Next
Previous
Showing posts with label ছোটগল্প. Show all posts
1

ছোটগল্প - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


ছোটগল্প


তামাশা
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়


নেশার ঘোরে বিরজু জুয়াখেলায় যে কি ডাক হাঁকছিল, সে নিজেই জানে না। ডাক দিচ্ছে আর হেরে ভূত হচ্ছে। লখিরামের তাতে খুব আনন্দ। খুচরো পয়সাগুলো দুহাতে কুড়িয়ে নিচ্ছে, যেন হরির লুটের পয়সা। যত পারো তুলে নাও। না, বেশী টাকা নিয়ে ওরা জুয়া খেলে না। একটাকা, দু’টাকার খুচরো করে, তাই নিয়ে সন্ধ্যায় জুয়ার আসর পাড়ে। সঙ্গে তাড়ি। লখিরাম দু এক চুমুক দেয়, বাকিটা বিরজু একাই সাবাড় করে। খেলে তো ভারি দুটো-তিনটে টাকা নিয়ে, লেকিন চাল দেখো ইসকো, একদম রাজাবাবু মাফিক ! গলায় দু ঢোঁক পড়ল তো একেবারে বাদশা, শাহেনশা। কে বলবে তখন যে বিরজু হল এ তল্লাটের নর্দমা পরিষ্কার করার জমাদার। বাপরে! উসকো কিছু বোলবে, তো মারতে আসবে!

লখিরামও এই সুযোগটা নেয়। আজকেও তার ব্যতিক্রম হল না। যে কটা টাকা খুচরো করেছিল বিরজু, তার সবটা লখিরাম জিতে নিল। পয়সাগুলো গুটিয়ে তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল লখিরাম। বিরজু তখন মহানিদ্রায় মগ্ন। লখিরাম উঠে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বনোয়ারী সামনে এসে হাজির। চোখের ইশারা করল বিরজুকে দেখিয়ে। লখিরাম পা দিয়ে বিরজুকে একটা ঠেলা দিল তারপর ওর দিকে তাকিয়ে মাটিতে থুক্‌ করে থুতু ফেলল---মর গয়া, শা লা!’ 

(২)

ঘুমটা যখন ভাঙ্গল বিরজুর, তখন মাঝরাত। এক চিলতে খাপরার ঘরের উঠোনে প্রকান্ড এক বটগাছের তলায় সে চিৎপটাং হয়ে পড়ে আছে। এই বটগাছের তলাতেই ওদের বসার ঘর, খাবার ঘর, জুয়ার আসরের জায়গা, গরমের দিনে ফুরফুরে হাওয়ায় এখানে বসেই ধনিয়ার সঙ্গে দুটো সোহাগের কথা...সব। চোখ কচলে উঠে বসার চেষ্টা করতেই গায়ের উপর থেকে চাদর পড়ে গেল। অল্প একটুক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল বিরজু। তারপর যেন সব মনে পড়ে গেল। কে তাকে গায়ে চাদর দিল? কথাটা মনে হতেই তড়াক্‌ করে উঠে বসল বিরজু। ধনিয়া...সেই তাকে গায়ে চাদরটা ঢেকে দিয়ে গেছে। লেকিন, ধনিয়া কোথায়? ‘আরে..., এ ধনিয়া!’ জোরে ডাকার চেষ্টা করল বিরজু কিন্তু কিছুটা নেশার পর ঘুম ভাঙ্গার কারণে আর কিছুটা ধনিয়ার ভয়ে গলা দিয়ে সেরকম আওয়াজ বার হল না। গতকাল, মাত্র গতকালই ধনিয়ার সঙ্গে ঝগড়া, একেবারে হাতাহাতি বলা যায়। মারমুখী হয়ে উঠেছিল ধনিয়া।–পি ব, তো দূর ভাগ্‌! ইতনা পিবে তো নাই থাকব। দারুবাজ কঁহিকা...! না দানাপানি, না কুছ...খালি দারু, খালি দারু। ভাগ যাব, নহি রহনা হ্যায় মেরেকো...ছিঃ’ ঘেন্নায় মাটিতে থুতু ফেলেছিল ধনিয়া। চলে যাবে সে। কেন থাকবে? কি দেয় তাকে? 

--আরে...যা যা! কঁহা যাইব, হ্যায় কোই আপনা?’ হ্যা হ্যা করে হাসতে হাসতে ঝগড়া করে বিরজুও। 

পালটা জবাব ধনিয়ারও---হাঁ আছে। এই দুনিয়ায় কি কেউ নেই নাকি? ইঁট ভাটাতে কাম করবে, ঘর বানাবে। ভাগ যাবে সে। দারুবাজের সঙ্গে আর নয়। বার করে দেবে ঘাড় ধরে। বেইমান !! মনে পড়তেই উঠে দাঁড়াল বিরজু। একবার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, দেখতে পেল না ধনিয়াকে। ঘর খালি। বাইরে এসে আকাশের দিকে একবার তাকাল। রাত তখনও অনেক বাকি। এত রাতে গেল কোথায়? তবে কি বনোয়ারী, লখিরামের সঙ্গে ওদের বাড়ি গেছে? লখিরামের বৌয়ের সঙ্গে ভারি ভাব ধনিয়ার। ওই বৌটাই যত নষ্টের গোঁড়া। সব ধনিয়াকে মন্তর দিচ্ছে। মনে মনে একটা খারাপ গালি দিল বিরজু। রাগে-দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করল। আর কোনদিন সে নেশা করবে না। মা কি কসম্‌... ধনিয়া কি কসম্‌! দরজায় গোড়ায় বসে রইল বিরজু সারারাত। 

(৩)

পরের দিন সকালেই বস্তিতে গোলমাল। ধনিয়া বস্তির ধারে বড় নর্দমার পাড়ে বসে মাথায় হাত দিয়ে কপাল চাপড়াচ্ছে আর কাঁদছে---আরে, কোই উঠাও উসকো...উ তো মরিয়ে যাবে। আরে, কোই উঠাও... বিরজু...এ বিরজু...তু মরনা নহি রে...বিরজু...’ নর্দমা পরিষ্কার করার জমাদার বিরজু নিজেই বড় নর্দমার ভিতর আধ শোয়া হয়ে পড়ে আছে। আকন্ঠ তাড়ি গিলে নেশায় একেবারে টইটম্বুর। নর্দমার জল বয়ে যাচ্ছে শরীরের উপর দিয়ে। মাঝে মাঝে বিড় বিড় করছে---ধনিয়া..., তু মত্‌ যা রে, উ শালা লখিরাম কি অউরত কে পাস.....সব পয়সা লে লিয়া রে... তু মত্‌ যা রে...’ বলেই ভেউ ভেউ করে কান্না...। ধনিয়ার চীৎকারের সঙ্গে বিরজুর কান্না মিলেমিশে এক। যেমন নেশা না করলে ওদের মিলমিশ হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি...!

নর্দমার দুপারে বস্তির লোকের ভিড়, তামাশা দেখছে। ইয়ে দুনিয়া ভি অজীব... !
0

ছোটগল্প - মৌলি ঘোষ

Posted in


ছোটগল্প


রাজকন্যেদের মা 
মৌলি ঘোষ 



আলোর স্নিগ্ধ জোয়ারে ভেসে যাচ্ছে জগৎ-সংসার। জ্যোৎস্না আতরে সুরভিত প্রতিটা জীব,নির্জীব।গাঢ় সবুজ পাতাগুলোর সঙ্গে পূর্ণিমার আলাপ শুরু হয়েছে, চলবে রাত্রির অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত। পাতার ফাঁক দিয়ে খণ্ড খণ্ড জোছনা অসম নুড়ির মতো রাস্তায় ছড়িয়ে আছে। হাওয়ার দোলনায় চেপে নারকেল গাছের পাতাগুলো পুলকে এ-ওর গায়ে লুটিয়ে পড়ছে। পুকুরপারে ঝুঁকে থাকা বুড়ো পাকুর গাছটা জলদর্পণে নিজের কাঁপাকাঁপা ঢেউ খেলানো জলছবি দেখছে নিবিষ্ট মনে, ভাবখানা দেখে মনে হয় যেন আরও কয়েক যুগ ধরে দেখে যাবে। মন পাতলে শোনা যায় বিশ্ব চরাচরব্যাপী ধ্বনিত হতে থাকা মহা সঙ্গীতের সুরধ্বনি।

সংসারের দুঃখ যন্ত্রণা যত, তার সবটুকুই ব্লটিংপেপারের মতো শুষে নেবার উপযোগী চমৎকার অলৌকিক এক রাত।

সমগ্র জীবকূল নিজেদের মতো করে যাপন করছে এই অপার্থিব সৌন্দর্য। ভালোবাসায় ভিজছে কেউ, কেউ বিরহবাষ্পে কাতর, অভিমানক্লান্ত এবারে খানিক উদাসী। আবার কোথাওবা লেখা হতে থাকে স্নেহ-মায়ার অভূতপূর্ব কাহিনি।

ঐ যে মাঠের পশ্চিমদিকের একদম শেষ যে মাটির কুঁড়েটা, যেটার দেওয়ালে থ্যাবড়া থ্যাবড়া ঘুঁটের ওপর চাঁদের আলো পড়ে অদ্ভুতুড়ে, ঘরের জানলা বলতে চালার থেকে অল্প নিচে একটা ছোট্ট গর্ত, বৈচিত্র্যহীন কুঁড়েটার ঘুলঘুলি দিয়ে মুখ বাড়ালে দেখা যায় চিরকালীন মধুর দৃশ্য। মায়ের কোলের নরম সিংহাসনে অধিষ্ঠাত্রী কন্যা। চিলতে ঘরটুকুর মধ্যে আলো বলতে ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে পড়া টুকরো জ্যোৎস্না, সে বোধহয় উৎসুক দুজনের গল্পে।

- আমরা ওই চাঁদটাতে যাব।

- সেখানে তো থাকে ওই চাঁদের বুড়ি। আমরা বরং ওই তারাগুলো হব।ও---ই যে বড়োটা,ওটা আমি,আর পাশের ছোট্ট চুমকির মতো যেটা, ওটা আমার রাজকন্যে।

মা-মেয়ে ঘুলঘুলির গর্তটুকু দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাজকন্যের মা’র আজকের আকাশটা বড়ো মায়াবী মনে হয়। সুন্দর লাগে এতোটাই,যেমনটা এর আগে মনে হয়নি কোনোদিনও। পুরনো কতো কথা ভিড় করে আসে, শৈশবের টুকরো টুকরো স্মৃতি। তার মা ঠিক এভাবেই কোলে নিয়ে তাকে দেখাতো রাতের আকাশ। সে সই পাতাতো তারাদের সঙ্গে। আর তার জন্মান্ধ বাবা দাওয়ায় বসে মা-মেয়ের কথা শুনত মন দিয়ে। প্রিয়তম দুজনের গল্প-কথার মধ্যে দিয়ে তার মন অনুভব করতো রাতের আকাশকে। সেই কবেকার কথা, যেন পূর্বজন্মেরই। বাপ কালীমন্দিরে বসে গান গাইত। মেয়েও বাপের কোলে বসে মিহি গলায় গুনগুন করতো। ভক্তদের কোলাহলে সে সুর চাপা পড়ে যেত। মন্দিরের ঘণ্টা, বামুনঠাকুরের মন্ত্রধ্বনি, ধূপের গন্ধের সঙ্গে মিশে যাওয়া নৈবেদ্যর ভেজা আতপচালের গন্ধ- সবকিছু মিলিয়ে খুব ভাল লাগত তার। আর সব চাইতে আনন্দের ছিল মন্দিরের পিছনদিকে যে পেয়ারাগাছটা,তার ডাল ধরে ঝুলে দোল খাওয়া। মুখটা আকাশের দিকে তুলে ধরা, পা’দুটো মাটির খানিক উপরে,সে এক অদ্ভুত অনুভূতি,দারুণ ভালোলাগা। তবে কোনো কোনো সময় তার মনটা হঠাৎ কিরকম করে উঠত, ঠিক যে কি সেটা বুঝে উঠতে পারতো না, তখ্খুনি ছুট্টে গিয়ে মায়ের কোলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠত।

মন্দিরে আসা ভক্তদের দাক্ষিণ্যে ওদের সংসারটা কোনোরকমে চলে যেত। অভাবের ঘুণপোকা ওই মানুষদুটোর মনগুলোকে ফোঁপরা করতে পারেনি। শান্তির, সহমর্মিতার কোনো খামতি ছিলনা। গরিব মা-বাপের কাছে সে অনাদর পায়নি কখনো।

বিচ্ছিরি রকমের কর্কশ শব্দে নাম না জানা নিশাচর ছিন্ন করে দিয়ে গেল স্মৃতিলাটাইয়ের সুতো। ভেজা গাল মুছে নিয়ে রাজকন্যের মুখের দিকে চাইল। খুব যত্ন নিয়ে আজকে সাজিয়েছে মেয়েকে। গেলোবারের আগেরবার পুজোর যে লাল রঙের ফুলফুল জামাটা,না, রাজকন্যের বাপ দেয়নি। তার সে সাধ্যি নেই। শহর থেকে একদল ছেলে-মেয়ে গ্রামের বাচ্চাদের মধ্যে বিলি করতে এসেছিল। রাজকন্যেকেও দিয়েছিল। 

পিঠের কাছটা একটু ফেঁসে গেছিল, দুপুরে বসে সেটা সেলাই করেছে। লাল জমির ওপর হলদেটে-সাদা সুতোর ফোঁড়, অনেকগুলো ছড়িয়ে থাকা কাঁটা যেন। তা হোক গে, ওইটুকুটা বাদে একেবারে নতুনই প্রায়। ওটাই পরিয়ে দিয়েছে। চোখে লম্বা করে কাজল টানা,ঠিক যেমনটা তার মা এঁকে দিত তার চোখে,ডাগর চোখের রূপকথার রাজকন্যাই লাগছে তার মেয়েকে। সরকারি হাসপাতালের কাগজে ওই নামটা না থাকলেও মেয়েকে মা ওই নামেই ডাকে। তার নাড়ি ছেঁড়া ধন, তার রাজকন্যের আজ সবথেকে বড় দিন, শুরু হবে নতুন এক জীবন।

ঘুলঘুলির উল্টো দিকের দেওয়ালে পুরোনো একটা ক্যালেন্ডার টাঙানো, বিয়ের ক’দিন পরে রাজকন্যের বাপ এনেছিল। তখনো মানুষটা ঘরে একেবারে বসে যায়নি। মাঝেসাঝে শহরে কাজে যেত। সেই কাজে গিয়েই একবার ফিরল প্রায় দু হপ্তা পর। ফিরল যখন,তখন ডান হাতটা কনুইয়ের কিছুটা ওপর থেকে নেই। সেও ছিল এক পূর্ণিমার রাত। 

ঘরটায় আলো বলতে ঘুলঘুলি দিয়ে ঢুকে পড়া একফালি জ্যোৎস্না। তাতেই ঘরের সবটুকুই স্পষ্ট দেখা যায়।এ বাড়িতে দিনের আলো নিভে যাওয়ার পরে অন্ধকারে থাকাটাই চল।মানুষগুলো দিবারাত্রি যেখানে খিদের আগুনে জ্বলছে,সেখানে তেল পুড়িয়ে আলো জ্বালার কথা এরা ভাবতেও পারে না। 

চাঁদের আলোয় ক্যালেন্ডারের ছবিটা স্পষ্ট দেখা যায়। দড়ি বাঁধা,সরু জং ধরা শিকের নিচে মলিন হয়ে আসা ছবি। নন্দদুলালকে যশোদা মাখন খাওয়াচ্ছে। হলুদ রঙের পোশাক, মাথায় ময়ূর-পালক, গলায় মুক্তোর হার, মুঠিতে ছোট্ট বাঁশিটি ধরা গোপালের মুখময় মাখন। ছবিটা রাজকন্যের খুব পছন্দের। পান্তার সানকিটা নিয়ে ওখানেই বসলো। ছবিটা দেখতে দেখতে মেয়ে খুব তাড়াতাড়ি খেয়ে নেয়, লক্ষ্মী মেয়ে তার। মেয়েকে জড়িয়ে আদর করে খাওয়াতে বসল। নুন, লেবু পাতা চটকে মেশানো মণ্ড।

অমৃত।

বড়ো বড়ো গ্রাস মেয়ের মুখে ভরে দিচ্ছে। সারাদিনের উপোসি রাজকন্যে চাকুম চুকুম খায়।

একটু পরে ছোট্ট শরীরটা ঢলে পড়ে কোলে। মা দেখে, মেয়ের শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, তাকিয়েই থাকে। ছিন্ন বুকের আঁচল দিয়ে মেয়ের মুখের চারপাশের ফেনা ওঠা গ্যাঁজলা পরম মমতায় মুছিয়ে দিয়ে চুমু দেয় কপালে।

রঙিন স্বপ্ন নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছিল যে মেয়েটা, তার স্বপ্নের প্রথমবার মৃত্যু হয় প্রথম কন্যা সন্তান বিক্রি হবার পরে। আবারও স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে দ্বিতীয় মেয়ের বেলাতেও। অভাবের সংসারে বাড়ির মেয়ে সম্পদ বইকি! রোজগারের মূলধন। তৃতীয়বার স্বপ্ন-মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রাজকন্যের মা মেয়েকে নিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল। ধরা পড়ে বেধড়ক মার খেয়েছে। বাইরে থেকে দরজায় তালা দিয়ে রেখেছে ওদের। একটু আগে অবশ্য সানকিতে পান্তাটুকু দিয়ে গেছে, অসুস্থ মালের দর উঠবেনা যে, তাই কৃপাটুকু।

ও এবারে আগে থেকে বিষটুকু যোগাড় করে রেখেছিল, ওই যে হাটবারে বেদেনির দল এলো, ওদের থেকে। ভেবেইছিল,পালাতে না পারলে ওইটা কাজে আসবে। মেয়েকে বুকের মধ্যে জাপটে ধরে ঘটিতে গুলে রাখা বাকি বিষটুকু এক নিশ্বাসে গিলে নিল।





- পাষাণ বলে পাষাণ, নিজে খেলি খেলি, মেয়েটাকেও বিষ দিলি!

- গত তিন মাসে এই নিয়ে দুবার, এর আগে পশ্চিমপাড়ার-

- আহা, কী ফুটফুটে মেয়ে ছিল গো।

- ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট কার হেঁশেলে নেই বাপু তা বলে-

- থামো তুমি পিসি, সব জেনেও আর ঠুলি পরে থেকো না। 

- তা বলে মা হয়ে নিজের পেটেরজনকে বিষ দেওয়া!রক্ষে করো ঠাকুর,

ভাবলেই গা শিউরে উঠছে। 

ফেলে রাখা লাশদুটোর চারপাশের ভিড়টা থেকে টুকরো-টাকরা কথাগুলো ছিটকে আসছে। যে যার মতো আলোচনা- ব্যাখ্যা-গবেষণায় ব্যস্ত। সবকিছু ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে যার গলা,সেই বয়স্কা চিল্লে নিজের বক্তব্য জাহির করছে - বৌয়ের নাকি বেপাড়ার কারোর সাথে রসালো সম্পর্ক, বিশেষ একটা ভঙ্গি করেন শাশুড়িমাতা। নির্ঘাত পেটে এসে গেছিল, তাই লজ্জায় গা বাঁচাতেই এ কাণ্ড। নাতনিটা তার নিজেরই কিনা সে বিষয়েও সংশয় প্রকাশ করলেন। ভিড়ের মধ্যে কেউ খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে ,কেউ বা নির্বিকার। এ ঘটনা খুব অপরিচিত নয় এ তল্লাটে। ভিড়টা থেকে একটু দূরে বাবলা গাছটার তলায় উবু হয়ে বসা চামড়া-হাড়ের কাঠামোটা রাজকন্যের বাপ। চামড়ার পোশাক ভেদ করে হাড়গুলো নির্লজ্জের মতো চেয়ে আছে। কোটরের ভেতরে ঘোলাটে বোবা দুটো চোখ, সেখানে কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ পায় না। 

সক্কালবেলা নিজের কাজ ফেলে এসবে সময় নষ্ট করা নেহাতই অবিবেচকের কাজ,তাই জটলাটা কাটিয়ে এগোতে লাগলাম। বেরোতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম যার সঙ্গে, তার পরনে - ময়লা বেরঙিন থান, মাথার সরু ধূসর সিঁথি চওড়া কপালে এসে মুক্তি পেয়েছে,আদুর দুটো হাতে শিশু কন্যাকে বুকের কাছে জাপটে ধরা। কান পেতে শুনলাম বিড়বিড় করছে “বিষটা সোয়ামীর পান্তায় দিতে পারলিনে? মুখপুড়ি।” চমকে উঠলাম। 

ভিড়ের ফাঁক গলে তাকিয়ে দেখলাম মেয়ে তার মায়ের পাশে ঘুমিয়ে। গর্ভধারিণীর চোখে পরম নিশ্চিন্তির ঘুম,নতুন জীবনের স্বপ্নে মগ্ন নাকি! মনে মনে ভাবলুম, বেঁচে গেছে, যা করেছে ঠিক করেছে। পর মুহূর্তেই আঁতকে উঠলাম, এসব কী ভাবছি !

তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে পাড়া থেকে বেরিয়ে এলাম। মোড়ের কুলগাছটার কাছে ছেলেপুলের দল হুল্লোড় করছে। কাছে এসে দেখি, তিনটে বিড়ালের ছানা। ছেলেরদল সেগুলোকে গাছের সরু ডাল দিয়ে খোঁচাচ্ছে। বেশ মজা পেয়েছে তারা। ছানাগুলো ভয়ে কুঁইকুঁই করছে, টলটলিয়ে এ – ওর গায়ের ওপর পড়ছে। মা’টা ছেলেগুলোর দিকে তেড়ে আসছে, তবু পারে নাকি। সে একা, উলটোদিকে জনা ছয়েক। লোমশ পিঠের ভেতর থেকে লাল রেখা উঁকি মারছে, লাঠির ঘায়ে কেটে গেছে। ধমক দিয়ে, কিল পাকিয়ে বীরপুরুষদের তাড়ালাম। 

ছানাগুলো গুটলি পাকিয়ে মায়ের বুকের সঙ্গে লেপটে আছে। ভয়েই বোধহয় পাঁজরের কাছটা তিরতির করে কাঁপছে,নইলে সাদা উলের বল ভেবে ভুল হতেই পারত। গর্ভধারিণী মুখ ঘষে সন্তানদের প্রতি আদর জাহির করছেন। আহা, চোখের কোণটা চিকচিক করে যেন। স্নেহ-মমতার চিরকালীন মধুর ছবি। চোখে ভেসে উঠল একটু আগের দেখা ছবিটা। মাটিতে পড়ে থাকা মা-মেয়ের দেহ। নিষ্প্রাণ। নাকি নতুন প্রাণের সন্ধানী? - তড়িঘড়ি সরে এসে হাঁটা লাগালাম, জোরে, আরও জোরে... 
1

ছোটগল্প - অনিন্দ্য গৌতম

Posted in


ছোটগল্প


অপত্য
অনিন্দ্য গৌতম


“গুডমর্ণিং, তোমার নাম কি?” প্রশ্নটি যিনি করলেন তাঁর উচ্চতা আমার কোমরের ঈষৎ উপরে, পরনে নীল রঙের ফুলপ্যান্ট, কালো সোয়েটার আর পায়ে কেডস জুতো। 

“আমার নাম রণ, রণবীর সরকার, আর তোমার?”

প্রশ্নকর্তা এবার আমার পাশে এসে বললেন, তারপর গম্ভীরভাবে বললেন আমার নাম স্যমন্তকজ্যোতি দত্তরায়, ডাকনাম বুরুন, ঠাম্মা বলে শিবনাথ, আর বাবা বলে কিশমিশ।”

এই শেষ নামটি বলার সময় তেনার মুখের হাসিটি দেখে বুঝলাম পিতৃদত্ত এই নামটি তাঁর বিশেষ পছন্দের। 

“ তুমি কোথায় থাকো?” আবার প্রশ্ন। 

“ওই সামনের ফ্ল্যাট বাড়িটায়।” 

“ও ওটা তো গ্রীনভিউ হাউসিং। আমরা দক্ষিণায়ণ হাউসিং কমপ্লেক্সে থাকি, ব্লক জি, চারতলা, ফ্ল্যাট নম্বর থ্রি সি।” 

আমার সঙ্গীটি দেখলাম গুছিয়ে কথা বলতে ওস্তাদ। তার বাকবিস্তারের প্রতিভা দেখে মনে হয় এ ছেলে বড়ো হয়ে হীরেন মুখুজ্জে বা চার্চিল না হয়ে যাবে না। 

পরবর্তী দশ মনিটে সে জানিয়ে দিলো যে তার বাবা স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইণ্ডিয়ার বরাহনগর ব্র্যাঞ্চে ম্যানেজার, মা একটি স্কুলে পড়ান, তাদের বাড়িতে বাবা – মা ছাড়াও বাসন্তীপিসী আর একটি পাগ প্রজাতির কুকুর আছে, কুকুরটির নাম ক্লিওপেট্রা। এই বাসন্তীপিসী মহিলাটি বুঝলাম পরিচারিকা, খোকার দেখভাল করেন।খঙ্খোকাখ খোকা তাঁকে বিশেষ পছন্দ করে না কারণ, তাকে তিনি জোর করে দুধ, ডিম, কর্নফ্লেক্স, ইত্যাদি অখাদ্য খাবারগুলি খেতে বাধ্য করেন। আর আইসক্রিম, আলুর চিপস, কোল্ড ড্রিঙ্কস, ঠাম্মার বানানো আচার ইত্যাদি পুষ্টিবর্ধক খাবার মোটেও খেতে দেন না। আর যেটা সবচাইতে সাংঘাতিক সেটা হলো বাসন্তীপিসী বাবা মা বেরিয়ে গেলে খোকাকে খাইয়ে দাইয়ে সিরিয়াল দেখতে বসেন, ফলে এই সময়টায় তিনি কার্টুন চ্যানেলের মতো শিক্ষণীয় জ্ঞান বর্ধনকারী অনুষ্ঠানগুলি দেখতে পান না। 

চাকুরীরত বাবা মায়ের এই সমস্যাটা বোধহয় সার্বজনীন। আমার ছোটবেলাতেও এমনটাই দেখেছি। তবে আমদের ছোটবেলায় টিভি ছিলো না। আমাদের ছিলো বই। শীর্ষেন্দু, সুনীল, সমরেশ, সত্যজিৎ রায়ের বই। চিলেকোঠার ঘরে বসে অলস দুপুরে আমরা সেইসব বই গিলতাম। এটুকুই যা তফাত। তানাহলে উত্তর কলকাতার সাবেকী বাড়িতে একুশ জনের একান্নবর্তী পরিবারে বড় হওয়া আমার সঙ্গে এই খোকার কোন তফাৎ নাই। 

খোকা যেভাবে উৎসাহ ভরে ঘাড় নাড়িয়ে তার নিজের কথা বলে যাচ্ছিলো তাতে বুঝলাম খোকা বাড়িতে কথা কইবার লোক বিশেষ পায় না --- আজকাল ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর ছোট ছোট পরিবারে যা হয় কি। তবে একটা জিনিস অবাক লাগলো আমার আন্দাজে খোকার বয়স সাত আট। এই বয়সে ওর মতো সম্পন্ন ঘরের ছেলেরা স্কুলে যায়, কিন্তু খোকা একবারও নিজের স্কুলের কথা বললো না। যাই হোক, খোকা এত উৎসাহ নিয়ে নিজের কথা বলছিলো যে আমি আর ওই প্রসঙ্গ তুলে তাকে অপ্রতিভ করলাম না। 

এমন সময় দূর থেকে কুয়াশার মধ্য থেকে ডাক এলো বুরুন, বুরুন। সঙ্গে একটা কুকুরের ডাক। বুঝলাম বুরুন কথিত বাসন্তী পিসীটি কুকুরটিকে প্রাতঃকৃত্য করাতে নিয়ে বেরিয়েছিলেন, বুরুনবাবু তাঁর সঙ্গী হয়েছেন। বুরুন এবার আমার দিকে চাইলো, তারপর ঘাড়টা উঁচু করে আমার গালে একটা চুমু খেয়ে “কাল এসো, আবার দেখা হবে বলে দৌড়ে পালিয়ে গেলো।” 

আমি পেশায় কম্প্যুটার ইঞ্জিনিয়ার। মাসছয়েক আগে আমার স্ত্রী শ্রীতমার সঙ্গে ডিভোর্সের পরে আমি আমার তৎকালীন কর্মস্থল বেঙ্গালুরু ছেড়ে হায়দ্রাবাদ চলে যাই। শ্রীতমার সঙ্গে বিগত তিন বছর আমার কোন সম্পর্ক ছিলো না। এই দুটো বছরে নিজের দশবছরের বিবাহিত স্ত্রী আর ছয় বছরের বাচ্চার থেকে আলাদা থাকার ফলে আমার দুটি প্রাপ্তি হয়। একটি ডিপ্রেশন অন্যটি এলকোহলিজম। ডিভোর্সের পর শ্রীতমা আমার ছেলে সাম্যর কাস্টডি খুব সহজে পায় কারণ আদালতে এটা খুব সহজেই প্রমাণিত হয় যে আমার বিহেভিয়ারাল সমস্যা আছে, আমি একটি মদ্যপ এবং রেগে গেলে আমার মাথার ঠিক থাকে না। কোর্ট রায় দেয় আমি সপ্তাহে একদিন সাম্যের সঙ্গে কথা বলতে পারবো , কিন্তু ওর মায়ের অনুমতি ছাড়া অর সঙ্গে দেখা করতে পারবো না। সেইদিন রাত্রে স্কচের সঙ্গে একগাদা ট্রাঙ্কুলাইজার খেয়ে আমি আত্মহত্যা চেষ্টা করি কিন্তু অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে হড়হড় করে সব বমি করে ফেলি। আমার দাম্পত্যে, আমার পিতৃত্বে আমি অপদার্থ বলে আগেই প্রমাণিত হয়েছিলাম এবার এটাও প্রমাণিত হয়ে যায় যে আমি একলা বেঁচে থাকার জন্যও অনুপযুক্ত। বেঙ্গালুরুতে থাকা আমার পক্ষে আর সম্ভব ছিলো না। তাই আমি হায়দ্রাবাদে এসে অপেক্ষাকৃত কম মাইনেতে অনেক ছোট একটা ফার্মে জয়েন করি। সেই থেকে দেড় বছর আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্টের এবং সাইকলজিস্টের তত্ত্বাবধানে আছি। বর্তমানে আমার অবস্থা অনেকটাই স্টেবল কিন্তু আমাকে এখনও রেগুলার ওষুধ খেতে হয়। 

ডিভোর্সের পর শ্রীতমা স্টেটসে সেটল করেছে, যতদূর জানি একটি লেবানিজ ছেলের সঙ্গে লিভ ইন করছে। সাম্যের সঙ্গে আমার স্কাইপে যেটুকু কথা হয় তাতে বুঝি ও একটা নতুন দেশে সম্পুর্ণ নতুন পরিবেশে, নতুন সংস্কৃতিতে গিয়ে একেবারে পালটে গিয়েছে, আমি হলপ করে বলতে পারি আর কয়েক বছর পর ও আমার সম্পুর্ণ অপরিচিত একটা মানুষ হয়ে উঠবে। 

ডিভোর্সের পর আমার মা অনেকবার আমার বিয়ের কথা বলেন, কিন্তু আমি রাজী হইনি। আমার কলিগ প্রিয়ার সাথে আমার বারদুয়েক শারীরিক সম্পর্ক হওয়ার একটা সম্ভবনা তৈরি হয়েছিলো --- কিন্তু আমি বুঝেছিলাম যে শ্রীতমা যাওয়ার সাথে সাথে আমার পৌরুষের একটা অংশ নিয়ে চলে গেছে, যৌনতা আমাকে আর আকর্ষণ করে না, ইন ফ্যাক্ট এখন নগ্ন নারী শরীর দেখলে আমার বিবমিষা হয়। ডাক্তার বলেছেন এই ফ্রিজিডিটি, এই এভার্সন টু সেক্স এটা টেম্পোরারি ফেজ, এটা কেটে যাবে ---- কিন্তু আমার তা বিশ্বাস হয় না। মাস ছয়েক আগে এই পৃথিবীতে আমার একমাত্র জীবিত বন্ধন, আমার মা মাল্টি অর্গ্যান ফেলিওর হয়ে মারা গেছেন, তারপর থেকে এই পৃথিবীর একপ্রান্তে, এক মহানগরীর একটি বহুতলের বারোতলায় একটি সুসজ্জিত ফ্ল্যাটে আমরা পাঁচজন বাস করি, আমি, আমার ঘরের চার দেওয়াল আর ছাদ। আমার অফিসের একটা কাজে দিন সাতেকের জন্য কলকাতায় এসেছি, উঠেছি কোম্পানির গেস্ট হাউসে, নিউটাউনের একটা হাউসিং কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাটে। রোজ সকালে ডাক্তারের পরামর্শ মতো আমায় ছুটতে হয়, আজও বেরিয়েছিলাম মর্নিং ওয়াক করতে সামনের পার্কটাতে, সেখানে এই খুদে বন্ধুটির সাথে আমার আলাপ। 

তার পরের দিন মাঠে গিয়েছি।

গিয়ে দেখি বুরুনের মুখ ভার। 

জিজ্ঞাসা করলাম “কি হলো?”

সে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো “তুমি এত দেরী করে এলে কেন? আমি তো ভাবছিলাম তুমি তো আর আসবেই না।”

তার এই ঠোঁট ফোলাবার ভঙ্গীটা আমার অপরূপ লাগলো। আমি যখন নিজের সন্তানের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছি তখন তার বয়স চার মাস। তাই এমনভাবে আমার জন্য কেউ কোনদিন অপেক্ষা করে থাকেনি, এমনভাবে আমার ওপর কেউ অভিমান করেনি, এমনভাবে আমার কাছে আদরের প্রত্যাশায় থাকেনি। এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে একদম নতুন। আমি ওর মাথার চুলটা একটু ঘেঁটে দিয়ে বললাম “রাগ কোরো না বুরুনবাবু, ঘুম থেকে উঠতে দেরী হয়ে গেলো যে।” 

বুরুন আমার কোলের কাছে এসে বলে “আমার বাবাও ঘুম থেকে উঠতে দেরী করে, রোজ। আর মার কাছে বকুনি দেয়। মা প্রথমে জানালার পর্দাগুলো সরিয়ে দেয়, তারপরো না উঠলে গায়ে জল ঢেলে দেয়।”

দাম্পত্য জীবনের অতি পরিচিত খুনসুটির দৃশ্য। আমি দীর্ঘদিন সামাজিক সম্পর্কগুলির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করছি, এইসব সাংসারিক খুঁটিনাটির সঙ্গে বহুদিন পর পরিচিত হতে পেরে অপ্রাপ্তবয়স্ক বালক যেমন নিষিদ্ধ জিনিস হাতে পেলে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে আমারও তেমন মনে হতে লাগলো। 

আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম “তোমাকে সবচেয়ে বেশী কে ভালোবাসে, বাবা না মা?”

বুরুন একটু ভাবলো, তারপর বললো “বাবা।”

আমি বললাম “কেন?”

“বাবা আমার জন্য ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক নিয়ে আসে, চকোলেট নিয়ে আসে। আমি দেয়ালে ড্রয়িং করলেও কিছু বলে না। বাবা বাড়িতে অফিসের কাজ নিয়ে বসলেই বাবার পিঠে দুমদুম করে কিল মারতে থাকি, আর বাবা আমাকে ঘাড়ের ওপর চাপিয়ে, বিছানায় ফেলে কাতকুতু দেয়।”

“আর মা?”

এবার বোধহয় ও একটু ফাঁপরে পড়লো। ভুরু কুঁচকে ভীষণ জটিল একটা কোন সমস্যায় পড়েছে এমন মুখ করে কিছুক্ষণ থাকলো, তারপর বললো “ মাও ভালো, কিন্তু যখন বলে বুরুন দুধ খেয়ে নাও, বুরুন এখন খেলো না, বুরুন চুপ করে বসে থাকো ----- তখন ভালো লাগে না।”

“তাহলে কখন ভালো লাগে?”

“যখন আমার হ্যাপি বার্থডেতে মা বিশাল কেক বানায়, কুকিজ বানায়, সারা বাড়িটা মোমবাতি আর কাগজের ফুল দিয়ে সাজায়, অথবা ক্রিসমাসের দিন আমার বিছানায় চুপিসাড়ে এসে গিফট রেখে যায় যদিও মা ভাবে আমি বুঝি এখনও বিশ্বাস করি যে সান্টাক্লজ এসে গিফট রেখে গেছে, কিন্তু আমি বড় হয়ে গেছি সব বুঝতে পারি এটা মানতেই চায় না।”

বুঝলাম খোকার জীবনে বাবার দিক থেকে প্রশ্রয় বেশী আর মায়ের দিক থেকে বেশী শাসন। আমার ছোটবেলায় ঠিক এর উলটো ছিলো। আমাদের যতো আবদার ছিলো মায়ের কাছে, বাবাকে আমরা যমের মতো ভয় পেতাম। বুঝলাম একটা প্রজন্মের তফাতে অনেক কিছুই পালটে যায়। 

এমন সময় আবার ডাক এলো “বুরুন, বুরুন।”

বুরুন সেদিনের মতোই আমাকে আলতো করে একটা চুমু খেয়ে চলে গেলো। 

সেদিন সারাদিন কাজ করতে করতে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলাম। বারবার বুরুনের মুখ, ওর দুষ্টুমিভরা চোখ, ওর নাক কুঁচকে হাসি, রেগে গেলে ওর ফোলা ফোলা দুটো ঠোঁট আমার মনে পড়ছিলো। নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর একটা সযত্নলালিত বাস্তববাদী, কাজপাগল, উচ্চাকাঙ্খী, উন্নাসিক মানুষের মুখোশ পরে ঘুরে বেড়িয়েছি এই কয়েক বছর, আসলে মানুষের সঙ্গে খোলামেলা ভাবে মিশতে আমার অস্বস্তি হতো, আজ দেখলাম সেই অভেদ্য বর্মটাকে ভেদ করে এই প্রিয়দর্শন বালক আমার হৃদয়ে প্রবেশ করে আমার হৃদয়ে ফল্গুধারার মতো প্রচ্ছন্ন স্নেহের স্রোতকে উৎসারিত করে বের করে দিয়েছে। 

তার পরের দিন মাঠে যেতেই বুরুন আমার হতটা চেপে ধরে বললো “গল্প বলো।” আমি মহা মুশকিলে পড়লাম। একেতো গল্প উপন্যাসের জগত থেকে বহুদিন বিচ্ছিন্ন, তায় গল্প বলার কোন অভ্যেসই আমার নেই। কিন্তু খোকা নাছোড়বান্দা। ওর জোরাজুরিতে গল্প বলতে শুরু করলাম এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলাম আমার ছেলেবেলায় পড়া অনেক গল্প এখনও দিব্যি মনে আছে। 

ঠাণ্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে, তার ওপর এই জায়গাটা জলের আবার জলের ধারে। ফলে একটানা অনেকক্ষণ বসে থাকলে শরীরের অনাবৃত অংশগুলি ঠাণ্ডা হয়ে আসে। বুরুন আমার কাছে বসেছিলো। আমি ওকে রাজকাহিনী থেকে গায়েব গায়েবীর কথা, বাপ্পাদিত্যের গল্প বলছিলাম, বুরুন হাঁ করে করে শুনছিলো, তারপর আমার বুকের কাছটায় এসে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলো। আমি ওর কাঁধের ওপর হাতটা দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বসলাম। দেখলাম ওর গাল আর কানদুটো অস্বাভাবিক ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। আমি আলতো ভাবে ওর গাল আর কানদুটো ঘষে দিতে লাগলাম। ও চুপটি করে ওর মাথাটা আমার বুকের কাছে রেখে বসে রইলো। আমি আমার ছেলেটাকে বহুদিন ছুঁয়ে দেখিনি, তার শৈশবের ছবি আমার মনে এখন অনেকটা অস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, অনেকটা পুরনো সাদা কালো ছবির মতো। আজ এই সদ্য পরিচিত বালকটির স্পর্শ আমার মনে আমার সেই হারিয়ে যাওয়া প্রবাসী সন্তানের জন্য এক অদ্ভুত হাহাকার তুলল। আমি আমার ছেলেকে এখন হপ্তায় একবার দেখি তাও স্কাইপে, সেখানে মার্কিনী ইংরাজীতে ওর সঙ্গে কথা বলে আমার সুখ হয় না, মনে হয় ওকে জড়িয়ে ধরে আদর করি, কিন্তু জীবনে কিছু জিনিস একবার নিজের ভুলে হারালে আর ফেরত পাওয়া যায় না, তাই ওইটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। 

আমি একজন উচ্চাকাঙ্খী যুবক ছিলাম, যৌবনের দর্পে, তীব্র উচ্চাশায় সব সম্পর্কগুইলোকে দুমড়ে মুচড়ে, মাড়িয়ে, গুঁড়ো করে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখানে আমার চারপাশে এক নিঃসীম শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই। একদিন আমার রূপ ছিলো, যৌবন ছিলো , তীব্র প্রাণশক্তি ছিলো, তখন আমার কাছে অর্জন করার জিনিস শুধু বিত্ত, ভোগ করার জিনিস শুধু নারীদেহ, সুরা আর ভোগের হরেক রকম সামগ্রী যা এই পণ্যমনস্ক সভ্যতা আমাদের চারদিকে ছড়িয়ে রেখেছে। তার তাড়নায় উদভ্রান্তের মতো ছুটেছি, আজ এই উত্তর চল্লিশে যখন স্থিতু হয়ে বসলাম তখন জমা খরচের হিসেব করতে গিয়ে দেখি খরচের ঘরেই অংক বেশী।

যে সময় সাম্য আমার জীবনে এসেছিলো, তখন আমার আর শ্রীতমার মধ্যে তীব্র অশান্তি শুরু হয়েছে, একটা সময় সাম্যের পিতৃত্ব নিয়েও আমার মনের মধ্যে সংশয় ছিলো, ফলে ওর শৈশবটা আমি কিছুই উপভোগ করতে পারিনি। আর যখন প্রথম ওর অভাব বোধ অনুভব করতে শুরু করলাম, তখন ও আমাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গিয়েছে। আমার শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত এই শহরে এই অপরিচিত বালকের হাত ধরে আমার অতৃপ্ত শুষ্ক পিতৃহৃদয়ে যেন একপশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো।

তারপর তিনটে দিন আমি যেন নতুন করে বাঁচলাম। আগে প্রতিটা দিন ক্লান্ত হয়ে নিজের শরীরটাকে ঘষটাতে ঘষটাতে ঘরে ঢুকেই মদের গ্লাস নিয়ে বসে পড়তাম। ততক্ষণ মদ খেয়ে যেতাম যতক্ষণ পর্যন্ত না চোখদুটো ঘুমে ঢুলে আসছে। বিগত এতগুলো বছরে আমি টিভি দেখিনি, কোন বই পড়িনি, যেকোন সামাজিকতা থেকে নিজেকে ছোঁয়াচে রুগীর মতো দূরে সরিয়ে রেখেছি । অথচ বিগত কটাদিন আমি একদম মদ ছুঁইনি, গোগ্রাসে গিলেছি সদ্য কলেজ স্ট্রিট থেকে কিনে আনা সত্যজিৎ, সমরেশ, সুনীল শীর্ষেন্দুর ছোটদের গল্পগুলো। আমার মনে পড়ে গেছে উত্তর কলকাতার সেই বাড়ি, তার শ্যাওলা ধরা উঠোন, সেই কলতলা, সেই শ্রীহীন ঘরগুলো, যেখানে আমার সমগ্র শৈশব কেটেছে, আমার মনে পড়ে গেছে ঠাকুমার আচারের বয়াম, কয়েতবেল মাখা, নীলষষ্ঠীর সাবু নারকেল, অরন্ধনের গোটা সব্জী সিদ্ধ। আমার মনে পড়ে গেছে বিজয়া দশমীর কুচো নিমকি, জিবেগজা আর লুচি আলুর দম, লক্ষ্মী পুজোর তিলের নাড়ু, নারকেল ছাপা, আর নারকেল কোরা দিয়ে বানানো পাঁচমিশেলি ডালের খিচুড়ি ভোগ আর নারকেলের ফোঁপড়া, আমার মনে পড়ে গেছে তালনবমীর তালের বড়া, ইশকুলের বাইরে মন্টুদাদার হাতের ঘুগনী আর আলুকাবলি, আমড়া আর কুলের আচার। সবচেয়ে বেশী মনে পড়ছে সেই নিস্তব্ধ দুপুরগুলো, যখন ছাতে কয়েকটা পায়রা ছাড়া আর কেউ নেই --- তখন চিলেকোঠার ঘরে একটা তক্তপোশে আধশোওয়া হয়ে বসে আমি এক অন্য জগতে চলে গিয়েছি, সেখানে সবাই একটা ছেলেকে অঙ্কে তেরো পাওয়ার জন্য দুয়ো দেয়, সেখানে দারোগারা বেজায় ভীতু, আর চোরেরা ভীষণ চালাক, সেখানে একটা খোঁড়া লোক ইয়েতির সন্ধানে হিমালয়ে ওঠে, আবার হায়ারোগ্লিফিক্স পড়তে মিশরে ছুটে যায়, আবার কোন এক গোয়েন্দা আমারই মতো কিশোর বয়সী এক সহকারীকে নিয়ে সমাধান করে চলে আশ্চর্য সব অপরাধ। এক কথায় এই কদিনে আমি আমার হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলাকে নতুন করে পাচ্ছিলাম। 

আর বুরুন বোধহয় জীবনে প্রথমার এমন একজন মনোযোগী শ্রোতা ওর এই অতিক্ষুদ্র জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার আমার কাছে উপুড় করে দিলো। তার বাবার সাথে খুনসুটি, মায়ের কাছে বকুনি খাওয়ার প্রতিদিনের জীবন যাপনের অজস্র খুঁটিনাটির বর্ণনা আমি হাঁ করে শুনতাম। একটা ছোট পরিবার, বাবা মা আর শিশু কি আশ্চর্য স্বর্গীয় শান্তির নীড় রচনা করেছে। আজ এই বালকের মুখ থেকে অতি পরিচিত সংসার যাত্রার এই কাহিনী গুলি শুনে আমি অনুভব করলাম আমার জীবনটা রিক্ত দিগন্ত বিস্তৃত, ঊষর মরুপ্রান্তরের মতো রিক্ত। রিক্ত এবং অসম্পূর্ণ। বাৎসল্য কি এতবছরে কোনদিন উপলব্ধি করিনি, আজ জীবনে প্রথমবার বাৎসল্যের স্বাদ পেয়ে আমার মনে হলো জীবনে এমন অনুভূতিও আছে যা এমন নাড়ি ধরে টান দেয়।

আজ আমার ফিরে যাওয়ার দিন। গতকালও আমার চলে যাওয়ার কথাটা বুরুনকে বলার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারিনি। বুরুন মহা উৎসাহে গল্প করছিলো যে গতকাল তার বাবা অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফিরে তার মাকে সারপ্রাইজ দেবে বলে রান্না করতে গিয়েছিলো। আনাড়ি হাতের পরীক্ষা নিরীক্ষা বেশীদূর সফলতা পায়নি, উলটে সারা রান্নাঘরটা যুদ্ধক্ষেত্রের চেহারা নেয় ও শেষ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় যে মাছ, মাংস, সব্জী সবকিছু পুড়ে গিয়ে ঝামা হয়ে গিয়েছে। তারপর বাবার কপালে যা জুটেছে তা বলতে গিয়ে খোকা হেসেই কুটোপাটি। শেষ পর্যন্ত হোটেলের খাবার খেয়া ক্ষুন্নিবৃত্তি হয়েছে। খোকাকে এতটাই তৃপ্ত, আর এতটাই খুশি মনে হচ্ছিল যে ওর মনটা খারাপ করে দিতে ইচ্ছা করলো না। ভাবলাম কাল অফিসফেরত ওদের বাড়ি গিয়ে ওকে কিছু দিয়ে আসবো, আর এই সুযোগে ওর বাবা মার সাথে আলাপও হয়ে যাবে। 

পরের দিন যখন দক্ষিণায়ন হাউসিং কমপ্লেক্সের ফ্ল্যাট নম্বর থ্রি সির বেল বাজালাম তখন ঘড়িতে সাতটা দশ। বুরুনের কাছ থেকে শুনেছি যে তার বাবা মা মোটামুটি এই সময়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। আমার বেল বাজানোর পর দরজাটা যিনি খুললেন তিনি একজন মধ্যবয়সী মহিলা। কালো, মোটা, চোখে চশমা, এঁকে মাঠে দেখেছি ইনিই বুরুনের বাসন্তী পিসি।

আমি বললাম “আপনি আমায় দেখে থাকবেন। মাঠে। তবে আমাদের আলাপ হয়নি। ইয়ে একটু বুরুনের সাথে কথা বলা যাবে।” 

ভদ্রমহিলা আমাকে আপাদমস্তক জরিপ করলেন, তারপর বললেন “কিছু যদি মনে না করেন আগে আপনার সঙ্গে একটু আলাদা ভাবে আগে কথা বলতে চাই। কথা দিচ্ছি বেশী সময় নেবো না।”

“বেশ তো’, আমি ভিতরে ঢুকতে যাচ্ছিলাম, ভদ্রমহিলা আমায় বাধা দিয়ে বললেন “ এখানে না, অন্য কোথাও নীচের পার্কে বসার ব্যবস্থা আছে সেখানে চলুন।”

আমি অবাক হলাম। এ আবার কী উদ্ভট প্রস্তাব! তবে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এই নিয়ে কথা কাটাকাটি করতে আমার প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না। আবার কৌতুহলও বাড়ছিলো। 

দুজনে পার্কে একটা বেঞ্চিতে বসলাম। 

“আপনি বুরুন সম্বন্ধে কতটুকু জানেন?” প্রশ্ন করলেন বুরুনের বাসন্তী পিসী। 

আমি ভিতরে ভিতরে কিছুটা বিরক্তও হচ্ছিলাম। তবুও বিরিক্তি চেপে রেখে ওর পরিবার সম্বন্ধে যা শুনেছিলাম সংক্ষেপে বললাম। 

“হুম এরকমই একটা কিছু আশা করেছিলাম।” চশমাটা খুলে ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকালেন। 

“আপনি রোহিনী চৌধুরীর নাম শুনেছেন? অভিনেত্রী রোহিনী চৌধুরী।”

আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বললাম। রোহিনী চৌধু্রী বাংলা সিনেমার বেশ নামকরা নায়িকা ছিলেন। ন্যাশানাল এওয়ার্ডও পেয়েছেন, এখন ছবি না করলেও সিরিয়ালে কাজ করেন। 

“রোহিনী চৌধুরীই বুরুনের মা। বুরুনের বাবা অভ্রজ্যোতি দত্তরায়ের সঙ্গে বুরুনের মার বুরুনের জন্মের মাস তিনেক আগেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বুরুন ওর মায়ের কাছেই থাকে। অবশ্য থাকা ব্যাপারটা আলঙ্কারিক , কারণ রোহিনী এখন হিন্দি সিরিয়ালের জন্য মাসের বেশীর ভাগ সময়টাই মুম্বইতে থাকে। বুরুন এখানে ওর দিদিমা আর আমার কাছেই থাকে।”

“তাহলে ও যেসব কথা বলেছিলো”

“ওগুলো বানানো কথা। ফিগমেন্ট অফ হিজ ইমাজিনেশন।” আমার কথা কেড়ে নিয়ে বললেন ভদ্রমহিলা।“ও ওর কল্পনায় একটা জগত তৈরি করে নিয়েছে, যেখানে ওর বাবা মা খুব কেয়ারিং, ওকে প্রচুর সময় দেন, এই জগতটাতে বাস করতেই ও কমফর্টেবল ফিল করে। এটা নিয়ে কেউ ওকে চ্যালেঞ্জ করলে বা রিডিকিউল করলে ও ভায়োলেন্ট হয়ে যায়। ইনফ্যাক্ট মাসখানেক আগে ও একবার এই কারণে ভায়োলেন্ট হয়ে ওর স্কুলের একটা বাচ্ছাকে সাংঘাতিক ভাবে হার্ট করে। চোখে পেনসিল ঢুকিয়ে দিয়েছিলো। অল্পের জন্য বাচ্ছাটা বেঁচে গেছে। কিন্তু ওকে স্কুল খেকে এক্সপেল করে দিয়েছে। অ্যান্ড হিজ মাদার হ্যাজ টু পে অ্যান অ্যাস্ট্রনমিকাল সাম টূ কভার ইট আপ।”

বুরুনের নিজের ইশকুলের গল্প না করার কারণটা পরিষ্কার হলো আমার কাছে। 

আমি বললাম “কিন্তু এটাতো একটা মানসিক রোগ, এর…” 

“চিকিৎসা! চলছেতো, হি ইজ আন্ডার সাইকিয়াট্রিক সুপারভিশন। বাই দি ওয়ে আমি কিন্তু একজন ট্রেইনড নার্স, আমার স্পেসালাইজেশন আছে এই ব্যাপারে।” 

পুরো ব্যাপারটা এতোটাই অবিশ্বাস্য যে আমি কি বলবো বুঝে উঠতে পারলাম না। 

“এই অবস্থায় ওর সঙ্গে আপনার দেখা করাটা সমীচীন হবে না মিঃ সরকার। মনে মনে ও আপনাকে একটা ফাদার ফিগার হিসেবে কল্পনা করে নিয়েছে, এখন আপনার কাছে মিথ্যেবাদী হিসেবে ধরা পড়লে ওর মনের ভেতর একটা অ্যডভার্স এফেক্ট পড়বে। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড।” 

আমি বুঝলাম। এমনিতেও ওর তৈরি করা স্বপ্নের পৃথিবীটা ভেঙ্গে দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার ছিলো না। আমি চুপচাপ ভদ্রমহিলাকে নমষ্কার করে বেরিয়ে এলাম। বাইরে বেরিয়ে এসে প্রথমেই ওর জন্য কেনা উপহারটা একটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। বুরুন তার বাস্তব জগত থেকে বাঁচতে একটা কল্পনার জগত তৈরি করে নিয়েছে, সেখানে ও পাকাপাকি থেকে যাবে না সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে আমি জানি না, কিন্তু আমারতো সেটুকু অবলম্বনও নেই। আমাকেতো এই দুর্বহ বোঝা নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে ---- সহসা আমার ভীষণ শীত করতে লাগলো,মনে হলো আমার একটু উষ্ণতার বড়ো দরকার। 
0

ছোটগল্প - গৌতম সাহা

Posted in


ছোটগল্প


নায়কী কানাড়া
গৌতম সাহা

বারাকপুর শিল্পাঞ্চলের এক চটকলের অফিসে সামান্য চাকুরে সুধীরবাবু। অজাতশত্রু, ভালো মানুষ বলেই চেনে তাকে মানুষজন। আসাধারণ মেধা সম্পন্ন না হলেও পড়াশোনায় আর পাঁচটা ছাত্রদের থেকে খুব একটা পিছিয়েও ছিলেন না তিনি। সেই মাঝারিয়ানার সুবাদেই কলেজের গণ্ডী পেরিয়েই পাড়াতুতো কাকার সামান্য সুপারিশে পাওয়া এই চাকরী। স্ত্রী গৌরী প্রকৃত অর্থেই দেবী দুর্গার মতন। যেমন তার রূপ, তেমনি তার স্বভাব। অসম্ভব সুপুরুষ সুধীরবাবু যখন কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে তার স্ত্রী গৌরীকে নিয়ে যান মানুষজন এই জুটিকে প্রশংসা না করে পারেন না। গৌরীও তার স্বামীকে নিয়ে গর্বিত। সুধীরবাবু যে শিল্পী। ছাত্রাবস্থাতেই কি করে যেন তার মাথায় গানের ভূত চাপিয়ে দিয়েছে কেউ। অথচ এই বংশে গানের চর্চা যে তেমন ছিল তা নয়। সুধীরবাবু যে কি করে এই পথে চলে এলেন তা সবার কাছেই আশ্চর্যের। শুধু চলে এলেন না, নিজ অধ্যাবসায়ে, একনিষ্ঠ সাধনায় কিভাবে নিজেকে এই তল্লাটের অন্যতম সেরা শাস্ত্রীয় সংগীত শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন সেটা সত্যিই কল্পকাহিনীর মতন। ফুলশয্যার দিন নতুন বউকে কাছে নিয়ে সুধীরবাবু আর কি কি বলেছিলেন তা মনে করতে না পারলেও একটা কথা কোনদিন ভুলবেন না গৌরী।

-“তোমার এক সতীন আছে জানতো?’’ অবাক বিস্ময়ে নতুন বউ এর লজ্জা আর দ্বিধা নিয়ে ঘোমটার ফাঁক দিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়েছিলেন গৌরী। সেই সংশয় মাখা অপরূপ সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে অট্টহাস্যে ফেটে পড়েছিলেন সুধীরবাবু। হাত ধরে নববধূকে খাট থেকে নামিয়ে এনেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, “চল, তোমাকে তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।’’ বলে হাত ধরে তাকে নিয়ে এসেছিলেন পাশের ঘরে। ঘরের কোণায় রাখা বিশাল আকৃতির এক তানপুরার সামনে দাঁড় করিয়ে সদ্যবিবাহিতা স্ত্রীকে বলেছিলেন সুধীরবাবু, “এই তোমার সতীন, নাও বন্ধুত্ব করে নাও।’’

এই ব্যাপার! বাপরে বাপ, বুকের ধুকপুকুনি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল একেবারে! উনি যে শিল্পী, গান যে ওনার প্রাণ এতো জানে গৌরী। এলাকার মানুষজন সবাই চেনে ওকে এই তল্লাটের অন্যতম সেরা গায়ক হিসাবে। গৌরীতো বিয়ের সম্বন্ধের সময়েই জানে তা। তাও এমনভাবে ভয় দেখাতে হয়! রাগই হয়ে যায় গৌরীর একটু। কিন্তু নতুন বউ এর কি আর রাগ দেখানো সাজে! মুখে তাই রাগের ভাব না এনে মৃদু স্বরে বলে ওঠেন গৌরী, “আমি জানি, গান আপনার সবকিছু, সবাই আপনাকে আপনার গানের জন্য শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে।’’

-“তুমিও নিশ্চয়ই চাইবে যে তোমার স্বামীকে সবাই এইভাবে শ্রদ্ধা করুক, সম্মান করুক।’’

বুঝেছিলেন গৌরী। হাজার হোক, তিনিও অভিজাত পরিবারের কন্যা। কোন কথার অন্তর্নিহিত অর্থ কি তা বোঝার শিক্ষা তার আছে, বোধও। মুখ নিচু করেই আশ্বস্ত করেছিলেন তার স্বামীকে, “আমি আপনার সংগীত চর্চার ক্ষেত্রে কখনো বাঁধা হয়ে দাঁড়াবো না। আপনি আগের মতই আপনার সাধনা নিয়ে থাকবেন, আমার জন্য কখনো আপনার এই সাধনায় বিঘ্ন ঘটবে না, আমি কথা দিলাম।’’

সংগীত অন্ত প্রাণ এক শিল্পীর কাছে তার স্ত্রী’র থেকে ফুলশয্যার দিনেই এর থেকে বেশী প্রাপ্তি কি থাকতে পারে! আপ্লুত হয়েছিলেন সুধীরবাবু। প্রথমদিনের সেই প্রাণে মধু ঢেলে দেওয়া আশ্বাস, তার পরে প্রকৃত অর্থেই তার সংসারকে মা দুর্গার মত চালিয়ে নিয়ে যাওয়া, তার সাধনার উৎকৃষ্ট বাতাবরণ প্রস্তুত করে দেওয়া- ভিষণ রকম ভাবে ভালোবেসে ফেললেন তিনি তার স্ত্রী’কে। বছর ঘুরতেই গৌরীদেবীর কোল জুড়ে জন্ম নিল তাদের প্রথম পুত্র সন্তান। ভালোবেসে গৌরী তার নাম রাখলেন রামানুজ।

*******

সুধীরবাবুর খ্যাতি তার বিবাহের পরে বেড়েই চলেছে। মফস্বলের একটু নামকরা যে কোন শাস্ত্রীয় সংগীতের আসরে সুধীরবাবুর উপস্থিতি, সংগীত পরিবেশনা সেই আসরে অন্য মাত্রা যোগ করে। এই তল্লাটে তার সমকক্ষ শিল্পী খুব কমই আছে এই বিষয়ে শ্রোতৃমহলে কোন দ্বিমত নেই। অথচ কলকাতার শিল্পী মহলে তার বিশেষ কোন নাম নেই, পরিচিতিও। কারণ অবশ্য একটা আছে। সুধীরবাবু মূলতঃ যার কাছে সংগীত শিক্ষা করেছেন সেই পন্ডিত দীনকর রাও এর সাথে কলকাতার নামজাদা সকল শিল্পীরই এক অঘোষিত বৈরীতা আছে। কেন, তা অবশ্য জানেন না সুধীরবাবু। অনেকেই মনে করেন যে দীনকর রাওয়ের সাথে তারই গুরুভাই তথা কলকাতা সংগীত সমাজের পুরোধা শিল্পী কুলদারঞ্জন বাবুর এক ব্যক্তিগত রেষারেষির কারণই দীনকর রাওকে কলকাতা ছাড়তে বাধ্য করেছিল। জানেন না ঠিক সুধীরবাবু। তবুও দীনকর রাও কলকাতা ছেড়ে চলে যাবার পর তাঁরই গুরুভাই এর কাছে তালিম পাবার জন্য, তাঁর সান্নিধ্যে আসার জন্য এক বিশিষ্ট শুভানুধ্যায়ীর অনুরোধে তার সঙ্গেই কুলদারঞ্জন বাবুর কাছে গিয়েছিলেন সুধীর। 

কলকাতার শিল্পীদের স্বভাবসুলভ তাচ্ছিল্লভরা ভঙ্গীতে করা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন সুধীর।

- “কার কাছে শেখা হয়েছে?’’

-“আজ্ঞে, পণ্ডিত দীনকর রাও....।’’

-“ওহ, দীন-কর! তা বেশ। কি গাওয়া হয়? খেয়াল? নাকি দীনকর এর মতন ঠুংরি? হা হা হা হা।’’ তাচ্ছিল্লভরা অট্টহাসিতে ভেসে গিয়েছিল বালিগঞ্জের সুবিশাল সেই বাড়ি। ভালো লাগেনি সুধীরবাবুর। হাজার হোক গুরুনিন্দা শুনে, গুরুর প্রতি অবহেলা দেখে তাঁর কাছে নতুন করে শেখার কিংবা শিক্ষার জন্য তদবির করতে মন সায় দেয়নি আর। আর কারো অনুরোধে তার শিল্পী সত্ত্বাকে পদদলীত করে কখনো কলকাতায় যাননি তিনি। গানের ঘরোয়া আসরে ক্কচিৎ কদাচিৎ আমন্ত্রণ পেয়েছেন, গেছেন, গান গেয়ে মাত করে এসেছেন, কিন্তু অনুষ্ঠানের তদবির করতে কিংবা কারও কৃপা পেতে কলকাতা মুখো হননি তিনি। যা তিনি তার গুণ্মুগ্ধদের থেকে পেয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট। পাশাপাশি তিনি এটাও জানতেন যে তার শিক্ষা সম্পূর্ণ নয়, আরো শিখতে পারলে ভালো হতো। মনে হতো আরো কোথায় শিখতে পারা যায়! কন্ঠসংগীতের আরো জটিল পথগুলোতে আলোকপাত কে করবে? কে দেখাবে আলো, কে চেনাবে পথ? কলকাতায় তো তার উপায় নেই, তাহলে তো কলকাতা ছাড়তে হয়! কিন্তু তার উপায় কোথায়? স্ত্রী, পুত্র, সংসার, চাকরী ফেলে তো আর অনির্দিষ্টের পথে পা বাড়ানো যায়না। সর্বোপরি, গৌরীকে ছেড়ে থাকবার কথা তিনি যে ভাবতেই পারেন না। তাই মনে ক্ষুধা থাকলেও যা পেয়েছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকেন সুধীরবাবু।

*******

কিন্তু শোভা কিছুতেই ছাড়বে না। এই এক এক অদ্ভূত মেয়ে শোভা। টিটাগড় এর কেল্ভিনশন জুট মিলের জেনারেল ম্যানেজারের স্ত্রী। নিজে ডাকসাইটে গাইয়ে। সবাই বলে তার গান চোখ বুজে শুনলে আখতারী বাঈ গাইছে না শোভা গাইছে এটা আলাদা করা যায়না। টালিগঞ্জের নামকরা ফিল্ম ডিরেকটরেরা অবধি শোভা গাঙ্গুলীকে দিয়ে কোন গান গাইয়ে নিতে পারলে বর্ত্তে যান। কিন্তু সে গাইবে না। রেডিওর বি হাই আরটিস্ট সে। মুড নেই তো প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে দেওয়া তার কাছে কোনও ব্যাপারই না। নিজে পারিবারিকভাবে রাজবাড়ির মেয়ে হওয়ায় রাজকীয় স্বভাব তার চলনে, বলনে কথাবার্তায়, আচার আচরণে। কাউকে সে পাত্তা দেয়না। এহেন শোভা কিন্তু সুধীরবাবুর ভীষণ ফ্যান। একদিন তার বাড়ির এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে সুধীরবাবু গাইলেন কৌশী কানাড়া। বড় প্রিয় রাগ তার এই কৌশী কানাড়া। বস্তুত যেকোন কানাড়া অঙ্গের রাগই তার প্রিয়। তার গুণমুগ্ধরা বলে, ‘কানাড়ার রূপ আপনার গলায় আরো বেশি খোলে’। 

গঙ্গার ধারের সেই বিলাসবহুল বাংলোর প্রতিটা কোণ দিয়ে যেন ঝরে পড়ছিল কৌশী কানাড়ার অপূর্ব সুর। ‘রাজন কে শিরতাজ.....’! প্রেম বিরহের অদ্ভূত মেলবন্ধনে কৌশী কানাড়ার সুর আর গঙ্গার দিক থেকে মৃদু মন্দ ভেসে আসা শীতল বাতাস কি যে স্বর্গীয় বাতাবরণ তৈরী করেছিল তা একমাত্র সংগীতের ঈশ্বরই জানেন। মাঝ খামাজে ঠুংরী গেয়ে অনুষ্ঠান শেষ করলেন সুধীরবাবু। সবার শেষে গাইবার কথা শোভা দেবীর। তিনিই এই অনুষ্ঠানের আয়োজক, উদ্যোক্তা, তিনিই শেষ শিল্পী। কিন্তু শোভা নিজে বেঁকে বসলেন। বললেন, “সুধীরদা’র এই গানের পরে আজ আমি আর গাইতে পারবো না।’’ শোভার এই রাজরাণীর মতন স্বভাব ও মেজাজ সম্বন্ধে সবাই ওয়াকিবহাল। কারো সাহস হ’লনা আর কিছু অনুরোধের। সময়ের আগেই এলাহি রাত্রিকালীন ভোজনের সূচনা করা হল। সবাই যখন ওই রাজকীয় ভোজনের স্বাদ নিতে ব্যস্ত, হাতে পানীয়ের গ্লাস নিয়ে সুধীরকে গঙ্গার দিকে টেনে নিয়ে গেলেন শোভা। গঙ্গার দিকে মুখ করে রাখা লোহার বেঞ্চে বসে সুধীরের একটা হাত নিজের হাতে টেনে নিয়ে ঈষৎ জড়ানো গলায় বললেন তিনি, “তোমাকে যদি এই জগতের কাছে বিখ্যাত না করে যাই সুধীর’দা, আমার নাম তবে শোভা গাঙ্গুলী নয়। সারা দেশের মানুষের কাছে তোমার নাম আমি পরিচিত করে যাবো।’’ ভয় পেলেন সুধীর। তিনি ছাপোষা মধ্যবিত্ত। বড়লোকের মতিগতি তিনি বোঝেন না, তাদের কথার অর্থও। দ্বন্দে পড়ে যান তিনি। কি বলবেন এই অপূর্ব মোহময়ী নারীর কথার উত্তরে! বোঝেন না সুধীর, চুপ করে থাকেন।

*******

ফ্যাক্টরী থেকে সবে ফিরেছেন সুধীর। গোধূলির আলো মেখে গেটের বাইরে ছাই রঙা বিরাট একটা কন্টেসা এসে দাঁড়ালো। ঊর্দি পরা ড্রাইভার গাড়ি থেকে নেমে সুধীরের হাতে একটা চিরকূট ধরিয়ে দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুই বুঝতে পারলেন না সুধীর, শুধু পড়লেন, ‘তানপুরাটা শুধু সাথে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে এসো। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।’ শোভার হুকুম। ইতস্তত করেন সুধীর। গৌরীর সাথে শোভাকে নিয়ে বহুবার তার কথা হয়েছে, আজ অবধি কোনদিন গৌরী কোনদিনও সুধীরের কোন মহিলা গুণমুগ্ধা, ছাত্রী কিংবা অতি উৎসাহী মহিলা শ্রোতাকে নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেননি। তবুও কেমন যেন বাঁধো বাঁধো লাগে সুধীরের। মুশকিল আসান হয়ে এগিয়ে আসেন গৌরীই। সমস্ত বিষয়টা যেন চোখের পলকে বুঝে ফেলেন তিনি। আলমারি থেকে পাটভাঙা সিল্কের পাঞ্জাবী স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে চোখের তারার ইশারায় বুঝিয়ে দেন, “যাও।’’ কৃতজ্ঞতায় মনটা আর্দ্র হয়ে যায় সুধীরের। গৌরীকে কি বলবেন ভেবে পাননা তিনি, শুধু এক মুহূর্তের জন্য তার হাতটা আঁকড়ে ধরেন গভীর ভরসায়।

অন্যদিনের মতন নয় আজ এই গঙ্গার ধারের বিশাল বাংলো। কেমন যেন একটু চুপচাপ, বাইরের পোর্টিকোয় দুটো বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে। কি গাড়ি কে জানে! কেউ কি এসেছে? শোভার যা পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান তাতে কোন এস্টেটের মহারাজার পরিবারের লোকের আসাটাও আশ্চর্যের নয়। সুধীরকে তলব কি তাহলে তেমন কোন বিশিষ্ঠ অতিথিকে গান শোনাবার জন্য? বুঝতে পারেন না সুধীর। সামনের বিশাল সেগুন কাঠের মূল প্রবেশ দ্বার দিয়ে তানপুরা হাতে প্রবেশ করতেই কোথা থেকে দৌড়ে এল শোভা। হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল গঙ্গার দিকের একটা বড় মাপের ঘরে। ঘরে ঢুকে অবাক হয়ে যান সুধীর। ঘরের মাঝে ফরাশ বিছানো, অথচ কোনও শ্রোতা নেই। অবাক বিস্ময়ে শোভাকে প্রশ্ন করতে যান সুধীর। মুখে হাত দিয়ে চুপ করিয়ে দেন শোভা। ফিসফিস করে বলেন, ‘একজনের সামনে তোমাকে গান গাইতে হবে সুধীর’দা, আমার মান রাখতে হবে আজ। আমি তাঁকে বলিনি এখনো যে এমন একজন শিল্পীর গান শোনাবো তাঁকে যে তিনি চমকে যাবেন।’

কেমন যেন সামান্য নার্ভাস হয়ে যান সুধীর। এমনিতে তার এই দোষ নেই, তানপুরা নিয়ে বসলে তিনি খুব তাড়াতাড়িই আত্মস্থ হয়ে যান। কিন্তু আজ কেন জানি একটু সংশয়েই পড়ে গেলেন। আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসাই করে ফেললেন, ‘কে তিনি?’ 

-‘তুমি তাড়াতাড়ি তানপুরা বেঁধে নিয়ে গান তো শুরু কর। আমি চাই তোমার গান তাঁকে টেনে নিয়ে আসুক এখানে’, শোভা’র মুখের চাপা উত্তেজনাও নজর এড়ায় না সধীরবাবুর। ইতিমধ্যেই গুটিগুটি পায়ে কয়েকজন সংগীতপীপাসু পরিচিত মানুষজন ঘরে প্রবেশ করেন, লক্ষ্য করেন সুধীর। তারাশঙ্কর তার সাথে তবলা সঙ্গত করে। অবাক বিস্ময়ে তবলার ব্যাগ হাতে তাকেও ঘরে ঢুকতে দেখেন সুধীর। একটা ছোটখাট সংগীত সভার আয়োজন করা হয়েছে চুপিচুপি, হয়ত কিছুটা তড়িঘড়ি করেই অথচ তার কোন আগাম ফরমান নেই। অবাকই হন সুধীর। পরিচিত শ্রোতাদের উপস্থিতিতে আর তিনি নতুন করে ভাবেন না কিছু। প্রশ্ন করেন, “কিছুই তো প্রস্তুতি নেইনি, কি গাই বলত?”

-“সেদিনের সেই কৌশী কানাড়াই গাও।” আবদার করে শোভা।

মাটিতে শোয়ানো তানপুরা কোলে তুলে নেন সুধীর। খড়জের তারকে সামান্য মোচড়ে সূক্ষভাবে ডি শার্পের সা তে মিলিয়ে নিতে নিতে বলেন, “আজ কৌশী না, নায়কী কানাড়া গাইবো।” শিল্পীর চোখের দিকে তাকিয়ে উপস্থিত শ্রোতারা বুঝতে পারেন আত্মস্থ হচ্ছেন সুধীর, সুরের রঙে ভাব মিশিয়ে নায়কী কানাড়াকে প্রতিষ্ঠা করা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। অনতিদূরে গঙ্গার পাড়ে রাসমণির ঘাটে তখন সন্ধারতি শেষ হয়েছে। কালো চাদরে মুড়ে রাত্রি নেমেছে গঙ্গার উপরে।

সুরের মোচড়ে উথাল পাথাল হয়ে উঠছে এই পুরনো দিনের বাংলো বাড়ি। সুধীরকে যেন আজ কোনও অতিপ্রাকৃত শক্তি ভর করেছে। সুধীরের গলায় নায়কী কানাড়া আজ অবধি কেউ শোনেননি তার পরিচিতরা। শুনেছেন আভোগী কানাড়া, কৌশী কানাড়া। দরবারি কানাড়া তো অজস্রবার। কিন্তু নায়কী কানাড়া? জীবনে এই প্রথম। প্রথমবারেই জীবনে প্রথম প্রকাশ্যে গাওয়া নায়কী কানাড়ায় মাতিয়ে দিলেন তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের। ‘মোরা পিয়া রসিয়া....” । সুরের বিস্তারে রাগের রূপকে প্রতিষ্ঠা করে তার সপ্তকের সা তে স্থিত হচ্ছিলেন সুধীর। বিলম্বিতের অন্তরার মুখটাকে ধরার পরিকল্পনা করে এগোচ্ছিলেন তিনি। ঠিক এই সময় ঘরের বাইরে যেন একটু মৃদু গুঞ্জন শোনা গেল। অন্তরার মুখ ধরতে গিয়েও পিছিয়ে এলেন সুধীর, সামান্য সময়ের জন্য মনোসংযোগ ছিন্ন হলো। 

-“কৌন গা রাহা হায়, কৌন গা রাহা হায়” বলতে বলতে টলোমলো পায়ে যিনি ঘরে ঢুকলেন তাকে দেখে সুধীর একা নয়, থমকে গেলেন উপস্থিত সক্কলে। যেন বিশ্বাস হচ্ছে না কারো, কে ইনি? ঠিক দেখছি তো? মৃদু, অতি মৃদু ফিসফাস এর আওয়াজও থেমে গেল যখন পরিপূর্ণ মদিরার পাত্র হাতে সুধীরের সামনে প্রায় তিন হাত দুরত্বে এসে পা গুটিয়ে বসে পড়লেন ওই বিস্ময় আগন্তুক। মাথা ঝোকানো সেই পরিচিত ভংগীতে জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলেন, “গা বেটা, গা, বহুত আচ্ছা, গা...”।

*******

ঘুম আসছে না আজ সুধীরের কিছুতেই। যেন এখনো ঘোরের মধ্যে আছেন। সামনে বসে আছেন তার অন্যতম সংগীত দেবতা পণ্ডিত ভীমরাও যোশী, আর তিনি তার সামনে গাইছেন! আর পণ্ডিত যোশী সুরের দ্যোতনায় “ওয়া ওয়া”, সাপাট তানের বিদ্যুৎ গতির ছোবলে “কেয়া বাত কেয়া বাত” করছেন! তার পরে যা ঘটলো তা তো তিনি স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেন না। সত্যিই কি এমন ঘটেছিল? কি করে সম্ভব হলো এটা! বিলম্বিত শেষ করে তিনি দ্রুতের গতে যাবেন ভাবছেন, হাতের পাত্র কে একটু দূরে সরিয়ে রেখে পণ্ডিতজি বলে উঠলেন, “ইয়ে তো নায়কী কানাড়া হ্যায়, অউর এক তারহা কা নায়কী কানাড়া শুন....”।

আর এক ধরণের নায়কী কানাড়া শুনালেন পণ্ডিতজি। দশ মিনিট। সুরের চলনের পৃথক রাস্তায় হেঁটে আবার ফিরে এলেন সুধীরের গাওয়া নায়কী কানাড়ায়, দুই একটা ছুট তান করে গানের খেই ধরিয়ে দিলেন সুধীরকে। অনির্বচনীয় এক স্বর্গীয় পরিবেশের সাক্ষী হয়ে থাকলেন উপস্থিত গুটিকয়েক শ্রোতা। রাজরাণীর মতো যার চালচলন সেই শোভার চোখের কোণেও আনন্দাশ্রু চিক্‌চিক্‌ করে উঠলো।

খাটের উপরে কি শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে গৌরী। পাশে তার ছেলে । মায়ের বুকের ভিতর মুখ গুঁজে সেও গভীর নিদ্রামগ্ন। ঘুমোতে পারছেন না একমাত্র সুধীর। বাড়ি ফিরে গৌরীকে সবিস্তারে গল্প করেছেন আজকের ঘটনা। গৌরী ভীষণ খুশী হয়েছে, কিন্তু গৌরী জানেনা এই ঘটনার প্রকৃত অনুভূতি কেমন! সারা দেশ যাঁর গানে মোহিত হয়ে থাকে সেই জগতবিখ্যাত পণ্ডিত ভীমরাও যোশী তার সাথে নায়কী কানাড়া গাইছেন! একসাথে! তাকে বলে দিচ্ছেন, “অউর এক তারহা কা নায়কী কানাড়া শুন....”! গৌরী যতই তার গানের সমর্থক হোক, এই অপার্থিব অনুভূতির সূক্ষতা সে ধরতে পারবে না। সুধীরের গায়ে যে লেগে আছে পণ্ডিতজির আলিঙ্গনের স্পর্শ! গান শেষ হতেই নিজে থেকে উঠে এসে সুধীরকে জড়িয়ে ধরেছিলেন তিনি। অনেক আশীর্বাদ করে মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি সুধীরকে বলে উঠলেন, “তু মেরে পাশ চলা আ, পুনে মে। ওয়াহা ম্যায় তুঝকো আউর শিখাউঙ্গা। সারা দেশ তুঝে পহেচানেগা”।

গৌরীর নিদ্রামগ্ন, পবিত্র, দেবীর মতন মুখটাকে আবার দেখেন সুধীর। দেখেন ছেলের কচি কচি হাত দুটিকে। আবার মনে পড়ে সেই জলদ্গম্ভীর কন্ঠস্বরের নির্দেশনা।

“নৌকরী?! মা সরস্বতী কা আশীর্বাদ জিসকে উপর হ্যায়, উনহে নৌকরী কি ফিকর হোনা নেহি চাহিয়ে। নৌকরী ওয়াক্রী ছোড়, পুনা চলা আ, মেরে পাস...”।

বড় দ্বন্দে পড়ে যান শিল্পী। কি করবেন তিনি! কোন পথে হাঁটবেন তিনি! উত্তর খুঁজে পান না। নিদ্রাতুর মা আর ছেলের ওই পবিত্র দৃশ্য তাকে বিহবল করে তোলে। না, না, এ মহা পাপ হবে। তার নাম, তার খ্যাতির জন্য এদেরকে ছেড়ে সুদূর পুনা চলে যাওয়া ঘোর অন্যায় হবে। এই অন্যায় করতে পারবেন না সুধীর। নাই বা হল তাতে তার দেশজোড়া নাম!

খাটের পাশ দিয়ে আস্তে নেমে দাঁড়ান সুধীর। যে পাঞ্জাবী পরে তিনি আজ গাইতে গেছিলেন তা ঝোলানো ছিল দেওয়ালে সাঁটা ডায়মন্ড আকৃতির কাঠের হুকে। সেই পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা ছোট্ট কাগজ বের করে আনলেন সুধীর। দেখলেন ওই রাতের আবছায়াতেও। পন্ডিত ভীমরাও যোশীর নিজের হাতে লিখে দেওয়া তাঁর পুনার বাড়ির ঠিকানা ও ফোন নম্বর। কাগজটা মাথায় ঠেকালেন তিনবার। দেওয়াল আলমারি খুলে ভাতখণ্ডেজির বই বের করে নায়কী কানাড়ার পাতা টা খুললেন। কাগজের টুকরোটা সেই পাতায় রেখে বই বন্ধ করে আলমারিতে তুলে রাখলেন সুধীরবাবু।
0

ছোটগল্প - কর্ণ শীল

Posted in


ছোটগল্প 


বড়দিন
কর্ণ শীল


এই ডিসেম্বরের শেষ থেকেই বরফ পড়া শুরু হয়েছে। জুলাইতে সবচেয়ে বেশি গরম পড়ে। মার্চ পর্যন্ত এবার চলবে হাড়কালি করা আটলান্টিক মহাসাগরীয় ঠাণ্ডা। রিকজাভিক নুউক ভস্টকের যত মরণদশা শিরশিরানি উত্তুরে ছোবল কোপেনহাগেন জুড়ে ছড়িয়ে যাবে। জুনের সেই রোদজ্বলা সোনাঝরা দিনগুলো মনে পড়ে রডরিকের। জুলাই সেপ্টেম্বরই বা খারাপ কোথায়? সেভিয়র চার্চের চূড়া ছোঁয়া মেপলপাতায় ঝুরঝুরে মিহি বৃষ্টি কি সুন্দর রামধনু মাখিয়ে দেয়। ডিসেম্বরের পনেরো তারিখ পার হ'লেই মেজাজটা খিঁচড়ে যায় ওর। রাস্তাজুড়ে বরফের পুরু প্রলেপ। সিটিহলের সামনেটা যেন ভেজা পেঁজা তুলো দিয়ে কেউ মুড়ে রেখেছে। সেন্ট নিকোলাজ গীর্জের ফাদার আবেরেদিন ডেকে বললেন,
-রডরিক, বাপু বড়দিনের দিনদুটো ফাঁকি দিসনে বাপ। বরফ, পাতা ঠিকমতো পরিস্কার রাখিস যেন। ভ্যাটিকানের প্রতিনিধি আসবেন। ডোবাসনে যেন।

তেইশের বিকেলে তখন ছায়া ছায়া মানুষগুলো বার্চের শঙ্কুআকৃতি মাথাগুলো কাঁধে, গাড়িতে চাপিয়ে ঘরফেরতা। বাড়িতে বাড়িতে লালনীলহলুদ বৈদ্যুতিন ছোটছোট আলোর মালা বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে রডরিক তিনচাকা আইসড্রাইভটা গীর্জার পর্চ, সমাধিস্থল, ফোয়ারার নীলচেসাদা পরীটার পাশ দিয়ে দুবার ঘুরিয়ে আনলো। অটোভ্যাকুয়ামে ঝরা বার্চ মেপলপাতাগুলো কন্টেনারে জমা হয়েছে। ডিসপোজাল ভ্যান আসবে সেই ছ'টায়। তিনটের সময় একবার ঘুরে গেছে।

ডিসপোজাল ভ্যানের ড্রাইভার রডরিকের এক ইয়ার। সেও বিরক্ত। দুটো বৌ। একটা অবশ্য ডিভোর্সি। চারটে ছেলে। তিন মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ের শ্বাশুড়ি আবার রডরিকের সাথে খুব ডেটিং করছে ইদানিং। একগাদা রাগ উগরে দিয়ে গেছে বিকেলের শিফটে,
-শালা, মাগী ছানা নিয়ে জ্বলে মরি সারাবছর। বড়দিনে সবাই যখন মাল খেয়ে হুল্লোড় করবে, তুমি আমি বরফ পাতা ঠেলবো। যীশুবাবা জেরুসালেম ছেড়ে যে কি করতে এই পোড়া উত্তুরে বরফের দেশে এসেছিলেন কিজানি! তুমি তো এই এক চার্চ খালাস করেই ঝাড়া ঠ্যাংহাত। আমার কোপেনহাগেন ঘুরে ঘুরে সবার পচাপাতা ভিজে বরফের অ্যাবরশন করতে হবে। শালা, এর চেয়ে আমাদের ভাইকিং থর ওদিনই ভালো। চার্চ টার্চের বালাই নেই।
যাই, ক্রিশ্চানবর্গ প্যালেসে আবার মার্বেলের দেবদূত আকাশে উড়তে গিয়ে ঠ্যাঙ পাখা সব ভেঙেছেন। তা তাঁকে ডিসপোজ করতে হবে কাবারখানায়। চলি। তুমি বাপু সব জড়ো করে রেখো যেন।
জ্বলন্ত সিগারটা দাঁতে চেপে কলারটা টেনে কানটা ঢেকে নিল। গাড়িটা ঝোপড়ালো ওয়ালনাট গাছটার নিচে রেখে ফার্স্ট গিয়ারে নিয়ে সামনের ঢালুটার উপরে তুলে, নিউট্রালে আনলো। স্টার্ট অফ করলো। চাবিটা আজানু ক্লোকের পকেটে রাখলো। কম্ফর্টারে মুখটা জড়িয়ে নিল। 
সবে চারটে। হাতে কম ক'রে এখনও দেড় ঘন্টা। সাড়ে পাঁচটায় এসে আরেকবার ড্রাইভ ক'রে নিলেই হবে।
অপারেশন কার্থেজের মরা লাশের মতো মেয়েদের স্কুলটা দাঁড়িয়ে আছে এখনও। সুইডিশ নর্থ ইন্ডিয়ান আমেরিকান আফ্রিকান ট্যুরিস্টরা ঘুরছে। ফটাফট ক্যামেরার ফ্ল্যাশে গোলাপী বিকেলের নরম শেষ আলোটা চমকে উঠছে। গাইড স্টার্লিং রোজকার মতোই ভ্যানভ্যান ক'রে ত্রাতা মার্শাল মন্টগোমরীর গল্প শুনিয়ে চলেছে। গেস্টাপোনিধন, ফুয়েরারপলায়ন..কত বড় বড় শব্দ। অসহ্য। 
আরও বেশি অসহ্য লাগে ওই চ্যাঁ চ্যাঁ করতে থাকা বাচ্চাগুলো। সারাক্ষণ শালা বায়না করেই চলেছে। ক্যান্ডি দাও। স্যান্টা দাও। না এই লালসাদা না। নীল গোলাপীটা। শালা সান্টা নীলগোলাপী কি করে হয় কিজানি!
অ্যামাগের পার্কে গতবছর গিয়েছিল রডরিক। দশমিনিটে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল ও। নকল দ্বীপটা বরফে বরফে ঢাকা। বাল্টিক সাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ে তীরের চিরন্তন সমতলে। উত্তরসাগরের কোনাচে ছুরির মতো হাওয়ায় সমুদ্রশুশুকের পিঠে বসা গালের গা যখন শিরশির ক'রে ওঠে, রডরিকের বুকটা হু হু ক'রে উঠেছিল। কি যেন নেই, কি যেন নেই, মনে হয়েছিল।

এলোমেলো ভাবতে ভাবতে সেভিয়রের চার্চের সামনে কমলা হলুদ ক্যাব থেকে নেমে এলো রডরিক। দুটো ওয়ান ওয়ে পার হ'য়ে উল্টোদিকের বারটা'য় ঢুকে গেল। ক্রীসমাসের বাজারে প্রচণ্ড ভীড়। পেঁচো মাতাল ঝিমুনি মাতাল কবি মাতাল দুখি মাতালে গিজগিজ করছে। একঘন্টা টেম্পোরারি বার টেন্ডারের ভালো রোজগার। দশ ড্যানিশ পাউন্ড। সোয়া পাঁচটায় বেরিয়ে এলো। বখসিস টখসিস মিলিয়ে প্রায় সতেরো পাউন্ড। পকেট গরম। মনটা খুব খুশী।

ছটা'র ডিসপোজাল খালাস করে দিয়েছে রডরিক। দু ঘন্টা আগেই। পাদ্রি ইমান্যুয়েল রডরিকের হাতে কুড়ি পাউন্ডের নোট গুঁজে দিলেন
-সংসার তো আর করলি না। বড়দিনের টাকাগুলো কি করিস কি জানি? প্রতিবছর কুড়ি তারিখ থেকে অমানুষিক খাটনি খাটিস। নেশাভাং তো করতে দেখিনা। রুলেটের আড্ডাতে যাসনা তো ব্যাটা? নরকে যাবি হারামজাদা ..রবিবার যেন কয়্যারে দেখতে পাই। 
আরও একগাদা বিড়বিড় করতে করতে রডরিকের বুকে ক্রশ এঁকে দিয়ে চলে গেলেন।
শস্তায় কেনা সিডানবডির সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িটায় বাড়ি যাওয়ার মতই পেট্রল আছে। বাড়িতে গিয়ে বাসি টুনার স্টেকটা গরম করে নিল। পেঁয়াজের বড় বড় টুকরোগুলো সাজিয়ে নিল। ব্রেডক্রাম্বস্। একটু গোলমরিচ গুঁড়ো। পেট ভ'রে গেছে। ইলেকট্রিক হিটারটা সিওনি গিফট্ করেছে। প্লাগপয়েন্টে তারটা গুঁজে দিয়ে সিওনিকে ফোন করলো একটা।
মৃদু মিঠেগুঞ্জনে এগারোটা বেজে গেল। শুয়ে পড়লো। কাল চার্চে অন্যজনের শিফটিং। ওর ছুটি। কিন্তু সারাদিন কাজ প্রচুর।

শনিবারটা নানান ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে ঘুরতে ঘুরতেই কেটে গেল। শুধু প্রথমে গিয়েছিল ডাউনটাউন ফিলিং স্টেশনে। সন্ধ্যে পাঁচটায় ডিনার ক'রে শুয়ে পড়লো রডরিক।

এগারোটায় অ্যালার্মক্লকটা চেঁচাতে লাগলো তারস্বরে। রডরিক উঠে পড়লো। অন্ধকার ঘরের প্রতিটা কোণ তার নখদর্পণে। তৈরী হ'তে দশমিনিট লাগলো। রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল ছ ফুটি দেহটা।

রবিবার সেন্ট নিকোলাস চার্চ সেজে উঠেছে। কয়্যারে চলছে মৃদু কোরাসে হিম্। নতমস্তক মাথাগুলো ক্রুশের মানুষের পায়ে প্রেরণ করছে একান্ত আর্তি। প্রার্থনা। তদগতচিত্ত কালোসাদা পোশাকপরা আবেরিদিন ইমান্যুয়েল রা কুমারী মায়ের মহান ঐশ্বরিক সন্তানের বন্দনায় অশ্রুবিগলিত। বেলজিয়াম কাচের ছাঁকনিছাঁকা রোদ্দুরে পরমক্ষমাশীল নগ্ন পিতার দুই নীল চোখে বর্ষিত হচ্ছে অপার ক্ষমাসুন্দর প্রেম। হিম্ শোনা যাচ্ছে ক্রিমসন গথিক খিলানের ফাঁকে ফাঁকে,

Let there be a prayer in our heart
Where blooms your paradise bud
Let your blessing be our flesh
Let your forgiveness our blood.........
ইমান্যুয়েলের চোখদুটো খুঁজে চলেছে চওড়া কাঁধের শক্তিশালী মানুষটাকে। নাঃ, রডরিক আসেনি প্রেয়ারে। চুলোয় যাক ব্যাটা। নিঘঘাত নরকে যাবে।

রডরিকের ঘরময় জুতো জামা ওভারকোট অগোছালো। অ্যালার্মক্লকটা ম্যান্টেলপীসে উপুড় হ'য়ে প'ড়ে আছে রডরিকের ছোটবেলার অনাথাশ্রমে তোলা গ্রুপ ফটোটার পাশে। জানালা দিয়ে আসা রোদ পড়ে রডরিকের ঘুমন্ত মুখটা কুঁচকে উঠলো।

উঠে বসলো ও। ঘুমজড়ানো চোখে লালমলাটের ডাইরিটা টেনে নিল। ডাইরির পঁচিশে ডিসেম্বরের পাতায় এন্ট্রি করলো।

সেন্ট নিকোলাজ অরফানেজ -100 পাউন্ড। 
পুরো ডাইরির ওই একটা পাতাতেই এন্ট্রি। বাকি সব পাতা খালি।

উঠে গেল বিছানা ছেড়ে। ম্যান্টেলপীসের উপরে দেয়ালে শোকেসে লাল ডায়রিটা রাখলো।

সেখানে আগে থেকেই রয়েছে আরও অজস্র ডায়রি। অবিকল একই।

কেউ রডরিকের অজান্তে ডায়রিগুলো খুললে দেখতে পেত, সবকটাতেই শুধু পঁচিশে ডিসেম্বরের এন্ট্রি। একটি করে অনাথাশ্রমের নাম তাতে। আর কিছু পাউন্ডের সংখ্যা লেখা। বাকি সব পাতা সাদা।

এটাই রডরিকের বড়দিন। প্রার্থনা। হিম্।
0

ছোটগল্প - সুষমা ব্যানার্জী

Posted in


ছোটগল্প


মালকিন
সুষমা ব্যানার্জী



খট খট খট খট.....
খট খট খট খট....
খট খট খট খট...
ভারী শরীরটা নিয়ে দাঁতে দাঁত পিষতে পিষতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছেন নমিতা দেবী। দোতলা থেকে একতলা নামতে গিয়ে দুবার জিরিয়েছেন। উচ্চরক্তচাপের জন্য তাঁর দ্রুত সিঁড়ি ভাঙ্গা নিষেধ, তবুও দিনে দুই তিনবার তাঁকে এই কাজটিই করতে হয়। এই বিশাল বাড়িতে তিনি বই দ্বিতীয় প্রাণীটি নেই। দরজা খুলে রাধাকে দেখেই তাঁর মাথায় রক্ত উঠে গেল।
- বাড়িতে মরদ বসিয়ে এসেছিস নাকি রে! এত তাড়া কিসের হারামজাদী? 
- গাল দিবা না বলে দিলাম কাকী!
- কি আমার বোলনেওয়ালা এসেছেন র‍্যা... ভাতারখাগী, জানিসনা আমি তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারিনা। আমি কি উড়ে আসব নাকি?
ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতে গজগজ করে রাধা, অবশ্যই মালকিনের কান বাঁচিয়ে।
- কি মুখ বুড়ির! থাকত যদি বড়মা, গালপাড়া বার করে দিত!
- কি বিড়বিড় করছিস? জোরে বল সাহস থাকে তো।
- কিছু না, উপরে চল। বেলা হলো ম্যালায় খানি।
কিছু কথ্য কিছু অকথ্য গাল পাড়তে পাড়তে সদরে তালা দিয়ে নমিতা দেবী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করেন। তিনি এবাড়ির ছোটো বউ, মানে চাটুজ্জে বাড়ির ছোটোগিন্নি। রাজা শঙ্কর মুখোপাধ্যায় উত্তর মালদহ জেলার এই বর্ধিষ্ণু গ্রামটিতে হুগলির বৈদ্যবাটি থেকে তিনঘর ব্রাহ্মণ এনে বসতি স্থাপন করিয়েছিলেন জমিজায়গা দিয়ে। তাও প্রায় দেড় শতক আগের ঘটনা। তারপর মহানন্দা দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। তিনঘর বামুনের বংশবৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধশালী হতে সময় লাগেনি বিশেষ। ইনি তাঁদেরই চতুর্থ পুরুষের এক শরিক, বিনয় চ্যাটার্জীর ছোটো ছেলের বিধবা স্ত্রী। 
আশেপাশের দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের বসতি হাঁড়িপাড়া ও জেলেপাড়া থেকে নিজেদের পৃথক রাখতে এই পাড়াটির নামকরণও হয়ে যায় বামুনপাড়া। চাটুজ্জেদের বাড়িটি বামুনপাড়ার সীমানায়। "নীচু জাতের" ছোঁয়া বাঁচাতে বাড়িটির চারিপাশে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দিয়েছিলেন বিনয় চ্যাটার্জী নিজে। সে পাঁচিল আজ স্থানে স্থানে ভগ্ন। সেই ভাঙা জায়গা দিয়ে গরু বাছুর মানুষ মায় শুকর পর্যন্ত বাগানে ঢুকে যায়। বাগানের লোভনীয় গাছগাছালি পাহারা দেবার জন্য বহুদিন বহাল ছিলো কালুয়া, যে কিনা রাধার স্বামী। তা সেও চাটুজ্জে বাড়িতেই খুন আর ডাকাতির দায়ে জেল খাটছে তা আজ বছর দশেক হয়ে গেছে। এসব কথা মনে পড়তেই দাঁতে দাঁত পিষে নমিতা দেবী বলে ওঠেন, " শালা নিমকহারাম"!
-" কিছু বললা কাকী? " বাসন মাজতে মাজতে ঘাড় ঘোরায় রাধা।
- তুই নিজের কাজ কর, মাগী!
রাগে জোরে জোরে বাসনকোসন ঘষতে থাকে রাধা। বারো বছর বয়স থেকে এবাড়িতে কাজ করে সে। চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল যার সাথে, সে বিয়ের রাতেই রাধাকে বিক্রি করে দেয় অন্য লোকের কাছে। কিভাবে যে ওদের খপ্পর থেকে বেঁচে ফিরেছে ভাবতেও অবাক লাগে। বাপের বাড়িতে ফিরে এসে আবার এবাড়িতেই কাজে বহাল হয়। এগারো বছর আগে কালুয়াকে বিয়ে করেছিল সে। কালুয়া এ গ্রামেরই ছেলে। কানাঘুষো শুনেছে দিল্লীতে নেশার কারবার করতে গিয়ে পুলিশের মার খেয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলো সে। তারপর এবাড়িতেই জমিজমার কাজ করত। ছোটো কর্তার খুব বিশ্বাসভাজন ছিলো। কি সুখেই না দিন গেছে। কিন্তু কপাল! একটা দীর্ঘনিশ্বাস বুক নিঙড়ে বেরিয়ে যায়।

রাধার কাজ শেষ হলে সদরে তালা লাগিয়ে দেন নমিতা দেবী। রাধাই সকালে বাজারহাট করে আনে। ব্যাংক, পোস্টাপিস যেতেও রাধাই ভরসা। অবশ্য তার জন্য মোটা টাকা দেন রাধাকে।
সকালের এটুকু সময়টাতেই প্রাণের স্পন্দন জাগে এই ভিটেতে। তারপর শ্মশানের স্তব্ধতা। আগে হইহট্টগোলে মুখরিত থাকত বাড়িটা। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। সোনুটাও যদি থাকত! সেও বউ মেয়ে নিয়ে দূরে চলে গেলো! 
আস্তে আস্তে মাঝের ঘরের সামনে দাঁড়ান। আঁচলের চাবির গোছা থেকে খুঁজে খুঁজে আন্দাজে চাবি বের করে খোলেন ঘরের তালা। বাড়ির মধ্যে এই ঘরটি সবচাইতে বড়। এইটে ছিল তাঁর শাশুড়ির ঘর। সব নাতিনাতনি নিয়ে এঘরেই থাকতেন তিনি। ঘরের ভিতরে একটা বড় ভারী কাঠের সিন্দুক আছে। সিন্দুকের ওপর কাঠের তক্তা পেতে বিছানা পাতা। বাইরের লোকজন এঘরেই বসতো। বাইরের কারুর বোঝার ক্ষমতাই ছিল না সিন্দুকের ওপরে বসে আছে তারা!
বুড়ির বুদ্ধি ছিল বটে! মনে মনে হাসেন নমিতাদেবী। সিন্দুকের তলার একটা খুপরি খুললে ভারী ভারী গয়না দেখতে পাওয়া যাবে! শাশুড়ি একদিন সিন্দুক খুলে জ্ঞাতির বিয়ের গয়না বাছছিলেন। চ্যাটার্জী বংশের ছেলের বিয়ে হলে বাড়ির গয়না দেওয়াই রীতি। মেয়েদের বিয়েতে নতুন গয়না গড়িয়ে দেওয়া হতো। এতে বাড়ির গয়না বাড়িতেই থাকতো। সেই গয়নার বের করার সময় জানালা দিয়ে দেখেছিলেন। জানালার সামনে আলনা ছিলো বলেই বোধহয় জানালা বন্ধ করার প্রয়োজন মনে করেননি সুহাসিনী দেবী। ভর সন্ধ্যেয় লোভে চকচক করে উঠেছিলো নমিতাদেবীর চোখ। কিন্তু তখন ছিল শুধু অপেক্ষা আর জাল বোনা! 
সিন্দুকের গায়ে আদর করে হাত বোলান নমিতা দেবী। কাউকে প্রাণে ধরে গয়নার ভাগ দিতে পারেননি। বুকের ভিতর থেকে দীর্ঘনিশ্বাস নিংড়ে বেরিয়ে আসে। এরপর? কাকে দিয়ে যাবেন সাম্রাজ্য? সোনুটাও হয়েছে বৌভেড়ুয়া! মনে মনে গালি পাড়েন! কত চোখের জল, কত অভিনয়, কত ষড়যন্ত্র করে এই বিশাল সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছিলেন। কি লাভ হলো? জীবনের সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্কে শুধু নেমেই গেছেন, আর নেমেই গেছেন। আজ হাতে রইলো 'শূন্য'। 

দরজা বন্ধ করে একবার সারা বাড়ির দিকে তাকান! খাঁখাঁ করছে। সারিসারি ঘর বোবা হয়ে তাঁকেই দেখছে। টানাবারান্দার থামের ওপর পায়রার বকমবকম মাঝে মাঝেই এই বুকে চাপ ধরা নিস্তব্ধতাকে ভেঙে আরও বেশী প্রকট করছে স্তব্ধতা। বিশাল উঠোনে কিছু শুকনো পাতা ঘুরপাক খাচ্ছে। পেছনের সাধের বাগান আগাছায় পূর্ণ ঘন জঙ্গল! হাঁড়ি আর তুরীদের ছাগল চড়ানোর জায়গা হয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েদের জ্বালায় একটা ফলপাকুড় চোখে দেখা যায় না। 
" বেজম্মার জাত"!
অদেখা, অজানা ছেলেমেয়েদের গালি দিয়ে বুকের জ্বালা জুড়ান তিনি।
জ্বালা আর জুড়োয় কই? বাড়ির মতঅই খাঁখাঁ করে বুকের ভেতরটা। ছেলে বলেছে তার কাছে গিয়ে থাকতে। রায়গঞ্জে ফ্ল্যাট কিনেছে তারা। বয়েই গেছে! এই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে ওই তিনকামরার ঘরে থাকতে!
দুপুরে ঘুমের অভ্যেস নেই। ছাদে বসে বসে বড়ি পাহারা দেন আর কাল্পনিক চোরেদের উদ্দশ্যে গালি পাড়েন। ছেলে অনেকবার বলেছে সারাদিনরাতের লোক রাখতে। কিন্তু সাহস করেননি তিনি। যদি গলা কেটে গয়নাগাটি নিয়ে চলে যায়? জীবন তাঁকে শিখিয়েছে কাউকে বিশ্বাস না করতে। কারণ তিনি নিজেই কারুর বিশ্বাস রাখেননি।
শাশুড়ির বিছানার নিচে সিন্দুকের চাবি। দিনের পর দিন শাশুড়ির সেবা করে বিশ্বাসভাজন হয়েছিলেন। সংসারের সব কাজের মধ্যেই সুহাসিনী দেবীর পান সেজে দেওয়া, কাপড় গুছিয়ে দেওয়া, বিছানা পাতা এই কাজগুলি করতেন নিজের হাতে। কাজ করতে করতেই বড় জায়ের নামে কান ভাঙানি দিতেন। বড় জা ছিলেন জমিদার বাড়ির মেয়ে। সংসারের কুটকাচালি খুব বেশী স্পর্শ করতো না তাঁকে। একমাত্র মেয়ের শিক্ষার দিকে যত নজর ছিল শিবাণী দেবীর, তার এক কণাও সংসারের দিকে দিলেই সহজেই টের পেতেন তাঁর বিরুদ্ধে একটা চোরা স্রোত বইছে। কিন্তু বড়বাড়ির মেয়ে বলে বাড়িশুদ্ধ সকলেই সমীহ করতো শিবাণী দেবীকে, এইটাই সহ্য করতে পারতেন না তাঁর শ্বাশুড়ি সুহাসিনী দেবী। আর এই অপছন্দটাকেই কাজে লাগিয়েছিল নমিতাদেবী। তার ফলস্বরূপ শাশুড়ির হাতের ব্রোঞ্জের চুড়ি বা কানপাশাটা আস্তে আস্তে নমিতাদেবীর আলমারিতে উঠে এসেছিলো।
কিন্তু শেষরক্ষা হলো কই? দাঁতে দাঁত চেপে সেদিনের কথা মনে করছিলেন নমিতাদেবীর। লোপামুদ্রা মানে বড় জায়ের মেয়ের বিয়ে। এবাড়ির প্রথম মেয়ে। শাশুড়ির সাতভরির সীতাহার পরিয়ে দিলেন তার গলায়। । মনে মনে জ্বলে উঠলেন নমিতাদেবী। এভাবে চললে তাঁর ভাগে কি থাকবে?
ভগবান নাকি শয়তান, কে যে ঠিক সহায় হলো তাঁর! মেয়ের বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু হলো ভাসুরের। তাঁর প্রতিপক্ষ দুর্বল হলো। ছেলের মৃত্যুশোক সহ্য করতে না পেরে ছ'মাসের মধ্যেই শ্বশুর মশায়ের হার্টফেল! মন্ত্রী, রাজা ভগবান তুলে নিয়েছেন। এবারে শুধু বোড়ের খেলা!

সেইমত কালুয়াকে টাকা পয়সা দিয়ে হাত করতে শুরু করেন। যেখানে টাকাপয়সাতে কাজ হতোনা, ইঙ্গিতবহ হাসি কিংবা ভ্রূভঙ্গীতেই কাজ হতো। কালুয়া ছিল স্বভাবলোভী। তাকে হাত করতে বেগ পেতে হয়নি। তাই বাগানের মূল্যবান কাঠ, জমির ধান, গম, সরষে বেচে যে টাকা আসতো তার সিংহভাগই নমিতাদেবীর হস্তগত হতো। তাঁর স্বামী বীরেন্দ্রনাথ ঋষিতুল্য মানুষ, পেশায় অধ্যাপক। টাকাপয়সার হিসাব নমিতাদেবী নেওয়াতে খুশিই হয়েছিলেন তিনি! কলেজের শেষে বিপুল পরিমাণ বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকাটা ছিল স্বভাব। গিন্নির স্বভাব আঁচ করার সময় তাঁর ছিল না।

বড়ছেলে ও স্বামী মারা যাবার পরে বড়বৌমার ওপর বিদ্বেষটা কিছু কমেছিল সুহাসিনীদেবীর। মন ও শরীর দুইই দুর্বল হয়ে গেছিল। তাই একদিন মেয়েকে ডেকে পাঠানোর কথা বলেছিলেন গয়না ভাগাভাগির জন্য। তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন নমিতাদেবী। বলেছিলেন, আপনার কাছে থাকলেই সুরক্ষিত থাকবে, মা! 
ক্ষীণ আপত্তি করেছিলেন সুহাসিনীদেদেবী। জোরের জায়গা নেই, তাই বলেছিলেন, 
-আমার যদি ভালোমন্দ কিছু হয়ে যায় মা!
- তাতেও কিছু হবেনা মা! কোর্টের অর্ডার আছে, ছেলের মতো মেয়েরও সম্পত্তিতে সমান অধিকার!
নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন সুহাসিনীদেবী। কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারেননি নমিতাদেবী। কিছুতেই ভাগাভাগি হতে দেবেননা তিনি! কিন্তু কতদিন? কতদিন আটকে রাখতে পারবেন?

এবারে হেস্তনেস্ত করতেই হবে। কালুয়ার শরণাপন্ন হলেন আবার। এবারে খুব গোপনে ঘুমের ওষুুধ এনে দিয়েছিল কালুয়া। বিনিময়ে কালুয়া অবশ্য আদায় করেছিল অনেকটা। ভরদুপুরে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে কালুয়া যখন তাঁর শরীর নিয়ে আদিম খেলায় মেতেছিলো, নমিতাদেবী মনে মনে শাশুড়ির গয়নাগুলোর কথাই ভাবছিলেন। এখনও তাঁর গা'টা ঘিনঘিন করে উঠলো। গলার কাছে আটকে থাকা একদলা থুথু থুঃ করে ছাতের ওপর ফেলে যেন কালুয়ার শরীরের অনুভূতিটাই দূর করতে চাইলেন তিনি এতদিন পরেও।
সন্ধ্যে নেমেছে। সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে জপের মালা নিয়ে বসলেন তিনি। টিভিতে সিনেমা একটা চলছে, নজর নেই সেদিকে। তার নিজের জীবনের গল্প কি নাটক নভেলের থেকে কিছু কম?
শাশুড়ির রাতের খাবার দুধরুটির সাথে খুব গোপনে মিশিয়ে দিয়েছিলেন ওষুধগুলো। আশ্চর্য! একটুও হাত কাঁপেনি তাঁর। সবথেকে বড়কথা, কেউ সন্দেহও করেনি! সকালে ডাক্তার এসেও বয়সজনিত কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু ভেবেই "death caused by silent Myocardial Infarction " লিখলেন। কি সহজ মানুষ মারা!
জা শিবাণীদেবী মারা অবশ্য অত সহজ হয়নি। অনেক নাটক করতে হয়েছিল। ততদিনে পরিণত হয়েছে সর্বস্ব গ্রাস করতে হবে এই ভাবনা! গয়নার তিনভাগ করার জন্য ননদকে ডাকতে বলেছিলেন শিবাণীদেবী। আর তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা উচিৎ নয় বলেই মনে করেছিলেন নমিতাদেবী। ছক কষেছিলেন। স্বামীকে রাজি করিয়েছিলেন গয়ায় গিয়ে শ্বশুর শাশুড়ির পিণ্ডদান করাতে, জা'কে নিরস্ত করিয়েছিলেন গয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে, কালুয়াকে রাজী করাতে হয়েছিলো চ্যাটার্জী বাড়িতে ডাকাতি করাতে। প্রথম দফায় হাজার দশেক টাকা দিয়েছিলেন। বাকি রফা কাজের পর! সব গোপনে। কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়। 
কিন্তু তাঁর স্বামী সন্দেহ করেছিলেন জায়ের খুনের পরেই। একটি ডাকাত যখন শিবাণীদেবীকে কোপাচ্ছিল, তার মুখের কাপড় সরে গিয়েছিল। শিবাণীদেবী পাড়ার লোকজনের কাছে "কালুয়া" নামটি বলে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু নমিতাদেবী যখন কালুয়াকে বাঁচাতে মরিয়া, তখনই বীরেন্দ্রনাথের সন্দেহ হয়। তাই নমিতাদেবীর সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করেই কালুয়ার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনেন তিনি। অভিযোগ প্রমাণিতও হয়। তারই ফলস্বরূপ কালুয়ার আজীবন কারাবাস!
ভয়! সেবারই প্রথম প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন তিনি। যদি কালুয়া তাঁর নাম বলে দেয়? ভয়ে ছটফট করতেন। স্বামী থানা থেকে ফিরলেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন কালুয়ার খবর জানার জন্য। বীরেন্দ্রনাথ অবাক হতেন খুব। আরও অবাক হলেন যখন কালুয়ার বৌকে কাজ ছাড়ালেন না নমিতাদেবী। 
স্বামী স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কে ফাটল ধরে যায় এক্কেবারে যখন বীরেন্দ্রবাবুর বোন ছন্দা এসে মায়ের গয়নার হদিস পায় না। ভারী ভারী সোনার গয়নাগুলোর গুটিকয়েক পড়ে ছিল। বাকিগুলোর হদিস তন্নতন্ন করেও যখন খুঁজে পাওয়া গেলনা, ভাইবোনে চোখচোখি হলো। পারিবারিক কেচ্ছা গোপন রাখলেন দুজনেই। বীরেন্দ্রনাথের বোন প্রীতিলতা অন্য মেয়েদের মতো ছিলেন না। ভারী নীরিহ প্রকৃতির ছিলেন। বৌদির সাথে কোঁদল করে গয়না নেবার সাধ্য বা বাসনা কোনওটাই তাঁর ছিল না। দু'দিন পরে অবশ্যি নন্দাই এসে পুলিশ টুলিশের ভয় দেখিয়ে গেছিলো, লাভ অবশ্য কিছুই হয়নি!

কিন্তু এই ঘটনায় বীরেন্দ্রনাথ বাবুর শরীর আর মন দুটোয় ভেঙে যায়। বাকি ঘটনাগুলোর সঙ্গে কার্যকারণ মেলাতে গিয়ে মনের দুঃখে সংসারজীবন থেকে সন্ন্যাস নেন তিনি। নিজের বৌকে পুলিশের হাতে দেবার মতো বুকের পাটা তাঁর ছিল না। কাজেই পড়া আর পড়ানোর মধ্যেই জীবনের সীমারেখা টেনে দিয়েছিলেন তিনি। তাই উচ্চমাধ্যমিকের পর তাঁর মেয়ে সুলগ্না যখন বাড়ির ড্রাইভারের সাথে পালিয়ে যায়, পুলিশে খবর দেবারও প্রয়োজন মনে করেননি। মুখে শুধু বলেছিলেন, 
"পাপ! পাপ! ধ্বংস করবে সব!"
নমিতাদেবীই থানা, পুলিশ করে মেয়ের খবর যোগাড় করেন। কিন্তু মেয়ে ততদিনে আঠারো পুর্ণ করেছে। তাই আইনত কিছুই করতে পারেননি তিনি। শুধু রাগে, দুঃখে মেয়ের মুখ দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
মেয়ের মুখটা ভেসে উঠতেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তাঁর। কেউ নেই তাঁর যার সঙ্গে দুটো কথা বলে মন হালকা করেন। স্বামী তো আলাদা ঘরেই সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। শেষ মূহুর্তে একফোঁটা জলও মুখে নেননি তাঁর হাতের!
রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন নমিতাদেবী, কার জন্য? কিসের জন্য এত কষ্ট? এত অপমান, এত ঘেন্না সহ্য করা? কি লাভ হলো? সম্পদের অধিকারী হয়ে কি লাভ যদি সম্পদ কারুর ঈর্ষার কারণ না হয়। ধরা পড়ে যাবার ভয়ে একটা গয়নাও গায়ে দিতে পারেননি কোনওদিন। মেয়ের ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে সবাইকে চমকে দেবেন এ'আশাতেও জল ঢেলে দিয়েছে মেয়ে। এখন মেয়েজামাই ঘুরঘুর করে তাঁর কাছে। কিসের আশায়? তিনি জানেন। মেয়ের আনা মিষ্টি, খাবার একটাও মুখে তোলেন না! শান্তি নেই! কিসের মোহ?
কিসের মালকিন হলেন তিনি? একটা মানুষও নেই ছড়ি ঘোরানোর যায় যার ওপরে! একটা কথা বলার লোক নেই। বোকা বাক্সের সামনে বসে শুধু শুনে যাওয়া! কতগুলো ইঁট কাঠ পাথরের মালিকানা? কিছু ধাতুর টুকরোর? কি মূল্য এগুলোর? স্বামী, ছেলে, মেয়ের জীবনের থেকেও বেশী? একটা মানুষের ভালবাসার জন্য হাহাকার করে তাঁর মন! কারুর হাতে সম্পদ তুলে নিশ্চিন্ত হবার মতো একটা মানুষও নেই। যক্ষের মতো পাহারা দেওয়াই নিয়তি তাঁর!
সম্পদ করার নেশায় ভোগ করার আনন্দটাই নষ্ট করেছেন তিনি! এই কথাগুলো তাঁকে কাঁটার মতো বিদ্ধ করে সারারাত। ফাঁকা বাড়িতে রাত গভীর হলেই দাপিয়ে বেড়ায় ছুঁচো, ইঁদুর, বনবিড়াল আর টিকটিকি, আরশোলা। তাদের চলার শব্দ, ঝিঁঝির ডাক, বাতাসের ফিসফিসানি শুনতে শুনতে আর ভয় পেতে পেতে ভোরের দিকে যখন চোখ জড়িয়ে আসে, কাকগুলোর তীব্র ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। আবার একটা ক্লান্তিকর দিন! নিরানন্দ, নিরাসক্ত জীবন! কাকগুলো যেন তাঁর জীবনের প্রতি ব্যঙ্গ করেই ডেকে চলেছে, খ্যা খ্যা খ্যা....

নমিতাদেবী বাসিমুখে বাসি বিছানা থেকেই গাল পাড়েন, দূর হ! পোড়ামুখো আগুনখেকোর দল!