ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in ধারাবাহিক
ধারাবাহিক
বানরায়ণ, পর্ব ৮
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
শিবির গুটিয়ে রওনা দেওয়ার অষ্টম দিনের মাথায় আমরা পৌঁছলাম কিষ্কিন্ধ্যার উপকন্ঠে।
পথে শুধু রাতের বিশ্রামের জন্য ছাড়া আর কোথাও একবারও থামা হয়নি। সুশৃঙ্খল পিঁপড়ের সারির মতন চলেছি আমরা। সবার সামনে ঘোড়সওয়াররা। তারপর পদাতিকরা। শেষে গরু-ভেড়া জাতীয় পশুগুলি। তাদের সবার পিছনে বন্য পশুর আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষার জন্য আর এক সারি ঘোড়সওয়ার।
আমাদের কোনও ধারনা ছিলো না, কোনও পশুর পিঠে চড়ে মানুষ এত দ্রূত পথ চলতে পারে। ঘোড়াগুলোকে যত দেখছিলাম, তত অবাক হচ্ছিলাম। কি অসাধারণ তেজী জানোয়ার! কি সুন্দর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত! যেন কথা বলা যায় ওদের সঙ্গে! আমাকে প্রচণ্ড আকর্ষণ করছিলো প্রাণীগুলো। কোনওদিন কি সুযোগ হবে ওদের কাছাকাছি যাওয়ার, ঘনিষ্ঠ হওয়ার?
পথ চলতে চলতে পরিচয় হচ্ছিলো নতুন মানুষদের সঙ্গে। নানা জায়গা থেকে আসা নানা ধরনের মানুষ। বিচিত্র তাদের সাজপোষাক, বিচিত্র আচার ব্যবহার। ভাষার একটু তারতম্য থাকলেও মোটামুটি সবার কথাই বোধগম্য। তাই মনোভাব আদান-প্রদানে খুব একটা সমস্যা নেই। সবার জন্যই এ এক নতুন পরিস্থিতি। এত লোকে মিলে যুদ্ধের কথা কেউ কোনওদিন শোনেনি। তার উপর শোনা যাচ্ছে, এ নাকি পুরো বাহিনীর একটা ছোট অংশ মাত্র! পুরো বাহিনী তাহলে কত বড়? রাবণের বাহিনীই বা কত বড়? এই সব আলোচনা করতে করতে পথ চলছিলো কিষ্কিন্ধ্যার রাজকীয় বাহিনীর এই নতুন যুক্তাংশ।
আরও কতগুলো নতুন তথ্য জানতে পারলাম যাত্রাপথে। কিষ্কিন্ধ্যার মানুষরা নাকি বানরদের পুজো করে। মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মা মনে করে তাদের। তাদের রক্ষণাবেক্ষন, পালনপোষন করে। সেখানকার কোনও উৎসবই নাকি বানরদের নৈবেদ্য না দিয়ে সম্পূর্ণ হয় না। তাই কিষ্কিন্ধ্যায় নাকি প্রচুর বানর।
আরও শুনলাম, কিষ্কিন্ধ্যার যোদ্ধারা নাকি যুদ্ধ করার সময় চামড়া দিয়ে তৈরি এক রকমের বানরের মুখোস ব্যবহার করে। তাতে নাকি তাদের পূর্বপুরুষদের শক্তি তাদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়ে তাদের পরাক্রম বাড়ায়। খুব সম্ভবত আমাদেরও ওই রকম মুখোশ পরে যুদ্ধ করতে হবে।
এ সব খবর মূলত যে দিচ্ছিলো, তার নাম করন্দ। সে কবেরু গ্রামের লোক। পাহানের সমবয়সী। কিষ্কিন্ধ্যায় গেছে বেশ কয়েকবার। অনেক খবর রাখে। আমি চেষ্টা করছিলাম যতক্ষন পারা যায় লোকটার কাছাকাছি থাকার… খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটা বিশেষ কারণে। করন্দ পড়তে জানে। একটু আধটু লিখতেও পারে। অনেক কিছু জানার আছে, শেখার আছে ওর কাছ থেকে।
শিবির ছাড়ার পর পঞ্চম রাত্রে জানতে পারলাম কিষ্কিন্ধ্যার গল্প। সে রাতে করন্দ কোথা থেকে যেন বাড়তি এক ভাঁড় তালের মদ জোগাড় করে এনেছিলো। এমনিতে প্রত্যেক সৈনিককে নৈশভোজের আগে এক পাত্র করে মদ দেওয়া হতো। তাতে ক্লান্তি মিটতো, ঘুম ভালো হতো। কিন্তু মৌতাতের অভ্যাস যাদের, তাদের একটু খেদ থেকে যেতো। করন্দ তাদের মধ্যে একজন। সে ছুঁক ছুঁক করে বেড়াতো... যদি আরেকটু মদ জোগাড় করা যায়।
পঞ্চম রাত্রে সেটা করেও ফেললো। খাওয়া দাওয়া হয়ে যাওয়ার বেশ অনেকক্ষণ পরে, প্রায় সবাই যখন ঘুমে ঢলে পড়েছে, দেখি কি যেন একটা কোঁচড়ে লুকিয়ে চুপিসাড়ে আসছে। ঘুমন্ত সৈনিকদের সারি পেরিয়ে জঙ্গলের দিকটা চলে গেলো, আর একটা ঝুপসি গাছের পিছনে আড়াল হলো।
আমিও পা টিপে টিপে উঠে গেলাম ওর পিছন পিছন। দূর থেকেই দেখতে পেয়েছিলো আমায়। কাছাকাছি যেতে চাপা গলায় বললো, ‘‘ফেউ লেগেছিস কেন রে ব্যাটা আমার পিছনে? কি চাই তোর?’’
আমি চুপ করে আছি দেখে আবার বললো, ‘‘মদের ভাগ পাবি না। অনেক কষ্টে জোগাড় করা। যা, ভাগ!’’
‘‘চাই না।’’ মাথা নেড়ে বললাম আমি।
‘‘তবে?’’
‘‘জানতে চাই।’’
‘‘কি?’’
‘‘তুমি যা যা জানো।’’
করন্দ খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। মদে চুমুক দিতেও ভুলে গেছে যেন। তারপর বললো, ‘‘পাগল নাকি তুই?’’
আমি বললাম, ‘‘কেন? জানতে চাওয়া পাগলামি নাকি?’’
আবার খানিকক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে থেকে তারপর নিজের পাশে একটা পাথরের চাঁইয়ের উপর বসতে ইশারা করলো করন্দ। সেই শুরু হলো আমদের কথোপকথন। বেশির ভাগটাই একতরফা। কিন্তু এটা আমি বুঝে গেছিলাম, যে বলতে পেরে করন্দ খুশি হয়েছে। সম্ভবত আর কেউ ওর কাছে কখনও এভাবে জানতে চায়নি কিছু।
মদে চুমুক দিতে দিতে কিষ্কিন্ধ্যার গল্প বলছিলো করন্দ। রাজা বালী কত বড় যোদ্ধা ছিলো। দাক্ষিণাত্যের সব রাজা তার ভয়ে থরহরি কম্পমান ছিলো। স্বয়ং রাবণ যুদ্ধে হেরে বাধ্য হয়েছিলো তার সঙ্গে সন্ধি করতে। তারপর দুই মহাশক্তিধরের বন্ধুত্ব হয়। সে বন্ধুত্ব বালীর মৃত্যু অবধি অটুট ছিলো...
কি ভাবে মৃত্যু হয় বালীর? প্রশ্নটা শুনে করন্দ কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো আমার দিকে। তারপর যে ঘটনাটা বললো, সেটা আমার প্রায় অবিশ্বাস্য মনে হলো। কিষ্কিন্ধ্যার উপকন্ঠে নাকি আস্তানা গেড়েছিলো একদল বন্য যাযাবর। অপরাধপ্রবণ, হিংস্র প্রকৃতির লোক। সুযোগ পেলেই লুঠতরাজ করতো। বেশ কিছু কিষ্কিন্ধ্যাবাসীর প্রাণ গিয়েছিলো তাদের হাতে। তাদের সর্দার ধুন্দু ছিলো মহাবলশালী। কিছুদিন সৈন্য পাঠিয়ে দলটাকে ধরার চেষ্টা করে বিফল হয়ে শেষমেষ বালী নিজেই একদিন ভাই সুগ্রীব আর কিছু লোকজন নিয়ে বেরোয় তাদের খোঁজে। খুঁজে বারও করে ফেলে। আর উপায় নেই দেখে ধুন্দু বালীকে এককযুদ্ধে আহ্বান করে, এবং বালী তৎক্ষণাৎ তাতে সাড়া দেয়।
ধুন্দু যতই বলশালী হোক, বালীর সঙ্গে এঁটে ওঠার মতন ক্ষমতা তার ছিলো না। তাই লড়তে লড়তে এক সময়ে সে পিছু হঠতে আরম্ভ করে, এবং একটা পর্যায়ের পর পালানো ছাড়া তার গত্যন্তর থাকে না। কিন্তু বালীর মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। এমনিতেই সে ভয়ানক মাথা গরম, রাগী লোক। তার উপর ধুন্দু তাকে অনেকদিন জ্বালিয়েছে, এবং লড়াইয়ের সময় আঁচড়ে কামড়ে বেশ খানিকটা ক্ষতবিক্ষতও করে দিয়েছে। বালী সুগ্রীবকে আদেশ দেয় ধুন্দুর দলের সবাইকে মেরে ফেলার, এবং নিজে ধুন্দুর পিছনে ধাওয়া করে।
কিন্তু সেই যে বালী গেলো, চার দিনের মধ্যে আর ফিরলো না। সুগ্রীব বালীর আদেশ পালন করার পর দলবল নিয়ে চার দিন অপেক্ষা করে তারপর কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরে গেলো। সেখানেও আরও দিন তিনেক অপেক্ষা করার পর সুগ্রীব ধরে নিলো, বালী মরে গেছে। দুঃখ হয়তো পেলো খানিকটা। কিন্তু সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ফেললো চটপট। নিজেকে রাজা ঘোষণা করে দিলো।
তাতে যে কিষ্কিন্ধ্যার মানুষদের খুব আপত্তি হলো, তা নয়। বালী দোর্দণ্ডপ্রতাপ, প্রচণ্ড শক্তিশালী হলেও ছিলো অহংকারী, স্বেচ্ছাচারী... কখনও কখনও অত্যাচারীও। বিশেষত, রাবণের মতন প্রবল পরাক্রান্ত রাজনৈতিক সহায় পাওয়ার পর থেকে সে প্রায় ধরাকে সরা জ্ঞান করা আরম্ভ করেছিলো। তার যথেচ্ছাচার এমন বেড়েছিলো, যে তার স্ত্রী-পুত্রও নাকি তাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলো। তাই অপেক্ষাকৃত নরম মানুষ সুগ্রীব যখন রাজা হলো, তখন কিষ্কিন্ধ্যার মানুষ কিছুটা হলেও হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।
কিন্তু তাদের, এবং বিশেষ করে সুগ্রীবের দুর্ভাগ্য, সে রাজা হবার তিন দিন পর হঠাৎ বালী ফিরে এলো। ক্লান্ত, রক্তাক্ত... কিন্তু বিজয়ী, বলদর্পী। হাতে ঝোলানো ধুন্দুর মুণ্ডু। এসে সুগ্রীবের কাণ্ড দেখে প্রথমটা হাঁ হয়ে গেলো। তারপর রাগে আগুন হয়ে আর কারও কোনও কথা না শুনে সুগ্রীবকে প্রায় মারতে মারতে বার করে দিলো রাজ্য থেকে। স্ত্রী রুমাকে পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে যেতে দিলো না। ভাইকে তাড়িয়ে দিয়ে জবরদস্তি ভ্রাতৃবধূকে অধিকার করলো বালী। বিপর্যস্ত, অপমানিত সুগ্রীব জনাকয়েক বিশ্বস্ত পার্ষদকে সঙ্গে নিয়ে বনবাসী হলো। এরা কিষ্কিন্ধ্যার সেই সব সভাসদ, যারা সুগ্রীব রাজা হওয়াতে খুশী হয়েছিলো।
এই অবধি বলে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেলো করন্দ। ততক্ষণে মদের ভাঁড় প্রায় নিঃশেষিত। মৌতাতও বেশ গাঢ়। আমি একটু চিন্তায় পড়লাম। আর বলবে না নাকি?
‘‘তারপর?’’ প্রশ্ন করলাম আমি।
‘‘তারপর যে ঠিক কি হলো, আমি সবটা জানি না রে। বালী সুগ্রীবকে তাড়িয়ে দেওয়ার কিছুদিন পরে আমি শেষবার কিষ্কিন্ধ্যায় গিয়েছিলাম।’’ বলে একটু থামলো করন্দ। হতে ধরা ভাঁড়টার দিকে একবার তাকালো। তারপর বললো, ‘‘শুনেছি, জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে একসময় সুগ্রীবের সঙ্গে দেখা হয় রামচন্দ্রের। সেও নির্বাসিত... তারও বউকে জবরদস্তি তুলে নিয়ে গেছে অন্য লোকে! দু’জন দু’জনের দুঃখ বুঝে বোধহয় বন্ধু হলো।’’ বলে চুপ করে গেলো করন্দ।
‘‘তারপর কি হলো? বালী মরলো কি ভাবে?’’ বাধ্য হয়ে প্রশ্ন করলাম আমি। শিবিরে কে যেন বলছিলো, বালীকে হত্যা করে বন্ধু সুগ্রীবকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রামচন্দ্র...
‘‘তারপর...’’ নেশাতুর গলায় বললো করন্দ, ‘‘তারপর বালী আর সুগ্রীবের যুদ্ধ হলো... আর তাতে বালী মরে গেলো।’’
আমার ভীষণ অবাক লাগলো। সুগ্রীবের সঙ্গে যুদ্ধে বালী মরে গেলো? এটা কি রকম হলো? তাই যদি হবার ছিলো, তাহলে যখন বালী তাড়িয়ে দিচ্ছিলো, তখন সুগ্রীব লড়লো না কেন? করন্দর দিকে তাকালাম। রাতের আবছা অন্ধকারে চোখ লুকিয়ে কি যেন একটা কথা এড়িয়ে যাচ্ছে সে...
‘‘তবে যে শিবিরে ওরা বলছিলো রামচন্দ্র বালীকে মেরে সুগ্রীবকে রাজা করেছেন...?’’ প্রশ্নটা আপনিই বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে। ‘‘বালীর সঙ্গে সুগ্রীবের লড়াই হলে রামচন্দ্র কি ভাবে মারবেন বালীকে?’’
‘‘অনেক রাত হয়েছে।’’ জড়ানো গলায় বললো করন্দ। ‘‘শুয়ে পড় গে যা।’’ খালি ভাঁড়টা ছুঁড়ে ফেলে দিলো জঙ্গলের ঝোপে। ‘‘আর তিন দিনের মাথায় কিষ্কিন্ধ্যা পৌঁছবো আমরা। সেখানে সব জানতে পারবি।’’ ইষৎ টলায়মান পায়ে করন্দ চলে গেলো।
আমি সেই জমাট বাঁধা অন্ধকারের মতন পাথরের চাঁইটার উপর বসে বসে ভাবতে লাগলাম...
আমরাও এক জমাট বাঁধা গল্পের পরিণতি জানার অপেক্ষায় আছি !!
ReplyDeleteআপনাদের উৎসাহেই লেখা... অশেষ ধন্যবাদ।
ReplyDelete