Next
Previous
Showing posts with label বইঘর. Show all posts
3

বইঘর - যশোধরা রায়চৌধুরী

Posted in







এই ভূগোল বস্তুত অনেক বেশি বিস্তৃত

যশোধরা রায়চৌধুরী






একটি নদী অনেক মানুষ - সতেরো গল্প
মৃদুল কান্তি দে
ঋতবাক প্রকাশনা
মূল্য ৪০০


২০০৯ -১১ , তিনটি বছর আমি গৌহাটিতে বসবাস করতাম। সরকারি চাকরির সূত্রে। সেখানে গিয়ে জানলাম গুয়াহাটি বলতে হয়। জানলাম সেখানে দুটি গ্রীষ্মকাল। বর্ষার অব্যবহিত পরে আগস্ট সেপ্টেম্বর তীক্ষ্ণ ও ঘর্মাক্ত এক গ্রীষ্ম পড়ে। জানলাম ভিজে ভিজে শীত সেখানে, জানলাম বাত দাঁত এই দুই সমস্যায় সে অঞ্চলে সবাই জর্জরিত। গুয়াহাটি আর ব্রহ্মপুত্র একাঙ্গী। অঙ্গাঙ্গী জড়িত । আমার আশৈশবের শোনা "ও গঙ্গা তুমি বইছ কেন" গানটির মূলে পল রোবসনের "ওল ম্যান রিভার" আছে তা যেমন জানতাম, অহমিয়া গান "বড়া লুইত তুমি বড়া লুইত বোবা কিয়োঁ"র কথাও জানতাম। ব্রহ্মপুত্রকে নিয়ে রচিত, ভূপেন হাজরিকার কন্ঠে সে গানটি বহুবার শোনার পর, একদিন সত্যিই অসমে গিয়ে দাঁড়ালাম ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। সত্যি সত্যিই ব্রহ্মপুত্রের সুবিশাল সুগভীর ঘোলা জলের কূল তল হীন গাম্ভীর্যের সামনে মনে হয়েছিল গানটির এই বড়া লুইত ভার্শনটিই যেন বেশি সুপ্রযুক্ত। দু কূল প্লাবী, বন্যাদায়ী, ব্রহ্মপুত্র শুধু নদ নয়, ভৈরব মূর্তি আছে তার।

এই সময়েই আমার আলাপ হয় শ্রী মৃদুল দে-র সঙ্গে। তিনি রেল অডিটের কর্মী ছিলেন। মৃদুলের গল্প পড়ার অভিজ্ঞতা সে সময় থেকেই, এবং রীতিমতো চমক দেওয়া নানা লেখা তাঁর।

এইবার হাতে এল তাঁর এক পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ। "একটি নদী অনেক মানুষ", সতেরো গল্প। এই বইয়ের প্রচ্ছদে ব্রহ্মপুত্রের শতজল ঝর্ণার ধ্বনি শোনা যায়। এবং লেখা থাকে, "ব্রহ্মপুত্র জেগে থাকে আঁতুড় ঘরে মা। নানা জাতি নানা ভাষার তুমি বন্দনা"।

শুরুতেই মালুম, এই বই একটি ব্রহ্মপুত্র নদকে ঘিরে ঘিরে বুনে তোলা গল্পের ভান্ডার। এ গ্রন্থের কনটেন্ট ঠিক কী তা বলতে গেলে দুভাবে বলা যায়। এক, গল্পসংগ্রহ । দুই, ফিক্স আপ নভেল। আসলে বিদেশের রে ব্রাডবেরি আদি বহু লেখক, লিখেছেন ফিক্স আপ নভেল। উপন্যাসোপম গল্পসংগ্রহ। যেখানে একেকটি গল্প নিটোল হয়েও, একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে আছে।

লেখক সূচনা কথায় লিখেছেন ঃ

"গল্প লেখার পটভূমি স্বভাবত সজীবতার আত্মপ্রকাশে নিজের নৈপুণ্যে বিচিত্রগামী। এই অনুভূতি মনের ভাবনায় উত্তর- পূর্বের অনন্য সাধারণ মানুষের ভালোবাসার স্পর্শে সচল অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে, যা চোখে দেখা সীমানার মধ্যে কেবল আটকে থাকে না, হৃদয়বৃত্ত ছুঁয়ে রাখে শাশ্বত সুর-ধ্বনির মতো। এটাই আত্মসন্ধানের পরম্পরা। উপলব্ধির এই প্রবাহে বহুমান ব্ৰহ্মপুত্র নদ আমাকে নব নব ঐশ্বর্য দিয়েছে সৃষ্টির উপাদান পেতে। সেখানে কোনো প্রাচীর নেই, দেখতে শেখায় প্রকৃতির গাছপালার ডাল একইরকমভাবে আলোছায়ার একই দিকে শুধু ছড়ায় না। নানা দিকেই তার শাখা প্রশাখা।

এই সংকলনে সতেরোটি গল্প। লেখার সময়কাল ১৯৯৫ থেকে ২০২১। এই বিস্তৃত সময় পর্বে লেখালেখির সংসার থেকে নির্বাচন করে নিলাম সেই সব গল্প যার ভরকেন্দ্র ব্রহ্মপুত্র নদের জনপদ। এবং শাখা প্রশাখায় উপস্থিত এপার- ওপার বাংলা। তবে সামাজিক-রাজনৈতিক দেশপ্রসিদ্ধ পরিসর এমনই, এই ভরকেন্দ্র সঞ্চরণশীল হয়েই যায় এবং ক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে যে-কোনো নদ-নদীর অববাহিকা মনোনীত স্থান ও লোকালয়ের ঘরে বাইরে।"

একের পর এক গল্প। সবকটির প্রেক্ষিত ব্রহ্মপুত্রপাড়, গুয়াহাটি বা তার আশেপাশের অঞ্চল। সময় যানে চেপে কখনো আশির দশক কখনো নব্বইয়ের দশকে যাতায়াত। এই গোটা চলাচল অত্যন্ত স্বচ্ছলভাবে করেন ঝরঝরে এক গদ্য ভঙ্গিতে মৃদুল দে। বোঝা যায় বাংলা কথাকারদের মধ্যে অন্যতম তিনি, যাঁর কলমে সময় সমাজ ফুটে ওঠে অতি সহজে, ছোট ছোট বাক্যে, অতীত বর্তমানের চলাচল হয় অবলীলায়।

মৃদুলের কলমে আছে মানবিকতা, জীবন বোধ, রাজনীতি সচেতনতা, সময় সচেতনতা। বলা হচ্ছে গুয়াহাটিকে ভূগোল করে। অন্তঃসারে আছে রাজনীতি সাম্প্রদায়িকতা হানাহানি অনিশ্চিতি, আর অনেক খেটে খাওয়া মানুষ। অঞ্চলের সারাৎসার না জানলে লেখা যায়না এভাবে ধুলোর গন্ধ আর হাই ওয়ের কথা।

চরিত্রগুলি বাস্তব, অতিবাস্তব, কখনো বা পরাবাস্তবের ধার ঘেঁষে যায়। যেমন তুহিন, যে আশির দশকে বুট পালিশ করেছে। ছাত্র আন্দোলন করেছে। বুটপালিসের টাকা ছাত্র সংগ্রাম তহবিলে জমা দিয়েছে। তাকে নিয়ে গল্প বুটপালিশ একদিন প্রতিদিন। বার বার কাব্যিক মোচড়ে ঘুরে এসেছে একটি কথা। নানা আকারে উৎকন্ঠা ফণা তুলে আছে।

প্রতি গল্পে মৃদুল এঁকে রেখে যাচ্ছেন নিরাপত্তাহীনতা। সমকালীন চোরা ঠান্ডা ভয়ের স্রোত। পূর্বের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের চেয়ে আলাদা। কিন্তু তবু উৎকন্ঠাগুলো সত্য। ঝাঁ চকচকে অফিস বা এরোপ্লেন আছে। তথাপি ভয়ের চোরা স্রোত। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে লিখেছেন মৃদুল এই গল্পগুলি । স্পষ্ট বোঝা যায়।

"অমরেন্দ্র একবার বলেছিলো, গণতান্ত্রিক দেশে কারিয়াপ্পার প্রভুত্ব বা শাসন কাম্য নয়। নরেন্দ্রনাথ তখনই চেপে ধরেছিলো ভাগ্নেকে, তুই গণতান্ত্রিক মহকুমাধিপতিকে ধরে কয়েনের বস্তা ফিরিয়ে দিস আমাকে! ক’বস্তা চুরি হয়েছে জানিস! চোর ডাকাতদের বাড়বাড়ন্ত, আর তুই নাকে তেল দিয়ে সুশ্রাব্য কথা বলে যাচ্ছিস।

পাঁচ মিনিট হাঁটলে হাইওয়ে। এই দিকে যাও, গুয়াহাটি। ওই দিকে, তেজপুর। আর কী চাই! ধান ভাঙার কল যন্ত্রনির্ভর শব্দের উৎস। এই শব্দ রামায়ণের মতো মিশে আছে মাংস-মজ্জায়। হৃৎপিণ্ডের শব্দ এখন ধানকলের শব্দপুঞ্জের একটি শাখা বটে।

ভালো লাগে রান্নাঘরের দীর্ঘ করিডোরে রাখা বেঞ্চে বসে, সুবিস্তৃত উঠোনের মুখোমুখি, গরম ভাত আর নানা সবজি বিভূষিত গরম ডাল খেতে। রুদ্র ধানকলের পাশ দিয়ে রাস্তা ধরে চলে এল মফস্বলের একমাত্র সিনেমা হলের কাছে। পাশে একটি ছোটো মাঠ। সেখানে মাইক, চোঙা, কয়েকটি চেয়ার আর কয়েক জন যুবক। বেলা তখন এগারোটা। খানিকটা গেলে হাইওয়ে, দোকানপাট।"

চলনে শৈল্পিক কাব্যিক। কথাসাহিত্যের এই ঢং বড় পছন্দের।

ক্ষেত্রহরির ক্ষেত্রভূমি। গল্পটি বিদেশি ভগনিয়া মানে শরণার্থীর । মা বাবার কাগজ না থাকা নিয়ে গল্প। এন আর সি -র কথা সোচ্চারে বলা নেই শুরুতে। গল্পের ভেতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। হালকা ঢঙে। নিরাপত্তাহীনতার গল্প শুরু হয় মুরগি নিয়ে বাসে ওঠার খন্ডচিত্র দিয়ে, মুরগির বাসভাড়া হাফটিকেট না ফুল টিকেট তাই দিয়ে। তারপর গল্পটা এসে পড়ে দুরন্ত এক সন্ত্রাসের ভেতর। আপাদমস্তক শোষিত মানুষের বিষয়ে।

বরং বলা যায়, বাধ্য হত। বাঁশের মাচান পায়ের আঙুলে চেপে উপরে উঠতে হত। এক তলা, দুই তলা, তিন তলা। খুব কষ্ট হত নারা শরীরে। ক্ষিধে জর্জর মনে।

একপাশে মহাবাহু ব্রহ্মপুত্র, অপার তার বিস্তার। একপাশে স্তব্ধ সারবদ্ধ গাড়ির জট। বাঁচার তাগিদে ক্ষেত্রহরির হঠাৎ মনে হলো, নির্বাক সহস্র ইঞ্জিন গর্জন করে উঠুক এক্ষুনি। এই শ্রমজীবী মানুষ স্বেচ্ছাচারিতার দাস নয়। ভয়শূন্য স্বাধীন চিত্তে ও শ্বাস নিক। অথবা বহমান ব্ৰহ্মপুত্র তেজস্বী ঢেউয়ের কলরবে বলে উঠুক, এই শ্রমিক এই ভূখণ্ডে এসেছে সত্তরের কুড়ি ফেব্রুয়ারি। তারপর গা-গতরে খেটে কত নির্মাণ শিল্পে বা উৎপাদন বলয়ে অহর্নিশ কাজ করেছে। খাঁচায় আটকে রেখো না ওকে। মুক্ত স্কুল বালকের মতো ও গাছতলার ছায়ায় বিশ্রাম চায়।

ঠা ঠা রোদ্দুরে ক্ষেত্রহরি হাঁটছে। কোথায় যাবে, সে জানে না। তাকে নজরবন্দি অবস্থায় নিয়ে যাচ্ছে দুই অচেনা যুবক। ধরণীর নির্দেশ, সস্তায় শ্রম দিতে হবে। মাথায় ষোলো বা কুড়িখানা ইট তুলে বহুতল দালানে কাজ। তবু কি রেহাই আছে! রাজনৈতিক পরিস্থিতির গঠন কৌশল এমন যে ক্ষেত্রহরিকে অস্তিত্বহীন করা কিছুই না।

এরপর চলচ্চিত্রের মত একটা ঘটনাপ্রবাহ, হাতে প্রাণ রেখে মানুষের পলায়নের বর্ণনা। দ্রুতগামী শটে শটে ।

যানজট আকার নিয়েছে এমন। আগুন আগুন। লেলিহান শিখা ট্রাক বাস মোটর গাড়ির ছাদ টপকে এগিয়ে আসছে। নিশ্চল গাড়িগুলো থেকে প্রাণ বাঁচাতে ঝটপট দরজা খুলে নেমে পড়লে লোকজন। চরম বিশৃঙ্খলার অন্তর্গত ধোঁয়াধূসর সে ওই যুবকদের থেকে বিচ্ছিন্ন।

একাকী ক্ষেত্রহরি পলাতক, এসে পৌঁছায় একটি বাড়িতে। আশ্রয় পায়।

পুত্রবধূ জানতে চাইলেন, ‘দেউতা, আপনি কি ওকে চেনেন? ‘ভালো করে চিনি। ক্ষেত্রহরি। বিল্ডিং-এর লেবার। বঙালি মানুহ ।

এইবার সমস্যা খোলসা করে বলা হল। তারপরও কোন পরিত্রাণ পেল না ক্ষেত্র হরি । তাকে এই সমৃদ্ধ মানুষটি নিজের খামারের কাজে পাঠিয়ে দিলেন, বন্দীসম! ঘেটো থেকে আরেক ঘেটোতে চলে যায় ক্ষেত্রহরি।

মৃদুল দের কলমে সুর আছে গান আছে ছবি আছে। আছে দীর্ঘকাল অসমে থাকার , অসমের সংস্কৃতি জগতকে কাছের থেকে দেখার প্রমাণ। অজস্র সুন্দর মানুষ, শিল্পী তাঁর গল্পে আনাগোণা করে। তবু একেবারে সাধারণ মানুষের অনিরাপত্তা পাশাপাশি তিনি লিপিবদ্ধ করেই চলেন।

যেমন ঠোক্কর গল্পের নকুল মন্ডল। যাকে পরিত্রাণ করে এক রহস্যময় পুরুষ। নকুলের সঙ্গে তার অহি নকুল সম্পর্ক হবার কথা। কিন্তু মানবিকতার কারণে সে পুরনো কৃতজ্ঞতা ভোলেনি।

অথবা দেওয়াল গল্পে বাস স্ট্যান্ড যার জমি গ্রাস করে নেবে সেই ভীত ধনেশ্বর থেকে ফুলেফেঁপে ওঠা ব্যবসায়ীতে পরিণত ধনেশ্বর। উল্টোদিকে নিতুল। যার কিছু না থাকলেও আত্মমর্যাদা আছে। শোষককে ভয় পায় না যে।

গল্পে গল্পে বাস্তবকে পরাবাস্তবের দিকে হাত ধরে এগিয়ে দিয়েছেন মৃদুল। একটি গল্পে ( পোশাক) ধাবমান নগ্ন মেয়েকে পাঞ্জাবি খুলে দেওয়া যোগব্রতর ছবি ভাইরাল হয়ে যাওয়া। সংবাদ পত্রে পত্রে ছড়িয়ে যাওয়া একটি নগ্ন মেয়ের ছুটে যাওয়ার কাহিনি , তাকে বাঁচাতে চেয়ে পাঞ্জাবি খুলে দেওয়া ... এই কাহিনির মূলে আছে সত্যি ঘটনা... আমার নিজ চোখে দেখা সেই ফুটেজ। সেই জায়গা থেকে মৃদুল বুনলেন গল্প। এনে দিলেন ভিয়েতনামে মার্কিন বোমার তান্ডবে পোশাক পুড়ে যাওয়া উলঙ্গ মেয়ের ছুটের কথা। সেই ছবিও লাইফ ম্যাগাজিনের পাতায় ষাটের দশকের শেষে আমরা দেখেছিলাম... জুড়ে গেল আন্তর্জাতিক বৃত্ত। ধ্বংস আর সন্ত্রাসের।

এই বইয়ের গল্প পড়ার পাঠক সেই সমাজ ও রাজনীতি সচেতন, ভাষামুখী পাঠক। এ বই একটা তীক্ষ্ণ শলাকার মত। ফিলগুডের পরত ছিঁড়ে ছিঁড়ে, লাতিন আমেরিকার ছায়াছবির মত আমাদের ছন্নছাড়া, নষ্ট সময়কে দেখায়। ভূগোল হতে পারে ব্রহ্মপুত্র। কিন্তু এ কাহিনি কি গঙ্গা যমুনা অথবা নর্মদার অববাহিকা থেকে আদৌ আলাদা? একেবারেই নয়।

কাব্যিক ভাষার এই বইটির ছাপাই বাঁধাই কাগজের মান, মুদ্রণের মান সবই অতি উৎকৃষ্ট। তবে প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ফন্ট একটু পুরনো বলে মনে হয়েছে।
0

বইঘর, - পল্লববরন পাল

Posted in


নদী ও দেবদূত
মূল জার্মান কবি - কাটরিন শ্মিট
বাংলা অনুবাদ - সুলগ্না মুখোপাধ্যায়
গ্রন্থ পর্যালোচনা - পল্লববরন পাল



কবির নাম কাটরিন শ্মিট। জন্ম ১২ মার্চ জার্মানীর এরফুর্ট অঞ্চলের গোঠায় ১৯৫৮ সালে – জেনেই মনটা আনন্দে ভরে উঠলো, কারণ আমারই সমবয়সী এক জার্মান কবির কবিতা পড়ার সৌভাগ্য হলো। কাটরিন মনোবিজ্ঞানে স্নাতক। বইয়ের নাম ‘নদী ও দেবদূত’। তেত্রিশটি কবিতার বাঙলা অনুবাদ করেছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের কৃতী ছাত্রী স্বনামধন্যা সুলগ্না মুখোপাধ্যায়। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা। প্রথম প্রকাশ ২০২০।

সুলগ্নাকৃত এই কবির কিছু কবিতার অনুবাদ বিচ্ছিন্নভাবে আমি এর আগে পড়েছি। যদিও টুকরো টুকরো অনুভুতির মধ্যেই থাকে অখণ্ড সম্পূর্ণতার প্রতিশ্রুতি, বিশ্বাস করুন ‘নদী ও দেবদূত’ পড়ার আগে আমি তার একটুও আভাস পাইনি। এ নিতান্তই আমার দৈন্যতা। কবির নিজের বয়ানে – ‘আমার শব্দের দ্বৈতার্থ আমি যেন দূরবীন দিয়ে দেখি আর পর্যবেক্ষণ করি, কেমন করে দুটি শব্দের মিলনে তৃতীয় শব্দটি তৈরি হয়, যার আসলে কোনো অস্তিত্বই নেই। একটি ভাষায় সৃষ্ট নতুন শব্দটির সমশব্দ অন্য ভাষায় ব্যক্ত করা, একটি দুঃসাধ্য কাজ’। একজন মগ্ন অনুবাদকের আসল কৃতিত্ব অমূর্ত অধ্যাহৃত ওই তৃতীয় শব্দটি আবিষ্কারে, যা সুক্ষ্ম শিরার মতো কবিতার আস্ত শরীরকে বোধের গভীর বুননে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধে আর পাঠকের চেতনায় নকশীকাঁথার বিচিত্র আলপনা ফুটিয়ে তোলে। কাজেই শুধু ভাষা জানলেই অনুবাদ হয় না, সেই তৃতীয় শব্দের আবিষ্কারে দেশ সমাজ সময় ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে গুলে খেতে হয়, তবেই সঠিকভাবে আত্মস্থ করা যায় অন্য ভাষার কবিতা।

দ্বিধাহীন বলি, ‘নদী ও দেবদূত’ পড়তে পড়তে কিছু জার্মান নাম যার অনুবাদ হয় না, বাদ দিলে কোথাও একবারের জন্যও মনে হয় না, এটা কোনো বিদেশী কবির কবিতা পড়ছি – এমনই অনায়াস স্পর্ধায় প্রিয় বান্ধবীকে বাঙলাসাহিত্যের পাঠকদের সঙ্গে পরিচয় করালেন সুলগ্না। 

শহরের পিছন দিকটা নোংরা
বাকি অংশটা তুমি ভাঁজ করে তোমার বুক পকেটে ভরে নিতে পার
মৃত ছোট নদীটা যার অনেক আগেই দেওয়া একটি প্রতিশ্রুতিকে মনে করিয়ে দেয়
সে-ও বয়ে চলে মৃত সৈনিকদের থেকেও দ্রুতবেগে 
তোমার হৃদয়কে সামান্য নাড়িয়ে যায়
তুমি বিশ্বাস করতে পার আবার না-ও ... [ছেড়ে যাওয়া]

বইয়ের প্রথম কবিতা। এগারো পংক্তির এই কবিতায় একমাত্র সপ্তম পংক্তির শেষে একটি যতিচিহ্ন – আর কোথাও কোনো পাঁচিল নেই, সম্পুর্ণ মুক্ত স্বাধীন বেপরোয়া ভঙ্গী দিয়ে গোটা বইয়ের চরিত্রটি বেঁধে দিলেন কবি কাটরিন - ‘নদী ও দেবদূত’ শিরোনামের নদীর সাথে পাঠকের পরিচয় করালেন - মৃত সৈনিকদের শবদেহবাহী যে নদী তার ফেলে আসা জমিকে উর্বর করে মানুষকে শস্য-ফসল উপহার দেয়, তোমার বিশ্বাসের তোয়াক্কা না করেই। এই ‘তুমি’ কে? সে কি পাঠক, প্রিয় বোন, বান্ধবী সিলভিয়া, নাকি তাঁর দেশ অবিভক্ত জার্মানী? নাকি আরো বড়ো মাপে আমাদের বিদগ্ধ সভ্যতার ইতিহাস? 

দ্বিতীয় কবিতায় চিত্রকল্পের বাহুল্য পাঠককে কোথাও কোথাও কুয়াশায় আচ্ছন্ন করবে কিন্তু তার মাঝখানেই সহসা বিদ্যুৎ ঝলকের মতো কিছু উচ্চারণ – 

‘আমার লেটারহেডটা যন্ত্রণা দিচ্ছে...’, ‘নিষেধাজ্ঞা আসে আর নিষেধাজ্ঞা যায়/ তার মাঝামাঝি কিছুই নেই...’, ‘এখন দেশের সীমান্তে অপেক্ষারত আরও একটি আঘাত আর ভিক্ষে...’, 

দুই জার্মানীর মিলন সংক্রান্ত রাজনৈতিক অভিমানচিত্রের পটভূমিকায় সেই সময়ের জার্মান সাহিত্যের প্রসঙ্গে কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এই বইয়ের ভূমিকায় লিখছেন – ‘ক্রিস্টা হ্বোলফ কিংবা হ্বোলফ বীয়ারমান পুব-পশ্চিমের বিভাজন কবুল করে নিয়েও শেষ পর্যন্ত অবিভাজ্য একটি নিখিল প্রাণসত্তার অভিমুখেই আমাদের চ্যালেঞ্জসঞ্চারী একটি আমন্ত্রণ জ্ঞাপন করেছেন... এই লেখিকার অন্যতম থীম ব্যবধানসূচক প্রাচীরের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি যাকে অনায়াসে ভেঙেচুরে দেওয়া একরকম অসম্ভব। একটু তলিয়ে দেখলে অবশ্যই আমরা ঠাহর করে নিতে পারি এই প্রাচীরের প্রকৃত শামিল যুগান্তবাহিত নারী ব্যক্তিজীবনে নির্জিত হয়েও মনের গহন কোণে যে রক্তদীপন মশাল জ্বালিয়ে সমস্তরকম ট্যাবু লুপ্ত করে দেয়’। কী নির্ভীক দাপটে এই নারী-কবি চাঁদনি রাতে গাড়ির চাকায় হাওয়া ভরেন, তারপর জ্বালানি ভরে টাকা মেটাতে গিয়ে গাড়ির আয়নায় নিজেকে দেখে ফেলছেন, আর পরক্ষণেই তাঁর নারীত্বের অহমিকাকে নিজ হাতে চুরমার করে ভাঙছেন পৈশাচিক উন্নাসিকতায় - 

আমাকে তাক করে গুলি ছুঁড়তে উদ্যত
আমার নারীত্ব আক্রান্ত সেইদিন থেকেই
আর তখন থেকেই আমি বয়ে নিয়ে চলেছি
ঋতুচক্রের চিহ্ন আমার সারা মুখে [রাতের তেল ভরা]

এ বইয়ের পাতায় পাতায় এক অস্থির সময়ের যন্ত্রণাক্লিষ্ট শব্দাবলীর রঙিন বাগান। দুই জার্মানীর মিলনে কবি ভারাক্রান্ত, রক্তাক্ত – একাধিক কবিতায় মৃত্যুর রূপক এসেছে বারেবারে বিভিন্ন মুদ্রায়। 

‘আমার মুখটা যেন মৃত মানুষের মত পাঙ্গাসে,
চুম্বনের আঘাতে মৃত, যে চুম্বন আমাকে অন্ধকার থেকে বাইরে আনে, 
যেন প্রতিটি যুদ্ধ এক একটি রাত 
ঘুমিয়ে আছে ভাড়াটে সৈন্যের পোশাকে [নামহীন কবিতা, পৃষ্ঠা ২৮] 

বইয়ের মলাটে ‘নদী ও দেবদূত’ শিরোনামের নিচে ছবিতে ছোপ ছোপ ওটা কি ভাসমান রক্ত? মলাট খুলে ভিতরে অনুপ্রবেশের পর আস্তে আস্তে পাঠকেরও মস্তিষ্কে সীমান্ত টপকে ঢুকে পড়ে পচা দুর্গন্ধময় একটা সময়, ক্ষত-বিক্ষত গোরস্তান, গুলিবিদ্ধ বিস্তৃতভূমি, গলাবন্ধনীর ফাঁসে শ্বাসরোধ আর তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সোচ্চার প্রতিশোধী উচ্চারণ।

তোমার গলার আওয়াজে গভীর জড়তা
আর প্রুশিয়া কড়া নাড়ছে তোমার দরজায়
স্টিয়ারিংটা চালানোর বদলে তুমি
তেরছাভাবে ঝুলিয়েছ তাকে
ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখটাকে শ্বাসরুদ্ধ করছে গলাবন্ধনী
প্রতিশোধ নেবই আমরা!
এক সুরে বলে ওঠে ঘাতকেরা
শুনতে কি পাও সেই ঘাতকের ধ্বনি
যখন জার্মান ভাষার গলা রুদ্ধ হয়ে যায়, আর
হাওয়া যেদিকে সেদিকেই হেলে যায় সে?
যখন তোমার প্রতিবেশী দেশের ঘুঁটি পড়তে চায় না পুবে বা পশ্চিমে?
তুমি টেনে নিয়ে চলো গাড়িটা, স্টিয়ারিং-এর সাহায্যে,
আর তৈলমর্দন করো যতক্ষণ না ভেঙে পড়ে সেটা
ঠিক যেমন করে গলাবন্ধনীটি তোমাকে শ্বাসরুদ্ধ করে।
শুধুই শুল্ক জুগিয়ে যাও তুমি
আর মৌন থাক [লৌহ হাইনরীশ]

এই অনির্বাণ লড়াইআগুনে দাউদাউ ডানা মেলে যেন ফিনিক্স পাখি হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছেন কবি। কবিতার শেষে লক্ষণীয় যতিহীনতা এই আগুনকে আরো প্রসার ঘটিয়ে দাবানলে প্রলুব্ধ করে। কবি কাটরিনের এই প্রতিবাদ যতটা বহির্মুখি ও যত অনায়াস ঔদ্ধত্যে আন্তর্জাতিক দেশসীমান্ত কাঁটাতার তিনি অতিক্রম করেন, ততোধিক ধারালো ও নির্দয় বেত্রাঘাত তাঁর নিজস্ব অন্তর্জগতের বৈড়ালব্রতী ফেরেব্বাজির পিঠে, কাটরিন ততটাই তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত অন্তর্মুখ অভিসারী, ততটাই নির্জনতাপন্থী তিনি। এবং কোথাও কোথাও এই অন্তর্মুখ ও বহির্মুখ একাকার হয়ে যায় – ভিতর আর বাহির, এই দুইয়ের পৃথক অস্তিত্বের সীমানাও সসম্মানে সংহার করেন অদ্ভুত এক বেপরোয়া দেবদূতের মতো। এখানেই তিনি মহৎ, অন্য অনেক সমসাময়িক কবিদের পিছনে ফেলে দৃপ্তপায়ে হেঁটে এগিয়ে যান অমরত্বের দিকে। কয়েকটা উদাহরণ দিই।

এক - ‘... যেখানে দূরত্ব এবং আঘাত একে অপরের সাথে/ সহবাসে লিপ্ত, যেখানে দাঁড়িয়ে রেডেফিন গ্রাম আর আমার পিতা,/ স্থূলকায়া নারীরা চলেছে সেখানে পাশাপাশি।/ ... পুবের মেয়েরা অয়স্টার-এর স্বাদ জানে না,/ তাদের বাড়িতে রয়েছে শুধুই কড়াইশুঁটির গন্ধ।/ ... পুবের পুতুলেরা নাচে/ পশ্চিমের বার্বিদের অঙ্গুলি হেলনে’। 

দুই - ‘... আর শরৎ যতই কাছে এগিয়ে আসে/ শরীরে সে জড়ায় বর্ষাকে/ আর্থিক আগ্রাসনে বিলীন হয়/ দেশের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা/ আর আমার যোনির বিভাজিকার মাঝে/ তৈরি হয় এক স্বপ্নের ঘর/ আমি হই অন্তঃসত্ত্বা/ ... কিন্তু আমি অপারগ আগের মতন জন্ম দিতে/ রক্তাকত দেশ আজ অকারণে বিস্তৃত/ আর আমার আসন্ন মৃত সন্তানের জন্য/ সময়টা এখনও প্রতিকূল নয়’

তিন - ‘... শূন্য প্রহর বয়ে আনে সেই সোনালী ভবিষ্যৎ,/ যা জোগান দেয় তোমাকে বাঁচার রসদ/ শূন্য ঘন্টা যেন পরিত্রাতা যিশুর মতন/ সে জানে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে,/ যদিও বারোটার ঘন্টা একটি দিনের সমাপ্তি ঘটায়/ আর অর্ধচক্রাকার/ যার থেকে বেরোনোর সব রাস্তাই বন্ধ’। 

চার - ‘... তোমাকে জোর করতে পারে যাতে নিজের/ মুখে তুমি ট্যাম্‌পন গুঁজে দাও/ কারণ তুমি তোমার যোনি আর মুখের/ মধ্যে কোনও প্রভেদ করতে পারছ না/ এমন একটা দিন যা তোমার/ গোপনাঙ্গের লোমের ক্ষতি করতে পারে/ কিংবা মুখে একটা অকারণ বিরাশি সিক্কা দেবে/ ... আর তোমাকে হাইজ্যাক করে ফেলে দেবে অন্য দেশে/ এমন একটা দিন যার গহ্বরে সেঁধিয়েছে কৃষ্ণাঙ্গ শিশুরা/ তারা চায় না জন্মাতে/ হিজড়েরা কাঁদছে উদ্দেশ্যহীনভাবে/ তাদের লিঙ্গবিহীন অবস্থার জন্য/ অকারণেই’

অজস্র উদাহরণ দেওয়ার থেকে বইটা সংগ্রহ করে পড়ে নেওয়া অনেক সহজ। এইখানে একটা কথা আমাকে বলতেই হবে। উপরোক্ত শেষ উদাহরণে ‘বিরাশি সিক্কা’ শব্দটি প্রয়োগে অনুবাদকের মগ্ন অনুশীলনকে সেলাম জানাতেই হয়। এই জটিল রূপকের আড়ালে কবির উচ্চারিত প্রতি দুটি শব্দের মাঝখানের ঐ অনুচ্চারিত শব্দটিকে সমুদ্র মন্থন করে প্রবালের মতো সংগ্রহ ও আবিষ্কার করা চাট্টিখানি কথা নয়। অনুবাদ ও অনুবাদক প্রসঙ্গে কবি কাটরিন নিজেই লিখেছেন – ‘আমরা একে অপরকে অনেকদিন ধরেই চিনি, আর এই অনুবাদের কাজটি চলাকালীন আমাদের দুজনের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। সুলগ্নার কোনো শব্দ বুঝতে অসুবিধা হলে, আমি চেষ্টা করতাম উদাহরণের মাধ্যমে তাকে সাহায্য করতে। এইভাবে আমি আমার কবিতার অনেকটাই ব্যাখ্যা করতে পেরেছি আর একই সঙ্গে অনুভব করতে পেরেছি এই অনুবাদের মূল অসুবিধার জায়গাগুলোকে। তবে আমার বিশ্বাস যে, যেখানে আমি অনুবাদককে আমার ব্যাখ্যার মাধ্যমে কোনওভাবেই সাহায্য করতে পারিনি, সেখানেও সে বাংলা ভাষায় তার একটা প্রতিশব্দ খুঁজে নিয়েছে’। এইরকম আরো উদাহরণ দেওয়াই যায়, তবে ঐ যে আগেই বলেছি সহজতর পন্থার কথা, সেটাই পাঠককে আবার অনুরোধ করছি। 

দেবদূত প্রসঙ্গে আসি। নইলে ‘নদী ও দেবদূত’ নামকরণের পশ্চাৎপটটা পরিষ্কার হবে না। অবশ্য পরিষ্কার হতেই হবে – এমন বাধ্যবাধকতা মেনে কোন যুগে কোন কবিই বা কলমে সার্ফ এক্সেল কালি ব্যবহার করেছেন? আমার ধারণা কবি কাটরিনও তার তোয়াক্কা করেননি। তবে সচেতন নিবিড় পাঠক তার নিজস্ব ভঙ্গিতে এর ব্যাখ্যা করে নেন – এটাই দস্তুর। এ বই পড়তে পড়তে কখনও মনে হয়েছে কবি নিজেই যেন নদী, ভেসে যাচ্ছেন নিজের স্পর্ধায় ও খেয়ালে – আদিম স্বেচ্ছাচারে – প্রথম কবিতার ‘তুমি’ কি তবে সেই পুরুষ দেবদূত’? 

‘সাইরেন-এর মধ্যে দিয়ে বার্তা পাঠাচ্ছে বিলম্বিত সময়
সমুদ্রের ঢেউ-এর ওপর দিয়ে ধেয়ে গিয়ে
গর্জে ওঠা মেঘের চারিপাশে চক্কর খায়
যারা দেবদূত ছিল তারাও চলেছে সেদিকে ধেয়ে ...’ 

স্প্রে নদীর ওপরের আকাশে ডানা ঝাপটে ঘুরপাক দিতে দিতে সেই দেবদূত হঠাৎ গোঁৎ খেয়ে ঢুকে যাচ্ছে নদীর সহবাসী বার্লিন শহরের বুকের গভীরে [‘বিবাহ’ কবিতায় কবি তাঁর বোনকে বলছেন – ‘আমি তোমাকে মনে করাতে চাইছি সেই কথাটা/ আমরা যেটা করতে পারতাম এই বিভাজনটা ঘোচাতে/ হয়তো আমরা একটা সোমত্ত পুরুষকে/ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে ভান করতাম যেন কিছুই হয়নি’] - যে শহরের পিছন দিকটা নোংরা আর বাকি অংশটা তোমার বুক পকেটে ভাঁজ করা কাগজে ছোট্ট একটা নৌকো, মাঝের বিন্দুগুলোকে কেউ একজন তুলনা করছে মৃত্যুর সঙ্গে, মোটাসোটা ইঁদুরদের হাতের ক্রীড়ানক নদীর জলে ডুবে যাওয়া সেইসব অনায়াস মৃত্যু হঠাৎ জিজ্ঞেস করে উঠলো – তরবারি না লিলি? 

চতুর গ্রীষ্ম ততক্ষণে নদীর অন্য প্রান্তের চরাচর অনর্গল ভরিয়ে চলেছে লিলি ফুলের আদিগন্ত বাগানে। তো, কোথায় গেলেন সেই দেবদূত? 

‘...আমি এখনও জানি কীভাবে আমরা ওই দেবদূতকে বেত্রাঘাত করতাম
যে এই পৃথিবী আর কাঠের ঘ্রাণ নিত আর হাসত
মনোহ্বিৎস-এর দেবতা আমাদের সর্বদা কড়া নজরে রাখতেন
তিনি জার্মান ও জোর করে জার্মান বনে যাওয়াদের দেবতা’ [নদী ও দেবদূত]

‘মনোহ্বিৎস’ শব্দের অর্থ কী? সুলগ্না পৃষ্ঠার নিচে টিকা দিয়ে জানালেন – এটি নাৎসি জার্মানি অধিকৃত পোল্যান্ডের একটি কন্‌সেন্ট্রেশন ক্যাম্প।

পাঠক, এ ক্যাম্পে আপনি স্বেচ্ছায় অনুপ্রবেশকারী হয়ে ঢুকবেন – আমার স্থির বিশ্বাস। 
1

বইঘর - রুবাইয়াৎ রহমান

Posted in


Unruly Waters: How Mountain Rivers and Monsoons Have Shaped South Asia's History
Author: Sunil S Amrith
Publisher: Penguin (UK)


‘Unruly Waters’ বইটি পেঙ্গুইন পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত। বইটির লেখক হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অধ্যাপক সুনীল আমরিত(Sunil Amrith)। বইটির বিষয়বস্তু খুবই পরিচিত – দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের নদী ও পানি সম্পদ। 

বইটি পড়ার মধ্যে দিয়ে আমরা পৌঁছে যাবো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের এক স্মৃতিময় অতীতে, যেখানে আমরা পরিচিত হবো নদী, পানি ও সমাজকে নিয়ে এক সংক্ষিপ্ত অথচ প্রামানিক ইতিহাসের সাথে। আর এই ইতিহাস চিত্রায়নের কাজটি অধ্যাপক সুনীল আমরিত করেছেন অত্যন্ত সাবলীল ভাবে।

নদী, উপকূল ও তাদের বুকের উপর মানুষের গড়ে তোলা বাঁধ কিভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় বৈচিত্রপূর্ণ সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার সাথে মিশে গেছে, অধ্যাপক সুনীল আমরিত তারই সার্থক রূপায়ণ করেছেন 'Unruly Waters' বইয়ে। বইটির প্রতি পরতে ইতিহাসের অধ্যাপক সুনীল এই অঞ্চলের জলরাশি, মাটি ও মানুষ নিয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের গবেষনাকে ঢেলে দিয়েছেন। পাঠককে বার বার তিনি নিয়ে গেছেন নদী পাড়ে, সৈকতে কিংবা উপকূলে। ভাবতে অবাক লাগে, অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের উপনিবেশকালে আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার অদম্য স্বপ্নকে কিভাবে উস্কে দিয়েছে নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ও সেচ ব্যবস্থা। আবার, উপনিবেশবাদের শিকল চূর্ণ করে স্বাধীন হবার পর এই আমরাই অর্থনৈতিক উন্নয়নের উস্কানিতে জলসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে নয়-ছয় করে চলেছি বাঁধ ও স্লুইস গেট নির্মাণের মাধ্যমে। অধ্যাপক সুনীল আমাদের এই 'অহিতকর' উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে একটি নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন - যা উপলব্ধি করা আমাদের একান্ত জরুরি।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির ইতিহাস বিভাগের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক অধ্যাপক বইটিতে পানি সম্পদ ও জলরাশি ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার অনেক উপাত্ত যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি এই সমস্যা নিরসনে এই অঞ্চলের সাংবাদিকবৃন্দের সাহসিকতা, সেই সাথে পানি বিজ্ঞানী, পরিবেশ আইনবিদদের একত্রে ও নিঃসার্থভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরতে কার্পণ্য করেননি। 

বইটি উপস্থাপনের ধরন কিছুটা অন্য রকম এবং নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রমী। পড়তে গিয়ে কখনও মনে হবে বইটি দক্ষিণ এশিয়ার বিগত ইতিহাসের দিনলিপির দার্শনিক উপস্থাপনা বৈকি! আবার কখনও বা উপলব্ধি হবে যে অধ্যাপক সুনীল আমরিত এই অঞ্চলের নদী ও পানি সম্পদের বিগত কয়েক শতকের আত্মজীবিনী আমাদের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস চালিয়েছেন। অধ্যাপক বইটির মাধ্যমে যে জগতের চিত্র এঁকেছেন, তা আমাদের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্ত তাঁর লেখনী ও বর্ণনার পরতে পরতে এই অঞ্চলের সামাজিক জীবনযাত্রা ও জলের সম্পর্কের যে চিত্র অংকিত হয়েছে, তা অনিবার্যভাবে মৌলিক। 

খুবই স্পষ্ট করে সমসাময়িক কালে এই অঞ্চলের পানি সম্পদের উপর জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব আর স্বার্থপর রাজনীতির প্রতি অধ্যাপকের (সুনীল আমরিত) সরল উপলব্ধির সহজ কথোপকথন পাঠককে অনুসন্ধানী করে তুলবে; আর মনে করিয়ে দিবে কেন দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের বিগত কয়েক শতকের জল রাশির ইতিহাসের প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবন্ধন প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস, অঞ্চলটির বুক চিড়ে শিরা-উপশিরার মতো বয়ে চলা নদী ও জলরাশির দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপনে অধ্যাপক সুনীল কতটুকু স্বার্থক - সেই মন্তব্যে আমি যেতে চাই না! তবে এতটুকু স্পষ্ট করে বলা যায় - এই অঞ্চলের জীবনযাত্রার সাথে নদী, দুর্যোগ, বাঁধ ও উপকূল কতটা নেপথ্যে জড়িত, কতটা অবিচ্ছেদ্য তা জানার প্রবল আগ্রহ তৈরী করে বইটি। এখানেই বইটি অনবদ্য, আর এখানেই অধ্যাপক সুনীল আমরিতের অসাধারণত্ব!
0

বইঘর - পল্লববরন পাল

Posted in

আবর্ত - সম্মতি দাও অবাধ্যতার
পল্লববরন পাল


বইয়ের নাম “আবর্ত”। কবি - শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী।  প্রথম প্রকাশ ডিসেম্বর ২০১৯। প্রকাশক ‘ধানসিড়ি’। ‘দু’জন মানুষ। শহর একটা। জীবনও, একটাই।’ এই শিরোনামে প্রথম ভূমিকার অংশ –

... তবে কাহিনিরা মানুষের চেয়ে বেশি ধুরন্ধর। কাউকে কিচ্ছুটি না জানিয়ে তারা নিজেদের মতো একটা শেষের পথে এগোতে থাকে, যে পথের নাম আমরা দিই অভ্যাস। নিজেদের গল্পের রথ নিজেরা ছোটাতে ছোটাতে কখন যে লাগাম হাতবদল হয়ে যায়, বুঝি না। আচম্বিতে আমরা দেখি, আমাদের ছোটাচ্ছে আমাদের কাহিনির ভার... নিজেদেরই তৈরি করা গল্পের জাল ভেঙে বেরোনোর পথে সৃষ্ট হয় আবর্ত।

এই আবর্ত-স্রষ্টার নাম শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী। অভিনবত্ব ত্রিমাত্রিক পদবিতেও। আমার অভিজ্ঞতায় ইতিমধ্যে ঘোষরায় বা রায়চৌধুরী একাধিক পেয়েছি – লক্ষ্য করুন পাঠক – ইনি ঘোষ রায় চৌধুরী – তিনটিই মৌলিক পদবি এবং স্বাধীন – মাঝখানে সুনির্দিষ্ট নোম্যান্স্‌ল্যান্ড সহ সীমান্ত মজুত। ত্রিমাত্রা শুভংকরের সৃষ্টিমাধ্যমেও – নাট্যকার, গদ্যকার এবং কবি। রবীন্দ্র জাদেজার মতো – ব্যাট বল ফিল্ডিং – এ এবং ও দুজনে নয়, এ ও এবং সে তিনজনেই বলে আমায় দ্যাখ্‌। বিরল প্রজাতি। নইলে দ্বিতীয় ভূমিকার পাতায় শেষ সংলাপে লেখেন – 

এই পার থেকে আমি কলকাতা পাঠাব আজীবন –
সন্ধ্যায়, সেতারে ইমন।

এর পরেও কোনো সচ্চরিত্র কবিতা পাঠক আবর্তের মধ্যে মাথা না ঢুকিয়ে পারেন?


বইয়ে দু’জন মানুষ – সূচিপত্রে নির্দিষ্ট – ‘একলব্য – হৃদয়ের ক্ষয়’ (কুড়িটি কবিতা) এবং ‘ফেরা’ (আঠাশটি কবিতা) – প্রথমজন শুরুই করছেন দ্বৈত উচ্চারণে –

সম্মতি দাও, সম্মতি দাও, আবার তোমায় আগলে রাখি
ঝড়ের গতি, উপড়ে আসা ঘর, প্রভৃতি ঠেকায় যদি
শক্ত করে আবার ধরো এই কথাদের, আর ছাড়া নয়।
হাতের মুঠো বন্ধ। এবার সম্মতি দাও, সম্মতি দাও। 

[যেমন করে গাইছে আকাশ]

কবি-নাট্যকারের মুন্সিয়ানাটা লক্ষ্য করুন পাঠক - আগলে রাখার অনুরোধ করে সম্মতির তোয়াক্কা না করেই ঝড়ের গতিতে ঘর উপড়ে পাঠককে নাছোড় হাতের মুঠোয় বন্ধ করতে শুভংকরের লাগলো মাত্রাবৃত্তের সহজ সাবলীলতায় মাত্র চারটি পংক্তি। এবং চতুর্থ পংক্তির মাঝখানে কী সাঙ্ঘাতিক ধারালো, কী নাটকীয় ঐ পূর্ণচ্ছেদ! মুঠো বন্ধ – ব্যাস! শেষ। স্তব্ধতা। শেষ মানেই তো ফের শুরু – ফের ‘সম্মতি দাও, সম্মতি দাও’

পরের স্তবকেই যে কলকাতাকে উনি আজীবন সেতারের ইমনে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন একটু আগে উৎসর্গের পাতায়, তার সম্পর্কেই বলছেন –

তছনছিয়ে চূর্ণ করি মগজজোড়া কলকাতাদের
অহং যত, ঘূর্ণিপাকে লোপাট করি গঙ্গাকিনার
সম্মতি দাও, বক্ষে তোমার রুদ্রপ্রয়াগ, মন্দাকিনী
লিখতে থাকি, এবং অমন চোখেই ধরি আষাঢ়বাড়ি

কবির নিজের আবর্তে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন কলকাতা থেকে রুদ্রপ্রয়াগ এবং মন্দাকিনী লিখতে লিখতে আমাদের সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে পৌঁছে দিচ্ছেন তাঁর ‘আষাঢ়বাড়ি’তে। এখানে আষাঢ় আর বাড়ির মধ্যে কিন্তু কাঁটাতার সীমানা ব্যবধান নেই – সম্পৃক্ত - পাঠকও কবির সঙ্গে – কী সুন্দর যুগলবন্দী – মেঘমল্লারের মতো – দুটি শব্দ পরস্পর জাপটে লীন হয়ে একটা পৃথক নতুন শব্দে যেন উত্তীর্ণ হলো এইমাত্র!

শব্দ নিয়ে যেন যা খুশি তাই আবর্তে ‘তছনছিয়া’ ঘুরপাক খেয়েছেন শুভংকর। দ্বিতীয় কবিতা ‘কালবৈশাখী’র শেষ পংক্তিতে খেলতে খেলতেই একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে বিপরীত মেরুতে গিয়ে নিজেও দাঁড়ালেন, পাঠককেও সেই মজায় মজিয়ে ছাড়লেন –

- কিন্তু এক ঝড় এসে রোজ ডেকে যায়,
সময়ের খবর পাঠায়
- সেইসবই শুনে, ভুলে থাকি।
- গতকাল শীত ছিল।
বসন্তের কবিতারা জেগে ওঠে আজ।


--কাল? বৈশাখী?

আগের কবিতার আষাঢ়বাড়িতে জুড়েছিলেন। এবার ভাঙলেন। কাল আর বৈশাখী – অনায়াস অবলীলায়। ‘দাড়িমের দানা ফাটিয়ে দশ আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে যেমন তার রস বের করে’ ঠিক তেমনি রক্তকরবীর রাজার মতো যেন বলে উঠলেন ‘সৃষ্টিকর্তার চাতুরী আমি ভাঙি’।

শুভংকরের কবিতার একটা নিজস্ব স্টাইল আছে – শব্দ গাঁথতে গাঁথতে সহসা একটি শব্দের প্রতিধ্বনি বেজে ওঠে – আচমকা দ্বিমাত্রিক কবিতা ঐ একটা শব্দে ত্রিমাত্রিক হয়ে ওঠে –

আসছে ফিরে একটানা সুর – হারমোনিয়াম...
প্রেম কি তোমার এমনি জানা?
(সবার কি সব শুনতে মানা?)

আদর বলতে, মধ্যগগন! কলোসিয়াম! [দেবব্রতর হারমোনিয়াম] 

এই আলটপকা হঠাৎ বৃষ্টির মতো ‘কলোসিয়াম’ শব্দটা কবিতার শেষে উচ্চারণের সাথে সাথেই পাঠককে চমকে দাঁড়িয়ে পড়তে হবে, শুরু থেকে একাধিকবার ফের পড়তে হবে, হবেই – অনুষঙ্গের ঠিকানা খুঁজে বের করতে – একইভাবে ‘ঋণ’ কবিতার শেষে ‘শহরের যতেক কেবিন’ পড়েও ঝটকা লাগবে এবং এই শব্দের অনুরণনের মজা অনুধাবনের নেশা পেয়ে বসবে পাঠককে। কবি শুভংকরের স্বভাবের ফাঁকে লুকিয়ে থাকা কথারা এমনিভাবেই শুধু কথার মত থাকে না – আচমকাই তারা কেউ কলকাতা, কেউ আবার পাহাড়, নয়তো হেমন্তকাল হয়ে পাঠকের সঙ্গে হেমন্ত মুখার্জীর গানের মতো এক সহজ বৌদ্ধিক সম্পর্কস্থাপন করে, যা মাথার মধ্যে অনেকক্ষণ রিনরিন ছন্দে বেজে চলে।

ছন্দে ছন্দে দুলতে দুলতে অভ্যস্ত পাঠক হঠাৎ এই কাব্যগ্রন্থে পেয়ে যাবেন পরপর দুটি গদ্যছন্দের জানলা। খুললেই শ্রাবণের নক্ষত্র নিঃসঙ্গ দহনে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ঠোঁটের এক কোণে আলতো আলস্যের মতো, ঘুমের মতো, মায়ার মতো ঝুলবে নীলকন্ঠী হাসি। নদী বা সমুদ্রের অতীত এক মাধুর্য হয়ে ‘আশ্বিনের গাঢ় সন্ধ্যা বুকে ভর করে সবার’, ‘নৈঋতে মেঘের সাম্রাজ্য সুঠাম হয়’ – কবির আড়ালে বসে আমরাও দেখি ‘কীভাবে একটা সমগ্র দেশ প্রতিপলে ভেসে যাচ্ছে শস্যের স্বপ্নে’, উত্তাল অভিমানী নদী উঠে আসছে নারীর চোখে, যার শরীরে ছায়া দেখলে লাবণ্যের অনধিকারের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেন কবি।

‘আমায় যদি পোড়াও, তবে আগুন আনো এই মুহূর্তে
সহ্য হয় না এখন দেরি, নইলে কী আর তোমার রক্তে
ডুব দিতে চাই জ্বলার আগে? জন্ম এখন প্রেমের মতোই
মিথ্যে লাগে।...’ [দ্বিধা]

পাঠককে মনে করিয়ে দেবে সত্তর দশকের সেই আগুন-কবির পংক্তি – ‘একটি হৃদয় পোড়ে শুধুই পোড়ে/ তার যেন আর কাজ ছিলো না কোনো’ – মাত্রাবৃত্ত শক্তিরও বড়ো প্রিয় ছন্দ ছিলো। এ ছন্দের ঝোঁকে শক্তির মতোই অনায়াসে উদাস বিষণ্ণতা বুনতে বুনতে শুভংকর হঠাৎ সুনীলের মতো উচ্চারণ করেন – ‘সমস্ত সাড়ে-সাততলা বাড়ির ছাদ থেকে/ নিশ্চিত জানি,/ দেখা যাবে কলকাতার স্কাইলাইন -/ দিগন্তে হাইরাইজ, তার উপর/ সিগারেটের ধোঁয়ার মতো মেঘ/ খুব বৃষ্টির আগে আকাশটাকে/ নেভানো উনুনও মনে হতে পারে। ...’ এই কবিতার মধ্যেই কবি শুভংকর আশ্চর্য নির্মাণ করেছেন –

...মাটি আর চলাচল, চলাচল আর
নীচু বাড়ির দরজা, দরজা আর
পরিচয়ের মধ্যেকার যেটুকু অপেক্ষা
এবং আমাদের এই ফিরে আসা –
সব মুছে যায়।

শুধু শোনা যায়,
এক পরাজিত গায়ক
মল্লারের রেকাব ধরছেন বারবার। 
[হাইরাইজ]

পাঠক, লক্ষ্য করুন, কবিতার পংক্তি ভাগ ও বাঁদিকের মার্জিনের বিভিন্নতা – যা এই কবিতাটির শরীরে দিয়েছে গোপন এক গতির দোলা। আমার কাছে এটা এই গ্রন্থের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা।

পাতায় পাতায় কালিকুন্তল ভার
লুটায় সমীপে, ভাঙাবসতের ছায়ে,
তোমার সান্ধ্য, বিনীত অন্ধকারে
ভালোবাসা আজও এরকমই নিরুপায়। ... 
[মধুমাস]

দ্বিতীয় মানুষ – ফেরা – এক অনন্ত খোঁজ আর তার পরতে পরতে কিছু উথাল-পাতাল দীর্ঘশ্বাস ও অহংকারী অভিমানের বিলাস। কিসের খোঁজ? কার খোঁজ? এই কল্পনাতীত প্রশ্নপত্রের উত্তর সম্ভবত কবি নিজেও খুঁজেই চলেছেন তাঁর আঠাশটি কবিতার প্রতিটি সযত্ন শব্দ, শব্দের মাঝখানের চিলতে রোদ্দুর, দুই স্তবকের ফাঁকে আটকে থাকা বিচিত্র ঋতুসম্ভার জুড়ে। এই দ্বিতীয় মানুষটি কিন্তু আদ্যোপান্ত আচ্ছন্ন দোলাচলে। ঐ যে, আগেই বলেছি – কিসের খোঁজ, কার খোঁজ? ‘আপনারে খুঁজি আর খুঁজি তারে সঞ্চারে আমার’ – এ শ্লোগান কবিরই উচ্চারিত অধ্যায় সূচনায়। এই আচ্ছন্নতার মধ্য থেকেই আলোকিত হচ্ছে কবির খোঁজযাত্রা পথ – তাঁর যাপনভাবনা।

এ’ যেন কলকাতার এক আশ্চর্য ম্যাজিক –
গাঢ় হয়ে আসা বিকেলে
তুমি যখন বলো, এ-দেশে থাকবে না
বিরহ আমাতে ভর করার আগেই
তুমি আমার হয়ে দুঃখ পাও, আবার পরক্ষণেই
চোখ ফিরিয়ে বলে ওঠো, ফিরে আসব আবার।

এই ক্ষমতা, দুঃসাহস ও অহংকার
তোমাকে এই শুর দিয়েছে, জানি। [অহংকার] 

এ কবির বোধের নিভৃত সিন্দুকে বিরাজ করছে কলকাতা, কবির নিজস্ব সেতারের ইমনে বেহাগে। এ শহর কখনও তাঁর একান্ত মগ্ন আদর, কখনও এক পশলা কবিতাবিলাস, আবার কখনও কবি নিরুত্তর হাহাকারে চিৎকার করে ওঠেন - ‘কলকাতা আমাদের অনন্ত এক পরাজয়’।

ঝড়ে-জলে উড়ে যাওয়া
চিঠিদের কথা, ভাঙা মন
আজকাল এ শহরে কে আর শোনায়?
শব্দও বন্ধক তার কাছে। ...
...
এ সব কাল্পনিক।
আমাদের সঙ্গী বলতে শুধু এক মুঠোফোন।
কেঁপে ওঠে মাঝেমাঝে –
‘ফাঁকা নাকি? দেখা করা যায়?’ 

[মুঠোফোন] 

‘আদ্যক্ষর’ কবিতাটির কথা আলাদা করে বলতেই হয়। কারণ, এটি কবি-নাট্যকার শুভংকর রচিত। দু’জনের সংলাপ – চুম্বন দূরত্ব থেকে নয়, বরং রেস্টুরেন্ট কেবিন-টেবিলের দু’পাশে মুখোমুখি – সটান দৃষ্টির কঙ্ক্রিট সেতু নয়, এক চামচ চিনি ঢেলে চামচের চা-ডুব সাঁতারে কাপের দেয়ালে খুব সংযত ঠুং শব্দে গাঢ়তর নিস্তব্ধতায় শ্বাস নিতে সহসা এ ওর চোখ ছুঁয়ে যাওয়া – সংলাপের ভঙ্গি দেখে আমার অন্তত সেরকমই একটা দৃশ্যকল্প মাথায় এসেছে –
- অনেক তো হল এই প্রেম-অপ্রেম-নিবেদন-গ্রহণ-অভিমান।
একমুঠো শান্তি পাওয়া যায়?
- লক্ষণ ভালো নয়! সখ্যেও পাক ধরল তবে?
- সে তো ইনেভিটেবল্‌!
সারাক্ষণ চরকিপাক, অপেক্ষায় ম্লান হয়ে যাওয়া
অভ্যাসের সংলাপ – ভালো লাগে নাকি?
- তার চেয়ে দূরে থাকা, কথায় না-থাকা,
জেনে নেওয়া, আজও ভালোবাসো,
মাঝে মাঝে সাক্ষাৎ, একসিডেন্টালি ...

হে পাঠক, এ সংলাপের কোনো চরিত্রের মধ্যে কবিকে খুঁজবেন না, কারণ, কবি নিজেও সন্তর্পণে নিজেকে এড়িয়ে গেছেন এই কবিতায় – বরং তাঁর প্রিয় চরিত্র, আজকের কলকাতাকে ধরেছেন যে সংলাপে ইনেভিটেব্লি ‘অনিবার্য’ শব্দটাকে অনাত্মীয় মনে করেন, অথবা বলার মুহূর্তে এক্‌সিডেন্টালি বাঙলাটা মনে পড়ে না, ‘দৈবাৎ’ বা ‘হঠাৎহঠাৎ’ মাতৃভাষা বিস্মৃতির মধ্যে কখনো কখনো ডান বা বাম হাতে মাফলারের মতো ঘাড় টপকিয়ে নিজের পিঠ চাপড়ানিও উপভোগ করেন। এই কবিতায় একটা ব্যাপারে আমার ব্যক্তিগত ‘ভালো-না-লাগা’ সম্পর্কে বলতে চাই – এই ‘হাইফেন’এর অত্যধিক ব্যবহার – প্রথম পংক্তিতে ‘প্রেম-অপ্রেম-নিবেদন-গ্রহণ-অভিমান’ যদি ‘প্রেম অপ্রেম নিবেদন গ্রহণ অভিমান’ হতো, ইলিশ মাছের কাঁটার মতো প্রতি শব্দের মাঝে খোঁচা ও রক্তক্ষরণটুকু না থাকলে কি ঐ পাঁচটি শব্দের পাশাপাশি অবস্থানগত পারস্পরিক সম্পর্কের রাশ আলগা হয়ে যেতো? পাঠক বোধহয় খোঁচাটা না খেতেই বেশি স্বচ্ছন্দবোধ করবেন, মানে কবিতার পাঠে হোঁচট খাবেন না। এই হাইফেন-প্রেম শুভংকরের এ বই জুড়ে অসংখ্য স্বাক্ষর রেখেছে – সচেতনভাবে নাকি অভ্যাসে, তা জানি না। শুধু হাইফেনই বা বলি কেন, ‘কমা’ও কম যায় না। দুটি উদাহরণ দিই –

এক।। মুখ ফুটে আর কেউ বলে না,
‘ভ্রান্ত হব, ভ্রান্ত হব,
নদীর কাছে চলো।’ 

দুই।। - দু-হাতেই ছেড়ে রাখো যাকে
তাকে কি কখনও বলো, ‘সাড়া দাও’?

প্রথম ক্ষেত্রে সংলাপ ভিন্ন পংক্তিতে – বেশ, তাহলে প্রথম পংক্তির শেষে ‘কমা’টির দরকার কি? আবার দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সংলাপের আগে ‘কমা’র বিরতি একই পংক্তিতে, অথচ ‘সাড়া দাও’-এ পংক্তি ভাঙলে সংলাপের গুরুত্ব কি কিছুটা বাড়তো না?

‘দু-হাতেই’ লিখছেন অথচ অন্যত্র দু’জন মানুষ (প্রথম ভূমিকায়), সে’ শহরে (দ্বিতীয় ভূমিকায়), দু’ হাতে ভুলের স্মৃতি (বাস্তুভিটে) ...

আস্ত বইটা জুড়ে শব্দ চয়নে, বোধে ও যাপনে, চিত্রকল্প নির্মাণে এতো যত্নবান নিজস্বতায় আপ্লুত কবি যতিচিহ্ন ব্যবহারেও সচেতন হয়ে উঠুন শিগগির, কারণ –

জোনাকির দেহে তুমি হয়ে ওঠো রক্তের ডানা
কাজল দিয়েই রোজ এঁকে দাও নদীর সীমানা। 

[জরাকাল]

চিরায়ত বাঙলা কবিতার নিবিষ্ট পাঠকেরা আপনার থেকে আরো অনেক অনেক এরকম মৌলিকত্বের আশায় আকুল অপেক্ষা করছে, শুভংকর। আপনার কথার সূত্র ধরেই বলি -

সম্মতি দাও, সম্মতি দাও, আমরা তোমায় আগলে রাখি
2

বইঘর - পল্লববরন পাল

Posted in

“ঘুমোই চশমা চোখে” – এক নির্জন আমি আবিষ্কার
পল্লববরন পাল

প্রাণ কি বুদ্বুদ তবে, তেপান্তর থেকে একা ভূমি ও হাওয়ায় 
গড়িয়ে এসেছে আজ এত দূর? নাকি সাত সমুদ্রের জলে
আর তেরো নদীকূলে ভেসে উড়ে হেঁটে দৌড়ে সূর্যাস্ত পেরিয়ে 
রমণীয় দিবালোকে রামধনুর রঙে জ্বলে আশ্চর্য ঝিলিকে?... ... [ভাসা]


বইয়ের প্রথম কবিতার প্রথম চারটি পংক্তি। বিখ্যাত ইংরেজি প্রবাদটা মনে পড়ছে, কিন্তু এ বই পড়ার পরে উচ্চারণ করতে ইচ্ছে করছে না – তাই বাংলা করে বলি - ভোরই জানে সারাদিনের ঠিকানা। ওপরের কবিতার নাম ‘ভাসা’। হ্যাঁ, তেপান্তর তো বটেই। সুদূর চট্টগ্রাম থেকে ভূমি ও হাওয়ায় ভেসে উড়ে নাকি জলরাস্তায় হেঁটে দৌড়ে প্রাণ পৌঁছে গেছে আমার শহর কলকাতার মহাপ্রাণে। নিমগ্ন পাঠক ইতিমধ্যেই রামধনুর অতিকায় দিগন্তদৈর্ঘ্যে এবং সরল বক্রতায় ঋদ্ধ হয়ে উপাসনা ঢঙে পা মুড়ে বসেছেন কবি খালেদ হামিদীর মুখোমুখি। কবির মুখোমুখি? – নাকি তাঁর সৃষ্টির? বইয়ের নাম ‘ঘুমোই চশমা চোখে’। চার ফর্মা। ক্রাউন মাপ। প্রকাশক ঋতবাক। প্রথম প্রকাশ ২০১৯ জানুয়ারি। তৃতীয় পংক্তির শেষে সূর্যাস্ত পেরিয়ে যে গোধূলিকাল – লক্ষ্য করুন পাঠক – কবি হামিদী তাকে বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন ‘রমণীয় দিবালোক’ – বইয়ের চতুর্থ পংক্তিতেই কলমের প্রবল স্বাস্থ্যে পাঠক আশ্বস্ত ও মগ্নতর অবগাহন প্রত্যাশী। 

গত শতাব্দীতে কৃত্তিবাস যুগ থেকেই আস্তে আস্তে বাঙলা কবিতায় ভৌত ও রাসায়নিক বদলের সন্তর্পন শুরু। কবিতা আদতে কবির নিভৃত আত্মরতির ফসল। তাই সময়ের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের সুবাদে এবং স্বাভাবিক রতিধর্ম অনুযায়ী সেও বড়ো আপাত অস্থির ও বিশৃঙ্খল। সাধারণ সাহিত্য পাঠকের অভিযোগ – এই অস্থিরতার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো ধৈর্যশীল সময় আজকের জীবনী আর নেই। তাই কবিতা ক্রমশ পাঠকের কাছে দুর্বোধ্য। আমাদের যাপনের মধ্যেও তো অসংখ্য দুর্বোধ্যতা – আর, কবিতা তো যাপনেরই একটা বিশেষ ভঙ্গিতে অনুবাদ। প্রথম বাঙলা কবিতা বলে স্বীকৃত চর্যাপদের ভাষাকে বলা হতো সন্ধ্যাভাষা – অর্থাৎ গোধূলির ছায়াময় আলোআঁধারি বা কবি হামিদীর ভাষায় ঐ ‘রমণীয় দিবালোক’ বাঙলা কাব্যের জন্মাবধি বৈশিষ্ট্য। এই দুর্বোধ্যতার অভিযোগের প্রতিবাদে কিম্বা অভিমানে শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ধর্মেও আছো জিরাফেও আছো’ বইটি উৎসর্গ করেছিলেন ‘আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্য পাঠক’কে। 

সিনেমা বা শিল্পকলার মতো কবিতারও নিজস্ব ভাষা আছে – নিজস্ব প্রকাশভঙ্গী আছে – নির্মাণশৈলী আছে। গত শতাব্দীর মধ্যভাগে সুধীন্দ্রনাথ দত্তের উত্তরাধিকার সূত্রে আশির দশক বাঙলা কবিতায় সঙ্কেত ও প্রতীকের ব্যবহারে আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে। প্রবন্ধের মতো কবিতার শেষে পাদটীকা লাগানোর নিয়ম নেই। লাগানো যায়ও না। সেগুলি খুঁজে নেওয়া মগ্ন পাঠকেরই দায়িত্ব। বিষ্ণু দে’র কবিতার ইতিহাস ও সমাজচেতনার নাগাল পেতে হলে পাঠককে শিক্ষিত হতে হবে। সুধীন্দ্র নাথের ভাষায় ‘যে দুরূহতার জন্ম পাঠকের আলস্যে, তার জন্য কবিকে দোষারোপ অন্যায়’ – তাই তাঁর ‘নিরাশাকরোজ্জ্বল চেতনার’ কাছাকাছি পৌঁছোতে পাঠককে তৎসম শব্দ ভেদী মানসিক পরিশ্রম করতেই হবে। বোধগম্যতার নিরিখে এগুলিকে কবির দুর্বোধ্যতা বলা ঠিক নয় বরং বলা উচিত আধুনিক পাঠকের মেধা ও মননের কাছে কবির মাননীয় ও মর্মান্তিক দাবি। 

ও বি হামিংবার্ড,
তুমি কি হাভানা থেকে আসো খুব উড়ে,
নিজের চারদিকে নাকি আমি মরি ঘুরে!
পরিযায়ী পাখি নও ভুলেও কখনো;
তথাপি উড়াল তোর ক্রমাগত ঘন।... ... [ও বি হামিংবার্ড]

এখানে ‘তথাপি’ শব্দটা উচ্চারণে একটা আলাদা সমীহ নিজের অজান্তেই পাঠক ঘোষণা করে ফেলে। এই ধরণের না-চলতি সাধু তৎসম শব্দ প্রয়োগ কবি খালেদ হামিদী এই কাব্যগ্রন্থে একাধিকবার করেছেন – অর্থাৎ সচেতনভাবেই এই সদ্যপ্রাচীন শব্দসমূহ প্রয়োগে বিষ্ণু দে’র উত্তরাধিকারী এই কবি তাঁর কবিতার সময়কালকেও চুইংগামের মতো বিস্তৃত করেছেন। তাই নিউটন থেকে নেইমার – আপেল থেকে উরুসন্ধি – কবি হামিদী পাশাপাশি সকাল আটটার রোদ্দুরের মতো ভীষণ রকম সাম্প্রতিক ও উষ্ণ। 

...শার্ট খুলে ভালোবাসা দেখাতেই চাই তবু কার প্রহরায়?
বৃষ্টিহীন বহু দূরে দ্বাদশী চাঁদের নিচে ছাতার আড়ালে,
ম্লান বস্ত্রে হেঁটে যান কে? রবীন্দ্রনাথ? বঙ্গবন্ধু? দূরতর
নমঃশূদ্র বংশপিতা নাকি, নতশির, যিনি দেখেননি তাঁদের! ...[ভালোবাসা দেখাতেই চাই] 

এ বইয়ের পাতায় পাতায় অনেক দুর্গম চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন কবি হামিদী – যার মধ্যে অনেক অর্থস্তর আছে – সঙ্কেত আছে – আমাদের আটপৌরে রোজকার যাপন-টুকরো দিয়ে গাঁথা – যেখানে পাঠকের নিবিড় মগ্নতায় বাধ্য হয়ে দ্রবীভূত হয় এক তীব্র বিহ্বল আগ্রাসন - 

জল না ফুরালেও অগ্নি নিভুনিভু।
এ কোন্‌ রসায়ন শোনাও তবে আজ?
জানার পুরোভাগে নাভিতে হাত কার
পাখির সংবাদে যে পোড়ে বিদ্যুতে? ...
তাহলে ডর কিসে, তোমারও কোথা জয়?
পানি কি আগ নয়, গীতেই বরাভয়? ... [জল না ফুরালেও] 

অথবা আরো দুর্গম জটিল চিত্রকল্পের গহন অরণ্যে অবধারিত পাঠককে অমোঘ চুম্বকে টেনে নিয়ে যান দুর্নিবার আকর্ষণে –

...তোমারই পরম গর্ভে আমার পুরোনো জন্ম, নবজন্ম
কি পুনর্জন্মের মাঝে আর মধ্যে কতো 
বহিরাগতের ভাসমান প্রাণিত সাঁতার!
এসবেরও ঢের পরে নখ ভেঙে যায় প্রেক্ষাপটে;
কাটা পড়ে স্বপ্নাদিষ্ট অমর আঙুলও। ... [প্রেক্ষাপট] 

পাশাপাশি কী নিটোল অনায়াস স্পষ্টতায় কবি হামিদী গাছের নিচে দাঁড়িয়ে সেই হামিংবার্ড নারীর প্রেরিত প্রেমপত্র বুকে নিয়ে সঠিক নাম খোঁজেন আর পতঙ্গসম পাখির উড়ানে হাজারো ফুল, প্রতিদিন, ছন্দে-লয়ে, বর্ণের বাগান অতিক্রমনের স্বপ্ন দেখেন। সহজ এবং প্রাচীন মাত্রাবৃত্তে লেখেন – ...পক্ষীকুল পোশাকহীন, তথাপি না-নগ্ন

তাই দাও পালকগুচ্ছ, হই মিলনমগ্ন। ... [নারিকেল তলে] 

আবার ‘তথাপি’ – দেখেছেন পাঠক? এরকম আরো অজস্র উদাহরণ আছে – এই কবিতার নামটাই তো ‘নারিকেল তলে’ – জীবনানন্দকে মনে পড়ে না? আবার অন্যত্র যেন ঢোল বাজাতে বাজাতে বা নাচতে নাচতে অতি পরিচিত ছড়ার ছন্দে লিখছেন – 

তাজ মহলের গায়
ছিদ্র দেখা যায়।
কাহার আঁধার, কাহার আলোক, লজ্জা কে লুকায়! ... [তাজ মহলের গায়]

এখানে ‘ছিদ্র’ ও ‘কাহার’! ‘আমি কোন্‌ কেতনতলে চুমু আঁকলে / আমার, তোমার সঙ্গে শুরু হয় অবিরল জীবন বদল?’ [আমার চুম্বন মাত্র]। ‘তুমি কোথা! আমি পানি, গড়াই কর্দমে’ [পুলিশি ট্রাকের নিচে]। ততসম শব্দ নিয়ে বাঙলা সাহিত্যে এ ধরণের কাজ সম্ভবত শেষ করেছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এই সাধু-অসাধু শব্দের মিশেলে আজকের বাংলা সাহিত্যে বিরল এক সম্পূর্ণ নিজস্ব কাব্যশৈলী তৈরি করেছেন কবি হামিদী। 

“Man is least himself when he talks in his own person. Give him a mask, and he will tell you the truth.” (Oscar Wilde) দাড়িপাল্লা হাতে কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে সত্য প্রকাশের রীতি বিচারালয়ে। কবিরও দায় সত্য কথনের। একমাত্র মুখোসের আড়াল থেকে লেখা হয় বলেই শেষ অবধি কবি ও পাঠক উভয়ের কাছেই কবিতা সৎ ও সার্বজনীন।

...আমি কাজী নজরুল অনুধাবনে বিফল বলে
প্রাচীন কবর থেকে উঠে
শীর্ণ গোরস্তানের সীমান্তে একাকী দাঁড়িয়ে
ডুকরে কাঁদছেন আমার বংশপিতা। ... [আমি কাজী নজরুল অনুধাবনে ব্যর্থ]

এই কবিতাটির মধ্যে আরো কিছু কিছু অভিনব আলোর ইঙ্গিত আছে, যা পাঠক হিসেবে আমাকে ঋদ্ধ করেছে – 
...জগদ্ব্যাপী এমন মহত্ত্ব
না ঘটলে আমারই চক্ষু এতো কালো কিংবা
রক্ত এভাবে মন্দ্রিত হতো কিনা মালুম হবার
খানিক আগেই আছড়ে-পড়া ঢেউয়ের কিনারে
আমিই সটান, মৃত। তবুও পর্যাপ্ত খোলা আমারই দু’চোখ জুড়ে
মা তাঁর নামাজ শেষে দৈনন্দিন বাজারমুখো ঋণগ্রস্ত পিতার
হাতে নির্দ্বিধায় গুঁজে দেন সংরক্ষিত কাবিনের অংশ
স্বর্ণালংকারের
কয়েকটি টুকরো। 

প্রথম কথা, যা আগেই বলেছি, কবি হামিদীর তৎসম-ঝোঁক ও সাধু-অসাধু শব্দ নিয়ে বিপজ্জনক খেলা এবং প্রত্যেকবারেই সগৌরবে জিতে যাওয়ার নেশা – ‘চক্ষু’র পাশে ‘চোখ’ অথবা ‘পিতা’র পাশাপাশি ‘মা’ – এ তো আছেই। তৎসহ এ কবিতায় কবির পংক্তিবিভাজনও চলতি বিন্যাস পদ্ধতির থেকে একদম অন্যরকম ও দুর্দান্ত সাহসী। লক্ষ্য করুন পাঠক, অন্য যে কোনো কবি এই একই শব্দশৃঙ্খলে লিখতেন এইরকম বিন্যাসে – জগদ্ব্যাপী এমন মহত্ত্ব না ঘটলে / আমারই চক্ষু এতো কালো কিংবা / রক্ত এভাবে মন্দ্রিত হতো কিনা / মালুম হবার খানিক আগেই / আছড়ে পড়া ঢেউয়ের কিনারে / আমিই সটান মৃত। ... কিন্তু হামিদীর কবিতার চরিত্রও কবি হামিদীর মতো স্বতন্ত্র। উনি প্রথম পংক্তি ভাঙলেন মহত্ত্ব শব্দের পরে – কেন? জগদ্ব্যাপী মহত্ত্বের বিপুল পরিসর বোঝাতে কি ঐ শূন্য স্পেস দিলেন মহত্ত্ব শব্দের পরে? আবার তৃতীয় পংক্তিতে’উপলব্ধি-টব্ধি’ নয় – একেবারে সাদামাটা যেন চা-দোকানের লঘু আড্ডা থেকে তুলে আনা ‘মালুম’ শব্দটা এই চক্ষু বা পিতার তৎসম ভীড়ে কী অনায়াসে স্বচ্ছন্দ! এবং রক্তের মন্দ্রতাকে মালুম করা তো আর চাট্টিখানি ব্যাপার নয় – তাই ‘মালুম হবার’-এর পরে শূন্য স্পেস। তেমনি ‘ঋণগ্রস্ত পিতা’র অসহায়তার প্রতিধ্বনি চাইলেন ষষ্ঠ পংক্তির শেষের শূন্য স্পেসে। স্বর্ণালংকারের – একটা আপাত দীর্ঘ শব্দ – একটা আস্ত পংক্তি। ‘কয়েকটি টুকরো’ যেন পৃথক পরিচ্ছেদ – পৃথক নির্মাণ। সর্বোপরি, মৃত্যুও কিন্তু এই কবিতায় কবির কাছে ততোটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যে সে একটা পংক্তিচ্ছেদ দাবি করতে পারে! এই রকমই পংক্তিবিন্যাসের আর একটা উদাহরণ দিই –

বর্ণিল মোড়কে ঢেকে তদুপরে সরু
ফিতের ফুটিয়ে ফুল লাল, বলিনি তো
এরকম শরমসজ্জা বিলকুল তোমার
পক্ষে অসম্ভব ব’লে আমিই পুরুষ।... ... [পুলিশি ট্রাকের নিচে] 

শুধু তৎসম শব্দই নয়, কবি হামিদী বিশ্বায়ন পরবর্তী সময়ের কবি, তাই বিদেশী আদব ও শব্দ আমার দেশজ আঙ্গিকে অনায়াস আত্মীকরণে প্রবম মুন্সিয়ানা তাঁর – 

...সব দূর্গার সমস্ত হাত খসিয়ে কবিতাপুর
ফিরিয়ে নে আজ;- অল্প ভোজনে স্বল্প পানীয়ে নাচি,
ঘরে ও বাহিরে অধিক রমণে অসি-ট্যানট্রামে বাঁচি। ... [ও বন্ধু মহিষাসুর]

অথবা এই কবিতার শিরোনাম শব্দই তো বিদেশী ভাষার। থেকেই লক্ষ্য করুন পাঠক - 

...কোথা উঠিবো, কাঁহা ছুপাঁউ, বলো তুমি হে সারথি;
না কহিলেও নর-নারীর বসবাস কি, ডরোথি,
বুঝে নেবোই নারকীয়ই! ...
তু সঙ্গম, মে রঙ্গম, আযা পুকারি জসম;
ঘর ছোড়কে দিল্‌ দুঙ্গা, মেরা আঁসু কি কসম। ... [তামান্না]

বিভিন্ন শৈলীর কাব্যছন্দের কবিতার মধ্যে এ বইয়ে পাঁচটি টানা গদ্যে লেখা কবিতা আছে – এই পাঁচটি কবিতা স্টাইলে যেমন, বক্তব্যেও স্বতন্ত্রতা দাবি করে। কেন টানা গদ্যে লেখা? পাঠক হিসেবে আমার উপলব্ধি নিম্নরূপ - 

আমাদের আধুনিক বিশ্বায়িত জীবন ও তার যাপন প্রণালী ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। আমরা জানতাম, প্রত্যেক প্রাপ্তবয়সী মানুষের মধ্যেও তার শৈশব লুকিয়ে থাকে, যা আগাপাশতলা এক সহজ সরল জল-স্বচ্ছ যাপন অভিজ্ঞতা। সেই শৈশবও তো আজকাল আর নেই। জীবন অত্যন্ত কর্কশ ও গদ্যময়। আধুনিক বাংলা কবিতাও তাই সেই জটিল নাগরিক জীবন যাপনের প্রতিচ্ছবি। 
...আশাতীতরূপে জনাকীর্ণ হয়ে-ওঠা ওই সভাস্থলে, মঞ্চের দূরস্থিত বিপরীত দিকে হতে লোকতরঙ্গের ভেতর দিয়ে ধীর বেগে মঞ্চমূখো গতিশীল রবি ঠাকুরের জামার পকেটে, সমাবিষ্ট প্রত্যেকেরই অজ্ঞাতে কে যেন পিস্তল রেখে দেয়। ...[রবি ঠাকুরের পকেটে পিস্তল] 

... আর, যারাইবা আমাকে সবান্ধব ষোলো ঘন্টা হাজতবাসে বাধ্য করে, তাদের পূর্ব ও পরবর্তী ন্যুনপক্ষে আঠারো প্রজন্মেরও অবগতির বাইরে থেকে যায় লেনিন কেন দৈনিক ষোলো ঘন্টা অধ্যয়নে অভ্যস্ত থাকেন এবং কেনইবা তাঁর উৎপাটিত মহান ভাস্কর্যের ওপর মূঢ়দের নৃত্যদৃশ্য কারুর স্মৃতিকে রক্তাক্ত করে ফের। ...[পুলিশেরও বোধগম্য নয়]

মোট ছাপ্পান্নটি কবিতা নাগাড়ে একবার দুবার নয়, বারবার পাঠ করে যে কোনো সচেতন পাঠকের বাসনা – শব্দ বুনে বুনে যে সামগ্রিক কবিতা শরীর, তাকে দেখে ছুঁয়ে কবির বোধকে স্পর্শ করা – যে কোনো সৃষ্টিমাধ্যমই আসলে তো সৃষ্টিকারের ব্যক্তিগত বাথরুমের আয়না – আমরা কবিতার মধ্যে সেই মানুষটাকেই খুঁজি – ‘ঘুমোই চশমা চোখে’ পড়ার পরে অজস্র ক্রোধ, হতাশা, রাজনীতি ছাপিয়ে শেষ অবধি কবি হামিদীর রোমান্টিক প্রেমিক সত্ত্বাই কিন্তু নায়ক হয়ে ওঠে - 

...আমার পাঁজর গলে কে তুমি বেরিয়ে এসে, কোমরে কলস,
ধীরে হেঁটে যাও তবু দিগন্তের দিকে?
খালি কলসি কাঁখে কি হেতু চলিষ্ণু তবে?
তোমার অযোগ্য আমি মলিন একখানা ছোট থলে হাতে বসে
চাওয়া-না-পাওয়ার পয়সা গুনি চিরভিখিরির হেন।
অথচ ভ্রুকুটি ছুঁড়ে জলকে নয়, দৃপ্ত চলো তুমি
আকাশ ও মৃত্তিকার বিরান বিবাহস্থলে,
কেঊ পৌঁছুবার আগে যেখানে নিবিড় বাজে হাওয়ার সানাই
আর জ্বলে অসংখ্য তারার মিটিমিটি শামিয়ানা। ... [তোমার অযোগ্য আমি]

কবি হাহাকার করছেন ‘প্রেমের কবিতা আমি লিখতে পারি না, তবু’ শিরোনামে – অন্যদিকে লিখছেন ‘বর্তুল বুকের জোড়া কিশমিশ অথবা / লিপস্টিকময় দুই ঠোঁটের বহুত্ববাদ / স্পর্শের আলপনা আঁকে আমারও নানান / অনুভবে শুধু নয়, শিরার রক্তেও’। পাঠ শেষে উঠে হেঁটে যেতে যেতে অসাধারণ একটি প্রেমের কবিতার গন্ধ অমর হয় পাঠকের মগ্ন সত্ত্বায় – 

...তোমারই শোবার ঘরে সারা রাত বৃষ্টি হয়েছিলো।
কে ছিলো তোমার সঙ্গে অথবা কী?
দীর্ঘ শস্যগুচ্ছ আর ঘামের সৌগন্ধে পূর্ণ আমার বগল,
যৌবনের কথিত রাজপুত্র এ আমারই
যুগল অপরিণত গৌর স্তন,
দিঘল গোঁফের যতো কন্টক-শলাকা
নাকি নিম্নবর্তী ওই যুদ্ধবাজ অমঙ্গল? ...
অথচ এখনো ভেজা তোমারই বিলকুল সেই রাত্রির জামায়
মুখ ঘষেও আমার জানা হলো না 
কিভাবে বাংলার 
বিগত সমস্ত বর্ষা কেবল মাত্র
সে-রাতেই একযোগে
তোমার শয়নকক্ষে অমন নির্ঘাত ঝরেছিলো। ...[তোমার শয়নকক্ষে বৃষ্টি হয়েছিলো] 

‘ঘুমোই চশমা চোখে’-র প্রচ্ছদ ভালো, যদিও কালো রঙে আমার প্রবল আপত্তি। অজস্র ভালো কবিতার মধ্যে বেখাপ্পা দু-একটি ছাপার ক্ষমাযোগ্য ভুল। কিন্তু কবিতার শিরোনামের ফন্ট হঠাৎ দুটি কবিতায় [‘পঁচিশে জানুয়ারি’(পৃ ৬১) ও ‘জল না ফুরালেও’(পৃ ২০)] সহসা অসম্ভব বড়ো – এটা দৃষ্টিকটু, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ বলে মনে হয়েছে।

শ্রেষ্ঠ শব্দাবলীর শ্রেষ্ঠ বিন্যাসে সৃষ্ট কবিতা সময়ের সাথে সাথে শ্রেষ্ঠ বিবর্তনের পরেও সাহিত্যের সবচেয়ে সূক্ষ এবং জটিল শাখা। কেননা কবিতার মধ্যে শব্দাবলী সচরাচর নতুন অর্থের ব্যঞ্জনায় বহুমাত্রিক। আর এখানেই দক্ষ শিল্পীর সার্থক কারু কাজ। শিল্পী-কবি খালেদ হামিদীকে সশ্রদ্ধ কুর্নিশ – কারণ, এ বই পড়ে ইতিমধ্যেই আমি আরো অনেকের মতো ঋদ্ধ হয়েছি ও মানুষ হিসেবে আরো দীর্ঘকায় হয়ে উঠেছি। বাঙলার প্রতিটি শোবার ঘরে খুব শিগগিরই আপনার কবিতা বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে – এই আশায় রইলাম। 
0

বইঘর - রঞ্জন রায়

Posted in


বইঘর
রঞ্জন রায়



নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা
— একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া 

[এটি সন্মাত্রানন্দ রচিত “নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা- অতীশ দীপংকরের পৃথিবী” উপন্যাসটির পুস্তক সমালোচনা নয়, সে যোগ্যতা আমার নেই, -- বড়জোর এক মুগ্ধ পাঠকের প্রতিক্রিয়া বলা যেতে পারে। ] 

পাতা ওল্টাতেই বিস্ময়। দর্শনের গুঢ় এবং কূট প্রশ্ন ও কয়েক শতাব্দী আগে জন্মানো এক ক্ষণজন্মা বাঙালী মেধা অতীশ দীপংকরকে নিয়ে উপন্যাস লেখার কথা ভেবেছেন প্রথম জীবনে রামকৃষ্ণ মিশনে সেবাব্রতী এক সন্ন্যাসী! এই পাঠকের মিশনের সঙ্গে যতটুকু সম্পর্ক তাতে ওখানকার সন্ন্যাসীরা গৌতম বুদ্ধকে জয়দেব গোস্বামীকৃত দশাবতার স্তোত্রের বেঁধে দেয়া ভূমিকা অনুযায়ী বিষ্ণুর এক অবতার --‘নিন্দসি যজ্ঞবিধেয়রহযাতম, সদয়হৃদয়দর্শিতপশুঘাতম’ হিসেবে ভাবতেই অভ্যস্ত। 

কিন্তু ‘অনাত্মবাদীন’ ‘ক্ষণিকবাদীন’ বৌদ্ধদর্শন মিশনের জীবনে কোন অভিঘাত সৃষ্টি করে না। কারণ রামকৃষ্ণদেব ও বিবেকানন্দের আধ্যাত্মিক মানসভূমি বেদান্ত এবং ধর্মাচরণের বাহ্যিক দিকটি শাক্তমত ও তন্ত্র আশ্রিত। ঠাকুরের ভৈরবীসাধনা ও বেলুড়ে কালীপূজোর রাতে পশুবলি জনসাধারণের গোচরে। 

অথচ বইটি ইতিহাসের গবেষণাপত্র নয়, কোন দার্শনিক পাত্রাধার-কি-তৈল কিংবা তৈলাধার-কি-পাত্র বিচারে কণ্টকিত গ্রন্থ নয় । এটি আদ্যন্ত নিটোল একটি উপন্যাস। ইহাতে কল্পনার যাদুমিশ্রণ, প্রেম-প্রত্যাখ্যান-বিরহ-বলিদান-প্রতিহিংসা-জয়-পরাজয় সবই আছে। 

উপন্যাসটি লিখলেন সন্মাত্রানন্দ! প্রথমেই সংশয়। একজন গার্হস্থ্যজীবন পরিত্যাগী মানুষ কী করে ফুটিয়ে তুলবেন ষড়রিপুর তাড়নায় জ্বলেপুড়ে খাক হওয়া মানুষের ছবি? যিনি এই রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের জগতকে অবিদ্যাজনিত মিথ্যাত্বের সাময়িক সৃষ্টি বলে মেনে নিয়েছেন তাঁর কলমে কী করে ফুটবে এর সৌন্দর্য ও কন্টকিত রূপ? এই পূর্বাগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। 

অবশ্য সন্ন্যাসীর সাহিত্যচর্চা একেবারে কালাপাহাড়ি কিছু নয়। স্বামী বিবেকানন্দ লিখেছেন ‘সখার প্রতি’ ও ‘দি কাপ’ এর মত কবিতা। আর রচেছেন অতি আধুনিক বাংলায় ছোট ছোট বাক্যবন্ধে ‘প্রবাসে’র মত জার্নাল। পণ্ডিচেরির নিশিকান্তের কবিতাও স্মরণীয়। তবে সেসব আধ্যাত্মিক বক্তব্যের কাব্যরূপ। কবিতার শৈলীর আবশ্যকীয় বিমূর্ত মাত্রা সেই স্পেস দেয় । কিন্তু গদ্যরচনা? বিশেষ করে উপন্যাস? এখানে তো চরিত্ররা রক্তমাংসের, সময় অতীতচারী হয়েও ছুঁয়ে যাবে সমকালের যন্ত্রণাকে, নইলে তা পর্যবসিত হয় জাদুঘরের দ্রষ্টব্যে। উপন্যাস লেখার এ’সব ঝামেলার সঙ্গে সন্মাত্রানন্দ সম্যক অবহিত। তাই বইটির প্রস্তাবনায় তিনি অকপট—“ – অতীশ দীপংকরের জীবনেতিহাস এ উপন্যাসের আশ্রয়, কিন্তু বিষয় নয়।– শাশ্বত মানবীসত্তাই ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু। কখনও সে-নারীসত্তার নাম কুন্তলা, কখনও স্বয়ংবিদা, কখনো –বা জাহ্নবী”। 

গজব রে গজব! এই সংশয় শুধু আমার নয়। বইটি পড়ে জানতে পারলাম যে মিশন কর্তৃপক্ষ ও একই দোলাচলে ভুগেছেন সন্মাত্রানন্দের সাহিত্যকৃতি নিয়ে, অবশ্য আমার বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে। তাই একদিন তাঁকে নিজের ঝোলা কাঁধে তুলে মিশন থেকে বেরিয়ে আসতে হল। শ্রেয় ও প্রেয়র দ্বন্দ্বে উনি কলমকেই বেছে নিলেন আর আমরা পেলাম এই উপন্যাসটি। 

এই ঘটনাটি, এই কঠিন নির্ণয় তাঁর মানসে এক অমিট ছাপ ফেলেছে। তাই বইটির কথক হিসেবে নিজের জীবনের আদলে বর্ধমান থেকে কোলকাতায় এসে সোনারপুরের হোস্টেলে থেকে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে স্ট্যাটিস্টিক্সে এম এস সি করে সন্ন্যাসী হওয়া এবং সাহিত্যচর্চার তাগিদে মিশন থেকে বেরিয়ে এসে লেখক হওয়া শাওন বসু চরিত্রটির নির্মাণ। তাই ভিক্ষু মৈত্রীগুপ্ত বিক্রমশীলা বিহারে সঙ্ঘনির্দিষ্ট আচারবহির্ভূত আচরণের জন্যে অতীশ দীপংকরের আদেশে সঙ্ঘ থেকে বহিষ্কারের মুখোমুখি হয়েও অবিচলিত শান্ত ও নির্বিকার থেকে যান । 

এবার আসি মূল বইটির কথায়। এর ‘কথনশৈলী’ আদৌ একরৈখিক নয় । এতে সময় তিন খন্ডে বিভক্ত—দশম শতকের শেষ থেকে একাদশ শতক,ত্রয়োদশ শতক ও একবিংশ শতক। কিন্তু এই ত্রিস্তর কালখণ্ডগুলো বিচ্ছিন্ন (ডিস্ক্রিট) নয়; বরং ‘ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বস্তুত একই সমতলে অংকিত পরস্পরছেদী তিন বৃত্তের মতন। এর পর আরও জটিল গঠন চোখে পরে । যেমন, “ওই তিনটি বৃত্তের ছেদবিন্দুগুলোর মধ্য দিয়ে কোনো কোনো বিশেষ মুহূর্তে এক যুগের চরিত্রগুলোর সঙ্গে অন্য যুগের চরিত্রদের’ দেখা হয়ে যায়, বিনিময়ও হয়। 

একে কী বলব? বাঙলাভাষায় লেখা প্রথম জাদু-বাস্তবতার উপন্যাস? জানি না । সেই নান্দনিক বিচারের ধৃষ্টতা আমার নেই । তবে আমি বলব যে এই প্রচেষ্টায় লেখার প্রসাদগুণ, কালোপযোগী ভাষার পরিবর্তন ও লেখার টান আমাকে বাধ্য করেছে সারারাত জেগে একটানা পড়ে উপন্যাসটি শেষ করে পরের দিন দুপুরে পাঠ-প্রতিক্রিয়া লিখে ফেলতে। কারণ, দেরি করলে সেটা হবে সুচিন্তিত এক সমীক্ষা; আতসকাঁচে ধরা পড়া অনেক ফাঁকি-ফোকর। কিন্তু উপে যাবে আমার তাৎক্ষণিক ভালো লাগা, পূর্বাগ্রহ কাটিয়ে মুগ্ধতায় ভেসে যাওয়া। 

কেন মুগ্ধতা? 

প্রথম কারণটি সন্ন্যাসীর কলমে প্রকৃতি ও নারীর রূপবর্ণনা, তাও একজন সাধারণ পঞ্চেন্দ্রিয়তাড়িত পুরুষের রূপমুগ্ধতার দৃষ্টিতে। কোথাও কোথাও দুই এক হয়ে গেছে। 

কাহিনীর আশ্রয় বাঙ্গালাদেশের ঢাকা- বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মানো রাজপুত্র চন্দ্রপ্রভ কেমন করে সুবর্ণদ্বীপে (ইন্দোনেশিয়া) আচার্য ধর্মকীর্তির কাছে পাঠশেষ করে বিক্রমশীলা মহাবিহারের আচার্য অতীশ দীপংকর হয়ে উঠলেন। কিন্তু মূল সুরটি হল প্রতিবেশী কিশোরী কুন্তলার বিফল কামনা, ও তন্ত্রসাধনার মধ্য দিয়ে কখনো স্বয়ংবিদা কখনও অন্যরূপে অতীশকে পাওয়ার প্রয়াস। এইভাবে এবং একবিংশ দশকে সেই বজ্রযোগিনী গ্রামে কৃষক অনঙ্গ দাসের কন্যা জাহ্নবীর মধ্যেও সেই চিরন্তন নারী হৃদয়ের আকুতির প্রকাশ। আর কালচক্রের পরস্পরছেদী তিন বৃত্তের ঘুর্ণনে চিরন্তন নারী কখনও ইয়ংচুয়া, কখনও স্বয়ংবিদা, কখনও বা জাহ্নবী। বাৎসল্য, প্রেম ও দাম্পত্যের মধ্যে নারীর তিন রূপের প্রকাশ। তাই তারাদেবীর ও তিনটি মূর্তি,--কাঠের, পাথরের ও ব্রোঞ্জের। 

এবার একটু তিব্বতী শ্রমণ চাগ লোচাবার চোখে স্বয়ংবিদার রূপ দর্শন করা যাক। 

‘শ্বেত রাজহংসের মত দৃঢ়পিনদ্ধ শুভ্র কঞ্চুলিকা, সুনীল উত্তরী পীনোন্নত বক্ষদেশকে আবৃত করে স্কন্ধের উপর বিলম্বিত ও দীর্ঘিকার মন্দবাতাসে উড্ডীন। ----- 

‘স্বয়ংবিদা প্রশ্ন করলেন, “কী দেখছ লামা? একে রূপ কহে। এই রূপসমুদ্র অতিক্রম করতে পারলে সন্ন্যাসী হবে। আর যদি অতিক্রম করতে অসমর্থ হও, যদি এতে নিমজ্জিত হও , তবে কবি হবে”। (পৃ- ১২৭) 

‘অশ্রুর প্লাবনের ভিতর অপরূপা রমণীর দৃঢ় কুচাবরণ কঞ্চুলিকা শিথিল হ’ল। শিহরিত চাগ দেখলেন, সেই সুবিপুল কনককলসবৎ স্তনকুসুমের যুগ্ম কুচাগ্রচূড়া অনাবৃত বিস্ময়ে তাঁরই দিকে উন্মুখ হ’য়ে তাকিয়ে রয়েছে। --- আহ! এ কী জ্বালা! রমণীর চুম্বনে এত বিষ , এত ব্যথা! ‘(পৃ- ১৩৬) 

আর চুয়াল্লিশটি অধ্যায়ে বিবৃত ও প্রায় ৩৫০ পৃষ্ঠায় বিন্যস্ত এই উপন্যাসটিতে ধ্রুবপদের মত ঘুরেফিরে আসে একটি বৌদ্ধ তান্ত্রিক দোঁহা—‘ যখন বৃক্ষরাজির ভিতর দিয়ে বহে যাবে সমুষ্ণ বাতাস/ নদীর উপর ছায়া ফেলবে গোধুলিকালীন মেঘ/ পুষ্পরেণু ভেসে আসবে বাতাসে/ আর পালতোলা নৌকো ভেসে যাবে বিক্ষিপ্ত স্রোতোধারায়---/ সহসা অবলুপ্ত দৃষ্টি ফিরে পেয়ে তুমি দেখবে—আমার কেশপাশে বিজড়িত রয়েছে অস্থিনির্মিত মালা;/ তখন –কেবল তখনই আমি তোমার কাছে আসব ---‘। 

দ্বিতীয় মুগ্ধতা সন্ন্যাসী লেখকের সমকালের রাজনৈতিক ও সামাজিক পটপরিবর্তনের প্রতি সজগতা ও সংবেদনশীলতা। বিশ বছর পরে কলকাতায় ফিরে এসেছে স্বামী শুভব্রতানন্দ, পূর্বাশ্রমের শাওন বসু হয়ে। দেখছে এই কোলকাতাকে সে চিনতে পারছে না । 

‘উড়াল পুলের ঘোমটা আর বাইপাসের ওড়না পরেছে কল্লোলিনী।--- কলকাতার নিজস্ব সম্মান ছিল তার কৃষ্টিতে, তার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে, এখন ব্যবসায়ীদের হাতে বিকিয়ে গেছে। ক্রমশঃ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে মানুষ, কেমন খিঁচিয়ে কথা বলে আজকাল সবাই। কেউ কাউকে একটু সরে বসে জায়গা দিতে রাজি নয়’। 

আবার দেখুন রাজনীতির ক্ষেত্রে ‘ আদর্শ কিছু নয় ক্ষমতাই সব। --- কেন্দ্রে সমাসীন এই ধর্মধ্বজীরা যাকে হিন্দুধর্ম বলে মানে, সেটা পৌরাণিক হিন্দুধর্মেরও একটা অবক্ষয়িত রূপ। এবং তারা নিজেদের সবথেকে বড়ো দেশপ্রেমিক বলে মনে করে। অহিন্দুরা কি ভারতীয় নয়?’ 

জে এন ইউয়ের কানহাইয়া কুমারের ঘটনায় বিচলিত প্রাক্তন শিক্ষক সন্মাত্রানন্দ লেখেন—‘ গ্রেপ্তার হয়ে গেল ছাত্রটি। বিচারের আগেই দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের প্রাঙ্গণে আইনজীবীরা ছেলেটির ওপর প্রচণ্ড প্রহার চালাল। ---- 

‘ছাত্ররা কি রাজনীতি করবে? নাকি, ছাত্রাণাং অধ্যয়নং তপঃ? (আহা! কী অভিনব চিন্তা!)বিচারের আগেই আইনজীবীরা কি আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারেন? তাঁদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে না কেন কেউ? এসব বহু তাত্ত্বিক আলোচনার অন্তে ছাত্রটি যখন ছাড়া পেল, তখন রাজনৈতিক দলগুলি এই যুবক ছাত্রটির মধ্যে তাদের মেসায়াকে খুঁজে পেতে লাগল’।(পৃ-১৪৩)। 

তৃতীয় কারণ, পৃ-১৫৬তে মতবাদ ও সত্যের আপেক্ষিকতা নিয়ে প্রাঞ্জল ব্যাখ্যাটিঃ 

‘মানুষ সত্যের এক-একটি রূপ কল্পনা করে মাত্র। আর সত্যের উপর আরোপিত বা কল্পিত সেই সব রূপকেই ‘মতবাদ’ কহে। অধিকারীবিশেষে প্রতিটি মতবাদই প্রাথমিকভাবে উপকারী, কিন্তু কোনও মতবাদই সত্যকে সাক্ষাৎ দেখিয়ে দিতে পারে না । যুক্তি প্রয়োগ করলে সমস্ত মতই অন্তিমে খণ্ডিত হয়ে যায়’। 

বিতর্কসভায় দীপংকরের মুখে এই বাক্যটিতে এক লহমায় ধরা পরে সমস্ত ‘বাদ’, --হিতবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ, জাতীয়তাবাদ থেকে সমাজবাদ ও মার্ক্সবাদ—এর উপযোগিতা ও সীমাবদ্ধতা। জীবন চলমান আর সমস্ত ‘বাদ’ দেশ ও কালে আবদ্ধ। তাই স্থবির। 

মুগ্ধতার শেষ কারণটি একটু ব্যক্তিগত। পৃষ্ঠা ৮৬ থেকে পাচ্ছি অতীশ দীপংকরের ভাবনাবিশ্ব। এখানে পৌঁছে চমকে গেলাম। প্রাক্তন বৈদান্তিক সন্ন্যাসী কত সংক্ষেপে ও সহজ করে দীপংকরের অনুভবের মাধ্যমে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করছেন বৌদ্ধদর্শনের সার। বিশেষ করে এই দুটো তত্ত্ব--তার ‘ল অফ কজালিটি’ বা কার্য-কারণ সম্পর্ এবং নির্বাণ বলতে কী বোঝায়। আর বৌদ্ধদের মধ্যেও সেই ধারণাগুলির বিবর্তন। প্রতি বিষয়ে প্রাচীন সর্বাস্তিবাদী ও সৌত্রান্তিক( মোটা দাগে হীনযানী) এবং শূন্যবাদী ও বিজ্ঞানবাদীদের ( মহাযানী) মধ্যে কোথায় তফাৎ ইত্যাদি। এই প্রসঙ্গে তুলে ধরেছেন মহাযান ও হীনযান নামের উদ্ভব ও সার্থকতা। উঠে এসেছে আদি বুদ্ধিজম ও পরবর্তী সংশোধনের যাথার্থ্য নিয়ে বিতর্ক। অনেকটা যেন ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট প্রভেদ, বা কম্যুনিস্ট শিবিরের গোঁড়া মার্ক্সবাদী ও সংশোধনবাদীদের বিতণ্ডা। 

আমি কয়েকবছর আগে কাংড়ার ধর্মশালায় তিবেতান ইন্সটিট্যুট এর বারান্দায় এক তরুণ লামাকে চেপে ধরে বৌদ্ধদর্শনের কার্য-কারণ তত্ত্ব (পতীচ্চসমুৎপাদ) বোঝার চেষ্টা করি। এঁরা নাগার্জুনের মাধ্যমিক দর্শন বা শূন্যবাদের অনুগামী। তারপর দিল্লির টিবেট হাউসে অধ্যক্ষ লামার দর্শন ক্লাসে যাই ও ‘গতে গতে পারাগতে’র ব্যাখ্যা শুনি যা এই উপন্যাসে দীপংকরের ভারতে গুপ্তভাবে গ্রন্থ পাঠানোর প্রয়াসে কোড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তারপর মন না ভরায় কোলকাতায় থেরবাদীদের প্রধান ভিক্ষু সুমনপালের কাছে যাই। উনি মিলিন্দ-পঞহো অর্থাৎ রাজা মিনান্দার ও ভিক্ষু নাগসেনের মধ্যে প্রশ্নোত্তর পড়তে বলেন। 

কিন্তু এখানে এই বারো নম্বর অধ্যায়ে সন্মাত্রানন্দ সংক্ষেপে সুন্দর বুঝিয়েছেন। 

“ ইতি ইমস্মিং সতি, ইদং হোতি। ইমসসুপ্পাদা, ইদং উপজ্জতি।–যদি এই কারণটি উপস্থিত থাকে, তবে এই ফল হবে। কারণ উৎপন্ন হলে কার্যও উৎপন্ন হবে। ইতি ইমস্মিং অসতি, ইদং ঞ হোতি। ইমস্ম নিরোধা, ইদং নিরুজ্ঝতি। -- যদি এই কারণ না থাকে তাহলে এই ফলও থাকবে না । কারণটির নিরোধ হলে কার্যটিও নিরুদ্ধ হয়ে যাবে”। (এখানে কি লেখক এই ধারণাটির একটি প্রচলিত ব্যাখ্যা ‘ডিপেন্ডেন্ট অরিজিনেশনে’র পক্ষে?) 

তারপর এসেছে এই কার্য-কারণ শৃংখলার বারোটি কড়া বা নিদান; যথাক্রমে অবিদ্যা, সংস্কার, বিজ্ঞান, নামরূপ, ষড়ায়তন, স্পর্শ, বেদনা, তৃষ্ণা, উপাদান, ভব, জাতি ও দুঃখ। এর একটি থাকলেই অপরটি থাকবে, একটি চলে গেলেই অপরটিও নির্বাপিত হবে। আর এই চক্রাকারে আবরতনের নাভি হল তৃষ্ণা। তাই নির্বাণপ্রাপ্তির জন্যে জয় করতে হবে সমস্ত তৃষ্ণাকে, এমনকি নির্বাণের তৃষ্ণাকেও! কোথাও কি এলিয়টের নাটক ‘মার্ডার ইন ক্যাথিড্রাল’ এ রাজদন্ডে মৃত্যুর আগে বিশপ অফ ক্যান্টারবেরির কাছে শহীদ হওয়ার লোভ ত্যাগের প্রস্তাবের কথা মনে পড়ছে! 

তারপর এল পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত করে এল এই নির্ণায়ক কথা যে রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান বা আত্মচেতনার প্রবাহ –এই পঞ্চস্কন্ধ মিলেই ‘আমি’। এর বাইরে আর কোন জ্ঞেয় বস্তু নেই । 

তারপর বিতর্কসভার মধ্য দিয়ে আমরা হীনযান ছেড়ে মহাযানে পৌঁছালাম, আরও বলতে গেলে অসঙ্গ –বসুবন্ধুর বিজ্ঞানবাদে। এখানে সন্মাত্রানন্দ কি মহাযানের পক্ষে একটু টেনে খেলিয়েছেন? কারণ আলয়বিজ্ঞান ও বিজ্ঞপ্তিমাত্রতার ধারণার সঙ্গে (জ্ঞাতা-জ্ঞেয় অভেদ) যে অদ্বৈত বেদান্তের (অহং ব্রহ্মোস্মি) বেশ মিল! আর উপন্যাসকারের সে স্বাধীনতা থাকে। কিন্তু সতর্ক লেখক ধরিয়ে দেন যে বৌদ্ধমতে সকলই ক্ষণিক, নিয়ত পরিবর্তনশীল। অন্যদিকে উপনিষদের কথিত ‘আত্মা’ জীবের অপরিবর্তনীয় সত্তা। 

আমার পরিচিত অনেকের কাছে এই অধ্যায়টি বাহুল্য এবং কাহিনীর গতিরোধক মনে হয়েছে। আমার তা মনে হয় নি। উপন্যাসে কাহিনীর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ দেশ-কাল-চরিত্রকে এবং তাদের মধ্যের সংঘাতকে তুলে ধরা। তাই ভাল উপন্যাসে একটি ডিসকোর্স থাকবেই। আর এই দার্শনিক অভিঘাতের মধ্যেই রয়েছে দীপংকর চরিত্রের অনীহার বীজ যা তাকে সংসার , ঐশ্বর্য এবং নারীর প্রেমের আহবানকে প্রত্যাখ্যান করতে প্রেরিত করে। 

আমার মুগ্ধতার চতুর্থ কারণ, আচার্য ধর্মকীর্তির চরিত্রচিত্রণ ও তাঁর সঙ্গে অতীশ (চন্দ্রগর্ভ) এর আলোচনায় বৌদ্ধদর্শনের নির্বাণ ও বোধিলাভের সঙ্গে আপামর জনসাধারণের ব্যক্তিক ও সামাজিক জীবনে অবিচার ও অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার অনুসন্ধান করা। 

ধীমান আচার্য ধর্মকীর্তি বুদ্ধিষ্ট লজিকের বিরাট ব্যক্তিত্ব, ‘প্রমাণবার্তিকে’র মত গ্রন্থ লিখেছেন। আর একদিকে সহজ সরল ও বালকের মত কৌতুক ও পরিহাসপ্রিয়। ছবিটি মিলে যায় পঞ্চাশ বছর আগে কোলকাতায় প্রকাশিত অবন্তীকুমার সান্যাল ও জয়ন্তী সান্যাল সম্পাদিত ‘হাজার বছরের প্রেমের কবিতা’সংকলনে ধর্মকীর্তির রচনা বলে প্রকাশিত একটি চার লাইনের কবিতায়। যার সারাংশ হচ্ছেঃ 

নারীকে দেখেই আমি বুঝেছি ভগবান বুদ্ধের কথাটি যথার্থ যে এই বিশ্বের স্রষ্টা কোন ঈশ্বর হতে পারে না। কারণ, তাহলে নারীকেও ঈশ্বরই সৃষ্টি করতেন। তারপর কি তিনি তাঁর এই অপরূপ সৃষ্টিকে ছেড়ে দিতেন! 

উপন্যাসের ১১০ পাতায় সংশয়দীর্ণ ধর্মকীর্তি শিষ্য অতীশ দীপংকরকে প্রশ্ন করেনঃ 

পীড়িত জনতা আনন্দময় জীবনের স্বপ্ন দেখে। তারা নির্বাণ চায় না, বাঁচতে চায় । তারা চায় দূঃখ-অতিক্রমী আনন্দময় জীবনযাপনের কৌশল। তাদের এই চলমানতার দর্শন যদিও কী বৈদিক, কী শ্রামণিক শাস্ত্রদ্বারা সমর্থিত নয়, তবু আস্তিক, নাস্তিক, লোকায়ত, উপাসনাকেন্দ্রিক সকল প্রকার চিন্তাকেই তা আত্মস্থ করে নিয়ে সমাজজীবনে স্থান দিয়েছে। ‘আমি তাই ভাবি, বস্তুত আমাদের ধর্মদেশনা কি লোকসাধারণের উপকার করে? অথবা, আমরাই লোকসাধারণের দ্বারা উপকৃত হই?’ 

এ সংশয় একেবারেই ঘটমান বর্তমানের সংশয়। আমাদের সবার মনেই অহরহ এ প্রশ্ন ওঠে, নানাভাবে। 

আবার তরুণ অতীশ বলেন— যে কোনও যুগেই পরপীড়ক রাজশক্তি লোকসাধারণের ওই দারিদ্র্যবিজয়ী দুঃখজয়ী জীবনীশক্তি শোষণ করে নিতে চায়, কিন্তু তা নিবিয়ে দিতে পৃথিবীর তাবৎ নৃপতিই অসমর্থ। 

এ যেন রবীন্দ্রনাথের ‘ওরা কাজ করে’ পড়ছি বা শুনছি ‘জরুরী অবস্থার’ দিনে ফক্কড় কবি বাবা নাগার্জুনের লেখা দুটি লাইনঃ 

‘সুকখী ঠুট পর বৈঠ কর কোয়েলিয়া কর গই কুক, 

বাল বাঁকা না কর সকী শাসন কা বন্দুক।“ 

অস্যার্থঃ 

শুকনো ডালে বসেও কোয়েল দিচ্ছে কুক, 

ঠেকাতে পারল কই তাকে ক্ষমতার বন্দুক. 

তাহলে এই পরীক্ষামূলক আঙ্গিকে লেখা উপন্যাসটি কতদূর সার্থক? আমার কাছে এ প্রশ্ন অবান্তর। অনেক সমীক্ষকের মতে দার্শনিক বিতর্কের মধ্যে কোথাও মাঝখানে দাঁড়ি টেনে দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে ষড়দর্শনকে প্রতিযোগী করে না দেখিয়ে একই মননের বিভিন্ন ভাবের প্রকাশ হিসেবে দেখানো যেন একটু জোর করে হয়েছে। আর এক সমীক্ষকের মতে ভাষায় কোথাও কোথাও সমস্যা আছে। কিছু শব্দের তদ্ভবীকরণ যেন ঠিকমত দাঁড়ায়নি। 

এহ বাহ্য। চারদিকে সিরিয়াল-গন্ধী উপন্যাসের প্লাবনের মধ্যে এই আখ্যানটি এক আনন্দদায়ক ব্যতিক্রম। 

আজকের এই অসূয়া-হিংসা- অনাচার- মদগর্বী পশুতার দিনে ভারতে বুদ্ধের বাণী, মাত্র শান্তিজল ছিটানো নয়, হিংসার অসারতা, অনিত্যতা ও আত্মঘাতী প্রবণতাকে বোঝা একান্ত জরুরী হয়ে পড়েছে। চাইব, এই বইটি আরও লোকে পড়ুক, আলোচনা করুক।