Next
Previous
Showing posts with label রূপকথা. Show all posts
1

রূপকথা - ধূপছায়া মজুমদার

Posted in


রূপকথা


শান্তিনগরের উপাখ্যান 
ধূপছায়া মজুমদার



বন্ধুরা, আজ এক মায়াময় রাজ্যের গল্প শুনবে? সে রাজ্যের চেহারাখানা ভারি মিষ্টি। তার মাথায় বরফঘেরা পাহাড়চুড়োর মুকুট, পায়ের কাছে খিলখিল হেসে লুটোপুটি খায় সাগরের নীল জলরাশি। সেখানে পথে দু'কদম হাঁটলেই দুপাশে দেখা মেলে ঘন সবুজ বনরাজির, আর বনে যে কত রকমের গাছপালার বাস, সে বলে শেষ করা যাবে না। যেমন প্রাণজুড়ানো সেসব গাছের ছায়া, তেমন মিষ্টি তাদের ফুলের সুবাস, আর ফলের স্বাদ? আহা মরি মরি, সে ফলের সোয়াদের টানে দূরদূরান্ত থেকে কত যে পাখি সারা বছর ধরে উড়ে আসে, তার কোনও হিসেব নেই। তাই তো পাখিদের কলতানে সে রাজ্যের আকাশ বাতাস ভরে থাকে সারাক্ষণ। এমন মায়াময় রাজ্যের নামটিও ভারি আরামের, শান্তিনগর।

শান্তিনগরের রাজা সোমদেব, রাণী চন্দ্রাবতী, আর তাঁদের একটিমাত্র কন্যারত্ন সোমাভা। রাজকন্যা সোমাভা বুঝি সার্থকনামা, তার প্রতিভা আর হৃদয়ের আভা যেন চাঁদের স্নিগ্ধ কিরণের মতোই চারপাশ আলো করে রাখে। তীক্ষ্ম বুদ্ধি আর নরম মন দিয়ে সে জয় করেছে রাজ্যশুদ্ধু মানুষ আর অবোলা প্রাণীদের হৃদয়। ঘোড়াশালের রুগ্ন ঘোড়াটি বলো, বা দূর গাঁয়ের শয্যাশায়ী বৃদ্ধ সৈনিক, রাজকন্যার হাতের স্নিগ্ধ ছোঁয়া যে একবার পেয়েছে, তার মন ভাল হবেই হবে। 

প্রতি বছর বর্ষার শুরুতে রাজ্যে মহা সমারোহে অনুষ্ঠিত হয় বৃক্ষোৎসব। এটিই রাজ্যের প্রধান উৎসব। সেদিন সকাল থেকে সারা রাজ্যে বেজায় হৈ-চৈ। ভিন্‌রাজ্যের প্রজা, রাজা, শান্তিনগরে সেদিন সব্বার নিমন্ত্রণ। গান-বাজনা, নাচ, খাওয়া-দাওয়া, বনে বনে, পথের ধারে নতুন গাছের চারা লাগানো, এসবের বন্দোবস্ত তো থাকেই, সেইসঙ্গে থাকে বনজ সম্পদের বাৎসরিক হিসেবনিকেশ আর বনজ সম্পদের প্রদর্শনী। প্রকৃতিকে প্রাণ ঢেলে ভালবাসলে প্রকৃতি-মা দু'হাত ভরে তাঁর সন্তানদের কি কি উপহার দেন, তারই নমুনা সকলের সামনে এনে রাখা হয় সেদিন। 

সেবার, এই বৃক্ষোৎসবের দিনে, ভারি গোল বাধল। প্রদর্শনীর কিছুক্ষণ আগে, সবে তখন সম্বৎসরের বনজ সম্পদের হিসেব মেলানো শেষ হয়েছে, রাজামশাইয়ের কাছে এসে হাজির হলো দূর পশ্চিমের সাগরতীরের শক্তিধর রাজ্য বলীদেশের এক দূত। তার হাতে বলীরাজ বজ্রবাহুর একখানি চিঠি। চিঠি পড়ে জানা গেল বলীদেশের এখন ঘোর বিপদ। অবশ্য সে বিপদ ঘনিয়ে আসার কারণ সে রাজ্যের মানুষের হঠকারিতা। তারা যন্ত্র তৈরির নেশায় মেতেছিল বহু বছর ধরে। সকাল থেকে রাত অবধি মানুষের যা যা কাজ, সেসবের উপযোগী যন্ত্র বানাবে তারা, যাতে মানুষকে কেবল মাথা ছাড়া আর কোনো অঙ্গ চালনা করতে না হয়, এমনটাই ছিল তাদের স্বপ্ন। 

এতদিনে সে স্বপ্ন প্রায় সত্যিই হয়ে এসেছে, কিন্তু সৃষ্টির নেশায় বুঁদ হয়ে থেকে সেদেশের লোকেরা খেয়াল করেনি, অত জটিল সব যন্ত্রের জ্বালানি পুড়ে যে ছাই তৈরি হচ্ছে, সেসব জঞ্জাল যাচ্ছে কোথায়? এত বছর ধরে সেইসব জঞ্জাল গিয়ে জমা হয়েছে সাগরের কোলে। সেখানে আবার রাজা অর্ণবতেজের সাম্রাজ্য। বলীদেশের জঞ্জালের দূষণে সাগররাজ্যের বাসিন্দারা অসুস্থ হয়ে পড়েছে, সেখানে মহামারী দেখা দিয়েছে। ব্যস, রাজা অর্ণবতেজ মহা চটেছেন এই অনাচারে। একেই তিনি একটু রাগী মানুষ, প্রজাদের এতটুকু কষ্ট সইতে পারেন না, তাঁর সৈন্যদলও বিশাল, সৈন্যসামন্ত নিয়ে বলীদেশ আক্রমণ করে তিনি সেদেশের মানুষকে ভিটেছাড়া করেছেন। এহেন সঙ্কটমুহূর্তে বলীরাজের মনে পড়েছে শান্তিনগরে বেশ বড় বড় জঙ্গল রয়েছে। তারই মধ্যে কয়েকটা জঙ্গল পরিষ্কার করে রাজা সোমদেব যদি তাঁদের একটু থাকতে দেন, বড় উপকার হয় তবে। যন্ত্রপাতি সঙ্গেই আছে, রাজামশাই অনুমতি দিলেই বলীদেশের লোকেরা গাছপালা উপড়োতে লেগে পড়বে। 

বজ্রবাহুর চিঠি প'ড়ে তো রাজা সোমদেবের মাথায় হাত। যে গাছপালাকে তিনি প্রজাদের মতোই স্নেহ করেন, বজ্রবাহু কিনা তাদেরই হত্যার অনুমতি চেয়ে বসেছেন? এ অনুমতি দেওয়া যে অসম্ভব। সভাসদদের মুখেও অসন্তোষের ছায়া দেখতে পান রাজামশাই। রাজকন্যা সোমাভা এখন মাঝেমাঝে সভায় এসে রাজকার্য শেখে, সে চিঠির বয়ান শুনে কেঁদেই আকুল,

"বাবা, তুমি ওদের এক্কেবারে বারণ করে দাও। গাছপালা কেটে আমাদের এখানে কেউ বসত গড়ে না যে!"

"সে নাহয় বারণ করব মা, তুই আগে চোখের জল মোছ্‌। এত আবেগী হলে রাজ্য চালাবি কেমন করে?" সস্নেহে মেয়েকে ধমক দেন রাজামশাই।

"আমি রাজা। কেউ আমার কাছে সাহায্য চাইলে তাকে কি আমি খালি হাতে ফেরাতে পারি? বলীরাজকে বরং সাগরতীরের নবগ্রামে থাকার বন্দোবস্ত করে দিই, কি বলিস মা? মহারাণী, মন্ত্রীমশাই, তোমাদেরই বা কি মত?"

"হ্যাঁ মহারাজ, সেটাই ন্যায্য বিচার হবে।"মহারাণী, যিনি রাজ্যের অর্থমন্ত্রীও বটে, সম্মতি জানালেন।

"নবগ্রাম তো বহু বছর ধরে ফাঁকা পড়ে রয়েছে। ওখানে বসতি হলে জায়গাটাও জমজমাট হবে, আর বলীদেশের লোকের সাগরতীরে থেকেই অভ্যেস, চেনা পরিবেশ পেলে মানুষগুলো দেশছাড়া হওয়ার দুঃখ ভুলবে।" প্রধানমন্ত্রীও সায় দেন রাজার প্রস্তাবে। 

রাজার প্রস্তাব লেখা চিঠি তুলে দেওয়া হল বলীরাজের দূতের হাতে। সে ফিরে যাওয়ার পর বৃক্ষোৎসবের বাকি অনুষ্ঠান সমাধা হলো। 

দু'দিন পর, সকালে প্রহরী এসে জানাল, বলীদেশ থেকে দূত এসেছে আবার। এবার দূতের বয়ে আনা চিঠি পড়ে জানা গেল বজ্রবাহু ভয়ানক চটেছেন। চিঠির ছত্রে ছত্রে তাঁর হুঙ্কার শোনা যাচ্ছে। তাঁর বক্তব্য হল, সাগরতীরে বাস করা মহা ঝামেলার ব্যাপার, তাছাড়া অর্ণবতেজের সৈন্যরা অপেক্ষায় আছে, সাগরতীরে বলীদেশের বাসিন্দাদের দেখতে পেলেই আবার আক্রমণ করবে। তার চেয়ে বরং সোমদেব তাঁর রাজ্যের সবসেরা শান্তিবন বলীরাজকে উপহার দিন, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি যুবরাজ বীরবাহুর সঙ্গে শান্তিনগরের রাজকন্যা সোমাভার বিবাহ দেবেন। শান্তিবনের গাছপালা কেটে সেখানে প্রতিষ্ঠা হবে বজ্রনগরী, রাজকন্যা সোমাভাকেও বিবাহের পরে দূরদেশে যেতে হবে না। কিন্তু সোমদেব এই প্রস্তাবে রাজি না হলে বলীরাজের সৈন্যরা জোর করে শান্তিবন দখল করবে।

প্রস্তাব শুনেই গর্জে উঠলো সোমাভা, "এত বড় সাহস! আমার বিবাহের বিনিময়ে শান্তিবনের দখল নিতে চায়? আমাদের সাধের শান্তিবন ধ্বংস করবে, এত স্পর্ধা! বাবা, অনুমতি দাও, আমার বাহিনী নিয়ে এক্ষুণি যাব শান্তিবন রক্ষা করতে।"

মল্লাচার্য প্রভাসের নেতৃত্বে সোমাভা আর তার সখীরা মিলে রাজ্যের যত কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে গড়ে তুলেছে সবুজ-বাহিনী। মল্লযুদ্ধ, লাঠি, ছোরা থেকে শুরু করে দড়ির ফাঁস, আত্মরক্ষার সবরকম কৌশল তারা নিয়মিত অনুশীলন করে। যেকোনো বিপদে এগিয়ে যেতে এরা প্রস্তুত। 

বজ্রবাহুর প্রস্তাবে রাজামশাইও যারপরনাই রেগে গিয়েছেন। তিনি এমনিতে নির্বিরোধী মানুষ, তবে রেগে গেলে মূর্তিমান বিভীষিকা। অনুমতি দিতে গিয়েও তিনি থেমে গেলেন, মনে পড়ল বলীরাজের বাহিনীর মূলধন হল যন্ত্রশক্তি। বন দখলের লড়াইয়ে তারা যেসব যন্ত্র নিয়ে আসবে, তাতে যদি সবুজ-বাহিনীর কারও প্রাণসংশয় হয়? 

তাঁকে আশ্বস্ত করলেন মল্লাচার্য প্রভাস, "আপনি অনুমতি দিন মহারাজ। আমাদের বাহিনী লড়বে বুদ্ধি আর হৃদয় দিয়ে। এই দুই শক্তির খোঁজ যন্ত্রের জানা নেই।"

তবুও ঠিক হলো রাজার সৈন্যদল তৈরি থাকবে, সবুজ-বাহিনীর বিন্দুমাত্র বিপদ বুঝলেই তারা ঝঁপিয়ে পড়বে শত্রুদের ওপর। 

এরপর শান্তিবনের শান্তি খানখান করে সেখানে বেজে উঠলো রণদামামা। সবুজ-বাহিনী তাদের সম্বল নিয়ে ঢুকে পড়েছে গহন বনে, এদিকে গাছ-কাটা যন্ত্র, আগুন-ঝরানো যন্ত্র ইত্যাদি নিয়ে এগিয়ে আসছে বলীদেশের সৈন্যরা, তাদের সঙ্গে আসছে তাদের দেশের সেরা আবিষ্কার যন্ত্রমানব, যার চেহারা দেখে তাকে যন্ত্রদানব বললেও ভুল হবে না। দশাসই চেহারার সেই যন্ত্রে জ্বালানি ভ'রে তাকে একবার চালু করে দিলে সে সামনে থাকা গাছপালা, পাথরের চাঁই, মানুষ, সবকিছুকে নিমেষে গুঁড়িয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে চলে। তার গতিকে সামলানোর জন্য তার পেটের ভেতরে দুটো মানুষকে ঢুকে কলকব্জা নাড়তে হয়। শান্তিবনের গাছপালা ভেদ করে সূর্যের আলোও ভাল ক'রে ঢুকতে পারে না, সেখানে এই অতিকায় যন্ত্র কেমন করে ঢুকবে? তাই তাকে রেখে আসতে হল রাজপথে। সেখানে পাহারায় রইলএকদল সৈন্য। বাকিরা গাছপালা সরিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে লাগল। কিছুদূর যেতেই অজানা কোণ থেকে উড়ে এল পাথরের টুকরো। কিছু সৈন্য মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। এমনি করে তারা একটু এগোয়, অমনি কারা যেন তাদের লক্ষ্য ক'রে পাথর, নয়ত গাছের ভাঙ্গা ডাল ছুঁড়ে মারে। সৈন্যদের হাতে আগুন-ঝরানো যন্ত্র আছে ঠিকই, তাতে ঠিক জায়গায় চাপ দিলেই আগুন ছিটকে বেরিয়ে চারপাশ জ্বালিয়ে ছারখার করে দেবে, তবে জঙ্গলে নিশানা ঠিক না ক'রে আগুন ছুঁড়লে নিজেদেরই বিপদ। গাছপালায় আগুন জ্বলবে মুহূর্তের মধ্যে। তাই সৈন্যরা ঠিক করল আপাতত গাছ-কাটা যন্ত্র দিয়ে বড় বড় গাছগুলোকে কাটতে কাটতে এগোনো হবে। 

এই কথামতো যেই গাছ কাটতে যাওয়া, অমনি, এ কি কাণ্ড? প্রতিটি গাছকে জড়িয়ে ধ'রে দাঁড়িয়ে আছে একেকজন অরণ্যকন্যা! বনের সাজে সেজেছে তারা, গায়ে তাদের পাতার অলঙ্কার। তাই এতক্ষণ তাদের ঠাহর করা যায়নি। থমকে গিয়েছিলো সৈন্যরা, তাদের হুঁশ ফেরালেন সেনাপতি ত্রিবিক্রম। তাঁর নির্দেশে অরণ্যকন্যাদের ঠেলে সরিয়ে গাছগুলোর গায়ে গাছ-কাটা যন্ত্র চেপে ধরল তারা। মুহূর্তে জ্বলে উঠল অরণ্যকন্যাদের চোখ। বনসাজে সজ্জিতা রাজকন্যা সোমাভা আর তার সখীর দল অরণ্যকন্যার রূপ ছেড়ে এবার ধরল মল্লযোদ্ধার রূপ। নিপুণ কৌশলে তারা সৈন্যদের ধরাশায়ী করতে লাগল। বাকি সৈন্যদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে থাকা কিশোরের দল। এতক্ষণ তারাই আড়াল থেকে সৈন্যদের দিকে পাথর ছুঁড়ছিল। এখন তাদের হাতে রয়েছে এক ওষধি লতা, যার পাতার রস একবার গায়ে লাগলে গাত্রদাহ হবে তিনদিন ধ'রে। সেই পাতার রসের জ্বালায় আর অরণ্যকন্যাদের কৌশলী আঘাতে কাবু হয়ে পড়ল সৈন্যদল।

ওদিকে শোনা গেছে যন্ত্রদানবের হুঙ্কার। তাকে নিয়ে বাকি সৈন্যরা জঙ্গলে ঢুকে পড়েছে, গাছপালা তছনছ করে সে এগোচ্ছে। তার হুঙ্কার রাজবাড়ি থেকেও শোনা গেছে, সেই হুঙ্কার শুনে শান্তিনগরের সৈন্যরা ছুটে আসছে শান্তিবনের দিকে। 

দানবের হুঙ্কার শুনে সোমাভার বুকে কাঁপন ধরে। তাদের লড়াই বুঝি এবার থেমে যায়! যন্ত্রের কাছে মানুষ যে বড় অসহায়। সঙ্কটমুহূর্তে তার মনে পড়ে গুরু প্রভাসের উপদেশ। হ্যাঁ, বুদ্ধি আর হৃদয় দিয়ে জিততে হবে এই অসম লড়াই। এদিকে আকাশ ছেয়ে গেছে কালো মেঘে, মুহূর্মুহূ মেঘের গর্জন শুরু হয়েছে। যেকোনো সময়ে বরষা নামবে। ঈশ্বর আর প্রকৃতি-মা-কে স্মরণ ক'রে সে চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বেলে ফেলে, ছুঁড়ে দেয় সামনে পড়ে থাকা গাছেদের ধ্বংসস্তূপের ওপর।

"সই, এ কি করলি? সবাই মিলে ঝলসে মরব যে!" হতবাক সখী ইন্দ্রাণীকে আশ্বস্ত করল সোমাভা,

"মা আমাদের রক্ষা করবেন। আয়, হাতে হাত রেখে আমরা শেকল গড়ে দাঁড়াই। ওদের যন্ত্র আগুনের বলয় পেরিয়ে এলেও আমাদের শেকল ভাঙতে দেরী হবে, ততক্ষণে নিশ্চয়ই আমাদের সৈন্যরা এসে পড়বে।"

সবুজবাহিনী মানবশৃঙ্খল গড়ে দাঁড়াল আগুনের দেওয়ালের এপারে। এগিয়ে আসা যন্ত্রদানব আর সবুজবাহিনীর মাঝে নেচে নেচে বাড়ছে আগুনের লেলিহান শিখা। বুঝি সমস্ত জঙ্গলটাকেই সে গিলে খাবে এক্ষুণি। বলীরাজের সৈন্যরা আর এগোতে পারছে না ঠিকই, কিন্তু আগুন যে বেড়েই চলেছে! সোমাভা একমনে ডেকে চলে প্রকৃতিমা -কে।

শেষে বুঝি মা তার ডাক শুনলেন। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামল। পাশের মানুষকে দেখতে পাওয়া যায় না, এমন তার তেজ। সেই প্রলয়ঙ্কর বৃষ্টিতে নিভে গেলসর্বগ্রাসী আগুনের শিখা, পেটের ভেতর জল ঢুকে অকেজো হয়ে গেল যন্ত্রদানব। বলীদেশের সৈন্যরা পালাতে গিয়ে বন্দী হলো শান্তিনগরের সৈন্যদের হাতে। আর রাজকন্যার সবুজবাহিনী? তারা তখন নিজেদের বাহাদুরিতে নিজেরাই অবাক!

সব ভাল গল্পেরই শেষভাগে যেমন রাশি রাশি খুশি এসে জড়ো হয়, এই গল্পের শেষেও তেমনটাই হল। বজ্রবাহু তাঁর দলবল নিয়ে রাজা সোমদেবের দরবারে গিয়ে পৌঁছলেন। তাঁরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরেছেন। রাজ্যের জঞ্জাল জড়ো করে সাগররাজ্যে ফেলে আসা, শান্তিবন ধ্বংস করতে চাওয়া , এসব যে কী ভয়ানক অন্যায়, বলীরাজ তা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি রাজার কাছে ক্ষমা চেয়ে সাগরতীরের কিছুটা জমি ভিক্ষা চাইলেন। বলীদেশের মায়েরা তাদের কোলের বাছাদের নিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে, তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই চাই যে!

রাজা সোমদেব ভারি খুশি হয়ে জমির বিলি বন্দোবস্ত করে দিলেন। ঠিক হল যতদিন না বজ্রনগরীর বাড়িঘর তৈরি হচ্ছে, ততদিন শান্তিনগরের মানুষজন তাদের বাড়িতে বলীদেশের একেকটি পরিবারের থাকার ব্যবস্থা করে দেবে।

বলীরাজ সেই যে গল্পের শুরুর দিকে তাঁর পুত্র বীরবাহুর সঙ্গে রাজকন্যা সোমাভার বিবাহের প্রস্তাব দিয়েছিলেন , সেটি নিয়েও আলোচনা শুরু হলো। তবে তাঁরা তো কিছুটা অন্যায় করেছেন, তাই ঠিক হলো তাঁদের অল্প শাস্তি পেতে হবে। শাস্তির মেয়াদ শেষ হলে তবে বিবাহ প্রস্তাব নিয়ে ভাবা যাবে। কি সেই শাস্তি? 

রাজ্যের পশ্চিম প্রান্তে বেশ খানিকটা অঞ্চল ছিল ঊষর, পাথুরে, ভারি রুক্ষ এলাকা। সেখানে না ছিল সবুজ গাছপালা, না ছিল নদীর জলের ধারা। বজ্রবাহু আর তাঁর পুত্র বীরবাহু সেখানে গিয়ে সবুজের চাষ করবেন, ঊষর ভূমিকে উর্বর করে তুলবেন, এই হল তাঁদের শাস্তি। তা, আগামীকাল শাস্তির মেয়াদ ফুরোচ্ছে, রাজা সোমদেব মন্ত্রীদের নিয়ে সেখানে কাল যাচ্ছেন নিজের চোখে সবকিছু দেখবেন বলে। তোমরাও যাবে নাকি? যাবে তো বলো, রাজামশাইয়ের কাছে গিয়ে আমাদেরও সঙ্গে নেওয়ার আর্জিখানা জানিয়ে রাখি।।
0

রূপকথা - অনসূয়া খাসনবীশ

Posted in


রূপকথা


লালাজীর গল্প 
অনসূয়া খাসনবীশ  

বুড়ো গাছ আর নুড়ির সারাদিন গল্প চলে। 
- কেমন দিন দেখছো লালাজী? 
- কালকের মতো হাওয়া দিচ্ছে না আজ দাদু। আজ বড় কুয়াশা। 
- না লালাজী আজকের দিনটাই সব চেয়ে সুন্দর। দেখছো কুয়াশা। তাতে সব পাখিরা গাছেই রয়েছে। কেউ কোত্থাও নড়ছে না। আজ তাহলে খুব আড্ডা হবে সবাই মিলে। তাই আজকের দিনটাই সব থেকে সুন্দর লালাজী। লালাজী এককালে একটা বড় পাথর ছিলো – বুড়ো গাছের তলায় থাকত। ঝর্ণার জলের ধাক্কায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে পাথর এখন নুড়ি হয়ে গেছে। বুড়ো সেই ছোট্ট লাল টুকটুকে নুড়িকে ডাকে, লালাজী বলে। ঝর্ণার পাশে,জলের আমেজে তারা সারাদিন, কখনো কখনো রাতেও গল্প করে। বুড়ো গাছ তাকে পাহাড়ের গল্প বলে। ঝর্ণা নামার আগের পাহাড় ছিল পাথুরে। সেই শক্ত জমি থেকে তখন গুটি কয়েক চারা গাছ সদ্য মাথা তুলেছে। তারপর ঝর্ণার জলে এত গাছ হয়েছে, পাখি এসেছে, ঝিঁঝিঁ ডেকেছে। পুরনো কিছু গাছ জলের দাপটে ভেঙে গেছে, কিছু পাহাড়ের নড়াচড়ায় ভেঙে গেছে। বুড়ো গাছেরও এখন বয়েস হয়েছে অনেক। ঝর্ণার জল তার শেকড়ে ছুঁয়ে গেছে। জলে ভিজে তার শেকড়ে নরম হয়ে গেছে। তাই সে ডেকে বলে, লালাজী,আমার সময় হয়ে এলো। তুমি জলের সাথে বয়ে যেও। যেখানে জল নিয়ে যায়, চলে চলো। জলকে ভয় পেও না। তৈরি থেকো, এই জলই তোমায় তোমার লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। লালাজী বুঝতে পারেনা, ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, আমি তোমার সাথেই থাকবো দাদু। আমি এখানেই থাকবো। তুমিই বা যাবে কোথায়? 
- না লালাজী, আমি অনেক বুড়ো হয়ে গেছি। আমার শেকড় আমায় যেতে দেয় না। কিন্তু তোমায় যেতে হবে। তবে, তুমি ভেবোনা লালাজী, আমি তোমার মনে শেকড় বানিয়ে থাকবো। লালাজী, তার চারিদিকে পাতাটাতা দেখিয়ে বুড়োকে বলে, এই তো আমারও শেকড় আছে দেখো। আমিও কোথাও যাবো না। বুড়ো হাসে, তারপর বলে, 
- শেকড় কি কেবল গাছের থাকে লালাজী? শেকড় থাকে আমাদের সবার মনে। সেই শেকড়ের সাথে বেঁধে থাকে আমাদের সব বন্ধুরা। কথা দাও তুমি তাদের সবসময় মনে রাখবে। যখন তোমার কাছে কেউ থাকবে না, এই শেকড় তোমায় পুরনো বন্ধুদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। 
- দাদু তাহলে তোমার মত আমারও শেকড় আছে? 
- হা হা হা, না দাদুভাই আমার মত নয়, আমার থেকেও শক্ত। লালাজী কিছু কথা বোঝে, কিছু বোঝে না। সেই রাতে খুব ঝড় উঠলো। আর কড়ক্কড় করে বাজ পড়তে লাগলো। লালাজী ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠলো ঘুমের মধ্যে। সকালে উঠে দেখে খুব সোরগোল। চারিদিকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে। রাতের ঝড়ে বুড়ো গাছখানা শেকড় আলগা হয়ে পড়ে গেছে জলে। সবাই বলল, ঝর্ণার জল তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কে জানে কত দূর। বুড়ো গাছের ডালে যত পাখি বসতো তারা উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বুড়ো গাছকে বিদায় জানাচ্ছে। লালাজী একা একা খুব কাঁদলো ক'দিন। তার তো আর কেউ নেই। গল্পও কেউ আর বলেনা। তারপর একদিন জলের ঝাপটে মাটি আলগা করে ঝর্ণা টেনে নিল তাকে। খুব ভয় হল তার। জলে সে কোনদিন বয়ে যায়নি আগে। প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো তীরে ফিরে আসার। কিন্তু চেষ্টাই সার। সে না পারলো ফিরে যেতে। না পারলো তীরে ভিড়তে। স্রোতের মধ্যে হাবুডুবু খেতে লাগলো। কে যেন তার কানে কানে বলে গেল, লালাজী ভয় পেও না, যতদূর জল যায়, চলে চলো। কথাগুলো তার বুকে সাহস জোগাল। সে নিজের গা এলিয়ে দিলো। এবার সে ঝর্ণার তালে তালে এগোতে লাগলো বিনা পরিশ্রমে। যেই সে নিজের গা এলিয়ে দিলো, অমনি দেখল, মাথার উপর টলটলে জল, তায় জোর স্রোত আর কুলকুল আওয়াজ। সে আওয়াজ বড় মিঠে লাগলো তার কানে। জলের রঙিন মাছেদের সাথে আলাপ হলো। জলের উপর দিয়ে পাখি উড়ে যেতে যেতে হাঁক দিয়ে গেলো, লালাজী সাগরের পানে যদি যেতে পারো, তাহলে আবার দেখা হবে। সাগর! লালাজীর বুক ছ্যাঁত করে উঠলো। কিন্তু সে শিখেছে, আজকের দিনটাই সব থেকে সুন্দর। তাই লালাজী সব চিন্তা ছেড়ে দুচোখ ভরে দেখতেই থাকলো। কত কি দেখলো সে, পাহাড়ি বন, পাহাড়ি গাছ পালা, পাহাড়ি ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়ে খেলতে আসে নদীর ধারে। লালাজী ছেলেমেয়েগুলোকে প্রাণ ভরে দেখে। পাথর কুড়িয়ে তারা নিয়ে যায় পকেটে পুরে। আহা কি সুন্দর ছেলেমেয়ে। আমাকেও যদি সংগে নিত! তার মনে বড় সাধ হয়। এরকম ভাবে চলতে চলতে লালাজী অনেক পথ পেরোয়। ঝর্ণা এসে নদীতে মেশে। নদীর একূল ওকূল দেখা যায় না। রাশি রাশি জল গমগম করে ঢেউ তুলে চলেছে। লালাজী দাঁতে দাঁত চেপে হাসিমুখে জলের টানে টানে চলেছে। সে নদীর মাছেরা অন্যরকম, ভারী তাদের অহংকার, যেন তাদের থেকে সুন্দর আর কেউ নেই। লালাজীর সাথে সাথে চলে একটা ছাই ছাই পাথর। সে এসেছে আরেক পাহাড় থেকে। বাড়ির কথা মনে করে সে বড় কাঁদে। লালাজীরো মনে পরে যায় সব। ভাবে শেকড়টা কই? দাদু যে বলেছিলো? সে আজকাল বড় ব্যস্ত। তার ভাবনার সময় কই। ছাই ছাই পাথরের সাথে সে এগিয়ে চলে। অনেকদূর চলে চলে নদী যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এত্তো জলের ভার নিয়ে সে চলতে পারেনা। ছাই ছাই পাথর বলে এইবার নাকি নদীটা মরে যাবে। লালাজীর খারাপ লাগে। নদীটা বড্ড ভালো ছিল। নদীর মাছগুলোও চেনা হয়ে গেছিলো। আশে পাশের গ্রামের ছেলে মেয়েগুলোর চোখগুলো যেন আঁকা, এই বড় বড়, কালো। টুপুস টাপুস বৃষ্টি হলে নদীটা যেন আরও সুন্দর দেখাতো। নদী মরে গেলে সেই বা কোথায় যাবে? গাছদাদু বলেছিল, জলের সাথে সাথে যেতে। আজকাল মনে হয়, দাদু কিছু জানেনা বাইরেটা। ওই তো সারাজীবন একটাই জায়গায় থেকে দাদু কি ঠিক জানতো সব? নদীর মাঝে মাঝেই চরা পড়েছে। সেই চরায় চেনা পাখিদের সাথে দেখা হয়ে গেল লালাজীর। তারা বলল, আর কয়শো মাইল পরেই নদী সাগরে পরেছে তাই নদীর এমন ক্লান্তি। এদিক ওদিক কথা বলে লালাজী জানতে পারলো, সাগর নাকি বিশাল বড়। নোনা জল তার। সাগরের আগেই নাকি নদীতে বেশ ঘুর্নী ওঠে, মাঝে মাঝেই। লালাজীর একটুও ইচ্ছে করলো না সাগরে যেতে। একটু ভয় ও পেলো। সে এখন আরও ছোট্ট হয়ে গেছে। আজকাল তার মনে হয়, কি হলো এই জলের সাথে চলে চলে? আমার লক্ষ্য পেলাম কই! আর আমি চলেছিই বা কোথায়? কিন্তু ইচ্ছে করলেই কি আর হয়,জল যেখানে নিয়ে যাবে যেতে হবে। একসময় ছাই ছাই পাথরের আর দেখা মিললো না। লালাজী একাই গিয়ে পরলো মোহনায়। আর সেখান থেকে এক্কেবারে জলের তোড়ে সাগরে। সাগর! লালাজী অবাক হয়ে দেখতে লাগলো, এই তবে সাগর? যেন শেষ নেই। কত যে মাছ, কত যে গাছ তার ইয়ত্তা নেই। আর কি সেই ঢেউ। লালাজী ভাবল এই বুঝি শেষ। কিন্তু না। সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ এর টানে লালাজী একদিন গিয়ে পড়লো তীরে। ছোট্ট টাপু তাকে কুড়িয়ে পেলো। মা বাবার কাছে বায়না করে তাকে নিয়ে চলল বাড়ি। লালাজী চলে এলো কলকাতা। সেখানে টাপুর পড়ার ঘরের একটা কাঁচের বাটিতে তার জায়গা হল। অনেক রকম নুড়ি পাথর সেখানে। লালাজী চোখ ভরে দেখে টাপুকে। ছোট ছেলেমেয়ে সে খুব ভালোবাসে। টাপু খেলে, পড়ে, মা কে লুকিয়ে দুধ বাইরে ফেলে দেয় সব দেখে সে। খুব খুশী হয় সে। এই তো চেয়েছিল সে। সারাজীবন খালি টাপুকে দেখে যাবে। কিন্তু, অনেক বছর পর যখন ঘরের সব দেখা হয়ে গেল, টাপু বড় হয়ে দূরে কোথায় চলে গেল। লালাজীও চোখ বন্ধ করল। দাদু গাছের সব কথা তার খুব মনে পড়ে আজকাল। এত বছর পর তার শেকড় খুঁজে পেল সে, তার নিজের মনের মধ্যে। আর হুড়মুড় করে গিয়ে পড়লো, দাদু গাছের ছায়ায়। পাশ দিয়ে পাহাড়ি ঝর্নার কুলকুল আওয়াজটাও স্পষ্ট শুনতে পেল । 
- লালাজী দিন কেমন দেখছো আজ? 
- সব থেকে সুন্দর দাদু। সব থেকে সুন্দর।