Next
Previous
Showing posts with label ঝরনাতলার নির্জনে. Show all posts
0
undefined undefined undefined

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in

ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ১৪
শিবাংশু দে



তোমার সুরের ধারা ঝরে যেথায়...

আসলে যে কোনও শিল্প উপভোগ করতে পারার একটা বিজ্ঞান আছে। কারণ যাবতীয় পারফর্মিং আর্টের প্রাসাদ পদার্থবিদ্যার সশক্ত স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকে। পদার্থবিদ্যার শর্তগুলি পূরণ হলেই তবে মনন ও অনুভূতির পর্যায় শুরু হয়। যেমন কণ্ঠ বা যন্ত্র যদি সঠিক কম্পাংকে না বাজে বা রঙের দুনিয়ায় পরস্পর পরিপূর্ত বর্ণিকাবিভঙ্গ বিষয়ে যদি আঁকিয়ের ধারণা না থাকে, তবে তো প্রথম বেড়াটিই পেরোনো যাবেনা। যে সব শিল্পীদের সিদ্ধিলাভ হয়ে গেছে, তাঁদের শিল্প পরিবেশন, পদার্থবিদ্যা কেন, মননেরও প্রাথমিক স্তরগুলি অনেকাংশে পেরিয়েই শুরু হয়। এই সত্য সঙ্গীতশিল্প, চিত্রশিল্প বা নাট্যশিল্প সবার জন্যই প্রযোজ্য। তেমনই প্রাথমিক স্তরের শ্রোতাদের কাছে শুধু কানে শুনে বা নিজস্ব মাপের শ্রবণ অভিজ্ঞতার নিরিখেই সঙ্গীত পরিবেশনার মান নির্ধারিত হয়। এঁরা সঙ্গীতস্বর্গের বাইরের দেউড়ির অতিথি। কিন্তু যখন এই সব শ্রোতারা সময়ের সঙ্গে ধীরে ধীরে সুরের অন্দর মহলের দিকে যাত্রা করেন, তখন তাঁদের উচ্চকিত মতামতের জগৎ নিঃশব্দে গভীরগামী হয়ে যায়। তখন তাঁরা যা 'ভালো' লাগে, তা নিয়েই এতো মগ্ন হয়ে থাকেন যে যা 'ভালো' লাগেনা, তা নিয়ে নষ্ট করার মতো সময় পান না।


আমি এখন সময় পেলেই অধিকারীজনদের সঙ্গে রবীন্দ্রসঙ্গীতের বর্তমান আর ভবিষ্যত নিয়ে বিনিময় করি। যেহেতু সে মাথার চারিপাশে।গায়নের ধরনে শোনার অভ্যেস পাল্টায়, না শ্রোতারাই ঠিক করে দেন কীভাবে গান গাইতে হবে। বিশ্বায়িত বাজারের পণ্য হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্থানটি ঠিক কোথায়? নিবেদিত শ্রোতা বলেন, সাহানাদেবীর গানের থেকে কাননদেবীর গানের পেশকারি অধিক উজ্জ্বল। আমিও এ বিষয়ে একমত। আমরা সাহানাদেবীর একান্ত অনুরাগী শ্রোতা। এমন কি কবি নিজেই বলতেন, সাহানাদেবীর গলায় তাঁর গান পূর্ণ মর্যাদা পায়। কিন্তু রাইচাঁদ বড়াল বা পঙ্কজকুমার কাননদেবীর গানের মধ্যে কোন রসায়নটি যোজনা করতেন, যাতে তাঁর গান অধিকাংশ শ্রোতার ভালো লাগতো। আমার এলেমমতো অনুসন্ধান করে সেকালের তথাকথিত বাণিজ্যসফল শিল্পীদের পরিবেশনার মধ্যে আপোস করার অভিপ্রেত খুঁজে পাইনি। তাঁদের নিষ্ঠা সচেতন শ্রোতার কাছে এখনও প্রাসঙ্গিক। ঠাকুরবাড়ির কুলুঙ্গি আর শান্তিনিকেতনের উপাসনাগৃহের বাইরে যে সংখ্যাগুরু শ্রোতার দল, তাঁদের জন্য পঙ্কজকুমার, সঙ্গে কুন্দনলাল যে রসটি পরিবেশন করতে পারতেন, দাবি অনুযায়ী অনেক বেশি উৎসমুখী, 'শুদ্ধ'ঘরানার শিল্পীরা সেটা পারতেন না।


অথচ ইন্দিরাদেবী দেবব্রতকে আলাদা করে পথনির্দেশ দিতেন, একক গাইতে উৎসাহিত করতেন। শান্তিনিকেতনের ধারায় অন্যমাত্রার স্ফূর্ত গায়ন নিয়ে এসেছিলেন সুচিত্রা। ছয় থেকে আট দশকে একসঙ্গে এতোজন সিদ্ধ শিল্পী রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের মানকে যে পর্যায়ে তুলে দিয়েছিলেন, সেটা ধরে রাখার চ্যালেঞ্জটি পরবর্তী শতকের শূন্য ও প্রথম দশকের গায়কদের নাগালের বাইরে চলে গেলো। একেবারে শীর্ষস্থানে থাকা পরিবেশকরাও 'গলাটা ভালো' জাতীয় মন্তব্যের সীমায় বাঁধা রয়ে গেলেন।


আসলে সময় বড়ো কম আর পৃথিবীতে আনন্দের উৎস এতো বিস্তৃত মানচিত্রে ছড়ানো আছে যে নিজেকে সতত টলস্টয়ের সেই গল্প, 'একটা মানুষের কতো জমি চাই'-এর চরিত্র প্যাহমের মতো লাগে। যা দেখি, তাকেই পেতে চাই নিজের করে, কিন্তু সদর্থকভাবে। নেতিবাচী ব্যসনের কোনও স্থান রাখতে পারিনা এই ছোটো জীবনে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার যে অভ্যেস মানুষের শ্বাসক্রিয়ার মতো অবিরল‚ অনর্গল বেড়ে ওঠে তার পিছনে দীর্ঘ প্রস্তুতি থাকে। অভ্যেসটি আমাদের বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নিজেও পরিণত হয়। বয়সের সঙ্গে আমার শরীরের দৈর্ঘ্য‚ প্রস্থ‚ মনের মধ্যে গড়ে ওঠা নানা রকম বেড়া‚ তাদের ভাঙা, আবার গড়ে তোলার খেলা চলতে থাকে। সংক্ষেপে আমার ঐহিক জীবন। তাকে জড়িয়ে ধরে আঙুরলতার মতো গান শোনার অভ্যেসটিও একসঙ্গে আকাশের দিকে হাত বাড়াতে চায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত এই মুহূর্তে জীবনে যেভাবে ছায়ানিবিড় মহীরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে‚ সেখানে মুগ্ধতা‚ প্রেম‚ সম্মোহন‚ আকর্ষণ ইত্যাদি ধ্বনি শব্দার্থে যথেষ্ট অভিঘাত আনতে পারেনা। হয়তো একটা শব্দই কিছুটা কাছে যেতে পারে। পরিপূর্ণতা। আমাদের প্রজন্মের সৌভাগ্য‚ গত একশো বছরের অধিক কাল‚ বিগত তিন-চার পুরুষ ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক যে শিল্পধারা গড়ে উঠেছে‚ তার শ্রেষ্ঠ ফলগুলি আস্বাদন করার সুযোগ আমরা পেয়েছি। এর ভালো দিকটা হলো‚ মানুষ হয়ে জন্মাবার সূত্রে একটা সেরা সম্পদ লাভ। আর আপাত বিপজ্জনক দিকটাও মনে রাখতে হয়। আমাদের প্রত্যাশা, রস আস্বাদনের মাত্রার মান, আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে। এই শিল্পে সের্গেই বুবকা বা এডুইন মোজেসের দল বা ‘তোমারি তুলনা তুমি প্রাণ’ যাঁরা ছিলেন‚ খেলা সাঙ্গ করে বাড়ি ফিরে গেছেন। একসঙ্গে আকাশে অগুন্তি নক্ষত্র ছিলো যখন‚ তার শ্রেয়ফল আমাদের নসিব হয়েছিলো। আবার যখন অন্ধকার আকাশ, একটি-দুটি মিটমিটে তারা, নিষ্প্রভ সীমাবদ্ধতায় কোনমতে জেগে থাকার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিলো‚ তার সাক্ষী থাকার সুযোগও হয়েছে আমাদের।


যে ব্যাপারটা বহুদিন আগেই জেনেছি যে কবির কাঙালও যখন বলে‚ আমায় ভিখারি করেছো‚ আরো কী তোমার চাই? এই ভিখারি তো আসলে কপিলবাস্তুর রাজকুমারের মতো। আমাদের ঐতিহ্যে প্রথম মানুষ‚ যিনি ভিক্ষাবৃত্তির মধ্যেও রাজকীয় সম্ভ্রমের সঞ্চার করেছিলেন। যিনি তাঁর ভুবন শূন্য করে ফেলেন আরেক কাঙালের আশ মেটাতে। এভাবে সর্বহারারও এক রাজসিক পরিচয় গড়ে ওঠে। রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের সেই রাজসিক উত্তরাধিকার। সন্ধ্যাকাশে ঊর্দ্ধকর হয়ে দাঁড়ালে থরে থরে ঝরে পড়া আপন প্রাণের ধন। তাকে তো ‘ম্যাজেস্টিক’ হতেই হবে।

যেরকম বলেছি, রসবস্তু উপভোগের তিনটি পথ আছে। শুধু হৃদয় দিয়ে, শুধু মস্তিষ্ক দিয়ে, অথবা হৃদয় ও মস্তিষ্কের মধ্যে ভারসাম্যের ভিত্তিতে একটা অবস্থান নিয়ে কোথাও পৌঁছোনো। নিজের গান সৃষ্টি করার সময় রবীন্দ্রনাথ শিল্পের সেরিব্রাল দিকটা নিয়ে শেষকথা বলে দিয়েছেন। তাই তাঁর গান প্রকৃতভাবে উপভোগ করতে গেলে শুধু তাঁর প্রকল্পিত সেরিব্রাল ম্যাপিংটাকেই মনে রাখতে হবে। কোনো খোদকারি করার অবকাশ নেই। গলায় তারযন্ত্র ঝুলিয়ে, মেটাল বাস দুন্দুভির সঙ্গে 'প্রাণশক্তি'র প্রেরণা প্রচুর শারীরিক লম্ফঝম্প যোগ করে ফেলে অনেকেই কবির গান আজকের শ্রোতার কাছে প্রাসঙ্গিক করে তুলতে চান। অন্য একটা একটা ফ্যাসাদ, 'রাগভিত্তিক' রবীন্দ্রসঙ্গীত নামে একটা জঁর তৈরি করতে চাওয়া। এরকম চলতে থাকলে অবিলম্বে দেখতে পাবো 'রাগভিত্তিক' মোজার্ট বা শোঁপ্যা'র কম্পোজিশন নিয়ে জনতা কাজ শুরু করে দিয়েছে।'নতুন কিছু করো' সহ্য হবার একটা সীমা থাকে।

এই প্রসঙ্গে দেখি বছর দুয়েক আগে এক কর্মশালায় বিশিষ্ট শিল্পী প্রমিতা মল্লিক আজকের অনুরাগী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু পথনির্দেশ দিয়েছিলেন।

"...দ্বিতীয় দিনে শিল্পী প্রমিতা মল্লিকের কাছে শিক্ষার্থীদের আশা কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে। একশো বছর আগের লেখা কবিগুরুর ‘ওরে আমার হৃদয় আমার’ গান দিয়ে শুরু করেন কর্মসূচি। দাদরা তালে গানটির লাইন ধরে অর্থ, গানের মূল বিষয়, গানটির পিছনের ঘটনা এবং ওই সময় কী কী গান কবি রচনা করেছিলেন, সবটাই আলোচনায় তুলে আনেন। গান শুরুর আগে শোনান ১৯১৪ সালের কবির নৈরাশ্যের এক চিঠি। কাকে লেখা সেই চিঠি, নৈরাশ্য কেটে যাওয়ার পরে কী গান তিনি রচনা করেছিলেন সবই জানিয়েছেন। এই প্রসঙ্গ আনতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গেলে আগে নজর রাখা উচিত কোথায় গাইছি, কেমন শ্রোতা আর গান নির্বাচনের কথা। ১৮৯৬ সালের মাঘোৎসবে গাওয়া বিলম্বিত ত্রিতালে ভাঙাগান ‘মহাবিশ্বে মহাকাশে’ গানটিও শেখান শিল্পী।"

(রবীন্দ্রসঙ্গীত কর্মশালাঃ আরও শেখার চাহিদা থেকেই গেল-পাপিয়া মিত্র/ খবরonline, ১৮/০৮/২০১৬)


কবির গান একান্তভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি শিল্পরীতি এবং তার ধরনটা একটা স্বীকৃত স্ট্রাকচার মেনে চলে। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে নানা অধিকারীর নিজস্ব ব্যাখ্যার মধ্যে কবি'র প্রতি যথেষ্ট আনুগত্য ও নিষ্ঠা হয়তো থাকে। কিন্তু বহু সময়েই সুর ও অন্যান্য প্রয়োগের দিকগুলি নিয়ে ময়নাতদন্ত করতে গিয়ে নিজস্ব অবস্থানটি অনেক বেশি জোরালো হয়ে যায়। গুণী ও সমর্থ শিল্পীদের গায়ন অবস্থানগুলি শ্রোতাদের কাছে সচরাচর লোকপ্রিয় হয়ে থাকে। কিন্তু যতো গুণী অধিকারীই হোন না কেন, তিনি কবির অবস্থানের উর্ধে যেতে পারেননা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি নিজস্ব অবস্থান প্রকট করার আগে বিষয়টি নিয়ে কবির বক্তব্য অনুধাবন করাটা প্রয়োজনীয়। নতুনত্বের খাতিরে তদ্গত, আত্মগত বা উৎকেন্দ্রিক যে অবস্থানই নেওয়া হোক না কেন, তা যেন কবিকে অতিক্রম না করে ফেলে।


শুধুমাত্র 'সময়ের দাবি' বা 'জনরুচির চাহিদা' জাতীয় কিছু বিমূর্ত কারণ রবীন্দ্রসঙ্গীতের জন্য যদি প্রযুক্ত নাই হয়, তবে ক্ষতি কী? সবাই জানে রবীন্দ্রসঙ্গীত কারও 'বাপের সম্পত্তি' নয়। কিন্তু পূর্বপুরুষের ইচ্ছাটাও যেন উত্তরপুরুষের বিবেকের কাছে নস্যাৎ না হয়ে যায়, এটা তো খুব বড়ো কিছু প্রত্যাশা নয়। কবি কেন নীচে উদ্ধৃত এই উক্তিটি করেছিলেন, আজ তা প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বড়ো বেশি হয়েই মনে বাজছে তার তাৎপর্য।

" ...আমার গান যাতে আমার গান ব’লে মনে হয় এইটি তোমরা কোরো। আরো হাজারো গান হয়তো আছে-তাদের মাটি করে দাও-না,আমার দুঃখ নেই। কিন্তু তোমাদের কাছে আমার মিনতি–তোমাদের গান যেন আমার গানের কাছাকাছি হয়, যেন শুনে আমিও আমার গান বলে চিনতে পারি। এখন এমন হয় যে, আমার গান শুনে নিজের গান কিনা বুঝতে পারি না। মনে হয় কথাটা যেন আমার, সুরটা যেন নয়। নিজে রচনা করলুম, পরের মুখে নষ্ট হচ্ছে, এ যেন অসহ্য। মেয়েকে অপাত্রে দিলে যেমন সব-কিছু সইতে হয়, এও যেন আমার পক্ষে সেই রকম।

বুলাবাবু, তোমার কাছে সানুনয় অনুরোধ–এঁদের একটু দরদ দিয়ে, একটু রস দিয়ে গান শিখিয়ো-এইটেই আমার গানের বিশেষত্ব। তার উপরে তোমরা যদি স্টিম রোলার চালিয়ে দাও, আমার গান চেপ্টা হয়ে যাবে। আমার গানে যাতে একটু রস থাকে, তান থাকে, দরদ থাকে ও মীড় থাকে, তার চেষ্টা তুমি কোরো।"
(গীতালি- ৩০ জুন ১৯৪০, ১৬ আষাঢ় ১৩৪৭)


আমাদের অধুনা প্রজন্মের বিবেকপ্রহরী কবি শঙ্খ ঘোষ। এই মনস্বীশ্রেষ্ঠ মানুষটি যখন গুরুর থেকে পাওয়া উত্তরাধিকার 'বিশ্বাস হারানো পাপ'প্রত্যয়ে অবিচল থাকতে পারেন না, তখন অনুজদের জন্য শুভবোধের প্রতি বিশ্বাসযোগ্য থাকার চ্যালেঞ্জটিও বেড়ে যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের শ্রেষ্ঠতম উত্তরাধিকারের একটি। আমরা যেন সেই পতাকাবহনের শক্তি অর্জন করতে পারি।

'এখানে আমাকে তুমি কিসের দীক্ষায় রেখে গেছ?
এ কোন জগৎ আজ গড়ে দিতে চাও চারদিকে?
এ তো আমাদের কোনো যোগ্য ভূমি নয়, এর গায়ে
সোনার ঝলক দেখে আমাদের চোখ যাবে পুড়ে।

বুঝি না কখনো ঠিক এরা কোন নিজের ভাষায়
কথা কয়, গান গায়, কী ভাষায় হেসে উঠে এরা
পিষে ধরে আমাদের গ্রামীণ নিশ্বাস, সজলতা,
কী ভাষায় আমাদের একান্ত বাঁচাও হলো পাপ।

আমার ভাইয়ের মুখ মনে পড়ে। গ্রামের অশথ
মনে পড়ে। তাকে আর এনো না কখনো এইখানে।
এইখানে এলে তার হৃদয় পাণ্ডুর হয়ে যাবে
এইখানে এলে তার বিশ্বাস বধির হয়ে যাবে

বুকের ভিতরে শুধু ক্ষত দেবে রাত্রির খোয়াই।
আমার পৃথিবী নয় এইসব ছাতিম শিরীষ
সব ফেলে যাব বলে প্রস্তুত হয়েছি, শুধু জেনো
আমার বিশ্বাস আজও কিছু বেঁচে আছে, তাই হব
পঁচিশে বৈশাখ কিংবা বাইশে শ্রাবণে আত্মঘাতী।'
(আত্মঘাত - শঙ্খ ঘোষ)


(শেষ)
0
undefined undefined undefined

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ১৩
শিবাংশু দে 

ওগো কাঙাল আমারে…


এঁর গাওয়া গানের মহিমা বুঝতে বোধ হয় নিজেকে কিছুটা প্রস্তুত করতে হয়। তার মানে এর মধ্যে কোনও এলিটিস্ট দাগ কাটার কিছু নেই। রবীন্দ্রসঙ্গীতনামক শিল্পটি কীভাবে পরিবেশন করা যায়, সে বিষয়ে তাঁর নিজস্ব কিছু ধারণা ছিলো। তাঁর গায়নভঙ্গির সঙ্গে হিমালয়প্রমাণ পূর্বসূরিদের পরিবেশিতলোকপ্রিয় ধারাগুলির ফারাকটি প্রথম থেকেই বেশ স্পষ্ট। প্রথমত তাঁর কণ্ঠসম্পদ। দার্ঢ্য ও সুরের কারুকাজ একসঙ্গে এভাবে শ্রোতারা শোনেননি আগে।আমাদের বাল্যকালে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওনার রবীন্দ্রসংগীত পরিবেশনকে মন্দিরের কারুকার্যের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন সনাতন পাঠক নামেরআড়ালে। উপমাটি নিয়ে একটু ভাবা যেতে পারে। কাশ্মিরি শালের কারুকাজ বা স্বর্ণালংকারের কারুনৈপুণ্য দুইই সূক্ষ্মতার পরিমাপ হিসেবে গ্রহণ করা যায়।যদিও বস্তুগত ও চরিত্রগতভাবে উভয়ের মধ্যে অনেক ফারাক আছে। কিন্তু পাথর কেটে, খোদন করে যে কারুকাজ, তার মহিমা আলাদা। আপন সৃষ্টিরমধ্যে পাথরের ভাস্কর্যের অভিঘাত নিয়ে আসতে পারা নিপুণতম স্বর্ণকারের পক্ষেও অসম্ভব। কারু ও চারুনৈপুণ্যে অবারিত দক্ষতা থাকলেও ঋতু গুহেরগায়নভঙ্গির অভিঘাত তাঁর সমসময়ে বা পূর্বজ নারীকণ্ঠে অন্য সিদ্ধ শিল্পীরা এনে দিতে পারেননি। বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে তাঁর কণ্ঠস্বরের প্রধান অবলম্বন ছিলো গভীর জোয়ারির প্লবতা। কখনও কখনও দেখা যায় শিল্পীরা জোয়ারিকে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে পরিবেশনার সময় সুরের পর্দার সূক্ষ্মতাব্যাহত হয়। বিশ্রুত ও প্রিয় শিল্পী অশোকতরু বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিবেশনায় এই চ্যুতিটি দেখা যেতো কখনও। কিন্তু ঋতু সুর লাগানোর সময় অত্যন্ত সতর্কথাকতেন। তাঁর সহজাত 'ভরাট' কণ্ঠের 'চাপ' সুরস্থানকে যেন প্রভাবিত না করে সে বিষয়ে সজাগ থাকতেন। সুরপ্রয়োগ ও উচ্চারণের ক্ষেত্রে তাঁর 'শুদ্ধ' থাকতে চাওয়ার আকুলতা রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়নশৈলিতে একটি নতুন মাত্রা যোজনা করে। 

সাক্ষাতে ওঁর গান প্রথম শুনি জামশেদপুরে, একাত্তর সালে। তখনও ঠিক গান শোনার তালিম হয়নি আমার। প্রথম শোনা যে গানগুলি এখনও আমার মনেআছে, ' তুমি খুশি থাকো', 'খেলার সাথি' ও 'তোমার সোনার থালায়'। তখন রবীন্দ্রসংগীত বলতে যে ছাঁচটি মাথায় ছিলো, সেখানে শেষ কথা ছিলেন, সুচিত্রা,দেবব্রত এবং হেমন্ত। ঋতু ছিলেন সেই বৃত্তের বাইরের মানুষ। সত্যিকথা বলতে আমার তো বটেই, আমার মতো অনেক সাধারণ শ্রোতার কাছেও ঐ শৈলীহয়তো একটু অধিক মাত্রায় নির্জল শুদ্ধ, অতি নিবিষ্ট বোধ হতে পারে। কিন্তু তিনি যখন 'তোমার সোনার থালায়' গানে নিজেকে প্রকাশ করেন, সেইব্যাকুলতাতাঁর কণ্ঠে জারিত হয়ে শ্রোতার সংবেদনশীলতাকে অজান্তেই যেভাবে নাড়া দিয়ে যায়, তার সমান্তরাল, অন্য উদাহরণ এখনও বিরল।


কলকাতাকেন্দ্রিক রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার সত্রগুলির মধ্যে অন্যতম প্রধান নাম 'দক্ষিণী'। তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের গান গাওয়ার ধরন ছিলো একটু অন্যরকম।অনেক শ্রোতাই ঐ লক্ষণগুলি নিয়ে স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। কোনও কোনও দক্ষিণীর গায়ককে দেখা যেতো যতোক্ষণ কথাবার্তা বলছেন ততোক্ষণ বেশ সহজ,স্বাভাবিক। কিন্তু যেই গান গাইতে শুরু করলেন, তখন যাকে বলে গালে মার্বেলগুলি নিয়ে গাওয়া, সেরকম একটা কৃত্রিমতা প্রকট হয়ে উঠতো। আমরাতখন ইতরযানী শ্রোতা। সর্বসমক্ষে মনের কথা বলার মতো আত্মবিশ্বাস অর্জন করে উঠতে পারিনি। নিজেদের মধ্যেই বলাবলি করতাম। দক্ষিণীর ট্রেনিংকেনিরেস বলার হিম্মত ছিলোনা। সম্ভবত তার প্রধান কারণ, একা ঋতু গুহ। ঋতু যখন মঞ্চে বসে কোনরকম ভূমিকা ছাড়াই সূত্রপাত করতেন, 'তুমি যেএসেছো মোর ভবনে....'। সেই আঁচলটি গায়ে জড়িয়ে, একটু উন্নত গ্রীবায়, শান্ত মুখশ্রী নিয়ে। স্পষ্ট উচ্চারণ, স্পষ্টতর স্বরনিক্ষেপ, অভ্রান্ত সুরসংস্থান। প্রথমগানটি থেকেই তিনি কেন প্রবাদপ্রতিম ঋতু গুহ সেই সত্যটি প্রতিষ্ঠা করতে পারতেন। আমরা ভাব্তুম কীভাবে, যে তথাকথিত মুদ্রাদোষগুলি দক্ষিণীর ট্রেডমার্ক, সেই 'দোষ'গুলি 'গুণ' হয়ে উঠছে ওনার পরিবেশনায়, সেটাই আমাদের মতো শ্রোতাদের কাছে শিক্ষনীয়। চূড়ান্তভাবে স্বরলিপিনিষ্ঠ হয়ে, কোনওরকম আপোস না করে, গানে অবলীলায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধি তিনি আয়ত্ব করেছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতে দক্ষিণীর শ্রেষ্ঠ অবদান তিনি। তাঁর অনেক গানএকটু অপ্রচলিত, কিন্তু তার অধিকাংশই তাঁর গায়নের গুণে আমাদের প্রিয় গান হয়ে উঠেছে। যখন 'গভীর রজনী নামিল হৃদয়ে' গাইছেন এবং তার পরেইচলে যাচ্ছেন 'আহা, আঁখি জুড়ালো হেরিয়ে' দুটি গানই একেবারে ভিন্ন ধরন ও চলনের উদাহরণ, কিন্তু পরিবেশনার মধ্যে একধরনের ক্ল্যাসিসিজম ফুটেউঠছে। কোনও রকম প্রগলভতার স্থান নেই। আজকের প্রজন্মে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনার মধ্যে অকারণ প্রগলভতার প্রাদুর্ভাব ও প্রিয়তা অনেক সময় ভুলসংকেত বহন করে আনে। অনুষ্ঠানের শেষে যখন তিনি শ্রোতাদের আগ্রহ আতিশয্যে যখন 'ওগো কাঙাল' গেয়ে ওঠেন, শ্রোতাদের যেন আর কিছু চাওয়ার বাকি নেই।


গত শতকের ষাট-সত্তর দশক থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চার যে নিবিষ্ট যুগটি আমরা লক্ষ্য করি তার সঙ্গে পরবর্তী যুগটির সেতুবন্ধ হিসেবে আমরা ঋতু গুহেরগায়ন'কে রাখতে পারি। পরবর্তী যুগ বলতে আমি নাম করতে পারি সে সময়ের তিনজন মুখ্য প্রতিনিধির। শ্রীমতী পূর্বা দাম, প্রয়াতা রমা মন্ডল এবং শ্রীমতীপ্রমিতা মল্লিক। এঁরা সবাই সুচিত্রা মিত্রের ছাত্রী। পূর্ববর্তী প্রধান শিল্পীরা যেমন রাজেশ্বরী দত্ত, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র, নীলিমা সেন, সুমিত্রা সেন,গীতা সেন, সঙ্ঘমিত্রা গুপ্ত, পূরবী মুখোপাধ্যায়, বনানী ঘোষ প্রমুখ, প্রত্যেকেই নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। এঁরা সবাই মোটামুটি এক প্রজন্মের। কিন্তুযেভাবে প্রত্যেক ছোটোবড়ো নদী স্রোত, যারা স্বভাবে হয়তো একান্ত আলাদা, সৌন্দর্যে ভিন্ন মাত্রার, যখন গঙ্গার মূলস্রোতে এসে মেশে, তাদের আর আলাদাকোনও অস্তিত্ব থাকেনা। এঁদের সৃষ্টিধারাও সেভাবে শ্রোতাদের মজিয়ে এসেছে নিজস্ব শৈলীর গৌরবে, দীর্ঘকাল ধরে, কিন্তু দিনের শেষে যে গানের রেশটিমনে থেকে যায় সেটি নিছক রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি এঁদের সমর্পণ। তাঁদের মধ্যে ঋতু ছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতে গভীরভাবে সমর্পিত একটি অনন্য গৌরবস্তম্ভ।


আমি হেথায় থাকি শুধু গাইতে তোমার গান

রবীন্দ্রসঙ্গীতে উত্তম পুরুষকণ্ঠের অধিকারী, সমর্থ শিল্পীর অভাব চিরকালই রয়েছে। নব্বই দশক থেকে যখন আকালটি তুঙ্গে উঠছিলো, একজন শিল্পীকে দেখেছি একা রবীন্দ্রসঙ্গীতের গ্রহণযোগ্যতা ও পরিবেশনের মান'কে ধরে রাখতে সক্রিয়ভাবে যত্নপর ছিলেন। তাঁর গান প্রথম শোনার পর থেকেই, শ্রোতা হিসেবে তাঁর গীত সমস্ত গান মুগ্ধ হয়ে শুনেছি। একজন বড়ো শিল্পীর মতো সীমাবদ্ধতাকে পাত্তা না দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের একটি সমন্বিত ধারা,যেখানে শান্তিদেবের স্ফূর্তি উৎসারিত হয় সুবিনয়ের ঋদ্ধ সুরবিন্যাসে। আমরা তাঁর থেকে শুনি এক নতুনধরণের একালের রবীন্দ্রসঙ্গীত, যেখানে হাত কেটে বা পা ছেঁটে নতুন হবার বহ্বাড়ম্বর নেই। হ্যাঁ, আমি বলছি মোহন সিং খঙ্গুরার কথা।


তিনি প্রায় আকৈশোর শান্তিনিকেতনবাসী। শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যে নারীকণ্ঠের কিন্নরী শিল্পীর সংখ্যা পরুষদার্ঢ্যের কণ্ঠশিল্পীর থেকে বেশ অধিক। সত্যিকথা বলতে অশোকতরু ছাড়া এই মূহুর্তে আর কারো নাম মনে পড়ছে না। পরিশীলিত‚ সুরেলা কণ্ঠ‚ গভীর প্রস্তুতি ও ধীমান পরিবেশনা‚পুরুষশিল্পীদের মধ্যে এই সব লক্ষণ অবিরল না হলেও কয়েকজন শিল্পী নিশ্চয় ছিলেন যাঁরা এই শিল্পরীতিটিকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন। রসিকজনের আকাঙ্খা পূর্ণ করার ক্ষমতা তাঁদের ছিলো। কিন্তু পঙ্কজকুমারের ঘরানা পূর্ণতা পাবার পর‚ সাধারণ শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের এক অন্যতর শৈলি লোকপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই লোকপ্রিয়তা রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বনিযুক্ত অভিভাবকদের নির্দেশিত শুদ্ধতার মাত্রাবোধকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ জানায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত যে শুধু নিভৃত গৃহকোণে গুনগুনানো নিজের মুদ্রাদোষে একলা হয়ে থাকা এককের গান নয় বা ব্রাহ্মমন্দিরের যান্ত্রিক ভক্তসম্পূট‚ সেই অবস্থানটি শক্তি পেয়েছিলো পঙ্কজকুমারের আজীবন প্রয়াসে। তিনি এতো অধিকমাত্রায় রবিসঞ্জীবিত ছিলেন যে হয়তো সম্পূর্ণভাবে নিজেও বোঝেননি‚ ভবিষ্যতের দেওয়াল লিখন তাঁর সঙ্গীতভাবনাকেই স্বাগত জানাবে। কথাপ্রসঙ্গে একটি শব্দ দিয়ে মোহন সিং রবীন্দ্রসঙ্গীতকে বোঝাতে তৎপর হয়েছিলেন‚যার অমোঘত্ব প্রশ্নহীন। কিন্তু হয়তো আজকের দিনেও অনেকের মনে তা নিয়ে দ্বিধা থাকতে পারে। শব্দটি ছিলো 'ম্যাজেস্টিক'।


তাঁর প্রথাবদ্ধ সঙ্গীতশিক্ষা মূলতঃ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে। রবীন্দ্রসঙ্গীতে আগ্রহী হয়েছিলেন পরবর্তীকালে। তাঁর শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে গভীরপাঠ তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এক ভিন্ন গরিমা দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারে তিনি শুধু পথিকৃৎই ন'ন‚ এখনও একম অদ্বিতীয়ম। গত একশো বছর ধরে বিভিন্ন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকারেরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়েছেন। এখনও কেউ কেউ গেয়ে থাকেন। কিন্তু তা একান্তভাবে তাঁদেরই গান হয়ে থেকে যায়‚ রবীন্দ্রনাথের গান হয়ে উঠতে পারেনা। এই ঘটনাটি আমার বিস্ময় উদ্রেক করে। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গীতশিক্ষার ভিত্তি চারতুকের ধ্রুপদ ফরম্যাটে। সামান্য কিছু ব্যতিরেকে তাঁর প্রায় সব গানই চারতুকের রচনা। অর্থাৎ ধ্রুপদের পরিমার্জিত অনুশাসন কখনও রোদের মতো‚ কখনও ছায়ার মতো‚ তাঁর গানকে অনুসরন করে চলে। কিন্তু প্রথাগত ধ্রুপদ বা অন্য আঙ্গিকে শিক্ষিত শাস্ত্রীয় কণ্ঠশিল্পীরা যখন তাঁর গান গাওয়ার প্রয়াস করেন‚ সেখানে রবীন্দ্রসৃষ্টির পরিমার্জনা প্রকৃত প্রস্তাবে সঞ্চারিত হয়না । সে‚ শিল্পী রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হো'ন বা অজয় চক্রবর্তী‚ ঘটনাটি একই থাকে।


মোহনদার কণ্ঠসঙ্গীতে তালিম পণ্ডিত ধ্রুবতারা যোশিজির কাছে। তার সঙ্গে পণ্ডিত অশেষ বন্দোপাধ্যায় আর পণ্ডিত ওয়াঝেলওয়ারের শিক্ষা। এটওয়া‚ আগ্রা‚ বিষ্ণুপুর‚ সমস্ত ঘরানার মণিমুক্তো সংগ্রহ করে তিনি তাঁর ভাণ্ডার পূর্ণ করেছিলেন। পেশাগতভাবেও তিনি দীর্ঘকাল যুক্ত উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের সঙ্গে। কিন্তু যখন তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের আঙিনায় যখন পা রাখেন তখনও আত্মবিশ্বাস সমানভাবে স্ফূরিত হয়। তিনি বলেছেন তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীতের দীক্ষা দু'জনের কাছে, শান্তিদেব ও কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই দু'জন শর্তহীনভাবে তাঁর পথপ্রদর্শন করে গেছেন। এই মূহুর্তে যাঁরা ক্রিয়াশীল শিল্পী রয়েছেন,তাঁদের মধ্যে মোহন সিং অনন্য।


মোহনদা'ই এখনও একজন ব্যতিক্রমী শিল্পী। তাঁর শাস্ত্রীয় শিক্ষার গভীরতা ও রবীন্দ্রনাথে একান্ত সমর্পণ এবং তার সঙ্গে কণ্ঠসম্পদ‚ তাঁর গীত রবীন্দ্রসঙ্গীতকে এক অন্যতর মাত্রা এনে দেয়। তিনি একাধারে শান্তিদেবের স্ফূর্তি‚ সুবিনয়ের নিষ্ঠা এবং পঙ্কজকুমারের ঔদাত্ত আত্মস্থ করেছেন। এই গরিমাটি আমরা অন্য কোনও শিল্পীর মধ্যে পাইনি।

রবীন্দ্রসঙ্গীতে'ম্যাজেস্টিক' শব্দটির প্রয়োগ কীভাবে হয়‚ তিনি নিজে তার মূর্ত উদাহরণ।

0
undefined undefined undefined

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in

ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন জেনএক্স রকেটপ্যাড- ১২
শিবাংশু দে



'এই দুর্ভাগা দেশকে আপনার কণ্ঠমাধুরী ও কলাসিদ্ধির দ্বারা আনন্দিত করুন, সুস্থ করুন। বিশেষত যখন রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি শ্যামার কথা ভাবি তখন আমি অভিভূত হয়ে যাই। এই সূক্ষ্ণ জটিল নানাবিপরীত অনুভূতির টানাপোড়েনে ক্ষতবিক্ষত নারীকে আপনি ছাড়া আর কে এমন সার্থক রূপ দিতে পারত? এই পাপিষ্ঠাকে রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্জ ট্রাজিক মহিমা দান করেছেন। কিন্তু আমাদের ও কবিরমাঝখানে একজন interpreter আবশ্যক ছ্ল। সেই সুযোগ্য interpreter কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। আপনার কাছ থেকে আমরা অনেক পেয়েছি।'

(একটি চিঠিতে আবু সয়ীদ আইয়ুব)


'শান্তিনিকেতনে প্রকৃতির আশ্রয়ে বড় হয়ে উঠেছি আমি। আমার সম্পদ রবীন্দ্রনাথের গান…আমার জীবন, আমার গান, আমার বেড়ে ওঠা, আমার বেঁচে থাকা, আমার আনন্দ-বেদনার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবেজড়িত হয়ে আছে শুধু রবীন্দ্রনাথের নয়, আমারও একান্ত শান্তিনিকেতন।'

লিখেছিলেন তিনি। মনে হয় এর থেকে নিখুঁতভাবে তাঁর সাঙ্গীতিক জীবনের পরিপ্রেক্ষিতটিকে বর্ণনা করা যায়না। একজন শিল্পী কী জন্য একটি বিশেষ শিল্পমাধ্যমকে আত্মস্থ করেন, তার নানা কারণথাকতে পারে। প্রথম শর্ত তো অবশ্যই শিল্পটিকে ভালোবাসা। কিন্তু তা একা যথেষ্ট নয়। শিল্পের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশের যে ইচ্ছে, তা সফল হবার আগে নানা রকম ব্যক্তিগত সংগ্রাম, অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে দিয়েযেতে হয় ইচ্ছুক ব্যক্তিটিকে। এই যুদ্ধ বহিরঙ্গে হতে পারে, অন্তরঙ্গেও। যাঁরা পেশা হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীত নামক শিল্পমাধ্যমটিকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের সামনে ছিলো অনন্ত চ্যালেঞ্জ।

দেবব্রত বিশ্বাস বা সুচিত্রা মিত্রের লড়াইটি দেখলে তার কিছু সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। এতোটা খ্যাতনাম যাঁরা ন'ন, সেরকম বহু নিবেদিত রবীন্দ্রসঙ্গীত সাধকদেরও পেরিয়ে আসতে হয়েছিলো পতন-অভ্যুদয়বন্ধুর পন্থা। যে চর্যাটি তাঁকে বিক্ষিপ্ত করেনি। তিনি আশ্রমবালিকার অমলিন সারল্যকে পুঁজি করে এগিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর গানের সেটাই প্রধানতম লক্ষণ। তাঁর অনর্গল পরিবেশনার ভিত্তিভূমি।


১৯৩৫ সালে পিতৃদত্ত 'অণিমা' নামটি বদলে 'কণিকা' রেখেছিলেন স্বয়ং কবি। তাঁর ইচ্ছাপত্রের সঙ্গে কবি আরও লিখেছিলেন

' আমার নামের আখরে জড়ায়ে আশীর্ব্বচনখানি ,
তোমার খাতার পাতায় দিলাম আমি।'

এই ঘটনাটি উল্লেখ করা জরুরি। স্বয়ং কবি ও তাঁর শান্তিনিকেতনের সঙ্গে কণিকার অঙ্গীকৃত অস্তিত্ত্বটিই তাঁর জীবনের চালিকাশক্তি। বাকি সব কিছু নিতান্ত গৌণ, অপ্রয়োজনীয়। তাঁর দাদামশাইরাজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯০২ সাল থেকে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর সূত্রে তাঁদের পরিবারের বহু সদস্যই পরবর্তী প্রজন্মে শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর সঙ্গেনানাভাবে যুক্ত ছিলেন। মায়ের ডাকনাম সোনা, দিদির গিনি, তাই তিনি মোহর। শান্তিনিকেতনে আদি গুরুপল্লীতে পাশাপাশি খোড়োচালের মাটির কুঁড়েঘরে থাকতেন নন্দলাল বসু, প্রভাতকুমারমুখোপাধ্যায়, প্রমদারঞ্জন ঘোষ, জগদানন্দ রায়, হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্ষিতিমোহন সেন, নেপালচন্দ্র রায়, নিত্যানন্দ গোস্বামী, সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়। সত্যচরণ মোহরের পিতৃদেব। রবীন্দ্রপ্রভাবে মগ্ন এইমানুষগুলি পরবর্তীকালে আমাদের সভ্যতার বাতিঘর হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন। প্রাচীন আর্ষ ইতিহাসে চিরকালীন আশ্রমিকজীবনের যে বর্ণনা দেখতে পাওয়া যায়, অবিকল সেই ছাঁচে কবি গড়েছিলেনশান্তিনিকেতনে তাঁর 'স্বর্গরাজ্য'। যেখানে কাঞ্চনমূল্যে কিছুই মাপা হতোনা। প্রতিভা ও সৃজনশীলতাই ছিলো মানুষকে মূল্যায়ণের চাবিকাঠি। এই রকম একটি আবহ থেকে রস আহরণ করে যে যাপনটিগড়ে ওঠে তার স্বরূপটি ভিন্ন তো হবেই। 


শৈশবে এক কালবৈশাখীর সন্ধে বেলা বৃষ্টি থেকে বাঁচতে দুটি মেয়ে 'শ্যামলী'র বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিলো। সেখানে তারা দেখতে পায় জানালার পাশে একজন 'সাদা চুল, সাদা গোঁফ-দাড়ি, বড় বড় চোখ।যেন তুলি দিয়ে আঁকা' মানুষ বাইরের বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। কিন্তু কিছুই যেন দেখছেন না। একটু পরে শিশুদুটি তাঁর নজরে পড়ে। তিনি তাদের ডেকে পাঠান। প্রশ্ন করেন, 'গান জানিস?' তাঁদেরমধ্যে একজন শিশু পরবর্তীকালে লিখেছেন, ' তিনি গান শোনাতে বললেন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে শুনিয়ে দিলুম। কোনও দ্বিধা বা জড়তা কাজ করেনি। তিনি যে আমার কাছে গান শুনতে চেয়েছেন, তাতেইআমি ডগোমগো। আর, শান্তিনিকেতনের মাটিতে আমার কোনও লজ্জা ছিল না গান গাওয়ার। এটা তো আমাদেরই জায়গা। ঘুরতে, ফিরতে গান করি। গুরুদেবকেও শুনিয়ে দিলাম সদ্য শেখা একখানাগান। মনে হল, তিনি খুশি হয়েছেন। ‘…. কালবৈশাখীর বিকেলের এই একটুকরো ঘটনায় যেন অনেকখানি পাল্টে গেলাম আমি।' কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নপদ্ধতি বা কৌশল নিয়ে বিচারকরতে গেলে এইসব পটভূমি স্মরণে রাখতে হবে।


তেরো বছর বয়সে, ১৯৩৮ সালে তাঁর প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়। না, রবীন্দ্রসঙ্গীত নয়। নীহারবিন্দু সেনের লেখা, হরিপদ চট্টোপাধ্যায়ের সুরে দু'টি গান। তার পরে একটি গীতিনাট্যে কণ্ঠ দেন 'কুমারীকণিকা'। সে বছরই তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রাকাশ পায়। 'ডাকব না, ডাকব না' আর 'মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে'। হিন্দুস্তান রেকর্ডের 'রেকর্ড পরিচয়ে' বলা হয়েছিলো 'কুমারী কণিকা মুখার্জিরপ্রথম রেকর্ডখানি সকলের তৃপ্তি সাধন করিয়াছে। এবার তাহার আর একখানি রেকর্ড বাহির হইল। এই গান দুখানি শুনিয়া সকলেই প্রীতিলাভ করিবেন।'


১৯৩৯ সাল থেকে কণিকাগীত রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড মোটামুটি নিয়মিত প্রকাশ হতে থাকে। ১৯৩৯ সালে 'ঐ মালতীলতা দোলে' এবং 'ঘরেতে ভ্রমর এল'। ১৯৪২শে 'ওগো তুমি পঞ্চদশী' ও 'এসোশ্যামলসুন্দর'। প্রথম রেকর্ডের গান থেকে ধরলে তাঁর সক্রিয় গায়নজীবনের বিস্তার পঞ্চান্ন বছর। দেশে-বিদেশে নানা সংস্থা তাঁর রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি ইত্যাদি প্রকাশ করেছে। সংখ্যাগতভাবে তাঁর ডিস্কোগ্র্যাফির নিখুঁত হিসেবে করা সম্ভব নয়। এতো জায়গায় এতোভাবে তারা ছড়িয়ে আছে যে সংবদ্ধ সূচি সংকলন করা শ্রম ও গবেষণাসাপেক্ষ। এগুলি অবশ্য নিতান্ত 'কাজের কথা'। পরিসংখ্যান দিয়েআমাদের মননে কণিকার ছড়ানো রাজ্যের পরিধি ঠিক মাপা যায়না।

প্রথম পর্যায়ে আমরা দেখেছি তিনি শৈশব কালেই স্বয়ং কবির নির্দেশে নতুন গান শিখে নিতেন। শুধু তাই নয়, কবির সঙ্গে তিনি সারাদেশে বিশ্বভারতীর দলের সঙ্গে গান গেয়ে বেড়াতেন। ১৯৪০ সালেবোলপুরে টেলিফোন কেন্দ্রের উদ্বোধন উপলক্ষে যে অনুষ্ঠান হয়েছিলো, সেখানে কবি তাঁর স্নেহের মোহরকে আলাদা করে 'ওগো তুমি পঞ্চদশী' শিখিয়েছিলেন। এই অনুষ্ঠানটির প্রায় তিন বছর আগে১৯৩৭ সালে স্বয়ং কবির সঙ্গে তিনি কলকাতায় প্রথম অনুষ্ঠান করতে আসেন। তাঁর বয়স তখন তেরো। কলকাতায় জোড়াসাঁকো বাড়ির এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত ঘুরে বেড়াতেন। যে অনুষ্ঠানে গান গাইতে তাঁরকলকাতায় আসা, তার শীর্ষক ছিলো 'বর্ষামঙ্গল'। সেখানে শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের সঙ্গে কলকাতার শিল্পীরাও আসতেন। তাঁদের জমকালো শাড়ি আর বিভিন্ন সুরভির ব্যবহার শান্তিনিকেতন থেকে আসাবালিকা মোহরের জন্য ছিলো একটি চমক। যদিও সেবার মঞ্চে 'ছায়া ঘনাইছে বনে বনে' গাইবার সময় শুনতে পান স্বয়ং কবি তাঁর সঙ্গে গাইছেন। সেই অনন্য অভিজ্ঞতা ছপিয়ে কিন্তু তাঁর মনে থেকেগিয়েছিলো কলকাতার লোকের জাঁকজমক। পরিণত বয়সে স্বীকার করেছিলেন 'কলকাতা নিয়ে ভীতি আমার কখনও কাটেনি।' এই স্বীকারোক্তিটি তাঁর শিল্পীসত্ত্বা ব্যাখ্যার ক্রমে অত্যন্ত জরুরি একটি বিন্দুহতে পারে।


গানের পরিবেশ ছিলো পারিবারিক পরিমণ্ডলে। দিদিমা ভালো গান গাইতেন। বাবা এসরাজ বাজাতেন। কবির বলয়ে অংশগ্রহণ করা ছাড়াও এই সুবিধেটি মোহরের ছিলো। এছাড়া 'দিনুদা' বা 'বিবিদি'রপ্রত্যক্ষ নির্দেশনায় গান গাইবার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু শিল্পী হিসেবে তাঁকে নির্মাণ করেছিলেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার। 'নিবিড়ভাবে শিক্ষা পেয়েছি শৈলজাদা, শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে। তাঁরকথা কতবার বলেছি। তাঁর ঋণ কখনও শোধ করা যাবেনা। হাতে ধরে, বকেঝকে, ভালবেসে কতভাবে তিনি গান শিখিয়েছেন অমাকে। নিজে যতক্ষণ না সন্তুষ্ট হচ্ছেন আমার গান শুনে, ততক্ষণ আমারমুক্তি নেই। আমার ধৈর্যচ্যুতি হলেও শৈলজাদা ধৈর্য হারাতেন না কখনও।' এর সঙ্গে আবার উল্লেখ করেছেন 'শিখেছি শান্তিদার (শান্তিদেব ঘোষ) কাছে। শিখিয়েছেন খুকুদি (অমিত সেন), নুটুদি (রমা কর)।' এই তালিকা থেকে স্পষ্ট সেকালে শান্তিনিকেতনে থেকে যে শ্রেষ্ঠ তালিম ভাবা যেতে পারে, তা কণিকার অর্জন হতে পেরেছিলো। এছাড়াও তিনি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম পেয়েছিলেন হেমেন্দ্রলাল রায়, অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ভি ভি ওয়াঝেলওয়ার, পি এন চিনচোড়ে, ধ্রুবতারা যোশি প্রমুখ সুখ্যাত কলাবিদদের কাছে।

ক্ষিতিমোহন সেনের কন্যা অমিতা সেন আশৈশব মোহরকে চিনতেন। তিনি লিখেছিলেন, 'খুব ছোট থেকেই মোহরের যেমন গানের গলা, তেমনি দেখতে সুন্দর। অসম্ভব গুণী ছিল। গুরুদেবও খুবভালোবাসতেন। বড়দের সঙ্গে ওকেও ডেকে পাঠাতেন গান শিখতে, বাড়ির জানালা দিয়ে কতদিন দেখেছি মাঠের মধ্যে দিয়ে মোহর ছুটছে গুরুদেবের কাছে। রাস্তা দিয়ে যেত না, পাছে দেরি হয়ে যায়।মাঠের ধারে একটা বনপুলকের গাছ ছিল, বসন্তে ফুল ফুটলে চারিদিক ভরে উঠত। তার তল দিয়ে মোহর দৌড়াচ্ছে, তাড়াতাড়িতে ফ্রকের পিঠের সব বোতামও লাগানো হয়নি-এ ছবি আজও স্পষ্ট মনে পড়ে।'

শিল্পীসত্ত্বা বিকাশের পথে মানুষের পারিপার্শ্বিক আর আবহ বড়ো ভূমিকা পালন করে। মহানগরবাসী, যাঁরা সমষ্টির সঙ্গে ওতপ্রোত জীবনযাপন করেন, তাঁদের অনুপ্রেরণার মূলে বহির্ভুবনের ঘটনাবহুলঘাতপ্রতিঘাতের স্রোত একটি মুখ্য উৎস হয়ে দাঁড়ায়। শিল্পীর অন্দরমহল, বহিরঙ্গের প্লবতা এড়িয়ে যেতে পারেনা। বাহিরের প্রতিক্রিয়াই তাঁর আয়না। তাঁর প্রধান চ্যালেঞ্জ। কিন্তু 'আশ্রম'আবহে স্বচ্ছন্দশিল্পীর সৃজনশীলতা বিকশিত হয় অন্তরঙ্গ যাপনে। তাঁর আয়না তিনি নিজে। শিল্পের সঙ্গে তাঁর কথোপকথন, বীক্ষা বা প্রয়োগপদ্ধতি, সবই একান্তভাবে অন্তর্মুখী, আত্মমগ্ন। শিল্পীর অন্তর্মুখিন প্রস্তুতিরএকটি আদর্শ উদাহরণ কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তিনি একই সঙ্গে সারা বিশ্বজোড়া শ্রোতাসমূহের অতি প্রেয়, প্রার্থিত এবং শ্রদ্ধেয় মহান পারফর্মার। আপাতভাবে প্রায় অসম্ভব একটি সেতুবন্ধন করেন তিনি অপরিমেয় সাঙ্গীতিক সিদ্ধির জাদুমন্ত্রে। 

এই সাফল্য কিন্তু অন্তরীক্ষ থেকে ঝরে পড়েনি। আত্মকথায় তিনি লিখেছিলেন, 'খুব ছোটবেলা থেকেই সমালোচনায় কুঁকড়ে যেতাম আমি।' কিশোরী বয়সে একবার কলকাতা বেতার কেন্দ্রে খুব উৎসাহিত হয়ে গেয়েছিলেন 'মনে কী দ্বিধা রেখে গেলে চলে'। কয়েকদিন পরে একটি পত্রিকায় তাঁর গান প্রসঙ্গে লেখা হলো 'গলা বিশ্রী'। এই জাতীয় মন্তব্য পড়ে তাঁর প্রতিক্রিয়াটি ছিলো এরকম। ' আগে যেমন গান গাইতাম নিজের মনে, সেদিন যে কাঁদলাম সেও নিজের মনে, লুকিয়ে লুকিয়ে। গলা যখন 'বিশ্রী', তখন কেন সবাই গান গাইতে বলে? ঠিক করলাম কলকাতা আর যাব না। আঘাত? পরে দেখেছি সেই আঘাতটাই আমার জীবনে পুরস্কার হয়ে ফিরে এসেছে বারে বারে।'

বহিরঙ্গ আর অন্তরঙ্গ জীবনের মধ্যে যে হাটের ধূলা একজন নাগরিক শিল্পীর ক্ষেত্রে হয়তো জীবনের অঙ্গ, কিন্তু তা একটি অন্তর্মুখী আশ্রমবালিকার স্পর্শকাতরতাকে বিড়ম্বিত করে। তাঁকে নিজস্বশিল্পবস্তুকে বাজারজাত করা বা বিজ্ঞাপন করার ক্লিষ্টতা স্বীকার করতে হয়নি। তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন শান্তিনিকেতনের পরিচিত আবহে, গুণগ্রাহী শ্রোতাদের মাঝে নিজেকে প্রতিভাসিত করার অভ্যস্ত খেলায়।১৯৭৯ সালে একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, রেডিও বা রেকর্ড করতে তাঁর তখনও ভালো লাগে। কিন্তু ফাংশন বা বড়ো অনুষ্ঠানে গান গাইতে তাঁর আর ভালো লাগেনা। আমি ১৯৭৫ সালেজামশেদপুরে একটি বড়ো অনুষ্ঠানের আগে তাঁকে বলতে শুনেছি গোরা সর্বাধিকারীর উপরোধে তিনি এই সব অনুষ্ঠানে গাইতে আসেন। নিজের ভালো লাগেনা। সেই অনুষ্ঠানেই গান শুনতে গিয়ে আমারমনে হয়েছিলো তিনি খুব উৎফুল্ল বোধ করছেন না। পরিবেশনে একটি যান্ত্রিক মাত্রা কাজ করছে। সত্যি কথা বলতে কী, তিনি রেডিও ও রেকর্ড মাধ্যম দুটিতেই স্বতঃস্ফূর্ত ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠা, খ্যাতিএসেছে এই দুই মাধ্যমে পরিবেশনের সূত্রেই। সাক্ষাৎ শ্রোতা হিসেবে তাঁকে শান্তিনিকেতনেই পূর্ণ মাত্রায় পাওয়া যেতো। জনসংযোগের ক্ষেত্রে তিনি চিরকালই আড়ষ্ট বোধ করেছেন। সুচিত্রা মিত্র একবার শ্রদ্ধেয় সুধীর চক্রবর্তীকে একটি সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে বলেছিলেন 'সুদীর্ঘকাল ধরে যে গান গাইছি, গানের মাধ্যমে কি স্বদেশে কি বিদেশে যে বিভিন্ন ধরনের শ্রোতার সঙ্গে র্যাপোর্ট ঘটেছে সেটাই আমি মনেকরি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য ও স্বীকৃতি।' সুচিত্রা সহজাত উদ্দীপ্ত ভঙ্গি তাঁর সব পরিবেশনায় অন্যতর মাত্রা যোজনা করতো। কিন্তু কণিকা নিজে স্বীকার করতেন উদ্দীপনার ভাব তাঁরস্বতঃস্ফূর্তভাবে আসেনা। তিনি সহজ থাকতে পারেন টপ্পাঙ্গে বা টানা, ঢিমে তালের রবীন্দ্রসঙ্গীতে। 'নীলাঞ্জন ছায়া', 'দূরে কোথায় দূরে দূরে', 'বন্ধু রহো রহো সাথে', 'আমি রূপে তোমায় ভোলাব না', 'তবু মনে রেখো', 'বাজে করুণ সুরে' এবং এজাতীয় অসংখ্য গান তাঁর কণ্ঠে অন্য মাত্রা, অন্য অনুভূতি নিয়ে আসে।


বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যাবে কণিকার স্বাভাবিক কণ্ঠ পেলব, ললিত ও মাধুর্যময়। শৈশব থেকেই তিনি নিজের কণ্ঠ বা স্বরপ্রয়োগের সঙ্গে স্বচ্ছ্ন্দ গানগুলিতে সাফল্যলাভ করে এসেছেন। তাঁর গুরুরাওতাঁকে স্বরাজ্যে স্বরাট থাকারই শিক্ষা দিয়েছিলেন। যেসব গানের লয় বা ওজস্বিতা তাঁর কণ্ঠ বা গায়নরীতির সঙ্গে বেমানান, তিনি সাধারণভাবে সেই সব গান এড়িয়ে এসেছেন। তাঁর এই বিবেচনা তাঁকে যে শুধুস্বাচ্ছন্দ্য বা আত্মবিশ্বাস দিয়েছে তাই নয়, শ্রোতাদের জন্যও তা স্বস্তি ও শান্তির আশ্বাস বয়ে এনেছে। তাঁর অনন্যতা, অকারণ 'পরীক্ষা'র দ্বিধায় ব্যাহত হয়নি। তাঁর প্রথম জীবনের বালিকাসুলভ আধোউচ্চারণ বা অতিরিক্ত ললিত সুরক্ষেপ কীর্তনাঙ্গ গানগুলিতে মানিয়ে গেলেও পরবর্তীকালে গীত গভীর ভাব ও দ্যোতনাময় গানগুলির জন্য তা ছিলো অনুপযুক্ত। সময়ের সঙ্গে তাঁর গায়নভঙ্গি, উচ্চারণ,উদ্দীপনা ক্রমাগতভাবে পরিশীলিত হয়েছিলো। তাঁর কণ্ঠের টিম্বার অবিশ্বাস্যভাবে বয়স ও দেহকষ্টকে অস্বীকার করে একইরকম স্ফূর্ত থেকে গিয়েছিলো। তাঁর গুণমুগ্ধ অপার শ্রোতাসমূহ কখনও তাঁরনিবেদনে বিন্দুমাত্র আলস্য বা আতিশয্য খুঁজে পায়নি।


তাঁর স্বভাবধর্ম সমকালীন শান্তিনিকেতনের স্থিতধী, শান্তিকল্যাণ আবহের পুণ্যে গড়ে উঠেছিলো। বহির্জগতের ঘটনার ঘনঘটা বা অস্থির চাঞ্চল্য, তাঁর আত্মমগ্ন শিল্পীসত্ত্বার অন্দরমহলে কখনও বিড়ম্বনা ঘটায়নি। ফলত তাঁর গীতনিবেদনে স্থৈর্য, শান্তি বা স্বস্তির ইশারা সর্বময়। শ্রোতাদের বিক্ষিপ্ত, অশান্ত চিত্ত বা শ্রবণে তা শুশ্রূষার আশ্বাস এনে দিতো। তাঁর এই সিদ্ধির গভীরে ছিলো আজন্মকাল কবিপ্রস্তাবিত'আনন্দ সর্বকাজে' মন্ত্রটির প্রতি প্রশ্নহীন সমর্পণ। শান্তিনিকেতন নামক ছোট্টো ভৌগলিক আবেষ্টনীটির মধ্যে সারাবিশ্বকে নীড় বেঁধে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন কবি । তার ফলে পরবর্তীকালে ঐসেরিব্রাল আবহে একধরনের ব্যতিক্রমী, গভীর আনন্দধ্বনি প্রত্যক্ষ হয়েছিলো। কণিকা ছিলেন সেই আবহের পূর্ণ পুণ্যভাগী। তিনি আত্মপ্রকাশের সুযোগ পেয়েছিলেন অবলীলায়। নিজস্ব গুণবত্তা ও শ্রমেসেই সুযোগের সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতেও তিনি সক্ষম হয়েছিলেন।

তাঁর কণ্ঠস্বরে সুর লাগানোর অননুকরণীয় ভঙ্গিটি বিষয়ে অতনু চক্রবর্তীর ভাবনা লক্ষণীয়। 'কণিকার সহজাত কণ্ঠ তন্ত্রবাদ্যের বিধিগত বৈশিষ্ট্যের অনুসারী। শৈশব থেকেই পিতৃদেবের এস্রাজবাদন শ্রবণেরসূত্রে বা পরবর্তীকালে বিশিষ্ট এস্রাজবাদক অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে তালিমের সুবাদে এবং শৈলজারঞ্জনের বিশ্বস্ত যন্ত্রটির সান্নিধ্যে থাকার ফলেই হয়তো এস্রাজের ধ্বনিময়তা, সুরের তীক্ষ্ণঅন্তর্মুখীভাব কণিকার কণ্ঠে গেঁথে গেছে।' 

দীর্ঘকাল ধরে রসিকজনের, যেমন মনস্ক শ্রোতা ও মেধাবী গুণীজন, উভয়ের আপ্লুত সাধুবাদের পরম্পরা লক্ষ্য করলে বোঝা যায় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাঙ্গীতিক সিদ্ধি কোনও আকস্মিক উপলব্ধি নয়। তিনি একবার বলেছিলেন, 'আমি যেন দুটি সত্তার মধ্যে আন্দোলিত-যখন প্রাত্যহিক প্রয়োজনের মধ্যে জড়িয়ে থাকি তখন একরকম, আর বাইরে বেরিয়ে শান্তিনিকেতনের পথে ঘুরে বেড়ানোর সময়ে, গানের মধ্যে ডুবে থাকার সময়ে আরেকরকম।' এই সাঙ্গীতিক বোধ ও পথ নির্মাণের উৎস ছিলো কবির গান নিয়ে তাঁর নিজস্ব দর্শন ও প্রয়োগকৌশল। তিনি কবির গানকে বৃহত্তর অর্থে প্রকৃতির হাতে গড়া একটি শিল্পসুষমা হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে তাঁর উক্তিটি অনুধাবনীয়। ' আমি তো শুধু তাঁর দুয়ারে ভিক্ষা নিতে যাই। তাঁর গান যখন গাই, তখন সেই সুরের সঙ্গে, কথার সঙ্গে আর প্রকৃতিরসঙ্গে যেন কোন পার্থক্য খুঁজে পাইনা।'

তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিলো, 'গান থেকে অবসর নেবেন কবে ভাবছেন?' তিনি আর্তকণ্ঠে বলেছিলেন,' অবসর নেবার কথা ভবতে পারিনা। গান আমাকে গাইতেই হবে। গান ছাড়া আমার জীবনে আর কিছুই নেই।'

প্রশ্নকর্তা সুধীর চক্রবর্তী লিখেছিলেন, 'এমন মর্মস্পর্শী সত্যভাষণ জীবনে বেশি শুনিনি।'

0
undefined undefined undefined

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in

ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ১১
শিবাংশু দে



আমারে তুমি অশেষ করেছো....

পার্থ দাশগুপ্ত নামে একজন তন্নিষ্ঠ রবীন্দ্রসঙ্গীতপ্রেমী'র লেখায় একটা মন্তব্য পেয়েছিলুম। "....রবীন্দ্রনাথের গানের সর্বকালের সফলতম অনুবাদক হিসেবে আমি যাকে মনে করি, তাঁর নাম সুবিনয় রায়। বুজুর্গরাও বলেন, যদি রবীন্দ্রনাথের গানের শুদ্ধতা আর অন্তর্নিহিত ভাবের হরগৌরী মিলনের সঠিক সুলুকসন্ধান পেতে চাও, তাহলে সুবিনয় রায়ের গান শোনো।" পার্থ নিজেকে একযোগে রবীন্দ্রখ্যাপা, হেমন্তখ্যাপা ও সুবিনয়খ্যাপা হিসেবেও ঘোষণা করেছিলেন। উক্তিটা আমি ভুলিনি কখনও। কারণ তিনি সরাসরি আমার মনের কথাটিই বলেছিলেন। আমার মনে পড়ে গেলো শান্তিনিকেতনে এক নিবিড় আড্ডায় কয়েকজন রবীন্দ্রমগ্ন বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা প্রসঙ্গে বলেছিলুম, "আজ যদি কবি নিজে থাকতেন, তবে তিনি সুবিনয়ের মতো করেই তাঁর গান শোনাতেন।" হয়তো আমার এই উক্তিটি একটু পক্ষপাতী মনে হতে পারে। সুবিনয়ের গানের প্রতি আমার ভালোবাসাটা প্রায় ভক্তি আপ্লুত হয়ে পড়ছে এভাবে। যে কোনও শিল্পবিচারকে যদি একটু দূরের পরিপ্রেক্ষিত থেকে না দেখা হয় তবে তার আলো অন্ধকার দুইই ধরা যায়না। একটা চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার অলীক প্রয়াস বোধ হতে পারে। কিন্তু আমি নাচার। আমার এরকমই বোধ হয়। কেন হয়, সে কারণটা ব্যক্তি আমার কাছে নিশ্চয় গ্রাহ্য। কিন্তু হয়তো অনেকের কাছে অতিশয়োক্তি বোধ হতে পারে।

ছোটোবেলায় বাড়িতে তাঁর দু'টি গান রেকর্ডে বাজতে শুনতুম। আদ্যিকালে গাওয়া গান। "তুমি ডাক দিয়েছো কোন সকালে" আর "ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়"। কিছু কিছু গান যেমন রক্তে এসে যায়, এই গানদুটি আমাদের জন্য সেমত নৈসর্গিক মাত্রা নিয়ে নিয়েছিলো। আমার মনে পড়ছে পাঁচ-ছ বছর বয়সে প্রথম ইশকুল যাত্রা। রামকৃষ্ণ মিশনের ইশকুল আর সেবছর স্বামীজীর জন্মশতবর্ষ। সব ক্লাস থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে অনুষ্ঠান হবে। আমি নেহাৎ শিশুত্বের বেড়া পেরোইনি তখনও। কেন যে মনে হয়েছিলো, কিভাবে, জানিনা। গেয়েছিলুম, "ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়..."। তখন আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ একটা গৃহস্থালীর চেনা নামমাত্র। প্রায় বালকটির কানে তখন ছিলেন রেকর্ডের সুবিনয়। ব্যক্তিগত সম্পর্কটা অতি পুরাতন। কিন্তু রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুনিয়ায় সুবিনয়ের স্থান নির্ণয়ের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক অবশ্যই নেই।

মাননীয় সুধীর চক্রবর্তী তাঁকে বলেছিলেন 'শুদ্ধান্তঃপুরের আচার্য'। 'শুদ্ধ' ও 'অন্তঃপুর' শব্দদুটি তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর ঘরানা বোঝাতে গেলে এই শব্দগুলির গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর শিল্পীসত্ত্বার দুটি স্পষ্ট বিভাজন রয়েছে। গায়নশিল্পী ও শিক্ষক। তাঁর সমসময়ে যেসব দিকপাল শিল্পী এই দুটি কাজে সিদ্ধ ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও তাঁর স্থানটি ছিলো অনন্য। শুধুমাত্র পারফরমার হিসেবে দুজন শিল্পী সেকালে শ্রোতাদের শ্রবণরুচির মধ্যে কিছু অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছিলেন। তাঁরা দেবব্রত বিশ্বাস এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাঁদের সর্বপ্রভাবী চাপের সমান্তরাল অন্যতর একটি গীতধারা প্রস্তাব করা এবং কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠা দেবার একটি দুরূহ কাজ সফলভাবে অর্জন করেছিলেন সুবিনয়। জর্জদা বা হেমন্তের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতে তাঁদের নিজস্ব মাত্রা,মুদ্রা বা শক্তির ছাপ ছিলো শেষকথা। লোকপ্রিয়তা, নিয়মিত জনসংযোগ, লোকরুচির প্রতি আগ্রহ তাঁদের 'হিরো' করে তুলেছিলো।


সুবিনয়ের সম্পূর্ণ গীতব্যক্তিত্বটিই ছিলো 'হাটের ধূলার' বাইরে অন্তর্মুখী আরাধনার মতো। সামগ্রিক শ্রোতাসমাজের একটি সীমিত অংশই তাঁর যাত্রার অনুসারী হবার যোগ্যতা অর্জন করতেন। তাঁর সঙ্গীতশিক্ষার প্রধান গুরু শৈলজারঞ্জন। তাঁর কাছ থেকে সুবিনয় রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ন বিষয়ে যে শিক্ষাটি পেয়েছিলেন, নিজের কথায়, "... আশ্রম-জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের গানকে যেভাবে পাওয়া যায়, এই পরিমণ্ডলের বাইরে থেকে ঐ গান চর্চা করলে তাকে সেভাবে পাওয়া যায়না।" তাঁর নম্র, অনুচ্চ, অনুচ্ছাস, অন্তর্মুখী গীতশৈলীর উৎস পাওয়া যাবে শৈলজারঞ্জন ও শান্তিনিকেতন বিষয়ক তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যায়। তিনি পেশাগতভাবে সম্পূর্ণ সঙ্গীতজীবী ছিলেন না। কিন্তু যাপনের একটি বৃহৎ অংশ তিনি ব্যয় করতেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়ন ও শিক্ষণে। পঞ্চাশের দশকে প্রথম রেকর্ড করা দুটি গান, "তুমি ডাক দিয়েছ কোন সকালে" বা "এই করেছ ভালো নিঠুর হে" শুনলে তাঁকে সুনীল রায় বা সমরেশ রায়ের গীতধারার তৃতীয় কোণ হিসেবেই মনে হতে পারে।


কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাঁর পরিশীলিত রুচিবোধ, আত্মবিশ্বাস, গান নির্বাচন ও স্থিতধী আবেদন তাঁকে প্রজন্মের সবার থেকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। বাল্যে তাঁকে যতোটুকু ব্যক্তিগতভাবে দেখেছি তাতে মনে হয়েছিলো তিনি বেশ সাহেবি মানুষ। 'সাহেবি' অর্থে নিয়মনিষ্ঠ, অনুচ্য, অচঞ্চল ও দক্ষ। এসরাজ বাদন শিখেছিলেন খুব যত্ন করে। তাঁর গানে সুর লাগানোর ধরনে এসরাজের স্বরপ্রক্ষেপণের বিশুদ্ধতা কানে বাজবে একটু মনোযোগী হলেই। বহুধরনের রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেও তাঁর সতর্ক গান নির্বাচন তাঁর সাফল্যে অন্যতর মাত্রা যোজনা করেছিলো। শঙ্খ ঘোষ বলেছিলেন, "মনে হয় যে-গান তার সম্পূর্ণ উদ্ঘাটনের জন্য দাবি করে একটা স্বচ্ছতার একটা স্পষ্টতার আর একটা সর্বসমর্পণের স্বর, সে গানের উপযুক্ত গলা আছে যেন শুধু সুবিনয় রায়ের মধ্যেই। কোনো মাত্রা ছাড়ানো মাধুর্য নয়, আবেগের কোনো বহুলতা নয়, কোনো উদাত্ততা নয়, শনাক্ত করার মতো বিশেষ কোনো ব্যক্তিভঙ্গিমা নয়, সুবিনয় রায়ের গানের মধ্যে আছে প্রকট ব্যক্তিত্বকে লুকিয়ে ফেলবার মতো এক-ধরণের সজল ব্যক্তিত্ব। জলতরঙ্গের মতো যেন সুরটাই খেলতে থাকে তাঁর গলায় আর তার মধ্যে দিয়ে পৌঁছতে থাকে কথা, যিনি গাইছেন তিনি যেন লুকিয়ে থাকেন দূরে। সুরের কাছে আত্মবিলোপময় সমর্পণের জন্যই হয়তো তাঁর গলায় স্মরণীয়ভাবে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে পূজাস্পর্শী গানগুলি।"


রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষের পর যখন এই ধারার সঙ্গীত চর্চার মধ্যে হঠাৎ ব্যাপ্ত জোয়ার এসেছিলো, প্রথিতযশা শিল্পীরা ক্রমশ নিজস্ব গীতভঙ্গি তৈরি করে নিয়েছিলেন নিজস্ব ক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতার লক্ষণগুলি মনে রেখে। দেবব্রত যেমন বেছে নিয়েছিলেন তাঁর অভ্যস্ত 'মাঠেঘাটে' গাওয়া গণসঙ্গীতের উদাত্ত গীতশৈলীর লোকপ্রিয় পথটি। সেভাবেই হেমন্তের সাফল্য ছিলো বিভিন্ন গণমাধ্যমে,বিশেষত চলচ্চিত্রে প্রযুক্ত গানের সঙ্গে ওতপ্রোত তাঁর মোহিনী কণ্ঠশিল্পের প্রতিভার শক্তিতে। সুবিনয় রায়ের শক্তির উৎস ছিলো তাঁর দীর্ঘকাল ধরে ক্রমাগতভাবে চালিয়ে যাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুশীলন, অনুধ্যান ও অনুরাগের মধ্যে। কণ্ঠশিল্পী ও শিক্ষক হিসেবে তিনি তাঁর বিষয়কে শল্য চিকিৎসকের মতো নিপুণ নিষ্ঠায় অন্তহীন বিশ্লেষণ করে গেছেন। এই প্রক্রিয়াজাত অভিজ্ঞতা তাঁকে অসীম আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছিলো। রবীন্দ্রসঙ্গীতের গভীর, নিহিত উদ্দেশ্য ও সন্ধান বিষয়ে তাঁর ধারণাটি প্রশ্নাতীত পারফেকশন পেয়ে গিয়েছিলো।

হেমন্তের গায়ন প্রসঙ্গে সুবিনয় যেমন বলেছিলেন, স্বর দু'ভাবে লাগানো যায়। Sophisticated এবং Unsophisticated। এই Sophisticated বিশেষণটি সম্ভবত তিনি শাস্ত্রীয়সঙ্গীতের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছিলেন, যেখানে প্রত্যেকটি স্বরকে ভিন্ন মাত্রা দিয়ে বিচার করা হয়। সুরের বারোটি স্বরকে পৃথক অস্তিত্ব হিসেবে কল্পনা করে তাদের বিভিন্নভাবে সমন্বিত করা হয়। এই প্রক্রিয়াটি অনুশীলন ও সাধনসাপেক্ষ। সেখানে এক ধরণের স্ট্রাকচার্ড সুরবিন্যাস গড়ে তোলা হয়, যা শুধু শ্রুতিমধুর হওয়ার ঊর্দ্ধে জটিল, অনুশাসিত সেরিব্রাল বন্ধনে বাঁধা থাকে। সুবিনয় কথিত Unsophisticated সম্ভবতঃ ন্যাচরল গায়ন শৈলি। যেখানে শ্রুতিমধুর স্বতঃস্ফূর্ততাই প্রধান শর্ত। আমাদের লোকপ্রিয়তার তুলনামূলক বিচারে ন্যাচরল সুরশিল্পীরাই অনেক এগিয়ে থাকেন। পঙ্কজকুমার থেকে কিশোরকুমার। কিন্তু সুবিনয় প্রথম থেকেই তাঁর সুরঋদ্ধ চিকণ কণ্ঠস্বরকে শাস্ত্রীয় স্বরক্ষেপণের নিয়ম অনুযায়ী ব্যবহার করেছেন। তাঁর মূল শিক্ষাগুরু শৈলজারঞ্জন তাঁর স্টাইলটি এভাবেই তৈরি করে নিতে তাঁকে উৎসাহ দিয়েছিলেন। যখন মাঠে ব্যাস, ব্যারিটোন, নিদেন টেনর কণ্ঠসম্পদ নিয়ে পঙ্কজকুমার, হেমন্ত বা দেবব্রত সৃষ্টিশীল রয়েছেন, তখন সুরেলা, মিহিন, নমনীয় স্বরক্ষেপনকে মঞ্চ করে সুবিনয় গান গেয়ে গেছেন। কণ্ঠ নয়, তাঁর প্রধান সম্পদ ছিলো নিখুঁত সুর লাগানো, নির্ভুল লয়জ্ঞান ও সামগ্রিক পরিবেশনায় গণিতের মতো ব্যবস্থিত বিন্যাসকে ধরে রাখার কৌশল। সুচিত্রা যেমন বলতেন, গাইবার সময় সমগ্র গানটি তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়। সুবিনয়ের ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে গানের শরীরটিকে তিনি জাদুকরের দক্ষতায় বেঁধে রেখেছেন এবং তাঁর শিল্পীমন যা করতে চায় সেভাবেই তাকে প্রসাধিত করে যাচ্ছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীতের থেকে এই পর্যায়ের আদায় আমরা খুব কমই দেখেছি। অন্তত রবীন্দ্রসঙ্গীতে শাস্ত্রীয়ঘরানায় অনুরক্ত আর কারো থেকে এই স্তরের সিদ্ধি আমরা দেখিনি। আবহমান ব্রাহ্মসমাজের সম্পন্ন গীতশৈলির ঐতিহ্য তিনিই সার্থকভাবে ধরে রাখতে পেরেছিলেন।


তিনি যখন প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের চর্চা শুরু করেন, বাংলার জনমনে কবির গানের আবেদন ছিলো নিতান্ত সীমিত। সাধারণ শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীত যথেষ্ট পৌরুষময় বা জেল্লাদার গান হিসেবে গ্রাহ্য হতোনা। মূলত নজরুলের গান, কিছুটা অতুলপ্রসাদের গীতধারাই ছিলো বাংলাগানের প্রধান ধারা। রাজ্যেশ্বর মিত্র জানিয়েছিলেন একবার ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটে স্বয়ং দিনেন্দ্রনাথকে শ্রোতারা দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার পরে থামিয়ে দিয়ে নজরুলগীতি শুনতে চেয়েছিলেন। শেষে দিলীপকুমার রায় এসে নজরুলগীতি গেয়ে অবস্থা সামলান। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে কলকাতার মানুষ সুবিনয় যে শুধু 'প্রকৃত' রবীন্দ্রসঙ্গীত শিখতে শান্তিনিকেতনেই গেলেন না, উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করে কলকাতায় ফিরে প্রথমে 'গীতবিতানে' ও পরে 'দক্ষিণী'তে দীর্ঘকাল ধরে শিক্ষকতাও করলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্তর্নিহিত শক্তি একসময় প্রকাশ পাবেই। তাঁর ধারণাজাত 'আশ্রম-জীবনের সঙ্গে মিশে যাওয়া'র গীতশৈলীও যে একদিন সাধারণ শ্রোতার কাছে আদৃত হবে, এ দৃঢ়মূল বিশ্বাস তাঁর শেষ পর্যন্ত অটল ছিলো। তিনি অনুভব করেছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের অন্তর্মুখী পরিবেশন আপাতভাবে প্রমোদপ্রাণ শ্রোতাসমূহের কাছে বিপুল স্বীকৃতি না পেলেও এই শৈলীটি নিমগ্ন শ্রোতাদের আনুকূল্য পাবে। কিন্তু পরবর্তীকালে আক্ষেপও বোধ করেছিলেন। ১৯৮৬ সালে একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদক জানতে চান ভবিষ্যতের কোন কোন শিল্পীর মধ্যে তিনি সম্ভাবনা লক্ষ করেছেন? উত্তরে তিনি নৈরাশ্য প্রকাশ করেন। "... সাধারণভাবে শেখবার আগেই এরা বেশি কমার্শিয়াল হয়ে পড়ছে। কিভাবে পরিচিতি এবং অর্থ দুটো'ই তাড়াতাড়ি লাভ করা যায় সেদিকেই এদের নজর বেশি। এবং আরো একটা খারাপ জিনিস হচ্ছে, ভালো করে না শিখেই এরা আবার অন্যদের শেখাতে শুরু করছে। জীবিকার উপায় আর কী।"


রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে নিজস্ব ধারণা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, "...আমি বরাবর বলি যে রবীন্দ্রনাথের গান শিখে জীবনে discipline আনা যায়। রবীন্দ্রসংগীতকে তাই আমি disciplined music বলি। আমি তো অন্যান্য গানও শিখেছি। আর কোনো গান এত disciplined নয়, এমনকে হিন্দুস্থানী ধ্রুপদ গানও নয়। যদিও রবীন্দ্রনাথ বলতেন ধ্রুপদ শেখা উচিত গানেdiscipline শেখবার জন্য, তিনি নিজের গানকে আরও অনেক বেশি discipline-এ বেঁধেছিলেন। এমন কতগুলো বাধ্যবাধকতা বা rigidity আছে তাঁর গানে, সেগুলো শিক্ষা করলে মানুষের জীবনের পরম উপকার হয়। আমার জীবনে যেটুকু discipline এসেছে, রবীন্দ্রনাথের গান শেখবার ফলেই এসেছে।"

পরবর্তীকালে অনুশীলনহীন, প্রস্তুতিহীন, মেধাহীন রবীন্দ্রগায়কেরা, যাঁরা শুধুমাত্র কণ্ঠস্বর সম্বল করে আসরে নেমেছিলেন বা এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন, তাঁদের জন্য সুবিনয় ছিলেন চূড়ান্ত সচেতক। 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' নামক শিল্পমাধ্যমটিকে পূর্ণতঃ অনুধাবন করতে গেলে গায়ক, চিন্তক, ভাবুক সুবিনয়কে ছাড়া আমাদের চলবে না। তাঁর কণ্ঠসম্পদ হয়তো 'ঈর্ষনীয়' ছিলোনা। আজকের বাজারের ভাষায় যাকে এক্স-ফ্যাক্টর বলা হয়, তা ছিলোনা ঐ স্বরে। কিন্তু স্বরসংযোগের স্থৈর্য, উচ্চারণের পবিত্রতা আর গানের ভিতর দিয়ে আত্ম-আবিষ্কারের ঐ পর্যায়ের মেধা তাঁকে এক অপরাজেয় শিল্পী করে তুলেছিলো। আজকের অস্থির, প্রস্তুতিহীন গায়ক ও শ্রোতাদের জন্য তিনি এক চির-আলোকিত বাতিঘর।
1
undefined undefined undefined

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in

ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ১০ 
শিবাংশু দে 


আমায় তাই পরালে মালা, সুরের গন্ধ ঢালা... 


"আকাশ যখন চক্ষু বোজে অন্ধকারের শোকে 
তখন যেমন সবাই খোঁজে সুচিত্রা মিত্রকে 
তেমনি আবার কাটলে আঁধার, সূর্য উঠলে ফের 
সবাই মিলে খোঁজ করি কার? সুচিত্রা মিত্রের 
তাঁরই গানের জ্যোৎস্নাজলে ভাসাই জীবনখানি 
তাইতো তাঁকে শিল্পী বলে, বন্ধু বলে জানি...." 
(নীরেন্দ্রনাথ) 


প্রিয় শিল্পী হয়ে ওঠার অবশ্যই কিছু ব্যাকরণ থাকে। কিন্তু শিল্পী যখন বন্ধু হয়ে ওঠেন, তখন তাকে যুক্তিগত ব্যাকরণের বাইরে একটা নৈসর্গিক মাত্রা ছাড়া আর কিছু বলা যায়না। সত্যিকথা বলতে কী, 'রবীন্দ্রসঙ্গীত' ছাড়া আর কিছু না গেয়ে (অন্যগানগুলি না গাইলেও কোনও ব্যাসকম হতোনা) বাঙালি শ্রোতার অস্তিত্ত্বের এত গভীরে শিকড় নামিয়ে দেবার শক্তি আর কোনও 'মহিলা' শিল্পীর মধ্যে আমরা পাইনি। 'শক্তি' শব্দটি সচেতনভাবেই ব্যবহার করছি। বাঙালির স্বভাবে 'শক্তি-সংস্কৃতি'র প্রতি যে আনুগত্য তাকে দেশের অন্যান্য প্রান্তের থেকে একটু আলাদা করে, তার মধ্যে ওজস্বী দেবীচেতনার একটি নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে। সুচিত্রা মিত্রের গানে ওজস্বিতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ তাঁকে পূর্ব ও উত্তরসূরিদের থেকে পৃথক করেছিলো। বাল্যবয়স থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের আবহে বড়ো হলেও তাঁর আত্মপ্রকাশের সলতেটিতে আগুনটি লেগেছিলো শান্তিনিকেতনে। সেই সময়ে, বা তার আগে রবীন্দ্রসঙ্গীতের গায়নভঙ্গিতে এতো মসৃণভাবে মেধার প্রয়োগ মানুষ বিশেষ শোনেনি। এই মেধার নির্দিষ্ট পরিভাষা 'শাস্ত্রীয়' অর্থে ধরা যাবেনা। একান্তভাবে নৈসর্গিক ক্ষমতার মাত্রা থেকেই তাকে আয়ত্ব করা যায়। প্রথম গান থেকেই তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতে যে আবহটি সৃষ্টি হয়, তার তুলনা মানুষ অন্য কোনও শিল্পীর পরিবেশনায় পায়নি। ১৯৪৫ সালে তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড। একদিকে "মরণ রে", অন্যদিকে "হৃদয়ের একুলওকুল দুকুল ভেসে যায়"। তখন তাঁর বয়স একুশ বছর। রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশ্রুত শিল্পী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন, "সুচিত্রা মিত্র মানে রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন এবং নিজস্ব একটি বিশেষ ঘরানায় সমৃদ্ধ রবীন্দ্রসঙ্গীতের শেষকথা।" এত সংক্ষেপে সুচিত্রা মিত্রের গানের এমন নির্ভুল মূল্যায়ণ আর কাউকে করতে দেখিনি। 


পূর্বসূরিদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় পঙ্কজকুমার ছাড়া আর কেউই জীবনের প্রথম রেকর্ডটি থেকেই 'বিশেষ ঘরানায় সমৃদ্ধ' রবীন্দ্রসঙ্গীত আমাদের জন্য এনে দিতে পারেননি।যাঁরা শান্তিনিকেতনে সুচিত্রার সঙ্গীতগুরু ছিলেন, যেমন ইন্দিরা দেবী, শৈলজারঞ্জন, অনাদি দস্তিদার এবং তাঁর ভাষায় 'সর্বার্থে' গুরু শান্তিদেব, কারো গায়নেই সুচিত্রা অনুসৃত গায়নের ইঙ্গিত ছিলোনা। অতএব আমরা স্বচ্ছন্দেই বলতে পারি সুচিত্রার'ঘরানা' একেবারেই তাঁর নিজস্ব। তাঁর উচ্চারণ, সুর-লাগানো, যতি'র টাইমিং বা লয়ের ছন্দ সবই তাঁর একান্ত ছাপ বহন করে। এ প্রসঙ্গে বলি, গায়কি ও ঘরানার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। গায়কিঘরানার অংশ হতে পারে। কিন্তু ঘরানা নামক ধারণার মধ্যে একটা পরিপূর্ণ সঙ্গীতভাবনার প্রকাশ আছে। গায়কির মধ্যে সঙ্গীতের কোনও বিশেষ ধারায় গায়নভঙ্গির কয়েকটি বিশেষ লক্ষণ ধরা থাকে মাত্র। 'ঘরানা' শব্দটির বিস্তার অনেকটা বড়ো। সুচিত্রার সমসাময়িক শান্তিনিকেতনি ঘরানার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছিলেন যাঁরা, সেই কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় বা নীলিমা সেনের গায়কি এক নয়, কিন্তু ঘরানা এক। সুচিত্রা ও কণিকার ঘরানা যেন চিত্রাঙ্গদার দুই রূপের মতো। স্বতন্ত্রা ও দয়িতার মধ্যের ফারাকটি মূর্ত হয়ে উঠেছিলো তাঁদের দুজনের পরিবেশনা। লক্ষ্যনীয়, গুরু ও সত্র এক। শিক্ষণ ও পথনির্দেশও একই। কিন্তু সুচিত্রার যাত্রাপথ প্রথম থেকেই আলাদা। মাত্র একুশ বছর বয়স থেকেই সঙ্গীতের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতে গেলে, তাঁর স্বাতন্ত্র্যবেমিসাল ছিলো। তিনি তাঁর সতীর্থদের থেকে কিভাবে আলাদা হলেন, তার উৎস নিয়ে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। প্রথমত, রবীন্দ্র-আবহে বেড়ে উঠলেও তিনি কলকাতার মেয়ে। পড়াশোনা করেছেন বেথুন কলেজিয়েট স্কুলে। সেখানে গান শেখাতেন অমিতা সেন। তাঁর গানের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা জানেন তাঁর সুর লাগানো ও লয়ের ব্যবহার, ছন্দের ধরন কেমন ছিলো। ঐরকম স্ট্যাকাটো শৈলিতে স্বর লাগানোর কৌশলসেকালে আর কারুর কাছে শোনা যেতোনা। এছাড়া পঙ্কজকুমার ছিলেন সুচিত্রার 'গানের জগতের হিরো'। প্রতি রবিবার রেডিওতে 'সঙ্গীতশিক্ষার আসর' শোনা ছিলো তাঁর অবশ্যকৃত্য। শান্তিনিকেতন পৌঁছোবার আগেই সুচিত্রা রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের যে ভঙ্গিটি আত্মস্থ করেছিলেন সেটি পরবর্তীকালে পরিমার্জিত হয়েছিলো হয়তো। কিন্তু কোনওদিন পরিবর্তিত হয়নি। 


সুচিত্রা শান্তিনিকেতনে প্রথম যান ১৯৪১ সালের অগস্ট মাসে। কবিপ্রয়াণের অব্যবহিত পরে। তখনও সেখানকার আলোবাতাসে কবির স্মৃতি ওতপ্রোত হয়ে জড়িয়ে ছিলো। ইন্দ্রপতনের পর শূন্যতাটি বিশেষভাবে প্রকট তখন। কবির নির্বাচিত সঙ্গীতগুরু শৈলজারঞ্জনের প্রগাঢ় প্রভাব সঙ্গীতভবনে। যদিও এই বিষয়ে একটু ভিন্ন ভাবনার পথিকৃৎ স্বয়ং ইন্দিরাদেবীও তখন সেখানে তালিম দিতেন। কিন্তুসেই মুহূর্তেশিক্ষার্থীরা বহুলভাবে শৈলজারঞ্জনের গুরুমুখী শৈলীকেই নিষ্ঠাভরে অনুসরণ করতেন। 'শৈলজাদা'র হাতে সুচিত্রার 'প্রকৃত পাঠ' শুরু হলেও 'সর্বার্থে তাঁর গুরু' ছিলেন শান্তিদেব। ২৯শে অগস্ট, ১৯৪১, বাড়িতে চিঠি দিয়েছিলেন সুচিত্রা। সেখানে উল্লেখ আছে, "...শান্তিদেব ঘোষের রবীন্দ্রনাথের গানের ক্লাসটা খুব ভালো লেগেছে। শিখতে শিখতে একটা ঘোর লেগে গিয়েছিল।"শৈলজারঞ্জন অনুসারী গীতধারা, যা কণিকা বা নীলিমার অন্বিষ্ট, তার থেকে সুচিত্রার শৈলী পৃথক হয়ে গিয়েছিলো প্রথম পর্ব থেকেই। 

সুচিত্রার যে গায়নশৈলীটি শ্রদ্ধেয় দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের মতে পরবর্তীকালে তাঁর নিজস্ব 'ঘরানা' হয়ে গিয়েছিলো, সে বিষয়ে সুচিত্রা কিন্তু শিল্পীস্বভাবজাত বিনয়ে 'ঘরানা' শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি 'গায়কী' ও 'ঢং' এই দুটি শব্দই ব্যবহার করেছিলেন। ‘গায়কী’র সঙ্গে সুচিত্রা ঐতিহ্যের যোগ খুঁজে পেয়েছিলেন। ঢং'বস্তুটি' তাঁর কাছে একান্ত ব্যক্তিগত একটি ধরন। শিল্পী বিশেষে তা বদলে যায়। কিন্তু যেমন ধ্রুপদের গায়কি মেনে খ্যয়াল গাওয়া যায়না, তেমনই রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে গিয়ে ঠুমরির গায়কি সর্বতোভাবে ত্যাজ্য। তাঁর মতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ‘গায়কী’বদলে অন্যকোনও ভাবে তা পরিবেশন করতে গেলে কম্পোজারের ক্ষমতা রবীন্দ্রনাথের থেকে অধিক হওয়া প্রয়োজন।তাঁর এই বিশ্বাসটি যেসব শিল্পীও শ্রোতার কাছে স্বীকার্য, তাঁরাই সুচিত্রার ঘরানার ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছেন। 


রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্বন্ধে তিনি যে মন্তব্যগুলি করেছিলেন, তার থেকে এই সঙ্গীতধারাটি বিষয়ে তাঁর ধারণাটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 'জীবনের আলোবাতাস' এবং 'অন্ধের যষ্টি'। 'জীবনের সুখদুঃখের ওঠাপড়ার প্রধান অবলম্বন।' 'একটা দিনও রবীন্দ্রসঙ্গীত না গেয়ে থাকতে পারিনা' ইত্যাদি। 

ডেকার্স লেনে সম্ভবত আইপিটিএর এক অনুষ্ঠানে তাঁর গান শুনে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, 'সে বেশ গলা ছেড়ে, পুরো দমে গান গায়। এর মধ্যে কোনও গোঁজামিল নেই। তার সাবলীলতা- সে একটা দেখার এবং শোনার জিনিস বটে। ... তার ছন্দজ্ঞানও অসামান্য। মেয়েরা সচরাচর তালে খাটো হয়। কিন্তু সুচিত্রা নিখুঁত। মনে হয় দিনেন্দ্রনাথ বুঝি ফিরে এলেন।' একজন সদ্যোতরুণী শিক্ষার্থী গায়িকার গান শুনে স্বয়ং ধূর্জটিপ্রসাদের এহেন প্রতিক্রিয়া বেশ ব্যতিক্রমী বলতে হবে। এই সময়কালটি সুচিত্রার সঙ্গীতব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার পথে তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁর নিজের ভাষাতে বলতে গেলে, "...শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে এসে আই পি টি এ-র সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়া যদি বলে, তবে সেটা তখনই। কিন্তু রাজনীতি করেছি, এই দাবি আমি কখনও করিনা। গণনাট্যসঙ্ঘের সক্রিয় সদস্য ছিলাম। কলেজে থাকতে গেট মিটিং করেছি। বক্তৃতা দিয়েছি। ঘাড়ে ঝান্ডা নিয়ে হেঁটেছি পথে পথে। একটা বিশ্বাস, একটা আদর্শের জন্য সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়েছিলাম। মিছিল, টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ- এসবের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছি ঠিকই, কিন্তু তাকে মোটেই রাজনৈতিক জীবন আখ্যা দেওয়া যাবে না।"এই যাপনের পথে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় জর্জদা, হেমন্ত, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, বিনয় রায়ের। তাঁর সামগ্রিক সঙ্গীত দর্শন ও পরিবেশনা জীবনের এই পর্বের পর একটা নির্দিষ্ট মোড় নিয়েছিলো। জীবনের 'অহরহ যুদ্ধ' তাঁকে একটি রাজনৈতিক সচেতনতা দিয়েছিলো। রাজনীতি মানেবৈঠকঘরে তোলা চায়ের কাপে তুফান নয়। সেটা একটা 'হোলটাইম ডেডিকেশন'। তিনি কোনও পার্টিতে নাম লেখাননি, কিন্তু নিজস্ব 'রাজনৈতিক আদর্শ' বিষয়ে তিনি স্থির নিশ্চিত ছিলেন। সেই বিশ্বাস থেকেই মাঠেময়দানে সলিল চৌধুরী বা জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের গানের সঙ্গে 'সার্থক জনম আমার' অসংখ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। 

১৯৪৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন রবীন্দ্রসঙ্গীতশিক্ষাপ্রতিষ্ঠান 'রবিতীর্থ'। সঙ্গে দ্বিজেন চৌধুরি। তাঁর গুরুদের থেকে পাওয়া শিক্ষা, নিজস্ব শৈলীতে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করলেন তিনি। তখন তাঁর বয়স মাত্র বাইশ বছর। হারমোনিয়ম বাজাতে জানতেন না। সুচিত্রা মিত্র ঘরানার প্রস্তুতি পর্বটি এভাবেই শুরু হলো। 

'শুধু গুরুর মুখের বাণীটি নয়, প্রতিটি মুহূর্তে গুরুর জীবনটিকে, গুরুর জীবনাদর্শটিকে দেখবার ও বোঝবার চেষ্টা....' শিক্ষক হিসেবে তাঁর প্রশিক্ষণ পদ্ধতির ভিত্তিটি ছিলো এরকম। 'সপ্তাহে একদিন তানপুরা ঘাড়ে করেধ্রুপদ-ধামার পকেটস্থ করা' যে রবীন্দ্রসঙ্গীত, তার বিরুদ্ধে আজীবন জেহাদ করে গেছেন। 

তাঁর প্রথম রেকর্ডটিগীত হয়েছিলো ইন্দিরাদেবীর প্রশিক্ষণে। ১৯৪৬-এ তাঁর দ্বিতীয় রেকর্ডটিতে 'আমার কী বেদনা সে কি জান' ও 'আরো কিছুক্ষণ না হয় বসিও' গেয়েছিলেন তিনি। 


স্বাধীনতালাভের আবেগমথিত সময় ১৯৪৮ সালের এপ্রিল মাসে মহাত্মা গান্ধির জীবৎকালেই সুচিত্রা রেকর্ড করেছিলেন তাঁর দুটি প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত, 'জীবন যখন শুকায়ে যায়' এবং 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে'। 


রবীন্দ্রসঙ্গীতের সর্বভারতীয় আবেদন সৃষ্টির মূলে এই রেকর্ডটির বড়ো ভূমিকা আছে। রবীন্দ্রনাথের গানের 'সাহিত্যমূল্য' বিষয়ে তিনি শ্রোতা ও শিক্ষার্থীদের সতত অবহিত করতেন।'....রবীন্দ্রনাথের গান শুধু সুর, তাল, লয় নয়। রবীন্দ্রনাথের গানের সাহিত্যমূল্য না বুঝলে কিছুই হবে না। বারে বারে পড়তে হবে। বুঝতে হবে। উচ্চারণ, পাংচুয়েশন শিখতে হবে। গানটাকে চোখের সামনে দেখতে হবে। 'ভিস্যুলাইজ' করতে হবে। আমি দেখতে পারি। আমি চোখের সামনে গানকে ভাসতে দেখি।' 

সম্ভবত তাঁর বিখ্যাততম রবীন্দ্রসঙ্গীত 'কৃষ্ণকলি' সম্বন্ধে তিনি লিখেছিলেন, 'আমি কৃষ্ণকলির পাঁচটা স্ট্যানজা যখন গাইতে বসি, চোখের সামনে স্পষ্ট দেখি-'ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে, মুক্তবেণী পিঠের পরে লোটে'। আমি দেখতে পাই: 'আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু, শুনলে বারেক মেঘের গুরু গুরু'। পাঁচটা স্ট্যানজা আমি স্লাইডের মতো দেখতে পাই।' 


বহুদিন ধরে গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইলেও রেকর্ড করেছিলেন ১৯৬১ সালের মার্চমাসে। পরবর্তীকালে এই গানটি না গেয়ে তাঁর অনুষ্ঠান কখনও শেষ হতোনা। মনে পড়ছে, ১৯৭৪ সালে জামশেদপুরে একটি অনুষ্ঠানের সকালবেলার আড্ডায় উপস্থিত শান্তিদেবকে আমরা অনুরোধ করি সন্ধেবেলা 'কৃষ্ণকলি' ও 'খাঁচার পাখি' পরিবেশন করার জন্য। তিনি তৎক্ষণাৎ পাশে বসা সুচিত্রার দিকে নির্দেশ করে বলে ছিলেন, 'ও দুটি সুচিত্রার গান। ওর অনুমতি না পেলে আমি গানদুটি গাইনা।' যথারীতি সুচিত্রা প্রতিবাদ করেন। শেষে ঠিক হয় অনুষ্ঠানের সময় সুচিত্রা 'খাঁচার পাখি' ও শান্তিদেব 'কৃষ্ণকলি' শোনাবেন। 


সাক্ষাতে বসে শোনা ছাড়াও তাঁর গীত অসংখ্য গান, যেগুলি এই অধম বিভিন্ন মাধ্যমে শুনে বড়ো হয়েছে, তার মধ্যে'নৃত্যের তালে তালে' ও 'কান্নাহাসির দোল দোলানো'র মহিমা অন্যরকম ভাবে কানে বাজে। এ প্রসঙ্গে যেটা আমার মনে হয়েছে, সুচিত্রাই প্রথম সাধারণ, পথঘাটের শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা নতুন চেহারা তুলে ধরতে পেরেছিলেন। তিনি পঙ্কজকুমার, জর্জদা বা হেমন্ত ন'ন, যাঁদের কণ্ঠসম্পদ এবং ব্যক্তিত্বের প্রভাব বহুমুখী। বিশেষত পঙ্কজকুমার এবং হেমন্ত, দুজনেরই নিবেদিত শ্রোতাদল তৈরি হয়েছিলো তাঁদের বহু ধরনের গানের সঙ্গে সম্পর্কেরসূত্রে। সুচিত্রা তথাকথিত রাবীন্দ্রিক পরিবেশজাত, শান্তিনিকেতন-প্রশিক্ষিত একটি বিশেষ আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর অংশ। কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক চেতনা থেকে তিনি অনভিজাতকিন্তু শ্রদ্ধাবান শ্রোতাদের মনোজগতের ঠিকানা পেয়ে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলো তাঁর ওজস্বী কণ্ঠের সঙ্গে ওতপ্রোত,সনিষ্ঠ মন্ত্র উচ্চারণের মতো পবিত্র রবীন্দ্রশ্লোকের অনিঃশেষ ধারাপাত। ছায়াছবির পর্দা বা মঞ্চজগতের জেল্লার তোয়াক্কা না করে, শুধু নিজস্ব আত্মবিশ্বাসের শক্তিতে, তিনি অর্ধশতক ধরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মাধ্যমে সাধারণ-অসাধারণ সব বর্গের শ্রোতাদের অভিভূত করে রাখতে পেরেছিলেন। এখনও পর্যন্ত এই কৃতিত্বের ক্ষেত্রে তিনি অনন্য। এটা এইজন্যই সম্ভব হয়েছিলো যেহেতু সুচিত্রা মনে করতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা তাঁর একধরনের 'চিত্তশুদ্ধি'র অবলম্বন। 

অভিনয়কলার সূক্ষ্ম লক্ষণগুলি বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট ধারণা থাকার সুবাদে তিনি যখন নৃত্যনাট্য বা নাটকের গানগুলি করতেন, আধেয় চরিত্রগুলির ব্যক্তিত্বের সঙ্গে তা অবিকল মিশে যেতো। সঙ্গীতে নিয়ন্ত্রিতভাবে নাট্যরসের সফল প্রয়োগ প্রসঙ্গে জর্জদা ও সুচিত্রার সিদ্ধি প্রশ্নাতীত। পঙ্কজকুমার বা হেমন্তের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের মধ্যেও এই লক্ষণ সুস্পষ্ট ছিলো। কিন্তু তাঁদের ছিলো চিত্রজগতে প্লেব্যাক গায়নের বিপুল অভিজ্ঞতা। সুচিত্রার সে অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাঁর অভিনয়বিদ্যার ধারণা তাঁকে গানের নাটকীয় অংশগুলি নিখুঁতভাবে পেশ করার ক্ষমতা দিয়েছিলো। একটা ধারণা রয়েছে টপ্পাঙ্গের রবীন্দ্রসঙ্গীতে তিনি স্বচ্ছন্দ ছিলেন না। মনে করিনা এই ধারণার বিশেষ ভিত্তি রয়েছে। কারণ রবীন্দ্রসঙ্গীত একটি স্বকীয় গীতশৈলী। টপ্পাগানের কিছু অঙ্গ হয়তো বেশ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীতে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেগুলি রবীন্দ্রসঙ্গীতই থাকে। টপ্পা হয়ে ওঠেনা। মুক্তছন্দের রবীন্দ্রসঙ্গীতগুলি সুচিত্রা সম্পূর্ণ নিজের ঢঙে গাইতেন। 'তবু মনে রেখো',' সার্থক জনম'বা 'সকল জনম ভরে' মন দিয়ে শুনলে ব্যাপারটি বোঝা যাবে। টপ্পার দানা বা মীড় কোনও গীতশৈলী নয়, অলংকারমাত্র। তার ব্যবহার শিল্পীসাপেক্ষ। সার্বভৌম নয়। মনে রাখতে হবে, ধূর্জটিপ্রসাদ তাঁর 'সার্থক জনম' শুনে ভেবেছিলেন সুচিত্রার কণ্ঠে 'টপ্পার দানা' বেশ ভালোভাবেই রয়েছে। 


সুচিত্রা ব্যক্তিপরিচয়ে নারী হলেও তাঁর পরিবেশনে কোনও 'মেয়েলিপনা' ছিলোনা। যা ছিলো, তা সামগ্রিকভাবে মানবিক অনুভূতির বিস্তৃত পরিবেশনা। সম্পূর্ণভাবে লিঙ্গনিরপেক্ষ। তাঁর আগে রবীন্দ্রসঙ্গীতে নারীকণ্ঠের গায়নে এই ব্যাপারটি দেখা যায়নি। ধূর্জটিপ্রসাদ সম্ভবত এই জন্যই বলেছিলেন সুচিত্রার গায়কী 'পুরুষালি' ধরনের। কিন্তু আমাদের শাস্ত্রীয়সঙ্গীতে যে শৈলীটিকে 'মর্দানি' হরকত বলা হয় তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। 

শৈশব থেকে বিভিন্ন আসরে তাঁর গান শুনেছিবার দশেক। যখন তাঁর কণ্ঠ সম্পূর্ণ স্ববশে ছিলো অথবা বয়সের ভার যখন তাঁর স্বরপর্দায় ছায়া মেলেছিলো, দুই অবস্থাতেই। একবার একটি অনুষ্ঠানে শুনেছিলুম 'অন্ধজনে দেহো আলো'। কণ্ঠ স্ববশে ছিলো না সেদিন। কিন্তু সেই আপাত দুর্বলতাটি তিনি ব্যবহার করেছিলেন গানটির অন্তর্নিহিত আর্তিটিকে গভীরভাবে প্রতিষ্ঠা করার কৌশলে। 'প্রেমসলিলধারে সিঞ্চহ শুষ্ক নয়ান,আ প্রভু'। রোমাঞ্চবোধ করেছিলুম। আসরে তাঁর গান নির্বাচনের কৌশল অন্যমন শ্রোতাদেরও গানের প্রতি টেনে রাখতে পারতো। 


রবীন্দ্রসঙ্গীতে প্রচলিত 'আভিজাত্য'বোধের পরিভাষাটি তাঁর সম্বন্ধে ব্যবহার করা যায়না। তিনি স্বঘোষিত ভাবে এই ধারণার বিপরীত মেরুর অধিবাসী ছিলেন। কিন্তু ইতর বা অভিজ্ঞ শ্রোতা, উভয়ের মননেই তাঁর পরিবেশনার 'আভিজাত্য' বিস্তৃতি ছড়িয়ে যেতো। ঘন্টা দেড়েক তাঁর গান শুনে বাড়ি ফেরার পথে যেন আর কিছুই ভাবা যেতোনা। এক একটি গানের অনুরণন ঘুরে যেতো 'মাথার চারিপাশে'। তাঁর মেধা ও রুচিবোধ রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিপুল জগতে তাঁকে হিমালয়শৃঙ্গের মর্যাদা দিয়েছে। নীরেন্দ্রনাথের যে কবিতাটির ঊদ্ধৃতি শুরুতে দিয়েছি তার যাথার্থ্য প্রশ্নহীন, সর্বমান্য। তাঁর সর্বমান্য মহিমা অন্য কবিতায় বোধ হয় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। 

".... এইখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত 
এই কণ্ঠে শব্দধ্বনি ডানা মেলে 
পার হয়ে যায় পাহাড়বাতি, ফুলসাজ, চার দেয়াল 
দৃপ্ত ঝাপটে হাওয়া টলায় 
আবার নীলে নীলে ভেসে চলে 
এই কণ্ঠে শব্দধ্বনি মানুষ, পৃথিবী, ঋতু নিয়ে 
প্রাণসূত্রে দিনরাতকে বাঁধে 

এই কণ্ঠ সুচিত্রা মিত্র, 
আমি ঘরের মধ্যে গান শুনি 
ঘর? 
কই ঘর? 
আমি তো এক অনন্ত ভুবনে... 
(অরুণ মিত্র) 


0
undefined undefined undefined

ঝরনাতলার নির্জনে - শিবাংশু দে

Posted in


ঝরনাতলার নির্জনে


জোড়াসাঁকো জংশন ও জেনএক্স রকেটপ্যাড - ৯
শিবাংশু দে

আমি যে গান গেয়েছিলেম, মনে রেখো…. 

'.... আমাদের সময়কার কথা আলাদা। তখন কে ছিলো? ঐ তো গুণে গুণে চারজন। জর্জ, কণিকা, হেমন্ত, আমি। কম্পিটিশনের কোনও প্রশ্নই নেই। ' (একটি সাক্ষাৎকারে সুচিত্রা মিত্র) 


বাবার কাছে গল্প শুনেছি। সাতচল্লিশ-আটচল্লিশে সেন্ট পলস কলেজে পড়াকালীন তিনি সেখানে ছাত্রসংগঠনের সাংস্কৃতিক সচিব ছিলেন। সেই সময় ভবানীপুরের দীর্ঘ সুদর্শন ছেলেটি, যে গল্প লেখে (দেশ পত্রিকাতে ইতোমধ্যে তাঁর গল্প প্রকাশিত হয়ে গেছে) আর আবাল্য বন্ধু 'গায়ক' সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের চাপে এদিকওদিক গান গেয়ে বেড়ায়, তার কাছে বাবা'রা গিয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউট হলে কলেজ সোস্যালে গান গাইবার অনুরোধ নিয়ে। ততোদিনে অবশ্য তার বেশ কিছু রেকর্ডও করা হয়ে গেছে, শৈলেশ দত্তগুপ্ত, কমল দাশগুপ্তের সুরে। ১৯৪৪ সালে সে নিজের সুরে প্রথম রেকর্ড করে, '' কথা কয়োনাকো, শুধু শোনো''। মোটামুটি এই সময়েই 'প্রিয় বান্ধবী' ছবিতে তার গাওয়া ''পথের শেষ কোথায়....'' বিশেষ লোকপ্রিয়তা পেয়ে যেতে কলাম্বিয়া কোমপানি তাকে দিয়ে একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড করেছিলো। দু'টি গান, ''আমার আর হবে না দেরি'' আর '' কেন পান্থ এ চঞ্চলতা'' সত্তর বছর পরেও একুশ শতকের মানুষ শোনে। জর্জদা বলতেন, হেমন্ত রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেকেন্ড হিরো। প্রথম হিরো ছিলেন অবিসম্বাদী পঙ্কজকুমার। 


অনুষ্ঠানে পৌঁছোতে একটু দেরি হয়েছিলো যুবকটির। সেই শাদা হাতা গুটোনো শার্ট আর ধুতি, দীর্ঘ পদক্ষেপ। এসেই সোজা মঞ্চে, পর্দা ওঠার আগেই গান ধরা হয়ে গেলো তাঁর, '' আমার আর হবেনা দেরি ...'' । বাবার ভাষায় কলকাতার সতত অতিকথনশীল, প্রগলভ ছাত্রদল মূহুর্তে নিশ্চুপ। গায়নভঙ্গি পঙ্কজকুমারের মতো, কিন্তু পেশকারি অনেক আধুনিক । আর তাঁর কণ্ঠসম্পদ ? শৈশবকাল থেকে অসংখ্যবার শোনা ''আমার আর হবে না দেরি'', যা আমাদের শ্রবণে প্রায় একটি নৈসর্গিক সম্পদ, সম্পূর্ণ ভিন্ন মনোনিবেশ নিয়ে শুনছি এখন। এই গানটি রেকর্ড করার সময় হেমন্তের বয়স ছিলো মাত্র চব্বিশ বছর। তাঁর উচ্চারণ, ডিক্শন, সুর লাগানো, লয় ধরে রাখার পরিণত সামর্থ্য এবং সর্বোপরি সংযমবোধ, রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশনের এক নতুন ভাষ্য তৈরি করতে পেরেছিলো। মনে রাখতে হবে এই সময়কালে জর্জদা'র কোনও একক রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়নি। 


হেমন্তের 'শিক্ষক' বলতে শৈলেশ দত্তগুপ্ত, যাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রশিক্ষণের কোনও বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিলো বলে জানা যায়না। সাহানা দেবী, কনক দাশের রেকর্ড হয়তো শুনেছিলেন তিনি, কিন্তু তাকে তালিম বলা যায়না। তিনি ছিলেন পঙ্কজকুমারের 'কানশুনি' শাগির্দ। অভিজাত বৃত্তের বাইরে সাধারণ শ্রোতারা যে দুজন অসাধারণ শিল্পীর রবীন্দ্রসঙ্গীতকে নিজের বলে গ্রহণ করেছিলেন, সেই পঙ্কজকুমার মল্লিক আর কুন্দনলাল সহগল ছিলেন তাঁর পথপ্রদর্শক। কিন্তু আজ একই সময়ে এই তিনজনের গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড শুনলে বেশ বিস্ময়বোধ হয়। যখন দেখি পঙ্কজকুমার তাঁর গায়নে, বিশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকের শিল্পীদের মতো সুর লাগানোর রেশ পুরোপুরি এড়িয়ে যেতে পারছেন না। যদিও রবীন্দ্রসঙ্গীতে স্পষ্ট উচ্চারণের যে বাধ্যতা পরবর্তীকালে অবশ্যকৃত্য হিসেবে স্বীকৃত হয়েছিলো, তার ভগীরথ ছিলেন পঙ্কজকুমার । এ ছাড়া কুন্দনলালের বাংলা উচ্চারণের মধ্যে অনুকরনীয় নিশ্চয় কিছু ছিলোনা এবং তাঁর সুর লাগানোর ধরনটি ছিলো একান্তভাবে উর্দু গজলের ধাঁচে। এই দুজন 'দ্রোণাচার্যে'র রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার অভিজ্ঞতা স্বীকার করেও হেমন্ত কিন্তু সম্পূর্ণ নিজস্ব এবং সেকালের পক্ষে প্রায় চমকে দেওয়া একটা পরিশীলিত পরিবেশনার নমুনা পেশ করে ছিলেন। অথচ মজার কথা, তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ন পারদর্শিতার যে বিপুল স্বীকৃতি তিনি পেয়েছিলেন সাধারণ আম শ্রোতার থেকে, তার ভগ্নাংশ সাধুবাদও তিনি পান'নি 'এলিট' শ্রোতামহল থেকে।

আশির দশকে স্বয়ং সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের লোকপ্রিয় শৈলী বিষয়ে আলাপচারিতায় সুভাষ চৌধুরিকে বলেছিলেন, ''.... এক এক জন exceptional গায়কের গলায় আমরা গানের (রবীন্দ্রসঙ্গীতের) সুন্দর চেহারাটা বা শ্রেষ্ঠ চেহারাটা খুঁজে পাবো। অন্যদের ক্ষেত্রে পাবোনা এবং বিচারটা সব সময়েই Bestকে দিয়ে হবে। আরেকটা জিনিস- সব ঘরে ঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীত চলছে- সেই ঘরে ঘরে গাওয়াটা তো আমরা প্রামাণ্য গাওয়া বলে ধরতে পারবো না।'' 

এখানে সুভাষ যোগ করেন, ''.. মুশকিল হচ্ছে কি - Popular গাইয়ের গলায় তো এটা Popular হচ্ছে। সেখানে এটার সাদামাটা চেহারা পাচ্ছি। খুব Popular গাইয়ে কিন্তু তিনি - সেখানে খুব সাদামাটা চেহারা পাচ্ছি।'' 

তখন সত্যজিৎ বলেন, ''..... এই তো হেমন্তই দেখনা (হাসি) অবশ্য এটা আবার উঠে গেল (হাসি)...... কিন্তু কথা হচ্ছে হেমন্তবাবুর গলায় ধরুন এটা নেই। একজন আমি বলছি যে এটা নেই-ই (জোর দিয়ে), সেক্ষেত্রে লোক কিন্তু হেমন্তবাবুর গলায় এটা শুনতে চাইছে। আপনি যে প্রশ্নটা তুলছেন সেটাতো চিরকালের আর্টের একেবারে গোড়ার প্রশ্ন। সাধারণ, মানে Lowest common denominator এর কাছে তার চেহারাটা কীরকম, তারা কী পছন্দ করছে, সে তো আমাদের সাহিত্যেও আছে, ফিল্মেও আছে, গানেও থাকবে। এটাতো নতুন কিছু না। কিন্তু তারা যখন classical গান শুনতে যাচ্ছে তারা তখন ভালটাই চাইবে - যারা classical গানের বোদ্ধা। কিন্তু যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত এসে যাচ্ছে সেখানে তো মুশকিল হয়ে যাচ্ছে ঐখানেই যে খুব সাধারণ লোকেরা ঐ popular গানটাই পছন্দ করবে। এটা তো পাশাপাশি থাকবেই। এটার কোনও রাস্তা নেই।'' প্রসঙ্গত রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভবিষ্যত বিষয়ে প্রশ্ন তোলায় তিনি বলেন, ''..... রবীন্দ্রসঙ্গীত in a pristine form, মানে ভালো form, রবীন্দ্রসঙ্গীতের চল তো থাকবেই।''

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে একটা প্রভাবশালী ও স্বীকৃত শ্রোতাগোষ্ঠীর কাছে হেমন্ত বা তাঁর গায়নভঙ্গি Exceptional বা Best নয়, সেটা নেহাৎ 'Popular' এবং এখানে Popular শব্দটি প্রকারান্তরে উৎকর্ষের অভাবই সূচিত করছে। আবার Pristine ফর্ম, যা কি না 'ভালো' form, সেটাই বা আদতে কী কী লক্ষণকে আশ্রয় করে গঠিত হয়? এখানে উল্লেখযোগ্য, যে দু'জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও স্বীকৃত শ্রোতা এই আলোচনাটি করছেন তাঁরা স্পষ্ট কোনও বিশেষ নজির উপস্থিত করছেন না, Pristine formটি আসলে কোন শিল্পী সঠিকভাবে ধারণ করতে পারেন। এই মোড়টিতে এসে আলোচনাটি একটি অন্ধগলিতে আটকে যায়, যেখানে শ্রোতারা আপন আপন শ্রবণ অভ্যেস ও অভিজ্ঞতাকে নির্ভুল ভেবে নিশ্চিন্ত থাকেন।


হেমন্ত বলতেন যে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষকের নাম 'স্বরবিতান'। তিনি দোকান থেকে স্বরবিতান কিনে আনতেন আর হারমোনিয়মে সুর টিপে গান বাঁধার মহলা চালিয়ে যেতেন। গুরুবাদী 'শুদ্ধতা'পন্থিদের পক্ষে রীতিমতো স্যাক্রিলেজ বলা যেতে পারে। কিন্তু যেকোনও গান, বিশেষতঃ রবীন্দ্রসঙ্গীত' যাঁদের কথা ভেবে রচিত হয়েছিলো , যদি তাঁরা শঙ্খ ঘোষের অভিজ্ঞতা অনুসারে শুধু 'মধ্যবিত্ত রুচিপ্রকৃতি'র মানুষই হ'ন, তাঁদের কাছে বিপুল সমাদর লাভ করেছিলো। একথা একশোভাগ সত্যি যে সংখ্যাতত্ত্বের বিচারে ফেলে শিল্পের মূল্যায়ণ করা যায়না, কিন্তু সেই ফর্মুলাটি কি হেমন্তের রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে? সর্বকালের কথা বলতে পারিনা, কিন্তু আমার নিজের দেখা অন্ততঃ তিনপ্রজন্মের বাঙালি শ্রোতার প্রতিক্রিয়া দেখে বলতে পারি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন মানুষের হৃদয়ের গভীর তন্ত্রী'কে স্পর্শ করতে সক্ষম এবং তার নজির আমরা এখনও দেখতে পাই।


দূরদর্শন পূর্ববর্তী যুগে, যে সময় বাঙালি শ্রোতা বিভিন্ন ছোটোবড়ো আসরে সরাসরি শিল্পীদের থেকে বাংলাগান শোনার সুযোগ পেতো, তখন একটি প্রথা বেশ প্রত্যক্ষ ছিলো। শিল্পীরা অনুষ্ঠানের প্রথম নিবেদনটি শুরু করতেন রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। যাঁরা পূর্ণসময়ের বা বহুস্বীকৃত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ন'ন, তাঁরাও মুখবন্ধ হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকেই আশ্রয় করতেন শ্রদ্ধাসহকারে। এখনও হয়তো কেউ কেউ করে থাকেন। কয়েকজনের কথা আমার নিজের মনে আছে। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পিন্টু ভট্টাচার্য, নির্মলা মিশ্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা তো এই মূহুর্তে মনে পড়ছে। এই প্রথাটি প্রথম শুরু করেছিলেন হেমন্ত। প্রশ্ন উঠতে পারে পঙ্কজকুমার ন'ন কেন? তাঁর সমস্ত পরিবেশনায় তো রবীন্দ্রসঙ্গীত আবশ্যিক অংশ হয়ে থাকতো। এই প্রসঙ্গে বলা যায় পঙ্কজকুমারের সময় থেকে হেমন্তের সময়ের মধ্যে বাংলাগানে একটা বড়ো পালাবদল ঘটে গিয়েছিলো। হেমন্তের শ্রোতাদের মধ্যে রবীন্দ্রপ্রজন্মের মানুষ কেউ ছিলেন না বললেই চলে। উপরন্তু নানা আর্থসামাজিক কারণে শ্রোতাদের মানসিকতার ফ্রেমও আমূল বদলে গিয়েছিলো। নতুন প্রজন্মের বাঙালি শ্রোতাদের কাছে রবীন্দ্রনাথের গান উপযুক্ত মর্যাদায় গ্রহণ করানোর জন্য যে ধরনের গ্ল্যামর কোশেন্ট প্রয়োজন ছিলো, হেমন্ত ব্যতীত সেই মূহুর্তে আমাদের মধ্যে আর কোনও শিল্পী ছিলেন না। তাঁর মাপের লোকপ্রিয় শিল্পীর যোগদান শিল্পবস্তুর মহিমা বিষয়ে শ্রোতার মনে অন্যধরণের তাৎপর্য বহন করে আনে। পরবর্তীকালে কিশোরকুমার এগিয়ে এলেও হেমন্ত ছিলেন তাঁদের পথিকৃৎ। এইখানে সত্যজিতের Pristine ঘরানার যাথার্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ কিশোর ছিলেন সত্যজিতের আশিসধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। এখনও ভাবি, কিশোরকুমারের রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়নের মধ্যে এমন কী 'রাবীন্দ্রিক উৎকর্ষ' ছিলো, যা তিনি হেমন্তের রবীন্দ্রসঙ্গীতে খুঁজে পাননি? 

রবীন্দ্রসংগীত নামক শিল্পধারাটির একজন অতিস্বীকৃত দিগগজ সুবিনয় রায় হেমন্তের রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্বন্ধে বলেছিলেন, “হেমন্ত যেভাবে সুর লাগায় সেটা বাংলা গানের পক্ষে আদর্শ। সা রে গা মা দু’রকমভাবে লাগানো যায় গলা দিয়ে, একটা sophisticated, অন্যটা unsophisticated। হেমন্ত unsophisticatedভাবে সুর লাগায়। এর তুলনা নেই। ওর গান নির্বাচন অতুলনীয়। কোনটা ও justice করতে পারবে ওটা ঠিক বুঝতে পারে। তার বাইরে বেরোয় না। এই গুণ খুব কম শিল্পীর থাকে। তোরা ভাবিস হেমন্ত-র ক্লাসিক্যালের উপর দখল নেই - সেটা একদম ভুল। আমি তো বহুদিন ধরে ওর সঙ্গে মিশছি, আমি জানি। নিজে গলা দিয়ে ওই চর্চাটা করেনি, কিন্তু ভেতরে ক্লাসিক্যাল সেন্স প্রখর। ওর মত উচ্চারণ বাংলা গানে খুব কম শোনা যায়। ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায়’, ‘কেন পান্থ এ চঞ্চলতা’ ভালো করে শুনিস, দেখবি মনে হবে ঝর্ণা বইছে”। (পুত্র সুরঞ্জন কথিত) 


এর পর আমাদের মতো অনধিকারীর কোনও মন্তব্য নিতান্ত বৃথা ও মূঢ় শোনাবে। অর্ধশতকেরও বেশি শোনার পর ব্যক্তি আমি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রসঙ্গীতকে শুধুমাত্র সঙ্গীতপরিবেশনা হিসেবে ধরিনা। বহিরঙ্গে বিভ্রমজনক সারল্যের আড়ালে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিবেদিত শ্রোতার কাছে অগণন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসে। চিরকালীন হিরণ্ময় পাত্রে লুকিয়ে থাকা উপনিষদের সত্যের মতো যেন তাকে ধরে ফেললেও ধরা দেয়না। কোথাও যেন একটা কাচের দরজা থেকে যাচ্ছে স্রষ্টা ও শ্রোতার মধ্যে। হেমন্তের কাছে ছিলো ঐ দরজাটি খোলার চাবিকাঠি। রবীন্দ্রসঙ্গীতকে মসৃণভাবে উন্মোচিত করে শ্রোতাকে ভাসিয়ে দেওয়ার ধ্যান আমি তাঁর পরিবেশনায় পেয়ে যাই। যা শুধু আর 'গানশোনা' হয়ে থেকে যায়না। একজন তদ্গত শ্রোতা যে কথাটি একবার নিজের মতো করে জানিয়েছিলেন আমাদের। 

"....রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বসে, উনি যেন ঠিক গান নয়, সাধনায় বসতেন। আর ওঁর এই ভাবটা ছড়িয়ে পড়ত শ্রোতাদের মধ্যেও।

রঞ্জি স্টেডিয়ামের একটা অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে। মঞ্চে মহম্মদ রফি। দর্শক উত্তেজনায় ফেটে পড়ছে। তাদের উল্লাস সাগরের ঢেউকেও হার মানায়। তুমুল চিৎকারের মধ্যে মঞ্চ ছাড়লেন রফি।

এর পরেই উঠবেন হেমন্তদা। আমরা রুদ্ধশ্বাস। এমন উত্তাল জনতাকে কী করে বাগে আনবেন তিনি? মঞ্চে উঠলেন। হারমোনিয়াম ধরলেন। তার পরেই অতি পরিচিত সেই জলদগম্ভীর স্বরে বেজে উঠল— ‘আমার কণ্ঠ হতে গান কে নিল…’।

তখন কোথায় সেই আছড়ে ওঠা সাগর-ঢেউ! মুহূর্তে কোন এক জাদুমন্ত্রের মায়ায় নিশুত রাতের নৈঃশব্দ্য ঘনিয়ে এল যেন…"
(পত্রিকা-সুবীর মজুমদার, ২০শে জুন ২০১৫)

সারাজীবনের অমেয় সঙ্গীতসিদ্ধি তাঁর জন্য হয়তো তেমন তাৎপর্য বহন করতো না। নিস্পৃহ প্রজ্ঞায় জীবনের সালতামামি করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, 

"....গুরুদেবের গান আমার মৃতসঞ্জীবনী। আমার সঙ্গীত জীবনে আমি যা কিছু পেয়েছি রবীন্দ্রকোষ থেকে। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া বাঁচবো না।" 

একজন ইতর শ্রোতা হিসেবে আমি রবীন্দ্রসঙ্গীত ও বেঁচে থাকার মধ্যে এই সমীকরণটিই শেষ কথা মনে করি। কেন আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীতে দ্বিতীয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায় আর পাইনি, সেই রহস্যটি এই বোধের উৎসেই রয়েছে।