গল্প - স্বাতী রায়
Posted in গল্প
গল্প
ওয়াতন তেরে লিয়ে
স্বাতী রায়
এখানে সবুজের ছড়াছড়ি। সবুজ মাঠের শেষে, সবুজ টিলার দল মাথা তুলতে তুলতে মিশে গেছে ধোঁয়ার মতো দলমা পাহাড়ে। আগে ছিল ঘন জঙ্গল। তখন নাম ছিল জারাগোড়া। হাতিদের দেশ। মাঝে মাঝে কয়েক ঘর আদিবাসীর ঝুপড়ি। খানিকটা চাষের জমি। আর তাদের ঘিরে ঘন শালের বন। তারপর জানা গেল এ জমিতে সোনা আছে। না, না সোনার থেকেও দামী জিনিস আছে মাটির তলায়। দলে দলে বাবুরা এলো। বলল, এ সব জমি সরকারের। সরকার যখন ইচ্ছে, নিজের দরকারে নিয়ে নিতে পারে। আইন নাকি তাই বলে। সে নিয়মও নাকি আজকের নয়। সেই প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে চাণক্য বলে কে এক মহাপণ্ডিত নাকি বলে গেছেন। এখানকার সাঁওতাল, গোন্দ উপজাতিরা ওরকম পণ্ডিতের নামও শোনেনি। এসব তারা বোঝেও না। সেই না বোঝার ফাঁকে হাত বদল হলো দিগন্ত জোড়া জমি। এল সিমেন্ট, কাঠ, ঠিকাদারের দল। জঙ্গল ফুঁড়ে উঠল ইমারত। বড়ো বড়ো কারখানা, টানা লম্বা পাইপ। ভারতজোড়া মহাযজ্ঞের একটা অংশ। এ দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য লাগবে অনেক অনেক শক্তি। তাপবিদ্যুত, জলবিদ্যুৎ, আণবিক - কোন উৎসকেই ছাড়া চলবে না। সেই লক্ষ্যে শুরু হলো মাইনিং। এ অঞ্চলের লোকেরা মাইনিং ব্যাপারটা ভাল বোঝে। আশেপাশের সব জায়গাতেই তো মাইন। সেই ইংরেজ আমলের থেকে শুরু। জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসা গাঁইতি, শাবলের ঠুং ঠাং ছাপিয়ে ব্লাস্টিং –এর আওয়াজ এখানকার লোকের চেনা শব্দ। পাহাড়ের গায়ে লুকিয়ে থাকা পোড়ো খাদান, ভেঙ্গে পড়া চিমনী আজো সেই শুরুর দিনগুলোর সাক্ষ্য দেয়। প্রথমে সবাই নেচে উঠেছিল। সরকারী চাকরী মিলবে, টাকা পাওয়া যাবে মেলা। তারপর অসুখ করলে ডাক্তার মিলবে, মিলবে ওষুধ। আসবে কলের জল, সুইচ টিপলে বিদ্যুৎ। আর কি চাই! বিরসাবাবার লড়াই করার সুফল মিলল এত দিনে। আচ্ছে দিন এল।
সেই সময়ে বিয়ে হয়েছিল রাধার। তের বছরের মেয়ে একদিন উনিশ বছরের সোনা মুরমু’র হাত ধরে চলে এল অনেক মাঠ পেরিয়ে এই ডুংরিডিহিতে। সিংবোঙ্গার নিজের দেশে। সোনা তখন তাগড়াই জোয়ান, এক মাথা বাবরি চুল, পেটা চেহারা – উঠোনে দাঁড়িয়ে যখন কাঠ চেরাই করত বা অন্য কাজ করত, কালো শরীরে যেন ঢেঊ উঠত! রাধা দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ফালুক ফুলুক দেখত। বিয়ের কমাস পরেই সোনা চাকরী পেল ওই খনিতে। পাথর কাটার কাজ। মাথায় আলো লাগান হলদে রঙের হেলমেট পরে খাদানে নামত। একখানা ছবিও ছিল। কিসের জন্য যেন বাবুরা তুলেছিল। সোনা তার স্যাঙ্গাতদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে খাদানে নামার খ্যাঁচকলের সামনে। গায়ের লাল কালো টেরিলিনের জামা পতপত করে উড়ছে। হেলমেটের রঙটা এতদিন পরেও যেন জ্বলজ্বল করে। সেই ছবিটা এতদিন পোঁটলার মধ্যে ছিল। সেই একদিন শহর থেকে বাবুরা এল – তারা নাকি এঞ্জি বাবু। চা খেল, সবার সঙ্গে অনেক অনেক গল্প করল, তাদের দেখাতেই বের হলো ছবিটা। সেই দেখেই না এক বাবু জানতে চাইল যে সোনা কি শুধু এই জামা পড়েই নামত খাদানে নাকি আরো কিছু গায়ে চাপাত নামার আগে? শুনে সবাই হেসে অস্থির! কি যে বলে বাবুটা! জামা কি আর রোজ পরত! এতো ফটো তোলার জন্য পরা। খাদানের ভিতরে যা গরম - জামা ঘামে নষ্ট হয়ে যাবে না! জোয়ান মরদ – খালি গায়েই গাঁইতি চালাত পাথরের গায়ে! আর সারাদিন পরে যখন উঠে আসত, ঘামে ধুলোয় সারা গা চপচপ করত। সেই নিয়েই বাড়িতে ফিরে রাধাকে জাপটে ধরত – বাচ্চাগুলোকে লেপ্টে নিত বুকের ভিতর। যেন কতদিন দেখেনি! বড্ড বৌ-বাচ্চা অন্ত প্রাণ ছিল রাধার মরদের।
অবশ্য কদিন-ই বা তাকৎ ছিল শরীরে। আস্তে আস্তে ধরল জ্বর। ঘুষঘুষে জ্বর। সঙ্গে কাশি। সব সময় ক্লান্তি শরীরে। অবশ্য খাদানের বাবুরা অনেক করেছিল। তারাই তো সঙ্গে করে নিয়ে গেল বড়ো ডাক্তারের কাছে। রাধাও ছিল সঙ্গে। বুকের ছবি তোলা হলো। সুঁই বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে কত রক্ত নিল, কিসব পরীক্ষা করবে বলল। তারপর বাবুরা ডাক্তারের সঙ্গে কত কিচির-মিচির কথা বললে! সোনা বলেছিল সেটাই নাকি ইংরাজী ভাষা। কে জানে বাবা, ওসব মরদানি কথায় তার আর কি কাজ! বাবুরা পরে সোনাকে বলেছিল যে ওর নাকি টিবি হয়েছে। অনেকদিন ওষুধ খেতে হবে, যতদিন ডাক্তার বাবু বলবেন, ততদিন। ওষুধের খরচপাতি সব কোম্পানির। সাধে বলে কোম্পানি মা–বাপ! এঞ্জি বাবুরা অবশ্য এই সব শুনে ভারী উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। টিবি কখনো কারোর এত বছর থাকে নাকি! নিয়ম করে ওষুধ খেলে তো সেরে যাবে। ঠিক কি হয়েছে বোঝার জন্য সেই সব ডাক্তারের কাগজ দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু রাধা কি করবে – সেসব তো বাবুদের কাছেই থাকত। এ দিগড়ে সোনারই তো প্রথম হলো অমন অসুখ! ছেলে দুটোও তখনো তেমন লায়েক হয়নি। মেয়েটা তখনো মাই টানে। বাবুরা যা বলেছে, ওরা তাই করেছে। আর বাবুরা করেওছে অনেক। যত দিন যাচ্ছিল সোনার শরীরের বল তত হুড়হুড় করে কমছিল। কোন রকমে খাদানে যেত আর ঘরে ফিরেই চারপাইতে শুয়ে পড়ত। বেশির ভাগ দিন তাও করতে পারত না। তবু বাবুরা চাকরী খেয়ে নেয়নি। চাকরী চলে গেলে বাচ্চাগুলো নিয়ে খেত কি! ক্ষেতি জমি তো কবেই টাঁড়ের গর্ভে চলে গেছে। শেষবারের ধানটাও ক্ষেতের থেকে তুলতে দেয়নি সরকারী বাবুরা।
এঞ্জি বাবুরা জানতে চেয়েছিল, ব্যস? তোমাদের টাকা পয়সা কিছু দেয়নি? রাধা বলেছিল, যে ক’দিন কাজ করত মাইনের টাকা তো ঠিক মতোই দিত গো। তাও বাবুরা কি সব কমপিনসিসন না কি বলছিল, সে কি জিনিস রাধা বুঝতেও পারেনি। বোঝাবুঝির সময়ও কি আর ছিল তখন! মেয়েটা যখন বেশ খানিকটা বড়ো হয়েছে, তখন পেটে আবার একটা ছেলে এল। কিন্তু সে জন্ম থেকেই পুঁয়ে পাওয়া। পা গুলো বেঁকা, কাঠির মতো – জোর নেই কো মোটে। না পারল ঠিক করে হামা দিতে, না শিখল ঠিক করে হাঁটতে। ঠিক তখন ঘরের মরদটাও একেবারে বিছানায় মিশে গেল। একদিকে ছেলে আরেকদিকে বিছানায় শোয়া মরদ নিয়ে রাধা তখন জেরবার। কে জানে কোন ডাইনের চোখ পড়েছিল! সিংবোঙ্গার থানে কত যে পুজো চড়িয়েছিল। এমনকি সেই কতদূরের রঙ্কিণী মায়ের মন্দিরে গিয়ে বুক চিরে রক্ত দিয়ে এসেছিল। তারপর ছেলেটা একদিন মরে গেল। আর কি আশ্চর্য ঘরের মরদও আবার একটু ভালো হয়ে উঠল! কোন ডাইনেরই চোখ পড়েছিল নিশ্চয়।
অবশ্য ডাইনের কথা বললে সে তো গোটা গ্রামের উপরই চোখ পড়েছিল। সরিতা মেঝেন আসত যেত ওর ঘরে – দিদি বলে কথা কইত। দুটো কন্দ, খানিকটা শাক মাঝে মাঝে দিয়ে যেত নিজের ভাঁড়ার থেকে। তারও যখন ছেলে হলো, ওমা! তার ঘাড়টা বেঁকা আর মাথাটাও কি বড়ো আর ভারী। সেই দেখে রাধা তো ভারী ভয় পেয়েছিল। কি জানি! ওর ঘরেও তো অমন ছেলে। যদি বলে ওর নজর লেগেই সরিতার ছেলেটা অমন হলো! তা অবশ্য কেউ বলেনি। বরং সরিতাই পরে খবর এনেছিল পাশের পাড়ার গোপদের ছেলেগুলোর একটার মুখের এক দিক বিরাট ফুলে একেবারে বুকের উপর ঝুলে পড়েছে! আরেকটা ছেলের পেটটা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে – পেটের মধ্যে শক্ত গুলির পারা কি যেন ঠেকে হাত বুলালে! তার কান্নায় সারা পাড়া ব্যতিব্যস্ত। অনেকগুলো বাচ্চা এমন হওয়ার পরে গ্রামে একবার অনেক লোক এল, যন্তরপাতি নিয়ে গ্রামের মাঝখানে কদিন থাকল। বাচ্চাগুলোকে টিপে টুপে, টেনে টুনে কতভাবে দেখল। অনেক ওষুধ পত্তর দিল। তারপর চলে গেল ওই টাঁড়ের দিকে। রাধার বাড়ির সামনে দিয়েই গেল। রাধা তখন পাথরের দেওয়ালের উপর গেরিমাটি লাগাচ্ছিল। বাবুরা ওর বাড়ির সামনে এসে থেমে গেল। দেওয়ালটা কেন জানি না বার বার করে দেখল। তারপর রাধাকে জিজ্ঞেস করল, এ পাথর পেলে কোথা ঠেকে। রাধা একটু রুষে উঠেই বলেছিল, এ তো খাদানের ফেলে দেওয়া পাথর। চুরি করে আনি নাই গো বাবু, সাহেবেরা নিয়ে যেতে বলেছে। দেখো না, এখানকার সবার বাড়িই এই পাথর দিয়ে তৈরি। বাবুরা ঘুরে ফিরে সবার ঘরগুলোই দেখল। কিসব রেডিয়েশন না কি যেন সব বলছিল নিজেদের মধ্যে। সে কথার মানে জানতে চেয়েছিল রাধা বড়ো ছেলেটার কাছে। সে তখন লায়েক হয়ে গেছে। খাদানে যাওয়া শুরু করেছে। তবে বাবার মতো সরকারী চাকরী পায়নি সে। ঠিকেতে কাজ করছে। সে খানিক মাথা চুলকে বলেছিল, ওসব বাবুরা বলে বটে। যেসব পাথর কাটি আমরা, তার থেকে নাকি কিসব আলো বেরোয়। সে আলো গায়ে লাগা ভালো না নাকি! কি জানি, আরো সব গুলিয়ে গিয়েছিল রাধার। ঘরের মানুষটাকে জিজ্ঞেস করেছিল, হ্যাঁগা খাদানের পাথর দিয়ে নাকি আলো বেরোয়? সে তো ঊড়িয়েই দিল কথাটা – বাপের জন্মে কোন আলো টালো দেখি নাই বাপু। আলো বেরোলে তো খাদানের ওই ধুলোর মধ্যে তবু একটু দিশা করা যেত। কোথায় কি! শুধু হেলমেটের আলোই ভরসা।
পাহাড়ের নীচে বিশাল এলাকা জুড়ে টাঁড়। খাদানের পাথর কাটার পরে চলে যায় কারখানায়। যাদুগোড়ায়। অবশ্য শুধু কি এখানকার খাদানের পাথর জমে কারখানায়। পাথর আসে সেই ভাটিন, নারোয়াপাহাড় থেকেও – বড়ো বড়ো খোলা ডাম্পারে চেপে। যখন ডাম্পারেরা যায় রাস্তা দিয়ে, পথের ধুলো, পাথরের ধুলো সব মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। সেই সব পাথর গলিয়ে মলিয়ে আরো কি সব করে তার থেকে তৈরি হয় জমাট ইঊরেনিয়ামের হলুদ কেক। আর যা কিছু পড়ে থাকে তাকে পাইপে করে নিয়ে গিয়ে ফেলা হয় ওই ডুংরিডিহির পাশের টাঁড়ে। সে টাঁড়ের তিন দিক পাহাড় দিয়ে ঘেরা। আর এক দিকে উঁচু বাঁধানো পাড়। যা কিছু সেই টাঁড়ে গিয়ে পড়ে, তার ভারী অংশ তলায় থিতিয়ে যায়, আর উপরের জলটা চলে যায় ছাঁকাই হতে। কিছুটা আবার মিশে যায় গাড়ার জলে। গিয়ে মেশে সুবর্ণরেখায়। শুখার সময় টাঁড়ের জল শুকিয়ে যায়। পড়ে থাকে থকথকে কাদা। যখন ঝড় ওঠে, ওই টাঁড়ের থেকে ধুলো ওড়ে। আশে পাশের গ্রাম ঢাকা পড়ে যায় মিহি ধুলোর আস্তরণে। আবার বর্ষাকালে খুব ভারী বৃষ্টি হলে, টাঁড়ের জল উপছে পড়ে – মিশে যায় পাশের ক্ষেতে। গোটা গ্রামের বাচ্চারা খেলা করে টাঁড়ের পাশেই। মানে যে বাচ্চাগুলো হেঁটে অতদুর খেলতে যেতে পারে, সেগুলো। বেশির ভাগেরই হলুদ, ক্ষয়াটে চেহারা। মাঝে মাঝে গরু ছাগলও চরতে চলে যায়। অত ঘাস তারা আর পাবেই বা কোথায়! মাঝে সাঝে চৌকিদারেরা জোর তাড়া করে – তখন গরু বাছুর বাচ্চা-কাচ্চা সব পালায়। তবে চৌকিদারেরা আর থাকে কতক্ষণ! সরে গেলেই আবার যে কে সেই। মায়েরা বকে, কি দরকার চৌকিদারের তাড়া খাওয়ার। তবু বাচ্চাগুলো কিছুতেই কথা শোনে না। গরমের দিনে সারা গায়ে ধুলো মেখে, বর্ষায় জল কাদা মাখামাখি হয়ে বাড়ি ফেরে। খেলতে খেলতে তেষ্টা পেলে ঝরণার জল আঁজলা করে মুখে দেয়। এঞ্জিবাবুরা পইপই করে বারণ করে গেছিল সে জল না খেতে। সে জলে নাকি সীসে আছে, আরো কি সব আছে। সে জল বিষ। বাচ্চাগুলোকে তবু কথা শোনান যায় না।
রাধার বাড়িতে অবশ্য সে সমস্যা নেই। বাচ্চা-ই নেই, তায় খেলার কথা। কত সাধ করে দুই ছেলের বিয়ে দিয়েছিল। নিজের মরদ শেষকালে বড়ো যাতনা পেয়েছিল। সব কিছু জ্বলে যেত তার, সারাদিন ছটফট করত আর ডুকরে কাঁদত। তারপর তো একদিন মরেই গেল। সেই যেদিন গান্ধী-মায়ের বড়ো ছেলেটাকে মেরে ফেলল, সেই দিনই। বড়ো ছেলেটা যখন পাশের সোরেনদের খবর দিতে গেল, তখন রেডিওতে সবাই শুনছে সে খবর। তারপর আর দেরী করেনি রাধা। বড়ো ছেলের বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। বৌ ঘরে এসেছে সেও বহু বছর হলো। তবে তার কপাল ভাল না। যতবার পেটে কিছু আসে, নিজে নিজেই ঝরে যায়। হাজার চেষ্টাতেও থাকে না। বৌটার তো সেই দুঃখে মাথাটাই কেমন হয়ে গেল! এখন সারাদিন বিনবিন করে কাঁদে আর যতক্ষণ ছেলেটা ঘরে থাকে, তারস্বরে তার সঙ্গে ঝগড়া করে। ছোটো ছেলেটার অবশ্য দেরীতে বিয়ে। তাও নয় নয় করে বছর দশেক হলো। তারও এতদিন ধরে কোন বাচ্চা-কাচ্চা হয়নি। বারে বারে পাহাড় ডিঙিয়ে, বাস পালটিয়ে পালটিয়ে সেই জামশেদপুরে ডাক্তারের কাছে গেছে – কত ওষুধ পালা খেয়েছে দুজনে! কিছুতেই কিছু হয় না। তবু ওরা হাল ছাড়েনি। এত দিন পরে এবার বোঙ্গা মুখ তুলে চেয়েছেন। বৌটা পোয়াতি হয়েছে। সেই থেকে তাকে সবাই মিলে তোয়াজ করে রাখছে। কোন কাজে হাত লাগাতে দেওয়া হয় না। অবশ্য এই ক’জনের সংসারে কাজই বা কি! তবে একটাই চিন্তা এই জাড়ের মধ্যে বিয়োবে বৌটা। কদিন ধরেই তাই বেঁকা কোমর নিয়ে ঘুরে ঘুরে কাঠ কুটো জোগাড় করছে বুড়ি রাধা। ঘর গরম রাখতে কাজে লাগবে। আশে পাশের বাড়ি থেকে চেয়ে চিন্তে এনে জড়ো করছে কাপড়। বাচ্চাটার ঠাণ্ডা না লাগে। ঠিক করে রেখেছে ছেলে হলে নিজের বিয়ের সময়কার রুপোর আংটিটা দিয়ে দেবে বউটাকে। হাটের থেকে ঝুমঝুমি কিনে আনাবে বড়ো বেটাকে দিয়ে। লাল টুকটুকে উলের জামা। আগেই কিনে মজুত করে রাখত। কিন্তু তাতে যদি বাচ্চার নজর লাগে! তাই থাক বরং। বাচ্চাটা জন্মে গেলেই সাইকেল দিয়ে পাঠিয়ে দেবে ছেলেটাকে। হাটের থেকে জামা কিনে আনবে। একটু মিঠাই-ও আনাবে। পাড়ার সবাই যখন ভিড় করে দেখতে আসবে, তখন সবাইকে মুখ-মিঠা করাবে, এ রাধার অনেক দিনের সাধ। কতদিন পরে বাড়িতে একটা বাচ্চা আসছে।
এখন অবশ্য এ গাঁয়েরও অনেকের বাচ্চাই হাসপাতালে হয়। রাধাও হয়তো বৌটাকে হাসপাতালেই পাঠাত। তবে কদিন আগে ছেলে খবর এনেছে নারোয়াপাহাড়ে যে ছোটো হাসপাতাল সেখানকার ডাক্তারবাবু ছুটিতে চলে গেছেন। কবে ফিরবেন তার ঠিক নেই। অগত্যা বাড়িতে ব্যবস্থা করতে হয়েছে। সেটা কোন সমস্যা না অবশ্য - রাধার দাই-এর কাজে পাকা হাত। আশে পাশের অনেক বাড়ির বৌ-ই খালাস হয়েছে তার হাতে। এখন বয়স হয়েছে বটে, হাতে হাতে সাহায্য করার জন্য বড়ো বৌ আছে সেটাই ভরসা। তবে বৌটার পেটটা এত বড়ো হয়েছে – কে জানে যমজ বাচ্চা আছে কিনা! হাতড়ে হাতড়ে অনেক বোঝার চেষ্টা করেছে রাধা – কিন্তু যমজ বাচ্চা বলে তো মনে হয়নি। তাহলে পেটটা এত বড়োই বা হলো কেন! কি জানি কি আছে কপালে! এই সব সাত-পাঁচ ভাবনা ঘোরে রাধার মাথায়! রাধা তাই উঠোনে ঘুরে ঘুরে হাতের কাজ সারে আর খাটিয়ায় শুয়ে থাকা বৌটার বুকে পিঠে দিনে তিন চার বার করে তেল মালিশ করে। আর কড়া নজর রাখে। কখন যে ব্যথা ওঠে।
সে ব্যথা উঠল একেবারে গভীর রাতে। রাধা সজাগ ছিল। এই বুড়ো বয়সে ঘুম পাতলা এমনিতেই। তার উপর এই চিন্তা ছিলই। তাড়াতাড়ি বড়োবৌকে তুলে দুজনে মিলে ছোটো বৌটাকে ধরে ধরে আঁতুড় ঘরে নিয়ে গেল। তার পর সারা রাত ধরে চলল জন্মদান-পর্ব। রাধা আর বড়োবৌ পালা করে ছোটোবৌর হাত পা সেঁক করছে, পেটে মালিশ করে দিচ্ছে – তবু বৌটা মাঝে মাঝে নেতিয়ে পড়ছে। এর মধ্যে ভোর হলো, চারপাশের সব বাড়িতে লোকজন জেগে উঠল। রাধার কপালের কুঁচকানো চামড়ার ভাঁজ আরো গভীর হলো। ছোটোবৌ একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। বড়োবৌ তখন প্রাণপণে ছোটোর পেটে চাপ দিচ্ছে আর তাকে চাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। হঠাৎ ছোটোবৌ এক মরণ কান্না কেঁদে উঠল আর শিশুটির মাথা বেরিয়ে এল রাধার হাতের উপর। একবার তাকিয়েই শিঊরে উঠল রাধা। একি! একি মানুষের বাচ্চা। একটা বিশাল মাথা, তাতে নাকের ফুটো ছাড়া আর সব কিছুই ভুল জায়গায়। আর তার তলায় একটা তিন চার আঙ্গুলের সমান দেহ। তার থেকে চারটে হাত পা এদিক ওদিক বেরিয়ে আছে – আর তার থেকে বেরিয়ে আছে অগুনতি আঙ্গুল। রাধা তাকিয়েই আছে। বোধবুদ্ধিহীন জড়ের মতো। হঠাৎ বড়োবৌ ডুকরে কেঁদে উঠল। রাধা তাকিয়ে দেখল ছোটোবৌ মরণখাবি খাচ্ছে। হঠাৎ ভয়ানক আতঙ্কে রাধা চেঁচিয়ে উঠল, “রাক্ষুসী, এ কার জন্ম দিলি!” তাড়াতাড়ি নাড়িটা কেটে দিয়েই বাচ্চাটাকে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, বাড়ি থেকে। বড়োবৌ ততক্ষণে মড়াকান্না জুড়েছে। ছোটো যে চলেই গেল। বাইরের উঠোনে দুই ছেলে হকচকিয়ে গেছে – তাদের কি হলো, কি হলো চিৎকারের মধ্যে রাধা ছুট লাগাল সোজা টাঁড়ের দিকে। এ মানুষ নয়, মানুষ নয়, পাক্কা শয়তান। শয়তান জেগে উঠেছে টাঁড়ের থেকে। সেখানেই ফিরিয়ে দিতে হবে তাকে।
দুই ছেলে ব্যাপারটা একটু বুঝে নিয়ে যখন মায়ের পিছু পিছু ছুটে টাঁড়ের ধারে এল, দেখল শীতের সকালের নরম আলোয় বিশাল টাঁড় আলসে রোদ পোহাচ্ছে। শুধু একটা জায়গায় একটু বুড়বুড়ি সাক্ষ্য দিচ্ছে কিছুক্ষণ আগের চঞ্চলতার। চারিদিক ফাঁকা শুনশান। আজ আর টাঁড়ের ধারে বাচ্চাদের খেলার ভিড় নেই। সবাই ভিড় জমিয়েছে গ্রামের একটি মাত্র টেলিভিশনের সামনে। আজ ২৬শে জানুয়ারী। টিভিতে এখন দিল্লির প্রোগ্রাম আছে। দুই ভাই যখন মোড়লের বাড়ি পৌঁছল শলাপরামর্শের জন্য, তখন টিভিতে ঝমঝমিয়ে চলছে ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জির ট্যাবলো। ট্যাবলোর উপরে মাথা উঁচিয়ে বিরাজ করছে যাদুগোড়া ইঊরেনিয়াম কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া মিলের মডেল। ঠিক আগেই চলে গেছে আর্মির একটা দল। এখনো শোনা যাচ্ছে তাদের বাজনার সুর – “দিল দিয়া হ্যায় জান ভি দেঙ্গে অ্যায় ওয়াতন তেরে লিয়ে।”
“The old Lie: Dulce et decorum est pro patria mori” - Wilfred Owen
রোমান অংশের অনুবাদ - “It is sweet and fitting to die for one’s country.”
0 comments: