3

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়




হায় হেমন্তলক্ষ্মী, তোমার নয়ন কেন ঢাকা–
হিমের ঘন ঘোমটাখানি ধূমল রঙে আঁকা॥
সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে,
কন্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা॥

লাবণ্যময়ী ঋতুকন্যা হেমন্তের অনিন্দ্যসুন্দর রূপলাবণ্যে বিশ্বচরাচর বিহ্বল। শিশিরসিক্ত স্নিগ্ধ শীতল ভোরে সবুজ ঘাসের আগায় হীরের কুঁচি, মায়াবী নীল আকাশে নরম সোনা রোদ, মৃদুমন্দ হিমেল সমীরণে শিহরিত প্রাণ। মোহিনী প্রকৃতির রহস্যময়ী সৌন্দর্যে প্রেমমুগ্ধতার আকুল আহ্বান। তাই তো বাংলার কবি বার বার ফিরে আসতে চান নতুন ধানের মৌ মৌ সুঘ্রাণ শুভেচ্ছায় ‘ধানসিঁড়িটির তীরে- এই বাংলায় … এই কার্তিকের নবান্নের দেশে’ যেখানে ‘সোনালি ধানের ক্ষেতে ঈষৎ শীতার্ত হাওয়া লাগে/আনন্দ অশ্রুতে যেন ভিজা ভিজা আঁখির পল্লবে/মাটি মাতা হেরিতেছে নবান্ন আসন্ন উৎসবে,/বিমুগ্ধ নয়নে হেরে পরিপূর্ণ ফসলের ভার,/অঙ্গ ভরিয়া আছে- আমার বাংলার’ (কবি সুফিয়া কামাল )।

প্রকৃতির এই কাব্যময়তা কেমন করে যেন ছুঁয়ে গেল ঋতবাক-এর এই সংখ্যার অন্তরাত্মা। অতীতে তো কতবার বলেছি, ঋতবাক মূলতঃ একটি গদ্যধর্মী মাসিক পত্র। কিন্তু প্রকৃতি যে কারোর সপ্রকাশ ঔদ্ধত্য সহ্য করে না! তাইতো সাহিত্য সরস্বতীর এমন অসাধারণ মধুর শাস্তি বিধান। আসলে ভুল তো আমাদের-ই। সাহিত্যের সূচনা তো কাব্যেই। তাকে অস্বীকার করা যায় কেমন করে! আজকের ঋতবাক তাই ঋতনিষ্ঠ লাবণ্যময় তরুণ যুবক। সর্বাঙ্গে তার কাব্যালংকারের সুশোভন সজ্জা। মননে তার কাব্যের ঈশ্বর নির্মাণের প্রবল প্রয়াস। উপলব্ধিতে তার অনন্ত প্রেমময়তার উজ্জ্বল উদ্ভাস। চেতনায় তার কাব্য সরস্বতীর চরণকমলে নিঃশর্ত উৎসর্গের হৈমন্তী নৈবেদ্য। সে কাব্য সরস্বতীর সঙ্গে ‘স্বপ্নে যদি না হয় দেখা, কাব্যে হবে তবে...’

অনন্ত প্রেমময়তার নিরন্তর মুগ্ধতায় সততঃ নিমজ্জমানতার আন্তরিক কামনা...

সুস্মিতা বসু সিং




3 comments:

4

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ পল্লববরন পাল

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ



কবিতাড্ডা - ঈশ্বরনির্মাণ
পল্লববরন পাল



কবিতার জন্ম হয় অন্তত দু’বার। প্রথমবারের মা হলেন অবশ্যই কবি স্বয়ং। দ্বিতীয় মা পাঠক। 

প্রবন্ধ-টবন্ধ বড্ডো ভারি কথা, গম্ভীর কথা – ভীষণ সিরিয়াস সিরিয়াস ব্যাপার - আমার ওসব আবার ঠিক আসেনা। আমি নিছক বাউণ্ডুলে আড্ডাবাজ মানুষ - মানুষ!!! উরিব্বাবা! এও তো বড্ডো শক্ত ও প্রমাণসাপেক্ষ কথা!- যাগ্গে, কথায় কথা বাড়ে। মানুষ সত্যি সত্যি মানুষ হয়ে উঠতে পারে কিনা, বা আর কী কী করলে আমি মানুষ হয়ে উঠতে পারবো, সম্পাদিকা অনুমতি দিলে পরে কোনোদিন এ নিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। আপাতত আসুন, রসময়ের চায়ের দোকানের ছারপোকাসমৃদ্ধ তেল কুচকুচে বেঞ্চিতে পা তুলে বসে – 

‘…দেশলাই? আছে।

ফুঃ, এখনও সেই চারমিনারেই রয়ে গেলে?

তোমার কপালে আর ক’রে খাওয়া হল না দেখছি।

বুঝলে মুখুজ্জ্যে, জীবনে কিছুই কিছু নয়

যদি কৃতকার্য না হলে।…’


ঠিক ধরেছেন। সুভাষ মুখুজ্জে। মুখুজ্জের সঙ্গে আলাপ। যত দূরেই যাই, ১৯৬২। আড্ডার মেজাজেই কবিতা লিখতেন সুভাষ মুখোপাধ্যায় – সহজ কথায়, আটপৌরে মেজাজে – 

‘…আকাশে গুড়গুড় করছে মেঘ –
ঢালবে।
কিন্তু খুব ভয়ের কিছু নেই;
যুদ্ধ না হওয়ার দিকে।
আমাদের মুঠোয় আকাশ,
চাঁদ হাতে এসে যাবে।
ধ্বংসের চেয়ে সৃষ্টির,
অন্ধকারের চেয়ে আলোর দিকেই
পাল্লা ভারি হচ্ছে।…’ 


দেখলেন? আড্ডার এই এক মুশকিল। কোথা থেকে কোথায় ছুটে যায় – আগে থেকে অনুমান দুষ্কর। কবিতা নিয়ে নিছক আড্ডা মারতে বসেই এই যে দুম করে একটা বোম্বাস্টিক কথা বলে ফেললাম – কবিতার জন্ম হয় অন্তত দু’বার - 

দাঁড়ান দাঁড়ান, আগে নিজে ব্যাপারটা বুঝি কিনা দেখি - নিজে বোঝার আগে অন্যকে বোঝানো যায় নাকি? 

আচ্ছা, জীবনে সব অভিজ্ঞতা কি আমরা জলের মতন পরিস্কার বুঝি? জল কি পরিস্কার? স্বচ্ছ? জল-কেও কি পুরোপুরি বুঝি? জলের অপর নাম জীবন – জীবন বুঝি? জীবনের কোন জিনিসটা আমরা পুরোপুরি বুঝি বলুন তো? আমার আঠাশ বছরের চব্বিশ গুন সাত বউ – পঁচিশ বছরের চব্বিশ গুন সাত পুত্র – চিনি? বুঝি? পিকাসো গগ্যাঁ বুঝি? ফিদা হুসেন গণেশ পাইন বুঝি? ভীমসেন যোশী বিসমিল্লা খান? গুলাম আলি জগজিৎ সিং? গজল? রবীন্দ্রসঙ্গীত? ‘ফুলের মত সহজ সুরে, প্রভাত মম উঠিবে পুরে’ – এর মানে কি? ফুলের আবার সুর কী? ‘বাদলদিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান / আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান’ কী মানে এর? কী বুঝলাম? 

তবে হঠাৎ কবিতার আগাপাশতলা, মাথার চুল থেকে পায়ের নখ - প্রত্যেকটা অণু পরমাণুকে সেকালের বৌ পছন্দ করার মতো ‘একটু হাঁটো তো মা’ ‘খোঁপাটা খোলো তো মা’ করে বুঝতেই হবে – এ মাথার দিব্যি কে কখন কোথায় কবে কেন দিয়েছেন? গুয়ের্নিকার সামনে দাঁড়িয়ে আমরা বলে উঠি – বাঃ – ঋষভ-ধৈবত বুঝিনা, কিন্তু ভীমসেন-কালোয়াতিতে চোখ বুঁজে বিজ্ঞের মতো মাথা দোলাই – গুলাম আলি শুনে বলি – ওয়াহ্, কেয়া বাত – কিন্তু কবিতার ক্ষেত্রে? নাক মুখ কুঁচকে চোঁয়া ঢেকুর কন্ঠে বলি – কিস্যু বুঝলামনা! সর্বনাশের বীজতলাটি ঠিক এইখানেই – ‘গভীরতম অসুখ’। তবু বোঝার চেষ্টা করা যাক – চেষ্টাই বলছি, কারণ – জানিনা টার্মিনাস অবধি পৌঁছনোর মতো পেট্রল রসদ আছে কিনা – নিজের ক্ষমতা কি কেউ কোনোদিন সঠিক জানতে বা বুঝতে পারে? – তবু, এটা কৈফিয়ৎ নয়, বরং আত্মখনন সঠিকতর শব্দ – যদিও বীজতলার যেখানে কোদাল পড়বে, সেটা পাথর নাকি মাটি – জানিনা, এবং খনন সম্ভব হলেও কোনো নিরঙ্কুশ সত্যের শাশ্বত শিলালিপি উদ্ধার হবে কিনা – তাও জানা নেই।

তবু – এগোনো যাক। আড্ডাই তো – মহামান্য আদালতের সামনে গীতা ছুঁয়ে তো শপথ বাক্য পাঠ করছি না - প্রবন্ধ তো নয়, যে হাড়হিম কোনো উপসংহারে পৌঁছতেই হবে। 

গত শতাব্দীর সাতের দশকে কলকাতা রবীন্দ্রসদনে কোনো এক সঙ্গীতানুষ্ঠান শুরুর আগে এক অনু্রাগিনী একটা বিশেষ গানের অনুরোধ জানালে উত্তরে দেবব্রত বিশ্বাস বললেন – যদি আসে, গাইমু – তারপর স্টেজে উঠে শুরু করলেন তাঁর উপাসনা – গানের সূত্র ধরে কথার সঙ্গে কথা, শব্দের সঙ্গে শব্দ, সুরের সঙ্গে সুর, গানে গানে বন্ধন টুটে অনুভূতির সঙ্গে অনুভূতি বুনে বুনে আলোর মালা গাঁথতে গাঁথতে চললো তাঁর ভাবের বিস্তার – পূজা প্রেম বা প্রকৃতি সব একাকার - প্রত্যেকটা গান বর্ণ শব্দ সুর বোধ সহ নতুন করে আবিস্কৃত হলো একটা বৃহৎ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ হিসেবে – সে শরীর সুন্দরের, সত্যের, জীবনের। আর সেই অনুরাগিনী? অনুরোধের সেই গানটির কথা ততক্ষণে বিস্মৃত হয়ে সেই মহাসত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজস্ব আবিষ্কারে তন্ময় বিভোর। 

দেবব্রত বিশ্বাস নির্মাণ করলেন, আর সেই অনুরাগিনী সমেত সদন ভর্তি শ্রোতারা প্রত্যেকে নির্মাণ করলেন নিজস্ব নিজস্ব শ্রবণ অভিজ্ঞতায়। কবিতাই তো লিখলেন দেবব্রত সুনীল সাগরে, সহস্র শ্রোতার বুকের শ্যামল কিনারে আলাদা আলাদা করে যার জন্ম হলো – সে-ই তো তুলনাহীনা, তারও নাম তো কবিতা। 

শুয়ে আছে বিছানায়, সামনে উন্মুক্ত নীল খাতা
উপুড় শরীর সেই রমণীর, খাটের বাইরে পা দু’খানি
পিঠে তার ভিজে চুল
                           এবং সমুদ্রে দুটি ঢেউ
ছায়াময় ঘরে যেন কিসের সুগন্ধ,
                                             জানলায়
রৌদ্র যেন জলকণা, দূরে নীল নক্ষত্রের দেশ।

কী লেখে সে কবিতা? না কবিতা রচনা করে তাকে?


কবিতার শরীরটা লক্ষ্য করুন – প্রথম দু’টি লাইনে দুটি করে চারটি বাক্য বা ছবি – মধ্যিখানে যতিচিহ্ন। লাইনের শেষটা মুক্ত। তৃতীয় লাইনটি দৈর্ঘ্যে ছোটো - একটি ছবি, যতিহীন, আর চতুর্থ লাইনে বাঁদিকের মার্জিন থেকে অনেকটা শূন্যতার শেষে ‘এবং সমুদ্রে দুটি ঢেউ’। তৃতীয় লাইনের ‘ভিজে চুল’ থেকে লাইনের শেষাংশ হয়ে চতুর্থ লাইনের প্রথমাংশ – পাঠকের স্বাধীনতা – খোলা আকাশ – ইচ্ছেমতন সেই রমণীশরীরের আরো কিছু ছবি ওই শূন্যস্থানে বসিয়ে নিন, অন্যথায় ওই শূন্যতার ছবিও রাখতে পারেন। লক্ষ্য করুন, দ্বিতীয় লাইনের রমণী চতুর্থ লাইনে সমুদ্র হয়ে গেছেন উপুড় শরীরের রেখায় ঘাড় থেকে নিতম্ব ঢেউ রচনা করে। ছবির আবহ তৈরি হচ্ছে পরবর্তী তিন লাইনে – ঘর, ঘর থেকে জানলা গলে বাইরে এসে মহাশূন্য - একমাত্রিক, দ্বিমাত্রিক, ত্রিমাত্রিক - এবং শেষে দাঁড়ি, পূর্ণযতি। সিনেমার ভাষায় ‘কাট্’। অষ্টম লাইনে বিরতি। এবারে কবির প্রশ্ন – 

কে কাকে লিখছে – উপুড় রমণী কবিতা লিখছে, নাকি কবিতা সেই রমণীর ছবি আঁকছে? একদম সিনেমার মতো - পথের পাঁচালী - ইন্দির ঠাকরুণের দাওয়া – সন্ধ্যেবেলা – স্ক্রিন জুড়ে মাটিলেপা এবড়োখেবড়ো দেয়ালে পিসি আর ছোট্টো দূর্গা-অপুর মুখোমুখি ত্যারাব্যাঁকা ছায়া – এত্তোবড়ো - পিসির হাড়জিরজিরে হাত নড়ছে, আঙুল নড়ছে, পিসি গল্প বলছেন – হাঁউমাউখাঁউ – ক্যামেরা পিছিয়ে গেলো – দাওয়ায় বসে ভাইবোনে – হাঁ করে পিসির দিকে তাকিয়ে – উভয়ের মাঝখানে হ্যারিকেনের আলো কাঁপছে – ক্যামেরা আরো পেছোচ্ছে – পিসির জীর্ণ ঘর, উঠোনের মাঝখানে তুলসীমঞ্চ… যেন ওই হাঁউমাউখাঁউ গল্পটা দাওয়ার মাটিলেপা মেঝে থেকে গড়িয়ে নেমে এলো উঠোনে...

এটা কী? সিনেমা? নাকি সিনেমায় কবিতা লিখলেন সত্যজিৎ?

কোনটা কবিতা? সুনীল যা করলেন, সেটা কী - ছবি লেখা নাকি কবিতা আঁকা? শেষ লাইনের প্রশ্ন দুটি কি আদৌ প্রশ্ন, নাকি উত্তর? ছয় বাই সাত বিছানা থেকে এই যে অসীম অনন্ত ছ’লক্ষ বাই সাতলক্ষ আলোকবর্ষ নক্ষত্রের দেশ – অথচ সুনীল পৌঁছে গেলেন মাত্র সাত পা হেঁটে – সাত লাইনের শেষে সপ্তম স্বর্গে পৌঁছোলেন সুনীলের হাত ধরে পাঠকও - এই যে পথ, যে বেঁধে দিলো বন্ধনহীন গ্রন্থি – এই তো কবিতা!

Poetry is a journey of experience with imaginative awareness expressed through meaning, sound, and rhythmic language choices so as to evoke an emotional response. Poetry is an ancient form that has been going through numerous and drastic reinvention over time. The very nature of poetry as an authentic and individual mode of expression makes it nearly impossible to define.

আদৌ কোনো সংজ্ঞা হয়না, এটাই বোধহয় কবিতার আসল সংজ্ঞা। 

পাবলো নেরুদার কবিতার অংশ – অনুবাদ সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের – এখানে কবিতার শরীর অতো গোলগাল নয়, টানটান মেদহীন – কবিতার চরিত্র গঠনে শরীরের ভূমিকা কতখানি, বোঝা যায়। 

এসো দেখ রক্ত রাস্তাময়
এসো
দেখ রক্ত রাস্তাময় -
এসো দেখ
রক্ত রাস্তাময় - 
এসো দেখ রক্ত

রাস্তাময়

চারটি শব্দ নিয়ে প্রথম বাক্য বা লাইনে একটা গোটা বিবৃতি – স্লোগানের মতো। পরবর্তী তিনটে বাক্যেও ঐ চারটিই শব্দ – পরপর, একইভাবে – অথচ তিনটি বাক্যের তিনটি ভিন্ন শরীর – এক একটি শব্দের শেষে লাইন ভেঙে ভিন্ন ছবি, ভিন্ন বিবৃতি – আবার শেষ বাক্যে ‘রক্ত’ ও ‘রাস্তাময়’-এর মাঝে একটা আস্ত লাইনের নিস্তব্ধতায় যেন রক্তের স্রোত বা বিস্তৃতির গতিটাও পাঠকের বোধগম্যতাকে ছুঁয়ে যায়। নৈঃশব্দের দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে অনুভূতি ক্রমাগত প্রতিধ্বনিত হয় – যেন অক্ষরগুলো আস্তে আস্তে বড়ো হয়ে উঠছে – ১২ পয়েন্ট থেকে ১৪ ১৬ ১৮ ২৪ ৩৬ …… তিন অঙ্ক, চার অঙ্ক …… 

এই পংক্তিগুলো এভাবেও তো লেখা যেতো – 

এসো দেখ রক্ত রাস্তাময়
এসো - দেখ রক্ত রাস্তাময় -
এসো দেখ - রক্ত রাস্তাময় - 
এসো দেখ রক্ত – 
                       রাস্তাময়

একইরকম কি হলো? অর্থ? কবিতার মেজাজ? হলো না। তীরের ফলার মতো বিঁধলো? বিঁধলো না। ধারালো শব্দগুলো কেমন যেন সেই তীক্ষ্ণতা বা নিজস্ব ঝাঁঝ হারিয়ে ফেললো। আর, কবিতার শরীরের সেই ঋজু বলিষ্ঠ সিক্সপ্যাক্‌ চরিত্রটাও উধাও। অর্থাৎ, কবিতার ক্ষেত্রেও ‘পহলে দর্শনধারী’ তত্ত্ব পূর্ণমাত্রায় বলবৎ। 

আরো একটা কারণে কবিতার শরীর খুব গুরুত্বপূর্ণ – ছন্দ। তাল। কবিতার মেজাজ অনুযায়ী কবি ছন্দে বাঁধেন কবিতাকে –

‘বাবুদের        লজ্জা হল
আমি যে         কুড়িয়ে খাবো
সেটা ঠিক       সইল না আর
আজ তাই        ধর্মাবতার
আমি এই         জেলহাজতে
দেখে নিই        শাঠ্যে শঠে।...’


হ্যাঁ। শঙ্খ ঘোষ। লজ্জা। কবিতার শরীর দেখেই পাঠের সময়ে পাঠক ছন্দটাকে বুঝে ফেলছেন অনায়াসে। এই প্রসঙ্গে অন্য এক কবির একটা কবিতার উদাহরণ দিই – কবি লিখলেন - 


চুম্বন      এক মন্দির উপাসনার
চুম্বন      মহাকাব্য সংস্করণ
চুম্বন      মৃতসঞ্জীবনীর সুধা
চুম্বন       দুই ওষ্ঠে সেতুর গড়ন ... 



এ কবিতায় ছন্দটা লক্ষ্য করুন। সহজ ছন্দ – 

চুম্বন এক । মন্দির উপা । সনার 
চুম্বন মহা । কাব্যসঙস্ । করণ … ইত্যাদি – 

অথচ কবির লেখার বিন্যাসে ‘চুম্বন’-এর পরে খানিকটা শূন্যস্থান। কেন? – আরে মশাই, সামান্য জল খেলেও ঢেকুর তোলার সময়টা লাগে, চুমু খাওয়ার জন্য সময় দেবেননা? ‘চকাস্’ – ব্যাস, শেষ? ছোঁয়াটা একটু প্রলম্বিত করবেননা? চুমুর রেশটাকে মাথায় রাখবেননা? ছন্দের সঙ্গে সঙ্গে এই যে প্রতিটি স্তবকে প্রতিটি লাইনে ‘চুম্বন’ ফিরে ফিরে আসছে – মাথা থেকে পা অবধি – শরীরের মহাদেশ জুড়ে - বৃষ্টির মতো - এরও একটা আলাদা ইয়ে আছে বৈকি! 

এখন এই কবিতাটা পত্রিকায় ছাপা হলো এইভাবে – 

চুম্বন এক মন্দির উপাসনার
চুম্বন মহাকাব্য সংস্করণ
চুম্বন মৃতসঞ্জীবনীর সুধা
চুম্বন দুই ওষ্ঠে সেতুর গড়ন ...


কবির তো মাথায় হাত। নিজের সন্তানকে চিনতেই পারছেননা কবি। কেমন অন্যরকম দেখতে। কবিতাটাও বোধবুদ্ধিহীন শান্তিগোপাল হয়ে পড়লো না কি? 


শরীর। সৌন্দর্য বা চরিত্র নির্মাণে এই শরীরের ভূমিকাটাকে ছোটো করে দেখা – মস্ত বড়ো এক ভুল বা ভণ্ডামি আমাদের। মেয়েটি দেখতে বেশ সুন্দর – বললে আশেপাশের শ্রোতাদের আড়চোখ এসে পড়বে আপনার ওপরে। এবারে আপনি যদি বলেন – চোখদুটি যেন শ্রাবণদীঘির মতো টৈটম্বুর, ঠোঁট যেন ...... বলতে বলতেই আপনার ঘোর কেটে যাবে – আপনার মাথায় আসবে - কে কী মনে করবে! অথচ আপনার অনুভূতি ততক্ষণে তার ঠোঁট, বুক, নাভি, কটিদেশে আপনার পূজা পৌঁছে দিয়েছে – গোপনে। ডেভিডের মর্মরমূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আমরা তার ঊরুসন্ধির দিকে লুকিয়ে দৃষ্টি ফেলবো, মুখ ফুটে কিছু বলতে পারবো না। শরীর নিয়ে আমাদের এ ভণ্ডামির মধ্যেও একরকম অন্ধ মৌলবাদী সন্ত্রাসের বীজ নিহিত। 

ধন্যবাদ। অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছিলাম। ধরিয়ে দিলেন বলে। আড্ডার এই মুশকিল। কখন কোনদিকে - যাকগে, যা বলছিলাম – শরীর – সুনীল দাশের ছবি – দেখুন, কী জৌলুশ, কী গতি – প্রতিটি রেখায়, রেখার গভীরতায়, আঁচড়ে, রঙে টের পাবেন – ক্ষুরের টগবগ শব্দ শুনতে পাবেন - ছবি দেখতে দেখতে আপনিও উদ্দাম দৌড়োবেন –




এ কী শুধুই একটা ছবি? কবিতা নয়?


দেবব্রত বিশ্বাসের গানে ফিরে যাই। বিখ্যাত গান। যতটা রবীন্দ্রসঙ্গীত, ততটাই দেবব্রতসঙ্গীত। দেবব্রত কন্ঠেই এ গান অমর। ‘তোরা যে যা বলিস ভাই’ – প্রতি স্তবকের শেষে ঘুরে ঘুরে আসছে – ‘আমার সোনার হরিণ চাই / আমার সোনার হরিণ চাই / তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’ – সুরটা স্মরণ করুন আর দেবব্রতর গায়কিটা মনে করুন – যদি লিখে বোঝাতে চাই, ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়ায় –

আমার সোনার হরিণ চাই
আমার সোনার হরিণ চাই
তোরা যে যা বলিস ভাই
আমার সোনার হরিণ চাই ……… 


এই যে এক একটা শব্দের উপর বিশেষ ঝোঁক দিয়ে অর্থ থেকে অর্থান্তরে যাত্রা – এ আবিষ্কার কি গানের রচয়িতার, নাকি কন্ঠশিল্পীর? নাকি এও সেই আদপে কবিতাই?


আর একটা মজার ব্যাপার ঘটে কবিতায়। শুধু কবিতায়ই নয়, যে কোনো সৃষ্টিকর্মেই। ওই যে প্রথমেই যে কথা বলেছি – কবি তো তাঁর ভাবতন্ময়তায় জন্ম দিলেন কবিতার। এবারে পাঠকের ভাব থেকে ভাবান্তরে কবিতার বারবার জন্ম হয়। 


‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে’ 

– শিশির পড়ার শব্দ? তার মানে নৈঃশব্দ, অর্থাৎ নিঃশব্দে সন্ধ্যার আগমন বোঝাচ্ছেন কবি। তাহলে শিশিরের মতন বললেই পারতেন। শিশিরের শব্দ বললেন কেন? নৈঃশব্দের শব্দ? ‘আমার নির্জন উৎসবে অম্বরতল হয়নি উতল পাখির কলরবে’ – উৎসব, কিন্তু নির্জন – নিঃশব্দে তো নিদ্রাও আসে, পটিবেগও আসে, প্রেমও আসে, দুঃখ আসে – শিশির কেন? পাঠক আবার গর্ভবতী হলেন – চললো গর্ভযন্ত্রণা – শিশিরের মধ্যে একটা সদ্যোজাত শিশুর পবিত্রতা আছে – নিষ্পাপ ভেজালহীনতা আছে - ঈশ্বরনির্মাণ আছে… ‘শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোৎস্নার মত যোনি…’ - কবি লিখেছিলেন ভাবের ডালে চড়ে, পাঠক দৌড়ে বেড়াচ্ছেন পাতায় পাতায় – বিভিন্ন কৌণিক দূরত্ব থেকে কবিতাটিকে দেখছেন – ‘এসো দেখ রক্ত রাস্তাময়’ ‘এসো / দেখ রক্ত রাস্তাময়’… ‘আমার সোনার হরিণ চাই / আমার সোনার হরিণ চাই’… আর ক্রমাগত নতুনতর মাতৃত্বের উল্লাসে মেতে উঠছেন। 


এক একবার পাঠের সময়ে এক একটা শব্দের উপর ওই ঝোঁক আমূল বদলে দেয় অর্থ – কবিতার মাত্রার বদল হয়ে যায় হঠাৎ করে –

‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

বিগত ষাট বছর ধরে পৃথিবীর সর্বত্র বাঙালি কবিতাপ্রেমীকে এই প্রশ্ন লক্ষাধিকবার করেছেন, করে চলেছেন বনলতা সেন – অথচ এ প্রশ্ন উচ্চারণের সুর নিয়ে গবেষণা সেই প্রথমদিন থেকে শুরু, চলবে আরো ছ’শো বছর – স্বরলিপিও লিখে যাননি জীবনানন্দ – প্রশ্নটায় ঠিক কোন শব্দে জোর – 

এতদিন কোথায় ছিলেন?’
নাকি
‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

দুইভাবে উচ্চারণ করলে দুটি প্রশ্নের আলাদা আলাদা অর্থ। আলাদা আলাদা অভিঘাত। পাঠক নিজস্ব বোধ অনুযায়ী নিজস্ব অর্থ নির্মাণ করে নেন। তেমনি –

'পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন'

নাকি

'পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন'

কোনটা সত্যি? 




১৩৫০০-র উপর ছবি এঁকেছেন পাবলো পিকাসো তাঁর ৯১ বছরের জীবনে। গ্যুয়ের্নিকা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি কীর্তি – ১৯৩৭ সালের কাজ। গ্যুয়ের্নিকা শহরের ওপর নাৎসি সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষনের প্রতিবাদে আঁকা তাঁর এই ছবি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ যুদ্ধবিরোধী চিত্রশিল্প হিসেবে স্বীকৃত। আধুনিক চিত্রশিল্পে ফ্যাসিবাদের চরম বীভৎস ও ক্রুর রূপ যেন নাজিম হিকমতের কবিতার মতো – এক নারী ও তার প্রসারিত হাত, যন্ত্রণাক্লিষ্ট ঘোড়া ও মহিষ সহ ছবির প্রত্যেকটি এলোপাথাড়ি উপাদানের রঙ রেখা ও আকার, গাঢ় অন্ধকারের একবর্ণ চরিত্রের মধ্য দিয়ে বিমূর্ত যেন এক দীর্ঘ কবিতার সংলাপ। সেই পাবলো পিকাসোর উক্তি - Painting is a blind man's profession. He paints not what he sees, but what he feels, what he tells himself about what he has seen." 


কবিতাও তো আদপে তাই – দৃশ্য থেকে অদৃশ্যে অথবা দৃশ্যান্তরে – শব্দ থেকে নৈঃশব্দে বা শব্দান্তরে যাঁর অনায়াস ভ্রমণ, তিনিই তো কবি।

এক কবির জবানবন্দীতেই বলা যাক -

লিখবো বলে যখন সাদা পৃষ্ঠার মুখোমুখি হই – যেন বিবাহসন্ধ্যায় শুভদৃষ্টি অনুষ্ঠান – পরস্পরের চোখে চোখে সেতু – রোজ যে সেতুবন্ধন হয়, তা নয় – আয়নার সামনে তো রোজ চুল আঁচড়াই, চোখাচোখি তো রোজ হয়না – রোজ তো জিজ্ঞেস করিনা – ‘কী হে, ভালো তো?’ কিন্তু সাদা পৃষ্ঠার মুখোমুখি যখনই আসি, রবীন্দ্রসংগীতের সুরে প্রশ্ন করি - ‘ভালো আছো সোনাই?’ উত্তরের মেজাজ ওতরফের রোজ থাকেনা – তাই সেতুবন্ধন রোজ হয়না – সব বীর্যের গায়ে কি সন্তানঠিকানা লেখা থাকে? কিন্তু যেদিন হয় – যে মুহূর্তে হয়, তার পরের ব্যাপারটায় আর আমার কোনো রাশ থাকেনা – আমার হাতে থাকে নিদেন একটা কলম কিম্বা ল্যাপটপের অক্ষরবোতাম – ব্যাস্ – 

আমার কাজ গণেশের, বেদব্যাসের নাম সময়। 

নিজস্ব বোধ ও অনুভূতির স্খলিত বীর্যে অবশ্যই নির্মাণ-তাগিদ মিশে থাকে শ্বেতঅম্লকণা হয়ে – কিন্তু এটাও সত্য যে, তখন সেই ঝোড়ো অন্ধকারে, সেই পর্বতের অন্দরদেশে তছনছ ভাঙচুরের মধ্যে ছেনিহাতুড়ির ধাতবশব্দ – যেন কাঁসরঘন্টা ধূপধুনোর আবহে কবি ও সাদা পৃষ্ঠার যৌন-উপাসনা শৃঙ্গারআরতি – ঈশ্বরনির্মাণ - নিরন্তর খোদাই হচ্ছে, একটু একটু করে আবিস্কৃত হচ্ছে প্রেম - এক আশ্চর্য সুন্দর সত্য মুর্তি – বনলতা সেন থেকে অনামিকা সেন মিলে মিশে যেন একই মিছিলের সম্মিলিত একাকার রূপ – যেন স্বপ্নের সেই শ্রেণীহীন সমাজ – সমস্ত অস্তিত্ব মিলে এক মহা অস্তিত্ব – সাত রঙ মিলে এক সাদা রঙ – সব অনুভূতি মিলে এক মহা সত্য – জীবন। 


এই একই শৃঙ্গার সমান্তরাল বেগে চলে পাঠকেরও বোধে মননে – কখনও কবির অনুভূতির সঙ্গে সাজুয্য রেখে, আবার কখনও বা অন্য কোনো নতুন উপলব্ধির আলোয় গা ভাসিয়ে। 

কবিতার জন্ম ঘটে যায় আপনা আপনি – নিজস্ব খেয়ালে – মাদাম ক্যুরি নিমগ্ন থাকেন গবেষণায়, রেডিয়মের জন্ম হয় কালের নিয়মে। 


কবি ও পাঠক উভয়েই ডুব দেন সাদা পৃষ্ঠার শরীরে – ডুব দেবার তাগিদ হয়তো ভিন্ন ভিন্ন জাগতিক অনুভূতির তাড়নায় – অসহ্য একাকীত্ব থেকে নয়তো একটা শাস্ত্রীয় চুম্বন থেকে উঠে সাদা পৃষ্ঠায় ডুব দিয়ে গভীরতম পাতালপ্রদেশ থেকে দু’হাত ভরা মণিমুক্তো নিয়ে ভেসে ওঠেন দুজনেই – প্রথমে কবি, তারপরে পাঠক – ব্যক্তিগত ইন্দ্রিয়সুখ ছাপিয়ে মুখ্য হয়ে ওঠে আবিষ্কার – তার গায়ে কিসের গন্ধ – সুখের না বিষাদের – সে যাচাই ডুবে যায় সানাইয়ের জোয়ারসুরে – রজনীগন্ধার শ্বেতবিলাসে – ভালোবাসার অমোঘ গোপন অভিসারে।


সে অভিসারের সাথি কে – কবি বা পাঠক কেউই উচ্চারণের বিড়ম্বনায় তখন ক্লিষ্ট হতে চাননা। বরং সদ্যোজাত কবিতাকে সন্তানের মতো বুক দিয়ে আগলে উভয়েই একাকী হেঁটে যান সেই অন্ধকার নির্জনতার দিকে, যেখানে পরস্পরকে ছুঁয়ে ফিসফিস করে বলে ওঠেন –


পাগলি,
তোমার জন্য স্বপ্নের বাসস্টপে অনন্ত অপেক্ষায় রাজি
তোমার জন্য আর একটুও অপেক্ষা করতে হলে মরে যাবো 
তোমার জন্য রসময়ের দোকানের উনুনে আঁচ নেভেনা, লাবডুব লাবডুব - কেটলি ফুটছে তো ফুটছেই - সারাক্ষণ, দিনরাত, বছরভর, 
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে…… 


বাবা রসময়, তোমার ঐশ্বরিক রসভাণ্ডার থেকে আর এক ভাঁড় উষ্ণ রস নির্মাণ করো – তৎসহ একটি চার্মিনার

4 comments:

3

প্রবন্ধঃ আইভি চট্টোপাধ্যায়

Posted in



প্রবন্ধ




প্রসঙ্গ : ১০০বছরের শ্রেষ্ঠ নিগ্রো কবিতা
(অনুবাদ – শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মুকুল গুহ )
আইভি চট্টোপাধ্যায় 


সাম্প্রতিক কবিতার জগতে আমার প্রবেশাধিকার স্বচ্ছন্দ নয়। বস্তুত দু’চারজন বিশিষ্ট চিন্তাশীল জীবন-অনুভবী সত্যদ্রষ্টা কবি মনীষী ছাড়া কারো কবিতায় আমার মনের জগতে নাড়া পড়ে না। আবার এই অজ্ঞতা আর না-বোঝা থেকেই মনে মনে একটা টানও টের পাই। কবিতা আমায় টানে। অপ্রতিরোধ্য সে টান। কবিতার প্রতীকীবাদ, ছায়াবাদ, প্রগতিবাদ, বস্তুবাদ, সমাজবাদ, বিপ্লববাদ, দেহধর্মবাদ, সহজিয়াবাদ, মরমিয়াবাদ ইত্যাদি নানা প্রকট বা অপ্রকট মতবাদের চাপে অনেক সময়ই যেমন সহজ ছন্দোময় সুললিত সুভাষিত সুবোধ্য রসটি নিতে পারি না, তেমনই অনেক সময় কোনও পঠনের পর ভিন্ন রুচির কবিমানুষের প্রজ্ঞামনের আর আনন্দ-অনুভূতির সুরটি অতীন্দ্রিয় জগতের আভাস এনে দেয়। কখনও অকারণেই অনামী এক কবির একটি কবিতা আকর্ষণ করে। কোনও কবিতার একটি লাইন ঝলমল করে উঠেছে, কখনও বা কোনও কবিতা শব্দঝঙ্কারে কানকে তৃপ্তি দিয়েছে, আপাত-সাধারণ কোনও একটি পংক্তি সমুদ্রের ঢেউ হয়ে এসে মন জুড়ে থেকেছে। কবিতা বুঝি বা না বুঝি, এটুকু বুঝি যে এ এক মায়া মায়া জগত। কবিতার জগত এক অন্য জগত। এই ভাবনা থেকেই আমার কবিতাপাঠে আগ্রহ বাড়ে।

সদ্যপঠিত কোনও কবিতার বই সম্বন্ধে লিখতে বেশ দোলাচলে পড়লাম। কবিতাচর্চার জন্য যতখানি জ্ঞানের দরকার, তা আমার নেই। সাহিত্যচর্চার আনন্দে যেটুকু কবিতাপাঠ, আমার পুঁজি সেটুকুই। সেই সম্বল নিয়ে কোনও পত্রিকার কবিতা-সংখ্যায় অন্তরঙ্গভাবে যোগ দেবার ক্ষমতা বা অধিকার আমার আছে বলে মনে করি না আমি। এমন সময় আমার হাতে এল এই কবিতার বইটি। “১০০ বছরের শ্রেষ্ঠ নিগ্রো কবিতা : অনুবাদ শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মুকুল গুহ”।

প্রথম নজরে বইটির প্রচ্ছদ বেশ আকর্ষণ করলো। কালো রঙের পশ্চাতপটে সাদা ডানা ঝাপটানো পাখির বিমূর্ত আবছায়া। ‘নিগ্রো’ আর ‘কালো’ শব্দ দুটি প্রায় সমার্থক বলেই বোধহয় প্রচ্ছদ শিল্পীর এই তুলির টান। কবিতাগুলো কিন্তু ‘কালো’কে ছাপিয়ে উঠে আলোর ছবি আঁকে।

‘নিগ্রো’ শব্দটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে দাসত্ব, অপমান আর কান্না। বিদ্রোহ আর সংগ্রামের অনুভূতি। অনুবাদক কবিযুগল পরম মমতায় সেই অনুভূতি ধারণ করেছেন প্রতিটি কবিতায়। কবিতার সঙ্গে উপরি পাওনা নিগ্রো কবিতার ইতিহাস এবং নিগ্রো কবিদের পরিচিতি। তথ্যের কারণেও এ বইটি স্বচ্ছন্দে একটি লাইব্রেরির সংগ্রহ তালিকায় জায়গা করে নিতে পারে। 

কোনও একজন কবির রচনাশৈলী, নির্মাণভাষা, বৈচিত্র্য, শব্দের কারুকাজ নিয়ে আলোচনা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। কবিতার অনুবাদ হয়েছে যে দুজন কবির হাত দিয়ে, তাঁরাও সে নিয়ে মাথা ঘামান নি। কবিতাগুলো নির্বাচন করেছেন অনুবাদক কবিরাই। তাঁদের বিবেচনাই এ সঙ্কলনের মূলসূত্র। আমার মনে হয়েছে, একটি সময় বা কালকে ধরে রাখা যেমন এ সংগ্রহের উদ্দেশ্য তেমনই ভাষা ও ব্যঞ্জনায় বৈচিত্র্যও মাথায় রাখা হয়েছে। তবু অনেক নিগ্রো কবির কবিতা এ সঙ্কলনে স্থান পায় নি, সে নিয়ে আমাদের আগ্রহ থেকেই যায়। 

এই সংগ্রহের কবিতাগুলো লেখা হয়েছে ১৮৬৮ থেকে ১৯৬৮ সালে। ১০০ বছরের কবিতা। বইটির ভূমিকা পড়ে জানতে পারি, প্রথম আমেরিকান নিগ্রো যিনি কবিতা লিখেছিলেন, তিনি একজন মহিলা, নাম লুসী টেরী। তিনি একজন ক্রীতদাসী ছিলেন। তারপর যাঁদের নাম পাওয়া যায়, তাঁরা জুপিটার হ্যামন, ফিলিস সুইটল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে অনেক নিগ্রো কবির প্রকাশ। ক্লড ম্যাকে, জেন টুমার, ল্যাংসটন হিউজেস এমন অনেক কবি। “বস্তুত সমস্ত নিগ্রো সাহিত্যের কবিতার ইতিহাসই জ্বলন্ত জীবনের স্পষ্ট ইতিহাস। ভাল লাগা, ভালবাসা, সংগ্রামের গতিশীল ইতিহাস, যে ইতিহাস মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে প্রতিনিয়ত।’’

“সূর্য এসেছিলো মিস ব্রুকস, রাত্রির অন্ধকার 
পার হয়ে মুখের হাপরে আগুনের হল্কা ছুটিয়ে,
আর আমরা সরে পড়েছিলাম, সব নির্মাণ নষ্ট হয়ে গেল
কঠিন হাতুড়ি সংকেতের জন্য তৈরি নয় আমাদের
চোখ, কান, হৃদয়ের, অন্তঃকরণের –
এখন সূর্য রক্তের লাল বমন করতে করতে ঐ পাহাড়
পেরিয়ে চোখের জল লুকোচ্ছে ..
…আজ যে অন্ধকার ঠিক আগের মত নয়-

সূর্য এসেছিলো ঠিক তার কথা রেখেছিলো মিস ব্রুকস..” (“সূর্য এসেছিলো”- এথ্রিজ নাইট, ১৯৩৩)

ইতিহাস বলে, ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে স্পেনের মানুষরা আমেরিকায় প্রথম আফ্রিকান নিগ্রো মানুষদের ক্রীতদাস হিসেবে এনেছিলো। ১৬১৯ সালে ভার্জিনিয়ার জেমসটাউনে প্রথম আফ্রিকান নিগ্রো ক্রীতদাস হিসেবে এসেছিলো বলে জানা যায়। যদিও ভার্জিনিয়ার আইনে নিগ্রোদের ক্রীতদাস হিসেবে উল্লেখ করা হয় ১৬৬২ সালে। এমনও বলা হয়, একবার ক্রীতদাস হলে ক্রীতদাস হিসেবে আজীবন থাকাই নিয়ম। এর মধ্যে ১৬৩০ সাল থেকে ইংল্যান্ডে নিগ্রো ক্রীতদাস আনার জোয়ার আসে। সেই সঙ্গে আমেরিকার বহু জায়গায় তামাক, নীল, আখ, তুলো, ধান ইত্যাদি চাষের কাজে ক্রীতদাসের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। ১৯৭১ সালে আমেরিকায় ক্রীতদাসের অবস্থান পরিষ্কার করে একটি নতুন আইন হয়, যাতে বলা হয় যে আজীবন ক্রীতদাস থাকার নিয়ম খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করলেও একই থাকবে। মানবিক আইনের কথার বিপক্ষে দাঁড়ালো বাইবেলের বাণীও। সবাই একযোগে বিধান দিলেন, ‘দাসত্ব ঈশ্বরের ইচ্ছা। জীসাস কখনও দাসত্বকে আক্রমণ করেন নি। সেন্ট পলও নয়।’ কবিতা পড়ার আগেই কবিতার বইয়ের ভূমিকায় এই কথাগুলো পড়ে পাঠকের চোখে জল আসবে। খুব জানতে ইচ্ছে করবে, কেমন সে কবিতা। এমন দমবন্ধ পরিস্থিতিতে বাস করেও কবিতা লিখতে পারার ক্ষমতা যাঁদের, তাঁরা কেমন আলোর মানুষ। 

“পন্ডিতরা আমাকে বলেছিলো
ক্রীস্টমাস একটা ছেলেখেলা
হয়ত ওদের কথায় সত্যি ছিলো –
দু’হাজার বছর আগে
তিনজন প্রাচ্যদেশীয় পন্ডিতব্যক্তি
একটি তারাকে অনুসরণ ক’রে ক’রে
একটা গোটা মহাদেশ পার হ’য়ে 
আস্তাবলে সদ্য জন্মানো একটি শিশুর 
মধ্যে সুন্দরতা, সরলতা দেখতে পেয়েছিলেন,
এখন যখন বোমা পড়ে,
ভাঙচুর হয়,
সারা পৃথিবী জুড়ে
আজ,
সত্যিকারের পন্ডিতব্যক্তিরা 
কিন্তু জানেন যে,
আমাদের যা করণীয় তা হচ্ছে 
তারাদের অনুসরণ করা আর একবার অন্তত আশার জন্যেও
ওই দু’হাজার বছর আগে
জন্মানো ছেলেখেলার
কিছুটা পাওয়ার জন্য,
যা প্রয়োজন –’’ (“ছেলেখেলা”– ফ্রাংক হর্ন, ১৮৯৯) 

বুকের মধ্যে আবেগ, অকারণে কান্না পায় আমার। কিংবা আওরেন ডডসনের লেখা কবিতা ‘মেরী আজ মারা গেছে’; জিশুর মৃত্যু, জুডাসের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস, এক অপরূপ চিঠি-কবিতা। মার্থাকে লিখছে জোসেফ। দিনপঞ্জীর মতো। অনেক বড় কবিতা, তাই এখানে উদ্ধৃত করা গেল না। ধর্মের গুঢ় তত্ত্বটি হৃদয়ে গ্রহণ করতে না পারলে এমন কবিতা লেখা যায় না। পড়তে গিয়ে পাঠক আমি সচেতন হয়ে উঠি। 

আবার এই কবিতাটা;

“এইমাত্র একটি অদ্ভূত জিনিস দেখতে পেলাম,
সোনালি সোনালি আকাশের পটভূমিতে,
অন্ধকারাচ্ছন্ন সাইপ্রাস বনের উপর দিয়ে
জীবন্ত
সুন্দর
রোগা দীর্ঘ একটা কালো আঙুল
ঊর্দ্ধে দিকনির্দেশ করে রয়েছে –
কেন হে সুন্দর স্থির আঙুল তোমার
রঙ কালো,
কেন ঊর্দ্ধে দিকনির্দেশ করে আছো অচঞ্চল –’’ (“কালো তর্জনী”- ওয়েল্ড গ্রিমকে, ১৮৮০)

এমন বিদ্রোহের সুর, কান্নার গান বেশ কিছু কবিতায়। তবু বুঝি, কোনও প্রাকনির্দিষ্ট মতবাদের জমাট দানা বেঁধে নেই কবির মনে। এ কবিতা পড়ার পর জীবনের সমস্যার ঘোলাজলের আবর্তে শালিখপাখির মত স্নান করার অনুভূতি জাগে না, বরং আসন্ন নদীর জলে বিকেলের সাদা রোদ্দুরের ছবি জেগে ওঠে। 

আমি বিশ্বাস করি, কবিকে হতে হবে অগণিত মানুষের সংগ্রামী জীবনের শরিক। সুখ দুঃখ আনন্দ বেদনার অংশীদার। কবি যখন নিঃসঙ্গতায় আত্মস্থ, তখনও তাঁর মনে বহির্জগতের ছায়া জেগে থাকে। প্রয়োজন ও আবেগ অনুযায়ী কবিতায় তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সেই শিল্পচেতনা, সেই কবিমন সমাজকে প্রেরণা দেয়। 

আর একটি কবিতা...

“স্বাধীনতা কোনদিনই আসবে না
আজ নয়
কোনদিনই নয়
ভয় অথবা সমঝাওতার মধ্যে –
আমারও তো অন্য সকলের মতন 
অধিকার রয়েছে
দুপায়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকার,
দুকাঠা জমির মালিকানার-
শুনে শুনে কান পচে গেল, 
‘সময়ে সবই হবে 
কাল একটা নূতন
দিন’-
মৃত্যুর পরে তো আমার কোন 
স্বাধীনতার প্রয়োজন হবে না,
আগামীকালের রুটি দিয়ে কি আজ বাঁচা যায়-
স্বাধীনতা একটা শক্তিশালী
বীজপ্রবাহ,
প্রোথিত,
একটা বড় প্রয়োজনের জন্যে
আমিও এখানে বাস করি,
তাই
স্বাধীনতা আমার প্রয়োজন-
তোমার যেমন” (“স্বাধীনতা”– ল্যাংনসটন হিউজেস, ১৯০২)

অনুভব করি, ব্যক্তিহৃদয় জীবনের বৃহত্তর পরিধি স্পর্শ করার জন্যে আকুল। এ কবিতা চিত্তকে উন্মুখ করে বৃহতের দিকে, নিমেষে বর্তমান যুক্ত হয় বিগত ও আগামীর সঙ্গে। 

ইতিহাসে পড়েছি, স্বদেশী আন্দোলনের সময় অনেক গ্রাম্য কবির কবিতা, তেমন খ্যাতনামা নন কেউ, সাগ্রহে শুনতো মানুষ। সমাজব্যবস্থার পরিবর্তনে রাজনৈতিক কর্মীর ভূমিকার মতনই কবির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জেনেছি, যুদ্ধক্ষেত্রে বসেও মুক্তিযোদ্ধারা কবিতা লিখেছেন। ভিয়েতনামের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে উঠে আসা অনেক কবিতা সে সময়ের দলিল। এ দেশেও বাঙালি কবিরা লিখেছেন তেভাগা আন্দোলানের পটভুমিতে, দেশভাগের সময়, ইতিহাসের সব সন্ধিক্ষণে।

কবির কাছে তাই মানুষের অনেক আশা। কবি যদি সে কাজে সৎ না থেকে কারো মুখপাত্র হয়ে থাকেন, তাতে সমাজের ক্ষতি। কবির প্রতিবাদ মূল্য হারায়। এ কবিতাগুলো পড়তে গিয়ে এ কথা নতুন করে বুঝি। শুধুই শব্দমালায় প্রতিবাদ, কারো মুখপাত্র হবার দায় নেই, তবু বুকের মধ্যে নাড়া পড়ে। 

“যখন মৃত্যু 
হবে আমার, আমি জানি
বড়সড় একটা শোকসভার আয়োজন হবে নিশ্চয়ই,
কৌতূহলী
লোকজনেরা চারদিকে
ভিড় করে আসবে দেখতে
আমি সত্যি সত্যিই মারা গেছি
নাকি
আর একটা 
গণ্ডগোল পাকাবার
চেষ্টা করছি মাত্র-’’ (“বিদ্রোহী”- মেরী ইভানস, ১৯২১)

বলা বাহুল্য, কবি-মানসিকতার এই ভিন্নতার জন্যেই এই কবিরা সাধারণের মধ্যে থেকে বিশিষ্ট হয়ে উঠতে পেরেছেন। আমার মনে হয়েছে, এ কবিতাগুলোকে পড়তে হলে সেই সময়টা বোঝা দরকার। কারণ, কবিতা সময়ের সৃষ্টি। কবির কাজ পরিশুদ্ধ সমাজের স্বপ্ন দেখানো। অন্ধকারকে অতিক্রম করে সাহিত্যকে প্রবাহিত মনুষ্যত্বের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।

সার্থক কবি মাত্রেই সত্যদ্রষ্টা এবং মানবকল্যাণের আলোকশিখায় উজ্জ্বল। একই সঙ্গে কোমল ও শক্তিশালী। তাই তাঁরা অন্তরতমের সাধনা করতে পারেন। বাল্মিকী, বেদব্যাস, হোমার, দান্তে থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, শেলি, কীটস, মিল্টন, এলিয়ট, হুইটম্যান, সমস্ত কবির মিল এক জায়গায়। তাঁরা মানবমুখী। তাঁরা শিল্পসৃষ্টির কাজটি সততার সঙ্গে করেন। 

এই কবিতাগুলো পড়ার সময় পাঠক সেই সততা চিনতে পারেন। রাজনৈতিক এবং সামাজিক নির্যাতন সহ্য করেও যে তাঁরা কবিতায় দিগন্ত স্পর্শ করেছেন। আজকের কবিতায় যেমন দেখি, বর্তমান মানেই অন্ধকার, সন্ত্রাস, রক্তাক্ত .. ভবিষ্যত নৈরাশ্যব্যঞ্জক। বাঁচার জন্যে যে পরিমাণ উল্লাস, প্রাণ, আলো নিয়ে লেখা দরকার, তেমন বলিষ্ঠপ্রাণ কবি কই?

আধুনিক কবিদের মধ্যে কতজন অমরত্ব পাবেন জানা নেই। কিন্তু বিপুলা এই পৃথিবীর নিরবধি এই কালের প্রেক্ষিতে বেঁচে থাকবেন তাঁরাই, যাঁদের চিন্তাধারা নির্যাসিত। 

যেমন এই কবিতাটি - “একটি নিগ্রো সৈনিকের ভিয়েতনামের ডায়েরি” 

“…আসলে এখানকার বুলেটগুলো আমাদের দেশের বুলেটগুলির 
মতনই হত্যা করতে পারে,
ভয় আসলে যা কিছু অপছন্দ করে সব নষ্ট করে দিতে চায়, 
আর কোনওদিন হত্যা না করার কথা ভেবেছি সারাক্ষণ-
যখন দেশে ফিরব, যদি ফিরি, আমাকে অভিনন্দন জানিও না,
পৃথিবীর সবচেয়ে ঘৃণ্য প্রাণীদের কাছাকাছি ঘুরঘুর করছি আমি
প্রার্থনা করি খুব সাবধানে,
.. তুমি কি ইদানিং প্রার্থনা করেছ, সেজন্যে” (হারবার্ট মার্টিন, ১৯৩৩)

এক অনির্বচনীয় চিত্রকল্প। মেধা বা বুদ্ধি দিয়ে নয়, শুধুই অনুভবে এ কবিতা পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারে। আমার এইরকম মনে হয়েছে। এ কবিতাগুলোয় হয়ত সেরিব্রাল শব্দ ব্যবহার হয় নি। অনিবার্য অপ্রকাশিতব্য স্বপ্নের ভাষায় লেখা কবিতা। যেন প্রকাশ না করে কবির উপায় ছিলো না।

কেমন মনে হয় আমার, কবিতায় কোনও শেষ কথা হয় না। মানুষের স্বপ্নের নাম কবিতা। মানুষই কবিতা লিখতে পারে, কারণ মানুষ স্বপ্ন দেখতে জানে। এ কবিতাগুলো সেই স্বপ্নের কথা বলে। আবেগের কথা বলে। পাঠকের মধ্যেও জন্ম নেয় অবশ্যম্ভাবী এক আবেগ। কবির নিজের সত্য, নিজের অন্তরদর্শন পাঠকের সত্য হয়ে ওঠে। 

এখানেই এই বইটি সার্থক।

আজকের বিপণনের দুনিয়ায় যখন বিনোদনই কবিতা সৃষ্টির একমাত্র এবং মূল কথা, যখন দেখি নেহাত ছন্দের ব্যবহার আর অন্ত্যমিলের কারসাজিতে হালকা বিনোদন-কবিতা প্রচারমাধ্যমের হাত ধরে আপামর বাঙালির মননসঙ্গী, যখন বিশেষ বিশেষ সময়ের আবেগকে পণ্য করে কবিতা লেখা চলছে, তখন এই কবিতাগুলো উদাহরণ হয়ে ওঠে। আজকের সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচারিত কবিদের কবিতায় রক্ত আর অন্ধকারের উপাসনা পড়ে ক্লান্ত পাঠক-আমি যখন এ কবিতাগুলো পড়ি, অনুভব করি সমকালের অন্ধকারের কবিতাও কোন জাদুকলমের পরশে আলোর কবিতা হয়ে উঠতে পারে। আত্মার শুদ্ধিকরণ লক্ষ্য না হলে এমন কবিতা লেখা যায় না। 

“মুখোশের মানুষজন অনর্গল মিথ্যে কথা বলে। হাসে, 
মুখোশের আড়ালে
দৃষ্টি আসল মুখচ্ছবি লুকোন থাকে,
ওই চতুরতার জন্য ঋণ পরিশোধ করতে হয়
আমাদের, রক্তাক্ত এবং ক্ষতবিক্ষত হৃদয় নিয়েও 
আমরা হাসি, মিথ্যে ইমারত বানিয়ে চলি –
..

হে ঈশ্বর, নির্যাতিত আত্মাসম্ভুত আমরা গান গাই
পায়ের নিচে মাটি জলে নরম, কাদায় হে ঈশ্বর
এগোন যায় না। আমাদের দূরত্ব ক্রমশ বেড়েই যায়..’’ (“মুখোশের মানুষ”– পল লরেন্স ডানবার, ১৮৭১)

১৮৭১ সালের কবিতা আজও সমকালীন প্রাসঙ্গিক হয়ে বুকের মধ্যে নাড়া দেয়। কিংবা কার্ল গার্ডনারের কবিতা “প্রতিবিম্ব”(১৯৩১).. 

“আমি নিজেকে চলে যেতে দেখেছিলাম,
দ্রুত ছুটে যাই,
পিছোতে হয় তাই, দেখার প্রয়োজনে
নিজের আয়নায়….”

আমিও পিছিয়ে আসি, একটু দাঁড়াই, নিজেকে দেখি। জীবন অন্বেষণের মন্ত্র যে। 

কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, যন্ত্রণা এক অনির্বচনীয় চেতনার স্তরে উত্তীর্ণ। এ কবিতায় জীবনের অমোঘ যাত্রার সুর। বেশিরভাগ কবির কবিতাই সর্বত্রগামী নয়। সাধারণত সমাজের আপেক্ষিকভাবে উচ্চস্তরের বুদ্ধিমান আবেগপ্রবণ পাঠকদের কাছে কবিতার বিশেষ সমাদর। কবিতা সাধারণভাবেই অস্পষ্ট, ছায়া ছায়া, মায়া মায়া। রূপক ও নতুনত্বের চমক না থাকলেও এ বইয়ের কবিতাগুলো কিন্তু সর্বজনবোধ্য। 

এ কবিতা দেখার চোখকে পরিশীলিত করে, মার্জিত করে। দম বন্ধ করা পরিস্থিতি কিভাবে পরিসরকে খুলে ধরে, কিভাবে অপমান আর কান্নার ভাষা অন্ধকারের সঙ্কট কাটিয়ে উঠে অবলীলায় মহাবিশ্বের সঙ্গে যোগসূত্র গড়ে তোলে, সেই অনুভূতি অপরূপ হয়ে ধরা পড়ে পাঠকের কাছে। এ কবিতা পড়ে পাঠক-আমি বুঝি, কবির কাছে অন্ধকার নিবিড় তন্ময়তা নিয়ে আসতে পারে। সেই তন্ময়তা থেকে জন্ম নেয় এক অন্তর্দৃষ্টি, যে অন্তর্দৃষ্টি পাঠের সম্পদ। সংগ্রামের মুহূর্তগুলো আমাদের আলোড়িত করে, প্রধানত যে আবেগে পাঠক নুগ্ধ হন তা হলো ভাবনার সংঘাত। এলোমেলো খাপছাড়া প্রান্তিক ভাষার প্রয়োগে সৃজনকর্মটি মানুষের বহতা জীবন-যাপনের ছবি।

চিরকালই কবিরা রাষ্ট্রবিপ্লব, মানবজীবনের বৃহত্তর সব সমস্যা, সামাজিক অবিচার নিয়ে কবিতা লিখেছেন। সমসাময়িক কবির রচনা থেকে একটি সময়কে আমরা ধরতে পারি তাই। সে কথা মনে রেখেও বুঝি, এ কবিতাগুলো শুধুই সময়ের কবিতা নয়। নিগ্রো সমাজের প্রতিটি মানুষের মুক্তির আকাঙ্খার কথা, হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতির নিপুণ বিশ্লেষণ, এক মুক্ত আকাশের জন্য আকুল আর্তি এ কবিতাগুলোয় ফুটে উঠেছে। অনুবাদক কবি কতখানি মরমী হলে এমনভাবে একটি ভিন্ন সমাজের ভিন্ন ছবি নিপুণ আকুতিতে ফুটিয়ে তুলতে পারেন, সেই ভাবনাও আসে। 

“যতক্ষণ আমি মনে রাখতে পারব,
যতক্ষণ আমার চোখ দেখতে পাবে,
যতক্ষণ আমার হাত তোমার হাতে
যতক্ষণ আমার পা টেনে নিয়ে যেতে পারবে আমাকে,
ততক্ষণ সমস্ত সময় এবং তোমারই নাম
মনে রাখি,
আকাশের তারাদের নিয়ে তোমারই
চোখের উপরে চোখ রাখি।..
.. এরকম স্বপ্নই সূর্যের চারিদিকে ছড়িয়ে রাখি পূর্ণতার,
যতক্ষণ আমি বেঁচে থাকব –’’ (“যতক্ষণ বেঁচে আছি”– মাজিসি কিউনেনে, ১৯৩০)

ইনি নিয়াসাল্যান্ডের কবি। আকাশ দেখার মুগ্ধতা কাটতে না কাটতেই পড়ে ফেলি কেপভার্দি দ্বীপপুঞ্জের কবি আগুইনালদো ফোনসেকার কবিতা ‘সমুদ্র অঞ্চলের সরাইখানা’। 

‘‘দূরে জ্বলছে
আনন্দ উচ্ছ্বাসে আলো
কালো রাত্রির মুখে
সব কিছু লবণাক্ত, স্নেহময় উৎসুক,
বাতাস পিঠে নিয়ে ঢেউ ছুটে চলেছে
কাঁপিয়ে দিচ্ছে সরাইখানা
নোঙর করা জাহাজে
..
..
আঃ নাবিকের কি মরুভূমির মতন তৃষ্ণা..
উল্কির দাগ চামড়ায়,
ব্যথা এবং দুঃসাহস ছড়ায়
বন্দরে পলাতকদের মধ্যেও,
সমস্ত জাতিধর্মের মানুষজন, সেই সব মানুষ যাদের গৃহ নেই, পরিচয় নেই
শুধু সমুদ্রেই যাদের পরিচয়, লবণ আর বাতাসের ভাষায়
জাহাজের নির্মম দৃষ্টিতে।..”(“সমুদ্র অঞ্চলের সরাইখানা”, ১৯২২)

আমেরিকার নিগ্রো কবি জেমস এ ইম্যানুয়েলের কবিতা “ইমেটি টিল” (১৯২১) স্নিগ্ধ সুন্দর জীবনের জলছবি।

‘‘জলশব্দে শিস দিয়ে কে ডাকছে
শুনতে পাই,
ছোট্ট ইমেট শান্ত হয় না।
সে ভেসে বেড়ায় অন্ধকারে,
নিস্তব্ধ হিমে সাঁতার কাটতে কাটতে –
আর একবার বল না গো, বল না,
ঘুমপাড়ানি সেই গান,
সেই গল্পটা পরীদের নিয়ে কিংবা 
নদীতে সন্তরণরত সেই ছেলেটির গল্প
যে
প্রবালের মালা গলায় পরে
আবহমানকাল 
গভীর ঐশ্বর্যে সাঁতার কেটে চলে
অবিশ্রাম-’’

আমেরিকার নিগ্রো কবি ছাড়াও এ সংগ্রহে আছে মাদাগাসকার, সেনেগাল, গাম্বিয়া, ঘানা, নাইজিরিয়া, কঙ্গো, দক্ষিণ আফ্রিকা, নিয়াসাল্যান্ড, মোজাম্বিক, কেপভার্দি দ্বীপ, সাও টোমে, কেনিয়া, ইত্যাদি অনেক জায়গার নিগ্রো কবিদের কবিতা। এই কবিদের কেউ জন্মসূত্রে ক্রীতদাস হয়ে জীবন শুরু করেছেন, কেউ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক জীবন কাটিয়েছেন, কেউ দেশ থেকে নির্বাসিত কবি, কেউ নিগ্রো লেখক আন্দোলনের নেতা। কেউ শিক্ষক, কেউ সঙ্গীতশিল্পী, কেউ চিত্রকর, কেউ গবেষক। এক জায়গায় সবার মিল। সবার গাত্রবর্ণ কালো, কিন্তু মনে অন্ধকার কালোর বদলে মুক্ত চেতনার আলো।

কেউ প্রেমকে নতুন চিন্তায় যাচাই করতে চেয়েছেন, কেউ প্রকৃতির চিরন্তন রূপকে নতুন ছবিতে এঁকেছেন, কেউ রাজনৈতিক চেতনাকে কবির ভাষা দিয়েছেন, কেউ মানব-অন্তরের রহস্য সন্ধান করেছেন। কেউ সমাজব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছেন, কেউ নতুন পৃথিবীর কল্পনায় বিভোর থেকেছেন। 

সব মিলিয়ে একটি বিশেষ সময়, সমাজব্যবস্থা, অশান্ত পৃথিবীর বহুবিধ চিন্তার অভিঘাত, ব্যক্তিগত সূক্ষ্ম মনন... এই সঙ্কলনটিকে আমার একটি শোভাযাত্রার মতন মনে হয়েছে। শোভাযাত্রার পুরোভাগে আছেন অনুবাদক কবিযুগল, নিজস্ব স্বাতন্ত্র্যে এই অনুবাদে যাঁরা অবলীলায় পাঠকমন জুড়ে থাকেন।

এ বইয়ে যেমন জীবন মৃত্যুর নিষ্ঠুর দ্বন্দ্বের রূপায়ণ আছে, তেমনি আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি, মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি। মনে দাগ রেখে যাবার মতন বই।

3 comments:

2

প্রবন্ধঃ সুপ্রভাত লাহিড়ী

Posted in


প্রবন্ধ


শঙ্খ ঘোষ
সুপ্রভাত লাহিড়ী


কবি শঙ্খ ঘোষ এক প্রচারবিমুখ, সহজাত বিনয়ী, কিছুটা আত্মমুখী সাহিত্যপিপাসু ব্যক্তিত্ব। যে কোনো রচনাকর্মে তাঁর নিষ্ঠা বিস্ময় জাগায়। ব্যবহারিক জীবন বা তাঁর সাহিত্যকর্ম দুই-ই বাঙ্ময়তা-বর্জিত। ধীর লয়ে তার বিস্তার ও প্রক্ষেপণ সহজেই পাঠককে আকর্ষণ করে। একদিকে বৃত্তিজীবন, অন্যদিকে সাহিত্যকর্ম, দুটি ক্ষেত্রেই তাঁর দায়বদ্ধতা তিনি পুরোপুরি স্বীকার করে নিয়েছেন। সন্মানিত হয়েছেন কবি এবং অধ্যাপক, এই দুই ভিন্ন সত্তায়।

শব্দচয়নে যত্নশীল। প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায় ব্যবহৃত অতি সাধারণ কথাকেও তিনি কবিতায় দক্ষতার সংগে জুড়ে দিতে তিনি জানেন এইভাবে:

‘ছোটো হয়ে নেমে পড়ুন মশাই / সরু হয়ে নেমে পড়ুন মশাই / চোখ নেই? / চোখে দেখতে পান না? / সরু হয়ে যান, ছোটো হয়ে যান।’

‘আরো কত ছোটো ঈশ্বর / ভিড়ের মধ্যে দাঁড়ালে / আমি কি নিত্য আমারও সমান / সদরে, বাজারে, আড়ালে?’

সহজাত প্রকাশভঙ্গিতে ভিড় বাসের কন্ডাকটরের এই কথন কবিতারূপে কী জীবনদর্শনই-না আমাদের উপহার দিলো! সদরে, বাজারে, সর্বত্র আমি তো নিজের চেয়েও ছোটো। নিজের মাপটুকু বজায় রাখতে পারছি কই!

কবি শখ ঘোষ মনে করেন কবিতায়(বিশেষ) মুহূর্ত বলে কোনো সুনির্দিষ্ট মুহূর্ত নেই। ব্যাপারটা পুরোপুরি আপেক্ষিক। কোনও অভিজ্ঞতা, অনুভব, ঘটনা একজন কবিকে যখন উজ্জীবিত করতে অক্ষম, তখন অন্য একজন লেখক সময়োচিত রচনাসৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ। তাই যে কোনো মুহূর্তই হতে পারে কবিতার মুহূর্ত। প্রসঙ্গক্রমে এটাই প্রযোজ্য যে, কবি সেই মূহুর্তে আর লিখতে পারছেন না, অথবা বা যা লিখছেন তা তাঁর মনঃপূত নয়। তবে অবচেতনের একটা ঢেউ কবির রচনার সহায়কের সঙ্গে চেতনা একটা মুহূর্ত - তখন তাঁর সমস্ত শরীর যেন দ্রব হয়ে আসছে, শরীরের মধ্যে জেগে উঠছে ঊর্মিমালার মতন একটা ছন্দ স্পন্দন, অদৃষ্ট-অলক্ষ ছন্দ-বিদ্যুৎ অথচ কোনও ভাবনা বা শব্দ দেহ নিয়ে আসেনি তখনও তাঁর চেতনায়। নিশ্চয়ই এই ‘rhythm, a dance a funny’ তাঁকে পাগল করে দেয় মুহূর্তের জন্য। কিন্তু সেই মুহূর্তের প্রতীক্ষায় বসে থাকে আজ দীর্ঘ প্রস্তুতিতে হৃদয় আর মেধায় সমন্বিত কোনো নির্যাস, ‘কেবলই মেধা নয়, কেবলই হৃদয় নয়’(শব্দ আর সত্য)

প্রচলিত আর্থসামাজিক ব্যবস্থায় সাহিত্যের পণ্যে পরিণত হওয়া আজ সর্বজন অভিজ্ঞতা। কবি-সাহিত্যিকের কাছে পাঠকের যতই প্রত্যাশা থাকুক না কেন, এর থেকে মুক্তি পাওয়ার মতন অতিরিক্ত শক্তির ঘাটতিই এর মূল কারণ। এ ব্যাপারে শঙ্খ ঘোষ মনে করেন, ‘প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়া খারাপ নয়, কিন্তু কেউ যেন নিজে প্রতিষ্ঠান না হন।’

কবিতায় ‘আধুনিকতা’ নিয়ে শঙ্খ ঘোষের বক্তব্য পরিষ্কার এবং যথার্থই চিন্তার খোরাক যোগায়, ‘আধুনিক কবিতায় সময় পড়ে থাকে বাইরে, তার আধুনিকতা তাকে আত্মস্থ করে নেয়। সময়কে বাইরে থেকে ছুঁতে চান বলেই বিবৃতি ধর্ম বেড়ে যায় আধুনিকের রচনায়। আর সময়কে ভিতরে নিয়ে লেখা হয় বলে আধুনিকতার সংহতি থাকে টান-টান(‘কবিতা বিষয়ে আলোচনা’, সাক্ষাৎকার, ‘গাঙ্গেয় পত্র’)। আধুনিক কবিতার এই টান-টান সংহতি এবং প্রজ্ঞার প্রকাশের এক উদাহরণ:

‘শ্মশান থেকে শ্মশানে দেয় ছুঁড়ে তোমারই এক টুকরো-করা শরীর/দুঃসময়ে তখন তুমি জানো/হালকা নয়, জীবন বোনে জমির/তোমার কোনো ধর্ম নেই তখন/প্রহরজোড়া ত্রিতাল শুধু গাঁথা-/মদ খেয়ে তো মাতাল হতো সবাই।/কবিই শুধু নিজের জোরে মাতাল।’

তাঁর নিজস্ব কবিতা ভাবনা নিয়ে লেখা ‘ছন্দের বারান্দা’, ‘নিঃশব্দের তর্জনী’, ‘শব্দ আর সত্য’ গ্রন্থগুলিতে তিনি এমনভাবে প্রথাকে ভেঙেছেন, যা পাঠককে আকৃষ্ট করেছে তাঁর পরিমিত মাত্রাবোধ এবং ভুবনজোড়া দৃষ্টিভঙ্গির যথার্থতার কারণে। ‘কবি সবার মধ্যে লুকিয়ে থাকবে ভিড়ে ‘সকল’ সাজার মুখোশ নিয়ে... তাই মনে হয় লিখতে হবে নিঃশব্দে কবিতা এবং নিঃশব্দ কবিতা। শব্দই জানে সে কেমন করে নিঃশব্দ পায়। ঐশ সূত্র না ছিঁড়েও। তার জন্য বিষম ঝাঁপ দেবার চেয়ে কঠিন (‘নিঃশব্দের তর্জনী’)।’

একালের কবিতায় ছন্দ নিষ্প্রয়োজন - এই ধারণা অনেকেই পোষণ করেন। অথচ কবি শঙ্খ ঘোষের ছান্দিক সৃষ্টিও কম নয়। তাঁর রচিত দুটি প্রবন্ধ ‘মুক্তি ও ছন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ’ ও ‘স্বাভাবিক ছন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ’ শ্রী প্রবোধচন্দ্র সেন মহাশয়ের কাছে অভিনন্দিত হয়। কবি শঙ্খ ঘোষের সাহিত্যনিষ্ঠা এবং সৃজনধর্মের মিলনে রচিত হয়েছে ‘এ আমির আবরণ’, ‘কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক’, ‘ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ।’ 

‘মূর্খ বড়ো সামাজিক নয়’ কাব্যগ্রন্থটির প্রকাশকাল ১৯৭৪। নাম-কবিতা সহ প্রত্যেকটি কবিতাই সবিশেষ তাত্‍পর্যবহ। প্রত্যেকটি রচনাই পরস্পরের দিকে আঙুল তুলে তার গুণমান, মেধাস্পষ্টতার মূল্যায়নাকাঙ্খী নাম-কবিতার প্রতিটি লাইন যে কী পরিমাণ অর্থবহ তার প্রমাণ:

‘ঘরে ফিরে মনে হয় বড়ো বেশী কথা বলা হলো?/ চতুরতা, ক্লান্তি লাগে খুব?/ মনে হয় ফিরে এসে স্নান করে ধুপ জ্বেলে চুপ করে নীল কুঠিতে/ বসে থাকি?/ মনে হয় পিশাচ পোশাক খুলে পরে নিই/ মানবশরীর একবার?/ দ্রাবিত সময় ঘরে বয়ে আনে জলীয়তা তার/ ভেসে-ওঠা ভেলা জুড়ে অনন্ত শয়ান লাগে ভালো?/ যদি তাই লাগে তবে ফিরে এসো। চতুরতা যাও/ কী-বা আসে যায়।/ লোকে বলবে মূর্খ বড়ো; লোকে বলবে সামাজিক নয়।’

আবার অপর একটি কবিতায় সমকালীন ঘটনাকে কী ভাবে দায়িত্ব নিয়ে তুলে ধরেছেন দেখুন:

‘হে ধর্মাধিপতি তুমি যদি একবার এসে/ বলে দিয়ে যাও শুধু কত ধানে কত চাল হয়/ তাহলে হয়তো আরো কিছুদিন টিকে যেতে পারি/ ভারিক্কি গম্ভীর চালে হতে পারি বয়স্ক বাঁদর/এ কে ওকে ঝাপটা দিয়ে চলে যেতে পারি, ভেবে দেখো/ এ জীবন কেটে গেল কতখানি বোকাসোকা হয়ে/ চালাকবাবুরা তাই ফিরেও দেখে না জানে না যে/ কত লোক আছে যারা ঘুঘুও দেখে নি ফাঁদও না।’ (গ্রাম থেকে একজন)

বা...

‘নিচু গলায় কথা বলার অপরাধে তার/ যাবজ্জীবন/ কারাদন্ড হলো/ হামলে পড়ল তার ওপর তিনটে ভালুক/ ঠিক ভালুক নয় প্রহরী/ ঠিক প্রহরীও নয়, সত্যি বলতে, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।’ (দিনগুলি রাতগুলি)

‘হাতের কাছে ছিল হাতেম তাই/ চুড়োয় বসিয়েছি তাকে/ দু-হাত জোড় করে বলেছি ‘প্রভু’/ দিয়েছি খত দেখো নাকে/ এবার যদি চাও গলাও দেব/ দেখি না বরাতে যা থাকে-/ আমার বাঁচা মরা তোমারই হাতে/ স্মরণ রেখো বান্দাকে।’ (রাধাচূড়া)

যুগ যুগ ধরে আমাদের সমাজের এটাই প্রকৃত ছবি। বাহ্যিক পরিবর্তন যাই ঘটুক-না কেন।

‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ কাব্যগ্রন্থটির রচনাকাল ১৯৮২-৮৩। আত্মপ্রচারধর্মী নাগরিক জীবনের ওষ্ঠাগত প্রাণের সময়োপযোগ পটভূমিকাই এই কাব্যগ্রন্থটির প্রতিটি কবিতার উপজীব্য বিষয়:

‘একটা দুটো সহজ কথা/ বলব ভাবি চোখের আড়ে/ জৌলশে তা ঝলসে ওঠে/ বিজ্ঞাপনে, রংবাহারে/.... বিকিয়ে গেছে চোখের চাওয়া/ তোমার সংগে ওতপ্রোত/ নিওন আলোয় পণ্য হলো/ যা কিছু আজ ব্যক্তিগত।’ (মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে)

‘মন্ত্রীমশাই আসবেন আজ বিকেলবেলায়/ সকাল থেকে অনেক রকম বাদ্যি বাদন, পুলিশ বাহার/ আমরাও সব যে-যার মতো/ ঘাপটে আছি/ ঘর খোয়ানো পথের কোনা।/ মন্ত্রীমশাই আসবেন আজ। তাঁকে/ একটি কথা বলব আমি/ বলব যে এই যুক্তিটা খুব বুঝতে পারি/ সবাইকে পথ দেবার জন্যে কয়েকজনকে সরতে হবে/ তেমন-তেমন সময় এলে হয়তো আমায় মরতে হবে/ বুঝতে পারে।’ (মন্ত্রীমশাই)

এই কবিতায় সমকালীন রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের প্রসঙ্গ এসেছে। রয়েছে সমস্যাজর্জরিত সমাজ, স্বার্থান্বেষী রাজনীতিকদের ব্যবহারিক জীবনের প্রতিফলন।

‘শবের উপর শামিয়ানা’-র প্রকাশকাল ১৯৯৬। পঞ্চাশ বছরের ব্যবধানে তাঁর দেশের বাড়ি বরিশালের বানারিপাড়া গ্রাম ঘুরে আসার সেই নৈসর্গিক উপলব্ধি, যার সংগে মিশ্রিত হয়েছে পনেরো ও পঁয়ষট্টি বয়সের অভিজ্ঞতা - এই মেলবন্ধনই যেন কাব্যগ্রন্থটির অন্য মাত্রা এনে দেয়। ছবির মতন ভেসে ওঠে পূর্ববঙ্গের গ্রাম-নদী-আকাশ-গাছপালা আর গ্রামীণ জীবন:

‘এর কোনও শেষ নেই, এ আবাদে, এই জলাভূমি/ এই রাত দু-প্রহরের ঢল, এই বানভাসি ভোর/ উদোম কিশোর আর কিশোরীর মাথা গোঁজা পাঁকে/ এই গেঁথে থাকা, এই করুণায় দুহাত বাড়ানো/...... ঠোঁটে লেগে থাকে রস, বুকের উপরে চলা চাকা/ চাকার উপরে শব, শবের উপরে শামিয়ানা-/ এর কোনও শেষ নেই মাথায় কুয়াশা মাখা ভোরে/ দেশের ভিতরে বন্দী দেশও ঘুমায় অকাতরে।’

শহুরে জীবনের সচ্ছল জীবনযাপন থেকে ফিরে গিয়ে সরল স্বচ্ছ গ্রাম্যজীবনে নিজেকে মিলিয়ে দিয়ে ফিরে দেখা, মিলিয়ে লেখা এবং তার বর্ণময় প্রকাশ - এ কবির একান্তই নিজস্ব ঘরানা।

বাংলা ভাষায় বিশ্বকবিতা সংকলন ‘সপ্তসিন্ধু দশ দিগন্ত’। অনেকের সংগে তাঁরও অনূদিত এগারোটি কবিতা এই সংকলনকে সমৃদ্ধ করেছে।

কবি শঙ্খ ঘোষ কিছু মানুষজনকে নিয়ে এক সংকলনের(সামান্য অসামান্য) মুখবন্ধে লিখছেন:

‘এঁরা সকলেই কোনও না কোনও লেখার কাজের সংগে জড়িত ছিলেন বা আছেন, কেউ প্রত্যক্ষে কেউ-বা পরোক্ষে, কেউ সামান্য বা অসামান্য। এখানে আছে তাঁদের নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা, তাঁদের কাছাকাছি থাকবার কিছু স্মৃতি। তাই, এক হিসাবে এই বই হয়তো এক রকমের আত্মকথাই। বা, আত্মসুত্রে অন্যের কথা।’

উপরোক্ত মুখবন্ধের উল্লেখ নির্দ্বিধায় যে মাত্রায় কবির পরিচিতি বহন করে, তা হলো সর্বজনে একাত্ম হবার সুচারু প্রবণতা। জীবনের চলার পথে, কি সংসারে, কি বাইরে, সর্বস্তরের মানুষকে আপন করে চিনে নেবার মতন অনুভূতির প্রকাশ, এই বইয়ের বিভিন্ন লেখায় ভিন্ন আঙ্গিকে বিদ্যমান। কিছু উদাহরণ:

‘আশি বছর বয়সের এক দেবর এসে বসেছেন সাতাশি বছরের শয্যাগত বৌদির শিয়রে কিংবা পায়ের কাছে, অনেকক্ষণ ধরে সযত্নে টিপে দিছেন মাথা কিংবা পা, অনেক অনেক দূর থেকে এসে মাঝে মাঝে গুনগুনিয়ে বলছেন একটা-দুটো পুরোনো দিনের কথা, রোগজীর্ন বৌদির ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠছে অল্প একটু হাসি। উঠে যাবেন তারপর।.....বয়স বেড়ে যায়, পায়ে হেঁটে ঘুরবার শক্তি যায় কমে। বৌদি বা দাদারা একে একে চলে যান সবাই। চিরকুমার মানুষটির চেনা জগত্‍টা শূন্য হতে থাকে।’ (একজন যত্‍সামান্য মানুষ)

‘দাদার মতো দাদা’ রচনায়... ‘হাসির চোখে কথা। হাসি দিয়ে দেখবার কথা। সহ্যের অতীত জীবনটাকে একটা কৌতুকের কোণ থেকে দেখতেও বেশ মজাই পেত দাদা।...হাসি দিয়েই ফুলশয্যার রাত্রে দাদা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল বৌদিকে। বলেছিল; ‘‘আমাদের বাড়ির নিয়ম হলো বিয়ের পর পরই যেতেই হবে কাশ্মীরে’। একেবারে কাশ্মীরে? স্কুলে অতদিনের ছুটি পাওয়া যাবে না ভেবে বৌদি বেশ বিপন্ন।....সেই হাসি দিয়ে যার শুরু হয়েছিল, ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে বৌদির মৃত্যুর সাতদিন আগে স্ট্রেচারে শুইয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাবার রাত্রে হাহকারে ভেঙে পড়া এক কান্নায় শেষ হলো সেই বৃত্ত।’ এ যেন আমার-আপনার দৈনন্দিন জীবনের কথকথা। যা অহরহ ঘটে চলেছে। আর এই ঘটনার ঘনঘটা কার মনে কতখানি ক্ষত সৃষ্টি করে, তা শুধুমাত্র অনুভূত হয় তাঁর প্রকাশ ভঙ্গিমায়। এই গ্রন্থে কিছু নামীদামী ব্যক্তির সম্বন্ধেও লেখা আছে। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখা ‘সুভাষদাকে নিয়ে পথ চলা’ যেন এক প্রামাণ্য দলিল। আছে নির্বাচিত কিছু অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কথা। সূচনাটা এই রকমের:

‘১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে পড়ন্ত এক দুপুরবেলায় প্রথম দেখেছিলাম সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে। সেই প্রথম দেখাতেই তাঁর সংগে অনেকটা পথ হাঁটবার যে সুযোগ মিলেছিল সেদিন, পায়ের ক্ষতিতে অশক্ত হয়ে পড়বার আগে পর্যন্ত অব্যাহত ছিল সেটা। এত দীর্ঘকাল জুড়ে কত যে পথ হেঁটেছি তাঁর সঙ্গে, কত যে বলবার কথা, শুনবার অবাধ অবকাশ। সাহিত্য জগতে আমার মেলামেশা খুব অল্পই, বড়োদের সংগে তো একেবারেই কম। সেই অর্থে আমার পক্ষে সুভাষদার সান্নিধ্য ছিল এক ব্যতিক্রম, আনন্দময় ছিল সে অভিজ্ঞতা, সহজের নিঃশ্বাস ছিল তাতে।’

একজন সৎ সার্থক শিল্পীর মতোই প্রতিটি সৃষ্টির মধ্যেই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর নিত্য গতিময় ছন্দ এবং নিয়ত রূপান্তরের চিহ্ন।

তিনিই একজন প্রকৃত মানুষ যিনি সবসময়েই ব্যক্তিনিরপেক্ষ, রাজনৈতিক বিশ্বাসনিরপেক্ষ। যে সমস্ত পঞ্চাশের আত্মোপলব্ধি কবি সত্তরের দশকে এসে দেশের সামাজিক বাতাবরণকে অনাবৃত করেছেন, শঙ্খ ঘোষ তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

‘প্রবন্ধের কাছে অনেক পাঠকের একটা সুনির্দিষ্ট দাবি তৈরি হয়ে যায় সংগত ভাবেই সেখানে তাঁরা আলোচনা শুনতে চান বিস্তারে আর বিশ্লেষে।’(শব্দ আর সত্য)। বর্তমান প্রবন্ধটি সেই পাঠকদের ব্যাহত করবে কারণ, শঙ্খ ঘোষের ভিন্নমুখী প্রতিভার প্রকাশ এই স্বল্প পরিসরে এবং নিশ্চয়ই স্বল্পজ্ঞানে সম্ভব নয়। এ শুধু তাঁর সাহিত্যসাগরের একমুঠো মণিমাণিক্যের মূল্যায়ন এবং তাই নিয়েই প্রতিবেদকের এই ধৃষ্টতা।

2 comments:

2

প্রবন্ধঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in




প্রবন্ধ


বানান-অজ্ঞের বানান-ব্যঞ্জন
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী



এটা ঠিকই যে বানান নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখার বরাত ‘ঋতবাক’-এর সম্পাদক, সুস্মিতা বসু সিংজী আমাকে দিয়েছেন। এটাও ঠিক যে সিংজী যেমন নামভারী, তেমনই গ্রামভারী এক মহিলা, যিনি ছবিতে আমার পলিত কেশ এবং কদাকার আনন দেখে আমাকে জ্ঞানাকর এক প্রাবন্ধিক ঠাওরে বসে আছেন। আবার এটাও ঠিক যে আমার মতো তুলা রাশির ব্যক্তির পক্ষে সিংহ রাশির কোনও মহিলার বরাত উপেক্ষা করা দুঃসাহসের নামান্তর। তাই বলে সম্পূর্ণ ভাষাজ্ঞানহীন, ব্যাকরণভীত ব্যক্তি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে কলম বাগিয়ে প্রবন্ধ লিখতে বসে যাবে!

এ-হেন বেআক্কেলে সিদ্ধান্তের স্বপক্ষে একটা কৈফিয়ত দেওয়া প্রয়োজন। সেটা যুক্তিসিদ্ধ হোক বা না হোক, মাঠে নামার আগে খেলোয়াড়দের ওয়ার্ম-আপ করার মতো আমার কলমের গা-টি একটু ঘামিয়ে নেওয়া যাবে।

১৯৬৫ সালের কথা। মফস্বল শহরের এক নামী স্কুলে বছর দেড়েক আগে নিযুক্ত হওয়া সহ প্রধান শিক্ষক নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার বাংলার খাতা দেখছিলেন। একটি ছেলের খাতা দেখে তিনি হতবাক হয়ে গেলেন। ওই ক্লাসে তিনি বাংলা পড়ান না। ছেলেটিকে তেমন চেনা নেই। তবে নাম জানা, ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত ছেলেটির সঙ্গে গত বছর একবার সাক্ষাতও হয়েছিল। পণ্ডিতমশায়ের অনুপস্থিতির কারণে সেদিন অষ্টম শ্রেণির সংস্কৃত ক্লাস নিতে নিজেই গিয়েছিলেন। ছেলেটির সংস্কৃত-জ্ঞান পরখ করতে গিয়ে হতাশ ও ক্রুদ্ধ হয়ে সেদিন তার পিঠের ধুলো ঝেড়ে দিয়ে এসেছিলেন। এই তো ভালো ছেলের নমুনা! উপরন্তু, গ্রীষ্মের ছুটিতে হা-ডু-ডু খেলতে গিয়ে ঠ্যাং ভেঙে বিছানায় পড়ে থাকায় নবম শ্রেণির শেষ ছ’মাস স্কুলেই আসতে পারেনি। সেই ছেলেই এত ভালো পরীক্ষা দেয় কী করে! সব চেয়ে বড় কথা, একটা বানান ভুল নেই! তিনি জনে জনে সেই কথাটি বলে বেড়াতে লাগলেন।

একটিও বানান ভুল না করার রহস্যটি এই যে, ছেলেটি ছিল গল্পের বই-এর পোকা। সেই বয়সেই সে বঙ্কিম-শরৎ শেষ করে রবীন্দ্রনাথে ঢুকে পড়েছিল। বানানের নীতি-নিয়মের বিন্দুবিসর্গ না জেনেও নির্ভুল বানান লিখতে পারার কারণ প্রতিটি বাংলা শব্দের ছবি তার চোখের সামনে ভাসত। ভুল বা প্রচলিত বানানের ব্যতিক্রম দেখলেই তা চোখকে পীড়া দিত। বাংলা ভাষার বানান পরিবর্তনের নীতি-নিয়ম সে সময়েই অনেকাংশে প্রবর্তিত হলেও তার প্রচার ও প্রয়োগ তেমন ভাবে ঘটেনি। ফলে বানান নিয়ে সংশয়ের অবকাশও তৈরি হয়নি। আজ এই পরিণত বয়সে এসে একই শব্দের বহুরূপী বানান দেখতে দেখতে অহরহ সংশয়ে ভুগছি। আমার ধারণা, বাংলা ভাষার অধিকাংশ নিষ্ঠাবান পাঠক এবং কিয়দংশ লেখক ও সম্পাদকের আমারই মতো দুর্দশা। হ্রস্ব ই-কার দেব, না দীর্ঘ ঈ-কার দেব – এই ভাবতে ভাবতেই কলমের কালি শুকিয়ে যাওয়ার জোগাড়! যতদিন বানানবিধি নিয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিলাম, ততদিন সমস্যা ছিল না। বিপদ হল, বাংলা লিপি, ভাষা ও বানান বিবর্তনের ইতিহাস পড়তে গিয়ে। জ্ঞানবৃক্ষের ফলটি খাওয়ার ফল এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। দশটি শব্দের মধ্যে অন্তত তিনটি শব্দের বানান নিয়ে দোলাচলে ভুগি। শব্দটির চোখে-ভাসা ছবিটির ওপর আর ভরসা রাখা যায় না। তখন তার জাত নির্ণয় করাটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। শব্দটি তৎসম-অর্ধতৎসম-তদ্ভব, না কি দেশি-বিদেশি-অনার্য বা অজ্ঞাতকুলশীল? আবার মূল শব্দটির ব্যুৎপত্তি জানলেই তো হবে না, শব্দটি উপসর্গ বা প্রত্যয়যুক্ত হলে সেগুলি সংস্কৃত, বাংলা না বিদেশি, কৃৎ না তদ্ধিত, মিশ্রশব্দ, সমাসবদ্ধ বা সন্ধিযুক্ত হলে তার জাত কী দাঁড়াল– ইত্যাদি ব্যাপারে আপনাকে পণ্ডিত হতে হবে। পণ্ডিত হয়েও কি সব শব্দের বানান সম্বন্ধে নিঃসংশয় হতে পারবেন? বোধ হয় না। কারণ, এসব ব্যাপারে পণ্ডিতদের মধ্যেও ঐকমতের অভাব আছে। আমার হাতের কাছে সব রীতির বানানবিধি নিয়ে লেখা পণ্ডিতদের বই এবং অভিধান আছে। সেগুলি থেকে টুকে টুকে পণ্ডিতি ফলাবার উদ্দেশ্যে আমার কলম বাগানো নয়; আমি সাহসে ভর করেছি আমার মতো সাধারণ পাঠক ও লেখকদের বানান-সমস্যার কিঞ্চিৎ সমাধানে কয়েকটি অতি ব্যবহার্য সাধারণ শব্দের বানান বিষয়ে আলোকপাত করতে। বানান নিয়ে যাঁদের সার্বিক ব্যুৎপত্তি লাভের আগ্রহ আছে, তাঁদের জন্যে এই প্রবন্ধের শেষে আমি কয়েকটি বই-এর নাম উল্লেখ করে দেব।

প্রবন্ধের মূল প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বাংলায় বানান পরিবর্তনের ধারাটির দিকে সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত করলে সুবিধে হয়। বাংলা লিপির বিবর্তনেরও একটি ইতিহাস আছে। সে প্রসঙ্গে ঢোকার কোন প্রয়োজন নেই। কেবল এটুকুই বলার যে, ঊনবিংশ শতাব্দের আগে বাংলা লিপির সাক্ষাৎ মেলে কেবলমাত্র হাতে লেখা বাংলা পুঁথিতে। মুদ্রণযন্ত্র না থাকার কারণে সে সময় বাংলা শব্দের কোন আদর্শ বানান গড়ে ওঠেনি। লিপিকারগণ নিজেদের জ্ঞানবুদ্ধিমতো শব্দের উচ্চারণানুগ বানান লিখতেন। তার একটি নমুনা পেশ করা যাক-

শ্রীচৈতন্য মোহাপ্রভু য়মরা শিখর।
জারো রশে উনমত হৈল শঙ্কর।।
গদাধর বেশে লক্ষ্মী জার পদ শেবে।
যনুক্ষ্যন ভাবিয়া না পায় কোন দেবে।।

(হৃদানন্দের ‘চৈতন্যচরিত’)

১৭৭৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইংরেজ কর্মচারী নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের বাংলা ব্যাকরণ ছাপার প্রয়োজনে প্রাচ্যবিদ্যায় পণ্ডিত চার্লস উইলকিন্স বাংলা লিপির সাট তৈরি করেন। পরবর্তী কালে উইলকিন্সের কর্মচারী পঞ্চানন কর্মকার এই সাট তৈরির কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। পরে এদের সাহায্যে উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুরে টাইপ ঢালাই-এর কারখানা স্থাপন করেন। এইভাবেই বিদেশিদের চেষ্টায় বাংলা-মুদ্রণের যুগ শুরু হয়।

মুদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে আরও দুটি লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটতে লাগল বাংলা ভাষার। প্রথমত, বাংলা গদ্যের সূচনা হল। দ্বিতীয়ত, এই ভাষা মধ্যযুগের বাংলা ভাষার থেকে অনেকখানি স্বতন্ত্র চরিত্রের এক উচ্চবর্গীয় ভাষা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করল। বাংলা ভাষার এই নবরূপের কারিগর ছিলেন মূলত ইউরোপীয় মিশনারিরা এবং ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত এদেশের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতজন। তাঁদের মধ্যে সর্বাধিক অবদান ছিল পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। কিঞ্চিৎ ইংরাজি এবং মূলত সংস্কৃত অনুসারী এই বাংলা ভাষা তখন থেকেই সংস্কৃত বানানবিধির নিগড়ে বাঁধা পড়ে গেল। তাতে একদিকে যেমন বাংলা শব্দের বানানে একটা সমতা এল, অন্যদিকে তেমনি সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা এবং লিখিত ভাষার মধ্যে এক দুস্তর ব্যবধান তৈরি হল।

ঊনবিংশ শতাব্দের শেষের দিকে ভাষাবিদরা একটু অন্যরকম চিন্তাভাবনা শুরু করলেন। ততদিনে বাংলা ভাষার খানিকটা বিবর্তন ঘটেছে। মিশনারি ও সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতজনের তৎসম শব্দ-প্রধান লিখনশৈলীর বদলে তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি শব্দ সমন্বিত নতুন গদ্যশৈলী তৈরি হচ্ছে। সে সব শব্দের উচ্চারণ সংস্কৃত থেকে একেবারেই আলাদা। তাহলে সংস্কৃত বানানবিধি মেনে চলার যৌক্তিকতা কী? তার চাইতে ভালো নয় কি বাংলা উচ্চারণের সঙ্গে সমতা রেখে বাংলা বানানে পরিবর্তন আনা? ১৮৭৮ সালে শ্যামাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় এক প্রবন্ধে লিখলেন যে বাংলা উচ্চারণে দীর্ঘ স্বর নেই, ঞ নেই, ণ নেই, য নেই, ষ নেই, ম-ফলা, ব-ফলা, য-ফলা, বিসর্গ ইত্যাদি সংস্কৃতের মতো উচ্চারিত হয় না। তাহলে অ-তৎসম শব্দে এত দীর্ঘ ঈ-কার ঊ-কার, ন, য, ষ, বিসর্গ, ক্ষ লেখার কী প্রয়োজন?

এরপর ১৮৮৫ সাল থেকে বাংলায় উচ্চারণ-অনুসারী বানান প্রবর্তনের পক্ষে নানাভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করতে লাগলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। ১৯১৬ সালে ‘বাংলা বানান’ প্রবন্ধে তিনি লিখলেন,-- ‘প্রাকৃত ও পালি, বানানের দ্বারা নির্ভয়ে নিজের শব্দেরই পরিচয় দিয়াছে, পূর্বপুরুষের শব্দতত্ত্বের নয়। পুরাতত্ত্বের বোঝা মিউজিয়ম বহন করিতে পারে, হাটে বাজারে তাহাকে যথাসাধ্য বর্জন করিতে হয়।’ এই প্রসঙ্গে তিনি বাংলা পুঁথির উচ্চারণানুগ বানানকে নির্ভীক বলে প্রশংসা করলেন। এরপর ১৯৩৫ সালে বানান সংস্কার নিয়ে লিখলেন, ‘অচিরে এমন সাহসিকের সমাগম হবে যাঁরা নিঃসংকোচে বানানকে দিয়ে সম্পূর্ণভাবেই উচ্চারণের সত্য রক্ষা করবেন।’

ফল মিলল অচিরেই। ১৯৩৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বানান সমিতি নিয়োগ করলেন। তাঁরা বানানের কিছু নতুন নিয়ম সুপারিশ করলেন। কিন্তু সেসব নিয়মের প্রচার বা প্রয়োগ কোনটাই তেমনভাবে না হওয়ায় সাধারণ পাঠক, এমনকি লেখকদেরও বেশির ভাগ পুরনো বানানকেই আঁকড়ে থাকলেন। এই অবস্থার খানিক পরিবর্তন ঘটলো ষাটের দশক থেকে, যখন আনন্দবাজার সংস্থা তাঁদের পত্রপত্রিকায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বানানরীতির বাইরেও কিছু কিছু শব্দের বানানে সরলতা আনতে সচেষ্ট হলেন। সেই অভিনব পরিবর্তনের ধাক্কায় পাঠকেরা নতুন বানানরীতি সম্বন্ধে সচেতন হতে শুরু করলেন। এইসব পত্রপত্রিকার প্রচার তুলনামূলকভাবে বেশি হওয়ার কারণেও শিক্ষিত জনসাধারণের একটি বড় অংশ নতুন বানানে অভ্যস্ত হতে লাগলেন। কিন্তু তাতে বিপত্তিও কম হল না। পুরনো এবং নতুন – একই শব্দের দু’রকম বানান সাধারণ পাঠকদের মনে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করল। তাঁরা লিখতে গিয়ে সংশয়াকুল হতে লাগলেন। আমারই মতো অনেকেই ছাত্রজীবনে বানান-প্রত্যয়ী হয়েও পরিণত জীবনে এসে বানান-সংশয়ীতে পরিণত হলেন।

পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি রাজ্যের কয়েকজন ভাষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীকে নিয়ে একটি বানান সমিতি গঠন করলেন। তাঁরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা, তর্কবিতর্ক ইত্যদি করে এবং সরকারি স্তরে বাংলাদেশের ভাষাবিদদেরও মতামত গ্রহণ করে একটি বানানবিধি তৈরি করলেন। সেই বিধি আকাদেমি একটি অভিধান মারফত প্রকাশ করলেন ১৯৯৭ সালে। এটিকে সরকারি বানানবিধি বলে ধরে নিতে হয়। যদিও আনন্দবাজারের বানানবিধি, সঙ্গত কারণেই, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বেশির ভাগই মেনে চলেন। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে এই সব বিধি নিয়ে ভিন্নমতের কোনও অবকাশ নেই। এগুলি নিয়ে ভাষাবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক বরং একটু বেশিই আছে। তবে সাধারণ পাঠক এবং লেখকদের সেই বিতর্কে না ঢোকাই ভালো। লেখকদের অবশ্য সমস্যা বিশেষ নেই। তাঁদের লেখায় প্রসাদগুণ যদি থাকে, বহুরূপী বানান তাকে ভক্ষণ করতে পারবে না। বিপদ হল পত্রিকার সম্পাদক আর প্রুফ রিডারদের। তাঁরা সকলেই তো আর ভাষাবিজ্ঞানে পণ্ডিত নন। প্রতিটি শব্দের ব্যুৎপত্তি, উপসর্গ-প্রত্যয় যোগে বা সমাসবদ্ধ-সন্ধিযুক্ত হয়ে তাদের রূপান্তরের ইতিহাসটি জানা সম্ভব নয় সকলের পক্ষে। সব শব্দের উচ্চারণও সর্বত্র এক হয় না। বাক্যের মধ্যে তার অবস্থান ভেদে উচ্চারণ পালটে যায়। কাজেই উচ্চারণানুগ বানান লিখেও যে পার পাবেন তা নয়। সমাধান একটিই। প্রথমে আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনি কোন বানানবিধি অনুসরণ করবেন। তারপর হাতের কাছে সেই বিধির একটি অভিধান নিয়ে বসবেন। তবে সেখানেও একটি সমস্যা থেকেই যায়। এমন কিছু শব্দ আছে যার দু’রকম বানান হয়(যেমন ‘কি’ এবং ‘কী’)। বাক্যের কোথায় কোন বানানটি হবে সেই নিয়মটি আপনাকে জানতেই হবে। এই ধরনের কিছু সাধারণ নিয়ম এবং যে সব শব্দ বা শব্দবন্ধ আমাদের খুব বেশি ব্যবহার করতে হয়, সেগুলির বানানবিধির উপর আলোকপাত সম্বন্ধীয় আলোচনা, অর্থাৎ যেটি এই প্রবন্ধের মূল বিষয় বলে চিহ্নিত করা আছে, তার মধ্যে এবার ঢুকে পড়া যাক।

বাংলা বানানে তিনটি প্রধান সমস্যা – হ্রস্ব-দীর্ঘ কার, ন-ণ এবং শ-ষ-স। এই তিনটি ব্যাপারে সব বিধিগুলিই মোটামুটি সহমত যে – (১) তৎসম শব্দের দীর্ঘ কার থাকবে এবং অতৎসম শব্দে সর্বত্রই হ্রস্ব কার হবে, (২) তৎসম শব্দে ণত্ব বিধির নিয়ম অনুসারে ণ থাকবে এবং অতৎসম শব্দে সর্বত্রই ন হবে, এবং (৩) তৎসম শব্দে ষত্ব বিধি অনুসারে ষ থাকবে, তদ্ভব শব্দে প্রচলন অনুসারে তিনটিই(শ, ষ ও স) বজায় থাকবে। অধিকাংশ বিদেশি শব্দে স হবে। কিছু কিছু ইংরাজি শব্দে উচ্চারণ অনুযায়ী এবং আরবি-ফারসি-তুর্কি শব্দে প্রচলন অনুসারে শ হবে।

পূর্ববর্তী অনুচ্ছেদে যা লিখলাম তাতে যে সাধারণ লিখিয়েদের বিন্দুমাত্র সুবিধে হবে না তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু ওই নিয়মগুলি নির্দিষ্ট করে লিখতে গেলে এই প্রবন্ধের যে বপু হবে তার ভার বহন করার সাধ্যি সম্ভবত ‘ঋতবাক’-এর নেই। তাছাড়া, সেগুলি উল্লেখ করার পরেও শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করার জটিলতা থেকেই যায়। তাই এবারে আমি সাধারণ নিয়ম সরিয়ে রেখে সাধারণ লিখিয়েদের বোধগম্য কিছু অতি প্রয়োজনীয় শব্দ ও শব্দবন্ধের নির্দিষ্ট বানান প্রসঙ্গে এক এক করে আসি।

(১) কি বনাম কীঃ এই নামে পলাশ বরন পাল, যিনি পেশায় বিজ্ঞানী হলেও ভাষাবিজ্ঞানে সুপণ্ডিত, একটি সম্পূর্ণ প্রবন্ধই লিখেছেন। এছাড়াও তাঁর ‘হ্রস্ব-দীর্ঘ’ নামে একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ ২০১০ সালে শারদীয় ‘অনুষ্টুপ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তাতে তিনি আকাদেমি ও আনন্দবাজারের অতৎসম শব্দে দীর্ঘ কার বর্জনের বিস্তৃত সমালোচনা করেছেন। ‘কি’ ও ‘কী’ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত, ‘কি’ অব্যয় এবং ‘কী’ সর্বনাম ও বিশেষণ। রবীন্দ্রনাথও নাকি সে হিসেবেই শব্দ দুটি ব্যবহার করতেন। তবে আমার মতো সাধারণ লিখিয়েদের পক্ষে যেহেতু অব্যয়-সর্বনাম-বিশেষণ চিহ্নিত করা দুঃসাধ্য, সুতরাং এ ব্যাপারে আকাদেমির ব্যাখ্যাটিই বোধ হয় সহজবোধ্য হবে। ব্যাখ্যাটি হল, যে-প্রশ্নের উত্তর কেবল ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ হবে সেখানে ‘কি’ লিখবেন। অন্যথায় সর্বত্রই ‘কী’ লিখবেন। উদাহরণ দিই:

অভিপ্রেত উত্তর যদি হয় ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’ তাহলে লিখতে হবে – ‘তুমি কি গান শুনছো?’ আর যদি গানের ধরন, নাম ইত্যাদি জানার অভিপ্রায় থাকে তাহলে লিখতে হবে – ‘তুমি কী গান শুনছো?’

(২) ক্রিয়াপদে ও-কার: আকাদেমি বানান অভিধানে ডজনখানেক পৃষ্ঠাব্যাপী বিভিন্ন ক্রিয়াপদের কাল অনুযায়ী বানানের রূপভেদ দেওয়া আছে, প্রধানত ক্রিয়ার অন্তে কোথায় ও-কার দেবেন আর কোথায় দেবেন না - তা বোঝাতে। কিন্তু তার কোনও নির্দিষ্ট নীতি বের করতে ব্যর্থ হয়েছি বলে সেগুলি উল্লেখ করা সম্ভব হল না। এ প্রসঙ্গে যে কয়টি নির্দিষ্ট নীতি পাওয়া গেছে সেগুলি উল্লেখ করা যাকঃ

(ক) ক্রিয়াপদের অতীত ও ভবিষ্যৎ রূপে শেষ বর্ণে ও-কার বর্জনীয়। ‘বললো’-‘বলতো’-‘বলবো’ নয়, লিখতে হবে ‘বলল’-‘বলত’-‘বলব’।

(খ) ক্রিয়াপদের অনুজ্ঞা-রূপে ও-কার প্রয়োগ সংগত। যেমন-- ‘বোসো’, ‘এসো’, ‘পোড়ো’, ‘ভেবো’ ইত্যাদি।

(গ) সাধিত ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যের শেষে ‘–নো’ যুক্ত হবে। যেমন-- খাওয়ানো, দেখানো, থামানো, চালানো, লাগানো, ভাজানো ইত্যাদি।

(ঘ) দ্বি-দল ধাতুর দ্বিতীয় ব্যঞ্জনে ও-কার দিতে হবে। যেমন-- এগোবে, পিছোবে, ঘুমোল, ফুরোল ইত্যাদি।

(৩) তদ্ভব শব্দে ক্ষ-এর বদলে খ-এর ব্যবহার সংগত। যেমন-- খিদে, খুদ, খেত, খ্যাপা ইত্যাদি।

(৪) বিদেশি শব্দে ঋ-কার: বিদেশি শব্দে ঋ-কার না দিয়ে র-ফলা ই-কার দিন। যেমন খৃস্ট, বৃটিশ, বৃটেন নয়, লিখুন খ্রিস্ট, ব্রিটিশ, ব্রিটেন।

(৫) লিপ্যন্তরে বিদেশি শব্দ: এ ব্যাপারে ণ-বর্জন সঠিক হলেও হ্রস্ব কার এবং স কে প্রাধান্য দেওয়ার যে বিধি সেটি আমার খুব যুক্তিযুক্ত বলে মনে হয় না। কারণ, লিপ্যন্তরে শব্দের বিদেশি উচ্চারণের যতটা সম্ভব কাছাকাছি থাকা বাঞ্ছনীয়। তার জন্যে দীর্ঘ কার এবং শ-এর ব্যবহার অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।

(৬) প্রত্যয় যোগে সমতা বিধান: স্ত্রীবাচক ঈ-প্রত্যয়, জীবিকা-ভাষা-জাতি-গোষ্ঠী ইত্যাদি বাচক ই-প্রত্যয়, মিশ্র ও বিদেশি বিশেষণ শব্দে ই-প্রত্যয় যোগে যে সব শব্দ গঠিত –- সব ক্ষেত্রেই ই-কার দেওয়ার বিধান। যেমন, কাকি-বাঘিনি-সাপিনি, ডাকাতি-নবাবি-হাকিমি, মারাঠি-আরবি- ফরাসি, ইরাকি-জাপানি- কাবুলি, কংগ্রেসি-অকালি, কয়েদি-খুনি-মজলিশি, ইত্যাদি। বানানে সমতা রক্ষার জন্যে নাকি এই বিধান। কিন্তু বিদেশি বা অতৎসম শব্দে সংস্কৃত ঈয়-প্রত্যয় যুক্ত হলে সমতার কথা ভুলে আপনাকে ঈ-কার লাগাতে হবে। যেমন -- ইউরোপীয়, এশীয়, আর্টেজীয় ইত্যাদি।

(৭) কি না এবং কিনা: কি এবং না কোথায় বিচ্ছিন্ন থাকবে আর কোথায় সংযুক্ত তা বোঝাতে উদাহরণই প্রকৃষ্ট পন্থা। ‘তুমি যাবে কি না?’ ‘ভাবছি যাওয়া উচিত হবে কিনা।’ বিচ্ছিন্নতায় জিজ্ঞাসা চিহ্ন, সংযুক্তিতে দাঁড়ি।

(৮) না-নি-নেঃ ‘না’ ক্রিয়াপদের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকবে। কিন্তু ‘নি’ এবং ‘নে’ ক্রিয়াপদের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে। উদাহরণ – আর কখনও প্রবন্ধ লিখব না। এমন ঝামেলার কাজ আগে করিনি। এখন লিখলাম বলে ভেবোনে যেন এটা সহজ কাজ। তবে ‘না’ যখন নিষেধাত্মক না হয়ে অনুরোধাত্মক, তখন তা ক্রিয়াপদের সঙ্গে জুড়ে বা হাইফেন দিয়ে লিখবেন। যেমন – দেখোনা/দেখো-না কী করে।

(৯) হাইফেন: দুয়ের বেশি শব্দের দ্বন্দ্বসমাসের ক্ষেত্রে হাইফেন দেওয়া যুক্তিযুক্ত। যেমন – তেল-নুন-লকড়ি, বাপ-মা-ভাই-বোন ইত্যাদি। তবে সমার্থক বা সমগোত্রের দুটি শব্দের সমাস হলে হাইফেন নয়। যেমন -- ঘরবাড়ি, ভেবেচিন্তে, রাজাবাদশা ইত্যাদি। আবার এ ক্ষেত্রে পরবর্তী শব্দটির গোড়ায় স্বরবর্ণ থাকলে হাইফেন দিন। যেমন -- আশা-আকাঙ্ক্ষা, বিষয়-আশয়, ভাদ্র-আশ্বিন ইত্যাদি। 

উপরোক্ত ন-দফা নিয়ম বহু নিয়মের ভিড় থেকে উদ্ধার এবং সাধ্যমতো সরল করে সাজিয়ে দিলাম। পাঠকের কতটুকু কাজে লাগবে সে ব্যাপারে সংশয় থেকেই গেল। আর মাত্র কয়েকটি শব্দের বিতর্কমূলক বানান নিয়ে আলোচনা করেই প্রবন্ধের ইতি টানতে চাই। ধরুন ‘ভারী’ শব্দটির কথা। সংসদ বানান অভিধানের মতে ‘ভারযুক্ত’ অর্থে ‘ভারী’ লিখতে হবে, যেমন, ‘ভারী বস্তা’। আর ‘খুব’ অর্থে ‘ভারি’ লিখতে হবে, যেমন, ‘ভারি তেজ হয়েছে’। আনন্দবাজার এবং আকাদেমির বিধান কিন্তু সব অর্থেই ‘ভারী’ লেখার। আমি বলি কি, কাজ কি ওসব বিতর্কে গিয়ে? তার চেয়ে বরং ‘হেভি’ বা ‘হেভ্‌ভি’ লিখুন। যেমন, ‘হেভ্‌ভি সুন্দর’। ইংরেজরা তাঁদের শব্দটির এমন অসাধারণ বাংলা-ব্যবহার দেখে যৎপরোনাস্তি গর্ব অনুভব করবেনই করবেন। তবে কিনা কারুর কানভারী করতে চাইলে হেভিত্যাগ করা ছাড়া উপায় নেই।

‘নীচ’ লিখবেন, না কি ‘নিচ’ লিখবেন। সংস্কৃতে ‘নীচ’ শব্দটির অর্থ ‘হীন’ বলে জানা ছিল রবীন্দ্রনাথের। তাই তিনি ‘নিম্ন’ অর্থে ‘নিচ’-কে আলাদা একটি অসংস্কৃত শব্দ ধরে নিয়ে ই-কার দিয়ে লিখেছেন, -- ‘তুমি তাই এসেছ নিচে – ’ । কিন্তু মণীন্দ্রকুমার ঘোষ পরে দেখিয়ে দেন যে ‘হীন’ ও ‘নিম্ন’ – এই দুই অর্থেই সংস্কৃত ‘নীচ’ শব্দটির ব্যবহার আছে। সুতরাং এটি নিছকই তৎসম শব্দ বিধায়ে সব অর্থেই ঈ-কার দিয়ে লেখার বিধান বলবৎ হল। মণীন্দ্রের এই ‘নীচতায়’ যদি কেউ আঘাত পেয়ে থাকেন, তার সান্ত্বনা এই যে তিনি তদ্ভব বিধায়ে ‘নিচু’-কে ই-কার যোগেই লেখার বিধান দিয়েছেন।

ধনুকের ‘তির’-এ ঈ-কার বর্জন করে নদীর ‘তীর’-এ ওঠার বিধানটি সর্বসম্মত হলেও পলাশ বরন পাল মশায়ের এটি ‘অদ্ভুত’ বলে মনে হয়েছে। ‘নিশানা’ অর্থে ‘লক্ষ’ লেখার পক্ষপাতী আনন্দবাজার। আকাদেমি সেখানে ‘লক্ষ্য’ বানানটিকেই শিরোধার্য করেছেন। এই মূর্খের পক্ষপাত আকাদেমির দিকে, নইলে লক্ষপতি হতে গিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। ‘রেফ’-এর সঙ্গে ব্যঞ্জনের দ্বিত্ব বর্জনের ব্যাপারে সবাই সহমত(মূর্ত্তি>মূর্তি, বর্জ্জন>বর্জন, কার্য্য>কার্য ইত্যাদি)। কিন্তু আকাদেমি একই বর্ণের দ্বিত্বের ক্ষেত্রে বর্জনশীল হলেও ভিন্ন বর্ণের দ্বিত্বের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল। যেমন, অর্ঘ্য, মর্ত্য, হার্দ্য ইত্যাদিতে আনন্দবাজার য-ফলা বর্জন করলেও আকাদেমি তা রেখে দেওয়ার বিধান দিয়েছেন। শেষ বর্ণে যুক্তাক্ষর থাকা বিশেষণের সঙ্গে য-প্রত্যয় যোগে বিশেষ্য হওয়া শব্দের বানানে আকাদেমি ও আনন্দবাজারের বিধিভেদ প্রকটতর। যেমন – বৈশিষ্ট্য(<বিশিষ্ট), স্বাচ্ছন্দ্য(<স্বচ্ছন্দ), স্বাতন্ত্র্য(<স্বতন্ত্র), দারিদ্র্য(<দরিদ্র) ইত্যাদি। এই সব শব্দে আকাদেমি য-ফলা রাখলেও আনন্দবাজার য-ফলা বর্জন করেছেন। আপনি সহজ বানানের লক্ষ্যে আনন্দবাজারের মতো ‘ব্যাকরণ মানি না’ বলবেন, নাকি ব্যাকরণ মেনে সুবোধ বালক হবেন, তা আপনাকেই ঠিক করতে হবে।

তাহলে মোদ্দা কথা এই দাঁড়াল যে প্রবন্ধটি পড়ে আপনার মাথাটি আরও গুলিয়ে গেল। বানানকে সরল, বাংলা উচ্চারণের উপযোগী করে তুলতে গিয়ে যে সব নিয়মের প্রবর্তন করলেন ভাষাবিজ্ঞানীরা তাতে ঐকমতের অভাব এতটাই বিস্তৃত যে লেখার মাঠে এখন বানানের মাৎস্যন্যায় চলছে। সেটিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে চাইলে নীচের বইগুলি পড়ে নিন। তবে তার আগে ঋতবাকের সম্পাদকের কাছে একটি প্রস্তাব রাখি। বানান-অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের জন্য তিনি একটি আন্তর্জালিক তাকিয়া(অনলাইন ডেস্ক) রাখুন। সেখানে পাঠকদের প্রশ্নের নিয়মিত উত্তর যোগাবেন সম্পাদক-নিযুক্ত বানান-বিশেষজ্ঞগণ। তাতে কাজিয়া জমে ওঠার মহৎ সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতেও নীচের বইগুলি যথেষ্ট সাহায্য করবে।

১) বাংলা বানান সংস্কারঃ সমস্যা ও সম্ভাবনা –-পবিত্র সরকার(দে’জ)।

২) বাংলা বানান-- মণীন্দ্রকুমার ঘোষ(দে’জ)।

৩) বাংলা কী লিখবেন কেন লিখবেন(আনন্দ)।

৪) সংসদ বানান অভিধান –- অশোক মুখোপাধ্যায়(সাহিত্য সংসদ)।

৫) আকাদেমি বানান অভিধান(পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি)।

তথ্যসূত্রঃ (১) পুরানো শাস্ত্র ও সাহিত্য অনুশীলনে পাণ্ডুলিপি চর্চার ভূমিকা প্রসঙ্গে – করুণাসিন্ধু দাস’ (‘অনুষ্টুপ’, বিশেষ বাংলা পুঁথি সংখ্যা-১৪২২)।

(২) রাজন্য-শাসিত কোচবিহারের পুথি-সাধনা – ত্রিপুরা বসু(ঐ)।

(৩) বিভিন্ন পাণ্ডুলিপির পুনঃপাঠের প্রয়োজনীয়তা ও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা – নীরদবরণ মণ্ডল(ঐ)।

(৪) হ্রস্ব-দীর্ঘ – পলাশ বরন পাল (‘অনুষ্টুপ’, শারদীয়-১৪১৭)।

(৫) প্রবন্ধের শেষে দেওয়া ৩), ৪) ও ৫) নং তালিকাভুক্ত গ্রন্থসমূহ।

2 comments: