1

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয় 



সময়টা ছিল কঠিন। প্রতিদিনই সম্পাদকমণ্ডলীর বিদগ্ধ সদস্যদের সঙ্গে কখনও আলাদা করে, কখনও একসঙ্গে বার বার কথা চলছে। কিন্তু সুরাহা হওয়া তো দূর অস্ত, পরিস্থিতি প্রতিদিন জটিলতর আকার ধারণ করছে। পত্রিকা  প্রকাশ ও পরিচালনার সামগ্রিক দায়িত্ব আমার, অথচ কোনও রকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা নেই। কার অনুমতি নিতে হবে, তাও স্পষ্ট নয়। যত রকম ভাবে অসহযোগিতা করা যায়, সমস্ত প্রচেষ্টা অব্যাহত। সবচেয়ে মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত, যে লেখা যেমন আসবে তেমনই প্রকাশ করতে হবে। -কোনও কাটছাঁট, অদল বদল - এক কথায়, কোনও রকম এডিটিং চলবে না। এই সিদ্ধান্ত যিনি নিয়েছিলেন, তিনি আর পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত নন অফিশিয়ালি, কিন্তু তাঁর প্রচলিত নিয়ম অপরিবর্তনযোগ্য। সবচেয়ে বড় কথা, এডিটর হিসেবে যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। প্রশ্ন যাঁরা তুলছেন, তাঁদের এই ‘প্রশ্ন তোলার যোগ্যতা’ নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্ন করার সাহস কারোর নেই! 

সমস্যা হচ্ছিল। একাধিক। স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া না গেলে কাজের মান বজায় রাখা কঠিন। তাছাড়া আমার ব্যক্তিগত ভাবে মনে হয়, একজন দায়িত্বশীল এডিটরের একটা অলিখিত দায়িত্বও থাকে। সেটি হল, নতুন যাঁরা লিখতে আসছেন, নিজের লেখা যাঁরা আরও উন্নত করতে চান, সম্ভব হলে, প্রয়োজন মতো বার বার এডিট করে তাঁদের এ বিষয়ে সাহায্য করা। সেক্ষেত্রে এডিটিং করার স্বাধীনতা না থাকা কাজের দায়িত্ব খর্ব করারই নামান্তর। সবচেয়ে বড় কথা, একটি পত্রিকায় অধিক সংখ্যায় অপরিণত, অসম্পাদিত লেখা থাকলে প্রথিতযশা কবিসাহিত্যিকরা যেমন লেখা দিতে দ্বিধান্বিত হন, এডিটর হিসাবে লেখা চাইতেও কম সঙ্কোচ হয় না। আর শেষ পর্যন্ত পত্রিকাটিরও মান থাকে না, অথবা, বলা ভাল – মানোন্নয়ন হয় না। 

সিদ্ধান্ত নিতেই হল। কষ্ট হচ্ছিল। আগেও বহুবার বলেছি, পত্রিকা সম্পাদনার কাজের সঙ্গে আমি যুক্ত অনেক ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু ওয়েব পত্রিকা হিসেবে সেটাই ছিল প্রথম। মনে পড়ছিল, সেই সব গোড়ার দিকের দিনগুলির কথা। একেবারে জন্মেরও আগের লগ্ন থেকে যে পত্রিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তিলে তিলে পরম যত্নে অক্লান্ত পরিশ্রমে যাকে বড় করে তোলা, এক মুহূর্তে তার সঙ্গে সমস্ত সংস্রব ছিন্ন করতে কষ্ট তো হবেই। তবুও ছাড়তেই হল। ৬ই জুলাই, ২০১৪। 

কিন্তু মন খারাপ করে বসে থাকার সময় পাওয়া গেল না এক মুহূর্তও। ফোন আর ইনবক্স... ওপেন ওয়ালেও অনেকেই লিখতে লাগলেন। বক্তব্য সেই একই... শুরু কর আবার নতুন করে, আমরা কাকে লেখা দেব? ৩০ শে আগষ্ট, ২০১৪ শুরু হল একটি অন্য ধারার বাংলা মাসিক ওয়েব পত্রের জয়যাত্রা। স্বনামধন্য ব্লগার ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়ের অতিথি সম্পাদনায় প্রকাশিত হল ঋতবাক, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা। 

ঋতবাক-কে একটি অন্য ধারার বাংলা মাসিক ওয়েব পত্র বলা যে অত্যুক্তি নয়, তা প্রমাণ হয়ে গেছে মাত্র এগার মাসেই। লেখার বিষয় নির্বাচন ও গুনগত মান নির্ধারনে একাধারে প্রখর সচেতনতা ও নিবিড় নিষ্ঠা ঋতবাক-কে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত করেছে নিঃসন্দেহে। মূলতঃ গদ্যধর্মী এই সাহিত্য পত্রটি সমকালীন ওয়েব পত্র-পত্রিকা গুলির তালিকায় বেশ ওপরের দিকেই জায়গা করে নিয়েছে, ইতিমধ্যেই। 

কিন্তু লক্ষ্য যে শ্রেষ্ঠত্বের শিরপা! তাই আরো অনেক সচেতনতা প্রয়োজন। মুদ্রিত সংস্করণ তো আসছেই। আর আসছে ঋতবাক পাবলিকেশন – অদূর ভবিষ্যতেই। 

এক বছরের যাত্রা পথ পুরোটাই মসৃণ ছিল না। সহযোগিতার অজস্র হাত যেমন ছিল, তিক্ত অভিজ্ঞতা যে হয়নি, তাও নয়। ম্যাগাজিনের মান বজায় রাখতে অনেক সময়ই সিদ্ধান্তের বিষয়ে কঠোর হতে হয়েছে, রূঢ় হতে হয়েছে। কিন্তু সে সবই যে ম্যাগাজিনের স্বার্থেই, এ কথা বুঝেছেন বিদ্বদ্জনেরা। 

ঋতবাক ওয়েব ম্যাগাজিন নিয়ে অনেক স্বপ্ন, সে স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার দায়ও আমাদের-ই। বিগত কুড়ি বছরের ওয়েব ম্যাগাজিনের অগ্রগতির ইতিহাস আমাকে আশান্বিত করে। প্রাকৃতিক এবং সমাজতাত্ত্বিক কারণেই মানব সভ্যতা রক্ষার প্রয়োজনে একদিন অবশ্যম্ভাবী ভাবেই প্রিন্টেড ম্যাগাজিনের তুলনায় ওয়েব ম্যাগাজিনগুলির প্রয়োজনীয়তা ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাবে। সে ভবিষ্যৎ বিশেষ দূরে নয়। আর সেদিন যাঁরা ইতিহাসের এই বিবর্তনের মূল্যায়ন করবেন, অনিবার্য ভাবেই ঋতবাক-এর নাম তাঁদের উল্লেখ করতেই হবে, আমি নিশ্চিত। আপনাদের নিরন্তর সাহচর্যে সমৃদ্ধ ঋতবাক-এর এই যাত্রাপথ মসৃণ ও সুগম হোক।

শুভেচ্ছান্তে

সুস্মিতা বসু সিং 

1 comments:

2

প্রচ্ছদ নিবন্ধঃ পল্লববরন পাল

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


ই-ম্যাগাজিন - ঋতবাক - ভবিষ্যৎ
পল্লববরন পাল



এক

গত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে এক ক্ষণজন্মা রূপোলি প্রার্থীর বিখ্যাত উপদেশ-বাণী ধর্ষিতাদের উদ্দেশ্যে – ‘হয় চীৎকার করো, নয় উপভোগ করো’ – ২০১৪-র বর্ষসেরা বাণী – আমরা তাঁর সেই বাণীর মর্ম উপলব্ধি করে আহ্লাদিত হয়ে তাঁকে বিপুল ভোটে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছি| 

দুই

মানবসভ্যতার বিবর্তনের ইতিহাস প্রস্তরযুগ দিয়ে শুরু করে আধুনিকযুগে এলেও বাংলা সঙ্গীতজগতে রাইচাঁদ বড়াল কমল দাশগুপ্ত থেকে হেমন্ত মান্না সলিল হয়ে সুমন অবধি বিস্তৃত আধুনিক যুগের সমাপ্তির পরে এখন পুরোদস্তুর প্রস্তর যুগ চলছে| এই যুগের একটি জনপ্রিয় প্রস্তর গানের একটি জনপ্রিয়তর লাইন – ‘আসলে সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’|


একটু উপক্রমণিকা করে নিলাম, মাননীয়া সম্পাদিকা মহাশয়া| আসলে এমন একটা ‘রডোডেণ্ড্রন’ মার্কা বিষয় দিয়েছেন – প্রাথমিক মাথা চুলকে নেওয়ার সময়টুকু চুরি করে নিলাম| 

ঋতবাকের ভবিষ্যৎ!!!!

১৪৪০-এ আবিষ্কার হয়ে গেছে মুদ্রণযন্ত্রের – জোহান্স গুটেনবার্গের হাতে| আরও ২৪৪ বছর পরে সাহিত্য পত্রিকার প্রথম প্রকাশ প্যারি শহরে| ঊনিশ শতক থেকে ছড়িয়ে পড়লো দেশে দেশে| ই-ম্যাগের আত্মপ্রকাশ ১৯৯৬ সালে – সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ| তাই তো ভবিষ্যৎ ভাবনা|

ভবিষ্যৎ? উরিব্বাবা! আমার নিজের জীবনে এক মুহূর্ত পরে কী হবে বা হতে চলেছে – সেটাই জানিনা| আমি কোন লাটসাহেবের পুত, মাননীয়াসু? আমার কোনো টি-আর-পিও নেই যে আমাকে ভবিষ্যৎদ্রষ্টা দেখিয়ে আপনার কোনো লাভ হবে - দ্রষ্টা হয়ে ওঠার প্রাথমিক শর্ত দৃষ্টিশক্তি থাকা – পেটসূত্রে চব্বিশ গুণ সাত আমার চোখ কম্পিউটার-জানলায় ফ্রেমবন্দী – ওই ছাব্বিশ ইঞ্চি দূরত্বটুকুই আমার কাছে ঈশ্বরসত্য, হযবরল-য়ের ছাব্বিশ ইঞ্চির মতো – গলা বুক পেট পাছা – সব ছাব্বিশ ইঞ্চি – সেই অর্বাচিন চতুষ্পদ - আমার ডানদিক বাঁদিক সামনে পিছনে যেদিকেই তাকাই – ওই জানলা – ওই ছাব্বিশ ইঞ্চি - যার বাইরেটা শুধুই ঝাপসা – ঘষা কাঁচ – বিশ্বায়িত পৃথিবীতে অস্তিত্বরক্ষার একমাত্র ফর্মুলা – আজ, এই মুহূর্ত – ব্যাস, পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে একটা বিন্দুর ওপর – অতীতহীন, ভবিষ্যৎহীন| 

গতকাল নেই – আগামীকাল নেই – আমাদের কাছে এই সামান্য মুহূর্তটুকুই আস্ত জীবন!

দু’ ধরণের মানুষ আছেন যারা ভবিষ্যৎ দেখতে বা বলতে পারেন - একদল নাকি ঠিকুজি-কুষ্ঠী পেলে ভবিষ্যৎ স্যাটাস্যাট কড় গুনে বলে দিতে পারেন – তাঁদের ইচ্ছেমতো ভবিষ্যৎ বদলেও দিতে পারেন পাথর-টাথর দিয়ে| আর এক দল – কবি – নিজের চক্ষে দেখা – ইদানিং সময়ের বিশ্বায়িত স্বনামধন্য কবি ওইসব বস্তাপচা পাথরটাথরে না – নিজের গলার উত্তরীয় দিয়ে শুধু কেদারা মুছলেন এবং পরবর্তী সময়ে অবলীলায় রাজশিরোপা লাভ করলেন – এঁরাও অতিমানুষ!

মুশকিল এই আমার মতো না-জ্যোতিষী না-কবি হিজবিজবিজদের নিয়ে – আমাদের না আছে ঠিকুজি কুষ্ঠী, না আছে উত্তরীয় – আছে সবেধন নীলমণি একটা জানলা| আমাদের না আছে অতীত, না ভবিষ্যৎ| আমরা গতকাল মৃত ছিলাম – আজও মৃত – আগামীকালও তাই| বানতলা কামদুনি মধ্যমগ্রাম রাণাঘাট সাত্তোরে যা হচ্ছে হোক, আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে! গোধরা থেকে মুজফ্‌ফরনগর, ছোটো আঙারিয়া থেকে নানুর, সংগ্রামপুর থেকে খাগড়াগড়, নন্দীগ্রাম থেকে যাদবপুর, বিজন সেতু থেকে জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস, সজল বাড়ুই থেকে সুদীপ্ত সেন, হেতাল পারেখ থেকে সুজেট জর্ডন – আমাদের দায়িত্ব ওই এ কান থেকে ও কান এপাং ওপাং ঝপাং – ফিসফিস করে নিজেকেই বলি – আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি মাস্টারমশাই, যা শুনছেন সব ষড়যন্ত্র, সাজানো ঘটনা| 

‘ফুটপাথ কারো বাপের জায়গা নাকি?
তা যদি ভাবিস, ঘুমিয়ে থাকিস
সেই ফুটপাথে – মদ্যপ রাতে 
তোর কপালেও গাড়ি চাপা পড়া বাকি’ – 

আলোকিত মঞ্চে এই গান শুনে আমরা সিটি দিয়েছি, উদ্‌বাহু নৃত্য করেছি | যিনি গাড়িচাপা দিয়ে মানুষ মারলেন, তাঁকে আমরা মনে মনে রূপোলি নৈবেদ্য সাজিয়ে পুজো করে চলেছি| আমরা শার্লক হোমস সাহেবের সেই বিখ্যাত উক্তিটাকে খুব পছন্দ করি – ‘পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে না সূর্য পৃথিবীর, তা জেনে রোজকার জীবনে আমার কিছু যায় আসেনা, তাই আমি ওসব মাথায় রাখিনা’ – আমরাও তাই – আমরা সবাই হিজবিজবিজ - আমাদের পৃথিবীর সীমানা ওই ছাব্বিশ ইঞ্চি দূরের জানলা অবধি – ব্যাস্‌, তার বাইরে আমরা কিছুই মাথায় রাখিনা| 

ঋতবাক| অর্থাৎ সত্য কথন| 

এ তো আবার মহা মুশকিলে পড়া গেলো| সত্য? সেটা আবার কী? খায় না মাথায় দেয়? একসময়ে সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে – এটা সত্য ছিলো| মিশরীয় বা মধ্যপ্রাচ্য সভ্যতার সময়ে অথবা পরবর্তীকালে বাইবেল রচনাকালে মানুষের কাছে চালু সত্য ছিলো - পৃথিবী সমুদ্রে ভাসমান একটি চ্যাপ্টা সমতল ক্ষেত্রবিশেষ| পরে পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা দিয়ে বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে – সে সব ঘোর মিথ্যা| বরং উল্টোটাই সত্য| সতীদাহ প্রথা একসময়ে বাঙলায় সত্য ছিলো| বিধবা রমণীরা একসময়ে সত্যই সামাজিক গলগ্রহ হিসেবে গণ্য হতেন – পরবর্তী সময়ে যুগান্তকারী বিধবা বিবাহ প্রথা প্রকৃত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো| ‘প্রকৃত সত্য’ লিখতে মনে পড়ে গেলো - এই কিছুদিন আগে, নব্বই দশকে, সঠিক সন তারিখ মনে নেই, সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বার্ধক্যজনিত কারণে উপমুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হলেন শ্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য| এই খবরটি লিখতে গিয়ে পরেরদিন একটি সংবাদপত্র বুদ্ধবাবু সম্পর্কে লিখলেন – ‘একজন প্রকৃত সৎ কমিউনিস্ট’| কয়েকদিন বাদে সেই সংবাদপত্রেই একটি চিঠি প্রকাশিত হলো, যার মধ্যে পত্রকার (নাম মনে নেই) লিখলেন – সাতের দশক অবধি ‘কমিউনিস্ট’ বললেই আমরা মানুষটির চরিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতাম, আশির দশকে শুধু কমিউনিস্ট বললে সম্পূর্ণ সত্যপ্রকাশ দুষ্কর হয়ে উঠলো, বলতে হলো – ‘সৎ কমিউনিস্ট’, নব্বই দশকে আবার সৎ শব্দটা নিয়েও ধন্দে পড়লাম, লিখতে হচ্ছে – ‘প্রকৃত সৎ কমিউনিস্ট’ – এরপর কী?

সত্য কি এমনি করেই ক্রমশঃ তরল হয়ে যায়? আজ যা সত্য সেটা কি কাল মিথ্যা হয়ে যাবে? তবে কি এখানে ‘সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই’? যে আদর্শটাকে মানুষের পক্ষে সবচেয়ে সত্য ও সুন্দর বলে বিশ্বাস করে পৃথিবীর ইতিহাসে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম হলো – এক শতাব্দীও পেরলোনা, ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেলো? যে বাঙলার বুকে ভূমিসংস্কার হলো, বর্গা অপারেশন হলো – মাত্র চৌঁত্রিশ বছরে সব মিথ্যা হয়ে গেলো? আর তার পরবর্তী এই চার বছর? সে তো আরো ভয়ঙ্কর! আরো সর্বনেশে!

আসলে, মানুষ নিজের অস্তিত্বের তাগিদে নির্মাণ করে একএকটি সত্যকে, আবার মানুষই সেই সত্যকে ধ্বংস করে| নিজ অস্তিত্বের তাগিদেই| নির্মাণও সত্য, ধ্বংসও সত্য| মানুষের নিজস্ব চিন্তন দর্শন কর্মের এই পরিবর্তন ও পরিণতিটাও তাহলে সত্য| মহত্বও সত্য, শয়তানিটাও সত্য| আলো সত্য, অন্ধকারও সত্য| 

এ সব নিয়ে আলোচনায় অসীম দার্শনিক সময় কেটে যাবে, উত্তর আবর্তিত হবে ধ্রুব কেন্দ্রের চারপাশে – ঘুরতেই থাকবে – ঘুরতেই থাকবে – বার্ট্রাণ্ড রাসেলের কথায় - Truth is a shining goddess, always veiled, always distant, never wholly approachable, but worthy of all the devotion of which the human spirit is capable. 

তাহলে ঋতবাকের ভবিষ্যৎ? কী করবে ঋতবাক? আমাদের কী আশা - কোন সত্য কথনে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করবে ঋতবাক? অস্ট্রিয়ান স্থপতি-দার্শনিক রুডল্‌ফ স্টেইনার-র মতে - Truth is a free creation of the human spirit, that never would exist at all if we did not generate it ourselves. The task of understanding is not to replicate in conceptual form something that already exists, but rather to create a wholly new realm, that together with the world given to our senses constitutes the fullness of reality.

২৬শে ফেব্রুয়ারি ২০১৫| ঢাকা বাংলাদেশ| আলোকিত বইমেলা মাঠ ফেরৎ উন্মুক্ত রাস্তায় নৃশংসতমভাবে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে অভিজিৎ রায়কে – আমরা ফেসবুকে রক্তাক্ত রাফিয়া আহমেদ বন্যাকে অভিজিতের লাশের পাশ থেকে উঠে দাঁড়াতে দেখেছি| চারপাশে নীরব বৃত্ত রচনা করেছিলো পুলিশ মিডিয়া ক্যামেরাসহ কয়েকশো মানুষ – একমাত্র একজন সাংবাদিক এগিয়ে গিয়ে দু’জনকেই স্থানীয় একটি হাসপাতালে পৌঁছিয়ে দিয়েছিলেন – আর কেউ এগিয়ে আসেনি সাহায্য করতে|

- ওই সাংবাদিকের নাম হোক ঋতবাক|


তোমার হাসিতে এতো সন্ত্রাস লেগে আছে কেন?
চুম্বন-নিঃশ্বাসে কেন এতো সুনামি সংকেত?
কামার্ত দৃষ্টিপথে শুয়ে আছে গাছের কাণ্ডেরা
পান্তাভাতে কেন এতো লঙ্কার অস্ত্রঝনঝন?

বিছানায় শুয়ে শুয়ে ‘গল্প বলো’ নাতি-আবদারে
ঠাকুরমার ঝুলি থেকে রাজপুত্র কোটালপুত্রেরা
ইদানিং মধ্যরাতে নেমে আসে গামছা-বাঁধা মুখে
রক্তে ভিজিয়ে দেয় শান্তিঘুমস্বপ্নের দালান

যে হাতে পেনসিল হয়ে স্বরবর্ণ আর ব্যাঞ্জনেরা
ভেবেছিলো বড়ো হয়ে কবিতা বা উপন্যাস হবে
এ কে সাতচল্লিশের ট্রিগারে সে হাতের তর্জনি
লাশ করে দিয়ে গেলো সমুদয় শিল্পসম্ভাবনা

‘কল্লোলিনী তিলোত্তমা হবে’ – এটা অবাস্তব জেনে
অথচ ভোরের স্বপ্নে জেগে উঠে আমরা ভেবেছি
ভাত পেলে অন্ততঃ ক্ষুধার সন্ত্রাস যাবে কমে
হয়তো দেরিই হলো – তবু এটা শুভ পদক্ষেপ

সন্ত্রাস ছিলোনা – কই, এমন তো বলিনি কখনো
ইস্পাত-শিলান্যাস ফিরপথে কিন্তু যার শুরু
সন্ত্রাসের বিকল্প কি উন্নততর সন্ত্রাস?
ভোররাতে সূর্য পোড়ে – পূর্বাকাশে রক্তের ছাই

সন্ত্রাস সন্ত্রাস খবরকাগজ শিরোনামে
দশম পাতার শেষ কলামেও লাশের পাহাড়
শিল্প গেলো, ভাত গেলো, গেলো বহু হাঁসদা সোরেন
হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো কি সত্যি সত্যি বদলে যাওয়া মাটি?

ঘাসের শিকড় থেকে বেরিয়েছে দৈত্য-কীটেরা 
মাঠে মাঠে ঢেলে দিচ্ছে চুপিসাড়ে বারুদ ও বিষ 
রক্তের রঙে আর গন্ধে বড়ো অ্যামোনিয়া ঝাঁঝ
আমরা কি সম্মোহিত হয়ে থাকবো বদল-ম্যাজিকে?

‘বদল’ ম্যাজিক নয় – নয় কোনো হনুমান লাফ
‘বদল’ বিদেশ থেকে আনা কোনো প্রযুক্তিও নয়
‘বদল-ফদল’ নয় – ‘ক্রমমুক্তি’ শব্দ সঠিক
আমার বাঁদিক-বুক সর্বাগ্রে ক্রমমুক্ত হোক 


ধর্ষিতা বাঙলার এই ক্রমমুক্তির সত্যবদ্ধ অঙ্গীকারে ক্রমাগত ‘উপভোগ’ নয় – মেরুদণ্ড উলম্ব রেখে সমস্ত অসত্যের চোখে চোখ রেখে ‘চীৎকার’ করে চলুক ঋতবাক| 



2 comments:

2

প্রবন্ধঃ ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়

Posted in


প্রবন্ধ


বিজ্ঞাপনের সেকাল একাল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়



একালে ‘বিজ্ঞাপন’এর কথা অমৃত সমান – শেষ হবার নয়। বিনোদনের জন্য টেলিভিশন খোলার জো নেই, রেডিওতে কান পাতার উপায় নেই, আর খবরের কাগজের প্রথম পৃষ্ঠাটাতেও পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন। ‘দুধে জল মেশানো না জলে দুধ মেশানো’ সেটা বোঝা যেমন মুস্কিল হয়, তেমনই বোঝা যায় না ‘খবরের সঙ্গে বিজ্ঞাপন না বিজ্ঞাপনের সঙ্গে কিছু খবরের টুকরো’। একালের কথা থাক , সে কালের কথা বলি।

সুপ্রাচীন কালে মিশরে, যখন কাগজ আবিস্কার হয়নি, তখন গাছের ছালে লিখে পন্য বিক্রির বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। প্রাচীন ভারতে শিলালেখ’এ যে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় নির্দেশ লেখা হত তাও তো বিজ্ঞাপন। সেই শিলালিপিবার্তা থেকে এই আধুনিক যুগে দেওয়ালে হাঁপানি কিংবা যৌনব্যাধি নিরাময়ের দাওয়াই-এর বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দীর্ঘ পরিক্রমা।

লন্ডনের টমাস জে. ব্যারাটকে আধুনিক বিজ্ঞাপনের জনকের মান্যতা দেওয়া হয়। সেটা উনিশ শতকের কথা। ব্যারাট কাজ করতেন লন্ডনের পিয়ার্স সাবান কোম্পানীতে। পিয়ার্স সাবানের ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপনের স্লোগান লিখেছিলেন “সুপ্রভাত, তুমি কি পিয়ার্স সাবান ব্যবহার করেছো?” দীর্ঘকাল সেই সাবান নির্মাতারা এই বিজ্ঞাপনটি দিতেন। বস্তুত ব্যারাট পিয়ার্স সাবানকে অভিজাত ও মধ্যবিত্ত শহুরে মানুষের কাছে দারুণ জনপ্রিয় করেছিলেন। আজও পীয়ার্স সাবানের কথা প্রবীণেরা জানেন। শুধু কি বিজ্ঞাপনের স্লোগান রচনা? না, পিয়ার্স সাবানকে জনপ্রিয় করার জন্য বার্ষিক ‘মিস পিয়ার্স’ প্রতিযোগিতা, ব্র্যান্ড অ্যামব্যাসাডর নিয়োগ করা, সেলিব্রিটিদের দিয়ে পণ্যের প্রচার, এ সবই ব্যারাটের মাথা থেকেই বের হয়েছিল। লিটল ল্যাংট্রি নামে এক ব্রিটিশ হোটেল গায়িকাকে দিয়ে তাদের সাবানের বিজ্ঞাপন করিয়েছিলেন ১৮৯১এ। ঐ ব্রিটিশ গায়িকাই প্রথম অর্থের বিনিময়ে পণ্যের বিজ্ঞাপন করা সেলিব্রিটি, যা ছিল ব্যারাটের অবদান ও মস্তিষ্ক প্রসূত।

প্রায় একই সময়ে, ১৮৯৮ নাগাদ ভারতে গ্রামফোন বা কলের গান চলে আসে। দম দেওয়া আর চোং লাগানো গ্রামোফোনে গালার চাকতিতে ধ্বনিবদ্ধ গান শোনা। সে এক বিস্ময় বটে ! সেই সময় গ্রামোফোন কোম্পানীর একটা বিজ্ঞাপন খুব লোকপ্রিয় হয়েছিল এবং এখনও প্রবাদের মত হয়ে আছে – “সুখী গৃহকোণ শোভে গ্রামোফোন”। এমন রুচিসম্মত স্লোগান কে রচনা করেছিলেন, তা জানা যায় না।

১৮৩৬এ ফরাসী সংবাদপত্র ‘লা প্রেসে’ প্রথম সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনের প্রচলন শুরু করে। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়ার পথ খুলে যাওয়ায় কয়েক বছরের মধ্যে মুদ্রিত বিজ্ঞাপনের অভূতপূর্ব বাজার তৈরী হয়ে গেলো এবং একাধিক বিজ্ঞাপন এজেন্সি গঠিত হয়ে গেলো। পণ্য বিক্রয়ের প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ের শুরু অতএব হয়ে গেলো। এদেশে তখন এ’সবের বালাই থাকার কথা নয়, ছিলোও না। দেশের পণ্যই নেই তো বিজ্ঞাপন কে দেবে! 

কিন্তু বিজ্ঞাপন ছিল। ১৮২৫-২৬এর মধ্যে এদেশে সংবাদপত্র এসে যায়। ১৭৬৫তে দেওয়ানী পাওয়ার পর ইংরাজ শাসন জাঁকিয়ে বসতে শুরু করে। নানান পেশায় ভাগ্যান্বেষি ইংরেজ মুচি, ধোপা, নাপিত, ফেরিওয়ালারাও কলকাতায় আস্তানা গাড়ে। লুটেপুটে খাওয়া শুরু হয়েছে যে! সেই সময়ে ইংরাজি সংবাদ পত্রে তাদের বিজ্ঞাপন থাকতো। গৃহভৃত্য চেয়ে, পুরাতন আসবাবপত্র বিক্রি করতে চেয়ে, কিংবা কর্মপ্রার্থী হয়ে সেসব বিজ্ঞাপন দেওয়া হত। এই বিজ্ঞাপনগুলি থেকে সেকালের কলকাতার সমাজজীবনের একটা বিশ্বাসযোগ্য পরিচয় পাওয়া যায়। ১৭৮৪ সালের ক্যালকাটা গেজেটের একটা বিজ্ঞাপন ছিল মেসার্স উইলিয়াম এন্ডলী একটি ঘোড়া বিক্রি করবেন ৩০০ সিক্কা টাকায়। ১৮০১ সালে শ্রীরামপুরের জনৈক আব্রাহাম একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন যে তার স্ত্রী কাউকে না বলে বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছেন। তিনি যদি কোথাও কোন ধার দেনা করেন, তার দায় আব্রাহামের নয়। বোঝ কাণ্ড! বৌ পালিয়েছে, তার খোঁজ পাওয়ার বিজ্ঞাপন নয়, সে যদি টাকা ধার করে, তার দায় ঐ ব্যক্তির নয়! ১৭৯১ সালের ২৮শে এপ্রিল এক সাহেব একটা অভিনব বিজ্ঞাপন দিলেন এই মর্মে যে তিনি ‘কলকাতার রাস্তায় যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানো ঘোড়াগুলির বংশবৃদ্ধি করাতে চান। ইচ্ছুক ঘোড়া-মালিকরা তার বিজ্ঞাপনের খরচটা মিটিয়ে দিলেই তিনি কাজ শুরু করবেন।’ বোঝা গেল সেই আদি কলকাতার ইংরেজদের শুধু টাকা রোজগারের ধান্দা ছাড়া আর কিছুই মাথায় আসতো না। [সূত্রঃ ‘শহর কলকাতার ইতিবৃত্ত’ / বিনয় ঘোষ ]

পণ্যের বিজ্ঞাপনে সেই পণ্যের টার্গেট ক্রেতাকে প্রলুব্ধ করার মনস্তত্ব পণ্য বিক্রেতার থাকেই, তা দোষের নয়। কিন্তু প্রলুব্ধ করার জন্য রুচিহীন ভাষা ও অনৈতিকতার যে প্রাবল্য এখন দেখা যায় তা সহ্য করা মুস্কিল। পঞ্চাশ, ষাট, সত্তর দশকের বিজ্ঞাপন নির্মাণে এই রুচিশীলতা ও নৈতিকতা বজায় ছিল। নামি লেখকরা পণ্যের বিজ্ঞাপনের ভাষা রচনা করতেন। সত্যজিৎ রায় তাঁর কর্ম জীবন শুরু করেছিলেন বিজ্ঞাপন রচনার কাজ করে। পূর্ব রেলওয়ে তাদের বিজ্ঞাপণে রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা ব্যবহার করত – “এ প্রাণ রাতের রেলগাড়ি, দিল পাড়ি......”। ১৯৪৭এ স্বাধীনতা লাভের পরের দিন ১৬ই অগস্ট ইংরাজি কাগজ স্টেটসম্যানের প্রথম পৃষ্ঠায় একটা হাতঘড়ির বিজ্ঞাপন দেখছি, হাতঘড়ির ছবি দিয়ে তিনটি মাত্র শব্দ খরচ করা বিজ্ঞাপন ‘ইট’স অ্যান ওমেগা’। অতি সংক্ষিপ্ত স্লোগান, কিন্তু অব্যর্থ। একালে এমন বিজ্ঞাপনে নির্ঘাত কোন সুবেশা তন্বির ছবি থাকতো! 

৫৪/৫৫ সালের কথা মনে আছে কাঁচি মার্কা সিগারেটের একটা বিজ্ঞাপন – রেল প্ল্যাটফর্মে সঙ্গের মালপত্রের ওপর বসে একজন সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে আর ট্রেন তার সামনে দিয়ে হুশ করে চলে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপনে এই রকম বুদ্ধির ছাপ ছিল। বালক বয়সে বিজ্ঞাপনটায় বেশ মজা পেতাম, সিগারেটে সুখটান দেওয়ার জন্য লোকটি ট্রেনটা ধরতে পারলোনা বলে।

বেশি দিনের কথা নয়। পুরাতন পত্রিকা ঘাঁটতে গিয়ে পেলাম ১৯৭১এ ‘হিন্দুস্থান স্টীল’এর একটা বিজ্ঞাপনের ভাষা “ভাষা ও ভঙ্গিমায় জীবনের প্রতিভাস। শিল্পকৃতি মানবিকতার সম্পদ”। বিজ্ঞাপন রচনায় এই ভাষা এখন আর কোথায় ! এখনতো ভাষায় শৈল্পিক স্পর্শ তো দূরের কথা, এখন অদ্ভুত জগাখিচুড়ী ভাষায় পণ্যের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে গেছে – ‘ঠান্ডার নতুন ফান্ডা’ জাতীয়।

বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে টার্গেট উপভোক্তাদের মাথা চিবিয়ে খাবার প্রক্রিয়ার আঁতুড় ঘর যে আমেরিকা এখন আর এতে কারো সংশয় নেই। প্রায় একশ’বছর আগে এই প্রক্রিয়ার সূচনা হয়েছিল আমেরিকায়। ‘মানুষের অর্থনৈতিক আচরণ ও তার অবচেতনে থাকা উপভোগ ও ক্রয়ের স্পৃহাকে লক্ষ্যবস্তু করার তত্ত্ব’ প্রয়োগ করা শুরু করলো ওখানকার বিজ্ঞাপন কোম্পানীগুলো। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে উপভোক্তাকে প্রলুব্ধ করার এই তত্ত্বের উদ্গাতা যে সে লোক নন, মনোবিজ্ঞানি সিগমন্ড ফ্রয়েডের ভাইপো এডওয়ার্ড বেরনাভস, আমেরিকা যাকে বলে আধুনিক বিজ্ঞাপন শিল্পের উদ্ভাবক।

বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রে উপভোক্তাকে প্রলুব্ধ করার এই মডেলই সর্ব দেশে অনুসৃত হয়ে আসছে। ১৯৫০এর দশক থেকে আমেরিকায় রেডিও ও টেলিভিশনে বানিজ্যিক বিজ্ঞাপনের চল হওয়ার পর থেকে বড় বড় মনোবিদরা নানান পদ্ধতি উদ্ভাবন করে চলেছেন। আমাদের দেশে রেডিওতে বানিজ্যিক বিজ্ঞাপন চালু হয় বিবিধ ভারতীর অনুষ্ঠানে ১লা নভেম্বর ১৯৬৭ থেকে।

এ কালের বিজ্ঞাপনের কথা বলতে ইচ্ছা হয় না। এ দেশে নব্বইএর দশক থেকে বিশ্বায়নের সর্বগ্রাসী থাবা আমাদের সংস্কৃতি, রুচি, ভাষা আর মূল্যবোধের সবটুকুই লুটে নিয়েছে। ‘রক্তকরবী’ নাটকে অধ্যাপক ও নন্দিনীর কথোপকথনের অংশ মনে পড়ে। অধ্যাপক নন্দিনীকে বলছেন “আমরা যে মরা ধনের শবসাধনা করি। তার প্রেতকে বশ করতে চাই। সোনার তালের তাল-বেতালকে বাঁধতে পারলে পৃথিবীকে পাব মুঠোর মধ্যে।” পণ্যায়ন আর ভোগবাদ পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার রাস্তা বাৎলে দিয়েছে আমাদের।এখন আর ‘সেনকোর অলঙ্কার আমার অহংকার’ নয়, হীরা চাই। তাই হীরা কেনার লোভ দেখানো বিজ্ঞাপন। এখন দেহ ব্যবসার বিজ্ঞাপনও অভিজাত বাংলা সংবাদ পত্রে বাধাহীন প্রকাশ হয়ে চলে।

হাতের মুঠোয় পৃথিবীকে ধরা – মহা পুণ্যবান
একালের বিজ্ঞাপন-কথা অমৃত সমান।


2 comments:

2

প্রবন্ধঃ অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ


প্রসঙ্গ ডাকঘর - একটু অন্য চোখে বিশ্লেষণ 
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য 



সালটা 1945, 2 মে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ পর্যায়। হিটলার আত্মহত্যা করার প্রাক্‌ মুহূর্ত। সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সাথে জার্মান সেনার রাস্তায় মুখোমুখি যুদ্ধ হচ্ছে। সেই সময় শোনা যায়, রবীন্দ্রনাথের "ডাকঘর' পথনাটক করা হয়েছিল জার্মানির রাস্তায়। WIkipedia জানাচ্ছে "It had a successful run in Germany with 105 performances and its themes of liberation from captivity and zest for life resonated in its performances in concentration camps where it was staged during World War II." from "Tagore for today". The Hindu. August 30, 201।.

এর থেকে একটা সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর অনেক বিদগ্ধ মনীষীর মনেই দাগ কেটেছিল। ভারতীয় নাট্যকারদের মধ্যে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র শম্ভু মিত্র। তাঁর নির্দেশনায় 'ডাকঘর' একটা নতুন ভাষা পেয়েছে। পাতার কার্বন থেকে জ্বলন্ত পাবক। নাটক মনের সাথে অনেক বেশী নিবিড় সংযোগ স্থাপন করে।

আজকের ফেসবুক আর ই-মেইল এর যুগে ডাকঘরে প্রায় যেতেই হয় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের 'ডাকঘর', একবার নতুন করে পড়ার জন্য আহ্বান করলো। নতুন চোখে পড়তে গিয়ে 'ডাকঘর' আবার নতুন করে ভাবতে চেনালো। অমল কি সত্যি মারা গেছিল? নাটকের শেষ সংলাপে পরিষ্কার তো লেখা নেই। আছে ব্যঞ্জনা। আর ব্যঞ্জনার মধ্যে দিয়ে একটা নাম এলো সুধা। সুধা মানে অমৃত। যা মানুষকে অমর করে। তাহলে অমলকে ফুল দিতে সুধা কেন এসেছিল। এত সুন্দর নামের ভিড়ে রবীন্দ্রনাথ সুধা নামটাই বা কেন পছন্দ করলেন? প্রশ্নটা মনকে নাড়া দিল বার বার।

নাটকের সংলাপ পড়তে গিয়ে কিছু প্রশ্ন মনে জেগেই রইলো। 

'অমল। আমি জানি নে। আমি তো কিচ্ছু পড়ি নি, তাই আমি জানি নে আমার কী হয়েছে। দইওআলা,' 

অমল জানেই না যে তার কি হয়েছে। সে শুধু জানে যে বৈদ্য তাকে ঘরের বাইরে যেতে মানা করেছে। কারণ তার অসুখ করেছে। নাটকের এক জায়গায় কবিগুরু লিখেছেন অসুখ "করতে পারে"। সেটা অমলের কাকার সংলাপ।কাকা, অমল কে দত্তক নিয়েছিল (adopted uncle)। করতে পারে - এটা ভবিষ্যত কাল। বর্তমান কালে অমলের কি অসুখ সেটা তো অমল জানেই না।বৈদ্য ডায়াগনসিস করেছে যে 'বাত, পিত্ত আর কফ'। বৈদ্য যে ঠিক নির্ণয় করেছে সেটা বলা কঠিন। কারণ বৈদ্যের ডাক্তারি বিদ্যার যে নাটকীয় ব্যঙ্গ রবীন্দ্রনাথ লেখনীতে মিশিয়েছেন, তাতে বৈদ্যের পুঁথিগত জ্ঞান কতটা সঠিক সেটা বিচার্য। যে দুর্বোধ সংস্কৃত লেখা রয়েছে, আর তার যা অর্থ বৈদ্য করেছে, সেটা দুর্বোধ শব্দটির-ই মত। ব্যুৎপত্তি বা শব্দের জন্ম পদ্ধতি বিচারে দুর্বোধ সঠিক শব্দ। যদিও দুর্বোধ্য কথাটা বাংলায় বহুল প্রচলিত। তবে ওই য ফলা ব্যাকরণ বিচারে শুদ্ধ বলা যায় না। সেরকমই লেখকের হাস্যরস বৈদ্যের বিদ্যা নিয়ে সংশয় রেখেই দেয়। সেই সাথে অমলের রোগ যতটা না কঠিন ছিল, তার থেকেও ছিল কঠিন স্নেহ। যেটা বাংলা প্রবচন কে মনে করিয়ে দেয় - স্নেহ অতি বিষম বস্তু। 

বৈদ্যের চিকিৎসা যে ভুল ছিল তার প্রমাণ রাজবৈদ্যের প্রবেশ। বৈদ্য ছিল কবিরাজ। ডাকঘরের রচনাকাল 1912। সেই সময় ভারতীয় চিকিৎসাতে অ্যালোপ্যাথি প্রবেশ করেছে। প্রাচীন কবিরাজি চিকিৎসাতে সঠিক বিদ্যার অভাবে নিয়ম ছিল রোগীকে ঘরে বন্ধ করে রাখা। কিন্তু অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা শিখিয়েছে, উন্মুক্ত বাতাস, খোলা আকাশ, সূর্যের আলো আরোগ্য লাভের প্রাথমিক প্রয়োজন। রাজবৈদ্য সেই আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে পারদর্শী। সহজ কথায় অ্যালোপ্যাথ ডাক্তার। অমল নাটকের শেষ দৃশ্যে ঘুমিয়ে পড়েছিল।সেই ঘুম আর ভেঙ্গেছিল কিনা সেটা বলা যায়না। কারণ নাটকে স্পষ্ট করে সেটা বলা নেই।

ডাকঘরে, রবীন্দ্রনাথ অমলকে প্রকৃত মারতে চেয়েছিলেন কিনা সেটা বলা শক্ত। নাটক মঞ্চস্থ করতে গেলে একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ এফেক্ট (effect) হলো ট্র্যাজেডি। ট্র্যাজেডি বেশী করে মনকে নাড়া দেয়। সেই কারণে নাটকের স্বার্থে কবিগুরু অমলের মৃত্যু বার্তাটা রহস্য জালে মুড়ে রেখেছেন। নাটকের আলোতে বিচার করলে শ্রদ্ধেয় শম্ভু মিত্র সার্থক।

তবে “ডাকঘর” সমাজের কাছে এক নতুন বার্তা নিয়ে এসেছে। সেটা মৃত্যু নয়।জীবনের বার্তা। পরিবর্তনের বার্তা। আধুনিক শিক্ষার বার্তা। কুসংস্কার মুক্ত মনের বার্তা। যাকে পরিভাষায় বলা যায় কান্তা সম্মিত বাণী, যা আত্মিক লোকে সর্ব মানব চিত্তের মহাদেশে বিরাজ করে। 1917 সালে বীন্দ্রনাথ প্রথম যখন ডাকঘর নাটক মঞ্চস্থ করেন,তখন তিনি কিছু গান নাটকে প্রয়োগ করেন। যদিও মূল নাটকে কোন গান নেই। তার মধ্যে একটা গান হলো - ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে। এই গান জীবনের গান। মৃত্যুর গান নয়। অমল যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন তার জন্য ফুল এনেছিল সুধা। সুধা নামের ভাব লক্ষ্যণ গত অর্থে জীবনের জয়গান গায়। বিদেশী লেখকের চোখে ডাকঘর নবজাগরণের বার্তা আনে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানিকে নতুন আলোতে জাগাতে 105 বার ডাকঘর নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে। যেখানে বন্দী জীবন থেকে মুক্তির আনন্দ ফোটানো হয়েছে।

উপসংহারে শেষ প্রশ্নটা থেকে গেল। অমলকে দেখতে যে রাজা আসার কথা ছিল তিনি কোন রাজা ? সেই উত্তর খোঁজার জন্য মন সন্ধান করলো শব্দের চতুর্বিধা শক্তিকে। সেটা হলো তাৎপর্য। মম্মটভট্টের টীকাতে, তাৎপর্যকে চতুর্বিধা শক্তি বলা হয়েছে। এখানে রাজার আগমনের তাৎপর্য হলো রেনেসাঁ বা নবজাগরণের বার্তা। পরিবর্তনের বার্তা। ডাকঘর নাটকে রাজা হলো রেনেসাঁ বা নবজাগরণ।



2 comments:

4

প্রবন্ধঃ পিয়ালী বসু

Posted in


প্রবন্ধ 



ভিন্ন আলোকে ডাকঘর
পিয়ালী বসু


১৯১১ তে ডাকঘর নাটকটি লেখেন রবীন্দ্রনাথ। তারও প্রায় ৩৬৫ দিন অপেক্ষা করার পর নাটকটি formally release হয় শান্তিনিকেতনে। ১৬ই জানুয়ারী ১৯১২ তে শান্তিনিকেতনের মুক্তাঙ্গনে মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। আবার ৩৫৬ দিন অপেক্ষা। WB Yeats-এর করা ডাকঘর এর ইংরেজি ভাষান্তর "The Post Office মঞ্চস্থ হয় ডাবলিনের The Abbey Theatre-এ। 

কলকাতাবাসীদের ডাকঘর নাটকটি দেখার জন্য প্রায় ছ বছর অপেক্ষা করতে হয়। অবশেষে ১৯১৭ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে ডাকঘর নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। ঠাকুরদার চরিত্রে নিজেই আবির্ভূত হন রবীন্দ্রনাথ। 

ডাকঘর-এর রচনাকাল ১৯১১, অর্থাৎ গীতাঞ্জলী রচনার ঠিক পরবর্তী time span-এ। আধ্যাত্মিকতা তখন রবীন্দ্রনাথের জীবন জুড়ে। আর তারই অনিবার্য প্রভাব ডাকঘরেও। ডাকঘর নাটকটি আমার চোখে symbolic...গদ্য লিরিক বা lyrical prose এ লেখা এই নাটক জীবন এবং মৃত্যু কে এক নতুন আলোকে জারিত করেছে নিঃসন্দেহে। ডাকঘরে  মৃত্যু আসে অনিঃশেষ গুঞ্জরনে। অমলের মৃত্যু নাড়িয়ে দেয় আপামর জনসাধারণের মনোলোক, আর এখানেই symbolic নাটক হিসেবে ডাকঘরের সার্থকতা। অমলের মৃত্যু শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি মানুষের মৃত্যু নয়, বরং সমগ্র নবীন প্রজন্মের মৃত্যু ...unimaginative, prosaic social structure এর কাছে ।

Poetics-এ অ্যারিস্টটল স্পষ্টতই জানিয়েছিলেন, Tragedy is an imitation of an action that is serious, complete, and of a certain magnitude।ডাকঘর নাটকেও এই tragedy-র সুষ্ঠু প্রতিফলন। কখনও তা এসেছে action এ, কখনও narratively... প্রতিটি চরিত্রের মধ্যে pity আর fear এর দোলাচল, আর এই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-টানাপড়েনেই সার্থক ট্রাজেডি নাটকের catharsis। চির রুগ্ন অমল বিছানায় শয্যাশায়ী, বাহ্যিক জগতের সঙ্গে সম্পর্ক রহিত, কিন্তু মনে সে চিরকালীন প্রকৃতির বাসিন্দা, তার neverending imagination তাকে অমৃতের সন্ধান দিয়েছে। অমলের প্রতি pity বা fear নয়, বরং তীব্র attraction আসে আমাদের। 

নাটকের একেবারে অন্তিম অঙ্কে মৃত্যু হয় অমলের। অনন্ত মরণ কবিতাটিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন...

জীবন যাহারে বলে মরণ তাহারই নাম 
মরণ তো নহে তোর পর
আয় তারে আলিঙ্গন কর 
আয় তার হাতখানি ধর...

সবটাই আসলে মৃত্যুর বিশাল পটভুমিকায় জীবনকে নতুন ভাবে দেখার প্রয়াস। ডাকঘর নাটকটিও ঠিক তাই...মৃত্যুর বৃহত্তর ক্যানভাসে দাঁড়িয়ে জীবনকে নতুন আলোকে ফিরে দেখা।



4 comments:

1

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in

প্রাচীন কথা



উত্তরাপথের পথে 
সৌরেন চট্টোপাধ্যায় 



= ৩য় পর্ব =

স্বতঃপ্রবাহিণী গঙ্গা-যমুনার দোআব অঞ্চলে কান্যকুব্জ বা কনৌজ নগরী। গতায়ু কনৌজরাজ অবন্তিবর্মার পুত্র মৌখরি বংশের কুলতিলক বর্তমান মহারাজ গ্রহবর্মার জন্মতিথি উপলক্ষে কান্যকুব্জে গত এক পক্ষকাল ধরে উৎসব চলছে। দেশ-দেশান্তর থেকে কত যে মানুষ সে উৎসবে সামিল হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বিচিত্র তাদের পেশা ও বেশ-বাস। নানা দেশের নানা পেশার পশারীরা তাদের বাণিজ্যসম্ভার নিয়ে ইতিমধ্যেই কনৌজের উপান্তে দোয়াবের বিস্তীর্ণ তটভূমিতে এসে ভিড় জমিয়েছে। হস্তিনাপুর, অবন্তি, গৌড়, প্রাগজ্যোতিষপুর, মালব, শ্রাবস্তী, কোশল, পুরুষপুর ইত্যাদি কোন জনপদই বাকি নেই। সারি সারি অস্থায়ী বিপণি ও পট্টবাসে বহু মানুষের ভিড়ে সমস্ত অঞ্চল জুড়ে যেন মেলা বসেছে। একদিকে ভিক্ষাজীবী বৈষ্ণব ব্রাহ্মণ, শৈব, শাক্ত, জৈন, বৌদ্ধ প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদের আখড়া। এরই মাঝে গৌড়েশ্বর শশাঙ্কদেব অতি সাধারণ এক শৈব সন্ন্যাসীর ছদ্মবেশে তাঁর অতি বিশ্বস্ত ও ক্ষিপ্রকর্মা কয়েকজন রক্ষী ও অনুচরকে নিয়ে নির্দিষ্ট লগ্নে কূটঘাত–এর জন্য সাগ্রহে কালাতিপাত করছেন। তাঁর ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র মালবের সুশিক্ষিত কূটঘাতি-বাহিনী এই অমানিশায় চুপিসারে কনৌজ আক্রমণ করবে। ওদিকে মালবরাজ দেবগুপ্তও সসৈন্যে কনৌজের সীমান্তে পৌঁছে যমুনা তীর থেকে অনেক দূরে একটি ছোট্ট টিলার পিছনে বিস্তীর্ণ জনহীন প্রান্তরে তাঁর শিবির স্থাপন করেছেন। 

রাজপুরীর শাল কাঠের তৈরী বিরাট তোরণ-দ্বার একটু আগেই বন্ধ হয়েছে; সিংহদ্বারের উপর নহবতখানায় সানাই-এর সুর এখন স্তব্ধ। তোরণের ভিতর দিকে দুই পাশে প্রহরীদের জন্য একদিক উন্মুক্ত ছোট ছোট ইষ্টকনির্মিত খুপরি ঘর, সেখানে কয়েকশো রক্ষী বিশ্রামে রত; এবং জাগ্রত প্রহরীরা কৃপাণ ও বর্শা হাতে পালা করে রাজপুরীর বিশাল চত্বরে পাহারা দিচ্ছে। কর্মচঞ্চল সুরম্য কনৌজ নগরীর বাসিন্দারা উত্তরভারতের প্রবল শৈত্য-প্রবাহে পীড়িত হয়ে অনেক আগেই ঘরে ফিরে গিয়েছে। বানিজ্য-চবুতরের স্থায়ী বিপণিগুলির ব্যবসায়ীরাও সারাদিন পরিশ্রমের পর ঝাঁপ বন্ধ করে ঘরে ফিরেছে। রাজপুরীর বাইরে অনতিদূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ভিনরাজ্যের অনেকগুলি অস্থায়ী পশারী তাদের নিজের নিজের পশরাগুলি ধীরে-সুস্থে গুছিয়ে রাখছে এবং তাদের দলের কেউ কেউ রন্ধনকার্যের উদ্যোগ করতে ব্যস্ত। অন্য দিন সন্ধ্যার মধ্যেই তাদের সব কাজ সারা হয়ে যায়, কিন্তু আজ যেন একটু বেশিই বিলম্ব! কিছু দূর অন্তর অন্তর একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি চুল্লি থেকে কাঁচা কাঠের আগুন থেকে ধূম্রজাল ঘন কুয়াশার মত ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে রাজপুরী-সংলগ্ন বাইরের চারিপাশ আরো বেশি দুর্নিরীক্ষ করে তুলছে। বেতনভূক চৌকিদারেরা সবে মাত্র নিদ্রার আলস্য ভেঙে এখনও তাদের নিয়মিত টহল শুরু করেনি। রাজপথের ধারে ধারে প্রজ্জ্বলিত মশালগুলির দীপ্তি ইতিমধ্যে অনেক কমে এসেছে; জনবিরল নিস্তব্ধ রাস্তায় শুধু কিছু অপোষ্য সারমেয়। 

অন্ধকার ক্রমশঃ গভীরতর হচ্ছে। কয়েকটি বিশেষ অস্থায়ী বিপণী থেকে মোটা কম্বলে সর্বাঙ্গ ঢেকে কয়েকজন বলশালী পুরুষ নিশাচর শ্বাপদের মত লঘু পায়ে নিঃশব্দ পদে বেরিয়ে এলো। তারা রাজপুরীর সিংহদ্বারের কিছুদূরে চতুষ্পথির অনতিদূরে কিছুটা দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে যেন কোন নির্দেশের জন্য প্রতীক্ষা করছে, ঘন ধোঁয়ার আড়ালে তারা প্রেতমূর্তির মতই দাঁড়িয়ে পড়ল। 

গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক ভূয়োদর্শী। তাঁর পরিকল্পনায় ও পরামর্শে মালবরাজ সৈন্যাধ্যক্ষ সুরথ গত শরৎকালের আগেই বিশজন চতুর গুপ্তচরকে নুনিয়া, কংসবণিক ও রত্নজীবী বণিকদের সঙ্গে ছদ্মবেশে কনৌজে প্রেরণ করেছেন। তারা ইতিমধ্যেই চাতুর্যের সঙ্গে তাদের কর্তব্য সম্পাদন করে রেখেছে। তারা কৌশলে প্রধান পুররক্ষক ও তার অনুচরদের প্রচুর উৎকোচে বশীভূত করেছে, সেই সঙ্গে রাজ-অন্তঃপুরের কয়েকজন কঞ্চুকী এবং যামচেটিকেও আশাতীত ধন-রত্ন দিয়ে দলভুক্ত করে নিজেদের কার্যকালে ব্যবহারের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে প্রস্তুত করে রেখেছে। পূর্বপরিকল্পনা মত প্রধান পুররক্ষ এইরাত্রে তার অনুগামী অনুচরদের রাজপুরীর তোরণদ্বারের কাছাকাছি সংস্থাপন করে রেখেছে। তারা রাজপুরীর তোরণদ্বার যথাসময়ে পরিঘমুক্ত করে বাইরে অপেক্ষারত সৈন্যদের বিনা বাধায় প্রবেশের পথ সুগম করে দেবে; এবং এই মুহূর্তে রাজপুরীর বাইরে অন্ততঃ সাতশত সশস্ত্র শত্রু-সৈনিক তাদের সেনানায়কের ইঙ্গিতে চরম আঘাত হানার জন্য প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থান করছে। 

কৃষ্ণা-একাদশীর ঘন তমসাবৃত হিমেল রাত্রি দ্বিতীয় যামে পৌঁছালো, গম্বুজের ঘন্টাধ্বনি রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর সূচিত করল। রাজঅন্তঃপুরের ভিতরে মহারাজাধিরাজ গ্রহবর্মা সবে মাত্র নৈশাহার শেষ করে তাঁর ত্রিতলের কক্ষ-সংলগ্ন অলিন্দ-বাগিচায় সুখাসনে গা এলিয়ে দিয়েছেন। কনৌজ-রাজ গ্রহবর্মা অত্যন্ত রূপবান ও বিদ্বান। এই মুহূর্তে তিনি একটি প্রাচীন কাব্য-পুঁথিতে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করছেন, কিন্তু পুঁথির একটি বর্ণও তাঁর হৃদয়ঙ্গম হচ্ছে না। প্রিয়তমা মহিষী স্থান্বীশ্বর-কুমারী রাজ্যশ্রীর জন্য বারংবার প্রবেশ পথের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছেন। পাটরানী রাজ্যশ্রী প্রতি রাত্রেই একটু বিলম্বে নৈশাহার সমাপন করে এখানে আসেন। তাঁর এই বিলম্বে মহারাজ গ্রহবর্মা খুবই অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন, কিন্তু উপায় নেই, রাজ্যশ্রী কোনদিনই সকল অন্তঃপুরনারীদের আহার সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আসেন না। মহারাজ পুঁথি রেখে গাত্রোত্থান করে এক রূপসী তাম্বুলকরঙ্ক-বাহিনীর হাত থেকে একটি সুরভিত তাম্বুল নিয়ে পরম তৃপ্তিতে চর্বন ও মনোরম অলিন্দ-উদ্যানে পাদচারণা করতে করতে প্রিয়তমা নারীর সান্নিধ্যে আসন্ন রাত্রির সুখ-স্বপ্নে বিভোর।

মহারাজ গ্রহবর্মা নিজের চিন্তায় ও কল্পনালোকে এমনই বিভোর ছিলেন যে, কখন সেই অলিন্দ-কাননে তাঁর নিজস্ব দেহরক্ষীদের জায়গায় একই ধরণের পোশাক পরিহিত ভিন্ন মানুষ তাঁকে ঘিরে ফেলছে তিনি জানতেই পারেন নি। 

ওদিকে মহারাণী রাজ্যশ্রী আহারের পর পোশাক পরিবর্তন করে উজ্জ্বল দীপালোকে মুকুরের সামনে বসে মৃদু স্বরে গুনগুন করতে করতে হালকা প্রসাধন শেষ করলেন। এখন তিনি তাঁর কন্দর্পকান্তি পতির সুখ-সঙ্গলাভের জন্য উন্মুখ। পরিণয়ের পর থেকেই এই গন্ধর্বসদৃশ দম্পতী রাত্রির এই সময়টিতে একান্তে কাব্য-গীতাদি ললিতকলার চর্চা করতে ভালোবাসেন, এবং শেষ পর্যন্ত দুটি মিলনোন্মুখ নর-নারীর প্রেম শৃঙ্গার পর্বে গিয়ে শেষ হয়। রাজ্যশ্রী কক্ষের বাইরে যেতে গিয়ে দেখলেন কবাট বাইরে থেকে অর্গলরূদ্ধ। তিনি তাঁর বিশস্ত যামচেটিদের নাম ধরে বেশ কয়েকবার ডাকলেন, কিন্তু তাদের কাউকেই আশেপাশে কোথাও দেখতে পেলেন না। বিস্ময়ে ও এক অজানা আতঙ্কে আতঙ্কিতা তরুণী রাজবধূ শয্যার এক কোণে বসে নীরবে অশ্রুমোচন করতে লাগলেন। 

গম্বুজের ঘন্টাধ্বনি শেষ হওয়া মাত্র গঙ্গাতীরে একটি জনশূন্য সন্ন্যাসীর কুটিরে অগ্নি সংযোজিত করা হল। পাট, শন ও পর্ণনির্মিত কুটিরটিতে আগে থেকেই ঘৃত, তৈল, গন্ধক ইত্যাদি সহজদাহ্য পদার্থ সঞ্চিত রাখা ছিল। মুহূর্তকালেই নদীতীরের প্রবল উত্তরের হিমেল বাতাসে আগুন উজ্জ্বলতর হয়ে পারিপার্শ্বিক অন্ধকার ও আকাশকে রাঙিয়ে তুলল। তার অল্পক্ষণের মধ্যেই রাজপুরীর ভিতরে উত্তর-পশ্চিম কোণের প্রাকারের পাশে পিলখানা থেকে নালিবাহকদের গগনভেদী আর্ত চীৎকারের সঙ্গে হস্তীযূথের বৃংহণ ধ্বনিতে দিগ্বিদিক কম্পিত হতে লাগল। দেখা গেল, পিলখানার তৃণ-পত্র নির্মিত আচ্ছাদন থেকে অকস্মাৎ আগুনের শিখা আর ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। অল্পক্ষণের মধ্যেই প্রবল উত্তরের হিমেল বাতাসে আগুনের সর্বগ্রাসী জিহ্বা লকলক করে যেন এককালে সব কিছু ভস্মীভূত করতে চায়। শতাধিক মহাকায় রাজহস্তী বিপদের আভাষে প্রাণভয়ে আলান-স্তম্ভে বাঁধা শিকলগুলি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য আকুলিবিকুলি করছে। 

হাতি ও নালিবাহকদের আর্ত চীৎকার শুনে মহারাজ গ্রহবর্মা সচকিত হয়ে অলিন্দ থেকে ঝুঁকে নীচের চত্বরের দিকে দৃ্ষ্টিপাত করে মশালচীদের দেখতে পেলেন না, আগুনের লাল আভা ও ধোঁয়ার কটূগন্ধের মধ্যে শুধু মানুষের জটলা। মহারাজ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকালেন, দেখলেন তাঁর নিজস্ব দেহরক্ষীর পোশাকে তিনজন অচেনা ভিন্ন প্রদেশের মানুষ প্রস্তর-কঠিন মুখে উন্মুক্ত কৃপাণ হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের পিছনে অলিন্দের বাইরে আরও কত জন সারিবদ্ধ ভাবে ব্যুহ রচনা করে রেখেছে। তিনি কাপুরুষ বা ভিতু নন, কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় এই মুহূর্তে তিনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও নিতান্ত অসহায়। 

অভূতপূর্ব অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হতবুদ্ধি পুররক্ষীরা কর্তব্যরহিত হয়ে ইতস্ততঃ ছোটাছুটি করছে, তাদের দলপতিরাও সেই সময় যেন তাদের নির্দেশ দিতে ভুলে গিয়েছে। সকলেরই দৃষ্টি এখন সেই এক কোণের পিলখানার বাত্যাহত অগ্ন্যুৎসবের দিকে। ইত্যাবসরে ষড়যন্ত্রকারী ঘরশত্রু পুররক্ষীরা সকলের অলক্ষ্যে রাজপুরীর তোরণদ্বার উন্মুক্ত করে দিতেই বাইরের অপেক্ষারত মালবসেনানী ছদ্মবেশ মুক্ত হয়ে স্বমূর্তি ধারণ করে ভিতরে প্রবেশ করল। কনৌজের সদাবিশ্বস্ত রক্ষী-সৈনিকেরা প্রাসাদ-চবুতরে এমন অকস্মাৎ অগ্নিকাণ্ড ও বহির্শত্রুর আক্রমণের জন্য প্রস্তুত না থাকায় নিসূদকরা অতি সহজেই তাদের পর্যুদস্ত করে নির্বিচারে হত্যা করতে লাগল। 

অন্যদিকে বাইরে মালবের সৈন্যাধ্যক্ষ সুরথের পরিচালনায় মালব-সেনানী কনৌজের মহামাত্য সহ পাত্র-মিত্র, সেনাপতি ইত্যাদি প্রায় সকলকেই তাঁদের নিজস্ব অট্টালিকায় গৃহবন্দী করে রেখে সমস্ত কান্যকুব্জ নগরীর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল অল্প আয়াসেই করায়ত্ত করে নিল। 

মহারাজ গ্রহবর্মা বুঝলেন তিনি এবং তাঁর রাজপুরী কোন শত্রুরাজ্যের দ্বারা আক্রান্ত, হয়তো বা এতক্ষণে সমস্ত রাজধানীই আগন্তুক শত্রুসৈন্যের করতলগত হয়েছে! প্রিয়তমা পত্নী রাজ্যশ্রীর কথা মনে পড়ল, তিনি এই সময় কি অবস্থায় আছেন! তিনি ও পুরনারীরাও কি শত্রুর হস্তে নিপীড়িতা হচ্ছেন! এই সব জানার জন্য মহারাজ অত্যন্ত ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। তাঁর মনে ক্ষীণ আশা --- বিশ্বস্ত প্রবীণ মহামাত্র, মন্ত্রী, অমাত্যরা ও সেনাপতি এতক্ষণে এদের হাতে বন্দী না হয়ে থাকলে অবশ্যই তাঁকে এবং রাজপুরনারীদের রক্ষা করতে নিশ্চয়ই সংবাদ পাওয়ামাত্র সসৈন্যে ছুটে আসবেন। সশস্ত্র প্রহরীবেষ্টিত বন্দী মহারাজ একান্ত নিরুপায় হয়ে উদ্বিঘ্নচিত্তে পার্শ্ববর্তী আসনে বসে আনতমস্তকে নিজের ইষ্ট দেবতা ভগবান শঙ্করের পাদপদ্ম স্মরণ করে নানাবিধ চিন্তা করতে করতে পরবর্তী ঘটনার জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। 

প্রহর উত্তীর্ণ হয়ে চলল। এক সময় প্রহরীদের মৃদু গুঞ্জনধ্বনি ও লঘু পদশব্দে তাঁর চিন্তা ব্যহত হল। মুখ তুলে দেখলেন তাঁর সামনে গৈরিক বেশধারী এক সৌম্যকান্তি সন্ন্যাসী, সঙ্গে একই পোশাক পরিহিত তাঁর কয়েকজন অনুগামী; প্রহরারত সৈনিকরা সস্মভ্রমে একটু দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। এক অসম্ভব আশায় তাঁর শরীরে শিহরণ জাগল। তবে কি দেবাদিদেবের কোন অলৌকিক মায়ায় তিনি বিপন্মুক্ত হতে চলেছেন! 

গ্রহবর্মা আভূমি নত হয়ে সন্ন্যাসীকে প্রণাম করলে তিনি কল্যাণ-আশীর্বাদ না করে মৃদু হাসলেন মাত্র। 

--- দয়া করে আসন গ্রহণ করুন, প্রভু? মহারাজ ভক্তি গদগদ কণ্ঠে বললেন, আমার রাজধানী কোন অজ্ঞাত শত্রুর হাতে আক্রান্ত, এই ঘোর দুঃসময়ে আপনি কি করে শত্রুপরিবৃত রাজপুরীতে প্রবেশ করলেন ভেবে পাচ্ছি না! আপনি কি আমার পরম ইষ্টদেব... 

--- না, আমি তোমার ভগবান শঙ্কর নই, আমি গৌড়াধিপতি শশাঙ্ক, গ্রহবর্মাকে থামিয়ে দিয়ে মেঘমন্দ্র গলায় বললেন সন্ন্যাসী, তোমার রাজ্য, রাজধানী, রাজপুরী এবং তোমার অপরূপা সুন্দরী স্ত্রী ও অন্য পুরনারীরা, সবই এখন গৌড় এবং মালবের অধিকারে, তুমি এখন আমাদের বন্দী। 

--- এ আপনি কি বললেন গৌড়রাজ! বিষাদাচ্ছন্ন কন্ঠে গ্রহবর্মা বললেন, শুনেছি আপনি বীর ও বিদ্বান! সম্মুখ যুদ্ধ না করে কূটযুদ্ধে আমার রাজ্য জয় করেছেন মেনে নিলাম, কিন্তু অন্তঃপুরের নারী ও শিশুদের কোন ক্ষতি নিশ্চয়ই আপনি করবেন না! 

--- “মাতুলো যস্য গোবিন্দঃ পিতা যস্য ধনঞ্জয়ঃ,
সোভিহমন্যুঃ রণে শেতে নিয়তিঃ কেন বাধ্যতে।” 

(শ্রীকৃষ্ণ যার মাতুল, অর্জুন যার পিতা, সেই অভিমন্যুকেও যুদ্ধে নিহত হতে হয়েছিল। নিয়তিকে কে বাধা দিতে পারে? -–চাণক্য) 

গ্রহবর্মার কথার উত্তর না দিয়ে শশাঙ্ক বললেন, এই যুদ্ধে পরাজয় তোমার নিয়তি ছিল রাজা, আমি নিমিত্ত মাত্র। 

গৌড়রাজের কথা শুনে কনৌজরাজ গভীর হতাশায় বাকরুদ্ধ হয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। 

শশাঙ্ক আর কথা না বাড়িয়ে ভ্রুসংকেত করতেই মালবের রক্ষীরা দ্রুত হাতে নিরস্ত্র গ্রহবর্মাকে শৃঙ্খলিত করে সাধারণ বন্দীর মত টেনে নিয়ে চলল। 

সেনাপতি সুরথের আজ্ঞাধীন সৈনিকেরা কনৌজের নগর ও রাজপুরী সম্পূর্ণ অধিকার করার পর মালবরাজ দেবগুপ্ত সদম্ভে রাজদরবারে প্রবেশ করেছেন। তাঁর আদেশে দরবারের সব আলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেবগুপ্ত পাত্র মিত্র নিয়ে শূন্য রাজসিংহাসনে বসলে সেনাপতি একে একে বন্দী কনৌজের মহামাত্য, মন্ত্রী, অমাত্য প্রভৃতিদের নিয়ে এলেন। মালবরাজ তাদের সঙ্গে সঙ্গে কারাগারে নিক্ষেপ করার আদেশ দিলেন।

চারিদিকে প্রচণ্ড বিশৃঙ্খলা আর মৃত্যু-কাতর চীৎকার ধ্বনির মধ্যে দিয়ে মহারাজ শশাঙ্ক নির্বিকারচিত্তে ধীর পদক্ষেপে তাঁর সন্ন্যাসী বেশী অনুচরদের সমভিব্যাহারে রাজঅন্তঃপুরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তাঁর লক্ষ্য মহারাণীর নিবাস কক্ষ। একজন বিশ্বাসঘাতিনী যামচেটি তাঁকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। দুপাশের দেওয়ালের ভিত্তিস্থ গহ্বরে রাখা আলোকবর্তিকার আলোকে নাতিপ্রশস্থ অলিন্দ-পথটি রহস্যময় আলোছায়ায় ঢাকা। দুই দিকেই সারি সারি অসংখ্য ছোট বড় কক্ষ। প্রতিটি কক্ষেই তখন নারকীয় দৃশ্যের অবতারণা চলছে। যুদ্ধবিজয়ী সৈনিকরা নির্লজ্জ পশুর মত বীর-বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অন্তঃপুরের নিঃসহায় শতাধিক নারীর ওপর। এটাই যেন তাদের যুদ্ধজয়ের অতিরিক্ত পুরস্কার, আর এ ব্যাপারে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ কুমারী থেকে ষাটোর্ধ প্রৌঢ়া –- কোন কিছুতেই তাদের অরুচি নেই। কোন কোন কক্ষে দুইজন বলশালী পুরুষ মৃতদেহ ভক্ষণকারী হায়নার বা বন্য কুক্কুরের মতই নারীমাংস পেয়ে উল্লসিত। 

যামচেটি মহারাণী রাজ্যশ্রীর কক্ষদ্বার উন্মুক্ত করলে শশাঙ্ক হাতের ইশারায় অনুচর দেহরক্ষীদের বাইরে অপেক্ষা করতে বলে একাকী ভিতরে প্রবেশ করলেন। ভূলুন্ঠিতা রাজেন্দ্রাণী সন্ন্যাসীবেশী শশাঙ্ককে দেখে একই ভুল করলেন। তিনি অশ্রুসজল নয়নে তাঁকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালেন। শশাঙ্ক আশীর্বাদের ভঙ্গীতে দক্ষিণ হস্ত সামান্য উত্তোলিত করে বললেন, 

--- হে কল্যাণী, সমগ্র রাজ্য জুড়ে ঘোর দুঃসময়। রাজধানী ও রাজপুরী শত্রু কবলিত হয়েছে। 

--- আপনি কে প্রভু? আর শত্রু অধিকৃত এই পুরীতে আপনিই বা প্রবেশ করলেন কি ভাবে? কৌতূহলী রাজ্যশ্রী না শুধিয়ে পারলেন না। 

--- আমি যোগসিদ্ধ সন্ন্যাসী, কনৌজের হিতৈষী, আমার অগম্য কোন স্থান নেই। 
--- আর আমাদের মহারাজ! তিনি কোথায়? 

--- মহারাজ গ্রহবর্মা শত্রুর হাতে বন্দী, যে কোন মুহূর্তে তারা এখানে পৌঁছে যেতে পারে। 

রাজ্যশ্রী এই সংবাদে বিষাদে-বিস্ময়ে কম্পিত হলেন। তাঁর আঁখিদুটি কজ্জ্বল-কৃষ্ণ দীর্ঘিকার মত অশ্রুজলে ভরে উঠল।

--- এখন রোদনের সময় নেই, দয়া করে গাত্রোত্থান করুন দেবী। শশাঙ্ক স্নেহ-কোমল গলায় বললেন, সম্ভ্রম ও নিজেকে রক্ষা করতে হলে আর এক লহমাও বিলম্ব না করে এই পুরী থেকে প্রস্থান করতে হবে। 

--- কোথায় যাব প্রভু? আমি যে রাজঅন্তঃপুরের বাইরের জগৎ সম্বন্ধে নিতান্তই অজ্ঞ!

--- আমার ওপর ভরসা রাখুন মহারাণী, রাজপুরীর দুজন দাসীকেও আপনার পরিচর্যার জন্য না হয় সঙ্গে নেব। আমার ওই শিষ্যরা আপনাদের নিরাপদে যথাস্থানে অবশ্যই পৌঁছে দেবে। মহারাজও যথাসময়ে বিপন্মুক্ত হয়ে আপনার সঙ্গে মিলিত হবেন, চলুন। 

নিরুপায় রাজ্যশ্রী সন্ন্যাসীবেশী শশাঙ্কের কথায় আর দ্বিরুক্তি না করে তাঁর অনুগামিনী হলেন। 

বন্দীদের বিচারের পর কনৌজ বিজয়ের আনন্দোৎসবের পরিপূর্ণ স্বাদ নিতে দেবগুপ্ত এলেন জলসা ঘরে। তাঁর বশংবদ অনুচরেরা মহারাজের শখের ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নবান। এরই মধ্যে তারা রাজঅন্তঃপুরের সদ্য বন্দিণী তিনজন সদ্যযুবতী কুমারীকে বেছে নিয়ে এসেছে তাঁর সম্ভোগের জন্য। মৈথুন-ভীত কিশোরী নারীকন্ঠের আর্তস্বর তাঁকে সর্বদাই কিছু বিশেষ তৃপ্তি দেয়। 

মধ্যরাত্রে যথেচ্ছ সুরা সহযোগে নিজের লালসা চরিতার্থ করে রতিতৃপ্ত মালবরাজ দেবগুপ্ত গ্রহবর্মার বন্দী-কক্ষটিতে প্রবেশ করলেন। তাঁর হাতে উন্মুক্ত কৃপাণ। তাঁর দুইচক্ষু ঘোর রক্তবর্ণ, মুখ মণ্ডল সুরাপানে ও হিংস্রতায় রক্তিম, পুরু ঠোঁটের কোন থেকে গাঢ় রক্তধারার মত তাম্বুলরস গড়িয়ে পড়ছে। তাঁর সেই ভীষণ দানবীয় রূপ দেখে প্রহরারত সৈনিকদেরও হৃৎকম্প হল। 

গ্রহবর্মার হাতদুটি শৃঙ্খলাবদ্ধ, দুজন অসুরাকৃতি সৈনিক তাকে বজ্র-কঠিন বাহুপাশে ধরে রেখেছে। দেবগুপ্ত সামনে এসে দাঁড়ালে গ্রহবর্মা তাঁর চোখের মণিতে সাক্ষাৎ মৃত্যুর প্রতিবিম্ব প্রত্যক্ষ করলেন। অসহায় নিরস্ত্র কনৌজরাজ চোখ বুজে পিতৃমাতৃ পাদপদ্ম স্মরণ করলেন, বন্ধ আঁখির সামনে ভেসে উঠল প্রিয়তমা পত্নী রাজ্যশ্রীর প্রেমময়ী মুখখানি।

মালবরাজ দেবগুপ্তর তাম্বুলরঞ্জিত দাঁতের ফাঁকে নির্মম হাসি খেলে গেল, তিনি অত্যন্ত নির্দয়তায় হাতের উন্মুক্ত কৃপাণ আমূল বসিয়ে দিলেন গ্রহবর্মার বুকে। কর্তিত সর্জবৃক্ষের মত পাষাণ মেঝেতে হাঁটু ভেঙ্গে পড়ে গেল কনৌজরাজের দেবকান্তি শরীর। প্রাসাদের প্রস্তরে প্রস্তরে ধ্বনিত হতে লাগল তাঁর অন্তিম আর্ত চীৎকার আর দেবগুপ্তের খলখল নিষ্ঠুর হাসি। 

*******************************************************************************************

কনৌজের রাজপ্রাসাদ থেকে বহু দূরে একটি অতি সাধারণ দ্বিতল কাঠের অট্টালিকা। চারিদিক ঘিরে দু-মানুষ সমান উঁচু প্রাচীর। দ্বিতলে একটি কক্ষ-সংলগ্ন অলিন্দে দাঁড়িয়ে আছেন কান্যকুব্জের একদা মহারাণী রাজ্যশ্রী। তাঁর মুখে বিষাদের গাঢ় প্রলেপ, অবিরাম অশ্রুপাতে চোখদুটিও রক্তাভ। শূন্য দৃষ্টি মেলে তিনি চেয়ে আছেন দূরের ধূসর নাতিউচ্চ পাহাড়শ্রেণীর দিকে। সেখানে ক্লান্ত সূর্য দিনশেষের রঙের খেলা শেষ করে রাত্রির আশ্রয়ে যাবার পথে। 

গত সপ্তাহকাল ধরে রাজ্যশ্রী প্রতিদিনই এই সময়ে এখানে এসে দাঁড়ান। স্বল্প পরিসর এই অলিন্দটি ছাড়া অন্য কোথাও যাবার সাধ্যও তাঁর নেই। কক্ষের একটি মাত্র প্রবেশপথের কপাট সারাদিনই অর্গলরুদ্ধ থাকে। একজন মাত্র মধ্য বয়স্কা পরিচারিকা দিনে কয়েকবার আসে, সে বেশ বলশালিনী এবং তার গম্ভীর মুখে সব সময় এক রূক্ষ কাঠিন্য ফুটে থাকে। আজ অবধি তার সঙ্গে একটিও বাক্য বিনিময় হয়নি রাজ্যশ্রীর। 

পাহাড়ের পিছনে সূর্য মুখ লুকালেও তার রক্তিম আভা তখনও ছড়িয়ে রয়েছে পশ্চিম আকাশ জুড়ে; সেদিকে দেখতে দেখতে রাজ্যশ্রী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। ওই দিকেই কনৌজ। তাঁর স্বামী মৌখরিরাজ গ্রহবর্মার রাজ্য ও রাজধানী, আর তিনি সেই রাজ্যের পাটরাণী। কিন্তু হায়! আজ তিনি একজন সামান্যা বন্দিনী মাত্র। 

অলিন্দের নিচে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান, প্রাচীরের ধারে ধারে সারিবদ্ধ অনেকগুলি গুবাক ও দেবদারু গাছ। রাজ্যশ্রী দৃষ্টি নামিয়ে সেদিকে তাকালেন। নীচে মখমলের মত সবুজ ঘাসে ঢাকা প্রাঙ্গণ, বাগিচায় অজস্র ফুলের সমারোহ, আকাশ পথে নীড়ে ফেরা বলাকার কলকাকলি --- কিছুই তাঁর মনে রেখাপাত করছে না, অশ্রুভেজা আয়ত চোখদুটি কাতরভাবে অন্য কিছুর অন্বেষণ করছে। 

নগরী থেকে বিচ্ছিন্ন এই বাড়িটিতে বন্দিনী হয়ে আসার পর থেকেই একটি শ্যামলা রঙের যুবককে দেখছেন তিনি। সে সারাদিনই বাগানের গাছগুলির পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে। সন্ধ্যার আগে রাজ্যশ্রী অলিন্দে এসে দাঁড়ালে শ্রমক্লান্ত যুবকটি নীচে থেকে নীরবে একটু হাসে, তার হাসিটিও বাগিচার ফুলগুলির মতই নিষ্পাপ। বন্দিনী অথচ রাজকীয় এই রমণীকে সে ভয় বা লজ্জা পায় না। দিনান্তে ঘরে ফেরার সময় একটি রক্তগোলাপ ছুঁড়ে দিয়ে যায়। রাজ্যশ্রীর বন্দী জীবনে সেই ফুলটি সামান্য কিছু মুহূর্তের জন্য হলেও এই নিষ্ঠুর পৃথিবীর প্রতি ভালবাসা উদ্রেক করে। আসন্ন রাত্রির অন্ধকার ধীরে ধীরে সমস্ত চরাচর গ্রাস করছে, কিন্তু আজ আর সেই মালঞ্চের মালাকারকে দেখতে পেলেন না রাজ্যশ্রী। দূরের রাজদেবালয় থেকে সন্ধ্যারতির শঙ্খ-ঘন্টাধ্বনি ভেসে এল, রাজ্যশ্রী কক্ষে ফিরে এলেন। তখনও পরিচারিকা এসে কক্ষের দীপাধারে দীপগুলি জ্বেলে দিয়ে যায়নি। আর একটি কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির সূচনা হল রাজ্যশ্রীর তমসাচ্ছন্ন জীবনে। 

কপাট খোলার শব্দ হল। পরিচারিকা এসে কক্ষের বাতিদানের আলোকবর্তিকাগুলি জ্বেলে দিল। রাজ্যশ্রী লক্ষ্য করলেন আজ তার সঙ্গে অন্য আর একটি প্রায় তাঁরই সমবয়সী মেয়ে রয়েছে। তার হাতে একটি তামার রেকাবীতে মহার্ঘ পোশাক ও অলঙ্কারের স্তুপ। বয়স্কা পরিচারিকাটি তার স্বভাবসিদ্ধ যান্ত্রিক গলায় বলল, --- মহারাণী, মহারাজ দেবগুপ্ত আপনাকে অভিবাদন জানিয়ে এই উপহারগুলি পাঠিয়েছেন, আপনি এগুলি গ্রহণ করলে মহারাজ সন্তুষ্ট হবেন। আজ রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে তিনি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসবেন; হয়ত রাত্রিযাপনও করবেন। দয়া করে এই পোশাক ও অলঙ্কারে নিজেকে রাজদর্শনের উপযুক্ত করে সাজিয়ে তুলুন। আমরা তাঁর নির্দেশ মত আপনাকে সাজিয়ে দিয়ে যাব। 

রাজ্যশ্রী একটুও বিস্মিত হলেন না। তাঁর নিষ্কলঙ্ক জীবনে এই কলঙ্কময় রাত্রি যে একদিন আসবেই তা তিনি জানতেন। মুখে ঈষৎ ব্যাঙ্গের হাসি ফুটিয়ে বললেন, --- আমি আর মহারাণী নই, মালবরাজের হাতে বন্দিনী সামান্যা এক নারী মাত্র। শুনেছি রাজধানী উজ্জয়িনীর রাজপ্রাসাদে কয়েকশো সুন্দরী আছে, তাদের যে কোন কাউকে এই পোশাক ও অলঙ্কারে সাজিয়ে তোমাদের মহারাজ এগুলির শিল্প সুষমা উপভোগ করতে পারতেন! আমার ওপর তাঁর এই অযাচিত অনুগ্রহ না থাকলেই খুশি হতাম। 

--- দেবী, আমরা দাসী মাত্র, পরিচারিকাটি আগের মতই সসম্ভ্রমে বলল, রাজার আদেশ পালন করাই আমাদের একমাত্র কাজ। তাছাড়া আপনি তো ভাল করেই জানেন, রাজ-অন্তঃপুরের কোন নারী বা বন্দিনীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোন মূল্যই নেই। 

সামান্যা এক পরিচারিকার মুখে এমন চরম সত্য শুনে রাজ্যশ্রী স্তব্ধ হয়ে তাঁর মতি-দন্তে অধর দংশন করে অতি কষ্টে উদ্গত অশ্রু সংবরণ করে বললেন, --- তা ঠিক, পুত্তলিকার তো শরীর বা মন থাকতে নেই, সে তো ক্রীড়কের হাতে একটি ক্রীড়ণক বই কিছু নয়! তাছাড়া রাজার ইচ্ছাই তাঁর আদেশ। ঠিক আছে, তোমরা তোমাদের মহারাজের পছন্দ মত আমাকে যেমন খুশি সাজাতে পার, আমি প্রস্তুত। 

রাজ্যশ্রী ধীর পদক্ষেপে কক্ষ-সংলগ্ন স্নানাগারের দিকে এগিয়ে গেলেন। স্নানান্তে ফিরে এলে দাসীরা এক দণ্ড ধরে সুগন্ধি ধূপের ধোঁয়ায় তাঁর নিশীথের জলপ্রপাতের মত আনিতম্ব কেশরাশি সুগন্ধিত করল, তারপর কস্তুরী, চন্দন ইত্যাদি নানা উপাচারে তাঁর বরতনু প্রসাধিত করে নূতন পোশাকে ও অলঙ্কারে সাজিয়ে তুলল। এতক্ষণ তিনি একটি প্রস্তর মূর্তির মত নিজেকে তাদের হাতে সমর্পণ করে চুপ করে বসে রইলেন। লক্ষ্য করলেন তাঁর পরণের পোশাকগুলি রত্নখচিত অত্যন্ত মিহি মসলিনের নেত্রবাস, সেগুলি যেমন সংক্ষিপ্ত তেমনই কামনা উদ্রেককারী। তবুও তিনি কিছুই বললেন না। প্রসাধনচর্চিতা ও বহুমূল্য পোশাক-অলঙ্কারে শোভিতা আলোকসামান্যা নারীটির রূপ যেন শতগুণে বর্ধিত হল। 

রাজ্যশ্রীর সজ্জা শেষ হলে যুবতী পরিচারিকাকে প্রসাধন দ্রব্য, পরিত্যক্ত পোশাক প্রভৃতি গুছিয়ে নেবার নির্দেশ দিয়ে বয়স্কা পরিচারিকা বেরিয়ে গেল। এই মেয়েটি এতক্ষণ কোন কথা বলেনি। হঠাৎ সে অত্যন্ত সপ্রতিভ ভঙ্গিতে দ্রুত বাইরেটা দেখে এসে চাপা স্বরে বলল,

--- মহারাণী আমি অন্তরা। আজকের রাত্রির তৃতীয় প্রহর অবধি যে ভাবেই হোক মহারাজের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করবেন, আর চতুর্থ প্রহরে সজাগ থাকবেন। একটা কথা মনে রাখবেন, মালবরাজ অত্যন্ত সুরাপ্রিয়, কিন্তু অত্যধিক মাত্রায় পান করলে জ্ঞানহীন হয়ে পড়েন, তখন আর কোন ক্ষমতাই অবশিষ্ট থাকেনা তাঁর। 

ওর এই আকস্মিক আচরণে ও কথায় স্তম্ভিত হয়ে শুধু মাথা নাড়লেন। কক্ষের বাইরে কাঠের সোপানে পদশব্দ শোনা গেল; অন্তরা দূরে সরে গিয়ে নির্বিকার মুখে কক্ষটির মার্জনায় ও সজ্জা-সামগ্রী গোছাতে মনোনিবেশ করল। বয়স্কা পরিচারিকাটি প্রচুর ফুলের স্তবক, মালা, সুগন্ধি দ্রব্য ইত্যাদি নিয়ে আবার ফিরে এলো, তারপর সেগুলি দিয়ে দুজনে রাজ্যশ্রীর কারাগার-কক্ষটিকে সুন্দর করে সাজিয়ে সুগন্ধি ধূপ জ্বেলে দিয়ে বিদায় নিল। অন্তরার চোখের ইশারা রাজ্যশ্রীর নজর এড়ালো না। ওরা যাবার আগে কক্ষটিকে অর্গলরুদ্ধ করতে ভুলল না। সালঙ্কারা রাজ্যশ্রী পাথর-প্রতিমার মত পালঙ্কের বাজুতে হেলান দিয়ে বসে আসন্ন নিদারুণ সময়টির জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। 




(ক্রমশঃ প্রকাশ্য) 











1 comments:

3

প্রাচীন কথাঃ অমৃত অধিকারী

Posted in


প্রাচীন কথা 




কাব্যোত্তর – ২
অমৃত অধিকারী



সূর্য অস্তমিত। শিবিরের সর্বত্র অগ্নিমুখ উল্কা প্রজ্জ্বলিত। তাদের কম্পমান আলোকসম্পাতে ইতস্তত প্রক্ষিপ্ত ছায়াগুলি সঞ্চরণশীল অশরীরীর মতন প্রতিভাত হচ্ছে। রক্ষীরা যথাসম্ভব প্রচ্ছন্ন ভাবে অবস্থান করার চেষ্টা করছে। নিতান্ত প্রয়োজন না হলে কেউ পদক্ষেপ পর্যন্ত করছে না।

শিবির মধ্যস্থিত উন্মুক্ত ভূমিতে ঘনসন্নিবিষ্টাবস্থায় দণ্ডায়মান কয়েকজন পুরুষ। তাঁরা এখনও রণসজ্জা উন্মোচন করেননি। একটু নিকটবর্তী হলে এখনও তাঁদের দীর্ঘশ্বাস শোনা যাচ্ছে। তাঁদের মধ্যে যিনি সর্বাপেক্ষা বৃহদাকায়, সেই শালপ্রাংশু পুরুষ নিজের সুবিশাল দক্ষিণ বাহুদ্বারা আরেক মহাকায় পুরুষের স্কন্ধবেষ্টন করে আছেন। বাকিরাও অবনত মস্তক। যে ক্ষতি তাঁদের আজ যুদ্ধক্ষেত্রে হয়ে গেছে, তা অপূরণীয় তো বটেই, প্রায় অভাবনীয়।

সৌভদ্র অভিমন্যু আজ দ্রোণাচার্যের রণযজ্ঞের বলি হয়েছেন। দ্রোণবিন্যস্ত কৌরবসৈন্য ভেদ করে সেই বালকবীর একাকী প্রবেশ করেছিলেন চক্রব্যূহের জঠরে। নিষ্ক্রমণের কৌশল অবগত না থাকায় আর বাইরে আসতে পারেননি। তাঁর পৃষ্ঠরক্ষক ধৃষ্টদ্যূম্ন, সাত্যকি, ভীমসেনাদিকে আশ্চর্য একক পরাক্রমে আজ ব্যূহদ্বারে প্রতিহত করেছেন ধৃতরাষ্ট্রের জামাতা সিন্ধুসৌবীররাজ বার্দ্ধক্ষত্র জয়দ্রথ... আর ব্যূহের অভ্যন্তরে একাকী বালক অভিমন্যুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন কৌরবপক্ষীয় সাত মহারথ, যাঁদের মধ্যে কর্ণ, দুর্যোধন, দুঃশাসনরা ছাড়াও ছিলেন দ্রোণাচার্য ও কৃপাচর্যের মতন গুরুস্থানীয়েরা!

ঘটনাটির বিষয়ে অর্জুন অবগত হয়েছেন যুদ্ধশেষে শিবিরে প্রত্যাগমন করার পর। তিনি আজ সমস্ত দিন সংশপ্তকদের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যস্ত ছিলেন। বস্তুত, সেইটিই ছিলো চতুর দ্রোণাচার্যের পরিকল্পনা। অর্জুনকে অন্যত্র ব্যস্ত রেখে চক্রব্যূহের দুর্ভেদ্য আবেষ্টনীতে পাণ্ডবপক্ষের যথাসম্ভব ক্ষতিসাধন করা। সে কার্যে তিনি আজ সম্পূর্ণ সফল হয়েছেন। কুমার অভিমন্যুর অপ্রত্যাশিত মৃত্যুতে আজ পাণ্ডবশিবিরে যে হৃদয়বিদারক শোকের ছায়া ঘণীভূত হয়েছে, তা থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আগামী কাল পূর্ণশক্তিতে যুদ্ধ করা কার্যত অসম্ভব মনে হচ্ছে। বিশেষ করে পাণ্ডবপক্ষের প্রধান যোদ্ধা অর্জুনের পক্ষে। তাঁর হৃদয়প্রতিম পুত্র, কৃষ্ণের প্রিয়তম ভাগিনেয় এভাবে মৃত্যুবরণ করলেন, এবং উভয়েই যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকেও তাঁকে ন্যূনতম সাহায্যটিও করতে পারলেন না, এ পশ্চাত্তাপ অর্জুনকে কিছুতেই সুস্থির হতে দিচ্ছে না।

আপাতত তিনি ভীমসেনের স্কন্ধে মস্তকস্থাপন করে মূহ্যমান হয়ে আছেন। ভীমের সবল বাহু যদি তাঁর স্কন্ধ ধারণ করে না থাকতো, তবে সম্ভবত তিনি এতক্ষণে ভূমির উপর উপবিষ্ট হতেন। কিয়ৎকাল পূর্বে রণক্ষেত্র থেকে ফিরে তিনি যুধিষ্ঠিরের মুখে যুদ্ধের পূর্ণ বিবরণ শুনেছেন। শুনেছেন, জয়দ্রথের বিক্রমে আজ পাণ্ডবপক্ষের মহারথরা কেউ দ্রোণের চক্রব্যূহে প্রবেশ করে পারেননি। সেই জয়দ্রথ, বনবাসকালীন দ্রৌপদীকে হরণ করতে গিয়ে ভীমের হাতে যাঁর চূড়ান্ত হেনস্থা হয়েছিলো... এবং অর্জুন সেখানে উপস্থিত না থাকলে যিনি আজ আর যুদ্ধ করার জন্য জীবিত থাকতেন না! বারকয়েক ‘‘জয়দ্রথ... ওহ! জয়দ্রথ’’ ছাড়া অর্জুনের আর বিশেষ বাঙ্নিষ্পত্তি হয়নি।

সংবাদ পেয়ে কৃষ্ণও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। পাণ্ডবরা হস্তিনাপুরের কুখ্যাত দ্যূতক্রীড়ায় পরাজিত হয়ে বনগমন করার পর থেকে শিশু অভিমন্যু তাঁরই তত্ত্বাবধানে দ্বারকায় বড় হয়েছেন। প্রিয়সখা ও পরম আদরের ভগিনীর একমাত্র সন্তান সেই পুত্রপ্রতিম ভাগিনেয়ের মৃত্যুতে শোকটুকু প্রকাশ করারও সময় পাননি রণক্লান্ত বাসুদেব। অর্জুনকে খানিকটা প্রবোধ দিয়েই ছুটেছেন শিবিরাভ্যন্তরে। অভিমন্যুর কিশোরী স্ত্রী উত্তরার মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। ব্যাকুল হয়েছেন ভগিনী সুভদ্রার শোকের কথা ভেবে... এবং সন্ত্রস্ত হয়েছেন সেই আলোকসামান্যা অথচ হতভাগিনী নারীর সন্তাপের কথা ভেবে, যাঁর স্নেহরসে তাঁর নিজের পঞ্চপুত্রের থেকেও বেশি সিক্ত ছিলেন কুমার অভিমন্যু। উত্তরা, সুভদ্রা এবং শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদীকেও সান্ত্বনা দিয়েছেন মধুসূদন। তাঁদের বলেছেন চক্রব্যূহের অভ্যন্তরে একাকী অভিমন্যুর অলৌকিক পরাক্রমের কথা। বলেছেন, প্রত্যেক ক্ষত্রিয় যোদ্ধার যা পরম কাঙ্খিত, রণক্ষেত্রে অভিমন্যুর সেই বীরগতি লাভের কথা। কৃষ্ণের বাক্যে কিঞ্চিৎ শান্ত হয়েছেন তিন নারী। ঈষৎ প্রশমিত হয়েছে তাঁদের ক্রন্দনের বেগ। এবার কৃষ্ণকে অর্জুনের কাছে যেতে হবে।

বাইরে যুধিষ্ঠির, ভীম, সাত্যকি, নকুল, সহদেব, ধৃষ্টদ্যূম্নাদি যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন অর্জুনকে শান্ত করতে। পারছেন না। গাণ্ডীবধন্বা সব্যসাচী শোকের চাইতেও অনেক বেশি নিজের অসহায়তায় সন্তপ্ত, ক্রুদ্ধ। তাঁর উষ্ণ নিশ্বাসে পাণ্ডবশিবিরের বাতাস উত্তপ্ত হয়ে উঠছে...

ঠিক এই সময় শিবিরাভ্যন্তর থেকে নির্গত হয়ে আসলেন কৃষ্ণ। তাঁর মুখমণ্ডলে ক্ষত্রিয়ের প্রতিজ্ঞার কাঠিন্য, দুই চক্ষে যোগীর নির্লিপ্ততা। দৃঢ় পদক্ষেপে এসে তিনি দাঁড়ালেন অর্জুনের সম্মুখে। অর্জুন একবার শুধু অবরুদ্ধ কন্ঠে বললেন, ‘‘মাধব! এ কি হলো? আমরা দু’জনেই তো রণক্ষেত্রে উপস্থিত...’’

অর্জুনের বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তাঁর স্কন্ধের উপর কৃষ্ণ তাঁর দক্ষিণ হস্তখানি স্থাপন করলেন। অত্যন্ত অর্থপূর্ণ স্বরে বললেন, ‘‘একবার এসো আমার সঙ্গে। প্রয়োজনীয় কথা আছে।’’

অর্জুনের সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সকলে চমকিত হলেন। এই পরিস্থিতিতে সান্ত্বনার থেকেও প্রয়োজনীয় কি কথা থাকতে পারে? অন্য কেউ বললে হয়তো সে কথা বাতুলতা বলে গণ্য হতো। কিন্তু একথা স্বয়ং বাসুদেব বলছেন! তাঁর চাইতে বড় হিতাকাঙ্খী অন্তত অর্জুনের যে আর কেউ নেই, সে বিষয়ে দু’জনের শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে নিঃসন্দেহ।

তাই হতবাক, বিহ্বল অবস্থাতেও অর্জুন চললেন কৃষ্ণের সঙ্গে। বিস্ময়দৃষ্টিতে তাঁদের দিকে চেয়ে থাকা মানুষগুলির শ্রবণ পরিধির বাইরে গিয়ে কৃষ্ণ দাঁড়ালেন। অর্জুনও সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তাঁর মুখের দিকে। পূর্ণ দৃষ্টিতে প্রিয় বন্ধুর দিকে চেয়ে হ্রস্ব অথচ গভীর স্বরে বাসুদেব বললেন... ‘‘একটি প্রতিজ্ঞা করতে হবে।’’

অর্জুনের বাক্যস্ফূর্তি হচ্ছে না। তিনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে চেয়ে আছেন কৃষ্ণের দিকে।

‘‘কৃষ্ণাকে চূড়ান্ত অপমান করা সত্ত্বেও শুধুমাত্র মহারাজ যুধিষ্ঠিরের নির্দেশে যার প্রাণ তুমি ভিক্ষা দিয়েছিলে, সেই মহাপাপী জয়দ্রথ আজ তোমার প্রিয়তম সন্তানের অসহায়, অকারণ মৃত্যুর প্রধান নিমিত্ত রূপে রণক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়েছে।’’

অর্জুন এখনও নির্বাক। তাঁর চক্ষে ধীরে ধীরে শোণিতসঞ্চার হচ্ছে...

‘‘প্রতিজ্ঞা করো, কাল সূর্যাস্তের পূর্বে তুমি পাপিষ্ঠ জয়দ্রথকে বধ করবে। যদি করতে না পারো, স্বয়ং অগ্নিপ্রবেশ করবে।’’

এই অকস্মাৎ প্রস্তাব, বাসুদেবের এই অমোঘ নির্দেশ মুহূর্তের জন্য অর্জুনকে পুত্রশোক বিস্মরণ করিয়ে দিলো। অবিশ্বাসপূর্ণ চক্ষে বিহ্বল কন্ঠে তিনি বললেন... ‘‘কিন্তু তা কি করে সম্ভব? দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কর্ণ, শল্যরা তাকে যথাশক্তি রক্ষা করবেন...’’

‘‘নিজের অস্ত্র ক্ষমতার উপর আস্থা রাখো, ধনঞ্জয়’’... নিজের দক্ষিণ হস্ত পুনরায় অর্জুনের বাম স্কন্ধের উপর স্থাপন করে মন্দ্রকন্ঠে বললেন অচ্যূত... ‘‘বিশ্বাস রাখো আমার উপর। সোচ্চারে প্রতিজ্ঞা করো জয়দ্রথ বধের... যেন তার প্রতিধ্বনি বিপক্ষ শিবিরেও পৌঁছয়!’’

.................................................................................................................................


দুন্দুভি-দামামা-বিষাণ ধ্বনিত হচ্ছে। দু’পক্ষের সৈন্য সমাবিষ্ট। কৌরববাহিনী আজ দুর্ভেদ্য চক্রশকট ব্যূহে বিন্যস্ত। ব্যূহমুখে স্বয়ং দ্রোণাচর্য বিরাজমান। ব্যূহের আভ্যন্তরীণ পশ্চাদ্ভাগে পদ্ম নামক এক গর্ভব্যূহ। সে ব্যূহের রক্ষণভাগে কর্ণ, অশ্বত্থামা, শল্য, ভূরিশ্রবা, কৃপাচার্য প্রমুখ মহারথরা। তারও অভ্যন্তরে এক সূ্চীব্যূহ। সে ব্যূহের সম্মুখে সসৈন্য যাদববীর কৃতবর্মা, এবং তার জঠরে অগণিত সৈন্য পরিবেষ্টিত জয়দ্রথ।

চরমুখে অর্জুনের প্রতিজ্ঞার সংবাদ কৌরবশিবিরে পৌঁছেছিলো গত রাত্রেই, এবং সে সংবাদ শ্রবণমাত্র প্রাণভয়ে ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলেন জয়দ্রথ। কাম্যক বনে দ্রৌপদী হরণের প্রচেষ্টাকালীন ক্রোশাধিক দূরত্ব থেকে সব্যসাচীর বাণক্ষেপণে সারথি-অশ্ব সমেত তাঁর রথ বিনষ্ট হওয়ার স্মৃতি পুনর্জাগরিত হয়েছিলো তাঁর মনে। রণভূমি ত্যাগ করে পলায়ন করতে চেয়েছিলেন তিনি স্বরাজ্য সিন্ধুদেশে। দুর্যোধন ও দ্রোণাচার্যের অভয়বাণীতে কথঞ্চিৎ আশ্বস্ত হয়ে তিনি আজ যুদ্ধ করতে সম্মত হয়েছেন, এবং তাঁর প্রাণরক্ষায় সর্বশক্তি নিযুক্ত করতে যত্নবান হয়েছেন কৌরবপক্ষের সব মহারথী। বস্তুত, সবাই অত্যুৎসাহিত। কারণ, সূর্যাস্তের পূর্বে জয়দ্রথকে বধ করতে না পারলে অর্জুন অগ্নিপ্রবেশ করবেন, এবং অর্জুনের মৃত্যুর অর্থই যে পাণ্ডবপক্ষের তৎক্ষণাৎ পরাজয়, তাই নিয়ে কারও কোনও দ্বিমত নেই।

যুদ্ধারম্ভেই অর্জুনের রথ সবেগে ধাবিত হলো কৌরবব্যূহ অভিমুখে। দুঃশাসন ও আরেক ধার্তরাষ্ট্র দুর্মর্ষণ ব্যূহের অগ্রভাগে অর্জুনের গতিরোধ করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু অতি অল্প সময়ের মধ্যেই অর্জুনের শরধারায় বিপর্যস্ত হয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন দ্রোণাচর্যের পশ্চাতে।

অর্জুন দ্রোণের সম্মুখীন হয়ে তাঁকে প্রণাম করলেন... ‘‘আচার্যদেব, আমার দুর্গতি বিষয়ে আপনি সম্যক অবগত, এবং তার জন্য কিঞ্চিৎ দায়ীও। আমার প্রতিজ্ঞার কথাও নিশ্চয়ই আপনার শ্রূতিগোচর হয়েছে। অনুরোধ করছি, আমার প্রতিজ্ঞারক্ষায় বাধা দেবেন না।’’

ইষদ্হাস্যে বৃদ্ধ অস্ত্রাচার্য বললেন... ‘‘আমিও প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, পার্থ। কুরুরাজের স্বার্থরক্ষার প্রতিজ্ঞা। তাই আমাকে অতিক্রম না করে তুমি ব্যূহে প্রবেশ করতে পারবে না।’’

শুরু হলো গুরুশিষ্যের তুমুল যুদ্ধ। সমগ্র আর্যাবর্তের দুই শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধরের দ্বৈরথ। আপাতদৃষ্টিতে অসম... কারণ দ্রোণাচার্যের বয়স সাতাশি বছর, এবং অর্জুন সদ্য পঞ্চাশোর্ধ। কিন্ত সেই অসাম্যের পরিপূরক অর্জুনের প্রগাঢ় যত্ন আচার্যের শরীরে অস্ত্রাঘাত না করার। তাই দু’জনের শরজালে আকাশ আচ্ছন্ন হলেও কারও বিশেষ ক্ষতি হলো না। 

দু’পক্ষের সৈন্যরা এবং অন্যান্য নিকটবর্তী রথীরা অবাক বিস্ময়ে দেখতে লাগলেন দুই মহারথের অবিশ্বাস্য অস্ত্রক্ষমতা। অস্ত্রাভ্যাস ও প্রশিক্ষণ প্রদানেই দ্রোণাচার্যের অশীতিপর জীবন অতিবাহিত হয়েছে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ প্রকৃত অর্থে তাঁর প্রথম মহাযুদ্ধ। কিন্তু তাঁর ভয়ংকর পরাক্রমে সে কথা স্মরণে থাকে না কারও। অর্জুনের বিরামহীন বাণবর্ষণকে কি অসামান্য দক্ষতায় প্রতিহত করছেন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ! তাঁর প্রত্যাক্রমণ প্রতিরোধ করতে সর্বোচ্চ পর্যায়ের কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে অর্জুনকে। 

কিছুক্ষণ যুদ্ধ চলার পর কৃষ্ণ বুঝলেন, বৃথা কালক্ষেপ হচ্ছে। সুকৌশলে কপিধ্বজকে দ্রোণের ক্ষেপণপথ থেকে কিছু দূরে অপসারিত করে তিনি অর্জুনকে বললেন... ‘‘আচার্যের সঙ্গে যুদ্ধে অকারণ কালক্ষেপ কোরো না, পার্থ। তোমার প্রতিজ্ঞার কথা বিস্মৃত হয়ো না।’’

পরিস্থিতি স্মরণে এলো দ্বৈরথে সম্পূর্ণ নিয়োজিতচেতন একাগ্র অর্জুনের। তিনি বাণবর্ষণ করতে করতে কৃষ্ণকে নির্দেশ দিলেন আচার্যের রথকে প্রদক্ষিণ করার। তৎক্ষণাৎ অশ্বচতুষ্টয়কে সেই মর্মে পরিচালিত করলেন বাসুদেব।

বিস্মিত দ্রোণাচার্য দেখলেন, অর্জুন তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ অসমাপ্ত রেখেই তাঁকে অতিক্রম করে ব্যূহাভ্যন্তরে প্রবেশ করছেন। তিনি উচ্চকন্ঠে বললেন... ‘‘একি, অর্জুন? তুমি তো শত্রুজয় না করে যুদ্ধে বিরত হও না! কোথায় যাচ্ছো তুমি?’’

দ্রোণাচার্যের রথচক্রের সমীপে দু’খানি নারাচ ভূমিতে প্রোথিত করে সব্যসাচী বললেন... ‘‘আপনি আমার শত্রু নন, গুরুদেব। আপনাকে জয় করি এমন আমার সাধ্য কোথায়? প্রণাম...’’

কপিধ্বজ বিদ্যুদ্বেগে ব্যূহে প্রবেশ করলো। দ্রোণ বুঝলেন, পশ্চাদ্ধাবন করে লাভ নেই। তাঁর রথ গতিতে অর্জুনের রথকে পরাস্ত করতে পারবে না। তিনি স্মিতহাস্যে সারথিকে আদেশ দিলেন পুনরায় ব্যূহমুখে রথস্থাপন করতে।

ব্যূহে প্রবেশ করে অর্জুনের রথ সবেগে ধাবিত হলো জয়দ্রথের উদ্দেশ্যে। সর্বাগ্রে তাঁর গতিরোধ করতে এলো শ্রুতায়ু, সুদক্ষিণ ও অচ্যূতায়ু নামক তিন রাজপুত্রের নেতৃত্বাধীন কম্বোজবাহিনী। অতি অল্প সময়ের মধ্যে গাণ্ডীবনির্গত অবিশ্রান্ত শরধারায় ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেন তাঁরা। একে একে নিহত হলেন তিনজন। 

এঁদের সঙ্গে অর্জুনকে যুদ্ধরত দেখে বরুণপুত্র নামে খ্যাত দক্ষিণদেশীয় নরপতি শ্রুতায়ুধ অরক্ষিত কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে একটি গদা নিক্ষেপ করলেন। সকলকে হতবাক করে দিয়ে কৃষ্ণ শরীরকে নমিত করে সেই গদার গতিপথ থেকে নিজেকে অপসারিত করলেন, এবং প্রায় অলৌকিক কৌশলে গদাটিকে ধারণ করলেন আপন হস্তে। তারপর কংসারির বিশাল বাহুর তাড়নায় সে গদা নিমেষমধ্যে প্রতিনিক্ষিপ্ত হলো শ্রুতায়ুধের উদ্দেশ্যে। বিভীষিকাগ্রস্ত কৌরববাহিনী দেখলো, শ্রুতায়ুধের নিজের গদা তাঁরই মস্তক চূর্ণ করে সশব্দে ভূমিতে পতিত হলো!

অর্জুনের রথ দুর্নিবার গতিতে অগ্রসর হলো সূচীব্যূহের মধ্যস্থিত জয়দ্রথের অভিমুখে। ম্লেচ্ছ ও যবন জাতীয় সৈন্যেরা বাধা দিতে এসে ধ্বংস হলো অগণিত সংখ্যায়। দুর্যোধন প্রমাদ গণলেন! সবেগে দ্রোণের সমীপে উপস্থিত হলেন তিনি। ত্রস্তস্বরে বললেন... ‘‘গুরুদেব, অর্জুন কি করে আপনাকে অতিক্রম করলেন? আপনি স্বয়ং তাঁকে অব্যহতি না দিলে তিনি কিছুতেই যেতে সক্ষম হতেন না! আপনারই আশ্বাসবাণীর উপর আস্থা রেখে আমি জয়দ্রথকে রণক্ষেত্র ত্যাগ করা থেকে নিবৃত্ত করেছিলাম। এখন মনে হচ্ছে, তাঁকে যেতে দেওয়াই উচিত কার্য হতো। আপনি আমাদের পক্ষে যুদ্ধ করেও বস্তুত পাণ্ডবদেরই হিত সাধনে রত! এ তো বিশ্বাসঘাতেরই...’’

দুর্যোধন স্তব্ধ হলেন। দ্রোণাচার্যের কপালে গভীর ভ্রূকুটি দেখা দিয়েছে। বিপর্যস্ত দুর্যোধন অনুধাবন করলেন, এ বিপন্ন কালে আচার্য যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হলে সমূহ বিপদ। তিনি করুণ মুখে সত্বর বললেন... ‘‘আমায় ক্ষমা করুন, আচার্যদেব! আমি আর্ত হয়ে প্রলাপ বকছি! দয়া করে ক্রুদ্ধ হবেন না। জয়দ্রথ বিপন্ন। সে আপনার শরণাগত। তাকে রক্ষা করুন।’’

ইষৎ বিলম্বে ক্ষুণ্ণ স্বরে দ্রোণাচার্য বললেন... ‘‘তুমি আমাকে বড় অপমান করো, রাজা। বোঝো না, আমার বয়স হয়েছে। অর্জুন ত্রিভুবনের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর। কৃষ্ণও সারথিশ্রেষ্ঠ। অত্যল্প পরিসর দিয়ে তিনি রথ সঞ্চালন করতে পারেন। অর্জুনের রথাশ্বগুলিও অত্যুৎকৃষ্ট। কপিধ্বজের পশ্চাদ্ধাবন করতে পারে এমন রথ সমগ্র কুরুক্ষেত্রে আর কোথায়?’’

দুর্যোধনের অসহায়াবস্থা দেখে দ্রোণাচার্য বললেন... ‘‘ভয় পেও না, ভারত। তুমিও বীর, কৃতি। এ শত্রুতা তোমারই শত্রুতা। এ যুদ্ধও তোমার যুদ্ধ। যাও, বীরের মতন যুদ্ধ করো অর্জুনের সঙ্গে।’’

বিস্মিত, বিপর্যস্ত দুর্যোধন বললেন... ‘‘অর্জুনের গতি আপনি রোধ করতে পারলেন না! আমি কি করে তার সঙ্গে যুদ্ধ করবো?’’

মৃদুহাস্যে দ্রোণ বললেন... ‘‘মাভৈঃ! আমি তোমার শরীরে অভেদ্য দৈব কবচ বন্ধন করে দিচ্ছি। ইন্দ্রদত্ত এ কবচ আমি লাভ করেছিলাম আমার গুরু ঋষি অগ্নিবেশের কাছ থেকে। এ কবচ ভেদ করার শক্তি অর্জুন কেন, স্বয়ং মহাদেবেরও নেই। এসো।’’

দ্রোণ বহু মন্ত্রোচ্চারণ করে দুর্যোধনের দেহে কবচবন্ধন করলেন। তারপর তাঁকে আশীর্বাদ করে প্রেরণ করলেন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। বৃদ্ধ ব্রাহ্মণের সূক্ষ্ম কৌতুকটুকু না বুঝে অতিদর্পী দুর্যোধন নবোৎসাহে চললেন অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে।

ততক্ষণে মধ্যাহ্ন অতিক্রান্তপ্রায়। অর্জুনের রথ তখনও জয়দ্রথের উদ্দেশ্যে ধাবমান। অবন্তীদেশীয় দুই রাজা বিন্দ ও অনুবিন্দ এলেন তাঁকে বাধা দিতে এবং নিহত হলেন তাঁর শরাঘাতে। ক্লান্ত, আহত অশ্বগুলিকে কিঞ্চিৎ পরিচর্যা করে কৃষ্ণার্জুন পুনরায় ধাবিত হলেন জয়দ্রথের উদ্দেশ্যে।

এই সময়ে দুর্যোধন এসে উপস্থিত হলেন অর্জুনের সামনে। অর্জুন বৃষ্টিধারার মতন বাণবর্ষণ করতে লাগলেন তাঁর উপর। কিন্তু দ্রোণের কবচ সে সব বাণকে বিফল করে দিলো। কৃষ্ণ বিস্মিত হলেন। বিষয়টি অনুধাবন করে অর্জুন ইষদ্হাস্যে বললেন... ‘‘আচার্যদেবের ওই কবচবন্ধন কৌশল আমি সম্পূ্র্ণ অবগত। দুর্যোধন যতই ওই কবচের আড়ালে লুকিয়ে থাকুন, আজ ওঁর নিস্তার নেই!’’

অতঃপর অর্জুনের বাণে নিমেষমধ্যে দুর্যোধনের সারথি ও রথাশ্বগুলি নিহত হলো। চ্ছিন্ন হলো তাঁর ধনু ও হস্তাবরণ। কর্ণ, কৃপ, শল্য, ভূরিশ্রবা প্রভৃতি বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত দুর্যোধনের রক্ষার্থে এগিয়ে এলেন এবং সসৈন্য অর্জুনের রথকে বেষ্টন করলেন। তখন কৃষ্ণ পাঞ্চজন্য ধ্বনিত করে এবং অর্জুন গাণ্ডীবে বারবার টঙ্কার দিয়ে পাণ্ডবদের আহ্বান করলেন তাঁর সাহায্যার্থে।

সে ধ্বনির সঙ্গে কৌরবদের সিংহনাদ কর্ণগোচর হতে চিন্তিত যুধিষ্ঠির সাত্যকিকে অর্জুনের সাহায্যকল্পে প্রেরণ করলেন। সাত্যকির প্রবল পরাক্রমে কৌরবপক্ষের বহু সৈন্য নিপাতিত হলো। সাত্যকি সবেগে কৃষ্ণার্জুনের অভিমুখে চললেন। ইতোমধ্যে যুধিষ্ঠির ভীমকেও প্রেরণ করেছেন অর্জুনের সাহায্যে। ভীম গদাঘাতে সারথি ও অশ্ব সমেত দ্রোণের রথ বিনষ্ট করে সবেগে ব্যূহাভ্যন্তরে প্রবেশ করলেন।

দুর্যোধনের একত্রিশজন ভ্রাতাকে একাদিক্রমে হত্যা করে ভীম কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন। কর্ণের প্রবল আক্রমণে ভীমের সারথি, অশ্ব ও রথ ধ্বংস হলো। ভীম খড়্গ ও চর্ম নিয়ে কর্ণকে আক্রমণ করলেন। কর্ণের বাণে সেগুলিও বিনষ্ট হলো। নিরস্ত্র ভীম হস্তিযূথের মৃতদেহ ও ভগ্ন রথের আড়ালে আশ্রয় নিয়ে হস্তীর দেহাংশ, রথচক্র, ইত্যাদি নিক্ষেপ করে আত্মরক্ষা করতে লাগলেন। এক সময়ে কর্ণের শরাঘাতে তিনি মূর্ছিতপ্রায় হলেন। কর্ণ তখন কুন্তীকে দত্ত বাক্যের কথা স্মরণ করে ভীমকে অব্যহতি দিলেন ও ভর্ৎসনা করে তাঁকে বললেন রণক্ষেত্র ত্যাগ করে বনগমন করতে।

ভীমকে দুর্গত দেখে অর্জুন কর্ণের উপর বাণবর্ষণ করতে লাগলেন। আহত, পরিশ্রান্ত কর্ণ তখন ভীমকে ছেড়ে দুর্যোধনাদির দিকে অগ্রসর হলেন। সাত্যকি এসে ভীমকে নিজের রথে আরোহণ করিয়ে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে গেলেন।

এই সময়ে সোমদত্ততনয় মহাবীর ভূরিশ্রবা এসে সাত্যকিকে আক্রমণ করলেন। দু’জনের ঘোর যুদ্ধ হলো কিছুক্ষণ। তারপর ভূরিশ্রবার অস্ত্রাঘাতে সাত্যকি মূর্ছিত ও নিপাতিত হলেন। ভূরিশ্রবা তখন খড়্গহস্তে রথ থেকে অবতরণ করে এসে সাত্যকিকে পদাঘাত করলেন এবং মুণ্ডচ্ছেদনের অভিপ্রায়ে তাঁর কেশ ধারণ করলেন।

সাত্যকি-ভূরিশ্রবার যুদ্ধ কৃষ্ণার্জুন দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সাত্যকির মহাবিপদ দেখে কৃষ্ণ অর্জুনকে নির্দেশ দিলেন তাঁকে পরিত্রাণ করার। অর্জুন তখন ভূরিশ্রবার খড়্গধৃত দক্ষিণহস্তটি এক তীক্ষ্ণাগ্র অর্ধচন্দ্র বাণে চ্ছেদন করলেন।

বিস্মিত, ব্যথিত ভূরিশ্রবা অর্জুন ও কৃষ্ণকে এই অবীরোচিত কাজের জন্য কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করলেন এবং নিজের বামহস্ত দ্বারা কর্তিত দক্ষিণহস্তটি তাঁদের দিকে নিক্ষেপ করে যোগাবলম্বন করলেন। ইত্যবসরে সাত্যকি সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে উঠে কৃষ্ণার্জুনসহ সকলের নিষেধ অগ্রাহ্য করে যোগযুক্ত ভূরিশ্রবার মুণ্ডচ্ছেদ করলেন।

সূর্য তখন অস্তাচলগামী। কুরুসৈন্য আলোড়ন করতে করতে অর্জুনের রথ চলেছে জয়দ্রথের অভিমুখে। ভীমসেন ও সাত্যকি তাঁর পৃষ্ঠরক্ষা করছেন। দুর্যোধন বুঝলেন, যুদ্ধজয়ের সুবর্ণসুযোগ তাঁর সামনে উপস্থিত। সূর্যাস্ত অবধি অর্জুনকে শুধু নিবারণ করে রাখতে হবে জয়দ্রথবধ থেকে। তাহলেই প্রতিজ্ঞাবশত অর্জুনকে অগ্নিপ্রবেশ করতে হবে, এবং তাঁর মৃত্যু হলে পাণ্ডবরা অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করবেন। তিনি কর্ণ, দুঃশাসন, কৃপ, শল্য, অশ্বত্থামাদের সে কথা বললেন, এবং সকলে একযোগে আর্জুনকে আক্রমণ করলেন।

কিন্তু অর্জুনের অবিশ্রান্ত বাণবর্ষণের সম্মুখে কেউই খুব বেশিক্ষণ থাকতে পারলেন না। বার বার পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে অবশেষে সকলে মিলে গিয়ে জয়দ্রথকে চারপাশ থেকে বেষ্টন করলেন। জয়দ্রথও বিপদ বুঝে এঁদের অবরোধের অন্তরালে নিজের রথের অভ্যন্তরে আত্মগোপন করলেন। অর্জুনের বাণে তাঁর সারথির মুণ্ড ও রথের ধ্বজ ভূপাতিত হলো। কিন্তু তা সত্ত্বেও ছয় মহারথের আবেষ্টনীতে রক্ষিত জয়দ্রথকে প্রহার করা অর্জুনের পক্ষে অসম্ভব প্রতিভাত হলো। 

এই সময় কৃষ্ণ পশ্চিমাকাশে অস্তমান সূর্যের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। তাঁর ওষ্ঠে মৃদু হাস্যাভাস হলো। তিনি অর্জুনকে বললেন... ‘‘পার্থ, দেখো, সূর্যের উপর ছায়া ঘণায়মান। আর কিছু মুহূর্তের মধ্যে দিবাকর আচ্ছ্বাদিত হবেন। সকলে ভাববে, সূর্যাস্ত হয়েছে। জয়দ্রথও আর আত্মগোপন করা প্রয়োজন মনে করবেন না। এই সুযোগ! অভিনিবেশ করো।’’

অর্জুনও মুখ তুলে সূর্যের দিকে তাকালেন। অস্তরবির উপর রাহুর ধূসর ছায়া ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। কেশব গতরাত্রে তাঁকে সঙ্গোপনে বলেছিলেন আজকের সূর্যগ্রহণের কথা। প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ সোচ্চার ছিলো, যাতে চরমুখে সে সংবাদ বিপক্ষশিবিরে পৌঁছয়, এবং কৌরবরা উল্লসিত হন কোনওক্রমে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জয়দ্রথকে রক্ষা করতে পারলেই অর্জুনের আত্মহত্যার আশায়। গ্রহণতিথি স্মরণ রাখার মতন একমাত্র যে মানুষটি কৌরবপক্ষে ছিলেন, তিনি এখন শরশয্যায় শয়ান। বাসুদেব নিশ্চিত ছিলেন, সায়াহ্নের ঠিক পূর্বে রাহুর পূর্ণগ্রাস সবার মনে সূর্যাস্তের বিভ্রম জাগাবে।

হলোও তাই। সহসা সূর্যগ্রহণ হয়ে চতুর্দিক অন্ধকারাচ্ছ্বন্ন হলো। কৌরবপক্ষীয়রা মনে করলেন, সূর্যাস্ত হয়েছে। তাঁরা প্রবল হর্ষধ্বনি করে উঠলেন। জয়দ্রথও ভাবলেন, তাঁর বিপদ অপসারিত। তিনি মস্তক উত্থিত করে সূর্যকে দেখতে গেলেন।

ঠিক এই সময় অর্জুন আরম্ভ করলেন প্রবল বাণবর্ষণ। ধূলা ও অন্ধকারে চারিদিক সমাচ্ছ্বন্ন হওয়ায় সৈন্যরা দৃষ্টিরহিত হয়ে অর্জুনের বাণাঘাতে আকুল হয়ে উঠলো। দুর্যোধন, কর্ণ, কৃপ, শল্যরাও সেই আকস্মিক আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। সেই সুযোগে তাঁদের রথগুলিকে অতিক্রম করে কপিধ্বজ বিদ্যুদ্গতিতে জয়দ্রথের সমীপে উপস্থিত হলো। জয়দ্রথ সভয়ে দেখলেন, অর্জুন গাণ্ডীবে এক ভয়ালদর্শন বাণ যোজনা করেছেন। কন্ঠ থেকে আর্তনাদ নির্গত হওয়ার পূর্বেই তাঁর মস্তক স্কন্ধচ্যূত হয়ে তাঁর বিখ্যাত পিতা রাজর্ষি বৃদ্ধক্ষত্র প্রদত্ত মন্ত্রপূতঃ বরাহধ্বজ রথের আসনের উপর পতিত হলো। পরমুহূ্র্তে ক্রুদ্ধ অর্জুনের বজ্রবাণে সে রথ শতধা বিদীর্ণ হলো, এবং তার ভগ্নাংশগুলি ছড়িয়ে পড়লো চতুর্দিকে।

কৌরবপক্ষীয় যোদ্ধারা মহাবিস্ময়ে দেখলেন, আকাশের অন্ধকার দূরীভূত হয়েছে! অস্তগামী সূর্যের অর্ধাংশ এখনও দিকচক্রবালের উপর দৃশ্যমান। কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য, অর্জুনের দেবদত্ত, ভীমের পৌন্ড্র এবং সাত্যকির শঙ্খ একসঙ্গে ধ্বনিত হলো। যুদ্ধক্ষেত্রের অপর প্রান্তে যুধিষ্ঠির সে ধ্বনি শ্রবণে নিশ্চিন্ত হলেন।



3 comments: