গল্প - সায়ন্তন ঠাকুর
Posted in গল্প
গল্প
দূরদর্শন
সায়ন্তন ঠাকুর
১
শরৎ ব্যানার্জি রোডের এই ছোট ছিমছাম রেস্তরায় এসে বসল ওরা দুজন। শনিবারের শহর তখন বৃষ্টি আসার অপেক্ষায় মৃদু মেঘের চাদরে নিজেকে ঢেকে নিয়েছে। রেস্তরাটা ছিমছাম, টলি পাড়ার বাংলা সিনেমার পোষ্টার আর মোটিফে সাজানো চারদিক। নরম আলো আর গান। ল্যাম্বের পাতলা শাঁসে মোড়া চিংড়ি মাছ ভাজা এলো টেবিলে ওদের। সঙ্গে ঠাণ্ডা ড্রট বিয়ার। প্রায় দু লিটার। একটা চিংড়ি আলগোছে ফর্কে গেঁথে মুখে দিতেই মেয়েটার মুখে আলো জ্বলে উঠল যেন! টেনে নিল ভারী উঁচু বিয়ারের গ্লাস। উল্টোদিকে বসে থাকা ছেলেটা চুপ করে একদৃষ্টে মেয়েটার মুখে ফুটে ওঠা সেই আলো দেখছে। প্রায় দুমিনিট পর বিয়ারে একটা মাঝারি চুমুক দিয়ে মেয়েটা জিগ্যেস করল, “কীসের এত দুঃখ তোমার”? মজা মেশানো প্রশ্নে মিশে গেল এক অতি মিহি কৌতুক এবং কিছু প্রচ্ছন্ন ব্যাঙ্গ!আসলে প্রায় দশ বছরের বড় এই লোকটার প্রতি কিছু মায়া অনুভব করে মেয়েটা। আবার বিরক্তিও লাগে, এত ঘ্যানঘেনে এই লোক। সারাদিন ধরে হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে পাঠাতে থাকে যত মনখারাপের শব্দ। লোকটার একটা নেগেটিভ ভাইব্রেশন ফিল করে সারাদিন ধরে সে। একেকসময় ভাবে এরকম লোকের সঙ্গে যোগাযোগ না রাখাই ভালো। রাখেও না তেমন।দশটা মেসেজ পাঠালে একটার উত্তর দেয়। তাও যতটা পারে নিঃস্পৃহ হয়ে,যেটুকু না পাঠালেই নয়।তবুও পুরোপুরি পারে না! তাকে কিছু মেটেরিয়ালিস্টিক সাহায্য করেছে মানুষটা একসময়, সে কথা ভেবেই কি? লোকটা কি তাকে ভালবাসে সত্যি? কে জানে। তার চারপাশের মানুষজন তাকে ক্রমাগত নিষেধ করে লোকটার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখতে, তবুও কিসের টানে কে জানে এড়াতে পারে না। এমনকি তার বাবাও নিষেধ করে। মাঝে মাঝে বাড়িতে মিথ্যে কথা বলেও বেরিয়ে আসে, আজই যেমন বলে এসেছে তার হবু বরের সঙ্গে বেরোচ্ছে! তবে কি কোনও মায়া? নাকি সাহায্যের বিনিময়ে দেওয়া কোনও প্রতিদান? সে নিজেও জানে না ঠিক। তবে লোকটা বড় ভীতু এবং ভালোমানুষ। ট্যাক্সির অন্ধকারে, আড়ালে আবডালে কখনও তাকে জোর করেনি। চুমু টুমুও খেতে চায়নি। ওই যেটুকু কথা বলে কবিতা মেশানো সান্ধ্য ভাষায়, তা অনায়াসেই উপেক্ষা করতে পারে সে। তবে আসল সমস্যাটা হলো এই ঘ্যানঘেনে নাকে-কাঁদা লোকটাকে আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এবার একে ছেঁটে ফেলতে হবে এবং সেটা খুব রুড ওয়েতে করাও যাবে না। সে চেষ্টা করছে। কৌশল এবং বুদ্ধি প্রয়োগ করে কোনও একটা উপায়ে।
“দুঃখ নেই তো! দুঃখ কিসের আর! শুধু একটা যন্ত্রণা আছে”, ছেলেটা বলে ওঠে।
“কোনও যন্ত্রণা নেই। ওসব তোমার মনগড়া গল্প। একটু স্বাভাবিক হও”
“এই যে ক্রমশ আমি একটা অন্য পৃথিবীর ডাকে মিশে যাচ্ছি, চলে যেতে চাইছি, সারাক্ষণ আমার কানের কাছে কে যেন বলে যায় এটা তোমার জগত নয়, সেটা তাহলে কি? পুরোটাই আমার কল্পনা?”
আবার শুরু করেছে। উফ! মুখের সামনে কিছু বলাও যায় না! কেন যে এর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। পাগল করে দেবে আমাকে। মনের কথাগুলো সযত্নে সরিয়ে রেখে মেয়েটা বলে ওঠে
“তা কেন! তোমার আসলে কোনও সমস্যাই নেই, তুমি বেশি ভাবা বন্ধ কর”
“বেশি ভাবছি না, শুধু চোখের সামনে কতগুলো দৃশ্য ভেসে যায় সারাদিন আর মনে হয় লেখা ছাড়া বাকি সব কাজই করতে পারছি”
এই এক লেখা লেখা শুরু করেছে। এমন ভাব যেন মার্কেজ। হোয়াটসঅ্যাপে মাঝে মাঝেই লেখা পাঠায়। যতদূর সম্ভব রিড না করে রেখে দেয়, আর যদি কখনও দ্যাখে, মানে মেসেজ থ্রেডটা খুলে যায় তাহলে লিখে পাঠায়, ভালো হয়েছে বা বেশ হয়েছে। মাঝে মাঝে ভাল হয়নি লিখেও পাঠায়, একটা রেশিও মেন্টেন করে। দুটো ভালো বা তিনটে ভালোর পর একটা খারাপ!
“এত ভেবো না তো! সব ঠিক আছে, কেন লিখতে পারবে না! নিশ্চয় পারবে”
আরে ভাই এবার চুপ কর তুই! খেতে দে আমাকে! গাড়িতে ফেরার সময় আবার শুনতে হবে অতক্ষণ ধরে! গাড়িতে উঠে মাথা ধরার কথা বলতে হবে।
“পারব লিখতে? মনে হয় না কিন্তু আর”
“কেন পারবে না, এত ভালো লেখ তুমি, কেন পারবে না!”
কোনও তর্কে না যাওয়াই ভালো! যতটা পারা যায় ভালো ভালো কথা বললে একটু চুপ করে অনেক সময়। অথচ প্রথমদিকে বেশ লাগত কথা বলতে। চারপাশের একঘেয়ে মানুষের ভিড়ে লোকটার কথা যেন টাটকা বাতাসের মতো ছিল। মায়াময় শব্দ দিয়ে ঘেরা এক আদিম ভূখণ্ড।
“আজকাল সারাদিন কত দৃশ্য দেখি জানো! কাল দেখছিলাম, ওই দুপুরে বৃষ্টি হচ্ছিল না, তারপর, এক ফালি নোংরা আলোয় ঢেকে ছিল এক্সাইড মোড়” বিয়ারে একটা চুমুক দিয়ে থামে লোকটা।
“তারপর ?” এটা তো আগে বলেনি, নতুন মনে হচ্ছে!
“হ্যাঁ দেখলাম, সবুজ রঙের একটা পাঞ্জাবি আর ঢোলা সাদা পাজামা পরে সিগনাল পার হচ্ছে সুনীল গাঙ্গুলি। সঙ্গে, সাদা সেই গাউন পরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো! স্পষ্ট দেখলাম”
“ওটা তুমি নিশ্চয় ভাবছিলে ওঁদের কথা, তাই”
বোঝা গেছে! সেই এক ইউটোপিয়া। এই জন্য এসব লোকের লেখা পড়া অবধি ঠিক আছে, কিন্তু নিজের জীবনে জড়াতে নেই!
“ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো আর সুনীল গাঙ্গুলি! একসঙ্গে ভাবব? আশ্চর্য লাগছে না তোমার?”
“না মানে দুজনের লেখা হয়তো আগে পরে পড়েছো, তাই তোমার কল্পনায় দেখেছো ওঁদের, একসঙ্গে”
প্রসঙ্গ থেকে বেরোতে না পারলে এই নিয়েই চলবে এখন!
“শোনো, এত ভেবো না তো তুমি! চিংড়িটা খাও, অপূর্ব বানিয়েছে এরা”
“ল্যাম্বের র্যাপারটা বেশ ইউনিক!” একটু অন্যমনস্ক দেখায় ছেলেটাকে।
“আবার কী হলো? কী ভাবছো এত?”
“না সেদিন বাড়ি ফিরছি, অনেকটা রাত হয়েছে ,গলির মুখে দেখি কমল মজুমদার আর সন্দীপন দাঁড়িয়ে কী সব গল্প করছে। তারাপদ রায়ও ছিল বোধহয়। তা উত্তেজনায় আমি এগিয়ে গেলাম, কিন্তু কোনও শব্দ শুনতে পেলাম না। অনেকবার ডাকলাম কিন্তু আমার ডাক মনে হলো কেউ শুনতেও পেল না। শেষে থাকতে না পারে গায়ে হাত দিলাম, কমলবাবুর গায়ে স্পষ্ট টাচ করলাম, কিন্তু তাও কেউ গ্রাহ্য করল না। কী অদ্ভুত না ?”
“শোন, এসব নিয়ে যত বেশি ভাববে, সমস্যা তত বাড়বে। বেটার হচ্ছে এসব নিয়ে কিছু না ভাবা”
এ তো মহা ঝামেলায় পড়া গেল আজ। এটা আবার নতুন সিমটম!মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে না বানিয়ে বলছে কিনা! দুঃখ বিলাস একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। পুরো শনিবারের সন্ধেটা দিল মাটি করে।
“ভাবব না? কিন্তু দেখতে পাচ্ছি তো স্পষ্ট”
“ওটা হ্যালুসিনেশন তোমার। একটু শান্ত জীবন কাটাও। দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে”
“শান্ত জীবন কাটাতেই তো চাইলাম সারাজীবন। তার বদলে দূরে চলে যেতে থাকল সবাই। সেই ছেলেবেলা থেকে একই গল্প। কবে একটা নদীর ধারে লাল আর হলুদ রঙে ডোবানো আকাশ দেখেছিলাম, তার ছায়ায় ভাসছিল একটা স্থির নৌকো, সাইকেল শুয়ে রেখে নদীর বাঁধের ওপর বসে ছিলাম আমি-সেদিন থেকেই কে যেন ধার দিল আমাকে মনখারাপ। মনে করিয়ে দিল যেন, ওহে, তুমি এ পৃথিবীর কেউ নও! এখানে বেশিদিন বসে থেকো না তুমি”
আবার! আর সত্যিই পারা যাচ্ছে না।
“এই শোনো, আমরা আরেকটা কিছু অর্ডার দিই?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়! কী খাবে বলো? দাও অর্ডার”
“পর্ক ইন ওয়েস্টার সস, বলি? এটা স্পাইসি হবে তো? দাঁড়াও ওয়েটারকে জিগ্যেস করে নিই”, হাত তুলে ওয়েটারের দিকে ইশারা করে মেয়েটা। মেয়েটাকে আজ ভারী চমৎকার দেখাচ্ছে। কালো টিশার্ট আর এলোমেলো বড় বড় নানারঙের খোপওয়ালা লং স্কার্টে।একটা রোগা ক্লিপ দিয়ে সামান্য আটকানো লালচে রঙা মসৃণ চুলের ঢাল।
“বলো এবার, কী বলছিলে?” অর্ডার দিয়ে জিগ্যেস করে মেয়েটা।
“কী বলছিলাম বলো তো ?” একটু দিশেহারা দেখায় ছেলেটাকে।
“চলো, সিগারেট খেয়ে আসি”, এই রেস্তরায় স্মোকিং জোন নেই, তাই সিগারেট খেতে হলে বাইরে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে হয়।
“আমি বলছি কি, এসব নিয়ে চিন্তা করো না” সিগারেট জ্বালিয়ে মেয়েটা স্থির গলায় বলে।
“হুঁ। আকাশটা আজ খুব লাল। বৃষ্টি হবে মনে হচ্ছে”
“আর খুব বেশি ওয়েট করব না। ন’টার মধ্যে বেরিয়ে যাব। অতটা রাস্তা আবার যেতে হবে”
“হ্যাঁ, যেতে তো হবেই”
“শোনো না, সামনের শনিবার সামপ্লেস এলস যাবে? অনেকদিন যাইনি”
“চলো, তোমার যখন ইচ্ছে করছে”
“আর এসব নিয়ে ভেবো না। দেখো আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে”
“কিচ্ছু ঠিক হবে না। আমি জানি। চলো ভেতরে যাই” খুব শান্ত আর নিঃস্পৃহ শোনায় ছেলেটার গলা।
যাহ বাবা! হঠাৎ উল্টো সুর! কিছু বুঝতে পারল নাকি! কিন্তু সে তো সরাসরি মুখের ওপর কিছু বলেনি। তাহলে ?
“চলো”
পর্কের নরম সস মাখা চাকতি মুখে তুলে মেয়েটা বলে ওঠে, “আহা!অসাধারণ বানিয়েছে, একবার খেয়ে দ্যাখো! সব মনখারাপ কেটে যাবে তোমার!”
“মনখারাপ নেই কিন্তু। তুমি বারবার বুঝতে ভুল করছো। আমি যন্ত্রণার কথা বলছি”
“হোয়াটেভার ইট ইজ, কেটে যাবে সব! খাও খাও” আরও একটা চাকতি মুখে তোলে মেয়েটা। আলগোছে একবার ঘড়ি দেখে নেয়।সাড়ে আটটা, প্রায় শেষ হয়ে এসেছে সময়। আর একটু। তারপর বাঁচা যাবে এই ঘ্যানঘেনে নাকে কাঁদার হাত থেকে!
“হোয়াট-এভার! হোয়াট-এভার! জানি আমি বাকি পৃথিবীর কথা” ছেলেটার অস্পষ্ট মৃদুস্বর আবছা আলোর মতোই মিশে যায় খাবারের গন্ধমাখা ভারী বাতাসে।
“কী বলছো বিড়বিড় করে?”
“কিছু না। পর্কটা সত্যিই ভালো করেছে”
“বললাম না তোমাকে!মনখারাপ কেটে গেল না?!”
“মনখারাপ নয়। যন্ত্রণা।”
“হ্যাঁ, কেটে গেল না সেটা ?”
“হ্যাঁ, সব কেটে গেছে। চলো একটা সিগারেট খেয়ে আসি”
“চলো। চলো।”
বাইরে বেরিয়ে ছেলেটা আবার দ্যাখে, খাকি জামা আর প্যান্ট পরে সার্দাণ এভিনিউএর ওপর দাঁড়িয়ে আছে পুরনো প্রবাদের মতো শক্তি চট্টোপাধ্যায়। রাস্তার ঠিক মাঝখানে। সাঁই সাঁই করে দুপাশ থেকে ছুটে যাচ্ছে বাস মিনিবাস এবং ট্যাক্সি। আকাশে জলের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে স্পষ্ট। যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে অ্যাকসিডেন্ট।
“কি হলো, জ্বালাও সিগারেট! কি দেখছো রাস্তার দিকে?”
“হ্যাঁ এই নাও” সিগারেট জ্বালিয়ে দেয় ছেলেটা। আড়চোখে দেখতে থাকে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে। এখনও রাস্তার মাঝেই দাঁড়িয়ে।
“এবার ওলা দেখতে হবে। প্রায় ন’টা বাজতে চলল”
“হ্যাঁ, চলো ভিতরে বসে দেখছি”
“কীরকম অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তোমাকে, কী হলো তোমার ?”
“না তো। ঠিকই আছি” ফ্যাকাসে হাসার চেষ্টা করে ছেলেটা। এখনও রাস্তার ওপর স্থির দাঁড়িয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
রেস্তরায় ফিরে এসে বিলের কথা বলে ছেলেটা ওয়েটারকে। বাকী বিয়ারটুকু শেষ করে। নীল ডেবিট কার্ড বের করে বিল মেটায়।আলতো করে কুড়ি টাকার একটা নোট রেখে দেয় কালো বিলবোর্ডের ভেতর। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “ওলা পাচ্ছি না।চলো হলুদ ট্যাক্সি দেখি”
“একটাও ওলা নেই? চাপ হয়ে গেল তো”
“এমনি ট্যাক্সি দেখি চলো, পেয়ে যাব মনে হয়”
“এই এক সমস্যা হয়েছে, শনিবার রাত হলেই, আর কিছু পাওয়া যাবে না! বিরক্তিকর”
রাস্তায় বেরিয়ে ছেলেটা দ্যাখে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর দাঁড়িয়ে নেই রাস্তার ওপর। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সে।
“একটা ক্লোরোমিন্টের প্যাকেট নাও তো”
ক্লোরোমিন্ট আর সিগারেট কিনে সার্দাণ অ্যাভিনিউ পার হয়ে উল্টো ফুটপাতে আসে ওরা দুজন।
দুটো তিনটে যেতে অরাজি ট্যাক্সি পার হয়ে যায় ওদের। আকাশ তখন আরও লাল। বাতাসে আসন্ন বৃষ্টির ইশারা।
অতঃপর এসে দাঁড়ায় সেই ট্যাক্সি। মেয়েটা এগিয়ে যায়, “এই যে দাদা, যাবেন ?”
পেছন থেকে স্পষ্ট দেখতে পায় ছেলেটা ট্যাক্সি ড্রাইভারের মুখ। সেই মুখ, অবিকল। হৃৎস্পন্দন প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আপ্রাণ বলে ওঠে, “না না এটা ছেড়ে দাও, আমি অন্য ট্যাক্সি দেখছি”
“আরে আশ্চর্য! দেখছো না বৃষ্টি আসছে। উঠে এসো শিগগীর!” মেয়েটা ততক্ষণে ট্যাক্সির ভেতর উঠে বসেছে দরজা খুলে।
নিরুপায় ছেলেটা উঠে আসে। ট্যাক্সির ভিতর কেমন যেন একটা সোঁদা গন্ধ। বহু পুরনো কোনও মাটির। উঠেই সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করে। দুটো কাঠি নষ্ট হয়। তৃতীয়বারের চেষ্টায় ধরাতে পারে সিগারেট। আড়চোখে লুকিং গ্লাসের ভেতর থেকে আরও একবার ড্রাইভারকে দেখে নেয়।
“কী হলো তোমার? কেমন অস্থির লাগছে। শরীর খারাপ করছে নাকি?”
“নাহ! একটু মাথা ধরেছে”
“চোখ বন্ধ করে রেস্ট নাও। কথা বলো না”
যাক বাবা! এতটা রাস্তা বকবকের হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল।খুশি হয়ে মেয়েটা আরও জানলার ধার ঘেঁষে আই ফোন খুলে ফেসবুক দেখতে শুরু করল।
২
বৃষ্টি নামল লেকটাউন ফ্লাইওভারে ওঠার ঠিক একটু আগে। চারপাশ ঝাপসা করে চরাচর ধেয়ে নেমে এলো আততায়ীর মতো। সঙ্গে এলোমেলো বাতাস। ভুতুড়ে কুয়াশার মতো ঘিরে ধরল ওদের ট্যাক্সি।
“আরে বৃষ্টি এলো, জানলাটা বন্ধ করে দাও”
“হ্যাঁ, বৃষ্টি এলো” জানলার কাঁচ তুলতে তুলতে আরও একবার দেখে নিল ছেলেটা ড্রাইভারকে। নিবিষ্ট মনে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে।মাঝে মাঝে লাল কাপড় দিয়ে মুছে নিচ্ছে সামনের কাঁচ। নাহ!ছেলেটার ভুল হয়নি। কতবার দেখেছে এই মুখ। কত বই-এর চতুর্থ কভারে। স্বয়ং উৎপল কুমার বসু আজ চালাচ্ছেন তাদের ট্যাক্সি!
“সেই লেখাটা মনে আছে তোমার?”
“কোন লেখাটা?” ঢোক গেলে ছেলেটা।
“ওই যে, মন মানে না বৃষ্টি হল এত/ সমস্ত রাত ডুবো নদীর ধারে/ আমি তোমার স্বপ্নে পাওয়া আঙুল/ স্পর্শ করি জলের অধিকারে!”
“হ্যাঁ, মনে আছে” ফ্যাসফেসে গলায় ছেলেটা বলে ওঠে। আবারও লুকিং গ্লাস দিয়ে দেখে নেয় ওঁর মুখ। একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে।নির্বিকার।
“কী নাম ছিল যেন লেখাটার ?”
“ইয়ে মানে, নবধারাজলে মনে হয়”, গলার স্বর আটকে আসছে ছেলেটার।
“তোমার কি শরীর খুব খারাপ লাগছে এখনও?”
“না, ঠিক আছি এখন”
এয়ারপোর্ট পার হয়ে বৃষ্টি কমে আসে একটু।
“দাদা সামনের সিগনাল পার হয়ে একটু রাখবেন গাড়ি। আমি নামব” মেয়েটা বলে ওঠে, “শোনো আমি নামছি, পৌঁছে জানিও”
“ছাতা আছে তোমার সঙ্গে?”
“হ্যাঁ আছে, পৌঁছে জানিও”, নেমে যায় মেয়েটা ট্যাক্সির দরজা খুলে।
ছেলেটার গা শিরশির করে ওঠে। কী হবে এবার?
৩
রাত প্রায় একটার সময় মেয়েটার ফোনে একটা ফোন আসতে থাকে বারবার। সে তখন তার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে আগামী সংসারের গল্পে ব্যস্ত। ফোন আসতেই থাকে। কয়েকবার ফোন আসার পর বয়ফ্রেন্ডের ফোন রেখে সে নিজেই কল ব্যাক করে। ওপার থেকে একটা ভারী খসখসে গলা শোনা যায়, “ম্যাডাম, এয়ারপোর্ট থানা থেকে বলছি”
ঈষৎ নার্ভাস গলায় মেয়েটা বলে, “হ্যাঁ, এত রাতে, মানে কি ব্যাপার?”
“আপনার নম্বরটা লাস্ট কল লিস্ট দেখে ট্রেস করেছি আমরা”
“হ্যাঁ মানে, কার কল লিস্ট? কী ব্যাপার বলুন তো?”
“একটা অ্যাকসিডেন্ট, সাদা জামা, নীল ফেডেড জিন্স...বয়স এই ৩৪/৩৫ হবে... ঘন্টাখানেক আগে, একটা ট্রাকের সঙ্গে... ট্যাক্সি... ড্রাইভারকে খুঁজে পাইনি আমরা... স্পট ডেড... হ্যালো ম্যাডাম, শুনতে পাচ্ছেন, চেনেন আপনি?... হ্যালো ?”
0 comments: