0

রম্যরচনা - সুনৃতা মাইতি

Posted in

রম্যরচনা


পড়াশুনা করে যে

সুনৃতা মাইতি


গা গতর নাড়িয়ে যদি কেউ এই বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষা শুরু করে তবে এটা স্হির নিশ্চিত যে অন্তত এই একটি বিষয়ে বঙ্গমাতাগণ “জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন” পাবেন। আহা, পোলাপানের পঠন পাঠনে নাক গলানোর মতো পরম মহৎ কাজটি তারা নিরবিচ্ছিন্নভাবে করে চলেন যে। আমাদের এলাকার গুগলজেঠু পুলিনবাবুর কাছে অবশ্য এর একটি মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যাও আছে। সেটা কিছুটা এইরকম। ইহারা তৃতীয় বিশ্বের ঈগলচক্ষু মাতা। পোলাপানের মধ্যে নিজ উচ্চাকাঙ্খা চরিতার্থ করিতে চাহেন।

তাই বুঝি! কি জানি! কিন্তু ছানাপোনা যদি বঙ্গীয় কু কোষ সমন্বিত কু বুদ্ধির আখর হয়, মাতাদের আর কিই বা করণীয় বলুন? এ সার সত্য কাকে বোঝাবেন? সকল বাচ্চাই তো আর ওই পাশের বাড়ির সুবোধ গোপাল কিংবা গোপালীর মত মহান অথবা মহতী নয়! ইশকুল থেকে ফিরেই সেইসব ভালোমানুষের পোয়েরা চাট্টি মুখে গুঁজেই পড়তে বসে যায় এবং পড়তে পড়তেই রাত ভোর।

অতএব পঠন পাঠন হেতু বাকিসব রাখাল জননীদের প্রত্যেকের স্বীয় “এক এবং অদ্বিতীয়” অঙ্গে বহুবিধ রূপ পরিগ্রহণ ব্যতিরেকে গত্যন্তর কি? বোঝা যাচ্ছেনা বুঝি! কয়েকটি উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটি একেবারে জলবৎ তরলম্ হয়ে যাবে।

যেমন ট্যাঁপার কথাই ধরুন। অতি চালাক ট্যাঁপার অদূরদর্শী পিতা সাত পাঁচ না ভেবেই ট্যাঁপার হাতে তুলে দিলেন “হাইজু” আ্যাপ, ভর্তি করলেন “বাতাস” কোচিং সেন্টারে। না কি ছেলে তার অতি ধুরন্ধর বিদ্যাবাগীশ হবেন। অমনি ছেলের হাতে চলে এল আস্ত দুইখানা “লার্নিং ট্যাব”। মহানুভব ট্যাঁপা তার কুবুদ্ধি প্রয়োগপূর্বক দুইখানি ট্যাবকে দিব্য “ফরম্যাটিং” করে কালক্রমে নিজ চিত্ত বিনোদন কার্যে নিয়োজিত করলেন। কিন্তু শেষরক্ষা হলো কই? মোক্ষম সময়ে ট্যাঁপার মাতা “মাতাহারী” রূপে রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করলেন এবং পুত্রের এবংবিধ কীর্তির পর্দা ফাঁস করে সপুত্র পিতাকে যারপনারই পর্যুদস্ত করে ফেলিদির শেষ হাসি হাসলেন।

আবার গদাই এর বাড়ির সামনে দিয়ে সন্ধ্যাবেলায় একটু পায়চারি করলেই শুনতে পাবেন গদাই এবং তস্য মাতার উত্তেজিত বার্তালাপ। গদাই বলছে পাঁচ। মাতা বলছেন পনেরো। অবশেষে মাতা নিদান দিলেন “আচ্ছা, তোমারও থাকবে, আমারও থাকবে, শেষমেশ দশে রফা করো”। আপনি আশ্চর্য হয়ে ভাবলেন এই ভর সন্ধ্যায় মাতা পুত্রের এইরকম গড়িয়াহাটীয় দরদামের কারণ কি? কিছুক্ষণ আরও কান পাতুন। বুঝতে পারবেন মাতা পুত্র অঙ্ক নিয়ে কথা কইছেন। গদাই এর অঙ্কাভ্যাস চলছে কিনা! অতএব সংখ্যা নিয়ে উভয়ের দরদাম এবং বাদানুবাদ চলছে। মাতা কালে কালে এক সুদক্ষ বেচুবাবু হয়ে উঠেছেন।

পটারামের মাতার ব্যাপার অবশ্য অন্য। তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় অতীব করিৎকর্মা। পটারামের “ইন ভোগ” মাতা সোশ্যাল মিডিয়ায় ইনিয়ে বিনিয়ে এবং প্যানপেনিয়ে সমাজশিক্ষামূলক গল্প লেখেন। “অসাধারণ”, “অনবদ্য”, “অতুলনীয়” ইত্যাদি বিশেষণে বিভূষিত হয়ে ইদানীং তিনি খটখটে দিনের আলোয় নিত্য “ঝিলমিলাতা সিতারা” দেখছেন । তা তার ঘরেও কি কম অশান্তি! একদিন স্বভাববশতঃ পুত্রের পড়ার ঘরে আড়ি পেতে তিনি শুনতে পেলেন তার রত্নপ্রতীম পুত্র এবং অঙ্কশিক্ষক মহাশয় কথোপকথনে প্রবৃত্ত। শিক্ষক মহাশয় বললেন...

“বাছা, কিভাবে এর উত্তর মিলে গেলো? মধ্যিখানে এটি কি? ভারী রহস্যময় তো!”

পটারাম অম্লানবদনে জবাব দিলেন...
“ইয়ে এক্স, মানে একটি ভ্যারিয়েবল্... আর কি!”

শিক্ষক মহাশয় চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসা করলেন...
“তা হঠাৎ এস্থানে এটির আগমনের হেতু?”

পটারাম নির্বিকল্প মুখে পা দোলাতে দোলাতে জানালো,
“ইয়ে, যে কোনও প্রবলেম সলভ্ করতে হলে ‘থার্ড পার্টিকে’ হস্তক্ষেপ করতেই হয় কিনা বলুন? তা উত্তর মিলছিল না। কি আর করি! শেষে একটা উপরি এক্স আনতেই পুরো কেস জমে ক্ষীর! প্রবলেম সলভ্ড”।

এদিকে দরজার আড়ালে পটারামের আপাদমস্তক জ্বলনরত মাতা বেশ বুঝতে পারছিলেন তার একলৌতা ছেলে দিব্যি লায়েক হয়ে উঠেছে। তিনি “আপন মনের মাধুরী মিশায়ে” গল্প লেখেন, আর তার পুত্র “আপন মনের মাধুরী মিশায়ে” অঙ্ক করেন। অতএব সেইদিন থেকে তিনি সামাজিক গল্পলিখন স্থগিত রেখে সপুত্র অঙ্কচর্চায় নিয়োজিত হলেন। কি আত্মত্যাগ বুঝুন! মাঝখান থেকে সোশ্যাল মিডিয়া একজন উদীয়মান সমাজ সংস্কারককে অকালে হারালো।

বুঁচকির আবার বাংলা নিয়ে সমস্যা। বানান প্রয়োগে সে এক মূর্তিমতী কালিদাসী। কোনও একখানি প্রশ্নের উত্তর লিখতে গিয়ে তিনি “আবিষ্কার” বানানের তিনরকম প্রয়োগ করেছেন। শঙ্কিত মাতা এ প্রসঙ্গে সদুত্তর চাইলে তিনি নিশ্চিন্ত মুখে জানিয়েছেন “আহা, ম্যামের যে বানানটি দরকার সেটা ঠিক বুঝেশুনে নিয়ে নেবেন । এতে এত চিন্তার কি আছে!” এতেই কি শেষ! এরই মধ্যে একটি পরীক্ষায় তার লেখা একটি ব্যক্তিগত পত্রের শেষ লাইনটি ইশকুলে একটি বহুচর্চিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে । লাইনটি হলো, বড়দের আমার “আসিব্বাদ” এবং ছোটদের “সোদ্দা” জানালাম। এইসব দেখেশুনে বুঁচকির মা প্রথমটায় হাসবেন না কাঁদবেন বুঝতে পারছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি হাল না ছেড়ে বরং কন্ঠ ছেড়েছেন জোরে। অতএব আশা করা যায় অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বুঁচকি ও তার মাতা বাংলা ব্যাকরণ বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠবেন।

বুঁচকির বেস্টোফ্রেন্ডো শুঁটকির আবার সমস্যা অন্যরকম। তিনি এই ইহ জীবনে বড্ড বেশী বুঝে ফেলেছেন। ফলতঃ প্রায়শই স্কুল থেকে বিবিধ অভিযোগ আসতে থাকে। উপরন্তু তিনি আবার বাংলায় বিশেষ দড়। কিছুদিন আগেই তিনি দুটি অসাধারণ বাক্যরচনা করেছেন। সন্ধান এবং নির্মাণ এই দুটি শব্দ দিয়ে তিনি যথাক্রমে লিখেছেন “আমার মা বাবার লুকানো টাকার সন্ধান খুব তাড়াতাড়ি করতে পারে”। এবং “পিতা মাতা নিজেদের শরীর দিয়ে সন্তান নির্মাণ করেন”। এইরকম অবস্থায় শুঁটকির মাতা পঠন পাঠনের পাশাপাশি নীতি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা মর্মে মর্মে অনুধাবন করেছেন এবং স্বীয় জীবনকে একটি পবিত্র নীতিকথায় পরিণত করেছেন। ইদানীং তার বাড়ির টিভিতে সাসবহু সিরিয়ালের পরিবর্তে অহোরাত্র “খাস্তা” চ্যানেল চলে এবং বাড়ির সামনে দিয়ে গেলেই যেন মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি বেজে ওঠে।

মাতাগণের এই অনলস প্রচেষ্টা এবং সমূহ আত্মত্যাগকে ভুলেও পরিহাস করবেন না যেন। কে বলতে পারে, একদিন এই গণ্ড গণ্ড রাখাল রাখালীর গোপালত্বে উত্তরণ ঘটবে না! সেইদিনের অপেক্ষায় মাতারা লড়ে যাবেন। উর্দ্ধনেত্র বুদ্ধিজীবীদের মনস্তাত্বিক আলোচনা চলুক গে। এইরকম আলোচনা তো কতই ঘটে। তাতে কি আসে যায়। মাতারা মাত্র দুটি বাক্য ভালোভাবে বোঝেন। পড়াশুনা করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে এবং আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।

0 comments: