1

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



মহান্তং কোশম্ উদ্ অচা ভি ষিঞ্চ
সবিদ্যুতং ভবতু বাতু বাতঃ। 
তন্বতাং যজ্ঞং বহুধা বিসৃষ্টা 
আনন্দিনীর্ ওষধয়ো ভবন্তু।। (অথর্ববেদ। ৪।১৫।১৪।)

মহাজলাধার তুলে ধরো, অভি
ষিক্ত করো এ ধরা। 
জ্বলুক বিজুরী, বয়ে যাক বায়ু,
যজ্ঞের আয়োজন হোক সুরু
চারিদিকে মেঘ- ভাঙা জলে জলে --
খুশী হোক ওষধিরা। (অনু. গৌরী ধর্মপাল) 


শ্রাবণ এসেছে। শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা। ঋতবাকও পায়ে পায়ে পেরিয়ে এল চার চারটে বছর। এই সংখ্যা আমাদের তৃতীয় বর্ষের শেষ সংখ্যা। মন চলে যাচ্ছে অতীতে। ঋতবাক যা হবে ভেবেছিলাম, আজকের ঋতবাক কি তাই? না। পথ চলতে চলতে সিদ্ধান্ত বদলাতে হয়েছে, নিজেদের বদলে নিতে হয়েছে। মারীচ-সুবাহুর রক্ত বৃষ্টির মধ্যে যজ্ঞের আগুন জ্বালিয়ে রাখতে বলা- অতিবলা মন্ত্র জপ করতে হয়েছে। নতুন ভাবে যজ্ঞ আরম্ভ করার আগে আপনাদের সকলকে অর্ঘ নিবেদন করছি আজ। সাত পা একসঙ্গে চললে বন্ধু হয়। আপনারা চলেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি পথ। এই চার বছরে কোন কোন দিকে নিজেকে ছড়িয়ে দিয়েছে ঋতবাক আপনারা জানেন। ঋতবাকের বইগুলো আপনারা আপন করে নিয়েছেন। আশানিকেতনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন আমাদের সঙ্গে। ম্যাজিকের মতো প্রায় এক লাখ টাকা জমিয়ে ফেলেছি আমরা ওদের কচি মুখগুলোয় হাসি ফোটাবো বলে। সামনের মাসের উনিশ তারিখ ঋতবাক ওদের পুজোর জামা দেবে। আপনারাও আসবেন তো? পুজোর মধ্যে যে কোনও একদিন ওদের সকলকে কলকাতার কয়েকটি বিখ্যাত পুজো ঘুরিয়ে দেখানো ও শোভাবাজার রাজবাড়ীতে মধ্যাহ্নভোজের পরিকল্পনা করা হয়েছে। কৃষ্ণেন্দু আর রিয়া নামের দুটি শিশুর স্কুলে ভর্তি এবং প্রতিমাসের স্কুল ফী-র ব্যবস্থাও করা গেছে। প্রতি মুহূর্তে অনুভব করি, আপনারা আছেন সঙ্গে। 

আরও অনেকদূর যেতে হবে। অনেকটা দূর। যাব। ঋতবাক যে এক স্বপ্নের নাম!

শুভাচ্ছা নিরন্তর





1 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - বিপুল দাস

Posted in

প্রচ্ছদ নিবন্ধ


কবিতার জন্ম 
বিপুল দাস 



(ব্যবহৃত পংক্তিগুলো কবি তপন রায়, সমর চক্তবর্তী, তুষার চৌধুরী, রাহুল পুরকায়স্থ ও জীবনানন্দের।) 

মানুষ কি তার নিজের রহস্যময়তা টের পায়? মানুষ কত সহজে ভুলে যায় তার এই শরীর, বড় আদরের এই শরীর আসলে আকাশবাতাস, তেজোময় শক্তিকণা, জলমাটি দিয়ে তৈরি। মৃত্যুতে তো উপাদানের পরিবর্তনমাত্র। জড় ও জীবের ক্রমাগত রূপান্তর এই জীবনপ্রবাহ। প্রকৃতিকে মানুষ কেমন করে ভুলে থাকবে। যদি এই পৃথিবীতে শুধুই জীবন থাকত, কণামাত্র জড় নেই কোথাও, তবে চেতন ও অচেতনের দ্বন্দ্বে জীবনের যে লীলাময়তা ফুটে ওঠে, যথার্থ অর্থে জীবন বিকশিত হয় – কেমন করে সেই সুর বেজে উঠত। 

প্রকৃতির ভেতরে সেই রহস্যময় সঙ্গীত, সেই প্রচলিত সমস্ত সংজ্ঞা মিথ্যে করে দেওয়া সঙ্গীত খুব গোপনে বাজে। মানুষ বড় বেশি সাংসারিক শব্দে সেই ধ্বনি, বিপুল তরঙ্গময় সেই গভীর বীণা শোনে না। আর যে শোনে, তার বড় তকলিফ হয়। এই গান কুয়াশার মত মগ্নচৈতন্যে ছড়ায়। এই সঙ্গীত দিব্য, অথচ এক বিষাদময় রাগরূপ সৃষ্টি করে। সে আর এই পৃথিবীর থাকে না, সে একা হয়ে যায়। অনন্ত দুঃখের পাষাণ-ভার বুকের ওপর চেপে বসে। 

একটা হাত এগিয়ে আসে। কখনও মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরার পথে, কখনও অলিম্পিয়ায় বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করার সময়। দু’একবার রমণকালেও। সে হয় পার্ক স্ট্রিটের ফুলওয়ালি, সে হয় শুঁড়িখানার মদ্য-পরিবেশক, সে হয় আমার অকালে মৃত গোপন প্রেমিকা। কিন্তু সব হাত এক রকম মনে হয়। নোটিস থাকে সেই হাতে। নিলামের ঢোল বাজে। এই নাও, তোমাকে দুঃখ দিলাম। যদি সেই প্রমা চাও, তবে তুমি একা। যদি স্বাধীনতা চাও, তবে তুমি একা। যদি রমণে দৈব-সম্ভোগের পুলক চাও, তবে তুমি একা। তোমাকে দিলাম বিষাদসিন্ধুর অতলান্ত গভীরতা। তোমার বুকের বাতাস আমার কাছে গচ্ছিত রেখে নেমে যাও। 

চূড়ান্ত প্রশ্নের জন্য কবির ক্রমাগত অন্বেষণ। এই চূড়ান্ত প্রশ্ন কবির গোপন ত্রাস। এই প্রশ্ন সংসারের মলিনতা থেকে দূরে, অনেক গভীরে বিষাদময় কুয়াশায় লুকিয়ে-রাখা প্রত্নসম্পদ। পাবলিক আবিল হাতে ছুঁতে চায় ওই স্বর্ণময় নিস্তব্ধ যন্ত্রণা। স্বর্ণময় যন্ত্রণা ছুঁয়ে দিলে মোহাবরণ খসে যায়। কনক-বিভা নিতান্ত সাংসারিক পাউডার হয়ে যায়। যা ছিল তেজস্ক্রিয় অস্পৃশ্য উজ্জ্বল ধাতু, ক্রমাগত disintegration-এর ফলে শেষ পর্যন্ত নিতান্ত সিসায় পরিণত হয়। জগত দ্যাখে জীবনের সেষ, আসলে শক্তির রূপান্তর। 

কবি শুধু খুঁড়ে যায়। হঠাৎ ভয়ঙ্কর ভাবে মনে পড়ে অনন্ত টানেলের শেষ বলে কিছু নেই। আছে শুধু নাস্তির গা-ছমছম করা ধারণামাত্র। তাতেই অন্তরাত্মা শিউরে ওঠে। আসলে তাহলে কিছু নয়, কিছু নেই। তবে কেন রাত জেগে একটি প্রার্থিত শব্দের জন্য প্রাণপণে পরিত্রাণ প্রার্থনা। কী আসে যায়, যদি ওই শব্দ আর না-ই খুঁজে পাওয়া যায়। একক মানুষের এই নতজানু পরাজয়ে কী আসে যায় অসীম ভরসম্পন্ন মৃত নক্ষত্রদের, ছায়াপথের অর্বুদ আলোকবিন্দুর, জড়পৃথিবী ও পৃথিবীর প্রাণপ্রবাহের। ত্রাসে কেঁপে ওঠে এই অস্তিত্ব, যখন ‘কারণবিহীনতাই কারণ’ –এই বাক্য ভেতরে ভেতরে উচ্চারিত হয়। কোথাও মহাপরিণাম অপেক্ষা করে আছে। কারণবিহীনতাই কারণ – এই সত্য উদ্‌ঘাটিত হলে সহসা এক সফল মানুষ গৃহকোণ ও গ্রামাফোনের মায়া তুচ্ছ করে কোথাও চলে যায়। আমরা বলি ‘বিপন্ন বিস্ময়’’। 

বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চলছে নিয়মের ছন্দে। কোথাও এতটুকু ব্যত্যয় হওয়ার উপায় নেই। কবি শুধু খুঁড়ে যায়। একটি শব্দের জন্য মাথা কুটে মরে। যেন ওই শব্দ পালটে দেবে নিয়মের ভুবন। সুশৃঙ্খলের বিন্যাসের অবয়ব থেকে একটি কুসুম ছিঁড়ে ফেলে একমাত্র কবিই পারে ওই ফোটোগ্রাফিক বিন্যাসকে রহস্যময় করে তুলতে। কবিই শুধু শিকল ভাঙার সাহস দেখায়। কবিই আর্কিমিডিস, যিনি বলেছিলেন – পৃথিবীর বাইরে দাঁড়ানোর মতো একটু জায়গা পেলে আর যথেষ্ট লম্বা একটা দণ্ড পেলে আমি পৃথিবীকে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারি। 

আসলে একটা গোলমাল পাকাতে হয়। এ গোলমাল অন্য জিনিস। মালটা ঠিক গোল নয়, কিন্তু বড় গোল বাধায়। গেল-গেল রব ওঠে সমস্ত সংসার জুড়ে। শিমুলতুলোর নরম বালিশ এবং বিশ্বাসী পাপোষও আর নিরাপদ মনে হয় না। দেশি নিরোধে ভরসা পাওয়া যায় না। 

আসলে ত্রাস, আসলে সংকট। ঘর্ষণহীন মসৃণ জীবনযাপনে কোনও সংশয় নেই, দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্ববিহীন মসৃণ জীবনযাপনে কোনও ফুল ফোটে না। সংশয় থেকেই শিল্পের জন্ম। 

তবে কি করিন্থের রাজা সিসিফাসের মতই কবির নিয়তি। এক অন্ধশক্তি কি তাহলে প্রকৃতপক্ষে আমাদের চালিত করে। এই শক্তিও বিশ্বব্রহ্মান্ডের সনাতন নিয়মের মতো অমোঘ ও স্থবির। তবে আর কেন বেঁচে থাকা। ত্রস্ত জীবনযাপনের সড়কি এবং বল্লম, সংকটের কুঠার ও থানইটের আঘাতে প্রতি মুহূর্তে রক্তাক্ত হতে হতে একজন দুখি মানুষ যখন বেঁচে থাকার পথ খোঁজে, তখন ভেতরে একটা লড়াই শুরু হয়। মুক্তিবেগের তীব্র কামনায় থরথর কেঁপে ওঠে সমগ্র অস্তিত্ব। তারপর মহানিষ্ক্রমণ। ভুবন ভরে ওঠে ক্ষারগন্ধে। তখন শিল্পের জন্ম। 

কবিতা লিখতে তার ভয় করে। ব্রহ্মস্বাদ কাকে বলে ধারণাতেই আসে না। উপনিষদ-টিষদ পড়েছে, এমন এক বন্ধুর কাছে একদিন সে একান্তে ব্যাপারটা বুঝতে চেয়েছিল। বন্ধু হেসে বলেছিল – তোর সঙ্গে একদিন বসতে হবে। অলিপাবে চলে আয়। বসা হয়নি। কাব্যকে কেন বলা হবে ব্রহ্মস্বাদ-সহোদরা? যতদূর জানা যায় 

ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছন্তি ন বাগ্‌গচ্ছন্তি নো মনঃ। 
ন বিদ্মো ন বিজানীমো যথৈতদনুশিষাৎ।। 

আমাদের দৃষ্টির বাইরে, আমাদের বাক্যের বাইরে, আমাদের মনেরও বাইরে – তা হলে আচার্যদেব কী ভাবে শিষ্যদের কাছে ব্রহ্মের স্বরূপ ব্যাখ্যা করবেন ? 

সমস্ত পরিচিত ও জ্ঞাত বস্তু থেকে ব্রহ্মা স্বতন্ত্র। কবি কী ভাবে ব্রহ্মস্বাদ-সহোদরার কাছে যাবে। এই জড়জগতের সঙ্গে কবি তার অস্তিত্ব আপেক্ষিকতার হাজারও বাঁধনে বেঁধেছে। এই দৃশ্যমান জগতের সঙ্গেই তার অবিরত সংঘর্ষ। এই কামনাবাসনাময় শরীর, ইন্দ্রিয়মগ্ন হতে হতে ভোরবেলা ঘুম ভাঙলে দূরে কোথাও ফুটেওঠা চাঁপাফুলের গন্ধ কবি পায়। তখন সে বুঝতে পারে – এই তো সত্যি। একটু বেলা হলে মনে পড়ে আজ রবিবার। তাড়াতাড়ি গিয়ে কবি মাংসের দোকানে দাঁড়ায়। এসব নিয়েই তো তার বেঁচে থাকা। বড় জান্তব বেঁচে থাকা। 

অথচ কবিতা লিখতে গেলেই সেই ভয়ঙ্কর সুড়ঙ্গের দিকে কেউ ডাক দেয়। কী ভীষণ মায়াবী, অথচ অমোঘ সর্বনাশের মত ডাক দেয়। ওই কি কল্পনার দেবী? তারই ইচ্ছেপূরণের বাসনায় যার জন্ম। অথচ সে কি জানে অপেক্ষার শেষে অপেক্ষা করে আছে ত্রিভুবনজোড়া ‘না’-এর অন্ধকার। ও-ই বাঘিনী। খায় লোহা, বোতাম, প্লাস্টিক, দমকলের গাড়ি। জাহাজ অদৃশ্য করে। খায় তার হাড়মাংস। রক্ত চাটে। আর সংসার পায় রন্ধনকালীন সুগন্ধ। শেষে পরিতৃপ্তির উদ্‌গার তুললে সেই শব্দ শোনার জন্য কেউ থাকে না। প্রকৃতপক্ষে শব্দ শোনাই যায় না। আমাদের চেনা বাতাসের বাইরে অন্য বাতাস বয়। আমাদের সাংসারিক সময় সেখানে দালির ঘড়ির মত গলে গলে মিশে গেছে থকথকে অন্ধকারে। সুতরাং, নাস্তি, চির অন্ধকার অথবা বাঘিনীবিষয়ক এই গল্প সংসারে অশ্রুত থেকে 

তখন বড় কষ্ট। দম বন্ধ হয়ে আসে। ব্রহ্মস্বাদ কাকে বলে , সে জানে না। কবিতা লিখতে তার ভয় করে। রাস্তার চাপাকলে বস্তির সুন্দরীকে স্নান করতে দেখলে তার মনে পড়ে প্রাচীন গ্রিসের কথা। গভীর রাতে ভিক্টোরিয়ার সামনে একটা টাঙা উলটে পড়ে আছে। তার মনে হয় শেষ যুদ্ধ সাঙ্গ হওয়ার পর থেকে নিঃশব্দে পড়ে আছে ওই গাড়ি। শতাব্দীর ধুলোর ঝড়, সহস্র উল্কাপাত এবং বিদেশি মাল্লার কৌতূহলী দৃকপাতেও স্থবির। কোনও এক মায়াবী বিকেলে খিদিরপুরের দিকে ট্রাম চলে গেলে সভয়ে দেখি ময়দানের নবদুর্বাদল মখমল গালিচার নীচে একজোড়া চকচকে ধাতব ট্রামলাইন। আড়ালে আড়ালে থাকে। সবুজের মোহিনী মায়ার নীচে ওৎ পেতে থাকে একজোড়া ধাতব হুংকার। মাথার ভেতরে অস্পষ্ট ছবি নাচে। কুয়াশার ভেতর দিয়ে একটা ট্রেন গেল। মালগাড়ি, না প্যাসেঞ্জার, মেটেলাল, না নীলসাদা – কবি বুঝতেই পারল না। শুধু একটা ‘কু’ ডাক শুনতে পেল সে। 

এসব নিয়ে তার কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে। খাতাকলম নিয়ে দস্তুরমত প্রস্তুতও হয় সে। ভাবতে থাকে। আসলে কী বলতে চায় সে, তা-ই ভাবে। নরম শব্দ, গরম শব্দ, হালকা এবং ভারি শব্দ। ছন্দের প্যাঁচপয়জার, মাত্রা-গণ-মেল। এসব নিয়ে খুব ঝামেলা শুরু হয়। য-ফলা এবং বিসর্গের ওজন নিয়ে খুব আতান্তরে পড়ে যায় সে। আর ক্রমাগত ভাবতে থাকে পথের ধারে চাপাকলে স্নান করা বস্তির সুন্দরী দেখে কেন তার মনে পড়ে প্রাচীন গ্রিসের কথা। তার মুগ্ধ চোখ সেই ভেজা শরীর ছুঁয়ে ছিল সেকেন্ডের ভগ্নাংশ। কই, কোনও অপরাধ বোধ তো জাগেনি। শুধু দেখতে পায় নীল সমুদ্র। বন্দরে সারি সারি জাহাজ, দশ বছরের জন্য ট্রয় অবরোধ হবে, লাসিডিমনের রাজা মেনেলাউসের বউ হেলেনকে চুরি করে নিয়ে গেছে ট্রয় রাজপুত্র প্যারিস। সে লেখে – প্রতিটি প্রণয়-হত্যা বারবার লিখে যেতে চাই। অ্যালকেমির খেলা শুরু হয়। সে খুঁড়তে শুরু করে। 

তখন প্রথমে একটা মৃদু কিনকিন শব্দ শোনা যায়।একটু পরে সেটা হয়ে যায় কুট্টুস কুট্টুস। এটা হ’ল ঘুণ পোকার কাঠ কুরে খাওয়ার শব্দ। ঘুণের ঘন্টা। তার শিরদাঁড়া শিরশির করে ওঠে। সেই সুড়ঙ্গের ভেতরে এখন খুনির দুপুর। কতগুলো রক্তচাটা হিংস্র কালো কুকুর ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

সেই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য তখন একটা লড়াই শুরু হয়। তার মাথার ভেতরে সূক্ষ্ম একটা ইশারা পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা বেশ্যার মত চোখ মারে। সে লেখে – প্রলয়ে আনন্দ জাগে, আনন্দে প্রলয়/ এ পৃথিবী সুরা আর জীবশস্যময়। 

সুরায় কারণবারির কথা মনে পড়ে। যে জল থেকে জন্ম প্রাণের। পৃথিবী জীবশস্যময়ে হয়ে ওঠে। তবু কেন শেষ পর্যন্ত বিষাদ আসে। রোমান্টিকতার সমস্ত পথের শেষে তা হলে যে অপেক্ষা করে আছে, সে আসলে এক বিষাদময়ী। মানুষ কি তা হলে কোনও ভাবে অবচেতনের প্রছন্ন সংকেতে বা আর কোনও রহস্যময় নিগূঢ় ইশারায় টের পায় অবিমিশ্র সুন্দর পূর্ণতা পায় না। বোদলেয়ার-বিষয়ক বুদ্ধদেব বসুর আলোচনায় দেখি এক জায়গায় তিনি(বোদলেয়র) বলছেন – “ আনন্দ তার এক ইতরোচিত ভূষণ, কিন্তু বিষণ্নতা তার মহিয়সী পত্নী। যার সঙ্গে দুঃখের কোনও সম্পর্ক নেই, এমন কোনও সৌন্দর্য আমার ধারণাতীত”। পরে আমরা দেখতে পাই – তার বিষাদ পরিণত হয়েছে বিতৃষ্ণায় – শুধু জগতের প্রতি নয়, তার নিজেরও প্রতি; এবং বিতৃষ্ণা থেকে সঞ্জাত হয়েছে নির্বেদ। সেই বিরাট, বহুকথিত বোদলেরীয় নির্বেদ – যা ‘ব্যাপ্ত হয় অমরত্বে, অন্তহীন যার পরিমাণ’। নির্বেদকে তিনি বলেছেন ‘জড়ের সন্তান’, যার প্রভাবে সময়ের মন্থরতা অসহ্য হয়ে ওঠে, নিজেকে মনে হয় ‘নামহীন ত্রাসে পরিবৃত এক শিলাখন্ডমাত্র’। 

এই ত্রাসের কথা বলছিলাম। বিষাদ থেকে যে বাষ্প উঠে আসে, ঘনীভূত হতে হতে একখণ্ড কালো মেঘ হয়ে যায়, সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে মেঘ ঘনায়। সংশয়ের মেঘ, সংকটের মেঘ। অর্থ, কীর্তি, স্বচ্ছলতার মসৃণ ম্যাজিকমলম মাখানো অবস্থান থেকে উঠে এসে -- “চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে/একগাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা ...। আর সে লেখে – “ যে রাত দংশনে জাগে/ আমি তার অন্ধ ক্রীতদাস ... যে রাত দংশনে জাগে/ আমি তার বিদেহসঙ্গম। 

কায়াহীন এই সঙ্গম ছাড়া মুক্তি নেই কবির। দংশনে উচ্ছ্রিত হয় বাসনার তপ্তশ্বাস, চোখ আর সনাতনকে দেখতে পায় না। নিবেদনের মন্ত্রপাঠ সারা হলে তার পিঠের ওপর প্রভু উঠে বসেন। সে তার অন্ধ ক্রীতদাস। এই নাও ক্ষত, এই নাও অনন্তযোনি 

আমি এক বিষাদময়ীর কথা বলতে চেয়েছিলাম। প্রাত্যহিক জীবনচর্যায় যে নান্দনিক অনুসন্ধিৎসা খুঁজে মরে এক কঙ্কাবতীকে, যে নারীর চোখের তারায় কবি আলো খুঁজে পায়, ভাবে – এই তো আমার পরম পাওয়া, প্রকৃত এবং পূর্ণ সৌন্দর্য সে কোনও দিন খুঁজে পায় না। কারণ – “চোখের তারার হাত ছেড়ে দিয়ে সেই আলো হয়ে আছে স্থির –পৃথিবীর কঙ্কাবতী সেইখানে পায় ম্লান ধূপের শরীর। শরীরী সৌন্দর্য পার হয়ে গেছে পৃথিবীর কঙ্কাবতী। ‘ম্লান’ শব্দে বিষাদ ব্যাপ্ত হয়। ‘ধূপের শরীর’ – এই শব্দে অলৌকিক, রহস্যময়, বিমূর্ত সৌন্দর্য ফোটে। তবে হোক বিদেহসঙ্গম। 

কবি তো আসলে দ্রষ্টা। জাগতিক, মহাজাগতিক কিছু খণ্ডমুহূর্তের ব্যতিক্রমী ঘটনায় সাময়িক ভাবে সংসারে আলোড়ন ওঠে। কিন্তু এসব ব্যতিক্রমী ও অনুক্রমী ঘটনার অনুপুঙ্খতা কবির মগ্নচেতনায় যদি সমগ্র জীবনপ্রবাহ, জড় ও প্রাণের রহস্যময়তা এবং শেষ সত্য কী – এসব প্রশ্ন না তোলে, যদি ভূমাদর্শনের আকাঙ্ক্ষা না-ই জাগে, তবে কেন কবিতার জন্য অমরত্বের বাসনা তুচ্ছ মনে হবে। তবে কেন প্রাণপাত, প্রণিপাত। কবির থাকে ইতিহাস চেতনা। সাংসারিক মানুষের আড়ালে অন্য মানুষ খোঁজার সাধনা, মৃত্যু ও যৌনতাবিষয়ক চূড়ান্ত জিজ্ঞাসার তাড়না। সামগ্রিকভাবে মানবাত্মার লাঞ্ছনার জন্য বিষাদ। একই সঙ্গে সে ত্রস্ত হয়, গ্রস্ত হয়। যতই ত্রস্ত হয়, ততই গ্রস্ত হতে থাকে। চূড়ান্ত প্রশ্নের দিকে ধাবিত হয় সমস্ত মেধা ও মনন। শেষতক দ্রষ্টা যখন স্রষ্টা হয়ে ওঠে, তখন বমি পায়। হাতে উঠে আসে ছেনি, তুলি, কলম। কবি তখন লেখেন -- 
দেশকাল অন্ধকার, দেশকাল অঙ্গের বিকার 

বিকৃতি হে, ভালোবাসি তোমার রন্ধনশালা 
তোমার প্রতিভা। 

এই বিকৃতি (Distortion) শিল্পের জন্মগাথায় নান্দীপাঠ। এই বিকৃতি এক আরশি। এই আরশি থাকে রানী ভানুমতীর তাপ্পিমারা ঝোলায়। এই বিকৃতি মানুষকে পাগল করে, প্ররোচিত করে, সন্ন্যাসী ও প্রেমিক করে। কবি সেই আরশির ভেতরে অরূপদৃশ্য, অলীকসুন্দর খুঁজে পায়। দেশ (space), কাল (Time) মিথ্যে হয়ে যায়। এই বিকৃতি আলতামিরার গুহায় ছবি আঁকে, স্পেনীয়-আলজিরিয়ার রৌদ্রস্নাত প্রান্তরে সূর্যমুখী ফুল ফোটায়, টিলার ওপরে দাঁড়িয়ে জীবনে অন্তত একবার সূর্যাস্ত দেখার সাধকে প্রকাশ করে। 

কাকে বলে কবিতা? কোন রসায়নে কয়েকটি শব্দের বিশেষ বিন্যাস ও বিশেশ সমন্বয়ে একটিমাত্র বাক্যও কবিতা হয়ে ওঠে ? সম্প্রতি বন্ধুকবি সমর চক্রবর্তীর কবিতার বই-এ একটি পৃষ্ঠা জুড়ে একটিমাত্র লাইন পাঠকদের উদ্দেশ্যে লিখেছেন – এখনও যা অলিখিত/তার সাদা তোমাকেই পড়ে নিতে হবে। 

বুঝতে পারি, লাইনটি লিখেই কবি লুকিয়ে পড়েছেন। ন’টি শব্দের গোলোকধাঁধার রহস্য ভেদ করে তাকে চিনে নাও। তার সঙ্গে যোজনদূরত্বের কুয়াশা সরিয়ে তার ইশারাটুকু বুঝে নেবার দায় কবি যেন পাঠকের দিকেই ছুঁড়ে দিলেন। আবার – “হে প্রাণ ভোরের রথ/ তোমার ভ্রুকুটি আমি ফুল ভেবে তুলি প্রতিদিন” ( রজকিনীর হাঁস, তপন রায়)। এ যেন সেই সিসিফাসের গল্পই দু’লাইনে বলা হ’ল। মানুষের যা কিছু অর্জন, যা কিছু মনে হয় পরমধন – আসলে সে প্রাণের ভ্রূকুটি। অনন্ত জীবনপ্রবাহের কৌতুকজড়ানো নিষেধের তর্জনী থাকে ওই ভ্রূকুটির আড়ালে। মানুষ বোঝে না। ছোট্ট একটা তরঙ্গকে মনে করে সিন্ধুকল্লোল। কায়া মনে করে যাকে তীব্র আবেগে আলিঙ্গন করেছে, আসলে সে মায়া। চিরবহমান প্রাণের রথ ভ্রূকুটি তোলেন শুধু। মানুষ বোঝে না। কবি টের পায়। সূক্ষ্ম ইশারাটুকু কবি বুঝতে পারে। তারপর শব্দ দিয়ে তার আরতি শুরু হয়। 

তুমিও কল্পনা, তুমি রতিমরীচিকা 
যতিভ্রমে গতি আনো প্রাণ 
সন্তরণপটু পক্ষী 
বাতাসে আজান। 

আজান তো মুক্তির আহ্বান। হায়্যা আলাল-ফালাহ্‌। মুক্তির দিকে এসো। 

কালের স্রোতে রামায়ণ, মহাভারত, হোমারের কাব্যকৃতি, মৃচ্ছকটিক, রঘুবংশ, এমন কী মেঘনাদবধ কাব্যও যে দার্ঢ্য নিয়ে আজও অম্লানজ্যোতি, তার মূলে চিরকালের সত্যকে অনুসন্ধানের ইতিহাস রচনা। ব্যক্তিমানুষের কামক্রোধলোভমোহমদমাৎসর্যকে নিংড়ে, তার ব্যক্তিগত অস্তিত্বের সংকটের সঙ্গে দেশ ও সমাজের পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, কখনও বা বাস্তবকে অতিক্রম করে পরা-বাস্তবের কুহকি মায়ার আভাস – এভাবেই সে সব লেখা বিশেষ সময়, বিশেষ সামাজিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়েও দেশকালপাত্র নিরপেক্ষ এক চিরকালের গাথা হয়ে যায়। আলোছায়ার ব্যবহার যেমন ছবির ক্ষেত্রে দৃষ্টিগ্রাহ্যভাবে বিষয়বস্তুকে ত্রিমাত্রিক ধারণাযুক্ত করে, কবিতার ক্ষেত্রেও আলোছায়া যদি না থাকে, তবে কখনওই সেটি সার্থক কবিতা হয়ে ওঠে না। কবির কাজ নিজের চৈতন্যে নিহিত রূপকে আশ্রয় করে অরূপের সন্ধান। রূপের এই ধারণা সে অর্জন করেছে হাজার বছর ধরে লালিত সৌন্দর্য-বিষয়ক সংস্কার থেকে। জীবনযাপনের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, যত বই সে পড়েছে – তার সারাৎসার, সিনেমা, নাটক, গান, চিত্রকলা – এসব তার অন্তর্লোকে সুন্দরের ধারণা তৈরি করে দেয়। অবশ্য এই সংজ্ঞা নিতান্তই অ্যাকাডেমিক। তাড়িত কবি এই সংজ্ঞা তার নিজের মত করে পালটে দিতে চায়। প্রচলিত অবয়ব ভাঙতে ভাঙতে তার যাত্রা শুরু হয়। শেষে সেও একদিন লোরকার মত বুঝতে পারে মরণ আর ভালোবাসার কেমন নিত্য সহবাস। 

আসলে এক নির্দেশতন্ত্রের ভেতরে আমাদের বেঁচে থাকা। পারিবারিক, সামাজিক, শারীরবৃত্তীয়ভাবে, এই নির্দেশতন্ত্র সমাজে সব সময় সক্রিয়। লক্ষ বছর পেরিয়ে গেলেও মূলগতভাবে এই তন্ত্র অপরিবর্তিত। সেই ঘৃণা, যৌনতাড়না, খিদে, লোভ, আরও শস্যশ্যামল উর্বর জমির লোভে এক্সোডাস, প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরুদ্ধে টিকে থাকার জন্য নিত্যনতুন কৌওল আবিষ্কার। হেমলক থেকে ফলিডল হয়ে মেট্রোর থার্ড লাইনের দিকে বিপন্ন ও বিস্মিত মানুষের চলে যাওয়া। এই তন্ত্রের কাছে শরীর অসহায়। 

আমাদের বেঁচে থাকার অনেক সেট আছে। কখনও তাদের ভেতরে ইন্টারসেকশন হয়, কখনও ইউনিয়ন হয়। সব মিলে মনে হয় – আঃ, এই তো কী সুন্দর বেঁচে আছি। কবির থাকে সেই নির্দেশতন্ত্র অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস। ভেতরে ভেতরে একটা এক্‌সেন্ট্রিসিটি (উন্মার্গগামীতা?) তাকে প্ররোচিত করে। কারও কারও ক্ষেত্রে বহিরঙ্গ ও অন্তরঙ্গ জীবনযাপনের সেটে ভরকেন্দ্র টালমাটাল করে। আবার বহিরঙ্গে অত্যন্ত ভারসাম্যযুক্ত কবিকে দেখেও আমার বিস্ময় জাগে তার অন্তর্লোকে উচ্চারিত নিভৃত-সংলাপ কী তীব্র উচ্চারণে ছিন্নভিন্ন করে আমাদের স্ট্যাটাস-কো-এর এই বেঁচে থাকার, আপাতত শান্তিকল্যাণের এই সময়কে। তার অবচেতনেও সেই সংকট কাজ করে। বলা বাহুল্য এই সংকট ব্যক্তিমানুষ ও সমগ্র মানব অস্তিত্বের সংকট। সমকালের কথাকেই তিনি নিয়ে যান চিরকালের চিরন্তন এক কথায়। সুনামিতে মৃত মানুষ ও বস্তি থেকে উৎসন্ন মানুষের দুঃখগুলো জুড়ে জুড়ে আরও বড় সন্ত্রাস, মহাজগত ও মহাজীবনের চিরকালীন রহস্যময়তার দিকে কবির যাত্রা। 

কী খোঁজেন কবি ?কখন জীবন আর মরণের সীমারেখা ঘুঁচে যায়। পরম সত্য কী -- খায়, না মাথায় দেয় ? সত্যকে খুঁজতে গিয়ে যদি দেখা যায় স্বর্গীয় নরক ? এই স্বর্গ আর নরকের ধারণা তো মানুষেরই তৈরি। তা হলে প্রকৃত স্বর্গ বা প্রকৃত নরক বলে কিছু নেই ? তা হলে আমদের কল্পনার যাবতীয় অবস্থার বাইরে কী আছে ? কিচ্ছু নেই। আবার সেই পরম নাস্তির কথা এসে গেল। চরম অন্ধকারের কথাই ফিরে এল। 

আমাদের সংসারের সুন্দর তাহলে ফিরে যাক। বিকৃত হোক বৈয়াকরণের বেঁধে দেওয়া সুন্দরের সংজ্ঞা। শব্দের আন্তর-আণবিক শক্তিকে জাগাবে বলে সুন্দরীর শবের ওপর সাধনায় বসুক কবি। সোজাসাপটা নিয়মে-বাঁধা যে ভয়ঙ্কর পাথর থমকে আছে খাদের কিনারায়, তাকে গড়িয়ে যেতে দাও। হুড়মুড় করে জাপানি তেল ছাড়াই প্রকৃত লিঙ্গোত্থান হয়। উপত্যকা ভেঙে যায়। চা-বাগানে ধ্বস নামে। লতাগুল্ম ছিঁড়ে যায়। একক মানুষের বাবা, মা, সন্তান, স্বামী, স্ত্রী, পিসেমশাই, বন্ধু, প্রেমিক, একজন চাকুরিজীবী ইত্যাদির পরিচয়ে জনকে বেঁধে রেখেছিল ওই লতাগুল্ম। আর ওই লিঙ্গোত্থান আসলে যুদ্ধের প্রস্তুতি। কবির শস্ত্র। জন্মবীজের নান্দীপাঠে দৃঢ় কথকতা। তবে জন্মবীজের ওদিকে শরীর যায় যাক। রক্তমাংসমেদমজ্জা চোলাই করা একবিন্দু অনিবার্য সংকেতে থেকে যায়। 



... প্রতি ভোরে 
যমের দখিনদ্বার, গুহামুখে উড়ছে পতাকা 
আমাকে ও-ধ্বজা দাও 
ধ্বজার শোণিতে মেলি ডানা 
মৃতের সঙ্গম থেকে 
জন্ম নিক সুরের বেদনা। 

দীর্ঘ কবিতার/ কত কাছে যেতে পারে একাকী মানুষ/ নির্জনতা, আজও হায় ইশারামর্মর। 

এই নির্জনতা ধূসর উপত্যকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকে। মৃত্যুগন্ধবাহী এই নির্জনতা শেষ পর্যন্ত কবির গম্য। নিয়তির মত বাতাস আসে। জাগতিক সম্পর্কের উষ্ণতা দিয়ে আমাদের সুস্থিত বেঁচে থাকার জন্য হিম-নৈঃশব্দকে ভাঙার আয়োজন শুরু হয়। কিন্তু উড়ে যায় সেই আয়োজন। কোথা থেকে বাচাল হাওয়া আসে। নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে কবি দেখতে পায় – শিরা উপশিরা দিয়ে কামসূত্র দিয়ে / যেই সব মায়াতাঁবু একদা খাটানো হয়েছিল/ হিম মালভূমি থেকে হাওয়া এসে সে সব উড়িয়ে নিয়ে গেছে; (তুষার চৌধুরী)। এই হাওয়া ইশারামর্মর। এই হাওয়ার মাঝে দাঁড়িয়েও এক ফোঁটা বাতাসের জন্য দমবন্ধ হয়ে আসে। তখন কেউ কানে কানে বলে – সুন্দরের সঙ্গ যদি চাও, জীবনেমরণে তুমি একা (হিমেনেথ, অনুবাদঃ শঙ্খ ঘোষ)। 

ত্রিগুণের আধার আমাদের এই প্রকৃতি। প্রাণের নিজস্ব প্রবৃত্তি তমোগুণের গড়ানো ঢালের দিকে। আলো আর অন্ধকারের দ্বন্দ্বে অন্ধকারই যেন আলোর অধিক উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শিল্পের জয়জয়ন্তীর আসরে তামস-উৎসব। প্রাণের নিজস্ব নিয়মে সে কি বোঝে আসলে শূন্য সব। তার আগে কবি দেখে নিতে চায় ধ্বংস। এই কি চূড়ান্ত রতিসুখসার। নাকি চূড়ান্ত প্রহার। সময় স্থির হয়ে আসে। সুন্দর ভেঙেচূরে যাচ্ছে। প্রাণ আসলে মুখোমুখি হতে চেয়েছিল মৃত্যু। কেমন সে সুন্দর। “ মৃত্যুর প্রতীকে এত সূক্ষ্ম কারুকাজ / মৃত্যু এক যৌন প্রতিচ্ছবি/ কিছুই পাওয়ার নেই চিতার ভস্মের মত মসৃণতা ছাড়া”(তুষার চৌধুরী)। 

আততায়ী ত্রাস অপেক্ষা করে থাকে প্রত্যেকটা বাঁকে। “ কবিতা কল্পনালতা / সেও মৃত্যু লেখে বাঁকে বাঁকে”। কোথাও মাথায় ঝালর-দেওয়া রঙিন কাগজের টুপি মাথায়, অন্য পৃথিবীর পোশাক-পরা গাধার পিঠে – সে কবি। আবহমানের ভাঁড়। অন্যজন্ম থেকে উঠে এসে আত্মরতিপর ‘তোমার’ সঙ্গে মুখোমুখি দেখা হবে বলে অপেক্ষা করে আছে। 

প্রাণের এই তামসযাত্রার শেষে সব স্থির হয়ে আসে। কবি দেখতে পায় – “ ... সংকেতচমক তুমি চমকসংকেত/ যতিচিহ্নে অগ্নিগ্রন্থি, ক্ষত গুঞ্জরণ/ নিয়তিতাড়িত শিখা, অস্থিচর্মসার/ আবার ডুবছি দেখি বিষাদতামসে/ তামসজর্জর আত্মা, আবেগমন্থন/ করে তোলো বিষ আর গরলপিপাসা/ জলরেখা ভাঙে দ্রুত, দিগন্ত চৌকির/ আলো ক্রমে স্তব্ধ হয়, স্থির হয়ে আসে/ স্থির রক্ত, স্থির মজ্জা, স্থির যৌনতায়/ আনন্দ বিলাও তুমি, অস্থির বিলাও 

এই আনন্দ সেই বিখ্যাত absurd, এই ‘অস্থির’ সেই ইশারামর্মর ভেঙে ডিকোড করতে করতে না পারার নির্যাতন। এই আনন্দ আর অস্থির আসলে মহাজাগতিক অসীম শূন্যতা, ব্রহ্মান্ডের জড়বস্তুসমূহে ব্যাপ্ত সীমাবদ্ধতা ও অসীমের কারণ-নির্নায়ক রহস্যময়তা। কবি তাই দার্শনিক। এই পৃথিবীকে, এই সৃষ্টিকে কবিই একমাত্র ডি-সেকশন করার সাহস দেখাতে পারে। খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে শেষ পর্যন্ত প্রত্ন-কঙ্কাল, তবু তার মাঝে সূক্ষ্ম কারুকাজ। 

কে ছড়ায় আনন্দ ? অস্থির ? নরক, করোটি, নীলবিষ, কঙ্কাল – এসব শব্দের অনুষঙ্গে মৃত্যুর হিম ছুঁয়ে দেয় আমাদের বেঁচে থাকার উষ্ণতাকে। সর্বব্যাপী অনির্ণেয় পরমা বলে কিছু আছে নাকি ? “ দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা / যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে ... প্রগাঢ় চুম্বন ক্রমে টানিতেছে তাহাদের”। নিরাপদ, সাংসারিক, প্রচলিত, সামাজিক “তুলোর বালিশে মাথা রেখে আর মানবীয় ঘুমে / স্বাদ নেই ...”। দেখবি আয় – বলে ঈশ্বরীর মত কয়েকটি নারী চিরকালের কাঙাল পুরুষকে ডাক দেয়, “ ক্রূর পথে নিয়ে যায় হরিতকি বনে – জ্যোৎস্নায়”। এখানে প্পথের বিশেষণ ‘ক্রূর’। তাই তো হবে। এই শব্দের নির্দয় অনুরণনে চকিত আভাস স্ফূরিত হয় পথের শেষে চরম সর্বনাশের। এই দ্যাখ তবে – “ বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ,/ পায়ের ভঙ্গির নীচে বৃশ্চিক-কর্কট-তুলা-মীন”। 

এখানে চারটি মাত্র রাশির উল্লেখ করা হলেও সমস্ত নক্ষত্রমন্ডলকে পদতলে রেখে চরাচর-ব্যাপ্ত এক চিরন্তনীর আভাসটুকু দেখতে পাই। কয়েকটি নারী মিলে যে নাচ দেখায়, সেই নাচের অঙ্গন সীমাহীন, কাল নিরবধি। ও-ই মহাপরিণাম। তার ‘ বিনুনিতে নরকের নির্বচন মেঘ’। নারীর কেশপাশের এমন বিশেষণ আমাদের অশ্রুত ছিল। 

অনন্তকালের শাশ্বতীর মুখে জানি ‘মৃত্যুর সূক্ষ্ম কারুকাজ’। হিমযুগ আসে, হিমযুগ পার হয়ে যায়। মাঝে কিছু ‘দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা’ যুদ্ধ ভুলে যায়, বাণিজ্য ভুলে যায়। জটিল গোলকধাঁধার মত অবিশ্বাসী পথ পার হয়ে কোনও এক জ্যোৎস্না রাতে হরিতকি বনে গিয়ে গোধূলি সন্ধির ওই নাচ দ্যাখে। তারপর অন্ধ হয়ে যায় বলে আমার বিশ্বাস। 

শুনেছি জীবনানন্দের এই কবিতাকে অনেক কবি অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তারা সবাই বড়মাপের কবি। আমার শ্রদ্ধেয়। আমি যতটুকু বুঝি, ততটুকুই জানালাম। 

কবি, তুমি চাঁপাফুলের গন্ধ পাও ? দোলনচাঁপার ? ওই গন্ধ বিষবাষ্প হয়ে তোমার চৈতন্যকে সম্পৃক্ত করে। যে সৌন্দর্যে তীব্র বিষ, যার মুখ ঘুরিয়ে দিলে ভয়ঙ্কর নাস্তির হাহাকার মরণসঙ্গীত হয়ে বেজে ওঠে, সেই বিষ যখন অস্তিত্বে একটু একটু করে মিশে যেতে থাকে, তখন সেই ঘুণের ঘন্টা, খুনির দুপুর, রক্তচাটা কুকুর আড়মোড়া ভাঙে। 

মনে রেখো তোমার জন্মের কোনও শেষ নেই। আলতামিরার গুহায় তুমিই ছবি এঁকেছিলে, আবার ওই ছবিতে বল্লম হাতে – সে তো তুমি। ‘শেষ ভোজ’-এর টেবিলেও তুমি ছিলে। তোমারই অনুশাসন লেখা ছিল স্বর্ণমুদ্রায়। আর একবার রাজরোষে আগ্রীবাপ্রোথিত হয়েছিলে। কবি, তোমাকে শিয়ালে খাইয়াছে। পেনিসিলিনের অভাবে কতবার তুমি সিফিলিসে মরে গেছ। 

পরের জন্মের জন্য আড়াল নাও। বলো -- মা আমার, আমিই থিব্‌সের রাজা, লেয়াসের পুত্র। এই যে খেজুরকাঁটা, কলোনসের পথ থেকে কুড়িয়ে এনেছি। এই যে আমার দু’টো চোখ। তার আগে আর একবার আমার আড়াল চাই। তোমার ঘনজলে কুঁকড়ে থাকব। দ্বার খোলো। অন্ধকার দাও। 

“মূর্ছা যাই, মূর্ছা যাও, শরীরে শরীরে ঢালি প্রাণ 
কামনার প্রতি বাঁকে আমি আজও তোমারই সন্তান”।

2 comments:

0

প্রবন্ধ - অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী

Posted in


প্রবন্ধ


বাঙলায় বোমার আবির্ভাব : তিলক ও রবীন্দ্রনাথের চোখে
 অলকরঞ্জন বসুচৌধুরী 

[১] 

ভারতেব্রিটিশবিরোধী জাতীয়তাবাদী চেতনায় অগ্রণী বাংলা নামক একটি প্রদেশকে দু’ টুকরো করার সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা প্রকাশ্যে এসেছিল ১৯০৪ সালে, যা কার্যকর করা হয় ১৯০৫ সালে। আর এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় যে আন্দোলন বাঙালিরা শুরু করেন, তা কার্যত সারা ভারতের রাজনৈতিক ধ্যানধারণায় নবযুগের সূচনা করে, যার পরিণতিতে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবিভাজনের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়। বিনয় সরকার বলেছিলেন, “বাঙালির বাচ্চা আমি, বাঙালির চোখে দুনিয়া দেখি। আমার কাছে ১৯০৫ হচ্ছে বিংশ শতাব্দীর প্রথম বৎসর। এ একটা খাঁটি যুগান্তর।” যে ঘটনার সূত্রে তাঁর এই মন্তব্য, সেই স্বদেশী আন্দোলন যে শুধু বাঙালিরই নয়, তামাম ভারতবাসীর জাতীয় জীবনে যুগান্তর এনেছিল। এ কথা আজ ইতিহাস-স্বীকৃত। কিন্তু আজকের ‘বাঙালির বাচ্চা’দের অধিকাংশেরই স্বদেশী আন্দোলন সম্পর্কে ধারণা নিতান্তই ভাসা ভাসা। আজকের প্রজন্মের কেউ কেউ নিশ্চয় জানেন, ১৯০৫ সালে অখণ্ড বঙ্গপ্রদেশকে দু’ টুকরো করার প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিরোধিতায় এই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু সন্দেহ হয়, কি ভাবে এই প্রতিরোধ এক সর্বাত্মক গণআন্দোলনের চেহারা নিয়ে ক্রমে বাঙলার বাইরে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল, কি ভাবে তা ছাপ ফেলেছিল সাহিত্য, চিত্রকলা, সঙ্গীত, শিল্প, শিক্ষা – সমস্ত ক্ষেত্রে, তার খোঁজ আজকের তরুণ বাঙালি কতটা রাখে!

স্বদেশী আন্দোলনের সূত্র ধরে বাংলাদেশে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের সূচনা হয়েছিল, তার প্রধান বাহন বা উপকরণ ছিল বোমা। য়োরোপের রাজনীতিতে বোমাবাহিত সন্ত্রাসবাদ অপরিচিত না হলেও ভারতে সে সময় এই বোমার তন্ত্র ছিল এক অভিনব বস্তু। ১৯০৭ সালের ৬ই মে ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায়, যার সম্পাদক ছিলেন স্বনামধন্য ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়, ‘কালীমায়ীর বোমা’ শিরোনামে এক নিবন্ধে লেখা হয়েছিল,

“ইহা বড়ই আনন্দের বিষয় যে, একটি চমৎকার ধরনের বোমা তৈয়ার হইতেছে। ইহার নাম ‘কালীমায়ীর বোমা’। ইহা পরীক্ষা করিয়া দেখা হইতেছে এবং পরীক্ষা সফল হইলে ইহা প্রতি গৃহে রাখিতে হইবে। এই বোমা এতই হালকা যে, একজন লোক ইহা এক হাতে লইয়া চলিতে পারে, ইহাতে অগ্নিসংযোগ করিতে হয় না ও অল্প আয়াসেই ইহাকে ভূমিতে নিক্ষেপ করিলে বিকট শব্দে ইহা বিস্ফোরিত হয় ও ধরণীকে প্রকম্পিত করে। ...প্রতি গৃহ হইতে একজন সন্তানের প্রয়োজন, যে ক্ষত্রিয় ধর্ম অনুশীলন করিবে। তাহারা কালীমায়ীর বোমা লইয়া ক্রীড়া করিবে। বোম্‌ কালী কলকাত্তাওয়ালী!” 

[সিডিশন কমিটির রিপোর্ট থেকে পুনরনুবাদ] 

অবশ্য এই নিবন্ধটি যখন ‘সন্ধ্যা’য় ছাপা হচ্ছে, বাঙলাদেশে তখনও বোমার প্রাদুর্ভাব হয়নি। তবে এমন মনে করার কারণ আছে যে, বাঙলাদেশের গুপ্তবিপ্লবী সংগঠনগুলিতে বোমা তৈরির প্রস্তুতি এ-সময় শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯০৬ সালের আগস্ট মাসেই অরবিন্দ-বারীন্দ্রকুমার ঘোষ পরিচালিত গুপ্তসমিতির হেমচন্দ্র কানুনগো বোমা তৈরির কৃৎ-কৌশল শিক্ষা করতে ফ্রান্সে পৌঁছে গিয়েছিলেন। এই সমিতিটির বিপ্লববাদী তরুণদের কারও কারও সঙ্গে ব্রহ্মবান্ধবের পরিচয় ছিল। আবার এমনটাও হতে পারে যে, ব্রহ্মবান্ধব হয়তো কোনও বাস্তব তথ্য হিসেবে নয়, শুধু তাঁর জাতশত্রু ইংরেজ শাসকদের নিছক ভয় দেখাবার উদ্দেশেই বোমার আগমনী ঘোষণা করেছিলেন ।

যে কারণেই ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় উপরোক্ত কথাগুলি লেখা হয়ে থাক না কেন, এটাই ছিল সম্ভবত বাংলার তথা বাঙালির বোমা সম্পর্কে জনমানসের প্রথম প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়া। আক্ষরিকভাবে বোমার আবির্ভাব না হলেও এই মন্তব্যের সমকালে বাঙলাদেশে বন্দুক ও বিস্ফোরক-নির্ভর গুপ্তহত্যার কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে গিয়েছিল। ১৯০৭ সালের শেষ ভাগ থেকেই পুলিশের ওপর আক্রমণ, তাদের চর হত্যা ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙলাদেশে সহিংস কার্যকলাপ শুরু হয়ে গিয়েছিল। অক্টোবরে কলকাতার বীডন স্কোয়ারে এক জনসভায় পুলিশি তাণ্ডব ও জনতার বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে গণ্ডগোল চলে, পুলিশের দিকে ও ট্রামগাড়ি লক্ষ করে পাথর ছোঁড়া হয়। নভেম্বরে বাংলাদেশের লেঃ গভর্নর অ্যান্ড্রু ফ্রেজারকে হত্যার উদ্দেশ্যে উল্লাসকর দত্ত নির্মিত মাইনের সাহয্যে চন্দনগর-মানকুণ্ডু অঞ্চলের রেললাইনে দু'বার চেষ্টা চালানো হয়, কিন্তু ফিউজের গণ্ডগোলে মাইনগুলি কাজ করেনি। শোনা যায় এই দুটি প্রচেষ্টার একটি হয়েছিল কালীপূজার রাতে ও সেটাই ছিল ব্রহ্মবান্ধবের ‘কালীমায়ীর বোমা’ রচনার প্রেরণা। এর পর ডিসেম্বরে মেদিনীপুরের নারায়ণগড়ে রেললাইনে মাইন পেতে ফ্রেজারের ট্রেন উড়িয়ে দেবার তৃতীয় চেষ্টা হয়। 

১৯০৮ সালের মার্চ মাসে কুষ্টিয়ার পাদরি হিকেনবোথামকে চর সন্দেহে গুলি করা হয়। বোমার যথার্থ প্রয়োগ শুরু হলো হেম কানুনগো পারিস থেকে বিস্ফোরকবিদ্যা শিখে ফিরে আসার পর। [ততদিনে অবশ্য বাঙালির বোমার প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ব্রহ্মবান্ধব ইহলোক থেকে বিদায় নিয়েছেন এবং কয়েক বছর পরে বিপিনচন্দ্র পাল লিখবেন, তাঁর লেখা ঐ ‘কালীমায়ীর বোমা’ বাঙালিকে বোমা তৈরির অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।] হেমচন্দ্রের নির্মিত প্রথম বোমাটির প্রয়োগ হয় এপ্রিলে চন্দননগরের ফরাসী মেয়র তার্দিভালকে হত্যার ব্যর্থ চেষ্টায়। এ-বছরই জুন মাসে কাঁকিনাড়ায় চলন্ত ট্রেন লক্ষ করে ছোঁড়া বোমায় একজন শ্বেতাঙ্গ আহত হয়।

বাংলার বোমা- বুদ্ধিজীবীদের প্রতিক্রিয়া 

বাঙলাদেশে বোমা ও প্রাক্‌-বোমা যুগের এই প্রাথমিক বৈপ্লবিক প্রচেষ্টাগুলির উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়, রবীন্দ্রনাথের ‘সদুপায়’ প্রবন্ধে [‘আত্মশক্তি’ গ্রন্থভুক্ত], যেটি প্রকাশিত হয়েছিল এর কয়েক মাস পরে একযোগে প্রবাসী, ভারতী ও বঙ্গদর্শন পত্রিকায়। [তিনটিরই শ্রাবণ, ১৩১৫ সংখ্যায়]। উল্লিখিত প্রচেষ্টাগুলিকে “অন্যায়ের দ্বারা অবৈধ উপায়ের দ্বারা কার্যোদ্ধারের নীতি” বলে নিন্দা করে তিনি লেখেন, “মঙ্গলবুদ্ধির অরাজকতার দিনে নিতান্তই সামান্য কারণে চন্দননগরের মেয়রকে হত্যা করিবার আয়োজন হয়, কোথাও কিছুই নাই, হঠাৎ কুষ্ঠিয়ার নিরপরাধ পাদ্রির পৃষ্ঠে গুলি বর্ষিত হয়, কেন যে ট্রামগাড়ির প্রতি সাংঘাতিক আক্রমণের উদ্‌যোগ হয়, তাহা কিছুতেই বুঝিতে পারা যায়না; বিভীষিকা অত্যন্ত তুচ্ছ উপায় অবলম্বন করিয়া চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতে থাকে, এবং কান্ডজ্ঞানহীন মত্ততা মাতৃভূমির হৃদ্‌পিন্ডকেই বিদীর্ণ করিয়া দেয়।” প্রবন্ধটিতে পাদটীকা যোগ করে পরে তিনি লেখেন, “কাঁকিনাড়ার কারখানার ইংরেজ কর্মচারীদের প্রতি লক্ষ করিয়া রেলগাড়িতে বোমা ছুঁড়িবার ঘটনার পুর্বে এই প্রবন্ধ লিখিত হয়। কোন ছিদ্রে পাপ একবার অন্তরে প্রবেশ করিতে পারিলে ক্রমশঃই মানুষকে তাহা কি রূপে বিকৃতিতে লইয়া যায়, এই লজ্জাকর শোচনীয় ঘটনাই তাহার প্রমাণ......।” বাংলাদেশে গুপ্তবিপ্লববাদের প্রাথমিক বহিঃপ্রকাশ সম্পর্কে এটাই রবীন্দ্রনাথের সমকালীন প্রতিক্রিয়া।

অবশ্য এখানে উল্লিখিত বিপ্লবকাণ্ডগুলির মধ্যে সর্বশেষটি [অর্থাৎ রেলগাড়িতে বোমা নিক্ষেপ] সংঘটিত হবার আগেই আরেকটি গুরুতর কাণ্ড বাংলার বিপ্লবীরা ঘটিয়েছিলেন বাংলার বাইরে মজঃফরপুরে, যা বাংলার এই ‘বোমা-তন্ত্রের’ জন্মকাহিনীকে দাবানলের মতো ছড়িয়ে দেয় সারা ভারতে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, রবীন্দ্রনাথের মূল প্রবন্ধটি লেখা হযেছিল এপ্রিলের সেই বোমাকণ্ডেরও আগে এবং লক্ষ্য করতে হবে যে, তখন পর্যন্ত তাঁর মনে হচ্ছিল যে, এই সব বিপ্লবকাণ্ড নিতান্তই ‘সামান্য কারণে’, বা অত্যন্ত ‘তুচ্ছ উপলক্ষ অবলম্বন’ করে ঘটছে। ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকির দুঃসাহসিক অধ্যবসায় যখন বাংলার বোমাকে বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড় করিয়ে দিল, তখন এর কার্যকারণ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণার পরিবর্তন হয়েছিল কিনা, সেটা আমরা যথাসময়ে লক্ষ্য করব।

মজঃফরপুরে বোমা বিস্ফোরণ ও আলিপুর বোমার মামলার প্রতিক্রিয়ায় দু’একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদ দিলে ভারতের রাজনীতিক থেকে শুরু করে লেখক, ভাবুক বুদ্ধিজীবীরা কেউই তেমন ভাবে মতামত প্রকাশে এগিয়ে আসেননি, এমনই ছিল সে-সময়কার সরকারি দমননীতির বিভীষিকা! লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক প্রধানত রাজনীতিবিদ্‌ ও নেতা হিসেবে দেশবিখ্যাত হলেও বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক ও পণ্ডিতরূপেও তাঁর দাবি নেহাত উপেক্ষনীয় নয় বলে আমরা বোমাকাণ্ডের প্রতিক্রিয়ায় ভারতের বুদ্ধিজীবীদের অভিমতের দৃষ্টান্ত হিসেবে ‘কেশরী’-তে প্রকাশিত তাঁর কয়েকটি বিশেষ প্রবন্ধকে উপস্থিত করতে চাই। এর আর একটি কারণ, এই অসাধারণ প্রবন্ধগুলিতে যে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও বিশ্লেষণ পাওয়া যায়, তাতে রাজনীতিকের চেয়ে তিলকের চিন্তাবিদের ভূমিকাটিই যেন বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে! 

বাংলার বোমার প্রতিক্রিয়ায় ‘কেশরী’তে তিলকের প্রথম প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল ‘দেশের দুর্ভাগ্য’। ভারতের মতো শান্তিপ্রিয় ও মৃদু প্রকৃতির দেশেও যে রাশিয়ার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, এতে সবাই দুঃখ আর অস্বস্তি বোধ করবে, এ-কথা উল্লেখ করে তিলক লিখলেন, “যে-পরিস্থিতি রাশিয়ার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ছিল, ভারতও যে সেই অবস্থায় এত তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাবে, তা ভাবা যায়নি! তাঁর মতে “ভারতের শ্বেত আমলাতন্ত্রের ঔদ্ধত্য আর বিকৃতিই আমাদের যুবকদের এত তাড়াতাড়ি নিরাশার মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।” ধৃত বিপ্লবীদের বিবৃতির উল্লেখ করে তিলক বলেন, তাদের বক্তব্য থেকে মনে হয়না যে, মজঃফরপুরে কোন বিশেষ ব্যক্তির প্রতি ঘৃণাবশত বোমা ছোঁড়া হয়েছিল- নির্দোষ কেনেডিদের মৃত্যুতে ক্ষুদিরাম দুঃখপ্রকাশও করেছেন। তারা এমন নির্বোধ বা উন্মাদ নয় যে, ভাববে- অত্যাচারী ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রকে দু’-চারটা বোমা ছুঁড়েই উৎখাত করা যাবে! তারা ব্যক্তিস্বার্থচালিত নয় বা গুণ্ডা-বদমায়েশও নয়। বাঙালিরা শ্বেত আমলাতন্ত্রের বেপরোয়া উৎপীড়নে অতিষ্ঠ হয়েই গুপ্তসমিতি গঠন করে এই পথে নেমেছে।”

বাংলাদেশে বোমার উদ্ভবের কার্যকারণ বিশ্লেষণের পর এই প্রবন্ধে তিলকের পর্যবেক্ষণঃ-বঙ্গভঙ্গের বিরাট অন্যায়ের পরেও যদি দু'একজনের মাথা গরম না হয়ে যায়, তবে সেটাই হবে বিস্ময়ের ব্যাপার, অবশ্য অপ্রশমিত ক্ষমতার দর্পে উন্মাদ শ্বেত আমলাতন্ত্রের সেই বিস্ময়বোধের ক্ষমতা না থাকতেও পারে। একটা বেড়ালকেও ঘরে বন্ধ করে রাখলে সে ছাড়া পেলেই প্রচণ্ড আক্রোশে উৎপীড়কের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আর বাঙালিরা তো মানুষ! যে-সব অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সংবাদপত্র বিপ্লবপন্থীদের ব্যঙ্গ করেছিল, বা তাদের কাজের জন্য জাতীয়তাবাদী নেতাদের বক্তৃতা ও রচনাকে দায়ী করে সে-সবকে অবদমনের সুপারিশ করেছিল, তাদেরও তিলক ছেড়ে কথা বলেননি। উপমার সাহায্য নিয়ে তিনি বলেছিলেন, বন্যার তোড়ে যদি বাঁধ ভেঙে যায়, তবে দোষ বন্যার নয়, অতিবৃষ্টির! তেমনই কিছু দেশবাসীর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাবার জন্য দায়ী দায়িত্বহীন, স্বৈরাচারী আর অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার অধিকারী গোরা আমলাশাহী। এর পর তিলকের বিষণ্ণ ভবিষ্যদ্বাণীঃ- “আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই সময় আজ সমাগত, যখন ভারতেও রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স প্রভৃতির নিহিলিস্ট দলের মতো সংগঠন গড়ে উঠবে।”

সশস্ত্র কার্যবিধির যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে এর প্রতি কিছুটা সমর্থনও তিলকের রচনায় ছিল, এমনটা মনে হতেও পারে :- “ভারতীয়েরা যে-বিদেশী শাসকদের থেকে শুধু অত্যাচার আর অবিচারই পেয়ে এসেছে, তাদের প্রতিরোধে দুটি পথই এতদিন অবলম্বন করা হয়েছে, অর্থাৎ আবেদন-নিবেদন ও নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধের পথ। কিন্তু শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ব্যর্থ হলে এই তিরিশ কোটি মানুষের মধ্যে কেউ অন্যায়-অত্যাচারের প্রতিকারের অন্য কোন তৃতীয় পথ নেবেনা, এমন কথা বললে তা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে।” বলপ্রয়োগের যুক্তি বোঝাতে তিলক একের পর এক উপমা প্রয়োগ করেন :- “হরিণও নিরুপায় হয়ে পড়লে বাঘকে আক্রমণ করে। ...... নাক বন্ধ না করলে মুখ খোলেনা- শাসনব্যবস্থার চাকায় শিক না ঢুকিয়ে দিয়ে উপায় নেই।” 

এভাবে যদিও তিলক কিছুই বলতে বাকি রাখলেন না, তবু তিনি অস্বীকার করলেন না যে, এই সহিংস পন্থা বিষবৃক্ষ। কিন্তু এর উন্মূলনের জন্য যে অনিবার্য প্রয়োজন শাসনসংস্কার, সে কথাও তিনি নিষ্কম্প কন্ঠে বললেন। শিক্ষিত ভারতবাসী সন্ত্রাসবাদের বিশ্বাসী হয়ে পড়ছে, সরকারের এই প্রচারে আপত্তি জানিয়ে তিলক বললেন, মানুষ ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছলেই মজঃফরপুরের মতো জঘন্য ঘটনা ঘটে। তাই একে শুধু নিন্দা করলেই কর্তব্য শেষ হয় না, তাঁর পরামর্শ :- “মজঃফরপুরের ঘটনা থেকে সরকার যেন এই শিক্ষাই নেয় যে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের ব্যর্থতাই কিছু যুবককে এই পথে ঠেলে দিয়েছে।” [১২ মে, ১৯০৮] 

‘কেশরী’র একই সংখ্যার সম্পাদকীয়টি ছিল বাংলার বোমার প্রতিক্রিয়ায় তিলকের দ্বিতীয় রচনা। এতে দু’টি সরকার-সমর্থক কাগজের বক্তব্য খণ্ডন করা হয়। বোমার রাজনীতির কারণস্বরূপ স্বদেশী আন্দোলনকে অবরুদ্ধ করার যে পরামর্শ ‘স্টেটসম্যান’ দিয়েছিল, তার সম্পর্কে তিলক বলেন, তা হলে তো স্বদেশী আন্দোলনের কারণ হিসেবে বঙ্গভঙ্গকে রদ করলেই ঠিক হয়! আর এলাহাবাদের ‘পায়োনীয়র’ এ-রকম বিস্ফোরণের জন্য সন্দেহভাজন নেতাদের যে প্রাণদণ্ড দেবার কথা বলেছিল, সে সূত্রে তিলক স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ইতিহাসের এই শিক্ষা যে, এটা জনগণকে সন্ত্রস্ত করবার একটা প্রচলিত পন্থা বটে, কিন্তু কার্যকালে দেখা গেছে যে, এই ওষুধে সহিংস প্রবণতা কমার বদলে বেড়েই গেছে। 

তিলকের পরবর্তী প্রবন্ধ - ‘একটি দ্বৈত ইঙ্গিত’, ‘কেশরী’তে বের হয় ১৯শে মে। প্রধানাংশে এটির বক্তব্য ছিল আত্মরক্ষামূলক। যে-সব অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পত্রপত্রিকা ও বিদেশী সরকারের দেশী খয়ের-খাঁর দল প্রচার চালাচ্ছিল যে, স্বদেশী নেতাদের আন্দোলন আর রচনাগুলোই এই বোমার উদ্ভবের জন্য দায়ী আর সেই কারণে এই সব নেতাদের কাজকর্ম ও লেখাকে দমন করা হোক, তাদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করে তিলক উলটে সরকারের কাছে এই সব প্রচার বন্ধ করার আর্জি জানালেন। তিনি অবশ্য স্বীকার করলেন যে, বোমা বা অন্য কিছুর সাহায্যে অপরের প্রাণনাশে তাঁদের নৈতিক সমর্থন নেই এবং কিছু শ্বেতাঙ্গ সরকারি কর্মচারীকে মারতে পারলেই যে পরিণামে স্বরাজ্য লাভ হবে, এমনটাও তিনি বা কেউই মনে করেন না। এই পথ শুধু ভুলই নয়, চরম আত্মঘাতীও। আইনশৃঙ্খলা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে, কিন্তু সেই অজুহাতে যে-সব নেতা জনগণকে তাদের স্বাভাবিক অধিকার অর্জনের শিক্ষা দিচ্ছেন, তাঁদের পথে কাঁটা বিছানো চলবে না। 

‘বোমার গুপ্তকথা’ শীর্ষক এর পরবর্তী প্রবন্ধটি ‘কেশরী’তে ছাপা হয় ২রা জুন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞাকে নির্মল সারল্যের ভঙ্গীতে আবৃত করে তিলক লিখলেন,“পাশ্চাত্য বিজ্ঞানই বোমার জন্ম দিয়েছে... সরকারের সামরিক শক্তি-দম্ভকে বোমা ধ্বংস করে। ...বোমার কারণেই এই শক্তিমত্ততা থেকে জন্মানো বিশৃঙ্খলার দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়।” বোমার প্রতীকী তাৎপর্য সম্পর্কে তিলকের আরও সরস বর্ণনা :- “যখন সরকারি কর্মচারীরা বিনা কারণে জনগণের অবদমন শুরু করে, এবং সন্ত্রাসের সাহায্যে তাদের হতাশাগ্রস্ত করার চেষ্টা চালানো হয়, তখনই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে উৎসারিত বোমার আওয়াজ কর্তৃপক্ষকে এই শিক্ষা দেয় যে, জনগণ তাদের অনুদার নীতিকে গদগদ ভাবে ভক্তিপ্রদর্শনের থেকে উচ্চতর স্তরে উত্তীর্ণ হয়েছে।” 

‘কেশরী’তে তিলকের পঞ্চম নিবন্ধটির শিরোনামের মর্মার্থ ছিল :-‘এ-সব প্রতিবিধান স্থায়ী হবেনা’, প্রকাশের তারিখ ৯ই জুন। তিনি তীব্র ভাষায় লিখলেন যে, সভাসমাবেশে নিষেধাজ্ঞা, সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ, বিস্ফোরক আইন ইত্যাদি নতুন নতুন উৎপীড়ন ব্যবস্থা সরকার চালু করেছে, কারণ তার কাঁধে ভূত চেপেছে। ভারতবাসীদের সামান্যতম অস্ত্র রাখবার অধিকারও কেড়ে নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা দেশবাসীর পৌরুষকে পিষে মেরে নিজেদের স্বার্থপর শাসনব্যবস্থা চালিয়ে যাবার যে ফন্দী করেছে, তার নিন্দার সঙ্গে সঙ্গে এই রচনায় তিনি মুঘল শাসনের সঙ্গে ব্রিটিশ শাসনব্যবস্থার তুলনা করে ইংরেজদের নীতিকে তুলনামূলক ভাবে বেশি অনুদার ও স্বার্থান্ধ বলে চিহ্নিত করলেন। 

বোমার তন্ত্র সম্পর্কে সরকারের বক্তব্যকে তিলক আক্রমণ করলেন এই ভাবে :- “কর্তৃপক্ষ এই ভুল কথা প্রচার করছে যে, বাঙালিদের বোমা সমাজনাশী। না, ইয়োরোপের যে-বোমা সমাজ ভাঙতে চায়, তার সঙ্গে বাঙলার বোমার আকাশ পাতাল প্রভেদ। ইয়োরোপের বোমার জন্মদাত্রী হচ্ছে স্বার্থপর কোটিপতিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা আর বাঙলার বোমার সৃষ্টি তীব্র দেশপ্রেম থেকে। বাঙালিরা নৈরাজ্যবাদী নয়, তবে তারা নৈরাজ্যবাদীদের অস্ত্র ব্যবহার করেছে মাত্র।” তিলকের মতে বোমার কার্যকারিতাও রয়েছে, যা তিনি স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেননি। তিনি জানান যে, বোমার দ্বারাই পর্তুগাল ও রাশিয়ায় শাসনসংস্কার সম্ভব হয়েছে, কাজেই শাসনসংস্কার হলে এ-দেশেও বোমার বিস্ফোরণ আর হবে না। 

তিলকের মতে বিজ্ঞানের দৌলতে বোমার সহজ নির্মাণ কৌশল অনেকেই বেশ জেনে গেছে। কলকাতায় আবিষ্কৃত বারীন্দ্রকুমার ঘোষ প্রমুখের বোমার কারখানাটি থেকেও এ কথার প্রমাণ মেলে। বারীন্দ্রের বোমার মামলার বিবরণ থেকে সরকার কি শিক্ষা নেবে না? আগের রচনাটির মতো এটিতেও তিলক বোমার উদ্ভবের কার্যকারণ ব্যাখ্যার ছলে বোমার রাজনৈতিক উপযোগিতার ওকালতি করতে কসুর করেন নি। তাঁর অনবদ্য ভাষায়:- “বোমাই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছে।...সরকারের কাজকর্মে দেশবাসী কতটা হতাশ, ক্ষুব্ধ বা ক্রোধন্মত্ত হয়েছে... এতদিন সরকারের তা জানার কোনও উপায় ছিলনা।... এতদিন দেশবাসী প্রতিবাদ জানিয়েছে আবেদনপত্রের মাধ্যমে। আবেদন গ্রাহ্য না হলে তারা সেই যন্ত্রণায় নিজেরাই জ্বলেছে, সরকারের কানে সে খবর পৌঁছয়নি। এখন এই উন্মত্ত মানুষগুলো বোমার বলে বলীয়ান – যে বোমা সরকারের সামরিক শক্তিকেও খর্ব করে দিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে যে, আগের রচনাগুলোর মতো এখানেও তিলক সরকারের কানে এই কথাটাই ঢুকিয়ে দিতে চাইলেন – “বোমা বন্ধের সঠিক পথ হল জনগণের হাতে স্বায়ত্ত শাসনের জরুরি অধিকার দেবার ব্যবস্থা।”

তিলকের এই পাঁচটি প্রবন্ধের প্রথম ও শেষটির জন্য তাঁর বিরুদ্ধে রাজদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়, যার পরিণতি ছিল দীর্ঘ ছ’ বছরের জন্য সুদূর মান্দালয়ে্র জেলে নির্বাসন। ভারতের অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের ওপর বাংলাদেশে উদ্ভূত এই বোমার রাজনীতির আরও কিছু প্রতিক্রিয়া আমরা এর পরে লক্ষ্য করব। 






[পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়]











আকর-পঞ্জীঃ-

১। আত্মশক্তি ও সমূহ / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২।LokamanyaTilak : A BiographyBy- G D Pradhan& A K Bhagwat
[Jaico Publishing House, 1956]
৩। তিলকের পত্রিকায় স্বদেশী ‎আন্দোলন/ শঙ্করীপ্রসাদ বসু [চার] – শিলাদিত্য, 
১-১৫ মার্চ, ১৯৮৪।
৪।মা কালীর বোমা/ পিয়ারীলাল দত্ত- বর্ণপরিচয়, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, 
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর , ২০০৯।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - শবনম দত্ত

Posted in


প্রবন্ধ


অ্যান ওড টু ওয়াটার অব লাইফ
শবনম দত্ত



আমার সাথে অ্যালকোহলের চেনাচিনি সেই হরপ্পা মহেঞ্জোদারোর আমলে। কিছুদিন টুকটাক হুইস্কি, ভদকা, জিন, রাম, টম কলিন্স, স্ক্রু ড্রাইভার, ব্লাডি মেরির সাথে ঝাড়ি টাড়ি মেরে, ফাইনালি ভদকার সাথেই পার্টনারশিপ করলাম। ককটেল ব্যাপারটা খুবই ভাল কিন্তু সমস্যা একটাই। জিভ বলত, "এসো এসো এসো প্রিয়" আর পকেট বলত, "একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি"। তা তখন পকেটের যা হাল থাকত তাতে করে স্টেপল দারু ছিল হোয়াইট মিসচিফ। স্মারনফ আলে কালে। বাড়িতে বাবাদের আসরে আর সি, আর এসের পেসাদ মিলতো বটে, কিন্তু সে আমার জমত না। আর সাথে ভাজাভাজি, চানাচুর, কাজু এগুলো জাস্ট পোষাতো না। আমি শুধু একটু শশা খেতাম দারুর সাথে। শুরু থেকেই সাত্ত্বিক টাইপস আরকি।

চাকরি বাকরি পেয়েও আমার ভদকার প্রতি লয়ালটি একটুও কমেনি বুঝলেন? আফটার অল সীতাসাবিত্রীর দেশের মেয়ে আমি। আনশেকেবল লয়ালটি। খালি তখন হোয়াইট মিসচিফ থেকে স্মারনফে শিফ্ট করলাম পার্মানেন্টলি। তারপরে এলাম ইউ কে। এক সিনিয়র জে ডি উইথ কোক খাওয়ালো। খেয়ে দেখলাম জম্পেশ কেস। বিটকেল গন্ধ নেই, গলা জ্বলে না। বুঝলাম হুইস্কির ডেফিনিশন আপডেট করতে হবে। বেশ ক'মাস কাটল জ্যাকদার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে। তারপরে লোকজন বলল এবার তো লেভেলে ওঠ! নিষ্পাপ মনে জিগালাম, "মানে?" দাদারা বলল জ্যাককে ছেড়ে জনিকে ধর। তা ধরলাম। ব্ল্যাক লেবেল খেলাম কোক সহযোগে। দেখি সেও ব্যাপক! প্রায় ধর্মসংকটে পড়া গেল। জ্যাক, না কি জনি? শ্যাম রাখিনা কুল? কিন্তু বুঝলেন কিনা, দিন তো কারোর সমান যায় না। মাসের শেষ বলে একটা কথা থেকেই যায়। সুতরাং মার্কেটে এলেন ফেমাস গ্রাউজ। সে একটি ব্লেনডেড হুইস্কি যেনাকে কোক ছাড়া খেতে গেলে ঐতিহাসিকভাবে বাংলা, চুল্লু এসব গেলার অভিজ্ঞতা থাকতে হয়। আমার সে বালাই ছিল না। সুতরাং আমি তেনার সঙ্গে বেঁধেছি আমারো পান/কোকেরো বাঁধনে। 

ঠিক এমনই সময়ে, আবির্ভাব হলো তাঁর। হ্যাঁ ঠিকই পড়েছেন। আগমন নয়, আবির্ভাব। আপনার শিলংপাহাড়ের অসম্মান বলে মনে হলে, আমি নাচার। তাঁর নাম গ্লেনফিডিথ। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী বিক্রি হওয়া সিঙ্গল মল্ট। না না সে যুগে আমি এসবের কিস্সু জানতাম না। কোন এক পূণ্য শুক্রবারে আমার পতিদেবতাটি প্রথমবার গ্লেনফিডিথ আমদানি করেছিলেন এবং সেই রাতটা আমি তাঁর উদ্দেশ্যেই নিবেদন করেছিলাম। এইখানে বলে রাখা ভাল যে কিছু কিছু লোক জন্মায়ই ন্যাচারাল গ্রেস, ন্যাচারাল ক্লাস নিয়ে।আমি ঠিক তেমনটা নয়। মানে আদতে পেঁচো মাতাল আর কি। সুতরাং গ্লেনফিডিথও প্রথমে কোক দিয়েই খেতাম। তবু বড় স্মুথ লাগতো। হাল্কা হাল্কা সুগন্ধ। একটু একটু আমেজ। 

এই সময়ই প্রথম ডিস্টিলারি ট্যুর নেবার সৌভাগ্য হলো এডিনবরাতে। শেষ ডিসেম্বরের হু হু করা ঠাণ্ডাতে আটশ বছরের পুরোনো এডিনবরা ক্যাসলের আনাচ কানাচ ঘুরে হাতের আঙুল, নাকের ডগা যখন প্রায় ফসিল হয়ে গেছে, তখন ক্যাসল চুড়ো থেকে গড়াতে গড়াতে নেমে (তিনপ্রস্থ সোয়েটার জ্যাকেট পরারপর আমার নিজেরই নিজেকে বোল্ডার বলে ভুল হয়, আর বোল্ডাররা গড়ায়। হাঁটে না মোটেই) ডান দিকে একটি ডিস্টিলারি ট্যুরের সাইন দেখতে পেলাম। টিকেট দেখলাম বেশ পকেট ফ্রেন্ডলি। সুতরাং ঢুকে পড়লাম।

এ্যাদ্দিনে প্রায় সব্বাই জেনে গেছেন হুইস্কি কি করে তৈরী হয়। তবু একটু সুখস্মৃতি রোমন্থন করেই ফেলি? খুব শর্টে বলতে গেলে বার্লিকে অঙ্কুরিত করে, সেটাকে শুকিয়ে, ম্যাশ করে, তার উপরে জল ঢেলে সুগারবার করে নেওয়া হয়। এই সুগার লিকুইডটাকে বলে ওয়র্ট (wort)। এর সাথে ইস্ট মিশিয়ে ফারমেন্ট করা হয়। ফারমেন্টেশনের পরে যে অ্যালকোহলিক লিকুইডটা তৈরী হয় তাকে ওয়াশ (wash) বলে। এবার বারকয়েক ডিস্টিলেশন। ফাইনালি যে জিনিষটা বেরোয় সেটাকে কাস্ক মানে কাঠের ব্যারেলে রেখে ম্যাচিয়োর করানো হয়। বার্লির জাত থেকে শুরু করে কাস্কের কাঠের জাত সব কিছুরই ওপরে ডিপেন্ড করে হুইস্কির স্বাদ, রং, গন্ধ। এক কথায় সামারি এই যে, যে বস্তুটা খেয়ে আমরা একটু সময় হিসাবের দুনিয়া থেকে ছুটি চাই সে বস্তুটা কিন্তু প্রচুর হিসাব করে বানানো হয়। 

ডিসটিলারি ভিজিটে কাজের জ্ঞান যেগুলো লাভ হয়েছিল তার মধ্যে প্রধানতম হলো  স্কটল্যান্ডে তৈরী হুইস্কিকে বলে স্কচ। হাসবেন না, মোটে হাসবেন না! আমি কত্ত ইনোসেন্ট ছিলাম সেটা ভেবে একটু উদাস হোন বরং! অ্যামেরিকায়ও নানা রকমের হুইস্কি হয়। সেগুলোর মধ্যে মোস্ট পপুলার হল বার্বন (Bourbon)। এটাতে 51% ভুট্টা ব্যবহার করা হয় আর 49% অন্য কোন গ্রেন। আমার আগে খাওয়া জ্যাক ড্যানিয়েলস হলো গিয়ে বার্বন হুইস্কি। টেনিসি স্টেটে তৈরী। আরও জানলাম সিঙ্গল মল্ট স্কচ হুইস্কি আর ব্লেন্ডেড স্কচ হুইস্কির মধ্যে তফাত মল্টের সংখ্যায় নয়। ডিস্টিলারির সংখ্যায়। যে স্কচের মধ্যে দুই বা তার বেশী ডিস্টিলারি থেকে তৈরী স্কচ মেশানো হয় তাকেই বলে ব্লেন্ডেড স্কচ। জনিদার সব লেবেল এবং দুনিয়া কাঁপানো শিভাস ব্লেন্ডেড স্কচ। সিঙ্গল গ্রেন স্কচ বলেও একটা বস্তু হয়। সেটা সিঙ্গল ডিস্টিলারি থেকে হয় বটে কিন্তু বার্লি ছাড়া অন্য গ্রেনও ব্যবহার হয়। এত সব জেনে টেনে স্কচের প্রতি যাকে বলে বেশ একটা ইনফ্যাচুয়েশন হলো। 

ইউ কে থেকে ফিরে ব্যাঙ্গালুরু। বছর দেড়েক যাবত আমার এবং দারুর মাঝে চাইনিজ ওয়াল হয়ে খাড়া রইলেন (ঠিক খাড়া বলা যায় না, শুয়ে রইলেন বলা ঠিক) একটি ই টি টাইপ দেখতে মানবশিশু। যেদিন ছাড়া পেলাম..! পুরো মনে হলো বঙ্গলক্ষ্মী বাম্পার লটারি জিতেছি। বর একটা ডিস্টিলারি এডিশন গ্লেনফিডিথ এনে রেখেছিল ডিউটি ফ্রী থেকে। 51%। সেটি নিউ ইয়ার ইভে খোলা হলো। তারপরে কি হলো,  সে প্রশ্ন আউট অব সিলেবাস। 

এরপরে চেঞ্জ অব সিনারি। ইউ এস গমন। সেখানে গিয়ে চোখে পুরো ধাঁধাঁ লেগে গেল। কত শত রকমের নতুন দারু রে ভাই। টেকিলা, কাছাখা, কাহলুয়া আর কত বলব। আর আজব সব নামের বীয়ার; ডগ ফিশহেড, স্টিল রিজার্ভ। তবু মাঝে মাঝেই তাঁকে বাড়ি নিয়ে আসি। তাঁর এক কাজিনের সাথেও পরিচয় হলো, গ্লেনলিভেট। ততদিনে গ্লেন মানে যে শীর্ণ উপত্যকা তা জানা হয়ে গেছে। জনিদার উপরের লেভেলগুলোর দাম আড়চোখে দেখতে শুরু করেছি। দেখলাম ব্লুটা একদমই নাগালের বাইরে। কিন্তু গ্রীন আর গোল্ডটার জন্য একজন উদারমনস্ক মানুষকে মোটিভেট করা দরকার। সেটা কে, সে কথা গেস করার জন্য কোন প্রাইজ নেই! তা একদিন গোল্ড লেবেল এলেন আমাদের বাড়ি। আমি গাড়িতে পেছনের সীটে তাকে তিনমাসের ছেলে ভেবে আঁকড়ে ধরে বসেছিলাম প্রায়। তা সে যাত্রা কি মনে হলো কোকটা মেশালাম না।বরফ দিয়ে খেলাম। জীবনে প্রথমবার ঢোক গিলেও দেখলাম একটা টফি টফি ভাব রয়ে যাচ্ছে জিভে। ইউএসে-তে বছর চারেক স্কচ বলতে ওই গ্লেনের দিকেই খেলাধুলো হলো আর জনিদা। তবে হ্যাঁ, সিঙ্গল মল্টের প্রতি একটু পক্ষপাত দেখা দিল। 

এরপরে আবার কন্টিনেন্ট শিফট এবং খুকুমণির প্রত্যাবর্তন টু ইউ কে। এ পাড়ায় স্কচের দাম কম হওয়াটা এই ডিসিশনের পেছনে কতটা রোল প্লে করেছিল, এসব কূট প্রশ্ন ইললিগাল। ইউ কে আসার পর পরই জীবনে প্রথম নন স্পেসাইড (speyside) স্কচ খেলাম। খাইয়েছিল এক বন্ধু। স্কচটার নাম জুরা (Jura) (অরিজিন)। জুরার লেবেল পড়ে জানলাম এটা অ্যাকচুয়ালি জুরা নামের দ্বীপে বানানো হয়েছে। গুগুল করে দেখলাম যে জুরা হলো স্কটল্যান্ডের পশ্চিমে একটা ছোট্ট দ্বীপ যেখানে কেবল একটাই ডিস্টিলারি আছে আর পুরো কম্যুনিটি বেঁচে আছে এই হুইস্কির ওপরে বেস করে। বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে দূরদ্বীপবাসিনী গাইবার পরিকল্পনা করছি সবে, বন্ধুবর জুরা, জলে জ্বারিত করে এনে দিল। আমার অশিক্ষিত জিভেও প্রথম দুটো সিপের পরে বুঝলাম, এ অন্য জাতের জিনিষ। গ্লেন যদি উচ্ছল পাহাড়ী ঝরনা হয় তো জুরা কাকচক্ষু জলাশয়। গ্লেন বড্ড চঞ্চল, খেয়াল না করলে স্বাদ ভাল করে বোঝার আগেই খাওয়া হয়ে যায়। জুরা জিভের কোষগুলোকে ডেকে বলে, "ওঠো, আমি এসেছি তো।" 

এ অভিজ্ঞতার পরে বাধ্য হয়ে হুইস্কি নিয়ে আরও একটু পড়তে হলো। দেখলাম স্কটল্যান্ডে চারটে মেন হুইস্কি প্রোডিউসিং রিজিয়ন আছে। মাঝ মধ্যিখানে পাহাড়ি হাইল্যান্ড হলো একটা রিজিয়ন। হাইল্যান্ডের ডানদিকে, উত্তর পূর্বদিকে, একটা ছোট্ট রিজিয়ন হলো স্পেসাইড। হাইল্যান্ডের বাঁ দিকে, আটলান্টিকের দ্বীপগুলো হলো আইল্যান্ড রিজিয়ন। আইলে একটা আইল্যান্ড কিন্তু আইলেকে একটা আলাদা রিজিয়ন বলে ধরা হয়। প্রতিটা রিজিয়নের হুইস্কির নিজস্ব চরিত্র আছে (গ্লেনফিডিথ আর গ্লেনলিভেট দুটোই স্পেসাইডের প্রোডাক্ট)। এত পড়াশোনা করার পরে ভেবে দেখলাম আমি অ্যাজ ইউজুয়াল নিষ্পাপ। এমন চরিত্রবান পুরুষদের প্রেমে না পড়ে কি আদৌ উপায় আছে? হ্যাঁ, ততদিনে পক্ষপাত প্রেমে পরিণত হয়েছে।

যাই হোক, স্কুলে ক্লাস শুরু হলো। স্টুডেন্টদশা, এক পয়সা ঘরে আনি না উল্টে খরচ করাই। সাথে গোদের উপরে বিষফোঁড়াসম পড়ার চাপ। দিনরাত নিজের মনে গাই, "হরি ক্লাস তো হলো, এক্সাম এলো, পার করো আমারে"। সব কাল রাতেরই শেষ থাকে। আমারও পড়া শেষ হলো। চাকরী হলো। জারা সা ঝুম লু ম্যায় মোডে তল্পিতল্পা নিয়ে লন্ডনে থাবা গাড়লাম। 

সামার আসতে না আসতেই স্কটল্যান্ডে উদয় হলাম লং উইকেন্ডের সাথে দু'দিন ছুটি জুটিয়ে নিয়ে। স্কটল্যান্ডের ট্র্যাভেলগ সিরিজ আলাদা লিখছি, তাই সে দিকে আর গেলাম না (সংযমটা, স্কচের প্রতি ডেডিকেশনটা, লক্ষ্য করবেন। স্কটল্যান্ডের কথাও তাকে তুলে রাখলাম)। সে যাত্রা গেলাম আরেকটা ডিস্টিলারি ট্যুরে। সিঙ্গলটন। এদের দুইখান ডিস্টিলারি আছে। একটা গ্লেন অর্ড, হাইল্যান্ডের মাথায়, ইনভারনেসের গায়ে। অন্যটা ডাফটাউন, স্পেসাইডে। সিঙ্গলটন আগে খেয়েছিলাম, স্পেসাইডওলাটা। কিন্তু খুব যে আউউটস্ট্যান্ডিং লেগেছিল এমনটা নয়। তবু হিরের আংটি থুড়ি স্কচ হুইস্কির আবার ট্যারা আর বাঁকা! 

এই ডিস্টিলারি ট্যুরে পুরোনো কিছু জ্ঞান আবার ঝালিয়ে নেওয়া গেল আর নতুন কিছু জ্ঞানও হলো। তারমধ্যে একটা হলো পরীরাও দারু খায়। সত্যি বলছি। ওই যে কাস্কের মধ্যে হুইস্কি ম্যাচিওর করানো হয়? তখনই কাঠের ফাঁকফোকর দিয়ে প্রতি বছর ২% বা তার বেশী পালায়। সেটা হলো অ্যাঞ্জেলস্ শেয়ার। ভাবছেন তো ফাঁকফোকর রাখার দরকার কি ছাই? দারু নষ্ট করা কি কোনও বুদ্ধিমানের কাজ? আমিও ঠিক ওই কথাটাই ভেবেছিলাম, বুঝলেন! তারপরে বুঝলাম যে কেস অত্যন্ত জটিল। হুইস্কির মধ্যে ডিস্টিলেশনের সময় মেটাল স্টিল (পাত্র) থেকে যে মেটালিক ভাবটা আসে, কাস্কের কাঠ সেটা নিয়ে নেয় আর কাঠ থেকে হুইস্কি পায় ভ্যানিলা, টফি, আরও সব রকমারি গন্ধ, কাঁচা সোনা বা তামার মতন রং। তাই এটুকু স্যাক্রিফাইস করতেই হবে। তা ২% দিলেও হাতে অনেকটাই থাকে বলুন? এরপরে আমার ঘোর বিশ্বাস জন্মেছে যে, দাদু আসলে লিখতে চেয়েছিলেন, "দেবে আর নেবে, মেলাবে মিলিবে, যাবে না উড়ে, স্কটল্যান্ডের ডিস্টিলারির কিনারে কিনারে।" ভুললে হবে না যে ভদ্রলোক এদিকে এসেছিলেন।

কাঠ আবার দু'রকম হয়। অ্যামেরিকান আর ইয়োরোপিয়ান ওক। অ্যামেরিকান ওক হলে গাছের বয়েসসত্তর পেরোলে তবেই তার কাঠ নেওয়া যায় আর ইয়োরোপিয়ান ওক হলে গাছের বয়েস অন্তত এক'শ পেরোতে হবে। এর থেকে অ্যামেরিকানরা অকালপক্ক এমন সিদ্ধান্তে কেউ পৌঁছলে আমি কিচ্ছু দোষ দেব না। এরপর আছে কাঠের তক্তা, যেগুলো দিয়ে কাস্ক বানায়, সেগুলো কাটবার আর্ট। গাছের গুঁড়িতে যে অ্যানুয়াল রিং থাকে, সেগুলো কাস্ক বানানোর পরে যেন ভার্টিকাল থাকে। আরও অনেক জটিল হিসাব আছে। নাহলে পরীরা আরও বেশী বেশী দারু খেয়ে নেবে এই আর কি। কাস্ক বানিয়েই সাথে সাথে ব্যবহারকরা যায় না কিন্তু। পোড়াতে হয়। সেই পোড়া কাস্কে স্কচ ম্যাচিয়োর করা হয়। স্কচের ক্ষেত্রে নতুন কাস্ক ব্যবহার হয় না। বার্বন বা শেরি বানানো হয়েছিল যে কাস্কে সেই কাস্ক রিইউজ করা হয়। হ্যাঁ, এই ইউজঅ্যান্ড থ্রো-র যুগেও রিইউজ। কাস্কে কতদিন রইল তার ওপরে নির্ভর করে কাঠ থেকে কি কি ফ্লেভার পেল বা কাঠকে কতটা কি দিল। একই হুইস্কি, একই কাস্ক, আট বছরে এক রকম আবার বারো বছরে একরকম। 

ডিস্টিলারি ট্যুরের শেষে এখানে তিন রকম দারু টেস্ট করাবে জানতাম। আমার তো প্রাণে পুরো রোদ উঠেছে ফুল ফুটেছে অবস্থা (বিশ্বাস করুন, লন্ডনে সারা বছর বৃষ্টি ঝেলবার পর চাঁদের থেকে রোদ অনেক দামী হয়ে ওঠে)। তিন রকম দারু, তাও আবার ডাবল ডোস পাব আমি। আসলে ট্যুরে গেছিলাম আমি, বর, ছানা, বাবা আর মা। মা তো আর দারু খায় না! সুতরাং উত্তরাধিকার সুত্রে সে দারু আমারই পাওনা হয়। তা ডিস্টিলারির লোকজনেরা বললেন প্রথমে সবচেয়ে কম স্মোকি তারপরে মাঝারি স্মোকি আর শেষে খুব স্মোকি দারু খাওয়াবেন। প্রথমে সিঙ্গলটন খেলাম গ্লেন অর্ড ডিস্টিলারির। আমি তো ধোঁয়ার ধোঁও পেলাম না। তারপরেরটা কি ছিল সে ভুলে গেছি। লাস্ট এল লাগাভুলিন (lagavulin) নামের একটা স্কচ। যে মাত্র সে বস্তুটি গ্লাসে ঢালা হলো নাকটা আরামে পাশ ফিরে শুলো। ঠিক যেন দামী সিগারেট বাসিগারের গন্ধ আর তার সাথে একটু বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধের ছোঁয়া। পপাত চ, মমার চ। এই একই যাত্রায় আইল অব মলের একমাত্র ডিস্টিলারি, লেজিগও ( Ledaig) গিয়েছিলাম। সেখান থেকে টোবারমোরি ১০বছর বলে একটা সিঙ্গল মল্ট বাণিজ্য করা গেছিল। লন্ডন দূরস্থান, কোনদিন গ্লাসগোতেও এনাকে দেখিনি আগে। 

সে যাত্রা বাড়ি এসে, কোনও রকমে সপ্তাহটা পার করে, শুক্রবারের সন্ধ্যায় টোবারমোরির আরাধনায় বসা গেল। গ্লাসে ঢেলে প্রথমেই মনে হলো মুরগী হয়েছি। এ কি স্কচের রং? এ তো জল, জাস্ট জল। বুকটায় হু হু করে লু বইতে শুরু করেছে এমন সময় পতিদেবতা অল্প ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে গ্লাসটা হাতে দিলেন। প্রথম সিপটা নেবার পরেই মুণ্ডুটা ব্যোমকে গেল। বলি কোনওদিন শুনেছেন ঝাল দারু? আমি তো শুনিনি। ভাবলাম ঠকে যাবার শোকে কি টেস্টবাডগুলো ঘেঁটে গেল? বরের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও চোখ গোলগোল করে হাতের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে আছে। ইতিউতি তাকিয়ে আবার একটা সিপ নিলাম। এবারে সতর্ক ছিলাম। কই? নাকে কেমন জানি হাল্কা সমুদ্দুর, সমুদ্দুর গন্ধ, জিভে হাল্কা মিষ্টি স্বাদ। কিন্তু ঝাল তো নেই! ঢোক গিললাম। গিলেই বুঝলাম আলজিভের কাছটায় আবার ঝাল। ঢোক গেলার ৩ সেকেন্ড পরেও মুখে ঝাল ঝাল ব্যাপারটা রয়েই গেল। অগত্যা গুগুল দেবতাকে স্মরণ করা গেল। তিনি জানালেন টোবারমোরির ফিনিশে আসলেই পেপার ব্লাস্ট রয়েছে আর ফিনিশটা লম্বাও। ফিনিশ মানে হলো ঢোক গেলার পরে যতক্ষণ ধরে স্বাদটা জিভে থেকে যায়। আইল্যান্ড স্কচের সাথে প্রথম আলাপটা ছিল এমনই তীক্ষ্ণ মধুর।

সেই উইকেন্ডেই মনে পড়ে গেল লাগাভুলিনের কথা। লোকাল গ্রসারি স্টোরে তাঁর দেখা পাওয়া গেল না। দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করেও কিছু হদিশ হলো না। মনের দুঃখে বাড়ি এসে খুঁজতে বসলাম যদি অনলাইন অর্ডার করা যায় কোথাও। করতে গিয়ে দেখি ইনি হলেন আইলে মল্ট। আইলে মল্ট কোনওদিন খাইনি। সুতরাং পুরো বাঁধ ভেঙে দাও টাইপ উৎসাহ এল প্রাণে। লাগাভুলিন ছাড়া আর কি কি আইলে মল্ট হয় তার খোঁজে লেগে পড়লাম। খোঁজ শেষে লিস্ট মিলিয়ে বোমোর (Bowmore) কিনে আনা গেল। সন্ধ্যেরাত করে হাতে গ্লাস নিয়ে সোফায় বসলাম। তখন আমরা থেমসের একদম পাশে একটা ফ্ল্যাটে থাকতাম। নদীর ওপারে আমাদের মুখোমুখি ক্যানারি হোয়ার্ফের হাইরাইজ বিল্ডিংগুলো। বোমোর গ্লাসে ঢালার পরপর ধোঁয়ার গন্ধ পেলাম বটে, কিন্তু লাগাভুলিনের গন্ধের থেকে অনেক কম তীব্র সে গন্ধ। নাকের কাছে এনে দেখি ধোঁয়ার ওদিকে আরও কিছু যেন আছে। একটু ডিটেকটিভগিরি করতেই তিনি ধরা দিলেন। এ তো লেবু লেবু গন্ধ! স্বাদ? একটু মিষ্টি, একটু ফল, একটু ধোঁয়া। সন্ধ্যারতি হয়ে যাবার ঠিক পরে প্রসাদের থালা থেকে কমলালেবু আর আপেলের সাথে লেপটে থাকা সন্দেশটা খাবার কথা মনে পড়ে গেল (কারোর ভাবাবেগে আঘাত লাগলে লেখক ক্ষমাপ্রার্থী)। শেষটুকু? লঅঅং ফিনিশ। বোমোরের হাত ধরে সে রাতে ক্যানারি হোয়ার্ফের সাদা বাড়িগুলোকে লাল কমলা রং ছেড়ে হাজার তারার নকশীকাঁথা হয়ে উঠতে দেখেছিলাম। 

এরপর ঘাড়মোড় ভেঙে পারিবারিকভাবে আইলে মল্টের প্রেমে পড়া গেল। ল্যাফ্রয়েগ (Laphroaig), কুল্যাইলা (Caol ila), লাগাভুলিন। এইখানে একটু পিট নিয়ে পিটপিট করতেই হবে। মস জাতীয় উদ্ভিদ ঠাণ্ডা, সামুদ্রিক আবহাওয়ায় ডিকমপোজ করে হয়ে ওঠে পিট। স্কটল্যান্ডের ২০% জায়গাই পিটে ঢাকা। পিটকে জ্বালানি হিসেবে মানুষ ব্যবহার করছে খুব সম্ভবত ব্রোঞ্জ যুগ থেকে। আইলে মল্টের ক্ষেত্রে অঙ্কুরিত বার্লি শুকানো হয় পিটের আগুনে আর তার থেকেই আসে ধোঁয়াটে ভাবটা। যত বেশীক্ষণ পিটের আগুন খাবে তত বেশী ধোঁয়াটে ভাব। কি ভাবছেন? সহজ ব্যাপার? ধীরে বন্ধু ধীরে! ধোঁয়ার ব্যাপার খুবই ধোঁয়াটে। ভুললে হবে না অঙ্কুরিত বার্লি শুকানো হুইস্কি তৈরীর একদম শুরুর দিকের স্টেপ। এরপরের স্টেপগুলোতে ধোঁয়াটে ভাব কমে যাবার হাই চান্স থাকে। কতক্ষণ ফারমেন্টেশন হচ্ছে, ডিস্টিলকরার স্টিলের মাপ কত, ডিস্টিলেশনের পরে অ্যালকোহল স্ট্রিমের কোন পার্টটা ডাইরেক্টলি নেওয়া হচ্ছে, কোন কাস্কে কত বছর ম্যাচিয়োর করছে সবকিছুরই উপর ডিপেন্ড করে ফাইনাল প্রোডাক্ট কতটা স্মোকি। তাই ফারমেন্টেশনের আগে ল্যাফ্রয়েগ আর লাগাভুলিনের মল্ট সমান স্মোকি হলেও শেষে গিয়ে লাগাভুলিন অনেক বেশী স্মোকি। 

এই অবধি এসে নিশ্চয়ই মাথা তাজ্ঝিম তাজ্ঝিম করছে? বলি কি, আজ তবে এইটুকু থাক। বিভিন্ন স্টিলেডিস্টিলেশনের গল্প, আলাদা আলাদা কাস্কের গল্প, হাইল্যান্ড স্কচের গল্প, এসব অন্য একদিন হবে। আমি এখন যাই বুঝলেন? হাল্কা হাল্কা বরফ পড়ছে সেই সন্ধ্যে থেকেই। চারদিকটা প্রায় সাদা হয়ে এসেছে। এক পেগ ল্যাফ্রয়েগে একটুখানি ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে নিয়ে, সোফায় বসে পায়ে থ্রো চাপা দিয়ে, রবার্ট গর্ডনের দারাইজ অ্যান্ড ফল অব অ্যামেরিকান গ্রোথ টা পড়া শুরু করি। স্বর্গ যদি কোথাও থাকে...

0 comments:

0

বইঘর - বিপুল দাস

Posted in


বইঘর


অলীক মানুষ ~ সৌন্দর্য ও বিষাদের প্রতিমা নির্মাণ
বিপুল দাস



উপন্যাসটি বিবৃত হয় কখনও সহজ বর্ণনায়, কখনও লম্বা-নেকো সেপাই নামের এক পাহারাদারকে আচাভুয়ার মতো দাঁড় করিয়ে মনোলগের আকারে, কখনও টুকরো সংলাপে। উপন্যাসে বিধৃত হয় মাটির মায়াবন্ধন, ভোগবাসনার এই দুনিয়া, জীবনের রহস্যময়তা, শফির ক্রমাগত মেটামরফোসিস, ক্রমশ কিংবদন্তীর দিকে উড্ডীন এক নাচার পিরের অসহায় আত্মসমর্পন এবং জীবনের প্রতি ঘৃণা ও ভালোবাসার টানাপোড়েনে তৈরি একটি আলো ও অন্ধকারের নকশাদার জামদানি। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, ওই নক্‌শায় আলো ও অন্ধকারের চৌখুপি সমান উজ্জ্বল। এমন কী, অন্ধকার যেন তীব্রতায় আচ্ছন্ন করে প্রচলিত সমস্ত বোধ, আমাদের বেস্ট-সেলার গ্যাদগেদে রচনাসমূহ। নির্মাণকৌশলের ভেতরে চারিয়ে যাওয়া Negetivism এক অসামান্য দক্ষতায় প্রচলিত, মান্য এবং তথাকথিত শাশ্বত জীবনবোধকে অতিক্রম করে। অন্য এক অপরিচিত ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করায় পাঠককে। সাদা জিন ও কালো জিন সমস্ত উপন্যাসজুড়ে অদৃশ্য দোরঙা সুতোর বিনুনি বুনতে থাকে। লৌকিক আর অলৌকিকের দ্বন্দ্বে জমিনে ফোটে বিস্ময়কর কুসুম। 

Behold the world, and curse your victories. 

‘অলীক মানুষ’ মূলত দু’জন হারিয়ে যাওয়া, একলা হয়ে যাওয়া মানুষের গল্প। বাস্তব ও পরাবাস্তবতার দ্বন্দ্বে দু’টি মানুষ দু’রকমভাবে অলীক মানুষে পরিণত হয়। একজন ধর্মবন্দী ও একজন ধর্মদ্রোহী ব্যক্তিগত পরিত্রাণের পথ খুঁজে নিতে চেষ্টা করে এবং প্রকৃতির রহস্যময়তার কাছে আত্মসমর্পন করে। 

বদুপিরের নিয়তি তাকে মহামানব বানিয়েছিল। তার পুরো নামটি ছিল প্রকাণ্ড। সৈয়দ আবুল কাসেম মুহম্মদ বদি-উজ্‌-জামান আল-হুসেইনি আল- খুরাসানি। এই ভার তাকে ক্রুশকাঠের মত আজীবন বহন করতে হয়েছিল। রক্তমাংসের এই দুনিয়ার প্রতি, কামনাবাসনাময় এই শরীরের জন্য, মানবভোগ্য ছোট ছোট সুখের জন্য যে কান্না চাপা পড়ে মুরিদদের জয়োল্লাসে, পিরবন্দনায় – সেই আকুতি দেখছি – “বালক বলল, দাদাজি! লোকে বলে আপনি মাটি ছাড়া হয়ে আশমানে উড়তে পারেন! সত্যি? চুপ করে আছি দেখে সে তাগিদ দিল, বলুন না দাদাজি? শ্বাস ছেড়ে বললাম, হ্যাঁ রফিকুজ্জামান, আমি দুনিয়াছাড়া হয়ে আশমানে ভেসে আছি। দেখতে পাচ্ছ না? পাবে। আরও বড় হও। জানতে পারবে আমার তকলিফ কী”। আরও পরে বদিউজ্জামানের এই বোধ জাগে – আমি এক অলীক ঘোড়ার সওয়ার। তার দুটি ডানা আছে। সফেদ জিনগুলান আমাকে আসমানে উঁচা জায়গায় শাহী তখ্‌তে বসাইল। লেকিন আমার দেল বনু-আদমের থাকিয়া জাইল। উহা গোশত্‌ আর খুন দ্বারা তৈয়ারী। 

আবার দু’শ কুড়ি পৃষ্ঠায় – ‘এক বিকেলে ব্রাহ্মণী নদীর ধারে দাঁড়িয়েছিলাম। সেই পিরের সাঁকোর চিহ্নমাত্র নেই। আচানক বুক হু হু করে উঠল। মনে হলো অতর্কিত শূন্যতার কিনারায় দাঁড়িয়ে আছি। কোথাও কিছু নেই, শুধু শূন্যতা। তারপর মনে হল থামগুলো দেখতে পাচ্ছি। সিঁদুরের উজ্জ্বলতা থামগুলিকে নিটোল, মসৃণ, কোমল করে তুলতে তুলতে এক নাঙ্গা আওরত – তওবা, নাউজুবিল্লাহ্‌। শয়তানের জাদু ... আমার বুকের ভেতরে তখন গিরিখাতের সিংহেরা গর্জন করছে অথবা হাহাকার করছে -- যত দূরে সরে যাচ্ছি ব্রাহ্মণী নদী থেকে, তত ওই গর্জন অথবা হাহাকার। যত সরে চলেছি, তত পিছনে সমুদ্রের তলায় ঝলমল মুক্তার মতো স্মৃতি, আর আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জে পিঙ্গলচক্ষু এক নাঙ্গা আওরত আমার দিকে তাকিয়ে আছে...

বদিউজ্জামান, নাকি তার পুত্র শফিউজ্জামান – এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র কোনটি, সেই তালাশ আমি এখনও জারী রাখিয়াছি। কহিতে শরম নাই, ‘সত্য’ কখনও জাহের হয়, কখনও গায়েব থাকে। বদুপির নামে খ্যাত এক ফরাজি ধর্মগুরু ক্রমশ ব্যোমপথে উড্ডীন হয়েন। শেষদিকে বৃক্ষবাসী জিনসকলের সঙ্গে তার কথাবার্তা, এমন কী বাহাস হয়। এন্তেকাল হলে তার আপত্তি থাকা সত্ত্বেও মার্বেল পাথরে ফারসি আর বাংলায় সনতারিখসহ ফলক স্থাপিত হয়। জীবদ্দশায় তিনি ঐশী ক্ষমতাসম্পন্ন এক মহাপুরুষ সাব্যস্ত হয়েন। এমন কী, কোনও কোনও কীর্তি, যা আপাতদৃষ্টিতে সংসারের নিয়মে পরাজয়, তাহাও শাগির্দের চোখে পিরের বুজুর্গিতে রূপান্তরিত হয়। অথচ তার বুকের ভিতরে হাহাকার ওঠে – ‘ ওহাবি হয়েও আমি কেন মোজেজা দেখি ... আমি যে সত্যি পির বুজুর্গ হয়ে পড়লাম। বুকের ভিতরে আর্তনাদ করে উঠল, আমি মানুষ, নিতান্ত এক মানুষ’। একমাসব্যাপী তার মসজিদে স্বেচ্ছা নির্বাসনকালে (ইত্তেফাক) এক প্রলয়ের রাতে এ রকম ভাবনা আসে – তিনি তো সর্বত্যাগী সাধকপুরুষ নন, তিনি ভ্রান্ত মতানুগামী সুফিও নন। তিনি ওহাবিপন্থী ফরাজি মুসলমান। ইহলোকের সব রকম নৈতিক সুখ উপভোগ করাই তো যথার্থ ইসলাম ... পবিত্র কোরানে আল্লাহ্‌ বলেছেন কৃষক যেমন শস্যক্ষেত্রের দিকে গমন করে, পুরুষ তার নারীর দিকে একই নিষ্ঠা ও প্রেমে অনুগমন করবে বলেই আদিমানব আদমের বুকের বাঁ পাঁজর থেকে নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে, অথচ তিনি এ কী করছেন, কেন করছেন ? 

স্বাভাবিক কামনাবাসনাযুক্ত মানুষের মতোই নারী শরীরের প্রতি আকর্ষণ, সন্তানের গালে একটি চুমু খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, সংসারের সুখদুঃখের অংশীদার হওয়া, স্বাভাবিক মানুষের মতোই হাসিকান্না – এ সবই তার বুকের দরিয়ায় অবিরত তুফান তোলে। কিন্তু সে অতি সঙ্গোপনে। তাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু কখনও দলিজঘরে একা বসে, মসজিদে ইত্তেফাক নিলে, কখনও বা একা বাঁশঝাড়ের নীচে আলের ওপর দাঁড়িয়ে, ভাঙা পিরের সাঁকোর ওপর ভাঙা থাম দেখতে দেখতে বুকের ভেতর তোলপাড় করে ওঠে। বুজুর্গ পিরের তকমা-আঁটা ইহ শরীর সওয়ার হয় এক অলীক ঘোড়ার ওপর। সে-ও তো এক ধরনের সুখ। তুচ্ছ মাটির বাঁধন ছিঁড়ে তার সামাজিক স্থানাঙ্ক নির্মিত হতে থাকে সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে। বায়বীয় স্তরে। তবু বদিউজ্জামান এক সময় বলেন, তার ‘তকলিফ’-এর কথা। সাদা জিনসকল তাকে শাহী তখত্‌-এ বসায়। রক্তমাংসের বদিউজ্জামান গাথায়, উপকথায় কিংবদন্তীর মানুষ হয়ে যান। তবু মাটি মায়া ছাড়ে না। এই কথা বলতে হয় – ‘... তবু আমার দেল বনু আদমের থাকিয়া জাইল, উহা গোশত্‌ আর খুন দ্বারা তৈয়ারী’। রক্তমাংসের এই বাস্তব জৈবিকতা, লৌকিক প্রয়োজন এবং ক্রমশ শূন্যমার্গে ধাবমান অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন পিরসাহেবের প্রকাণ্ড ছায়া – এই দুই-এর দ্বন্দে তার সমস্ত জীবন অশান্ত থেকে গিয়েছিল। পিরসাহেব একটি বালকের কাছে confess করতে বাধ্য হন যে, সমস্ত মুরিদগণ, যাবতীয় এলাকাবাসী বেরাদরে এসলাম তাকে এক ঘোড়ার পিঠে সওয়ার করে দিয়েছে। ওই ঘোড়ার ডানা আছে। বদুপিরের পৃথুল শরীর, সবুজ পাগড়ি, মন্ত্র ও সুরেলা কন্ঠস্বর, মোজেজা দেখানোর তথাকথিত অলৌকিক ক্ষমতা ওই ডানায় প্রবল কম্পন সৃষ্টি করে। তিনি ওপরে উঠতে থাকেন। সাধারণ থেকে অসাধারণ স্তরে তার উত্তরণ হতে থাকে। এখানেই নাচার বদুপিরের তকলিফ। তার কলিজা তো কোনও দিব্যকুসুম নির্মিত নয়, সাধারণ মানুষের মতোই রক্ত আর মাংস দিয়ে তৈরি। ওই হৃদয়ে নারীশরীরের জন্য তীব্র আসঙ্গলিপ্সা জাগে। সন্তানের প্রতি স্নেহ, স্ত্রীর প্রতি কর্তব্য – সবই মনে আসে। অথচ নাচার এক ধর্মবন্দী মানুষ এই তকলিফে ক্রমশ রক্তাক্ত হতে থাকেন। পিরেরা ওড়েন না, শিষ্যরাই তাকে ওড়ায় – বহুল প্রচলিত এই প্রবাদ বদিউজ্জামানের জীবনে পাষাণের মতো সত্য হয়। 

সমস্ত উপন্যাসজুড়েই আছে দৃশ্যমান জগৎ ও অদৃশ্য জগতের সংঘর্ষের কথা। মানুষ বদিউজ্জামান ও সাধক বদুপিরের সংঘর্ষ। কৃষক যেমন বীজ বপনের তীব্র আকাঙ্ক্ষায় মৃত্তিকার দিকে এগিয়ে যায়, কোরানের বাণী মোতাবেক বদুপিরেরও এই গমনেচ্ছা থাকে, অথচ যার প্রতি এই তীব্র কামনা জেগে ওঠে, সে আবদুল কুঠোর বউ, নীল চোখের এক বেশরম আওরত। এই কি সেই হিন্দু স্ত্রীলোক, যার সিঁথিতে টকটকে সিঁদুর ছিল। যাকে আবদুল তার স্বামীর চিতা থেকে তুলে এনেছিল। ইকরাতন। ‘হাম্মালাতুল হাতাব’। এই নারী তার দৈনন্দিন জীবনযাপনের ‘বন্ধুর মাঠের শাদামাঠা কোনও লৌকিক বাস্তবতার কোনও সুক্ষ্ম ছিদ্র দিয়ে’ অলৌকিক এক মায়ানদী হয়। লৌকিক ভালোবাসার কাঙালপনা তার চোখে পরাবাস্তবতার যে অঞ্জন মাখায়, তার ফলে রুক্ষ মাঠের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া একটি নদীর আকাঙ্ক্ষা ক্রমশ তার ধূসর মানসে এমন অবসেশন সৃষ্টি করে যে, শেষ পর্যন্ত ‘ধূসর গোধূলির পটভূমিতে প্রাতিভাসিক বক্ররেখাটি তাকে শিহরিত করত, হঠাৎ আবিষ্কার করতেন সিঁদুরে আভা’। বলা বাহুল্য, এই সিঁদুর ইকরাতন নাম্নী এক প্রাক্তন হিন্দু নারীর সিঁথির উজ্জ্বলতা। আর যখনই বুকের ভেতর প্রথমে খেঁজুরকাঁটা ও পরে দিগন্তব্যাপী মরুভূমির মাঝে কাঙ্খিত শীতল জলের ধারা জেগে ওঠে, ততক্ষণাৎ বদুপিরের বিশাল ফোলানো অবয়ব সবুজ পাগড়িসহ ঢেকে দেয় ওই নদী। ওই দৃশ্য না-পাক, শয়তানের ইন্দ্রজাল – এই কথা ভাবেন পিরসাহেব। চাপা পড়ে যায় রহস্যময় নদী, যা ‘স্নিগ্ধতার অনুপুঙ্খ চাপে যেন বা একটি স্ত্রীলোক’। 

পরাবাস্তবতার কুহকি মায়ায় আক্রান্ত, তবু গোশত্‌ আর খুন দিয়ে তৈরি কলিজা মানুষের উষ্ণ সান্নিধ্য কামনা করে। শরীরের গ্রন্থিগুলো্র হরমোন নিঃসরণ এত জপতপেও কন্ট্রোল হয় না। মায়া ও বাস্তবতার সংঘর্ষ জারী থাকে। 

একটা সাঁকো ছিল। অনেক কালের পুরনো। এই সাঁকো বদিউজ্জামানের জীবনে এক প্রতীক-পিলার। এই সাঁকো ছিল তার জীবনের অনিবার্য স্পষ্টতা। অথচ নিজেকে উঁচুতে তুলে রাখার দরুন এই স্পষ্টতাকে ‘দেখব না’ বলে চোখ ঢেকে রাখতে হয়েছে। এই সাঁকো তার জয় ও পরাজয়ের মিনার। আবদুল কুঠো মারা যাওয়ার পর তার বিবি ‘ডাইন’ হয়ে যায়। ‘নদীতে পিরের সাঁকোর কাছে রাতে নাঙ্গা হয়ে চেরাগ জ্বেলে হিন্দুদের মতো পুজো করে’ – এই সংবাদ বদুপিরের বুকের ভেতর অচানক তুফান তোলে। পুরো মৌলাহাট যখন ফরাজি হয়ে গেছে, তখন হিন্দুদের মতো ‘বুতপরস্থি’ আচার অনুষ্ঠান কোন বেশরম বেতমিজ নাদান আওরত করতে সাহসী হয়। এ তো তার পরাজয়। আবার, এবং অবশ্যই সংবাদবাহক মারফত প্রাপ্ত বাক্যটি তিনি ভিসুয়ালাইজ করেন। তীব্র সত্য চোখ বন্ধ রাখলেও মস্তিষ্কের দর্শনকেন্দ্রে প্রক্ষেপিত হয়। ‘আমার নজর খুলে যাচ্ছে...’ এই নজর আসলে অবদমিত চক্ষু। প্রাণের চাওয়া, অথচ চোখের না চাওয়া – বিখ্যাত গানের সেই লাইন বদুপিরের জীবনে সবচেয়ে সত্য। পাপদৃশ্য যাতে তার সাধনায় বিঘ্ন না ঘটায়, সে জন্য প্রকট দুই চোখ তিনি দুহাত দিয়ে বন্ধ করেন। তবু ভেতরের চোখে তীব্র কামনায় ‘একটি কালো থামের গায়ে দগদগে লাল সিঁদুরের ছোপ’ তিনি অনেক দূর থেকে দেখতে পান। আবার ওই দৃশ্যের বাস্তবতা সম্পর্কে সন্দেহ জাগে। মনে প্রশ্ন উঠে আসে – ‘নাকি দেখতে চাইছি বলেই দেখছি ?’ প্রশ্নবোধক চিহ্নে বদুপিরের সংশয় স্পষ্টই প্রকাশিত হয়। তিনি নিজেও জানেন তিনি দেখতে চেয়েছেন। তার এই শরীর, শরীরের চালক পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মন দেখতে চায় ‘ওই কালো থামের মধ্যে চেহারা নিচ্ছে একটি স্ত্রীলোক, নাঙ্গা আওরত, সিঁথিতে সিঁদুর, আর ওই নদী, চিতার মতো দাউদাউ রোদ...’ 

এখানে ‘নদী’ এবং ‘চিতার মতো দাউদাউ রোদ’ উপমাগুলো ঘুরেফিরে আসে। কারণ আবদুল কুঠো ওই নারীকে তুলে এনেছিল নদীর পারের সাজানো প্রজ্জ্বলিত চিতা থেকে। নদী এবং আগুন থেকে ওই নারীর উঠে আসা। নাঙ্গা আওরতের অনুষঙ্গে সব সময় থাকে সিঁদুর,নদী, মসৃণ উজ্জ্বল কাল থাম, রৌদ্র। ইকরাতন নামের ওই নারী নদী হয়ে জেগে ওঠে বদুপিরের শুকনো কলিজার ভেতর। ‘চিতার মতো দাউদাউ রোদ’ এই উপমা প্রতিষ্ঠা দেয় ইকরাতনের তীব্র ফিরে আসা, সেই আঁচে এক সাধকের ঝলসে যাওয়া। আগুনের অমোঘ শিখা ছারখার করে দেয় তিল তিল করে জমে ওঠা সমস্ত পুণ্যের মহিমা। তখন বদিউজ্জামানকে আর্তনাদ করতে হয় – ‘ আল্লার পবিত্র হাত আমার চোখ ঢেকে দিক।‘ তখন তিনি শরণাগত দৈবের কাছে। তখন তার হাতদুটো অবশ থাকে, তাই পাপচক্ষুদুটো ঢাকার জন্য, ওই দৃশ্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লার কাছে প্রাণপণে পরিত্রাণ প্রার্থনা করেন। ওহাবি হয়েও মোজেজা দেখার জন্য অনুতাপ জাগে। 

হুঁশিয়ারনামা কেতাবে যেমন লেখা আছে, আবদুল কুঠোর বউ ছিল অবিকল সেই বর্ণনার নারী। প্রাক্তন ব্রাহ্মণ ঘরের এই হিন্দু রমণীর চোখদুটো পিঙ্গল, ঠোঁটে ছিল তিল, চঞ্চলা। অবিকল যেন আবু লাহাবের কাঠকুড়োনির বউ। আবু লাহাব ছিল অভিশপ্ত, কারণ সে হাত দিয়ে প্রেরিত পুরুষকে আঘাত করেছিল। পবিত্র কেতাবে সেই গল্প আছে। এদের বিষয়ে কেতাবে হূঁশিয়ার করা হয়েছে। একদিন হঠাৎ জঙ্গলে বদুপিরের মুখোমুখি হয়ে পড়েছিল এই নারী। তার হাতে কাটারি ছিল। সম্ভবত সে কাঠ জোগাড় করতে বেরিয়েছিল। চোখাচোখি হতেই পিরসাহেব দেখলেন সেই পিঙ্গল বর্ণ চোখ থেকে নীল রোশনি ঠিকরে বেরোচ্ছে। তারপর সেই আওরত যখন চলে যাচ্ছে, তিনি যেন দেখলেন একটা ঘুর্ণি বাতাস ওই বেশরম আওরতকে ঘিরে পাক দিচ্ছে। বাতাস খুলে নিচ্ছে তার পরনের সামান্য আবরু। প্রায় নাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে ওই নারী শরীর। চোখ বুজে ফেলেছিলেন বদুপির। 

সত্যি কি হাওয়া উঠেছিল? এই হাওয়া সম্ভবত মানুষ বদিউজ্জামানের মনপবন। উলঙ্গ করে দেখতে চায় ঠোঁটে তিল, কয়রা চোখের চপল এক নারীকে। নাউজুবিল্লাহ্‌। রাগে, দুঃখে, অভিমানে বদুপির ক্রমশ রক্তাক্ত হতে থাকেন। যে কলিজা রক্তমাংস দিয়ে তৈরি, সেই কলিজা ব্যর্থতায় অবসন্ন হয়ে পড়ে। মনে হয়, সব নিষ্ফল। সমস্ত সাধনা, আরাধনা, পাঁচ ওয়ক্ত ছাড়াও অতিরিক্ত নফল-নমাজ অর্জিত সমস্ত নেকি বুঝি বিফলে যায়। এই যে উড়ান, উচ্চাবস্থান, জলদমন্দ্রস্বরে শাস্ত্র ব্যাখ্যার সময় সামনে সারি সারি বিস্ময়বিমূঢ় শ্রাদ্ধাবনত মুখ, তার সঙ্গে কালো জিনের সংঘর্ষ ও সাদা জিনের সৎসঙ্গবাবদ অর্জিত খ্যাতি – সব কিছু বরবাদ হয়ে যায় একটি দৃশ্যের কাছে। ব্রাহ্মনী নদীর ওপরে অনেক কালের পুরনো একটা সাঁকো, পিরের সাঁকো বলে সবাই – সেই সাঁকোর কালো থামের নীচে , রাত্রিবেলা এক পিঙ্গলচক্ষু হরিণী মাথায় প্রদীপ নিয়ে নৃত্য করে। হিন্দু আচার। ওই নারী হিন্দু ছিল। আবদুল ওকে দাউদাউ আগুন থেকে উঠিয়ে এনেছিল। বেপরদা বে-শরম আওরত। 

এই দৃশ্য থেকে নিষ্কৃতি, অথবা যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে তিনি ফতোয়া জারি করেন অই সাঁকো ভেঙে ফেলার জন্য। সাঁকোর পাথরের থাম, যা মসৃণতায় যেন জঙ্ঘা, উদোম – তার হুকুমে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। অই থামে বন্দী ছিলেন অসহায় বদুপির। 

তবু হায়! এবাদতখানায় বসে, অথবা নিশুতিরাতে পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে বদিউজ্জামান অবিকল সিঁদুরের ছাপমারা সেই থাম দেখতে পান। তারপর দৃশ্যের পরিপূরক হিসেবে অবধারিতভাবে সেই অন্ধকারের পটে চিত্রিত হয় এক নাঙ্গা আওরত। চোখ বুজে ফেলতেন। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করতেন – ‘আল্লাহ্‌, শয়তানের জাদু থেকে আমাকে বাঁচাও। নিজেকে অনেক উঁচুতে তুলে রাখতে গিয়ে সংসারী মানুষের হাসিকান্না, আনন্দবেদনা, মিলন ও বিরহের তীক্ষ্ণ গ্রাফগুলো তাই নজরে আসে না। অথচ মাটির কী ভীষণ প্রবল টান। প্রকৃতির সেই অনিবার্য রসায়ন সক্রিয় হয়ে উঠলে তার মনে হয় ওই উচ্চাবচ গ্রাফ আসলে শয়তানের জাদু। তাকে বুঝি আশমান থেকে টেনে নামায়। বা ‘মেনকা’ অথবা ‘মার’। বদিউজ্জামানের ধীরে ধীরে একা হয়ে যাওয়ার দুঃখ, মানুষ থেকে অলীকমানুষ হয়ে ওঠার যন্ত্রণা, লৌকিক জগৎ থেকে অলৌকিকের জগতে নির্বাসনের বেদনা যেন তার নিয়তি ছিল। এই ‘নিয়তি’ তাকে আকাশে ভাসিয়ে রাখে। আবার প্রকাণ্ড এই পৃথিবী শুধু তার জলজঙ্গল, নদীসাগর, পাহাড়পর্বত দিয়ে নয় – এই দুনিয়া তার শত শত কথা, গাছ থেকে খসেপড়া পাতা, নিতান্ত শারীরিক খাহেস – এই সব তুচ্ছ জিনিস দিয়েও তাকে মাটির দিকে টানে। সারারাত ঘুম না আসার কারণ তিনি নিজেই খুঁজে বের করেন। “উঁচুতে উঠে গেলে যেন মানুষের সবটুকু চোখে পড়ে না নিচে থেকে। ওরা ভাবে আমার ঘরগেরস্থালি নেই, স্ত্রীপুত্র নেই, আমি এক অন্য মানুষ। অথচ আমার মধ্যে এই সব জিনিস আছে। টিকে থেকে গেছে সব কিছুই ... আমার কষ্ট, আমার মনে খাহেস। তসবিহ জপে ভুল হয় ... আমার চারদিকে তারপর থেকে হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার, হুঁশিয়ার ... অথচ রাত নিশুতি হলে সেই হুঁশিয়ারির মধ্যেও চাপা হাসিকান্নার মানবিক আর্তি ভেসে আসে ... সারারাত ঘুম আসে না দুচোখে।

অসাধারণ দক্ষতায় একজন সাধক মানুষের যন্ত্রণা চিত্রিত হয় এই উপন্যাসে। পুকুরের পানিতে জ্যোৎস্নার খেলা, পায়রার ডাকের মতো শতসহস্র সাংসারিক কথা তাকে মায়ার বাঁধনে বাঁধতে চায়। পুকুরের পানি ডাকে – আয়। পিরের সাঁকোর কালো মসৃণ স্তম্ভ লালছোপ নিয়ে হাতছানি দেয়। পিঙ্গল চোখের বেপরদা এক নারী, যেন বা এই নারী তারই বুকের বাঁ-পাঁজর থেকে তৈরি – সেও ডাক দেয় আদিম ও রহস্যময় খেলার জন্য। বুকের ভেতরে কাতর পাখি ডানা ঝাপটায় – বদু, আমি বাইরে যাব। তখন সমস্ত চরাচরজুড়ে রাত-পাহারাদার হেঁকে ওঠে – হুঁশিয়ার বদিউজ্জামান, হুঁশিয়ার হো। একটু আগে বুকের গিরিখাতে আসঙ্গলিপ্সায় যে সিংহগর্জন উঠেছিল, এখন হাহাকারে পরিণত হয়। 

এই উপন্যাসে গড়ে ওঠে কামনাবাসনায় পৃক্ত দৃশ্যমান ধুলোবালি ও অদৃশ্য, অথচ শক্তিশালী এক মায়ার ভুবন। লৌকিক-অলৌকিকের সংঘাত, বাস্তব ও অলীকের দ্বন্দ্ব, তীব্র প্রেম ও অপ্রেম – এই সব গতি ও বিরুদ্ধ গতির ফলে ঘুর্ণি তৈরি হয়। এ উপন্যাস অসংখ্য ঘুর্ণির এক চণ্ড-নদী। 

Hatred and vengeance, my eternal portion,
Scarce can endure delay of execution,
Wait, with impatient readiness, to seize my 
Soul in a moment. ( Cowper ) 

“বালক পয়গম্বর যখন রাখাল ছিলেন, হঠাৎ সেই উপত্যকায় নেমে এল দুই ফেরেশতা।তাঁকে ধরে ফেলল তারা। চিত করে শোয়াল। তারপর তাঁর বুক চিরে ফেলে তাঁর কলজে থেকে অসৎ টুকরোটি কেটে নিয়ে সৎ এবং স্বর্গীয় একটি টুকরো জুড়ে দিল। ... এই ঘটনার নাম ‘সিনা-চাথ’ বা বক্ষবিদারণ।“

কিশোর শফিউজ্জামানের ‘সিনা-চাথ’ পর্ব অনুষ্ঠিত হয় উলুশরার জঙ্গলে। নবাব বাহাদুরের দেওয়ান আবদুল বারি চৌধুরি ছিলেন সেই ফেরেশতা। শফির বারিচাচা। একটা হাতির পিঠে চাপিয়ে উলুশরার মাঠে শফিকে নিয়ে গিয়ে যেন এমন কিছুই তিনি করেছিলেন। সেদিন শফি বুঝতে পারেনি কখন যে কলজে বদল হয়ে গেছে। এই ‘সিনা-চাথ’ বুঝতে শফির আরও তিরিশ বছর লেগে গিয়েছিল।

পাঠক জানেন, বারি চৌধুরি সেদিন উলুশরার মাঠে শফির কানে কানে কোন ফুঁসমন্তর ফুঁকেছিলেন। এক স্বাধীনতার কথা প্রকৃতি থেকে এক্সট্রাক্ট করে শফির বুকের ভেতরে চালান করে দিয়েছিলেন বারি চৌধুরি। এলিট, সত্যদ্রষ্টা, নির্মম বারি চৌধুরি। বারিচাচা শফিকে জীবনের অন্য পাঠ দিতে চেয়েছিলেন। অল্প বয়সে বিয়ে এবং প্রথাগত জীবনযাপনের বিরুদ্ধে শফিকে তিনি টেনে বাইরে আনতে চেয়েছিলেন। পির পরিবারের এই ছেলেটিকে তাঁর অন্য রকম মনে হয়েছিল। তাকে প্রকৃতির গোপন-পাঠ, যা মানুষকে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ শেখায় – তেমন কিছু বলতে চেয়েছিলেন। 

হাতির পিঠে চেপে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ‘বারি চৌধুরির কন্ঠস্বর ক্রমশ ভরাট হয়ে উঠছিল ... তোমার সঙ্গে রুকুর শাদির কথা পাকা হয়ে গেছে।‘ এই রুকুকে শফি স্বপ্নের মাঝে দেখত। বোররাখের ছবি, ‘যার মুখ সুন্দরী নারীর, শরীর পক্ষীরাজ ঘোড়ার’ – শফি তার ঘরের দেওয়ালে সেই ছবি দেখতে দেখতে আবিষ্কার করতই মুখ আস্তে আস্তে রুকুর মুখ হয়ে যাচ্ছে। ‘ আমার বুক ঠেলে কান্না আসত, মনে হত কেঁদে ফেলি ... আমার বুকের ভেতর ঝড় বইতে লাগল। রুকুর সঙ্গে আমার শাদি হবে ? এ কি সত্যি ? রুকু আমার বউ হবে এবং সে আমার পাশে শোবে এবং আমি তাকে --- এ কি সত্যি হতে পারে ?’

বারিচাচার মুখে তার সঙ্গে রুকুর শাদির কথা যখন প্রথম শুনল, তখন শফি উলুশরার জঙ্গলে দেখছে ‘নেচার’। দু’চোখের ভেতর দিয়ে প্রাকৃতিক স্বাধীনতা, আসলে যা প্রকৃত স্বাধীনতা, শফির বুকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধিকার করে নিচ্ছিল। সেই মুহূর্তে একটা ‘বদল’-এর খেলা শুরু হয়েছিল। খুব দ্রুত অর্জন এবং বর্জনের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটতে শুরু করে। একঝাঁক বুনোহাঁস কেমন কাশবনের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে, কোথাও একলা কোনও হাট্টিটি পাখি ডাকছে, আর শফি দেখতে দেখতে আবিষ্কার করে ‘এই সব নানা রং-এর নানা ঘটনার টানাপোড়েনে গাঁথা বারু চৌধুরির নেচারকে কেউ বা কিছু এক অগাধ বিষাদে আচ্ছন্ন করে আছে।‘ কুয়াশার মতো বিস্তৃত সেই বিষাদ, হরিণমারার জমিদার বাড়িতে শোনা বেহালার গম্ভীর, করুণ এক সুর। 

উলুশরার বনে একলা একটা শামুকখোল পাখি, একঝাঁক বুনো হাঁসের হঠাৎ উড়াল দেওয়া, হাট্টিটি ডাক – এসব মিলে একটা দুঃখের অবয়ব গড়ে উঠেছিল। নির্জন প্রকৃতির এক মহান স্তব্ধতার ভেতরে পরিপূরক এই সব শব্দ নৈসর্গিক ঘটনামাত্র। কিন্তু শফি দেখে বিষাদ। কোথা থেকে আসে এই বিষাদ? সমস্ত বিশ্বজগতজুড়ে অশ্রুত যে সঙ্গীত বেজে যায়, সে কি অনন্ত দুঃখময় কোনও ballad. রুকু নামের একটি মেয়ে তার নারীশরীর নিয়ে ক্রমশ দূরে যেতে থাকে। আত্মা অধিকার করে কুয়াশার মতো দুঃখের মলিন আবরণ। এই বিষণ্ণতা আজীবন শফির সঙ্গী হয়ে ছিল। পিরজাদা হয়েও নিসিং পন্ডিতের পাঠশালায়, পরবর্তীতে ইংরেজি স্কুলে পড়া শফিকে বারিচাচা ষড়যন্ত্রের ভঙ্গিতে বলতে থাকেন – শফি, তুই এখনও নাবালক। সাদি দিলে তোর লেখা পড়া কিছুতেই হবে না বাবা। ‘ষড়যন্ত্রসংকুল’ উল্লেখিত হলেও স্পষ্ট শোনা যায় বারিচাচার ব্যাকুল স্বর। যেন – জয়লাভ করলেই মহী তোর ভোগের জন্য। যেন – তুই পারবি শফি, হিন্দুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় জিতে মুসলমানের মুখ উজ্জ্বল করতে। তুই আমার বাজির ঘোড়া শফি ... 

বারিচাচা যখন শফিকে এসব শোনায়, তখন এক অদ্ভুত বিষাদময়তার ভেতরে আস্তে আস্তে শফি লগ্ন হতে থাকে। একলা হতে থাকে। একদিকে রুকু, বুজুর্গ পির আব্বাসাহেব, মুরিদমুসল্লিদের শ্রদ্ধা, পিরজাদা হওয়ার দরুণ সামাজিক উচ্চাবস্থান – অন্যদিকে ঘনজঙ্গলের ভেতর দিয়ে দুরন্তবেগে ছুটেচলা একটা বুনো ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হওয়ার আদিম কামনা, অবাধ স্বাধীনতাময় প্রাগৈতিহাসিক বন্যতাকে চিনে নেওয়ার দুরন্ত বাসনা। রূপান্তর পর্ব শুরু হয়ে যায়। হিম-নিষ্ঠুরতার বীজ বপন হয়। 

তখন শফির বয়স ষোলো। শফি তখন অল্প অল্প শরীরের রহস্য বুঝতে শিখেছে। ক্লাসের বন্ধুরা তাকে নারী-শরীরের গভীরগোপন রহস্যের কথা ব্যাখ্যা করে। কিশোর শফির বুকের ভেতরে দুরদুর করে। রুকুর দিকে এই তীব্র আকর্ষণ কামজাত, নাকি এ-ই প্রেম – এই সংশয়ও আসে। রুকুকে মনে হয় ‘আকাশচারিণী পরি ... যার বাসস্থান আকাশের দ্বিতীয় স্তরের পরিস্থানে, যেখানে ফুটে আছে লক্ষকোটি নক্ষত্র দিয়ে গড়া প্রলম্বিত ছায়াপথ।‘ তার আব্বা মহামান্য বদিউজ্জামান যখন শফিকে প্রশ্ন করেন শাদিতে তার সম্মতি আছে কিনা, শফি শুধু বলেছিল -- ‘জি’। চল্লিশ বছর বাদে ফাঁসির জন্য গারদে অপেক্ষমান শফিউজ্জামান ব্যক্তিগত সংলাপাকারে লম্বানেকো শান্ত্রীকে সাক্ষী রেখে সেই ‘জি’ ধ্বনির ব্যাখ্যা শোনায়। সেই শব্দের অর্থ মূর্খ বদুপির শফির সম্মতি মনে করেছিল। অথচ সেই ‘জি’ ছিল অর্থহীন একটি ধ্বনিমাত্র। নিরর্থক শব্দ। কিছু কিছু শব্দ আছে – প্রকৃতিজাত, যা তার জড়ত্বে একান্তই তার, সাংসারিক উপমাহীন সেই সব শব্দের মতো শফি শুধু ‘জি’ উচ্চারণ করেছিল। অথচ সাধারণের মতোই পিরসাহেবেরও ভ্রান্তি ঘটেছিল। তিনি ভেবেছিলেন শফি ‘হ্যাঁ’ বলেছে। চল্লিশ বছর বাদে শফির মনে হয় – ‘ ... যদিও আমি হ্যাঁ বা না কিছু বলতে চাইনি। কারণ তখন আমার দু’পাশে দাঁড়িয়ে ছিল দু’জন। বারুচাচাজি এবং রুকু। আমি ভাবছিলাম কার দিকে যাব – কে আমার প্রিয়।‘

পরদিন বাড়িতে সাদির জন্য সাজো-সাজো রব শুরু হলে শফি পালিয়ে এসেছিল হরিণমারায়। মাকে বলেছিল – ‘আম্মা, আমি চললাম। স্কুল কামাই করলে নাম কেটে দেবে।‘ পরবর্তীকালে এই রুকুর সঙ্গে শাদি হয়েছিল শফির প্রতিবন্ধী বিকৃতকাম দাদা মণিরুজ্জামানের। মনি পাছা ঘষটে ঘষটে হাঁটত, টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করত, তার মুখ দিয়ে লালা গড়াত, সে দুহাতের আঙুল দিয়ে সঙ্গমের মুদ্রা দেখাত, শফির দিকে তাকিয়ে খ্যা খ্যা করে হাসত। ঠিক হয় যে, পিরসাহেবের দ্বিতীয় পুত্র এই মনিরুজ্জামানের সঙ্গে শফির আকাশচারিণী পরির শাদি হবে। 

শফি বলেছে ‘ হঠাৎ একটা জোরালো অভিমান আমার বুকের ভেতর চেপে বসল। সেই অভিমান সূর্য ওঠার আমাকে বলিয়ে দিল – আম্মা, আমি চললাম। যে অভিমানে শফি রুকুর দিকে পিঠ রাখে, বারিচাচার দিকে মুখ রাখে, কৈশোরের সেই অভিমান, অন্তত শফির মতো ক্রমশ একলা-হয়ে-যাওয়া পিরের সন্তান, সম্প্রতি ‘প্রকৃতি যার বোধে তুমুল ওলোটপালট ঘটায়, বিষণ্ণ ‘নেচার’ যার মননে বিস্তীর্ণ হয়, তার ক্ষেত্রে এই অভিমান অত্যন্ত জটিলভাবে ক্রিয়াশীল হতে শুরু করে। 

কেন সে সেদিন রুকুকে অস্বীকার করেছিল ? যার ফল তার জীবনে তাৎপর্যময় এবং সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। আব্বার প্রকাণ্ড ছায়ার বাইরে এসে প্রকৃত রোদ্দুর ডানায় মেখে নেওয়া ? নাকি দু’টি কাঙ্ক্ষিত বস্তুর ভেতরে যখন একটি পাওয়ার জন্য অন্যটি বর্জন করতে হয়, তখন সেই না-পাওয়া বস্তুর জন্য অবিরত গোপন কান্না, নিষ্ফল অভিমান এবং কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর এই দায় চাপিয়ে দিতে না পেরে সমস্ত পৃথিবীর প্রতি ক্রোধ? এবং এই ক্রোধ পরিবর্তিত হয় ঘৃণায়। এই উপন্যাস শুরু হওয়ার আগে সৈয়দ সাহেব মুখবন্ধ হিসেবে H.G.Wells-এর কয়েকটি লাইন উল্লেখ করেন, যার প্রথম লাইন – Hatred is one of the passion that can master a life …

ঘৃণা জন্ম দেয় ঘাতক সত্তার। শফির ফিলসফি – জড়ের অভ্যন্তরীণ শক্তির মুক্তি। যে মুক্তিবেগ সে নিজেও সংবরণ করতে পারেনি। প্রকৃত সৌন্দর্য, যা স্বভাবত প্রাকৃতিক, সেই সৌন্দর্য সে আগ্রাসী ক্ষুধায় আত্মসাৎ করতে চেয়েছে। যে স্বাধীনতা আরোপিত নয়, স্বতঃ – “ এখানে যা আছে, তা প্রকৃতিসৃষ্ট এবং স্বাভাবিক, এইসব উদ্ভিদ, পাখি, প্রজাপতি, শিশির, পোকামাকড়, চতুষ্পদ যাবতীয় প্রাণী কী অবাধ, স্বাধীনতাময়।“ সেই স্বাধীনতার দিকে তীব্র আকাঙ্ক্ষা শফির আপাত-নির্লিপ্তির ভেতর সমস্ত জীবন ধরে ভয়ানক ভাবে সক্রিয় ছিল। এই স্বাধীনতার ধারণায় সিতারা, স্বাধীনবালা, রত্নময়ী ছিল তার দ্বারা defined, মুক্ত-সৌন্দর্য। এই definition থেকে যখনই এইসব নারীরা সামান্য মানুষের হাতে বন্দী হয়ে সংজ্ঞাচ্যুত হয়েছে, তখনই ‘ঘাতক সত্তা’ আড়মোড়া ভাঙে। শফির লজিক বলে –“সে বধ্য প্রাণী, যেহেতু সিতারাকে গৃহস্থালীর আসবাবে পরিণত করিয়াছে, এবং প্রেমহীন করিয়াছে বলিয়াই কাল্লু সিপাহি বধ্য ছিল

এই কাল্লু ছিল সিতারার স্বামী। আর সিতারা ছিল প্রকৃতির অন্তর্গত এক সৌন্দর্য, যে একদিন নদীতে মৎস্যকন্যার মতো সাবলীল সাঁতার কাটতে কাটতে শফিকে ডাক দিয়েছিল –“ আও শফিসাব, খেলুঙ্গি”।

শফির ভেতরে এই ঘাতক-সত্তার উন্মোচন, ধর্মদ্রোহিতা, নৈরাজ্যবাদী চেতনার সংক্রমণ – কোনও কোনও সময় মনে হয় যা প্রার্থিত ছিল, সেই বস্তু না পাওয়ার জন্য তীব্র অভিমান এবং ক্ষোভের ফল। না। এই চিন্তা স্থূল ব্যাখ্যা হয় বটে, কিন্তু সমগ্র উপন্যাসের মূল ধারণা থেকে আমাদের ভুল পথে চালিত করবে। এই উপন্যাসে ‘নাস্তি’ এক ভয়ানক অভিঘাত তৈরি করেছে। অধরা সৌন্দর্য, স্বাধীনতাময় প্রকৃতি, স্থিতিজাড্য ও গতিজাড্যের অবিরাম সংঘর্ষ এবং জড় ও চেতনের দ্বন্দ্ব -- এসব কিছু যেন একটা মোড়কে বন্দী করে বলা হয় – এই দেখো, কিছু নেই। সমস্ত জীবনব্যাপী শফি চেষ্টা করে গেছে ওই মোড়ক পাহারা দিতে। আর যে হতভাগা নিতান্ত সহজ সাংসারিক নিয়মে অধরাকে দৈনন্দিন ব্যবহারে আবিল করতে চেয়েছে, মায়া-মঞ্জুষা খুলে দেখতে চেয়েছে, প্রকৃতিকে গৃহস্থালীর উপাদানে পরিণত করতে চেয়েছে – শফি তাকে শাস্তি দিয়েছে। H.G.Wells কথিত justice এবং Revenge এভাবে একজন প্রেমিক demonstrate করে। 

খয়রাডাঙা ছেড়ে সেকেড্ডো মখদুমনগরে যাওয়ার পথে কয়েকটি ঘটনা ঘটে। বদিউজ্জামান এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারতেন না। শিষ্যবর্গকে কাঁদিয়ে ঠাঁইনাড়া হয়ে স্মভবত এক ধরণের আত্মসুখ অনুভব করতেন। তিনি ছিলেন ফরাজি ধর্মগুরু, হাতদুটো নাভির ওপর রেখে নমাজ পড়তেন। তাঁর জোরালো উদাত্ত কন্ঠস্বরে ফজরের আজান শুনে সমস্ত গ্রামের ঘুম ভেঙে যেত। তারপর একদিন সমস্ত ভক্তবৃন্দকে অনাথ করে অন্য গাঁয়ে গিয়ে ডেরা বাঁধতেন। 

তো সেবার তাদের সাতটি গোরুর গাড়ির কাঁরবা গন্তব্যে পৌঁছয়নি। বদিউজ্জামানকে মৌলাহাটের মোমেনবৃন্দ আটকে দিয়েছিল। কারণ তাদের চোখে ছিল ‘ঐশী নিদর্শন অনুসন্ধানের আকুলতা’। কারণ তারা একখণ্ড পাথরের ওপর মৌলানাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেবেছিল –‘চৈত্রের নীলধূসর আশমানের গায়ে আঁকা সাদা আলখাল্লা আর সাদা পাগড়িপরা ওই মানুষটি দুনিয়ার নয়’। এরপর খুব দ্রুত পুরো মৌলাহাট ফরাজি হয়ে যায়। কারণ ‘ তিনি পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে প্রথম যে ভাষণটি দিয়েছিলেন, সে সম্পর্কে পরে মৌলাহাটের মুসলমানদের কাছে শোনা যায় যে, হুজুর নাকি তাদের কানে গরম সীসার মতো কিছু ঢেলে দিয়েছিলেন।‘ আর কিশোর শফি পুরো দল থেকে একা হয়ে মৌলাহাটের পুকুরপারে গিয়ে দেখল দিলরুখ আর দিল আফরোজ, যমজ দু’বোন বুকে পেতলের কলসি নিয়ে সাঁতার কাটছে। 

সাতটি গোরুর গাড়ির সেই ক্যারাভ্যান অনেক ঝোপজঙ্গল,উলুশরার মাঠ, শুকনো নদীখাত পার হয়েছিল। এই পথে একটি কালোমানুষ তাদের ভুল পথ দেখিয়ে বিপদে ফেলেছিলেবং একটি সাদামানুষ তাদের সঠিক পথের নিশানা বলে দিয়েছিল। স্পষ্টই বোঝা যায়, গাঁয়ের এক রোদেপোড়া কালো চাষাভুষো এবং একজন অ্যালবিনো ‘যার ভুরু এবং চোখের পাতা পর্যন্ত সাদা ছিল’, তারাই এসব কাণ্ড ঘটায়। কিন্তু শফি নিশ্চিত ছিল সাদাজিন ও কালোজিন বিষয়ে। 



সুন্দরের সঙ্গ যদি চাও, জীবনে মরণে তুমি একা। ( হিমেনেথ, অনুবাদঃ শঙ্খ ঘোষ) 

সেই দীর্ঘসফর শফির মনে চিরিস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিয়েছিল। সেই প্রথম শফি যেন ‘strange liberty’-এর স্বাদ পাচ্ছিল। এই পথে সে প্রথম একাকীত্ব টের পায়। ‘তখন শফির মন ভারাক্রান্ত, মগজে অন্য দুনিয়ার ঝড়’। বোঝা যায় শফি ধর্মীয় আবহাওয়ায় বড় হতে থাকলেও তার সত্তায় এমন ধাতু কাজ শুরু করে দিয়েছিল, মৌলানা বদিউজ্জামানের পুত্রকে যা মানায় না। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য ছিল সেই ধাতু। 

মৌলাহাটে সবাই যখন মওলানা এবং তার পরিবারকে নিয়ে ব্যস্ত, তখন শফি হঠাৎ একা হয়ে পড়েছিল। এই মহান আপ্যায়ন-পর্বে শফিকে কেউ গণ্যই করেনি। ভীষণ একা। তার খুব অভিমান হয়েছিল। ‘তারপর বাকি জীবন সে একা হয়েই বেঁচে ছিল। জীবনে বহুবার অস্থিরতার মধ্যে ক্রুদ্ধ ক্ষিপ্ত শফিউজ্জামানের আশ্চর্যভাবে মনে পড়ে যেত মৌলাহাটের দক্ষিণপ্রান্তে শাহি মসজিদের নীচে প্রকাণ্ড বটতলায় একা হয়ে পড়ার ঘটনাটি’। সেদিন যেন সবাই তাকে ভুলে গিয়েছিল। তারপর থেকে ভুলেই রইল। 

সেই সফর ছিল প্রকৃতির কাছে শফির প্রথম পাঠ। প্রথম সমর্পণ।সেদিন সে সম্পূর্ণ ‘নতুন আর অচেনা দুনিয়ায়’ ঢুকে পড়েছিল। ঘাসফড়িং, হনুমান, বটের চিকন পাতার দুলে ওঠা, ঝাঁকে ঝাঁকে প্রজাপতি, একটা খরগোশ। ‘শফি বুঝতে পারছিল এটা মানুষের দুনিয়া নয়’। শফির মনে হচ্ছিল ধু ধু মাঠে, জঙ্গলের বাতাসে একটা সম্মোহনী আরক ছড়ানো রয়েছে। শফির অজান্তেই সম্মোহন-ক্রিয়া শুরু হয়েছিল। সমস্ত NATURE, যাকে শফি তখনও রপ্ত করে উঠতে পারেনি, সমস্ত শক্তি দিয়ে শফির বুকের ভেতরে ঢুকে পড়ছিল। আরকের অণুর ফাঁকে ফাঁকে যে আন্তর-আণবিক ব্যবধান থাকে, সেই ফাঁকফোকরে মিশে যাচ্ছিল শফির অস্তিত্ব। জলে যেমন চিনি মিশে গেলেও গ্লাসে জলতলের উচ্চতা বাড়ে না, তেমনি সেই প্রকৃতি আগের মতোই থেকে যায়, কিন্তু ভ্রমণের পর শফির মগজে জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। বাদবাকি জীবন সে এই নেচারকে রক্ষা করার চেষ্টা করে গেছে। এই নেচারকে যে ছুঁতে চেয়েছে নোংরা হাত দিয়ে, তার জীবনজোড়া বিষণ্ণ গীতিময়তায় যখন কোনও অবাঞ্ছিত স্বর প্রবেশ করেছে – শফিউজ্জামানের সেই ধাতু হঠাৎ জেগে উঠেছে। যেন এ সব কিছুর স্ব-নির্বাচিত পাহারাদার সে-ই। কুমারী প্রকৃতির স্বনিযুক্ত রক্ষাকর্তা। প্রাকৃতিক স্বাধীনতায় যে মূর্খ হাত দিয়েছে, শীতল নিষ্ঠুরতায় তাকেই সে হত্যা করেছে। ফ্রয়েড-ইয়ুং, ডারউইন-ল্যামার্ক, মার্ক্স-এঙ্গেলস-এর ছুরি দিয়ে এ উপন্যাস ব্যবচ্ছেদ ঘটালে শফির মনোজগত বিষয়ে ভুরি ভুরি তত্ব পাওয়া যাবে, কিন্তু তার পরেও কিছু বাকি থাকে।

শফি বলছে -- “ বইটির পাতা উলটেই একটা বাক্য চোখে পড়ল। চমকে উঠলাম। ‘স্ট্রেঞ্জ লিবার্টি’। সত্যই তাই। আমিও প্রকৃতিতে যাই এবং ফিরে আসি অদ্ভুত স্বাধীনতা নিয়ে। সেই স্বাধীনতা প্রকৃতিরই অংশ’। অন্য জায়গায় শফি আবার – “ আমি ধার্মিক নই ... বারিচাচাজি সেই যে কবে আমার মাথায় ‘নেচার’ ঢুকিয়ে দিয়েছেন, তাই আমায় গিলে খেয়েছে। ব্রাহ্মধর্মের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায় নাকি ছেলেবেলাতেই পরম সত্য টের পান। আমিও কি পেয়েছিলাম ? সেই সেদিন উলুশরার মাঠে গাড়ির সারির পেছনে আসতে আসতে একলা হয়ে গেলাম, আর তৃণভূমিতে প্রকৃতির রহস্যময় সঙ্গীত শুনতে পেলাম

WHOSE HEART-STRING ARE A LUTE 

মানুষ কি তার নিজের রহস্যময়তা টের পায় ? মানুষ কত সহজে ভুলে যায় তার ইহশরীর, বড় আদরের এই শরীর আসলে আকাশবাতাস, তেজোময় শক্তিকণা, জল, মাটি দিয়ে তৈরি। মৃত্যুতে তো উপাদানের পরিবর্তন মাত্র। জড় ও জীবের ক্রমাগত পরিবর্তন এই জীবন-প্রবাহ। প্রকৃতিকে মানুষ কেমন করে ভুলে থাকে। যদি এই পৃথিবীতে শুধুই জীবন থাকত, কণামাত্র জড় নেই কোথাও, তবে চেতন ও অচেতনের দ্বন্দ্বে জীবনের যে লীলাময়তা ফুটে ওঠে, যথার্থ অর্থে জীবন বিকশিত হয় – কেমন করে সেই সুর বেজে উঠত ? শফিউজ্জামান প্রকৃতির ভেতর সেই সুর শুনতে পেয়েছিল। কে বাজায় ভুবন-দুলিয়ে-দেওয়া পরমসঙ্গীত ? মানুষ বড় বেশি সাংসারিক শব্দে সেই ধ্বনি, বিপুল তরঙ্গময় সেই বীণা শোনে না। আর যে শোনে, তার বড় তকলিফ হয়। এই সঙ্গীত কুয়াশার মতো তার মগ্ন-চৈতন্যে ছড়িয়ে পড়ে। এই সঙ্গীতের সুর দিব্য অথচ বিষাদময় রাগরূপ তৈরি করে। সে একা হয়ে যায়। সে আর এই সংসারের থাকে না। শফি উলুশরার মাঠে প্রথম সেই সুর শুনতে পেয়েছিল। অনন্ত দুঃখের পাষাণ-ভার সেদিনই তার বুকে চেপে বসেছিল। এই পীড়ন দুঃসহ হলে মানুষ চিৎকার করে ওঠে – কেন জন্ম, কেন নির্যাতন ( শংকর চট্টোপাধ্যায় ), তখন গোপনে স্বীকারোক্তি – বিশ্বাস করুন/ এই জন্ম গোগ্রাসে আমার রক্তমাংস খাচ্ছে (শংকর চট্টোপাধ্যায় )। পাতালছায়ার আড়ালে সামান্য একটা ফড়িং-এর ডানার কম্পন, বটের চিকন পাতার বাতাসে দুলে ওঠা – এসব কড়ি ও কোমলে বাজতে থাকে। ‘পরম সত্য’ খুঁজে ফেরেন কনফুসিয়স, সোক্রেতেস, গৌতম বুদ্ধ, সুফি সাধক। শফির সিনা-চাথ হওয়ার আগেই তার কানে মন্ত্র পড়েছিল যে, আকাশপরিধিজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সেই নিহিত পাতালছায়ার গভীরে টানটান বাঁধা ছিল তন্ত্রী। উলুশরার মাঠে হাওয়া উঠেছিল। একটি হাত অসম্ভব সুরেবাঁধা সেই তার ছুঁয়ে দিয়েছিল। whose heart-strings are a lute. সেই হাত এগিয়ে এসে শফিকে বলেছিল – এই নাও, তোমাকে দুঃখ দিলাম। যদি strange liberty চাও, তবে তুমি একা। তোমাকে দিলাম বিষাদ-সিন্ধুর অতলান্ত গভীরতা। এই গভীর থেকে দম নেবার জন্য যখনই শফিকে ওপরে আসতে হয়েছে, যখনই একাকীত্বের পীড়ন দুঃসহ হয়েছে, একটি করে বহ্ন্যুৎসব হয়েছে। 

দ্রষ্টাকবি বোদলেয়র বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর লেখায় পাওয়া যায় –‘ তার বিষাদ পরিণত হয়েছে বিতৃষ্ণায় – শুধু জগতের প্রতি নয়, তার নিজেরও প্রতি; এবং বিতৃষ্ণা থেকে সঞ্জাত হয়েছে নির্বেদ ... যার প্রভাবে সময়ের মন্থরতা অসহ্য হয়ে ওঠে, নিজেকে মনে হয় নামহীন ত্রাসে পরিণত এক শিলাখণ্ড মাত্র। 

শফির জীবনচক্রের সঙ্গে আশ্চর্য সাদৃশ্য বোদলেয়ারীয় দর্শনের। রুকুকে না পাইবার যন্ত্রণা ইত্যাদি ক্লিশে ভাবনা সরিয়ে রাখলে দেখা যায় বারি চৌধুরি নামের একজন নিপুণ শল্য-চিকিৎসক সেদিন শফির বুকে সফল অস্তর করেন। তার কলিজা থেকে স্থূল আবেগ কেটে বাদ দেওয়া হয় এবং ‘নেচার’ নামক ব্যাপ্তি জুড়ে দেওয়া হয়। ইহাই সিনা-চাথ। এই ব্যাপ্তিই শেষ পর্যন্ত শফিকে অধিকার করে নিয়েছিল। ধর্ম বিষয়ে শেষ পর্যন্ত তার এই ধারণা হয় – “ জিনগ্রস্তের মতো একলা, জনহীন কোনও স্থানে থুথু ফেলে মনে মনে বলি, ঘৃণা ধর্মকে – যা মানুষের মধ্যে অসংখ্য অতল খাদ খুঁড়েছে। ঘৃণা, ঘৃণা এবং ঘৃণা। ধর্ম নিপাত যাক। ধর্মই মানুষের জীবনে যাবতীয় কষ্ট আর গ্লানির মূলে। ধর্ম মানুষকে হিন্দু অথবা মুসলমান করে। ধর্ম মানুষের স্বাভাবিক চেতনা আর বুদ্ধিকে ঘোলাটে করে। তার চোখে পরিয়ে দেয় ঘানির বলদের মতো ঠুলি।“

শফি ধর্মকে ঘৃণা করতে শিখেছিল। শিখেছিল বললে ভুল হবে। এই ঘৃণা একশ কুড়িদিন পরপর শরীরে লোহিতকণিকাদের মতো তার শরীরেও জন্ম হচ্ছিল। এ উপন্যাসে শরীরের কথা অনেকবার এসেছে। শফির প্রথম নারীশরীর গ্রহণের অভিজ্ঞতা সংক্ষিপ্ত অথচ তীব্র কৌশলে লেখা হয়েছে। তার হরিণমারার স্কুলে পড়ার সময় সহপাঠি রবি তাকে শরীরের রহস্য বোঝাত। অই সময়ে নারীশরীরের বঙ্কিমরেখার রহস্য মনে অনেক ফ্যান্টাসির জন্ম দেয়। শফি তখন রুকুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখত। প্রথমবার অনাত্মীয়া যুবতীর উন্মুক্ত স্তন দেখার অভিজ্ঞতা এবং প্রতিক্রিয়া এবং পরে আসমার সঙ্গে মিলনের কথা আছে। এ কথাটি খেয়াল রাখা দরকার, কারণ আসমাকে তো সে নিজেই কলুষিত করেছিল, তবু কোনও ঘাতক প্রবৃত্তি তো জাগেনি। বরং সে নিজেই ‘প্রাকৃতিক স্বাধীনতার এই হঠকারিতায়’, শরীরের কাছে আত্মার পরাজয়ে তার মস্তিষ্ক থেকে শরীরকে আলাদা করে নিয়েছিল। তার কাছে হঠাৎ অপরিচিত মনে হয়েছিল তার নিজেরই শরীর। ‘আসমার শরীরে আমার শরীর মাথা কোটার ভঙ্গিতে আছড়ে পড়ছিল। হায় শরীর ! মানুষের হারামজাদা শরীর ! শুয়োরের বাচ্চা শরীর’। দেহমিলনের বর্ণনায় কোনও প্রচলিত উপমা নয়, ‘ মাথা কোটার ভঙ্গি’ এই তুলনা শরীরের কাছে শফির অসহায় সমর্পণ এবং পরাজয়ের ব্যাখ্যা ছাড়া আর কিছু নয়। জীবনে একবার অন্তত শফি টের পায়, শরীর কখনও কীভাবে বেইমান হয়ে ওঠে। সব প্রতিরোধ ভেঙে দিয়ে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ হয়ে যায় এই শরীর। 

কিন্তু এসব তো ভূমিকামাত্র। যে ‘সৌন্দর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলে মৃত্যুর কাছে উৎসর্গীকৃত হতে হয় ‘(প্লাতিন, জার্মান কবি), আসমাক্কে শফি কখনও-ই সেই আসনে বসায়নি। সিতার, স্বাধীনবালা বা রত্নময়ী ছিল সেই প্রকৃতির অন্তর্গত রহস্যময় সৌন্দর্য। অথচ আসমার ক্ষেত্রে – ‘মনে হল সৌন্দর্য বা লালিত্যের তুলনায় আসমার হাতখানি ঈষৎ রুক্ষ আর শক্ত। স্রমজীবী নারীর হাত’। আসমাকে গ্রহণ করে শফি শুধুমাত্র শরীরের হঠকারিতায় বিমূঢ় হয়েছিল। 

সিতারা ছিল কাল্লু পাঠানের বউ। নবাব বাহাদুরের দেওয়ান আবদুল বারি চৌধুরির বরকন্দাজ ছিল কাল্লু পাঠান। লালবাগে নবাব বাহাদুর ইন্সটিটিউশনে ভর্তি হওয়ার জন্য ওরা রওনা হয়েছিল। পথে ইন্দ্রাণী মহালে পৌঁছে শফি খবর পেল রুকুর সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেছে তার অর্ধপশু দাদা মনিরুজ্জামানের। সেখানেই এক সন্ধ্যায় আসমার সঙ্গে তার প্রথম যৌন-স্বাধীনতার আস্বাদ। লালবাগে আসার পর খুব দ্রুত তার রূপান্তর পর্ব শুরু হয়ে যায়। সেখানেই একদিন পান্না পেশোয়ারিকে ইট মেরে শফি লালবাগ ছেড়ে পালিয়েছিল। এই লাইনটি পড়ার সময় আমার অবধারিত ভাবে মনে হয়েছিল এই নামের কোনও বিকল্প হয় না। ‘পান্না’ শব্দে যেন খনিজ কাঠিন্য, ‘পেশোয়ারি’ শব্দ যেন ‘পেশল’ শব্দেরই অনুগ। বিবিমহল্লার দেখভাল, সেলামি আদায় ছিল সমকামী পান্নার পেশা। এই পান্নাকে শফি ইট মেরে পালিয়েছিল। অনেক পরে জানা যায়, তার ঘিলু বেরিয়ে গিয়েছিল। 

সিতারা একটা খেলায় শফিকে জড়িয়ে দিয়েছিল। পান্নার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য শফিকে তাতিয়েছিল সিতারা। পান্নার সমকামিতা, বিবি মহল্লায় মাস্তানি, পান্নার জন্য সিতারার বিপন্নতা একটা চরম বোঝাপড়ার লক্ষে শফিকে বলেছিল – আঘাত করো। এই ঘটনা শফির জীবনে বারে বারে ঘটেছে। প্রকৃতির স্বাধীনতার অন্তর্গত সিস্টেমে যে আঘাত করেছে, disintegrate করার চেষ্টা করেছে, অই রহস্যময়তাকে ছুঁতে চেষ্টা করেছে – সেই মুহূর্তে বিষাদময় এক কুয়াশার ভেতর থেকে ‘নামহীন ত্রাসে পরিণত এক শিলাখণ্ড’ জেগে উঠেছে। H.G.Wells—সেই justice আর revenge, বিদ্রোহী ঘাতক সত্তা জেগে উঠেছে। 

এই সিতারা ‘মনুষ্যভোগ্য নহে’ – এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল শফি। ‘উহা প্রকৃতির অন্তর্গত’। একদিন বিকেলে কেল্লা নিজামতের পেছনের গঙ্গায় সাঁতার দিতে দিতে সিতারা শফিকে ডাক দিয়েছিল –‘ আও শফীসাব খেলুঙ্গি।‘ শফি সে ডাকে সাড়া দেয়নি। কারণ –‘ আমি যদি জলে ঝাঁপ দিতাম, ও নষ্ট হয়ে যেত’। স্বর্ণময় সৌন্দর্য ছুঁয়ে দিলে মোহাবরণ খসে যায়। কনক-বিভা নিতান্ত পাউডারে ও যা ছিল তেজস্ক্রিয়, অস্পৃশ্য, উজ্জ্বল ধাতু, সেটি disintegration-এর ফলে শেষ পর্যন্ত সিসায় পরিণত হয়। 

সেই সিতারাকে বহুদিন পরে শফি আবার যখন দেখল, তখন সিতারা দৈনন্দিন ব্যবহারে ধূসর। তখন সে আর আশমানের সিতারা নয়, লেখক তাকে উল্লেখ করেন – সিপাহী বধূ। মুহূর্তে সেই বোঝাপড়ার আকাঙ্ক্ষা শফির বুকের ভেতর জেগে উঠল। সিতারাকে যে সিপাহী বধূ বানায়, সে অবশ্য বধ্য। ‘চোখের সে দীপ্তি কই? সুরমার টান আছে, কিন্তু দৃষ্টিব্যাপী ধূসরতা। কন্ঠার হাড় ঠেলে উঠেছে। শফি কুরশিতে বসল, কিন্তু মুহূর্তে অনুমাণ করল কাল্লু এগুলো কেল্লাবাড়ি থেকে আত্মসাৎ করেছে। যথেষ্ট, যথেষ্ট। এই চ্যুতি, System-এর পরাজয়ে শফির বোদলেয়ার কথিত ‘শহীদ ও ঘাতকের আবেশ জাগ্রত হয়ে উঠল। 

মৃত্যু নয়, শফি চেয়েছিল জীবন ও মৃত্যুর এক সম্বন্ধস্থাপন। কিন্তু আমরা দেখি জীবনের শেষ। শফি দেখে রূপান্তর। তার কোনও পাপবোধ জাগে না। লম্বা-নেকো সেপাই দেখে গারদের ভেতরে শফির একা একা কথা বলা। সিতারার জন্য বধ হয়েছিল কাল্লু পাঠান আর পান্না পেশোয়ারি। স্বাধীনবালার জন্য স্ট্যানলি-হত্যা সংঘটিত হয়েছিল। আর রহস্যময়ী রত্নময়ীকে মুন্সিজি শফির থেকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন। শফির কাছে জানতে চেয়েছিলেন –‘কেন এসেছ তুমি? কীসের জন্য? ... বৃদ্ধের এই স্পর্ধা ‘শিলাখণ্ডকে আবার চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করাল। সম্ভবত ‘বেশি জানতে চাইলে মাথা খসে যায়’ এই নোটিস বৃদ্ধের জানা ছিল না। ‘চূড়ান্ত প্রশ্নের দিকে ধাবিত হওয়ার দরুণ এক সেমেতীয় বৃদ্ধ নিহত হন। 

এই চূড়ান্ত প্রশ্নের দিকেই তো শফির ক্রমাগত অণ্বেষণ ছিল। এই চূড়ান্ত প্রশ্নই ছিল শফির গোপন ত্রাস এবং সংসারের মলিনতা থেকে দূরে, বিষাদময় কুয়াশায় লুকিয়ে রাখা সম্পদ। অথচ বৃদ্ধ আবিল হাতে ছুঁতে চেয়েছিল ওই স্বর্ণময় নিস্তব্ধ যন্ত্রণা। একটা বোঝাপড়ার সামনে শফির অস্ত্র উদ্যত হয়, সত্যিই বৃদ্ধের মুণ্ডু খসে পড়ে। বৃদ্ধ দার্শনিক সম্বন্ধে শফির আরও সন্দেহ ছিল – ‘যে রত্নময়ীকে সে একটু আগেই দেখেছিল পুজোর নৈবেদ্য নিয়ে চলেছে, শরীরে পিচ্ছিল গরদ, অনাবৃত পীত দুই বাহু’ ... শফি নির্নিমেষ দর্শন করে সেই রূপ অথবা মায়া ... অথচ কিছুক্ষণ বাদে যখন ... প্রাচীন দেওয়াল থেকে টেরাকোটা রূপ ত্যাগ করে জীবন্ত হয় অর্থাৎ মায়া বর্জন করে নিতান্ত লৌকিক হয়ে ওঠে, তখন শফির সন্দেহ দৃঢ় -- ‘মুন্সি আবদূর রহিম, আপনার কারচুপি সবই। সেই মুহূর্তেই বৃদ্ধের মৃত্যু সুনিশ্চিত হয়। কারণ সেই বৃদ্ধ মায়া-জগৎ থেকে রত্নময়ীকে নিতান্ত এক লৌকিক নারীতে পরিণত করে। মূর্খ প্রকৃতির স্বাধীনতায় হাত দিয়েছিল। 

দীর্ঘ, প্রায় একশ বছরের সামাজিক পট পরিবর্তনের ইতিহাস ছুঁয়ে ছুঁয়ে মূলত একটি পরিবারকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাস। কখনও সলিটারি সেল-এ শফির আত্মকথন, কখনও বদিউজ্জামানের বয়ান, জেলা-সমাচার বার্তার রিপোর্টিং-এর আড়ালে, পুরনো দলিলদস্তাবেজ, শেষ পর্বে বৃদ্ধা দিলরুখ বেগম ও নাতিনাতনিদের মধ্যে কথোপকথনের মাধ্যমে এই উপন্যাসের নির্মাণ। দিলরুখ(রুকু) বেগমের আত্মবিলাপের ঢং-এ তার প্রতিবন্ধী স্বামীর কবরের সামনে confession পর্বের শেষে তিনি মারা যান। মৃত্যুর আগে নির্জনে প্রকৃতিগত পারিপার্শ্বিকের শব্দসমূহ হঠাৎ অর্থবহ হয়ে উঠেছিল। এই তো শফি ফিরে এল। ওই তো শফির কন্ঠস্বর। শফি, তার শ্বশুরের ছোটপুত্র। অনেকদিন আগে ষোলো বছরের কিশোর শফিকে পুকুরঘাটে প্রথম দেখেছিলেন। তিনি তো ওই কিশোরের জন্যই নির্দিষ্ট ছিলেন। শফির সঙ্গে তার শাদি হয়নি। এমন কী, ফাঁসি হওয়ার পর তার লাশ পর্যন্ত মৌলাহাটে আসেনি। শফি তাকে ফেলে চলে গিয়েছিল অনেক দূরে। মৃত্যুর আগের মুহূর্তে ‘ল্যাংড়াভ্যাংড়া’ স্বামীর কবরের সামনে বসে বৃদ্ধা যখন সেই স্বামীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছেন, তখন সমস্ত ঘাস, ফড়িং, লাইম-কংক্রিটের চাঙড় – এসব ঘিরে পাক খায় একটা বাতাস। চুপচাপ, ফিসফাস উচ্চারিত শব্দগুলো বহন করে শফির নির্ভুল কন্ঠস্বর – রুকু রুকু রুকু ...

এক একটি স্তরের ভেতর দিয়ে শফির ক্রমশ রূপান্তর এবং সেই সূত্রে উপন্যাসের পর্বান্তরের মধ্য দিয়ে ঊনিশ-বিশ শতকের একটি পির পরিবারের অবস্থান, সামাজিক পট-পরিবর্তন, মুসলিম সমাজ, ব্রাহ্ম সমাজ, বিপ্লবী কর্মকাণ্ড – এসব কিছু এমন নিপুণ ভাবে বিন্যস্ত যে, পাঠকের পক্ষে সময়ান্তর কোনও সমস্যা সৃষ্টি করে না। সমস্ত উপন্যাসজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য আরবি, ফারসি শব্দ উপন্যাসের গতিকে কখনও বিঘ্নিত করেনি, বরং প্রার্থিত আবহ বিস্তারে প্রসাধন কর্মই করেছে। এ উপন্যাসে ওইসব শব্দের কোনও বিকল্পের কথা ভাবাই যায় না। 

হিন্দু পাঠকের কাছে এই উপন্যাস আশ্চর্য জানালা খুলে দেয়। অচেনা, অজানা দৃশ্য ফুটে ওঠে পরিচিত আয়নায়। বিস্ময় জাগে। এই বাংলার বাংলা ভাষার পাঠক, বিশেষ করে পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছেন যারা, তাদের কাছে মুসলমানী সাধারণ সমাজ, তাদের আদবকায়দা, তাদের বিশেষ আচারব্যবহার অপরিচিত নয়। কিন্তু একজন মৌলানা ও তার পরিবারকে কেন্দ্র করে প্রতিটি খুঁটিনাটি, বিশেষভাবে পালনীয় ধর্মীয় আচরণ, হিন্দুদের তুলনায় শিক্ষিত মুসলমান সমাজের পিছিয়ে পড়ার আক্ষেপ, ধর্মের প্রতি আনুগত্য এবং পির পরিবারের অন্তঃপুরের ব্যক্তিগত হাসিকান্না এমন নিপুণ Details-এ বর্ণিত যে, পাঠকের কাছে অপরিচিত জগৎ বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে শুধু বয়ন কৌশলে। ইসলামিক শাস্ত্র থেকে কাহিনির প্রয়োজনে অনেক টুকরো ঘটনার উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু তার মর্মোদ্ধারের জন্য কোনও পাঠককে আলেম বা ফাজিল হতে হয় না। অসংখ্য শাস্ত্রীয় বচন, প্রবচন, ঐশী ঘটনার প্রয়োগে মানুষের জীবনের কথাই বলা হয়েছে। 

একটি কাহিনি তখনই পাঠকের বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে, যখন পাঠক ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে কাহিনির সত্য যাচাই করে। এ উপন্যাস পড়তে পড়তে “ যাঃ এ রকম হয় না” এ রকম ভাবনার কোনও অবসরই নেই। এ উপন্যাসের অবয়বে আমাদের লৌকিক জীবনের সমস্ত উপাদান উপস্থিত থেকেও অদ্ভুত এক রসায়নে আলাদা হয়ে যায় বাংলা ভাষায় লেখা অন্যান্য উপন্যাস থেকে। নির্মাণরীতি, বিষয়বস্তু, নির্মাণের কারুকুশলতার অভিনবত্বে এটি সহজেই আলাদা হয়ে গেছে আমাদের সাহিত্যে। লৌকিক উপাদান শনাক্ত করা সহজ, কিন্তু উপন্যাসের রক্তমাংসের আড়ালে মাননীয় মুস্তাফা সিরাজ যে ‘সত্য’ রচনা করেছেন, সেটি ব্যাখ্যা করা যায় না। সেটি অনুভবের। মনযোগী পাঠক নিশ্চয় টের পেয়েছেন দুটি লাইনের মাঝে ধাতব-শীতল নির্লিপ্তির সেই অপেক্ষমানতা। Strange Liberty যখনই বিপদে পড়েছে, তখনই সেই ধাতব-শীতল ক্রুদ্ধ গরগর ধ্বনি। কঠিন ও জটিল পরিকল্পনা, মানবমনের জটিলতা, ইতিহাস-সমাজ-ধর্ম-দর্শন – এসবের প্রাজ্ঞতা মন্থন করে, শৈল্পিক শুচিতা অক্ষুন্ন রেখে ‘অলীক মানুষ’ নির্মাণ করেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। এই নির্মাণের দৃঢ় ফাসাঁদ, তীক্ষ্ণ মিনার, খিলানওয়ালা গম্বুজ ও ললিত ঝরোকা ‘অলীক মানুষ’ কে অন্যতম মহতী উপন্যাসের মর্যাদা দিয়েছে। আমাদের নিতান্ত লৌকিক উঠোনে দেখি ‘সেদরা বৃক্ষ’। সেই স্বর্গীয় তরু। 



একটি বাজে কথা 

এই কেতাবের প্রতিটি অধ্যায়ের পূর্বে একটি অশ্বের চিত্র মুদ্রিত হইয়াছে। ওই চিত্র ব্ল্যাক অ্যাণ্ড হোয়াইট। আমি নিশ্চিত, ছবি রঙিন হইলে অশ্বের শরীরে সিঁদুরের লালছোপ দেখা যাইত। পিরের সাঁকোর নীচে এইরূপ দেখা যায়। ইহা টোটেম। উহা মন্দিরগাত্রের টেরাকোটার ঘোড়া বা ‘বোররাখ’ হইতে পারে। কিংবা এই অশ্বের আরোহী হইয়াই কি শফিউজ্জামান মৌলাহাটে তাহার আম্মার সহিত সাক্ষাৎ করিতে রওয়ানা হইয়াছিল? কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সেই দিবস তাহার সহিত কোনও ঘোড়া ছিল না। এইরূপ শুনা যায়, একটি কালো জিন অশ্বরূপ ধারণ করিয়া শফিকে মৌলাহাটে পঁহুছায়। শফি একা ছিল।

0 comments: