ব্যক্তিগত গদ্য
অনুভবে রবীন্দ্রনাথ
গৌতম দত্ত
“দেখেছি তোমার নামে সবার প্রথমে
শ্রাবণে ধানের শিসে দুধটুকু জমে,
তোমারি তো নামে
বৈশাখে আখের খেতে যত মধু নামে |
তবুও হাজার হাতে হাওয়া দেয় ডাক,
কোথায় মাটির স্বপ্নে শিলীভূত পঁচিশে বৈশাখ |
কোথায় আকাশে বাজে সোনার সরোদ
পঁচিশে বৈশাখী ভোর গলে হয় গিনিসোনা-রোদ |
তুমি তো বনস্পতি তোমার পায়েতে থরে থরে
অজস্র শব্দের রং কৃষ্ণচূড়ার মতো ঝরে
তুমি এক অবাক মৌচাক
কথাগুলি চারপাশে ঘোরে যেন গুনগুন সুর এক ঝাঁক |
তোমার ছন্দের নদী জমা হতো যদি
পৃথিবীতে হতো মহাসমুদ্র-বলয়,
ঝুরঝুরে গানের মাটি জ’মে জ’মে হ’ত
আর-এক নতুন হিমালয়!
আকাশে বরুণে দূর স্ফটিক ফেনায়
ছড়ানো তোমার প্রিয়নাম,
তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা----
কোনখানে রাখব প্রণাম!” ---- প্রণমি - কবি দিনেশ দাস
‘শ্রাবণে ধানের শিসে দুধটুকু জমে’ – এ-কথাটা যদি সত্যিই অনুভবযোগ্য মনে হয়, তাহলে সেই অনুভব-এর মতন আমাদের বাঙালী জীবনে মিশে আছেন রবীন্দ্রনাথ।
আমি বা আমরা যারা অন্তত বাঙালী এবং রবীন্দ্রনাথকে পড়েছি (কতখানি নিতে পেরেছি জানি না) তারা যে এই বিশ্বপৃথিবীতে কত ভাগ্যবান, সে কথা বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি যদি আজ এই ভারতের অন্য প্রদেশে জন্মাতাম আর আমার মাতৃভাষা হতো অন্য কিছু তাহলে কি পারতাম এমন অনুভবে রবীন্দ্রনাথকে আত্মস্থ করতে ?
মনে পড়ে আজও, যেদিন আমি এই ছবিটা প্রথম দেখলাম আর ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে পড়লাম ছবির তলার লেখাগুলো :-
এক মুগ্ধতায় যে নিশ্চয় ভরে গেছিলাম তা আজ এই বয়সে এসে অনুমান করতে একটুও কষ্ট হয় না। অনেক পরে জেনেছিলাম যে, এই ছবিগুলো কার আঁকা? ঠাকুরবাড়ির আর এক উজ্জ্বল সন্তান অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর মশাই-এর।
আমার জন্ম কলকাতার প্রাচীন সিমলে পাড়ায়। দু-পা হাঁটলেই গৌরমোহন মুখার্জী স্ট্রীট। এক সরু গলির এক পুরোনো বাড়ি! আজ সেখানে ঝকঝকে স্বামী বিবেকানন্দ ইন্সটিটিউট। কত বার যে উঁকি মেরেছি বাবার হাত ধরে ও বাড়ির দরজায়, কিন্তু ঢোকার উপায় ছিল না অজস্র ভাড়াটিয়াদের বসবাসের মধ্যে। এখন নতুন বাড়িতে ঢুকে সব যেন অচেনা লাগে। মনে হয় ওই গলিটা যেন আজ পাল্টে গেছে।
আমাদের বাড়ি থেকে সেন্ট্রাল এভিনিউ পেরিয়ে মুখোমুখি একটা রাস্তা, এঁকেবেকে আমায় পৌঁছে দিত আমার মামার বাড়ি নতুন-বাজারের সামনে। তার থেকে একটু বাঁ-দিকে একটা গলির মধ্যে ছিল আমার মামার বাড়ি। আর সেই গলিটার থেকে চিৎপুরের ট্রাম লাইন ধরে কিছুটা দক্ষিণে গেলেই আমার জন্মস্থান ‘লোহিয়া মাতৃ-সেবাসদন’। তার থেকে আরও একটু ফুটপাথ ধরে এগোলেই চার মাথার একটা মোড়। গনেশটকির মোড়। (গনেশটকি’জ বলে একটা সিনেমা হল ছিল সে সময়। হলটা হয়ত এখনো আছে।) আর ওই মোড় পেরিয়ে দু-চার পা গেলেই আর এক বিখ্যাত বাড়ি – ‘জোড়াসাঁকো’র ঠাকুরবাড়ি’।
প্রথম গেছিলাম বাবার হাত ধরে। একটু অবাক হয়ে ছিলাম প্রথমে। ঠাকুরবাড়িতে কোনও ঠাকুর না দেখতে পেয়ে। এ কথাটা বললাম এই জন্যে যে, আমাদের ওই অঞ্চলে তখন অনেকই ঠাকুরবাড়ি আর সেসব ঠাকুরবাড়িতে ঠাকুরই থাকত। হয় রাধা-কৃষ্ণ কিংবা কালী অথবা অন্য আরও কত দেব-দেবী।
তবে যখন বাড়িটায় ঢুকে ওই দাড়িওয়ালা মানুষটির ছবি দেখেছিলাম আর বাবা বলেছিলেন যে এই বাড়িতেই জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তখন আর আশ্চর্য হইনি, কারণ তার আগেই আমি ওই দাড়িওয়ালা বুড়োটাকে বেশ চিনে গেছি। আর মুখস্থও হয়ে গেছে :
“অঞ্জনা-নদী-তীরে চন্দনীগাঁয়ে
পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে
জীর্ণ ফাটল ধরা—— এক কোণে তারি
অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী।
আত্মীয় কেহ নাই নিকট কী দূর,
আছে এক লেজ-কাটা ভক্ত কুকুর।
আর আছে একতারা, বক্ষেতে ধরে
গুন্গুন্ গান গায় গুঞ্জন-স্বরে।
গঞ্জের জমিদার সঞ্জয় সেন
দু-মুঠো অন্ন তারে দুই বেলা দেন।
........................,”
খুব সম্ভবতঃ আমি তখন দ্বিতীয় শ্রেণী।
এই আমার ছোট্ট বেলার রবিঠাকুর। পঁচিশে বৈশাখের দিন হলেই বাবা এনে দিতেন রজনীগন্ধার গোড়ে মালা আর একখানা সাদা পদ্মফুল। আগের দিন থেকেই ছবি সাজিয়ে রেখে দিতাম সেই ছোটো থেকেই। এখন ছবিখানা আর পাড়া হয় না, দেয়াল থেকে। ওখানেই মালা পরেন তিনি। আর আমাদের বাঙালী জীবনে এই দিনটা এখন এক ঊৎসবে পরিণত হয়ে গেছে। বাইশে শ্রাবণ এখনও অত গুরুত্ব পায় নি যদিও।
রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়েছিল এই জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই বাঙলা ক্যালেন্ডারের ২৫শে বৈশাখে। বাঙলা সন ১২৬৮। আর বিলিতি মতে ৭ই মে, ১৮৬১। তখন কেমন ছিল আমাদের এই প্রাচীন কলকাতা :
“শহরে শ্যাকরাগাড়ি ছুটছে তখন ছড়্ছড়্ করে ধুলো উড়িয়ে, দড়ির চাবুক পড়ছে হাড়-বের করা ঘোড়ার পিঠে। না ছিল ট্রাম, না ছিল বাস, না ছিল মোটরগাড়ি। তখন কাজের এত বেশি হাঁসফাঁসানি ছিল না, রয়ে বসে দিন চলত। বাবুরা আপিসে যেতেন কষে তামাক টেনে নিয়ে পান চিবতে চিবতে, কেউ বা পালকি চড়ে কেউ বা ভাগের গাড়িতে। যাঁরা ছিলেন টাকাওয়ালা তাঁদের গাড়ি ছিল তকমা-আঁকা, চামড়ার আধঘোমটাওয়ালা, কোচবাক্সে কোচমান বসত মাথায় পাগড়ি হেলিয়ে, দুই দুই সইস থাকত পিছনে, কোমরে চামর বাঁধা, হেঁইয়ো শব্দে চমক লাগিয়ে দিত পায়ে-চলতি মানুষকে। মেয়েদের বাইরে যাওয়া-আসা ছিল দরজাবন্ধ পালকির হাঁপ ধরানো অন্ধকারে, গাড়ি চড়তে ছিল ভারি লজ্জা। রোদবৃষ্টিতে মাথায় ছাতা উঠত না। কোনো মেয়ের গায়ে সেমিজ, পায়ে জুতো, দেখলে সেটাকে বলত মেমসাহেবি; তার মানে, লজ্জাশরমের মাথা খাওয়া। কোনো মেয়ে যদি হঠাৎ পড়ত পরপুরুষের সামনে, ফস্ করে তার ঘোমটা নামত নাকের ডগা পেরিয়ে, জিভ কেটে চট্ করে দাঁড়াত সে পিঠ ফিরিয়ে। ঘরে যেমন তাদের দরজা বন্ধ, তেমনি বাইরে বেরবার পালকিতেও; বড়োমানুষের ঝি-বউদের পালকির উপরে আরও একটা ঢাকা চাপা থাকত মোটা ঘেটাটোপের, দেখতে হতো যেন চলতি গোরস্থান। পাশে পাশে চলত পিতলে-বাঁধানো লাঠি হাতে দারোয়ানজি। ওদের কাজ ছিল দেউড়িতে বসে বাড়ি আগলানো, দাড়ি চোমরানো, ব্যাঙ্কে টাকা আর কুটুমবাড়িতে মেয়েদের পৌঁছিয়ে দেওয়া, আর পার্বণের দিনে গিন্নিকে বন্ধ পালকি-সুদ্ধ গঙ্গায় ডুবিয়ে আনা। দরজায় ফেরিওয়ালা আসত বাক্স সাজিয়ে,......”
একথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের। ‘ছেলেবেলা’য়।
“মাস্টারমশায় মিটমিটে আলোয় পড়াতেন প্যারী সরকারের ফার্স্ট্বুক। প্রথমে উঠত হাই, তার পর আসত ঘুম, তার পর চলত চোখ-রগড়ানি।...”
আমরাও প্রথম ইংরেজি শিখতে পড়েছি এই প্যারী চরণ সরকারের “ফার্স্ট্বুক”। এখন শিশুদের আর লাগে না। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় হল, বইখানা এখনও বাজারে পাওয়া যায়।
একথা বলার মানে হলো যে রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন আমার জন্মেরও ৯৫ বছর আগে। কিন্তু আমি বা আমার সম-সাময়িক মানুষেরা কিছুটা হলেও পেয়েছি আমাদের প্রাচীন কলকাতার সেই ব্যবহারিক ধারাবাহিকতাগুলো। তখন তো আমাদের পাড়ার চারপাশে এত ‘মডার্ন ডে স্কুল’ গজিয়ে ওঠেনি আর আমরাও স্যুট-প্যান্ট-টাই পরে স্কুলেও যাই নি। তাই হয়তো জীবনের মাধুর্য্য ছিল অনেক বেশী। সময় বহে যেত মন্দাক্রান্তায়!
“তখন জলের কল বসে নি। বেহারা কাঁখে করে কলসি ভরে মাঘ-ফাগুনের গঙ্গার জল তুলে আনত। একতলার অন্ধকার ঘরে সারি সারি ভরা থাকত বড়োবড়ো জালায় সারা বছরের খাবার জল। নীচের তলায় সেই-সব স্যাঁৎসেতে এঁধো কুটুরিতে গা ঢাকা দিয়ে যারা বাসা করেছিল কে না জানে তাদের মস্ত হাঁ, চোখ দুটো বুকে, কান দুটো কুলোর মতন, পা দুটো উলটো দিকে। সেই ভূতুড়ে ছায়ার সামনে দিয়ে যখন বাড়ি ভিতরের বাগানে যেতুম, তোলপাড় করত বুকের ভিতরটা,পায়ে লাগাত তাড়া। তখন রাস্তার ধারে ধারে বাঁধানো নালা দিয়ে জোয়ারের সময় গঙ্গার জল আসত। ঠাকুরদার আমল থেকে সেই নালার জল বরাদ্দ ছিল আমাদের পুকুরে। যখন কপাট টেনে দেওয়া হতো ঝরঝর কলকল করে ঝরনার মতো জল ফেনিয়ে পড়ত। মাছগুলো উলটো দিকে সাঁতার কাটবার কসরত দেখাতে চাইত। দক্ষিণের বারান্দার রেলিঙ ধরে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতুম। শেষকালে এল সেই পুকুরের কাল ঘনিয়ে, পড়ল তার মধ্যে গাড়ি-গাড়ি রাবিশ। পুকুরটা বুজে যেতেই পাড়াগাঁয়ের সবুজ-ছায়া-পড়া আয়নাটা যেন গেল সরে। সেই বাদামগাছটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু অমন পা ফাঁক করে দাঁড়াবার সুবিধে থাকতেও সেই ব্রহ্মদত্যির ঠিকানা আর পাওয়া যায় না।
ভিতরে বাইরে আলো বেড়ে গেছে।”
কবেই কবি বুঝেছিলেন এই “ভিতরে বাইরে আলো বেড়ে গেছে।” তখন থেকেই দেখতে পাচ্ছি সেই পুকুরগুলো গাড়ি-গাড়ি রাবিশ ফেলে বোজানোর চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। ভাবুন, আজ থেকে প্রায় একশো চল্লিশ বা দেড়শো বছর আগে! আর শুধু আলোই বাড়েনি আজ, বারান্দা আর রেলিঙ উধাও হয়ে গেছে শহর থেকে, ভূতেরা আজ আর থাকবার জায়গা পায় না সুউচ্চ বহুতলের কোনও ফাঁকা ঘরে। অলস দুপুরে শোনা যায় না আর পায়রার বক্বকম্ সেই টানা বারান্দাগুলোর কার্নিশ থেকে।
রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ তখনকার দিনে বেশ ধনী মানুষই ছিলেন। কিন্তু বাড়িতে বাহুল্য ছিলই না কোনও। বালক রবির কথা শুনুন :
“জানিয়ে রাখি আমাদের চাল ছিল গরিবের মতো। গাড়িঘোড়ার বালাই ছিল না বললেই হয়। বাইরে কোণের দিকে তেঁতুল গাছের তলায় ছিল চালাঘরে একটা পালকিগাড়ি আর একটা বুড়ো ঘোড়া। পরনের কাপড় ছিল নেহাত সাদাসিধে। অনেক সময় লেগেছিল পায়ে মোজা উঠতে। যখন ব্রজেশ্বরের ফর্দ এড়িয়ে জলপানে বরাদ্দ হলো পাঁউরুটি আর কলাপাতা-মোড়া মাখন, মনে হলো আকাশ যেন হাতে নাগাল পাওয়া গেল। সাবেক কালের বড়োমানুষির ভগ্নদশা সহজেই মেনে নেবার তালিম চলছিল।
“আমাদের এই মাদুর-পাতা আসরে যে চাকরটি ছিল সর্দার তার নাম ব্রজেশ্বর। চুলে গোঁফে লোকটা কাঁচাপাকা, মুখের উপর টানপড়া শুকনো চামড়া, গম্ভীর মেজাজ, কড়া গলা, চিবিয়ে চিবিয়ে কথা। তার পূর্ব মনিব ছিলেন লক্ষ্মীমন্ত, নামডাকওয়ালা। সেখান থেকে তাকে নাবতে হয়েছে আমাদের মতো হেলায়-মানুষ ছেলেদের খবরদারির কাজে। শুনেছি গ্রামের পাঠশালায় সে গুরুগিরি করেছে। এই গুরুমশায়ি ভাষা আর চাল ছিল তার শেষ পর্যন্ত। বাবুরা ‘বসে আছেন’ না বলে সে বলত ‘অপেক্ষা করে আছেন’। শুনে মনিবরা হাসাহাসি করতেন। যেমন ছিল তার গুমোর তেমনি ছিল তার শুচিবাই। স্নানের সময় সে পুকুরে নেমে উপরকার তেলভাষা জল দুই হাত দিয়ে পাঁচ-সাতবার ঠেলে দিয়ে একেবারে ঝুপ করে দিত ডুব। স্নানের পর পুকুর থেকে উঠে বাগানের রাস্তা দিয়ে ব্রজেশ্বর এমন ভঙ্গীতে হাত বাঁকিয়ে চলত যেন কোনোমতে বিধাতার এই নোংরা পৃথিবীটাকে পাশ কাটিয়ে চলতে পারলেই তার জাত বাঁচে। চালচলনে কোনটা ঠিক, কোনটা ঠিক নয়, এ নিয়ে খুব ঝোঁক দিয়ে সে কথা কইত। এ দিকে তার ঘাড়টা ছিল কিছু বাঁকা, তাতে তার কথার মান বাড়ত। কিন্তু ওরই মধ্যে একটা খুঁত ছিল গুরুগিরিতে। ভিতরে ভিতরে তার আহারের লোভটা ছিল খুব চাপা। আমাদের পাতে আগে থাকতে ঠিকমতো ভাগে খাবার সাজিয়ে রাখা তার নিয়ম ছিল না। আমরা খেতে বসলে একটি একটি করে লুচি আলগোছে দুলিয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করত, ‘আর দেব কি?’ কোন উত্তর তার মনের মতো সেটা বোঝা যেত তার গলার সুরে। আমি প্রায়ই বলতুম, ‘চাই নে’ -তার পরে আর সে পীড়াপীড়ি করত না। দুধের বাটিটার ‘পরেও তার অসামাল রকমের টান ছিল, আমার মোটে ছিল না। শেলফওয়ালা একটা আলমারি ছিল তার ঘরে। তার মধ্যে একটা বড়ো পিতলের বাটিতে থাকত দুধ, আর কাঠের বারকোশে লুচি তরকারি। বিড়ালের লোভ জালের বাইরে বাতাস শুঁকেশুঁকে বেড়াত।
“এমনি করে অল্প খাওয়া আমার ছেলেবেলা থেকেই দিব্যি সয়ে গিয়েছিল। সেই কম খাওয়াতে আমাকে কাহিল করেছিল এমন কথা বলবার জো নেই। যে ছেলেরা খেতে কসুর করত না তাদের চেয়ে আমার গায়ের জোর বেশি বই কম ছিল না। শরীর এত বিশ্রী রকমের ভালো ছিল যে, ইস্কুল পালাবার ঝোঁক যখন হয়রান করে দিত তখনও শরীরে কোনোরকম জুলুমের জোরেও ব্যামো ঘটাতে পারতুম না। জুতো জলে ভিজিয়ে বেড়ালুম সারাদিন, সর্দি হলো না। কার্তিক মাসে খোলা ছাদে শুয়েছি, চুল জামা গেছে ভিজে, গলার মধ্যে একটু খুসখুসানি কাশিরও সাড়া পাওয়া যায় নি। আর পেট-কামড়ানি বলে ভিতরে ভিতরে বদহজমের যে একটা তাগিদ পাওয়া যায় সেটা বুঝতে পাই নি পেটে, কেবল দরকারমতো মুখে জানিয়েছি মায়ের কাছে। শুনে মা মনে মনে হাসতেন, একটুও ভাবনা করতেন বলে মনে হয় নি। তবু চাকরকে ডেকে বলে দিতেন, ‘আচ্ছা যা, মাস্টারকে জানিয়ে দে, আজ আর পড়াতে হবে না’। আমাদের সেকেলে মা মনে করতেন, ছেলে মাঝে মাঝে পড়া কামাই করলে এতই কি লোকসান। এখনকার মায়ের হাতে পড়লে মাস্টারের কাছে তো ফিরে যেতেই হতো, তার উপরে খেতে হতো কানমলা। হয়তো বা মুচকি হেসে গিলিয়ে দিতেন ক্যাস্টর অয়েল। চিরকালের জন্যে আরাম হতো ব্যামোটা। দৈবাৎ কখনো আমার জ্বর হয়েছে; তাকে চক্ষেও দেখি নি। ডাক্তার একটু গায়ে হাত দিয়েই প্রথম দিনের ব্যবস্থা করতেন ক্যাস্টর অয়েল আর উপোস। জল খেতে পেতুম অল্প একটু, সেও গরম জল। তার সঙ্গে এলাচদানা চলতে পারত। তিন দিনের দিনই মৌরলা মাছের ঝোল আর গলা ভাত উপোসের পরে ছিল অমৃত।
“জ্বরে ভোগা কাকে বলে মনে পড়ে না। ম্যালেরিয়া বলে শব্দটা শোনাই ছিল না। ওয়াক-ধরানো ওষুধের রাজা ছিল ঐ তেলটা, কিন্তু মনে পড়ে না কুইনীন। গায়ে ফোড়াকাটা ছুরির আঁচড় পড়ে নি কোনোদিন। হাম বা জলবসন্ত কাকে বলে আজ পর্যন্ত জানি নে। শরীরটা ছিল একগুঁয়ে রকমের ভালো। মায়েরা যদি ছেলেদের শরীর এতটা নীরুগী রাখতে চান যাতে মাস্টারের হাত এড়াতে না পারে তা হলে ব্রজেশ্বরের মতো চাকর খুঁজে বের করবেন। খাবার-খরচার সঙ্গে সঙ্গেই সে বাঁচাবে ডাক্তার-খরচা; বিশেষ করে এই কলের জাঁতার ময়দা আর এই ভেজাল দেওয়া ঘি-তেলের দিনে।”
‘জলপানে বরাদ্দ হলো পাঁউরুটি আর কলাপাতা-মোড়া মাখন’। আমাদেরও ছোটোবেলায় এই কলাপাতা-মোড়া মাখন যার রঙ ছিল সাদা, তা পাঁউরুটি দিয়েই খেয়েছি কতোদিন। সেই পুরনো কলকাতার অনেক কিছুরই স্বাদ আমরা নিতে পেরেছিলাম। কিন্তু এত আলো বেড়ে গিয়ে সেসব স্বর্ণালী দিনগুলো আস্তে আস্তে হারিয়েই গেল, কলকাতার নাগরিক জীবন থেকে।
এত লাইনের পর লাইন উদ্ধৃতি দিয়ে হয়ত একটু বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, তখনকার দিনে অত বড়লোক ঘরেও চলতো “simple living and high thinking”। আমাদের জমানাতেও আমরা এই ভাবেই মানুষ হয়েছি। এটা এই কারণে বলছি যে, আমাদের সাধারণ স্কুল বা কলেজেও অনেক বড়লোক ছেলে-মেয়েরাও পড়াশোনা করতো। কিন্তু আমাদের মেলামেশায় তা কোনও দিন বাধা হয়ে ওঠেনি।
আমাদের ছেলেবেলায়ও দেখেছি আমাদের বাড়িতে চাকর বা রান্নার ঠাকুর থাকতে। আর আমাদেরও ছোটোবেলায় জ্বর হলেই উপোষ ছিল একেবারে বাধা। কতখানি ডিসিপ্লিন তখন মেনে চলতে হতো তা আমরাও অনুভব করেছি।
“আহারে আমাদের শৌখিনতার গন্ধও ছিল না। কাপড়চোপড় এতই যৎসামান্য ছিল যে এখনকার ছেলের চক্ষে তাহার তালিকা ধরিলে সম্মানহানির আশঙ্কা আছে। বয়স দশের কোঠা পার হইবার পূর্বে কোনোদিন কোনো কারণেই মোজা পরি নাই। শীতের দিনে একটা সাদা জামার উপরে আর-একটা সাদা জামাই যথেষ্ট ছিল। ইহাতে কোনোদিন অদৃষ্টকে দোষ দিই নাই। কেবল, আমাদের বাড়ির দরজি নেয়ামত খলিফা অবহেলা করিয়া আমাদের জামায় পকেট-যোজনা অনাবশ্যক মনে করিলে দুঃখ বোধ করিতাম-- কারণ, এমন বালক কোনো অকিঞ্চনের ঘরেও জন্মগ্রহণ করে নাই, পকেটে রাখিবার মতো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি যাহার কিছুমাত্র নাই; বিধাতার কৃপায় শিশুর ঐশ্বর্য সম্বন্ধে ধনী ও নির্ধনের ঘরে বেশি কিছু তারতম্য দেখা যায় না।”
আজকের আমাদের এই অণু-সংসারে কি ভাবতেও পারি এমন কথা ? ছোটো থেকে আমরাও আদর পেয়েছি প্রচুর। কিন্তু তার সাথে সাথে ছিল এক নীরব নিয়মানুবর্তিতা, সব যৌথ সংসারেই। সে সবের পাট বালাই আর খুঁজে পাওয়া দায়! রবীন্দ্রনাথ তো কবেই লিখে গেছেন :
“আমাদের চেয়ে যাঁহারা বড়ো তাঁহাদের গতিবিধি, বেশভূষা, আহারবিহার, আরাম-আমোদ, আলাপ-আলোচনা, সমস্তই আমাদের কাছ হইতে বহুদূরে ছিল। তাহার আভাস পাইতাম, কিন্তু নাগাল পাইতাম না। এখনকার কালে ছেলেরা গুরুজনদিগকে লঘু করিয়া লইয়াছে; কোথাও তাহাদের কোনো বাধা নাই এবং না চাহিতেই তাহারা সমস্ত পায়। আমরা এত সহজে কিছুই পাই না। কত তুচ্ছ সামগ্রীও আমাদের পক্ষে দুর্লভ ছিল; বড়ো হইলে কোনো-এক সময়ে পাওয়া যাইবে, এই আশায় তাহাদিগকে দূর ভবিষ্যতের-জিম্মায় সমর্পণ করিয়া বসিয়া ছিলাম। তাহার ফল হইয়াছিল এই যে, তখন সামান্য যাহাকিছু পাইতাম তাহার সমস্ত রসটুকু পুরা আদায় করিয়া লইতাম, তাহার খোসা হইতে আঁঠি পর্যন্ত কিছুই ফেলা যাইত না। এখনকার সম্পন্ন ঘরের ছেলেদের দেখি, তাহারা সহজেই সব জিনিস পায় বলিয়া তাহার বারো-আনাকেই আধখানা কামড় দিয়া বিসর্জন করে-- তাহাদের পৃথিবীর অধিকাংশই তাহাদের কাছে অপব্যয়েই নষ্ট হয়।”
একেই কি বলে পরিবর্তন? আমরা বলি বটে যে, কলকাতার অবক্ষয় শুরু হয়েছে দূরদর্শন আর মোবাইল ফোনের হাত ধরে! কিন্তু সেটা সত্যি কি না, তা আমাদের ভেবে দেখার সময় এসেছে। কতদিন আগেই তো রবীন্দ্রনাথ অনুভব করেছিলেন এই সত্য। তার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, কলকাতার ব্যবহারিক পরিবর্তন শুরু হয়ে গেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় গোড়া থেকেই। চোরাস্রোতের মতন সে পরিবর্তন আমাদের মতন সাধারণের চোখে ধরা না দিলেও, বিশ্বকবির দূরদৃষ্টি’র চোখ তা এড়ায় নি।
আমাদের ছোটোবেলায় দেখা সবকিছুই, রবীন্দ্রনাথও দেখেছিলেন এই ভাবে :
“চৈৎ-বৈশাখ মাসে রাস্তায় ফেরিওয়ালা হেঁকে যেত ‘বরীফ’। হাঁড়িতে বরফ-দেওয়া নোনতা জলে ছোটো ছোটো টিনের চোঙে থাকত যাকে বলা হোত কুলফির বরফ, এখন যাকে বলে অইস কিংবা আইসক্রীম। রাস্তার দিকের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেই ডাকে মন কী রকম করত তা মনই জানে। আর-একটা হাঁক ছিল ‘বেলফুল’। বসন্তকালের সেই মালীদের ফুলের ঝুড়ির খবর আজ নেই, কেন জানি নে। তখন বাড়িতে মেয়েদের খোঁপা থেকে বেলফুলের গোড়ে মালার গন্ধ ছড়িয়ে যেত বাতাসে। গা ধুতে যাবার আগে ঘরের সামনে বসে সমুখে হাত-আয়না রেখে মেয়েরা চুল বাঁধত। বিনুনি-করা চুলের দড়ি দিয়ে খোঁপা তৈরি হতো নানা কারিগরিতে। তাদের পরনে ছিল ফরাসডাঙার কালাপেড়ে শাড়ি, পাক দিয়ে কুঁচকিয়ে তোলা। নাপতিনি আসত, ঝামা দিয়ে পা ঘসে আলতা পরাত। মেয়েমহলে তারাই লাগত খবর-চালাচালির কাজে।”
এ সব কিছুই আমার চোখে এখনও ভাসছে। ‘মালাই-বরফ’, ‘বেলফুল’ কিংবা ‘মাটি-ইই’-র ডাক শুনতে শুনতে কেটেছে আমাদের সেই ছোট্ট গলিখানা। বিকেল হলেই আমাদের বাড়ীর ছোটো টানা বারান্দায় মা-ঠাকুমাদের দেখেছি বিনুনি করে খোঁপা বাঁধতে। গ্রীষ্মকালে এই চুল বাঁধার পর গা-ধুয়ে মা-ঠাকুমা যখন কাচা শাড়ি পরতেন, তখন মা-ঠাকুমাদের গায়ে যেন লেগে থাকতো বিকেলের গন্ধ। নাপতিনি হয়তো রোজ আসতোনা, কিন্তু হপ্তায় একদিন মা-ঠাকুমাদের পায় এক-রকমের লাল তুলো দিয়ে আলতা পরানোর ছবি এখনও মনে আছে আমার।
আজ এই লেখা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে আমি কত ভাগ্যবান! বিশ্বকবির চোখে দেখা সে-দিনের কলকাতার স্মৃতি আমি একটু হলেও চোখে দেখেছি। আজ তা স্বপ্ন!
“আগেকার কালটা ছিল যেন রাজপুত্তুর। মাঝে-মাঝে পালপার্বণে যখন মর্জি হতো আপন এলেকায় করত দান-খয়রাত। এখনকার কাল সদাগরের পুত্তুর, হরেক রকমের ঝকঝকে মাল সাজিয়ে বসেছে সদর রাস্তার চৌমাথায়। বড়ো রাস্তা থেকে খদ্দের আসে, ছোটো রাস্তা থেকেও।”
(ঊপরের সব উদ্ধৃতি)--ছেলেবেলা – রবীন্দ্রনাথ।
সত্যি! বড্ড বেড়ে গেছে খদ্দের!
অবক্ষয় যে তাঁর কাল থেকেই একটু একটু করে শুরু হয়েছে তা বুঝেছিলেন তিনি। অনেকে হয়ত বেশ তেড়েফুঁড়ে বলবেন, - সে আবার কি? অবক্ষয় বলছেন কেন? বলুন প্রগতি—। সত্যি কি তাই? আমি জানি না। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন :
“এখনকার নিয়ম হচ্ছে প্রথমে হারমোনিয়মে সুর লাগিয়ে সা রে গা মা সাধানো, তার পরে হালকা গোছের হিন্দি গান ধরিয়ে দেওয়া। তখন আমাদের পড়াশুনোর যিনি তদারক করতেন তিনি বুঝেছিলেন, ছেলেমানুষি ছেলেদের মনের আপন জিনিস,আর ঐ হালকা বাংলা ভাষা হিন্দি বুলির চেয়ে মনের মধ্যে সহজে জায়গা করে নেয়। তা ছাড়া, এ ছন্দের দিশি তাল বাঁয়া-তবলার বোলের তোয়াক্কা রাখে না। আপনা-আপনি নাড়িতে নাচতে থাকে। শিশুদের মন-ভোলানো প্রথম সাহিত্য শেখানো মায়ের মুখের ছড়া দিয়ে, শিশুদের মন-ভোলানো গান শেখানোর শুরু সেই ছড়ায়—এইটে আমাদের উপর দিয়ে পরখ করানো হয়েছিল।
“তখন হারমোনিয়ম আসে নি এ দেশের গানের জাত মারতে, কাঁধের উপর তম্বুরা তুলে গান অভ্যেস করেছি। কল-টেপা সুরের গোলামি করি নি।
“তখনকার কালের শৌখিন গিন্নিরা রঙ সাফ করবার সরঞ্জাম কৌটোতে করে কিনে আনেন বিলিতি দোকান থেকে, তখন তাঁরা মলম বানাতেন নিজের হাতে। তাতে ছিল বাদাম-বাটা, সর, কমলালেবুর খোসা, আরও কত কী-- যদি জানতুম আর মনে থাকত তবে বেগম-বিলাস নাম দিয়ে ব্যাবসা করলে সন্দেশের দোকানের চেয়ে কম আয় হতো না।
“তখনকার কালের সঙ্গে এখনকার কালের তফাত ঘটেছে এ কথা স্পষ্ট বুঝতে পারি যখন দেখতে পাই আজকাল বাড়ির ছাদে না আছে মানুষের আনাগোনা, না আছে ভূতপ্রেতের। পূর্বেই জানিয়েছি, অত্যন্ত বেশি লেখাপড়ার আবহাওয়ায় টিঁকতেনা পেরে ব্রহ্মদৈত্য দিয়েছে দৌড়। ছাদের কার্নিসে তার আরামে পা রাখবার গুজব উঠে গিয়ে সেখানে এঁঠো আমের আঁঠি নিয়ে কাকেদের চলেছে ছেঁড়াছেঁড়ি। এ দিকে মানুষের বসতি আটক পড়েছে নীচের তলার চারকোনা দেয়ালের প্যাক্বাক্সে।”
এর মধ্যেই বড় হয়ে উঠছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বাংলা ভাষাকে একটা জায়গা দিতে, কি না করেছেন। আর আজ আমরা চাইছি, আমাদের প্রিয় মাতৃভাষা বাংলাকে যত দ্রুত ভুলে যেতে পারি। আজকালকার জগতে টিঁকে থাকতে হলে ‘সাহেব’ হতেই হবে। তাই চতুর্দিকে তারই আয়োজন চলছে। কিন্তু এই ভাবে চলতে পারে কি একটা গোটা জাতি? অবশ্য এই কথা আমি এখনই বা বলি কেন! এই সমস্যা রবীন্দ্রনাথের সময়েও যে ছিল তার প্রমাণ পাই :
“আমাদের বাল্যকালেও দেশের সাহিত্যসমাজ ও দেশের শিক্ষিত সমাজের মাঝখানকার ব্যবধানরেখা অনেকটা স্পষ্ট ছিল। তখনো ইংরেজি রচনা ও ইংরেজি বক্তৃতায় খ্যাতি লাভ করিবার আকাঙ্খা ছাত্রদের মনে সকলের চেয়ে প্রবল ছিল। এমন-কি, যাঁহারা বাংলা সাহিত্যের প্রতি কৃপাদৃষ্টিপাত করিতেন, তাঁহারা ইংরেজি মাচার উপরে চড়িয়া তবে সেটুকু প্রশ্রয় বিতরণ করিতে পারিতেন। সেইজন্য তখনকার দিনে মধুসূদনকে মধুসূদন, হেমচন্দ্রকে হেমচন্দ্র, বঙ্কিমকে বঙ্কিম জানিয়া আমাদের তৃপ্তি ছিল না-- তখন কেহ বা বাংলার মিল্টন, কেহ বা বাংলার বায়রন, কেহ বা বাংলার স্কট বলিয়া পরিচিত ছিলেন-- এমন-কি, বাংলার অভিনেতাকে সম্মানিত করিতে হইলে তাঁহাকে বাংলার গ্যারিক বলিলে আমাদের আশ মিটিত, অথচ গ্যারিকের সহিত কাহারো সাদৃশ্য নির্ণয় আমাদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না, কারণ গ্যারিক যখন নটলীলা সংবরণ করিয়াছিলেন তখন আমাদের দেশের নাট্যাভিনয় যাত্রার দলের মধ্যে জন্মান্তর যাপন করিতেছিল।
“......একদিন গেছে যখন আমাদের শিক্ষিত লোকেরা ইংরেজি পুঁথির প্রত্যেক কথাই বেদবাক্য বলিয়া জ্ঞান করিত। ইংরেজিগ্রস্ততা এতদূর পর্যন্ত সাংঘাতিক হইয়া উঠিয়াছিল যে, ইংরেজি বিধি বিধানের সহিত কোনোপ্রকারে মিলাইতে না পারিয়া জামাইষষ্ঠী ফিরাইয়া দিয়াছে এবং আমোদ করিয়া বান্ধবের গায়ে আবির-লেপনকে চরিত্রের একটা চিরস্থায়ী কলঙ্ক বলিয়া গণ্য করিয়াছে-- এতবড়ো শিক্ষিত-মূর্খতার প্রমাণ আমরা পাইয়াছি।”
বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ এক অভ্যর্থনা সভায় ছাত্রদের সম্ভাষণ করছেন কবি এই বলে :
“পূর্বে এমন দিন ছিল যখন ইংরেজি পাঠশালা হইতে আমাদের একেবারে ছুটি ছিল না। বাড়ি আসিতাম, সেখানেও পাঠশালা পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিয়া আসিত। বন্ধুকেও সম্ভাষণ করিতাম ইংরেজিতে, পিতাকেও পত্র লিখিতাম ইংরেজিতে, প্রাণের কথা বলিতাম ইংরেজি কাব্যে, দেশের লোককে সভায় আহ্বান করিতাম ইংরেজি বক্তৃতায়। আজ যখন সেই পাঠশালা হইতে, একেবারে না হউক, ক্ষণে ক্ষণে ছুটি পাইয়া থাকি তখন সেই ছুটির সময়টাতে আনন্দ করিব কোথায়? মাতার অন্তঃপুরে নহে কি? দিনের পড়া তো শেষ হইল, তার পরে ক্রিকেট খেলাতেও নাহয় রণজিৎ হইয়া উঠিলাম। তার পরে? তার পরে গৃহবাতায়ন হইতে মাতার স্বহস্ত জ্বালিত সন্ধ্যাদীপটি কি চোখে পড়িবে না? যদি পড়ে, তবে কি অবজ্ঞা করিয়া বলিব ‘ওটা মাটির প্রদীপ’? ঐ মাটির প্রদীপের পশ্চাতে কি মাতার গৌরব নাই? যদি মাটির প্রদীপই হয় তো সে দোষ কার? মাতার কক্ষে সোনার প্রদীপ গড়িয়া দিতে কে বাধা দিয়াছে? যেমনই হউক না কেন, মাটিই হউক আর সোনাই হউক, যখন আনন্দের দিন আসিবে তখন ঐখানেই আমাদের উৎসব, আর যখন দুঃখের অন্ধকার ঘনাইয়া আসে তখন রাজপথে দাঁড়াইয়া চোখের জল ফেলা যায় না-- তখন ঐ গৃহ ছাড়া আর গতি নাই।”
একে কি বলবো আমরা ? ভবিষ্যতের রূপরেখা তিনি লিখে গেছেন তাঁর অজস্র বক্তৃতা, বাণী আর লেখার মধ্যে। তিনি জানতেন যে রাজনীতি কোথায় যেতে পারে। আর তাই এই ‘বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ’-এর বক্তৃতার এক জায়গায় তিনি বলছেন :
“আমরা যাহাকে পলিটিক্স্ বলি তাহার মধ্যেও এই ভাবটা দেখিতে পাই। প্রথমে যাহা সানুনয় প্রসাদভিক্ষা ছিল দ্বিতীয় অবস্থাতে তাহার ঝুলি খসে নাই, কিন্তু তাহার বুলি অন্যরকম হইয়া গেছে—ভিক্ষুকতা যতদূর পর্যন্ত উদ্ধত স্পর্ধার আকার ধারণ করিতে পারে তাহা করিয়াছে।” --আত্মশক্তি - ছাত্রদের প্রতি সম্ভাষণ।
আর এই রকম প্রজ্ঞার একজনকে পেয়েও আমরা কি করেছি? জীবিতকালেই ব্যঙ্গ করেছি তাঁকে নিয়ে। সমালোচনায় ভরিয়ে দিয়েছি অজস্র পাতা। অসম্মান করেছি কত বার! আজ সে-সব স্বীকার করা হচ্ছে! সত্য বড় নিষ্ঠুর! আরও কষ্ট হয়, ব্যথা পাই যখন আমার এই বয়সে এসে দেখতে হয়, বিশ্বকবি আর তাঁর বৌঠান কাদম্বরী দেবী-কে নিয়ে রগরগে লেখাযুক্ত বই আজকের বই-পাড়ার বেস্টসেলার! সত্য সেলুকাস, কি বিচিত্র এই দেশ!
“১৯৩৪-৩৫ সালে তরুণ মার্ক্সবাদীদের মধ্যে দেখছি রবীন্দ্রসাহিত্যকে এক নিঃশ্বাসে ফিউডাল বাবুর্জোয়া বলে ধূলিসাৎ করবার চেষ্টা—আরও বাকচাতুর্য্যের সাহায্যে যার জের আজও টেনে চলেছেন নিরুক্ত গোষ্ঠি। রাজনীতির দিক থেকে তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে ছিলাম এতে পীড়িত হতাম খুবই। ক্রমাগতই মনে হতো এদের মুখের বড়াই সত্ত্বেও এরা নিশ্চয়ই লুকিয়ে লুকিয়ে রবীন্দ্রনাথের গান ভালবাসে। আজ যে তারা রবীন্দ্রসাহিত্যের ঐতিহ্যকে শ্রদ্ধা করতে পেরেছে এ আমারই ব্যক্তিগত জয়লাভ। কবিগুরুর শবদেহের পরে অজস্র ফুলের মালার ভীড়ের মধ্যে সংগোপনে অথচ পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তখনকার দিনে রবে-আইনি কম্যুনিষ্ট পার্টির দেওয়া একখানা মালা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। সে মালাটির ব্যঞ্জনা ছিল আমার কাছে গভীর। সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদ যে শৈশবকাল উত্তীর্ণ হয়েছে তারই সাক্ষ্য ছিল সেটী।”–– রবীন্দ্রনাথের উত্তরাধিকার –চিন্মোহন সেহানবীশ– ৪৬ নং একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে।
“...... একথাও মনে রাখা দরকার যে সেদিন কমরেড ভবানী সেনের মত বড়ো মাপের নেতা ঐ বিতর্কে ভ্রান্ত মতের প্রবক্তা হওয়া সত্ত্বেও সেদিনও ঐ মত কমিউনিস্ট শিবিরে সর্ববাদীসম্মত হয়নি, আর অচিরে তিনি নিজেও সে-মত বর্জন করেছিলেন পুরোপুরি।......” – আমরা ও ওরা–চিন্মোহন সেহানবীশ– ৪৬ নং একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন প্রসঙ্গে।
অর্থাৎ পরবর্তী কালে সংশোধিত হলেও রবীন্দ্রনাথ ও আখ্যাত হয়েছিলেন ‘বুর্জোয়া’ বলে। জীবিতকালেই কবি বারংবার আক্রান্ত হয়েছেন বিচিত্র সব সমালোচনায়! এই প্রসঙ্গে আমি শ্রী তিতাশ চৌধুরী’র একটি ওয়েব-প্রকাশিত “রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ”– নামক প্রবন্ধ থেকে আরো কিছু উদাহরণ দেবার চেষ্টা করছি।
“ ‘সোনার তরী’ কবিতা এবং কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সেই সময় কবিকে কিরূপ সহ্য করতে হয়েছিল তা জানা যায় প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটি লেখা থেকে। এই একটি কবিতা নিয়ে বাংলা সাময়িক সাহিত্যে যে পরিমাণ অমৃত ও গরল মথিত হয়ে উঠেছিল, তা বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের কোনো একটি রচনা সম্বদ্ধে কী পূর্বে কী পরে কখনো হয়নি। আসলে কবিতা উপলক্ষমাত্র, কবিই আক্রমণের লক্ষ্য। তার কারণ, রবীন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভার বৈশিষ্ট্য দেশের শিক্ষিত সমাজের বড়ো একটা অংশ স্বীকার করে নিচ্ছিল বলেই, আরেক দলের সেটাকে হেয় প্রমাণ করবার একান্ত প্রয়োজন হয়েছিল।”
বাঙলা ভাষার আর এক বিখ্যাত সাহিত্যিক এবং বিখ্যাত নাট্যকার ডি. এল রায় অর্থাৎ দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রবীন্দ্রনাথের ইংল্যান্ড যাওয়াকে কেন্দ্র করে ‘আনন্দ-বিদায়’ শীর্ষক একটি ব্যঙ্গ-নাটক রচনা করেছিলেন এবং তাতে তিনি কি রূপ বিষোদ্গার করেছিলেন তা বোঝা যায় “একাধারে কবি, অধিকারী ঋষি কিবা ত্যাগ কিবা দান, পরিষদ জল ছিটায়ে দিলেই (কবিবর) স্বর্গে উঠিয়া যান”, ইত্যাদি বলে। এছাড়াও তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘বিজয়িনী’ ও ‘উব্বর্শী’র বিরুদ্ধেও অশ্লীলতার অভিযোগ খাড়া করেছিলেন। সাহিত্য পত্রিকার ১৩১৩ সালের জৈষ্ঠ্য সংখ্যার রবীন্দ্রনাথের কাব্য নাট্য ‘চিত্রাঙ্গদা’র বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ এনে তিনি একে দগ্ধ করারও পরামর্শ দিয়েছিলেন।
তদানীন্তন ‘হিতবাদী’ পত্রিকার তরুণ সম্পাদক কালী প্রসন্ন কাব্য বিশারদ। রবীন্দ্রনাথের ‘কড়ি ও কোমল’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরই কালী প্রসন্ন ‘রবিরাহু’ ছদ্মনামে একটি প্যারডি রচনা করেন এইভাবে – “ইহা কড়িও নহে কোমলও নহে পুরো মুরে ‘মিঠেকড়া’...” শুধু তাই নয়, তিনি রবিঠাকুরকে ‘পায়রা কবি’ বলেও ব্যঙ্গ করেন। যেমন:
উড়িস নে রে পায়রা কবি
খোপের ভিতর থাক ঢাকা।
তোর বকবকম আর ফোঁসফোঁসানি
তাও কবিত্বের ভাবমাথা।
তাও ছাপালি গ্রন্থ হলো,
নগদ মূল্য এক টাকা।
সম্ভবত রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে’ সবচেয়ে বিতর্কিত উপন্যাস। ‘সবুজপত্রে’ মাসিক কিস্তিতে প্রকাশিত হবার সময়ই ঝড় উঠতে শুরু হয় বিমলার আচরণ নিয়ে। বিশেষত সন্দীপের মুখে সীতা ও রাবণের বিরোধের প্রসঙ্গ ঝড় তুলেছিল। কবি বঙ্কিম মিত্র ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে পদ্যে এক অভিযোগ খাড়া করেন। ১৩২৬ সালের ‘অর্চনা’ পত্রিকার ফাল্গুন সংখ্যার বঙ্কিম মিত্র লিখেন দীর্ঘ একপদ্য। এর দু’একটি স্তবক এরকম:
এ মহাপাতকে হিন্দু। তব পুণ্য গেহ
করিওনা কলঙ্কিত; আর্যরক্ত দেহ
ধরে যদি একবিন্দু একটি শিরায়
যদি শুদ্ধ শুচিতার একটি রেখায়
শুভ্র থাকে ও চিত্তের এক তিলস্থান,
এ-কলুষ হতে দূর করো অবস্থান:...
কিন্তু যেই লেখনীর লজ্জা লেশহীন
বর্বর যথেচ্ছাচার সেই অমলিন
শুদ্ধ শুচি সতীত্বের তেজে জ্যোতির্ময়
সীতা চিত্ত কল্পিয়াছে পাপিষ্ঠ আশায়
তার হাতে আর্যনারী ‘বিমলার’ প্রায়
যথেচ্ছাচারিণী হবে কি আশ্চর্য তায়? ...ইত্যাদি।
এ সম্পর্কে চিত্রাদেব লেখেন (অনালোচিত রবীন্দ্র প্রসঙ্গ) : ‘জীবনে বহুবার তিনি (রবীন্দ্রনাথ) সমালোচনার কাঠগড়ায় আসামীরূপে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্কিম মিত্রের কবিতা তাঁর মনে একটি মাত্র তিক্ত স্মৃতি বয়ে নিয়ে এসেছিল’। ১৩১১ শ্রাবণের ‘ভারতী’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের একটি গান প্রকাশিত হয়। এর চার পংক্তি উদ্বৃত করে ১৩১১’র ভাদ্রের সাহিত্য পত্রিকার মাসিক সাহিত্য সমালোচনা’ বিভাগে বলা হয় যে, ‘গানটি সম্পূর্ণ অর্থহীন’। তারপর মন্তব্য করা হয় :
‘রবীন্দ্রবাবু অনেক লিখিয়াছেন, অনেক ছাপিয়াছেন, অনেক গাহিয়াছেন- এখনও যে তিনি যা-তা ছাপাইবার লোভ সংবরণ করিতে পারেন না, ইহা আমাদের বিচিত্র বলিয়া বোধ হয়। নাবালক কবি সুলভ কবিত্ব-কৃতি লব্ধ প্রতিষ্ঠা কবির পক্ষে নিতান্ত অশোভন- সে দৃষ্টান্ত সাহিত্যের পক্ষে নিতান্ত অপকারী, রবীন্দ্রবাবুর ন্যায় প্রতিভাশালী লেখকই যদি তাহা না বুঝিতে পারে, তাহা হইলে আমরা নাচার।’...
শুধু তাই নয়, শ্রী অরবিন্দ, যদুনাথ, প্রমুখ রবীন্দ্রবিবোধী দলে যোগ দিয়েছিলেন। বিপিনচন্দ্র পালের মতন প্রখ্যাত জাতিয়তাবাদী নেতা প্রকাশ্যে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন-রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে। বলতেই হয়, রবীন্দ্রনাথের ভাগ্যে তার দেশের কাছ থেকে জুটেছে অবিরত অপমান, অবিশ্রান্ত নিন্দা, অকারণ কটুক্তি এবং প্রায় ক্ষেত্রেই তার প্রীতিভাজন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এতে সোৎসাহে ইন্ধন জুগিয়েছেন। অবশ্যি এ ক্ষেত্রে বিদেশীরাও কম যাননি। ইয়েটস এবরা পাউন্ড প্রমুখ জীবনবাদী শিল্পীরাও এক সময় রবীন্দ্র বিরোধিতায় নেমেছিলেন। (বিশেষ করে ইংরেজ কবি ইয়েটস) ইয়েটস (১৮৬৫-১৯৩৯) গীতাঞ্জলির একটি চমৎকার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। নিতান্ত এক ভারতীয় কবির ‘মুরব্বী’ ভাব প্রকাশের ইচ্ছায়। সেই ভারতীয় কবি যখন নোবেল পুরস্কার পেয়ে গেলেন, তখন তাঁর উপর মুরব্বী খানা ফলানোর সুযোগ ফসকে গেল। শুধু তাই নয়, তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন আরও দশ বছর পর। কাজেই খুব স্বাভাবিক কারণেই এক অসহ্য ঈর্ষার জ্বালায় তিনি রবীন্দ্রবিরোধী শিবিরে ঢুকে পড়েছিলেন।
ঐতিহাসিক নলিনীকান্ত ভট্টশালীর ‘ঢাকায় রবীন্দ্রনাথ’ স্মৃতিকথা পাঠে জানা যায় যে, ‘মেয়েলি কবিতার লেখক বলিয়া রবীন্দ্রনাথের কবিতা তখন বিশেষ সমাদর লাভ করিত না’। তিনি লিখেছেন, ‘দলে মিলিয়া আমিও রবীন্দ্রনিন্দুক সম্প্রদায়েরই একজন হইয়া দাঁড়াইয়াছিলাম। আমরা অনেকেই তখন রবীন্দ্র কাব্যের প্রায় কিছুই পাঠ করি নাই; তথাপি রবীন্দ্র কাব্যের নিন্দা করা তখন এক শ্রেণীর লোকের ফ্যাশন হইয়া দাঁড়াইয়াছিল’। (শনিবারের চিঠি, আশ্বিন, ১৩৪৮)
এর মধ্যেই কবি আপনমনে সৃষ্টি করে চলেছেন কবিতা, গান, গীতিকাব্য, নৃত্যনাট্য, ছোটোগল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রহসন, হাস্যকৌতুক, ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন প্রবন্ধ তো আছেই। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবলে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। একদিকে নানান পারিবারিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত কবি আর অন্যদিকে চলেছে নিত্য সৃষ্টির অঙ্কুর। স্ত্রী, সন্তান বিয়োগেও তিনি অবিচল। এমন একজন মানুষকে কি বলা যায় বলুন তো? স্বপ্নের বিশ্বভারতী গড়ে উঠছে তারই মধ্যে। প্রাচীন আশ্রম-ধারণাকে কেন্দ্র করে ডেকে ডেকে নিয়ে আসছেন বিভিন্ন রকম গুণী মানুষজনকে। তাঁদের নিয়ে চলছে এক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরীর কাজকর্ম। নিঃশব্দে, নীরবে। এই ভাবেই আমার রবীন্দ্রনাথ বোঝার শুরু।
এই আমার অনুভবের রবীন্দ্রনাথ। ‘আমার সাধের সাধনা, মম শূন্য গগনবিহারী।
তোমার কাব্যের বীজ পাথরে পড়িয়া যদি
ফুলে-ফলে না হয় সফল
পড়িতে পথের ‘পরে পথিক দলিয়া যায়
খেয়ে যায় খঁটে-খাওয়া পাখী।
হাজার আগাছা সাথে মহামূল্য কোন চারা
দূর করে ফেলে দেয় কেহ—
সে দোষ তাদের যারা দাঁড়ায়ে মাটির ’পরে
মাটিরেই দিতে চায় ফাঁকি।
দুবেলা তাদের সাথে দু’মূঠো অন্নের লাগি’
আমাদের অশ্লীল সংগ্রাম,
কদর্য কলহে মাতি অন্ধকারে হাতাহাতি,
দীর্ঘ দেহ ছিন্ন বহির্বাস।
তোমার কায়ারে তাই ছায়া ভেবে হেসে ওঠে,
তোমার সুধারে বলি সুরা ;
জ্বরের বিকার ঘোরে তোমারে চিনিতে নারি
গালি দেই করি উপহাস।
...... রবীন্দ্রনাথ – সরোজ দত্ত
আর ক’দিন পরেই বিশ্বকবির মৃত্যুদিন। ২২শে শ্রাবণ। আসুন, স্মরণে-মননে যদি একটুও শ্রদ্ধা জানাতে পারি তাঁর প্রতি। তাহলে হয়তো আমরা একটু সার্থক হবো তাঁর চিন্তাধারায়!
শেষ করছি কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবিতা ‘২২শে শ্রাবণ ১৩৪৮’ দিয়ে :
“মেঘ চাপা পূর্ণিমা, / আর সারি সারিমুখঢাকারুদ্যমান আলোয় / শহরের নিষ্প্রদীপ রাত শ্রাবণ-সমাচ্ছন্ন। / আলো নিবল, / রাত কাটল, / পূর্ণিমা ছাড়ল, / কিন্তু প্রভাতের কপালে / আজ আর সূর্য উঠল না। / এমন দিনেই, / এমনি শ্রাবণঘন গহন মোহে,-- / কাননভূমি যখন কূজনহীন, / সকল ঘরে যখন দুয়ার দেওয়া,-- / একেলা পথিক গোপন তার চরণ ফেলে / নিশার মত নীরবে পথ চলে। / শহরে তা অশোভন, / শহরে তা অসম্ভব। / পথিকের বাঁধা পথ আরও বেঁধে দেওয়া হয়েছে-- / কলুটোলা স্ট্রীট, কলেজ স্ট্রীট, / কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট হয়ে / পথিক যাবে। / তারই একটা মোড়ে-- / সহস্র নিরুপায়ের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ভিজছি। / দূর হতে কানে আসছে-- / বিপুল পরাজয়ের তুমুল জয়ধ্বনি! / সহসা দেখা গেল-- / মরণের কুসুম কেতন জয়রথ! / মনে হলো-- / কি বিচিত্র শোভা তোমার-- / কি বিচিত্র সাজ! ............”