0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়



এব স্য সোমঃ পবতে সহস্রজিদ্ -
হিন্বানো বাচম্ ইষিরাম্ উষর্বুধম্। (ঋক ।৯।৮৪।৪৮) 

অনন্তজয় এই তো সে সোম চলছে বয়ে 
ছুটিয়ে দিয়ে তীরের মতো উষায় জাগা বাক্। (অনু.গৌরী ধর্মপাল) 

আঁধার পেরিয়ে সেই অতিথি যখন প্রাণের দ্বারে আসেন, তখনই জাগে নবজন্মের অরুণ আলোয় রাঙা ভোর। এই ভোরকেই বেদের ঋষি বলেন উষা। এই উষায় আবির্ভূত হন তমোনাশ বৈশ্বানর, চোখ মেলেন সূর্য আর চেতন পান বাক্ : সর্বদেবময়ী বাক্। এই বাক্ -এরই বন্দনা করল ঋতবাক ৩ আষাঢ়, ১৪২৪, (১৮জুন, ২০১৭) শোভাবাজার রাজবাড়িতে গোপীনাথের নাটমন্দিরে। বর্ষা বন্দনা আর বাক্ আরাধনা এক হলো বই উৎসবের মধ্য দিয়ে।

সেতারে বাজল ভীমপলাশ, কবি কালিদাসের মেঘদূতম্ কায়া ধারণ করল সুরে, নাচের তালে আর মন্দ্র পাঠে। ঋতবাক প্রকাশ করল পাঁচটি বই। এবারের 'বইয়ের খবর'- এ তাদের কথাই বিস্তারিত বলা রইল।

আশানিকেতনের কথা তো আগেই জানিয়েছি আপনাদের। এফ -এম - আর (Fellowship with Mentally Retarded)-এর অধীনে আশানিকেতনের কলকাতা শাখার জন্ম হয় ৯জুন, ১৯৭৩। এবছর ঐ শাখার চুয়াল্লিশতম জন্মদিনে আমাদের নেমন্তন্ন ছিল ওখানে। আরও কিছুকাল বাঁচার আনন্দে বেঁচে থাকা কাকে বলে; কাকে বলে জীবনউৎসব উদযাপন তা ওদের কাছ থেকে শিখে এলাম। ওরা ওদের আশানিকেতনের জন্মদিনে প্রাণভরে আনন্দ করল। অনুষ্ঠানের শুরুতে যখন রাখীদি 'হ্যাপি বার্থডে টু আশানিকেতন' - গাইছেন আর ওরা গলা মেলাচ্ছে আমরা সবকটা মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। কী জ্বলজ্বলে! তাকানো মাত্র প্রত্যেকে হেসে হাত নাড়ছিল। যেন কতকালের চেনা। এগিয়ে এসে ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছিল। আমরা খেলাম, গাইলাম, নাচলাম ওদের সঙ্গে। নেচে নেচে ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়তেই চোখ পড়ল সামনের হুইলচেয়ারে বসা বুলানিদার দিকে। ঊনসত্তর বছর বয়স, ডাউনস্ সিন্ড্রোমে আক্রান্ত, মুখ হাঁ, জিভ বাইরে ঝুলছে। কিন্তু দুটো হাত ঊর্ধ্বে তোলা। দশটা আঙুল কাকে যেন হাতছানি দিচ্ছেন। নাচছেন বুলানিদা'। বাঁচার আনন্দে। একা। জীবনের কি অফুরান প্রকাশ!

অথচ দেখুন, এই ক'দিন আগেই 'খবরে প্রকাশ' -এক পঞ্চাশ বছরের প্রৌঢ়ের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার করা হয়েছে; নাম তাঁর অদ্রীশ বিশ্বাস। অদ্রীশদা, তুমি স্রেফ একজন প্রৌঢ় হয়ে গেলে? তোমার মেধা, বিদ্যাবত্তা, তোমার লেখা কিছুরই কথা মনে করালো না মিডিয়া দেবতা? বুধমণ্ডলীতে এক অতি পরিচিত নামকে হঠাৎ করে বেনামী লাশ হতে দেখলে গা শির শির করে। 

দীর্ণ হই। তবুও আশা ছাড়ি না। 

সকলে ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভকামনা নিরন্তর।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - চয়ন

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


যাপনকথা
চয়ন 


বড় অস্থির সময়। চারিদিকে উচ্চরব। ধর্মঘোষ। ধনতন্ত্রের নির্ঘোষ : এস বিচ্ছিন্ন হও। কারণ, তুমি পৃথক। তুমি কেবল নিজের কাছেই বলি প্রদত্ত। ইংরিজি বলা ক্রিয়াযোগী গীতার নব ব্যাখ্যা দিয়ে বলছেন : সব্যসাচিন্ নিমিত্ত মাত্র তুমি তবে নিষ্কাম কর্ম বলে কিছু নেই। তুমি শত্রু হনন করে সাম্রাজ্যবিস্তারের ব্রতে নিয়োজিত। ঠিক এই সময়ে আমার যাজ্ঞবল্ক্যকে খুব মনে পড়ে। সেই কোনকালে তিনি বুঝেছিলেন ক্ষুদ্র ব্যক্তিসত্তাকে বৃহৎ এক সমষ্টি সত্তার অংশ হিসেবে না জানলে জীবনের প্রকৃত রূপ অনুধাবন সম্ভব নয়। এই জানাটা খুব জরুরি। কারণ, বিচ্ছিন্ন এককের বোধ মিথ্যে না হলেও অসম্পূর্ণ। একক ব্যক্তি ভাবে সে না থাকলে কিছুই নেই। ভেতরে ভেতরে সে মৃত্যুর চরম আর্তিতে ক্লিষ্ট। এই আত্মদীর্ণ মানসিকতাকেই এক নকল একীভবনের প্রলোভন দেখিয়ে বিচ্ছিন্নতাকামীরা অতি সহজে ব্যবহার করতে পারে। তাই তার জানা দরকার যে সে ব্রহ্ম বা এক বৃহৎ অস্তিত্বের অংশ। আত্মন্ জেনে নিক আত্মা অক্ষয়, অমর। কারণ, সমগ্র জনগোষ্ঠীর যা কিছু প্রেয়, যা কিছু শুভ, যা কিছু আনন্দময় তাই হলো আত্মা। অ মৃত সে। তাই সে অমৃত। এই অমর্তের সন্তান হিসেবে নিজেকে জানলে আপনা থেকেই জানা হয়ে যায় যে বাকী মানুষজনও তাইই। আর তাই, হিংসা তার দ্বারা অসম্ভব। আত্মার জ্যোতির উদ্ভাস হলো এই জ্ঞান। নিজেকে জানা। যাজ্ঞবল্ক্য বলেন যে আত্মার জ্যোতিকে চেনার আগে আরেক জ্যোতিকে দেখতে হয়। বস্তত এই উদ্ভাসকে না চিনলে আত্মদীপ হওয়া সম্ভব নয়। সূর্য চন্দ্র অগ্নি নিভে গেলেও এই জ্যোতি জাগরূক থাকে। এই জ্যোতি বাক্ এর। বাগেবস্য জ্যোতির্ভবতীতি। এই বাক্ আরাধনাতেই সত্য জ্ঞানের সাধনা।


টালমাটাল সময়েও ঋতের পথ ছাড়েনি ঋতবাক। ঋত সত্য, ঋত নীতি, ঋত বিশ্বসৃষ্টির অলঙ্ঘ্য নিয়ম। ছাড়েনি কারণ ছাড়তে পারেনি। ঋত ও বাক্-কে নিয়ে তার যাপন আর উদযাপন দুইই। ঋতবাকের সাধনা আলাদা হওয়ার নয়। হাত ধরার। নিজেকে বঙ্গভাষী এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর অংশ হিসেবে জানে বলেই ঋতবাক নেমন্তন্ন পায় জগতের আনন্দযজ্ঞে। সেখানে গোঁসাই উল্লিখিত হাত সাফাইয়ের হাত বা চোর, সাধু, ডাকাতকে দেখে না সে। দেখে সমমনস্ক, সহৃদয়, সমানুভূতিসম্পন্ন বহু আত্মজনকে। তাঁরা ঋতব্রতী। তাঁরা আত্মসুখের তোয়াক্কা না করে ভূমার আনন্দে তৃপ্ত। বাঙালি আত্মঘাতী? বাঙালি বাজার নিয়ন্ত্রিত? বাঙালি আমোদগেঁড়ে? হালকা মজায় মজে থাকা মধ্যমেধার কদরদান? সত্য। তবে শেষ সত্য নয়। প্রতি বয়ানেরই প্রতিবয়ান থাকে। থাকে বলেই ৩ আষাঢ়, ১৪২৪ সন বা ২০১৭ সালের ১৮ জুন ঋতবাকের বই উৎসবে শোভাবাজার রাজবাড়ির গোপীনাথ মন্দিরে জড় হন দুশ-এর ওপর মানুষ। তাঁরা সেতারে এক ঘন্টা ভীমপলাশী শোনেন তন্ময় হয়ে; তাঁরা বিভিন্ন রাগে গাওয়া মেঘদূতের শ্লোকের সঙ্গে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় নৃত্য দেখে পুলকিত হন। সেদিন আবার ভারত - পাকিস্তানের ক্রিকেট যুদ্ধ। খেলার রাজনীতিকরণ আর ধর্মীভবন ঘটিয়ে আস্তিন গুটিয়ে উচ্চনাদে দেশপ্রেম ঘোষণার দিন। তবু, তার মধ্যেও যাঁরা এলেন, শুদ্ধ রসের স্বাদ গ্রহণ করলেন, হাতে তুলে নিলেন ঋতবাক নির্মিত পাঁচটি বই যার একটিও বাজারের দাবি মেনে পাবলিককে 'খাওয়ানো'র জন্য নির্মিত হয়নি, তাঁরা আমার চোখে আগ্রাসী পুঁজিবাদের রচা সাংস্কৃতিক বয়ানকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন একটা। 'ভেবেছ কি উদ্ধতের হবে না শাসন?/ জাগেনি কি সুপ্ত হুতাশন?/ বিদ্রোহের বাজেনি সানাই?/শব্দ আছে প্রতিশব্দ নাই?' ধর্ম জনতার আফিম। আবার, সেই তার piece of resistance। সেকারণেই, শোভাবাজার রাজপরিবারের গোপীনাথ সেই মুহূর্তে এক শৈল্পিক প্রতিরোধের রূপক হয়ে উঠলেন। এই মন্দিরে কোনও ধর্মীয় ভেদরেখার শাসন মানা হয় না বহুদিনই। তাই, সেই মানবমিলনক্ষেত্রে সমবেত জ্ঞানীগুণীজন বিগ্রহের মধ্যে প্রত্যক্ষ করলেন ভাস্কর্যের সুষমা, তাজমহলের রূপকার ওস্তাদ ইশার বংশজ ইশা মুশা খাঁর নকশা থেকে গড়ে ওঠা নাটমন্দিরের স্থাপত্যের মধ্যে সন্ধান করলেন ইন্দো -ইসলামিক প্রভাবের। আমি দেখলাম প্রাণ আছে -- এখনও প্রাণ আছে।


পূর্বের ঋষিরা ছিলেন ঋতবান। বাণীর আত্মাকে তাঁরা জেনেছিলেন আপন সত্তা বলে। ভাষা- যাপনকে দেহ -মন দিয়ে অনুভব করে তাঁরা বুঝেছিলেন ওঙ্কার আত্মৈব। আত্মনই বাক্। আজকালকার ভাষায় বলতে গেলে ভাষা দিয়ে গড়া আমার Self-hood। কথায় কথায় গড়া যাপন। যাপনকথাই আত্মকথা। আঁত ও কথা যখন এক হয় তখনই আলো ফোটে। চারপাশে যদি তখন ঘন অন্ধকারও থাকে তবুও আমরা বলতে পারি ক্রমে আলো আসিতেছে। ঋতবাকের আখরযাপন উৎসবে দাঁড়িয়ে আমি দেখে এলাম এক শাশ্বতী মহা উষার উদ্ভাস। বাইরে তখন রাত নেমেছে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


প্যারীচাঁদ মিত্র, উপন্যাসকার
রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য



রায়সাহেব হারাণচন্দ্র রক্ষিত (১৮৬৪-১৯২৬)-এর নাম বললে এখন বোধহয় কেউ চিনবেন না। এককালে কর্ণধার আর বঙ্গবাসী-মতো পত্রিকার ইনি সম্পাদক ছিলেন। ঔপন্যাসিক, জীবনীকার ও শেক্সপিয়র- অনুবাদক বলে তাঁর নাম ছিল। ভিক্টোরিয়া-যুগে বাঙ্গালা-সাহিত্য নামে একটি বই তিনি লিখেছিলেন (১৩১৮ব.)। তার ‘পূর্ব্বভাগ’ শুরু হয়েছে চণ্ডিদাস (হুবহু) দিয়ে, তারপর কয়েক শতক পেরিয়ে এসে পৌঁছেছে উনিশ শতকে। সেখানেই আলালের ঘরের দুলাল তথা প্যারিচাঁদ (হুবহু) নিয়ে অল্পকিছু আলোচনা আছে। বাঙলা গদ্য রচনায় প্যারীচাঁদ কীসে বিশিষ্ট সে নিয়ে কিছু মন্তব্যও পাওয়া যায়। কিন্তু উপন্যাস হিসেবে আলাল-এর দোষগুণ নিয়ে হারাণবাবু নীরব। ঔপন্যাসিক বলতে তিনি বোঝেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে, আর একমাত্র বঙ্কিমকেই। দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬৫)-র আগে বেরুনো কোনো রচনার যে বিশিষ্ট দাবি বা মর্যাদা থাকতে পারে – এমনটি তাঁর মনে হয় না।

এই ধারণা শুধু হারাণবাবুর একার নয়। বাঙলা সাহিত্যের বহু ইতিহাসকার ও সমালোচক আলাল-কে উপন্যাসের সম্মান দিতে কেমন যেন কুন্ঠিত। যেমন, সুকুমার সেন লিখেছেনঃ

যদিচ কাহিনীর ধারাবাহিকতা উপন্যাসের মতোই তবু কয়েকটি কারণে বইটিকে রীতিমত উপন্যাস বলা চলে না। প্রথমত, প্লট খাপছাড়া রকমের। দ্বিতীয়ত, মূল কাহিনী প্রায়ই অবান্তর ঘটনায় আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। তৃতীয়ত, অধিকাংশ ভূমিকাই অপরিণত, অস্ফুট অথবা ক্ষণদৃশ্য। চতুর্থত, নারী-ভূমিকাগুলি অত্যন্ত অবহেলিত। পঞ্চমত, রীতিমত উপন্যাসে অপেক্ষিত প্রণয়রসের স্পর্শমাত্র নাই।২

এরপর, যেন খানিক করুণা করে সুকুমার সেন বলেছেনঃ ‘সুতরাং আলালের-ঘরের-দুলালকে কতকটা ডিকেন্সের “পিকউইক পেপারস” (১৮৩৬-৩৭)-এর মতো চিত্রোপন্যাস বলা যাইতে পারে।’

একেবারে গোড়া ধরে টান। আলাল যে উপন্যাস নয় – তা বোঝানোর জন্যে পরপর পাঁচটি গোলা দাগা। ‘চিত্রোপন্যাস’ বলতে সুকুমারবাবু বোধহয় পিকারেস্ক্ নভেল বোঝাতে চেয়েছেন। কিন্তু পিকউইক পেপার্স্ আদৌ সে-জাতের উপন্যাস নয়। পিকারেস্ক্ উপন্যাসের নায়ক হয় অশিষ্ট, অসৎ কিন্তু পাঠকদের কাছে আবেদন আছে এমন কোনো চরিত্র । তেমন অসৎ ও শঠ চরিত্র ডিকেন্স –এর উপন্যাসটিতে আছে, ঠিকই। তবে উপন্যাসের নায়ক সে নয়। উপন্যাসের নায়ক আগাপাশতলা ভালোমানুষটি, মিস্টার পিকউইক। পিকারেস্ক্ শব্দটি এসেছে স্পেনীয় পিকারো থেকে, যার মানে বদমাশ।৩

কিন্তু তার চেয়েও বড় কথাঃ ‘রীতিমত উপন্যাস’ বলতে ঠিক কী বোঝায়? অভিধানে, সাহিত্য বিষয়ক পরিভাষাকোষে নভেল-এর নানান সংজ্ঞার্থ দেওয়া থাকে। সব দিক দিয়ে সেগুলি মেলে না। কোন্ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হচ্ছে সবটাই নির্ভর করে তার ওপর। কোনটা বড় গল্প আর কোনটা উপন্যাস, আর কোনটা (বাজারি পত্রিকার বিজ্ঞাপনী বয়ানে) ‘উপন্যাসোপম বড় গল্প’ – এসব বিষয়ে সর্বসম্মত কোনো মত নেই, নিকট ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না।

মার্কসবাদীরা এ বিষয়ে আরলন্ড কেটল (১৯১৬-৮৬)-এর সংজ্ঞার্থ ধরেই চলেন। তাঁর সংজ্ঞার্থ এইঃ ‘উপন্যাস – একটি বাস্তববাদী গদ্য-কল্পপথা (prose-fiction), স্বয়ংসম্পূর্ণ ও কিঞ্চিৎ দীর্ঘ।’৪ রোমান্স মানে অ-বাস্তাববাদী রচনা, উপন্যাসকে বাস্তববাদী হতেই হয়।৫

এই সংজ্ঞার্থ ও বিচার সকলের না-ও পছন্দ হতে পারে। কিন্তু গদ্য-কল্পকথার ইতিহাস থেকে এই সত্যই বেরিয়ে আসে। ঐতিহাসিক রোমান্স আর ঐতিহাসিক উপন্যাস-এই দু ধরণের রচনাতেই সিদ্ধহস্ত ছিলেন ওয়ালটার স্কট (১৭৭১-১৮৩২)। ডক্টর স্যামুয়েল জনসন (১৭০৯-৮৪)-র অভিধান-এ রোমান্স আর নভেল-কে একটি কল্পকথামূলক কাহিনী (fictitious narrative), রোমান্স থেকে আলাদা, কারণ মানবিক ঘটনাবলির সাধারণ ধারা ও সমাজের বর্তমান অবস্থার সঙ্গে (এর) ঘটনাবলি যুক্ত।৬

কেটল্-এর সংজ্ঞার্থটি তাহলে স্কট-এর সঙ্গেই মেলে। আখেরে ব্যাপারটি অ-বাস্তববাদ (রোমানস) বনাম বাস্তববাদ (নভেল)। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে আলাল-কে উপন্যাস না বলার কোনো হেতু নেই। সচেতনভাবে, পশ্চিমী ধারার নভেল-এর আদলে আলাল লিখেছিলেন প্যারীচাঁদ। দেশজ ধারা (সংস্কৃত বা বাঙলা) –য় যেসব গল্প, আখ্যান, বৃত্তান্ত ইত্যাদি চালু ছিল সেগুলি থেকে প্যারীচাঁদের কিছুই পাওয়ার ছিল না। এই হলো সহজ সত্যি কথা।

আগেই দেখেছি, আলাল প্রসঙ্গে সুকুমার সেনের মনে পড়েছিল ডিকেনস-এর পিকউইক পেপারস। সবদিক দিয়েই সেটি অবান্তর। বরং ১৮৩১-এ লেখা ভিকতর উগো (১৮০২-৮৫)- পারী- নোতর দাম (ইংরেজি অনুবাদে দ হান্চব্যাক অফ নোতর দাম, নোতর দাম গির্জার কুঁজো)-এর কথা ভাবলে সুবিধে হতো। উপন্যাসের গড়ন ও রচনার বিশিষ্টতায় উগো-র বইটির সঙ্গেই আলাল-র মিল।

এর জন্য প্যারীচাঁদকে নিছক অনুকারক, বা আরও এক পা এগিয়ে, চোর- উঁচু রীতির ভাষায়, কুম্ভীলক –বলে মার্কা মারা অনুচিত। ইওরোপীয় সাহিত্যের সংস্পর্শে এসেই প্যারীচাঁদের নভেল লেখার ইচ্ছে হয়। শখ নয়, ইচ্ছে। তিনি নীতিমূলক একটি উপন্যাস লিখবেন বলে ঠিক করেন। উগো-র বইটির বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্যারীচাঁদের উপন্যাসের কোনো যোগ নেই; একটি চরিত্রও উগো-র উপন্যাস থেকে তিনি নেন নি। গল্প বলার ফাঁকে ফাঁকে খানিক ঐতিহাসিক তথ্য (যেমন, পারী শহরের ইতিহাস, আইনি ব্যবস্থা) পরিবেশন আর নীতিবাক্য – প্যারীচাঁদ এগুলি নিজের মতো করেই জোগান দিয়েছেন।

উগো, আর হয়তো স্কট, থেকে তিনি পেয়েছিলেন উপন্যাসের রূপ সম্পর্কে ধারণা। তাঁদের রচনার সঙ্গে প্যারীচাঁদের উপন্যাসের আকারগত মিল নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সেগুলো অন্তর্গত যোগ (ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি)এর ব্যাপার। প্যারীচাঁদের মৌলিকতা তাতে ক্ষুণ্ণ হয় না।



টীকা

১. বইটির একটি ইংরিজি নামপত্রও ছিলঃ

The/History & Gradual Development/of Bengali Literature/In the Victorian Era. মজিলপুর (দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা) ‘কর্ণধার কুটীর হইতে গ্রন্থকার কর্তৃক প্রকাশিত’ এই বইটি ছাপা হয়েছিল হেয়ার প্রেস, ১৬ বেচু চ্যাটার্জী ষ্ট্রীট কলকাতা থেকে। পৃষ্ঠাসংখ্যা (চোদ্দ) + ১৫ – ৩৫৬। পূর্বভাগ ১৫-১৭১, উত্তরভাগ ১৭২-৩৫৬। বইটিতে ‘রাজরাজেশ্বরী বৃটন-লক্ষ্মী, স্বর্গীয়া ভিক্টোরিয়া’র একটি ছবিও আছে।

২. সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, খণ্ড ২, ইস্টার্ন পাবলিশার্স, ১৯৭৭ (ষষ্ঠ সং.) পৃ.১৮৯।

৩. David Herman and others (eds.), Routledge Encyclopedia of Nattative Theory, London and New York: Routledge, 2008, pp 430-31 দ্র.। আরও সংক্ষেপে জানার জন্য Concise Oxford English Dictionary, 2011 দ্র.।

৪. Arnold Kettle, An Introduction to the English Novel, Vol. 1, London Arrow Books, 1962, p. 29.

৫. ঐ, পৃ. ২৯-৪২-তে বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা আছে। রোমানস-এর লক্ষণ হিসেবে অ-বাস্তববাদ ছাড়াও কেটল বলেছেন পলায়নবাদ ও ইচ্ছাময় ভাবনা-র কথা (পৃ. – ২৯)। হেরমান প্রমুখ সম্পা., বিশ্বকোষ (টী.-ত)-এ অবশ্য মিখাইল বাখতিন প্রমুখ আধুনিকোত্তর ভাবুকদের কথাই আছে (পৃ. ৩৯৮-৪০৪)। কেটল তো বটেই, স্কট-এরও নাম নেই। পরের টীকা দ্র.।

৬. Sir Walter Scott, An Essay on Romance [first published in the Supplement to Encyclopedia Britannica 1824] in: The Prose Works of Sir Walter Scott, Bart., Vol 6, Edinburgh, 1834, pp. 129-30. Available on the net.


কৃতজ্ঞতাস্বীকারঃ দেবপ্রিয় পাল, সিদ্ধার্থ দত্ত।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সৌমিত্র বসু

Posted in


প্রবন্ধ




কবি বনাম আবৃত্তিকার
সৌমিত্র বসু



The art of the actor is made up of speech and bodily movement... as in music, the correct, precise, and pure striking of each single tone is the foundation of all further artistic execution, so in the art of the actor the clean and perfect pronunciation of each word is the basis of all higher recitation and declamation... By recitation is understood a delivery which... lies midway between cold, quiet speech and highly excited speech. The auditor must feel that.... the speech is objective. (The Purpose of Playing: Modern Acting Theories in Perspective By Robert Gordon)

গর্ডনের গ্রন্থে উদ্ধৃত গয়টের বিখ্যাত মন্তব্য দিয়ে শুরু করতে চাইছি রচনা, তার অন্যতম কারণ হল, আবৃত্তি সংগীত আর অভিনয়ের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে এটি একটি দিকনির্দেশক বাণী বলে আমার মনে হয়। যাঁরা আবৃত্তি শিল্পের সঙ্গে মনে প্রাণে জড়িয়ে আছেন তাঁরা কতটা মানবেন আমি জানি না, আমার মনে হয় আবৃত্তি বেচারি শিল্প হিসেবে নিতান্তই দুর্ভাগা। নিশ্চয় এমন বেশ কিছু মানুষ আছেন যাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে এর চর্চা করে থাকেন, কিন্তু তার বাইরে একটি বড় অংশের ধারনা, আবৃত্তি করতে গেলে শেখবার তেমন কোনও দরকার হয় না, কবিতা (বা গদ্য) মোটামুটি উচ্চারণে মানে বুঝে পড়ে গেলেই চলে। আমি কোন কোন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী সান্ত্রিদের কবিতা পাঠ করতেও দেখেছি, অভিনয় বা গানে তাঁরা এতটাই সাহসী হবেন বলে মনে হয় না। বলে রাখা দরকার, একটা অনুষ্ঠানে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য আবৃত্তি করে বেশ চমকে দিয়েছিলেন, আবার বর্তমান শিক্ষামন্ত্রীর আবৃত্তি একেবারেই দাঁড়ায়নি। তার বাইরেও, এই শিল্পের প্রথম ধাপ যাঁরা তৈরি করেন, সেই কবিরা সাধারণত একে একেবারেই পছন্দ করেন না। তাঁদের মতে, আমি লিখেছি লিখেছি, অন্য একজন আবার সেটা ইনিয়ে বিনিয়ে পড়বে, আর সেটা আমায় সহ্য করে যেতে হবে – এ মেনে নেওয়া যায় না। এটা আপাতদৃষ্টিতে একটু অদ্ভুত বলে মনে হয়। যাদের বলতে পারি পরনির্ভর শিল্প, অর্থাৎ অন্য কোন শিল্পের ওপর ভর করে যারা দাঁড়িয়ে থাকে, যেমন ধরা যাক বাক্য নির্ভর গান বা নাটক – সেখানে মূল শিল্পটি যিনি তৈরি করেছেন, অর্থাৎ সাহিত্যিক, তিনি যে সব সময় তার সংগীতরূপ বা নাটকরূপ পছন্দ করছেন এমনটা নয়, কিন্তু প্রায় কখনই তিনি এমন অভিমান নিয়ে বসে থাকছেন না যে ওই শিল্পের নাক গলানো আমার দরকার নেই, আমি যা লিখেছি ছাপা রূপে তা যে ভাবে আছে তাই আমার কাছে যথেষ্ট। নাটকের চূড়ান্ত মোক্ষ হল অভিনয়ের মঞ্চ, গানের চূড়ান্ত লক্ষ্য সুর সহযোগে তার উপস্থাপনায় – এ কথাকে স্বতঃসিদ্ধ বলে ধরে নেওয়া হয়, কিন্তু কবিতা তার পূর্ণতা পায় আবৃত্তির মধ্যে, এমন মত চালু আছে বলে শুনিনি কখনো।

কবিরা মনে রাখেন কিনা জানি না, সাহিত্যের ইতিহাসের অনেকখানি অংশ কিন্তু উপস্থাপনার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। সেলিম আল দীন যেমন বলেছিলেন, ছাপাখানা আবিষ্কৃত হবার আগে পর্যন্ত যে কোন সাহিত্যই ছিল নাটক, উপস্থাপনার মধ্যে দিয়েই তারা উপভোক্তার সঙ্গে সংযোগ তৈরি করত। যদি বাংলা সাহিত্যের কথা ভাবি, সেই প্রাচীন থেকে প্রাক আধুনিক যুগে অবশ্য নাট্য, গান আর আবৃত্তির মধ্যে ফারাক খুব স্পষ্ট ছিল না। পাঁচালী যে ভাবে পড়া হয়, তাকে গান বলব না আবৃত্তি বলব? যদি আবৃত্তি হিসেবে ধরি, তাহলে তো বলা যায়, চর্যাপদ থেকে ভারতচন্দ্র সকলের লেখা মূলত আবৃত্তিই করা হত, পুথি নামক লিখিত আকার থাকত আর কটি? সাহিত্য বলুন সাহিত্য, কাব্য বলুন কাব্য – এদের ধরনের একটা বদল এল ছাপাখানা আসার পরে। কবি যা লিখেছেন, ছাপার হরফে হুবহু তা চলে যাচ্ছে পাঠকের কাছে, মধ্যবর্তী কারুর দরকার হচ্ছে না সেখানে। সেই সূত্রে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। উপস্থাপনানির্ভর শিল্পে যা হয়ে থাকে, উপস্থাপকের স্মৃতিভ্রংশতার কারণেই হোক, আর তাঁর সচেতন বিবেচনার জন্যেই হোক, মূল রচনাটা খানিক খানিক বদলে যেতে পারে, যায়ও, ছাপার হরফ তাকে একটা স্থায়িত্ব দিল। যে সাহিত্য বা কাব্য যত জনপ্রিয় তার বিকৃতি তত বেশি হয়েছে। যেমন ধরুন, কৃত্তিবাসী রামায়ণের ভাষা আদিতে কী ছিল তা জানবার কোনও উপায় আজ আর নেই, কথকদের মুখে মুখে এতটাই বদলে গেছে সে। সবচেয়ে বড় কথা, যা ছিল এতকাল শ্রোতার উপভোগের জন্যে, বাচিক শিল্পীর মারফৎ যা পৌঁছোত সেই শ্রোতার কাছে, বাচিক শিল্পীর দৃষ্টিভঙ্গি, লেখাটি বিষয়ে তাঁর ব্যাখ্যা রূপ পেত উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে, তা অদৃশ্য হয়ে রচনাটি এখন পাঠকের উপভোগের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। 

কবিতা সেই শর্তে পাল্টে ফেলল নিজেকে। নানা সামাজিক রাষ্ট্রীক এবং অবশ্যই মানসিক কারণে অনেক মানুষের সামূহিক উপভোগের শিল্প থেকে সে হয়ে উঠতে চাইল একক মানুষের নিভৃত পাঠের সামগ্রী, তার মধ্যেও চলে এল গভীর নির্জনতা, ভীড়ে যার সংবেদন নষ্ট হয়। এই পর্বান্তরের দীর্ঘ ইতিহাস আছে, আবার হা আমলের কবিতাও সব সময়েই সেই গভীর নির্জনতাকে নিয়ে চলেছে এ কথা বললে ভুল হবে, কিন্তু বাংলা কবিতার অন্যতম জোরালো বৈশিষ্ট্য হয়ে এলো এই ধরন, বর্ণনার থেকে যে নিজেকে সরিয়ে আনতে চায় প্রতিক্রিয়ার দিকে, যার সঙ্গে আলোছায়ার মত মিশে আসে নানা ধরনের বিমূর্ততা। কবি মানুষেরা এ ব্যাপারে একটু অভিমানীও হয়ে পড়লেন, বিরল ব্যতিক্রম ছাড়া যে কোনো নাটককার যেমন নাটক লেখার সময় থেকেই অপেক্ষা করে থাকেন সে নাটকের মঞ্চায়নের জন্যে, কবিরা অনেকেই তেমন করে উপস্থাপনার মধ্যে দিয়ে তাঁর লেখাটি পৌঁছাক তা চাইলেন না। আর এই থেকেই জন্ম নিল কবিদের সঙ্গে আবৃত্তিকারদের বিরোধ।

এই সূত্রে আরও দু একটা কথা মনে রাখা চাই। রবীন্দ্র পরবর্তী বাংলা কবিতা যখন তার নতুন পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে, সেই সময় আবৃত্তির জগতে খ্যাতিমানদের মধ্যে আছেন শম্ভু মিত্র বা কাজী সব্যসাচীর মত মানুষেরা, যাঁরা খানিকটা নাটকীয় করে কবিতা বলে থাকেন। শম্ভু মিত্রের কথা বলার ধরনে যে অতিরেক, শব্দকে তার ব্যঞ্জনায় বাজিয়ে তোলার যে সচেতন প্রয়াস, তা হয়তো মধুবংশীর গলির বেলাই যতখানি অমোঘ, জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তির বেলায় ততখানি নয় – এমনটা ভেবেছেন অনেকে, সে ভাবনাকে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়া উচিত হবে বলে মনে হয় না। সব্যসাচীর বেলাও সমস্যাটা অনেকটাই তাই। কবিতা পাঠের বা আবৃত্তির সময় শুধু তার শব্দগুলোকে বলে যাওয়া হোক, আর কোন কিছুর দরকার নেই – শ্রোতা তার ভেতর থেকে নিজের মত পাঠ তৈরি করে নেবেন, এমনটাই মনে হচ্ছিল কবিদের অনেকের। তাঁদের সামনে তখন এসে গেছে বিদেশী কবিদের কন্ঠে তাঁদের লেখা কবিতা পাঠের রেকর্ড, সভায় সঙ্গতে আমাদের কবিরাও তাঁদের লেখা পড়ছেন, নাটকীয়তাহীন সেই সব উচ্চারণ পছন্দ করছেন বেশ কিছু মগ্ন মানুষ। অরিণ মিত্রের কবিতা পড়া নিয়ে সিমনের সেই গান তো অনেকেরই স্মৃতিধার্য হয়ে আছে নিশ্চয় - ‘নতুন একটি কবিতা পড়তে উঠে দাঁড়ালেন অরুণ মিত্র।’ মনে পড়ে, সম্ভবত সন্তোষকুমার ঘোষের আয়োজনে রবীন্দ্র সদনে একবার আবৃত্তি বিষয়ে একটি আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়, তাতে উপস্থিত ছিলেন শম্ভু মিত্র তাঁর কন্যা শাঁওলীকে নিয়ে, অন্যদিকে ছিলেন কবি অরুণ মিত্র। স্বীকার করা ভাল, এই সন্ধ্যায় শম্ভু মিত্রের অসহিষ্ণুতা অনেককেই পীড়া দিয়েছিল।

নাটক গান এবং কবিতার মধ্যে আর একটি তফাতের জায়গা আছে, যা আদৌ উপেক্ষার যোগ্য নয়। হাল আমলের তথাকথিত কোম্পানি থিয়েটারের কথা জানি না, কিন্তু চল্লিশ পরবর্তী বাংলা নাটকের প্রধান ধারার সঙ্গে অনেক দিন পর্যন্ত আদর্শের অনুষঙ্গ লেগে ছিল, নাটক লিখে সম্মানজনক অর্থ পাবেন, এমনটা নাটককারেরাও ভাবতেন না, দলগুলিও দেবার কোন দায় বোধ করত না। সে ধারা এখনও আছে। বহু দল ছাপা নাটক নির্বিচারে অভিনয় করেন, ছাপা নাটকের জন্যে নাকি টাকা দেবার দরকার নেই, এমনটাই তাঁদের বেশিরভাগের বিশ্বাস। এমনকি, লেখককে একবার জানানোর সৌজন্যটুকু পর্যন্ত মনে থাকে না তাঁদের। ফলে, নাটক লিখে অর্থাগমের কল্পনা অধিকাংশ নাটককারের মনেই থাকে না। নাটককারেরাও নিজেদের থিয়েটারের মানুষ বলে মনে করেন, খানিকটা বন্ধু, অনুজ বা অভিভাবকসুলভ ঔদার্যে এসব মেনে নেন বা নিতে বাধ্য হন। গানের বেলা কিন্তু বিষয়টা এমন নয়, সেখানে একটা পেশাদার মনোভাব কাজ করে থাকে। রেকর্ড করার সময় কোম্পানির সঙ্গে রীতিমত আর্থিক চুক্তি হয়, সেই চুক্তি অনুযায়ী টাকা দেওয়া হয় গীতিকারকে। এ কথাও তো আমরা জানি, যে আধুনিক গান রেকর্ড করা হয় নি, তেমন গান আসরে গাইবার রীতি অন্তত পেশাদার গায়কদের মধ্যে প্রায় নেই। এ দুয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে আবৃত্তি। তার রেকর্ড খুব কম, রেকর্ডের বাইরে থাকা কবিতাও আবৃত্তিকার আসরে পরিবেশন করে থাকেন, তার বদলে কবিকে কোনও দক্ষিণা দেবার প্রথা প্রচলিত নেই। কবিরা তো আর নাটককারদের মতো নিজেদের আবৃত্তির লোক বলে মনে করেন না, তাই এই বঞ্চনা তাঁদের ভেতরের ভেতরে রাগ তৈরি করে।

এতক্ষণের আলোচনায় যদি আমি এখটু কবিদের দিকে ঝুঁকে পড়ে থাকি, সেখান থেকে ফিরে আসতে চাই এবার। এ কথা কবিদের মেনে নিতেই হবে, তাঁদের জনপ্রিয়তা, বা কবিতার প্রসারে আবৃত্তিকারদের বড় ভূমিকা আছে। কোন অচেনা কবির ভাল কবিতা আসরে পড়া বা আবৃত্তি করা হলে সংবেদনশীল শ্রোতা তার কবি সম্পর্কে আগ্রহভরে খোঁজ খবর নিচ্ছেন, এমনটা একাধিকবার নিজের চোখে দেখেছি। আর্থিক লেনদেনের একটা সম্পর্ক নিশ্চয় আবৃত্তিকারদের সঙ্গে কবিদের হওয়া উচিত, বিশেষ করে আজকাল আবৃত্তিশিল্পীরা কেউ কেউ যখন অনুষ্ঠানের জন্য ভদ্র সম্মান দক্ষিণা পেয়ে থাকেন।

আমার মনে হয় কবি আর আবৃত্তিকারদের মধ্যে সম্পর্কের প্রধান আততি তৈরি হয় কবিতাটির শিল্পরূপ নিয়ে। কবির ভালবাসাবার শব্দগুলি নিয়ে আবৃত্তিকার যথেচ্ছাচার করছেন, মূল রচনাকারের যদি এমনটা মনে হয় তাহলে তো তিনি রাগ করবেনই। আবৃত্তি শিল্পীরা কি অন্তত জীবিত কবিদের সঙ্গে কবিতা নিয়ে একটু আলোচনা করে নিতে পারেন? তার মানে কিন্তু এমন নয় যে আবৃত্তির ব্যাপারে কবি যা বলবেন তাকেই অক্ষরে অক্ষরে মানতে হবে। মা যেমন তাঁর সন্তানকে বোঝেন না, কবিও তেমনি সব সময় তাঁর নিজের কবিতা ভাল বুঝতে পারেন না, অনেক সময়েই নিজের লেখার ভুল, একপেশএ, এমন কি অসম্পূর্ণ ব্যাখ্যাও করতে দেখা যায় তাঁদের। তাছাড়া, যে কোন শিল্পের প্রধান রহস্য হল, সে এক একজনের কাছে এক এক মানে নিয়ে ধরা দেয়, সেক্ষেত্রে কবির মানে আর আবৃত্তিকারের মানেতে খানিকটা প্রভেদ ঘটে যেতেই পারে – কবি কি তা মেনে নিতে পারবেন না? আমি জানি মেনে নেওয়া ব্যাপারটা আপেক্ষিক। আবৃত্তিকারদের অনেকের মধ্যে ফাঁকিবাজি আছে, অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রস্তুতির ধার না ধেরে কোন একটা কবিতায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে সেটি পড়ে দিলেন, এমনটা তো হয়েই থাকে। কবি কেন তাঁর নিজের লেখা নিয়ে এই ব্যভিচার সহ্য করবেন? যে ধ্যান দিয়ে তিনি কবিতাটি রচনা করেছেন, আবৃত্তিকার যদি তা না দেন, কবির অধিকার আছে তাঁকে প্রত্যাখ্যান করার। তবে এর উল্টো যুক্তি হিসেবে বলা যায়, যাঁরা এমনটা করেন, তাঁরা কি সত্যিই আবৃত্তিশিল্পী? তাঁদের দোষে যাবতীয় আবৃত্তিকার সম্পর্কে বিরূপ ধারনা পোষণ করা কী কবিদেরই উচিত কাজ হচ্ছে?

আশা করা যায় এ লেখা কিছু আবৃত্তিকারের চোখে পড়বে, দু একজন কবির নজরে আসাও অস্বাভাবিক নয়। তাঁদের কাছে আমার একটা প্রস্তাব আছে। যে সব বাচিক শিল্পীদের যে সব সংগঠন আছে, তাঁদের উদ্যোগে কয়েকজন কবির সঙ্গে আবৃত্তিকারেরা একটু বসলে কী হয়? কবিরা তাঁদের কথা বলবেন, আবৃত্তিকারেরা তাঁদের কথা। দু পক্ষের কাছ থেকে দু পক্ষের বেশ কিছু কথা শোনার, জানার এবং শেখার আছে, এ কথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারেন?

0 comments:

2

প্রবন্ধ - শিবাংশু দে

Posted in


প্রবন্ধ


সিঁদুরে মেঘ ও হরিপদ কেরানি
শিবাংশু দে



ছোটোবেলায় প্রতি রথযাত্রায় নতুন পালার নতুন চমক সিরিজে 'সিঁদুর দিওনা লেপে', টাইপ নামের ছড়াছড়ি থাকতো। ‘নামভূমিকা’য় লাস্যময়ী নায়িকা। অন্যদিকে কোনও মিহিগুম্ফ নায়ক। তৎসহ কিশোরকুমার, "...হাটবাজারে শাঁখাসিঁদুর অনেক পাওয়া যায়/ কপালে থাকলে পরে তবেই পরা যায়...." শাঁখা ও সিঁদুরের এই দ্বৈত বাদ্যবাদন থেকেই মেয়েদের প্রোফাইল নির্ধারিত হয়ে যেতো সেকালে। এখনও হয় অনেক জায়গায়।

আমাদের গ্রীষ্মপ্রধান দেশের সংস্কৃতিতে প্রকৃতির তিনটি মৌলিক রং, যাদের earth colours বলা হয়, তার বিশেষ তাৎপর্য আছে। হলুদ, লাল ও দুটির মিশ্রণে, গৈরিক। সিন্ধুসভ্যতার সময় থেকে আমাদের 'ধর্ম'সংস্কৃতিতে এই রংগুলি 'পবিত্রতা'র চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। হরিদ্রা ও সিন্দূর, এই দুটি ভেষজ রঞ্জক ব্যতিরেকে কোনও 'ধর্মীয়' অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হতোনা সেকালে। একালেও সেই ট্র্যাডিশন অচল হয়ে যায়নি। 'বিবাহ' নামক অনুষ্ঠানটিতে হলুদ ও সিঁদুরের ব্যবহার অন্য সমস্ত সনাতন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মতো'ই সুলভ। এদেশে লাল রংটি আবহমান কাল ধরেই প্রেয় ও পবিত্র মনে করা হয়। লক্ষ্য করার বিষয়, টোটেমভিত্তিক যেসব প্রধান দেবতা আমাদের দেশের সর্বত্র বিশেষভাবে পূজিত হ'ন, যেমন গণপতি বিনায়ক বা পবনপুত্র মারুতি, তাঁরা ব্যতিক্রমহীনভাবে সিঁদুরে আলিপ্ত থাকেন। অন্যপক্ষে শাক্ত সাধনপদ্ধতি ও দেবীপূজার যাবতীয় অনুষ্ঠানে সিঁদুরের ব্যাপক ব্যবহার হয়ে থাকে। বৈদিক ঐতিহ্যে লাল রঙের সমূহ ব্যবহার থেকে স্বতন্ত্র হবার জন্য শাক্যমুনি শুদ্ধ লাল ছেড়ে ভিক্ষুদের হলুদ বা কাষায় রঙের উর্দি ব্যবহার করতে বলেছিলেন। কারণ তাঁর কালে যোগী বা যাজকরা রক্তিম চীবর পরিধান করতেন। কিন্তু তাঁর ভক্তরাও শেষ পর্যন্ত হলুদ রঙে টিকে থাকতে পারেননি। হলুদের সঙ্গে লাল মিশিয়ে গৈরিক বা জাফরানি রঙে নিজেদের রাঙিয়েছিলেন মহাযান পদ্ধতি বিকশিত হবার পর। অতএব বিবাহ অনুষ্ঠানের সঙ্গে রক্তিম রঞ্জক বা সিঁদুরের যোগাযোগ মানেই বিজয়ী ধর্ষকের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্ত্রীধনকে রাঙিয়ে দেওয়ার প্রচলিত মিথটির সত্যতা বিশেষভাবেই প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে । 

এই মিথটির উল্লেখ অনেকেই করে থাকেন। সিঁদুর আসলে , বিজয়ী পুরুষের অধিকৃত নারীর শরীরে এঁকে দেওয়া রক্তনিশান। সিলমোহর। এই তত্ত্ব একথাও বলে যে নারীর যাবতীয় অলঙ্কারও তাকে বেঁধে রাখার জন্য পুরুষের আবিষ্কৃত বেড়িশৃঙ্খলের নব্যরূপ। এই তত্ত্বটির উৎস প্রাগৈতিহাসিক কিছু সামাজিক নিয়ম। বৈদিক যুগে আটরকম বিবাহপদ্ধতির কথা আমরা জানতে পারি। এইসব বিচিত্র বিবাহপদ্ধতিকে যখন সামাজিক স্বীকৃতি দেবার কাজ শুরু হয়, তখন বলপূর্বক নারীহরণ ও বিবাহকে 'রাক্ষস' বিবাহের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিলো। এই বিবাহ সচরাচর অনার্য-আর্য, অনার্য-অনার্য বা কোনও স্থলে আর্য-আর্য বিবাহের ক্ষেত্রেও প্রযুক্ত হতো। অর্জুনের সুভদ্রাহরণ এর মধ্যে পড়ে। কিন্তু রাক্ষসবিবাহের নথিভুক্ত সারণীতে যদিও আর্যসভ্যতা সিঁদুর বা পরাজিতের রক্ত ব্যবহারের কোনও উল্লেখ করেনি তবুও ধরা যেতে পারে এই প্রথা আর্যসভ্যতার বাইরের লোকসমাজে হয়তো প্রচলিত ছিলো । উত্তর-পশ্চিম থেকে গাঙ্গেয় উপত্যকা বেয়ে আর্যাবর্তের যে সভ্যতা মগধ পর্যন্ত আসে সেখানে মূলত গান্ধর্ববিবাহেরই প্রচলন ছিলো । আজকের গাঙ্গেয় অববাহিকা, অর্থাৎ পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, বিহার, বাংলা, ওড়িশা এবং অসমসহ সমগ্র অঞ্চলে মূলত গান্ধর্ববিবাহেরই প্রচলন আছে। তৎসহ এই অঞ্চলের বিবাহিতা নারীদের মধ্যেই সিঁদুরের ব্যবহার সর্বাধিক দেখা যায়। অন্যপক্ষে দ্রাবিড় ও পৈশাচ অঞ্চল, অর্থাৎ আজকের দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারত, যেখানে রাক্ষসবিবাহের প্রচলন গান্ধর্ববিবাহের থেকে অনেক বেশি ছিলো সেকালে, সেখানে কিন্তু সিঁদুরের কোনও ব্যবহার নেই। যৎসামান্য কুমকুমের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। তাই এতো সহজ সমীকরণে সিঁদুরকে খলনায়ক বানানোর প্রক্রিয়াটি আজকের ইতিহাসচর্চার সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যায়না। বস্তুত এই বিজিতের রক্ত নিশান তত্ত্বটি ঊনবিংশ শতকের প্রথমদিকে য়ুরোপীয় মিশনারি পণ্ডিতদের প্রচারিত ব্যাখ্যা। অথচ যে পাশ্চাত্য সভ্যতা বিভিন্ন ভারতীয় কুপ্রথা নিয়ে সর্বাধিক সরব, তাদের সমাজেই chastity বা heresy নিয়ে তুমুল হিংস্রতা লক্ষ্য করা যায়। তবে একথা অনস্বীকার্য সিঁদুরপ্রথার প্রাথমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবহারের পিছনে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের যোগদান ছিলো। কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ভিত্তি হচ্ছে নারীর 'সতীত্ব' এবং সেই অনিবার্যতায় ভার্যাকে শুধুমাত্র পুত্রার্থে ব্যবহার করাই গরিমান্বিত প্রথা মনে করা হতো। তাই দেশজাতি নির্বিচার, নারীর প্রতি মনোভাব নিয়ে গর্ব করার মতো ইতিহাস পৃথিবীর কোনও দেশেই নেই। 

অনূঢ়া বা পুরুষসংসর্গরহিত কুমারী নারীর জন্য বৈদিকসমাজে কিছু অন্যধরণের নিয়মকানুন ছিলো। তা শুধু আমাদের দেশে নয়। তৎকালীন প্রতীচীতেও তার ব্যাপক সন্ধান পাওয়া যায়। কিন্তু বিবাহসংস্কারের (লক্ষণীয় 'সংস্কার' শব্দটি। যেমন বিপ্রের উপবীতসংস্কার) পর নারীর সামাজিক পরিচয়টি আমূল পরিবর্তিত হয়ে যেতো। শুধু গোত্রান্তর নয়, প্রায় জন্মান্তরের সমান তার অভিঘাত। গ্রহনক্ষত্রের প্রভাব ও ফলিত জ্যোতিষচর্চার প্রতি অতিবিশ্বস্ত এদেশী জনতা সিঁদুরের লালরং'কে মঙ্গলগ্রহের প্রতি আনুগত্য হিসেবেও প্রচার করে থাকতো। পুরুষত্বের সঙ্গে রক্তিমবর্ণ মঙ্গলগ্রহের যোগাযোগ সারা বিশ্বে চিরকাল আছে। পশ্য, এন অরে ফ্রোম অর্স' জাতীয় পশ্চিমি পণ্য আজকেও মানুষ নির্বিকার ভোজন করে থাকে। কুমারীকন্যার যৌনজীবনে প্রবেশ করার সময় মঙ্গলগ্রহের আশীর্বাদ প্রয়োজন। তাই এই রক্তিম চিহ্ন ধারণ করলে ঐ গ্রহটি নারীকে প্রয়োজনীয় প্রজনন শক্তি দেবে এমত বিশ্বাস ব্যাপকভাবেই প্রচলিত ছিলো। যেসব লোকজন সিঁদুরের প্রতি 'বৈজ্ঞানিক' বা 'ঐতিহাসিক' কারণে বিমুখ, তাঁরা হয়তো বহু সময়েই কুপিত মঙ্গলকে তুষ্ট করতে আঙুলে রক্তবর্ণ প্রবাল ধারণ করে থাকেন। আজও। 

আমাদের শক্তিদেবীপূজার ঐতিহ্যের সঙ্গে বিজড়িত যতো ডিসকোর্স রয়েছে, সেখানে দুজন মূলদেবী রয়েছেন। এই দুই দেবী পরে মিলেমিশে একজন মহাদেবী হয়ে গিয়েছিলেন। এঁরা হলেন পার্বতী ও সতী। পরবর্তীকালের দুর্গা বা আরো পরের কালী নামের মহাদেবীর সঙ্গে সিঁদুর নামক রঞ্জকটি অতিমাত্রায় জড়িত। কারণ আগম বা তন্ত্র অনুযায়ী পার্বতী এবং সতীর শক্তির উৎস এই রক্তবর্ণ প্রতীকটি। এর পিছনে রয়েছে প্রজননতত্ত্ব বা fertility cult, যার উৎস আবার নারীর প্রজনন ক্ষমতার দর্প । মনে করা হয় রক্তবর্ণ স্ত্রীরজ বিশ্বের সকল সৃষ্টির আকর। পুরুষের পেশীশক্তির অহংকার থাকতে পারে। কিন্তু নারীর প্রজননশক্তির গরিমা জীবনধারা তথা প্রকৃতিকে ধরে রাখতে অনেক বেশি প্রয়োজন। তাই স্ত্রীরজের অনুকারক রক্তবর্ণ সিঁদুর নারীর প্রজনন ক্ষমতার সূচক। নারীর শিরোদেশের ঠিক মধ্যবিন্দুতে সিঁদুর প্রয়োগের কিছু আয়ুর্বেদিক বা যৌগিক ব্যাখ্যাও রয়েছে। সিঁদুর তৈরি হতো কিছু ভেষজ পদার্থের সংমিশ্রণে। যেমন হলুদ, চুন, নানা পুষ্পনির্যাস ও প্রকৃতিজ রঞ্জকসমূহ। এগুলির নিজস্ব ভেষজ নিরাময় বা শক্তিবর্ধক ক্ষমতা আছে বলে মনে করা হতো। সম্মুখশিরোদেশে, যেখানে আজ্ঞাচক্রের উপস্থিতি রয়েছে এমত ধারণায়, এই দ্রব্যগুণ আজ্ঞাচক্রকে উদ্দীপ্ত করে নারীর যৌন ও প্রজননক্ষমতাকে নাকি সমৃদ্ধ করতে পারে। এই বিশ্বাসের কথা নানা স্থানে দেখা যায়। ভর্তৃহারা নারীর যেহেতু 'বৈধ' সন্তান ধারণের সম্ভাবনা নেই, তাই তাঁর জন্য এই চিহ্ন অপ্রাসঙ্গিক। স্বামীর মৃত্যুর পর নারীর সিঁদুর মুছে দেওয়ার যে প্রথাটি সারা দেশে দেখতে পাওয়া যায় তার পিছনে আপাতকারণ হয়তো পতিশোক। কিন্তু নিহিত কারণটি হলো পিতৃতন্ত্রের ভেটোতে সেই নারীর সন্তানধারণের সামাজিক অধিকারটি কেড়ে নেওয়া। Female powerয়ের এই অবমাননাই নারীর মৌলিক অধিকারকে বিপর্যস্ত করে দেয়। 

বালুচিস্তানের মেহরগড়ে সিন্ধুসভ্যতার কিছু অবশেষ থেকে জানা গিয়েছে যে তৎকালে সেদেশে নারীদের মধ্যে সিঁদুরজাতীয় রঞ্জক ব্যবহারের রীতি ছিলো। সেক্ষেত্রে আমাদের সভ্যতায় অন্তত তিন-চার হাজার বছর ধরে এই দ্রব্যটির প্রচলন রয়েছে। আমাদের সব মহাকাব্যেই সিঁদুরকুংকুমের উল্লেখ রয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রতীকী ব্যঞ্জনাও রয়েছে পুরোমাত্রায়। যেমন শ্রীরাধা, শ্রীকৃষ্ণের বিবাহিতা স্ত্রী ন'ন। কিন্তু তাঁর শক্তি হিসেবে রাধা সিঁদুরকুংকুম ধারণ করেন। আবার পাণ্ডবদের নপুংসকতায় ক্ষিপ্ত যাজ্ঞসেনী তাঁর সিঁদুর মুছে ফেলেন প্রতিবাদে। বিভিন্ন অন্য পুরাণেও বারম্বার সিঁদুর সংক্রান্ত উল্লেখ পাওয়া যায়। বিশেষত শক্তিদেবী বিজড়িত আখ্যানগুলিতে। খোদ আদিশংকর 'সৌন্দর্যলহরী'তে সিঁদুরের মাহাত্ম্য নিয়ে লম্বা শ্লোকও লিখে ফেলেছিলেন। হয়তো অনেকেই মনে রাখেন না, সারাদেশে বহু পুরুষরাও নানা 'ধর্মীয়' ও অন্যান্য কারণে সারাজীবন সিঁদুরের টিপ পরে থাকেন। বেশ কিছু সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাহের সময় পুরুষকেও সিঁদুর ধারণ করতে হয়। ওয়াহাবি ইসলামে শুনেছি টিপ পরা অধর্মীয়। কিন্তু সুফি ইসলামে সিঁদুরের টিপ একসময় প্রচলিত ছিলো।

এবার একটু অন্যদিক থেকে দেখা যাক। সিঁদুর নামক একটি নিরীহ প্রসাধন সামগ্রী নিয়ে সামন্ততান্ত্রিক রাজনীতি বেশ পুরোনো ব্যাপার।এই প্রসাধনটির যাথার্থ্য নন্দনতত্ত্বের এলাকার মধ্যেই বিচার করলে ভালো হয়। কারণ দ্রব্যটির এর থেকে অধিক কোনও মাহাত্ম্য নেই। বঙ্গীয় হিন্দু বিবাহ আচার, যা আর্য, অনার্য ও লৌকিক পদ্ধতির এক মিশ্র রূপ, সেখানে ধর্ম ও জিরাফের বেশ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখা যায়। এই সব মধ্যযুগীয় লৌকিক অনুষ্ঠানকে সকৌতুকে উপভোগ করাই শ্রেয়। তার প্রতি অকারণ মাহাত্ম্য আরোপ নিতান্ত অপ্রয়োজনীয়। প্রশ্ন হলো, সব রকম 'ধর্মবাদী', 'নারীবাদী', 'প্রতিবাদী', 'নীতিবাদী', 'স্বাস্থ্যবাদী', 'হিন্দুত্ববাদী' ইত্যাদি দৃষ্টিকোণকে আমল না দিয়ে যদি আমরা শুধু সৌন্দর্যবাদী চোখে দেখতে চাই তবে হয়তো এর চেয়ে বড়ো 'রাজনৈতিক ভুল' আর কিছুই হতে পারেনা। কারণ ইতিহাস কিছু জেনে, অনেকটাই হয়তো না জেনে সিঁদুরবিরোধী জনতা এই মূহুর্তে বেশ জঙ্গি মুডে থাকেন। যেহেতু এই অধমের শৃংখল ছাড়া কিছুই হারাবার নেই, তাই সে নির্ভয়। সিঁদুর রাজনীতি আরও অনেক অকর্মক মূঢ়তার মতই স্বাধীনচিত্ততার বিরোধী বলে অনেকে প্রচার করেন। সমাজতত্ত্ব বা ধর্মতত্ত্বের কূটকচালের সঙ্গে যদি একে নাই মেলাই, তবে খুব একটা অপরাধ হবে না হয়তো। বিদেশপ্রবাসী মেয়েরা, যারা বাঙালি জীবনের মূল স্রোত থেকে অসম্ভব দূরত্বে বসবাস করে, তাদের দৈনন্দিন জীবনে সিঁদুরের কোনও তাৎপর্যই নেই। কিন্তু বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের দেখেছি প্রসাধন হিসেবে সিঁদুরের সৌন্দর্যের প্রতি আন্তরিক থাকতে চায়। তখন মনে হয় যে রূপতত্ত্বের ফল্গুধারা বিজ্ঞাপনে ঢাকা পরিচয়হীন কোটি কোটি মুখের ভিড়ে কোথাও অন্তসলিলা হয়ে থেকে গেছে ঠিক। 'ঠোঁটের সিঁদুর' যদি এতো গ্ল্যামারদ্যোতক হয় তবে কপালের সিঁদুরকে কেন এতো 'গেঁয়ো' বলে ভাবা হবে? সত্যিকথা বলতে কি, সম্প্রতি কিছু সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে দেখলুম মহানগরগুলিতে শুধু বিবাহিতা ন'ন, অবিবাহিত মেয়েরাও পার্লারে সাজার সময় সিঁদুরটিপের নানা বৈচিত্র্য নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাইছেন। সিঁদুরের কোনও ধর্মীয় তাৎপর্য নেই। যা আছে তা নিতান্ত লোকাচার ও সামাজিক অভ্যেস। নারীর বিপন্নতাবোধকে নিরাপত্তাবোধের উষ্ণতায় উত্তীর্ণ করার জন্য পুরুষ অভিভাবকের থেকে ধার করা সিলমোহর। আজকের নারী নিজেই অর্জন করেছে ঐ সিলমোহর, তাকে আর ওটা কারুর থেকে ধার করতে হয়না। মেয়েরা নিজেদের শক্তি সম্ভবত এখনও পুরো ঠাওর করে উঠতে পারেনি এবং এ ব্যাপারে দিশি-বিলিতি কোনও ভেদাভেদ নেই। বিবাহিতা মেয়েদের অবশ্যপালনীয় চিহ্ন হিসেবে সিঁদুরের ব্যবহার বিষয়ক ফতোয়া এই মূহুর্তে সময়ের ঘড়িকে উল্টোদিকে টেনে নিয়ে যাবার অপপ্রয়াস ছাড়া কিছু নয়। দিনের শেষে সিঁদুর একটি প্রসাধন সামগ্রী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটি বিষাক্ত সীসক যৌগ। কিন্তু কোনও 'ধর্মীয়' চিহ্ন নয়। তার মাহাত্ম্য বাঙালি মেয়ের সামগ্রিক সাজের সঙ্গে সমানুপাতিক হলে চোখে ভালো লাগে। একজন বাঙালি মেয়ে যখন পাশ্চাত্য বা অন্যতর 'অ-বাঙালি' পোষাকে সজ্জিত হবে, তখন তার সঙ্গে একটি সিঁদুর টিপ নিশ্চয় মানাবে না। সাজসজ্জা বা পোষাক তো একটা স্টেটমেন্ট এবং প্রসাধনও তার অঙ্গ। সিঁদুরও তার বাইরে নয়। বাংলায় বলতে গেলে 'টেক ইট ইজি'। দাস ফার, নো ফার্দার।

আমার জন্য কিন্তু প্রিয় নারীর ( সে যেই হোকনা কেন, স্ত্রী বা বান্ধবী, বিবাহিতা-অবিবাহিতা) সিঁদুর টিপ একটি নান্দনিক প্রসাধন। সিঁদুর টিপ মেয়েদের মুখশ্রীতে একটা 'অলৌকিক' আভা এনে দেয়। তা সে মেয়ে গৌরী হোক বা শ্যামা। আমরা যখন ছবি আঁকতুম একটা ব্যাপার শিখতে হতো, পটের কেন্দ্রটা কোথায় থাকবে। চোখটা প্রথম পড়বে কোথায়? সেখানের রংটা যদি লাল হয়, তবে তার পরিমাপ নিয়ে খুব সতর্ক থাকতে হবে । কারণ লাল সব থেকে উজ্জ্বল আর দৃষ্টিআকর্ষক earth colour। কম হলেও অসম্পূর্ণ আর বেশি হলে জবরজং। একালে যাঁরা 'বাঙালি' মেয়ের ছবি এঁকে খ্যাতি পেয়েছেন, বিকাশ বা সঞ্জয় ভট্টাচার্য, অথবা প্রকাশ কর্মকার বা যোগেন চৌধুরি,আরও অনেকে, সবাই বাঙালি মেয়ের কপালের সিঁদুর টিপটিকে সযত্নে সম্মান জানিয়েছেন। এই 'সম্মান' আজকের বহু মেয়েরাও জানান দেন সব পুজোকেন্দ্রিক মোচ্ছবে অবিরল সিঁদুর মাখামাখির চঞ্চল উদ্দামতায়। কিছুদিন আগেও এই প্রদর্শনকামী প্রবণতাটি এত প্রকট ছিলোনা। 

আমার এক বন্ধু বেশ বিষয়ী মানুষ, আমার মতো পাগল নয়। পদ্য-টদ্যের ধার ধারেনা , নিরীহ টাইপ। কদাপি সুকুমারী ভট্টাচার্য পড়ে স্ত্রীর সামাজিক অবস্থান বিষয়ে কোনও ধারণা তৈরি করেনি। কী ভেবে না জানি, তার স্ত্রীকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলো। যেদিন সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরে সে তার স্ত্রীকে শাড়ি ও সিঁদুরে দেখবে সেদিন তাঁর জন্য কুড়ি টাকা নগদ বিদায়, পাক্কা ( এ গল্প বছর পঁচিশ আগের এবং এই কুড়ি টাকার সাম্মানিক পাঁচ টাকা থেকে দরদাম করতে করতে বেড়েছিলো)। মিথ্যে বলবো না, তার স্ত্রী কয়েকদিন চেষ্টা করে ঐ রূপে পতিদেবকে দর্শনও দিয়েছিলেন। কিন্তু সপ্তাহখানেক পরে প্রচেষ্টা ভঙ্গ করে তিনি বললেন, কুড়ি টাকার জন্য এতো ঝামেলা পোষায় না। ব্যাক টু সলওয়ার বা বাংলার জাতীয় পোষাক, ম্যাক্সি। 


হরিপদ কেরানির স্বপ্নেই থেকে যায় সেই মেয়ে, যার পরনে ঢাকাই শাড়ি, কপালে.....

2 comments:

2

বইঘর - চয়ন

Posted in

বইঘর
চয়ন


বই : শ্রাবন্তীর জন্য গল্প
লেখক : সৌমিত্র বসু


ছোট গল্প বলতে আমরা এখন যা বুঝি তার জন্ম সাগরপাড়ের দেশে। ১৮৪২ এ Edgar Allan Poe এর তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ করেন। মোটামুটি ভাবে এটা সিদ্ধ হয় যে ছোটগল্প হলো কথাসাহিত্যের সেই শাখা যাকে একবারে পড়ে ফেলার পর প্রতীতি সমূহ একীভূত হয়ে পাঠক মনে একটি মাত্র সামূহিক অনুভূতির জন্ম দেয়। এরই নাম unity of effects or impressions। যে কোনও ভাবেই গল্প বলা যেতে পারে। সরল, জটিল, লঘু, গুরু যে ভাবেই বলি না কেন গল্পের কাজ যে impression সৃষ্টি করা সেটা এখনও পর্যন্ত প্রায় সকলেই মেনে চলেন। এখানে দুটো জিনিস মাথায় রাখতে হবে। এক,প্রতীতি ঐক্য কিন্তু পাঠক ভেদে বদলে যাবে। আর দুই, যে কোনও ভাবে যে কোনও বিষয় নিয়ে গল্প বলা যায়। বিষয় নির্বাচন সম্পূর্ণ ভাবে রচয়িতার অধিকারাধীন। পাঠক হিসেবে আমি বলতে পারি না যে একটি বিষয় আরেকটির চেয়ে ভালো। 'To do this is to favour certain kinds of unity over others, whereas the glory of the short story's single minded concision is that it can be put to an infinite number of uses in what it is made to say -- about human experience, about ideas and emotions. A highly self conscious form, the short story can celebrate spontaneity and the instinctual, or the dramatic moment of revelation which brings a character to full consciousness for the first time in his life; it can use its instances to say that life's possibilities are hedged and narrow, or to express a view of life as violent and torn by harsh conflict; deliberate and calculated in aim, it can have the apparent casualness of a snapshot.' ( The Short Story : A Critical Introduction by Valerie Shaw)। আর এগোনোর আগে আরেকটি বিষয়ও স্পষ্ট করা প্রয়োজন। প্রাচ্যবাসী আমাদের ক্ষেত্রে পঠন কালে গণ্য করতেই হবে রসের বিচার। আমরা প্রতীতি বা অনুভূতি গুলিকে রস বলব। আর অখণ্ড রসানুভূতির আধার হলো সহৃদয় পাঠকের মন। আর এখানেই যত গোল। কারণ, 'মনের ভেতর একশরকম শেকল গড়ার কারখানা/ একটা শেকল ভাঙি যদি গজিয়ে ওঠে চারখানা।' যে যে সাংস্কৃতিক নির্ধারক আমার মনকে নিয়ন্ত্রণ করে সচেতন প্রয়াস ছাড়া তাদের এড়ানো ভারী মুশকিল।


এতসব কথা মনে এল বইঘরে সৌমিত্র বসুর লেখা 'শ্রাবন্তীর জন্য গল্প' বইটি এসে পৌঁছনোর পর। কী ভাবে পড়ব এ বই? কারণ লেখকের নামটা পড়া মাত্রই একটিই অনুষঙ্গ জেগে উঠল মনের মধ্যে : বেতার। পুরো ছোটবেলাটা আমি সৌমিত্র বসু নামটার সঙ্গে একটা বিশেষ গলার স্বরকে জুড়ে কাটিয়েছি। কত কত চরিত্র হয়ে উঠেছে সেই অবয়বহীন স্বরটি। আজ এই বইয়ের একুশটা গল্প পড়ার সময় কথককন্ঠস্বরে আমি সেই স্বরটাই বারবার শুনছি কেন? এটা কি কালচারাল কন্ডিশনিং? যত এগোচ্ছি ততই যে অনুভূতিটা জন্মাচ্ছে সেটা সেই বেতার নাটক শুনে জন্মানো অনুভূতিরই মতো। এর কারণ কি এই যে ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন বইয়ের ইতিহাস? 


'ফ্রেন্ডস এফ এম-র আমন্ত্রণে বেশ কিছুদিন শ্রাবন্তী মজুমদার শ্রাবন্তীর সরগম বলে রেডিওতে একটা অনুষ্ঠান করতেন। তাতে প্রতিদিন তিনি একটি করে গল্প পড়তেন,আর গল্পগুলোর ফাঁকে ফাঁকে পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই একেকটা গান বাজানো হত। গল্পগুলো লিখতাম আমি। গল্প বানানোর নানা রকম শর্ত ছিল, যেমন সোমবার হল সা-এর দিন, সেদিন যে গল্প শোনানো হবে তার নাম দিতে হবে স দিয়ে, মঙ্গলবার রে-র দিন, র দিয়ে দিতে হবে গল্পের নাম...' 


তাহলে ব্যাপারটা কি এমনই দাঁড়ালো যে আমি কোথাও একটা গোত্র বিভাগ করছি? প্রতীতি সংহতি থেকে জন্মানো রসানুভূতিকেও উচ্চ বা নিম্ন ভ্রূ -এর বর্গে ফেলে বিচার করছি তার? মনে করছি যে একরৈখিক কথন ভঙ্গিমা, জটিলতা বর্জিত কাহিনী নির্মাণ, লেখা পড়বার সময় মাথা না ঘামানো এগুলো ঠিক ততটা নান্দনিক নয়? ফরমায়েসি, পপ্ আর্ট বলে গল্পগুলোকে অবজ্ঞা করছি মনে মনে? লেখক তো স্পষ্ট করে জানাচ্ছেন : 'আমি ইন্টেলেকচুয়াল মানুষ নই, আম জনতার জন্যে অনুষ্ঠান লিখতে গিয়ে বুদ্ধিজীবি মার্কা কায়দা দেখানোর মতো গোঁড়ামিও আমার নেই। না ভেবে চট করে পড়ে ফেলার মতো মুচমুচে করে লেখার চেষ্টা হয়েছে এদের,...' সত্যিই কোন শেকল যে মনকে কখন বাঁধে তার ঠিক নেই কিছু! কারণ, এভাবে পাঠ করার অর্থই হলো আম আদমিকে ম্যাঙ্গো পিপল্ বলে ডেকে এলিটিসম্-এর আস্ফালন। প্রায় একটা প্রভুত্বকামী ক্ষমতার বয়ানের কাছে আত্মসমর্পণ। শেষ পর্যন্ত, ভূমিকায় বলা তত্ত্বকথাগুলো মনে করে খোলা মনে গল্প শোনায় মন দিলাম। দেখতে দেখতে একটা আলো-আলো ভালোলাগায় ভরে গেল মন।


কলকাতায় ছোটবেলার গন্ধ খুঁজতে আসা অরুময় (গল্প 'গন্ধ'), অভিজিৎ-মন্দিরার মিষ্টি প্রেম (গল্প 'গজদাঁত'), স্বামীর 'সেই ছেলেটা' হতে চেয়ে আগের প্রেমিকা আর এখনকার বউয়ের বুকে মুখ গুঁজে মায়ের ছোঁয়াকে খোঁজা (গল্প 'অরণ্যে'), ননীবালার মা হওয়ার তীব্র ইচ্ছে ( গল্প 'রাক্ষসী') মন ছুঁয়ে গেল। আর পাকাপাকি ভাবে মনে রয়ে গেল দুটো গল্প : 'মাঝখানে' এবং 'প্রেমিকের জন্যে'।


প্রথমটিতে পরমা - প্রিয়তোষের দাম্পত্য প্রিয়তোষের মতোই মুমূর্ষু। হানিমুনে গিয়ে যে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে আজ সে বিছানায় শোয়া তার কালো ছায়া তাদের সম্পর্কের মধ্যেও এসে পড়েছে। প্রিয়তোষের অসুস্থ মনে নানা সন্দেহ। এদিকে পরমার জীবন নষ্ট হতে দেখে তার শাশুড়ি চান সে একটা সুস্থ জীবন পাক। নতুন করে আবার বাঁচুক মনোচিকিৎসক ডঃ মুখার্জির সঙ্গে। শিউরে ওঠে পরমা। মনগহনের যে ইচ্ছে সে নিজের কাছেই স্বীকার করে না সেটা তাহলে এতটা বেআব্রু? অতি সংযতবাক এই গল্প অস্তিত্বের বিভিন্ন স্তরে বন্দী চরিত্রদের জটিলতা যে ভাবে প্রকাশ করে তার জন্যই এ গল্প বারবার পড়া যায়। 


'প্রেমিকের জন্য' গল্পটি মানুষের দেবতা হওয়ার চেষ্টাকে, ঔদার্যের মোহকে বেনাকাব করে। সোমা আর অপুর যে সম্পর্ক স্বাভাবিকভাবেই শেষ হয়ে যেত সোমার বর মৃন্ময়ের অতি ঔদার্য তাকেই নতুন করে জিইয়ে তোলে। তারপর, ভালোবাসা, অধিকারবোধ, সম্পর্কের টানাটানির এক জটিল নকশা অতি অল্প কথায় যেভাবে আঁকেন কাহিনীকার তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না।


বিদ্যা থেকে বেরোন ৯৬ পাতার বইটি অতি সুন্দর দেখতে। কোনও ছাপার ভুল নেই। দামও খুব কম। মাত্র চল্লিশ টাকা। এই বই সংগ্রহে রাখলে পড়া -শোনা হবেই। মানে পড়া শোনা হয়ে উঠবে। মুখ্যতঃ শোনার জন্যই তো গল্পগুলো লেখা হয়েছিল।

2 comments:

0

বইঘর - গ্রন্থকীট

Posted in










বইঘর



বইয়ের খবর 
গ্রন্থকীট




বই : ইশ্‌তেহার
কবি : রাজা ভট্টাচার্য
নির্মাণ : ঋতবাক 
বিনিময় মূল্য : ১২৫ টাকা।

কথাভুবনে যদি এক পংক্তি লিখে থাকে কেউ, সত্তার গভীর অন্ধকার, বিচ্ছিন্নতার যন্ত্রণা বা অমল আলোর অন্তর থেকে উঠে আসা অক্ষর পুরুষের আবাহনমন্ত্রের একটি শব্দও যদি কেউ উচ্চারণ করে থাকে, তবে সে 'ইশ্‌তেহার'-এর কবির পরমাত্মীয়। চোখের কোণে শুকিয়ে থাকা জলের দাগে বসত করা কবি জানেন 'তেমন করে হলো না ভালবাসা'; জানেন যে জীবনও পুড়ে যাওয়া মরণও তাই। তবু, মহাশূন্যে ঘুরে মরা এই নীল সবুজ গ্রহের প্রতিটি প্রত্যন্তে কবি লিখে দেন অমোঘ ঘোষণা -- সকলেই একযোগে লিখে চলেছে একটিই কবিতা। আঘাতে আবাদ করলে সোনা ফলে মানবজমিনে। ঈশ্বরের অশ্রুভেজা মাটি থেকে অঙ্কুরিত স্মৃতি -সত্তা-ভবিষ্যৎ আগামীকে ডেকে বলে, 'তোমার কথা আগামীকাল হবে।' এই মুহূর্তে আর সব ক্ষণস্থায়ী, শোক শুধু দীর্ঘজীবি হয়। এই মুহূর্তকথনেরই নাম 'ইশ্‌তেহার'।সব্যসাচী ভট্টাচার্যের আঁকা প্রচ্ছদ আর কবিতাগুলির অঙ্গসজ্জা এই বইয়ের আর এক বাড়তি আকর্ষণ।


বই : পাঁচ দিগন্ত : বিশ্বসাহিত্যের পুনর্কথন 
রচয়িতা : বৈজয়ন্ত রাহা 
নির্মাণ : ঋতবাক 
বিনিময় মূল্য : ২০০ টাকা 

গল্প বলা, তাকে আবার বলা, আবার তাকে বলা ... কথা ভুবনে এই রীতি চিরকালীন। এই যে পুনরায় বলা তা একরকম নবীকরণও বটে। প্রতিটি পুনর্কথন নতুন রূপে সাজিয়ে নেয় কথনকে। অনুবাদকও একরকমভাবে নতুন আঙ্গিকে বলেন কাহিনীকে। এক সংস্কৃতির অপত্যকে অপর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে উপস্থাপনার সময় তাকে ভিন্ন সাজে সাজিয়ে দেন। কথকস্বরের সমান্তরালে শোনা যায় তাঁরও কন্ঠ। এই কন্ঠস্বর টীকাভাষ্য রচনা করে চলে। 'পাঁচ দিগন্ত : বিশ্বসাহিত্যের পুনর্কথন'--এও তাই বিংশ শতকের বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের অন্যতম প্রাণপুরুষ সুধীন্দ্রনাথ রাহার পৌত্র বৈজয়ন্ত রাহার স্বতন্ত্র স্বরটি স্পষ্ট শোনা যায়। এ বই কেবলই এক অনুবাদগ্রন্থ নয়। এ এক জটিল সৃজনক্রিয়ার নজির। টলস্টয়, ও হেনরি, মিগনন্ জি এবারহার্ট, আনাতোল ফ্রাঁস এবং চার্লস ডিকেন্সের বিভিন্ন রসের পাঁচটি কাহিনীকে নতুনভাবে বলে বৈজয়ন্ত গড়ে তুলেছেন এক নিজস্ব কথনবিশ্ব। বইয়ের প্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে প্রচ্ছদ এঁকেছেন সব্যসাচী ভট্টাচার্য। সৌমিত্র বসুর অতি চমৎকার ভূমিকাটি একটা বাড়তি পাওয়া।



বই : এক ডজন সাম্য
লেখক : সাম্য দত্ত
নির্মাণ : ঋতবাক
বিনিময় মূল্য : ২৫০ টাকা

এক ডজন সাম্য বারোটি জাদুকরী গল্পের সংকলন। আট থেকে আশি সকলকেই ছুঁতে পারে সে জাদু। অলৌকিকের দুনিয়ায়, অধ্যাত্ম চেতনার অন্তর্লোকে, প্রেমের জগতে, হাসিভরা জীবন-উৎসবে, নাট্যমঞ্চে, সৃষ্টিবিশ্বে, বালক-বালিকাকে রহস্যসন্ধানী করে তোলা পৃথিবীতে অনায়াস পদচারণা লেখকের। প্রতিটি গল্পের পরতে পরতে মিশে থাকা জীবনরস, এক নিজস্ব কথনভঙ্গিমা এবং অতি সাবলীল ভাষা গল্পগুলিকে পাঠকের আঁতের শরিক করে তোলে। এ বই শুধু বই নয়। এক ডজন সাম্য এক উদযাপনের নাম।  বইটির প্রচ্ছদের বর্ণবৈভব আর কোলাজধর্মী গঠনের মধ্য দিয়ে এর চরিত্রকে চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করেছেন সব্যসাচী ভট্টাচার্য।



বই : ভুতোর বই
স্রষ্টা : অনুষ্টুপ শেঠ
নির্মাণ : ঋতবাক
বিনিময় মূল্য : ১০০ টাকা

বাঙালি বাড়িতে আজও শিশুর মুখে কথা ফোটে মায়ের মুখের ছড়া শুনে। সেই ছড়ায় কখনও শোনা যায় চিরবহমান বাংলার কৃষ্টির সুরঝংকার, কখনও যোগীন্দ্রনাথের কন্ঠ, আবার কখনও বা সুকুমারের কন্ঠ। এই বহুলস্বরের সঙ্গে ঋতবাক যুক্ত করল আরও এক নবীন স্বর। অনুষ্টুপ শেঠের। তাঁর বন্ধুর শিশুপুত্রের জন্য রচিত 'ভুতোর বই' শুধু মাত্র একটি বই নয়। এটি এক অখণ্ড শিল্পবস্তু। কারণ এর ছড়া, ছবি, লিপি, বিন্যাস, সব কিছুরই স্রষ্টা রচয়িতা নিজে। ঋতবাক উত্তর প্রজন্মের হাতে তুলে দিল ভাষা, ছন্দ, রেখা, লেখায় গড়া অনুষ্টুপের শিল্পবোধ আর সংস্কৃতিচেতনার প্রতীকটিকে তাঁর নির্মাণের হুবহু প্রতিরূপ বা facsimile -র আকারে। বাংলায় এক শিশুর জন্য এই জাতীয় গ্রন্থ নির্মাণ প্রকল্পের আর একটি মাত্র নিদর্শনই এখনও পর্যন্ত চোখে দেখেছে গ্রন্থকীট। নাম তার হিতোপদেশের গল্প। ১৪ মার্চ, ১৯৪৩ থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ পর্যন্ত সময়কাল ধরে দৌহিত্রীপুত্র দীপঙ্কর বসুর জন্য সেই অমূল্য শিল্পকীর্তিটি গড়েছিলেন 'পরশুরাম' রাজশেখর বসু।



বই : আশবন্দিশ : আর কথা নয়
রচয়িতা : চয়ন ও সব্যসাচী ভট্টাচার্য
নির্মাণ : ঋতবাক 
বিনিময় মূল্য : ১২৫ টাকা


প্রেম আর শৃঙ্গার, উচ্ছ্বাস আর বিপণ্ণতা, গ্লানি আর শুদ্ধতা, রেখা আর লেখার যুগলবন্দী আশবন্দিশ : আর কথা নয় -তে চয়নের কবিতা আর সব্যসাচী ভট্টাচার্যের ছবি পরস্পরের মধ্যে এক সংলাপ রচনা করে। একুশটি ছবি ব্যাখ্যা করতে চায় ঊনিশটি কবিতাকে। রিরংসা, বিপণ্ণতা, আর্তি, জুগুপ্সা, লজ্জা, থেকে ব্যক্তিগত অথচ নৈর্ব্যক্তিক প্রণয়ের শুদ্ধিতে উত্তরণের এক জটিল কাহিনী ছবি আর কবিতার স্বরে পাঠককে ডেকে বলে : 

প্রেমিক বলে আমায় ডেকো কিংবা শুধু কামুক --
বৃষ্টি তবু নামুক কেবল আমার জন্য নামুক।

এই বইয়ের কথামুখেও যুগলবন্দী -- এক চিত্রশিল্পী ও এক কবির। রামানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ও কালীকৃষ্ণ গুহ। সব দিক থেকে বইটা একটু আলাদারকম।

0 comments:

1

আলাপ বিস্তার - সব্যসাচী ভট্টাচার্য

Posted in



আলাপ বিস্তার 
সব্যসাচী ভট্টাচার্য


এবারের আলাপ বিস্তারে সৌমিত্র বসুর সাক্ষাৎকার নেব ঠিক করলাম। বলাই বাহুল্য, প্রশ্ন প্রণয়নও আমারই। এখন পাঠক জিজ্ঞাসা করতে পারেন, কে এই সৌমিত্র বসু। পরিচয় হিসাবে বলতে পারি একজন ক্রিয়াশীল, তন্নিষ্ঠ নাট্যকর্মী, প্রাবন্ধিক এবং অন্তরে আদ্যন্ত সাহিত্যপ্রেমী। যেহেতু সৌমিত্র বসু আমার বাল্যবন্ধু শুধু নন একই বিদ্যালয়ের সহপাঠীও, সেই কারণে ওঁর আজকের এই 'হয়ে ওঠা'র ধাপগুলি অনেকটাই আমার কাছে জানা; এবং ঠিক এই কারণেই সাক্ষাৎকারটি ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় পরিণত হয়েছে। একেবারে সেই কিশোর বেলা থেকেই (তখন ক্লাস সিক্স-এ বালিগঞ্জ রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ে আমরা একই সেকশনে পড়ি) আমাদের একসঙ্গে বেড়ে ওঠা প্রকৃতপক্ষে। ছুটির দিনগুলোর বিকেল, দুপুর, পালা করে দু'জনের বাড়ি যাতায়াত -- একই পরিবারের অন্তর্ভুক্তি। এমনকি, আমার নাটকের প্রতি আগ্রহের মূলেও সৌমিত্রই। ও-ই আমাকে নাটক পড়তে শেখায়, প্রতি সপ্তাহে শনি ও রবিবার নিয়ম করে দু'জনের নাটক দেখা -- কোনওদিন ও কাটে তো কোনওদিন আমি। প্রথম একসঙ্গে বহুরূপীতে যোগ দেওয়ার জন্য যাওয়া এবং গম্ভীর কঠিন প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি হওয়া, যেহেতু তখনও আমরা স্কুলের গণ্ডী পার হইনি (১৯৭৪ সাল,শীতকাল)। ছোটবেলা থেকেই ওর লেখার (কবিতা, গল্প বা উপন্যাস) প্রথম পাঠক/শ্রোতা আমিই ছিলাম। এই অভ্যাস অনেকদিন পর্যন্ত বজায় ছিল -- তারপর কালের নিয়মে এবং কর্মব্যস্ততায় ক্রমশঃ ফিকে হয়ে এলেও এখনও কোনওদিন ওর বাড়ি গেলে প্রথমেই ওর লেখার প্রসঙ্গ ওঠে। ওর সৌজন্যেই বিভিন্ন নাট্যব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। শম্ভু মিত্র, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সবিতাব্রত দত্ত, তৃপ্তি মিত্র, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, এবং এদের মতো আরও অনেকের সঙ্গে। শুধু নাট্যজগতের গুণীরাই নন, সৌমিত্রর সঙ্গে আমি নিয়মিত যেতাম কবি মণীন্দ্র গুপ্তের বাড়ি, সেখানে আমি শ্রোতা মাত্র। কত ভাল আলোচনা শুনেছি মণীন্দ্রবাবু এবং ওঁর স্ত্রী দেবারতি মিত্রর মুখে। সেসব সোনালী দিন আমার জীবনকে ঋদ্ধ করেছে। আমার অল্পবিস্তর ছবি আঁকার অভ্যাসকেও ও উৎসাহ দিয়ে এসেছে বরাবর। স্কুলের ছাত্রদের পত্রিকা বাগবিতানে ওর লেখা গল্পের সঙ্গে আমার ছবি ছাপা হয়, যে ঘটনাটি আমার শ্লাঘনীয়। আমার অল্পবিস্তর সংগীতচর্চাও ও যথেষ্ট সম্ভ্রমের চোখে দেখত। যেমন, একবার, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর ওর লেখা নাটকে (নায়ক আসছেন) আমি সুর দিয়েছিলাম। একটি মাত্র শো হয় বন্ধু শ্যামলেন্দুর পিসির বাড়ির ছাদে। সুতরাং পাঠক বুঝতেই পারছেন যে কেন এই সাক্ষাৎকার আলাপচারিতার রূপ নিয়েছে। 


সব্যসাচী : আমরা অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ডঃ সৌমিত্র বসুর সাক্ষাৎকার নেব না নাট্যকর্মী সৌমিত্র বসুর সঙ্গে কথা বলব? 


সৌমিত্র : এরা আলাদা মানুষ নাকি? যে কোনও মানুষই তার সারা জীবনে নানা রকম কাজ করে, বা একটু গ্রাম্ভারি করে বলতে গেলে নিজেকে প্রকাশের চেষ্টা করে। সবটা নিয়েই সে। কাজেই যে দিক থেকে পারো গোলাগুলি চালাও।


সব্যসাচী : ব্যক্তিত্বের বহুকৌণিক হীরক বিচ্ছুরণ চার পাশের দর্শক, পাঠক কী ভাবে দেখে বলে তোমার মনে হয়?


সৌমিত্র : বহুকৌণিক হীরক বিচ্ছুরণ? ওরে বাবারে! দর্শক, পাঠক আমাকে আলাদা করে নজর করে এমন তালেবর হয়েছি বলে তো মনে হয় না। মুশকিল যেটা হয়, যিনি আমার নাটুকে পরিচয়টা জানেন, তিনি যখন সেই সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার ওপর দাবি করতে থাকেন তখন স্বভাবতই আমার অন্য ক্ষেত্রগুলোকে মনে রাখেন না। অভিমান করেন তাঁর দাবি মেটাচ্ছি না বলে। দুই, সবটা মিলিয়ে বেশ চাপ পড়ে যায়। আর আমি যেহেতু অমর সৃষ্টি করে যেতে হবে এই রকম কোনও সাঙ্ঘাতিক প্রতিজ্ঞা নিয়ে বাঁচি না, তাই মাঝে মাঝে খুব ক্লান্ত লাগে। সব ছেড়ে কোথাও গিয়ে চুপচাপ বসে থাকতে ইচ্ছে করে। 


সব্যসাচী : কিশোর বয়স থেকে মূলতঃ একজন হয়ে -উঠতে - চাওয়া সাহিত্য সেবক কী ভাবে ক্রমে একজন নাট্যকর্মীতে পরিণত হলো : উত্তরণের সেই সময়ছবিকথা আমাদের বলো।


সৌমিত্র : কম বয়সে গল্প, কবিতা লিখতাম, যেমন সবাই লেখে, বা অন্তত আমাদের সময় লিখত। আসলে ওই বয়সে তো নানাভাবে ভেতরের কথাগুলো বের করে দেখবারএকটা তাগিদ থাকেই, মানে থাকার কথা। মনে পড়ে, তুমিও তো ছবি আঁকতে, সেতার বাজাতে। কিন্তু মনে রাখতে বলব নাটকের প্রতি আমার আকর্ষণটাও দুর্মর ছিল। তুমি আর আমি দুজনে মিলে কত কত নাটক দেখেছি সেই বয়সে; বহুরূপী, পি.এল.টি, নান্দীকার থেকে নতুন জন্মানো চেতনা, থিয়েটার ওয়র্কশপ, শূদ্রক আরও কত কত নাটক। কতসব বিখ্যাত মানুষের বাড়ি হুটহাট করে চলে গেছি। তাই নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা, তর্ক, স্বপ্ন দেখার কথা মনে পড়ে নিশ্চয়ই? সেই সূত্রে বহুরূপী এবং তারপর প্রাতিষ্ঠানিক নাট্যচর্চার মধ্যে ঢুকে পড়া। প্রতিষ্ঠানের তো নিজস্ব কিছু দাবি থাকে, সে তোমাকে তার শর্তে অধিকার করে নিতে চাইবেই। কিছুদিন পর কবিতা আবার ফিরে এসেছিল আমার কাছে। আমার ভাই আত্মহত্যা করে। সেই আঘাতের চাপ শুধু নাটকের পক্ষে সামলানো সম্ভব ছিল না, ফলে কবিতার আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু সেটা স্থায়ী হয়নি। বয়স বাড়লে তো মানুষকে অনেকের ভেতর থেকে এক বা দুইকে বেছে নিতেই হয়। আমার কপালে নাটকটাই প্রধান হয়ে উঠল। 


সব্যসাচী : একটি ইতিহাস সৃষ্টিকারী নাট্যগোষ্ঠীতে সংলগ্ন হওয়া, তারপর মগ্ননাট্যচেতন থেকে অন্য আরএক মগ্নতায় নিজের নাট্যদোহার গঠন -- এ ব্যাপারে সিংহাবলোকন আমাদের সঙ্গে ভাগ করে নাও।


সৌমিত্র : বহুরূপী নানা কারণে ক্লান্ত করছিল শেষের দিকে, আদর্শগত দিক থেকেও কিছু কিছু ব্যাপার মেনে নিতে অসুবিধে হচ্ছিল। ছেড়ে দিলাম। ভেবেছিলাম থিয়েটারই আর করব না। কিন্তু এর মধ্যে অন্য জায়গা থেকে ডাক এসে গেল। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। একটু বিজ্ঞাপন করি? আমার একটা আত্মকথা আছে। 'বহুরূপী যাপন' নামে। সপ্তর্ষি থেকে বেরিয়েছে। তাতে এসব কথা অনেক অনুপুঙ্খসহ লেখা আছে। 


সব্যসাচী : এই প্রজন্মে নাট্যকর্মী হয়ে ওঠার আগ্রহ একজন নাট্যকার, নির্দেশক এবং শিক্ষক হিসেবে তুমি কীভাবে দেখছ? 


সৌমিত্র : রবীন্দ্রভারতীর নাটক বিভাগে একবার একটা বিতর্ক তৈরির চেষ্টা করেছিলাম, থিয়েটারটা পেশাদার হবে না হবে না। পেশাদারিত্বের পক্ষে প্রায় সবাই। প্রচণ্ড উত্তেজনা, চেঁচামিচি। এখনকার ছেলেমেয়েরা পেশাদার নাট্যকর্মী হয়ে উঠতে চাইছে, অনেকে হয়ে উঠছেও। নাটক করেই এখন মোটামুটি একটা রোজগার করা যায়। আমরা এ সব ভাবতে পারতাম না। কিন্তু পরিকাঠামোটা খুব পেশাদারিত্বের পক্ষে অনুকূল হতে পেরেছে এমন নয়। থিয়েটার থেকে রোজগার করা যায় যদি তার ভেতরের নানা সম্ভাবনাকে বার করে আনতে পারি। সে কাজে বাংলা থিয়েটার এখনও বেশ পিছিয়ে। তার একটা কারণ, আমাদের মিডিয়াধন্য থিয়েটার থেকে আদর্শ ও নীতিবোধ মোটামুটি বিদায় নিয়েছে। ফলে পেশাদার নাট্য অভিনেতারা খানিকটা পেশাদার সিরিয়াল অভিনেতাদের মতো হয়ে দাঁড়াচ্ছে, দক্ষ এবং খেপবাজ। 


সব্যসাচী : সিরিয়ালের ফেনায়িত খারস্রোতে ঋদ্ধ অভিনয়রীতি ক্ষতিগ্রস্ত - এই মত সম্বন্ধে তোমার মনের কথা কী?


সৌমিত্র : সিরিয়ালটা কেবলমাত্র ব্যবসা এবং লোক পটানো ব্যবসা। এ পাড়ায় আসা অভিনেতাদের মুশকিল হলো ক. পুরো গল্পটা তার জানা নেই, ফলে সে চরিত্রের সামগ্রিক রূপ সম্পর্কে অন্ধকারে। চিত্রনাট্যকার বা পরিচালকেরাও তাই। খ. সেদিনের যে পার্টটুকু তাকে দেওয়া হয়, তা নিয়ে ভাববার সময়ও অভিনেতা পায় না, মুখস্তটুকু করে যা হয় করে দেওয়ার বাইরে কিছু করার নেই। গ. পুরো পরিবেশটার মধ্যে এমন একটা গা এলানো, চালিয়ে দাও, গোছের মনোভাব থাকে, যার সংক্রমণ সিরিয়াস অভিনেতার পক্ষেও এড়ানো মুশকিল। পরিচালক একটু জটিল শট নিতে গেলেই অভিনেতারা সমস্বরে দাবি তোলেন, শিল্প কোরো না, ছেপে দাও বলে। পরিচালককেও রোজ বেশ অনেক মিনিটের কাজ দেখাতে হয়, তা না হলে ড্রইং রুম বা শোওয়ার ঘরের প্রাত্যহিক খাদ্য দেওয়া যাবে না। এইসব অভিনেতারা অনেকেই থিয়েটার করেন, চরিত্রের গভীরে ঢোকার, একটি চরিত্রকে তার ডালপালা শুদ্ধু দেখার অভ্যেসই তাঁদের নষ্ট হয়ে গেছে। 


সব্যসাচী : একটি সম্পূর্ণ প্রজন্ম বেতারে তোমার বাচিক অভিনয় শুনে বড় হয়েছে। বেতারে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে ভাগ নেবে?


সৌমিত্র : বেতার অভিনয় অভিনেতাকে বাচিক অভিনয়ে পারদর্শী করে তুলতে পারে। উচ্চারণ, কন্ঠের উচ্চাবচতা, কোন শব্দে কেমন জোর পড়বে ইত্যাদি। আবার গলা বাঁচিয়ে অভিনয় করার একটা খারাপ অভ্যেসও রেডিওর অভিনেতাদের মধ্যে তৈরি হয়ে যায়। আমার একটা বাড়তি সুবিধে ছিল, আমার গলাটা নায়কোচিত নয়। ফলে গৌতম চক্রবর্তী, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়রা যেখানে মূলত বিড়বিড়ে গলার নায়কের পার্ট করে যাচ্ছে, আমি সেখানে নানা ধরনের চরিত্র করার সুযোগ পাচ্ছি। গলা নিয়ে কোনও খুঁতখুঁতুনিও তৈরি হতে পারেনি। তবে সেখানেও খুব গভীরে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হতো না। আসলে পণ্যের মালিক তো চাইবেন তাড়াতাড়ি তাঁর মালটা তৈরি হয়ে যাক, তাতেই তাঁর লাভ। পণ্যাভিনয় এক ধরনের দক্ষতা নিশ্চয়ই তৈরি করে, কিন্তু ক্ষতিও করে মারাত্মক।


সব্যসাচী : নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় বহুরূপী 'নবান্ন' মঞ্চস্থ করে নতুন করে। তাতে তোমার অভিনয় দেখে কোনও একজন নাট্যসমালোচক বলেছিলেন শম্ভু মিত্রের তৃতীয় বা চতুর্থ কার্বন কপি ...এইরকম কিছু একটা। এ বিষয়ে কিছু বলবে? 


সৌমিত্র : মন্তব্যটা সুরজিৎ ঘোষের, তিনি তখন 'দেশে' নাট্যসমালোচনা লিখতেন। একটু চালাক চালাক কথা লেখার অভ্যেস ছিল তাঁর। কিছু অভিনেতা যেমন গ্যালারি মাতানো অভিনয় করেন, এও হলো সেইরকম গ্যালারি মাতানো লেখা। অবশ্য কথাটা সত্যি। তবে এর জন্য দায়ী কুমার রায়, যিনি ঐ ঘরানাটা মেনে চলতেন; বহুরূপীর তখনকার অবস্থা, যেখানে শম্ভু মিত্রকে ঈশ্বরের জায়গায় বসানো হতো অন্তত বাইরের আচরণে; আর নিশ্চয় আমার কম বয়সের ব্যক্তিত্বহীনতা, যা সহজেই প্রবল ওই অভিনয়রীতির মধ্যে ডুবে মরেছিল। এখন বোধহয় সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি।
-
-
-
অসম্পূর্ণ...। আরও কত কথাই মনে পড়ছে। আপনাদেরও জানাতে ইচ্ছে করছে। আবার আর একদিন বসবো হয়তো ওর সঙ্গে... মুখোমুখি। আজ এই পর্যন্তই... 







1 comments:

1

প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা গাঙ্গুলী

Posted in


প্রাচীন কথা


চক্রব্যূহে একা 
অনিন্দিতা গাঙ্গুলী


শৈশব থেকেই তিনি পিতৃস্নেহবঞ্চিত। মাতাও যে খুব আদর করে বড় করেছেন তাও নয়। যেমন হয় রাজারাজড়ার ঘরে। দাসদাসীদের কাছেই মানুষ। এই স্নেহহীনতার দায় তাঁকে কর্কশ অত্যাচারী করে তুলেছিল। যা চাই তাকে জোর করে আদায় করে নিতে হবে। আর তা যদি রাজসিংহাসন হয় তো কথাই নেই। সমাজে প্রভাব ও প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে ক্ষমতার শিখরে আরোহণ না করে উপায়? মথুরাধিপতি কংস এই কথাই ভেবেছেন এতকাল। পিতা তাঁকে পালন করেছেন মাত্র। মহারাজ উগ্রসেন কংসকে কখনও ঔরসজাত পুত্রের সম্মান তো দেননি, এমনকি দানবরাজ দ্রুমিল তাঁর মাকে বলাৎকার করেছিলেন, সেই কারণে তাঁর জন্ম বলে মাও স্নেহ দিতে পারেননি। এহেন প্রতিকুল পরিবেশে, যেখানে চারপাশে কোনও আত্মীয় পরিজন বন্ধু স্বজন নেই যে তাঁকে ভালোবাসে, হঠাৎ আত্মীয়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন মহাপরাক্রমশালী মগধরাজ জরাসন্ধ। ভারতবর্ষে এমন কোনও নৃপতি নেই যিনি জরাসন্ধের পরাক্রম ও সমৃদ্ধিকে সমঝে চলেননা। উত্তরপশ্চিম ভারতের কুটিল রাজনৈতিক ছক বিনষ্ট করে দেবার শক্তি যদি কারোর থাকে তবে পূর্বভারতের এই রাজা, যাকে বাকী ভারত সম্মান করে। খাতির করে। কিন্তু কংসকে তিনি কন্যাদান করতে চেয়েছেন কেন? কংস দুর্বৃত্ত। কংস অন্ধক, ভোজ, বৃষ্ণি, প্রত্যেক জ্ঞাতিভ্রাতার চক্ষুশূল। তাঁকে কন্যাদান! 

আপাতত মহারাজ উগ্রসেন কারাগারে। রাজ্য জুড়ে হাওয়ায় কথা উড়ছে। কংস তো রাজ্যাভিষেকের জন্য চিহ্নিত ছিলেনই। তবে কেন এই হঠকারী সিদ্ধান্ত? পিতাকে কারাগারে নিক্ষেপ? কিন্তু কেউ জানুক আর না জানুক, পিতা উগ্রসেনের অন্নে প্রতিপালিত, তাঁর মন্ত্রীসভার উল্লেখযোগ্য পদ অলংকৃত করে বসে আছেন যে যাদবকুলপতি বসুদেব, উগ্রসেন যে তাঁকেই রাজা ঘোষণা করবেন সেকথা কংস টের পেয়েছিলেন। ভাবলেই রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। হাজার হোক দানব রক্ত তাঁর গায়ে। দানবের মত শক্তিশালী এবং সরল কংস। ষড়যন্ত্রের আভাস পান কিন্তু নিজে ষড়যন্ত্র কষতে পারেননা। কাউকে উৎকোচ দিয়ে, মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে দল ভারী করতে পারেননা। কিন্তু বসুদেব একাজে দারুন দক্ষ। পিতার সে প্রিয়পাত্র তো বটেই, তলে তলে মন্ত্রীসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যকে দলে টেনেছেন। কংস অবশ্য কোনও সিদ্ধান্ত নেননি এতদিন। তবে কানাঘুষোয় যখন শুনেছিলেন বসুদেব তাঁর পুত্রকে ভবিষ্যৎ রাজা হিসেবে, নেতা হিসেবে প্রস্তুত করবেন, তখন নিজের পিতৃব্যকন্যা দেবকী, বসুদেবের স্ত্রীকে কারাগারে বন্ধ করেছিলেন। সেখানেই সেই পুত্রের জন্ম হয়। কংস ভাবেন কতদূর চক্রান্ত থাকলে কারারক্ষী সহ সকলে বসুদেবের পক্ষ নিতে পারেনযে রাতের অন্ধকারে সদ্যোজাত পুত্রকে বসুদেব গোপগৃহে রেখে আসতে পারেন! ওখানেই তখন প্রতিপালিত হচ্ছে বসুদেবের আরেক পত্নী রোহিণীর গর্ভজাত বলরাম নামের বালকটি। তাঁকে ফাঁকি দিয়ে পুত্রটিকে পাচার করে দিয়েছিলেন। সকলে নাকি পূর্বাহ্ণেই ভেবে নিয়েছিলেন এ শিশুটিকে কংস নিধন করবেন। অদ্ভুত! দুগ্ধপোষ্য শিশু! এখন সেই শিশু বড় হয়েছে। যাদব ও গোপেরা তার নানা কীর্তিকলাপ চারিদিকে প্রচার করছে। সে নাকি অত্যাচারী কংসের হাত থেকে মথুরা উদ্ধার করবে। রাজা উগ্রসেনকে কারাগার থেকে মুক্তি দেবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। মগধরাজের আশ্বাসও মাঝে মাঝে কংসকে নিশ্চিন্ত করতে পারেনা। তিনি যে নিজগৃহে পরবাসী! তাঁর যে কোনও বন্ধু নেই! এত কিছুর মধ্যে তাঁর সান্ত্বনা অক্রুর। সেও মন্ত্রীসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে বৃত। সংঘমুখ্য। যতই রাজা বলে খাতির করা হোক, এই যাদব অন্ধক ভোজ বৃষ্ণিদের রাজ্যগুলি আসলে গণ। গণতান্ত্রিক মতে চলে। সেখানে মন্ত্রীসভার গুরুত্ব অপরিসীম। কাজেই অক্রুর তাঁর পক্ষে বলে কংস তবু একটু ভরসা পান। 

অক্রুর নিজের বংশপরিচয়ে কিছু হীনমন্যতায় ভোগেন। উল্লেখযোগ্য পদে থাকলেও, কংসের বিশ্বাসভাজন হলেও, মনে মনে তিনি নিজপরিচয়ে নিজেকে হীন মনে করেন। চারিদিকে উজ্জ্বল সব ভোজ বৃষ্ণি কুলপতিদের মধ্যে তিনি যেন কিছুটা শ্রীহীন। তবুও রাজানুগত্যে তিনি দিনের আলোর মতো প্রতিভাত এই রাজদ্রোহের ষড়যন্ত্রে নাম লেখাননি। কিন্তু জানেন, কংস একা। কংস নির্বান্ধব। শ্বশ্রূকুল যতই শক্তিশালী হোক, বিপদে ঘরের কাছের মানুষই পাশে দাঁড়ায়। তিনি তাই কিছুটা সহানুভূতিতে কংসের পাশে ছিলেন। এমন সময়ে কৃষ্ণের মধ্যস্থতায় বন্দী রাজা উগ্রসেনের আরেক পত্নী, কংসের সপত্ন ভগিনী সুতনুর সঙ্গে অক্রুরের পরিণয় হলো। কেউ এর মধ্যে কোনও রাজনীতি দেখতে পেলেননা। বরং কৃষ্ণের এই মহান পদক্ষেপে তাঁকে অন্ধক ভোজ বৃষ্ণিবংশীয়রা বাহবা দিল। আর অক্রুর? সেই অক্রুর, যিনি মনে মনে কংসের দুর্ভাগ্যকে করুণা করতেন, চাইতেন সে যেন বিপন্ন না হয়ে শান্ত সুস্থির জীবনে ফিরে আসে, এই এক চালেই কৃষ্ণের পক্ষে চলে গেলেন। প্রথম প্রথম নিজেই টের পেলেননা। কারণ পত্নী যে কংসের ভগ্নী! কিন্তু অগ্রজ যে পিতাকে কারাগারে বন্দী করে রেখেছেন! সারা মথুরায় কেউ কংসের প্রতিপক্ষ হিসেবে বসুদেবকে কল্পনাও করতে পারেননি। সকলে ভেবেছেন কংস দুর্বিনীত। পিতাকে বন্দী করে রেখেছেন। নিজের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কতটা নিরাপত্তাহীনতায় যে তিনি ভুগছিলেন! 

মানসিক প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পটভূমিতে বিরাট পরিবর্তন আসতে চলেছে। পূর্বভারতীয় প্রভাবকে হারিয়ে উত্তরপশ্চিম ভারত জাগছে। নতুন রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে। বাসুদেব তার হোতা। কংস বিষণ্ণ হাসলেন। মথুরায় আজ বাসুদেব কৃষ্ণ আসছেন। সঙ্গে বলরাম। ভালোই হবে। শত্রুপুরীতে তাঁকে আর জীবনধারণ করতে হবেনা। এই জীবনচক্রে তাঁকে যুদ্ধ একাই করতে হলো যে।

1 comments:

1

প্রাচীন কথা - মিথিল ভট্টাচার্য্য

Posted in


প্রাচীন কথা


পরাহত ভাগ্যনায়ক 
মিথিল ভট্টাচার্য্য


(ষষ্ঠ পর্ব)

একটা অদ্ভুত মিষ্টি তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ যেন এই আতঙ্কের পরিবেশ কে বিদীর্ণ করে স্তম্ভিত করে দেয় প্রত্যেক ব্যক্তিকে। অক্রুর স্তব্ধ হয়ে দেখেন মথুরার কিশোর রাজকুমার এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি ঠোঁটের কিনারায় নিয়ে মায়াবীদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর অবতার গজরাজের দিকে। আর অদ্ভুত ভাবে তার সামনে এসে এইসাক্ষাৎ মৃত্যুর অবতার ও থমকে দাঁড়িয়ে রয়েছে, যেন স্বয়ং মৃত্যু দেব মৃত্যু দানের আগের মুহূর্তে অযাচিত ভাবে পরে গেছেন কোনও অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের সামনে। তার দুই চোখে মিশে আছে এক অদ্ভুত সংশয় আর অবিশ্বাস। কৃষ্ণ এক এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর দিকে। প্রচণ্ড আতঙ্কে মহাসামন্ত প্রায় চীৎকার করে বারণ করে উঠতে গেলেন, "কি করছেন রাজকুমার? দাঁড়ান।"

কিন্তু পর মুহূর্তেই একটা দৃঢ় মুষ্টি তাকে স্তব্ধ করে দিলো। তার সামনে পর্বতের মতন এসে দাঁড়ালেন, কৃষ্ণের ইস্পাতকঠিন অগ্রজ স্বল্পভাষী বলরাম। মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে তিনি বলে উঠলেন "দাঁড়ান মহাসামন্ত, কানু যা করছে ওকেকরতে দিন। ও জানে ও কি করছে।"

কিছু মুহূর্তের জন্য বিমূঢ় হয়ে গেলেন অক্রুর, তারপর কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে দেখলেন একটু একটু করে গজরাজের দিকে আরও এগিয়ে গেছেন মথুরার ভবিষ্যৎ নায়ক। দিশেহারার মতো তিনি আবার বলে উঠতে গেলেন "কিন্তু কুমার।"

কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে বলরামের উদ্যত তর্জনী তাকে স্তব্ধ করে দিলো , "এখন আর একটাও কথা নয় মহাসামন্ত, আপনিশুধু কানুর উপর ভরসা রাখুন।"

আতঙ্কে নীল হয়ে মহাসামন্ত অক্রুর দেখলেন কৃষ্ণকে ওই অদ্ভুত সুমধুর শিস দিতে দিতে গজরাজের আরও কাছে এগিয়ে যেতে, গজরাজের দৃষ্টিতে এখনও যেন লেগে রয়েছে এক অজানা সংশয়। আগের মতন ক্ষিপ্ত হয়তো সে আরনেই, কিন্তু এখনো মাঝে মাঝেই এক গম্ভীর স্বরে সে দিয়ে উঠছে প্রচণ্ড হুঙ্কার। 

আতঙ্কে রুদ্ধবাক দর্শক হয়ে অক্রুর দেখলেন হাসি মুখে নিয়ে গজরাজের একেবারে সামনে এসে দাঁড়ালো ষোলোবছরের এই কিশোর। মধুর শিস দিতে দিতে সে তার হাত এগিয়ে দিচ্ছে এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর দূতের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য যেন আবার হিংস্র হয়ে উঠতে গেলো গজরাজ। যেন মুহূর্তের মধ্যে পিষে ফেলতে চায় সে এই তুচ্ছ মানব সন্তানকে। গলা দিয়ে একটা অস্ফূট আর্তনাদ বেরিয়ে এলো অক্রূরের ,কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি দেখলেন এক মুখ হাসি নিয়েতার অদ্ভুত শিস ধ্বনির সামান্য কিছু বদল করলেন কৃষ্ণ।এই অদ্ভুত ধ্বনি যেন আরো বেশি মোহময় হয়ে উঠলো, আর তার সাথে ধীরে ধীরে আবার শান্ত হয়ে উঠলো ক্ষিপ্ত গজরাজ।

বিনা কোনো দ্বিধায় হাত বাড়িয়ে গজরাজের বিশাল শরীরে এক অদ্ভুত ভঙ্গীতে হাত বোলাতে লাগলেন কৃষ্ণ। কিছু খণ্ড মুহূর্তের জন্য হৃদধ্বনি যেন থেমে গেলো মহাসামন্তের। আর গজরাজও যেন এক প্রচণ্ড বিস্ময়ে সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো এই ক্ষুদ্র মানব সন্তানের দিকে। তারপর হতবাক মহাসামন্তের বিমূঢ় দৃষ্টির সামনে ওই কালরূপী প্রকাণ্ড দানবাকৃতি পশুও যেন এক অবোধ প্রাণীর মতো শুঁড় তুলে অভিবাদন জানালো এই তরুণ মানব সন্তানকে।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেননা মহাসামন্ত অক্রুর। একোন মায়া দেখাচ্ছে এই অদ্ভুত কিশোর ! কোন মহামন্ত্রে সে বশ করলো এই সাক্ষাৎ মৃত্যুর অবতারকে ?

শুধু এখানেই অবসান হলোনা তার বিস্ময়ের। স্তব্ধ হয়ে তিনি দেখলেন, নিজের পেছনের পা কৃষ্ণের চোখের সামনেনিয়ে এলো এই মূক প্রাণী, একটা অব্যক্ত স্বরে সে যেন কিছু বলতে চাইছে এই কিশোরকে। কৃষ্ণ কি দেখতে পেলেন, বুঝতে পারলেননা অক্রুর। কিন্তু দেখলেন কয়েক মুহূর্তের জন্য ওই মধুর হাসি মুছে গিয়ে একটা তীব্র ঘৃণার ছাপ ফুটে উঠতে ওই তরুণ মুখে।

আলতো করে হাত বাড়িয়ে দিয়ে গজরাজের পেছনের পা থেকে একটা তীক্ষ্ণ কিছু যেন চোখের পলকে বার করে নিয়ে আসলো কৃষ্ণ। একটা তীব্র আর্তনাদ বেরিয়ে এলো গজরাজের কণ্ঠ থেকে, কিন্তু সেই আর্তনাদে আর মিশে নেই কোনক্রোধ বা হিংস্রতা, বরং ফুটে উঠেছে এক তীব্র যন্ত্রণা আর অসহায়তার ছাপ।

আরেকবার ওই অদ্ভুত শিস ধ্বনি করে উঠলো কৃষ্ণ আর তারসাথে আলতো করে তার হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো ওইবিশাল প্রাণীর দেহে। এই অদ্ভুত স্নেহের পরশে ওই দানবাকৃতি প্রাণীটিও যেন ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে ক্লান্ত শরীরে ধীর পায়ে সরে সরে দাঁড়ালো রাজপথের এক ধারে। আর তারপর পিছন ফিরে রাজপথ থেকে ফিরে যেতে লাগলো অজানাপথে তার পিলখানার দিকে। কৃষ্ণ তখনও এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন ওই দানবাকৃতি প্রকাণ্ড প্রাণীটির দিকে। পথের প্রায় অন্যপ্রান্তরে পৌঁছে গিয়ে সে একবার পিছন ফিরে তাকালো এই ক্ষুদ্র মানব সন্তানের দিকে, শংকিত হয়েউঠলেন অক্রুর "আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলোনা তো ওই চলমান বিভীষিকা?" কিন্তু না, তার আশংকাকে ভুল প্রমাণিত করে কৃষ্ণের দিকে ফিরে নিজের শুঁড় তুলে একটা অদ্ভুত বৃংহন করে উঠলো গজরাজ। না জানি নিজের ভাষায় কি বোঝাতে চাইলো এই মূক প্রাণী? কৃতজ্ঞতা না কোনও অজানা প্রতিশ্রুতি? আর তারপরেই ধীরগতিতে সে হারিয়ে গেলো নগরের পথের বাঁকে।

কৃষ্ণ অবশেষে এইবার তাদের দিকে ফিরে তাকালেন, অক্রুর এতক্ষণে দেখতে পেলেন কৃষ্ণ গজরাজের পা থেকে কিবার করে নিয়েছিলেন? কৃষ্ণ তার ডান হাতে ধরে রয়েছে একটি সুতীক্ষ্ণ রক্তাক্ত অঙ্কুশ, কেউ যেন ইচ্ছে করেই বিদ্ধ করেছিল ওই মহাকায় প্রাণীটিকে এই ধারালো অস্ত্রটি দিয়ে, আর সেই যন্ত্রণাতেই এতক্ষণ পাগলের মতো হয়ে গিয়ে একচলমান মৃত্যু দূতে পরিণত হয়েছিল ওই অবোলা প্রাণীটি।

অক্রুর নিজের স্তব্ধ দশা থেকে অবশেষে বাস্তবের মাটিতে ফিরে আসেন, কি হলো এতক্ষণ? তার নিজের চোখের সামনে একি অদ্ভুত মায়া ঘটে গেলো গেলো এই কয়েক মুহূর্তে? কে এই ষোলো বছরের বালক? একি সত্যি মথুরারএতো দিনের প্রতীক্ষার ফল? না কি কোনও ছদ্মবেশী মায়াবী! কিভাবে বশ করলো ও ওই সাক্ষাৎ কালকে?

আর নিজেকে সংযত রাখতে পারেননা মহাসামন্ত। ব্যাকুল স্বরে তিনি বলে ওঠেন "এত ক্ষণ এখানে একি ঘটে গেলো রাজকুমার? ক্ষিপ্ত গজরাজ, তারপর আপনি এগিয়ে গেলেন ওর দিকে, গজরাজ অদ্ভুত ভাবে শান্ত হয়ে নিজের পথে ফিরে গেলো।...আর এখন আপনার হাতে এই ধারালো অঙ্কুশ, এসবের অর্থ কি?”

মধুর হাসিটি মুছে গিয়ে একটা চাপা ক্রোধ যেন ফুটে উঠলো কৃষ্ণের মুখে কয়েক মুহূর্তের জন্য, একটা দৃঢ় স্বরে সে বলে উঠলো "কিছু মানুষ নিজেদের পাশবিক ইচ্ছায়, যন্ত্রণা দিয়ে পাগল করে দেওয়ার প্রয়াস করেছিল ওই নিরীহ অবোলা প্রাণীটিকে, আর প্রচণ্ড যন্ত্রণায় দিশেহারা হয়ে ছুটে এসেছিলো বেচারা আমাদের রথের দিকে। না পারছিলো কাউকে বোঝাতে ওর কষ্টটা আর না কোনও পথ খুঁজে পাচ্ছিলো ওই যন্ত্রণা থেকে মুক্তির।"

অক্রুর ব্যগ্র স্বরে বলে ওঠে "সে না হয় বুঝলাম রাজকুমার, কিন্তু আপনি কিভাবে শান্ত করলেন ওই সাক্ষাৎ মৃত্যু দূতকে? এ কোন মায়া দেখালেন আজ আপনি?"

কৃষ্ণ হাসি মুখে বলে উঠলেন "এ কোন মায়া নয় মহাসামন্ত। এ শুধু হলো ভালোবাসার পরশে এই অবোধ প্রাণীগুলিরযন্ত্রণার সহভাগী হয়ে ওঠার কিছু গোপন কৌশল। একটা কথা জেনে রাখবেন এই সমস্ত প্রাণীই কখনো অকারণে কাউকেই আঘাত করতে চায়না।যখন সে কাউকে, বিশেষ করে মানুষ কে আঘাত করে তখন তার পেছনে একটাই কারণ থাকে, তার নিজের বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম। সে সংগ্রাম নিজের খিদে মেটানোর জন্য হোক কি আত্মরক্ষার জন্য। তাই এই প্রাণীটিকে এই রকম দিশেহারা হয়ে ছুটে আসতে দেখে আমিও বুঝতে পেরেছিলাম, যে কোনও কিছু থেকে আত্মরক্ষা করার জন্যই অক্ষম চেষ্টা করে যাচ্ছে বেচারা, কিন্তু ওই অবোধ প্রাণী বুঝে উঠতে পারছিলোনা যেকিভাবে মুক্তি পাবে ওই প্রচণ্ড যন্ত্রণা থেকে, আর সেই কারণেই এক অজানা আক্রোশে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল সে।"

অক্রুর ব্যাকুল স্বরে বলে ওঠে "কিন্তু রাজকুমার আপনি এখনোও আমাকে বললেননা যে কিভাবে আপনি শান্ত করলেন ওকে, আর ওই অদ্ভুত শিস ধ্বনি কোথায় শিখলেন আপনি ওই অদ্ভুত ধ্বনি?"

কৃষ্ণের মুখে আবার ফিরে আসে তার চিরপরিচিত ওই মোহময় হাসিটা, মধুর স্বরে সে বলে ওঠে "এ আমার একগুরুর শিক্ষা মহাসামন্ত। তিনি আমাকে হাতে ধরে শিখিয়েছিলেন এই সমস্ত অবলা প্রাণীদের ভালোবাসায় ছোঁয়ার ভাষা, সে কাহিনী না হয় অন্য আরেকদিন শোনাবো আপনাকে, এবার চলুন যাওয়া যাক"

মথুরার রাজপ্রাসাদের দিকে কিছু সময়ের জন্য একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো মথুরার ভবিষ্যৎ ভাগ্যনায়ক, তারপর একটা গাঢ় স্বরে সে বলে উঠলো "মাতুল নিশ্চয়ই খুব অধীর আগ্রহে অনেক সময় ধরে প্রতীক্ষা করছেন আমাদের, আর তাকে অপেক্ষায় রাখা সঠিক হবেনা, চলুন মথুরার রাজপ্রাসাদ অপেক্ষা করছে আমাদের।"

হতভম্ব অক্রুর অবশেষে কোনওমতে ফিরে আসেন বাস্তবের মাটিতে, স্তম্ভিত ভাবে কৃষ্ণের দিকে তাকিয়ে, হঠাৎ করে তার হাতদুটি জড়ো করে তিনি বলে ওঠেন "যেমন আপনার ইচ্ছা রাজকুমার, আসুন বহু বছর ধরে এই প্রাসাদ রয়েছে আপনার প্রতীক্ষায়।"

মহাসামন্তের রথের চাকা বহু চেষ্টায় অবশেষে তুলে নিতে সক্ষম হন তার সারথি। রথে উঠে আসেন কৃষ্ণ। তাকে, বলরামকে আর মহাসামন্ত অক্রুরকে নিয়ে অবশেষে রথ আবার এগিয়ে চলে মথুরার শ্বেত পাথরে নির্মিত রাজপ্রাসাদের দিকে। 

(ক্রমশ)

1 comments: