গল্প - অসীম দেব
Posted in গল্পচিঙড়ির বহুদিনের প্রেমিকা মোনালিসার বিয়ে হয়ে গেলো, অন্য এক ছেলের সাথে।
চিঙড়ি উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর অঞ্চলের মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, বয়স বেশি নয়, এখন উনিশ চলছে। আর মোনালিসা বড়লোকের মেয়ে। বয়স এখন সতেরো। চিঙড়ি ক্লাস নাইন পর্যন্ত পড়াশুনা করে তারপর পড়াশুনা ছেড়েই দিলো। তাঁর স্বপ্ন, নিজের মতন করে ব্যাবসা করবে, সে যতই ছোট হোক। নিজের স্কুলের সামনে তেলেভাজার দোকান দিয়েই শুরু করলো। আর এই দু’বছরে চপ কাটলেট বিরিয়ানি এরকম আরও কিছু সম্ভার নিয়ে দোকান সে এখন বেশ জমিয়ে নিয়েছে। স্কুলের ছাত্ররা আছেই, পাড়ার অন্যরাও এখন তাঁর নিয়মিত কাস্টমার। ভালোই রোজগার। আর অন্যদিকে মোনালিসা এখন সদ্য কলেজে ঢুকেছে।
চিঙড়ি বখাটে বাজে ছেলে নয়। সুদর্শন, কথাবার্তায় নম্র, ভদ্র, রকবাজ নয়, মেয়েদের সিটি মারে না, গালাগালি খিস্তি মারে না, মদ গাঁজা খায় না। সেজন্য পাড়ার লোকেরাও ভালোবাসে। দোষের মধ্যে একটাই, সে ক্লাস সিক্স থেকেই বিড়ি খায়, তবে লুকিয়ে, পাড়ার বড়দের সামনে খায় না। মোনালিসা জানতো যে চিঙড়ির বিড়ির শখ, কিন্তু মধ্যবিত্ত ঘরের স্বাধীনচেতা ছেলে বাপের পয়সায় বড়লোকি নেশা করবে না। মোনালিসাই চিঙড়িকে সিগারেটের খরচা দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু সে রাজি হয় নি। অনেক হ্যাঁ না হ্যাঁ না’র পরে চিঙড়ি রাজি হয়, তবে সস্তার বিড়ির খরচা নেবে, সিগারেটের নয়। সেই সিস্টেম এখনও চলছে। চিঙড়ির ব্যাবসা এখন ভালো চলা সত্বেও বড়লোকের মেয়ে মোনালিসা এখনও চিঙড়িকে বিড়ির পয়সা দেয়।
ভালোই প্রেমপর্ব চলছিলো, কিন্তু চিঙড়ির এক হিংসুটে প্রতিদ্বন্দ্বী মোনালিসার বাবাকে গোপনে জানিয়ে দিলো যে মোনালিসা চিঙড়ির সাথে লুকিয়ে প্রেম করে। শুধু তাই নয়, চিঙড়িকে নেশা করারও পয়সা দেয়। মোনালিসার বাবা সব শুনলেন। গোপনে চর লাগিয়ে খবর নিলেন যে দুজনের মধ্যে সত্যিই যোগাযোগ আছে। কিন্তু বিড়ির পয়সার ব্যাপারে হাতেনাতে প্রমাণ ধরতে পারলেন না। উনার পিতৃদত্ত নাম কমল মিত্র। এবং বাংলা সিনেমার কমল মিত্রের আদবকায়দা নকল করেন। ভাবলেন, বাংলা সিনেমার সেই কমল মিত্রের স্টাইলেই চিঙড়িকে ডেকে বলবেন, এই নাও, ব্ল্যাংক চেকে সই করে দিয়েছি। টাকার অংকটা তুমিই বসিয়ে নিও, আর এবার আমার মেয়ের থেকে দূরে সরে যাও। কিন্তু ব্যাবসায়ী মানুষ, এক অচেনা তেলেভাজাওয়ালাকে এত অনায়াসে ব্ল্যাংক চেক কেন দেবেন?
মেয়েকে ডাকলেন।
তুমি এই তেলেভাজাওয়ালা চিঙড়িকে চেনো?
মোনালিসা বুঝলো, যে করেই হোক বাবার কানে খবর গেছে, আর লুকিয়ে রাখা যাবে না। আমতা আমতা করে জবাব দিলো, “হ্যাঁ বাবা। কিন্তু সে এখন আরও অনেক কিছুই করে।“
কি রকম?
মানে সকালে চা, লুচি, আলুর দম, ডিম। দুপুরে মাংস, বিরিয়ানি, আর বিকেলের দিকে তেলেভাজা, চপ, ফিস ফ্রাই, বিরিয়ানি, এইসব। হোম ডেলিভারিও দেয়। ভালোই রোজগার করে।
বাঃ, তাহলে তো তিনি একজন শিল্পপতি।
মোনালিসা চুপ করে থাকে। বুঝে গেছে যে, বাবার কাছে আর লুকিয়ে লাভ নেই। বাবা হাঁক দিলেন, “শুনছো, তোমার মেয়ে নিজের বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক করে ফেলেছে, একজন শিল্পপতির সাথে।“
শুনেই মা দৌড়ে এলেন, “ও মাঃ, তাই? ছেলে কি করে?”
সে তোমার মেয়েকেই জিজ্ঞেস করো।
হ্যাঁরে, ছেলে কি করে? বাড়ি গাড়ি আছে তো?
মোনালিসাই জবাব দেয়, “গাড়ি, মানে একটা মোটর সাইকেল কিনেছে।“
মোনালিসার মা শুনে মনে স্বস্তি পেলেন। “সে ঠিক আছে, আমরাই না হয় যৌতুকে একটা গাড়ি দিয়ে দেবো।“
মোনালিসার বাবা থামিয়ে দিলেন, “দাঁড়াও। আগে খোঁজ নিয়ে দেখি গাড়ির তেল ভরার টাকা ওঁর আছে কি না।“
পরের দিন সকালে অফিস যাওয়ার পথে মোনালিসার বাবা চিঙড়ির দোকানে গিয়ে হাজির হলেন। দামী গাড়ি থেকে নামলেন, গায়ে স্যুট, মুখে পাইপ, কে ইনি? চিঙড়ি ভদ্রলোককে ঠিক চিনতে পারে না। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই উনি সোজা প্রশ্ন করলেন, “তোমার নাম চিঙড়ি?”
আজ্ঞে হ্যাঁ, আমিই চিঙড়ি, কাকু আপনাকে তো চিনলাম না।
চিনবে না। তুমি যার থেকে বিড়ি খাওয়ার পয়সা নাও, আমিই তাঁর বাবা।
চিঙড়ি কি করবে ভেবে পায় না। সামনের কাঠের বেঞ্চ দেখিয়ে বলে “কাকু, বসুন বসুন। একটু চা খাবেন?”
না, বসবো না। এরকম কাঠের বেঞ্চে আমার বাড়ির দারোয়ান বসে। আর শোনো, পথেঘাটে আমাকে জোর করে কাকু বানাবে না।
চিঙড়ি চুপ করে থাকে।
মাসে কত পয়সা রোজগার করো?
চিঙড়ি এবার কাকুর থেকে স্যারের সম্বোধনে চলে আসে।
স্যার, সব খরচা, লোকের মাইনে, পুলিশ, তোলা এসব দিয়েও মাসে হাজার পয়ত্রিশ চল্লিশের মতন হাতে থাকে স্যার।
বাজে কথা বলো না। এতো টাকা থাকলে এরকম নোংরা গেঞ্জি আর সস্তার প্যান্ট পড়ে আছো কেনো?
চিঙড়ি চুপ করে গেলো।
প্রেমপর্ব থমকে গেলো। আর অন্য ছেলের সাথে মোনালিসার বিয়েও হয়ে গেলো। বর কোনরকমে একটা ডিপ্লোমা জুটিয়ে ছোটখাটো এক ওষুধ কোম্পানির সেলস রিপ্রেসেন্টেটিভ। যা মাইনে পায়, তাতে মাসের শেষে বাপের থেকেই মোটর সাইকেলের তেলের পয়সা নেয়। কিন্তু মোনালিসার বাবা দেখেছেন ছেলের বাবা বড়লোক। ছেলে ভালো জামাকাপড়, গলায় টাই লাগিয়ে মোটর সাইকেলে করে অফিস যায়। আর ছেলের বাবাও দেখেছেন মেয়ের বাপ মালদার পার্টি। সুতরাং দুই জাঁদরেল বাবার ইচ্ছেয় বিয়েটা হয়েই গেলো। দুঃখে বিরহে চিঙড়ি আর দোকানেই গেলো না। এক সপ্তাহ কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ালো। দাড়ি না কামিয়ে নিজের অজান্তেই দেবদাস হয়ে গেলো।
পাড়ার মনু’দা চিঙড়ির দোকানে রোজ সকালে চা খেতে আসেন। চিঙড়ির সাথে হেব্বি দোস্তি। এই মনু’দার অনেক বয়স। কলকাতার ছেলে, ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে বিহারে কোল ইন্ডিয়ায় চাকরী করতে গিয়ে কালক্রমে কয়লাখনির ছোট্মাপের মাফিয়া হয়ে যান। এখন সব ছেড়ে কলকাতায় ফিরে এসেছেন। যেমন প্রচুর টাকা, তেমনই প্রচুর দানধ্যান। অভাবী লোকজনদের নিয়মিত অর্থসাহায্য করেন। অঞ্চলের প্রভাবশালী লোক। কলকাতার অনেক বড় বড় নেতা, মন্ত্রী, পুলিশের সাথে ভালোই ভাব ভালোবাসা আছে। তবে রাজনীতির ঝুট ঝামেলায় থাকেন না। সেই মনু’দা রোজ এসে দেখেন চিঙড়ির দোকান বন্ধ।
হঠাৎ একদিন রাস্তায় চিঙড়িকে পেলেন। “এ কিরে? কি চেহারা বানিয়েছিস? দোকান বন্ধ করে দিয়েছিস কেন?”
চিঙড়ি চুপ করে থাকে। মনু’দা চিঙড়ির প্রেমের উপাখ্যান জানতেন, আর এও জানেন যে সেই মেয়ের কিছুদিন আগেই অন্য ছেলের সাথে বিয়েও হয়ে গেছে। মনু’দা লোকচরিত্র খুব ভালো বোঝেন। চিঙড়ির সমস্যা বুঝতে মনু’দার সময় লাগে না। সামনেই যে চায়ের দোকানটা ছিলো, জোর করে চিঙড়িকে সেখানে নিয়ে গিয়ে সোজা প্রশ্ন করলেন, “মেয়ের শ্বশুরবাড়ি কোথায়?”
চিঙড়ি জানে না, সত্যি জানে না। তবু প্রশ্ন করলো, “কেন? জেনে কি করবে?”
তাহলে শোন। তুই এখন নিজের পাড়ায় একটা ছোট চায়ের দোকানের মালিক। তুই এবার ওঁর বাড়ির সামনেই থ্রি স্টার রেস্টুরেন্ট খুলবি। দেখিয়ে দিবি ব্যাবসা আর পয়সা কাকে বলে। আমিই তোর সব ব্যাবস্থা করে দেবো।
চিঙড়ি বুঝলো না। শুধু বললো, “আর এখনের দোকান?”
সেটাও চলবে। কিন্তু সবার আগে সেই মেয়ের শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা আমার চাই।
চিঙড়ির খেয়াল হলো যে বিয়ের ঠিক আগেই মোনালিসার বাবা গাড়ি হাঁকিয়ে বিয়ের কার্ড দিতে এসেছিলেন। গাড়ি থেকে নামেন নি। বলেছিলেন, “এই যে, আমার মেয়ের বিয়ের কার্ড দিয়ে গেলাম। তোমাকে আর বিয়ের আসরে আসতে হবে না, আমিই তোমার জন্য দই সন্দেশ নিয়ে এসেছি।“ এরপর গাড়ির ড্রাইভার এক হাঁড়ি দই আর এক বাক্স সন্দেশ রেখে চলে গেলো। চিঙড়ি ভাবলো, সেই কার্ডেই হয়তো শ্বশুরবাড়ির ঠিকানা দেওয়া আছে। আর মনু’দা যদি ইচ্ছে করেন, তাহলে অনেক অসম্ভবকেই সম্ভব করতে পারেন। “মনু’দা, কাল সকালেই আমি দোকান খুলবো, তুমি সকালেই একবার এসো।“
ভাগ্যিস মোনালিসার বিয়ের কার্ডখানা চিঙড়ি রেখে দিয়েছিলো। মনু’দা কার্ড দেখলেন। “আচ্ছা। বাপের নাম কমল মিত্র। তুমি যদি শালা কমল মিত্র হও, তাহলে আমিও চিঙড়িকে উত্তমকুমার বানিয়ে ছাড়বো।“
চিঙড়ি কিছুই বুঝলো না। “তোকে এখন এসব বুঝতে হবে না। এই কমল মিত্র, মানে তোর মোনালিসার এখনের বাড়ি টালিগঞ্জের গলফ গ্রীনে। তোর থ্রিস্টার রেস্টুরেন্ট তাহলে ঐ পাড়াতেই হবে। আমাকে কিছুদিন সময় দে।“
সেদিন এর বেশি আর আলোচনা হলো না।
দিনকয়েক বাদেই মনু’দা ফিরে এলেন। “শোন, তোর জন্য ভালো খবর আছে। আপাতত টালিগঞ্জ টিভি সেন্টারের ক্যান্টিনের বরাত তোকে করিয়ে দেবো। আর বাইরে তার পাশেই একটা খালি জায়গা আছে। কিছুদিন বাদে সেখানেই তুই একটা এক্সটেনশন কাউন্টার দিবি। পাকা কথা সব হয়ে গেছে। আমিই সব ব্যাবস্থা করে দেবো।“
চিঙড়ি কিছুই বুঝলো না। “টিভি সেন্টারের ক্যান্টিন?”
হ্যাঁ, টিভি সেন্টার। টিভির আর্টিস্ট গায়ক গায়িকা মিউজিশিয়ান স্টাফ কর্মচারি এনাদের তুই চা কফি, বিরিয়ানি, ফিস ফ্রাই এসব সাপ্লাই করবি।
আর কি যেন বললে টেনশন কাউন্টার?
শালা, লেখাপড়া ছেড়ে দিলে এই হয়। ওটা এক্সটেনশন কাউন্টার। ওটা পরে হবে। আগে শুধু টিভি সেন্টার দিয়ে শুরু কর।
টিভি সেন্টারের ক্যান্টিন আগেই ছিলো। কিন্তু বন্ধ ছিলো। চিঙড়ি হাজার তিরিশ খরচ করে সেই ক্যান্টিনই মডার্ন করে সাজালো। মনু’দা বুঝিয়েছেন, এঁরা উঁচু ক্লাসের লোক, এঁদের চাই শো বিজনেজ। চায়ের কাপ, প্লেট, জলের গ্লাস, ফ্রিজের কোল্ড ড্রিঙ্কস, বিস্কুট, চিপস সব টপ ক্লাস ব্র্যান্ড চাই, একদম টপ ক্লাস। আর চিঙড়িকে দোকানে নিয়ে গিয়ে ভালো জামাকাপড়ও কিনে দিলেন। টিভি সেন্টারে চিঙড়ির ক্যান্টিন শুরু হয়ে গেলো।
টিভি সেন্টারে চিঙড়ি এখন অর্ডারের ফোন পেলে গুড মর্নিং বা গুড ইভনিং দিয়েই কথা শুরু করে। কিছুদিন আগে যে ভাঁড়ের চা ছ’টাকায় বিক্রি হতো, সেই চা এখন দামী কাপে কুড়ি টাকায় বিক্রি হয়। একটা বছর সতেরো আঠারোর সদ্যযুবতী মেয়েকেও মাইনে দিয়ে রেখেছে, টেবিলে গিয়ে অর্ডারের জিনিষ দিয়ে আসে। রোজকার চা, শিঙাড়া, লুচি পরোটা তরকারি, দুপুরের ভাত মাংস বিরিয়ানি, সন্ধ্যার ফিস ফ্রাই চিকেন মাটন রোল এসব আছেই, আর শ্যুটিং বা রেকর্ডিং থাকলে স্পেশাল মেনু। সব মিলিয়ে প্রথম মাসে চিঙড়ি ভালোই রোজগার করলো। মনু’দার উপদেশে চিঙড়ি নিজেই কিচেন সামলায়, কাউন্টারে বসে, তাই খরচও অনেকটা বেঁচে যায়। চিঙড়ি এখন ভালো জামা পড়ে। চুলে শ্যাম্পু দেয়। দাড়ি কামায়। সেই চায়ের দোকানের চিঙড়ি এখন ক্যান্টিন ম্যানেজার হয়ে গেছে। ওদিকে চিঙড়ির শ্যামপুকুরের চায়ের দোকানে মনু’দাই একটি বিশ্বাসী ছেলেকে কমিশন রেটে লাগিয়ে দিয়েছেন।
মাসের শেষে মনু’দা একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন, “নে এই কাগজটা সবাইকে দিয়ে আয়।“
এটা কি?
ফিডব্যাক ফর্ম। তুই বুঝবি না। কাগজগুলো দু’দিন পরে সকলের থেকে ফেরত নিয়ে তারপর আমাকে সবগুলো দিবি।
কয়েকমাসের মধ্যেই চিঙড়ির ক্যান্টিন দাঁড়িয়ে গেলো। মনু’দা সেলিব্রিটিদের খাওয়ার ভিডিও তুলছেন, আর ইউটিউবে পোস্ট করছেন। এবার মনু’দা বুঝিয়েছেন, “তোর চায়ের ঠেক আছে, টিভি সেন্টারে ক্যান্টিন আছে। এবার থ্রি স্টার রেস্টুরেন্ট খুলবি, জায়গাও ঠিক করা আছে।“
আরও বললেন, “একটা শেফ আর একটা ভালো মেয়ে জোগাড় করতে হবে। শেফ দরকার, দু’জায়গার কিচেন তুই একা সামলাতে পারবি না।“
কিন্তু মেয়ে কেন?
হ্যাঁ, মেয়ে চাই। থ্রি স্টার রেস্টুরেন্টে তোমার শ্যামপুকুরের গেঞ্জি পড়া ছেলে চলবে না।
মেয়েও জোগাড় হয়ে গেলো, নাম পদ্মরাণী। মনু’দা বললেন, এই নাম চলবে না। নাম দিলেন তনুজা। “তোকে আমি উত্তমকুমার বানাবো, সঙ্গে এসব পদ্মরাণী চলবে না।“
চিঙড়ির চায়ের দোকানে রোজগার ভালোই ছিলো। টিভি সেন্টারের ক্যান্টিন থেকেও ভালো রোজগার হচ্ছে। হাতে এখন পয়সা আছে। মনু’দাই ভালো আর্কিটেক্ট ডেকে নতুন রেস্তোরাঁ বানিয়ে দিলেন। রেস্তোরাঁ দেখে চিঙড়ি অবাক। ভেতরটা কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার। “শোন, দিনের বেলায় ভেতরে লাইট জ্বলবে, আর রাতে হাল্কা আলো। আর প্রেম করা ছেলেমেয়েরা এলে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিবি।“
দিনে লাইট আর রাতে মোমবাতি?
হ্যাঁ, মোমবাতির আলোয় প্রেম, তবে শুধুই রাতের সময়।
দেয়ালের চারিদিকে কিসব ছবি, চিঙড়ি আগে এরকম দেখেনি। “শোন, এই লোকটা জর্জ হ্যারিসন, আর এই লোকটা ড্রাগের সম্রাট পাবলো এস্কোবার, ইনি মার্লোন ব্র্যান্ডো, বিসমিল্লা খান, জিমি হেন্ড্রিক্স, ওদিকে আমাজনের জঙ্গল। “
আমার দোকানে ড্রাগের চোরাকারবারির ছবি?
দোকান নয়, এটা তোর রেস্তোরাঁ। কি বলবি? রেস্তোরাঁ। আর এই ছবিগুলো হলো ইন্টিরিয়র ডেকরেশন। এগুলোই আমাদের মার্কেটিং। এখানে তোর দীপিকা পাড়ুকোনের ছবি চলবে না।
কলকাতার কিছু নেই?
ঐ তো, কোনায় পুরনো ট্রামের ছবি।
দেওয়ালে বিরাট এক টিভি। দেখানো হবে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ফর্মূলা ওয়ান, স্প্যানিশ লীগ, উইমবল্ডন, বিগ ব্যাশ, আইসল্যান্ডের ভল্কানো। সাউন্ড সিস্টেমে চলবে সাইকেডেলিক মিউজিক, রক মিউজিক। চিঙড়ি শুনছে, কিছুই বুঝছে না। তবে এটা বুঝে গেলো যে, ঘ্যামা কিছু একটা হতে চলেছে। এককোনে একটা মোটা দড়ির জাল, কিছু ঘড়া আর বন্দুক ঝোলানো। “এটা কেন? আমার বন্দুকের লাইসেন্স কোথায়?”
এসব ইন্টিরিয়র ডেকরেশন। বুঝবি না। তুই এবার রেস্তোরাঁ চালু কর।
এবার টিভি সেন্টারের ঠিক বাইরে রাস্তায় লোকজন দেখলো এক ঝাঁ চকচক নতুন রেস্তোরাঁ, মোনালিসা কাফে। ইংরেজিতে মেনু কার্ড ছাপানো হয়েছে, যা চিঙড়ি নিজেই বোঝে না।
Shingnim Cashewnut with Spanish Red Tomato & Sugar, মানে শিঙাড়া নিমকি টমেটোর চাটনি, এক প্লেট ৭৫ টাকা।
Deep-Fried South Asian Puffy Bread Unstuffed মানে লুচি, এক প্লেট ৬০ টাকা।
Deep-Fried Flat Bread Large মানে পরোটা। এক প্লেট ৫০ টাকা।
Andulesian Flat Bread Egprota Small ডিমের পরোটা। এক প্লেট ৫০ টাকা।
Andulesian Flat Bread Egprota Large মানে ডাবল ডিমের পরোটা। এক প্লেট ৭০ টাকা।
Roasted King Veg with White Butter, মানে শুকনো নিরামিষ তরকারি। এক প্লেট ৫০ টাকা।
Continental Salted Mutton Veg Reddish Brewani, মানে বাঙালী বিরিয়ানি। এক প্লেট ১৫০ টাকা।
Rice Soup with Fried Soft Chicken & Onion, মানে পান্তা ভাত, পেঁয়াজ আর এক পিস চিকেন ফ্রাই দিয়ে, ১৫০ টাকা।
Castrated Casual Caprae Escam in Onion Garlic and Masterd Oil. মানে দু’ পিস পাঠার মাংসের ঝোল, এক প্লেট ২০০ টাকা।
Marinated Italian Fish Fried with Yogurt Coating, মানে ফিস ফ্রাই। এক প্লেট ৭০ টাকা।
Exotic Chicken with Curated Lactobacillus Sauce and Garnished Coriandrum. মানে মুরগীর ঝোল, দু’ পিস। এক প্লেট ১৫০ টাকা।
মনু’দা বুঝিয়ে দিলেন। পরোটা মানে Flat Bread, ডিমের পরোটা মানে এগ পরোটা, সেটাকেই Egprota করা হয়েছে, বিরিয়ানিকে Brewani
চিঙড়ি দেখছে, এইরকম সব নাম,আর দাম। প্রতিটি মেনুর সাথে একটা করে রঙচঙে ছবিও দেওয়া আছে। বাংলা নামগুলো মনু’দাই বুঝিয়ে দিলেন, “পাবলিক অচেনা নাম হলেই খেতে আসবে। তোর শিঙাড়া, ডিমের পরোটা খেতে কেউ আসবে না।“
মনু’দা, এগুলো তো আমাদের পাতি বাঙালীদের মেনু! আর যা দাম রেখেছো লোকে কিনবে?”
মনু’দা বিজ্ঞের হাসি দিয়ে বললো, “ভুলে যাস না, থ্রি স্টার রেস্তোরাঁ। শিঙাড়া নিমকির বদলে শিঙনিম খাবে। এগ পরোটা নয়, এগপ্রোটা। এই নামেই কাটবে। লুচি ডিম বললে থ্রি স্টার হবে না।“
কিন্তু পাড়ার ছেলেরা, স্কুলকলেজের ছেলেমেয়েরা, প্রেম করা বেকার ছেলেমেয়েরা এই দাম শুনে আসবে?
বাইরে বোর্ড টাঙিয়ে দেবো, স্টুডেন্ট এন্ড ইয়ং কাপল ডিসকাউন্ট। তাহলেই আসবে।
রেস্তোরাঁয় ঢুকতেই এসবেস্টস শেডের নীচে কিছু বেতের মোড়া, আর দুটো ছোট ছোট সেন্টার টেবল। “এগুলো বিজয়গড় আর নেতাজীনগর কলেজের ছেলেদের জন্য যারা এক কাপ চা নিয়ে দু’ঘন্টা বসবে, এঁড়ে তক্কাতক্কি করবে, তাঁদের জন্য।“
চিঙড়ি বুঝলো না। “তোকে এসব বুঝতে হবে না। ওঁরা এসে নিকারাগুয়ার কৃষক আন্দোলন, প্যালেস্টাইনের গৃহযুদ্ধ, পাগালু দ্বীপে মার্কিন উপনিবেশ, ইথিওপিয়ায় খরা মোকাবিলা এসব নিয়ে আলোচনা করবে। ওঁদের কথাবার্তা তুই বুঝবি না। তোর কাজ হবে শুধু ওনাদের চা দিয়ে সরে আসা।“
রেস্তোরাঁ চালু হয়ে গেলো। মনু’দার স্ট্র্যাটেজিক উপদেশে কাউন্টারের স্কার্ট পড়া মেয়েটি নিজের নাম বদলে এখনে তনুজা হয়ে গেছে। পথচলতি স্কুলের ছেলেমেয়েরা আর কমবয়সী লোকজন ডিসকাউন্ট দেখে ভিড় করে। মনু’দা ইউটিউবে সেই ভিডিও ছড়িয়ে দিলেন। প্রতি দশদিন বাদে বাদে পাড়ার বাড়ি বাড়ি ফ্রি হোম ডেলিভারির লিফলেট বিলি করে দিলেন। এখন ফোনে অর্ডার আসছে। দেখা গেলো জনতা দশ টাকার জিনিষ খুশী হয়ে ত্রিশ চল্লিশ টাকায় খেয়েও নিচ্ছে। এক কাপ কফি সত্তর টাকায় খুশী হয়ে খাচ্ছে। সেই খুশীর ভিডিও ইউটিউবেও পোস্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছুদিন বাদে যখন ডিসকাউন্টও কমিয়ে দেওয়া হলো, কাস্টমাররা তার কিছুই টের পেলো না।
মোনালিসা কাফের নাম পাড়ায় আর আশেপাশে ছড়িয়ে গেছে। দশ মাসের মাথায় মনু’দার উপদেশে কাউন্টারের মেয়েটি মোনালিসার নাম্বারে একের পর এক ফোন শুরু করলো। ম্যাডাম, একবার চান্স দিন। একবার প্লিজ ভিজিট দিয়ে ট্রাই করুন। এত অনুরোধের পর ম্যাডাম একদিন সত্যিই রেস্তোরাঁয় এলেন, তবে জানতে পারলেন না যে কে রেস্তোরাঁর মালিক? এরপর আরেকদিন এলেন। মোনালিসা খেয়ে খুশী, ওঁর বাড়িতে হোম ডেলিভারি শুরু হয়ে গেলো।
ইতিমধ্যে মনু’দার উপদেশে ব্যাংক লোন নিয়ে চিঙড়ি একটা গাড়িও কিনেছে। আর তার কয়েকদিন বাদেই এলো মোনালিসার বিয়ের বার্ষিকীর দিন। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় রেস্তোরাঁয় কিছু স্পেশাল মেনু তৈরি হয়েছে। রাত আটটায় স্যুট টাই পরে চিঙড়ি আর তাঁর সঙ্গী তনুজা সুন্দর সেজে গাড়ি হাঁকিয়ে স্পেশাল মেনু, হাতে ফুলের গোছা, আর একটা গ্রীটিংস কার্ড নিয়ে মোনালিসার বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। বেল বাজাতেই দরজা খুললেন স্বয়ং মোনালিসা। পিছনে দাঁড়িয়ে কমল মিত্র। মেয়ের বাড়ি এসেছেন, বিয়ের বার্ষিকীতে।
“ম্যাডাম, আমরা পাড়ার মোনালিসা কাফে থেকে এসেছি। আমাদের কম্পিউটার ডাটাবেস বলছে আজ আপনার ম্যারেজ এনিভার্সারি। আপনার নাম দেখলাম মোনালিসা। তাই এটা আমাদের মোনালিসা রেস্তোরাঁ থেকে আপনাদের জন্য আমাদের স্পেশাল স্পেশাল কমপ্লিমেন্টারি।“
মোনালিসার চিনতে কোন অসুবিধা হয় নি, কিন্তু কমল মিত্র চিনতে পারলেন না। বললেন, “কমপ্লিমেন্টারি ফুড? বাঃ বেশ ভালো বিজনেস প্রমোশন তো। থ্যাঙ্কস ইয়ং বয়। কোথায় তোমার কাফে?
স্যার, এই তো টিভি সেন্টারের পাশেই। মোনালিসা ম্যাডাম কয়েকবার ক্যান্ডল লাইট এভনিং স্ন্যাক্স খেতে এসেছিলেন।
মোনালিসা অবাক। বার তিনেক সে বরের সাথে কাফেতে গিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু আশ্চর্য? চিঙড়িকে তো সে খেয়াল করে নি।
কমল মিত্র বেশ ইম্প্রেসড, “কি নাম তোমার?”
স্যার, আমার নাম উত্তমকুমার। আর ইনি আমার ম্যানেজার তনুজা।
কমলবাবু বেশ পুলকিত। “বাঃ, বেশ ইন্টারেস্টিং কম্বিনেশন!!”
স্যার, মাঝে মাঝে প্লিজ অর্ডার দেবেন। আর ম্যাডাম মোনালিসা, মাঝে মাঝে প্লিজ আমাদের কাফেতে ক্যান্ডেল লাইট ডিনারে আসবেন।
বলো কি? এই পাড়ায় ক্যান্ডল লাইট ডিনার? কেমন চলছে বিজনেস?
ভালোই স্যার। মোনালিসা ম্যাডামের পাশেই গলফ গ্রীন সি টাওয়ারের ১২ তলার ফ্ল্যাটটা বুক করেছি। খুব তাড়াতাড়িই এখানে চলে আসবো।
আই এম রিয়ালি ইম্প্রেসড মাই বয়। কি যেন বললে, তোমাদের নাম? উত্তমকুমার তনুজা? আমার নামও ফিল্ম স্টারের, কমল মিত্র।
জানি স্যার। আর স্যার, প্লিজ মনে রাখবেন, আমার নাম উত্তমকুমার।
কমল মিত্র আর মোনালিসার চোখের সামনে দিয়ে উত্তমকুমার আর তনুজা সোফার ড্রিভেন গাড়িতে গিয়ে উঠলো।
Brilliantly written!
ReplyDeletethanks so much
DeleteNice 👍👍 👍👍👍
ReplyDeleteThanks for your nice comment
Deleteএকেবারে ঝরঝরে বাংলাতে সুন্দর সপাট গল্প । তবে প্রত্যাশিত শেষ তাই ছোটগল্পের শেষে যে একটা চমক থাকার দস্তুর সেটা পেলাম না ।
ReplyDeleteনিশ্চয়ই আপনার মতামতের খেয়াল রাখবো
Deleteখুব সুন্দর হয়েছে।
ReplyDeleteথ্যাংকস বস
DeleteVery nice. Enjoyed the smooth flow.
ReplyDeleteThanks, however could not get your name
Deleteবাঃ। খুব ভালো লাগলো। এক কথায় "অপূর্ব" ।
ReplyDeleteথ্যাংকস মিস্টার সেনগুপ্ত
Deleteবাহ জমে ক্ষীর! এত স্বপ্নের থেকেও ভালো! এরকম মনুদা সমাজে অনেক দরকার!
ReplyDeleteসঞ্জয়, কি খবর? খুব ভালো লাগলো তোর মতামত দেখে
Deleteদারুণ দারুণ। গল্প সত্যিই নতুন ধরণের। লেখক কি বাস্তবের কোন ঘটনা থেকে গল্পের প্লট পেয়েছেন?
ReplyDeleteধন্যবাদ মিস্টার সরকার। গল্পের শুরুটা বাস্তব, ছেলেটির ঘুড়ে দাঁড়ানোটাও বাস্তব, তবে স্থান কাল পাত্র পরিবর্তিত।
Deleteচমৎকার
ReplyDeleteএক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। চিংড়ির উত্তমকুমার হয়ে ওঠার কাহিনী লেখনীর জোরে অসাধারণ হয়ে উঠেছে।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ মিস্টার বোস, মতামত দিয়ে উৎসাহ দেওয়ার জন্য
Deleteঝরঝরে লেখা। নতুন যুগের মোড়কে পুরনোদিনের নস্টালজিক প্রেমের চোট খাওয়া দেবদাসের পুনরুত্থান গল্প ভালই লাগল চারিদিকের এই ঝিমমারা সময়ে।
ReplyDeleteথ্যাংকস রুদ্রসাহেব।
Deleteলেখার ধরণটা আমার বেশ লেগেছে। বেশ ছন্দ মিশ্রিত আবেগ আছে। অল্প বয়সের প্রেমের যা পরিণতি সাধারণত হয়ে থাকে তাই হয়েছে। যদিও একটু বেশি রঙিন করে দেখাবার চেষ্টা হয়েছে তবুও ভালো লেগেছে। চলুক, আগামী দিনে আরো এইরকম লেখা আশা করবো। ❤
ReplyDeleteথ্যাংকস, ভালো লাগলো আপনার মতামত। কিন্তু আপনার পরিচয় জানতে পারলাম না
DeleteIodized salt মতো free flowing লেখার style, আর topic তো ever-appealing, সাথে একটা positive vibe ... প্রচুর আমোদ পেলাম - এক কথায়, বেশ চনমনে হয়ে পড়লাম।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ সুদীপ
Deleteবাঃ ! বেশ সুন্দর লেখা । যেন সিনেমার চিত্রনাট্য।
ReplyDeleteধন্যবাদ, আপনার ভালো লাগলো। কিন্তু আপনার পরিচয় জানতে পারলাম না।
ReplyDeleteখুব ভালো লেখা।
ReplyDeleteসুন্দর।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteফাটাফাটি । এক্কেবারে বেস্ট সেলার । তবে উপন্যাস নয় গল্প। Jokes aside. সত্যি ভাল হয়েছে লেখাটা
ReplyDeleteWill share the story, taking your name, in a few groups when I am back
দারুণ লাগল।
ReplyDeleteধন্যবাদ, আপনার ভালো লাগলো জেনে। কিন্তু আপনার পরিচয় জানতে পারলাম না। - অসীম দেব
Deleteখুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteখুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteAnother piece of outstanding write up from your pen. The characters are unique and thoroughly enjoyed the reading..
DeleteThanks Ajoy-da, (Ghosh).
DeleteAsim Deb
হাল্কা অথচ চটুল নয়,সুন্দর প্রাণবন্ত লেখা।খুব সাবলীল গতিতে লেখা এগিয়েছে।অনু গল্পের শর্ত পূরণ করে সীমিত পরিসরে গল্পের শেষ হয়েছে। খুব ভাল লাগল।
ReplyDeleteরুমা কুন্ডু
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ, রুমা ম্যাডাম৷ - অসীম দেব
ReplyDeleteলেখাটা পড়লাম। সুন্দর লেখা। আমার মেনু কার্ডটি খুব ভালো লেগেছে।।।।😊
ReplyDelete