Next
Previous
Showing posts with label নাটক. Show all posts
0

নাটক - অংশুমান দাশ

Posted in








পাখোয়াজের বোল । যুদ্ধের আভাস । আলো জ্বলে উঠছে । দর্শকের দিকে পিছন ফিরে বসে কথক। পাখোয়াজ থামলে - ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন।

যুদ্ধ শেষ হল সবে
কোলাহল কলরবে
এতদিন কাক পক্ষীটিও আসেনি ধারে কাছে
এখন গাছে গাছে
কেবল চিল ও শকুনি
রোজ রোজ এমন ভোজ
আগে তো মেলেনি ।

আঠেরো দিন, আঠেরো দিন ধরে
কাতারে কাতারে
হাতি ঘোড়া রথ
পদাতিক সেনাবাহিনী
- সে এক মস্ত কাহিনী ।

যুদ্ধ মানেই গল্প
শুরু তার যতই অল্প
হোক না, নারী বা ভূমি –
অথবা নিছক খনিজ তেল –
ব্যবসা অঢেল –
অস্ত্র সৈন্য জোয়ান মানুষ ।

আসল যুদ্ধ তো যুদ্ধের পরে
ঘরে ঘরে
ফেরেনি মানুষ – ছেলে, ভাই
অনিচ্ছুক সাধারণ লোক – নিছক চাকরির খাতিরে ।

আসল যুদ্ধ এই না-থাকার সঙ্গে থাকা
শূন্যস্থানের পাশে
মনে হয়, যদি আসে – যদি ফিরে আসে ।

যুদ্ধ শেষ হল সবে –
কি আর হবে
সে কথা ভেবে,
পাণ্ডব কৌরব নয় –
এখন দুই দল – জীবিত ও মৃত ।

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মাঠে
হাজারে হাজারে চিতা
আগুনেই শেষ শয্যা পাতা
যতটুকু পাওয়া গেছে, টুকরো টাকরা
শরীরের আভাসের মত ।

যতটুকু হৃদয়ের ক্ষত
তাই দিয়ে ঢেকে রাখা যায় ।

পাখোয়াজের শব্দ – যেন হৃদস্পন্দন । কথক নির্দেশ করেন একটি পড়ে থাকা সাদা কাপড়ের দিকে।

মাঠের প্রান্তে কে ওই নিশ্চল
কেউ নেই আশেপাশে
কেবল উড়ে আসে
আগুনের ফুলকি - ঈষৎ অগ্নিভ রং ?

মৃতদেহের কপালে রাখা হাতে জ্যা-এর দাগ?
সূর্যাস্তের অস্তরাগ
ঘটোৎকচের শীতল বুকের উপর এসে পড়ে –
হিড়িম্বা জননী তার মূর্তি পাথরের ।

শেষ শক্তিটুকু তার, ওই শুয়ে – একা
যেমন একাকী ছেড়ে যেতে একদিন, দুবারও ভাবেনি কেউ ।

সেই কথা মনে করে আজ,
ছেলের বুকে হাত রেখে হিড়িম্বা ভাবেন –
এইবার শেষ হল কাজ ।

কোন কথা? কোন কাজ?
এইবার মনে করা যাক ।

বাজনা – দ্রুত । কথক স্থান বদলাচ্ছেন ।

সারারাত্রি জুড়ে জতুগৃহ পুড়ে
অনলে হয়েছে ছাই
কিরাত রমণী পঞ্চপুত্র তার
পুড়েছে সে পাঁচ ভাই ।

পুড়েছে, নাকি পুড়িয়ে মেরেছে
সে কথা কে আর গায়
ওদিকে পাণ্ডব সাথে কুন্তীমাতা
যেদিকে দুচোখ যায়
পালিয়ে পালিয়ে বনে জঙ্গলে
ধূলায় রাত্রিবাস
জেগে আছে ভীম, বীর ভীমসেন
সাথে জেগে হা হুতাশ ।

সেই জঙ্গলে আসলে রাজ্য
অনার্য প্রজাতির
হিড়িম্ব ও তার বোন হিড়িম্বা
মহাবাহু মহাবীর ।

তাদের আহার মাংসই শুধু
মানুষে অরুচি নাই
হিড়িম্বা চলে, দেখে আসি কোথা
মানুষের ঘ্রাণ পাই ।

শিকারে বেরোল অনার্য নারী
যোদ্ধা সে বিভীষণ
দূর থেকে দেখে পাঁচটি মানুষ
ঘুমে ঘুমে অচেতন ।

তার পাশে ও কে? কে আছেন জেগে
অমিত পরাক্রম
ভুলে গেল মেয়ে, ঘরে হিড়িম্ব
খিদেয় মতিভ্রম ।

ভুলে গেল তার যুদ্ধ পোশাক
ভুলে গেল ধনুতীর
হাজার দ্বিধায় পায়ে বেড়ি দিল
গতি হয়ে এল ধীর ।

চোখ তুলে চেয়ে ভীমও সহসা
ভুলে গেল যেন সব
যেমন আহত হিড়িম্বা
তেমনই মধ্যম পাণ্ডব ।

কথকের প্রকাশ ভঙ্গী – যেন ভীম ও হিড়িম্বার পূর্বরাগ । *

মঞ্জু বিকচ কুসুমপুঞ্জ
মধুপশবদ গুঞ্জ গুঞ্জ
কুঞ্জরগতি-গঞ্জি গমন
মঞ্জুল কুলনারী ।

ঘন গঞ্জন চিকুরপুঞ্জ
মালতী ফুল-মালে রঞ্জ
অঞ্জনযুত কঞ্জনয়নী
খঞ্জনগতি-হারি ।।

হিড়িম্বার দেরি দেখে জঙ্গল তোলপাড় করে এসে পড়ে ভাই হিড়িম্ব । যাদের ধরে আনতে পাঠানো খাদ্য হিসেবে – তাদের সঙ্গে কিনা সখ্যতা । হিড়িম্ব হুঙ্কার দিয়ে ওঠে ।

হিড়িম্বা বলে – ভীম, এই আমার ভাই । এর কথাই বলছিলাম । রাজপাটে মন নেই – শুধু খাওয়া ।

হিড়িম্ব দুকথা শোনায় বোনকে – এইজন্যেই মেয়েছেলের উপর ভরসা করতে নেই । পাঠালাম শিকারে – এখন তারই বশ্য হয়ে উঠল ।

হিড়িম্ব ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় ভীমের উপর । রুখে দাঁড়ায় হিড়িম্বা ।

আগে আমার সঙ্গে লড়াই কর, আমাকে মার – তারপর হাত দিবি ওদের গায় ।

এদিকে কোলাহলে ঘুম ভেঙ্গে গেছে চারভাই আর কুন্তীর । মহাবাহু পুরুষপুঙ্গব ভীমসেনের লেগেছে আত্মসম্মানে ঘা – মেয়েছেলে, এক মেয়েছেলে কিনা বাঁচাবে আমাকে ? হিড়িম্বাকে ঠেলে সরিয়ে ভীম নেমে পড়ে হিড়িম্বর সঙ্গে যুদ্ধে ।

পাখোয়াজ । ভীম ও হিড়িম্বর যুদ্ধ – হিড়িম্বর মৃত্যু ।

হিড়িম্ব নিধন হল জঙ্গল তোলপাড়
এবার হিড়িম্বার দিকে নজর সবার
ভুলে গেল ভীমসেন, কিছুক্ষণ আগে
দেখেছিল পরস্পরে, দৃষ্টি - পূর্বরাগে ।

ভাইএর সঙ্গে একে নরকে পাঠাই
পৃথিবীতে অনার্যের নাই কোন ঠাই ।

রুখে দাঁড়াল হিড়িম্বা ।

শোন ভীম – আমি অনার্য হতে পারি, তোমাদের ভাষায় মেয়েছেলে হতে পারি – কিন্তু আমি এই রাজ্যের রক্ষক । দেবতা । যুদ্ধবিদ্যায় কারো থেকে কম নই । আমার সাথে লড়তে চাও – এসো । কিন্তু আমি যুদ্ধ করবনা – কারণ তোমাকে আমার ভাল লেগেছে – আমি তোমার সঙ্গে থাকতে চাই । নাহলে আমি তোমাকে হিড়িম্বর কথা বলতাম না – তোমাদের বাঁচানোরও চেষ্টা করতাম না । এখন সকলের সামনে পড়ে তোমার মত বদলাতে পারে – তোমার মন একে ছেলেখেলা ভাবতে পারে । কিন্তু আমি আমার মনোভাবে অনড় । এই নামিয়ে রাখলাম আমার ধনুক – তুমি মারতে চাইলে আমাকে মারো ।

পাঁচ ভাই মাতা কুন্তী ধরম সঙ্কটে
বিনাযুদ্ধে প্রাণনাশ অধর্ম বটে
এদিকে নারীর রক্তে অস্ত্র রাঙ্গা হলে
কি করে মহান যোদ্ধা তাকে আর বলে ?
আবার অনার্যকে আত্মীয় স্বীকার
রাজরক্তে এও কি মানা চলে আর ?

এ সব শোনে হিড়িম্বা – অপমানে জ্বলে ওঠে । এদের জন্যে সে ভাই-কেও হারাল । চলে যেতে চায় – কিন্তু ভীম কি পুরোটাই মিথ্যা বলেছে তাকে? নাকি এখন পারিপার্শ্বিকের চাপে ফিরেও তাকাচ্ছেনা আর । ফিরে যাব না যাবনা । অপমান কি ভালোবাসার থেকেও বড় ? হিড়িম্বা এক পা দু পা ফিরে যায় । আবার ফিরে তাকায় ভীমের দিকে ।

মাতা কুন্তী বলেন শোন অনার্য দুহিতা
তুমি ভুল বল নাই, মানি সেই কথা
ভীমসেন বিবাহ করুক গান্ধর্বমতে
কিছুকাল থাক তোমরা থাক একসাথে
তারপর ভবিষ্যতে হওয়া রাজরানী
এ চাওয়া অনার্য রক্তে অসম্ভব জানি

রাজরানী ? আমি যাবই না তোমাদের সঙ্গে । কে দেখবে আমার রাজ্য ? - হিড়িম্বা ঘুরে তাকায় ।

যুধিষ্ঠির বলেন, তবে পুত্রসন্তান হলে
তখন ভীমসেন ফিরে আসবেন চলে
যখন যেমন হবে যুদ্ধে প্রয়োজন
সত্বর পাঠাবে তুমি পুত্রকে তেমন

রাজি আমি । হিড়িম্বা বলেন – দু দণ্ড কাটাবো ভীমের সঙ্গে, এর থেকে বেশি আর কী চাইব । তোমাদের রাজ্য ধন রত্ন সম্মান, এসবের পরোয়া করিনা আমি । বদলাইনা মন, বদলাইনা মত, তাই এই অসম্মান মেনে নিলাম । ভীমের পুত্র হবে ভীমের মতই বীর ।

মিলনের আভাস ।

সঘন বরষা জলদ গম্ভীর
আনন্দে থরথর দেহ
মিলন পিয়াসী বারিষে আঁধার
যেন হেথা নাহি কেহ
কত রম্য সুরে কত ফুল সাজে
ভ্রমিয়া স্বপনপুরে
ভ্রমে ভ্রমে কেটে গেল কিছুদিন
অতীতের থেকে দূরে ।

কথক ধীরে ধীরে সেই প্রথমের পিছন ফিরে বসা অবস্থায় ফিরে গেছেন ।

এইবার শেষ হল কাজ ।
মাতা নাকি জায়া –
কোন দায়, আজ?
ফিরেও তাকায়নি কন্যা
তাচ্ছিল্যে ঢেকেছে অধিকার
ভালবাসাটুকু বুকে ধরে
বড় করে করে
এই ভীমপুত্র আমার ।

সেই কাঁধ, বাহু, প্রশস্ত বক্ষ, শার্দূলের পেশীময় দেহ,
নাই সন্দেহ
ভীম, এইটুকু বেঁচে আছ তুমি ।
অথবা ছিলে ।

সহসা স্বচ্ছ হয় –
কোন শলা দিয়েছিলেন কুন্তী
কেন রাজী গান্ধর্ব বিবাহে,
যুদ্ধ যুদ্ধ যুদ্ধের প্রস্তুতি
হিড়িম্বার মাধ্যমে যদি ভীমসম মহাবাহু এক
পাওয়া যায় অতিরিক্ত হাত যুদ্ধের সময়ে ।
কারণ অস্ত্র নয়, অর্থ নয়
যুদ্ধে আসল প্রয়োজন যুবক জোয়ান ছেলে ।

এই ছলে
হিড়িম্বাবিদায়,,
তবু পুত্রকে তার
ভাড়াটে সৈন্য হিসাবে বিশেষ দরকার ।

কথক ফিরে আসেন সেই সাদা চাদরের কাছে, ঠিক যেখানে ছেলের বুকে হাত রেখে পুরনো কথায় ফিরে যাওয়া হয়েছিল।

আমার রয়েছে অহং
রাজরক্ত তোমাদেরই থাক,
যাক
যেটুকু মায়া
জমা ছিল কঠিন খোলসে ।

কার ছায়া
এসে পড়ে ম্লান চন্দ্রিমায়
এসে বসে
পাশটিতে তার ?
ভীম তুমি ? এ পুত্র একার আমার ।
যেরকম তাকাওনি ফিরে,
বুকের গভীরে
এতদিন –
আমিও ফিরি না আর
আমি তো স্বাধীন ।

আর্যরক্ত, এ পুরুষকার – তোমাদের পায়ের শিকল,
তার কাছে বিক্রি চিরকাল ।
এ কথা ভাবেন তিনি - বলার প্রয়োজন গেছে ঘুছে ।
দুই কাল পায়ে মুছে,
হিড়িম্বা, আসল মানুষ
পা রাখেন সামনের দিকে ।

ঘটোৎকচের মৃতদেহ দুই হাতে তুলে কথক বেরিয়ে আসেন ।
----

* পদটির পদকর্তা জগদানন্দ
0

নাটক - সায়ন্তন ঠাকুর

Posted in








নাটক


গড়নাসিমপুরের মাঠ 
চিত্রনাট্য ও সংলাপ 
সায়ন্তন ঠাকুর 


আজ থেকে ঠিক কুড়ি বছর আগে শুরু হয়েছিল এই গল্প।একটা নদী ঘেরা মফস্বল শহরে তখন সন্ধে নেমে আসত দ্রুত।মোবাইল নেটওয়ার্ক ছাড়া তখন আকাশ আরেকটু বেশি নীল ছিল।বাতাসে ছিল হলুদ রঙ।আর ছিলেন এক ম্যাজিশিয়ান, যিনি আমাদের দিয়ে গেছিলেন একটু মনখারাপ। 


ঋণ 

আমাদের লাল স্কুলবাড়ি, বিকেলবেলা, হীরো সাইকেল এবং পনেরো বছর বয়স 


প্রথম অঙ্ক 

মণীন্দ্র মেমোরিয়াল বয়েজ হাইস্কুলের মাঠ।ছুটির পর ক্লাস নাইন বি সেকশনের চারজন স্কুলের মাঠের পাশে বসে আছে।সাদা জামা আর খাঁকি ফুল প্যান্ট।একটু দূরে চারটে সাইকেল স্ট্যান্ড করে রাখা।বিকেল নামছে চারপাশে। ফাল্গুন মাসের বিকেল।মফস্বলের হাওয়ায় শীত বাতাসের চোরা টান। 

অমিতঃ আর্যুর চোট্টামিটা দেখলি ?পরিস্কার এলবি ছিল।দিলই না!ওখানে ওকে আউট দিলে ম্যাচ আর ওদের জিততে হত না।যত্তসব চিটিংবাজি। 

সন্দীপঃ আমি তো প্রথমেই বলেছিলাম,এ সেকশনের সঙ্গে ম্যাচ খেলব না। শুনলি কেউ আমার কথা?!আর এই দেবায়নের জন্যই ওদের সঙ্গে খেলতে হল। 

দেবায়নঃ আরে শুধু ওদের কথা না বলে অমিত যে কী বাজে বল করল সেটা বল!ছ ওভারে চল্লিশ রান!তার মধ্যে আবার ন’টা ওয়াইড। একের পর এক হাফভলি।হাজারবার বললাম লাইনে রাখতে,দেখে মনে হচ্ছিল জীবনে প্রথমবার বল করছে। 

অমিতঃ বাজে কথা বলিস না,নিজে তো তিরিশ বলে দশ রান করেছিস! আর আর্যু প্রথম ওভারেই আউট ছিল।সেটা তোর চোখে পড়ে না ? 

দেবায়নঃ ওমনি গায়ে লাগছে,তাই না ? সত্যি কথা শুনে ? 

অমিতঃ গায়ে লাগবে কেন ?আমিও সত্যি কথাই বললাম!সন্দীপও দুটো ক্যাচ মিস করেছে।সে কথা তো বললি না! 

সন্দীপঃ আরে!সব দায় কি আমাদের চারজনের নাকি ?আরও তো সাতজন ছিল।তারা তো হেরে গিয়েও বাড়ি কেটে পড়ল! 

অমিতঃ শোন সন্দীপ,সবাই আমাদের ওপরেই ভরসা করে,সে সবাই জানে। আর দেবু যেখানে ক্যাপ্টেন,সেখানে হারের দায় ওকে নিতেই হবে। 

দেবায়নঃ সব দায় একা ক্যাপ্টেনের ? দারুন... 

রিতমঃ (মাঝপথে থামিয়ে) এই দেবু চুপ কর তো!নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করিস না।একটা লিগের ম্যাচ হারলে কিছু হয় না।আর ওটা সত্যি এলবি ছিল না রে!হাইট বেশি ছিল। 

অমিতঃ একদম ঠিক হাইটেই ছিল।আর ওরা যে নো বলে দেবুকে আউট দিল তার বেলায় ? 

রিতমঃ ওরা ভুল করলে আমরাও ভুল করব ? অনেকদিন আগে আম্পায়ার আউট দেওয়ার পরও কোর্টনি ওয়ালশ মার্ক টেলরকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল,কারণ ওয়ালশ নিজে জানত মার্ক আউট ছিল না।ক্রিকেট মানে শুধু জেতা বা হারা নয়,এই সৎ থাকতে পারাটাও ক্রিকেট! 

দেবায়নঃ কিন্তু রিতম সেদিন দ্যাখ জাদেজা আউট ছিল,আম্পায়ার দিল না,ও তো চলে গেল না!সেঞ্চুরিও করল!আজকের দিনে ওই রোমান্স আর চলে না রে!হয় জেতো নাহলে হারো! 

রিতমঃ দেবু,এর পাশে কিন্তু একজন বেঁটে মরাঠির কথাও মনে রাখতে হবে!যে নিজে আউট হলে কখনও মাঠে দাঁড়িয়ে থাকেনি।কোনওদিন না।কারণ সে জানে জেতা বা হারার থেকেও অনেক বেশি দামী ক্রিকেট নিজে। 

সন্দীপঃ যেমন আজ তুই বেরিয়ে এলি!আটচল্লিশ রানে!ওরাও অবাক হয়ে গেছিল,তুই থাকলে কিন্তু ম্যাচটা আমরা জিতে যেতাম।তুই নিজেও জানতিস তোর পর আর কেউ নেই রান করার মতো! 

রিতমঃ জানতাম,আর এটাও জানতাম আমার ব্যাটের কাণা টাচ করেছিল বল,কিন্তু এতই সামান্য যে কিপার সন্তু অবধি বুঝতে পারেনি। 

অমিতঃ এক্সজ্যাক্টলি,ওরা অ্যাপিল অবধি করেনি। 

রিতমঃ আমি যে জানতাম ওটা টাচ করেছিল।কী করব বল!যে লোকটার পোষ্টার ঘরে টাঙিয়ে রাখি,যাকে দেখে নিজের স্ট্রেট ড্রাইভের স্বপ্ন দেখি,তার মতো হব না ? কোনওদিন তার মতো খেলতে পারব না সে আমি জানি, কিন্তু চেষ্টা করলে তার মতো একজন সৎ মানুষ তো হতেই পারি,তাই না ? 

দেবায়নঃ এই ইমোশনের কোনও দাম নেই রে রিতম আজকের দিনে। দ্যাখ ওরা একবার বলল তোর কথা ? অথচ সন্তু নিজে তো জানে,তুই থাকলে ওরা আজ হেরে যায় শিওর! লিগের প্রথম ম্যাচেই তোর নিজের হাফ সেঞ্চুরিও মিস হল। 

রিতমঃ ওদের বলার জন্য তো আমি করিনি কিছু!হ্যাঁ,ওরা একবার বললে আমার ভালো লাগতো,সেটা ঠিক,কিন্তু তার থেকে অনেক বেশি দামী আমার কাছে এই ক্রিকেটে থাকা! 

সন্দীপঃ ক্রিকেটে থাকা মানে ? 

রিতমঃ (একটু হেসে)তাহলে একটা গল্প বলি শোন,অনেকদিন আগের একটা আনন্দমেলায় পড়েছিলাম,বিল ভোস,চল্লিশ বছর বয়সী স্কুল মাষ্টার, বডিলাইন সিরিজে লারউডকে আটকানোর জন্য রিটায়ারমেন্ট ভেঙে তাকে নিয়ে এসেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেন।সেই ভদ্রলোক পুরো দুটো সেশন লারউডকে নিজের গায়ে খেলে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন ম্যাচ।রান বোধহয় করেছিলেন দশ কি বারো।আবার দ্যাখ বডিলাইন সিরিজের জন্য লারউডকে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। যদিও পুরো প্ল্যান ছিল ক্যাপ্টেন ডগলাস জার্ডিনের।অথচ পুরো দোষ দেওয়া হয়েছিল লারউডকে।খনি শ্রমিকের ছেলের ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল না কিছুই!তাই তাকে নির্বাসন দেওয়াও সহজ ছিল অনেক।এবার বল আমরা কার জন্য দাঁড়াব ? মার্ক টেলর যখন ৩৩৪ রান করার পর ব্যাট নামিয়ে রাখে,নিজে রেকর্ড না করেও,শুধু ব্র্যাডম্যানকে সম্মানের জন্য,তখন কি সে সত্যিই এক অন্য ক্রিকেটের রেকর্ড তৈরী করে না ? এটাই কি ক্রিকেটে থাকা নয় ?এবং জীবনেও থাকা নয় ? 

দেবায়নঃ তোর সঙ্গে কথা বললেই কীরকম যেন মন ভালো হয়ে যায়! 

অমিতঃ আজকের বিকেলটাও কেমন যেন অদ্ভুত,তাই না ? সুমনের সেই গানটার মতো,মনখারাপ করা বিকেল মানেই মেঘ করেছে!দোল আসছে, স্পষ্ট টের পাচ্ছি যেন। 



সন্দীপঃ আর তার আগের দিনের নাড়াপোড়া ?আরে আমার মামার ছেলে সেদিন এসেছিল,আমাদের ক্লাসেই পড়ে,কলকাতায়,ডন বস্কো স্কুলে,সে জানেই না নাড়াপোড়া কাকে বলে! 

দেবায়নঃ তুই বললি না ? 

সন্দীপঃ বললাম তো!দোলের আগের দিন মাঠের সব আগাছা একজায়গায় জড়ো করে আগুন দিয়ে পোড়ানো। 

অমিতঃ আর তার মধ্যে মাঠ থেকে কাঁচা কলাই ফেলে দিয়ে কলাই পোড়া খাওয়া ? 

রিতমঃ অন্য সবার তো আমাদের মতো গড়নাসিমপুরের মাঠ নেই! 

দেবায়নঃ উচ্চমাধ্যমিকের পর কোথায় সবাই চলে যাব আমরা, তাই না ?আমাদের স্কুলের এই ক্রিকেট লিগ,লাল ইঁটের দেওয়াল,এই দেবদারু গাছ,আমাদের সাইকেল,গড়নাসিমপুরের মাঠ, হিমাদ্রি স্যারের কোচিং...........সব থেকে যাবে।শুধু আমরা আরেকটু বড় হয়ে অন্য এক অচেনা শহরে চলে যাব।এই মফস্বল শহরে তখনও সন্ধে নেমে আসবে ঠিক এমনি করেই,অন্য একদল ছেলে আবার আমাদের মতোই এখানে বসে থাকবে। 

রিতমঃ আর গার্লস স্কুলের রাস্তা ? যেখানে তুই মাঝেমাঝেই সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকিস!সব জানি কাকা! 

দেবায়নঃ (একটু লজ্জা পেয়ে) ধ্যাত!সেদিন আমার চেন পড়ে গেছিল! 

(সবাই হেসে ওঠে) 

রিতমঃ সেই,শুধু মধুরিমা সাইকেল নিয়ে স্কুল থেকে বেরোলেই তোর চেন পড়ে যায় বারবার! 

সন্দীপঃ স্বরস্বতী পুজোর দিন যখন আমাদের স্কুলে ঠাকুর দেখতে এল ওরা দলবেঁধে,তখনই বললাম যা গিয়ে কথা বল! 

দেবায়নঃ আরে স্যাররা সবাই ছিল তো!গৌতম স্যার পিটিয়ে তক্তা করে দিত!আসতিস তোরা বাঁচাতে?সবকটা তো কেটে পড়তিস তখন! 

অমিতঃ স্বরস্বতী পুজোর দিন কেউ কিছুই বলতো না!তাছাড়া মধুরিমা তোকে দেখছিল! 

দেবায়নঃ তুই জানলি কী করে ?!!তারমানে তুই ওকে দেখছিলিস! 

অমিতঃ যা বাবা!আমি কেন দেখব!তোর ভালোর জন্যই বললাম,উল্টে আমার সঙ্গে ঝামেলা করছিস ? 

রিতমঃ শোন,মুখে বলতে না পারিস একটা চিঠি লেখ!বা ওই ম্যাগাজিন,যেখানে তোর লেখা ছাপল এবার সেটা অন্তত পাঠিয়ে দে ওকে। 

দেবায়নঃ হ্যাঁ,তারপর ওর বাবার হাতে পড়ুক আর জন্মের কেস খাই আমি! 

অমিতঃ আচ্ছা পাগল তো!বাড়িতে পাঠাবি নাকি,হিমাদ্রি স্যারের কোচিং থেকে ফেরার পথে হাতে দিবি!সঙ্গে একটা ক্যাসেটে ওই গানটা,যেটা দারুণ গাস তুই। 

দেবায়নঃ কোন গান ?নীলাঞ্জনা ? 

রিতমঃ না না ওটা নয়,হান্ড্রেড মাইলস! 

দেবায়নঃযদি কিছু বলে! 

অমিতঃ তাহলে বসে থাক আর আমড়ার আঁটি চোষ! 

সন্দীপঃ সে সব তো হল,মধুরিমা কিন্তু এবছরও ফার্স্ট হয়েছে,আর আমাদের একমাস পরেই পরীক্ষা!সেদিকে খেয়াল আছে ? আমার অঙ্কে যা অবস্থা,তার ওপর শুনছি দয়াময়বাবু এবার কোশ্চেন সেট করবে! পঞ্চাশ তুলতে না পারলে বাবা জুতো খুলে পেটাবে আমাকে। 

দেবায়নঃ ওরে বাবা,ইংরাজিতে আমার যে কী হবে,কে জানে! 

অমিতঃ কেউ যদি কোনও মন্ত্রবলে রেজাল্ট ভালো করে দিত!যা যা আমাদের সবার ইচ্ছে সব পূরণ হত! 

সন্দীপঃ রিতম শচীনের মতো কভার ড্রাইভ মারতে পারতো!আমি অঙ্কে একশো পেতাম,দেবু প্লেব্যাক সিঙ্গার হতে পারতো,অমিত সারারাত টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ দেখতো...কী ভালো হত না ? 

রিতমঃ তোরা কেউ গড়নাসিমপুরের মাঠের কেসটার কথা শুনেছিস ? 

দেবায়নঃ শুনেছি,কিন্তু বিশ্বাস করিনি! 

সন্দীপঃ আমি কিন্তু শুনেছি,পালপাড়ার সুধীন গেছিল আর তারপর পাঁচশো টাকার লটারি পেয়েছে গত পরশুদিন। 

রিতমঃ লটারি পেয়েছে তোকে কে বলল ? 

সন্দীপঃ আমাদের বাড়ির পাশেই তো থাকে তাপসকাকু,লটারির দোকান আছে,কাকুই বলছিল যে তোদের বন্ধু পাঁচশো টাকা পেয়েছে! আর গড়নাসিমপুরে ও গেছিল সুধীন নিজেই বলেছে আমাকে। 

দেবায়নঃ মাঠে তাঁবুটা আমিও দেখেছি!রঙচঙে তাঁবু! 

রিতমঃ লোকটাকে দেখেছিস কেউ তোরা ? 

সন্দীপঃ সুধীন বলছিল এমনি সাধারণ চেহারা,বেঁটে,একটা হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে থাকে,চোখে কালো চশমা।শুধু হাতে একটা সাপের মুখ বসানো লাঠি থাকে।ওটারই নাকি সব ক্ষমতা। 

দেবায়নঃ আর কি বলে ? কোনও মন্ত্র দেয় ? সুধীনকে জিগ্যেস করিসনি ? 

সন্দীপঃ করেছিলাম।কিন্তু বলল না, বলল,লোকটা কাউকে না বলতে বলেছে।আরও বলেছে,বললে নাকি সব ইচ্ছা নষ্ট হয়ে যাবে।শুধু সুধীন বলছিল,একটা মৃদু ঘন্টাধ্বনি শোনা যাচ্ছিল নাকি,অনেক দূর থেকে...ঘুম চলে আসে সে শব্দ শুনলে। 

রিতমঃ হিপনোটিজম নয় তো ? 

দেবায়নঃ তাহলে লটারির টাকা ? 

রিতমঃ ঝড়ে কাক মরে ফকিরের কদর বাড়ে টাইপ হয়তো ? 

অমিতঃ কী ব্যাপার বল তো ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! কে ম্যাজিশিয়ান,কীসের তাঁবু,খুলে বল তো! 

রিতমঃ গড়নাসিমপুরের মাঠে বুড়ো বটগাছটা যেখানে আছে,তার পাশে চার পাঁচদিন আগে এক ম্যাজিশিয়ান তাঁবু পেতেছে।লাল নীল হলদে বেগুনি কাপড়ের কোলাজ তাঁবুর গায়ে।মাথায় একট হাওয়া মোরগ।বাতাসে খালি ঘুরে চলে।অদ্ভুত সব ম্যাজিক দেখায় লোকটা খালি হাতে,যেমন ধর শূণ্য থেকে হাত ঘুরিয়ে দুহাঁড়ি রাবড়ি এনে দিতে পারে,এমনি জলকে ফুঁ দিয়ে পেস্তাবাদামের শরবত করে দেয়,কোনও যন্ত্র ছাড়া সিনেমা দেখাতে পারে চোখের সামনে,তারপর ধর লেভিটেশন,অদৃশ্য হয়ে যাওয়া...আশ্চর্য সব ম্যাজিক।কোনও যন্ত্রপাতি কিছু নেই,একজন সহকারী আছে,সেও নাকি বোবা! 

দেবায়নঃ আর আসল ব্যাপারটাই তো বললি না! 

অমিতঃ কী আসল ব্যাপার ? 

সন্দীপঃ মানুষের ইচ্ছেপূরণ,তাও সবার নয়,যাদের বয়স চোদ্দ-পনেরো, শুধু তাদেরই!অবশ্য যদি তাকে পছন্দ হয় ম্যাজিশিয়ানের তবেই! 

রিতমঃ এই পছন্দের ব্যাপারটা তো জানতাম না আমি। 

সন্দীপঃ হ্যাঁ,ওটাই হচ্ছে ব্যাপার!কৃষ্ণ গেছিল,ওকে ভাগিয়ে দিয়েছে! 

অমিতঃ কীভাবে করে ইচ্ছেপূরণ ?সত্যি হয় ? 

দেবায়নঃ শুনলি না সুধীনের গল্পটা! 

অমিতঃ আমরা একবার যেতে পারি না ? 

রিতমঃ যেতে তো পারি কিন্তু ম্যাজিশিয়ানের ফি একশো টাকা! 

দেবায়নঃ তাছাড়া গড়নাসিমপুর এখান থেকে প্রায় বারো কিলোমিটার। মানে আপডাউন মিলে চব্বিশ।সাইকেল করে যেতে আসতে ঘন্টা চারেক। বাড়িতে কী বলে যাবি ? 

সন্দীপঃ সে বাড়ি ম্যানেজ হয়ে যাবে,কিন্তু চারশো টাকা জোগাড় করাই তো মুশকিল। 

অমিতঃ হ্যাঁ,অত টাকা পাব কোথায়! 

রিতমঃ আমার কাছে একশো আছে,বাবার কাছ থেকে ব্যাট কিনতে নিয়েছিলাম। তোরা যদি চাস,দিতে পারি... 

দেবায়নঃ আর তোর ব্যাট ? 

রিতমঃ সে হবেখন,আর যদি সত্যি ইচ্ছেপূরণ হয়,তাহলে তো... 

সন্দীপঃ কিন্তু আমাদের তো চারশো লাগবে চারজনের। 

অমিতঃ যদি আমরা দুজন যাই ? 

দেবায়নঃ তাহলেও তো দুশো,আর দুজন যাব বাকি দুজন কী করবে ? তাদের ইচ্ছেপূরণ হবে না ?আশ্চর্য!স্বার্থপরের মতো কথা বলিস না! 

রিতমঃ আমার মনে হয়,ব্যাপারটা খারাপ হবে না দেবু।যদি সন্দীপ আর অমিত যায়...অন্তত ব্যাপারটা কি সেটা বোঝা যাবে।এইটুকু আমরা করতেই পারি 

দেবায়নঃ আমার কাছে অবশ্য একশো আছে,জীবনানন্দ সমগ্র কিনব বলে ঠাকুমা দিয়েছে। 

সন্দীপঃ তোরা ভাবলি কী করে,তোদের এই প্রস্তাবে আমি রাজি হব ? যেতে হলে তোরা কেউ যা।আমি এটা করতে পারব না! 

রিতমঃ আরে বেশি সেন্টি হোস না!যা বলছি শোন!এটা একটা এক্সপিরিমেন্ট।সবাই যাব একসঙ্গে।শুধু তোরা দুজন ভেতরে যাবি।কিছু বেগড়বাই দেখলেই ডাকবি।আমার মনে হয় কিছু দুনম্বরি ব্যাপার আছে! ব্যাটাকে হাতেনাতে ধরব। 

দেবায়নঃ তাহলে কাল সকাল সকাল যাই নাকি ? কিন্তু বাড়িতে কী বলব ? 

সন্দীপঃ বাড়িতে বলব কয়ামতপুরে ম্যাচ আছে সারাদিন! 

অমিতঃ এটা বেস্ট। 

দেবায়নঃ তাহলে কাল সকাল সাতটা,এখানেই মিট করি ? 

রিতমঃ না এখানে নয়,হাইরোডের ধারে মিট করব।এখান থেকে কেউ দেখে ফেলতে পারে। 

অমিতঃ ওকে। চল এবার উঠি। 

(আস্তে আস্তে ওরা চারজন সাইকেল নিয়ে বাড়ির পথ ধরে। ততক্ষণে সন্ধে নেমে এসেছে চারপাশে) 

প্রথম অঙ্ক সমাপ্ত 


বিরতি 


দ্বিতীয় অঙ্ক 

গড়নাসিমপুরের মাঠে বয়ে যাচ্ছে তখন ফাল্গুনের বাতাস।দুএকটা কোকিল ডাকছে।আমের মুকুলের গন্ধ চরাচর জুড়ে।ঠিক ততটাই রোদ্দুর উঠেছে যতটা উঠলে হাল্কা কুয়াশা মুছে জেগে ওঠে দৃশ্যময় জগত।খাঁ খাঁ মাঠে একটাও জনমনিষ্যি নেই।অনেকদূরে একপাল গোরু চড়ছে।বুড়ো প্রকাণ্ড বটগাছের নীচে ম্যাজিশিয়ানের তাঁবুও অদৃশ্য।ভারী অলস এক সকাল।লোকে বলে গড়নাসিমপুরের মাঠে নাকি এভাবেই সময় থমকে থাকে।ওরা চারজন সাইকেল নিয়ে বটগাছের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। 

দেবায়নঃ আরও মাইলখানেক মনে হচ্ছে! 

রিতমঃ সময় কীরকম যেন থমকে আছে,তাই না ? 

দেবায়নঃ গড়নাসিমপুরের মাঠে এমনই হয়।ভর দুপুরে নাকি হটাত লকলক করে ওঠে নীল আগুনের শিখা!বেভুল মানুষ দিশা হারিয়ে ফেলে এই দৃশ্যমান জগতের। 

সন্দীপঃ আচ্ছা এই মাঠের নাম গড়নাসিমপুর হল কেন ? 

রিতমঃ দাদুর কাছে শুনেছি,বহু বছর আগে নাসিম আলি নামে এক সুলতান এখানেই তৈরী করেছিল তার গড়।এখনও নাকি মাঠের পশ্চিমে সে গড়ের কিছু অংশ চোখে পড়ে। 

অমিতঃ তারপর ? সে গড় ধ্বংস হয়ে গেল ? 

রিতমঃ ঠিক জানা যায় না,লোকে বলে নাসিম আলি নাকি ভোরবেলা মরে পড়েছিল ওই বুড়ো বটগাছ যেখানে আছে,ঠিক সেখানেই।গড় ছেড়ে রাতারাতি সবাই পালায়।তারপর থেকে এই মাঠে কোনও ফসলও হয় না।দ্যাখ কেমন অনাবাদী হয়ে আছে বছরের পর বছর। 

দেবায়নঃ যতবার আসি এখানে ততবারই মনে হয় কিছু একটা যেন ডাকছে আমাকে।কোনও জ্যান্ত কিছু।ঠিক বোঝাতে পারব না কিন্তু মনে হয় আমার। 

রিতমঃ কিংবদন্তীর মাঠে এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। 

সন্দীপঃ (হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে) আরে ওই তো বটগাছ,কোনও তাঁবু তো নেই! কিছুই তো চোখে পড়ছে না! 

অমিতঃ তাই তো!কোথায় গেল ম্যাজিশিয়ানের তাঁবু ? 

রিতমঃ আশ্চর্য! 

দেবায়নঃ কালও তো ছিল এখানেই,রাতারাতি চলে গেল লোকটা তাঁবু গুটিয়ে ! 

দ্রুত সাইকেল চালিয়ে বটগাছের কাছে আসে।সাইকেল স্ট্যান্ডে রেখে চারজনে মাঠের ওপর বটগাছের নীচে বসে। 

অমিতঃ এবার তাহলে ? 

দেবায়নঃ সেটাই ভাবছি,এত কষ্ট করে এসে...শেষ অবধি ফিরে যেতে হবে আবার। 

রিতমঃ (হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে, কিছুটা উত্তেজিত)শুনতে পাচ্ছিস তোরা? 

সন্দীপঃ কী রে ? 

রিতমঃ শোন ভালো করে। 

(খুব মৃদু একটা ঘন্টার শব্দ।হিসহিসে।অনেকটা শিসের শব্দের মতো শোনা যায়) 

(সবাই চুপ করে যায়।মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করে) 

দেবায়নঃ কীরকম একটা নেশার মতো,তাই না ? 

রিতমঃ হ্যাঁ,খুব মেলাঙ্কোলিক। 

অমিতঃ কেমন যেন হাহাকার ভরা।বুকের ভেতর থেকে কে যেন গুমরে গুমরে কাঁদছে। 

সন্দীপঃ কেউ,কতদিনের পুরোনো কেউ যেন ডাকছে। 

রিতমঃ(আবার উঠে দাঁড়িয়ে)চুপ!ওই দ্যাখ! 

(বাকি তিনজন উঠে দাঁড়ায়।দৃষ্টিতে বিস্ময়) 

একটা বেঁটে লোক,নীল রঙের হাফপ্যান্ট,সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি,হাতে একটা লম্বা বাঁশের লাঠি।লাঠির মাথায় একটা সাপের মুখ।ওদের দিকে এগিয়ে আসছে। 

ম্যাজিশিয়নঃ (খুব মিহি গলা)বাবারা তোমরা কাউকে খুঁজছো? 

(সবাই হতভম্ব।এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে) 

ম্যাজিশিয়নঃ বলো বাবারা!কোনও ভয় নেই!আমি তো আছি! 

রিতমঃ আপ...আপ...আপনি কে ? 

ম্যাজিশিয়নঃ আমি ? হা হা হা হা, আমি এখানেই থাকি। এই গাছপালা, অই যে দিকচক্রবালরেখা,অই যে আকাশ,এই যে হিসহিসে ঘন্টার শব্দ...আমি সবখানে ছড়িয়ে থাকি।লোকে বলে আমি নাকি পাহারাদার! 

দেবায়নঃ পাহারাদার ? কী পাহারা দেন আপনি ? 

ম্যাজিশিয়নঃ যা কিছু মানুষ ধ্বংস করে,আমি সব পাহারা দি! 

সন্দীপঃ আপনিই কি সেই ম্যাজিশিয়ান ?যাদুগর ? 

ম্যাজিশিয়নঃ আমি তো কোনও যাদু জানি না বাবারা!আমি শুধু সব দেখি,যে যেখানে যেভাবে ভালো থাকে,তাকে সেখানেই দেখি।আমি ধুলোর মতো মিশে থাকি,বাতাসে ভাসিয়ে দি আমার স্বর,আকাশে চোখ রেখে দেখি আলো আর মেঘের খেলা,রাতের বেলা তারার আলো কুড়িয়ে মানুষের ঘরে পৌঁছে দি...আমি তো কোনও যাদু জানি না বাবারা! 

অমিতঃ আপনি এখানেই থাকেন ? 

ম্যাজিশিয়নঃ আমি যতদিন যেখানে দরকার ঠিক ততদিনই থাকি বাবারা!আমার তো কোনও ঘর নেই।তোমাদের থেকেও ছোট বয়েসে ঘর ছেড়েছিলাম,তারপর এই দেখাশোনার কাজ করি বাবুর বাড়ির। 

রিতমঃ আপনার বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে না ? 

ম্যাজিশিয়নঃ করে তো বাবা!(গলার স্বরে কান্না)খুব করে!কিন্তু কী করব বলো!বাবুর বাড়ির কাজ শেষ না করে যে আমার ফেরার উপায় নেই! 

সন্দীপঃ কে আপনার বাবু ? 

ম্যাজিশিয়নঃ(একটু হেসে)ও কথা থাক বাবারা,সেই কতদূর থেকে সাইকেল চালিয়ে এসেছো তোমরা,বলো,কী বলবে তোমরা ? 

দেবায়নঃ আপনি কী করে জানলেন ? 

ম্যাজিশিয়নঃ আমি জানতে পারি বাবা!আমি কিছু খুঁজি না তো,আমি পেয়ে গেছি,তাই জানতেও পারি। 

রিতমঃ সত্যি করে বলুন তো,আপনি কে ?আপনার তাঁবু গেল কোথায় ? 

ম্যাজিশিয়নঃ আমার তাঁবু? তার দরকার ফুরিয়েছে যে!কোন দুজন আসতে চাও আমার কাছে ? 

(চারজন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে) 

ম্যাজিশিয়নঃ (রিতমের দিকে আঙুল তুলে) তুমি এসো। তার আগে ওই বটপাতা,দুটো বটফুল,একটু মাটি আর তোমার ব্যাগে যে জলের বোতল আছে সেখান থেকে একটু জল আমার হাতে দাও। 

(রিতম তাই করে।ম্যাজিশিয়ন দুহাত কড়জোরে হাঁটু মুড়ে বসে) 

ম্যাজিশিয়নঃ (দেওয়ার পর)আহ!কী আরাম বাবা!আমি তোমার দান গ্রহণ করলাম।আমার বুক ভরে গেল।আলো হয়ে গেল আমার মন।আশীর্বাদ করি তোমায়। বল তোমার কি ইচ্ছে ? 

রিতমঃ আমার এত কষ্ট হচ্ছে কেন আপনার কথা শুনে? 

ম্যাজিশিয়নঃ মানুষ যে বড় কষ্টে আছে বাবা! তাই তুমি কাঁদছো!তোমার মন যে বড় নরম বাবা! এসো আমি তোমাকে স্বপ্ন দি।এমন এক পৃথিবী, এমন এক দুনিয়া যেখানে সবাই বেঁচে উঠবে আনন্দে।এই হোক তোমার ইচ্ছে। আর এই নাও আমার লাঠি, যখন সমুদ্রে তুফান আসবে, নড়বড় করবে তোমার নৌকা,কান্না আসবে বুকে, তখন এই সাপের চোখ তোমাকে পথ দেখাবে। 

রিতমঃ সত্যি দেখাবে ? 

ম্যাজিশিয়নঃ যদি তুমি বিশ্বাস করো,তাহলে দেখাবে বৈকি বাবা!বিশ্বাস রেখো নিজের বুকে। বিশ্বাসে থেকো তোমরা সবাই।ভালবাসায় থেকো।...আমি আসি বাবা এবার... 

দেবায়নঃ আর দেখা হবে না কোনওদিন ? 

ম্যাজিশিয়নঃ নিশ্চয় হবে! আবার যখন যেবার তোমাদের বয়স চোদ্দ বছর পেরিয়ে পনেরো হবে...আমি আবার আসব। 

(আস্তে আস্তে ম্যাজিশিয়ন চলে যায় হেঁটে হেঁটে। ওরা চারজন দাঁড়িয়ে থাকে। দূর থেকে শোনা যায় একটা গান) 

If you missed the train I'm on
You will know that I am gone
You can hear the whistle blow a hundred miles 

A hundred miles, a hundred miles,
A hundred miles, a hundred miles
You can hear the whistle blow a hundred miles 

Lord, I'm one, Lord, I'm two,
Lord, I'm three, Lord, I'm four
Lord, I'm five hundred miles away from home 

Away from home, away from home,
Away from home, away from home
Lord, I'm five hundred miles away from home 

Not a shirt on my back
Not a penny to my name
Lord, I can't go back home this ole way 

This ole way, this ole way,
This ole way, this ole way,
Lord, I can't go back home this this ole way 

If you missed the train I'm on
You will know that I am gone
You can hear the whistle blow a hundred miles 

A hundred miles, a hundred miles,
A hundred miles, a hundred miles,
You can hear the whistle blow a hundred miles
You can hear the whistle blow a hundred miles
You can hear the whistle blow a hundred miles 

সমাপ্ত
0

নাটক - প্রকল্প ভট্টাচার্য

Posted in


নাটক 


ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ
প্রকল্প ভট্টাচার্য


(একটা ক্লাবঘর। চেয়ার টেবিল গোছাচ্ছে একজন মাঝবয়েসী লোক।)
 
দিলীপ : উফ, আর পারিনা। এই পুজোর আগে যেন দম ফেলতে দেয় না কেউ। খালি মিটিন আর মিটিন! কী যে ছাতার এতো মিটিন হয়, তা কে জানে! খেটে মরতে হয় আমাকে। এই চেয়ার টেবিল গোছাও, ঝাঁটপাট দাও, শুরু হলে মুড়ি তেলেভাজা চায়ের যোগান দাও, আবার শেষে সব গুছিয়ে তোলো... কিছু গণ্ডগোল হলেই দিলীপদা আজ তোমার কী হয়েছে বলতো? 

(উদয়ের প্রবেশ) 

উদয়: দিলীপদা আজ তোমার কী হয়েছে বলতো? 

দিলীপ: ওই শুরু হলো। কিছু না, উদয়ভাই, নিজের মনেই কথা বলছি। 

উদয়: সে তো শুনলাম! তোমায় নাকি খেটে মরতে হচ্ছে। তা মিটিং হলে চা তেলেভাজার ভাগ তো তুমিও পাও, আর এই পুজোর আগেই যা আমাদের বেগড়বাঁই ক্লাবের কাজকম্মো হয়। বাকি দিনগুলো তো তুমি নাক ডাকিয়ে ঘুমোও ! তাতেও যদি এতো অসুবিধে তোমার, তাহলে তুমি ছেড়ে দাও, আমরা বরং অন্য লোক.. 

দিলীপ: আরে, কী মুশকিল.. নিজের মনে দুটো কথা বললেও দোষ! এই যে এতো লোক মনের কথা না বলতে পেরে ফেসফুস, হোসপাইপ সব করে... 

উদয়: আঃ, ঠিক করে বলো, ফেসবুক , হোয়াটস্যাপ।

দিলীপ: ওই হলো। তা আমার তো সে সব বালাই নেই, তাই একা ঘরে দুটো কথা কই নিজের সাথেই...

উদয়: ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি কাজ সারো, সবাই আসছে। (দিলীপ ভিতরে চলে যায়) এত দেরি করছে কেন বাকিরা, দেখি ফোন করে...

(মলয়ের প্রবেশ) 

মলয়: এই তো, আমি ডট অন টাইম! 

উদয়: এই তোমার টাইম! পনেরো মিনিট লেট্ করে এসে... 

মলয়: তো কী হয়েছে, বাকিরা তো কেউ আসেনি! 

উদয়: এই কথাটাই সবাই ভাবলেই হয়েছে আর কি. কবে যে সবাই একটু অর্গানাইজড হবে..

মলয়: উদয়দা, তুমি বড্ডো স্ট্রিক্ট। বাঙালিদের কাছে ক্লাব হলো একটু রিলাক্স করবার জায়গা, সেখানেও যদি ঘড়ি ধরে..

(তরুণের প্রবেশ) 

তরুণ: এসে গেছি! ঘড়ি ধরে সময়মতো!

উদয়: তোমার ওই ঘড়ি ফেলে দাও। আধঘন্টা লেট্ করেছো, আর বলছি সময়মতো! 

তরুণ: মাত্র আধঘন্টা আবার লেট্ হয় নাকি! তুমি না, ওই ইউ-এস এ গিয়েই নিজের বাঙালিয়ানা খুইয়ে বসেছ। বাঙালির সময়জ্ঞান খুব টনটনে। সাতটা বললে আটটা হতে পারে, কিন্তু ন'টা কখনোই নয়. কি বলিস, মলয়? 

মলয়: এই ঠিক এই কথাটাই তো আমিও.. 

উদয়: আচ্ছা হয়েছে হয়েছে। বাকিরা আসছে আশা করি, আমাদের কাজের আলোচনা সেরে ফেলি। পুজো তো এসেই গেলো, আমি গত ছ'মাস দেশে ছিলাম না বলে এই বার একদম সময় দিতে পারিনি। কিন্তু পুজোর আগে ঠিক ছুটে এসেছি। 

মলয়: আরে উদয়দা, তুমি হলে আমাদের বেগড়বাঁই ক্লাবের ইয়ে, যাকে বলে প্রাণপুরুষ। তোমায় ছাড়া কি চলবে? 

তরুণ: তবে চিন্তা কোরো না, আমরা সব কাজ সেরে রেখেছি। (কান্তির প্রবেশ) 

কান্তি: হ্যা দাদা, সারা কাম বিগড়কে রাখা। 

মলয়: ওহ, এই এসেছে ব্যাটা হিন্দীওলা, যত ভুলভাল হিন্দি বলবে! 

কান্তি: ভুলভাল? কান্তি কভি কোই ভুলভাল নহি বোলতা। যো বোলতা, সচ বোলতা !
উদয়: আচ্ছা বাবা ভীমরুল আর বোলতা, ভ্যানভ্যান না করে উত্তরগুলো দাও। পুজোর ফুল, ফল, আর দশকর্ম কেনা হয়েছে? 

কান্তি- সবকুছ কিন্ লিয়া। 

উদয়: বেশ কিয়া। পুরোহিত তৈরী? 

মলয়: তৈরী, তবে আরো দু'জায়গায় উনি পুজো করবেন, তাই... 

উদয়: আমাদের ক্লাবে যেন ঠিক সময়ে পুজোটা হয়, তোর দায়িত্ব. নয়তো তোকেই আরতি করতে হবে বলে দিচ্ছি! 

মলয়: আমি! এই রে... আচ্ছা দাদা, এই বাজারে পুরো ফ্রি পুরোহিত কোথায় পাবো বলো...

উদয়: বাজে কথা। বল, প্রণামীটা শেয়ার করলে তোদের কমিশন কিছু থাকে। এই তো? 

মলয়: হে হে দাদা, কী যে বলো না! 

তরুণ: দাদা, আমার দায়িত্বে ছিল প্যান্ডেল আর ডেকোরেশন. সব প্ল্যান তৈরী। ফ্রেমওয়ার্ক শুরু হয়েও গেছে। 

উদয়: গুড, এই একটা পসিটিভ রেস্পন্স. তাহলে প্রতিমা এলেই... হ্যাঁ, প্রতিমা আনতে কে যাচ্ছে? 

মলয়: প্রতিমা! 

তরুণ: প্রতিমা! 

কান্তি: পরতিমা ! 

উদয়: হ্যা প্রতিমা! পুজো করব, তার প্রতিমা লাগবে না! কী হলো, প্রতিমা জোগাড় হয়নি নাকি! আজ বাদে কাল পুজো, আর তোরা কেউ প্রতিমা অর্ডার দিস্নি! (আলো নিভে যায় ) 

*****************

(আলো জ্বলে, একই ঘরে আগের পাঁচজন বসে) 
মলয়: উদয়দা, কোথাও প্রতিমা পাওয়া গেলো না.. অনেক খুঁজেছি..

উদয়: তোরা জানিস তোরা কোন লেভেলের বুদ্ধুমিটা করেছিস? এত করে বলি অর্গানাইজড হ... নাঃ, উপায় নেই, এবার পুজো ক্যানসেল। 

তরুণ: সেকি ক্যানসেল কেন! অরে একটা উপায় ঠিক বেরিয়ে আসবে। 

উদয়: কখন, বাবা তরুণ? ক্রিসমাসের সময়? 

দিলীপ: আমি বলি কি, মায়ের ফটো এনে..

উদয়: সে আমিও ভেবেছি, কিন্তু নাঃ, রাস্তার উল্টোদিকে ধরপাকড় ক্লাব নাকি ডিস্ক ঠাকুর বানাচ্ছে, ওদের সামনে ফটো পুজো করলে প্রেস্টিজ একেবারে ফুসস 

মলয়: তাছাড়া, ফটোতে কি সেই ফিলিংটা আসে! 

দিলীপ: ফিলিং না কিলিং তা জানিনা, তবে তুমি যে কাগজে ঐশ্বর্যা রাইয়ের ফটো দেখলেই লুকিয়ে চুমু খাও, সে আমি জানি. তাই বললাম আর কি! 

মলয়: এই নিয়ে, এগুলো ঠিক নয়, পার্সোনাল ব্যাপার নিয়ে.. 

কান্তি- এক মিনিট, হামারে মাথামে এক আইডিয়া আয়া। 

তরুণ: থাক বাবা, তোমার আইডিয়া তুমিই রাখো। 

কান্তি- আরে একবার বলতে তো দেগা, নাকি! সবলোগ শুধুশুধু চিন্তা করনেসে ক্যা হোগা? প্রবলেম জব আয়া, তো সল্যুশন ভি তো চাহিয়ে, নাকি! 

উদয়: ওরে, যা বলবি তাড়াতাড়ি বল, কিন্তু প্লিজ হিন্দি বলিস না! 
কান্তি- ইসবার হম এক স্পেশাল থিম বানায়েগা। লাইভ ঠাকুর! ট্যান-ট্যান-ট্যান!! 

মলয়: লাইভ ঠাকুর! তার মানে?

তরুণ: মানে? এক একজন দুর্গা অসুর সব সেজে দাঁড়িয়ে থাকবো? 

দিলীপ: কান্তিদার মাথাটা একেবারে গেছে। একি থ্যাটারের স্টেজ নাকি! 

উদয়: দাঁড়াও দাঁড়াও, একটু ভাবতে দাও.. কান্তি, আর একটু ডিটেইলে বল তো! 

কান্তি- সিম্পল। ক্লাবকা লেডিজলোগোকো দুর্গা লক্ষী সরস্বতী সাজাকর দাঁড় করায়া দেগা, আর হম বাকি কার্তিক গণেশ বনবো ! 

মলয়: সারাদিন তারা সেজে দাড়িয়ে থাকবে? 

তরুণ: তা পারবে. সারাদিন সেজে ঠাকুর দেখতে পারে যখন... 

কান্তি- কিউ সারাদিন? পুজোমে কেউ কি সারাদিন ঠাকুর দেখতা হ্যায়? সকালে এক ঘন্টা, সন্ধেয় দু ঘন্টা, বাস! 

দিলীপ: কী উদ্ভট আইডিয়া রে বাবা! বাপের জন্মে শুনিনি! 

উদয়: সে তো আমিও বাপের জন্মে শুনিনি কোনও ক্লাবের এতগুলো মেম্বার দুর্গাপুজো করবার আগের দিন দেখলো প্রতিমা কেনা হয়নি! কিন্তু যা বুঝছি, এই একটাই রাস্তা খোলা, নইলে এবার পুজো ক্যানসেল করে ওই ধরপাকড় ক্লাবের খোরাক হতে হবে! 

মলয়: কিন্তু দাদা, যদি বেগড়বাঁই কিছু হয়? 

উদয়: আর কী হবে, ক্লাবের নামটাই তো বেগড়বাঁই! না, এবার চটপট ঠিক করে ফেল তো কে কোনটা সাজবে! 

কান্তি- ইয়েস! ফির অডিশন শুরু! 

মলয়: জয়গুরু জয়গুরু! 

*****************

 (আলো নিভে যায়, আবার জ্বলে যখন, ঘরে অডিশন চলছে।)
উদয়- তাহলে এখনো অবধি কী ঠিক হলো... 

মলয়: ওই তো, ষষ্ঠীর দিন লুচি তরকারি, সপ্তমীতে খিচুড়ি, মহাষ্টমীতে ... 

তরুণ: অরে ধুৎ আমরা মরছি ঠাকুরের চিন্তায়, যিনি বসে বসে মেনুকার্ড বানাচ্ছেন! 

মলয়: তো কী করব, আমার দ্বারা তো ঠাকুর সাজা সম্ভব নয়! 

কান্তি- কিঁউ নেহি! তুম হাথমে লাড্ডু লেকর গণপতি বাপ্পা সাজেগা! 

উদয়: নট এ ব্যাড আইডিয়া! মলয়, গনেশ সাজবে। 

মলয়: ব্যাটা কান্তি, আমি গণেশ? তুই কি তাহলে কাত্তিকঠাকুর? 

কান্তি: না না কাত্তিক ইস নাও আউট অফ ফ্যাশন। নায়ক নহি, খলনায়ক হুঁ ম্যায়। মহিষাসুর সাজেগা! বু-হু-হা-হা-হা-হা! 

দিলীপ: আরে না না, শ্যামলকে অসুর সাজাও, রোজ জিম এ যায়। হেব্বি মাসকুল! 

উদয়: হ্যাঁ শ্যামলই ঠিক হবে, অন্তত: মুখটা বন্ধ রাখবে। 

কান্তি: আই অবজেক্ট! এই লাইভ ঠাকুর কা আইডিয়া ভি মেরা হ্যায়, আর এখন মুঝে হি সাইডলাইন! ম্যায় কেয়া বান কা প্যানিমে ভাসকে আয়া? 

তরুণ: আরে রাগিস কেন, কাত্তিক সাজবি না তুই? 

কান্তি: কভি নেহি! 

মলয়: আচ্ছা, তুই জিভ বার করতে পারিস? বড় করে? 

কান্তি: অফ কোর্স! অয়ায়ায়ায়ায়ায়া ... 

মলয়: এই তো, হয়ে গেছে! তুই বরং অসুরের তলায় মোষ সাজবি. আরে, অরিজিনাল মহিষাসুর! শেষে জিভ বার করে নেগেটিভ হিরো! 

কান্তি: আই প্রোটেস্ট! দিস ইস ইনসাল্ট! ম্যায় নহি রহুঙ্গা ক্লাব মে, গুড বাই! (প্রস্থান) 

তরুণ: কেন ফালতু রাগালি ছেলেটাকে! 

মলয়: ফালতু! ব্যাটা আমাকে গণেশ বানালো, তার বেলা? 

উদয়: আচ্ছা হয়েছে, আমাদের আর সময় নেই। দুর্গা কে হবে? বীথিকাদি রাজী হয়েছেন? 

তরুণ: হয়ে যাবেন। ওনার স্বামী অনেক চাঁদা দেন, উনিই এবার আমাদের দুর্গতিনাশিনী। 

উদয়: আর কাত্তিক? দিলীপদা? 

দিলীপ: আমি! কাত্তিক! 

মলয়: হয়ে যাও দাদা! ক্লাবের জন্যে এত কিছু করলে, তার একটা সম্মান হিসেবেই...

তরুণ : হ্যাঁ এতদিন ঝাঁটা হাতে আমাদের পাশে দাঁড়াতে, এবার ধনুক হাতে দাঁড়াও! 

দিলীপ: কিন্তু আমি... 

উদয়: কোনো কিন্তু নয়, তুমিই কাত্তিক, মলয় গণেশ। বীথিকাদি দুর্গা , শ্যামল অসুর। ব্যাস এবার লক্ষ্মী আর সরস্বতী হলেই... 

মলয়: নিয়ে, বলছিলাম কি... মানে ..

উদয়: কী হলো? 

মলয়: ভয়ে বলব না নির্ভয়ে বলব? 

উদয়: এতে ভয়ের কী আছে! বলেই ফ্যাল না! 

মলয়: ওই রোলদুটোর জন্যে রুমকি আর ঝুমকি... মানে, তোমার আপত্তি না থাকলে..

উদয়: এই না, আবার ঝুমকি কে এইসবের মধ্যে কেন... 

তরুণ: মলয় কিন্তু খারাপ বলেনি! দুই বোনকে দেখতে খুবই সুন্দর, আর ঝুমকিকে তানপুরা হাতে একদম মা সরস্বতী লাগবে!

উদয়: ধুর, তোরা না, একবারে... 

দিলীপ: আরে দাদা লজ্জা পাও কেন! তুমি একবার বললে ওরা রাজীও হয়ে যাবে। 

মলয়: আরো একটা সুবিধা আছে। তুমি সারা পুজোটা একসঙ্গে... মানে, নিজের ক্লাবেই, আর নিজের লোকেদের সঙ্গে... 

উদয়: বলছিস? তাহলে ঠিক আছে, এত করে বলছিস যখন... 

তরুণ: এই তো! থ্রি চিয়ার্স ফর বেগড়বাঁই ক্লাব, হিপ হিপ 

সকলে: হুরররে! (আলো নিভে যায় )

***************

(পুজো প্যান্ডেল, সবাই ঠাকুর সেজে দাঁড়িয়ে ) 

উদয়: বা:, এই তো, দিব্যি মানিয়েছে সবাইকে! লাইভ ঠাকুর এবার পুজোয় হিট করে যাবে!

তরুণ: হ্যাঁ, কিন্তু পুরুতমশাই এখন এলে হয়... 

উদয়: সেকি, পুরুতমশাই আসেননি! কে যেন দায়িত্বে ছিল?

তরুণ: ওই যে মলয়, এখন গণেশঠাকুর সেজে মাথা নাড়ছে আর লাড্ডু খাচ্ছে! 

উদয়: সর্বনাশ! দিলীপদা কী হবে! 

দিলীপ: আমি কী করব, আমি তো এখন কাত্তিকঠাকুর! পই পই করে বললুম.. 

উদয়: ওহ, তাও তো বটে, সকলেই এখন এক এক দেবতা.. তাহলে বাকী রইলি তুই, যা বোস আসনে... 

তরুণ: আমি! পুজো! মাইরি বলছি, আমি কিছু মন্ত্র জানিনা! 

উদয়: উপায় নেই, তোকেই বসতে হবে! লোকজন আসতে শুরু করেছে, সব প্যান্ডেলে পুষ্পাঞ্জলি শুরু হয়ে গেছে। এই নে ধুতি, লুঙ্গি করেই পরে বোস না হয়। 

তরুণ: আমি সত্যি বলছি পুজোর কিচ্ছু জানি না.. 

উদয়: আরে অভিনয় করতে পারবি না! এত বছর পুজো দেখছিস কিছু মন্ত্র তো জানবি! রূপং দেহি জয়ং দেহি.. 

তরুণ: হ্যাঁ, ঐটা কিছুটা... 

উদয়: ব্যস ব্যস তাতেই হবে, আগে বোস তুই, লোক আসছে এবার, আমি সামলাই... (পিসিমা ও কান্তির প্রবেশ) 

উদয়: উফ কান্তি এসেছিস? বাঁচালি ভাই! একি পিসিমা তুমি! 

পিসিমা: এই কান্তিই তো আমাকে নে এলো! বলল তোদের কেলাবে নাকি ইস্পেশাল ঠাকুর...

উদয়: হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিকই তো! পুরোহিত, একটু জোরে মন্ত্র পড়ুন! 

তরুণ: রূপং দেহি, জয়ং দেহি, যশও দেহি, দ্বিষো জয়ী! অশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোক মঞ্জিরা! হিমালয় দিলেন সিংহ, বিষ্ণু দিলেন চক্র, মহামায়া, মহাশক্তি, বাজলো তোমার আলোর বেনু...

পিসিমা: ও আবার কেমন মন্তর! 

উদয়: আরে পিসিমা, তুমি কি এখনও সেই পুরোনো দিনে পড়ে থাকবে! এটা হলো রিমিক্স মন্ত্র! চালিয়ে যান, পুরোহিত! আর দেবতারা, আপনার দয়া করে হাসবেন না, নড়ে গেলে বিপদ...

পিসিমা: কী যে কস... আহা সরস্বতীঠাকুরটা বড়ো সুন্দর... এই উদয়, এদিকে আয় তো!

উদয়: এইরে আবার কী হলো? 
পিসিমা: কী সব ছাইপাঁশ ডিগ্রি পেয়েছিস, ঠিকঠাক পড়াশোনা তো আর করলি না, এইবার সরস্বতীর পায়ে প্রণাম করে বর চা দিকি! 

উদয়: মানে! পায়ে! 

পিসিমা: হ্যাঁ ঠাকুরের পায়ে হাত দিয়ে বল, আমাকে বিদ্যা দাও.. 

তরুণ: যা দেবী সর্বভূতেষু বিদ্যারূপেণ সংস্থিতা... নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ! 

কান্তি: ঠিক কহি হ্যায় আপ পিসিমা! দেবী কি পা পকরনেসে বিদ্যা জরুর মিলেগা! 

উদয়: হতভাগা, তাহলে এইসব তোমার প্ল্যান! 

কান্তি: নায়ক নেহি, খলনায়ক হু ম্যায়! 

তরুণ: জয় জয় দেবী চরাচর সারে. ওহ সরি .. রূপং দেহি, জয়ং দেহি... বন্দেমাতরম, সুজলাং সুফলাং... 

উদয়: পিসিমা... 

পিসিমা: কোনো কতা নয়, তুই এদিকে এসে সরস্বতীর পায়ে হাত দিয়ে বর চাইবি কি না... (উদয়কে টেনে সরস্বতীর কাছে আনতেই সরস্বতী লাফিয়ে টুল থেকে নেমে পালিয়ে যায়) 

পিসিমা: একি একি! 

তরুণ: ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ ঠাকুর যাবে বিসর্জন... 

(হুলুস্থুলু বেঁধে যায়, তার মধ্যে কান্তি এগিয়ে আসে) 

কান্তি: আমাদের বেগড়বাঁই ক্লাবের পুজো, এবং এই নাটিকা এখানেই শেষ হলো। আপনাদের সকলকে জানাই শারদীয়ার প্রীতি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। আর হ্যাঁ, যদি মায়ের পুজো করতে চান, এইভাবে চালাকি করে নয়, নিষ্ঠাভরে, ভক্তিভরে পুজো করবেন। চালাকির দ্বারা, জানেনই তো, কোনও মহৎ কর্ম হয় না! নমস্কার!