2

ধারাবাহিকঃ নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক



ছুটি কথা - ১১ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত


ইস্কুলে গরমের ছুটি শেষ হবার আগে আগেই চলে আসতো বর্ষাকাল। কখনও কখনও বর্ষার এই আসা আমার একদম একটা ম্যাজিকের মত মনে হত। গরমে সব্বাই হাঁসফাঁস করছে। ঠাম্মা খালি বকাবকি করত আমাকে গরমে রোদ্দুরে ছাতে গেলে অসুখ করবে এই বলে। শুক্তুনি, পাতলা মসূর ডাল, হাল্কা করে রান্না মাছের ঝাল, কাঁচা আমের টক, ঘরে পাতা দই এসব নিত্য আহার্য-তালিকায়। গরমে গুরুপাক কিছু খাওয়া একদম বারণ। পাঁঠার মাংস রবিবারেও আসছেনা বাড়িতে। ঠাম্মা গম্ভীর মুখ করে বলছে, ‘আগে বৃষ্টি নামুক’। সবকিছু কেমন যেন আটকে আছে এই বৃষ্টি না নামার জন্য। সন্ধেবেলায় ছাতে গিয়ে মাদুর পেতে আকাশ দেখছি আর একেকটা মেঘ দেখিয়ে দেখিয়ে ঠাকুরদাকে জিজ্ঞাসা করছি সেই মেঘে শীগগির বৃষ্টি হবে কিনা! তা সেইরকম মেঘ আগেরদিন সন্ধ্যায় একটাও দেখিনি, কিন্তু হঠাৎ কোনও একটা সকালে সোঁদা মাটির গন্ধে ঘুম ভেঙ্গে উঠে দেখতাম অঝোর ধারায় বৃষ্টি নেমেছে। বাবাকে জিজ্ঞাসা করতাম, ‘এসে গেল?’ বাবা কোনও কথা না বলে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ত। তাকিয়ে থাকতো জানালা দিয়ে বৃষ্টির দিকে। আমি এক ছুটে ছাতে গিয়ে ভিজতাম। মা টের পেলেই টেনে নিয়ে যেত আমাকে তোয়ালে দিয়ে পেঁচিয়ে, কাজেই মা টের পাওয়ার আগেই যতটা সম্ভব ভিজে নিতাম। খুব বৃষ্টি হলে দুপুরে খিচুড়ি, ডিম আর পাঁপড়ভাজা। বাড়ির সামনে প্রকাণ্ড দুটো মাঠ, সেগুলো জলে ভর্তি হয়ে গেলে আমাদের বাচ্চাদের খেলা বন্ধ; কিন্তু জুতো খুলে জলে পা ডুবিয়ে হাঁটা তো বন্ধ নয়! সন্ধে হয়, চারিদিক থেকে ভেসে আসে ব্যাঙের ডাক। বাবা বলেছে, কিছু ব্যাং খুব বড় বড়। ওদের বেজায় খিদে। ওদের খিদে পেলেই নাকি ওরা ডাকে, ‘পোলাও লাও, কালিয়া লাও, কোর্মা লাও, লাও, লাও, লাও, লাও...’। আর কিছু ব্যাং ছোট ছোট, তাই তারা বেশী খেতে পারে না। ওরা ডাকে, ‘রুটি, রুটি, রুটি, রুটি, রুটি, রুটি...’। 

বর্ষা এলেই সব কিছু কেমন যেন অন্যরকম। সব্বাই যেন খুশি খুশি মেজাজ প্রথম প্রথম। কিন্তু কিছুদিন পরেই সবার মুখে মেঘ নেমে আসে। বৃষ্টিতে সর্দিকাশি, যাতায়াতের অসুবিধা, প্যাচপেচে কাদা নানারকম সমস্যার কথা বড়রা আলোচনা করতে থাকে। কিন্তু আমাদের শিশুদের তাতে বিশেষ কোনও হেলদোল থাকে না। বৃষ্টিতে ‘রেনিডে’ হয়ে যদি ইস্কুল ছুটি হয়ে যায়, তাহলে তো মজার শেষ নেই। খাবার ঘরে দুপুরবেলা দড়ি টাঙ্গিয়ে জামাকাপড় শুকানো হচ্ছে ফ্যান চালিয়ে। সেখানে মেলে দেওয়া মা আর ঠাম্মার শাড়ির ফাঁক দিয়ে দিয়ে আমি লুকোচুরি খেলি। একা একাই বা কখনও কখনও আমার পিসতুতো দিদি তুলতুলের সঙ্গে। 

রথযাত্রার দিন এগিয়ে আসে। আমাকে মা দোতলা রথ কিনে দেয়। আমার ছোড়দা, মানে ‘বলো’ (বড়মাসি)র ছোট ছেলে আমাকে আধঘণ্টার মধ্যে কি দারুণ করে রঙিন কাগজ কেটে ডিজাইন করে, বেলফুলের মালা দিয়ে সাজিয়ে দেয় আমার রথ। বসিয়ে দেয় জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার ছোট ছোট মূর্তি। সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে দেয়, ‘এই দেখ, সুভদ্রা যেমন জগন্নাথের বোন, তেমনি তুইও আমার বোন’। আবার ছোট ছোট থালায় সাজিয়ে দেয় নকুলদানা। ইয়াব্বড় একটা শাড়ির পাড় নিয়ে এসে জুড়ে দেয় রথের সঙ্গে। দেখিয়ে দেয় একটু টেনে কি ভাবে টানতে হবে রথ। ‘উঁহু, বেশী তাড়াহুড়ো করবি না’ গম্ভীর গলায় বলে ওঠে ছোড়দা— ‘তাহলেই কিন্তু তোর জগন্নাথ ধপ্পাস! একদম আস্তে ধীরে টানবি রথ’। আমি ধীরে ধীরে তাই করি। ‘একটু দাঁড়া’ বলে ছোড়দা উধাও হয়ে যায়। আধঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসে ছোট ছোট টুনিবাল্ব নিয়ে। আমার রথ ঘিরে জ্বলে ওঠে আলো। আমি আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠি। আহ, এই পাড়ায় যত বাচ্চাদের রথ আছে, আমারটা এবার সেরার সেরা হয়েছে দেখতে। সন্ধ্যা ঘন হলে আমরা রথ নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ি। এরপর আমরা মেলায় যাবো। ঠাম্মা শাড়ি পরে, কপালে বড় একটা টিপ, কাঁধে চাবির গোছা, একদম রেডি মেলায় যাবার জন্য। আমাদের বাড়ির কাছেই ঢাকুরিয়া ব্রিজের সামনে বসে মেলা। ঠাম্মা শক্ত করে ধরে রাখে আমার হাত; পাছে মেলার ভিড়ে আমি হারিয়ে যাই। রাস্তায় আমাদের সামনে দিয়েই এগিয়ে যায় বড় রথ; ঢাকুরিয়া কালীবাড়ির রথ। ঠাম্মা বলে ‘শক্ত কইরা একবার স্পর্শ কর রথের দড়িখান, দর্শন অইব পুরীধামে জগন্নাথদেবের’। আমি ধরি, শক্ত করে ধরি রথের রশি ঠাম্মার সঙ্গে। জানিনা, সত্যিই কি রথের রশি স্পর্শ করলেই পুরীধামে যাওয়া যায়? উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করি- কি আছে ওই রথের ভিতরে। আমার দৃষ্টি পৌঁছায় না; অনেক উঁচু রথ। মেলায় গিয়ে কিনি মাটির পুতুল, খেলনা-বাটির কিছু কিছু জিনিস যেগুলো হারিয়ে গেছে বা ভেঙে গেছে, সেগুলো। ঠাম্মা কেনে একটা কাঠের জলচৌকি, বসে রান্না করবার জন্য। যেটা আছে সেটার অবস্থা ভালো নয়, একটু নড়বড়ে, তাই। শীতল দি, আমাদের বাড়িতে কাজ করে, সেও গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে। ঠাম্মা ওকে কিনে দেয় চুড়ি আর রংচঙে টিপ। তুলতুলের জন্য কেনে মাটির পুতুল। খুব ভিড় বেড়ে উঠছে মেলায়। আমরা বেশীক্ষণ দাঁড়াইনা আর ভিড়ে। ঠাম্মা বলে, ‘অখন বাড়ি চল, যা হইসে, হইসে। আর কিসু কিনতে হইলে উল্টারথে আসুম অনে’। এই সেরেছে! উল্টারথ! সেটা আবার কি জিনিস? এই যে রথ দেখলাম, সেইটা আবার উল্টে যাবে নাকি? খেয়েছে—তাহলে তো জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা সব্বাই একদম ধপ্পাস! আমি ভিড় থেকে একটু ফাঁকায় এসেই চেপে ধরে জানতে চাই ঠাম্মার কাছে এই উল্টারথের ব্যাপারখানা। ঠাম্মা হাসে, বলে—‘আরে না না, রথ উল্টাইয়া যাইব না। সাতদিন ধইরা জগন্নাথদেব মাসির বাড়ি থাকবো। এই যে তুমি কয়দিন আগে ঘুইরা আইলা মাসির বাড়ি থিক্যা- যখন গেসিলা, তখন মাসির বাড়ির দিকে মুখ কইরা গেসিলা, আবার যখন ফিরলা তখন নিজের বাড়ির দিকে মুখ কইরা ফিরলা। এইরকম আর কি! জগন্নাথদেব যখন ফিরবো সাতদিন পরে, তখন রথের মুখও এইরকম উল্টাদিকে থাকবো। তারেই কয় উল্টারথ’। যাক বাবা, আমি হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। আবার টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। মেলার থেকে কেনা খেলনা-পুতুল সব আঁকড়ে ধরে একহাতে, আরেকহাতে ঠাম্মাকে ধরে ফিরে আসি মহাসুখে বাড়িতে। সব ঠিক-ঠাক সোজা ভাবে যেন থাকে, যেন কিছু উল্টেপাল্টে না যায়, এরকম ভাবতে ভাবতে তাকিয়ে থাকি বৃষ্টির দিকে। সাতদিন পরে আবার মেলার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ভাবি যে তাহলে উল্টোরথের দিন আমার নিজের ছোট দোতলা রথটা কিভাবে কোনদিকে টানব? কিন্তু না, এইটা নিয়ে এখন আর ঠাম্মাকে জ্বালানো উচিত হবেনা। এইটা বরং ঠাকুরদাকে জিজ্ঞেস করবো। ঠাকুরদা ঠিক একটা জুতসই কিছু উপায় বের করে দেবে।

2 comments:

  1. স্মৃতির সরণি বেয়ে এই পথ চলা বেশ মনোরম এবং উপভোগ্য !!

    ReplyDelete
  2. Darun.amio dhakuria r melay ghurtam

    ReplyDelete