undefined
undefined
undefined
অণুগল্প - সঞ্চয়িতা বিশ্বাস
Posted in অণুগল্প
অণুগল্প
সত্য
সঞ্চয়িতা বিশ্বাস
পশ্চিম আকাশে এখন রঙের খেলা… লালচে-কমলা আকাশে দিনশেষের ক্লান্তি মিশেছে। সব পাখিরা ঘরে ফিরছে। শুধু শান্তনব দেবব্রতের কোথাও ফেরবার নেই। পরিখা-মধ্যে শরশয্যায় শায়িত তিনি। ক্ষণকাল পূর্বে সমস্ত কুরু-পাণ্ডব জ্ঞাতি ফিরে গেছেন তাকে শ্রদ্ধাজ্ঞাপণ করে। এখন তিনি একা। দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।
-"কুরুশ্রেষ্ঠ…"
পরিচিত বলিষ্ঠ পুরুষকন্ঠের আকুতিভরা ডাকে তাকান ভীষ্ম। এই কন্ঠে নম্রতা থাকতে পারে, এ কথা তিনি জানতেন না। বিষ্ময় গোপন করে তিনি তাঁর পদতলে আসীন দেবকান্তি পুরুষকে আহ্বান করেন, "এসো রাধেয় কর্ণ।"
ঈষৎ নতমুখে সূতপুত্র এগিয়ে আসেন ভীষ্মের নিকটে। ভীষ্ম তাকান কর্ণের বিব্রত মুখের দিকে, "তোমার মতো পরাক্রমী যোদ্ধার দৃষ্টিতে আজ কিসের ছায়া?"
কর্ণ মৃদুস্বরে বলেন, "কুরুশ্রেষ্ঠ, আমি সামান্য সূতপুত্র। দুর্যোধনের বন্ধুতায় আজ সিংহাসনলাভ করেছি। আমি জানি না এতে আমার অপরাধ কি! তবে আমি আপনার বিরাগভাজন, এ কথা আমি জানি। আমি করজোড়ে আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করছি। "ভীষ্ম স্নেহভরে স্পর্শ করেন কর্ণকে, "তুমি এসেছো, আমার ভালো লাগছে, কৌন্তেয়।"
কর্ণ চমকে ওঠেন। বৃদ্ধের প্রাচীন ক্লান্ত চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। কর্ণ ফিসফিস করেন, "আপনি…" মুখের কথা কেড়ে নেন ভীষ্ম, "আমি দেবর্ষি নারদের কাছে শুনেছি তোমার জন্মকথা। আমি জানি তুমি সূতপুত্র নও। তোমার পিতা সূর্য।"
কর্ণ তিক্তকন্ঠে বলেন, "তাহলে আপনি নিশ্চয়ই জানেন, গাঙ্গীন, আমি জন্মমাত্র পরিত্যক্ত। আমি আমার মায়ের কাছে অযাচিত লজ্জাবিশেষ।"
ভীষ্ম মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বলেন, "তিনি তোমার জন্মদাত্রী। তাঁর প্রতি এ বিদ্বেষ তোমার অশোভন।" কর্ণ থমকে যান। ভীষ্মের হাতখানি নিজের দুই হাতের মধ্যে নিয়ে কাতরকন্ঠে বলেন, "বীরশ্রেষ্ঠ, আপনি কি আমায় ক্ষমা করেছেন?"
ভীষ্মের স্বরে কোমলভাব ফিরে আসে। তিনি এক হাতে আলিঙ্গন করেন কৌন্তেয়কে, "আমি তোমার স্পর্ধায় ক্রুদ্ধ হইনি কখনও। কিন্তু দুর্যোধনের সান্নিধ্যে তুমি পরশ্রীকাতর হয়েছ। বারংবার খর্ব করতে চেয়েছো পাণ্ডবদের। আমি তোমার তেজোহানি করবার নিমিত্ত তোমায় মুহুর্মুহুঃ কটুবাক্য বলেছি। রাজন, তুমি অস্ত্রচালনায় অতুলনীয়। তোমার দান ও জ্ঞানের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। তুমি কেন দুর্যোধনের পাপের ভাগী হচ্ছো? তুমি অস্ত্রত্যাগ করো। ফিরে যাও সত্যের পথে।"
কর্ণ দীর্ঘ সময় নতশিরে বসে থাকেন ভীষ্ম-সান্নিধ্যে। ছায়া নামছে। দূরে, অনেক দূরে বিলাপধ্বনি শোনা যাচ্ছে মৃত সৈনিকের স্ত্রীর। কর্ণ উঠে দাঁড়ান একসময়, "পুরুষোত্তম, আমি যোগ্যতা সত্ত্বেও সারা জীবন অপমানিত হয়েছি। একমাত্র দুর্যোধন আমার প্রতিভাকে মর্যাদা দিয়েছেন। আমি তার কল্যাণার্থে উৎসর্গ করেছি আমার সমস্ত কিছুকে। এটাই আমার সত্য। এর বিরোধিতা করতে আমি অপারগ। আপনি ক্ষমা করুন আমায়।"
নমস্কারান্তে ফিরে যাচ্ছেন এক বঞ্চিত নায়ক, যিনি শীঘ্রই সত্যরক্ষার্থে ত্যাগ করবেন তাঁর কবচ-কুণ্ডল। ভীষ্মের দৃষ্টি তার গমনপথের দিকে। ছায়া গাঢ় হতে হতে অষ্পষ্ট করে দেয় দৃষ্টিসীমানা। তারপর সব অন্ধকার।
0 comments: