0

সম্পাদকীয়

Posted in



চায়না, চায়না, চায়নাকে কেউ চায়না 

তাই চায়নার ভারি দুঃখু 
সে বিদ্বান, তবু মুখ্যু 
তার তির্যক দুটি চক্ষু 
ভালো আয়না দেখতে পায় না 
তাই চায়না, চায়না, চায়নাকে কেউ চায়না 

উত্তর-আধুনিক এক কবি এই সেদিন এটা লিখে পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে সে কি হুলুস্থুলু! পুরস্কার এবারে একটা এক্কেবারে বাঁধা। তবে একটা কথা ঠিক যে, মাথার পোকা নড়ে উঠেছে ওদের। এই ভাইরাস বানাচ্ছে, তার পরেই আবার যুদ্ধুযুদ্ধু খেলতে শুরু করছে… কি যে করবে ঠিক করেই উঠতে পারছে না যেন! 


এদিকে দিন তো মন্দ কাটছে না। তিন মাস পূর্ণ হলো লকডাউনের। মোটামুটি সিস্টেমেই এসে গেছে। রেগুলার-ওয়্যার/ ডিসাইনার / পার্টি-ওয়্যার মাস্ক, স্যানেটাইজার - লাইট স্মেল, সান্দ্র-ফিল... তার ওপরে তেলের দাম বাড়ছে, জীবন বীমা থেকে বিমান সংস্থা – শুরু হয়ে গেছে সব কিছুর প্রাইভেটাইজেশন। এরই মধ্যে বেশ আছি আমরা, কি বলেন? 


লকডাউন দরকার ছিলো কিনা না, সেই নিয়ে প্রশ্নই নেই কোনও। কিন্তু ঠিক যে নিয়ম মেনে প্রথম বিশ্বে লকডাউন জারি হয়েছে, আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে সে নিয়ম মানা সম্ভব কি না, বিশেষজ্ঞরা ভেবেছিলেন কি? এই পরিকল্পনাহীন বন্দীত্বে করোনাকে কতটা বন্দী করা গেছে, জানা নেই। তবে এই স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আগেই তলনিতে ঠেকা অর্থনীতির যে দুর্দশা করা হলো, তার ফল ভুগবো তো আমরাই, কিন্তু তার দায় কে নেবে? এই পরিস্থিতিতে সাইক্লোন আম্পান প্রবল প্রতাপে ধ্বংসলীলা চালিয়ে মৃত অর্থনীতির কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে গেছে। 


প্রধানমন্ত্রী বললেন – আত্মনির্ভর ভারত! গুড জোক! করোনা-কালীন পরিস্থিতিতে ছোট বাণিজ্য সংস্থাগুলির জন্য স্বল্প হারের সুদে ঋণের ঘোষণা করলেন সেনাপতি; আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হলো এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও পরিকল্পনার বাস্তবতা নেই ভারতীয় অর্থ-ব্যবস্থায়! ব্যাংকগুলিতে এই সংক্রান্ত নতুন কোনও নির্দেশ আসেনি এখনও পর্যন্ত। SIDBI জানাচ্ছে, ওঁরা নিজেদের তেমন কোনও প্রচার ইচ্ছে করেই করেন না, ঋণ প্রদান পদ্ধতি এতটাই জটিল, যে আসলে তা অবাস্তব প্রায় – অবশ্যই অফ দ্য রেকর্ড। তবে যে দেশের অর্থমন্ত্রীর মতে দেশের গড় মধ্যবিত্ত পরিবারের বার্ষিক আয় ছয় লক্ষ টাকা থেকে পনেরো লক্ষ টাকা, সেই দেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর কোন সমাধান আশা করা যায়? 


আর ত্রাণশিবিরগুলোর কথা না উল্লেখ করাই ভালো! কত দলাদলি, কত গোষ্ঠীবাজি! সবাই খালি ঢাকঢোল পিটিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিয়ে প্রমাণ করতে ব্যস্ত, কত 'নিঃশব্দে' জনসেবা করছেন তাঁরা! প্রহসন ছাড়া আর কি বলা যায় একে?! 


তবুও আশা মরে না। কিছু তো একটা হবেই। এবং যা হবে, ভালোই হবে। কারণ পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেলে, ফের সামনে এগোনো ছাড়া আর উপায় থাকে না। 


সুস্থ থাকুন মনে ও শরীরে 
শুভেচ্ছা নিরন্তর

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in









 
[ইতিমধ্যে আমাদের দেশে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা আড়াই লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। আমরা স্পেন ও ইতালিকে পেছনে ফেলে বিশ্বে পঞ্চম স্থানে, যদিও মৃত্যুহার (২.৭%) ক্রমশঃ কমছে এবং ‘আক্রান্তের সংখ্যা দু’গুণ’ও হবার পিরিয়ড ক্রমশঃ দীর্ঘ (এখন ২৩ দিন) হয়ে চলেছে। শেষ কিস্তিতে আমরা সংক্ষেপে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করব সরকারের আর্থিক নীতির ফলে করোনা পরবর্তী ভারতের বদলে যাওয়া ছবিটা কেমন হবে।] 
লকডাউন-৫ বা লকওপেনের গোড়ায় প্রধানমন্ত্রী তাঁর দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর গত একবছরের খতিয়ান দিতে গিয়ে কোনও অর্থনৈতিক সাফল্য বা নতুন কোনও যুগান্তকারী পদক্ষেপের কথা শোনাতে পারেননি; বিশেষ যে উপলব্ধির কথা বলেছেন সেগুলি—ধারা ৩৭০, তিন তালাক, রামমন্দির ও সি এ এ—বাস্তবে বিজেপির ইলেকশন ম্যানিফেস্টো এবং রাজনৈতিক এজেন্ডার অঙ্গ, কিন্তু দেশের আম জনতার আর্থিক কল্যাণের সঙ্গে সম্পর্কহীন। 
তবে গত ১৭ই মে “আত্মনির্ভর ভারত” বা রিলিফ-২ এর শেষদিনের প্রেজেন্টেশনে নির্মলা সীতারমন শিল্প এবং কৃষি নীতিতে যে ‘রিফর্ম’ বা পরিবর্তনের কথা বলেছেন, তা তাক লাগিয়ে দেবার মতন বটে। 
দেশের অর্থনীতি ক্রমশঃ বাজারের হাতে? 
শিল্পক্ষেত্রে আগে যেগুলো কেবল সরকারি বিনিয়োগের জন্যে নির্ধারিত ছিল, তার প্রায় সবই প্রাইভেট সেক্টরের—দেশি এবং বিদেশি-- বিনিয়োগের জন্য হাট করে খুলে দেওয়া হলো। যেমন সবরকম অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ এবং প্রতিরক্ষা সামগ্রী; যুদ্ধবিমান এবং যুদ্ধজাহাজ; এটমিক এনার্জি; রেল পরিবহন; খনিজ তেল; কয়লা, লোহা, তামা, ম্যাঙ্গানিজ, সোনা, হীরে, ইত্যাদি খনি থেকে তোলা, ইত্যাদি। 
এয়ার ইন্ডিয়াকে বেচতে পারলে নাগরিক উড্ডয়ন পুরোটাই প্রাইভেট হবে। বীমাতে প্রাইভেট কোম্পানি ক্রমশঃ জাঁকিয়ে বসছে। পাবলিক সেক্টর ব্যাংকগুলোর গঙ্গাযাত্রা কেবল সময়ের অপেক্ষা। বলা হচ্ছে সরকারের কাজ দেশ চালানো, ব্যবসা করা নয়। 
কৃষিক্ষেত্রে ফসল সরকারি মণ্ডিতে বেচার কোনও বাধ্যবাধকতা রইল না। যেকোন রাজ্যের কৃষক তার ফসল দেশের যে কোনও জায়গায় খোলা বাজারে বেচতে পারে। এছাড়া জোর পড়বে কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং বা নীলচাষের মতন আগে প্রাইভেট কোম্পানির থেকে দাদন নিয়ে নিজের জমিতে কোম্পানির মর্জিমতো ফসল ফলানো। 
কিন্তু কিরণ বিসসা- সহ আহ্বায়ক, ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ফর সাস্টেনেবল এগ্রিকালচার, সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যে, এসেনশিয়াল অ্যাক্টে যা সংশোধন হয়েছে, তাতে ব্যাপক কৃষকের বদলে ধনী কৃষক এবং কৃষি পণ্যের বড় কোম্পানিগুলোকে খুশি করা হয়েছে। 
লঘু এবং সীমান্ত কৃষকের ফসল গূদামে রাখার ধরে রাখার ক্ষমতাই নেই, ওদের পেটের দায়ে চটপট ফসল কম দামে বেচে দিতে হয়। ওরা কী করে এই আইনের সুবিধে পাবে? 
আর গতবছর থেকে কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে যে বছরে ৬০০০ টাকা করে দেওয়া হচ্ছে তাতে বাদ পড়ছেন ভুমিহীন ও খেতমজুরেরা; কারণ যোজনায় কৃষক বলতে বোঝানো হয়েছে শুধু যাদের জমি আছে। 
এদিকে রিজার্ভ ব্যাংকের ছ’সদস্যীয় মনিটারি পলিসি কমিটি্র (এমপিসি) গত ২০-২২ মে তারিখের বৈঠকে দেশের অর্থনীতিতে করোনা সম্পর্কিত লকডাউনের প্রভাব নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গভর্নর শক্তিকান্ত দাস জানান যে ম্যাক্রো ইকনমির তিনটে প্রধান প্যারামিটার বাজারে চাহিদা, ব্যক্তিগত উপভোগ এবং শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের আর্থিক বিনিয়োগ মার খেয়েছে। ব্যাংকগুলোর ঋণ বৃদ্ধি বলার মতো নয়। তবে কৃষির সাফল্যে ভর করে ইকনমি আগামী বছরে ঘুরে দাঁড়াবে এটাই আশা। 
(অথচ জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র ১৭%! তবে জনসংখ্যার প্রায় ৪৮% লোক কৃষিনির্ভর।) 
আবার ডেপুটি গভর্নর মাইকেল দেবব্রত পাত্র মনে করেন-আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি এত গভীর যে, সারতে কত বছর লাগবে বলা কঠিন। 
রিজার্ভ ব্যাংকের মনিটারি পলিসি কমিটি্র(এমপিসি) কাজটা কী? 
এরা নিয়মিত দেশের অর্থনীতিতে টাকার যোগান এবং চাহিদার হিসেব কষে কতটা টাকা বাজারে থাকা উচিত, সেটা ঠিক করে। রিজার্ভ ব্যাংক সেই পরামর্শ অনুযায়ী মন্দার সময় আর্থিক ব্যবস্থায় টাকার যোগান বাড়ায়—ব্যাংকের বন্ড আদি সিকিউরিটি পেপার কিনে বা কম দরে ব্যাংকগুলোকে টাকা ধার দিয়ে, যাতে ব্যাংক কম সুদে বাজারে টাকা ধার দিতে পারে। আবার মুদ্রাস্ফীতির সময় বাজারে টাকার যোগান কমায়—ব্যাংককে সরকারি বন্ড বিক্রি করে এবং ব্যাংককে ধার দেবার সুদের হার বাড়িয়ে, যাতে ব্যাংকের কাছে শস্তায় লোন দেবার মতো টাকা না থাকে। 
আপনা হাত, জগন্নাথ? 
কিন্তু অক্টোবর ২০১৮তে রিজার্ভ ব্যাংকের স্বাধিকার বা অটোনমি প্রশ্নের মুখে দাঁড়ায়। স্বাধীনতার পর প্রথম বার কেন্দ্রীয় সরকার রিজার্ভ ব্যাংক অ্যাক্টের ধারা ৭(১)এর অধিকার প্রয়োগ করে নিজেদের রাজকোষের চাপ কমাতে রিজার্ভ ব্যাংকের ৭০ বছরে আয় থেকে সঞ্চিত জমা রাশি নিয়ে্‌ নেবার জন্যে চাপ সৃষ্টি করে। তাতে তৎকালীন গভর্নর উর্জিত প্যাটেল পদত্যাগ করেন। ডেপুটি গভর্নর বিরল আচার্য রিজার্ভ ব্যাংকের স্বায়ত্ত রক্ষার পক্ষে তিক্ত বক্তব্য রাখেন। তারপর বিরল আচার্যকেও পদত্যাগ করতে হয় এবং নিয়ম বদলে রিজার্ভ ব্যাংকের বোর্ড অফ ডায়রেক্টর্সে সরকারের প্রতিনিধির সংখ্যা বাড়ানো হয়, ফলে বাজারে টাকার যোগানের সংকোচন বা প্রসারণের প্রশ্নে রিজার্ভ ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে কোনও মতভেদ বা বিতর্কের সম্ভাবনাই থাকে না। অবশেষে ২৭ অগাস্ট, ২০১৯ তারিখে রিজার্ভ ব্যাংক নিজেদের রিজার্ভ থেকে ১,৭৬,০৫১ কোটি টাকা বা ১.৭৬ ট্রিলিয়ন টাকা কেন্দ্রীয় সরকারকে দেবার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে আর্থিক মন্দা এবং ক্রমাগত কমতে থাকা ট্যাক্স আদায়ের ফলে সরকারের রাজকোষে যে চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল, তা অনেকটা কমে যায়। অর্থনীতিবিদেরা আশা করেছিলেন এর ফলে সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ নির্মাণ ও কৃষক এবং ছোট বিজনেস এবং ক্ষুদ্র শিল্পকে কিছু রিলিফ দেবে যাতে বাজারে কেনাকাটা বাড়ে। 
গরীবী হটাও 
ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক দল মনে করে দারিদ্র্য দূর হওয়া উচিত এবং এতে সরকারের ভূমিকা আছে। কিন্তু কাকে গরীব বলব, গরীবী রেখার দাঁড়ি কোথায় টানা হবে, সে নিয়ে বিস্তর মতভেদ। তেন্দুলকার কমিটির মতে, এই লাইনটি হলো ব্যক্তিপ্রতি দৈনিক খরচ ২৭ টাকা। 
২০০৯ সালে তেন্দুলকর কমিটি মনে করেন, এখন জনসংখ্যার ২২% দারিদ্র্য রেখার নীচে বাস করে। তবে রঙ্গরাজন কমিটির(২০১২) মতে এই সংখ্যাটি ৩০%। ইউনাইটেড নেশন্স ডেভেলপমেন্ট প্রোজেক্টের মতে ২০০৫-৬ থেকে ২০১৫-১৬র মধ্যে ২৭১ মিলিয়ন ভারতীয় গরীবী রেখার উপরে উঠেছে। কিন্তু নভেম্বর ৮, ২০১৬ থেকে উলটো গঙ্গা বইছে। নোটবন্দী এবং জিএসটির জটিলতা ও ডিজিটাল বাধ্যবাধকতার ফলে মার খেল ইনফর্মাল ইকনমি। জিডিপি দ্রুত নিম্নগামী। শেষে করোনার প্রকোপে গত মার্চে এলো চারঘন্টার নোটিসে লকডাউন—কাজ হারিয়েছে কত লোক? বিভিন্ন মতে প্রায় ৫০ থেকে ১২০ মিলিয়ন লোক। এদের উপর নির্ভরশীল পরিবার দ্রুত গরীবী রেখার নীচে নেমে যাচ্ছে। এরা জিরো-ইনকাম গ্রুপ থেকে কবে লোয়ার ইনকাম গ্রুপে ফিরবে আন্দাজ করা কঠিন। 
অভিজিত ব্যানার্জি এনডিটিভিকে দেওয়া এক সাম্প্রতিক দীর্ঘ সাক্ষাতকারে বলেন যে, ভারতের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারে এবং চীন থেকে কাজ ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন্স বা বাংলাদেশে চলে গেছে বলে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই। ভারতের আর্থিক কাঠামো, টেকনোলজি, আঁতেপ্রেনারের সাইজ –সবই ওদের তুলনায় বেশি। যদি একবছরে জিডিপি বৃদ্ধির দর ৬% বা ৭% পৌঁছে যায় তাহলেই কাজ হারানো মানুষেরা অনেকেই কাজ ফিরে পাবে। কিন্তু সবই নির্ভর করছে সরকারের সঠিক নীতি নির্ধারণের উপর। 
অধিকাংশ খেটে খাওয়া মানুষের বর্তমান সংকটের আশু সমাধান হিসেবে ওঁর নোট ছাপানোর যুক্তিকে সমর্থন করে উনি আরও বলেন যে গোটা বিশ্বে সবাই এই পথ নিয়েছে—আমেরিকা, বৃটেন, জার্মানি, জাপান সবাই। ভারত কেন শুধুমুদু উলটো পথে হাঁটবে? 
সরকার রাজকোষ ঘাটতি মেটাতে নতুন করে টাকা ছাপাবে কি না? 
তেমন কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী দ্বিতীয় রিলিফ প্যাকেজ (২০ ট্রিলিয়ন) ঘোষণার আগে জানিয়েছিলেন যে, করোনা-জনিত রিলিফ ইত্যাদির ফলে রাজকোষ ঘাটতি বাজেটের সময় বলা ৩% এর জায়গায় ৫% হবে; অর্থাৎ ৭.৮ লক্ষকোটির বদলে ১২ ট্রিলিয়ন টাকা ধার করতে হবে। কিন্তু রিলিফ ঘোষণার সময় বাড়তি টাকা কোত্থেকে আসবে, সেই প্রশ্ন উনি এড়িয়ে গিয়েছিলেন। 


সরকার যদি এই টাকাটা তুলতে বাজারে বন্ড বিক্রি করে তাহলে প্রাইভেট সেক্টরের ধার নেওয়ার জন্যে উপলব্ধ টাকা কমবে, ফলে বাজারে সুদের হার বাড়বে। কিন্তু তা না করে সোজা রিজার্ভ ব্যাংকে ট্রেজারি বিল (বিনা সুদের অল্পকালীন বন্ড) জমা রেখে নোট ছাপিয়ে নিলে বাজারে সুদের হারে কোন প্রভাব পড়বে না, তাই মনে হচ্ছিল নোট ছাপানো হবে। 


কর্পোরেট দুনিয়া কী ভাবছে? 


কোটক মহীন্দ্র ব্যাংকের কর্ণধার এবং কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিজ (সি আই আই)এর নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান উদয় কোটক প্রধানমন্ত্রীর “আত্মনির্ভর ভারত” যোজনার প্রতি আস্থাশীল। ওঁর মতে লকডাউন খুলে দেওয়ায় মানুষের দুমাসের চেপে রাখা খরচ করার স্পৃহা বাজারে ডিমান্ড বাড়িয়ে দেবে। মদের দোকানে ভিড় তারই ইঙ্গিত বলে উনি মনে করেন। তাই সরকার এখন সাপ্লাই সাইড বা শিল্পব্যবসায়কে টাকা যোগানোর বন্দোবস্ত করে সঠিক নির্ণয় নিয়েছে। উনি মনে করেন আগামী দিনে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ দরকার হেলথকেয়ার ও শিক্ষায়। 
তবে আর এক ইন্টারভিউয়ে উনি জানিয়েছেন যে, নোট ছাপানোর বদলে রিজার্ভ ব্যাংক যে ‘ওপেন মার্কেট অপারেশন’ (অর্থাৎ ব্যাংকগুলোর জমা সরকারি বন্ড কিনে নিয়ে ওদের টাকার যোগান বাড়িয়ে দেওয়া) করছে, সেটাই ঠিক। 
বিরোধী রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের নেতা রাহুল গান্ধীর মতে আশু দরকার হলো প্রতি মাসে ১০০০০ টাকা করে গরীবদের হাতে দেয়া এবং এমএস এমইর জন্যে নগদভিত্তিক রিভাইভাল প্যাকেজ। 


‘আত্মনির্ভর ভারত’ ও চীনের মাল বয়কট? 


লাদাখ সীমান্তে চীন ও ভারতের সৈনিকদের হাতাহাতি খুব বেশি দূর গড়ায়নি। দু’পক্ষেই উচ্চস্তরের আলোচনার মধ্যে দিয়ে ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নেওয়ার দিকে এগোচ্ছে।কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ার এবং টিভি চ্যানেলের মাধ্যমে একটা আহ্বান ছড়িয়ে পড়ছে—চীনের মাল বয়কট কর; ভোক্যাল ফর লোক্যাল হও এবং এভাবেই ভারত “আত্মনির্ভর” হবে। 
মজার ব্যাপার হলো ভারতের চীন থেকে আমদানি ২০১৪ সালে ১২ বিলিয়ন ডলার ছিল, কিন্তু মোদীজির সময় মাত্র পাঁচ বছরে বেড়ে গিয়ে ২০১৮-১৯শে ৭০.৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে—যাতে ভারতের রপ্তানি ১৬.৮ বিলিয়ন ডলার এবং চীন থেকে আমদানি ৭০.৩ বিলিয়ন ডলার। মানে চীনের পাওনা ৫৩.৫ বিলিয়ন ডলার। 
বর্তমান ভারতে অধিকাংশ মোবাইল যেমন রেডমি, অপ্পো, ভিভো, সব চীনের। গত দু’বছরে ভারতে স্টার্ট আপে চীনের প্রাইভেট বিনিয়োগ বেড়ে ২ ট্রিলিয়ন টাকা হয়েছে। ভারতে ৩০ টি বড় স্টার্ট আপের মধ্যে ১৮টি স্টার্ট আপে চীনের প্রাইভেট বিনিয়োগ রয়েছে। ওলা, হাইক, বিগ বাস্কেট, ওওয়াইও, পেটেম (নোটবন্দীর সময় প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞাপন), স্ন্যাপডীল, জোম্যাটো, বোইজু, টিকটক-- সবেতেই চীনের বিনিয়োগ। 


ভারতের কিছু কোম্পানিও চীনে বিনিয়োগ করেছে। 


কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি্র দু’বছর আগের একটি স্টাডি রিপোর্ট অনুযায়ী চীনে ৫৪টি ভারতীয় কোম্পানি ম্যানুফ্যাকচারিং, হেলথকেয়ার এবং ফিনান্সিয়াল সার্ভিসে যুক্ত রয়েছে। 
চীনে এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কয়লা এবং বিদ্যুৎ সাপ্লাইয়ে আদানি গ্লোবাল (সিঙ্গাপুরে অফিস, ডঃ রেড্ডিজ ল্যাব, জিন্দাল স্টিল এন্ড পাওয়ার, বিইএম এল, বি এইচ এম এল, অরোবিন্দো ফার্মা এবং মহীন্দ্র এন্ড মহীন্দ্র। 
অনেকের মতে এই বয়কটের আহ্বান খুব একটা ফলপ্রসু হবে না। কারণ সরকারি বাণিজ্য ছাড়াও ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রোগ্রামে ভারতে তৈরি বহু উৎপাদনে ব্যবহৃত মেশিন বা তার যন্ত্রাংশ, কেমিক্যালস সব চীন থেকে আসে। এছাড়া অনেক স্টার্ট আপে চীনের আলিবাবা ইত্যাদির বিনিয়োগ রয়েছে। কাজেই কাকে চীনে মাল বলা হবে এটাও একটি বিতর্কিত প্রশ্ন। 
এমনকি, সর্দার প্যাটেলের স্ট্যাচুর বাইরের ব্রোঞ্জের আবরণের প্লেটগুলো পর্য্যন্ত চীনের সিয়াংসি টংকিং কোম্পানিতে ঢালাই হয়ে এসেছে। 
এছাড়া ভারতে চীনের রফতানি ৭৫ বিলিয়ন ডলার ওদের সমগ্র রফতানির ৩%। কিন্তু চীনে ভারতের রফতানি ১৭ বিলিয়ন ডলার যা কিনা দেশের সমগ্র রফতানির ৫.৩%। কাজেই দু’দেশের বাণিজ্য মার খেলে ভারতের লোকসান বেশি। 
কিন্তু কিছু ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন ১০ জুন থেকে দেশ জুড়ে চীনামাল আমদানি বন্ধ করার ডাক দিয়েছে। 






খাব খাব, কোথায় পাব? ধার কর না! শুধবে কে? লবডংকা! 


অর্থশাস্ত্র নামের বিদ্যাটির জন্মের, অর্থাৎ অ্যাডাম স্মিথ-এর সময়ে সরকার বাজারে বন্ড ছেড়ে ঋণ করত মূলতঃ যুদ্ধবিগ্রহের খরচা মেটাতে। অভিজাত এবং সম্পন্ন বর্গের লোকজন সেটা কিনতেন কারণ তাতে সুদের হার চড়া ছিল। ওদের যুক্তি ছিল সরকার এভাবে ঋণ করলে দেশের কোন ক্ষতি নেই। ধার দিচ্ছে দেশের কিছু লোক, নিচ্ছে এবং খরচ করছে ও সুদ দিচ্ছে দেশের সরকার। ‘এক হাত থেকে আরেক হাতে যাচ্ছে-দেশের বাইরে তো যাচ্ছে না’! 
অ্যাডাম স্মিথ তাঁর ম্যাগনাম ওপাস ‘ওয়েলথ অফ নেশন্স’ (১৭৭৬) এর দ্বিতীয় ভল্যুমে এই লাইনের যুক্তির কড়া সমালোচনা করেছেন—মূলতঃ দুটো দিক থেকে। 
এক, এটা নৈতিকভাবে অনুচিত। কারণ এতে দেশের সম্পত্তি শান্তিপূর্ণ উৎপাদক কাজ থেকে সরে যুদ্ধের জন্যে খরচ হয়। এর পরিশোধ হয় আগামী দিনে দীর্ঘসময় ধরে। এভাবে অর্থনীতি ‘বিকৃত’ হয়। 
দুই, এছাড়া সরকারী ঋণ দেশের সম্পত্তির মালিকানা “উৎপাদক শ্রেণী”র হাত থেকে নিয়ে “ বসে বসে খাওয়া” শ্রেণীর হাতে চালান করে এবং মিলিটারি এই টাকায় যুদ্ধে নামে, পরিণামে জীবন ও সম্পত্তি নষ্ট হয়। 
মার্ক্স এবং উনিশ শতকের প্রায় সব সমাজবাদীরাই ধার করে দেশ চালানোর বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁদের চোখে এটা ব্যক্তি-পুঁজির আধিপত্য জমানোর একটা কল মাত্র। মার্ক্স তাঁর “ক্লাস স্ট্রাগল ইন ফ্রান্স” – ১৮৪৯-৫০ সালে লেখা—বইয়ে সরকারি বন্ডের ওপর ভূস্বামীদের পাওনা মেটাতে নেপোলিয়নের বিত্তমন্ত্রীর হঠাৎ করে মদের উপর ট্যাক্স বাড়ানোর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। 
মজার ব্যাপার হলো বৃটেনের সরকারি ঋণ ১৭৭০ সালে জাতীয় আয়ের ১০০% প্রতিশত এবং ১৮১০ সাল নাগাদ ২০০% ছুঁয়েছিল। এবং বৃটেন এই ধার একশ’ বছর ধরে শোধ করেছিল, বেশির ভাগ সময় শুধু সুদ দিয়ে। ফলে উচ্চবর্গের কাছে খামোকা সরকারকে ট্যাক্স দেওয়ার বদলে ধার দিয়ে সুদ কামানো অনেক বেশি আকর্ষণীয় ছিল। 
কিন্তু দেড়শ বছর পরে কি ইকনমিস্টদের চিন্তা বদলে গেছে? নইলে হরদম ফিসক্যাল ডেফিসিট কড়া হাতে সামলানো নিয়ে এত উপদেশের পাশাপাশি ডেফিসিট ফাইনান্স বা সরকারের ধার করে খরচ করা নিয়ে এত বিতর্ক কেন? 
এ নিয়ে এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি কী বলছেন শুনুন। 
“ বিংশ শতাব্দীতে পাবলিক ডেট বা সরকারের ঋণ নিয়ে একেবারে অন্যরকম কথা শোনা যেতে লাগল। মনে করা হলো যে, এই ঋণ নীতিগতভাবে সরকারের উন্নয়নমূলক ব্যয় বাড়িয়ে সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া অংশের পক্ষে দেশের সম্পত্তি পুনর্বণ্টনে সহায়ক হতে পারে”। 
উনি আরও বলছেন যে, এই দুটো দৃষ্টিকোণের মধ্যে ফারাক বেশ সরল ও স্পষ্ট। উনবিংশ শতাব্দীতে উত্তমর্ণদের (উচ্চবর্গ এবং ভূস্বামী) থেকে ধার নেওয়া টাকা ফেরত দেবার সময় রাষ্ট্র(খাতক) সুদে-আসলে ভাল করে পুষিয়ে দিত। ফলে ব্যক্তিগত সম্পত্তি ফুলে ফেঁপে উঠত। কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে মুদ্রাস্ফীতির (ইনফ্লেশন) ঘায়ে ধার নেওয়া টাকার মূল্য কমে যেত, এবং ফেরত দেওয়া হত মূল্য কমে যাওয়া টাকায়। এভাবে রাষ্ট্র বাজেটের ঘাটতি হলে নতুন কর না বসিয়ে উত্তমর্ণদের টাকায় ঘাটতি পূরণ করে দেশ চালাতে শুরু করল। 


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালোবাজারি ইত্যাদিঃ 


পিকেটি দেখিয়েছেন যে মুদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে সম্পত্তির পুনর্বন্টন সমাজের একটা ছোট অংশের জন্যেই খাটে। 
আমরা কোলকাতা এবং বঙ্গে বিশ্বযুদ্ধের সময় দুটো জিনিস দেখেছি। 
এক, বিয়াল্লিশের ভয়ংকর মন্বন্তর। চাল বৃটিশ ফৌজের জন্যে বাজেয়াপ্ত হচ্ছে এবং মজুতদাররা লুকিয়ে ফেলে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াচ্ছে। ফলে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ এবং অনাহারে মৃত্যু। 
দুই, একশ্রেণীর মানুষেরা যুদ্ধের আবশ্যকীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ এবং কালোবাজারি করে রাতারাতি ছিরু পাল থেকে শ্রীহরি ঘোষ হয়ে যাচ্ছে। এরা সম্পত্তি কিনছে ভবানীপুর, বালিগঞ্জ এবং ঢাকুরিয়ার রেললাইনের এপারে। আর এই কালোবাজারি দেশের অর্থনীতিকে খানিকটা চালু রাখে বটে! 


ডেফিসিট ফাইন্যান্সিং- ভাল না মন্দ? 


এখানে দুইখান কথা আছে। আমেরিকা ইউরোপের মত উন্নত অর্থনীতিতে সাধারণতঃ ইকনমির অন্তর্নিহিত শক্তির প্রায় পূর্ণ দোহন হতে থাকে। তখন বাজারে অতিরিক্ত পয়সা এলে উৎপাদন বা শ্রমশক্তির নিয়োগে বিশেষ তফাত হয় না। তাই বাড়তি টাকা বাজারে পণ্যের দাম দ্রুত বাড়িয়ে দেয়। এই পরিস্থিতিকে বলে ‘টু মাচ মানি চেজিং টু ফিউ গুডস’। 
কিন্তু ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের লোকজনের আয় কম, জমাপুঁজি কম, জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ হয় বেকার বা ছদ্ম-বেকার, মানে নাম-কে-ওয়াস্তে কিছু একটা করছে। ফলে বাজারে জিনিসের যোগান বাড়লে বা নতুন পণ্য এলেই যে সাততাড়াতাড়ি বিক্রি হবে সে সম্ভাবনা কম। তাই ইন্ডাস্ট্রিও “ফুল ক্যাপাসিটি”তে উৎপাদন করেনা। মহাগুরু কেইন্সের মতে এইসময়, বিশেষ করে মন্দার সময়, সরকার এগিয়ে এসে লোকের হাতে বেকার ভাতা দিলে বা রাস্তা হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণ কাজের মাইনে হিসেবে নগদ দেওয়ার বন্দোবস্ত করলে লোকে বাজারে ভোগ্যপণ্য কিনতে আসবে, ক্রমশঃ বাজার আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াবে। 
যেটা দরকার হিসেব করে ধার নিয়ে নোট ছাপানো এবং প্ল্যান করে কয়েকবছরের মধ্যে সেই ধার চুকিয়ে ফেলা। এভাবে এই ডেফিসিট ফাইন্যান্সিং উন্নয়নশীল অর্থনীতির জন্যে বিকাশের সহায়ক হবে, লাগামছাড়া মুদ্রাস্ফীতির পথে হাঁটবে না। 
আগামী দিনের জীবিকার রূপঃ 
অর্থনীতি কেবল শুকনো টাকাকড়ির হিসেব নয়, কোন বিমূর্ত ছবি বা রকেট সায়েন্স নয়, এটি একটি সামাজিক বিজ্ঞান। তাই এতে প্রতিফলিত হয় আমাদের জীবনশৈলী এবং সংস্কৃতি ও তার বিবর্তন। মনে হচ্ছে জুনের শেষে ভারতে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে এবং জুলাইয়ের শেষে ১০ লক্ষ। 
এর আতংক এবং বাধ্যবাধকতা আমাদের জীবিকা ও জীবনশৈলীতে কী ধরণের পরিবর্তন আনবে আজ সেটা আন্দাজ করা কঠিন। তবু কয়েকটা কথা বলাই যায়। যেমন কেনাকাটিতে নগদে লেনদেন কমে ক্রমশঃ ডিজিটাল হবে। অনেকগুলো ব্যবসায় এবং ইন্ডাস্ট্রিতে “ওয়ার্ক ফ্রম হোম” হবে ‘নিও-নর্মাল’। স্কুলকলেজের পড়াশুনোতেও এর ছাপ পড়বে। কিন্তু এর জন্যে দরকার উন্নত স্কিল-সেট যা ব্যয়সাধ্য। ফলে গাঁ এবং ছোট শহরের খেটে খাওয়া পরিবারের নতুন প্রজন্ম হয়তো পিছিয়ে পড়বে এবং কম আয়ের কাজে আটকে থাকবে। 
লকডাউন শুরু হওয়ার পর সবচেয়ে মার খেয়েছে খেলাধূলো, বিনোদন শিল্প এবং ট্যুরিজম ও হসপিটালিটি ব্যবসায়। 
‘সামাজিক দুরত্ব’ বজায় রাখতে গিয়ে নতুন খোলা রেস্তোরাঁতে টেবিল সাজানো হচ্ছে ফাঁক রেখে, গ্রাহক বসছে পাশাপাশি নয়, মুখোমুখি। এতে ব্যবসায়ের টার্ন ওভারে বিরাট লস। মনে হয় যতদিন না করোনার ভ্যাকসিন আবিষ্কার হচ্ছে এবং তা আমজনতার হাতে পৌঁছচ্চে ততদিন এভাবেই চালাতে হবে। 


খেলাধূলো 


সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে মুখে মুখোস এঁটে কোন খেলাটি খেলা যায়? দাবা। টেনিস? ফুটবল? ক্রিকেট? আইসিএল? কুস্তি-বক্সিং—সাঁতার? 
তবে বার্সিলোনা রিয়েল মাদ্রিদের সঙ্গে মাঠে নামছে, মেসি ট্রেনিং করছেন; দেখা যাক। 


নাটক-সিনেমা 


টিভি সিরিয়ালের শ্যূটিং শুরু হচ্ছে, কিন্তু গ্রুপ থিয়েটার এবং পথ-নাটকের কী হবে? আবেগের প্রকাশ হবে হাত না ধরে? শুধু ডায়লগ বলে? 
জাদুই ঝাপ্পিঃ করোনামুখর দিনে 


ভার্জিনিয়া টেক-এর বিজ্ঞানী লিনসে মার বায়ুবাহিত অসুখের ছড়িয়ে পড়ার বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ জানাচ্ছেন, মাস্ক লাগিয়ে মুখ পাশের দিকে করে বেঁধে ছোট্ট একটু আলিঙ্গনে সংক্রমণের ভয় নেই বললেই চলে। 


আদিম জীবিকা কি করোনার সামনে মাথা নোয়াবে? 


অল ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক অফ সেক্স ওয়ার্কার্সের প্রেসিডেন্ট কুসুম জানিয়েছেন যে, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সের ভয়ে গ্রাহকেরা আসছে না। তাই কাজ হারিয়ে দিল্লির যৌনকর্মীদের ৬০%-- প্রায় ৩০০০ কর্মী-- তাঁদের নিজের গৃহরাজ্যে ফিরে গেছেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ শালিনীর মতো উত্তর প্রদেশের গাঁয়ের বাড়ি ছেড়ে পরিবারের অত্যাচার থেকে রেহাই পেতে দিল্লিতে এসেছিলেন, এখন সেখানেই ফিরে যেতে হচ্ছে। 
গার্স্টিন বাস্টিয়ন রোড বা জিবি রোডের শর্মিলা, রজনীদের মতো অনেকেরই এখন বাচ্চাকে খাওয়ানোর পয়সা জুটছে না—সামনে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। 
কোলকাতার সোনাগাছি এবং অন্যান্য লালবাতি এলাকাতেও প্রায় একই অবস্থা। যৌনকর্মীদের ইউনিয়ন ‘দুর্বার’ এবং কিছু এনজিও’র সহায়তায় এঁদের কোনরকমে দু’বেলা মোটা ভাতের জোগাড় হচ্ছে বটে, কিন্তু কতদিন? খবরে প্রকাশ বড়তলা থানার ওসি দেবজিত ভট্টাচার্য্য ৫০০০ যৌনকর্মী মহিলাকে চিহ্নিত করে কিছু এনজিওর সহায়তায় দুবেলা খাবার জোগানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। 
কিন্তু মানুষ বাঁচতে চায়, তাই বিষম পরিস্থিতিতে হার না মেনে প্রাণপণ লড়াই করে। করোনার হট জোন মুম্বাইনগরী এখন ভয় ধরায়। এখানে বিশেষ ধার্মিক সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষও বাড়ছে। মুম্বাইয়ের গ্রান্ট রোডের যৌনপল্লীর বাসিন্দা রিয়া (নাম বদলে দেওয়া) ও তাঁর সাথীরা টেকনলজি ব্যবহার করে পেশার কৌশল পালটে নিয়েছেন। তাঁরা মোবাইলের মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন হিন্দু এবং মুসলিম দুটো নাম নিয়ে। উনি নির্ধারিত সময়ে সেজেগুজে কিন্তু ওড়নায় মুখ ঢেকে ভিডিও চ্যাটে বসেন। সময় ৩০ মিনিট, এভাবে প্রতিদিন ঘরে বসেই প্রতি গ্রাহক ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা দরে দুই বা তিনজন গ্রাহকের মনোরঞ্জন করেন। উনি খুশি, কাউকে কমিশন দিতে হয়না, গুণ্ডা বা পুলিশের উপদ্রব নেই এবং সবচেয়ে বড় কথা স্বাস্থ্যের উপর চাপ নেই। 


নতুন সম্ভাবনাঃ 


মনে হচ্ছে এই প্যানডেমিকের ঠেলায় আগামী দিনে রাষ্ট্রের ভূমিকা আরও বাড়বে। মার্ক্স-লেনিনের মত সমাজতন্ত্রী এবং প্রুধোঁ-বাকুনিনের মতো নৈরাজ্যবাদীদের স্বপ্নটি রাষ্ট্র ক্ষয়ে গিয়ে ফুরিয়ে যাবে বা ধ্বংস হবে—সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা আপাততঃ নেই। 
কিন্তু দুটো বিষয়ে রাষ্ট্রের সক্রিয় ভুমিকা নিয়ে করোনা -পরবর্তী দশকে বড় বিতর্ক শুরু হতে চলেছে। এক, ইউনিভার্সাল হেলথ-কেয়ার বা সার্বজনিক স্বাস্থ্য -প্রকল্প এবং ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম বা সার্বজনিক মৌলিক আয়। দ্বিতীয়টি নিয়ে কেনিয়া, ইরান ও আলাস্কায় প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এ নিয়ে ভবিষ্যতে আলাদা করে কথা বলা যাবে। 
(সমাপ্ত)

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in









প্রকৃতিগতভাবে মানুষ অবাধ্য। হাজারো বিশৃঙ্খলার মধ্যে থেকেও প্রকৃতি যেভাবে শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলে, আবির্ভাবের পর থেকেই আর সব প্রাণী এবং মানুষ-পূর্ব মানব প্রজাতিদের যেটুকু শৃঙ্খলা তা-ই মানুষ জিনে বয়ে নিয়ে এসেছে এবং এতদিন কাটিয়েছে। এছাড়া অন্য কোনোরকম নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। সামাজিক, ধর্মীয় বা আইনি সব নিয়মই আধুনিক মানুষের সৃষ্টি। তাই শৃঙ্খলা ভাঙার চেষ্টা একেবারে শিশুকাল থেকে। শিশু শৃঙ্খল পড়তে জানে না, তাই তার গতিবিধি কাজকর্ম সবই বড়দের মনে হয় বে-নিয়ম। একে তো হাজারটা নিয়মের চোটে নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা, তার ওপর যদি হঠাৎ কোনো কিছুর জন্যে আবার কিছু নিয়ম বাধ্যতামূলক করা হয় তো সব বয়সের মানুষই বিরক্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছু নিয়ম যদি সমাজের সকলের ভালোর জন্যে চালু হয় তাহলে নাচার হলেও মেনে নিতে হয়। এই চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম এবং বাধ্য হয়ে ভালো ছেলেমেয়ের মত মেনে নেওয়া এটাতে মনের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। যা হয়েছে বর্তমান কোভিড-১৯ জীবাণুর ব্যাপক সংক্রমণের ছোঁয়াচ এড়াতে। একনাগাড়ে অন্তরীণ থাকতে থাকতে সব মানুষেরই অল্পবিস্তর অবসাদ সংক্রমিত হচ্ছে এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। 
স্কুলে পড়া সু-স্বাস্থ্য এবং গার্হস্থ্য বিজ্ঞানে শরীর-স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্যে পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা সম্বন্ধে যা কিছু শিখেছিলাম তার সবটাই উপদেশ মনে করে পরবর্তী জীবনে বিসর্জন দিয়ে সমাজের নিয়ম-না-মেনে-চলার মূল স্রোতে মিশে গিয়েছি। এমনকি খাবার আগে হাত ধোয়ার মত অবশ্য কর্তব্যটাকেও অমান্য করেছি। কোভিড-১৯-এর কল্যাণে কিছু শৃঙ্খলা আমাদের অভ্যেস করতে বাধ্য করেছে। পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার জন্যে কয়েকটা নিয়ম এখন মেনে চলতে হচ্ছে যেমন বারবার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, খাবার আগে হাত ধোয়া, মুখে হাত বা রুমাল চাপা দিয়ে কাশি হাঁচি, যেখানে সেখানে থুতু নোংরা না-ফেলা ইত্যাদি অর্থাৎ যেসমস্ত কাজ না করার জন্যে সাধারণ জীবাণু ছড়িয়ে সর্দি কাশি জ্বর গলাব্যাথা ইত্যাদি রোগ হয়ে থাকে। সত্যি বলতে কি এগুলো মেনে চলার জন্যে শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে। সর্বদাই এসব দিকে নজর দেওয়া অবশ্যই উচিৎ, এসময় তো বটেই এবং আমরা দিচ্ছিও কিন্তু আমরা নজর দিচ্ছি না আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি। প্রতিদিন একটু একটু করে মনের অবক্ষয় হচ্ছে তা বুঝতে পারছি না, শুধু মনে হচ্ছে, ধুর্‌, ভালো লাগছে না। একটা আরোপিত চাপের মধ্যে থাকতে থাকতে এই ভাবটা যখনই আসছে তখনই বুঝতে হবে মনের অবস্থান আর স্বাভাবিক নেই, পরিবর্তন আসছে, অস্থির হয়ে উঠছে। এই অস্থিরতার মাত্রা প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে আলাদা এবং তা নির্ভর করছে ব্যক্তির পারিবারিক, সামাজিক, কর্মক্ষেত্র, আর্থিক ইত্যাদি নানা অবস্থানের ওপর। এরসাথে আছে বয়স এবং শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য। 
মানুষ অভ্যেসের দাস। বয়স অনুসারে যে বয়সের যা কাজ আমরা তাতে অভ্যস্ত হয়ে যাই। যেমন শিশু যতক্ষণ বাড়িতে থাকে সে তার নিজের মনে খেলা করতে থাকে যা অনেকসময় বড়দের মনে হয় দুষ্টুমি আর তখন শাসন প্রক্রিয়া চলে; পড়ুয়ারা স্কুল-কলেজে যাওয়া, পড়া-টিউশন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা ইত্যাদিতে ব্যস্ত থাকে; চাকুরি বা শ্রমজীবীরা নিজের কর্মক্ষেত্রে সারাদিন বা রাত কর্মব্যস্ত ছাড়াও বন্ধুদের সাথে নিয়মিত দেখা, আড্ডা, ক্লাব, পার্টি ইত্যাদিতে পরিশ্রান্ত হয়; অবসর জীবন যাদের তারাও নিজের নিজের মত সময় কাটানোর একটা পন্থা বের করে নেয়। অর্থাৎ প্রত্যেকে তার জীবন যাপনের একটা উপায়ে দিন কাটায়। এখন এই লকডাউন আমাদের এই যাপনের অভ্যেসকে ঘেঁটে দিয়েছে একেবারে। হঠাৎ করে গৃহবন্দি অবস্থাটাকে জীবনের, নাকি মৃত্যুর(?), ভয়ে মেনে নিতে বাধ্য হলেও যখন এটা দীর্ঘদিন চলে তখনই কালবৈশাখীর মেঘের মত হামাগুড়ি মেরে আসতে থাকে অবসাদ। ভালো লাগছে না। কবে উঠবে এই লকডাউন। কবে যাব স্কুল, কলেজ। কবে আবার অফিসে কারখানায় গিয়ে কাজ করতে পারব। কবে আবার পার্কে, সরোবরে প্রাতর্ভ্রমণ বা সান্ধ্য আড্ডায় মিলিত হব। কবে আবার সিনেমা, নাটক ইত্যাদি মনোরঞ্জনের জায়গায় যাব। কবে সাজুগুজু করে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেব। তার মানে কবে আবার আমরা যে যার অভ্যেসের জগতে ফিরে যাব। 
এক ব্যক্তির সাথে আর এক ব্যক্তির সাক্ষাতে কথার সাথে চোখের মিলনও হয়। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে না পারলে স্বস্তি মেলে না। চার চোখের মিলনে মনের সেতুও গড়ে ওঠে। অথচ সামাজিক দূরত্ব সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আজকাল অডিও ফোনে স্বস্তি মেলে সিকি ভাগ। তাই ভিডিও কলিং করে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর একটা চেষ্টা চলছে। মন ভালো রাখার জন্যে নানা জনে বা গোষ্ঠী মিলে হরেক উপায় বের করছে। ডিজিটাল মাধ্যমে অডিও ও ভিডিও অনুষ্ঠান চলছে, অনেকে যোগদান করছে আর বেশিরভাগ লোক শুনছে বা দেখছে। মনোবিদেরা ফোনে এবং বিভিন্ন মাধ্যমে পরামর্শ দিচ্ছেন, মন উৎফুল্ল রাখার উপায় বলছেন। কিছুদিন আগে এক উৎকণ্ঠিত মায়ের প্রশ্ন ছিল, “আর পারছি না। একদম কথা শুনছে না ছেলে। ভীষণ দুষ্টুমি করছে” ইত্যাদি যা অনেক মায়েরেই অভিযোগ। খুব সুন্দর করে বর্তমান পরিস্থিতি বুঝিয়ে উত্তর দিলেন মনঃচিকিৎসক, অনেক কিছু বলার পর বললেন, “ওকে ঘরের কাজে লাগান, ছাত থেকে কাপড় তুলে আনতে বলুন” ইত্যাদি। প্রশ্নকর্ত্রী বুঝলেন কী না জানি না, চুপ করে গেলেন কিন্তু আমার মনে কৌতুহল যদি ঘরের কাজ করতে বা ছাত থেকে কাপড় তুলতে ছেলে অস্বীকার করে কারণ সে তো আগে কখনও এ কাজ করেনি আর সে এই অবস্থা বুঝে বা না-বুঝে যে দুষ্টুমি করছে বাড়িতে তা তো তার স্বাভাবিক ক্রিয়াকর্মের বাইরে থাকার জন্যে। মনোবিদেরাও এই অবস্থায় কীভাবে সামাল দেবে নানা বয়সের লোকেদের বিভিন্ন মানসিক সমস্যার তা তাদেরও গবেষণার বিষয়। কারণ প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজস্ব মানসিকতার ওপর বাঁচে আর এই মানসিকতা তৈরি হয় মস্তিষ্কের বৃহত্তর সম্মুখভাগ সেরিব্রাম বা গুরুমস্তিষ্কের ওপরের স্তরের ধুসর বাহ্যাংশে যা দশ হাজার কোটি নিউরন মস্তিষ্ক কোষ দিয়ে তৈরি। এটাই মানুষের একান্ত নিজস্ব এবং মনের রান্নাঘর। আপাতভাবে মানুষে মানুষে প্রচুর মিল থাকলেও প্রতিটা মানুষ তার নিজস্ব শারীরগত এবং মানসিক গঠন নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানেই মনের গোষ্ঠী চিকিৎসা অচল হয়ে যায়। অন্তরীণ শিশুদের ওপর মনের যে চাপ বাড়ছে তা কীভাবে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে প্রতিক্রিয়া করবে তা ভবিষ্যতই বলবে। গার্হস্থ কলহের অভিযোগ যে ক্রমশ বাড়ছে তা তথ্যই প্রমাণ। প্রবীণদের মনে হতাশা, অশক্ত প্রবীণদের অবস্থা আরও করুণ। বৃদ্ধ বয়সে একলা যারা আছেন তাদের একাকীত্ব এমনিতেই জীবনসঙ্গী হয়ে আছে তার ওপর গৃহবন্দি অবস্থায় পথ্য ও ওষুধের চিন্তায় মনের অবস্থা ভেঙে পড়ার মত। সকালে বা বিকেলে ঘর থেকে দু-পা দূরে কয়েকজন মিলে কথাবার্তা বলে মন হাল্কা করার একটা উপায় ছিল, সেটাও বন্ধ। বদ্ধ ঘরের বাইরে বেরিয়ে বাড়ির মহিলারাও নানা কাজ করতেন, সেটাও ছিল কিছুক্ষণের জন্যে হলেও একঘেয়েমি থেকে একটা মুক্তির স্বাদ। ঘরের কাজে সাহায্য করার লোকেরা না আসায় অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ আপাত স্বস্তি দিলেও অভ্যস্ত কর্মক্ষেত্র পরিবেশ প্রবল কাজের চাপেও মনকে কিছুটা হলেও শান্তি দেয়, পাঁচটা লোকের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলা একটা দারুণ টোটকা মন ভাল রাখার। এসবের বাইরেও জনসংখ্যার দশ শতাংশ শিশু থেকে প্রৌঢ় আছেন আমাদেরই সাথে যাদের কথা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। কেমন আছেন এইসব লোকেরা যারা বিশেষ কোনো সহায়তা ছাড়া কিছু করতে পারেন না? আমরা সবাই কিছু না কিছু ভাবে অন্যের ওপর নির্ভর করি কিন্তু এই সংখ্যালঘু অথচ সংখ্যার নিরিখে উপেক্ষিত মোটেই নয় তারা কিভাবে যাপন করছেন জীবন এই দুর্বিষহ লকডাউনে? এদের মধ্যে অনেকেই আছেন সাহায্য ছাড়া এক পা-ও চলতে পারেন না, বসতে পারেন না, খেতে পর্যন্ত পারেন না। কিছুদিন আগে এক বৃদ্ধ পিতা তার অসমর্থ স্ত্রীর চোখের সামনে হুইল চেয়ারে আবদ্ধ তারই মানসিক অপরিণত প্রৌঢ় সন্তানকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে কারণ সন্তান মাস্ক পড়ে রাস্তায় বেরোতে রাজি হচ্ছিল না। সমাজ এবং আইনের চোখে পিতা খুনী বলেই সাব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু কেন তাকে এই কাজ করতে হল, কোন মানসিক হতাশার তলানিতে আগে থেকেই নিমজ্জিত হওয়া এবং এই লকডাউন তাকে আরও গভীরে নিয়ে গিয়ে তার এতদিনের ভাল গুণকে একমুহূর্তে নষ্ট করে তাকে দিয়ে খুন করাতে বাধ্য করল তা কোন মনোবিদ ব্যাখ্যা করবে? স্কুল জীবনে অভ্যস্ত অপরিণত মনের সন্তানদের কিভাবে সামাল দেবেন অভিভাবকেরা যখন বাধ্যতামূলক বন্ধ স্কুল এবং সন্তানেরা সেখানে যাওয়ার জন্যে কান্নাকাটি করছে। কারণ সেখানে স্কুল পাঠ্যক্রম ছাড়াও গান খেলাধুলা আর শিক্ষক ও বন্ধুদের মাঝে সে খুঁজে পায় আনন্দ, তার জীবনের সার্থকতা। 
একশো বছর আগে প্লেগের সময় এমন অবস্থা হলেও মানসিক চিকিৎসার উন্নতি তখনও হয়নি যার জন্যে সে নিয়ে গবেষণাও কম। তবু আমাদের সবাইকেই এই ভয়ংকর কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেই বাঁচতে হবে, অন্যদের বাঁচাতে হবে। এখনই কোনো নির্দিষ্ট দিশা জানা নেই। জীবনই এখন বিশাল পরীক্ষাগার বিশেষ করে মনের স্বাস্থ্য গবেষণার জন্যে যেখানে যত মানুষ তত মনের রোগ জন্ম নিচ্ছে। আশা করি কালো মেঘ একদিন সরবে, শরতের উজ্জ্বল আলো সব মলিনতা ঘুচিয়ে দেবে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অভীক কুমার চৌধুরী

Posted in












["সময় কখন যে থমকে দাঁড়ালো কালবোশেখীর মাসে"/ সজারুর কাঁটা, ১৯৭২/ আর তাই খুব নিঃশব্দে আড়ম্বরহীন চলে গেলো ১৬ জুন ২০২০I একশো বছর পেরিয়ে আজও "সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা "হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বিশ্বব্যাপী আপামর সংগীতপ্রেমীর কাছে গানের ঈশ্বর -- "তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী"... তাঁর ই গানে উদ্বেলিত হয়েছে কত শত মানুষের জীবন, এমনই একজনকে (নাম পরিবর্তিত) নিয়ে কল্পনা ও বাস্তবের রংতুলিতে আমার এ লেখা এক একনিষ্ঠ হেমন্ত অনুরাগী স্মরণে ও একই সঙ্গে গানের ঈশ্বরকে শ্রদ্ধাঞ্জলি |]
"আমার আর হবে না দেরি", পাড়ার ফাংশানে শুনেছিলাম, আমার বন্ধু তপনের সঙ্গে তখন আমরা নেহাতই কিশোর| অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম সাদা ধুতি, শার্ট পরিহিত দীর্ঘদেহী, সৌমকান্তি এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোক, মনে হোল অবিকল সেই গলায় গাইছেন| হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এসেছেন আমাদের পাড়ায়? তখনো ওনার গান সামনাসামনি শুনিনি, বাড়িতে রেডিওতে যা শুনতাম| আমি বিস্ময়ে হতবাক| একের পর এক গান শোনাচ্ছেন," শোন্ কোন একদিন" "আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা", "পথ হারাবো বলেই এবার", "আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা", "ঠিকানা আমার চেয়েছো বন্ধু", "একগোছা রজনীগন্ধা হাতে নিয়ে বললাম", "তোমার চোখের জলে যদি "... বাড়ি ফিরে আসছি , মাইকে ভেসে আসছে ,' ... "যদি পৃথিবীটা সপ্নের দেশ হয় তবে কেমন হতো"...
সেই সেদিন থেকে, এক গানের জাদুকরের মোহময় অলৌকিক, অপার্থিব সব গানের জগতের সন্ধান দিলেন আমায় সেই অনামী গায়ক, যার নাম সুনীল মুখোপাধ্যায় (পদবিতেও আশ্চর্য মিল) তারপরেই এলো সেই উথাল পাতাল সত্তর - একাত্তর সালের দিন| আমাদের স্কুল শেষ করে কলেজে ঢোকার পালা| "পথে এবার নাম সাথী পথেই হবে পথ চেনা'র আবহে শ্রেণী সংগ্রাম চলছে , "প্রত্যহ যারা ঘৃণিত আর পদানত / দেখো আজ তারা সবেগে সমুদ্যত".. উদাত্ত আহ্বান| এরই মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ , উত্তাল হয়ে উঠেছে এপার ওপার, আমাদের শপথ . "মা গো ভাবনা কেন ..", "ও আমার দেশের মাটি .."
একদিন সুযোগ এলো,তপনের সঙ্গে সুনীলদার বাড়ি গেলাম| মন্দিরতলার কাছেই বিশাল বাড়ির দোতলায় ছোট্ট দুটো ঘর, এক চিলতে বারান্দা, আমরা যে ঘরে বসলাম, তাঁর ছোট্ট চৌকিতে হারমোনিয়াম, তবলা, প্রচুর গানের বই| দেয়ালের কোণে তানপুরা, ঠিক ওপরে ফ্রেমে বাঁধানো আমাদের গানের ঈশ্বর আরো ওপরে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ| লেখা-''আমার হৃদয় তোমার আপন হাতে দোলে"|
আর কাঠের তাকে, চৌকির তলায় অজস্র রেকর্ড| শরিকি বাড়িতে এইটুকুই তাঁর বরাদ্দ| সুনীলদা আমাদের গান শোনালেন , "জীবন বলে এ ঘর তুমি ভোল, হৃদয় বলে এ ঘর গড়ে তোল "তারপর শুরু করলেন, "এমন আমি ঘর বেঁধেছি ...", পরের গান "নীড় ছোট ক্ষতি নেই, আকাশতো বড়....."., "লাজবতী নুপুরের রিনিঝিনিঝিনি " একদম শেষে " তারে বলে দিও, সে যেন আসেনা আমার দ্বারে..."
আমার গানের ঈশ্বরের কাছে কোনদিন যেতে পারিনি কিন্তু তাঁর একনিষ্ঠ সেবকের কাছেই তাঁর গান শুনতে যেতাম তাঁর বাড়ি| নভেম্বরের সন্ধ্যে, একটু ঠাণ্ডা ভাব| হারমোনিয়ামে হাত দিয়ে বসে ছিলে| কেন জানিনা সেদিন সুনীলদার মুডটা কোন কারণে অফ ছিল| কিছু বললেননা তারপর একটাই গান ধরলেন," নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবী /আর পৃথিবীর পরে ঐ নীলাকাশ." সেদিন সত্যি ওনার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল, যখন গাইছিলেন, "এই বেদনার ইতিহাস শুনেছ কি ,/ দেখেছো কি মানুষের অশ্রু/ শিশিরে শিশিরে ঝরে"| এই সময়ে এ গান যখনই শুনি নিজের অজান্তে চোখে জল চলে আসে|

কলেজ সোশ্যাল, ইউনিভার্সিটি, রবীন্দ্রসদন আরো কিছু জায়গায় আমি ঈশ্বরের দর্শন পেয়েছি, মোটামুটি সামনে থেকে অনেকবার বেশ কিছু গান শুনেছি| জোয়ান ছয় বেহারার সঙ্গে হুন হুনা করেছি "পালকির গানে"| মনেমনে গলা মিলিয়েছি," আজ সবার মিলন বিনা/ এমন জীবন বৃথা যায়"| ভোর রাতে ঘুমের ঘোরেস্পষ্ট শুনেছি," রানার রানার ভোর তো হয়েছে /আকাশ হয়েছে লাল..." দেখেছি, "শান্ত নদীটির পটে আঁকা ছবিটি" বাড়ি ফিরে আবার কোনদিন ছুটে গেছি সুনীলদার কাছে| আবদার করেছি সুনীলদা আজ বর্ষার দিনে কিছু শোনান| শুরু করেছেন, "মন মোর মেঘের সঙ্গী", "গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকেছিলো তারা .." ," বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল"|| তারপর শোনালেন, "সেদিন নিশীথে বরিষণ শেষে /চাঁদ উঠেছিল বনে" (১৯৪৩) আর শেষে "মেঘ মেদুর বরখারে" (১৯৫০)| শেষ গানটা ঠিক মনেও ছিলোনা, গুগল সার্চ করে পেলাম| সত্যি বলতে কি আমরা খুব হতাশ হয়েছিলাম, আমরা চেয়েছিলাম "এই মেঘলা দিনে একলা" কিংবা রবীন্দ্র সংগীত "এমন দিনে তারে বলা যায়.."| তবে একবার বর্ষণসিক্ত সন্ধ্যায় স্বয়ং ঈশ্বরের কন্ঠে শুনেছিলাম, "ওগো মেঘ তুমি উড়ে যাও কোন ঠিকানায়"| আহা কি আকুতি , কি বেদনা কথায়, সুরে, গায়কীতে | 
তারপর দিন কেটে যায়| সময় পেলেই গান শুনেছি, গানের ঈশ্বরের কন্ঠে কত সুন্দর, কত বেদনার, কত আনন্দের চিত্রিত দৃশ্যপটে বিভোর হয়েছি, আজও যেমন করে অভিভূত হয়ে যাই বারবার প্রতিবার---"কত রাগিণীর ভুল ভাঙাতে" "অনেক অরণ্য পার হয়ে", "সূর্য ডোবার পালা আসে যদি" "পথের ক্লান্তি ভুলে" "অলির কথা শুনে" "কোনোদিন বলাকারা অত দূরে যেত কি /ঐ আকাশ না থাকলে?",
দেখতে দেখতে দিন যায় দিন আসে|
একদিন সুযোগ আসে, চাকরি পেয়ে হাতে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে সুনীলদার কাছে যাই, প্রণাম করি| সুনীলদার খুশি আর ধরে না, আজ অভীকের অনারে বিশেষ কিছু গান| শোন্ অনুভব করো, -- সুনীলদা শ্রদ্ধায় কপালে হাত ছোঁয়ালেন| হারমোনিয়ামে হাত রাখা কিন্তু চোখ কোন সুদূরে| ধরো ওই লাইনটা, "তুমি এলে অনেক দিনের পরে যেন বৃষ্টি এলো"-- একলাইন গাইলেন| আবার ধরলেন এক দু লাইন করে অনেক গান, "আরো ভালো হোত যদি তুমি আর আমি", "..ছিল ভাবে ভরা দুটি আঁখি চঞ্চল" , "মনের জানালা ধরে উঁকি দিয়ে গেছে ..", "ও দুটি আঁখি যেন", "রাগ যে তোমার মিষ্টি আরো" "কেন দূরে থাকো /শুধু আড়াল রাখো..", "বসে আছি পথ চেয়ে...", "ভোরের আলোয় পড়লো তোমায় মনে", "সেদিন তোমায় দেখেছিলাম ভোরবেলায়" ,"আর কত রহিব শুধু পথ চেয়ে", "তোমার মাঝে পেলাম খুঁজে আমার পরিচয়" "তোমায় আমায় মিলে বাঁধবো যেথা ঘর"... আর শেষে "কথা কোয়নাকো শুধু শোনো"
...সব মনে নেই... 

আবার নানারকম কাজে মেতে উঠি, সুনীলদার কাছে যাওয়া হয়না |
তপন একদিন বললো, চল, সুনীলদা ডেকেছে তোকে| কেন রে? তা জানিনা তুই চলতো|
---তুমি গল্প লেখো অভীক? বানিয়ে বানিয়ে বেশ প্রেমের গল্প লিখেছো| আমায় লিয়ে লিখবে নাকি?
"পুরানো সেই দিনের কথা" বুঝলে, অফিসে এক জলসায় শুনিয়েছিলাম," কোন পাখি ধরা দিতে চায় / অসীম আকাশ ফেলে সোনার খাঁচায়", "তোমার আমার কারো মুখে কথা নেই", "বনতল ফুলে ফুলে ঢাকা", "ও দুটি আঁখি যেন", "অমন ডাগর ডাগর চোখে কেন" আর "মেঘ কালো আধার কালো" এই ছ'টি গান| একজনের অনুরোধে "কোন পাখি ধরা দিতে চায়" গানটি শেষে আবার| কিছুদিন পরে অফিস থেকে বেরোচ্ছি, সোজাসুজি সেই একজন আমার সামনে এসে বললো, আমিই সেই পাখি| আমি ঘাবড়ে গেলাম, মানে? 
সেই তন্বী তরুণী বললো, আমার নাম পাখি, আমি ধরা দিতে চাই অসীম আকাশ ছেড়ে সোনার খাঁচায়...
সর্বনাশ, বলে কি| মুখে বললাম, "তুমি কি যে বলো বুঝিনা"| বলা হয়নি, "জানিনা কখন তুমি আমার চোখে" ...
"চোখে যদি জল করে টলমল" , আমি দেখলাম, "তুমি চলে গেলে" , "যাবার আগে কিছু বলে গেলে না"
তারপর?
সুনীলদা হারমোনিয়াম টেনে নিলেন," তার আর পর নেই, নেই কোন ঠিকানা"
সম্ভব ছিলোনা ভায়া, সরকারি অফিসের পিওন | 
দেনা করে নিজের গানের রেকর্ড করেছিলাম, কেউ কেনেনি| হেমন্ত বাবু আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন| আমি অন্য কারো গান কোনদিন গাইতে পারবো না, ওনার গান করি বলে তবু দুটো খেতে পাই|
আর কিছুনা সেদিন বলে ফিরে এসেছিলাম, তারপরেও কিছুদিন ওনার বাড়ি গেছি| ওনার মুখে শোনা বেশ কিছু গান একটু সাজিয়ে নিলাম, "সূর্য ডোবার পালা আসে যদি আসুক বেশ তো" "এ জীবন বেশ চলছে", ভাবি "যায় দিন এমনি যদি যায় যাক না", তবু "কে জানে ক'ঘন্টা পাবিরে জীবনটা", দেখো, "সবাই চলে গেছে" একদিন  "আমিও পথের মত হারিয়ে যাবো" "ফেরানো যাবে না আর"| "যদি জানতে চাও" "ঘুম নেই কেন চোখে", জানি "এই যে পথের দেখা পথেই শেষ হবে" তবু "বসে আছি পথ চেয়ে" যদিও "আজ দুজনার দুটি পথ গেছে বেঁকে" কিন্তু "আজও হৃদয় আমার পথ চেয়ে দিন গোনে"| আসলে "এ ব্যাথা কি যে ব্যাথা বোঝে তা আনজনে"| 
শেষবার সুনীলদার সঙ্গে দেখা ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে, দেখলাম প্রচণ্ড ঝড়ে বিদ্ধস্ত চেহারা , কোন গান নয়, যেন বলছেন, "যে বাঁশি ভেঙে গেছে", "সাক্ষী থাকুক ঝরাপাতা" "স্মরণের এই বালুকাবেলায়" "হিসাব মিলাতে গিয়ে দেখি", "মুছে যাওয়া দিনগুলি", "আমার যাবার বেলায় পিছু ডাকে"| "নিঝুম সন্ধ্যায়" "শূন্যে ডানা মেলে পাখিরা উড়ে গেলে" "পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে"? 
"ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমে" 'ছেলেবেলার গল্প শোনার দিনগুলি', না, সুনীলদার গল্প কোনদিন শেষ হবে না| প্রতিদিন দেখি "নতুন নতুন রং ধরেছে সোনার পৃথিবীতে", দিগন্তে ভাসে সুর, "মালতী ভ্রমরে করে ওই কানাকানি" "আমি গান শোনাবো একটি আশা নিয়ে" "আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে "| "জীবনপুরের পথিক " মনে করায় "বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও "|
প্রতিদিন প্রতিক্ষণ অসংখ্য শব্দের মাঝে শুনি সেই স্বর্ণকণ্ঠ" এমন কিছু শব্দ দিতে পারো, যাতে কোন শব্দ নেই, স্তব্ধ আমি, শব্দে শব্দে ক্লান্ত, শিশির ঝরার শব্দ...,কুঁড়ি থেকে ফুলের ফোটার শব্দ... স্মৃতিতে অতীতকে ফিরে পাবার শব্দ"...

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সুমন্ত্র চট্টোপাধ্যায়

Posted in










ভূমধ্যসাগরের বুকে ক্যালিফোর্নিয়া শহরের কিছু দূরে আছে এক দ্বীপপুঞ্জ, যার পোশাকি নাম ‘চ্যানেল আইল্যান্ডস’। মাত্র আটটি দ্বীপের সমষ্টি। কেউ চাইলেও আজ এখানে যেতে পারবেন না কারণ মার্কিন নৌসেনা এই দ্বীপপুঞ্জকে ব্যবহার করে সেনা প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র পরীক্ষার কাজে। মার্কিন আদমশুমারি অনুযায়ী এ দ্বীপে কোনও স্থায়ী বাসিন্দা নেই। থাকেন শুধু শ’দুয়েক সেনা ও আধা সেনা লোকজন।
এই দ্বীপপুঞ্জের এক ধারে আছে এক দ্বীপ, যার নাম সান নিকোলাস। আজ কেউ না থাকলেও এক দিন এখানে থাকতেন আদিবাসী সম্প্রদায়, দ্বীপের নামে যাদের নাম হয়েছিল নিকোলিনো। আর অন্যান্য দ্বীপে যারা থাকতেন তাঁদের নাম ছিল চুমাস ও টংভা। এঁরা এখানে বাস করেছেন দশ হাজার বছর বা তার বেশি সময় ধরে। আজ আর কোনও নিকোলিনো বেঁচে নেই। 
নিকোলিনোরা তাঁদের নাম যে নিকোলিনো সে কথা জানতেন কি না বলা কঠিন। ১৫৪০ সালে স্পেনীয় কাপ্তান কাব্রিলো এই দ্বীপ আবিষ্কার করেন। সান নিকোলাস নামটা তাঁরই দেওয়া। কয়েক হাজার বছর ধরে এই দ্বীপসমূহের অধিবাসীরা সুখে দুঃখে নিজেদের মতোই ছিল। বাকি পৃথিবীর সঙ্গে কোনও যোগাযোগই ছিল না তাঁদের। যোগ ছিল না তথাকথিত ইউরোপীয় বা অন্য কোনও সভ্যতার সঙ্গে। আঠেরোশো শতকের শেষ ভাগে শুরু হল সেই যোগাযোগ যা অচিরেই দুর্যোগে পরিণত হল ১৮১৪ সালে। এই দ্বীপে পাওয়া যেত প্রচুর ভোঁদড় ও সিল, ফার ও চামড়ার জন্য যা শিকারিদের কাছে লোভনীয়। রাশিয়ার জার প্রথম পল-এর পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি হল ‘রুশ মার্কিন কোম্পানি’, তারা পাড়ি জমাতে লাগল সান নিকোলানোতে। রফা হল, নিকোলিনোরা সিল আর ভোঁদড় শিকার করে চামড়া ছাড়িয়ে দেবে তাদের। কিছু কাল চলেও ছিল সে ব্যবসা, তার পর লাগল গোলমাল। প্রথমে বচসা, তার পর এক অসম যুদ্ধ তিরধনুক ও মাস্কটের। বলা বাহুল্য, দাঁড়াতেই পারল না নিকোলিনোরা। দশ হাজার বছর ধরে যাঁদের এখানে বাস, তাঁদের বড়জোর দশ-বিশ জন বেঁচে রইল।
এর পর কুড়ি বছর কেটে গিয়েছে। মূল মার্কিন ভূখণ্ডের শাসনভার মেক্সিকানদের হাত-ফেরতা চলে এসেছে আমেরিকানদের হাতে। ১৮৩৫ সালে সিদ্ধান্ত হল, যে ক’জন নিকোলিনো তখনও বেঁচেবর্তে আছেন তাঁদের নিয়ে আসা হবে মূল ভূখণ্ডে। জাহাজ চলল। নিকোলিনোদের জড়ো করা হল সমুদ্রসৈকতে, তার পর তোলা হল জাহাজে। সেদিন প্রকৃতি একেবারেই বিরূপ, ঝড় উঠতে পারে যে কোনও মুহূর্তে, ক্যাপ্টেন চার্লস হুবার্ড ক্রমাগত তাড়া লাগাচ্ছেন। চিরকালের বাসভূমি চিরতরে ছেড়ে জাহাজে উঠলেন অধিবাসীরা। জাহাজ সবে চলতে আরম্ভ করেছে, তখন ঘটল এক সাংঘাতিক ঘটনা। এক নিকোলিনো যুবতী জাহাজ থেকে জলে দিল ঝাঁপ, আর সেই উত্তাল হয়ে ওঠা সমুদ্রে সাঁতরে চলল সদ্য ছেড়ে আসা দ্বীপের দিকে। লোকে বলে, সে জাহাজে উঠে দেখেছিল তার সন্তান সেখানে নেই, তাই এই দুঃসাহসিক কাজ। ঝড় উঠছে, কাজেই এক জনের জন্য জাহাজ থামানো ঠিক নয় বলে সিদ্ধান্ত নিলেন কাপ্তেন।
নিকোলিনোরা কিন্তু ‘সভ্য’ সভ্যতায় এসে বাঁচলেন না। যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান নিকোলিনো নারী-পুরুষেরা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন। তখন সবার খেয়াল হল সেই মেয়েটির কথা। সে যদি বেঁচে গিয়ে থাকে আর সাঁতরে দ্বীপে উঠতে পেরে থাকে, তা হলে সে-ই তো এই গোটা জাতির একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি। অতএব খোঁজ লাগাও। সেই বাজারে একশো ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে, বলে এক জনকে পাঠানো হল। সে ফিরে এল, মেয়েটিকে খুঁজে পায়নি। কিছু বছর পর আর-এক জন গেলেন, তাঁকে কবুল করা হয়েছে দুশো ডলার। কিন্তু তাঁর ভাগ্যেও শিকে ছিঁড়ল না। এঁদের কথায় উৎসাহিত জর্জ নিডেভার নামে এক ব্যক্তি চললেন সেই নাম না-জানা নিকোলিনো মহিলার খোঁজে।
দ্বীপে পৌঁছে নিডেভারের নজরে এল সিলের চামড়া, যত্ন করে কেটে শুকোতে দেয়া হয়েছে। দেখতে পেলেন পায়ের ছাপ। তার পর পেলেন এক অদ্ভুত আস্তানার সন্ধান। তিমির পাঁজরার হাড় দিয়ে তৈরি সে বাড়ি। তার সামনে বসে মাছের ছাল ছাড়াচ্ছেন এক মহিলা, যার বয়স চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে। পাখির পালক শুকিয়ে তা গেঁথে জামা তৈরি করে পরেছেন তিনি। এই সেই জাহাজ থেকে লাফিয়ে পড়া সেদিনের তরুণী। ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে আঠেরো বছর। না, সন্তানকে তিনি বাঁচাতে পারেননি। এরই মধ্যে কোন সময়ে সে মারা গিয়েছে, হয়তো বন্য কুকুরের আক্রমণে, বা অন্য কিছুতে। নিজের হাতেই তার দেহ সমাহিত করেছেন মা, সেটাই ওঁদের প্রথা। তার পর একা বাস করছেন এতগুলো বছর। ঝড় উঠলে তা থেকে বাঁচার রাস্তা খুঁজে নিয়েছেন, আবিষ্কার করেছেন এক গুহা। আর সেই গল্পের মতো কোনও ‘ফ্রাইডে’ কিন্তু তাঁকে সঙ্গ দিতে আসেনি।
এত দিন পরে একজন মানুষ— তাও আবার অন্য সম্প্রদায়ের— দেখে মহিলা কিন্তু রেগে ওঠেননি। ভয় পাননি। সুন্দর করে হেসেছেন। এমনকি কিছুটা মাছ কেটে খাবার জন্য এগিয়েও দিয়েছেন অতিথিকে। কেউ কারও ভাষা বোঝেন না। আকারে-ইঙ্গিতে তাঁকে বোঝানো হল, জাহাজে করে তাঁকে নিয়ে আসা হবে। তাতেও তাঁর কোনও আপত্তি নেই। মহিলা চলে এলেন সান্টা বারবারা মিশন-এ। কিন্তু কে তাঁর ভাষা বুঝবে? আগে যে নিকোলিনোদের আনা হয়েছিল তাঁরা তো মারা পড়েছেন সভ্যতার সংস্পর্শে এসেই। কাছের দ্বীপ চুমাস ও টংভা দ্বীপের লোক এনে লাভ হল না। কেউ বোঝে না এই মহিলার ভাষা।
এত কাল একা থেকেছেন, সন্তানকে হারিয়েছেন, কিন্তু মহিলা অত্যন্ত প্রাণোচ্ছল। নিজের ভাষাতে গান করেন। নাচেন। তাঁকে দেখতে ভিড় করেন বহু মানুষ। নিডেভার নিজের বাড়িতেই রাখলেন তাঁকে। তার সেই গানের নাম হল ‘টোকি টোকি’ গান। মানে বোঝেন না কেউ, কিন্তু মুখে মুখে ফিরতে লাগল সেই গান। ‘টোকি টোকি ইয়াহামিমেনা/ ওয়েলেশকিমা নিশুইয়া হামিনা/ টোকি টোকি...’ মহিলা মাঝে মাঝে ঘুরে চারদিক দেখেন। কখনও ঘোড়া দেখেননি, বিস্ময় প্রকাশ করেন। ভাষা না থাকলেও হাসিতে আর আচরণে সবার তিনি প্রিয়পাত্রী হয়ে উঠলেন। 
মাত্র সাত সপ্তাহ। অসুস্থ হয়ে পড়লেন মহিলা। আঠেরো বছর ঝড়ঝঞ্ঝায় একা কাটিয়ে যিনি ছিলেন স্বাস্থ্যবতী, তথাকথিত সভ্য সমাজে এসে তিনি ভয়ানক ডিসেন্ট্রির শিকার হলেন। মহিলা যখন মৃত্যুশয্যায়, তখন ফাদার সাঞ্চেজ তাঁকে ব্যাপ্টাইজ করে নাম রাখলেন জুয়ানা মারিয়া। সভ্যতা তাঁকে কিছুই দেয়নি, বরঞ্চ নষ্ট করে দিয়েছে তাঁর জীবন, তাঁর প্রিয় সব মানুষকে। শেষ সময়ে তাঁকে শুধু একটা নাম দেয়া হল। তার আসল নাম কী ছিল, কেউ জানল না। বহু হাজার বছর ধরে যাঁরা পৃথিবীর বুকে চলেফিরে বেড়িয়েছিলেন তাঁদের শেষ প্রতিনিধি চলে গেলেন। সভ্যতা তাঁকে কিছুই দেয়নি অকালমৃত্যু ছাড়া, তিনি পৃথিবীকে দিয়ে গেলেন বাঁচার ইচ্ছার এক অতুলনীয় কাহিনি। সান্টা বারবারার সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত করা হল তাঁকে। 
ক্যলিফোর্নিয়ার সান্টা বারবারাতে রাস্তার ধারে জুয়ানার মূর্তি আছে সন্তান কোলে। 
এর অনেক পরে, ১৯৩৯ সালে এক অভিযাত্রী দল গিয়ে দেখেছে, তখনও দাঁড়িয়ে আছে সেই তিমির পাঁজরের হাড়ে তৈরি কুটির। আর মাত্র বছর আটেক আগে, ২০১২ সালে আবিষ্কার হয়েছে সেই গুহা, যা মহিলাকে বাঁচাত সামুদ্রিক ঝড়ের হাত থেকে। তবে এক দিন হয়তো মার্কিন নৌবাহিনীর মারণাস্ত্র পরীক্ষার সময়ে সে গুহা ধ্বংস হয়ে যাবে। হয়তো বা গিয়েছে এর মধ্যেই।
শহুরে মানুষের একটা অভ্যাস আছে এটা ভাবা যে প্রকৃতির কোলে যাঁরা থাকেন তাঁদের কাছে না যাওয়াই ভাল, তাঁরা রোগের আকর ইত্যাদি। প্রথম সেই বিশ জন নিকোলিনো ও পরে জুয়ানা মারিয়ার পরিণতি কিন্তু এ বিশ্বাসে প্রশ্ন তুলে দেয়। সভ্যতা কি নিরাপদ, না কি বেশি নিরাপদে আছেন তাঁরাই যাঁরা নগরসভ্যতার থেকে অনেক অনেক দূরে জীবনকে সাপ্টে বাঁচছেন, ‘তাজা মাছ যারা টেনে তোলেন ডাঙায়’? প্রশ্নটা আরও বেশি করে ওঠে আজ, যখন সারা বিশ্ব, বিশেষত তথাকথিত প্রথম বিশ্ব এক মহামারির আঘাতে পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সোমব্রত সরকার

Posted in











পূর্ব-প্রকাশিতের পর

 
চিরাচরিত আনুষ্ঠানিক ধর্মের বিপক্ষে বাউল সমাজ সেই উদ্ভবের কাল হতেই কথা বলে এসেছেন। তাঁরা বলে থাকেন তাঁদের আচার: রাগের বিচার। আনুষ্ঠানিক ধর্ম বলতে তাঁরা বেদ-বিধিকেই চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের সাধনতত্ত্বের গানে এর স্পষ্ট উল্লেখ আছে। 
বেদে কি তার মর্ম জানে ৷ 
যেরূপ সাঁইর লীলা-খেলা 
আছে এই দেহ-ভুবনে॥ 
পঞ্চতত্ত্ব বেদের বিচার 
পণ্ডিতেরা করেন প্রচার, 
মানুষ-তত্ত্ব ভজনের সার, 
বেদে ছাড়া বৈ রাগের মানে॥ 
গোলে হরি বললে কি হয়, 
নিগূঢ় তত্ত্ব নিরালা পায়, 
নীরে-ক্ষীরে যুগলে রয়, 
সাঁইর বারামখানা সেইখানে॥ 
পড়িলে কি পায় পদার্থ 
আত্মতত্ত্বে যারা ভ্রান্ত, 
লালন বলে সাধু-মোহন্ত 
সিদ্ধ হয় আপনারে চিনে॥ 
বাউলের এই নিজেকে চেনা হল তাঁর দেহকে চেনা। তার জন্যই সর্বপ্রথমে তাঁরা কিছু সাংখ্যিক পরিসংখ্যানের ব্যঞ্জনাসহ দেহকে দেহ গড়ে ওঠার প্রারম্ভ-পাঠে ঢুকিয়ে দেন। যেগুলো সবই দেহসাধনার কারুময় বিনম্র সমর্পণ। কী তন্ত্রে, কী বাউলে, কী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের অস্তিত্ব পরম্পরায়। কিছু অর্থন্যাসের হেরফের ছাড়া ঐক্যসূত্রটি মোটামুটি প্রায় একই। মদনের পঞ্চবাণের কথা বলেন বাউল। 
পঞ্চবাণের ছিলা কেটে 
প্রেম যজ স্বরূপের হাটে, 
সিরাজসাঁই বলেরে, লালন, 
বৈদিক বাণে করিস নে রণ, 
বাণ হারায়ে পড়বি তখন 
রণ-খোলাতে হুবড়ি খেয়ে। 
বাণ অবশ্যই লিঙ্গ। প্রধানত কুম্ভক শক্তির ওপরে নির্ভর করে বাউলের বাণক্রিয়া। শুধু বাউলের কেন দেহসাধনার প্রয়োগগত উদাত্ত উপস্থাপনায় সব দেহসাধককেই বাণক্রিয়ার মহাপ্রাণ বর্ণগুলোকে শিখে নিতে হয়। তার জন্যই কুম্ভক যোগ। শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক গতিছন্দ ভঙ্গ করার ক্রিয়া এটি। শরীরের প্রধান দুই বায়ু প্রাণ আর অপান বায়ুর খেলা এটি। তাই প্রাণায়াম। দেহসাধককে তিন প্রকারই প্রাণায়াম করতে হয়। বাউল জোর দেন কুম্ভকে। কেন না কুম্ভকেই প্রধানত বাউলের বাণক্রিয়া নির্ভর করে। বৈদিক বাণ হল— মদন, মাদন, শোষণ, স্তম্ভন ও সম্মোহন। এই পঞ্চবাণের ক্রিয়াতে সংসারে কামের সংবৃত ধ্বনিটি রণিত হচ্ছে। বাউল সাধক একেই অস্বীকার করতে চান। তাই বৈদিক এই পঞ্চবাণের ছিলা তাঁরা কাটেন শরীরের অব্যর্থ শ্বাসক্রিয়ার সমাবেশে। তার জন্যই প্রাণায়াম করতে হয়। শরীরের অব্যর্থ শ্বাসক্রিয়ার সমাবেশে তাঁরা শরীরের বাইরের বায়ুকে টেনে এনে প্রথমে অভ্যন্তর ভাগ পূরণ করে নেন। এই হল পূরক। তারপর অভ্যন্তরের সেই বায়ুকে জলভরা কলসির মতো ধারণ করে রাখা হয়। তা হল কুম্ভক। একেবারে শেষে জমা বায়ুকে আস্তে আস্তে শরীরের বাইরে বের করে দেওয়া হয় রেচক করে। বাণ-যোজনা কীভাবে হয় বাউল শরীরে? সাধক বাউল প্রথমে সঙ্গিনীর বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানগুলোকে স্পর্শ করেন। তাঁরা বলেন বাউল সাধক চোখ দিয়ে সঙ্গিনীর সেই বিশেষ স্থানগুলো স্পর্শ করেন। বাস্তবিক সেটা কতখানি হয় বলা শক্ত। স্পর্শ-দৃষ্টিতেই তাঁদের মত, সঙ্গিনীর শরীরে উত্তেজনা বৃদ্ধি হয়। এটি হল মদন। মাদন তাঁদের ভাষায় হল গিয়ে হিল্লোল। দোলা হিসেবে আমরা একে দেখতে পারি। সঙ্গী, তাঁর সঙ্গিনীর সমস্ত যৌন উত্তেজক স্থানগুলো স্পর্শ করছেন আর সঙ্গিনীর শরীর জাগছে না তা কি হয়? এই উত্তেজনা বৃদ্ধির সময় শরীরের ডান দিকে অবস্থিত পিঙ্গলা নাড়িতে স্বাস কিছুক্ষণ প্রবাহিত হতে থাকে তখনই সঙ্গিনীর ডান চোখের দিকে দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে ফেলেন দেহসাধক। মদনের ক্রিয়াতে স্বাস চলে বাঁ দিকের ইড়া নাড়িতে। অর্থাৎ বাঁ নাকে শ্বাস নিয়ে মাদনের ক্রিয়ার সময় তাকে ডান দিকে নিয়ে আসা হয়। তাঁরা বাঁ নাককে বলেন চন্দ্র। তাঁদের চন্দ্র নাড়ি ইড়া। ডান নাক সূর্য। পিঙ্গলা হল সূর্য নাড়ি। যোগশাস্ত্রও অবশ্য এ নামকে প্রতীক হিসেবে শিরোধার্য করেছে। সহজিয়া মত দক্ষিণ/ডান দিক কামের দিক। এদিক তাই পরিত্যাগের নির্দেশও রয়েছে চণ্ডীদাসের সহজিয়া পদে— দক্ষিণ দিগেতে কদাচ না যাবে/যাইলে প্রমাদ হবে। শোষণকে যোগশাস্ত্র বজ্রোলী মুদ্রা হিসেবে নির্দেশ করেছে। এই শোষণ বাউলের রূপ-রতি-রসের চলিঞ্চ নিঝুম সঞ্চার। রূপ তাঁদের রজ। রতি স্ত্রী-বীর্য/রজ। শুক্র বা বীর্য হল গিয়ে বাউলের রস। মিলন ক্রিয়ার সময় রূপ-রতি-রসকেই শোষণ করা হয়। বীর্যকে ঊর্ধ্বগতি দিয়ে এই কার্যকে সুসম্পন্ন করা হয়। স্তম্ভন হল যখন উভয় দেহের রসের একটা স্থিতাবস্থা চলে আসে তখন সেই অবস্থার মধ্যে স্থির-অচঞ্চল আনন্দানুভূতির সঞ্চার হয় বলে তাঁরা বলে থাকেন। এই আনন্দানুভূতির বর্ধিত রূপ, দীর্ঘক্ষণ স্থায়িত্ব হল গিয়ে স্তম্ভন বাণ-ক্রিয়া। সম্মোহন হল দেহ-স্মৃতি লুপ্ত হয়ে যাওয়া। আনন্দকে পরম শূন্যতার মধ্যে চেতনায় অনুভব করা। দুই শরীরের সেই বাহ্যজ্ঞান লুপ্ততার মধ্যে যে বিপুল তরঙ্গের অতীন্দ্রিয়তার আভাস, তাই হল সম্মোহন ক্রিয়া। সম্মোহনকে সাধক ভেদে অনেকে আবা বলে থাকেন মোহন। মিলনস্থ শরীরের কাঙ্ক্ষিত চিরপ্রতীক্ষার আনন্দধ্বনিকে বাউল বলে থাকেন জেন্তে মরা। বাউলের এটাই হল নিজস্ব অনুভূতির শান্ত চরণে আসা রাজ সমারোহ। বৈদিক ঈশ্বর বিশ্বাসের করুণাধারা বলেও একে আমরা অনায়াসে চিহ্নিত করতে পারি। 
কীভাবে হয় বাউলের এই মিলন ক্রিয়ার স্বরূপ? শরীরস্থ চন্দ্র নাড়ি ইড়ায় অর্থাৎ বাঁ নাকে যখন সাধকের শ্বাস চলতে থাকে তখন সাধন-সঙ্গিনীর সূর্য নাড়ি পিঙ্গলাতে শ্বাসের চলাচল স্পন্দিত হয়। বাউল গুরু বলেন এটাই মিলনের প্রশস্ত সময়। তাঁদের মত, এই সময় সূচিত হয় রাতের খাবার খাওয়ার ঠিক দু’ঘণ্টা পরে। এর স্থায়িত্ব প্রায় দেড়ঘণ্টা। এই সময়ই তাঁদের যুগল-ক্রিয়ারম্ভের সময়। 



বাউলের সাধনা তাঁদের নিজস্ব বোধজমির সাধনা। বোধ তাঁদের গুরু প্রদর্শিত সব নির্দেশিকার নিবিড় পঙ্ ক্তি। জমি হল শরীর। এই বোধজমি গুরুমান্য পথ তাঁরা কীভাবে, কোন নির্দেশিকায় আর নিষেধনামায়— নিষেধাজ্ঞা আর সাবধান বাণীর দ্বৈতনামায় পৌঁছবেন তা নিয়েই পদকর্তারা আর রসিক-মহজনেরা সব রচনা করেছেন সাধনতত্ত্বের গান। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রসগ্রাহী সাধন সঙ্গীতের মতো এরও শারীরিক বাহুল্যের বাড়াবাড়ির নিজস্ব লজিক-এ রচিত হয়েছে সাধনতত্ত্ব বা দেহতত্ত্বের গান। যা শরীরকে মূর্ত প্রয়াস ও ব্যর্থতার মধ্যবর্তী চেতনা-সমন্বিত অটুট আধারের এক বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডের ঘর-বাড়ির আলোকসজ্জার অভিঘাতকে যৌনতার রূপস্থ দীপালি হিসেবেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কীভাবে? তারই আখরগত রূপে এখন আমরা একে-একে প্রবেশ করব। 
ক্ষ্যাপা প্রেম নদীতে স্নান করেত যাবে সাবধানে। 
যাবে সেই পিছল ঘাটের অকপটে সাধনসন্ধি জেনে। 
সেই প্রেম নদীতে ত্রিধারা বয় ত্রিধারায় অমৃত আছয়। 
পান করিয়ে হয় মৃত্যুঞ্জয় তারে কী করবে আর শমনে। 
সেই প্রেম নদীতে জোয়ার আসে তিন দিন করে প্রতি মাসে। 
সেথা রসিক যারা আছে বসে স্নান করিবে সেখানে। 
গোঁসাই ক্ষ্যাপা বলে এই প্রসঙ্গে কামগায়ত্রী রাখবি সঙ্গে। 
তখন পার হবি ভবতরঙ্গে সনাতন ভজ গা বসে এক মনে। 
বাউলের প্রেম নদী নারী বা সাধন সঙ্গিনীর শরীর। নারীকে তাঁরা সাধনতত্ত্বের গানে নদীর অর্থস্তর সৃজনে চিহ্নিত করে থাকেন। নদীর স্রোতধারার সঙ্গে নারীর রজ-প্রবৃত্তির উচ্ছলিয়া রূপ-সংযোগ তাঁদের দেহ-তত্ত্ব বা সাধন-তত্ত্বের গানে গুহ্য প্রতীক-এর নাতিস্ফূট অনুষঙ্গ। বাউল সাধনা মূলত আচরণবাদী— প্রচ্ছন্ন ও সংগুপ্ত। এই আচরণ নারী-পুরুষের দেহাচরণ। দেহে দেহ স্থাপনের আত্মীয়তা, কুটুম্ব তাঁদের মূল সাধনের অঙ্গ। আর তাঁদের সাধনা যেহেতু গুরুমুখী, লোকসমাজে বলা একেবারেই নিষিদ্ধ। সেজন্য বাউল গুরু পদকর্তা মহাজনেরা তাঁদের শরীর সাধনার ভাষাকে, ভাবকে, সাধন-তত্ত্বকে প্রচ্ছন্ন ও সংগুপ্ত করে রেখেছেন নিজস্ব এলাকার মধ্যে। সাধারণের পক্ষে এর অর্থ বোঝা, মানে করা সহজসাধ্য নয়। শুক্র বা বীর্য তাঁদের বীজ বা মণি বা রস। মল = অজর, মূত্র = রামরস, লিঙ্গ = বাণ, মুখ = লঙ্কা, দাঁত = দশানন, ডান চোখ = অধ, বাম চোখ = ঊর্ধ্ব, ডান নাক = সূর্য, বাঁ নাক = চন্দ্র। প্রেমকে তাঁরা পূর্ণচন্দ্র বলেন। রজ তাঁদের কারণবারি। আর রজঃপ্রবৃত্তির সময় হল গিয়ে অমাবস্যা। লিঙ্গ ও গুহ্যদ্বারের মাঝখানকে তাঁরা বলেন গৌইন্দ্রিয়। লিঙ্গের যে দ্বার দিয়ে শুক্র আসে সেটাকে আবার দশম-দ্বার বলে চিহ্নিত করেন। মদন, মাদন, শোষণ, স্তম্ভন, সম্মোহন— এই পাঁচ শারীরিক ক্রিয়া পঞ্চবাণ। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী রূপী তিন নদীর সংযোগস্থল আদতে ত্রিবেণী। সেই ত্রিবেণী তাঁদের তিন রতি। শরীরের তিন প্রধান নাড়ি— ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্নাকে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী নদীর প্রতীক-এ চিহ্নিত করেছে আমাদের যোগশাস্ত্র। আর শুধু প্রথান তিন নাড়ি কেন, শরীরের সাড়ে-তিন লক্ষ নাড়ির মধ্যে প্রধান যে চোদ্দটি নাড়ি যোগ সাধনাতে ক্রিয়ারত, আর শুধু যোগই বা কেন— আমাদের দেহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থেকে এই চোদ্দ নাড়িই আসলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যসকল সুসম্পন্ন করছে। ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না সহ গান্ধারী, হস্তিজিহ্বা, কুহু, সরস্বতী, পূষা, শঙ্খিনী, পয়স্বিনী, বারুণী, অলম্বুষা, বিশ্বোদরী, ও যশাস্বিনী— এই চোদ্দ নাড়িকেই চোদ্দটি নদীর নামে বোধ্যতার উপাসনা দিয়েছে যোগশাস্ত্র। বাউলের সাধনা মূলত তিন নাড়ির সাধনা। তাই তাঁরা ত্রিবেণীর কথা বলেন। বলেন ত্রিধারা। গানটিতেও ত্রিধারার অমৃত যোগের ইঙ্গিত রাখা হয়েছে। বাউল বলেন তাঁদের সাধনায় অমাবস্যার মধ্যে পূর্ণচন্দ্র উদয় হয়। প্রেম তাঁদের পূর্ণচন্দ্র আগেই বলেছি। তাঁদের সাধন অভিমত, যৌন স্বেচ্ছাচারকে তাঁরা সাধন এলাকার বাইরে রেখে আসেন। বলে রাখা ভালো, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এই ধারণাকে এখন সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। সে অবশ্য অন্য প্রশ্ন। কিন্তু দেহ-সাধনার উদ্দেশ্যগত দিকই ছিল শরীরের কামকে প্রেমে রূপান্তরিত করে দেওয়া। অমাবস্যা বাউলের ঘোর অন্ধকারময় কামের সময়। সাধন-সঙ্গিনীর দেহে তখন রজঃবৃত্তির মধ্যেই সাধক বাউলকে প্রেমের নৌকা বাইতে হয়। অমাবস্যা তাই তাঁদের কামের প্রতিরূপ। তেমনই পূর্ণিমা হল গিয়ে প্রেম। বাউল বলে থাকেন কামকেই প্রেম সাধনার দিকে নিয়ে যাবার কথা। বলেন— কামকে নাচাও, কামে নেচো না। আর এই অমাবস্যায় তাঁরা কামকে নাচান। সাধন গানে বলা রয়েছে: অমাবস্যায় পূর্ণচন্দ্র যে করে উদয়,/ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে—/ তিন ধামেতে হবে জয়;/ সামান্যের কর্ম নয়,/ সাধিলে সিদ্ধ হয়। এই সাধনার জন্যেই প্রেম নদীতে স্নান করা কথা বলা হয়েছে সনাতন দাসের (গোঁসাই খ্যাপা) গানে। খ্যাপা বলেছেন: সেই প্রেম নদীতে ত্রিধারা বয় ত্রিধারায় অমৃত আছয়।/ পান করিয়ে হয় মৃত্যুঞ্জয় তারে কী করবে আর শমনে। —এই ত্রিধারা হল সঙ্গিনীর শরীরের তিন দিনের রজঃস্রোত। এই রজঃপ্রবাহের ধারাকে তিন নামে তাঁরা অভিহিত করে থাকেন। যদিও এই নামকরণ তাঁরা ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ থেকে নিয়েছেন। এই তিন দিনের রজঃস্রোত বা কারণ-প্রবাহের নাম হল— কারুণ্যামৃত, তারুণ্যামৃত ও লাবণ্যামৃত। পদকর্তা পাঞ্জু শাহ্ অবশ্য তিন দিনের তিনটি প্রবাহকে তিনটি ভিন্ন নাম দিয়েছেন— প্রথম গরল রস, দ্বিতীয় শাম্ভু রস, তৃতীয় হল গিয়ে অমৃত রস। তিন দিনকে বলেছেন— অমাবস্যা, প্রতিপদ, দ্বিতীয়া। তিন দিনের মিলন ক্রিয়ার শেষ দিনটিকেই তিনি বলেছেন পরিণত ক্রিয়া। অর্থাৎ সাধনসিদ্ধি এ দিনেই আসে বলে তাঁর অভিমত— তিনটি রসের ভিয়ান যে জানে সে-ই পাবে নিরঞ্জনে ৷/ শাম্ভু গরল মিলন করে সুধার মিলনে॥/ যেমন দুগ্ধে জল মিলন করিলে হংস পাখী পান করে বেছে ৷/ রসিক জন হংস হয় সেই রসের সাধনে॥/ অমাবস্যায় গরল প্রকাশে,/ অমূল্য হয় সাঁই আগমনে ৷/ সাবধানেতে সাধন করে রসিকের গণে॥/ পদের শেষে দ্বিতীয়ার প্রথমে,/ রত্ন মিলে তিন রস মিলনে॥ 
বাউল সাধক বলেন, তিন রসে তিন রতি বর্তমান। গরল রসে সাধারণী, শাম্ভু রসে সমঞ্জসা, অমৃত রসে সমর্থা রতি। সাধারণী বলার কারণ হল সে দিন অর্থাৎ মিলনের প্রথম দিন সঙ্গিনীর শরীর স্থূল কামের পরিগণিত রূপ নিয়ে বসে থাকে। সমঞ্জসা হল দ্বিতীয় দিনে সাধক বাউল সঙ্গিনীর শরীরকে নিজস্ব সমতা অর্থাৎ সাধন স্তরের এলাকার আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারেন, গুরু নির্দেশিত বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়। সমর্থা বলার কারণ সাধক বাউল তৃতীয় দিনের শরীর ক্রিয়ায় সহজাবস্থায় চলে যান। তাঁরা তাঁদের অনুভূত অধর মানুষ বা অটল রূপে বিরাজ করেন। তাঁরা আবার এ-ও বলে থাকেন, তাঁদের সাধনা টল নয়, নয়কো অটল, তা হল গিয়ে সুটল। আর তার জন্যেই দেহকে তৈরি করার কথা বলে থাকেন বাউল সাধক। কীভাবে তৈরি করে নিতে হয় এই দেহ? তারই বর্ণচ্ছায়া সব লিপিবদ্ধ রয়েছে বাউলেরই সাধন তত্ত্বের গানে। তেমনই এক গান লালশশীর। 
ভাই রিপু ছয় ইন্দ্রিয় দশ আছে ষোলো জনা 
দেখ তাদের কথাতে ভুল না 
যেন বস্তু মজিও না ভাইরে 
চেতন হয়ে দেখ কার বা কোথা স্থান 
রাখবে সব স্থানে স্থানে যার যেমন আছে। 
এরা যখন হইবে শান্ত 
তখন দেখবে ভাই কোথায় আছে ঋতু বসন্ত 
আর নীরে ক্ষীরে একযোগে 
নীর ফেলে ক্ষীর বেছে খাও।

0 comments:

0

someপ্রতীক - রীতা পাল

Posted in




আমাদের আবাসনের একটি মেয়ে তিন বছর বয়স থেকে আমাদের কাছে খুবই আসা যাওয়া করতো। ওর সঙ্গ আমাদের সকলেরই খুব প্রিয় ছিলো। সেই মেয়ের বয়স যখন ছয়, তখন একদিন দেখি আমাদের বাড়িতে এসে মনমরা হয়ে বসে আছে। আমার চোদ্দ বছরের ছেলে কী হয়েছে প্রশ্ন করায় বললো, ওর ক্লাশের অন্য একটি মেয়ে ওকে আজ মেরেছে। আমার ছেলে সঙ্গে সঙ্গে ওকে বললো – তুইও ওকে মারলি না কেন? সে বলে উঠলো – না রে, ওর একটা খুব বড়ো দল আছে। তখন তাকেও একটা দল তৈরির প্রস্তাব দিলে ফোঁস্‌ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো – আমার দলে কেউ আসবেই না।

এতো বছর পর গল্পটা আজ হঠাৎ মনে পড়ার কারণ – এই পরিস্থিতিতে আমারও একটা দলের অভাব অনুভূত হচ্ছে। আর নেত্রী হওয়ার সাধ বা সাধ্য কোনোটাই আমার নেই। কিন্তু দল বা আমার মতো সাধারণ সমমনস্ক কিছু মানুষের সঙ্গে সংঘবদ্ধ হওয়ার তাগিদ খুবই অনুভব করছি। করোনা এবং পরিযায়ী প্রসঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য যা করলো, তার প্রতিবাদে চীৎকার করে উঠতে খুব ইচ্ছে হলেও গভীর মনন তা করতে দিলো না। অন্য একটি দৃশ্য চোখের পাতায় ভেসে উঠলো। ছেলের পরীক্ষার ফল বের হয়েছে। একেবারেই আশানুরূপ হয়নি। হওয়ার কথাও নয়। ভাবুক গোছের ছেলেটি বর্তমান শিক্ষার বিষয়বস্তুতে কোনো আকর্ষন খূঁজে পায় না। বাবা-মা সে খবর রাখেন না, কিংবা রাখলেও প্রতিকারের পথ জানেন না। তাই ছেলেটির সামনেই একে অপরের নীতির প্রতি দোষারোপ করতে থাকেন। ছেলেটি নীরব হয়ে শুনতে থাকে। আমার আপনার নির্বাচিত কেন্দ্র-রাজ্য সরকার তাই তো করবে, যা আমরা করে থাকি – তাই না? প্রতিবাদ করতে হলে তো নিজের বিরুদ্ধেই করতে হয় – তাই তো? দিনের পর দিন যখন সরকারি স্বাস্থ্য শিক্ষা কাঠামো ভেঙে পড়ছে, নদী ভাঙন রোধ করা হচ্ছে না, তখন আমরা সাধারণ মানুষ চুপ থেকেছি। আমফান বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণ সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবে – এটা ভাবা বাড়াবাড়ি নয়? কান্তি গাঙ্গুলি নিজের সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের কাছে অনেকবার বলেছিলেন, ত্রাণের টাকা দলের লোকের মধ্যে ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটাতে দৃষ্টি দেওয়া সম্ভব হয়নি। বাম দলের সেই লোকেরাই বর্তমান সরকারি দলের সদস্য। কাজেই আরো দক্ষতার সঙ্গে সে প্রথা বয়ে চলেছে। সুযোগসন্ধানী বাম বিরোধী মানুষ এবার একটু মুচকি হেসে বলে উঠবেন – তাহলে স্বীকার করছেন তো সমস্যাটা বাম আমলে তৈরি, তৃণমূলের কোনো দোষ নেই? না, আমি সহমত নই। ৫ বছরের বাচ্চাকে ভালো স্কুলে ভর্তি করার জন্য ৩ লাখ ডোনেশনরূপী ঘুষ দিই, বাড়ির বেআইনি নির্মাণের জন্য কর্পোরেশন আর কাউন্সিলারকে উৎকোচ দিই – সেই আমাদের দ্বারা নির্বাচিত সরকারের কিছু লোক কাটমানি নেবে না তো কী করবে? স্বামী কণিকার ভক্ত, স্ত্রী সুচিত্রার – শুধু এই কারণেই তাদের মধ্যে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে আদানপ্রদান বন্ধ। আমাদের আগের প্রজন্ম হিন্দি সিনেমাকে অপসংস্কৃতি মনে করতেন। সেই আমার আপনার নির্বাচিত নেতা যদি বিরোধীদের দেশদ্রোহী আখ্যা দেন, খুব অবাক হওয়ার কিছু থাকে কি? ‘যব গোডাউনই এইসা হ্যায়, তো শোরুম ঔর ক্যায়সা হোগা’?

নিদান যে নেই তা নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে কালো মানুষের বিক্ষোভে সাদারাও সামিল হয়। অন্তঃসত্ত্বা হাতিটিকে যে পদ্ধতিতে হত্যা করা হয়েছে সারা দেশ তাতে ধিক্কার জানিয়েছে – ভালো কথা। কিন্তু ভালো কথা নয় একেবারেই যখন এরই সাথে সাড়ে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বাকে প্রায় বিনা অপরাধে তিহার জেলে আটক রাখা নিয়ে একটিও কথা বলা হয় না। আমার আপনার সংঘবদ্ধ হতে হবে এই সব বিষয়ে। সংরক্ষণ আইন নিয়ে কিছু বলতে গেলেই তাতে রাজনীতির রঙ তথা ভোটের অঙ্ক এসে যাবে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যদি এ সম্পর্কে এই মত প্রকাশ করে যে, সংরক্ষণ নিয়ে আমাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই, নিম্নবর্গের কতজন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী বা ডেপুটি কালেক্টর হলেন তা নিয়েও আমরা চিন্তিত নই – আমাদের সম্মিলিত দাবি – দলিতদের স্বাধীনভাবে দেশের সর্বত্র চলাফেরা করার অধিকার দিতে হবে, দেশের সম্পদ সমানভাবে ভোগ করতে দিতে হবে – তাহলে সরকারও ভাবতে বাধ্য হবে। আজ না হয় কাল নয়তো অবশ্যই পরশু। পরিস্থিতি দেখালো, মহামারীতেও একদিন লকডাউন তুলে দিতে হয়, মন্দিরের দরজা খোলার ফরমান জারি হলেও পুরোহিত প্রাণভয়ে বেঁকে বসেন। কাজেই নিজেদের রক্ষার দায়িত্ব এবং সভ্যতাকে পরিপুষ্ট করার ভার শিক্ষিত-অশিক্ষিত নারী-পুরুষ ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলকেই কাঁধে তুলে নিতে হবে। সহানুভূতি বা সমবেদনা ভালো। কিন্তু আত্মমর্যাদা না থাকলে সমবেদনা খুব একটা কাজে আসে না। অর্থাৎ আমাদের সমস্যা সরকার অথবা বিরোধী পক্ষ দূর করে দেবে – এ চিন্তা যেমন অমূলক, তেমনি গরীবের সমস্যা অনুভূতিশীল ধনী দূর করবে কিংবা দলিতদের সমস্যা উচ্চবর্গের লোক সমাধান করবে – এ ভাবনাও ভিত্তিহীন। ‘অধিকার কেড়ে নিতে হয়’। জনমত তৈরি করতে হবে, পথে নামতে হবে। সাথী জুটবেই। লড়াই যদি হয় অশুভের সঙ্গে, সেখানে নেতৃত্ব নিয়ে চিন্তা নেই – দলিত সমস্যায় দলিতরা নেতা, অন্যরা সমর্থক – পরিযায়ী সমস্যায় তারাই নেতা, দলিত ও দরিদ্ররা সমর্থক। এই আন্দোলনে ‘আমরা সবাই রাজা’। নিরন্ন ধর্মভীরু হিন্দুরা যদি রামমন্দির নির্মাণের বিরোধিতা করে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে সোচ্চার হয়, এবং কোটি কোটি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ দল নির্বিশেষে ধর্ম নির্বিশেষে সে দাবির প্রতিধ্বনি তোলে – তবেই একমাত্র বন্ধ হবে ‘জাতের নামে বজ্জাতি’। সব ঝড়ই থেমে যায় একদিন, ঝরাপাতাদের আমরা মনেও রাখি না। প্রতিটা ঝড় থেকেই নতুন কিছু আহরণ করে সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেই নিহিত থাকে ঝরাপাতাদের বলিদানের সার্থকতা। মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে বিনা দোষে মার খেয়ে চলা – কখনোই সমাধান হতে পারে না।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - গার্গী বসু

Posted in






চোখ (পর্ব ১) 


জন্মদিন মানেই খুব খারাপ একটা দিন
 বিলির অন্তত তাই ধারণা মা বলত, যে বছর ও জন্মেছিলো সেবার জানুয়ারী মাসের কনকনে শীতেও আকাশ বাতাস কালো করে এসেছিল খুব। দুর্যোগ হয়েছিল সারা শহর জুড়ে। বৃষ্টি হয়েছিল কিনা সেটা অবশ্য জানেনা বিলি। মা কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ত ওর জন্মদিনের কথা বলতে বলতে। তখন কতটুকুই বা বয়েস! মায়ের কাছে প্রশ্ন ছিল অনেক। সব প্রশ্নের উত্তর আজও পায়নি। তার আগেই তো মা কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। তার আগে পর্যন্ত সারাটা দিন মায়ের সাথেই কাটত। বাবাকে খুব ভাল মনে নেই বিলির। কিন্তু একটা সন্ধ্যের স্মৃতি এক্কেবারে স্পষ্ট ভাসে চোখে। সেদিন বাড়ি ফিরতে অনেক রাত করেছিল বাবা। মা দুশ্চিন্তায় একবার ঘরে একবার বারান্দায় আসা যাওয়া করছিল। অনেক রাতে টলতে টলতে এসে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মায়ের নাম ধরে বাবা ডাকছিল জোরে জোরে। চমকে ঘুম থেকে জেগে উঠেছিল বিলি। তারপর জানলার আড়াল থেকে দেখেছিল বাবা কে ধরে ধরে মা নিয়ে যাচ্ছে ঘরের ভেতরে। তার দিন কয়েকের মধ্যেই বাবা আর মা কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।সেটা ছিল বিলির দশ বছরের জন্মদিন। রাতারাতি জীবন বদল যাওয়া বোধহয় একেই বলে। এক রাতেই জীবনটা পুরোপুরি ভোল পাল্টে ফেলল যেন। প্রথমবার ভয় আর কষ্ট মিশিয়ে গলার কাছে একটা দলা পাকানো ব্যথা হলো। ভয় ব্যাপারটা এর আগে অনুভব হয়নি কখনও। মা-বাবা একসাথে হারিয়ে যাওয়াতে প্রথমে ভয় হলো খুব। ক্রমে ভয় কেটে গিয়ে রাগ হলো। আর রাগ পড়ে যাওয়ার পর মন খারাপ। এই বিশাল পৃথিবীতে একেবারে একা হয়ে গেল সে। 

পাশের বাড়িতে থাকতেন মিসেস ইভাঙ্কা নিনিবে। মোটাসোটা হাসি-খুশি মানুষটি এলাকায় পরিচিত ছিলেন মিসেস নিনিবে নামে। সবাই ওঁকে চেনে। সকলের বিপদে পাশে এসে দাঁড়ান। সবার খবর নেন। তিনি এসে পুলিশি তদন্ত চলাকালীন বিলিকে আগলে রাখলেন। পুঙ্খানুপুঙ্খ জেরা চলতে থাকল। কেন যেন বিলির মনে হয়েছিল মা বাবার সাথে আর দেখা হবে না। হলোও তাই। অনেক খুঁজেও তাদের পাওয়া গেল না। বাড়িতে পুলিশি পাহারা বসল। মিসেস নিনিবে তাকে নিয়ে গেলেন নিজের বাড়িতে। সেখানে ঘটে গেল এক অদ্ভুত ঘটনা। এক রাত্রে ঘুমন্ত বিলিকে দেখে প্রচণ্ড ভয় পেলেন মিসেস নিনিবে। ছোট্ট একটা মেয়েকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে কেউ ভয় পেতে পারে? কি আশ্চর্য! সবাই বলাবলি করতে লাগল মিসেস নিনিবের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আসল কারণটা কিন্তু জানা গেল না। 

ঘটনার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় গীর্জার ধর্মগুরুকে ডেকে আনা হলো। তিনি এসে সস্নেহে বিলির মাথায় হাত রাখলেন। সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন এক ক্যাথলিক গীর্জার অনাথ আশ্রমে। 

অনাথ আশ্রমে বিলি কয়েকজন বন্ধু পেল। এমন ছেলে-মেয়েরা সেখানে ছিল যাদের বাবা যুদ্ধে মারা গেছেন এবং মা একা তার সন্তানের দায়িত্ব নিতে অপারগ। কিছু ছেলে মেয়েরা এমন ছিল যারা কুমারী মায়ের সন্তান। হয়ত মা নিজেই তার সন্তানকে অনাথ আশ্রমে বা গীর্জায় এসে রেখে দিয়ে গেছেন। থাকার জায়াগাটা আসলে গীর্জা লাগোয়া একটা বিরাট বাড়ি। প্রকাণ্ড হলঘরে সার দিয়ে পাতা বিছানা। হলের একপ্রান্তে বেদীর ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন মাতা মেরি। মায়ের মতো করে তাকিয়ে আছেন অনাথ শিশুদের দিকে। ছেলে আর মেয়েদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। গীর্জার ঘণ্টার সাথে সাথে প্রার্থনা করতে হয় এখানে। ফাদার নিজে খোঁজ রাখেন বাচ্চাদের। এক একটি বাচ্চার এ্রক একরকম ইতিহাস। তারা নিজেদের মধ্যে বেশ স্বতস্ফূর্ত, সুখ-দুঃখের কথা তারা ভাগ করে নেয় একে অপরের সাথে। বিলিও চট করে তাদের একজন হয়ে গেল। বন্ধুত্ব হলো মার্থা, জন, ক্যাথি, ডেভিড, সুসান, মাইকেল, জেনিফারদের সাথে। কিছুদিন পরে একটি নতুন মেয়ে এলো সেখানে। শার্লি মেরিউইক। শার্লিও একা। তারও মা বাবা কেউ নেই। বিলির সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল। শার্লি যেন বিলির ছায়াসঙ্গী হয়ে গেল। দুজনকে একসঙ্গে দেখা যেতে লাগল সব জায়গায়। 

কিন্তু এখানেও খুব বেশদিন থাকা হলো না। বিলির খোঁজ করতে করতে একদিন দুজন এলেন যারা নিজেদের বিলির দাদু ও দিদা বলে পরিচয় দিলেন। বিলি তো জানতই না তার দাদু আর দিদা বলে দুজন আছে এই পৃথিবীতে। চেনা তো অনেক দূরের কথা। মা কখনও উল্লেখই করেনি। প্রথমবার তাদের দেখা হলো গীর্জার ফাদারের অফিসে। দিদার চেহারা ভারির দিকে। ছোট ছোট চোখ। খাড়া নাক। ডান চোখের জায়গায় একটা কালো গর্ত। এই অবধি ঠিকই আছে, কিন্তু কথা বললেই বিপদ। মানুষের গলার স্বর এত কর্কশ হতে পারে? না শুনলে বিশ্বাস করা যায় না। দিদা কম কথার লোক। হয়ত গলার আওয়াজকে চাপা দেওয়ার জন্যই কথা কম বলেন। বিলির বন্ধুরা তো ভয়ই পেয়ে গেল দিদার চেহারা দেখে। পরনে কালো হাঁটু পর্যন্ত ঢাকা পোষাক। আর হাঁটু অবধি কালো কাঠের জৌলুসহীন জুতো। দিদার পায়ে কোন সমস্যা আছে বোধহয়। ঈষৎ খুঁড়িয়ে হাঁটেন। 

বিলি ঘরে ঢুকতে তাকে কাছে ডাকলেন তিনি। বিলি খেয়াল করল দিদা হাসলেন না। বিলি এগিয়ে গেল পায়ে পায়ে। উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে বিলির গায়ের কাছে মুখ নামিয়ে গন্ধ শোঁকার ভঙ্গি করলেন দিদা। তারপর বললেন, “আমার আর কোন সংশয় নেই ফাদার। এই সেই বিলিন্ডা গ্রিন যাকে আমি খুঁজছি।“ বিলির কিন্তু ভালই লাগল দিদাকে। মনে মনে একটা যুক্তি খাড়া করল ও। দিদার বয়েস হয়েছে। তায় আবার একটা চোখ নেই। চোখে কম দেখেন বলেই হয়ত গন্ধ শুঁকে ঠাহর করেন। তাতে আর ভয়ের কি? 

সামান্য যেটুকু জিনিষপত্র ছিল, একটা বাক্সে গুছিয়ে নিল বিলি। গরম জামা পরে তৈরি হয়ে নিল। যাওয়ার আগে সকলের সাথে দেখা করল সে। 

শার্লি খুব কাঁদল। বেচারি। সে আরও একবার একা হয়ে গেল কিনা। 

ফাদার বিলিকে গীর্জার ঠিকানা লিখে দিলেন কাগজে। 

বললেন, “যোগাযোগ রাখতে চাইলে, কোন বন্ধুকে চিঠি লিখতে চাইলে এই ঠিকানা কাজে আসবে।“ 

একটু থেমে গলা নামিয়ে বললেন, “তুমি কি জান কি দেখে মিসেস নিনিবে ভয় পেয়েছিলেন?” 

বিলি মাথা নাড়ল। হ্যাঁ, সে জানে। 

ফাদার বিলির মাথায় হাত রাখলেন। বললেন, “সাবধানে থাকবে। কোন বিপদে পড়লে মনের কথা শুনবে। অতীত তোমায় পথ দেখাবে। খেয়াল রেখো। বিদায়।“ 

ঠিকানা বদলে গেল আবার। 

বিলিকে নিয়ে আসা হলো দিদার বাড়িতে। দিদা বিলিকে যত্ন করেন। তাদের অবস্থা খুব স্বচ্ছল না হলেও ভালভাবে চলে যায়। বাড়িতে তিন সদস্য। দাদু, দিদা আর বিলি মিলে তিনজনের সংসার। ওহ! হ্যাঁ আর একজন আছে সাথে। দিদার পোষা বেড়াল ডার্বি। চোখধাঁধানো সোনালী রঙের উলের বল ডার্বি | দিদা তার গলায় বেঁধেছেন একটা লাল রিবন আর তাতে ঝোলে একটা ক্রিস্টালের লকেট। ডার্বির সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেল বিলির। 

সালেম শহর ছাড়িয়ে একটু ভেতরের দিকে ওরা থাকে। বাগান ঘেরা পুরোনো দিনের বেশ বড়োসড়ো বাড়িটার দরজা জানলা বন্ধ থাকে বেশিরভাগ সময়ে। একতলার একটা ঘরে দাদু জুতো তৈরী করেন সারাদিন। আধুনিক সময়ের উপযোগী হাল ফ্যাশনের জুতো নয়, কালো গাবদা মধ্যযুগীয় জুতো। স্কুল পালানো অবাধ্য ছেলে মেয়েদের মা বাবারা সেই জুতো কিনে একপ্রকার শাস্তিই দিতো বাড়ির ছোট সদস্যদের
 সেই একই জুতো বাড়ির সবার জন্যে দাদু তৈরী করে দেন| দিদার পায়ের সমস্যা আড়াল করার জন্য শক্তপোক্ত বেল্ট দেওয়া জুতো দাদু নিজের হাতে বানান মা বাবার যে ভালোবাসা বিলি চোখে দেখতে পায়নি সেটা ও দ্যাখে দাদু দিদার মধ্যে। দাদু অবসরে ম্যান্ডোলিন বাজান। দুজনে মিলে গাছ লাগান। গাছের যত্ন করেন। বিলি পড়াশোনার ফাঁকে দাদু-দিদাকে সাহায্য করে। এইভাবে চলছিল। 
হঠাৎ একদিন ওদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো কালো কাঁচে ঢাকা একটা লম্বা গাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে এলেন ম্যাডাম ভার্জিনিয়া কেন্ট মিলার। বিলি শুনেছিলো তার পিসি থাকেন নিউইয়র্ক শহরে। তাকে দেখার সুযোগ মিললো দ্বাদশ জন্মদিনে। সেই দিনটা বিলি কখনো ভুলবে না। সোনালী চুল আর নীল চোখের ভার্জিনিয়াকে সুন্দরী বললে কম বলা হয়। ওঁর পাশে ঝাঁকড়া কালো চুল আর ঢোলা জামা পরে বিলি নিজেই কি ভীষণ বেমানান। সবথেকে বেশি যেটা দৃষ্টি আকর্ষণ করলো সেটা হলো ভার্জিনিয়ার জুতো। টকটকে লাল পেন্সিলের মতো চকচকে জুতোজোড়া। কি তার আওয়াজ। মশমশ করে যেন কথা বলতে বলতে চলেছে। এই জুতোটা দাদুর বানানো জুতোগুলোর মত নয়। দাদুর বানানো কালো গাবদা জুতোগুলো কি বিশ্রী ওই একজোড়া জুতোর পাশে। বিলি হাঁ করে তাকিয়ে থাকল। ভার্জিনিয়া পিসি বিলির সাথে আলাপ করে খুশি হলেন কিনা ঠিক বোঝা গেল না। বিলির কিন্তু মনটা ভিজে থাকলো ভালোলাগায়। 

পিসি সেইদিন শুধু দিদার সাথে কথা বলতেই এসেছিলেন। দরজা বন্ধ করে দিদা আর ভার্জিনিয়া পিসি অনেক কথা বলেছিলো
 বিলি পুরোটা শুনতে পায়নি কিন্তু টুকরো টুকরো কথা কানে এসেছিল। এখন অবশ্য সে বুঝতে পারে। পিসি তাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে চান। নিউইয়র্কে। সেখানে বিলি নতুন স্কুল পাবে। বন্ধু পাবে। পছন্দের বিষয়গুলি শেখার সুযোগ পাবে এবং হয়তো পরবর্তী কালে কোনো পুরুষ বন্ধুকে পছন্দ করে সংসার পাততে চাইবে। মোটকথা একটা স্বাভাবিক জীবন পাবে। বিলি পড়াশোনার দিক দিয়ে ভালই। ওর স্কুলের প্রিন্সিপ্যাল মিস্টার ফীপ্স ওকে বিশেষ স্নেহ করেন। বিলি খুব সুন্দর ছবি আঁকে। পিসি চান নিউইয়র্কে গিয়ে বিলি কোনও ছবি আঁকা শেখার স্কুলে ভর্তি হোক। আসল পড়াশোনার পাশাপাশি শখের পড়াশোনার চর্চাও চলতে থাকুক। হয়তো এই ভাবেই তার জীবনের দিক নির্দেশ হবে। চাকরির সুযোগও জুটে যেতে পারে। এখনকার মেয়েরা কেবল স্কুলে পড়ানো বা চার্চে পিয়ানো বাজানোর মতো কাজের মধ্যেই নিজেকে আটকে রাখে না। অন্যরকম চাকরিও করে। খবরের কাগজের অফিসে বা টেলিফোনের অফিসেও এখন অনেক মেয়েরা চাকরি করে। বিলিও পছন্দমতো জীবন বেছে নেবে। সালেমে এত সব সুযোগ কোথায়? কিন্তু পিসির এত সব ভাবনাকে এক কথায় নাকচ করে দেন দিদা। কিছুতেই বিলিকে ছাড়তে চান না উনি। দিদার ভয়, অনেক বড় শহরে গিয়ে পড়লে হয়ত বিলির উদ্দেশ্য ব্যহত হতে পারে। নানারকম হাতছানিতে ভুলে আসল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যেতে পারে সে। তাছাড়া অনেক দূরে চলে গেলে ফিরে আসা কঠিন হয়ে যায়। মানুষ শিকড়ের স্বাদ ভুলে যায়। 


সময়টা ১৯৬০ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলেও কোথাও কোথাও তার রেশ তখনও লেগে আছে। যুদ্ধের ভয়াবহতা যেমন সবকিছু গ্রাস করে ফেলেছিল তেমনই আবার ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসছে চারপাশ। না, সবটুকু বোধহয় না। ভিয়েতনামে কিছু বিচ্ছিন্ন অস্বস্তিজনক ঘটনার কথা শোনা যাচ্ছে যা আগামী দিনে গিয়ে আর একটা যুদ্ধের রূপ নিতে পারে। এইসময়ে নিউইয়র্কের বেশ কিছু জায়গায় অন্য এক লড়াই জন্ম নিচ্ছিল। মেয়েরা জোট বেঁধে পথে নামছিল দলে দলে। এমন একটা সময় তখন, নিউইয়র্ক টালমাটাল। সমানাধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই দানা বাঁধছে। নারীসুলভ বলে দাগিয়ে দেওয়া সবকিছুকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে চায় তারা। নিউয়র্কের রাস্তায় অন্তর্বাস জ্বালিয়ে দিয়ে এক অভিনব বিপ্লব গড়ে তুলছে মেয়েরা। নারীশক্তিকে জাগানোর ব্রতে পথে নেমেছে অনেক মানুষ। কিন্তু ভার্জিনিয়া কেন্ট মিলারের মতো নারীর গায়ে তার আঁচ লাগেনা। উনি একার লড়াই পছন্দ করেন। সমবেতভাবে নয়। স্বার্থ তাঁর পাখির চোখ। আর বিত্ত এবং ক্ষমতার ব্যবহার করার মতো একটা কারণ যখন রয়েইছে তখন তিন পিছপা হবেন না। বিলিকে নিয়ে আসতে হবে নিউইয়র্কে। সে কথা তিনি বারবার বোঝান বিলির পরিবারকে। কিন্তু বিলির দিদা শক্তপোক্ত মহিলা। কিছুতেই উনি নাতনিকে কাছছাড়া করতে চান না। ভার্জিনিয়া ঠিক করলেন সোজা পথে কাজ হাসিল না হলে আইনি পথ ধরবেন। যে কোনও মূল্যে বিলিকে তাঁর চাই। 

(ক্রমশ)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




সোয়ানার রহস্যময় মানুষ 
নন্দিনী সেনগুপ্ত 
১৯ 
ফ্রান্সেস্কো লক্ষ্য করলো সোয়ানা কিম্বা আশেপাশের জায়গায় যারা থাকে, তাদের কারো সঙ্গে লোকটির চেহারায় কোনো মিল নেই। তার সুগঠিত শরীর এবং পেশির গড়ন অনেকটা খেলোয়াড় বা দৌড়বিদদের মতো। নীল হ্রদের মত রঙের চোখের দৃষ্টিটা ভীষণ গভীর, অন্তর্ভেদী। চোখের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সেস্কোর হঠাৎ সেন্ট আগাথার শিখরের উপরে উড়ে বেড়ানো অসপ্রে বাজপাখির জোড়ার কথা মনে পড়ে গেলো। কপালের গড়ন চাপা, ঠোঁট পুষ্ট এবং ভেজা ধরণের। হাসি এবং দৃষ্টি দক্ষিণদেশের বাসিন্দাদের মত মাপা ও চাপা ধরণের নয়, বেশ প্রকট। এই সব কিছু খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে, মন্‌টে জেনারাসো পর্বতে এই স্বর্ণকেশ যুবকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফ্রান্সেস্কো মনে মনে এই পাহাড়ি গ্রাম্য মানুষটির সহজ সৌন্দর্যের তারিফ না করে পারলোনা। 
এখানে আসার প্রকৃত কারণ ফ্রান্সেস্কো ঠিক ভেঙে বললো না লোকটিকে। বললো যে অনেক দূরে এক গ্রামে এক মুমূর্ষু মানুষকে ধর্মকথা শোনাতে এসেছিল। তারপরে তার সহকারীকে ছাড়াই রওনা দিয়েছিল। এখন পাহাড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে সে। একটু বিশ্রাম না করে সঠিক পথে যেতেও পারবে না সে। মেষপালক সরল মানুষটি বিশ্বাস করলো এই মিথ্যা। ঝকঝকে দাঁতের সারি দেখিয়ে হাসলে সে। জ্যাকেট খুলে সেটা আগুনের পাশে ভালোভাবে বিছিয়ে যাজকের বসবার আসন বানিয়ে দিলে। জ্যাকেট খুলে ফেলার পরে তার সুগঠিত কাঁধ এবং কোমর অবধি উন্মুক্ত রোদ্দুরে পোড়া তামাটে বাদামী শরীর দৃশ্যমান হল, কারণ জ্যাকেটের নিচে লোকটির কোনো শার্ট ছিলনা। 
এই সরল প্রকৃতির মানুষটির সঙ্গে বাক্যালাপ শুরু করা খুবই সমস্যার বলে মনে হল ফ্রান্সেস্কোর কাছে। লোকটি নিজেও তরুণ যাজকের সামনে অপ্রস্তুত বোধ করছিল। হাঁটু গেড়ে আগুনের সামনে বসে কাঠকুটো দিয়ে উস্কে দিচ্ছিল আগুনটা একটু পর পর, রান্নার পাত্রের ঢাকা খুলে দেখছিল এবং দুর্বোধ্য পাহাড়ি ভাষায় এক দুটো কথা বলবার চেষ্টা করছিল। এইসব করতে করতে হঠাৎ উচ্ছল একটা সুরেলা আওয়াজ লোকটা পাহাড়ের উপত্যকায় ভাসিয়ে দিলো। আওয়াজটা জেনারাসো পর্বতের ঢালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এলো। 
প্রতিধ্বনিটা মিলিয়ে যাবার আগেই জোর হাসাহাসি, চেঁচামেচির আওয়াজ শোনা গেলো। মনে হল যেন কারা এদিকেই আসছে। অনেকগুলো কণ্ঠস্বর, শিশুদের গলা, তার মধ্যে একজন নারীর কণ্ঠ, সে হেসে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে, আবার ক্ষণে ক্ষণে সাহায্য চাইছে। সেই নারীর কণ্ঠস্বর শুনে ফ্রান্সেস্কোর হঠাৎ মনে হল যে তার অবশ হয়ে যাওয়া হাতে পায়ে সাড় ফিরে আসছে। প্রাণের অদ্ভুত রহস্য যেন তার আপন সত্তার মাঝে ইন্দ্রজালের খেলা দেখাচ্ছে। অন্তরে সে দগ্ধ হতে লাগলো, যদিও বাইরে সেই ভাব প্রকাশ পেলোনা। সে যেন একইসঙ্গে মুক্তির আনন্দে এবং এক অদৃশ্য বন্ধনে জড়িয়ে যেতে লাগলো। 
ইতিমধ্যে, সেই নারীকণ্ঠের হাস্যরোলের সঙ্গে উদ্ধার করবার জন্য ডাকাডাকির আওয়াজ কাছাকাছি এগিয়ে আসতে লাগলো। সামনের খাড়াই নিচের ঢাল বেয়ে উঠে এলো সেই দুরন্ত ঝাঁকড়া লোমশ রামছাগলটি। সেই যে, সেই প্রাণীটি যে পাহাড়ি পথে একদিন ফ্রান্সেস্কোকে নাকাল করে ছেড়েছিল। তার পেছন পেছন এলো ছাগল- ভেড়ার বড় একটা দল। সেই কন্যা এলো সেই প্রাণীর পিঠে বসে, তার বাঁকানো শিং ধরে। হয়তো নিছক মজা করতে গিয়েই তার পিঠে চড়ে বসেছে সে। এখন আর নামতে পারছেনা। প্রাণীটির গলা জড়িয়ে ধরে পেছনদিকে বেঁকে যাচ্ছে সে, কিন্তু কিছুতেই বাগে এনে থামাতে পারছেনা দুরন্ত প্রাণীটিকে। সে যে ঠিকভাবে তার পিঠে বসতে পারছে, এমনও নয়; তার জুতোবিহীন খালি পা ভূমি স্পর্শ করে আছে। প্রাণীটিকে সামলাতে বিশেষ চেষ্টা করে যাচ্ছে সে; তা করতে গিয়ে তার পোশাকের ঢিলে ব্লাউজের গলার সীমানা নেমে গিয়ে উন্মুক্ত হয়ে যাচ্ছে তার পুষ্ট স্কন্ধ, আভাস পাওয়া যাচ্ছে বক্ষের বিভাজিকার। তার কেশরাশি হাওয়ায় উড়ছে বন্ধনবিহীন। তার স্কার্টের ঝুল সরে গিয়ে পায়ের গোছ, হাঁটু অবধি দৃশ্যমান হচ্ছে। 
সেই কন্যা সামনাসামনি আসবার বেশ কিছু আগে থেকেই ফ্রান্সেস্কো বুঝতে পেরেছিলো যে ছাগল–ভেড়ার দলের সঙ্গে কে আসছে! দূর থেকেই শোনা গিয়েছিল তার কণ্ঠস্বর। কন্যার হাসি, চিৎকারের শব্দ, হাত-পায়ের অনিচ্ছাকৃত আন্দোলন, উড়ন্ত উন্মুক্ত কেশরাশি, হাঁ হয়ে যাওয়া খোলা ঠোঁট, বুকের ওঠাপড়া- সব মিলিয়ে তাকে একদম আলাদা এক মানুষ বলে মনে হচ্ছিল। গোলাপি আভায় ঢেকে গিয়েছিল তার মুখ, প্রগাঢ় উচ্ছ্বাসে উজ্জ্বল ছিল তার চোখ। সব মিলিয়ে তাকে অপরূপ দেখাচ্ছিল। তড়িৎগতিতে সে সরে যাওয়া পোশাকের প্রান্ত স্বস্থানে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করছিল। 
ফ্রান্সেস্কো কোনো কথা বলতে পারছিলনা। সম্পূর্ণ দৃশ্যপট তাকে যেন একদম বিবশ, অসাড় করে দিচ্ছিল। তার কাছে সেই কন্যার উপস্থিতি এত সুন্দর বলে মনে হয়েছিল যে - প্রাণীকে বশীভূত করে তার পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গে যে ডাকিনীতন্ত্রের বিন্দুমাত্র কোনো সংযোগ থাকতে পারে, সে কথা ঘুণাক্ষরেও তার মনে হয়নি। পরিবর্তে, নানারকম ছবি জেগে উঠেছিল তার মনে। মর্মরের মূর্তি খোদাই করা সারকোফাগাস, যা পাহাড়ি ঝর্ণার জলে টইটম্বুর থাকে, সোয়ানার গ্রামের চৌকোনা মোড়ের মাঠ, তার কাকা, বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা ছবির মূর্তি– এসব নানা ছবি ভেসে আসছিল তার মনে। সারকোফাগাসের পাথরের খোদাই করা মূর্তিগুলো যেন জীবন্ত হয়ে উঠতে লাগলো তার সামনে। নেকড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া রথ, নেচে নেচে যাওয়া স্যাটিয়ারের মূর্তি, বাঁশিওয়ালা, ঈশ্বরভক্ত নর্তকীর দল- সব ছবি মনে পড়তে লাগলো তার। মনে হল যেন সেই দলের মধ্য থেকেই এই কন্যে এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। 
ফ্রান্সেস্কোকে আগাথা প্রথমে লক্ষ্য করেনি, কিন্তু রামছাগলটি তরুণ যাজককে সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পেরেছিলো। কাজেই সেখানে এসে সে সবার আগে ফ্রান্সেস্কোর কোলের উপরে সামনের দুই পায়ের ক্ষুর অবলীলায় তুলে দিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়ালো। সে স্থির হয়ে দাঁড়ানোর ফলেই অবশেষে আগাথা তার পিঠ থেকে ধীরেসুস্থে নামতে সক্ষম হল। আগাথা যখন টের পেলো যে সেখানে একজন আগন্তুক রয়েছে, এবং যখন দেখল যে সেই আগন্তুক তরুণ যাজক ছাড়া আর কেউ নয়, তার মুখের হাসি এবং উচ্ছলতা মুহূর্তে নিভে গেলো; পরিবর্তে মুখে দেখা দিলো এক অদ্ভুত কাঠিন্য এবং উদ্ধতভাব। 
-‘তুমি আজ গির্জায় এলেনা কেন?’- ফ্রান্সেস্কোর ফ্যাকাসে মুখ এবং কণ্ঠস্বরে এমন একটা অভিব্যক্তি ছিল যে আপাতদৃষ্টিতে তাকে ক্রোধ ছাড়া আর কিছু বলা যাবেনা; যদিও তরুণ যাজকের মনের প্রকৃত অবস্থা ছিল অত্যন্ত জটিল। তার অন্তরের উত্তেজনা লুকোতে চাইছিল সে। অপ্রস্তুত মনে হচ্ছিল নিজেকে। তার পুরোহিত সত্তা ক্রুদ্ধ হয়েছিল নিঃসন্দেহে। তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ দেখে মেষপালক ফিরে তাকালো; গোলাপি আভার ঔজ্জ্বল্য মিলিয়ে গিয়ে এক হতাশা এবং লজ্জার বিবর্ণতায় সেই কন্যার মুখমণ্ডল ঢেকে গেলো। 
আগাথাকে শব্দবাণে বিদ্ধ করে ফ্রান্সেস্কোর অদ্ভুত তৃপ্তি হচ্ছিল। যদিও সে জানে যে এই শব্দগুলি তার আত্মার অন্তঃস্থলের বাণী নয়; তার মর্মরশুভ্র কপালের শিরা ফুলে উঠছিল কথার অভিঘাতে এবং সেই কথার মধ্য দিয়েই সে যেন মুক্তির আনন্দ অনুভব করছিল। জীবনের গভীরতম প্রয়োজন যেন সেই মুহূর্তে তার কথার মধ্যে প্রাণ পেয়েছিল, তার অনুরাগ রূপান্তরিত হয়েছিল পুঞ্জীভূত রাগে, তার অন্তরাত্মা যে কী সাঙ্ঘাতিক নরকযন্ত্রণা ভোগ করেছিল, সেই সব কষ্ট যেন স্বর্গীয় আলোতে সিক্ত হয়ে উঠেছিল। তার ধিকিধিকি ছাইচাপা ক্রোধের আগুন অবশেষে প্রচণ্ড শক্তিশালী হয়ে দাউদাউ জ্বলে উঠল। সে নিজেও বুঝতে পারছিল যে সে অদ্ভুত মরিয়া আচরণ করছে, কিন্তু এই দুর্বলতাকে ঐমুহূর্তে তার ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে হচ্ছিল। তার মনে হচ্ছিল যে এই ক্রোধের সেতু অতিক্রম না করলে সে কোনোদিন আনন্দের ভূমিতে পৌঁছাতে পারবেনা। সে প্রেমের ঐন্দ্রজালিক যাদুবৃত্তের কেন্দ্রের এতখানি কাছাকাছি চলে এসেছিল যে প্রিয় মানুষের উপস্থিতি তাকে বিহ্বল করে তুলেছিল, পরিণামের ভয়াবহতা নিয়ে সে বিন্দুমাত্র ভাবিত ছিলনা। 
তরুণ যাজক ইতিমধ্যে সচেতনভাবেই অনুভব করেছিল নিজের আমূল পরিবর্তন। আপন সত্তার প্রতিফলন নগ্নভাবে দেখতে পেলো ফ্রান্সেস্কো। সে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল পার্বত্য পথে, কতকটা আগাথার চিন্তায় মগ্ন হয়েই সে এলোমেলোভাবে ঘুরছিল এবং অবশেষে আগাথাকে খুঁজে বের করে তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ- এই কর্মসূচী সম্পূর্ণভাবে গির্জার অনুশাসন- বহির্ভূত। গির্জায় ধর্মীয় কাজের সঙ্গে এর কিছুমাত্র সম্পর্ক নেই। সে শুধুই পাহাড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। তার নিজের কাজের দিশাও যেন সে হারিয়ে ফেলেছে। নিজেকে পথভ্রষ্ট মানুষ বলেও মনে হচ্ছিলো না তার, মনে হচ্ছিল সে যেন উচ্চতা থেকে পড়তে থাকা একটা পাথরের নুড়ি কিম্বা জলের ফোঁটা, অথবা যেন ঝড়ের আগে উড়ে যাওয়া খড়কুটো। 
-------------------------------- 
(চলবে) 
গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা 


0 comments:

4

ধারাবাহিক - প্রিয়াঙ্কা চ্যাটার্জী

Posted in




পর্ব-৫ 

শয়তান কখন যে তার মায়াজাল বিস্তার করে, তা বোধ করি কালের জানা নেই। সঠিক সময়ের অপেক্ষায় সে থাকে, সময় উপস্থিত হলেই সর্বগ্রাসী রূপে হয় প্রকট। সময়, তিথি, এসব বড় অদ্ভূত। এসবের তিলেক পরিবর্তনে ঘটে যায় অনভিপ্রেত ঘটনা। লোভ, ক্ষমতায় যখন মোহান্ধ হয় মানুষ, তখনই সে ছদ্মবেশ ধারণ করে এসে মানুষের মনকে করে বশীভূত। সেইরূপ সকলে যখন টালমাটাল পরিস্থিতির কারণে ভুলেছিলেন সব কিছু, তখন যেন বিস্তৃত হয়েছে মায়াজাল, সকলের চক্ষুর আড়ালে। সহদেব ভুলে গেছিলেন দারুক এবং ঐ অঙ্গুরীয়র কথা। কদাচিৎ সম্রাটের ব্যবহার তাকে অবাক করলেও, কালের পরিবর্তন বলে তিনি অগ্রাহ্য করেছেন। 

এক দিন রাত্রিতে মহাদেবী কুমারের মহলের দিকে আসছিলেন। প্রবেশের আগে কানে আসে কিছু নিম্নস্বরের বার্তালাপ। কক্ষে প্রবেশ না করে উঁকি দিয়ে দেখেন, এক দেবী মূর্তির সামনে মহারাজ কাকুতি মিনতি করে অত্যন্ত নীচু স্বরে কথা বলছেন। 
কক্ষ অন্ধকার। একটি প্রদীপ জ্বলছে। সেই ক্ষীণ আলোকে দেখা যায় সম্রাটের মুখে অপরিসীম ক্রোধ। একটি মার্জারকে (বিড়াল) হত্যা করে তিনি একটি বাটিতে তার রক্ত নিয়ে তাতে একটি অঙ্গুরীয় ফেলে উৎসর্গ করলেন দেবীকে। সেই রক্ত তিনি নিজে পান করলেন। বীভৎস সে রূপ! পান করার পর সেই অঙ্গুরীয় ধারণ করলেন তিনি। এসময় এক পরভৃৎ(কাক), কা কা রবে উড়ে যায়। অঙ্গুরীয় হতে এক রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ছে। তিনি বলছেন, 
-- কিছুদিনের অপেক্ষা মাতা, তারপরেই আমি শুরু করব যাত্রা। 
কক্ষ তীব্র কটু পচনশীল গন্ধেপূর্ণ। বাইরে থেকে মহাদেবীও পেয়েছেন সেই গন্ধ। ভীত বুদ্ধিমতী মহাদেবী সঙ্গোপনে সে স্থান পরিত্যাগ করেন। 
গোপনে সহদেবকে সকল কথাই জানান মহাদেবী। 
সহদেব, মহাদেবীর কথা বিশ্বাস করতে পারেননি। সম্রাট তার বাল্যবন্ধু, ভ্রাতাসম। দিবসকালে তার সদাহাস্যময় রূপ, বন্ধুত্ব সব কিছুই বড় বেমানান মহাদেবীর বলা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে। মহাদেবীর রাত্রিকালে দেখা কোনো ভয়াল স্বপ্ন ভেবেই তিনি গুরুত্ব দিলেন না। অনেক সময় ভ্রম হয়, সেটাকেই সত্য বলে ভাবে মানুষ, এই ধারণার বশবর্তী ছিলেন সহদেব। 

পর দিন প্রাতে এক তস্কর ধরা পড়ে। পুরবাসী বিচার প্রার্থনা করলে, মহারাজের মুখে ক্ষণেকের তরে গম্ভীর হয়। তিনি আদেশ দেন, 
--এর দুই হস্তের সমস্ত অঙ্গুলি কর্তন করে তাতে লবন ও মরিচ ছড়িয়ে দাও। 
সম্রাটের মুখে খেলে যায় নিষ্ঠুর হাস্য। শিউরে উঠলেন সহদেব, মহাদেবী, পুরবাসীগণ। এ কোন রাজন? অশোকের মতো মহামতির এ কি পরিবর্তন? ফিসফিস করে এক পুরবাসী বলে, 
--ইনি মহামতি সম্রাট অশোক নন, ইনি চণ্ডাশোক!


4 comments:

0

ধারাবাহিক - শিবাংশু দে

Posted in












৩. 

সন্ধেবেলা একটা মেসেজ পেলুম, ফোনে। 
-তোমাকে আর এমব্যারাস করবো না, সরি। হায়দরাবাদে আর থাকতে ভালো লাগছে না। কোথায় যাবো ঠিক করিনি। ভালো থেকো... 
সঙ্গে সঙ্গে ফোন লাগালুম। ধরলো না। এক ঘন্টা পরে আবার। ধরলো না। এত রাতে নন্দিনীদিকে ফোন করা উচিত নয়। একটা মেসেজ করে দিলুম। 'অনু কি বাইরে গেছে?' উত্তর সঙ্গে সঙ্গে। না তো, আজই ফোন করেছিলো। এখানেই আছে। 
এবার তো সঙ্গিনীকে বলতেই হয়। 
- শোনো, বিজয়া সান ইসিদ্রো ফিরে যেতে চাইছে .. 
- হঠাৎ কেন? তুমি ম্যাজিক দেখানো শুরু করলে নাকি? 
- আরে না। ম্যাজিক জানলে কি আর তোমাকে বলি? 
- ওসব অন্যকে বোলো। আমিও ভুগি তোমার ম্যাজিকের জ্বালায়। নয়তো কবেই শিলাইদা ফিরে যেতুম ... 
- প্রিয়ে... 
- মনে রেখো, তোমার থেকে অন্তত বারো-চোদ্দো বছরের ছোটো। জীবনটা পড়ে আছে। কষ্টে থাকে। আর কষ্ট দিও না.. 
সুখ আর শুশ্রূষা, মেরুগুলো কেন যে এত আলাদা, এত দূর ... 
আমার অফিস থেকে অনুর ডিপার্টমেন্ট গাড়িতে পাঁচ-সাত মিনিট লাগে। ইউনি'র পোস্ট অফিসটার কাছে। সাড়ে বারোটায় একটা মিটিং শেষ করে বসকে বলি একটা কাজে যাচ্ছি। কাছেই। দরকার হলে পিং করবেন। গাড়ি পার্ক করার সময় ড.ভেঙ্কট রাওয়ের সঙ্গে দেখা। অনু'র এইচ-ও-ডি। লাঞ্চে বাড়ি যাচ্ছেন। 
- হ্যালো, ইউ'র হিয়ার? নাও? 
- অনন্যা? 
- ইয়াহ, পারহ্যাপ্স ইন স্টাফ রুম .. 
- থ্যাংকস .. 
স্টাফরুমের সামনে একজন মহিলা রক্ষী। অনু'র নাম বলি। 
- ওয়েটা, 
এক মিনিট পরেই অনু বেরিয়ে আসে। ওর চোখ দেখেই বুঝতে পারি একেবারে অপ্রত্যাশিত কেউ দাঁড়িয়ে আছে সামনে। 
- তুমি? 
- জি ম্যাডাম .. 
অস্ফুটে বলে, 
- এখানে আসবে ভাবিনি.. 
- গলতি মাফ কিয়া জায়। আপনে মজবুর কী.. 
তাকিয়ে থাকে। কিছু বলে না। 
- কুছ তো বোলিয়ে জনাব.. 
- এখানে? এখন? 
- খুব সত্যি কথা। তবে কোথায়? কখন? 
- জানি না... 
- আর ইউ আনকমফর্টেবল ? 
- নাহ, একেবারেই না.. 
- তোমার চোখ কিন্তু অন্য কথা বলছে .. বেশ, আমি যাই। চারদিকে ছেলেমেয়েরা ঘুরছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকাটা এমব্যারাসিং হতে পারে। 
- তবে এলে কেন? 
- বলতে হবে? 
- জানি না... 
- ফোন করলে ধোরো, কথা আছে... 
- আমারও আছে ... 
- টেক ইয়োর টাইম.. 
দিন তিনেক ফোন করিনি। ফোন আসেওনি। ব্যস্তও ছিলুম অন্য কাজে। অনুষ্ঠানের দিন এগিয়ে আসছে। এবার গোছানো শুরু করতে হবে। নন্দিনীদি দুবার ফোন করেছেন। সন্ধের দিকে অফিস থেকে বেরোবার আগে ফোন করলুম অনুকে। একবার বাজতেই ধরলো। 
- কী ব্যাপার? ফোন করোনি কেন? 
- ফোন তো তোমার করার ছিলো.. 
- তাও সত্যি.. 
- তবু ভুল স্বীকার করলে। ভালো লাগলো.. 
- বালিকে, বয়স হচ্ছে, মাফ কর দিয়া জায়.. 
- আমারও বয়স হচ্ছে.. 
- ঝগড়া করবে নাকি? 
- নাহ, বলো .. 
- ফাইন্যাল রিহার্সালের শিডিয়্যুলটা বানাতে হবে। কবে বসা যায়? 
- আমি তার কী জানি? 
- মানে? আর কে জানবে? 
- তুমি জানবে। আর বাকিদের আমি জানি না.. 
- প্রথমত আমি তোমাকে চাই... 
- মানে? 
- দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই.. 
- খেপে গেলে নাকি? 
- শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই.. মানে প্রোগ্রামের জন্য.. 
- আমি চাই না.. 
- আই'ল ওয়েট ফর ইয়োর কল.. 
অনু আর ফোন করেনি। কিন্তু রিহার্সালে গিয়ে দেখি পৌঁছে গেছে। অত্যন্ত বাধ্য সহকারীর মতো যা বলছি, শুনছে। অনুষ্ঠানে নিজের অংশটা দারুণভাবে পারফর্ম করছে। হয়তো একটু ইউফোরিক ভাবসাব। কিন্তু ভালো লাগলো খুব। সবাই প্রশংসা করছে। নন্দিনীদি একবার বললেন, অনুর জন্য এমন মাস্টার লাগিয়েছি না, ওকে পারফর্ম করতেই হবে। খেয়াল করলুম, শর্মিলা অপাঙ্গে একবার আমার দিকে চাইলো। জানি, বাড়িতে ফোন গেলো বলে। 
অনুষ্ঠানের দিন দেখি বালিকা তার 'বৌদি'র সঙ্গে এমনভাবে জড়িয়ে আছে, যেন একশো বছরের পরিচয়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এসেছিলেন উদ্বোধন করতে। মেলা লোকজন। লালফিতের জয়জয়কার। ক্যামেরা, প্রেস, ফোকাস। ক্যামেরাওয়ালারা তো দেখি অনুকেই ফোকাস করে যায়। সেটাই স্বাভাবিক। ওকে দেখতে ভারি সুন্দর লাগছিলো সারা সন্ধে। গাঢ় নীল রঙের তসর শাড়ি একটা। চওড়া সোনালি পাড়। আর অনুর চলাফেরা তো সব সময়েই, কী যেন বলে নাজুক, নাজুক। খুশি থাকাটা সে সংক্রমিত করতে পারে। 
সেদিনের অনুষ্ঠান উতরে গেলো। আমাদের দেশের ভাষায় যাকে বলে 'ঠিকে বা'। গ্রুপ ছবি তোলার সময় ঠেলেঠুলে 'আমার মাস্টারের সঙ্গে ছবি তুলবো' বলে পাশে এসে দাঁড়ায়। ধন্দ লাগে। অচেনাও লাগে বেশ। চারদিকে এত লোকজন। আলাদা করে অনুর সঙ্গে কোনও কথা হয় না আর। ফেরার পথে সঙ্গিনী বলেন, মেয়েটার খুব ডেপথ আছে। এমন মেয়েদের নিজেদের প্রায়োরিটির সঙ্গে জীবনটা মেলে না। সারাজীবন অ্যাডজাস্টমেন্ট। কষ্ট পাওয়াটাই নিয়ম। উপলক্ষ হয়তো কেউ থাকে। কিন্তু তারা বোধ হয় দায়ী নয়। আমি চুপ করে থাকি। মনে মনে পাশে বসা ভদ্রমহিলাকে বলি, ছুটি, ইউ আর গ্রেট। 
আমি যে অপেক্ষা করছিলুম, এমন নয়। কিন্তু পাঁচ-ছ'দিন অনুর থেকে কোনও ফোন না পেয়ে একটু অবাকই হই। মনে হলো, থাক। বোধ হয় নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার পালা চলছে ওর। সেদিন বিকেলদিকে অফিস থেকে বেরোবো বলে তৈরি হচ্ছি, ফোন এলো। 
- বলো.. 
- ফোন করনি কেন? 
- যা বাবা, আমি তো ভাবলুম তুমিই.. 
- কেন? আমিই বা কেন সব সময় আগে ফোন করবো? 
- ঐ যে বলেনা 'লেডিজ ফার্স্ট ... 
- ছিঃ, এত চীপ জোক মেরোনা দয়া করে.. 
- বেশ বলো... 
- কাল বিকেল ছটার সময় একবার ব্যারিস্টায় আসবে? 
- ছটায় বেরোবো কী করে? 
- কাল শনিবার... 
- ওহ, আচ্ছা। কিছু আছে নাকি? 
- আছে, আমার ফিউনারেল... 
- সে কী? সুইসাইড করছো নাকি? 
- অনেকদিন আগেই করেছি। কাল বাকিটা চুকিয়ে দেবো... 
- ধুর, ফ্রেইলটি দাই নেম... 
বঞ্জারা হিলস মেন রোডে শনিবার বিকেলবেলা গাড়ি পার্ক করার জায়গাই থাকে না। সিটি সেন্টার মলের পাতালই ভরসা। গাড়ি রেখে আসতে আসতে মিনিট দশেক দেরি হয়ে গেলো। দেখি আগের দিন ঠিক যেখানে আমরা বসেছিলুম, সেখানেই বসে। দরজার দিকে পিছন ফিরে। কাছে গিয়ে বলি, স্যরি। 
- আজকেও দেরি করলে? 
- হয়ে গেলো। কিন্তু 'আজকেও' শব্দের অর্থ বিশদে কহিও... 
- বলেছি না, আজ আমার ফিউন্যারেল.. 
চুপ করে থাকি। হঠাৎ হেসে ওঠে। 
- মুখটা অমন হয়ে গেলো কেন? বাবুমোশায় অত ভালোবাসা ভালো নয়... 
- এই বলার জন্যই ডেকেছো নাকি? 
- নাহ, ঐ একটু ভূমিকা আর কী... 
- হয়ে গেছে? ভূমিকা? 
- হমম, আমি কাল চলে যাচ্ছি.. 
- মানে.. 
- মানে আপাতত বাড়িতে, দিল্লি... 
- তার পর? 
- আমার আগের ইনস্টিটিউটে ফিরে যাবো এমাসের শেষ দিকে.. 
- মানে, বিদেশে.. 
- হ্যাঁ, লণ্ডনে.. তবে ঠিক নেই। যদ্দূর মনে হয় জ্যুরিখ যেতে হবে... 
- বেশ। তোমার ফেলে আসা সংসার অপেক্ষা করছে সেখানে... 
- আমার সংসার? ও, তুমি আমার এক্স হাজব্যান্ডের কথা বলছো বোধ হয়? নাহ, আমাদের লিগাল সেপারেশন হয়ে গেছে... 
- ওহ, জানতুম না .. 
- তুমি কিছুই জানো না..., ভাবো গায়ে পড়া একটা 'বাচ্চা মেয়ে' ... অলওয়েজ দেয়ার টু এমব্যারাস ইউ, দ্য আদার ওম্যান ... 
- আর কিছু বলবে? 
- স্যরি, অ্যায়াম টকিং ট্যু মাচ ... না 'কাকু' যা বলছি সব মিথ্যে, কিচ্ছু বিশ্বাস কোরো না ... সব মিছে কথা.. সব... 
চুপ করে থাকি। সজল চোখের শুশ্রূষা দিতে শিখিনি কখনও। শুধু সময়ের স্বস্তিটুকুই থাক। শনিবার সন্ধেবেলা কফিশপের উচ্চকিত কোলাহলের মধ্যে নিঃশব্দ একটা চরাচর স্থির হয়ে আছে। 'যেতে পারি, যেকোনও দিকেই আমি চলে যেতে পারি'। যেন ঘড়ির কাঁটার চলনে বাঁধা একটা নিঃশব্দ সংলাপ। শরীরের এক কোণে লুকিয়ে থাকা হৃদপিণ্ডের না শোনা সপ্তম সিম্ফনিতে বাঁধা রাগ ভৈরবি। যে সংলাপ আসা উচিত এই মুহূর্তে, হয়তো গুলজার সাহেবও মজবুর তার সন্ধানে। আমার জন্য স্রেফ আত্মসমর্পণ। সে বড়ো সুখের সময় নয়... 
ঠিক বলা যাবে না মাঝখানে কতটা সময় গোধূলি লগনের মেঘ ঢেকে দিয়ে গেছে। শুধু বুঝতে পারি, মেঘে ভিজে গেছি খুব। সত্যিই খুব ভিজে গেছি। 
গাঢ় বাদামি রঙের টেবিলে সোনালি কোস্টার পাতা। তার উপর অনুর হাত। সুগঠিত আঙুল। মেয়েটা আংটি পরে না। 
- ছুঁতে পারো। বাধা নেই.. 
ঐ ওষ্ঠে যে হাসি তার অর্থ এখনও বুঝি না। হয়তো বুঝি, কিন্তু কে আর হৃদয় খুঁড়ে.. 
- সরিয়ে নেবো? হাতটা? 
- না, আমাকে দাও.. 
কতক্ষণ শব্দহীন, ভুলে গেছি। হঠাৎ হেসে ওঠে পাহাড়ি নদীর মতো, 
- এখন যদি শর্মিলাদি এখানে এসে পড়ে? কী করবে? 
- কিছুই করবো না। বাড়িতে ফোন যাবে একটা, আর কী? 
- তুমি খুব ভাগ্যবান। অমন একজন তোমার জন্য অপেক্ষা করে থাকে... 
- ঠিক বলেছো, আই ডোন্ট ডিজার্ভ হার.. 
- খুব সাজিয়ে কথা বলতে পারো তুমি। কখনও বেঁধে ফেলা যায় না... 
- এমনিতেই বাঁধা থাকি এপার ওপার । আর কত বাঁধবে? 
- এবার যাবো.. 
- হ্যাঁ, চলো ওঠা যাক... 
- একটা গিফট দেবো ভাবলাম তোমাকে। কিছুই পেলাম না.. 
- আমি তো এত কাণ্ড কিছুই জানতুম না। চলে এলুম খালি হাত ... 
- তুমি তো গিফট দিয়েছো আমাকে.. 
- সে কী? কবে? 
- কবিতার বই, তোমার সেই হোলি স্ক্রিপচার , বলিও তাহা ফেরত চাহো কি না? 
- কবে দেখা হচ্ছে আবার? 
- বোধ হয় আর হবে না.. 
- সে কী? নিঠুর রমণী তুমি কি এতই নিষ্ঠুর? 
- যে কথাটা বলার জন্য আজ এসেছি সেটা বলে নিই এবার.. 
- বাপরে, খুব লোডেড ভূমিকা তো.. 
- দ্যাখো, তোমার কথা জানি না। কিন্তু আমি এই গত কয়েকমাসের যা কিছু, সব সঙ্গে নিয়ে যাবো। চোখের দেখা আবার নাও হতে পারে। ম্যাটার করে না। তুমি কী ভাবছো, তাও ম্যাটার করে না... শুধু জানিয়ে রাখলাম... যদি কিছু নাও বলো, তাও কিছু আসে যায় না.. তোমার একটা টুকরো আমার সঙ্গে থেকে যাবে... 
- ভালো থেকো, সাবধানে থেকো... 
- আসি, টা টা... 
- এসো..

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in






রূপেশের ওই চিঠিটা! যেন অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষায় থেকে মনোযোগ হারিয়ে ফেলা স্লিপ ফিল্ডারদের সামনে স্নিক থেকে ছিটকে আসা ক্যাচ! ফার্স্ট স্লিপের হাত ফসকে পড়ে যাওয়ার মুহুর্তে ডাইভ মেরে বলটা মাটি থেকে তুলে নিয়েছে সেকন্ড স্লিপ। উইকেট কিপার থেকে শুরু করে সব ফিল্ডারদের আনন্দ দেখে কে! 
বড়বৌদির বাপের বাড়ির ওই তুতো বোনটি যেন ওরই অপেক্ষায় ছিল। হবু শাশুড়ি রূপেশের চিবুকে হাত দিয়ে চুমু খেয়ে বললেন – কিছু ভেব না বাবা। আমার মেয়ে খুব গুণী; ইংলিশ মিডিয়ামে পড়লে কি হবে, গাঁয়ে গিয়েও মানিয়ে নিতে পারবে। ওকে আমরা সেভাবেই বড় করেছি। অনেকদিন তো হাত পুড়িয়ে খেয়েছ, এবার তোমার কষ্টের দিন শেষ। 
এই যে ম্যানেজার!
রূপেশ চমকে উঠেছে। বাড়ির ছাদে গিয়ে চিলেকোঠার পাশে দুটো ইঁটের উপর বসে একটা সিগ্রেট ধরিয়েছিল, আচমকা অপরিচিত মেয়েলি গলার সম্বোধনে ওর হাত থেকে সিগ্রেট পড়ে যায় ।
এই অভ্যেসটা ওর ছুরিতে থাকার সময়ই বেড়ে যায় , প্রথমদিকে রামনিবাস সঙ্গী হত, পরের দিকে রাজন। বাড়িতে বড়বৌদি জানেন, উনিই বলেছিলেন যব খুব ধুঁয়া পীনে কী তিয়াস হোগী তব ছাত পর চল দেনা দেবরজী। উহাঁ কপড়া সুখানে কে লিয়ে লছমনিয়া ইয়া হম জাতে; অউর কোই নহীঁ।
আজকে দু’পক্ষের কথাবার্তা হবার পর ভেবেছিল ল্যাঠা চুকে গেছে। আসলে ও তো মেয়েদেখার পক্ষপাতী ছিল না । বড়ীভাবীকে বলেছিল—এটা একটা লটারি, আমি টিটি সিরিজ কি এবি সিরিজ দেখে কি বুঝব? আপনার পছন্দ মানে সব ঠিকই আছে।
কিন্তু ভাবী বলেছিলেন—তুমি না দেখ তো চোখ বুজে থেক ; মেয়ে বলেছে ও ছেলে দেখবে। আজকালকার মেয়ে , তায় ইংলিশ মিডিয়াম; বুঝতেই পারছ।
এখন সেই মেয়েটা ছাদে উঠে এসে ওকে এভাবে ডাকছে!
--শোন, অমন হাঁ করে থেকো না । চটপট কাজের কথায় আসি। মেরী জীজী, মতলব তোমার বড়ীভাবী, বলেছেন—দশ মিনিট, তার বেশি নয় । তোমাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আমার কয়েকটি শর্ত আছে । এক, আমি তোমাকে ‘এ জী, ও জী’ করতে পারব না । ডাকব ম্যানেজার বলে, তুমি রাজি?
বেশ; টাকাপয়সা গয়নাগাঁটি নিয়ে আমার খুব একটা মাথাব্যথা নেই। বছরে দু’বার গয়না গড়িয়ে দাও—এসব বায়নাক্কা করব না। কিন্তু একবার কোথাও বেড়াতে নিয়ে যাবে, নইলে ঝগড়া করব। আমার জিভে খুব ধার, পাড়ায় কেউ লাগতে আসেনা।
তিন নম্বর, খাওয়া দাওয়া নিয়ে খুব ঝামেলা হবে না। রাত্তিরে রুটি খাই, ও আমি বানিয়ে নেব। দিনের মধ্যে যতবার চা-কফি বলবে আমি বানিয়ে দেব। কিন্তু বেড-টি তুমি বানাবে। আমার অনেকদিনের ইচ্ছে হাজব্যান্ড সক্কালে চা-বিস্কুট ট্রেতে করে নিয়ে এসে “জাগো, মোহন প্যারে জাগো’ গেয়ে আমার ঘুম ভাঙাবে—অন্ততঃ একটা বছর, ব্যস।
চার, আমি তোমাকে ‘আপ-আপ” করতে পারব না; বড়দের সামনেও না। দুজনেই দুজনকে ‘তুম” বলব, আমরা ভাল বন্ধু হব। বড়রা এ’নিয়ে আপত্তি করলে তুমি আমাকে ডিফেন্ড করবে; করবে তো? ব্যস, হাত মিলাও।
রূপেশ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। মেয়েটার বাড়ানো হাত ও অগ্রাহ্য করতে পারে না। কিন্তু নারীশরীরের অপরিচিত গন্ধে ও অবাক হয় , হাত ছাড়তে ভুলে যায় ।
মেয়েটা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। 
এমনসময় নীচের থেকে বড়ী ভাবীর আওয়াজ শোনা যায় – এ নিমকি! নিমকি রে!
মেয়েটা তড়িঘড়ি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে সিঁড়ির দিকে ছুট লাগায়—টা-টা।
আরে, মেয়েটির ডাকনাম তাহলে নিমকি! কি গেঁয়ো নাম। বিয়ের পর রূপেশ এসব বদলে দেবে। মানে নিজে ওর একটা প্রাইভেট নাম দেবে, যা আর কেউ জানবে না ।

ও সবাইকে বলেছে আজ একটু তাড়াতাড়ি আসতে।
কাল থেকে ও ছুটিতে যাচ্ছ-- দু’সপ্তাহের জন্যে। রিলিভার সি প্রসন্নাকে ভাল করে চার্জ বুঝিয়ে দেবে। চেয়েছিল তিনসপ্তাহ, কিন্তু এখন পিক সীজন, বছরের টার্গেট পুরো করতে মাত্র দ’'মাস বাকি আর তারপরেই অ্যানুয়াল ক্লোজিং বা বার্ষিক লেখাবন্দী। এ’সময় কাউকেই ছুটি দেওয়া হয় না, মেডিক্যাল গ্রাউন্ড ছাড়া। হেড অফিসে পার্সোন্যাল ম্যানেজার সুরভি সাক্সেনা হেসেই খুন।
--রূপেশ স্যার, হানিমুন তিনমাসের জন্যে পেন্ডিং থাক, নতুন বছরের গোড়ায় বসন্তকালে যাবেন’খন। 
প্রসন্না চার্জ বুঝে নিতে ঠিক এগারটায় হাজির। রূপেশ নিজের স্যুটকেস গুছিয়ে কেবিনের একপাশে রেখে দিয়েছে। লাঞ্চের পর এখান থেকেই আলি আহমদ সার্ভিসের বাসে চড়ে চার ঘন্টায় বিলাসপুর। আশি কিলোমিটার পথ, চারঘন্টা একটু বেশি। কিন্তু রাস্তা খারাপ। এমনিতেই গাঁয়ের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে যাওয়া মোরাম ঢালা ফেয়ারওয়েদার রোড, পাকা পিচঢালা হতে আরও দু’বছর। তারপর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত দৈত্যাকার বিশাল বিশাল ডোজার সমানে গর্জন করে ছুটে চলেছে। প্রায়ই রাস্তা ভেঙে গর্ত তৈরি হয়, বৃষ্টি হলে তো কথাই নেই।
খোঁড়া হচ্ছে মাটি—বড় একটা লেকের মত এলাকা জুড়ে, তার মধ্যে তৈরি স্লোপ বেয়ে ট্রাক নেমে যাচ্ছে প্রায় ৬০ ফুট নিচে, কয়লা ভরে উঠে আসছে উপরে। এর নাম নাকি ওপেনকাস্ট মাইনিং। এতদিন সবাই জানত মাটির তলায় লুকিয়ে থাকা এই কালো হীরে তুলে আনতে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে লিফট বেয়ে নিচে নামতে হয়। এমনটা রূপেশ ‘কালা পাত্থর’ সিনেমায় দেখেছে। এখানে যে নতুন টেকনিক, মাটির উপরেই বিরাট কর্মযজ্ঞ। তাই সারাক্ষণ হাওয়ায় একটা ধূলোর আস্তরণ ও কয়লার গুঁড়ো, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
এর মধ্যে নিমকি মানে সরলাকে এনে কোথায় তুলবে? হ্যাঁ, ওর হবু বৌয়ের নাম সরলা শ্রীবাস্তব। কার্ড ছাপা হয়ে বিলি হয়ে গেছে। তবে ওর ক্লার্ক নরেশ আর ফিল্ড অফিসার খান্ডে ভাল পরামর্শ দিয়েছে।
রেললাইনের ওপারে গড়ে উঠেছে লেবার কলোনি, ঘোরাপাট গাঁয়ে। সেখানে জমি হারিয়ে মজদুর বনে যাওয়া অনেক চাষি কোয়ার্টার পেয়েছে। কিন্তু বেশ কিছু নতুন মজুরের দল গাঁয়ের মোহ ছাড়তে পারেনি। ওরা কোয়ার্টারের দরজায় তালা ঝুলিয়ে থাকে গাঁয়ের বাড়িতে—যতদিন না ক্রমশঃ হাঁ করে এগিয়ে আসা কয়লা খাদান ওদের পাড়া অব্দি পৌঁছে গিয়ে বাপ-ঠাকুর্দার সময়ের বাস্তুভিটেটি গিলে নিচ্ছে।অনেকে দল বেঁধে খাদান এরিয়ার বাইরে ভাটা বা পড়তি ঊষর জমিতে মাটির দেয়াল আর খাপরার চাল তুলে নতুন ঘর বানিয়ে নিচ্ছে। এভাবে গড়ে উঠেছে বেদখল কলোনি যাতে নিজেদের ফেলে আসা গাঁয়ের স্মৃতিতে ওরা দুটো খুঁটির গায়ে টিনের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বড় বড় আঁকাবাঁকা অক্ষরে লিখে দিচ্ছে জনপদের নাম—“নয়া বরপালী” বা “নয়া চারপারা”। সকাল সন্ধ্যে ওদের ঘরের সামনে লোহার পাতে তৈরি কয়লার উনুনে আঁচ পড়ে আর নীলচে ধোঁয়ার কুন্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশে উঠতে থাকে। এখানে কয়লা ফ্রি—তাই জঙ্গলের চুরি করে কেটে আনা কাঠে উনুন ধরানোর দিন শেষ। 
সুন্দর করে গোবর লেপে নিকানো ঘরের মেঝে আর বাইরের দেয়ালে বড় বড় করে স্থানীয় শিল্পীর আঁকা ছবি। নীলকন্ঠ শিবের গোটা শরীর নীল,গলায় জড়ানো ফণাতোলা সাপ, মাটিতে পোঁতা ত্রিশুলের গায়ে বাঁধা ডমরু আর শিঙ্গা, পাশে সাদা রঙের নন্দীষাঁড় শুয়ে শুয়ে অলস চোখে জাবর কাটছে। কোথাও রামসীতা কেবট বা কৈবর্তের নৌকো চড়ে গোদাবরী নদী পার হচ্ছেন। আবার কোথাও একটি লতানো গাছে একটি চারপাপড়ির ফুল, তাকে ঠোকরাচ্ছে একটা বড়সড় টিয়েপাখি।
এখানে বিজলি ফ্রি, তাই যেখানে যেখানে বাঁশের ডগায় করে লাইনটানা সম্ভব হয়েছে সে পাড়ায় অনেকের ঘরে হলদে ষাট পাওয়ারের বাল্ব। বাকি ঘরে এখনও হ্যারিকেন, হ্যাজাকবাতি বা টেমি জ্বলে।
কিন্তু একটা ঘরেও পায়খানা বা সেপ্টিক ল্যাট্রিন নেই। সবাই যায় লোটা হাতে জল নিয়ে মাঠে ঘাটে, সকাল-সন্ধ্যে। হেসে বলে বাড়ির মধ্যে দুর্গন্ধযুক্ত পায়খানা থাকবে –এ কেমন কথা! এসব শহুরে ব্যামো! আর স্নান করে সবাই পুকুরে বা কুয়োর পাড়ে বালতি দিয়ে জল তুলে।
কিন্তু সরলা যে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া মেয়ে, আবার ইন্ডাস্ট্রিয়াল টাউনে বড় হয়েছে।
খান্ডে আর নরেশ জানায় ওই ঘোরাপাট কলোনির লেবার কোয়ার্টার যারা তালা মেরে রেখেছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ মাসে একশ’ টাকা নিয়ে ভাড়া খাটাচ্ছে। অনেক স্কুল টিচার বিশেষ করে মহিলারা ওভাবেই আছেন। চারপাড়া গাঁয়ের ডোজার ড্রাইভার চামারসায় থাকে নিউ চারপাড়ায়, আমাদের ডিপোজিটার। জমির ক্ষতিপূরণের টাকা বাঁচিয়ে এক লাখ টাকা এই ব্র্যাঞ্চে ফিক্সড ডিপোজিট করেছে। ও ম্যানেজার সাহাবের ফ্যামিলির জন্যে বিনে পয়সায় দিতে রাজি। কিন্তু আমরা বলেছি আমাদের স্যার ফোকটে নেবেন না। সবার মত মাসে একশ’ টাকা করে দেবেন। দুটো পাকা ঘর, ছোট রান্নাঘর পেছনের পাকা আঙিনা উঁচু বাউন্ডারি ওয়াল দিয়ে ঘেরা। পাকা বাথরুমের ছাদ নেই, তাতে কি, কাপড় টাঙানোর গজাল পোঁতা আছে। আলাদা সেপ্ট্রিক ল্যাট্রিন। উঁচুতে একটা ঘুলঘুলি। কলের জল চব্বিশঘন্টা ফ্রি, কয়লা ও বিজলি ফ্রি। আর কি চাই?
রূপেশের কিন্তু কিন্তু ভাব দেখে নরেশ বলে ওঠে—এত ভাববেন না স্যার। ওখানে কয়লাখনির হাসপাতাল আছে, তাতে একজন এমডি আর একজন এমবিবিএস ডাক্তার। এছাড়া নার্স, ড্রেসার, ফার্মাসিস্ট। ডক্টর তিওয়ারি আমাকে বলেছেন – ব্যাঙ্কের স্টাফের জন্যে পয়সা লাগবে না। এছাড়া মার্কেট কমপ্লেক্স তৈরি হয়েছে। তাতে চাল-ডাল-ডেইলি নীডস এর দুটো দোকান, একটা মিষ্টির, একটা ওষূধের, একটা গম পেষার কল, একটা দোসা-ইডলি-কফিওলা আন্না রেস্টুরেন্ট –সব খুলে গেছে। আর কলিয়ারির তরফ থেকে ওখানের মাঠে স্ক্রিন টাঙিয়ে মাসে দুটো করে সোমবার সিনেমা দেখায়। ঘর থেকে ফোল্ডিং চেয়ার নিয়ে যেতে হয়। ভাবীজির দিল বহলানে কা কাম হো জায়েগা। নইলে রোববারে ওনাকে নিয়ে যাবেন কোরবা। শপিং করিয়ে আনবেন। আর দুটো পিকনিক স্পট।
সে যাকগে, বিয়ের পর ভাবীজিকে এখানে নিয়ে আসার আগে আপনি নিজে ঘরটা দেখে নেবেন। কোন অসুবিধে হলে আমরা আছি।
প্রসন্নাকে রিজার্ভ ব্যাংকের পেন্ডিং রিটার্ন্সের ফাইলটা খালি ধরিয়েছে এমন সময় চড়া গলায় কথাকাটাকাটি কানে আসায় ওর মেজাজ বিগড়ে গেল।
-- হচ্ছেটা কী?
খান্ডের উত্তেজিত গলাঃ--স্যার, ক্রিমিনাল কন্সপিরেসি! ব্যাংককে চুণা লাগানোর ষড়যন্ত্র; মনে হচ্ছে পুলিশ ডাকতে হবে। 
ও প্রদন্নাকে ফাইলটা দেখতে বলে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে।
হলের এককোণায় মাটিতে উবু হয়ে বসে একটা হাবাগোবা লোক। হেঁটো ধুতি আর নীলরঙা পিরান। মুখে কথা নেই। তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে দুজন নারীপুরুষ। তারা তুমুল ঝগড়া করছে ফিল্ড অফিসার খান্ডের সঙ্গে। মহিলাটির মুখের সঙ্গে উত্তেজিত হাতনাড়া দেখার মত।
--ক্যা হুয়া? ইতনা চিঁ-পোঁ কাহে? ইয়ে ব্যাংক হ্যায়, কোঈ মছলীবাজার নহীঁ হ্যায়। আরামসে বাত করো। হম সুনেঙ্গে।
--সাহাব, আপকে ইয়ে আদমী হম লা ঠগ কহিস, মোর আদমী লা চোর কহিস। এ কোঈ তরীকা হ্যায়?
খান্ডেও সমান উত্তেজিত। বলে - চোরকে চোর বলব না?
সবাইকে চুপ করিয়ে রূপেশ বলে—সবার কথা শুনব, কিন্তু এক এক করে। আমি যাকে জিজ্ঞেস করব শুধু সে কথা বলবে; ঠিক আছে? আগে খান্ডে বল কী হয়েছে?
খান্ডের হাতে একটা “জমিন কী পর্চি” বা ল্যান্ড রেভিনিউ বিভাগ থেকে ইস্যু করা জমির মালিকানার ডকুমেন্ট। এতে মালিকের নাম, পরিবারের অংশীদারদের নাম, ক’জন অপ্রাপ্তবয়স্ক, জমির পরিমাণ এবং তাতে কী কী ফসল হয়েছে, খাজনা কত—সব লেখা থাকে।
–দেখুন স্যার, আপনিই দেখুন---মালিকের নাম কী লেখা আছে? আর বাবার নাম কী?
--- বিহানু পুত্র আত্মারাম, মানে আত্মারামের ছেলে বিহানু হল জমির মালিক। তাই তো?
--ঠিক স্যার। এবার ওই মাটিতে বসা লোকটাকে জিজ্ঞেস করুন ওর নাম কী? এটা নাকি ওরই জমির কাগজ। 
--কেইসে গা? কা নাম তোর ? 
--- আত্মারাম। 
--দেখলেন তো, ব্যাটা নিজের ছেলের জমির কাগজ ব্যাংকে বন্ধক রেখে লোন নিতে এসেছে। এটা ঠগবাজি নয় ? চিটিং নয়?
কল কল করে ওঠে সঙ্গী মহিলাটি। 
--না সাহেব , ইয়ে জোজোয়া হবে, বেইমান নহীঁ। ইয়ে সহী গোঠিয়াথে, ওকর ঘর কা নাম আত্মারাম, সরকারি নাম বিহানু।
( না সাহেব, এ বোকাহাঁদা, কিন্তু বেইমান নয়। ও সত্যি কথা বলছে। ওর ঘরের নাম আত্মারাম, সরকারি কাগজে বিহানু।)
--দেখলেন স্যার, ওই মেয়েটার চালাকিটা দেখলেন! ঘরের নাম আত্মারাম? তাহলে সরকারি কাগজে বাপের নাম আত্মারাম হয় কীকরে ? আত্মারামের ব্যাটা আত্মারাম? চালাকি পেয়েছে? এসব থানায় গিয়ে শোনাক।
এবার মুখ খোলে সঙ্গের আধপাকা চুলের পুরুষটি। বলে—মহিলাটি ঠিক বলছে। ওর পতিদেবের ঘরের নাম আত্মারাম, কিন্তু সরকারি কাগজে বিহানু, দুটোই ওর নাম। 
--তুমি কে হে? এই বিহানু বা আত্মারাম তোমার কে হয়? 
-- নাহী; কোন রিস্তা নাহী; হমন ওকর পড়োশি হন, অউ গাঁওকে সিয়ান।
( কোন আত্মীয়তা নেই, ওরা আমার পড়শী, আর আমি গাঁয়ের মুখিয়া।
খান্ডে ভাঙা ইংরেজিতে বলে – এসব কমিশন খাওয়ার ধান্ধা স্যার, এর কথায় বিশ্বাস করবেন না।
রূপেশ মাথা চুলকোয়। এই আষাঢ়ে গল্প এরা এমন জোর গলায় বলছে কী করে? কিন্তু আজকে যে ওকে বাস ধরে বিলাসপুর যেতে হবে। দু’দিন পরে বিয়ে, তারপরে দ্বিরাগমন সেরে ফিরবে সেই দুটো রোববার জুড়ে নামে ১৪ দিন , আসলে ১৬ দিন ছুটি কাটিয়ে।
হে ভগবান! আজকে কাউকে কড়া কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।ও ফিল্ড অফিসারকে বলে থানাপুলিশ ছাড়, এদের ঘরে যেতে বল। আত্মারাম সন অফ আত্মারাম লিখে লোন দিলে আমাকেই অফিস সাস্পেন্ড করবে বা পাগলা গারদে পাঠাবে।
খান্ডে নিতান্ত অনিচ্ছায় জমির ডকুমেন্ট ফিরিয়ে দিয়ে বলে – যা ভাগ! আজ সাহেবের মেজাজ ফুরফুরে, তাই এ’যাত্রা বেঁচে গেলি।
ওরা চলে যায় ,কিন্তু মহিলাটি বিড়বিড় করতে করতে যায়—মোলা ন্যায় নহীঁ মিলিস। 
রূপেশ প্রসন্নাকে গোল্ড সিলভারের থলেগুলো লোনলেজার আর প্রমিসরি নোটের সঙ্গে নম্বর মিলিয়ে চেক করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রসন্না সিকিউরিটি ফর্মস ও ক্যাশ চেক করার পর বলে—যান, লাঞ্চ করুন গে’। আপনাকে বাস ধরতে হবে। বাকি আমি আপনার ফিল্ড অফিসারের থেকে বুঝে নেব।
সব ঘড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছিল। এবার রূপেশ সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে বলে—রোববারে বিলাসপুরে আমার পার্টিতে আপনারা সবাই আসছেন। নরেশ, প্রসন্না স্যারকে তুমি সঙ্গে করে নিয়ে আসবে, কোন কিন্তু-পরন্তু শুনছি না।ভিলাইনগরে সেক্টর সিক্সে কমিউনিটি হল, সন্ধ্যে সাতটায়। মনে থাকে যেন!
চাপরাশি মনবোধি যাদব ওর স্যুটকেসটা তুলে নেয়। বাসে তুলে দিয়ে ফিরে আসবে। ব্যাঙ্কের মকানমালিক দাদুসাহেবের কথায় আগের চাপরাশি বুধরাম চুরির অপবাদ মাথায় নিয়ে কাজ ছেড়ে নিজের গাঁ হরদিবাজারে ফিরে গেছে। এখন আরেকজনকে ছ’টাকা দৈনিক মজুরিতে রাখা হয়েছে। ম্যাট্রিক ফেল এই নতুন ছেলেটি কিন্তু বেশ চটপটে। তবু বুধরামের মারখাওয়া অপমানিত মুখ মনে পড়ে আর নিজের অজান্তে মনবোধির প্রতি রূপেশের ব্যবহার কেমন যেন রুক্ষ হয়ে যায়। কিন্তু রূপেশ যে আজ কার মুখ দেখে উঠেছিল!
বেরনোর সময় বাধা পড়ল।
ব্যাংকের বারান্দায় উঠে এসে গায়ের ধুলো ঝাড়ছে সেই আত্মারামের দল এবং সঙ্গে চশমা পড়া গিরিধারী পাটোয়ারি। গিরিধারী হাসিমুখে এগিয়ে এসে রূপেশকে নমস্কার করে—জানি আপনার তাড়া আছে, ছুটিতে যাচ্ছেন। আমি শুধু পাঁচ মিনিট নেব, ব্যস।
রূপেশ বুঝে যায় আজ আলি আহমদ বাসে চড়া ওর কপালে নেই। পরের বাস আদর্শ ট্রান্সপোর্ট আসবে দেড়ঘন্টা পরে। ওর ইশারায় মনবোধি স্যুটকেসটা নিয়ে ভল্ট রুমে রেখে দেয়। গিরিধারী রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাওয়া পাটোয়ারি, কালেক্টরের অফিসেও ওর “পঁহুচ” আছে। ওকে চটানো ঠিক নয়।
পাটোয়ারি চটপট কাজের কথায় আসে। বলে – ওরা ঠিক বলছে। ওর নাম আত্মারাম, ওর বাপের নামও আত্মারাম, সরকারি কাগজে বিহানু নামটা আমার দেওয়া।
মানে? রূপেশের হাঁ-মুখ বন্ধ হয় না। পাটোয়ারি চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়ে, বটুয়া থেকে পান বের করে গালে পোরে। মনবোধি হাওয়া বুঝে চায়ের জল চড়াতে চলে যায়।
--শুনুন সাহেব, এই গতবছরের কথা। দু'বছর আগের সার্ভেতে এদিকের মৌজা দুরপা, মৌজা ভেলইবাজার এবং মৌজা হরদিবাজার এলাকায় প্রায় কুড়িটি গাঁয়ের নীচে কয়লা আছে বলে জানা গেল। গত বছর কোল ইন্ডিয়া সেকশন নাইনের নোটিশ দিয়ে জানাল যে আপাততঃ বারোটা গ্রাম অধিগ্রহণ করা হবে আর প্রতি জমির পর্চিতে , মিনিমাম পাঁচ একর, সবাই একটা করে চাকরি পাবে। আমার কাজ হল ওই গ্রামগুলোর রেকর্ড দুরুস্ত করা, ম্যাপ বানানো। যারা ক্ষতিপূরণ পাবে তাদের নামের লিস্টি তৈরি করা। এখন হল কি যাদের বাবা বা জমির লম্বরদার মারা গেছে তারা আমার কাছে এসে মৃত ব্যক্তির নাম কাটিয়ে নতুন জীবিত লম্বরদারের নাম লেখাতে লাগল। ধরুন, স্বর্গবাসী বাবার জায়গায় বড়ছেলে। একে বলে—ফৌতি উঠানা।
আমি ভীষণ ব্যস্ত, সকাল থেকে খাটছি। এই রেকর্ড ঠিক করছি, ওই চেন নিয়ে কারও জমি মাপছি। বলতে দ্বিধা নেই, আপনাদের কৃপায় দু’পয়সা আমদানিও হচ্ছে। এমনই এক দিন সাতসকালে এরা তিনজন এসে হাজির। আমি জমি মেপে দেখেছি, ঠিক আছে। ওর বাবা মারা গেছে। ফৌতি ওঠাতে হবে। কিন্তু কাগজ দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ, যেমন আপনাদের আজ হয়েছে। ওর বাবা আত্মারাম আর ওর নামও নাকি আত্মারাম। দেখছেন তো, ব্যাটা একনম্বরের জোজোয়া। মুখে একটাই বুলি – ওর নামও আত্মারাম। শেষে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে পাড়া পড়শির থেকে চেক করে জানলাম যে ওর বাবা আত্মারাম ছিল সফল পুরুষ, করিৎকর্মা লোক। ওই সম্পত্তি বাড়িয়ে কুড়ি একর জমি করেছে, তাও তিন গাঁয়ে। ছেলেটা এমন ন্যালাক্যাবলা হওয়ায় গাঁয়ের বৈগাপুরুত গুনে বলেছিল যে ওকে ওর বাপের নামটাই করে দিলে ওর মধ্যে বদলাও আসবে। তাই ও হয়ে গেল আত্মারাম নম্বর দুই। যেমন আপনি স্কুলের ইতিহাসে পড়েছেন না—চার্লস ২, ইয়া শাহ আলম ২। 
আমার এত ভ্যান্তারা পোষাল না। সরকারি কাগজে ওসব চলবে না। ওকে বললাম—শোন ব্যাটা, জরদ্গব ভ্যাবাগঙ্গারাম! আজ থেকে তোর নাম হল বিহানু। সাতসকালে, মানে বিহানবেলায় , এসে আমার মাথাখারাপ করেছিস তাই। রেকর্ডে ওর নাম হল বিহানু পুত্র আত্মারাম। দেখবেন ওই পর্চিতে ওর ফটো লাগানো আছে। আমার এবং তহসীলদার সাহেবের সই আছে। নিয়মে যা লোন পাবে দিয়ে দিন । কয়লা খাদান বরপালী গাঁয়ের ভেতর একেবারে ওর বাড়ির উপর দিয়ে যাবে। কুড়ি একর জমি ; ক্ষতিপূরণ হিসেবে কম-সে-কমঁইয়ের কয়েক লাখ টাকা পাবে, চাকরি পাবে। সবটাকা আপনার ব্যাংকে জমা হবে। আমি বলছি ঠকবেন না ।
আরও একঘন্টা কেটে গেছে। রূপেশ দাঁড়িয়ে আছে গাঁয়ের সীমানায় একটা পলাশ গাছের ছায়ায়। এখানেই বাস থামবে । আরও ক’জন যাত্রী অপেক্ষায় রয়েছে। দু’জন স্কুলের দিদিমণি, একজন গ্রামসেবিকা, আর নতুন পুলিশ আউটপোস্টের থানেদার পান্ডেজি। ওকে দেখে হেসে মাথা নেড়ে নমস্তে করলেন। রূপেশও প্রত্যুত্তর দিয়ে চুপ করে রইল ।নইলে বাসে পাশের সীটে বসে বিলাসপুর অবদি যত রাজ্যের ফালতু গসিপ আর কিসসা শুনতে হবে।
বাস আসতে আর কত দেরি? মনবোধিকে ফিরে যেতে বললেও যাচ্ছে না, জিদ ধরেছে বাসের মাথায় স্যুটকেস তুলিয়ে সাহাবকে সামনের দিকে জানলার পাশে একটা ভাল সীটে বসিয়ে তবে যাবে। ও টের পেয়েছে রূপেশের অকারণ রূঢ়তা, কিন্তু কারণ বুঝতে পারছে না—তাই প্রাণপণে সাহাবকে খুশি করতে এঁটুলির মত লেগে রয়েছে। 
হঠাৎ একটা হুইসিলের চেরা আওয়াজে ও চমকে উঠল । পাশের আর একটা বড় গাছের নীচে জমা হয়েছে ভিড় আর মুখে বিচিত্র রঙ মাখা দুই ভাঁড় সবাইকে চটজলদি ডায়লগ আর মেঠো রসিকতায় হাসানোর চেষ্টা করছে। 
সুনো, সুনো! সব্বোজন সুনো! কাল আহিরণকে তির দুঠিন সাগোন অউ সীসম ভারি বতিয়ানে লাগিস। কেইসে গা ভাই সুকালু? 
হাঁ ভাই দুকালু। মহুঁ রহেন ওহাঁ। আপন আখোঁ মা দেখেহন, কানো মা সুনেহন”।
( শোন গো শোন; সবাই শোন। কাল আহিরণ নদীর তিরে দুটো সেগুন আর শিশুগাছ নিজেদের মধ্যে খুব গল্পগুজব করছিল । কি গো ভাই সুকালু? হ্যাঁ ভাই দুকালু। আমি ওখানে ছিলাম তো। নিজের চোখে দেখেছি, নিজের কানে শুনেছি।)
এইভাবে সুকালু দুকালুর (সুখীরাম দুখীরাম) রসালো গল্প আর ভাঁড়ামিতে দর্শকেরা মজে যায়, মাঝে মাঝে হাততালি ও হাসির হররা ওঠে। রূপেশ বুঝতে পারে এই দুই ভাঁড় এলাকায় বেশ পরিচিত। একটা বাচ্চা মেয়ে এলুমিনিয়ামের বাটি নিয়ে দর্শকদের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় । বেশ চলছিল, আচমকা তাল কাটল।
সুকালু জিজ্ঞেস করে—চল ভাই, বিলাসপুরে সত্যম টকিজে ‘শোলে’ লেগেছে , গিয়ে দেখে আসি। কী বললি? বাসের ভাড়া আর টিকিটের পয়সা কোত্থেকে জুটবে? চিন্তা করিস না। থানেদারের বিবিকে পটিয়ে রেখেছি। ওই দেবে।
পাবলিকের হাসি বাধা মানে না। ভিড়ের থেকে সুঁই সুঁই করে সিটি বেজে ওঠে।
কিন্তু জটলার মধ্যে এতক্ষণ হাসতে থাকা থানেদারের মুখ রাগে বেগুনি; বগল থেকে টুপি মাথায় চড়িয়ে হাতের রুল উঁচিয়ে পান্ডেজি তেড়ে যান ওদের দিকে, মুখে গালির ফোয়ারা।
বিপদ বুঝে সুকালু কথা পালটায়।
“আরে দুকালু ! তুই কি থানেদারের বিবি শুনলি নাকি? গলত। মেহর জমাদারকী বিবি বলে হন; অব কান পকড়, নাক রগড়। থানেদার সাহাব মাফ কর দেহি।“
(আমি তো জমাদারের বিবি বলেছি। তুই ভুল শুনেছিস। এবার কান ধর, নাকখৎ দে। থানেদার সাহাব মাফ করে দেবেন।)
এবার ওরা হাসিমুখে দৌড়ে পালায়। তেড়ে যাওয়া পান্ডেজির তেজ কমে। মোটরের গর্জন, ধুলো উড়িয়ে বাস এসে গেছে। 
(চলবে)

0 comments: