0

সম্পাদকীয়

Posted in

 




হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী! এ উক্তি আজকের নয়। কিন্তু এমন প্রাসঙ্গিক কখনও ছিল কি? অন্যভাবে ভাবলে এরকম কোনও কালের মধ্য দিয়ে কি আমাদের সভ্যতার ইতিহাস বিবর্তিত হয়েছে হানাহানি আর রক্তক্ষয় যার কেন্দ্রস্থ উপাদান ছিল না? 

সত্যিই ছিল না। আমাদের মহাকাব্যগুলি এই মতের সারবত্তা প্রমাণ করবে। প্রতিটি হত্যা সেখানে অকাট্য যুক্তিজালের ন্যায়বলয়ে সুরক্ষিত। কিন্তু সে তো মহাকাব্য। কবির কল্পনা।

এযুগের হত্যালীলা আসলে বৃহত্তর এক মনোরঞ্জনের অঙ্গ। প্রাণ হননের জন্য যখন কারণ কিংবা  অকারণের ছদ্ম অছিলাই যথেষ্ঠ। তা না হলে শিকাগোতে উৎসবের জন্য মিলিত হওয়া একদল মানুষের ওপর নির্বিচারে কেন গুলিবর্ষণ করবে অজ্ঞাত আততায়ী? আর কেনই বা সামান্য দশ হাজার টাকার জন্য দিল্লির এক জনবহুল অঞ্চলে নিহত হবে দুই বোন? একই দিনে কয়েক সহস্র মাইল ভৌগলিক ব্যবধানে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা। কিন্তু কী আশ্চর্য অন্তর্লীন যোগ! মনে কি হয়না ' এ জগৎ মহা হত্যাশালা '! 

পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে উভয় ক্ষেত্রেই এই নিধনযজ্ঞের কোনও জোরালো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। তাহলে? প্রকারান্তরে এ কি আত্মহনন নয়? আমরা কি তবে অতি দ্রুত এগিয়ে চলেছি শেষের সেই দিনের দিকে? প্রফেসর শঙ্কু নিশ্চিহ্নাস্ত্রের পাশাপাশি আবিষ্কার করেছিলেন মিরাকিউরাল বড়ি - যার মধ্যে নিহিত ছিল সকল রোগের নিরাময়। আজকের এই গভীর মানবিক অসুখ সারাবে কোন বিশল্যকরণী?

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।


0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




















ইউনিফর্ম সিভিল কোড  - বিতর্ক-বিমর্শ-বিতণ্ডা ইত্যাদি

গৌরচন্দ্রিকা

সমান নাগরিক আচার সংহিতা বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউ সি সি) একটি স্পর্শকাতর বিতর্কিত বিষয়। আজকের বদলে যাওয়া পরিবেশে হিন্দু সমাজের মধ্যবিত্ত শিক্ষিত লোকজনের একাংশ বলছেন—এটা একটা দরকারি আইন যা দৈনন্দিন জীবনে ধর্মের বিভেদ ভুলিয়ে সবাইকে সমান অধিকার এবং সুযোগ দেবে। এটাও বলা হচ্ছে যে এর ফলে মুসলিম সমাজের মধ্যে মেয়েদের মুখ বুঁজে থাকা অংশটি পুরুষের সঙ্গে সমতার দিকে অনেকখানি এগিয়ে যাবেন।যেমন তিন তালাক নিরোধক আইন পাস হওয়ায় মেয়েদের উপর অন্যায় অত্যাচার খানিকটা কমেছে।

এই বিতর্কের ফ্রেমে রয়েছে মুখ ফুটে না বলা একটি প্রেমিস- হিন্দুসমাজের আইনে মেয়েরা অনেক বেশি জেন্ডার ইকুয়ালিটি এবং স্বাধিকারের স্বাদ পায়, তাই সমাজের বাকি অংশ ওদের অনুসরণ করবে –এটাই তো স্বাভাবিক, এমনটাই হওয়া উচিত।

এর প্রতিক্রিয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ভাবছেন যে রাষ্ট্র তাঁদের সামাজিক ও ব্যক্তিগত পরিসরে খামোকা নাক গলাচ্ছে যা হওয়া উচিত নয়।

এ নিয়ে দু’একটি ফোরাম এবং ইনফর্মাল আলোচনায় যা শুনেছি এবং যে ধরণের বিতর্কে জড়িয়েছি—সেসব সংক্ষেপে দুটো কিস্তিতে লিখছি। আমার আশা, পাঠকেরা এর ভিত্তিতে আরও তলিয়ে দেখে নিজস্ব মতামত দাঁড় করাতে পারবেন। এবং চাইলে আমার ভুল শুধরে দেবেন। আমার উদ্দেশ্য ভারতীয় পরম্পরায় সুস্থ বিতর্কের মুখ খুলে দেওয়া, এইটুকুই।

গত ৯ ডিসেম্বর, ২০২২ বিজেপি সাংসদ কিরোড়ী লাল মীণা রাজ্যসভায় একটি প্রাইভেট মেম্বার্স বিলে পেশ করেছেন যার সার কথা হল দেশে ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা সমান আচার সংহিতা জারি করার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করা হোক।

নিন্দুকে বলল —বিজেপি গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে বিজয়ের পর একজন সাংসদকে দিয়ে একটি ব্যক্তিগত বিল পেশ করে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে জল মাপছে।

কারণ, তার আগে একবছর ধরে মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, কর্ণাটক, ছত্তিশগড়, মধ্য প্রদেশ, রাজস্থান, মিজোরাম, তেলেঙ্গানার মত ৯ টি বিধানসভা নির্বাচন এবং একগাদা পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে।


বিজেপির নেতারা মুখ ভার করে বলছেন—এসব কী? সংবিধান সভা দেশকে যে কথা দিয়েছিলেন – যা এতদিন কেউ রাখে নি— আমরা তো সেটাকেই আইনের চেহারা দেওয়ার চেষ্টা করছি মাত্র।

আর এস এসের লোকেরা ব্যক্তিগত স্তরে বলছেন—আমরা তো কবে থেকে বলছি যে এক জাতি, এক রাষ্ট্রভাষা, এক আচার সংহিতা দেশ এবং রাষ্ট্রকে ঐক্যবদ্ধ করে, সুদৃঢ় করে।

এই শব্দকল্পদ্রুমের পরিবেশে বর্তমান প্রবন্ধে নিচের বিন্দুগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করছি। মোদ্দা কথা-- ইউনিফর্ম সিভিল কোড ব্যাপারটা কী- খায় না মাথায় দেয়? সংবিধান সভা এ নিয়ে ৩ নভেম্বর ১৯৪৮ এবং ১৯৪৯ সালে কী বলেছিল?

এবং এটা যদি সবার জন্যে উইন -উইন গেম হয় তাহলে আপত্তির কারণ কী? এ নিয়ে কতদূর চেষ্টা করা হয়েছে এবং কোথায় আটকাচ্ছে?

একটা ডিসক্লেমার দিয়ে রাখি—এই আলোচনার জন্যে আমি ঠিক যোগ্য ব্যক্তি নই। আমি খালি বিতর্কের মুখ খুলে দিচ্ছি, সুস্থ তথ্যসমৃদ্ধ বিতর্ক চলুক।

আমার একটাই যোগ্যতা—যখন ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে ২১তম ল’ কমিশনের চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত জাস্টিস বলবন্ত সিং চৌহান ইউনিফর্ম সিভিল কোডের ব্যাপারে আম জনতার মতামত জানতে চেয়ে মিডিয়ায় এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ১৬ পয়েন্ট প্রশ্নাবলী জারি করেছিলেন এবং নভেম্বর মাসের মধ্যেই প্রায় ১০,০০০ উত্তর পেয়েছিলেন তার মধ্যে একটা সেট আমারও ছিল। স্বল্পবুদ্ধিতে যা মনে হয়েছিল তাই উত্তরের খোপে ভরে দিয়েছিলাম।

সিভিল ও ক্রিমিনাল কোড

যে কোন দেশের আইনকানুনকে মোটামুটি দুটো ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

এক, ক্রিমিনাল কোড –যা রাষ্ট্র এবং সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ; এর আওতায় আসবে চুরি-ডাকাতি, খুনজখম, শারীরিক আক্রমণ, ধর্ষণ ইত্যাদি।

দুই, সিভিল কোড—যা্র ভিত্তি হল এক দেশ বা সমাজে বাস করার আচরণ বিধির সামাজিক কন্ট্র্যাক্ট। এতে রয়েছে বিয়ের অনুষ্ঠান পদ্ধতি, বিচ্ছেদ, এবং সম্পত্তির কেনাবেচা, ব্যবসার নিয়ম, উত্তরাধিকার এবং দত্তক নেয়ার নিয়ম কানুন ইত্যদি।

ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা সমান নাগরিক আচার সংহিতাঃ

কিন্তু এইখানে এসে কি একটু গুলিয়ে যাচ্ছে?

অনেক লিব্যারাল আধুনিক ভাবনা-চিন্তার লোকজন বলছেন যে ক্রিমিনাল কোড তো জাতিধর্ম নির্বিশেষে দেশের সমস্ত নাগরিকের জন্যে সমান। খুন-চুরি-ডাকাতির অপরাধে শাস্তি দেবার সময় আইন বা রাষ্ট্র নাগরিকের জাতধর্ম দেখে না, একই আইনে একই শাস্তি দেয়। তাহলে একটি গণতান্ত্রিক সেকুলার রাষ্ট্রে সিভিল কোড এক হবে না কেন?

--ভাল কথা; কিন্তু সিভিল কোডের অন্তর্গত অনেকগুলো আইন তো মূলতঃ সবার জন্যেই সমান!

ব্যবসা করতে কন্ট্র্যাক্টের নিয়ম ও আইন, সেলস্‌ অফ গুডস অ্যাক্টের আইন, জি এস টি, ইনকাম ট্যাক্স, রেজিস্ট্রির নিয়ম, জমি বাড়ি সম্পত্তি কেনাবেচার আইন, মর্টগেজ বা সম্পত্তি বন্ধক রাখার আইন –সবই তো হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-পারসিক-মুসলমান-খ্রিস্টানী সবার জন্যে এক। তাহলে?

--আছে, তফাৎ আছে। ভারতবর্ষে সিভিল কোডের অন্তর্গত কিছু বিষয় বিভিন্ন ধার্মিক এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্যে আলাদা। সেগুলো হল মুখ্যতঃ তিনটি-- বিয়ের অনুষ্ঠান পদ্ধতি এবং বিচ্ছেদ; সম্পত্তির উত্তরাধিকার, এবং দত্তক নেয়ার নিয়ম কানুন।

সমান নাগরিক আচার সংহিতার সমর্থকেরা চাইছেন- ওই তিনটে ব্যাপারেও বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকজনের জন্যে আলাদা আলাদা নিয়ম বন্ধ হোক। সব ধুয়ে মুছে এক হয়ে যাক, ঠিক স্কুল ইউনিফর্মের মত।

এখানে কর্ণাটকের স্কুলের হিজাব-বিতর্ক মনে পড়া স্বাভাবিক।

আমরা সংক্ষেপে আলোচনার সুবিধের জন্যে দেশের সবচেয়ে বড় দুটো ধর্মভিত্তিক সম্প্রদায়ের (হিন্দু ও মুসলিম) কোড বিল নিয়ে আলোচনা করব।

হিন্দু কোড বিল এবং মুসলিম পার্সোনাল ল’

হিন্দু ল’ এবং মুসলিম ল’এর গোড়ার কাঠামোটি তৈরি হয়েছে কোম্পানির আমলে ক্রমশঃ ১৭৮৩ এবং ১৭৮৫ সালে, অর্থাৎ প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের আগ্রহে এবং প্রাচ্যবিদ্‌ উইলিয়াম জোন্সের অধীনে কিছু টুলো পণ্ডিত এবং মৌলবীদের ডেকে বিভিন্ন স্মৃতি বা সংহিতা (মনু, যাজ্ঞবল্ক্য, পরাশর ইত্যাদি) এবং কুরানশরীফ ও হাদিস্‌ ঘেঁটে।

স্বাধীন ভারতে প্রণীত হিন্দু কোড বিলের (১৯৫৫-৫৬) অন্তর্গত রয়েছে চারটে আইন—হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৫; হিন্দু সাকসেসন অ্যাক্ট; হিন্দু মাইনরিটি অ্যান্ড গার্ডিয়ানশিপ অ্যাক্ট এবং হিন্দু অ্যাডপশন (দত্তক নেয়া) এবং মেইন্টেন্যান্স (খোরপোষ) অ্যাক্ট।

তেমনই ভারতের মুসলিমদের রয়েছে মুসলিম পার্সোনাল ল (শরিয়ত) অ্যাক্ট ১৯৩৭। এতে বিয়ে, তালাক, খোরপোষ, দান-দক্ষিণা সব কিছুর ব্যাপারে নির্দেশ দেওয়া রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে মুসলিম জীবনযাপন পদ্ধতির নির্দেশের ব্যাপারে চারটি উৎসকে মান্যতা দেওয়া হয়েছে।

সেগুলো হলঃ কুরআন, সুন্না বা অহল -এ- হাদিস (হজরত মহম্মদের নিজের আচরণে যা সিদ্ধ), কিয়াস (ব্যখ্যা টীকা ভাষ্য ইত্যাদি) এবং ইজমা ( বিদ্বানদের সর্বসম্মত ব্যাখ্যা)।

এছাড়া রয়েছে পলিগ্যামি অ্যাক্ট ১৯৫৬; যার মাধ্যমে ভারতে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করা হলেও মুসলিমদের (অধিকতম চারজন স্ত্রী পর্য্যন্ত) এবং গোয়া ও পশ্চিম উপকূলের কিছু অঞ্চলে একজন পুরুষের একাধিক স্ত্রী আইনসম্মত।

বলে রাখা ভাল বর্তমান বিশ্বে (২০২২ পর্য্যন্ত) ২০০টি দেশের মধ্যে মাত্র ৫৮টি দেশে বহুবিবাহ আইনসম্মত; এর অধিকাংশই আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের।

এখানে একটা ডিস্‌ক্লেমার দিয়ে রাখি। আইন যাই হোক, এখন বিশ্বের সর্বত্র, এমনকি ভারতের আদিবাসী এবং মুসলিম সমাজেও একপত্নীই দস্তুর।

তার দুটো কারণ।

এক, এই ধরণের সিভিল আইনগুলো প্রেস্ক্রিপটিভ, ডিটারেন্ট নয়। যেমন হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন মানে এই নয় যে সমস্ত বিধবাকেই ফের বিয়ে করতে হবে বা সব পুরুষকে বিধবাকেই বিয়ে করতে হবে বা তাদের শাস্তির ভয় দেখিয়ে বাধ্য করতে হবে। এখানে ব্যক্তিগত পছন্দকে স্থান দেওয়া হয়েছে, করলে কোন বাধা নেই—এই আর কি!

তেমনই মুসলিম সমাজে দুই বা চার বিয়ের অনুমোদন মানে এই নয় যে সবাইকেই বেশি বেশি করে বিয়ে করতে হবে। এমনকি বাংলাদেশ ও ভারতে মুসলিম সমাজেও প্রথম স্ত্রীর বর্তমানে তাঁর অনুমতি বিনা দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের নিয়ম নেই।

দুই, আর্থিক, সামাজিক এবং চেতনার বিকাশ।

এখন মেয়েরা বেশি বেশি করে চাকরি বা আর্থিক রোজগারের জীবিকার দিকে ঝুঁকছেন, শিক্ষার প্রসার হচ্ছে। তাঁরা পড়াশুনো করে স্বতন্ত্র রোজগারের মধ্যে নিজেদের ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা দেখছেন। নিজেদের স্বাস্থ্য এবং শরীরের অধিকারের বিষয়ে সচেতন হচ্ছেন।

ইউনিফর্ম সিভিল কোড মানে—ওইসব বিভিন্ন আইন বাতিল করে সবার জন্য কোন ধার্মিক রেফারেন্স ছাড়া একটাই আইন চালু করা।

আচ্ছা, তাতে অসুবিধা কী? বেশ আধুনিক এবং প্রগতিশীল শোনাচ্ছে তো। ধর্মনিরপেক্ষ আধুনিক ভারতে এরকমটা হওয়ারই কথা তো! অসুবিধেটা কোথায়?

সংবিধান সভার আর্টিকল ৪৪ এ নেহরুজি এমনই কিছু বলেছিলেন কিনা?

--বলেছিলেন বটে, কিন্তু অসুবিধেটাও তখনই স্পষ্ট হয়েছিল। কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলি বা সংবিধান প্রণয়ন সভার ২৩ নভেম্বর, ১৯৪৮ এর বিতর্কটি দেখলেই বোঝা যাবে।

বোম্বাই থেকে কংগ্রেসের নির্বাচিত প্রতিনিধি স্বাধীন দেশের জন্যে ধর্মের অনুশাসনের উর্দ্ধে উঠে একটি সমান নাগরিকতার পক্ষে যুক্তি দেন। বিরুদ্ধে মাদ্রাজ এবং বিহারের প্রতিনিধিরা বলেন –এতে ভারতের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং বিবিধতা নষ্ট হবে। ঐক্য এবং একরূপতা এক কথা নয়।

ওঁরা উদাহরণ দিয়ে বললেন—বিশাল দেশ ভারতবর্ষে ভৌগলিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের জন্য বিখ্যাত। পূবে আসামে এত বৃষ্টি হয়, কিন্তু পশ্চিমে রাজস্থানে খটখটে মরুভূমি। উত্তরে বরফ পড়ে , হাড়কাঁপানো শীত। কিন্তু দক্ষিণে শীত সেভাবে টের পাওয়া যায় না।

শেষে একবছর পরে ১৪ নভেম্বর, ১৯৪৯ সালে সংবিধান সভার এই বিষয়ে বিতর্ক সমাপ্ত করে নেহরু বললেন—তাড়াহুড়ো না করে এই প্রগতি জনতার উপর চাপিয়ে না দিয়ে ধীরে ধীরে জনতার মধ্যে চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে ওদের সম্মতি নিয়ে ট্র্যাডিশনে পরিবর্তন আনতে হবে। এবং ওঁর পরামর্শ মত ইউনিফর্ম সিভিল কোডের ধারণাটিকে সংবিধানের ডায়রেক্টিভ প্রিন্সিপলের (মার্গদর্শী সিদ্ধান্ত) অধীনে আর্টিকল ৪৪ এ নিচের শব্দে বাঁধা হলঃ

Article 44. Uniform civil code for the citizens.

The State shall endeavour to secure for the citizens a uniform civil code throughout the territory of India.

ঠিক আছে, কিন্তু করে ফেলতে কিসের অসুবিধে? সত্তর বছর হয়ে গেল যে!

হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুযায়ী বিয়ে

--দেখুন, হিন্দুদের স্মৃতিশাস্ত্রে বিহিত আটরকমের বিয়ের মধ্যে শুধু ‘প্রাজাপত্য’ই আজকাল চলছে। এতে বাবা বা তাঁর অবর্তমানে পরিবারের কোন গুরুজন ‘কন্যাদান’ করে আর বিয়ের কার্ডে প্রজাপতির ছবির নীচে ‘প্রজাপতয়ে নমঃ’ লেখা থাকে। প্রজাপতির নির্বন্ধে ডিভোর্সের কথাই ওঠে না, জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধনে হাঁসফাস করলেও।

অবশ্য আজকাল যেটাকে লাভ ম্যারেজ বলা হয় সেটা মনু’র গান্ধর্ব বিবাহের (বর কনে নিজেদের সম্মতি বা পছন্দের হিসেবে) আধুনিক রূপ মাত্র।

তবে ইদানীং হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে কিছু সংশোধন হয়েছে। তাই সময়ের দাবিতে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ডিভোর্সের সুযোগ রয়েছে। এই বিয়ের অনুষ্ঠানে সপ্তপদী গমন এবং যজ্ঞ একটি আবশ্যিক অনুষ্ঠান। আর রয়েছে (হিন্দি বলয়ে) সাতটি শপথ (সাতোঁ বচন) নেওয়ার কথা, যেমন পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা- ভাত- কাপড়ের দায়িত্ব নেওয়া, ইত্যাদি।

মুসলিম বিয়ে

কিন্তু মুসলিম বিয়ে হল পিওর কন্ট্র্যাক্ট। বিয়ে মসজিদে না হয়ে কারও বাড়িতে (কন্যার ঘরে) হয়। পুরোহিতের স্থানে কাজি বসেন বটে, তবে পাঁচ জন সাক্ষী রেখে কন্যাকে বসিয়ে তিনবার জিজ্ঞেস করা হয়—আপনি কি অমুককে কবুলনামায় লেখা শর্ত অনুযায়ী জীবনসঙ্গী হিসেবে স্বীকার করতে রাজি?

কন্যা তিনবার ‘কবুল’ বললে একই কন্ট্র্যাক্টের পাঁচ কপিতে ওরা দুজন, কাজি এবং সাক্ষীদের সইসাবুদ হয়ে গেলে বিয়ে সম্পন্ন হয়। ওদের দুজন এবং সাক্ষীদের কাছেও একটি করে ওই নিকাহ্‌নামা বা চুক্তির কপি থাকে। তাতে কন্যার সিকিউরিটি হিসেবে পূর্বনির্ধারিত ‘দেনমোহর’ কত টাকা তার উল্লেখ থাকে। বিয়ের সময় ওই টাকা মেয়ের হাতে দিতে হয়।

যদি কিছু বকেয়া থাকে সেটা ডিভোর্স বা তালাক দিলে তখন দিতে হয়। একেবারে কন্ট্র্যাক্ট ও তার কনসিডারেশন! তবে বাস্তবে কী হয় সেটা অন্য প্রসংগ।

আমি এক মুসলিম কলীগের ছোট ভাইয়ের বিয়েতে সাক্ষী একজন কম পড়ে যাওয়ায় এন্ট্রি পেয়েছিলাম এবং সই করার পরে এক কপি (বেশ রঙীন কাগজে) পেয়েছিলাম।

চুক্তি বলেই মুসলিম ম্যারেজ অ্যাক্টে তিন রকমের তালাকের প্রথা রয়েছে—আহসান, হাসান, এবং বিদ্যৎ। ভাববার সময় না দিয়ে যখন মর্জি তখন তিনবার ‘তালাক’ বলে স্ত্রীকে ঘরের বাইরে করে দিলাম-এটাই ওই বিদ্যৎ তালাক। এটা প্রথাসিদ্ধ কিন্তু শরিয়ত অনুমোদিত নয়, তাই অধিকাংশ মুসলিম দেশে এই রকম তালাক উঠে গেছে।

ভারতেও সুপ্রীম কোর্টের রায় মেনে আইন করে শুধু ওই তালাক-এ-বিদ্যৎ নিষিদ্ধ হয়েছে, বাকি নিয়ম যথাবৎ আছে।

একটা কথা; ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী মুসলিম মেয়ে কোন অন্য ধর্মের ছেলেকে বিয়ে করতে পারে না। তবে মুসলিম ছেলে একেশ্বরবাদী ধর্মের (ক্রিশ্চান ও ইহুদী) মেয়েকে বিয়ে করতে পারে, কিন্তু কোন বহুদেববাদী ধর্মের ( হিন্দু) মেয়েকে নয়। (কুর্‌আন, সুরা ৫.৫)।

ক্রীশ্চান ম্যারেজ অ্যান্ড ডিভোর্স অ্যাক্টের (১৮৭২) অনুষ্ঠান চার্চে হতেই হবে। কিন্তু ইসলাম ও ক্রিশ্চানিটি দুটোই আব্রাহামিক ধর্ম, তাই অনুষ্ঠানে কিছুটা মিল রয়েছে। পাদ্রী সবার সামনে ব্রাইডকে তিনবার জিজ্ঞেস করে সম্মতি পেলে পরমপিতা পরমেশ্বরের আশীর্বাদে বা দৈব ইচ্ছায় ওই জোড়াকে তখন বিধিসম্মত স্বামী-স্ত্রী বলে ঘোষণা করেন। তারপর বলেন –এখন তোমরা একে অপরকে চুমো খেতে পার।

তখন ওরা সবার সামনে একে অপরকে চুমো খায়, ব্যস্‌।

হিন্দুদে্র শুধু মালাবদল হয়, সবার সামনে চুমো-টুমো খাওয়ার সুযোগ নেই। এবার বলুন, এই তিনরকমের বিয়ের আইন তুলে দিয়ে কী করতে চান? কেমন কোড আনতে চান?

চুমো খাওয়া তুলে দেবেন? নাকি সবাইকেই ভবিষ্যতে আইন মেনে চুমো খেতে হবে?

সাক্ষীসাবুদ-দেনমোহর করে রীতিমত চুক্তিপত্রে সই করে বিয়ে দেওয়া তুলে দেবেন? নাকি সবাইকেই ওইরকম করতে হবে?

সপ্তপদী, যজ্ঞ, অরুন্ধতী নক্ষত্র দেখানো তুলে দেবেন? নাকি সবাইকেই তাই করতে হবে?

আরও আছে। হিন্দু তেলুগু সম্প্রদায়ে মামাতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে সবচেয়ে উত্তম সম্বন্ধ ধরা হয়। আমার এক কলীগ তিনভাই। ওরা ওদের আপন মামার মেয়েদের বিয়ে করেছে।

এটা কি বাদ যাবে? নাকি সবাইকে মামাতো পিসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে করতে হবে?

মুসলমানদের মধ্যেও তুতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ে করার চল আছে।ওদের হয়তো অসুবিধে হবে না? কিন্তু আমাদের?

মৈত্রী কড়ার (Friendship Contract):

সত্তরের দশকের গুজরাতে কোন এক প্রাচীন ট্র্যাডিশনের ধুয়ো তুলে ঊচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে শুরু হল মৈত্রী কড়ার । এর মানে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে সাব-রেজিস্ট্রারের অফিসে গিয়ে ১০ টাকার স্ট্যাম্প পেপারে এগ্রিমেন্ট বানিয়ে একসঙ্গে লিভ টুগেদার করতে পারে—আশা এই যে ওরা কিছুদিন পরে বিয়ে করবে।

হিন্দু কোডে কোথাও এমন কোন টেম্পোরারি বিয়ের কথা বলা নেই। কিন্তু আইন এর প্রতিবন্ধক নয়। শুধু ছ’বছর আগে দুই ছোটবেলার সাথী (ছেলে মুসলিম, মেয়ে হিন্দু) ওই কড়ার করে বাধা পেয়ে শেষে গুজরাতের হাইকোর্টে গিয়ে ২৫ নভেম্বর, ২০১৬ রায়ে অনুমোদন আদায় করায় গুজরাতে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের টনক নড়ল। শেষে কি আমাদের ঘরের মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি গিয়ে মাছ-মাংস রান্না করতে বাধ্য হবে?

আজকে সমান আচার সংহিতা শুরু হলে মৈত্রী কড়ার বন্ধ হবে নাকি?

তারপর অ্যান্থ্রোপলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার হিসেবে ভারতে ৪৬০০ আদিবাসী সম্প্রদায় আছে যাদের পূজার্চনা এবং বিবাহ সংস্কারের নিয়ম আমাদের থেকে ভিন্ন। ওদের সংস্কৃতিকেও কি দুরমুশ করে আমাদের মত করতে হবে?

--ভাল জ্বালা! তার চেয়ে বিয়ের জন্যে এমন একটা আইন করা যায় না যাতে দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেমেয়ে , নিজেদের জাত ধর্ম বাবা-মার অনুমতির তোয়াক্কা না করে ধর্মের দোহাই না দিয়ে বিয়ে করতে পারে? তাহলেই তো ল্যাটা চুকে যায়।

সে আইন তো কবেই হয়ে গেছে—স্পেশ্যাল ম্যারেজ অ্যাক্ট ১৯৫৪। অর্থাৎ হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টের (১৯৫৫) একবছর আগে। তাতে শুধু ছেলের বয়েস ২১ হতে হবে, আর মেয়ের ১৮।। তবে প্রধানমন্ত্রী বলছেন শিগগিরই মেয়েদের বয়েসও আইন করে বাড়িয়ে ২১ করে দেওয়া হবে, ভাল কথা।

তফাৎ হল—হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্টে আগে বিয়ে, পরে রেজিস্ট্রি। স্পেশ্যাল অ্যাক্টে আগে দরখাস্ত দিলে রেজিস্ট্রার দেবে একমাসের নোটিস, তারপরও যদি মিয়া-বিবি রাজি থাকে, তবে একই সঙ্গে রেজিস্ট্রি এবং বিয়ে।

তাহলে আর হৈ চৈ কিসের?

কারণটা রাজনৈতিক, পরে আসছি। আগে সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে বলি।

হিন্দু ও মুসলিম কোডে মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার

হিন্দু কোড বিলে আগো মেয়েদের পৈতৃক সম্পত্তিতে কোন অধিকার ছিল না। প্রথমে সংশোধিত হয়ে মেয়েদের বসবাসের অধিকার স্বীকৃত হল, কিন্তু মালিকানা হক নয়। পরে ২০০৫ সালের সংশোধনে ভাই এবং বোনের সমান অধিকার স্বীকৃত হল। তারপর ২০২২ সালের একটি রায়ে সুপ্রীম কোর্ট বললেন যে বিবাহিত মেয়েরাও ভাইয়ের সমান অংশীদার, সমান ভাগ পাবে।

মুসলিম কোডে কিন্তু প্রাচীন কাল থেকেই সম্পত্তিতে বাবা-মায়ের পৈতৃক এবং স্বোপার্জিত সম্পত্তিতে মেয়েদের অধিকার স্বীকৃত, সে বিবাহিত হলেও। তবে সবসময় সেটা ছেলেদের সমান ভাগ নয়, কখনও ১/২, কখনও ১/৪।

ব্যাপারটা বেশ জটিল। যখন আইনের স্নাতক স্তরের পরীক্ষায় বসেছিলাম তখন আমরা সবাই ভয় পেতাম মুসলিম সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারার প্রশ্নকে। তাতে খেয়াল করে ভগ্নাংশের অংক কষতে হত।

--যাকগে, এসব জটিল ব্যাপারে আপনার আমার মত হরিদাস পালেদের মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই। এর জন্যে উপযুক্ত সংস্থা হল ল’ কমিশন। ওদের দিয়েই এসব আইন ও ট্র্যাডিশনের প্যাঁচ খুলে একটি আধুনিক সিভিল কোডের খসড়া বানানো হোক। মিঃ আম্বেদকর, নেহেরুজী, প্যাটেলজী –সবার আত্মা শান্তি পাক। অসমাপ্ত কাজ পুরো করা হোক।

ল’ কমিশন

গোড়াতেই বলা দরকার যে ল’ কমিশন কোন সাংবিধানিক(constitutional) অথবা বৈধানিক (statutory) সংস্থা (body) নয়। এটি বিশুদ্ধ প্রশাসনিক (executive) সংস্থা যা ভারত সরকারের নির্দেশে কোন নিশ্চিত ইস্যুতে এবং নির্ধারিত সময়ের (tenure) জন্য গঠিত হয়।

এর দায়িত্ব হল আইনের সংস্কারের ব্যাপারে রিসার্চ করে সরকার চাইলে বা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ( Suo moto) পরামর্শ দেওয়া।

বর্তমান ভারত সরকার ইউ সি সি’র বিষয়ে ২০১৬ সালে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জাস্টিস বি এস চৌহানের অধ্যক্ষতায় ২১ তম ল’ কমিশন গঠন করে।

উনি এ’ব্যাপারে আম নাগরিক এবং সিভিল সোসাইটির অভিমত এবং পরামর্শ জানতে চেয়ে ৩/১০/২০১৬ তারিখে এক ১৬ বিন্দু প্রশ্নাবলী সম্প্রচারিত করেন। নভেম্বর মাসের মধ্যে প্রায় দশ হাজার উত্তর এবং মতামত পেয়ে বেজায় খুশি হয়ে প্রেসকে জানিয়েও দেন।

এতে গুজরাতের হিন্দুদের ‘মৈত্রী কড়ার’ প্রথা চালু রাখার নিয়েও প্রশ্ন ছিল।

কিন্তু বুঝতে পারছিলেন যে ব্যাপারটা এত সোজা হবে না। অতঃপর জাস্টিস চৌহান ২০১৮ তে কোন রিপোর্ট পেশ না করেই অবসর নেন।

তারপর গত চার বছর ধরে কমিশনের কোন চেয়ারম্যান না থাকায় ব্যাপারটা ন যৌ ন তস্থৌ হয়ে থেমে ছিল।

অবশেষে ভারত সরকার গত ৮/১১/২২ তারিখে কর্ণাটক হাইকোর্টের সদ্য অবসরপ্রাপ্ত চিফ জাস্টিস ঋতুরাজ অবস্থীর অধ্যক্ষতায় ২২তম ল’ কমিশন গঠন করেছে। জাস্টিস অবস্থী কর্ণাটকের বিবাদিত হিজাব মামলার রায়দাতা যা কর্ণাটকের বিজেপি সরকারের নীতিতেই সীলমোহর লাগিয়েছে।

আশা করা যাচ্ছে আগামী মার্চ ২০২৩ নাগাদ ল’ কমিশন ইউ সি সি ইস্যুতে তাঁদের রেকমেন্ডেশন বা সুপারিশ ভারত সরকারকে জানিয়ে দেবেন।

কিন্তু তাই যদি হয় তাহলে আমরা মার্চ অব্দি অপেক্ষা না করে এখন থেকেই চেঁচামেচি করছি কেন? উত্তরটাও সহজ, রাজনীতি।

সমান নাগরিক আচার সংহিতা বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউ সি সি) ও রাজনীতি

আসলে সমান আচার সংহিতা নিয়ে এত আগ্রহের পেছনে রয়েছে আরেকটি ইস্যু – মুসলিম সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ।

মোদীজি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বিজেপি ও আর এস এসের ঘোষিত তিনটে এজেন্ডা ছিল –রাম মন্দির নির্মাণ, সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা বাতিল এবং ইউনিফর্ম সিভিল কোড। এর জন্যে দরকার ছিল বড় মাপের সংখ্যাগরিষ্ঠতার। সেটা পাওয়া গেল ২০১৯ সালের মে মাসের সাধারণ নির্বাচনে।

ব্যস্‌ ব্রুট মেজরিটির জোরে ৫ অগাস্ট ২০১৯ সালে বাতিল হল আর্টিকল ৩৭০, অবশ্য নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ইত্যাদির আলাদা আইন, আলাদা পতাকার অনুমতি নিয়ে আর্টিকল ৩৭১ আগের মতই রয়ে গেল।

তারপর ৯ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে অযোধ্যা মামলার রায় বেরোল। ৫ অগাস্ট ২০২০তে সংসদে মন্দির নির্মাণের জন্য বিশেষ ট্রাস্ট গঠনের ঘোষণা হল।

বাকি রইল একটাই—সমান নাগরিক আচার সংহিতা, ইউনিফর্ম সিভিল কোড।

এতসব চেঁচামেচির একটাই লক্ষ্য—মুসলিম আইনে যে চারটে বিয়ের অনুমোদন রয়েছে সেটা বাতিল করে সবাইকে এক পত্নীব্রতে থাকতে বাধ্য করা। বাকি সম্পত্তির অধিকার-টার যাক চুলোয়।

ওদের যুক্তিঃ বেশি পত্নী মানেই বেশি সন্তান; এর মানে মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি। তার মানে কোন এক ভবিষ্যতে ওরা মেজরিটি হবে এবং আমাদের দেশকে ফের ভাগ করবে।

এটা খোলাখুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় বলা হয় এবং বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক নেতারা এটাকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের মোড়কে গম্ভীর মুখে বলে থাকেন।

বিজেপি সাংসদ এবং আর এস এসের তাত্ত্বিক নেতা রাকেশ সিনহা সংসদে জুলাই ২০১৯ সালে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি প্রাইভেট মেম্বার্স বিল পেশ করলেন।

প্রধানমন্ত্রী সে’ বছর স্বাধীনতা দিবসের অভিভাষণে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্বের কথা বলে এটাকে ‘a form of patriotism’ আখ্যা দেন। অর্থাৎ যাদের সন্তান বেশি তারা দেশকে ভালবাসে না।

উনি সেটা বলতেই পারেন।

মোদীজির ভাষণের একই দিনে ১৫ই অগাস্ট, ২০১৯শের স্বাধীনতা দিবসে আসাম সরকার ঘোষণা করে দিল যে যাদের দুটোর বেশি সন্তান রয়েছে তারা সরকারি চাকরি পাবে না এবং স্থানীয় স্তরে কোন নির্বাচনে দাঁড়াতে পারবে না।

অবশ্য এন ডি এ জোট থেকে বেরিয়ে এসে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার স্বাধীনতা দিবসের অভিভাষণে বলেছেন যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন নতুন আইনের দরকার নেই। ওঁর একটিই সন্তান।

এদিকে প্রাক্তন মন্ত্রী এবং ইউপির মুজফফরনগর কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত সাংসদ সঞ্জীব বালিয়ান সেই ২০১৯ থেকে নিয়মিত সংসদে বলছেন ভারতে জনসংখ্যা যে হারে বেড়ে চলেছে যে রিসোর্সে টান পড়ছে, করদাতাদের উপর বোঝা বাড়ছে, এখনই ১৩৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে, ভবিষ্যতে কী হবে? ওঁর আবেদনে ১২৫ জন সাংসদের সই ছিল।

তবে ডঃ রাকেশ সিনহার (আর এস এস বুদ্ধিজীবি এবং রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য) তিনবছর আগে পেশ করা বিলটিকে এ’বছর এপ্রিল মাসে স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী মনসুখ মণ্ডাভিয়া অপ্রয়োজনীর বলে মতপ্রকাশ করে খারিজ করে দেন।

ওনার মতে দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির দর আশংকাজনক নয়। জোর করে প্রতি পরিবার দুই সন্তানের লক্ষণরেখা টেনে দেওয়ার দরকার নেই। সরকারের প্রচেষ্টায় জনতা এখন অনেক জাগরুক, বাকিটুকু শিক্ষার আরও প্রসার হলেই হয়ে যাবে।

তখন রাকেশ সিনহা বিলটি প্রত্যাহার করে নেন।

কিন্তু উত্তর প্রদেশ সরকার দুই সন্তানকে বাধ্যতামূলক করার খসড়া বিল জুলাই ২০২১ শে বিধানসভায় পেশ করে।

তবে গত বছর জুলাই মাসে সংসদে দুই বিজেপি এম পির প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে NFHS III(2005-06) সার্ভে হিসেবে TFR 2.7 ছিল, তারপর NFHS IV (2015-16) অনুযায়ী কমে 2. 2 হয়ে গেছে। কাজেই আইন করে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার দরকার নেই।

তারপর এ’বছর জুন মাসে এক সাংবাদিককে স্বাস্থ্য মন্ত্রক থেকে জানানো হয় যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মণ্ডাভিয়া কোনরকম জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ বিল আনার কথা ভাবছেন না যেহেতু NFHS V অনুযায়ী ভারতের টোটাল ফার্টিলিটি রেশিও স্থায়িত্ব দর ২.১ থেকে কমে ২.০ হয়ে গেছে।

অথচ এ’বছর গত ৯ ডিসেম্বর তারিখে দু’জন বিজেপি এম পি নিশিকান্ত দুবে এবং রবিকিষণ লোকসভায় প্রাইভেট মেম্বার্স পপুলেশন কন্ট্রোল বিল পেশ করেছেন। রবিকিষণ, ভোজপুরি লোকগায়ক এবং গোরখপুরের বিজেপি এমপি, ওঁর তিন মেয়ে এক ছেলে।

এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উনি বলছেন এর জন্যে কংগ্রেস দায়ি। ওরা যদি আগেই এই বিল আনত তাহলে নাকি রবিকিষণ আগের থেকে সতর্ক হয়ে যেতেন।

মুশকিলে পড়লাম, কে ঠিক বলছেন?

প্রধানমন্ত্রী না স্বাস্থ্যমন্ত্রী, কে ঠিক?

দুই বিপরীত মেরুর বক্তব্য বুঝতে হলে কিছু সরকারী ডেটা দেখুন। প্রথমে বিগত ২০১১ সালের সেন্সাস অনুয়ায়ী আমাদের দেশে ধর্মভিত্তিক নাগরিকদের সংখ্যা ও অনুপাতঃ

তালিকা -১

সম্প্রদায় জনসংখ্যার প্রতিশত

হিন্দু ৭৯.৮০

ইসলাম ১৪.২৩

খ্রীস্টান ২.৩০

শিখ ১.৭২

অন্যান্য ১.৯৫

মোট ১০০.০০


National Family Health Survey (NFHS-5) অনুযায়ী ভারতের গড় ফার্টিলিটি রেশিও ২.২ থেকে কমে ২.০ হয়েছে। আন্তর্জাতিক রিপ্লেসমেন্ট রেশিও হল ২.১। অর্থাৎ যে অনুপাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি (নতুন জন্ম-নতুন মৃত্যুর সংখ্যা কাটাকুটি করে যা পাওয়া যায়) স্থির থাকে। তার মানে এখন ভারতের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আশংকাজনক নয়।

মাত্র পাঁচটি স্টেটের টি এফ আর ন্যাশনাল অ্যাভারেজের এবং রিপ্লেসমেন্ট রেশিওর থেকে বেশি। তারা হল—

বিহার (২.৯৮), মেঘালয় (২.৯১), উত্তর প্রদেশ (২.৩৫), ঝারখণ্ড(২.২৬) এবং মনিপুর (২.১৭)। এর কোনটিই মুসলিম বহুল রাজ্য নয়। অথচ, মুসলিম প্রধান জম্মু-কাশ্মীর(১.৩) এবং বঙ্গে (১.৬) টি এফ আর ন্যাশনাল গড়ের থেকে অনেক কম।

তার মানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির দর ধর্ম নির্ভর নয়, বরং শিক্ষার হার এবং জীবনযাপনের স্তরের উপর নির্ভরশীল।

এবার ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সমস্ত জনগোষ্ঠীতে সন্তানোৎপাদনক্ষম বয়সের মহিলার সন্তান সংখ্যা কত নিচের তালিকায় দেখুন।

তালিকা-২

Total Fertility Rate (TFR) by Religion, average number of children by woman of reproductive age

Hindu 1.94 children

Muslim 2.36

Christian 1.88

Sikh 1.61

Buddhist 1.39

Jain 1.66

Others 2.15

সূত্রঃ National Family Health Survey (NFHS-5)

আমি অংকে কাঁচা, তাই সিদ্ধান্তের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম। তালিকা একের জনসংখ্যাকে মূলধন এবং TFR কে সূদের হার ধরে কম্পাউণ্ড ইন্টারেস্টের ফর্মূলা লাগিয়ে আঁক কষে বলুন তো এভাবে চললে কত বছর পরে মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দুদের ছাড়িয়ে যাবে?

শেষপাতেঃ

বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো বসে নেই।বিশেষ করে যেখানে একের পর এক নির্বাচন। উত্তরাখণ্ডে রিটায়ার্ড জাস্টিস রঞ্জনা দেশাইকে অধ্যক্ষ করে রাজ্য ল’ কমিশন কাজ শুরু করে দিয়েছে। হিমাচলের বিজেপি সরকার নির্বাচনের আগে বলেছিল – জিতলে ওরা রাজ্যে ইউ সি সি চালু করবে। চিঁড়ে ভেজে নি।একই হাল হল কর্ণাটকে, সাধারণ মানুষ ক্রমশঃ মূল্যবৃদ্ধি ও রোজগার সৃষ্টির ইস্যুকে বেশি গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। মহারাস্ট্রে মধ্যপ্রদেশে এবং গুজরাতে শোনা যাচ্ছে ইউ সি সি নিয়ে কমিটির কথা এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেরও।

কিন্তু সুপ্রীম কোর্টের প্রখ্যাত অ্যাডভোকেট সঞ্জয় হেগড়ে বলছেন—ভিন্ন রাজ্যের ভিন্ন সংস্কৃতি। তাহলে তো কোন প্রথা, ধরুন বিয়ে এক রাজ্যে বৈধ হবে তো অন্য রাজ্যে অবৈধ। কিন্তু এটি তো গোটা দেশের জন্যে ‘ইউনিফর্ম’ হওয়ার কথা।

নিন্দুকে বলছে—আরে এগুলো ইলেকশনের আগে জিগির তোলা। কিন্তু গত মার্চে ২২ তম কেন্দ্রীয় ল’ কমিশনের রিপোর্ট এল না। গত মাসে জাস্টিস ঋতুরাজ অবস্থী যে রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করেছেন, শোনা যাচ্ছে তাতে ইউনিফর্ম সিভিল কোডের বদলে এসেছে সিডিশন ল’, মানে আই পি সি ১২৪ (এ) বাতিল করার বদলে আরও কড়া করার পরামর্শ।

তাহলে কি বর্তমান সরকারের চোখে ইউসিসির বিল আনার চেয়ে একটি আরও কড়া দমনমূলক আইন প্রণয়নটাই আজ বেশি জরুরি?

দিন গুণছি।


....................................

 ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২৫ ডিসেম্বর, ২০১৬।

 সুপ্রীম কোর্ট,অরুণাচল গৌন্ডার বনাম পন্নুস্বামী, জানুয়ারি ২০২২।

দি স্টেটস্‌ম্যান, ১৬ অগাস্ট, ২০১৯।  

 দি হিন্দু, ১৬ অগাস্ট, ২০১৯।

 ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ২ এপ্রিল, ২০২২। 

হিন্দুস্থান টাইমস্‌ ২৪ জুলাই, ২০২১।
 টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ৯ জুন, ২০২২।
ঐ, ৯ ডিসেম্বর, ২০২২।

ঐ, ৬ মে, ২০২২।


0 comments:

0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






সুবোধ ঘোষ সম্পর্কে আলোচনায় আমার মতো অজ্ঞজনের কতটা অধিকার আছে , তা যদি জানতে চান তবে বলব পাঠকের অধিকারে এ লেখায় হাত রাখলাম। পাঠকের দরবারে যে সৃষ্টি কালের গণ্ডি অতিক্রম করে আধুনিক কালের পাঠককেও মুগ্ধ করে সেই কালোতীর্ণ সৃষ্টিকে সমালোচনা করে কোন আহাম্মকে ? সুবোধ ঘোষের ছোটগল্পগুলো নিয়ে দুকথা লিখেই ফেলি তাই ।

সাহিত্যের দরবারে সুবোধ ঘোষের আগমন একেবারেই আকস্মিক। বন্ধুদের গল্পপাঠের আসরে অনুরুদ্ধ হয়ে, নিতান্ত অনিচ্ছায় ও সঙ্কোচে দুটি গল্প লিখে ফ্যালেন। সেই দুটি গল্পই তাঁর যশ প্রতিষ্ঠিত করে দেয়। এরকমটা আমরা মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনেও পড়েছি । এক বন্ধু আক্ষেপ করেছিলেন , নামী পত্রিকা সুপারিশ ছাড়া গল্প ছাপে না । মাণিক তখন প্রেসিডেন্সির ছাত্র । এই অভিযোগ ভুল প্রমাণ করতেই তিনি নামী পত্রিকায় একটি গল্প পাঠান । এবং তা ছাপা হয় । অতসী মামী নামের সেই গল্পটি বাংলা সাহিত্যের আগমনবার্তা সরবে ঘোষণা করে । সুবোধ ঘোষে ফিরি । কেমন ছিল তাঁর লেখার প্রেক্ষাপট ? কেমনভাবে চেতনে অবচেতনে তৈরি ছিলেন তিনি ? ফিরে দেখি । টিউশনি বাস কন্ডাক্টরি ট্রাক ড্রাইভারি সার্কাস পার্টি , এমনকি বোম্বাই মিউনিসিপ্যালিটির ঝাড়ুদারি পর্যন্ত । এত সব অদ্ভুত বিচিত্র পেশায় নিজেকে যুক্ত রাখার ফলে জীবনে অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার তাঁর পূর্ণ ছিল। এছাড়াও ছিল সর্বভুক একটি চিত্ত। কত যে বিষয়ে তিনি লেখাপড়া করেছেন! গল্পগুলোর বিষয় বৈচিত্র অনুভব করলেই বোঝা যায় যে সেই সব পাঠ ও অভিজ্ঞতার জারিত ফল তাঁর সৃষ্টি আর তাই একটু বেশি বয়সেই তাঁর সাহিত্যের আসরে আবির্ভাব। এবং জয়।

যারা মনে করেন, লিখতে গেলে পূর্বপ্রস্তুতির প্রয়োজন, সঠিক দীক্ষা নইলে কেউ ঠিক লিখতে পারবেননা, তাদের জানা দরকার এটি একটি মিথ। লিখতে গেলে যে ঠিক কি কি চাই, তার বোধ হয় কোনও নির্দিষ্ট তালিকা হয়না। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই, শুধু একটি অনুভতিপ্রবণ মন নিয়ে এবং অবচেতনে জারিত অভিজ্ঞতা ও পাঠের মিশেলে একের পর এক অপূর্ব সব গল্প উপহার দিয়েছেন সুবোধ ঘোষ। তাঁর প্রায় প্রতিটি গল্পই স্বতঃস্ফূর্ত। লিখতে বসে অনায়াসে লিখে ফেলা। এমনকি সাগরময় ঘোষের অনুযোগ অনুযায়ী, তাড়া না দিলে লেখা পাওয়া কষ্টকর ছিল। এবং, শারদীয়ার লেখা পাওয়া যেত সবার শেষে। সুতরাং, রিসার্চ করে, পরিকল্পনা করে, প্লট খাড়া করে না লিখলেও অবিস্মরনীয় সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব। সেদিক দিয়ে সুবোধ ঘোষ যেন পথিকৃৎ। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত রমাপদ চৌধুরী বিমল কর মহাশ্বেতা দেবী প্রমুখ, তাঁর গল্প বলার ধরনটিকে বাংলা গদ্যের নতুন একটি চলন বলে মেনেছেন। ছোট ছোট বাঁক, অপ্রত্যাশিত মোড়, এবং তীব্র শ্লেষ ও গভীর দর্শন ভেদ করে হঠাত আলোর ঝলকানির মতো বেরিয়ে এসেছে জীবনের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা।

স্বল্প পরিসরে আলোচনা করতে গিয়ে মনে হয়েছে তাঁর প্রেমের গল্প নিয়েই আলোচনা করি । দেখেছি, প্রেমকে তিনি যেন অমূল্য এক হীরকখণ্ডের মতন বিভিন্ন দিক থেকে প্রতিফলিত করেছেন । নানাদিকে সেই বিচ্ছুরিত আলোয় আমরা দেখেছি প্রেম নিয়ে তাঁর লেখা অন্য মাত্রা নিয়েছে । অন্য একটি কারণ, ব্যাক্তিগতভাবে ওঁর লেখা প্রেমের গল্পের অনুরাগী আমি। এখনকার প্রজন্ম অবশ্য এধরণের প্রেমের গল্প পরে একটু অবাক হবেন। প্রেমের জন্য যে বিস্তৃত পরিসর লাগে, কল্পনা ও বাস্তবের যে মেল লাগে তা এখনকার লেখক ও পাঠক দুপক্ষই নিঃশেষে ভুলেছেন। এখন যেমন বাসস্থানগুলিও শহর শহরতলি নির্বিশেষে একে অন্যের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফ্যালে, মানুষেরও তেমনি ব্যাক্তিগত পরিসর আর নেই বললেই চলে। এই পরিসর শুধু মানসিক নয়, একেবারেই বাস্তবিক, দৈহিক। ফলে কল্পনার স্থান হয়না। একটুকু ছোঁয়ার সঙ্গে একটু সুষমা জড়িয়ে একটি অপূর্ব অনুভূতির জন্ম দেয়না। সুবোধ ঘোষের গল্পে এই পরিসর বড় বিস্তৃত। ভারী সুন্দর তার ব্যবহার। এক একটি কথার আঁচড়ে এঁকে দ্যান মনের গহনে থাকা অভিমানের আবেগ, দীর্ঘকালের সঞ্চিত কষ্টের উৎসমুখ যায় খুলে।

প্রথম যে গল্পটির উল্লেখ করব তার নাম সুনিশ্চিতা। সামান্য একটি ঘটনা। বিমলেন্দু গিয়েছিল হীরাপুরে কর্মযোগে। ব্যাচেলর বিমলেন্দুর সেখানে তিন তিনটি সুন্দরী ও ধনী কন্যার সঙ্গে আলাপ হয়। বিমলেন্দুর বাংলোটি ফুলগাছে ঘেরা। ভারী শৌখিন সে। তার শৌখিন জীবনে ধীরা অতসী ও সুমনা নাম্নী তিন কন্যা, যারা বিমলেন্দুর রোম্যান্টিকতার সুযোগে তাকে একটু খেলিয়ে দেখেছে। একটু নাচিয়ে দেখেছে, কেমন লাগে। একটা আমোদ বই তো নয়! কিন্তু রোম্যান্টিক বিমলেন্দু ভেবেছে এরা সত্যিই তাকে মনে স্থান দিয়েছে। আর তাই হীরাপুর ছেড়ে চলে যাবার দিনে প্ল্যাটফর্মে ফার্স্ট ক্লাস কোচের সামনে সে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। কেউ তো একটি ফুলের তোড়া তাকে দেবে! কিন্তু তার স্তব্ধ দৃষ্টির সামনে তিন তিনটি ফুলের তোড়া পৌঁছে যায় গাড়ির একমাত্র সেলুনের কাছে। যেখানে কোলপ্রিন্স ডি কে রায় অপেক্ষমাণ গাড়ি ছাড়ার জন্য। যার বাংলোয় ফুলের কোনও আতিশয্য ছিলনা। যার বাংলোয় কারো এমন আহ্বান ছিলনা। ছিলনা মেয়েলি হাসির শব্দ। ছিলনা অনর্থক কিছু গুনগুন। অথচ আজ তারই কাছে এমন আত্মসমর্পণ? শুধু সম্পদের জন্য এমন লোভ? আর কি তুচ্ছতায় ভরিয়ে দিয়ে ডি কে রায় সেই তিনটি ফুলের গোছা নিতে হুকুম করেন চাপরাশিকে! লোভ তিনি চিনেছেন বই কি! গল্পটি এতো দূর হলে বেশ সরলরৈখিক একটি ভাষ্য মিলত। কিন্তু লেখক যে এতটুকুতে সন্তুষ্ট নন। তিনি যে মনের গহীনে প্রবেশ করছেন! বিমলেন্দুর বিরক্তি উদ্রেক করে নিখিল সরকার বলে এক ভদ্রলোক তাঁর কন্যার লেখাপড়ার জন্য বিমলেন্দুর কাছে সাহায্য চাইতে আসতেন। বারবার তিনবার। শেষবারে বিমলেন্দু তাঁকে সতর্ক করেছিল। আর নয়। এমন একটি রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে ঘষা খাওয়াটা বিমলেন্দু একেবারেই মেনে নিতে পারছিলনা। অভাবের তাড়নায় কেউ এমন করে সাহায্য চাইতে পারে? তার নরম রোম্যান্টিক মন কষ্ট পাচ্ছিল। আজ হঠাত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে একটি স্যাটায়ার দেখতে দেখতে সে যখন সত্যিই বাস্তবের মাটিতে নামছিল, ঠিক তখনই নিখিল সরকারের মেয়ের আগমন। সাহায্যের কথা মনে রেখে কৃতজ্ঞচিত্তে সে এসেছে বিমলেন্দুর পথের পাথেয় হিসেবে কিছু আহারের সংস্থান নিয়ে। আজ বিমলেন্দুও নতুন দৃষ্টি পেয়েছে। মেকি ন্যাকামির চেয়ে মীরা নামের এই মেয়েটির উপস্থিতি যে তাকে একরকমের শান্তি দিচ্ছে তা সে উপলব্ধি করতে পারে। মীরার হাত ধরে সে নেমে আসে হীরাপুরে। নিজেকে পরীক্ষা করার দরকার হয়না তার। কারণ নিজের মনটা আর অকারণ রোম্যান্টিকতার আবরণে ঢাকা নেই। এ কাহিনী তখনকার, যখন একটি মেয়ে তার গোত্রান্তরকেই জীবনের পরম পরিণতি ভাবত। তার পরিবারের সকলেও এই লক্ষ্যে নিয়ত কাজ করে যেত। এবং, পাত্র মাত্রই ঈশ্বরের অবতার হিসেবে পরিগণিত হতো। সামাজিক প্রেক্ষাপটকে অস্বীকার করলে অবশ্য এ গল্পের সমসাময়িকতাকে উপলব্ধি করা মুশকিল।

দ্বিতীয় গল্পটি শ্মশানচাঁপা। ভয়ঙ্কর একটি গল্প। হতাশার মধ্যে, নিরন্তর ঠেলে দেওয়ার মধ্যে, সমস্ত কিছু হারিয়ে ফেলার মধ্যেও যা জেগে থাকে। এ গল্পে একটি চরিত্র কিছু শাগরেদ যোগাড় করে সমাজসেবার উদ্দেশ্যে। সঠিক উদ্দেশ্য শবদাহর ছাইয়ের তলায় চাপা পড়ে যায়। কিন্তু সেই সমাজসেবীর অকারণ নিরীহ ঘাটবাবু ওরফে মাধব গাঙ্গুলির প্রতি আচরণ লোকটিকে যেন কি এক বিষাদে কি এক নিস্তব্ধতায় ঠেলে দেয়। সে যখন শ্মশানের ছাই আর কাঠ, শব আর মৃত্যুর ধূসরতার মধ্যে একটুকরো জীবনের ছবি আঁকে, তখনই কুমারসাহেবের পোষা সেই সমাজসেবী সক্রিয় হয়ে ওঠে। আবার হতাশায় ডুবে যায় ঘাটবাবু। নিশ্চিত চলে যাওয়ার পথ থেকে সরে সে আবার সেই ধুসর জগতে অপেক্ষা করে। তারপর একদিন ঘাটবাবুর সেই একটুকরো জীবন, সেই লাল গোলা সিঁদুরের টিপ পরা সুন্দর মুখটি ফিরে আসে শব হয়ে। রানীমার শব। কুমারসাহেবের অমন কত রানী আছে! সবাই কি আর বিয়ে করা বউ হয়? ঘাটবাবুর অদ্ভুত আনন্দ ও উল্লাস দেখে এই প্রথম ভয় পায় সেই সমাজসেবী। এ কি অদ্ভুত ব্যাপার! মৃতাকে দেখে আনন্দ? কিন্তু ঘাটবাবু খোঁজ করতে থাকেন মৃতার শিশুসন্তানের। সে কই? তার এখানে আসতে কত দেরি? সে এলে বহুদিনের ইচ্ছে, সেই পারিবারিক ফটোটি যেন তোলা হবে। এমন বিভীষিকাময় পরিবেশ, এমন দমবন্ধ কষ্ট, সব ছাপিয়ে শব নিয়ে যাওয়া ছেলেরা বুঝতে পারে। ঘাটবাবু স্বপ্নের মানুষ। ‘লোকটা জাগা চোখে স্বপ্ন দ্যাখে’। সে মৃতার নামের পাশে স্বামীর নাম লেখে – মাধব গাঙ্গুলি। যে জীবনের স্বাদ, যে প্রেমের স্বাদ, বেঁচে থেকে মিললনা, মরণে যেন তাই পাওয়া হয়। গল্পটির অভিঘাত বড় বেশি। সবলে নাড়া দেয় আমাদের। প্রেম বলতে আমরা যে কি অনুভব করি, তার গোড়া ধরে টান দেয়। যে স্ত্রী অপহৃত হয়, যে সন্তান অপরের কাছে নির্দয় অবহেলায় শুয়ে থাকে, সেই স্ত্রী সেই সন্তানের প্রতি কি মর্মান্তিক ভালোবাসা!

জীবনের এক বিভীষিকাময় অধ্যায়ে প্রেম নিঃশব্দ চরণে এসে দাঁড়ায়। টের পাওয়া যায়না। যেমন মানশুল্কা গল্পে। আগো তার অরণ্যজীবনে স্বাধীন এক নারী। দেহের আনন্দ সেও অনুভব করে। কিন্তু তার জন্য এমন জবরদস্তি কেন? কেন এমন গামছা দিয়ে হাত পা মুখ বাঁধা? একটু কি ভালো কথায় হয়না? একটু ভালোবেসে বললে কি এমন ক্ষতি? তা নয়, শুধুই জোর। শুধুই পশুর মতন গুঁতিয়ে খাবলে সুখের খোঁজ করা। সেই আগো পালিয়ে এলো কলকাতা শহরে। বাঃ! বেশ তো শহর! কেউ এমন পেছনে পড়েনা। কেউ তাকে বিরক্ত করেনা। কিন্তু ভুল ভাঙতে সময় লাগলনা। সে যেন খেপা কুকুর। কেউ তার হাঁটু খিমচে ধরে। কেউ তার কোমরে চিমটি কাটে। আর এর মধ্যেই দাঁত বের করে হাসে একটা লোক। অশরীরির মতো তাকে অনুসরণ করে। শেষমেশ ক্লান্ত আগো যখন ময়দানে শুয়ে পড়ে, ক্ষণিক ঘুমিয়ে পড়ে, জেগে উঠে দেখতে পায় সেই লোকটা। পালিয়ে পালিয়েও নিস্তার মেলেনি। সে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকে। কিন্তু লোকটা তার সামনে নামিয়ে দেয় এক ঠোঙা তেলেভাজা। বলে – সারাদিন কিছু খাওনি। দেখেছি। খেয়ে নাও। আমি জল নিয়ে আসছি। আগো অবাক হয়ে দেখে, লোকটি দুটো খুরি করে তার জন্য জল আনছে। অবশেষে ট্রেনের টিকিট কেটে সে আগোকে তুলে দেয় আগোর গন্তব্যে। নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। ট্রেনের জানলায় তার হাতের ওপরে মাথা রাখে আগো। ঠিক এমনই একটা ভালোবাসার পুরুষ যে খুজেছিল সে! লোকটাকে তখন পুলিশে হাতকড়া লাগাচ্ছে। সে চোর। আগো ভাবে এই ভালো। শুধু হাতের ওপরে মাথা রেখেছে। নইলে তার বড় পাপ হতো। এ গল্প কিন্তু কালজয়ী । এখনো প্রাসঙ্গিক ।

বৈদেহী। যে নারীর শরীর এতই ক্ষীণ, যে তা ভরাট করতে বিধাতা তাকে দিয়েছেন বিশাল হৃদয়। গল্পটি আপাতভাবে বেশ মিষ্টি। মল্লিকা ফুলের মতো নরম মেয়েটি তার স্বামীর মনের দুয়ার খুলে দেয়। কিন্তু এতই কি সহজ? গল্প থেকে সরাসরি তুলে দিই একটি সংলাপ।

মল্লিকা – কোথায় যাচ্ছ?

...হেসে ফেলে মল্লিকা। - একটু সেজে যেতে হয়। কথাগুলি একটা অর্থহীন বাজে ঠাট্টার মতোই, কিন্তু শুনে আশ্চর্য হয় বিকাশ। কথা বলতে গিয়ে যেন ছলছল করে উঠেছে মল্লিকার গলার স্বর।

- একটু সাজিয়ে নিতেও হয়। পরপর বলতে থাকে মল্লিকা। - মুখের দিকে তাকাতে হয়, একটু হাসতে হয়, আর আলো নেবাতে হয়না।

কী চমৎকৃত হই! একটি নরম সরম মেয়ে, যে স্বামীর ঘরে সোহাগ আদরের অনাবশ্যক বাড়াবাড়ি নয়, বরং পুরুষের দৈহিক প্রয়োজনে দাসীর মতো বেশ্যার মতো সাড়া দিয়ে নিজেকে ক্ষয়ে ফেলেছে, সে আজ বিকাশের দুর্বলতাকে সঠিক ধরে ফেলেছে। এ পুরুষ জানেনা এমন করে। এ পুরুষ জানেনা একটি নারীর শরীরের আগে তার মনকে জাগাতে হয়। শরীরের আদরও শুরু হয়ে মনের সংযোগে। তাই হতবাক বিকাশ এই প্রথম পাঠ নেয় মল্লিকার কাছে। মল্লিকা থামেনা। একটু জোরেই বলে ফেলে – ফুলশয্যার ফুল সরিয়ে দিতে হয়না।

এ এক অতি আধুনিক লেখকের কলম। যিনি নারীর মনস্তত্ব বিশদে বোঝেন। যিনি জানেন নারীর সম্মান, তার স্পর্শকাতরতাকে আদর করতে জানতে হয়। শিখতে হয়। এমন কত কত হীরের টুকরোর মতো মুহূর্ত ঝলকে ওঠে! চমকে উঠি। গল্পগুলো কিন্তু এখনকার নিরিখে ছোট আয়তনের নয়। আজকের মতো শব্দসীমা বেঁধে দিলে তাঁর গল্পের এমন বিস্তৃত ব্যাঞ্জনা পাওয়া যেত কিনা সে কে জানে! আয়তনে কম নয় বলেই লেখক দর্শনের গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছেন বলে বিশ্বাস করি। বিশ্বাস করি, তিনি ভেদ করতে পেরেছেন অন্তরের নিভৃততম ব্যাথা বেদনার উৎস। ভালোবাসার উৎস।

উল্লেখ করব অন্য দুটি গল্পের । একটি গল্পের নাম জতুগৃহ , অন্যটি অচিরন্তন । অদ্ভুত পরীক্ষা করেছেন ! জতুগৃহ গল্পে এক বিবাহবিচ্ছিন্ন দম্পতির আবার দেখা হয় এক ওয়েটিং রুমে । দুজনের জীবনই ভিন্ন খাতে ভিন্ন সঙ্গীকে নিয়ে বয়ে চলেছে । এই হঠাৎ দেখায় দুজনের প্রাথমিক আড়ষ্টতা কি সুন্দর ধরেছেন লেখক ! কিন্তু সেই আড়ষ্টতা কেটে দুজনের সামান্য আলাপ জানিয়ে দেয় , সমাজে তারা অন্য পরিচয়ে বাঁচলেও প্রাক্তন সম্পর্কের কিছু টুকরো টাকরা রয়ে যায় । সব মোছেনা । এবার তাঁর অচিরন্তন গল্পটি । এ গল্পে এক ভয়াবহ অবস্থায় স্টেশন মাষ্টারের পরামর্শে দুই অচেনা যুবক ও যুবতী একটি গেস্ট হাউসে থাকতে বাধ্য হয় । সেইরকমই আড়ষ্টতা । অচেনা দুটি মানুষ আপাতত স্বামী স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন । প্রথমেই একে অপরকে সন্দেহ , ভয় , এবং প্রবল বিরুদ্ধতা পেরিয়ে দুটো দিন কাটল । তৃতীয় দিন সকালে দুজনেই নিরাপদে ট্রেনে উঠছে । মহিলা কামরায় উঠে বসা যুবতীকে যুবক বলছেন – গলায় কম্ফর্টারটা ভালো করে জড়িয়ে নিও । যুবতীও আপনির বেড়া ছাড়িয়ে বলে – সাবধানে যেও । যেন দুটিদিনের নকল দাম্পত্য চিরকালীন হয়ে স্থান করে নিলো দুটো মনে । কেউ কি ভোলে ? যেমন বারবধূর লতা । দুদিনের নকল দাম্পত্যের আকর্ষণ তাকে ঘোর লাগিয়ে দিলো । সংসারের সকল সম্পর্কের আকর্ষণ তাকে এমন ভোলালো যে পতিতা লতা পর্যন্ত নকল স্বামী প্রসাদকে হারিয়ে ফেলার কারণ হিসেবে আভা ঠাকুরঝিকে দায়ী করে ।

চোখ গেল গল্পে যেমন অপরাজিতা অনুভব করে , হিরন্ময়ের বাইরের চোখ না থাকলেও অন্তর্দৃষ্টি এমনই যে অপরাজিতার প্রতিটি চলন সে অনুভব করে ।

তবু কথা থাকে । আজকের পাঠক হয়ত এত সময় নিয়ে এমন গভীর অনুভূতি ও এত জটিল বিশ্লেষণে প্রেম পড়তে ভালবাসবেন না । এমন গভীরতায় যেতে কেউ কি আর ভালোবাসে আজকাল ?

[গল্পমেলা ২০১৮]

0 comments:

0

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in







একলব্য কামারের পা চেপে ধরে বলল, তোমার কন্যা মানে আমার ভগ্নী। না কোরো না খুড়ো।



“বেশ, চল তবে। কিন্তু ভাইপো, ঝামেলা করলে, তোর খুড়ি কিন্তু দুজনকেই আঁশবটি দিয়ে কেটে ফেলবে।”

“মা কালীর দিব্যি।”

দুজনে বাজার থেকে বের হয়। বাইরে একলব্যের ঘোড়াটা মাঠে বড় দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিল। একলব্য কামারকে বলে, কাকা! ঘোড়াটা নিয়ে আসি।

কামার অবাক হয়ে বলে, ওরে রাজপুত্তুর! তোর আবার ঘোড়াও আছে। একেই বলে গরিবের ঘোড়া রোগ।

একলব্য ঘোড়ায় চাপে। পিছনে বসিয়ে নেয় কামারকে। তার পর নির্দেশিত পথে ছুটিয়ে দেয় অশ্ব।

কামারের বাড়ি হস্তিনার উত্তরে। অস্ত্রবাজার থেকে কুরুক্ষেত্র পার হয়ে সে অনেক রাস্তা। বেশ গোছানো বাড়ি। কামারের বউ আর মেয়ে বেশ খাতিরযত্ন করল তার। জল এনে দিল। খেতে দিল যত্ন করে। কামার সদোপবাসী মানুষ—দিনে মাত্র দু বার আহার গ্রহণ করে। যেদিন অস্ত্রবাজারে যান সেদিন সকালে খেয়ে যায় আবার রাতে ফিরে খায়। একলব্যের তেমন হলে চলবে না। ব্রীহি ও যব এদের প্রধান খাদ্য। মাংসভক্ষণ করে না বললেই চলে। কামার মাঝেমধ্যে সুরাপান করে, সে কথা একলব্য তার মুখ থেকেই শুনেছে।

যবাগু আর ভর্জিত বার্তাকু দিয়ে নৈশ ভোজন সেরে কামারের সঙ্গে এক ঘরে শুয়ে পড়ল একলব্য। কামার তাকে বলল, হস্তিনার আখ্যান শুনেছিস?

একলব্য জবাব দেয়, না।

“খুব শীঘ্র একটা যুদ্ধ হবে।”

“কার সঙ্গে কার?”

কামার বলে, ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের। সে অনেক বড় কাহিনি। শুনবি?

“বলো।”

“মৎস্যগন্ধার নাম শুনেছিস?”

একলব্য জবাব দেয়, হ্যাঁ। দাশরাজ জেলের কন্যা।

“বাহ, অনেক জানিস দেখছি! তাহলে ঘুমো।”

একলব্য বলে, তুমি বলো। কিছুই জানি না তার পর। যুদ্ধের কথা বলছিলে না?

“শুনবি?”

“বলছি তো বলো। ঘুম আসছে না।”

কামার কাহিনি বলতে শুরু করে। শোন আমার নাম কানাহাইয়া কুমার, লোকে আদর করে ডাকে কামার। অবশ্য আমি ছুরি বানাই, শান দিয়ে এত তীক্ষ্ণ করে যে কুমড়ো কিংবা মানুষ ফালি করলে কেউ ধরতেই পারবে না মালটা গোটা না অর্ধেক করা! সে যাক গে! রাজবাড়ির অসি থেকে মসী সব ধার দেওয়ার জন্য রাজপেয়াদারা আমার কাছেই আসে। সেই আমি কানহাইয়া কুমার ওরফে কামার শুরু করছি।

মৎস্যগন্ধা আগে নৌকা বাইতো। সেই সময় একজন ঋষি বন থেক হস্তিনার রাজপ্রাসাদে আসতো রাজা শান্তনুকে পরামর্শ দিতে। সে বেশ কিছু কাল আগের কথা। মুনির সেই বন থেকে প্রাসাদে আসতে গেলে যমুনা নদী পার হতে হয়। মৎস্যগন্ধার নৌকাতেই আসত পরাশর। তার পর ভাব-ভালবাসা হয়ে পোয়াতী হয় মৎস্যগন্ধা। সেই ছেলের জন্ম হয় এক দ্বীপে। তার নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। সে থাকে বাপের সঙ্গে। পরাশর মৎস্যগন্ধাকে বলে, তুই রাজা শান্তনুকে বিয়ে কর। মৎস্যগন্ধা জানায়, তা কী করে হয়! অমন বুড়ো লোক। ওর ছেলে দেবব্রত তো আমার বয়সী। পরাশর বলে, যা বলছি শোন। রাণী হতে চাইলে রাজাকেই বিয়ে করতে হয়, তার পর তোর ছেলে রাজা হবে; গঙ্গাপুত্রকে সরিয়ে দেব।

মৎস্যগন্ধা বলে, রাজা কেন রাজি হবে!

“ঠিক হবে।”

তার পর পরাশর মুনি শান্তনুকে বলে, “অনেক দিন হল তোমার স্ত্রী পালিয়েছে। একটা বিয়ে করো, বুড়ো বয়সে নইলে কে দেখবে?

রাজা বলে, আরে রাম রাম! এই বয়সে বিবাহ! আমার পুত্র দেবব্রত এখন যুবক। তার বিয়ে দেব।

পরাশর বলে, সে দাও। কিন্তু তুমিও একখানা যুবতী মেয়ে দেখে বিয়ে করো।

রাজা জানায়, তাকে আর কোন যুবতী পছন্দ করবে!

অপরাহ্নে নদীর তীরে বেড়াতে যেও, মুনি এই কথা বলে চলে যায়।

রাজা শান্তনু বিকেলে মৎস্যগন্ধার দেখা পান। অপূর্ব সাজসজ্জায় ভূষিত সেই কন্যার সারা শরীরে বহিরাগত সুগন্ধের হাতছানি। এমন সুগন্ধী কোথায় পেল কন্যা? গঙ্গার গন্ধবণিক তো এত ভাল গন্ধদ্রব্য সরবরাহ করে না!

শান্তনু ভাবতে লাগলেন, অনেক কাল থেকেই পরাশর মুনি বলছে যে তার মামাতো ভাই অনন্তমুখ নামকরা বৈশ্য, তাকেই হস্তিনার বাণিজ্যের ভার দিন রাজা। কিন্তু গঙ্গার বণিকরা খুব সৎ ও ভাল মানুষ। যমুনার ওই চিত্রমুখ বৈশ্যরা তেমন সুবিধার লোক নয়। কোনও জালে পড়তে চলেছেন কি রাজা শান্তনু?

কিন্তু ওই সুগন্ধ টেনে নিয়ে গেল রাজাকে মৎস্যগন্ধার কাছে। শান্তনু জালে ধরা পড়লেন। মৎস্যগন্ধার বিবাহ হল শান্তনুর সঙ্গে। শান্তনু-গঙ্গার পুত্র দেবব্রত বুদ্ধিমান, তিনি বিবাহ না করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তাতে মানও বাঁচে, সংঘাতও এড়ানো যায়। সেই থেকে অস্ত্রবাজার থেকে কাঁচাবাজার সব অনন্তমুখের দখলে। অনন্তর পুত্র দুর্মুখ এখন সব কিছুর দেখভাল করে। সে চাইছে বড় একটা যুদ্ধ হোক।

মৎস্যগন্ধার দুটি পুত্র হয়েছিল শান্তনু রাজার ঔরসে। বড়টির নাম চিত্রাঙ্গদ। সে এক গন্ধর্বের হাতে খুন হয়। ছোটো বিচিত্রবীর্য অনিয়ম করে মারা যায়, রেখে যায় দুই বিধবা স্ত্রীকে। মৎস্যগন্ধার আগের পক্ষের ছেলে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ওই বিধবাদের দেবর। সে পুত্র উৎপাদন করে বিধবাদের গর্ভে। তাদের একজন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র, সেই এখন রাজা। কিছুই দেখে না চোখে। তার ১০১ জন ছেলে আর একটি মেয়ে। ধৃতরাষ্ট্রের ছোটো ভাই পাণ্ডু মারা গিয়েছে কিছু দিন আগে। পাণ্ডুর স্ত্রীদের গর্ভে দেবতারা পাঁটি পুত্রসন্তান উৎপাদন করেছে। এখন লড়াই হবে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের সঙ্গে পাণ্ডুর ক্ষেত্রজ পুত্রদের। সেই জন্য নতুন অস্ত্রগুরু এসেছে, তার নাম দ্রোণাচার্য।

একলব্য বলে, আচার্য দ্রোণের সঙ্গে দেখা করা যায়?

কামার উত্তর দেয়, কী হবে সাক্ষাতে! তীরধনুক বেচবে?

“আজ্ঞে!”

“তুমি কি ভেবেছো, নতুন একটা ছেলে বাজারে অস্ত্র বেচছে সে কথা ওদের কানে যায়নি! দেবব্রত ভীষ্ম থেকে দ্রোণ সকলের কাছে খবর পৌঁছে গেছে। নাও এখন ঘুমোও দেখি।!”

একলব্যের ঘুম আসতে চায় না। কামারের নাসিকা গর্জন শুনতে শুনতে এক সময় কখন নিদ্রাদেবী তার উপর ভর করেছেন সে কথা একলব্য জানে না। ঘুম ভাঙলো মোরগের আওয়াজে।

কামারের বউ অনিন্দ্যা এবং কন্যা সুগন্ধা দুজনেই বড় ভাল মানুষ। তারা একলব্যের প্রাতঃরাশের ব্যবস্থা করল। ঘোড়াকে জাবনা দিল। তার পর কামারের দিকে তাকিয়ে বলল, আজ আর কাজে যেও না। ছেলেটাকে প্রাসাদ দেখিয়ে আনো। ফেরার সময় একটু মাংস কিনে এনো।

একলব্য বেশ অবাক হল। কেননা সে জানে, দুধ-মাংস-তেল এইসব জিনিস বিক্রি হয় না। যদি কোনও দেশে এই সব বস্তুর কেনাবেচা হয় তাহলে জানতে হবে সেই রাজ্য পতিত। সে কামারকে জিজ্ঞাসা করল, কী গো খুড়ো, তোমাদের দেশে মাংস খোলা বাজারে বিক্রি হয়?

কামার জবাব দিল, হ্যাঁ হয়। ব্যাধেরা করে না। মাংস বেচে বৈশ্যরা। এখন তাদের নতুন নাম মাংসবণিক। শোনো ভাইপো, এককালে নদী পারাপার করতে পারানির কড়িও লাগতো না। মৎস্যগন্ধা সে সব চালু করেছেন। রাজা শান্তনুর পিতা প্রতীপ যখন নৃপতি ছিলেন, তখন হস্তিনা ছিল স্বর্ণনগরী। বণিকরা এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিল। আগে বিদেশি বণিকদের আয়ের পরে কর নেওয়া হত। এখন ঢুকতে না ঢুকতে গলায় গামছা দিয়ে সব কেড়েকুড়ে নিচ্ছে। এই দেখো না, তোমার তীরধনুকের অর্ধেক তো নিয়েই নিয়েছে। দু একটা পাঠাবে রাজার অস্ত্রশালায়, বাকিটা নিজেরা বেচে দেবে। যাক গে, প্রস্তুত হয়ে নাও। হস্তিনানগর দেখে আসি চলো।

এমন সময় দরজায় করাঘাত শোনা গেল। কে?

রাজপেয়াদা।

কী সংবাদ?

অতিথির ডাক পড়েছে রাজদরবারে।

‘যাচ্ছি’ বলে কামার একলব্যকে জানালেন, দেরি করা ঠিক নয়; এক্ষুনি বের হও।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২৯



মিসেস সুজান এখনও অবধি যত খদ্দের দেখেছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো এই সৈনিকগুলি। আটজন মিলে বেশ কয়েক মাস ধরে থেকেছিল তার সরাইখানায়। ব্রিজ উড়ে যাওয়ার আগে অবধি যা ব্যবসা হয়েছিল তার, তার থেকেও অনেকটা বেশি উসুল হয়ে গিয়েছিল এই সময়ের মধ্যে। সৈনিকদের সম্ভবত হাতে অনেক পয়সা আর সময় ছিল। তারা যে কাজটা করছিল, মিসেস সুজানের কাছে সেটা একদম হাস্যকর মনে হয়েছিল। তাদের মধ্যে দুজনে মিলে কিছুটা রাস্তা নদীর পাড় ধরে হেঁটে যেত, আবার নৌকায় নদী পার হয়ে কিছুটা রাস্তা উল্টোদিকের পাড় ধরে হেঁটে যেত। দু’ঘণ্টা ধরে দু’জনে মিলে এই কাজটা করত। আবার অন্য দু’জন এলে তাদের ছুটি। এদিকে আবার একজন সরাইখানার ছাদে বসে থাকত দূরবীন নিয়ে। চারদিকে নজর রাখত। খুব কম করে হলেও টানা তিন ঘণ্টা বসতে হত একজনকে। সৈনিকেরা নিজেরাই ছাদে বসবার ব্যবস্থা ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে নিয়েছিল। হেলানো কৌণিক ছাদের গায়ের জানলাটা ছাদের বেশ কয়েকটা টালি সরিয়ে আরেকটু চওড়া করে নিয়েছিল তারা। রাতের বেলা সেই ফাঁকা জায়গাটা টিন দিয়ে ঢেকে রাখত, আর দিনের বেলা সেই জানলার সামনে একটা টেবিল পেতে পুরনো চেয়ারের মধ্যে কুশন সাজিয়ে বসে থাকত তারা। প্রায় সারাদিন একজন থাকত সেখানে দূরবীন আগলে। দূরে পাহাড়ের দিকে, জঙ্গলের দিকে, নদীর তীরে, পাশে টেসার্জি গ্রামের দিকে তাক করে করে কী যে দেখে কে জানে! বাকি সৈনিকেরা বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ায়। ওদের কি একঘেয়ে লাগে না এই কাজ করতে? কে জানে!

মিসেস সুজানের ভাবতে অবাক লাগে যে শুধু এইসব কাজ করবার জন্য সৈনিকেরা কত পয়সা রোজগার করছে! শুধু তারাই পাচ্ছে এমন তো নয়; দেশে তাদের পরিবার আছে, তারাও ভাতা পাচ্ছে। সৈনিকদের মধ্যে আবার অতীতে একজন ছিল শিক্ষক। সে একদিন হিসেব করছিল যে দেশের বাড়িতে তার বউ ঠিক কত টাকা পাচ্ছে ভাতা হিসেবে। সৈনিকের কাজের কী বহর! তারা এখানে বসে বসে আলুভাজা, স্যালাদ, গুলাশ, রুটি, সসেজ কত কি খাচ্ছে! কফি তো এত খায় যে হিসেব নেই। তার উপরে তামাকের খরচ! রোজই ধোঁয়া উড়ছে। ওই সৈনিক যখন খায় না, তখন সরাইখানার পানশালায় বসে বিয়ারে চুমুক দেয় ধীরে ধীরে, আর সারাক্ষণ বই পড়ে। কত যে পড়তে পারে লোকটা, সে আর বলার নয়। গোটা একটা রুকস্যাক ভর্তি করে বই নিয়ে ঘুরছে বোধহয় এই সৈনিক! যখন খাওয়া কিম্বা পড়াশুনো কিছুই করে না, তখন ছাদের ঘরে গিয়ে দূরবীনে চোখ রাখে। আর কী কাজ লোকটার? চতুর্দিকে বনেবাদাড়ে চেয়ে কী দ্যাখে লোকটা কে জানে! পাহাড়, জঙ্গল, মাঠে চাষারা কাজ করছে, এইসব দেখে কী লাভ! তবে এই সৈনিকের ব্যবহার বেশ ভালো। নাম বেকার। কিন্তু এই লোকটাকে মিসেস সুজানের সেরকম পছন্দ নয়। কারণ লোকটা কাজেও বেকার। হয় বই পড়ছে, নয়তো খানাপিনা করছে, একদম কাজের কাজ কিচ্ছুটি না করে বসে বসে সেনাবাহিনীতে মাইনে নিচ্ছে।

তবে এসব বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা। প্রথমে সৈনিকদের যে দলটা এসেছিল, তারা খুব বেশিদিন নয়, প্রায় চার মাসের মত সময় ধরে এখানে ছিল। পরের যে দলটা এলো, তারা প্রায় ছয় মাস ধরে ছিল। তার পরের দলটা প্রায় এক বছর। এর পর থেকে ছয় মাস অন্তর অন্তর লোক পাল্টায় এরা। অনেক সময় প্রথমে যারা ছিল, অনেকেই আবার ফিরে আসে। গত তিন বছর ধরে এই ব্যবস্থা চলছে। এরা এখানে থাকতে আসে। চারদিকে ঘুরে বেড়ায়, বিয়ার খায়, তাস খেলে কিম্বা ছাদের ঘরে ঘাপটি মেরে বসে কী দ্যাখে ওরাই জানে! আবার কখনো কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে বনে বাদাড়ে মাঠে ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। সৈনিকদের থাকবার জন্য ঘর ভাড়া দিয়ে আর তাদের খাবার রেঁধে দিয়ে অবশ্য মিসেস সুজানের অনেক টাকাকড়ি হয়েছে। অন্য খদ্দেরও আসে তার সরাইখানায়। সরাইখানার খাবার ঘরটা এখন সৈনিকদের বসার ঘর।

এখন যে সার্জেন্ট গত চার মাস ধরে আছে এই দলটার সঙ্গে, তার নাম পিটার। মিসেস সুজান লোকটার পদবি জানেন না। বেশ ভারিক্কি গোছের চেহারা; চাষাদের মত দোহারা গড়ন, আবার একটা গোঁপ আছে। লোকটাকে দেখে প্রায়ই তার নিজের স্বামী ভেনজেলের কথা মনে পড়ে তার। ভেনজেল সুজান, যুদ্ধে গিয়েছিল। সেই যুদ্ধটা কবে শেষ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু লোকটা ঘরে ফেরেনি। সেই সময়ের যুদ্ধে যখন সৈনিকরা এই ব্রিজটা পেরত, তাদের সব ধুলোকাদামাখা চেহারা হত। কাউকে চেনা যেত না আলাদা করে। মিসেস সুজানের মনে আছে। পায়ে হেঁটে কিম্বা ঘোড়ার পিঠে কিম্বা ঘোড়ায় টানা মালবাহী গাড়ি সঙ্গে থাকত। এখনকার মত এত বিশাল গাড়ি, ট্রাক এসব কিছুই ছিল না। যে দলটা ব্রিজ পেরিয়ে যেত, তারাই ফিরত কি না, সেসব কিছুই বোঝা যেত না। যারা বহুদিন পরে ফিরত, ধুলোকাদা মাখা চেহারায় খুব কাছ থেকেও ঠাহর করা যেত না যে ঠিক কোন সৈনিক ফিরে এল যুদ্ধ থেকে।

সেই যুদ্ধটার সময়ে তার অল্প বয়স ছিল। বাইশ বছর, সুন্দরী। তাকে ভেনজেল পছন্দ করে নিয়ে এসেছিল পাহাড়ের গ্রাম থেকে। বিয়ে করে নিয়ে এসেছিল সমতলের এই সরাইখানায়। মিসেস সুজানের ভারি সুখের সময় ছিল সেটা। সরাইমালিকের বউ সে। পয়সাকড়ির কোনো অভাব নেই। শুধু সরাইখানা নয়, চাষের জমি, ঘোড়া এসবও ছিল ভেনজেলের। ছাব্বিশ বছরের ভেনজেলের হেলেদুলে ধীরপায়ের চলন আর মোটা গোঁপ খুব পছন্দ ছিল মিসেস সুজানের।

ভেনজেলকে প্রেসবুর্গে পাঠানো হল সেনা অফিসার হিসেবে। গায়ে ধুলোমাখা বিদেশী সেনারা তাদের গ্রামের মধ্য দিয়ে জঙ্গল ভেদ করে পাহাড়ের দিকে যাবার কিছুদিন পরেই প্রেসবুর্গে পাঠানো হয়েছিল তাকে। তারপর সেখান থেকে সোজা পাঠানো হল রোমানিয়া বলে অন্য একটা দেশে। সেখানেও পাহাড়ের দেশ। সেই জায়গাটা থেকে ভেনজেল তিনটে পোস্টকার্ড পাঠিয়েছিল কুশল সংবাদ জানিয়ে। শেষ পোস্টকার্ডে লেখা ছিল যে সে সার্জেন্ট হয়ে গিয়েছে। তারপরে চার সপ্তাহ কোনো চিঠি আসেনি। তারপর ভিয়েনা থেকে একটা চিঠি এসেছিল তার মৃত্যুসংবাদ জানিয়ে।



তার কিছুদিনের মধ্যে মারিয়ার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু এখন মারিয়া নিজেই গর্ভবতী। এই যে সার্জেন্ট, পিটার, এই লোকটাই, যাকে ভেনজেল সুজানের মত দেখতে, এই লোকটাই মারিয়াকে গর্ভবতী করেছে। মিসেস সুজানের স্মৃতিতে ভেনজেল ছাব্বিশ বছরের যুবক হয়ে বেঁচে আছে। কিন্তু এই পিটার, যে ভেনজেলের মত দেখতে হলেও তার বয়স পঁয়তাল্লিশ, ভেনজেল বেঁচে থাকলে কি এরকম বুড়োটে চেহারার হত? লোকটাকে মিসেস সুজানের বেশ বয়স্ক বলে বোধ হয়। মারিয়ার তুলনায় লোকটা বেশ বয়স্ক। মাঝেমাঝেই রাতে মারিয়া ঠিক সময়ে ঘুমোতে আসছিল না। ভোরের দিকে পা টিপে টিপে মোরগ ডাকবার আগে এসে বিছানায় ঢুকছিল। মিসেস সুজান একমনে ঈশ্বরের নাম জপ করছিলেন। মাতা মেরির মূর্তিতে কদিন ধরে বেশি বেশি করে ফুল দিয়েছেন। কিন্তু তবুও মারিয়া পেট বাঁধিয়ে বসল। পিটার একটু অপ্রস্তুত, মুখ ঝুলে যাওয়া অবস্থায় এসেছিল তার কাছে। বলে কিনা যুদ্ধটা থামলেই সে মারিয়াকে বিয়ে করবে।

আচ্ছা বেশ, এখন আর মিসেস সুজান কিছু বদলে ফেলতে পারবেন না। বরঞ্চ প্রতিদিন হলঘরে মাতা মেরির ছবির সামনে অনেক ফুল সাজিয়ে দেবেন, অপেক্ষা করবেন ঐশ্বরিক কৃপার জন্য। বার্কজাবা গ্রামটা হঠাৎ করে বেশ চুপচাপ ঠেকছে তার কাছে, যদিও এই কদিনে সেরকম কিছুই বদলায়নি। সৈনিকেরা সরাইখানার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে, বিয়ার খাচ্ছে, চিঠি লিখছে, তাস পেটাচ্ছে। আবার কেউ কেউ এমন সব জিনিস এখানে নিয়ে এসে বিক্রিবাটা শুরু করেছে, যেগুলো আগে এখানকার মানুষজন চোখেও দেখেনি। পকেট ছুরি, সেফটি রেজার, খুব ভালো কাঁচি, মোজা ইত্যাদি। সৈন্যরা এইসব জিনিস বিক্রি করে টাকা রোজগার করে, সেই টাকা দিয়ে মাখন আর ডিম কিনছে গ্রাম থেকে। এরা এখন এইসব কারবার করছে, কারণ এদের পয়সা যত না আছে, তার চেয়েও বেশি আছে সময়। আর সেই সময়ে বিয়ার খাওয়া ছাড়া সেরকম কোনো কাজ নেই।

এখন আবার এক পড়ুয়া সৈনিক এসেছে। যে সারাদিন শুধু পড়াশুনা করে। টেসার্জি স্টেশনে ট্রেনে করে এক ট্রাঙ্ক বই আনিয়েছে লোকটা। লোকটা নাকি প্রফেসর ছিল। দিনের কিছুটা সময় ছাদের ঘরে দূরবীনে চোখ লাগিয়ে বসে থাকে লোকটা। পাহাড়ে দ্যাখে, জঙ্গলে দ্যাখে আবার কখনো টেসার্জির দিকে চাষারা মাঠে কাজ করছে এইসব দেখতে থাকে দূরবীন দিয়ে। এই লোকটাও বলছিল যে দেশের বাড়িতে লোকটার বউ অনেক টাকা পায়। পাঁচ অঙ্কের ক্রাউন পায় মাসে মাসে। কী অবিশ্বাস্য পরিমাণ টাকা! হতে পারে এরকম? নির্ঘাত মিছে কথা বলছে লোকটা। বর এখানে বসে বসে অর্ধেক দিন, অর্ধেক রাত বই পড়ছে, আর লিখছে কী সব! মাঝে কয়েক ঘণ্টা ছাদে উঠে দূরবিনে চোখ রাখছে, স্রেফ এই কাজের জন্য দেশে বউ এত বিরাট অঙ্কের ভাতা পেতে পারে? সব ফালতু কথা।

এদের মধ্যে আবার একজন ছবি আঁকে। আবহাওয়া ভালো থাকলে নদীর ধারে বসে দূরের পাহাড়গুলোর ছবি আঁকে। নদী, পাহাড়, ব্রিজের ভাঙা টুকরো, যা কিছু দেখছে লোকটা তাইই আঁকছে। এক দু’ বার মিসেস সুজানের ছবিও এঁকে ফেলেছিল। ছবিগুলো বেশ ভালো হয়েছে। তিনি বসার ঘরের দেওয়ালে টাঙ্গিয়ে রেখেছেন কয়েকটা।



তিন বছর হয়ে গেল আটজন করে সৈনিক এসে এখানে থাকছে। থাকছে এবং কাজের কাজ সেরকম কিছুই করছে না। নদীর এ পাড় দিয়ে কিছুটা হেঁটে, তারপর নৌকা করে নদী পেরিয়ে, ওপাড় ধরে আবার কিছুটা হেঁটে টেসার্জি অবধি যাচ্ছে, ব্যস ছুটি। ভালো করে খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, হাতে অঢেল পয়সা। মিসেস সুজানের মাঝে মাঝে মনে হয় যে ভেনজেলকে এরকম কোনো অদ্ভুত কারণে দূরদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়নি তো? ভেনজেলকে তার খুব দরকার ছিল। এই অভাব যে পূর্ণ হবার নয়। তাছাড়া ভেনজেল কাজ করতে ভালবাসত। হয়তো এইরকমভাবে বসিয়ে রেখেছিল তাকে রোমানিয়াতে পাঠিয়ে, তারপর কী ভাবে যেন গুলি লেগে লোকটা মরে গেল। কিন্তু এই যে সৈনিকেরা এখানে রয়েছে এদ্দিন ধরে, সেরকম কোনো গোলাগুলি তো চলেনি! এরা নিজেরাই দু’ তিন বার গুলি চালিয়েছিল। সে একটা ভীষণ উত্তেজনা! কিন্তু প্রতিবার বোঝা গিয়েছে যে এরা ভুলভাল কারণে গুলি চালিয়েছে। বারণ করা সত্ত্বেও জঙ্গলে শিকার করবার জন্য এরা গুলি চালিয়েছে এক দু’ বার। একবার এক মহিলার উপরে চালিয়েছিল। রাত্রিবেলা বিশেষ প্রয়োজনে সে তার বাচ্চাকে নিয়ে গাড়ি চালিয়ে জেনকোশিক থেকে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে টেসার্জির দিকে যাচ্ছিল ডাক্তার দেখাতে। বুঝতে না পেরে এরা গুলি চালিয়েছিল। ভাগ্য ভালো যে মহিলার লাগেনি। পরে অবশ্য নিজেরাই নৌকা করে মহিলাকে নিয়ে গিয়েছিল টেসার্জি অবধি। এই যে প্রফেসর, নিষ্কর্মার ঢেঁকি লোকটা, খাবার ঘরে বসে সারাদিন পড়ে আর লেখে, এই লোকটা ওই মহিলার সঙ্গে গিয়েছিল। কিন্তু তিন বছরে আজ অবধি এরা একটাও সন্ত্রাসীকে খুঁজে বের করতে পারেনি। পারবে কী ভাবে? আরে, এখানে একটা বাচ্চাও জানে যে শোয়র্টশিক গ্রামের ছেলেগুলো চলে যাবার পর থেকে এই এলাকায় একটাও বিপ্লবী নেই।

(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(৫)

বিমূঢ় ও বিপর্যস্ত অবস্থাতেও এতক্ষণৃ গোলকপতি টের পেল যে রাঢ়বঙ্গে এসেও আজন্ম এক অনাহুতের মত তাকে এক এক করে তার সমস্ত অবলম্বনগুলি যেন বন্ধনমুক্তির স্বাধীনতায় তাকে জোর করে ঠেলে দিচ্ছে নির্মোহ সামাজিকতায়। তাই আগামীকালের পৃথিবীতে যদিও বা সে শেষমেশ বেঁচে থাকে তবে তার পরিচয়টি হবে কৌলিকবংশপরিত‍্যাজ‍্য একজন অতি সাধারণ এক শ্রমজীবি মানুষের মতই।

গোলকপতি তার মৃত স্ত্রীর মাথাটি কোলে নিয়ে সারারাত আর না ঘুমিয়েই স্তব্ধবাক হয়ে বসে থাকল ভোরের প্রতীক্ষায়।

....

বিস্ময়ের ব‍্যাপার এই যে কোন অজানিত কারণে তার আজ আর একটুও শোক বোধ হচ্ছে না। সে যেন জেনেই গেছে যে কাল সকালে লক্ষ্মীমণির শবদেহটি সৎকারের সাথে সাথেই যেন তার সংগ্রামটি যেন আরও তীব্রতর হতে চলেছে।

নবাবহাটের আড়তে একটা কথা কদিন হল বেশ লোকমুখে ফিরছে। গোলকপতি এতদিন এসবের কিছুই জানত না। গতকাল লক্ষ্মীমণির অকাল মৃত‍্যু তাকে সবরকম বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়েছে বলে সে ভাবল আবার সকল উদ‍্যমটিকে ফিরিয়ে আনাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ হবে। সে জানে যে তার শরীরে অস্বীকৃত হলেও রাজরক্ত বইছে তাই নিশ্চেষ্ট অবস্থায় বসে থেকে ভাগ‍্যকে কেবল দোষারোপ করার মূর্খামি সে কখনোই করবে না। তাই সে আজ এইসব রোমহর্ষক খবরাখবরের সবটা আড়তদার নগেন মুৎসুদ্দির কাছে সে উৎকর্ণ কন্ঠে শুনছিল। সেখানেই সে জানতে পারল যে নবাবী আমলের একজন দক্ষ রাজকর্মচারী কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পৌত্র ‘রামকান্ত রায়’ মুর্শিদাবাদ থেকে এসে এখন হুগলী জেলার অন্তর্গত একটি বর্ধিষ্ণু গঞ্জ খানাকুলে এসে স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেছে ও নিজের অবিশ্বাস‍্য বুদ্ধিবলে ও কর্মদক্ষতার জোরে পূর্বজদের ব‍্যবহৃত ‘চৌধুরী’ উপাধির বদলে ‘রাজা’ বা ‘মহারাজাধিরাজ’ উপাধির জন‍্য ঈষৎ লালায়িত হয়েছেন । যদিও এই কৃষ্ণচন্দ্রের অন‍্য শাখার কিছু বংশধরেরা আরও বিভিন্ন বিষয় সম্পত্তির মালিক হয়ে বর্ধমান রাজারই অধীনে ছোটখাটো জমিদার হয়ে বসে আছেন। সেজন‍্য রামকান্ত ইদানীং কালে "রায়" পদবীটিকে পুরোপুরি ত‍্যাগ করতে পারেননি। তাছাড়া তিনি নিজেও বর্ধমানের মহারাণী বিষণকুমারীকে নানা বৈষয়িক বিষয়ে সাহায্য করতে এগিয়ে এসে তাঁর বন্ধুবৃত্তে বেশ স্থায়ী একটি জায়গা করে নিতেও সক্ষম হয়েছেন।

ইদানীং ইংরেজ কোম্পানির এজেন্টরাও এই ব্যবস্থায় বেশ খুশী। এরমধ‍্যে রামকান্ত রায়ের কনিষ্ঠ পুত্রটিও ইদানীং দেশে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। 'রামমোহন' নামের এই কনিষ্ঠপুত্রটি অবশ‍্য রামকান্তের জ‍্যেষ্ঠপুত্র জগমোহনের চেয়ে মেজাজে ও স্বভাবে অনেকটাই আলাদা।

সে ইংরাজী ও ল‍্যাটিনে শ্বেতাঙ্গদের সমতূল‍্য যথেষ্টভাবে শিক্ষিত ও হিন্দুস্তানী রায়তদারে কাজকর্মের জন‍্য উর্দু ও ফারসীভাষায় একইরকমভাবে সুপন্ডিত হলেও সে বড় একরোখা ও তর্কপ্রিয় স্বভাবের এক স্পষ্টবাদী নব‍্যযুবা। কিছুদিন সে কাশীধাম থেকে সোজা তিব্বতে গিয়ে অনেকদিন শাস্ত্রচর্চা করেছে ও স্বভাবতই দীর্ঘকাল নিরুদ্দেশ থাকার পরে বছর দেড়েক হল স্বদেশে ফিরেছে।

এখন সেই শিক্ষিত যুবাটির মনে হয়েছে যে চিরায়ত হিন্দুধর্মের লোকাচারগুলির বেশীটাই নাকি এখনকার দিনে অচল। তাই সে নিজে এসব পাল্টে দেবার সংকল্পে নেমেছে। শোনা যাচ্ছে যে লাটবাহাদুর স্বয়ং বেন্টিঙ্ক সাহেব এই রামমোহনের সুহৃদতূল‍্য। এখন যদিও জনস্বার্থেই নাকি ইংরেজ সরকার " সতীদাহে"র মত চিরায়ত প্রথাটিকে বন্ধ করতে অগ্রসর হয়েছে।তবে দুর্জনে বলাবলি করছে এসব কিছুই নাকি এই ম্লেচ্ছ রামমোহনের কূট মস্তিষ্কের ফসল।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in




















দুই

বিজয় বলে,আমি শুনেছি দাদুর কাছে, নিম্নবর্গ পরিবারের মানুষগুলি দেবতার পূজা,পৌরহিত্য ইত্যাদি থেকে দূরে ছিল বহুদিন, বহুযুগ ধরে। ব্রাহ্মণ্য সংষ্কৃতির চাপে সমাজে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব একরকম ঢাকা ছিল। যখন তারা সেই আস্তরণ সরিয়ে সেই অধিকার আবার ফিরে পেতে শুরু করল, ব্রাহ্মণ্য পূজার রীতিগুলিকে নিজেদের করায়ত্ত করার চেষ্টা করল। কিংবা বলা ভালো, এই রীতিগুলির প্রতি তাদেরও লোভ জন্মাল। কিন্তু দীর্ঘদিনের অশিক্ষা, ভাষাজ্ঞানের অভাব ইত্যাদি নানাকারণে তা রপ্ত করতে পারল না। ফলও হল মারাত্মক! এগুলি শুনতে, পড়তে আনন্দদায়ক মনে হলেও অজস্র ভুলভ্রান্তিতে ভরা, অনুকরণের অক্ষম প্রচেষ্টা। ভাষা এবং উচ্চারণ দুয়েরই ভুল। মাঝে মাঝেই মন্ত্র ভুলেগিয়ে দৈনন্দিন যাপনের কথা কখনও বা স্বগতোক্তির মত মন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও জনগনকে বোঝানোর জন্য কথ্যভাষার ব্যবহারও করতে হয়েছে পূজার ক্রম ও রীতিগুলি বোঝানোর জন্য। এর পরিণাম হল এই মন্ত্রগুলি।আর একটি কথা মাঝে মাঝে মনে হয় সেটি হল– এই অন্ত্যজ, নিম্নবর্গ মানুষগুলি যার মধ্যে মিশে আছে কিছু জনগোষ্ঠী সমাজের মানুষও যাদের আমরা বলি আদিম অধিবাসী, হয়তো এই পূজাগুলি একদিন ছিল তাদেরই অধিকারে। বহুযুগ পরে তাদের ফিরে পেয়ে আর মনে করতে পারেন না সেই মন্ত্রগুলিকে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভুলে থাকা সেই অতীতকে মনে করতে পারে না। কারণ ঘটে গেছে অনেক সংযুক্তি, অনেক বিযুক্তি।

রবিবাবু বলেন,যাইহোক এইসব বিশ্বাস নিয়েই বেঁচে আছে বাঙালির নিজস্ব কৃষ্টির প্রাণ।


(বিজয়েরর লেখক হওয়ার গল্প ও তার আত্মসমালোচনা)।

আজ কালুরায়ের পুজো কিন্তু বিজয় কোলাহল ছাড়িয়ে সবুজ মাঠে গিয়ে বসে আছে।বাড়ির সকলে পুজোয় ব্যাস্ত।তারা জানে বিজয় অন্য ধরণের ছেলে।পড়াশোনা আর লেখা নিয়েই সে মত্ত।

বিজয় খোলা মাঠে থাকতে ভালোবাসে সবুজের সঙ্গ ভালোবাসে। সে গাছের সঙ্গে কথা বলে। নদীর পাড়ে এসে বসে নদীর সঙ্গে সে আপন মনেই গান করে আর খাতা-কলম নিয়ে লেখে।

স্কুলে যাওয়ার সময় মায়ের কাছে ভাত খেয়ে স্কুলে যায়। স্কুলে গিয়ে ভালোভাবে পড়াশোনা করে। কিন্তু চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে তার ভালো লাগে না।

তবু কষ্ট করে থাকে। স্কুলে সময় কাটিয়ে আবার মাঠে মাঠে হেঁটে বাড়ি ফেরে তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে যায়। এইভাবে ছোট থেকে বড় হয় সীমাবদ্ধ হয়ে। ধীরে ধীরে সে স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়। কলেজের সেখানেও সেই অন্যমনস্ক ভাবে, আপন মনে সে নিজের খেয়ালে থাকে। একটা ম্যাগাজিন পরিচালনা করে এবং কিছু লিখতেও ভালোবাসে। গ্রাজুয়েট হওয়ার পর চাকরির পড়া না পড়ে সে উপন্যাস গল্পের বই পড়ে। গল্পের বই পড়ে পড়ে চাকরির কথা ভুলে যায় এবং শেষ পর্যন্ত চাকরি বয়সটা চলে যায়। সে কিন্তু আর চাকরি ও পায়না। শিবপদর সব বন্ধুরা খুব চালাক। তারা নিজেরা পড়াশোনা করে চাকরি যোগাড় করে নেয়। কিন্তু শিবপদ সারা জীবন বেকার হয়ে রয়ে যায় , সংসারের মাঝে।তার কোন কদর নেই, তার কোন ভালোবাসা নেই তার কোনো বন্ধু নেই। এভাবেই ধীরে ধীরে সে একা হয়ে যায়। আর একা হতে সে, খাতা পেন নিয়ে বসে। খাতা-কলম নিয়ে বসার পর ধীরে ধীরে মনের কথা লিখতে শুরু করে। কয়েকবছর পরে তার পরিচয় হয় লেখক হিসাবে।সে ভাবে,চারুকলার ক্ষেত্রে, লেখক শব্দটি অন্য কোথাও ব্যবহৃত হয়, যেমন গীতি লেখক, তবে শুধু লেখক বললে সাধারণত, যিনি লিখিত ভাষা তৈরি করেন, তাঁকে বোঝায়। কিছু লেখক মৌখিক প্রথা থেকে কাজ করেন।

স্কুলে শিক্ষকদের কাছে শুনেছে বিজয়,লেখকরা কাল্পনিক বা বাস্তব বেশ কয়েকটি রীতির উপাদান তৈরি করতে পারেন। অনেক লেখক তাঁদের ধারণাকে সবার কাছে পৌঁছে দেবার জন্য একাধিক মাধ্যম ব্যবহার করেন – উদাহরণস্বরূপ, গ্রাফিক্স বা চিত্রণ। নাগরিক এবং সরকারী পাঠকদের দ্বারা, অ-কাল্পনিক প্রযুক্তিবিদদের কাজের জন্য, সাম্প্রতিক আরেকটি চাহিদা তৈরি হয়েছে, যাদের দক্ষতা ব্যবহারিক বা বৈজ্ঞানিক প্রকৃতির বোধগম্য, ব্যাখ্যামূলক দস্তাবেজ তৈরি করে। কিছু লেখক তাঁদের লেখাকে আরও বোধগম্য করার জন্য চিত্র মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করতে পারেন। বিরল দৃষ্টান্তে, সৃজনশীল লেখকগণ তাঁদের ধারণাগুলি সংগীতের পাশাপাশি শব্দের মাধ্যমে প্রকাশ করতে সক্ষম হন। লেখকের স্ত্রীবাচক শব্দ হচ্ছে লেখিকা। লেখককে অনেকক্ষেত্রে গ্রন্থকারের সমার্থক শব্দরূপে গণ্য করা হয়। কিন্তু লেখক শব্দটি মূলতঃ ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়। তাঁদের নিজস্ব রচনাগুলি সৃষ্টির পাশাপাশি, লেখকরা প্রায়শই 'কীভাবে' তাঁরা লেখেন সেটাও প্রকাশ করেন (অর্থাৎ, যে প্রক্রিয়াটি তাঁরা লেখার জন্য ব্যবহার করেন) কেন তাঁরা লেখেন (অর্থাৎ তাদের প্রেরণা কি)এবং অন্যান্য লেখকের কাজের বিষয়েও মন্তব্য (সমালোচনা) করেন।

বিজয় প্রশ্ন করেছিল,লেখকরা পেশাদার বা অপেশাদারভাবে কাজ করেন, অর্থাৎ, অর্থের জন্য বা অর্থ ছাড়াই, এছাড়াও অগ্রিম অর্থ গ্রহণ করে, বা কেবল তাঁদের কাজ প্রকাশিত হবার পরে। অর্থ প্রাপ্তি লেখকদের অনেক অনুপ্রেরণার মধ্যে একটি, অনেকে তাঁদের কাজের জন্য কখনও কোন অর্থই পান না।

স্যার বলেছিলেন,সংবিধান রচয়িতা আমাদের প্রণম্য।তিনিও কোন পারিশ্রমিক ছাড়াই সংবিধান রচনা করেছেন।শুধু অর্থই সব নয়।লেখক শব্দটি প্রায়শই সৃষ্টি মূলক লেখক এর প্রতিশব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যদিও পরবর্তী শব্দটির কিছুটা বিস্তৃত অর্থ রয়েছে এবং লেখার কোনও অংশের জন্য আইনি দায়িত্ব জানাতে ব্যবহৃত হয়।

বিজয়ের গণিতের শিক্ষকমশাই বলতেন, যোগ,বিয়োগ,গুণ,ভাগ জীবনের ক্ষেত্রেও মেনে চলবি। যত দুঃখ,ব্যথা বিয়োগ করবি। আনন্দ যোগ করে খুশি গুণ করবি। আর খাবার ভাগ করে খাবি। একা খেলে,বেশি খেলে রোগ বেড়ে যাবে। মজার মধ্যেও কতবড় শিক্ষা তিনি আমাদের দিয়েছিলেন আজ বুঝতে পারি। আদর্শ শিক্ষক বোধহয় এই রকম হন। ফোচন বললো।ফোচনের বোন ফোড়োনকে মাস্টারমশাই মশলা বলে ডাকতেন। ফোড়োন খুব রেগে যেতো। কারণ বন্ধুরাও তাকে মশলা বলেই ডাকতো। একদিন স্যারের কাছে ফোড়ন বললো,আপনি মশলা নামে ডাকেন বলে সবাই ডাকে। মাস্টারমশাই বলেছিলেন,আদর করে দেওয়া নাম কোনোদিন ফেলবি না। রাগ করবি না। দেখবি একদিন যখন তোর বন্ধু, বান্ধবীরা দূরে চলে যাবে তখন এই নাম তোর মুখে হাসি ফোটাবে। সংসারের সমস্ত দুঃখ ভুলিয়ে দেবে আদরের পরশে। ফোড়োনের জীবনে সত্য হয়েছিলো এই কথা। একদিন বিয়ের পরে রমেশের সঙ্গে দেখা হলো তার। রমেশ বললো,কেমন আছিস ফোড়োন। ফোড়োন বললো,একবার মশলা বলে ডাক। তা না হলে আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দেবো না। রমেশ তারপর ওকে মশলা বলে ডেকেছিলো। মশলা সেবার খুশি হয়ে রমেশকে ফুচকা খাইয়েছিলো। গ্রামে থাকতেই প্রাইমারী স্কুলে যেতাম। মাষ্টারমশাই আমাদের পড়াতেন। পরের দিন আমরা দুই ভাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম। বড়দা গ্রামে কাকার কাছে আর ছোটো ভাই বাবু একদম ছোটো। স্কুলে মীরা দিদিমণি সহজ পাঠের প্রথম পাতা খুলে বললেন,এটা কি? আমি বললাম অ য়ে, অজগর আসছে ধেয়ে।

আবার বই বন্ধ করলেন। তারপর আবার ওই পাতাটা খুলে বললেন,এটা কি?

আমি ভাবলাম,আমি তো বললাম এখনি। চুপ করে আছি। ঘাবড়ে গেছি। দিদি বাবাকে বললেন,এবছর ওকে ভরতি করা যাবে না।

বিজয় ভাবে ছোটবেলার স্মৃতির কথা।ছোড়দা ভরতি হয়ে গেলো। তারপর বাসা বাড়িতে জীবন যাপন। সুবিধা অসুবিধার মাঝে বড়ো হতে লাগলাম। আমাদের খেলার সঙ্গি ছিলো অনেক। ধীরে ধীরে আমরা বড়ো হয়ে টি,আর,জি,আর,খেমকা হাই স্কুলে ভরতি হলাম। তখন লাইনের পাশ দিয়ে যাওয়া আসা করার রাস্তা ছিলো না। লাইনের কাঠের পাটাতনের উপর দিয়ে হেঁটে যেতাম। কতজন ট্রেনে কাটা পরে যেতো তার হিসাব নেই। তারপর ওয়াগন ব্রেকাররা মালগাড়ি এলেই চুরি করতো রেলের সম্পত্তি। কঠিন পরিস্থিতি সামলে চলতো আমাদের লেখাপড়া।এখন পরিস্থিতি অনেক ভালো। পাশে রাস্তা আছে। ওয়াগান ব্রেকারদের অত্যাচার নেই।মনে আছে ক্লাস সেভেন অবধি লিলুয়ায় পড়েছি। তারপর গ্রামে কাকাবাবু মরে গেলেন অল্প বয়সে। বাবা অবসর নিলেন চাকরী থেকে। বড়দা ও ছোড়দা রয়ে গেলো লিলুয়ায়। বাবা, মা ও আমাদের দুই ভাইকে নিয়ে এলেন বড় পুরুলিয়া গ্রামে।গ্রামে কাকীমা ও দুই বোন। রত্না ও স্বপ্না। আমরা চারজন। মোট সাতজন সদস্য। শুরু হলো গ্রামের জীবন।আবার বিল্বেশ্বর হাই স্কুলে ভরতি হতে গেলাম বাবার সঙ্গে। ভরতি র পরীক্ষা হলো। হেড মাষ্টারমশাই বললেন,বাঃ, ভালো পত্রলিখন করেছে। বিজয়া প্রণামের আগে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছে। কজনে জানে।আমি প্রণাম করলাম স্যারকে। ভরতি হয়ে গেলাম।

বিজয় ভাবে অতীতের কথা।স্কুলে আজ বাংলার স্যার দুটো ক্লাস একসঙ্গে নিলেন। কবি বিহারীলাল ও অক্ষয়কুমার বড়াল সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করলেন।স্যার সুদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন তিনি বললেন,কবি বিহারীলাল বাংলা ভাষার কবি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতি-কবি হিসেবে তিনি সুপরিচিত। কবিগুরু তাকে বাঙলা গীতি কাব্য-ধারার 'ভোরের পাখি' বলে আখ্যায়িত করেন। তার সব কাব্যই বিশুদ্ধ গীতিকাব্য। মনোবীণার নিভৃত ঝংকারে তার কাব্যের সৃষ্টি। বাঙালি কবি মানসের বহির্মুখী দৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। স্যার বলেন,অতি অল্পকালের ভিতরে তিনি বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে নিবিড় অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে গীতিকবিতার ধারা চালু করেন। এ বিষয়ে তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। বিহারীলাল তার কবিতায় ভাবের আধিক্যকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রকৃতি ও প্রেম, সংগীতের উপস্থিতি, সহজ-সরল ভাষা বিহারীলালের কবিতাকে দিয়েছে আলাদাধারার বৈশিষ্ট্য।বিহারীলাল চক্রবর্তী ২১ মে, ১৮৩৫ তারিখে কলকাতার নিমতলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দীননাথ চক্রবর্তী। মাত্র চার বছর বয়সে মাতা মারা যান।বিহারীলাল চক্রবর্তী শৈশবে নিজ গৃহে সংস্কৃত ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তিন বছর অধ্যয়ন করেন।বিহারীলাল চক্রবর্তী উনিশ বছর বয়সে অভয়া দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। অল্পকাল পরে অভয়া দেবী মারা গেলে কাদম্বরী দেবীকে বিবাহ করেন।তার রচনাবলীর মধ্যে স্বপ্নদর্শন, সঙ্গীত শতক (১৮৬২), বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০), নিসর্গসন্দর্শন (১৮৭০), বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০), প্রেম প্রবাহিনী (১৮৭০), সারদামঙ্গল (১৮৭৯), মায়াদেবী, ধুমকেতু, দেবরাণী, বাউলবিংশতি, সাধের আসন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। পূর্ণিমা, সাহিত্য সংক্রান্তি, অবোধবন্ধু ইত্যাদি তার সম্পাদিত পত্রিকা। সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।সারদামঙ্গল কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কাব্য। আখ্যানকাব্য হলেও এর আখ্যানবস্তু সামান্যই। মূলত গীতিকবিতাধর্মী কাব্য এটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাব্য সম্পর্কে লিখেছেন, “সূর্যাস্ত কালের সুবর্ণমণ্ডিত মেঘমালার মত সারদামঙ্গলের সোনার শ্লোকগুলি বিবিধরূপের আভাস দেয়। কিন্তু কোন রূপকে স্থায়ীভাবে ধারণ করিয়া রাখে না। অথচ সুদূর সৌন্দর্য স্বর্গ হইতে একটি অপূর্ণ পূরবী রাগিণী প্রবাহিত হইয়া অন্তরাত্মাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে থাকে।”[৫] সমালোচক স্যার বলেন,শিশিরকুমার দাশের মতে, “মহাকাব্যের পরাক্রমধারার পাশে সারদামঙ্গল গীতিকাব্যের আবির্ভাব এবং শেষপর্যন্ত গীতিকাব্যের কাছে মহাকাব্যের পরাজয়ের ইতিহাসে সারদামঙ্গল ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ কাব্য। বিহারীলালের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশি নয়, কিন্তু নিজ উদ্যোগে তিনি সংস্কৃত, ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্য অধ্যয়ন করেন এবং অল্প বয়সেই কবিতা লেখা শুরু করেন। তাঁর পূর্বে বাংলা গীতিকবিতার ধারা প্রচলিত থাকলেও এর যথার্থ রূপায়ণ ঘটে তাঁর হাতেই। তিনি বাংলা কাব্যের প্রচলিত ধারার রদবদল ঘটিয়ে নিবিড় অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে গীতিকবিতার প্রবর্তন করেন। এ বিষয়ে তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্য দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হন। তাঁর রচনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য কবিদের প্রভাব থাকলেও নিজস্ব রীতিই ফুটে উঠেছে। বিহারীলাল বস্ত্ততন্ময়তার পরিবর্তে বাংলা কাব্যে আত্মতন্ময়তা প্রবর্তন করেন। বাংলা কবিতায় তিনিই প্রথম কবির অন্তর্জগতের সুর ধ্বনিত করে তোলেন। তাঁর কবিতায় রূপ অপেক্ষা ভাবের প্রাধান্য বেশি। প্রকৃতি ও রোম্যান্টিকতা, সঙ্গীতের উপস্থিতি, সহজ-সরল ভাষা এবং তৎসম ও তদ্ভব শব্দের যুগপৎ ব্যবহার বিহারীলালের কাব্যকে করেছে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তাঁর কবিতার বিষয়-ভাবনা, প্রকাশভঙ্গির অভিনবত্ব, অনুভূতির সূক্ষ্মতা, সৌন্দর্য প্রকাশের চমৎকারিত্ব, ছন্দ-অলঙ্কারের অভূতপূর্ব ব্যবহার অন্যদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পঁয়ত্রিশ বছরের কবিজীবনে বিহারীলাল অনেক গীতিকাব্য ও রূপককাব্য রচনা করেছেন।বিহারীলালের রচনাবলির মধ্যে স্বপ্নদর্শন (১৮৫৮), সঙ্গীতশতক (১৮৬২) বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০), প্রেমপ্রবাহিণী (১৮৭০), নিসর্গসন্দর্শন (১৮৭০), বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০), সারদামঙ্গল (১৮৭৯), নিসর্গসঙ্গীত (১৮৮১), মায়াদেবী (১৮৮২), দেবরাণী (১৮৮২), বাউলবিংশতি (১৮৮৭), সাধের আসন (১৮৮৮-৮৯) এবং ধূমকেতু (১৮৯৯) উল্লেখযোগ্য। নিসর্গসন্দর্শন কাব্যে বিহারীলাল বঙ্গপ্রকৃতির শোভা অপূর্ব ভাব-ভাষা ও ছন্দ-অলঙ্কার প্রয়োগের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন। বঙ্গসুন্দরী কাব্যে কয়েকটি নারী চরিত্রের মাধ্যমে তিনি গৃহচারিণী বঙ্গনারীকে সুন্দরের প্রতীকরূপে বর্ণনা করেছেন। সারদামঙ্গল কাব্য বিহারীলালের শ্রেষ্ঠ রচনা। এটি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের একটি স্তম্ভস্বরূপ। এর মাধ্যমেই তিনি উনিশ শতকের গীতিকবিদের গুরুস্থানীয় হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ এ কাব্যটি পড়ে নানাভাবে প্রভাবিত হয়েছেন এবং বিহারীলালকে আখ্যায়িত করেছেন ‘ভোরের পাখি’ বলে।বিহারীলাল কাব্যচর্চার পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনার কাজও করেছেন। তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা: পূর্ণিমা, সাহিত্য-সংক্রান্তি, অবোধবন্ধু প্রভৃতি। এসব পত্রিকায় অন্যদের রচনার পাশাপাশি তাঁর নিজের রচনাও প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ভারতী, সোমপ্রকাশ, কল্পনা প্রভৃতি পত্রিকায়ও তাঁর রচনা প্রকাশিত হয়েছে। বিহারীলাল ১৮৯৪ সালের ২৪ মে মৃত্যুবরণ করেন।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















[ হিন্দি গদ্যসাহিত্যের দশটি শ্রেষ্ঠ রচনার মধ্যে একেবারে সামনের সারিতে থাকবে শ্রীলাল শুক্ল রচিত “রাগ দরবারী”। এটি স্বাধীনতা পরবর্তী দুইদশকের হিন্দিবলয়ের গ্রামজীবনের স্যাটায়ার । উত্তর প্রদেশের কাল্পনিক গ্রাম শিবপালগঞ্জ আসলে ওই সময় এবং গ্রামজীবনের প্রোটোটাইপ। প্রান্তিক গ্রামে আধুনিক বিকাশের খঞ্জ পদচাপ এবং তার ফলে মূল্যবোধের পতন ধরা পড়েছে এক তেতো হাসির মাধ্যমে। এই অনুবাদে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর অক্ষম প্রচেষ্টায় যদি একজন পাঠকও মূল হিন্দি রচনাটি পড়তে আগ্রহী হন, তাহলে আমার পরিশ্রম সার্থক হবে।] 


অধ্যায়-১

শহরের সীমানা ছাড়িয়ে একটু এগোলেই গ্রাম-ভারতের মহাসাগরের ঢেউ।
ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি ট্রাক। দেখলেই মনে হয় যে শুধু সড়কের সাথে বলাৎকার করার জন্যেই এর জন্ম। সত্যের যেমন নানা রং,এই ট্রাকেরও তেমনি। ওদিক থেকে দেখলে পুলিসের মনে হবে যে ওটা রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। আবার এদিক থেকে দেখলে ড্রাইভার ভাববে যে ও তো রাস্তার একপাশে দাঁড় করানো রয়েছে। চালু ফ্যাশনের হিসেবে ড্রাইভার ওর ডানদিকের দরজাটা খুলে ডানার মত ছড়িয়ে রেখেছে। এতে ট্রাকের সৌন্দর্য নিঃসন্দেহ বেড়ে গে্ছে, আর ওর পাশ কাটিয়ে কোন গাড়ি যে এগিয়ে যাবে তার ভয় ও এড়ানো গেছে।
রাস্তার এক দিকে পেট্রল পাম্প, উল্টো দিকে খাপরা কাঠ আর টিনের পচে যাওয়া টুকরোটাকরা নিয়ে নিজেদের ক্ষমতা অনুযায়ী তৈরি কিছু দোকানের চালাঘর। একবার চোখ বোলালেই বোঝা যায় যে এগুলোকে দোকানের মধ্যে গন্য করা মুশকিল। সবগুলোতে জনগণের প্রিয় একটি পানীয় পাওয়া যায়-- যা কিনা ময়লা কালো চা বানাতে বার কয়েক ব্যবহৃত পাতা আর গরম জলের মিশ্রণ মাত্র। এর মধ্যে বারকোশে কিছু মেঠাই আপনার চোখে পড়বে যেগুলো রাত-দিন ঝড়-ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিপাত ও মশা-মাছির হামলার বাহাদুরের মত মোকাবিলা করে টিঁকে আছে। এগুলো আমাদের দেশি কারিগরের হস্তশিল্প ও বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির নমুনা বটে। এর থেকে বোঝা যাচ্ছে যে যদিও আমরা এখনো ভালো ব্লেড বানাতে পারিনি কিন্তু আবর্জনাকে সুস্বাদু খাদ্য পদার্থে পরিবর্তিত করার দক্ষতা গোটা দুনিয়ায় শুধু আমাদেরই আয়ত্ত্বে।
ট্রাকের ড্রাইভার ও ক্লিনার একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল।
রঙ্গনাথ দূর থেকে ট্রাকটাকে দেখতে পেয়ে জোরে পা চালাতে লাগল। আজ রেলওয়ে ওকে ধোঁকা দিয়েছে। লোক্যাল প্যাসেঞ্জার ট্রেনটাকে ও রোজকার মত দু'ঘন্টা লেট ধরে নিয়ে ঘর থেকে রওনা দিয়েছিল। গিয়ে দেখল সে ব্যাটা আজ মাত্তর দেড় ঘন্টা লেট। নালিশ-বইয়ের কথাসাহিত্যে নিজস্ব যোগদান করে আর রেলওয়ের অফিসারদের চোখে বোকা সেজে ও স্টেশন থেকে বেরিয়ে এসেছিল। রাস্তায় চলতে চলতে ট্রাক দেখতে পেয়ে ওর মন- সেটা শরীরের যে জায়গাতেই থাকুক না- নেচে উঠল।
ট্রাকের কাছে পৌঁছে গিয়ে দেখল ড্রাইভার ও ক্লিনার চায়ের শেষ চুস্কি-চুমুক নিচ্ছে। ও এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের খুশি ঢেকে ড্রাইভারকে একটু নির্বিকার ভাবে জিগাইল,--কি গো ড্রাইভার সাহেব, ট্রাক শিবপালগঞ্জের দিকে যাবে?
ড্রাইভার খাচ্ছিল চা আর দেখছিল চা-ওয়ালিকে; দায়সারা জবাব দিল--যাবে।
" আমাকে সঙ্গে নেবেন? পনের মাইলের মাথায় নেমে যাবো। শিবপালগঞ্জ পর্য্যন্ত ।"
ড্রাইভার এতক্ষণে চা-ওয়ালির মধ্যে নিহিত সমস্ত সম্ভাবনাকে জরিপ করে নিয়েছে। এবার চোখ ফিরেছে রঙ্গনাথের দিকে। আহা! চেহারা বটে! নবকঞ্জলোচন-কঞ্জমুখকর-কঞ্জপদ-কঞ্জারুণম্! মাথায় খদ্দরের টুপি, গায়ে খদ্দরের খদ্দরের পাজামা-পাঞ্জাবী। কাঁধে ঝুলছে বিনোবা ভাবের ভূদানী-ঝোলা। হাতে চামড়ার অ্যাটাচি। ড্রাইভার ওর দিকে অবাক হয়ে দেখতেই থাকল। তারপর কিছু ভেবে বলল-- বসুন শিরিমানজী, এক্ষুণি রওনা দেব।

ঘরঘরিয়ে চলছে ট্রাক। শহরের আঁকাবাঁকা মোড়ের প্যাঁচ থেকে ফুরসত পেয়ে একটু এগোতেই অনেক দূর পর্য্যন্ত জনহীন পরিষ্কার রাস্তা। ড্রাইভার প্রথমবার টপ গিয়ার লাগালো, কিন্তু সেটা পিছলে পিছলে নিউট্রাল হতে শুরু করল। প্রতি একশ'গজ চলতেই গিয়ার পিছলে যায় আর অ্যাকসিলারেটরে চাপ থাকায় গাড়ির ঘর-ঘর আরো বাড়ে।
রঙ্গনাথ বলল," ড্রাইভার সাহেব, তোমার গিয়ার তো একদম দেশের সরকারের মত"।
ড্রাইভার মুচকি হেসে এই সার্টিফিকেট গ্রহণ করল। রঙ্গনাথ ভাবল যে নিজের বক্তব্যটি আরো একটু স্পষ্ট করে দেয়। --" ওকে যতই টপে চড়াও না কেন, দু'গজ যেতে না যেতেই পিছলে ঠিক নিজের পুরনো খাঁচায় ফিরে আসে।"
ড্রাইভার হেসে উঠলো " অনেক বড় কথা বলে দিলেন শিরিমানজী।"
এইবার ও গিয়ার কে টপে নিয়ে নিজের এক পা' প্রায় নব্বই ডিগ্রি কোণে বেঁকিয়ে গিয়ারের জঙ্ঘার নীচে চেপে দিল। রঙ্গনাথ ভাবল যে বলে- দেশ শাসনের স্টাইলও এমনিই হয়। কিন্তু কথাটা বড্ড বেশি বড় হয়ে যাবে ভেবে চুপ করে রইল।

ইতিমধ্যে ড্রাইভার নিজের ঠ্যাংখানা গিয়ারের জঙ্ঘার থেকে সরিয়ে যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।আর গিয়ারের ওপর একটা কাঠের লম্বা টুকরো গুঁজে দিয়ে ওর আর এক মাথা প্যানেলের নীচে ঠুকে দিয়েছে।
ট্রাক দৌড়ুচ্ছে ভীমবেগে। ওটাকে দেখামাত্র সাইকেল-আরোহী, পথচারী, এক্কাগাড়ি সবাই ভয়ের চোটে অনেক দূর থেকেই রাস্তা ছেড়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। ওদের পালানোর স্পীড দেখে মনে হচ্ছে যে ওটা ট্রাক নয়, কোন দাবানল, বঙ্গোপসাগরের ঘুর্ণিঝড়, অথবা পিন্ডারি দস্যুদলের হামলা।
রঙ্গনাথ ভাবছিল যে অনেক আগেই হাঁকা পাড়া উচিৎ ছিল---শোনো গ্রামবাসী ,শোনো! নিজেদের পশু ও বাচ্চাদের ঘরের ভেতর আটকে রাখো। শহর থেকে এক্ষুনি একটা ট্রাক বেরিয়েছে।
এবার ড্রাইভার বলল, " বলুন শিরিমানজী! কী খবর? অনেক দিন পরে গাঁয়ের দিকে যাচ্ছেন।"
রঙ্গনাথ শিষ্টালাপের জবাবে একটু মুচকি হাসলো। ড্রাইভার বললো," শিরিমানজী, আজকাল কি করছেন?"
--"ঘাস কাটছি।"
ড্রাইভার হেসে ফেললো। কপাল খারাপ, একটা ন্যাংটো-পুঁটো বাচ্চা ট্রাকের নীচে চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে গেল আর পাশের নয়ানজুলিতে টিকটিকির মত আছড়ে পড়ল। ড্রাইভার অ্যাকসিলারেটরে চাপ বাড়িয়ে দাঁত বের করে বলল," কি কথাই বল্লেন! একটু খুলে বলুন।"
--" বল্লুম তো, ঘাস কাটছি। একেই ইংরিজিতে রিসার্চ করা বলে। গত বছর এম এ পাশ করেছি, এবছর রিসার্চ শুরু করেছি।"
ড্রাইভার যেন ব্যঙ্গমা-ব্যঙ্গমীর গল্প শুনছে। মুচকি হেসে বললো," তো শিবপালগঞ্জে কি করতে যাচ্ছেন?"
-" ওখানে আমার মামা থাকেন। অসুখে পড়েছিলাম। কিছুদিন গাঁয়ে থেকে শরীর ভাল করে আসব।"
এবার ড্রাইভার অনেকক্ষণ হাসতে থাকলো," কি যে গল্পো বানিয়েছেন শিরিমানজী?"
রঙ্গনাথ ওর দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললো," এর মধ্যে গল্প বানানোর কি হল?"
ড্রাইভার ওর সারল্যে হাসতে হাসতে বিষম খেল। " কি যে বলেন! আচ্ছা, কাটিয়ে দিন ওসব। বলুন, মিত্তাল সাহেবের কি অবস্থা? ওই পুলিশের গারদে খুনের ব্যাপারটা কদ্দূর?"
রঙ্গনাথের রক্ত শুকিয়ে গেছে। শুকনো গলায় বললো," আরে, আমি কি জানি এই মিত্তাল কে?"
ড্রাইভারের হাসিতে ব্রেক লেগে গেছে। ট্রাকের গতি কিছু কমেছে। রঙ্গনাথের দিকে কড়া করে তাকিয়ে ও জিগ্যেস করলো," আপনি মিত্তাল সাহেবকে চেনেন না?"
-" না তো।"
--" আর জৈন সাহেবকে?"
--" একদম না।"
ড্রাইভার এবার ট্রাকের জানলা দিয়ে বাইরে থুতু ফেলে সাদা গলায় বলল," আপনি সি আই ডি বিভাগে কাজ করেন না?"
রঙ্গনাথ এবার ক্ষেপে গিয়ে বলল," সি আই ডি? সেটা কি জিনিস? খায় না মাথায় দেয়?"

ড্রাইভার বেশ জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে সামনে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। ক'টা গরুর গাড়ি যাচ্ছে। একটি জনপ্রিয় থিয়োরি হল যখ্ন যেখানে জায়গা পাবে, ঠ্যাং লম্বা করে দখল নেবে। গাড়োয়ানের দল ওই থিয়োরি মেনে গরুর গাড়ির ওপর মুখ ঢেকে পা লম্বা করে শুয়ে আছে। গরুগুলো নেহাৎ অভ্যেসবশে গাড়িগুলোকে রাস্তা দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এ নিয়েও 'জনগণ-জনার্দন' মার্কা ডায়লগ আছে, কিন্তু রঙ্গনাথের মুখ খোলার সাহস হল না। সি আই ডিওলা কথায় ওর মেজাজ খিঁচড়ে গেছে। ড্রাইভার প্রথমে রবারের হর্ন বাজালো। তারপর এমন একটা হর্ন বাজালো যা সঙ্গীতের আরোহ-অবরোহ সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও বড় ভয়াবহ। কিন্তু গরুর গাড়ি আপন মনে আগের মতই যাচ্ছিল। ড্রাইভার বেশ স্পীডে ট্রাক চালাচ্ছিল, ভাবখানা যেন গাড়িগুলোর ওপর দিয়ে পার করবে। হটাৎ ওর আক্কেল হল যে ও ট্রাক চালাচ্ছে, হেলিকপ্টার নয়। তাই আচমকা ব্রেক কষলো, প্যানেলে ঠুঁসে রাখা কাঠের টুকরোটাকে ফেলে দিয়ে গিয়ার বদলে গরুর গাড়িগুলোকে প্রায় ছুঁয়ে দিয়ে আগে বেরিয়ে গেল। এবার ও ঘেন্নার চোখে রঙ্গনাথের দিকে তাকিয়ে বলল," সি আই ডি না হলে অমন খাদির কাপড় কেন পরেছ?"
এই আচমকা আক্রমণে রঙ্গনাথ হড়বড়িয়ে গেল। কিন্তু এটাকে সামান্য কথাবার্তা ভেবে সহজভাবে বলল," খদ্দর তো আজকাল সবাই পরে।"
--"দূর! কোন ঢঙের লোক এইসব পরে নাকি?" তারপর ও আবার জানলা দিয়ে থুতু ফেলে টপ গিয়ারে গাড়ি চালাতে লাগল।
রঙ্গনাথের পার্সনালিটি কাল্ট শেষ হয়ে গেছল। খানিকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ও ঠোঁট গোল করে সিটি বাজাতে লাগল। ড্রাইভার ওকে কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে বললো-- দেখো জী! চুপচাপ বসে থাকো, এটা সংকীর্তনের জায়গা নয়।"
রঙ্গনাথ চুপ করল। তখন ড্রাইভার বিরক্তির সঙ্গে বলল," এই গিয়ার হতচ্ছাড়া বারবার পিছলে গিয়ে নিউট্রাল হয়ে যাচ্ছে। দেখছ কি? একটু ধরে থাক না!"
পরে আবার চটে গিয়ে বলল, " আরে অমনি করে নয়, এমনি করে! ভালকরে চেপে ধরে বসে থাকো।"
ট্রাকের পেছন থেকে বার বার হর্নের আওয়াজ ভেসে আসছে। রঙ্গনাথ শুনতে পাচ্ছিল, কিন্তু ড্রাইভার না শোনার ভান করছিল। এমন সময় ক্লীনার ঝুলতে ঝুলতে এসে ড্রাইভারের কানের পাশের জানলায় খট খট করতে লাগল। ট্রাকওয়ালাদের ভাষায় এই কোডের নিশ্চিত কোন গূঢ় ভয়ংকর মানে আছে। কারণ, ড্রাইভার তক্ষুণি স্পীড কম করে ট্রাককে বাঁদিকের একটি লেনে চালান করে দিল।
হর্নের আওয়াজ এমন একটি স্টেশন-ওয়াগন থেকে আসছিল যেগুলো আজকাল বিদেশের আশীর্বাদে শ'য়ে শ'য়ে আমাদের দেশের প্রগতির জন্যে আমদানি হচ্ছে। স্টেশন-ওয়াগনটি ডানদিক দিয়ে এগিয়ে গিয়ে স্লো হয়ে একপাশে থামছিল। ওর থেকে বেরিয়ে আসা একটি খাকি হাত ট্রাককে থামতে ইশারা করল। এবার দুটো গাড়িই থেমে গেল।
স্টেশন-ওয়াগন থেকে নামল একজন অফিসারের মত দেখতে চাপরাশি আর চাপরাশির মত দেখতে এক অফিসার। খাকি পোশাকে গোটা দুই সেপাই ও নেমে পড়েছে। দলটা এসেই পিন্ডারী-দস্যুদের মত লুটপাট শুরু করে দিয়েছে। কেউ কেড়ে নিয়েছে ড্রাইভারের ড্রাইভিং লাইসেন্স, তো কেউ নিয়েছে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন কার্ড।কেউ ব্যাক-ভিউ মিররের নড়া ধরে নেড়ে দেখছে , তো কেউ ট্রাকের হর্ন বাজিয়ে দেখছে। তারপর এরা ব্রেক দেখল, ফুটবোর্ড নাড়িয়ে দেখল, লাইট জ্বালালো, ব্যাক করার সময় যে ঘন্টি বাজে তাও বাজালো। ওরা যা নেড়েচেড়ে দেখল তাই খারাপ। যেটাকে ছুঁলো সেটাই বিগড়ে গেল। এই ভাবে চারজনের দলটি চারমিনিটে প্রায় চল্লিশটি দোষ খুঁজে বের করল। তারপর একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ডিবেট শুরু করল যে এই শত্রুর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করা উচিৎ?
রঙ্গনাথ বুঝে গেল যে এই দুনিয়ায় কর্মফলের সিদ্ধান্ত, 'পোয়েটিক জাস্টিস' আদি গল্প--সব সত্যি। এখন ট্রাকের চেকিং হচ্ছে -মানে ওকে অপমান করার জন্যে ভগবান ড্রাইভারকে শাস্তি দিচ্ছে, হাতে হাতে । ও নিজের সীটে বসেছিল। এক ফাঁকে ড্রাইভার ওকে বললো--"শিরিমানজী, একটু নীচে নেমে আসুন। এখন আর গিয়ার ধরে বসে থেকে কি লাভ?"
রঙ্গনাথ নীচে নেমে অন্য একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রইল। ওদিকে ড্রাইভার আর চেকিং স্কোয়াড ট্রাকের এক-একটা পার্টস্‌ নিয়ে তর্ক জুড়েছে। দেখতে দেখতে তর্ক ট্রাক ছেড়ে দেশের পরিস্থিতি ও আর্থিক দুরবস্থা পর্য্যন্ত পৌঁছে গেল। আর একটু পরেই ওখানে উপস্থিত জনগণের মধ্যে ছোট ছোট সাব-কমিটি তৈরি হয়ে গেল। তারা আলাদা আলাদা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে এক একটি বিষয় নিয়ে এক্স্পার্ট ওপিনিয়ন দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনেক তর্ক-বিতর্কের পরে সবাই মিলে একটি গাছের নীচে ওপেন সেশন শুরু করে দিল। আর একটু পরে বোঝা গেল সবার দম ফুরিয়ে এসেছে, সেমিনার সমাপ্ত প্রায়।
সব শেষে রঙ্গনাথের কানে এল অফিসারের মিনমিনে কন্ঠস্বরঃ
-- কি গো মিয়াঁ আশরফ, কি ভাবছ? ছেড়েই দিই?
চাপরাশি বলল,-- আর কি করবেন হুজুর! কহাঁ তক চালান-টালান বানাতে থাকবেন? এক-আধটা ভুলচুক হলে না হয় চালান করতেন?
এক সেপাই বলল,-- চার্জশীট ভরতে ভরতে রাত কাবার হয়ে যাবে।
কিছু আশকথা-পাশকথার পর অফিসারটি বলল,--- যা ব্যাটা বন্টা সিং, তোকে এবার মাপ করে দিলাম।
ড্রাইভার খোশামুদে স্বরে বললো-- এটা শুধু শিরিমানজী বলেই করতে পারলেন।
অফিসার অনেকক্ষণ ধরে দূরে একটি গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা রঙ্গনাথকে দেখছিলেন। কাছে এসে বল্লেন," আপনিও এই ট্রাকে চড়ে যাত্রা করছেন?"
--আজ্ঞে হ্যাঁ।
--- কোন ভাড়া-টাড়া দেন নি তো?
-- আজ্ঞে না।
- - সে আপনার পোশাক দেখেই বুঝেছি। তবু জিগ্যেস করা আমার কর্তব্য।
রঙ্গনাথ ওকে একটু খ্যাপাবার জন্যে বলল,-- এটা আসল খদ্দর ভেবেছেন নাকি? এতো মিলে তৈরি খাদি।
কিন্তু অফিসারটি বেশ শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, " খাদি খাদিই হয়, তার আর আসল-নকল!
অফিসার চলে যেতেই চাপরাশি আর ড্রাইভার রঙ্গনাথের কাছে এল। ড্রাইভার বলল, "দুটো টাকা বের কর দিকি!"
ও মুখ ঘুরিয়ে কড়া সুরে বলল," ব্যাপারটা কি? আমি কেন টাকা দিতে যাব?"
ড্রাইভার তখন চাপরাশির হাত ধরে বলল," আসুন শিরিমানজি, আমার সঙ্গে এদিকে আসুন।" যেতে যেতে ও রঙ্গনাথকে শুনিয়ে দিল," তোমার জন্যেই আমার চেকিং হল, আর আমার বিপদের সময় তুমিই এমন ব্যভার করলে? এই লেখাপড়া শিখেছ?"
বর্তমান শিক্ষা-পদ্ধতি হল রাস্তায় শুয়ে থাকা কুকুরের মত, যার ইচ্ছে দুটো লাথি মেরে যাবে। ড্রাইভারও যেতে যেতে ওর ওপর দুটো ডায়লগ ঝেড়ে চাপরাশির সঙ্গে ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেল।
রঙ্গনাথ দেখল--- সন্ধ্যে নেমে আসছে, ওর অ্যাটাচি ট্রাকে তোলা রয়েছে, শিবপালগঞ্জ এখনো মাইল পাঁচেক হবে, ফলে ওর এখন মানুষের সহানুভূতির একান্ত দরকার। ও ধীরে ধীরে ট্রাকের দিকে এগিয়ে গেল। এদিকে স্টেশন-ওয়াগনের ড্রাইভার বার বার হর্ন বাজিয়ে চাপরাশিকে তাড়া দিচ্ছে। রঙ্গনাথ ড্রাইভারকে দুটো টাকা দিতে চাইল। ও বলল," যদি দেবেই তো আর্দালি সাহেবকে দাও। আমি তোমার টাকা নিয়ে কি করব?"
বলতে বলতে ওর গলার স্বরে সেই সব সন্ন্যাসীর প্রত্যয় এসে গেল, যাঁরা কারো পয়সা নিজের হাতে ছুঁয়ে দেখেন না, শুধু অন্যদের বলতে থাকেন- আরে, তোমার পয়সা তো হাতের ময়লা মাত্র। চাপরাশি টাকা ট্যাঁকে গুঁজে বিড়ির সুখটান দিয়ে ওটার আধজ্বলা টুকরোটা প্রায় রঙ্গনাথের পাজামার ওপর ছুঁড়ে ফেলে সটান স্টেশন-ওয়াগনের দিকে চলে গেল। ওরা রওনা হয়ে গেলে ড্রাইভারও স্টার্ট দিল আর আগের মত টপ গিয়ারে গিয়ে রঙ্গনাথের হাতে ধরিয়ে দিল। তারপর কী জানি কী ভেবে মুখ ছুঁচলো করে শিস দিয়ে সিনেমার গানের সুর ভাঁজতে লাগল। রঙ্গনাথ চুপচাপ শুনছিল।

রাস্তার দুপাশে ধোঁয়া ধোঁয়া অস্পষ্টতার মাঝে কিছু যেন কাপড়ের গাঁঠরি মতন দেখা যাচ্ছে। এরা হল গাঁয়ের মেয়েছেলের দল, লাইন বেঁধে রাস্তার দুপাশে বসে আছে। এরা নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে বসে বাক্যালাপ চালিয়ে যাচ্ছে, হাওয়া খাচ্ছে আর হয়ে যায় তো মলমূত্র ত্যাগও করছে। রাস্তার নীচে নোংরা ছড়িয়ে আছে আর তার দুর্গন্ধের ভারে সন্ধ্যের হাওয়াও কোন গর্ভবতী নারীর মতন আলস্যভরা চালে বয়ে চলেছে। একটু দূর থেকে কুকুরের খ্যাঁক-খ্যাঁক শোনা যাচ্ছে। চোখের সামনে ধোঁয়ার একটি জাল ছড়িয়ে পড়ছে। কোন সন্দেহ নেই যে আমরা একটি গাঁয়ের সীমানায় এসে পড়েছি। হ্যাঁ, এটাই শিবপালগঞ্জ।

ক্রমশ

0 comments: