1

ছোটগল্প - চন্দ্রভানু বসাক

Posted in











ছোটগল্প


ফাঁস 
চন্দ্রভানু বসাক



দেবগ্রাম ষ্টেশনের লেভেল ক্রসিং থেকে জ্যামিতিক ভাবে লম্ব রাস্তাটা ধরে পুবদিকে আন্দাজ দেড়শো মিটার হেঁটে রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের উল্টোদিকে ছোট্ট এই একতলা বাড়িটা দেখে কেমন যেন পছন্দ হয়ে গেল সমীরণের। দুটো ষ্টেশন পরেই হসপিটাল, যেখানে সমীরণ সদ্য আরএমও হিসেবে জয়েন করেছে, সুতরাং যাতায়াতে কোনও সমস্যা নেই। হাসপাতালে শিফ্টের ডিউটি, তবে এমডির জন্য পড়াশুনা করতে হবে এমনটা ভেবেই শহরের ব্যস্ত হাসপাতাল ছেড়ে এরকম গঞ্জ এলাকায় চাকরি নেওয়া। বাড়ির বাইরের দেওয়ালে প্লাষ্টারের ওপর সাদামাঠা একটেরে রঙ করা, বাইরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেই একটা মাঝারি সাইজের বসার ঘর যার একদিকে লাগোয়া কিচেন আর বাথরুম, অন্যদিকে বড় একটা শোবার ঘর। সবথেকে বড় ব্যাপার, প্রত্যেকটা ঘরেই বেশ লম্বাচওড়া এক বা একাধিক জানলা রয়েছে যেটা সমীরণকে আর দ্বিতীয়বার চিন্তা করার সুযোগ দেয়নি। 

একটা কেটে যাওয়া প্রেম সরিয়ে রাখলে সমীরণের জীবন মোটামুটি ভাবে নারীসঙ্গ বিবর্জিত, সুতরাং ঝাড়া হাত পা। সমীরণের মতো ব্যাচেলার লোকের জন্য এই গঞ্জ টাইপের জায়গায় এর চেয়ে ভালো বাসা আর কি হতে পারে। তবে বাড়ির দালাল প্রভঞ্জন সাহা আগে থাকতেই বলে রেখেছিল, 
- দ্যাখেন দাদা ঐ বাড়িতে কিন্তু পবন সমাদ্দার খুন হইয়েছেন, আগে থেইকতে বইলে রাখলাম পরে কিছু ভালমন্দ হইলে আমারে কুনো দোষ দিবেন না।
একটু খুঁচিয়ে প্রশ্ন করে সমীরণ জানতে পারল, স্থানীয় প্রাইমারী স্কুলের টিচার পবনবাবু কোন এক রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন এবং রাজনৈতিক দলাদলির চরমে যা হয় আর কি, একদিন সকালে বসার ঘর থেকে ওঁর লাশ আবিষ্কার হয়, কুপিয়ে মারা হয়েছিল। এই ঘটনার পর অবশ্য বছর চারেক কেটে গেছে এবং রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে আপাতভাবে মালাবদলও ঘটেছে, সব মিলিয়ে যাকে বলে চারিদিকে শান্তি বিরাজমান; বদনাম হওয়া বাড়িটা শুধু ভাড়াটের অভাবে খালি পড়েছিল। আনন্দে আটভাগ হয়ে বাড়িওলা কথা দিয়েছে সমস্ত ঘরদোর পরিষ্কার করে দেওয়াল, দরজা জানালা রঙ করিয়ে দেবেন, এমনকি জানলা দরজায় পর্দা অবধি লাগিয়ে দেবেন, আর পুরোন খাট আলমারি আর চেয়ার-টেবিল তো রয়েইছে, আবার কি চাই। সমীরণের কোনওদিন পরলোক বা ঐ সংক্রান্ত ব্যাপারে কখনও কোনও বিশ্বাস ছিলনা, সুতরাং পবনবাবুর অপঘাত মৃত্যুর ব্যাপারটা মনের কোণে কখন যে তলিয়ে গেছে সে নিজেও জানে না। সব মিলিয়ে সমীরণ মনস্থির করে ফেলেছিল আগামী দেড়-দুবছরের জন্য এইটেই হবে তার আস্তানা। 

পাকাপাকিভাবে সমীরণ যখন নতুন বাড়িতে এসে ডেরা বাঁধল তখনও ঘরের আনাচে কানাচে কাঁচা রঙের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। সজ্জন বাড়িওলা সত্যিই তবে কথা রেখেছে বলতে হবে, আলো খটখটে, হাওয়া ফুরফুরে, পর্দা ওড়ানো সুন্দর বাসস্থান। রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের অমায়িক মালিকের সহায়তায় স্থানীয় এক মহিলা চম্পাদির সাথে ঘরের কাজকর্ম আর রান্নাবান্না নিয়ে রফা হয়ে গেছে। কাজ বলতে রাত্তির আটটা নাগাদ এসে একজন লোকের একবেলার রান্না করা, ঘরদোর ঝাঁড়পোঁছ আর বাসনকোসন ধোয়া, ব্যস। আর যেদিন যেদিন সমীরণের নাইট ডিউটি সেদিন চম্পাদি সকাল সাতটা নাগাদ এসে কাজকর্ম মিটিয়ে দিয়ে যাবে। দু-একদিন যেতে না যেতেই সমীরণ বুঝে গেল মহিলার নাম যেমন চম্পা তাঁর রান্নাও একদম চাম্পি আর কাজকর্মও বেশ গোছালো। এদিকে সকালের ব্রেকফাষ্টে রামকৃষ্ণের গরমাগরম কচুরি-জিলিপি আর দুপুরে হাসপাতালের বাইরে তাজমহল পাইস হোটেলের মাছভাত। মোটমাট থাকা, খাওয়া আর চাকরীর দিক দিয়ে দিব্যি সুখেই আছে সমীরণ। নতুন জায়গায় এসে থিতু হতে হপ্তাদুয়েক পার হয়ে গেছে; এবার আদাজল খেয়ে এমডির জন্য পড়াশোনা শুরু করলেই হয়, রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে সিগারেট টানতে টানতে এটাই ভাবছিল সমীরণ। কলেজের সময় থেকেই একটা লুপ্তপ্রায় অভ্যেস রপ্ত করেছে সমীরণ, ডায়েরি লেখা; বিশদভাবে কিছু লেখে না, দৈনন্দিন জীবন থেকে কয়েকটি মাত্র লাইন ডায়েরিতে তুলে রাখে কেবল। ততক্ষণে রাত্তির দশটায় পাড়াগাঁয়ের রাস্তা জনমানবশূন্য, দূর থেকে কশ্চিৎ কুকুরের বা শেয়ালের ডাক ভেসে আসে। রাত আরও গভীর হলে তন্দ্রার মধ্যে কখনও কখনও শুনতে পায় উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসটা কোনও কিছুর রেয়াত না করে দেবগ্রাম পার হয়ে যাচ্ছে ঝুমঝুমি বাজিয়ে। ট্রেনের শব্দ মিলিয়ে যাবার সাথে সাথে ঘুমের মধ্যে ভেসে থাকা ক্ষীণ চেতনাটুকুও বুঝি লোপ পায়, অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে সমীরণ। 

একমাস পার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে, হাসপাতালের ডিউটির পাশাপাশি পড়াশোনাও শুরু হয়েছে জোরকদমে। ছোট হাসপাতাল বলে সবসময় খুব একটা চাপ থাকে না, তাই সঙ্গে করে গাবদা কোয়েশ্চেন ব্যাঙ্কের বইটা নিয়ে আসে সমীরণ, আর ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক প্রশ্ন সল্ভ করতে থাকে। হাসপাতালে অন্য কলিগদের সাথে জীবিকাসূত্রে যেটুকু কথা বলা তার বাইরে বিশেষ কোন কথাবার্তা হয় না। এমনিতেই সমীরণ একটু চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে, তার ওপর এমডির প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বোধহয় একটু বেশিই গুটিয়ে নেয় নিজেকে। এমন নিস্তরঙ্গ জীবনে হঠাৎ একজনের সাথে পরিচয় হয়ে গেল, বলতে গেলে খানিকটা নাটকীয়ভাবেই। সেদিন রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে সিগারেটে শেষ টান দিয়ে দগ্ধাবশেষটা টোকা মেরে জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে সমীরণ সবে ডায়েরিটা খুলেছে, এমন সময় বাইরের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। মনের ভুল নিশ্চয়ই, কিন্তু সমস্ত সন্দেহ নিরসন করে কর্কশভাবে বেজে উঠল দরজার কড়া, আরও একবার। রাত সাড়ে দশটায় এই নির্বান্ধব জায়গায় কে আসতে পারে? কোনও উটকো ঝামেলা নয়তো? সাতপাঁচ চিন্তা করতে করতে ভুরু কুঁচকে দ্বিধাগ্রস্তভাবে দরজা খোলে সমীরণ। বসার ঘর থেকে বাল্বের স্তিমিত ছড়িয়ে পড়া আলোয় দেখল প্রায় তারই বয়েসি একটি ছেলে দাঁড়িয়ে, পরনে সাধারণ প্যান্টশার্ট, কাঁধে নিত্য-অফিসযাত্রী মার্কা ব্যাগ ঝোলানো,
- সর‍্যি দাদা, অসময়ে বিরক্ত করছি বলে সত্যিই দুঃখিত, -আন্তরিকভাবে বলে ছেলেটি। সমীরণ মুখ খোলার আগেই ছেলেটি বলে চলে,
- আসলে ট্রেন থেকে নেমে দেখি ষ্টেশনের বাইরের সিগারেটের দোকানটা বন্ধ হয়ে গেছে, তাই বাধ্য হয়ে বাড়ির দিকেই ফিরছিলাম হঠাৎ অন্ধকারে নজরে এল আপনার বাড়ির জানলা দিয়ে একটা জ্বলন্ত সিগারেটের টুকরো রাস্তায় এসে পড়ল, দেখলাম ঘরে আলো জ্বলছে তাই মনে হলো একটা চান্স নিয়ে দেখি। কিছু মনে করবেন না, একটা সিগারেট স্পেয়ার করতে পারেন, প্লিজ?
ছেলেটির কথাবার্তার মধ্যে এমন একটা আন্তরিকতা এবং মার্জিত ভাব ছিল যেটা চট্ করে ঝেড়ে ফেলা মুশকিল। সুতরাং, একটা সিগারেট এনে দিতেই হলো, সিগারেট ধরিয়ে একটা লম্বা সুখটান দিয়ে ছেলেটি নিজের পরিচয় দিল, অনিল, মহকুমা অফিসে চাকরি করে আর পাড়ার ভেতরে কোথাও একটা থাকে যা সমীরণের কাছেও খুব একটা স্পষ্ট হয় না, কারণ একদিনের জন্যেও সে পাড়ার ভেতর বেড়াতে বেরোয়নি কখনও। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পরিচয়পর্ব শেষ করে বসার ঘরে টেবিলের ওপর সাজানো দাবার বোর্ডের দিকে তাকিয়ে অনিল জিজ্ঞেস করে-
- ওইটির প্রতি আকর্ষণ আছে বুঝি? 

তা, আকর্ষণ ছিল বৈকি, ইদানীং সময়ের ও সঙ্গীর অভাবে চর্চা বন্ধ আছে, সেই কথাই বলে সমীরণ। কথা হয় সময় সুযোগ পেলেই অনিল চলে আসবে দাবা খেলতে। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে অনিলের কথা লিখে রাখে ডায়েরিতে। 

এর দু-তিন দিন পরে একদিন রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ অনিল এল দাবা খেলতে। খেলতে বসে সমীরণ দেখল অনিল বেশ ভালো ষ্ট্র্যাটেজি নিয়ে খেলে। সমীরণের কালো রাজা প্রায় কোণঠাসা এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ, চম্পাদি এসেছে। কাজকর্ম সেরে চম্পাদি চলে যাবার পর অনিলও বিদায় নেয়, এদিকে পরপর দুটো গেমে সমীরণ ফাইট করেও হেরে গেছে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সমীরণ এবং খানিক পরেই তলিয়ে যায় ঘুমে। গভীর রাতে ঘুমটা একটু পাতলা হতে সমীরণ টের পায় পায়ের পাতায় একটা স্যাঁতসেঁতে ভাব, ঘুম জড়ানো চোখ খুলে চারিদিকের ঘন অন্ধকারে প্রথমে কিছু ঠাওর হয় না, অন্ধকার একটু সয়ে যেতে সমীরণ বুঝতে পারে সে দাঁড়িয়ে আছে নিজের বাড়ির বাথরুমে অন্ধকারে আবছা হয়ে যাওয়া আয়নার সামনে। কখন বাথরুমে এল মনে করতে পারে না সমীরণ, আলো জ্বালানোর কথাও মনে পড়ে না, হাতড়ে হাতড়ে কোনওমতে বিছানায় ফিরে আবার তলিয়ে যায় ঘুমে।

দিন চারেক পর এক সন্ধ্যেবেলায় আবার অনিলের আগমন। চম্পাদি তখন রান্নাঘরে কাজে ব্যস্ত। সমীরণ খেয়াল করল, খেলতে বসে মাঝেমাঝেই অনিলের দৃষ্টি চলে যাচ্ছে রান্নাঘরের দিকে। একটু অস্বস্তিতে পড়ল সমীরণ, লক্ষ্য করল চাল দিতে গিয়ে আনকোরা নতুনদের মতন ভুল করছে অনিল। নাঃ, অনিলের চালচলনে সেরকম কোনও লক্ষণ আবিষ্কার করা যায়নি, যদিও বেশি দিনের আলাপ নয়, ব্যাপারটা সমীরণকে একটু ভাবিয়ে তোলে। দাবার চাল দিতে দিতে অনিল মৃদুস্বরে বলে, 
- সমীরণদা, যদি কিছু মনে না কর, তোমার এখানে ডিনার করা যাবে?
 
বোঝো, এইজন্য ব্যাটা আড়চোখে রান্নাঘরের দিকে তাকাচ্ছিল, আর সমীরণ কি ভাবতে কি ভেবে যাচ্ছিল। সমীরণ মনে মনে একটু লজ্জা পেলেও সত্যিকারের খুশী হয়, বোধহয় মন থেকে একটা খারাপ সন্দেহ দূর হয়ে যাবার জন্য। চট্ করে উঠে গিয়ে রান্নাঘরে চম্পাদিকে বলে আসে দুজনের জন্য রান্না করার কথা। চম্পাদি বোধহয় একটু অবাক হয়, কিন্তু মুখে কিছু বলে না। সেদিন রাতের খাওয়া দাওয়া সারতে দশটা সোয়া দশটা হয়ে যায় আর তারপর সিগারেট পর্বের পর অনিলও চলে যায়। যথারীতি ডায়েরিতে কয়েক ছত্র লিখে সমীরণ ঘুমোতে যায়।

কত ঘন্টা পর সে খেয়াল নেই, কিন্তু মুখের ওপর একটা ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা লাগতেই অস্বস্তিতে ঘুমটা ভেঙে যায় সমীরণের। অন্ধকারে চোখ সয়ে যেতে সারা গায়ে একটা শিহরণ বয়ে যায়, সমীরণ তার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, সামনে আবছা অন্ধকারে রাস্তার ওপাশে রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের বন্ধ শাটার দেখা যাচ্ছে। সমীরণের সারাদেহে একটা কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ে, কতক্ষণ সে এইভাবে দাঁড়িয়ে ছিল? অন্যদিনের ঘটনাটাও হঠাৎ মনের মধ্যে ভেসে ওঠে। দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে ঘরের ভেতর ঢুকে দরজায় ছিটকিনি দিয়ে অন্ধকারে দেওয়াল হাতড়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালায়। সমীরণ বুঝতে পারে মাথার মধ্যে কেমন যেন ঢিপ ঢিপ করছে। তাহলে কি সে সম্নামবুলিষ্ট, যারা ঘুমের মধ্যে হেঁটে চলে বেড়ায়? কিন্তু তার পাঁচ বছরের হোস্টেল জীবনে কেউ তো তাকে এমন কিছু বলেনি, এমনকি তার বাপ মা পর্যন্ত এব্যাপারে কখনও কিছু বলেনি। সমীরণ ঠিক করে কাল সকলেই সমীরদাকে ফোন করবে, কলেজের সিনিয়র এবং সায়কায়াট্রিষ্ট, এখন অবশ্য দিল্লিতে থাকে। 

কয়েকবার রিং হবার পরেই ফোনের উল্টোদিকে সমীরদার গলা পাওয়া যায়। পুরোনো স্মৃতি ঝালাতে কয়েক মিনিট সময় যায়, তারপরই সমীরণ সরাসরি চলে আসে মূল সমস্যায়। সমীরদা সব কিছু মন দিয়ে শোনে, তারপর বলে,
- দ্যাখ, সম্নামবুলিজম কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাচ্চাদের হয় এবং দেখা যায় কৈশোর কাটতে না কাটতেই ঐ সমস্যাও কেটে গেছে। তবে প্রাপ্তবয়স্কদেরও কখনও সখনও এই রোগ হতে পারে, যদিও সংখ্যায় তা অতি নগন্য। সাধারণত কোন মানসিক চাপ বা স্ট্রেস থেকেও এ ধরনের ডিসঅর্ডার হতে পারে।
- কিন্তু আমার কোনরকম স্ট্রেস নেই সমীরদা- সমীরণ প্রায় কাতোরোক্তি করে। 
- দেখা গেছে গভীর ঘুমের সময়ই লোকে স্লিপ ওয়াকিং করে। তাই আমি তোকে সাজেষ্ট করব একটা ভালো সেডাটিভ নেওয়ার জন্য। এক কাজ কর, তুই দিন পনেরোর জন্য এক মিলিগ্রামের ডায়াজেপাম খা, ঘুমোতে যাবার আগে। তারপর আমাকে জানা কোন উন্নতি হচ্ছে কিনা।

সমীরদার সাথে কথা বলে অনেকটা স্বস্তি পায় সমীরণ।
সেদিন সমীরণের নাইট ডিউটি ছিল, হসপিটালে রুগীটুগী খুব একটা নেই, একমনে প্রশ্ন সল্ভ করে চলেছে সমীরণ। হঠাৎ ডেস্কের ওপর কার যেন ছায়া পড়ল, নার্স এসেছে মনে করে মুখ তুলতেই চমকে ওঠে সমীরণ, অনিল দাঁড়িয়ে আছে। একটু খুশিই হয় সমীরণ, পরিচিত কারওর সাথে একটু কথা বলা যাবে। অনিল তার কোন এক আত্মীয়ের বাড়িতে এসেছিল, হসপিটালের কাছেই, ফেরার পথে ভাবল একবার সমীরণের সাথে দেখা করে যাবে। টুকটাক কথাবার্তার পর সমীরণ তার সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা না বলে পারে না। সব শুনেটুনে অনিল বলে,
- দ্যাখো সমীরণদা, তুমি বরং শুতে যাবার আগে খাটের পায়ার সাথে একটা দড়ি দিয়ে নিজের পা বেঁধে রাখো, তাহলে আর যাইহোক বাড়ির বাইরে কোনওমতেই বের হতে পারবে না। ব্যাপারটা একটু ক্রুড মনে হলেও কার্যকরী, ভেবে দেখ।
এরপর আরও কিছু খেজুরে গল্পের পর অনিল চলে যায়। 

নিয়ম মেনে ওষুধ খাওয়া শুরু করেছে সমীরণ, আজ প্রায় দেড় সপ্তাহ হয়ে গেল। এই ক'দিন নাইটডিউটির দিনগুলো বাদে রোজই অনিল এসেছে, জমিয়ে দাবা খেলা হয়েছে এবং সমীরণের অনুরোধে রাতের খাওয়াটা অনিল এখানেই সেরেছে। আজ সন্ধ্যেবেলা চম্পাদি হঠাৎ বেঁকে বসেছে, তার মাইনে একজনের একবেলা রান্নার জন্য, অথচ সে প্রায় প্রতিদিনই দুজনের জন্য রান্না করেছে, সুতরাং মাইনে বাড়াতে হবে। সমীরণও অস্বীকার করতে পারে না, চম্পাদির দাবী সে মেনে নেয়। আজ অনিল আসেনি, তাই রাতে একটু তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে শোবার আয়োজন করে সমীরণ, বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। মাঝরাতে ঘুমটা ভাঙল বৃষ্টির ছাঁটে, আতঙ্কে চোখ খুলে তাকিয়ে ঝাপসা অন্ধকারে সমীরণ বুঝতে পারে সে দাঁড়িয়ে আছে বাজারের কাছাকাছি, বাড়ি আর ষ্টেশনের মাঝামাঝি কোনও একটা জায়গায়। মাথা থেকে শুরু করে চটি অবধি ভিজে গেছে বৃষ্টিতে। তার মানে ঘুমের মধ্যে সে পায়ে চটি গলিয়ে রাস্তায় বের হয়েছে এবং এই বৃষ্টির মধ্যে পাঁচ মিনিট মতো হেঁটেছে, তাতেও ঘুম ভাঙেনি। নিজেকে হঠাৎ কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ বলে মনে হয় সমীরণের, সে কি তবে পাগল হয়ে যাচ্ছে? কোনওমতে পা চালিয়ে হাট করে খোলা দরজা দিয়ে ঘরে ঢোকে সমীরণ, একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে এবার।


- তাহলে আপনি বলছেন এক মিলিগ্রাম ডায়াজেপামে কোন কাজ হয় নি? 
কেবিনের মোলায়েম আলোয়, সোনালি ফ্রেমের চশমার ওপর দিয়ে সমীরণের দিকে তাকিয়ে কলকাতার অন্যতম নামকরা সায়কায়াট্রিষ্ট, ডঃ সেন জিজ্ঞেস করেন।
- সেই রকমই তো মনে হচ্ছে
- হুম -একটু চিন্তা করেন ডঃ সেন, তারপর আরও কিছু খুঁটিনাটি জরুরি প্রশ্ন করেন, সবশেষে সমীরণকে বলেন, 
- আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি, প্যারোক্সেটাইন, দু সপ্তাহ খেয়ে উপকার না হলে ফোন করবেন ওষুধ বদলে দেব। আর হ্যাঁ, পারলে দরজায় তালা দিয়ে শোবেন। 
বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ অনিলের কথা মনে পড়ে, একটা হার্ডওয়্যারের দোকান থেকে এক বাণ্ডিল পাটের দড়ি কিনে ফেলে সমীরণ। 


ডঃ সেনের ওষুধে কাজ হয়েছে বলে মনে হয়, কারণ, গত দশ বারো দিনে উল্টোপাল্টা কিছু ঘটেনি। অবশ্য অতিরিক্ত সতর্কতার জন্য ইন্টারনেট ঘেঁটে ঘুঁটে কনষ্ট্রিকটর নট খুঁজে বের করেছে সমীরণ, এ গিঁট এমনই কঠিন যে খুলতে গেলে দড়ি কাটা ছাড়া অন্য কোনও উপায় নেই। এমনিতে সমীরণের রাত্তিরে বাথরুমে যাবার দরকার হয় না, তাই রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কাজ হলো কাঁচি দিয়ে দড়ি কাটা, তারপর অন্য কাজ। এই ক'দিনের রুটিনে সমীরণ বেশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, জীবনযাত্রা আবার ফিরে গেছে সেই চেনা ছকে। 


রাতে যখন চম্পাদি কাজ করতে এল, সমীরণ আগে থাকতেই দুজনের রান্নার কথা বলে রাখল, অনিল তখনও আসেনি। দাবার ছক সাজিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে সমীরণ। কাজকর্ম শেষ করে যাবার আগে চম্পাদি একটা অদ্ভুত কথা বলে - 
- এই বাড়ি ছেড়ে দাও, দাদাবাবু
- কেন বলত চম্পাদি? সমীরণ বিলক্ষণ অবাক হয়। 
- এ বাড়ির হাওয়া খারাপ -সমীরণের দিকে একটু অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে চম্পাদি ভয়ে ভয়ে মন্তব্য করে। 
সমীরণের বারবার করা প্রশ্নের উত্তরে আর কিছুই বলতে চায় না চম্পা, শুধু মাথা নেড়ে কিছু একটা বিড়বিড় করে বলতে বলতে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। অবাক হয়ে সমীরণ শুধু খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। অনিল একটু পরে আসে, দুজনের মধ্যে কথাবার্তা খুব একটা হয় না, দাবা খেলাও জমে না। রাতের খাওয়া সেরে অনিল চলে যায়, আর সমীরণ ডায়েরি খুলে বসে। বুঝতে পারে চম্পাদির কথাগুলো অহেতুক ভাবে তাকে অস্থির করে তুলেছে। ধীরেসুস্থে একটা সিগারেট শেষ করে একখণ্ড দড়ি নিয়ে সমীরণ খাটের পায়ায় কনষ্ট্রিকটর গিঁট মারে, অন্য প্রান্ত ঐ একই কায়দায় পায়ের গোড়ালিতে বাঁধে। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় ঘুমে তলিয়ে যায়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে সমীরণ, একটা আশ্চর্য উজ্জ্বল আলো চোখের ওপর পড়ছে। ঐ অদ্ভুত আলোর উৎস ছাড়া দিগবিদিক নিকষ অন্ধকার এমনকি মাথার ওপর একটা তারা পর্যন্ত মিটমিট করে জ্বলছে না। একটা মৃদু কিন্তু গম্ভীর আওয়াজ কোথা থেকে যেন ভেসে আসে আর আলোটা আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, অস্বস্তিতে শেষ পর্যন্ত ঘুম ভেঙে চোখ খোলে সমীরণ আর সাথে সাথেই একটা চোখ ঝলসানো আলো যেন অন্ধ করে দেয় আর তার সাথে কানে তালা ধরানো একটা চেনা আওয়াজ। ঝমঝম শব্দে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসটা দেবগ্রাম পার হয়ে যায়। 



মাথা থেঁতলে যাওয়া অবস্থায় সমীরণের প্রাণহীন দেহটা পরেরদিন আবিষ্কার হয় রেললাইনের ধার থেকে। যথারীতি পুলিশ, মর্গ, জিজ্ঞাসাবাদ, তদন্ত ইত্যাদি শুরু হয়ে যায়। পোষ্টমর্টেম রিপোর্টে মেডিক্যাল অফিসার দুটো অদ্ভুত পয়েন্টের উল্লেখ করে। এক, লাশের এক পায়ে বাঁধা দড়ি (অদ্ভুত গিঁটে বাঁধা) আর দড়ির অন্যপ্রান্তে ঐ একই গিঁটে বাঁধা একটা ফাঁস। দুই, লাশের পাকস্থলী থেকে যে পরিমাণে অর্ধপাচিত খাবার পাওয়া গেছে তা একজনের পক্ষে খাওয়া প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। সমীরণের ডায়েরি থেকে পুলিশ অনিলের নাম খুঁজে পায় কিন্তু তার কোনও ফোন নাম্বার বা ঠিকানা পাওয়া যায় না। চম্পাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও আর কোনও ব্যক্তির সম্পর্কে কিছু জানতে পারেনি পুলিশ। বহু তদন্তের পর পুলিশ এটা কোল্ড কেস বলে সরিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। সমীরণের মৃত্যুর পরে দেবগ্রামে মানুষের মনে যেটুকু চাঞ্চল্য উঠেছিল তাও ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় সময়ের সাথে। 



অনিল সরকার পেশায় শিক্ষক। দেবগ্রাম প্রাইমারি স্কুলে দিন দুয়েক হলো যোগ দিয়েছেন। গত দু দিন কোলকাতা থেকে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে পোষাচ্ছে না, ঠিক করেছেন দেবগ্রামেই সপ্তাহের পাঁচদিন কাটিয়ে সপ্তাহান্তে কোলকাতা ফিরে যাবেন। সেই বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে, দেবগ্রাম ষ্টেশনের লেভেল ক্রসিং থেকে জ্যামিতিক ভাবে যে লম্ব রাস্তাটা পুবদিকে চলে গেছে সে রাস্তায় আন্দাজ দেড়শো মিটার হেঁটে রামকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের উল্টোদিকে ছোট্ট এই একতলা বাড়িটা দেখে কেমন যেন পছন্দ হয়ে গেল অনিলের।

1 comment:

  1. অসীম দেব12 July 2023 at 14:25

    খুব ভালো লাগলো, চন্দ্র। লেখা ছাড়িস না

    ReplyDelete