0

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়

কলকাতায় এখন উৎসবের বাতাবরণ। বই প্রেমীদের উৎসব। বই প্রেমীদের দুর্গোৎসব। আর ঠিক আট দিনের মাথায় শুরু ৪৪তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। এবারের থিম কান্ট্রি রাশিয়া। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ২০০ তম জন্মবার্ষিকী পালন করাও এই উৎসবের অঙ্গ। এ এক এমন মেলা, যেখানে নৈতিকতার হিসাবটাই অন্যরকম।

এবারের বইমেলায় ঋতবাকের স্টলনম্বর ৩২২। আসছে ৪০টির ওপর নতুন বই। ব্যস্ততার পারদ এখন চরমে... তারই মাঝে রেখে গেলাম নিয়মিত ই-সংখ্যা। কিছুটা সংক্ষিপ্ত। বাদ পড়লো কিছু রেগুলার আইটেমও। তবুও, প্রেজেন্ট প্লিজ 😀

দেখা হবে ৩২২এ

সুস্থ থাকুন, সৃজনে থাকুন...

শুভেচ্ছা নিরন্তর...

0 comments:

1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - মনোরঞ্জন ব্যাপারী

Posted in

পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় হাজার বছর ধরে মহিলাদের প্রতি যে চরম দলন দমন-পীড়ন অত্যাচার প্রবহমান সে সত্য তো কম বেশি সবাই জানে- সংবেদনশীল প্রাণকে ব্যথিত করে- খানিকিটা হলেও বিড়ম্বিত করে চিন্তাশীল পুরুষ মানুষ সকলকে। কিন্তু যে মহিলা একাধারে দলিত এবং দরিদ্র সামাজিক অবমাননা অত্যাচার ছাড়াও সংসার জীবনে পরিবার পরিজনদের নিকট থেকে যে কি ভয়াবহ বর্বর দলন দমন অত্যাচার প্রতিনিয়ত তাকে সহ্য করতে হয় সে-সংবাদ বহু মানুষের কাছেই অজানা। 

দলিতরা সাধারণত বাস করে নোংরা বস্তিতে, খালপাড়ে, রেল লাইনের ধারে বা প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে। সেখানে সচরাচর সেই সব মানুষের পদার্পণ বড় একিটা ঘটে না যাঁরা মাঠে- ঘাটে বক্তৃতা দেন, পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন লেখেন বা সমাজকল্যাণমূলক কাজ-কর্ম করেন, অন্যায়-অবিচার, অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। ফলে সেই বিশাল সংখ্যক নারীর পারিবারিক জীবন কি দুঃসহ যন্ত্রণায় কাটে সে- তথ্য চাপা পড়ে থাকে অজানা এক অন্ধকারের গর্ভে। 

আমি নমঃশূদ্র নামে অভিহিত এক দলিত পরিবারের সদস্য। ফলে এই সমাজের নারীদের জীবন বাল্যকাল থেকে দেখে দেখে বড় হয়েছি। যে – নির্মম নিষ্ঠুর পারিবারিক অত্যাচার তাদের জন্ম থেকে মৃত্যুকাল অবধি সহ্য করে যেতে হয় সে করুণ কাহিনী স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছি। 

পূর্ববঙ্গের নমঃশূদ্র, এপাড় বাংলার কাওড়া-বাগদি, জাত পরিচয়ে ভিন্ন হলেও মোটামুটি শিক্ষা-সংস্কার, পেশা জীবন-যাপন প্রণালি, খাদ্যাভাস-পরিচ্ছদ প্রায় একই। ফলে নারীদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিতেও খুব একটা প্রভেদ পাওয়া যায় না। এই সব দলিত পরিবারেই তারা নিগৃহীত, সমান অমানবিক অত্যাচারের শিকার। 

যে ব্যক্তি-মানুষটির অবস্থান বর্ণবাদী ব্যবস্থার সর্বনিম্ন ধাপে, যে অপরাধে সে আর্থিক দিক থেকে অতীব দুর্বল, সুশিক্ষা-সুসংস্কার থেকে বঞ্চিত, প্রতিটা দিনযার কাটে চরম অপমান, অত্যাচার আর অনাহারের মধ্যে, খুবই স্বাভাবিক কারণে সেই মানুষের মনে দয়ামায়া-স্নেহ-ভালোবাসা- অর্থাৎ মানবিক যে সাধারণ অনুভূতি-সেগুলি ততটা বৃদ্ধি-বিকাশ পেতে পারে না। তার বিকাশ প্রকাশ বিস্তারের সামনে বাধার পাহাড় হয়ে দাঁড়ায় যাপিত জীবনের ক্লেদ পাঁক তীব্র হলাহল। যা তাকে অধৈর্য্য-উগ্র-ক্রোধী চন্ডস্বভাবের লোকে পরিণত করে তোলে। ফলে সে যদি সামান্য কোন ব্যাপারে তর্ক করে তার শেষটা হয় ঝগড়ায়। গলার শিরা ফুলিয়ে বিরাট চিৎকার আর অকথ্য গালি গালাজের মাধ্যমে। আর সে যদি কাউকে শাসন করে, শুধু ধমক ধামক দিয়ে ছাড়তে পারে না- মনের সব ক্রোধ উগরে দিয়ে নির্মমভাবে ঠেঙ্গায়। সেই নির্দয় নির্মম মার দেখে মনে হয়- যেন আত্মজন নয়-কোনো চোর-ডাকাতকে ঠেঙ্গাচ্ছে। 

দলিত সমাজের মহিলা- একে তো মহিলা হবার কারণে শারীরিক এবং মানসিক দিক থেকে ভীষণ দুর্বল। যে-দুর্বলতার অন্তর্নিহিত কারণ লুকানো রয়েছে সামাজিক ভেদভাবমূলক দৃষ্টিভঙ্গির গোপন কন্দরে। এই সমাজে পুত্রের যে-কদর, কন্যার তার কানাকড়িও নয়। বলাই হয়ে থাকে যে পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা। শুধু পুত্র উৎপাদনের জন্যই ভার্যার পালন পোষণ। আর কন্যা এখানে শুধু একটা দায়। অবাঞ্চিত একটা উৎপাত তাই-“মেয়ের নাম ফেলি, পরে নিলেও গেলি, যমে নিলেও গেলি।” এই মনোভাবের কারণে- বহুস্থানে তো কন্যা সন্তান জন্ম নেবার পরে গলা টিপে বা নুন খাইয়ে মেরে ফেলা হয়। যখন সেটা পারা যায় না সে মেয়ে বেঁচে থাকে। বেড়ে ওঠে চরম অনাদরে অবহেলায়। পুষ্টিকর খাদ্যের অপ্রতুলতায় রোগা পাতলা অপুষ্ট দুর্বল হতে থাকে এই সব কারণে। মরে যায় না বটে, বাঁচে মরো মরো হয়ে। 

দলিত পরিবারে এমনিতেই তো চিরদিনের ভাতের আকাল, তার ওপর এই অবহেলা-অনাদর- সব মিলিয়ে সেই শিশু বয়েস থেকেই মেয়েটি শারীরিক ও মানসিক উভয় দিক থেকে আর সবল হয়ে ওঠার কোনো সুযোগ না পেয়ে মনে মনে নুয়ে বেঁকে থেকে যায়। 

এই সমাজে মূলত অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে থাকার কারণেই শিশু শিক্ষার হার খুব কম। যেখানে ছেলেদেরই ইস্কুলে পাঠানো সম্ভব হয় না, মেয়েদের আর কি কথা! ফলে অধিকাংশ মেয়েই সম্পূর্ণ নিরক্ষর। শিক্ষা মানুষকে সচেতন সাহসী করে তোলে। অধিকারবোধ বুঝতে শেখায়-সাবলম্বী হতে সাহায্য করে। 

শিক্ষাদীক্ষাবঞ্চিত দলিত নারীরা এই কারণে মানসিক দিক থেকে ভীষণ কমজোরি। শত অন্যায় অত্যাচার অবিচার বঞ্চনাতেও সে কোন প্রতিবাদ করতে সাহস পায় না। তাকে বেঁচে থাকতে হয় সম্পূর্ণ পরনির্ভয় হয়ে- অপরের দয়া-কৃপা-করুণায়। স্বাবলম্বী নয়, তাই তার কোন স্বাধীনতাও নেই। বলা হয়ে থাকে- সে শিশুকালে পিতার অধীন, যৌবনে স্বামীর অধীন এবং বার্ধক্যে পুত্রের অধীন। যে-কারণে অধিকাংশ দরিদ্র দলিত অশিক্ষিত পরিবারে তাদের স্বামী তো বটেই, তুচ্ছাতিতুচ্ছ অপরাধে কখনও কখনও ভাসুর-শ্বশুর-দেবরও তাকে অকথ্য ভাষায় গাল দেয়- ফেলে গরুর মতো পেটায়। যেসব দলিত মানুষ শিক্ষায় দীক্ষায় কিছু উন্নত হয়ে চাকরি বাকরি পেয়ে ভদ্র শিক্ষিত লোকজনের সাথে মিলেমিশে নতুন সংস্কারে পরিশীলিত হয়ে গেছে- তাদের কথা আলাদা। সেই গুটি কয়েক পরিবারকে বাদ দিলে এমন খুব কম পরিবার আছে যেখানে বৌ পেটানো হয় না। কিছু তো এমন আছে যেখানে গর্ভধারিণী মাকে পিটিয়ে দেয় তারই আপন ছেলে। 

আমি দেখেছি- নমঃশূদ্র পরিবারের ছেলে বিবাহ করতে যাবার পূর্বে প্রথা অনুসারে প্রণাম করে মাকে বচন দিয়ে যাচ্ছে-“মা তোমার জন্য দাসী আনতে যাচ্ছি।” এই একটিমাত্র বাক্যে সেই নারীর এই সমাজ সংসারে কোন অবস্থা-অবস্থান তা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আর তাই সেই সদ্য বিবাহ করে নিয়ে আসা নববধূ পতিগৃহে পদার্পণ করেই টের পায়- সে যেন পিতৃগৃহ নামক অভয়ারণ্য থেকে নির্বাসিত হয়েছে এক শ্বাপদসংকুল বিজন প্রান্তরে। তার চারদিকে উদ্যত তর্জনী, অসংখ্য নিষেধের বেড়াজাল, শাসানি, রক্তচক্ষু,হিংস্র দাঁত-নখ। 

সে এক দাসী, আর কিছু নয়, হুকুমের চাকরানী। তাই দাসী-বাঁদী মালিকের কাছে যে ব্যবহার পায় সেটাই বরাদ্দ থাকে তার জন্য। থাকে শৃঙ্খলাপরায়ণতা- নিয়মানুবর্তিতা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা। আর বেচাল বেতাল চলার অপরাধে কঠিন শাস্তির বিধান। না, জোরে হাঁটবে না, এমনভাবে ঘাড় নীচু করে হেঁটে যাও পায়ে যেন কোন শব্দ না হয়। না, জোরে হাসবে না, সতর্ক থেকো যেন হাসিতে শব্দ না হয়। কথা বলবে না, যদি বলো খুব ধীরে- মৃদু মিনমিনে গলায়। কখনও যেন মাথা থেকে ঘোমটা না সরে যায়, ভাসুর-শ্বশুর কেউ যেন মুখ না দেখে ফেলে। এমন ধরনের শতেক নিষেধাজ্ঞার শেকলে বেঁধে নিয়ন্ত্রিত করে রাখা হয় জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ। পরপুরুষের দিকে তাকানো, হাসা বা কথা বলা- এসব ধরা হয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে। যার সাজা চোরের চেয়েও বেশি। 

নমঃ, পোঁদ, কাওরা, বাগদি এই চার প্রকারের জনসমুদায়ের জীবন যাত্রার পথ প্রণালী সব প্রায় একই। অধিকাংশের কোনো জমি জিরেত নেই। মাছ ধরা, চাষের জমিতে জনমজুর খাটা, ঘর ছাওয়া, বেড়া বোনা, মাদুর বোনা- এমন ধরনের কাজকর্মের দ্বারা অতিকষ্টে জীবন নির্বাহন। আগে তাদের সমাজে কোনো বরপণ বলে কিছু ছিল না। এখন উচ্চবর্ণের দেখাদেখি সেই জীবাণু এই সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছে। এটাই হয়েছে সবচেয়ে বড় মুশকিল। নিম্নবর্ণ সমাজ, উচ্চ বর্ণের অনেক অবগুণ তো গ্রহণ করে নিয়েছে, কিন্তু একটাও উচ্চগুণ আত্মসাৎ করে উঠতে পারে নি। সেটা পারলে তো আমরাও শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি- সর্বক্ষেত্রে ওদের পরাজিত করে দিতে পারতাম। আমাদের তাহলে আর আজ এমন দশা হত না। মাত্র পনেরো শতাংশ লোক পঁচাশি শতাংশ লোককে ছল-কপটতা দিয়ে হাজার বছর ধরে দলন দমন বশীভূত করে রেখেছে, এমন বক্তব্যে সত্য কম, নিজেদের ব্যর্থতা অনেক বেশি। 

ওদের সমাজে- স্বশ্রেণি-স্বজাতির মধ্যে যে-পারস্পরিক সৌহার্দ্য-দয়া-দরদ, দায়িত্ব-কর্তব্য আমাদের মধ্যে তা কই? 

কালীঘাট অঞ্চলে একদল ছেলে থাকে, কারও বাবা আছে মা নেই, তো কারও মা আছে বাবা নেই। কারও আবার মা-বাবা কেউই নেই। কেউ বা কোনো যৌনকর্মীর পরিত্যক্ত সন্তান। এবং এরা প্রায় সবাই নিম্নবর্ণ পরিবারের সন্তান। সব থাকে ফুটপাতে আর খিদে পেলে খায় ছোটখাটো চুরি ছিনতাই করে। তাই মাঝে মাঝে পুলিশ এদের ধরে নিয়ে যায়। 

একবার এই রকম চার-পাঁচজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে পুলিশ অফিসার নাম-পরিচয় জিজ্ঞাসা করার সময় জানতে পারলেন একটি বাচ্চার পদবি চক্রবর্তী। তিনি নিজেও ব্রাহ্মণ। তাই এক ব্রাহ্মণ বালকের এ হেন দুরবস্থা দেখে প্রাণ কেঁদে উঠল তাঁর। তিনি অন্য সব কটাকে তো জেলে পাঠিয়ে দিলেন, শুধু ওই ব্রাহ্মণ বালককে নিজে উদ্যোগ নিয়ে পাঠিয়ে দিলেন সরকারি হোমে। সেখানে বালক থাকবে,খাবে, সরকারি খরচে লেখাপড়া শিখে মানুষ হবে। 

আমাদের জাতিতে পুলিশ অফিসার অনেক আছে। আছে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক, মন্ত্রী, নেতা, আছে ডান হাত, বাঁ হাতে কামানো বড় বড় সরকারি কর্মচারী। বিশাল বাড়ি, দামি গাড়ি, প্রচুর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, পোষা কুকুর- সব আছে তার, নেই শুধু স্বজাতের জন্য কোনো মানবিক উদাহরণ। 

আমাদের আছে মায়াবতী- যে ‘দলিত কি বেটি’ থেকে ‘দৌলত কি রানি’ হয়ে যায় দলিত-দরিদ্র সাধারণ মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করে। ওদের আছে মহাশ্বেতা দেবী, অরুন্ধতি রায় যাদের একজন ম্যাগসাইসাই আর একজন বুকার পুরষ্কারের সব অর্থ অকাতরে দান করে দেয় আদিবাসী বনবাসী দরিদ্র দলিত কল্যাণে। 

ওদের আছে অমর্ত্য সেন যে নোবেল পুরষ্কারের টাকায় প্রতীচী ট্রাস্টের মাধ্যমে শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ নেয়, আমাদের আছে লালু যাদব যে গরুর মুখের খাদ্য কেড়ে খেয়ে ফেলে। 

আমাদের মধু কোড়া শিবু সোরেন-“জন সেবা”র দ্বারা জনশত্রু হিসাবে নিন্দিত আর ওদের শংকর গুহ নিয়োগী-বিনায়ক সেন ওই কাজের জন্য জনগণ দ্বারা বন্দিত। আমাদের জেলের মেয়েরানি রাসমনি বহু অর্থ ব্যয় করে- মন্দির গড়ে উচ্চবর্ণ সমাজে সম্মান পাবার চেষ্টায় মরিয়ে আর ওদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- সে চেষ্টা না করে শান্তি নিকেতন গড়েন- শিক্ষা বিস্তারে ব্রতী হন। 

এইসব কারণেই আমরা ওদের কাছে হেরে যাই, হেরে যাচ্ছি। উচ্চবর্ণ সমাজে পুরুষতন্ত্রের প্রবল দাপটের পরেও সতীদাহ এবং বাল্যবিধবাদের দুর্বিষহ জীবন-যাপনে বাধ্য করার পরেও যেটুকু যা আদর সম্মান, প্রেম-ভালোবাসা নারী জাতির জন্য অবশিষ্ট আছে, দলিত সমাজে তার কিছুমাত্র নেই। এই সমাজে নারীকে সর্বক্ষণ ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকতে হয়, কি জানি কি ভুল করে ফেললাম। কি জানি কখন স্বামী এসে চুলের মুঠি ধরে আছড়ে ফেলবে উঠোনে, পিঠে চেলা কাঠ ভাঙবে। বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। সতীন নিয়ে আসবে। লোকে বলে পেটে খেলে পিঠে সয়। এইসব অভাগী নারীর পেটে নেই ভাত, পরনে নেই কাপড়, মাথায় তেলবিহীন চুলে জটা তার ওপর ওই মার। সতীনসহ বসবাস। সন্তানসহ বিতারণ। 

আমার বাল্যকাল কেটেছে শিরোমণিপুর ক্যাম্পে, কিশোরকাল ঘোলা দোলতলায়, আর কিছু বছর দণ্ডকারণ্যে। এই তিনস্থান নমঃশূদ্র আর পোঁদ জাতির মানুষ দ্বারা পরিপূর্ণ। মাঝে কয়েকবছর দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় ছিলাম। সেখানে দেখেছি কাওরা মেয়েদের। আর এখন দেখছি বাগদি নারীদের। এই তিন জায়গার মধ্যে- নমঃ, পোঁদ, কাওরা, বাগদির মধ্যে- সব মিলের মধ্যে আর একটা বড় মিল-কেউ যদি তার বউকে পেটাতে থাকে-মারের চোটে যতই সে বউটা ‘ওরে বাবারে, মরে গেলাম রে’ বলে চেঁচাক, প্রতিবেশীদের কেউ ঠেকাতে ছুটে যাবেন না। আক্ষেপ করে বলবে-ওদের স্বামী-স্ত্রীর ব্যাপার, আমরা বাইরের লোক কি বলবো! 

দণ্ডকারণ্যের নমঃ, পোঁদদের মুখে অদ্ভুত একটা বাক্য শুনতাম, বলত তারা- গরু মরে পোড়া কপালের, বউ মরে ভাগ্যবানের। ওই সমাজে বউয়ের মূল্য গরুর চেয়েও কম। তার মৃত্যু তাই কোনো দুখঃদায়ক ঘটনা নয়, সৌভাগ্যের সূচক। সে মরা মাত্র আর একটা আনকোরা বউ পাওয়া যাবে-পাওয়া যাবে বরপণও। 

দণ্ডকারণ্যে যেখানে আমি ছিলাম, পূর্ব পাকিস্থান থেকে আগত পুনর্বাসনপ্রাপ্ত ওইসব শরণার্থী ভিলেজগুলো ঘিরে আছে ছোট বড় অনেক আদিবাসী গ্রামে। যেখানে গোন্ড জনজাতির মানুষের বসবাস। এই সমাজ এখনও মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বর্জন করে পুরোপুরি পিতৃতান্ত্রিক হয়ে উঠতে পারে নি। তাই এই সমাজে মেয়েরা অনেক বেশি স্বাধীনচেতা, সাবলীল এবং স্বাবলম্বী। সভ্য সমাজে মেয়ে যেন একটা অভিশাপ, দায়, দুঃসহ, বোঝা। আর এই সমাজে সে হচ্ছে একটা সম্পদ। এই সমাজে কোনো মেয়ের বাপ কোনো ছেলের বাপের কাছে গিয়ে নতজানু হয়ে বলবে না- দয়া করে আমার মেয়েটিকে গ্রহণ করে আমাকে কন্যাদায় থেকে মুক্ত করুন। ছেলের বাপকেই আসতে হবে মদ-মুরগি নিয়ে গলায় গামছা পেঁচিয়ে। বিনয় সহকারে বলতে হবে মেয়ের বাপকে, তার সম্পদটি দান করে যেন এক অন্ধকার গৃহের কোণে আলোক স্থাপনা করেন। যদি সে বিবাহ হয়ে যায়, এমন ভাবনার কোনো অবকাশ নেই যে, বনের পাখি ধরে খাঁচায় পুরে দিলাম। এখন সে আমার অধীন। যদি তার প্রতি কোনো অন্যায়-জুলুম হয়, যদি মনে কষ্ট পায়- পালিয়ে চলে যাবে সোজা বাপের বাড়ি। আর আসবে না। চাইলে বিয়ে করে নেবে অন্য কোথাও। একবার দু’বার নয়-প্রয়োজনে আঠারো বার। সমাজ তাকে সেই অধিকার দিয়েছে। তাকে গায়ের জোরে নয়, বেঁধে রাখতে হবে আদর সম্মান ভালোবাসা দিয়ে 

আমাদের এই নমঃ- পোঁদ সমাজ, উচ্চবর্ণ সমাজ থেকে নারী জাতির প্রতি নরম, কোমল, মানবিক হবার শিক্ষা তো নিল না। নিতে পারল না- আমরা যাদের জংলা বুনো বলি- সে আদিবাসী সমাজের শিক্ষা, সহমর্মিতার পাঠ- নারীকেও সংসার জীবনে সমকক্ষ ভাবার সংস্কৃতি। 

আমি কয়েক বছর আগে দলিত লেখিকা বেবী কাম্বলের আত্মজীবনী হিন্দি থেকে বাংলায় আনুবাদ করেছিলাম। উনি মহারাষ্ট্রের ডোম জাতির মেয়ে, জীবনের যে বিশ্রী বিড়ম্বনাময় চালচিত্র এঁকেছেন তা পড়ে শিউরে উঠতে হয়। একজন দলিত- যে জানে দলনের কি যন্ত্রণা, সে তারই নিজের সহধর্মিনীর কি ভীষণ যম-যন্ত্রণায় বেঁচে থাকা কঠিন করে তোলে। 

লিখেছেন তিনি-“রোগা, খর্বকায়, রোজগারহীন পতিকে আমরা ‘রাজা’ বলে স্বীকার করেছি। নিজের জীবন মন পতির শ্রীচরণে সমর্পন করেছি, বিনিময়ে সে কি দেয়? এক মাত্র দুঃখ,” কেন দেয়? 

একটি অপ্রিয় কিন্তু কঠোর সত্য যেন পুরুষ পুঙ্গবদের মনের ভিতর থেকে তুলে এনে বসিয়ে দিয়েছেন সাদা কাগজের পাতায়। যা ডোমদের বেলা যেমন আমাদের বাঙালি দলিতদের বেলায়ও একদম সঠিক। 

“সমাজ আমাদের গোলাম বানিয়ে রেখেছে। কিন্তু আমরা গোলামরাও মানুষ। আমাদের মনের মধ্যেও সেই ইচ্ছে চাগাড় দেয় যে, আমরাও কারো ওপর হুকুম চালাই, মনিবগিরি ফলাই। কিন্তু কে মানবে আমাদের মতো মানুষের হুকুম? তাই আমরা আমাদের ঘরের লোককে গোলাম বানাবার কথা ভেবেছি। যা খুবই সহজ কাজ। গোলাম বানিয়েছি পরের ঘর থেকে নিয়ে আসা মেয়েটিকে। যার পক্ষে দাঁড়াবার মতো আশেপাশে কেউ নেই। 

এই মহারাষ্ট্রের ডোম সম্প্রদায়ে মেয়ের বয়স আট-দশ বছর হলেই তাকে বসিয়ে দেওয়া হয় বিয়ের পিঁড়িতে। আগে যেমন নমঃশূদ্র মেয়েদের দেওয়া হতো। লিখেছেন তিনি- এইবার বধূর ঘটবে সত্যিকারের বনবাস যাত্রা। একটুখানি মেয়ে...। মা-বাবা সবাইকে ছেড়ে শ্বশুরালয়ে যাবে। “শ্বশুরালয়” মানে- স্বামীর মানে- সবকিছু অবগত সেই মেয়ে। 

শ্বাশুরবাড়ি আসার পর তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়বে নানাবিধ সমস্যা আর কাজের চাপে। সর্বপ্রথমে যে-কাজটি তাকে দেওয়া হবে তা রুটি বানানো। যদি কোনো রুটি সেঁকতে গিয়ে পুড়ে যায়, শুরু হবে বকাঝকা।(দণ্ডকারণ্যের কোনো নমঃ পরিবার হলে গোয়াল সাফ, উঠোন ঝাঁট, তারপর চান করে ভাত-তরকারি রাঁধা।) 

ভোর তিনটের সময় মোরগ ডাকার সাথে সাথে ওই ছোট্ট বউটাকে তার শাশুড়ি মাথার চুল ধরে টেনে ঘুম থেকে জাগায়। তারপর তাকে জাঁতা সাফ করতে বলে। শ্বাশুড়ি একঝুড়ি যব পেষাই করার জন্য বের করেছে। সে বউকে দেকে নিয়েছে নিজের সাথে একটু সহযোগিতা করার জন্য। পেষাইটা প্রথম শুরু করে সে-ই। সামান্য কিছু পেষাই করেই কোনো এক ছল-ছুতোয় বউকে জাঁতায় বসিয়ে দিয়ে সে উঠে যায়। আর আসে না। হয়তো গিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। কি আর করে সেই ছোট্ট বউ! সে জাঁতা ঘোরাতে শুরু করে। যব পিষতে পিষতে তার ছোট্ট হাতে ফোস্কা পড়ে যায়। আটা পেষাই হয়ে গেলে কলসি নিয়ে যায় নদীতে। জল আনবার পর বসতে হয় রুটি বানাতে। আর রুটি পুড়ে গেলে- গোল না হলে শাশুড়ি তার গালের চামড়া খামচে ধরে- যা মুখে আসে তা বলে গাল দেয়। আর স্বামী? না সে কিছু বলবে না। দূর থেকে দেখবে। বোঝা যাবে মায়ের কর্মকান্ডে তার সমর্থন আছে। 

নাক বহতা ননদ, অর্ধ উলঙ্গ দেবর সবার গালাগালি খেয়ে কাজ করে যেতে হবে সেই ছোট্ট বউটাকে। কাজ করতে করতে বেলা গড়িয়ে যাবে। ততক্ষণে বাড়ির সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। ওর জন্য পড়ে থাকবে পোড়া ধরা কয়েকটা রুটির কুঁচি। যা খেতে হলে খাবে কি দিয়ে? শাশুড়ি যখন এদিক-সেদিক যায় তখন নুনের ডেলা চুরি করে আঁচলে বেঁধে রাখে- সেই দিয়ে চলে তার রুটি খাওয়া। 

দণ্ডকারণ্যের পারাল কেটে দেখেছি নমঃ পরিবারের বালিকা বা কিশোরী বধূটির ভাগ্যেও জোটে- অধিকাংশ দিন- হাড়ভাঙা খাটুনির পর, হাঁড়ির তলায় পড়ে থাকা- কড়কড়ে-ঠান্ডা, কাঁকরযুক্ত কয়েকটা ভাত। অধিকাংশ দিনই তরকারিবিহীন সেই ভাত নুন আর লঙ্কা দিয়ে খেয়ে খিদেয় দহন নিবৃত্ত করতে হয় তাকে। 

আর কি ডোম কি নমঃ সব পরিবারের সব শাশুড়ির মনে সর্বদা এক আতঙ্ক জেগে বসে থাকে- এই বোধ হয় বউ আমার ছেলেকে বশ করে নিল। ছেলে আমার বুঝি পর হয়ে গেল। আর হয়তো বাধ্য অনুগত রইল না। তাই বউয়ের বিকশিত যৌবন সে সহ্য করতে পারে না। পুরুষকে বশ করার ওটাই তো সর্বনাশা অস্ত্র। তাই বউয়ের ওপর ছেলের মন বিষিয়ে তোলার জন্য ছেলের কানে অনবরত ঢেলে চলে কুতসা-নিন্দা,মন্দ। এর মধ্যে সবচেয়ে মোক্ষম এবং মারাত্মক সেই কুৎসা- তোর বউয়ের স্বভাব ভালো নয়। অমুককে দেখে হাসে। আর যদি গোটা দুয়েক সাক্ষী জোগাড় করে গল্প্টাকে আর একটু এগিয়ে নেওয়া যায়, পুত্রের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে খুব বেশি সময় লাগে না। 

বেবী কাম্বলে লিখেছেন- এই রকম বিরূপ-ক্ষিপ্ত, মাথামোটা সন্দেহপ্রবণ স্বামীর হাতে কত মেয়ের যে নাক কাটা গেছে সমাজে- তার কোনো হিসেব নেই। ক্রোধান্ধ স্বামীর ক্রোধ প্রশমন এবং ‘দুশ্চরিত্র’ স্ত্রীকে উচিৎ শিক্ষা দিতে তার নাক কেটে মুখাবয়ব বিকৃত করে দেওয়া- এটাই নাকি যথার্থ পৌরুষের লক্ষণ। নমঃশূদ্র বা কাওরা বাগদি সমাজে অবশ্য নাক কাটার মতো সাজা দিতে দেখা যায় না। তবে মাথার চুল কেটে দেওয়া-মেরে আধমরা করা, এসব খুব আছে। এতে শুধুমাত্র সন্দেহের বশে কত নিরপরাধ-অসহায় বধূকে যে সারা জীবন কি গ্লানি বয়ে বেড়াতে হয় কে জানে? 

ডোম বা নমঃশূদ্র, কাওরা বা বাগদি- নিম্নবর্ণ, অশক্ষিত মহল্লা-বস্তি-গ্রাম-গঞ্জে, পুরুষেরা বউদের কারণে-অকারণে যখন তখন জন্তুর মতো পেটায়। কারও মাথা ফেটে যায়, কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়ে, হাত-পা-কোমর ভেঙে যায় কারও কারও। 

এত মার খাবার পরেও সেই সব হতভাগীর ওপর কারও কোনো দয়া-দরদের সামান্য প্রকাশ দেখা যায় না। তার প্রতি দয়া দেখাতে গিয়ে প্রতিবেশীকে কেন অসন্তুষ্ট করবে! 

তখন এই পারাপারহীন দুঃখ-অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন বউটা হয়তো পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাবে বা কোথায়? গিয়ে ওঠে বাপের বাড়ি। সেই বাপ-মা’র কাছে মেয়ের নাম ফেলি...। সে তো বহু কষ্টে মেয়েকে এক জায়গায় ফেলে দিয়েছিল। আবার সেই মাথার উকুন মাথায় ফিরে এসেছে। যদি সে হতভাগী নমঃশূদ্র সমাজের মেয়ে হয়-সে বাড়ি গিয়ে পৌঁছানো মাত্র- মা-বাপ শুরু করে দেবে বকাঝকা। আর একবেলা বা একদিন রেখে- পরদিন বাপ ভাই কেউ একজন তাকে নিয়ে রওয়ানা দেবে সেই অগ্নিকুন্ডে ফেলে আসার জন্য। বুঝিয়ে বলে দেওয়া হবে- মরো বাঁচো স্বামীর ঘরই তোমার ঘর। বাপের বাড়ি যেন একা কোনো দিন এসো না। এলে স্বামীর সাথে-। 

এরপর তার সামনে একটা পথই খোলা থাকে-বিষের শিশি না হয় গলায় দড়ি। অত্যাচার অসহ্য হলে এই পথে মুক্তি। 

আর ডোম সমাজের মেয়ে যদি হয়- সে পালিয়ে বাপের বাড়ি পৌঁছবার আগেই সেখানে পৌঁছে গিয়ে বসে থাকবে স্বামী বা দেওর। সে তো এসেছে পায়ে হেঁটে ঝোপঝাড় বন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নদী-নালা পেরিয়ে- জন্তু জানোয়ার এবং বদলোকের নাগাল বাঁচিয়ে-নিজেকে লুকাতে লুকাতে। হয়তো পথে এক দু’দিন লেগে গেছে। স্বামী বা দেওর তো এসেছে সরল সোজা রাস্তা ধরে। শ্বশুর বাড়িতে এত দুঃখ-কষ্ট সয়ে ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর মেয়ে পিতৃগৃহে কোনো সহানুভূতি পাবে না। মেয়ে উঠোনে পা রাখামাত্র যে শ্বশুরালয় থেকে এসেছে বেদম পেটাতে শুরু করে দেবে। এরপর আর একপ্রস্থ পেটাবে মেয়ের বাপ-ভাই। তাদের সেই কথা প্রমাণ দেবার দায় রয়েছে-দ্যাখো আমরা আমাদের মেয়েকে কোনো প্রশ্রয় দিচ্ছি না। 

তারপর- সেই অনির্বাণ দুঃখের আগুনে নিত্য দহন হতে তাকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে শ্বশুর বাড়িতে।আবার সেই বউটি এসে পড়বে একদল কসাইয়ের হাতে। 

দ্বিতীয়বার শ্বশুরালয় আসবার পর অবাধ্য বউকে শায়েস্তা করার জন্য শুরু করা হয় নতুন ধরনের অত্যাচার। পাঁচ কিলো ওজনের একটা কাঠ সুতোর মিস্ত্রির কাছে নিয়ে গিয়ে এমনভাবে তার মাঝে ছিদ্র করা হয় যেন পায়ের মধ্যে ঢোকে। সেটা জেলখানার কয়েকদির ডান্ডাবেড়ির মতো পরিয়ে দেওয়া হয় বউটির পায়ে। এই ওজনদার কাষ্ঠখন্ড পায়ে নিয়ে নিত্যদিনের সব কাজকর্ম সারতে হবে তাকে। কাঠের গায়ে ঘষায় ঘষায় পা কেটে রক্ত গড়াবে, জখম হয়ে যাবে পা। হাঁটতে পারবে না। অর্থাৎ আর চাইলেও পারবে না। খাঁচায় পোরা বন্য পশুর মতো দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হবে তাকে, যতক্ষণ শ্বশুর বাড়ির লোকের আত্মা শান্ত না হয়। যতক্ষণ না সে বাধ্য-বিনীত-পোষা কুকুর না হয়ে যায়। 

দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কাওরা জাতিগোষ্ঠীর যে-সব মহিলাদের দেখেছি তাদের অধিকাংশের স্বামী সন্ধ্যে হবার সাথে সাথে ডুবে যায় মদ-তাড়ির নেশায়। কেউ কেউ তো দিনের বেলাতেও ডুবে থাকে। ফলে সংসার জুড়ে তীব্র অনটন। ওইসব মহিলারা সকাল বেলায় ট্রেন বোঝাই হয়ে চলে আসে শহর কলকাতায় বাবু বাড়ির বাসন মাজতে, ঘর ঝাঁট দিতে, কাপড় কাচতে। সংখ্যায় যে তারা কত গুণে শেষ করা যাবে না। সেই ভোর ছটা থেকে আটটা সাড়ে আটটা- সব আপ ট্রেনে গিজগিজ ভিড়- এদের জন্য। এদের জন্য একটা ট্রেনের নামই হয়ে গেছে- ঝি স্পেশাল ঝিয়ের ট্রেন। এরা সকালে এসে ফের ফিরে যায় সন্ধ্যার সময়। মাসান্তে পায় অতি সামান্য গুটি কয়েক টাকা। বলা চলে সেই সামান্য মাইনেয়- সে খায়, খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখে তার পুত্র কন্যা এবং নেশারু স্বামীকে। তবুও মাঝে মাঝে জোটে নির্দয় মার। তা সত্ত্বেও এদের পতিভক্তি পতিপ্রেম একটা বলার মতো বিষয়। এরা নিজেদের জন্য নিজেরা একটা ছড়া বানিয়েছে। মাঝে মাঝে সেটা বলে। বিইলে ভাতার জন্মের কুড়ে/ থাকুক আমার বেছন জুড়ে। এই ছড়ার দুটো লাইনে পরকীয়া থেকে নিজেকে সাবধান থাকার উপদেশ দিচ্ছে নিজেই। পরের ভাতার খড়ের নুড়ে/ ফুঁ দিলি সে যায় রে উড়ে। 

শোন রে যা হোক তা হোক আর যেমনই হোক স্বামীই হচ্ছে তোমার আসল আশ্রয়। যদি তাকে ছেড়ে অন্যের প্রেমে মজো সে-সুখ মাত্র দু’দিনের। তাই সে-সুখে দরকার নেই। আর একটি ছড়ায় সেই কথাই বলা আছে- পরের সোনা দিও না কানে/ কেড়ে নেবে হ্যাঁচকা টানে। 

বর্তমানে আমি যে-অঞ্চলে বাস করি-সেখানে বেশ কিছু বাগদি মানুষের বসবাস। বাগদি মহিলাদের খুব কমই ‘ঝি-গিরি’ পছন্দ করে। এদের প্রথম পছন্দ খাল-বিল, নদী-নালা সেচে জাল পেতে মাছ ধরে বেচা। আজকাল আর খাল-বিল খুব একটা নেই। কিছু বুজে গেছে, কিছু নগর সভ্যতার আগ্রাসন বুজিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ দূর বাজার থেকে কিনে এনে সেই মাছ নিজের অঞ্চলে বাজারে বেচে। 

এভাবেই প্রতিপালন করে পরিবার পরিজন। দু’বেলা দুটো দুঃখের অন্ন খেয়ে ‘সুখে’ বেঁচে বর্তে থাকে। বড় কোনো উদ্দেশ্য নেই- চাহিদাও খুব ছোট, সেই নিয়ে তাদের কোনোক্রমে টিকে থাকা। এইভাবে বেঁচে থাকে দলিত সমাজের মহাদলিত মহিলারা। যাদের জানা নেই বিচার ব্যবস্থা তাদের জন্য কি কি রক্ষা কবচ দিয়ে রেখেছে। কিভাবে পেতে পাড়ে তার ওপর ঘটে চলা অন্যায় অত্যাচার থেকে পরিত্রাণ। 

বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গ বিশেষ করে দুই চব্বিশ পরগণা জুড়ে দলিত-দরিদ্র, কিশোরী-যুবতীদের ওপর আর একটা ভয়াবহ বিপদ শকুনের ডানার ছায়া ফেলেছে। সেটা হচ্ছে পাচার। দুই জেলার হাজার হাজার মেয়ে ‘রাতের অন্ধকারে’ পাচার হয়ে চলে যাচ্ছে ভিনরাজ্যের কোন পতিতালয়ে। নানা জায়গা থেকে আড়কাটিরা খোঁজ-খবর নেয় কোন ঘরে কিশোরী বা যুবতী কন্যা আছে। তারপর তার মা-বাপের কাছে টোপ দেয়। একটা ভালো ছেলে আছে। টাকা পয়সা জমি জায়গার কোনো কমতি নেই। কোনো পণ তো নেবেই না, উল্টে কিছু দেবে। যদি বিয়ে দাও মেয়ে রাজরানি হয়ে থাকবে। 

এরপর একটা লোক দেখানো বিয়েও হয়ে যায়। বউ নিয়ে সে চলে যায় ইউ.পি., বিহার। আর তার কোন হদিস মেলে না। কিছু কিছু মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হয় কোথাও কোনো উচ্চ বেতনের কাজের লোভ দেখিয়ে, কাউকে ফাঁসানো হয় প্রেমের ফাঁদ পেতে। যেভাবেই হোক একবার সে-মেয়ে ঘরের বাইরে পা রাখে-ফিরে আসার আর পথ পায় না- হারিয়ে যায় অন্ধকারের চোরা বাঁকে। তলিয়ে যায় পুঁতিগন্ধময় অতল বিতলে। 

আরও একটি ভয়ংকর বিপদ তাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে, সেটি ধর্ষণ। ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরো- N C R B-র একটি রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে যে গত ২০১১-২০১২ এই দুই বছরে যে-ধর্ষণের অভিযোগগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার সংখ্যা ৬০০৭৫। অনুমান করে নিতে অসুবিধা নেই যে, এর বহুগুণ বেশি লিপিবদ্ধ হয় নি, নানা কারণে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে একটি বা দু’টি বাদ দিলে- এই সমস্ত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে দলিত-দরিদ্র, কিশোরী-যুবতী-মহিলাদের ওপর। কারণ এরাই তো সবচেয়ে দুর্বল আর অরক্ষিত। মাঠে ঘাটে নিরালা পথে- রাতে এদের চলাচল করতে হয় পোড়া পেটের প্রয়োজনে। 

এভাবেই বেঁচে রয়েছে দলিত সমাজের মা-বোন-মেয়ে অনাত্মীয় এক হিংস্র সমাজে।

1 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in













১৪ 

পরবর্তী সময়ে দিনের চব্বিশ ঘণ্টার বেশির ভাগটাই ফ্রান্সেস্কো চার্চে পৌরোহিত্যের কাজ, একাগ্রচিত্তে ঈশ্বরের প্রার্থনা, ধর্মগ্রন্থ পাঠ, কঠোরভাবে সংযম পালন করা- ইত্যাদি ব্যাপারে নিজেকে ব্যস্ত রাখছিলো। অতীতে সে কখনো ভাবেই নি যে তাকে এমন অসহায়ভাবে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে হবে, যাতে স্থূল, পঙ্কিল, মাংসল এক অদ্ভুত যুদ্ধের মধ্য থেকে সে জয়লাভ করে বেরিয়ে আসতে পারে। ভালো এবং মন্দ- এই দুয়ের প্রবল কী দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল তাঁর বুকের মধ্যে! প্রবল ভীতি ঘিরে রেখেছিলো তাঁকে; তাঁর মনে হয়েছিল ঈশ্বর এবং শয়তান যেন লড়াইয়ের ময়দান হিসেবে তাঁরি বুকের ভেতরটা বেছে নিয়েছেন। 

তাঁর অস্তিত্বের সবচেয়ে দায়হীন অংশ, এমনকি তাঁর ঘুম- সেখানেও শান্তি পাচ্ছিলো না তরুণ যাজক। একদম ঠিক মাঝরাতের অরক্ষিত সময়টাকে শয়তান তাঁর আক্রমণের জন্য বেছে নিয়েছিল। ঘুমের মধ্যে শয়তান হামলা চালাতো নিষ্পাপ, নির্দোষ ফ্রান্সেস্কোর উপরে; অদ্ভুত প্রলোভনকারী এবং হানিকারক ঠাট্টা, স্বপ্ন এসবই ছিল শয়তানের অস্ত্র। একদিন ভোররাতে, সে জেগে ছিল না ঘুমিয়ে ছিল, ঠিক বুঝতে পারছিলো না; সে দেখলো এক অপার্থিব চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে তাঁর ঘর, তাঁর বিছানা। সেই দুধসাদা আলোয় দাঁড়িয়ে আছে সেই সামন্তপ্রভুর তিন কন্যার শ্বেতশুভ্র মর্মরমূর্তি। সে তাঁর বিছানায় বসে খুঁটিয়ে দেখছে সেই মূর্তিগুলি এবং অবশেষে মূর্তিগুলি সেই মন্‌টে ক্রোশের আল্পসে দেখা কিশোরী মেষপালিকার অবয়বে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে। 

ফ্রান্সেস্কোর ঘরের জানালা দিয়ে দূরে আল্পস পর্বতের ঢালে খেলনার মত দেখাচ্ছে স্কারাবোটাদের জনপদ। নিঃসন্দেহে এক অদ্ভুত যোগসূত্র তৈরি হল এই দুই স্থানের মধ্যে, তবে এই সূত্রের বাঁধনটা অবশ্যই দেবদূতেরা বুনে দেয়নি। ফ্রান্সেস্কো স্বর্গের ক্রমবিভাগের শ্রেণি সম্পর্কে অবগত, এবং নরকের শ্রেণিভেদ সম্পর্কেও কিছু কম জ্ঞান নেই তাঁর; অতএব, সে বুঝতে পারছিল এই কাজ কার! ফ্রান্সেস্কো ডাকিনীবিদ্যার বিষয়ে জানতো, এই বিষয়েও বিশেষ পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান থাকার দরুন সে বুঝতে পারছিলো যে গ্রহতারার অবস্থান ও বিশেষ সময়ের মুহূর্তগুণকে কাজে লাগিয়ে শয়তানের প্রভাব দ্বারা কেউ তাঁর ক্ষতি করবার চেষ্টা করে চলেছে। সে জানতো যে জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী, মানুষের উপরে গ্রহতারার বিশেষ প্রভাব আছে। মানুষের মনে দেবদূতের প্রভাব প্রকট হলে, ঈশ্বরের আশীর্বাদ পাবে সে; কিন্তু ঈশ্বর পথভ্রষ্ট দেবদূতদের অনেক সময় প্রশ্রয় দেন, এবং সেই বিশেষ সময়ে তারা ঈশ্বরের পথ থেকে মানুষকে সরিয়ে দিয়ে শয়তানের রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এছাড়াও একটা সাময়িক, শারীরিক প্রভাব, যা নরকের প্রেতাত্মা বিস্তার করে, অবশেষে মানুষের ধ্বংসের কারণ হতে পারে। সব মিলিয়ে, তরুণ যাজকের অন্তরাত্মা ভয়ে কেঁপে উঠেছিল- ডায়াবোলির বিষাক্ত কামড়ের ভয়ে, জান্তব রাক্ষস বেথেমোথের ভয়ে, এবং বিশেষভাবে অসমোডিয়াস, ব্যভিচারের দানবের ভয়ে। 

প্রথমে সে মনস্থির করতে পারছিলো না, ভাবতে পারছিলো না সত্যিই এরকম হতে পারে। সে ভাবতে পারেনি যে সেই অভিশপ্ত ভাই বোন তাঁর উপরে কালা যাদু প্রয়োগ করবার মত পাপ করতে পারে! কিন্তু দিনে দিনে নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে তাঁর সন্দেহ পাকাপোক্ত হতে লাগলো। প্রতিদিন, সমস্ত ধর্মাচরণ কঠোরভাবে পালন করেও তাঁর অন্তর থেকে সেই মেষপালিকার ছবি মুছে ফেলতে পারছিলো না সে। বরং সেই ছবি আরও পরিষ্কারভাবে শিকড় গেড়ে বসছিল তাঁর মনে। সেই ছবি কোথায় আঁকা? কেমন ক্যানভাস? নাকি কোনো কাঠের টুকরো... যা জলে ভেসে যায়না, কিম্বা আগুনে পুড়ে যায়না! 

ছবিটা নিঃশব্দে সর্বত্র ছড়িয়ে যাচ্ছে, সে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করছিলো। একদিন সে বই পড়ছিল, হঠাৎ তাঁর মনে হল সেই বইয়ের পাতায় রয়েছে অদ্ভুত মেটে বাদামী রঙের চুলে ঘেরা সেই নরম মুখমণ্ডল। দীঘল আয়ত চোখে গভীর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে সেই কন্যা, যেন এখনই কথা বলে উঠবে। সেই পাতাটা উল্টে অন্য পাতায় গেলো, মনে হল সেখানেও দেখা যাচ্ছে সে ছবি। ছড়িয়ে যাচ্ছে প্রতি পাতায়। পরে হয়তো আবার বইয়ের পাতায় নয়, অন্য কোথাও, পর্দার উপরে, দরজার পাল্লায়, ঘরের দেয়ালে, এমনকি গির্জার দেয়ালেও ভেসে উঠতে লাগলো সে মুখের ছবি। 

তরুণ যাজক অধৈর্য হয়ে উঠতে লাগলো এরকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব এবং উদ্বেগের মাঝে, কারণ স্যান্ট আগাথার শিখরে তাঁর বিশেষ সেবামূলক কাজের তারিখ আরও দেরিতে। সে ঐ কাজটি তাড়াতাড়ি করতে চাইছিল যাতে নরকের রাজপুত্রের কবল থেকে ঐ মেষপালিকাকে বাঁচানো সম্ভব হয়। তাঁর আরও একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিল, তা হল সেই কন্যাকে আরেকটিবার দেখতে পাওয়া। কিন্তু যা সে ভীষণভাবে চাইছিল, তা হল মুক্তি; সমস্ত কুৎসিত, অত্যাচারী মুহূর্ত, বীভৎস, উৎকট, উদ্ভট খেয়ালখুশি থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিল সে। ফ্রান্সেস্কো খাওয়াদাওয়া কমিয়ে দিয়েছিল, রাতের অধিকাংশ সময়ে জেগে থাকছিল। আরও ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছিল সে। কঠোর সংযমের মধ্য দিয়ে সে আগের চেয়েও আরও মহৎ, আরও বেশি এবং প্রায় দৃষ্টান্তস্বরূপ এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি হয়ে উঠলো। 

অবশেষে সেই সকাল উপস্থিত হল। হতদরিদ্র সেই পাপীদের স্যান্ট আগাথার শিখরে সুগারলোফ পর্বতের চ্যাপেলে জমায়েত হওয়ার দিন। ফ্রান্সেস্কো তাদের মধ্যে ঈশ্বরের বার্তা পৌঁছে দেবার জন্য যাত্রা শুরু করবে। দুঘণ্টার কমে সেই স্থানে আরোহণ করা সম্ভব নয়; অসম্ভব কায়িক শ্রম প্রয়োজন সেই দুর্গম পথে যাত্রা করবার জন্য। সকাল নটা নাগাদ পৌরোহিত্যের কর্তব্যের জন্য প্রস্তুত হয়ে ফ্রান্সেস্কো রওনা দিলো। সোয়ানা গ্রামের কেন্দ্রস্থলের সেই চতুষ্কোণ মাঠের মধ্য দিয়ে প্রফুল্লচিত্তে, জগতকে দেখবার এক নতুন চোখ নিয়ে যাত্রা শুরু করলো তরুণ যাজক। মে মাসের আরম্ভ, বড় সুন্দর দিন! কিন্তু প্রকৃতির মায়া ছাড়াও সে একইরকম সৌন্দর্য অনুভব করেছে। সে যেন ঐশ্বরিক স্পর্শ অনুভব করছে। সে স্বর্গের ইডেন উদ্যানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তাঁর এই ধরণের অনুভব হতে লাগলো। 

সেই এলাকার স্ত্রীলোক এবং কিশোরীরা যথারীতি সারকোফাগাসের* পাশে উপচে পড়া ঝর্ণা এবং ফোয়ারার জলের আশেপাশেই ছিল। তারা উচ্চস্বরে ফ্রান্সেস্কোকে সকালের শুভেচ্ছা জানাতে লাগলো। তাঁর ভঙ্গি এবং অভিব্যক্তির মধ্যে এমন কিছু ছিলো, যার ফলে, যারা জল নিতে এবং কাপড়চোপড় কাচতে এসেছিলো, তারা যথেষ্ট সাহসী হয়ে উঠে তাঁর সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছিল। হাওয়ায় তাদের স্কার্ট দুপায়ের ফাঁকে আটকে গিয়ে পায়ের গোছ এবং হাঁটু অবধি দৃশ্যমান হচ্ছিল, যখনই তারা নিচু হয়ে কাচাকুচি করছিল। তাদের উন্মুক্ত পরিপুষ্ট বাদামী হাতগুলি অবিরত শ্রমে নিযুক্ত ছিল। ফ্রান্সেস্কো একটা দলের সামনে দাঁড়িয়েছিলো। সে তাদের সঙ্গে কোনো ঐশ্বরিক আলোচনা করছিলো না, বরং সময়টা কেমন, আবহাওয়া কেমন, সবার মেজাজ-গতিক, এবছরে কেমন ওয়াইন বানানো সম্ভব- এসব নানা জাগতিক বিষয়ে কথা বলছিল তাদের সঙ্গে। 

যিনি প্রসিদ্ধ ভাস্কর ছিলেন, সেই কাকার বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে, সম্ভবত সেখানেই- শিশুকালে প্রথম সারকোফাগাসের সূক্ষ্ম অলঙ্কৃত ছাঁচ দেখেছিলো ফ্রান্সেস্কো। ব্যাকাস যাদের আরাধ্য দেবতা, সেই বিশেষ সম্প্রদায়ের পুরোহিতরা সারকোফাগাস নিয়ে রাস্তা দিয়ে শোভাযাত্রা করে যাচ্ছিল। সারকোফাগাসের গায়ের অলংকরণে দেখা যাচ্ছিল এক অদ্ভুত রোমান দেবতা, স্যাটিয়ার- যার শরীর মানুষের মত, অথচ কান ঘোড়ার মত, তাঁর লাফিয়ে লাফিয়ে চলার চিত্র। সেই অলঙ্করণের চিত্রে নেচে নেচে বাঁশি বাজাতে বাজাতে যাচ্ছিল কেউ, নেকড়েরা ডায়োনিসাসের রথটা টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিলো, ডায়োনিসাসের মাথায় আঙুরের মুকুট, তিনি ওয়াইনের দেবতা। শিশুবেলায় তাঁর কাছে এই প্রাচীন রীতি অদ্ভুত বলে মনে হয়নি; সেসময় তাঁর এটা দেখে আশ্চর্য লাগেনি যে মৃত্যুর কঠিন নির্মোক ঘিরে উচ্ছ্বাস এবং উচ্চকিত জীবনের জয়গাথা খোদাই করা রয়েছে। এই মুহূর্তে তাঁকে গ্রামের কত নারী এবং কিশোরীর দল উচ্ছ্বাসে ঘিরে ধরে কথা বলে চলেছে, এরা অনেকেই ভারি সুন্দর, অদ্ভুত সুন্দর... যেন সেই সারকোফাগাসের অলংকরণের সুন্দরী মেনাড, অর্থাৎ ডায়োনিসাসের অনুগামিনী মদমত্ত সঙ্গিনীদের মত, যারা তাঁর রথটিকে ঘিরে ঘিরে নাচছিল- এরাও সেরকমভাবে তাঁকে ঘিরে ধরে নানা কথা বলে চলেছে। 

ফ্রান্সেস্কোর এই দ্বিতীয়বারের পর্বতারোহণকে যদি প্রথমবারের সঙ্গে তুলনা করা হয়, এখন যদি তা চোখ কান খোলা কোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পথ চলা হয়ে থাকে, তাহলে প্রথমবারের যাত্রা ছিল মায়ের গর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়া কোনো জন্মান্ধ শিশুর পথে বেরোনো। এক অদ্ভুত, অনিবার্য স্বচ্ছতার সঙ্গে যেন সে সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলো। সেই অর্থে সারকোফাগাসের এই অলঙ্করণ অর্থহীন নয়, সে যেন এইমাত্র বুঝতে পারলো। এই সমাধির মাঝে মৃত্যুর জায়গা কোথায়? জীবন্ত ঝর্ণার জলধারা এসে সমাধির চারপাশের গহ্বর জলে পূর্ণ করে দিচ্ছে, জীবনের শাশ্বত সত্যের বাণী প্রাচীন ভাষায় এই সমাধির মর্মরের গায়ে উৎকীর্ণ রয়েছে। এ তো মৃত্যুর নয়, বেঁচে থাকার গল্প, বেঁচে থাকার শিক্ষা। 

আগে সে যা শিখেছে, তাঁর সঙ্গে এই শিক্ষার কোনো মিল নেই। এই শিক্ষা বইয়ের পাতার থেকে, ধর্মগ্রন্থের কালো কালো অক্ষরের মধ্যে থেকে পাওয়া সম্ভব নয়, গাছের পাতায়, মাটির তৃণদলে, ফুলের পাপড়ির মধ্যে, লতায়, শাখায়, শিকড়ে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে নানা রকমের শিক্ষা। পৃথিবীর মাটি থেকে উঠে আসে, সূর্যের আলোয় আত্মপ্রকাশ করে প্রকৃতি থেকে পাওয়া এই শিক্ষা। প্রকৃতির সর্বত্র জীবনের জয়গান গাওয়া হচ্ছে। মৃত এবং মূক যা কিছু, তারাও যেন মুখর হয়ে উঠছে, গোপনে গোপনে কত কথা বলে চলেছে। প্রকৃতি এতদিন এই তরুণ যাজককে এরকম কোনো শিক্ষা দেয়নি, এরকম কোনো কথা বলেনি। আজ যেন সে হঠাৎ তাঁকে জীবনের নতুন নতুন পাঠ দিয়ে চলেছে। এখন যেন সে প্রকৃতির পরম প্রিয় এক সন্তান, যাকে ধরিত্রী মা সন্তানের মত আগলে রেখেছে, প্রকৃতির পবিত্র গোপনীয় সত্য সে আপন অন্তরাত্মায় অনুভব করছে, পৃথিবীমায়ের স্নেহস্পর্শ সে অনুভব করতে পারছে। তাঁর ত্রাস, ভীতি, উদ্বেগ, সবকিছুর থেকে যেন সে মুক্তি পেয়েছে। অন্ধকার নরকের ডাক, যা তাঁকে অনবরত ভাবিয়ে তুলেছিল, সেসব কোথায় দূরে চলে গেছে। প্রকৃতির অকৃপণ ভালোবাসা পেয়ে আজ তাঁর অন্তর পরিপূর্ণ হয়েছে। প্রীতিতে উপচে যাচ্ছে তাঁর হৃদয়। যে ভালোবাসা সে পেয়েছে, বিপরীতে একইরকমভাবে প্রীতি, প্রেম ও ভালোবাসা প্রকৃতিকে দেবার জন্যেও সে আজ প্রস্তুত। 

পাহাড়ে আরোহণের যাত্রা খুব সুখকর নয়, ঢালু পথে পায়ের নিচে টুকরো পাথর ছিটকে ওঠে, পিছলে যায় নিচের দিকে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল ফ্রান্সেস্কোর কোনো গ্লানিবোধ হচ্ছিলো না। সুন্দর বসন্তের সকালে, লতাগুল্মের ঝোপজঙ্গলের মধ্য দিয়ে, বিচ গাছ, ব্ল্যাক বেরির বাগানের মধ্য দিয়ে- সে এগিয়ে চলেছিলো। প্রকৃতি যেন তাকে ঘিরেই ঘুরতে ঘুরতে এক আনন্দময় ও শক্তিশালী সিম্ফনির মতো সুর ছড়াচ্ছিলো যা সৃষ্টির গভীর রহস্যের কথা বলে যাচ্ছিলো তাঁর কানে কানে। মৃত্যুর বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে থাকা সৃষ্টির রহস্য উদ্ঘাটিত হচ্ছিলো তাঁর কাছে। তরুণ যাজকের মনে হল যে, প্রকৃতির এই সিম্ফনির সুরের পাশে যারা এতদিন ‘জুবিলিটি ডিও ওমনিস টেরা’ কিম্বা ‘বেনিডিক্‌ট কোলি ডমিনো’র সুরের প্রশংসা করেছে, তারা নিজেকেই প্রতারণা করেছে। 

(চলবে) 

*সারকোফাগাস- পাথরের তৈরি সূক্ষ্ম অলঙ্করণ যুক্ত সমাধির বাক্স। কফিন নয়। 

গেরহার্ট হাউপ্টমান রচিত ‘ড্যের কেৎজার ফন সোয়ানা’ অবলম্বনে লেখা

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সায়ন্তন ঠাকুর

Posted in


আমার বামদিকে একখানি চওড়া পিচের রাস্তা আর ডানদিকে অনুচ্চ মালভূমির সারি, মধ্যিখানে যতিচিহ্নের মতো এই মাঠা বনবাংলো। বঙ্গালদেশে কার্ত্তিকমাস অতিথি হয়ে এসেছে ক’দিন হল, মেঘ এখনও বিদায় জানায় নাই এই শ্যাম ভূখণ্ডকে, মাঠা ও পাখি পাহাড়ের গায়ে গায়ে দোলা খাচ্ছে মেঘের দল। কুয়াশার মায়া রচনা করে উনানের ধোঁয়ার মতো ভেসে ভেসে কী জানি কোথায় চলেছে।

বাংলোটির বাহুল্য নাই, সবুজ রঙ করেছে এরা দেওয়ালে। সকাল থেকেই আজ খুব বৃষ্টি, কার্ত্তিকের দ্বিপ্রহরে বৃষ্টি হলে ভালো লাগে না, মন বিষণ্ন হয়, নরম হলদে মতো আলো প্রত্যাশী হৃদয় তোমার কথা মনে করে ভার হয়ে থাকে।

উঠানে বসে আছি। একখানি টিনের চাল মাথার ওপর, অনবরত জলপাতের শব্দ সেখানে পতঙ্গের পায়ের মলধ্বনি হয়ে বেজে চলেছে, বেজেই চলেছে। আমার এপাশে দুটি যমজ তেঁতুল গাছ একে অপরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর উঠানের ওপারে পাহাড়ের সানুদেশে যৌবনকালের ভালবাসা হয়ে ফুটে আছে বৃক্ষরাজি। শাল আর মহুয়া। এখন ভারী সবুজ চারধার। অত সবুজ রঙের উৎসব দেখলে মহাপ্রাণের কথা মনে ভেসে ওঠে। সরু পথখানি পায়ে পায়ে মাঠা পাহাড়ের ওপরের দিকে গেরুয়াবসন সন্ন্যাসীর মতো চলে গেছে। সহদেব বলল, ও পথেই সায়ংকালে হাতির দল যাতায়াত করে।

সহদেব, ওঁরাও উপজাতির মানুষ। ওদের জাহেরদেবীর একটি প্রাচীন থান আছে ওইখানে, আমার সে অনার্য দেবীকে দেখার বড় বাসনা জেগেছে, একমুঠো বুনো ফুল কয়েকটি পাতা ভিজা শালপাতায় মুড়ে নিয়ে যাব, তবে বাসনা ক্ষয় করব বললেই তো আর করা যায় না, তার জন্য সংস্কার দরকার হয়। তবুও পথ বেয়ে যেতে ইচ্ছা করে তাঁর কাছে।

নিবিড় বৃষ্টিসম্পদে ভরা পথটি বেয়ে দেখি মাঠা পাহাড়ের সানুদেশে নেমে আসছে দুজন যুবতি। একজনের পরনে হেমন্তঋতুর বসন, অন্যজন নীলাম্বরী। টান করে চুল বেঁধেছে, তেলতেল জলে ভেজা মুখ। বৃষ্টির জল গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে শরীর বেয়ে। আজ বিষ্যুদবারে হাট বসে, দুয়ারসিনির হাট। কলহাস্যমুখর যুবতিরা বোধহয় হাটেই চলেছে।

কী কিনবে হাট থেকে কে জানে ! মাথার ফিতা, মোটা চাল, শুয়োরের মাংস নাকি ভাগা দিয়ে বিক্রি হয় হাটে, বড় বড় কাঁচা শালপাতায় মুড়ে দেয়, হয়তো মাংসও খানিক কিনবে। সর্ষের তেল, ঝাঁঝওয়ালা শুকনো লঙ্কা, তাজা মেটে আলু। আমি দীন নগরজন, জঙ্গলবিলাসী হাটের এসব চিত্রমালা তৈরি করি, জিনিস কিনতে পয়সা লাগে, ওদের হাতে পয়সা আছে কিনা তা জানা নাই। দুমুঠো ভাত জোগাড় করতেই আমাদের দিন ঢলে পড়ে রাত্রির দিকে, তারপর আবার অলঙ্কার আর জিভের স্বাদ! ওসব অরণ্যপ্রণয়কথা বাবুদের সাহিত্যেই ভালো!

দু ফাঁকওয়ালা ল্যাজ নিয়ে একটা ফিঙে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে শালগাছের মাথায়। শব্দহীন দ্বিপ্রহরে ওই দুজন যুবতি আর আমিই যেন জগত রচনা করেছি এখানে। আর কোথাও কোনও শব্দ নাই, শনশন শব্দে হাওয়া বইছে, ওপর থেকে পাহাড় মুছে দিয়ে নেমে আসছে শ্লেটরঙা মেঘ। 

এমন জলের দিনে হাট বসে না ভালো। দু চারজন জীর্ণ লোক ক’টি ক্ষেতের সবজি নিয়ে ভুঁইয়ের ওপর বসে থাকে। কোনও রঙ নাই, সন্ধে নেমে আসে চারপাশে, বেচাকেনা জমে না, আমার মতো বনবাংলোয় বেড়াতে আসা দিকুরা অশ্লীল রসিকতার মতো সস্তা বাজারে ঘুরে বেড়ায়। চা সিগারেট খায়, তাজা মউল খোঁজে, সেই কবে থেকে এমনই হয়ে চলেছে। আজকাল তো মোবাইল ফোন উঠেছে এদিকেও, হিন্দি গান বাজছে একটা ছোট চা-দোকানে। কাঠের আখার চায়ে ধোঁয়া ধোঁয়া গন্ধ। ডালবড়া ফুলুরি ভাজা চলছে কড়াইয়ে। 

একটু পরেই ময়লা মেঘের আলো ফুরিয়ে যাবে। হাতির দল যাতায়াত করে এ পথে, দুপাশে সাদা হলুদ পুটুস ঝোপ, পাতা ছিঁড়ে আঙুলে ঘষলে বুনো কষাটে গন্ধ লেগে যায় হাতে। জোনাকপোকা উড়বে আঁধারে, এমন পথের মাঝে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে শ্বাস নিতে ইচ্ছা করে, মনে মনে কত কথা ওঠে। সব অস্পষ্ট, কতক বুঝতে পারি কতক বোধবুদ্ধির সীমানার বাইরে বসে থাকে।

পথ বেয়ে একজন বুড়া লোক এক বালককে সঙ্গে নিয়ে সামনের দিকে চলেছে। লোকটির উদোম শরীর, মলিন খেটো ধুতি পরনে, সারা দেহে আঁচড়ের মতো বলিরেখা। বালকটির খালিগায়ে বৃষ্টির জল মুক্তোর মতো ফুটে উঠেছে। ভারী সাধ হয় ওদের সঙ্গ নি, ওই রাস্তায় ভারতবর্ষ নামক এই বিচিত্র ভূমি হেঁটে চলেছে চার হাজার বছর পাঁচ হাজার বছর। 

ওই যাত্রাপথটুকুই শুধু বোধহয় বেঁচে থাকে,মহাকালসাগর স্রোতে মানুষের মতো ক্ষুদ্র অসহায় প্রাণীর হাত পা ছুঁড়ে আপ্রাণ ভেসে থাকার অসম যুদ্ধের কথা লেখা থাকে সেখানে। পথের প্রতিটি বাঁকে অস্ত সূর্যের আভায় ঝোপ জঙ্গল উঁচু উঁচু গাছেদের মাথায় কুয়াশাবৃত সন্ধ্যা ও সকালে প্রত্নচিহ্নের মতো লেগে থাকে নশ্বর ধুলাখেলার বাসনা রেণু। 

ভারী ভালো লাগে ওসব দেখতে, কোথাও পৌঁছে যাওয়ার তাড়া নাই আমার, সময়ের তীর নাই ঘাড়ের ওপর, শুধু সামনের দিকে চলা এখন, অনির্দিষ্ট পথে।



তবে বৈকালে মেঘ দূরদেশে রওনা দিল, দরিদ্র আলো ফুটে উঠল মহাকাশে, ভিজে ভিজে, জলে ধোওয়া নূতন ধান হতে তৈরি চালের মতো। 

আমার ঘরের ওদিকে পাহাড়, সবুজে সবুজ। তার পূর্বে চঞ্চলা নদী। পাথর আর পাথর নদীর দেহে, মাঝে ঝিরিঝিরি জলের শব্দ। 

জানলার পর্দা সরিয়ে চেয়ে আছি, উপত্যকায় চাঁদ উঠি উঠি তখন। কত রাত কে জানে! ঘড়ি নাই, চোখে আঁঠা আঁঠা তন্দ্রা। পাহাড়ের ঢালে রুপো রুপো আলো। দেখি জানলার বাইরে একজন বলিষ্ঠ মানুষ হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন, গায়ে মোটা খদ্দরের পাঞ্জাবি, সরু পাড় মিলের ধুতি, হাতে একখানি ছড়ি। অবাক হয়ে চেয়ে আছি, একটু যেন ছায়া ছায়া দেহ। আমার দিকে চেয়ে জিগ্যেস করলেন
—খোকা! যাবি বেড়াতে ?
—এখন ?! এই এত রাতে ?!
—ভয় কী! আমি আচি তো! চল, তোকে গাচ চেনাব কেমন!
—কী গাছ ?
—কেন, এলাচ গাচ! তুই চিনিস খোকা এলাচ গাচ ?
—এখানে কি এলাচ হয় খুব ?
—হয় তো! তারপর দেকবি কেমন পাখি আচে! এই বড় বড় মুরগির মতো!
—কী পাখি ?
—ওরা তো কালিস বলে ডাকে শুনেচি!
—কালিস ?
—হ্যাঁ রে!
বলেই কেমন বিষণ্ন হয়ে গেল মানুষটির মুখ। চাঁদের আলোয় দুঃখী মানুষের মুখে অতীন্দ্রিয় ছায়া খেলা করে, প্রথমবার দেখলাম আমি। একটু চুপ করে থেকে বলে উঠলেন
—সবাই ওদের মারতে চায় জানিস খোকা! শিকার করে! কালিসের মাংস নাকি খুব ভালো খেতে। 
—ইসস
—খুব লোভ রে চারধারে! দেকচিস না কেমন মানুষকে ঘর ছাড়া দেশ ছাড়া করার বিচার বসেচে। 
—আপনি কি এখানেই থাকেন ?
এ-কথা শুনে হা হা করে খোলার মতো হেসে উঠলেন তিনি, তারপর বললেন
—আমাদের কি ঘর আচে, খোকা! 
—নাই ?
—নাহ! কেউ আমাদের ভালবাসে না রে বাবু
—তাহলে ?
—সে জন্যই তো তোকে নিতে এলাম!
—কোথায় যাব, আপনার সঙ্গে ?
—ওই যে দ্যাক, পাহাড়, তারপর একটা বরপের পাহাড়, তারপর ফুলের উপত্যকা, তার আগে ভালুকের দেশ, ওসব পার করে, সে এক দুনিয়া বুজলি কিনা!
—ভালুকের দেশ ?
—হ্যাঁ রে, এদিকে বলে ভুঁই-ভালু!
—তারপর ?
—তারপর, মৃত মানুষের জগত! কতরকমের বাসনার মানুষ!
—আপনি জানলেন কী করে ?
একটু মুচকি হেসে বললেন
—আমি জানি! ওসব যে আমারই তৈরি রে!
ভারী অবাক হয়ে শুধোলাম
—আপনার তৈরি ?
—হ্যাঁ রে! আমারই জগত! আমি মারি আবার বাঁচাই, আবার মারি, আবার বাঁচাই! সব আমার খেলা!
—আপনি কি লেখক ?
উঁচু গলায় হেসে উঠলেন তিনি।
—ওসব লেখা টেকা তোদের ব্যাপার খোকা! বুজলি কিনা, এই নিয়েই নিজের জগত আমার!
তারপর একটু থেমে ফের বললেন
—যাবি ? ওসবের পরেও এক অন্য ভুবন আচে! যাবি ? সেকেনে কিচুই নাই! আবার সব আচে! যেমন তুই ভাববি! তেমন! যাবি ? খোকা, যাবি না ?

তন্দ্রায় চোখ জুড়িয়ে এসেছে তখন। আমার মনে পড়ছে গত সন্ধ্যার কথা। সেই যে সহদেব আগুন জ্বেলে বসতে দিলেন আমায়,তাজা মহুয়া এনে দিলেন যত্ন করে। আকাশে কুচি কুচি তারা, চাঁদ ওঠে নাই তখনও। ওসব আগুন নক্ষত্রের দেশে পরী নামে বলে শুনেছিলাম, হাঁ করে কতক্ষণ আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে তার মন ভাবছিলাম, সেই যাকে কখনও আমার বলা হল না পীরিতের কথা, সেই তার কথা, ভাবছিলাম।

যাব কি ওই মানুষটির সঙ্গে, ঠিক বুঝতে পারি না। কী একটা পাখি ডাকছে, আধবোজা চোখে ঘুম পিঁড়ি পেতে এসে যেন বসেছে। একটা স্বপ্ন দেখার বড় বাসনা আমার, কতদিন স্বপ্ন দেখি না, সেই কতকাল পূর্বে যৌবনবেলায় দেখতাম, সুঁড়িপথ, দুপাশে পুটুসের দল, লোহার ঝোলাপুল পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি, সামনে, আরও সামনে, পূর্ব দিগন্তের দিকে!

গাছেদের শরীরে কারা যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। একটু দূরে বসে আছে হব্যবাহ, তার দাঁতগুলি সোনা দিয়ে বাঁধানো। তপ্ত কাঞ্চণবর্ণ পিঠ, স্বর্ণকেশরাজি কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। প্রথমে পুড়ছে চামড়া তারপর শুকনো পাতা সরু সরু ডাল, কৃষ্ণবর্ণের ধূম পাখা মেলেছে অন্তরীক্ষের দিকে।

বসে বসে ধুঁকছে একটি বুনো হাতি। পেটের কাছে দগদগে ক্ষত, ঝলসে গেছে শুঁড় আর চোখদুটি। কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। ভকভক করে পেটের গর্ত দিয়ে বেরিয়ে আসছে টাটকা রক্ত, আর কিছুক্ষণ মাত্র তারপর প্রাণবায়ুটুকু মিশে যাবে লেলিহান অগ্নিশিখায়।

চিতাবাঘের কুশি কুশি বাচ্চাগুলো তিরতির করে কাঁপছে। ওদের চোখে এখন সবকিছুই রক্তবর্ণ। গুঁড়ো গুঁড়ো ছাই উড়ছে বাতাসে, গতকাল থেকে ওদের মা ফেরেনি। কালো আঙরা হয়ে পড়ে আছে তার দেহখানি, দুপাশে যতদূর চোখ যায় পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া বৃক্ষশরীর। 

আজ অনেকদিন পর দেখা হল আমার এক পুরাতন সখার সঙ্গে। সাদা ধুতি আর জামা পরে বাড়ির দরজা খুলে দিল। উঠান জুড়ে এই বড় বড় বর্ষাঋতুর দলঘাস। কাঠচাঁপা গাছে কত ফুল এসেছে। সেই বিকশিত সজল কুসুম আমাকে শোনাল অগ্নির কথা, তাদের আত্মজনের পুড়ে মরার গল্প।

হরি মহারাজ শশী মহারাজদের নিয়ে কথা হল। সেসব এই ধুলামলিন পৃথিবীর ভালবাসার আখ্যান। বন্ধুটির ওষুধ বিক্রি এখনও ফুরোয়নি, একটু বুড়ো হয়েছে, বলল, অবুঝমারের জঙ্গল নষ্ট করে দিয়েছে খনিজ সম্পদ লোভী বানিয়ার দল। 

আমার আর কখনও জঙ্গলে যাওয়া হবে না। চুকেবুকে গেছে ওসব পীরিত। বনবাংলোর অন্দরমহল নিয়ে যে লেখা আমি দেখেছিলাম, সংসারের কারাগার সেখানে ঢেলে দিয়েছে বিষ। 

আধো ঘুমে স্বপ্ন দেখলাম, অনেক বৃক্ষ, প্রাচীন দেবতার মতো তারা আমাকে বলছে, তুমিও বিস্মৃত হলে ? আমি হাত বাড়িয়ে মান ভাঙানোর চেষ্টা করলাম, দেখি করতলে সাদা সাদা ছাই লেগে গেল।

ফেরার সময় চারটি রুটি কিনলাম, আর এক কৌটো আলুর তরকারি, রাতে খাব। তারপর ঘুমোব। গাছেদের কথা ভেবে কী করব আমি! ওসব মহাজগতের বিষয়।




গাঢ় ঘুম নেমে এলো বোধহয় এবার, রাত কি এখনও বাকি ?শুনেছি শেষরাতের ঘুমে কামনা লেগে থাকে। ওই টানেই তো এখনও তাঁর দেখা মেলে না, শুধু চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে কাল কেটে যায়। ওই ভবচক্রেই এবারের মতো খেলা ফুরোবে আমার, জানি! কিন্তু আর কতদিন ?

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুবল দত্ত

Posted in




















১০

সারাদিন ধরে কুনিহা গ্রামটি থমথমে অন্ধকার হয়ে রইল। মাঝেমাঝে চমক দিয়ে সারা আকাশ জুড়ে বিদ্যুতের ঘনঘটা। কুটিরগুলো ঘিরে একটা বিশাল আটচালা ঘরের মাঝে গোরাচাঁদের নির্দেশমত কুয়ো খুঁড়তে লেগেছিল জন তিরিশেক লোক। ওই আটচালা একটি প্রার্থনা সভা মিটিং ও শিক্ষাদানের কেন্দ্র। বাইরে কুয়ো হলে তাতে এখন বিষাক্ত বৃষ্টিজল জমবে, সেটা পান করলে হবে আরো খারাপ। কিন্তু মাত্র চার পাঁচ হাত খুঁড়তেই ফিনকি দিয়ে কুয়োতে জল আসতে শুরু হয়ে গেল। সারাদিন ধরে তেষ্টায় থাকা মানুষগুলোর তখন ভীষণ আনন্দ। এমনসময় গোরাচাঁদ প্রায় ছুটতে ছুটতে আটচালার নিচে এলেন। বালতিতে জল ভরে ছাকতে লেগেছে ওরা সেই জল পান করার জন্য। কয়েকজন খেয়েও নিয়েছে ইতিমধ্যে। গোরাচাঁদ বালতি উল্টে দিলেন।–খবরদার, এই জল পান কোরোনা কেউ। পাশেই সরোবরের দূষিত জল। তাই এতো তাড়াতাড়ি গর্তে জল এসেছে। এইজল বিষাক্ত। মাটির ভিতর দিয়ে চুইয়ে এসেছে। আর্সেনিক এন্টিমনি সাংঘাতিক বিষাক্ত ধাতু। এর নমুনা তো তোমরা দেখছো। 

সবাই চুপ। যারা জল পান করেছে তারা মুখে আঙুল ঢুকিয়ে বমি করার চেষ্টা করছিল। প্রত্যেকের মুখে অসহায়তা। গোরাচাঁদ সবাইকে বৃষ্টি থামলে নিজের ঘরে ফিরতে নির্দেশ দিলেন। উনি নিজের কুটিরের দিকে পা বাড়াবেন,সেইসময় তড়বড় করে বৃষ্টি নামল। ইশারায় সবাইকে মানা করলেন না যেতে। এইজল গায়ে পড়লে আর বাঁচতে হবেনা। প্রায় আধঘণ্টা তুমুল বৃষ্টিপাতের পর বৃষ্টির ধারা কম হতে দেখাগেল সেখানের একধরনের জংলী বেতে বোনা মস্ত ঘেরাওলা ছাতা নিয়ে পেরো হাজির। গোরাচাঁদকে নিয়ে যাবার সময় আশ্বাস দিল প্রত্যেককে নিয়ে যাবে। কেউ যেন না বেরোয়। 

গোরাচাঁদের ঘরে জেরেকা জোহা পেরো ও পাঁচজন সেবক বসেছিল। চুপচাপ। বৃষ্টির ছাটে জোহা মাঝে মাঝে শিউরে উঠছিল আর মাঝে মাঝে ফুপিয়ে কেঁদে উঠছিল। পেরো ওর কাঁধে হাত রাখলো। গোরাচাঁদ মুখ খুললেন। 

-কুয়োর জল পান করা কোনোমতেই যাবেনা। যেমন বৃষ্টি পড়ছে মনেহয় রাতভর পড়বে। আগামীকাল বৃষ্টি থামলে আমাদের এখানের যত বহুমুল্য জরুরী ঔষধি ফল ফুলের চারা, শস্যবীজ ও খাদ্য শস্য সংগ্রহ করতে হবে। যত শীঘ্র সম্ভব এখান থেকে যাওয়া দরকার। 

একজন সেবক বললেন,-গুরুজি চিন্তা করবেন না। আমাদের এখানে একধরনের গাছ আছে যার কান্ড হাঁড়ির মত ফোলা। সেখানে ছেঁদা করলে যে জল বেরোয় তাতেই আমাদের পিপাসা মিটে যাবে।

-কিন্তু তা আর কতক্ষন?

বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। কুটিরের বাইরে জল থৈ থৈ। কিন্তু জলাশয়ে জলস্তর অনেক নেমে গেছে। যেন দ্রুত খালি হয়ে যাবে। মাঝে মাঝে কড়কড় শব্দে এখানে ওখানে বাজ পড়ছে। ডিনামাইট দিয়ে পাহাড় ফাটানো নতুন অভিজ্ঞতা নয় বনবাসীদের কাছে। কিন্তু এমন অদ্ভুতভাবে পাহাড় ফেটে চৌচির হওয়া? আর সাথে সাথে এমন ভয়ানক বৃষ্টিপাত? প্রকৃতি নিজের পছন্দমত সৃষ্টি করেছে এই ভূস্বর্গ,এখন নিজেই তা নাশের জন্য ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। গোরাচাঁদ সরোবরের দিকে চোখ রেখে বললেন,-আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। যত শীঘ্র সম্ভব। -আমরা কি কোনোদিন এখানে ফিরব না? জোহার হাহাকার। সবাই নতমুখে। কারো মুখে কোনো কথা নেই। ভেষজ রেডির তেল দিয়ে জ্বালানো প্রদীপ নিভু নিভু। -অনেক রাত হোলো এবার তোমরা নিজের ঝোপড়িতে গিয়ে শুয়ে পড়। সকাল থেকে অনেক কাজ। জেরেকা গোরাচাঁদের কাছে গিয়ে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ল।-না গুরুজি,আমাকে আজ এখানেই থাকতে দিন। এই রাত আপনিই আমার বাঁচার আশা। তারপর তো আমাদের কিছুই করার নেই। আমি হেরে গেছি গুরুজি।মনে হয় এই ধরতি আমাদের জন্য নয়। আমরা সর্বকালে সবার কাছ থেকে প্রতারিত বিতাড়িত। প্রকৃতিও আমাদের উপর জুলুম করেছে। এক জায়গায় তিষ্ঠতে দেয়নি। ও আমাদের চায়না তার কোলে আমরা শান্তিতে বাস করি। 

-ওরকম কথা কেন বলছ জেরেকা। প্রকৃতি তো নিজেই এখানে শোষিত। তাকে উদ্ধার করতেই তো সে আমাদের এখনো সুস্থ সবল রেখেছে। তারই কোলে তোমাদের সবার মন প্রাণ শরীরের পরিবর্তন হোলো এটা দেখছো না? পেরোকে দেখ? কেমন আদিম মানুষের মত চেহারা আর স্বভাব ছিল? শুধু পেরো কেন? এখানের প্রতিটি মানুষ বহির্জগতের জন্যে আদর্শ পুরুষ হয়ে উঠতে পারে। এই বিপর্যয় কোনো বাধাই নয়। আমাদের এখন নতুন করে বাঁচতে হবে। ভেবে দেখ। এখানে আসার পর প্রত্যেক জনজাতি মানুষের বুদ্ধি বেড়েছে,শরীরে বল এসেছে, ডিসিপ্লিন শিখেছে,প্রতিকূল অবস্থার সাথে লড়াইয়ের ক্ষমতা হয়েছে। প্রতিটি মানুষ জানে অমূল্য বনৌষধি গুল্ম লতা বৃক্ষের জীবনরক্ষাকারী গুণ। প্রত্যেকে চিনে ফেলেছে সেই সব গাছ। গতানুগতিক শস্যদানা শরীররক্ষার খাদ্য ছাড়া অনেককিছু মহারণ্যে রয়েছে যাতে সারাজীবন সুস্থ জীবনযাপন করা যেতে পারে।তবে আর কিসের ভয়?এবারে আমরা নতুন করে বাঁচবো। 

গোরাচাঁদ আরো অনেককথা বলতে লাগলেন। একসময় খেয়াল হলো কেউ সাড়া দিচ্ছেনা। বাইরে বৃষ্টি তুমুল। সবাই ভীষণ ক্লান্ত। উত্কণ্ঠার অবসানে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। ভোর হওয়া অব্দি জেগে রইলেন গোরাচাঁদ। আকাশ এখনো থমথমে। বৃষ্টি একটু ধরেছে। সবার আগে পেরো জাগলো। ঘুম থেকে উঠেই সটান বাইরে। একটু পরে দেখা গেল একে একে সবাই সরোবরের কিনারে উপস্থিত। সরোবরের জল প্রায় শেষ। পড়ে রয়েছে পদ্মের শিকড় জলজ শৈবাল মৃত সাপ আর প্রচুর মাছ। ওরা খাদ্য বস্তু,কিন্তু এখন জলহীন মৃতপ্রায় অবস্থায় দেখে সবার চোখে জল। দূরে পাহাড়ের ভগ্নস্তুপ দেখা যায়। বিশাল পাহাড় ছিল কিন্তু এখন বোঝা যায় সেটার ভিতরটা একেবারেই ফাঁপা ছিল।এখন তো সেখানে টইটম্বুর জল। যারা এই কাজ করেছে তাদের খনিজ আকর উদ্ধার করা এখন প্রায় অসম্ভব। গোরাচাঁদ জেরেকাকে তদারকি করতে বললেন সবাইকে নিজের জিনিষপত্র গুছিয়ে নিতে। পেরো ও জোহাকে বললেন বনৌষধি ও মুল্যবান সব গাছের চারা গুল্ম বীজ সংগ্রহিত মধু ও শস্য সব আজকেই জোগাড় করতে। আজ দুপুরের মধ্যেই এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আর জোহা হবে আমাদের গাইড।

দুপুরের সময় আবার ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। আকাশ অন্ধকার। দুর্যোগ মাথায় করে বেরোতেই হবে এই আদেশ গোরাচাঁদের। সবাই কিন্তু এমনি অসময়েও তৈরি হয়ে গেল। গোরাচাঁদ ও পেরো প্রত্যেককে বয়ে নিয়ে যাওয়া অহেতুক অবাঞ্ছিত জিনিসগুলো রেখে দিয়ে প্রয়োজনীয় চারাগাছ খাদ্য শস্য বীজ ওষুধ ইত্যাদি বেশি করে দেওয়া হলো। যারা কুয়ো খোড়ার সময় জল খেয়েছিল, তাদের সেবকেরা একধরনের পাচন খেতে দিয়েছিল যাতে বিষ মল মুত্রের সাথে বেরিয়ে যায়। ওরা একটু কাহিল হয়ে পড়েছিল। একসময় শুরু হলো যাত্রা। প্রায় তিনশো মানুষ খুব সংযত হয়ে নিয়মানুবর্তিতা মেনে লাইনবন্দী হয়ে চলতে লাগলো। মহিলা বেশি নয় মাত্র কুড়ি আর বাচ্চা দশজন। সব পুরুষের কাঁধে বাঁক। মেয়েদের মাথায় ঝুড়ি। কয়েকজন পদ্মের বীজ সংগ্রহ করেছে। পাকদন্ডি বেয়ে অনেকটা উপরে উঠে গোরাচাঁদ লক্ষ্য করলেন মস্ত সাপের মত মানুষের লাইন এঁকেবেঁকে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে পাহাড়ের উপর উঠছে। এতো উপর থেকে দক্ষিণ দিকটা আবছা দেখা যায়। সেদিকে শুধু জল আর জল। গোরাচাঁদের মনে পড়ে সেই পুরাণে বর্ণিত মহাপ্লাবনের কথা। সেইসময় সৃষ্টি রক্ষার তাগিদে মহর্ষি মনু ঠিক এমনিই গাছপালার চারা বীজ সংগ্রহ করে মত্স্যবাহী নৌকোতে চেপে অপেক্ষা করছিলেন প্লাবন থেমে যাওয়ার জন্য। জলস্তর নেমে নতুন উর্বর মাটি পাওয়ার পর তিনি আবার প্রকৃতি রোপণ করেছিলেন। তিনি জোহার দিকে তাকালেন। জোহা খুব অন্যমনস্ক হয়ে পথ চলছে। চোখে জল। পিছু ফিরে দেখছে বারবার। আচ্ছা ! জোহা কি পারবে নতুন উর্বর মাটি দিতে? এই দুর্লভ অমৃত চারাগাছ ও বীজ রোপণ করার? 



0 comments:

0

ধারাবাহিক - সোমঙ্কর লাহিড়ী

Posted in




















২২ 

কাঞ্চন ঘোষ দস্তিদারকে আর শিলিগুড়ির কে পি বাজোরিয়ার সেই মুনিমজিকে এক সাথে পুলিস গ্রেফতার করেছিল দু জায়গা থেকে। 

একসাথে চারটে খুন আলাদা আলাদা জায়গায়, আর একটা অ্যাসিড অ্যাটাক। একটা আত্মহত্যার কারণ, সব একসাথে মেটানর পরে পুলিসকে মিডিয়ার মুখমুখি হতেই হত। সুব্রত সেনগুপ্ত পরেশ সামন্তকে অনুরোধটা করায় সামন্ত প্রায় একহাত জীভ কেটে বলেছিল ওসব প্রাইভেট ডিটেকটিভ এজেন্সির কাজ যারা করে তাদের জন্য নয়। তাদের যদি লোকে চিনেই ফেলে তবে চুপিচুপি কাজটা কি করে করবে? 

সুব্রত সেনগুপ্ত মিডিয়ার সামনে এসে একে একে সব জানালেন। সেও একটা গল্পেরই মতো। যার শুরু সেই টি ভ্যালী রিসর্টে উদ্বোধনের রাতে। 

ঐ ভিডিও ফুটেজ দেখার পরেই কেপি তার ছেলের বৌয়ের অসম্মানের জন্য তার মুনিমজিকে বলেছিলেন যেন তেন প্রকারেণ ঐ গায়ককে যেন পথের ভিখারি করে দেওয়া হয়। 

মুনিমজির হাতে অ্যান্ডির কন্ট্যাক্ট বলতে তখন কাঞ্চন। পুরো ব্যাপারটা তাকে বলে একটা বিরাট টাকার টোপ দিয়েছিল মুনিমজি। বসে খাওয়া কাঞ্চনের কাছে সেটা ছিল একটা লটারি পাওয়ার মতো। অবশ্য রক্তের সম্পর্কের নাহওয়া সত্ত্বেও তার স্ত্রী অলি অ্যান্ডিকে খুব ভালবাসত সেটা তার একটা ঈর্ষা বা সন্দেহের কারণও হতে পারে, নেশাগ্রস্থ অবস্থায় অ্যান্ডিকে বাড়িতে আনার পরে থেকেই সে অ্যান্ডির পরিবারের ব্যাপারে খোঁজ খবর করা শুরু করে এবং ব্যাকট্র্যাক করে সঞ্জয়ের পরিবারকে সে খুঁজে বার করে। 

সঞ্জয় আর তার মাকে অ্যান্ডির বাবা অনিকেত মৌলিক বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন যখন তার বয়েস মাত্র তিন। তারপরে উত্তর শহরতলীর পাঠ চুকিয়ে দক্ষিণ শহরতলীতে এই নতুন হাউসিং এ ফ্ল্যাট নিয়ে তিনি চলে আসেন। এই ফ্ল্যাটের অর্ধেকের বেশী টাকা অ্যান্ডির মা তাঁকে দেন। আর সঞ্জয়ের মা তাকে নিয়ে তাঁর বাপের বাড়ীতে ফিরে যান। 

তিনি এখানে থিতু হয়েই নিজের ফর্মে ফেরেন। অত্যাচার অনাচার যৌন নির্যাতণ সবই তিনি নিজের ইচ্ছামতো করেছেন অ্যান্ডি ও তার দিদির উপরে কারণ এরা দুজন কেউই তার নিজের ঔরসজাত সন্তান ছিল না। তাঁর মানসিক নির্যাতনে অ্যান্ডির দিদির মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায় তাকে মেন্টাল অ্যাসাইলামে পাঠানো হয়। অ্যান্ডির মা এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকবার মারধরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। আর তাঁর এই দ্বিতীয় স্বামীর সাথে তিনি এঁটে উঠতে পারতেনও না। 

বয়স বাড়ার সাথে সাথে অ্যান্ডি এই সব কিছু থেকে মুক্তির রাস্তা হিসাবে নেশার রাস্তা বেছে নেয়। গানের গলা ভাল ছিল তাই গান টান করত বন্ধুদের সাথে আর করত নেশা। 

হঠাৎ তাকে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়ার একটা সুযোগ পেয়ে যান অনিকেত মৌলিক। নেশাগ্রস্থ অবস্থায় অ্যান্ডির একটা দুষ্কর্মের জন্য। সেখান থেকে বহু ঘাটের জল খেয়ে তার আশ্রয় হয় ঘোষদস্তিদারপরিবারে। 

যেকোন কারণেই হোক কাঞ্চনবাবু ওনার স্ত্রী অলির অ্যান্ডিকে ভালবাসাটা মেনে নিতে পারেননি। হতেই পারে, উনি ওনার পরিবারে একমাত্র সন্তান, তাই ভাই বোন দিদি ইত্যাদি ব্যাপারটা বা স্নেহ মায়া মমতার ব্যাপারটা তাঁর হয়ত খুব একটা পছন্দের তালিকায় ছিল না। 

নিজের স্ত্রীকে কিছু না জানিয়ে নিজের শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের ও আপার্ট্মেন্টের অন্যান্য বাসিন্দাদের মাধ্যমে উনি অ্যান্ডিদের পরিবারের খবরাখবর জোগাড় করতে থাকেন। তারপরে খুঁজে বার করার পালাটাও খুব সন্তর্পণে সমাধা করেন কাঞ্চন। 

তিনি খুঁজে পান সঞ্জয় মৌলিক ও তার অসুস্থা মাকে। বলে অলস মাথা শয়তানের বাসা, কাঞ্চন ঘোষদস্তিদারহচ্ছেন তার একটা আদর্শ উদাহরণ। উনি বাবার কাছ থেকে পাওয়া ক্লায়েন্টেলকে প্রপার সার্ভিস দিতে খুব অনীহা বোধ করতেন। একদিকে কিছু ইমপ্রেসেরিও বন্ধুদের সাহায্যে অ্যান্ডির প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করে দিতেন, অ্যান্ডি গান করত উনি কাট মানি খেতেন। অন্যদিকে সঞ্জয়কে গুছিয়ে মগজ ধোলাই করতেন। 

এই কাজটাকে উনি প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছিলেন। আর ওনার ছাত্র সঞ্জয় ছিল আরো এককাঠি সরেস। শয়তানিটা জিনগত ভাবে বোধ হয় নিজের জন্মদাতা বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল। 

দুটো স্ট্রিট হুলিগানকে তাদেরই অস্ত্র দিয়ে খুন করা দিয়ে হাতেখড়ি। তারপরে নজরে পড়ে গণেশ নামের এক বড়োমাপের মস্তানের। সে খুব বুদ্ধি করে সঞ্জয়কে তার দলের বাকীদের থেকে আড়ালে রেখে কাজ করাতে থাকে। 

দুজন প্রোমোটারের অনেক টাকা একজন মেরে বসে ছিল, সেই লোকটিকে শিক্ষা দেওয়ার দ্বায়িত্ব নিয়ে তাকে চোখে অ্যাসিড ঢেলে অন্ধ করে দেয় সঞ্জয়। এইখানে তার অসম্ভব একটা কূট বুদ্ধির ছাপ আমরা দেখতে পাই। সেই লোকটির সমস্ত খবরাখবর সঞ্জয় একটা ডিটেকটিভ এজেন্সিকে দিয়ে নেওয়ায়। একদম পেশাদার খুনিদের মতো নিখুঁত ভাবে কাজ করে বেরিয়ে যায়। 

সেই অন্ধ হয়ে যাওয়া লোকটি পরে টাকা শোধ করে দেয় ঐ দুই প্রোমটারকে, গণেশের নাম ছড়িয়ে পড়ে ঐ মহলে। 

পরেরটা ছিল একজনের স্ত্রী তাঁরই ড্রাইভারের সাথে প্রচুর পরিমাণে ক্যাশ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় সেই স্ত্রীকে আর সেই টাকাকে উদ্ধার করে দেওয়া, সাথে যার সাথে সেই ভদ্রমহিলা পালিয়েছিলেন সেই ড্রাইভারকে শিক্ষা দেওয়ার কাজ। । 

আবার গণেশ ও সঞ্জয়ের জুটি কাজটা নিঁখুত ভাবে করে। আর সেই লোকটি তার পালিয়ে যাওয়া স্ত্রী ও টাকা ফেরত পায়। 

নাম বাড়তে থাকে, এবারে কাজ আসে সিন্ডিকেট থেকে অন্য সিন্ডিকেটের এক মাথাকে সরিয়ে দেওয়ার বরাত। এইখানে এসে সঞ্জয় তার প্রথম ভুলটা করে ফেলে একই এজেন্সিকে সে তিনবার কাজ দেয়। হয়ত সেটাও ধরা পড়ত না, কিন্তু এজেন্সির মালিকও ধুরন্ধর বুদ্ধিমান লোক। আর বোধহয় ধর্মের কল বাতাসে নড়েও গেছিল খানেকটা। যে লোকের খবর নেওয়ার জন্য সঞ্জয় গেছিল, সেই লোকটি এই এজেন্সির মালিকের ব্যক্তিগতভাবে পুর্বপরিচিত। আর তাকে যখন বলা হয় যে ঐ লোকটি সঞ্জয়ের জামাই তখন তার সন্দেহ গাঢ় হয়, কারণ সেই লোক বিয়েই করেনি। বাই দ্য ওয়ে সঞ্জয় সেখানে একজন বৃদ্ধ সেজে গেছিল। আর তার হাটাটা একটু ভুলভাল হয়ে গেছিল এজেন্সি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময়। সেটাও খটকাটাকে আরো বাড়িয়ে দেয় সেই ডিটেকটিভ এজেন্সির মালিকের। 

উনি তখন ওনার ঘরে রাখা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ইত্যাদি নিয়ে কাজ শুরু করেন। নিজের অফিসের একজন প্রিয় সহকর্মীকে সঞ্জয়ের দেওয়া ঠিকানা খোঁজ করতে পাঠায়। 

সঞ্জয় কি ভাবে যেন বুঝতে পারে যে তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। সঞ্জয় ঐ লোকটিকে পেয়ে যায় তার নিজের দেওয়া ঠিকানা ভেরিফিকেশানের সময়। সেই ঠিকানাটা ছিল ওর বাড়ির কাছাকাছি একটা বড় গোয়ালের। এবারে এজেন্সির সেই লোকটি সঞ্জয়ের শিকার হয়। 

ডিটেকটিভ এজেন্সির মালিক এবার ব্যাপারটা পার্সোনালি নিয়ে নেন। আর সঞ্জয়কে খোঁজা শুরু করেন, আর আমাদের ও খবরটা দেন। 

এই খোঁজের একটা অংশে এসে তিনি বার করেন যে সঞ্জয় আরো দুজনের খোঁজ করিয়েছিল ওনার এজেন্সিকে দিয়ে। এবারে উনি খুঁজতে যান সেই দুজনকে আর তাতেই তার সামনে আসে সঞ্জয়ের আরো দুটো দুষ্কর্মের। এই দুটো কাজের মধ্যে একটাই মাত্র যোগ সুত্র ছিল ক্লোরোফর্ম। সঞ্জয় যাকে যাকে আক্রমণ করেছে তার সাথে আর যাকে পেয়েছে তাকে নাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে পালিয়েছে। আর এই ক্লোরোফর্মের সুত্র ধরে উনি বার করেন যে গায়ক অ্যান্ডিকে দুবার আক্রমণের শেষ বার নাকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে নাকে কোকেনের গুঁড়ো দেওয়া হয়েছিল। 

এই সুত্রধরে আমরা মোট তিনজন প্রোমোটারকে গ্রেপ্তার করি, তাদের থেকে গণেশর নামটা পাই। ইতি মধ্যে আমাদের লোকেরা সঞ্জয়ের শেষ টার্গেট ভালূয়ার উপরে নজর রাখতে থাকি। সেখানে গণেশকে আমরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হই। সঞ্জয়ের অনুপস্থিতিতে সে নিজেই ভালুয়াকে মারতে চেষ্টা করেছিল এবং ধরা পরে গেছিল আমাদের লোকেদের হাতে। আর গণেশের সাহায্যে আমরা পাজলের বেশ কিছু টুকরোর খোঁজও পেয়ে যাই। 

এরমধ্যে টি ভ্যালীর ওপেনিং সেরিমনির রাতের আরো একটি ভিডিও ক্লীপীংস মিডিয়ার হাতে চলে আসে। আর তার ফলে সেখানকার মালিক প্রেস কনফারেন্স করে জানিয়ে দেন তিনি তাঁর বর্তমান স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে সেই মেয়েটিকে বিয়ে করবেন যার সাথে ঐ ক্লীপীংস এ তাকে দেখা গেছে। ওনার স্ত্রী আত্মহত্যা করেন প্রায় সাথে সাথে, ঐ প্রেস কনফারেন্স থেকে কেউ একজন ওনাকে তাঁর মোবাইল থেকে সরাসরি সাক্ষাতকারটা শোনাচ্ছিল। উনি ব্যাপারটা জাস্ট মেনে নিতে পারেননি। 

পুরো ব্যাপারটা অন্য দিকে মোড় নেয়। কে পি বাজোরিয়ার অত্যন্ত স্নেহভাজন ছিলেন ওনার ছেলের বৌ। উনি আবার ওনার মুনিমজিকে মাঠে নামান। আর মুনিমজি তাঁর কোলকাতার কন্ট্যাক্টকে সিগন্যাল দেন অ্যান্ডি শুড ডাই। 

কিন্তু সঞ্জয় ততদিনে নিরুদ্দেশ। তার মা দুজন নার্সের সেবায় বেঁচে রয়েছেন। এই খবরটা আমরা পাই গণেশের কাছে থেকে। আমরা নার্স দুজনের উপরে নজরদারই বাড়াই। আর তার থেকেই আমরা জানতে পারি যে তাদের দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে কেউ একজন ফোন করে খোঁজ খবর নেয়। আর সেই নম্বরটা কাঞ্চন ঘোষ দস্তিদারের। আমরা ওনার উপরেও নজর রাখা শুরু হয়। সেই নজরদারি থেকে আমরা জানতে পারি ওনার কাছে আসা ফোনের ব্যাপারে। আর সেখান থেকেই আমাদের কাছে খবর চলে আসে যে অ্যান্ডিকে মারার চক্রান্ত চলছে। 

অ্যান্ডির উপরে আগে দুটো অ্যাটাক হয়ে গেছে। সে দুটো যে করেছে সে খুব ভালো ভাবে চারপাশের খবরাখবর নিয়েই কাজ দুটো করেছে। আর চলে যেতেও সক্ষম হয়েছে। কাছের লোক না হলে এই খবরগুলো দেবে কে? সিসি ক্যামেরারতেও ধরা যায়নি সঞ্জয়ের মুখের সুস্পষ্ট ছবি। কাছে এলেই স্ক্রীনে ইন্টারফিয়ারেন্স। যেটা এজেন্সির লবির ক্যামেরাতে হয়েছিল। ফ্রন্ট ডোরের ক্যামেরাতে হয়েছিল, অ্যান্ডির রাজারহাটের ফ্ল্যাটের ক্যামেরাতে হয়েছিল, কিন্তু এজেন্সির মালিকের ঘরের ক্যামেরাতে হয়নি। কারণ ঐ একটা মাত্র ক্যামেরা ছিল যেটার কাছে সঞ্জয় পৌছতে পারেনি। ওর মাথায় একটা স্ন্যাপব্যাক টুপি থাকত সর্বদা যেটার মাথার উপরে একটা এল.ই.ডি প্যানেল সঞ্জয় খুব দক্ষতার সাথে লাগিয়ে রেখেছিল আর এল.ই.ডি প্যানেলের উপস্থিতি সিসি ক্যামেরায় রেকর্ডিংএ ইন্টারফিয়ারেন্স ক্রিয়েট করে দিত। ফলে ওর মুখের ছবি ক্যামেরাতে সুস্পষ্ট ভাবে পাওয়া যায়নি এজেন্সিতে তৃতীয়বার আসার আগে। আগের দুবার ওনার সাথে কথা বলেন এজেন্সির অন্য দুজন লোক। তৃতীয়বারে এজেন্সির মালিক নিজে সঞ্জয়ের সাথে কথা বলেন। 

এবার সমস্ত ইনফর্মেশানকে অ্যানালিসিস করে আমরা কনফর্ম হয়ে যাই যে কে এই সব ব্যাপারের পিছনে রয়েছে। তখন আমরা অ্যান্ডির বাড়িতে যোগাযোগ করি। আর কিরণ বাবুকে জানিয়ে দিই যে অ্যান্ডির প্রাণনাশের চেষ্টা চলছে। উনি সত্যিই অ্যান্ডিকে ভালবাসেন। আর তাই আমাদের সব রকম সাহায্য করার প্রতিশ্রুতিও দেন। 

এবারে আসে সেই খুনি সঞ্জয়কে ধরার ব্যাপার। আমরা সবদিক থেকে আট ঘাট বেঁধে কাজ শুরু করে দিই। 

দিন কতক বাদেই ছিল অ্যান্ডির একটা সিনেমাতে নায়ক হওয়ার ঘোষণা। আর অন্য একটা মিউজিক ডিভিডি লঞ্চের অনুষ্ঠান। আমার প্রযোজক সংস্থার সাথে কথা বলে অনাদের টাইম সিডিউলের আচমকা এদিক সেদিক করে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। 

আর অন্যদিকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাহায্যে অ্যান্ডির বাবাকে সামনে এনে একটা মৃত্যুপুর্ব দৃশ্যের প্রচার করতে শুরু করে দিই। অ্যান্ডিকে সেখানে আনার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে আমাদের লোক তৈরী ছিল। অ্যান্ডি সেখানে পৌছায়, সঞ্জয় ও পৌছায়। তাকে মারতে। এর মধ্যে আমাদের লোক ছিল ঐ ঘরের মধ্যে। তার গুলিতে সঞ্জয় মারা যায়। তাকে গ্রেফতার করাটা সম্ভব হয়নি কারণ ঐটুকু সময়ের মধ্যে সে ঐ ঘরের প্রায় সবাইকে আহত করে দিয়েছিল। 

আর এর সাথে খতম হয় এক ভয়ংকর খুনীর মারত্মক খুনের প্রচেষ্টা। আমরা এই ষড়যন্ত্রের বাকী সবাইকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। 

আশা করি আপনাদের আর কোন প্রশ্ন নেই? 

বেশ নাটকীয় ভাবে প্রেস কনফারেন্স শেষ করে বেরিয়ে নিজের চেম্বারে গেলেন সুব্রত সেনগুপ্ত। 

বিকেলে পরেশ সামন্ত ফোন করে বললেন, 

স্যার আরো একবার দেখা করা দরকার যে। 

সুব্রত সেনগুপ্ত ভুরুটা একটু কোঁচকালেন, তারপরে বললেন, 

চলে আসুন। 

আধঘণ্টা বাদে পরেশ সামন্ত ঘরে ঢুকে একটা সাদা খাম ওনার টেবিলে দিয়ে বললেন, পড়ে দেখুন স্যার। আমি কিন্তু জ্ঞান ফেরার পরে নিজে বডি আইডেন্টিফাই করতে চেয়েছিলাম। 

সুব্রত সেনগুপ্ত খামটা তুলে তার ভেতর থেকে চিঠিটা বারকরে পড়তে শুরু করলেন। 

মিঃ সামন্ত। 

একজন বুদ্ধিমানের সব সময় তার প্রতিপক্ষকে মর্যাদা দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি, আর সেই সুত্রে আমি প্রথমেই আপনাকে আমার শ্রদ্ধা জানাই। 

কিন্তু আপনার বড়কর্তা (সত্যিই উনি আপনার বড়কর্তা কিনা জানিনা, কারণ আমার মনে হয় উনি ও ওনার দপ্তর আপনার সাথে প্রযোজনভিত্তিক হাত মিলিয়েছেন) উনি মশাই বেজায় মিথ্যাবাদী একজন লোক। তা নাহলে উনি মিডিয়ার সামনে বেমালুম চেপে গেলেন যে ঐ গণেশদা ও কাঞ্চন ঘোষদস্তিদার(যিনি কিনা আমাকে নিজের নাম বলেছিলেন হিরণ্ময় নন্দ) ডেডবডি দেখে বলে যে ওটা আমার বডি নয়। আর আপনারা ঐ দুজন নার্সকে ধরতে পারেছেন ঠিকই কিন্তু আমার মাকে উদ্ধার করতে পারেননি সেটাও ওনার বলা উচিত ছিল। 

আপনাকে কয়েকটা ব্যাপার আমি বলে দিই যেটা আপনি হয়ত মেলাতে পেরেছেন বা পারেননি। 

কাঞ্চন ঘোষদস্তিদারএসে যেদিন আমাকে বলেন আমার জীবনের দুঃখের কারণ ঠিক কে সেটা তিনি জানেন, আর তিনি একদিন আমাকে তার ঠিকানাও জানিয়ে দেবেন সময় এলে। আর এই সব বলে আমাকে তাতাতে শুরু করেন আমিও সেই দিন থেকে ওনার ব্যাপারে খোঁজ খবর করতে শুরু করে দিই। 

মানতে হবে উনি আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন যেগুলো আমি আমার ঐ অল্প বয়েসে জানতামই না। আর যে শিক্ষাগুলো আমাকে অনেকের থেকে এগিয়ে যে রেখেছে সেটা আপনি আমার এই চিঠিটা পড়েই বুঝতে পারছেন। 

এবারে আসি সেদিন আমি কি করেছিলাম। কাঞ্চন ঘোষ আমাকে যখন অ্যান্ডিকে মেরে ফেলার কথা বলল আর তার জন্য প্রচুর টাকা অফার করল আমি তখন থেকেই একজনকে এই কাজের জন্য ফিট করি। আপনি ভাববেন হয়ত যে ব্যাপারটা কি ছেলের হাতের মোয়া? না তা নয়। কিন্তু এ দেশে পঞ্চাশ হাজার টাকা ক্যাশ দিলে একটা গরীব ছেলেকে দিয়ে অনেক কিছু করা যে যায় সেটা আপনিও দেখলেন। আমি শুধু ছেলেটাকে টোপটা ঠিকঠাক খাওয়াতে পেরেছিলাম। 

কাঞ্চন ঘোষ সেই দিন আমাকে যে খবর দিচ্ছিল, আমি সেটা তৎক্ষণাৎ আমার সেই ছেলেটিকে দিচ্ছিলাম। নিজে অনেকটা দূরে ছিলাম যাতে কোন ভাবেই ধরা না পড়ে যাই। 

আসলে আমি টাকাটা পাওয়ার পরে ভাবলাম এটা না থাকার জন্যেই তো আমার আর মায়ের জীবনে এত ভোগান্তি। তা এতটাকা পেলাম সেটা ভোগ করব না? 

তাই ঘুঁটি সাজাব বলে বেরিয়ে প্রথমে আমার মাকে আমি সরিয়ে ফেলি ঐ দুই নার্সের হাত থেকে। তারপরে ঐ ছেলেটাকে টাকাটা দিয়ে দিই। এবারে ও মারতে পারলে ভালো না পারলে আমার কিছু অসুবিধা নেই। এবারে দেখুন ব্যাপারটা কেমন হল। 

আমি বেঁচে আছি সেটা আপনি জানতে পারলেন। পুলিস ও জানবে আপনার কাছ থেকে। আমি নিজের ভোল পালটে কোথায় আছি সেটা আপনি বা পুলিস জানতে পারবে না। 

আমার বাবা যিনি আমাদের বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে অন্য একটা সংসার করে সেখানেও অত্যাচার চালিয়ে এতদিন বেঁচে আছেন তিনিও দু এক দিন বাদে জানতে পারবেন যে আসল লোকটা এখনো বেঁচে আছে। আর তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনাটা এখনো বাতিল হয়নি। যে কোন দিন যে কোন মুহুর্তে সে আঘাত হানতে পারে। জীবনের বাকি দিনগুলো তার মোটামুটি নারকীয় হয়ে গেল। 

অ্যান্ডির ক্ষেত্রেও সেই একই ব্যাপার, কারণ আমি আঘাত করব কি করব না সেটা আপনাকেও আমি জানাচ্ছি না। তাই সে বা আপনি কেউই নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন না। 

আর আপনাকে কুরে কুরে খাবে আপনার অফিসের ঐ লোকটার মৃত্যু। এরপরে আপনি হয়ত আবেগতাড়িত হয় আমাকে খুঁজতে বেরতে পারেন। কিন্তু কোথায় খুঁজবেন আর কতদিন সেই খোঁজ আপনি চালু রাখতে পারেন সেটাও আপনাকে ভেবে দেখতে হবে। 

পুলিস ডিপার্টমেন্ট আপনার আঘাতের সুযোগে আপনাকে এড়িয়ে বডি আইডেন্টিফাই করিয়ে নিয়েছে। তার উপরে ভিত্তি করেই এখন কেস সাজাবে। এখন যদি জানতে পারা যায় যে আসল খুনি ধরা পরেনি আর অনেক রাঘব বোয়ালকে পুলিস ধরেছে তখন আপনাদের ঐ বড়কর্তার কি অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখুন। 

কাঞ্চন ঘোষ যদি সাজা পায় তাহলেও সে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না, কারণ তার তৈরী করা ফ্যাঙ্কেনস্টাইন এখন তাকেই চিন্তায় রেখে দেবে। খারাপ লাগছে ওনার বাবার আর স্ত্রীর জন্য। কিন্তু কি আর করা যাবে বলুন? আমার পুর্ন সহানুভূতি ওনাদের প্রতি রইল। 

আমি যে ঐ প্রেস কনফারেন্সে উপস্থিত ছিলাম সেটার প্রমাণ এই চিঠির শুরুতেই দিয়ে আরো একবার আমি আপনাদের কাছে প্রমান করে দিলাম যে আমার ছদ্মবেশ নেওয়ার শিক্ষাটা বেশ ভালোই হয়েছে। 

আর একটা কথা যে মিডিয়ার রিপোর্টারের উচ্চাকঙ্কার জন্য এতকিছু ঘটল একজন আত্মহত্যা অবধি করে ফেলল, আমি তাকে মেরে অজ্ঞান করে তার নিজের গাড়ীর ডিকিতে রেখে দিয়েছি। ওনার ফ্ল্যাট কম্পাউন্ডেই গাড়ীটা আছে। আপনারা গিয়ে ওনাকে উদ্ধার করে নিলে ভদ্রলোক প্রাণে বাঁচেন। 

আরো একটা ব্যাপার, যে ভদ্রলোকের স্ত্রী তার গাড়ির ড্রাইভারের সাথে আশি লাখ টাকা নিয়ে পালিয়েছিল আর আমার হাতেই মরেছিল সে আসলে অনেক বেশীটাকা নিয়ে চলে এসেছিল ঐ মহিলার সাথে বোধহয় জানত না দুজনের কেউই। আমি শুধু পরে গুনে গেঁথে গণেশদার হাতে পঁচাত্তর লাখটাকা ফিরত দিয়ে দিই। বাকীটাকাটার সঠিক পরিমাণ একটু গণেশদাকে আর ঐ ভদ্রলোককে জানিয়ে দেবেন। সেটা কম বেশী এক কোটি। আর সেটা দিয়েই আমি আমার পালানোর ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম, অনেক আগে থেকেই। 

আমি নিজে উধাও হয়ে গিয়ে আমার ছায়াকে রেখে যাচ্ছি আপনাদের মধ্যে। আপনারা প্রতিনিয়ত শুনবেন তার পায়ের শব্দ। 

নমস্কার নেবেন। 

ইতি 

সঞ্জয় মৌলিক।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















৭) 

ভরত-মিলাপ 

পরের দিন। ব্যাংক খুলতেই দুই ট্রেনি অফিসারকে রিলিভিং লেটার ধরিয়ে দেওয়া হয়। ওরা আজই সন্ধ্যেয় বিলাসপুর ফিরে যাবে। কাল হেড অফিসে রিপোর্ট করে নিজেদের নতুন পোস্টিং এর অর্ডার হাতে হাতে পেয়ে যাবে। 

অর্ডার পেয়ে চমকে ওঠে শ্রীরাম; আশা করেছিল ম্যানেজার ওকে আরও একমাস রেখে দেবে। তার জন্যে হেড অফিসে রেকমেন্ড করবে। কিছু একটা বলবে বলে মুখ খুলতে গিয়েও বুজিয়ে ফেলে। জল খায়। ডোঙ্গরে কিছু বলে না। 

লাঞ্চ এর পর ওরা চলে যায়। যাওয়ার আগে রূপেশের সামনে মাথা নীচু করে বলে- জানে অনজানে অগর কিসীকো কুছ দুখ পঁহুচায়া তো মাফ কর দেঙ্গে। 

জেনে-না জেনে যদি কাউকে দুঃখ দিয়ে থাকি, তার জন্যে মাপ চাইছি।

বিকেলে ক্যাশ ক্লোজ হবার পর রাজন ঠুল্লুকে কফি বানাতে বলে। রূপেশের জিজ্ঞাসু চোখ দেখে বলে –স্যার, ওরা চলে যাওয়ায় একটু হালকা লাগছে। ঠিক যেন তেলে জলে মিশছিল না। 

রূপেশ এড়িয়ে যাবার চেষ্টায় বলে – আরে দু’মাসের ডেপুটেশন, পুরো হয়ে গেছে। এক্সটেন্ড করলে এক্সট্রা ডেপুটেশন অ্যালাউন্স পে করার ব্যাপারে আমাকে জাস্টিফিকেশন দিতে হবে,তাই। 

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে রাজন অনুরোধ করে একটা অসমাপ্ত গল্প শেষ করতে। 

মানে? 

চুড়ৈল অউর দারু পীনে কী কহানী তো হো গয়ী। কিন্তু আপ আপকে ঘরওয়ালে কে বারে মেঁ মনে মনে যে কী গিঁট বেঁধে রেখেছেন তা বলতে বলতে থেমে গেছেন। আমাকে বলুন, বলে ফেলুন। বুকের ভার হালকা হবে, সত্যি বলছি। 

রূপেশ কি এই অনুরোধের জন্যে মনে মনে অপেক্ষা করছিল? নইলে কেন এত কথা হটাৎ কল কল করে জলের ট্যাপ খোলার মত বেরিয়ে এল? 

রূপেশ জানে না। 

‘তখন ভিলাইয়ের ছেলেমেয়ে সবাই সায়েন্স পড়তে ১৪ কিলোমিটার দূরে জেলাসদর দুর্গ শহরের সরকারি কলেজে ভর্তি হত। আর্টস আর কমার্সের ছাত্ররা যেত ভিলাই সেক্টর সেভেনের কল্যাণ সমিতির প্রাইভেট কলেজে। আমার অংক ভাল লাগত। স্কুলে স্যারেরা বলতেন আমার নাকি অংকের মাথা ভাল। এ নিয়ে বাবা,বড়ে ভাইয়া বেশ গর্ব করতেন। বলতেন আমাদের ছোটু একদিন বড়ো হয়ে ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের চিফ ইঞ্জিনিয়র হবে। 

‘আমি ভাবতাম অংকের প্রফেসর হব, রিয়েল নাম্বার বা স্ফেরিক্যাল ট্রিগনোমেট্রি নিয়ে রিসার্চ করব। আমাদের এইচ ও ডি প্রফেসর বর্মার প্রিয় ছাত্র ছিলাম। ওঁর গণিত নিয়ে প্রবন্ধ একটি দেশি জার্নালে বেরোত। এই ভাবেই দুটো ইয়ার পেরিয়ে এলাম। ইচ্ছে এখান থেকেই গণিতে এম এস সি করব। তারপর? 

‘আমার ফাইনাল ইয়ার। বর্মাজী ট্রান্সফার হয়ে সাগর ইউনিভার্সিটি চলে গেলেন। বললেন ফাইনাল ইয়ারে ভাল রেজাল্ট করলে খড়গপুর বা কোন আই আই টিতে ম্যাথস এ পছন্দের টপিক নিয়ে এম ফিল করতে। ভর্তির ব্যাপারে উনি রেকমেন্ডেশন লেটার দেবেন। বিএস সি ফাইনালের রেজাল্ট বেরোলে ওঁর সঙ্গে সাগর ইউনিভার্সিটিতে চিঠি লিখে যোগাযোগ করতে। ব্যস, ম্যাঁয় তো হাওয়া মেঁ উড়নে লগা। মেরা দিলো-দিমাগ সব সাতওয়াঁ আসমান পর। 

‘হাওয়ায় উড়ছিলাম, মন মেজাজ সব খুশির সপ্তম স্বর্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এত সুখ কপালে সইল না। আমি কি একটু অহংকারী ও অসতর্ক হয়ে পড়েছিলাম? 

ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হলো। সব ভালই চলছিল। ফিজিক্স কেমিস্ট্রি উতরে গেল। এবার ম্যাথস। প্রথম পেপারে ক্যালকুলাস, অ্যাডভান্স অ্যালজেব্রা ও ভেক্টর অ্যালজেব্রা মেরা বাঁয়া হাত কা খেল থা। উসকে বাদ সেকন্ড পেপার। স্ট্যাটিস্টিক্স অউর প্রোবাবিলিটি। মজেদার পেপার। তিন সওয়াল বন গয়া থা। অব এক লার্জ স্যাম্পল কে সওয়াল হলো কর রহে থে কি পিছে সে এক লড়কা কোচ নে লগে। 

ইয়ার, টি অউর জেড ফাংশন কা টেস্টিং ফর্মূলা বতা দো। প্লীজ, ইয়ার! 

‘বলে দিতাম। কিন্তু তখন আমার মাথা গরম। বাই লিঙ্গুয়াল কোশ্চেন পেপারে ওই লার্জ স্যাম্পলের অংকটার ডেটা দুই ভাষায় দু’রকম দেখাচ্ছে। আমি ইংরেজি ভার্সনের ডেটা নিয়ে কষতে গিয়ে দেখি উটপটাং রেজাল্ট আসছে। তবে কি প্রশ্নটা ভুল! ইংরেজি ভার্সন নাকি হিন্দি? কোনটা ? এদিকে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে। আর একবার চেক করি, কষে দেখি; আমারও ভুল হতে পারে। 

‘কিন্তু মনঃসংযোগ যে কী কঠিন! কারণ সামনে পেছনে ছেলেগুলো কথা বলেই চলেছে। আর ইনভিজিলেটর যেন দেখেও দেখছেন না,মাঝে মাঝে হুমকি দিচ্ছেন বটে, -- আপস মেঁ বাতচিত নহীঁ, -- কিন্তু সেগুলো যে গিদড়-ভপকি বা নকল ধমক, তা সবাই বুঝছে। 

এমন সময় একটি অচেনা গলার আওয়াজে চমকে উঠলাম। 

--হোয়াট আর ইউ ডুইং মাই বয়? কিছুই লিখছ না,গালে হাত দিয়ে বসে আছ? আজকের পেপার কি খুব কঠিন? প্রশ্নগুলো কি আউট অফ কোর্স? 

আমি গণিতশাস্ত্রের সমস্যার ভুবন থেকে কঠিন বাস্তবের দুনিয়ায় ফিরে এলাম। তাও ঝাঁকুনি খেয়ে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে একজন মাঝবয়েসি সৌম্যদর্শন ভদ্রলোক, মুখে এক চিলতে হাসি, কিন্তু চশমার ফাঁকে চোখজোড়া হাসছে না। 

গোটা ক্লাসরুমে সন্নাটা। 

‘আমি উঠে দাঁড়াই। আমাকে উনি কী বলছেন, কেন বলছেন কিছুই মাথায় ঢুকছে না। আমার মাথার ওপর দিয়ে উনি ক্লাসরুমের পেছন দিকে কাউকে কিছু যেন আদেশ দিলেন। মাথা ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই ব্যাপারটা বুঝলাম। নকল রোখার ফ্লাইং স্কোয়াড! 

তিনজনের একটি দল কখন যেন আমাদের রুমে ঢুকে পড়েছে। দু’জন পেছনের ও দরজার দিকের বেঞ্চগুলোতে সবার পকেট চেক করছে ডেক্সের ভেতর চেয়ারের তলা সব খুঁটিয়ে দেখছে। কিন্তু এই ভদ্রলোক আমাকে জেরা করছে কেন? 

একটু পরে আওয়াজ আসতে লাগল—পেয়েছি স্যার, ফর্মূলা লেখা চিটগুলো শার্টের কলারের মধ্যে গুটিয়ে রাখা। 

আর একে দেখুন, এই গরমে জুতো মোজা পরে এসেছে, মোজার ভেতরে। আর এই চিকলমুন্ডি ন্যাড়ামাথা শ্রীমান, ইনি ফুলহাতা শার্ট পরে এসেছেন। 

‘এই ভদ্রলোক সম্ভবতঃ দলের নেতা। সবজান্তা মোডে মাথা নেড়ে বললেন—জানতাম। ঠিকই খবর পেয়েছিলাম যে এখানে মাস লেভেলে চিট চলছে। এটা গভর্ণমেন্ট কলেজ, তার এই হাল? এমন রিপোর্ট দেব যে ইনভজিলেটর অধ্যাপকটির ইনক্রিমেন্ট আটকে যাবে। 

এরপর উনি আমাকে বললেন—আমি কারও পকেটে হাত দিই না,যা আছে বের করে দাও। 

উনি যে আমাকেও চিট চালাচ্ছি বলে সন্দেহ করছেন এটা বুঝতে খানিকক্ষণ লাগল। ধমক খেয়ে পকেট উলটে দেখালাম যে রুমাল ছাড়া কিছু নেই। উনি আমাকে একনজর দেখে ধমকে উঠলেন—হাত দুটো ডেস্কের উপর রাখ। 

তারপর আচমকা নীচু হয়ে আমার পায়ের কাছ থেকে একটা দোমড়ানো কাগজের দলা তুলে নিলেন। এটা কি? দেখ, দেখে বল। 

আমার গলা শুকিয়ে গেছে। স্যার, এটা আমার না। 

বেশ, তাহলে কোনটা তোমার সেটাই বলে দাও। 

স্যার, আমি চিটিং করি না। সাক্সেনা স্যারকে জিজ্ঞেস করুন। 

আমার কাউকে জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। এই চিট তোমার কাছ থেকে পাওয়া গেছে। এই যথেষ্ট। 

স্যার, এটার ফর্মূলা কার্ল পিয়ার্সন কো-এফিশিয়েন্ট আর মিউচুয়ালি এক্সক্লুসিভ প্রোব্যাবিলিটির। এর কোন সওয়াল আজকের পেপারে আসে নি। 

ও হো, তাই তুমি এটা মাটিতে ফেলে দিয়েছ। 

না স্যার, আমি এটা বানাইনি, ফেলিওনি। 

তাহলে কি করে জানলে এই চিটে কিসের ফর্মূলা লেখা আছে। 

জানতাম না,তখন আপনি দেখতে দিলেন, তাই। 

আচ্ছা? ওই খুদে খুদে লেখা একনজর দেখেই তুমি ওটা কার্ল না আর্ল সব বুঝে গেলে! স্ট্রেঞ্জ! 

বিশ্বাস করুন, আমি সিরিয়াস স্টুডেন্ট; কখনও চিট বানাইনি। 

বল, কখনও ধরা পড়নি। 

হ্যাঁ স্যার। 

এই তো সুবোধ ছেলের মত কথা বললে। 

এবার এই কাগজে দস্তখত করে বাড়ি যাও। তোমাকে হাতেনাতে ধরেছি। এই হলের চারজনকে বুক করলাম। তোমরা চাইলে যদি কিছু পেপার বাকি থাকে তাতে বসতে পার। কিন্তু রেজাল্ট উইথহেল্ড থাকবে। এরপর ইউনিভার্সিটি যা ভাল বুঝবে। 

‘কীভাবে যে বাড়ি ফিরেছিলাম মনে করতে পারি না। তারপর যা হলো সেটাকে আজও ভুলতে পারি নি। আমার কথা কেউ বিশ্বাস করে নি; বাবা, মা,দাদা,পাড়া-প্রতিবেশি—কেউ নয়। সবার এক কথা; হলে বেয়াল্লিশ জন পরীক্ষা দিচ্ছিল, বাকি তিনজনের সঙ্গে তোকে কেন ধরল! দাদা বললেন--তোর সঙ্গে কি ওদের জাতি –দুশমনি ছিল ? ওরা তো বোধহয় তোকে চিনতই না। ছি-ছি-ছি! আমাদের মুখ হাসালি! 

বন্ধুরাও বাঁকা হাসি হেসে বলল—চিট পেয়েছে তবেই তো বুক করেছে। খামখা চেঁচিয়ে কী লাভ? তারচেয়ে ভাল করে তৈরি কর, তিনমাস পরে সাপ্লিমেন্টারী পরীক্ষা দিয়ে দে, বছর নষ্ট হবে না। 

এরাই আমার বন্ধু! স্কুলের দিন থেকে? 

বাবা সাতদিন বাড়ি থেকে বের হলেন না। সবাই জানত ওর ছোট ছেলে অংকে ভাল। এখন সবাই জানতে চায় কেন এমন হলো? রূপু কি ইদানীং বখে যাচ্ছিল? নইলে চিট নিয়ে হলে যায়! আরে চিট তো ওর পায়ের কাছেই পাওয়া গেছল, তবে? 

‘কী বলব, এই তবে’র উত্তর পেয়েছিলাম অনেকদিন পরে। পেছনের বেঞ্চের ছেলেটি,যাকে অনেক অনুনয়-বিনয় সত্ত্বেও ফর্মূলা বলে দিই নি। সেই গুরবানী এল আমাদের বাড়িতে ওদের গাড়ি নিয়ে। আমার মায়ের প্রেসার বেড়ে মাইল্ড অ্যাটাক মত হয়েছিল। দাদা অফিসের কাজে আউট অফ স্টেশন। বাবা ঘাবড়ে গিয়ে কি করবেন কিছু বুঝতে পারছিলেন না। শিগগির মাকে নিয়ে সেক্টর নাইনের মেইন হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। আমাদের গাড়ি নেই,ভরদুপুরে ফোন করে অ্যাম্বুলেন্স খালি পেলাম না। সেই সময় কী করে খবর পেয়ে গুরবানী এল গাড়ি নিয়ে। ওদের লোহার ছড়ের ব্যবসা, পেল্লায় বাড়ি; তিনটে গাড়ি। 

এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে গিয়ে ওই চেনা ডাক্তার বের করে সাততাড়াতাড়ি মাকে ভর্তি করিয়ে দিল। আমাকে বলল –টেনশন মত লেনা। পতা কিয়া, মামলা উতনা সিরিয়াস নহীঁ হ্যাঁয়। দো দিন অবজার্ভেশন কে বাদ শায়দ পরশুদিন বাড়ি যেতে দেবে। আমি জানতে চাই গাড়ি পেট্রল বাবদ কত দেব? 

ও আমার পিঠে হাত রেখে মাথা নাড়ে। ওয়ার্ডের বাইরে গার্ডেনে নিয়ে গিয়ে একটা সিগ্রেট ধরিয়ে আমাকে একটা দেয়। বলে শোন, কিছু দিতে হবে না। আজ বলে নয়, যখনই দরকার পড়বে,বলবি। আমি গাড়ি নিয়ে আসব। 

এটা দেখি ক্যালকুলাসের চেয়েও জটিল ব্যাপার। 

ও হাসে; বলে এটা ওর পাপের প্রায়শ্চিত্ত। কয়েক বছর আগে পরীক্ষার হলে ফ্লাইং স্কোয়াডের রেইডের সময় ও ভয় পেয়ে ওর চিট দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে। সেটা গিয়ে সামনে বসা আমার পায়ের সামনে পড়ে। জলারামের কসম খেয়ে বলে –বিশ্বাস কর, তোকে ফাঁসাব ভেবে কিছু করি নি; কিন্তু তুই বুক হলি। তোর বছর নষ্ট হলো। আমি জানি ইস গুনাহ কী মাফি হো নেহী সকতা; পর--। 

আমার একটা অদ্ভুত অনুভূতি। রাগ, ঘেন্না কিছু নয়, একটা শুকনো বোদা ভাব। খালি একটা বছর নষ্ট! না,তিন-তিনটে বছর। 

‘আমি সাপ্লিমেন্টারী না দিয়ে কলেজ বদলে নিলাম। সায়েন্স ছেড়ে কমার্স নিয়ে তিন বছর প্রাইভেট কলেজে পড়ে গ্র্যাজুয়েট হলাম। আগের একজন বাদে সব বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করেছিলাম। সেই দোস্ত আর তার বাবা আমার কথা বিশ্বাস করেছিলেন। 

তাই বাড়ি থেকে একটাও পয়সা নিই নি। অংকের টিউশনি করে পড়ার খরচা চালিয়েছি। বড়ে ভাইয়া ব্যঙ্গ করলেন, গাল দিলেন। কিন্তু আমি জেদ ছাড়ি নি। 

এভাবেই একদিন এমার্জেন্সির সময় গ্রামীণ ব্যাংক খুলল, বিজ্ঞাপন বেরোল। বাড়িতে না জানিয়ে বন্ধুর বাড়ির ঠিকানা দিয়ে অ্যাপ্লাই করলাম, পরীক্ষা দিলাম। ইন্টারভিউ হলো। বাকিটা তো আগেই তোমায় বলেছি। ব্যস’।‘ 

রাজন এক গেলাস জল খেল। মুখ মুছল, গলা খাঁকরি দিল। 

--স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করি? আমায় যে প্রথম দিন দাদার থেকে টাকা আনতে হবে শুনে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে সিকিউরিটির টাকা দিয়েছিলেন সেটা --? 

--ঠিকই বুঝেছিস। সেই ‘দাদা’ ফ্যাক্টর। 

রূপেশ হাসে, রাজন উশখুশ করে। খাবার সময় হয়েছে। ঠুল্লু এসে টিফিন ক্যারিয়ার খুলে টেবিলে থালা সাজাচ্ছে। 

--স্যার, আই উড লাইক টু সে সামথিং। আই হ্যাভ অলসো ওয়ান স্টোরি,নট আন-ইউজুয়াল লাইক ইয়োর্স, বাট ইয়েস, এ স্টোরি অল রাইট। 

‘স্যার, হয়েছিল কি জয়েন্ট ক্লিয়ার করতে পারি নি। আসলে আমার মন লাগত না অংকে, ঠিক আপনার উলটো কেস। তবু, বাবা ভর্তি করে দিলেন এক কম্পিউটার ইন্সটিট্যুটে জেলা সদরে। এক ব্যাটা অ্যাপল না কিসের ফ্রাঞ্চাইজি নিয়ে ফেঁদে বসেছে একটা ঝকাস স্মার্ট কম্পু-ক্লার্ক বানাবার দোকান। অথচ সাইনবোর্ডে এবং প্রস্পেক্টাসে বড়ো বড়ো করে লেখা এখান থেকে পাশ করে ইঞ্জিনিয়ার হওয়া যায়। সাউথ আফ্রিকার কোন ইউনিভার্সিটির অ্যাফিলিয়েশন। এত সহজে ফরেন ডিগ্রি! কম্প্যু ইঞ্জিনিয়র! ব্যস, আমার বাবা ও ওঁর মত অনেক মাঝারি চাষি জমি বেচে পয়সা লাগিয়ে দিল। হোস্টেলে থেকে পড়তে হবে, ভালো পোষাক চাই। পার্সোনাল কম্পিউটার চাই, ডেস্কটপ। তখন ল্যাপটপ দেড় লাখের নিচে পাওয়া যেত না। 

‘প্রথম প্রথম বেশ লাগছিল, কিন্তু ওই দুটো সেমিস্টার পর্য্যন্ত। অ্যালগোরিদম ও অংক গুলো কঠিন হতে হতে আমার ক্যাপাবিলিটির বাইরে চলে গেল। আমি ক্লাস বাংক করতে শুরু করলাম। 

আমি একা নই, বেশ ক’জন সঙ্গী জুটে গেল। বেশিরভাগ শহরের, আমিই শুধু গ্রামের। তবে সবারই এক প্রবলেম—এইসব ছাইছাতার অংক আর অ্যালগোরিদম ! কাজ নেই বিদেশি ইঞ্জিনিয়র হয়ে। আস্তে আস্তে দীক্ষা হলো, সিগ্রেট থেকে মদ ও গাঁজা। না,ব্রাউন সুগার বা কোন ড্রাগস নয়। কিন্তু দুপুরের শো’তে সিনেমা দেখা সব চেয়ে বড়ো নেশা হয়ে দাঁড়াল। আমাদের গাঁয়ের বাড়িতে কারও টিভি ছিল না। কলেজের ফীস বাকি পড়তে লাগল। আজ দেব, কাল দেব করেও লোড বেড়ে যাচ্ছিল। এক বন্ধু ধার দেবে বলেও আজ- নয়- কাল করতে লাগল। শেষে বাড়িতে চিঠি গেল। প্রাইভেট কলেজ বলে কথা। বাবা এল। প্রিন্সিপালের রুমে আমাকে ডেকে পাঠানো হলো। বাবা জানলেন যে আমি দিনের পর দিন ক্লাসে যাইনি, মাসের পর মাস মাইনে দিই নি। বাবা বললেন যে উনি তো নিয়মিত আমার নামে মানি অর্ডার করেছেন। 

বাবা হাতজোড় করে প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে মাপ চাইলেন, আমার হয়েও। তারপর আমাকে কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাড়ি চলে এলেন। সাতদিন কোন কথা বলেন নি। গুম হয়ে বসে থাকতেন আর মাঝে মাঝে বিড়বিড় করতেন—আমার ছেলে চোর! ছিঃ। 

সাতদিন পরে এক সকালে আমাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে বললেন—তৈরি হও। আমার সঙ্গে ক্ষেতে কাজ করতে যাবে। 

মাকে বললেন—আমার সঙ্গে ওর খাবারও বেঁধে থলিতে ভরে দাও। দুপুরে ওখানেই খাবে। চাষার ছেলে চাষাই হোক, আমারই ভুল। 

‘সাতটা দিন গেল না,আমি হাঁফিয়ে উঠলাম। জমিতে কাদার মধ্যে মই দেওয়া, হাল ধরা, আগাছা নিড়ানো—এ যে কি পরিশ্রমের কাজ যে করেছে সে জানে। রাত্তিরে ঘুমুতে পারি নে, সারা শরীরে ব্যথা। বাবার পা ধরে ক্ষমা চেয়ে বললাম –অন্যায় করেছি। আর একটা চান্স দাও, ভাল করে পড়াশুনো করব। চাষের কাজ আমার দ্বারা হবে না। 

বাবা অবিচল। 

পাশের বাড়ির জ্যাকব আংকল বাবার বন্ধু। উনি বললেন –অনুশোচনায় সব পাপ, অনেক বড়ো বড়ো পাপ ধুয়ে যায়। আর এ তো তোমার ছেলে, কীই বা বয়েস! 

শেষে সব কথা খুলে জানিয়ে জ্যাঠতুতো দাদাকে চিঠি লিখলাম। উনি ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টের চার্জম্যান, উইনাদের আইটি আই থেকে পাশ, মেশিনিস্ট কাম মিলার। 

‘তারপর দাদার চিঠি এল। উনি আমাকে ভিলাইয়ে নিজের কাছে রাখবেন, একটা আর্টস কলেজে ভর্তি করে দেবেন। আমি যাতে ভালভাবে গ্র্যাজুয়েট হই সেটার দায়িত্ব উনি নেবেন। বাকিটা বুঝতেই পারছেন। এখন আমাকে নিয়ে বাবা বেশ গর্বিত। উইনাদের চাষার ছেলে ব্যাংকের মত কঠিন কাজের লায়েক হয়েছে। লাখ লাখ টাকা নাড়াচাড়া করে। ভারত সরকার ওকে বিশ্বাস করে’। 

রূপেশ বলল খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে নে। 

খাবার পর হাত ধুয়ে বসে রাজনকে বলল যে ওর কাছে সিগ্রেট থাকলে একটা দিতে। 

রাজন কোন কথা না বলে একটা বাড়িয়ে দিল। 

একটু পরে বলল—এই যে আপনি শুধু দিওয়ালির সময় বাড়ি যান, গিয়ে কী করেন? বাবা-মার সঙ্গে কথা বলেন না ? 

যা বলি তা না বলারই মত। মানে মা বা বৌদি চায়ের কাপ ধরিয়ে বলল দিয়ে আসতে। আমি নিয়ে গিয়ে ঠক করে ওঁদের সামনে রেখে দিয়ে বলি—চায় লীজিয়ে, ব্যস। 

রাজন দু’দিকে মাথা দোলায়। আচ্ছা, ওঁরা কিছু বলেন না ? ধরুন, বোস, আমাদের সঙ্গে বসে চা খাও। 

--আগে বলতেন, আমি উত্তর না দিয়ে উঠে চলে যেতাম। এখন আর কিছু বলেন না। 

-- আপনি বয়সে ও পোস্টে বড়ো। আপনাকে অ্যাডভাইস দেব সে অধিকার নেই। আপনাকে ভাল লাগে, বুঝতে পারি আপনি কষ্ট পাচ্ছেন, তাই বলি—সারাজীবন ওই একটি ঘটনার ব্যাগেজ বয়ে বেড়াবেন? আজকে আপনার নতুন করে কাউকে কিছু প্রমাণ করার নেই। কিসীকো দিখানে কী কোই জরুরত নহী হ্যাঁয়; ঘরওয়ালে মুহল্লেওয়ালে-- কিসীকো নহী। ইসীলিয়ে কহতা হুঁ, বাতচিত শুরু কীজিয়ে। পিতাজীসে, বড়ে ভাইয়া সে। জিদ ছোড়িয়ে, ঘর জাইয়ে। খুদ পহল কীজিয়ে, করকে দেখিয়ে। 

রুপেশ সিগ্রেট নিভিয়ে ওকে শুতে যেতে বলে। 

পরের শনিবার। দিনের শুরু, বেলা দশটা। ঝাঁট-পাট হয়ে টেবিলে লেজার সাজানো হচ্ছে, কাস্টমারের জন্যে গেট খুলবে আরো আধঘন্টা পরে। 

রূপেশের টেবিলের পাশে একটি এয়ারব্যাগ দেখে রাজন বলল—এটা কার? 

--আমার রে। আর কার! আজ আমিও হাফ ডে’র পর ব্যাংক বন্ধ করে তোর সাথে ভিলাই যাব; হ্যাঁ, ‘বন্দে মাতরম’ বাস ধরে। ফিরব সোমবার সকালে, তোর সাথে। কণ্ডাকটারকে বলে একটা ভাল সিট জোগাড় করিস তো, সামনের দিকে। 

রাজনের চোখ বড়ো বড়ো, কথা ফোটে না। রূপেশের মুখে হাসি, কিন্তু চেহারায় একটা লজ্জা লজ্জা ভাব। 

--তোকে বলা হয় নি। কাল ছিল বড়ে ভাইয়ার জন্মদিন। কী মনে হলো, সকালবেলা ব্যাংকের ল্যান্ডলাইন থেকেই ফোন করে ‘হ্যাপি বার্থ ডে ভাইয়া’ বললাম। 

খানিকক্ষণ সন্নাটা। ভাবছিলাম লাইন ছেড়ে দেব কি না। এমন সময় একটা কাঁপা কাঁপা আওয়াজ শোনা গেল—কৌন? 

ভাইয়া, আমি রূপেশ; আজ আপ কা জন্মদিন হ্যাঁয় না,ইসীলিয়ে। 

আবার সন্নাটা। তারপর এল এক হুঙ্কারঃ বেওকুফ, জানবর, উল্লু কঁহিকে! এতদিন পরে আমাকে মনে পড়ল? তোর বড়ে ভাইয়াকে? 

৮) 

আহিরণের পূবপাড়ে আজ সন্ধ্যেয় গাছগাছালি আবার চৌপালে বসেছে। বৃদ্ধবটের শরীর খারাপ, সভায় অনুপস্থিত। ওর প্রতিনিধি হয়ে এসেছে অশত্থ। আসলে বনবিভাগ থেকে কয়েকদিন আগে কিছু মুখ্যু কর্মচারি এসেছিল। তারা কুড়ুল দিয়ে বটের গায়ে বাকল তুলে একটা চৌকো মত আকার বানিয়েছে। তাতে গরম আলকাতরা দিয়ে একটা নম্বর লিখে দিয়েছে—৫৫৭। 

মানে এই জঙ্গলে এই বটগাছটির সংখ্যা হলো ওই ৫৫৭। গুণতি হচ্ছে, রেকর্ড দুরুস্তি হচ্ছে। কিন্তু বটের যে লেগেছে, ঘা শুকুতে যে সাতদিন লাগছে—তার বেলা? 

সে কথা উঠতেই পাকুড় বলে উঠল—মানুষেরা এ’রকমই হয়। 

কোসম সেবারের অভিজ্ঞতা ভোলে নি, তাই মানুষের কথা উঠতেই মাথা নেড়ে সায় দেয় ,-- সে আশকথা পাশকথা যাই হোক। মানুষ নামের দু’পেয়ে জন্তুর ব্যাভার নিয়ে তার মনে কোন সন্দ নেই। বলল সেবার যখন ছুরিখুর্দ গাঁয়ের আমোল সিং বৈগা আমার বোঁটা ছিঁড়ে ফুল-পাতা নিতে এল অষুধ বানাবে বলে, তখন তো আমি তোমাদের পূজ্য পঞ্চায়েতে নালিশ করেছিলাম। কিন্তু আমার ব্যথা নিয়ে তোমরা কেউ কিছু কর নি। খালি আমার বন্ধু কাঁকড়াবিছে ওকে উচিত শিক্ষা দিয়েছিল। 

পরে যখন কোরবা থেকে ওষুধ কোম্পানির আড়কাঠি এসে জোর করে আমায় তছনছ করে সব নিয়ে গেল, তোমরা বললে কেঁদে লাভ নেই,যা হবার তা তো হয়ে গেছে। বনইমলি আমার হয়ে বলতে এলে বুড়োর দল ওকে চুপ করিয়ে দিল। উলটে বটদাদু আমাকে বোঝাচ্ছিলেন যে আমাদের নাকি মানুষজন ছাড়া চলে না। ওদের বিরুদ্ধাচরণ করে নাকি জঙ্গলে টেকা দায়। এখন হলো তো? নিজের গায়ে না লাগলে অন্যের কষ্ট কেউ বোঝে না। 

পলাশ শিমূল যমজ ভাইয়ের মত। একসঙ্গে বৈঠকে আসে, একসঙ্গে যায়। যা বলে তা যেন আগে থেকে মহড়া দিয়ে তৈরি হয়ে এসেছে। কখনও দাঁড়ি কমা আলাদা হয় না। পলাশ বলল এই সব নাকে কান্না বন্ধ করে কাজের কথায় এস। আহিরণের ওপারে কোশ চারেক ওপাশে বিজলি কারখানা খুলছে; দিল্লি সরকারের। পাশেই আগারখার, দুরপা, কোসমন্দা, মনগাঁও, গেওরা –এসব জায়গায় দু’বছর আগেই জরিপ হয়ে কয়লা খাদানের কাজ শুরু হয়ে গেছে। মাটির তলায় নয়, মাটির ওপরে। এবার সেই কয়লায় এপারে বিজলি তৈরি হবে। এর জন্যে অনেক কাঠ চাই,-- বরগা, খুঁটি, বল্লী, বাতা এসবের জন্যে। তাই অনেক গাছকে মরতে হবে। এই যে গায়ে আলকাতরা দিয়ে নম্বর লেখা হচ্ছে তা আর কিছুই নয়, বলির আগে পাঁঠাদের দড়ি বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা। 

যত্ত গাঁজাখুরি কথা। আগারখার, দুরপা বা কোসমন্দায় বিজলির কল বসবে তো এখানে গাছ কাটবে কেন? কে এই সব আতংক ছড়াচ্ছে? নামটা বল! তুই এই জঙ্গলের গাছ। এর বাইরে কোনদিন পা বাড়াস নি। তুই কোত্থেকে এত সব খবর পেলি? 

গলা তুলল শিমূল। 

ওকে ধমকাচ্ছ কেন? তোমাদের সাবধান করতে এল, তো খেরে উঠলে! জেগে ঘুমুতে চাও, তো ঘুমোও। কে মানা কচ্ছে ? সেই যে বলে না –‘ভাল রে ভাল করে গেলাম কেলোর মার কাছে, কেলোর মা বলল আমার ছেলের সঙ্গে আছে’। তোমাদের হলো সেই দশা। 

একটা সিড়িঙ্গে তেঁতুল গাছ আগ বাড়িয়ে বলতে গেল—এসব খবর দিল কে? 

ঝাঁঝিয়ে উঠল শিমুল। ‘তুই চুপ কর! তিনদিনের এঁড়ে, এল শিং নেড়ে’! খবর দিয়েছে শালিক, ময়না আর টিয়েপাখির ঝাঁক। ওদিকে গাছকাটা শুরু হলো, তো ওদের পুরনো বাসা ভেঙে গেল। তখন সবাই দলবেঁধে এদিকের জংগলে চলে এসে কুটোকাটা দিয়ে ঘর বানানো শুরু করেছে। কিন্তু সে আর ক’দিন? এখানে দাগ পড়া শুরু হয়েছে। এর পর কুড়ুল করাত আর মস্ত মস্ত ট্রাক নিয়ে চলে আসবে ঠেকেদারের দল। 

আচ্ছা, এই দলের পান্ডা কেটা? তাকে কিছু করা যায় না ? পটিয়ে পাটিয়ে কাজটা যদি একটু ঢিলে করা যায়! তাহলে কিছুটা সময় পাওয়া যাবে। 

বড়ো দেশি আমগাছ আর বাবুল মুখ খুলল--একটা নতুন আস্তানা খুঁজে পেতে একটু সময় তো লাগবেই। এমন ওঠ- ছুঁড়ি-তোর-বিয়ে ধম্মে সইবে? নদীর ওপারে কোসগাই পাহাড়ের উপর দেবীর মন্দির। কোসগাই দেবী খুব জাগ্রত। উনি এমন অন্যায়ের কোন প্রতিবিধান করবেন না ? 

পলাশ বলল –আছে, লোক আছে। সরকারি কোম্পানির পাটোয়ারি ঝাড়ু সিং আর ঠিকেদার সমেলাল দেবাঙ্গন, ছুরি গাঁয়েরকাশ্যপ ডাক্তারের গিন্নি যার নাম দিয়েছে নারদমুনি। কিন্তু এদের খাঁই মেটানো তোমার আমার কম্মো নয়। আমাদের দু’একজন চেষ্টা করেছিল। তো ব্যাটা ঝাড়ু সিং হাঁকিয়ে দিল। বলল যে এসবের অর্ডার এয়েছে উপর থেকে, মানে দিল্লি থেকে। ওর পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। 

ব্যাটা নচ্ছার! এদিকে ওর মাটির ঘর পাকা হচ্ছে, ছাদের টালি-খাপরা ফেলে ছাত ঢালাই হয়ে গেছে। মেজেতে নাকি সাদা-কালো দাবাখেলার ছকের মত টাইলস বসবে 

আচ্ছা, ঝাড়ু সিং আবার একটা নাম হলো নাকি! মানুষদের যে দিন দিন কি পিবিত্তি হচ্ছে? কোথায় আগের দিনের মত মহেশ, সুরেশ, গণেশ,,রমেশ বা অন্য কোন 

ঠাকুর-দেবতার নাম রাখবে, অন্ততঃ রাকেশ, নরেশ, দেবেশ—তা না কিসব অলুক্ষুণে ঝাড়ু, মেথর, চামার এইসব। 

অলুক্ষুণে কথাটা ঠিকই ধরেছ। আসলে ওর আগে তিন ভাইবোন জন্মেছিল। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই যমরাজ টেনে নেয়। তাই এর পরে ওর দিদির নাম হলো মহেতরীন বাঈ ( মেথরানী), ওর নাম ঝাড়ু আর ছোট ভায়ের নাম চামার সিং। তারপর দেখ হাতে হাতে ফল। এমন সব যমের অরুচি বিচ্ছিরি নাম রাখায় যমরাজ আর ফিরেও তাকায় নি। 

একপাশে কখন এসে চুপটি করে বসেছিল ঠিকরে বাজ। দেখতে ছোট, কিন্তু বাঁকানো ঠোঁটে আর নখে তরোয়ালের ধার। সে ডানা ঝাপটে বলে উঠল—ফের বাজে মেয়েলি গাল-গল্প! এদিকে যে অমঙ্গল নেবে এসেছে ছুরি গাঁয়ে তার কোন খবর রাখ তোমরা? 

সবার চোখ এখন ঠিকরে বাজের দিকে। হয়েছেটা কি? আহিরণের জঙ্গলে এমন কোন খবর তো আসে নি! 

বাজের চেহারায় বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব, ভাও খেয়ে সে আরও গম্ভীর। একটা কৃত্রিম মোটা ফ্যাসফেসে আওয়াজে ও বলতে শুরু করল। 

তবে শোনঃ কাঠঘোরা –ছুরি বাসরাস্তা-- প্রায় নব্বই কিলোমিটার -- এখন পাকা হচ্ছে। এতদিন কোরবা থেকে দশ কিলোমিটার আর কাঠঘোরা থেকে পাঁচ কিলোমিটার পাকা ছিল। মাঝের পঁচাত্তর কিলোমিটার খোয়াওঠা মোরাম ঢালা কাঁচা রাস্তা যা বর্ষায় গাড়ি চলার মত নয়। কিন্তু বিজলি কারখানা তৈরি হচ্ছে, ট্রাক চলবে, সাহেব-মেমদের গাড়ি আসবে যাবে; ওদিকের গাঁয়ে কোয়ার্টার, বাজার-হাট, ইস্কুল, দোকানপাট সব বসানো হবে। তাই রাস্তা পাকা হবে। 

নবযুবক বনইমলি বিরক্ত হয়ে বলে –কাজের কথায় এস। এর মধ্যে ছুরিগাঁয়ে অমঙ্গলের ছায়া কোথায় দেখলে? 

ঠিকরে বাজ জবাব না দিয়ে এমনভাবে তাকালো যে মুরুব্বিরা চেঁচিয়ে উঠল—ভাইগে ভাইগে, খামোশ! খামোশ! কেউ মাঝখানে কথা বলবে না। 

একটু কেশে ঠিকরে বাজ আবার শুরু করল। 

পঁচাত্তর কিমি রাস্তায় পিচ ঢালার কাজ চারজন ঠিকেদারকে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে বড়ো টুকরো, প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার,পেয়েছে কোরবার ঠিকেদার মহেন্দ্রপাল শর্মা। এর মধ্যে ধনরাস-ছুরি গাঁয়ের সামনে গতকাল কাজ চলার সময় একটা ট্রাক থেকে মজদুর নামার সময় ট্রাকের চাকা সিলিপ মারে আর পালটি খাওয়া ট্রাক একটা গরম প্রায় ফুটন্ত পিচের ড্রামে ধাক্কা মেরে কাত করে দেয়। রাস্তায় গড়িয়ে পড়ে গাঢ় দলা দলা পিচ কাত হওয়া ট্রাকের নীচে গড়িয়ে গড়িয়ে ঢুকতে থাকে। পাঁচজন মজদুর, তিনজন মর্দ অউর দো জন অঊরত, আটকা পড়ে ছটফট করতে থাকে; বাঁচাও বাঁচাও চেঁচাতে থাকে। কিন্তু ঠিকেদারের বাকি লোকেরা ভেবে পায় নি কী করা উচিত। ট্রাকের নীচের থেকে ওদের টেনে হিঁচড়ে বার করতে গেলে নিজেরা গরম গলা গলা পিচে ঝুলসে যাবে। 

কয়েক ঘন্টা ধরে এই নাটক চলল, মানে যতক্ষণ ওদের প্রাণ ছিল,জল চাইছিল। ছুরিগাঁয়ের মেয়ে-মদ্দ ভীড় করে করুণ মুখে এই তামাশা দেখল। এখানেই শেষ নয়। 

ঠিকেদার শর্মা সরপঞ্চ সঝলা কুমারকে পটিয়ে ফেলল, উনি যেন পুলিশের এবং ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে দিব্যি গেলে বলেন যে খালি ট্রাক পালটে গেছল। তাতে কোন মানুষ ছিল না। কেউ মারা যায় নি, শুধু ড্রাইভার আহত হয়ে হাসপাতালে। শর্মা ডেডবডিগুলোকে লোপাট করে দেয় আর তাদের আত্মীয়দের বলে ওরা কাজ ছেড়ে পালিয়ে গেছে ভিনগাঁয়ে, বেশি টাকার লোভে আর কি! কোথায় গেছে? তা শর্মা জানে না। 

এবার দেখ দেবীর কোপে গাঁ যদি ছারখার না হয়ে যায়! 

অমঙ্গলের লক্ষণ দেখা যেতে লাগল ক’দিন পর থেকে। 

ব্যাংকের কাজকম্মের মাঝে রূপেশের নজরে এল একটা খুব ফর্সা জোয়ান ছেলে আলোয়ান জড়িয়ে একটা বেঞ্চে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। দু’ঘন্টা কেটে গেল, ভিড়ের লোকজন চলে গেছে। ছেলেটা একই ভাবে বসে আছে। অসুস্থ? জ্বরজারি নাকি? রূপেশের অস্বস্তি বাড়তে লাগল। একটু পরে ঠুল্লুকে বলল—যা তো, ওকে ডেকে নিয়ে আয়, কী চাই ওর? 

ও জানাল যে একটু পরে ও ম্যানেজার সাহাবের সঙ্গে কথা বলবে, কিন্তু একলা। 

রূপেশের ভ্রূ ওপরে উঠল। কী কেস? কোন কমপ্লেন? লোন পাস করানোর নাম করে ঘুস চাওয়া? এখন তো স্টাফ মাত্র দু’জন। ফিল্ড অফিসার নতুন রিক্রুট থেকে আগামী মাসে পাওয়া যাবে। এদের মধ্যে ঘরশত্রু বিভীষণটি কে? রাজন নাকি ঠুল্লু? তবে লোনের কাগজপত্রে ঠুল্লুর হাত পৌঁছয় না। রাজনের সুযোগ বেশি। ও ডকুমেন্ট ফিল আপ করে। তাহলে তো রাজনকে এখান থেকে সরাতে হবে। দু’পক্ষের স্টেটমেন্ট নিয়ে প্রাইমা ফেসি কেস মেঁ দম হ্যাঁয় মনে হলে ওকে সাস্পেন্ড করিয়ে ডিপার্টমেন্টাল ইনভেস্টিগেশন করার রেকমেন্ডেশন পাঠাতে হবে হেড অফিসকে। দু’মাস আগেই ও বিলাসপুরের স্টেট ব্যাংক ট্রেনিং সেন্টারে ফ্রড, ইনভেস্টিগেশন ও ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারি নিয়ে একটা সাতদিনের ক্যাপসুল কোর্স করে এসেছে। এর মধ্যেই সে নতুন শেখা বিদ্যেটি কাজে লাগানোর সুযোগ এসে গেল! হে ভগবান! 

রাজনকে যে ও খুব পছন্দ করে। কিন্তু তাবলে কি চোখ বুঁজে থাকবে? মাই স্টাফ, রাইট অর রং ! তাহলে ন্যাচারাল জাস্টিসের কী হবে? প্রাকৃতিক ন্যায়? 

ও হ্যাঁ, প্রাকৃতিক ন্যায় তো বলে কাউকেই তার পক্ষ না শুনে সাজা দেওয়া উচিত নয়। দ্যাট উইল বি এ ট্র্যাভেস্টি অফ জাস্টিস। ঠিক, নালিশটা শোনার পর রাজনের কী বলার আছে তা ও শুনতে হবে। আগে থেকেই কেন ওকে দোষী মনে করছি? নাঃ, এই বায়াসড এই পূর্বাগ্রহ ঠিক নয়। আমার মনটাকে ক্লিন শ্লেটের মত রাখতে হবে। 

এই যে শোন, এদিকে এসে আমার সামনের চেয়ারটাতে বস। এবার বল। কী কমপ্লেন তোমার? আমার ব্যাংকে কী অসুবিধে হচ্ছে? 

সাহেব, আমার লোন চাই। 

আচ্ছা, কত টাকা? 

সাহেব দশ হাজার। 

কবে অ্যাপ্লিকেশন দিয়েছ? কার হাতে? আমার ব্যাংকে কিসী কে সাথ বাত কিয়া? 

না না,আজই প্রথম আপনার ব্যাংকে এলাম। কেউ জানে না,আমার বাড়িতেও না। 

কী নাম তোমার? দশ হাজার অনেক টাকা। কী বিজনেস করতে চাও? 

মুন্নালাল দেবাঙ্গন, আমরা তাঁতি। বিজনেস নয়, এই টাকাটা আমার চিকিৎসায় খরচা হবে। 

মানে? কী হয়েছে তোমার? 

আমি দিন প্রতিদিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। শরীরে রক্ত কমে যাচ্ছে। কোন কাজ করতে পারি না। ঘরে দুটো খটখটা (পিট লুম), তাতে দুই হাতের সঙ্গে দুই পা’ও চালাতে হয়। পেরে উঠছি না। রাত্রে জ্বর আসে। 

রূপেশ ভাল করে ওর অস্বাভাবিক হলদেটে চেহারা, নিস্তেজ চোখ ও ফিসফিস করে কথাবার্তা খেয়াল করে। --শোন, তুমি কোরবায় সরকারি হাসপাতালে যাও। রক্ত পরীক্ষা করাও। বিনে পয়সায় হয়ে যাবে। তখন ধরা পড়বে কী হয়েছে। 

মুন্নালাল আরও এগিয়ে আসে। ফিসফিস করে বলে—না মালিক, আমি জানি আমার কী হয়েছে। আসল হল আমার বৌ। ও হলো টোনহী, আমার রক্ত শুষে নিচ্ছে। তাই দিন দিন কমজোর হো রহা হুঁ। চেহরা পীলা পড় গয়া হ্যাঁয়। 

এ কোন দুনিয়া! রূপেশ চেনে না। 

ও দুর্বল গলায় বলে—আমি কী করতে পারি? কোন ধান্ধা অথবা রোজগারের জন্যে ছাড়া কী করে লোন দেব? 

ছেলেটা রূপেশের হাত ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। 

মালিক, আপনি আমায় বাঁচান। এই টাকা নিয়ে আমি যাব রায়পুরে মীরা দাতারের দরবারে। সেই দরগায় এইসব কালাজাদুর চিকিৎসা হয়। একমাস থেকে ইলাজ করিয়ে তবে ফিরব। তাই টাকাটা চাইছি, হুজুর, ফিরিয়ে দেবেন না। 

জোশী মহারাজ বলেছিলেন – বিপদা অকেলে নহী আতী। আপদ-বিপদ কখনও একা আসে না। আরও বলেছিলেন যে বুরে ওয়ক্ত সাবধানে মাথা নীচু করে পার করতে হয়। গোঁয়ার্তুমি করে লাভ হয় না। যব ওয়ক্ত পর গয়ে বাঁকা, তো গধে কো বোলো কাকা! সময় খারাপ হলে, লোকে গাধাকেও কাকা বলে। 

উনি পাঠিয়েছিলেন ভগতরাম রামায়ণীকে ওর পাঠশালার জন্যে লোন চাইতে। তা ব্যাংক ম্যানেজার ওকে বেয়ারিং চিঠির মত ফেরত পাঠিয়েছে। বিকেল বেলা পেতলের গেলাসে কালো গরুর দুধ চুমুক দিয়ে খেতে খেতে উনি ভগতরামের দুঃখের কথা শুনলেন। এও শুনলেন যে উনি জামিন হবেন জেনেও ব্যাংক ম্যানেজার টস-সে-মস নহীঁ হুয়ে। এবম্বিধ ব্যবহারে কি গুরু মহারাজের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করা হয় নাই? উনি যে এই এলাকার মারোয়াড়ি সমাজের গুরু। 

দু’সপ্তাহ পরে রূপেশ বিলাসপুরের ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টরের অফিস থেকে একটি চিঠি পেল। তাতে রামায়ণীর নালিশের উল্লেখ করে বলা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের ছুরি শাখা কি সত্যিই ন্যায়প্রার্থী ভগতরামের স্কুলের জন্যে লোন দিতে অস্বীকার করেছে? করে থাকলে তার কারণ জানিয়ে সাতদিনের মধ্যে উত্তর দিক। 

রূপেশ সেই দিনেই উত্তর দিনে জানিয়ে দেয় যে ওর ব্যাংকের বর্তমান ঋণনীতি অনুযায়ী পাঠশালার জন্যে ঋণ দেবার কোন বাজেট নেই। আর ওই পাঠশালাটি ইতিমধ্যেই সরকারের ‘বালবাড়ি’ প্রজেক্টের অন্তর্গত অনুদান পেয়েছে। ফলে ওদের আর কোন ফান্ডের দরকার নেই। এবং ঋণ আবেদনে ক্যাশ চাওয়া হয়েছে, অথচ সেই টাকা কী কাজে খরচ হবে তার কোন স্পষ্ট প্রপোজাল নেই। 

এর দুদিন পরে জোশী মহারাজ ওকে ডেকে ঘরে বসিয়ে চা খাইয়ে বুরে দিন কেমন করে কাটাতে হয় তার উপদেশ দিলেন। রূপেশ ভেবে পেল না কাকে ‘কাকা’ ডাকতে হবে। তার ঠিক একদিন পরে রামায়ণী এসে হাজির। সঙ্গে এক মহিলা। ওর পাঠশালার প্রধান শিক্ষিকা। রামায়ণী পান চিবুতে চিবুতে বলল – সেই তো ফজিহত হলো। আগেই আমার কথা শুনলে এই ‘বুরে দিন’ দেখতে হত নয়া। 

--বুঝলাম না। 

--কেন? কালেক্টরের অফিস থেকে আপনার কাছে আমাকে লোন দেওয়ার আদেশ আসে নি? 

-- না তো! 

-কিঁউ ঝুট বোল রহে হো, সাব? আমি বিলাসপুরে ওদের অফিসের ডেসপ্যাচ রেজিস্টার দেখে এসেছি। ওরা তো বেশ কয়েকদিন আগেই আপনাকে চিঠি দিয়েছে। আমাকে কপিও দিয়েছে। 

--ও হ্যাঁ; চিঠি তো এসেছিল। তার জবাব ও পাঠিয়ে দিয়েছি। 

--তার কপি? কী লিখেছেন? 

-- ওখান থেকেই নিয়ে নিন। তবে আপনাকে লোন দেব বলি নি। 

বজ্রাহতের মত দাঁড়িয়ে থাকে রামায়ণী। তার পর করুণ স্বরে বলে—কেন রাগ করছেন সাহাব? কুছ লে দে কর মামলা খতম কীজিয়ে না ! দোনো কা ভলা হো জায়ে। 

- রাগ করি নি তো। আসলে আমি খুব ছোটা আদমী। মামলা এখন কালেক্টরের কোর্টে; আমার হাতের বাইরে। এবার আপনাকে ওনার অফিস থেকেই লোন নিতে হবে। 

সেদিন বিকেলে খবর এল যে মুন্নালাল দেবাঙ্গন ‘রক্তাল্পতায়’ ভুগছিল, মারা গেছে। ঠুল্লু বিকেলের চা দেওয়ার সময় বলল—সাহাব, এটা আপনার ভুল। ওকে মীরা দাতারের দরগায় চিকিচ্ছের জন্যে দশ হাজার টাকা লোন দিলে ও সেরে উঠত। ওর বৌ সত্যি সত্যি ওর রক্ত শুষে নিচ্ছিল। আসলী চুড়েল। পাক্কা ডাইনী। 

রূপেশের মন খারাপ হয়ে গেল। খালি হাতে ফিরে যাওয়ার সময় মুন্নার হলদেটে চোখের হতাশ চাউনি ওর স্বপ্নে বারবার ফিরে আসবে। 

কিন্তু খারাপ সময় এত তাড়াতাড়ি শেষ হয় না। তিনদিন পরেই কাঠঘোরা থানা থেকে কালো গাড়ি ভরে সাতজন সেপাই আর জিপে করে থানেদার হাজির। বাজারের কাছে বুড়ো সীতারাম আগরওয়ালকে আজ সকালে নিজের ঘরের আঙিনায় কুয়োর বাঁধানো পাড়ে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। ধুতি-বানিয়ান পরা নিঃসন্তান বিপত্নীক বৃদ্ধ কুয়োর মধ্যে গলা বাড়িয়ে কিছু দেখার অবস্থায় পড়ে আছেন। গলায় কালশিটে। দুপুর নাগাদ দারোগা সদলবলে হাজির হলো ব্যাংকে। এই ব্যাংকে বুড়োর কোন টাকাপয়সা জমা আছে কি না,থাকলে কত, তাতে কোন নমিনির নাম আছে কি না ! 

ঠুল্লু জনান্তিকে বলল—সাহাবের এখন সাড়ে সাতি’র দশা চলছে।

0 comments: