3

গল্প - মৌসুমী ভট্টাচার্য

Posted in


গল্প


ক্যাকটাস ফুল 
মৌসুমী ভট্টাচার্য 

এ এক নেশা হয়েছে হেনার, হালফিলের ‘মুখ-পুস্তিকা’। ইতিমধ্যেই অনেক বন্ধু হয়ে গেছে তার। চেনা গণ্ডির বাইরে অচেনা বন্ধুদের প্রতি তার আগ্রহ বেশী। অবাঙ্গালী ও আছেন বেশ কয় জন। এদের মধ্যে একজনকে হেনার বিশেষ ভাললাগে,উনি একজন মারাঠী ভদ্রলোক, দীপক মোরে। দীপক প্রতি শুক্রবার উদয় হন, শনি, রবিবার। পুরো সপ্তাহ সময় নেই, এক বহু জাতিক সংস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদে আছেন, পুনেতে থাকেন। দীপকের সাথে চ্যাট করতে ভাললাগে। ধীরে ধীরে একে অপরের সম্বন্ধে জানতে থাকে। হেনা জানতে উৎসুক এই নতুন বন্ধু সম্বন্ধে। 

হেনার সময় বাঁধা, সন্ধ্যা আটটা থেকে নয়টা। সারাদিন অগুন্তি কাজ শেষ করে, পরের দিনের লেকচার রেডি করে,পতিদেব অফিস থেকে ফিরলে চা জলখাবার দিয়ে,কিশোর ছেলেকে পড়াতে বসিয়ে, সে কম্পুটার টেবিলে বসে। 

শনিবার সন্ধ্যায় হেনা একটু চঞ্চল, দীপক আসবে চ্যাটিং এ। স্বামী সুদীপ লক্ষ্য করে বলল, “কি ব্যাপার? কোনো প্রোগ্রাম আছে নাকি?” হেনা লজ্জা পেয়ে মাথা নাড়ে। হেনা এই মূহূর্তের জন্য অপেক্ষা করে থাকে, সে বুঝতে পারছে অজান্তেই তারা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে। অনেক সমস্যা হেনা দীপককে বলতে পারে, দীপক মন দিয়ে শোনে, সমাধান করে দেয়। হেনার পৃথিবী নিষ্ঠুর, বন্ধু কম, যন্ত্রণা শোনার তো কেউ নেই। এমত অবস্থায় দীপক এক মরুদ্যান, যেখানে হেনা শান্তি পায়। 

লাজুক প্রকৃতির হেনার কোনদিনই পুরুষ বন্ধু ছিল না। কো-এডুকেশনে পড়েও ছেলে সহপাঠীদের সাথে কমই কথা হতো, মেশা দূরস্থান। সত্তর-আশির দশকের এক ছোট শহর আগরতলা অনেকটাই ট্রাডিশনাল ছিল। কঠোর শাসনের বেড়াজালে বড়ো হওয়া হেনা তাই সনাতনপন্থী। যে বন্ধু হতে পারত, তার স্বামী সুদীপ, হতে পারল না। এটাই হেনার দুঃখের জায়গা। 

সুদীপের আত্মকেন্দ্রিকতা, সংসার সম্পর্কে উদাসীনতা, নিজের কেরিয়ার নিয়েই ব্যস্ততা, হেনার সংগে এক মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি করেছে । 

হেনা ভীষণ একা, ভাইবোন না থাকাতে, ঐ সুখ থেকেও বঞ্চিত। বিউটি পার্লার, কিটি-পার্টিতে সময় কাটানো পছন্দ নয়। বুদ্ধিহীন কথা, জাগতিক ভোগ বিলাসে বিশ্বাসী এই মহিলামণ্ডলীর সংগে হেনা মেশাতে পারে না। জীবনকে সে মেনে নিয়েছে,শুধু মাঝে মাঝে নিঃসঙ্গতা অসহ্য ঠেকে। এই নিঃসঙ্গতা হেনাকে ঠেলে দিচ্ছে এই নেশার দিকে। হাঁ, নেশাই হয়ে যাচ্ছে। 

দীপকের জীবনও সহজ নয়। সে ডির্ভোসী, দশ বছরের ছেলের কাস্টডি তার। স্ত্রী এক আই. টি কম্পানীতে ভাল পোস্টে আছেন। চাকরী, পার্টি, শপিং,এ সবের মাঝে ছেলের জন্য ও সময় নেই। ধনী পরিবারের দুলালী, তার জীবন দর্শন, মূল্যবোধ ভিন্ন। দীপক ভেবেছিল মাতৃত্ব তাকে ঘরমুখো করবে, কিন্তু ভুল ভেবেছিল। মতের বিরোধ, ইগো, ইত্যাদি বহু কারণ বড় হতে হতে তারা উভয়ই ডির্ভোসের আশ্রয় নেয়। দীপক আহত হয়, যখন তার স্ত্রী ছেলের কাস্টডি চাইল না। 

তাই শিশুটি আয়ার কাছেই বড় হয়। দীপকের মা যতদিন জীবিত ছিলেন, নাতির অযত্ন হতে দেননি। গত বছর তিনি গত হলে, দীপকের কাছে আর কোনও রাস্তা থাকে না, ছেলেকে হস্টেলে রাখা ছাড়া। এত আদরের ছেলেকে ছেড়ে থাকতে, তার বড় কষ্ট হয়, কিন্তু নিরুপায়। 

ঘর বলতে বিশাল ফ্ল্যাট, যেখানে অখণ্ড নীরবতা বিরাজ করে, প্রাণহীন। সারাদিনের অফিস করে, ক্লান্ত হয়ে অনেক রাতে ফ্ল্যাটে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ে। সকালে আবার ছোটা। উইক এন্ডে ছেলেকে দেখে আসে। খুব সামাজিক না হওয়াতে একাকীত্বে ভোগে। মদ্য পানের প্রতি আসক্তি অনুভব করত। 

কিন্তু ইদানীং হেনার সংগে যোগাযোগের পর, এই অশুভ আসক্তি থেকে দূর থাকতে পারছে। হেনার সংগে চ্যাট করে, তার আর একা লাগে না। দু-জনেই পরিশ্রমী, জীবন যুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। বির্মষভাবটা কাটিয়ে উঠছে দুজনেই। দুজনেই বই পড়তে ভালোবাসে, ভালোবাসে ভালো সিনেমা দেখতে। ভালোবাসে সঙ্গীত, দু জনেই বড়ে গোলাম আলি, হরিহরণ, জগজিৎ সিং, ভুপেন্দরের গানের ভক্ত। হেনা সুকণ্ঠী, ভাল গান গাইত, এখন সময়ের অভাবে চর্চা নেই। দীপকের অনুরোধে আবার মাঝে মাঝে গাইছে। 

দীপকের ফটোগ্রাফির সখ ছিল, হেনার অনুরোধে আবার দামী ক্যামেরা বেরলো আলমারী থেকে। মাঝে মাঝে সুন্দর ছবি পোস্ট করে, যা হেনার খুব ভাল লাগে। দুজনে কোনও নভেল বা সিনেমা নিয়ে আলোচনা করে, এক সমমনস্ক চিন্তাধারা দুজনকে এক অচ্ছেদ্য বন্ধুত্বের বন্ধনে বেঁধে দিচ্ছে। হেনার যা বিশেষ ভালো লাগে, দীপকের রসবোধ। প্রশংসনীয় সেন্স অব্ হিউমার। 

এই গুণটার কিছুটা যদি সুদীপের থাকত, হেনার জীবন অনেক সুন্দর হতো। যখনই হেনা খুশী হয়ে কোনও কথা সুদীপকে বলতে যায়, সুদীপ এক নিষ্ঠুর মন্তব্যে হেনার হৃদয় টুকরো টুকরো করে দেয়। হেনার মনে হয়, এটা সে ইচ্ছে করেই করে, স্যাডিস্টিক মনোভাব কাজ করে তার মধ্যে। এতে তাদের মাঝে দূরত্ব বেড়েই যাচ্ছে। এখন দীপক সমস্ত টুকরোগুলো জুড়ে দিচ্ছে তার বন্ধুত্বের ছোঁয়ায়, সহানুভূতির স্পর্শে। ধীরে ধীরে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হতে লাগল। 

ইদানীং দীপক দেখা করতে চাইছে, দেখতে চায় সেই নারীকে, যে তার জীবনে খুশির ছোঁয়া, প্রাণ ফিরে দিয়েছে। হেনা অধরা হয়ে থাকতে চায়, সামনে আসতে চায় না। যদিও মনের গভীরে সুপ্ত ইচ্ছে, সেই পুরুষকে দেখার, যে জীবনে হারানো রং এনে দিয়েছে। কিন্তু তার মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী মূল্যবোধ বাধা দেয়, এক পরপুরুষের সংগে দেখা করার, তার এতদিনের বিবাহিত জীবন না বিপদগ্রস্ত হয়! 

দীপক পরিকল্পনা করে, কোথায়, কিভাবে দেখা করা যায়। অফিসের কাজে বিভিন্ন শহরে তাকে যেতে হয়, কলকাতায় আসা হয় না। হেনা উত্তর-পূর্ব ভারতে থাকে, কলকাতায় আসে, মাঝে মধ্যে। মা বাবা থাকেন, গরমের বা শীতের ছুটিতে কলকাতা এসে ওঁদের সংগে থাকে। হেনা শীতের ছুটিই পছন্দ করে। প্যাচপ্যাচে গরম তার সহ্য হয় না। 

ঠিক হলো, আসছে ডিসেম্বরে ক্রীসমাসের ছুটিতে কলকাতা এয়ার পোর্টে দেখা হবে। ধার্য হলো দিন ক্ষণ, তারিখ, ড্রেস-কোড। হেনা লাল পাড়ের কাল তাঁতের শাড়ি, লাল ব্লাউজ পরবে। হেনা জানাল, কলকাতা এয়ার-পোর্টে সবচেয়ে কুৎসিত মহিলাটিই হেনা হবে, দীপক যেন বুঝে নেয়। 

হেনাকে দেখতে ভাল, ফর্সা গায়ের রং, সুন্দর ধারালো মুখশ্রী, মাঝারি উচ্চতা। ছত্রিশ বছর বয়সে একটু কমই দেখায়। দীপক জানাল, সে কোন ড্রেস কোড মানবে না, হেনাকে ঠিক বের করে নেবে, কোনও অসুবিধা হবে না। 

দিন যত ঘনিয়ে আসছে, হেনার মন তত অস্থির হয়ে উঠছে। তার পরিচিত কোনও মহিলার কি এমন অভিজ্ঞতা আছে! এই গোপন সম্পর্ক এক মানসিক চাপ সৃষ্টি করেছে। আর কোনও পরিচিত মহিলা কি স্বামীকে ঠকাচ্ছে? সেই কি একমাত্র যে বিশ্বস্ততা রাখছে না? তার অন্য একটি মন যুক্তি দেয়, যে না, কোনও অবিশ্বস্ততার কাজ হচ্ছে না। দীপক তার বন্ধু, কোন প্রেমিক নয়। হেনা দেখা করবে, দু-চারটি কথা বলবে, এর বেশী কিছু নয়। সুদীপ এই সুন্দর সম্পর্ক কখনোই বুঝবে না, বাঁকা নিষ্ঠুর মন্তব্য করবে। তাই গোপনীয়তা বজায় থাকুক। 

প্লেন যখন মাটি ছুঁল, হেনার হৃদয় ধকধক্ করতে লাগল, রক্তচাপ বেড়ে গেল। যথাসম্ভব নিজেকে শান্ত রেখে প্লেন থেকে নামল। মালপত্র নিয়ে বেরোতে গিয়ে দেখে এক সুবেশ ভদ্রলোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, “হ্যালো, আপনিই হেনা, তাই না?” ভারী কণ্ঠস্বর, মিটিমিটি হাসি মুখে হেনাকে দেখছে। সেই প্রতীক্ষিত মুহূর্ত এল অবশেষে। হেনা কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছে না, কিশোরীর মতো একরাশ লজ্জা তাকে ঘিরে ধরল। দীপক করমর্দন করতে হাত বাড়িয়ে দিল। 

তার উষ্ণ করমর্দন, হাতের ভাষাময় চাপ, গভীর চাহনি, হেনাকে আরও আকৃষ্ট করে। হেনা মৃদু হাসল, তারা পাশাপাশি হাঁটতে থাকল। চোখের কোণ দিয়ে দীপককে লক্ষ্য করল, বলিষ্ঠ চেহারা, কানের পাশে কিছু রুপালী চুল, ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, আকাশী শার্ট, বাদামী রং এর প্যাণ্ট, সবমিলিয়ে আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। 

একটি ট্যাক্সি অপেক্ষা করছিল, দীপক ড্রাইভারকে হোটেল যেতে নির্দেশ দিল। হেনার অস্বস্তি লক্ষ্য করে দীপক বলল, “একটু কফি খেয়ে ফ্রেশ হয়ে তারপর বেরোবো।’’ হেনা মাথা নাড়ল, জানালা দিয়ে শীতের সকালের কলকাতার রূপ দেখছিল। মৃদু অলসতা ছড়িয়ে আছে। দীপক বলল, “কেন বলে লজ্জা নারীর ভূষণ, আজ বুঝলাম। হেনা, আপনি আরও সুন্দর, যা আমি ভেবেছিলাম তার থেকে বেশী। তবে শিক্ষিত কোন মহিলা এত লাজুক হতে পারে, জানতাম না।’’ 

হটেলে কফি খেতে খেতে হেনা সহজ হতে চেষ্টা করল, বলল, “ব্রেকফাস্ট হয়ে গেছে? আপনি কখন এলেন?” কথা ইংরাজীতেই হচ্ছিল, দীপকের বাচনভঙ্গী, উচ্চরণ সবই আকর্ষণীয়। দীপক উত্তর দিল, মৃদু হাসিমুখে বলল, “এই দেখা নিয়ে আমি এত উত্তেজিত ছিলাম, এখন সামনাসামনি বসে আছি। এক স্বপ্ন সত্যি হয়েছে।’’ কফি চুমুক দিতে দিতে বলল, “আমরা ছবি প্রদর্শনীতে যাই? ভাল প্রদর্শনী চলছে।’’ হেনা মাথা নাড়ল। দুজনেই তারা আর্ট ভালোবাসে। প্রদর্শনীতে দেখাকালীন হেনা আরও মুগ্ধ হয়, দীপকের জ্ঞান দেখে। 

লাঞ্চ করতে এক চাইনিজ রেস্তোঁরাতে বসল, এ ক্ষেত্রেও মিল, চাইনিজ খাবার। খেতে খেতে হেনা ঘড়ি দেখল। দীপক বলল, “প্লীজ সময় দেখো না। কতদিন পর যে আমি রিলাক্সড মুডে আছি, বলতে পারব না। ইচ্ছে করছে সময় থেমে থাকুক।’’ হেনার মন ও এক কথাই বলছে, কিন্ত এ ও সত্যি যে দামী মুহূর্তগুলো ক্ষণস্থায়ী হলেই ভালো। এরপর তারা আউটরাম ঘাটে গিয়ে বসল। একটু ছায়াময় জায়গা দেখে বসে রইল। পড়ন্ত দুপুরের মিঠেকড়া রোদ, গঙ্গা থেকে বয়ে আসা বাতাস এক আমেজের সৃষ্টি করল। দু জনেই নদীর দিকে চেয়ে রইল। দীপক হেনার ডানহাত তুলে নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়াল। হেনা বাধা দিল না, দীপক গভীর কণ্ঠে বলল, “ইচ্ছে হয়, তোমার হাত ধরে এ ভাবেই বসে থাকি। সময়কে ধরে রাখি।’’ হেনার কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে, চোখে চোখ রেখে বলে, “ যে মুহূর্তে দেখেছি তোমায়, প্রেমেই পড়ে গিয়েছি।’’ 

হেনার মন ও এ কথার জাদুতে শৃংখল মুক্ত হতে চাইল। বহু দিনের উপোসী মন ডানা মেলতে চাইল। দীপক তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখল, গভীর দীর্ঘ চুম্বন। হেনা অজান্তেই দীপককে জড়িয়ে ধরল। কিন্তু প্রকাশ্যে এমন অবস্থা কেউ দেখে ফেলতে পারে, হেনা সম্বিত ফিরে পায়। তাদের যেতে হবে, সামাজিক ব্যবস্থা মানতে হবে। দীপকের ফ্লাইট কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। হেনার মা বাবা অস্থির হবেন, দেরী হলে। অনিচ্ছাসত্বেও তারা উঠে দাঁড়াল। দীপক বলল, “এখন থেকে যেন দেখি চ্যাটিং এর সময়। আর গান গাইবে, শুনবো পরের বার।’’ হেনা হেসে মাথা নাড়ল, মনটা খারাপ লাগছিল। ‘এই দিনটি জীবনে ভুলব না’, দীপক বলল। হটেল থেকে মালপত্র নিয়ে তারা এয়ারপোর্টে এল, দীপক ভিতরে ঢুকে গেলে, হেনা এক শূন্যতা বোধ করে। মা বাবার বাড়ি আসে, ডিনারের পর ছাদে যায়। শীতের মরসুমী ফুল আছে টবে। এর মধ্যে একটি ফুল দৃষ্টি আকর্ষণ করল, ক্যাকটাসের ফুল। অদ্ভুত সুন্দর, আর বিরলও বটে। হেনার মনে হলো, আজকের দিনটি ও খুব বিরল, এই ক্যাকটাস ফুলের মতোই। ডিসেম্বরের রাত, শীতল কনকনে হাওয়া ছুঁচ ফোটায়। হেনা ভাবে আবার কখন, কোথায় দীপকের সংগে দেখা হবে। স্বপ্ন দেখে, কারণ স্বপ্নহীন জীবন, ডানাভাঙ্গা পাখির মতন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আবৃত্তি করে, ‘আই হ্যাভ ডিজায়ার টু গো...।’

3 comments: