0

প্রবন্ধ - সনাতন সিংহ

Posted in






শ্রাবণের সহচর বৃষ্টি। একেবারে নাছোড় বান্দা। লেগেই থাকে। যেন সময় আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকে শুধু। যেই না গ্রীষ্ম শেষ, ওমনি মৌসুমীর হাতছানিতে তা ঝরে পরে 'মুখের পরে, বুকের পরে'। সেই মুখ ও বুক যেমন আমাদের প্রকৃতি, তেমনি আমাদের সাহিত্য ও মানব-জীবন। তবে মনে বা সাহিত্যে তার প্রভাব কম নয়। বিস্তর। রবিঠাকুরের ঝর্ণা কলমও মুখর হয়ে ওঠে তার লাবণ্যে। যেন কলম নয়, তুলি, কবিতার ক্যানভাসে বর্ণনাময় হয়ে ওঠে তা... 'টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে নদে এল বান'।

সে বৃষ্টিতে নদীর বুক ছলাৎ ছলাৎ করে উঠুক বা বান ডাকুক বাচ্চাদের কাছে ভিন্ন। তারা দল বেঁধে সুর করে তাকে ডাকে, 'আয় বৃষ্টি ঝেঁপে/ ধান দেব মেপে।' ধান মেপে দিতে গেলে মাঠে তার জোগান থাকা দরকার। যে মাটি ফুটিফাটা, তার বুকে সোনার ফসল ফোলানোর কারিগর, চাষীরাও প্রার্থনা করে আরাধ‍্যের কাছে, 'আল্লা মেঘ দে পানি দে। পানি দে রে।'

তবে কখন সে নেমে আসবে সেই সময় অবধি সবুর করার প্রশ্নই ওঠে না। তর সয় না তাদের বউ-ঝিদের। শুরু করে দেয়, 'মেঘারানির ব্রত'। ব্রত পালন করতে করতে গলা মেলায়... 'হ্যাদে লো বুন মেঘারানি/হাত পাও ধুইয়া ফেলাও পানি/ ছোটো ভুঁইতে চিনচিনানি/ বড়ো ভুঁইতে হাঁটু পানি।'

ব্যস, 'বিন্দু বিন্দু জল' দল বেঁধে নামে বৃষ্টি হয়ে। বর্ষাও হয় মুখর। মন নাচে কবিরও। অক্ষরে অক্ষরে তারা জন্মলাভ করে ভাষার ঔরসে, 'বর্ষা যখন খুলল খাতা, প্রেমের লেখাও পারুক সে/ মেঘ যদি হয় দীপ্তি নভাল, শহর তবে ফারুক শেখ।'

প্রেমিক সত্তা তখনই যেন অভিসারের পটভূমি রচনা করে। প্রেমিকাকেও চাক্ষুষ ও স্পর্শ করতে চায় বৃষ্টি শরীরে। 'ঝিন্টি তুই বৃষ্টি হতে পারতিস/ ঝরে পড়তিস টিপ টুপ টাপ গায়ে মাখতাম।' মন-মদিরা পাল তুলে ভেসে যায় পানসি মেঘের সঙ্গে। 'নীল নবঘন'-এ আকাশ তখন এলোকেশী। থেকে থেকে বিজলীর ঝলকানি। আকাশ চেরা গর্জন। দিগন্ত ওঠে কেঁপে। আর কোন সুদূরে অপেক্ষারত প্রেমিকার উদ্দেশ্যে সন্দিগ্ধ প্রেমিক উৎকণ্ঠা জানায়, 'মেঘ করেছে মেঘের মতোই সাজাচ্ছে সে বৃষ্টিসেনা/ ধরেই নিলাম, এই চিঠিটাও তোমার কাছে পৌঁছাবে না।'

সেসব তো আর আবহাওয়া দপ্তর দেখবে না। আবার উপেক্ষাও করেও না। মেঘেদের ভেলা দেখে বিজ্ঞপ্তির অঞ্জলি-বাক্যে ভরিয়ে দেয়... হালকা থেকে মাঝারি বা ভারি, আবার কোথাও বা অতিভারি বৃষ্টিপাত হবে। সেই রকমারি বৃষ্টি সশরীরে নেম আসে মাটিতে। দেখলে মনে হবে জল-ভারি মেঘের দল যেন অর্ঘদান করছে বসুমাতাকে। আর তার ধারায় সশরীরে সপরিবারে ভিজছে আকাশ-গঙ্গার নিচে। তবে বর্ণনার বহর অনুযায়ী সে যেখানেই ঝরুক না কেন, তা কবির চোখে ভিন্ন রকম। 'ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি/ ইলিশ মাছের ডিম/ ইলশে গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ি/ রোদ্দুরে রিমঝিম।'

সেই ইলশে গুঁড়িতে জেলের মন উড়ু উড়ু করলেও বিরহী-মন আবার জানলায় বসে বেদনাকুল। অক্ষরে অক্ষরে তারা শরীর পায়। প্রিয়রও কাছে নিজের ব্যথাতুর করুণ ছবি দেখাতে চায় দ্বিধাহীন ভাবে। সে বেদনা কম কিসে? 'ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতায় ঝর না/ আমার এত সুখের কান্নার দাগ ধুয়ো না/ সে যেন এসে দেখে তার বিরহে কত আমি কেঁদেছি।'

সবার ইচ্ছে পূরণ করা কি সহজ-সাধ্য? কার কথা রাখবে শুনি? নিজস্ব বলে কি কিছু নেই তার? নাকি খালি লোকের শখ বা ইচ্ছে অনুযায়ী ঝরবে? কোনো কোনো দিন সেসব উপেক্ষা করে সে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ে, দেশ-দেশান্তরে। মনাকাশ থেকে সাদাখাতার বেলাভূমি ভিজিয়ে দেয় ব্যক্তিরসে। তখন সে বিগলিত হয়ে ঘোষণা করে, 'আর হ্যাঁ, শোন-এখন আমি মেঘ নই আর/ সবাই এখন বৃষ্টি বলে ডাকে আমায়।'

প্রকৃতি ডুব দেয় স্নিগ্ধতায়। মন কেমন করে ওঠে অনেকের। ভাইয়ের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে দিদি। 'ওপারেতে কালো রং/ বৃষ্টি পড়ে ঝমঝম/এ পারেতে লঙ্কাগাছটি রাঙা টুকটুক করে/ গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে।'

তবুও সে 'আষাঢ় গগনের' বুক চিরে নিজের দায়িত্ব নিজেই কাঁধে তুলে নেয়। সবার মঙ্গলে, সবার আবদারে ভেসে বেড়ায় প্রত্যাবর্তনের বিশুদ্ধ অঙ্গীকারে। মেঠো পথ থেকে শহুরে নালা বা শুকনো ঘাসের থেকে নবীন প্রেমাস্পদ, শুনতে পায় সে আকাশবাণী, 'এখন পুরো বর্ষা চলছে/ তাই আমরা সবাই এখন/ নানান দেশে ভীষণ ব্যস্ত/ তুমিও যাও, মন দাও গে তোমার কাজে/ বর্ষা থেকে ফিরে আমরা/ নিজেই যাব তোমার কাছে ।”

নিজের দেশে ফিরে আসা তখন তার নিজের উপর নির্ভরশীল নয়। পথ আটকে দাঁড়ায় অনেকে। স্কুল-কলেজ-অফিস -আদালতে রুটিন মাফিক জীবন কাটানো, অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক কর্তব্যকে উপেক্ষা করে কায়মনবাক্যে আহবান করে বৃষ্টিকে, 'সকল থেকে বলছি, আকাশ ঢালো একটু ঢালো/ ঠিক দশটায় ঝম ঝমাঝম বৃষ্টি হলে ভালো/বৃষ্টি হলে ঘরের ভেতর শুকতে দিস কাপড়/ বৃষ্টি হলে দুপুর বেলায় খিচুড়ি আর পাঁপড়'।

তবে কারোর 'বুকে যখন বৃষ্টি নামে নৌকা টলমল', তখন অন্তর সিক্ত হয় অনুরাগে। 'বৃষ্টি নামল যখন আমি উঠোন পানে একা/দৌড়ে গিয়ে ভেবে ছিলাম তোমায় পাব দেখা/হয়তো মেঘে-বৃষ্টিতে বা শিউলিগাছের তলে/আজানুকেশ ভিজিয়ে নিচ্ছ আকাশ-ছেঁচা জলে।'

বৃষ্টির নিজের নিয়ন্ত্রণ আর নিজের উপর থাকে না। নিম্মচাপ উস্কানি দেয় সুযোগ বুঝে। দলে দলে তারা নেমে আসে। দুকূল ছাপায়। আপন বেগে পাগল পারা হয় নদ-নদী। ভেসে যায় ঘরবাড়ি, গাছপালা, পশু, মানুষজন। কলম তখন দার্শনিক হয়ে কানে বসে থাকে না, নেমে আসে সাদাখাতার সমুদ্রে। 'নিরবধি সাত দিন বৃষ্টি নিরন্তর/আছুক শস্যের কার্য হেজ্যা গেল ঘর'।

বন্দি হয় জনজীবন। থমকে যায় দিনলিপি। কর্মনাশা দিন কানের কাছে এসে বলে যায়... 'বৃষ্টিতে দেখা যায় না পৃথিবী/বৃষ্টি গড়ে তোলে নিজস্ব দেয়াল।'

সংসার অচল হয়ে অনাসৃষ্টির বৃষ্টিতে। ভাতের হাঁড়ি ভেলা হয় হা-ভাতে। পেট হাহাকার করে। নুন আনতে পান্তা ফুরানো হিসেবি জীবন সংসার-দলিলে নিজের অভাবী কলম ধরে, বেদনার-কালি জ্যান্ত হয়ে ওঠে নিদারুণভাবে, 'শ্রাবণব্যাপারী আমি, মেঘে মেঘে আমার উপায়/যত উপার্জন করি, বৃষ্টিতে খরচ হয়ে যায়।'

তবুও তা উপেক্ষা করে কোথাও আবার কেউ চাতকের মতো অপেক্ষা করে। দিন বদলের আশায় দিন যাপন করে প্রতিদিন। উপাচারে উপাচারে আরাধনা করে মেঘমল্লারের কাছে। সেই অন্তরাকুতিময়-বাষ্প বয়ে বেড়ায় বাতাস। 'বিহিত হবেই। মেঘ বদলের কাব্যি লিখছে একটা লোক/ তোমার জন্যে অন্য কোথাও অন্যরকম বৃষ্টি হোক।'

0 comments: