0

প্রবন্ধ - সোমব্রত সরকার

Posted in











পূর্ব-প্রকাশিতের পর

 
চিরাচরিত আনুষ্ঠানিক ধর্মের বিপক্ষে বাউল সমাজ সেই উদ্ভবের কাল হতেই কথা বলে এসেছেন। তাঁরা বলে থাকেন তাঁদের আচার: রাগের বিচার। আনুষ্ঠানিক ধর্ম বলতে তাঁরা বেদ-বিধিকেই চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের সাধনতত্ত্বের গানে এর স্পষ্ট উল্লেখ আছে। 
বেদে কি তার মর্ম জানে ৷ 
যেরূপ সাঁইর লীলা-খেলা 
আছে এই দেহ-ভুবনে॥ 
পঞ্চতত্ত্ব বেদের বিচার 
পণ্ডিতেরা করেন প্রচার, 
মানুষ-তত্ত্ব ভজনের সার, 
বেদে ছাড়া বৈ রাগের মানে॥ 
গোলে হরি বললে কি হয়, 
নিগূঢ় তত্ত্ব নিরালা পায়, 
নীরে-ক্ষীরে যুগলে রয়, 
সাঁইর বারামখানা সেইখানে॥ 
পড়িলে কি পায় পদার্থ 
আত্মতত্ত্বে যারা ভ্রান্ত, 
লালন বলে সাধু-মোহন্ত 
সিদ্ধ হয় আপনারে চিনে॥ 
বাউলের এই নিজেকে চেনা হল তাঁর দেহকে চেনা। তার জন্যই সর্বপ্রথমে তাঁরা কিছু সাংখ্যিক পরিসংখ্যানের ব্যঞ্জনাসহ দেহকে দেহ গড়ে ওঠার প্রারম্ভ-পাঠে ঢুকিয়ে দেন। যেগুলো সবই দেহসাধনার কারুময় বিনম্র সমর্পণ। কী তন্ত্রে, কী বাউলে, কী বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের অস্তিত্ব পরম্পরায়। কিছু অর্থন্যাসের হেরফের ছাড়া ঐক্যসূত্রটি মোটামুটি প্রায় একই। মদনের পঞ্চবাণের কথা বলেন বাউল। 
পঞ্চবাণের ছিলা কেটে 
প্রেম যজ স্বরূপের হাটে, 
সিরাজসাঁই বলেরে, লালন, 
বৈদিক বাণে করিস নে রণ, 
বাণ হারায়ে পড়বি তখন 
রণ-খোলাতে হুবড়ি খেয়ে। 
বাণ অবশ্যই লিঙ্গ। প্রধানত কুম্ভক শক্তির ওপরে নির্ভর করে বাউলের বাণক্রিয়া। শুধু বাউলের কেন দেহসাধনার প্রয়োগগত উদাত্ত উপস্থাপনায় সব দেহসাধককেই বাণক্রিয়ার মহাপ্রাণ বর্ণগুলোকে শিখে নিতে হয়। তার জন্যই কুম্ভক যোগ। শ্বাস-প্রশ্বাসের স্বাভাবিক গতিছন্দ ভঙ্গ করার ক্রিয়া এটি। শরীরের প্রধান দুই বায়ু প্রাণ আর অপান বায়ুর খেলা এটি। তাই প্রাণায়াম। দেহসাধককে তিন প্রকারই প্রাণায়াম করতে হয়। বাউল জোর দেন কুম্ভকে। কেন না কুম্ভকেই প্রধানত বাউলের বাণক্রিয়া নির্ভর করে। বৈদিক বাণ হল— মদন, মাদন, শোষণ, স্তম্ভন ও সম্মোহন। এই পঞ্চবাণের ক্রিয়াতে সংসারে কামের সংবৃত ধ্বনিটি রণিত হচ্ছে। বাউল সাধক একেই অস্বীকার করতে চান। তাই বৈদিক এই পঞ্চবাণের ছিলা তাঁরা কাটেন শরীরের অব্যর্থ শ্বাসক্রিয়ার সমাবেশে। তার জন্যই প্রাণায়াম করতে হয়। শরীরের অব্যর্থ শ্বাসক্রিয়ার সমাবেশে তাঁরা শরীরের বাইরের বায়ুকে টেনে এনে প্রথমে অভ্যন্তর ভাগ পূরণ করে নেন। এই হল পূরক। তারপর অভ্যন্তরের সেই বায়ুকে জলভরা কলসির মতো ধারণ করে রাখা হয়। তা হল কুম্ভক। একেবারে শেষে জমা বায়ুকে আস্তে আস্তে শরীরের বাইরে বের করে দেওয়া হয় রেচক করে। বাণ-যোজনা কীভাবে হয় বাউল শরীরে? সাধক বাউল প্রথমে সঙ্গিনীর বিভিন্ন স্পর্শকাতর স্থানগুলোকে স্পর্শ করেন। তাঁরা বলেন বাউল সাধক চোখ দিয়ে সঙ্গিনীর সেই বিশেষ স্থানগুলো স্পর্শ করেন। বাস্তবিক সেটা কতখানি হয় বলা শক্ত। স্পর্শ-দৃষ্টিতেই তাঁদের মত, সঙ্গিনীর শরীরে উত্তেজনা বৃদ্ধি হয়। এটি হল মদন। মাদন তাঁদের ভাষায় হল গিয়ে হিল্লোল। দোলা হিসেবে আমরা একে দেখতে পারি। সঙ্গী, তাঁর সঙ্গিনীর সমস্ত যৌন উত্তেজক স্থানগুলো স্পর্শ করছেন আর সঙ্গিনীর শরীর জাগছে না তা কি হয়? এই উত্তেজনা বৃদ্ধির সময় শরীরের ডান দিকে অবস্থিত পিঙ্গলা নাড়িতে স্বাস কিছুক্ষণ প্রবাহিত হতে থাকে তখনই সঙ্গিনীর ডান চোখের দিকে দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করে ফেলেন দেহসাধক। মদনের ক্রিয়াতে স্বাস চলে বাঁ দিকের ইড়া নাড়িতে। অর্থাৎ বাঁ নাকে শ্বাস নিয়ে মাদনের ক্রিয়ার সময় তাকে ডান দিকে নিয়ে আসা হয়। তাঁরা বাঁ নাককে বলেন চন্দ্র। তাঁদের চন্দ্র নাড়ি ইড়া। ডান নাক সূর্য। পিঙ্গলা হল সূর্য নাড়ি। যোগশাস্ত্রও অবশ্য এ নামকে প্রতীক হিসেবে শিরোধার্য করেছে। সহজিয়া মত দক্ষিণ/ডান দিক কামের দিক। এদিক তাই পরিত্যাগের নির্দেশও রয়েছে চণ্ডীদাসের সহজিয়া পদে— দক্ষিণ দিগেতে কদাচ না যাবে/যাইলে প্রমাদ হবে। শোষণকে যোগশাস্ত্র বজ্রোলী মুদ্রা হিসেবে নির্দেশ করেছে। এই শোষণ বাউলের রূপ-রতি-রসের চলিঞ্চ নিঝুম সঞ্চার। রূপ তাঁদের রজ। রতি স্ত্রী-বীর্য/রজ। শুক্র বা বীর্য হল গিয়ে বাউলের রস। মিলন ক্রিয়ার সময় রূপ-রতি-রসকেই শোষণ করা হয়। বীর্যকে ঊর্ধ্বগতি দিয়ে এই কার্যকে সুসম্পন্ন করা হয়। স্তম্ভন হল যখন উভয় দেহের রসের একটা স্থিতাবস্থা চলে আসে তখন সেই অবস্থার মধ্যে স্থির-অচঞ্চল আনন্দানুভূতির সঞ্চার হয় বলে তাঁরা বলে থাকেন। এই আনন্দানুভূতির বর্ধিত রূপ, দীর্ঘক্ষণ স্থায়িত্ব হল গিয়ে স্তম্ভন বাণ-ক্রিয়া। সম্মোহন হল দেহ-স্মৃতি লুপ্ত হয়ে যাওয়া। আনন্দকে পরম শূন্যতার মধ্যে চেতনায় অনুভব করা। দুই শরীরের সেই বাহ্যজ্ঞান লুপ্ততার মধ্যে যে বিপুল তরঙ্গের অতীন্দ্রিয়তার আভাস, তাই হল সম্মোহন ক্রিয়া। সম্মোহনকে সাধক ভেদে অনেকে আবা বলে থাকেন মোহন। মিলনস্থ শরীরের কাঙ্ক্ষিত চিরপ্রতীক্ষার আনন্দধ্বনিকে বাউল বলে থাকেন জেন্তে মরা। বাউলের এটাই হল নিজস্ব অনুভূতির শান্ত চরণে আসা রাজ সমারোহ। বৈদিক ঈশ্বর বিশ্বাসের করুণাধারা বলেও একে আমরা অনায়াসে চিহ্নিত করতে পারি। 
কীভাবে হয় বাউলের এই মিলন ক্রিয়ার স্বরূপ? শরীরস্থ চন্দ্র নাড়ি ইড়ায় অর্থাৎ বাঁ নাকে যখন সাধকের শ্বাস চলতে থাকে তখন সাধন-সঙ্গিনীর সূর্য নাড়ি পিঙ্গলাতে শ্বাসের চলাচল স্পন্দিত হয়। বাউল গুরু বলেন এটাই মিলনের প্রশস্ত সময়। তাঁদের মত, এই সময় সূচিত হয় রাতের খাবার খাওয়ার ঠিক দু’ঘণ্টা পরে। এর স্থায়িত্ব প্রায় দেড়ঘণ্টা। এই সময়ই তাঁদের যুগল-ক্রিয়ারম্ভের সময়। 



বাউলের সাধনা তাঁদের নিজস্ব বোধজমির সাধনা। বোধ তাঁদের গুরু প্রদর্শিত সব নির্দেশিকার নিবিড় পঙ্ ক্তি। জমি হল শরীর। এই বোধজমি গুরুমান্য পথ তাঁরা কীভাবে, কোন নির্দেশিকায় আর নিষেধনামায়— নিষেধাজ্ঞা আর সাবধান বাণীর দ্বৈতনামায় পৌঁছবেন তা নিয়েই পদকর্তারা আর রসিক-মহজনেরা সব রচনা করেছেন সাধনতত্ত্বের গান। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রসগ্রাহী সাধন সঙ্গীতের মতো এরও শারীরিক বাহুল্যের বাড়াবাড়ির নিজস্ব লজিক-এ রচিত হয়েছে সাধনতত্ত্ব বা দেহতত্ত্বের গান। যা শরীরকে মূর্ত প্রয়াস ও ব্যর্থতার মধ্যবর্তী চেতনা-সমন্বিত অটুট আধারের এক বৃহৎ ব্রহ্মাণ্ডের ঘর-বাড়ির আলোকসজ্জার অভিঘাতকে যৌনতার রূপস্থ দীপালি হিসেবেও দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। কীভাবে? তারই আখরগত রূপে এখন আমরা একে-একে প্রবেশ করব। 
ক্ষ্যাপা প্রেম নদীতে স্নান করেত যাবে সাবধানে। 
যাবে সেই পিছল ঘাটের অকপটে সাধনসন্ধি জেনে। 
সেই প্রেম নদীতে ত্রিধারা বয় ত্রিধারায় অমৃত আছয়। 
পান করিয়ে হয় মৃত্যুঞ্জয় তারে কী করবে আর শমনে। 
সেই প্রেম নদীতে জোয়ার আসে তিন দিন করে প্রতি মাসে। 
সেথা রসিক যারা আছে বসে স্নান করিবে সেখানে। 
গোঁসাই ক্ষ্যাপা বলে এই প্রসঙ্গে কামগায়ত্রী রাখবি সঙ্গে। 
তখন পার হবি ভবতরঙ্গে সনাতন ভজ গা বসে এক মনে। 
বাউলের প্রেম নদী নারী বা সাধন সঙ্গিনীর শরীর। নারীকে তাঁরা সাধনতত্ত্বের গানে নদীর অর্থস্তর সৃজনে চিহ্নিত করে থাকেন। নদীর স্রোতধারার সঙ্গে নারীর রজ-প্রবৃত্তির উচ্ছলিয়া রূপ-সংযোগ তাঁদের দেহ-তত্ত্ব বা সাধন-তত্ত্বের গানে গুহ্য প্রতীক-এর নাতিস্ফূট অনুষঙ্গ। বাউল সাধনা মূলত আচরণবাদী— প্রচ্ছন্ন ও সংগুপ্ত। এই আচরণ নারী-পুরুষের দেহাচরণ। দেহে দেহ স্থাপনের আত্মীয়তা, কুটুম্ব তাঁদের মূল সাধনের অঙ্গ। আর তাঁদের সাধনা যেহেতু গুরুমুখী, লোকসমাজে বলা একেবারেই নিষিদ্ধ। সেজন্য বাউল গুরু পদকর্তা মহাজনেরা তাঁদের শরীর সাধনার ভাষাকে, ভাবকে, সাধন-তত্ত্বকে প্রচ্ছন্ন ও সংগুপ্ত করে রেখেছেন নিজস্ব এলাকার মধ্যে। সাধারণের পক্ষে এর অর্থ বোঝা, মানে করা সহজসাধ্য নয়। শুক্র বা বীর্য তাঁদের বীজ বা মণি বা রস। মল = অজর, মূত্র = রামরস, লিঙ্গ = বাণ, মুখ = লঙ্কা, দাঁত = দশানন, ডান চোখ = অধ, বাম চোখ = ঊর্ধ্ব, ডান নাক = সূর্য, বাঁ নাক = চন্দ্র। প্রেমকে তাঁরা পূর্ণচন্দ্র বলেন। রজ তাঁদের কারণবারি। আর রজঃপ্রবৃত্তির সময় হল গিয়ে অমাবস্যা। লিঙ্গ ও গুহ্যদ্বারের মাঝখানকে তাঁরা বলেন গৌইন্দ্রিয়। লিঙ্গের যে দ্বার দিয়ে শুক্র আসে সেটাকে আবার দশম-দ্বার বলে চিহ্নিত করেন। মদন, মাদন, শোষণ, স্তম্ভন, সম্মোহন— এই পাঁচ শারীরিক ক্রিয়া পঞ্চবাণ। গঙ্গা, যমুনা, সরস্বতী রূপী তিন নদীর সংযোগস্থল আদতে ত্রিবেণী। সেই ত্রিবেণী তাঁদের তিন রতি। শরীরের তিন প্রধান নাড়ি— ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্নাকে গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী নদীর প্রতীক-এ চিহ্নিত করেছে আমাদের যোগশাস্ত্র। আর শুধু প্রথান তিন নাড়ি কেন, শরীরের সাড়ে-তিন লক্ষ নাড়ির মধ্যে প্রধান যে চোদ্দটি নাড়ি যোগ সাধনাতে ক্রিয়ারত, আর শুধু যোগই বা কেন— আমাদের দেহের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত থেকে এই চোদ্দ নাড়িই আসলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যসকল সুসম্পন্ন করছে। ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না সহ গান্ধারী, হস্তিজিহ্বা, কুহু, সরস্বতী, পূষা, শঙ্খিনী, পয়স্বিনী, বারুণী, অলম্বুষা, বিশ্বোদরী, ও যশাস্বিনী— এই চোদ্দ নাড়িকেই চোদ্দটি নদীর নামে বোধ্যতার উপাসনা দিয়েছে যোগশাস্ত্র। বাউলের সাধনা মূলত তিন নাড়ির সাধনা। তাই তাঁরা ত্রিবেণীর কথা বলেন। বলেন ত্রিধারা। গানটিতেও ত্রিধারার অমৃত যোগের ইঙ্গিত রাখা হয়েছে। বাউল বলেন তাঁদের সাধনায় অমাবস্যার মধ্যে পূর্ণচন্দ্র উদয় হয়। প্রেম তাঁদের পূর্ণচন্দ্র আগেই বলেছি। তাঁদের সাধন অভিমত, যৌন স্বেচ্ছাচারকে তাঁরা সাধন এলাকার বাইরে রেখে আসেন। বলে রাখা ভালো, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট এই ধারণাকে এখন সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। সে অবশ্য অন্য প্রশ্ন। কিন্তু দেহ-সাধনার উদ্দেশ্যগত দিকই ছিল শরীরের কামকে প্রেমে রূপান্তরিত করে দেওয়া। অমাবস্যা বাউলের ঘোর অন্ধকারময় কামের সময়। সাধন-সঙ্গিনীর দেহে তখন রজঃবৃত্তির মধ্যেই সাধক বাউলকে প্রেমের নৌকা বাইতে হয়। অমাবস্যা তাই তাঁদের কামের প্রতিরূপ। তেমনই পূর্ণিমা হল গিয়ে প্রেম। বাউল বলে থাকেন কামকেই প্রেম সাধনার দিকে নিয়ে যাবার কথা। বলেন— কামকে নাচাও, কামে নেচো না। আর এই অমাবস্যায় তাঁরা কামকে নাচান। সাধন গানে বলা রয়েছে: অমাবস্যায় পূর্ণচন্দ্র যে করে উদয়,/ স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে—/ তিন ধামেতে হবে জয়;/ সামান্যের কর্ম নয়,/ সাধিলে সিদ্ধ হয়। এই সাধনার জন্যেই প্রেম নদীতে স্নান করা কথা বলা হয়েছে সনাতন দাসের (গোঁসাই খ্যাপা) গানে। খ্যাপা বলেছেন: সেই প্রেম নদীতে ত্রিধারা বয় ত্রিধারায় অমৃত আছয়।/ পান করিয়ে হয় মৃত্যুঞ্জয় তারে কী করবে আর শমনে। —এই ত্রিধারা হল সঙ্গিনীর শরীরের তিন দিনের রজঃস্রোত। এই রজঃপ্রবাহের ধারাকে তিন নামে তাঁরা অভিহিত করে থাকেন। যদিও এই নামকরণ তাঁরা ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ থেকে নিয়েছেন। এই তিন দিনের রজঃস্রোত বা কারণ-প্রবাহের নাম হল— কারুণ্যামৃত, তারুণ্যামৃত ও লাবণ্যামৃত। পদকর্তা পাঞ্জু শাহ্ অবশ্য তিন দিনের তিনটি প্রবাহকে তিনটি ভিন্ন নাম দিয়েছেন— প্রথম গরল রস, দ্বিতীয় শাম্ভু রস, তৃতীয় হল গিয়ে অমৃত রস। তিন দিনকে বলেছেন— অমাবস্যা, প্রতিপদ, দ্বিতীয়া। তিন দিনের মিলন ক্রিয়ার শেষ দিনটিকেই তিনি বলেছেন পরিণত ক্রিয়া। অর্থাৎ সাধনসিদ্ধি এ দিনেই আসে বলে তাঁর অভিমত— তিনটি রসের ভিয়ান যে জানে সে-ই পাবে নিরঞ্জনে ৷/ শাম্ভু গরল মিলন করে সুধার মিলনে॥/ যেমন দুগ্ধে জল মিলন করিলে হংস পাখী পান করে বেছে ৷/ রসিক জন হংস হয় সেই রসের সাধনে॥/ অমাবস্যায় গরল প্রকাশে,/ অমূল্য হয় সাঁই আগমনে ৷/ সাবধানেতে সাধন করে রসিকের গণে॥/ পদের শেষে দ্বিতীয়ার প্রথমে,/ রত্ন মিলে তিন রস মিলনে॥ 
বাউল সাধক বলেন, তিন রসে তিন রতি বর্তমান। গরল রসে সাধারণী, শাম্ভু রসে সমঞ্জসা, অমৃত রসে সমর্থা রতি। সাধারণী বলার কারণ হল সে দিন অর্থাৎ মিলনের প্রথম দিন সঙ্গিনীর শরীর স্থূল কামের পরিগণিত রূপ নিয়ে বসে থাকে। সমঞ্জসা হল দ্বিতীয় দিনে সাধক বাউল সঙ্গিনীর শরীরকে নিজস্ব সমতা অর্থাৎ সাধন স্তরের এলাকার আয়ত্তে নিয়ে আসতে পারেন, গুরু নির্দেশিত বিভিন্ন প্রক্রিয়ায়। সমর্থা বলার কারণ সাধক বাউল তৃতীয় দিনের শরীর ক্রিয়ায় সহজাবস্থায় চলে যান। তাঁরা তাঁদের অনুভূত অধর মানুষ বা অটল রূপে বিরাজ করেন। তাঁরা আবার এ-ও বলে থাকেন, তাঁদের সাধনা টল নয়, নয়কো অটল, তা হল গিয়ে সুটল। আর তার জন্যেই দেহকে তৈরি করার কথা বলে থাকেন বাউল সাধক। কীভাবে তৈরি করে নিতে হয় এই দেহ? তারই বর্ণচ্ছায়া সব লিপিবদ্ধ রয়েছে বাউলেরই সাধন তত্ত্বের গানে। তেমনই এক গান লালশশীর। 
ভাই রিপু ছয় ইন্দ্রিয় দশ আছে ষোলো জনা 
দেখ তাদের কথাতে ভুল না 
যেন বস্তু মজিও না ভাইরে 
চেতন হয়ে দেখ কার বা কোথা স্থান 
রাখবে সব স্থানে স্থানে যার যেমন আছে। 
এরা যখন হইবে শান্ত 
তখন দেখবে ভাই কোথায় আছে ঋতু বসন্ত 
আর নীরে ক্ষীরে একযোগে 
নীর ফেলে ক্ষীর বেছে খাও।

0 comments: