Next
Previous
Showing posts with label পুবের জানালা. Show all posts
0

পুবের জানালা - রুখসানা কাজল

Posted in



মরার কোকিল! মাঘ মাস শেষ না হতেই হৃদয়ের দরোজা খুলে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে।

প্রথম দিন ভেবেছিলাম, হয়ত কেউ গাড়িতে সখ করে কোকিলের তান লাগিয়েছে। করোনার কারণে ফাগুনের আগুনে এবারের ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন করা যাবে না সেই দুঃখে। ঢাকার তরুণদের সখ বৈচিত্র্য যেমন বিচিত্র তেমন অভাবনীয় এবং উত্তুঙ্গগামী! গেল দুবছর পহেলা বৈশাখে এমন ভুভুজলা বাজাতে শুরু করেছিল কিছু ছেলেপেলে। কান ঝালাপালা হয়ে গেছিল! মনে হয়েছিল ওদের হাত থেকে ভুভুজলাগুলো কেড়ে নিয়ে ওগুলো দিয়েই ওদের পেটাই।

মর জ্বালা! এ যে ভোরেও ডেকে উঠছে! গাড়িঘোড়ার কোনো বালাই নেই। শব্দহীন নিঝুম একলা ভোর। তবে ত কোকিল পাগলাই হবে! ভেতর বারান্দায় গিয়ে ভুচকুলি পাখির মত ভুচি মেরে দেখার চেষ্টা করি। বিশাল আমগাছ ঘুম চোখে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। কিন্তু কই সে ঘনকেষ্ট ব্লাক ডায়মন্ড! নেই ত নেইই।

দুদিন পর। চনমনে উষ্ণ দুপুর। আবার সেই ডাক, কুহু কুহু। কোকিল কি প্রেমের দেবী ভেনিসের দূত? আরাম করে পড়ছিলাম এক বন্ধুর কাছ থেকে উপহার পাওয়া প্রিয় লেখক মাহমুদুল হকের রচনাবলী থেকে নিরাপদ তন্দ্রা গল্পটি। কুহু কুহু অভিরামে ভেসে গেল আমার অন্তরাত্মা। বাল্য বন্ধুকে ফোন করি, এই শোন তোদের ওদিকে কি কোকিল ডাকতে শুরু করেছে ?

না তো ! মাঘমাস তো এখনও শীতকালে ট্যাগে আছে। তুই কোকিল পাচ্ছিস কোত্থে !

আরে আমাদের এখানে তিন দিন ধরে ডেকে যাচ্ছে। শালার কোকিল খুঁজেই পাচ্ছি না –

না পাওয়াই ভাল। তোর ত আবার বর্ষাকালেও বসন্ত লাগে। কৃষ্ণরসে ভেসে যাস। মনে নাই সে কাহানি ? সাবধান কলাম !

তুই একটা শয়তান। যা ভাগ কুত্তা যেন কোহানকার---তুমুল হাসতে হাসতে আমরা ফোন কেটে দেই।

কেটে দিলে কি হবে ! দেখি আমার হাত বেয়ে নেমে এসেছে যমুনা। ঘর ভেসে যাচ্ছে থইথই যমুনার জলে। আমি যেখানেই পা রাখি ঝলকে ছলকে উঠছে নীল যমুনার জল। আর তখুনি, রাধা রাধা চোখে ভেসে আসে ঘোর ঘননীল এক বর্ষাদিন।

ছোট্ট শহরের অনামা এক লঞ্চঘাট। কাদামাটির বুকে নাক গেঁথে থেমে আছে একটি লঞ্চ। সারেং ঘরের উপরে ভিজে বাতাসে দুলে উঠছে লাল সবুজ পতাকা। ডেভিডরা চলে যাচ্ছে আমাদের শহর থেকে। ওর ড্যাডা ডাঃ ভ্যান ট্রান্সফার হয়ে গেছেন তার নিজের দেশ আয়ারল্যান্ডে। বৃষ্টি পিছল ডেকএ দাঁড়িয়ে তিনি হাত নাড়ছেন। ওঁর পাশে রেলিং ধরে হাসছে ডেভিড। তখনও আমরা ওদের দেওয়া বিদেশি ক্যান্ডি খাচ্ছি আর হাসাহাসি করছি। শেষবারের মত ভেঁপু বাজিয়ে নাক তুলে নিল লঞ্চটি। ঢেউ খেলে গেল নদীর জলে। তীর ছেড়ে মাঝনদীতে গিয়ে একটু থামলো। এরপর চলতে শুরু করল। প্রথমে ধীরে। তারপর বেগে। লঞ্চ যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে সুদূর। অনন্ত আঁচল বিছিয়ে বয়ে যাচ্ছে বড় নদী। ঢেউ আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের গায়ে আর বড় বড় ঘূর্ণি স্রোত সারাক্ষণ ডেকে যাচ্ছে জলসিক্ত ঘর্ঘর গলায়। লঞ্চের গতি আরও দুরন্ত হলে বুঝতে পারলাম, ডেভিড চলে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, ও চলে গেলে আমি থাকব কি করে? কে থাকবে আমার সাথে? কে আমাকে কাঁধে করে শীত নদী পেরিয়ে নিয়ে যাবে শিমুলপলাশ বটপাকুড়ের অরণ্যে? ফিরে আয় ডেভিড -- লদী লাগোয়া রাস্তা ধরে সেই যে দৌঁড় দিয়েছিলাম, এক মোটরসাইকেলের সাথে ধাক্কা লেগে উড়ে গিয়ে পড়েছিলাম কাশবনে। আমার প্রথম প্রেমে রক্তারক্তি ঘটলেও কাশফুলের মত ভেসে গেছিল সেই কৈশোরে! কিন্তু সে প্রেম গল্প হয়ে জেগে আছে আমাদের বন্ধু মহলে।

এখনও ডেভিডের লাল তিল ভরা কিশোর মুখ মনে পড়ে যায়। ওর গ্র্যান্ডমা চেয়েছিল, ডেভিড যাজক হোক। বংশ পরম্পরায় হেভেন লাভের সুযোগ করে দিক তার নাতি। জানিনা শেষপর্যন্ত কি হয়েছে ডেভিড। আজকাল যখন কেউ বলে তার ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়াচ্ছে, তখনই বুকের ভেতর ডেভিড ভেসে আসে। ধর্মের কী আশ্চর্য যাদু কা ঝাপ্পি। কী অভাবনীয় অদ্ভুত মোহশক্তি। হিন্দু, মুসলিম, ক্রিশ্চান, ইহুদি সকলেই বেহেশতে যেতে চায়, অথচ কেউ চায় না, ছোট বড় স্বার্থগুলো ত্যাগ করে এ পৃথিবীটাকে বেহেশ্‌ত বানাতে!

পাশের দেশে ছেলের বয়েসি একজন লেখক থাকে। নিপুণ হাতে যেমন অক্ষর সাজায় তেমনি থরে থরে ফসল ফলায় সে। ওর সাথে যখন কথা বলি, শতধা হয়ে স্নেহ নেমে আসে। সে দেশের কৃষিভাইরা লড়ছে ।তাদের ফলানো অনেক জিনিস আমরা ব্যবহার করি। প্রতিদিন পত্রিকায় পড়ি, ছবি দেখি। কেমন আছে ওরা! কারও কারও মুখ দেখে মনে হয়, এইতো আমার তিন পুরুষ আগের অগ্রজের মুখ। ওই যে পেশির ভাঁজে আলো ফেলেছে ঈষের ফলার ধারালো প্রখরতা সে তো আমার অচেনা কিছু নয়। ওদের মুষ্টি উদ্যত হাতের তালুতে লেগে আছে গর্ভবতী বীজের সুগন্ধ। চোখের নিচে অজস্র আলপথ। অখন্ড ভারতের হারানো একাত্মতা ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে মনের ভেতর। এর বেশি কিছু করা যে অশোভন!

আজকাল যখন তখন মাকে মনে পড়ে। বকুলফুলের মত রঙ আর এক রত্তি মেদহীন চিকন শরীরের মা বিছানায় গা এলিয়ে বসলেই বুঝতাম, এখন গল্পের বই পড়তে বসবে। মার সামনে ইশকুলের পড়া মুখস্থ করতে হত। পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হত, মা কি সরস্বতী? বইটির প্রচ্ছদ দেখেই জানতাম কি আছে ভেতরে। কারণ নজরুল পাবলিক লাইব্রেরি থেকে আমিই বই এনে দিই। আনার আগে পড়ে ফেলি। না পড়তে পারলে বই নিয়ে খাটের নিচে চলে যাই। সেখানে আমার নিজস্ব জগত। পুতুলের ভরা সংসার। পড়তে পড়তে কতদিন ঘুমিয়ে গিয়েছি। মার খুব ইচ্ছে ছিল, পড়াশুনায় অনেক দূর যাব আমি। আমার স্বপ্নবাজ স্বল্প আয়ুর পিতামাতা নিকট ভবিষ্যতে তাদের মৃত্যুর অনাকাঙ্ক্ষিত ছায়াটি তখনও দেখতে পায়নি।

ছায়ায় সাথে মিশে থাকা মাকে বলি, তুমি খুশি মাগো? আমি একজন ছেলের মতই স্বাবলম্বী হতে পেরেছি। দুহাত বাড়িয়ে রেখেছি মানুষের সাহায্যের জন্যে। ছেলে মরে গেছে, ছেলে নেই বলে দুঃখ নেই ত তোমার?

সেই মুখ টিপে হাসা। আমার প্রবল পুরুষ বাবার পাশে সর্বদা ছায়া হয়েই ছিল মা। আমপাতা ঝরঝর। মেয়ে তুই বই পড়। ঝরা কৃষ্ণচূড়া আলো করে রেখেছে উঠান। ফুল ঝরে পড়তেই টমি কুকুর ছুটে যাচ্ছে। নাচছে, গাইছে। এ বাসার অনেকেই বানিয়ে বানিয়ে গল্প কবিতা লিখে, ছবি আঁকে। আমার ইচ্ছে করে না। তবু একবার ছড়া লিখেছিলাম। সাথে ছবিও ছিল, আমগাছে কাঁঠাল হয়, বুলবুলিতে ঠুকরে খায়। হয়নি মা ?

কড়া বিষম খেয়ে হাসতে হাসতে নেচে ওঠেছিল বাড়িটা। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অপরিসীম দুঃখে কান্না পেয়ে গেছিল, আমি কি গোপালভাঁড়? আবার হাসি। এবার হাস্য মুখর বাড়িটার দরোজা খুলে যায়। বাপি আসে। আমার আঁকা আর লেখা পড়ে খুব খুশি হয়ে বকে দেয় সবাইকে। বুঝিয়ে দেয়, হাসজারু ছড়া হলেও ছন্দ ত মিলে গেছে। এতে হাসির কি হল ! উজিরে আলা আপনিও হেসেছেন। আপনার জন্যে শাস্তি বরাদ্দ হল। আজকের সন্ধ্যায় মহা নাস্তা বানানো হোক।

আমি মুড়মুড় করে লুচি ভাঙ্গি আর বায়ে দুলি, আমাগাছে কাঁঠাল হয়, এবার ডাইনে দুলি, বুলবুলিতে ঠুকরে খায়---হাহাহাহ আমি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আর বিদ্রোহি কবি নজরুল হয়ে যাচ্ছি তাই না বাপি !

অবশেষ মাঘ পেরুলো বাংলাদেশ। শাড়ি টাড়ি রেডি করে রেখেছিলাম। ইচ্ছে ছিল শাহবাগের ফুলের দোকানে গিয়ে অশোকফুলের মুকুট বানাব। না পেলে রক্তগাঁদা বেছে নেব। কিছুতেই ওই আজরা জাবরা বিদেশী ফুল পরব না। তারপর হলুদ রোদ্দুরে রিকশার হুড ফেলে চলে যাব পুরোন ঢাকার সদরঘাট। খুঁজে বের করব ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরী। যেখানে এতিম লাবণ্য গুপ্তের সাথে বিয়ে হয়েছিল, কেবল শুধুমাত্র কেবল কবি হওয়ার ভাগ্য নিয়ে জন্মানো জীবনানন্দ দাশের।

জ্যাঠামশাইয়ের বাছাই করা পাত্রের সাথে দেখা করার দিন বৃষ্টি পেছল মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়েছিলেন লাবণ্য। সেদিন ভাগ্য তাকে আছড়ে ফেলেছিল কুটিল পঙ্কে। তার স্বপ্ন, সাধ, স্বদেশ প্রেম সব লেপটে গেছিল কাদামাটির সাথে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি কাকের চঞ্চুর মত, শকুনির হৃদয়বাহী এক নারী। ভাত কাপড়ের নিরাপত্তাহীন সংসারে যে কেবল খুঁড়ে গেছে এক কবি হৃদয়। লাবণ্যের হৃদয় এবং শরীর? নারীর আবার এসব কি ফালতু বায়নাক্কা !

আপনজনদের কাছে এ জগতের সবচে বেশি ভারবাহী হচ্ছে এতিমের ভার। তাই ঝেড়ে ফেলাই দস্তুর। জ্যাঠামশাই যেভাবে ঝেড়ে ফেলেছিল। আমার চাচা কাকারাও সেভাবে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। আমি আলোকিত সময়ের সন্তান। পাশে ছিল আমার মা বোন। লাবন্য গুপ্ত কেবলই ধ্বসে গেছেন। একা। কেবলই ধূসর হয়েছেন। শুষে গেছিল জীবনের সব সাধ। দাহ্য হয়ে উঠেছিলেন। খর চৈত্রে বাংলার শুকনো ঘাসের মত, জলহীন চৌচির পুকুরের মত, হিজলের বনে খা খা রোদ্দুরের মত, অগাধ জ্যোৎস্নায় প্রেমহীন সঙ্গমের ঘৃণ্য শীৎকারের মত।

উত্তরবঙ্গ থেকে আসা সদ্য বিধবা এবং দুটি সন্তানসহ শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত মহিলাটিকে আমি কড়া গলায় বলি, সাহায্য করতে পারি। কিন্তু---

বলুন আপা। ছেলেমেয়েদের জন্যে আমি সব করব।

স্পষ্ট উচ্চারণ, জীবনের সাথে যুদ্ধে রত প্রত্যয় আর তেজি গলা। এখনও স্বচ্ছলতার জৌলুস লেগে আছে। আমি ওর অনার্স পড়ুয়া মেয়ের এ বছরের সমস্ত খরচ মিটিয়ে দিয়ে নিজে চলার মত একটি চাকরি যোগাড় করে দেব, কিন্তু মেয়েকে বিয়ে দেওয়া চলবে না। অনেক বছরের ব্যাপার। পারবেন?

হয়ত পারবে। হয়ত পারবে না। সমাজ এবং পরিবারে জ্যাঠামশাই এবং চাচাকাকাদের ত অভাব নেই। তবু একটা স্বপ্ন বুনে দিলাম। সেই স্বপ্ন। আমার মাবাবা বলতেন, ভেঙে যাক। আবার দেখো। ভয় কি মেয়ে।
0

পুবের জানালা - রুখসানা কাজল

Posted in


ভোর সাতটা চুয়ালিশ, ফ্ল্যাট লগ্ন রাস্তায় হেঁকে যাচ্ছে মাছওয়ালা - হেই মাইছ, মাইছ, মাইছ, দেশি রুই, ভেটকি, পদ্মার ইলিশ, বাগদা চিংড়িইইই---

দু’পাত্তার মাস্ক পরে দাঁত কিড়মিড় করে গালি দেয় ফ্ল্যাটবাড়ির কোর সদস্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারক – শালা লুম্পেনের জাত - সকাল না হতেই বেরিয়ে পড়েছে - কারও মুখে মাস্ক নেই - করোনা কি সহজে ছাড়বে বাংলাদেশ! নুইসেন্স পিপলকে ব্রাশ ফায়ার করা উচিত ।

বিচারকের বিরক্তি ব্রহ্মতালুতে দপদপ করছে। অযথা গে্টম্যানকে ডেকে কভিড১৯ এর ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা দিচ্ছে, এসময় পুরানো কাজের বুয়া দিনুর মা ধাই করে লিফট থেকে বেরিয়ে আসে। পলকে একবার তাকিয়ে হনহন্‌করে চলে গেল সামনে দিয়ে। ব্যাজার মুখ। মশার কামড়ে ডোগা ডোগা হয়ে ফুলে উঠেছে হাত কপাল। মশারি কিনবে বলে গেল কাল বিকেলে টাকা চেয়েছিল। তিনি দেননি। তার বিচার অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত। দিনুর মা তার বাসায় অল্প মাইনের ঠেকা কাজ করে। তাও একবেলায়। সুতরাং মশারি কিনে দেওয়ার দায় তার নয়। দিনুর মা যে বাসায় বেশি টাকার কাজ করে, রাতে থাকে - এ দায় তাদের।

এরমধ্যে ঢুকে পড়েছে জুতা সেলাই, ছাইওয়ালি। ছাইওয়ালির গলা যেন ছর্‌রা কার্তুজের গোলা। তাদের বারো তলা বিল্ডিংএর সব ক’টা ফ্ল্যাটের জানালায় এসে ছাইয়া ছাইয়া, নে ছাই নে, ছাই নে করে ধাক্কা মারে।

সাতটা পঞ্চান্ন। নয় তলার ইঞ্জিনীয়ার বউটা বারমুডা ফতুয়ার সাথে ম্যাচিং মাস্ক পরে নেমে এসেছে। বিশাল লম্বা চুল। হিপের নিচে বেণীটা দুলছে। তাকে দেখে ‘হাই আঙ্কল, সালাম’ বলে স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে গেল। তিনি পিতৃসুখ অনুভব করবেন নাকি পুরুষসুখে চাগিয়ে উঠবেন এটা ভাবতে ভাবতে পাড়ার মসজিদ থেকে মাইক বেজে ওঠে।

বেওক্তে মাইকে ঘোষণা এলেই তার বুক কাঁপে।

আবার মৃত্যু সংবাদ। সাদা হয়ে যায় বিচারকের মুখ। যিনি মারা গেলেন তিনি অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন। তার স্বল্প পরিচিত। তবে সদ্য মৃত ভদ্রলোকের স্ত্রী বরং বেশি চেনাজানা ছিল সবার কাছে। রেগুলার ইয়োগা করতেন ভাবি। ঝড় বৃষ্টি কারফিউ-টারফিউ কিছুই মর্নিং ওয়াক থেকে ঠেকাতে পারেনি তাঁকে। সেই তিনি করোনার শিকার হয়ে গেল সপ্তাহে মারা গেছেন হাসপাতালে। আজ মৃত্যু হলো স্বামীর। এদের ছেলেমেয়ে দুজনেই প্রবাসি। ডান বাম ইনকামের কোন কিছুই এরা স্বদেশে রাখেনি একটি ছোট ফ্ল্যাট ছাড়া। শেষকৃত্যে এখন ফ্ল্যাট সমিতি শেষ ভরসা।

থুম হয়ে বসে থাকেন বিচারক। কভিড১৯ কি সোস্যাল ক্লাশ বোঝে! বেছে বেছে বড়লোক, স্বচ্ছল লোকদের ফুসফুসে থাবা বসাচ্ছে! কেড়ে নিচ্ছে নিঃশ্বাস নেওয়ার শেষ শক্তিটুকু! এ কারণেই তার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, এ ভাইরাস চিনা হারামখোরদের কাজ। গবেষণাগারে কভিড১৯ এর স্টেইনগুলোকে শ্রেণী সচেতনতার মন্ত্রণা দিয়ে চুপসে ছেড়ে দিয়েছে বাতাসে। মানুষের সংস্পর্শে এলেই সে মন্ত্র বেজে ওঠে, চুইং চ্যায়াঙ ঝুইং ঝ্রান, ঝাড়বংশে ধনীদের মার!

এত যে রিকশাওয়ালা, কাজের বুয়া, জুতা সেলাইকারি, সিলভারের হাঁড়িপাতিল, প্লাস্টিকের বালতি মগ বদনাওয়ালা, ছাইওয়ালি, মাছওয়ালা, সব্জী বিক্রেতারা মাস্ক ছাড়া দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। কই এদের কেউ কী মরছে? এরা কবার সাবান মেখে হাত ধুচ্ছে, গরম জলের ভাপ নিচ্ছে নিয়ম মেনে? এত কি প্রোটিন খাচ্ছে শালারা কই কাউকে ত মরতে দেখছি না! বিরস মনে তিনি লাল লিফটের ভেতর ঢুকে প্লাস্টিক স্টিক দিয়ে চার নম্বর বাটনে চাপ দিয়ে মাস্ক টাইট আছে কিনা চেক্‌করে নেন।

অন লাইন পরীক্ষা হবে। করোনার কাছে কিছুতেই হেরে যাওয়া নয়। সতর্ক সুরক্ষার মধ্যে অফিস, আদালত, শপিংমল, বাজার ঘাট চালু হয়ে গেছে মে মাস থেকেই। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দেশের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবিদের একাংশ দাবি তুলেছে ইশকুল কলেজসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়া হোক। লক ডাউন শেষে মৃত্যু ও আক্রান্তদের সংখ্যা কম দেখে কিছু কিছু ফরেন কান্ট্রি ইশকুল কলেজ খুলে দিলেও সেকেন্ড ওয়েভের ধাক্কায় ফের বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশ শ্যেন দৃষ্টি রাখছে। কারও চাপাচাপিতে সরকার কর্ণপাত করছে না।

দুঃখজনক হল, ব্যবসা বাণিজ্য চাকরিক্ষেত্রের মত শিক্ষা অঙ্গনের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়েছে। ড্রপ আউট শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সরকারি, বেসরকারি বা একেবারে প্রাইভেট ইশকুল, কলেজ, কিন্ডারগার্টেনের প্রায় এক অবস্থা। দেশের কোথাও ত বিনা বেতনে পড়াশুনা করার ব্যবস্থা নেই।

আজকাল কিছু কিছু কাজে কলেজে যেতে হয়। এপার ওপার চলাচলের একটি ঝুলন্ত ব্রিজ পেরিয়ে আমরা যাই। কয়েকদিন ধরে মেয়েটাকে দেখছি। গুছিয়ে সংসার পেতেছে ব্রিজের উপর। সংসার বলতে দুটো বড় পলিথিনের ব্যাগে ঠাসা জামাকাপড়। ঝকঝকে বোতলে পরিষ্কার সাদা পানি। ভিক্ষার থালাটাও নিটোল সাদা। বুক জুড়ে ক’মাসের একটি ছেলে শিশু। এখনও ঘাড় শক্ত হয়ে ওঠেনি। পরিচ্ছন্ন মায়ের পরিচ্ছন্ন সুস্থ শিশু।

পায়ের উপর ছেলেটাকে বিছিয়ে মাঝে মাঝে এক হাত পেতে দেয় ভিক্ষের জন্যে। অন্য হাতটি শিশুটিকে ছুঁয়ে থাকে। চোখ তোলে না কখনও। কেউ ভিক্ষে দেয়। কেউ দেয় না। কেউ কেউ দিয়ে চকিতে চেয়ে দেখে মেয়েটির দুধ স্ফীত ভরা বুক। পুরুষদের চোখে জ্বলে ছুঁয়ে ধরে নেড়ে চেড়ে আদরে চটকে খুবলানোর লোলুপ জিগীষা। আর অপুষ্ট স্তনবতী নারীরা জ্বলে ঈর্ষার আগুনে। মনে মনে গালি দেয় ঈশ্বরের বেফিকির বেকুবপানায়। যার পেটে নাই ভাত তার এমন ভরভরান্ত স্তন দিয়ে কী লাভ হল রে খচ্চর ঈশ্বর! দেহ খাঁচায় খালি প্রাণদান করতে পারা ছাড়া বাদবাকি সব কিছুতে তোর বৈষম্য রে গুরু!

আমাদের হিসাববিজ্ঞানের আপা সবজান্তা বলে পরিচিত। হিসেবি মুখ করে জানায় - বাচ্চাটা সিওর ইললিগ্যাল। আর এ অকামটা কোনো আলাম শুয়োরের বাচ্চা করেছে বুঝলে। কিন্তু এভাবে কি বাঁচবে মেয়েটা? ও তো আবার---

আমরাও কিন্তু করে থেমে যাই। মেয়েটি কি বাঁচবে রাত পুরুষদের হাত থেকে? নারীর বীজক্ষেত্র সঙ্গমের মায়া খেলার জন্যে ওৎ পেতে বসে থাকে। বীজ খসে পড়তেই কোল পেতে দেয়। সে তো হিসেব বোঝে না লিগ্যাল ইললিগ্যালের প্যাঁচ ঘোঁচ!

হঠাৎ হিসাববিজ্ঞানী আপার চোখে টলটল করে ওঠে মায়া। মাস্কের বাঁধন খুলে বলে - চলো মেয়েটাকে বলে আসি প্রোটেকশন নেওয়ার কথা। ওর দেহটা ত ওর অফিস। সেটা যেন সুস্থ থাকে----

২০২০ চলে গেল পরাজিত মুখে। একবার যে শুধু মুখ খুলে বলবে - বিদায় মানুষ, বিদায় পৃথিবী - সে উপায়ও নেই বেচারা কুড়ির। ভিলেন মরে গেলে যেমন খুশি হয়ে হাঁফ ছাড়ে সবাই, সেভাবে ‘বিদায়’ বলে সরে গেছে মানুষ। একুশ নেমেছে পৃথিবীকে রোগমুক্তির শুভাশিস নিয়ে।

তিনদিন ধরে টুনি বাল্বে সেজেছে আমাদের বিল্ডিং। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কোন তলার এক মেয়ের বিয়ে। ঘরোয়া ভাবে এখন বিয়ে সেরে ফেলা হচ্ছে। হই চই আনন্দ উৎসব করতে পারবে না বলে মেয়ে আবদার ধরেছে, অন্তত লাইট জ্বলুক। আলো হচ্ছে শুভ আর কল্যাণের প্রতীক।

প্রথম দিকে অনেকে সমালোচনা করলেও, পরে তাদের মন নরম হয়ে যায়। কেবল দু’একজন মুখফোড় বিল্ডিঙের সামনে দিয়ে যেতে যেতে বলে যায়, এদের সখ কত! মানুষ বাঁচে না মানুষের জ্বালায়, কুট্টি একখান তাবিজ গলায়। এ দুঃসময়ে কেউ আলোক জ্বেলে বিয়ে করে!

দূর থেকে গান ভেসে আসছে। অনেকটা হামদ্‌নাত গজলের সুরে। মাস্ক পরে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। কে গাইছে? বোঝা যাচ্ছে না। এক সময় একটি জীর্ণ ভ্যানগাড়ি বিল্ডিঙের সামনে এসে দাঁড়ায়। রেকর্ড করা গান বাজছে - কই গেলা গো প্রাণের বাবা, কই গেলা গো মা, আমি কারে কই আমার দুঃখ থমকিয়া থমকিয়া—

চটের মত শক্ত কাঁথায় মোড়ানো একটি খিন্ন শরীর। নিচের দিকে বাঁকানো গাছের ডালের মত বের হয়ে আছে একটি মনুষ্য পা। কেউ হয়ত দয়া করে গানটি গেয়ে রেকর্ড করে দিয়েছে। ভ্যান টেনে নিচ্ছে এক গরীব বৃদ্ধ। সে কী জানে দুঃখ কখনও থমকিয়া থমকিয়া আসে না। দুঃখ আসে স্রোতের মত। অবিরল ধারা বৃষ্টির মত। বাঁধভাঙ্গা বন্যার মত। না ফুরানো রাত্রির মত। বৃদ্ধ লোকটি মুখ তুলে উপরে তাকায়। চমকে উঠি থাই কামিনি গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আমি। এত চেনা মুখ ! কে? কে ইনি?

স্মৃতির সড়কে গেঁথে থাকা ছবিগুলো মনে করতে চেষ্টা করি। সস্তা চশমা। সেই মুখ তুলে তাকানো। ঝলসে ওঠা কাঁচ। অপারগতায় বিব্রত। বিরক্ত মুখ। খুব চেনা। চেনাই ত! কে তবে?

চলে যাচ্ছে ভ্যান গাড়ি। আমাদের ফ্ল্যাট বিল্ডিং পেরুলেই অন্য রাস্তা। গানটা শোনা যাচ্ছে। যদিও ক্রমশ সরে যাচ্ছে দূরে। আর আমি চেনা মানূষের খোঁজে স্মৃতি পুকুরে জাল ফেলেছি।
0

পুবের জানালা - রুখসানা কাজল

Posted in


জেলা শহরের সরকারী গার্লস ইশকুলের সামনে দিয়ে যতবার গাড়ি যায়, ততবার ইশকুলের গেটটা দেখে শিউরে উঠে তালিয়া। 

পাশে বসা সহকর্মী বা অন্য কেউ কিছু বুঝতে পারে না। তালিয়া বুঝতেও দেয় না । এমনিতে পাথরের মত মুখ করে বসে থাকে সে । দরকারের বাইরে সামান্যতম বাড়তি কথা খরচ করে না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত এক চিলতে হাসিও সে হাসে না কারো সাথে । অনেক সময় স্থানীয় কেউ আন্তরিকতার সাথে কথা বলতে গেলে দূরত্বের কঠিন গন্ধ পেয়ে নিজেরাই সরে যায়। ফলে স্থানীয়দের কারো সাথেই কাজের বাইরে কোন সম্পর্ক গড়ে উঠেনি জেলা প্রশাসক তালিয়া শাহরিয়ারের। 

এখানকার সবাই জেনে গেছে উনি উনার মধ্যে থাকতে বেশি পছন্দ করেন। থাকুন গে। তাদের কাজ হলেই হলো। 

তালিয়ার স্বামী রায়হান ইউএনডিবির চাকুরে। আজ এদেশ কাল ওদেশ। একমাত্র ছেলে স্বাগত অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। কম্যুনিকেশন এন্ড জার্ণালিজম এ পড়াশুনা করছে। ছেলের খুব ইচ্ছে এদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে পরিবর্তনশীল বর্তমান সাম্প্রদায়িক মনোভাব নিয়ে লেখালেখি এবং ফিল্ম বানানোর। 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে রায়হানের বাবাকে মেরে ফেলেছে স্থানীয় রাজাকাররা। তিনি ছিলেন একটি বেসরকারী কলেজের ফিজিক্যাল শিক্ষক। কলেজ চত্বরের শহিদ মিনার যখন ভেঙ্গে দিচ্ছিল উন্মত্ত রাজাকারের দল, তখন রায়হানের বাবা ছুটে এসে প্রতিবাদ করেছিলেন। রাজাকাররা তখনই রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে আধমরা মানুষটাকে বেয়নেট চার্জ করে মেরে ফেলেছিল । তারপর শহিদ মিনার ভাঙ্গা সম্পূর্ণ করে পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি দিয়ে সেই রাবিশের স্তুপের নীচে লাশ রেখে চলে গেছিল শয়তানের দল । 

শোনা যায় রাজাকারদের কেউ কেউ নাকি সেই স্তুপে মনের আনন্দে প্রস্রাব করে হাসাহাসিও করেছিল। শোনা গল্পের এই ঘটনা যখনই রায়হানের মনে পড়ে , রায়হানের মুখচোখ শক্ত হয়ে ওঠে। ও জানে শোনা গল্প হলেও ঘটনা সত্য। সে সময় এর চেয়েও জঘন্য ঘটনা ঘটিয়েছে পাকিস্তানী আর্মি আর তাদের পা চাটা রাজাকারের বাচ্চারা। 

রায়হান বাবাকে পেয়েছিল মাত্র আটমাস। বাবার সাথে কিছু ছবি ছাড়া আর কোনো স্মৃতি নেই ওর। মামারা অল্পবয়সি বিধবা মাকে বেশিদিন একা থাকতে দেয়নি। দ্বিতীয় বিয়ের ফলে মা হয়ে যায় প্রবাসি। ইচ্ছে থাকলেও রায়হানকে কাছে রাখতে পারেনি মা। কিন্তু কর্তব্যে কখনো অবহেলা করেনি। প্রবাসে থেকেও রায়হানের লেখাপড়ার দিকে সযত্নে নজরদারি করে গেছে। 

মা চলে যাওয়ায় একলা পড়ে গেছিল রায়হান। একবার দাদাবাড়ি একবার মামাবাড়ি করে করে শেষ পর্যন্ত ক্যাডেট ইশকুল এন্ড কলেজ পেরিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে বেশ ভালো রেজাল্ট করে। কিন্তু কি যে নেশা রায়হানের। দেশে থাকলে যেখানেই একাত্তরের কিছু হয় ও পাগলের মত ছুটে যায়। শহিদ মিনারের গায়ে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে কি সব কথা বলে। হাসে। রাগ দেখিয়ে দু পা হেঁটে এসে আবার ফিরে গিয়ে অভিমানে তাকিয়ে থাকে । 

গাঢ় রোদ্দুর। গাছেরা ঝিমুচ্ছে, পাতারা অলস তাকিয়ে আছে রোদ্দুরের মুখের দিকে চেয়ে। উলোঝুলো শিশু বাতাস হাঁটি হাঁটি পা পা খেলছে পথের ধূলাময়লার সাথে। সেই সময় রায়হান ফাঁকা শহিদ মিনারের গায়ে হাত বুলিয়ে চুপি চুপি ডাকে, বাবা, বাবা, ও বাবা তুমি কি শুনতে পাচ্ছ বাবা আমার একটা ছেলে হয়েছে ! নাম রেখেছি স্বাগত! ভালো না বাবা? 

ঝুম বৃষ্টি । রায়হান শহিদ মিনারের পাশে দাঁড়িয়ে ভেজে আর কথা বলে, বাবা ও বাবা এবারের পোস্টিং পড়েছে সাউথ আফ্রিকা। যাবো তো বাবা ? 

প্রথম দিকে তালিয়া ভয় পেয়েছিল, ওহ গড ! এই তুমি পাগল টাগল নও তো ? 

রায়হান লজ্জা পেয়ে হেসে ফেলেছিল, জানো তো তালিয়া আমার কাছে না আমার বাবা আর শহিদ মিনার এক হয়ে গেছে। সবাইকে তো সব কথা বলা যায় না। তাই মন টানলে মাঝে মাঝে শহিদ মিনারে চলে যাই। মন ভাল হয়ে যায়। এই টুকুই পাগল আমি বুঝলে ফুল পাগলি ! 

ছেলে স্বাগতের তখন কথা ফুটেছে ভাল করে। সেও বাবার সাথে শহিদ মিনার ছুঁয়ে ডাকে, দাদু ও দাদু গান শুনবে দাদাভাই আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ার ? 



তালিয়া এসবের কোনো কিছুতে কোনো দিন যায় নি। 

রায়হান কতবার ডেকেছে, হাত ধরে টেনে নিয়েছে, তালিয়া একবার গলা মেলাও ! শুধু একবার আমার সোনার বাংলা-- গেয়ে দেখো ! তোমার মন ভাল হয়ে যাবে। ভালো লাগবে তোমার ! 

ছেলে চোখে, মুখে, চিবুকে চুমু খেয়ে কত বার বলেছে, গাও না মা, প্লিজ গাও---

তালিয়া কখনো গায়নি। 

এমনকি আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠানগুলোতেও তালিয়া ঠোঁট বদ্ধ করে চোখ বন্ধ করে রাখে। ওর পিঠের উপর তখন শিরশির করে ওঠে সাদা অক্টোপাসের মত কতগুলো আঙ্গুলের ছোঁয়া, এ লাড়কি তু তো হাফ পাকিস্তানি হ্যায়—তু গা, গা বদনসীব নাপাক নাজায়েজ লাড়কি, গা পাক সার জমিন -- তুর জন্যি এই গান ----- 

তালিয়ার মা বিভিন্ন জেলা শহরের সরকারী গার্লস ইশকুলের হেডমিস্ট্রেস ছিল। মার কাছে সে গল্প শুনেছে সদ্য স্বাধীন দেশে নাকি নিয়ম করে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হত। এসেম্বলীতে সব ধর্মের ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে ধর্মপাঠও করানো হত। এমনকি এক ধর্মের ছাত্রি অন্য ধর্মের আয়াত, শ্লোক, বাণী পাঠ করলেও কেউ কিছু মনে করত না। তখনো মানুষের মাঝে সম্প্রীতির সহবস্থান ছিল, ছিল মায়া মমতা আর পরস্পর পরস্পরের প্রতি অনম বিশ্বাস আর ভালোবাসার মোহময়ী সম্পর্ক । 

তালিয়ার সময় এগুলো আর হয়নি। এসেম্বলিই হত না নিয়মিত। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার সাথে সাথে সম্প্রীতি, সদ্ভাব উবে গিয়ে দেখা গেলো নিজস্ব সংস্কৃতি ভুলে বাংগালীরা দ্রুত খাঁটি মুসলিম হতে উঠে পড়ে লেগে গেছে। এমনকি কেউ কেউ আভাসে ইংগিতে বলেও ফেলেছে, হিন্দুর লেখা গান কেনো বাঙালি মুসলিমদের জাতীয় সংগীত হবে ?

সেই প্রথম তালিয়া জানলো, রবীন্দ্রনাথা মানুষ নয়। রবীন্দ্রনাথা হিন্দু ! নজরুল বিদ্রোহী সাম্যবাদি কবি নয়, কেবল মুসলিম!



ওর মা ছিল জয়বাংলার কট্টর সমর্থক। 

বাবা নামের লোকটা যুদ্ধের পর পর পালিয়ে চলে গেছিলো ইংল্যান্ড। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একবার এসেছিল। পাকিস্তানের সমর্থনে আর বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ছেলেমেয়েদের আজেবাজে কথা শেখানোর পাশে চুপি চুপি পাক সার জমিন নামে একটা গানও শেখাতে শুরু করে দিয়েছিলো তাদের। 

জানতে পেরে প্রচুর আপত্তি করেছিল ওর মা। আপত্তি থেকে ঝগড়া আর ঝগড়া থেকে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে চলে যাওয়ার হুমকি দেয় সেই বাবা। মা তখন কি সব কাগজপত্র বের করে। তারপর ঠাণ্ডা মাথায় বলে, এক্ষুণি কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে না গেলে সেগুলো পুলিশের কাছে তুলে দেবে ! বেরিয়ে যাও এক্ষুণি। তালাকের কাগজ পেয়ে যাবে তুমি। 

মার ব্যক্তিত্বের কাছে লেজ গুটিয়ে চলে গেছে লোকটা। আর আসেনি। শুনেছে পাকিস্তানী কোন মহিলাকে বিয়ে করে ইংল্যান্ডে ভালই আছে। লোকটা চলে যাওয়ায় মা বা ওরা কেউ দুঃখ পায়নি। বরং হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল সবাই। 

বেশি খুশি হয়েছিল তালিয়া। 

কারন সেই বাবাটা সুযোগ পেলেই তালিয়ার পিঠ খামচে দিয়ে বলত, তোর জন্যে এদেশ নয়। তোর জন্যে পাক সার জমিন। আরে তু তো হাফ পাকিস্তানি হ্যায় গুড়িয়া।



অই বয়সে কথাটার অর্থ ভালো করে বুঝতে পারত না সে। তাছাড়া বড় দুই বোন তানজিয়া আর তানহা, তালিয়াকে বাবা নামের লোকটা থেকে সব সময় দূরে সরিয়ে রাখত। পুরো তিনটে মাস লোকটা ওদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে গেছে নির্লজ্জ নিষ্ঠুর প্রতিহিংসায়। 

চাকরী থেকে অবসর নেওয়ার পর নিজ শহরে ফিরে আসে তালিয়ার মা। শরীরও কেমন ভেঙ্গে পড়ছিল তার। আড়িয়াল খাঁ নদীপারে বসে মা একদিন এক গোপন সত্যকে খুলে দিয়েছিলো ওদের সামনে। অন্য তিন সন্তানকে তিনি বলেছিলেন, তালিয়াকে তোমরা ঘিরে থেকো। তালিয়া আমার অহংকার। 



মুক্তিযুদ্ধর সময় তিনি একটি ছোট শহরের গার্লস ইশকুলের হেডমিস্ট্রেস ছিলেন। যুদ্ধ শুরুর প্রথমে বামধারার একজন সচেতন নেতা এসে বলেছিলেন, ম্যাম প্রতিরোধ যুদ্ধে মেয়েদেরও তৈরি করা দরকার। ওদের ট্রেনিংএর জন্যে ইশকুলের মাঠটা কি পেতে পারি ? 

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকে মানুষটাকে তিনি চেনেন, ভালো করেই জানেন। শহরের অধিকাংশের মত তালিয়ার মার কাছে শ্রদ্ধায় সন্মানে অনেক উঁচুতে ছিলেন মানুষটা। তিনি সাথে সাথেই সম্মতি দিয়ে দেন। 

অই ইশকুলের মাঠে ডামি রাইফেল নিয়ে মেয়েদের ট্রেনিং করাতেন সেই কমরেড। অনেক সময় মেয়েদের সাহস দিতে তালিয়ার মাও নেমে পড়তেন ট্রেনিংরত মেয়েদের সাথে। একটু চা, সামান্য মুড়ি মাখা, কোনোদিন সব্জী লুচি খেয়ে সবাই মুক্তিযুদ্ধের গল্প করত। কি টগবগ দুরন্ত সময় তখন। মেয়েদের প্রত্যয় মাখা মুখে যুদ্ধ করার স্বপ্ন দুলে যেত কঠিন প্রতিজ্ঞায়। রেডিওতে পাকিস্তানী মিলিটারিদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ের খবর শুনে মেয়েরা চাপা ঠোঁটে জানতে চাইত, ম্যাম আমরা কবে যুদ্ধে নামবো ? আর তো সহ্য হচ্ছে না ! কবে যুদ্ধে যাবো আমরা ! 



তখনো পাকিস্তানী আর্মি অই শহর দখল করে নেয়নি। তবে খবর আসছিল, খুলনার পথ ধরে যে কোনো দিন শয়তানরা চলে আসতে পারে এই শহরের দিকে। 

এপ্রিলের শেষ দিনের সকাল। পাকিস্তানী আর্মি প্রতিরোধ ভেঙ্গে ঢুকে পড়েছিল সে শহরে । তালিয়ার মা সুলতানা শাহরিয়ার গার্লস ইশকুলের হেডমিস্ট্রেস, মুক্তিপিয়াসি মেয়েদের নতুন কমরেড অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে পাকিস্তানীদের পথপ্রদর্শকদের মধ্যে তার স্বামী নেতাগিরি করছে। মাথায় জিন্না টুপি পরণে পেশোয়ারী কুর্তা কামিজে এক নতুন অবতার যেনো ! 

মধুমতি নদীকে রক্তে ভাসিয়ে পাকিস্তানীরা দখল নেয় শহরটি। ডামি রাইফেলে লড়া যাবে না বুঝে মেয়েরা গ্রামে পালিয়ে গিয়েও বটি, সড়কি, বর্শা, দা হাতে সতত সজাগ থাকে। মনের ভেতর যুদ্ধ জয়ের মন্ত্র, মেরে তবে মরব ! 

এরমধ্যে অবশ্য কয়েকটি ঘটনাও ঘটে গেছে। সন্মিলিতভাবে শহরের কাছেরই এক গ্রামে দা, বটি, সড়কি, বর্শা হাতে আক্রমণ উদ্যত পাকিস্তানী সৈন্য আর রাজাকারদের মেরে কয়েকজন মেয়ে প্রাণ দিয়েছে। কেউ কেউ ভরা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে কচুরিপানার সাথে ভেসে পালিয়ে গেছে। আবার কেউবা ধরা পড়ে গেছে। 

ইশকুলের দারোয়ান জলিল সে সব খবর বলতে গিয়ে সজল হয়ে যেত ইশকুলের দারোয়ান জলিল মোল্লার চখ, আহা কি সোনার মেয়েরা গো আম্মা ! আচ্ছা আম্মা আল্লাহ কি অন্ধ কালা বোবা । নমরূদের মত পাকিস্তানি মিলিটারিদের উপর গজব দিয়ে মেরে ফেলে না ক্যান ! 



জোর করে ইশকুল কলেজ খুলে রেখেছিল পাকিস্তানী আর্মিরা। ছোট ক্লাশের মেয়েরা কেউ কেউ ইশকুলে আসতো। হিন্দু শিক্ষক শিক্ষিকারা কেউ ছিলনা। তারা পালিয়ে গেছিল। শহরে বাসা এরকম কিছু মুসলিম শিক্ষক শিক্ষিকা সিগনেচার করে তাড়াতাড়ি চলে যেত বাসায় । 

দারোয়ানরা ভয়ে কাঁটা হয়ে গেট পাহারা দেয়। তাদের গলার জোর কমে গেছে। যখন তখন পাকিস্তানী সৈন্যরা ইশকুলে ঢুকে ম্যামের কোয়ার্টারে তার স্বামীর সাথে দেখা করতে চলে আসে। ম্যামের স্বামি বিরাট রাজাকার। মিলিটারি গাড়ি করে শহরে ঘুরে বেড়ায়। দেখলে বাঙ্গালী লাগে না। কেমন পাকিস্তানী পাকিস্তানী লাগে। আজকাল কথাও বলে উর্দুতে। 

যুদ্ধ সময়ের একদিন ইশকুল ছুটির পর কি এক কাজে চারজন নিম্নপদস্থ পাকিস্তানী আর্মি ইশকুলে আসে। তালিয়ার মা তখন একজন শিক্ষিকাসহ অন্য একজন ছাত্রীর মাকে নিয়ে গল্প করছিলেন। সিনিয়র পাকিস্তানী সৈন্যটি ছাত্রীর মাকে টেনে নিতে গেলে বাঁধা দেন তালিয়ার মা। 

আর কি আশ্চর্য ! তার স্বামির কাছে বহুবার এসেছে নাজিম সালিম নামের যে সৈন্যটি, সেই তাকে ধর্ষণে উদ্যত হয়। শত প্রতিরোধেও তিনি সেদিন ধর্ষিত হয়েছিলেন হেডমিস্ট্রেসের রুমে। দেয়ালজুড়ে অখন্ড পাকিস্তানের ম্যাপ, তার পাশে মোহাম্মাদ আলী জিন্নাহর ছবি, টেবিলের উপর গ্লোব, ডাস্টার, শিক্ষকদের হাজিরা খাতা আর মুড়িমাখা একটি ঘি রঙ বিষণ্ণ গামলা দেখে নিলো ধর্ষণের দৃশ্যটি। 

রুমের সামনে টানা লাল বারান্দা। বারান্দার মাটি ছুঁয়ে বিশাল মাঠ। মাঠের এক প্রান্তে ভাঙ্গা শহীদ মিনার। সেখানে উড়ছিল পাকিস্তানের চানতারা পতাকা। পতাকাদণ্ডের মাথার উপর আর্ত চীৎকার করে উড়ে উড়ে বসছিল কয়েকটি দাঁড়কাক। ম্যামের স্বামী তখন দারোয়ান জলিলকে শাসাচ্ছিল, চুপ। একদম চুপ থাকবি। কেউ যেনো কিছু জানতে না পারে। 

তালিয়া সেই ধর্ষণের সন্তান। 

সব শুনে তালিয়া কাঁদেনি। ইনফ্যাক্ট কান্নার সুযোগ পায়নি। পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মত তিন ভাইবোন তালিয়াকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিল। যেনো তালিয়া একটি বদ্বীপ। ব্রম্মপুত্রের গেরুয়া জল প্রতিদিন নৈবদ্য দিয়ে চলেছে পলিমাটির শুদ্ধতায়। আর বুড়ো আড়িয়াল খাঁ তার পুণ্য জলে ধুয়ে মুছে নিয়ে গেছে তালিয়ার জন্মকথন। 



বিসিএস ট্রেনিংএ রায়হানের সাথে পরিচয় হয়। তালিয়ায় মুগ্ধ রায়হান সব শুনে শক্ত হাতে ওর হাত ধরে বলেছিল, ঈগলের চোখে অই পতাকাকে দেখবে আর মন্ত্রের মত গেয়ে যাবে, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি --- 

তালিয়া অবশ্য সুর তোলেনি গলায় কিন্তু রায়হানকে জড়িয়ে নিয়েছিল জীবন চলার পথের সাথি হিসেবে।  



এই সেই শহর। চাকরী জীবনে তালিয়া কেবল অপেক্ষা করেছে এই শহরে আসার। এখানেই এক পাশবিক সঙ্গমে তার ভ্রুণ স্থাপিত হয়েছিল একটি অনিচ্ছুক গর্ভে। তাকে ভেসে যেতে দেয়নি সে গর্ভফুল। এই গার্লস ইশকুলের কোয়ার্টারেই জন্ম হয়েছিল তালিয়ার। 

নুন নয়, মধু মুখে প্রথম চীৎকার করে কেঁদে উঠেছিল যুদ্ধশিশু তালিয়া। ধাত্রী, শহরের পার্টটাইম কির্তন গায়িকা ললিতা বালা নরম কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে খুশিতে বলে উঠেছিল, আহা আহা! কি ঝামা গলা গো আমাদের মেয়ের! শ্রীকৃষ্ণের চরণফুল ঝরে ঝরে পড়বে এ মেয়ের গান শুনে ! 



এবারের ছাব্বিশ মার্চ, স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে নাজমা নামের মেয়েটি লাঠি খেলায় ওস্তাদ জব্বার শেখকে হারিয়ে দিয়েছে। হাত তালিতে ভেসে যাচ্ছে গোটা স্টেডিয়াম। জব্বার শেখ স্নেহ আশীর্বাদের হাত রাখে তার পায়ের কাছে বসে থাকা শিষ্যা বিজয়নি নাজমার মাথায়। সারা স্টেডিয়াম জুড়ে হাততালির সাথে ভেসে আসছে গর্ব আর অহংকারের স্নেহভাস , হু নাজু আমাদের মেয়ে ! বীর মেয়ে! সোনা মেয়ে ! আমাদের মাতঙ্গিনী হাজেরা বালার নাতনি। সেই হাজেরাবালা গো। বর্শা আর রামদার কোপে যে একাত্তরে দুজন রাজাকার আর একজন পাকিস্তানি সৈন্য মেরেছিল ! মনে নাই ? 

দ্বিতীয় পুরস্কার হাতে নিয়ে জব্বার শেখ এক অদ্ভুত অনুমতি চেয়ে বসে জেলা প্রশাসক তালিয়া শাহরিয়ারের কাছে, হুজুর একবার দেখা করতি চাই। বড় দরকার গো হুজুর মা জননী। 

অনেকটা বাধ্য হয়েই বিকেলে নিজ বাংলোয় আসতে অনুমতি দেয় তালিয়া। 



চৈত্রের গুম বিকেলে নাজমাকে নিয়ে ডিসি সাহেবার বাংলোয় আসে জব্বার শেখ। তালিয়ার সামনে নত হয়ে প্রায় কেঁদে ফেলে, মাগো একাত্তরে ওর দাদুকে দুহাতে পেরেক গেড়ে নারকেল গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছিল পাকিস্তানি মিলিটারিরা। রক্তের গন্ধ পেয়ে অসংখ্য পিঁপড়ে খুবলে খেয়েছিল জ্যান্ত মানুষটাকে। সে দিরিশ্য কথায় বলা যায় না গো মা। ওর দাদিমা বর্শা আর রামদা দিয়ে কুপিয়ে দুজন রাজাকার আর একজন পাকিস্তানি সৈন্য মেরেও নিজের সম্ভ্রম বাঁচাতে পারেনি। ধর্ষণের পর বর্শায় গেঁথে ঝুলিয়ে রেখেছিল হাজেরা বালার লাশ। নাজমা আমাদের অহংকার। কিছু কি করা যায় না এই বাপ মা মরা মেয়েটার জন্যে ? 



ফ্যানের বাতাসে ভারি পর্দাগুলো দুলে দুলে উঠছে। গড়িয়ে যাচ্ছে অস্বস্তির কয়েকটি মূহূর্ত। তালিয়া বৃদ্ধ জব্বার শেখের দিকে অনিমিখে তাকিয়ে আছে। বৃদ্ধের চোখ অনেকটা ওর মায়ের মত দৃষ্টিবদ্ধ। উজ্জ্বল দরদী মায়াময়। সেখানে ভাসছে বন্ধুতা, ভালোবাসা আর অণুপ্রেরণনার ঋদ্ধ ছায়া। আর পরম আশ্রয়ে নাজমা নামের মেয়েটি ছুঁয়ে আছে জব্বার শেখের একটি হাত। 

উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে অতিশয় গম্ভির অসামাজিক জেলা প্রশাসক নাজমাকে কাছে ডেকে নেয়। বুকের কোথায় যেনো আত্মীয়তার সুখসুর বেজে ওঠে। কারা যেনো শুভ শুভ শব্দে হেসে ওঠে চারদিকে। আর দুটি দেহের রক্তের ভেতর মার্চ করে যায় রক্তাক্ত একাত্তর। 

নাজমার শক্ত পোক্ত হাতদুটি নিজের হা্তের ভেতর নিয়ে কথা দেয় তালিয়া, নাজমার জন্যে কিছু সে করবেই। 

বৃদ্ধের চলে যাওয়া ধুলো পথ থেকে যেনো সুর ভেসে আসছে। পলাশ ফোটা সন্ধ্যায় তালিয়ার মনের ভেতর গুণগুণিয়ে ওঠে , খেলাধূলা সকল ফেলে তোমার কোলে, ওমা তোমার কোলে ফিরে আসি, সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি --- 
1

পুবের জানালা - রুখসানা কাজল

Posted in


ছেলে এসে জানালো এখন থেকে অফিস যেতে হবে মাম। ফালতু কোন প্যানিক করবা না। 

ধ্বক করে একটা ধাক্কা খেলাম মনে। 

লক ডাউনের প্রথমেই ওকে বলেছিলাম, কভিড১৯ একেবারে নির্মূল না হলে তুমি কিন্তু অফিস যেও না বাবা। কখন কী বিপদ হয় কে জানে! 

আমার আত্মীয় বন্ধু সহকর্মিরাও বলেছিল, আছে তো অই ছেলে। কিছুতেই ওকে বেরুতে দিও না। কিছু হয়ে গেলে. . . 

গেল ক মাসে ঘর থেকে যতবার বেরিয়েছে আমি বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। ও যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছে, এভাবেই পৃথিবীর পরিবর্তন আসে মা। কভিড১৯ হচ্ছে নিউ নর্মাল পৃথিবী আসার একটি সাফাই প্রক্রিয়া। এতদিন মানুষ পৃথিবীর ক্ষতি করেছে। এবার পৃথিবী দিচ্ছে। মানুষকে ত মেনে নিতে হবে। তাছাড়া যথেষ্ট প্রটেকশন নিয়েই বাইরে যাই। সো ষ্টপ ইয়োর সিরিয়াল প্যানিক মাম। 

সেই কবে মা হয়েছি। ওকে কোলে নিয়ে মুখস্থ করেছি, ‘পিস এন্ড কনফ্লিক্ট থিয়োরি’র কঠিন মারপ্যাঁচ। কতবার ভেঙ্গে আবার ওকে গড়ে নিয়েছি। আজ ও আমাকে প্রকৃতির শক্তি সুরক্ষা গুঁড়িয়ে মনুষ্য নির্মিত সভ্যতার মরণাপন্ন ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীর পুনর্জন্মের নবউত্থান বোঝাচ্ছে! এটাকে কি বলব? প্রাকৃতিক রেনেসাঁ নাকি প্রকৃতির প্রতিশোধ? 


এমনিতে এই অতিমারি, লক ডাউন, বন্ধুদের সাথে বিচ্ছেদ, বেড়ানো আর খানাপিনা না করতে পারা তায় অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে অহর্নিশ সচেতন হওয়ার যন্ত্রণায় ছেলেটা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে গেছে। কিছু বলতে গিয়েও গিলে ফেলি। কথায় কথায় ফ্যাচ করে ওঠে স্বভাবে শান্ত ছেলেটি। চারদিক থেকে কিছু খারাপ খবরও আসছে। কোভিডে মৃত্যুর চেয়ে সে মৃত্যু আরও যন্ত্রণার। তরুণ ছেলেমেয়েরা নিরবিচ্ছিন্ন এই বাধ্য গৃহবাস মেনে নিতে না পারছে না। অনেকেই ডুবে যাচ্ছে গভীর বিষাদে। এদের কেউ কেউ নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে এক অস্থির বিভ্রমে। 

আমার পিকচার টিউব নষ্ট পুরানো আমলের বাক্সো টিভি। লালচে রঙের ছবি আসে তাতে। বহুবার বহুজন বলেছে, পাল্টে ফেল। সাথে নিজেকেও খানিক পাল্টাও। 

প্রাণে ধরে পাল্টাই না। আমার স্মৃতির পিকচার টিউব ত নষ্ট হয়নি! কোন এক মা দিবসে ব্যাপক সারপ্রাইজ দিয়ে গিফটেছিলেন যিনি তিনি এখন নষ্ট মনিটর। টিভিটা ত জীয়ন্ত। আমি সুখি স্মৃতি ভালোবাসি। স্মৃতিসুখের পানসীতে ভেসে পান্নাহীরা খচিত বৈঠায় ঘাই মেরে জীবনকে সোনারঙে রাঙিয়ে তুলি। মনবৃক্ষে বাস করে এক টিট্টিভ পাখি। সারাক্ষণ সে ডেকে যায়, টুডে টুডে টুডে—হ্যা আজ। আজই ত! এই যে এখনও বেঁচে আছি। আজই নির্ভুল। আজই শুদ্ধ। কাল? কে জানে সেই অধিযুগকে! 


টিভির পর্দায় ভেসে ওঠে জেলা শহর নাটোরের কাগজ কুড়ানি এক বনলতা সেন। বয়েসি বটের পাতার মত জীর্ণ মুখ। শীর্ণ হাতে ভিক্ষে পাওয়া ভাতগুলো ধুয়ে রোদ্দুরে শুকিয়ে নিচ্ছে নিউ নর্মাল ভাতের আশায়। ক্যামেরাম্যানের দুচোখে নদি আত্রাইয়ের জলস্রোত। মাস্ক ভিজে আর্দ্র জলাভূমি। ছুটে এসেছেন জেলাপ্রশাসক। বয়েসি বনলতা ছাতিমফুলের গন্ধের মতন ভেসে আসা ভাতের সুবাস পায়। তবে কি ভাত ফেরেশতারা নেমে এসেছে তার পথনীড়ে! ভাত ! আহা ভাত। ভাত খোয়ানো নারী হাত পাতে, দুগ্‌গা ভাত পাল্যে – বাবাগো ভাত – কিছু না—আর কিছু না--- 


গেল সন্ধ্যায় কাঁদতে কাঁদতে জাকিয়া ফোন করেছিল। দুদিন আগে থার্ড ইয়ার অনার্সের মিনিষা, ওদের বন্ধু সুইসাইড করেছে। 

কিছুটা বিহবল হয়ে বসে থাকি। এসব ঘটনা নতুন কিছু নয়। আমাদের অনেক ছাত্রছাত্রী এমন মৃত্যুকে গ্রহন করে নেয়। ওদের মা বাবা আসে। চোখ মুছে জানিয়ে যায়, বোর্ডের পরীক্ষায় ফেল করেছিল। বকাবকি করেছিলাম। কেউ বলে, স্মার্ট ফোন চেয়েছিল। দিতে পারি নাই গো। চুপিচুপি কেউ বলে যায়, বয়ফ্রেন্ড ব্রেক আপ করেছিল। মেয়ে সামলাতে পারেনি গো ম্যাম। 

বুকে পাথর বেঁধে ওদের মাবাবাকে আমরা সান্ত্বনা দিই। 

মিনিষা খুব স্বতঃস্ফুর্ত মেয়ে ছিল। ম্যাচিং পোশাক, নেইলপলিশ জুতায় উড়ে উড়ে বেড়াত কলেজ ছাড়াও হেথা সেথা। কিছুতেই একা থাকতে পারত না। দলে বলে ঘুরে বেড়াত। কোন কোন শিক্ষক খুব বকে দিলে খুঁজে বের করে অনুযোগ করত, ম্যাম আমাদেরও ত নিজস্ব একটা পার্ক থাকা দরকার। প্রেমপার্ক। তাইলে ত আমরা চন্দ্রিমা উদ্যানে গিয়ে স্যারের কাছে ধরা খেতাম না। একবার বিতর্ক সভায় বিচারকসহ পুরো অডিয়েন্সকে নাকাল করে ছেড়েছিল ওদের গ্রুপ। 

সেই মেয়ে সুইসাইড করেছে ? 

জাকিয়ার সাথে আমারও বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। ভাবতেও কষ্ট হয়, গাজিপুরের পারিবারিক গোরস্তানে একা শুয়ে আছে মিনিষা! 

হয়ত কোন একদিন ওর হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে গজিয়ে উঠবে কোন রাধাকৃষ্ণ বৃক্ষ। সেই গাছ জড়িয়ে বাতাস কেঁদে উঠবে উথালপাথাল সুরে, ... আমার মাথার বেণী খুইলে দিমু, নাকের ব্যসন খুইলে দিমু, গলার হার ছড়িয়ে দিমু তারে আইন্যা দে... প্রাণ সখিরে ... 


সকালে জামা প্যান্ট ইস্ত্রি করে রাখলাম। জুতাটা মুছে রাতে ধুয়ে শুকিয়ে রাখা মোজার পাশে নতুন সার্জিক্যাল মাস্কের বক্স, স্যানিটাইজারের মিনি স্প্রে বটল, লাঞ্চবক্স রেখে দিলাম। শান্ত মুখে নাস্তা খেয়ে হেলমেট হাতে নিয়ে দরোজার নবে হাত রেখে ছেলে জানালো, এগুলো আর করবে না। আমি ডিপেন্ডেট হয়ে যাব। বাই মা। টেক কেয়ার। 

আমার মাতৃত্ববোধে জোর ধাক্কা লাগে। খণ্ডবিখণ্ড শিলালিপি কেঁপে ওঠে। 

বালকবেলায় কলাবাগান মাঠে দুর্গাকে দেখে ছবি এঁকেছিল ছেলে। দশ হাতে খুন্তি, কড়াই, বই, পেন, ল্যাপ্টপ, ইস্তিরি, ঝাড়ু, বালতি কি নেই! সে দুর্গার বার্গান্ডি কালার খাটো চুল, পায়ে হাইহিল। বাড়িসুদ্ধ সবার সে কি হাসি, দুর্গা কই! এ যে তোমার মা। 

আম্মুই তো দুর্গা। দেখো না কত কাজ করে। খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছিল তখন। আর এখন! 


আমি কখনও আন্ডার গার্মেন্টস ওকে দেখে লুকিয়ে ফেলিনি। জানিয়েছি, এটা মেয়েদের দরকারি পোশাক। যেমন ছেলেরা পরে। ব্রা নেড়ে দিয়েছি ওড়না বা গামছার নিচে। উৎকট প্রদর্শন যে অস্বস্তিকর সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছি। আজকালকার সব ছেলেমেয়েই রান্না জানে এবং করতে ভালবাসে। মা, বোন, প্রেমিকা আর স্ত্রীদের বেশ সহায়ক হয়ে উঠছে আজকের পুরুষরা। মাঝে মাঝে ‘টক শো’ দেখতে আরাম করে বসে ওকে বলি, চা খাওয়াবে অশেষ অর্ণব ইসলাম? নিম্বু উইথ মিন্ট লিভস! 

কিচেনে ঢুকে বিরক্ত হয়ে যায়। উফ্‌ মা আদ্দিকালের সব জিনিস। একটু মডার্ণ হও মা। হাঁক দেয়, চিনি কই? জুয়েলারি বাক্সে রেখেছ নাকি! 

কিচেনের দরোজায় আমাকে দেখলেই রেগে যায়, বেবি সিটিং করতে এসেছ?


আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহে কাশফুল ভরা একটি ডালি দিয়ে গেছিল কেউ। বাতাসে উড়ে উড়ে দুলে যাচ্ছে ধবল সৌন্দর্য। বাপের বাড়ি আসবে বলে লক্ষ্মী সরস্বতীকে নিয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছে দুর্গা। নিচে তাকিয়ে দেখি, ছোটখাটি দেখতে ব্যারিস্টার মেয়েটি ওর ছোটবোনকে নিয়ে বেরিয়েছে। স্ক্রুটিতে স্টার্ট দেওয়ার আগে চেঁচিয়ে জানতে চাইছে, আম্মু ওষুধগুলোর নাম ঠিকমত লিখছ তো? আর কিছু লাগবে? আব্বুকে জিগ্যেস কর একবার। 

নিউরোলজী হাসপাতাল থেকে নাইট ডিউটি শেষ করে বেরিয়ে এসেছেন দুজন মুখঢাকা ডাক্তার। মাথামুন্ডু আর ফিগার দেখে বোঝা যায় একজন ডাঃ গাঙ্গুলী অন্য জন ডাঃ আকবর। ছোট মেয়েটা সদ্য ল ইয়ার হয়েছে। ওদের দেখে ছুটে যায়, আব্বু না একদম ঘুমাতে পারে না কাকু। টিভি চালিয়ে সারারাত জেগে বসে থাকে। একবার যদি বাসায় আসেন ত খুব ভাল হয় -- 

ডাঃ আকবর গাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে মাস্কের ভেতর বিষাদ হাসে, আর ঘুম মামণি। এ দুনিয়া থেকে ঘুম চলে গেছে রে মা। গাড়ির দরোজা ধরে বারোতলা ফ্ল্যাটের না দেখা ছাদের উপর ঘুম খুঁজতে খুঁজতে ডাঃ গাঙ্গুলী ভাবে, চিরঘুমের দেও দৈত্য নেমে এসেছে পৃথিবীতে। তার মেয়েটা আছে চিন দেশে। কেমন আছে কে জানে। মুখে ত বলে ভাল আছে। যদি কিছু --- 

মেয়েদুটির বাবাও ব্যারিস্টার। এদের মায়ের বাবাও ছিলেন স্বনামে পরিচিত একজন লড়াকু ব্যারিস্টার। ওদের পরিবারে ছেলে সন্তান নেই। মেয়েরাই দশভূজা। এই দুর্যোগে প্রৌঢ় বাবামাকে ঘরে রেখে সব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে দু মেয়ে। 

ছোট মেয়েটার মাথায় হাত রেখে অভয় দেন ডাক্তার গাঙ্গুলী। হে মা ভবপ্রীতা, ত্রিনেত্রা, শূলধারিণী, সর্বমন্ত্রময়ী, দজ্ঞযজ্ঞবিনাশিনী তোমার বাপেরবাড়িকে কোভিড মুক্ত করে দাও হে অমেয়বিক্রমা।

0

পুবের জানালা - রুখসানা কাজল

Posted in





আমাদের ক্যালেন্ডারগুলোতে ইংরেজি মাসের সাথে কেন যে বাংলা মাসগুলো দেওয়া থাকে না কে জানে! এবারের আশ্বিন মাসের প্রথম দিনের ভোরটি আমার ভীষণ দরকার। তাই ১৬ আগস্ট, ভাদ্র মাস শুরু হতেই নড়েচড়ে বসি। তারিখটাকে সার্কেল করে প্রমিস করি, আশ্বিনের প্রথম দিনের ভোর আমাকে ধরতেই হবে। কিছুতেই মিস করা চলবে না। 

মাখনের মত নরম কোমল আলো লেগে থাকা কিছু অনুভব নেমে আসে আমার মনে। এবার আমি গাস্যি করব। মায়ের ভেজা চুলের মত মখমল ঠাণ্ডা ভোরে অলকানন্দা, গুটি করবী, কণকলতা আর গন্ধরাজ গাছের সাথে হবে আমার গাস্যি। গাছগুলোতে কিছুতেই ফুল আসছে না। 

রোজ সার পানি দিয়ে গান শুনাই। গায়ে মাথায় পাতায় ডালে হাত বুলিয়ে আদর করি। তবু ফুল ফোটায় না। তাই ত মনে পড়ে গেল আশ্বিনের প্রথম ভোরে আমাদের ছোট্ট শহরের গাস্যি উৎসবের কথা। সে কী হইহই ব্যাপার ছিল! বয়সে বড় কেউ দা নিয়ে অফুলবতী বা অফলবান গাছকে ভয় দেখানোর নাটক করে বলত, হ্যারে গাছ তুই কবে ফল দিবি, কবে ফুল ফোটাবি? এরমভাবে আর কতদিন থাকবি তুই! নাহ্‌ আর ত সহ্যি হচ্ছি না। ইবার তোকে রাখব না। কাটি ফেলাবো। ফেলাবোই--- 

দা উঁচিয়ে কোপানোর ভান করতেই আমরা কুচোকাচারা গাছটাকে জড়িয়ে ধরে চেঁচিয়ে উঠতাম, কেটো না কেটো না প্লিজ। দেখো সামনে বার সিওর ফলফুল ফোটাবেনে। ও কাকু এবা্রের মত ছাড়ি দাও। কেটো না গো কাকু। 

কাকু তখন রক্তরাঙ্গা চোখ করে গাছের গায়ে আলতো করে দা ঠেকিয়ে বলত, ওকে ওকে। আচ্ছা তোরা বললি বলে এবারের মত ছাড়ি দিচ্ছি। তয় আসছি বছর ফলফুল না দিলি সত্যি সত্যি কাটি ফেলাবানি কিন্তুক। কারও কথা শুনবোনানে। 

নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল, ভয় পেয়ে এবার ফলফুল দিবে গাছ। অনেক সময় বাস্তবে এমন ঘটেও যেত। 

আমরা কেউ কখনও জানতে চাইনি, গাস্যি কাদের আচার অনুষ্ঠান। হিন্দু্র নাকি মোছলমানের। শুধু জানতাম এ যে আনন্দের এক মহা উৎসব। 

অথচ বড় হতে হতে শুনলাম, এগুলো হিন্দুদের আচার। মোছলমানের করা পাপ। কেউ কেউ যদিও প্রতিবাদ করে বলেছিল, গাছের আবার হিন্দু আর মোছলমান। যত্তসব ধর্ম ফাজিলদের কান্ডকারখানা। 

আমাদের অনেকেরই মুখ শুকিয়ে গেছিল। গাস্যি ত বাহানা। আসলে সেদিন গাছওয়ালা হিন্দু মোছলমানদের বাড়িতে কাঁসার থালা ভর্তি নারকুলে সন্দেশ, তালের পিঠা আর তালের ফোঁপা সাজানো থাকত। দেদারসে খেতাম। এমনকি চালাকি করে ডান হাতেরটা বাঁ হাতে রেখে আবার ডানহাত পেতে দিতাম আমরা। 

করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে কি করে যেন পেরিয়ে গেল আশ্বিনের ভোর। যখন বুঝলাম তখন দুপুর হয়ে গেছে! গাছগুলো ছায়া ফেলে মায়াঘর বানিয়ে খেলছে বারান্দায়। 

সকালে ভেজা কাপড় নেড়ে দিয়ে কিচেন ঝেড়ে মুছে চুলোয় আগুন জ্বালাচ্ছি, ছেলে এসে দাঁড়ালো, মাম দাঁত ব্যথা করছে। শক্ত ছেলে, সহজে কিছু বলে না। নুনজল করে দিয়ে জানাই ব্যাথাটা মেনে নিতে হবে বাবা। তোমার থার্ড মোলার টিথ উঠছে যে! চলে যেতে যেতে ফিরে আসে ছেলে। মূহূর্তের জন্যে ওর চিবুক ছুঁয়ে যায় আমার চুল। আমি বুঝি সে স্পর্শের ভাষা, লাভ ইউ মাম। হ্যাপি ডটার্স ডে। 

ডটার! মানে কন্যা, আমি আমরা! সুখে আছি কি? 

পাহাড়ের মৌন শান্তশ্রীকে ছিঁড়েখুঁড়ে খাগড়াছড়িতে আদিবাসী এক প্রতিবন্ধী কন্যাকে ধর্ষণ করেছে নয় জন সমতলের বাঙ্গালী পুরুষ। সিলেটে ধর্ষিত হয়েছে এক নববধূ। নোয়াখালীতে নারীদেহ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে। ফেসবুক, টিভির বদৌলতে জানা যাচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও ভাল নেই নারীরা। ধর্ষণের ধরণ পাল্টেছে। এখন একজন নয়। দলবদ্ধভাবে এমনকি কোথাও কোথাও হিন্দু মোছলমান মিলেঝুলেও ধর্ষণ করছে। শিশ্নের কাছে ধর্মও পরাজিত। 

লবঙ্গ এলাচ, দারচিনির সাথে লেবু চায়ের উপর দুটি পুদিনাপাতা ভাসিয়ে অন্যমনে ভাবি, পুরুষত্ব কি কেবল শিশ্নে বাঁধা এক পাশবিক তমসুক! কেবলি শিকার, খুন, হত্যা, নির্যাতন, দখল ধর্ষণ আত্মসাৎ এর পশ্বাচার? পুরুষ পুরুষ তোমার কী মন নেই পুরুষ? 

বাংলাদেশে সম্ভবত কভিড১৯ এর দ্বিতীয় ঢেউ তরঙ্গিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত এটি হতেই থাকবে। ভয়কে তুচ্ছ করে বীর বাঙ্গালীরা বেরিয়ে পড়েছে। অধিকাংশের মাস্ক নেই। কারও আছে। কেউবা গলায় মালা করে রেখেছে আবার কেউ কেউ জোরালোভাবে শুধু মহামূল্যবান চিবুকখানি ঢেকে রেখেছে সযত্নে। ফলে করোনা তার রক্তিম আঙ্গুল তুলে বলে দিয়েছে, রেডি সেডি গোওও —রি স্টার্ট অ্যাকশন ধুমসেএএ। ! মৃত্যু বাড়ছে। গ্রাফ উর্ধ্বমুখীন। 

জিম এখও বন্ধ। তাই হাঁটতে বেরিয়েছিলাম লেকের আশপাশে। দেখি ব্রজে গোপাল খেলছে। রাধা রাঙিয়ে নিচ্ছে নিজেকে। জনম জনম ভরের খেলা। হ্যাপি শারদীয়া আন্টি! আমি হেসে ফেলি। ধানমন্ডি বত্রিশের কালো পিচের রাস্তায় ঝাঁপিয়ে ঝরেছে রাতের শেফালি। মর্নিং ওয়াকের নাম করে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে বেরিয়ে এসেছে আমাদের ফ্ল্যাটের সাততলার মেয়েটি। প্রেমিকের কাস্ট আলাদা। তাই নিয়ে নিত্য ঝগড়াঝাঁটি। লিফটে দেখা হলেই মেয়েটি হাসে, এসব কেউ মানে এখন! 

গেল মার্চে হোলির সকালে চারুকলায় যাওয়ার আগে দেখা করে গেছে, আন্টি হ্যাপি হোলি। আপনার গিফট। সঞ্জয় দিয়েছে। 

ফাটাফাটি সুন্দর দুটি শোলার পাখি। রঙে রঙিন। এক ডালে মুখোমুখি দুজন। গল্পবাজ ভঙ্গী। আমি খুশিতে উইশ করি, তোমাদের হোলি, আমাদের দোল। 

আমাদের? 

ছিটকে উঠে আসে ধাঁ ধাঁ এক দুপুর, এই তোরা হিন্দু হইছিস তাই না? 

কালো দাড়ি, ফর্সা বাচ্চুকাকার পাশে কুচুটে ঠান্ডু কাজি। অন্ধ রাগে কান মলে দেয় ভাইয়া আর আমার। রঙপচা স্যাঁতসেঁতে এক বোটকাগন্ধে মন খারাপ হয়ে যায় আমাদের। রঙ খেলা ফেলে ফিরে আসি ঘরে। দুপুরে ফার্মেসি থেকে বাপি ফিরলে বুঝিয়ে দেয়, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। 

ফোঁস করে উঠে মা, ওদের সাহস হয় কি করে শুনি! আমার ছেলেমেয়েদের কান কি সস্তা? ওরা কারা? 

আল্লামা শফি সাহেব মেয়েদের তেঁতুলের সাথে তুলনা করে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাবীনামা পেশ করেছিলেন। দাবী নামাগুলো পরে এক সময় আলোচনা করা যাবে। এবার একটি সত্যি কথা বলি, তেঁতুল কি কেবল পুরুষদের লোভ জাগায়? আমরা নারীরা কি ক্রাশ খাইনা কোন কোন পুরুষের সিক্স প্যাক বডি, ভয়েস, চোখ, কথা বলার আর্ট, মেধা, সততা দেখে। তো পুরুষরাও ত ভোগ্য। তারা কেন নিজেদের ঢেকে রাখে না? 

যদিও কয়েক শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মজাক হলো, নারীদের ঢাকনা দিয়ে রাখার নিয়ম। 

ঢেকে রাখলেই কি ধর্ষণসহ নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে! কুমিল্লার তানিয়া, চট্টগ্রামের পোশাককন্যা, নোয়াখালীর রোজীসহ ধর্ষিতাদের অধিকাংশ বোরখা হিজাবের ঢাকনাতে ঢাকা ছিল। ওরা পেরেছে ধর্ষণ এড়াতে? 

মিরপুর রোডের জ্যামে আটকে আছি। কে বলবে করোনাকাল! গাড়ী, মানুষে মিলেমিশে এক বিপুল জনসমুদ্র। জীবন যেন হো হো করে হোপাক নাচছে। ওদিকে বেঙ্গলে অপেক্ষায় রয়েছে একজন। হঠাৎ চোখে পড়ে আমার রিক্সা বাহকের দিকে। হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ক্লান্ত জীর্ণ চেহারা। দুপায়ে রবারের গোলা। ধানমন্ডির ছায়ামাখা রাস্তায় যেতে যেতে জানতে চাই, বাড়ি কই গো মামু? সিরাজগঞ্জ। ওহো, নদীভাঙ্গা দেশের মানুষ আপনি। তা কেমন আছে যমুনা? 

জানিনা গো মা। যমুনা ছাড়ি অনেকদূর চলি আসিছি। আগে পাতাম নদীর গন্ধ। এখন খালি ধুলো পলিথিন আর বিষ্ঠার গন্ধ পাই। 

লকলকিয়ে ওঠে আমার পাপী জিভ, মামু কোনো দিন ভরপেট ভাত খাইছেন? থালা থালা গরম ভাত! 

প্যাডেল স্লো করে এবার ফিরে দেখে আমাকে। মেডিকেল মাস্কে বাঁধা মুখ, উথাল পাথাল এক বোঝা খাটো চুল আর পিউনিফুলের মত ছোট চোখের আমাকে দেখে কি ভাবল কে জানে! 

খাইছিলাম একবার। আমাগের ইউনুস মেম্বারের মা মরি গেলি জেয়াফত হইছিল। অড়হড়ের ডালের সাথি আলুকচু আর মুরগির গিলাপরান পা চামড়ার লটপটি। ঝাঁকা ঝাঁকা ভাত। কী যে সোয়াদ – 

মিনমিন হয়ে আসে আমার সুর, মাংস দেয়নি? 

কী যে কন মা। মাংস পোলাউ খাইছেলো বড়লোকরা। চেয়ারমেনের জন্যি শুনেছি আস্তো খাসি হইছেলো। তারা ছেলো তাম্বুর ভিত্রে। আমরা খাইছিলাম তাম্বুর পিছনে ইশকুলির মাঠে বসি। মনে কয় তিন চার থাল --- 

সিটের উপর কিছু বেশি টাকা রেখে নিজের শয়তান মনটাকে অভিশাপ দিতে দিতে নেমে আসি। নেমে আসি নাকি পালিয়ে আসি কে জানে! 

কোয়ান্টাম ক্লাশে মডারেটর যখন দুমিনিটের জন্যে চোখ বুঁজতে বলে, আমার অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। মনে হয় কেয়ামত হয়ে যাবে এই দুমিনিটে। কিছুই দেখতে পাবো না। একবার বাঁ চোখ অন্য বার ডান চোখ বন্ধ করে ডান বামের নড়াচড়া, বন্ধ মুখের অভিব্যক্তি দেখে হাসি পেয়ে যায়। স্তব্ধতায় ভেসে আসে মডারেটরের কথামালা, এবার নিজেকে সমর্পণ করুন, মৃত অথবা বিচ্ছিন্ন বন্ধু প্রিয়জনের জন্যে কাঁদুন, হালকা করে নিন দুঃখের অপরাহত আঘাতকে। 

একটুখানি চোখ বন্ধ করেই তাকিয়ে ফেলি, আমি তো এমনিতেই নদী। সামান্য টাল খেলেই দুকূল ভাসিয়ে কেঁদে ফেলি। তাই বলে এমন অর্ডারি কান্না! নাহ্‌ আর আসব না এখানে। 

আমি বরং মনছবিতে হেঁটে চলে যাই নদী ধরে। বড় নদীর ভেজা বুকের অতল থেকে গুমগুম ডাক শোনা যাচ্ছে। ঢেউ ভাঙ্গছে ফেনা তুলে। দেখি এক কোষা এক নাও দুলিয়ে দিচ্ছে শূন্য রঙের এক ফেরেশতা, কী খোঁজো জলকপালি মেয়ে? 

তরঙ্গিত জলের ফণা পেরিয়ে দ্রুত নেমে আসি, আদমকে খুঁজছি গো! আবার গন্ধম খাবো! চলে যাবো কোনো অগম অতল সুনীল পাতালে। আবার গড়ে নেবো কোনো ঈশ্বর। নীতিবাগীশের ধুতি টুপি আয়াত শ্লোকের ভার ছেড়ে সে ঈশ্বর সমান ভাগে খেতে দেবে মানুষকে, সমান ভালোবাসায় ভরিয়ে দেবে সবাইকে। 



ফেরেশতা জল ছিটোয় চকিত ঠারে, আদম কি রাজি হবে মেয়ে?