Next
Previous
Showing posts with label অনুবাদ সাহিত্য. Show all posts
0

অনুবাদ সাহিত্য - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in




















[লেখক পরিচিতি: পার লাগারকভিস্ট নোবেল বিজয়ী ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও কবি । তিনি ১৮৯১ সালের ২৩ মে সুইডেনের ভাক্সজো শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পুরো নাম ফেভিয়ান পার লাগারকভিস্ট । তিনি ১৯৫১ সালে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস “ অ্যাগুইশ’ গ্রন্থের জন্যে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। ১৯২২ সালে তাঁর প্রথম কবিতাগুচ্ছ ও সাড়া জাগানো উপন্যাস ‘ পিউপিল’ প্রকাশিত হয়। ‘ দ্য ইটারনাল স্মাইল এন্ড আদার স্টোরিজ ’ তাঁর বিখ্যাত ছোটগল্প সংকলন। কবি হিসাবে সুইডিশ সাহিত্যে তিনি এক বিশেষ ধারার প্রবর্তন করেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘ বারব্বাস’ । নাট্যকার হিসাবে তিনি খ্যাতিমান। ‘দ্য সিভিল ’ তাঁর সাড়াজাগানো নাটক। এছাড়াও ‘দ্য ডোয়ার্ফ’,‘ দ্য ম্যান উইদাউট এ সোল ’.‘ লেট ম্যান লিভ’,‘ দ্য ম্যারেজ ফিস্ট এন্ড আদার স্টোরিজ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। তিনি ১৯৭৪ সালের ১১ জুলাই ৮৩ বছর বয়সে সুইডেনের স্টকহোমে লোকান্তরিত হন। সুইডিশ ভাষায় লেখা পার লাগারকভিস্ট এর ছোটগল্পের এ্যালান ব্লেয়ারের ইংরেজি ভাষান্তরিত ‘দ্য লিফট দ্যাট ওয়েন্ট ডাউন ইন্টু হেল’ এর বঙ্গানুবাদ করা হল। স্বামীকে অগ্রাহ্যকারী এক নারীর ব্যাভিচারের কাহিনি এ গল্পে বিশেষ অনুষঙ্গে উঠে এসেছে ]

স্মিথ অভিজাত হোটেলের ভেতরের লিফটটি খুলল। সে শহরের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। দামী পাউডারের গন্ধে ভরা পশমের গদি আটা রমণীয় লিফটির চালু হতেই তারা লিফটের নরম সিটে বসে পড়ল।

স্মিথ মদে ভেজা মুখটা এগিয়ে নিয়ে নাদুসনুদুস চেহারার ছোটখাটো সুন্দরী মহিলাটির সঙ্গে চুম্বন-বদ্ধ হল। লিফটের নরম সিটে নেশায় চুর হয়ে এখন তারা এক অবর্ণনীয় স্বপ্নিল আমেজে বিভোর! লিফটটি নিচের দিকে নামতে লাগল।‘ ডার্লিং, এখানকার পরিবেশ স্বর্গীয় আবেশে ভরা ’ মহিলাটি ফিসফিস করে বলল। ‘ তারা ভরা আকাশের মাঝে এক কাব্যিক স্বপ্নিল পরিবেশে আমরা বসে আছি। ভালোবাসা কাকে বলে জানার পরই তুমি এখানকার কাব্যিক পরিবেশটাকে অনুভব করতে পারবে। আচ্ছা স্মিথ, তুমি কি আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসো ?”মহিলাটির কথা শেষ হওয়ার পর স্মিথ অনেকক্ষণ ধরে তাকে আদর করতে লাগল।

লিফটটি নিচের দিকে নামতে থাকল।‘ ডার্লিং, তুমি না এলে আমাকে নিরানন্দ অবস্থায় থাকতে হতো !’ স্মিথ বলল। ‘ তুমি হয়তো জান না , আমাকে এক অসহনীয় পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এখানে আসতে হয়েছে। ’ মহিলাটি স্মিথকে বলল। ‘ তাই নাকি।’ ‘আমি বাড়ি থেকে বের হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছি ঠিক সে সময় অরভিড আমাকে জিজ্ঞেস করল যে আমি কোথায় যাচ্ছি। আমি তাকে বললাম- যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাব ! অরভিড , আমার স্বামী হয়েছ বলে আমাকে ঘরের মধ্যে বন্দী করে রাখতে পার না। তারপর সে অভিসন্ধিমূলক দৃষ্টিতে আমার জামাকাপড় পরা বিশেষ ভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগল। স্মিথ, তুমি কি মনে করো লোকটা ভাল ? তুমি কি ভাবতে পার এ অবস্থায় ওই লোকটার সঙ্গে আমার ঘর করা উচিত? মহিলাটি স্মিথকে জিজ্ঞেস করল। ‘ সব কিছুই তোমাকে মানিয়ে নিতে হবে, প্রিয়তমা।’ মহিলাটির কথা শুনে স্মিথ তাকে বললেন । ‘ তোমাকে আজকের মতো অপূর্ব সুন্দরী আগে কখনো দেখিনি।’মহিলাটি কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে তার গায়ের ফার কোটটা খুলে ফেললে তার গায়ে রইল শুধু মাত্র একটা অন্তর্বাস। অন্তর্বাসের নিজ থেকে গোলগাল সুন্দর স্তনদুটো যেন ফুটে বেরোতে চাইছিল। তারা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ চুম্বনাবদ্ধ হয়ে থাকল। লিফটটি নিচের দিকে নামতে থাকল।মহিলাটি আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায়ই আবারও মুখ খুলল,‘ আমি বাইরে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি,সে সময় আমার স্বামীটি আমার হাতটা এমন জোরে চেপে ধরলে, যাতে ভেঙে যাওয়ার অবস্থা হল! সে কিন্তু আমার ওই অবস্থা দেখে একটুও সহানুভূতি প্রকাশ করল না। তুমি বুঝতে পারবে না ডার্লিং, লোকটা কতটা নিষ্ঠুর ! আমি তাকে বললাম —তুমি থাক, আমি চললাম। আমার কথা শুনে লোকটা একটাও কথা বলল না। এক মুহূর্তের জন্যেও আমি ওকে সহ্য করতে পারি না।’ ‘ যত সব তুচ্ছ ব্যাপারস্যাপার নিয়ে ভাবছ!’ স্মিথ মহিলাটির কথার জবাবে বলল। ‘ আমি এক মুহূর্তের জন্যে কোথাও গিয়ে আনন্দে থাকি তা সে মেনে নিতে পারে না। আমার শোচনীয় অবস্থা সম্বন্ধে তোমার কোন ধারণা নেই, ডার্লিং। আমি যেন সারাক্ষণ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকি।’ মহিলাটি স্মিথের কাছে তার দু:খের কথা বলতে থাকল।‘ বেচারি! তোমাকে এসব ঝামেলার মাঝেই দিন কাটাতে হবে।’ ’‘ ওহ, আমি কিন্তু সত্যি সত্যি চরম ভোগান্তি শিকার হচ্ছি। এমন ভাবে কেউ কখনো জীবন কাটাতে পারে না! তোমার সঙ্গে দেখা না হলে আমি জানতাম না ভালোবাসা কাকে বলে! ’ মহিলা বলল। ‘ ডার্লিং।” মহিলাটার সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থাই স্মিথ হেসে উঠে বলল। লিফটটি নিচে দিকে নামতেই থাকল।‘ চমৎকার!’ মহিলাটি স্মিথের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে খুশিতে ডগমগ হয়ে বলল। ‘ তোমার সঙ্গে লিফটে বসে তারা ঝলমলে আকাশের দিকে চেয়ে আমি এখন যেন স্বপ্ন দেখছি! আমি জীবনে এ মুহূর্তে কথা ভুলব না। অরভিড নামের লোকটার কাছ থেকে কখনোই এমন সুখের মুহূর্ত আশা করা পাগলামি। ওর মনের মধ্যে আনন্দের অনুভূতি নেই।’ ‘ প্রিয়তমা, তোমার ওইসব কথাবার্তা এখন অসহ্য লাগছে।’ ‘ হ্যাঁ, এমন আনন্দঘন মুহূর্তে আজেবাজে কথা বলা বা শোনা সত্যি সত্যি অসহ্য! কিন্তু—’ মহিলাটি কথা শেষ না করে স্মিথের গালে একটা চুমু দিয়ে বলল,‘ আজেবাজে কথা আর ভাবার দরকার নেই। এখন এসো এ আনন্দঘন মুহূর্তটাকে উপভোগ করি। ঠিক আছে ডার্লিং। আচ্ছা, সত্যি করে বলতো তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?।’ মহিলাটির কথা শেষ হতে না হতেই স্মিথ তাকে জাপটে ধরে তার নরম গোলাপি ঠোঁট-দুটো নিজের ঠোঁট-দুটো মধ্যে নিয়ে চুষতে শুরু করল।

লিফটটি নিচের দিকে নামতে থাকল।‘ এসো আমরা আজ রাতে অন্তরঙ্গ হই। আজ তোমার গহীন গাঙে ডুব দিয়ে আমি হারিয়ে যেতে চাই, তুমি রাজি তো ডার্লিং ? স্মিথ ফিসফিস করে মহিলাটির কানে কানে কথাটা বলে তাকে নিজের কোলের মধ্যে টেনে নিয়ে চোখ বুজল। লিফটটি নিচে দিকে নামতেই থাকল।লিফটটি আরও আরও নিচের দিকে নামতে থাকায় স্মিথ অকস্মাৎ বিরক্ত হয়ে বলে উঠল,‘ লিফটি থামছে না কেন? তার মুখটা লাল হয়ে উঠতে লাগল। মহিলাটিও বিস্ময় প্রকাশ করল লিফটি না থামায়। সে কী যেন ভেবে বলে উঠল,‘ যাক, লিফটটি না থামলে আমরা দু’জনে যুগ যুগ ধরে আমোদ আহ্লাদ করে যেতে পারব এখানে বসে। কী যে ফুর্তি হবে! ’ ‘ হ্যাঁ ডার্লিং , তোমার আইডিয়াটা খুব সুন্দর কিন্তু! সময়টা উপভোগ করতে থাকলে আমরা বুঝতেই পারব না কীভাবে যুগ যুগ কেটে গেছে। ’ স্মিথ কথা শেষ করে গ্রিলের বাইরে তাকিয়ে অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেল না। লিফটটি দ্রুত নিচে দিকে নামতে থাকল। গভীর থেকে গভীরে।‘ চারদিকে অসীম শূন্য ! হায় ঈশ্বর ! লিফটি চলতে থাকতে থাকলে আমরা যুগ যুগ কাল এখানে বসে থাকব। মহিলাটা বলল। এবার তারা দু’জনই অতল গহ্বরের দিকে উঁকি দিয়ে দেখবার চেষ্টা করল। ‘লিফটি নরকে চলছে নাকি।’ স্মিথ বলল। মহিলাটি স্মিথের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলল,‘ ওহ ডার্লিং’ । তারপর আবার সে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘আমি ভয়ে আঁতকে উঠছি। তোমার এখন এমার্জেন্সি ব্রেক টানা উচিত।’স্মিথ সজোরে এমার্জেন্সি ব্রেকে টান দিল। কিন্তু কোন কাজ হল না। লিফটটি অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকল। ‘ ভয়াবহ ব্যাপার!’ মহিলাটি চিৎকার করে উঠল।‘ আমরা কোথায় পৌঁচ্ছাছি!’ ‘ বড় একটা শয়তান আমাদের পিছু লেগেছে।’ স্মিথ বলে উঠল।‘ এখন আর এ জায়গাটা আমাদের জন্যে নিরাপদ নয়।’ ছোটখাটো নাদুসনুদুস মহিলাটি হতজ্ঞান হয়ে কেঁদে ফেলল। ‘প্রিয়তমা, কাঁদছ কেন? সত্যি সত্যি আমরা বিপদের মাঝে আছি।এখন এখানে চুপটি করে এক অপরকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার নেই। তুমি আমাকে জড়িয়ে ধর। এক সময় লিফটটি কোথায়ও না কোথায়ও থামবে। তখন শয়তানটাকে উচিত শিক্ষা দেব।’ স্মিথ মহিলাটিকে বলল। তারা ভীতসন্ত্রস্ত হয় এক অপরকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকল। ‘ কী ঘটতে যাচ্ছে আমাদের ভেবে দেখা উচিত।’ মহিলাটি ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে বলল।‘ এখন আমোদ প্রমোদ করার সময় নয়! ’ ‘ এটা শয়তানের কাজ!’ স্মিথ বলে উঠল।এ অবস্থার মধ্যেও মহিলাটি স্মিথকে গদগদ কণ্ঠে আবারো জিজ্ঞেস করল,‘ তুমি সত্যি সত্যি আমাকে ভালোবাসো তো?’ মহিলাটির আদুরে গলার কথাটা শুনে স্মিথ আরও জোরে তাকে জাপটে ধরে তার গোলাপি গালে শব্দ করে চুমু দিয়ে আবেগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল,‘ ওহ আমার ডার্লিং , তোমায় ভালো না বেসে পারি?’ লিফটটি তখনো নিচের দিকে নামতে থাকল।অবশেষে এক সময় লিফটটি চোখ ধাঁধানো আলো ঝলমলে জায়গায় পৌঁছাল। জায়গাটা হচ্ছে নরক, নরকের বাসিন্দারা হল শয়তান।

একটা শয়তান ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বলল,‘ শুভসন্ধ্যা’ শয়তানটার পরনে কেতাদুরস্ত লম্বা ঝুলুমওায়লা সান্ধ্যকালীন পোশাক। স্মিথ ও মহিলাটি তাকে দেখে হতবাক! তারা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে শয়তানটা সামনে এসে হাজির হয়ে ভয়ে ভয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ আমরা এখন কোথায়?’ শয়তানটা তাদেরকে ঘিরে একটা আলোর বৃত্ত তৈরি করলে তার আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল। এক ধরনের শব্দ শোনা গেলে তার বলল,‘ এ শব্দটা কিন্তু মন্দ নয়।’ তারা এক সঙ্গে হড়বড়িয়ে বলল। ‘ আমার মনে হয়, তোমরা এখানে আমোদ আহ্লাদে কাল কাটাতে পারবে। শুধুমাত্র একরাতের জন্যে এখানে এমন একটা পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়েছে আমরা এখানে স্থায়ী ভাবে থাকব না, কেমন?’ শয়তানটা তাদেরকে বলল।মহিলাটির প্রায় নগ্ন নাদুসনুদুস শরীরটা স্মিথের বুকের মাঝে ! তার সারা শরীরটা ভয়ে কাঁপছে স্মিথ বুঝতে পারল।

হলুদাভ উজ্জ্বল আলো চারদিকে। আলোর উজ্জ্বল আভায় তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যাবার মতো অবস্থা। চারপাশের সব কিছু যেন অস্পষ্ট। এক ধরনের তীব্র গন্ধ নাকে এসে লাগছে। একটু পরেই তারা বুঝতে পারল যে তারা একটা চারকোণা আকৃতির অন্ধকারে চত্বরে দাঁড়িয়ে আছে। চত্বরটার চারপাশের ঘরগুলোর দরজা দিয়ে শুধুমাত্র ভেতরের আলো বাইরে ঠিকরে পড়েছে। ঘরগুলোর ভেতর থেকে কিছু একটা যেন পোড়ানোর গন্ধ হচ্ছে।শয়তানটা তাদেরকে জিজ্ঞেস করল,‘ তোমরা কি দু’জন পরস্পরকে ভালোবাসো?’ ‘হ্যাঁ, মনে প্রাণে।’ মহিলাটি তার পটলচেরা চোখ দুটো তুলে জবাব দিল। ‘ এ পথে–’ সে একথাটা বলে তাদেরকে অনুসরণ করতে অনুরোধ করল। তাকে অনুসরণ করে তারা চত্বরটার ষে প্রান্তের অন্ধকারে ঢাকা একটা রাস্তায় এসে হাজির হল। একটা পুরনো ভাঙা হারিকেন নোংরা রাস্তার পাশের দরজায় ঝুলছে। ‘ এদিকে–’ কথাটা বলে দরজাটা খুলে তাদেরকে ভেতরে ঢুকিয়ে এক ফাঁকে সেখান থেকে সে সরে পড়ল। বড় বড় স্তন, রক্তবর্ণ-চোখ, নাকের নিচে এক জোড়া বড় গোঁফওয়ালা একটা মোটাসোটা শয়তানী তাদেরকে স্বাগত জানাল। শয়তানীটা তাদেরকে দেখে হাঁপানি রোগীর মতো শব্দ করে হাসল। মাথার দুটো শিং ও সিল্কের ফিতে দিয়ে বাঁধা দুটো চুলের বেণী।‘ তোমরা কি মিস্টার স্মিথ আর সেই ছোটখাটো মহিলা ?’ সে জিজ্ঞাসা করল। তোমাদের জন্যে আট নম্বর রুম।’ বিকট চেহারার শয়তানীটা তাদের হাতে বড় একটা চাবি দিয়ে বলল,‘ সামনের সিঁড়ি ধরে এগিয়ে গিয়ে একটা সিঁড়ি পাবে।’ তারা আলোআঁধারি ঘেরা একটা পিচ্ছিল বেশ চওড়া একটা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় হাজির হল তারা। প্রথমে আট নম্বর রুমটা স্মিথের চোখে পড়ল। তারা দু’জনেই রুমে প্রবেশ করল। ছাতা পড়া বেশ বড় একটা রুম, মাঝখানে নোংরা টেবিল ক্লথে ঢাকা একটা টেবিল । দেয়াল ঘেঁষে চাদর বিছানো একটা খাট। নিরিবিলি পরিবেশে ওখানকার সব কিছুই তাদের কাছে সুন্দর বলে মনে হল। স্মিথ তার গায়ে কোটটা খুলে ফেলল। মহিলাটির গায়ে কোট তো আগেই খোলা ছিল।

এবার তারা পরস্পরকে জড়িয়ে চুম্বনাবদ্ধ হল। অপ্রত্যাশিত ভাবে অন্য একটা দরজা দিয়ে একটা লোক রুমটার ভেতরে হাজির হল। তার পোশাক ওয়েটারের মতো। তার গায়ের ডিনার জ্যাকেটটাকে আলোআঁধারি পরিবেশে ভৌতিক বলে মনে হচ্ছিল। সে নীরবে রুমটার ভেতরে হাঁটাহাঁটি করে রুমটা পরিষ্কার করতে লাগল। তার পায়ে কোন শব্দ নেই, তার চলাফেরা যেন যান্ত্রিক,চোখের দৃষ্টি সামনের দিকে। তার মুখটা মরা মানুষের মুখের মতো ফ্যাকাসে। কপালে বুলেটের একটা ক্ষত। এতক্ষণ স্মিথ ও মহিলাটি তাকে মোটেই আমল দেয়নি , তবে সে তাদের কাছাকাছি এলে স্মিথ বলল, ‘ একটু ওয়াইন পেতে পারি না? আধা বোতল হলেই চলবে।’ লোকটা মাথা নাড়িয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।স্মিথ তার গায়ের জামা ও পরনের প্যান্ট ও আন্ডারওয়ার খুলে ফেলে দিগম্বর হল। মহিলাটি কিন্তু তার গায়ের জামা ,ব্রা ও পরনের প্যান্ট খুলতে ইতস্তত করে বলল,‘ লোকটা তো আবার ফিরে আসছে।’ ‘ ধুত্তোর! এখানে ওদেরকে নজরে আনতে নেই। এখন তোমার জামা , ব্রা আর পরনের প্যান্টটা খুলে ফেলত দেখি। ’ স্মিথ নিজেই মহিলাটির গায়ের জামা ও ব্রা খুলতে খুলতে বলল। মহিলাটি এবার তার পরনের প্যান্টটা খুলে ফেলে ফিসফিস করে বলল,‘ এখানে শুধুমাত্র তুমি আর আমিই আছি। আমরা একটা রোমান্টিক জুটি। এখানকার পরিবেশটা কী সুন্দর কাব্যিক ও রোমান্টিক! আমি জীবনেও মোহনীয় এ ক্ষণটির কথা ভুলব না।’ স্মিথ মহিলাটির সুডোল স্তনের বোঁটায় একের পর এক চুম্বন দিয়ে বলে উঠল,‘ ও আমার প্রাণাধিকা!’ তারপর তারা দীর্ঘক্ষণ চুম্বনাবব্ধ থাকার পর স্মিথ মহিলাটির স্তনদুটো নিয়ে যেন খেলায় মেতে উঠল। সেই লোকটা আবার নি:শব্দ পায়ে ওখানে এসে হাজির হল। যান্ত্রিক ভঙিমায় সে গ্লাসে মদ ভরল। তার মুখটাতে টেবিল ল্যাম্পের আলো পড়ল। লোকটার মুখে কোন বিশেষত্ব নেই, মুখটা আগের মতোই ফ্যাকাসে। কপালের এক অংশে বুলেটের ক্ষত। ‘ হায়, ঈশ্বর! অরভিড! তুমি? তুমি? ’ লোকটিকে দেখে মহিলাটি আর্তনাদ করে উঠল। ‘ হায় ঈশ্বর! অরভিড, তুমি মৃত!’ তার স্বামী অরভিড তাহলে নিজের কপালে নিজেই বুলেটবিদ্ধ করে আত্মহত্যা করেছে। মহিলাটির তা বুঝে উঠতে দেরি হল না। অরভিড নামের লোকটি নিশ্চল ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। তার চোখে মুখে ভোগান্তির লেশ মাত্র নেই। তার মুখটা যেন আগের চেয়ে দৃঢ় ও রাশভারী। ‘ হায়! অরভিড তুমি কী করেছ , তুমি কী করলে, কেমন করে এটা করতে পারলে? আমার প্রিয়তম অরভিড, যদি ঘুণাক্ষরেও আমি জানতাম তবে আমি বাড়িতেই থাকতাম। তুমি আমাকে কিছু বলোনি। আমি বাইরে গেল তুমি আত্মহত্যা করবে তা তুমি তোমার মনেই পুষে রেখেছিলে। তুমি এ সম্বন্ধে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। তাহলে আমি কী করে জানব এমন একটা মর্মান্তিক ঘটনা ঘটনা ঘটাবে। হায় ঈশ্বর—–! মহিলাটি এক নি:শ্বাসে কথাগুলো বলে গেল। মহিলার শরীরটা ভয়ে কাঁপতে লাগল। চা পরিবেশনকারী লোকটা মহিলাটিকে নবাগত ভেবে সে তার দিকে তাকিয়ে থাকল। লোকটার দৃষ্টি বরফ শীতল। তার কপালের ক্ষত স্থান থেকে রক্ত বের না হলেও সেখানে একটা গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।‘ ওহ, অসহ্য ! মহিলাটি কপালে বুলেটের দাগটা দেখে চিৎকার করে উঠল। ‘ আমি এখানে থাকব না। চল এখনই এখান থেকে চলে যাই, আমি আর দাঁড়াতে পারছিনা।’ তড়িঘড়ি করে স্মিথ ও মহিলাটি জামা কাপড়, হ্যাট, ফার কোট পরে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়িতে উঠে পড়ল। নিচে সিঁড়িতে পৌঁছালে গোঁফওয়ালা মহিলাটি হেসে মাথার শিং নুয়ে স্বাগত জানাল। তারা সেখান থেকে আগের সেই রাস্তাটিতে ফিরে এসে কিছু সময়ের জন্যে থামল। মহিলাটি মুখে , নাকে ও গায়ে পাউডার মাখল। স্মিথ মহিলাটির কোমর জড়িয়ে ধরলে সে স্মিথের গালে চুমু খেল। তারপর তারা হেঁটে আগের সেই চত্বরটাতে পৌঁছাল।পালের গোদা শয়তানটা সেখানে হাঁটাহাঁটি করছিল। ‘তোমরা তাড়াতাড়ি করো।’সে দৌড়ে এসে বলল।‘ তা, তোমরা নিশ্চয়ই ওখানে আরামে ছিলে।’ ‘ হায় ঈশ্বর ! কী যাচ্ছেতাই, ভয়াবহ অবস্থা! নরক আর কাকে বলে।’ মহিলাটি লোকটার প্রশ্নে জবাবে বলল। ‘ ও কথা বল না। তোমরা নরকের আগের অবস্থার কথা চিন্তা করতেই পারবে না। আগের দিনে যদি তোমরা আসতে তবে বুঝতে তখন নরকের অবস্থা কেমন নারকীয় ছিল। এখন নরক সম্বন্ধে অভিযোগ করার কিছু নেই। আমরা এখন নরকে সব রকম আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা করেছি। ‘হ্যাঁ, ’ স্মিথ সম্মতি দিয়ে বলল, ‘ তা সত্যি, আমি বলতে পারি জায়গাটা ভাল।’ ‘ বেশ। ’ শয়তানটা বলল,‘ এখন আমরা সবকিছুকে আধুনিকীকরণ করেছি। তোমাদের জন্যেই নরককে সম্পূর্ণরূপে নতুন করে সাজিয়েছি।’ ‘ হ্যাঁ। তা অবশ্যই, তোমরা সময়ের দাবিকে মেনে নিয়েছ।’ স্মিথ বলল। ‘ তবে আজকাল এখানে শুধুমাত্র আত্মাই শাস্তি ভোগ করে থাকে।’ শয়তানটা বলল। ‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ,’ মহিলাটি বলল।শয়তানটি লিফট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে খুব ন¤্র কণ্ঠে বলল,‘ গুড ইভিনিং , আবার আসবে।’ কথাটা শেষ করেই গ্রিল বন্ধ করে দিল। লিফটটি উপরের দিকে চলতে লাগল। আবার তারা লিফটটিতে একত্রে বাসা বাধল এবং উভয়ে এক সঙ্গে বলে উঠল, ‘ এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ।’ মহিলাটি ফিসফিসয়ে বলল,‘ আমি তোমাকে ছাড়া কখনো আর লিফট চড়ব না।’ স্মিথ তাকে কাছে টেনে অনেকক্ষণ ধরে চুমো খেল। ‘ ডার্লিং , তুমি সত্যি সত্যি অপূর্ব সুন্দর! ’ স্মিথ তাকে চুমো দেওয়ার পর সে আনন্দে আপ্লুত হয়ে বলল। ‘অরডিভের কি এ কাজটা করা উচিত হয়েছে। ও কোন কিছুকেই মানিয়ে নিতে পারতো না।’ ‘ঘটনাটা সত্যি সত্যি যাচ্ছেতাই।’ স্মিথ মহিলাটির কথা ধরে বলল। ‘ সে আমাকে বলতে পারত! তখন না হয় আমি বাড়িতে থেকে যেতাম। আমরা না হয় আর এক সন্ধ্যায় বের হতাম।’ ‘ তা অবশ্যই ।’ স্মিথ বলল। ‘ তা অবশ্যই পারতাম।’ ‘ কিন্তু প্রিয়তম, আমাদের আর ওই চিন্তা করা উচিত না।’ মহিলাটি তার গলা জড়িয়ে ধরে ফিস ফিস করে বলল।‘ এখন ওটার পরিসমাপ্তি ঘটেছে, তাই ওটা নিয়ে ভেবে আর কাজ নেই। ‘হ্যাঁ প্রিয়তমা, এখন বিষয়টার সত্যি সত্যি পরিসমাপ্তি ঘটেছে।’কথা বলে সে মহিলাটিকে জাপটে ধরে চুমো খেতে লাগল। লিফটি উপরে উঠতে থাকল।
0

অনুবাদ সাহিত্য - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in





অমৃতা প্রীতম পাঞ্জাবী সাহিত্যের স্বনামধন্য এবং জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও কবি। পাঞ্জাবী ভাষা ছাড়াও হিন্দি ভাষাতেও তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন। জন্ম পাকিস্তানের অন্তর্গত পঞ্জাব প্রদেশের গুজরনওয়ালা নামক স্থানে ইংরাজী ১৯১৯ সালের ৩১শে আগষ্ট। অজস্র গল্প, কবিতা,উপন্যাস তিনি রচনা করেছেন।
‘কাগজ অউর ক্যানভাস’ নামক কবিতা সংকলনের জন্য ১৯৮০-৮১ সালের জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পান। এ ছাড়াও সাহিত্য একাডেমী,পদ্ম বিভূষণ সম্মানেও তিনি সম্মানিতা। ২০০৫ সালের ৩১শে অক্টোবর তারিখে তিনি প্রয়াত হন।
অমৃতা প্রীতমের ’ বর্জিত এক বাগ কি কথা’ মহাভারতের শকুন্তলা উপাখ্যানের মূল ভাবনাটি থেকে নেওয়া। এ কাহিনি হল সেই সময়ের যখন মেনকা বিশ্বামিত্রের পুষ্করতীর্থস্থ বনে এসে মুনির তপস্যা ভঙ্গ করতে আগ্রহী এবং ইন্দ্রের নিকট সেখানে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করছেন, সেই সময় ইন্দ্রের সঙ্গে মেনকার কথোপকথন ও সেই অরণ্য সম্বন্ধে কিংবদন্তী কবির নিজের মত করে কবিতায় বর্ণিত।
‘ পরিত্যক্ত এক অরণ্যের ইতিকথা’ নামক কবিতাটি অমৃতা প্রীতমের ‘বর্জিত এক বাগ কি কথা’ অবলম্বনে রচিত।
##



পরিত্যক্ত এক অরণ্যের ইতিকথা

.
স্বর্গের উপবন নয় সে
পরিত্যক্ত এক অরণ্যের ইতিকথা
আকাশে যার নেই ঠিকানা
ধরায় আসন পাতা।
আসা-যাওয়াও ‘নিষেধ’ সেথায়
মেলে না কারো দেখা
পায়ের চিহ্ন পড়েনা হোথায়
নেই কো পথের রেখা।
অরণ্যের ফুল তুলতে মানা
‘নিষেধ’ আছে সবার জানা।
উর্বশী, এক অপ্সরা যেদিন
ওই বাগিচার চাইল ফুল,
‘দেবলোকের জন্য সে নয়’
ইন্দ্র জানায়-‘কোরোনা ভুল।‘
.
মেনকা নামের অপ্সরীটি
সেদিন ছিল দেব-সভায়
বিভোর হল সে নিজ চিন্তায়----
নিশুত রাতের অন্ধকারে
শব্দ যেথা যায় না কানে
কোন মুনি রয় সেই অরণ্যে?
আসা-যাওয়া ‘নিষেধ’ যেথায়
কোন অশরীরী বাস করে তায়?’
.
পরের এক পূর্ণিমাতে
দেবরাজ আর মেনকাতে
এই কথা হল দুইজনাতে-----
‘কি কাজ মোরে দিলে, রাজন!
মুনিদের শুধু তপস্যা ভাঙ্গন?
তোমার ভয় রাজা আমি মানি
থাকে যদি কেউ তেমন মুনি
তোমার আসন টলবে জানি।
কিন্তু আমি, বারে বারে ধরায় গিয়ে
ফিরে আসি ব্যর্থ হয়ে।
ওই অরণ্যে কোন সে মুনি?
পূর্ণিমা রাতে তার গান শুনি।
অনুমতি যদি দাও হে, বিরাট
ওখানে গিয়ে করি রাজ-পাট।
কে যেন আমায় ডাক দিয়ে যায়
ওখানে যেতে বড় সাধ হয়।‘
.
ইন্দ্র --
‘সে মুনি-ঋষিদের আস্তানা প্রিয়,
মুকুট-আসন কিছু চায় না কেহ
অরণ্যময় যত ফুলের গন্ধ
নিঃশ্বাসে তাদের সেই সুগন্ধ
তাই তো সেথায় ‘আদেশ’ জারি
আসা-যাওয়া পড়ে ভারী। ‘
.
মেনকা--
‘কিছু না জানি কিছু না মানি
আমি শুধু এইটুকু জানি,
যে কর্মের পুণ্যফলে ধরার মাটি সবুজ হবে
সেই কর্মদোষেই রাজা রক্তে ধরা লাল রবে।
এও সত্য! জেনে রাখো রাজন,
সাধু-দরবেশের হয় প্রেমিক হৃদয়
যোগী-ভোগী প্রেমে রয়না তেমন।
প্রেমের ফুল যার জীবনে ফোটে
প্রেমগন্ধে মাতোয়ারা সেই তো ছোটে।
কিন্তু অবাক লাগছে হেন
অরণ্যে প্রবেশ ’নিষেধ’ কেন?’
.
ইন্দ্র--
‘প্রেম-সুগন্ধই তো ছড়িয়ে পড়ে।
যে তারে বুঝতে নারে
সৌন্দর্য সে বিনাশ করে।
সত্ত্বারও জেনো আত্মা আছে
আত্মার কোন বিনাশ নেই
তাই সেই অরণ্যেই...’
.
ভাবুক ইন্দ্র বলে চলেন--
‘আত্মা হলেন নানা বেশধারী
কখনও তিনি প্রেমপূজারী।
কখনও তিনি অস্ত্র ধরেন
কখনও ধর্মে মতি হলে তাঁর
যাগ-যজ্ঞ পূজাও করেন।‘
.
মেনকা--
‘এসব শোকগাথা জানি রাজা,
প্রেম কাকে বলে জানিনা শুধু
কখনও তার পাইনি মজা।
প্রেমের গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে
বড় সাধ হয় জানতে তারে
দেহে-মনে প্রেমের গন্ধে
গোলাপ পাপড়ি কেমনে ঝরে!’
.
ইন্দ্র—
এক জন্ম, এক মৃত্যু দিতে পারি আমি
রক্তেভেজা মৃত্যু হবে, সইতে কি পারবে তুমি?’
বাহুডোরে বেঁধে তারে
মেনকা কয় ইন্দ্রেরে----
‘ কিছু কথা কইতে চাই...’
--আমার সৌভাগ্য! বুঝেছি কি চাও।
শুধু দেবলোকের ইতিহাস
তুমি শোননি কোথাও
কে জানত, এমন দিন আসবে হেথাও......’
.
দুনিয়াতে সবাই এই কাহিনি জানে --
.
‘মায়ের কোলে হীরের যখন জন্ম হল
জ্যোতিষীরা বলেছিলেন-
অমঙ্গলের কোন কথা নয়
ঈশ্বর যেন রক্ষা করেন।
এরা সব পরী-অপ্সরা
সেইকথাই তো বলেন তারা।
বাতাসের এক দমকা হাওয়ায়
বসন কোথায় উড়ে চলে যায়
পড়ে এসে এক ঝিলের পারে
আঙিনাময় দেবশিশু এক
দেখল সেথায় খেলা করে।‘
.
কিন্তু ইতিহাস জানে অন্যকথা---
.
দুই যুবক-যুবতী এসেছিল হেথা
মানুষ তাদের নেয়নি মেনে
বিষ দিয়েছিল তারা সজ্ঞানে
কবরে শায়িত আছে দুইজনে।‘
.
ইতিহাস আরো বলে চলে---
.
‘এসব নিয়ে কেউ কখনো
লেখেনি তো আমার পাতায়
একটি বর্ণ দাগ পড়েনি
সাদা পাতা রয়েছে খাতায়।
কখনো কেউ বলেনি তো,
ফুলসংহার হয়েছিল!
ওই বাগানের দিক থেকে
এক দমকা হাওয়া বয়ে ছিল।
কিন্তু এসে কবর স্থানে
তাদের জন্য সসম্মানে
হাওয়ার মাথা নুয়েছিল।
তারপর সে ফিরেছিল
যেখানে সেই অরণ্য ছিল‘
.
চারিদিক চেয়ে আপনকথা
বলে ইতিহাস কত না কথা---

‘কত সংস্কার এখনও বাকি
একবর্ণও কেউ লেখে না দেখি।
এই যে এখন যিনি দেবরাজ
আদতেই তিনি নন সে রাজা
এই যে এখন যিনি মেনকা
আদতে তিনিও নকলসাজা।
.
দুজনেই এখন থাকে সেইখানে
পরিত্যক্ত সেই অরণ্যে
নানা বর্ণের ফুলের গন্ধে
সারা অরণ্য ভরে সুগন্ধে।
তাই তো সেখানে যাওয়া নিষিদ্ধ
তাই তো সেখানে ‘আদেশ’ সিদ্ধ।'
0

অনুবাদ সাহিত্য - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in

 

লুইস গ্লুকের কবিতা

অনুবাদ ও আলোচনা


২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন একজন কবি তাঁর ‘Triumph of Achillies’ কাব্যগ্রন্থের জন্য। ইনি হলেন কবি লুইস গ্লুক। লুইস গ্লুক আমেরিকান কবি, জন্ম ১৯৪৩ সালের ২২শে এপ্রিল। পেশায় অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক ও কবি।
গ্লুকের কবিতা সম্বন্ধে ‘New York Times’ পত্রিকার লেখক ও সমালোচক জানাচ্ছেন— গ্লুকের লেখা হলো ‘clearer’, ‘sharper’, purer’ and ‘straightforward’. কবিতাগুলি পড়লে আমরা বুঝতে পারি তাঁর লেখা কোনওরকম দ্বিধার মধ্যে থাকে না, তাঁর মত তিনি জানান সোচ্চার হয়ে।
এখানে তাঁর ‘Love-poem’, ‘Blue Iris’ ও ‘Mock Orange’ কবিতা তিনটির অনুবাদ ও কবিতা সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।

প্রথম কবিতা— Love-Poem
গ্লুকের কবিতা খুব স্পষ্ট, কোনওরকম আড়াল নেই। যা বলার উনি বলেছেন সোজাসুজি। কিন্তু কবিতায় আছে দুঃখ, মৃত্যু, ভয় ইত্যাদি।
যেমন এই কবিতাটি। একজন সৈনিকের স্ত্রী তাঁর ছেলেকে চেষ্টা করেন বাস্তব জীবনের কঠিন শৈত্য থেকে বাঁচিয়ে উষ্ণতায় মুড়ে রাখতে। বড়দিনে বুনে দেন তার জন্য উলের চাদর, নানারকমের লাল রঙের উল দিয়ে। যে লাল রঙ যুদ্ধ, রক্ত, ভয়াবহতার প্রতীক, যিনি বছরের পর বছর অপেক্ষা করে থাকেন কবে ফিরবেন তাঁর মৃত স্বামী।
ছেলেটির দিন এভাবেই কাটে রক্তাক্ত মৃত্যুভয় আর মা, যিনি সৈনিক-রমণী, তাঁর বোনা লাল উলের পাঁচিলের আড়ালে।


প্রেম কাব্য

সমস্ত প্রেমই যেন দুঃখ দিয়ে গড়া।

এই যে তোমার মা উল বুনছেন
একরাশ লাল রঙের বিভিন্ন আভাযুক্ত উলের চাদর
যা তোমার বড়দিনের উপহার,
যা তোমার সঙ্গে থেকে সধবা এই রমণী
উষ্ণতায় মুড়ে রাখেন তোমাকে।

অথচ, তা কি করে হয়!
বছরে পর বছর তাঁর রিক্ত হৃদয় নিয়ে তিনি অপেক্ষা
করে আছেন
একদিন তাঁর মৃত মানুষটি ফিরে আসবে বলে।

এভাবেই তোমার দিনযাপন
রক্তাক্ত, মৃতের ভয়ে ভীত রমণী, তোমার মা
একের পর এক দেয়াল তুলে চলেছেন তোমার চারপাশে...

দ্বিতীয় কবিতা— Blue Iris
অনুবাদ সবসময়েই স্বকীয় মহিমায় একটি কবিতা হয়ে উঠুক, এমনটাই চেষ্টা করি। এখানে বুনো বা জংলী অর্থে Wild শব্দটি ব্যবহার করিনি। গভীর, ঘন, অন্তরস্থ...সেই অর্থেই ‘নীল’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। চেতনায় মৃত্যু ও মুক্তি দুইই যেন স্বমহিমায় প্রকাশিত।



নীল আইরিশ

আমার অশেষ কষ্ট পেরিয়ে এলেই একটা
খোলা দরজা
বেরিয়ে এসোঃ মৃত্যু হাতছানি দেয়
আমি জানি, আমি বুঝতে পারি

কিছু অস্ফুট গুঞ্জন, পাইনের শিরশিরানি
তারপর শূন্যতা... হালকা রোদের আলো
শক্ত জমির উপরে ঠিকরে ঠিকরে পড়ে

অসম্ভব এই বেঁচে থাকা
আমার সমস্ত চেতনা এখন
অন্ধকার তলানিতে

তারপর সব শেষঃ যা ভেবেছি,
মুখে আর কোনও কথা নেই, হঠাৎ যবনিকা
শুধু ঝোপঝাড়ে পাখিদের কিচিরমিচির

তোমার কিচ্ছুটি এখন মনে নেই
তুমি যেন অন্য জগতের লোক...

কিন্তু আমি বলছি, আমি পারবো...আমি কথা বলতে পারবো...

কোন বিস্মৃতির অতল হতে উঠে আসা
কন্ঠস্বর

জীবনের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সে উঠে আসে
যেন সাগরের নীল জলে অফুরান ঝর্ণার প্রতিচ্ছবি...!


তৃতীয় কবিতা— Mock Orange

বস্তুতঃ গ্লুকের ‘Mock Orange’ কবিতাটি সম্বন্ধেই ‘New York Times’ পত্রিকার লেখক ও সমালোচক লিখেছেন তাঁর লেখার ধরন সম্বন্ধে যেখানে বলা হয়েছে গ্লুকের লেখা হলো ‘clearer’, ‘sharper’, purer’ and ‘straightforward’.
কবিতাটি পড়লে আমরা বুঝতে পারি তাঁর লেখা কোনওরকম দ্বিধার মধ্যে থাকে না, তাঁর মত তিনি জানান সোচ্চার হয়ে। কবিতাটি পড়া যাক—


মিথ্যে কমলার গন্ধ

এ চাঁদের আলো নয়’ বিশ্বাস করো, আমি বলছি তোমাকে
ফুলগুলির জন্য বাগানটি আলোকিত হয়ে আছে।

আমি ঘৃণা করি,
এই মিথ্যেকে আমি ঘৃণা করি।
যেমন ঘৃণা করি যৌনতা
যখন পুরুষ তার ঠোঁট দুটি দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করে দেয়
পুরুষের সেই কামুক নিথর দেহ...

দুজনের এই মিথ্যে যৌন মিলন
চাপা কান্না, উপহাস, বিদ্রুপের মতো মনে হয়

এখন এই রাত্রে আমার মনে হচ্ছে
আমি যেন সেই প্রশ্ন ও উত্তর শুনতে পাচ্ছি
যা মনের মধ্যে উত্তাল হয়ে টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে পড়ছে
অনেক মনের ভিতরে
সেই পুরনো দ্বন্দ্ব, পুরনো যুদ্ধ

তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?
আমাদের ঠকানো হয়েছে
আমাদের বোকা বানানো হয়েছে
একটা মিথ্যে মিষ্টি কমলালেবুর গন্ধ যেন জানালা দিয়ে
ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে


কী করে শান্ত হবো?
কী করে সুখে থাকবো, বলো?
এখন সেই গন্ধটা ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত পৃথিবীতেই

0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in


অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ১২ 


এবারের প্রেমের কবিতার কিস্তিতে পাঁচজন কবি।


পেরুর কবি সেসার ভায়েহো বেঁচেছিলেন ৪৬ বছর। পরের প্রায় পাঁচ দশক তাঁর স্ত্রী জর্জেত তাঁর কবিতাকে বুকে করে জীবন কাটিয়েছেন, প্রকাশ করেছেন অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত লেখার সংকলন, তত্বাবধান করেছেন নানান ভাষায় তাঁর কবিতা অনুবাদের। “ত্রিলসে” নামে ৭৬ টি পরাবাস্তববাদী কবিতার একটি গ্রন্থ, দুরূহতায় যার তুলনা হতে পারে জেমস জয়েসের “ফিনেগান এর শোকযাত্রা” এর সঙ্গে। মনপার্নাসের অভিজাত সমাধিক্ষেত্রে তিনি অন্তিম শয্যায় অন্যান্য কালজয়ী কবি-লেখক-শিল্পীদের সঙ্গে।

হুলিও কোর্তাসার কোন দেশের? আর্হেন্তিনার, ফ্রান্সের না পৃথিবীর? কথাসাহিত্যের জগতে যিনি বিপ্লব ঘটিয়েছেন, কবিতার জগতেও তাঁর অবদান ভেবে দেখার মত। ১৯৬২ সালে প্রকাশিত “ক্রোনোপিওদের আর ফামাদের কাহিনী” লাতিন আমেরিকার হাইব্রিড সাহিত্যের এক অমোঘ উদাহরণ। গদ্যকবিতার শৈলী, অথচ তাতে রয়েছে ন্যারেটিভের উষ্ণতা এবং জাদুবাস্তবতার গোলকধাঁধা। মালার্মের তীব্র প্রভাবে তাঁর কবিতা লেখার সূচনা, কিন্তু খুব সহজেই তিনি তাঁর নিজের কাব্যপথটি খুঁজে নিয়েছিলেন। এসপানিওল ভাষায় কবিতাকে বলে “poema”, বহুবচনে “poemas”। ওই শব্দের আখরগুলিকে এলোমেলো করে দিয়ে তিনি তাঁর কবিতার বইয়ের নাম দিলেন “তকিবা ও বতিকা” (“Pameos i Meopas”)। এখানে সঙ্কলিত দুটি কবিতা তাঁর “গোধূলি ব্যতীত” (“সালভো এল ক্রেপুসকুলো”, ১৯৮৪) কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।

জেন শোর এর কবিতাটি বিষাদকরুণ ব্যর্থ প্রেমের -- জেন এবং তাঁর স্বামী কথাসাহিত্যিক হাওয়ার্ড নরম্যান বাস করতেন মেরিল্যান্ড রাজ্যের চেভি চেজ শহরে। ২০০৩ সালের গ্রীষ্মকালে তাঁদের অনুপস্থিতিতে সেই বাড়িতে হাউসসিটিং করতে আসেন উদীয়মান ও প্রতিশ্রুতিময় ভারতীয়-মার্কিন কবি ঋতিকা ভাজিরাণী (১৯৬২-২০০৩) এবং তাঁর শিশুপুত্র জিহান। ঋতিকা তখন উইলিয়াম এবং মেরির কলেজে আবাসিক লেখিকার কাজ করছিলেন এবং হেমন্তকালে তিনি যোগ দেবেন এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে। তাঁর প্রেমিক এবং সন্তানের পিতা এক ডাকসাইটে মার্কিন কবি। কিন্তু ২০০৩ সালের জুলাই মাসে তিনি তাঁর শিশুসন্তানের কব্জি কেটে ফেলে তাকে হত্যা করেন এবং নিজেও আত্মহত্যা করেন। জেন এর “মালকিন” কবিতাটি সেই ভয়াবহ ও রক্তাক্ত ঘটনার পরে বাড়িতে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা বিষয়ে। 

ভিয়েতনামের যুদ্ধের রক্তাক্ত ছায়ায় লাম থি মাই জা’র কবিতা জীবনের সূচনা। তিনি বাস করেন মধ্য ভিয়েতনামের থুয়া থিয়েন হুয়ে প্রদেশের হুয়ে শহরে -- যুদ্ধের বীভৎসতা ও বিষন্নতার মধ্যেও তিনি খুঁজে পান কবিতার বীজ। শহরের কেন্দ্র দিয়ে বয়ে গেছে সং হুয়াঙ অর্থাৎ অপরূপা সুগন্ধি নদী, তার জলের রং সবুজ, দুধারে ঘন হয়ে দাঁড়ানো গাছের সারি, সেই গাছের ছায়া পড়ে নদীর জলে, দূরে দেখা যায় নু বিন পর্বতমালা। মে থেকে নভেম্বর নিয়মিত বৃষ্টি ঝরে, বছরে গড়ে ৭১ ইঞ্চি। দিগন্ত অব্দি ঘন সবুজ আর আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলের মাথায় টোকা। এই পরিবেশের সঙ্গে আন্তরিক সাযুজ্যই মাই জার কবিতার মেরুদণ্ড। যুদ্ধ তাঁকে আঘাত দিয়েছে, কিন্তু ভেঙে ফেলতে পারে নি। “ধানের সোনালী রঙ ক্লাস্টার বোমার রঙে মেশে” আর বোমার গর্তগুলি হয়ে দাঁড়ায় প্রকৃতির, পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

রোবের্তো বোলানো চিলের লেখক এবং লাতিন আমেরিকার রাঁবো -- বোহেমিয়ান কবি, আপাদমাথা প্রতিষ্ঠান বিরোধী এবং পেশাদার সাহিত্য প্ররোচক। তাঁর হাতে নিগ্রহ সয়েছেন মেহিকোর রবীন্দ্রনাথ, স্বয়ং ওকতাবিও পাস -- মঞ্চে কবিতা পড়তে ওঠার আগে তিনি প্রেক্ষাগৃহে উঁকি মেরে দেখে নিতেন, বলেন ও তার দলবল কোথাও ওঁৎ পেতে রয়েছে কি না। কবিতার জন্যে যে কোনো শারীরিক ও মানসিক অনাচার ও নৈরাচারই যথেষ্ট নয় এই কবির কাছে। মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে তিনি লিখেছেন হাজার হাজার পাতার থকথকে গদ্য, সেগুলি এখন শোরগোল তুলেছে পৃথিবীতে।


এবার আমরা তাঁদের কবিতাগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। 

সেসার ভায়েহো (পেরু, ১৮৯২-১৯৩৮)


অনন্ত ফুলশয্যা 

প্রেম থেমে গেলেই প্রবল হয়।
এবং সমাধি হয়ে ওঠে বিশাল এক আঁখিগোলক,
বাঁচে আর কাঁদে, মধুর অনন্ত 
এবং কৃষ্ণ প্রত্যুষের পানপাত্রে যেমন।

যখন ওষ্ঠ অধর কুঞ্চিত চুম্বনের প্রস্তুতিতে,
যখন ভরা পাত্র উপচায় আর মরে 
এবং সেই আলোকিত সংযোজনে,
একজোড়া ঠোঁট অন্যজোড়া ঠোঁটের জন্যে 
প্রত্যাখ্যান করে অসুখী দিনযাপনের জীবন।

এবং, এইভাবে ভাবলে, মধুর লাগে সমাধিকে 
যেখান সকলেই ঢোকে একে অন্যের গর্ভে
সমবেত গর্জনে;
মধুর সেই ছায়া, যার নিচে জড়ো সবাই 
প্রেমের সার্বজনীন হস্তাক্ষরে। 


[মূল কবিতার নাম: “এল তালানো এতারনো”।]


ক্লান্ত বলয়গুলি 

যে কামনাগুলির কাছে ফিরে আসি, ভালোবেসে
অদৃশ্য হয়ে যাই না, এমন কামনা রয়েছে যার জন্যে 
মৃত্যুও শ্রেয়, যার জন্যে যুদ্ধে মাতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী 
জলরাশি, যাদের জোড়া হয়নি কখনো।

এক মহান চুম্বনের কামনা, যা ঢেকে ফেলতে পারে 
জীবনকে, যার সমাপ্তি আফ্রিকায়, অসহ্য 
যন্ত্রণার মধ্যে এক আত্মহত্যায়।

এমনও কামনা রয়েছে ..... যার কোনো কামনা নেই,
হে ঈশ্বর! আমার দেবহন্তা আঙ্গুল দেখায় 
তোমাকে দিকে: সে কামনা হৃদয়কে বন্ধ করে রাখার।

বসন্ত আসে ফিরে ফিরে, চলে যায় আবার।
আর ঈশ্বর, সময়ের চাপে নতজানু,
বারবার বলে যান: চলেন, চলেন, 
ব্রহ্মাণ্ডের মেরুদণ্ডকে পিঠে বোঝা নিয়ে।

আমার মন্দিরে যখন বিষাদের ঢাক বাজে,
যখন ছোরার গায়ে খোদিত স্বপ্ন পীড়িত করে আমাকে,
কামনাগুলো হেলায় ছড়িয়ে রাখি এই কবিতার গায়ে।

[মূল কবিতার নাম: লস আনিওস ফাতিগাদোস”।]

[“আমার মৃত্যু হবে প্যারিসে; সকাল থেকে বৃষ্টি হবে সেই দিনটিতে।” ফরাসি স্ত্রী জর্জেতকে প্রায়ই এই কথা বলতেন পেরুর এই কবি। ১৯৩৮ সালের ১৫ এপ্রিল এক বৃষ্টিমেদুর দিনে তাঁর মৃত্যু প্যারিসে। বামপন্থা থেকে পরাবাস্তববাদ পর্যন্ত দীর্ঘ সাহিত্যিক পদযাত্রা এই কবির। পেরুর জাতীয় কবি, সে দেশের প্রথম আধুনিক কবি, বিংশ শতাব্দীর এক মহীরুহ। এসপানিওল ভাষা থেকে কবিতাদুটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ক্লেটন এশলেম্যান।]


হুলিও কোর্তাসার (আর্হেন্তিনা, ১৯১৪-১৯৮৪)


এক প্রেমের চিঠি 

যা কিছু আমি তোমার কাছে চাই 
অন্তিমে সব তুচ্ছ 

আবার অন্তিমে তাই সর্বস্ব

পাশ কাটিয়ে যাওয়া কুকুর, অথবা এক পাহাড়,
অর্থহীন সব সামগ্রী, যা একঘেয়ে,
গমের শিষ, লম্বা চুল, চিনির দুটো ডেলা,
তোমার শরীরের সুবাস,
যা কিছু তুমি বলে যাও যে কোনো বিষয়ে 
আমার পক্ষে বা বিপক্ষে,
এই সব যা তোমার কাছে পাওনা 
সব তুচ্ছ, কারণ তোমাকে ভালোবাসি।

আমি চাই তুমি আমাকে পেরিয়ে দূরে তাকাও,
আর আমাকে ভালোবাসো আগামীকালের 
জবরদস্ত অবজ্ঞায়,
তোমার রাগমোচনের শীৎকার ফেটে পড়ুক 
আপিসের কোনো বড়বাবুর মুখের ওপর 

এবং যে ইন্দ্রিয়সুখ আমাদের যৌথ আবিষ্কার 
তা হোক স্বাধীনতার আর এক চিহ্ন।

[মূল কবিতার নাম: “উনা কার্তা দে আমোর”]



অনুষ্ঠান 

অশ্রু ও কম্পনের ফাঁকে ফাঁকে বসনমুক্ত করি তোমায় 
এই শয্যা অসীম পর্যন্ত উন্মুক্ত,
এবং তোমার প্রতিবাদ, মিনতি অথবা লজ্জায় রাঙা মুখ 
আমার মনে আনে না কোনো করুণা,
সময়ের আদিকালে আমি ছিলাম কুম্ভকার,
মাটির তালের ভেতর জন্মের অনুভূতি 
জ্বলন্ত আগুনে পোড়ার মন্দগতি ও প্রথাগত ঝুঁকি সমেত,
ফুল হয়ে বা সৃষ্টির মুখে ফেরার পৌরাণিক অভিপ্রায়।

আমার বাহুতে তুমি বুনে দাও শৃঙ্খলের মতন 
সময়ের মর্মরিত গুচ্ছ গুচ্ছ কেশদাম 
বিসর্জন দাও তাকে অন্তহীন পুনরাবৃত্ত আগুনে।

জানি না তোমার বিলাপের মধ্যে কি দেখেছি,
দেখেছি ঈগল আর শৈবাল, আমি হয়েছি 
আরশির সেই দিকটা যেখানে সরীসৃপ গান গায়।


[মূল কবিতার নাম: “লা সেরিমোনিয়া”]


[আর্হেন্তিনার কবি, ডাকসাইটে গল্পকার, এস্পানিওল ভাষার কথা সাহিত্যের খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন “রাউএলা” (“এক্কা দোক্কা” অথবা “হপস্কচ”) উপন্যাস লিখে (প্রকাশ ১৯৬৩)। দৈনন্দিন আমরা যেসব ভয়াবহ ঘটনা ঘটাতে সক্ষম বনাম প্রতি রাতে আমাদের মনের দুর্গম গোলকধাঁধায় যেসব মোহিনী, জাদুকরী ব্যাপার ঘটে -- তিনি তাঁর মধ্যেকার কোমল ভারসাম্যটিকে সবর্দা নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখেন তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে। এস্পানিওল ভাষা থেকে কবিতাদুটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন স্টিফেন কেসলার।]


জেন শোর (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪৭- )


মালকিন 

আমার নীড়ে তার বিশ্রাম, ডবল বেডে শুতো সে
আমার দিকটায়, থাক করে বই রাখতো --
আমার বই সব -- পড়া শেষ হলে নাইটস্ট্যান্ডে।
আলমারিতে তার ইস্ত্রি করা ড্রেস 
আমার স্বামীর ট্রাউজারের গা ঘেঁষে।
শিশুর খেলনার সঙ্গে আমি সেগুলো 
বাক্সবন্দি করে পাঠিয়েছি তার বাপের বাড়ি।
তার নীল টুথব্রাশ আর কচ্ছপখোলার চিরুনি 
ফেলে দিয়েছি জঞ্জালে। পুলিস নিয়ে গেছে 
গালচেটা। আর আমার দুটো ধারালো ছুরি।

কিন্তু হেঁশেলে এখনও তার মশলাপাতি ঘ্রাণ --
তার দারুচিনি, কারি পাউডার, লবঙ্গ।
সারা ঘরে ধূপধুনো অগুরুর 
সুগন্ধি গোলকধাঁধা। প্রায় প্রতিদিন 
খুঁজে পাওয়া যায় তার নতুন নতুন জিনিস।
যেমন লা ব্রেয়ার আলকাতরার খনি থেকে 
মাঝে-মাঝেই উঠে আসে প্রাচীন অস্থি,
পৃথিবীর কালো পেশি তাদের 
দুমড়ে মুচড়ে ছুঁড়ে দেয় ভূ-পৃষ্ঠে।

যোগব্যায়ামের মাদুর একটি।
আমার নিজেরই তো রয়েছে। আর কী দরকার?
জপের মালা। স্ট্র্যাপবিহীন ব্রা একটা।
সোনার আংটিটা। খুব সুন্দর।
খাপে খাপ আমার করে আঙুলে।

তার প্রিয় সাবানে হাত ধুয়ে আমি,
ঠান্ডা, শাদা একতাল মাটির মণ্ড সাবান।
একগাছি কালো চুল এখনো তার গায়ে লেগে।
তার জড়িবুটির চা-পাতা দিয়ে চা বানালে,
তার গন্ধতেল মাখলে, তার হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খেলে,
তার হজমিগুলি (খুব ভালো কাজ দেয়,
বলেছিলো সে) খেলে অন্যায় হবে কি?
হলুদ বোতলটি প্রায় ভরা। নষ্ট করি কেন?
চারটে টকটক বড়ি মুখে ফেলি।

টীকা: “লা ব্রেয়া আলকাতরার খনি” (“La Breya Tar Pit”) -- এসপানিওল ভাষায় “লা ব্রেয়া” মানে “আলকাতরা”। তাই সঙ্গে “Tar Pit” জুড়ে দেবার প্রয়োজন নেই স্থান নামে। লস এঞ্জেলিস শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত এবং বর্তমানে একটি জাদুঘরের অংশ। এখন থেকে আবিষ্কৃত জীবাশ্ম দিয়ে প্রমান হয়েছে প্রাচীনকালে নানান জাতের ঘোড়া ও উটের বসবাস ছিল আমেরিকায়।

[জেন শোর এর সাম্প্রতিক গ্রন্থের নাম “সুখী পরিবার”। কবি জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। “লাঙল” নাম একটি বিখ্যাত ক্ষুদ্রপত্র সম্পাদনা করতেন। সবমিলিয়ে ছ’টি কাব্যগ্রন্থ।]


লাম থি মাই জা (ভিয়েতনাম, ১৯৪৯- )


সায়গনের বৃষ্টি

একই সঙ্গে
আমাকে ভেজায়
বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি
সায়গনের বৃষ্টি

আর আবেগপ্রবণ প্রেমের বাণী
বন্য উদ্দামতায়
জলপ্রপাত হয়ে ভাসায়

মেঘ জমা আকাশ 
পুরুষের বুকের মতন 
ভারী, ঈষৎ বক্র 
তার দরজা ভাঙে আর 
দমকে দমকে বেরোয় 
প্রেম প্রেম প্রেম 

বিবাহিত নারী ভাসাতে পারে না নিজেকে 
দগ্ধে মরি 
যখন কন্যা ছিলাম 
এমন বৃষ্টির দেখা পাই নি কেন 

তুমি কি আমার উপযুক্ত?

ধানের দানা যদি পৃথিবীকে শুধোয়
তুমি কি আমার উপযুক্ত?

গাছ যদি বাতাসকে শুধোয় 
তুমি কি আমার উপযুক্ত?

মেঘ যদি আকাশকে শুধোয় 
তুমি কি আমার উপযুক্ত?

তুমি অনন্ত বিশাল আকাশ 
আমি তাতে মেঘ হয়ে ভাসি

তুমি প্রবল বেগে বও বাতাস 
আমি বৃক্ষ জড়াতে চাই তোমায় 

তুমি গভীর গহন ধরিত্রী 
আমি পাকা ধান সোহাগ করি তোমায় 

কিন্তু প্রশ্নের রেশ থেকেই যায় 
হৃদয়ের আনাচে কানাচে 
তুমি কি আমার উপযুক্ত?


কর্পূর গাছের সারি


অন্তরে যেই বিষাদ জাগে
তোমার কাছে আসি 
সারি সারি কর্পূর গাছ 
আমার সুখের রাশি 

সবুজ গোল পাতার ফাঁকে 
জেড পাথরের আকাশ 
ফলের মতন বাতাস ঝরে 
ফিসফিসানি দূরের পথে বাঁকা 

গাছের ছায়ায় হাঁটতে গিয়ে 
ভাবি না: আমি শিশু 
বৃক্ষ বাড়ে দৈর্ঘ্যে আড়ে 
আমার মতোই, কী সুখ 

অনুতাপে লাভ ক্ষতি কার 
পাতায় হবে জরা 
হলুদ পাতা দরজা হয়ে 
আকাশটাকে সরায়

কর্পূরের গন্ধ আসে 
সত্তায় ও নাকে 
রাতের ঘুমে দিনের জাগায় 
দেখতে পারি তাকে 

সারি সারি কর্পূর গাছ 
হুয়ে শহরে আমায় 
ধরে রাখে বেঁধেও রাখে 
বিষাদটাকে নামায় 

[“লাম” তাঁর পদবি অথবা বংশনাম, “থি” অর্থাৎ তিনি এক নারী, “মাই জা” এর অর্থ “সুন্দর নিশীথিনী” (মা তাঁর এই নাম রেখেছিলেন); তিনি “লাম” পরিবারের কন্যা অথবা বধূ, যাঁর নাম “সুন্দর নিশীথিনী”। তিনি ভিয়েতনামের এক প্রধান কবি। প্রেম, প্রকৃতি, ভিয়েতনামের যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী জীবনযাত্রা নিয়ে তাঁর কবিতা। ভিয়েতনামি ভাষা থেকে কবিতাগুলির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন মার্থা কলিন্স এবং থুই দিন।]


রোবের্তো বোলানো (চিলে, ১৯৫৩-২০০৩)


প্রেমে দিওয়ানা কুকুর 

অনেক কাল হল, বয়েস যখন আমার বিশ ছুঁই ছুঁই, আমি 
আপাদমাথা উন্মাদ।
আমি হারিয়েছি স্বদেশ 
কিন্তু জিতে নিয়েছি স্বপ্ন।
এবং সেই স্বপ্ন যতক্ষণ আমার সহায় 
পরোয়া করি না অন্য কিছুর।
না করি কাজকর্ম, না করি পুজো,
না করি ভোরের আলোয় 
প্রেমে দিওয়ানা কুকুরের পাশে বসে লেখাপড়া।
আমার অস্তিত্বের শূন্যতায় শিকড় গাড়ে স্বপ্ন।
আলো আঁধারের কম্বলে মোড়া 
কাঠের শয়নকক্ষে 
যা গ্রীষ্মমন্ডলের ফুসফুসের গভীরে বসানো।
মাঝে মাঝে আমি নিজের অন্তরে পিছু হটে 
স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছোই: তরল ভাবনায় 
চিরন্তন ভাস্কর্য,
কামনায় শিউরে ওঠা 
শুভ্র কীট।
পলাতক প্রেম।
স্বপ্নের অভ্যন্তরে আরো এক স্বপ্ন।
দু:স্বপ্ন আমাকে ডেকে বলে: বয়েস বাড়বে তোমার।
যন্ত্রণার প্রতিচ্ছবি ও তার গোলকধাঁধা পিছনে ফেলে
এগোবে তুমি, ভুলেও যাবে তাদের।
কিন্তু অনেক কাল আগে, সেই বয়েস বাড়াটাও ছিল অপরাধ।
যা বলছিলাম, আমি এখন হাজির, প্রেমে দিওয়ানা
কুকুরদের সঙ্গে এবং এলাকা ছেড়ে নড়ছি না আমি।


[মূল কবিতার নাম: “লস পেররোস রোমান্তিকোস”।] 


লুপে 

মেয়েটি শরীর বেচতো লা গুয়েরেরো শহরে, জুলিয়নের বাড়ি থেকে
খানিকটা দূরে, বয়েস মোটে সতেরো, কোলের ছেলেটা মরেছে আঁতুড়ে।
ত্রেবোল হোটেলে আমার কক্ষটি প্রশস্ত, আলোকবিহীন,
বাথটব আর বিদে সমেত -- ঘরে কাটানো যায় কয়েক বছর -- সেখানে 
সন্তানের স্মৃতিতে কেঁদেছিল সে। সেখানে বসে আমি লিখতে চেয়েছিলাম
বিভীষিকার কবিতাগুচ্ছ অথবা সন্দেহজনক
স্মৃতিচারণার গ্রন্থ। লুপে মেয়েটি
খ্যাংরাকাঠি রোগা, লম্বা ঊরুদুটোয় 
চিতাবাঘের মতন ছোপ ছোপ।
প্রথমবার আমার যন্তর তো দাঁড়ালোই না:
তবে তাতে একেবারেই ভেঙে পড়ি নি আমি। লুপে তার 
জীবনের কথা বলে যায়, কিসে তার সুখ হয়, সেই কথা।
এক হপ্তা পরে আবার দেখা -- রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে সে 
পুরানো ক্যাডিলাকের গায়ে হেলান দিয়ে, অন্য কিশোরী বেশ্যাদের সঙ্গে।
দেখা হয়ে আমরা দুজনেই খুশি। সেদিন থেকে শুরু হল তার 
মনের কথা বলা আমাকে: কখনো কাঁদতে কাঁদতে,
কখনো ঠাপাতে ঠাপাতে, অথবা হাত ধরাধরি করে 
বিছানায় শুয়ে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে, সর্বদা নগ্ন।
তার ছেলেটা পেট থেকে পরেই রুগ্ণ, লুপে মানত করেছিল 
জাগ্রত মা মেরির কাছে -- বাচ্চাটি সেরে উঠলে 
সে দেহব্যবসা ছেড়ে দেবে। দু-এক মাস কথা রেখেছিল,
কিন্তু ভাত না জোটায় ফিরে গেল নরকে।
কয়েকদিন পরে মরলো শিশুটি, লুপে বলে দোষটা তারই 
মানত করেও সে কথা রাখতে সমর্থ হয় নি।
শপথ ভঙ্গের মূল্য হিসেবে মা মেরি নিজের হাতে 
তুলে নিলেন তাঁর দেবশিশুকে ধরাধাম থেকে।
আমি কিছু উত্তর দিতে নারাজ তখন।
আমি শিশুদের পছন্দ করি অবশ্যই, কিন্তু 
অনেক বছর পরে যখন সন্তান এলো আমার নিজের জীবনে,
বুঝলাম দুধের শিশুকে হারানো কতোটা ভয়াবহ হতে পারে।
তাই চুপ ছিলাম আমি, চরাচরে বা হোটেলের কোনো ঘরেই 
শব্দের রেশ নেই, শিরশিরে আতংকজনক নীরবতা।
হয় দেওয়ালগুলো খুব পুরু অথবা কেউ নেই অন্য ঘরগুলোতে,
অথবা থাকলেও কেউ বলছে না কিছুই, শীৎকার তো নয়ই।
লুপের তরুণী শরীরে আরোহণ করা সোজা, নিজেকে 
মনে হয় পুরুষালি আবার একই সঙ্গে হতভাগা।
লুপেও তালে তালে জঘন নেড়ে সাড়া দেয়, আর 
তলঠাপের সঙ্গে সঙ্গে গল্প মারে -- বুকারেলি থিয়েটারে 
নতুন কী রোমহর্ষক সিনেমা দেখেছে।
চিতাবাঘ ঊরু দিয়ে আশ্লেষে জড়ায় কোমর,
মাথা ডুবিয়ে দেয় আমার বুকে আর জিভ দিয়ে 
খোঁজে আমার নিপল অথবা হৃদস্পন্দন।
এক রাত্তিরে বলে সে,
এখানটায় চোষো আমায়, খুব আরাম হবে। 
কোথায় লুপে? তোমার হৃদয়ে?


[মূল কবিতার নাম: “লুপে”।]


[যখন বেঁচে ছিলেন, তখন তিনি পুরোপুরি অপরিচিত পাঠক মহলে, কিন্তু ৫০ বছর বয়েসে অকাল মৃত্যুর দেড় দশক পরে এখন তিনি ভুবন বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হিসেবে। কিন্তু তাঁর মতে,

“People are cowardly to their last breath. Poetry is the last thing that is not contaminated ….. Only poetry is not shit!” লেখকের কবিতাগুলিও তাঁর গল্প উপন্যাসের মতন: তাড়াহুড়ো করে লেখা। এসপানিওল ভাষা থেকে কবিতার ইংরেজি অনুবাদ করেছেন লরা হিলি।]


[আগস্ট ২০২০. ক্রমশ:]
0

অনুবাদ সাহিত্য - অংকুর সাহা

Posted in


অবিস্মরণীয় প্রেমের কবিতা -- ১১ 


ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসছে প্রেমের কবিতার সম্ভার। এই দু:সময়ে বইপত্রের সন্ধানে বিফল হয়ে কুড়িয়ে বাড়িয়ে যা পেয়েছি তাই উপস্থিত করতে চাই সুধী পাঠকের সামনে। সংকলিত সাতজন কবির মধ্যে অনেকেই আমাদের পরিচিত নাম।

উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস পেশায় চিকিৎসক, রাজনীতিতে বামপন্থী এবং পুঁজিবাদের তীব্র বিরোধী। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর যখন আমে রিকায় বামপন্থী বুদ্ধিজীবী চিন্তাবিদদের বিরুদ্ধে অবদমন এবং নির্যাতনের জোয়ার এসেছিলো, তার বিরুদ্ধে যে অল্প কয়েকজন কবিলেখক প্রতিবাদে মুখর হয়েছিলেন, তিনি তাঁদের অন্যতম। “ম্যাকার্থিজম” মার্কিন রাজনীতির এক কুখ্যাত সময় যার ফলে ধ্বংস হয়েছে অনেক নিরপরাধ মানুষের সুনাম ও পেশা। তিনি চেষ্টা করেছিলেন রুখে দাঁড়াতে। মার্কিন কবিতায় ব্রিটিশ কবিদের গভীর প্রভাবের বিরুদ্ধে তাঁর সাহিত্যচর্চা। শিশুদের চিকিৎসক হিসেবেও তিনি সফল -- যে হাসপাতালে তিনি চার দশক চিকিৎসা করেছেন, সেখানে তাঁর মৃত্যুর পর একটি সম্মানফলকে লেখা রয়েছে, "We walk the wards that Williams walked." ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনীর নাম, “আমি একটা কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম”।

ডি এইচ লরেন্স বিংশ শতাব্দীর এক বিতর্কিত লেখক। শিল্পায়ন ও আধুনিকতার ফলে মানবসমাজ যে হারিয়ে ফেলছে তার আন্তরিকতা ও মানবিকতাকে, সেটাই তাঁর সাহিত্য সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। “পুত্রেরা এবং প্রেমিকেরা“, “রামধনু”, “প্রেমে পড়া নারী”, “লেডি চ্যাটার্লির প্রেম”: এই লেখকের কয়েকটি যুগান্তকারী উপন্যাস। নি:সংকোচ আর স্বতঃস্ফূর্ত যৌনতা যে স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর, কথাসাহিত্যের মাধ্যমে সেই ভাবনাবিশ্বকেই তিনি তুলে ধরেছেন; শেষোক্ত উপন্যাসটি নিয়ে অশ্লীলতার দায়ে নিষ্ফল মামলা চলেছিল বহু বছর, প্রধান আপত্তি ছিল দুটি অপ্রচলিত ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যবহার নিয়ে: একটি নারীতনু সংক্রান্ত এবং অন্যটি যৌনকর্মের ক্রিয়াপদ। দুটি শব্দই (“সি” এবং”এফ” যাদের আদ্যক্ষর) এখন সুভদ্র ইংরেজিতে জলভাত। ছোটোগল্প এবং উপন্যাসিকার জগতেও তিনি নতুন পথ দেখিয়েছেন; তাঁর রচিত কবিতা তুলনামূলকভাবে অবহেলিত।

সাহিত্যিক টমাস লানিয়ার উইলিয়ামস এর জন্ম আমেরিকার মিসিসিপি রাজ্যে, কিন্তু লেখক হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করার পর নাম পাল্টে করে নেন “টেনেসি”। তাঁর বাবার জন্ম প্রতিবেশী টেনেসি প্রদেশে, এবং তাঁর মৌখিক শব্দব্যবহারেও ছিল টেনেসির প্রাধান্য। প্রায় দু দশক ধরে তাঁর রচিত নাটকগুলি সুসমালোচিত, প্রশংসিত ও জনপ্রিয়; নিউ ইয়র্কের ব্রডওয়েতে তাঁর একের পর এক হাউসফুল নাটক: “গ্রীষ্ম এবং ধোঁয়া” (১৯৪৮), “গোলাপি উল্কি” (১৯৫১), “রাজপথ” (১৯৫৩), “গরম টিনের ছাদে বেড়াল” (১৯৫৫), “অর্ফিউস নেমে আসছেন” (১৯৫৭), “উদ্যান জেলা” (১৯৫৮) এবং “যৌবনের মিষ্টি পাখি” (১৯৫৯)। একই সময়ে তাঁর নাটক অবলম্বনে একের পর এক চলচ্চিত্র। এলিয়া কাজান, যিনি লেখকের বেশির ভাগ নাটকের জনপ্রিয় চলচ্চিত্ররূপ দেন, তিনি লিখেছিলেন, “তাঁর জীবনের বেশির ভাগ উপাদান রয়েছে তাঁর নাটকে, তাঁর নাটকের বেশির ভাগ উপাদান রয়েছে তাঁর জীবনে”। নিভৃত জীবনে তিনি সমকামী, কিন্তু সময়টা সমকামীদের পক্ষে সুখের ছিল না| তাঁর সাহিত্য শৈলির নাম “দক্ষিণের গথিক “। ১৯৮৩ সালে নিউ ইয়র্কের একটি হোটেল ঘরে তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু, মৃত্যুর কারণ ড্রাগ্স বিষয়ক দুর্ঘটনা অথবা ওভারডোজ। তাঁর কবিতাগুলি নিয়েও সিরিয়াস আলোচনা হয়নি বিশেষ।

অন্য মার্কিন কবিদের সঙ্গে বিলি কলিন্সের একটা প্রধান তফাৎ: তাঁর কবিতা প্রথম পাঠেই বোঝা যায় এবং বেশ কয়েক হাজার কপি বিক্রি হয় তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থ। কবিতার জটিলতম গঠন তাঁর ভীষণভাবে অপছন্দ, সেই সঙ্গে তার ধ্রুপদী, বিশ্লেষণমূলক আলোচনাও। হাই স্কুল পাস করা ছাত্রছাত্রীরাও যাতে তাঁর কবিতার সমঝদার হতে পারেন, সেই ভাবেই তিনি কবিতা লেখেন। কবিতায় হাস্যরসের জন্যে “মার্ক টোয়েন পুরষ্কার“ দেওয়া হয় প্রতি বছর, তাঁকে দিয়েই এই পুরষ্কারের সূচনা।

কোস্তা রিকার কবি আনা ইসতারু বাঁধনছেঁড়া কবিতা লিখে খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন ১৯৯০ এর দশাব্দে, এখন তিনি সেই দেশের শীর্ষস্থানীয় কবি, নাট্যকার এবং নারীবাদী টিভিব্যক্তিত্ব। 

ইরাকের নির্যাতিত কবি দুনিয়া মিখাইল আমেরিকায় বাস করেছেন দু দশকের বেশি -- আরবি এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই কবিতা ও গদ্য লেখেন।

জশুয়া বেকম্যান মার্কিন কবি -- এক দশক আগে তিনি বাস পরিক্রমা করে কবিতা পাঠের আসর বসিয়েছিলেন পঞ্চাশটি শহরে।

সব মিলিয়ে সাত কবির বিচিত্র সমাবেশ। আসুন তাঁদের প্রেমের কবিতাগুলি উপভোগ করি:

উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৮৮৩-১৯৬৩)


অমরত্বের প্রমাণ 

যত পুষ্প আছে এ ধরায়, তাদের সবার থেকে বীর,
স্বচ্ছ জহরত থেকে মূল্যবান, আকাশের সমান গভীর;
অমর ও অচঞ্চল: তাঁহার উত্তুঙ্গ শক্তি ডাকে
পার হয় যুক্তি, প্রেম, মানসিক প্রকৃতিস্থতাকে !

আর তুমি, হে প্রেয়সী, হলে সেই দেবোপমা নারী।
একই ঝলকে তার দুই রূপ, অলৌকিক এবং আনাড়ি।
স্বর্গের রাজার সঙ্গে যুদ্ধে রত, বিক্ষত যে জুনো!
তার নাম অজ্ঞানতা, হে সুন্দরী, কান পেতে শুনো।

টীকা: জুনো: রোমের পুরাণের দেবী; গ্রিক পুরাণে তাঁর নাম “হেরা”। ভার্জিলের “এনেইড” মহাকাব্যের প্রধান চরিত্র।

[পেশায় চিকিৎসক, কিন্তু জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছেন সাহিত্যের সেবায়। “মডার্নিজম” এবং “ইমেজিজম”: এই দুটি সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা। বাবা ইংল্যান্ডের আর মা পুয়ের্তো রিকোর; বিটকবিদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। অ্যালেন গিন্সবার্গের “আর্তনাদ” কবিতার ভূমিকা লিখেছিলেন। কমিউনিস্ট সন্দেহে নানান সন্দেহ ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছিলেন ১৯৫০ এর দশকে।]


ডি এইচ লরেন্স (ইংল্যান্ড, ১৮৮৫-১৯৩০)

অবৈধ 

স্থিতপ্রজ্ঞ পর্বতের গায়ে, সরু ফিতের মতন রামধনু,
আর আমাদের মাঝে তুমুল ঝড়;
অনেক অনেক নিচে, সবুজ গমের ফাঁকে ফাঁকে শ্রমিকেরা 
হরিৎ বৃক্ষের মাঝখানে কালো ডাকটিকিটের মতন দাঁড়িয়ে।

কাছে রয়েছ তুমি আর তোমার খালি পা চটিতে,
এবং বারান্দার নগ্ন কাঠের গন্ধ পেরিয়ে 
তোমার চুলের ঘ্রাণ পাই; আর সেই মুহূর্তে 
স্বর্গ থেকে নামে অনাবৃত বজ্র আর বিদ্যুৎ।

হালকা সবুজ বরফ-গলা জলস্রোতে 
তমসায় কালো নৌকা -- কোনদিকে যায়?
বন্ধ হয় না বিদ্যুতের আওয়াজ। আমরা দুজনে একান্তে।
স্বর্গের নিরাবরণ বিদ্যুৎ আনমনে আকাশে আসে আর 
অদৃশ্য, চলে যায়। আমরা ছাড়া আমাদের কে আছে?
নৌকাটিও নেই আর।

[ডেভিড হারবার্ট লরেন্স তাঁর নামের আদ্যক্ষরেই পরিচিত। “লেডি চ্যাটার্লির প্রেমিক” এর লেখক হিসেবে যদিও তাঁর বিশেষ খ্যাতি, পয়ঁতাল্লিশ বছরের জীবনে তিনি লিখেছেন প্রচুর: উপন্যাস, ছোটোগল্প , প্রবন্ধ, সাহিত্য সমালোচনা, ভ্রমণকাহিনি , অনুবাদ ও অন্যান্য; অর্থাৎ কবিতাও; হ্যাঁ, প্রায় আটশোটি। বিংশ শতাব্দীর এক বিতর্কিত লেখক তিনি।]

টেনেসি উইলিয়ামস (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯১১-১৯৮৩)

দিন ফুরালো ভালোবাসার 

দিন ফুরালো ভালোবাসার 
কমতে থাকে আলো।
কোমলতা ভাঁজ করে সে 
তোরঙ্গে ঢোকালো।

আমার গায়ে মোটা কাপড় 
বৃষ্টিঘামে মলিন।
নীরব হাতে তোমায় দেখি 
বাঁধতে চুলের বেণী।

ছড়াল সেই নীরবতা 
উষ্ণ ও নিষ্প্রভ।
হাত বাড়িয়ে তোমার বাহু 
আবার কবে ছোঁব।

ভাঙতে চাই যা নিথর, তাকে 
বিফল হয়ে সাজাই।
(ফিসফিসানি ভাষাও কানে 
তীব্র ঢেউয়ে বাজে।)

মুহূর্তেরা পার হয়ে যায় 
ইচ্ছে তাদের থামে।
দিন ফুরালো ভালোবাসার 
অন্তপ্রহর নামে……

[বিখ্যাত মার্কিন নাটককার, জন্ম মিসিসিপি রাজ্যে। ইউজিন ও’নিল এবং আর্থার মিলার মিলে বিংশ শতাব্দীর তিন মহীরুহ। ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত “কাচের চিড়িয়াখানা” এবং ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত “ট্রামগাড়ির নাম অভিলাষ”: দুটি যুগান্তকারী অথচ জনপ্রিয় নাটক। কথাসাহিত্য আর নাটককে টেনেহিঁচড়ে পাশাপাশি দাঁড় করাতে পেরেছিলেন তিনি। তাঁর লেখা কবিতার সংখ্যাও কম নয়। সংকলিত কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল কবির মরণোত্তর, ১৯৯১ সালে “পোয়েট্রি” পত্রিকায়।]


বিলি কলিন্স (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৪১- )

সনেট 

দরকার আর কুল্লে চোদ্দোটি লাইন, এরপর তেরো,
আর এইটে শেষ হলেই আরো এক ডজন দিয়ে 
প্রেমের ঝড়ব্যাকুল সাগরে ভাসাতে পারি নৌকো,
তারপরে দশটি পড়ে থাকে শিমের বিচির মতন সারি বেঁধে।
এলিজাবেথিয় ঢঙে না গেলে খুব সহজেই করা যায় 
যদি ছান্দসিকের ঢাক পেটাতে জোরজার না কারো 
আর প্রতিটি লাইনের শেষ অন্তমিলের বায়না না ধরো,
বধদণ্ডের প্রতিটি গাঁটের জন্যে একটি একটি করে।
কিন্তু শক্ত করে হাল ধরো -- আমরা এমন মোড় নিচ্ছি 
শেষ ছ’ লাইনে হয়ে যাবে সব সমস্যার সমাধান,
আকাঙ্খা ও বুক ধড়পড়ানির সমাপ্তি, যেখানে 
লরা বললেন পেত্রার্ককে -- কলমটা নাবাও এবার ছাই,
মান্ধাতার আমলের জংলি টাইট জাঙিয়াটি ছেড়ে ফেলো,
আলো নিভিয়ে দাও আর শেষমেশ উঠে এস বিছানায়।

[কবিতাকে সাধারণ পাঠকের কাছাকাছি আনতে সারা জীবন চেষ্টা করেছেন বিলি কলিন্স: তাঁর কবিতা গভীর অথচ সহজবোধ্য, তাঁর আগে যেমন ছিলেন রবার্ট ফ্রস্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্টের পোয়েট লরিয়েট ছিলেন দু বছর। নিউ ইয়র্ক রাজ্যের সভাকবি খেতাব পেয়েছিলেন ২০০৪ সালে। নিউ ইয়র্কের স্টোনিব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ে সৃজনশীল সাহিত্যের অধ্যাপনা করেন। কাব্যগ্রন্থ বিপণনের সংখ্যায় তিনি আমেরিকার জনপ্রিয়তম কবি।]

আনা ইস্তারু: (কোস্তা রিকা, ১৯৬০- )

যোনির পাপড়ি মেলো 

যোনির পাপড়ি মেলো
ভীরু, নতমুখ ফুলের মতন 
খিড়কির দরজা খুলে 
যাতে 
পালাতে পারে সহনশীল সাঁতারু,
থামো, বাধা দিও না,
ভঙ্গুর নৃত্যের তালে এগোও,
সাহসে ভর দিয়ে দাঁড়াও,
শূন্যে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা ঝুলবারান্দায় 
গর্ব করে দেখাও তোমার জেরানিয়াম পুষ্পগুচ্ছ 
প্রকাশ করো 
তোমার গভীরতার রহস্য। 

পালতোলা নৌকাটিকে ঢুকতে দাও 
বাধা দিও না 
তোমার বিদায়বার্তা 
বিদ্ধ করবে উত্তুরে বাতাসের মতন,
তোমার জঘনকে ভিত করে 
বানাবে তার শীতল বাসগৃহ।

যোনির পাপড়ি মেলে ধরে 
জলপ্রপাতে পরিণত হও,
ভুলে যাও শোক দু:খ।
তোমার দিবাস্বপ্নের শিশুটির জন্যে 
খুলে ধরো তাকে।

সাহসে ভর দিয়ে 
খুলে দাও ফ্লাডগেট 
দ্যাখো, আসে মধু মাখানো ললিপপ,
আর আসে জন্তুটা 
ঝোড়ো বাতাসের মতন কাঁপতে কাঁপতে,
আর ওই কুঁচকে যাওয়া ফলদুটো 
নিমজ্জিত হবে তোমার আলোকিত ক্রোধে,
দুচোখ বন্ধ করে হরিণের মতন খুঁজবে 
দিবসের দুই স্তন,
বাতাসে আন্দোলিত তাদের বৃন্ত।

[মূল কবিতার নাম: “ওপেন আপ, জেনিটালিয়া”; ইংরেজি অনুবাদ আন্দ্রেস আলফারো।]


কামনার মুহূর্ত (নির্বাচিত অংশ)

।।১।।

কোন দেশ থেকে এসেছ তুমি,
ঘুমন্ত প্রেমিক!
কোন মেঘ উথলে ওঠে তোমায় ঘিরে 
কোন ময়ূরপঙ্খী!
কে তোমায় অনুমতি দিল ছড়ানোর 
নীল পদ্মের দল,
কে তোমার ত্বকে ছড়িয়ে দেয় 
রুপালি পাখির পালক।
আমার শয্যায় শুয়ে থাকো দ্বিধাহীন 
পথ ভোলা দেবদূত,
যেন রাজার সকাশে উপস্থিত।
মানুষটাকে বুঝি না আমি 
নিশ্ছিদ্র, সম্পূর্ণ।
ঘুম আসে না: আমার চাদর 
ঝোড়ো হাওয়ায় নৌকার পাল,
ল্যাভেন্ডারের সুবাস বয়ে আনে।
আমার বালিশ 
সিন্ধুসারসের মতন পাড়ি দেয় আকাশে।
খাটের নীচে পুরানো জুতো,
দুটো সামুদ্রিক প্রাণী।

এই যে খুদে মানুষটা,
গায়ে একটা গোলাপের পাপড়ি পর্যন্ত নেই।
আমার দু হাত কেন উড়ে যায় 
তার চিনেমাটির বাটিতে অসতর্ক 
টোপা কুলদুটোর দিকে।
কী হতাশা 
এই নাগরকে দেখা সমাপ্ত হলে 
ধরায় আর কিছু দ্রষ্টব্য থাকবে না।
কোথায় পেলে তুমি ওই বৈঞ্চি ঝোপ ভুরু, 
আর বুকের দুটো তামাটে কানাকড়ি?
তোমার নরম চুলে হাত দিলে 
জীবনে ভেলভেট ছুঁতে চাইবো না আমি,
কোথায় কলসি-দড়ি, কোথায় চুম্বন,
তোমার ওষ্ঠবিহীন আমি নদীতীরে একা,
ঘুমন্ত মানুষ।
স্বপ্নে তোমায় ছাড়া 
সোনার থালায় রুটিও বিস্বাদ লাগে।


।।২।।

দ্বিতীয়ার চাঁদ

আমার দুই ঊরুর ফাঁকে।

তোমার জঘনে জ্বলে 
তেজি অশ্ব, সকালের সূর্য।

আমার স্বামী এক ঘুঘুপাখি
পাকা তালের মতন গোলগাল।

আমি তার অদূরে স্ত্রী 
ধনীর আবাসে ঘোরানো সিঁড়ির মতোই সম্ভ্রান্ত।

আমার জ্ঞানী মানুষটার শরীরে 
কুচকুচে কালো খরগোশ একটা।

আমার ভেতর শুয়ে থাকে দিগন্ত 
বক্রতা আর পাকা পেয়ারা সমেত।

তার শরীর আর আমার দেহ মিলে 
সন্ধি আর সম্পর্কের অক্ষ।

দুটি তোড়ায় একই কৃষ্ণচূড়া 
কালো কালির টানে।

দ্বিতীয়ার চাঁদ আমার 
দুই ঊরুর ফাঁকে।

তোমার জঘনে জ্বলে 
তেজি অশ্ব, সকালের সূর্য।

।।৩।।

স্বপ্নে তোমার লিঙ্গ 

নীল ডেইজি ফুলের মতন গড়াতে গড়াতে 
আমার পাতা অন্ধকার ফাঁদে এসে থামে।
শান্তি,
সঙ্গমের পর 
সিল্কের মৃদু ছোঁয়া।

[প্রকৃত নাম: আনা সোতো মারিন; নারীবাদী কবি, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা ও নাট্যব্যক্তিত্ব; নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে উপস্থাপন করেন প্রেম, যৌনতা ও নারীর সমতা; সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন: “My style of writing does not look for the objectivity, is scandalously subjective with eagerness to seduce the reader with games of words, rhythms, but, especially, with ideas.” কবিতাগুলির এসপানিওল থেকে ইংরেজি অনুবাদ শন টি গ্রিফিন এবং এমা সেপালবেদা-পালবিরেনতি।] 


দুনিয়া মিখাইল (ইরাক ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৬৫- )

ছবি আঁকা

নারীটি তার পুরুষের নাম দিয়েছিল “নদী”
নিজেকে সে বলতো “মাছ।”
একদিন সে তার প্রেমিককে ছবি এঁকে পাঠালো 
ডাঙায় উল্টে পড়ে থাকা একটা মাছের --
সঙ্গে একটা নদী: তার ওপরে ইংরেজি “এক্স” 
অক্ষরের কাটাকুটি।
বিরহে শুকিয়ে থাকা প্রেমিকের দুশ্চিন্তা বাড়লো,
এই ছবির মানে কী সে তার 
প্রেমিকার চোখে মৃত, অথবা 
প্রেমিকা ভাবছে 
তাকে সঙ্গে না পেলে তার 
বেঁচে থাকা বৃথা।

শিলালিপি (অংশ)


।।১।।

আমাদের প্রথম দেখা হওয়ার মুহূর্তকে
যদি ফোটোকপি করে রাখতে পারতাম 
তার ভেতর ভোরে দেওয়া যেতো 
আমাদের দিন আর রাতগুলি।


।।২।।

চাঁদ চলে যায় 
পৃথিবীর ওপারে 
আমার মনের মানুষের সন্ধানে।


।।৩।।

ঋতুর সঙ্গে রঙ বদলায়,
তুমিও আসো আর যাও।
তোমার বিদায়ের রং কী?



।।৪।।

বলেছিল সে, 
“তুমি রয়েছো আমার নয়নে।”
এখন সে ঘুমিয়ে পড়লে 
আমি আশ্রয় নিই তার চোখের পাতায়।


।।৫।।

লোকে বলে, প্রেম মানে 
সবগুলি ডিম 
একই ঝুড়িতে রাখা।
যদি ভেঙে যায় সবগুলো ডিম 
ঝুড়িটার কী হবে?

[কবির জন্ম ইরাকে। “বাগদাদ অবজার্ভার” সংবাদপত্রে সাংবাদিকতা করতেন। সাদ্দামের বিরোধিতা করার জন্যে সরকারি রোষে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। প্রথমে জর্ডন এবং পরে আমেরিকা। একই কবিতা তিনি ডানদিক থেকে বাঁদিকে লেখেন আরবি ভাষায়, আবার বাঁদিক থেকে ডানদিকে লেখেন ইংরেজি ভাষায়। সেগুলি অনুবাদ নয়, সেগুলি দুই ভাষায় লেখা মৌলিক কবিতা। বর্তমানে মিশিগান রাজ্যে আরবি সাহিত্যে অধ্যাপনা করেন;]

জশুয়া বেকম্যান (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ১৯৭১- )


[শুয়ে শুয়ে তোমার কথা ভাবি]

বিছানায় শুয়ে শুয়ে তোমার কথা ভাবি
তোমার কুৎসিত, জনমানবহীন, দমবন্ধ করা এপার্টমেন্ট
আর তোমার দুটো চোখ। দুপুর বারোটা এখন, এবং ক্লান্ত আমি
বাকি দিনটার জাগরুক সময়ের দিকে তাকিয়ে কিছুই
অনুভব করি না, বিস্ময় অথবা সমীহও নয়, কেবল
বস্তুকণা ও তরঙ্গের উপস্থিতি টের পাই, কেবল সেই
সীমিত আর সুচিন্তিত মানবিক পর্যবেক্ষণ। 
তোমার সরু সরু আঙুলগুলির মুখোমুখি,
গলতে থাকে আমার দৃঢ় সক্ষমতা। মেলে ধরো একান্তে
তোমার শ্বেতশুভ্র, পবিত্র শরীর আর অপ্রস্তুত 
মৌমাছির মতন ডানা কাঁপিয়ে উড়ে উড়ে 
আমাকে সন্তর্পণে গিয়ে বসতে অনুমতি দাও সেখানে।
এক লাবণ্য আর এক স্বাচ্ছন্দ্য। এক দৃশ্য আর এক
সহজ সৌন্দর্য। তোমার সম্মোহনের জালে আবদ্ধ।
পথ কোথায়? তোমার গভীরে ডুবে যাই আমি।
এইভাবে দুজনকে সঞ্চারিত হতে হয়, আমরা এখন
এক উদ্যানের অংশবিশেষ, এই দৃশ্যাবলীর শরিক, 
তার মানে, আমরা পৃথিবীর সেই অংশের বাসিন্দা,
যার কথা বিশ্বাস করে না কেউ।

[মার্কিন কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। আটটি কাব্যগ্রন্থ; ২০০৬ সালে “কবিতার বাস পরিক্রমা” চালু করেছিলেন। ৪০ ফুট লম্বা আর বায়ো-ডিজেলে চালানো বাসটি উত্তর আমেরিকার ও কানাডার ৫০ টি শহরে ঘুরে ঘুরে কবিতা পাঠের আসর চালু করেছিল প্রতিদিন একটি করে; কবিতাটি ২০০৬ সালে প্রকাশিত “ঝাঁকুনি” কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে|]

জুলাই ২০২০ [ক্রমশ:]
0

অনুবাদ সাহিত্য - সুলগ্না মুখোপাধ্যায়

Posted in



দেবদূত

বড়দিনের কেনাকাটার পর্ব শেষ করে আমি গাড়ি চালিয়ে গিয়ে পৌঁছলাম বৃদ্ধাবাসে। কাফেটারিয়ায় কয়েকটি পরিবার তাঁদের পরিবারের বয়োবৃদ্ধদের ঘিরে বসে ছিলেন। কয়েকজন বসার ঘরে বসেছিলেন, আর একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন খালি টেবিলের দিকে। একজন নার্সের গায়ে ছিল কার্ডবোর্ডের ডানা আর কপালে হলদে তারা। আমার মা-বাবা বসেছিলেন তাঁদের ঘরে। আমি বাবার সঙ্গে করমর্দন করলাম আর মায়ের গালে চুমু খেলাম।
ছোট্ট ক্রিসমাস-ট্রি-টা রাখলাম আমি টেবিলের ওপরে, আর ড্রয়ারের ওপরে রাখলাম লাল ওয়াইনের বোতলটা। দেবদূতটি ঘরের দরজায় টোকা মেরে ঢুকল, তারপর বাবার উরুতে একটা ইনজেকশন দিল। প্যান্টের বোতাম লাগিয়েই বাবা তক্ষুনি বড়দিনের সাজানোর জিনিসপত্র আনতে তাঁর ফেলে আসা শূন্য বাড়িতে যেতে চাইলেন। 
“শুধু বরফ আর আপেলগুলো”, কড়া সুরে মা বললেন। 
“আমরা জানি সেটা। ক্রিসমাস-ট্রি সাজানোর মালাগুলো আর বলগুলো তোমার কাজের ঘরের আলমারিতে আছে, তাই না?”
মা মাথা নাড়লেনঃ “এরা ফুল আনতে আমাদের বারণ করেছেন …”
“এই বৃদ্ধাবাসে মোমও বারণ। তোমার মতন সবাই এখানে সব জিনিস সামলাতে পারে না।”
বাবাকে আমি কোটটা পরতে সাহায্য করলাম।কাফেটারিয়া পার হয়ে যাওয়ার সময় পরিচিতদের উদ্দেশে আমরা সম্ভাষণ জানালাম। যখন আমি গাড়িটা আনতে গেলাম, বাবা দরজার কাছে নীচে দাঁড়িয়ে রইলেন। কাঁপা হাঁটু আর স্থির দৃষ্টি নিয়ে বাবা গাড়িতে উঠলেন। সন্ধ্যা নামার মুখে আমরা বেরিয়ে পড়লাম।
গাড়িতে করে যাওয়ার সময়ে এক রাতের একটি যাত্রার কথা আমার মনে পড়ল, মা-বাবা তখন বাড়িতেই থাকতেন। প্রায় মাঝরাতে মায়ের ফোন আসে। স্ট্রোক হওয়ার পর থেকে যেটুকু কথা তিনি বলতে পারতেন, তার সাহায্যে মা আমাকে বঝাতে চাইলেন যে অনেকক্ষণ ধরে বাবার নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। এই খবর শোনার পরে যে রাস্তা দিয়ে আমি গাড়ি চালিয়ে যাই, সেটা ছিল বরফে ঢাকা। বাবা বসার ঘরের টেবিলে বসেছিলেন। চেষ্টা করছিলেন একটা রুমাল দিয়ে নাকের রক্তটা বন্ধ করতে। শোয়ার ঘর, বাথরুম আর বসার ঘরে বাবার যাতায়াতের রাস্তাটা রক্তের দাগে ভর্তি। আমি সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্সকে ফোন করলাম, পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলাকে জাগালাম আর রক্তের দাগগুলো মুছে ফেললাম। আমি বাবাকে জুতো পরতে সাহায্য করলাম।পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলা এসে পড়লেন আর মায়ের দেখাশোনা করতে লাগলেন। গাড়ির স্তিয়ারিং-এ হাত রেখে আর প্যাডেলে পা রেখে আমি ওই পিছল রাস্তা দিয়ে কোনোরকমে গাড়িটাকে চালানোর চেষ্টা করলাম। একইসঙ্গে বাবার রক্তক্ষরণের দিকে নজরে রাখলাম। অনুমান করা সম্ভব ছিল না কতটা রক্তপাত হচ্ছিল। ইমার্জেন্সিতে তড়িঘড়ি ধকার সময় বাবা আমাকে সাবধান করলেনঃ “আমার শরীরের অবস্থা ভাল নয়।” বাস্তবটাকে বাবা খুব সহজেই মেনে নিতেন। আর সেটা সহজে সবাইকে বলতেও পারতেন। আমি বাবার হাতটা শক্ত করে ধরি। রেজিস্ট্রেশন করার সময় বাবার পা কাঁপছিল, আমি একটা চেয়ার টেনে বসতে দিলাম। দৃঢ় গলায় তিনি কম বয়সী মহিলাটিকে নাম, ঠিকানা, মেডিকেল ইন্স্যুরেন্সের সবকিছু বললেন। রক্ত বন্ধ করার জন্যে বাবার নাকে যে তুলো দেওয়া ছিল, এমার্জেন্সির মহিলা ডাক্তারটি সেটা সরিয়ে দিলেন। তার বদলে তিনি বাবাকে বললেন, চিবুকের কাছে একটা বাতি ধরতে, রক্তটাকে ধরার জন্য। বাবা মাথাটা পিছন দিকে ঝুঁকিয়ে দিলেন, আর ডাক্তারটি বাবার যেখান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সেখানে আলো ফেললেন। বাবার চোয়ালের হাড়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। বাবার চোখে ফুটে ওঠা শঙ্কা আমার মাথায় ঢুকে গেল। এক মুহূর্তের জন্য আমি মস্তিষ্কের ভেতরে রক্তক্ষরণের একটা ছবি দেখতে পেলাম। পরমুহূর্তেই আমি আমার দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম।
বাবা বাড়ির দরজা খুললেন। ক্রিসমাস-ট্রি সাজানোর মালা আর বলগুলো খুব সহজেই পেয়ে গেলাম আমরা। বৃদ্ধাবাসে ফেরার পথে আমি বাবাকে তাঁর শেষবার হাসপাতালে থাকার ব্যাপারে কিছু কথা জানতে চাইলাম। 
“ওটার কোনও দরকার ছিল না।” 
“দরকার ছিল না? এন্ডোস্কোপির রিপোর্ট কী বলছে?”
“একটা ছোট আলসার পাওয়া গেছে পেটে, আবার ঠিক হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িটা বিক্রি করতে হবে।”
“ঠিক হয়ে গেছে? কিন্তু তুমি…”
“আর্কিটেক্টরা এই বাড়ির মূল্যায়নের ব্যাপারে কবে জানাবে?”
“নতুন বছরে। মা কেমন আছেন?”
“ও তো প্রায়ই কাঁদে। ওর পক্ষে খুব অপমানজনক, হঠাৎ সঠিক কথা মনে করে বলা। আমিও অনেক সময়েই ওকে বুঝে উঠতে পারি না। ওর একদিকের এই পক্ষাঘাত চিকিৎসায় খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। রিহ্যাব স্ট্রোকের পরে ওকে যে কীভাবে সুস্থ করে তুলেছে, সেটা দেখার মতন বিষয়। আমরা দুজনে একসঙ্গে অসাধারণ সময় কাটিয়েছি, খুবি অসাধারণ। এখন আমরা কোনোরকমে মানিয়ে নিচ্ছি আজকের এই দিনগুলোর সঙ্গে।”
কাফেটারিয়াতে বসে থাকা বেশিরভাগ দলগুলোই চলে গিয়েছিল। বড়দিনের দেবদূতটি আমাদেরকে মা-বাবার ঘরে অভ্যর্থনা জানাল। টেবিলের ওপরে গেলাসগুলো রাখা ছিল। একটা দক্ষিণ ফ্রান্স-এর ওয়াইনের বোতল খুললাম আমি আর গেলাসে ঢাললাম। ছোট ক্রিসমাস-ট্রি-টা সাজাতে লাগলাম। পক্ষাঘাতে বেঁকে যাওয়া মুখে মা টেবিলের দিকে হাত দেখিয়ে বললেনঃ
“চিনিটা ওখানে আছে।” 
“তুমি কি ক্রিসমাস কুকিসগুলোর কথা বলছ?”
“হ্যাঁ, ঠিক। কিসের জন্য তোমাদের একটা সন্তান?”
আমি মায়ের গেলাসে আবার ওয়াইন ঢাললাম আর হাসলামঃ “না মা আর নয়। কিসের জন্য আমাদের আরও সন্তান দরকার? তোমার জন্য?”
“হ্যাঁ, ঠিক তাই।”
আরেকটা ক্রিসমাস কুকিসের প্যাকেট খুলে আমি তার গন্ধ শুঁকতে লাগলাম।
“গির্জায় বয়স্কদের প্রার্থণাসভা কেমন হলো?”
“খুব সুন্দর”, বাবা বললেন। কিছুক্ষণ আগে ওয়াইনে চুমুক দেওয়ার পড় থেকেই বাবা তাঁর দুই চোখ আধখোলা অবস্থায় রেখেছেন। “কিন্তু বাড়ির পিছনে আমরা রাখতে বাধ্য হয়েছি যে রাস্পবেরি ইয়াহেব(১) এখনাটনের(২) সঙ্গে হেজেল গাছ এমুনার(৩) বাচ্চা সন্ন্যাসীরা…”
“কী বিড়বিড় করছ তুমি? মার্টিন, তুই কি কিছু বুঝতে পারছিস?”
“আমার নাম উর্স, মা। মার্টিন তোমার ভাই- যাই হোক। বাবা, তোমার শরীর ভাল লাগছে না? আমিও তো তোমার কথা বুঝতে পারছি না।” বাবার চোখের দৃষ্টিতে ভ্রান্তি-, “না? আমি ভাবছিলাম পুরো ব্যাপারটা আর রাস্পবেরি- মরুভূমি, ব্যাবিলনের পিছনে সেই তেরছা পুলটা সিঁড়ির কাছে ঈশ্বর মধু পাথর বেদি জানালা, বুঝতে পারছ না তুমি?” 
বাবার গলার আওয়াজে এই পীড়াদায়ক দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটল। “এইবার তুমি বুঝলে মাঝে মাঝে আমার কি অবস্থা হয়, মা!” মুচকি হেসে বাবা মায়ের কপালে চুমু খেলেন। মা-ও হাসলেন, তারপর আমরা সবাই হাস্তে লাগলাম। অপূর্ব লাল ওয়াইনের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই উর্স”, বাবা আমার গেলাসের সঙ্গে নিজের গেলাসটা ঠেকালেন।
“এই অপূর্ব লাল ওয়াইনের জন্য তোমাকে ধন্যবাদ জানাই, উর্স”, বাবা আমার গেলাসে সঙ্গে নিজের গেলাসটা ঠেকালেন।
“এখন আমি তোমাকে আবার ঠিকঠাক বুঝতে পারছি, বাবা। কী হয়েছিল…?”
“তুমি মনে করো, তোমাদের ঠিকঠাক চলবে, তুমি, এলসাবেট আর ছোট্ট ডিটার-এর, যখন একদিন আমরা আর থাকব না, উর্স?”, মা হটাৎ স্পষ্টভাবে জিজ্ঞেস করলেন। আমি দারুচিনির গন্ধলাগা তারার মতন দেখতে একটা কুকি তুলে নিলাম। “সেটা এখনও অনেক দেরি আছে, মা। তবে আমাদের ঠিক চলে যাবে।”
দেবদূতটি ঘরে ঢুকল। সে আমাদের জিজ্ঞেস করল, আমরা কফি খেতে চাই কিনা।

_____________
নীচে দ্রস্তব্যঃ 
(১) ইয়াহেবঃ ওল্ড টেস্টামেন্ট অনুযায়ী ঈশ্বরের একটি নাম, যেটা হিব্রু ব্যঞ্জনবর্ণ YHVH থেকে অনুদিত। যাভে, জিহভা, JHVH, ইয়াভে, ইত্যাদি।
(২)এখনাটনঃ আখনাতন, আখেনাতন, ইখনাতন বা এখনাটন ছিলেন মিশরের অষ্টাদশ রাজবংশের ফারাও, যিনি সতেরো বছর রাজ্য শাসন করেছিলেন এবং ১৩৩৬ বা ১৩৩৪ খ্রিষ্টপূর্বে মারা যান। তাঁর নামের অর্থ, ‘আতেন-এর প্রভাবশালী আত্মা’।
(৩) এমুনাঃ এটি একটি হিব্রু শব্দ, যার অর্থ হল ‘বিশ্বাস’। 

অনুবাদঃ সুলগ্না মুখোপাধ্যায় 
মুল গল্পঃ Der Engel