0

ধারাবাহিকঃ স্বপন দেব

Posted in


ধারাবাহিক





আমার বারুদ-বেলা (৫)
স্বপন দেব





১৯৬৭ সাল। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের বাম-আন্দোলনের সাফল্যের এক ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করল। ৬৭ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত হল পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে কংগ্রেস ১২৭ টি আসন পেয়ে একক বৃহত্তম দল হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও তারা যেহেতু একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্যে প্রয়োজনীয় ১৪১ টি আসন লাভে অসমর্থ হয়েছে তাই তারা সরকার গঠনে আগ্রহী হলনা। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে সি পি এম পেল ৪৩টি আসন। যখন কোন দল বা জোটই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলনা, তখন পর্দার আড়ালে শুরু হল নীতি বিসর্জন দিয়ে মন্ত্রীসভা গড়ার তৎপরতা। বাংলা-কংগ্রেস নেতা হুমায়ুন কবিরের তৎপরতা ও দৌত্যে সি পি আই, সি পি আই এম, বাংলা কংগ্রেস সব একাকার হয়ে গেল রাইটার্স বিল্ডিং-এর মোহময় হাতছানিতে! পূর্বেকার অবস্থান থেকে সরে এসে সি পি আই ও সি পি এম এই উভয় কমিউনিস্ট পার্টি নতুন মন্ত্রীসভা গঠনের জন্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠন করল যুক্তফ্রন্ট। ২৪শে ফেব্রুয়ারী সি পি এম এর নেতৃত্বাধীন সাত পার্টির ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট (U.L.F) এর বৈঠক বসল এবং সেখানেই অকংগ্রেসি যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। পরেরদিন ২৫শে ফেব্রুয়ারী ভারত সভা হল-এ অনুষ্ঠিত হল প্রোগ্রেসিভ ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট (P.U.L.F) এবং ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট এর সর্বদলীয় বৈঠক। এই দুটো জোটের বারোটা পার্টি মিলে বিধানসভায় মোট ১৪১ টি আসন পেয়েছে। এই বারো পার্টির জোট রাজ্যপালের আমন্ত্রণ পেলে এবং পরে আরো দুটি পার্টি যোগ দিয়ে এদের আসন সংখ্যা কিছুটা বাড়াল। ১৮ দফা ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই চোদ্দো পার্টি ঐক্যবদ্ধ হয়ে পয়লা মার্চ, ১৯৬৭ ময়দানের জনসভায় তাদের কর্মসূচী ঘোষণা করল।“দেশহিতৈষী” তাদের ৩ মার্চ, ১৯৬৭ তারিখের সংখ্যায় লিখল---“এমন একটি বিকল্প জনপ্রিয় সরকার সংস্থাপিত হোক, যে সরকার তাদের আশু রিলিফ দেবে, তাদের অগ্রাধিকার রক্ষা করবে এবং গণতন্ত্র ও উন্নত জীবনযাত্রার জন্যে তাদের সংগ্রামকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাবে…বিকল্প মন্ত্রিত্ব গঠনের প্রয়োজনীয় প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে ন্যূনতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে গঠিত একটি পার্লামেন্টারি ফ্রন্টে যোগদানের এবং মন্ত্রিত্ব গঠনের উদ্দেশে শ্রী অজয় কুমার মুখার্জিকে এই ফ্রন্টের নেতা হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্তই সেক্রেটারিয়েট করছে।” এই যুক্তফ্রন্টের ১৮ দফা কর্মসূচীর মধ্যে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল ৩ নং, ১০ নং এবং ১৪ নং ধারা। ৩ নম্বর কর্মসূচীতে সরকার অঙ্গীকার করল--- প্রগতিশীল ভূমিসংস্কার ও গরীব চাষী, ভাগ চাষী, কৃষিমজুর এবং দুর্দশাগ্রস্ত চাষীদের সবাই যে তীব্র সমস্যায় আছেন সেদিকে দৃষ্টি দেবে সরকার। এবং ১০ নম্বর কর্মসূচীতে বলা হল---- তফশিলী জাতিসমূহ এবং উপজাতি ও অনগ্রসর অংশের অবস্থান বিশেষ উন্নতির জন্য সরকার মনোযোগ দেবে। গুরুত্বপূর্ণ ১৪ নম্বরে বলা হল “যুক্তফ্রন্ট সরকার শ্রমজীবি, কৃষিজীবি, শিক্ষক এবং সমস্ত স্তরের মেহনতী মানুষের অধিকারকে স্বীকৃতি দেবে এবং তাদের ইউনিয়ন ও অ্যাসোশিয়েশনের মাধ্যমে ন্যায্য দাবী ও অভাব অভিযোগ গুলি জানানোর অধিকারকে স্বীকার করবে এবং জনগণের গণতান্ত্রিক ও ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করবে। যুক্তফ্রন্ট প্রশাসন ব্যবস্থা ও পুলিশ বিভাগকে জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্খানুযায়ী পুনর্বিন্যাস করবে। এই সরকার জনগণের মৌলিক নাগরিক অধিকারকে সন্মান করবে এবং রক্ষা করবে ও ভারত সরকারের নিকট জরুরি অবস্থা, ভারত রক্ষা আইন অবসানের দাবী জানাবে। নিবর্তনমূলক আটক আইন সহ সমস্ত অগণতান্ত্রিক ও দমনমূলক আইনের অবসানের দাবী করা হবে।” ২রা মার্চ, ১৯৬৭ যুক্তফ্রন্ট সরকার শপথ নিল। সরকারের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলেন বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখোপাধ্যায়। স্বরাষ্ট্র (পুলিশ) মন্ত্রী হলেন সি পি এম এর জ্যোতি বসু! কিন্তু মন্ত্রীসভায় যোগদানের বিষয়টি যে পার্টির সমস্ত স্তরের নেতা ও কর্মীরা মেনে নিতে পারেননি, তা বোঝা যায় তখনকার ‘দেশহিতৈষী’- প্রকাশিত কয়েকটি প্রবন্ধ থেকে। যে রকম – ২৪শে ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৭ সি পি এম নেতৃত্ব যখনমন্ত্রীসভায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করছে, ঠিক সেদিনই ‘দেশহিতৈষী’র পাতায় (২৭ তম সংখ্যা) প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হচ্ছে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের লক্ষ্য হচ্ছে, ‘কমিউনিস্ট পার্টির কর্ত্তৃত্ব এদিকে বামপন্থী মুখোশ রেখে কর্মীদের দলে রাখতে গিয়ে সি পি এম নেতাদের পুরাতন বক্তব্য এখন বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে লাগলো। বামপন্থী সরকার ক্ষমতায়, এই উৎসাহে তাই নতুন সরকারের শপথ গ্রহণের পরদিনই অর্থাৎ ৩ মার্চ ১৯৬৭, প্রায় ১৫০ জনের মতো আধিয়ার, যারা নকশালবাড়ি থানা এলাকায় বড়মনিরাম জোতের জয়ানন্দ সিং ও গগৌ সিং এর জমিতে চাষ করত, তারা জোর করে এই মহাজনের গোলা থেকে প্রায় ৩০০ মণ ধান লুঠ করে নেয়। এদের হাতে ছিল তীর, বল্লম, প্রভৃতি, অস্ত্র এবং সি পি এম এর পতাকা (Police Report P.S. Naxalbari)।

কৃষকদের এই অত্যুৎসাহের আর একটি কারণ ছিল। ঠিক এইসময়ে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভা তাদের সভ্য সংগ্রহ অভিযানের একটি সার্কুলার দেয়। এই সার্কুলারে বলা হয়--- “সাধারণ নির্বাচনে প্রতিক্রিয়াশীল কংগ্রেস গদিচ্যূত হওয়ায় জনগণের সম্মুখে এক নতুন ও অনুকুল পরিস্থিতির সৃষ্টি হইয়াছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি এই পরাজয়কে সহজে মানিয়া লইবেনা --- অগ্রগতির পথে নানা বাধা সৃষ্টি করিবে। গ্রাম শহরের সচেতন ও সংগঠিত শক্তির জোরেই সমস্ত বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করিয়া জনগণের স্বার্থ ও দাবীকে আগাইয়া লওয়া সম্ভব। এই কাজে কৃষক সভার দায়িত্ব খুবই বেশি। তাই বর্তমান অনুকুল পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করিয়া কৃষক আন্দোলন ও সংগঠনকে শক্তিশালী ও বিস্তৃত করা জন্যে আমাদের সচেষ্ট হইতে হইবে। বেনামী ও বে-আইনি ভাবে লুকোন জমি উদ্ধার করা, উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা, উচ্ছেদ বন্ধ করা, প্রগতিশীল ভূমিসংস্কারের ব্যবস্থা করা, প্রভৃতি দাবিকে গুরুত্ব দিতে হইবে।” সার্কুলারের এই অংশটি ঠিকমত অনুধাবন করলেই বোঝা যাবে যে, একদিকে সংসদীয় রাজনীতির মধু ভক্ষণ ও অপর দিকে বিপ্লবী ক্যাডারদের হাতে রাখার এই দ্বিচারিতাই প্রথমে গ্রামাঞ্চলে সহিংস আন্দোলনের সূত্রপাত করে। ফলে এই অঞ্চলেই বে-আইনি ও বেনামী জমি উদ্ধার এবং কংগ্রেসি আমলের চিহ্নিত জোতদার-মহাজনদের উপর আক্রমণ শুরু হল। 

নির্বাচনের আগেই চারু মজুমদার তাঁর সপ্তম দলিলে বলেছিলেন, ‘‘সাধারণ নির্বাচন আসছে। নির্বাচনের সময়ে বিক্ষুদ্ধ মানুষ রাজনীতি শুনতে চায়, শুনবে। নির্বাচনের আগে প্রত্যেকটি দল তার রাজনীতি জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের চেষ্টা করবে। আমাদেরও এই নির্বাচনের সুযোগ নিয়ে আমাদের রাজনীতি প্রচার করতে হবে। অকংগ্রেসি গণতান্ত্রিক সরকারের ভুয়া আওয়াজে যেন আমরা বিভ্রান্ত না হই। আমাদের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনীতি, অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক ঐক্য, সশস্ত্র সংগ্রাম এবং পার্টি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার রাজনীতি জনসাধারণের মধ্যে বলিষ্ঠ ভাবে নিয়ে যেতে হবে। আমরা যদি এই সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করি তবে কোন বামপন্থী নেতার পক্ষে আমাদের বিরোধিতা করা সম্ভব হবেনা। এই সুযোগ আমাদের পুরোপুরি গ্রহণ করতে হবে।’’ নির্বাচনের পর চারু মজুমদারের কথা সত্য প্রমাণিত হল। অকংগ্রেসি গণতান্ত্রিক সরকারের ভুয়া আওয়াজ তুলল সি পি এম। অষ্টম দলিলে চারু মজুমদার লিখলেন---- ‘‘নির্বাচনের পরবর্তী যুগে আমাদের আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণিত করতে পার্টি নেতৃত্ব উঠে পড়ে লেগেছেন। পলিটব্যুরো আমাদের কাজ নির্দেশিত করেছেন, অকংগ্রেসি মন্ত্রীসভা গুলোকে প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা করার সংগ্রাম চালাতে হবে। অর্থাৎ সংগ্রাম তীব্র করে তোলা নয়, মন্ত্রীসভার পক্ষে ওকালতি করাই হবে মার্ক্সবাদীদের প্রধান কাজ (এপ্রিল, ১৯৬৭)। একদিকে তাত্বিক বিতর্ক আর অন্যদিকে জঙ্গি তৎপরতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠল সমগ্র উত্তর বাংলা। নেপাল-ভারত সীমান্ত এলাকায় একটি মোবাইল পুলিশ পার্টির থেকে অস্ত্র দখল করতে গিয়ে গুরুতর আহত হলেন পবিত্র সেনগুপ্ত। যুক্তফ্রন্টের ভূমি-রাজস্ব মন্ত্রি ও কৃষকসভার নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙার বিধানসভায় ঘোষণা করলেন বিভিন্ন চা বাগানের ২ হাজার একর হুকুম দখল করা জমি চা বাগানের মালিকেরা বেনামীতে বিলি করেছেন। সরকার সেইসব জমি উদ্ধার করে শ্রমিক ও চাষীদের মধ্যে বিলি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি আরও ঘোষণা করেন যে, বর্গাদার উচ্ছেদ বন্ধের লড়াইয়ে সরকার বর্গাদারদের পাশেই দাঁড়াবেন। জোতদারদের স্বার্থে পুলিশ দেওয়া হবেনা (আনন্দবাজার, ১লা এপ্রিল,১৯৬৭)। এই বক্তব্যের তাৎপর্য ছিল, বাম কথার প্রতিশ্রুতির আড়ালে বুঝিয়ে সুঝিয়ে আন্দোলনকে সরকারি আইনের পথে অর্থাৎ J.L.R.O, Police, S.D.O দের হাতে তুলে দেওয়া। এর প্রমাণ, মাত্র কয়েকদিন পরেই উদ্বিগ্ন তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় বাবু ১৭ ই মে, ১৯৬৭তে এক সাংবাদিক বৈঠকে বলেন----“সরকার সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের নানা স্থান থেকে এরূপ উদ্বেগজনক খবর পাচ্ছেন যে, কিছু সংখ্যক লোক ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত ভাবে সরকারি বা বেসরকারি বাড়ি ও জমি জোর করে দখল করছে বা করার চেষ্টা করছে। আমি পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণের উদ্দেশ্যে আবেদন জানাই, তাঁরা যেন আইন না ভাঙ্গেন এবং অপর লোকের অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ না করেন, প্রয়োজনে তাঁরা আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন।” দেখুন, একটি সরকারের ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী আর মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে কতটা ফারাক! (চলবে)

0 comments: