0

সম্পাদকীয়

Posted in

সম্পাদকীয়

"এমন করিয়া চার পাঁচ বছর কোথা দিয়া যে কেমন করিয়া কাটিয়া গেল তাহা চোখে দেখিতে পাইলাম না।"

রবিপ্রদক্ষিণপথে ঋতবাকের পাঁচে পা। 

'তোমরা রচিলে যারে 
নানা অলংকারে
............
বাহির হইতে
মিলায়ে আলোক অন্ধকার
কেহ এক দেখে তারে, কেহ দেখে আর।
খণ্ড খণ্ড রূপ আর ছায়া,
আর কল্পনার মায়া,
আর মাঝে মাঝে শূন্য, এই নিয়ে পরিচয় গাঁথে
অপরিচয়ের ভূমিকাতে।'

তিনিই বলে দিলেন সমস্তটুকু। মনে পড়ছে জন্মক্ষণটি। সেদিন যাঁরা ছিলেন সঙ্গে, আজও আছেন। কেউ সক্রিয়ভাবে, কেউ প্রচ্ছন্নভাবে অন্তরালে। তবু আছেন। মাঝে কতজন এলেন, চলেও গেলেন। কেউ কেউ রেখে গেলেন অনেক কিছু। আবার অনেকেই শুধু নিয়েই গেলেন দু'হাত ভরে। কত প্রতিভা আবিষ্কৃত হলো, কত প্রতিভা নির্মূল হলো জন্মমুহূর্তেই। আর রইলেন আপনারা... অনন্ত শুভেচ্ছা নিয়ে। 

এই দীর্ঘ অতীত পথ সবসময় সুগম ছিলোনা, স্বভাবতই। অনেকেই চেষ্টা করেছেন অন্তর্ঘাত করতে, ক্ষতি সাধন করতে। কিন্তু ওই যে, শুভ আর সত্যের জয় রোধ করা যায়নি কোনও দিনও!

এই ক'বছরে সঞ্চয়ও তো বড়ো কম নয়! বহু সুখস্মৃতি আজ ভীড় করে আসছে। এক একটা মাইলফলক আমরা উদযাপন করেছি একসঙ্গে। সত্যিই সকলে না থাকলে আজকের এই দিনটি আসতোই না। 

কাজের কথা হবে অন্য কোথাও অন্য কোনও দিনে... আজ শুধু সুখানুভবে আবিষ্ট হওয়ার দিন। 

এমনি করেই সঙ্গে থাকুন

শুভেচ্ছা নিরন্তর
শব্দঋণ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অভীক চৌধুরী

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


ভারতবর্ষে ব্যাঙ্কিং সেক্টর ভবিষ্যৎ 
অভীক চৌধুরী


অতি সম্প্রতি আমাদের দেশের জনসাধারণের মধ্যে বিশেষ করে চাকুরীজীবি, অবসরপ্রাপ্ত মধ্যবিত্ত যাদের সারাজীবনের সঞ্চয়ের সিংহভাগ গচ্ছিত থাকে সরকারি ব্যাঙ্কগুলোতে তারা আজ সত্যি প্রচণ্ড দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। সময়মতো তারা তাদের টাকা সুদ সমেত ফেরত পাবেন কিনা এ বিষয়ে আজ শিক্ষিত মানুষ ও সন্দিহান। তাদের মাথাব্যথার কারণগুলো একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক --- 

১) ব্যাঙ্কগুলিতে স্থায়ী আমানতের ওপর সুদ পর্যায় ক্রমে কমতে কমতে একদম তলানিতে এসে ঠেকেছে। 

২) দেশের বৃহত্তম সরকারি ব্যাঙ্ক স্টেট ব্যাঙ্ক সহ প্রায় সমস্ত সরকারি ব্যাংকে লোকসানের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়েই চলেছে। 

৩) অনাদায়ী ঋণের পরিমান এতো বিশাল মাত্রায় বাড়ছে যে আজ ব্যাঙ্কগুলিতে বিশাল লোকসানের বোঝা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। 

৪) এছাড়াও বিশেষ করে সরকারি ব্যাঙ্ক গুলিতে এক শ্রেণীর কর্মী - অফিসারদের চূড়ান্ত অসহযোগিতা ও কর্ম বিমুখতা, দায়বদ্ধতার অভাব সাধারণ মানুষকে সরকারি ব্যাঙ্ক সম্বন্ধে বিরূপ মনোভাবে ইন্ধন জুগিয়েছে। 

৫) সর্বোপরি সরকারি তরফে নানারকম বিভ্রান্তিমূলক ঘোষণা ও একশ্রেণীর মিডিয়ার নিকৃষ্ট অপপ্রচার মানুষকে সরকারি ব্যাঙ্ক বিরোধী হতে প্রচরিত করেছে। 

অতি সম্প্রতি পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে নীরবে ইতিহাসের বৃহত্তম ব্যাঙ্ক জালিয়াতি (যার পরিমান আনুমানিক সতেরো হাজার কোটি টাকা) সমস্ত সরকারি ব্যাঙ্কের মেরুদণ্ডকে দুর্বল করে দিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সত্যি আজ ভারতবর্ষে সমগ্র ব্যাঙ্কিং সেক্টরের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। এ বিষয়ে দেশে-বিদেশে এত রকম গবেষণা, অন্বেষণ, চুলচেরা বিশ্লেষণ, সরকারি -বেসরকারি স্তরে বিভিন্ন প্রস্তাব, আইন প্রণয়ন প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে যা নিয়ে বেশ কয়েকটি রামায়ণ-মহাভারত রচনা করা যাবে। সবিনয়ে বালি আমার সে যোগ্যতা বা ধৃষ্টতা কোনোটাই নেই I 

আমাদের দেশে ব্যাঙ্কিং ব্যবসার আদিপর্ব থেকে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। 

* ভারতবর্ষের প্রথম ব্যাঙ্ক - ব্যাঙ্ক অফ হিন্দুস্তান ১৭৭০ সালে স্থাপিত হয় আর বিনাশ ঘটে ১৮২৯-৩২ সাল নাগাদ। 

* কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন তার সময়ে একজন বিখ্যাত বহুমুখী কর্মযোগী। অনেক কিছুর সাথে তিনি ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক লিমিটেড স্থাপন করেন ১৮২৯ সালে, যার পরমায়ু ছিল মাত্র কুড়ি বছর। এরকম আরো অনেক ব্যাঙ্ক সেই সময় শুধু অকালে পাততাড়ি গুটিয়েছে তা নয়, হাজার হাজার পরিবারকে নিঃস্ব ভিখারীতে পরিণত করেছে। 

* পূর্ব স্বাধীনতা পর্বে (১৯০৬-১৯৪৩) ভারতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটে। একথা গর্বের সঙ্গে বলা যায় আরো অনেক কিছুর মতো স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া গোড়াপত্তন হয় আমাদের প্রিয় কলকাতাতেই। ব্যাঙ্ক অফ ক্যালকাটা (১৮০৬), ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল (১৮০৯), ব্যাঙ্ক অফ বোম্বে (১৮৪০ ), ব্যাঙ্ক অফ মাদ্রাজ (১৮৪৩) মিলেমিশে বর্তমানের স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া। ব্যাঙ্কগুলির কাজকর্মের নিয়ন্ত্রক হিসাবে ১৯৩৫ সালে আত্মপ্রকাশ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার। 

* স্বাধীনতার পরেই সমগ্র ব্যাঙ্কিং ব্যবসাকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য তৈরি হয় ১৯৪৯ সালে নতুন আইন, যা এখন পরিবর্তিত ও সংশোধিত আকারে চালু। 

*এতসব আইন ও নিয়ন্ত্রক ব্যবসার মধ্যেও অনেক ফাঁকফোকর থাকার জন্য দেশের মধ্যে এক সমান্তরাল নন-ব্যাঙ্কিং ব্যবসা চালু ছিল যাতে দীন-হতদরিদ্র খুইয়েছে তাদের খুদকুঁড়ো সামান্য ঋণের বিশাল পরিমান সুদ গুনতে। 

*ব্যাঙ্ক গুলিকে প্রত্যক্ষভাবে সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৯৬৯ সালে ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ হয় ১৪ টি ব্যাঙ্ক অধিগ্রহণ দ্বারা। 

একটি যুগান্তকারী ইতিহাসিক পদক্ষেপের মাধ্যমে তৎকালীন মোট ব্যাঙ্ক আমানতের প্রায় ৭০ শতাংশ এই ১৪ টি ব্যাঙ্কে গচ্ছিত ছিল যা সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে সারা দেশে ব্যাঙ্কের সংখ্যা শাখা নিম্নরূপ --- 

***** সরকারি ব্যাঙ্ক -২৭, বেসরকারি ব্যাঙ্ক - ২২, বিদেশি ব্যাঙ্ক - ৪৪, R .R .B (গ্রামীণ ব্যাঙ্ক) - ৫৬, সমবায় ব্যাঙ্ক (শহর - ১৫৮৯), সমবায় ব্যাঙ্ক (গ্রাম) -৯৩৫৫০। 

* মোট আমানতের পরিমান - ১০৬ লক্ষ কোটি টাকা প্রায়, মোট ঋণের পরিমাণ - ৭৭ লক্ষ কোটি 

প্রথমেই যে কথা দিয়ে শুরু হয়েছে আবার সেখানেই একটু ফিরে তাকানো যাক। আজকাল বহুল প্রচারিত একটা শব্দ আমরা শুনে থাকি যেটা ব্যাঙ্কে N.P.A (NON PERFORMING ASSETS), ব্যাংকের বিপুল পরিমান অনাদায়ী ঋণ যার জন্য ব্যাঙ্কগুলিকে লোকসানের পথে চলতে বাধ্য করেছে এবং ব্যাঙ্কের ও আমাদের ভবিষ্যৎ প্রশ্নচিহ্নের মুখে সেই অনাদায়ী ঋণের সংখ্যামান নিয়ে কিছু তথ্য দেখা যাক --- 

**** বর্তমানে অনাদায়ী NPA ঋণের মোট পরিমান ১০.৩ লক্ষ কোটি টাকা যা মোট ঋণের প্রায় ১১.২ শতাংস। এর মধ্যে ২১ টি সরকারি ব্যাঙ্কের অবদান ৮.৯৭ লক্ষ কোটি টাকা আর ১৮ টি বেসরকারি ব্যাঙ্কের অবদান ১.২৮ লক্ষ কোটি টাকা। দেশের বৃহত্তম ব্যাঙ্ক SBI এর ২.২৩ লক্ষ কোটি টাকা। নিয়ম অনুসারে ব্যাঙ্কগুলিকে তাদের লাভের একটি নির্দিষ্ট অংশ অনাদায়ী ঋণ খাতে বরাদ্দ রাখতে হয় আর তাই করতে গিয়ে লাভের গুড় পিঁপড়ে খায়। আন্তর্জাতিক কিছু নিয়ম আরোপের জন্য অনেক কঠিন বেড়াজালের মধ্যে বাধা ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্ক সাধারণ মানুষের থেকে টাকা জমা নেয় বিনিময়ে সুদ দেয়, আবার ঋণ দেবার জন্য যে সুদ ব্যাঙ্ক পেয়ে থাকে তা আমানতে দেয় সুদের থেকে বেশি হলে তবে ব্যবসায়ে লাভ হয়। একটানা তিনমাস কোনো ঋণ (কৃষি ঋণ ছাড়া) সুদ জমা নাহলে তা সাধারণ ভাবে npa হয় ও তাতে আর কোনো সুদ পাওয়া যায়না। সাধারণত এভাবেই লোকসানের সৃষ্টি হয়। আর এভাবেই NPA (অনুৎপাদক সম্পদ) খাতে সংস্থান রাখতে গিয়ে ব্যাঙ্কগুলি লোকসানের পথে চলেছে। ক্রমশ লোকসানের বোঝা বাড়তে বাড়তে ব্যাঙ্কগুলি কি শেষমেষ দেউলিয়া হয়ে যাবে ? সাধারণ মানুষের গচ্ছিত টাকা তবে কি আদৌ সুরক্ষিত নয় ? 

তাহলে উপায় ? 

সম্ভাব্য কিছু কিছু প্রস্তাব ও আইন নিয়ে একটু দেখা যাক 

**** বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণের ফলে বিশেষ করে সরকারি ব্যাঙ্কগুলিতে মূলধনের যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে তা পূরণের জন্য সরকার ২০ টি সরকারি ব্যাঙ্কে প্রায় ৮৮০০০ কোটি টাকার মূলধন যোগান দেবার কথা ঘোষণা করেছে যা ব্যাঙ্কের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে। ব্যাঙ্কগুলি নতুন ব্যবসা/শিল্প ক্ষেত্রে ঋণ দিতে সক্ষম হবে 

*** আমাদের দেশে যেহেতু ব্যাংকের সংখ্যা প্রচুর তাই সরকার ও RBI তরফে বিভিন্ন প্রস্তাব গ্রহণ করার চেষ্টা চলছে যদিও আইন প্রনয়ণ ছাড়া সম্ভব নয়। RBI প্রস্তাব অনুসারে ব্যাঙ্কগুলোকে চারটি স্তরে ভাগ করা হবে - 

**প্রথম স্তরে - দেশের ৩/৪ টি বৃহৎ ব্যাঙ্ক, দ্বিতীয় স্তরে - মাঝারি ব্যাঙ্ক, তৃতীয়া স্তরে - কিছু বেসরকারি, গ্রামীণ ও সমবায় ব্যাঙ্ক চতুর্থ স্তরে - ছোট বেসরকারি ও সমবায় ব্যাঙ্ক। 

** নতুন ব্যাঙ্ক লাইসেন্স দেওয়া হবে । 

** ব্যাঙ্কের পরিকাঠামোগত আকার ও আকৃতি পরিবর্তন করা হবে। 

** দুই বা ততোধিক ব্যাঙ্ক সংযুক্তিকরণ, অলাভজনক ব্যাঙ্কের জন্য এটি প্রযোজ্য। 

* ব্যাঙ্কগুলিতে সরকারি অংশীদারি ৩৩ শতাংস পর্যন্ত নামিয়ে আনা হবে । 

*** ঠিক এই মুহূর্তে একটি লোকসানে চলা ব্যাঙ্ক IDBI এর ৫১ শতাংস শেয়ার কেনার জন্য আর দেশের বৃহত্তম রাষ্ট্রীয় সংস্থা ভারতীয় জীবন বীমা নিগম কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যদিও এতে অনেক আপত্তির কারণ আছে। 

*** কতকগুলি নতুন ব্যাঙ্ক খোলা হয়েছে যেমন পেমেন্ট ব্যাঙ্ক ও স্মল ব্যাঙ্ক। দেশের অগণিত মানুষজন যাদের রোজগার কম, শ্রমিক শ্রেণী, খুব ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও কারিগররা এতে উপকৃত হবেন। এর ফলে বৃহৎ ব্যাঙ্কগুলিকে আর দেশের প্রত্যন্ত স্থানে শাখা অফিস খুলতে হবেনা। ইতিমধ্যে এরকম কয়েকটি ব্যাঙ্ক চালু হয়েছে। এভাবে দেশের সর্বত্র ব্যাংকের পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হবে। 

**গায়ের জোরে সরকারি ব্যাঙ্কগুলোকে বেসরকারি না করে কি করে তা লাভজনক হয়ে ওঠে তার সদর্থক ব্যবস্থা নিতে হবে। **ইচ্ছাকৃত অনাদায়ী (WILLFUL DEFAULTER) ঋণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঋণ গ্রহীতাদের কোনো রং না দেখে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে ও সমস্ত স্থাবর -অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। যে সব মহান পুরুষদের কালো টাকা বেনামে বিদেশি ব্যাংকে জমা আছে তাদের নাম জানার অধিকার আপামর দেশবাসীর আছে। সরকারের প্রতিশ্রুতির উপর আমাদের ভরসা রাখতে হবে। 

****ব্যাঙ্কগুলিকে লাভজনক সংস্থায় পরিণত করতে অন্যতম প্রধান উপায় আধুনিকতম টেকনোলজির ব্যবহার। ব্যাঙ্কের Alternative delivery channel ( ADC ) অর্থাৎ ATM, INTERNET, MOBILE ইত্যাদি আধুনিকতম মাধ্যম যাতে সাধারণ মানুষ অভ্যস্ত হাতে পারে তার জন্য সর্বস্তরে প্রচার ও শিক্ষাদান প্রয়োজন। ইতিমধ্যেই এ ব্যবস্থা শিক্ষিত সমাজের কাছে খুব জনপ্রিয়। বর্তমানে ব্যাঙ্কে শহরাঞ্চলের ৩০-৪০ % গ্রাহক এই প্রযুক্তি ব্যবহারে অভ্যস্ত। ব্যাঙ্কে হাজির না হয়েও ঘরে বসে এখন ব্যাঙ্কের অনেক কাজ করা যায়-- একাউন্ট খোলা, বন্ধ করা, অন্য একাউন্টে টাকা পাঠানো, ইলেকট্রিক, ফোন ইত্যাদির বিল মেটানো সব কাজ বাড়িতে বসে কম্পিউটার ও মোবাইল ব্যবহার করে সম্ভব। শুধুমাত্র কিছু প্রাথমিক জ্ঞান ও সচেতনতা থাকলেই এই প্রযুক্তি ব্যবহারকরা খুবই সহজ। 

*****এবং ব্যাঙ্কের যেকোনো শাখা অফিসে গেলেই দেখাযায় কর্মী সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অস্বাভাবিক কম কারণ অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদের স্থলে নতুন নিয়োগ প্রায় বন্ধ। কাজেই সামান্য কাজ বা পরিষেবা ব্যাঙ্কে বিলম্বিত হয় যা গ্রাহক অসন্তুষ্টির অন্যতম কারণ। আধুনিকতম প্রযুক্তির সফল ব্যবহারে মানুষ অভ্যস্ত হলে ব্যাঙ্কের পরিষেবা লাভজনক হয়ে উঠবে। কোনো গ্রাহক যদি ব্যাঙ্কে উপস্থিত থেকে কোনো কাজ / লেনদেন করেন তবে মাথাপিছু খরচ প্রায় ২০০ টাকা আর তিনি ADC ( Alternative Delivery Channe) র মাধ্যমে এই কাজ / লেনদেন করলে খরচ ২০ টাকা। এভাবে ব্যাঙ্কে খরচ সংকোচন করা সম্ভব। 

***** পূর্বে ব্যাঙ্কের যে কোনো শাখা অফিস খুলতে ৪০০০-৫০০০ বর্গফুট স্থানের / ঘরের প্রয়োজন ছিল, বর্তমানে মাত্র ১০০০-১৫০০ বর্গফুট পরিমিত ঘরেই ব্যাঙ্কের কাজ চালানো সম্ভব। এভাবেও অনেক খরচ কমবে I 

****** অবশ্যই সরকারের সৎ ও আন্তরিক প্রচেষ্টা না থাকলে কোনো কাজের সুফল পাওয়া যাবেনা, বেসরকারিকরণ কোনোভাবেই আমাদের দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গলদায়ক নয়। 

***** ব্যাঙ্কের থেকে ঋণ নিয়ে যারা ব্যবসা করেন, শিল্প গড়েন তাদের জন্য ঋণ প্রদানের নীতি সহজ ও সফল রূপায়ণ প্রয়োজন, দেশের কৃষিক্ষেত্রে সহানুভূতির সঙ্গে ঋণ প্রকল্প তৈরি করতে হবে। ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিটি স্তরে উপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যাতে অসাধু লোকেদের হাতে কোটি কোটি টাকা না যেতে পারে। ব্যাঙ্কে নিয়মিত সুদসহ ঋণের কিস্তি জমা পড়লে ব্যাঙ্কগুলিও লাভের মুখ দেখবে I 

** একটি প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সমীক্ষা করে দেখেছে ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতবর্ষ আমেরিকা ও চীনের পরেই তৃতীয় বৃহত্তম ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে পরিণত হবে I 

** আমাদের দেশে বিজয় মালিয়া ও নীরব মোদির মতো আরো অসংখ্য ভদ্রলোক বার বারেই সমাজের উচ্চতম প্রভাবশালী অংশের সাথে হাত মিলিয়ে ব্যাঙ্কগুলি থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি করে এখনো পার পেয়ে যাচ্ছে নাহলে আমাদের দেশের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ আরো অনেক বেশি পাকাপোক্ত হতো। এত সব আর্থিক জালিয়াতির বোঝা মাথায় নিয়েও আমাদের দেশ যে বিশ্বের অর্থনীতিতে অন্যতম বৃহৎ শক্তি হিসাবে পরিণত হাতে চলেছে এর জন্য দেশের সরকারি ব্যাঙ্কগুলির অবদান অনস্বীকার্য। , এমনকি ২০০৮ সালে আমেরিকার চতুর্থ বৃহত্তম আর্থিক সংস্থা লেহম্যান ব্রাদার্স এর ভরাডুবিতে যখন সারা বিশ্বের ব্যাঙ্কগুলির টালমাটাল অবস্থা তখন ভারতে ব্যাঙ্কগুলির গায়ে কোনো আঁচ লাগেনি। বছর দুয়েক আগে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সময় ব্যাঙ্কগুলিতে যে অপরিসীম ধৈর্য, অতিমানবীয় পরিশ্রম, অতুলনীয় আন্তরিকতা ও দায়বদ্ধতার সঙ্গে গ্রাহক পরিষেবার নিদর্শন আমরা পেয়েছি তা সত্যি প্রশংসার দাবি রাখে। 

আমরা আশাবাদী এই ২০১৮ সাল্ থেকেই ব্যাঙ্কগুলি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এবং ২০২৫-২৬ সালের মধ্যেই পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ ব্যাঙ্কিং শক্তিতে পরিণত হবে। সরকারি ব্যাঙ্ক সম্বন্ধে কোনোরকম বিভ্রান্তিমূলক প্রচারে কান না দিয়ে নির্ভয়ে টাকা রাখুন, আপনার আমানত সুরক্ষিত থাকবে, অবশ্যই নামি বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলিও যথেষ্ট নিরাপদ। শুধুমাত্র আর্থিক প্রলোভনের জন্য ভুঁইফোড় কোনো সংস্থায় বা চিটফাণ্ডে টাকা রেখে বিপদে পড়বেন না। সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ধার নিয়ে আর সেটা শোধ না করে যারা বিদেশি ব্যাঙ্কে টাকা জমা করছে তারা শুধুমাত্র শয়তান নয় তারা দেশদ্রোহী, তাদের আর কোনো সুযোগ দেওয়া যাবেনা। ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলি এখন ভয়াবহ প্রতিযোগিতার মধ্যে দাঁড়িয়ে কেননা ব্যাঙ্ক অফ চায়না-কে ভারতে ব্যবসা করার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। দেশের আপামর জনসাধারণের হাতে ভারতীয় ব্যাঙ্কের ভবিষ্যৎ। 

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


ফকিরাণি কথা (দ্বিতীয় পর্ব)
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচয় হয়েছিল হালিম ফকিরের সঙ্গে। সেই যে আশ্রমে গিয়ে গান শুনেছিলুম, সেই আশ্রমেই পরিচয়। মানুষটি কয়েকবার আমার বাড়িতেও পায়ের ধূলো দিয়েছেন। তাঁর কথায়—মুসলিম সমাজে 'ফকিরি' অবলম্বন করেন এইরকম ফকিরাণির সংখ্যা নেই বললেই চলে। তার সবচেয়ে বড় কারণ হলো পর্দা প্রথা। বাউল-বৈষ্ণব সমাজের আচার-আচরণ, ধর্মমত অনেক বেশি খোলামেলা। মুসলিম সমাজের মেয়েরা শরিয়তি আইন লঙ্ঘন করা মানেই বেপর্দা, বেআব্রু হওয়া, আর সমাজের চোখে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। তাই প্রকাশ্যে গুরুগিরিও তারা করতে পারেন না এই একই কারণে। হালিম ফকিরকেও জিজ্ঞাসা করেছি---কিন্তু মুসলিম সমাজে রাবিয়া বশরী তো একজন শ্রদ্ধেয়া চরিত্র, তিনি তো ছিলেন ‘ফকিরি’ নারী, তা কিভাবে সম্ভব?’ হাসি মুখে বলেছেন, কজন মানে, জানে তাঁর কথা...একবার কিজ্ঞেস করবেন দেখি?’

এই বিষয়ে মুসলিম সমাজের বন্ধুদের কারোর সঙ্গেই কথা বলতে বাকি রাখিনি। মসজিদের ইমাম, মুসলিম বিয়ের কাজী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, পরিচিত শিক্ষিত মুসলিম বন্ধু, জ্ঞানী বলে পরিচিত কেউই বাদ যাননি। প্রশ্ন ছিল একটাই—তাহলে কি ফকিরাণি বলতে আমরা যা বুঝি, সেইরকম ‘ফকিরি’ নেওয়া নারীর সাধনা সম্ভব নয়! কারো মনে কি ঈশ্বরচিন্তা আসতে পারে না? এলেও কি তা দূর করে দিতে হয়? বিস্ময় বোধ করেছি, সকলে একই উত্তর দিয়েছেন, সংসার ত্যাগ করে ফকিরি নিয়ে বিবাগী হয়ে ঈশ্বরচিন্তা শরিয়তে বিধি নেই। শরিয়ত এই নিয়ম মানেন না। আরোও বেশী বিস্ময় বোধ করেছি, আমার এই মুসলিম সমাজের বন্ধুরা কেউই তাঁদের নাম জনসমক্ষে আসুক, চাননি। উত্তর দেবার একটাই শর্ত ছিল, নাম প্রকাশ্যে না আসা। এ এক আশ্চর্য সত্যি। তাহলে আর শুধু মহিলাদের দোষ দিয়ে কি লাভ! শরিয়তের ভয় তো সকলেরই। অথচ, এঁরা সকলেই রাবিয়া বশরীকে স্বীকার করেন, শ্রদ্ধা করেন। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার! রাবিয়া তো মুসলিম ছিলেন, তাহলে তাঁর পক্ষে কি করে সংসার ত্যাগ করে ঈশ্বরচিন্তায় জীবন বাহিত সম্ভব হয়েছিল? অনেকেই উত্তর দিয়েছেন, এটি একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা, আর ব্যতিক্রমী ঘটনা তো সাধারণ উদাহরণ হিসাবে ধরা যায় না! অনেকে আবার বলেছেন, রাবেয়া মুসলিম হলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি সুফী সাধিকা ও গায়িকা, তাই হয়ত সম্ভব। অর্থাৎ সমাজের একটা অংশ এই জীবনের প্রতি আস্থা রাখেন। রাবিয়া বশরী নিয়ে এত কথাই যখন হল, কে এই রাবিয়া বশরী একটু জানা যাক। যদিও হয়ত অনেকের জানা আছে, তবু সেই সাধিকা সম্বন্ধে দু-চার কথা বলি।

রাবিয়া বশরীর জন্ম ইরাকের বসরা শহরে। সম্ভবতঃ ৯৫-৯৯ হিজরীর মধ্যে ওনার জন্ম। তিনি ছিলেন পিতামাতার চতুর্থ সন্তান, তাই তাঁর নাম রাবিয়া। হিজরী গণনা অনুযায়ী চতুর্থ মাসটির নাম রবি-উল। দারিদ্র্য ছিল তাঁর আজন্ম সঙ্গী। পিতামাতার মৃত্যুর পর বসরা শহরে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। দুর্ভিক্ষের তাড়নায় অন্যান্যদের সঙ্গে রাবিয়া অন্যত্র গেলে পরিবারের অন্যান্য সহোদরা বোনেদের থেকে বিচ্ছিন হন এবং দস্যুদের দ্বারা লুন্ঠিত হন ও ক্রীতদাসী হিসাবে বিক্রিত হন। কিন্তু এত দুঃখ,যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জীবন কাটলেও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ও অনুরাগ ছিল অটুট। তাই দেখে যিনি তাঁকে ক্রয় করেছিলেন, মুক্তি দেন। ধীরে ধীরে এই ঈশ্বর প্রেমই তাঁকে একজন সাধিকা রূপে প্রতিষ্ঠা দেয়। এই সাধনার পথে তাঁর মুরশিদ ছিলেন হজরত হাসান বশরী। রাবিয়ার ভগবৎ প্রেম, ঈশ্বরসাধনা, ঈশ্বরচিন্তা তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। অনেকেই তাঁকে বিবাহ করতে চান, কিন্তু রাবিয়া ঈশ্বর ছাড়া আর কোন কিছুর কাছে নিজেকে ধরা দেন না। তিনিই প্রথম প্রচার করেন ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরলাভ সম্ভব। সুফী সাধনার অন্যতম কবি ও সাধিকা রাবিয়া বশরীর নাম আজও অম্লান হয়ে আছে।

এক ফকিরের কথায় মুরশিদ ছাড়া কখনই এই ধরণের সাধনা সম্ভব নয়। মুরশিদই হলেন সেই পথের দিশারী। যতই প্রকাশ্যে স্বীকার অথবা অস্বীকার করুন না কেন, মুরশিদই সাধনার উপায়ের পথটি বাতলে দেন। তাই যদি হয়, তাহলে কি বাউলসাধনার সঙ্গে খুব আলাদা কিছু? এখানেও তো গুরুই সব। তাঁর মতে, অনেক ফকিরই গোপনে বাউলদের মত সাধনা করেন, সাধনসঙ্গিনীও রাখেন, কিন্তু প্রকাশ্যে তা স্বীকার করেন না। এ তো নাহয় গেল ফকিরদের কথা, কিন্তু ফকিরাণি, তারাও কি তাই? রাবিয়া বশরী কিন্তু মুরশিদের সাহায্যেই সাধনার উন্নত স্তরে পৌঁছতে পেরেছিলেন।

কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে যদিও বা দু/একজন ফকিরাণির সন্ধান পাওয়া গেল, তাঁরা নিজেরা পুরুষের উপস্থিতিতে কোনরকম শিক্ষা, দীক্ষা দিতে নারাজ। সে দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন কোন পুরুষের হাতে। প্রশ্ন করতেই তাঁরা নাম করলেন হজরত কন্যা ফতেমার কথা, যিনি মারফতি জীবন যাপন করলেও শিক্ষা-দীক্ষার ভার তুলে দিয়েছিলেন আলির হাতে। তবে কি, শরিয়তে মেয়েদের জন্য বিধান বড়ই কঠোর?

মুর্শিদাবাদ থেকে আগত দুই ফকিরের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়েছিল। তাঁরা হলেন আমীরচাঁদ ফকির এবং মোসলেম ফকির। তাঁরা জানালেন, তাঁদের ওদিকে ভিক্ষাজীবি ফকিরাণির সংখ্যা অনেক। দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই একত্র বসবাস করলেও তাঁরা কতটা ঠিক মারফতি জীবন যাপন করেন, কিংবা সাধনভজন করেন, একথা বলা শক্ত। অনেক স্থানেই ফকির-ফকিরাণিরা একসঙ্গে থাকেন, কিন্ত তার অর্থ এই নয় যে একত্রে তারা সাধনায় রত। ছুটেছি আরো কয়েক জায়গায়। কোথাও তাঁদের দেখা মেলেনি, কোথাও আবার ছিলেন, যেদিন গেছি, তাঁর দেখা পাইনি। শুধু চিন্তা করে গেছি, তবে কি, এই সমাজে মেয়েদের ঈশ্বরচিন্তায় বাধা আছে? শিক্ষা-দীক্ষা দিতে নিষেধ আছে? তাঁরা কি প্রকাশ্যে দেখা দিতেও নারাজ?

হঠাতই এক ভদ্রলোক আমাদের বাড়িতে কি একটা কাজে এলেন। আমি তখন মুসলিম সমাজের কোন মানুষ দেখলে, যাঁরাই একটু এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন, শিক্ষিত মানুষ মনে করলেই তাঁকে এসব কথা বলি, জিজ্ঞাসা করি। ভদ্রলোক অবাক, বুঝিবা কিছুটা অবিশ্বাসও করেন। আমি এসব জিজ্ঞাসা করব হয়ত ভাবেন নি। সেদিন অন্যত্র কাজ ছিল বলে তাঁকে চলে যেতে হল। একদিন এসে এই নিয়ে আলোচনা করবেন, আমায় কথা দিয়ে গেলেন। প্রশ্ন করলাম, তাঁর নামটি কি জানাতে নিষেধ আছে? যদি আমি আমার আলোচনায় তাঁর নামের উল্লেখ করি?’

দৃঢস্বরে জানালেন, না।

আমিও আশা নিয়ে রইলাম, তাঁর কাছে হয়ত বা কিছু উত্তর মিলবে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী

Posted in


প্রবন্ধ


কাল্পনিক ঘটনা অবলম্বনে একটি সত্য কাহিনী 
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্তী 


হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে হায়দ্রাবাদের হুসেন সাগরের উত্তর পাড়ের এক বেঞ্চিতে বসে উদাস দৃষ্টিতে জলের দিকে তাকিয়ে আছি। চোখের সামনে অপর সব পাড়ের সমস্ত জীবন চূড়ান্ত ভাবে জঙ্গম। 
হুসেন সাগরের এই পাড়টা মধ্যসপ্তাহে বেশ ফাঁকা থাকে। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু কপোত-কপোতী আবেগঘন অবস্থায় বকবকমরত। আমি প্রত্যেক জুটির থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে সবুজ ঘাসের আঙিনায় একটা রেলিঙে হেলান দিয়ে বসে আছি। সপ্তাহান্তে অবশ্য এইরকম নিরাপদ স্থান নির্বাচন করা অতীব দুরূহ। 

একটু পরেই চার পাশের সব আলো জ্বলে উঠে জায়গাটাকে স্বপ্নপুরী বানিয়ে দেবে। এখন অস্তগামী সূর্যের আলো হুসেন সাগরের জলে রক্ত রাঙা হোলি খেলতে খেলতে পদার্থ বিজ্ঞানের প্রতিফলন আর প্রতিসরণের অধ্যায় শেখাচ্ছে। 

অদূরে মূর্তিমান বুদ্ধদেব মাঝ সাগরে চির শান্তির প্রতীক রূপে দণ্ডায়মান। 

অবশ্য আমার চোখের সামনে সবকিছুই ধরা পড়ছে কিন্তু কিছুই যেন দেখা দিচ্ছে না। কোন এক আধুনিক কবি (শঙ্খ ঘোষ বোধহয়) বলেছিলেন যে চেয়ে থাকা আর দেখা এক নয়। এত দিনে আমি কথাটার মানে উপলব্ধি করলাম। বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকার পর বুঝতে পারলাম যে আমি অনেকক্ষণ ধরে কিছুই দেখছি না। 

আসলে মনের দিক থেকে আমি আজ একটু বিধ্বস্ত। 

কোম্পানির প্রথম তিনমাসের আয়ব্যয়ের ফল প্রকাশিত হয়েছে। আমার অঞ্চলের ফল একেবারে লালে-লাল – সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে আমি এক্কেবারে লাল বাদশা হিসেবে পরিচিত হয়ে গেছি। ভিডিও কনফারেন্সে উপরওয়ালা নিকৃষ্টতম চার অক্ষরীয় শব্দ সহযোগে মোজা টেনে তুলতে বলে দিয়েছেন আর কোমর-বন্ধনীও কষে বাঁধতে বলেছেন। 

আকারে ইঙ্গিতে এটুকু বুঝিয়ে দিয়েছেন যে বৎসরান্তে আমার অঞ্চলের ব্যবসায়িক ফলের রং একেবারে সবুজ ক্যাপ্সিকাম না হলেও নিদেনপক্ষে যেন তার হলুদ জাত ভাইয়ের গোত্রে থাকে, আর তা না হলে আমার হিমালয় পর্বত সমান স্থবির কপালে গোলাপি চিরকুটের প্রাপ্তিযোগ অবশ্যম্ভাবী। 

যে সব অত্যুৎসাহী ব্যক্তিগন চারঅক্ষরীয় শব্দ সহযোগে জনগণকে শাসন করে থাকেন, তাঁদের উদ্দ্যেশ্যে ক্রুশবিদ্ধ যীশুখ্রীষ্টের ন্যায় বলতে ইচ্ছে করে, “হে পিতঃ, এদের ক্ষমা করে দিও। “ভালবাসা”-ও যে একটা চারঅক্ষরীয় শব্দ এই বোধোদয় তাঁদের আর হয়ে উঠল না!” 

তাই আজ হুসেন সাগরের ধারে আমার এই শ্মশান বৈরাগ্য। 

এমত অবস্থায় বাতাসে ভাসমান কয়েকটি শব্দ আমার কানে চাবুকের মত আছড়ে পড়ল। বক্তার বাচনভঙ্গি বঙ্কিম যুগীয় এবং তা অতি পরিচিত বোধ হল। 

শব্দের উৎস সন্ধানে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেলাম আমার থেকে প্রায় হাত কুড়ি দূরত্বে দুই বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে কোন এক অত্যন্ত জরুরি বিষয়ে আলোচনারত। আলোচনায় ওনারা এতই মগ্ন যে বাইরের জগত ওনাদের ওপর কোন প্রভাব ফেলছে বলে মনে হচ্ছে না। 

দুজনেরই সাজপোশাক, চুলের বাহার ইত্যাদি আমার কাছে ভীষণ রকম পরিচিত বলে মনে হল। 

অপেক্ষাকৃত বয়স্ক মানুষটির কদম ছাঁট চুল। পরনে একটি অর্ধ মলিন ফতুয়া আর হাঁটু পর্যন্ত ধুতি। তবে বৃদ্ধের ফতুয়া আর ঘাড় সংলগ্ন উন্মুক্ত কাঁচা সোনার মত গায়ের রঙের ওপর উঁকি মারছে তাঁর দুধশুভ্র যজ্ঞপবীতটি। সঙ্গের বাঁশের বাঁকানো বাঁটওয়ালা ছাতাটি ভাঁজ করে পাশে রাখা থাকলেও তার বয়সটি সহজেই অনুমান করা যায়। হিসেব করে দেখলাম ছাতাটি লর্ড ক্লাইভের আমলের না হলেও লর্ড কর্নওয়ালিসের সমসাময়িক তো হবেই। 

অপর ভদ্রলোকটির বয়স যথেষ্ট হলেও চোখ দুটি খুবই উজ্জ্বল। মাথায় অযত্ন লালিত একমাথা সাদা চুল। মুখের চামড়ায় জ্যামিতির আঁকিবুঁকি। পরনে কোট-প্যান্ট। 

ভাল করে একটু নজর করতেই চমকিয়ে উঠে নিজেই নিজেকে বলে উঠলাম, আরে, এ তো এক্কেবারে ছবি থেকে উঠে আসা আমাদের আইনস্টাইন সাহেব!

এই ভর সন্ধে বেলাতে সাহেব হুসেন সাগরের ধারে কি করছে আর অপর বৃদ্ধটাই বা কে! 

ঠিক সেই মুহূর্তেই আবার বঙ্কিমি ভাষার চাবুক। 

(২) 

"যাহাই বল তুমি সাহেব, তোমাদের বৈজ্ঞানিক কুবুদ্ধির জোরেই আজ আমাদের প্রসন্ন গোয়ালিনী তাহার গাভীটিকে হরমোন ইনজেকশন দিয়া অতি লাভের ব্যবসা ফাঁদিয়াছে।"

আরে এ তো আমাদের কমলাকান্ত! কমলাকান্ত চক্রবর্তী!! 

এই প্রাতঃস্মরণীয় বিখ্যাত চরিত্রদ্বয় এই হুসেন সাগরের ধারে ভর শ্রাবণের পড়ন্ত বিকেলে কি করছে! আমি কি জেগে ঘুমচ্ছি না ঘুমন্ত অবস্থায় জেগে আছি সেটা বোঝার জন্য ডান হাতের একটি সপাট থাপ্পড় গালে মেরে দেখি মাথাটা একেবারে ঝন-ঝন করে ঝনাৎ শব্দ করে উঠল। 

চাকুরির অনিশ্চয়তার প্রভাবে কি মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! 

তারপর মনে হল যতই অবাস্তব হোক, এই দুই কিংবদন্তি চরিত্রর আলোচনায় একটু কান পাতা যাক। এটা মনে হতেই সরীসৃপের মত নিঃশব্দে দুই বৃদ্ধের বেঞ্চের পেছনে ঘাপটি মেরে বসলাম। 

এরপর 

অহো, 

যাহা শুনিলাম তাহা যেন অমৃতসমান। 
স্বামী ধ্রুবানন্দ কহে ইহা শোনে পুণ্যবান।। 

গীতার গাত্র (গীতা আমার বন্ধু পত্নী) স্পর্শ করিয়া বলিতেছি যে যাহা শুনিয়াছি তাহাই লিপিবদ্ধ করিব, কোনপ্রকার অতিরঞ্জন করিব না। 

যাই হোক, কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে আইনস্টাইন সাহেব আর আমাদের কমলাকান্তের কথোপকথন শুনবার পর বুঝতে পারলাম যে এই দুই মহান ব্যক্তিত্ব “বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ” এই বিতর্কে মত্ত। 

কমলাকান্ত অত্যন্ত উত্তেজিত ভাবে বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে আর ওদিকে যথেষ্ট যুক্তি সহকারে আইনস্টাইন সাহেব তা খণ্ডন করবার অক্লান্ত চেষ্টা করে চলেছেন। 

এই বিচিত্র বিতর্কসভার শ্রোতা-দর্শক একমাত্র আমি। 

বিতর্কে ভাষার ব্যবহারে আমি চমকিত। কমলাকান্ত এবং আইনস্টাইন দুজনই দেখলাম ইংরেজি এবং বঙ্কিমি বাংলায় সমান পারদর্শী। আল্লা কে পেয়ারে হবার পর এই দুই ব্যক্তি মহোদয় মনে হয় মা সরস্বতীর কৃপায় বহু ভাষা বিশারদ হয়ে উঠেছেন। তাই দুই ভাষাতেই বিতর্ক একেবারে জমে দই। 

তবে আমি এই বিতর্কের সব যুক্তি-তক্কো সর্বসাধারণের জন্য বঙ্কিমি বাংলায় লিপিবদ্ধ করার দুর্বল প্রচেষ্টা চালালাম মাত্র। আশা করি পাঠক নিজ গুনে বুঝে নেবেন। 

এবারে সেই অদৃষ্টপূর্ব, অশ্রুতপূর্ব বিতর্ক সভায় প্রবেশ করা যাক। 

কমলা – যাহা বলিতেছিলাম সাহেব, তোমাদিগের বিজ্ঞান মানুষকে অসৎ উপায় অবলম্বনে প্রলুব্ধ করিতেছে। ইহার ফলে আমাদের প্রসন্ন গোয়ালিনীর গাভীর দুগ্ধে সে স্বাদ নাই। আসল ক্ষীর, ননী, দধি আর পরমান্নের আজ চরিত্রের বদল ঘটিয়াছে। 

আইন - তোমার মতন খাদ্য বিশারদের দৃষ্টিতে ইহা বাস্তব হইলেও বর্তমান সমগ্র পৃথিবীর সাতশত কোটি বুভুক্ষু জনসাধারণের দুইবেলা দুই মুঠা আহারের সংস্থান কল্পে বৈজ্ঞানিক প্রথায় চাষ আবাদ অতীব জরুরি। 

কমলা - সাহেব, তোমার বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিতে যতই এই ব্রাহ্মনের যুক্তিকে খণ্ডন করিবার চেষ্টা কর না কেন, আমি ইহা জোর গলায় বলিতে পারি যে তোমাদের সমস্ত বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন আজ সৃষ্টিকে ধ্বংসের পথে চালিত করিতেছে। 

আইন – দেখ ব্রাহ্মণ, তুমি যাহা বলিতেছ, তাহাতে যে কোনই যুক্তি নাই তাহা আমি বলিতেছি না। কিছু অতি লোভী মানুষ তাহাদের ক্ষুদ্রতর স্বার্থ সিদ্ধির তাগিদে বিজ্ঞানের যে কু-ব্যবহার করিতেছে, তাহার জন্য বিজ্ঞানকে কোনমতেই দায়ী করা যায় না। 

কমলা – সাহেব, সমস্ত বিজ্ঞানীদের ইহা এক পলায়নকর মনোবৃত্তি। আমি বিজ্ঞানের অপব্যবহারের কথা কহিতেছি না। তোমরা সকল বৈজ্ঞানিক মানবজাতির উন্নয়ের নামে প্রকৃতিকে প্রতিনিয়ত বলাৎকার করিতেছ। তোমাদের সকল উদ্ভাবনী শক্তি মানব জাতির একটি ক্ষুদ্র সমস্যা সমাধানের হেতু ক্রমাগত বৃহৎ সমস্যার সৃষ্টি করিয়া চলিতেছে। 

আইন – শোন হে বেরাদর কমলা, বিজ্ঞান মানুষের অজানাকে জানিবার আগ্রহকে উদ্দীপীত করে। আর তাই আজ মনুষ্যজাতির এত অগ্রগতি, এত উন্নতি। বিজ্ঞানের শক্তিতেই মানুষ আজ পৃথিবী শাসন করিতেছে। তাহা না হইলে জন্তু জানোয়ার আর মানুষে আর কোনও প্রভেদ থাকিত না।” 


(৩) 

কমলা – তোমার যুক্তি কুযুক্তি মাত্র সাহেব। অগ্রগতি আর উন্নয়নের নামে তোমরা যাহারা বিজ্ঞানের ধ্বজাধারী, তাহারাই আজ পৃথিবীকে ধ্বংসের মুখে দাঁড় করাইয়া দিয়াছ। ভোগবিলাসের যথেচ্ছচারীতায় বিজ্ঞান ক্রমাগত ইন্ধন যোগাইয়া চলিতেছে এবং উহার ফল স্বরূপ সকল সৃষ্টি আজি এক অতল গহ্বরের সামনে দাঁড়াইয়া তাহার অন্তর্জলি যাত্রার প্রহর গুনিয়া চলিতেছে মাত্র। 

আইন – তোমার যুক্তি কুযুক্তি বটে ব্রাহ্মণ। তুমি কি বলিতে চাহ মনুষ্য জাতির জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের পথে বিজ্ঞানের কোন অবদান নাই? বিজ্ঞান যদি উন্নয়নের আলোকিত পথটি না দেখাইত তবে আজও মানূষ গুহাবাসী থাকিত। 

কমলা – সাহেব, তোমার মত সুপক্ক মস্তিষ্কবান বিজ্ঞানীদের এই আত্মতুষ্ট ভাবটিই বর্তমান মনুষ্যজাতির প্রভূত ক্ষতি করিয়াছে। তোমাদের নিত্যনূতন আবিষ্কারের মোহ তোমাদের দৃষ্টি শক্তিকে যে অস্বচ্ছ করিয়া তুলিয়াছে তাহা তোমরা মানিতে চাহিতেছ না আর ইহার ফলেই এত মারাত্মক রকম গোল বাধিয়াছে। 

আইন – মনে হইতেছে তোমার আফিঙ্গ সেবন আজ কিছু বৃদ্ধি পাইয়াছে। সঠিক কি বলিতে চাহ তাহা যদি কিছু উদাহরনসহ পেশ কর তবে বির্তকটি চলিতে পারে, তাহা না হইলে এই আমি ক্ষেমা দিলাম। 

কমলা – ভুল করিলে সাহেব। আমার উদাহরণ এতই মর্মান্তিক হইবে যে তোমায় অতি শীঘ্রই রণে ভঙ্গ দিতে হইবে। 

আইন – আচ্ছা, তাহা দেখা যাইবে। এক্ষণে তোমার দু-একটি উদাহরণ তো পেশ কর দেখি। 

কমলা – তবে শোন সাহেব, বর্তমান মনুষ্যজাতির বিজ্ঞান প্রদত্ত যে অগ্রগতির ধারাটির কথা তুমি বলিতেছ সেই বিদ্যুৎ শক্তি অতিমাত্রায় প্রচলিত জ্বালানী পদার্থ নির্ভর। সেই প্রচলিত জ্বালানী পদার্থ দহনকালে যে বিপুল পরিমাণ দূষণ সৃষ্টি হইতেছে সেই বিষয়ে তোমার আশা করি কোন দ্বিমত নাই। একটি বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদন কেন্দ্র যে পরিমাণ দূষণ উৎপাদন করিয়া থাকে তাহা তাহার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং উর্বর কৃষি জমির উৎপাদন ক্ষমতা বিপুল ভাবে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে হ্রাস করিয়া থাকে। আইস একটি ছোট্ট উদাহরণ পেশ করি। 

আইন – তাহা হইলে সেটা বেশ হয়, ব্রাহ্মণ। তোমার উর্বর মস্তিস্ক প্রসূত যুক্তিহীন আলাপ-আলোচনা হইতে আমি মুক্তি পাই। 

কমলা – বঙ্গভূমির বক্রেশ্বরের বিদ্যুৎ প্রকল্পের কথা তোমার জানা আছে সাহেব? 

আইন – অতি অবশ্যই। দুর্জনে যাহাকে একদা রক্ত বিদ্যুৎ প্রকল্প বলিয়াছিল। 

কমলা – সঠিক ধরিয়াছ। সেই প্রকল্পের উড়ন্ত ছাই দূর-দুরান্তের মানবজীবন অসহনীয় করিয়া তুলিয়াছে। তাহার জেরেই দূষণ বাড়িতেছে বীরভুমের বক্রেশ্বরে। নদীর জলে ছাই, জমিতে ছাই, হাওয়াতেও ছাইয়ের গুঁড়া। বিপন্ন এলাকার পরিবেশ এবং বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য। এলাকার একদা বহতা ষোড়শী চন্দ্রভাগা নদী এখন একটি মজিয়া যাওয়া খালে পরিণত হইয়াছে। আজ দেশের সর্বচ্চ আদালত অতিশীঘ্র বক্রেশ্বরের বিদ্যুৎ প্রকল্পের কতৃপক্ষকে দূষণ নিয়ন্রনে আনিতে আদেশ জারি করিয়াছেন নচেৎ বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধের আদেশ জারি করিয়াছেন। 

আইন – আহা, ইহা তো বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটির গাফিলতি মাত্র। উপযুক্ত আধুনিক দূষণ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের দূষণের মাত্রা নিয়ন্ত্রনে রাখিবার ব্যবস্থা আজি প্রমাণিত। কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তাহার সাহায্য না লইলে, বিজ্ঞানকে কখনই দায়ি করা যায় না। সে তো দূষণ নিয়ন্ত্রণেরও পথ দেখাইয়াছে।

কমলা – ইহা একটি অতি অবশ্য সত্য কথা। কিন্তু তুমি ইহা তো মান সাহেব যে সারা পৃথিবী জুড়িয়া যে কয়েক লক্ষ মহাশক্তি সম্পন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র আজি বিদ্যুৎ শক্তি প্রতিনিয়ত ২৪x৭x৩৬৫ ধরিয়া উৎপাদন করিয়া চলিতেছে তাহার দূষণ পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে রাখিতে পারিলেও তাহা অতীব বিপজ্জনক মাত্র। 

আইন – হাঁ তাহা আমি স্বীকার করিতেছি বটে তবে অপ্রচলিত জ্বালানি শক্তি দ্বারা বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রচেষ্টায় বিজ্ঞান আজি যথেষ্টই সফল হইয়াছে। 

কমলা – সাহেব, তোমাদিগের জয়যাত্রার ইহাই এক যন্রনা। তোমরা সর্বপ্রথমে সমস্যার সৃষ্টি কর এবং তাহা হইতে নিস্তার পাইতে আর একটি বড় সমস্যার আনয়ন কর। পরমাণু শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ শক্তির ফল যে কি ভয়ঙ্কর তাহা জাপান দেশের সুনামির সময় এবং রুশ দেশের চের্নোবিলের অঘটন কালে আমাদিগের চোখে আঙ্গুল দিয়া দেখাইয়া দিয়াছে যে ইহার প্রচলন অতীব ভয়ঙ্কর। যখন উন্নত দেশগুলি ইহার ভয়ঙ্কর ধ্বংস ক্ষমতার হাত হইতে নিস্তার পাইতেছে না সেস্থলে উন্নয়নশীল দেশগুলি তো জতুগৃহ মাত্র।  


(৪)

আইন – অঘটনের আশঙ্কায় কোন আবিস্কারের প্রচেষ্টাই স্তব্ধ হইয়া যাইতে পারে না। বাবু কলম্বাসের যদি সমুদ্র ঝঞ্ঝায় তরীর সলিল সমাধির ভয় থাকিত তবে বিশ্বের দরবারে আজি ভারতবর্ষ যে অপরিচিত থাকিয়া যাইত না তাহা কে বলিতে পারে। অজানাকে জানিবার, অচেনাকে চিনিবার এই যে স্পৃহা তাহা বিজ্ঞানই মানুষের মনে সদা জাগরিত রাখিয়া দেয়। 

কমলা – তোমার যুক্তি অস্বীকার একমাত্র মূর্খেরাই করিবে। তবে একথা একবারটি ভাবিয়া দেখিতে পার সাহেব যে বিজ্ঞান তাহার কাজটি পূর্ণাঙ্গরূপে সুসম্পন্ন করিতে অপারগ এবং ইহার ফলেই যে সকল সর্বনাশ আজ মনুষ্য প্রজাতি উপর বজ্রের ন্যায় পতিত হইতেছে তাহার সকল কারন-ই বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের ভ্রষ্ট চিন্তারই নামান্তর মাত্র। তোমাদিগের বহুল আবিস্কার শুধুমাত্র মনুষ্যজাতিকেই নহে, সমগ্র পৃথ্বীকেই আজি অন্তিম ক্ষণের দিকে ঠেলিয়া লইয়া চলিতেছে। 

আইন – সমস্ত বিজ্ঞানীই যে সৎ উদ্দ্দেশ্যে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করিতেছে তাহার দাবি বিজ্ঞান কখনই করিতে পারে না ইহা যেমন আলোকের ন্যায় সত্য তেমনই সকল ইষ্টচিন্তাময় বিজ্ঞানম্নষ্ক মানব সকল মনুষ্য সমাজ এবং পৃথ্বীর কল্যান সাধনে সদাই জাগ্রত। 

কমলা – সাহেব তোমার এই মন্তব্যটিও আমি মানিয়া লইতেছি। কিন্তু আমি যাহা বলিতে চাহিতেছি তাহা ভিন্ন। তুমি যদি ইহা সঠিক অনুধাবন করিতে পার তাহা হইলে তুমি বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের বালখিল্যতা উপলদ্ধি করিতে পারিবে। নচেৎ আমার সকল অকাট্য যুক্তি বেণু বনে মুক্তা ছড়াইবার সামিল হইয়া যাইবে। 

আইন – ভাই হে কমলাকান্ত, তোমার বক্তব্যে যত না যুক্তি খুঁজিয়া পাইতেছি তাহা হইতে অনেক বেশী বিজ্ঞানীদের উপর তোমার আক্রোশ প্রকাশ পাইতেছে। তোমার ব্যক্তিগত মতামতের ঝুলিটি আপাতত বন্ধ করিয়া যুক্তিপূর্ণ আলোচনায় প্রবেশ করিলে বড়ই বাধিত হইব। 

কমলা – সাহেব, তুমি দেখিতেছি চতুর্থ রিপুর বশবর্তী। সমালোচনা শুনিতে মোটেই অভ্যস্ত নও। 

আইন – অন্যায্য, কুযুক্তিপূর্ণ সমালোচনা কখনই কোনও সৎ উদ্দেশ্য সাধন করিতে পারে না। তুমি কি বলিতে চাহ মানব জীবনের উন্নতি সাধনে বিজ্ঞানের কোন অবদানই নাই! আজি মানব জাতি দূরূহ সকল রোগ-ভোগের হাত হইতে নিস্তার পাইয়াছে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হইয়াছে, দ্রুতগতির যানবাহনের আবিস্কারের ফলে সময়ের অপচয় বন্ধ হইয়াছে ইত্যাদি কত সফল বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ডের কথা বলিয়া শেষ করা যাইবে না। 

কমলা – সাহেব, তুমি বিজ্ঞানের সাফল্যের দম্ভে স্বচ্ছ দৃষ্টি শক্তি হারাইয়া ফেলিয়াছ। হইতে পারে তুমি অর্ধ-পূর্ণ কুম্ভের কথা বলিতেছ। কিন্তু আমি সদাই চিন্তিত কুম্ভের পশ্চাতের ছিদ্রটির লাগি। আমি তাই সদাই ভীত কুম্ভটি যেন বিজ্ঞান আর বিজ্ঞানীদের যথেচ্ছচারিতায় একেবারে নিঃশেষিত না হইয়া যায় । আজি উন্নয়নের নাম লইয়া তোমরা সকলে প্রকৃতি ধ্বংসের যে হোরি খেলায় মাতিয়াছ তাহা অবলোকন করিয়া কোন সুস্থ্য মানব স্থির থাকিতে পারিবে না। ইহার লাগি তোমরা আমাকে যতই নেতিবাচক মনোবৃত্তির অধিকারি বলিয়া গালি দাও না কেন আমার তাহাতে কোন প্রকার দুঃখ নাই। তোমরা দ্রুত গতির যানবাহনের লাগি সুদীর্ঘ রাজপথ বানাইতেছ আর তাহার লাগি সবুজ পত্রবান, ফলদায়ক, সুনিবিড় ছায়াময় বৃক্ষরাজির পতন ঘটাইতেছ। অতিশীঘ্র আমাদিগের এই সুজলা সুফলা জননী পৃথ্বী বৃষ্টিপাত হইতে বঞ্চিত হইয়া এক শুষ্ক নীরস এক রেগিস্তানে পরিণত হইবে। হায়! মানব প্রজাতির দ্বিচারিতা! বৃক্ষ ধ্বংস করিয়া তাহারা বৈজ্ঞানিক প্রথায় কাগজ বানায় আবার তাহাতেই “বৃক্ষ সকল পরিবেশ সংরক্ষণ করিয়া থাকে। বৃক্ষ নিধন বন্ধ করিতে হইবে।” ছাপাইয়া বিলি করিয়া থাকে। অহো! কি পরিমাণ এই আত্মপ্রবঞ্চনা!! হস্তে কুলহারি লইয়া বৃক্ষছায়ার সন্ধানে ঘুরিয়া মরিতেছে। তোমাদিগের সৃষ্ট কলকারখানার বিষাক্ত ধুম্রজালের প্রভাবে কোমল সদ্যজাত শিশুটিও আজি জম্নমূহুর্তেই শ্বাসকষ্টজাত রোগের শিকার। সস্তা সুবিধালাভের প্ররচনায় তোমরা “পলিথিন” নামক অজড়-অমর এক আত্মঘাতী পদার্থ আবিস্কার করিয়াছ যাহার সৃষ্টি এবং বিণাশ উভয় কালেই পৃথ্বি দূষণের দ্বারা আক্রান্ত হয়। কত আর উদাহরণ দিব সাহেব? শীঘ্রই তোমার ধৈর্যচ্যুতি ঘটিবে। তোমরা যে পরিমাণ মারণাস্ত্রের আবিস্কার ঘটাইয়াছ তাহার দ্বারা কত সহস্রবার এই পৃথিবীর ধ্বংস সম্ভব তাহা কি একটি বারের তরেও আঁক কষিয়া দেখিয়াছ কি? তোমাদের সৃষ্ট e-যুগের e-Waste আজি সর্বংসহা ধরিত্রী জননীর শিরঃপীড়ার কারণ। 


(৫) 

আইন – তুমি সত্যই বুদ্ধিভ্রষ্টের ন্যায় কথা বলিতেছ। 

কমলা -সত্য বলিতেছি সাহেব, তোমরা এক-একটি ভষ্মলোচন সৃষ্টি করিয়া মানব জাতির অতীব ক্ষতি সাধন করিয়া চলিতেছ। তোমাদিগের সমস্ত মানবজাতির হিতকারি আবিস্কার, অনাসৃষ্টিকারি আবিস্কারের নিকট আত্মসমর্পন করিয়াছে। খেয়াল কর সাহেব, সদ্য দোয়ানো প্রসন্ন গোয়ালিনির গাভীর খাঁটি দুগ্ধও যেমত একবিন্দু অম্লরসের প্রভাবে ছিন্ন হইয়া তাহার দুগ্ধত্ব হারাইয়া ফেলে, সেইরূপ তোমাদিগের শতসহস্র মানব হিতকারী আবিস্কার আজি তাহাদের শ্রেষ্ঠত্ব বিষর্জন দেয় তোমাদিগের-ই আবিস্কৃত অনাসৃষ্টিকারি সকল আবিস্কারের নিকট। 

(একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে দম নিতে কমলাকান্ত একটু থামল। ধুতির কোনা দিয়ে মুখ মুছল। আইনস্টাইন সাহেবের অবস্থা খুবই করুন মনে হল। দূর্মুখ কমলাকান্তের কাছে যে এতটা হেনস্তা হতে হবে সেটা বোধহয় না ভেবেই তিনি এই বিতর্ক সভায় যোগ দিয়েছিলেন। এখন দেখছি ডানহাতে কপালের দুই রগ টিপে ধরে বসে আছেন। শেষের দিকে সাহেব কিছু যুক্তি পেশের চেষ্টা করলেও কমলাকান্ত তাঁকে মাছি তাড়াবার ভঙ্গিতে থামিয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকে সাহেব একেবারে নীরব শ্রোতামাত্র। একটু দম নেবার পর কমলাকান্ত আবার শুরু করে) 

কমলা – শোন সাহেব, অপরাধ লইও না। তোমরা সম্যক বুঝিতে পারিয়াছ যে এই পৃথিবী ক্রমশ বসবাসের অনুপযুক্ত হইয়া উঠিতেছে। ইহার ফল স্বরূপ আজি দেখিতে পাইতেছি যে তোমাদিগের মহাকাশ অনুসন্ধান বাড়িয়া উঠিয়াছে। তোমাদিগের ভাতৃ-বন্ধু সকল আজি চন্দ্র অভিযান সম্পূর্ণ করিয়া মঙ্গলে মাহাকাশযান পাঠাইতেছে, ধূমকেতুতে মহাকাশ বিজ্ঞানের গবেষণাগার স্থাপন করিয়াছেন। 


(এইবার দেখি আইনস্টাইন সাহেব তড়িঘড়ি নিজের বক্তব্য রাখলেন) 

আইন – মূর্খ ব্রাহ্মণ, তোমার অতি উর্বর মস্তিষ্কের দ্বারা ইহা উপলব্ধি করা অতীব দুষ্কর মনে হইতেই পারে কিন্তু ইহা চিরকালীন সত্য যে কোন সৃষ্টিই চিরকালীন নয়। অতএব মানব জাতির নতুন বাস যোগ্য স্থান সন্ধানের প্রচেষ্ঠা জারি রাখা অতীব জরুরি। 

কমলা – সাহেব, তুমি আমায় মূর্খ বলিয়া যতই গালি দাও না কেন, আমার ক্ষুদ্র বিদ্যায় আমি ইহা বুঝিতে পারি যে আজি সারা বিশ্বে উষ্ণায়নের দ্বারা পৃথিবী ধ্বংসের যে ডঙ্কাটি বাজিয়াছে তাহার হোতা বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞানীদের যথেচ্ছচারিতা মাত্র। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের শিখন্ডীটি সামনে রাখিয়া তাহারা আমাদের অনাসৃষ্টিকারি জীবনযাত্রায় প্রলুব্ধ করিয়াছে। ইহার ফলে শীতকালে গ্রীষ্ম এবং গ্রীষ্মে শীতের অভিজ্ঞতার স্বাদ লইতে মানবজাতি আজি লালায়িত। অতএব ইহার ফল স্বরূপ আজি বিশ্বব্যাপী উষ্ণায়ন। 

আইন – তুমি একটি গো-মূর্খ অপগন্ড! তোমার সহিত আলোচনা শুধু কালক্ষেপ মাত্র। 

কমলা – সাহেব, তুমি চটিয়া যাইতেছ দেখিতেছি। আমার উপর তোমার এই অন্যায় ক্রোধ আমায় আরো সাহসী করিয়া তুলিতেছে। আমি বুঝিতে পারিতেছি যে আমার যুক্তি সকল খণ্ডন করিতে তোমার তূণ এক্ষণে নিঃশেষিত। অতএব এই আলোচনায় যতি টনিবার পূর্বে তোমার জ্ঞাতার্থে জানাই যে বিজ্ঞান বস্তুত একটি একচক্ষু সমৃদ্ধ হরিণ মাত্র। তোমাদের ওই একটি চক্ষুতে যাহাই দৃশ্যমান তাহাই তোমরা সঠিক বলিয়া মানিয়া লও। শুধু নিজেরাই মানিয়া লইয়া ক্ষ্যান্ত দাও না, নিজেদের কন্ঠ শক্তির সাহায্য লইয়া নিজেদেরই আবিস্কৃত সকল শব্দ যন্ত্রের সাহায্যে চোঙা ফুঁকিয়া সকল মানব জাতিকে বুঝাইতে চাহ যে তোমাদের সকল মতবাদই সঠিক। পরবর্তীকালে সেই মতবাদের আমূল পরিবর্তন তোমরা নিজেরা করিলেও তোমাদের একবিন্দু লজ্জিত অথবা অপদস্ত বোধ হয়না। 

(সাহেব দেখি কঠিন চোখে কমলাকান্তের দিকে তাকালেন) 


(৬) 

কমলা - না সাহেব, তুমি যতই অগ্নিসম দৃষ্টি দ্বারা আমায় ভষ্ম করিতে চাহ না কেন আমি কিন্তু আমার উপলব্ধি হইতে একবিন্দু টলিব না। উদাহরণ চাহ? 

(সাহেব হাল ছেড়ে দিয়েছেন মনে হল। কিন্তু কমলাকান্ত দেখলাম ছেড়ে দেবার পাত্র নয়।) 

কমলা - শুন সাহেব,

উদাহরণ-১ - তোমরাই প্রথমে প্রচার করিয়াছিলে যে পৃথিবী সমতল। তাহার পর ঘোষণা করিলে যে পৃথিবী সমতল নহে গোলাকার মাত্র। অবশেষে এক্ষণে সকল বিজ্ঞানী সহমত হইয়াছেন যে পৃথিবীর আকৃতি সঠিক গোলাকৃতি নহে তবে নাসপাতি ফলের ন্যায়। একমাত্র ঈশ্বরই বলিতে পারেন যে অদূর ভবিষ্যতে তোমাদিগের মতের আবার পরিবর্তন হইবে কিনা। ঈশ্বরকে যন্ত্রণা দিয়া লাভ নাই কারন বিজ্ঞান তো আবার ওনার উপস্থিতিতে বিশ্বাস করে না। 

(এইক্ষণে আমার স্বীকার করিতে দ্বিধা নাই যে ঈশ্বর প্রসঙ্গে তুমি অবশ্য অন্য গোত্রভুক্ত। কারন প্রকৃতির নিখুঁত সময় জ্ঞানকে ব্যাখ্যা করিতে গিয়া তুমি বলিয়াছ, “God doesn’t play dice।” আবার গীতা প্রসঙ্গে তোমার উক্তি, “When I read the Gita and reflect about how God created the Universe, everything else seems so superfluous.”) 

উদাহরণ-২ – তোমাদিগের বিখ্যাত ষ্টিফেন হকিন্স সাহেব একদা সদর্পে ঘোষণা করিয়াছিলেন যে কৃষ্ণ গহ্বর সর্বগ্রাসী মাত্র। উহার উদরে কোনকিছু একবার প্রবেশ করিলে তাহা সেই “দূর্বাসা মুনির বাতাপি হজম” কর্ম কাণ্ডের সামিল হয়। কৃষ্ণ গহ্বরের উদর হইতে কোন কিছু নির্গত হইবার সম্ভবনা একেবারেই অসম্ভব। কিন্তু পরবর্তী কালে হকিন্স সাহেব নিজেই স্বীকার করিয়াছেন যে কৃষ্ণ গহ্বর হইতে কিছু রশ্মির বিকিরণ এক্ষণে প্রমানিত সত্য। তাঁহার এই মত পরিবর্তনের ফলে ওনার এক বৈজ্ঞানিক বন্ধুর নিকট বাজী হারিবার খেসারত হিসাবে আমেরিকান ফুটবল রাগবির একটি হ্যান্ডবুক ক্যুরিয়র মাধ্যমে পাঠাইতে হইয়াছিল। তোমার বিশ্বাস না হইলে তুমি গুগুল জ্যাঠামশায়ের শরণাপন্ন হইতে পার। 



উদাহরণ-৩ – আমাদিগের প্রাচীন মুণি-ঋষিগন বহুকাল হইতেই বলিয়া আসিতেছেন যে মহাকাশের নবগ্রহের মধ্যে রাহু এবং কেতু পুর্ণ গ্রহ নহে। তোমরা আমাদিগের এই গরীব দেশটির মহাকাশ চর্চার প্রতি কটাক্ষ করিয়াছ। অবশেষে নিজেরাই স্বীকার করিয়াছ যে তোমাদিগের “প্লুটো” গ্রহটি অর্ধ গ্রহ মাত্র। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে তোমরাই আবার অন্য কোন গ্রহকে “অর্ধ” বানাইয়া আমদিগের পাঠশালাতেই নাম লিখাইবে। 

যাহাহৌক, উদাহরন সংখ্যা বৃদ্ধি করিয়া তোমাকে আর লজ্জায় ফেলিতে চাহি না সাহেব। আশা করি আমার বক্তব্য তুমি সঠিক উপলব্ধি করিয়াছ। কিন্তু আমায় যাহা ক্রমাগত পীড়া দেয় তাহা বিজ্ঞানের এই চঞ্চলতা নহে। আমি এই বিষয়ে তোমার “আপেক্ষিক” তত্ত্বকে শতকরা শতভাগ বিশ্বাস করিয়া থাকি। এই জগতে কোন কিছুই চিরকালীন সত্য নয়, সবই আপেক্ষিক মাত্র। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে বিজ্ঞানের যে অগ্রগতি ঘটিয়া চলিয়াছে তাহাতে সকল সত্য নূতন আলোকে আলোকিত হইতেই পারে ইহাতে কোন দ্বিমত নাই। 

আইন – হাঁ, ইহা সত্য বটে যে বিজ্ঞান কখনই এই দাবি করে না যে সে চিরকালীন সত্যটি জানিয়া গিয়াছে। 

কমলা – তাহা আমি জানি সাহেব। তবে বিজ্ঞান তাহার পুরাতন মতটিকে বেমালুম ভুলিয়া গিয়া, যখন তাহার বর্তমান মতটিকে জবরদস্তি করিয়া অন্য সকল মতবাদকে তাহার কন্ঠশক্তিতে পরাজিত করিয়া প্রতিষ্ঠিত করিবার যে অপচেষ্ঠা করিয়া থাকে তখনই আমার প্রবল আপত্তি সাহেব। 

আইন – তোমার এই কথার কোন যুক্তি নাই। 


(৭) 

কমলা – বল কি সাহেব? তবে আইস তোমায় উদাহরণ স্বরূপ বলি, তোমরা তোমাদিগের বিজ্ঞান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত “অ্যাষ্ট্রোনমি”কে মান্যতা দাও, কিন্তু “অ্যাষ্ট্রোলজি”তে বিশ্বাস কর না যদিও বহু বিজ্ঞান মনষ্ক মানবক নব গ্রহের শান্তি স্বস্ত্যয়নের জন্য বহু প্রকার প্রস্তর খন্ড ধারণ করিয়া থাকেন। বিজ্ঞান এই সমগ্র বিশ্বাসটিকে কুসংস্কার বলিয়া ব্যঙ্গ করিয়া থাকে। বিজ্ঞান বলে কোন গ্রহের প্রভাবে মানব জীবন নিয়ন্ত্রিত হয় না এবং কোন প্রস্তর খন্ড ধারণ দ্বারা নব গ্রহের প্রভাব মুক্ত হওয়ার প্রচেষ্ঠা মূর্খামি মাত্র। এই প্রসঙ্গে তর্ক সাপেক্ষে একটি কথা বল দেখি সাহেব, চন্দ্র-সূর্যের আকর্ষন-বিকর্ষনের ফলের প্রকাশ হিসেবে যদি পৃথিবীর সমুদ্র আর নদীতে জোয়ার-ভাঁটা খেলিতে পারে তাহা হইলে মানব জীবনে উহাদের প্রভাব অবশ্যি থাকিতে পারে এই “Hypothesis” টির প্রতিষ্ঠা পাইতে বাধা কোথায়? এই “Hypothesis”টিকে “Law”-এ পরিণত করিবার প্রচেষ্টায় সাহায্য না করিয়া বিজ্ঞান আজ তাহাকে ব্যঙ্গ করে মাত্র। বিজ্ঞান অদ্যপি “মানব জীবনে গ্রহের প্রভাব” রহস্যটি উদ্ঘাটন করিতে পারে নাই বলিয়া তাহা যে সত্য নহে – এই অপপ্রচারটি বিজ্ঞানের প্রবল কন্ঠশক্তিরই পরিচয় মাত্র। 

আইন – কমলাকান্ত, তুমি নিজের বিজ্ঞান বিদ্রোহ প্রকাশ করিতে ক্রমাগত অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ টানিয়া আনিতেছ। 

কমলা – হাঁ সাহেব। এই অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ উপলক্ষে বিজ্ঞানের আর একটি অস্বাভাবিক আচরণ অনুধাবন কর সাহেব। বিজ্ঞান দ্বারা যেহেতু “অ্যাষ্ট্রোলজি” একটি প্রমানিত সত্য নয় সেই কারন বশত ইহা বিজ্ঞান জগতে অচ্ছুৎ। আবার যেহেতু অপ্রমাণিত সত্য বিজ্ঞান স্বীকার করিয়া থাকে না সেহেতু “অ্যাষ্ট্রোনমি”তে নোবেল পুরস্কারের বরাদ্দ নাই। এই কারনে তোমাদিগের ওই ষ্টিফেন হকিং সাহেবের কপালে নোবেল জোটে নাই এবং ইহাতে তিনি যথেষ্ট মনক্ষুন্নই ছিলেন বলিয়া শুনিয়াছি। কিন্তু বৈজ্ঞানিক মহলে তিনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি! “অ্যাষ্ট্রোলজি”র চর্চারত ব্যক্তিগণের ন্যায় তিনি মোটেই অচ্ছুৎ নন। এই দুইটি বিষয়-ই যখন “প্রমাণিত সত্য” নয় তখন বিজ্ঞানের “অ্যাষ্ট্রোনমি”র ক্ষেত্রে এই পক্ষপাতিত্ব কেন – এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর সাহেব তোমার নিকট আশা করিতে পারি কি? অবশ্য তোমার নিকট যদি তাহা উপলব্ধ হয়। 

আইন – কমলাকান্ত, মনে হইতেছে তুমি বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক সংক্রান্ত সকল কর্মকান্ডেরই বিরোধী। ইহা মোটেই সুস্থ্য মস্তিস্কের পরিচয় নয়। বর্তমান মানব সমাজের দৃশ্যমান যা সকল উন্নয়ন এবং মনুষ্য জীবনযাত্রার উন্নতি প্রকল্পে বিজ্ঞানের অবদানকে অস্বীকার করা আত্মহননের সামিল হইবে এই সত্যটি আশা করি বিস্মৃত হইবে না। “কূপমণ্ডূক” শব্দটির অর্থটি তোমার নিশ্চয় অজানা নয় ব্রাহ্মণ। 

কমলা – তুমি সাহেব আমায় অনর্থক দোষী সাব্যস্ত করিতেছ। আমি বিজ্ঞানের সফলতাকে কখনই কটাক্ষ করিতেছি না। আমি আবার আমার বক্তব্য পরিষ্কার করিয়া বলিতেছি যে নিত্য নূতন আবিস্কারে মোহে বৈজ্ঞানিকেরা তাহাদের সকল আবিস্কারের নেতিবাচক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুলিতে সঠিক দৃষ্টিদান হইতে বিরত থাকিতেছে। এই ধারাটি বজায় থাকিলে বিজ্ঞানসহ মনুষ্য প্রজাতির সমূহ ক্ষতির সম্ভবনা আছে। উদাহরণ স্বরূপ বলিতে পারি যে মানব জীবন যাত্রার মানের উন্নতিকল্পে বিজ্ঞান মানুষকে ক্রমাগত অলস করিয়া তুলিতেছে এবং ইহার ফলে মানুষ ক্রমশ শ্রম বিমুখ হইয়া উঠিতেছে। সাহেব আশা করি ইহা স্বীকার করিতে তোমার দ্বিধা নাই যে বর্তমান আধুনিক জীবনযাত্রা জনিত রোগ-ব্যাধির আক্রমণে মনুষ্য জাতি আজিকে যৌবনেই পঙ্গু হইয়া পড়িতেছে। বিজ্ঞান মানুষের গড় পরমায়ূ বৃদ্ধি করিতে সফল হইলেও তাহার মান বৃদ্ধি করিতে পারে নাই। 

আইন – একটি কথা তোমায় জানাইয়া রাখা জরুরী মনে করি কমলাকান্ত, বিজ্ঞান মানুষের ক্ষতি সাধন করিতে কখনই ইচ্ছুক নহে। আমি আবার বলিতেছি, বিজ্ঞানকে অসৎ পথে চালিত করিতে কিছু দুষ্ট লোক সদাই তৎপর। 

কমলা – তোমার এই যুক্তি মানিয়া লইয়াও বলা যাইতে পারে যে বিজ্ঞানকে অসৎ পথে চালিত যাতে না করা যায় সেই দিকে বিজ্ঞানের যাঁহারা সেবক বলিয়া দাবি করিয়া থাকেন, তাঁহাদেরকেই সচেষ্ট থাকিতে হইবে। তাঁহারা এক একটি ফ্রাঙ্কেনষ্টাইন সৃষ্টি করিয়া তাহাদেরকে মনুষ্য সমাজে ছাড়িয়া দিলে সাধারন মানুষ কখনই বিজ্ঞান এবং তাহার ধারক ও বাহকদের ক্ষমা করিবে না। সেই ক্ষেত্রে বিজ্ঞান চিরকাল মনুষ্য জাতির নিকট অভিশাপ রূপেই পরিগণিত হইবে। 

আইন – ব্রাভো কমলাকান্ত ব্রাভো! তোমার শেষ দিকের বক্তব্য শুনিয়া আমার এই ধারণা হইতেছে যে তুমি নিজেও বিশ্বাস কর যে একমাত্র বিজ্ঞান প্রদর্শিত আলোকিত পথেই জগত এবং মনুষ্য প্রজাতির উন্নতি সম্ভব। কিন্তু তুমি বিচলিত হইয়া পড় যখন দেখিতে পাও কিছু অসাধু ক্ষমতা প্রিয় মানুষ অতি লোভী কিছু বিজ্ঞানীর সহিত একত্রে জগত এবং মানুষের ধ্বংসের কাজে বিজ্ঞানকে ব্যবহার করিতেছে। হাঁ কমলাকান্ত, এই বিষয়ে আমিও তোমার সহিত একমত। অতএব আইস, এইস্থলে আমাদিগের আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটাই। 

(৮) 

(এরপর দেখলাম আইনস্টাইন সাহেব কমলাকান্তকে একটি Tight Bear Hug দিলেন। তারপর শুনলাম কমলাকান্ত সাহেবকে বলছে...) 

কমলা – তথাস্তু! অপ্রাসঙ্গিক হইলেও সর্বশেষে তোমায় একটি কথা জানাইয়া রাখি সাহেব। তোমার আপেক্ষিক তত্ত্বটির আমি একটি সহজ সরল ব্যাখ্যা আমি এই হায়দ্রাবাদে উপলব্ধি করিয়াছি। তুমি অনুমতি করিলে তোমার গোচরে আনিতে পারি। আশা করি তুমি এই মুর্খের অবিমৃশ্যকারিতায় রুষ্ট হইবে না। 

আইন – আমার Theory of Relativity তত্ত্বের তুমি যে সহজ-সরল ব্যাখ্যাটি উপলব্ধি করিয়াছ তাহা আমি শুনিতে অতীব ব্যাকুল। তুমি অকপটে তাহা আমার নিকট এইক্ষণে ব্যক্ত করিতে পার। 

কমলা – অপরাধ লইও না সাহেব। তোমার ওই জটিল তত্ত্বটির সরল উপলব্ধি হইবে যদি কোন ব্যক্তি হায়দ্রাবাদের আমিরপেট নামক স্থানে রাজপথ দিয়া হাঁটিতে থাকে এবং কিয়ৎকাল পরে যদি সেই ব্যক্তি সেই রাজপথে মোটরযান যোগে ভ্রমণে প্রবৃত্ত হয়। 

আইন – হন্টন এবং মোটর যান যোগে ভ্রমণ – এই দুই কার্য-কারণে কি প্রকারে আমার এই Theory of Relativity তত্ত্বটি উপলব্ধি হয় তাহা একটু বুঝাইয়া দাও দিকি ভাই। 

কমলা – দেখ সাহেব, তুমি যখন আমিরপেটের রাজপথে হাঁটিতেছ, তখন তোমার মনে হইবে যে রাজপথের সকল মোটর যান তোমার স্কন্দে আসিয়া পড়িতেছে, আবার সেই রাজপথেই যদি তুমি মোটরযানে ভ্রমণ করিতে থাক তাহা হইলে তোমার মনে হইবে যে রাজপথের সকল পথিক তোমার মোটরযানের সামনে আসিয়া আত্মহত্যায় ইচ্ছুক। অতএব ইহা সঠিক নয় কি যে পথিকের মানসিক উপলব্ধি তাহার আপেক্ষিক অবস্থানের উপর সতত নির্ভরশীল? 

(কমলাকান্তের এই Theory of Relativity-র এই ব্যাখ্যা শুনে সাহেব দেখি এক লাফ দিয়ে উঠে কমলাকান্তকে জড়িয়ে ধরে তার ডান গালে একটি সশব্দ চুমু খেয়ে ফেলল! কমলাকান্তের শ্মশ্রু-গুম্ফ হীন দুধ শুভ্র গাল ম্লেচ্ছ চুম্বনে রক্ত বর্ণ ধারণ করল। ধুতির খুঁট দিয়ে সাহেবের উপহারটির পরিচর্যা করতে করতে কমলাকান্ত সাহেবকে বলল…) 

কমলা – সাহেব, তুমি বল দেখি আমার এই ব্যাখ্যা সঠিক কিনা? 

আইন – ভাই কমলা, আমার Theory of Relativity তত্ত্বের ব্যাখ্যা আমি নিজেও দিয়াছি আবার বহু বড় বড় বিজ্ঞানীরাও দিয়াছেন। কিন্তু এত সহজ-সরল ব্যাখ্যা আমি কখনও শুনি নাই। আমি আজই বৈদ্যুতিন পত্রের মাধ্যমে জেনিভা নগরে আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সঙ্ঘের নিকটে তোমার এই ব্যাখ্যা পেশ করিব। “বোস-আইনস্টাইন” থিওরির ন্যায় “আইনস্টাইন থিওরি ও চক্রবর্তীর ব্যাখ্যা” নামে ইহা তাহাদের আগামী বৈজ্ঞানিক জার্নালে প্রকাশিত হইবে এবং ইহা বৈজ্ঞানিক মহলে অতি অবশ্যি স্বীকৃতি পাইবে।” 

এরপর দেখি দুই বয়োবৃদ্ধ মানুষ হাত ধরাধরি করিয়া “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে...” গানটি গাইতে গাইতে হুসেন সাগরের দিকে হাঁটতে লাগলেন। হঠাৎ পাশের ঝোপ থেকে “ম্যাঁও” ডাক শুনে সেদিকে চেয়ে দেখি “হ-য-ব-র-ল” র সেই হুলো বেড়ালটা কেমন ফ্যাক ফ্যাক করে এক চোখ বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ওকে তাড়া দিতেই দেখি সে তার মোটা ল্যাজ তুলে ভোঁ দৌড়। 

তারপর আবার সামনে তাকিয়ে সেই ঐতিহাসিক চরিত্রদ্বয়ের আর দেখা পেলাম না। 

কি আর করি বাড়ি ফিরে গিন্নীকে এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার কথাটি জানাতে উনি যে দৃষ্টিতে আমাকে দেখলেন, তাতে আমার পক্ষে তাঁর কাছে আমার এই দূর্লভ অভিজ্ঞতাটির বিবরণ সম্পূর্ণ করা হয়ে উঠল না। শেষমেশ ঠিক করলাম আমার এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার কথাটা লিপিবদ্ধ করে “ঋতবাক”-এর সম্পাদকের দপ্তরে পাঠিয়ে দেব। 

তারপরের কথা পরে ভাবা যাবে। 

0 comments:

1

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ৪ 
শিবাংশু দে

'...ফেরার পন্থা বন্ধ করে আপনি বাঁধো বাহু ডোরে 
ওরা আমায় মিথ্যে ডাকে বারে বারে 
জানি নাই...' 


রবীন্দ্রনাথকে 'এলিটিস্ট' বলার প্রথাটি আধুনিক বাঙালি, অর্থাৎ বঙ্কিমপরবর্তী যুগের নব্যশ্রেণীর নাগরিক সমাজের কাছে একধরনের সেরিব্রাল কণ্ডূয়ণ হয়ে উঠেছে দীর্ঘকাল ধরে। হয় এই সৃষ্টিটিকে ‘ফুলের মালা, দীপের আলো, ধূপের ধোঁয়া’দিয়ে পুজোআচ্চা অথবা সঙ্গীতবোর্ডের সংরক্ষণ দিয়ে দিয়ে আবেষ্টিত রাখা হবে। নয়তো মাঠময়দান, চা'য়ের ঠেকে চীৎকৃত নানা অগভীর যুক্তিঝঞ্ঝায় ছিন্নভিন্ন করাটাই অভীষ্ট স্মার্টনেস। যতো সময় এগিয়েছে, দ্বিধাবিভক্ত বৃহত্তর আমশ্রোতার জগৎ পরস্পর আরো দূরে চলে গেছে। এই নিয়ে প্রথম বিভাজনটি প্রকট হয় পঙ্কজকুমার মল্লিকের রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার সূত্রে। তিনি নিজে ছিলেন ন্যাচরল গায়ক। সুকণ্ঠ এবং একান্তভাবে রবীন্দ্রমনস্ক। খোদ রবীন্দ্রনাথও তাঁকে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচারপ্রসারে নিজস্ব ধারার প্রবর্তন করেন। লোকপ্রিয় জনমাধ্যম চলচ্চিত্রের তারকা কুন্দনলাল সহগলকে অনর্গল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার সুযোগ করে দেন। তার সঙ্গে নিজেও সবধরনের গণমাধ্যমে নিরন্তর রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে চলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের একটি পৃথক জঁর, যেটা জোড়াসাঁকো-শান্তিনিকেতনের গায়নধারা থেকে ভিন্ন, সাধারণ শ্রোতার শ্রবণ অভ্যাসের মধ্যে জায়গা করে নিতে থাকে। চলিত গণমাধ্যমের শ্রোতাদের কাছে তখনও পর্যন্ত জোড়া-নিকেতনের গান বিষয়ে বিশেষ স্পষ্ট ধারণা ছিলনা। শ্রোতাদের যে অংশটি চিরকাল এলিটিজমের বিরুদ্ধে সক্রিয় ছিলো, তারা পঙ্কজকুমারের প্রয়াসকে কেন্দ্র করে নিজস্ব মতপ্রকাশের একটি মঞ্চ খুঁজে পায়। যদিও পঙ্কজকুমার নিজে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে এই জাতীয় কাজিয়ার অংশ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর এবং কুন্দনলাল সহগলের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিপুল জনসমাদর জোড়া-নিকেতনের অনেক প্রভাবশালী মানুষকে তাঁর প্রতি বিরূপ করে তোলে। 


এই বিরূপতা বেশ প্রকট হয়ে ওঠে পরবর্তীকালে, যখন দেখা যায় পঙ্কজকুমারের অনুসারী গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বা আরো পরে কিশোরকুমার গীত রবীন্দ্রসঙ্গীত বৃহত্তর শ্রোতৃবর্গকে একেবারে অভিভূত দিয়েছিল। এই দুই ধারাকে সমন্বিত করার একটা আন্তরিক প্রচেষ্টা করতেন সন্তোষকুমার সেনগুপ্ত মশায়। তিনি নিজে ছিলেন একজন গুণী শিল্পী ও এইচ এম ভির রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রশিক্ষক। কিন্তু তিনিও শেষ পর্যন্ত জোড়া-নিকেতন নির্দিষ্ট শাসনের বিরুদ্ধে দেবব্রত বিশ্বাস নামক নেমেসিসকে আটকাতে পারেননি। মনে হয়, তিনি চান'ওনি। কারণ প্রথমতঃ তিনি দীর্ঘকাল ব্যবসায়িক রেকর্ড কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত থাকার সূত্রে জনগণেশের রুচি ও চাহিদার ক্রমবিবর্তন বিষয়ে ওয়াকিফ ছিলেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি দীর্ঘকাল ধরে জর্জদার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন। তাই রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে জর্জদার ধারণাটির সঙ্গে তাঁর সম্যক পরিচয় ছিলো। একবার একটি একান্ত আলাপচারিতার সময় উপস্থিত থাকার সুবাদে তাঁর কাছে শুনেছিলুম রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক গীতধারাটিকে অনভিজাত শ্রোতার দরবারে পত্রপুষ্পে ভরিয়ে তোলার যে শ্রেয়ফল তা পঙ্কজকুমার ও তাঁর অনুসারী শিল্পীদেরই প্রাপ্য। পঙ্কজকুমার ও তাঁর অনুসারী শিল্পীদের ন্যাচরাল গায়নভঙ্গির অংশীদার হওয়া ব্যতিরেকে জর্জ বিশ্বাস নিজে সচেতনভাবে এই বিভাজনের সঙ্গে সংলিপ্ত ছিলেন না। কিন্তু পাকেচক্রে তিনিও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো অতি লোকপ্রিয় অথচ 'এলিট' শ্রোতা অনাদৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ন ঘরানার পথিকৃৎ হয়ে পড়েন। কালক্রমে রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক শিল্পধারণাটির ভবিষ্যতের অভিমুখ নির্দিষ্ট করে দেন। 



'...আমি যত ভার জমিয়ে তুলেছি সকলই হয়েছে বোঝা' 



জর্জ বিশ্বাসের 'স্বেচ্ছায়' রেকর্ডিং বন্ধ করা একালের বাঙালিমানসে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভবিষ্যত বিষয়ে একটি নির্ণায়ক মোড়। এই ঘটনাটি বৃহত্তর শ্রোতাসমগ্র ও পরবর্তী প্রজন্মের শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গ্রহণযোগ্যতার ক্ষেত্রে একটা নতুন বাঁক এনে দিয়েছিলো। 

" এলিটিস্ট বলতে যা বোঝায়, রবীন্দ্রসঙ্গীত যে কেবল তাঁদেরই 'বিষয়' হয়ে রইলো, একথাটা আমি মানিনা তত। স্কুলের প্রাঙ্গনে, পাড়ার ক্লাবে, রাজনীতির আখড়ায় রবীন্দ্রসঙ্গীত আজও একেবারে অপাঙক্তেয় বা অপরিচিত হয়ে যায়নি। এলিটিজমের বৃত্তে নয়, এইটুকু হয়তো বলা যায় যে এই গান আমাদের মধ্যবিত্ত গণ্ডিটিকে এখনও পেরিয়ে যেতে পারেনি।" (শঙ্খ ঘোষ) 

'রবীন্দ্রসঙ্গীত' বিষয়ে খোদ রবীন্দ্রনাথের ধারণাটি কী ছিলো? মানে নিজস্ব চিন্তা-কল্পনা ও মননে সৃষ্ট সঙ্গীতের রূপ নিয়ে তাঁর প্রত্যাশাটি কেমন ছিল তা নিয়ে একটু ভাবা যেতে পারে। 

যখন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড হতে শুরু করেছে তখন থেকে একটা ডকুমেন্টেশন আছে। কিন্তু তার আগের পর্বে লোকমুখে ও স্মৃতিকথাসূত্র অনুসারে জনমনে এই গানের ছাঁচটি কেমন ছিল তাও মনে রাখতে হবে। 

১৮৯৮ সালে গায়ক শ্যাম ভট্টাচার্য মশায়কে মাসিক বেতনের চুক্তিতে শান্তিনিকেতনে নিযুক্ত করা হয়। তিনি উপাসনামন্দিরে প্রভাতী ও সান্ধ্য অধিবেশনে ব্রহ্মসঙ্গীত পরিবেশন করতেন। এই সব গানের সিংহভাগের রচয়িতা ছিলেন ঠাকুরবাড়ির বিভিন্ন সদস্যেরা। উল্লেখ নিষ্প্রয়োজন যে রবীন্দ্রনাথই ছিলেন মুখ্য রচয়িতা। তিনি যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন করতেন তখন রবীন্দ্রনির্দিষ্ট স্বরলিপি ও গায়নভঙ্গির বিশেষ তোয়াক্কা করতেন না। সম্পূর্ণ নিজের ঢঙে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে গেছেন খোদ শান্তিনিকেতনে বসে ১৯৪০ সালে তাঁর দেহাবসান পর্যন্ত। কবি যখন শান্তিনিকেতনে থাকতেন, তিনি এই ভঙ্গিতেই নিজের গান শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন। কখনও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন বলে জানা যায়না। ১৯১৫-১৬ সালে শান্তিদেব যখন ৫-৬ বছরের বালক তখন তিনি দেখতেন দেহলি বাড়ির একতলার অধিবাসী দিনু ঠাকুরকে দোতলার মালিক রবীন্দ্রনাথ গান বেঁধে শোনাচ্ছেন আর দিনু ঠাকুর তৎক্ষণাৎ সেগুলির সুর লিখে ফেলছেন। তার পর সেই সব গান সবাইকে ডেকে শেখানোর মধ্যেই তাঁর আনন্দ। 'সবাই' মানে পাঁচ থেকে পঞ্চান্ন বয়সি সব আশ্রমিক। তাঁদের অধিকাংশেরই কোনও যথার্থ সঙ্গীত শিক্ষা ছিলোনা। কিঞ্চিৎ বেসুরো বা বেতালা হবার ক্ষেত্রে কোনও বাধাও ছিলোনা। সচরাচর বিকেলের দিকে এই গানের আসর অনুষ্ঠিত হতো এবং সেখানে অধিকাংশ দিনই কবি স্বয়ং উপস্থিত থাকতেন। তিনি নিজে দিনু ঠাকুরসহ গলা মেলাতেন খোলা মনে। সানন্দে, সমস্ত সহগায়কদের সঙ্গেই। এই পরিবেশনের সময় একটা বিষয় স্পষ্ট থাকতো, সবাই যেন স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের সঙ্গে এই যজ্ঞে ভাগ নেয়। অতএব শুরু থেকেই এটা নির্দিষ্ট ছিল তাঁর গান নিছক আনন্দের গান, 'আভিজাত্যে'র ছদ্ম আবরণ মুক্ত। বাঁধাবাঁধির বহুদূরে তার স্থান। 

কবির গান পরিবেশনের শাস্ত্রীয় অঙ্গটি নিয়ে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস নে'ন পন্ডিত ভীমরাও শাস্ত্রী। তিনি যে শুধু বিভিন্ন হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় গায়নকলায় দক্ষ ছিলেন তাই নয়। তিনি তবলা, পাখোয়াজ আদি বাদ্যযন্ত্রেও সমান পারদর্শী ছিলেন। ১৯১৪ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে সঙ্গীত অধ্যাপক হয়ে আসেন এবং প্রায় পনেরো বছর ধরে এই দায়িত্বপালন করে যন। তিনি বাংলা জানতেন না, কিন্তু একান্ত আগ্রহী চেষ্টায় বাংলা শেখেন। তার পর রবীন্দ্রসঙ্গীতও গাইতে শুরু করেন। যদিও তাঁর বাংলা উচ্চারণে কিছু জড়তা ছিলো, কিন্তু কবি তাঁর গায়ন খুব পছন্দ করতেন । বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে দিয়ে একক গানও করাতেন। অতএব ক্ষেত্রবিশেষে উচ্চারণের নিখুঁতত্বও কবির বিচারে তেমন জরুরি ছিলোনা। 



প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিছুদিন আগে থেকেই বিভিন্ন পেশাদার গায়কগায়িকারা রবিবাবুর গান গ্রামোফোন রেকর্ড করতে উদ্যোগী হয়ে পড়েন। এঁরা কেউ সুর-বাণী-লয়-তালের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রাবীন্দ্রিক মানদণ্ডের ধার ধারতেন না। যে যেমনভাবে পেরেছেন, গান রেকর্ড করে গেছেন। 


সেকালের যে রেকর্ডিংগুলি রয়েছে সেখানে প্রাচীনতম দ্বিজেন্দ্রনাথ বাগচী গীত 'কেন যামিনী না যেতে জাগালে না'। ১৮৯৭ সালে রচিত এই গানটি ১৯০৪ সালে প্রথম রেকর্ড হয়। প্রথম থেকেই বিতর্কিত এই গানের বাণী এবং বক্তব্য। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তো রীতিমতো যুদ্ধং দেহি রব তুলেছিলেন এবং অশ্লীল বলে ঘোষণাও করেছিলেন এই গানটিকে। আমাদের পিতৃদেবেরা যখন রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুরু করেন, তখন হেমন্ত গীত এই গানটির রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এখনও পর্যন্ত সেটাই স্ট্যান্ডার্ড গায়ন। হেমন্তের মাপদণ্ডের নিরিখ নিয়ে যদি নিরপেক্ষও থাকি, তবু দ্বিজেন্দ্র বাগচী গীত রেকর্ডটি নবীন প্রজন্মের শ্রোতা কেন, আমাদের প্রজন্মের শ্রোতাদের কাছেও একটি কমিক গান বোধ হবে। সেই একই পরিণাম দেখবো ১৯০৫ সালে রেকর্ড করা পূর্ণকুমারী দাসীর দু'টি গান, 'পুরানো সেই দিনের কথা' ও 'আমি চিনি গো চিনি তোমারে'। 


আমি নিশ্চিত, বলে না দিলে একালের শ্রোতা বুঝতেই পারবেন না, এগুলো আসলে কোন গান রেকর্ড করা হয়েছিলো। অথবা ১৯০৬ সালে বেদানা দাসীর গাওয়া 'আজ তোমারে দেখতে এলেম অনেক দিনের পরে'। 'প্রায়শ্চিত্ত' নাটকে বসন্ত রায়ের গান, কিন্তু আমরা এই গানটি যাঁর কণ্ঠে শুনে বড়ো হয়েছি, অর্থাৎ অশোকতরু বন্দোপাধ্যায়, তাঁর সঙ্গে এই গান বা গায়কি এত-ই আলাদা যে বোঝাই যায়না যে কোন গান। 



এর সঙ্গে ১৯০৫ সালে মানদাসুন্দরীর গাওয়া 'মাঝে মাঝে তব দেখা পাই' নেওয়া যেতে পারে। এই সব গায়িকারা দু'রকম গান জানতেন, টপ্পা-খেমটা বা নিজের মতো করে কীর্তন। তাই এই সব 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' ঐ সব শৈলীর জারজসন্তান হয়ে বিক্রি হতো। আবার ১৯১৮ সালে জিতেন্দ্রনাথ দত্তের গাওয়া 'একদা তুমি প্রিয়' বা ' এতোদিন যে বসেছিলেম' শুনলে মনে হবে প্রসাদী শ্যামাসঙ্গীত শুনছি। 


কবি এ সমস্তই শুনতে পেতেন। কিন্তু এই সব যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে কোনও সরব প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন, এমন কোনও উল্লেখ দেখিনি। ১৯২৬ সালে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠিত হবার পর কবি এ বিষয়ে সচেতন হতে শুরু করেন। যেসব রেকর্ড কোম্পানি রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রকাশ করতো, তাদের তিনি নির্দেশ দেন যে গানের বাণী ও সুর যথার্থভাবে শেখার পরেই যেন গায়কেরা তা রেকর্ড করেন। কিন্তু এ ব্যাপারেও তাঁর কোনও গোঁড়ামি ছিলোনা কখনও। বরং তিনি স্বতপ্রবৃত্ত হয়ে তৎকালীন লোকপ্রিয় শিল্পীদের উৎসাহিত করেন। যদিও এই সব শিল্পীদের সঙ্গীত শিক্ষণ ছিলো অন্য ধারার, কিন্তু তাঁরা কবির প্রেরণা ও আশীর্বাদ লাভ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখ্য, কুন্দন লাল সহগল, কানন দেবী, পঙ্কজকুমার মল্লিক, কৃষ্ণচন্দ্র দে, নীহারবালা, শান্তা আপ্তে, রেণুকা দাশগুপ্ত প্রমুখ। লক্ষ্য করার বিষয়, কবি কিন্তু নিজে কখনও এঁদের গায়নপ্রক্রিয়ার মধ্যে কোনও অসম্পূর্ণতা বা বিধিচ্যুতি আবিষ্কার করেননি, যা পরবর্তীকালে তাঁর তাঁদের নিজস্ব ধ্বজাধারীরা খুঁজে পেয়েছিলেন। 


অনেক পরে কবির পরিণত বয়সেও এ নিয়ে তাঁর অবস্থানে কোনও পরিবর্তন আসেনি। ১৯৩১ সালে কবির সত্তরবর্ষ জন্মদিন উদযাপনকালে সেই সময়ে বাংলার যতো প্রথিতযশা শিল্পীরা ছিলেন, তাঁরা নিজস্ব সঙ্গীতধারা নির্বিশেষে সেই অনুষ্ঠানে যোগদান করেছিলেন। সেখানে ২৭ জন পুরুষ শিল্পী ও ৪৭ জন মহিলা শিল্পী সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন, বিষ্ণুপুরের গোপেশ্বর, সত্যকিঙ্কর, রমেশচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, অনাদিকুমার দস্তিদার, পঙ্কজকুমার মল্লিক, অনিলকুমার বাগচি, সুধীর কর থেকে মালতী বসু (ঘোষাল), কনক দাস, রমা কর, সাবিত্রী গোবিন্দ (কৃষ্ণন), অমিয়া ঠাকুর, অমিতা সেন, হাসি বসু এবং আরো অনেকে। এই চুয়াত্তর জন শিল্পীর মধ্যে শান্তিনিকেতন থেকে ছিলেন মাত্র কুড়ি জন। তাই বোঝা যায় শিল্পী নির্বাচন নিয়ে কোনও গোঁড়ামি আয়োজকদের মধ্যে তখনো দেখা যায়নি। 


আর্নল্ড বাকে সাহেব ১৯২৫ সালে শান্তিনিকেতনে আসেন। যদিও তাঁর নিজস্ব গায়ন বা শিক্ষণ পদ্ধতি একেবারে পৃথক ছিলো, কিন্তু কবি নিজে বা দিনু ঠাকুর কখনও তা নিয়ে কোনও বিরূপ অবস্থান নেন'নি। এর থেকে স্পষ্ট হয়, কবি নিজে বা তাঁর সহযোগী রবীন্দ্রসঙ্গীতের চিহ্নিত ধারকবাহকেরা এই সৃষ্টিমাধ্যমটির বিস্তৃত প্রচারে আগ্রহী ছিলেন। জনগণেশের মধ্যে একে আরো অধিক মাত্রায় প্রসারিত করার জন্য যথাযোগ্য প্রয়াসে তাঁদের অনীহা ছিলোনা। 

যদিও এ প্রসঙ্গেও শঙ্খ ঘোষের বক্তব্যটি প্রনিধানযোগ্য। 

“.... রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভাষা, তার অনুভূতিজগৎ, তার সুরকাঠামো একেবারে সেই সাহিত্যরেখারই সঙ্গে লগ্ন, সাহিত্যেরই যেন আরো-একটা দিক। তাই ঐতিহাসিক কারণেই একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে এর প্রতিপত্তি হওয়া শক্ত। রামপ্রসাদি বা বাউলগান, পদাবলীসঙ্গীত বা পল্লিগীতি, তার সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যপ্তিগত দূরত্ব একটা থেকেই যাবে। কয়েক প্রজন্মের মধ্যে 'গীতাঞ্জলি'র গান পথের ভিখিররও কাছে পৌঁছে যাবে, সাতাশি বছর আগে (শঙ্খ এই কথা ১৯৯৯ সালে বলেছিলেন) বলা ইয়েটসের এই ভবিষ্যবাণী সফল হয়ে উঠবার কোনো সম্ভাবনাই নেই কোথাও।“ 


'... এ জীবনে যা কিছু সুন্দর, সকলই আজ ভরে উঠুক সুরে' 


1 comments:

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর 
অনিন্দিতা মণ্ডল


মানুষের কল্পনাশক্তি কত দূর যায় তার কিছু কিছু উদাহরণ আমরা রূপকথার গল্পে পেয়ে থাকি। ঠাকুরমার ঝুলির মতো সেসব গল্প আমাদের শৈশবের চেতনভূমিকে এমন করে গড়ে দেয় যে বড় হয়ে বাস্তবের কঠিন সীমারেখার মধ্যে থেকেও কেউ কেউ মনের সেই দেওয়ালকে যখন তখন ভেঙে দিই সরিয়ে দিই। এখানে লক্ষ্য করার মতো কথা হলো, কেউ কেউ। সবাই নয়। 

কিন্তু সেই বাস্তবের সঙ্গে সম্পর্কহীন, নিরর্থক শৈশবের কিচিরমিচির কি প্রাপ্তবয়স্কদের যাপনে বিন্দুমাত্র ছায়া ফেলে? আমরা ত বড়দের জন্য রূপকথা ভাবিনা! বড়রা বাস্তবের সঙ্গে লড়াই দিতে দিতে রূপকথার সব মায়া সব রং হারিয়ে ফেলে। সাতটা রঙের বাইরে যে কত রং! টের পাওয়া হয়না আর। 

এরকম ভাবনায় স্থির থাকি, আর তখনই হাতে আসে বইটি। Stardust। লিখেছেন Neil Gaiman। এ সময়ের একজন দিকপাল। তাঁর কল্পনার জগতে বড়রাও স্বচ্ছন্দে পা ফেলতে পারে। তাঁকে নিয়ে, তাঁর সৃষ্টি নিয়ে সমসময়েই পণ্ডিতেরা আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। এ যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক তিনি। 

আলোচ্য বইটি একটি রূপকথা। যেখানে তারার টুকরো নারী আর মাটির পুরুষ একে অন্যের ভালোবাসায় জড়িয়ে যায়। তাদের কত না অদ্ভুত সংলাপ! কি অবিশ্বাস্য তাদের দৈনন্দিন যাপন! অথচ পাঠক কখনো অবিশ্বাসের হাতছানিতে দৌড়ে যান না। কল্পনা ও বাস্তবের এই মিশ খাওয়া যে আমাদের মধুর স্বপ্ন! আমরাও যে চাই ওই রূপকথার টুকরো! নেমে আসুক আমাদের জীবনে। যেমন এসেছিল ত্রিস্তানের জীবনে। তার জন্য যুদ্ধ চললে ক্ষতি কি? 
এবারের পছন্দ এই বইটি।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক 


গার্ড (অনুবাদ গল্প) 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 


৮ 

‘বোকা ছেলেটা!’ শুধু এইটুকু বলে চুপ করে গেলো ঠীল, কারণ ঠিক তখনি তার গায়ে গাছের গুঁড়ির ছালের ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো খসে পড়ল। 

ঠীল আর টোবিয়াস যখন ফিরল, লেনা তখনো মাটি কোপাচ্ছিল। অর্ধেকের বেশি জমি সে খুঁড়ে ফেলেছিল ততক্ষণে। কিছুক্ষণ পর পর ট্রেন যাচ্ছিল; প্রত্যেকবার টোবিয়াস মুখ হাঁ করে দেখছিল। লেনাও মজা পেয়েছিল ট্রেনের যাওয়া আসায়। সেও প্রত্যেকবার কাজ থামিয়ে অদ্ভুত মুখ করে ট্রেন দেখছিল। 

শুয়োরের মাংসের ঠাণ্ডা রোস্ট আলু দিয়ে খেয়ে দুপুরবেলায় ওরা সবাই জিরিয়ে নিচ্ছিল ঠীলের গার্ড- কেবিনে বসে। ঠীল সহজ ব্যবহার করবার চেষ্টা করছিল লেনার সঙ্গে। টুকটাক নানা কথা বলছিল তার কাজ নিয়ে, তার ডিউটির ব্যাপারে। লেনার হাঁ-মুখ বন্ধ হচ্ছিল না এটা জানতে পেরে যে একখানা রেলওয়ে ট্র্যাকের মধ্যে ছেচল্লিশখানা স্ক্রু থাকে! 

সকালবেলায় লেনা মাটি খুঁড়েছিল; বিকেলে ক্ষেতের মধ্যে আলু বুনে দিয়ে তবে তার কাজ সারা হবে। সে চাইছিল টোবিয়াস যেন একটু ছোট বাচ্চাটার কাছে বসে; ঠীল যেন এবেলা টোবিয়াসকে সঙ্গে নিয়ে চলে না যায়। 

‘ঠিক আছে।’ ঠীল যেতে যেতে আবার কি মনে করে ফিরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘সাবধান! রেলওয়ে ট্র্যাকের কাছাকাছি তোমরা কেউ যেওনা কিন্তু!’ 

প্রত্যুত্তরে লেনা কাঁধ ঝাঁকালো। 

ঠীলকে শীগগিরই রেলগেটের কাছে যেতে হবে। সাইলেশিয়ান এক্সপ্রেস ট্রেনটা এখনই আসবে। সিগনাল হয়ে গেছে। ঠীল গেট বন্ধ করে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই দেখতে পেল ট্রেনটা আসছে। 

ট্রেনটা দেখা যাচ্ছে। এগিয়ে আসছে একটা দানবের মত। কী প্রচণ্ড শক্তিতে বাষ্প বেরিয়ে আসছে এঞ্জিনের চিমনির কালো খোলামুখ দিয়ে। দুধ- সাদা বাষ্প বেরিয়ে এলো ফোয়ারার মত, তারপর ভীষণ জোরে হুইস্‌ল বেজে উঠলো। এক, দুই, তিন, হ্যাঁ, তিনবার বাষ্প বেরিয়ে এলো আর পর পর তিনবার হুইস্‌ল বেজে উঠলো তীক্ষ্ণ শব্দে। তার পর ইঞ্জিনটা ব্রেক কষল ভয়ঙ্কর শব্দে। কেন? ঠীল বুঝতে পারছিলনা কেন হঠাৎ ট্রেনটা ব্রেক কষলো! তারপর আবার এমারজেন্সি হুইস্‌ল বাজলো, এবার একটানা বাজতে লাগলো, একটুও না থেমে। 

ঠীল ট্র্যাকের কাছে ট্রেনের সামনের দিকে তার গার্ডের লাল পতাকাটা নিয়ে এগিয়ে গেলো নিয়মমাফিক। পতাকাটা লাগাতে গেলো সে ট্র্যাকের সামনে... হা ঈশ্বর! হায় পরমপিতা যীশু! সে কি অন্ধ হয়ে গিয়েছিল? হা ভগবান, হায় যীশু, যীশু, যীশু... রক্ষা কর ভগবান... বাঁচাও ঈশ্বর, তুমিই পারো... কী? কী ওটা? ট্রেনের সামনে রবারের বলের মত ধাক্কা খেয়ে ট্র্যাকে পড়ে আছে! হা ঈশ্বর! ‘ওইখানে’... সর্বশক্তি দিয়ে গার্ড চিৎকার করে উঠল। বড্ড দেরি হয়ে গেছে কি? ট্রেনটা ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে গেছে স্থির। ওই তো... ব্রেকের ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজটা এখনো মিলিয়ে যায়নি। 

নিস্তব্ধ অরণ্যের মাঝখানে রেলওয়ে ট্র্যাকটা যেন হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ট্রেনের ড্রাইভার, কনডাকটার, স্টাফেরা সব্বাই ট্র্যাকের নুড়িপাথরের উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে এসেছে ট্রেনের সামনে। ট্রেনের জানালা দিয়ে ভিতরে অজস্র কৌতূহলী চোখমুখ দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ মাথা বের করে সামনের দিকে দেখবার চেষ্টা করছে। ভীষণ ভিড় হয়ে গেছে চারদিকে হঠাৎ করে। 

ঠীল ভীষণ হাঁপাচ্ছিল। সে কি পড়ে যাবে? চারদিকে এত ভিড় কেন? না, তাকে এখন হেরে যাওয়া মোষের মত পালিয়ে গেলে চলবে না। শক্ত হতে হবে। না, হারতে পারবেনা সে, ভেঙ্গে পড়তে পারবেনা। সত্যিই... উঠে দাঁড়াও, সে নিজেকে বলছিল। অ্যাকসিডেন্টের জায়গাটা থেকে কেমন যেন একটা জান্তব গোঙানির আওয়াজ আসছিল। কে ওটা? কার কণ্ঠস্বর? লেনা? নাহ... লেনার গলা এরকম নয়। কে?... বেঁচে আছে, এখনো বেঁচে আছে। 

একটা লোক ট্র্যাকের উপর দিয়ে দৌড়ে এলো। 

-‘গার্ড!’ 

-‘আজ্ঞে, বলুন।’ 

-‘একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।’ ভয়ার্ত গলায় লোকটা বললো। গার্ড কেমন অদ্ভুতচোখে তাকিয়ে ছিল লোকটার দিকে। গার্ডের টুপিটা বেঁকে গিয়েছে। চুলগুলো এলোমেলো। গার্ডের মাথায় কিছু ঢুকছিল না। রেলওয়ে স্টাফের মেসেঞ্জার এসে গার্ডকে বোঝাচ্ছিল... ‘দুর্ঘটনা! বুঝলে তো? বেঁচে আছে এখনও। তাড়াতাড়ি চিকিৎসা পড়লে বেঁচে যাবে।’ 

উত্তরে গার্ডের গলা দিয়ে একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ বেরিয়ে এলো। 

-‘তাড়াতাড়ি এসো। তাড়াতাড়ি!’ লোকটা বোঝাচ্ছিল। 

ঠীল শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে। তার পেশীগুলো কঠিন হয়ে আছে। সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তার মাথায় কিচ্ছু ঢুকছেনা। কেমন শূন্য, হাবাটে চোখের দৃষ্টি, মুখটা মরা মানুষের মত। 

ঠীল মেসেঞ্জারের সাথে দৌড়াতে থাকে। সে ট্রেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকা আতঙ্কিত, ভয়ার্ত মুখগুলো দেখতে পায়না। এক যুবক, এক হকার, এক দম্পতি যারা মধুচন্দ্রিমা করতে বেরিয়েছে– সবাই, সবাই কেমন অদ্ভুতভাবে ট্রেনের জানালা দিয়ে মুখ বাড়ায়। গার্ড ঠীল জানেনা এই এক্সপ্রেস ট্রেনটার খুপরি খুপরি কামরাগুলোর ভেতরটা ঠিক কিরকম! ঠীল দৌড়ায়। হঠাৎ তার কানে এসে ঢুকতে থাকে লেনার আর্তস্বরের কান্না আর চিৎকারের আওয়াজ। তার চোখের সামনে অজস্র হলুদ রঙের বিন্দু ফুটে উঠতে থাকে। ঠীল হতবাক, বিস্মিত চেয়ে থাকে। হলুদ রঙের বিন্দুগুলোর মধ্যে দিয়ে একটা মুখ সে দেখতে পায়। ফ্যাকাসে কপালে কালশিটে, নীলচে ঠোঁটের নিচে রক্তের দাগ। উফফ... হ্যাঁ, ও... 

ঠীল কথা বলতে পারেনা। তার মুখ একেবারে ফ্যাকাসে, রক্তশূন্য হয়ে গেছে। অচেতনভাবে হাল্কা হাসির রেখা ফুটে ওঠে তার ঠোঁটে। সে বেঁকে বসে পড়ে। তার হাতের মধ্যে তুলে নেয় ওকে। উফফ, এত ভারি লাগছে কেন ওর ছোট্ট শরীরটা? 

‘এখন ওকে নিয়ে যেতে হবে।’ মেসেঞ্জার বলে। 

‘কোথায়?’ ঠীল প্রশ্ন করে। 

‘রেলের ডাক্তারের কাছে।’ মেসেঞ্জার কেমন অদ্ভুতভাবে বলে। 

‘আমরাই নিয়ে যাচ্ছি।’ রেলের একজন স্টাফ একটা রেল সার্ভিস ওয়াগন নিয়ে হাজির হয়... ‘এখনই’। 

ঠীল ওকে যেতে দেবে কিনা বুঝতে পারেনা। ওকে ঝাঁকায়। কোনও সাড়া পায়না। 

একটা স্ট্রেচার নামিয়ে নিয়ে আসে ওরা সার্ভিস ওয়াগন থেকে। চেঁচিয়ে বলে আরেকজন লোককে ঠীলকে সাহায্য করবার জন্য। 

সময় বেরিয়ে যাচ্ছে। সময় ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ট্রেনে হুইস্‌ল বেজে ওঠে। ট্রেনের জানালা থেকে কারা যেন পয়সা ছুঁড়ছে। লেনা পাগলের মত চিৎকার করছে। ট্রেনের কামরা থেকে রব ওঠে, ‘ওই যে মা! আহা গো!’... লোকে চেঁচিয়ে বলে, ‘ইসস... উফফ, হায় রে... আহা, মায়ের কী অবস্থা গো!’ 

ট্রেনের ড্রাইভার আবার হুইস্‌ল বাজায়। আওয়াজের সাথে সাথে আবার ধোঁয়া বেরিয়ে আসে। ট্রেনের এঞ্জিনের চাকার সঙ্গে লেগে থাকা ধাতব দণ্ডগুলি সঙ্কুচিত-প্রসারিত হতে থাকে। চাকাগুলো আবার নড়ে ওঠে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ভীষণ গর্জন করে দ্বিগুণ বেগ তুলে ট্রেনটা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে চলে যায়। 

ঠীলের মাথায় তখন কোনো কথাই ঢুকছিল না। আধমরা ছেলেটাকে সে স্ট্রেচারে শুইয়ে রেখেছিল। ছেলেটার ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া জামার নিচে, রুগ্ন পাঁজরের নিচে খুব জোরে জোরে শ্বাস উঠছিল, পড়ছিল। হাত পাগুলো একদম ভেঙ্গে গিয়েছিলো দুমড়ে। হাতগুলো স্ট্রেচারের বাইরের দিকে ঝুলছিল। 

লেনা হাঁউমাউ করে কেঁদে কেঁদে কি যেন বলছিল। তার মুখরা, উদ্ধত স্বভাবের চিহ্ন ফুটে ফুটে বেরিয়ে আসছিল এই চরম বিপদের সময়েও। সে বার বার বলার চেষ্টা করে যাচ্ছিল যে কীভাবে ব্যাপারটা ঘটে গেলো; বারে বারে প্রমাণ করবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল যে পুরো ব্যাপারে তার কোনও হাত ছিল না। 

ঠীলের মাথায় এসব কিছুই ঢুকছিল বলে মনে হয়না। সে কিছুই শুনছিল না। একদৃষ্টে বিস্ফারিত চোখে সে ছেলের দিকে তাকিয়েছিল তখন। 

চারদিক একদম নিস্তব্ধ হয়ে রয়েছে। মৃত্যুর মত একটা নৈঃশব্দ ঘিরে আছে যেন। নুড়িপাথরের উপরে কালচে, গরম রেলওয়ে ট্র্যাক শুনশান শুয়ে আছে। দুপুরবেলার পর থেকে চারদিকে কোনও বাতাস নেই। কিচ্ছু নড়ছেনা কোথাও। জঙ্গলের গাছপালাগুলো অবধি পাথরের মত স্থির হয়ে আছে। 

চারপাশের লোকগুলো ফিসফিস করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল যে তাড়াতাড়ি ফ্রিডরিশহাগেনে ডাক্তারের কাছে পৌঁছাতে হলে উল্টোদিকে, মানে ব্রেসলাউয়ের দিকে এক স্টেশন গেলে ভালো হয়। কারণ এর পরের যে প্যাসেঞ্জার ট্রেনটা আসছে, সেটা আবার ফ্রিডরিশহাগেনে থামে না। 

ঠীল সঙ্গে যেতে চায়, কিন্তু এখানে সে কার কাছে নিজের ডিউটি বুঝিয়ে দিয়ে যাবে? কীভাবে যাবে সে? সে লেনার দিকে ইশারা করে। লেনার নিজের দুধের বাচ্চাকে ফেলে যাবার ইচ্ছে না থাকলেও ঠীলের কথা অমান্য করবার সাহস হলনা। লেনা আরেকজন অচেনা লোকের সঙ্গে স্ট্রেচার বয়ে নিয়ে গেলো; গেলো ওয়াগনে ছেলের সঙ্গে। ঠীল নিজের ডিউটির এলাকার সীমানা অবধি গেলো সার্ভিস ওয়াগনের সঙ্গে; স্থির হয়ে দাঁড়ালো সেখানে। তাকিয়ে রইল ছেলের দিকে, যতদূর তার দৃষ্টি যায়। তারপর হঠাৎ নিজের কপাল চাপড়াতে শুরু করল। 


(চলবে) 

[গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘বানভ্যার্টার ঠীল’ গল্প অবলম্বনে রচিত] 

0 comments: