3

সম্পাদকীয়

Posted in


সম্পাদকীয়




শরত আলোর কমল বনে
বাহির হয়ে বিহার করে
যে ছিলো মোর মনে মনে...

নিয়ম মত শরত এসে গেল। আর শরতের সোনা ঝলমল রোদের ওম, পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভাসা নীল আকাশের গন্ধ মেখে প্রকাশিত হল ঋতবাক ২য় বর্ষ, ১৩তম সংখ্যা। বা বলা ভালো, দ্বিতীয় বর্ষ, প্রথম সংখ্যা। দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতেই একটু অন্যরকম ঋতবাক। কিছু সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়াই গেল। বাদ পড়ল প্রচুর লেখা। বিচার্য মাপকাঠি লেখার গুণগত মান, বানান বিধির বিশুদ্ধতা, রচনাশৈলী, বিষয়গত সারবত্তা এবং অবশ্যই বক্তব্যের যুক্তিগত স্বচ্ছতা। অনেক বন্ধু ক্ষুণ্ণ হবেন, জানি। কিন্তু সম্পাদকের নিরুপায়তা উপলব্ধি করে অচিরেই ক্ষমাও করে দেবেন, এ বিশ্বাসও রাখি।

মুদ্রণ সংখ্যার কাজও এগিয়েছে অনেকটাই। প্রকাশক, মুদ্রক প্রস্তুত। লেখা নির্বাচনের কাজও এগোচ্ছে দ্রুত গতিতে। আবারও সেই একই কথা, লেখার সার্বিক মান লেখা নির্বাচনের একমাত্র মাপকাঠি। ঋতবাক মুদ্রিত সংস্করণকে কোন প্রথিতযশা সাহিত্যিকের সক্রিয় অংশগ্রহণের গৌরবে একীভূত করার প্রত্যাশায় সম্পাদক মণ্ডলী নিরন্তর সচেষ্ট। একটি সত্যিকারের অন্যধারার বাংলা সাহিত্য সংকলন প্রকাশের এই প্রচেষ্টায় ঋতবাক সম্পাদক মণ্ডলীর সঙ্গে আপনারাও আছেন, সুনিশ্চিত জানি। 

এরই মধ্যে ঘটে গেল এক মহামানবের মহাপ্রয়াণ। আবুল পাকির জয়নুল-আবেদিন আব্দুল কালাম। শিলং আই আই এম এ ‘বাসযোগ্য পৃথিবী’ বিষয়ে বক্তব্য রাখতে রাখতেই তিনি পাড়ি জমালেন না ফেরার দেশে। ‘বাসযোগ্য পৃথিবী’!! কি বলতে চেয়েছিলেন? শোনা হল না। আজীবন বিজ্ঞান নিষ্ঠ এই মানুষটি যেতে যেতেও যেন আপামর বিশ্ববাসীকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে গেলেন এক কঠিন আত্মজিজ্ঞাসার সামনে। আজ, স্বাধীনতার ৬৯তম উদযাপন দিবস অতিক্রম করে এসেও কি সময় হয়নি এ প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়ার?

স্বাধীন ভারতবর্ষেই জন্মেছি। আজ থেকে মাত্র তিরিশ বছর আগের তুলনায়ও বর্তমান কালের আর্থসামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক, বিশেষত সর্বাঙ্গীন ব্যবহারিক পরিমণ্ডলে এক সর্বাত্মক অগ্রগতি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সার্বিক মূল্যবোধে কোথাও কি একটুও টান পড়েনি? সামনে তো অন্ধকার নেই! বরঞ্চ অজস্র আলোর হাতছানি। তারই মধ্যে সঠিক আলোটিকে চিনে নেওয়ার পথের হদিস ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দিয়ে যেতে হবে আমাদেরই। এ দায়িত্ব এড়ানোর নয়।

সর্বাত্মক সমৃদ্ধির শুভেচ্ছা নিরন্তর।

সুস্মিতা বসু সিং



3 comments:

3

প্রচ্ছদ কাহিনীঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in




প্রচ্ছদ কাহিনী




স্বাধীনতা 69
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়



‘ফর্সা, সুশ্রী, স্বাস্থ্যবতী, গৃহকর্মনিপুণা, শিক্ষিতা, ব্রাহ্মণ পাত্রী চাই’

খবরের কাগজটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখে সেটা টেবিলের উপর রেখে দিলেন সুহৃদ বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর টেবিল থেকে চায়ের পেয়ালাটা তুলে নিলেন হাতে। হুঁ। ঠিকঠাকই ছেপেছে। একটু চিন্তায় ছিলেন সুহৃদবাবু। আগের বার ব্রাহ্মণটা বাদ দিয়ে দিয়েছিলো ব্যাটারা।

একটু আগে সুহৃদবাবু ফিরেছেন প্রগতি সংঘের স্বাধীনতা দিবস পালনোৎসবে বক্তৃতা দিয়ে। পৌরপিতা হওয়ার সুবাদে তিনিই ছিলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি। বেশ জম্পেশ একখানা স্পীচ দেওয়া গেছে। স্বাধীনতা মানে শুধু বিদেশী শাসনের হাত থেকে মুক্তি নয়। স্বাধীনতা মানে দৃষ্টির প্রসার, চিন্তার মুক্তি, নাগরিক দায়িত্ববোধের দৃঢ়তা, ইত্যাদি, ইত্যাদি... প্রচুর হাততালি পড়েছে সভায়।

পড়বেই, সুহৃদবাবু জানতেন। তিনি সুবক্তা। এলাকায় জনপ্রিয়। আগামী পৌরসভা নির্বাচনেও তিনিই শাসকদলের প্রার্থী। তাঁর সম্ভাব্য জয় নিয়ে শাসক বা বিরোধী, কোনও দলেরই বিশেষ সন্দেহ নেই। আজকের সভায়ও তার স্পষ্ট আভাস মিলেছে। তাই সুহৃদবাবু আজ খুশি।

পাত্রপাত্রী কলামে বিজ্ঞাপনটা দেখেও তিনি সন্তুষ্ট। ছেলে সুজয় গত এপ্রিলে ছাব্বিশে পড়লো। দু’বারের চেষ্টায় জয়েন্ট এন্ট্রান্স ক্লিয়ার করতে না পারার পর প্রচুর টাকা ডোনেশন দিয়ে তাকে দক্ষিণ ভারতের নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়িয়েছেন সুহৃদবাবু। এখন একটি সফ্টওয়্যার সংস্থায় কর্মরত সুজয়। মাইনে মন্দ নয়। তবু তার শিক্ষার পিছনে যা খরচ হয়েছে, তার তুলনায় কিছুই নয়। তাই তাকে আর বিব্রত করেননা সুহৃদবাবু। ওই বিয়ের পণ থেকেই টাকাটা উঠিয়ে নেবেন তিনি।

ওই ক’লাখ টাকা সুহৃদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতের ময়লা হলেও তিনি বিলক্ষণ হিসেবী লোক। সেই কোন কাল থেকে ব্যবসা করছেন, আজ অবধি এক পয়সাও লোকসান দেননি। শুরু করেছিলেন সামান্য রিয়েল এস্টেট এজেন্সি দিয়ে। মূলধন জুগিয়েছিলেন শ্বশুরমশাই। বিয়ের প্রধান শর্তই ছিলো সেটা। সেই রিয়েল এস্টেট এজেন্সি আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে কন্স্ট্রাকশন কম্পানি। সেই সঙ্গে আছে বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী কেবল টিভির ব্যবসা এবং একটি বিরাট মোটর গ্যারাজ। এই মধ্যপঞ্চাশে দাঁড়িয়ে সুহৃদবাবু আজ একজন সফল এবং প্রতিপত্তিশালী মানুষ। তাঁর দাপটে এলাকার পুলিশ-সমাজবিরোধীরা এক ঠেকে মদ খায়।

আজ তাঁর কন্স্ট্রাকশন কম্পানির অফিস ছুটি। কিন্তু তবু সুহৃদবাবু একবার সেখানে যাবেন। তাড়া নেই। স্বপ্না বসে থাকবে এসে। থাকুক। সেক্রেটারির চাকরি করা অত সোজা নয়! এখন সবে এগারোটা বাজে। ধীরে সুস্থে খেয়েদেয়ে গেলেই চলবে।

দুপুরবেলা খেতে বসে সুহৃদবাবুর মনটা টইটম্বুর হয়ে গেলো। নীলিমা আজ নিজের হাতে লাউচিংড়ি ও কচি পাঁঠার ঝোল রেঁধেছেন। দু’টোই সুহৃদবাবুর অতি প্রিয়। অফিসে যাওয়ার ঝামেলাটা না থাকলে আজ জমিয়ে খাওয়া যেত। আসলে, ব্যাপারটাকে ঝামেলা বলেই ভাবতে পারছেন না সুহৃদবাবু। তাই নীলিমার অনুযোগ সত্ত্বেও খুব বেশি ভাত খেলেন না তিনি। নীলিমা নিজে কোনওদিনই খুব বেশি খাননা। বিশেষ করে এই পঞ্চাশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এখন তিনি অত্যন্ত ফিগার সচেতন। তাই স্বামীকে খাইয়েই যতটুকু আনন্দ পান। সুহৃদবাবু নিজেও যথেষ্ট স্বাস্থ্যসচেতন। তবু তিনি এককালে খাইয়ে লোক ছিলেন, এবং এখনও প্রিয় খাদ্য পেলে মাঝেমধ্যে একটু অতিভোজন করে ফেলেন।

আজ তিনি সেটা করলেন না। আজকের দুপুরটা কোনওমতেই নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। বাড়িতে আজ দুপুর থেকে নীলিমার এন.জি.ও’র মীটিং আছে। নারীকল্যানব্রতী সংস্থাটি নীলিমা অতি দক্ষভাবে পরিচালনা করেন। সেই মীটিং-এর জমায়েত শুরু হওয়ার আগেই সুহৃদবাবু বেরিয়ে পড়লেন, এবং ঝকঝকে নতুন সেডানটি চেপে সোজা অফিসে এসে উপস্থিত হলেন। গেটে সিকিউরিটির থেকে খবর নিলেন, স্বপ্না সেই দশটা থেকে এসে বসে আছে। সিকিউরিটিকে বলে দিলেন, কাউকে যেন এখন অফিসে ঢুকতে দেওয়া না হয়।

স্বপ্না মাস দুয়েক হলো চাকরিটা জয়েন করেছে। বছর পঁচিশেক বয়স। খুব যে সুশ্রী, তা নয়। কিন্তু একটা চটক আছে। বেশ স্বাস্থ্যবতী, ভারভার্তিক চেহারা। ঠিক যেমনটা সুহৃদবাবুর পছন্দ। আর মেয়েটাও মনে হয় বেশ সাহসী। চোখে বেশ বিদ্যুৎ খেলে। আগের মেয়েটার মতন ম্যাড়ম্যাড়ে, ঘ্যানঘ্যানে নয়। ওরকম মেয়ে সুহৃদবাবুর একদম পছন্দ নয়। সুন্দরী দেখে নিয়ে ফেলে ভুল করেছিলেন। আজকালকার মেয়ে হবে আউটগোয়িং, সেক্সি। কেরিয়রে উন্নতি করার জন্য কোনও কিছুতেই পিছ্পা হবেনা। তবে না নতুন যুগের স্বাধীনচেতা নারী!

সন্ধ্যের মুখে যখন সুহৃদবাবু অফিস থেকে বেরোলেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ পরিতৃপ্ত। মুখে একটি স্বর্গীয় হাসি লেগে আছে। অনেকদিন পর আজ নিজের সমগ্র শরীরটাকে, তার সজীবতাকে অনুভব করেছেন। স্বপ্না তুলনাহীনা! কালিদাস, বা নিদেনপক্ষে জয়দেব গোস্বামী পড়া থাকলে সুহৃদবাবু হয়তো রতিচতুরা বা রমণকুশলিনী গোছের বিশেষণ ব্যবহার করে ফেলতেন মেয়েটার জন্য। মোটের উপর, সুহৃদবাবু তাঁর নতুন সেক্রেটারি নিয়োগের সার্থকতায় মহা খুশি!

অফিস থেকে বেরিয়ে সুহৃদবাবু চলে এলেন পার্টি অফিসে। সেখানে আজ আসন্ন পৌরসভা নির্বাচন নিয়ে জরুরি মীটিং। যদিও সুহৃদ বন্দ্যোপাধ্যায় যে জিতবেন তাই নিয়ে বিশেষ সংশয় নেই কারও, তবু বিরোধী দলকে হাল্কাভাবে নিলে চলবে না। দেশের অন্যান্য রাজ্যে ওরা বেশ জাঁকিয়ে বসছে। এখানে সেটা মোটেই হতে দেওয়া যাবে না। এ রাজ্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নিরপেক্ষ। এখানকার প্রশাসন শুধুমাত্র মানবকল্যানে বিশ্বাসী। কোনওরকম সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এরাজ্যে ঘাঁটি গাড়তে দেওয়া হবে না। তাই ইলেকশন ক্যাম্পেনের পরিকল্পনাটা ভালো করে করতে হবে।

সে সব করে পার্টি অফিস থেকে বেরোতে বেরোতে প্রায় ন’টা বাজলো সুহৃদবাবুর। বাড়ির পথে যেতে যেতে তেমাথার মোড়ে ড্রাইভারকে বললেন গাড়িটা দাঁড় করাতে। গাড়ি থেকে নেমে কালী মন্দিরের দিকে এগোলেন। বড় জাগ্রত দেবী! আজকের এমন সফল, সুন্দর দিনটায় কি তাঁকে প্রণাম না করে যাওয়া যায়? ভক্তিভরে নিকষকৃষ্ণ দেবীমূর্তিকে প্রণাম করলেন প্রগতিশীল রাজনীতির প্রতিনিধি পৌরপিতা সুহৃদ বন্দ্যোপাধ্যায়, এবং একটি কড়কড়ে পাঁচশো’ টাকার নোট প্রণামীর থালায় রেখে দিলেন গাড়িতে ফিরে আসার আগে।

3 comments:

0

প্রবন্ধঃ অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য

Posted in


প্রবন্ধ




পর্ন বনাম ইরোটিকা -সঙ্গে হ্যাকটিভিজম (hactivism)
অরূপ জ্যোতি ভট্টাচার্য



কিছুদিন ধরে ফেইসবুক খুললেই বেশ কিছু জোক চোখে পড়ছে। প্রসঙ্গ, পর্ন সাইট নিষিদ্ধিকরণ। পর্ন সাইট বন্ধ হয়ে যেতে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলেরা নাকি ম্যাগি খেয়ে সুইসাইড করেছে! এরকম অনেক জোকই স্থান পাচ্ছে সোশ্যাল নেটওয়র্কিং সাইটটিতে। আমাদের দেশে দুটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় চলছে। উত্তরপ্রদেশে অনাবৃষ্টি আর বাকি সর্বত্র অতিবৃষ্টি। বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশুর আনমনে খেলে চলার মাঝে ভারত সরকারের পর্ন সাইট ব্যান। এ যেন আগুনে ঘৃতাহুতি। বিভিন্ন পত্র পত্রিকাতে নামকরাসোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্টরা পক্ষে বিপক্ষে মত দিচ্ছেন। ৮ই আগস্টটাইমস অফ ইন্ডিয়াতে এডিটোরিয়াল পেজে বেশ ভালো দুটি আর্টিকল পড়লাম। সাথে চোখে পড়ল বেশ কিছু স্ট্যাটিসটিক্স। তার মধ্যে বেশ কিছু তথ্য চমকপ্রদ।আমেরিকা বা ইউরোপের মত এত সেক্স ফ্রি দেশেও পুরুষ কি মহিলা, আট থেকে আশি, পর্ন সাইট অ্যাক্সেস করে। পার্লামেন্ট মেম্বার, ভারত-ব্রিটেন নির্বিশেষে, পর্ন সাইট দেখে। পার্লামেন্ট‌-এর ভেতরে কি বাইরে। পর্ন সাইট নিষিদ্ধ হলে শুধু ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তার নয় –সাইন্স, আর্টস, কমার্স কোনো ছাত্রই খুশি নয়। সেই সাথে আর একটা বিতর্ক উঠে আসছে পর্ন নয়, ইরোটিকা চাই। সাথে প্রশ্ন উঠছে ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রাথমিক অধিকার কি না, তাই নিয়ে। বিষয়টা একটু আলোচনার অবকাশ রাখে।

ভারতীয় সংবিধানের একুশ নং ধারায় বলা আছে সমস্ত মানুষেরই একটা ব্যক্তি স্বাধীনতা আছে। যেটাকে তার মৌলিক অধিকারও বলা যায়। তাই সুপ্রিম কোর্টএই পর্ন সাইট নিষিদ্ধিকরণ সমর্থন করে না। ভারত সরকারকেও ভাবতে হয়েছে। শুধু অপ্রাপ্তবয়স্ক পর্ন সাইটই ব্যান করা হবে। এটা নিঃসন্দেহে সমর্থনযোগ্য। সংবিধান সিদ্ধ।ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক দায়িত্ব এগুলি বর্জন করা। অপ্রাপ্তবয়স্ক পর্ন সাইট নিষিদ্ধ হওয়া আবশ্যক। তবে অ্যাডাল্ট সাইট গ্রহণযোগ্য। ভারতীয় সংস্কৃতি, কাম তথা সেক্স কে অসমর্থন করে না।ঋক বেদের দশম অধ্যায়ে বলা আছে, কাম বা সেক্স ইউনিভার্স এর অন্তরঙ্গ অংশ। কামদেবের পঞ্চশরের পীড়ায় স্বয়ং মহাদেবও পার্বতীর যৌবন রসের জারণে কামতাড়িত হন। তাই মহাদেবের তৃতীয় নেত্র কামদেবকে ভস্ম করে দিলেও পরে প্রাণ ফিরিয়ে দেন। কাম আর রতি স্বামী স্ত্রী। বাস্তবে কাম আর রতি যেন সহধর্মাবলম্বী।

কাম আর শিল্প দীর্ঘকালের বন্ধু। বেসিক ইনস্টিনক্ট সিনেমাতে শ্যারন স্টোনের ইন্টারভিউ সারা বিশ্বকে অলোড়িত করেছিল। ক্রস লেগ দৃষ্টি টেনেছিল সবার। সাথে সেই "ইট ইজ নাইস" যুগান্তকারী ডায়লগ! ক্যামেরাতে ধরা না দিয়েও কামনার গোপন ত্রিভুজের পরিমিতি। শিল্পে যৌনতা, সেক্স, কাম এগুলো একটা গ্রিক শব্দকে নির্দেশ করে।যাকে পরিভাষায় বলে ইরোটিকা। যেখানে সেক্স শিল্পের ছন্দ পায়।তা সে স্থাপত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নাটক, সিনেমা যাই হোক। যেখানে আছে ভাবের সাথে রসের পর্যায়ক্রমিক রূপান্তর। তাই ইরোটিকা শিল্পের পরিভাষায় সংস্কৃতি সম্পন্ন। গ্রহণযোগ্য। এর সাথে আর এক শ্রেনীর সিনেমা হয়। যেগুলো তিনটি X লেটার দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।যেখানে শিল্প নয়, যৌনতাটাই গুরুত্ব পায়। চার দেওয়ালের মধ্যে ঘটা অন্তরঙ্গ ব্যাপারগুলি বেরিয়ে আসে দেয়ালের বাইরে। আর সেখানেই বিতর্ক। যাকে বলা হয় পর্নোগ্রাফি, সংক্ষেপে পর্ন। সমর্থন, অসমর্থন, আইনি বৈধতা, অবৈধতা সব উপেক্ষা করে তৈরী হয় মিলিয়ন মিলিয়ন পর্নমুভি। বিতর্ক ওঠে পর্নস্টারের সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে। 

এই তর্ক বিতর্কের মাঝে ২২শে শ্রাবণ। ইংলিশ সাল তারিখকে স্বমহিমায় উপেক্ষা করে যে হাতে গোণা ক’টি বাংলা তিথি, তার মধ্যে অন্যতম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মনে পড়ে যায় ক্লাস টেন-এর ভাব সম্প্রসারণ- দ্বার বন্ধ করে দিয়ে ভ্রমটারে রুখি, সত্য বলে আমি তবে কোথা দিয়ে ঢুকি? প্রসঙ্গ পর্ন মুভি। এটা ঠিক, যে ক্রমবর্ধমান পর্ন মুভির চাহিদা জন্ম দিয়েছে MMS লিকের মত ক্রাইম এর। বাড়িয়ে দিয়েছে হ্যাকিং। যেটা একপ্রকার সাইবার ক্রাইম। আর সেই ক্রাইম নিয়ে সচেতন করতে এসেছে হ্যাকটিভিস্ট। হ্যাকটিভিজম নামটা চমকপ্রদ। শব্দটা জন্ম নিয়েছে 1994 সালে। অক্সফোর্ড ডিক্শনারী তে সপ্তম এডিশনে শব্দটা দেখতে পেলাম না। নতুন এডিশনে নিশ্চয়ই স্থান পেয়ে গেছে। হ্যাকটিভিজম একটা পলিটিকাল চেতনা, যেটা হ্যাকিং এর সম্ভাবনা বিষয়ে সাবধানতা জানায়। কোড, ওয়েবসাইট মিররিং, জিও বম্বিং, এগুলো সবই ওই হ্যাকটিভিজম এর আওতায় পড়ে। তাই ভ্রম আর সত্য যখন একই দরজা দিয়ে আসে তখন পর্ন মুভি ব্যান করলে হয়ত কোনো সত্যের রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে। যেটা হয়ত আজ চোখে পড়ছে না, কিন্তু পড়বে ভবিষ্যতে।

0 comments:

1

প্রবন্ধঃ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

Posted in





প্রবন্ধ




বৃহন্নলা, তৃতীয় লিঙ্গ এবং আমাদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 



নারী না পুরুষ? এই প্রশ্নবৃত্তের বাইরে আমাদের মানুষ হয়ে ওঠার কোন চেনা গল্প নেই। যদিও বা থাকে তা কেন্দ্রচ্যূত, বিধ্বস্ত এবং ধ্বংসচিত্রের মত ম্লান এবং খণ্ডিত। ক্রমশ দলদাসের মত হয়ে যাচ্ছে মানুষের সামাজিক পরিসর। হয়ে যাচ্ছে শব্দটাও বোধ হয় ঠিক নয়। ছিলই। ইতিহাস পুরাণ তার সাক্ষ্য বহন করে। চেতনা বাড়ছে। জ্ঞানতাত্বিক পক্রিয়ার প্রতিদিন নবায়মান হচ্ছে আমাদের চেতনা। কিন্তু আমরা মানুষ হয়ে উঠছি কতদূর? শোচনীয় কালের দুর্বিপাক বলে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ছি আবার। চিন্তা বিশ্বাসের জায়গা থেকে ক্রিয়াকলাপের দুনিয়া – ব্যবধান দুস্তর। অন্তর্ঘাত দেখতে দেখতে হারিয়ে যাচ্ছে যুক্তিবাদের সম্ভাবনা ঋদ্ধ পরিমণ্ডল।

বৃহন্নলা – কীভাবে দেখছি এদের? একজন মানুষ হিসেবে? সমাজের অধিবাসী হিসেবে? না কি প্রান্তবাসী বা নিছকই দ্রষ্টব্য কিছু? আসলে যৌন পরিচয়ের বাইরে আমাদের কোন পরিচয় নেই – এই চর্চার মধ্যেই আমাদের বেড়ে ওঠা, আমাদের সামাজিক চোখের প্রসারণশীলতা। এখন প্রশ্ন হল কাদের আমরা বৃহন্নলা বলব? ক্রোমোজোম বা হরমোনে ত্রুটি বা মানসিক কারণে লিঙ্গ পরিচয় নির্ণয়ে জটিলতা দেখা দিলে বা দৈহিক পরিচয়ের সাথে আচরণগত বৈসাদৃশ্য দেখা গেলে তাদের আমরা বৃহন্নলা হিসেবে চিহ্নিত করি। সচরাচর আমরা যাদের কিন্নর গোষ্ঠীভুক্ত মনে করি,তাদের মূলত হার্মফ্রোডাইট বা উভলিঙ্গ হিসেবে সূচিত করাই সমীচিন। এরা প্রধানত দুধরনেরঃ-

১) প্রকৃত উভলিঙ্গ ২) অপ্রকৃত উভলিঙ্গ। অপ্রকৃত উভলিঙ্গ আবার ছ'ভাগে বিভক্ত ১) কনজেনিটাল এড্রেনাল হাইপারপ্লাসিয়া ২) এন্ড্রোজেন ইনসেনসিটিভিটি সিনড্রোম ৩) গোনাডাল ডিসজেনেসিস ৪) হাইপোস্পাডিয়াস ৫) টার্নার সিনড্রোম(XO) ৬) ক্লাইনেফেলটার সিনড্রোম (XXX)।আপাতদৃষ্টিতে উভলিঙ্গত্বকে অপ্রাকৃত এবং অস্বাভাবিক মনে হলেও আমরা যদি ফিরে দেখি প্রাণীজগতের আদিপর্বের দিকে, তাহলে দেখতে পাব যে প্রোটোজোয়া, পরিফেরা, প্ল্যাটিহেলমিন্থিস,অ্যানালিডা, মোলাস্কা, কর্ডাটা পর্বের প্রাণীদের মধ্যে উভলিংগত্বের সহাবস্থান বিদ্যমান। সুতরাং বিষয়টি কোন অপ্রাকৃত ব্যাপার নয় বা নেচার একে সাপোর্ট করেনা এরকম ভেবে নেওয়ার সঙ্গত কোন কারণ নেই। তাই বৃহন্নলাদের ভিনগ্রহেরদ্রষ্টব্য কোন জীব বা সাধারণের চেয়ে অন্যকিছু ভেবে নেওয়ার মধ্যে বিকৃতিই আছে, যুক্তিসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নেই।

আমাদের দেশে জেন্ডার সম্পর্কিত ধারণা খুব অস্পষ্ট। প্রখ্যাত রূপান্তরকামী বিশেষজ্ঞ হেনরি বেঞ্জামিন কী বলেছিলেন দেখা যাক – Every Adam contains the element of Eve and Every Eve harbors traces of Adam physiologically as well as psychologically. এই পরিপ্রেক্ষিতে সেক্স এবং জেন্ডার শব্দদুটির মর্মার্থ অনুধাবন জরুরি। বাংলা ভাষায় লিঙ্গ শব্দটিই পরিপূরক শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেক্স শব্দের বাংলা তর্জমা লিঙ্গ হলেও জেন্ডার শব্দটির গ্রহণযোগ্য বাংলা প্রতিশব্দ সেভাবে পরিস্ফুটিত হয়নি। সেক্স একটি শারীরবৃত্তীয় ধারণা হলেও জেন্ডার হচ্ছে নারী ও পুরুষের সমাজ মনোবৃত্তিয় অবস্থান। ডঃ অভিজিৎ রায় যথার্থই বলেছেন – সেক্স দেহজ পরিকাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও জেন্ডার আমাদের নিয়ে যায় এক সাংস্কৃতিক নীলিমায়।

এটা বুঝতে হবে যে লিঙ্গ কোনোভাবেই একজন মানুষের মূল পরিচয় নয়। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা আসলে জন্মগতভাবে যৌন প্রতিবন্ধী। সেক্স ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে একটি শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণে কিছু জটিলতা তৈরি হয়। যেভাবে অনেক শিশুর হাত পা গঠিত হয়না।শারীরিক বিকাশ সম্ভব হয় না। না পুরুষ না নারী - তৃতীয় লিঙ্গ। একটি শিশু যখন ছেলে হয়ে জন্মাচ্ছে, সেক্ষেত্রে তার সেক্স ক্রোমোজোম – XY এবং যখন মেয়ে হয়ে জন্মাচ্ছে তখন তার সেক্স ক্রোমোজোম XX। মাতৃগর্ভে ভ্রূণ নিষিক্তিকরনের সময় বা বিভাজনকালে জেনেটিক্স এর কারনে সেক্স ক্রোমোজোমের ত্রুটির কারণে বা অন্যান্য কোন অজ্ঞাত কারণে কিছু অস্বাভাবিক সেক্স ক্রোমোজোম তৈরি হয়ে যায় অনেকানেক সময়, যেমন - XYY বা XXY। এই শিশুরা লিঙ্গের অসম্পূর্নতা ব্যতীত আর অন্যকোন ভাবেই অসম্পূর্ণ নয় মানুষ হিসেবে। প্রকৃতির খেয়ালিপনার জন্য তাদের এই অন্যভাবে গড়ে ওঠা।

এ তো গেল বিজ্ঞান ভিত্তিক বিষয়। কিন্তু আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে? কেমন হবে ব্যক্তিগত আচরণের জায়গা বা অবস্থান? লিঙ্গগত পরিচয়ের উপরে উঠে আদৌ কি সামাজিক হতে পারছি আমরা? অন্তত আমাদের এই উপমহাদেশের কাঠামোর মধ্যে? দ্বিধাহীন উত্তর নেতিবাচক। পশ্চিমেও যে অবস্থা খুব মানবিক তাও কিন্তু নয়। তবু সেখানে অনেক ব্যক্তিত্ব আছেন যাঁরা সামাজিক ভাবে উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতি, আইন, ব্যবসা থেকে শুরু করে শিক্ষাজগতে তাঁরা সম্ভ্রমের জায়গা আদায় করে নিতে পেরেছেন। এই জয় কে হয়তো সার্বিক বলা যাবে না।আংশিক হলেও তা অর্জন। ডোনাল্ড ম্যাকক্লসকি (Donald MCloskey) একজন ট্রান্সজেন্ডারযিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েরস্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক। শিকাগোর পোলিশ ভাইয়েরা Wachowski Brothers,যাঁদের নাম সারা দুনিয়া জানে Matrix Trilogy-র জন্য,তাঁরাও ট্রান্সজেন্ডার। এরকম উদাহরন আরও অনেক দেওয়া যেতে পারে। এতে কিন্তু এটা প্রমান করা যাবে না যে তাঁরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন না বা বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন না। হতেই পারে তাঁরা সামাজিক প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করে উঠে আসতে পেরেছেন। ভারতেও কম বেশি এ উদাহরণ আছে। কিন্তু আমাদের চারপাশের পৃথিবীতে এই দৃষ্টান্ত অপ্রতুল।

আমরা যে দুনিয়াটাকে প্রতিদিন দেখি, আমাদের নজরসীমার মধ্যে যে ভূমণ্ডল, সেখানে হিজড়া কালচার অত্যন্ত অমানবিক এবং বর্বর। বাবা মাও এক্ষেত্রে সমাজের ভয়ে যৌন বিকলাঙ্গ সন্তানকে গ্রহন করতে পারেন না। সমাজ ঘৃণা, করুণা আর অবজ্ঞার চোখে তাকাবে, এই আতঙ্কে। কোথাও বৃহন্নলার জন্ম হলে অন্তেবাসী হিজড়ারা এসে শিশুটিকে নিয়ে যায়।আবার কখনও কখনও পরিবারের মধ্যে বড় হতে হতেও পারিবারিক বা সামাজিক নিগ্রহের চাপে তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলি খুঁজে নেয় ভালোবাসার উষ্ণ আশ্রয়। নিরুপায় এই মানুষজনের সামনে এছাড়া আর কোন সোনালি আলোকরেখা নেই। বিয়েবাড়ি, বাসাবাড়ি থেকে চাঁদা তুলে, সন্তান জন্মালে সেই পরিবার থেকে গৃহীত চাঁদা এবং ট্রেনে বাসে ভিক্ষার মাধ্যমে এদের দিনাতিপাত। দৈনিক আয় এরা তুলে দেয় গুরুমার হাতে। লৈঙ্গিক বৈষম্যের এই ঘৃণার দীনতা আমরা কবে কাটিয়ে উঠতে পারব?

কী করবে এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠী? দীর্ঘ লড়াই এবং সংগ্রামী পথ চলার মধ্য দিয়ে তাদের যৌন পরিচয়ের আইনি স্বীকৃতি অর্জিত হয়েছে। ২০১৪ সালের ১৫ই এপ্রিল ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি কে এস রাধাকৃষ্ণাণ এবং এ কে সিক্রি’র ডিভিশন বেঞ্চ এই মর্মে রায় এবং নির্দেশ দেন যে – 

১) হিজড়া বা কিন্নরদের যৌনপরিচয় আজ থেকে আইনস্বীকৃত হল, অর্থাৎ যেকোন আবেদন পত্রে নারী পুরুষের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের পরিচিতিও বৈধ রূপ পেল।

২) কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারি চাকুরিতে তাদের জন্য সংরক্ষণের সুবিধা থাকবে।

৩) এই সংরক্ষণ ওবিসি দের সমান্তরাল হবে।

৪) এদের জন্য অফিসে, রেল স্টেশনে আলাদা শৌচাগারের ব্যবস্থা করতে হবে।

৫) সরকার জনসচেতনতা অভিযান প্রকল্পের মাধ্যমে বিষয়টি গুরুত্বসহ প্রচার করবে যাতে সমাজ তাদের নিচু চোখে না দেখে।

৬) ভোটার কার্ড এবং পাসপোর্টের ব্যবস্থা করতে হবে।

ট্রান্সজেন্ডার দের তরফে আইনজীবী সঞ্জীব ভাটনগর সেদিন এই রায়কে ঐতিহাসিক আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন- এর ফলে ১৫ লক্ষ মানুষের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল। এশিয়া প্যসিফিক ট্রান্সজেন্ডার নেটওয়ার্ক এর লক্ষী নারায়ন ত্রিপাঠীর বক্তব্য ছিল- অবশেষে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা মানবাধিকার অর্জন করল। আর যিনি দীর্ঘদিন ধরে তৃতীয় লিঙ্গের সামাজিক ও আইনি অধিকার নিয়ে গবেষণা করছেন, সেই শ্রদ্ধেয় ডঃ স্মরজিত জানাও খুশি হয়েছিলেন। পাশাপাশি তিনি এও বলেছিলেন, যে এই অধিকারের প্রশ্নে তামিলনাড়ু অনেক এগিয়ে আছে। এখানে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলি নিজেদের জন্য আলাদা বোর্ড গঠন করতে পেরেছে।

এখানেই কি দুর্গ জয় শেষ হয়ে গেল? যতদিন না অর্থনৈতিক সামাজিক অধিকার কায়েম করা যাচ্ছে ততদিন যে তিমিরে তারা ছিল সেই তিমিরেই থাকবে তাদের অবস্থান। মূলস্রোতে ফেরা তো দূরের কথা, মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে না এই প্রান্তিক মানুষগুলি। কলোনিজীবন চলতেই থাকবে।

বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ আইনের দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির পর্যালোচনা করলেই তো হবেনা। দেখতে হবে সামাজিক এবং মানবিক চিন্তন সহকারে। শুরু করেছিলাম যে কথাগুলো দিয়ে আবার সেখানেই ফিরে আসছি। নারী না পুরুষ, এর বাইরে আমাদের মানুষ হয়ে ওঠার কোন সচেতন প্রয়াস নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও কি প্রকারান্তরে এই ধারনাকেই লালন পালন করেনা? বিচ্ছিন্নকরণের অচলায়তন কখনোই রসে ভরা ফল বাসে ভরা ফুল সুস্নিগ্ধ মাটি সুধাসম জলে সকলের সম অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করতে দেয়নি। আইনি স্বীকৃতি অবশ্যই একটি দৃঢ় অর্জন। কিন্তু পাশাপাশি সামাজিক দৃষ্টিদুনিয়ার প্রসার না ঘটলে আমাদের অগ্রসারণ কতদূর?তাই সামাজিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মানবিক চেতনার বিকাশ ঘটিয়ে এক সুন্দর বৈষম্যহীন ভাবনার আলোকে প্রাণের চর্চার মাধ্যমে বিশুদ্ধ করতে হবে আমাদের বিবেক।

1 comments:

4

প্রবন্ধঃ রিয়া চক্রবর্তী

Posted in


প্রবন্ধ




পাল যুগের শিল্প
রিয়া চক্রবর্তী



ভারতীয় ভাস্কর্য‌-চিত্র কলার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে গুপ্তসম্রাটদের শাসন কালে, অর্থাৎ ৩২০ থেকে ৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ বা তার কাছাকাছি সময়ে। এই সময়টিকে ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসে মার্গ যুগ বা ক্ল্যাসিকাল যুগ বলে ধরা হয়। এই সময়ে ভারতীয় চিত্রকলা যে কতখানি উন্নত হয়েছিল তার প্রমান আমরা পাই বাঘ, অজন্তা ও বাদামীর গুহাচিত্রে। এই গুহাচিত্রগুলিকে শিল্প ঐতিহাসিকরা মার্গ চিত্রকলা বলে অভিহিত করেছেন।

ভারতীয় মার্গরীতির চিত্রকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তার প্রবহমান নিরবচ্ছিন্ন ছন্দোময় রেখা ও বর্ণের ব্যবহারে পরিপূর্ণ রূপসৃষ্টি। গুপ্তযুগের এই রূপাদর্শ পরবর্তীকালে ভারতীয় কলাশিল্পের বিকাশে এক চিরায়ত আদর্শ হিসেবে গৃহীত হয়েছে।

এই মার্গ রূপকলার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল রং ও রেখার পরিপূর্ণ অলংকরণে শিল্পের সৃষ্টি। আবার প্রাক মধ্যযুগের ভারতে প্রধানত এই আদর্শের অনুবর্তন দেখা যায় তার ভাস্কর্যশিল্পে।

কিন্তু এই সময় আবার অন্য এক চিত্ররীতির বিকাশ ঘটে, যে রীতিকে শিল্পৈতিহাসিকগণ ‘মধ্যযুগীয় চিত্ররীতি' বলে অভিহিত করেছেন। এই চিত্ররীতির লক্ষণ হল ডৌলবিহীন তীক্ষ্ণ রেখা এবং অলঙ্করণহীন সমতল রঙের প্রলেপ।

এই রীতির চিত্র আমরা দেখতে পাই ইলোরার প্রাচীরচিত্রে।

গুপ্ত যুগের পরবর্তী কালে পাল রাজাদের আমলে এই চিত্রশিল্পের আরও বিকাশ ঘটে। শিল্পী ধীমান ও বিটপাল ভারতীয় মার্গরীতিকেই পুণঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। কেননা তারনাথ তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ধীমান তাঁর শিল্পরীতিতে ছিলেন ‘নাগ’ শিল্পের অনুগামী। আর ‘নাগ’ পদবীধারী রাজাদের শাসিত মথুরা ছিল এই মার্গ রীতির আদি কেন্দ্র। তবে আনুমানিক নবম শতাব্দী থেকে যে সব প্রস্তর ও ধাতুমূর্তির আবিষ্কার হয়েছে পাল শাসিত পূর্ব ভারতে, সেগুলি যে গুপ্ত কালীন আদর্শেই রূপায়িত তা নিয়ে দ্বিমত নেই কারো।

পাল যুগের অধিকাংশ চিত্রিত পাতার পুঁথিগুলির মধ্যে অজন্তা ও বাঘের প্রভাব দেখা যায়। বুদ্ধের জীবনের ঘটনা নিয়ে আঁকা পাল পুঁথিচিত্রের মধ্যেও অজন্তার ও বাঘের গুহা চিত্রের রূপ দেখতে পাই।

এই পাল পুঁথিচিত্রের ‘মধ্যযুগীয়’ রীতির প্রথম সাক্ষাৎ মেলে মহীপালদেবের সময় রচিত মহাযান গ্রন্থ ‘অষ্টসাহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতায়’। এই গ্রন্থ এখনও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সযত্নে রক্ষিত আছে। এই গ্রন্থে পনেরোটি চিত্র পরীক্ষা করলে সহজেই জানা যায় পশ্চিম ভারতের জৈন পুঁথিচিত্রের বিশেষ চরিত্রগুলির লক্ষণগুলি। যেমন দ্বিমাত্রিক রূপসংস্থান, তরল পীতবর্ণের প্রলেপন, এবং তীক্ষ্ণ রেখার অলঙ্করণহীন প্রয়োগ।

কিন্তু অনেকে আবার এই মহীপালদেবকে দ্বিতীয় মহীপাল দেব বলে মনে করেছেন। এই দ্বিতীয় মহীপালদেবের রাজত্বকাল ছিল সংক্ষিপ্ত। তাছাড়া বজ্রযান মতের ‘পঞ্চরক্ষা’, ‘কারণ্ডব্যূহ’,‘কালচক্রযান’ প্রমুখ গ্রন্থের প্রমান পাওয়া যায়। যা প্রণিধানযোগ্য, তা হল পুঁথির গ্রন্থ ও চিত্রের মধ্যে কোন সম্পর্কের অভাব। অর্থাৎ, চিত্রের গ্রন্থগুলি চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে নয়, বরং স্বমহিমায় স্বতন্ত্রসত্তায় ছিল বিরাজমান। পুঁথি নির্বিশেষে চিত্রের বিষয় হল গৌতম বুদ্ধের জীবনের প্রধান আটটি ঘটনা আর মহাযান–বজ্রযান সম্মত দেবদেবীর প্রতিকৃতি।

দেবদেবীর মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছেন প্রজ্ঞাপারমিতা, তারা, লোকনাথ, মৈত্রেয়, মহাকাল, বজ্রপাণি, বসুধারা, কুরুকুল্লা, চুন্দা, বজ্রসত্ত্ব, মঞ্জুঘোষ, প্রমুখ। একাদশ শতকের শেষ থেকে দ্বাদশ শতকের প্রথম দিক পর্যন্ত সময় রামপালদেবের রাজত্বকাল। এই সময়ে যে সাতখানি পুঁথিতে বহু দেবদেবীর চিত্র অঙ্কিত হয়েছিল তার সবকটিই মার্গরীতি অনুযায়ী, অলঙ্করণযুক্ত, রং ও রেখায় রূপায়িত।

পরবর্তীতে পালশাসনের অবসানের পরে, অর্থাৎ দ্বাদশ শতকের অন্তিমকালে পূর্ব ভারতে এই ‘মধ্যযুগীয়’ রীতি বেশ কিছুটা ছাপ ফেলেছিল। আমরা তিনটি সুত্র থেকে এর প্রমান পাই। ১) বাংলায় আবিষ্কৃত তিনটি তাম্রপট্টে উৎকীর্ণ রেখাচিত্রে। ২) বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দিরে মেঝের প্রস্তরফলকের রেখা চিত্রে। ৩) পাল পরবর্তীকালের তিনটি পুঁথিচিত্রে।

প্রথম মহীপালের সময় থেকে রামপালের সময় পর্যন্ত পালচিত্রকলার দুই ধারার প্রভাব অনেক ক্ষেত্রেই সুস্পষ্ট। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে স্বল্প সংখ্যক ছবি হলেও স্বতন্ত্র এক চিত্ররীতির ধারা পাওয়া যায় পালযুগের চিত্র কলায়। তবে পাল চিত্রকলার অস্তিত্ব এখন আর পুঁথি নির্ভর নয়। কয়েক বছর আগে নালন্দার সরাই ঢিবি খনন করে যে বৌদ্ধমন্দিরটির নিম্নভাগ আবিষ্কৃত হয়েছে, তার ভিতরে পাল যুগের আঁকা ভিত্তিচিত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে।

কালের বিপর্যয়ে এই চিত্রের যে সামান্য অংশটুকু টিঁকে আছে, তা হল মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরের দেওয়ালে অঙ্কিত ফুল, লতা, পাতা, চলমান হাতি ও বৌদ্ধ দেবতা কুবের। ছবিগুলি ছিল বহুবর্ণের। কিন্তু এখন আর তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। ফলে এই ছবিগুলির শৈলী বিচার পুরোপুরি করা সম্ভব নয়। তবুও ছবিগুলির যতটুকু আদল দেখতে পাওয়া যায়, তা থেকে নিঃসন্দেহেই বলা যায় যে এই ভিত্তিচিত্র পাল আমলের পুঁথিচিত্রের এক অমূল্য শৈলীর অভিব্যক্তি।

4 comments:

1

প্রবন্ধঃ অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

Posted in


প্রবন্ধ




অমরত্বের সন্ধান 
অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী 



বর্তমান নিবন্ধের বিষয়বস্তু দর্শন নয়, বিজ্ঞান। এই নিবন্ধকারের উদ্দেশ্য, জীব মাত্রেই নশ্বর – এই আপাতসত্য বাক্যটির অসারতা প্রতিপন্ন করা। তবে আগেভাগেই জানিয়ে রাখি যে সাদাসাপটা তথ্য-সমাহারে প্রস্তুত বিজ্ঞান-বিষয়ক এই আলোচনার উপসংহারে যদি কোন পাঠক উচ্চমার্গীয় দর্শনের চকিত বিভা আবিষ্কার করেন, সেই বিভ্রান্তির দায় এই নিবন্ধকারের নয়। 

আলোচনার সুবিধের জন্যে প্রবন্ধটিকে আমি দুটি অংশে ভাগ করে নিচ্ছি। প্রথম অংশেপ্রকাশ্য অমরতা, দ্বিতীয় অংশে সঙ্গোপন অমরতা। 



প্রকাশ্য অমরতা

দেবতারা অমৃতের সন্ধানে সমুদ্র মন্থন করেছিলেন। বৃথা হয়নি সেই মন্থন। তাঁরা অমৃত আহরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার সঙ্গে আশ্লিষ্ট পাপের মতো হলাহলও উঠে এসেছিল। সেটিকে মহেশ্বরের গলায় গুঁজে দিয়ে অমৃতটুকু পান করে দেবতারা সব অমর হলেন। ভারতীয় পুরাণের এই আখ্যান বহুল প্রচারিত। বেশির ভাগ মানুষই এটিকে মিথ বা কিংবদন্তী হিসেবে গণ্য করেন। এই মিথটিকে সরল এক সত্যের প্রতীক হিসেবে বিজ্ঞানের আলোয় যাচাই করা বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের একটি প্রয়োজনীয় ধাপ। 

চতুর্দশ শতকের চিন্তাবিদ উইলিয়াম দ্য ওখাম একটি ল্যাটিন প্রবচনকে জনপ্রিয় করে তোলেন। প্রবচনটির বাংলা অর্থ হল – অনেক ব্যাখ্যার মধ্যে যে ব্যাখ্যাটি সব চাইতে সরল, সেটাই সত্যি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এই প্রবচনটিকে একটু ভিন্নভাবে বললে বলা যায় যে সরলতার মধ্যেই নিহিত থাকে সত্য। সমুদ্রমন্থন এমনই এক সরল সুন্দর আখ্যান যে বিশ্বাসে অথবা অবিশ্বাসে, যুগ যুগ ধরে মানুষ এই মিথটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এসেছে। 

এবার আদম ও ইভের আখ্যানটির কথা ভাবুন। যতদিন না পর্যন্ত জ্ঞানবৃক্ষের ফলটি তাঁরা ভক্ষণ করেছেন ততদিন পর্যন্ত তাঁরা অবিনশ্বর ছিলেন। ভক্ষণের পরই তাঁদের মধ্যে যৌনতার উন্মেষঘটল, তাঁরা নশ্বরতায় আক্রান্ত হলেন। অর্থাৎ, জ্ঞানের প্রথম ধাপ যৌনতা। যৌনতার যে অপরিসীম জটিলতা ও আনন্দ তা আসলে জ্ঞানের চূড়ান্ত জটিলতা ও আনন্দেরই প্রথম প্রকাশ। এই জটিলতাটুকু পরিহার করতে পারলে আমরা প্রাণের সমস্ত রূপের মধ্যেই অমরতাকে চিহ্নিত করতে পারব। 

একটি সহজ ও সরল তথ্য এই যে পৃথিবীতে অমর জীবের সংখ্যা নেহাৎ নগণ্য নয়। অথচ এই নগ্ন সত্যটিকে চোখের সামনে দেখেও সে ব্যাপারে আমরা সচেতন নই। এই সব অমর প্রাণীদের মধ্যে অগ্রগণ্য যেটি, সেটি যৌনতাকে সম্পূর্ণত পরিহার করে চলে। এই প্রাণীটি হল জলচর অ্যামিবা। জীববিজ্ঞানের স্কুলপাঠ্য বই খুললে যে কেউই এর পরিচয় পেয়ে যাবেন। বৈজ্ঞানিক নাম ‘অ্যামিবা প্রোটিয়াস’। ঝিল্লি দিয়ে ঘেরা প্রোটোপ্লাজমের একটি মণ্ড। হাড়গোড় নেই, মস্তিষ্ক নেই; স্নায়ুতন্ত্র ও ইন্দ্রিয়হীন অতীব সরল একটি এককোষী জীব। চলনের সময় এরা শরীরের খানিকটা অংশ প্রসারিত করে ছদ্মপদ বানিয়ে নেয়, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণু খেয়ে জীবনধারণ করে। 

প্রাণীজগতের প্রেমহীন প্রজননের সরলতম পদ্ধতিটি অনুসরণ করে এরা। জীবনের কোন একটা সময়ে এই প্রাণীটি প্রথমে গোলাকার রূপ ধারণ করে। তারপর এর নিউক্লিয়াসটি দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। দু’টি ভাগই পরস্পরের বিপরীত দিকে সরতে সরতে একসময় কোষটিও দ্বিখণ্ডিত হয়ে যায়। দু’টি কোষই একটি করে স্বতন্ত্র নিউক্লিয়াস নিয়ে দু’টি আলাদা অ্যামিবাতে পরিণত হয়। অর্থাৎ, পুরনো অ্যামিবাটির থেকে যে দু’টি নতুন প্রাণীর জন্ম হল, সেগুলি অর্ধেক নতুন আর অর্ধেক পুরাতন। এভাবেই পুরনো অ্যামিবাটি মৃত্যুঞ্জয়ী হয়ে থেকে যায়। বিগত শতকের প্রথমার্ধেই জীববিজ্ঞানীরা বলেছিলেন যে অ্যামিবা সত্যি সত্যিই অমরত্বের অধিকারী। অথচ অ্যামিবার এই প্রকাশ্য অমরতা সত্ত্বেও আমরা আজও অমরত্বকে অলীক বলে মনে করি। 

অ্যামিবা ছাড়াও আরও কিছু সামুদ্রিক প্রাণী অযৌন বিভাজন পদ্ধতিতে বংশবৃদ্ধি করে। ডেনমার্কের জীববিজ্ঞানী, ডঃ মর্টেনসেন এই সব জীবদের নিয়ে সারা জীবন গবেষণা করে গেছেন।

এইসব প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সি আর্চিন, স্টারফিশ এবং ব্রিট্‌লস্টার। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি সমুদ্রশৈলে ডঃ মর্টেনসেন দেখেছিলেন অসংখ্য ব্রিট্‌লস্টার। প্রথম যে ব্রিট্‌লস্টার থেকে দ্বিবিভাজন পদ্ধতিতে তাদের এই বংশবৃদ্ধি ঘটেছিল, ডঃ মর্টেনসেন সেটিকে তখনও জীবিত দেখেছিলেন। আরও কিছু সামুদ্রিক প্রাণী আছে যারা উদ্ভিদের মতো মুকুলন (budding) পদ্ধতিতে বংশ বিস্তার করে। এদের দেহের একটি অংশে প্রথমে একটি আব মতো জন্মায়। তারপর ধীরে ধীরে সেটি বড় হয় এবং একসময় পরিপূর্ণ একটি প্রাণী হয়ে মূল জীবের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে স্বতন্ত্র একটি প্রাণীতে পরিণত হয়। হাইড্রা, প্রবাল, সামুদ্রিক স্পঞ্জ প্রভৃতি প্রাণী এভাবেই বংশ বিস্তার করে। (গ্রীক পুরাণে হাইড্রার আখ্যান অনেকেই পড়ে থাকবেন। সেখানে সে এক বহুমুখী দানব। হারকিউলিস তার মাথাগুলি কেটে ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলি ফের গজিয়ে উঠছিল।) প্রবাল তো এভাবেই বংশবৃদ্ধি করতে করতে সমুদ্রে তৈরি করে প্রবাল প্রাচীর। তবে এই প্রাণীগুলির বিশেষত্ব হল যে এদের মধ্যে পুং-স্ত্রী ভেদ আছে এবং খাদ্যের জোগান কমে গেলে যৌনমিলনের মাধ্যমে ধীরেসুস্থে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে। অর্থাৎ, এরা পরিবেশের চাপে সরলতা ত্যাগ করে জটিলতা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সেই সঙ্গে বর্জিত হয় তাদের প্রকাশ্য অমরতা। 

দেবতাদের সমুদ্রমন্থনে উত্থিত যে অমৃত, তা আসলে তাঁদের সমুদ্র-গবেষণায় অযৌন প্রজননের দ্বিবিভাজনে নিহিত অমরত্বের জ্ঞানের প্রতীক। প্রতীক না ভেবে আখ্যানটিকে কেউ যদি বাস্তব বলে ধরে নেন, তাতেও অসুবিধে কিছু নেই। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা দাঁড়াল এরকম যে, দেবতারা যৌনমিলনের আনন্দ বিসর্জন দিয়ে অযৌন প্রজননের কৌশল রপ্ত করলেন। স্বর্গে নিষিদ্ধ হয়ে গেল যৌনতা। কয়েকজন যৌন-স্মৃতি ভারাক্রান্ত অসংযমী দেবতা ও অপ্সরা, যাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ইন্দ্র, মেনকা, উর্বশী, ইত্যাদি – তাঁরা মাঝে মাঝে মর্তে পাড়ি দিতেন সেই আনন্দ আস্বাদনের জন্যে। সেখানে পছন্দমত ঋষিপত্নী বা কন্যা এবং ঋষি খুঁজে নিয়ে তাদের ফুসলিয়ে (seduce) যৌনসম্ভোগ করতেন। সম্ভোগের ফলে সন্তানের জন্ম হলে তাকে মর্তে ফেলে রেখেই স্বর্গে ফিরে আসতেন এবং ফের অমরত্বে স্থিত হতেন। এসব গল্প সকলেরই জানা আছে। বিশদ বলে এই নিবন্ধের স্থূলতা বাড়িয়ে লাভ নেই। তবে মহেশ্বরের কথা একটু বলতেই হয়। তাঁর ব্যাপারটা একটু আলাদা। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই দেব-দেবী। তাঁদের দাম্পত্য-প্রেমও উদ্দাম। তাছাড়া, মহেশ্বর সমুদ্রমন্থনে উত্থিত গরল নিজের কণ্ঠে ধারণ করে দেবতাদের সমূহ উপকার করেছেন। তাই স্বর্গের সংবিধানে মহেশ্বর-পার্বতীকে হিমালয়ে গিয়ে প্রেম-সম্ভোগের বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়। মোটের ওপর, স্বর্গে কায়েম হল যৌন-জটিলতাহীন সরল জীবন। নতুন দেবতার জন্ম চিরকালের মতো বন্ধ হল। তবে তাঁদের সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটতে লাগল নিয়ন্ত্রিতভাবে অ্যামিবা-প্রবর্তিত দ্বিবিভাজনের মাধ্যমে রূপ পরিবর্তন করে। এই কারণেই আমরা একই দেবতাকে বহু রূপে দেখতে পাই। 

সরল থেকে জটিল, প্রকাশ্য থেকে সঙ্গোপনে যাওয়ার আগে পাঠকদের কমিক রিলিফ দেওয়ার উদ্দেশ্যে দেবতাদের নিয়ে একটু লঘু পরিহাস করার চেষ্টা করা গেল। ব্যর্থ এই চেষ্টার জন্যে আশা করি সিরিয়াস পাঠকেরা এই অধম নিবন্ধকারকে নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন। 



সঙ্গোপন অমরতা

অযৌন প্রজনন ত্যাগ করে উন্নত প্রাণীরা কেন যৌন প্রজননের জটিলতা গ্রহণ করল তার ব্যাখ্যা আছে ডারউইনের বিবর্তনবাদে। পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে বৈচিত্র্যের প্রয়োজন হয়। অযৌন প্রজননে যে বৃদ্ধি ঘটে তা বৈচিত্র্যহীন। যৌন প্রজননে দরকার হয় দু’টি স্বতন্ত্র প্রাণীর। তাদের ডিম্বাণু ও শুক্রাণুর মিলনে যে সব নতুন প্রাণীর জন্ম হয়, তাদের ক্রোমোজোমের অর্ধেক আসে জননীর কাছ থেকে, বাকি অর্ধেক জনকের কাছ থেকে। ফলে তাদের শরীরে দু’ধরনের জিনের সংমিশ্রণ ঘটে এবং এই গঠনবৈচিত্র্যই তাদের যোগায় পরিবর্তিত পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করার শক্তি। 

মানুষসহ অন্যান্য উন্নত প্রাণীরাও কেন অমরত্ব থেকে বঞ্চিত নয়, সেই ব্যাপারটাই এবার বোঝার চেষ্টা করা যাক। প্রাণীকুলে সর্বাধিক উন্নত ও জটিল হল মানুষ। অতএব মানুষকে ধরেই এই প্রতিপাদ্যটির দিকে এগোন যাক। সাধারণভাবে আমরা সবাই জানি যে বংশগতির একক হল জিন। এই জিন বংশানুক্রমে সমস্ত প্রাণীর উত্তরপুরুষে সঞ্চালিত হয়। কিন্তু জিন তো কোন স্বয়ংসম্পূর্ণ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নয়। মায়ের ডিম্বাণু ও বাবার শুক্রাণুর মিলনে সৃষ্টি হয় একটি ভ্রূণ। প্রাণীর দেহে যত জোড়া ক্রোমোজোম তার অর্ধেকের উৎস মা, বাকি অর্ধেকের বাবা। অতএব, সন্তানের জিন মা-বাবা দু’জনের বৈশিষ্ট্যের বাহক মাত্র, তাদের প্রতিরূপ নয়। মানবদেহে জিনের সংখ্যা কুড়ি হাজারের মতো। প্রতিটি জিনকে শনাক্ত করে মানব জিনোম মানচিত্রও তৈরি করে ফেলেছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু তার মধ্যে অতি অল্পসংখ্যক জিনের কার্যকারিতা জানতে পেরেছেন তাঁরা। সুতরাং, জিনের চরিত্র নিয়ে আলোচনায় ঢুকে লাভ নেই। জিনসহ জীবকোষের অজস্র উপাদানের প্রতিটি যে বিশেষ কৌশলে এমন জটিল জীবনকর্ম এত সুষ্ঠুভাবে নির্বাহ করে তা আজও গভীর রহস্যে ঢাকা। কিন্তু জীববিজ্ঞানের এ তাবৎ সবচেয়ে যুগান্তকারী যে আবিষ্কার তার মধ্যেই নিহিত আছে অমরত্বের চাবি। এই আবিষ্কারটি হল জিনের ক্ষমতার মূল রহস্য লুকিয়ে থাকে যে ডি এন এ-র মধ্যে, তার গঠন। 

১৯৫৩ সালে জেমস ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক এই অতুলনীয় কাজটি সম্পন্ন করেন। ওয়াটসনের দেওয়া নাম অনুসারে ডি এন এ অণুর গঠনটি ‘ডাবল হেলিক্স’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। এই অণুর মধ্যে থাকে দু’টি আলাদা আলাদা শিকল যারা পুরনো আমলের বাড়ির ঘোরানো লোহার সিঁড়ির মতো পাক খেয়ে খেয়ে ওপরে বা নীচে প্রসারিত হয়(চিত্র–১)। 

এই অতিকায় অণু নিজের মধ্যে অবিকল প্রতিরূপ তৈরির কৌশল বহন করে। ডাবল হেলিক্সের একটি শিকল অন্যটির প্রতিরূপ নয়, একে অন্যের অনুপূরক। একটি অন্যটির ছাঁচ। প্রতিরূপ তৈরি করার সময় একটি করে নতুন শিকল তার জন্মদাতা পুরনো ছাঁচের সঙ্গেই লেগে থাকে(চিত্র-২)। 

অর্থাৎ, প্রতিটি নতুনের মধ্যে থাকে ঠিক আধখানা পুরাতন আর আধখানা নতুন। প্রখ্যাত প্রাণরসায়নবিদ ডঃ তুষার চক্রবর্তী রহস্যের ছলে ডাবল হেলিক্স-কে বলেছেন কুলকুণ্ডলিনী। প্রাচীন তন্ত্রশাস্ত্রে সদাজাগ্রত কুলকুণ্ডলিনীর অসীম ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। রহস্যের ছলে বলা হলেও ডঃ চক্রবর্তীর এই উপমায় প্রাণের মূল এই ডাবল হেলিক্সের প্রতিরূপ তৈরি করার ক্ষমতায় এবং এই প্রতিরূপের ‘আধখানা নতুন ও আধখানা পুরাতন’ সূত্রের মধ্যে সঙ্গোপনে লুকিয়ে আছে মানুষের অমরত্বও। 

নাম-যশ-খ্যাতি অর্জন করে অমরত্ব লাভ করার বাসনায় যাঁরা আকুল, তাঁরা অতএব এই প্রবন্ধ পাঠ-শেষে আশা করি কিঞ্চিৎ মোহমুক্ত হবেন, কারণ তাঁদের শ্রেষ্ঠত্ব সত্ত্বেও রামা-শ্যামা-যদু-মধু দিনের শেষে ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’ শরীর থেকে শরীরে সঞ্চালিত করতে করতে তাঁদের সঙ্গে একাসনেই অমরত্বে সামিল হয়ে যাবে। 




তথ্যসূত্র ও ঋণস্বীকারঃ 

1. জিনঃ ভাবনা, দুর্ভাবনা জিনতত্ত্ব/সমাজ/ইতিহাস – তুষার চক্রবর্তী 

2. The Mating Game – Robert Burton 

3. Man and Animal – Yuri Dmitriyev

1 comments:

0

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রাচীন কথা




উত্তরাপথের পথে 
সৌরেন চট্টোপাধ্যায় 



= ৪র্থ পর্ব = 



ঈশান কোণে সূর্য উঠেছে। আর্যাবর্তের অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য স্থান্বীশ্বরের পুষ্পভূতি বংশের গৌরব আদিত্যভক্ত মহারাজ প্রভাকরবর্ধন প্রতিদিনের মতই সূর্যোদয়ের পূর্বেই স্নান সমাপন করে শুভ্র দুকূলপরিধান করে আদিত্যমন্ত্রে ইষ্টবন্দনা শেষ করেছেন। প্রাতঃকালীন আহারাদির পর তিনি তাঁর বক্ষাকাশের সূর্য-চন্দ্রসম দুই কুমারকে নিজের মন্দিরে ডেকে পাঠালেন। তাঁরা মহারাজের কক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন মহামাত্য ভণ্ডীও সেখানে উপস্থিত রয়েছেন। ভণ্ডী মহারাণী যশোবতীর ভাই বীর্যদ্রুমের পুত্র। আট বছর বয়স থেকে তিনি স্থান্বীশ্বরের রাজপুরীতে আছেন। এবং নিজের প্রতিভা, মেধা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতায় মহারাজের স্নেহধন্য ও প্রধান অমাত্য পদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রাজকুমারদের চেয়ে কয়েক বছরের বড় হলেও ভণ্ডী তাঁদের পরম মিত্রও বটে। 

দুই ভাই প্রণাম করে পিতৃদেবের পদতলে ধরাসন গ্রহন করলে পরম ভট্টারক মহারাজ সস্নেহে বললেন, ‘‘রাজ্য, হর্ষ, তোমরা দুজনেই স্বাবলম্বী হয়েছ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যতে তোমরা মণ্ডলেশ্বররূপে অবশ্যই পরিগণিত হবে। আজ তোমাদের রাজনীতি বিষয়ে কিছু আবশ্যিক শিক্ষা দেব, রাজকার্যকালে সেগুলি সর্বদা স্মরণ রেখো।’’

রাজ্য ও হর্ষ গভীর মনোযোগে বিচক্ষণ রাজনীতিজ্ঞ ও ভূয়োদর্শী পিতার অমৃতভাষণ শুনতে লাগলেন। 

‘‘রাজনীতিতে সর্বপ্রথম সপ্ত রাজ্যাঙ্গ। যেমন রাজা, অমাত্য, সুহৃৎ, ধনাগার, রাষ্ট্র, দূর্গ ও সেনা। আদেশ পালন করার মত যোগ্য কর্মবীর ভৃত্য পাওয়া দুষ্কর --- সদ্ভর্তা সুলভ, কিন্তু সদ্ভৃত্য দুর্লভ। 

প্রাজ্ঞে নিযোজ্যমানে হি সন্তি রাজ্ঞস্ত্রয়ো গুণাঃ,
যশঃ স্বগ্নির্বাসশ্চ বিপুলশ্চ ধনাগমঃ। 

(বিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ করলে রাজা তিনটি সুফল পেয়ে থাকেন – যশ, স্বর্গলাভ ও বিপুল সম্পদ।) 

আর সেই কারণেই আমি অনেক চিন্তা করে তোমাদের সাহচর্যের জন্য কুমারগুপ্ত ও মাধবগুপ্তকে আহ্বান করেছি। এই দুই ভাই বিদ্বান, বিচক্ষণ, নম্র এবং সাহসী। ধর্ম, অর্থ, কাম ও ভয় –-- এই চার উপাধায় তাঁরা পরীক্ষিত।’’

এই পর্যন্ত বলে মহারাজ কুমার ও মাধবকে নিয়ে আসার জন্য প্রতিহারকে আদেশ দিলেন। 

কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই দুই তরুণ যুবা ধীর পদক্ষেপে কক্ষে প্রবেশ করে দূর থেকেই মহারাজকে ভূমি স্পর্শ করে পঞ্চাঙ্গ প্রণাম করল। কুমারের বয়স অষ্টাদশ, রাজ্যর সমবয়সী। নাতিদীর্ঘ অথচ খর্বও বলা যায় না, গাত্রবর্ণ ঈষৎ শ্যাম, চোখে মুখে পরিপক্ক প্রতিভা ও মেধার ছাপ। মাধব ষোড়শবর্ষীয়, হর্ষর সমবয়স্ক। গৌরবর্ণ প্রাংশু দেহ, দুই চোখে অপার কৌতূহলের সঙ্গে রহস্য ও কৌতুকের চাঞ্চল্য। দুই ভাইয়ের দেহই অত্যন্ত সুগঠিত ও তারা যথেষ্ট শক্তিমানও বটে। 

রাজা তাদের দিকে স্নেহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘‘আজ থেকে তোমরা দুজনে অষ্টপ্রহরের অঙ্গরক্ষক হয়ে সর্বদা পুষ্পভূতি কুমারদের অনুবর্তন করবে, মনে রেখ, 

বৃত্তেন রক্ষ্যতে ধর্মো বিদ্যা যোগেন রক্ষ্যতে,

সুনীত্যা রক্ষ্যতে রাজা সদগৃহিণ্যা তথা কুলম।

( চরিত্র ধর্মকে রক্ষা করে, অভ্যাসই একমাত্র অধীত বিদ্যাকে রক্ষা করে। সুনিপুণ রাজনীতি রাজাকে রক্ষা করে, আর সুগৃহিণী বংশকে রক্ষা করে।) 

‘‘মহারাজের আদেশ শিরোধার্য’’ বলে দুই ভাই রাজা ও রাজকুমারদের প্রণাম জানালেন। মহারাজ প্রভাকর আশীষ জানিয়ে এরপর বললেন,‘‘বার্তাবহ মারফৎ খবর, বৈদেশিক হুণ দস্যুরা আর্যাবর্তের উত্তর প্রান্তে হিমালয়ের সানুদেশে পার্বত্য জনপদগুলিতে ঢুকে নিরীহ বাসিন্দাদের উপর যথেচ্ছ উৎপীড়ণ ও লুটতরাজ চালাচ্ছে। তাদের অত্যাচারে স্থানীয় প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে প্রাণ বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। আমি বহুবার অভিযান করে এই দুর্বৃত্তদের দেশ থেকে বিতাড়িত করলেও তারা বারংবার নতুন শক্তি সংগ্রহ করে অনুপ্রবেশ করছে। আমি চাই, তোমরা দুই ভাই রাজকটক নিয়ে হূণ দস্যুদের সমুচিত প্রতিবিধান করে জনপদবাসীদের সম্পদ ও সম্ভ্রম রক্ষা কর। যুবরাজ রাজ্যবর্ধন এই অভিযানের নেতৃত্ব দিক। মহামাত্য ভণ্ডী শত্রুর অবস্থান, শক্তি, রসদ ইত্যাদি সবকিছু কুমারদের বিশদ ভাবে বুঝিয়ে দাও। অহেতুক বিলম্বে শত্রু অধিকতর শক্তিমান হবে, সুতরাং কালবিলম্ব না করে যুদ্ধাভিযানের প্রস্তুতি নাও।’’

মহারাজের পদধূলি নিয়ে তাঁর আদেশ পালন করতে দৃঢ়সংকল্প হয়ে রাজকুমারদ্বয় অমাত্যদের সমভিব্যাহারে কক্ষ থেকে নির্গত হলেন। তিনদিনের মধ্যেই ভণ্ডীর তত্ত্বাবধানে সমস্ত আয়োজন সমাপ্ত করে রাজ্যবর্ধন বিজয়যাত্রায় বার হলেন। অনুজ হর্ষদেব ছাড়াও সঙ্গী হল স্থান্বীশ্বরের অনুরক্ত মহাসামন্ত সঙ্ঘ ও দুই সহস্র তুরঙ্গ-সৈন্য। 

দিনের তৃতীয় প্রহর অতিক্রান্ত হয়েছে। দিনপতি বিরোচনের বৈকালিক রশ্মিচ্ছটায় উপরের আকাশ যেন মরকত মণির মতন জাজ্বল্যমান। দিগন্তব্যাপী সম-বিষম প্রান্তর ও অরণ্যপথ উল্লঙ্ঘন করে ধূলি-ঘূর্ণিঝড়ের মতন একটি সৈন্যদল দ্রুত এগিয়ে চলেছে। পুরোভাগে নীলসিন্ধুবার রঙের একটি বৃহৎ অশ্বপৃষ্ঠে অষ্টাদশ বর্ষীয় তরুণ তেজস্বী মহাপরাক্রমশালী হূণবিজেতা মহারাজ প্রভাকরবর্ধনের জ্যেষ্ঠ পুত্র কুমার রাজ্যবর্ধন। তাঁর পাশে পাশে একটি শ্বেত অশ্বপৃষ্ঠে ষোড়শবর্ষীয় অনুজ হর্ষবর্ধন। দুই রাজকুমারের সঙ্গে তাঁদের দুই প্রিয় নিত্যসহচর অমাত্য কুমারগুপ্ত ও মাধবগুপ্ত। কিছুটা পিছনে ছুটে আসছে অজেয় অশ্বারোহীবাহিনী। 

কুমার রাজ্যবর্ধন কিছুদিন পূর্বেই যুবরাজের কবচ ধারণ করে যুবরাজপদে অভিষিক্ত হয়েছেন। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কুমার রাজ্যবর্ধন ক্ষত্রিয় কুলতিলক, পিতার মতই রণপ্রিয়। শৈশব থেকেই তিনি প্রথিতযশাঃ পিতা ছাড়াও বিখ্যাত সমর বিশারদদের কাছ থেকে বিভিন্ন অস্ত্রচলনা, অশ্বারোহণ, ব্যূহ রচনার কূট কৌশলের সঙ্গে সৈন্য পরিচালনার শিক্ষালাভ করেছেন। এই অষ্টাদশ বছরেই তার ব্যায়ামপুষ্ট নির্মেদ দেহটি যেন নববসন্তের সদ্য পত্রকুসুম অঙ্কুরিত সর্জবৃক্ষের ন্যায় ঋজু ও সতেজ। তাঁর প্রশস্ত বক্ষ, পেশল বাহু, সুগঠিত উরুদ্বয় ও ক্ষীণকটিতে যেন বিপুল শক্তি প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। কার্মুকের ন্যায় বক্র ও দীর্ঘ ভ্রুযুগল, ওষ্ঠ দৃঢ়বদ্ধ, দৃষ্টিতে সরলতার সঙ্গে প্রবল ব্যক্তিত্বের ছটা। সমস্ত দেহ জুড়ে নবযৌবনের লাবণ্য আর অপরিমেয় ক্ষাত্রতেজের দম্ভ ও চঞ্চলতা। অশ্বপৃষ্ঠে পঞ্চায়ুধ ছাড়াও শ্রীরাজ্যর কটিবন্ধে ত্রিশাঙ্গুলি পরিমাণ খরশান অসিপত্র। তুলনায় অনুজ হর্ষদেব অনেক চিন্তাশীল, শান্ত ও একটু ভাবুক প্রকৃতির। সুবিখ্যাত ক্ষত্রিয় বংশে জন্মের সুবাদে তিনিও অস্ত্রচালনায় যথেষ্ট দক্ষ, কিন্ত ভালবাসেন কাব্যগীতাদি ললিতকলার চর্চা। পৃষ্ঠদেশে ঝোলানো একটি ত্রিহস্ত পরিমাণ বীণযন্ত্র তাঁর নিত্যসঙ্গী। যুদ্ধের নৃশংস রক্তপাতে তাঁর বিষম অনীহা। দুই রাজকুমারেরই স্কন্ধের উপর শৈত্যনিবারক রুরুমৃগের কৃত্তিবাস, কর্ণে মণিকুণ্ডল, কন্ঠে প্রলম্বিত মুক্তাহারের মাঝে উজ্জ্বল হীরকখণ্ড রৌদ্রাভায় জ্বলজ্বল করছে। 

অনেকখানি রুক্ষ শিলাময় পথ অতিক্রম করে এসে সামনে কয়েকটি সুশ্যামল আটববিটপাকীর্ণ ছোট বড় টিলা, তাদের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে বহে চলেছে একটি নাতিপ্রশস্তধৌতী। আশেপাশে অজস্র ফুলে ভরা গাছ। তার স্ফটিক-স্বচ্ছ জলের নীচে রংবেরঙের রত্ন-সদৃশ উপলরাশি দ্বিপ্রহরের সূর্যালোকে ঝিলমিল করছে। চতুর্দিকের নিস্তব্ধতার মাঝে নাম না জানা পাখির মৃদু কলকাকলিতে মুখর স্থানটি যেন বনদেবীর নিভৃত আবাসস্থল। 

রাজ্যবর্ধন সেই শ্যামল অরণ্যানী অধ্যুষিত নাতিউচ্চ পর্বতমূলে ঘোড়ার রাশ টেনে অবতরণ করে সামনের ছায়া সুশীতল পর্বত-সানুদশের দিকে এগিয়ে গেলেন। অনুজ হর্ষদেব, অমাত্য কুমার ও মাধব যুবরাজকে অনুসরণ করলেন। প্রবীণ সৈন্যাধ্যক্ষ সিংহনাদ সেখানেই বাহিনী থামিয়ে শিবির সন্নিবেশের নির্দেশ দিলেন। দুই দিকে দুটি নাতি উচ্চ টিলার মাঝে একটি তৃণাচ্ছন্ন গালিচার মত শ্যামল উপত্যকায় রাজকুমারদের স্কন্ধাবার সংস্থাপিত হল। 

দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সাঙ্গ হতে কিঞ্চিৎ বিলম্বই হল। সামান্য বিশ্রামের পর রাজনন্দনদ্বয় শিবির ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন, সঙ্গে যথারীতি পার্শ্বচর দুই ভাই কুমার ও মাধব। শীতের পড়ন্ত বেলায় ভানুদেব ধৌতীর চঞ্চলা তনুতে হোলির রঙ মাখিয়ে পাহাড়ের পিছনে আত্মগোপন করতে ব্যস্ত। রাজ্যবর্ধন পার্শ্বচর কুমারগুপ্ত ও সেনাপতি সিংহনাদের সঙ্গে হূণশক্তিকে দমন করার রণকৌশল নিয়ে আলোচনা করলেন। শ্রীহর্ষ কিছু সময় সে আলোচনায় যোগ দিলেও পরে দাদার আদেশে স্কন্ধাবারে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট পট্টাবাসে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন।

ষোড়শবর্ষীয় তরুণ ভাইকে সমরাঙ্গনে নিয়ে যেতে শ্রীরাজ্যর নিতান্তই অনিচ্ছা, আর হর্ষদেব নিজেও বিশেষ আগ্রহী নন। স্বভাবতঃই তিনি সেই পাহাড়-ঝর্ণা-বনানী অধ্যুষিত প্রকৃতির সৌন্দর্য আহরণ এবং মৃগয়া-ক্রীড়াতেই বেশী উৎসাহী। 

পরদিন প্রত্যুষেই শ্রীরাজ্য সখা কুমার ও সিংহনাদের সঙ্গে দুর্দমনীয় সৈন্যের বাহিনী নিয়ে শৈলশ্রেণী-মধ্যস্থিত গিরিখাতের ভিতর দিয়ে কৈলাসপর্বতের প্রভাসিনী উত্তর দিকে যুদ্ধাভিযানে অন্তর্হিত হলেন। 

হর্ষদেব প্রিয় সুহৃৎ মৃগয়াবিৎ মাধবকে সঙ্গে নিয়ে তুষার-শৈলের কন্ঠে উপকন্ঠে সিংহ-শরভ-বরাহ-মৃগ শিকার ক্রীড়ায় কাটিয়ে দিলেন কয়েকটি বহির্মুখিন দিন। 

সেদিন সূর্যদেব তখন তাঁর প্রখর কিরণাশ্ব রথে মধ্যগগনে সদম্ভে বিচরণ করছেন, মৃগয়ায় ক্ষান্ত দিয়ে শিবিরে ফিরে এলেন কুমার। চন্দ্রকিরণধবল উপাধানে মাথা রেখে, মখমল ঢাকা পালক বিছানো বেত্র-পট্টিকায় বিছানো নরম শয্যায় মৃগয়াক্লান্ত অঙ্গখানিকে এলিয়ে দিলেন হর্ষ। তাঁর দুই পাশে দুজন পরিচারিকা তালবৃন্তের ব্যজনী হাতে ধীরে ধীরে বীজন করতে লাগল। কিন্তু কুসুমকোমল শয্যাতেও তিনি কিছুতেই স্থির থাকতে পারছেন না, মনের কোণে এক অদ্ভুত আশঙ্কায় তাঁর মন আজ বড়ই চঞ্চল। 

হর্ষ শয্যা ত্যাগ করে উন্মুক্ত বাতায়নপাশে দাঁড়িয়ে দিগন্তব্যাপী প্রান্তরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। হঠাৎ দেখলেন দূর থেকে ধূলা উড়িয়ে দৌড়তে দৌড়তে এক দূরাধ্বগ আসছে। বাতাস-বৈমুখ উত্তরীয়র দুই প্রান্ত তার দুই পাশে বিহঙ্গ-পক্ষের মত উড়ছে, দেখে মনে হচ্ছে সে যেন উড়তে উড়তে আসছে। দূরাধ্বগ কাছে এলে হর্ষ চিনতে পারলেন তাকে। সে স্থান্বীশ্বর রাজপুরীর বিশ্বস্ত বার্তাবাহক কুরঙ্গক। তার মাথায় নীলিরাগ দিয়ে রাঙানো একখানি ময়ূরকণ্ঠী চৈলচীরিকা ছোট ছোট মালার মত করে মাথায় জড়ানো, আর তার ভিতরে জ্বলজ্বল করছে একখানি লেখ। দীর্ঘ পথশ্রমে আর সূর্যস্নানে কালিবর্ণ, ধূলিধুসরিত চেহারা। বিমর্ষ মুখে লেখখানি হর্ষের হাতে দিল সে। পত্রটি তাঁর পূজ্যপাদ পিতার নয়, তাঁকে অবিলম্বে রাজধানীতে ফিরে যাবার অনুরোধ জানিয়ে মহামাত্য-সখা ভণ্ডী লিখেছেন। কিন্তু, এই তো সেদিন পিতা নিজেই তাঁদের দুই ভাইকে হূণ-বিতারণের নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন! এরই মধ্যে কি এমন ঘটল! তাছাড়া পিতার পরিবর্তে ভণ্ডী কেন লেখ রচনা করলেন! অজানা অশুভ আশঙ্কায় বারেকের জন্য চিত্ত কম্পিত হল তাঁর। 

‘‘পিতা ভাল আছেন তো কুরঙ্গক? কোন মন্দ সংবাদ নয় তো!’’ ব্যাকুল কন্ঠে শুধালেন তরুণ রাজকুমার। 

‘‘কুমার, মহারাজ ভয়ঙ্কর দাহজ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যা গ্রহণ করেছেন।’’ অশ্রুসজল চোখে এইটুকু মাত্র নিবেদন করে মাথা নীচু করল কুরঙ্গক।

শ্রবণমাত্র আকস্মিক আঘাতে যেন শতখণ্ডে খণ্ডিত হল হর্ষের সিংহহৃদয়। কিছু সময় নির্বাক থেকে পদ্মাসনে বসে ইষ্টদেব ভগবান মহেশ্বরকে স্মরণ করে নিজেকে কিঞ্চিৎ সামলে নিয়ে ধীর ও দৃঢ় কন্ঠে প্রতিহারীদের ঘোড়ায় জিন চড়ানোর আদেশ দিলেন, পড়ে রইল মাধ্যাহ্নিক ভোজন। অশ্বপাল হর্ষবর্ধনের প্রিয় শ্বেতাশ্ব নিয়ে এলে তিনি এক লাফে তাতে চড়ে বসলেন; তাঁর সামান্য ইশারায় শিক্ষিত তুরঙ্গম বালুকা-কঙ্কর সমাচ্ছন্ন প্রান্তরের বুক চিরে নক্ষত্রগতিতে ছুটে চলল। 

অচিরেই মাধবগুপ্তর নির্দেশে অস্থায়ী মৃগয়া-শিবির ভঙ্গ করে স্থান্বীশ্বরের তুরঙ্গ-সৈন্য দ্রুতবেগে রাজকুমারের পশ্চাদানুসরণ করল। বহু যোজন পথ একদিনেই অতিক্রমের পর রাত্রি নামল। তবু হর্ষ ও তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর চলার বিরাম নেই, ঘোড়ার পিঠেই রাত্রি অতিবাহিত হল। পরদিন মধ্যাহ্নে শ্রীহর্ষ সসৈন্যে রাজধানীতে এসে পৌঁছলেন। নৃপতি-নিকেতনের প্রবেশদ্বারে রাজবৈদ্য সুষেণকে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গেলেন, 

‘‘কুমার, মহারাজ প্রভাকরবর্ধনের শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। কঠিন আস্য-শোষী ব্যাধিতে তিনি ভোজন, এমনকি জলপানও করতে পারছেন না। আমি যথাসাধ্য করছি, বাকি ভগবান পিনাকপাণির ইচ্ছা।’’

হর্ষদেব অন্দরমহলে প্রবেশ করে দেখলেন তাঁর মহাতেজস্বী পিতার কথা বলার শক্তি নেই, দৃষ্টিও ক্ষীণ, রসনা শুষ্ক। রাজকীয় পালঙ্কে তাঁর অনিন্দ্যকান্তি দেহটি যেন শুষ্ক-শীর্ণ ভগ্ন পাদপ-শাখার মত পড়ে আছে। রাজ-অঙ্গে কৃতান্তের অমোঘ কটাক্ষপাত, কালের অঙ্গুলিতে লিখিত হয়ে গিয়েছে তাঁর জীবন-পরিসমাপ্তির ললাট-লিখন। পিতার শিথানপাশে পুষ্পবিহীন লতিকার মত নুয়ে রয়েছেন তাঁর নিরাভরণ মাতা মহারাণী যশোবতী। মৃত্যুপথযাত্রী পিতার বক্ষে জননীর সেই শীতল শ্রদ্ধার ছবিখানি দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন হর্ষ। 

পরদিন প্রভাতে নিজের মন্দিরে সমাসীন হর্ষদেবকে মহারাণীর নিজস্ব প্রতিহারিনী বেলা বুক চাপড়ে হাপুস-নয়নে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলল, ‘‘কুমার রক্ষা করুন। মহারাজ এখনও জীবিত, অথচ মহাদেবী চিতাগ্নিতে আত্মবিসর্জন দিতে চলেছেন।’’

হর্ষ দ্রুতপদে গিয়ে দেখলেন মা যশোবতী অন্তঃপুর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে দুহাতে অজস্র স্বর্ণ-রত্নালঙ্কার বিলিয়ে দিতে দিতে তোরণদ্বার পার হয়ে পদব্রজে এগিয়ে চলেছেন অদূরে সরস্বতী নদীর দিকে। তাঁকে ঘিরে পুরাঙ্গনারা করুণ সুরে বিলাপ করতে করতে সঙ্গে চলেছে। 

বজ্রাহত হর্ষ মায়ের কাছে গিয়ে বললেন, ‘‘মা গো আমি কি এমনই অভাগা, যে তুমিও আমাকে ত্যাগ করে যাচ্ছো? প্রসন্না হও মা, ফিরে চল।’’ বলতে বলতে মাতৃদেবীর চরণে লুটিয়ে পড়ল হর্ষদেবের চুড়া। যশোবতীর এতক্ষণের চেপে রাখা আবেগের সঞ্চিত মেঘরাশি প্রিয় পুত্রের রোদন-বিদ্যুতে খণ্ড খণ্ড হয়ে দুচোখ ভরে নেমে এল স্নেহের বারিধারা হয়ে। 

অনেকক্ষণ পরে দুঃখের বেগ কিছুটা প্রশমিত হলে মহারাণী কুমারকে মাটি থেকে তুলে দুহাতে তাঁর অশ্রু মুছিয়ে বললেন, ‘‘দ্যাখ বাবা, ধার্মিক বংশে আমার জন্ম, মহান কুলের বধু হয়ে আমি এসেছিলাম, চরিত্র আমার ঐশ্বর্য। শত-সমরের বীর হর্ষক্ষ-পুরুষের পত্নী আমি কেশরিনী। আমি বীরজা, বীরজায়া, বীর-জননী। এর অন্যথা হওয়া কি সম্ভব! আমার একমাত্র কামনা, আমি সধবা থেকে মরব। আর্যপুত্র ছাড়া দগ্ধস্বামী রতির মত বিলাপ করতে আমি চাই না। তোদের পিতার পদধূলির মতই আমি আগে উঠব স্বর্গলোকে।’’

পুরনারীদের ক্রন্দনে ভারাক্রান্ত হল দিগ্বিদিক। সরস্বতীর তটপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দীনতমা নারীর মত শান্ত চোখে একবার চিতার লেলিহান শিখার দিকে তাকালেন মহারাণী যশোবতী। তাঁর দৃষ্টিপাতে প্রষ্ফুটিত কুসুমের প্রসন্নতা। তারপর ইষ্টদেব সূর্যকে প্রণাম করে স্বামীর চরণযুগল স্মরণ করতে করতে ধীর অকম্পিত পদে প্রবেশ করলেন অগ্নিতে। স্নিগ্ধ চন্দ্রমা যেন নবোদিত সূর্যের সঙ্গে সন্ধিক্ষণে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। 

জননীর মৃত্যুতে বিহ্বল হর্ষ জ্ঞাতিকুটুম্ব ও পরিজনদের সঙ্গে ফিরে এলেন রাজপুরীতে। মৃত্যু পথযাত্রী পিতার চরণদুটি বুকে জড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন শিশুর মত। মহারাজের চোখে তখন দৃষ্টিশূন্য, কিন্তু পুত্রর রোদনধ্বনিতে সেই শেষবারের মত ক্ষণকালের জন্য ফিরে এল তাঁর বাহ্যচেতনা। ক্ষীণ কন্ঠে থেমে থেমে উচ্চারণ করলেন তাঁর অন্তিম আশীর্বাণী। 

‘‘নিয়তির স্বভাব অতি তরল। সুখের বিধান নিয়ে, মানুষের সংসারে প্রথমে তিনি আসেন; তারপরে তিনি আনেন অকস্মাৎ এক নিদারুণ দুঃখ। যেন জীমূত মাঝে সৌদামিনীর বিভা। প্রথমে আলোর ঝলকানি, অবসানে বজ্রের পলক-প্রলয়।’’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘‘কাঁদিস না হর্ষ, তুই পুষ্পভূতি বংশের জ্বলন্ত সূর্য, আমি মানসচক্ষে দেখছি এই পৃথিবী একদিন তোর আজ্ঞাবহ হবে। তোর মত পুরুষ-সিংহের অধীর হওয়া উচিত নয়। জানবি প্রজাদের প্রথম অবলম্বন হচ্ছে অচঞ্চল মহাপ্রাণ নরপতি, তারপরে তারা রাজার সম্পদ, ক্ষমতা ও বংশমর্যাদা দেখে। যে জনমনের আশ্রয়, মনুষ্যশ্রেষ্ঠ, তার কোন অবস্থাতেই বিচলিত হতে নেই। আশীর্বাদ করি মর্তলোকে তোর কীর্তির কথা চিরকাল ঘোষিত হোক।’’ বলতে বলতে আর পারলেন না। রাজাধিরাজের আঁখিপল্লব নিমীলিত হয়ে এল ধীরে ধীরে। নিস্তব্ধ কক্ষে ভূপতি প্রভাকরবর্ধন অন্তিম নিঃশ্বাস ফেললেন। আর কিছুই রইল না তাঁর, পড়ে রইল কেবলমাত্র বিপুল যশঃকীর্তি। 

দ্রুতগামী অশ্বারোহী দূরাধ্বগের মুখে হৃদয়বিদারক সংবাদ শুনে হুণবিজয় অসম্পূর্ণ রেখে বহু দূরের পথ অবিশ্রামে পার হয়ে রাজধানীতে ফিরে এসেছেন কুমার রাজ্যবর্ধন। জ্যেষ্ঠভ্রাতার আসার খবর শুনে হর্ষ এগিয়ে গেলেন। কিন্তু এ কি চেহারা হয়েছে দাদার! সারা দেহ পথের ধূলায় ধূসর, রৌদ্রে ভেজা ললাট-পট্ট থেকে স্বেদবিন্দু চিবুকের নবশ্যাম তৃণের মত পাতলা শ্মশ্রু ভিজিয়ে ঝরে পড়ছে। হূণ-সংগ্রামে শস্ত্রের আঘাতে ক্ষতস্থানগুলি শুভ্র বস্ত্রখণ্ড দিয়ে বাঁধা, রক্তধারা কালচে হয়ে জমাট বেঁধে আছে। কোন বাহুল্য আজ নেই তাঁর সঙ্গে। ছত্রধর পড়ে রয়েছে পিছনে; আচমন, ভৃঙ্গার, তাম্বুল, পরিচ্ছদ বাহককেরা সঙ্গে নেই। একেবারে কৃশ হয়ে গেছেন রাজ্য, কতদিন যে স্নান-অশন-শয়ন হয় নি! অমন দেবসেনাপতি কার্তিকেয়ের মত শৌর্য ও রূপ যেন নিয়তির নিদারুণ আঘাতে অঙ্গারে পরিণত হয়েছে। পাহাড় ধ্বসে পড়েছে, তাই আজ যেন বিহ্বল গুহাহীন কেশরী। সুর্যদেব অস্ত গিয়েছেন, অন্ধকারে কাল হয়ে হেঁটে আসছে দিন, ভেঙে পড়েছে বিশাল মহীরুহ, ছায়াশূন্য বৃক্ষতলে নিরাশ্বাস নিরালম্ব পথিক। 

শ্রীরাজ্য ভাইকে দেখে এতক্ষণের উদ্গত আবেগাশ্রু আর সংবরণ করতে পারলেন না। শ্রীহর্ষকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন শিশুর মত। অনেক সময় পরে বর্ষণক্লান্ত শরত-মেঘের মতই স্তিমিত হল রোদনবেগ। রাজ্যবর্ধন সরস্বতীর তীরে স্নানভূমিতে গিয়ে সমস্ত আভরণ ত্যাগ করে অনাদরে মৌলিতে বাঁধলেন ঘনকৃষ্ণ বিস্রস্ত কুন্তলরাশি। তারপর দুই ভাই ক্ষৌমবাস পরিধান করে ভূমিতলে তৃণশয্যায় শয়ন করলেন। 

‘‘ভাই হর্ষ, আজ আমাদের পিতৃদেব স্বর্গারোহন করেছেন। তাঁর শতাধিক অশ্বমেধের কীর্তিতে আমাদের বংশ এ ভারতভূমিতে উজ্জ্বল। পিতার সঙ্গে মাতৃদেবীও চলে গেলেন! নিজেকে আমার মনে হচ্ছে যেন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অতল শোকসাগর-তরঙ্গে নিমজ্জমান হাল ভাঙা, পাল ছেঁড়া, নাবিকহীন সামান্য এক তরণী। রাজ্যসুখ আমার জন্য নয় রে, তুই গ্রহণ কর আমার যৌবরাজ্য, আমার রাজ্যচিন্তা, রাজলক্ষ্মী।’’

অগ্রজের ভাষণ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন হর্ষদেব। যেন শানিত শূলে তাঁর কিশোর-হৃদয়খানি দ্বিধাবিভক্ত হতয়ে রক্তক্ষরণ করতে লাগল। 

পরদিন। স্থান্বীশ্বরের রাজসভা বড়ই নিস্প্রভ। নহবতে বাজেনি প্রভাতের মাঙ্গলিক সুর, রাজদরবারের প্রতিটি দ্বারে নিশ্ছিদ্র প্রহরা, সভার বিশিষ্ট পণ্ডিত ও সভাসদদেরও আজ সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। পাশের মন্ত্রণাকক্ষে শুধু মাত্র মহামন্ত্রী ভণ্ডী। তাঁর প্রশস্ত ললাটে চিন্তার বলিরেখা। একটু পরেই প্রবীণ সেনানায়ক সিংহনাদ ও রাজভ্রাতা হর্ষবর্ধন চিন্তিত চিত্তে কক্ষে প্রবেশ করলেন। 

আজ সকালেই কনৌজ থেকে ভগ্নী রাজ্যশ্রীর প্রিয় ভৃত্য সংবাহক এক দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে। তা যেমন নিদারুণ, তেমনি গুপ্ত। রাজ্যজুড়ে মহারাজের প্রয়াণ-শোক ছাপিয়েও তার গুরুত্ব অপরিসীম। 

‘‘সংবাহক কি সংবাদ নিয়ে এসেছে তা আমাকে বিস্তারিত বলুন, ভণ্ডী।’’ মন্ত্রণাকক্ষে প্রবেশ করে আসন গ্রহণ না করেই রাজ্যবর্ধন উদ্বিগ্ন মুখে বললেন। 

‘‘রাজন, সংবাহক একটি দুঃসংবাদ এনেছে।’’ ভণ্ডী তাঁর স্বভাবসুলভ ধীর ও গম্ভীর স্বরে বললেন।‘‘সপ্তাহকাল আগে মালবরাজ দেবগুপ্ত এবং গৌড়রাজ শশাঙ্ক হঠাৎই একযোগে রাত্রির অন্ধকারে কনৌজ আক্রমণ করে, এবং কনৌজ তাদের করায়ত্ত হয়।’’

‘‘সে কী!’’ রাজ্যবর্ধন অস্ফুট চিৎকার করে বললেন, ‘‘ভগ্নী রাজ্যশ্রী ও ভগ্নীপতি মৌখরিরাজ গ্রহবর্মা নিরাপদ তো? আমি তাঁদের জন্য বিশেষ চিন্তিত।’’

‘‘বলতে আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে রাজন,’’ ভণ্ডী মাথা নীচু করে বললেন, ‘‘কনৌজরাজ সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় পরাজিত ও নিহত হয়েছেন, আর ওরা আমাদের দেবীপ্রতিমা ভগ্নীকে কোন এক গোপন কারাগারে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। দুর্মতি মালবরাজের পরের লক্ষ্য স্থান্বীশ্বর গ্রাস করা। এখন মহারাজকুমারের যা আদেশ!’’

এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা শুনে মন্ত্রণাকক্ষে সূচ-পতনের নীরবতা নেমে এল। মহারাজ দুহাতে কপাল চেপে ধরে হাহাকার করে উঠলেন...

‘‘হে মহেশ্বর! এমন মর্মান্তিক সংবাদ শোনার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন!’’

কুমার হর্ষ পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের মত মন্ত্রণাকক্ষে পাদচারণা করতে লাগলেন। 



(ক্রমশ প্রকাশ্য)



0 comments:

0

ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব

Posted in


ধারাবাহিক





আমার বারুদ-বেলা (৫)
স্বপন দেব





১৯৬৭ সাল। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বাম-আন্দোলনের সাফল্যের এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করল। ৬৭ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত হল পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে কংগ্রেস ১২৭ টি আসন পেয়ে একক বৃহত্তম দল হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও তারা যেহেতু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্যে প্রয়োজনীয় ১৪১ টি আসন লাভে অসমর্থ হয়েছে তাই তারা সরকার গঠনে আগ্রহী হলনা। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে সি পি এম পেল ৪৩টি আসন। যখন কোন দল বা জোটই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলনা, তখন পর্দার আড়ালে শুরু হল নীতি বিসর্জন দিয়ে মন্ত্রীসভা গড়ার তৎপরতা। বাংলা-কংগ্রেস নেতা হুমায়ুন কবিরের তৎপরতা ও দৌত্যে সি পি আই, সি পি আই এম, বাংলা কংগ্রেস সব একাকার হয়ে গেল রাইটার্স বিল্ডিং-এর মোহময় হাতছানিতে! পূর্বেকার অবস্থান থেকে সরে এসে সি পি আই ও সি পি এম এই উভয় কমিউনিস্ট পার্টি নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের জন্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করল যুক্তফ্রন্ট। ২৪শে ফেব্রুয়ারী সি পি এম এর নেতৃত্বাধীন সাত পার্টির ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট (U.L.F) এর বৈঠক বসল এবং সেখানেই অকংগ্রেসি যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। পরেরদিন ২৫শে ফেব্রুয়ারী ভারত সভা হল-এ অনুষ্ঠিত হল প্রোগ্রেসিভ ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট (P.U.L.F) এবং ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট এর সর্বদলীয় বৈঠক। এই দুটো জোটের বারোটা পার্টি মিলে বিধানসভায় মোট ১৪১ টি আসন পেয়েছে। এই বারো পার্টির জোট রাজ্যপালের আমন্ত্রণ পেলে এবং পরে আরো দুটি পার্টি যোগ দিয়ে এদের আসন সংখ্যা কিছুটা বাড়াল। ১৮ দফা ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই চোদ্দো পার্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পয়লা মার্চ, ১৯৬৭ ময়দানের জনসভায় তাদের কর্মসূচী ঘোষণা করল।“দেশহিতৈষী” তাদের ৩ মার্চ, ১৯৬৭ তারিখের সংখ্যায় লিখল---“এমন একটি বিকল্প জনপ্রিয় সরকার সংস্থাপিত হোক, যে সরকার তাদের আশু রিলিফ দেবে, তাদের অগ্রাধিকার রক্ষা করবে এবং গণতন্ত্র ও উন্নত জীবনযাত্রার জন্যে তাদের সংগ্রামকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে…বিকল্প মন্ত্রিত্ব গঠনের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে গঠিত একটি পার্লামেন্টারি ফ্রন্টে যোগদানের এবং মন্ত্রিত্ব গঠনের উদ্দেশে শ্রী অজয় কুমার মুখার্জিকে এই ফ্রন্টের নেতা হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্তই সেক্রেটারিয়েট করছে।” এই যুক্তফ্রন্টের ১৮ দফা কর্মসূচীর মধ্যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ৩ নং, ১০ নং এবং ১৪ নং ধারা। ৩ নম্বর কর্মসূচীতে সরকার অঙ্গীকার করল--- প্রগতিশীল ভূমিসংস্কার ও গরীব চাষী, ভাগ চাষী, কৃষিমজুর এবং দুর্দশাগ্রস্ত চাষীদের সবাই যে তীব্র সমস্যায় আছেন সেদিকে দৃষ্টি দেবে সরকার। এবং ১০ নম্বর কর্মসূচীতে বলা হল---- তফশিলী জাতিসমূহ এবং উপজাতি ও অনগ্রসর অংশের অবস্থান বিশেষ উন্নতির জন্য সরকার মনোযোগ দেবে। গুরুত্বপূর্ণ ১৪ নম্বরে বলা হল “যুক্তফ্রন্ট সরকার শ্রমজীবি, কৃষিজীবি, শিক্ষক এবং সমস্ত স্তরের মেহনতী মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে এবং তাদের ইউনিয়ন ও অ্যাসোশিয়েশনের মাধ্যমে ন্যায্য দাবী ও অভাব অভিযোগ গুলি জানানোর অধিকারকে স্বীকার করবে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক ও ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করবে। যুক্তফ্রন্ট প্রশাসন ব্যবস্থা ও পুলিশ বিভাগকে জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্খানুযায়ী পুনর্বিন্যাস করবে। এই সরকার জনগণের মৌলিক নাগরিক অধিকারকে সন্মান করবে এবং রক্ষা করবে ও ভারত সরকারের নিকট জরুরি অবস্থা, ভারত রক্ষা আইন অবসানের দাবী জানাবে। নিবর্তনমূলক আটক আইন সহ সমস্ত অগণতান্ত্রিক ও দমনমূলক আইনের অবসানের দাবী করা হবে।” ২রা মার্চ, ১৯৬৭ যুক্তফ্রন্ট সরকার শপথ নিল। সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখোপাধ্যায়। স্বরাষ্ট্র (পুলিশ) মন্ত্রী হলেন সি পি এম এর জ্যোতি বসু! কিন্তু মন্ত্রীসভায় যোগদানের বিষয়টি যে পার্টির সমস্ত স্তরের নেতা ও কর্মীরা মেনে নিতে পারেননি, তা বোঝা যায় তখনকার ‘দেশহিতৈষী’- প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধ থেকে। যে রকম – ২৪শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৭ সি পি এম নেতৃত্ব যখনমন্ত্রীসভায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছে, ঠিক সেদিনই ‘দেশহিতৈষী’র পাতায় (২৭ তম সংখ্যা) প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হচ্ছে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের লক্ষ্য হচ্ছে, ‘কমিউনিস্ট পার্টির কর্ত্তৃত্ব এদিকে বামপন্থী মুখোশ রেখে কর্মীদের দলে রাখতে গিয়ে সি পি এম নেতাদের পুরাতন বক্তব্য এখন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে লাগলো। বামপন্থী সরকার ক্ষমতায়, এই উৎসাহে তাই নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের পরদিনই অর্থাৎ ৩ মার্চ ১৯৬৭, প্রায় ১৫০ জনের মতো আধিয়ার, যারা নকশালবাড়ি থানা এলাকায় বড়মনিরাম জোতের জয়ানন্দ সিং ও গগৌ সিং এর জমিতে চাষ করত, তারা জোর করে এই মহাজনের গোলা থেকে প্রায় ৩০০ মণ ধান লুঠ করে নেয়। এদের হাতে ছিল তীর, বল্লম, প্রভৃতি, অস্ত্র এবং সি পি এম এর পতাকা (Police Report P.S. Naxalbari)।

কৃষকদের এই অত্যুৎসাহের আর একটি কারণ ছিল। ঠিক এইসময়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভা তাদের সভ্য সংগ্রহ অভিযানের একটি সার্কুলার দেয়। এই সার্কুলারে বলা হয়--- “সাধারণ নির্বাচনে প্রতিক্রিয়াশীল কংগ্রেস গদিচ্যূত হওয়ায় জনগণের সম্মুখে এক নতুন ও অনুকুল পরিস্থিতির সৃষ্টি হইয়াছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি এই পরাজয়কে সহজে মানিয়া লইবেনা --- অগ্রগতির পথে নানা বাধা সৃষ্টি করিবে। গ্রাম শহরের সচেতন ও সংগঠিত শক্তির জোরেই সমস্ত বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া জনগণের স্বার্থ ও দাবীকে আগাইয়া লওয়া সম্ভব। এই কাজে কৃষক সভার দায়িত্ব খুবই বেশি। তাই বর্তমান অনুকুল পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করিয়া কৃষক আন্দোলন ও সংগঠনকে শক্তিশালী ও বিস্তৃত করা জন্যে আমাদের সচেষ্ট হইতে হইবে। বেনামী ও বে-আইনি ভাবে লুকোন জমি উদ্ধার করা, উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা, উচ্ছেদ বন্ধ করা, প্রগতিশীল ভূমিসংস্কারের ব্যবস্থা করা, প্রভৃতি দাবিকে গুরুত্ব দিতে হইবে।” সার্কুলারের এই অংশটি ঠিকমত অনুধাবন করলেই বোঝা যাবে যে, একদিকে সংসদীয় রাজনীতির মধু ভক্ষণ ও অপর দিকে বিপ্লবী ক্যাডারদের হাতে রাখার এই দ্বিচারিতাই প্রথমে গ্রামাঞ্চলে সহিংস আন্দোলনের সূত্রপাত করে। ফলে এই অঞ্চলেই বে-আইনি ও বেনামী জমি উদ্ধার এবং কংগ্রেসি আমলের চিহ্নিত জোতদার-মহাজনদের উপর আক্রমণ শুরু হল। 

নির্বাচনের আগেই চারু মজুমদার তাঁর সপ্তম দলিলে বলেছিলেন, ‘‘সাধারণ নির্বাচন আসছে। নির্বাচনের সময়ে বিক্ষুদ্ধ মানুষ রাজনীতি শুনতে চায়, শুনবে। নির্বাচনের আগে প্রত্যেকটি দল তার রাজনীতি জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের চেষ্টা করবে। আমাদেরও এই নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে আমাদের রাজনীতি প্রচার করতে হবে। অকংগ্রেসি গণতান্ত্রিক সরকারের ভুয়া আওয়াজে যেন আমরা বিভ্রান্ত না হই। আমাদের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনীতি, অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক ঐক্য, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং পার্টি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার রাজনীতি জনসাধারণের মধ্যে বলিষ্ঠ ভাবে নিয়ে যেতে হবে। আমরা যদি এই সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করি তবে কোন বামপন্থী নেতার পক্ষে আমাদের বিরোধিতা করা সম্ভব হবেনা। এই সুযোগ আমাদের পুরোপুরি গ্রহণ করতে হবে।’’ নির্বাচনের পর চারু মজুমদারের কথা সত্য প্রমাণিত হল। অকংগ্রেসি গণতান্ত্রিক সরকারের ভুয়া আওয়াজ তুলল সি পি এম। অষ্টম দলিলে চারু মজুমদার লিখলেন---- ‘‘নির্বাচনের পরবর্তী যুগে আমাদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণিত করতে পার্টি নেতৃত্ব উঠে পড়ে লেগেছেন। পলিটব্যুরো আমাদের কাজ নির্দেশিত করেছেন, অকংগ্রেসি মন্ত্রীসভা গুলোকে প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা করার সংগ্রাম চালাতে হবে। অর্থাৎ সংগ্রাম তীব্র করে তোলা নয়, মন্ত্রীসভার পক্ষে ওকালতি করাই হবে মার্ক্সবাদীদের প্রধান কাজ (এপ্রিল, ১৯৬৭)। একদিকে তাত্বিক বিতর্ক আর অন্যদিকে জঙ্গি তৎপরতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠল সমগ্র উত্তর বাংলা। নেপাল-ভারত সীমান্ত এলাকায় একটি মোবাইল পুলিশ পার্টির থেকে অস্ত্র দখল করতে গিয়ে গুরুতর আহত হলেন পবিত্র সেনগুপ্ত। যুক্তফ্রন্টের ভূমি-রাজস্ব মন্ত্রি ও কৃষকসভার নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙার বিধানসভায় ঘোষণা করলেন বিভিন্ন চা বাগানের ২ হাজার একর হুকুম দখল করা জমি চা বাগানের মালিকেরা বেনামীতে বিলি করেছেন। সরকার সেইসব জমি উদ্ধার করে শ্রমিক ও চাষীদের মধ্যে বিলি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন যে, বর্গাদার উচ্ছেদ বন্ধের লড়াইয়ে সরকার বর্গাদারদের পাশেই দাঁড়াবেন। জোতদারদের স্বার্থে পুলিশ দেওয়া হবেনা (আনন্দবাজার, ১লা এপ্রিল,১৯৬৭)। এই বক্তব্যের তাৎপর্য ছিল, বাম কথার প্রতিশ্রুতির আড়ালে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আন্দোলনকে সরকারি আইনের পথে অর্থাৎ J.L.R.O, Police, S.D.O দের হাতে তুলে দেওয়া। এর প্রমাণ, মাত্র কয়েকদিন পরেই উদ্বিগ্ন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় বাবু ১৭ ই মে, ১৯৬৭তে এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন----“সরকার সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থান থেকে এরূপ উদ্বেগজনক খবর পাচ্ছেন যে, কিছু সংখ্যক লোক ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে সরকারি বা বেসরকারি বাড়ি ও জমি জোর করে দখল করছে বা করার চেষ্টা করছে। আমি পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের উদ্দেশ্যে আবেদন জানাই, তাঁরা যেন আইন না ভাঙ্গেন এবং অপর লোকের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ না করেন, প্রয়োজনে তাঁরা আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন।” দেখুন, একটি সরকারের ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী আর মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে কতটা ফারাক! (চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিকঃ সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Posted in


ধারাবাহিক




বানরায়্ণ, পর্ব ৯
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়






কিষ্কিন্ধ্যার কাছাকাছি যে পৌঁছে গেছি, সেটা দিন তিনেক আগে থেকেই টের পাচ্ছিলাম বাঁদরের সংখ্যা দেখে। চারিদিকের গাছে অসংখ্য বাঁদর। এবং তারা এত মানুষ একসঙ্গে দেখে বা এত আওয়াজ শুনেও বিশেষ বিচলিত হচ্ছে না। কিষ্কিন্ধ্যাবাসীদের পূর্বজদের আত্মা এরা? কথাটা ভেবে প্রথমে একটু হাসি পেলেও হঠাৎ কেন জানি না জন্তা বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। হাজার বছরের বুড়ো অশ্বত্থের গোড়ায় ফোকলা হাসির মতন ফোঁকড়টা... কই, তাকে জন্তা বাবা বলে বিশ্বাস করতে তো এক মুহূর্তও লাগেনি! কথাটা মনে পড়ার পর আর হাসি পায়নি।

যেটা বেশ আশ্চর্য লাগলো, সেটা হলো বাঁদর আর মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। আমাদের ওদিককার বাঁদরগুলো এরকম শান্তশিষ্ট, ভব্যসভ্য নয়। রীতিমতন বাঁদরামি করে। এখানে সে বালাই নেই। শুনলাম, কিষ্কিন্ধ্যার লোক বাঁদরদের শুধু পালনপোষণ, তোয়াজই করে না। প্রয়োজন মতন শাসনও করে। প্রশিক্ষণ দিয়ে নানান রকমের কাজে ব্যবহারও করে। তাই তারা এত শান্ত আর অনুবর্তী।

নগর কেমন হয়, সে বিষয়ে কোনও ধারনা ছিলো না আমাদের। সেই প্রথম দেখলাম। যদিও করন্দর মতন বহুদর্শীরা বলছিলো যে কিষ্কিন্ধ্যাও সেই অর্থে নগর নয়, তবু আমাদের মতন জংলীদের তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য এই অনেক! একটা অনুচ্চ পাহাড়ের মতন জায়গাকে ঘিরে আছে পাথরের তৈরি অগুন্তি ছোট বড় বাড়ি। সেই সব বাড়িতে থাকে কিষ্কিন্ধ্যার সাধারণ নাগরিকরা। আর ওই পাহাড়টার ভিতর কিষ্কিন্ধ্যার রাজকীয় আবাস।

পাহাড়ের ভিতর রাজার বাড়ি শুনে প্রথমটা আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর করন্দ বুঝিয়ে বললো, ওই পাহাড়ের গর্ভে আছে মানুষের তৈরি গুহাকন্দরের এক বিস্তীর্ণ ও জটিল শৃঙ্খলা। অনেকটা খরগোশের গর্তের মতন। সেই গিরিগর্ভ নাকি সজ্জায় ও সৌন্দর্যে কোনও রাজপ্রাসাদের চাইতে কম নয়। মহারাণী তারার নিজের হাতে সাজানো...

মহারাণী তারা! নামটা আগেও কয়েকবার শুনেছি। ইনি বালীর মহিষী ছিলেন। এখন সুগ্রীবের স্ত্রী, কিষ্কিন্ধ্যার পাটরাণী। যুবরাজ অঙ্গদের মা। দাক্ষিণাত্য ছাড়িয়ে আর্যাবর্ত অবধি ছড়িয়ে পড়া রূপের খ্যাতি নাকি তাঁর।সে রূপ দেখার জন্য নতুন সৈনিকরা সবাই উদ্গ্রীব।

কিন্তু সবার আগে বিশ্রাম। এতদিনের পথশ্রমের ক্লান্তি অপনোদন। পাথরের বাড়িগুলোর চৌহদ্দির ঠিক বাইরে সার সার তাঁবু খাটানো হয়েছে।আর সেই সব তাঁবুর ফাঁকে ফাঁকে মাটির তৈরি বিশাল বিশাল গভীর গামলার মতন পাত্রে সুগন্ধী ভেষজ মেশানো ঠাণ্ডা জলে স্নানের ব্যবস্থা! এত আরামে জীবনে কোনওদিন স্নান করিনি আমরা কেউ।

স্নান সেরে উঠে পাওয়া গেলো প্রত্যেকের জন্য দু’প্রস্থ করে নতুন কাপড়। আমাদের যাদের এর আগে কাপড় পরার সুযোগ জোটেনি কপালে, তারা তো আনন্দে প্রায় আত্মহারা। তারপর যখন খাওয়ার পালা এলো, তখন সবার চক্ষুস্থির হয়ে গেলো! শিবিরে যা খেয়েছি, সে খাবারও এর তুলনায় কিছু নয়। কত রকমের যে মাছ-মাংস, শাক-সব্জী‌, ফল-দুধ-মিষ্টির পদ, গুনেই শেষ করা যায় না। ভরপট খেয়েও আফশোস থেকে গেলো, অর্ধেকেরও বেশি খাবার চেখেই দেখা হলো না বলে।

কিন্তু এই সব আরামে গা ভাসিয়ে দিয়ে যে একেবারে টইটম্বুর হয়ে যাবে কেউ, সে উপায় নেই। লাঠি হাতে পাথুরে মুখের দল নিরন্তর পাহারা দিয়ে চলেছে। লাঠি যে খুব কারও ঘাড়ে পড়েছে, তা নয়। এই এত দিনে বড় জোর বার কয়েক। কিন্তু লোকগুলোর ঠাণ্ডা, কঠিন মুখের দিকে তাকালে আর ওদের বিরূদ্ধাচরণ করতে সাহসে কুলোয় না কারও।

যাই হোক, খাওয়া দাওয়ার পর তাঁবুর ভিতর আরামদায়ক বিছানায় শুতেই শ্রান্তি আর পরিতৃপ্তিতে চোখ ভেঙে ঘুম এলো। ঘুম ভাঙলো যখন, সূর্যাস্ত হয়ে গেছে। কিষ্কিন্ধ্যার পাহাড়ের পিছনে আকাশ কমলা থেকে আস্তে আস্তে গাঢ় লাল হচ্ছে... যেন এই শান্তি আর আরামের পরিবেশে আশ্বস্ত মানুষগুলোকে আসন্ন যুদ্ধের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

কিন্তু সেকথা নিয়ে আপাতত কেউই ভাবিত নয়। যুদ্ধ করতেই এসেছে সবাই। তাই নিয়ে আর ভেবে লাভ কি? বরং আজকের দিনটা উপভোগ করা যাক। আজ ছুটি। সম্পূর্ণ বিশ্রামের দিন। সামনে সারা সন্ধ্যেটা পড়ে আছে। আমি, গোর্তন, মাহারু, দুরন আর মণ্ডু একসঙ্গে বেরোলাম নগর দর্শনে। পাথরের বাড়িগুলোর সারির মাঝখান দিয়ে সর্পিল ভঙ্গীতে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পাথরেই ঢালাই করা সরু সরু পথ। উঁচুনীচু, অমসৃণ পথ। কিন্তু পরিচ্ছন্ন।

সেই পথেএকটা অদ্ভূত জিনিস দেখলাম। বাঁশের পোক্ত মাচার মতন জিনিসের সঙ্গে বড় বড় কাঠের চ্যাপ্টা গোল গোল খাঁজকাটা চাকতি জুড়ে তার উপর মালপত্র বোঝাই করে সেগুলোকে মহিষ দিয়ে টানানো হচ্ছে। দুটো করে মহিষ টানছে একেকটা মাচা, আর সেই মাচার উপর বসে সরু বাঁশের কঞ্চির আগায় পাতলা চামড়ার ফালি লাগানো ছপটির মতন জিনিস দিয়ে মেরে মেরে মহিষগুলোকে চালাচ্ছে একেকজন মানুষ... মুখে ‘‘হুররর, হৈঃ হৈঃ!’’ গোছের শব্দ করতে করতে। মালপত্র বওয়ার বেশ সুবিধাজনক ব্যবস্থা। পুরো ব্যবস্থাটার মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো ওই মাচার সঙ্গে লাগানো বড় বড় কাঠের চাকতিগুলো। ওগুলো আছে বলেই মাচাগুলো ওই ভাবে চলছে। পরে জেনেছিলাম, ওগুলোকে বলে চক্র বা চাকা, আর পুরো ব্যাপারটাকে বলে শকট।

আরেকটা ব্যাপার আরও আশ্চর্য লাগলো। পথের দু’ধারে খড়ের তৈরি ছোট ছোট গুমটির মতন ঘর। কোনওটাতে একেকজন নারী, কোনওটাতে একেকজন পুরুষ বসেছে ফল, মাছ-মাংস, দুধ, শাক-সব্জী, মাটির তৈরি ঘটি-মালসা এবং আরও অনেক রকম কি কি সব আমাদের অচেনা জিনিসপত্র নিয়ে... আর কিছু নারীপুরুষ তাদের কাছ থেকে সেই সব জিনিসপত্র নিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্রথমটা ভেবেছিলাম, নগরে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস বিলি করার ব্যবস্থা বুঝি এই রকমই। কিন্তু তারপর কাছে গিয়ে দেখলাম, যারা নিচ্ছে তারা জিনিসগুলোর পরিবর্তে ছোট ছোট ধাতুর চাকতির মতন কি যেন সব দিচ্ছে। ব্যাপার কিছু বুঝলাম না। বোকা, গেঁয়ো প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে গিয়ে জিজ্ঞেসও করতে পারলাম না। হাসি হাসি মুখ করে চলে এলাম।

শিবিরে ফিরে করন্দকে খুঁজে বার করলাম। ততক্ষণে নেশায় তার দু’চোখ লাল। জিজ্ঞেস করাতে প্রথমটা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তারপর জড়ানো গলায় হো হো করে হাসতে হাসতে বললো, ‘‘ওগুলো তো দোকান রে ব্যাটা! ওখান থেকে জিনিস কিনতে হয়।’’

‘‘কিনতে হয়? মানে?’’

‘‘এক্কেবারে জংলী ভূত!’’ বলে মদের পাত্রে লম্বা চুমুক দিলো করন্দ। কথাটা শুনতে আমার ভালো না লাগলেও অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইলাম।

আমার অনভিজ্ঞতার জন্যই হোক, বা করন্দর নেশার জন্যই হোক, দোকান, কেনা, বেচা, মুদ্রা বিনিময়ের পুরো ব্যাপারটা বুঝতে বেশ খানিকটা সময় লাগলো আমার। বেশ জটিল ব্যাপার। এর থেকে আমাদের সোজা সাপটা জিনিস অদলবদলের নিয়ম সহজ। কিন্তু এটাও ঠিক, যে এখানে ব্যবহার্য জিনিস অনেক বেশি, সেই সব পণ্যের প্রস্তুতকারকও অনেক, আর ক্রেতার তো কথাই নেই। তাই এখানে আদানপ্রদানের ওরকম সরল ব্যবস্থা চলবে না। সেই জন্যই মুদ্রা বস্তুটার আমদানি। ও দিয়ে সব কিছুর মূল্যমান নির্ধারণ করা সহজ। তবে এই মুদ্রার মান সর্বত্র কি এক? তা না হলে তো এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গিয়ে অসুবিধায় পড়তে হবে। অত বিস্তারিত বোঝানোর মতন অবস্থা করন্দর তখন ছিলো না। থাকলেও পুরোটা ও নিজেই বোঝে কি না, তাই নিয়েও আমার সন্দেহ ছিলো। শুধু বুঝলাম, শিখতে হবে... ভালো করে শিখতে হবে এই সব খুঁটিনাটি বিষয়।

সে রাতেও খাওয়া দাওয়ার খাসা বন্দোবস্ত ছিলো। দুপুরের তুলনায় পদের সংখ্যা কিছু কম হলেও স্বাদে ও বৈচিত্রে অতুলনীয়।সব চাইতে আনন্দের কথা, সে খাদ্য পরিবেশন করছিলো একদল সুন্দরী যুবতী। বেশির ভাগ সৈনিক খাওয়ার কথা ভুলে তাদের সঙ্গে রসালাপে মগ্ন হয়ে পড়ছিলো। খাওয়ার আগে পান করা রসের ভূমিকা যে সে আলাপে অতি গুরুত্বপূর্ণ, সে কথা বলাই বাহুল্য। মেয়েগুলো বেশ চটুল, লাস্যময়ী যাকে বলে। শরীরিক ভাবেও বেশ সপ্রতিভ। আমাদের মেয়েরাও যথেষ্ট খোলামেলা। কোনও পুরুষকে মনে ধরলে সেটা তাকে জানিয়ে দিতে মোটেই রাখঢাক করে না। কিন্তু এদের হাবভাব কিরকম যেন অন্য রকম!

কেমন যেন সবটাই বেশি বেশি করছে মনে হচ্ছিলো। শরীর আর চোখমুখের ভঙ্গী থেকে আরম্ভ করে খাবার পরিবেশনের কায়দা অবধি... সব কিছুতেই কেমন একটা আকর্ষণ করার চেষ্টা। বাছবিচারহীন ভাবে সবার সঙ্গে শরীর মেলানোর আহ্বান। আমাদের অদ্ভূত লাগছিলো। অস্বস্তি হচ্ছিলো। 

পরে জেনেছিলাম, এরা দেহোপজীবিনী। মুদ্রার বিনিময়ে পুরুষের সঙ্গে শারীরিক ভাবে মিলিত হওয়াই এদের ব্যবসা। সে রাতে এদের আনা হয়েছিলো রাজকীয় বাহিনীর নবনিযুক্ত সৈনিকদের চিত্তবিনোদনের জন্য... এবং সে কাজটা এরা বেশ ভালোভাবেই করেছিলো।

পরদিন ভোরবেলা ঢ্যাঁঢরা পেটানোর শব্দে সবার ঘুম ভাঙলো। সবাই ধড়মড় করে উঠে দেখলো, লাঠি হাতে পাথুরে মুখের দল শিবিরে টহল দিচ্ছে, আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে ঢ্যাঁঢরাওয়ালারা। আজ থেকে শুরু আবার সৈনিকের নিয়মবদ্ধ জীবন। সকাল থেকে অনুশীলন। তারপর বিকেলবেলা সূর্যাস্তের আগে রাজকীয় সম্ভাষণ।

এই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা চলতে লাগলো অনুশীলনের ফাঁকে ফাঁকে। রাজা বা তাঁর সেনানায়করা কেউই এই মুহূর্তে রাজধানীতে উপস্থিত নেই। আমাদের নিয়েগশিবিরের অধ্যক্ষ সেনাপতি গবাক্ষও থামেননি কিষ্কিন্ধ্যায়। আমাদের পৌঁছে দিয়ে যাত্রা করেছেন কুমারিকার পথে। তাহলে কে করবে রাজকীয় সম্ভাষণ? সে তো যে সে লোকের কাজ নয়! বিকেল অবধি সংশয়টা থেকে গেলো।

তারপর... এক রক্তবর্ণ অপরাহ্নের পটভূমিকায় আমরা সবাই গিয়ে দাঁড়ালাম রাজকীয় পর্বতাবাসের প্রবেশপথের সম্মুখে... সারিবদ্ধ, সুনিয়ন্ত্রিত, নিশ্চুপ। 

পাহাড়ের গায়ে অগণিত গুহাদ্বার। প্রবেশপথের ঠিক উপরে একটা প্রশস্ত রন্ধ্রপথ। সেখানে দু’পাশের দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন ভল্লহস্ত শান্ত্রী। খানিকক্ষণ শ্বাসবন্ধ করা নিস্তব্ধতা...

তারপর... দলনেত্রী হস্তিনীর মতন ধীর অথচ দৃঢ়, নমনীয় অথচ চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাসী পদক্ষেপে সেই রন্ধ্রপথে এসে দাঁড়ালেন রক্তবস্ত্র পরিহিতা, রত্নালঙ্কার শোভিতা, চোখ ঝলসানো সুন্দরী প্রগাঢ়যৌবনা কিষ্কিন্ধ্যার মহারাণী তারা।



0 comments: