Next
Previous
Showing posts with label প্রেমের গল্প. Show all posts
4

প্রেমের গল্প - অনিন্দ্য রাউৎ

Posted in


প্রেমের গল্প


পরিযায়ী
অনিন্দ্য রাউৎ




নিজের ব্যাপারে কিছু জিনিস আমার বরাবর অসহ্য লেগে এসেছে, আর এখনো সেই অনুভূতিটাই হচ্ছে। আমি নাকি এখন দীপের সাইকেলের পেছনে বসে আছি। অথচ এসময় আমার থাকার কথা ছিল ম্যাটাডোরের পেছনে। আজ মহালয়া। আজই আমাদের পাড়ায় তুমুল হইহুল্লোড়ের সঙ্গে মা দূর্গাকে প্যান্ডেলে আনা হয়। আর আমি পাড়ার পুজো কমিটির জুনিয়র সেক্রেটারি শ্রী আয়ান সেনগুপ্ত থাকছি না, কারণ? কারণ দীপ তোর্সাকে ভালোবাসে। 
গুলিয়ে গেল? তা একটু গোলানোই থাক। এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারছি না। ভীষণ রাগে মাথা দপদপ করছে। শুধু এটা জানি কুখ্যাত 'বেড়ে বিটলে' র কাছে আমরা যাচ্ছি। দীপ রাস্তায় সাইকেল চালাতে চালাতে হঠাৎ থামিয়ে বললো, "নাম"।
আমি নামলাম। কোথায় ওদের ডেরা? সাইকেলটা স্ট্যান্ড করিয়ে দীপ আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে বললো, " চল ভেতরে। "
ভেতর? ভেতরটা ঠিক কোথায় বুঝলাম না। চওড়া ফুটপাথের ওপর বসার জায়গা, দুদিক থেকে অস্থায়ী বেড়া লাগানো, মানে রাস্তা দিয়ে গেলেও বসার জায়গা দেখা যায়, ওপেন স্পেস, তার আবার ভিতর আর বাহির!
দেখি বেড়ে বিটলে বসে আছে আরও দু তিনজনের মাঝে। দীপ এগিয়ে গেল। 
"বেড়ে দা, এই যে ছবি। এই ছেলেটা, একেই ..."




" ... একেই স্কুলের বাইরে বিকেল ৪টের সময় পেয়ে যাবে। ধুয়ে দিও জাস্ট। "
বেড়ে বিটলে রাহুলের কোনো কথাই যেন শুনতে পায়নি। সেই শুরু থেকে কেমন একভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি বুঝেছি কোথায় গন্ডগোলটা। কিন্তু চুপ থাকলাম।
রাহুল এবার নিজের হাতটা মুঠো করে চোয়াল শক্ত করে বললো, "বেড়ে দা, এটা তোমায় পারতেই হবে।"
বেড়ে বিটলে রাহুলের কাঁধে হাত রেখে ওকে ফুটপাথের কিনারায় এনে মুখ থেকে 'পুচ' করে পানের পিকটা ড্রেনের জলে ফেলে বললো, "হুঁ, হুঁ, হবে হবে। তুই যা।"
রাহুল এগিয়ে গেল ওর বাইকের দিকে। আমিও ওর পেছন পেছন পা বাড়িয়েছি, হঠাৎ কাঁধটা কেউ খপ করে ধরলো। আমি ফিরে তাকাতেই দেখি বেড়েদার মুখটা পুরো প্রশ্নচিহ্ন হয়ে আছে। 
"তোর ব্যাপার কি ভাই?"
আমি একটা গোবেচারা অবোধ শিশুর মতো হাসি দিলাম। বেড়েদা বলে চললো,
"তুই কাল ঐ ছেলেটার সঙ্গে এসে এই রাহুলকে ক্যালানোর সুপারি দিলি, আর আজ রাহুলের সঙ্গে এসে ঐ ছেলেটাকে ক্যালানোর সুপারি দিলি। কি ব্যাপার ভাই ? আসল কলকাঠি কী তুই নাড়ছিস?"
আমি মাথাটাকে দুপাশে নাড়িয়ে বেড়েদা কে সংক্ষিপ্তভাবে সব বললাম। বেড়ে দা শুনে বললো, 
"ধুস, এসব ব্যাপারে তাহলে আমি নেই। অন্য রাস্তা দেখে নিতে বলিস ওদের।"




গোলদিঘির উত্তরে কৃষ্ণচূড়া গাছের ছোট্ট এক মেলা আছে। আকাশ থেকে হঠাৎ দেখলে হয়তো মনে হবে যেন আগুন জ্বলছে। আশ্চর্য এটাই, এত কৃষ্ণচূড়া গাছের মধ্যে একটিও রাধাচূড়া গাছ নেই। এখানে যেন সব কৃষ্ণই একা, রাধার অপেক্ষা করে আছে। দীপও তাই এত কৃষ্ণের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে থাকে, অপেক্ষা করে ওর রাধার। ও বলে, 
"আমার রাধা ছুটতে ছুটতে আসে আমার কাছে, দীঘির ওপারের রাস্তা ধরে।"
আমি বলেছিলাম, "আর ওপারের রাস্তা ধরেই সোজা বেরিয়ে যায়, তোকে দেখতেও পায় না।"
"তুই কী আর বুঝবি, প্রেয়সীর একঝলক দেখার জন্য বাল্মীকির মতো তপস্যাও করা যায় ! এই দূর থেকে দেখা তো সৌভাগ্য। এই কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর মাঝে দাঁড়ালে বেশ কিছুটা সময় ধরে তোর্সাকে দেখতে পাই।"
আসলে তোর্সা সপ্তাহে তিনদিন বিকেলে অশোক স্যারের কোচিং থেকে বেরিয়ে এই গোলদীঘির পাশ বরাবর রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে বড় রাস্তার দিকে যায়। আর দীপ এই দূরে গাছগাছালির মাঝে দূরবীন নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এইভাবে দেখে নাকি ওর মন শান্ত হয়।
আমি প্রথম যেদিন ওর থেকে জেনেছিলাম হাসি চাপতে পারিনি। জোরে হেসে বলেছিলাম, "সে তো সকালের প্রাতঃকৃত্য সারলেও মন শান্ত হয়।"
ও এগিয়ে এসে চাপড়টাপড় মেরে বলেছিল, "তুই শালা আর কী বুঝবি! জীবনে তো শিশুসাহিত্য থেকে বেরোলি না!"
শিশুসাহিত্য আমি পড়ি। হ্যাঁ, আর কিছু মাস পর আমি আইনত ভোট দিতে পারবো কিন্তু তাতে কী এসে যায়! আমার হবিট, গালিভার্, টিনটিন থেকে ফেলুদা, টেনিদা, পাণ্ডব গোয়েন্দা, কাকাবাবু, জুল ভার্ণ এর লেখা বা ক্যাপ্টেন কুক এর এডভেঞ্চার সবই আমি ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ি। ভালো লাগে। বড় হয়ে গেলে এসব বুঝি ভালো লাগতে নেই? আমি তাহলে অত বুঝি না।
ঠিক এখনও যেমন আমি বুঝতে চাইছি না আমি কেন এখানে বসে রয়েছি। দীপ আমায় এখানে থাকতে বলে নিজেই হাওয়া। 
কিছুসময় পর দূরে তাকিয়ে দেখি, রাহুল আসছে তাও আবার পাশে নাকি দীপ। নির্ঘাৎ আজ খুব কেলো কিছু হবে। একটা সাইকেল আর তার পাশে ধীরে চলতে থাকা বাইক থামলো আমার সামনে।
রাহুল একদম সোজাসাপ্টা আমায় বললো, "দেখ আয়ান, তুই আমার খুব ভালো বন্ধু, একসঙ্গে কোচিংয়েও পড়ি, তুই জানিস আমি কতটা ফিট। তোর কী মনে হয় এই প্যাংলা কার্তিকের সঙ্গে তোর্সার ভালোবাসা হওয়া উচিৎ? পুরো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অপুষ্টিতে ভুগবে না?" 
আমি খুব সিরিয়াসলি শুনছিলাম ওর কথা, কিন্তু লাস্ট কথাটা শুনে হাসির বিস্ফোরণ ঘটলো, কিন্তু দীপের মুখের দিকে চেয়ে জাস্ট গিলে নিলাম। 
দীপ শিঙি মাছের মতো ঝটকা দিতে লাগলো শুনে। "হ্যাঁ, শুধু জিম করা শরীর হলেই সে উপযুক্ত? আর মাথা? মাথায় যদি সামান্য এই জ্ঞানও না থাকে আমরা লাফালে আবার মাটিতে নেমে আসি কেন, তার সঙ্গে ভালোবাসা হলে পুরো ভবিষ্যৎ প্রজন্মটাই হারাধনের ছেলে হয়ে যাবে।" 
রাহুল দীপ এর দিকে এগিয়ে আসতেই আমি বাধা দিয়ে বললাম, "দেখ, তোরা এমনিতেই অনেক বাড়াবাড়ি শুরু করেছিস। না ভেবে যা খুশি তাই করছিস । যাইহোক, তোরা যা খুশি কর কিন্তু আজ আমায় এখানে ডাকলি কেন দীপ?"
দীপ অনেকটা শান্ত হয়ে বললো, "দেখ, কিছু একটা ব্যবস্থা করতে হবে। তোর মনে হয় না আমরা দুজনই যদি এইভাবে নিজেদের ভালোবাসা নিয়ে যাই, তাহলে তোর্সা কনফিউজড হয়ে যাবে আমাদের মধ্যে? তখন যদি নিজের মনের কথাটা ঠিকভাবে বুঝতে না পারে আর ভুলজনকে হ্যাঁ বলে দেয়, তাহলে? মেয়েরা এসব ব্যাপারে খুব কনফিউজড হয় আয়ান। তুই বুঝবি না তবু জেনে রাখ, ছেলেদের ঠিক কোন জিনিসটা দেখে দুম করে হঠাৎ হ্যাঁ বলে দেয়, স্বয়ং ব্রহ্মা জানেন না।"
আমি শুনে বললাম, "তো তাতে আমার ভূমিকা কি?"
এবার রাহুল বললো, "দেখ, তোকে আমি নিউট্রাল হিসাবে দেখি। তুই আমাদের দুজনকেই চিনিস। তুই একটা উপায় বাতলা যাতে যেকোনো একজন নিজেই সরে যায় আর অন্যজন একা তোর্সাকে বলতে পারে।"
আমার সত্যিই এবার বিরক্ত লাগলো, কোথায় আমার পাড়ার থিম পুজোর শেষ কাজটা একটু ঘুরেফিরে দেখবো তা না, কে তোর্সার কাছে যাবে তার উপায় আমায় বলতে হবে। বুঝলাম, এখন বিরক্তি দেখিয়ে লাভ নেই। রাহুল যেমন আমার কোচিংয়ের বন্ধু, তেমনই দীপ আমার স্কুলের। তাই তাড়াতাড়ি একটা যাহোক উপায় বলে কাটতে হবে আমায়।
আমি বললাম, "দেখ অনেককিছুই করতে পারিস। পাঞ্জা, মেমোরি গেম, ১০০ মিটার দৌড়, ক্যুইজ, সুইমিং রেস, লং জাম্প ..."
কোনো অপশনই দুজনের একসঙ্গে মনে ধরলো না। একবার এ ঘাড় নাড়ে, আরেকবার ও।
আমি তাই না থেমে বলতে লাগলাম যা মনে আসলো, "লুকোচুরি, ছোঁয়াছুঁয়ি, ইকিরমিকির, কিতকিৎ, ফুটবল, ক্রিকেট ... "
যেই ক্রিকেট বলেছি দুজনে একসঙ্গে বলে উঠলো, "হ্যাঁ, হ্যাঁ ক্রিকেট।"
আমি দীপকে ইশারায় চুপ থাকতে বললাম। কিন্তু না, দীপ তখন হয়তো ম্যাচ জিতে তোর্সার সঙ্গে সাতপাকের প্ল্যান করছে। তো দুজনের অতি উৎসাহে ঠিক হলো ক্রিকেট ম্যাচ হবে দুজনের দুটো টিমের মধ্যে। যার টিম হারবে সে ভুলে যাবে তোর্সাকে। আর তাছাড়াও দীপের প্রস্তাব অনুযায়ী, জয়ী ক্যাপ্টেন পরাজিত ক্যাপ্টেনকে একটা কাজ দেবে, যেটা করতেই হবে। ম্যাচ হবে আমাদেরই স্কুলের বাইরের মাঠে, ষষ্ঠীর দিন। ট্রফিও থাকবে। খেলার শেষে নাকি পরাজিত ক্যাপ্টেন জয়ী ক্যাপ্টেনের হাতে তুলে দেবে সেই ট্রফি। ট্রফির নাম "তোর্সা কাপ"। 
দুজনের ক্রমাগত এইসব কথা শুনে আমার মনে হচ্ছিল, তোর্সাকে ডেকে সব শুনিয়ে দিই। 
সিরিয়াসলি? তোর্সা কাপ?




তোর্সারা এই পাড়ায় সাত আট মাস আগে এসেছে। ওর বাবার বদলির চাকরি। এখন এখানে, আবার ৩-৪ বছর যেতে না যেতে হয়তো চলেও যাবে। আসার পর থেকে বেশ আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠেছে তোর্সা। আমাদের স্কুলে ভর্তি হয়েছে, অ্যানুয়াল প্রোগ্রামে গান করে মানুষজনকে কাঁদিয়ে দিয়েছে, দীপ, রাহুল আর আরও কিছু ছেলেকে পাগল করেছে, রাস্তায় ওকে দেখে বাজে কথা বলায় তাদের পেঁদিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছে (মা নিজে দেখেছে)। 
আমি সেদিন ভাবছিলাম এই যে তোর্সাকে লোকে এত ফুটেজ দিচ্ছে, এর কারণ কী? ভালো দেখতে বলে? হ্যাঁ, তোর্সা বেশ সুন্দরী। গায়ের রং গমের মতো, মায়ায় মাখানো একটা মুখ, লম্বা চুল আর হাইটটাও একটু লম্বার দিকেই যেন। তবে ঐ চোখ দুটো খুব বিপজ্জনক। চোখের দিকে দেখলেই মনে হয় আমি কী ভাবছি সেটাও যেন পড়তে পারছে। তাই ওকে ওই তিন চারবার, ব্যস তার বেশি দেখিনি। আর মা তো ছোট থেকেই বলতো, রাস্তাঘাটে বিপজ্জনক কিছু দেখলে ধারেকাছে ঘেঁষবি না। 
আর তাছাড়া তোর্সারা পরিযায়ী পাখি। নিজেদের মনোরম পরিবেশের খোঁজে আবার অন্য কোথাও চলে যাবে কোনোদিন। তাই এদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে লাভ কী? আমি এসব বুঝলেও বাকিরা বোঝে না। যখন চলে যাবে তখন বুঝবে। আমার কী? আমি শুধু ভাবছি পুজোর জন্য এত খেটে যে কাজ করলাম, একটা এশিয়ান পেন্টস কী জুটবে! তবে সেই ভাবনাটাও যদি শান্তিতে ভাবতে পারতাম!

চতুর্থীর দিন দীপ এসে বললো, "ভাই ১১ জনই তো জোগাড় হচ্ছে না। টিম নামাবো কি করে?"
আসলে মানুষ যখন যেচে নিজের গলাটা হাড়িকাঠে ঢুকিয়ে দেয় আর অস্ত্র তুলে দেয় ক্ষ্যাপা তান্ত্রিকের হাতে তখন আর তাকে কে বাঁচায়? দীপও এখন তাই ভাবছে। আসলে ও জানতো না, রাহুল সিএবি তে সেকেন্ড ডিভিশনে খেলে। তাই তার বিপক্ষে ওর এই নড়বড়ে টিম দাঁড়াবে কি করে তা বুঝতে ও এলাকার অনেক গুরুজন, জ্যোতিষীর কাছে ঘুরে ফেলেছে। সবাই নাকি একটাই কথা শুনিয়েছে, "সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ থাকলেও শেষ হাসি তুমিই হাসবে।"
আমি শুনে বলেছিলাম, "হ্যাঁ, জীবন তো আমাদের পাড়ার পাগলটা। শেষ কেন, সবসময়ই হাসি দেয়।"
দীপ প্রথমে না বুঝে পরে রেগে গিয়ে চোটপাট নিয়ে বললো, "কেন শালা, তুই বলতে পারিসনি আমায় যখন ও ক্রিকেটে রাজি হয়ে গেল?"
"আমি তোকে অনেকবার ইশারা করেছিলাম, কিন্তু তুই তো তুইই।"
দীপ এবার কাঁচুমাচু হয়ে বললো, "দেখ, জানিসই তো। ক্রিকেট খেলতে ভালো লাগে, আর স্কুলের টিমে বেশ ভালোই খেলি। তাই শুনে আর কিছু ভাবিনি। কে বুঝবে যে ঐ গাম্বাটমার্কা চেহারা নিয়ে কেউ এত ভালো ক্রিকেট খেলে। কিন্তু এখন? এখন কি হবে? পুজোর ছুটির জন্য স্কুলটিমের প্লেয়ারগুলোই না করে দিচ্ছে।"
আমার সত্যিই কোথায় একটা খারাপ লাগলো। কারণ আমি জানি রাহুল ওর ক্লাবের বন্ধুগুলোকে ঠিক আনবে। কারণ ও বড়লোক আর পপুলার। আমি দীপকে জিজ্ঞেস করলাম, "কতজন হয়েছে টিমে?"
"সাতজন।"
"তুই ভাবিস না, বাকি চারজন আমি জোগাড় করে দেব। পরশুদিন সকালে তোর্সা কাপ তুইও খেলবি।"
দীপ কেমন যেন বুকে একটা জোর পেলো। গা ঝাড়া দিয়ে বললো, "ভাই জিততেই হবে। তোর্সা কাপ পেয়েই ছাড়বো।"
দীপের এই মনের জোরফোর ঠিক আছে। কিন্তু ট্রফিটাকেই ও তোর্সা মনে করছে নাকি? 




রবির করা ফুলটসের জবাব আমাদের সবার মাথার অনেক ওপর দিয়ে মাঠ পার করে বিশুদের তিনতলার ছাদে গিয়ে পড়লো। এরকম ধুয়ে টাঙিয়ে দেওয়ার মতো মার আমি আজ অব্দি বুক ক্রিকেটেও দেখিনি। এখন ১১তম ওভার চলছে আর রান নাকি ২৩৮! ২০ ওভার শেষ হলে রান কোথায় গিয়ে থামবে কে জানে! দীপের মুখটার দিকে জাস্ট দেখা যাচ্ছে না। জীবনের সমস্ত আশার শেষ কিনারে দাঁড়িয়ে দেবদাসের মুখ কী এমন হয়েছিল?
আমার মামাতো দাদা টুবলাইকে বলেছিলাম খেলার জন্য। ও ওর সঙ্গে আরও দুটো ওর বন্ধুকে এনেছিল, কিন্তু কারোরই ঐ রকম ক্ষমতা নেই যে রাহুল আর তার বন্ধুদের আটকায়। আচ্ছা এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, টিমের ১১তম প্লেয়ার হলাম আমি। কোনো প্লেয়ারকেই যখন পাওয়া যায়নি তখন দীপের প্রস্তাবে আমিই নেমে যাই। দীপ আমায় জিজ্ঞেস করেছিল, " তুই ব্যাটসম্যান না বোলার? "
"ঐ অলরাউন্ডার।"
"সাব্বাশ, এতদিন বলিসনি কেন? স্কুলের টিমে তোকে এবার ট্রায়াল দিয়ে নেব।"
না আমি মিথ্যে বলিনি। আমি অলরাউন্ডারই। কিন্তু যে অলরাউন্ডার ৬ ডাউনে নামে আর টিমের ৬তম বোলার হিসাবে থাকে, মানে ম্যাচে ঐ যার তেমন কোনও ভূমিকা থাকে না।
হঠাৎ দীপ আমায় বল ধরিয়ে দিলো, "এক ওভার তুইও কর।" 
আমি বাধা দিতে গিয়েও কিছু বললাম না। পালানোটা আমি শিখিনি। সে পড়াশোনা, পুজোর দায়িত্ব বা এই খেলাই হোক।আর তাছাড়া ওদের টিমের রান আর আমাদের টিমের বোলিং দেখে এটা বুঝে গেছি যে আমি খুব বাজে বল করলেও কিছু এসে যাবে না।
আমি দৌড়ে এসে বল করলাম। মনেপ্রাণে আক্রম আর জাহির খান কে মনে করার চেষ্টা করলাম কিন্তু বলটা হলো যোগিন্দর শর্মা স্পিডে। একটা লো ফুলটস গেল। আর রাহুল ওটাকেও টাঙিয়ে ছয়। রাহুল আর বিশাল ওপেনিংএ নেমেছে, আর ওঠেনি। অন্যদেরকেও তো ব্যাট করার সুযোগ দিতে পারে!
পরের বলটাও একইভাবে করলাম। মনে আক্রম, বাস্তবে যোগিন্দর। আর ফলও একই পেলাম, ছয়। মন খারাপ হয়ে গেল, রাগ উঠলো। পরের বলটা খুব জোরে দৌড়ে এসে ছাড়লাম, কিন্তু বলটা হাত থেকে বেরিয়েই কী আস্তে হয়ে গেল। কিন্তু এবার রাহুল গায়ের জোরে ব্যাট ঘোরালেও এত আস্তে বলের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারায় মিসহিট হয়ে গেল। ওপরে উঠে গেল আর লং অনে দাঁড়ানো পীযুষ সুন্দর লোপ্পা ক্যাচ ধরলো। কারোর কোনো উচ্ছ্বাস দেখা গেল না তেমন, শুধু দীপ হাত পা ছুঁড়ে আমার দিকে দৌড়ে এলো। আমিও শূন্যে হাত তুলে একটা সিগনেচার সেলেব্রেশন করার চেষ্টা করলাম। কেমন দেখতে হয়েছিল কে জানে? তবে আমি খুব খুশি হলাম। ম্যাচের প্রথম উইকেট আমার নেওয়া। 
বাকি সারা ইনিংসে আর উল্লেখযোগ্য কিছু হলো না। টুবলাই একটু ভালো বল করে শেষের দিকে আরো দুটো উইকেট নিলেও ২০ ওভার শেষে রান দাঁড়ালো ৪৬১। ভাবছিলাম, নিজেই গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কমিটিকে ফোন করি।

দীপ আর টুবলাই নামলো। দুজনেরই খেলা দেখেছি। এই বিশাল রানের পাহাড় অতিক্রম করতে না পারলেও ভরসা ছিল, আমায় নামতে হবে না। দুজনে শুরুটাও মোটামুটি করলো, কিন্তু দীপের মাথায় ছিল রানটা, ৪৬২ করতে হবে। ও মার শুরু করলো। প্রথম এক দু ওভার টিকে গেলেও বলের লাইন মিস করে বোল্ড হয়ে গেল ও ৫ম ওভারের শুরুতেই। টুবলাইও কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। রান তখন ৬.২ ওভারে ৭১। এরপর চললো বোলিংয়ের সাইক্লোন। চোখে যেন কিছু দেখতে পেলাম না। শুধু দীপ যেন হঠাৎ বললো, "আয়ান তুই নাম এবার।" 
রান তখন ৭৮, ৮.৫ ওভারে। বোলিংয়ে যাও একটু ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছিল, ব্যাটিংয়ে তাও হলো না। গেছিলাম যত তাড়াতাড়ি, ফিরে এলাম তার থেকেও দ্রুত গতিতে। এই ম্যাচে প্রথম থেকেই আমাদের টিমের হয়ে বলার কিছু ছিল না, শেষ মুহূর্তেও সুযোগ হলো না। ৮৯ রানে ইনিংস গুটিয়ে গেল। দীপ বা আমরা কেউই ভাবিনি ফল এরকম হতে পারে।
মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দীপ "তোর্সা কাপ" রাহুলের হাতে তুলে দিলো। রাহুল সগর্বে ঘোষণা করলো, "তোর্সা আমার।"
আমি ভাবলাম কাপটা হয়তো উচ্চারণ করতে ভুলে গেছে। দীপ আর আমরা ফিরে আসছিলাম, তখন রাহুল বললো, "আরেকটা কাজ করানোর কথা ছিল না! মানে সারপ্রাইজ টাস্ক।"
দীপের গলা দিয়ে ঠিক আওয়াজ বেরোলো না। কেমন একটা ঘড়ঘড়ানি বেরোলো, "হ্যাঁ, বল।"
"তুই সবার মাঝে চিৎকার করে ঘোষণা কর, ' আমি নপুংশক, আমি আর তোর্সার পেছনে কোনোদিন যাবো না। ' এখনই বলতে হবে।"
আমি এবার রেগে গেলাম। "কী এগুলো রাহুল? ও এসব বলবে না। ও যাবে না তোর্সার পেছনে, ভাবিস না।"
"তুই মাঝখানে কথা বলিস না আয়ান, দীপ তুই নিজেই কিন্তু বলেছিলিস একটা সারপ্রাইজ টাস্ক থাকবে।"
দীপ আমায় কিছু বলতে না দিয়েই সবার মাঝে জোরে চিৎকার করে বললো রাহুলের বলা কথাগুলো। আমরা কিছুজন ছাড়া সবাই হেসে গড়িয়ে পড়লো শুনে।




"মনখারাপ করিস না দীপ, কিছু জিনিস আমরা বাস্তবে চেয়ে পাই না।" 
দীপ চুপ করেই আছে। কাউকে চেয়ে হারানোটা হয়তো খুব কষ্টের, কিন্তু তার সঙ্গে যদি ক্ষত, অপমানও জড়িয়ে থাকে, তাকে এত সহজে মন থেকে দূর করা যায় না। রাহুলের করা অপমানটা হয়তো দীপ ভুলতে পারছে না। কিন্তু পুজোর দিনগুলোতে ও মনখারাপ করে থাকবে?
"দেখ, একদিক থেকে কিন্তু ভালোই হয়েছে। তোর্সারা কিছুদিন পরেই চলে যাবে। তখন তোর আরও খারাপ লাগতো।"
দীপ মুখে হাত দিয়ে মায়ের প্রতিমার দিকে চেয়ে আছে। কোনও কথা বলে না ও। প্যান্ডেলে কেউ নেইও তেমন। আসলে বিকেল হতেই সবাই নিজের ঘর, পাড়া ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে দূরের ঠাকুর দেখতে। আমার ইচ্ছে করে না। এই মণ্ডপ, এই মায়ের মূর্তি, মাঝে মাঝেই বেজে চলা ঢাক, আলো এসবই আমার পুজো। বেশ কিছু মাস যে খাটনিটা থাকে তা যখন লোকেরা মুগ্ধ হয়ে দেখে, আমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি। 
আমার সঙ্গে আজ দীপও বসে আছে। বিকেল এখন। লোক তেমন হয়নি। হঠাৎ দেখি তোর্সা আরও কিছু মেয়ের সঙ্গে ঢুকলো। এগিয়ে আসতে আসতে আড়চোখে একবার আমাদের দেখেই আবার চোখ ঘুরিয়ে নিলো। দীপের মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। প্রতিটা হতাশা থেকে আশায় আসতে যে কয়েক ন্যানো সেকেন্ড আর একটা বাইরের শক্তি লাগে তা বেশ বুঝলাম। দীপ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। ধীরপায়ে মায়ের প্রতিমার দিকে যেতে লাগলো যেখানে তোর্সারা দাঁড়িয়ে আছে। যখন ও বেশ কাছে চলে গেছে তখনই কোত্থেকে রাহুল হেসে ওকে এক ধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিলো। পড়ার শব্দে সবাই দীপের দিকে তাকালো আর দেখে হাসতে লাগলো। সামনে কিছুটা কাদা থাকায় দীপ ওতে স্লিপ খেয়ে একেবারে ঐ কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে। কেউ ঠাহর করতে পারলো না কি করে হল ব্যাপারটা। হয়তো বুঝেছে স্লিপ খেয়ে দীপ পড়ে গেছে। আমি ছুটে গিয়ে ওকে তুললাম। রাহুল কে কিছু বলতে যাবো, দীপ আমায় আটকালো। হ্যাঁ, ওদের চুক্তি অনুযায়ী দীপ পারে না নিজে গিয়ে কথা বলতে। রাহুল দেখি বেশ হেসে হেসে তোর্সার সঙ্গে কথা বলছে। তোর্সাও রাহুলকে ঐ কোচিং থেকে চেনে। 
রাহুল, তোর্সা আর বাকিরা ধীরে ধীরে মণ্ডপ ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে তোর্সা আবার একবার আমাদের দিকে ফিরে তাকালো। দীপ ঐ কাদামাখা, বিধ্বস্ত অবস্থাতেও একটু হাসার চেষ্টা করলো।




"যারা যারা এখনও অঞ্জলি দিতে পারেননি কিন্তু মনেপ্রাণে অঞ্জলি দেওয়ার বাসনা নিয়ে কাল রাতে শুয়েছিলেন এবং এখনো বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবছেন 'ইশশ, অঞ্জলিটা যদি দিতে পারতাম' বা যারা ভাবছেন 'এবারটা মিস হয়েই গেল' তাদের জন্য সুখবর, আরও দুটো রাউন্ড অঞ্জলি দেওয়া হবে। তাই তাড়াতাড়ি আসুন মণ্ডপে এবং নিজের মনোবাঞ্ছা মাকে জানিয়ে যান।" মাইকে ঘোষণা করে একটু দূরে চেয়ারে বসলাম। রাহুল বসে আছে। ও নাকি আজ জীবনে প্রথমবার অঞ্জলি দেবে, তাই স্মরণীয় করে রাখতে তোর্সার সঙ্গে অঞ্জলি দিতে চায়। তোর্সারও এপাড়ায় প্রথম পুজো। আমি দেখেছি তোর্সা মণ্ডপে ঢুকেছে, আমার মা, কাকিমা আর কিছু মেয়েদের সঙ্গে আছে। অঞ্জলি শুরু হলে হয়তো এদিকে আসবে। শুধু দীপকেই দেখা যাচ্ছে না। মানে কালকের ঐ কাদায় পড়ে যাওয়ার ঘটনার পর থেকে ওকে আর দেখাই যায়নি। কোথায় আছে কে জানে। 
"বুঝলি, প্রায় সব ঠিক।"
আমি জিজ্ঞেস করলাম, "কি ঠিক?"
"আমার আর তোর্সার ব্যাপারটা। কাল সন্ধ্যেটা আমার সঙ্গেই ছিল ও। অনেক কথা হলো। দীপ, তোর ব্যাপারেও ..."
এইসময় পুরুত মশাই মাইকে জানালেন, অঞ্জলি শুরু হবে। তোর্সা, বাকি মেয়েদের সঙ্গে এগিয়ে এলো। রাহুল আমার পাশের চেয়ার থেকে কথাটা শেষ না করেই ঠিক তোর্সার এক সাইডে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। তোর্সা ওকে দেখে হাসলো। 
সত্যিই তোর্সা কী রাহুলের প্রপোজাল মেনে নিয়েছে? অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে গেল। মেয়েরা যে কী চায়?
আমায় বাবাইদা ডাকলো এইসময়। অষ্টমীর ভোগের জন্য সব রেডি করতে হবে। আমি উঠে গেলাম। আমি খুব বেশিদূরও যাইনি, এমন সময় এক মেয়ের তীক্ষ্ণ চিৎকার শোনা গেল, " তোর সাহস কি করে হয়? মেয়ে দেখলেই নোলা ঝরে বুঝি? একটু ছুঁয়ে দেখতেই হবে, তাই না? .."আমি দৌড়ে মণ্ডপের দিকে গেলাম। তোর্সা দেখি বলে চলেছে, "কাল নানা অছিলায় হাত ধরার চেষ্টা করছিলি আর আজ সোজা .. ভাবলি ভিড়ের মধ্যে অত টের পাবো না।"
কথাগুলো বলা হচ্ছে রাহুলকে উদ্দেশ্য করে। অঞ্জলি মাঝপথে থেমে গেছে। কিছু পাড়ার দাদা, কাকু আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলারা এগিয়ে এসেছে। জিজ্ঞেস করছে, কি হয়েছে। তোর্সা যা বললো তার সারমর্ম এটাই, রাহুল তোর্সাকে ভিড়ের মধ্যে বাজেভাবে ছুঁয়েছে। রাহুল ওদিকে এত আক্রমণের সামনে আমতা আমতা করছে। কিছুজন রাহুলকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, "তুমি কে ভাই? আগে তো এই পাড়ার পুজোয় দেখিনি।"
রাহুল কিছুই বলতে পারছে না। এত বড় চেহারাটাও রাহুলের আত্মবিশ্বাসের গোঁড়ায় ফু দিতে পারছে না। কিছু দাদা ওকে ধাক্কা দেওয়া শুরু করলো। আমি বুঝলাম, এখন না থামালে ব্যাপার বাজে দিকে গড়াবে। এগোতে যাব দেখি দীপ একটা চেয়ারে বসে পুরো ব্যাপারটা দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। ও কখন এলো? আমি দীপের কথা না ভেবে রাহুলের চারপাশে থাকা ভিড়টার দিকে গেলাম। মনে হয় রাহুল একটা দুটো চড়চাপড়ও খেয়ে গেছে। ওর মুখটা ফ্যাকাশে, ভয়ে সবার দিকে তাকাচ্ছে। আমি সবার মাঝে গিয়ে বাকিদের আটকালাম, "আমার পরিচিত ও। মেরো না।"
তপন কাকু আমায় বললো, "দেখ পিকলু, কাউকে খুব ভালোভাবে না চিনে থাকলে পাড়ার পুজোয় ডাকিস না। সব চেনা লোক ভালো হয় না।"
ওরা চলে গেল। রাহুল কেমন একটা কাঁপছে যেন। আমি বললাম, "ওরা চলে গেছে। কেউ কিছু করবে না।"
রাহুল আমার হাতদুটো ধরে বললো, "বিশ্বাস কর আয়ান, আমি কিছু করিনি। হঠাৎ করে কেন তোর্সা ওরম করলো জানি না।"
"কাল তুই তোর্সাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করছিলি?"
রাহুল চুপ করে গেল। আমতা আমতা করে, "না .... মানে .. সেরকম না। আসলে ..."
চোয়ালটা শক্ত হয়ে গেল। রাগটা গিলে বললাম, "আচ্ছা, পরে শুনবো। এখন বাইরে চল, এখানে বেশিক্ষণ থাকা উচিত না। পুজোর দিনগুলোতে আর আসিস না এদিকে।"
রাহুলকে নিয়ে বেরোনোর সময় দেখলাম, তোর্সা দীপের কাছে এসে কীসব বলছে। দীপের মুখটা আবার সেই ফ্ল্যাশবাল্বের মতো জ্বলে উঠেছে।




দীপ..


আমিই বলছি বাকিটুকু, কারণ আয়ান এখন ধুনুচি নাচের রিহার্সাল করছে প্যান্ডেলের পেছনে। হ্যাঁ, আজ বিজয়া দশমী। জানি না আয়ানের বলা কথাগুলোয় আপনারা কতটা ওকে চিনতে পেরেছেন, কিন্তু ও এরকমই, ধুনুচি নাচও ওর জীবনের অঙ্গ। যে জিনিসগুলো আমরা জীবনে এড়িয়ে চলি সচরাচর, ও সেগুলো করে আর তা নিয়েই খুশি থাকে। আমার বাবা বলে, জীবনে যতটা কম চাওয়া থাকে ততই আমরা শান্তি, আনন্দে থাকতে পারি। আর আয়ানকে দেখে তা বুঝতেও পারি। দশমীতে ধুনুচি নাচ, টিনটিন-ফেলুদার বই, ঘুড়ি ওড়ানো, বিকেলে মাঠে ফুটবল খেলা, পড়াশোনা, মায়ের সঙ্গে খুনসুটি এসবই ওর জীবনকে ভালো রেখে দেয়। 
আমি পারিনা এটুকু নিয়ে থাকতে। এখন হাসি পায় ভাবলে, আমি বিজ্ঞের মতো ওকে বলেছিলাম, তুই ভালোবাসার কী বুঝিস? ও চুপ থাকতো সবসময়, শুধু একবারই বলেছিল, "ভালোবাসা মানে অন্যদের ভালো রাখা।"
তাই কি? কে জানে? আমার কাছে ভালোবাসা মানে নিজের পছন্দের মানুষটার সঙ্গে থাকা। আর সেটাই চেষ্টা করেছিলাম যাতে নিজের পছন্দের মানুষটার কাছে যেতে পারি। রাহুলও তাই, এমনকী তোর্সাও। 


তোর্সা অষ্টমীর সকালের ঐ কান্ডটার পর নিজে আমার কাছে এসে বলেছিল যে আমার সঙ্গে একদিন দেখা করে কথা বলতে চায়। আমি শুনে ফানুসের মতোই আকাশে ভাসছিলাম। মনে হচ্ছিল, রূপকথাও তাহলে সত্যি হয়? 
মনের সমস্ত ঘুড়িগুলোকে আকাশে উড়িয়ে দিয়ে ওর সঙ্গে গতকাল বিকেলে দেখা করেছিলাম আর সেখানেই জানতে পারি ওর মনের ইচ্ছেটাকে। কোনো ইতস্তত না করে বলেছিল ও আমায় নিয়ে ...
"কিরে আয়, শুরু হয়ে যাবে তো!", আয়ান ডাকলো। 
দেখুন ঠিক এখনই ওকে ডাকতে হলো। সবে বলতে যাচ্ছিলাম, তোর্সা কি বলেছিল আমায়! যাই হোক, ওর নাচটা দেখে আপনাদের বলছি।
মণ্ডপের ভেতরে মায়ের প্রতিমার সামনে একটা ছোট্ট স্টেজ করা হয়েছে। যেখানে এখন আয়ান দাঁড়িয়ে আছে একটা শাদা রঙের ধুতিকে কাছার মতো পরে। দুই হাতে দুটো ধুনুচি। ও দুই হাত ঘুরিয়ে নাচ শুরু করলো। ধীরে ধীরে আরও দুটো ধুনুচি দুইহাতে আর মুখে একটা ধুনুচি তুলে দুই হাত আর পায়ের নানা ভঙ্গিমায় যেন বুঝিয়ে দিতে লাগলো এই বিশ্ব সংসারে মা দূর্গার প্রতি নিবেদন কেমন হওয়া উচিত। কী অপরূপ দক্ষতায় ও পাঁচটা ধুনুচি সামলে মা কে আহ্বান করছে। 
'মা সত্যি তুমি যাবে কিভাবে এই দামাল ছেলের ভালোবাসা ফিরিয়ে?'
ওর নাচ প্রায় যখন শেষের দিকে, ঠিক তখন তোর্সা দেবী দূর্গার সাজে স্টেজে উঠলো হাতে এক জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে। এক মুহূর্তের জন্য সবাই স্তব্ধ হয়ে গেলেও আয়ানের স্বতঃস্ফূর্ততায় সবাই সম্বিৎ ফিরে পায়। আমি আয়ানকে দেখছিলাম, ও সামান্য ঘাবড়ে গেলেও খুব সুন্দরভাবে ম্যানেজ করলো। নিজে প্রণামের ভঙ্গিতে প্রার্থনা করতে লাগলো, যেন পুজো দিয়ে মাকে বলার চেষ্টা, থেকে যাও। তোর্সাও এক মায়ের অভিমান, স্নেহ, আনন্দ, কষ্টের প্রতিটা ভাব ফুটিয়ে তুলতে লাগলো নিজের নাচে। স্টেজ জুড়ে নিজেদের নাচের আনন্দ ছড়িয়ে দিতে লাগলো। কিছু সময় পর আয়ান হাঁটু গেড়ে তোর্সার পায়ের কাছে ধুনুচি গুলো রেখে দুহাত পাতলো আর তোর্সা নিজের হাতের প্রদীপ আয়ানকে দিয়ে আশীর্বাদ করলো। আর কার কাছে এ দৃশ্য কিভাবে ধরা দিলো জানি না, আমার মনে হলো, মা নিজের সত্তাটুকু মর্ত্যে রেখে গেলেন ঐ প্রদীপের আলোর মাধ্যমে। আমাদের দায়িত্ব ঐ আলোটুকু সারা বছর প্রতিটা দিন আমাদের মাঝে জ্বালিয়ে রাখা, অন্ধকার যেন গ্রাস না করে আমাদের। 
হাততালিতে ফেটে পড়লো চারিদিক। কখনো এরূপ সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়নি দশমীর দিন, সবাই যেন নিজের অন্তরে মা দূর্গাকে অনুভব করছিলেন। 
আয়ান উঠে পড়লো, দর্শকদের বাহবা নিতে নিতে মণ্ডপের পেছনের দিকে গেল। আমিও ওর পেছন পেছন গেলাম।


"দেখলি পুরোটা, কেন এরকম করলো মেয়েটা? কেন নিজেকে এতটা চিনিয়ে যাচ্ছে সকলের মাঝে? দুদিন পর তো চলে যাবে।" শেষের কথাটা বলার সময় আয়ানের গলাটা কেঁপে উঠলো।
আমি কিছু বললাম না। আয়ান যেন কিছু বুঝতে পারলো। নিজের গলা ঝেড়ে টোন পাল্টে বললো,
"আর দেখলি, কিভাবে আমার নাচটায় ভাগ বসিয়ে সমস্ত প্রশংসা নিয়ে নিলো। হেব্বি সেয়ানা জানিস তো। ভাগ্যিস ..." 
কথাটা শেষ করতে পারলো না। এক মেয়ের নরম কন্ঠ ভেসে এলো, "আর এভাবেই সারাজীবন প্রতিটা জিনিসে ভাগ বসাবো। পালাতে দেব না। আমি হেব্বি সেয়ানা।"
আয়ান পুরো ভেবলে গেছে। ও কোনোরকমে বললো, "মানে?"
তোর্সা আরও একটু এগিয়ে এলো। আয়ানের চোখে চোখ রেখে বললো, "এখানেই আমার বাবার শেষ বদলি। আমরা এখানেই তোদের বাড়ির পাশে নতুন এপার্টমেন্টে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। কোথাও যাবো না আমরা.. আমি.. তোকে ছেড়ে।"
আয়ানের মুখচোখ পাল্টে গেল। যেন হঠাৎই এক আকাশ তারার মাঝে নিজেকে পেয়েছে ও। কিন্তু আয়ান তো আয়ানই। ওর দৃষ্টি আমার দিকে যেতেই অস্ফুটে বললো, "দীপ তোকে ভালোবাসে।"
এবার আমি আয়ানের পেটে একটা আলতো করে ঘুসি মেরে বললাম, "আর তোর একটু আগের মুখের ভাব বুঝিয়ে দিলো, তুই অনেক বেশি ভালোবাসিস। আর সবচেয়ে বড় কথা তোর্সা তোকে ভালোবাসে। এত ভাবিস না। শোন, আমি একটু আসি। অনেকজনকে কিছু বলার আছে।"
"কাকে? কি বলবি?"


*******
শেষের আগে ..


বুঝলেন, আমি ওদের দুজনকে একটু একা রেখে চলেই এলাম, আপনাদের কিছু জিনিস জানাবো বলে। আর এইসব মুহূর্তে তৃতীয় ব্যক্তিকে থাকতেও নেই। 
যাইহোক, যা বলছিলাম- প্রথমত, অষ্টমীর সকালে রাহুল-তোর্সাকে দেখে আমি আমার ১০ বছরের ভাইকে বলেছিলাম, তোর্সার কোমরে আর রাহুলের হাতে দুটো পটাপট চিমটি কেটে বসে পড়ে ধীরে ধীরে সরে যেতে ওখান থেকে। তাই করলো ও। রাহুল আর তোর্সা পাশাপাশি থাকায় দুজন দুজনের দিকে তাকালো। রাহুল হয়তো ভেবে খুশি হচ্ছিল, ওকে তোর্সা চিমটি কেটেছে। কিন্তু তোর্সা? হাহাহাহাহা। কি হলো তা তো দেখতেই পেলেন। ভাবছেন কী খারাপ কাজটাই না করলাম আমি! আসলে সম্মানে আঘাত করলে তাতে মলম দেওয়ার জন্য আর মানুষের স্বরূপ দেখানোর জন্য এরকম কিছু খারাপ কাজ আমি করে থাকি। 
দ্বিতীয়ত, কাল বিকেলে তোর্সা দেখা করে এটাই বলেছিল যে ও আয়ানকে পছন্দ করে। আয়ানের কাছে যেতে চায়, কিন্তু আয়ান নানাভাবে ওকে ইগনোর করে। এমনকি নানা অছিলায় আয়ানের বাড়ি গেলেও আয়ান নিজের ঘরের দরজা বন্ধ রাখে। কেন এরকম? এই একই প্রশ্ন ও রাহুলকেও করার জন্য রাহুলের সঙ্গে বেরোতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু বলতে পারেনি।
আমি সব শুনে আমাদের সবটাই বলেছিলাম, কিছু লুকাইনি। বলেছিলাম, হয়, আয়ান তোর্সাকে আমাদের জন্য ইগনোর করে বা হয়তো ভাবে তোর্সা চলে যাবে, থাকবে না।
তোর্সা আমার অনুভূতির কথা জেনে চুপ করে গেছিলো। আমিই ওকে ভরসা দিই আমার ব্যাপারে যে, আমি কিছু মনে করবো না। তোর্সা অভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, "কি করে ওকে বোঝাতে পারি আমার কথা?"
"কাল বিজয়া দশমী। ও ধুনুচি নাচ করেই। তন্ময় হয়ে থাকে ঐসময়। তখন যদি কিছু পারিস।" কিন্তু তোর্সার মাথায় যে এই প্ল্যান আসবে আমি ভাবতেও পারিনি।
কি ভাবছেন? আমি মহান? না আসলে তা না। জানেন, ভালোবাসা আমাদের ভেতরে এক অদ্ভুত ক্ষমতার জন্ম দেয়। আমাদের ত্যাগ করা, কষ্ট পাওয়া, আনন্দ করা সবকিছুর নতুন এক লিমিট তৈরি করে। আমরা বুঝতে পারি, আমরা এইটুকু নই, আমাদের ক্ষমতা অনেকটাই বেশি। আর আমিও সেটাই পারলাম, আয়ানের বন্ধুত্বের জন্য। 
আমরা সকলেই অলক্ষ্যে বা জ্ঞানত চেষ্টা করে যাই যাতে নিজেরা ভালো থাকি। কিন্তু আয়ান নিজে সবসময় চেষ্টা করে যাতে অন্যরা ভালো থাকে। তাই যার থেকে ভালোবাসার প্রকৃত মানেটা বোঝা, তাকে যদি আমি একটু খুশি করতে পারি, তাহলে হয়তো আমিও কিছুটা ভালোবাসতে শিখলাম। তাই না? 


বুঝলেন, ভাসান শুরু হবে। যাই। আসছে বছর আবার হবে।