পুবের জানালা - রুখসানা কাজল
Posted in পুবের জানালামরার কোকিল! মাঘ মাস শেষ না হতেই হৃদয়ের দরোজা খুলে ডাকতে শুরু করে দিয়েছে।
প্রথম দিন ভেবেছিলাম, হয়ত কেউ গাড়িতে সখ করে কোকিলের তান লাগিয়েছে। করোনার কারণে ফাগুনের আগুনে এবারের ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপন করা যাবে না সেই দুঃখে। ঢাকার তরুণদের সখ বৈচিত্র্য যেমন বিচিত্র তেমন অভাবনীয় এবং উত্তুঙ্গগামী! গেল দুবছর পহেলা বৈশাখে এমন ভুভুজলা বাজাতে শুরু করেছিল কিছু ছেলেপেলে। কান ঝালাপালা হয়ে গেছিল! মনে হয়েছিল ওদের হাত থেকে ভুভুজলাগুলো কেড়ে নিয়ে ওগুলো দিয়েই ওদের পেটাই।
মর জ্বালা! এ যে ভোরেও ডেকে উঠছে! গাড়িঘোড়ার কোনো বালাই নেই। শব্দহীন নিঝুম একলা ভোর। তবে ত কোকিল পাগলাই হবে! ভেতর বারান্দায় গিয়ে ভুচকুলি পাখির মত ভুচি মেরে দেখার চেষ্টা করি। বিশাল আমগাছ ঘুম চোখে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে। কিন্তু কই সে ঘনকেষ্ট ব্লাক ডায়মন্ড! নেই ত নেইই।
দুদিন পর। চনমনে উষ্ণ দুপুর। আবার সেই ডাক, কুহু কুহু। কোকিল কি প্রেমের দেবী ভেনিসের দূত? আরাম করে পড়ছিলাম এক বন্ধুর কাছ থেকে উপহার পাওয়া প্রিয় লেখক মাহমুদুল হকের রচনাবলী থেকে নিরাপদ তন্দ্রা গল্পটি। কুহু কুহু অভিরামে ভেসে গেল আমার অন্তরাত্মা। বাল্য বন্ধুকে ফোন করি, এই শোন তোদের ওদিকে কি কোকিল ডাকতে শুরু করেছে ?
না তো ! মাঘমাস তো এখনও শীতকালে ট্যাগে আছে। তুই কোকিল পাচ্ছিস কোত্থে !
আরে আমাদের এখানে তিন দিন ধরে ডেকে যাচ্ছে। শালার কোকিল খুঁজেই পাচ্ছি না –
না পাওয়াই ভাল। তোর ত আবার বর্ষাকালেও বসন্ত লাগে। কৃষ্ণরসে ভেসে যাস। মনে নাই সে কাহানি ? সাবধান কলাম !
তুই একটা শয়তান। যা ভাগ কুত্তা যেন কোহানকার---তুমুল হাসতে হাসতে আমরা ফোন কেটে দেই।
কেটে দিলে কি হবে ! দেখি আমার হাত বেয়ে নেমে এসেছে যমুনা। ঘর ভেসে যাচ্ছে থইথই যমুনার জলে। আমি যেখানেই পা রাখি ঝলকে ছলকে উঠছে নীল যমুনার জল। আর তখুনি, রাধা রাধা চোখে ভেসে আসে ঘোর ঘননীল এক বর্ষাদিন।
ছোট্ট শহরের অনামা এক লঞ্চঘাট। কাদামাটির বুকে নাক গেঁথে থেমে আছে একটি লঞ্চ। সারেং ঘরের উপরে ভিজে বাতাসে দুলে উঠছে লাল সবুজ পতাকা। ডেভিডরা চলে যাচ্ছে আমাদের শহর থেকে। ওর ড্যাডা ডাঃ ভ্যান ট্রান্সফার হয়ে গেছেন তার নিজের দেশ আয়ারল্যান্ডে। বৃষ্টি পিছল ডেকএ দাঁড়িয়ে তিনি হাত নাড়ছেন। ওঁর পাশে রেলিং ধরে হাসছে ডেভিড। তখনও আমরা ওদের দেওয়া বিদেশি ক্যান্ডি খাচ্ছি আর হাসাহাসি করছি। শেষবারের মত ভেঁপু বাজিয়ে নাক তুলে নিল লঞ্চটি। ঢেউ খেলে গেল নদীর জলে। তীর ছেড়ে মাঝনদীতে গিয়ে একটু থামলো। এরপর চলতে শুরু করল। প্রথমে ধীরে। তারপর বেগে। লঞ্চ যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে সুদূর। অনন্ত আঁচল বিছিয়ে বয়ে যাচ্ছে বড় নদী। ঢেউ আছড়ে পড়ছে ঢেউয়ের গায়ে আর বড় বড় ঘূর্ণি স্রোত সারাক্ষণ ডেকে যাচ্ছে জলসিক্ত ঘর্ঘর গলায়। লঞ্চের গতি আরও দুরন্ত হলে বুঝতে পারলাম, ডেভিড চলে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে হলো, ও চলে গেলে আমি থাকব কি করে? কে থাকবে আমার সাথে? কে আমাকে কাঁধে করে শীত নদী পেরিয়ে নিয়ে যাবে শিমুলপলাশ বটপাকুড়ের অরণ্যে? ফিরে আয় ডেভিড -- লদী লাগোয়া রাস্তা ধরে সেই যে দৌঁড় দিয়েছিলাম, এক মোটরসাইকেলের সাথে ধাক্কা লেগে উড়ে গিয়ে পড়েছিলাম কাশবনে। আমার প্রথম প্রেমে রক্তারক্তি ঘটলেও কাশফুলের মত ভেসে গেছিল সেই কৈশোরে! কিন্তু সে প্রেম গল্প হয়ে জেগে আছে আমাদের বন্ধু মহলে।
এখনও ডেভিডের লাল তিল ভরা কিশোর মুখ মনে পড়ে যায়। ওর গ্র্যান্ডমা চেয়েছিল, ডেভিড যাজক হোক। বংশ পরম্পরায় হেভেন লাভের সুযোগ করে দিক তার নাতি। জানিনা শেষপর্যন্ত কি হয়েছে ডেভিড। আজকাল যখন কেউ বলে তার ছেলেকে মাদ্রাসায় পড়াচ্ছে, তখনই বুকের ভেতর ডেভিড ভেসে আসে। ধর্মের কী আশ্চর্য যাদু কা ঝাপ্পি। কী অভাবনীয় অদ্ভুত মোহশক্তি। হিন্দু, মুসলিম, ক্রিশ্চান, ইহুদি সকলেই বেহেশতে যেতে চায়, অথচ কেউ চায় না, ছোট বড় স্বার্থগুলো ত্যাগ করে এ পৃথিবীটাকে বেহেশ্ত বানাতে!
পাশের দেশে ছেলের বয়েসি একজন লেখক থাকে। নিপুণ হাতে যেমন অক্ষর সাজায় তেমনি থরে থরে ফসল ফলায় সে। ওর সাথে যখন কথা বলি, শতধা হয়ে স্নেহ নেমে আসে। সে দেশের কৃষিভাইরা লড়ছে ।তাদের ফলানো অনেক জিনিস আমরা ব্যবহার করি। প্রতিদিন পত্রিকায় পড়ি, ছবি দেখি। কেমন আছে ওরা! কারও কারও মুখ দেখে মনে হয়, এইতো আমার তিন পুরুষ আগের অগ্রজের মুখ। ওই যে পেশির ভাঁজে আলো ফেলেছে ঈষের ফলার ধারালো প্রখরতা সে তো আমার অচেনা কিছু নয়। ওদের মুষ্টি উদ্যত হাতের তালুতে লেগে আছে গর্ভবতী বীজের সুগন্ধ। চোখের নিচে অজস্র আলপথ। অখন্ড ভারতের হারানো একাত্মতা ডাক ছেড়ে কেঁদে ওঠে মনের ভেতর। এর বেশি কিছু করা যে অশোভন!
আজকাল যখন তখন মাকে মনে পড়ে। বকুলফুলের মত রঙ আর এক রত্তি মেদহীন চিকন শরীরের মা বিছানায় গা এলিয়ে বসলেই বুঝতাম, এখন গল্পের বই পড়তে বসবে। মার সামনে ইশকুলের পড়া মুখস্থ করতে হত। পড়তে পড়তে হঠাৎ মনে হত, মা কি সরস্বতী? বইটির প্রচ্ছদ দেখেই জানতাম কি আছে ভেতরে। কারণ নজরুল পাবলিক লাইব্রেরি থেকে আমিই বই এনে দিই। আনার আগে পড়ে ফেলি। না পড়তে পারলে বই নিয়ে খাটের নিচে চলে যাই। সেখানে আমার নিজস্ব জগত। পুতুলের ভরা সংসার। পড়তে পড়তে কতদিন ঘুমিয়ে গিয়েছি। মার খুব ইচ্ছে ছিল, পড়াশুনায় অনেক দূর যাব আমি। আমার স্বপ্নবাজ স্বল্প আয়ুর পিতামাতা নিকট ভবিষ্যতে তাদের মৃত্যুর অনাকাঙ্ক্ষিত ছায়াটি তখনও দেখতে পায়নি।
ছায়ায় সাথে মিশে থাকা মাকে বলি, তুমি খুশি মাগো? আমি একজন ছেলের মতই স্বাবলম্বী হতে পেরেছি। দুহাত বাড়িয়ে রেখেছি মানুষের সাহায্যের জন্যে। ছেলে মরে গেছে, ছেলে নেই বলে দুঃখ নেই ত তোমার?
সেই মুখ টিপে হাসা। আমার প্রবল পুরুষ বাবার পাশে সর্বদা ছায়া হয়েই ছিল মা। আমপাতা ঝরঝর। মেয়ে তুই বই পড়। ঝরা কৃষ্ণচূড়া আলো করে রেখেছে উঠান। ফুল ঝরে পড়তেই টমি কুকুর ছুটে যাচ্ছে। নাচছে, গাইছে। এ বাসার অনেকেই বানিয়ে বানিয়ে গল্প কবিতা লিখে, ছবি আঁকে। আমার ইচ্ছে করে না। তবু একবার ছড়া লিখেছিলাম। সাথে ছবিও ছিল, আমগাছে কাঁঠাল হয়, বুলবুলিতে ঠুকরে খায়। হয়নি মা ?
কড়া বিষম খেয়ে হাসতে হাসতে নেচে ওঠেছিল বাড়িটা। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অপরিসীম দুঃখে কান্না পেয়ে গেছিল, আমি কি গোপালভাঁড়? আবার হাসি। এবার হাস্য মুখর বাড়িটার দরোজা খুলে যায়। বাপি আসে। আমার আঁকা আর লেখা পড়ে খুব খুশি হয়ে বকে দেয় সবাইকে। বুঝিয়ে দেয়, হাসজারু ছড়া হলেও ছন্দ ত মিলে গেছে। এতে হাসির কি হল ! উজিরে আলা আপনিও হেসেছেন। আপনার জন্যে শাস্তি বরাদ্দ হল। আজকের সন্ধ্যায় মহা নাস্তা বানানো হোক।
আমি মুড়মুড় করে লুচি ভাঙ্গি আর বায়ে দুলি, আমাগাছে কাঁঠাল হয়, এবার ডাইনে দুলি, বুলবুলিতে ঠুকরে খায়---হাহাহাহ আমি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ আর বিদ্রোহি কবি নজরুল হয়ে যাচ্ছি তাই না বাপি !
অবশেষ মাঘ পেরুলো বাংলাদেশ। শাড়ি টাড়ি রেডি করে রেখেছিলাম। ইচ্ছে ছিল শাহবাগের ফুলের দোকানে গিয়ে অশোকফুলের মুকুট বানাব। না পেলে রক্তগাঁদা বেছে নেব। কিছুতেই ওই আজরা জাবরা বিদেশী ফুল পরব না। তারপর হলুদ রোদ্দুরে রিকশার হুড ফেলে চলে যাব পুরোন ঢাকার সদরঘাট। খুঁজে বের করব ব্রাহ্ম সমাজের রামমোহন লাইব্রেরী। যেখানে এতিম লাবণ্য গুপ্তের সাথে বিয়ে হয়েছিল, কেবল শুধুমাত্র কেবল কবি হওয়ার ভাগ্য নিয়ে জন্মানো জীবনানন্দ দাশের।
জ্যাঠামশাইয়ের বাছাই করা পাত্রের সাথে দেখা করার দিন বৃষ্টি পেছল মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়েছিলেন লাবণ্য। সেদিন ভাগ্য তাকে আছড়ে ফেলেছিল কুটিল পঙ্কে। তার স্বপ্ন, সাধ, স্বদেশ প্রেম সব লেপটে গেছিল কাদামাটির সাথে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি কাকের চঞ্চুর মত, শকুনির হৃদয়বাহী এক নারী। ভাত কাপড়ের নিরাপত্তাহীন সংসারে যে কেবল খুঁড়ে গেছে এক কবি হৃদয়। লাবণ্যের হৃদয় এবং শরীর? নারীর আবার এসব কি ফালতু বায়নাক্কা !
আপনজনদের কাছে এ জগতের সবচে বেশি ভারবাহী হচ্ছে এতিমের ভার। তাই ঝেড়ে ফেলাই দস্তুর। জ্যাঠামশাই যেভাবে ঝেড়ে ফেলেছিল। আমার চাচা কাকারাও সেভাবে ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। আমি আলোকিত সময়ের সন্তান। পাশে ছিল আমার মা বোন। লাবন্য গুপ্ত কেবলই ধ্বসে গেছেন। একা। কেবলই ধূসর হয়েছেন। শুষে গেছিল জীবনের সব সাধ। দাহ্য হয়ে উঠেছিলেন। খর চৈত্রে বাংলার শুকনো ঘাসের মত, জলহীন চৌচির পুকুরের মত, হিজলের বনে খা খা রোদ্দুরের মত, অগাধ জ্যোৎস্নায় প্রেমহীন সঙ্গমের ঘৃণ্য শীৎকারের মত।
উত্তরবঙ্গ থেকে আসা সদ্য বিধবা এবং দুটি সন্তানসহ শ্বশুরবাড়ি থেকে বিতাড়িত মহিলাটিকে আমি কড়া গলায় বলি, সাহায্য করতে পারি। কিন্তু---
বলুন আপা। ছেলেমেয়েদের জন্যে আমি সব করব।
স্পষ্ট উচ্চারণ, জীবনের সাথে যুদ্ধে রত প্রত্যয় আর তেজি গলা। এখনও স্বচ্ছলতার জৌলুস লেগে আছে। আমি ওর অনার্স পড়ুয়া মেয়ের এ বছরের সমস্ত খরচ মিটিয়ে দিয়ে নিজে চলার মত একটি চাকরি যোগাড় করে দেব, কিন্তু মেয়েকে বিয়ে দেওয়া চলবে না। অনেক বছরের ব্যাপার। পারবেন?
হয়ত পারবে। হয়ত পারবে না। সমাজ এবং পরিবারে জ্যাঠামশাই এবং চাচাকাকাদের ত অভাব নেই। তবু একটা স্বপ্ন বুনে দিলাম। সেই স্বপ্ন। আমার মাবাবা বলতেন, ভেঙে যাক। আবার দেখো। ভয় কি মেয়ে।