0

গল্প - রুমঝুম ভট্টাচার্য

Posted in

ভোরবেলা খবরটা কানে আসতেই কলাবনীর জঙ্গলের দিকে দৌড় লাগিয়েছিল রতন। আসলে খবরটা বিশ্বাস করে নি সে। বিশ্বাস করতেও চাইছিল না। কালো পিচের রাস্তা ধরে দৌড় দিল সে। আবেগের বশে দৌড়তে শুরু করলেও পাঁচ মিনিটের মধ্যে বুকে হাঁফ ধরে গেল তার। থামতে বাধ্য হল সে। দুপাশে শাল বৃক্ষের সারি, গত বর্ষার জল পেয়ে কাঁচা সবুজ রঙ ধরেছে চারপাশে।জঙ্গলের বুনো গন্ধ নাকে এসে লাগতে রতনের অনেক পুরোনো কথা মনে পড়ে গেল। রতন তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। ওদের স্কুলে একজন নতুন ভৌতবিজ্ঞানের মাস্টারমশাই এল। নাম বিজয় সরকার। দীর্ঘদেহী মানুষটাকে দেখলে এক চোটে মনে হবে ভীষণ রাগী। কিন্তু রতন পরবর্তীকালে বুঝেছিল আসলে মানুষটা নারকেলের ফল। বাইরে শক্ত, ভেতরে নরম শাঁসে ভর্তি। চিচুঁড়গেড়িয়ায় লেখাপড়া জানা মানুষের সংখ্যা নেহাতই কম। হাতে গোনা যে কয়জন আছে তারা গরীব অশিক্ষিত খাদান শ্রমিক আর খেটে খাওয়া মানুষদের মানুষ বলেই জ্ঞান করে না। কিন্তু বিজয় স্যার একদম অন্য রকম। অল্প ক'দিনে যেন তাদেরই একজন হয়ে উঠেছিল স্যার। রতনের মনে পড়ে সন্ধ্যের দিকে স্যার প্রায়ই আসত তাদের বস্তিতে। ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের সমস্যা মন দিয়ে শুনতো। স্কুল ছেড়ে দেওয়া ছেলেদের ডেকে ডেকে ফেরত নিয়ে যেত স্কুলে। এই শাল পিয়ালের জঙ্গলে ভোরের বেলা স্যারের সাথে অনেক ঘুরেছে রতন। জঙ্গলের বুনো গন্ধ বুক ভরে নিতে নিতে স্যার ওকে বলত, ' রতন মনে রাখিস এই জঙ্গল আছে তো আমরা আছি। শালবনীর মানুষের অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে এই শাল পিয়ালের পাতায় পাতায়। খাদান মালিকরা নিজেদের স্বার্থে অবলীয়ায় গাছ কেটে চলেছে। এর বিরুদ্ধে চিচুঁড়গেড়িয়ার মানুষকে রুখে দাঁড়াতেই হবে। পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একজোট হতেই হবে।' রতন স্যারের সব কথা বুঝত না। শুধু এটুকু বুঝত তাদের জীবনের লড়াইয়ে পাশে থাকার মতো চিচুঁড়গেড়িয়াতে একজনই আছে, সে হল বিজয় স্যার। রতনের হাতে শুকনো পিয়ালের পাতা তুলে দিয়ে স্যার বলত তুই হবি আমার আগামী ভারতবর্ষ। 

এই অরণ্যভূমির তুই হলি আসল উত্তরাধিকারী। 

এত তাজা বাতাসেও রতনের দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড় হয়। কত বয়স ওর, বড় জোর পঁচিশ। বুকের ভেতর হ্যাঁচর প্যাঁচরের শব্দ নিজের কানেই বিশ্রী ঠেকে। ভয় দানা বাঁধে মনে। বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবাও ছিল পাথর খাদানের শ্রমিক। যা আয় হত তাতে ওদের ছয় জনের সংসার টানাই দায়। কষ্টে সিষ্টে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া টানতে পেরেছিল। বিজয় স্যার বাবাকে বলেছিল,'গোপাল ছেলেকে লেখাপড়াটা ছাড়িও না। তা না হলে ওকেও ওই বিষ বুকে বয়ে বেড়াতে হবে।' রতন অবশ্য সে সময়ে এ কথার মানে ভাল ভাবে বোঝে নি। শুধু দেখেছে কাজ থেকে ফিরে বাবা দাওয়ায় যখন বসত তখন যেন মরণ কাশি এসে চেপে বসত বাবার বুকে। কাশির দমকে দুটো চোখ 

ঠিকরে বেরিয়ে আসত। তাই দেখে রতন রীতিমতো ভয় পেয়ে যেত। মায়ের কোল ঘেঁসে দাঁড়াতো। মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে ভরসা খুঁজতে চেষ্টা করত। কিন্তু সেখানে শুধুই অনিশ্চয়তার ছায়া টলটলে জল হয়ে ঝরে পড়তে দেখতো। সেই জল যেন রতনকে একধাপে অনেকটা বড় করে দিয়েছিল। মাস ছয়েকও গেল না। মানুষটার আর খেটে খাওয়ার সামর্থ্য রইল না। মাছ যেমন জল থেকে ডাঙায় তুললে খাবি খায় গোপালও তেমনি দাওয়ায় পড়ে পড়ে খাবি খেতো। রথীকান্তের কামারশালের হাপড়ের মতো ওঠানামা করত ক্ষয়ে যাওয়া বুক। সে কষ্ট চোখে দেখা যায় না। ব্লকের সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার বলল টি বি। এদিকে ঘরে তখন উনুনে আঁচ পড়া বন্ধ হয়েছে। দিশেহারা রতন ছুটে গেছিল বিজয় স্যারের কাছে। কি করে বাবাকে বাঁচানো যায় সে বিষয়ে শলা পরামর্শ করতে। বিজয় স্যার সব শুনেছিল উত্তর করে নি কোন। তাদের গ্রামে গত দুবছরে এই নিয়ে বাইশ জন। হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে স্যার বলেছিল পরশু ব্লক অফিসের সামনে জমায়েত আছে, মাকে নিয়ে আসিস। কথা হবে। রতনের মনে আছে সে দিনটার কথা।তাদের মতোই আরও দশ বারো জন বিজয় স্যারের কথায় ব্লক অফিসারের কাছে দরখাস্ত করেছিল ক্ষতিপূরণের জন্য। ব্লক অফিসার ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল। সরকারি কাগজে তো সাফ লেখাই আছে টি বি। আবার কিসের ক্ষতিপূরণ? সরকার বিনা পয়সায় টি বি র চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে তো। সে সময় বিজয় স্যারের সে এক মূর্তি দেখেছিল রতন। গর্জে উঠেছিল স্যার -

মিথ্যা কথা, টি বি নয় ওরা সিলিকোসিসে ভুগছে। খাদানে কাজ করতে গিয়ে পাথরের গুঁড়োর সঙ্গে মিশে থাকা সিলিকা ওদের ফুসফুসে জমাট বাঁধছে। এ রোগের কি কোন প্রতিকার আছে? টিবি বলে একে ঊড়িয়ে দিলে চলবে? এই কাজে শ্রমিকদের জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এই অপূরণীয় ক্ষতির দায় কোম্পানী এড়িয়ে যেতে পারে না। সরকারও কি পারে এই দায় এড়াতে। কোম্পানির উচিত ওদের জন্য ক্ষতিপুরণের ব্যবস্থা করা। অকস্মাৎ রতনকে হ্যাঁচকা টানে সামনে টেনে এনে বলেছিল, ' এই ছেলের চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারবেন যে ওর বাবার সিলিকোসিস নয় টিবি হয়েছে। এই পরিবারগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন, এদের খিদের দিব্যি দিয়ে বলুন এরা সিলিকোসিসে নয় টি বি তে ভুগছে।' বিডিও স্যার রাগে গর গর করতে করতে বলেছিল বিজয় স্যারের এই বিপ্লব করার ইচ্ছা নাকি চিরতরে ঘুচে যাবে। স্যার তোয়াক্কা করে নি। কলকাতার ডাক্তার বন্ধুকে ডেকে খাদানে কাজ করে বা এক কালে কাজ করত এখন যারা অসুস্থ তাদের সব্বার বুকের ছবি করিয়েছিল। চাপ চাপ সিলিকার গুঁড়ো জমে বেশিরভাগেরই ফুসফুস প্রায় অকেজো। ধোঁয়াটে ফুসফুসে মৃত্যু দানা বেঁধেছে। রতন, ডাক্তারবাবুর মাথা নাড়া দেখে বুঝেছিল এ রোগের কোনও প্রতিকার নেই। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া ওদের আর কিছুই করার নেই। বাবাকে চোখের সামনে ওভাবে দগ্ধে দগ্ধে মরতে দেখে রতনের মেরুদন্ড বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে আসে। মায়ের চোখের দিকে তাকাতে ভয় পেত সে। মৃত্যু ভয় জেঁকে বসতো তার মনে। পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে থাকল সে। কিন্তু কতদিন? তার সামনে দুটো পথই খোলা এক অনাহারে মৃত্যু নয়তো সিলিকোসিসে। সমাজের জরায়ু প্রসূত এ সমস্যা খাদান শ্রমিকদের ঘরে ঘরে। আত্মক্ষয়ের যন্ত্রণার থেকে অবশেষে নিজেকে মুক্তি দিল রতন। ঘরের ছোট ছোট ভাই বোনের আর বিধবা মায়ের মুখ চেয়ে তিল তিল মরাকেই বেছে নিল। নাম লেখালো খাদানের কাজে। সেদিনও ও এমন করেই বিজয় স্যারের কাছে ছুটে গেছিল। 

রতন যখন কলাবনীর জঙ্গলে পৌঁছালো তখন ভোরের আলো অনেক উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। পাখিদের কিচিরমিচির আর কিছু লোকের জটলা মিলে অরন্যের নৈ:শব্দ চিরে ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে। শুকনো পাতায় মড় মড় আওয়াজ তুলে সে এগিয়ে গেল জটলার দিকে। রতন দেখল বিজয় স্যারের ঋজু দীর্ঘ নিথর দেহটা ঝুলছে গাছের ডাল থেকে। টুপ টাপ খসে পড়ছে শাল পিয়ালের শুকনো পাতা। যেন অরণ্যের পাঠানো চিঠি। বন, জঙ্গল, প্রান্তিক মানুষের দুর্দশার খবর ভরা চিঠিগুলো বিলি করে যেন দুদন্ড বিশ্রাম নিচ্ছে অরণ্যের পোষ্টম্যান। এ কি আত্মহত্যা না হত্যা, এ রহস্য শুধু শাল পিয়ালের অরণ্য জানে। রতন নীচু হয়ে তুলে নেয় একটা শুকনো পিয়ালের পাতা। বুক ভরে ঘ্রাণ নেয় ঝরা পাতার, পড়ে দেখতে চায় সেই চিঠির ভাষা। যেন আগামী ভারতবর্ষ কড়ায় গন্ডায় তার হিসাব বুঝে নিচ্ছে। 

0 comments: