0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in


ধারাবাহিক


জলরেখা 
নন্দিনী সেনগুপ্ত


তেরো

ক্যাম্পে খাবার ঘর থেকে শোবার ঘরে যাবার পথে মাথাটা একটু ঘুরে গেলো নিরূপের। ধীরে ধীরে সামলে ফিরে গেলো বিছানায়। জোর করে সরমার ওখান থেকে পরদিনই ক্যাম্পে ফিরে এসেছে সে। ক’দিন একটু রেস্ট দরকার। তারপর নাহয় বাড়ি ফিরবে সব গুটি শুকিয়ে ঝরে গেলে। কারণ, এই অবস্থায় গেলে তো তার ছোঁয়া থেকে অন্য কারওর হয়ে যেতে পারে। নীরুর যদি হয়? না, একটু কমলেই যাওয়া ভাল। নিজের মনেই মাথা নাড়ে নিরূপ। ভাবনার জাল ছিন্ন হয়ে যায়... হঠাৎ ক্যাম্পের রান্নার ঠাকুর ভরত চীৎকার করে ওঠে, ‘ভুচাল, ভুচাল... বাবুজীইই... বাহার চলে আও’। নিরূপ চীৎকারের সাথে সাথেই টের পায় যে ওর নিজের খাটটাও অল্প অল্প দুলছে। নিরূপ নিজের মনেই মৃদু মৃদু হাসে। ভূমিকম্প ওকে বিছানা থেকে নামাতে পারেনা। ও জানে এই অঞ্চল ততটা ভূমিকম্পপ্রবণ নয়। একটু পরেই সব স্থির হয়ে যাবে। হয়ত অনেক দূরে কোথাও জোর ঝটকা দিয়েছেন ধরিত্রীমাতা। ও হাসছিল এটা ভেবে যে একটু আগের মাথা ঘোরাটা তাহলে ভূমিকম্পের অনুভব। সত্যিই মাথাঘোরা নয়। কম্পন থেমে যায়। ভরত দৌড়ে এসে জানতে চায়, ‘বাবুজী, তুম ঠিক হো?’ নিরূপ হেসে হাত তুলে তাকে আশ্বাস দেয়। ভরত আরও কত কি বলে যায়। তার কানে ঢোকে না। একটু হেসে পাশ ফিরে শুতে শুতে কৌতূহল হয় তার এটা ভেবে যে এপিসেনটার কোথায়? পাহাড়ে? পাহাড়ে হলে কোন দিকে? সেই দিকে কি? নিজেকে প্রশ্নে প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত করতে থাকে। খবর আসতে একদিন লাগবে। এত জলদি সে কিছু জানতে পারবেনা এই গণ্ডগ্রামে। তারপর ভাবে-- যেখানেই হোক, তার কি? সে তো সব ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছে। উপড়ে নিয়ে এসেছে ভালবাসার গাছের শিকড়। 

ঘুমোবার চেষ্টা করে সে। পারে না। ভূমিকম্প শুধু কাঁপিয়ে দেয় না, হয়ত মনে করিয়ে দেয় অনেক পুরানো কথা। ভূস্তরের চ্যুতি মনে করায় তার নিজের ভুলের কথা, চ্যুতির কথা। নিরূপ ফিরে যায় পুরানো স্মৃতির ঘরে যেখানে একটা সোনালি বিকেলে সে আর আইয়ম একসঙ্গে বসে কফি খাচ্ছিল। অরূপের মৃত্যুর প্রায় মাসতিনেক পরে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছিল জীবন। শোকের তীব্রতা ফিকে হয়ে যাচ্ছিল একটু একটু করে। দুদিন আগেই মা, বাবা আর নয়ন তার কাছ থেকে ফিরে গিয়েছে কলকাতায়। ওদের নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছে সে একটা গাড়ি করে। মা বড্ড থম ধরে ছিল সারাক্ষণ। পাহাড়, উপত্যকা, জলপ্রপাত, প্রকৃতির কোনও সৌন্দর্য যেন মায়ের মনকে টানছিল না। মাঝে মাঝে নিরূপের মায়ের দিকে তাকাতে ভয় করছিল। এক বিকেলে আইয়মকে ডাকে সে। মায়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। মায়ের মুখে একচিলতে হাসি দেখেছিল নিরূপ। সম্মতি? হ্যাঁ, সেরকম একটা কিছু মনে হয়েছিল বটে তার। শুধু কলকাতায় ফিরে যাবার আগে একপাশে তাঁকে ডেকে নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে মা বলেছিল, ‘দ্যাখ ছোটন, আমি সবকিছু নিয়ে বড় ব্যতিব্যস্ত আছি। নয়নকে একটু সামলে নিই। একবছরের আগে কিন্তু তোর বিয়ে দিতে পারবোনা!’ একথা বলবার সময় এষার ভ্রুতে যে একটুকরো কৌতুক জেগে উঠেছিল সেটা চোখ এড়ায়নি নিরূপের। 

দুদিন পরে সেই সোনালি ছুটির বিকেলে আইয়ম এসেছিল। কফিটা ওই বানিয়েছিল। পাহাড়ে বিকেলের দিকে সাধারণত এত মিষ্টি রোদ্দুর ওঠেই না এই ঋতুতে। অজস্র মেঘ আর বৃষ্টি এসে চারদিক আরও ঠাণ্ডা করে দিয়ে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে যায়, কেউ বুঝতেই পারেনা। কিন্তু সেদিন বিকেল অনেকক্ষণ স্থির হয়ে ছিল এক সোনালি আলোয়। চেরিব্লসমের ফুল বদলে দিয়েছিল দিগন্তরেখার সংজ্ঞা। বাড়ি ফাঁকাই ছিল। দাস নিজের বাড়ি গিয়েছিল। আইয়ম সেদিনও খুব মিষ্টি করে সেজেছিল। নিরূপ সরাসরি চোখ তুলে দেখতে পারছিল না। উল্টোদিকের আয়নায় মাঝে মাঝে দেখছিল নিজের এবং আইয়মের প্রতিবিম্ব। পশ্চিমী পোশাক নয়। দেশীয় পোশাক পরেছিল সেদিন আইয়ম। কাঁধের ব্রোচ থেকে ঝর্নার মত নেমে এসেছিল হাল্কা গোলাপি রঙের সেই পোশাকের প্রান্ত। চুল বেঁধে রেখেছিল একটু উঁচু চুড়ার মত করে। বিকেলের সোনালি আলো এসে বারেবারেই ঠিকরে পড়ছিল তার চিবুকে। এদিক ওদিক দোল খাচ্ছিল কানের দুলের ঝুলন্ত লাল পাথর। ফুলহাতা কালো রঙের লেসের ব্লাউসের উপর ঝিকিয়ে উঠছিল বামহাতের রূপালী কঙ্কন। আইয়ম একটু মাথা নাড়ল... তিরতির করে কেঁপে উঠল তার চোখের পাতা। আইয়ম বলে উঠল, ‘না, নিরূপ, সব কিছু এত সহজ ভেবো না। তোমার বাড়িতে মত দিয়েছে একথা ঠিক। আমার বাড়িতে মত দিলেও অনেক কথা অনেকে বলবে। এখানে চট করে সমতলের মানুষদের কেউ বিশ্বাস করে না। হাজারটা কথা বলবে। এখনও সময় আছে। তুমি ভেবে দেখো। কষ্ট হবে জানি। কিন্তু পরে সামলাতে পারবে তো? আমাদের এখানে বিয়ের পর মেয়ের বাড়িতে থাকে দুজনে। বাড়ি সম্পত্তি এসব মেয়েরাই পায়। অনেক পরিবারে ছেলেরা খুব অকর্মণ্য। যত রাজ্যের নেশাভাং। বরং মেয়েরা অনেক বেশি পড়াশুনা করে, নিজের পায়ে দাঁড়ায়। আমার তো এই জন্যই আমার সমাজের কোনও ছেলেকে মনে ধরল না’। এবার মুচকি হাসি হাসে আইয়ম। নিরূপ শোনে আর আয়নার ভেতর তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ লক্ষ্য করে সে প্রতিবিম্বটা একবার ঝাপসা হয়ে গিয়ে দুলে উঠল। এবার খেয়াল করে যে আয়নাটা কাঁপছে। ইতিমধ্যে আইয়ম লাফ দিয়ে উঠে চেপে ধরেছে তার হাত। ‘ট্রেমর, ট্রেমর...’ তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে ওঠে সে... ‘লেট’স গো আউট’... বাড়ির দরজা খোলা রেখেই ওরা দৌড়ে গিয়ে দাঁড়ায় পাশের মাঠে। বিকেলে বাচ্চারা অনেকেই মাঠে খেলছিল। ভূমিকম্পের ভয়ে আশেপাশের বাড়ির অনেকেই দৌড়ে চলে এসেছে। বেশ ভিড় হয়ে গিয়েছে মাঠে। মেলার মতো। অনেকেই আতঙ্কিত। কেউ আবার মজা পেয়ে লঘু সুরে কথা বলে যায়। 

কম্পন থেমে যায় ধীরে ধীরে। ওরা ফিরে আসে আধখাওয়া কফির কাপের টেবিলে। আইয়ম ম্লান হাসে.... ‘জানো নিরূপ, এখানে এরকম কম্পন প্রায়ই হয়। আমাদের অভ্যেস আছে। তবু তো এই পাড়ায় এত বড় একটা মাঠ আছে। অনেক বসতি এত ঘিঞ্জি, ধরো যারা গরিব, অনেকে বাড়ি থেকে বের হবার সময়টুকু পর্যন্ত পাবেনা যদি খুব জোর ঝটকা লাগে। বাড়ির ছাদ চাপা পড়ে মরবে। সেই তুলনায় আমরা অনেক ভালো আছি। বরং গ্রামের বাড়িগুলো অনেক ফাঁকা ফাঁকা সেই তুলনায়’। নিরূপ মাথা নাড়ে... ‘হ্যাঁ, তবে অনেকে তো বলে খাটের নিচে ঢুকে পড়তে বা টেবিলের নিচে’। আইয়ম কৌতুকের হাসি হাসে... ‘তাই? দেখি তো এই টেবিলের নিচে ক’জন ঢুকতে পারে? চলো, নিরূপ, লেট’স প্র্যাকটিস... ড্রপ, কভার, হোল্‌ড অন’... বলতে বলতে সুড়ুত করে টেবিলের নিচে ঢুকে নিরূপকেও হ্যাঁচকা টান মারে সে। নিরূপ হুমড়ি খেয়ে উপুড় হয়ে মাটিতে শুয়ে থাকে টেবিলের নিচে। তার মুখের খুব কাছে আইয়মের মুখ; ঠোঁটের খুব কাছে সেই মানসীর অধর। তার মাথার কাছে দুলছে টেবিলক্লথের সাদা নেটের আড়াল। প্রাকৃতিক রাসায়নিক বিক্রিয়ার মতই স্বাভাবিকভাবে সে তার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। ধরিত্রীমাতার কম্পন থেমে গিয়েছে। কিন্তু কম্পন চলতেই থাকে... লাব ডুপ ... লাব ডুপ... আরও দ্রুত ছন্দে স্পন্দিত হতে থাকে দুটি হৃদয়। 







0 comments: