের শিখরে উঠছেন সত্য, কিন্তু প্রান্তিক নারীসমাজ, কৃষক রমণী, খণি শ্রমিক, আয়া, পরিচারিকারা নারীত্বের সম্মান থেকে বঞ্চিতই থেকে যান । 

অথচ এই প্রান্তিক কিংবা অন্ধকার জগত থেকে সমাজের মূলস্রোতে আশার আকাঙ্খায় নারী কি নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়েছেন, তা আমরা মনে রাখি না । আমি এই প্রসঙ্গে বিনোদন জগতের কথা বলবো । বিনোদন জগতের মহত্তর সৃষ্টির ক্ষেত্রে নারীর অবদান সর্বাধিক । নগর কলকাতার আদিযুগের থিয়েটার ও সঙ্গীত জগতকে সমৃদ্ধ করে গেছেন সমাজের অন্ধকার জগত থেকে উঠে আসা নারীরা, রেখে গেছেন অনেক মহত্তর অবদান । এবং তা ছিল অন্ধকার জগতের গ্লানি থেকে সমাজের মূলস্রোতে ফেরার সংগ্রাম । মাত্র একশো বছর আগের কথা, বাঙ্গালির সমাজ তখন মেয়েদের গান গাওয়া অনুমোদন করতো না । এদিকে কলের গান এবং গানকে রেকর্ড করার প্রযুক্তিও এসে গেছে । কিন্তু গান গাইবে কে ? রেকর্ড কোম্পানী স্মরণাপন্ন হল দুই বারাঙ্গনা কন্যার । কলের গানে প্রথম গান গাইলেন শশীমুখী ও ফণিবালা নামে দুই থিয়েটারের নৃত্যশিল্পী ১৯০২এ ।

তারও দেড়শো বছর আগে নগর কলকাতার নাগরিক বাবুসমাজ পেয়ে গিয়েছিল তাদের বিনোদনের নতুন মাধ্যম থিয়েটার । আর এই থিয়েটারকে ঘিরেই পিতৃপরিচয়হীনা এইসব কন্যারা থিয়েটারকে আঁকড়ে ধরে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন আত্মগ্লানি থেকে মুক্তি পেতে । উনিশ শতকের ধনী বাবুদের পরস্ত্রী গমন, রক্ষিতা পোষা তখনকার সমাজ অনুমোদন করতো, তাদের নারীলোলুপতা আর অনৈতিক জীবনযাপনের ক্লেদাক্ত বিবরণ আমরা জানি । কলকাতার নাগরিক জীবনের অঙ্গ স্বরূপ তখন কলকাতায় গণিকার সংখ্যা বৃদ্ধি পায় । সম্ভ্রান্ত বাবুদের লালসার শিকারে গর্ভবতী হয়ে অনেক তরুণী বিধবা আশ্রয় নিতেন গণিকালয়ে । ধনাঢ্য ব্যক্তির রক্ষিতারাও গর্ভবতী হয়ে পড়তেন । বারাঙ্গণা নারী স্বপ্ন দেখতেন তাদের কন্যারা যেন এই গ্লানিময় জীবনের স্পর্শ না পায় । থিয়েটার তাদের সামনে গ্লানিমুক্তির পথ হয়ে দেখা দিল । 

এর পেছনে একজন মানুষের অবদান আমাদের স্মরণ করতে হবে, তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত । বাংলা থিয়েটারের সেই শৈশবকালে ধনকুবের আশুতোষ দেবের(ছাতুবাবু) দৌহিত্র শরৎচন্দ্র ঘোষ ‘বেঙ্গল থিয়েটার’ নামে থিয়েটার খুললেন এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তকে তাঁদের থিয়েটারের জন্য দুটি নাটক লিখে দিতে অনুরোধ করলেন । মধুসূদন সম্মত হলেন কিন্তু একটি শর্তে, নাটকে স্ত্রী চরিত্রের রূপায়ণ মেয়েদের দিয়েই করাতে হবে । উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে, সেইসময় বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী থিয়েটার সম্পর্কে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন । থিয়েটারের দরজা সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গেছে ১৮৭২এর ৬ই ডিসেম্বর ন্যাশানাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে । ভালোভাবে থিয়েটার পরিচালনার জন্য বেঙ্গল থিয়েটার একটি উপদেষ্টা সমিতি গঠন করেছিল । উপদেষ্টা মন্ডলীতে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ । অভিনেত্রী নিয়োগ সংক্রান্ত জরুরি সভায় বিদ্যাসাগর বিরোধীতা করলেন থিয়েটারে অভিনেত্রী নিয়োগের । উমেশচন্দ্র দত্ত ও মধুসূদনের সমর্থন পেয়ে বেঙ্গল থিয়েটার কর্তৃপক্ষ বিদ্যাসাগরের মত মানুষের বিরোধিতাও অগ্রাহ্য করে বারাঙ্গনাপল্লী থেকে চারজন অভিনেত্রীকে নিয়োগ করলেন যাদের একজন ছিলেন গোলাপ সুন্দরী । ১৮৭৩ সালের ১৬ই অগস্ট মধুসূদনের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার তার যাত্রা শুরু করলো । নাট্যাভিনয়ে পুরুষের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করে থিয়েটারে নারীদের অংশগ্রহণও শুরু হল সেইদিন থেকে । শুরু হলো সেকালীন রক্ষণশীল সমাজের প্রবল বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে । এ ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা । নারীদের থিয়েটারে অংশগ্রহণের প্রথম প্রবক্তা মধুসূদন দত্ত অবশ্য এই যুগান্তকারী ঘটনা দেখে যেতে পারেন নি । থিয়েটারে গোলাপ সুন্দরীদের পথচলা শুরুর আগেই তাঁর দেহাবসান হয় (২৯ জুন, ১৮৭৩) ।

মেয়েদের জন্য থিয়েটারের দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ায় অন্ধকার জগতের মেয়েরা মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পেলেন । তাদের একটা তাগিদ ছিল – মুক্তির তাগিদ । থিয়েটারকে তাই তারা নিজেদের মুক্তিতীর্থ মনে করলেন, থিয়েটারকে ভালোবেসে পবিত্র হতে চাইলেন । এই পথ ধরেই থিয়েটারে এসেছিলেন গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনী, তারাসুন্দরী, কুসুমকুমারী, কৃষ্ণভামিনীরা । বস্তুত, নাট্যাভিনয়ে তাঁদের যোগদানের কারণেই বাংলা থিয়েটার তার শৈশব কাটিয়ে পুরো মাত্রায় পেশাদারী হয়ে ওঠার দিকে পা বাড়িয়েছিল । গোলাপসুন্দরী, বিনোদিনীরা বাংলা থিয়েটারের নির্মাণে ঐতিহাসিক গুরুত্ব দাবী করে । পরবর্তী সত্তর/আশি বছর বাংলা থিয়েটারকে আলোকিত করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন এরাই ।

পরিতাপের কথা আমাদের সমাজ পঙ্কজা থেকে মহিয়ষী হয়ে ওঠা এই সব নারীদের প্রাপ্য মর্যাদা দেয় নি, দিতে চায় নি । গত বৎসর নটী বিনোদিনীর সার্ধশত জন্মবর্ষ উদযাপনের সুবাদে কিছু আলোচনা হয়েছে, আমরা নাটক ও মঞ্চের জন্য বিনোদিনীর ত্যাগ ও বঞ্চনার কথা জেনেছি । কেমন করে সমাজের গভীর অন্ধকার স্তর থেকে উঠে আসা এক অসহায় নারী তাঁর তন্ময় সাধনায় ও দুরূহ সিদ্ধি আয়ত্ব করেছিলেন, স্থায়ী রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গিয়েছিলেন এবং খ্যাতির শীর্ষ বিন্দু স্পর্শ করেও নীরবে মঞ্চের অন্তরালে চলে গিয়েছিলেন বঞ্চনার শিকার হয়ে মাত্র তেইশ বছর বয়সে, তা ভাবলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় । রঙ্গালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগের ছাব্বিশ বছর পরে, ৪৯ বছর বয়সে, বিনোদিনী তাঁর আত্মজীবনী ‘আমার কথা’ গ্রান্থাকারে প্রকাশ করেন । তার আগে এবং পরেও বিনোদিনীর লেখনি চর্চা অব্যাহত ছিল । প্রকাশ করেছিলেন ‘বাসনা’ এবং ‘কনক ও নলিনী’ নামে দুটি কাব্যগ্রন্থ । কিন্তু বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহিলা আত্মজীবনী লেখিকার মর্যাদা কিংবা দুটি কাব্যগ্রন্থের লেখিকার মর্যাদা বিনোদিনী পান নি । বারারাঙ্গনা কুলোদ্ভবা যে !

বিনোদিনীর মস্তক স্পর্শ করে রামকৃষ্ণদেব আশির্বাদ করেছিলেন, এক সমভ্রান্ত পুরুষ শিশুকন্যা সহ বিনোদিনীকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সমাজের মানী লোকেরা যারা তাঁর অভিনয় দেখার জন্য রাতের পর রাত প্রেক্ষাগৃহে ছুটে যেতেন, তাঁকে ধন্যধন্য করতেন, তাঁরা বিনোদিনীর কন্যাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে দেন নি, বাধা দিয়েছিলেন । বিনোদিনী পারেননি তার কন্যা শকুন্তলাকে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে । শকুন্তলাকে বাঁচাতে পারেন নি বিনোদিনী, ১৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয় ।

বিনোদিনী পারেন নি । গোলাপসুন্দরী পেরেছিলেন । গোলাপ তখন স্বনামে সুকুমারী দত্ত । মেয়েকে মানুষ করার জন্য গোলাপ থিয়েটারও ছেড়ে ছিলেন বেশ কয়েক বছর । মেয়েকে শিক্ষা দিয়েছিলেন, প্রচুর অর্থব্যয় করে তার বিবাহ দিয়েছিলেন এক সমভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে । যদিও মেয়েকে দেখার জন্য তার শ্বশুর গৃহে প্রবেশের অধিকার তাকে ত্যাগ করতে হয়েছিল । জানা যায় সুকুমারীর নাতি বিহারের এক প্রসিদ্ধ ডাক্তার হয়েছিলেন । 

মাইকেল মধুসূদনের পরামর্শে বাংলা থিয়েটারে আসা প্রথম চার অভিনেত্রীর একজন গোলাপ সুন্দরী বা সুকুমারী দত্তর অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম বিস্ময়কর । সাহায্য পেয়েছিলেন এক মহতী হৃদয় মানুষের, তিনি বেঙ্গল থিয়েটারের নাট্যপরিচালক উপেন্দ্রনাথ দাস । উপেন্দ্রনাথ গোলাপের বিবাহ দিয়েছিলেন থিয়েটারেরই এক অভিনেতা গোষ্ঠবিহারী দত্তর । এই ঘটনায় তখনকার সমাজে প্রবল নিন্দাবাদ হয়েছিল । উপেন্দ্রনাথকে পিতৃসম্পর্কও ত্যাগ করতে হয়েছিল । গোষ্ঠবিহারী – সুকুমারীর মর্যাদাপূর্ণ দাম্পত্যজীবনের ব্যবস্থা উপেন্দ্রনাথ করেছিলেন । তারা ভদ্রপল্লীতে বাসা বেঁধে ছিলেন । এই সময় উপেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পিতার সম্পর্ক পুনঃস্থাপিত হয় । তিনি উপেন্দ্রনাথকে বিলাতে পাঠিয়ে দেন । উপেন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে গোষ্ঠবিহারীও জাহাজের খালাশি হয়ে বিলাত চলে যান । গোলাপ স্বামী পরিত্যক্তা হন ।

সুকুমারী কিন্তু থেমে থাকেন নি । গোষ্ঠবিহারী তাঁকে ত্যাগ করে চলে যাওয়ায় নিদারুণ অর্থকষ্টে পড়লেন । সেখান থেকেই ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করলেন। মেয়েদের নাচ ও অভিনয় শেখাবার একটা স্কুল খুললেন । কিন্তু বেশি দিন চালাতে পারলেন না। ন্যাশানাল ফিমেল থিয়েটারের উদ্যোগে শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য নাটক করলেন । ইতিমধ্যে এক সহৃদয় মানুষ, নবভারত পত্রিকার সম্পাদক, বাবু দেবপ্রসন্ন রায়চৌধুরী সুকুমারীর কন্যার শিক্ষা ও প্রতিপালনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন । অর্থকষ্ট সামাল দিতে সুকুমারী নাট্যরচনায় মন দিলেন, নিজের ব্যক্তিজীবন ও নাট্যজীবনের অভিজ্ঞতা উজাড় করে রচনা করলেন ‘অপূর্ব সতী’ নামে একটি নাটক । নাটকটি অভিনীতও হয়েছিল । বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস সুকুমারীকে প্রথম মহিলা নাট্যকারের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিয়েছে । 

দেড়শো বছর আগে লেখা দুষ্প্রাপ্য নাটকটি গবেষক অধ্যাপক বিজিতকুমার দত্তর সম্পাদনায় পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাডেমি পুনঃপ্রকাশ করে ১৯৯২এ । ‘অপূর্ব সতী’ নাটকটি নানা দিক দিয়েই তাৎপর্যপূর্ণ । শুধু একজন নারী রচিত প্রথম বাংলা নাটকের মর্যাদা পাওয়াই নয়, নাটকে তখনকার সমাজের এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার কথা, অসহায়া বারাঙ্গনা কন্যাদের কথা তুলে ধরা হয়েছে । উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের সেই সময় বারাঙ্গনাদের সংখ্যা বৃদ্ধি সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি করেছিল । তখনকার নানান সরকারী প্রতিবেদনে এর উল্লেখ আছে । সুকুমারীর ‘অপূর্ব সতী’ নাটকের নায়িকা নলিনী বারবণিতার মেয়ে । সে স্কুলে পড়ে, কবিতা লেখে, লেখাপড়ায় আগ্রহী । বিদ্যাচর্চার মহিমায় সে বুঝতে পারে তার মায়ের বারবণিতা জীবন নরকের জীবন । সে চায় পবিত্র জীবন আর সংসার যাপন । গবেষকদের অনুমান সুকুমারীর জীবনবৃত্তান্তই তাঁর নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে ।

সুকুমারী আবার থিয়েটারে ফিরে এসেছিলেন পুরোদমে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেই যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী রূপে । কত বড় অভিনেত্রী ছিলেন গোলাপসুন্দরী সেই বিবরণ পেশ করা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়, আমি বুঝতে চেয়েছি দেড়শো বছর আগে, যখন আমাদের সমাজে নারী নির্যাতনের প্রশ্নে কোন হেলদোল ছিলনা, তখন সমাজের রক্তচোখ অগ্রাহ্য করে এক বারাঙ্গনা কূলজাতা বালিকা কি ভাবে অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার সংগ্রাম জারি রেখেছিলেন । 

সেকালের অনেক অভিনেত্রীর শেষ জীবন দুঃখময়, নিঃসঙ্গ । গোলাপের শেষ জীবনও কোন ব্যতিক্রম ছিল না । শোকসংবাদ বা সংবাদপত্র প্রতিবেদন দূরের কথা, অনেকের মৃত্যুর তারিখটিরও কোন লেখাজোখা থাকে না । বিনোদিনীর শেষ জীবন নিঃসঙ্গ দুঃখময় ছিল, আর গিরিশ-অর্ধেন্দুশেখর যুগ পেরিয়ে শিশির ভাদুড়ী যুগেও দাপটে অভিনয় করা কুসুম কুমারী শেষ জীবনে হাতিবাগানের রঙমহল থিয়েটারের গেটে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতেন । অভিনেত্রী কৃষ্ণভামিনী মৃত্যুর আগে তাঁর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ ও সম্পত্তি উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন শিক্ষা বিস্তারের কাজে ও দুঃস্থ মানুষের চিকিৎসার কাজে । কৃষ্ণভামিনীরা ইতিহাস নির্মাণ করেন কিন্তু ঐতিহাসিকের সম্মান অর্জন করেন না, এমনই পরিহাস ! 

১৮৯০-৯১ পর্যন্ত সুকুমারীর নানান রঙ্গমঞ্চে অভিনয়ের সংবাদ জানা যায় । কিন্তু জানা যায় না কবে নিঃশব্দে চলে গেলেন বাংলা থিয়েটারের প্রথম অভিনেত্রী, প্রথম মহিলা নাট্যকার ও প্রথম নারী নাট্যসংগঠক গোলাপসুন্দরী ।





গ্রন্থসূত্র – (১) ‘নাট্য আকাডেমি পত্রিকা’ জানুয়ারি ১৯৯২, (২) ‘রঙ্গালয়ে বঙ্গনটী’ – অমিত মৈত্র, (৩) ‘আমার কথা’ – বিনোদিনী দাসী, ও (৪) ‘বাংলার নট-নটী’ – দেবনারায়ণ গুপ্ত ।



2 comments:

2

প্রবন্ধঃ অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ



আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা - সমাজে ও সাহিত্যে
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য



চেতন ভগত এর one night @ the call center পড়তে গিয়ে ভূমিকাতেই একটা আশ্চর্য ঘটনা দেখলাম। আমার মত চেতন ভগতও ট্রেন চড়ার সময় রিজার্ভেসন চার্ট এ নিজের কনফার্মেসন দেখার সাথে সাথে চোখ বুলিয়ে নেন পাশাপাশি কোনো মহিলা যাত্রী আছেন কিনা, বিশেষ করে অনুর্ধা চল্লিশ । এই একটা বিষয়ে আকবর বাদশা থেকে হরিপদ কেরানি সবাই একই রকম। উগ্র নারীবাদী বলবেন - পুরুষের যৌনাকাঙ্ক্ষা। বায়োলজি বলবে হরমোনের খেলা। সাহিত্যিক বলবে নারী পুরুষের অমলিন অদৃশ্য সুতোর টান। 

সাহিত্য আর সমাজের এখানেই বোধহয় মিল, আবার এখানেই বিচ্ছেদ। সাহিত্য সমাজের প্রতিফলন। কিন্তু সাহিত্যে গরু গাছে ওঠে, ঘোড়া আকাশে উড়ে যায় ডানা মেলে। সমাজে তা হয় না। যদিও গরু, ঘোড়া পাখি সবই সমাজের উপাদান। ববডিলান এর অভিমতে - কোনো নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা সমর্থন ছাড়া কোনো পুরুষ তাকে ছুঁতে পারে না। তাই নারীরাই এই পৃথিবী শাসন করে। কিন্তু সমাজে আমরা রোজই দেখি কিছু পুরুষের বিকৃত লালসার শিকার হচ্ছে নারী। যেখানে নারীর সমর্থন নেই, আছে পুরুষের পাশবিক নির্যাতন। আছে সমাজের বুকে প্রতি রাতে হারিয়ে যাওয়া নারীত্বের অভিশাপ এর বিষবাস্প। সমাজ আর সাহিত্যের এখানেই পার্থক্য। সাহিত্যের কান্তাসম্মিত বাণী আত্মিক লোকের সর্ব মানব চিত্তের মহাদেশে ছড়িয়ে দেয় নারী পুরুষের চিরন্তন প্রেমের বার্তা। যেখানে মিলন আছে, বিরহ আছে, সম্ভোগ আছে, বিচ্ছেদ আছে, কিন্তু লালসা নেই, নির্যাতন নেই আর নেই নারীত্বের অপমান। নারী পুরুষের প্রেমই যুগে যুগে ইতিহাস রচনা করে চলেছে।

সমাজ আর সাহিত্যের সংযোগ সেই ঐতিহাসিক যুগ থেকে। আর যুগ থেকে যুগান্তরে সেই ইতিহাসের চাবিকাঠি কোনো না কোনো নারীর হাতে। পুরাণে পঞ্চ নারী -অহল্যা, কুন্তী, দ্রৌপদী, তারা, মন্দোদরী। নারী জাতির আদর্শ (স্বামী বিবেকানান্দর চোখে) সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী। বুদ্ধদেবের জীবন রক্ষায় সুজাতা। অথবা ইতিহাস স্বীকৃত গ্রন্থ কলহনের রাজতরঙ্গিনী | সুলতান যুগে 1202 সালে সুলতান রাজিয়া প্রথম ভারতীয় নারী শাসক। ঝাঁসীর রানী লক্ষ্মী বাই-এর মহাবিদ্রোহে মহাসংগ্রাম। অথবা বৈদিক যুগে সপ্তর্ষির পাশাপাশি অপালা, লোপামুদ্রা, গার্গী, মৈত্রেয়ী-দের আত্মপরিচয়। অথবা শুদ্রক রচিত মৃচ্ছকটিক-এর অনুসরণে বলিউড ফিল্ম উৎসব-এ দেখানো হয়েছে বাৎসায়ন-এর কামসূত্র রচনার পেছনে বসন্তসেনার অবদানের কথা। নারী জাতির অবদান নির্ণয়ের পরিসংখ্যান এখানে বিচার্য বিষয় নয়। সমাজের সাথে নারীর অবিচ্ছেদ্য সংযোগই এখানে পর্যালোচিত। পুরাণে `পার্বতীর স্তন পানের  বাসনা থেকে নারায়ণের মাটির পুতুলে প্রবেশ। সেখান থেকে গনেশের জন্ম বৃত্তান্ত আরম্ভ। গৌড়ীয় বৈষ্ণব রসে রাধা আনন্দদায়িনী। কৃষ্ণের হ্লাদিনী শক্তি। আবার মা দূর্গা শক্তি রূপে সংস্থিতা। দানবদলনী। মুণ্ডমালা ধারী মা কালীর পায়ের তলায় দেবাদিদেব। একদিকে নারী আনন্দদায়িনী,  অন্যদিকে সংহারিণী।

সাহিত্য হলো ভাষা বহন শিল্প। আর এই শিল্প কর্মের সার্থকতা হলো মনের ভাব থেকে রস এ পর্যাবরণ। রস আমাদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ভয়, বিস্ময়, সুখ, বিষাদ, সব কিছুতেই নতুন অনুভূতির সজীবত্ত্ব আনে। রতি হাস, শোক, ভয়, জুগুপ্সা, বিস্ময় -এই ভাব গুলো পরিপূর্ণতা পায় না নারীর স্পর্শ ছাড়া। তা সেটা সাহিত্যেই হোক বা সমাজে। সাহিত্যে নারীর স্থান প্রসঙ্গে মনে এলো প্রথমেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রহর শেষ এর আলোয় রাঙ্গা সেদিন চৈত্র মাস … তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ …” । সাহিত্যে নারীর স্থান প্রসঙ্গে এর থেকে যথার্থ উক্তি আর মনে এলো না। কালিদাসের কুমারসম্ভব-এ মহাদেবের জঙ্ঘায় পার্বতীর গুরু নিতম্বের শোভা, বা স্তন নির্মানে সৃষ্টিকর্তার উজাড় করা রস ভান্ডার, কোমরের হিল্লোল, সম্ভোগ কালে পার্বতীর লজ্জা, শিবের দু চোখ হাত দিয়ে ঢেকে দিলে শিব তৃতীয় নয়ন খুলে পার্বতীর আরক্ত যৌবন রসাস্বাদন, সব কিছুই সাহিত্যের ভাষায় হৃদয়সংবাদী । কালিদাসের শকুন্তলা, রবীন্দ্রনাথের বিচারে, প্রথমে সারল্য, তারপর তাতে অপরাধের অনুপ্রবেশ, তারপর লজ্জা, গ্লানি, কষ্টের মধ্যে দিয়ে সর্বশেষে পরিনতি শান্তি। শেক্সপীয়ারের মিরান্দা আর কালিদাসের শকুন্তলা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মিরান্দা শক্তি তো শকুন্তলা শান্তি। নারীর নারীত্ব বিচারে সমাজের দর্পনে পোশাকের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বাণী ও রচনায় পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য প্রসঙ্গে পোশাক নিয়ে চর্চা করেছেন। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে মেম বুক খোলা সান্ধ্য পোশাকে অতিথি দের আপ্যায়ন করে। প্রাচ্য সংস্কৃতি তে ঘরের বউ মাথায় ঘোমটা টানতে গিয়ে কাপড় যে কোমর ছেড়ে উঠে যাচ্ছে সেটা খেয়াল করে না। অর্থাৎ সাহিত্যের দর্পনে স্বামী বিবেকানন্দ এই পোশাক নিয়ে অযথা পাগলামি আর সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠতে বলেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তো সরাসরি বলেছেন স্বামীর অবর্তমানে অন্য পুরুষের সামনে মহিলাদের আচরণ একটু পাল্টে যায়। একটু অন্য রকম আনন্দ করলে ক্ষতি নেই। অথবা বয়স বেড়ে যাওয়াটা মেয়েরা সহজে মেনে নিতে পারে না। তাই সাহিত্যই সমাজকে শিখিয়েছে কি করে সম্পর্কের সংকীর্ণতাকে কাটিয়ে উদার আর মুক্তমনা হতে হয়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজতে গেলে প্রথমেই মনে আসে রাজা রামমোহন রায়ের নাম। যিনি সতী দাহ প্রথা বন্ধ করে ভারতবর্ষে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের সূচনা করেন। সেই ছিল নারীত্বের প্রথম জয়ধ্বব্জা, যা মধ্যযুগীয় অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাত্রা শুরু করে। এরপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাল্য বিবাহ রদ আর বিধবা বিবাহের প্রচলন করেন। তৎকালীন নারী স্বাধীনতা বিহীন ঘুন ধরা সমাজে বিধবা বিবাহের প্রচলন ছিল সব থেকে তীব্র কশাঘাত। সেই সময়ে তুলনামূলক প্রগতিশীল ঠাকুরবাড়িতে মেয়েরা ধীরে ধীরে সমাজের বুকে নারীত্বের জয়গান গাইতে শুরু করে। এরপর একশ বছর পার হয়ে গেছে কিন্ত আজ ও আমরা নারীদিবসের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে চলেছি। আজ ও আলো থেকে অন্ধকারে হারিয়ে যায় কত ফুল। ফুলের কুঁড়ি ফোটার আগেই ঝরে যায় অনাদরে। বর্বরতা আজ ও পথে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। এই তামসিকতা কাটিয়ে উঠতে সাহিত্যকেই এগিয়ে আসতে হবে। কবি তবে উঠে এস যদি থাকে প্রাণ। পুরুষ আর নারীতে প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতাই নিয়ে আসতে পারে এক অন্ধকার মুক্ত সমাজ। পুরুষ বিদ্বেষ নয়, নারী পুরুষের একত্র সমাবেশই খুঁজে আনবে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতা; শুধু নারী নয় নারীত্বের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করবে নারী দিবসের প্রাসঙ্গিকতাকে।

2 comments:

1

প্রবন্ধঃ মনোজিৎ কুমার দাস

Posted in


প্রবন্ধ

ভারতীয় প্রাচীন নারী কবিদের গীতিকবিতায় প্রেমকল্প
মনোজিৎ কুমার দাস 



ভারতীয় সাহিত্যে প্রাচীনকাল থেকে নারী কবিরা চান্দগ, সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃত ভাষার অসংখ্যক প্রেমের কবিতা রচনা করেছেন। বৈদিকযুগ থেকে খ্রীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতীয় নারী কবিদের প্রেমের কবিতার উপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা এ নিবন্ধের উদ্দেশ। 

প্রাচীন ভারতীয় ভাষা সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃততে সেকালের নারী কবিরা তাঁদের কবিতায় প্রেমের যে অনুষঙ্গ তুলে ধরেছেন তা আমরা দেখার চেষ্টা করবো। প্রথমে তাঁদের লেখা লিরিকধর্মী বা গীতিধর্মী কবিতা প্রসঙ্গে দু’চারটি কথা বলে নেওয়া যেতে পারে।

প্রেমের মূলে কাম, কিন্তু কাম যে প্রেম নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রেম যে কাম নয়---- কামের উর্দ্ধায়ণ এটা স্বত:সিদ্ধ। আদিমকালেও একজন পুরুষ আর একজন নারী যুথবদ্ধ জীবন থেকে পৃথক হয়েছে পারস্পরিক মোহ চুম্বকের কারণে।

যেখানে প্রেম প্রাণধারণেরর স্থুল ক্রিয়াকলাপের সাথে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, সেখানে প্রেম নিছকই দেহের খাদ্য, যাকে দেহসম্ভোগ সর্বস্ব কাম বলা যেতে পারে। আবার দেহসম্ভোগ সর্বস্ব কাম যখন দেহকে ছাড়িয়ে মনের খাদ্য হয়ে ওঠে তখন তা প্রেমে পর্যবসিত হয়। সামাজিক রীতিনীতির বেড়াজালে প্রেমাসক্ত নরনারীর জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসে। লিরিক বা গীতিধর্মী কবিতায় প্রেম অনুরণিত হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষার মতোই ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃত, পালি ও প্রাকৃত ভাষা লিরিক বা গীতিধর্মী কবিতায় ঋদ্ধ । 

প্রাচীন সংস্কৃতসাহিত্যে কয়েকজন নারী কবির প্রাচীনতম প্রেমের কবিতার সন্ধান পাওযা যায়। এ সমস্ত নারী কবিদের কাল ও পরিচয় যথাযথভাবে নিরূপন করা কঠিন হলেও গবেষকদের মতে কারো কারো কাল খৃষ্টপূর্বাব্দে, আবার কারো কারো কাল ৬ থেকে ১৩ শতকের মধ্যে। ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যে যে সব নারী কবিদের নাম জানা যায় তারা হচ্ছেন, লোপমূদ্রা, বিজ্জিকা, বিকটনিতম্বা, শীলা ভট্টারিকা, অবন্তিসুন্দরী, প্রিয়ংবদা, ভাবকদেবী, প্রমুখ। 

ঋকবেদের বৈদিক সুক্তে (শ্লোকের সমষ্টি) অগস্ত্যের পত্নী লোপামুদ্রার দুটো ঋককে (শ্লোক) প্রেমের কবিতার মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। ঋষি কবি লোপমুদ্রা তাঁর ভোগস্পৃহাহীন, উদাসীন, তপস্বী স্বামী অগস্ত্যকে অকপট ভাষায় নিজের কামনা ব্যক্ত করেছেন। কবি, অনুবাদক ও গবেষক সুশীলকুমার দে অনূদিত লোপামুদ্রার ‘আক্ষেপ’ সূচক গীতিধর্মী দুটো কবিতা উদ্ধৃত করা যেতে পারে এখানে।

লোপামুদ্রা।।আক্ষেপ দিবস রজনী শ্রান্ত আমারে দীর্ঘ বরষ জীর্ণ করে, প্রতি ঊষা হয়ে কায়ার কান্তি, ---- আসুক পুরুষ নারীর তরে।১ দেব- সম্ভাষী সত্যপালক পূর্ব ঋষিরা, তাদের ঘরে ছিল জায়া, তবু ছিল তপস্যা --- যাক নারী আজ পুরুষ তরে।২ 

(ঋকবেদ: লোপমুদ্রা।। আক্ষেপ: অনুবাদ: সুশীলকুমার দে: হাজার বছরের কবিতা—অবন্তী সান্যাল, পৃষ্ঠা-৪১) 

লোপামুদ্রার স্বামী অগস্ত্য সুন্দরী ঋষি স্ত্রীকে নিজ গৃহে ফেলে রেখে ভাদ্রের প্রথম দিবসে নিরুদ্দেশে গমন করলে নারীঋষি লোপমুদ্রার মধ্যে বেদনাবোধ আর আক্ষেপের সুর অনুরণিত হয়েছে, যা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত হলেও তাতে নিখাদ নারীত্বের আকুতিই প্রকাশ পেয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে বেদের ভাষা সংস্কৃত নয়, ছন্দগ । 

চতুর্বেদের মধ্যে অথর্ববেদ অন্যতম। ঋকবেদের বিমূর্ত কাম অথর্ববেদের শ্লোকে বিশিষ্টরূপে প্রতিভাত হয়েছে। মনের প্রথম বীজ কাম, যা ছিল যৌন- অযৌন যে কোন কামনা, অথর্ববেদে তা সকল দেবতাদেরও বড়, কখনো কখনো আগ্নির সঙ্গে অভিন্ন; শুধু তাই নয়, অথর্ববেদে কাম মন্থন, তার তীক্ষ্ম শায়ক হৃদয় বিদ্ধ করে। এ যে পরবর্তী যুগের অতি পরিচিত পুষ্পধনু মদনের পূর্বাভাস। যে সূক্তে কামের এই বর্ণনা আছে সেটি ঈপ্সিত নারীকে আয়ত্ত করার আভিচারিক মন্ত্র । মন্ত্র মানেই প্রার্থনা যদি আন্তরিক হয়, তাহলে মন্ত্রকারের হৃদয়াবেগে তা অতি সহজেই কবিতা পদবিতে উন্নীত হয়। অথর্ববেদের এই মন্ত্রটি সম্পর্কেও এই কথাই প্রযোজ্য । অতি উচ্চাঙ্গের না হলেও এটি যে কবিতা আর তা যে প্রেমের কবিতা, অস্বীকার করার উপায় নেই। ঠিক এই ধরনের আরও একটি মন্ত্র আছে। সেটির মন্ত্রকার নারী। সেখানে কামনার তীব্রতা বিস্ময়কর। মন্ত্রটি যেন এক কামনাক্ষুব্ধ নারী হৃদয়ের তপ্ত আলোড়ন।’ (হাজার বছরের কবিতা—অবন্তী সান্যাল, পৃষ্ঠা-৯, প্রকাশক: বিশ্ববাণী, কলকাতা-৯) 

এখানে সেই অজ্ঞাত নারী কবির কবিতা উদ্ধৃত করা যেতে পারে।

বশীকরণ (পুরুষকে নারী)

মাতাও, মাতাও বায়ু তার মন; মাতাও, মরুদগণ; 
অগ্নি, আমার প্রণয়ে তাহার চিত্ত করো গো উচাটন; 

আপাদ-শীর্ষ্ আমার বিরহে তাহারে; মোর প্রেমে যেন লভে সে লয়। (অথর্ববেদে: অজ্ঞাত নারী কবি- অনুবাদ আশুতোষ ভট্টাচার্য)।

বিজ্জিকা সংস্কৃত ভাষার প্রেমধর্মী কবিতার একজন নারী কবি। তাঁর কাল সম্বন্ধে মতভেদ আছে। কারো মতে তিনি ৮ম শতাব্দীর আগের কালের কবি নন । সংস্কৃত ভাষায় লেখা বিজ্জিকার একটি কবিতার বঙ্গানুবাদ এমন: 

হে প্রাণবন্ধু, ফিরিয়ে তোমার কতদিন আর রয়েছে আর বাকী? 
চাঁদরো কিরণ দহন করিছে—এই পোড়া দেশে কেমন করে?

অনুবাদ:সুশীলকুমার দে 

এ কবিতায় যে আকুতি ব্যক্ত হয়েছে তা প্রষিতভর্তিৃকারও হতে পারে আবার দূরে থাকা প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকারও হতে পারে। বিজ্জকা বা বিজ্জা নামে একজন মহিলা কবির ‘ কৌমুদী মহোৎসব ‘ নামে একটা নাটকের কথা জানা যায়। তিনি সম্ভবত চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর জ্যেষ্ঠপুত্র চন্দ্রাদিত্যের পত্নী বিজয় ভট্টারিকা। অনেক গবেষকের মতে বিজ্জকা ও বিজয় ভট্টারিকা একই জন । বিজ্জকার কবিতার দেহনিষ্ট প্রেমের বর্ণনা বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। প্রথম স্বামী সহবাসে নববধূ অভিব্যক্তি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন নারী কবি বিজ্জতার তাঁর ‘বসন্ততিলক’ ছন্দে রচিত সংস্কৃত ভাষার এ কবিতাটিতে এভাবে উঠে এসেছে - 

ধন্যাসি যা কথায়সি প্রিয়সঙ্গমেহপি
বিশ্রব্ধচাটুকশতানি রতান্তরেষু। 
নীবীং প্রতি প্রাণিহিতে তু করে প্রিয়েণ 
সথ্য:! শপামি যদি কিঞ্চিদপি স্মরামি 

নারী কবি বিজ্জকার ‘বসন্ততিলক’ ছন্দে রচিত সংস্কৃত ভাষার এ কবিতাটির অনুবাদ বিভিন্ন ভাষায় হয়েছে বলে জানা যায়। আমরা এখানে এ কবিতার বাংলা অনুবাদ তুলে ধরব।

ধন্য তোমার সখি, তোমাদের এত কথা থাকে মনে—
পটু চাটু যত নর্মবিলাস হযেছে যা প্রিয় সনে; 
কটিবসনের বন্ধন যবে টুটালো সে প্রিয়—কর—শপথ আমার, 
সখি, যদি কিছু মনে থাকে তারপর! 

বঙ্গানুবাদ: সুশীলকুমার দে 

নারী কবি বিজ্জকার এ কবিতার ভাব, ভাষা ও রস মাধুর্য্ অপূর্ব । নববধূর বিবাহিতা বান্ধবীরা ঠাট্টাছলে তাকে নানা কথা জিজ্ঞাসা করায় সে বলল- তোরা থন্যি, তোরা এখনো বলতে পারছিস কেমন মুগ্ধ হাসিটি হেসেছিলি প্রিয়তমের সাথে কত রঙ্গরসিকতায়। তোরা সবই বলতে পারিছিস। আমারে তো ভাই কটিবন্ধ ছুঁয়েছিল, বাস! এইটুকু শপথ করে বলছি সখি, এইটুকু, আর আমার মনে কিছুই নেই। 

ভারতীয় প্রাচীন সাহিত্যের প্রেমের অনুষঙ্গের কবিতায় বিমূর্তভাবের পরিবর্তে পুরুষ ও নারী উভয় কবিদের লেখায় খোলামেলা ভাবে দেহনিষ্ঠ বিষয়াদি প্রকাশ করতে কুন্ঠাবোধ করেনি। সত্যি কথা বলতে সংস্কৃত সাহিত্যে নরনারীর সম্পর্কে আদিরসাত্মাক চিত্র সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে। তবে নারী কবি বিজ্জকার উল্লিখিত কবিতায় বিমূর্ত ভাব না থাকলেও আছে এক বিশেষ ধরনের কাব্যিক প্রকাশ, যা নি:সন্দেহে অপূর্ব্।

বিকটনিতম্বার পরিচয় ভালভাবে জানা যায় না। কোন কোন গবেষকের মতে এটা কোন পুরুষ কবির ছদ্মনাম। তবে অন্য গবেষকরা তাঁকে নারী কবি হিসাবেই উল্লেখ করেছেন। তাঁদের মতে, তিনি ৮ম থেকে ১০ম শতাব্দীর মধ্যে কোন এক সময়ের নারী কবি। তাঁর লেখা একটি কবিতারে অনুবাদ থেকে তাঁকে নারী কবি বলেই মনে হয়।

ত্রিকোণ, পৃথিবী, তার অর্ধেক রহে নগ-নদী, 
অর্ধেক তার নারী আর শিশু, যোগী আর রোগী যদি, 
থাকে কয়জন, তা হতে মান্য ছাড়ি গুরুজন সব? 
মিছে অপবাদ— অসতীঅসতী মুখর এ মুখ—রব ।

অনুবাদ:সুশীলকুমার দে 

ভাবকদেবী একজন নারী কবি। তাঁর কাল ১০ শতাব্দীর আগে । ভাবকদেবীর কবিতায় সেকালের নারী জীবনের আক্ষেপ ও দু:খের কথা ব্যক্ত হয়েছে তাঁর লেখা থেকে অনুধাবন করতে কষ্ট হয় না। এবারও আমরা সুশীলকুমার দে’র অনুবাদে তাঁর কবিতা দেখব।

স্বামীরা স্বাধীন, তবে কেন মিছে লুটিছে আসিয়া আমার ? 
মন বসেছিল অন্য কোথাও, কিছুদিন তবে? কি দোষ তায়? 
পতির বিহনে সতী নাহি বাঁচে, এই কথা আজো সকলে কহে—
আমি বেঁচে আছি তোমার বিরহে,-- দোষ আমার, তোমার নহে।

প্রখ্যাত ইতিহাসবেত্তা ও গবেষক নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘ বাঙালীর ইতিহাস ‘ মতে ভাবকদেবী বা ভাবদেবী এবং নারায়ণ লক্ষ্মী এ দু’জন সে সময়ের নারী কবি। 

মোরিকা ত্রয়োদশ শতাব্দীর কিংবা ত্রয়োদশ শতাব্দীর আগের মহিলা কবি । প্রাচীনকাল থেকেই কবি, সাহিত্যিকরা ছদ্মনাম ব্যবহার করে আসছেন। এজন্য কে মহিলা কবি আর কে পুরুষ কবি তা জানা কষ্টকর। ভাবকদেবী ও মেরিকার কবিতায় চটুলভাব প্রকটভাবে ধরা দিলেও নারীর মর্মবেদনা প্রকাশ পেয়েছে। 

বিরহের শ্বাস কত না তাহার কাঁচুলি নিত্য ছিড়িয়া পড়েছে, একবার তুমি এস ওগো, আর সেলাইয়ের সুতা নেই যে ঘরে। (অনুবাদ:সুশীলকুমার দে ) 

সংস্কৃত ভাষার প্রাচীন নারী কবিদের মধ্যে ঋদ্ধতার নিরিখে শীলা ভট্টারিকা অন্যতম। তাঁর কাল ১০ম শতাব্দীর আগে। তিনি সে যুগের বিশিষ্ট নারী কবি হিসাবে স্বীকৃত । সংস্কৃত ভাষার লেখা শীলা ভট্টারিকার নিচের কবিতাটি থেকেই তাঁর কাব্য প্রতিভার উজ্জ্বল স্বাক্ষর মেলে।

য: কৌমারহর: স এব হি বরস্তা এব চৈত্রক্ষপা— 
স্তে চোন্নীলিতমালতীসুরভয়: প্রৌঢ়া: কদম্বনিলা:।
সা চৈবাস্মি তথাপি তত্র সুরতব্যাপারলীলাবিধৌ: 
রেবারোধসি বেতসীতরুতলে চেত: সমুৎকন্ঠতে। 

শীলা ভট্টারিকার এ কবিতার গৌরব অসামান্য । স্বয়ং চৈতন্যদেব শীলা ভট্টারিকার এ কবিতারটির রসাস্বাদন করে ভাবাবিষ্ট হতেন বলে জানা যায়। আমরা এই অসাধারণ সংস্কৃত এই কবিতাটির যথাক্রমে সুশীলকুমার দের বাংলা ভাষান্তর তুলে ধরব। 

কৌমার মোর হরেছিল যেই, সেই বর সেই চৈত্ররাতি;
তেমনি ফুল্ল মালতী গন্ধ , কদম্ব – বায়ু বহিছে মাতি; 
আমিও তো সেই!—তবু সেদিনের সে—সুরতলীলা কিসের তরে 
রেবাতটে সেই বেতসীর মূলে আজিও চিত্ত আকুল করে । 

সংস্কৃত ভাষার প্রেমের কবিতায় প্রেমের অঙ্কুর, বৃদ্ধি ও পরিস্ফুটন দেহকে কেন্দ্র করে হলেও তা পরিশেষে দেহাতীত হয়েছে এবং দেহগত সমস্ত অনুভূতির উর্ধ্বে তা এক আনন্দঘন উপলব্ধি জন্ম দিয়েছে।এ অনুষঙ্গের প্রকৃত প্রমাণ মেলে শীলা ভট্টারিকার য: কৌমারহর: স এব হি বরস্তা এব চৈত্রক্ষপা— এ শ্লোকে । লৌকিক বিষয় ভিত্তিক এ শ্লোকটি দেহগত সমস্ত অনুভূতির উর্ধ্বে রেখে দয়িতা স্মৃতিচারণ করছেন। 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনুবাদকৃত অজ্ঞাত একজন কবির এ কবিতাটি একজন নারী কবির রচনা বলে ধারণা করা যেতে পারে।

আসে আসুক রাতি, আসুক বা দিবা, 
যায় যদি যাক নিরবধি। 
তাহাদের যাতায়াতে আসে যায় কিবা 
প্রিয়জন নাহি আসে যদি ।

(অনুবাদ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, হাজার বছরের কবিতা—অবন্তী সান্যাল, পৃষ্ঠা-৭২, প্রকাশক: বিশ্ববাণী, কলকাতা-৯) 

এছাড়াও আরো অনেক প্রাচীন নারী কবি তাঁদের গীতিধর্মী কবিতার প্রেমকে দু:খ- বেদনা, হাসি- আনন্দ, মান-অভিমান সহ নানা আঙ্গিকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, যা আজও বিশ্বসাহিত্যাঙ্গনে লোকায়ত ও চিরন্তন ।

1 comments:

2

বিশেষ প্রতিবেদনঃ পিয়ালী বসু

Posted in













বিশেষ প্রতিবেদন


আইরিশ সমাজে নারীর অবস্থান 
পিয়ালী বসু 



আয়ারল্যান্ড (Ireland ) দেশটির অবস্থান ইউরোপের উত্তর পশ্চিম, এবং গ্রেট ব্রিটেনের একেবারে পশ্চিমে, তা এ হেন আয়ারল্যান্ড দেশটি কে প্রাচীনপন্থী আইরিশ রা মাদার আয়ারল্যান্ড ( Mother Ireland ) বলেও ডেকে থাকেন, শোনা যায় আয়ারল্যান্ড দেশটি নাকি মাতৃতান্ত্রিক, আর তাই মাদার শব্দের উল্লেখ । Eavan Boland এর উক্তিতে এও জানা যায়, “The heroine, ….. was utterly passive. She was Ireland or Hibernia. She was stamped, as a rubbed-away mark, on silver or gold; …... Or she was a nineteenth-century image of girlhood, …….. She was invoked, addressed, remembered, loved, regretted. And, most importantly, died for. She was a mother or a virgin ... Her identity was as an image. Or was it a fiction?” অর্থাৎ কুমারী মায়ের প্রসঙ্গ, ঠিক যেমন মাদার মেরী, তেমনই মাদার আয়ারল্যান্ড, এই মিথ কে যদি তেমন আমল নাও দেওয়া হয়, তাহলেও কিন্তু আয়ারল্যান্ড যে মাতৃতান্ত্রিক দেশ, এ তথ্যটি পাল্টায় না, এবং এর স্বপক্ষে হাজার হাজার উদাহরণও পেশ করা যায় । পুরুষ হল সংস্কৃতির প্রতীক, আর নারী হল প্রকৃতির ... এই উভয়ের মেলবন্ধনেই সুস্থু সমাজ প্রতিষ্ঠা। মা (Mother ) এমন একজন, যিনি তাঁর মৌনতাতেই মুখর করে তোলেন পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, আর প্রকৃতিও এই মায়ের মতোই সহনশীল, মৌন ... তাই নারী কে প্রকৃতির সাথে তুলনা । 

১৯২২ সাল থেকে আয়ারল্যান্ড পূর্ণমাত্রায় একটি Free State এর মর্যাদা পায়, ১৯৩৭ সালেই রচিত হয় সংশোধিত নতুন সংবিধান, আর এই সংবিধানেই মেয়েদের অধিকার এর কথাও ঘোষিত হয়। সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে নারীর অবদান, Other হয়ে ওঠে Mother ...আর আস্তে আস্তে কমতে থাকে Father এর প্রতিপত্তি, এখনও পর্যন্ত আয়ারল্যান্ড মাতৃতান্ত্রিক দেশ, (যদিও নারী অর্থেই মা নন) ১৯২৭ সালে পাশ হয় এক নতুন আইন, যে আইন স্বীকৃতি দেয় অবিবাহিতা মায়েদের, bars and restrictions have been lifted and it is no longer socially unacceptable to have a child outside of marriage .. In a country where Mothers quite definitely have a place, they evidently do not have a position in the constitution...এই চিরাচরিত ধারণাটাই পাল্টাতে থাকে ক্রমে । 

আপাদমস্তক ক্যাথলিক খৃস্টান একটি দেশের (চার্চ, পাদ্রী এদের নিয়েই) এমন নজির কিন্তু বেশ নজর কাড়ে, কিন্তু প্রতিটি সিদ্ধান্তেরই একটি বিপ্রতীপ অপসিদ্ধান্ত থাকে, এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনা, সমাজ ও সংবিধানে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং অবিবাহিতা মায়েদেরও সমাজে মূল স্বীকৃতি দেওয়ায় গর্ভপাত বেআইনি বলে গন্য হয়, এবং সাম্প্রতিক কালের সারা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা সবিতা হালাপান্নাভার এর মৃত্যু আমাদের আরও একবার এক বিরাট প্রশ্নের সামনে এনে উপস্থিত করে। ২৮ শে অক্টোবর ২০১২ ...আয়ারল্যান্ডের Galway City Hospital এ মৃত্যু হয় সবিতার। ১৭ সপ্তাহের গর্ভবতী সবিতা অপ্রতিরোধ্য ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনে আক্রান্ত হয়ে Galway City Hospital ভর্তি হন, সেসময়তেই Miscarriage হয় তাঁর, নিজেও ডাক্তার সবিতা ডাক্তারদের কাছে Abortion এর আর্জি জানান ২১ শে অক্টোবর, তাঁর সেই আবেদন খারিজ হয় এই ভিত্তিতে যে, ক্যাথলিক দেশে গর্ভপাত বেআইনি ! সেপটিক শক, মাল্টি অরগ্যান ফেলিওর এবং কার্ডিয়াক ফেলিয়োরে শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয় সবিতার। 

আইন কি মানুষের জীবনের চেয়েও দামী ? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে তোলপাড় হয় গোটা আয়ারল্যান্ড, ১৪ ই নভেম্বর আয়ারল্যান্ডের সর্বপ্রচারিত দৈনিক সংবাদপত্র The Irish Times ৭০০,০০০ কপি বিক্রী করে। সোশাল মিডিয়া জুড়ে বিতর্কের ঝড় বয়ে যায়, অবস্থা হাতের বাইরে চলে যেতে দেখে United Nations Special Rapporteur হস্তক্ষেপ করে । প্রধানমন্ত্রী Enda Kenny তাঁর বয়ানে জানান, “"I don't think we should say anything about this until we are in possession of all the facts.” ...Health Service Executive সাবারাত্নাম আরুল্কুমারান সাতজন ডাক্তার সহ একটি মেডিক্যাল প্যানেল তৈরি করে এই বিষয়টির তদন্ত শুরু করেন। তাঁর রিপোর্টে আরুল্কুমারান স্পষ্টতই জানান, সবিতার মৃত্যু হয় শরীরে অতিমাত্রায় ইনফেকশন ছড়িয়ে যাওয়ায়, এবং সঠিক মেডিকেল সুযোগ সুবিধা না পাওয়ায় । আয়ারল্যান্ড, লন্ডন, জার্মানির Indian Embassy র সামনে শুরু হয় মিটিং, ...কর্পোরেট দুনিয়ার খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব Colm O Gorman জানান, “successive Irish Governments have failed in their duty to provide necessary clarity on how this right is protected and vindicated, leaving women in Ireland in a very vulnerable position” 

সমস্ত জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটে ৩০শে জুলাই ২০১৩ এ , রাষ্ট্রপতি Michael D Higgins নতুন আইনে স্বাক্ষর করেন Protection Of Life Pregnancy Act 2013 ... চূড়ান্ত ক্যাথলিক দেশ আয়ারল্যান্ড তার আইন পাল্টাতে বাধ্য হয়, জীবন যে আইনের চেয়েও বেশি মূল্যবান, এই সহজ সত্যটা আরও একবার প্রমানিত হয় । 

আয়ারল্যান্ডের সমাজ বিষয়ক ইতিহাস ঘাঁটলে মেয়েদের অবস্থানগত বিবর্তন স্পষ্টতই চোখে পড়ে, খ্যাতনামা রিলেশনশিপ এক্সপার্ট Brendan Madden জানান, “Over the past 50 years we've seen fundamental change in Irish society and Irish family life, however one constant has remained – the desire for people to form strong, sustaining relationships throughout their life” আর এই সুষ্ঠু সম্পর্ক ও পরিবার প্রতিষ্ঠায় নারীর অবদান অনস্বীকার্য, মেয়েদের কোমল স্পর্শ ছাড়া যে কোন পরিবারই অসম্পূর্ণ । Madden এও জানান যে, বিগত ৫০ বছরের আইরিশ সমাজতত্ব ঘাঁটলে দেখা যাবে মহিলারা এখন ঘরে আর বাইরে সমান স্বচ্ছন্দ, আর তাই শিক্ষাগত প্রতিষ্ঠান, অফিস এবং আরও অন্যান্য বিভাগেও মহিলাদের অবাধ বিচরণ, কাজের প্রতি নিষ্ঠা তাঁদের আলাদা করেছে পুরুষদের চেয়ে, আর এই আলাদা হওয়ার সুবাদেই তাঁরা ছিনিয়ে নিচ্ছেন পুরুষদের কাজ ।অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও পরিবর্তন হয়েছে আয়ারল্যান্ডের, ভাল ভাবে বাঁচতে গেলে এখন পরিবারের উভয়েরই উপার্জন প্রয়োজন, তাই স্বাভাবিক ভাবেই মেয়েদেরও এগিয়ে আসতে হচ্ছে, পরিবারের হাল ধরতে, The result is that women often has to juggle their careers while still handling the bulk of household duties . 

সময় এগোচ্ছে, এগোচ্ছে সমাজ, আর তার সাথে সাথে পারিপার্শ্বিক পটভূমি। traditional model Family র সংখ্যা কমছে, তার জায়গা নিচ্ছে Single Parent Family, আশাতীতভাবে হ্রাস পাচ্ছে বিবাহ এর সংখ্যাও । ১৯৬০ সালের পর থেকে গড় বিবাহ এর সংখ্যা বেশ নিম্নমুখী, আর তার কারণ হিসেবে এটাই বলা যায়, পুরুষ এর পরিচয়ে আর নিজেদের পরিচিত করতে চাইছেন না মেয়েরা, তাই বিবাহ নয়, Co Habiting, ...চিরকালীন Commitment নয়, বরং অস্থায়ী Commitment বেশ স্বচ্ছন্দ আজকের আধুনিক আইরিশ নারী, you might need me, but I don’t need you ..পুরুষের নর্মসহচরী নয়, আজকের আইরিশ নারী পুরুষের কর্মসহচরী, আর তাই

The perception 
of truth
is not dependent
nor is it failed to
be
logic
without us 



2 comments:

3

বিশেষ রচনাঃ ঈশানী রায়চৌধুরী

Posted in


বিশেষ রচনা


কৃষ্ণচূড়া আখ্যান
ঈশানী রায়চৌধুরী



সে ছিল এক পাগলী কৃষ্ণচূড়া | এক্কেবারে পাগলী | তার বাবা সামান্য কেরাণীর চাকরি করতেন | মাসের মধ্যে অর্ধেক দিনই ট্যুরে | মা নিপুণ হাতে দরাজ বুকে আগলে রাখতেন খুব স্বল্প স্বাচ্ছন্দ্যের সংসার | অর্থের অভাব ছিল হয়ত, প্রাচুর্য ছিল না ; কিন্তু মনের দৈন্যও তো ছিল না ! দু'টি খুদে ভাই বোন ছিল | তাদের জন্য পরাণ ফাটত তার | ভাই বড় চঞ্চল | সারা দুপুর উঠোনে ক্রিকেট | দিদির সঙ্গে | মা দুপুরে দু'চোখের পাতা বুজতে পারেন না | রেগেমেগে গুমগুমিয়ে কিলোতে এলে দিদি পিঠ পেতে দেয় নিজের | ভাইটা যখন একবছরের , ওরা থাকত বেঙ্গল কেমিক্যালে | সেখানে খালের জলে ডুবে যাচ্ছিল ভাইটা | সাঁতার না জেনেই তার ছ'বছরের খুদে দিদি জলে ঝাঁপ দিয়েছিল সেদিন | বাকিটা মাঝিমাল্লার গল্প |

মেয়েটা বড় বুদ্ধিমতী | অঙ্কে খুব মাথা | কিন্তু ওই যে, খালি ঝোঁক পড়ার বইয়ের ফাঁকে গল্পের বই লুকোনোর | বই কিনে আর কত পড়বে ! চেয়েচিন্তে আনে | আর ক্যারাম | এখন ওরা বেঙ্গল কেমিক্যালের পাট চুকিয়ে ভবানীপুরে | বাবা বড্ড কড়া |নিম্ন মধ্যবিত্ত বা টেনেটুনে মধ্যবিত্তের সংসারে পড়াশুনো করতেই হবে ! তাই অসময়ে ক্যারাম পিটলে লালচোখ করে বাবা দেশজ ভাষায় বলেন , " ছেমড়ি , তর ওই ক্যারাম বোর্ড কাইট্যা আজ আখায় দিমু অনে |"

তাহলে মেয়েটা পাগলী কেন ? কারণ সে সাজুগুজু নিয়ে মাথা ঘামায় না | বায়নাবাটি করে না | এলোঝেলো হয়ে থাকে | আঁক কষা তার নেশা | চটি ছিঁড়ে গেলে সেফটিপিন লাগিয়ে কাজ চালায় | দুপুরে ইস্কুল থেকে ফিরলে একটা বড় বগি থালায় ভাত মেখে গোল্লা পাকিয়ে তার মা খাইয়ে দেন তিনজনকে | সে দেখেই না , তার ভাগের মাছটা ভাই খেয়ে নিল কিনা...সে পিঁড়িতে বাবু হয়ে বসে কোলে গল্পের বই রেখে পড়েই যায়, পড়েই যায় |

স্কুল শেষ হল | রেজাল্ট ভালো হল, কিন্তু আশানুরূপ হল না | কারণ একটা জ্যামিতির এক্সট্রা, ১২ নম্বরের, সে প্রশ্ন পড়তে ভুল করেছিল | সেটা নিয়ে রগড়াতে রগড়াতে চলে গেল সময় | অঙ্কে লেটার হল. একশ' হল না |

হল না তো আরও অনেক কিছুই | সার্জেন হতে চেয়েছিল, বায়োলোজি ক্লাসে নিখুঁত ডিসেকশন করত | বাবার টাকার জোর ছিল না | ডাক্তারী পড়তে, প্রতিষ্ঠিত হতে সময় লাগে | ইঞ্জিনীয়ারিং ? ছবি আঁকার হাত খুব ভালো | একমাত্র মেয়ে, যে অত বছর আগে পরীক্ষা দিয়ে খুব ভালো রেজাল্ট করে চান্স পেয়েছিল আর্কিটেকচার পড়তে | হল না | শিবপুরে তখন এ. সি . রায়ের আমল | তিনি বলেছিলেন, " তুমি একা মেয়ে | হোস্টেল দিতে পারব না | তুমি বাড়ির কাছে কোনো কলেজে পড় | তুমি তো অঙ্কে এক্সেলেন্ট, ফিজিক্স নিয়ে পড় |"

তাই সই | মর্নিং কলেজ | খুব ঘুমকাতুরে | সকালে রোজ দেরী | তাই রাতেই চুলে দু'বিনুনি বেঁধে শুতে হয় | সকালে উঠে চায়ে রুটি ডুবিয়ে খেয়ে কোনক্রমে আলনা থেকে একটা শাড়ি নামিয়ে শরীর ঢেকেঢুকে একছুটে কলেজ | তাকে কলেজে সবাই চেনে | যে মেয়েটা চুল না আঁচড়ে আসে রোজ রোজ, যে মেয়েটা দেখনহাসি |

পাগলী এবং দেখনহাসি | তার প্রেমে পড়েন অন্যবিভাগের এক সুপুরুষ অধ্যাপক | তিনি আবার বাপ মায়ের এক পুত্র এবং সুপুত্র | তাঁদেরও মধ্যবিত্ত সংসার | কিন্তু তাতে কী ? পাত্রপক্ষ তো ! প্রেমপর্ব চলছে | দাদারা, বন্ধুরা মধ্যস্থতা করছে | এর মধ্যে মেয়েটি স্নাতক স্তর উত্তীর্ণ হয়ে যায় | তার বাবা তখন উইদাউট পে বাড়িতে | দুর্ঘটনায় মারাত্মক জখম | মেয়েটি স্কুলে চাকরি করছে | বাড়িতে টাকার তো দরকার খুব | মাস্টার্স ? সে হবে'খন | না হয়, এক বছর পর | পাত্রের বাবা গোবেচারা, ভালোমানুষ | মা রণং দেহি | এই মরকুটে হাভাতে গরীবঘরের কালো মেয়ের হাসিতে মজেছে ছেলে ! বিয়ে হবে | কিন্তু গোড়া থেকে মেরে রেখে দাও | "আমাদের বাড়ির বউরা চাকরি করতে বাইরে যায় না |" মেয়েটি তখন মাত্রই উনিশ | তার বাবা বলেছিলেন, " এত ভালো পাত্র , আমি যেভাবে পারি চালিয়ে নেব | তুই চাকরিটা ছেড়েই দে | ওঁদের যখন ইচ্ছে নয় !"

ছেড়ে দিল সে চাকরি | স্কুলের চাকরি | সাউথ পয়েন্ট স্কুল | চেয়েচিন্তে কিছু ধারধোর করে বিয়ে হয়ে গেল তার | ছোট ভাইবোন কপাটের আড়াল থেকে দেখল দিদি যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি |

ফুলশয্যার রাতেই তার বর বলে দিয়েছিল, " আমি এক ছেলে | মায়ের অবাধ্য হতে পারব না | তোমায় মারুক, কাটুক..সইতে হবে |"
" আমি মাস্টার্স করব না ?"
" করবে | কিন্তু তা বলে সংসার চুলোয় দিয়ে নয় |"

রান্নার লোক ছিল এতদিন | এখন বউ এসেছে | কী দরকার ? আর এ বাড়ির সবাই টুকটুকে ফর্সা | বৌয়ের না আছে রূপের জোর .না আছে রুপোর | আর কালো রঙে উনুনপাড়ে গেলেই কী, না গেলেই কী |

সে রান্না করে , ঘর গোছায় | তোলা কাজের লোক না এলে বাসন মাজে , কাপড় কাচে| তারপর হাতের কাজ মিটলে ধুঁকতে ধুঁকতে ইউনিভার্সিটি যায় | আর ফিজিক্স নয় |এবার বিশুদ্ধ গণিত | প্র্যাক্টিকালের ঝামেলা নেই... তাই | সে ঠিক আছে | অঙ্ক মেয়েটির বিশল্যকরণী |

যেদিন বাড়িতে অতিথি এসে পড়েন কেউ, সেদিন কলেজ কামাই | চা জলখাবার দেবে কে ! তবে কোনো কোনো বিশেষ অতিথি এলে, বড়মানুষ অতিথি...সেদিন চা জলখাবার বানাতে হয় না বটে, তবে কলেজেও যাওয়া হয় না | সেদিন তাকে পুরো সময়টা তার শাশুড়ি বাথরুমে বন্ধ করে রাখেন | কালো বউ | ছি :|

মেয়েটি ভাবে, বাবার টাকা থাকলে তার রঙের জলুস বাড়ত কি ? একটু ?

সন্তানসম্ভবা হয় সে | এবং জন্ম দেয় এক কন্যার | এখানেও শাশুড়ি মুখ বেঁকান | "হয়েছে তো এক ডোমের চুপড়ি ধোয়া মেয়ে ! " প্রথম প্রথম নাতনীকে কোলেই নিতেন না | তারপর অবিশ্যি নাতনির গায়ের রংটি দেখে কিঞ্চিত মজেন | মেয়ের জন্ম দিয়ে তরুণী মা মরমে মরে থাকে | তার লেখাপড়া শিকেয় ওঠে | এত কথা... এত কথা... এত অত্যাচার... সে যখন ৭ মাস গর্ভবতী, মনের জ্বালা সইতে না পেরে গিয়েছিল গর্ভপাত করাতে | বলেছিল, "চাই না "| অনেক দেরী হয়ে গেছে | ডাক্তার রাজী হননি| সেই খুকী জানে, সে অবাঞ্ছিত ছিল | তার মায়ের কাছে | জানে, অনেক যন্ত্রণায় তার মা ছুটে গিয়েছিল ডাক্তারের কাছে | এও জানে, খোঁটার ভয়ে, যদি আবার মেয়ে হয়... সেই ভয়ে... তার মা কাকবন্ধ্যা রয়ে গেছে |

এরপর হল এক মজা | খুকী যেই বড় হল একটু, তার ঠাকুমা তাকে কুক্ষিগত করলেন| খুকী তাঁর কাছে খাবে, ঘুমোবে | খুকীর মা দূর থেকে দেখে, মেয়ে ঠাকুমার আঁচল ধরে গুটিগুটি হাঁটে | ঠাকুমার গলা জড়িয়ে গল্প শোনে | খুকীর মা বলে, "আয় না, আমার কাছে শুবি |" খুকি গা মুচড়ে বলে, "যা:, ঠাম্মা কাঁদবে |"

তরুণী মা রাঁধে বাড়ে, কর্তব্য করে | আত্মীয়স্বজনের যত্ন করে দু'হাতে | এখন লোকের চোখে কালো রং সয়ে গেছে | খুকী পড়ে -..তার মায়ের কাছে | ফ্রক সেলাই করে... মা | চুল বেঁধে দেয়... মা | মা তার প্রয়োজনের জায়গা | ঠাকুমা তার আব্দারের, আহ্লাদের |

তরুণী মা | চারাগাছ থেকে ফুলধরানো ডাল | খুকী | খুকী বড় হয় | ইস্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি...

খুকী অঙ্কে ভালো | কিন্তু মেধায় সে তার মায়ের পায়ের নখের যুগ্যি নয় | খুকীও চারাগাছ ছিল, কিন্তু তাতে জল পড়েছে, সার পড়েছে | খুকীর মা ? গাছ বেড়েছে, পরিচর্যা পায়নি |

খুকীর মায়ের চুলে রুপোর তার | অনেক | অনেক | কিন্তু চুলের আড়ালে তীক্ষ্ণ মেধায় এখনও যেকোনো অঙ্ক কষা হয়ে যায় হেলায়, কঠিনতম সুডোকু বা অঙ্কের ধাঁধা রেকর্ড সময়ে, যেকোনো হাতের কাজ নিখুঁত পারদর্শিতায়, আই কিউ লেভেল পরীক্ষা করতে ভয় পায় খুকী | জানে, মায়ের কাছে হেরে ভূত হয়ে যাবে |

দেখনহাসি আছে আগের মতোই | চোখের দীপ্তিও | তেমনই ঝকঝকে | বয়সের সর পড়েছে সামান্য | তাতে সৌন্দর্য এখন অন্য মাত্রায় |

খুকী চোখ বুজলেই দেখতে পায় , তার মায়ের ডুরে শাড়ির আঁচল মিলিয়ে যাচ্ছে ট্রামলাইন পেরিয়ে | ইউনিভার্সিটির দিকে |

দেখনহাসি নাকি নিজের কথা লিখেছে একটা | মোটা রুলটানা খাতায় | কাউকে পড়ায়নি | কে জানে ! সঙ্কোচে, নাকি অভিমানে?

এ এক অন্য কৃষ্ণচূড়া | কতটা আকাশ ছুঁয়েছিল.. জানি না | তবে ছায়া দিয়েছিল | ফুলও |

3 comments: