নাটক
গড়নাসিমপুরের মাঠ
চিত্রনাট্য ও সংলাপ
সায়ন্তন ঠাকুর
আজ থেকে ঠিক কুড়ি বছর আগে শুরু হয়েছিল এই গল্প।একটা নদী ঘেরা মফস্বল শহরে তখন সন্ধে নেমে আসত দ্রুত।মোবাইল নেটওয়ার্ক ছাড়া তখন আকাশ আরেকটু বেশি নীল ছিল।বাতাসে ছিল হলুদ রঙ।আর ছিলেন এক ম্যাজিশিয়ান, যিনি আমাদের দিয়ে গেছিলেন একটু মনখারাপ।
ঋণ
আমাদের লাল স্কুলবাড়ি, বিকেলবেলা, হীরো সাইকেল এবং পনেরো বছর বয়স
প্রথম অঙ্ক
মণীন্দ্র মেমোরিয়াল বয়েজ হাইস্কুলের মাঠ।ছুটির পর ক্লাস নাইন বি সেকশনের চারজন স্কুলের মাঠের পাশে বসে আছে।সাদা জামা আর খাঁকি ফুল প্যান্ট।একটু দূরে চারটে সাইকেল স্ট্যান্ড করে রাখা।বিকেল নামছে চারপাশে। ফাল্গুন মাসের বিকেল।মফস্বলের হাওয়ায় শীত বাতাসের চোরা টান।
অমিতঃ আর্যুর চোট্টামিটা দেখলি ?পরিস্কার এলবি ছিল।দিলই না!ওখানে ওকে আউট দিলে ম্যাচ আর ওদের জিততে হত না।যত্তসব চিটিংবাজি।
সন্দীপঃ আমি তো প্রথমেই বলেছিলাম,এ সেকশনের সঙ্গে ম্যাচ খেলব না। শুনলি কেউ আমার কথা?!আর এই দেবায়নের জন্যই ওদের সঙ্গে খেলতে হল।
দেবায়নঃ আরে শুধু ওদের কথা না বলে অমিত যে কী বাজে বল করল সেটা বল!ছ ওভারে চল্লিশ রান!তার মধ্যে আবার ন’টা ওয়াইড। একের পর এক হাফভলি।হাজারবার বললাম লাইনে রাখতে,দেখে মনে হচ্ছিল জীবনে প্রথমবার বল করছে।
অমিতঃ বাজে কথা বলিস না,নিজে তো তিরিশ বলে দশ রান করেছিস! আর আর্যু প্রথম ওভারেই আউট ছিল।সেটা তোর চোখে পড়ে না ?
দেবায়নঃ ওমনি গায়ে লাগছে,তাই না ? সত্যি কথা শুনে ?
অমিতঃ গায়ে লাগবে কেন ?আমিও সত্যি কথাই বললাম!সন্দীপও দুটো ক্যাচ মিস করেছে।সে কথা তো বললি না!
সন্দীপঃ আরে!সব দায় কি আমাদের চারজনের নাকি ?আরও তো সাতজন ছিল।তারা তো হেরে গিয়েও বাড়ি কেটে পড়ল!
অমিতঃ শোন সন্দীপ,সবাই আমাদের ওপরেই ভরসা করে,সে সবাই জানে। আর দেবু যেখানে ক্যাপ্টেন,সেখানে হারের দায় ওকে নিতেই হবে।
দেবায়নঃ সব দায় একা ক্যাপ্টেনের ? দারুন...
রিতমঃ (মাঝপথে থামিয়ে) এই দেবু চুপ কর তো!নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করিস না।একটা লিগের ম্যাচ হারলে কিছু হয় না।আর ওটা সত্যি এলবি ছিল না রে!হাইট বেশি ছিল।
অমিতঃ একদম ঠিক হাইটেই ছিল।আর ওরা যে নো বলে দেবুকে আউট দিল তার বেলায় ?
রিতমঃ ওরা ভুল করলে আমরাও ভুল করব ? অনেকদিন আগে আম্পায়ার আউট দেওয়ার পরও কোর্টনি ওয়ালশ মার্ক টেলরকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল,কারণ ওয়ালশ নিজে জানত মার্ক আউট ছিল না।ক্রিকেট মানে শুধু জেতা বা হারা নয়,এই সৎ থাকতে পারাটাও ক্রিকেট!
দেবায়নঃ কিন্তু রিতম সেদিন দ্যাখ জাদেজা আউট ছিল,আম্পায়ার দিল না,ও তো চলে গেল না!সেঞ্চুরিও করল!আজকের দিনে ওই রোমান্স আর চলে না রে!হয় জেতো নাহলে হারো!
রিতমঃ দেবু,এর পাশে কিন্তু একজন বেঁটে মরাঠির কথাও মনে রাখতে হবে!যে নিজে আউট হলে কখনও মাঠে দাঁড়িয়ে থাকেনি।কোনওদিন না।কারণ সে জানে জেতা বা হারার থেকেও অনেক বেশি দামী ক্রিকেট নিজে।
সন্দীপঃ যেমন আজ তুই বেরিয়ে এলি!আটচল্লিশ রানে!ওরাও অবাক হয়ে গেছিল,তুই থাকলে কিন্তু ম্যাচটা আমরা জিতে যেতাম।তুই নিজেও জানতিস তোর পর আর কেউ নেই রান করার মতো!
রিতমঃ জানতাম,আর এটাও জানতাম আমার ব্যাটের কাণা টাচ করেছিল বল,কিন্তু এতই সামান্য যে কিপার সন্তু অবধি বুঝতে পারেনি।
অমিতঃ এক্সজ্যাক্টলি,ওরা অ্যাপিল অবধি করেনি।
রিতমঃ আমি যে জানতাম ওটা টাচ করেছিল।কী করব বল!যে লোকটার পোষ্টার ঘরে টাঙিয়ে রাখি,যাকে দেখে নিজের স্ট্রেট ড্রাইভের স্বপ্ন দেখি,তার মতো হব না ? কোনওদিন তার মতো খেলতে পারব না সে আমি জানি, কিন্তু চেষ্টা করলে তার মতো একজন সৎ মানুষ তো হতেই পারি,তাই না ?
দেবায়নঃ এই ইমোশনের কোনও দাম নেই রে রিতম আজকের দিনে। দ্যাখ ওরা একবার বলল তোর কথা ? অথচ সন্তু নিজে তো জানে,তুই থাকলে ওরা আজ হেরে যায় শিওর! লিগের প্রথম ম্যাচেই তোর নিজের হাফ সেঞ্চুরিও মিস হল।
রিতমঃ ওদের বলার জন্য তো আমি করিনি কিছু!হ্যাঁ,ওরা একবার বললে আমার ভালো লাগতো,সেটা ঠিক,কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি দামী আমার কাছে এই ক্রিকেটে থাকা!
সন্দীপঃ ক্রিকেটে থাকা মানে ?
রিতমঃ (একটু হেসে)তাহলে একটা গল্প বলি শোন,অনেকদিন আগের একটা আনন্দমেলায় পড়েছিলাম,বিল ভোস,চল্লিশ বছর বয়সী স্কুল মাষ্টার, বডিলাইন সিরিজে লারউডকে আটকানোর জন্য রিটায়ারমেন্ট ভেঙে তাকে নিয়ে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন।সেই ভদ্রলোক পুরো দুটো সেশন লারউডকে নিজের গায়ে খেলে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ম্যাচ।রান বোধহয় করেছিলেন দশ কি বারো।আবার দ্যাখ বডিলাইন সিরিজের জন্য লারউডকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। যদিও পুরো প্ল্যান ছিল ক্যাপ্টেন ডগলাস জার্ডিনের।অথচ পুরো দোষ দেওয়া হয়েছিল লারউডকে।খনি শ্রমিকের ছেলের ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না কিছুই!তাই তাকে নির্বাসন দেওয়াও সহজ ছিল অনেক।এবার বল আমরা কার জন্য দাঁড়াব ? মার্ক টেলর যখন ৩৩৪ রান করার পর ব্যাট নামিয়ে রাখে,নিজে রেকর্ড না করেও,শুধু ব্র্যাডম্যানকে সম্মানের জন্য,তখন কি সে সত্যিই এক অন্য ক্রিকেটের রেকর্ড তৈরী করে না ? এটাই কি ক্রিকেটে থাকা নয় ?এবং জীবনেও থাকা নয় ?
দেবায়নঃ তোর সঙ্গে কথা বললেই কীরকম যেন মন ভালো হয়ে যায়!
অমিতঃ আজকের বিকেলটাও কেমন যেন অদ্ভুত,তাই না ? সুমনের সেই গানটার মতো,মনখারাপ করা বিকেল মানেই মেঘ করেছে!দোল আসছে, স্পষ্ট টের পাচ্ছি যেন।
সন্দীপঃ আর তার আগের দিনের নাড়াপোড়া ?আরে আমার মামার ছেলে সেদিন এসেছিল,আমাদের ক্লাসেই পড়ে,কলকাতায়,ডন বস্কো স্কুলে,সে জানেই না নাড়াপোড়া কাকে বলে!
দেবায়নঃ তুই বললি না ?
সন্দীপঃ বললাম তো!দোলের আগের দিন মাঠের সব আগাছা একজায়গায় জড়ো করে আগুন দিয়ে পোড়ানো।
অমিতঃ আর তার মধ্যে মাঠ থেকে কাঁচা কলাই ফেলে দিয়ে কলাই পোড়া খাওয়া ?
রিতমঃ অন্য সবার তো আমাদের মতো গড়নাসিমপুরের মাঠ নেই!
দেবায়নঃ উচ্চমাধ্যমিকের পর কোথায় সবাই চলে যাব আমরা, তাই না ?আমাদের স্কুলের এই ক্রিকেট লিগ,লাল ইঁটের দেওয়াল,এই দেবদারু গাছ,আমাদের সাইকেল,গড়নাসিমপুরের মাঠ, হিমাদ্রি স্যারের কোচিং...........সব থেকে যাবে।শুধু আমরা আরেকটু বড় হয়ে অন্য এক অচেনা শহরে চলে যাব।এই মফস্বল শহরে তখনও সন্ধে নেমে আসবে ঠিক এমনি করেই,অন্য একদল ছেলে আবার আমাদের মতোই এখানে বসে থাকবে।
রিতমঃ আর গার্লস স্কুলের রাস্তা ? যেখানে তুই মাঝেমাঝেই সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস!সব জানি কাকা!
দেবায়নঃ (একটু লজ্জা পেয়ে) ধ্যাত!সেদিন আমার চেন পড়ে গেছিল!
(সবাই হেসে ওঠে)
রিতমঃ সেই,শুধু মধুরিমা সাইকেল নিয়ে স্কুল থেকে বেরোলেই তোর চেন পড়ে যায় বারবার!
সন্দীপঃ স্বরস্বতী পুজোর দিন যখন আমাদের স্কুলে ঠাকুর দেখতে এল ওরা দলবেঁধে,তখনই বললাম যা গিয়ে কথা বল!
দেবায়নঃ আরে স্যাররা সবাই ছিল তো!গৌতম স্যার পিটিয়ে তক্তা করে দিত!আসতিস তোরা বাঁচাতে?সবকটা তো কেটে পড়তিস তখন!
অমিতঃ স্বরস্বতী পুজোর দিন কেউ কিছুই বলতো না!তাছাড়া মধুরিমা তোকে দেখছিল!
দেবায়নঃ তুই জানলি কী করে ?!!তারমানে তুই ওকে দেখছিলিস!
অমিতঃ যা বাবা!আমি কেন দেখব!তোর ভালোর জন্যই বললাম,উল্টে আমার সঙ্গে ঝামেলা করছিস ?
রিতমঃ শোন,মুখে বলতে না পারিস একটা চিঠি লেখ!বা ওই ম্যাগাজিন,যেখানে তোর লেখা ছাপল এবার সেটা অন্তত পাঠিয়ে দে ওকে।
দেবায়নঃ হ্যাঁ,তারপর ওর বাবার হাতে পড়ুক আর জন্মের কেস খাই আমি!
অমিতঃ আচ্ছা পাগল তো!বাড়িতে পাঠাবি নাকি,হিমাদ্রি স্যারের কোচিং থেকে ফেরার পথে হাতে দিবি!সঙ্গে একটা ক্যাসেটে ওই গানটা,যেটা দারুণ গাস তুই।
দেবায়নঃ কোন গান ?নীলাঞ্জনা ?
রিতমঃ না না ওটা নয়,হান্ড্রেড মাইলস!
দেবায়নঃযদি কিছু বলে!
অমিতঃ তাহলে বসে থাক আর আমড়ার আঁটি চোষ!
সন্দীপঃ সে সব তো হল,মধুরিমা কিন্তু এবছরও ফার্স্ট হয়েছে,আর আমাদের একমাস পরেই পরীক্ষা!সেদিকে খেয়াল আছে ? আমার অঙ্কে যা অবস্থা,তার ওপর শুনছি দয়াময়বাবু এবার কোশ্চেন সেট করবে! পঞ্চাশ তুলতে না পারলে বাবা জুতো খুলে পেটাবে আমাকে।
দেবায়নঃ ওরে বাবা,ইংরাজিতে আমার যে কী হবে,কে জানে!
অমিতঃ কেউ যদি কোনও মন্ত্রবলে রেজাল্ট ভালো করে দিত!যা যা আমাদের সবার ইচ্ছে সব পূরণ হত!
সন্দীপঃ রিতম শচীনের মতো কভার ড্রাইভ মারতে পারতো!আমি অঙ্কে একশো পেতাম,দেবু প্লেব্যাক সিঙ্গার হতে পারতো,অমিত সারারাত টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ দেখতো...কী ভালো হত না ?
রিতমঃ তোরা কেউ গড়নাসিমপুরের মাঠের কেসটার কথা শুনেছিস ?
দেবায়নঃ শুনেছি,কিন্তু বিশ্বাস করিনি!
সন্দীপঃ আমি কিন্তু শুনেছি,পালপাড়ার সুধীন গেছিল আর তারপর পাঁচশো টাকার লটারি পেয়েছে গত পরশুদিন।
রিতমঃ লটারি পেয়েছে তোকে কে বলল ?
সন্দীপঃ আমাদের বাড়ির পাশেই তো থাকে তাপসকাকু,লটারির দোকান আছে,কাকুই বলছিল যে তোদের বন্ধু পাঁচশো টাকা পেয়েছে! আর গড়নাসিমপুরে ও গেছিল সুধীন নিজেই বলেছে আমাকে।
দেবায়নঃ মাঠে তাঁবুটা আমিও দেখেছি!রঙচঙে তাঁবু!
রিতমঃ লোকটাকে দেখেছিস কেউ তোরা ?
সন্দীপঃ সুধীন বলছিল এমনি সাধারণ চেহারা,বেঁটে,একটা হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে থাকে,চোখে কালো চশমা।শুধু হাতে একটা সাপের মুখ বসানো লাঠি থাকে।ওটারই নাকি সব ক্ষমতা।
দেবায়নঃ আর কি বলে ? কোনও মন্ত্র দেয় ? সুধীনকে জিগ্যেস করিসনি ?
সন্দীপঃ করেছিলাম।কিন্তু বলল না, বলল,লোকটা কাউকে না বলতে বলেছে।আরও বলেছে,বললে নাকি সব ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যাবে।শুধু সুধীন বলছিল,একটা মৃদু ঘন্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছিল নাকি,অনেক দূর থেকে...ঘুম চলে আসে সে শব্দ শুনলে।
রিতমঃ হিপনোটিজম নয় তো ?
দেবায়নঃ তাহলে লটারির টাকা ?
রিতমঃ ঝড়ে কাক মরে ফকিরের কদর বাড়ে টাইপ হয়তো ?
অমিতঃ কী ব্যাপার বল তো ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! কে ম্যাজিশিয়ান,কীসের তাঁবু,খুলে বল তো!
রিতমঃ গড়নাসিমপুরের মাঠে বুড়ো বটগাছটা যেখানে আছে,তার পাশে চার পাঁচদিন আগে এক ম্যাজিশিয়ান তাঁবু পেতেছে।লাল নীল হলদে বেগুনি কাপড়ের কোলাজ তাঁবুর গায়ে।মাথায় একট হাওয়া মোরগ।বাতাসে খালি ঘুরে চলে।অদ্ভুত সব ম্যাজিক দেখায় লোকটা খালি হাতে,যেমন ধর শূণ্য থেকে হাত ঘুরিয়ে দুহাঁড়ি রাবড়ি এনে দিতে পারে,এমনি জলকে ফুঁ দিয়ে পেস্তাবাদামের শরবত করে দেয়,কোনও যন্ত্র ছাড়া সিনেমা দেখাতে পারে চোখের সামনে,তারপর ধর লেভিটেশন,অদৃশ্য হয়ে যাওয়া...আশ্চর্য সব ম্যাজিক।কোনও যন্ত্রপাতি কিছু নেই,একজন সহকারী আছে,সেও নাকি বোবা!
দেবায়নঃ আর আসল ব্যাপারটাই তো বললি না!
অমিতঃ কী আসল ব্যাপার ?
সন্দীপঃ মানুষের ইচ্ছেপূরণ,তাও সবার নয়,যাদের বয়স চোদ্দ-পনেরো, শুধু তাদেরই!অবশ্য যদি তাকে পছন্দ হয় ম্যাজিশিয়ানের তবেই!
রিতমঃ এই পছন্দের ব্যাপারটা তো জানতাম না আমি।
সন্দীপঃ হ্যাঁ,ওটাই হচ্ছে ব্যাপার!কৃষ্ণ গেছিল,ওকে ভাগিয়ে দিয়েছে!
অমিতঃ কীভাবে করে ইচ্ছেপূরণ ?সত্যি হয় ?
দেবায়নঃ শুনলি না সুধীনের গল্পটা!
অমিতঃ আমরা একবার যেতে পারি না ?
রিতমঃ যেতে তো পারি কিন্তু ম্যাজিশিয়ানের ফি একশো টাকা!
দেবায়নঃ তাছাড়া গড়নাসিমপুর এখান থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার। মানে আপডাউন মিলে চব্বিশ।সাইকেল করে যেতে আসতে ঘন্টা চারেক। বাড়িতে কী বলে যাবি ?
সন্দীপঃ সে বাড়ি ম্যানেজ হয়ে যাবে,কিন্তু চারশো টাকা জোগাড় করাই তো মুশকিল।
অমিতঃ হ্যাঁ,অত টাকা পাব কোথায়!
রিতমঃ আমার কাছে একশো আছে,বাবার কাছ থেকে ব্যাট কিনতে নিয়েছিলাম। তোরা যদি চাস,দিতে পারি...
দেবায়নঃ আর তোর ব্যাট ?
রিতমঃ সে হবেখন,আর যদি সত্যি ইচ্ছেপূরণ হয়,তাহলে তো...
সন্দীপঃ কিন্তু আমাদের তো চারশো লাগবে চারজনের।
অমিতঃ যদি আমরা দুজন যাই ?
দেবায়নঃ তাহলেও তো দুশো,আর দুজন যাব বাকি দুজন কী করবে ? তাদের ইচ্ছেপূরণ হবে না ?আশ্চর্য!স্বার্থপরের মতো কথা বলিস না!
রিতমঃ আমার মনে হয়,ব্যাপারটা খারাপ হবে না দেবু।যদি সন্দীপ আর অমিত যায়...অন্তত ব্যাপারটা কি সেটা বোঝা যাবে।এইটুকু আমরা করতেই পারি
দেবায়নঃ আমার কাছে অবশ্য একশো আছে,জীবনানন্দ সমগ্র কিনব বলে ঠাকুমা দিয়েছে।
সন্দীপঃ তোরা ভাবলি কী করে,তোদের এই প্রস্তাবে আমি রাজি হব ? যেতে হলে তোরা কেউ যা।আমি এটা করতে পারব না!
রিতমঃ আরে বেশি সেন্টি হোস না!যা বলছি শোন!এটা একটা এক্সপিরিমেন্ট।সবাই যাব একসঙ্গে।শুধু তোরা দুজন ভেতরে যাবি।কিছু বেগড়বাই দেখলেই ডাকবি।আমার মনে হয় কিছু দুনম্বরি ব্যাপার আছে! ব্যাটাকে হাতেনাতে ধরব।
দেবায়নঃ তাহলে কাল সকাল সকাল যাই নাকি ? কিন্তু বাড়িতে কী বলব ?
সন্দীপঃ বাড়িতে বলব কয়ামতপুরে ম্যাচ আছে সারাদিন!
অমিতঃ এটা বেস্ট।
দেবায়নঃ তাহলে কাল সকাল সাতটা,এখানেই মিট করি ?
রিতমঃ না এখানে নয়,হাইরোডের ধারে মিট করব।এখান থেকে কেউ দেখে ফেলতে পারে।
অমিতঃ ওকে। চল এবার উঠি।
(আস্তে আস্তে ওরা চারজন সাইকেল নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। ততক্ষণে সন্ধে নেমে এসেছে চারপাশে)
প্রথম অঙ্ক সমাপ্ত
বিরতি
দ্বিতীয় অঙ্ক
গড়নাসিমপুরের মাঠে বয়ে যাচ্ছে তখন ফাল্গুনের বাতাস।দুএকটা কোকিল ডাকছে।আমের মুকুলের গন্ধ চরাচর জুড়ে।ঠিক ততটাই রোদ্দুর উঠেছে যতটা উঠলে হাল্কা কুয়াশা মুছে জেগে ওঠে দৃশ্যময় জগত।খাঁ খাঁ মাঠে একটাও জনমনিষ্যি নেই।অনেকদূরে একপাল গোরু চড়ছে।বুড়ো প্রকাণ্ড বটগাছের নীচে ম্যাজিশিয়ানের তাঁবুও অদৃশ্য।ভারী অলস এক সকাল।লোকে বলে গড়নাসিমপুরের মাঠে নাকি এভাবেই সময় থমকে থাকে।ওরা চারজন সাইকেল নিয়ে বটগাছের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
দেবায়নঃ আরও মাইলখানেক মনে হচ্ছে!
রিতমঃ সময় কীরকম যেন থমকে আছে,তাই না ?
দেবায়নঃ গড়নাসিমপুরের মাঠে এমনই হয়।ভর দুপুরে নাকি হটাত লকলক করে ওঠে নীল আগুনের শিখা!বেভুল মানুষ দিশা হারিয়ে ফেলে এই দৃশ্যমান জগতের।
সন্দীপঃ আচ্ছা এই মাঠের নাম গড়নাসিমপুর হল কেন ?
রিতমঃ দাদুর কাছে শুনেছি,বহু বছর আগে নাসিম আলি নামে এক সুলতান এখানেই তৈরী করেছিল তার গড়।এখনও নাকি মাঠের পশ্চিমে সে গড়ের কিছু অংশ চোখে পড়ে।
অমিতঃ তারপর ? সে গড় ধ্বংস হয়ে গেল ?
রিতমঃ ঠিক জানা যায় না,লোকে বলে নাসিম আলি নাকি ভোরবেলা মরে পড়েছিল ওই বুড়ো বটগাছ যেখানে আছে,ঠিক সেখানেই।গড় ছেড়ে রাতারাতি সবাই পালায়।তারপর থেকে এই মাঠে কোনও ফসলও হয় না।দ্যাখ কেমন অনাবাদী হয়ে আছে বছরের পর বছর।
দেবায়নঃ যতবার আসি এখানে ততবারই মনে হয় কিছু একটা যেন ডাকছে আমাকে।কোনও জ্যান্ত কিছু।ঠিক বোঝাতে পারব না কিন্তু মনে হয় আমার।
রিতমঃ কিংবদন্তীর মাঠে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক।
সন্দীপঃ (হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে) আরে ওই তো বটগাছ,কোনও তাঁবু তো নেই! কিছুই তো চোখে পড়ছে না!
অমিতঃ তাই তো!কোথায় গেল ম্যাজিশিয়ানের তাঁবু ?
রিতমঃ আশ্চর্য!
দেবায়নঃ কালও তো ছিল এখানেই,রাতারাতি চলে গেল লোকটা তাঁবু গুটিয়ে !
দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বটগাছের কাছে আসে।সাইকেল স্ট্যান্ডে রেখে চারজনে মাঠের ওপর বটগাছের নীচে বসে।
অমিতঃ এবার তাহলে ?
দেবায়নঃ সেটাই ভাবছি,এত কষ্ট করে এসে...শেষ অবধি ফিরে যেতে হবে আবার।
রিতমঃ (হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে, কিছুটা উত্তেজিত)শুনতে পাচ্ছিস তোরা?
সন্দীপঃ কী রে ?
রিতমঃ শোন ভালো করে।
(খুব মৃদু একটা ঘন্টার শব্দ।হিসহিসে।অনেকটা শিসের শব্দের মতো শোনা যায়)
(সবাই চুপ করে যায়।মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করে)
দেবায়নঃ কীরকম একটা নেশার মতো,তাই না ?
রিতমঃ হ্যাঁ,খুব মেলাঙ্কোলিক।
অমিতঃ কেমন যেন হাহাকার ভরা।বুকের ভেতর থেকে কে যেন গুমরে গুমরে কাঁদছে।
সন্দীপঃ কেউ,কতদিনের পুরোনো কেউ যেন ডাকছে।
রিতমঃ(আবার উঠে দাঁড়িয়ে)চুপ!ওই দ্যাখ!
(বাকি তিনজন উঠে দাঁড়ায়।দৃষ্টিতে বিস্ময়)
একটা বেঁটে লোক,নীল রঙের হাফপ্যান্ট,সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি,হাতে একটা লম্বা বাঁশের লাঠি।লাঠির মাথায় একটা সাপের মুখ।ওদের দিকে এগিয়ে আসছে।
ম্যাজিশিয়নঃ (খুব মিহি গলা)বাবারা তোমরা কাউকে খুঁজছো?
(সবাই হতভম্ব।এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে)
ম্যাজিশিয়নঃ বলো বাবারা!কোনও ভয় নেই!আমি তো আছি!
রিতমঃ আপ...আপ...আপনি কে ?
ম্যাজিশিয়নঃ আমি ? হা হা হা হা, আমি এখানেই থাকি। এই গাছপালা, অই যে দিকচক্রবালরেখা,অই যে আকাশ,এই যে হিসহিসে ঘন্টার শব্দ...আমি সবখানে ছড়িয়ে থাকি।লোকে বলে আমি নাকি পাহারাদার!
দেবায়নঃ পাহারাদার ? কী পাহারা দেন আপনি ?
ম্যাজিশিয়নঃ যা কিছু মানুষ ধ্বংস করে,আমি সব পাহারা দি!
সন্দীপঃ আপনিই কি সেই ম্যাজিশিয়ান ?যাদুগর ?
ম্যাজিশিয়নঃ আমি তো কোনও যাদু জানি না বাবারা!আমি শুধু সব দেখি,যে যেখানে যেভাবে ভালো থাকে,তাকে সেখানেই দেখি।আমি ধুলোর মতো মিশে থাকি,বাতাসে ভাসিয়ে দি আমার স্বর,আকাশে চোখ রেখে দেখি আলো আর মেঘের খেলা,রাতের বেলা তারার আলো কুড়িয়ে মানুষের ঘরে পৌঁছে দি...আমি তো কোনও যাদু জানি না বাবারা!
অমিতঃ আপনি এখানেই থাকেন ?
ম্যাজিশিয়নঃ আমি যতদিন যেখানে দরকার ঠিক ততদিনই থাকি বাবারা!আমার তো কোনও ঘর নেই।তোমাদের থেকেও ছোট বয়েসে ঘর ছেড়েছিলাম,তারপর এই দেখাশোনার কাজ করি বাবুর বাড়ির।
রিতমঃ আপনার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না ?
ম্যাজিশিয়নঃ করে তো বাবা!(গলার স্বরে কান্না)খুব করে!কিন্তু কী করব বলো!বাবুর বাড়ির কাজ শেষ না করে যে আমার ফেরার উপায় নেই!
সন্দীপঃ কে আপনার বাবু ?
ম্যাজিশিয়নঃ(একটু হেসে)ও কথা থাক বাবারা,সেই কতদূর থেকে সাইকেল চালিয়ে এসেছো তোমরা,বলো,কী বলবে তোমরা ?
দেবায়নঃ আপনি কী করে জানলেন ?
ম্যাজিশিয়নঃ আমি জানতে পারি বাবা!আমি কিছু খুঁজি না তো,আমি পেয়ে গেছি,তাই জানতেও পারি।
রিতমঃ সত্যি করে বলুন তো,আপনি কে ?আপনার তাঁবু গেল কোথায় ?
ম্যাজিশিয়নঃ আমার তাঁবু? তার দরকার ফুরিয়েছে যে!কোন দুজন আসতে চাও আমার কাছে ?
(চারজন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে)
ম্যাজিশিয়নঃ (রিতমের দিকে আঙুল তুলে) তুমি এসো। তার আগে ওই বটপাতা,দুটো বটফুল,একটু মাটি আর তোমার ব্যাগে যে জলের বোতল আছে সেখান থেকে একটু জল আমার হাতে দাও।
(রিতম তাই করে।ম্যাজিশিয়ন দুহাত কড়জোরে হাঁটু মুড়ে বসে)
ম্যাজিশিয়নঃ (দেওয়ার পর)আহ!কী আরাম বাবা!আমি তোমার দান গ্রহণ করলাম।আমার বুক ভরে গেল।আলো হয়ে গেল আমার মন।আশীর্বাদ করি তোমায়। বল তোমার কি ইচ্ছে ?
রিতমঃ আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন আপনার কথা শুনে?
ম্যাজিশিয়নঃ মানুষ যে বড় কষ্টে আছে বাবা! তাই তুমি কাঁদছো!তোমার মন যে বড় নরম বাবা! এসো আমি তোমাকে স্বপ্ন দি।এমন এক পৃথিবী, এমন এক দুনিয়া যেখানে সবাই বেঁচে উঠবে আনন্দে।এই হোক তোমার ইচ্ছে। আর এই নাও আমার লাঠি, যখন সমুদ্রে তুফান আসবে, নড়বড় করবে তোমার নৌকা,কান্না আসবে বুকে, তখন এই সাপের চোখ তোমাকে পথ দেখাবে।
রিতমঃ সত্যি দেখাবে ?
ম্যাজিশিয়নঃ যদি তুমি বিশ্বাস করো,তাহলে দেখাবে বৈকি বাবা!বিশ্বাস রেখো নিজের বুকে। বিশ্বাসে থেকো তোমরা সবাই।ভালবাসায় থেকো।...আমি আসি বাবা এবার...
দেবায়নঃ আর দেখা হবে না কোনওদিন ?
ম্যাজিশিয়নঃ নিশ্চয় হবে! আবার যখন যেবার তোমাদের বয়স চোদ্দ বছর পেরিয়ে পনেরো হবে...আমি আবার আসব।
(আস্তে আস্তে ম্যাজিশিয়ন চলে যায় হেঁটে হেঁটে। ওরা চারজন দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে শোনা যায় একটা গান)
If you missed the train I'm on
You will know that I am gone
You can hear the whistle blow a hundred miles
A hundred miles, a hundred miles,
A hundred miles, a hundred miles
You can hear the whistle blow a hundred miles
Lord, I'm one, Lord, I'm two,
Lord, I'm three, Lord, I'm four
Lord, I'm five hundred miles away from home
Away from home, away from home,
Away from home, away from home
Lord, I'm five hundred miles away from home
Not a shirt on my back
Not a penny to my name
Lord, I can't go back home this ole way
This ole way, this ole way,
This ole way, this ole way,
Lord, I can't go back home this this ole way
If you missed the train I'm on
You will know that I am gone
You can hear the whistle blow a hundred miles
A hundred miles, a hundred miles,
A hundred miles, a hundred miles,
You can hear the whistle blow a hundred miles
You can hear the whistle blow a hundred miles
You can hear the whistle blow a hundred miles
সমাপ্ত