0

রূপকথা - অনসূয়া খাসনবীশ

Posted in


রূপকথা


লালাজীর গল্প 
অনসূয়া খাসনবীশ  

বুড়ো গাছ আর নুড়ির সারাদিন গল্প চলে। 
- কেমন দিন দেখছো লালাজী? 
- কালকের মতো হাওয়া দিচ্ছে না আজ দাদু। আজ বড় কুয়াশা। 
- না লালাজী আজকের দিনটাই সব চেয়ে সুন্দর। দেখছো কুয়াশা। তাতে সব পাখিরা গাছেই রয়েছে। কেউ কোত্থাও নড়ছে না। আজ তাহলে খুব আড্ডা হবে সবাই মিলে। তাই আজকের দিনটাই সব থেকে সুন্দর লালাজী। লালাজী এককালে একটা বড় পাথর ছিলো – বুড়ো গাছের তলায় থাকত। ঝর্ণার জলের ধাক্কায় ক্ষয়ে ক্ষয়ে পাথর এখন নুড়ি হয়ে গেছে। বুড়ো সেই ছোট্ট লাল টুকটুকে নুড়িকে ডাকে, লালাজী বলে। ঝর্ণার পাশে,জলের আমেজে তারা সারাদিন, কখনো কখনো রাতেও গল্প করে। বুড়ো গাছ তাকে পাহাড়ের গল্প বলে। ঝর্ণা নামার আগের পাহাড় ছিল পাথুরে। সেই শক্ত জমি থেকে তখন গুটি কয়েক চারা গাছ সদ্য মাথা তুলেছে। তারপর ঝর্ণার জলে এত গাছ হয়েছে, পাখি এসেছে, ঝিঁঝিঁ ডেকেছে। পুরনো কিছু গাছ জলের দাপটে ভেঙে গেছে, কিছু পাহাড়ের নড়াচড়ায় ভেঙে গেছে। বুড়ো গাছেরও এখন বয়েস হয়েছে অনেক। ঝর্ণার জল তার শেকড়ে ছুঁয়ে গেছে। জলে ভিজে তার শেকড়ে নরম হয়ে গেছে। তাই সে ডেকে বলে, লালাজী,আমার সময় হয়ে এলো। তুমি জলের সাথে বয়ে যেও। যেখানে জল নিয়ে যায়, চলে চলো। জলকে ভয় পেও না। তৈরি থেকো, এই জলই তোমায় তোমার লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। লালাজী বুঝতে পারেনা, ঠোঁট ফুলিয়ে বলে, আমি তোমার সাথেই থাকবো দাদু। আমি এখানেই থাকবো। তুমিই বা যাবে কোথায়? 
- না লালাজী, আমি অনেক বুড়ো হয়ে গেছি। আমার শেকড় আমায় যেতে দেয় না। কিন্তু তোমায় যেতে হবে। তবে, তুমি ভেবোনা লালাজী, আমি তোমার মনে শেকড় বানিয়ে থাকবো। লালাজী, তার চারিদিকে পাতাটাতা দেখিয়ে বুড়োকে বলে, এই তো আমারও শেকড় আছে দেখো। আমিও কোথাও যাবো না। বুড়ো হাসে, তারপর বলে, 
- শেকড় কি কেবল গাছের থাকে লালাজী? শেকড় থাকে আমাদের সবার মনে। সেই শেকড়ের সাথে বেঁধে থাকে আমাদের সব বন্ধুরা। কথা দাও তুমি তাদের সবসময় মনে রাখবে। যখন তোমার কাছে কেউ থাকবে না, এই শেকড় তোমায় পুরনো বন্ধুদের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। 
- দাদু তাহলে তোমার মত আমারও শেকড় আছে? 
- হা হা হা, না দাদুভাই আমার মত নয়, আমার থেকেও শক্ত। লালাজী কিছু কথা বোঝে, কিছু বোঝে না। সেই রাতে খুব ঝড় উঠলো। আর কড়ক্কড় করে বাজ পড়তে লাগলো। লালাজী ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠলো ঘুমের মধ্যে। সকালে উঠে দেখে খুব সোরগোল। চারিদিকটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে। রাতের ঝড়ে বুড়ো গাছখানা শেকড় আলগা হয়ে পড়ে গেছে জলে। সবাই বলল, ঝর্ণার জল তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কে জানে কত দূর। বুড়ো গাছের ডালে যত পাখি বসতো তারা উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে বুড়ো গাছকে বিদায় জানাচ্ছে। লালাজী একা একা খুব কাঁদলো ক'দিন। তার তো আর কেউ নেই। গল্পও কেউ আর বলেনা। তারপর একদিন জলের ঝাপটে মাটি আলগা করে ঝর্ণা টেনে নিল তাকে। খুব ভয় হল তার। জলে সে কোনদিন বয়ে যায়নি আগে। প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলো তীরে ফিরে আসার। কিন্তু চেষ্টাই সার। সে না পারলো ফিরে যেতে। না পারলো তীরে ভিড়তে। স্রোতের মধ্যে হাবুডুবু খেতে লাগলো। কে যেন তার কানে কানে বলে গেল, লালাজী ভয় পেও না, যতদূর জল যায়, চলে চলো। কথাগুলো তার বুকে সাহস জোগাল। সে নিজের গা এলিয়ে দিলো। এবার সে ঝর্ণার তালে তালে এগোতে লাগলো বিনা পরিশ্রমে। যেই সে নিজের গা এলিয়ে দিলো, অমনি দেখল, মাথার উপর টলটলে জল, তায় জোর স্রোত আর কুলকুল আওয়াজ। সে আওয়াজ বড় মিঠে লাগলো তার কানে। জলের রঙিন মাছেদের সাথে আলাপ হলো। জলের উপর দিয়ে পাখি উড়ে যেতে যেতে হাঁক দিয়ে গেলো, লালাজী সাগরের পানে যদি যেতে পারো, তাহলে আবার দেখা হবে। সাগর! লালাজীর বুক ছ্যাঁত করে উঠলো। কিন্তু সে শিখেছে, আজকের দিনটাই সব থেকে সুন্দর। তাই লালাজী সব চিন্তা ছেড়ে দুচোখ ভরে দেখতেই থাকলো। কত কি দেখলো সে, পাহাড়ি বন, পাহাড়ি গাছ পালা, পাহাড়ি ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়ে খেলতে আসে নদীর ধারে। লালাজী ছেলেমেয়েগুলোকে প্রাণ ভরে দেখে। পাথর কুড়িয়ে তারা নিয়ে যায় পকেটে পুরে। আহা কি সুন্দর ছেলেমেয়ে। আমাকেও যদি সংগে নিত! তার মনে বড় সাধ হয়। এরকম ভাবে চলতে চলতে লালাজী অনেক পথ পেরোয়। ঝর্ণা এসে নদীতে মেশে। নদীর একূল ওকূল দেখা যায় না। রাশি রাশি জল গমগম করে ঢেউ তুলে চলেছে। লালাজী দাঁতে দাঁত চেপে হাসিমুখে জলের টানে টানে চলেছে। সে নদীর মাছেরা অন্যরকম, ভারী তাদের অহংকার, যেন তাদের থেকে সুন্দর আর কেউ নেই। লালাজীর সাথে সাথে চলে একটা ছাই ছাই পাথর। সে এসেছে আরেক পাহাড় থেকে। বাড়ির কথা মনে করে সে বড় কাঁদে। লালাজীরো মনে পরে যায় সব। ভাবে শেকড়টা কই? দাদু যে বলেছিলো? সে আজকাল বড় ব্যস্ত। তার ভাবনার সময় কই। ছাই ছাই পাথরের সাথে সে এগিয়ে চলে। অনেকদূর চলে চলে নদী যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এত্তো জলের ভার নিয়ে সে চলতে পারেনা। ছাই ছাই পাথর বলে এইবার নাকি নদীটা মরে যাবে। লালাজীর খারাপ লাগে। নদীটা বড্ড ভালো ছিল। নদীর মাছগুলোও চেনা হয়ে গেছিলো। আশে পাশের গ্রামের ছেলে মেয়েগুলোর চোখগুলো যেন আঁকা, এই বড় বড়, কালো। টুপুস টাপুস বৃষ্টি হলে নদীটা যেন আরও সুন্দর দেখাতো। নদী মরে গেলে সেই বা কোথায় যাবে? গাছদাদু বলেছিল, জলের সাথে সাথে যেতে। আজকাল মনে হয়, দাদু কিছু জানেনা বাইরেটা। ওই তো সারাজীবন একটাই জায়গায় থেকে দাদু কি ঠিক জানতো সব? নদীর মাঝে মাঝেই চরা পড়েছে। সেই চরায় চেনা পাখিদের সাথে দেখা হয়ে গেল লালাজীর। তারা বলল, আর কয়শো মাইল পরেই নদী সাগরে পরেছে তাই নদীর এমন ক্লান্তি। এদিক ওদিক কথা বলে লালাজী জানতে পারলো, সাগর নাকি বিশাল বড়। নোনা জল তার। সাগরের আগেই নাকি নদীতে বেশ ঘুর্নী ওঠে, মাঝে মাঝেই। লালাজীর একটুও ইচ্ছে করলো না সাগরে যেতে। একটু ভয় ও পেলো। সে এখন আরও ছোট্ট হয়ে গেছে। আজকাল তার মনে হয়, কি হলো এই জলের সাথে চলে চলে? আমার লক্ষ্য পেলাম কই! আর আমি চলেছিই বা কোথায়? কিন্তু ইচ্ছে করলেই কি আর হয়,জল যেখানে নিয়ে যাবে যেতে হবে। একসময় ছাই ছাই পাথরের আর দেখা মিললো না। লালাজী একাই গিয়ে পরলো মোহনায়। আর সেখান থেকে এক্কেবারে জলের তোড়ে সাগরে। সাগর! লালাজী অবাক হয়ে দেখতে লাগলো, এই তবে সাগর? যেন শেষ নেই। কত যে মাছ, কত যে গাছ তার ইয়ত্তা নেই। আর কি সেই ঢেউ। লালাজী ভাবল এই বুঝি শেষ। কিন্তু না। সাগরের বিশাল বিশাল ঢেউ এর টানে লালাজী একদিন গিয়ে পড়লো তীরে। ছোট্ট টাপু তাকে কুড়িয়ে পেলো। মা বাবার কাছে বায়না করে তাকে নিয়ে চলল বাড়ি। লালাজী চলে এলো কলকাতা। সেখানে টাপুর পড়ার ঘরের একটা কাঁচের বাটিতে তার জায়গা হল। অনেক রকম নুড়ি পাথর সেখানে। লালাজী চোখ ভরে দেখে টাপুকে। ছোট ছেলেমেয়ে সে খুব ভালোবাসে। টাপু খেলে, পড়ে, মা কে লুকিয়ে দুধ বাইরে ফেলে দেয় সব দেখে সে। খুব খুশী হয় সে। এই তো চেয়েছিল সে। সারাজীবন খালি টাপুকে দেখে যাবে। কিন্তু, অনেক বছর পর যখন ঘরের সব দেখা হয়ে গেল, টাপু বড় হয়ে দূরে কোথায় চলে গেল। লালাজীও চোখ বন্ধ করল। দাদু গাছের সব কথা তার খুব মনে পড়ে আজকাল। এত বছর পর তার শেকড় খুঁজে পেল সে, তার নিজের মনের মধ্যে। আর হুড়মুড় করে গিয়ে পড়লো, দাদু গাছের ছায়ায়। পাশ দিয়ে পাহাড়ি ঝর্নার কুলকুল আওয়াজটাও স্পষ্ট শুনতে পেল । 
- লালাজী দিন কেমন দেখছো আজ? 
- সব থেকে সুন্দর দাদু। সব থেকে সুন্দর। 

0 comments: