Next
Previous
Showing posts with label ব্যক্তিগত গদ্য. Show all posts
0

ব্যক্তিগত গদ্য - ফাল্গুনী ঘোষ

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


যাত্রাখেলা_সরস্বতীমেলা
ফাল্গুনী ঘোষ



মাল্টিপ্লেক্স, ডলবি, আইনক্স-এর থ্রিডি এফেক্টের সাঁ সাঁ গতির পাশ কাটিয়ে মাঝে মধ্যে টাইম মেশিনে চড়ে গ্রামের যাত্রাপালার আসরে নেমে পড়তে আজকাল বেশ লাগে। সারাবছরে কড় গুনে গুনে একটি একটি দিন পার করা। দুর্গা পুজোর পর থেকে ঘাসের ডগায় শিশিরের রেখা শিরশিরানি ধরাত মনে। উত্তেজনার পারদ আর শীতের ওমে যেন পাল্লাপাল্লি। মনে প্রতীক্ষার প্রহর ‘এস মা সরস্বতী’—জমিয়ে মেলা বসাও ঘরে ঘরে। লোকে করে কম্মে খাক। কোমর কষে রোজগার পাতি করুক। গ্রামের বুড়ুটে মার্কা সময় একটু যৌবন পাক। 

ছোটোবেলায় কুরুমগ্রামের বৎসরান্তের জাঁকালো সরস্বতী মেলা, সাথে জমজমাট যাত্রাপালা ফ্রি ফ্রি ফ্রি। গ্রামের সপ্তাহব্যাপী প্রাণভোমরা ‘মেলা’র জীয়নকাঠি যাত্রাপালের হাতে। দুর্গাপুজোর কিছু আগে থেকেই কলকাতার যাত্রাদলের বায়না করা, কমিটি গঠন, সিজন টিকিট ছাপানো, বিলির হাজার একটা ব্যস্ততা লেগেই থাকত কমিটি মেম্বারদের মধ্যে। যেহেতু স্কুলের বড় মাঠ ছিল যাত্রাস্থল সেকারণে মান্যগণ্য সামান্য শিক্ষকেরা এসব কাজে শুধু নাক নয়, হাত-পা সবই গলাতেন। সুতরাং আমাদের ঘরের চার দেওয়ালে যাত্রা যাত্রা গন্ধ ছাড়ত বাবার দৌলতে মূল যাত্রাপালার মাস তিন চারেক আগে থেকেই। 

শীতের পিকনিকের ধুমের পাশাপাশি গাঁ-ভিনগাঁ ছাড়িয়ে মফঃস্বল ঘেঁষা গ্রামগুলিতেও দেওয়ালে দেওয়ালে পড়ত পোস্টারের ধুম—‘সিঁদুর দিও না মুছে’, ‘মায়ের ভালোবাসা’, ‘রক্তলেখা জীবন’, ‘সোনার সংসার’—পুরো সমাজকে তুলে এনে আঠা দিয়ে দেওয়ালে সাঁটিয়ে দেওয়া হত। মাঝে মাঝে আবার বর্তমানের স্টেজ পেরিয়ে ‘আমি সিরাজের বৌ’ অতীতের গ্রিনরুম থেকে উঁকি দিত ‘খাপখোলা তলোয়ার’এ। সত্য বন্দ্যোপাধায়, তরুনকুমার, বিপ্লব চক্রবর্তী তারকাখচিত এই নামগুলি উপযুক্ত ক্ষেত্রে পাঁচফোড়নের ঝাঁজ ধরাত। রাস্তার মোড়ের মাথায় চা, পান, বিড়ির গুমটিতে, ছ্যাড়ছ্যাড়ে ধুলো উড়ানো ভ্যানরিক্সা, বাবু-বিবির রিক্সা, ভিড়ে ঠাসা শাক সব্জির ঝাঁকা মাথায় দু-চারটে বাসের আওয়াজে মিশে যেত সেই ঝাঁজ—“এবাটি মেলাতে কুরুংগা আসছ তো?” কুরুমগ্রামের আদরের নাম ‘কুরুংগা’। 

তা আসতও, মেয়ে জামাই, বেটা বিটি, নাতি পুতি, পোলা পান, মাসি পিসী, খুড়ি খুড়ো যেখানে যত আছে ঝেঁটিয়ে। সরস্বতী পুজোর দুতিন দিন আগে থেকে গ্রামে ঢোকার রাস্তার ধার বরাবর পোস্ট অফিস থেকে সাধনের মিষ্টির দোকান ছাড়িয়ে প্রায় দু কিমি জায়গা জুড়ে বাঁশ পোতা, ছাউনি খাটানোর সলতে পাকানো শুরু হতো। সাধনের মিষ্টির দোকান ছিল আমাদের মত অনেকবাড়ির পেটেন্ট করা। নির্ভেজাল ছানার পান্তুয়া, রসগোল্লা আর কলাই-এর ডালের মুচমুচে গরম জিলাপি—এই দোকানকে আমার স্মৃতিতে উসকিয়ে দেবে চিরদিন। আর দু-একদিন তো নয়। এসময় আত্মীয় স্বজন আর সাধনের দোকানের মিষ্টিমুখ দুই অগুনতি।

মেলার ভেঁপু, বাঁশি, মিষ্টির রসে মাছির ভনভনানির সাথে চলত চলন্ত চোঙের ঘ্যানঘ্যানানি—“ আর মাত্র কয়েকঘন্টা পরে শুরু হতে চলেছে তিনদিনব্যাপী বিরাট যাত্রানুষ্ঠান। প্রথম রজনীর আকর্ষণ......” কান উন্মুখ হয়ে থাকত সেদিকেই। স্কুলের মাঠ ততক্ষণে তার সাজ সম্পূর্ণ করেছে। চারিদিকে দর্শকের প্রায় মধ্যেখানে দুথাকবিশিষ্ট মঞ্চ। নিচের থাকে বাজনদারদের কেতা, উপরে পাত্রপাত্রীদের কেতা। বাঁশ দিয়ে পুরুষ ও মহিলাদের জায়গা আলাদা করা। নীচে শতরঞ্জি শতচ্ছিন্ন উপরে সামিয়ানা- যেন একটি বিরাট তাঁবুর খোলে অসংখ্য মানুষের মেলা আর রংবাজি। বুকে স্বেচ্ছাসেবকের ব্যাজ লাগিয়ে ঘুরে বেড়ানো মানুষগুলোকে দেখে প্রতিজ্ঞাও করেছিলাম, ভবিষ্যতে এই কাজ করাই ভালো। কারণ যাদেরকে দেখার জন্য আমাদের হাপিত্যেশ, গ্রিন রুমের পর্দার আড়ালে চায়ের পেয়ালা নাচিয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে তাদের সাথে সে কি দেঁতো হাসি। এই সৌভাগ্যকে হিংসে না করে পারা যায় না। 

সন্ধ্যের শাঁখে ফুঁ দিয়েই গ্রামের মা বউরা বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন যাত্রা অভিযানের উদ্দেশ্যে। রাত্রি আটটায় বাঙালির টাইম। সুতরাং ন’টা থেকে চলবে তিন ঘন্টার যাত্রা। কিন্তু মনোমত জায়গাটি তো পাওয়া চাই। সেকারণে কিছু খাবার পেটের খোলে বাকিটা প্যাকেটে ভরে জল চাদর, কম্বল মুড়ি দিয়ে উত্তুরে হাওয়া, হিমেল শিশিরের সাথে লড়াইয়ের শক্তি বাগিয়ে গুঁতোগুতি করতে হতো। শীত চমকানোর মোক্ষম দাওয়ায়। আবার জায়গা ধরে রাখার বরাতও আসত আশেপাশের বাড়ি থেকে। এসবের পালা শেষ হলে, ঝনননন... প্যাঁপ্যাপ্যাঁ... ঢিন চ্যাক ঢিন চ্যাক...... জমকালো আওয়াজের ভণিতায় লাল-নীল-হলুদ-সবুজ- বেগুনীর রামধনুতে চড়ে সাত সুমুদ্দুরের দেশে হারিয়ে যেতে সময় লাগত না। কোথাও খিলখিলে হাসি, কখনও দুর্বার কান্নার স্রোত, অস্ত্রের ঝনঝনা পেরিয়ে সকালবেলা মায়ের পাশে লেপের তলায় নিজেকে খুঁজে পেতাম। 



মনের জেদ ধরে পরের দিনের জন্য দাঁতে দাঁত চাপলেও নিদ্রাদেবী কখনও বিশ্বাস ঘাতকতা করেননি। এই মনের খেদ মেটাতে একবার বাড়িতেই শুরু হলো আমার আর ভাইয়ের যাত্রাখেলার আসর। বারান্দার দুপাশের থামে দড়ি বেঁধে, সেই দড়ি থেকে ঝুলত ‘লাউডস্পিকার’। আসলি টর্চের পাক্কা নষ্ট হয়ে যাওয়া ব্যাটারি সেই লাউডস্পিকার জোগান দিয়েছিল। রঙিন লাইটের ছটা দেবার জন্য ভাঙা ইঁট পাটকেল কম পড়েনি বলাই বাহুল্য। আর গ্রিনরুমের গোপনীয়তা বজায় রাখতে পুরনো ছেঁড়া গামছার জুরি পাওয়া ভার! পাড়ার আরও দু-চারজনকে জুটিয়ে জমকালো যাত্রাদল গড়ে উঠলেও নামভূমিকায় সবার নাম ভিড় করে আসার কারণে অচিরেই যাত্রাদল লাটে উঠেছিল। বাকবিতণ্ডার কোনও কমিটি করতে পারিনি কিনা!
0

ব্যক্তিগত গদ্য - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


শুধু যাওয়া-আসা
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস


গতকাল বাবু চলে গেলেন।বাবু মানে আমার শ্বশুরমশাই…শিবাজীর বাবা। নিজের বাবার বাইরে কাউকে 'বাবা' সম্বোধন করতে অস্বস্তিবোধ করি বলে বিয়ের পর নিজেই ঠিক করে নিয়েছিলাম 'বাবু' সম্বোধনটুকু। বাবু কখনও আপত্তি করেননি। বেশ কিছুদিন ধরেই উনি অসুস্থ ছিলেন। বার্ধক্যের শক্তির সাথে ডাক্তাররাও যুঝতে পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছিল ওঁকে।ঘর থেকে উঠোন অবধি কোনওরকমে নেমেছিলেন নিজের পায়ে।তারপর ড্রাইভার ছেলেটি কোলে করে গাড়িতে উঠিয়েছিল। পিছনে ঠাম্মার কোল থেকে মোহর তখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছে "দাদানকে নিয়ে যেও না…"

সব 'চলে যাওয়া'র কারণ এক না হলেও কোথায় যেন চলে যাওয়াগুলোর মধ্যে খুব মিল। প্রতিটা মৃত্যুর অভিজ্ঞতা তার পূর্ববর্তী মৃত্যুগুলোর স্মৃতি টাটকা করে দেয়…সেই নব গণিত মুকুলের 'পূর্বপাঠের পুনরালোচনা' চ্যাপ্টারটার মতো। বাবুর পার্থিব অবয়বটুকু চারটে মানুষের ওপর ভর করে আসলো…বারান্দায় থাকলো…কিছু পাশবিক সামাজিকতা চললো…। আমি এসব কিছুই দেখলাম না। আমি টের পেলাম, মৃত্যুর গন্ধ সবসময় একরকম…হিম হিম আঁশটে একটা বাস…ধূপ-ফুল কিছুতেই ঢাকে না সেটা…এই গন্ধটুকুই লেগেছিল বাবার শরীরে…কিংবা ভীমের মুখের মধ্যে মুখ ঢুকিয়ে যখন ওর শ্বাসপ্রশ্বাস চালু করবার চেষ্টা করছিলাম, তখন…। বাবুর পায়ে তেল-হলুদ লাগানোর লম্বা লাইন পড়ে গেল।আমার ঠাকুরদার চলে যাওয়ার দিনও এরকমই হয়েছিল মনে পড়লো। তিরানব্বুই সালে ঠাকুরদা চলে যাওয়ার পর আজ অবধি এই স্মৃতিটুকু কখনও মনে আসেনি। কি আশ্চর্য!

আমার ঠাকুরদা মারা গিয়েছিলেন সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের একটা দুপুরে। সেবারই প্রথম এবং শেষবার গিয়েছিলাম ঠাকুরদার বাড়িতে। নদীর ধারে উঁচু মাটির দালান…ইংরেজী 'L' অক্ষরের মতো। উঠোনের একপাশে রান্নাঘর। তার গায়ে বিশাল এক তেঁতুল গাছ। এক বাড়ি ভর্তি লোকজন, বাচ্চাকাচ্চা। গোয়ালঘর…চালকলের একটানা যান্ত্রিক আওয়াজ…পোষা রাজহাঁস…মা মুরগীর পিছনে একগাদা ছানা। সেদিন আমি বোধহয় একটা মুরগীর সাথে খেলছিলাম। হঠাৎ কোনও একজন জেঠি আমাকে টেনে নিয়ে গেল ঠাকুরদার ঘরে। ঠাকুরদা ভাঙাচোরা শয্যাশায়ী একজন মানুষ যার সাহচর্য আমি কখনওই পাইনি। বার্ধক্য তাঁর শরীরকে বিকৃত করে দিয়েছে। আর ছয় বছর বয়সী আমার কাছে সেই শরীর নিতান্তই আতঙ্কের বিষয়। ফলে পারতপক্ষে সে ঘরে আমি ঢুকতাম না।আমাকে সেদিন জেঠি টেনেহিঁচড়ে ভিড় ঠেলে ঠাকুরদার পাশে নিয়ে গিয়েছিল। এই বয়সে এসে আমার মনে নেই ঠাকুরদা তখনও জীবিত কিনা কিংবা ওঁর কোটরগত চোখ খোলা ছিল না বন্ধ।আমার স্মৃতি জুড়ে আছে একটা হাঁ করা মুখ যার মধ্যে পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার জমাট বেঁধে আছে। কে যেন জলভর্তি ঘটি না গ্লাস নাকি চামচ আমার হাতে ধরিয়ে ওই ভয়াবহ অন্ধকারে জলটুকু ঢেলে দিলো…

মুসলিমপাড়ার সুন্দরীদি আত্মীয়দের ভিড় ঠেলে আমার কাছে এগিয়ে এসে খুব সংকুচিতভাবে জিগ্যেস করলো, "অ বৌমা, আমি একটু বাবার পায়ে তেল-হলুদ দেবো?" সুন্দরীদি এ বাড়িতে দীর্ঘদিন কাজ করেছে। বাবুর নির্দেশে বাড়ির সবার জন্মদিনের আগে সুন্দরীদির গাইগরুর দুধ আনা হয় পায়েসের জন্য। বাবু হাঁক দেয়, "ও মেয়ে!" সুন্দরীদি 'বাবা' ডাকে ওঁকে…মানেও খুব। কি সহজ সাবলীল একটা সম্পর্ক…রক্তের সম্পর্কের জটিলতা থেকে মুক্ত একটা সম্পর্ক!

মোহরকে আমি উপরের ঘরে মায়ের কাছে বসিয়ে রেখেছিলাম খেলনা দিয়ে। বাবুকে যখন নিয়ে চলে যাচ্ছে সবাই, জানলা দিয়ে মা ওকে দেখালো বাবুকে। মোহর জানে, দাদান ডাক্তারের কাছে যাচ্ছে।শুধু অভ্যেসবশে ও মাকে বললো, "দাদান আমাকে বলে গেল না!" আমি জানি, ওর সচেতন স্মৃতিতে এই অধ্যায়টুকু ধরা থাকবে না…কিন্তু কোথাও তো থাকবে…!

সারা বাড়ি শুনশান।বাড়ির ছেলেরা গ্রামের লোকের সাথে শ্মশানে গেছে ঠাকুরদাকে দাহ করতে। মা কিংবা জেঠিরা সবাই কোথায় কি জানি! মাটির টানা বারান্দা দিয়ে হাঁটছি। ধলা জেঠুর ঘর আর মেজো জেঠুর ঘরের মাঝের ঘরটা ঠাকুরদার। প্লাবণ বলেছে, ও ঘরে ঠাকুরদার ভূত আছে। আমি ধলা জেঠুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। মেজো জেঠুর ঘরে যেতে পারছি না। সন্ধ্যা নামছে। কেউ আলো জ্বালেনি আজকে। আমার সামনে ঠাকুরদার মুখের মতো আঁধার নামছে। আমি দেয়ালে সেঁটে অপেক্ষা করছি…আমার পা ভারী…গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না…কেউ এসে আমার হাত ধরুক…
0

ব্যক্তিগত গদ্য - স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


স্বয়ংপ্রভা 
স্মৃতি চট্টোপাধ্যায় সমাদ্দার



আমি যতদূর জানি - ইনি কবি নন - ঔপ্যন্যাসিক বা গল্পকারও নন, সে সব গুণ ওঁর নেই। তবু প্রতিদিন এক নীল খাতায় কি যে রাত জেগে সব লেখেন কে জানে! এখন রাত একটা বাজে। অদম্য কৌতূহল নিয়ে নিদ্রিতার পাশ থেকে খাতাটি নিয়ে পড়তে বসি।

আচ্ছা কি লিখতে পারেন? যাপিত জীবনের পাওয়া না পাওয়ার কথা? নাকি আর দশটা গৃহবধূর মতো ছেলে, বৌমা, নাতি নিয়ে... দূর পড়েই ফেলি...

২৯শে অগাস্ট ২০১৬ 
রাত  ১১টা ৪০ মিনিট

যে দিন তোমার সাথে প্রথম দেখা
সে দিন বুঝিনি আমি হব যে একা---

আজ দুপুরবেলা তোমার এক বছরের কাজ হলো।

আমার এই শ্রাবণেই গুটি গুটি ছিয়াত্তর এসে ঘাঁটি গাড়ল দেহে। কবে তোমায় প্রথম দেখেছিলাম, হে জমিদার তনয়? 

বয়েস তখন আঠারো অথবা উনিশ
হাওয়ায় ভাসতো স্বপ্নের শুভ্রতা
ছিল না কোথাও কোনও আবিলতা কালো
সবুজ ঘাসের পরশ লাগতো ভালো।

গত বছর আমাকে একলা রেখে তুমি চলে গেলে। আজ তোমাকে আমার কিছু কথা জানাই। যাহা বলিব সত্য বলিব, গো বিচারক। 

আচ্ছা, এই যে সাতান্ন বছর ঘর করার পর তুমি চলে গেলে - আমি কি খুব দুঃখ পেয়েছি? একসাথে এতদিন অতিবাহিত করার পর একা হওয়ার এক বেদন অনুভাব করছি না বললে মিথ্যে বলা হবে। আমি তোমাদের কাছে এক হাবা গোবা, মুখ্যু মেয়েছেলে ছাড়া আর কিছুই কি হয়ে উঠতে পেরেছি? 

অষ্টম শ্রেণীর বিদ্যে নিয়ে মেয়েছেলে থাকা যায়, কিন্তু মেয়েমানুষ? আরে ছি! 

তবে আমি নাকি অপূর্ব সুন্দরী, ঘরে পরে লক্ষ্মী বলে সবাই। আমি যে কেমন তা তোমাদের ঐ দাড়ি কামানো আয়নাতে সিঁদুর পরার সময় যতটুকু বিম্বিত হয়, তাই দেখেছি। আমার চাঁপাফুল রঙ, সাদা পায়রার মতো স্তন, নিটোল গভীর নাভিকূপ - এ সব তোমার মুখে শোনা। সেই যখন চারদিকে ছেলে মেয়েরা ঘুমিয়ে ন্যাতা, সেই যখন বোশেখী দাহে বা বৃষ্টির জল পড়ত টিনের চালের ফুটো দিয়ে টুপটুপ আর জেগে উঠত তোমার দেহ তখনই, একমাত্র তখনই এগুলো আমার শোনা। 

কোনওদিন ভাবিনি আমার মন কি বলে - সেই উনিশে তোমাদের যজ্ঞিবাড়ির উনুনের ধারে মুখ করে বসেছিলাম। তারপর কখন যে সংসারের জালে নিজেই এক মাকড়সা-মন হয়ে গেছি বুঝতেই পারিনি।

তুমি গত কয়েক বছর ধরে আমায় মাসান্তে তিনশ টাকা দিয়ে বলতে 'নাও তোমার হাত খরচ তি ন 'শ টাকা দিলাম'। ঘেন্না করত। বড়ো ঘেন্না করত নিতে, তাও নিতাম। কেন জান? তাই দিয়ে তোমাদের কিছু দেওয়ার আনন্দ কিনতাম আমি। বড়ো আনন্দে - বড়ো লজ্জায় - বড়ো ঘেন্নায়।

জান, এখনও আমার বড়ো ভালো লাগে এই পৃথিবীর আলো। ভালোবাসি ঘাস, ফুল, আকাশ ভরা সূর্য তারা। রবি ঠাকুরের গান। কি ভালো গাইতাম আমি। এখনও গাইতে চেষ্টা করি - সবাই বলে কাঁদছ কেন? পেত্নীর খোনা সুর আজ আমার সাথী। 

লেখা পড়া শিখিনি তো, ওই রবি ঠাকুর, শরৎচন্দ্র, বঙ্কিম, তারাশঙ্কর, গজেন মিত্র আর কথামৃত। যা পাই তাই পড়তাম। ঠোঙাটাও বাদ দিতাম না। আজও দিই না। এই বয়েস অবধি শুনে আসছি - ভারি তো বিদ্যে, তবু লেখা পড়া ছাড়া রাতে ঘুম হয় না!

বয়েস হয়েছে। লেখার তাল আর ঠিক রাখতে পারি না। তবু আমার যে আরও বলার আছে। ক্ষমা-ঘেন্না করে নিও। জান, আমি রোজ বলি আমার আরও বাঁচতে ইচ্ছে করে। তোমাদের সুখেই আমার সুখ। আমার তো সাঙ্গ হলো ধূলা খেলা। আমি হাসছি ---

রাহু রঙ চাঁদের হাসি। হ্যাঁ, আমার এখনও বাঁচতে ইচ্ছে করে। কেন জান? তুমি চলে গিয়ে আর তিনশ নয় গো, আমি এখন অনেক টাকা পাই। ঘেন্নার নয়। ওই যে তোমাদের জন্য জীবনের সব ফুল- কুঁড়িগুলো দিয়ে দিয়েছি - এ বোধহয় তারই মূল্য। পেনশন পাই গো! বৈধব্য ভাতা। রীতিমত আমার টাকা। তুমি আগে চলে গেলে বলেই না এই 'আমার টাকা'র সুখ পাচ্ছি গো! 

আমার এখনও খুব ইচ্ছে করে নির্ভার মেঘের মধ্যে দিয়ে এরোপ্লেন করে যেতে - আমার সেই একা তালগাছের মতো বলতে ইচ্ছে করে 'যদি পেত পাখা সে...'

এই ধরিত্রী, আকাশ, অন্ধকারের জোনাক আলো, টিপ টিপ তারার আলো, হয়তো তার মধ্যে তুমিও আছ - আছেন সেই সে মানুষটি 'তুমি জানাও যারে সেই জানে' আমি সব সব কিছু যে বড়ো ভালোবাসি।

আমি জানি আমি তো গুছিয়ে লিখতে পারি না -
তাও ছেলেটা দুটো চোখেই ফেকো না কি, করিয়ে দিয়েছে - তাই তোমায় এই তুচ্ছ কথা জানাতে পারছি।

এবার তোমায় বলি - হে আমার ইষ্টদেব, যেখানে যত দেব দেবী আছ, সবাইকে আমার প্রণাম। আর একটা শেষ ইচ্ছে জানাই দয়াময়-আমাকে পরের জন্মে এইখানে আবার পাঠিও মেয়েছেলে করে নয় -
মেয়েমানুষ করে, স্ব- নির্ভরা মেয়েমানুষ করে....




আরও কি সব লেখা আছে - আমি পড়তে পারছিনা। আমার চোখপাতা ঝাপসা। 

আচমকা সম্বিত ফিরে পেয়ে খাতাটা বন্ধ করে দেখি আমার দিদি... হ্যাঁ, এতক্ষণ চুরি করে যাঁর লেখা আমি পড়ছিলাম, সেই ছিয়াত্তর বছরের সাধারণী "অনিতা গঙ্গোপাধ্যায়" জেগে উঠে তাঁর প্রয়াত স্বামীর ছবির দিকে চোখ বুজে ধ্যানস্থ... অবিরল ধারায় গোলাপী গাল দুটো ভেসে যাচ্ছে...



1

ব্যক্তিগত গদ্য - শর্মিষ্ঠা নাহা

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


আমি তোমার বিরহে রহিব বিলীন...
শর্মিষ্ঠা নাহা



(১)
কে গো? কে এলে? ওই শ্যামলাবরণ, পদ্মপলাশ আঁখি, কে তুমি পীতাম্বর? তুমি কি আমার কানু? আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে আমার সঙ্গে আবার মিলিত হতে এসেছ? এসো গো। তোমার জন্য সেই সে দিনের পর থেকে আজ দীর্ঘ বছর অপেক্ষা করে আছি।

কানু, আমার কথা তোমার আজও মনে আছে দেখে বড় বিস্ময় জাগছে! হ্যাঁ, এই আগাছার জঙ্গলটাই সে দিনের সেই কুঞ্জ। তুমি দেখছি পথ চিনে ঠিক চলে এসেছ!

আমাকে চিনতে পারছ কি তুমি? যমুনায় নিজের ছায়া দেখে আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারি না। হ্যাঁ গো, আমিই তোমার সেই রাধা। তোমার শ্যামল দেহের উপর বিপরীত রতিবিহারে আমার যে উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ শাঁওন মেঘের বুকে বিদ্যুতের পীতরেখা বলে ভ্রম হতো, তা আজ পাঁশুটে হয়ে গেছে। সে দিন মিলনের শেষে আমার যে ময়ূরপাখার মতো ঘন কেশদাম তুমি বিবিধ কুসুমে সযত্নে সাজিয়েছিলে, তা আজ পক্ক জটায় পরিণত। যে স্তনসন্ধিতে চন্দন লেপন করে দিয়েছিলে, সেই স্তনযুগল আজ শিথিল, নিম্নমুখী। যে সরস জঙ্ঘায় তুমি খসে যাওয়া মেখলা পুনর্বিন্যস্ত করে দিয়েছিলে, তা আজ শুষ্ক, অনুভুতিহীন। সেই চরম রাতে আমার স্বামী কুঞ্জদ্বারে এসে আমাদের দু’জনকে মিলিত অবস্থায় হাতেনাতে ধরে ফেলার পর তুমি যখন যমুনার জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে পার হয়ে মথুরা চলে গেলে, তিনি আমাকে কলঙ্কিনী বলে জন্মের মতো ত্যাগ করলেন। সেই থেকে আমি এখানেই। ভিক্ষাই আমার একমাত্র বৃত্তি। কোনওদিন ভিক্ষা পেলে ভাল, না পেলে অভুক্তই থাকি। আজকের গোপবালকেরা আশেপাশেই গোরু চরায় বাঁশিতে ইচ্ছেমতন সুর তুলে। তারা আমাকে এক পাগলি বলেই জানে। তারা কেউ আমার নাম জানে না।

তারা সবাই তোমার নাম জানে। তাদের কথাবার্তায় শুনতে পাই। মথুরা নরেশ শ্রীকৃষ্ণ। এই বৃন্দাবনের তিনি ভূমিপুত্র বলে তাদের কত গর্ব। তিনি কুরুক্ষেত্রের বিজেতাদলের অর্জুনের রথের সারথিবেশে প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধ নিয়ামক। যশোদা-নন্দের পালিত পুত্র, তিনি বৃন্দাবনের সম্পদ।

(২)
কানহাইয়া, এক দিন সমগ্র বৃন্দাবনবাসীর মত আমিও তোমাকে গভীর ভালোবেসেছিলাম। এক বৃষ্টি-দুর্যোগপূর্ণ রাতের শেষে সে এক নির্মল ভোর। খবর এল প্রতিবেশিনী যশোদার কোল আলো করে জন্ম নিয়েছে এক শিশুপুত্র। ছুটে গিয়ে তার মুখ দেখে বুক জুড়িয়ে গিয়েছিল। আমি তখন সদ্য কিশোরী। সবে বৌ হয়ে এ পাড়ায় এসেছি। মনে মনে কামনা করেছিলাম যেন আমারও কোল জুড়ে এমন ধন আসে।

তুমি তখন কোলেরটা। এক দেহাতি মেয়েছেলে দূরদেশ থেকে আসার পথশ্রমের ক্লান্তির আছিলায় তোমাদের ঘরের দাওয়ায় বসে তোমাকে নিজের দুধ খাওয়াতে গিয়েছিল। তুমি সদ্য ওঠা চারটে দাঁত দিয়ে তার স্তনবৃন্ত কামড়ে হা হা করে হেসে উঠেছিলে। ছেলেপিলে অমন একটু করেই থাকে। কিন্তু, তোমার কামড়টায় অন্য কিছু ছিল। ওই মেয়েছেলে, পুতনা, ব্যাথায় নীল হয়ে ছটফট করতে শুরু করেছিল। সেই বিকট আওয়াজে আমরা সবাই ছুটে এসে দেখি, তার স্তনবৃন্তে বিষ মাখানো। মনে ভেবেছিলাম গোকুলের শিশুদের হত্যা করার এ এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। সমবেত জনতার গণপিটুনিতে মৃত্যু হয় পুতনার। তুমি হয়ে উঠেছিলে গোকুলের সকলের নয়নের মণি।

তখন তুমি নেহাত বালক। বৃন্দাবনের শান্ত জনপদের ওপর চোখ পড়েছিল আদিবাসী নেতা নাগরাজ কালীয়র। মাঠেঘাটে সহচরদের সঙ্গে খেলা করতে করতে কিভাবে তুমি তার গোকুলের ওপর আক্রমণের পরিকল্পনা জেনে গিয়েছিলে। তোমার মুখে এ কথা শুনে গোপরা সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলে নাগবাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দিয়ে নাগরাজ কালীয়কে হত্যা করেছিল। কালীয়র মৃতদেহের পাশে তোমার সেই উদ্যাম বিজয় নৃত্য যে দেখেছে, কোনওদিন ভুলতে পারবে না। 

এক বার টানা অনেক দিন মুষলধারে বৃষ্টি বৃন্দাবনকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বৃন্দাবনের জনজীবন তত ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি। গোধন সমেত সমস্ত বৃন্দাবনবাসীর লোকালয় ত্যাগ করে নিকটবর্তী গিরি গোবর্ধনের গুহাগুলিতে বাস করার পরিকল্পনা কথায় কথায় তুমিই বলেছিলে। গুরুজনেরা বালকের কথা মেনে নিয়েছিলেন মাত্র।

কেশব, তুমি বুদ্ধিমান, মেধাবী ছিলে বটে, কিন্তু বড় দুর্বোধও ছিলে। একরত্তি হলে কি হয়, তোমার দৌরাত্ম্যে বৃন্দাবনের সক্কলে অতিষ্ঠ ছিল। এমন কোনও ঘর ছিল না যাদের ননীর হাঁড়ি ভেঙে তুমি তোমার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে চুরি করে খেয়েছো। বাকি গোপবালকেরা তোমায় শুধু সঙ্গ দিত। তুমি ছিলে আসল পালের গোদা। আমরা সবাই তোমার এই দৌরাত্ম্য হাসিমুখেই সহ্য করতাম। 

কিন্তু, সহ্য করতে পারি নি যমুনার ঘাটে স্নানরত গোপনারীদের বস্ত্র লুকিয়ে রেখে গাছের ওপর থেকে তাদের স্নান দেখা। কোনওমতে বস্ত্র আদায় করে নিজেদের একটু সম্বৃত করে তোমার পিতার কাছে নালিশ জানাতে গিয়েছিলাম।

নন্দ আর যশোদা মাথা হেঁট করে সে দিনই বলেছিলেন, তুমি গোপকিশোর নও। তোমার দেহে রাজরক্ত আছে। তুমি মথুরারাজ কংসের ভাগিনেয়। তুমি সম্ভাব্য কংস-হন্তা। পাপের বিনাশ হেতু ওঁরা নিজেদের সদ্যজাত কন্যাসন্তানের প্রাণের বিনিময়ে তোমাকে লালনপালন করে চলেছেন।

মাধব, আমরা তোমার এই আচরণের প্রতিবাদ করলে কি হবে, যমুনাতীরে যখন তুমি বাঁশি বাজাতে, আমাদের সকলেরই বুকের মধ্যে কেমন তোলপাড় করে উঠত। জল নেওয়ার আছিলায় যমুনায় ছুটতাম। তুমি আমাদের একেবারে পাত্তা না দেওয়ার ভান করতে। ওই নিতান্ত কৈশোরেই প্রেমিকপ্রবর ছিলে যে তুমি।

এমনি এক রাতে তোমার বাঁশির অমোঘ টানে আমি যমুনার তীরে চলে গিয়েছিলাম। কেউ জানতেও পারে নি। এয়োতির চিহ্ন পায়েল দুটিকে চীরবসনে বেঁধে নিয়েছিলাম যে। 

তুমি আমারই পথ চেয়ে ছিলে। সে দিন আর বাঁশির সুরে সুরে নয়, সরাসরি বলেছিলে গোপন ইচ্ছার কথা। কে জানে, ফুলের মত গোপকিশোরীদের ফেলে আমাকে কেন।

ততদিনে আমার কপালে লেগে গেছে বাঁজা মেয়েছেলের কলঙ্ক। দুঃসহ জীবনযাপন। স্বামী একই ছাদের নীচে থেকেও অনেক অনেক দূরে। তোমার ডাক আমার বদ্ধ জীবনে এক ঝলক টাটকা বাতাস ছিল। আমি তোমার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম। তারপর এমন অনেক নৈশাভিসার আমাদের জীবনে এসেছে।

বিধাতা পুরুষের শরীরে কৌমার্যের আলাদা করে কোনও চিহ্ন রাখেন নি। কিন্তু, আমার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলাম, তোমার সেই প্রথম রমণী-সঙ্গম। 

এই মিলনকুঞ্জ সাক্ষী। তারপর কতবার এমন রাত এসেছে আমাদের দু'জনার জীবনে। আমি, সেই ভরপুর কামনার জ্বলন্ত আগুন নিয়ে জ্বলতে জ্বলতে শেষ হয়ে যেতে বসা আমি, তোমাকে পেয়ে উজাড় করে দিয়েছিলাম। অনেক অনেক সুখে ভরিয়ে দিয়েছিলাম তোমায়। তুমিও ক্রমশ নবীন কিশোরটি থেকে এক নটবর নাগরে পরিণত হয়ে উঠছিলে।

আমি ভুলে গিয়েছিলাম, এ সব কথা চাপা থাকতে পারে না। কে বা কারা আমাদের দেখে ফেলে আমার স্বামীকে বলে দিয়েছিল।

সে দিন সেই পরম সুখের শেষে আমার অবিন্যস্ত কেশপাশে অঙ্গুলি সঞ্চালন করে কিছুটা বিন্যস্ত করে স্থানচ্যুত মেখলা যথাস্থানে ফিরিয়ে দিয়ে তুমি নিজেকে আচ্ছাদিত করতে যাচ্ছ, এমন সময় কুঞ্জে প্রবেশ করলেন ভগ্নদূতবেশী আমার পতিদেব। তুমি প্রায় সেই অবস্থাতেই যমুনায় ঝাঁপিয়ে পড়লে। আমার স্বামী আমাকে তিরস্কার করে কত কি বললেন, আমাকে সে সব স্পর্শও করল না। আমি কুঞ্জে শুয়ে তোমার সঙ্গ সুখের কথা ভাবতে লাগলাম।

মাধব, আমি ভেবেছিলাম, ওই শয্যাতেই তোমার স্পর্শ সারা শরীরে মাখা অবস্থায় প্রায়োপবেশনে জীবন ত্যাগ করব। কত দিন, কত রাত সেইভাবেই ছিলাম মনে পড়ে না। কিন্তু মৃত্যু যে এল না। ফিরে এল জঠরে ক্ষুধার অসহ্য অনুভুতি। এল দীর্ঘদিনের অপরিচ্ছন্নতার দুর্গন্ধ। স্নান করতে যমুনায় গিয়ে নিজের ছায়া দেখলাম। যেন এক অস্থিচর্মসার প্রেতিনী। যমুনায় জল আনতে, স্নান করতে আসা প্রতিবেশিনীরা কেউই চিনতে পারল না আমায়। ভিখারিনী ভেবে কেউ কেউ কিছু খাদ্য দান করে গেল দয়া পরবশ হয়ে। কেউ পুরোনো বস্ত্র, লজ্জা নিবারণের জন্য। ওদের কথাবার্তায় জানলাম আয়ান ঘোষের বৌ যমুনায় ডুবে মরেছে। মা হতে না পারার যন্ত্রণাই না কি তার আত্মহত্যার কারণ। আমার চতুর পতিদেব পারিবারিক কলঙ্কের কথা সুকৌশলে চেপে গিয়েছিলেন।

এরপর আমার বেঁচে মরে থাকা ছাড়া আর কিই বা করার ছিল? অন্য কোনও জনপদে গিয়ে একাকী নতুন করে বাঁচার মতো সামর্থ যে আমার ছিল না। আর একাকিনী স্বামীপরিত্যক্তা নারীকে সে সমাজ কি সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে দিত? যে সমাজ এক জন নারীকে মৃৎপাত্র ছাড়া কিছু মনে করে না, যাতে এক বার ভোজন করলেই তা উচ্ছিষ্ট হয়ে যায়।

(৩)
হে কেশব, সে দিন তুমি সাঁতরে যমুনা পার হয়ে মথুরা চলে গিয়েছিলে। মাতুল কংসকে হত্যা করে মথুরাধিপতি হয়েছিলে। ব্যক্তিগত জীবনে তুমি রেবতীরমণ, রাজকুমার শাম্বের গর্বিত পিতা। লোকমুখে শুনেছি, তুমি মস্ত রাজনীতিবিদ। এ নিয়ে তোমার গর্বও খুব। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আগে তুমি অর্জুনের রথের সারথি হয়ে বিরাট চাল দিয়েছ বলে ভেবেছিলে। অর্জুন আত্মীয়বধ করতে চান না বলে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। তুমি তাঁকে কি না কি বলে ভুল বুঝিয়ে যুদ্ধে রাজী করিয়েছিলে। সেই যুদ্ধের ফল তুমি তো নিজের চোখেই দেখেছ। তোমার সখারা বিজয়ী হয়েছিলেন বটে, কিন্তু তাঁদের এক স্বজন হারানো শ্মশানে বাকি জীবন রাজত্ব করতে হয়েছিল। জয়ের স্বাদ ঠিকভাবে পাওয়া হয়নি তাঁদের। এহ বাহ্য, নিজের ভাগিনেয় অভিমন্যুকে হারাতে হয়েছিল তোমায়। এত কৌশল করে ঘটানো যুদ্ধ সত্যিই তোমায় কি দিয়েছিল? বড় জোর আর কেউ জীবিত না থাকার কারণে অভিমন্যুতনয় পরীক্ষিত যুধিষ্ঠিরের পর হস্তিনাপুরের রাজা হতে পেরেছিলেন যুধিষ্ঠিরের বংশ লোপ পাওয়ায়। একটাই ভালো কাজ করেছিলে ভরা রাজসভায় মহারানি দ্রৌপদীর সম্ভ্রম রক্ষা করে। বোধহয় এক দিন গোপিনীদের শ্লীলতাহানির সংবাদে হেঁট হয়ে যাওয়া যশোদা মায়ের মুখটা তোমার মনে পড়ে গিয়েছিল।

আসলে নরাণাং মাতুলক্রমঃ। তোমার মাতুল কংসও তো তোমার মাতাকে তোমার পিতার সঙ্গে এক কারাগারে বন্দী করার মুর্খামি করেছিলেন তাঁর অষ্টম গর্ভের সন্তান নিজের হত্যার কারণ হবেন জেনেও। কি জানি, হয়ত রাজনীতির আবর্ত এতটাই পঙ্কিল।

হে মথুরা নরেশ, আমি তোমার জীবনের লক্ষ্য কোনওদিনই ছিলাম না। আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল খুব ক্ষণিকের। বৃন্দাবনের বীজতলা ছেড়ে মথুরার জনারণ্যে তোমাকে প্রবেশ করতেই হতো। কিন্তু, আমার কেমন যেন মনে হয়, তুমি আমাকে কখনও ভোলোনি। বিবাহের মধুযামিনীতে তোমার প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে কৌমার্যের সমাপ্তির সেই পবিত্র ক্ষণ। প্রসব গৃহের বাইরে অধীর প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে, সদ্য পিতৃত্বের গর্বে গর্ব্বিত হতে হতে তোমার মনে বারংবার মনে পড়ছিল আমার না পাওয়ার দীর্ঘশ্বাস। দেশশাসনের দায়িত্ব কিংবা যুদ্ধক্ষেত্রে রক্ত ঝরানোর মাঝে ক্ষুদ্র অবসর সময়ে তোমার প্রবল ইচ্ছে হয়েছে বাঁশিতে একবার সুর তোলার। বলো, কতবার ইচ্ছে হয়েছে এই কুঞ্জে একবার এই রাধার সঙ্গে মিলিত হতে। তোমার কর্তব্য তোমার ইচ্ছার গলা টিপে মেরেছে প্রতি মুহূর্তে।

কিন্তু আমি আজও তোমার অপেক্ষায় এই কুঞ্জে রয়ে গেছি। আমার মন বলছিল এক বার তুমি আসবে। এক বার আমার নাম ধরে ডাকবে। সেই দিন তবে আজ এল! এসো, এসো হে সখা।

না, না। তুমি কে? তুমি আমার কানাই কেমন করে হবে? কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ তো কবে শেষ হয়েছে। তারপর কত বছর রাজত্ব করে পৌত্রসম পরীক্ষিতের হাতে রাজত্বভার দিয়ে রাজা যুধিষ্ঠির নিতান্ত বৃদ্ধ অবস্থায় সপরিবারে মহাপ্রস্থানের পথে বিলীন হয়ে গেছেন। তুমি তবে কি করে সে দিনের সেই নওল কিশোর থাকো? সত্য বলো, কানু নও, তার ছদ্মবেশে তুমি সাক্ষাৎ মৃত্যু।

না না, তুমি কানু, তুমিই আমার গোপাল। 

তুমি মথুরাধিপতি। তোমার চক্রের নাম 'সুদর্শন', শঙ্খের নাম 'পাঞ্চজন্য', মণির নাম 'স্যমন্তক'। কিন্তু এই যে বংশীখানি এই কুঞ্জে সে দিন ফেলে রেখে গিয়েছিলে, এর কোনও নাম নেই। আজ এক বার সেই অনামী বংশীতে বাজাও তোমার রাধিকার সেই প্রিয় সুর। তোমার বুকে বুক রেখে আমার এই দীর্ঘ বিরহের চির অবসান হোক।




1

ব্যক্তিগত গদ্য - শাশ্বতী সরকার

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


চিঠি 
শাশ্বতী সরকার 



আবালবৃদ্ধবণিতা চিঠি পেতে সকলেই ভালোবাসেন। জীবনের শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন যে মানুষটি তিনিও এক চিঠির অপেক্ষায় বসে আছেন এখনও – না অন্য কোনও চিঠি নয়, যৌবনের চিঠি। তার ভিতরকার যুবক বা যুবতীটি চিঠি চান তার প্রেমিকা বা প্রেমিকটির কাছ থেকে। চারদিকে এত হানাহানি, রেষারেষি, হিংস্রতার মধ্যেও অনন্ত যৌবন নিয়ে আমরা বসে আছি একখানা সবুজ চিঠির আশায়।

বহুকাল বাদে তোমার সাথে আবার যখন দেখা হলো, মুছে ফেলা যন্ত্রণারা সব এক এক করে পা রাখতে লাগল আমার বিছানায়। কারণ যন্ত্রণা ও তুমি- এ যেন কখন এক সূত্রে বাঁধা হয়ে গেছে। অনেক ভেবে দেখলাম জানো, তোমার আমার সম্পর্কটা সাধারণ চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে বেঁধে ফেলা ঠিক হবে না।আমি বরং রোজ তোমায় একটা করে চিঠি দেব। তুমি তো আমার কাছে ঠিক কবিতার মতন। আচ্ছা, কবিতার কোনও পুংলিঙ্গ হয় না? তুমিই ভেবে একটা নাম দিও না, প্লিজ! রোজ রাতে তোমায় আমি নতুন নতুন ঢং-এ আঁকব আর সকালে পৌঁছে দিয়ে আসব তোমার ড্রয়িংরুমে। 

জানো, সেদিন যখন পাগলের মত তুমি একে একে তারাদের ডেকে তোমার ঘর-সংসার দেখাচ্ছিলে, কি যে অনুভূতি হয়েছিল আমার! মনে হচ্ছিল যেন প্রবল ঝড় উঠেছে – সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে নটরাজ মেতেছেন প্রলয় নাচনে। বিশ্বাস করো, একটুও বাড়িয়ে বলছি না। ভয়ও হচ্ছিল, সবাই তোমাকে শিবের মতই পাগল না ভাবেন। হাসিও পাচ্ছিল –তুমি সত্যিই পাগল, এক্কেবারে শিশু ভোলানাথ। আমার মন-কবুতরের পায়ে বেঁধে এ চিঠি পৌঁছে দিলাম তোমার কাছে। ইচ্ছে হলে উত্তর দিও, নাহলে দিও না। তবে আমি কিন্তু রোজ তোমাকে চিঠি লিখব, হ্যাঁ রোজ। আমার ভালো থাকার জন্য লিখব, নিজেকে বোঝার জন্য লিখব, নিজেকেই আয়নায় নতুন নতুন রূপে দেখার জন্য লিখব। আমার ভাল, আমার মন্দ – সব সব লিখব, নিজেকে উজাড় করে দেব চিঠির মধ্যে। রং-বেরঙের চিঠিগুলো আমার দুঃখগুলোকে নিয়ে উড়ে যাবে প্রজাপতি হয়ে। মুক্ত বাতাসে আমার কথাগুলো প্রতিধ্বনি তুলবে – “ভালোবাসি, ভালোবাসি...”
0

ব্যক্তিগত গদ্য - মৌসুমী ঘোষ দাস

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


খোলা চিঠি 
মৌসুমী ঘোষ দাস 



কেমন আছিস পাগলি? আমি ভাল নেই রে! ক’দিন ধরে কেবলই তোর কথা মনে পড়ছে, তোর গলা শুনতে ইচ্ছে করছে! কোনও কাজে মন দিতে পারছি না, জানিস! সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে যেন! এতদিন পর হঠাৎ তোর অভাবটা আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছে শুধু! 

এখন রাত তিনটে বেজে একচল্লিশ। সবাই গভীর ঘুমে মগ্ন। আর একটু পরেই পাখির ডাকের সঙ্গে ভোরের আলো ফুটবে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই! টিভি চালিয়ে দিয়ে ঘুমোনোর সেই পুরনো বদ অভ্যেসটা এখনও আছে আমার। সে জন্য তুই কত বকাবকি করতিস। আজও তেমন টিভি খোলা রয়েছে। কিন্তু মনটা শুধু তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! জানি এসব শুনে তুই বলবি এখন নাটক করছি! কারণ তুই আর বিশ্বাস করিস না যে এখনও কেবল তুই, শুধু তুইই আছিস আমার সারা মন জুড়ে! 

আজ আবার পয়লা আগস্ট। কত বছর আগে ঠিক মনে নেই, আমি তো আবার কিছুই মনে রাখতে পারিনা- এ তোর মস্ত বড় অভিযোগ ছিল! তবে এমনি এক পয়লা আগস্টের বৃষ্টিঝরা বিকেলে, বুকভরা ভালোবাসা নিয়ে তুই এসেছিলি আমার কাছে, সে কথা আজও স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে! যদিও পরে জেনেছিলাম, তুই অনেক আগে থেকেই আমাকে মনে মনে ভালবাসতিস। 

তোকে জড়িয়ে কাটানো মুহূর্তগুলো স্মৃতিচারণ করতে কেন জানি খুব ভাল লাগছে আজ! আর তাই মনটা বার বার সেই অতীতে ফিরে গিয়ে সোনাঝরা দিনগুলোকে বর্তমানে এনে উপস্থিত করছে! সেইসব দিনের অনুভূতিগুলো এখনও কেমন জীবন্ত হয়ে আছে, জানিস! যেন এখুনি এই মুহূর্তে ঘটছে! তোর মনে আছে রে, আমাদের দুজনার প্রথম বৃষ্টিতে ভেজার কথা? শুভদের বাড়ির সবাই কলকাতা গিয়েছিল। অত বড় বাড়িতে শুভ একা। তোকে একটু ঘনিষ্ঠ ভাবে কাছে পাবো বলে ওদের বাড়িতে দেখা করার প্ল্যান করেছিলাম। শুভদের তিনতলা বাড়ির ছাদটা পাড়ার অন্য বাড়ির ছাদের চেয়ে উঁচু ছিল বলে আসে পাশের বাড়ির ছাদ থেকে ওদের বুক সমান উঁচু পাঁচিল দেওয়া ছাদের ভেতরটা দেখা যেত না। শুভ তখন নিচে কম্পিউটার ঘরে। আমরা দুজনা হাত ধরে সেদিন ছাদে খোলা আকাশের নিচে কত ভালোবাসা-বাসি করেছিলাম! খোলা আকাশ, পাখি, মেঘ, বাড়ির চারিধারের সারিবদ্ধ নারকেল গাছেরা, ছাদ-বাগানের ফুলেরা সেদিন সাক্ষী ছিল আমাদের প্রেমের! 

দুজনার প্রেম যখন বেশ জমে উঠেছে, হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। তুই বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য এক ছুটে চিলেকোঠার ঘরের দিকে এগিয়ে যেতেই আমি তোকে থামালাম। তারপর গভীরভাবে জড়িয়ে ধরে সেদিন মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুব ভিজেছিলাম দুজনা! তোকে অপরূপা লাগছিল! বুকের ওড়না হাওয়ায় উড়ছিল। সাদা কুর্তি আর লাল সালোয়ার ভিজে গায়ের সাথে সেঁটে গিয়ে তোর শরীরের ভাস্কর্য ফুটে উঠেছিল! তোকে দেখতে পুরীর মন্দিরের দেওয়ালের গায়ের মূর্তির মত লাগছিল! মুগ্ধ হয়ে দু চোখ দিয়ে তোকে শুধুই গিলছিলাম! কিন্তু আমার সেই পরম অনুভূতির কথা সেদিন তোকে বলা হয়নি! 

খুব মনে পড়ছে তোকে নিয়ে প্রথম যেদিন টোটোতে চড়েছিলাম! লোক-লজ্জা উপেক্ষা করে সারাটা পথ তুই আমার ডান হাতটা ধরে বসেছিলি! আমার কনুইটা একটু করে তোর বাম বুক স্পর্শ করছিল! কি অসাধারণ একটা রোমাঞ্চ হচ্ছিল! আর কি ভীষণ দুঃসাহসী হয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল, জানিস! তুই বার বার মুগ্ধ চোখে ঘুরে ঘুরে দেখছিলি আমাকে! তোর কপালে উড়ে এসে পরা অবাধ্য চুলগুলোকে সরিয়ে দিয়ে, হাওয়ায় উড়ে যাওয়া শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে দিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, - “কি এত দেখছিস রে?” 

তুই আমার কাঁধে মাথা রেখে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলেছিলি, “তোকে দেখছি, আমার ভালবাসাকে দুচোখ ভরে দেখেই যে আমার সুখ”! কথাটা শুনে মন ভরে গিয়েছিল আমার! ইচ্ছে করছিল আমার ভালোলাগার কথাটাও তোকে বলি, কিন্তু কি জানি কেন আমি কিছুই বললাম না! সারাটা পথ শুধুই তোর স্পর্শ অনুভব করে গেলাম! 

বড্ড অল্পতেই খুশি হতিস রে! আসলে তোর চাহিদা ছিল কম। আমার একটুখানি সান্নিধ্য পেলেই তোর মন ভরে যেত! যেন আমাকে ভালোবেসেই তোর রাজ্যের সুখ! কেন আমাকে এত ভালবাসতিস বলতো? কি পেয়েছিলি এই সৃষ্টিছাড়াটার মধ্যে? 

তোর কি মনে আছে আমাদের প্রথম চুমু খাওয়া? আমার কিন্তু তারিখটাও মনে আছে! তেরোই অক্টোবর! কি ঠিক বললাম তো? গভীর আবেগে তুই ভালোবাসার কথা বলতেই, আমি অতর্কিতে তোকে কাছে টেনে নিয়ে তোর নরম ঠোঁটে আমার ঠোঁটদুটো চেপে ধরেছিলাম! প্রথমে তুই তো ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণে যুদ্ধ করতে লাগলি! আমিও তেমনি, কিছুতেই তোকে ছাড়ছি না, আষ্টেপৃষ্ঠে তোকে আরও আবদ্ধ করে ফেলছি, ধীরে ধীরে তুই সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করলি। আমার ব্যপক লেগেছিল, কিন্তু সেদিন বলিনি! তুই কিন্তু বলেছিলি, তোকে ছেড়ে দিতেই বেশ কিছুক্ষণ আচ্ছন্নের মত আমার দিকে চেয়ে থেকে, তারপর আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলেছিলি, “এই প্রথম চুমু নাকি তোর জীবনের পরম সম্পদ হয়ে থাকবে”! শুনে মুচকি হেসেছিলাম সেদিন! 

তবে আমার বেশ ভাল লাগত যখন অনেকদিন পর দুজনা সামনা সামনি হতাম। লজ্জাবতী লতার মত তুই কেমন লজ্জায় গুটিয়ে যেতিস, হাতটা ধরে আলতো একটা চাপ দিয়ে কাছে টানতেই, আমার বুকে এসে মুখ লুকাতিস! তোর নরম শরীরটা আমার আলিঙ্গনে তিরতির করে কাঁপত! কি যে ভাল লাগতো! প্রতিবারই যেন তোকে নতুন করে পেতাম! আমার সেই রোমাঞ্চকর অনুভূতির কথাও বলা হয় নি। 

তুই খুব তৃষ্ণার্ত হতিস, তোকে পেয়ে আমার কেমন অনুভূতি, কতটা ভালোবাসি, কতটাই বা মিস করি - এসব কথা জানবার জন্য! কিন্তু খানিকটা ইচ্ছে করেই তোকে তড়পাতে চাইতাম বলেই কোনওদিন বলিনি আমার মনের ভালোলাগার কথা! তুই শুধু আমার সম্পর্কে ধারণা নিয়ে গেলি, আমার কোনও আবেগ নেই, মনের গভীরতা নেই, সূক্ষ্ম অনুভূতি নেই! কিন্তু আজ আমি তোকে সব বলতে চাই। আমার সব ভালোলাগা অনুভূতির কথা তোকে বলতে চাই! কারণ, আজ বুঝেছি ভালোলাগা অনুভূতিটা ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রকাশ করাটা খুব জরুরী! 

নদীর জলে ডুবে যাওয়া লাল সূর্যটার মত সুন্দর সেই দিনগুলো কত তাড়াতাড়ি হারিয়ে গেল আমাদের জীবন থেকে! আসলে তুই তো আমাকে আঁকড়ে থাকতেই চেয়েছিলি! তোর সমস্ত মন প্রাণ আমাতেই সমর্পণ করেছিলি! বড্ড চোখে হারাতিস আমাকে! আমিই সময় দিতে পারিনি তোকে। ভেবেছিলাম তুই তো আছিসই! তোকে আলাদা করে অত গুরুত্ব দেওয়ার কি বা আছে! কাজ নিয়ে এত মেতে ছিলাম, তাই কখন যে জীবনের মূল্যবান সময়গুলো হারিয়ে গেছে বুঝতে পারিনি রে! তখন মাথায় ছিল একটাই নেশা, পয়সা রোজগার করতে হবে! অনেক টাকা চাই! কারণ, হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম, এ জগতে টাকাই সুখ, শান্তি, নাম, প্রতিপত্তি, সব এনে দেয়! টাকা না থাকার জন্য প্রথম জীবনে কম কষ্ট, কম অসম্মান তো পাইনি! তুই তো সবই জানিস! দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যেমন করেই হোক প্রচুর অর্থের মালিক হতে হবে! হয়েওছি। 

কিন্তু আমাকে সেভাবে না পেয়ে বাধ্য হয়ে তুই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিস! যখন দিনের পর দিন আমার সাথে একটু কথা বলার জন্য তুই ছটফট করতিস, আমার একটা ফোনের অপেক্ষায় বিনিদ্র রজনী কাটাতিস, আমি তখন আমার কাজ নিয়ে মেতে। তোর সাথে একটু দেখা করার সময় পর্যন্ত করে উঠতে পারিনি! অথবা ইচ্ছে করেই দেখা করার চেষ্টা করিনি! তোকে একটু ছটফট করিয়ে চোরা আনন্দ পেতাম যে! তোর ‘আমাকে না পাওয়ার’ প্রবল কষ্টটাকে ‘যতসব ছেলেমানুষি’ বলে মনে করতাম! আমার কথা ভেবে রাতের পর রাত তোর ঘুম হয় না শুনে ‘পাগলামি’ বলে উড়িয়ে দিতাম! আসলে দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝিনি তখন! তোর পাগলকরা ভালোবাসাটা অত্যন্ত সহজলভ্য বলে মনে করেছিলাম! অথচ দেখ, আজ তোর কথা ভেবেই ঘুম নেই চোখে! তবে রাতের পর রাত না ঘুমোতে পেরেও কোনও ক্লান্তি নেই শরীরে! তোকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করে অদ্ভুত ভাবে উজ্জীবিত হই আমি! এটাই তো ভালোবাসা, তাই না পাগলি?

সত্যি বলছি রে, সব হওয়া সত্ত্বেও কিছু একটা নেই যেন! আসলে ভালোবাসা না থাকলে জীবনে শান্তি থাকে না -এটা আজ আমি বুঝেছি! “যার জীবনে ভালোবাসা নেই, তার কিছু নেই! সে পৃথিবীতে সব চাইতে দরিদ্র” - তুই বলতিস এ কথা। তখন উপলব্ধি করিনি! আজ অনুভব করি, সখি ভালোবাসা কারে কয়! অনাদরে, অবহেলায় আজ তুই কত দূরে সরে গেছিস! আমার ভুবন হয়ে উঠেছে কেবলি যাতনাময়! এই দেখ, আবার কাব্য করে ফেললাম! 

অভিমান হলে একটা কথা তুই প্রায় বলতিস, “ভালোবাসা মুখে বলে হয় না, ভালোবাসা অনুভবের। সত্যি করে কেউ কাউকে ভালবাসলে সে অন্তর থেকে অনুভব করতে পারবেই পারবে!” এই যে সারাদিন কেবল তোর কথাই ভেবে যাচ্ছি, তুই কি অনুভব করতে পারছিস? আমার কথা মনে পড়ে তোর? না কি একেবারেই ভুলে গেছিস? 

আর একটা কথাও খুব বলতিস, “সম্পর্কটাকে মাঝে মাঝে renew করতে হয়। তাতে বাঁধন পোক্ত হয়, longevity বাড়ে”! এখন বুঝি, তুই ঠিক বলতিস। শত কাজের মধ্যেও যদি তোকে একটু বুঝতাম, একটু সময় দিতাম, তাহলে অভিমান করে তুই এত দূরে সরে যেতিস না! 

আজ আমি ভীষণ একা! আমার মত নিঃস্ব আর কেউ নেই! প্রতি মুহূর্তে তোকে মিস করি! তোকে সেই আগের মত করে ফিরে পেতে চাই! কতদিন দেখিনি বল তো! ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে রে! তোর অভিযোগ ছিল, আমার নাকি একটুও আবেগ নেই! আচ্ছা বল তো পাগলি, এই যে শুধু তোর কথাই ভেবে যাচ্ছি, এটা কি আবেগ নয়? এটা কি ভালোবাসা নয়? তবে আর তোকে দূরে সরে থাকতে দেবো না! ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে আনবোই আনবো ।

আপন মনে অনেক কথা বলে গেলাম! এখন সকাল হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি চিঠিটা তোকে পৌঁছে দেবে বলে আমার ঘরের ব্যালকনির সামনে এক টুকরো মেঘ এসে দাঁড়িয়ে আছে! খোলা চিঠিটা মেঘের ভেলায় ভাসিয়ে দিলাম। জানি এই চিঠি তুই পাবিই পাবি! তোর ফিরে আসার অপেক্ষায় রইলাম পাগলি। ভাল থাকিস, আর ভাল রাখিস। 

ইতি 

তোর সন্টাই-মন্টাই 

48

ব্যক্তিগত গদ্য - রাজা ভট্টাচার্য

Posted in


ব্যক্তিগত গদ্য


চলাচল
রাজা ভট্টাচার্য


আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিন হলো - চাকরিতে জয়েন করার দিনটা। এস.এস.সি. পাশ করে গেছি, ফাইনাল লিস্টে নাম আছে - স্বচক্ষে দেখে এসেছি। সুতরাং আগের ছোট্ট চাকরিটা সদর্পে ছেড়ে এসেছি। বিয়ে করলাম সম্পূর্ণ বেকার অবস্থায়। এদিকে চিঠি আর আসে না। বৌ নিজের চাকরিতে জয়েন করে গেল, আমি বসে আছি বাড়িতে। সাধু ভাষায় যাকে বলে -"মরমে মরে আছি"! হেনকালে এক শনিবার দেবদূত - অর্থাৎ পিওন এসে সেই বহু-আকাঙ্ক্ষিত চিঠিটি দিয়ে গেল। কোনোক্রমে রোববারটা পার করে সোমবার রওনা দিলাম। তার আগে অবশ্য এক আত্মীয়র কাছ থেকে জেনে নিতে হলো - জে.এম.এভিনিউ কোথায়।

বহু কষ্টে, এক পুলিশ ভদ্রলোকের সাহায্যে খুঁজে পেলাম সেই স্কুল। এটা স্কুল! চেহারা আর আশপাশ দেখে চোখ কপালে উঠে গেল। একটা প্রকাণ্ড ভাঙাচোরা প্রাসাদ; দেখলে মনে হয় - এক্ষুনি ভেঙে পড়বে হুড়মুড়িয়ে। তারই বারবাড়িতে, বারান্দা আর অন্ধকার তিন-চারটে ঘর নিয়ে স্কুল বসে। ছাত্রদের সংখ্যা দেখলে কান্না পায়। আমার বিরাট মফস্বলী স্কুলে পড়ত বারো-শো ছেলে। এখানে কোনোদিন একশো ছেলে চলে এলে সবার জায়গা হবে না। অবিশ্যি সে দুর্দৈব কখনও ঘটে না, এই যা। ছেলেদের চেহারাও তেমনি - অধিকাংশ ছেলেই অসম্ভব গরিব, খেতে পায় না ভাল করে। বাইরের চেহারা আরও খারাপ। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকে রং-মাখা স্বল্পবেশী মেয়েরা, এক কাপ চা খেতে যাওয়ারও সাহস হয় না আমার। টিপিক্যাল মধ্যবিত্ত মফস্বলী মন সংকুচিত হয়ে থাকে ভয়ে আর লজ্জায় - এই বুঝি আমায় কেউ দেখে ফেলল এই ‘খারাপ’ পাড়ায় - আর ভুল বুঝল। চাকরির দ্বিতীয় দিনেই দালালের খপ্পরে পড়ে গেলাম আমি - একা ফিরছিলাম - হাত ধরে টানাটানি করতে লাগল তাদেরই একজন -"চলিয়ে বাবু - ক্যায়সি লেড়কি চাহিয়ে - নেপাল কি লেড়কি-ভি মিলেগি বাবু"! আমি ভয়ে আর ঘেন্নায় কেঁচো হয়ে গেলাম। বাড়ি ফিরে কেঁদে ফেললাম ভীত শিশুর মতন। মা আর গিন্নি মিলে সান্ত্বনা দিতে লাগল আমায় - আর আমি ভাবতে লাগলাম - আমায় কী সম্ভাব্য ‘খদ্দেরের’ মতন দেখতে ?

কিছুদিনের মধ্যেই অবশ্য যাথারীতি কেটে গেল এসব মেকী আত্মগ্লানি। দ্রুত বুঝতে পারছিলাম - রাস্তায় যে মেয়েদের আমি দেখতে পাচ্ছি - তাদের অধিকাংশই অসম্ভব গরিব। আর তাদেরই ছেলেপুলেরা পড়ে আমার কাছে। আবার - কী আশ্চর্য - দর্জিপাড়া বা বাগবাজারের গৃহস্থবাড়ির ছেলেরাও দিব্যি তাদের পাশে বসেই পড়ে, একসাথেই খেলে, টিফিন খায়। ক্রমে ভাব হয়ে গেল বাচ্চাগুলোর সঙ্গেও। বুঝতে শিখলাম এদের। হ্যাঁ, এরা আলাদা - আর তাইই তো হওয়ার কথা! এরা তো আমার বা আমাদের মতন করে বড় হয় নি! অকাতরে মুখ-খারাপ করে বাচ্চাগুলো ; জানেই না - এটা খারাপ কিছু। ক্লাস ফাইভের ছোট্ট ছেলেও অম্লান কণ্ঠে বলে -"ওর কথা বিশ্বাস করবেন না স্যার, ও খুব হারামি আছে! " অনেকেই সকালে স্কুলে আসে না-খেয়ে ; পথে কিনে নেয় চিপস্ বা অমন কিছু। টিফিনে বাড়ি থেকে মা বা অন্য কেউ এসে দিয়ে যায় খাবার - ভাত বা রুটি। কেউ-বা গেটের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে কেনে ঝালমুড়ি, নইলে দারোয়ান বীরেনদার দাদার দোকান থেকে কচুরি। কারো বা পয়সা নেই, খাবারও আসে নি। কাঁদে সিঁড়িতে বসে। কোনও শিক্ষকের চোখে পড়ে গেলে খুব ধমক দিয়ে তার হাতে গুঁজে দেওয়া হয় পয়সা। চোখ মুছে লজ্জিত মুখে কচুরি কিনতে যায় সে ধীর পায়ে। ক্লাসে এসে ঢুলতে থাকে অনেকেই। জেরা করলে জানা যায় - রাত্তিরটা সে কাটায় ক্লাবে ; ঘরে থাকার জায়গা নেই। কেন নেই - তা বোঝার জন্য জিজ্ঞেসবাদ করতে হয় না। ভাল লেগে গেল স্কুলটাকে, আর এই অসহায় বাচ্চাগুলোকে। রাস্তায় দাঁড়ানো মেয়েগুলোও চিনে ফেলল নতুন মাস্টারকে - তাদেরও চোখের ভাষা এল নম্র হয়ে।

মাস-খানেক পরে একদিন হেড মাস্টারমশাই ডেকে পাঠিয়ে বললেন -"রাজা, সামনেই তো রবীন্দ্রজয়ন্তী। শুনলাম তুমি গান-টান গাও। তা এবার তাহলে ক’টা রবীন্দ্রসঙ্গীত তুলে দাও না বাচ্চাদের! গাইবে সব - যে ক’জন পারে।" এইসব অকাজে আমার অনন্ত উৎসাহ। কোমর বেঁধে নেমে পড়লাম ওমনি। আলমারি থেকে বেরলো ভাঙা হারমনিয়াম - বহুকাল তাতে হাত দেয় নি কেউ। আর আমাদের ভাঙা স্কুলবাড়িতে বহুদিন পর - বেজে উঠল সুর। বাচ্চাদের চোখ কপালে উঠে গেল। রাজাবাবু-স্যার (হ্যাঁ, এইটিই এই স্কুলের সরকারি আবাহন-বিধি) কী না পারেন, মায় হারমোনিয়াম বাজালে সুর বেরোয় - ভাবা যায়!! টিপে দেখা হলো সাদা-কালো রিড। তারপর গান বাছাই, লিখে নেওয়া, এবং রিহার্সাল শুরু।

প্রথমেই ধাক্কা লেগে গেল এদের গলা শুনে। সুর নেই যে কারোর গলায়! সুর আমার আজন্মের সংস্কার, এর মধ্যেই বড় হয়েছি। বেসুর বড় কষ্ট দেয় তাই। আর এরা গান বলতে বোঝে কুমার শানু আর বাবা সায়গল - তখন এদের গানই বাজত প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ শুনে এরা তাই তাকিয়ে থাকে হাঁ করে। শব্দ, সুর - সবই ওদের অচেনা ঠেকে। সব্বাই মিলে গান গাওয়ার ব্যাপারটা অন্য স্যারদেরও খুব একটা পছন্দ হয় নি। একজন তো সরাসরি বলেই দিলেন -"ওরে বাবা, সব কিছু কি আর সবার জন্য? " তা নয় অবশ্য, জানি সে কথা। এও জানি, ওদের মধ্যে যে-কজনের গলায় অল্পস্বল্প সুর আছে, তাদের আলাদা করে নিলেই গানগুলো একটু শোনার যুগ্যি হতো। কিন্তু যেই গানের রিহার্সাল শুরু হয় - অমনি ওদের পাকাটে মুখ আর চোরা চাউনি বদলে যায় যে! যেন আলো জ্বলে ওঠে অন্ধকার ঘরে, ওদের মুখগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মাথা নেড়ে, বেঞ্চি থাবড়ে ওরা গাইতে থাকে -"মম চিত্তে নিতি নৃত্যে" - আর অমনি আমার আর ওদের ভাল, মন্দ, জন্ম, মৃত্যু - সব নেচে ওঠে তালে তালে - বুড়ো নোনাধরা দেওয়াল নেচে ওঠে - তা তা থৈ থৈ। আদ্যিকালের বাড়ির কড়ি-বরগা নড়ে ওঠে ওদের কচি গলার আধো-বেসুরো চিৎকারে -"কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী আনন্দ!" কেমন করে বলি -"না রে, তোর গলায় সুর নেই, আর গাইতে হবে না। তুই বাদ!" কল্পনাই করতে পারি না - উৎসাহে জ্বলজ্বলে মুখটার কি দশা হবে এই কথাটা শুনলে। অসম্ভব। বরং আমার বেসুর সইবে, ওই মুখটা নয়। কাজেই চলতে লাগল আমাদের বিচিত্র মহড়া, জানলায় উঁকি মারতে লাগল অচেনা কৌতূহলী মুখ।

অবশেষে এল পঁচিশে বৈশাখ। সেই তিনটে দিনের একটা - যেদিন আমরা বাংলায় তারিখ বলি। হৈ হৈ করে হয়ে গেল অনুষ্ঠান। এরা অনেকেই পুজোর সাজ বানায়, রোজগারের একটা প্রধান উপায় সেটা। কাজেই ইশকুলের সাজগোজের ঘটা দেখে তাক লেগে গেল সবার। বিচিত্র পোষাকের গার্জিয়ানরা ভিতু ভিতু মুখে দেখতে এল অনুষ্ঠান, আর ছেলের গান বা আবৃত্তি শুনে গদগদ মুখে ফিরে গেল সগর্বে। ছেলেরাও খুশ, আম্মো তর। শুধু পরের দিন থেকেই ক্লাস শুরু হয়ে গেল পুরোদমে - এই যা এক দুঃখ। 

মাস-খানেক পরে একটা কর্মশালা শুরু হলো ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলে। আমি আবার কিচ্ছু চিনি না কলকাতার পথঘাট। পুরনো মাস্টারমশাইদের জিজ্ঞেস করে চলে তো গেলাম। ফেরার পথে চিত্তির কাণ্ড ঘটল। বেরিয়েই এক ছাত্রের সঙ্গে দেখা। পেন্নাম করে, দু-এক কথার পর শুধলো - কোথায় যাব আমি। শোভাবাজার মেট্রো স্টেশনে যাবো শুনে বলল -"তাইলে আবার বিডন স্ট্রিট ধরতে যাবেন কেন স্যার? এই গলিটা দিয়ে সোজা চলে যান, বড় রাস্তায় উঠে যাবেন একবারে।" তা বেশ। ভাল করে বুঝে নিয়ে, ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে ঢুকে পড়লাম সেই গলিতেই। বড্ড সরু গলি, দু’পাশে মাথা তুলে রয়েছে আদ্যিকালের সব বাড়ি। দিনেমানেই যেন অন্ধকার। তা হোক, একবার বড়রাস্তায় উঠে গেলেই নিশ্চিন্ত।

মিনিট পাঁচেক হাঁটার পরেই বুঝলাম - কিছু একটা গোলমাল করেছি। রাস্তা এখানে একটু চওড়া হয়েছে। দু-পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই রং-মাখা মিনি-স্কার্ট পরা মেয়েরা ; অকারণ হাসিতে ঢলে পড়ছে একে অপরের গায়ে। টলমল পায়ে দিনের বেলায় হেঁটে যাচ্ছে মাতাল, দালালের দল ভিড় জমিয়েছে মদের দোকানে - ডাক দিচ্ছে আমায় গলা ছেড়ে। কেউ কেউ সেই প্রথম দিনের মতন উঠে আসছে কাছে, হাঁটছে পাশে পাশে, মৃদু গলায় দর বলছে ঘন্টা-পিছু। হঠাৎ ফিরে এল সেই দ্বিতীয় দিনের স্মৃতি ; আমার সর্বাঙ্গ কাঠ হয়ে গেল, মাথা নীচু করে, কোনওদিকে না তাকিয়ে অন্ধের মতন হেঁটে চললাম আমি। আমার অবস্থা বুঝে খিলখিল করে হাসতে লাগল পথে-দাঁড়ান মেয়েরা। 

এমন সময় হঠাৎ কানে এল সুর। না, সিনেমায় দেখা সেই বাইজির মুজরার সুর নয়। সেই ভয়ানক অবস্থাতেও আমার চিনতে ভুল হলো না - কোনও একটা বাড়ি থেকে ভেসে আসছে আমার খুব চেনা একটা গান -"প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে..."! সুর-টুর হচ্ছে না মোটেই, কিন্তু খুব উৎসাহের সাথে, ফুর্তি করে গাইছে কয়েকটা বাচ্চা-গলা। ইচ্ছের বিরুদ্ধেই গতি কমে এল আমার। আর তক্ষুনি, সেই বাড়ির জানলা থেকে ভেসে এল চিল-চিৎকার -"ও স্যার, ও রাজাবাবু-স্যার! " আর সেই ডাকের পিছন পিছন, সামনে দাঁড়ান মেয়েদের ছত্রভঙ্গ করে ছুটে এল একদল বাচ্চা! আমাদেরই ইশকুলের ছেলে সব। অন্য পোষাকে এখন কেমন অন্যরকম দেখাচ্ছে তাদের, কিন্তু হাসি-ভরা মুখ আর চকচকে চোখ দেখলেই বোঝা যায় - যেমন অবাক, তেমনি খুশি হয়েছে তারা। পলকে ঘিরে ফেলে তারা প্রশ্ন করে চলল প্রাণভরে - এখানে কেন, কোত্থেকে ফিরছি ইত্যাদি। যখন বললাম - বড় রাস্তায় যেতে গিয়ে পথ গুলিয়ে গেছে - তখন তাদের খুশি দেখে কে! এহে, স্যার কিচ্ছু চেনেন না - এ এক ভারি মজার কথা। আমি জিজ্ঞেস করলাম -"তা তোরা এই বিকেলবেলায় মাঠে না গিয়ে ঘরে বসে গান গাইছিলি যে ?" সমবেত উত্তর এল -"আমরা তো স্যার রাত্তিরে খেলি, আলো জ্বললে। তাই এখন সবাই মিলে..."

উত্তেজিত গলায় আমার সঙ্গে গল্প করতে করতে চলল ওরা - পথ চিনিয়ে দিতে। দু’ পা হেঁটেই একজন বলল -"স্যার, ওই ‘আরও বেদনা, আরও বেদনা’ জায়গাটায় সুর ভুল হচ্ছিল, তাই না? " এই রে, অতটা তো তখন বোঝার অবস্থা ছিল না আমার। কিন্তু সে কথা তো আর স্বীকার করা যায় না ; কাজেই বললাম -"তাই বুঝি ? কই, গা দেখি আর একবার।" 

বলতে যা দেরি, গলা খুলে সব ক’টা মিলে চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় তুলে গান ধরল ফের -"আরও বেদনা, আরও বেদনা, প্রভু দাও মোরে আরও চেতনা...."

বুড়ো কলকাতার নিষিদ্ধ রাস্তায় হাঁটছিলাম আমরা; মফস্বল থেকে আসা এক শিক্ষক, আর জনাকয় শিশু-কিশোর। প্রায়ান্ধকার গলির বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠছিল সুরের টানে টানে -"আরও আলো, আরও আলো, এই নয়নে প্রভু ঢালো..."

আমার আর ভয় করছিল না। সামনে তাকিয়ে দেখি - আমাদের অদ্ভূত দলটার সামনে সামনে হেঁটে চলেছেন এক লম্বা-পানা বুড়ো মানুষ। বদ্ধ গলিতেও সুরের হাওয়ায় হাওয়ায় উড়ছে তাঁর পাকা দাড়ি আর পরণের জোব্বা। কোনও জোড়াসাঁকো, কোনও শান্তিনিকেতন যাকে বাঁধতে পারে নি কোনও মতেই - তিনি এখন হাঁটছেন আমাদের আগে আগে। বরাবরের মতন আজও, নিশ্চিন্তে তাঁকে অনুসরণ করে হাঁটতে লাগলাম আমি। দূরে দেখা যাচ্ছিল বড়োরাস্তা। 

আর বাচ্চাগুলো তখন গাইছিল সমস্বরে - ভুলভাল সুরে - "আমারে বাঁধবি তোরা, সেই বাঁধন কী তোদের আছে?"


3

ব্যক্তিগত গদ্য - গৌতম দত্ত

Posted in





ব্যক্তিগত গদ্য

অনুভবে রবীন্দ্রনাথ 
গৌতম দত্ত



“দেখেছি তোমার নামে সবার প্রথমে
শ্রাবণে ধানের শিসে দুধটুকু জমে,
তোমারি তো নামে
বৈশাখে আখের খেতে যত মধু নামে |
তবুও হাজার হাতে হাওয়া দেয় ডাক,
কোথায় মাটির স্বপ্নে শিলীভূত পঁচিশে বৈশাখ |
কোথায় আকাশে বাজে সোনার সরোদ
পঁচিশে বৈশাখী ভোর গলে হয় গিনিসোনা-রোদ |

তুমি তো বনস্পতি তোমার পায়েতে থরে থরে
অজস্র শব্দের রং কৃষ্ণচূড়ার মতো ঝরে
তুমি এক অবাক মৌচাক
কথাগুলি চারপাশে ঘোরে যেন গুনগুন সুর এক ঝাঁক |

তোমার ছন্দের নদী জমা হতো যদি
পৃথিবীতে হতো মহাসমুদ্র-বলয়,
ঝুরঝুরে গানের মাটি জ’মে জ’মে হ’ত
আর-এক নতুন হিমালয়!

আকাশে বরুণে দূর স্ফটিক ফেনায়
ছড়ানো তোমার প্রিয়নাম,
তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা----
কোনখানে রাখব প্রণাম!” ---- প্রণমি - কবি দিনেশ দাস

‘শ্রাবণে ধানের শিসে দুধটুকু জমে’ – এ-কথাটা যদি সত্যিই অনুভবযোগ্য মনে হয়, তাহলে সেই অনুভব-এর মতন আমাদের বাঙালী জীবনে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ।

আমি বা আমরা যারা অন্তত বাঙালী এবং রবীন্দ্রনাথকে পড়েছি (কতখানি নিতে পেরেছি জানি না) তারা যে এই বিশ্বপৃথিবীতে কত ভাগ্যবান, সে কথা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি যদি আজ এই ভারতের অন্য প্রদেশে জন্মাতাম আর আমার মাতৃভাষা হতো অন্য কিছু তাহলে কি পারতাম এমন অনুভবে রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করতে ? 

মনে পড়ে আজও, যেদিন আমি এই ছবিটা প্রথম দেখলাম আর ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে পড়লাম ছবির তলার লেখাগুলো :-


এক মুগ্ধতায় যে নিশ্চয় ভরে গেছিলাম তা আজ এই বয়সে এসে অনুমান করতে একটুও কষ্ট হয় না। অনেক পরে জেনেছিলাম যে, এই ছবিগুলো কার আঁকা? ঠাকুরবাড়ির আর এক উজ্জ্বল সন্তান অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মশাই-এর।

আমার জন্ম কলকাতার প্রাচীন সিমলে পাড়ায়। দু-পা হাঁটলেই গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রীট। এক সরু গলির এক পুরোনো বাড়ি! আজ সেখানে ঝকঝকে স্বামী বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউট। কত বার যে উঁকি মেরেছি বাবার হাত ধরে ও বাড়ির দরজায়, কিন্তু ঢোকার উপায় ছিল না অজস্র ভাড়াটিয়াদের বসবাসের মধ্যে। এখন নতুন বাড়িতে ঢুকে সব যেন অচেনা লাগে। মনে হয় ওই গলিটা যেন আজ পাল্টে গেছে।

আমাদের বাড়ি থেকে সেন্ট্রাল এভিনিউ পেরিয়ে মুখোমুখি একটা রাস্তা, এঁকেবেকে আমায় পৌঁছে দিত আমার মামার বাড়ি নতুন-বাজারের সামনে। তার থেকে একটু বাঁ-দিকে একটা গলির মধ্যে ছিল আমার মামার বাড়ি। আর সেই গলিটার থেকে চিৎপুরের ট্রাম লাইন ধরে কিছুটা দক্ষিণে গেলেই আমার জন্মস্থান ‘লোহিয়া মাতৃ-সেবাসদন’। তার থেকে আরও একটু ফুটপাথ ধরে এগোলেই চার মাথার একটা মোড়। গনেশটকির মোড়। (গনেশটকি’জ বলে একটা সিনেমা হল ছিল সে সময়। হলটা হয়ত এখনো আছে।) আর ওই মোড় পেরিয়ে দু-চার পা গেলেই আর এক বিখ্যাত বাড়ি – ‘জোড়াসাঁকো’র ঠাকুরবাড়ি’। 

প্রথম গেছিলাম বাবার হাত ধরে। একটু অবাক হয়ে ছিলাম প্রথমে। ঠাকুরবাড়িতে কোনও ঠাকুর না দেখতে পেয়ে। এ কথাটা বললাম এই জন্যে যে, আমাদের ওই অঞ্চলে তখন অনেকই ঠাকুরবাড়ি আর সেসব ঠাকুরবাড়িতে ঠাকুরই থাকত। হয় রাধা-কৃষ্ণ কিংবা কালী অথবা অন্য আরও কত দেব-দেবী।

তবে যখন বাড়িটায় ঢুকে ওই দাড়িওয়ালা মানুষটির ছবি দেখেছিলাম আর বাবা বলেছিলেন যে এই বাড়িতেই জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তখন আর আশ্চর্য হইনি, কারণ তার আগেই আমি ওই দাড়িওয়ালা বুড়োটাকে বেশ চিনে গেছি। আর মুখস্থও হয়ে গেছে :

“অঞ্জনা-নদী-তীরে চন্দনীগাঁয়ে
পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে
জীর্ণ ফাটল ধরা—— এক কোণে তারি
অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী।
আত্মীয় কেহ নাই নিকট কী দূর,
আছে এক লেজ-কাটা ভক্ত কুকুর।
আর আছে একতারা, বক্ষেতে ধরে
গুন্‌গুন্‌ গান গায় গুঞ্জন-স্বরে।
গঞ্জের জমিদার সঞ্জয় সেন
দু-মুঠো অন্ন তারে দুই বেলা দেন। 
........................,”

খুব সম্ভবতঃ আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণী।

এই আমার ছোট্ট বেলার রবিঠাকুর। পঁচিশে বৈশাখের দিন হলেই বাবা এনে দিতেন রজনীগন্ধার গোড়ে মালা আর একখানা সাদা পদ্মফুল। আগের দিন থেকেই ছবি সাজিয়ে রেখে দিতাম সেই ছোটো থেকেই। এখন ছবিখানা আর পাড়া হয় না, দেয়াল থেকে। ওখানেই মালা পরেন তিনি। আর আমাদের বাঙালী জীবনে এই দিনটা এখন এক ঊৎসবে পরিণত হয়ে গেছে। বাইশে শ্রাবণ এখনও অত গুরুত্ব পায় নি যদিও।

রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল এই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই বাঙলা ক্যালেন্ডারের ২৫শে বৈশাখে। বাঙলা সন ১২৬৮। আর বিলিতি মতে ৭ই মে, ১৮৬১। তখন কেমন ছিল আমাদের এই প্রাচীন কলকাতা : 

“শহরে শ্যাকরাগাড়ি ছুটছে তখন ছড়্‌ছড়্‌ করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড়-বের করা ঘোড়ার পিঠে। না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি। তখন কাজের এত বেশি হাঁসফাঁসানি ছিল না, রয়ে বসে দিন চলত। বাবুরা আপিসে যেতেন কষে তামাক টেনে নিয়ে পান চিবতে চিবতে, কেউ বা পালকি চড়ে কেউ বা ভাগের গাড়িতে। যাঁরা ছিলেন টাকাওয়ালা তাঁদের গাড়ি ছিল তকমা-আঁকা, চামড়ার আধঘোমটাওয়ালা, কোচবাক্সে কোচমান বসত মাথায় পাগড়ি হেলিয়ে, দুই দুই সইস থাকত পিছনে, কোমরে চামর বাঁধা, হেঁইয়ো শব্দে চমক লাগিয়ে দিত পায়ে-চলতি মানুষকে। মেয়েদের বাইরে যাওয়া-আসা ছিল দরজাবন্ধ পালকির হাঁপ ধরানো অন্ধকারে, গাড়ি চড়তে ছিল ভারি লজ্জা। রোদবৃষ্টিতে মাথায় ছাতা উঠত না। কোনো মেয়ের গায়ে সেমিজ, পায়ে জুতো, দেখলে সেটাকে বলত মেমসাহেবি; তার মানে, লজ্জাশরমের মাথা খাওয়া। কোনো মেয়ে যদি হঠাৎ পড়ত পরপুরুষের সামনে, ফস্‌ করে তার ঘোমটা নামত নাকের ডগা পেরিয়ে, জিভ কেটে চট্‌ করে দাঁড়াত সে পিঠ ফিরিয়ে। ঘরে যেমন তাদের দরজা বন্ধ, তেমনি বাইরে বেরবার পালকিতেও; বড়োমানুষের ঝি-বউদের পালকির উপরে আরও একটা ঢাকা চাপা থাকত মোটা ঘেটাটোপের, দেখতে হতো যেন চলতি গোরস্থান। পাশে পাশে চলত পিতলে-বাঁধানো লাঠি হাতে দারোয়ানজি। ওদের কাজ ছিল দেউড়িতে বসে বাড়ি আগলানো, দাড়ি চোমরানো, ব্যাঙ্কে টাকা আর কুটুমবাড়িতে মেয়েদের পৌঁছিয়ে দেওয়া, আর পার্বণের দিনে গিন্নিকে বন্ধ পালকি-সুদ্ধ গঙ্গায় ডুবিয়ে আনা। দরজায় ফেরিওয়ালা আসত বাক্স সাজিয়ে,......”

একথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। ‘ছেলেবেলা’য়।

“মাস্টারমশায় মিটমিটে আলোয় পড়াতেন প্যারী সরকারের ফার্‌স্ট্‌বুক। প্রথমে উঠত হাই, তার পর আসত ঘুম, তার পর চলত চোখ-রগড়ানি।...”

আমরাও প্রথম ইংরেজি শিখতে পড়েছি এই প্যারী চরণ সরকারের “ফার্‌স্ট্‌বুক”। এখন শিশুদের আর লাগে না। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় হল, বইখানা এখনও বাজারে পাওয়া যায়। 

একথা বলার মানে হলো যে রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন আমার জন্মেরও ৯৫ বছর আগে। কিন্তু আমি বা আমার সম-সাময়িক মানুষেরা কিছুটা হলেও পেয়েছি আমাদের প্রাচীন কলকাতার সেই ব্যবহারিক ধারাবাহিকতাগুলো। তখন তো আমাদের পাড়ার চারপাশে এত ‘মডার্ন ডে স্কুল’ গজিয়ে ওঠেনি আর আমরাও স্যুট-প্যান্ট-টাই পরে স্কুলেও যাই নি। তাই হয়তো জীবনের মাধুর্য্য ছিল অনেক বেশী। সময় বহে যেত মন্দাক্রান্তায়!

“তখন জলের কল বসে নি। বেহারা কাঁখে করে কলসি ভরে মাঘ-ফাগুনের গঙ্গার জল তুলে আনত। একতলার অন্ধকার ঘরে সারি সারি ভরা থাকত বড়োবড়ো জালায় সারা বছরের খাবার জল। নীচের তলায় সেই-সব স্যাঁৎসেতে এঁধো কুটুরিতে গা ঢাকা দিয়ে যারা বাসা করেছিল কে না জানে তাদের মস্ত হাঁ, চোখ দুটো বুকে, কান দুটো কুলোর মতন, পা দুটো উলটো দিকে। সেই ভূতুড়ে ছায়ার সামনে দিয়ে যখন বাড়ি ভিতরের বাগানে যেতুম, তোলপাড় করত বুকের ভিতরটা,পায়ে লাগাত তাড়া। তখন রাস্তার ধারে ধারে বাঁধানো নালা দিয়ে জোয়ারের সময় গঙ্গার জল আসত। ঠাকুরদার আমল থেকে সেই নালার জল বরাদ্দ ছিল আমাদের পুকুরে। যখন কপাট টেনে দেওয়া হতো ঝরঝর কলকল করে ঝরনার মতো জল ফেনিয়ে পড়ত। মাছগুলো উলটো দিকে সাঁতার কাটবার কসরত দেখাতে চাইত। দক্ষিণের বারান্দার রেলিঙ ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতুম। শেষকালে এল সেই পুকুরের কাল ঘনিয়ে, পড়ল তার মধ্যে গাড়ি-গাড়ি রাবিশ। পুকুরটা বুজে যেতেই পাড়াগাঁয়ের সবুজ-ছায়া-পড়া আয়নাটা যেন গেল সরে। সেই বাদামগাছটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু অমন পা ফাঁক করে দাঁড়াবার সুবিধে থাকতেও সেই ব্রহ্মদত্যির ঠিকানা আর পাওয়া যায় না।

ভিতরে বাইরে আলো বেড়ে গেছে।”

কবেই কবি বুঝেছিলেন এই “ভিতরে বাইরে আলো বেড়ে গেছে।” তখন থেকেই দেখতে পাচ্ছি সেই পুকুরগুলো গাড়ি-গাড়ি রাবিশ ফেলে বোজানোর চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। ভাবুন, আজ থেকে প্রায় একশো চল্লিশ বা দেড়শো বছর আগে! আর শুধু আলোই বাড়েনি আজ, বারান্দা আর রেলিঙ উধাও হয়ে গেছে শহর থেকে, ভূতেরা আজ আর থাকবার জায়গা পায় না সুউচ্চ বহুতলের কোনও ফাঁকা ঘরে। অলস দুপুরে শোনা যায় না আর পায়রার বক্‌বকম্‌ সেই টানা বারান্দাগুলোর কার্নিশ থেকে।

রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তখনকার দিনে বেশ ধনী মানুষই ছিলেন। কিন্তু বাড়িতে বাহুল্য ছিলই না কোনও। বালক রবির কথা শুনুন :

“জানিয়ে রাখি আমাদের চাল ছিল গরিবের মতো। গাড়িঘোড়ার বালাই ছিল না বললেই হয়। বাইরে কোণের দিকে তেঁতুল গাছের তলায় ছিল চালাঘরে একটা পালকিগাড়ি আর একটা বুড়ো ঘোড়া। পরনের কাপড় ছিল নেহাত সাদাসিধে। অনেক সময় লেগেছিল পায়ে মোজা উঠতে। যখন ব্রজেশ্বরের ফর্দ এড়িয়ে জলপানে বরাদ্দ হলো পাঁউরুটি আর কলাপাতা-মোড়া মাখন, মনে হলো আকাশ যেন হাতে নাগাল পাওয়া গেল। সাবেক কালের বড়োমানুষির ভগ্নদশা সহজেই মেনে নেবার তালিম চলছিল।

“আমাদের এই মাদুর-পাতা আসরে যে চাকরটি ছিল সর্দার তার নাম ব্রজেশ্বর। চুলে গোঁফে লোকটা কাঁচাপাকা, মুখের উপর টানপড়া শুকনো চামড়া, গম্ভীর মেজাজ, কড়া গলা, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা। তার পূর্ব মনিব ছিলেন লক্ষ্মীমন্ত, নামডাকওয়ালা। সেখান থেকে তাকে নাবতে হয়েছে আমাদের মতো হেলায়-মানুষ ছেলেদের খবরদারির কাজে। শুনেছি গ্রামের পাঠশালায় সে গুরুগিরি করেছে। এই গুরুমশায়ি ভাষা আর চাল ছিল তার শেষ পর্যন্ত। বাবুরা ‘বসে আছেন’ না বলে সে বলত ‘অপেক্ষা করে আছেন’। শুনে মনিবরা হাসাহাসি করতেন। যেমন ছিল তার গুমোর তেমনি ছিল তার শুচিবাই। স্নানের সময় সে পুকুরে নেমে উপরকার তেলভাষা জল দুই হাত দিয়ে পাঁচ-সাতবার ঠেলে দিয়ে একেবারে ঝুপ করে দিত ডুব। স্নানের পর পুকুর থেকে উঠে বাগানের রাস্তা দিয়ে ব্রজেশ্বর এমন ভঙ্গীতে হাত বাঁকিয়ে চলত যেন কোনোমতে বিধাতার এই নোংরা পৃথিবীটাকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারলেই তার জাত বাঁচে। চালচলনে কোনটা ঠিক, কোনটা ঠিক নয়, এ নিয়ে খুব ঝোঁক দিয়ে সে কথা কইত। এ দিকে তার ঘাড়টা ছিল কিছু বাঁকা, তাতে তার কথার মান বাড়ত। কিন্তু ওরই মধ্যে একটা খুঁত ছিল গুরুগিরিতে। ভিতরে ভিতরে তার আহারের লোভটা ছিল খুব চাপা। আমাদের পাতে আগে থাকতে ঠিকমতো ভাগে খাবার সাজিয়ে রাখা তার নিয়ম ছিল না। আমরা খেতে বসলে একটি একটি করে লুচি আলগোছে দুলিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করত, ‘আর দেব কি?’ কোন উত্তর তার মনের মতো সেটা বোঝা যেত তার গলার সুরে। আমি প্রায়ই বলতুম, ‘চাই নে’ -তার পরে আর সে পীড়াপীড়ি করত না। দুধের বাটিটার ‘পরেও তার অসামাল রকমের টান ছিল, আমার মোটে ছিল না। শেলফওয়ালা একটা আলমারি ছিল তার ঘরে। তার মধ্যে একটা বড়ো পিতলের বাটিতে থাকত দুধ, আর কাঠের বারকোশে লুচি তরকারি। বিড়ালের লোভ জালের বাইরে বাতাস শুঁকেশুঁকে বেড়াত।

“এমনি করে অল্প খাওয়া আমার ছেলেবেলা থেকেই দিব্যি সয়ে গিয়েছিল। সেই কম খাওয়াতে আমাকে কাহিল করেছিল এমন কথা বলবার জো নেই। যে ছেলেরা খেতে কসুর করত না তাদের চেয়ে আমার গায়ের জোর বেশি বই কম ছিল না। শরীর এত বিশ্রী রকমের ভালো ছিল যে, ইস্কুল পালাবার ঝোঁক যখন হয়রান করে দিত তখনও শরীরে কোনোরকম জুলুমের জোরেও ব্যামো ঘটাতে পারতুম না। জুতো জলে ভিজিয়ে বেড়ালুম সারাদিন, সর্দি হলো না। কার্তিক মাসে খোলা ছাদে শুয়েছি, চুল জামা গেছে ভিজে, গলার মধ্যে একটু খুসখুসানি কাশিরও সাড়া পাওয়া যায় নি। আর পেট-কামড়ানি বলে ভিতরে ভিতরে বদহজমের যে একটা তাগিদ পাওয়া যায় সেটা বুঝতে পাই নি পেটে, কেবল দরকারমতো মুখে জানিয়েছি মায়ের কাছে। শুনে মা মনে মনে হাসতেন, একটুও ভাবনা করতেন বলে মনে হয় নি। তবু চাকরকে ডেকে বলে দিতেন, ‘আচ্ছা যা, মাস্টারকে জানিয়ে দে, আজ আর পড়াতে হবে না’। আমাদের সেকেলে মা মনে করতেন, ছেলে মাঝে মাঝে পড়া কামাই করলে এতই কি লোকসান। এখনকার মায়ের হাতে পড়লে মাস্টারের কাছে তো ফিরে যেতেই হতো, তার উপরে খেতে হতো কানমলা। হয়তো বা মুচকি হেসে গিলিয়ে দিতেন ক্যাস্টর অয়েল। চিরকালের জন্যে আরাম হতো ব্যামোটা। দৈবাৎ কখনো আমার জ্বর হয়েছে; তাকে চক্ষেও দেখি নি। ডাক্তার একটু গায়ে হাত দিয়েই প্রথম দিনের ব্যবস্থা করতেন ক্যাস্টর অয়েল আর উপোস। জল খেতে পেতুম অল্প একটু, সেও গরম জল। তার সঙ্গে এলাচদানা চলতে পারত। তিন দিনের দিনই মৌরলা মাছের ঝোল আর গলা ভাত উপোসের পরে ছিল অমৃত।

“জ্বরে ভোগা কাকে বলে মনে পড়ে না। ম্যালেরিয়া বলে শব্দটা শোনাই ছিল না। ওয়াক-ধরানো ওষুধের রাজা ছিল ঐ তেলটা, কিন্তু মনে পড়ে না কুইনীন। গায়ে ফোড়াকাটা ছুরির আঁচড় পড়ে নি কোনোদিন। হাম বা জলবসন্ত কাকে বলে আজ পর্যন্ত জানি নে। শরীরটা ছিল একগুঁয়ে রকমের ভালো। মায়েরা যদি ছেলেদের শরীর এতটা নীরুগী রাখতে চান যাতে মাস্টারের হাত এড়াতে না পারে তা হলে ব্রজেশ্বরের মতো চাকর খুঁজে বের করবেন। খাবার-খরচার সঙ্গে সঙ্গেই সে বাঁচাবে ডাক্তার-খরচা; বিশেষ করে এই কলের জাঁতার ময়দা আর এই ভেজাল দেওয়া ঘি-তেলের দিনে।”

‘জলপানে বরাদ্দ হলো পাঁউরুটি আর কলাপাতা-মোড়া মাখন’। আমাদেরও ছোটোবেলায় এই কলাপাতা-মোড়া মাখন যার রঙ ছিল সাদা, তা পাঁউরুটি দিয়েই খেয়েছি কতোদিন। সেই পুরনো কলকাতার অনেক কিছুরই স্বাদ আমরা নিতে পেরেছিলাম। কিন্তু এত আলো বেড়ে গিয়ে সেসব স্বর্ণালী দিনগুলো আস্তে আস্তে হারিয়েই গেল, কলকাতার নাগরিক জীবন থেকে।

এত লাইনের পর লাইন উদ্ধৃতি দিয়ে হয়ত একটু বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, তখনকার দিনে অত বড়লোক ঘরেও চলতো “simple living and high thinking”। আমাদের জমানাতেও আমরা এই ভাবেই মানুষ হয়েছি। এটা এই কারণে বলছি যে, আমাদের সাধারণ স্কুল বা কলেজেও অনেক বড়লোক ছেলে-মেয়েরাও পড়াশোনা করতো। কিন্তু আমাদের মেলামেশায় তা কোনও দিন বাধা হয়ে ওঠেনি। 

আমাদের ছেলেবেলায়ও দেখেছি আমাদের বাড়িতে চাকর বা রান্নার ঠাকুর থাকতে। আর আমাদেরও ছোটোবেলায় জ্বর হলেই উপোষ ছিল একেবারে বাধা। কতখানি ডিসিপ্লিন তখন মেনে চলতে হতো তা আমরাও অনুভব করেছি। 

“আহারে আমাদের শৌখিনতার গন্ধও ছিল না। কাপড়চোপড় এতই যৎসামান্য ছিল যে এখনকার ছেলের চক্ষে তাহার তালিকা ধরিলে সম্মানহানির আশঙ্কা আছে। বয়স দশের কোঠা পার হইবার পূর্বে কোনোদিন কোনো কারণেই মোজা পরি নাই। শীতের দিনে একটা সাদা জামার উপরে আর-একটা সাদা জামাই যথেষ্ট ছিল। ইহাতে কোনোদিন অদৃষ্টকে দোষ দিই নাই। কেবল, আমাদের বাড়ির দরজি নেয়ামত খলিফা অবহেলা করিয়া আমাদের জামায় পকেট-যোজনা অনাবশ্যক মনে করিলে দুঃখ বোধ করিতাম-- কারণ, এমন বালক কোনো অকিঞ্চনের ঘরেও জন্মগ্রহণ করে নাই, পকেটে রাখিবার মতো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি যাহার কিছুমাত্র নাই; বিধাতার কৃপায় শিশুর ঐশ্বর্য সম্বন্ধে ধনী ও নির্ধনের ঘরে বেশি কিছু তারতম্য দেখা যায় না।” 

আজকের আমাদের এই অণু-সংসারে কি ভাবতেও পারি এমন কথা ? ছোটো থেকে আমরাও আদর পেয়েছি প্রচুর। কিন্তু তার সাথে সাথে ছিল এক নীরব নিয়মানুবর্তিতা, সব যৌথ সংসারেই। সে সবের পাট বালাই আর খুঁজে পাওয়া দায়! রবীন্দ্রনাথ তো কবেই লিখে গেছেন :

“আমাদের চেয়ে যাঁহারা বড়ো তাঁহাদের গতিবিধি, বেশভূষা, আহারবিহার, আরাম-আমোদ, আলাপ-আলোচনা, সমস্তই আমাদের কাছ হইতে বহুদূরে ছিল। তাহার আভাস পাইতাম, কিন্তু নাগাল পাইতাম না। এখনকার কালে ছেলেরা গুরুজনদিগকে লঘু করিয়া লইয়াছে; কোথাও তাহাদের কোনো বাধা নাই এবং না চাহিতেই তাহারা সমস্ত পায়। আমরা এত সহজে কিছুই পাই না। কত তুচ্ছ সামগ্রীও আমাদের পক্ষে দুর্লভ ছিল; বড়ো হইলে কোনো-এক সময়ে পাওয়া যাইবে, এই আশায় তাহাদিগকে দূর ভবিষ্যতের-জিম্মায় সমর্পণ করিয়া বসিয়া ছিলাম। তাহার ফল হইয়াছিল এই যে, তখন সামান্য যাহাকিছু পাইতাম তাহার সমস্ত রসটুকু পুরা আদায় করিয়া লইতাম, তাহার খোসা হইতে আঁঠি পর্যন্ত কিছুই ফেলা যাইত না। এখনকার সম্পন্ন ঘরের ছেলেদের দেখি, তাহারা সহজেই সব জিনিস পায় বলিয়া তাহার বারো-আনাকেই আধখানা কামড় দিয়া বিসর্জন করে-- তাহাদের পৃথিবীর অধিকাংশই তাহাদের কাছে অপব্যয়েই নষ্ট হয়।”

একেই কি বলে পরিবর্তন? আমরা বলি বটে যে, কলকাতার অবক্ষয় শুরু হয়েছে দূরদর্শন আর মোবাইল ফোনের হাত ধরে! কিন্তু সেটা সত্যি কি না, তা আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে। কতদিন আগেই তো রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন এই সত্য। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, কলকাতার ব্যবহারিক পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় গোড়া থেকেই। চোরাস্রোতের মতন সে পরিবর্তন আমাদের মতন সাধারণের চোখে ধরা না দিলেও, বিশ্বকবির দূরদৃষ্টি’র চোখ তা এড়ায় নি। 

আমাদের ছোটোবেলায় দেখা সবকিছুই, রবীন্দ্রনাথও দেখেছিলেন এই ভাবে :

“চৈৎ-বৈশাখ মাসে রাস্তায় ফেরিওয়ালা হেঁকে যেত ‘বরীফ’। হাঁড়িতে বরফ-দেওয়া নোনতা জলে ছোটো ছোটো টিনের চোঙে থাকত যাকে বলা হোত কুলফির বরফ, এখন যাকে বলে অইস কিংবা আইসক্রীম। রাস্তার দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই ডাকে মন কী রকম করত তা মনই জানে। আর-একটা হাঁক ছিল ‘বেলফুল’। বসন্তকালের সেই মালীদের ফুলের ঝুড়ির খবর আজ নেই, কেন জানি নে। তখন বাড়িতে মেয়েদের খোঁপা থেকে বেলফুলের গোড়ে মালার গন্ধ ছড়িয়ে যেত বাতাসে। গা ধুতে যাবার আগে ঘরের সামনে বসে সমুখে হাত-আয়না রেখে মেয়েরা চুল বাঁধত। বিনুনি-করা চুলের দড়ি দিয়ে খোঁপা তৈরি হতো নানা কারিগরিতে। তাদের পরনে ছিল ফরাসডাঙার কালাপেড়ে শাড়ি, পাক দিয়ে কুঁচকিয়ে তোলা। নাপতিনি আসত, ঝামা দিয়ে পা ঘসে আলতা পরাত। মেয়েমহলে তারাই লাগত খবর-চালাচালির কাজে।”

এ সব কিছুই আমার চোখে এখনও ভাসছে। ‘মালাই-বরফ’, ‘বেলফুল’ কিংবা ‘মাটি-ইই’-র ডাক শুনতে শুনতে কেটেছে আমাদের সেই ছোট্ট গলিখানা। বিকেল হলেই আমাদের বাড়ীর ছোটো টানা বারান্দায় মা-ঠাকুমাদের দেখেছি বিনুনি করে খোঁপা বাঁধতে। গ্রীষ্মকালে এই চুল বাঁধার পর গা-ধুয়ে মা-ঠাকুমা যখন কাচা শাড়ি পরতেন, তখন মা-ঠাকুমাদের গায়ে যেন লেগে থাকতো বিকেলের গন্ধ। নাপতিনি হয়তো রোজ আসতোনা, কিন্তু হপ্তায় একদিন মা-ঠাকুমাদের পায় এক-রকমের লাল তুলো দিয়ে আলতা পরানোর ছবি এখনও মনে আছে আমার।

আজ এই লেখা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে আমি কত ভাগ্যবান! বিশ্বকবির চোখে দেখা সে-দিনের কলকাতার স্মৃতি আমি একটু হলেও চোখে দেখেছি। আজ তা স্বপ্ন! 

“আগেকার কালটা ছিল যেন রাজপুত্তুর। মাঝে-মাঝে পালপার্বণে যখন মর্জি হতো আপন এলেকায় করত দান-খয়রাত। এখনকার কাল সদাগরের পুত্তুর, হরেক রকমের ঝকঝকে মাল সাজিয়ে বসেছে সদর রাস্তার চৌমাথায়। বড়ো রাস্তা থেকে খদ্দের আসে, ছোটো রাস্তা থেকেও।”

(ঊপরের সব উদ্ধৃতি)--ছেলেবেলা – রবীন্দ্রনাথ।

সত্যি! বড্ড বেড়ে গেছে খদ্দের!

অবক্ষয় যে তাঁর কাল থেকেই একটু একটু করে শুরু হয়েছে তা বুঝেছিলেন তিনি। অনেকে হয়ত বেশ তেড়েফুঁড়ে বলবেন, - সে আবার কি? অবক্ষয় বলছেন কেন? বলুন প্রগতি—। সত্যি কি তাই? আমি জানি না। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন :

“এখনকার নিয়ম হচ্ছে প্রথমে হারমোনিয়মে সুর লাগিয়ে সা রে গা মা সাধানো, তার পরে হালকা গোছের হিন্দি গান ধরিয়ে দেওয়া। তখন আমাদের পড়াশুনোর যিনি তদারক করতেন তিনি বুঝেছিলেন, ছেলেমানুষি ছেলেদের মনের আপন জিনিস,আর ঐ হালকা বাংলা ভাষা হিন্দি বুলির চেয়ে মনের মধ্যে সহজে জায়গা করে নেয়। তা ছাড়া, এ ছন্দের দিশি তাল বাঁয়া-তবলার বোলের তোয়াক্কা রাখে না। আপনা-আপনি নাড়িতে নাচতে থাকে। শিশুদের মন-ভোলানো প্রথম সাহিত্য শেখানো মায়ের মুখের ছড়া দিয়ে, শিশুদের মন-ভোলানো গান শেখানোর শুরু সেই ছড়ায়—এইটে আমাদের উপর দিয়ে পরখ করানো হয়েছিল।

তখন হারমোনিয়ম আসে নি এ দেশের গানের জাত মারতে, কাঁধের উপর তম্বুরা তুলে গান অভ্যেস করেছি। কল-টেপা সুরের গোলামি করি নি।

তখনকার কালের শৌখিন গিন্নিরা রঙ সাফ করবার সরঞ্জাম কৌটোতে করে কিনে আনেন বিলিতি দোকান থেকে, তখন তাঁরা মলম বানাতেন নিজের হাতে। তাতে ছিল বাদাম-বাটা, সর, কমলালেবুর খোসা, আরও কত কী-- যদি জানতুম আর মনে থাকত তবে বেগম-বিলাস নাম দিয়ে ব্যাবসা করলে সন্দেশের দোকানের চেয়ে কম আয় হতো না।

“তখনকার কালের সঙ্গে এখনকার কালের তফাত ঘটেছে এ কথা স্পষ্ট বুঝতে পারি যখন দেখতে পাই আজকাল বাড়ির ছাদে না আছে মানুষের আনাগোনা, না আছে ভূতপ্রেতের। পূর্বেই জানিয়েছি, অত্যন্ত বেশি লেখাপড়ার আবহাওয়ায় টিঁকতেনা পেরে ব্রহ্মদৈত্য দিয়েছে দৌড়। ছাদের কার্নিসে তার আরামে পা রাখবার গুজব উঠে গিয়ে সেখানে এঁঠো আমের আঁঠি নিয়ে কাকেদের চলেছে ছেঁড়াছেঁড়ি। এ দিকে মানুষের বসতি আটক পড়েছে নীচের তলার চারকোনা দেয়ালের প্যাক্‌বাক্সে।”

এর মধ্যেই বড় হয়ে উঠছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা ভাষাকে একটা জায়গা দিতে, কি না করেছেন। আর আজ আমরা চাইছি, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে যত দ্রুত ভুলে যেতে পারি। আজকালকার জগতে টিঁকে থাকতে হলে ‘সাহেব’ হতেই হবে। তাই চতুর্দিকে তারই আয়োজন চলছে। কিন্তু এই ভাবে চলতে পারে কি একটা গোটা জাতি? অবশ্য এই কথা আমি এখনই বা বলি কেন! এই সমস্যা রবীন্দ্রনাথের সময়েও যে ছিল তার প্রমাণ পাই :

“আমাদের বাল্যকালেও দেশের সাহিত্যসমাজ ও দেশের শিক্ষিত সমাজের মাঝখানকার ব্যবধানরেখা অনেকটা স্পষ্ট ছিল। তখনো ইংরেজি রচনা ও ইংরেজি বক্তৃতায় খ্যাতি লাভ করিবার আকাঙ্খা ছাত্রদের মনে সকলের চেয়ে প্রবল ছিল। এমন-কি, যাঁহারা বাংলা সাহিত্যের প্রতি কৃপাদৃষ্টিপাত করিতেন, তাঁহারা ইংরেজি মাচার উপরে চড়িয়া তবে সেটুকু প্রশ্রয় বিতরণ করিতে পারিতেন। সেইজন্য তখনকার দিনে মধুসূদনকে মধুসূদন, হেমচন্দ্রকে হেমচন্দ্র, বঙ্কিমকে বঙ্কিম জানিয়া আমাদের তৃপ্তি ছিল না-- তখন কেহ বা বাংলার মিল্টন, কেহ বা বাংলার বায়রন, কেহ বা বাংলার স্কট বলিয়া পরিচিত ছিলেন-- এমন-কি, বাংলার অভিনেতাকে সম্মানিত করিতে হইলে তাঁহাকে বাংলার গ্যারিক বলিলে আমাদের আশ মিটিত, অথচ গ্যারিকের সহিত কাহারো সাদৃশ্য নির্ণয় আমাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না, কারণ গ্যারিক যখন নটলীলা সংবরণ করিয়াছিলেন তখন আমাদের দেশের নাট্যাভিনয় যাত্রার দলের মধ্যে জন্মান্তর যাপন করিতেছিল।

“......একদিন গেছে যখন আমাদের শিক্ষিত লোকেরা ইংরেজি পুঁথির প্রত্যেক কথাই বেদবাক্য বলিয়া জ্ঞান করিত। ইংরেজিগ্রস্ততা এতদূর পর্যন্ত সাংঘাতিক হইয়া উঠিয়াছিল যে, ইংরেজি বিধি বিধানের সহিত কোনোপ্রকারে মিলাইতে না পারিয়া জামাইষষ্ঠী ফিরাইয়া দিয়াছে এবং আমোদ করিয়া বান্ধবের গায়ে আবির-লেপনকে চরিত্রের একটা চিরস্থায়ী কলঙ্ক বলিয়া গণ্য করিয়াছে-- এতবড়ো শিক্ষিত-মূর্খতার প্রমাণ আমরা পাইয়াছি।”

বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ এক অভ্যর্থনা সভায় ছাত্রদের সম্ভাষণ করছেন কবি এই বলে :

“পূর্বে এমন দিন ছিল যখন ইংরেজি পাঠশালা হইতে আমাদের একেবারে ছুটি ছিল না। বাড়ি আসিতাম, সেখানেও পাঠশালা পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিয়া আসিত। বন্ধুকেও সম্ভাষণ করিতাম ইংরেজিতে, পিতাকেও পত্র লিখিতাম ইংরেজিতে, প্রাণের কথা বলিতাম ইংরেজি কাব্যে, দেশের লোককে সভায় আহ্বান করিতাম ইংরেজি বক্তৃতায়। আজ যখন সেই পাঠশালা হইতে, একেবারে না হউক, ক্ষণে ক্ষণে ছুটি পাইয়া থাকি তখন সেই ছুটির সময়টাতে আনন্দ করিব কোথায়? মাতার অন্তঃপুরে নহে কি? দিনের পড়া তো শেষ হইল, তার পরে ক্রিকেট খেলাতেও নাহয় রণজিৎ হইয়া উঠিলাম। তার পরে? তার পরে গৃহবাতায়ন হইতে মাতার স্বহস্ত জ্বালিত সন্ধ্যাদীপটি কি চোখে পড়িবে না? যদি পড়ে, তবে কি অবজ্ঞা করিয়া বলিব ‘ওটা মাটির প্রদীপ’? ঐ মাটির প্রদীপের পশ্চাতে কি মাতার গৌরব নাই? যদি মাটির প্রদীপই হয় তো সে দোষ কার? মাতার কক্ষে সোনার প্রদীপ গড়িয়া দিতে কে বাধা দিয়াছে? যেমনই হউক না কেন, মাটিই হউক আর সোনাই হউক, যখন আনন্দের দিন আসিবে তখন ঐখানেই আমাদের উৎসব, আর যখন দুঃখের অন্ধকার ঘনাইয়া আসে তখন রাজপথে দাঁড়াইয়া চোখের জল ফেলা যায় না-- তখন ঐ গৃহ ছাড়া আর গতি নাই।”

একে কি বলবো আমরা ? ভবিষ্যতের রূপরেখা তিনি লিখে গেছেন তাঁর অজস্র বক্তৃতা, বাণী আর লেখার মধ্যে। তিনি জানতেন যে রাজনীতি কোথায় যেতে পারে। আর তাই এই ‘বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ’-এর বক্তৃতার এক জায়গায় তিনি বলছেন :

“আমরা যাহাকে পলিটিক্‌স্‌ বলি তাহার মধ্যেও এই ভাবটা দেখিতে পাই। প্রথমে যাহা সানুনয় প্রসাদভিক্ষা ছিল দ্বিতীয় অবস্থাতে তাহার ঝুলি খসে নাই, কিন্তু তাহার বুলি অন্যরকম হইয়া গেছে—ভিক্ষুকতা যতদূর পর্যন্ত উদ্ধত স্পর্ধার আকার ধারণ করিতে পারে তাহা করিয়াছে।” --আত্মশক্তি - ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ।

আর এই রকম প্রজ্ঞার একজনকে পেয়েও আমরা কি করেছি? জীবিতকালেই ব্যঙ্গ করেছি তাঁকে নিয়ে। সমালোচনায় ভরিয়ে দিয়েছি অজস্র পাতা। অসম্মান করেছি কত বার! আজ সে-সব স্বীকার করা হচ্ছে! সত্য বড় নিষ্ঠুর! আরও কষ্ট হয়, ব্যথা পাই যখন আমার এই বয়সে এসে দেখতে হয়, বিশ্বকবি আর তাঁর বৌঠান কাদম্বরী দেবী-কে নিয়ে রগরগে লেখাযুক্ত বই আজকের বই-পাড়ার বেস্টসেলার! সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!

“১৯৩৪-৩৫ সালে তরুণ মার্ক্সবাদীদের মধ্যে দেখছি রবীন্দ্রসাহিত্যকে এক নিঃশ্বাসে ফিউডাল বাবুর্জোয়া বলে ধূলিসাৎ করবার চেষ্টা—আরও বাকচাতুর্য্যের সাহায্যে যার জের আজও টেনে চলেছেন নিরুক্ত গোষ্ঠি। রাজনীতির দিক থেকে তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ছিলাম এতে পীড়িত হতাম খুবই। ক্রমাগতই মনে হতো এদের মুখের বড়াই সত্ত্বেও এরা নিশ্চয়ই লুকিয়ে লুকিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান ভালবাসে। আজ যে তারা রবীন্দ্রসাহিত্যের ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা করতে পেরেছে এ আমারই ব্যক্তিগত জয়লাভ। কবিগুরুর শবদেহের পরে অজস্র ফুলের মালার ভীড়ের মধ্যে সংগোপনে অথচ পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তখনকার দিনে রবে-আইনি কম্যুনিষ্ট পার্টির দেওয়া একখানা মালা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সে মালাটির ব্যঞ্জনা ছিল আমার কাছে গভীর। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদ যে শৈশবকাল উত্তীর্ণ হয়েছে তারই সাক্ষ্য ছিল সেটী।”–– রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার –চিন্মোহন সেহানবীশ– ৪৬ নং একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে।

“...... একথাও মনে রাখা দরকার যে সেদিন কমরেড ভবানী সেনের মত বড়ো মাপের নেতা ঐ বিতর্কে ভ্রান্ত মতের প্রবক্তা হওয়া সত্ত্বেও সেদিনও ঐ মত কমিউনিস্ট শিবিরে সর্ববাদীসম্মত হয়নি, আর অচিরে তিনি নিজেও সে-মত বর্জন করেছিলেন পুরোপুরি।......” – আমরা ও ওরা–চিন্মোহন সেহানবীশ– ৪৬ নং একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে।

অর্থাৎ পরবর্তী কালে সংশোধিত হলেও রবীন্দ্রনাথ ও আখ্যাত হয়েছিলেন ‘বুর্জোয়া’ বলে। জীবিতকালেই কবি বারংবার আক্রান্ত হয়েছেন বিচিত্র সব সমালোচনায়! এই প্রসঙ্গে আমি শ্রী তিতাশ চৌধুরী’র একটি ওয়েব-প্রকাশিত “রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ”– নামক প্রবন্ধ থেকে আরো কিছু উদাহরণ দেবার চেষ্টা করছি।

“ ‘সোনার তরী’ কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সেই সময় কবিকে কিরূপ সহ্য করতে হয়েছিল তা জানা যায় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখা থেকে। এই একটি কবিতা নিয়ে বাংলা সাময়িক সাহিত্যে যে পরিমাণ অমৃত ও গরল মথিত হয়ে উঠেছিল, তা বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের কোনো একটি রচনা সম্বদ্ধে কী পূর্বে কী পরে কখনো হয়নি। আসলে কবিতা উপলক্ষমাত্র, কবিই আক্রমণের লক্ষ্য। তার কারণ, রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভার বৈশিষ্ট্য দেশের শিক্ষিত সমাজের বড়ো একটা অংশ স্বীকার করে নিচ্ছিল বলেই, আরেক দলের সেটাকে হেয় প্রমাণ করবার একান্ত প্রয়োজন হয়েছিল।”

বাঙলা ভাষার আর এক বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং বিখ্যাত নাট্যকার ডি. এল রায় অর্থাৎ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথের ইংল্যান্ড যাওয়াকে কেন্দ্র করে ‘আনন্দ-বিদায়’ শীর্ষক একটি ব্যঙ্গ-নাটক রচনা করেছিলেন এবং তাতে তিনি কি রূপ বিষোদ্গার করেছিলেন তা বোঝা যায় “একাধারে কবি, অধিকারী ঋষি কিবা ত্যাগ কিবা দান, পরিষদ জল ছিটায়ে দিলেই (কবিবর) স্বর্গে উঠিয়া যান”, ইত্যাদি বলে। এছাড়াও তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘বিজয়িনী’ ও ‘উব্বর্শী’র বিরুদ্ধেও অশ্লীলতার অভিযোগ খাড়া করেছিলেন। সাহিত্য পত্রিকার ১৩১৩ সালের জৈষ্ঠ্য সংখ্যার রবীন্দ্রনাথের কাব্য নাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’র বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ এনে তিনি একে দগ্ধ করারও পরামর্শ দিয়েছিলেন।

তদানীন্তন ‘হিতবাদী’ পত্রিকার তরুণ সম্পাদক কালী প্রসন্ন কাব্য বিশারদ। রবীন্দ্রনাথের ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরই কালী প্রসন্ন ‘রবিরাহু’ ছদ্মনামে একটি প্যারডি রচনা করেন এইভাবে – “ইহা কড়িও নহে কোমলও নহে পুরো মুরে ‘মিঠেকড়া’...” শুধু তাই নয়, তিনি রবিঠাকুরকে ‘পায়রা কবি’ বলেও ব্যঙ্গ করেন। যেমন: 

উড়িস নে রে পায়রা কবি
খোপের ভিতর থাক ঢাকা।
তোর বকবকম আর ফোঁসফোঁসানি
তাও কবিত্বের ভাবমাথা।
তাও ছাপালি গ্রন্থ হলো,
নগদ মূল্য এক টাকা।

সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাস। ‘সবুজপত্রে’ মাসিক কিস্তিতে প্রকাশিত হবার সময়ই ঝড় উঠতে শুরু হয় বিমলার আচরণ নিয়ে। বিশেষত সন্দীপের মুখে সীতা ও রাবণের বিরোধের প্রসঙ্গ ঝড় তুলেছিল। কবি বঙ্কিম মিত্র ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে পদ্যে এক অভিযোগ খাড়া করেন। ১৩২৬ সালের ‘অর্চনা’ পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যার বঙ্কিম মিত্র লিখেন দীর্ঘ একপদ্য। এর দু’একটি স্তবক এরকম:

এ মহাপাতকে হিন্দু। তব পুণ্য গেহ
করিওনা কলঙ্কিত; আর্যরক্ত দেহ
ধরে যদি একবিন্দু একটি শিরায়
যদি শুদ্ধ শুচিতার একটি রেখায়
শুভ্র থাকে ও চিত্তের এক তিলস্থান,
এ-কলুষ হতে দূর করো অবস্থান:...
কিন্তু যেই লেখনীর লজ্জা লেশহীন
বর্বর যথেচ্ছাচার সেই অমলিন
শুদ্ধ শুচি সতীত্বের তেজে জ্যোতির্ময়
সীতা চিত্ত কল্পিয়াছে পাপিষ্ঠ আশায়
তার হাতে আর্যনারী ‘বিমলার’ প্রায়
যথেচ্ছাচারিণী হবে কি আশ্চর্য তায়? ...ইত্যাদি।

এ সম্পর্কে চিত্রাদেব লেখেন (অনালোচিত রবীন্দ্র প্রসঙ্গ) : ‘জীবনে বহুবার তিনি (রবীন্দ্রনাথ) সমালোচনার কাঠগড়ায় আসামীরূপে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্কিম মিত্রের কবিতা তাঁর মনে একটি মাত্র তিক্ত স্মৃতি বয়ে নিয়ে এসেছিল’। ১৩১১ শ্রাবণের ‘ভারতী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের একটি গান প্রকাশিত হয়। এর চার পংক্তি উদ্বৃত করে ১৩১১’র ভাদ্রের সাহিত্য পত্রিকার মাসিক সাহিত্য সমালোচনা’ বিভাগে বলা হয় যে, ‘গানটি সম্পূর্ণ অর্থহীন’। তারপর মন্তব্য করা হয় :

‘রবীন্দ্রবাবু অনেক লিখিয়াছেন, অনেক ছাপিয়াছেন, অনেক গাহিয়াছেন- এখনও যে তিনি যা-তা ছাপাইবার লোভ সংবরণ করিতে পারেন না, ইহা আমাদের বিচিত্র বলিয়া বোধ হয়। নাবালক কবি সুলভ কবিত্ব-কৃতি লব্ধ প্রতিষ্ঠা কবির পক্ষে নিতান্ত অশোভন- সে দৃষ্টান্ত সাহিত্যের পক্ষে নিতান্ত অপকারী, রবীন্দ্রবাবুর ন্যায় প্রতিভাশালী লেখকই যদি তাহা না বুঝিতে পারে, তাহা হইলে আমরা নাচার।’...

শুধু তাই নয়, শ্রী অরবিন্দ, যদুনাথ, প্রমুখ রবীন্দ্রবিবোধী দলে যোগ দিয়েছিলেন। বিপিনচন্দ্র পালের মতন প্রখ্যাত জাতিয়তাবাদী নেতা প্রকাশ্যে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন-রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। বলতেই হয়, রবীন্দ্রনাথের ভাগ্যে তার দেশের কাছ থেকে জুটেছে অবিরত অপমান, অবিশ্রান্ত নিন্দা, অকারণ কটুক্তি এবং প্রায় ক্ষেত্রেই তার প্রীতিভাজন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এতে সোৎসাহে ইন্ধন জুগিয়েছেন। অবশ্যি এ ক্ষেত্রে বিদেশীরাও কম যাননি। ইয়েটস এবরা পাউন্ড প্রমুখ জীবনবাদী শিল্পীরাও এক সময় রবীন্দ্র বিরোধিতায় নেমেছিলেন। (বিশেষ করে ইংরেজ কবি ইয়েটস) ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯) গীতাঞ্জলির একটি চমৎকার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। নিতান্ত এক ভারতীয় কবির ‘মুরব্বী’ ভাব প্রকাশের ইচ্ছায়। সেই ভারতীয় কবি যখন নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেলেন, তখন তাঁর উপর মুরব্বী খানা ফলানোর সুযোগ ফসকে গেল। শুধু তাই নয়, তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন আরও দশ বছর পর। কাজেই খুব স্বাভাবিক কারণেই এক অসহ্য ঈর্ষার জ্বালায় তিনি রবীন্দ্রবিরোধী শিবিরে ঢুকে পড়েছিলেন।

ঐতিহাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ’ স্মৃতিকথা পাঠে জানা যায় যে, ‘মেয়েলি কবিতার লেখক বলিয়া রবীন্দ্রনাথের কবিতা তখন বিশেষ সমাদর লাভ করিত না’। তিনি লিখেছেন, ‘দলে মিলিয়া আমিও রবীন্দ্রনিন্দুক সম্প্রদায়েরই একজন হইয়া দাঁড়াইয়াছিলাম। আমরা অনেকেই তখন রবীন্দ্র কাব্যের প্রায় কিছুই পাঠ করি নাই; তথাপি রবীন্দ্র কাব্যের নিন্দা করা তখন এক শ্রেণীর লোকের ফ্যাশন হইয়া দাঁড়াইয়াছিল’। (শনিবারের চিঠি, আশ্বিন, ১৩৪৮)

এর মধ্যেই কবি আপনমনে সৃষ্টি করে চলেছেন কবিতা, গান, গীতিকাব্য, নৃত্যনাট্য, ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, হাস্যকৌতুক, ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন প্রবন্ধ তো আছেই। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। একদিকে নানান পারিবারিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত কবি আর অন্যদিকে চলেছে নিত্য সৃষ্টির অঙ্কুর। স্ত্রী, সন্তান বিয়োগেও তিনি অবিচল। এমন একজন মানুষকে কি বলা যায় বলুন তো? স্বপ্নের বিশ্বভারতী গড়ে উঠছে তারই মধ্যে। প্রাচীন আশ্রম-ধারণাকে কেন্দ্র করে ডেকে ডেকে নিয়ে আসছেন বিভিন্ন রকম গুণী মানুষজনকে। তাঁদের নিয়ে চলছে এক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরীর কাজকর্ম। নিঃশব্দে, নীরবে। এই ভাবেই আমার রবীন্দ্রনাথ বোঝার শুরু।

এই আমার অনুভবের রবীন্দ্রনাথ। ‘আমার সাধের সাধনা, মম শূন্য গগনবিহারী।

তোমার কাব্যের বীজ            পাথরে পড়িয়া যদি
ফুলে-ফলে না হয় সফল
পড়িতে পথের ‘পরে         পথিক দলিয়া যায়
খেয়ে যায় খঁটে-খাওয়া পাখী।
হাজার আগাছা সাথে              মহামূল্য কোন চারা
দূর করে ফেলে দেয় কেহ—
সে দোষ তাদের যারা                দাঁড়ায়ে মাটির ’পরে
মাটিরেই দিতে চায় ফাঁকি।
দুবেলা তাদের সাথে                 দু’মূঠো অন্নের লাগি’
আমাদের অশ্লীল সংগ্রাম,
কদর্য কলহে মাতি                    অন্ধকারে হাতাহাতি,
দীর্ঘ দেহ ছিন্ন বহির্বাস।
তোমার কায়ারে তাই                    ছায়া ভেবে হেসে ওঠে,
তোমার সুধারে বলি সুরা ;
জ্বরের বিকার ঘোরে               তোমারে চিনিতে নারি
গালি দেই করি উপহাস।

                                                            ...... রবীন্দ্রনাথ – সরোজ দত্ত 

আর ক’দিন পরেই বিশ্বকবির মৃত্যুদিন। ২২শে শ্রাবণ। আসুন, স্মরণে-মননে যদি একটুও শ্রদ্ধা জানাতে পারি তাঁর প্রতি। তাহলে হয়তো আমরা একটু সার্থক হবো তাঁর চিন্তাধারায়!

শেষ করছি কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতা ‘২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮’ দিয়ে :

“মেঘ চাপা পূর্ণিমা, / আর সারি সারিমুখঢাকারুদ্যমান আলোয় / শহরের নিষ্প্রদীপ রাত শ্রাবণ-সমাচ্ছন্ন। / আলো নিবল, / রাত কাটল, / পূর্ণিমা ছাড়ল, / কিন্তু প্রভাতের কপালে / আজ আর সূর্য উঠল না। / এমন দিনেই, / এমনি শ্রাবণঘন গহন মোহে,-- / কাননভূমি যখন কূজনহীন, / সকল ঘরে যখন দুয়ার দেওয়া,-- / একেলা পথিক গোপন তার চরণ ফেলে / নিশার মত নীরবে পথ চলে। / শহরে তা অশোভন, / শহরে তা অসম্ভব। / পথিকের বাঁধা পথ আরও বেঁধে দেওয়া হয়েছে-- / কলুটোলা স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট, / কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট হয়ে / পথিক যাবে। / তারই একটা মোড়ে-- / সহস্র নিরুপায়ের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ভিজছি। / দূর হতে কানে আসছে-- / বিপুল পরাজয়ের তুমুল জয়ধ্বনি! / সহসা দেখা গেল-- / মরণের কুসুম কেতন জয়রথ! / মনে হলো-- / কি বিচিত্র শোভা তোমার-- / কি বিচিত্র সাজ! ............”