প্রাচীন কথা - অনিন্দিতা মণ্ডল
Posted in প্রাচীন কথা
প্রাচীন কথা
মিশ্রি পাক (শেষ পর্ব)
অনিন্দিতা মণ্ডল
সেবা ঠাকুরানী বসেছিলেন ঘর লাগোয়া তিনদিক খোলা এক দালানে। তাঁর সামনে জ্বলন্ত উনুন। সেখানে প্রকাণ্ড কড়ায় কি এক জলের মতো বস্তু টগবগ করে ফুটছে। সেবা ঠাকুমা এক বিরাট ধাতব হাতায় করে নাড়ছেন আর ফেনা সরিয়ে হাতায় করে তুলে তুলে পাশে রাখা আরেকটি বিশাল ধাতব কলসীতে রাখছেন। তাঁর গায়ের রঙ সিস্তানার চেয়ে আরও একটু শ্যামল। চোখ দুটোও যেন বেশি কালো। মাথার চুল সিস্তানার মতোই কোঁকড়া। পরনে ঢিলেঢালা এক কাঁধের এক কাফতান। তবে বাংলা দেশের তুলনায় কি সিস্তানা কি তার ঠাকুমা, দুজনেই বেশ বড়সড় চেহারার। আন্তনি এসে ঠাকুমাকে যথাযোগ্য অভিবাদন করে উঠোনে বাঁধানো পাথরের বেদিটায় এসে বসল। মণিপাল তখনও দাঁড়িয়ে। বাংলা দেশে এসো বোসো না বললে কেউ আসন গ্রহন করেনা। কিন্তু সেবা ঠাকুমা একটু কঠিন তির্যক চাউনি দিলেন। তাই দেখে আন্তনি তাকে ঝটিতি ইশারা করল – আরে বোসো! মণিপাল ধপ করে বসে পরল আন্তনির পাশে। যস্মিন দেশে যদাচারঃ। তারপর আন্তনি আর ঠাকুমার যা কথোপকথন হলো তার সার কথা অনেকটা এইরকম --
আন্তনি – ঠাকুমা, এ হলো মণি। আমার অনেকদিনের বন্ধু। আমাদের যেমন ভূমধ্য সাগরের পারে বাড়ি, এর তেমন বঙ্গোপ সাগরের পারে বাড়ি। এ সেই গঙ্গাহৃদি থেকে ফি বছর এখানে বাণিজ্য করতে আসছে। দেখছ না কেমন শ্যামল চেহারা? খুব বড় ঘরের ছেলে। ওদিক থেকে উত্তর এলো – হুঁ। তা আমার কাছে কেন বাছা? এসব খোঁজে আমার কি দরকার? আন্তনি একটুও না ঘাবড়িয়ে বলল – ঠাকমা, তুমি যে সেই প্রাচ্য দেশের পাতলা জলের মতো কাপড়ের পোশাক বড় ভালোবাসো, এ সেই কাপড়ই তো বেচতে আনে! ঠাকুমা এবার হাতা নাড়তে নাড়তে ফিরে চাইলেন। চোখে সন্দেহ আর আশা কেমন খেলা করছে। ধীরে ধীরে জ্বলন্ত উনুনের পেট থেকে দু চারটে আংরা চিমটে করে সরিয়ে রাখলেন। নিভুনিভু উনুন আঁচে কড়া বসিয়ে রেখে ফিরে বসলেন। মুখে যেন কী এক নরম আভা। তারপর বেশ সতর্ক উচ্চারণে বললেন – তা আমি কি ওসব কিনতে পারি বাছা? ওসব রোমক পাড়ার বিলাস সামিগ্রী। এখানে ওসব কি হবে বাছা? মণিপাল এমনই একটা জুতসই সুযোগ খুঁজছিল। সে তৎক্ষণাৎ একটা বেতের তৈরি বাক্স ঠাকুমার সামনে রাখল। আন্তনি হেসে বলল – নাও ঠাকুমা, খুলে দেখো দেখি আমার বন্ধু কি এনেছে তোমার জন্য! সেবা ঠাকুমার সন্দেহ পুরো যায়নি তখনও। কিন্তু বাক্সর ডালা খুলতেই নজরে পড়ল ঠিক ভূমধ্য সাগরের মতো রঙ, এক সাগর রঙের মসলিনের নীচ থেকে উঁকি দিচ্ছে এক মোটা কাপাসের থলে। উজ্জ্বল মুখে ঠাকুরানী যেন গুপ্তধন খুঁজছেন, এমন ভাবে সেই মসলিন সযত্নে সরিয়ে দেখতে পেলেন কাপাসের আস্তরণে সার দিয়ে সাজানো কি এক গুলি গুলি চাকা চাকা বাদামী রঙের বস্তু। মুখ তুলে চাইতেই আন্তনি চট করে একটি নারকেল নাড়ু তুলে মুখে ফেলে দিলো। তারপর সেটি চুষে চিবিয়ে নানা ভাবে মুখের ভেতরে ঘুরিয়ে মুখে এক স্বর্গীয় আহ্লাদ ফুটিয়ে তুলল। ঠাকুমা বুঝলেন এটি খাদ্যবস্তু। তিনি তখন ঈষৎ হালকা বাদামী একটি চাক, মানে তিলের তক্তির কোণ ভেঙে মুখে ফেললেন। ওহ কী অপূর্ব! তাঁর চোখ টানা টানা। সেগুলো পুরো বর্তুলাকার ধারণ করল। অর্থাৎ যারপরনাই বিস্মিত পুলকিত শিহরিত হচ্ছেন। মণিপাল শত হলেও বেনের ছেলে। সে বুঝেছে ওষুধ ধরেছে। অতএব সবুরে কাজ হবে। ওদিকে ঠাকুমা ততক্ষণে উঠে ঘরে চলে গিয়েছেন। কিছুক্ষণ পরেই তিনি বেরিয়ে এলেন। হাতে একটি ব্রোঞ্জের থালা। তাইতে ক’টি শুভ্র স্ফটিক খণ্ড। এনে রাখলেন মণিপালের সামনে। মণি ধন্দে পড়ল। এ কী জিনিস? হীরা বা অন্য কোনও মুল্যবান রত্ন? সে একটি হাতে তুলে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। আন্তনি চুপ করে দেখছিল মণিপাল কি করে। এবার সে পূর্ববৎ একটি স্ফটিক খণ্ড তুলে মুখে চালান দিল। মণিপাল এগুলিকে রত্নই ঠাউরে ছিল। ঠাকুমার মতো সেও বুঝল এ খাদ্যবস্তু। সেও তখন একটি খণ্ড মুখে দিলো। ব্যাস। সঙ্গে সঙ্গে এক সুন্দর মধুর রসে তাঁর মুখের ভেতর ভরে গেলো। আহা কি সুন্দর তার স্বাদ! দুপক্ষই যখন মধুর মাধুরীতে আচ্ছন্ন তখন আন্তনি কাজের কথা পাড়ল। সে বলল – ঠাকুমা, তোমার সিস্তানা বড়ই দুষ্টু হয়েছে। রাতেবিরেতে হাটেবাজারে ঘুরে বেড়ায়। একটু শাসন বারণ না করলে ...। ঠাকুমা বিরক্ত হলেন – তাতে তোমার কি বাছা? তার অমন ডাকাতের মতো বাপই যখন আমার ভয়ে তাকে কিছু বলতে পারেনা, তখন তুমি কোথাকার মোড়ল এলে? আন্তনি গলার স্বর বদলিয়ে বলল – আরে না না। সে কথা নয়। রোমকগুলো বড় লোভী। তাই বলা। তা তুমি তো তাকে বেশ ভালো মিশরীয় পাত্র দেখে পাত্রস্থ করতে পারো। সেবা ঠাকুমা তখনও তিলের তক্তি চুষছেন। মুখে কিন্তু একটা দুঃখের ভাব। বললেন – বাছা পালটি ঘরে পাত্রস্থ করার মতো পাত্র কই এখানে? আন্তনি মুখখানা দুঃখে ভরিয়ে বলল – আমি আবার অর্ধেক রোমক কিনা। খাঁটি মিশরীয় তো নই। তাও আবার দাসীর ছেলে। তারপর হঠাৎ যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে এমন ভাবে লাফ দিয়ে উঠে বলল – দেখো তো আমার এই বন্ধুটিকে পছন্দ কিনা? খুব বড় ঘরের ছেলে। ওর সিস্তানাকে ভারী পছন্দ। ঠাকুমা আসলে নীলরক্তের কথা তুলে সিস্তানার মোটেই বিয়ে দিতে চাননা। তাঁর সমস্ত ধনের উত্তরাধিকারিণীকে তো আর যার তার হাতে দেওয়া যায়না। তার ওপরে বিয়ের পর সেই নাতজামাইই আসল মালিক হবে সেসবের। তাই এসব নিয়ে ভাবেননা বিশেষ। এখন আন্তনির কথায় একদম চুপ মেরে গেলেন। তখন তাঁর মুখে হতাশা আনন্দ উৎসাহ, এমন কতশত অনুভূতি যে খেলা করতে লাগল! মণিপালের মনে হলো কয়েকটা মুহূর্ত নয়, এ যেন অনন্ত কাল! একটু পরেই বড় হতাশ হয়ে পড়লেন। কারণ এ ছোকরা ভিনদেশী। এ এখানে রইবে কেন? তারপর সেবা ঠাকুরানী এক আজব শর্ত দিলেন। বললেন – হ্যাঁ বাবা আন্তনি, তোমার মিত্রটি বড়ই সুশীল ও সহৃদয়। সে নিজে সিস্তানাকে কিছু বলতে যায়নি। তার ওপর আমার জন্য কত উপহার এনেছে। আন্তনি কথার মাঝেই বলে উঠল – রাজবংশের কারুর সাথে দেখা করতে গেলে, বুঝতেই পারছ ঠাকুমা...। ঠাকুরানী হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল – দেখো এ বিয়েতে আমি রাজি। তবে শর্ত জানো তো? তা হলো বিয়ের পর পাত্র এখানেই থাকবে। পাত্র একথা জানে তো? মণিপালের মাথায় বজ্রপাত। সে কি করে হয়? গঙ্গাহৃদিতে তার সর্বস্ব! এক কথায় সব ছেড়েছুড়ে এখানে পাকাপাকি ভাবে থেকে যাওয়া? কিন্তু আন্তনি গভীর জলের মাছ। সে আগেই জানত যে মিশরী রূপসীর সোয়ামী তার সঙ্গে এদেশেই থাকে। বিয়ের পর কন্যে শ্বশুরবাড়ি যায়না। জামাই এসে ওঠে এখানে। সে ঠাকুমার দিকে করুন চোখে চাইল, যেন কেঁদে পড়ল – ঠাকুমা, এ কেমন কথা! মণি যদি দেশেই না যায়, তবে এসব নাড়ু বড়ি তক্তি, মসলিন কাপড় এসব তোমায় কে এনে দেবে? ঠাকুমা নরম হলেন। আচ্ছা আচ্ছা। তবে মণি যাবে, কিন্তু সিস্তানা নৈব নৈব চ। অগত্যা। রাজি হতেই হয়। মণিপালের দুঃখিত মুখভাব দেখে ঠাকুমা বুঝলেন পাত্র রাজি বটে, তবে দুঃখ আছে মনে। তখন আবার রফা হলো। ফি বারে জাহাজ ফেরবার সময় ঠাকুমার তৈরি স্ফটিক খণ্ড নিয়ে যাবে গঙ্গাহৃদিতে।
শেষমেশ একদিন মিশরী পল্লীর এক মন্দিরে মিশরী পুরোহিতের পৌরোহিত্যে মণিপালের আর সিস্তানার বিয়ে হয়ে গেলো। সেবারে ফেরবার সময়ে ঠাকুমা সঙ্গে দিলেন স্ফটিক খণ্ড। তাড়াতাড়ি ফিরবে এই আশ্বাস দিয়ে সিস্তানার থেকে বিদায় নিল মণিপাল। সেই মিশরী মিষ্টি নিয়ে সে যখন ফিরল তখন বাঙালির জিভে তার নাম হয়ে দাঁড়ালো মিশ্রি। সেই থেকে মিছরি। আর মিশরে পাকাপাকি ভাবে বাঙালি বণিকদের পরিবার বসবাস শুরু করে দিল।
0 comments: