0

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in









আমরা যত বিশ্বায়নের কথা বলছি, গ্লোবালাইজেশন- এর কথা বলছি, যত ভুবনগ্রামের কথা বলছি, বিশ্বায়িত পৃথিবীর কথা বলছি, তত কিন্তু মানুষ শিকড়হীন হয়ে পড়ছে। সীমা রেখাগুলো মুছে গিয়ে মিশে যাওয়ার বদলে আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এবং কোথাও ধর্মের নামে,কোথাও রাজনীতির নামে,কোথাও রাষ্ট্রের চাপে,কোথাও যুদ্ধের জন্য, কোথাও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মানুষ চলে যাচ্ছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়।নিজে বাঁচতে এবং পেটে ভাতের সন্ধানে, কাজের সন্ধানে।এবং এই ধারাবাহিকতা অনেক জায়গায় জনবিন্যাস বদলে দিচ্ছে।জনবিন্যাসের যে প্যাটার্ন,তার যে রৈখিক গতি তা কিন্তু বদলে যাচ্ছে।জনবিন্যাস বদলে যাওয়ার ফলে ভাষাও বদলাচ্ছে।খাদ্যাভ্যাস বদলাচ্ছে।তার চেয়েও বড় কথা খাদ্যের ভাঁড়ারে কিন্তু টান পড়ছে।আজকের পৃথিবীতে কিন্তু খাদ্যের ভাঁড়ার অফুরন্ত নয়।জলের ভান্ডার অফুরন্ত নয়।আগামী দিনে এমন হবে স্টার ওয়ার্সের কল্পনায় আমরা দেখতে পারি চাঁদের জল নিয়ে মারামারি হবে।

এই যে মানুষের চলাচল, মানুষের এই যে চলিষ্ণু জীবন, সেই জীবনটা কিন্তু ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াচ্ছে।আমরা দেখেছি ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ থেকে দলে দলে শরণার্থী এসেছে।এবং ভারতবর্ষ বুক পেতে তাদের জায়গা দিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ দিন ধরে যদি এটা চলে, তাহলে তো মুশকিল। দেশের অর্থনীতিতে টান পড়বে,অর্থের ভাঁড়ারে টান পরবে,খাদ্যের ভাঁড়ারে টান পড়বে,এবং অন্যান্য জায়গায় টান পড়বে।

১৯৪৬ সালে বিহার শরীফের দাঙ্গায় বাংলাদেশে বহু মানুষ গেছেন তখনকার পূর্ব পাকিস্থানে। যাঁরা ইসলাম ধর্মের বিহারী মানুষ, যাঁরা হিন্দি ভাষী।তাঁরা বাংলাদেশে কোনো মর্যাদা পান নি সেই ভাবে। তাঁরা ইসলাম ধর্মের কিন্তু মর্যাদা পান নি।একটা সাধারণ কলোনির মতো জায়গায় তাঁরা আটকে আছেন।এবং সেখানে তাঁরা মূলত কথা বলেন হিন্দিতে। আজ পর্যন্ত তাঁদের কোনো আর্থিক উন্নতি নেই। তাঁরা সেখানে ছোটখাটো সেলাইয়ের কাজ, রেডিও সারানর কাজ করে। এবং তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ মেশেন না। ফলে জায়গাতেই ছোঁয়াছোঁত, ছোঁবনা ছোঁবনা- এরকম একটা ব্যাপার আছে। সেই ব্যাপারগুলোকে যদি আমাদের মাথায় রাখতে হয়,দেশকে আমাদের যদি এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়,দেশের প্রযুক্তিকে,দেশের মানুষকে, তাহলে এই ক্রমবর্ধমান উদ্বাস্তু সমস্যা কমাতে হবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে ২০১৫-১৬ সাল থেকে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক অনুপ্রবেশ হচ্ছে।রোহিঙ্গারা ইসলাম ধর্মের মানুষ। মায়ানমার থেকে তাঁরা সেখানকার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সরকার ও সেনাবাহিনীর তাড়া খেয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ছে।আমরা জানি মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপ চলে যাচ্ছেন সবাই।আফ্রিকা, ফ্রান্স, তুরস্ক থেকে জার্মানিতে চলে যাচ্ছেন।যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চলগুলি থেকে মানুষ চলে যাচ্ছেন।সিরিয়া, ইউক্রেন থেকে চলে যাচ্ছেন। একটা ঘাড় ভাঙা ছেলের সমুদ্র পাড়ে পরে থাকার চিত্র আমরা দেখতে পেয়েছিলাম।তার গায়ে একটা গেঞ্জি এবং সমুদ্রের জল তার চারপাশে। যেটা খুব বেদনাদায়ক ছিল।

একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি গভীরভাবে উপলদ্ধি করেন ও দেখতে পান যে, তিনি বা তাঁরা জাতিগত হিংস্রতা ধর্মীয় উন্মাদনা, জাতীয়তাবোধ, রাজনৈতিক আদর্শ, সমাজবদ্ধ জনগোষ্ঠীর সদস্য হওয়ায় ঐ দেশের নাগরিকের অধিকার থেকে দূরে সরানো হচ্ছে, ব্যাপক ভয়-ভীতিকর পরিবেশ বিদ্যমান, রাষ্ট্র কর্তৃক পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে; তখনই তিনি শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হন। ১৯৬৭ সালের

সম্মেলনের খসড়া দলিলে উদ্বাস্তুর সংজ্ঞাকে বিস্তৃত করা হয়। আফ্রিকা ও ল্যাতিন আমেরিকায় অনুষ্ঠিত আঞ্চলিক সম্মেলনে যুদ্ধ এবং অন্যান্য হিংস্রতায় আক্রান্ত ব্যক্তি কর্তৃক নিজ দেশত্যাগ করাকেও অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

শরণার্থীকে প্রায়শঃই ভাসমান ব্যক্তিরূপে বা গোষ্ঠীরূপে অন্তভুর্ক্ত করা হয়। বাইরে থেকে যদি যুদ্ধের কারণে নির্যাতন-নিপীড়নে আক্রান্ত না হয়েও মাতৃভূমি পরিত্যাগ করেন অথবা, জোরপূর্বক নিজ ভূমি থেকে বিতাড়িত হন - তাহলে তাঁরা শরণার্থী হিসেবে বিবেচিত হবেন।

মানুষের এই যে আসা-যাওয়া, এই যে যাতায়াত, সেটা আগেও ছিল।আগে কীরকম ছিল? আগে মানুষ অসুখের ভয়ে,কলেরা ম্যালেরিয়া মহামারীতে মানুষ গ্রাম ত্যাগ করত।অনাহারে খাবারের অভাবে মানুষ গ্রাম ত্যাগ করত।মানুষ লোকচাপে,ধর্মীয় চাপে,গ্রাম ত্যাগ করত দলকে দল।নয়ত গ্রামকে গ্রাম মরে ভুত হয়ে গেছেন না গ্রাম ত্যাগ করেছেন।

আজকের পৃথিবীতে ব্যাপারটা হচ্ছে এরকম- এলাকা থেকে এলাকান্তরে মানুষ চলে যাচ্ছে কিন্তু তার ছবিটা একদম আলাদা।এই নিয়ে ভারতে প্রচুর লোককাহিনী আছে।আমরা এমনই একটি লোককথা আলোচনা করব।আমরা একটি রিয়াং লোককথা বলব।

সে বহুকাল আগের কথা এক গ্রামে সুনা রইহা নামে এক ছেলে তার বুড়ি মায়ের সঙ্গে বাস করত।সে নদীতে স্নান করতে গিয়ে দূরে কিছু একটা ভেসে আসতে দেখল। প্রথমে সে চিনিতে পারে নি।পরে কাছে আসায় চিনতে পারে, এটি খুম্বা রাঙজাক ফুল।সুন্দর ফুলটি সে বাড়ি নিয়ে আসে।বাড়ি এসে মাকে বলে, মা এই ফুলটি যত্ন করে রেখে দাও।মা তার কথা মতো রেখে দিল।

সেদিন রাতে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল।রাতে তাদের ঘর ফুলের আলোয় আলোকিত হয়ে গেল।ফুলটির পাপড়ি থেকে জ্যোতি বেরোতে লাগল।দুজনের ভীষণ খুশি।প্রত্যেকদিন রাতে ফুলের আলোয় ঘর আলোকিত হতে দেখে গ্রামের মানুষেরা জানতে পারল।এই আলো তো রাজার ঘরেও নেই।তাই গ্রামবাসীরা রাজার কাছে আলোকবাতির খবর দিল।রাজা তা শুনে সিপাহি পাঠাল সুনা রইহাকে ডেকে আনার জন্য।

সুনা রইহা রাজার ডাক শুনে ভয়ে ভয়ে রাজার কাছে উপস্থিত হল।রাজা জানতে চাইলেন বাড়িতে আলোকচ্ছটার কারণ কী? সুনা রইহা খুম্বা রাঙজাক ফুলের কথা জানাল।মহারাজ আদেশ দিলেন রাজার এই ফুল চাই।মহারাজ একটা ছোট ডিঙি দিয়ে তাকে নদী থেকে এই ফুল এনে দিতে বললেন।

সুনা রইহা বাড়ি ফিরে মায়ের কাছে কাঁদতে থাকে, কোথায় পাবে সেই ফুল।কিন্তু রাজার আদেশ, তাই পরের দিন ভোর বেলা মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পরে।সে ডিঙিতে ভাসতে ভাসতে কত গ্রাম,কত বন,কত পাহাড় পেরল।পরে সে ডিঙি বাঁধতে গিয়ে তউমসার বাড়িতে ধাক্কা মারে।তউমসা বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে 'কে তুমি।তুমি এখানে কী করছ'?

সুনা রইহা বলে আমি রাজার আদেশে খুম্বা রাঙজাক ফুলের খোঁজে বেরিয়েছি।তুমি কি বলতে পার কোথায় পাব সেই ফুল।তউমসাকে যদি সুনা রাইহা বিয়ে করে তাহলে ফিল আনার পর দেখিয়ে দেবে। সুনা রইহা বিয়ে করে তউমসাকে।পরের দিন তউমসা পথ দেখিয়ে দেয়।সে বেরিয়ে পরে ফুলের উদ্দেশ্যে।

তারপর ভাসতে ভাসতে সে একইভাবে তাউকুরু,মাখমাই,তাউথুকে পায়,বিয়ে করে তিন জায়গার তিন কন্যাকেই।শেষে তাউথু এক রাক্ষসীর সন্ধান দিল।নদীর ওপারে থাকে এক রাক্ষসী,তার বিশাল বড় দাঁত,আর ভীষণ তার শক্তি। কেউ তাকে হারাতে পারে না। যে যায় তাকেই খেয়ে ফেলে।সুনা রইহা তার উপায় জানতে চাইল।তাউথু উপায় বলে দেয় যে,ওপারে ডিঙ্গি বেঁধে চুপি চুপি যাবে ,যাতে রাক্ষসী টের না পায় তুমি গিয়ে পেছন থেকে মা বলে জড়িতে ধরবে, সে আর তোমার খেতে পারবে না। সে সব শুনে বেরিয়ে পরে গন্তব্য স্থলের উদ্দেশ্যে ।

তাউথুর কথা মতো সুনা রইহা তাই করল।রাক্ষসী জানতে চাইল কেন এসেছ? সুনা রইহা সব জানাল রাজার কথা। রাক্ষসী তার উপায় বলে দেয় সমুদ্র পেরিয়ে আছে এক সুন্দর স্নানের ঘাট। সেই ঘাটে স্বর্গপরীরা রোজ স্নান করতে আসে।তার আগে তার সখিরা আসে। স্বর্গপরীরা স্নানের শেষে চলে যাওয়ার প্রস্তুতির সময় তাকে রাঙজাল দন্দ্রাই দিয়ে তাকে ধরে নিতে হবে। তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, যে পরীর সোনার পাখা আছে তাকেই ধরতে হবে।

শুনে সুনা রইহা চিন্তায় পরে গেল। এতো ছোট ডিঙি দিয়ে সে সমুদ্র কীভাবে পার হবে? যাই হোক রাক্ষসী তার উপায়ও বলে দিল। সুনা রইহাকে এক জাদু বালিশ দিল।সেই বালিশই তাকে সমুদ্র পার করে দিল।রাক্ষসীর কথা মতো স্বর্গ পরীদের স্নানের শেষে বুদ্ধি করে পেছন থেকে স্বর্গপরীকে জড়িয়ে ধরল।

স্বর্গপরী জানতে চাইল কেন এখানে এসেছে সুনা রইহা।সে সব ঘটনা বলল।তখন স্বর্গপরী বলল তাহলে সুনা রইহাকে স্বর্গে যেতে হবে।কিন্তু কীভাবে যাবে সে? তাই স্বর্গপরী তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়।সুনা রইহা স্বর্গপরীকেও বিয়ে করে।পরে সুনা রইহাকে পরীর চুলের কাঁটা বানিয়ে স্বর্গে নিয়ে যায়। দিনের বেলা যে পরীর চুলের কাঁটা এবং রাতের বেলা সে মানুষ রূপে ফিরে আসে।সুনা রইহা তখন ফুলের কথা ভুলেই গেল।

হঠাৎ একদিন রাজার কথা মনে হল।তখন সে স্বর্গপরীকে বলল, চল আমরা রাজার কাছে যাই।

স্বর্গপরী বলল আমিই সেই খুম্বা রাঙজাক।যার খোঁজে তুমি এখানে এসেছ।সুনা রইহা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। যে স্বর্গপরীই খুম্বা রাঙজাক,সেই তার বিয়ে করা বউ।আবার তাকেই রাজার কাছে নিয়ে যেতে হবে। সুনা রইহা স্বর্গপরীকে সব জানাল।পরে স্বর্গপরী তার বাবার মতামত নিয়ে পৃথিবীতে চলে আসে।

তারা দুজনে উড়ে উড়ে সমুদ্র পার হয়ে সেই রাক্ষসীর কাছে এসে পৌঁছয়। রাক্ষসী খুব খুশি হয়ে তাদের ঘরে তুলে নেয়।সেখানে রাত কাটিয়ে তারা উড়তে উড়তে আসে তাউথুর বাড়িতে। সেখান থেকে তাউথুকে সঙ্গে নিয়ে তারা আবার উড়তে উড়তে মাখমাই-এর বাড়িতে আসে।সেখানে রাত কাটিয়ে মাখমাই কে সঙ্গে নিয়ে এলো তাউমসার বাড়ি।।তাউমসা সবাইকে দেখে খুশি হয়।সেই রাতে সবাই তাউমসার বাড়ি থেকে পরের দিন সবাই মিলে উড়তে উড়তে এসে পৌঁছুল সুনা রইহার গ্রামে।

সুনা রইহা তার পাঁচ বউ নিয়ে মায়ের কাছে গেল।বুড়ি মা এতদিন তার ছেলের জন্য পথ চেয়ে বসেছিল।সবাইকে পেয়ে মা খুব খুশি।সুনা রইহা গ্রামে আসার খবর গ্রামের সবাই জানতে পারে। রাজাও খবর পায় সুনা রইহা গ্রামে এসেছে। রাজা খবর পাঠায় খুম্বা রাঙজাক এনেছে কী না?এদিকে সুনা রইহা চিন্তায় পড়ে গেল।কী করে সে তার বউকে রাজার কাছে দেবে।

সব শুনে চিন্তা করে স্বর্গপরী বলল চিন্তা নেই, আমরা আছি।তুমি যাও রাজবাড়ি। সুনা রইহা রাজবাড়ি গেলে রাজা ফুল এনেছে কী না জিজ্ঞাসা করতেই সুনা রইহা উত্তর দিল কয়েকদিনের মধ্যেই নিয়ে আসবে। সুনা রইহা মনের দুঃখে বাড়ি ফিরল।স্বর্গপরী বলল চিন্তা নেই, আমি যখন আছি তখন একটা ব্যবস্থা হবেই।স্বর্গপরী পরের দিন স্নান করে ঘাট থেকে এসে চুল ঝাড়তে লাগল। সেই চুলের জলের ফোঁটায় অনেক খুম্বা রাঙজাক গাছ হল আর তাতে অনেক ফুল। সেই ফুল টুকরিতে করে সুনা রইহা রাজার বাড়ি নিয়ে গেল।রাজা খুব খুশি হলেন। তাই রাজার মেয়ের সঙ্গে সুনা রইহার বিয়ে দিতে চাইলেন।সুনা রইহা রাজার মেয়ে বিয়ে করল।তখন থেকে সুনা রইহা তার ছয় বউ নিয়ে সুখে বাস করতে থাকে।

এই গল্পটার মধ্যে রয়েছে বহুমাত্রিকতা।নদীতে একটা ফুল ভেসে আসছে। সেই ফুলটা কী ফুল? আলোর ফুল।এবার রাজা তাকে এই ফুল এনে দেওয়ার জন্য আদেশ দিলেন।চলে আসছে রাক্ষস,চলে আসছে গরীবের চালের ঘর,চলে আসছে সমুদ্র,সমুদ্র পেরিয়ে যাত্রা, বিবাহ,ছয়টা বিবাহ,রাক্ষসটাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরা,তাকে মা বলে ডাকার কথা, সব মিলিয়ে একটা গল্প।

জলের অপর নাম জীবন। এই জীবন তরঙ্গের মাঝে ভাসছে আলোর ফুল।আলো মানে আমাদের জীবনে যা শুদ্ধতা নিয়ে আসে।আলোর ফুলের যে সৌরভ, তা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে। সেটা আলো থাকুক আর না থাকুক। অর্থাৎ কোনো একটা ভালোবাসা,কোনো একটি প্রেম,কোনো একটা প্রীতি, কোনো একটা সৌন্দর্য, ছেলেটা অর্জন করে নিল যার নাম সুনা রাইহা।

রাজা তাকে এবার বলল যে রাজাকে ফুল দিতে হবে।আমরা একটা গল্প জানি যে- এলাটিং বেলাটিং সইলো, কীসের খবর আইলো, রাজা একটি বালিকা চাইলো,কোন বালিকা চাইলো এরকম।এবার সে কাঁদছে।কিন্তু ফুল তো দিতেই হবে রাজাকে। ফলে রাজাকে ফুল দেওয়ার জন্য সে যাত্রা শুরু করে।এই যে যাত্রা সেটা হচ্ছে মানব জীবনের এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আমরা সবাই সবাই একটা জার্নির মধ্যে থাকি সারাজীবন। মায়ের গর্ভ থেকে শুরু করে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত জীবনের একটা জার্নি।সুনা রাইহা সেই যাত্রা করছে।করতে করতে তাকে অনেক রকম বাধাবিপত্তির মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন জায়গা পেরতে হয়েছে।তাকে বিভিন্ন জায়গায় বিয়ে করতে হয়েছে,সংসার হয়েছে,কিন্তু সঠিক ঠাঁই কোথাও হয় নি।সে হয়ে গেল উদ্বাস্তু।হয়ে গেল শরণার্থী। বেরিয়ে পড়ে জীবনের নতুন নতুন ঠিকানায়।

তারপর সে পেয়ে যায় ডিঙি নৌকা।এই ডিঙি হচ্ছে জীবন তরী।কারণ তাকে ফুল সংগ্রহ করতেই হবে।তার জীবন বাজি রেখে পাড়ি দিল দূর থেকে বহুদূর।তারপর এক রাক্ষসীর সঙ্গে দেখা।তার বিরাট বড় দাঁত,বিশাল তার শক্তি। সেই রাক্ষসীকে পেছন থেকে 'মা' বলে ডেকে তার মন জয় করে নেয়। ভারতীয়দের বিশ্বাস মায়ের মতো আপন এই পৃথিবীতে কেউ হয় না।তাই মা ডাকলে সব অপরাধ ক্ষমা করে দেবে।রাক্ষসীও তাকে আপন করে নেয়।

জীবন তরী পার হওয়ার জন্য রাক্ষসী যে অরণ্যবাসী মানুষ সে জাদুমন্ত্র দিয়ে একটা বিশাল বালিশ বানিয়ে দেয়। এই বালিশ আমরা সাধারণত মাথায় দিয়ে শুই।এবং বালিশ আমাদের ঘুমকে আরামদায়ক করে তোলে। এই বালিশে শুয়ে আমরা নানারকম স্বপ্ন দেখি।এই জাদুবালিশ দেওয়া হল অর্থাৎ খানিকটা স্বপ্ন তার মধ্যে দিয়ে দেওয়া হল।সে সমুদ্র পেরিয়ে গেল।চলে গেল স্বর্গপরীদের কাছে। সে স্বর্গপরীর দেশে যাওয়ার কথা বললে স্বর্গপরী তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়।নইলে সে স্বর্গে যেতে পারবে না।যথারীতি সে বিয়ে করে স্বর্গপরীর চুলের কাঁটা হয়ে স্বর্গে পৌঁছল।চুলের কাঁটা করে রাখল মানে স্বর্গপরী তাকে হারাতে চায় না। চুলের ভেতর যত্ন করে রেখে দেয়। দিনের বেলা পরী তাকে লুকিয়ে রাখে। রাতের বেলা সে মানুষ হয়ে স্বর্গপরীর কাছে থাকে। রাতেই তাদের মিলন হয়। হঠাৎ তার একদিন মনে হল রাজার কথা। এত দিনের পরিশ্রমের পর সে এই স্বর্গপরী লাভ করল।তাই তাকে হারাতে চায় না।কিন্তু সে জানে না যে এই স্বর্গপরীই খুম্বা রাঙজাক। যাকে রাজার হাতে তুলে দিতে হবে। সুনা রাইহা স্বর্গপরীকে সব জানাল।স্বর্গপরী তার বাবাকে সব জানিয়ে পৃথিবীতে চলে এল স্বপ্নের ডানায় উড়ে।

একে একে তারা সবার বাড়ি এক রাত করে কাটিয়ে, বিয়ে করা পাঁচ বউ নিয়ে উড়তে উড়তে বাড়িতে এল।যেখানে বসে আছে তার বুড়ি মা। দ্রৌপদীর পঞ্চ স্বামীর মতো সুনা রাইহা পাঁচ বউ নিয়ে সংসার করতে থাকে।রাজা খবর পেল সুনা রাইহা এসেছে।কিন্তু ফুল কই? কী করে সে তার বউকে রাজার হাতে তুলে দেবে সুনা রাইহা ভাবে।কিন্তু স্বর্গপরী তো অসাধারণ বুদ্ধিমান। সে উপায় বের করল।স্বর্গপরী স্নান করে তার চুলের জল থেকে অনেক ফুল সৃষ্টি করে সুনা রাইহাকে দিয়ে রাজার বাড়ি পাঠাল।রাজা খুব খুশি হয়ে তার মেয়ের সঙ্গে সুনা রাইহাকে বিয়ে দিল।একটা মেয়ে জানে ফুল নিয়ে গেলেই রাজা তার মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেবে,সে জানে তার ঘরে সতীন আসবে।একটা মেয়ে তার সর্বস্ব দিয়ে স্বামীকে রক্ষা করে।কিন্তু মেয়েদের ভালোবাসা এমনই, যে সে যদি কাউকে একবার মন প্রাণ সমর্পণ করে তাহলে মৃত্যুও তাকে আটকাতে পারেনা।তাই স্বামীকে বাঁচাতে তার পারিপার্শ্বিকভাবে সহায়তা করছে,নিজেকে খানিকটা সরিয়ে রেখে, তার সহজীবনের মানুষের সুখের জন্য এগিয়ে আসে।

আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে অন্যতম বড় সমস্যা হচ্ছে উদ্বাস্তু সমস্যা।নানা কারণ যেমন ধর্মীয় কারণ, রাজনৈতিক কারণ, যুদ্ধের কারণে দেশ ভাগ হচ্ছে । এক দেশের লোক চলে যাচ্ছে অন্য দেশে।দেশের সীমা রেখা মুছে যাচ্ছে। নতুন নতুন দেশ তৈরি হচ্ছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলি এবং এশিয়ার কিছু কিছু অংশ সেগুলো নানাভাবে ভাগ হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর টুকরো টুকরো হয়ে গিয়ে অনেক ছোট ছোট দেশের জন্ম হয়েছে। ফলে সেই সব কথা মাথায় রেখেই আমরা রিয়াংদের যে উৎখাত হওয়া,এবং রিয়াংদের যে বাস্তচ্যুত হওয়া এই কথাটিকে নতুন করে একটি কাহিনির মাধ্যমে বলতে চেষ্টা করলাম।

আসলে মানুষ কিন্তু শিকড়হীন। মানুষ আসলে নো ম্যান্স ল্যান্ড-এ বাস করে। ফলে সে পথিক হয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দেয়। প্রাচীন পৃথিবীতে মানুষ খাদ্যের অভাবে,মহামারির প্রকোপে,ধর্মের চাপে,যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে ঘর ছাড়ত। সমস্ত গ্রাম,সমস্ত শহর,সমস্ত দেশ উজাড় হয়ে যেত।ফলে বিভিন্ন কারণেই দেশের মানচিত্র পালটে যায়। আর এই সব চির শরণার্থী মানুষের যাত্রাপথ সুখকর নয়।

0 comments: