0

সম্পাদকীয়

Posted in





সম্পাদকীয় 

উৎসবের দিনগুলি আপাতত অতিক্রান্ত। এর মধ্যে ঘটে গিয়েছে দু'দুটি ইন্দ্রপতন। আলোর উৎসবের পরদিন চলে গেলেন বাঙালির চিরকালীন অপু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। প্রায় চল্লিশ দিন অসুস্থ ছিলেন তিনি। সবাই আশা করেছিলেন তিনি সুস্থ হয়ে আবার ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন। তা হলো না। 

আর এর দুদিন পর জার্মানির হির্শবার্গ-এ প্রয়াত হলেন এই সময়ের এক শ্রেষ্ঠ ভাষা শিল্পী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। এও এক আশ্চর্য সমাপতন! একই সময়কালের মধ্যে নিজ নিজ জগতে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন এই দুই শিল্পী - কবিতা ছিল যাঁদের হৃদয়ের অন্তঃস্থলে। 

এদিকে অতিমারির আগ্রাসন কিছুটা হলেও মনে হয় স্তিমিত। কিন্তু যতদিন এর প্রতিষেধক আমাদের হাতে না আসছে, ততদিন সাবধানের মার নেই। চারপাশের নিরাশার মধ্যে তবুও খুঁজি আশার জোনাকি।

শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন মিত্র

Posted in


তখন রাত একটা বাজে। সকাল থেকেই টেলিভিশনের সামনে বসে ছিলাম। একটিবারের জন্য উঠতে পারিনি। সারাদিন শুধু অঝোরে কান্না। এ কান্না স্মৃতি হয়তো আমার জীবনের শেষ সজ্ঞান মুহূর্ত পর্যন্ত থেকে যাবে। চল্লিশ বছরের সম্পর্ক, কম দিন নয়- আজ যেন একটা সমাপ্তির সামনে এসে দাঁড়াল। চল্লিশ বছরের সম্পর্ক কথাটা যেমন সত্য, আবার এটাও ঠিক যে সম্পর্ক সবসময় সমান ঘনিষ্ঠতার চেহারায় ছিল না। নানান উত্থান-পতন, ওঠা নামা গেছে। কিন্তু তাঁর সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে আমার কোনও সাময়িক বিচ্ছেদও কখনও ঘটেনি। একটি বারের জন্য তাঁর কাজের প্রতি আমার কোনও অনাগ্রহ তৈরি হয়নি। আজ একরাশ শূন্যতার সামনে আমি বসে আছি। ব্যথায় বুকটা টানটান করছে, পাঁজর ভেঙে যাচ্ছে- প্রথম ছবি ওঁর সত্যজিৎ রায়ের অপুর সংসার; আপর্ণার আকস্মিক মৃত্যুর পরে প্রায় বৈরাগী, জীবনবিমুখ অপু তার প্রাণের চেয়ে প্রিয় আত্মজীবনীমূলক উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির পাতা এক এক করে উড়িয়ে দিচ্ছে বনজঙ্গল, পাহাড় ঘেরা নিসর্গে। সময় যেন স্তব্ধ দুঃখে নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে অপুর সামনে, চারিদিকে শুধু অসীম শূন্যতা। এইক্ষণে আমার মনের অবস্থাও যেন কতকটা অপুর-ই মতন।

পথের পাঁচালী, অপরাজিত, পরশপাথর, জলসাঘর - সত্যজিৎ রায়ের করা হয়ে গেছে তখন। এই চারটি ছবির কোনটাতেই প্রচলিত কোনও নায়কের প্রয়োজন পড়েনি; যেমন দরকার হল অপুর সংসারের বেলায়। সেই সময়ে বাংলায় সিনেমার কোনও নায়ক/অভিনেতা-কে সত্যজিৎ রায় নিজের ছবির নায়ক করে তুলতে রাজি ছিলেন না। তাঁর প্রয়োজন হল নিজস্ব এক নায়ক নির্মাণের। নিজের মনের মতো গড়ে নিলেন সৌমিত্র-কে। সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণের পরে, তাঁকে নিয়ে লেখা অসামান্য গ্রন্থ- ‘মানিকদার সঙ্গে’, সৌমিত্র লিখেছিলেন- ‘উনি অসাধারণ যত্ন ও ভালোবাসায় শেখাতে চেয়েছিলেন আর আমি শিখতে চেয়েছিলাম। উনি যা চেয়েছিলেন, তা ওঁকে অনুসরণ করেই করতে পেরেছিলাম বলে মনে হয়। উনিও তখন যথেষ্ট পরিণত বয়সের মানুষ নন, সেই প্রথম অ্যাডাল্ট অপুকে নিয়ে কাজ করবেন। সে জন্য যথেষ্ট সতর্ক হয়ে কাজ করছিলেন এবং আমাকেও তৈরি করে নিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, উনি কিন্তু অন্য কোনও অভিনেতার জন্য এতটা সময় দেননি, এতটা উদ্যোগ নেননি।’ প্রথম ছবিতে সৌমিত্র সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনাকে আত্মস্থ করে অভিনয়ে এমন উৎকর্ষ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন- যা শুধু বিশ্বমানেরই নয়, সিনেমার আন্তর্জাতিক মানের শ্রেষ্ঠ অভিনেতাদের অভিনয়ের সমতুল্য। প্রথম ছবিতেই সৌমিত্র দেশে-বিদেশে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এদেশের সিনেমার অভিনয়ে এক নতুন অভিনয় ধারার সূচনা হয় তাঁরই হাত ধরে। অপর্ণা সেন, সৌমিত্র বিষয়ক এক নিবন্ধে, সঠিকভাবেই লিখেছিলেন- 'পুলুদা(সৌমিত্র ডাকনাম) বাংলা ছবির অভিনয় ধারায় এক নতুন দিক উন্মোচন করেছেন। খুব স্বাভাবিক, বাস্তব আর জীবন্ত অভিনয়ের এক নতুন ধারা এনেছেন তিনি৷' অপুর সংসার ছবিতে অভিনয়ের পরে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সিনেমায় তাঁর যে যুগ্ম পরিক্রমণ শুরু হয়েছিল, সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণেরর পূর্ব মুহূর্ত অবধি তা নিরবচ্ছিন্ন থেকেছে। ১৯৯০ সালে কলকাতার সিনে সেন্ট্রালের আয়োজনে সৌমিত্র রেট্রোস্পেকটিভ 'তিন দশকের সৌমিত্র' অনুষ্ঠানে সত্যজিৎ রায় লিখেছেন- 'সৌমিত্রর ওপর আমার নির্ভরশীলতা আমার শিল্পী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বজায় থাকবে, এটা আমি জানি।'

অপুর সংসারের পরের বছরের সৌমিত্রর দুটি ছবি ক্ষুধিত পাষাণ ও দেবী। ক্ষুধিত পাষাণ বাংলা সিনেমার সর্বকালের অন্যতম বড় হিট ছবি। খুব দ্রুত পাকাপোক্ত হয় বাংলা সিনেমায় সৌমিত্রর স্থান। এই পর্যায় ক্রমে ক্রমে মৃণাল সেন, তপন সিংহ, অসিত সেন, অজয় কর প্রমুখ বড়ো পরিচালকদের ছবিতে নানান ধরনের ভূমিকায় বিবর্তিত হতে থাকেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সমসময়ে নির্মিত তিনটি সিনেমায়, সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী চরিত্রে অসামান্য অভিনয়ের সূত্রে- [ঝিন্দের বন্দী(১৯৬১), অভিযান(১৯৬২) এবং সাত পাকে বাঁধা(১৯৬৩)] জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাংলা সিনেমার সবচেয়ে বড় স্টার ও তুমুল শক্তিমান অভিনেতা উত্তম কুমারের গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার দিনে একজন সমান্তরাল নায়ক রূপে খুব দ্রুত নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন সৌমিত্র। এই সময়কালেই বাঙালীর চিরসুন্দর বিবাদ, উত্তম বনাম সৌমিত্র- আরম্ভ হয়ে যায়- যা অদ্যবধি অব্যাহত থেকেছে। জানি না, সৌমিত্রর প্রয়াণের পরে সেই ঝগড়া বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াইয়ে পরিণত হবে কিনা! তবে এই পরিণত মধ্য পঞ্চাশের উপান্তে পৌঁছে এখন মনে হয় - সেই ঝগড়ার মধ্যে আর যাই থাকুক যুক্তি বা বুদ্ধিজনিত বিশ্লেষণের কোনও স্থান ছিল না। আমরা তর্কের উত্তেজনায় উপলব্ধি করতে ভুলে গেছি যে - আমরা কত বিরল সৌভাগ্যবান যে, প্রায় দুই দশক এই স্তরের দুজন নায়ক/অভিনেতা-কে আমরা পাশাপাশি অভিনয় করতে দেখেছি। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিনয় ধারা, অথচ কি অতুল ঐশ্বর্য, দুটি ধারা যেন পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়- একে অপরের পরিপূরক। সারা ভারতবর্ষের মানুষের কাছে এঁদের সহবস্থানের জন্য আমরা তো গর্ব করতে পারি।

প্রথম থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উদ্দেশ্য ছিল নায়ক চরিত্রের চরিত্র-অভিনেতা হওয়ার। শুধুমাত্র রোমান্টিক নায়কের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ করতে চাননি। নানান ধরনের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার অদম্য বাসনা ছিল তাঁর। নানাবিধ অনুশীলনী, নিবিড় চর্চার মধ্য দিয়ে নিজের অভিনয় শৈলী, অভিনয়ের ক্রাফটকে এমন উচ্চপর্যায়ে সম্প্রসারিত করেন যে, যখন-ই অন্য ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ এসেছে - কোথাও কখনও এতটুকু অস্বাচ্ছন্দ বোধ করেননি। চারুলতা(১৯৬৪) সিনেমায় ধ্রুপদী নায়কের ভূমিকায় তাঁর অসামান্য অভিনয় তো আজ বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অঙ্গ হয়ে রয়ে গেছে। এরই পাশাপাশি অনায়কোচিত চরিত্র - অয়নান্ত(১৯৬৪), আকাশকুসুম(১৯৬৫), বাঘিনী(১৯৬৮), তিন ভুবনের পারে(১৯৬৯)- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সম্পূর্ণ অন্যরকম অভিনয় সার্থকভাবে করতে পেরেছিলেন। চরিত্রের প্রয়োজনে নিজের অমন রূপবান চেহারাকে ডিগ্লামারাইজ করতে কখনও আপত্তি করেননি, সাহসের অভাব মনের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। নিজের নায়ক জীবনের প্রভূত পরিমাণ জনপ্রিয়তার দিনেও সৌমিত্রর অশনি সংকেত(১৯৭১), সংসার সীমান্ত(১৯৭৫), গণদেবতা(১৯৭৯), অগ্রদানী(১৯৮৩), কোনী(১৯৮৬) ছবিগুলোতে তাঁর অসামান্য চরিত্রাভিনয়ের সার্থক রূপদান ইতিহাস হয়ে আছে। সারাজীবন অসংখ্য বড় পরিচালকের অসামান্য সব সিনেমায় অভিনয়ের দুর্লভ সুযোগ সৌমিত্র পেয়েছেন (ভারতবর্ষের অন্য কোনও অভিনেতা ভাল পরিচালকের উল্লেখযোগ্য ছবিতে এমন সুযোগ পাননি)- সেই সব সিনেমায় অবিস্মরণীয় অভিনয় করে নিজেকে একজন উচ্চস্তরের ভার্সেটাইল অভিনেতা রূপে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন। মধ্য পঞ্চাশে উপনীত হয়ে যখন সৌমিত্র পুরোপুরি একজন চরিত্রাভিনেতা হয়ে ওঠেন, তাঁর উল্লেখযোগ্য পূর্বপ্রস্তুতি-দরুণ সেই সব ভূমিকায় অনায়াসে স্বাচ্ছন্দে মানিয়ে যান। 

নিজের নায়কজীবনের চূড়ান্ত সাফল্যের দিনে তাঁর তিনটি ছবিতে তিন ধরনের অসামান্য চরিত্রচিত্রন তাঁকে ভার্সেটাইল অভিনেতার স্বীকৃতি দিয়েছিল। অশনিসংকেত, সোনার কেল্লা এবং সংসার সীমান্তে কিন্তু প্রায় সম সময়ে নির্মিত। অথচ কি বৈচিত্রে ভিন্নধর্মী তিনটি চরিত্র নির্মাণে সৌমিত্র তাঁর চূড়ান্ত অভিনয় ক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিলেন। একজন অসামান্য ক্ষমতাসম্পন্ন অভিনেতা হিসেবে কমেডি চরিত্রেও খুব ভালো অভিনয় করতে পারতেন সৌমিত্র। অভিনয় জীবনের প্রায় প্রথম পর্বেই বাক্সবদল(১৯৬৫), একটুকু বাসা(১৯৬৫), হঠাৎ দেখা(১৯৬৭) এবং সত্তর দশকে নির্মিত সিনেমা বসন্ত বিলাপ(১৯৭৩), ছুটির ফাঁদে(১৯৭৫) এবং মন্ত্রমুগ্ধ(১৯৭৭)- ছবিগুলিতে প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন কমেডিয়ানদের পাশে দাঁড়িয়ে কি তুমুল হাসির অভিনয় সার্থকভাবে করেছিলেন সৌমিত্র। পুরোপুরি চরিত্রাভিনয়ে সরে আসার সময়ে তাঁর সারাজীবনের অভিজ্ঞতা, নিবিড়চর্চা ইত্যাদিকে মূলধন করে আতঙ্ক(১৯৮৬), একটি জীবন(১৯৯০), গণশত্রু(১৯৯০), শাখা-প্রশাখা(১৯৯১), মহাপৃথিবী(১৯৯১), অন্তর্ধান(১৯৯২) বা হুইলচেয়ার(১৯৯৪)- সিনেমায় অমন উচ্চস্তরের সার্থক অভিনয়ের স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। নিজের অভিনয়কে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার বিশ্লেষণ করবার এক দুলর্ভ ক্ষমতা ছিল তাঁর। মু্ক্তচিন্তা, যুক্তিবাদী মনের অধিকারী এবং অতৃপ্ত ও অসন্তুষ্ট স্বভাবের মানুষ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নিজের থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে নিজের কাজের দিকে তাকাতে জানতেন। এ ক্ষমতা সকলের থাকে না। সমস্ত পৃথিবীর সিনেমার অভিনয়ের বদলও তাঁর প্রখর দৃষ্টিতে ধরা পড়তো। দীর্ঘদিন অভিনয় কর্মে রত থাকলে অভিনয়ে একটা একঘেয়েমি আসতে পারে। সচেতন শিল্পী সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজের মৌলিক অভিনয় শৈলী, নাটক বর্জিত সংলাপ উচ্চারণ, শান্ত, নিরুচ্চার অনুচ্চ অভিনয়ের ধারা অক্ষুন্ন রেখেও নানা পরিবর্তন এনেছেন। পারমিতার একদিন বা অসুখ নয় দশকের শেষভাগে নির্মিত দুটি চলচ্চিত্রে সৌমিত্র সম্পূর্ণ অন্য এক অভিনয় করেছিলেন। ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত গৌতম ঘোষের দেখা সিনেমায় সৌমিত্রর অভিনয় তো তাঁর সারা জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হওয়ার যোগ্য। এই সময়কালে তৈরি ছবি সাঁঝবাতির রূপকথা বা আবার অরণ্যে, কালবেলা বা আরও কিছুকাল পরের ছবি পদক্ষেপ, অংশুমানের ছবি, রূপকথা নয় প্রভৃতি চলচ্চিত্রে অভিনয় আজকের দিনের বিচারেও চূড়ান্ত আধুনিক। ছ’টি দশক ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে অভিনয়ের পর তিনি একজন আধুনিক সিনেমার অভিনেতা রয়ে গেছেন- কখনও পুরনো হননি। অভিনয় জীবনের প্রায় শেষ পর্বে এসে মঞ্চে রাজা লিয়ার(নভেম্বর,২০১০; নির্দেশনা- সুমন মুখোপাধ্যায়) এবং সিনেমা ময়ূরাক্ষী(ডিসেম্বর,২০১৭; পরিচালনা- অতনু ঘোষ) অভিনয়ে সৌমিত্র তাঁর আধুনিক মনন ও ক্ষমতার সর্বোচ্চ নিদর্শন রেখে গেছেন। প্রায় সব ধরনের সিনেমার সঙ্গে নিজের অভিনয়-কে মানিয়ে নেওয়ার কারণে হাল আমলের মূলধারা ছবি বেলাশেষে বা পোস্ত- তেও তিনি আশ্চর্য ভালো অভিনয় করেছেন এবং জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকতে পেরেছেন। ভারতীয় সিনেমায় মূল ধারার ছবি ও অন্য ধারার শিল্প সম্মত সিরিয়াস সিনেমা- দুটি ক্ষেত্রেই এমন অনায়াস বিচরণ, অভিনয় ক্ষমতার সহজাত প্রকাশ- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ব্যতীত আর কাউকে স্মরণকালে ঘটাতে দেখা যায়নি। সেই দিক থেকে বিচার বিবেচনা করলে সৌমিত্র এক বিরল প্রতিভা সম্পন্ন অভিনয় শিল্পী। মানুষের জীবনের সঙ্গে নিরন্তর যোগ বিপুল পঠন-পাঠনের নিয়মিত অভ্যাস, মনন ক্ষমতা, তীব্র পর্যবেক্ষণ শক্তি, এক অদ্ভুত দার্শনিক মন, শিল্পীর সঙ্গে মানুষের দৈনন্দিন যোগ- এসবের সংমিশ্রণেও প্রায়োগিক ক্ষমতায় ভারতীয় সিনেমার একজন বিশিষ্টতম অভিনেতা হয়ে উঠতে পেরেছেন সৌমিত্র, জীবিতকালেই হয়ে উঠেছেন এক প্রতিষ্ঠান। সত্যজিৎ রায়ের নিজস্ব অভিনেতা রূপে সৌমিত্র আন্তর্জাতিক সিনেমার অঙ্গনে ক্ষমতাসম্পন্ন শ্রেষ্ঠ অভিনেতার সম্মান, মান্যতা পেয়েছেন বহুদিন আগেই, সেই বিচারে তিনি আন্তর্জাতিক সিনেমার চৌহদ্দিতে সবচেয়ে মান্যতা প্রাপ্ত ভারতীয় অভিনেতা।

বাংলা ভাষার উপর তাঁর অসামান্য দখল, উচ্চারণ, ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ নিয়ে নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষমতা- যে নিবিষ্ট চর্চার মধ্য দিয়ে তিনি আয়ত্ত করেছেন- তাঁর সংলাপ উচ্চারণে, কথা বলার যে সহজ প্রকাশ দেখা যায় অভিনয় কালে- তেমন বৈচিত্র্যময় উচ্চস্তরের প্রকাশ স্মরণকালে কোনও বাঙালি অভিনেতার মধ্যে লক্ষ করা যায়নি। আসলে সম্পূর্ণ অন্য পরিবেশ থেকে বাংলা সিনেমায় আসেন সৌমিত্র। তার মানে এই নয় যে, তাঁর আগে বা পরে আর কোনও শিক্ষিত সুদর্শন বাঙালী অভিনেতা আসেননি। অনেকেই এসেছেন। কিন্তু শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির সঙ্গে যে বিপুল সংযোগ, চর্চা সৌমিত্রর ছিল তেমন আর কারোর ছিল না। আদতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নির্মাণ করেছে এক বিশেষ সময়। অন্য এক শিক্ষায়, রাজনৈতিক বিশ্বাসে, ভিন্নতর পঠন পাঠনে, অন্যতর সংস্কৃতির উজ্জীবনে তাঁর মন ও মনন ঋদ্ধ হয়েছিল। যৌবনের শুরুর দিনগুলোয় পেয়েছিলেন দুজন অসামান্য প্রতিভা সম্পন্ন মানুষের শিক্ষা, দিকনির্দেশ- শিশিরকুমার ভাদুড়ী এবং সত্যজিৎ রায়-কে। সিনেমায় যোগদান এবং প্রথম ছবিতেই তুঙ্গজয়ী সাফল্য, তাঁর মনকে নষ্ট করতে পারেনি। এক অতি উচ্চমানের পত্রিকা এক্ষণ সম্পাদনা যুগ্মভাবে করেছেন বন্ধু নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে। সিনেমার অভিনয়ের প্রবল ব্যস্ততার মধ্যেও দীর্ঘ আঠারো বছর অক্ষুন্ন থাকে তাঁর এই পত্রিকা সম্পাদনা ও প্রকাশের সঙ্গে সংযোগ। গদ্য রচনায় প্রথম থেকেই সৌমিত্র তাঁর মৌলিক চিন্তা-ভাবনা ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার আকৈশর কবিতা লেখা অনেক সুসংহত হয়েছে তাঁর কলেজ জীবনে কবিবন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ কৃত্তিবাসী কবিদের প্রত্যক্ষ প্রভাবের ফলে। কবি সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতার পঠন-পাঠনের ফলে এবং প্রায় সমসাময়িক কবিবন্ধু শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, এঁদের প্রভাব আধুনিক বাংলা কবিতার নতুন প্রকাশরীতি বা বাচনভঙ্গি খুব দ্রুত অনুধাবন করে, নিবিড় অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ক্রমে ক্রমে একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি হয়ে ওঠেন। কবিতার প্রতি এই আজন্ম ভালোবাসা আবৃত্তিকার হিসেবে সৌমিত্রকে স্বাতন্ত্র দিয়েছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রায়াণের পরে একটি লেখায় কবি জয় গোস্বামী একদম সঠিক কথা লিখেছেন - কোনও ভারতীয় অভিনেতার একইসঙ্গে কবিতা সমগ্র, নাটকসমগ্র এবং গদ্য সমগ্র নেই- সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া। তাঁর বিপুল কবিতা লেখা, গদ্য রচনা, নাটক রচনা, রূপান্তর, আবৃত্তিকার, পত্রিকাসম্পাদনা, নাটকে অভিনয়, নাটক নির্দেশনা, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ- এ সব নিয়ে পৃথক বই লেখা যেতে পারে। বাংলা থিয়েটারে তাঁর অসামান্য অবদান, পেশাদার থিয়েটারে তার একক লড়াই- অবশ্যই আলাদা বই লিখে আলোচনা করার যোগ্য। চিত্রকর রূপেও তাঁর কাজ ইতিমধ্যে শিল্পক্ষেত্রে তাঁর সম্পর্কে অন্য এক আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। 

রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ রায়ের সর্বোচ্চ উত্তরাধিকার এসে পৌঁছেছে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বহুবিধ শিল্পচর্চার মধ্যে। তাঁর নানাবিধ কাজ, তাঁর মৌলিকচিন্তা, গভীর জীবনবোধ তাঁকে এক অনন্য সাধারণ শিল্পীর মর্যাদা দিয়েছে। শোক সন্তপ্ত ভারাক্রান্ত মন নিয়ে যখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের এত সব কাজের দিকে তাকাই, তখন মনের মধ্যে এক সান্ত্বনা পাই, মৃত্যুতে সৌমিত্রকাকু ফুরিয়ে যাবেন না। 'মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায়'- এই অমোঘ উচ্চারণ আমরা ক’জনের ক্ষেত্রে করতে পারি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়া।

2 comments:

1

প্রবন্ধ - রিজোয়ান মাহমুদ

Posted in


উপনিবেশত্তোর বাংলা কবিতা উপনিবেশিক সময়ের কিছু চেহারা নিয়ে দাঁড়াবার জায়গা খুঁজে পেয়েছিল। ঔপনিবেশিক সময়ের মনন শাসন ও সাংস্কৃতিক জটিলতা, সর্বোপরি চিন্তার অস্থির দরিদ্রতায় কবিতা স্বজাতিক ইচ্ছা থেকে অনেক দূরবর্তী ছিল এবং কিছু ভিন্ন অবয়ব স্বীকার করে নিয়েও, কবিতা ভাষা ও প্রকরণ শৈলীতে এগিয়েছিল কিন্তু মাটি ভর্তি ঘ্রাণ থেকে অবস্থান ছিল দীর্ঘ দূরে। এটি বুঝেছিল কবি বোদ্ধা ও কবিতার শিল্প শ্রমিকরা। যারা এসব বিষয়ে অনেক পরে এসে বুঝেছিল, তাদের উপর ছিল এই মানসিক চাপ অনেক লম্বা ও দীর্ঘস্থায়ী। ততদিনে রাষ্ট্র ও সমাজ জন মানসের বিকলাঙ্গ চিন্তা নিয়ে আমাদের সামনের দিকে যেতে হয়েছিল। এ দেশে উপনিবেশ আসে শুধু সংস্কৃতিকে আঘাত করবার জন্য নয়। এখানকার অন্যান্য সম্পদ লুণ্ঠনের একটি সুদীর্ঘ চিন্তন প্রক্রিয়াও এতে যুক্ত ছিল। কবিতার গুচ্ছ গুচ্ছ স্বপ্নের মতোন এদেশ ও জাতি ছিল নানা অর্থকরী ফসলে সমৃদ্ধ একটি জাতি। নদী বিধৌত এ অঞ্চলের মানুষ ছিল সহজ সরল। এ কারণে একটি প্রভুত্ব অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক শাসন এ অঞ্চলে সফলকাম হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ সাংস্কৃতিক বহু স্তরবাদকে আপন করে সোল্লাসে উচ্চারণ করেছিল। দেবে আর নেবে মিলাবে মিলিবে। এই আকাক্সক্ষাকে গলা টিপে হত্যা করেছিল উপনিবেশবাদ। আধিপত্যবাদী ধারণা নিযে সাংস্কৃতিক জন মানসের একতাবদ্ধ চিন্তাকে খর্ব করে উপনিবেশিক সংস্কৃতি চালু করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলা সাহিত্যের মিলনের পথকে প্রকৃত অর্থে সহজ করে দেয় নি। ড. হান্টার, ম্যাক্সমুলার প্রভৃতি ইউরোপীয় পণ্ডিতদের প্রভাব ছিল অত্যন্ত প্রবল। একটি বিভাজন রেখার মধ্যে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে হত্যা করে নিজস্ব উদ্দেশ্য হাসিল করেছিল উপনিবেশের লক্ষ্য। একজন বাঙালি হিন্দুর কাছে একজন মারাঠি ছিল একজন বাঙালি মুসলমানের চেয়েও প্রিয়। আর একজন বাঙালি মুসলমানের কাছে একজন আফ্রিদি মুসলমান ছিল একজন বাঙালি হিন্দুর চেয়েও প্রিয়। অথচ বাঙালি হিন্দু ও বাঙালি মুসলমানের সংস্কৃতি, কিছু পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দূরবর্তী ছিল না। ভিন্ন সুরে ব্যঞ্জনা থাকলেও কোন এক মোহনায় মিলিত হয়ে নব সুরের অবিধীত হয়ে উঠতে পারতো। আমাদের ছিল সুফী ও বৈষ্ণবের প্রেম ধর্ম, উদার প্রীতি, উদার মানবতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের ধারায় বিকশিত জাতিসত্তা। উপনিবেশবাদ হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালি ভেতরে দূরত্ব সৃষ্টি করে আমাদের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদকে ধ্বংস করেছে। প্রকৃতপক্ষে দৃষ্টিভঙ্গির হীন মানসিকতার দ্বন্দ্ব ও স্বার্থের কারণে এখানে জাতীয়তাবাদের চেহারাটি ভঙ্গুর হয়ে যায়। এখানে একটি কথা উল্লেখ করতে হয় যে, সব উপনিবেশিক ব্যক্তিত্বের একই চেহারার হয় না। আবার জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে একটি কথা উক্ত হতো যে, আরব জাতীয়তাবাদ বিশ্বের অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে এ জিনিসটি কারো কল্পনাতে ছিল না, আরব জাতি ধর্মমতে সাধারণ মুসলমান। অথচ আরব জাতীয়তার গোড়াপত্তন করেছিল আধুনিক প্রথায় শিক্ষিত দুজন খ্রিস্টান মনীষী, নাজিফ এজিফি ও বেতেরাস বোস্তানি। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এ দুই মনীষী জাতীয়তার এক অভূতপূর্ব আদর্শ প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তারা খ্রিষ্টানদের প্রতি আরব জাতির সম্প্রীতি সাধন করতে গিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন; মূঢ়তা গোচাতে না পারলে মানুষের গোঁড়ামি ঘুচবে না। আরবে শিক্ষা প্রসারের ব্যবস্থা করা হলো। সে শিক্ষা নিকেতন হলো জাতীয় বিদ্যালয়। আরব প্রেমকে কেন্দ্র করে ধর্ম বিদ্বেষ ত্যাগ করে শিক্ষা দেবার ব্যবস্থা হলো। এতে করে একটি বিষয় দাঁড়ালো যে, বিপুল সাধনায় আরব জাতি ক্ষুদ্রতা ভুলে, হিংসা-দ্বেষ ভুলে সব ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শিখল। একটি অখ- জাতীয়তাবাদ ও সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের জন্য পরমত সহিষ্ণুতা একটি বড় বিষয়। প্রকৃতপক্ষে আমরা ভারতবর্ষে ফেলে যাওয়া উপনিবেশ থেকে সে শিক্ষা পাই নি। 

উপনিবেশ থেকে আমরা পেয়েছি সাংস্কৃতিক পরাধীনতার গ্লানি ও দুর্বিনীত রাজনৈতিক উত্তরাধিকার এবং আধুনিকতার নামে নির্লজ্জ ক্ষমতার আস্ফালন, শ্রেণি বৈষম্যের প্রসারণে নগ্ন উদ্বাহ। এটা ক্ষমতাবানকে আরো ক্ষমতা দিয়েছে এবং সংস্কৃতি করেছে উম্মুল। 

উপনিবেশত্তোর সংস্কৃতিক চর্চা : 

সৃজনশীলতা ধারণ করে স্বকীয় চারুময় স্বভাবের ভেতর দিয়ে উপনিবেশত্তোর সংস্কৃতিক চর্চা শুরু হওয়া উচিত ছিল। ২য় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী উপনিবেশবাদী দেশগুলো স্বাধীন হলেও, তার অবকাঠামো উপনিবেশকে সমর্থন করেছে বেশি, ফলে শিক্ষা সংস্কৃতি সমাজ বিনির্মাণে যেকোন ভাবে উপনিবেশের জায়গাটি বয়ে যায়। উত্তর উপনিবেশ এই ধারণার জন্ম দেয় পশ্চিমা সমাজ। যেহেতু এই তত্ত্বের জন্মদাতা, পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী সে কারণে এর স্বভাব ও ব্যবহারিক পর্যায়ে পশ্চিমের একতরফা জ্ঞান ও শৃঙ্খলার গন্ধ লেগে থাকে। প্রাচ্যের চিন্তার জগতের দরজা একেবারে বন্ধ হয়ে ঊনিশ শতকে, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভুত্ব এবং ক্ষমতার উগ্র বাসনার মত ইউরোপীয় মনন, আমাদের প্রতিবাদী চেতনায় আঘাত হানে। আমরা ব্যর্থ হয়েছি উপনিবেশত্তোর নতুন ভাষা তৈরিতে। সমাজ বিবর্তনের ধারায় নতুন মানবিক সমাজের দর্শন নিয়ে দাঁড়াতে পারেনি। কেন্দ্র ও প্রান্তের ধারণায় চিন্তার বৈকল্য নিয়ে প্রান্তে পড়ে আছি। উত্তর উপনিবেশের তীরে দাঁড়িয়েও উপনিবেশ এর মনন চাষে, সংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখছি। মূলতঃ চারটি স্তম্ভের অভাবের কারণে উত্তরউপনিবেশ শক্তি অর্জনে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এক. জাতীয়তাবাদ বিকাশের চূড়ান্ত পর্যায়ে না যাওয়ার তৈরি হয়েছে, এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব। দ্বিতীয়. অর্থনৈতিক পরনির্ভরতা, তৃতীয়. দারিদ্রতার কারণে মানবিক বৈকল্য। চতুর্থ. রাজনৈতিক দূর দৃষ্টির সীমানায় আশাবাদের অভাব। সবশেষে প্রাচীন অথচ বতর্মানের সাথে সাংঘর্ষিক নয় এমন মূল্যবোধকে গ্রহণ না করা। উত্তর উপনিবেশবাদ কী? পশ্চিমা প্রবণতাকে যদি বাদ রেখে বলি, তা হলে ওঠে আসে জ্ঞানতাত্ত্বিক বিশ্বে স্বদেশ সংস্কৃতির এক বর্ণাঢ্য মহামিলন, যাতে ধরা দেয় নিজের যা কিছু আছে, তার অহংকার, মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি, পুরানো মূল্যবোধের আলোকে সমগ্র মানবতাবাদের সৃজনশীল ক্ষমতা। উপনিবেশবাদ ধর্মকে হাতিয়ার করে ভারতবর্ষীয় জীবন ও মানবতাকে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করেছে। অথচ উপনিবেশ পর্ব আমাদের একটি সম্মিলিত বহুত্ববাদ সংস্কৃতি ছিল, যেমন মঙ্গলকাব্য, আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে আরম্ভ করে শতাব্দীর কবি ভারতচন্দ্রের কাল পর্যন্ত বঙ্গ সাহিত্যের যে বিশেষ এক শ্রেণীর ধর্ম বিষয়ক আখ্যান কাব্য, সেটিই মঙ্গলকাব্য। 

ডাঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেন, এটি বাংলা ভাষা-ভাষী অঞ্চলের একটি বিশেষ যুগের সাহিত্য সাধনা হলেও এটি সৃষ্টির প্রেরণা কোন এক বিশেষ সাম্প্রদায়িক ধর্ম বিশ্বাস থেকে আসেনি। বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন অবস্থার সম্মুখীন হয়ে বাংলাদেশের লৌকিক ও বহিরাগত বিভিন্ন ধর্ম মতের সে অপূর্ব সমন্বয় সাধিত হয়েছে, মঙ্গল কাব্যগুলো তারি পরিচয় বহন করে। হিন্দু কবিগণ সচরাচর মুসলমান সমাজের চিত্র শ্রদ্ধার সঙ্গে অঙ্কন করেছেন। আবার মধ্য যুগে একজন মুসলমান কবি বৈষ্ণব পদাবলী রচনায় অসামান্য কর্তৃত্ব অর্জন করেন। 

সে কালের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন ধারায় মুসলমান কবিদের ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও উদারতা আমাদের অবাক করে। এমন কি সৈয়দ আলাওল ও দৌলত কাজী তাঁদের বিশুদ্ধ রচনার ফাঁকে ফাঁকে বৈষ্ণব পদও রচনা করেছিলেন। সে যুগে কবি শায়ানুর সৈয়দ ভগবান কে প্রিয়া রূপে দেখেছেন, তিনি লিখেন, “হিন্দুরা বলে তোমায় রাধা, আমি বলি খোদা। রাধা বলে ডাকিলে মুল্লা মুন্সিতে দেয় বাঁধা”। 

শুধু সাহিত্যে কেন? প্রাত্যহিক জীবনের আচরণ ও জীবন চর্চার মধ্যে হিন্দু শৃঙ্খলা সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটেছিল। বাংলায় হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয়কারী এ সম্পর্ক মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পরও বিদ্যমান ছিল। এটি স্বীকার করতে দোষ হবার কথা নয় যে উভয়ের মিলিত মোহনায় এ অঞ্চলে এক শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে ওঠেছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বেনিয়া ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার শাসন ভার এবং পরবর্তী পর্যায়ে সমগ্র ভারতে আধিপত্যবাদ বিস্তারে সক্ষম হলে, এই মধুর সম্পর্কে চিড় ধরে। 

এক্ষুণি আমাদের একটি সুচিন্তিত প্রস্তাবনা দরকার। পশ্চিমা প্রভাবমুক্ত একটি উত্তর উপনিবেশ কাঠামো চয়ন করা যেখানে শাসনতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক অবকাঠামো নিজস্ব সম্পদ ও উৎস থেকে আহরিত হবে এবং সক্রিয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে প্রথমে নিজে বেঁচে পরবর্তীতে বিশ্বমানবতার সঙ্গে সম্পৃক্ত হবে। 

আমার ধারণা একটি এশিয়াটিক গ্রাম ও নগর ধারণা কার্যকরী সংমিশ্রণ ঘটলে উত্তর উপনিবেশের তাত্ত্বিক ধারণাটি শক্তিশালী হবে। 

ইংরেজ উপনিবেশ পূর্ব ভারতবর্ষ ও এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের গ্রামীণ সমাজের স্বরূপ শ্রেণীবিন্যাস, উৎপাদন ব্যবস্থা, নগর ও শহরের প্রকৃতি আলোচনা করতে গিয়ে এশিয়াটিক সমাজ এর মডেল নির্মাণ করেছিলেন। কাল মার্কস এর মতে, “পারস্পরিক নির্ভরতার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের গ্রামের কৃষি ও শিল্পের জন্য শ্রমশক্তি যৌথভাবে নিয়োজিত হতো। গ্রামীণ সমাজে যা গড়ে উঠেছিল জমির যৌথ মালিকানার উপর।” সার্ক যদিও ইউরোপীয় সমাজ বিজ্ঞানী ও ইতিহাসবিদ হিন্দেস ও হান্ট একে অমূলক এবং বাস্তবতা বিবর্জিত, সামন্তবাদী অর্থনীতির একটি অংশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। তৎপরবর্তী ভারতীয় ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব, এশিয়াটিক উৎপাদন প্রণালীকে নাকচ করে তার জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন। হাবিব জমির মালিক কে ছিল এনিয়ে তুলকালাম কাণ্ড করতে গিয়ে দফারফা করতে পারেন নি। মার্কসের বক্তব্যই যা সবাই সঠিক বলে মান্য করে। জমির কোন রকম ব্যক্তি মালিকানা ছিল না। তবে জমির উপর ব্যক্তিগত ও যৌথ অধিকার ও ব্যবহার ছিল। রোমিলা থাপ্পার ও এ সত্যকে উদঘাটন করেন। যে জমির মালিকানা কখনো সামন্ত প্রভুদের মধ্যে ছিল না, রাজা বা রাষ্ট্র ছিল। উত্তর উপনিবেশের মধ্যে আমরা দেখতে চাই রাজা ও রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ক্ষমতার দুর্গ ভেঙে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হোক। আমাদের সংস্কৃতির উৎস জমি, কৃষিজীবী মৎস্যজীবী এবং নিম্নবর্গীয় মানুষের বেলাভূমি। এখানে জমির সাংস্কৃতিক মালিকানা শাসন থাকবে জনগণের। সব বর্গ সব ধর্মের কল্যাণের নির্যাস নিয়ে হবে মম ফাল্গুনী। কারণ পশ্চিমাদের রসায়ন আমাদের জানা আছে এরই মধ্যে উত্তর উপনিবেশের ফাঁক ফোকরে খোলা বাজার ও বিশ্বায়নের ভিতরে সাম্রাজ্যবাদীদের কালো সাপটি ইতিমধ্যে তারা ঢুকিয়ে দিয়েছে। এটিকে সঠিক সময়ে উত্তর উপনিবেশিক প্রবণতা সমূহ দিয়ে আঘাত করতে না পারা যায়, তবে উত্তর উপনিবেশের ভিতরে ছায়ার মতোন সংহারী উপনিবেশ থেকে যাবে। সাংস্কৃতিক মুক্তি কখনো আসবে না। 

এশিয়ার নগর ও গ্রামগুলির চরিত্র উন্নয়নমুখী। আধিপত্যবাদী বা আগ্রাসীমুখী নয়। এশিয়ার মানুষ ও জনজীবনের রক্তে সরল ও সহজ অভিব্যক্তির ছাপ রয়েছে। কোন কোন দেশে একেবারে রিমোট এলাকায় এখনো যৌথ জীবন ধারণা গঠনপ্রণালী বিদ্যমান। এসব দেশের জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক জীবনাচরণ শুধুমাত্র এশীয় উপমহাদেশের মধ্যে ক্রম সম্প্রসারণের মধ্যে দিয়ে উপনিবেশত্তোর চেতনাকে ধারন ও পালন করা যায়। আমাদের এই অঞ্চলে সার্ক আসিয়ান কিংবা এরকম আরো আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠান আছে, যাদের আছে নিজস্ব অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প। তাদের সম্মিলিত পুঁজি একত্রিত করে জমি ও শিল্পের উন্নয়ন প্রসারণে এগিয়ে এলে উত্তর উপনিবেশ একটি শক্ত কাঠামো পাবে। একটি কথা এখানে লক্ষযোগ্য যে পাশ্চাত্যকে আমরা যত বেশি গ্রাহ্যতার মধ্যে রাখি, তত বেশি প্রাচ্যকে নয়। আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতির পর্বটাও যদি হিসেবে রাখি তাহলে পাশ্চাত্যের জীবনামুখী আচরণ ও বৈশিষ্ট্যগুলি আমরা অনেকটা অজু করে পালন করতে চাই। পার্শ্ববর্তী দেশ এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আমাদের সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক সম্পর্কগুলো তৈরি হয় না। ফলে আমরা বঞ্চিত হই এশিয়ার উল্লেখযোগ্য কবিতা ও সাহিত্য থেকে। যেমন একজন অমৃতা প্রীতম কি লিখছেন? তার দর্শন কী, আমরা জানি না। যেমন জানি না একনিষ্ঠ পাঠ করে ফয়েজ আহমদ ফয়েজ, নিশিওয়াকি জুন ঝাবুরু, মাহমুদ দারবিশ, অরুন্ধতি রায়, লেন এনগুয়েন, শু চেং অথবা অহিলা সাম্বামূর্তির মতো নবীন কবিরা কবিতায় কী কাজ করছেন? এভাবে আমাদের অগোচরে থেকে গেছে, কবি কমলা দাশ (কেরালা), কেদারনাথ সিং (উত্তর প্রদেশ), অরুণ কোলাৎকার (কোলাহাপুর), আহমদ ফায়াজ (কোহার্ট, পাকিস্তান) ভুপি শেরচান (নেপাল), মাধব ঘিমির (নেপাল), জুইট ও কিতা (জাপান) দু ফু চীনা আমরা ভুলেও বাড়ির পাশের আরশি নগরের দিকে তাকাইনি। তারা আধুনিক, উত্তর আধুনিক অথবা প্রাগৈতিহাসিক, আমাদের নজর কখনো পড়েনি। উল্লেখিত এসব দেশ শুধু শিক্ষা, সাহিত্যে নয়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে কর্মে, অর্থনীতিতে প্রভূত সাফল্য নিয়ে এসেছে। এমনকি একক ও যৌথভাবে প্রভুত্ববাদী অর্থনীতির চালিকাশক্তি হতে পারে তাহলে একটি এশিয়াটিক গ্রাম কমপ্লেকস্ কেন হবে না? এশিয়ার এসব দেশ উত্তর উপনিবেশ একক শক্তি ও প্রতীক। স্বয়ম্ভ ও স্বাধীন। 

এশিয়া কবিতার দেশ। মিশ্র সংস্কৃতির বঙ্গ ভাষা মানুষ ও জনপদের সুখ-দুঃখের অমর গাঁথা নিয়ে দাঁড়িয়েছে এশিয়া মহাদেশ। এখানে কোন কোন দেশের ধর্মের আচরিত জীবন প্রবাহে সংস্কৃতির মেলবন্ধন তৈরী হয়েছে। এই জনপদের মানুষের ভাগ্য ও নিয়তি একটি সুতোয় গেঁথে অপার জীবনধারায় সামিল হয়েছে। নদী ভর্তি মানুষ মাঠ, জনপদ, সবুজ পাহাড় এবং ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর নির্মল পবিত্র সংস্কৃতি জীবন ও বেদনার কাব্য হয়ে অপার সৌন্দর্য্যরে স্রোতে মিশে গেছে। এশিয়ার একটি জনপদ ভারত। ভারত সহ তার পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রসমূহ উপনিবেশের যাঁতাকলে দীর্ঘদিন বন্দী ছিল। ১৯৪৭ সনে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হয়। বলা হয়ে থাকে ব্রিটিশ উপনিবেশ পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাওয়ার কারণ হলো - তারা রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে ঠিকই কিন্তু সাংস্কৃতিক আধিপত্য কায়েম করতে সক্ষম হয় নি। মূল কথা যে জনগণ সম্মতি দেবে, তারা তা দেয়নি, আর জনগণের সম্মতি না থাকলে হেজিমনি কায়েম করা যায় নি। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তি, সম্ভবত যে কোন ঔপনিবেশিক শক্তির কিছু কৌশল থাকে,শাসন করার, যেমন একটি হচ্ছে কর্তৃত্ব করার জন্য আইন আদালত, বল প্রয়োগকারী বিভিন্ন সংস্থা ও বাহিনী, তাদের সাহায্যে অনেকটা জোর জবরদস্তি করে জনগণকে চাপের মধ্যে রাখে। দ্বিতীয়টি সম্মতি আদায়। এটিও করা হয়ে থাকে নানাবিধ প্রতিষ্ঠানের চাপ, সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে চিন্তাধারা পরিবর্তন করে। এসব গবেষণা বিখ্যাত প্রাবন্ধিক ও গবেষক রণজিৎ গুহের ডমিনেন্স উইদ আউট হেজিমনি : হিস্ট্রি এ্যান্ড পাওয়ার ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া ১৯৯৮, তে সরাসরি পাওয়ায় উত্তর ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গির সবচে প্রয়োজনীয় টার্মিনোলজি হচ্ছে সাব অলটার্ন মানুষ। এরা ভারতবর্ষীয় জনপদের সবচে অবহেলিত দলিত দুর্দশাগ্রস্ত সমাজভুক্ত মানুষ। ঔপনিবেশের যাঁতাকলে তদের ইতিহাস সঠিক ভাবে নিরূপিত হয় নি। এটা সর্বত্র ঔপনিবেশের চরিত্র ছিল যে কিভাবে তাদের কে ইতিহাসের বাইরে রাখা যায়। উপনিবেশত্তোর সার্ব অলটার্ন অথবা নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদরা যুৎসই কিছু কাজ দেখানোর চেষ্টা করেছেন। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদরা সমাজকে যতটুকু গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন তা চেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করেন সংস্কৃতির বিকাশমান পর্বগুলোকে। সে কারণে সাব অলটার্ন কথাটি তাদের কাছে বিশেষ গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেছে। আন্তনিয় গ্রামসি মনে করেছেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার ভেতরে এটি লক্ষ্য করা গেছে যে, উচ্চবর্গ, সে দেশী হোক কিংবা বিদেশী হোক, নিম্নবর্গের ওপর তারা নানাভাবে কর্তৃত্বারোপ করেছে। কিন্তু মতাদর্শিক সম্মতি না বশ্যতা আদায় করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এই নিম্নবর্গের ইতিহাস তথাকথিত স্থানীয় ইতিহাসও নয়। স্থানীয় ইতিহাসের ভেতরে সকল পেশা শ্রেণীর কাহিনী বর্ণনা করে অথচ বলা হয়ে থাকে যে, নিম্নবর্গ ইতিহাস জনপদের এবং জনমানুষের কথা সোচ্চার কণ্ঠে উচ্চারণ করেন এবং সর্বত্র খুঁজে বেড়ায় উচ্চবর্গীয় বিজ্ঞজনদের বিরুদ্ধে জনসমুদ্র বিদ্রোহের ঘটনার। নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদেরা নিম্নবর্গকে কখনোই নীচ থেকে কিংবা ওপর থেকে দেখেন নি। ভেতরের জীবন প্রবাহের ধারাপাতিক ব্যঞ্জনা থেকে চেতনার জগতটাকে আবিষ্কার করেছেন। জিজ্ঞাসা ও পাঠের ভেতর দিয়ে তাদের উনুত্তাপিত ইতিহাসের প্রপঞ্চগুলো ওঠে এসেছে। ফলাফল এসেছে সঠিক ও গভীর অনুসন্ধিৎসার মধ্যে থেকে যে নিম্নবর্গের চেতনা একমাত্রিক নয়, বহুমাত্রিক, সেখানে তাদের স্বর ভিন্ন, সংস্কৃতি, উচ্চবর্গীয় সংস্কৃতি থেকে দীর্ঘ দূরে। 

বিখ্যাত তাত্ত্বিক খ্যাতনামা নিম্নবর্গীয় ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ। 

ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের কিছু দিকে এইভাবে উন্মোচন করেছেন : দীর্ঘকাল ধরেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ইতিহাস পাঠ উচ্চবর্গীয় আধিপত্যের দ্বারা আচ্ছন্ন। বই উচ্চবর্গীয়রা দুই রকমের পাঁচটি উপনিবেশিক, অপরটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী। উভয়ের উদ্ভব ব্রিটিশ শাসনের আদর্শিক পরিশ্রম থেকে। জাতীয়তাবাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরেও এই উচ্চবর্গীয়তা বহাল রয়েছে। ঔপনিবেশিক উচ্চবর্গীয় ইতিহাসবিদেরা মূলতঃ ব্রিটিশ কিন্তু ভারতে এবং অন্যত্র যে তাদের অরুকারীরা নেই তা নয়। অপরদিকে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ইতিহাসবিদেরা প্রায় সবাই ভারতীয়। ইতিহাসের উভয় পাঠই মনে করে যে ভারতীয় জাতির সৃষ্টি এবং জাতীয়তাবাদের বিকাশ উচ্চবর্গীয়দের দ্বারাই ঘটেছে। 

উচ্চবর্গীয় ইতিহাসপাঠের কোন উপযোগিতা যে নেই তা নয়। আছে। এইটি থাকার পাঠ ,পাঠককে অনেক কিছু বুঝতে সাহায্য করে যার মধ্যেরয়েছে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের গঠন, বিশেষ বিশেষ ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে তাঁর বিভিন্ন অঙ্গের কার্যক্রম, ওই রাষ্ট্রের সংরক্ষক বিভিন্ন শ্রেণীর বিন্যাস, উচ্চবর্গীয়দের যে মতাদর্শ কর্তৃত্ব করেছে তার বিভিন্ন দিক, দেশীয় ও বিদেশী উচ্চবর্গের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, তাদের পারস্পরিক বিরোধ ও সংযোগের জটিলতা গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ ও ভারতীয় ব্যক্তিত্ব ও সংগঠনের ভূমিকা, এবং সর্বোপরি উচ্চবর্গের নিজস্ব মতাদর্শ, কিন্তু এই ইতিহাস পাঠ সেখানে ব্যর্থ সেটা হলো ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চরিত্র ব্যাখ্যা। কেননা ইতিহাসের ওইপাঠ নিম্নবর্গের বিপুল সংখ্যক জনগণের স্বকীয় যে অবদান, যা উচ্চবর্গের অবদান থেকে আলাদা, তার খবর রাখে না। যার খবরই রাখেনা তার ব্যাখ্যা সে করবে কি করে? 

নিম্নবর্গের মানুষের অশিক্ষিত। রাষ্ট্রের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত তারা ইতিহাস কি? তার ধারাবাহিকতা কী এমনকি অধিকারের প্রশ্নে তারা অনেকটা নিস্পৃহ। প্রকৃতপক্ষে নিম্নবর্গের মানুষদের সচেতন করতে হবে একজন উচ্চবর্গীয় বেনিভোলেন্ট ইতিহাসবিদদের মধ্যে থেকে, যে নিম্নবর্গীয়দের সর্বপ্রকার সাংস্কৃতিক কাঠামো, যেমন নিম্নবর্গীয় মানুষের মৌখিক বয়ান, লোক কাহিনী, ছড়া ও গানের যে সরল উপাদান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে তার ভেতর থেকে উপাদান সংগ্রহ করে ইতিহাসের কাজ শুরু করা। ইতিহাসে লিপিবদ্ধ মানুষ কোন না কোন সময়ে জয়ী হয়। তারা জয়ী হতে না পারলে, তার উত্তরাধিকার যারা আছে তারা হবে। কারণ ইতিহাসের দলিল মানুষের সংগ্রাম ও অধিকারের দলিল। 

পুঁজিবাদ মানুষকে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্ত করে সেজন্য নিম্নবর্গের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। যদি ঐক্যবদ্ধ না করা যায় তাহলে শ্রেণী বিভাজনের যাঁতাকলে পূর্বের ন্যায় পিষ্ট হতে হবে অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না। উচ্চবর্গের লোকেরা যেভাবে ধর্ম অঞ্চল সামাজিকতা ইতিহাস বিভাজন করে খড়গহস্ত হয়ে শাসন কার্য পরিচালনা করে অনুরূপ একই কর্তৃত্বে নিম্নবর্গকে শোষিত করে যাবে। 

ইতিহাস সঠিকভাবে বিবৃত না হলে কোন না কোন সময়ে মানুষ শোষিত হয় কারণ ইতিহাসের সঙ্গে শ্রেণীর একটা সম্পর্ক আছে। যে জায়গায় ইতিহাস নিয়ে সে জায়গার মাটির রং ও সংস্কৃতির কি ধরন তা বোঝা অনেক কষ্টসাধ্য। এসব কথা অন্যরকম করে ভাবেন আন্তোলিও গ্রামসি। অন্যভাবে যদি বলি মিশেল ফুকো। তিনি শ্রেণীর কথা তেমন করে ভাবেন না। ব্যক্তি তার কাছে যত বড়, শ্রেণী তার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গ্রামসি আর ফুকো এদের কে এত বেশী গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। তার প্রধান কারণ হলো, তারা উভয়ই নিম্নবর্গ ইতিহাস নিয়ে চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। 

উত্তর ঔপনিবেশিক মানস গঠনে নিম্নবর্গীয়দের বেশি দরকার। ইতিহাসের আলোকে তাদের আলোকিত করে সামনের দিকে নিয়ে আসা। এখানে আরো একটি কথা বলা জরুরি যে, নিম্নবর্গীয়দের অধিকারবোধ প্রচার করে আলোড়ন সৃষ্টি করে পরবর্তী পর্যায়ে চুপসে যাওয়া নয়। মৌলিক পরিবর্তন ও অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হলে, সেটি কেবল নিস্ক্রিয় বিপ্লব বা প্যাসিভ বেভুলেশন হবে। আন্তোলিও গ্রামসি তার প্রিজন নোটবুকস এ ধরনের বিশাল প্রকৃত বিপ্লব প্রকৃত বিপ্লবকে যথেষ্ট ক্ষতি করে বলে উল্লেখ করেছেন। তবে নিম্নবর্গীয় মানুষেরা এসব জানে না, তাদের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বীর্যবান করে তুলে আনবে ঐতিহাসিকেরা। 



সহায়ক গ্রন্থ 

১) উপনিবেশপূর্ব বাংলার সমাজ সংস্কৃতি 
২) রোমিলা থাপার, ভারত ইতিহাস 
৩) ইরফান হাবিব, Colonial Transformation in India 
৪) বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্ব 
৫) Maurice Goodlier; Notions of Asiatic mode of Production 
After marks & Engels 
৬) ভারতে বৃটিশ শাসন; কার্ল মাকর্স 
৭) ডমিনেন্স উইদ আউট হেজিমনি; হিষ্ট্রি এন্ড পাওয়ার ইন কলোনিয়াল ইন্ডিয়া ১৯৯৮ 

1 comments:

2

প্রবন্ধ - খালেদ হামিদী

Posted in

চলমান বৈশ্বিক বাস্তবতায় কবিতাভাবনার প্রকাশ বলতে কবির রাজনৈতিক-দার্শনিক দায়িত্ববোধের পরিচয় জ্ঞাপন ছাড়া আর কি বুঝে নিতে পারি? কেননা ফিলিস্তিনের পরে, ইরাক, সিরিয়া ও মিয়ানমার থেকে পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ, লক্ষ লক্ষ মানুষকে, ঠিকানা ও রাষ্ট্রহীন করে চলেছে। ধনতান্ত্রিক এই সভ্যতা এর নিজের হিসেবে অপূর্ণাঙ্গ নয়। কিন্তু ধনতান্ত্রিক রাজনীতির সব অপশক্তি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে মানুষের এতো উৎকর্ষ লাভ সত্ত্বেও, সভ্যতাকে অসম্পূর্ণ করে রাখে। তাই স্থানিক-বৈশ্বিক পুঁজিবাদ, পুঁজিতন্ত্রের সমস্ত সহায়ক শক্তি, সাম্রাজ্যবাদ এবং ধনতান্ত্রিক চিন্তা ও প্রকল্পের তুমুল বিরোধিতাই আমাদের পরম প্রাথমিক কর্তব্য বলে মনে হয়। আমাদের সাহিত্যে, বিশেষত কবিতায়, এই দায়িত্ববানতার অনুবাদ, বলতে গেলে, খুবই জরুরি। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিশ্বকথাসাহিত্যের অন্যতম দিকপাল দস্তয়েভস্কিও, পশ্চিমের তথা ইয়োরোপীয় চিন্তা এবং আধুনিকায়নের, বিরোধিতা করেন। ওরহান পামুক যেমন বলেন: It is from Dostoyevsky’s gloomy, damning ambivalence-his familiarity with European thought and his anger against it, his equel and opposite desires to belong to Europe and to shun it…(Orhan Pamuk; chapter thirty-six; Dostoyevsky’s Notes from Underground: The Joys of Degradation; Other Colours; in UK in 2007; in USA in 2008) 

দস্তয়েভস্কির ইডিয়ট, ব্রাদার্স কারামাজভ এবং ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট-এর চরিত্রগুলো সেই পৃথিবীর বাসিন্দা, যে-জগৎ এখনো মনুষ্যোপম হয়ে ওঠেনি, হয়ে ওঠার জন্যে প্রক্রিয়াধীন:

... it is set in world still in the process of becoming. (Orhan Pamuk; chapter thirty-eight; The Brothers Karamazov; Other Colours; in UK in 2007; in USA in 2008)

দস্তয়েভস্কি যা নেই তার উপস্থিতির ঔচিত্যের বোধ দ্বারা তাড়িত একজন অতীব মহান লেখক। মুনাফাভিত্তিক পুঁজিবাদী সমাজে কি নেই? নেই মনুষ্যত্ব। ধনতন্ত্র-উপনিবেশবাদ-সাম্রাজ্যবাদ হত্যা করে এই মানবতাকেই। যদিও, গেলো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ্বে উদ্ভূত প্রতীচ্যের পোস্ট মডার্ন চিন্তা বিষম সমাজভুক্ত শ্রেণীর ভেতরকার নানা শ্রেণী, যেমন নারী, সমপ্রেমী, তৃতীয় লিঙ্গ ও রূপান্তরকামী মানুষদের অস্বীকৃত-অবহেলিত থাকার বিষয়গুলি শনাক্ত করে। সেই সঙ্গে তাদের সকলের মুক্তিসংগ্রাম আর প্রকৃতিবিধ্বংসী শিল্পায়ন ও প্রযুক্তির বিপরীতে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনও সূচিত হয়। কিন্তু এই পোস্ট মডার্নিজম পুঁজিবাদবিরোধী নয়, তা ধনতন্ত্রের আওতার ভেতরে ওই পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের ক্ষেত্র সম্প্রসারণেরই দিকনির্দেশনা, বলা যায়। পাশাপাশি, ক্ষেত্রবিশেষে আপাত চমকের আড়ালে পুঁজিতন্ত্র ধ্বংস করে মানুষের এখনো-অবশিষ্ট মৌলিক বা আদিম গুণাবলী, যেমন : সহানুভূতি, প্রেম ও শ্রদ্ধাবোধ; জঁ জাক রুসো যে আদিম সাম্যবাদী সমাজের প্রসঙ্গ বিশদ করেন তাঁর মানব জাতির অসমতার উৎস এবং ভিত্তি শীর্ষক প্রথম রচনায়ই, আশ্চর্য সাবলীলতায়। দস্তয়েভস্কি তাই পশ্চিমের বিরোধিতা করেন। তাঁর ইডিয়টকে খুব মনে পড়ে। আমাদের উপলব্ধির গভীরে বেজে ওঠে এই প্রতীতি: মানুষের আসলে ইডিয়টের অনুরূপই হওয়া উচিত। কিন্তু পামুক দস্তয়েভস্কির ইয়োরোপ-বিরোধিতাকে, উপর্যুক্ত প্রবন্ধে, বর্তমান মুসলিমদের মার্কিন বিরোধিতার সঙ্গে মেলান কেন? দস্তয়েভস্কির পশ্চিমের প্রতি ঘৃণা আর ফিলিস্তিনি মুসলিমদের ইসরায়েল-এমেরিকা-বিদ্বেষের মধ্যে মূলত কোনো অমিল নেই বলেই হয়তো। 

... it is a notable irony that Dostoyevsky, who wrote one of the greatest novels ever, hated the West, and Europe, as much as today’s provincial Islamists. 

মনুষ্যজগতে তো জাতি বাস্তবে দুটিই, ধনী ও দরিদ্র। তাই গরিব জাতির ঐক্যের মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক শত্রুদের মোকাবেলার আগে, আমরা, অন্তত সচেতন মধ্যবিত্ত মানুষেরা, এই সভ্যতার সীমাবদ্ধতা বা অসম্পূর্ণতার ক্ষেত্রগুলো বার বার চিনে নিতে পারি, যেভাবে, পামুক, উপরের একই গদ্যে, বলেন: 

For a writer like Dostoyevsky, the world is a place that is in the process of becoming; unfinished, it is somehow lacking. It resembles our own world, which is also in the process of becoming, so we want to dig deep: to understand the rules that govern this world, to find inside it a corner wherein we might live by our own ideas of right and wrong.

2 comments:

1

প্রবন্ধ - অবন্তিকা পাল

Posted in





প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী মল্লিকা সারাভাই ও তাঁর পুত্র রেবন্ত সারাভাই উত্তর কলকাতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে বললেন- “এবার আমরা শিব ও শক্তির আরাধনা করব। শিব আর শক্তি একে অন্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নৃত্য করেন। কেউ কারও চেয়ে কম কিংবা বেশি নন। ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও লয়ের লীলায় শক্তি কেবল শিবের অনুগামিনীমাত্র নন, তাঁরা একে অন্যের পরিপূরক। বাংলার মঞ্চ এই নৃত্য উপস্থাপনের শ্রেষ্ঠ জায়গা, কেননা দেবী কী, তা বাংলার মানুষ জানেন।” একদিকে নটরাজের উদ্দাম নাচ, অন্যদিকে শক্তির সংহারকারী নৃত্যরূপ, প্রায় কুড়ি মিনিটের রুদ্ধশ্বাস মুহূর্ত-শেষে শক্তি আর শিব একে অন্যের মধ্যে বিলীন হন, রূপ নেন অর্ধনারীশ্বরের। রাজ্য জুড়ে অসুরদলনী এবং স্ত্রী ও জননীরূপী দুর্গার আরাধনার পাশাপাশি, ক্ষুদ্র পরিসরে, স্বল্প পুঁজি সম্বল করে এক শ্রেণির প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে সেজে ওঠে আরও এক আরাধ্য, খোদ শহর কলকাতার বুকেই, যার অর্ধেক শরীরে শিব এবং বাকি অর্ধেকটায় শক্তি বা পার্বতী।

একটি অলাভজনক সংস্থার উদ্যোগে গত বছর থেকে শুরু হয় এই উৎসব। দুর্গাপুজোর পাঁচদিনের নিয়ম মেনে অর্ধনারীশ্বরের বোধন হয়, হয় কলাবউ স্নান, অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপুজোর মতো যাবতীয় রীতিরেওয়াজ। কিন্তু না, পৌরোহিত্যে থাকেন না কোনও ব্রাহ্মণ। মন্ত্রজ্ঞ কোনও রূপান্তরিত-মানুষ এই পুজো সম্পাদন করেন। গত কয়েক বছর ধরেই নানান প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়েছিল তাঁদের। কেননা, উৎসবের পুরোধায় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সকলেই ভিন্নলিঙ্গের (প্রচলিত তৃতীয় লিঙ্গের) মানুষ – তাঁরা ট্রান্সজেন্ডার, তাঁরা হিজড়ে। অলাভজনক সংস্থাটির নিত্যদিনের কাজকর্ম তাঁদের ঘিরেই। একদল মানুষ বলে ওঠে, “হতেই পারে তারা তৃতীয় লিঙ্গ, তাই বলে আলাদা করে পুজোর আয়োজন করতে হবে কেন? দুর্গাপুজো তো আপামরের!” অন্যদল রে রে করে ওঠে অব্রাহ্মণকে দিয়ে পুজো করানোর শাস্ত্রবহির্ভূত সিদ্ধান্ত দেখে। কিন্তু দুর্গাপুজো কি আজও সত্যিই আপামরের? ভোগ রান্নায় এখনও অব্রাহ্মণ রমণীর ঠাঁই হয় না। হিন্দু পাড়ায় বেড়ে ওঠা কোনও সংখ্যালঘু কিশোরী অঞ্জলি দিতে গেলে পুজো কমিটির গণ্যমান্যরা তার অভিভাবককে ডেকে বলেন মেয়েকে ঠাকুরদালান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে। শহর ছাড়িয়ে জেলার অভ্যন্তরে ঢুকলেই দেখা যাবে, গ্রামের দলিতরা উচ্চবর্ণের পুজোয় অবাধ প্রবেশাধিকার পান না। এমনকি পুষ্পাঞ্জলিতেও তাঁদের পৃথক সারিতে দাঁড়াতে হয়। ভোগ বিতরণের সময় আলাদাভাবে বসানো হয় তাঁদের। আর ভিন্নলিঙ্গ মানুষের দূরবস্থা তো ততোধিক শোচনীয়। ইদানিং শহরের পুজো উদ্বোধনে মাঝে মধ্যে ডাক পান তাঁরা, অথচ ওই পুজো প্যান্ডেলে বসেই কৌতুকেরও শিকার হন। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ভিন্নলিঙ্গের মানুষ আজ ‘আদার জেন্ডার’ হিসাবে সমস্ত নাগরিক সুযোগ সুবিধা পেতে সক্ষম। কিন্তু আইনি ছাড়পত্র মানেই তো আর সামাজিক স্বীকৃতি নয়!

অর্ধনারীশ্বরের পুজো এই লিঙ্গকেন্দ্রিক, ধর্মকেন্দ্রিক, বর্ণকেন্দ্রিক সমস্ত অবমাননার বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর প্রতীকী প্রয়াস। পুজোর পাঁচদিনের প্রত্যেকটি দিনে তাই আলাদা আলাদা গোষ্ঠির মানুষেরা এসে সামিল হন উৎসবে, যাঁরা সকলে সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে প্রত্যাখ্যাত। হয়ত তাঁরা যৌনকর্মী, দুর্গাপুজোয় বেশ্যাবাড়ির মাটি নিয়ে আসার পরেও এই বাবুবিবি-অধ্যুষিত দুনিয়া যাদের মূলধারার অঙ্গীভূত করতে অপ্রস্তুত। ওরা কেউ পথশিশু, মাতৃপিতৃহীন, অভুক্ত, উদযাপনের দিনেও ওই ফুটপাথই যাদের বিশ্বসংসার। কেউ বা অ্যাসিড আক্রান্ত নারী, ত্রিনয়নী চিন্ময়ীর সামনে অগণিত আইলাইনার-পরিহিত বঙ্গতনয়াদের ভিড়ে যাদের মুখ দেখে ফেললে ভয়ে দূরে সরে যায় দর্শনার্থীরা।

অর্ধনারীশ্বরের অস্তিত্ব পরস্পর-বৈপরীত্যের একাত্মকরণের দর্শন। শিব শ্বেতবর্ণ, শক্তি কাঞ্চনবর্ণা। শিব স্থিতি, শক্তি সৃষ্টিশীল ও গতি। শিব অসীম, শক্তি সীমাহীনের পরিমেয় প্রকাশ। এই দুই বিপরীতধর্মী সত্তা একীভূত হলে তবেই সৃষ্টি সম্ভব, গঠন সম্ভব। কেননা পার্বতী বিনা শিব আসলে শব-সদৃশ, আবার শিব-ব্যতীত শক্তির প্রকাশ সম্ভব নয়। প্রাচ্যদর্শনের এই স্বর অনুরণিত হয় জীববিদ্যার ক্ষেত্রেও। একটি ভ্রূণ, সৃষ্টির আরম্ভকালে ‘উভয়লিঙ্গ’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। অন্তর্ভাগের মেডুলা অংশ টেস্টিস অর্থাৎ পুরুষের অণ্ডকোষের উৎস, আর বহির্ভাগের কর্টেক্স ওভারি বা নারীর ডিম্বাশয়ের মূল। যদি একটি ‘ওয়াই’ ক্রোমোজোম প্রাধান্য পায় তাহলে মেডুলা থেকে উৎপন্ন হয় পুংজননতন্ত্র; অন্যদিকে একটি ‘এক্স’ ক্রোমোজোম সক্রিয় হলে কর্টেক্স বৃদ্ধি পেয়ে তৈরি হয় নারীর জননতন্ত্র। এমনকি একটি পূর্ণাঙ্গ পুরুষের অণ্ডকোষ থেকেও শুধুমাত্র যে পুরুষের হরমোন বা টেস্টোস্টেরন ক্ষরিত হয় তা নয়, সামান্য মাত্রায় নারীর হরমোন অর্থাৎ ইস্ট্রোজেন-এর ক্ষরণও ঘটে থাকে। উল্টোদিকে নারীর ডিম্বাশয় থেকে পর্যাপ্ত মাত্রায় ইস্ট্রোজেন নির্গমনের পাশাপাশি ন্যূনতম টেস্টোস্টেরন-এর অস্তিত্বও দেখা যায়। অধুনা মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা এ কথা স্বীকার করে যে যৌন-অবস্থানের নিরিখে কোনও মানুষ কেবলমাত্র বিপরীতকামী বা সমকামী হয় না, একজন বিপরীতকামী মানুষের মধ্যে প্রচ্ছন্ন সমকামিতা, অথবা সমকামী মানুষের মধ্যে প্রছন্ন বিপরীতকামিতা বিদ্যমান। অর্ধনারীশ্বর এই লিঙ্গ ও যৌনতার পরিসরেও পরস্পর বিপরীতধর্মী চেতনার সহাবস্থান।

অথচ যাবতীয় অসহিষ্ণুতার মূলে থাকে বিপরীতকে অস্বীকারের প্রবণতা। সাদা চামড়ার কালোকে অস্বীকার, বিপরীতকামীর সমকামীকে অস্বীকার, পুরুষের নারীকে অস্বীকার, নারীপুরুষের ভিন্নলিঙ্গকে অস্বীকার। পৃথিবীর নিজ-অক্ষের প্রতি আবর্তনে যেমন একটি দিন থাকে, তেমনই তার বিপরীতে থাকে একটি রাতও। ভিন্নলিঙ্গের অর্ধনারীশ্বর সাধনা যাবতীয় বৈপরীত্যের প্রতি অসহিষ্ণুতার উৎসমূলে কুঠারাঘাত করুক – দেবীপক্ষে এটুকুই প্রার্থনা।

1 comments:

1

প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in



‘কেউ কথা রাখে নি, তেত্রিশ বছর কাটল, কেউ কথা রাখে না।’ এটি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কবিতার লাইন। ‘বন্দি জেগে আছ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতা। এতে যৌবনের অভিমান আছে। সুনীলদা তাঁর তেত্রিশ বছরের জীবনে কারোকে কথা না রাখতে দেখে অভিমান প্রকাশ করেছেন। আমি কিন্তু সেই বয়েসে পৌঁছে সে কথা বলতে পারিনি। কারণ কথা রাখতে দেখেছি আমি। দেখেছি সুনীলদাকেই। তিনি তখন জনপ্রি্য ও প্রতিষ্ঠিত লেখক। আমার মতো অজ্ঞাতকুলশীলের কথা না রাখলেও বলার কিছু ছিল না। কিন্তু কথা দিয়ে কথা রেখেছিলেন তিনি। একবার নয়, একাধিকবার। 

তখন বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম বলে সুনীল-শক্তিগোষ্ঠী সম্পর্কে বীতস্পৃহা ছিল। এমন কি সুনীলদাকে সি আই এর চর বলেও মনে হত। তথাকথিত শ্রেণিদৃষ্টি নিয়ে তাঁর লেখা পড়তাম বলে তাঁকে অর্ধেক চিনতান। সংশোধনবাদী বলে যাঁরা সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে উড়িয়ে দিতে পারেন, তাঁদের খণ্ডিত দৃষ্টিতে সুনীলরা যে উড়ে যাবেন, সে কথা বলাই বাহুল্য। অবশ্য পরবর্তীকালে সুনীলদার যে মেদহীন গদ্যের প্রেমে পড়েছি, তখন যদি তার স্বাদ পেতাম, কি হত বলা যায় না। 

পল্লব, ঝুমা ও বাংলাদেশি বন্ধু শামিমের তাগিদে একবার দমদমের ‘প্রথম আলো’ বাড়িতে সুনীলদার মায়ের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়েছিলাম। সেখানে ছিলেন সুনীলদার ভাই অনিল, বোন আর স্বাতী বউদি। সুনীলদার মা কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘যাই করুক সুনীল, সংসারের দায়িত্ব সে কখনও ভোলে নি। স্কলারশিপের টাকা নিয়ে বিদেশে পড়তে গিয়েও সে বাড়িতে টাকা পাঠিয়েছে।‘ অকালে পিতৃবিয়োগের পর সংসারের কাছে কথা রেখেছিলেন মীরাদেবীর জ্যেষ্ঠ সন্তান। শক্তি-সুনীল এই দুই বন্ধুর মিল থাকলেও পার্থক্যও ছিল। জীবনের লক্ষণরেখাকে একেবারে বিস্মৃত হতেন না সুনীলদা। একটা সংযমের শাসনে ফিরে আসতেন। আর তাইতো এত কাঁড়িকাঁড়ি গদ্য লিখতে পেরেছেন। রবীন্দ্রনাথ একেই বলেছেন, ‘প্রতিভার গৃহিণীপনা’। 

১৯৭৩ সালের শেষ দিক। বহু পরিশ্রম করে অকালে নিহত ঢাকার তরুণ লেখক সোমেন চন্দের 

লেখা সংগ্রহ করেছি। মজহারুল ইসলাম ‘সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনা সংগ্রহ’ নামে সে বই প্রকাশ করলেন। সেপ্টেম্বর মাসে। কিম্বার নাসিং হোমে মৃত্যুশয্যায় শায়িত মুজফফর আহমদ সে বইএর ভূমিকা লিখেছেন। তিনি মুখে বলেছেন, সুমন্ত হিরা তা কপি করেছে। তখন এপার বাংলায় সোমেন চন্দ অপরিচিত। বইটির প্রচার দরকার। আমরা সাধ্যমত চেষ্টা করছি। ছাপাখানার মালিক অধীর পাল একটা প্রস্তাব দিলেন। তাঁর সঙ্গে আলাপ ছিল সুনীলদার। সুনীলদা তখন ‘দেশ’ পত্রিকায়। নামকরা পত্রিকা। সেখানে বইটি সম্বন্ধে সমালোচনা হলে পাঠকের নজরে পড়বে। অধীর বললেন তিনি বই সমেত আমাকে নিয়ে যাবেন সুনীলদার কাছে। তখন সুনীলদা সম্পর্কে শ্রদ্ধা বা ভরসা না থাকলেও প্রস্তাবে রাজি হলাম। দেখি না মানুষটাকে কাছাকাছি। এক রবিবার সকালের দিকে অধীরের সঙ্গে গড়িয়াহাট ব্রিজের ডানদিকে সুনীলদার ফ্ল্যাটে হাজির হলাম। সোমেন চন্দের বইটি তাঁকে দিতে তিনি পাতা উল্টাতে লাগলেন। বেশ মগ্ন হয়ে। প্রায় আধঘন্টা কেটে গেল। তারপর বই থেকে মুখ তুলে তিনি বললেন, ‘ এই রচনা সংগ্রহের দরকার ছিল। দেখি কি করতে পারি।’ ‘দেশ’ পত্রিকায় সনাতন পাঠকের কলমে সে বইএর কথা লিখলেন। সোমেন চন্দকে পুনরাবিষ্কারের চেষ্টার প্রশংসা করলেন। বইএর পরিশিষ্টে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত কিছু মানুষের সোমেনসম্পর্কিত লেখা ছিল। সেগুলো সনাতন পাঠকের মতে ‘বোকা বোকা’। সুনীলদার সে লেখা পড়ে আমার রাজনৈতিক বন্ধুরা খুব রেগে গেলেন। 

পরের বছর ঘটনাচক্রে সুনীলদার মুখোমুখি হতে হল। শিবরাম চক্রবর্তীর সঙ্গে পাইকপাড়ায় অসুস্থ শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়কে দেখতে গিয়েছিলাম। সরকার যাতে শৈলজানন্দের চিকিৎসার ভার নেয়, সেই মর্মে আনন্দবাজারে একটা চিঠি লিখে, কয়েকজন লেখকের সই নিয়ে সন্তোষ ঘোষের কাছে যাবার নির্দেশ দিলেন শিবরামদা। আমি অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শিবরাম চক্রবর্তী, সরলানন্দ সেন, বিশু মুখোপাধ্যায় প্রভৃতি কয়েকজন লেখকের সই নিয়ে আনন্দবাজারে সন্তোষ ঘোষের কাছে যেতে তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে যেতে বললেন। কারণ চিঠিপত্র বিভাগ দেখেন সুনীলদা। সুনীলদা চিঠি দেখে বললেন, ‘আনন্দবাজারের বিভিন্ন বিভাগে আরও অনেক লেখক আছেন। তাঁদেরও সই করিয়ে নাও। পাল্লাটা ভারি হোক। তারপরে আমি যা করার করব।’ ১৯৭৪ সালের ১মে আনন্দবাজারে বক্স করে সে চিঠি ছাপা হয়। কাজও হয় সঙ্গে সঙ্গে। তখনকার তথ্যমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় সে চিঠি পড়ে তাঁর ব্যক্তিগত সচিবকে শৈলজানন্দের বাড়ি পাঠান। তারপর অসুস্থ লেখককে পি জি হাসপাতালের উডবার্ন ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়। 

ইতিমধ্যে ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ‘সোমেন চন্দ ও তাঁর রচনা সংগ্রহ’এর সমালোচনা পড়ে হাওড়ার দাশনগর থেকে আইনজীবী নির্মলকুমার ঘোষ আমাকে একটি চিঠি লিখে জানান যে তাঁর কাছে ‘বালিগঞ্জ’ নামে যে পত্রিকা আছে, তাতে সোমেনের ‘বন্যা’ উপন্যাস ছাপা হয়েছিল। সেটি সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে প্রকাশ করি। আনন্দবাজারের অফিসে গিয়ে সুনীলদাকে সে বই দিয়ে আসি গ্রন্থসমালোচনার জন্য। তিনি সে বই সানন্দে গ্রহণ করলেও কিছুদিন পরে ( ১৫ মে, ১৯৭৫) একটি চিঠিতে লিখলেন, ‘কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোন কারণে মতান্তর হওয়ায় আমি দেশ পত্রিকায় সাহিত্য সংবাদ লেখা বন্ধ করে দিয়েছি। সুতরাং বইটি সম্বন্ধে কিছু লেখা সম্ভব নয়। বইটি ফেরৎ পাঠালাম।’ সুনীলদার এই ছোট্ট চিঠি তাঁর চরিত্রের একটি দিক আলোকিত করে। একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক কেন কথা রাখতে পারলেন না, তার কারণ ব্যাখ্যা করে চিঠি দিচ্ছেন একজন অভাজনকে, কথা রাখতে না পারার জন্য ফেরৎ পাঠাচ্ছেন বইটি। 

রাজনৈতিক গোঁড়ামি ত্যাগ করে আমি তখন এই মানুষটির ভেতরের মানুষটির সন্ধান পেয়েছি। এবার একটু দুঃসাহস হয়েছে। দেশ পত্রিকায় গ্রন্থসমালোচনা করতে ইচ্ছুক বলে সুনীলদাকে একটি চিঠি লিখি। সপ্তাহ দুয়েক পরে সুনীলদার চিঠি পেয়ে আবার বিস্ময় চমক। তিনি লিখছেন, ‘আপনি দেশ পত্রিকার জন্য মাঝে মাঝে যদি গ্রন্থসমালোচনা করে দেন, তাহলে তো ভালোই হয়। রবিবার ছাড়া অন্য যে কোন দিন দুপুরের দিকে আমাদের দফতরে চলে আসুন। এ বিযয়ে আলোচনা করা যাবে।’ 

সুনীলদা তখন থাকেন পারিজাত অ্যাপার্টমেন্টে। সেখানে যাতায়াত শুরু হল। দেখতাম ফোন তিনি নিজেই ধরেন। সচিব-টচিব নেই কোন। দায়সারা কথা বলেন না। সবচেয়ে বড় কথা তিনি একজন ভালো শ্রোতা। এ যুগে যা দুর্লভ। নানা অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছি তাঁকে। ব্যস্ত মানুষেরা যেমন নোটবুকে টুকে রাখেন অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ, তাঁকে তেমন করতে দেখিনি। অথচ কথা খেলাপ হত না। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অসাধারণ। একবার তাঁকে নিয়ে গেছি নজরুল মঞ্চে, বামার লরির অনুষ্ঠানে। ফেরার পথে গড়িয়াহাটের মোড় পেরোবার পরে তিনি গাড়ি থামাতে বললেন। গাড়ি থেকে নেমে উনি একটা দোকানের দিকে গেলেন। উঁকি দিয়ে দেখলাম সিগারেটের দোকান। খুব সিগারেট খেতেন তিনি। কিন্তু তখন ডাক্তারের নির্দেশে সিগারেট খাওয়া বারণ। ডাক্তারকে কথা দিয়েছেন তিনি। সে কথা কি রাখবেন না ? ফিরে এলেন একটা সিগার নিয়ে। সেটা জ্বালানো হয় নি। তার গন্ধ শুঁকছেন। ঘ্রাণে অর্ধভোজন আর কি! বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে আপন মনে তিনি বললেন,’ সিগারেট খেলেই যে ক্যানসার হবে, তার নিশ্চিত প্রমাণ কি কেউ দিতে পেরেছে ?’ 

২০০২ সালে আমি ‘শিল্পী আক্রান্ত’ নামে সোমেন চন্দের এক জীবনোপন্যাস লিখি। সুনীলদাকে তার ভূমিকা লিখে দিতে অনুরোধ করি। তিনি আমাকে ছাপা ফর্মাগুলো দিয়ে যেতে বলেন। ফর্মা দেবার পরে তিনি বললেন, ‘আল সন্ধেবেলা সাহিত্য আকাদেমিতে থাকব। তোমার বইএর ভূমিকা নিয়ে যাব। তুমি নিয়ে যেয়ো’

সাহিত্য আকাদেমির অফিস ছিল তারাতলায়, আমার বাড়ির কাছে। কিন্তু পরের দিন আমি যাই নি। কারণ আমি নিশ্চিন্ত ছিলাম একদিনের মধ্যে ছাপা ফর্মা পড়ে ভূমিকা লেখা সম্ভব নয়। দুদিন পরে সুনীলদার বাড়িতে যেতে প্রচণ্ড বকুনি খেলাম। বললেন, ‘কেন এলে না? তোমার জন্য আমি সভার পরেও অপেক্ষা করেছিলাম।’ 

আমাদের পর্ণশ্রী সাহিত্য সম্মেলনের একটি অধিবেশনে তাঁকে সভাপতি করে নিয়ে এসেছিলাম। স্বাতী বউদিও ছিলেন। সুনীলদা তাঁর ভাষণের শেষ দিকে বলেন, ‘আপনাদের সম্মেলনের প্রস্তাবগুলো শুনলাম। তার মধ্যে একটা প্রস্তাব বাড়ি করা। এটা অবশ্যই দরকার। প্রথমে আপনাদের যে কোনভাবে এক টুকরো জমি জোগাড় করতে হবে। তারপর দেখুন সেখানে একটা কুঁড়ে ঘর করা যায় কি না। কুঁড়ে ঘর থেকে পরে প্রাসাদ করা যাবে। ছোট থেকে বড় হওয়া মন্দ কি! আমি আশা করি, আপনাদের এই পর্ণশ্রী সাহিত্য সম্মেলন আগামী দু-তিন বছরের মধ্যে উদ্যোগ নিয়ে নিজস্ব ভবন তৈরি করবে। আপনারা আমাকে ডাকবেন, আমি উদ্বোধনের দিন আসব।’ 

আমরা সুনীলদার কথা রাখতে পারিনি। কিন্তু আমি জানি, সুনীলদা ঠিক তাঁর কথা রাখতেন।

1 comments:

1

বিশেষ ক্রোড়পত্র - রাহি সোরেন

Posted in






সাঁওতাল জীবন / Santal Life



সূচী / Contents

Note from the Editor
Samantak Das - Eleven simple propositions about reservation
Mahadev Hansda - Insight into the Santal Rebellion of 1855
Sitaram Baskey - সাঁওতালি সমাজ ও সংস্কৃতি তে cy¡ শায় উৎসব
Jogendranath Murmu - “An Introduction to Santali folk rhymes”
Rahi Soren - Archives of Traditional Santali Songs
Amit Murmu - সাঁওতালি ভাষায় প্রথম সাহিত্য পত্রিকা: “হর হপনরেন পেরা”
Maroona Murmu - Reflections of a Daughter: Gurucharan Murmu
Malini – ওরা


-------------------

Note from the Editor:

Santals are the largest tribes in India. Yet, how much do we happen to know about their language, culture or religion? It is beyond the scope of this issue to address all these concerns. However, it is a humble attempt to know our neighbours a little better than we know of.

We often do not recognise the marginalisation or are ignorant of the life and position of Santals. The authors address century-old rebellion as well as current issues pertinent to the status of reservation. Attempt has also been made to share the practice and oral narratives such as Dasai and Gidra Bowli. It also includes the story of initiation of the first Santali magazine which contributed to the development of written literature in Santali. This issue also includes the recent attempts to preserve the earliest recordings of Traditional Santali songs, personal narratives of the struggle of the first IPS officer and last but not the least, the Santals in the eyes of the “others”.

I do hope this issue will entice the reader to know more by appreciating this attempt and recognize “Santal Life”!

Rahi Soren

--------------------


Eleven simple propositions about reservation
Samantak Das


Before I begin, a word about nomenclature. An early reader of this piece pointed out – correctly – that using “casteism” to refer to all forms of discrimination, is not accurate, because, even though the term “Dalit” is often used to refer to those who belong to the formerly “untouchable” castes along with members of tribal (or indigenous, or Adivasi) peoples, it does not fully take into account the ways in which tribal movements for dignity and self-respect often distinguish themselves from caste-based movements. Tribal societies are not caste-dependent for their functioning, so to speak of anti-tribal sentiment in the same breath as anti-caste sentiment is misleading. Also to be noted is that the term “Adivasi” itself is contentious, since many of the people who belong to tribal communities, especially in the northeastern parts of the country, do not accept this term. It may be pertinent to point out that the term “Dalit” has no legal status in India, the courts preferring the terms “Scheduled Caste” (SC), and “Scheduled Tribe” (ST), as well as “Other Backward Classes” (OBC) as being more terminologically exact. However, it is also true that upper-caste, upper-class animosity towards all three groups (SC, ST, OBC) has much in common, which is probably the reason why scholars and commentators use terms like “Dalit” or “Dalitbahujan” to refer to all sections of society who were previously spoken of as “the depressed classes” (a term preferred by Dr Ambedkar, among others). Since this is a piece about reservation, and reservation invokes the categories SC, ST, and OBC, it may be best to stick to these terms, at least for this brief essay. For reasons of space, and focus, I shall not be discussing gender-based reservation – vitally important though that is – here. For which, my apologies.

The first point to remember is that Hinduism, or, more accurately Brahmanical Hinduism, predicated on the inflexible rigidity of the caste system, depended on a system of reservation for its successful implementation and functioning, with birth determining the position once could, or could not, occupy in society. Any deviation from, or challenge to, such reservation could lead to ostracism, physical punishment, or death. Just ask Ekalavya, deprived of his thumb for daring to trespass on the realm reserved for kshatriyas, or Khona, deprived of her tongue for daring to do what only male scholar-astrologers were supposed to.

The second proposition is that casteism, and anti-tribal sentiment, is still an integral part of Indian life, permeating all ranks, classes, regions, and occupations. A corollary to this second proposition is that the framers of the Indian Constitution wanted – after much discussion, disagreement, and debate – to provide at least some paths whereby this grossly inhumane aspect of Indian society could be mitigated, and, in time, done away with altogether.

The third is that “reservation” does not refer to a single thing, it has at least three realms in which it operates: the political, the educational, and the occupational. Each of these has its own history, special characteristics, and specific features. We need also to remind ourselves that both supporters and opponents of reservation often get things wrong when arguing their positions. I shall not discuss reservation in elected bodies here, confining myself to a few brief comments on reservation in educational institutions, and in jobs.

Fourth, in case of educational institutions and jobs, reservation is mandated only for the public sector, that is, for bodies funded by the state. Given that only about 32% of students in higher educational institutes (colleges and universities) attend government-funded institutions in India today, it is quite easy to calculate that the percentage of seats reserved for those from various reserved categories is nowhere near what it should be. Similarly, with just about four percent of all jobs being in government organisations, the actual percentage of jobs that are reserved works out to about 0.002% (yes, you read that right).

The fifth proposition is that reservation is not about reparative justice; if that was the case, then all political posts, every single seat in every school, college, and university, and all jobs in all sectors would have to be reserved for decades, if not a century or two, to undo the millennia of exclusion and deprivation that the “depressed classes” have suffered from. Reservation is primarily about two things: representation, and the possibility of empowerment.

The sixth is the invocation of “merit”. The argument goes something like this: by reserving seats for candidates who have lower standards (fewer marks, less impressive qualifications or credentials), those who are possessed of more “merit” are deprived from what should rightfully be theirs. Quite apart from the fact that marks and qualifications are not the only yardsticks to measure merit, the simple fact of the matter is that study after study has shown that having a more heterogeneous group of people – whether in a classroom or in an office – naturally raises creativity, empathy, understanding, and critical thinking. Merely on this one ground, we need to encourage more, not less, diversity in our offices and classrooms. Reservation leads to an increase in “merit” of everybody, and not just its direct beneficiaries.

The seventh proposition on my list has to do with what the beneficiaries of such “quotas” gain by receiving that initial small push. Opponents of reservation tend to gloss over the fact that such an advantage is received by the individual only at the point of entry, and this is particularly true of educational institutions. A person who gains admission despite having fewer marks, or a lower grade than her/his peers no longer receives such a benefit when it comes to being assessed during the course of her/his studies. In fact, quite the contrary. There are any number of instances where a candidate has been under-marked, or given a failing grade, merely because she/he belonged to a particular community. This is further exacerbated if that person happens to be of the female gender. Where assessment is done anonymously, this bias is less detectable, but once a person’s identity is revealed aeons of prejudice work to ensure that she/he is given a poorer score than deserved. This is especially true where the final stage of assessment is an interview where, typically, most of the assessors belong to savarna ranks.

Eighth, it is difficult to comprehend just how all-pervasive this anti-SC/ST/OBC bias is. Even in the most liberal families, institutions, organisations, and so on, a significant number (usually the majority), retains this bias, of which they may themselves be blissfully unaware. This may take the form of a kind of patronizing sympathy, at best, or outright hostility and rejection, at worst. But it is there. To deny this bias is to give it a renewed lease of life, and the sooner that everyone recognises this, the better it is for us as a people, and a nation.

Some have argued that the whole concept of reservation has gone against the interests of the scheduled tribes, scheduled castes, and members of other backward classes, by permanently labelling millions of individuals as belonging to one specific category or the other – as a friend put it to me, decades ago, more in bitterness than in anger, “Once an ST, always an ST; nothing I ever do will be judged otherwise.” This is the ninth proposition I would like to put forward, that our politicians continue to use, abuse, and manipulate reservations for their own narrow and selfish reasons (primarily to hang on to power), and it is difficult to judge whether the benefits of reservation (and there are many) outweigh the cynical use it continues to be put to by our leaders. The choice is not between maintaining reservations versus doing away with them altogether. One has to start a real debate, at all levels, about reservation – critically scrutinising its genesis, operation, effects, possible alternatives, and so on – and not jump to simplistic, biased, uninformed conclusions about what is an undeniable feature of Indian life. The oppression of people based on their caste, or ethnic origin, or class-status (or religion, or gender for that matter), and the possibility of emancipation are too important to be left in the hands of our politicians, and other empowered decision-makers, alone.

Why, given all the above, are debates about reservation, especially in the public sphere, carried on with so little concern for the facts, lacking in nuance, and all-too-easily lapsing into mudslinging and trading in insults? The reason is simple: we are not taught about reservation in our schools, colleges, and universities – except perhaps for those who study political science as a subject. My tenth proposition is that reservation should be made a compulsory subject of study from, say, the middle-school level onward. The history of reservation; the debates about it in the Constituent Assembly; the views of those who supported it as well those who didn’t; its use, misuse, and abuse in subsequent years; a comparison with similar processes at work elsewhere in the world (affirmative action in the United States of America, to take the most obvious example); even the nomenclature used, and the debates around it (e.g. why, as mentioned earlier, the term “Dalit” has no validity in Indian jurisprudence); and much more – all of these should be studied in our classes, in an organised manner. Without this, debates around reservation will continue to be characterized by ill-informed opinions, prejudices, and biases to the detriment of every one of us.

My final, eleventh, proposition is this: reservation is not about justice; as stated earlier it is about representation, and the possibility of empowerment, or, in a word: dignity. If one believes that every individual has the right to live with dignity, then one may well challenge reservation as it exists right now, but one cannot dismiss it out of hand, as so many of its detractors seem to do.

These are the eleven simple propositions about reservation that I place before you, dear reader. I have no doubt in my mind that there is a crying need for reservation in all three arenas – representative politics, education, and jobs – where it currently operates, even if its implementation is sometimes flawed, often misused, and too readily abused for narrow sectarian interests. You are, of course, free to form your own opinion; I merely hope that this helps you a little bit to put your thoughts together.

Samantak Das is Professor at Department of Comparative Literature, Jadavpur University, Kolkata

-------------------

Insight into the Santal Rebellion of 1855
Mahadev Hansda

Remembering the heroic feat of Sidhu and Kanu, the leaders of the Santal rebellion of 1855, let me share a few words. A rebellion cannot be realized in a day. The collective resentment over the years, the shared grievance leading to a communal bitterness erupts to take the form of a rebellion. Santal rebellion is one of the earliest revolutions that had taken a shape of a movement against the oppressive British rule in India. Not only did the Santals took part in the rebellion, Kol, Kamar, Bhuiya, Dom, Gowala, Rajawar and several oppressed people of the region actively participated in the movement.



The history of Santal rebellion can be traced from The Illustrated London News (Feb. 23, 1856), District Gazetteer, judicial proceedings following the Hul and of course the narratives embedded and passed on for generations in the remembrance of the great rebellion. The Santals in general had been much troubled by extortionate money lenders, unfair grain dealers and victims of nefarious practices. On 7th July Sidhu and Kanu met Maheshlal Dutta, the police inspector and Kanaram, the moneylender in Panchkatia (near Murshidabad). They came into an argument which led to a confrontation, which resulted in the death of the inspector and five money lenders. This fuelled the long suppressed Santals of the region and on July 12, 1855, the rebellions gathered around Pkur Rajbari, Kalikapur, Ballabhpur and Sahabajpur. After that on July 16, the Santals declared themselves victorious at Piyalpur. Between 20 July and 30 July, under the leadership of Tribhun Majhi, Mansingh Majhi and Gocho Majhi, the revolution spread far and wide – starting from Sahebgunj to Nalghat (in Birbhum), Rampurhat, Suri,to Nangulia as well as Murshidabad. On 19 August, 1855, the British declared a public warning to stop the revolt. However, the Santals paid no heed to the warnings, rather plundered the residence, villas as well as the courts of the Sahibs. In response to this atrocity, on 10 November, Marshal Law was declared which resulted in the crushing of the rebellion with an iron fist. According to the Illustrated London News (Feb. 23, 1856), “On one occasion, when, in company with Lieutenant and Adjutant J, Burn, of the 7th Regiment Native Infantry, and Dr. Macnamers, accompanied by fifty Sepoys (see Sketch), we were reconnoitring the road for the next day’s march, we were surrounded by almost 600 Santhals, who, shouting and screaming, and beating drums, seemed to spring out of the ground, so sudden was their appearance. They advanced, forming nearly a complete circle around our small band, who, who with the utmost coolness, under the orders of their Adjutant – when the rebels had approached to within sixty yards, and when the arrows were falling back amongst the Sepoys – commanded independent file firing, killing and wounding a number of the rebels before they dispersed.”

In another instance, “Such was the thriving state of the Santhals previous to the sudden and astounding outbreak in July, 1855, when murder, pillage, fire, and destruction were hurled through the length and breadth of the country, inhabited by 123,000 Santhals, who had migrated from the jungles of Orissa to the jungles of the Bhagulpoor District, on the banks of the Ganges, about 200 miles north-west of Calcutta.” 


Sidhu was arrested by Major Sakbargh from Bhagalpur (Kashiadih) whereas Kanhu was arrested on 30 November from Obarbandh. On 23 February, 1856, Kanhu was hung from the Banyan tree at Panchkathia in Bhagalpur. Such was the fate of Sidhu as well, but the date is yet unknown. It is known from several sources that at least 30-40 thousand shed their blood in the Santal rebellion of 1855. Some scholars are of the opinion that the Santal rebellion was the result of the repression of Zamindars while others opine that it is mostly a rebellion of the common man, the farmers. The revolt was against the unfair tax system imposed upon the farmers and labourers by the Zamindars as well as the money lenders. After the rebellion, the name of the region, Damin-e-koh was changed to Santal Pargana and the administration of the region was left to the existing Majhi Pargana (customary laws) system.

At the present times, Santal rebellion is remembered through the observance of the “Hul day” on 30 July. Several documentaries, films, plays, novels as well as songs have been inspired by the great Santal rebellion of 1855. 

Mahadev Hansda is the Editor of the Santali magazine, “Tetre”.

---------------------

সাঁওতাল সমাজ ও সংস্কৃতিতে দাঁশায় উৎসব
সীতারাম বাস্কে

ভারতবর্ষ বিভিন্ন জাতি এবং স্মপ্রদায়ের বাসস্থান। প্রত্যেক জাতিরই নিজস্ব ধর্ম, পূজার্চনা, উৎসব-আনুষ্ঠান আছে। সেইভাবে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এইসবের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তারা এইসব উৎসব পালন করে থাকে। বিভিন্ন উৎসবগুলির মধ্যে অন্যতম একটি উৎসব বা পরব হল ‘দাঁশায়’। এটি পালন করা হয় আশ্বিন মাসে, দূর্গাপূজার সময়। আশ্বিন মাস কে সাঁওতালরা দাঁশায় মাস বলে। সাঁওতালদের অন্যান্য উৎসবের থেকে এই উৎসব নাছে-গানে, বাদ্যযন্ত্রে অনেকটা পৃথক। সাধারণত পুরুষ ও নারী উভয়েই টামাক (ধামসা), তুমদাঃ (মাদল), রেগড়া, কাঁসা (বাদ্যযন্ত্রবিশেষ), করতাল, ঘণ্টা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র সহ উৎসবকালীন নাচে অংশগ্রহণ করে। দাঁশায় উৎসব অন্য উৎসবের তুলনায় একটু ভিন্ন। অন্যান্য বাদ্যযন্ত্রের পাশাপাশি ‘ভুয়াং’ নামক একটি বিশেষ বাদ্যযন্ত্রের ব্যাবহার হয়। এটি শুকনো লাউয়ের খোল দিয়ে তৈরী। বাদ্যযন্ত্রটি দাঁশায় উৎসব ব্যতীত অন্য কোন উৎসবে ব্যবহৃত হয় না। এই উৎসবে মহিলাদের অংশগ্রহণ নেই, তবে পুরুষেরাই মহিলাদের পোশাক-আশাক ও অলঙ্কার দিয়ে সজ্জিত হয়ে অংশগ্রহণ করে। এই উৎসবের গানগুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ‘হায়রে-হায়’ সব্দ সমষ্টি দিয়ে শুরু হয় – দুঃখের কথা প্রকাশ করার জন্য। এই উৎসবে বিভিন্ন গ্রামের নাচ-গানের দল অংশগ্রহণ করে। প্রতিটি দলে একজন করে গুরু থাকে। দাঁশায় নাচের দল এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ-গান করে এবং দান-সামগ্রী সংগ্রহ করে।


দাঁশায় পরব-এর গানে ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাব অপরিসীম। সাঁওতাল জাতির ইতিহাস সন্ধানে এই উৎসব অনেক তথ্য দিতে পারে। ভারতের প্রাচীন আদিবাসী যথা – সাঁওতাল, মুন্ডা, হো, মাহালি, ভূমিজ, লোধা, কোড়া প্রভৃতি অস্ট্রিক ভাষাগোষীভুক্ত মানুষকে ‘খেরওয়াল’ বলা হয়। সাঁওতাল হল খেরওয়াল জনগোষ্ঠীর একটি জাতি। দাঁশায় উৎসব কে কেন্দ্র করে সাঁওতাল সমাজে পূর্বপুরুষদের কথিত কাহিনীগুলির মধ্যে একটি হল–খেরওয়াল জনগোষ্ঠীর মানুষরাই নাকি সর্বপ্রথম ভারতবর্ষের মাটিতে পা রেখেছিল। এখানে তারা বহু লড়াই লড়েছে। বলা হয় সর্বপ্রথম যে লড়াই হয়েছিল তা হল আর্যগোষ্ঠীর সঙ্গে। সেই লড়াইয়ে আর্যদের দলপতি ছিল দেবরাজ ইন্দ্র। খেরওয়াল জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে ছিল হুদূড় দুর্গা। সেই লড়াইয়ে খেরওয়াল গোষ্ঠীর দলপতির কাছে আর্যগোষ্ঠীর দলপতি পরাজিত হয় এবং যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধের আবহাওয়া ঠাণ্ডা হলে ইন্দ্রের কাছ থেকে এক সন্ধিপ্রস্তাব পাঠানো হয় হুদূড় দুর্গার কাছে। এই প্রস্তাব রাখা হয় যে আর্য আর খেরোয়ল – এরা যুদ্ধ করবে না, বিবাহের সম্পর্ক গড়ে সুখে শান্তিতে থাকবে। এই সন্ধিপ্রস্তাবে হুদূড় দুর্গার সায় পাওয়া মাত্র ইন্দ্র আর্যদের সবচেয়ে সুন্দরী নারী কে উপহার-স্বরূপ হুদূড় দুর্গাকে গ্রহণ করতে অনুরোধ করেছিল। ফলে আর্যরা অনায়াসে খেরওয়ালদের অন্দরমহলে আসা-যাওয়ার সুযোগ পায়। মেয়েটির নাম ছিল দেবী। দেবীর কাছে ইন্দ্রের নির্দেশ ছিল অন্দরমহলের সমস্ত খবরাখবর যেন তার কাছে পৌঁছে দেয়। দেবী স্বামীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করলেও ইন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করেনি।তাই হুদূড় দুর্গার যাবতীয় খবর – সে কখন খায়, ঘুমায়, নেশায় বিভোর থাকে, আনন্দ ফুর্তি করে – সব ইন্দ্রের কাছে পৌঁছে দেয়। বহুদিন ধরে এইভাবে তথ্য

সংগ্রহ করে ইন্দ্র হুদূড় দুর্গা কে অপহরণের ফাঁদ আটলেন। সে যখন নেশায় অচৈতন্য অবস্থায়ে থাকবে, ঠিক সেই সময় অপহৃত হবে। সেইরূপ ইন্দ্র তার বীরযোদ্ধাদের অতিথিস্বরূপ খেরোয়াল বাসভুমিতে পাঠাল। সময় বুঝে দেবী ও হুদূড় দুর্গা দুজনেই অপহৃত হলেন আর সেই দিনেই খেরোয়াল দের সঙ্গে আর্যগোষ্ঠীর লড়াই হল। হুদূড় দুর্গা অপহৃত হওয়ায় খেরোয়ালরা সেই লড়াইয়ে পরাজিত হয় এবং খেরোয়াল জনগোষ্ঠীর মানুষ সকলে সেখান থেকে পালিয়ে পাহাড়-জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। পরে তারা আলোচনা করে ঠিক করে যে দেবী ও হুদূড় দুর্গা যেখানেই থাক তারা তাদের উদ্ধার করবেই। খেরোয়ালদের বিশ্বাস তারা অমর। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি দেবী তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে – আদতে হুদূড় দুর্গাকে মেরে ফেলা হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয় যে ছদ্মবেশ ধারন করে অস্ত্র গোপন করে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের সন্ধান করবে। যেখানেই তারা দেবী আর হুদূড় দুর্গার সন্ধান পাবে সেখানেই তাদের উদ্ধার করবে। সেইরূপ সমস্ত খেরওয়াল গোষ্ঠীর পুরুষেরা নারী সজ্জায় সজ্জিত হয়ে ছদ্মবেশ ধারণ করে, যথা – শুকনো লাউয়ের খোল দিয়ে তৈরী ভুয়াং কে ধনুক দিয়ে বেঁধে তার মধ্যে তির লুকিয়ে রাখে, ঢালকে বাদ্যযন্ত্র হিসেবে হাতে নেয়, তরোয়ালকে শাড়ীর কোচে লুকিয়ে রাখে। এইভাবে সম্পূর্ণ পরিকল্পনা নিয়ে খেরওয়ালরা যাত্রা শুরু করে। নাচ-গানের ছদ্মবেশ ধারণ করে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে যায়। জানা যায় সাতটি দলে তারা ভাগ হয়েছিল। প্রত্যেকদলে একজন করে গুরু ছিল। যথা – ধরম গুরু, কাম্রু গুরু, সিদ গুরু, সিধা গুরু, ভুয়াং গুরু, গান্ডো গুরু আর রহড়া গুরু। গুরুরাও বৃদ্ধের ছদ্মবেশ ধারণ করে। এইভাবে বাড়ি বাড়ি প্রবেশ করে দেবী ও হুদূড় দুর্গার সন্ধান নেওয়া শুরু হয়। তারা ‘হায়রে-হায়’ গান করতে করতে দানসামগ্রী চাওয়ার ওজুহাতে বাড়ি বাড়ি যেতে লাগল দেবী ও হুদূড় দুর্গার সন্ধানে। এখনও সেই যাত্রা চলছেই। গ্রামে গ্রামে এখনও এই উৎসবের সময় ‘হায়রে-হায়’ করতে করতে খুঁজে চলার রীতি আছে। এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে যে কত দাঁশায় গানের সৃষ্টি হয়েছে, তার হিসেব নেই। এখানে একটি দাঁশায় গানের উল্লেখ করা হল –

“হায়রে হায়রে –
অতমা পাতালরে গুরু হো ভুয়াং সাডে কান
সের্মা চটেরে চেলা হো কাঁসায় রাঁওয়াঃ কান? 
হায়রে হায়রে –
চেতে লাগিৎ দ গুরু হো ভুয়াং সাডে কান
চেতে লাগিৎ দ চেলা হো কাঁসায় রাঁঅয়াঃকান?
হায়রে হায়রে –
দেশ দাঁড়ান লাগিৎ গুরু হো ভুইয়ান সাডে কান
দিশম সাঁঘার লাগিৎ চেলা হো কাঁসায় রাঁওয়াঃ কান।“


উপরিউক্ত গানটির বঙ্গানুবাদ এইরূপ –

“হায়রে হায়রে –
পাতালপুরীতে হে গুরু ভুয়াং এর সুর শোনা যায়
অম্বরতটে হে চেলাগণ কাঁসার বোল প্রতিধবনিত হয়।
হায়রে হায়রে –
কিসের জন্য হে গুরু ভুয়াং এর সুর শোনা যায়
কিসের জন্য হে চেলাগণ কাঁসার বোল প্রতিধবনিত হয়?
হায়রে হায়রে –



দেশ ভ্রমণের জন্য হে গুরু ভুয়াং এর সুর শোনা যায়
দেশ পরিভ্রমনের জন্য হে চেলাগণ কাঁসার বোল প্রতিধবনিত হয়।”

সভ্যতার অগ্রগতির সাথে এই উৎসবের গভীরত্ব খুঁজে পাওয়ার আশায় সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষকে কয়েকটি প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে–উপরিউক্ত কাহিনী ছাড়াও দাঁশায় নিয়ে অনেক কথিত কাহিনী প্রচলিত আছে, কথিত কাহিনীগুলির সত্যতা, কবে থেকে এই উৎসব শুরু হয়েছিল, দাঁশায় উৎসবের উদ্দেশ্য কী, উৎসবটি সুখের নাকি দুঃখের প্রভৃতি। এই নিয়ে সাঁওতালী ভাষার বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যেমন মতভেদ আছে তেমনি দাঁশায় উৎসবের সত্যতা উন্মোচনের জন্য তারা নিরন্তর অনুসন্ধানের কাজ করে চলেছে। 


Sitaram Baskey is radio-anchor at the Santali Section of All India Radio, Kolkata.

---------------

‘Gidra Bowli’ - Santali folk rhymes
Jogendranath Murmu

Born in a Santal family, I have been familiar with Santali folk rhymes since my childhood and used to recite them frequently. I could not understand the meaning of rhymes as a child, but the rhythm and tone of it intensely appealed to me. Later on, in life, while studying folk literature, I discovered that there lies immense wealth in the folk literature of Santali. I have been deeply attracted to the Santali folk rhymes thenceforth.

Before discussing about Santali folk rhymes, let me say a little about the lives, occupation and language of the Santals. In sociological discourse, the terminology of the word ‘tribal’ has changed the concept regarding the Santals. Santals call themselves ‘Hor’, which means ‘we, the man’. They are mostly illiterate but they have societal education, traditional knowledge, and cultural value which they learn from the community. 

Santals are an agrarian community, who established their village surrounded by greenery and far from the city. Every day, they are involved with agricultural work or are engaged in collecting food and fuel from the adjacent jungle. Amidst the real experience of such life, the Santals discovered different types of rhymes. These rhymes are designed to resonate with the child and its emotion. Later, it gradually became associated with various family events and social gatherings. Even today, Santals use rhymes at folk festivals, at weddings and of course to engage a child, that contributes to the mental growth. Now, the rhymes are chiefly used as apparatus of education. It is used as a folk play item at its best, carved out for children. 

These rhymes have small verses, created in everyday life, and largely used by the community. Many different types of pictures are portrayed through the rhymes. It has several imagery derived from the real world as well as speaks of imaginary worlds. Santali rhymes can be divided into different categories depending upon its use in different situation. 

The name ‘Gidra Bowli’ consists of two words. One is ‘Gidra’ which means ‘child’ and ‘Bowli’ means ‘deluded’ or ‘overwhelming’. When the children cry, they are then deluded or overwhelmed by the rhyme and rhythm of ‘Gidra Bowli’. So, rhyme is an excellent verbal art that has been created from the ancient times in Santal society. The rhymes are a source of constant pleasure, and emotes a wide range of emotions.

Children in Santal society grow up with their immediate family as well as the adjoining families, where fostering is a common practice. Women create rhymes at the time of leisure or at the end of a busy day. These rhymes are transmitted orally from generations across the community. Santals rest their belief in ‘Ol knon do thuti ge saresh a’, which means ‘Orality is better than writing’. So, in the santal society, all the rhymes, songs, myths, legend, fables, fairytales, riddles, proverbs, folk story and narratives etc. are orally transmitted. There is a tendency to match the sound of the words in rhymed stanzas. We can find anomalous expressions in such folk rhymes.

Santali 

Oka te kahum chalaw lena, Mag tala Tiju Jom 

Kag kag kag 

English

Where you have gone, Eating Insects in the bamboo garden

Kag kag kag

Here, a child asks the crow, “Where you have gone?” The crow replies, “To eat insects.” 

Santali 

Alo Babu rak, Sim chupi pak 

Hopon Babuy nom goda 

Pakug pakug pakug! 

English

Don’t Cry baby, I will give you chicken

My baby will eat

Pakug pakug pakug!

Here is the image of a poor family where children cry for food. As the poor parents fail to provide their child with adequate food, they take shelter in the solace of rhymes. Here ‘rak’ means ‘to cry’ (verb) and ‘pak’ means ‘chicken’ (noun), wherein both has been used to create a rhyming pattern. 

The idea of Santal culture and society emerges with the study of such ‘Gidra Bowli’, which is a treasure house and awaits to be explored.

References:

Biswajit Patra, Bankura jelar dakhin-paschim anchale prachalito Santali chara o Bangla charar tulana mulak alochana, 2015.




Parimal Hembram, Santali Sahityer Itihas, 2008.


Jogendranath Murmu is Assistant Professor at the Department of Santali, The University of Burdwan, Purba Bardhaman.


-----------------

Archives of Traditional Santali Songs
Rahi Soren


Long used as a tool for colonial dispossession, mapping has also been used by Indigenous peoples as a tool for reclaiming, reimagining, and renewing Indigenous connections to the land and water, and their traditional territories. Indigenous mapping—or mapping by, with, or for indigenous peoples—can take multiple forms. In cultural-resilience initiatives, indigenous mapping has supported intergenerational knowledge transfer within communities of songs, stories, place names, in order to reconnect indigenous peoples to the places where they come from and enable community protection of cultural sites. Santali songs has existed not only within a definable space or time, but rather at moments of disjuncture – in between regions, amid moments of transition and transformation, and at the border of ethnic, religious, and social boundaries. There is also no public archive of any note anywhere where sound recordings of Santali music are stored and are made available to researchers into music, musicology and cultural ecology. In an attempt to achieve the same, Jadavpur University had taken a project under RUSA 2.0 entitled “Resource Mapping the Early Recordings of Traditional Santali Songs”. A systematic study of holdings and the extent of the collections have been catalogued with extensive metadata dating from 1914 to 2005.

Till now 519 recordings could be retrieved from collection of All India Ratio Stations, Kolkata, Ranchi, Berhampore as well as private collections.

The earliest recordings that we found were field recordings from the Linguistic survey of India. National Library of France, Paris. Dated 1914.

Arnold Bake had come to India during 1937-1944, in search of musicological and religious history material. The British Library is actively engaged with a number of international academics and communities who are working with was cylinder recordings from the Arnold Adriaan Bake archive to enhance the documentation for these recordings. 

Kali Dasgupta (b 1926) is among the greatest singers and collectors of Eastern Indian folksongs. While a participant in left movements in the 1940s, he started collecting songs that captured the lives and labours of ordinary people. Now, the several thousand songs, many of them extremely rare, in his collection articulate not only a wide range of life experiences, including those of rural women, extinct professions, and rare musical traditions, but also the history of Bengal under British rule. 

Deben Bhattacharya (1921–2001) was a radio producer, record producer, ethnomusicologist, anthropologist, documentary filmmaker, photographer, translator, poet, writer, broadcaster, lecturer, and folk music consultant. He produced over 100 records, 23 films and published more than a dozen books in his lifetime and much of his work was carried out under UNESCO.


It is now being attempted to reintroduce the dwindling cultural practice to be revived. The fact that they have been ‘reclaimed’ gives a presence in the Santal community as highly valued and important cultural property of the community that has been returned. The repatriated recordings have been the focus of close study, from the point of view of their historical, cultural, social and artistic significance and their return has had substantial positive and empowering outcomes for elders as they share the knowledge to future generations. While some feel that many of these recordings should perhaps not have been taken in the first place, others believe that with the tenuous state of Santali songs, language and ceremony they are now of great value to the community for the preservation of culture as well as being a meaningful resource for the continuation of existing and new forms. The ethno-religious mobilization might be one of the reasons among the amalgamations which led in the homogeneity among the Santal community. As the numbers of indigenous people living traditional lives in the world disappear, “The whole vast of archives of knowledge and expertise... will be consigned to oblivion”.

Rahi Soren is Assistant Professor at School of Oceanographic Studies, Jadavpur University, Kolkata. Principal Investigator of the RUSA Project, “Resource Mapping the Early Recordings of Traditional Santali Songs”.

------------------

সাঁওতালি ভাষায় প্রথম সাহিত্য পত্রিকা – ‘হড় হপনরেন পেড়া’
অমিত মুর্মূ


সাঁওতালি সাহিত্যে, সাহিত্য পত্রিকার উদ্ভব ‘হড় হপনরেন পেড়া’ (আক্ষরিক অর্থে ‘সাঁওতালদের অতিথি’) পত্রিকার দ্বারা । এই পত্রিকাটি ১৮৯০ সালের মে মাস থেকে মাসিক পত্রিকা রূপে বেনাগাড়িয়া মিশন প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়।1 যদিও এই পত্রিকা খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার প্রসারের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত করা হয়েছিল, যা পরবর্তীকালে মিশনের ঐতিহাসিক ওলাব হদনে লিপিবদ্ধ করেছেন। তবুও এই পত্রিকা নির্দ্বিধায় একটি সাহিত্য পত্রিকা, কেননা এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা যেমন প্রবন্ধ, কবিতা, গীত, স্মৃতি লেখা, ভ্রমণ সাহিত্য, গল্প, হেঁয়ালি, ধাঁধা এবং বাগধারা ইত্যাদি প্রকাশিত হয়।2

এই পত্রিকার সম্পাদনা রেভ লার্স ওলসেন স্ক্রেফসরুদ দ্বারা হয়েছিল, তবে সহযোগিতায় রেভ পল ওল্ফ বোডিং এর অবদানও অস্বীকার করা যায় না। ১৮৯০ সালের ১৬ জানুয়ারি বেনাগাড়িয়ায় রেভ পল ওল্ফ বোডিং এর আগমনের সঙ্গে সঙ্গে লাগাতার চার মাস ধরে তিনি রেভ স্ক্রেফসরুদ দ্বারা সংগৃহীত ১৩,০০০ সাঁওতালি-ইংরেজি এবং ইংরেজি-সাঁওতালি শব্দগুলি অধ্যয়ন করেন আর সাঁওতালি ভাষা ভালোভাবে রপ্ত করেন।3 এদিকে ‘হড় হপনরেন পেড়া’ পত্রিকার প্রকাশনা মে মাস থেকে শুরু হয়। সম্পাদনায় রেভ লার্স ওলসেন স্ক্রেফসরুদ এর নাম থাকলেও নেপথ্যে সব কাজেই রেভ পল ওল্ফ বোডিং পরিচালনা করতেন – বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এই পত্রিকার প্রকাশ এর পিছনে রেভ বোডিং এর সহযোগিতা অনুস্বীকার্য।4 

এই পত্রিকার মধ্য দিয়ে অনেক বড় বড় কবি ও লেখক এর উত্থান হয়েছে। পরিমল হেমব্রম এইজন্য তার ‘সাঁওতালি সাহিত্যের ইতিহাসে’ (২০০৭) -এ লিখেছেন - "সাঁওতালি পত্রপত্রিকার ইতিহাসে এটিই প্রথম মাইলস্টোন।"5 এই পত্রিকার আরেকটি বিশেষ গুণ হলো সাঁওতালি অনুবাদ সাহিত্যের প্রকাশ। ভাষা সাহিত্যের ক্ষেত্রে অনুবাদ সাহিত্যের যোগদান অপরিসীম। বিশেষ করে অনুবাদের মাধ্যমে এক দেশের সাহিত্য অন্য দেশেতে সঞ্চারিত হয় এবং ওই ভাষার সাহিত্যের সমৃদ্ধি ঘটে।6

এই সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে যেসব সাঁওতাল কবিদের উত্থান হয়েছে তাদের মধ্যে অন্যতম ডেডেম হাঁসদাক্(১৮৬৬ - ১৯২১); বিরাম হাঁসদাক্(১৮৪৩ - ১৮৯৭); শিবু বেসরা; নুকা মারান্ডি(১৮৬৬ - ১৯২২); নিকোদেম মারান্ডি(১৮১০ - ); সূর্য মুর্মু ( - ১৯১৪); বেঞ্জামিন বাবুরাম সরেন (১৮৬৪ - ১৯৩০); বারিয়াড় সরেন (১৮৭১ - ১৯৪৭);7 সাগরাম মুর্মু8 ইত্যাদি।

পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্বে থাকা রেভ পল ওল্ফ বোডিং ১৮৯৪ সালের মধ্যে এক অসাধারণ কাজ করে দেখান - ৬৮৭ প্রকার প্রশ্ন-উত্তর সমৃদ্ধ ‘কুকলি পুথি’ নামে একটি ২৩২ পৃষ্ঠার পুস্তক লিখেন । কিন্তু এই সময় রেভ লার্স ওলসেন স্ক্রেফসরুদ আমেরিকা-ভ্রমণে থাকায়, তার ফেরবার পরে ১৮৯৯ সালে বেনাগাড়িয়া মিশন প্রেস থেকে এটি ছাপা হয়।9 ১৮৯০ দশকের গোড়ার দিকে বাইবেল পুরনো নিয়ম অনুবাদের জন্য ইন্ডিয়ান হোম মিশন, চার্চ মিশনারি সোসাইটি, স্কটিশ ফ্রী চার্চ সাঁওতাল মিশন এবং বাইবেল সোসাইটির মধ্যে চুক্তি হয় যে যৌথভাবে একটি বাইবেল সংস্করণ প্রকাশ করা হবে আর এর দায়িত্ব রেভ পল ওল্ফ বোডিং এর উপর এসে পড়ে।10 এদিকে জেনেসিস এর প্রথম ভাগ সেমুয়েল বইটি ১৯০২ সালে সাঁওতালি ভাষাতে অনুবাদ করা হয়। এইটি ১৯০৪ সালে দা ক্যালকাটা অক্সিলিয়ারি বাইবেল সোসাইটি হাউস থেকে ছাপা হয় এর মধ্যে আরও বাইবেল অনুবাদ এর দায়িত্ব এসে পড়ায় বোডিং এর পক্ষে আর ‘হড় হপনরেন পেড়া’ পত্রিকাটি প্রকাশিত করা সম্ভব হয়নি। তাই পত্রিকাটি ১৯০৪ সালের অক্টোবর মাস থেকে প্রকাশিত হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।11 আঠারো বছর পরে রেভ পল ওল্ফ বোডিং ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে ‘পেড়া হড়’(আক্ষরিক অর্থে ‘অতিথি’)পত্রিকার সম্পাদকের কলমে পত্রিকা বন্ধ হবার কারণ উল্লেখ করেন। তিনি এই পত্রিকার সম্পাদনার কলমে লিখেছেন - "অনেকদিন আগে আমাদের একটা পত্রিকা ছিল, ওকে ‘হড় হপনরেন পেড়া’ নাম দেয়া হয়েছিল; ওই অতিথির খাবার-দাবারে অনেক অসুবিধা হচ্ছিল, ১৯০৪ সালে কখনো কখনো ক্ষুধা-তৃষ্ণায় সে বের হতে পারেনি; শেষবার ওই বছরের অক্টোবর মাসে ওকে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, অনেক লোকের এরকমও বিচার থাকতে পারে কি ওর মৃত্যু হয়ে গেল, ব্যাপারটা এরকম নয়; এখন সে আমাদের মধ্যে এই বছর আবার ফিরে আসছে আর ওর বিশ্বাস আছে যে এখন তার খাবার-দাবারের অভাব থাকবে না, কেননা অনেক লোক মিলে ওর ভরণপোষণ করবে। উপবাসে এখন আর থাকবে না বরং অতিরিক্ত খাবারের দরুন কষ্ট হবে, যদি আমরা হিসাব মতো খাবার বিতরণে সাবধানতা বজায় না রাখি (বঙ্গানুবাদ)।"12 এর থেকে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে ওই সময় রেভ পল ওল্ফ বোডিং এর মিশনের কাজের চাপ থাকায় তার পক্ষে ‘হড় হপনরেন পেড়া’ পত্রিকা প্রকাশনার কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি; তাছাড়া এইসব কাজে রেভ পল ওল্ফ বোডিং কে যে সাহায্য করত সেই সাঁওতাল মহাপুরুষ বিরাম হাঁসদার ১৮৯৭ সালে অসময় মৃত্যু, মিশনের এবং রেভ পল ওল্ফ বোডিং এর জন্য একটি দুর্দান্ত এবং সংবেদনশীল ক্ষতি হয়েছিল।13

এইভাবে সাঁওতালি ভাষা সাহিত্যের প্রথম সাহিত্যিক পত্রিকার প্রকাশ এর অবসান ঘটে। তবে ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাস থেকে রেভ পল ওল্ফ বোডিং এর সম্পাদনায় ‘পেড়া হড়’ নামে প্রথমে সাপ্তাহিক এবং পরে পাক্ষিক পত্রিকা অনুসারে প্রকাশ শুরু হয়। তবে ‘হড় হপনরেন পেড়া’ পত্রিকার নাম পরিবর্তন করে যে ‘পেড়া হড়’ পত্রিকা হয়, সম্পাদকের কলমে তা পরিষ্কার - "এখন আবার আমাদের মধ্যে ফিরে আসার পরে ওর নামের কিছু পরিবর্তন হয়েছে ; ওটার জন্য কিন্তু কারণও রয়েছে। প্রথমে সে অতিথি তো অতিথিই ছিল কিন্তু অপরিচিত ভাবে ছিল; সে একলাই দিত, তার বদলে সে এক দুজন সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতো; অন্যদের ঘর থেকে পেয়েও সে স্বয়ং দিত, কিন্ত নিত না। সে এখনো লোকের ঘরে তে যাবে, সে কোন অপরিচিত ব্যক্তি নয়, সে আমাদের অতিথি। লোকের কাছ থেকে যা কিছু প্রাপ্ত হবে, তাওসে গ্রহণ করবে ; আর যদি ওকে ভালো কাজের জন্য দেয়া হবে তো, তা লোকেদের মধ্যে পরিবেশন করবে, নিজের জন্য কিছু বাঁচিয়ে রাখবে না।" এর থেকে প্রমাণিত হয় যে ‘হড় হপনরেন পেড়া’ পত্রিকার প্রতিরূপ হলো পেড়া হড় পত্রিকাটি।14 


সহায়ক গ্রন্থ সূচি


1. মারান্ডি, ডক্টর লুইস, ২০১২, রেভারেন্ড পাউল ওলাফ বোডিং (ব্যক্তিত্ব এবং কৃতিত্ব), নিউ দিল্লি: ইউনিভার্সিটি পাবলিকেশন ২২/৪৭৩৫, প্রকাশ দীপ বিল্ডিং, আনসারী রোড, দারিয়াগঞ্জ. পৃষ্ঠা ৯৮ 
2. বেসরা, ডক্টর বাসুদেব, হস্তলিখিত
3. Soren, Sagram Santosh Kumar, 1999, SANTALIA. Catalogue of Santali Manuscripts in Oslo, Denmark: Nordic Institute for Asian Studies, Leifsgade-33, DK-2300 Copenhagen S, Page-97
4. বেসরা, ডক্টর বাসুদেব, ২০০৩, রেভারেন্ড পাউল ওলাফ বোডিং, এক সংক্ষিপ্ত জীবনী, দুমকা: সাঁওতাল একাডেমি, সিদো-কানহু মূর্মু বিশ্ববিদ্যালয় , ঝাড়খন্ড, Page-50
5. হেমব্রম, পরিমল, ২০০৭, সাঁওতালি সাহিত্যের ইতিহাস, কলকাতা: নির্মল বুক এজেন্সি, ২৪ বি, কলেজ রো, কলকাতা- ৭০০০০৭, পৃষ্ঠা ৪৮
6. বেসরা, ডক্টর বাসুদেব, হস্তলিখিত
7. সম্পাদনায় স্ক্রেপসরুড, রেভারেন্ড লার্স ওলসেন, ১৯৭৭, সেরেঞ পুথি, বেনাগাড়িয়া: পাবলিস্ট জয়েন্টলি দ্য সানতালি চার্চ কাউন্সিল অব দ্য ইউনাইটেড চার্চ অফ নর্থ ইন্ডিয়া দ্য মেথডিস্ট এপিস্কপেল চার্চ ইন সাউথার্ন এশিয়া অ্যান্ড দ্য নর্থার্ন ইভানজেলিক্যাল লোথার্ন, পৃষ্ঠা ২৫৫, ২৬০, ২৬৫
8. Andersen, Peter B., Carrine, Marine, Soren Santosh K., 2011, From Fire Rain to Rebellion, Reasserting Ethnic Identity Through Narrative, New Delhi: Ajay Kumar Jain for Manohar Publishers & Distributors 4753/23 Ansari Road, Daryaganj, Page-27
9. Bodding, Rev. P.O., 1199, Kuk’li Puthi, Benagaria: Indian Home Mission, Santal Parganas
10. Hodne, Olav, 2006, The missionary and the scientist Paul Olaf Bodding (1865-1938), Oslo: Luther Publisher, Page-115 
11. বাস্কে, ধীরেন্দ্র নাথ, ১৯৯৯, সাঁওতালি ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস, কোলকাতা: দি বাসন্তী প্রেস,১৪এ, শিয়ালদহ, কোলকাতা - ৯ মহাত্মা গান্ধী রোড প্রকাশনায়: শ্রী সুশীল বাস্কে, ১৮/১ শান্তিনগর, রিজেন্ট পার্ক, Page-113 
12. বেসরা, ডক্টর বাসুদেব, ২০০৩, রেভারেন্ড পাউল ওলাফ বোডিং, এক সংক্ষিপ্ত জীবনী, দুমকা: সাঁওতাল একাডেমি, সিদো-কানহু মূর্মু বিশ্ববিদ্যালয়, ঝাড়খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৫
13. Hodne, Olav, 2006, The missionary and the scientist Paul Olaf Bodding 
(1865- 1938), Oslo: Luther Publisher, Page-112
14. বেসরা, ডক্টর বাসুদেব, ২০০৩, রেভারেন্ড পাউল ওলাফ বোডিং, এক সংক্ষিপ্ত জীবনী, দুমকা: সাঁওতাল একাডেমি, সিদো-কানহু মূর্মু বিশ্ববিদ্যালয়, ঝাড়খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৫

Amit Murmu is Assistant Professor (Contractual) at the Department of Santali, Sido Kanhu Murmu University, Dumka.

---------------------

Reflections of a Daughter on Gurucharan Murmu
Maroona Murmu


My father Gurucharan Murmu, who entered the hallowed Indian Police Service in 1972, is the first ever Santal to serve the Union Civil Services. He was born in 1944 in the village of Muransole, West Midnapore in the Jangal Mahal area of south western Bengal. Political independence did not ensure economic development for this cursed region and adivasis here continue to be inhabitants of a republic of hunger, still stalked by malnutrition, poverty and underdevelopment. My grandfather, Barai Murmu, passed away even before my father had turned three. But his elder brother, Manik Chand Murmu, worked selflessly to make sure that he finished primary and secondary education. He performed competently enough at the Gandapal Primary School and later at Belpahari S. C. High School. 


The family

By 1962, he had enrolled at the Scottish Church College in Calcutta for pre-university courses. Without the socio-economic and cultural capital required for a premier Calcutta college, he was something of a misfit. Every once in a while, he would be advised by his teachers to return to his village and take to agriculture or fishing for a living as adivasis in his village do. Yet others encouraged him to go for higher studies in Sanskrit, in which he displayed proficiency. My father told me that even at that tender age he knew well enough that a Santal scholar of Sanskrit would not be accepted by the upper caste bhadralok society. Sanskrit being associated with high culture, he had no realistic chance of making a respectable living in a society driven by casteist prejudices. He received his History Honours degree, and a Masters degree in Modern History from the University of Calcutta. After making it to the Indian Police Service in 1972, he began his career 1974 as the Assistant Superintendent of Police and went to become the Sub-divisional Police Officer of Lalbagh in Murshidabad district.

It was during his posting as Additional Superintendent of Police of Nadia district that the Left Front came to power in West Bengal (1977). A regime informed by the lofty principle of equality but managed by the upper caste bhadralok, the educated, urban and invariably upper caste ministers, there was very little leftism in their actual practice of authority. This uncompromisingly honest young officer soon fell out with the party in power. In consequence of his consistent differences with the ruling party, he would either be shunted off to a ‘punishment posting’ far away from Kolkata or to the unenviable status of an officer on ‘compulsory waiting’. On several occasions, he would file complaints to the Central Administrative Tribunal, protesting against institutionalized discrimination and a win in the legal battle. But obviously, his protests did not go down too well. No wonder he was denied the final promotion as an Additional Director General (ADG) in 2004 which had been due to him before retirement and he was superseded.


Deputy Commissioner of Calcutta Police

On 9 March, 2004, The Stateman, in its Kolkata edition, published a report on this episode. Titled Punished for Doing His Job Well?, the reporter Tanmay Chatterjee wrote: “Is an apparently upright IPS officer being punished for the diligence with which he pursued corruption in officialdom? That, at least, is what a section of IPS officers in the state believe.... He was transferred within 13 months....” Another report in Bartaman, the second most circulated Bengali daily in West Bengal, reported about how he had acquired a formidable reputation as a crusader against corruption during his tenure as the Inspector General of the Vigilance Commission. For an individual to mount a campaign against corruption with wider social support, he or she had to belong to a more ‘mainstream’ background. Thanks to relentless persecution, the principled adivasi officer who had taken on the might of the ruling party of a province for years together, was finally held down to a literally vegetative existence, within a year of his retirement due to cerebral stroke. 

He had moved to his native place soon after retirement. His post retirement dreams for a rural development complex, with a school, a hostel and an old age home made him buy a thirteen bigha plot in west Midnapore commuting thirty percent of his pension. He had also planted medicinal plants used by the Santals for curing diseases, perhaps as an extension of his unfinished doctoral research on ‘Santal Medicine Over Time and Space’. Numerous of his articles were published in popular Bengali magazines with the contention that Santali and other Austric languages had similarities with Sanskrit and Bengali and that Santali might have influenced Sanskrit and Bengali. He explored the relation between these languages in essays published in ‘Mukta Ganga’, ‘Bartika’, ‘Samatat’, ‘Seemanta Sahitya’, ‘Ushree’, ‘Tatarekha’, ‘Murshidabad Sahitya Patrika’, ‘Murshidabad Parikrama’, ‘Murshidabad Sandesh’, ‘Mitali’, ‘Purbabhas’, ‘Uththan’, ‘Rodhbrishti’, ‘Shabdik’, ‘Ketaki’, ‘Beerbhumi’, ‘Uttar Bangla Patrika’, ‘Sahitya Bharati’, ‘Sahitya Saikat’, ‘Palikrit’, ‘Trapeze’, ‘Darshak’, ‘Adalbadal’, ‘Ushashi’, ‘Medha’, ‘Dhula Mandir’, ‘Godhuli Mon’, ‘Maryada Barta’, and Cultural Research Institute Bulletin to name a few. Apart from being one of the founder members of Paschim Banga Santali Academy, he is also the co-author of the book titled Bibliography: Santali Literature published in 1998. I remember him engrossed in writing a paper entitled ‘Decipherment Of The Indus Script’ in accordance with Iravatham Mahadevan’s The Indus Script Text Concordance and Tables (1977) and sound values gleaned from the world of scripts the day before he was struck by the stroke. He had been working on the theme for over a decade and this was an extension of his linguistic work developed on the hypothesis that the Austric-Santali language might have had some ancestral affinity with the language decoded by the Indus script. 

Even after seventy-three years of independence, the adivasi communities remain abysmally underrepresented in bureaucracy, educational institutions and politics where the government guarantees reservation. Nonetheless, Gurucharan Murmu surpassed all adversities owing to his socio-economic and ethnic background and went on to create history illustrating that if one has the determination to withstand hardship, it is possible to make it big. He remains an inspiration for young adivasis aspiring to overcome myriads of structural and systemic disadvantages and shine against all odds.

Maroona Murmu is Professor at the Department of History, Jadavpur University, Kolkata

-------------------

ওরা


Malini

সম্পাদিকা বললেন, শোনো, লেখা দিতে হবে!

আমি হাঁ হাঁ করে বললাম, আমি আদিবাসী সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতির বুঝি কী? আমি লিখতে পারবনা।

তাতে তিনি বললেন, ওই যে তুমি নানাসময় নানা জায়গায় ঘোরো, নানান জনজাতিদের সাথে মেলামেশা আছে...তাদের সবাইকে নিয়েই লেখো।

তা করি। কিন্তু তা দিয়ে তাদের সমাজ সংস্কৃতি নিয়ে লেখার অধিকার জন্মায় কিনা জানি না। তাহলে যেটা করতে পারি, সেটা হল বাইরের চোখ দিয়ে যা দেখি যেটুকু বুঝি সেটাই লিখতে পারি।

...........

‘ওরা’

ছোটবেলা কেটেছে ধানবাদে। তখন বিহার, এখন ঝাড়খন্ড। আদিবাসী ঘেরা ধানবাদ এর কোলিয়ারি বেল্টে বহু সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাওরা কাজ করত - খাদানে বা ফ্যাক্টরি প্লান্টে । অফিস স্টাফ, আমার যতদূর মনে পড়ে, সব উচ্চবর্ণ বিহারি বা বাঙালি। আমদের কলোনির আশেপাশে ছোটছোট ‘গাঁও’ বা ‘বস্তি’...সেখানে আমরা কোনদিন যাতায়াত করতাম না। ‘ওদের’ ছেলেমেয়েদের সাথে মেলামেশার প্রশ্নই নেই। স্কুলে আমার মনে পড়েনা কোন সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও ছাত্রীদের কথা। তবে সে বহুদিন আগের কথা। বাবার কাছে প্রায়ই শুনতাম শিবু সরেন এর কথা। কিন্তু তখনও যারা শ্রমিক রাজনীতিতে বা আদিবাসীদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তারা বেশির ভাগ রায়, সিং বা বক্সী। 

সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক – ‘ওরা-আমরা’র ভাগাভাগি স্পষ্ট।

পরে বিশ্বভারতীতে পড়তে গিয়ে দেখলাম শান্তিনিকেতনের চারপাশে বহু সাঁওতাল গ্রাম। শিক্ষাসত্রে কিছু সাঁওতাল ছেলে মেয়ে পড়ে, পাঠভবনে তার থেকে কম। সেখানে ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে সামাজিক ভাবনা কী, ঠিক বলতে পারব না। স্নাতক স্তরে এক দুজন পড়ে আমাদের সাথে। অন্তত আমার বিভাগে তারা ছায়ার মত থাকে। আমি সাইকেল চালিয়ে সাঁওতাল গ্রামে পড়াতে যাই। সেই যোগাযোগ ছাড়া,পৌষ মেলায় একবার তারা নাচতে আসে, বা লাঠি খেলা দেখাতে – এত কাছাকাছি থেকেও এর বেশি যোগাযোগ নেই। 

আমি শান্তিনিকেতনের পড়শোনা শেষ করে, এক সাঁওতাল গ্রামে থেকে যাই কাজের সুত্রে। আমার কাছে বিকেলে গ্রামের বাচ্চারা আসে- বেশির ভাগ সাঁওতাল। তারা লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে খেলেকুদে বেড়ায়। দুটি ছেলে এসে গম্ভীর ভাবে থাকে – সবাই যখন মাটিতে থেবড়ে বসে, তারা একটু উঁচু বাঁধানো জায়গায় বসে। পরে জানতে পারি তারা গ্রামের উচ্চ বর্ণের সম্ভ্রান্ত বাড়ি থেকে আসে। পরে লক্ষণের শক্তিশেল- এ, একজনকে বানর আরেকজন কে জাম্বুবানের পার্ট দেওয়ায় তারা উচ্চস্থান থেকে নীচে এসে বসে। 

‘ওদের’ সাথে মেশামেশি

কাল রাতে বসে টিভিতে ইদানিংকালের একটি বহু প্রশংসিত বাংলা ফিল্ম দেখছিলাম। এক পরিবারের সবাই মিলে শান্তিনিকেতনে গেছে। কোন এক সময়ে তারা শনিবারের হাটে বেড়াতে গেছে। দৃশ্যটি দেখতে দেখতেই আমি বুঝতে পারলাম- এবার সাঁওতাল নাচ দেখাবে, এবং সেখানে পরিবারের মহিলারা সেই নাচে যোগ দেবে। ভাবা মাত্র সেই দৃশ্য হাজির। মনে পড়ল, আমাদের আরেক শ্রদ্ধেয় পরিচালকের এক ফিল্মে এরকমই এক দৃশ্য ছিল। দৃশ্যটিতে মুখ্য ভূমিকায় যে নারী চরিত্র ছিলেন, তিনি শান্তিনিকেতনের সাঁওতাল মহিলাদের সাথে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে নাচে যোগ দেন। বোধহয় প্রমাণ করার জন্য যে তিনি কেমন ‘মিশে যেতে পারেন’। উনি যদি ইটালির রাস্তায় বাজনা শুনতেন, এত সহজে ‘মিশে যেতে’ পারতেন বা চাইতেন কী? 

এই কিছুদিন আগে মণিপুর থেকে খুব খারাপ রাস্তা ঠেঙ্গিয়ে গাড়ি করে আসামের চা বাগানে পৌঁছেছি। ক্লান্ত, নোংরা, ক্ষুধার্ত। চাট্টি খেতে পেলে বর্তে যাই। সেইসময়ে দেখি আমার সৌজন্যে বাচ্চারা সেজেগুজে নাচবে বলে রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। তারাও এখানকার সাঁওতাল। আমার কাঁদো কাঁদো মুখ দেখে আমার সাথী, এক অত্যন্ত ফচকে সাঁওতাল ছেলে, বলল- ওরকম মুখ করে লাভ নেই ম্যাডাম, যান নাচুন। নাচতে আমি ভালইবাসি, কিন্তু সে সময়ে বাচ্চাদের থেকেও আমার নিজের জন্য বেশি কষ্ট হল। বরং বিকেলে ভরপেটে এক গ্রামের মধ্যে যখন বাচ্চারা হিন্দি সিনেমার গানের সাথে নেচে দেখাল, তখন আমি অনেক স্বচ্ছন্দ বোধ করলাম। 

তার মানে কি আমরা নিজেদের সুন্দর সংস্কৃতিকে অতিথির সামনে তুলে ধরব না? প্রশ্ন হচ্ছে সেই সংস্কৃতিকে কতটা আমরা আমাদের রোজকার যাপনের মধ্যে জিইয়ে রেখেছি, আর কতটা দেখনদারি বা পেটের দায়ে বিক্রি করছি। আজকাল শান্তিনিকেতনের অনেক রিসোর্টে সাঁওতাল নাচের ব্যবস্থা করা হয়। ‘ওদের’ সাথে আমরাও কেমন পা মিলিয়ে ‘এক’ হয়ে যাই।

..........................................

‘ওদের ‘ সাথে না মেশা মেশি

ওড়িসার লোধাদের গ্রামে গ্রামে ঘুরছি। লোধারা এক সময় অরণ্যনির্ভর জনজাতি ছিল। ‘ছিল’ বললাম এই কারণ, কারণ এখন নানা আইন করে তাদের অরণ্যে বিচরণ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের ‘মূল স্রোতে’ আনার চেষ্টা চলছে। এরা জঙ্গলের কাঠ কেটে, বন্যপ্রানীদের মেরে’ জঙ্গলের সর্বনাশ করছিল, সেহেতু এরকম ব্যবস্থা। ভারতবর্ষের নানা জায়গায় কত হেক্টর অরণ্য সাফ করে দিয়ে আমরা ‘উন্নয়ন’ এর ব্যবস্থা করছি, সে তথ্য দিয়ে এই লেখাকে ভারাক্রান্ত করব না, এখানে তা লিখতেও বসিনি।

লোধারা নাকি একসময় ক্রিমিনাল জাতি ছিল। লোকজন মেরেধরে, সব কিছু কেড়ে কুড়ে জীবন নির্বাহ করত। তাদের সেই দুর্নাম আজও ঘোচেনি। মাথা নীচু করে বাঁচে তারা।

ইস্কুলের পর ইস্কুলে গিয়ে দেখি কিছু বাচ্চা কালো মুখ করে স্কুলের দেওয়াল ঘেঁষে বসে আছে। তাদের কিছু প্রশ্ন করলে তারা উত্তর দেয় না। প্রথম প্রথম শিক্ষকদের জিজ্ঞেস করলে তারা সেইসব বাচ্চাদের সামনেই বলে বসে - ওরা তো লোধা। ওদের বাবা মা-রাও চায় না ওরা উঁচু জাতের বাচ্চাদের সাথে বসুক, আর উচ্চ বর্ণের বাবা মা রাও সেটা কখনেই হতে দেবে না। কিছু ইস্কুলে কেবল মাত্র লোধা বাচ্চারা আসে। সেইসব বাচ্চারা স্বচ্ছন্দ – আমায় গান কবিতা শোনায়। সহজে প্রশ্নের উত্তর দেয়।

সরকারি আমলা রা নাক কুঁচকে বলেন – আসলে অপরাধপ্রবন জাতি, বুঝলেন তো...।তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকার নীতিতে কোথাও লোধাদের নিজস্ব চিন্তাধারা কে জায়গা দেওয়া হয় নি।

উচ্চ বর্ণের কথা বাদ দিলাম। পাশাপাশি লোধা আর সাঁওতালদের গ্রাম। কিন্তু বাচ্চারা একসাথে খেলে না, উৎসবে পরস্পরকে ডাকে না, বিপদে আপদে পাশে দাঁড়ায় না। আগে নাকি খুনোখুনি হত, এখন সেসব কম, এটাই যা মঙ্গলের কথা।

.................................

ছোটবেলা থেকে যে ভাগাভাগি দেখেছি , তার কেবল রকম হেরফের হতে দেখি চারপাশে। আদিখ্যেতা আর আন্তরিক ভাবে একসাথে পরস্পর কে গ্রহণ করার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম তফাৎ আছে। আর হ্যাঁ, গ্রহণ করাটা দ্বিপাক্ষিক হওয়াটা জরুরী বলে মনে করি। ভিন্নতা কে স্বীকার করে গ্রহন, সবাইকে কান মুচড়ে ‘মূল স্রোতে’ আনার ধৃষ্টতা নয়।

Malini is the founder of Uṝaan, a Kolkata based collective of creative and experienced minds geared towards quality improvement of life and society through education at large.

1 comments: