ছোটগল্প - সুষমা ব্যানার্জী
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
মালকিন
সুষমা ব্যানার্জী
খট খট খট খট.....
খট খট খট খট....
খট খট খট খট...
ভারী শরীরটা নিয়ে দাঁতে দাঁত পিষতে পিষতে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছেন নমিতা দেবী। দোতলা থেকে একতলা নামতে গিয়ে দুবার জিরিয়েছেন। উচ্চরক্তচাপের জন্য তাঁর দ্রুত সিঁড়ি ভাঙ্গা নিষেধ, তবুও দিনে দুই তিনবার তাঁকে এই কাজটিই করতে হয়। এই বিশাল বাড়িতে তিনি বই দ্বিতীয় প্রাণীটি নেই। দরজা খুলে রাধাকে দেখেই তাঁর মাথায় রক্ত উঠে গেল।
- বাড়িতে মরদ বসিয়ে এসেছিস নাকি রে! এত তাড়া কিসের হারামজাদী?
- গাল দিবা না বলে দিলাম কাকী!
- কি আমার বোলনেওয়ালা এসেছেন র্যা... ভাতারখাগী, জানিসনা আমি তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারিনা। আমি কি উড়ে আসব নাকি?
ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে করতে গজগজ করে রাধা, অবশ্যই মালকিনের কান বাঁচিয়ে।
- কি মুখ বুড়ির! থাকত যদি বড়মা, গালপাড়া বার করে দিত!
- কি বিড়বিড় করছিস? জোরে বল সাহস থাকে তো।
- কিছু না, উপরে চল। বেলা হলো ম্যালায় খানি।
কিছু কথ্য কিছু অকথ্য গাল পাড়তে পাড়তে সদরে তালা দিয়ে নমিতা দেবী সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করেন। তিনি এবাড়ির ছোটো বউ, মানে চাটুজ্জে বাড়ির ছোটোগিন্নি। রাজা শঙ্কর মুখোপাধ্যায় উত্তর মালদহ জেলার এই বর্ধিষ্ণু গ্রামটিতে হুগলির বৈদ্যবাটি থেকে তিনঘর ব্রাহ্মণ এনে বসতি স্থাপন করিয়েছিলেন জমিজায়গা দিয়ে। তাও প্রায় দেড় শতক আগের ঘটনা। তারপর মহানন্দা দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। তিনঘর বামুনের বংশবৃদ্ধি এবং সমৃদ্ধশালী হতে সময় লাগেনি বিশেষ। ইনি তাঁদেরই চতুর্থ পুরুষের এক শরিক, বিনয় চ্যাটার্জীর ছোটো ছেলের বিধবা স্ত্রী।
আশেপাশের দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের বসতি হাঁড়িপাড়া ও জেলেপাড়া থেকে নিজেদের পৃথক রাখতে এই পাড়াটির নামকরণও হয়ে যায় বামুনপাড়া। চাটুজ্জেদের বাড়িটি বামুনপাড়ার সীমানায়। "নীচু জাতের" ছোঁয়া বাঁচাতে বাড়িটির চারিপাশে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দিয়েছিলেন বিনয় চ্যাটার্জী নিজে। সে পাঁচিল আজ স্থানে স্থানে ভগ্ন। সেই ভাঙা জায়গা দিয়ে গরু বাছুর মানুষ মায় শুকর পর্যন্ত বাগানে ঢুকে যায়। বাগানের লোভনীয় গাছগাছালি পাহারা দেবার জন্য বহুদিন বহাল ছিলো কালুয়া, যে কিনা রাধার স্বামী। তা সেও চাটুজ্জে বাড়িতেই খুন আর ডাকাতির দায়ে জেল খাটছে তা আজ বছর দশেক হয়ে গেছে। এসব কথা মনে পড়তেই দাঁতে দাঁত পিষে নমিতা দেবী বলে ওঠেন, " শালা নিমকহারাম"!
-" কিছু বললা কাকী? " বাসন মাজতে মাজতে ঘাড় ঘোরায় রাধা।
- তুই নিজের কাজ কর, মাগী!
রাগে জোরে জোরে বাসনকোসন ঘষতে থাকে রাধা। বারো বছর বয়স থেকে এবাড়িতে কাজ করে সে। চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল যার সাথে, সে বিয়ের রাতেই রাধাকে বিক্রি করে দেয় অন্য লোকের কাছে। কিভাবে যে ওদের খপ্পর থেকে বেঁচে ফিরেছে ভাবতেও অবাক লাগে। বাপের বাড়িতে ফিরে এসে আবার এবাড়িতেই কাজে বহাল হয়। এগারো বছর আগে কালুয়াকে বিয়ে করেছিল সে। কালুয়া এ গ্রামেরই ছেলে। কানাঘুষো শুনেছে দিল্লীতে নেশার কারবার করতে গিয়ে পুলিশের মার খেয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলো সে। তারপর এবাড়িতেই জমিজমার কাজ করত। ছোটো কর্তার খুব বিশ্বাসভাজন ছিলো। কি সুখেই না দিন গেছে। কিন্তু কপাল! একটা দীর্ঘনিশ্বাস বুক নিঙড়ে বেরিয়ে যায়।
রাধার কাজ শেষ হলে সদরে তালা লাগিয়ে দেন নমিতা দেবী। রাধাই সকালে বাজারহাট করে আনে। ব্যাংক, পোস্টাপিস যেতেও রাধাই ভরসা। অবশ্য তার জন্য মোটা টাকা দেন রাধাকে।
সকালের এটুকু সময়টাতেই প্রাণের স্পন্দন জাগে এই ভিটেতে। তারপর শ্মশানের স্তব্ধতা। আগে হইহট্টগোলে মুখরিত থাকত বাড়িটা। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেন। সোনুটাও যদি থাকত! সেও বউ মেয়ে নিয়ে দূরে চলে গেলো!
আস্তে আস্তে মাঝের ঘরের সামনে দাঁড়ান। আঁচলের চাবির গোছা থেকে খুঁজে খুঁজে আন্দাজে চাবি বের করে খোলেন ঘরের তালা। বাড়ির মধ্যে এই ঘরটি সবচাইতে বড়। এইটে ছিল তাঁর শাশুড়ির ঘর। সব নাতিনাতনি নিয়ে এঘরেই থাকতেন তিনি। ঘরের ভিতরে একটা বড় ভারী কাঠের সিন্দুক আছে। সিন্দুকের ওপর কাঠের তক্তা পেতে বিছানা পাতা। বাইরের লোকজন এঘরেই বসতো। বাইরের কারুর বোঝার ক্ষমতাই ছিল না সিন্দুকের ওপরে বসে আছে তারা!
বুড়ির বুদ্ধি ছিল বটে! মনে মনে হাসেন নমিতাদেবী। সিন্দুকের তলার একটা খুপরি খুললে ভারী ভারী গয়না দেখতে পাওয়া যাবে! শাশুড়ি একদিন সিন্দুক খুলে জ্ঞাতির বিয়ের গয়না বাছছিলেন। চ্যাটার্জী বংশের ছেলের বিয়ে হলে বাড়ির গয়না দেওয়াই রীতি। মেয়েদের বিয়েতে নতুন গয়না গড়িয়ে দেওয়া হতো। এতে বাড়ির গয়না বাড়িতেই থাকতো। সেই গয়নার বের করার সময় জানালা দিয়ে দেখেছিলেন। জানালার সামনে আলনা ছিলো বলেই বোধহয় জানালা বন্ধ করার প্রয়োজন মনে করেননি সুহাসিনী দেবী। ভর সন্ধ্যেয় লোভে চকচক করে উঠেছিলো নমিতাদেবীর চোখ। কিন্তু তখন ছিল শুধু অপেক্ষা আর জাল বোনা!
সিন্দুকের গায়ে আদর করে হাত বোলান নমিতা দেবী। কাউকে প্রাণে ধরে গয়নার ভাগ দিতে পারেননি। বুকের ভিতর থেকে দীর্ঘনিশ্বাস নিংড়ে বেরিয়ে আসে। এরপর? কাকে দিয়ে যাবেন সাম্রাজ্য? সোনুটাও হয়েছে বৌভেড়ুয়া! মনে মনে গালি পাড়েন! কত চোখের জল, কত অভিনয়, কত ষড়যন্ত্র করে এই বিশাল সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছিলেন। কি লাভ হলো? জীবনের সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্কে শুধু নেমেই গেছেন, আর নেমেই গেছেন। আজ হাতে রইলো 'শূন্য'।
দরজা বন্ধ করে একবার সারা বাড়ির দিকে তাকান! খাঁখাঁ করছে। সারিসারি ঘর বোবা হয়ে তাঁকেই দেখছে। টানাবারান্দার থামের ওপর পায়রার বকমবকম মাঝে মাঝেই এই বুকে চাপ ধরা নিস্তব্ধতাকে ভেঙে আরও বেশী প্রকট করছে স্তব্ধতা। বিশাল উঠোনে কিছু শুকনো পাতা ঘুরপাক খাচ্ছে। পেছনের সাধের বাগান আগাছায় পূর্ণ ঘন জঙ্গল! হাঁড়ি আর তুরীদের ছাগল চড়ানোর জায়গা হয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েদের জ্বালায় একটা ফলপাকুড় চোখে দেখা যায় না।
" বেজম্মার জাত"!
অদেখা, অজানা ছেলেমেয়েদের গালি দিয়ে বুকের জ্বালা জুড়ান তিনি।
জ্বালা আর জুড়োয় কই? বাড়ির মতঅই খাঁখাঁ করে বুকের ভেতরটা। ছেলে বলেছে তার কাছে গিয়ে থাকতে। রায়গঞ্জে ফ্ল্যাট কিনেছে তারা। বয়েই গেছে! এই রাজপ্রাসাদ ছেড়ে ওই তিনকামরার ঘরে থাকতে!
দুপুরে ঘুমের অভ্যেস নেই। ছাদে বসে বসে বড়ি পাহারা দেন আর কাল্পনিক চোরেদের উদ্দশ্যে গালি পাড়েন। ছেলে অনেকবার বলেছে সারাদিনরাতের লোক রাখতে। কিন্তু সাহস করেননি তিনি। যদি গলা কেটে গয়নাগাটি নিয়ে চলে যায়? জীবন তাঁকে শিখিয়েছে কাউকে বিশ্বাস না করতে। কারণ তিনি নিজেই কারুর বিশ্বাস রাখেননি।
শাশুড়ির বিছানার নিচে সিন্দুকের চাবি। দিনের পর দিন শাশুড়ির সেবা করে বিশ্বাসভাজন হয়েছিলেন। সংসারের সব কাজের মধ্যেই সুহাসিনী দেবীর পান সেজে দেওয়া, কাপড় গুছিয়ে দেওয়া, বিছানা পাতা এই কাজগুলি করতেন নিজের হাতে। কাজ করতে করতেই বড় জায়ের নামে কান ভাঙানি দিতেন। বড় জা ছিলেন জমিদার বাড়ির মেয়ে। সংসারের কুটকাচালি খুব বেশী স্পর্শ করতো না তাঁকে। একমাত্র মেয়ের শিক্ষার দিকে যত নজর ছিল শিবাণী দেবীর, তার এক কণাও সংসারের দিকে দিলেই সহজেই টের পেতেন তাঁর বিরুদ্ধে একটা চোরা স্রোত বইছে। কিন্তু বড়বাড়ির মেয়ে বলে বাড়িশুদ্ধ সকলেই সমীহ করতো শিবাণী দেবীকে, এইটাই সহ্য করতে পারতেন না তাঁর শ্বাশুড়ি সুহাসিনী দেবী। আর এই অপছন্দটাকেই কাজে লাগিয়েছিল নমিতাদেবী। তার ফলস্বরূপ শাশুড়ির হাতের ব্রোঞ্জের চুড়ি বা কানপাশাটা আস্তে আস্তে নমিতাদেবীর আলমারিতে উঠে এসেছিলো।
কিন্তু শেষরক্ষা হলো কই? দাঁতে দাঁত চেপে সেদিনের কথা মনে করছিলেন নমিতাদেবীর। লোপামুদ্রা মানে বড় জায়ের মেয়ের বিয়ে। এবাড়ির প্রথম মেয়ে। শাশুড়ির সাতভরির সীতাহার পরিয়ে দিলেন তার গলায়। । মনে মনে জ্বলে উঠলেন নমিতাদেবী। এভাবে চললে তাঁর ভাগে কি থাকবে?
ভগবান নাকি শয়তান, কে যে ঠিক সহায় হলো তাঁর! মেয়ের বিয়ের মাসখানেকের মধ্যেই মেয়ের বাড়ি থেকে ফেরার পথে পথদুর্ঘটনায় মৃত্যু হলো ভাসুরের। তাঁর প্রতিপক্ষ দুর্বল হলো। ছেলের মৃত্যুশোক সহ্য করতে না পেরে ছ'মাসের মধ্যেই শ্বশুর মশায়ের হার্টফেল! মন্ত্রী, রাজা ভগবান তুলে নিয়েছেন। এবারে শুধু বোড়ের খেলা!
সেইমত কালুয়াকে টাকা পয়সা দিয়ে হাত করতে শুরু করেন। যেখানে টাকাপয়সাতে কাজ হতোনা, ইঙ্গিতবহ হাসি কিংবা ভ্রূভঙ্গীতেই কাজ হতো। কালুয়া ছিল স্বভাবলোভী। তাকে হাত করতে বেগ পেতে হয়নি। তাই বাগানের মূল্যবান কাঠ, জমির ধান, গম, সরষে বেচে যে টাকা আসতো তার সিংহভাগই নমিতাদেবীর হস্তগত হতো। তাঁর স্বামী বীরেন্দ্রনাথ ঋষিতুল্য মানুষ, পেশায় অধ্যাপক। টাকাপয়সার হিসাব নমিতাদেবী নেওয়াতে খুশিই হয়েছিলেন তিনি! কলেজের শেষে বিপুল পরিমাণ বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকাটা ছিল স্বভাব। গিন্নির স্বভাব আঁচ করার সময় তাঁর ছিল না।
বড়ছেলে ও স্বামী মারা যাবার পরে বড়বৌমার ওপর বিদ্বেষটা কিছু কমেছিল সুহাসিনীদেবীর। মন ও শরীর দুইই দুর্বল হয়ে গেছিল। তাই একদিন মেয়েকে ডেকে পাঠানোর কথা বলেছিলেন গয়না ভাগাভাগির জন্য। তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলেন নমিতাদেবী। বলেছিলেন, আপনার কাছে থাকলেই সুরক্ষিত থাকবে, মা!
ক্ষীণ আপত্তি করেছিলেন সুহাসিনীদেদেবী। জোরের জায়গা নেই, তাই বলেছিলেন,
-আমার যদি ভালোমন্দ কিছু হয়ে যায় মা!
- তাতেও কিছু হবেনা মা! কোর্টের অর্ডার আছে, ছেলের মতো মেয়েরও সম্পত্তিতে সমান অধিকার!
নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন সুহাসিনীদেবী। কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারেননি নমিতাদেবী। কিছুতেই ভাগাভাগি হতে দেবেননা তিনি! কিন্তু কতদিন? কতদিন আটকে রাখতে পারবেন?
এবারে হেস্তনেস্ত করতেই হবে। কালুয়ার শরণাপন্ন হলেন আবার। এবারে খুব গোপনে ঘুমের ওষুুধ এনে দিয়েছিল কালুয়া। বিনিময়ে কালুয়া অবশ্য আদায় করেছিল অনেকটা। ভরদুপুরে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে কালুয়া যখন তাঁর শরীর নিয়ে আদিম খেলায় মেতেছিলো, নমিতাদেবী মনে মনে শাশুড়ির গয়নাগুলোর কথাই ভাবছিলেন। এখনও তাঁর গা'টা ঘিনঘিন করে উঠলো। গলার কাছে আটকে থাকা একদলা থুথু থুঃ করে ছাতের ওপর ফেলে যেন কালুয়ার শরীরের অনুভূতিটাই দূর করতে চাইলেন তিনি এতদিন পরেও।
সন্ধ্যে নেমেছে। সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বালিয়ে জপের মালা নিয়ে বসলেন তিনি। টিভিতে সিনেমা একটা চলছে, নজর নেই সেদিকে। তার নিজের জীবনের গল্প কি নাটক নভেলের থেকে কিছু কম?
শাশুড়ির রাতের খাবার দুধরুটির সাথে খুব গোপনে মিশিয়ে দিয়েছিলেন ওষুধগুলো। আশ্চর্য! একটুও হাত কাঁপেনি তাঁর। সবথেকে বড়কথা, কেউ সন্দেহও করেনি! সকালে ডাক্তার এসেও বয়সজনিত কারণে স্বাভাবিক মৃত্যু ভেবেই "death caused by silent Myocardial Infarction " লিখলেন। কি সহজ মানুষ মারা!
জা শিবাণীদেবী মারা অবশ্য অত সহজ হয়নি। অনেক নাটক করতে হয়েছিল। ততদিনে পরিণত হয়েছে সর্বস্ব গ্রাস করতে হবে এই ভাবনা! গয়নার তিনভাগ করার জন্য ননদকে ডাকতে বলেছিলেন শিবাণীদেবী। আর তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা উচিৎ নয় বলেই মনে করেছিলেন নমিতাদেবী। ছক কষেছিলেন। স্বামীকে রাজি করিয়েছিলেন গয়ায় গিয়ে শ্বশুর শাশুড়ির পিণ্ডদান করাতে, জা'কে নিরস্ত করিয়েছিলেন গয়ায় যাওয়ার ব্যাপারে, কালুয়াকে রাজী করাতে হয়েছিলো চ্যাটার্জী বাড়িতে ডাকাতি করাতে। প্রথম দফায় হাজার দশেক টাকা দিয়েছিলেন। বাকি রফা কাজের পর! সব গোপনে। কাকপক্ষীতেও যেন টের না পায়।
কিন্তু তাঁর স্বামী সন্দেহ করেছিলেন জায়ের খুনের পরেই। একটি ডাকাত যখন শিবাণীদেবীকে কোপাচ্ছিল, তার মুখের কাপড় সরে গিয়েছিল। শিবাণীদেবী পাড়ার লোকজনের কাছে "কালুয়া" নামটি বলে যেতে পেরেছিলেন। কিন্তু নমিতাদেবী যখন কালুয়াকে বাঁচাতে মরিয়া, তখনই বীরেন্দ্রনাথের সন্দেহ হয়। তাই নমিতাদেবীর সব প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ করেই কালুয়ার বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ আনেন তিনি। অভিযোগ প্রমাণিতও হয়। তারই ফলস্বরূপ কালুয়ার আজীবন কারাবাস!
ভয়! সেবারই প্রথম প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলেন তিনি। যদি কালুয়া তাঁর নাম বলে দেয়? ভয়ে ছটফট করতেন। স্বামী থানা থেকে ফিরলেই ঝাঁপিয়ে পড়তেন কালুয়ার খবর জানার জন্য। বীরেন্দ্রনাথ অবাক হতেন খুব। আরও অবাক হলেন যখন কালুয়ার বৌকে কাজ ছাড়ালেন না নমিতাদেবী।
স্বামী স্ত্রীর স্বাভাবিক সম্পর্কে ফাটল ধরে যায় এক্কেবারে যখন বীরেন্দ্রবাবুর বোন ছন্দা এসে মায়ের গয়নার হদিস পায় না। ভারী ভারী সোনার গয়নাগুলোর গুটিকয়েক পড়ে ছিল। বাকিগুলোর হদিস তন্নতন্ন করেও যখন খুঁজে পাওয়া গেলনা, ভাইবোনে চোখচোখি হলো। পারিবারিক কেচ্ছা গোপন রাখলেন দুজনেই। বীরেন্দ্রনাথের বোন প্রীতিলতা অন্য মেয়েদের মতো ছিলেন না। ভারী নীরিহ প্রকৃতির ছিলেন। বৌদির সাথে কোঁদল করে গয়না নেবার সাধ্য বা বাসনা কোনওটাই তাঁর ছিল না। দু'দিন পরে অবশ্যি নন্দাই এসে পুলিশ টুলিশের ভয় দেখিয়ে গেছিলো, লাভ অবশ্য কিছুই হয়নি!
কিন্তু এই ঘটনায় বীরেন্দ্রনাথ বাবুর শরীর আর মন দুটোয় ভেঙে যায়। বাকি ঘটনাগুলোর সঙ্গে কার্যকারণ মেলাতে গিয়ে মনের দুঃখে সংসারজীবন থেকে সন্ন্যাস নেন তিনি। নিজের বৌকে পুলিশের হাতে দেবার মতো বুকের পাটা তাঁর ছিল না। কাজেই পড়া আর পড়ানোর মধ্যেই জীবনের সীমারেখা টেনে দিয়েছিলেন তিনি। তাই উচ্চমাধ্যমিকের পর তাঁর মেয়ে সুলগ্না যখন বাড়ির ড্রাইভারের সাথে পালিয়ে যায়, পুলিশে খবর দেবারও প্রয়োজন মনে করেননি। মুখে শুধু বলেছিলেন,
"পাপ! পাপ! ধ্বংস করবে সব!"
নমিতাদেবীই থানা, পুলিশ করে মেয়ের খবর যোগাড় করেন। কিন্তু মেয়ে ততদিনে আঠারো পুর্ণ করেছে। তাই আইনত কিছুই করতে পারেননি তিনি। শুধু রাগে, দুঃখে মেয়ের মুখ দেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
মেয়ের মুখটা ভেসে উঠতেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তাঁর। কেউ নেই তাঁর যার সঙ্গে দুটো কথা বলে মন হালকা করেন। স্বামী তো আলাদা ঘরেই সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে। শেষ মূহুর্তে একফোঁটা জলও মুখে নেননি তাঁর হাতের!
রাতের খাওয়া শেষ করে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন নমিতাদেবী, কার জন্য? কিসের জন্য এত কষ্ট? এত অপমান, এত ঘেন্না সহ্য করা? কি লাভ হলো? সম্পদের অধিকারী হয়ে কি লাভ যদি সম্পদ কারুর ঈর্ষার কারণ না হয়। ধরা পড়ে যাবার ভয়ে একটা গয়নাও গায়ে দিতে পারেননি কোনওদিন। মেয়ের ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে সবাইকে চমকে দেবেন এ'আশাতেও জল ঢেলে দিয়েছে মেয়ে। এখন মেয়েজামাই ঘুরঘুর করে তাঁর কাছে। কিসের আশায়? তিনি জানেন। মেয়ের আনা মিষ্টি, খাবার একটাও মুখে তোলেন না! শান্তি নেই! কিসের মোহ?
কিসের মালকিন হলেন তিনি? একটা মানুষও নেই ছড়ি ঘোরানোর যায় যার ওপরে! একটা কথা বলার লোক নেই। বোকা বাক্সের সামনে বসে শুধু শুনে যাওয়া! কতগুলো ইঁট কাঠ পাথরের মালিকানা? কিছু ধাতুর টুকরোর? কি মূল্য এগুলোর? স্বামী, ছেলে, মেয়ের জীবনের থেকেও বেশী? একটা মানুষের ভালবাসার জন্য হাহাকার করে তাঁর মন! কারুর হাতে সম্পদ তুলে নিশ্চিন্ত হবার মতো একটা মানুষও নেই। যক্ষের মতো পাহারা দেওয়াই নিয়তি তাঁর!
সম্পদ করার নেশায় ভোগ করার আনন্দটাই নষ্ট করেছেন তিনি! এই কথাগুলো তাঁকে কাঁটার মতো বিদ্ধ করে সারারাত। ফাঁকা বাড়িতে রাত গভীর হলেই দাপিয়ে বেড়ায় ছুঁচো, ইঁদুর, বনবিড়াল আর টিকটিকি, আরশোলা। তাদের চলার শব্দ, ঝিঁঝির ডাক, বাতাসের ফিসফিসানি শুনতে শুনতে আর ভয় পেতে পেতে ভোরের দিকে যখন চোখ জড়িয়ে আসে, কাকগুলোর তীব্র ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। আবার একটা ক্লান্তিকর দিন! নিরানন্দ, নিরাসক্ত জীবন! কাকগুলো যেন তাঁর জীবনের প্রতি ব্যঙ্গ করেই ডেকে চলেছে, খ্যা খ্যা খ্যা....
নমিতাদেবী বাসিমুখে বাসি বিছানা থেকেই গাল পাড়েন, দূর হ! পোড়ামুখো আগুনখেকোর দল!
0 comments: