6

বইঘর - সুকন্যা দাস ও শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া

Posted in


বইঘর


'বাবু বলেন' - শঙ্খ ঘোষ
সুকন্যা দাস ও শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া


কবিতার নামটি একটি সরল বাক্য। একটি কর্তা আর তার একটি ক্রিয়া। কাজটা বলার। বলেন কর্তা - বাবু। কোনও সমস্যা নেই। আর তারপর যখন ক্রিয়াটি আর তার কর্তাটিকে নিয়ে একটু জরিপে নামা হয়, তখন প্রশ্ন জাগে, বাবু কে? তিনি কী বলেন? তার উত্তর কবিতায় খুব স্পষ্ট এমন নয়। কিন্তু একটি অভিযোগের সুর স্পষ্ট, একটি ব্যঙ্গ, একটু বিদ্রুপ। ব্যঙ্গ বিদ্রুপ বাবুটির বাবুয়ানির দিকে, নাকি তাঁর অবস্থানের দিকে? ব্যঙ্গের লক্ষ্য কর্তাটি নাকি তাঁর ক্রিয়াটি? 

কর্তাটিকে নিয়ে ভাবনা চিন্তা করার আগে তাঁর ক্রিয়াটির নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। ক্রিয়াতেই কর্তার পরিচয়। প্রশ্ন, ক্রিয়াটি সকর্মক, অর্থাৎ বাবু ‘কী’ বলেন সেটা কর্তার পরিচয়, না কি অকর্কম অর্থাৎ কর্তা যে বলেন সেটাই কর্তার পরিচয়। 

যদি দেখা যায় কর্তার বলাতেই আপত্তি, তবে কেন? প্রথম দু লাইনে কর্তার ক্রিয়ার বহর কিছু বিস্তৃত-

“আমি কেবল কথাই বলি
পুঁথিই পড়ি বসে...” 

এই দুই পংক্তিতে দুটি আলাদা আলাদা বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে— ১। কথা বলা। ২। পুঁথি পড়া। দুটি বাক্যেই কোনও যতি চিহ্ন নেই। সে কি কর্তার কর্ম দুটির নিত্যতা বোঝাতে? কর্তার কথা বলা ছেদ হয় না, পুঁথি পড়া ছেদ হয় না। কিন্তু কর্তা বলেনটা কী? যা বললেন, সেটাই কি তাঁর বক্তব্য। অর্থাৎ তিনি কেবল পুঁথি পড়েন বসে। তবে তিনি কথা বলেন কখন? কথা বলতে বলতে কি পুঁথি পড়া যায়? না কি তাঁর পুঁথি পড়ার ব্যাপারটাকেই ‘বলা’ বলা হচ্ছে? না কি তিনি কাউকে কিছু পড়ে শোনান? তাই যদি হয়, সেটার কারণ কী? তিনি কি পড়ে শোনাবার চাকরি করেন? চাকরি যদি করতে হয় তবে আর তাঁর স্বাধীনতা কোথায় রইল? তিনি তো যে কোনও কারণেই হোক চাকর মাত্র। তবে তিনি বাবু হবেন কী করে? 

একথার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয়, বাবুত্বের প্রচলিত ধারণার সঙ্গে যেন বিরোধ আছে, এই বক্তব্যে। বাবু বললে আমরা কী বুঝি? সমাজে যুগে যুগে বাবুত্বের ধারণা বদলে গেছে। ইংরাজ রাজত্বের পূর্বে ‘বাবু’ কোনও বিশেষ অর্থ বহন করে না। ইংরাজ যুগে ‘বাবু’ কী, তার হাজার ব্যাখ্যা আছে। ব্রিটিশ সরকারের উপাধি যেমন ‘বাবু’, তেমনি ধনী, বিলাসী, অকর্মন্যরাও বাবু। আবার সঠিক অর্থেই সমাজের গণ্যমান্যরাও তো ‘বাবু’; সে তিনি অর্থ কৌলিন্যেই হোক, বা জাত কৌলিন্যে বা বিদ্যা-বুদ্ধির কৌলিন্যে। তারপর বহুদিন কেটে গেছে, কবি যে সময়ে কবিতা লিখছেন, তখন আর উনবিংশ শতকের বাবু নেই। কিন্তু নতুন বাবু শ্রেণীর উদ্ভব হয়েছে। কোন বাবু কবির উদ্দিষ্ট? 

“জীবনযাপন? করুক সেটা 
চাকরবাকরেরা।”

পরবর্তী দুই পংক্তিতে দুটো স্পষ্ট বিষয় পাওয়া গেল। চাকরবাকর এবং জীবনযাপন। এবার যা বোঝার থাকে, চাকরবাকর কারা? যারা পরের কাছে নিজেদের শ্রম মেধা বিক্রি করে। নাকি শুধু শ্রম বা মেধা? এর আগেই সন্দেহ দেখা দিয়েছিল, তথাকথিত বাবু আদৌ নিজের ইচ্ছেয় কথা বলেন কি না। এ দু পংক্তিতে মনে হয়, বাবু পরের ইচ্ছেয় চলেন না। তাহলে চাকরবাকরের সঙ্গে তাঁর ব্যবধান থাকে না, যা এই দু পংক্তিতে ইঙ্গিত করা হয়েছে। চাকরবাকর আর বাবুর সঙ্গে ব্যবধানের ক্ষেত্রটা যদি হয় স্ব-অধীনতা আর পর-অধিনতা, তবে চাকরবাকর ‘জীবনযাপন’ করছে কী ভাবে? বাবু কি তাঁকে সেই অনুমতি দিচ্ছেন? তবে চাকরবাকরদের নিয়ে সমস্যাটা কী? তারা কি বাবুর ইচ্ছেয় জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে? সেটা কী সম্ভব? জীবনটাকে যাপন করার মধ্যেই তো একটা স্বেচ্ছাবৃত ব্যাপার আছে, মনে হয়। ‘স্ব-ইচ্ছা’ আর ‘পর-ইচ্ছা’ কোনওটাই কি সার্বভৌম হতে পারে? প্রাচ্য পাশ্চাত্য দুই ঘরানাতেই তো এই নিয়ে চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণ আছে। আর সার্বভৌম ইচ্ছা বলে যে কিছু হয় না, সে তো বার্নার্ড শ-র ‘ফ্রিডম’ না পড়লেও বোঝা যায়। 

“মরছে যারা মরুক তারা
নিজের নিজের দোষে...”

মৃত্যুর মধ্যে ‘দোষ’ গুণ কিছু কি আছে? দুর্ঘটনা হোক বা স্বাভাবিক মৃত্যু— কোনওটাই তো কারও ইচ্ছাধীনই নয়। এই মৃত্যু কি তবে রূপকার্থে— জীবন্মৃততা? এক মানুষ আর এক মানুষের জীবনের পরিসর নিশ্চয়ই সীমিত করতে পারে। সেই উৎপীড়ক শ্রেণীকেই কি তবে ‘বাবু’ বলা হচ্ছে? সেই ‘বাবু’ই কি তবে পূর্ববর্তী সমালোচনার লক্ষ্য? তিনি কেবল ‘কথাই’ বলেন; ‘পুঁথিই’ পড়েন বসে। বসে বসে কথা বলে আর পুঁথি পড়ে কি অন্যের জীবনকে সীমিত করা যায়? যদি যায়ও সেটা কি ‘জীবনযাপন’ নয়? ‘জীবনযাপন’ সেটা যেটা চাকরবাকরেরা করছে। তাদের করার মধ্যে দেখা গেছে, তারা ‘নিজের দোষে’ মরছে। মনে হয় এটা তাঁদের বয়ান নয়। বয়ানটা বাবুর। অর্থাৎ তারা নিজের দোষে মরছে কি না, বা আদৌ মরছে কি না, সেটা বাবুই ঠিক করছেন। বাবুর সিদ্ধান্তটা মেনে নিচ্ছে কারা? চাকরবাকরেরা? যদিই মেনেই নিচ্ছে, তবে আর সমালোচনাটা কিসের? আর যদি না মেনে নেয়, তবে সেটা নিয়ে কথা বলা কেন?

“আমি জানি, মাথার জোরে 
আমিই সবার সেরা।”

এই বয়ানটা বাবুর। মানুষ তো নিজের নাম ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ বলে মেনে নিয়েছে; অর্থাৎ বুদ্ধিমান মানুষ। মানুষের সঙ্গে সারা জীব জগতের ব্যবধানের জায়গাটাই তো তার ‘মাথার জোর’। আর সেখানে কেউ ‘সেরা’ হলে তার কথার মূল্য মেনে নিতেই হয়। কিন্তু কোনও সেরা মাথার মানুষ কি অথাকথিত খাটো মাথার মানুষের বাঁচার পরিসর সীমাবদ্ধ করতে চাইবে? বলবে, “মরছে যারা মরুক তারা / নিজের নিজের দোষে”? তবে সেই সেরা মাথার মানুষটি বাঁচবে কাকে নিয়ে? একা একা? না কি একদল চাকরবাকর নিয়ে? সেটা কি কোনও সেরা মাথার কারও পক্ষে করা সম্ভব? তবে তো বোঝা যাচ্ছে, বক্তা অর্থাৎ ‘বাবু’ কোনও সেরা মাথা-সুলভ কথা বলছেন না। তবে তাঁর কথা গুরুত্ব দিচ্ছে কে? চাকরবাকরেরা? যাঁরা দিচ্ছে, তাঁরা তবে একটি নির্বোধকে ‘বাবু’ বানিয়েছে। তবে তো তাঁরা নির্বোধতর প্রমাণ হয়। নির্বোধকে বাঁচাবে কে? যদি বাঁচায় তবে কোনও সেরা মাথার লোকই তো বাঁচাবে। 

“মানুষ ছুঁতে চাই না বটে,
মানবতার জ্ঞানে...”

এটাও তথাকথিত বাবু বলেন। যে মানুষকে মানবতার জ্ঞানে না ছুঁতে পারে, সে তো না ছুঁলেই মঙ্গল। সে তো নিজেই মানুষ হতে পারেনি। ‘বাবু’ হয়তো হয়েছে। কেউ বানিয়েছে; যারা ওই বাবুর থেকেও অব-মানব। গোটা নির্মাণ প্রক্রিয়াটাই তো ভুল। সে নির্মান তো কার্যকরী হতে পারবে না। 

“হৃদয়মেধা থাকে আমার 
সব সময়ে ঘেরা”

এটাও বাবুর বচন। হৃদয় হোক বা মেধা— সবসময় ঘেরা থাকলে তার বিকাশ লাভ সম্ভব নয়। এটা বাবুর স্বনির্মিত। সমাজের স্বীকৃতি না পেলে, কার কি হৃদয় বা মেধা আছে না আছে, তাতে কারও কিছু যায় আসে কি?

“পালটে দিতে পারি ভুবন
আখ্যানে-ব্যাখ্যানে—”

ভুবনের স্বরূপ চেনা কি সম্ভব? স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভুবনের স্বরূপ সীমিতভাবে প্রতিদিন নতুন নতুন ভাবে ব্যাখ্যাত হচ্ছে। বিভিন্ন পণ্ডিত, দার্শনিক, বৈজ্ঞানিক তা পালটে দিচ্ছেন। কোনওটাই শেষ কথা নয়। শেষ কথা কে বলবে? তাঁরা এই আস্ফালন করেন না। ইনি কোনও অন্তঃসারশূন্য বাক্যবাগীশ মাত্র। এঁর কথা তো সাময়িকভাবেও স্বীকৃতি পেতে পারবে না। যিনি ভুবন পালটে দেওয়ার কথা বলেন, তাঁর সে নিয়ে ভাবনাচিন্তাতেই সময় চলে যায়, ‘বলা’র সময় থাকে না। 

অনুচ্ছেদের শেষে কবি আবার ‘জীবনযাপন’ নিয়ে বাবুর অপব্যাখ্যা ফিরিয়ে আনছেন, যা তাঁর অন্তঃসারশূন্যতাই প্রমাণ করে। 

“সবাই যদি বলেও আমায়
মিথ্যে এবং মেকি
নিজের কথার জ্বালায় যদি
জ্বলে নিজের ডেরা
পুড়তে পুড়তে তখনো তার 
জানালা দিয়ে দেখি
জীবনযাপন করছে যত
চাকরবাকরেরা। 

গোটা স্ট্যানজাটাই একটা জটিল বাক্য, শেষ হচ্ছে, বাবুর অন্তিম পরিণতি দেখিয়ে। তিনি নিজের অন্তঃসারশূন্যতার ফাঁদে বন্দি; জ্বলে যাচ্ছে তাঁর সাধের কিন্তু মিথ্যা ‘আখ্যান-ব্যাখ্যান’-এর ‘ডেরা’। বাবু নামে চিহ্নিত বক্তার এটাই পরিণতি হওয়ার ছিল। 

গোটা কবিতাটিতে কবি বিশ্বকে সহজ সরল দুটি বিশ্বে ভাগ করে ফেলেছেন— বাবু এবং চাকরবাকর। মোটামুটি পরিচিত মার্কসীয় দৃষ্টিভঙ্গি। বুর্জোয়া বাবু আর প্রোলেতারিয়া চাকরবাকর। কবি ভাবলেও পারতেন, বিশ্ব এমন সাদা কালোয় বিভাজিত নয়। বাবু আর চাকরবাকরের রোল-আদানপ্রদান নিত্য চলতে থাকে। আর ‘বাবু’ শ্রেণী তৈরি করে এইসব ‘চাকরবাকর’এরাই। আখ্যান-ব্যাখ্যানে যারা সত্যিই ভুবন পালটে দিতে পারেন, তাঁরা এমনভাবে চাকরবাকরদের অছ্যুত করে রাখেন না; যাঁরা রাখেন তাঁদের আখ্যান ব্যাখ্যানে ভুবনের কিছুই পালটায় না। তাদের নিয়ে চাকরবাকরদের মাথা ঘামানোরও কিছু নেই। জীবনটাকে যাপন করার জন্য ‘জ্ঞান’ চাই। জ্ঞানই মানুষকে মানুষ করে। মানুষ নিয়েই ভুবন রচিত। মানুষ আর ভুবন প্রায় সমার্থক।



6 comments: