0

সম্পাদকীয়

Posted in





































সম্পাদকীয়


ধর্মপত্নী হবে নারী?
শ্রেষ্ঠ কবিতা হবো
যুগপৎ সঙ্গম শয্যায়...

ধন্য বাঙালি! গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর প্রকোপে প্রাণ অতীষ্ঠ। তবুও বাঙালি তার প্রিয় নারীর মুখশ্রীতে খোঁজে সহস্র বছরের ভাষ্কর্য, বিচারে বসে ওষ্ঠচাপা হাসির ণত্বষত্ব ব্যাকরণ নিয়ে, বয়ঃসন্ধি রসায়নে আদর তন্দ্রার জন্মবীজ আহরণে নিষ্ঠ হয়! বাঙালি এমনই। 

প্রসঙ্গক্রমে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর কথা যখন উঠেই পড়লো, তখন এ বিষয়ে একটি ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট অফ ভিউ আপনাদের সঙ্গে শেয়ার না করে পারছি না। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আমরা সকলেই জানি, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বিশ্ব উষ্ণায়নের মূল কারণ দূষণ তথা গ্রীনহাউস এফেক্ট - যার ফলে প্রতিনিয়ত পৃথিবীর সামগ্রিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে, মেরু অঞ্চলের বরফ গলে যাবে, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাবে এবং অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ পৃথিবী তথা মানব সভ্যতা সময়ের বহু আগে ধ্বংস হবে। 

এই পুরো ডিক্লারেশনটার মধ্যে কেমন যেন একটা "যেমন পাপ করেছিস, তেমন ফল ভোগ" - বা "দেখ কেমন লাগে" - গোছের বার্তা লুকিয়ে রয়েছে। প্রকৃত ঘটনাটি কি, একবার তথ্য-পরিসংখ্যানে চোখ বুলিয়ে দেখা যাক। 

বিশ্ব উষ্ণায়নের মূল কারণ গ্রীনহাউস গ্যাসের প্রতিক্রিয়ায় দূষিত হয় জলীয় বাষ্প ৩৬%, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ৯%, মিথেন ৪%, ওজোন ৩% (ন্যুনতম)। তার মানে, সাকুল্যে ৫২% দায় মানুষের। তাহলে বাকি দায় কার? শুনলে অবাক হবেন, বাকি দায় প্রকৃতির নিজের। 

আসুন, পৃথিবীর ইতিহাসের দিকে একবার ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি। মনে রাখবেন, আমরা মানব সভ্যতার ইতিহাস দেখতে চাইছি না, দেখতে চাইছি পৃথিবীর ইতিহাস। আজ থেকে আনুমানিক ১৫/২০ কোটি বছর আগে, ডাইনোসররা তখনও পৃথিবীর বুকে রাজত্ব করছে দাপটে। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা এখনকার তুলনায় ১২ গুণ বেশী, পৃথিবীর সামগ্রিক তাপমাত্রা এখনকার তুলনার কয়েক গুণ বেশী, মেরু প্রদেশে নেই বরফ, সমুদ্রের উচ্চতাও এখনকার তুলনায় ১০০ থেকে ২৫০ মিটার উঁচু।

তাহলে? তাহলে বিষয়টা হলো এই যে, পৃথিবীর তাপমাত্রা হ্রাস বা বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হলো সোলার ভ্যারিয়েশন বা সূর্যের তাপমাত্রার হ্রাস বা বৃদ্ধি, যা মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। আসলে বলতে বাধ্য হচ্ছি, বিশ্ব উষ্ণায়ন এখন নিজেই একটা সিস্টেম ও ইন্ডাস্ট্রি এবং আধুনিক পপ কালচারের একটা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গও বটে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ন্ত্রণের যে গাইড লাইন দেওয়া হচ্ছে, তা স্রেফ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রপাগান্ডা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর পিছনে পুরোদমে কাজ করছে বিশ্বরাজনীতির একটা নোংরা চক্র যার টিকিটি বাধা আছে অর্থ নামক এক অনর্থের কোল আঁচলে। 

এমতাবস্থায়, প্রাকৃতিক সম্পদকে যথেচ্ছ নষ্ট না করে যত্ন করে কিপটের মতো রেখে রেখে ব্যবহার করা, আর সম্পদগুলির পুনঃপ্রতিস্থাপন (সৌরশক্তি, জল, বন ও বায়ু সম্পদ, মূলত)করা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার আছে বলে মনে হয় না। 

তাই, বাঙালি যা করছে, ঠিক করছে। তাইই করা উচিৎ। নিজের বসতবাটি সামলাও আর সাহিত্য করো।

শুভেচ্ছা নিরন্তর


তথ্য- গুগলমামা

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রচ্ছদ নিবন্ধ


ফকিরাণি কথা (প্রথম পর্ব) 
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায় 


বাউলানিদের কথা যখন হামেশাই হয়, তখন একটু ফকিরাণিদের কথাও হোক। কিন্তু সেকথা বলতে গেলে আগে গোড়ার দু/চার কথা বলা প্রয়োজন। সত্যি কথা বলতে কি, বাউল সাধনা করেন এমন এক বাউলের আশ্রমে আমার দেখা হয়েছিল মুর্শিদাবাদ থেকে আসা লালবাবার সঙ্গে। তিনি সাহেবধনী সম্প্রদায়ের মানুষ। দোল উৎসবে গেছি সেই আশ্রমে, অনেকে এসেছেন সেখানে। বয়স্ক, বৃদ্ধ লাল টুকটুকে আপেলের মতো মানুষটি আমায় বলেছিলেন—মা রাধারাণী, মেয়ে বাউল খুঁজে বেড়াচ্ছিস, আমাদের ওখেনে যা, কত মেয়ে বাউল, মেয়ে ফকির দেখতে পাবি। ওদের চেনার লোক কম রে মা, পারিস যদি...তবেই বুঝব!’ বলেই যে হাসিটি হাসলেন, সে অমূল্য। 

বাউল-ফকিরদের আড্ডায়, আখড়ায়, আশ্রমে কত রকম কথার যে চাষ! আর কি মিষ্টি করেই যে তাঁরা কথা বলতে পারেন! আগে সেকথাই হোক, এ তো আর রেলের গাড়ি নয়, যে ঠিক সময়ে ইস্টিশনে গাড়ি থামতে হবে! এ হলো গালগল্প, একটু এদিক/ওদিক হলেই ক্ষতি কি বাপু, দুটো কথা নাহয় বলেই যাই। 

যে আশ্রমে গিয়েছিলুম, সেই আশ্রমের মূল মানুষটিকে সকলে গুরুজি বলে ডাকেন, দেখাদেখি আমিও তাই। একদিন সকালের দিকে গুরুজির কাছে গেছি, গিয়ে দেখি গেরুয়া ধুতি, চাদর, মাথায় গেরুয়া টুপি পরা এক সাধু বসে আছেন গুরুজির পাশে। গুরুজি আমায় ডেকে পরিচয় করিয়ে দিলেন---এ হলো পরমানন্দ আশ্রমের সাধুজি, তুই চিনিস না। এর সঙ্গে আমার বড় প্রেম গো’। আহা...এভাবে কেউ বলতে পারে নাকি, এর সঙ্গে আমার বড় প্রেম! বুকের মধ্যে কেমন যেন ধ্বকধ্বক করে উঠল। কই, আমি তো বলতে পারি নে, কার সঙ্গে আমার প্রেম! বলতে আর পারলুম কই, এ জীবনে? আর এমন উদার ভাবে আমরা কাউকে গ্রহণ করতেই কি পারি? জানি না, একটু হয়ত কথা শুনে অন্যমনস্ক হয়েছিলুম, গুরুজি আমায় হাঁক দিলেন—ওরে, তোদের সেই সিনেমার গান আছে না...তুমি দেখ নারী-পুরুষ/ আমি দেখি শুধুই মানুষ’। যেদিন সেটা পারবি, সেদিন বুঝবি তুই মানুষ হলি।‘ বুঝলুম, সাধুবাবা আর গুরুজি আলাদা পথের পথিক, তবু তারা একে অপরের গুণমুগ্ধ, সেখানে ধর্মের কোনও বিভেদ নেই, পথের কোনও বিভেদ নেই, মানুষে মানুষে কোনও বিভেদ নেই। গুরুজী তাঁর কাছে কাজের কথা আশ্রমের কথা, সুবিধে-অসুবিধের কথা বলেন, বলেন স্বামীজিও। তারপর দুজনে খানিক গল্প গুজব করে আবার যে যার কাজে চলে যান। কোথাও কোনও মলিনতা নেই, কোনও বিরোধ নেই,উজ্জ্বল অন্তর আলোর মতো। 

হচ্ছিল আশ্রমের গানের কথা, এসে পড়লেন সাধুবাবা। যে কথা বলছিলেম, সেই আশ্রমেরই এক দোল উৎসবের সময় আমার দেখা লালবাবার সঙ্গে, আবার আমার আলাপ হলো সেদিনই বাউল-ফকিরদের বন্ধু শক্তিনাথ ঝা মশাইয়ের সঙ্গেও। একটু খুলে বলি। কদিন ধরেই আশ্রমে যাচ্ছি, এটা সেটা নিয়ে গুরুজিকে প্রশ্ন করছি, বিরক্ত করছি। সেদিন শক্তিনাথ ঝা মশাইয়ের সঙ্গে উনি আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন, উনিও এসেছিলেন গুরুজীর উৎসবে। গুরুজি তাঁকে বললেন—এই যে এই মেয়েটা খালি এখান-সেখান যেতে চায়, জানতে চায়। আপনি পড়াশোনা জানা মানুষ, দেখুন তো এটাকে’ বলেই আমাকে ঠেলে দেবার ভঙ্গি করে বললেন—যা’। আমি অল্প হেসে গুরুজীর দিকে তাকিয়ে বললুম—জয়গুরু! গুরুজি হেসে ফেললেন—যা, আর আমাকে জ্বালাস না।‘ 

বসলুম শক্তিনাথ বাবুর কাছে। সেই একদিনের কয়েকঘন্টার সুবাদে তিনি আজও আমার মাষ্টারমশাই। আমি খুব সামান্য বাউলানি-ফকিরাণিদের কথা জানি, জানি না বলাই সমীচীন, খুব সামান্যই তাঁদের জগতকে দেখেছি; অনুভবও আমার অতি সামান্য, তবু যদি কিছু পূর্বজন্মের করুণা আমার উপর থাকে, তাহলে সুধীরবাবু এবং শক্তিনাথ বাবুর মতো শিক্ষক পাওয়াই আমার জীবনে পরম প্রাপ্তি। তাঁরা দুজনেই আমার প্রথাগত শিক্ষক নন। সুধীরবাবুর সঙ্গে পরে যদিও বা কয়েকবার দেখা হয়েছে,শক্তিনাথবাবুর সঙ্গে আমার দেখা সেই একবারই। আমি নিশ্চিত, তিনি তাঁর কয়েকঘন্টার ছাত্রীটিকে মনে করতে পারবেন না, সম্ভবও নয়। তবু তাঁর কথাতেই আমি ফকিরাণিদের নিয়ে আগ্রহী হয়েছিলাম। তিনিই আমায় উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন—অন্ত্যজ মানুষদের নিয়ে কাজ কর, বাউল-ফকিরদের নিয়ে কাজ করতে চাইলে, মেয়েদের নিয়ে কর। ওরা পুরুষদের কাছে মুখ খুলে কথা বলতে পারে না, একজন নারীর পক্ষে সে কাজ করাও অনেক সুবিধেজনক। আর ঘুরে ঘুরে, মাঠে নেমে কাজ কর, যত পারো ওদের দেখো, সঙ্গ করো, নইলে চিনবে কি করে! মহিলা ফকিরদের নিয়ে কোনও কাজই হয়নি, যদি একটা পাতাও তুমি ওদের নিয়ে লিখতে পারো, জানবে তুমি পেরেছ। শুরু করো।‘ 

ঠিক সেই লোভে যে কাজ করতে শুরু করেছি তা নয়। এ তো আর এসি বার্থ রিজার্ভ করে বেড়াতে যাওয়া নয়, এ কাজ কত যে কঠিন, কত রকমের সমস্যার, বিরক্তিরও সম্মুখীন হতে হয়, যারা এই কাজে রত তারাই জানেন। এই নিয়ে একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা একটু বলে নিই। এক জায়গায় এক মহিলা ফকিরের সন্ধান দিলেন একজন। তিনি নাকি খুব সাধনা করেন, সব কিছু বলে দিতে পারেন, তাঁর এমন ক্ষমতা। সব সময় হাতে তসবি নিয়ে মালা ঘোরাচ্ছেন। কম কথা বলেন। তাঁর কাছে গেলে হয়ত ফকিরাণিদের সম্বন্ধে কিছু জানা যাবে। 

গেলুম, যা অভিজ্ঞতা হলো সে আর বলার নয়। মহিলার সঙ্গে একজন ভদ্রলোকও ছিলেন, তাঁর স্বামী কিনা জানি না। ফকিরাণিদের কি স্বামী থাকে? তখনও বিশেষ কিছুই জানি না, তেমন করে খোঁজখবর করাও হয়নি। মহিলার চেয়ে দেখলুম সেই ভদ্রলোকই বেশী কথা বলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমার অসুবিধেটা কি?
--আমার তো কোনও অসুবিধে নেই।‘ 

তিনি ঠিক কি অসুবিধের কথা বলছেন, তাও বুঝলাম না। এবার লোকটি সেই মহিলাকে ইশারা করলেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন---আমার কি স্বামীর সঙ্গে কোনওরকম বনিবনার অভাব? আমি কি সেজন্য ওনাদের কাছে এসেছি? 

আমি অবাক! বললুম-- না, আমার সে অসুবিধের কথা নয়,আমি তো সেজন্য আসিনি! আমি মহিলা ফকির দের সম্বন্ধে জানতে এসেছি। একজনের কাছে এনার সংবাদ পেলুম’ বলে মহিলাটিকে দেখাই। 

ভদ্রলোক আবার বললেন—স্বামী কি অন্য নারীতে আসক্ত? স্বামীর সঙ্গে বোঝাপড়া না থাকলে ঠিক করে দেওয়া যায়, এসব আমাদের কাছে কিছু নয়। কিন্তু কিছু টাকা-পয়সা লাগবে, জলপড়া এসব তো আছে... বুঝতেই তো পারেন, তার ওপর ধরুন কবজ, তাবিজ এসব নিতে গেলে...’ মাঝপথে উঠে পড়ি। আর কোনও কথা নয়। এ অভিজ্ঞতা আরও হয়েছে। 

একজন মহিলার সাংসারিক, পারিবারিক বৃত্তের বাইরে এসে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে যে কতরকমের অসুবিধে, যারা যান তারাই বোঝেন ভালো। কত রকমের যে দায় দায়িত্ব! সত্যি কথা বলতে কি, অনেক সময় সেসব দায়-দায়িত্ব এড়ানোও যায় না। মা হয়েছি, সন্তানের পাশে থাকা, স্বামীর প্রয়োজনে বাড়িতে থাকা, বৃদ্ধশ্বশুরমশাইকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া এমন সব হাজারো কাজের পরিধি থেকে বেরিয়ে যেতে অনেক সময়ই পারিনি। যা করা যেত, তার অনেক বাকি, করতে আর পারলুম কই? 

শুধু ঘুরে বেড়ানোর ফলে হয়েছে ঘোরার নেশা, হয়েছে মানুষ দেখার নেশা। মানুষকে কাছ থেকে জানতে, চিনতে তাই তো এত ভালো লাগে...! 

ফকিরাণি সম্বন্ধে বলতে গেলে নারী সাধনার দিকটির কথা আগে একটু বলতে হয়। সেই প্রসঙ্গেই আসি। 

বিভিন্ন লৌকিক ধর্মগুলিতে নারীর অংশগ্রহণ সাদরে গৃহীত এবং নারীকে সিদ্ধিদাত্রী বলেও মনে করা হয়। নারীই সেখানে প্রকৃত গুরু। কিন্তু বাউল,সহজিয়া তন্ত্রবাদ প্রভৃতিতে সেকথা স্বীকার করলেও জনমানসে এর প্রতিক্রিয়া বিপরীত। আবার যেভাবে বাউলানি-বৈষ্ণবীদের (এখানে উভয়কেই বাউলানি নাম দিয়েছি)দেখা যায় প্রকাশ্যে আচার বা ধর্মপালন করতে, মহিলা ফকির কিংবা ফকিরাণিদের তেমন দেখা যায় না। সামাজিক বিধিনিষেধের ভয়ে তাঁরা হয়ত তা পারেন না। কিন্তু একটা কথা ভেবে অবাক হই, ভগবত প্রেম,সঙ্গীত প্রেম কিংবা মানবপ্রেম যাইই হোক, তাঁদের কারো মধ্যে জেগে ওঠে না, তা কি হতে পারে! এ তো বিশ্বাস যোগ্য নয়। যদিও ফকিরাণিদের নিয়ে আলোচনা করার আগে জানা দরকার ইসলাম মতে এই সাধনা কতখানি বিধিসম্মত(কিংবা বিধিসম্মত নয়)। তারও আগে জানা দরকার ‘ফকির’, ফিকির’ বা ‘ফকিরাণি’ শব্দগুলির অর্থ। এই আলোচনার শুরু কিন্তু সুফীবাদ দিয়ে। 

হজরতের জীবদ্দশাতেই সুফীবাদের শুরু। এই মতবাদের মূল কথাই হলো প্রেম, প্রেমই ধর্ম। স্রষ্টা ও সৃষ্টির মিলনই হলো প্রেম। সুফী সাধকের প্রেমের গুরু হলেন তাঁর পির বা মুরশিদ। গুরু, পির কিংবা মুরশিদের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া সুফীসাধকের সাধনা সম্ভব নয়। অর্থাৎ আমরা বাউলে যেমন বলি শিক্ষাগুরু, দীক্ষাগুরু, এও তাই। মুরশিদই হলেন বাহ্যিক ও আত্মিক গুরু। সুফীরা এদেশে এসে নানা জনহিতকর কাজ, অলৌকিক কার্যকলাপ ইত্যাদির কারণে সাধারণ জনগন কিছুটা ভয় পেতেন কিন্তু সমাজের নিম্নস্তরের মানুষগুলি তাঁদের কল্যাণমূলক কাজের জন্য অনেককেই শ্রদ্ধার আসনে বসেছিলেন। ক্রমে ক্রমে বাউল, সহজিয়াদের সঙ্গেও সুফীদের সংমিশ্রণ শুরু হয়। সমাজে অবহেলিত, অত্যাচারিত নিম্নবর্গের মানুষগুলি ক্রমশঃ সুফীবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়,কখনও বা একত্রে বসবাস করতে থাকে। অত্যাচারিত মানুষগুলি সুফীদের দ্বারা উপকৃতও হতে থাকে। এইসব সমাজের নারীরাও সুফীদের কাছে অপাংক্তেয় ছিলেন না, সুফীরা তাদের গ্রহণ করেছিলেন সহজেই। অনেকের সঙ্গেই তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধও হয়েছিলেন। ফলে সুফীদের সঙ্গে এইসব সমাজের মানুষদের একটা সামাজিক মিলমিশ শুরু হয়। সামাজিক মিলমিশের কাছে ধর্ম বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনই। কিন্তু বাউল-সহজিয়া সম্প্রদায়ে যেভাবে আমরা তাদের সমাজের নারীদের প্রকাশ্যে দেখি, সেকালে কিংবা একালে কোনও সময়েই মুসলিম সমাজের নারীদের তা দেখা যায়নি, দেখা গেল না। এখন প্রশ্ন হলো, তাহলে আমরা কাদের বলব ফকিরাণি? 

বৈষ্ণব সমাজে একজন বৈষ্ণবের স্ত্রীকে বৈষ্ণবী আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। অনেক সময় ভ্রাম্যমান ভিক্ষাজীবি গায়িকাকেও আমরা বৈষ্ণবী বলে থাকি। তেমনই ভিক্ষাজীবি মুসলিম নারীও থাকতে পারেন, যাদের আমরা ফকিরাণি বলতে পারি। বাউলানিদের মধ্যে গোঁসাই মায়ের মতো শিক্ষা, দীক্ষা দেওয়াও এদের কাজ হতে পারে। শিক্ষা ও দীক্ষা দেওয়া নারীরা কিন্তু ‘ফকিরি’ নারী, যারা নিজেরাও প্রকাশ্যে ’ফকিরি’ আচরণ করেন। শব্দটির অর্থ—সর্বত্যাগী বা সন্ন্যাসীনি /সন্ন্যাসী। তাহলে ফকিরাণি বলতে আমরা ভিক্ষাজীবি মুসলিম নারী, ফকিরি নারী এবং ফকিরদের স্ত্রী—এই তিনজনকেই বলতে পারি। 

‘ফিকিরি’ কথার অর্থ চিন্তা, যদিও বেশীর ভাগ সময় চালাকি বা ধান্দা অর্থে ব্যবহৃত হয়। এর সঙ্গে ‘ফকিরাণির‘ কোনও সম্পর্ক নেই। মুসলিম সমাজে এই সন্ন্যাসিনী, সর্বত্যাগী নারীদের কোনও স্থান নেই,কারণ ইসলাম ধর্মে বৈরাগ্যের কোনও স্থান নেই। তার অর্থ এই নয় যে, এইধর্মে ভগবত চিন্তার কোনও স্থান নেই। এর অর্থ মুসলিম সমাজে গৃহধর্ম বাদ দিয়ে ঈশ্বরের আরাধনা নয়। যেহেতু ইসলাম শরিয়ত আইন কঠোর ভাবে মেনে চলে, তাই এই ধর্মে বিশেষতঃ নারীদের পক্ষে ‘ফকিরি’ নেওয়া সম্ভব নয়। 

শক্তিনাথ বাবুর ফকিরাণি সম্বন্ধে যা বলেছিলেন, মাঝে মাঝেই সেকথা মনে পড়ে। তাই যেসব মুসলিম বন্ধুবান্ধব আছেন, তাদের কাছেই প্রথম খোঁজ খবর নিতে শুরু করলুম। সত্যি কথা বলতে কি,আমার এই সব বন্ধুরা বইপত্র দিয়ে, তাঁদের নিজস্ব ধর্মীয় জ্ঞান দিয়ে, মৌলবীর কাছে নিয়ে গিয়ে এমনি সব নানাভাবে সাহায্য করেছেন আমায়। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ। দারুণ আবার নিদারুণ অভিজ্ঞতাও হয়েছে কত সময়। তেমনই একটি শুরুর অভিজ্ঞতা বলি। 

বাড়ি থেকে কিছু দুরেই এক মাজার আছে। সন্ধ্যার সময় ঐ দিক দিয়ে গেলে দেখতে পাই,অনেক লোক সেখানে সন্ধ্যেবেলায় বাতি জ্বেলে দিয়ে যান, ধুপ জ্বেলে দিয়ে যান। ভিতরে আমিও গেছি। সুন্দর পরিবেশ, মনকে টানে। সেই মাজারে একবার ‘উরস’ উৎসবের খোঁজ মিলল। মুসলিম এক বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে যাবার কথা ব্যক্ত করলুম। ইনিই খোঁজটি দিয়েছিলেন আগে। আমি কেন যেতে চাই, বন্ধুটি জানেন। এই উৎসবে এক ফকিরাণি আসবেন, কথা বলবেন, গান গাইবেন, বন্ধুটিই জানিয়েছেন। অধীর আগ্রহ নিয়ে সেই দিনটির দিকে তাকিয়ে আছি। বন্ধুটী হাসি হাসি মুখে আমায় যে ইঙ্গিত করলেন, তার একটিই অর্থ--এত আগ্রহ নিয়ে যেন না যাই, প্রশ্নের উত্তর তো না মিলতেও পারে! আমিও নাছোড়, যাবই। কিছু তো মিলবে! 

ধারণা হয়েছিল, বাউলানিদের মতো গেরুয়া কিংবা সাদা, কিংবা মুশকিল আসান পীরের মতো কালো যে কোনও একরঙা কোনও পোশাকে ফকিরাণিকে দেখব। না, ইনি একেবারে সাধারণ গৃহবধূ। চোখে চশমা, বয়স মধ্যচল্লিশ। পরণে ছাপা শাড়ি, মাথায় ঘোমটা। স্বামীর সঙ্গে এসেছেন। তিনিই সব জায়গায় নিয়ে যান সঙ্গে করে। তখনও কিছুই জানি না। যা দেখি, তাই অবাক লাগে। গান বাজনা হলো। কিছু পাঠপর্বও চলল। অনেক মানুষজন এসেছেন। খাওয়া দাওয়ারও বিরাট পর্ব চলছে সেখানে। যারা এসেছেন, সকলের জন্যই ব্যবস্থা হয়েছে। ফকিরাণি নিজেও কিছু কিছু তদারক করছেন।এত সবের মাঝে আমি তাঁকে একা পাওয়ার জন্য ছটফট করছি। বন্ধুটিকে বললাম সেকথা। তিনি তাঁকে গিয়ে কি বললেন জানিনা, মহিলা খুব হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। এটা সেটা কথা হলো। স্বামীটিও ফকিরাণিকে আমার কাছে আসতে দেখে তাড়াতাড়ি চলে এলেন, আমাদের কাছেই বসলেন। তাঁকে সকলে ডাকেন ফকিরণ মা বলে। অর্থাৎ গোঁসাই মা আমরা যেমন বলি, তেমন আর কি! আমিও সকলের দেখাদেখি সেই সম্বোধনই করলাম। প্রশ্ন করি, কিরকম এই মারফতি জীবন, তিনি কিভাবে এই আচরণ করেন, তিনি কি তাহলে শরিয়তি নিয়ম মানেন না? কারণ ইসলামে তো গৃহধর্ম ছাড়া বৈরাগ্যের অনুমতি নেই, তাহলে? তিনি কি প্রকাশ্যে শিক্ষা, দীক্ষা দেন? তা কি ধরণের...। আমার জানার, কৌতূহলের সীমা নেই। একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছি। ফকিরণ মা তাঁর স্বামীর দিকে একবার তাকিয়ে আমার হাতখানা নিজের হাতে নিয়ে বললেন---রাত্রিবেলা আগে স্বামীকে সন্তুষ্ট করবে।‘ স্পষ্ট যৌন ইঙ্গিত। আবার বললেন—তাঁর সন্তুষ্টিতেই সব। স্বামী ভালোমতো সন্তুষ্ট হলে তারপর শুদ্ধ কাপড়ে ছাদে গিয়ে আরাধনা করবে, আমি তো তোমাদের কালীর আরাধনাও করি...’ বুঝলাম, যতই ফকিরণ মা হোন আর যাই হোন, গার্হ্যস্থ জীবনকে বাদ দিয়ে শুধু মারফতি জীবন এদের সমাজে বোধহয় সম্ভব নয়। আর একদিন কি তিনি আমায় সময় দেবেন? মারফতি জগত সম্বন্ধে তাঁর কি ধারণা জানার ইচ্ছে ছিল। কথার মাঝখানেই বলে উঠলেন, যাই করো...স্বামী না বললে কিছুই করা যাবে না...আগে তাঁকে সন্তুষ্ট...  

— তাহলে রাবেয়া বশরী, তিনি কি করে মারফতি জগতে যেতে পারলেন? উত্তর দিলেন না। স্বামী কিছু একটা বলার চেষ্টা করলেন, আমিও আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম...কিন্তু উত্তর এলো না। আমার বলার মধ্যে কিছু ছিল কিনা জানি না, উনি চুপ করে রইলেন। এর পর প্রায় দেড়/দু বছর অনেক চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। না, টেলিফোনেও তিনি কোনও উত্তর দেননি, দেখা করার অনুমতিও না। সেদিনের ফকিরণ মায়ের মারফতি জগত কিরকম আমার আর জানা হয়নি।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী

Posted in

প্রবন্ধ


কমলাকান্ত উবাচ
ধ্রুবজ্যোতি চক্রবর্ত্তী


উবাচ-৩

মন ভাল নেই। একদম ভাল নেই। 

একে তো গতমাসে কমলাকান্ত দেখা না দেওয়ার ফলে আমার লেখার তৃতীয় কিস্তি জমা পড়েনি। সেই দিয়ে মন খারাপের শুরু। তার ওপর কিছুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা একটা ছবি মনটাকে আরও খারাপ করে দিয়েছে। এখনও ছবিটার ভয়াবহতা থেকে নিজেকে বের করে আনতে পারিনি। তাই আমার দৈনিক কর্মকাণ্ডেও মন খারাপের প্রভাবটা থেকে যাচ্ছে। আর তার ফলে জনগন আমার ওপর যারপর নাই রুষ্ট হয়ে পড়ছেন। 

এই সময়ে আমার কাছে কমলাকান্তের প্রয়োজন অতিব জরুরী বোধ হচ্ছে। আমি যতই এই আফিমসেবী, ঠোঁটকাটা, অপ্রিয় সত্যভাষী ব্রাহ্মণকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করিনা কেন, পরে ভেবে দেখেছি যে কমলাকান্তের IQ, EQ এবং SQ অত্যন্ত উচ্চমার্গে বিরাজমান। আমার মতো সাধারণ মানুষকে তার নাগাল পেতে গেলে “সন্ধানে ধন্ধায় নবাবে” করে ঘুরে বেড়াতে হবে। এই মুহূর্তে, সত্যি বলছি, আমি কমলাকান্তকে বড্ড বেশী মিস করছি। ওর সংগে একটু সময় কাটাতে পারলে মানসিক চাপটা থেকে মনে হয় মুক্ত হওয়া যেত।

কে জানে নেশার তাড়নায় সে এখন কোন ঠেকে আফিমের সন্ধানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। 

যাইহো্‌ কমলাকান্তের আশা ছেড়ে দিয়ে লেখার কাজে মন দেওয়া যাক।

হ্যাঁ, যেকথা বলছিলাম, সোশ্যাল মিডিয়ার ছবির ব্যাপারটা নিয়ে একটু বিশদে আলোচনা করা দরকার। 

আমাদের মহাবিদ্যালয়ের ছাত্রদের সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা আখড়া আছে। সেখানে আমরা নিজেদের মধ্যে “ছায়ার সাথে যুদ্ধ করে গাত্রে হল ব্যাথা”র মতো মারামারি, ঝগড়া করা ছাড়াও সারা বিশ্বে ঘটমান ঘটনার সংগে নিজেরা পরিচিত হই। অবশ্য তার মধ্যে সত্যি-মিথ্যের সীমানা ছাড়িয়ে “হাতে রইল পেন্সিলের মতো” যেগুলো পড়ে থাকে, সেগুলোর মধ্যে একটা ছবি দেখে আমি একই সঙ্গে ভীত এবং সন্ত্রস্ত।

ছবিটা পাঠিয়েছিল পৃথ্বীশ। এমনিতে পৃথ্বীশ খুব কমই আমাদের আখড়ার ইধার কা মাল উধার আর উধার কা মাল ইধার ব্যবসায়ে জড়িত থাকে, তবে যেগুলো সে আখড়ায় পরিবেশন করে থাকে, সেগুলোর গভীরতা আমাদের ভাবিয়ে তোলে। তা সেরকমই একটা ছবি পৃথ্বীশ পাঠিয়ে ছিল আমাদের আখড়ার মাণ্ডিতে। 

তারপরে অবশ্য এই ছবিটা আমি খবরের কাগজেও দেখতে পাই। 

একটা বড় তিমি মাছ বার বার নরওয়ে দেশের সমুদ্রের তীরের দিকে চলে আসছে দেখে সেই দেশের সমুদ্র উপকূল বাহিনী তাকে গভীর সমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে এলেও কয়েকদিন পর তার মৃতদেহ সেই উপকূলে আবার ফিরে আসে। 

তারপর তাকে পোষ্টমর্টেম করে তার পেট থেকে কয়েক মেট্রিক টন পলিথিন পাওয়া যায়। পলিথিনের সেই বর্জ্যকে সেই সমুদ্র পাড়ে পাশাপাশি ছড়িয়ে দিয়ে দেখা যায় তা বেশ কয়েক মাইল লম্বা জায়গা জুড়ে অবস্থান করছে। 

ভয় পাবার মতো ঘটনাই বটে। 


(২)

“Beat Plastic pollution” – এটাই ছিল এই বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের থিম। আমাদের দেশ ভারতবর্ষ এবার বিশ্ব পরিবেশ দিবসের আয়োজক ছিল। সেই সূত্রে গত পাঁচই জুন, ২০১৮ আমার শহর হায়দ্রাবাদে সারা বিশ্বের পরিবেশ বিজ্ঞানীরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে যেসব তথ্য বিশ্বের সাধারণ মানুষের নজরে এনেছেন, তার ভয়াবহতা বোধহয় পারমানবিক যুদ্ধের ভয়াবহতার সংগে তুলণীয়। তাঁরা সবাই একত্রে বলে গেছেন যে প্ল্যাস্টিক বম্বের ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা এটম বম্বের থেকে কিছু কম নয়! 

Jenna Jambeck একজন পরিবেশ বিজ্ঞানী, যিনি জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। রিসার্চ করে চলেছেন, যে বিপুল পরিমাণ প্ল্যাস্টিক সমুদ্রের তলদেশে জমা হচ্ছে, তার প্রভাবের ওপর। 

তাঁর মতে মানুষসহ সমস্ত প্রাণী আজ জনজীবনে অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণহীন প্ল্যাস্টিক ব্যবহারের ফলে নিজেদের অস্তিত্বের সঙ্কটের সন্মুখীন। পৃথিবীতে প্রতিদিন যে পরিমাণ সলিড ওয়েস্ট তৈরী হয়, তার শতকরা প্রায় দশ থেকে বারো ভাগই হচ্ছে প্ল্যাস্টিক। তার মধ্যে অনিয়ন্ত্রিত প্ল্যাস্টিক বর্জ্যের যে ভাগটা সমুদ্রে গিয়ে পরে, তার পরিমান বেশ কয়েক মিলিয়ন টন। সংখ্যাটা মারাত্মক। ২০১০ সালেই তার পরিমাণ ধরা হয়েছিল ৮ মিলিয়ন টন। আর আজকের হিসেবে তা প্রায় ১৩ মিলিয়ন টনের কাছাকাছি। 

সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত এই বিপুল পরিমাণ প্ল্যাস্টিক কিছু ভেসে বেড়ায়, কিছু ডুবে যায়। দেখা গেছে ভেসে বেড়ানো প্ল্যাস্টিক সামুদ্রিক বাতাসের বিচিত্র গতিপ্রকৃতির কল্যাণে একত্রিত হয়ে কৃত্রিম ভাসমান দ্বীপেরও সৃষ্টি করেছে। আর ডুবে যাওয়া প্ল্যাস্টিক সামুদ্রিক প্রাণীরা তাদের খাবারের সঙ্গে প্রতিনিয়ত গ্রহণ করে চলেছে। যার কারণে নরওয়ের সমুদ্র উপকূলে প্রাপ্ত হতভাগ্য তিমি মাছের পেটে আমরা কয়েক টন প্ল্যাস্টিক দেখতে পাচ্ছি। 

শুধু তাই নয়, যেসব সামুদ্রিক প্রাণী মানুষ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে, তাদের দ্বারা অসংখ্য পরিমাণ প্ল্যাস্টিক মাইক্রোবস মানুষের দেহে প্রবেশ করে চলেছে। আর তার পরিমাণ যে ভয়ঙ্কর, সেটা তো আর বলে বোঝনোর দরকার নেই। 

পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৫০ সাল থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে ৮.৩ বিলিয়ন মেট্রিকটন প্ল্যাস্টিক তৈরি হয়েছে, যার শতকরা ৭৫ ভাগই বর্জ্য হিসেবে নিক্ষিপ্ত হয়েছে আমাদের এই ধরিত্রীতে, যা বিনষ্ট হয়নি। সেই পর্বত প্রমাণ প্ল্যাস্টিক এবং প্রতিদিনকার উৎপাদিত প্ল্যাস্টিক প্রতিনিয়ত আমাদের নদী, মাটি আর সমুদ্রকে আস্তে আস্তে গ্রাস করে ফেলছে।

Erik Solheim সাহেব, যিনি UN Environment Programme (UNEP)’র কর্ণধার, বলছেন যে, আমরা যদি আমাদের না বদলাই তবে সেই সময়ের আর বেশী দেরি নেই, যখন প্ল্যাস্টিক পলিউসান আমাদের শ্বাস রোধ করে ফেলবে। সারা পৃথিবীতে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, খাবার জলে পর্যন্ত মাইক্রোপ্ল্যাস্টিক, যাকে মাইক্রোব বলা হয়, তা বিদ্যমান। নরওয়ে আর স্পেনের উপকূলের তিমি মাছ দুটির মৃত্যুর কারণ হচ্ছে প্ল্যাস্টিক। ভারতবর্ষের কেরালাতেও প্ল্যাস্টিক এক হাতীর মৃত্যুর কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এছাড়া আজ গরু, ছাগল, উট, সামুদ্রিক পাখী, মাছ, কচ্ছপ সবার খাদ্য চক্রেই প্ল্যাস্টিকের অবস্থান দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, যা অত্যন্ত ভয়াবহ।



(৩)


Solheim সাহেব ভারতবাসীকে আর একটা বড় সঙ্কটের কথা শুনিয়ে গেছেন। উনি বলেছেন যে, ক’য়েক বছরের মধ্যেই ভারতবর্ষ সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশী লোকসংখ্যার মালিক হতে চলেছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে যে, আরও বেশী জনগণ প্ল্যাস্টিক ব্যবহার করবে। তাই ভারতবর্ষ যদি এখুনি প্লাস্টিক পলিউসনের দ্রুত গতিশীল চাকাটাকে উল্টো মুখে চালিত করতে না পারে, তাহলে শুধু ভারতবর্ষেরই নয়, সমগ্র পৃথিবীতেই সমূহ বিপদ আসন্ন।

Solheim সাহেবের অশনি সঙ্কেত মাথায় রেখে ভারতবর্ষের Plastic Pollution Picture-এর PPT-গুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। 

ভারতবর্ষ প্রতিদিন কমবেশী ৩৫৬০০ মেট্রিকটন প্ল্যাস্টিক উপভোগ করে, যার বাৎসরিক পরিমানটা ১৩ মিলিয়ন মেট্রিকটনের কাছাকাছি। এর মধ্যে ৯ মিলিয়ন মেট্রিকটনের কাছাকাছি প্ল্যাস্টিক বর্জ্যে পরিণত হয় @২৫০০ মেট্রিকটন প্রতিদিনকার হিসেবে। 

ভাবতে ভাবতে ভয় লাগতে লাগলো। হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে মনে হলো। জলের বোতলের দিকে হাত বাড়তে গিয়ে শুনতে পেলাম ঠাকুরদাদার ঘড়িতে রাত বারোটার ঘণ্টা পেটা শুরু হলো। জল খেতে খেতে ঘণ্টাগুলো গুনছি......এক, দুই, তিন...। ছোটবেলাকার স্বভাব। 

দাদুর কাছে মুখে মুখে এক-দুই আর ওয়ান-টু গোনা শিখেছিলাম ঘড়ির ঘণ্টা পেটার আওয়াজ গুনে গুনে। বিদ্যাসাগর মহাশয় মাইল ফলক দেখে ইংরেজি ওয়ান-টু শিখেছিলেন – এই তথ্যটাও দাদুই আমাকে দিয়েছিলেন আমাকে ইংরেজী সংখ্যার সংগে পরিচয় করাবার সময়। 

আর একটু বড় হয়ে ইস্কুলের উঁচু ক্লাসে উঠলে দাদু আর একটা তথ্য আমায় দিয়েছিলেন; না সেটাকে ঠিক তথ্য বলা যাবে না, বরং ওটা দাদুরই নিজস্ব একটা থিওরি বলা যেতে পারে, যেটা আমি পরবর্ত্তীকালে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের কোনও জীবনীকারের লেখাতে পাইনি। 

দাদু আমায় বলেছিলেন, “দেখ দাদুভাই, আমরা সবাই বই পড়ে ইংরেজী সংখ্যা 1,2,3,4..ইত্যাদি এই ছন্দে শিখেছি। কিন্তু বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথমে ইংরেজীর বড় সংখ্যা দিয়ে শুরু করে তারপর ছোট সংখ্যাগুলো শিখেছিলেন, মানে ধর 10, 9, 8, 7..... এই ছন্দে।”

আমি অবাক হয়ে তার কারণ জানতে চাইলে উনি আমায় বলেছিলেন, “বিদ্যাসাগর মশাই তাঁর বাবার সঙ্গে বীরসিংহ গ্রাম থেকে হেঁটে শহরে আসার সময় মাইল ফলক দেখে দেখে ইংরেজি সংখ্যাগুলো শিখে ফেলেছিলেন।”

আমার কাছে তাও ব্যপারটা পরিষ্কার হলো না দেখে তিনি বলেছিলেন, “বীরসিংহ গ্রামের বাড়ি থেকে বাবার সংগে বেরিয়ে বড়ো রাস্তায় পৌঁছে বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রথম যে মাইল ফলকটি দেখে বাবাকে প্রশ্ন করেছিলেন, তাতে কি লেখা থাকতে পারে বলে মনে হয়?”

মনে আছে আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম,“কেন, যেখানে যাচ্ছিলেন সেই জায়গার যতটা দুরত্ব মাইল ফলক তো ঠিক ততটাই দূরত্ব দেখাবে।”

“ঠিক তাই। মনে কর বিদ্যাসাগর মশাই প্রথম যে মাইল ফলকটা দেখেছিলেন সেটতে দূরত্ব লেখা ছিল 10Mile. তাহলে আবার এক মাইল হাঁটার পর বিদ্যাসাগর মশাই যে মাইল ফলকটার দেখা পেয়েছিলেন সেটাতে নিশ্চয় 9Mile লেখা ছিল। এইভাবে বিদ্যাসাগর মশাই প্রথমে ইংরেজি বড় সংখ্যা থেকে শুরু করে ক্রমে ক্রমে ছোট সংখ্যার সংগে পরিচিত হচ্ছিলেন আর মনে মনে সেটা মুখস্ত করে ফেলছিলেন। আমরা সবাই কিন্তু প্রথমে ছোট সংখ্যার সংগে পরিচিত হয়ে পড়ে বড়ো সংখ্যার সংগে পরিচিত হয়েছি, সেটাই কিন্তু দস্তুর।” 



(৫)


দাদুর মুখে সেই সময়ে এই কথাটা শুনে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। তারপর বড়ো হয়ে ভেবেছি যে দাদুর ধারণাটার সত্যি মিথ্যে জানা খুব মুশকিল, তবে একটা যে লজিক আছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।

তাই আজও দাদুর ঘড়ির ঘণ্টা পেটা যখন শুরু হয়, তখন প্রত্যেকবার আমার দাদুর কথা মনে পড়ে। কি আশ্চর্য লজিক ছিল দাদুর!

ঠাকুদা-ঘড়ি ১২টা ঘণ্টা পেটা শেষ করতেই, আমার নাকে কস্তুরী মৃগের নাভির সেই বিশেষ গন্ধটা ধরা পড়ল। 

বুঝতে পারলাম, আজ কমলাকান্ত আমার ডেরায় উপস্থিত হয়েছে। 

জলের বোতলটা টেবিলের ওপরে রেখে চোখ তুলে তাকাতেই আমার চোখ একেবারে কপালে উঠে গেল!

কমলাকান্ত আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আর মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ বাঁধা। বাঁদিকের কোনায় একটু লালের ছোপ। মুখটা বেশ কৃশ।

কমলাকান্তের এই দশা দেখে আমি একেবারে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের কোনায় রাখা তার বরাদ্দ চেয়ারটা এনে তাকে বসতে বললাম। অভ্যেস মতো কাঁধের উড়ুনিটা দিয়ে চেয়ারটাকে একটু ঝেড়ে কমলাকান্ত তার সিগনেচার পোজে বসে জলের বোতলটার দিকে হাত বাড়াতে গিয়েও হাত সরিয়ে নিল। আমি একছুটে রান্নাঘরে গিয়ে তার কাঁসার ঘটিটাতে এক ঘটি জল এনে তার সামনে ধরতেই সে আলগোছে ঘটির জলটা পুরোটাই শেষ করে ফেলে ঘটিটা টেবিলের ওপর রেখে দিল। 

বুঝলাম আজ কমলাকান্ত বেশ ক্লান্ত। 

আমি তাকে কোনওরকম প্রশ্ন করে বিরক্ত না করে একটু স্পেস দেব ঠিক করলাম। একটু জিরিয়ে নিক আগে। 

কিছুক্ষণ পর নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে একটু ম্লান হাসল সে। এবার আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,“তোমার এই দশা হলো কি করে।”

“বহুদিন পর আমার কাঁঠালপাড়া গ্রামে আমার পৈতৃক ভিটাতে যাইবার ইচ্ছা হইয়াছিল। দুর্ভাগ্যবশতঃ গ্রামে ঢুকিতে গিয়া দেখি ওইস্থানে কুরুক্ষেত্র চলিতেছে। চারিদিকে বিস্ফারিত পটাকার আওয়াজ কানে আসিতেছে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থা। এই অবস্থায় প্রসন্নর দেখা পাইলাম। এক বৃক্ষতলে হতাশ হইয়া বসিয়াছিল। সে বলিল, ঠাকুর তুমি অতি সত্বর এই স্থান ত্যাগ কর। তাহার কাছে জানিতে পারিলা্‌ গ্রামে পঞ্চায়েত ভোট চলিতেছে। আমি তাহার মর্ম জিজ্ঞাসা করিলে প্রসন্ন কহিল যে, সাহেবরা ভারতবর্ষ ত্যাগ করিয়া যাইলে স্বাধীন ভারতবর্ষে একটি ভোটপূজা নামক আমোদের আবির্ভাব ঘটিয়াছে। আমি বলিলাম, তা পূজাকর্মে এত হাঙ্গামা হইতেছে কেন? সে বলিল, এই পূজাতে নাকি এটাই দস্তুর।”

একটানা অনেক কথা বলে কমলাকান্ত দম নেবার জন্য একটু থামল। আমি তাকে কোনওরকম বিরক্ত করলাম না। সময় নিয়ে সেই নিজেই বলুক। 

দম নেবার পর কমলাকান্ত শুরু করল, “প্রসন্নর কথার কোনওরূপ মাথামুণ্ড না বুঝিয়া আমি আমার পৈতৃক গৃহের দিকে পা বাড়াইলাম। প্রসন্ন আমার পিছনে পিছনে কিছুদূর চলিতে চলিতে আমায় বারংবার অগ্রসর হইতে নিষেধ করিতে লাগিল। কিন্তু আমি তাহার কথায় কর্ণপাত করিলাম না। আসিয়া পড়িয়াছি যখন, তখন একটিবার পৈতৃক ভিটাটি দর্শন করিয়াই যাইব। প্রসন্ন আমাকে অভিসম্পাত করিয়া নিজের জায়গায় প্রত্যাবর্তন করিল। তাহারপর আমি কিছুদূর অগ্রসর হইতেই আমার কর্ণপটহ বিদারিত করিয়া একটি পটাকা বিস্ফারিত হইতেই কিসের আঘাতে যেন আমি চৈতন্য হারাইয়াছিলাম।

তাহারপর আমার আর কিছুই মনে নাই। কতকাল পর চক্ষু খুলিয়া প্রসন্নর চিন্তান্বিত মুখমণ্ডল দর্শন করিলাম, তাহা আমার স্মরণে নাই। তাহারপর মাসাধিক কাল শয্যাশায়ী থাকিয়া প্রসন্নের সেবা যত্নে কিছুটা সুস্থ্য বোধ করিলে তোমার কথা মনে পড়িতেই আজ আসিয়া হাজির হইলাম।”

কমলাকান্তের মুখে ঘটনার বিবরণ শুনে আমি যাকে বলে স্তম্ভিত। নির্বিচারী সাত্ত্বিক ব্রাহ্মণের ওপর যে রাজনৈতিক আক্রমণ হতে পারে, এটা আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল। কিন্তু গণতন্ত্রের তান্ত্রিকদের বর্তমান সামাজিক কর্মকাণ্ডের জেরে আজ আমার মাথা হেঁট করতে হলো কমলাকান্তের কাছে। 

আমার অবস্থা বুঝে কমলাকান্ত হেসে আমায় সান্ত্বনা দেবার জন্য বলে ওঠে, “তুমি লজ্জিত হও কেন লেখক। ইহা আমার প্রাপ্য ছিল বলিতে পার। আমার বিষয় পরিত্যাগ করিয়া তুমি কি লিখিতেছ বল।”

আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম, “লেখার কাজ মাথায় উঠেছে। প্ল্যাস্টিক দূষণের খবরাখবর পড়ে আমার অবস্থা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হবার আগে অর্জুন বিষাদযোগ-সম। অতি সম্প্রতি প্রকৃতি দূষণের ওপর আমার শহরে একটি আন্তর্জাতিক আলাপ আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে। সেই আলোচনা থেকে যে সব তথ্য নজরে এল, তা দেখছি অতিমাত্রায় ভয়াবহ।”

এই বলে, আমি কমলাকান্তকে Jenna Jambeck মেমসাহেব আর Erik Solheim সাহেবদের কথা বললাম। ওঁরা যে সব তথ্য দিয়েছেন, সেগুলো যখন কমলাকান্তকে বলছি, তখন একবার চোখ তুলে তাকিয়ে দেখি সে একদৃষ্টে আমার জলের বোতলের দিকে তাকিয়ে আছে। 

আমার কথা শেষ হলে সে জলের বোতলের দিকে দৃষ্টি রেখেই আমাকে বললো, “তোমাদের সাহেব আর মেমসাহেব আরও দু-একটি তথ্য উল্লেখ করিতে ভুলিয়া গিয়াছেন বলিয়া মনে হয়।”

“কি সেই তথ্য?” আমার প্রশ্ন।

এইবার কমলাকান্তের মুখে সেই রহস্যময় হাসিটা দেখা পেলাম। ঠোঁটের ওপর তার সেই বিখ্যাত হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে সে বলে ওঠে, “তোমার জলের বোতলটি দেখিয়া আমার তথ্যটি স্মরণে আসিল। তুমি অবগত হইয়া আশ্চর্য্য হইবে বোধকরি যে, প্রতি পলে সমগ্র পৃথিবীতে এই প্রকার দশ লক্ষ্যাধিক পাণীয় জলের বোতল বিক্রীত হইতেছে। আর তোমাদের ওই দূষণ সৃষ্টিকারি পেটিকার বাৎসরিক সংখ্যাটা জান? পাঁচ লক্ষ্য কোটি এবং ইহা প্রতিনিয়ত অবলা ধরিত্রীর বুকে নিক্ষিপ্ত হইতেছে। এই সকল দূষিত বস্তুর সিংহ ভাগ সমুদ্রতলে আশ্রয় পাইতেছে।”

কমলাকান্তের জ্ঞানের পরিধি দেখে আমি যাকে বলে স্তম্ভিত!

তবুও একবার গুগুল জেঠু আর উইকি মাসীর তথ্য ভাণ্ডারে উঁকি দিয়ে দেখতে পেলাম কমলাকান্তের তথ্য এক্কেবারে অক্ষরে অক্ষরে সত্য। প্রতি মিনিটে সমগ্র পৃথিবীতে বিক্রীত প্ল্যাস্টিক বোতলের সংখ্যা কমবেশী one million আর বছরে single use disposable ব্যবহৃত প্ল্যাস্টিক ব্যাগের সংখ্যা five trillion! 

আমার স্তম্ভিত ভাবটা লক্ষ্য করে কমলাকান্ত বলে ওঠে, “বিজ্ঞান দ্বারা সৃষ্ট অজড় অমর এই বস্তুর ক্ষয় নাই, লয় নাই। মৃত্তিকার উর্ব্বরা শক্তি নষ্ট করিয়া এই প্ল্যাস্টিক নামক বস্তুটি ধীরে ধীরে ফসল ফলাইবার জমির মৃত্যু ঘটাইতেছে। ইহার ফল বড়ই সুদূর প্রসারী।”

কমলাকান্ত দম নেবার জন্য থামলে আমি বলে উঠলাম, “এই আত্মনিধনকারী বস্তুর হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার কি কোনওই উপায় নেই?”



(৬)


কমলাকান্ত বলে, “সস্তা সুখের সন্ধানে বর্ত্তমান মনুষ্য সমাজ প্রতিনিয়ত আপন কবর খনন করিয়া চলিয়াছে।”

আমার মুখে কোনও কথা নেই। কমালাকান্তও দেখছি গভীর চিন্তামগ্ন। ঘরে একটি আলপিন পড়লেও শব্দ শোনা যাবে মনে হয়। কিছুক্ষণ পর গুরুগম্ভীর পরিস্থিতির অবসান ঘটিয়ে কমলাকান্ত বলে ওঠে, “মহাভারতের মুষল পর্বের কাহিনী তো বিস্মৃত হও নাই নিশ্চয়।”

এবার আমার অবাক হবার পালা। কোথায় plastic pollution আর কোথায় মহাভারত!

কমলাকান্ত তার ঠোঁটের কোণে আবার সেই রহস্যময় হাসিটা ফিরিয়ে এনে বলে, “মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ উত্তর কালে শ্রীকৃষ্ণের যদুবংশ ধ্বংসের পেছনে মুষলের প্রভাব অনস্বীকার্য। শত চেষ্টা করিয়াও মুষলের হাত হইতে নিস্তার পায়নি যাদবকুল। সর্বশেষে সেই মুষলের প্রভাবে উৎপাদিত নল খাগড়ার বনে আত্মহননকারি যুযুধান যদুবংশের সমাপ্তি ঘটে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদ না অভিশাপ অজড় অমর এই প্ল্যাস্টিক বস্তুটি আজ মুষলরূপ ধারণ করিয়া তোমাদের এই আধুনিক যুগের সমাপ্তি ত্বরান্তরিত করিতেছে। যত শীঘ্র সম্ভব এই বস্তুটির ব্যবহার হইতে পৃথিবীবাসীকে নিরস্ত হইতে হইবে নচেৎ এই সভ্যতার মৃত্যুঘণ্টার পদধ্বনিই শুধু আমার কানেই বাজিতেছে না, সেই সঙ্গে আমাদের এই সুজলা সুফলা ধরিত্রী যে এক নিস্ফলা অনুর্বর বধ্যভূমিতে পরিণত হইতে চলিতেছে, তাহা আমি যেন প্রত্যক্ষ করিতেছি।”

আমি কি বলব বুঝে উঠতে পারছি না। কমলাকান্তের প্রতিটি কথায় আমি যেন Erik Solheim সাহেবের আর Jenna Jambeck মেমসাহেবের বক্তৃতার প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি! কি অসাধারণ বিশ্লেষণ এই সাধারণ ব্রাহ্মণের! ভাবতেও অবাক লাগছে যে, দুর্জনে এই high IQ সম্পন্ন ব্রাহ্মণকেই নিরক্ষর, নেশাখোর বলে হেয় করে থাকে! 

আমি এই শুভ্রকান্তি ঋষি প্রতিম মানুষটির দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ দুটি সজল হয়ে উঠেছে। হয়তো আমাদের এই প্রিয়তম গ্রহটির ভবিষ্যতের কথা ভেবে।

আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে একটু হেসে কমলাকান্ত বলে ওঠে, “বুঝলে হে লেখক চূড়ামণি, ইহার কারণেই বাঙলা ব্যাকারণে যমক অলঙ্কারের একটি অতি প্রসিদ্ধ উদাহরণ হইল – যা নেই ভারতে, তা নেই ভারতে।” 

আমি এই প্রথম কমলাকান্তের মুখে চলিত বাঙলা ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করলাম। 

কমলাকান্ত আমার বোতলের দিকে হাত বাড়িয়েও হাত সরিয়ে নিল। আমি তাড়াতাড়ি তার বরাদ্দ ঘটিটা খালি দেখে সেটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঘটিটায় জল ভরতে ভরতে বুঝতে পারছি আমার মাথার মধ্যে কমলাকান্তের প্রতিটা কথা ঘুরপাক খেয়ে চলেছে। 

ঘটিতে জল ভরে নিয়ে আবার আমার ষ্টাডি রুমে ফিরে এসে দেখি কমলাকান্ত প্রস্থান করেছে। তৃষ্ণার্ত কমলাকান্ত জল না খেয়ে আমার এখান থেকে চলে যাওয়াতে মনটা খুঁতখুঁত করতে লাগল। তারপর আমার জল ভরা প্ল্যাস্টিক বোতলের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম যে, আমার মতো তথাকথিত শিক্ষিত মানুষ প্ল্যাস্টিকের বোতলে জল খেতে খেতে প্ল্যাস্টিকের বিরুদ্ধে মন্তব্য করছি – এই হিপক্রাসিটার বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে চলে গেছে সে। 

লাখ সেলাম তোমায় কমলাকান্ত, লাখ লাখ প্রণাম তোমায়।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - পল্লববরন পাল

Posted in


প্রবন্ধ


পাখির চোখ 
পল্লববরন পাল 



কী দেখা যাচ্ছে সামনে? 

এই বিখ্যাত প্রশ্ন পৃথিবীতে সম্ভবত প্রথম করেছিলেন অস্ত্রগুরু দ্রোণাচার্য – তাঁর একশো পাঁচজন ছাত্রের উদ্দেশে, যার মধ্যে একজন মাত্র উত্তর দিয়েছিলেন – পাখির চোখ – আমরা সবাই জানি সেই ছাত্রের নাম অর্জুন - এবং অর্জুনের দেওয়া উত্তরটাই নাকি সঠিক উত্তর – শুধু পুরাণেই নয়, ত্রেতা-সত্য-কলি যুগনির্বিশেষে গুরু-শিক্ষক-বাবা-মা-অভিভাবকেরা ছাত্রছাত্রী-সন্তানসন্ততিদের মুখ থেকে এইরকম উত্তর পেলে যারপরনাই তৃপ্ত ও গৌরবান্বিত বোধ করেন। যদিও পাখির চোখ ব্যাপারটা প্রতিকী – এখনকার শহুরে ছেলে ছোকরারা তো আর পাখি দেখবে না, কারণ শহর থেকে আমরা উন্নয়নের নামে যেমন গাছপালা উচ্ছেদ করেছি, কলেরা নির্মূল করেছি, তেমনি পাখিদেরও আধার কার্ড ইস্যু করিনি, আমরা গর্ব ভরে পাখিহীন শহরের নামে সোচ্চার হই – এখনকার ছেলেরা তাই এই প্রশ্নের উত্তরে ‘পাখির চোখ’-এর পরিবর্তে পূর্ণ আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলবে – ‘আমেরিকা’, এবং এই উত্তরে অভিভাবকদের চোখও আনন্দে চকচক করে উঠবে। মহাভারতের যুগে যা ছিলো পাখি, একশো বছর আগে যা হয়তো ছিলো স্বাধীনতা, আজ সেটাই আমেরিকা – অথবা অন্য কিছু। 

বিজ্ঞান আমাদের শিখিয়েছে, ধ্রুব সত্য (সোজা বাংলায় যাকে আমরা absolute truth বলি) বলে কিছু নেই, যে কোনও সত্যের গায়ে গা ঠেকিয়ে প্রিয় বন্ধুর মতো থাকে কিছু স্থান-কাল-পাত্রের শর্ত – অর্থাৎ স্থান কাল বা পাত্রের পরিবর্তনের সংগে সংগে সত্যেরও বদল ঘটে। একই সময়ে পৃথিবীর কোনও এক জায়গায় দিন, আবার কোনও এক জায়গায় রাত – একই মুহূর্তে দুটোই সত্য, কিন্তু দুটি আলাদা জায়গায় – এখানে এই দুটি সত্যের সঙ্গে কাল ও স্থানের যুগপৎ শর্ত আছে। 

একটা ধোঁয়াটে কুয়াশা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে - মনের মধ্যে খচ্‌খচ্‌ - অর্জুন ছাড়া বাকিরা উত্তরে যা বলেছিলো, অর্থাৎ - গাছ পাখি আকাশ মানুষজন ইত্যাদি অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছে – এ উত্তরটার মধ্যে ভুলটা কোথায়? আদৌ কি ভুল বলা যাবে এই উত্তরটাকে? 

আসলে যে কোনও প্রশ্নেরই একাধিক উত্তর হতে পারে। উত্তরদাতাকে বুঝতে হবে, প্রশ্নের প্রকৃত উদ্দেশ্য কি? অর্থাৎ প্রশ্নকর্তা এই এতগুলো উত্তরের মধ্য থেকে কোন উত্তরটা আশা করছেন। হাঁ-মুখের সামনে সন্দেশ হাতে নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন করেন – মিষ্টিটা কি আমি খাবো? – উত্তরদাতাকে সর্বাগ্রে বুঝতে হবে – উনি গলাধঃকরণের জন্য বড়োই উদগ্রীব ও উতলা হয়ে আছেন, এ প্রশ্নের মাধ্যমে শুধুমাত্র আপনার সম্মতি চান – এখন যদি আপনি হঠাৎ হাঁ হাঁ করে ডায়াবেটিসের ওপর একটা উইকিপিডিয়া-মুখস্থ দীর্ঘ বক্তৃতা শুরু করেন – ত্রেতা বা সত্য যুগে কী হতো বলতে পারবো না, তবে কলিযুগে যে আপনার কপালে নির্ঘাৎ চোদ্দপুরুষ উদ্ধারকারী অনভিধানিক শব্দাবলী অথবা বাংলা প্যাঁদানি জুটতো, এটা বলার জন্য আমাকে জ্যোতিষশাস্ত্রে ডিলিট হওয়ার দরকার নেই। 

কী দেখা যাচ্ছে সামনে? 

জ্যোতিষশাস্ত্রর কথা এলোই যখন, এই প্রশ্নটির সম্পূর্ণ অন্য একটি মাত্রা উদ্ঘাটিত হলো – এযাবৎ মনে পড়ে গেলো – একমাত্র জ্যোতিষীরা এই প্রশ্নে যার পর নাই আহ্লাদিত হন, কারণ, ওঁরা দাবি করেন যে, সামনে যা যা দেখা যাচ্ছেনা, মানে সাদাচোখে আমরা যা দেখতে পাইনা অর্থাৎ আমাদের সামনের দিনগুলো কেমন কাটবে, মানে আমাদের ভবিষ্যৎ ওঁরা পরিষ্কার দেখতে পান - যা আমরা চেষ্টা করেও পারিনা। 

জ্যোতিষীরা একজন একজন করে মানুষকে তার নিজস্ব ভবিষ্যৎ দেখান, এবং এ কথা অনস্বীকার্য যে, আমার ভবিষ্যৎ আমি মনে মনে ঠিক যেমনটি দেখতে চাই, মোটামুটি জ্যোতিষীর গণনাও সেই পথই নির্দেশ করে, কিন্তু এই পথে অনেক লোমহর্ষক ঘটনা-টটনা ঘটাতে হয় তাঁদের, জীবিকার খাতিরেই - নইলে আমাদের অন্ধ বিশ্বাসের সুতো আলগা হয়ে যেতে পারে। এটা তো ঘটনা যে, সুতোটা সত্যিই খুব আলগা। অবশ্য আলগা বলিই বা কি করে – যেখানে সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে জ্যোতিষীদের রমরমা বিজ্ঞাপণ ক্রমবর্ধমান। আসলে জ্যোতিষ দাঁড়িয়ে আছে শুধুমাত্র একটা ধারণা বা বিশ্বাসের ওপর, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এখনও প্রতিষ্ঠিত নয়। তাতে অবশ্য ইদানিং কিছু যায় আসেনা। কারণ, খুব সুচিন্তিতভাবেই জড়িবুটি যজ্ঞমন্ত্র ইত্যাদির ওপর মানুষের আস্থা ফেরানোর ভয়ঙ্কর কৌশলকে মানবকল্যাণকর হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে সর্বত্র – ছোটবেলায় জানতাম – সাধু-সন্ন্যাসীরা মূলত হিমালয়বাসী – ইদানিং দেখছি দেশের এবং বিভিন্ন রাজ্যের রাজধানীতেই শাসনক্ষমতার আশেপাশেই এই সব জটাজুট সাধু সন্ন্যাসীদের ভীড় ক্রমবর্ধমান। জ্যোতিষশাস্ত্রকে(Astrology) জ্যোতির্বিজ্ঞানের(Astronomy) সাথে গুলিয়ে দিয়ে জ্যোতিষের গায়ে বিজ্ঞানের পোষাক পরানোর একটা গভীর চেষ্টা অনেকদিন ধরেই চলছে গোপনে গোপনে। ইদানিং তো টুথপেস্ট থেকে পায়খানার প্যান পরিষ্কারের লোশন সবকিছুতেই জড়িবুটির পরিমাণে মানুষের বিশ্বাস আদায়ের কর্পোরেট প্রতিযোগিতা চলছে। মৃতদেহ নিয়ে যজ্ঞ পূজা এসব আবার ফিরে ফিরে আসছে। বৃষ্টি আনবার জন্য পূজা, বন্যা রুখবার জন্য পূজা – এসব তো সামাজিক আচার অনুষ্ঠান হিসেবে দেখি আমরা। আমরা শক্তিদেবীর পুজো করি বিপুল জাঁক আড়ম্বরে, কিন্তু শক্তিদেবীর মন্দিরে তাঁর মূর্তির সামনে একটি আট বছরের মেয়েকে কয়েকজন শক্তিপুজারীর উপর্যুপর ধর্ষণ ও হত্যার পরেও সেই দেবীর শক্তির প্রতি আমাদের কোনও প্রশ্ন জাগেনা। 

কী দেখা যাচ্ছে সামনে? 

পাঁচ বছর বাদে বাদে এক একজন দ্রোণাচার্য গুরু এই প্রশ্ন করেন কোটি কোটি ছাত্রের উদ্দেশে – প্রথম দ্রোণ দেখিয়েছিলেন কাঠের পাখি, সাম্প্রতিক দ্রোণেরা দেখান ‘উন্নয়ন’ কিম্বা ‘আচ্ছে দিন’ – তফাৎ, প্রথমবারের পরীক্ষায় পাশের হার ০.৯৫, এক শতাংশেরও কম, নিরানব্বই শতাংশ ফেল – আর এখন? – এখন পাশ-ফেল উঠে গেছে, সবাই পাশ। সবাই দেখতে পাচ্ছে পাখি এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে ‘পাখির চোখ’ – এ ছাড়া অন্য কিছুই আর দেখা যাচ্ছে না। অন্তত খাতায়-কলমে তো তাই। 

সত্যি কি তাই? 

একদল সামনে দেখছে উন্নয়নের সুনামি, আর এক দল কিন্তু দেখছে আধপেটা কৃষকদের বিক্ষোভ মিছিল - এক দল দেখছে লণ্ডন, অন্য দল দেখছে ভাগাড় - এক দল সংরক্ষণ বলতে বোঝে গরু, অন্য দল বোঝে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর মানুষ - এক দল দেখছে সামনে ‘আচ্ছে দিন’, অন্য দল দেখছে ধর্ষিতা কন্যাশ্রী। 

তপন সিংহের ‘আতঙ্ক’ সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়লগ – মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি। মাস্টারমশাইয়ের চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সেই ভাঙাচোরা ভয়ার্ত মুখের ক্লোজ-আপ আমরা কেউ ভুলিনি। ভোলবার কথাও নয় – কারণ, আজ ঘরে ঘরে আমাদের সকলের মুখের ক্লোজ-আপে অবিকল সেই একই আতঙ্ক। সেই সিনেমার গল্পে ঘটনাচক্রে রাস্তার মাঝখানে ভর সন্ধ্যাবেলায় মাস্টারমশাই যা দেখে ফেলেছিলেন, সেটাই আসলে কিন্তু উনি দেখেননি – মানে দ্রোণাচার্য যা দেখাতে চান না, উনি সেটাই দেখে ফেলেছিলেন – এবং যেহেতু সেই দেখাটা একেবারেই উচিতকাজ হয়নি, তাই সেটা আদৌ ঘটেইনি কোনওদিন, অর্থাৎ উনি ভুল দেখেছিলেন। মাস্টারমশাইয়ের বোঝা উচিৎ ছিলো যে, দ্রোণাচার্যের ইচ্ছেমতো ওঁর ওইসব কৃষকমিছিল, ভাগাড়, অনগ্রসর মানুষ বা ধর্ষিতা কন্যাদের দেখতে পাওয়াটা মোটেই উচিৎ কাজ নয়, বরং ওতে জান-প্রাণ-মান সংশয়ের যথেষ্ট আশঙ্কা আছে - পরীক্ষায় যদি দশে দশ পেতে হয়, তবে ওঁকে দেখতে হবে – 

শুধুই পাখির চোখ 

অর্থাৎ 

উন্নয়ন আর আচ্ছে দিন 

যা ওঁর মতন আমরাও সবাই সামনে বেমালুম দেখতে পাচ্ছি। 

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মানস লায়েক

Posted in


প্রবন্ধ


শাস্তি সমগ্র
মানস লায়েক


সময়কাল ৮৮ থেকে ৯৩। বাবার বদলির চাকরির সুবাদে অনেকগুলো স্কুল পেরিয়ে তখন পাকাপাকি একটা স্কুলে স্থিত হলাম। মধ্য কলকাতার নাম করা সরকারি স্কুল। আরও নামকরা সেখানকার শিক্ষকসম্প্রদায় ---পড়ানো আর ছাত্রশাসনে। প্রথমেই মনে পড়ে যাচ্ছে অষ্টমশ্রেণীর ভূগোল ক্লাসের একটা ঘটনা। ভূগোল স্যর সবসময় সামনের টেবিলে দুটো হাত ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়াতেন।ছাত্র সম্প্রদায় ওইজন্য ওঁর নাম দিয়েছিলো ৬টা দশ। আমরাও নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ৬'টা দশের ক্লাস' এরকমভাবেই বলতাম। তা একবার অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংশের ক্লাস। স্যর জিজ্ঞেস করেছিলেন লন্ডনে সকাল আটটা বাজলে দিল্লীতে সময় কত? ওমা আমার পাশে বসা সৌম্য বলে উঠল, 'স্যর ৬টা দশ'। স্যর বললেন, 'কি বললি?' আমি উত্তর দিলাম হেসে হেসে 'স্যর ও ৬টা দশ বলেছে'। সারা ক্লাসে হাসির তুফান। স্যর পুরো বাঘের মতন সৌম্যর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। স্যর সৌম্যকে উত্তমমধ্যম দিয়ে যখন ক্লান্ত, ততক্ষণে আমি নিজেই কান ধরে বারান্দায় বসে পড়েছি।

আমি যে সময়ের কথা বলছি, সে সময়ে ছাত্র-শাসন ও শাস্তিদান ছিল নিতান্তই স্বাভাবিক ঘটনা। টিচার্স রুমে বিভিন্ন সাইজের বেত রাখা থাকতো। কেউ কেউ আবার নিজের হাত অথবা বোর্ড পরিস্কার করার ডাস্টারকে বেশি উপযোগী বলে মনে করতেন।

এ প্রসঙ্গে কোনও কোনও শিক্ষকমশাইয়ের কথা। সারাটা ক্লাস যেন সার্কাসের রিহার্সাল। ক্লাস মনিটরের প্রথম কাজ---স্যরের হাতে নিয়মভঙ্গকারী ছাত্রদের তালিকা তুলে দেওয়া। তারপরে অপরাধের গুরুত্ব বিচার করে শুধু দাঁড়িয়ে থাকা, কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা, পরস্পরের কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, দূর প্রান্তে থাকা আসতে দেরী করা ছাত্রের প্রতি অব্যর্থ নিশানায় ডাস্টার নিক্ষেপ। এর মধ্যেই চলেছে ক্লাসের পড়া আর পড়া ধরা।

পড়া ধরা প্রসঙ্গে মনে পড়লো ইতিহাস শিক্ষকের কথা। তিনি এক একদিন পড়া ধরতেন। না পারলে হাতে ডাস্টারের বাড়ি আর কানমলা যা আমরা খুবই ভয় পেতাম। একদিন দুজন ছাত্র বসে ঘনঘন ঘড়ি দেখছিলো কখন ক্লাস শেষ হবে! শেষে একজন আর না থাকতে পেরে বলে উঠলো, 'আর পাঁচ মিনিট।' তারপর যে কি শাস্তি হলো তাদের, তা বলাই বাহুল্য। এই স্যরেরই আর একটি ঘটনা বলে শেষ করছি। তিনি ছিলেন আমাদের ক্লাস টিচার। কোনও কারণে স্কুলে না গেলে, অনুপস্থিতির কারণ ক্লাস ডাইরিতে লিখে নিয়ে যাওয়া ছিল নিয়ম। না লিখে নিয়ে গেলে বা অনুপস্থিতির কারণ যথেষ্ট সন্তোষজনক না হোলে জুটতো শাস্তি! আমি একবার দুতিনদিন স্কুলে যাইনি। ডাইরিতে লেখা ছিল সজনেখালি বেড়াতে যাবার জন্য স্কুলে আসতে পারিনি। নিচে বাবার সই। দুরুদুরু বুকে স্যরের কাছে গেলাম। ভাবছি স্যর কি করেন! স্যর লেখাটা পড়ে মৃদু হাসলেন। বললেন---'তুমি সত্যি কথা লিখে নিয়ে এসেছো---তোমার শাস্তি হবেনা।'

একটা বিখ্যাত বাংলা রক গানের ততোধিক বিখ্যাত একটি লাইন – “এখানে সত্যি বলে সত্যি কিছু নেই”। যে সময়ের কথা বলছিলাম, তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। বিশ্বায়ন এসে জাঁকিয়ে বসেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে – বোধে ও অভ্যাসে – আড্ডায় ও একাকীত্বে। সত্যিই এখন সত্যি বলে কিছু নেই – সব ভার্চুয়াল। এই সন্তর্পণ সামাজিক পরিবর্তনের সংগে সংগে স্কুল থেকে হারিয়ে গেছে সেই সব শাস্তি – এখন শাস্তি দেওয়া সামাজিক অপরাধ। এ আমাদের উত্তরণ নাকি অবনমন? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎ সময়। তবে খুব নিরাসক্ত অভিজ্ঞতার নিরিখে এটুকু অবশ্যই বলা যায় – এই শাস্তিহীন কৈশোর বৃহত্তর অপরাধ প্রবনতাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, যদিও শুধুমাত্র শাস্তিহীনতাই এই অসুখের একমাত্র কারণ নয়।

0 comments:

0

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে



জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড 
শিবাংশু দে



২ 

আমি যে গান গাই, জানিনে সে... 


নিজের গান, বা বৃহদার্থে 'গান' সম্বন্ধে কবির ধারণা সারা জীবনে পাল্টে গেছে বারবার। নিজের বিষয়ে তিনি বলেছিলেন যে তাঁর 'গ্রেটেস্ট ভাইস' হলো 'ইনকনসিস্টেন্সি' আর তাঁর 'গ্রেটেস্ট ভার্চু'ও হলো ঐ 'ইনকনসিস্টেন্সি' । 

নিজের সম্বন্ধে তাঁর এই মূল্যায়ণ যে কতো যথার্থ ছিলো তার প্রমাণ পেয়েছি বহুবার। যেমন ১৯১২ সালে 'জীবনস্মৃতি'র একটি অধ্যায় তিনি শুরু করেছিলেন এইভাবে, '' বাক্য যেখানে শেষ হইয়াছে সেই খানেই গানের প্রারম্ভ।'' তিনি লিখেছিলেন, ''সুর কেন কথার দাস হইবে'' অথবা '' .... গীতকলার নিজেরই একটি বিশেষ প্রকৃতি ও বিশেষ কাজ আছে। গানে যখন কথা থাকে তখন কথার উচিত হয়না সেই সুযোগে গান'কে ছাড়াইয়া যাওয়া, সেখানে সে গানেরই বাহনমাত্র। গান নিজের ঐশ্বর্যেই বড়ো, বাক্যের দাসত্ব সে কেন করিতে যাইবে।'' এখানে 'গান' বলতে তিনি সুর'কেই সমার্থ বোধ করছেন। সেই গ্রন্থেরই আরেক স্থানে তিনি একটি বিশেষ স্মৃতির উল্লেখ করে বলছেন, ''... সুর যে জায়গায় কথাটা উড়াইয়া লইয়া গেল, কথা আপনি সেখানে পায়ে হাঁটিয়া গিয়া পৌঁছিতে পারিত না।'' অথচ দিলীপকুমারের সঙ্গে তাঁর যখনই প্রাসঙ্গিক আলাপ হয়েছে তিনি আমাদের কালোয়াতি গানে সুরের ইম্প্রোভাইজেশন, অর্থাৎ দৈলীপী 'সুরবিহার', বিষয়ে নিজের দ্বিধা প্রকট করেছেন। ১৯১২ সালে তাঁর এ বিষয়ে ধারণা ১৯৩৮ সালে পাল্টে গেলো। তখন তিনি বলছেন ( এ বিষয়ে) '' ....মত বদলিয়েছি। কতোবার বদলিয়েছি তার ঠিক নেই।'' তিনি আরও জানাচ্ছেন, হিন্দুস্তানি কালোয়াতি গানের তিনি কদরদান, তার রস তিনি পূর্ণতঃ উপভোগ করেন। কিন্তু 'খাঁচার পাখি'র মতো শুধু বুলি আউড়ে গেলে কিন্তু সঙ্গীতে মুক্তি নেই। তিনি চাইছেন নতুন সৃষ্টি ও গণ্ডী ভেঙে নতুন জীবনের পথ। এই ধারণাটি তিনি গ্রহণ করেছেন আবহমান কালের বাংলা পদাবলীসঙ্গীত থেকে। যে শৈলিতে পদাবলী, গীতকলাকে সঙ্গিনী করে শিল্পকে জাগিয়ে তুলেছিলো। সুর যখন কথার সঙ্গিনী হয়ে উঠবে, তখনই এই যুগলবন্দি থেকেই সার্থক হয়ে উঠবে সঙ্গীত। এই বর্ণনাটি কিন্তু যথার্থ উপমা সহকারে তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন 'জীবনস্মৃতি'তে বহুকাল আগেই, ''.... আমাদের দেশে স্ত্রী যেমন স্বামীর অধীনতা স্বীকার করিয়াই স্বামীর উপর কর্তৃত্ব করিতে পারে, এ দেশে গানও তেমনি বাক্যের অনুবর্তন করিবার ভার লইয়া বাক্যকে ছাড়াইয়া যায়।'' ১৯৩৭ সালে তিনি ধূর্জটিপ্রসাদকে লিখেছিলেন , ''... কথাও সুরকে বেগ দেয়, সুরও কথাকে বেগ দেয়, উভয়ের মধ্যে আদানপ্রদানের স্বাভাবিক সম্বন্ধ আছে।'' ১৯২১ সালে বলেছিলেন, ''... সংগীতের মধ্যে বাণীর মিলন সাধনই এখন আমার প্রধান সাধনা হয়ে উঠেছে'' (আমাদের সংগীত)। এই সময়েই তিনি আরো লিখেছিলেন, ''... বাংলাদেশে কাব্যের সহযোগে সংগীতের যে বিকাশ হচ্ছে, সে এক অপরূপ জিনিস হয়ে উঠবে। তাতে রাগরাগিণীর বিশুদ্ধতা থাকবে না, যেমন কীর্তনে তা নেই; অর্থাৎ গানের জাত রক্ষা হবে না, নিয়মের স্খলন হতে থাকবে, কেননা তাকে বাণীর দাবি মেনে চলতে হবে। কিন্তু এমনতরো পরিণয়ে পরস্পরের মন জোগাবার জন্য উভয় পক্ষেরই নিজের জিদ কিছু কিছু না ছাড়লে মিলন সুন্দর হয় না।'' তার পর ১৯২৬ সালে তিনি দিলীপকুমারকে আবার লিখেছিলেন, ''... কীর্তনে বাঙালির গানে সঙ্গীত ও কাব্যের যে অর্ধনারীশ্বর মূর্তি, বাঙালির অন্য সাধারণ গানেও তাই।'' 

দিলীপকুমারের সঙ্গে তাঁর এই বার্তালাপ থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূল কাঠামোটি বিষয়ে কবির অবস্থান কী রকম। দিলীপকুমার চেয়েছিলেন তাঁর গানের ব্যক্তিত্বস্বরূপটি নির্মাণ করবেন গায়ক নিজেই। তিনিই হবেন গানের 'রূপকার'। আমাদের কালোয়াতি গানের মতো। কিন্তু কবি জানতেন গানের ব্যক্তিত্ব ইতোমধ্যেই নির্মিত হয়ে গেছে সুরকারের সৃজিত কাঠামোতে। গায়ক বা রূপকার সেই প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বকে প্রাণ দেবেন তাঁর স্বরে, পরিবেশনায়, কিন্তু সুরকারকে অতিক্রম করে যাবার অধিকার তাঁর থাকবে না। 

'' ... যে মানুষ গান বাঁধিবে আর যে মানুষ গান গাহিবে দুজনেই যদি সৃষ্টিকর্তা হয় তবে তো রসের গঙ্গাযমুনাসংগম। যে গান গাওয়া হইতেছে সেটা যে কেবল আবৃত্তি নয়, তাহা যে তখন-তখনি জীবন-উৎস হইতে তাজা উঠিতেছে, এটা অনুভব করিলে শ্রোতার আনন্দ অক্লান্ত অম্লান হইয়া থাকে। কিন্তু মুশকিল এই যে, সৃষ্টি করিবার ক্ষমতা জগতে বিরল। যাদের শক্তি আছে তারা গান বাঁধে, আর যাদের শিক্ষা আছে তারা গান গায়–সাধারণত এরা দুই জাতের মানুষ। দৈবাৎ ইহাদের জোড় মেলে, কিন্তু প্রায় মেলে না। ফলে দাঁড়ায় এই যে, কলাকৌশলের কলা অংশটা থাকে গানকর্তার ভাগে, আর ওস্তাদের ভাগে পড়ে কৌশল অংশটা। কৌশল জিনিসটা খাদ হিসাবেই চলে, সোনা হিসাবে নয়। কিন্তু ওস্তাদের হাতে খাদের মিশল বাড়িতেই থাকে। কেননা, ওস্তাদ মানুষটাই মাঝারি, এবং মাঝারির প্রভুত্বই জগতে সব চেয়ে বড়ো দুর্ঘটনা। এইজন্যে ভারতের বৈঠকী সংগীত কালক্রমে সুরসভা ছাড়িয়া অসুরের কুস্তির আখড়ায় নামিয়াছে। সেখানে তান-মান-লয়ের তাণ্ডবটাই প্রবল হইয়া ওঠে, আসল গানটা ঝাপ্সা হইয়া থাকে।'' (সংগীতের মুক্তি) 

এ বিষয়ে আমার মনে হয় তাঁর অভিপ্রেত অনেকটা পাশ্চাত্যের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ধরনের সঙ্গে মেলে। সেখানেও স্বরলিপির নির্দিষ্ট বাঁধনকে আপোসহীনভাবে স্বীকার করে নিয়েও বিভিন্ন শিল্পীর পরিবেশনে নিজস্বতার সিলমোহর লক্ষ্য করা যায়। তবে এই মিলটা শুধু সুরের ক্ষেত্রেই প্রযুক্ত হতে পারে, সুর ও বাণীর মালা গাঁথার সাফল্য এক্ষেত্রে অর্জিত হয়না। নিজের সৃষ্টির অবয়বকে এইভাবে রক্ষনবেক্ষণ করার সাধ ও সাধ্য, শুধু বাংলায় কেন সারা ভারতবর্ষে কোথাও চোখে পড়েনি। বাংলাতে অন্য যেসব প্রধান কম্পোজার ছিলেন, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল বা নজরুল কেউই নিজস্ব সৃষ্টির পরিবেশন পদ্ধতি বিষয়ে এ জাতীয় স্পষ্ট ও নির্দিষ্ট নীতিনির্দেশ রেখে যাননি। তাই তাঁদের গান পরিবেশনের ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে দিলীপকুমারের ঈপ্সিত পদ্ধতিটিই বলবতী হয়েছে । উল্লেখ্য, যা আমাদের আবহমান কালের গীতকৌশল। 


এখন হবে প্রাণের আলাপ 

রবীন্দ্রসঙ্গীত বিচার করার সময় পণ্ডিতেরা মোটামুটি দুটি পর্যায় লক্ষ্য করেন। ১৯১৩র আগে ও তার পরে। ইন্দিরাদেবী ১৯৪২ সালে ( অর্থাৎ কবির চলে যাওয়ার অব্যবহিত পরে) বলেছেন , তিনি নোবেল পাওয়ার আগের রবীন্দ্রসঙ্গীতকে 'সাবেক' এবং পরবর্তী কালের রচনাকে 'আধুনিক' আখ্যা দিয়েছিলেন। এই 'আধুনিক' রবীন্দ্রসঙ্গীত সৃষ্টি হয়েছে ১৯১৫ সালের পর থেকে। 'সাবেক' রচনাগুলি মূলত রাগাশ্রয়ী ঐশী ও আরাধনাকেন্দ্রিক, যার রচনা, সুরসৃষ্টি ও স্বরলিপিকরণ হয়েছিলো ব্রাহ্মসমাজের প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি রেখে। এই ধারার বাইরে যেসব গান, ধরা যাক তাঁর নিজের সুর করা একেবারে প্রথমযুগের গান, শাহিবাগের প্রাসাদে বসে লেখা 'বলি ও আমার গোলাপ বালা' গোছের গান অবশ্যই রবিবাবুর গান, কিন্তু 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' হয়ে উঠতে পারেনি। এরকম অনেক উদাহরণ হয়তো দেওয়া যায় কিন্তু তা নিষ্প্রয়োজন। মূল কথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে স্বাতন্ত্র্য ও আত্মবিশ্বাস খুঁজে পান নোবেল পাওয়ার পর। এই ধরনের কথা শুধু ইন্দিরাদেবী নন, ধূর্জটিপ্রসাদও বলেছিলেন। তাঁর 'আমরা ও তাহারা' বইয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতের যুগবিভাগ করেছিলেন সুরপ্রয়োগের বৈশিষ্ট্য দিয়ে। প্রথমযুগের গানে নানা শাস্ত্রীয়গানের উৎস থেকে আহরণ করা অমিশ্রিত সুরপ্রয়োগ পরবর্তীকালে বিভিন্ন রাগের মিশেলে সম্পূর্ণ নতুনধরনের সুরব্যক্তিত্ব নিয়ে হাজির হয়েছিলো। প্রমথনাথ বিশী যেরকম বলেছিলেন, ''প্রথমবয়সের গানের মুখ বিরহমিলনপূর্ণ খণ্ডক্ষুদ্র সংসারের দিকে, শেষ বয়সের গানের মুখ বিরহ-মিলনাতীত অখন্ড সৌন্দর্যলোকের দিকে; মধ্য বয়সের গানে, অল্প কিছুদিনের জন্য এই দুই স্বতোবিরোধের মধ্যে সেতুবন্ধনের সুর।'' 


এ প্রসঙ্গে শান্তিদেব বলেছেন, '' মধ্যজীবনে দেখি ছন্দপ্রধান গানের প্রতি তাঁর আকর্ষণ বেশি ও আগের অনুপাতে ঢিমে লয়ের গানের সংখ্যা অনেক কম''। কবি নিজে ইন্দিরা দেবীকে বলতেন, ''আগেকার গান গুলি ইমোশনাল , এখনকার গুলি এসথেটিক''। আবার কবি নিজে বলছেন, ''।।। প্রথম বয়সে আমি হৃদয়ভাব প্রকাশ করবার চেষ্টা করেছি গানে, আশা করি সেটা কাটিয়ে উঠেছি পরে। পরিণত বয়সের গান ভাব বাৎলাবার জন্যে নয়, রূপ দেবার জন্য''। এই 'রূপ' দেওয়া প্রসঙ্গে উদাহরণ দিয়েছেন যে গানটির, '' কেন বাজাও কাঁকন কনকন'', সেটি কিন্তু তাঁর মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সের রচনা। তাই তাঁর নিজের মতে গান বিষয়ে 'পরিণত বয়স' এসে গেছে আরো আগেই । 


আবার ধূর্জটিপ্রসাদ ব্যাপারটিকে দেখছেন সম্পূর্ণ অন্য স্তর থেকে। তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের যুগবিভাগ করছেন সুর যোজনার লক্ষণ থেকে। তিনি লিখেছিলেন, '' ... রাধিকাবাবুর মুখে ভালো ধ্রুপদ শুনে হিন্দুস্তানি কথার বদলে বাংলা কথা বসানো-ই তাঁর কাজ, যেমন- 'সত্যমঙ্গল প্রেমময় তুমি', 'মন্দিরে মম কে'; এই সব গান হিন্দুস্তানি সুরের তর্জমা। দ্বিতীয় যুগে তিনি কথায় ভালো ভালো সুর বসাচ্ছেন, যেমন-'ঝরঝর বরিষে বারিধারা, 'রিমঝিম ঘন ঘন রে' প্রভৃতি গান । তৃতীয় যুগে তিনি সঙ্গীত রচনা করলেন -বাহারের সঙ্গে মল্লার মিশল, ভৈরবীর সঙ্গে মিশল খাম্বাজ, বেহাগের সঙ্গে কেদারা।'' এই মূল্যায়ণটি আজকের দিনে শ্রোতারা হয়তো সঠিক মনে নাও করতে পারেন, কিন্তু যাঁরা কালোয়াতি গানের সমঝদার, তাঁদের বিচারে এই রকম একটা পর্ববিভাগ সমুচিত মনে হওয়াটা অসম্ভব নয়। 

আমরা নিজেদের মধ্যে আড্ডায় লঘুমেজাজে বলতুম মহর্ষির পাঁচশো টাকা পুরস্কারের মোহ কবিকে নোবেল পাওয়া পর্যন্ত ‘রবিবাবু’ করে রেখে দিয়েছিলো। যখনই আমাদের কেউ ঐ সব পর্যায়ের গান গাইতে বলতেন, আমরা হয়তো ঈষৎ আড়ষ্টবোধ করতুম, স্বতোচ্ছাস গায়ন হয়ে উঠতো না। এ বিষয়ে সম্প্রতি একজন পরিণতমনস্ক গায়কের সঙ্গে আলাপসূত্রে সেই কথাই হচ্ছিলো। তাঁকে দীর্ঘকাল ধরে সনিষ্ঠভাবে পূজা পর্যায়ের ঐ সব গান পরিবেশন করতে শুনেছি, কিন্তু তিনিও এখন জানালেন ঐসব গানে তিনি ঠিক স্ফূর্তি পাননা। এর একটাই কারণ , আমাদের মনে 'রবীন্দ্রসঙ্গীতে'র শ্রেষ্ঠতর কাজগুলির ছাপ এতোটা প্রবল, যে অপেক্ষাকৃত দুর্বলতর কাজগুলির প্রতি তাদের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছাড়া বিশেষ আগ্রহ আর উৎসাহ বোধ হয়না। 


রবীন্দ্রসঙ্গীতের পর্যায়ভেদ বিষয়ে এত বিশদ চর্চা এই জন্য প্রয়োজন, যে আমাদের সময়ে যেসব শিল্পী রবিবাবুর গানকে 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' করে তুলেছিলেন, তাঁদের পরিবেশনায় এই গুণগত পর্যায়বাচী সৃষ্টির ধারা বেশ স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছিলো। রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার যে সমস্ত ঘরানাগুলি রয়েছে তার মধ্যে মুখ্য উৎস জোড়াসাঁকো আর শান্তিনিকেতন। ইন্দিরা দেবী বলেছেন কলকাতাকেন্দ্রিক ঘরানা মুখ্যত ব্রাহ্মসমাজমুখী, যেখানে কাঙালিচরণ সেন, প্রতিভাদেবী, সরলাদেবী ও তিনি নিজে যুক্ত ছিলেন। শান্তিনিকেতন সঙ্গীতঘরানার মুখ্য ব্যক্তি দিনু ঠাকুর ও সঙ্গে অনাদি দস্তিদার, শৈলজারঞ্জন ও শান্তিদেব। এই দুই ঘরানার মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার বিবিধ অঙ্গ নিয়ে বেশ তর্কবিতর্ক চলতো। বিশেষত দিনু ঠাকুর ও ইন্দিরাদেবীর মধ্যে। দিনু ঠাকুর যে গায়নশৈলির প্রচারক ছিলেন সে প্রসঙ্গে ইন্দিরাদেবীর কিছু ভিন্নমত ছিলো। 

আপাতভাবে মনে হতে পারে ইন্দিরাদেবী হয়তো একটু 'রক্ষণশীল', কিন্তু তিনি যখন লেখেন, "..... স্বরশুদ্ধি এক জিনিস, সুরসিদ্ধি বা রসসিদ্ধি আর। সেই রসপূর্ণ গায়কীতে উত্তীর্ণ হওয়াই গায়কের লক্ষ্য ; এবং সেই উদ্দেশ্যসিদ্ধ করবার জন্য সদগুরুর দ্বারস্থ হওয়া চাই, নিজ সাধনা দ্বারা স্বরলিপির কঙ্কালে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করা চাই।'' ইন্দিরা দেবীর দীক্ষিত বিখ্যাততম শিল্পী ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস। রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রথাগত 'গুরু' বলতে তিনি সংক্ষিপ্তকালের জন্য হলেও শুধু ইন্দিরাদেবীরই সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তার আগে তাঁর চর্চা তো সীমিত ছিলো শুধু ব্রাহ্মসমাজের প্রার্থনাসঙ্গীতের সমবেত স্বরের একটি স্বর হিসেবে। তাই বিভিন্ন মহল থেকে প্রচারিত রবীন্দ্রসঙ্গীতে 'রক্ষণশীলতা'র মিথটি মনে হতে পরে কিছু কায়েমি স্বার্থান্বেষীর গড়ে তোলা ব্যাপার। যদি ইন্দিরা দেবীর মতো 'রক্ষণশীল' গুরুর শিক্ষা শ্রোতাদের জন্য একজন দেবব্রত বিশ্বাসকে এনে দিতে পারে, তবে এই রটনাটিকে ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ভেবে বর্জন করাই শ্রেয়। এই ভ্রান্ত অপপ্রচারের বিরুদ্ধে আরো একটি প্রমাণ, স্বত্ববিলোপের এতোদিন পরেও রবীন্দ্রসঙ্গীতের মূলস্রোতটিতে এখনও সৎ শিল্পী ও শ্রোতাদেরই স্বরাজ চোখে পড়ে। 


0 comments:

0

বইপোকার বইঘর - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in


বইপোকার বইঘর
অনিন্দিতা মণ্ডল


ভাস্বতী বন্দ্যোপাধ্যায় কাব্য লেখেন, গল্পও লেখেন। পেশায় উচ্চপদস্থ সরকারী আমলা হলেও তাঁর মনোজগৎ সমৃদ্ধ। কারণ শিক্ষার নিক্তিতে তিনি সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্কিত। দেশ বিদেশের নানা সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। জীবন ছেঁচে তিনি তুলে আনেন অমূল্য কিছু পল। তাঁর দেখার চোখ তাঁর বোধের মন, সেই সব পলকে কখনও কবিতা করে তোলে, কখনও বা গল্প। সুতরাং কোনও কঠিন সীমানা দিয়ে তাঁকে ঘিরে ফেলা সম্ভব নয়। 


আলোচ্য গ্রন্থটি প্রতিভাসের প্রকাশনায় একটি কাব্যগ্রন্থ। নাম - কিছু দাহ কিছু জল। মোট ছাপ্পান্নটি কবিতা আছে বইটিতে। প্রতিটি কবিতাই কবির এক স্বতন্ত্র স্বরকে জাগিয়ে দেয়। প্রথম যে কবিতাটি, নাম - ফেরা। কোথায় যে ফিরতে চাই, কেন যে চাই, তাই আমাদের কাছে অজ্ঞাত। অথচ দিনশেষে ফিরতে হয়, অভ্যাসে, কর্তব্যে, আর আপোষে। কোথাও কি নারীর বিষাদকণ্ঠ বেজে উঠছে? সন্ধ্যেবেলার শঙ্খধ্বনির মতন? কবি যে নারী ! কত কত অভিমান যে ভিড় করে! ভুল কবিতায়। "আমাকে আজন্ম তুমি পড়ে গেলে ভুল উচ্চারণে"। সত্যিই! পুরুষ কি কখনও নারীকে ঠিক উচ্চারণে পড়তে পেরেছে? না, পড়তে চায়? অথচ তার কাছে নারীর বাড়ে ঋণ। সে বলে ওঠে, "এখনই যেওনা। থাকো।/ এ জীবন, প্রতিধ্বনিহীন।/ তোমার অপ্রেম দিয়ে তবু ঘিরে রাখো।" কেন এই ঋণ? কারণ, একদিন যত জ্বালা যত দাহ গান হবে। তাই "বেদনা তোমার কাছে ঋণী"। কিন্তু শুধুই কি এমন ছবি? কবি বিজয়িনীও। কখন? মনখারাপের একলা ঘরে সে তার মুকুটখানি খুলে রাখে। দর্পহারা মানবী অন্তরালে বিজয়িনী। তার একলা ঘরের অন্ধকারে অহঙ্কার নামিয়ে রেখে সে বিজয়িনী। 
এ বইয়ের প্রতিটি কবিতা কবির স্বগত উচ্চারণ। কোথাও বৈপ্লবিক উচ্চকিত স্বর নেই। অথচ ফল্গুর ধারার মতো বয়ে যায় এক উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া অভিমান অনাদর আর বেদনার সম্পদ। নারীর যা একান্ত নিজের ধন। এই সম্পদি তাকে অন্তরে ধনী করে। চেতনায় ঊর্ধ্বমুখী করে। সে নিজের সঙ্গে অনবরত কথা বলে। নিজেকে আদর করে। নিজের অভিমানের সঙ্গে খেলে চলে কাব্যখেলা। 

শাদা কালো আর লাল, এই তিনটি প্রাথমিক রঙে আঁকা প্রচ্ছদটি সুদীপ্ত দত্তর। কালোর মধ্যে লালের উন্মোচন যেন অন্তরের অন্ধকারে নিরন্তর রক্তপাতের খবর দেয়। শাদা পাতায় তাই লিখে চলেন কবি। 

যারা নিজের মনে কবিতার সঙ্গে একলা বসত করতে ভালোবাসেন, তাদের কাছে এ বই সঙ্গী হবে। সখী হবে।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - ফাল্গুনি ঘোষ

Posted in


ধারাবাহিক


বইপাড়ার তন্ত্রধারক
ফাল্গুনি ঘোষ


নব্বই দশকের প্রথম ভাগ। কলেজস্ট্রিট বইপাড়ায় নিয়মিত যাতায়াত শুরু। তারপর একসময়ে বেশ কয়েকবছর চব্বিশ ঘন্টাই কলেজস্ট্রিটের বুকে থেকে যাওয়া। ক্রমশ প্রকাশনার কাজে জড়িয়ে পড়ে আজও নিত্য সঙ্গী বইপাড়া। একদিন মফস্বল থেকে এসে পড়েছিলাম এই মহানগরে। সেই অথৈ সমুদ্রে এই বইয়ে ঘেরা পাড়াটি যে একটু একটু করে আমার পাড়া হয়ে উঠল, তার পিছনে এমন বেশ কিছু মানুষের ভূমিকা প্রবল, যাঁরা প্রচলিত খ্যাতির আলোকবৃত্তে হয়তো দাঁড়িয়ে নেই, কিন্তু আমার জীবনে আমার বইপাড়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এঁদের হাত ধরেই আমি বইপাড়াকে চিনেছি- আজও চিনে চলেছি। এই সিরিজ সেইসব মানুষের প্রতি আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের দুর্বল প্রয়াস।



নব্বইয়ের দশকের কোনো এক দুপুর। আমি আর এক বন্ধু প্রেসিডেন্সির রেলিঙে পুরোনো বইয়ের সম্ভারে ব্যস্ত। লক্ষ্য মূলত কবিতার বই। বই থেকে বই। দরদাম থেকে দরদাম। হঠাৎই পিছন দিক থেকে কাঁধে হাত পড়ল। ঘুরে দেখি একটু ভাঁজ পড়া কপাল আর মৃদু হাসি মেশানো এক চাপদাড়ি মুখ। "এই বইটা পড়েছ?" অফ হোয়াইট আর গৈরিক মেশানো প্রচ্ছদের একটা বই ততক্ষণে বাড়িয়ে ধরেছেন তিনি। কবিতার বই। এই কবি ও তাঁর কবিতা- দুইই অজানা। স্বীকার করতেই হল। "পড়ে দেখো।" বইটি হাতে গুঁজে দিয়ে দামের অপেক্ষা না করেই হাঁটা দিলেন চাপদাড়ি। বইটি ছিল বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের 'পা রেখেছেন পরম'। আর চাপদাড়ির নাম ...

দুই বন্ধু রাত জেগে পাগলের মতো পড়ে ফেললাম বইটি। পড়তেই থাকলাম। তারপর মাঝারি লম্বা একটা চিঠি লিখলাম কবিকে। এবার চিঠি পাঠাতে হবে। ঠিক করলাম, ওই বইবাহককে খুঁজে বার করে তাঁর হাত দিয়েই পাঠানো হবে। অতঃপর কখনো বন্ধুটি, কখনো আমি চিঠিটি পকেটে নিয়ে বইপাড়ার পথে পথে তাঁর সন্ধানে। একদিন শিকে ছিঁড়ল আমার ভাগ্যেই। কফিহাউসের এক কোণের টেবিলে প্রুফের তাড়ায় ব্যস্ত তিনি। চিঠি তো দেওয়া গেল। তারপর প্রায়শই দেখা হয়। বিচিত্র বইয়ের খবরাখবর। সঙ্গে নানা মানুষের অসুস্থতায় তাঁর অক্লান্ত ছোটাছুটি, ব্যবস্থাপনা। কানে আসতে লাগল নানা কাহিনি। এককালের কলেজস্ট্রিটে নানা আন্দোলনের মুখ এই মানুষটি বেলঘড়িয়ায় মেতে আছেন চোখে-না-পড়া শিশুদের নিয়ে। আর আছেন এবং আছেনই বইপাড়ায়। প্রুফে সম্পাদনায় আর পছন্দসই বই, খুব দুঃসাধ্য না হলে, একাধিক কপি কিনে তরুণদের পড়িয়ে চলায়।

প্রথম দেখার পরে কেটে গেছে বছর কুড়ি প্রায়। যতদিন দেখছি, কোনোদিনই অসম্ভব সুস্বাস্থ্য দেখিনি, তবু আরও কিছুটা ভেঙেছে শরীর। কিন্তু বইয়ের সম্ভারের সামনে চোখদুটো একইরকম সন্ধানী ও উজ্জ্বল। আমরাও প্রেসিডেন্সি রেলিঙে বই দেখে চলেছি আজও। কাঁধের উপরে একটা অপেক্ষা চলছে। আরও কোনো রঞ্জন সরকারের হাত এসে পড়ে কিনা।

0 comments:

1

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

ধারাবাহিক 


গার্ড (অনুবাদ গল্প) 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 



৬ 

স্বপ্নগুলো ঠিকঠাকভাবে মনে পড়ছিল না তার। মনে হচ্ছিল স্বপ্নগুলো যেন একটা আরেকটাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে, এ ওর ঘাড়ে চড়ে বসছে। একটা স্বপ্নের ভিতরে সে নিজে ছিল, টোবিয়াসও ছিল। হ্যাঁ, আবছা আবছা মনে পড়ছে তার, কে যেন তার সামনেই টোবিয়াসকে বিশ্রীভাবে অপমান করছে। হ্যাঁ, সে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দেখছে, কিচ্ছু করতে পারছে না, কিন্তু তার খুব কষ্ট হচ্ছে, স্বপ্নের মধ্যেই সে বুঝতে পারছিল যে তার খুব কষ্ট! পরের স্বপ্নটা? হ্যাঁ, তার পরের স্বপ্নে সে তার প্রিয়তমা প্রথম স্ত্রীকে দেখেছিল। দেখেছিল সে রেললাইন ধরে হেঁটে আসছে। সে আরও রুগ্ন, আরও ফ্যাকাসে তার মুখ। সুন্দর কোনও পোশাক নয়, তার শরীরে পাগলীর মত ছেঁড়াখোঁড়া নোংরা কাপড় জড়ানো; উদাস ভঙ্গীতে চলে যাচ্ছিল তার কেবিনের পাশ দিয়ে। হ্যাঁ, তার পর আর কিছু মনে পড়ছে না তার। কিন্তু কিছু একটা ঘটেছিল স্বপ্নের ভিতরে। ঠিক এই জায়গাটাতেই কিছু হয়েছিল .. তারপরে তার প্রিয়তমা দ্রুত পদক্ষেপে রেললাইন ধরে মিলিয়ে যাচ্ছিল তার দৃষ্টিসীমার বাইরে... যেতে যেতে সে টলে টলে পড়ে যাচ্ছিল... তবুও, ভীষণ তাড়াতাড়ি দৌড়ে চলে যাচ্ছিল। 

ঠীল জোর করে মনে করবার চেষ্টা করছিল পুরো স্বপ্নটা। ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্নটা জুড়ে নির্মাণ করবার চেষ্টা করছিল তার সম্পূর্ণ অবয়ব। নাহ, শুধু এইটুকুই মনে পড়ছে যে মিনা চলে যাচ্ছিল। একেবারে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল তাকে? হ্যাঁ, হয়তো তাই। কারণ, যাবার আগে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছিল সে। প্রিয়তমার দুই চোখে কত কষ্ট, যন্ত্রণা, ক্ষোভ ফুটে উঠছিল। তার পা দুটো তাকে টেনে নিয়ে যেতে পারছিল না। হয়তো সেই জন্য সে টলে পড়ে যাচ্ছিল। উফফ, কী সাঙ্ঘাতিক স্বপ্ন! 

ওর হাতে যেন কী একটা ছিল। হ্যাঁ, কাপড়ে জড়ানো, ছোট রক্তমাখা, কী যেন! এমনভাবে ওই জিনিসটার দিকে সে তাকিয়েছিল, উফফ ওর দৃষ্টিটা! নাহ... ওই স্বপ্নের দৃশ্য থেকে ঠীলের মনে পড়ে গেলো অতীতের ঘটনা। মনে পড়ে গেলো মৃত্যুপথযাত্রিণী সেই মা, তার প্রথম স্ত্রী তার সদ্যোজাত শিশুটির দিকে ঠিক এইভাবেই একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। মৃত্যুর পরেও চোখের পাতা বুজে যায়নি। চোখের মধ্যে ভীষণ কষ্ট ছিল, সন্তানকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট! সেই চোখের চাউনি ঠীল কোনওদিন ভুলতে পারবে না। সে নিজে অনাথ হয়ে জন্মায় নি, তার বাবা- মা দুজনকেই সে দেখেছে। সে হয়তো সেই কষ্ট নিজের অন্তর দিয়ে বুঝতে পারবে না কোনওদিন, তবে ভুলতেও পারবে না। 

কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে ও ওইভাবে এলো কেন? চলেই বা গেলো কেন? সে জানে না, বুঝতে পারছে না। সত্যিই কি বুঝতে পারছে না? হয়তো বা তার অন্তরাত্মা জানে। সম্ভবত তার প্রথম স্ত্রী তাকে অস্বীকার করে চলে গেলো; চিরতরে চলে গেলো তার আত্মার ঠাঁই ছেড়ে। ঝড়বৃষ্টির রাতে একবারে চলে গেলো সে; ঠীল পিছনে পিছনে অনেকবার ডেকেছিল, ‘মিনা, মিনা!!’ ডাকছিল, চীৎকার করে ডাকছিল। ডাকতে ডাকতেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার। 

নিকষ অন্ধকারের মধ্য দিয়ে ট্রেনটা এগিয়ে আসছে। ট্রেনের সামনের লাল আগুনের ভাঁটার মতো হেডলাইটদুটো একটা বিশালাকার দৈত্যর চোখের মতো দেখাচ্ছে। লাইটের সামনের বৃষ্টিফোঁটাগুলোকে লালচে আভায় মনে হচ্ছে যেন রক্তবিন্দু। মনে হচ্ছে রক্তের ধারাপাত, আকাশ থেকে ঝরে পড়ছে। ঠীলের মনে হঠাৎ আতঙ্ক জাগলো। ট্রেন যত এগিয়ে আসছে, তত তার ভয় বেড়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন আর বাস্তব যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে। সে এখনো স্বপ্নের অপসৃয়মান নারীর অবয়ব দেখতে পাচ্ছে রেললাইনের উপরে। সে কার্তুজের থলিটা হাতড়াচ্ছিলো অন্ধকারে। আরেকটু হলেই গুলি ছুঁড়ে ট্রেনটা থামিয়ে দিতো সে। ভাগ্যক্রমে বেশ দেরি হয়ে গেলো; ট্রেনের আলোয় তার চোখ ধাঁধিয়ে গেলো আর ট্রেনটা ঝমঝম করে এগিয়ে গেলো তাকে পিছনে রেখে। 

রাতে ডিউটির বাকি সময়টুকু ঠীল কোনওভাবেই শান্তি পাচ্ছিল না। তার মনে হচ্ছিল সে এখনি বাড়ি ফিরে যায়। ফিরে যায় তার ছোট্ট সোনা টোবিয়াসের কাছে। মনে হচ্ছিল সে যেন কতযুগ তাকে দেখেনি। সম্প্রতি সে টোবিয়াসের স্বাস্থ্য নিয়ে একটু চিন্তিত ছিল। এরকমও ভাবছিল যে চাকরিটা ছেড়ে দেবে এক্কেবারে। 

সময় কাটাবার জন্য ভোর হতে না হতেই সে ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণের কাজে লেগে পড়ল। বাঁহাতে একটা লম্বা লাঠি আর ডানহাতে একটা লোহার রেঞ্চ নিয়ে সে লাইনের জোড়গুলো যখন ঠুকে ঠুকে পরীক্ষা করছিল বা ফিসপ্লেটের নাটবল্টু টাইট দিচ্ছিল, তখনও সূর্যের আলো ফোটেনি। ঝড়বৃষ্টি থেমে গিয়েছে; ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের স্তরের ফাঁক দিয়ে হাল্কা আকাশ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। 

রেললাইনের ধাতব পাতের উপরে নিজের পদক্ষেপের আওয়াজ মিশে যাচ্ছিল গাছগুলোর ডালপালা- পাতা থেকে খসে খসে পড়া জলবিন্দুর শব্দের সাথে। এই শব্দগুলোই হয়তো বা কিছুটা শান্তি দিল ঠীলকে; একাকীত্ব, নৈঃশব্দ সবকিছু হঠাৎ ভীষণ অসহ্য মনে হচ্ছিল। সকাল ছ’টায় পরের ডিউটির লোক আসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঠীল এতটুকু সময় নষ্ট না করে রওনা দিল বাড়ির দিকে। 

কী সুন্দর এই রবিবারের সকালটা! ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘগুলো অনেকক্ষণ দূরে সরে গেছে, হারিয়ে গেছে দিগন্তসীমার ওপারে। সূর্যটা রক্তমুখী মাণিক্যের মতো জ্বলজ্বল করে উঠে নিষ্কলুষ আলোয় ভাসিয়ে দিতে চাইছে অরণ্যের অন্ধকার কোণগুলো। অরণ্যের গাছের কাণ্ডগুলোর গোলকধাঁধার ফাঁক দিয়ে সূর্যের ধারালো রশ্মি এসে বিদ্ধ করছে। ফার্নের পাতাগুলো সূর্যের আলোয় স্নান করে শাণিত ফলকের মতো হয়ে উঠছে; অরণ্যভূমির রূপালী ধূসর লাইকেন ছত্রাকগুলিকে রক্তপ্রবালের গুচ্ছের মতো দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন অরণ্যে গাছগুলোর মাথায়, কাণ্ডে, ঘাসে ঘাসে দাবানল ছড়িয়ে পড়ছে। আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। আকাশে বাতাসে একটা সতেজ সজীব ভাব! এই সজীবতার ছোঁয়া, প্রাণের ছোঁয়া ঠীলকেও স্পর্শ করছে। তার হৃদয়মন হাল্কা হয়ে উঠছে, মাথার ভেতরে একটু একটু আবছা হচ্ছে গতরাতের দুঃস্বপ্নের ছবিগুলো। 

বাড়ি ফিরে ঠীল যখনি রোদ্দুরমাখা বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা টোবিয়াসের আপেলের মতো লাল গালদুটো দেখতে পেল, তখনি সব দুশ্চিন্তা, দুঃস্বপ্নের ছবি একেবারে মিলিয়ে গেলো। সত্যি, কী যেন একটা অদ্ভুত পরিবর্তন এসেছে ঠীলের মধ্যে। সারাদিনে এই ব্যাপারটা লেনাও লক্ষ্য করলো। রবিবারে চার্চে গিয়ে আজ ঠীল কেবল ধর্মগ্রন্থের ভেতরে মুখ গুঁজে বসে রইলনা; পাশ থেকে আড়চোখে কী যেন দেখছিল লেনার দিকে। এমনকি দুপুরবেলাতেও সেরকম কোনও কথা না বলেই, ঠীল নিজেই গুছিয়ে নিচ্ছিল টোবিয়াসের অতিরিক্ত ছোট জামাকাপড়, যেগুলো রাস্তায় ঠাণ্ডার জন্য গায়ে চাপানো প্রয়োজন। এই ছোটখাট পরিবর্তনগুলো হয়তো সেভাবে লক্ষণীয় ছিলনা, কিন্তু সূক্ষ্ম একটা বদল কোথাও ঘটেছিল। 

সারাদিনে ঠীল একটুও ঘুমায়নি; ছুটি ছিল তার। সেদিন রাতে ডিউটি ছিলনা। তাড়াতাড়ি রাত নটার মধ্যেই ঘুমাতে গেলো সে। সবে ঘুমিয়ে পড়বে, তখনি লেনা জানালো যে পরদিন সকালে সে তার সঙ্গে ডিউটিতে যেতে চায়, কারণ ওই উপহার পাওয়া জমিটা সাফসুতরো করে, ঠিকঠাক ভালোভাবে খুঁড়ে, তারপর আলু বুনতে চায় সে ওই জমিতে।

1 comments: