1

গল্প - রূপশ্রী ঘোষ

Posted in






সৌদামিনী ঘুম থেকে চোখ খুলেই ভাবতে থাকে আজ কাজে বেরোনো আছে কি নেই। ঘুমের রেশ কাটিয়েই সম্বিত ফিরে পেয়ে যেই বোঝে আছে, তড়াক করে বিছানা ছাড়ে। সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ির ইঞ্জিনের মতো টার্বো চার্জ এবং স্পিড বাড়িয়ে ঝড়ের গতিতে কাজ শুরু করে দেয়। না বেসিনের কাছে আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের রূপচর্যার কথা তখন আর ভাবতে পারে না। ব্রাশটা করে নিয়েই রান্নাঘরে ঢুকে, প্রথম কথা, ‘ওকে গুগল প্লে রবীন্দ্রসঙ্গীত’। গুগল নেস্টও উত্তরে, ‘sure, check out these Rabindra Sangit songs on YouTube music station’ বলেই শুরু করে দেয়, ‘মেঘ বলেছে যাব যাব…’।

সৌদামিনী ভাবে, মেঘ কোথায় যাবে জানি না। কিন্তু আমাকে তো কাজে বেরোতেই হবে। দুটো হাতেই দশভূজা হয়ে, ভাতের চাল ধোওয়া, চা বসানো, বাসন গোছানো সবটা সেরে বড়ো বড়ো দুকাপ চিনি ছাড়া লিকারকে সঙ্গী করে ডাইনিং চেয়ারে বসে যায়। আরাম করে চায়ে চুমুক দেওয়ার সঙ্গী এখন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘জার্নি টু লাসা অ্যান্ড সেন্ট্রাল টিবেট’। ভ্রমণের গল্প পড়তে পড়তে সৌদামিনী যেমন নিজেও ভ্রমণ করে তেমনি নিজের পুরোনো ভ্রমণ বিষয়েও একটু স্মৃতিচারণ করে নেয়। আজ সেরকমই পড়ার পাশাপাশি ল্যাপটপে আর একটা উইন্ডো খুলে নিজের মধ্য প্রদেশ ভ্রমণ নিয়ে লেখাগুলোও পড়ে নেয়। পড়তে পড়তে হারিয়ে যাওয়া সব মানুষেরই স্বভাব মনে হয়। সৌদামিনীরও তাই হয়েছে। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তার স্পিডের থেকে ঘড়ির স্পিড অনেকটা এগিয়ে গেছে। সৌদামিনী আবার নিজের স্পিড বাড়িয়ে বাকি কাজগুলো সেরে নিয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়ে।

বেরিয়ে ভাবল গাড়িতে তেল কম আজ কম দূরত্বের রাস্তা দিয়েই যাওয়া ভালো। সাধারণত ওই রাস্তায় জ্যাম বেশি থাকে বলে ওটা অ্যাভয়েড করে বাইপাস দিয়েই যেতে সে ভালোবাসে। আজ বাইপাস অ্যাভয়েড করে জ্যামের রাস্তাই ধরল।

কী আশ্চর্য! রাস্তায় এতটুকু জ্যাম নেই। সৌদামিনী ভেবে নিয়ে বুঝল রাজ্যে পঞ্চায়েত ভোট আসন্ন। আজ বাদে কাল ভোট। ভাবতেই পারে সবাই পঞ্চায়েত ভোট তো কলকাতার কী? কলকাতার তো কিছু বটেই। আমাদের রাজ্য যাঁরা চালান তাঁরা কলকাতাতেই থাকেন। ভোটের প্রয়োজনে গ্রামে যেতে হয়। কলকাতার যত বাস আছে এমনকি প্রাইভেট স্কুলের বসাগুলোও বেঁধে নিয়ে যেতে হয়। তাই বাচ্চাদের স্কুলগুলোয় এখন ছুটি। সকালবেলা কলকাতার রাস্তায় স্কুল বাস, স্কুলের বাচ্চা, বাচ্চার বাবা-মা না বেরোলে গাড়ির স্পিড অনেকটাই বেড়ে যায়। পঞ্চায়েত ভোট প্রসঙ্গে সৌদামিনীর মনে পড়ে ছোটোবেলার সেই আতঙ্কের দিনগুলোর কথা। গ্রাম থেকে আতঙ্ক এখনও চলে যায়নি, কিন্তু সৌদামিনী আর গ্রামে থাকে না। এখন টিভি খুলে আতঙ্কের কথা জানা যায়। দুদিন আগেই খবরে দেখা গেল, নির্বাচনী দিন ঘোষণার পর থেকে মোট ১৬ জন মারা গেছে এই রাজ্যের বিভিন্ন গ্রাম মিলিয়ে। মারা যাওয়া তো চরম ক্ষতি। তাছাড়া অনেক ক্ষতি হয়। অনেক মানুষকে অনেককিছু হারাতে দেখেছে সে। ছোটো থেকেই দেখে এসেছে তার বাড়ির লোক কংগ্রেস। তারা কংগ্রেসকে ভোট দিত। ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীর ছবি বাড়িতে টাঙানো থাকত। এর বেশি কিছু জানত না, কারো সঙ্গে তেমন করে কথাও হয়নি কখনো। কোনো পার্টি বা দলের প্রতি এমন কোনো ভালবাসা নেই তার। রাজনীতি বুঝতও না, আজও বোঝে না। যেটুকু আছে তা সবই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।


সৌদামিনীর গ্রামটা খুব ছোটো। জনসংখ্যা কম ছিল বলে ভোটের জন্য গ্রামে আলাদা বুথ হত না, পাশের গ্রামে ভোট দিতে যেত সবাই। আজকাল অবশ্য যেতে হয় না। বছর সাতেক হল গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভোটের বুথ হচ্ছে। এখন লোকসংখ্যাও বেড়েছে, পার্টির সংখ্যাও। তার একদম ছোটোবেলায় ছিল মাত্র দুটো দল - কংগ্রেস আর সি পি এম।


গ্রামে মাঝে মাঝেই মিছিল বেরতো, ভোটের আগে আগে বেশি করে বেরতো। রাজনীতি অর্থে মিছিল ব্যাপারটাই সে খুব উপভোগ করত। তাদের পুকুর পাড় দিয়ে মিছিল যেত, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোক গোনা ছিল সৌদামিনীর একটা পছন্দের কাজ। কাদের দলে কতজন। সে যখন খুব ছোটো ছিল তখন ব্যাপারটা মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল। মিছিলটাও বেশ পালা করেই হত। আজ যদি একটা দল বেরোয় তো কাল অন্য দল।


তবুও তাদের ওখানকার কংগ্রেস দল ছিল তুলনায় নিরীহ। একটু বড়ো হবার পর দেখল সি পি এমের দাপট আরো বেড়ে গেল। ওই অঞ্চলে সি পি এমের এক দাপুটে নেতা ছিলেন। এখন মারা গেছেন। সেই নেতার চুনোপুঁটিরাও কোনো অংশে কম ছিল না। নিয়ম তারাই জারি করত - কবে দোকানপাট খোলা থাকবে, কবে বন্ধ রাখতে হাবে। জমিতে চাষ করতে পারবে কি পারবে না। কোনো কংগ্রেস দলের লোকের প্রতি যদি খুব রাগ থাকত তাহলে তার জমি চাষ করার জন্য কোনো লেবার দেওয়া হত না। সকলই তাঁদের ইচ্ছা। এমনকি একটা সময় তারা ভোট দিতে যাওয়াটাও বন্ধ করে দিতে পেরেছিল। ভোটের আগে বিপক্ষ সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট দিতে যেতে বারণ করা হত। সৌদামিনীর মনে আছে, একবার তাদের বাড়িতে এক সি পি এম নেতা এসে তার মাকে বলেছিলেন - ‘মামী ভোটটা দিতে যাওয়ার দরকার নেই, দিলে ভালো হবে না কিন্তু বলে দিলাম। বুঝতেই পারছ খেয়ে পরে থাকতে হলে…’। মামীর ঘাড়ে আর কটা মাথা!

বহুদিন মামী ছাড়া ওই বাড়ির কেউই ভোট দিতে যায়নি।

আরও মনে পড়ে তার এক জ্যাঠতুতো দাদা একবার পঞ্চায়েত ভোটে কংগ্রেস থেকে প্রার্থী হয়েছিল। সেবার সি পি এমের মিছিলটা মেন রাস্তা ছেড়ে, একটু ভিতরে তাদের বাড়ির লাগোয়া রাস্তা দিয়ে গিয়েছিল। এটা তো শাসক পক্ষের করতেই হয়। যাওয়ার সময় প্রার্থীর বাড়িতে অসংখ্য ঢিল ছুঁড়েছিল - ভয় দেখানোর জন্য। গ্রামের আরো দু-চারটে বাড়িতেও একই কাজ করেছিল। সেবার সে খুব ভয় পেয়েছিল। তাদের মিছিলের শ্লোগান সব সময় - ‘কংগ্রেসের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’। স্লোগানে কখনো কখনো নোংরা ইঙ্গিতও থাকত। যেবার তার জ্যাঠতুতো দাদা দাঁড়িয়েছিল সেবার একটা স্লোগান ছিল এরকম, অমুকের (প্রার্থীর নাম) কোলে, অমুক দোলে। দ্বিতীয় অমুক কংগ্রেসেরই অন্য আর একজন মহিলা প্রার্থী। সেগুলো শাসক দল বেশ উপভোগ করত।

তার আর এক জ্যাঠতুতো দাদা একটু রাজনীতির বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করতে ভালোবাসত। আজও ভালোবাসে, শুধু রংটা বদলে গেছে। সে রোজ পেপার নিত, সৌদামিনী তার থেকেই পেপারটা পড়ে নিত। তারপর তার সেই দাদা কখনো কখনো তার সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করত। বিভিন্ন ঘটনার কথা তার সঙ্গে গল্প করেই জানত। ঘটনার মধ্যে বেশিরভাগই ছিল কোন গ্রামে সি পি এম দল কত অত্যাচার করেছে তার নমুনা। ঐ দল কতটা নির্মম ছিল খবরগুলো তার সাক্ষী। তারমধ্যে একটা খবর মনে পড়ে কোনো একটা গ্রামে, নামটা মনে নেই একজনদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে শুকনো লঙ্কা ছুঁড়ে দিয়ে চলে গিয়েছিল। এরকম রোজই পড়ত, কার বাড়ি ভাঙচুর, কার গোয়ালে গরু পুড়িয়ে দেওয়া, কার ধানের গাদায় আগুন, নিত্যদিন এসব লেগেই থাকত। তবে এটা কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি যে, এই বাড়ি ভাঙার বিকট শব্দ তাকে নিজের কানে শুনতে হবে। সে এক ভয়ঙ্কর দিন, ভাবলে এখনও তার গায়ে কাঁটা দেয়।


তাদের গ্রামে তখন সবে সবে তৃণমূলের তৃণ গজিয়ে উঠছে। মিটিং, মিছিল শুরু। কয়েকজন নেতার নামও শোনা যাচ্ছে। একদিন তাদের মিছিলে সৌদামিনীর ছোড়দাকে ডেকেছিল স্লোগান দেওয়ার জন্য। ছোড়দাকে সে দাদা না বলে ‘ভাই’ বলে ডাকে। ভাই তার পরিণতি না ভেবে দিব্যি নাচতে নাচতে চলে গিয়েছিল মিছিলের স্লোগান দিতে। হঠাৎ সি পি এমের লোকেরা মিছিলের মধ্যে এসে তৃণমূলের নেতাকে বেধড়ক পেটাতেই মিছিল ভেঙে যায়। সব লোক ভয়ে এদিক-ওদিক দৌড় দিয়েছিল। যাঁকে মেরেছিল তাঁকে দেখে তার ভাইয়ের কেমন মায়া হওয়ায় সে সেখান থেকে যেতে পারেনি। রাস্তার পাশে একজনের বাড়ি থেকে জল এনে পড়ে থাকা লোকটার মুখে দিচ্ছিল। এমন সময় কয়েকজন লাঠি নিয়ে তেড়ে আসায় সেও আর সাতপাঁচ না ভেবে পড়িমরি করে ঝোপঝাড় ডিঙিয়ে দৌড়ে নিজে সে যাত্রায় বেঁচেছিল। তবে বাঁচাতে পারেনি সৌদামিনীর সাইকেলটাকে। সেটা সি পি এম দলের লোকেরা ওখান থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে তাদের জিম্মায় রেখে দিয়েছিল বহুমাস। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তাদের টাকা দিয়ে উদ্ধার করতে হয়েছিল তার সাইকেল। এর থেকে বেশি কিছু ক্ষতি তাদের হয়নি। তবে ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়েছিল তার ভাইয়ের ওই মিছিলে যাওয়ার জন্য। ঐ সময় তৃণমূলের সক্রিয় নেতা যারা ছিল তারা আর বাড়ি ঢুকতে পারেনি। দীর্ঘদিন তারা ছিল গ্রাম ছাড়া।

সৌদামিনীর আরও মনে পড়ে গ্রীষ্মের একটা ভয়াবহ দুপুরের কথা। সে আর তার দাদা ভাত খেয়ে জাস্ট হাতটা ধুয়ে বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিল। হঠাৎ দেখে একদল লোক রে রে করে লাঠিসোঁটা, বাঁশ, বল্লম, কোঁচা নিয়ে তাদের পাড়ার দিকে ধেয়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে তারা দুজনে বাড়িতে ঢুকে খিল লাগিয়ে, চিৎকার করে বাড়ির অন্যান্য সবাইকে ডেকে নিয়ে দোতলায় উঠে পড়েছিল। একটু পরে তাদের বাড়ির দিকে আসা আওয়াজটা থেমে যায়, আওয়াজটা মেন রাস্তা দিয়ে চলে গিয়েছিল। পাশের বাড়ির এক কাকু চিৎকার করে বলেছিল, ‘আমাদের আর ভয় নেই। আমি কাস্তে হাতুড়ি মার্কা লাল ঝাণ্ডাটা লম্বা বাঁশ দিয়ে উঠোনে পুঁতে দিয়েছি। ওরা সেটা দেখতে পেয়েই চলে গেছে’। ওই কাকু তখন সদ্য সি পি এম দলে নাম লিখিয়েছিল।

মুহূর্তেই কানে ভেসে আসতে থাকল ঘর ভাঙা আর কান্নার শব্দ। ঠিক কান্না নয়, ছিল আর্তনাদ। সৌদামিনীও ভয়ে খুব কেঁদেছিল। তার দাদা তাকে ধমক দিয়ে থামিয়েছিল। তার হাত-পা রীতিমতো থরথর করে কাঁপছিল। দাদা পরিস্থিতির ওপর নজর রাখার চেষ্টায় থাকায়, তাকে সামলানোর মতো অবস্থায় ছিল না বলেই ধমক দিতে হয়েছিল। ঘরবাড়ি ভাঙার শব্দটা আসছিল প্রধান দুজন তৃণমূল নেতার একজনের বাড়ি থেকে। তাঁর বাড়িটা ওদের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে, তাই তাদের বারান্দা থেকে আওয়াজটা ছিল খুব স্পষ্ট, মনে হচ্ছিল যেন তার মাথাতেই মারছে। ওদের বাড়ি ভাঙা শেষে তারা অন্য নেতার বাড়িটাও ভেঙে চুরমার করেছিল। শুধু বাড়ি ভেঙেই তারা ক্ষান্ত থাকেনি, তার সঙ্গে তাদের দামিদামি জিনিস, গয়নাগাটি লুঠপাট, ধানের মড়াই ভেঙে ধান, ভাত, মুড়ি সব মাটির সঙ্গে মিশিয়ে অদম্য উল্লাসে নাচ করছিল। সে তো শুধু আওয়াজটুকু শুনেছিল। সেই বাড়ির লোকগুলোর কী হয়েছিল? তাদের হৃদপিণ্ডটা থেমে গেলেও হয়ত কেউ এতটুকু অবাক হত না! পরে জানা গিয়েছিল, সেই বিধ্বংসী দলের যে পাণ্ডা সে সৌদামিনীর দাদার ক্লাসমেট ছিল, ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের খাতিরে সে দলকে ঘুরিয়ে অন্যদিকে নিয়ে গিয়েছিল। দাদার ক্লাসমেট তার দলের উন্মত্ত লোকদের বলেছিল, ‘তোরা ভুল দিকে চলে এসেছিস’।


লাঠিসোঁটা নিয়ে রে রে করে আসা লোকগুলো কিন্তু অন্য একটা শ্রেণি। পার্টির ওপরতলার লোকেরা ওদেরকে একটু মদ ঘুষ দিলেই ওরা সানন্দে রে রে করতে রাজি হয়ে যেত। ওদের নিজস্ব কোনো রং নেই। আজ যারা ক্ষমতায় তারাও অমন ঘুষ দিলে আজ তাদের হয়ে রে রে করে। তাদের একটা পাড়া আছে। ওই পাড়া দিয়ে সৌদামিনীকে স্কুলে যেতে হত। যদিও তার কোনো ক্ষতিই তারা করেনি, তবুও সে একটু ভয় পেত ওই পাড়া দিয়ে যেতে। যে-কোনো বিষয়েই মারপিটটা তাদের দিয়ে করানো হত। সেই কারণেই তার এত ভয়। পার্টিগত ঝামেলায় একবার তাদের গ্রামে মেলা, যাত্রা, গাজন সব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মেলাটা আবার চালু হয়েছে, গাজনটা বন্ধ। তবে সব ঝামেলার মূলে কিন্তু ছিল ওই পাশের গ্রাম। আর মারপিটে ওই পাড়া।


সেই ভাংচুরের ঘটনার আফটার এফেক্ট - গোটা গ্রাম থমথমে। কারো মুখে কথা নেই, হাসি নেই! আলোচনা হলেই আবার কি বিপদ নেমে আসে কে জানে। কানাঘুষো শোনা যেত এরপর কার ঘর ভাঙা হবে। চেনা মানুষগুলোও সব অচেনা হয়ে গিয়েছিল রঙের হেরফেরে। পাড়ার নিরীহ মানুষগুলো যারা রং না মেনে সকাল সন্ধ্যে চায়ের দোকানে আড্ডা বসাতো, খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হাসিঠাট্টা করে মজা পেত, তারাও আর সে তল্লাটে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। সবার চোখে মুখে একটা ভয়ের বিভীষিকা। দলবেঁধে, জটলা পাকিয়ে গল্প করাটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কিছুদিন।


কয়েকদিন পর আবার একটা ভয়ঙ্কর খবরে ঘুম ভেঙেছিল সৌদামিনীর। তাদের গ্রামে সি পি এমের একটা পার্টি অফিস ছিল, সেটা জ্বলছে। মাটির অফিস, খড়ের চাল। তাই জ্বালিয়ে দিতে কোনো অসুবিধাই হয়নি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শোনা গিয়েছিল অফিসের ভিতরের কোনো জিনিসই নাকি পোড়েনি। আসবাব, কাগজপত্র সবই অক্ষত ছিল অন্য জায়গায়। ওরা আগে থেকে সব সরিয়ে নিয়ে, নিজেদের অফিসটা ধরিয়ে দিয়েছিল। তৃণমূলের নামে দোষ চাপানোর জন্যে। এটা বোধহয় ক্ষমতায় থাকা সব দলেরই একটা ছক।


তাদের গ্রামের আর এক দাদা সক্রিয় তৃণমূল করত। একেবারে ‘দিদি’ বলতে অজ্ঞান। কিন্তু ফল ভোগ করতে হয়েছিল তার বাবাকে। সি পি এম নেতারা এসে তাদের বাড়িতে বলে গিয়েছিল, ‘তোমাদের জমিতে কোনো লেবার দেওয়া হবে না, তোমরা লোক দিয়ে চাষ করতে পারবে না’। বেচারি জেঠু ছিলেন একজন পুরোহিত। লাঙল ধরা তো দূরের কথা কোনোদিন কোদাল দিয়ে মাটি কুপোনোর অভ্যেসটুকু ছিল কিনা কে জানে। কিন্তু সেই বছর জেঠু পুরো জমিটা কোদাল দিয়ে একটু একটু করে কুপিয়েই চাষ করেছিলেন। জেঠু আজ নেই, ছেলে আজ শাসক দলের দাপুটে নেতা।


শোষণ এতটাই চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল যে, এক নেতা অন্যের অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ঝেপে দিয়ে সেটাকে জাল করে নিজের অযোগ্য ছেলেকে সরকারি চাকরি দিতেও দ্বিধা করেননি। সেই ছেলে দাপিয়ে চাকরি করেও ছিল একবছর। সবাই এর ওর মুখের দিকে তাকাত, কিন্তু তার মুখের ওপর কিছুই বলতে পারেনি। সত্যি ফাঁস হওয়ার পরে তাকে তাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল ঠিকই, তবে তেমন কোনো শাস্তি পেতে হয়নি।


তারপর এই কয়েক বছর আগে, তৃণ যখন বৃক্ষে পরিণত হয়ে সি পি এম কে নির্মূল করল তখন গ্রামের নেতা হয়ে গেল ওই পুরোহিত জেঠুর ছেলে এবং পাড়ার আরো কয়েকজন। এখন গ্রামে আর সেভাবে যাওয়া হয়ে ওঠে না সৌদামিনীর। তবে সব খবরই তার কানে আসে মোটামুটি। সে জানতে পারে ওই গ্রামের তৃণমূল দলটারই দুটো ভাগ হয়ে গেছে। একদলে তার জেঠুর ছেলেরাসহ পাড়ার আরো কয়েকজন নেতৃত্ব দেয়, অন্য দলে ওই পুরোহিত জেঠুর ছেলে। এদের দু-দলের মধ্যে একদিন তুমুল মারামারি হয়ে গেছে। রাতের অন্ধকারে পুলিশ এসে মেরে তাদের ভ্যানে করে তুলেও নিয়ে গিয়েছিল দু-দলকেই। কয়েকদিন হাজতবাস। তারপর ছুটি। এক্ষেত্রেও তার ভাইকে পুলিশের লাঠির গুঁতো খেতে হয়েছিল বিনা অপরাধে, কারণ তার জেঠুর বাড়িতে পুলিশ এসেছে শুনে সে দেখতে গিয়েছিল। বেচারা ভুগেছিল বেশ কয়েকদিন।


গ্রামে খেয়ে পরে, বেঁচেবর্তে থাকার জন্য বা কিছু কিছু সুবিধা ভোগ করার জন্য তখন যেমন অনেকে সি পি এম এ নাম লিখিয়ে ছিল, আজ তেমন তৃণমূলেও লিখিয়েছে। তারাই এখন রাজা। তাদের রক্তচক্ষু দেখে সি পি এমও আজ জুজু। একদিন যে সি পি এম নেতার দাপটে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেত, পুজোর সময় একবার গিয়ে শুনেছিল তাকে এক তৃণমূল নেতা ফেলে জুতো দিয়ে মেরেছে। তা দেখে তৃণমূলের অন্য দল বলেছে - ছি ছি এটা উচিত হয়নি। যতই হোক ওর থেকে বয়সে তো বড়ো।


নিয়ম করে ভোটের প্রতিশ্রুতি দেওয়া তখনও ছিল, এখনও আছে। ভোটটা বহুকাল নিয়ম মেনে হত না, গতবারে হয়েছিল। কে জানে এবারে হবে কিনা। কিন্তু তাতে কী? গ্রামের রাস্তা-ঘাট কিছুটা বদলালেও সামাজিক পরিস্থিতি আগের তুলনায় খারাপ হয়েছে। কারণ সৌদামিনী তার এক ক্লাসমেটের সঙ্গে গল্প প্রসঙ্গে বলেছিল, ‘হ্যাঁ রে, গ্রামে আমরা সবাইমিলে একটা লাইব্রেরি করে দিলে কেমন হয়?’ তার বন্ধু শুনে বলেছিল, ‘তুই এখন অন্য জগতে আছিস, তার চেয়ে বরং গ্রামে মদের দোকান করে দে, ইয়ং ছেলেরা খুশি হবে’। সেটা শুনে সৌদামিনীর অভিব্যক্তি কী হয়েছিল জানার দরকার নেই। আসলে মানুষগুলো তো সব এক। যখন যে কিছুটা ক্ষমতা পেয়ে যায়, সে সেটা যেভাবে খুশি প্রয়োগ করে। তাদের গ্রামে এখন মারামারিটা একটু কম হয়। তবে অন্যান্য জায়গায় অনেক কিছু হয়, খবরে শোনা যায়। এই পার্টিই যখন আবার কোনো প্রতিপক্ষের সামনে আসবে, তখন হয়ত মারপিট করে, ঘর ভেঙে, হুমকি দিয়ে ভোট দিতে যাওয়া বন্ধ করে ভোটে জেতার চেষ্টা করবে।


আসলে দল বা পার্টি বলে তো কিছু হয় না।


বাইরে মেঘ ঘনিয়ে এসেছে। সৌদামিনীর মন আনন্দে ভরে উঠল। এই গ্লুমি ওয়েদার তার খুব পছন্দের। গাড়ির কাঁচ বন্ধ থাকলেও বোঝা যাচ্ছে, ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। গাছের পাতাগুলো উড়ে উড়ে গাড়ির কাঁচে এসে লাগতে থাকল। তার মনে হল পাতাগুলো যেন তাকেই ছুঁয়ে ছুঁয়ে আদর করে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। এক অজানা আবেশে বুঁদ হয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ খেয়াল হয় থামতে হবে। সিগনালের রাঙাচোখ তাকিয়ে আছে।

এর মধ্যেই সৌদামিনী ভাবছে কাল তার বন্ধুর বিবাহবার্ষিকী। গিফট কেনা হয়েছে কিনা একবার ভেবে নিল। ভেবে নিয়ে নিশ্চিন্ত হল। বাইরে অন্ধকার বাড়ছে। ঝড়ে পাতা ওড়া বাড়ল। লাল কৃষ্ণচূড়া, হলুদ রাধাচূড়া সিগনালের লাল হলুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামল। সৌদামিনী আবারও খেয়াল করল সে অনেকক্ষণ ধরে একটা হলুদ ট্যাক্সির পিছনে পড়ে আছে। এ সহ্য করা যায় না। সে জানে কলকাতার রাস্তায় ফাঁকা হলুদ ট্যাক্সির পিছনে পড়ার মতো বিড়ম্বনা মনে হয় আর কিছুতে নেই। সুযোগ বুঝে ওভারটেক করে নিল। সারা কলকাতা জুড়ে শাসক দলের সুপ্রিমোর হোর্ডিং আর পোস্টারে সাবধান বাণী ছেয়ে আছে। কোথাও কোথাও জায়েন্ট স্ক্রিনেও গাড়ি আস্তে চালানোর সাবধান বাণী ফুটে ওঠে। সাবধানে গাড়ি চালান, প্রাণ বাঁচান। নিজে বাঁচুন অপরকে বাঁচান এসব লেখা দেখা যায়। গড়িয়াহাটের মোড়ে তো মাইকে বাজতেই থাকে, ‘সাবধানে রাস্তা পার হন, আপনার জন্য বাড়িতে কেউ অপেক্ষা করছে’। বাড়িতে কেউ অপেক্ষা করার না থাকলে বুঝি মরা যায়!

চলতে চলতে টালিগঞ্জ ফাঁড়ির দুর্বিষহ জ্যামের রাস্তাটা হাজির। জ্যাম কাটিয়ে এগোতে এগোতে দেখা গেল দূরে ঘন কালো মেঘ কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। দুই লেনের রাস্তার দুপাশের গাছগুলো চাঁদোয়ার মতো মেঘকে ঢেকে দেয়। লাল হলুদ ফুল মাথায় মাথা লাগিয়ে পথচারীদের স্বাগত জানায়। চার লেনের রাস্তায় গাছের দূরত্ব বোঝা যায়।

সৌদামিনীর মাথায় এল কাল তারও অফিস নেই। তাহলে তো পার্লারে একবার যাওয়াই যায়।

এত সাত পাঁচের মধ্যেই এফ.এম-এ কান , ভেসে এল উড়জা কালে কউয়া তেরে…।

কাঁচের বাইরে এক ফোঁটা দু ফোঁটা। ওয়াইপার অন। খুব স্লো স্পিডে ওয়াইপার চললেও সৌদামিনীর খুব ভয় করে। নিরন্তর উপর নিচ করে জল সরাতে গিয়ে ভেঙে যাবে না তো। না, নিরন্তর কতকিছুই তো চলে, তাও কী ভাঙে। মাঝে মাঝে তার ছিঁড়ে যায় ঠিকই, তাই নিয়ে অনেকেই হাহাকার করে না। ওয়াইপারেরও রাবার ক্ষয়ে যায়। আবার লাগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। সবই বোধহয় এভাবেই চলে। যতদিন চালানো যায়। মিতু আর সুমনা এত হাসে কেন? তাদের জীবন তো খুব সহজ নয়। তাহলে কী ‘হতাশা’ হাসির জন্ম দেয়? হাসতে হলে হতাশা, দুঃখ, কষ্ট দরকার জীবনে? নানান হিজিবিজি ভাবনার মধ্যেই ওয়াইপারের স্পিড বেড়ে যায়।

ঝড়ের সঙ্গে বাড়তে থাকে বৃষ্টি। সৌদামিনীর পছন্দের বিষয় ঘনঘোর বর্ষায় গান চালিয়ে ড্রাইভ করা। আপন মনে চলতে চলতে জিঞ্জিরা বাজারের কাছে এসে খুব জোরে ব্রেক দিয়ে থেমে গেল। না না নিজের জন্যে নয়। গাড়ি চালাতে গেলে অন্যের জীবনের দায়িত্বও নিতে হয়। সে দেখল একটা ছেলে সাইকেল চালাতে চালাতে বাঁহাতে ছাতা ধরে নিজের পুরো ঢেকে গাড়ির সামনের দিকে আসছে। বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচানোর চেয়ে নিজে বাঁচা আগে দরকার সেটা মাথাতেই নেই। তাই গাড়ির সামনে এসেই থতমত খেয়ে থামল। সৌদামিনী বড়ো বড়ো করে চোখ দেখানোর চেষ্টা করল। তারপর নিজেই খেয়াল করল এই ঘন বর্ষায় সে চোখে সানগ্লাস দিয়ে রেখেছে। হ্যাঁ এটা সে করে। কাউকে পাত্তা দেয় না। রাতেও সানগ্লাস চোখে দিতে পারলে ভালো হয়। সে চশমা পরে না। দূরদৃষ্টি আজ সানগ্লাসেই বন্দী। বৃষ্টির স্পিড ওয়াইপারের স্পিড প্রতিযোগিতায় নামে। অনাবিল আনন্দে গাড়ির স্পিডও বাড়ে। বৃষ্টির সময় পথচারী থাকে না। রাস্তা ফাঁকা থাকে।


এবার বড়ো রাস্তা ছেড়ে একেবারে শেষ দু কিলোমিটারে ঢুকে পড়া। এখানে রাস্তার গর্তে জল জমে পুকুর। রাস্তা হাতড়িয়েই একপ্রকার গন্তব্যে পৌঁছনোর চেষ্টা। ছোটবেলায় সে পুকুরের জল সেঁচে হাতড়িয়ে মাছ ধরতে দেখেছে পাড়ার ছেলেদের। এখন সে নিজে হাতড়ে হাতড়ে রাস্তা বোঝার চেষ্টা করে। গোটা কলকাতা জুড়ে রাস্তায় হঠাৎ হঠাৎ বড়ো বড়ো গর্ত হয়ে আছে। বৃষ্টি হলেই সেসব পুকুর। এখন তো পঞ্চায়েত ভোট। শহরের রাস্তা নিয়ে কারুর মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। শহরে ভোট এলেও রাস্তায় প্যাচ ওয়ার্ক করে ছেড়ে দেয়। গোটা জগৎ সংসারই এখন প্যাচ ওয়ার্কের অধীনে। কলকাতাতেও মিছিল হয়। হাজরা মোড় বা কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে এখন গেলেই শোনা যায়, ‘চোর ধরো জেল ভরো’। কে কার উদ্দেশ্যে বলে কে জানে। কিন্তু সৌদামিনী এখন আর লোক গোনে না, এখন তার একটাই দুশ্চিন্তা, সংশোধনাগারে এত জায়গা আছে তো? এসব ভাবতে ভাবতেই গন্তব্যে পৌঁছে গেল সৌদামিনী। যখন গাড়ি থেকে সে নামল, দেখল রোদ এবং বৃষ্টি একসঙ্গে হচ্ছে। সানগ্লাস বাঁচাতে চোখ থেকে খুলে নিতেই হল। অফিসের দরজায় ওঠার সময় দারোয়ান এক গাল হেসে বললেন, কী সুখ। কোথাও কিছু ভেজেনি, সাজ একটুও ঘাঁটেনি। সৌদামিনী শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল কী বলছেন? মহব্বতদা আবারও একগাল হেসে, বলছি, কী সুখি, কী বড়োলোক গায়ে কোনো আঁচ লাগল না। না, দারোয়ান হলেও অমন তাকে গরিব ভাবার কিছু নেই। শোনা যায় তিনি প্রতিদিন বালিশের নিচে তিন লাখ টাকা নিয়ে ঘুমান। এটা আট বছর আগের কথা। সময়ের সঙ্গে আশাকরি টাকার পরিমাণ বেড়েছে। সৌদামিনীর হাতটা ধরে থামিয়ে দিয়ে মহব্বতদা আরও জানতে চাইলেন, সৌদামিনী রোজ সকালে ঘুম থেকে কটায় ওঠে। শোনার পর চোখ কপালে। সৌদামিনী না দাঁড়িয়ে অফিস ঘরে ঢুকে বায়োমেট্রিক যন্ত্রে আঙুল ছোঁয়ালো। এত বছরের বায়োমেট্রিক জীবনে প্রথম সেই যন্ত্রের কাছে শুনল, ‘প্লিজ ট্রাই এগেন’!

সৌদামিনীর সেকেন্ড টাইম ট্রাই করে, নিজের দেমাকের কাছে হেরে গেল।

আগামীকাল পঞ্চায়েত ভোট। বাইরে মেঘ আরও কালো হয়ে ঘনিয়ে এসেছে।


1 comment:

  1. বর্তমানের প্রেক্ষাপটে এক অনবদ্য লেখা।

    ReplyDelete