ছোটগল্প - শুক্লা মালাকার
Posted in ছোটগল্প
ছোটগল্প
বাসন্তীর বেঁচে থাকা
শুক্লা মালাকার
খুটখুট শব্দে বাসন্তীর আলগা ঘুম ভেঙে গেল। এই এক হয়েছে।কদিন ধরেই এক মিনসে রোজ এসময় এসে জ্বালাচ্ছে। দুপুরে কাজের বাড়ি থেকে ফেরার সময়তেও আজ পিছুপিছু আসছিল।বাসন্তীর বুক ঢিপঢিপ করে।
সোয়ামীটা ফেলে পালিয়েছে বছর দুই। বিয়ে হয়ে ইস্তক শান্তি পায়নি মেয়েটা। আজ এখানে কাল সেখেনে নিয়ে নিয়ে ঘুরেছে। দু মাসও কোথাও একটানা থাকতে পারেনি। পোঁটলা পুটলি নিয়ে এজায়গা সেজায়গা করতে কাঁহাতক পারা যায়! বাসন্তী অজ পাড়াগাঁর মেয়ে। একদিন মাত্তর গঞ্জতে নিয়ে গেছিল বাপ। তার বাইরে আর কোনও জগৎ ছিল না। ষোল বছরে বিয়ে হয়ে সোয়ামী নিয়ে এল এদিকে। শহরের নাম শুনেই ভয় পেয়েছিল। রাস্তাঘাট গুলিয়ে ফেলে। সারাদিন ঘরের মধ্যে চুপটি করে বসে থাকত।
ছ-সাত মাস পর একরাতে সোয়ামী ফিরল না। সারারাত বসে যত রকমের ঠাকুর দেবতা আছে তাদের ডেকে ডেকে কাটাল। সকালে সে মিনসে ফিরলে বুকের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে কেঁদে কেটে অনুযোগ করে একসা। তার নাকি অনেক কাজ, তাই ফিরতে পারেনি। এরপর থেকে এমনই হতে লাগল। দশ বার দিন বাদে বাদেই কাজের জন্য বাইরে থাকা শুরু হলো। কি আর করে বাসন্তী, ভয়ে ভয়ে শহর চিনতে হলো তাকে।
বছর দেড়েকের মাথায় একসঙ্গে তিনদিন এল না সে। বাসন্তী ততদিনে শহরের বাতাসে অনেকটা খাপ খাইয়ে নিয়েছে নিজেকে। সে সময় থেকেই বুঝেছিল মিনসের চরিত্র ভালো নয়। নতুন মেয়েছেলে জুটিয়েছে সেটা জেনেছে আরও তিনমাস পরে। ও তখন পাঁচ মাসের পোয়াতি। রাগারাগি কান্নাকাটি করেও ফল হলো না। চারপাশের আলো নিভে গেল বাসন্তীর। কি করবে সে? গুণকীর্তির কথা জানাজানি হবার ভয়ে গাঁয়েও রেখে আসবে না তাকে। তবে কি ভেসে যেতে হবে তাকে?
একদিন এক মাঝবয়সি গিন্নি মতন নিয়ে এল বর। বলল দুঃসম্পক্কের আত্মীয়। সেটা ছিল বুধবার। মাঝে বেস্পতি শুক্কুর শনি, রবিবার সে মিনসে যে গেল আর এল না। সেই থেকে বাসন্তী আর মাসি। হ্যাঁ! প্রাণের দায়ে বাসন্তী ওই গিন্নি মতন মেয়েছেলেকে মাসি পাতাল আর তাকেই খড়কুটোর মতন আঁকড়ে ধরল।
মাসির কাছে কিছু খরচা দিয়ে গেছিল বর, তাই দিয়ে মাস দুই চালাল। আর চলে না। এই দুমাস বাসন্তী কেঁদে কেঁদেই কাটিয়েছে। এতকাল যত খারাপ কাজই করে থাকুক এই বয়সের একটা পোয়াতি মেয়েকে একা ফেলে যেতে মাসির মন সরল না। তাও যদি মেয়েটা চালাক চতুর হতো। ‘মাসি’ বলে যখন ডাকে মনটা টাটায়। হদ্দবোকা এক মেয়ে, গাঁয়ের নামটা অব্দি বলতে পারেনি। নাহলে বাপের বাড়ি রেখে আসত। ওর দ্বারা কিছু হবার নয়। পেটের দায়ে মাসি নিজেই বাবুদের বাড়ি কাজ নিল। মাসি বাইরে কাজ করতে যায়, আর বাসন্তী ঘর সামলায়।
ছেলেটা হবার সময়তেও মাসি অনেক করেছে। এই দুবছরে বাসন্তী অনেক চালাকচতুর হয়েছে। বলা ভালো মাসি ওকে তৈরি করছে। ছেলে বড় হচ্ছে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে খরচ। নাতি অন্ত প্রাণ মাসি। তবুও কত আর করবে! বাসন্তীও কাজ নিল। ছেলেকে রেখে দুজনে পালা করে কাজে যায়। দুচারটে সইও জুটেছে। একসঙ্গে বাবুদের বাড়ি কাজে যায় ফেরে। বাসন্তীর কাছে নতুন এক দরজা খুলে গেল। কত কী থাকে শহরের আকাশে বাতাসে।
বাজার করতে গিয়ে আলাপ সতীর সঙ্গে। চা দোকান চালায়। সেখান থেকেই কদিন হলো এই মিনসে পিছু পড়েছে। রাতদিন বাসন্তীর চারপাশে চক্কর কাটছে। সতী খোঁজ নিয়েছে। ইস্টিশানের দিকে রিক্সা চালায়। ভালোই রোজগার। বাসন্তী সুন্দরী। সতী বলে ও নাকি খুকি খেঁজুরগাছ। বিকেলে হাঁড়ি বাঁধলে মাঝরাতেই টইটুম্বুর। আগে এমনটা হতো না। আজকাল ও মিনসের চোখের দিকে তাকালে শরীর বেয়ে সাপ নামে যেন। রাত বিরোতে কেমন আনচান আনচান করে। বাইরে বেরিয়ে গায়ে দু মগ জল ঢালবে তার জো নেই। মাসি অমনি হাঁক পাড়বে।
আবার দরজায় আওয়াজ। এবার বেশ জোরে। বাসন্তী মাসিকে ধাক্কা দিল-
- মাসি! ও মাসি! দেক দিকিনি দরোজায় কিসের আবাজ হচ্চে।
- এই কে র্যা? এত আত্তিরি জ্বালাতি এয়েছিস?
আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল।
পরদিন সতীর কাছে সব জানাল।
- নিজের দিকে তাইকে দেকেছিস কখনও? যেন ভেঙে যাওয়া আধখানা চাঁদ। পুরুষ মানুষদেরে কদ্দিন আর আটকি রাখতি পারবি বল তো? ওট্টুসকানি ছেলেরে নিয়ে থাকিস। মাসি তো ওই বুড়ি মাগী। সামলাতি না পারলি তইলে যেতি কতক্কন? ভালো দেকে একখান খুঁটি তো চাই নাকি! সব দিক দেকে এ মিনসেরে ঠিক মনে হতিছে। তুই তো আবার ভালো মানষির ঝি। আমার কথা মন দে শোন্ -
কদিন পরে রাতে বাসন্তীর দরজায় আবার টোকা পড়ল। এর মাঝে লক্ষ্য করে দেখেছে লোকটা তার সব কাজের বাড়িই চেনে। আসতে যেতে বহুবার চোখাচোখি হয়েছে। কিছু বলতে গিয়েও বলেনি। এখন এসেছে। সতীর পরামর্শ মনে পড়ল বাসন্তীর। মাসিকে না জাগিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে এল। সরাসরি বলল –
- এত রাতের বেলায় কি কইতে এয়েছ? আমার সোয়ামী থাকে না। ডের বচ্ছরের ছেলে আচে। লোকে গালমন্দ করবে নে?
- তোর সঙ্গে এট্টু কতা বলতে সাধ হয়। তাই-
- তা দিনের বেলায় তো কইতে পারো
- ভয় লাগে যদি রাগ করিস
গলা শুকিয়ে কাঠ বাসন্তীর। পরপুরুষের সঙ্গে একা দাঁড়িয়ে কথা বলছে। তাও আবার এখন রাত। কিন্তু কি করবে? পুড়ে যাওয়া জীবন তার। ভোরের আলো দুপুরের রোদ্দুর আর বিকেলের মমতা তার জন্য নয়। তার জন্য বরাদ্দ এই রাতের আঁধার। এটাই তার ভয়। আর এই ভয় সামলাতে পেরিয়ে যাচ্ছে সময়। সতীর বলা কথাগুলো ভালো করে ভেবে নিল। তারপর গলায় জোর আনল-
- আমারে বে করবে? যদি বে কর তবে কথা বলব। না হলি পথ দেক। ঢোঁক গিলল।
- হ্যাঁ বে করব তো? পিছে পিছে ঘুরি কি আর সাদে? বে করব, সংসার করব। এই দেক জিলপি নিয়ে এয়েচি। তুই জিলপি খেতে ভালোবাসিস আমি জানি।
- তুমি জানলি কি করি?
- কতদিন দেকেছি যে! জিলপি খাচ্চিস আর তোর চোক-মুক কেমন খুশিপারা হয়ে উটেচে।
মনে মনে হেসে ফ্যালে বাসন্তী। এত মনযোগ দিয়ে দেখেছে? তবু ভয় যায় না। গম্ভীর ভাবে বলে-
- জ্বালিও না বাপু। আগে বল বে করবে? তিন সত্তি কর! তবে খাব।
- সত্তি! সত্তি! সত্তি! হলো তো? তুই যা বলবি সব করতি পারি। চাইলে মরতিও পারি, আবার মারতিও পারি।
- হয়েচে! আর ঢলানিপনা করতি হবে না।
- তবে চ! কোথাও বসে এট্টু গপ্প করি।
- এত রাতে? না বাপু সে পারবু নি। কই তোমার জিলপি দাও দিকি, দুটো খাই।
- নে! সব নে! তোর জন্নিই তো এনেচি।
- আমার ছেলে আচে জান তো? আর মাসি। সব কিন্তুক আমাদের সাতে থাকবে। মনে থাকে যেন।
- হ্যাঁ রে! তুই আর তোর ছেলে কি আলাদা!
রোজ দেখা হতে লাগল। আলুর চপ, বেগুনী, ঘুগনি, আরও কত রকমের খাবার আনে। ছেলেকে দেয়, মাসিকে দেয়। মাসি বোঝে জল পাক খাচ্ছে। উথাল পাতাল স্রোত। ডাঙা পাবে কি মেয়েটা? দেখা হওয়াটা দিন থেকে রাতের দিকে গড়াল। বাসন্তী রোজ জানতে চায় কবে বিয়ে করবে। আজ বলে মাকে বলি আগে, কাল বলে মা বলেনি কিছু, একদিন বলে মা ছেলে আছে শুনে রাগ করেছে, মাকে মানিয়ে নিতে যতটুকু দেরি তারপরই বিয়ে করবে। আবার একদিন বলল বিয়ে করবে বলে টাকা ধার করে রিক্সাতে ব্যাটারি লাগিয়েছে। বাসন্তী আর ছেলেকে সুখে রাখতে হবে তো? ব্যাটারির দেনাটা শোধ হলেই হলো। বাসন্তী গলে গলে পড়ে। এখানে সেখানে ঘুরতে নিয়ে যায়। বই দেখাতে নিয়ে যায়। অন্ধকার সিনেমা হলে মনের মানুষের হাত চেপে ধরে সিনেমা দেখে দুজনে। একদিন এগরোল না কি একটা যেন খাইয়েছিল। খুব স্বাদ। এক বুক তাজা নিঃশ্বাস নিয়ে বাসন্তী ভাসছে। ভাসতে ভাসতে ছমাস পেরোল।
বাসন্তী আবার পোয়াতি। মাসি গজগজ করে। সতী আর বাসন্তী দুজনে মিলে চেপে ধরল।
- কি বলচিস? তাই! এত ভাল কতা। ত্রিফলা আলোতেও ঝলমল করে উঠল। আজই মাকে বলচি। তুই একদম চিন্তা করিস না।
পরদিন থেকেই বেপাত্তা। বাসন্তী কেঁদে মরে। ওর কাছে তিন-সত্যি ভয়ানক রকমের প্রতিজ্ঞা। লঙ্ঘণ করলে মহাপাপ। মহাপাপ হলে কি হয় তাও ঠিকমতো জানে না। ছোট থেকে শুনে শুনে শিখেছে মহাপাপ হলে ইহকাল পরকাল ঝরঝরে হয়ে যায়। সেই মহাপাপের ভয়ও নেই লোকটার। বাসন্তীর সামনে আবার সমুদ্র, আবার পাতালে সেঁদিয়ে যাওয়া। সতীকে একবার বকাবকি করে, ওর বুদ্ধিতেই মেলামেশা করেছিল। আবার তাকেই বলে সে মিনসের খোঁজ এনে দিতে।
ইস্টিশানের ধারের বস্তিতে দুনিয়ার লোক এসে বাসাভাড়া করে থাকে। কেউ কারও ঠিকমতো খোঁজ রাখে না। শহরের হাওয়ায় পয়সা ওড়ে, সেই পয়সা ধরে পুটুলি বেঁধে দেশ বাড়িতে পাঠায়। ঘরবাড়ি জমিজিরেত হয়। সবাই তাই নিজের নিজের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকে। তার মাঝেও ঠাট্টা মস্করা হয় কিন্তু কেউ কারও জীবনের খবর রাখে না, রাখতে পারে না। সতী বহু কষ্টে খবর জোগাড় করল। দেশের বাড়িতে মা নেই, বউ আছে সঙ্গে দুটো বাচ্চা।
একুশ বছরের বাসন্তী দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম দিল একা। তিন মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে কাজে বেরোল। তিনটে পেট চালাতে হবে তো। মাসি কি এক মায়ায় জড়িয়ে রয়ে গেছে। জীবন হলো ছলনা, শুধুই কুহেলিকা। আবার মায়াও বটে। মায়াকে বাদ দিলে কিছুই থাকে না। মাসি আছে বলে বাচ্চা দুটোর জন্য চিন্তা থাকে না। বড় ছেলেকে স্কুলে দিয়েছে। ছোটটা বছর দুই। এর মাঝে বহুবার বাসন্তীর দরজায় রাতের বেলা ঘা পড়েছে। একটুও ভয় না পেয়ে খুব সহজভাবে সামলেছে। সতীও জেনে গেছে বাসন্তীর আর খুঁটির দরকার হবে না। মনের চারদিকে দেওয়াল তুলে দিয়েছে ও। কোথাও কোনও ফাঁক গলে টুকরো ঝড় কিম্বা মেঘ কোনও কিছুই গলতে পারে না। তার মন এখন একটা গণ্ডির মাঝেই ঘুরপাক খায়। বাঁচতে হবে। চারটে পেট নিয়ে যেভাবেই হোক ওকে বেঁচে থাকতে হবে। এখন আর কারও চোখের চাহুনি ওর ভিতরের সাপটাকে জাগিয়ে তোলে না। বাসন্তী এখন পাক্কা শহুরে।
- ঠক্ ঠক্! আবার কয়েকদিন হলো রাত্রিবেলায় বাসন্তীর দরজায় আওয়াজ শুরু হয়েছে।
- কে গো জ্বালাচ্চ রাতের বেলা! কাল সকালে এস কথা কইব।
পাশ ফিরে শুল মাসি। জানে তার ঘুম না ভাঙলেও চলবে। রাতের অন্ধকারকে আজকাল বাসন্তী আর ভয় পায় না। পরদিন থেকে একটা ঢ্যাঙা মতন লোকের সঙ্গে বাসন্তীকে দেখা যেতে লাগল। রাস্তাঘাটে বাজারে, সতীর চায়ের দোকানে, সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে ফুচকা খেতে। সন্ধ্যেবেলা কাজের শেষে স্টেশনের ওপারে বড় ঝিলের পারে প্রায়ই দুজনে বসে থাকে।
- আজ তোর জন্য মুড়ি আর বেগুনী এনেচি খেয়ে নে আগে। সেই কখন কাজে বেরিয়েছিস?
- বাব্বা! অত চিন্তে ভালো নয় গো বাপু। রোজ রোজ মুড়ি চিবুতে আমার ভালো লাগে না। অন্য কিছু আনতি পার না?
- আচ্ছা বেশ কাল এগরোল নিয়ে আসবখোন। ঢ্যাঙা মানুষটার হাত তখন বাসন্তীর শরীর চষে বেড়াচ্ছে। নির্বিকার বাসন্তী এক সময় চেঁচিয়ে ওঠে
- না! না! ওকেনে নয়! ওকেনে হাত দিয়োনি বাপু। দিলে কিন্তু কাল তোমারে বিরিয়ানি খাওয়াতে হবে, আমারে আর ছেলেরে। ছেলেটা আমার বিরিয়ানি খেতে বড্ড ভালোবাসে।
0 comments: