0

প্রাচীন কথাঃ সৌরেন চট্টোপাধ্যায়

Posted in


প্রাচীন কথা




উত্তরাপথের পথে 
সৌরেন চট্টোপাধ্যায় 



= ৪র্থ পর্ব = 



ঈশান কোণে সূর্য উঠেছে। আর্যাবর্তের অন্যতম শক্তিশালী রাজ্য স্থান্বীশ্বরের পুষ্পভূতি বংশের গৌরব আদিত্যভক্ত মহারাজ প্রভাকরবর্ধন প্রতিদিনের মতই সূর্যোদয়ের পূর্বেই স্নান সমাপন করে শুভ্র দুকূলপরিধান করে আদিত্যমন্ত্রে ইষ্টবন্দনা শেষ করেছেন। প্রাতঃকালীন আহারাদির পর তিনি তাঁর বক্ষাকাশের সূর্য-চন্দ্রসম দুই কুমারকে নিজের মন্দিরে ডেকে পাঠালেন। তাঁরা মহারাজের কক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন মহামাত্য ভণ্ডীও সেখানে উপস্থিত রয়েছেন। ভণ্ডী মহারাণী যশোবতীর ভাই বীর্যদ্রুমের পুত্র। আট বছর বয়স থেকে তিনি স্থান্বীশ্বরের রাজপুরীতে আছেন। এবং নিজের প্রতিভা, মেধা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতায় মহারাজের স্নেহধন্য ও প্রধান অমাত্য পদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। রাজকুমারদের চেয়ে কয়েক বছরের বড় হলেও ভণ্ডী তাঁদের পরম মিত্রও বটে। 

দুই ভাই প্রণাম করে পিতৃদেবের পদতলে ধরাসন গ্রহন করলে পরম ভট্টারক মহারাজ সস্নেহে বললেন, ‘‘রাজ্য, হর্ষ, তোমরা দুজনেই স্বাবলম্বী হয়েছ, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যতে তোমরা মণ্ডলেশ্বররূপে অবশ্যই পরিগণিত হবে। আজ তোমাদের রাজনীতি বিষয়ে কিছু আবশ্যিক শিক্ষা দেব, রাজকার্যকালে সেগুলি সর্বদা স্মরণ রেখো।’’

রাজ্য ও হর্ষ গভীর মনোযোগে বিচক্ষণ রাজনীতিজ্ঞ ও ভূয়োদর্শী পিতার অমৃতভাষণ শুনতে লাগলেন। 

‘‘রাজনীতিতে সর্বপ্রথম সপ্ত রাজ্যাঙ্গ। যেমন রাজা, অমাত্য, সুহৃৎ, ধনাগার, রাষ্ট্র, দূর্গ ও সেনা। আদেশ পালন করার মত যোগ্য কর্মবীর ভৃত্য পাওয়া দুষ্কর --- সদ্ভর্তা সুলভ, কিন্তু সদ্ভৃত্য দুর্লভ। 

প্রাজ্ঞে নিযোজ্যমানে হি সন্তি রাজ্ঞস্ত্রয়ো গুণাঃ,
যশঃ স্বগ্নির্বাসশ্চ বিপুলশ্চ ধনাগমঃ। 

(বিজ্ঞ ব্যক্তিকে নিয়োগ করলে রাজা তিনটি সুফল পেয়ে থাকেন – যশ, স্বর্গলাভ ও বিপুল সম্পদ।) 

আর সেই কারণেই আমি অনেক চিন্তা করে তোমাদের সাহচর্যের জন্য কুমারগুপ্ত ও মাধবগুপ্তকে আহ্বান করেছি। এই দুই ভাই বিদ্বান, বিচক্ষণ, নম্র এবং সাহসী। ধর্ম, অর্থ, কাম ও ভয় –-- এই চার উপাধায় তাঁরা পরীক্ষিত।’’

এই পর্যন্ত বলে মহারাজ কুমার ও মাধবকে নিয়ে আসার জন্য প্রতিহারকে আদেশ দিলেন। 

কিয়ৎক্ষণের মধ্যেই দুই তরুণ যুবা ধীর পদক্ষেপে কক্ষে প্রবেশ করে দূর থেকেই মহারাজকে ভূমি স্পর্শ করে পঞ্চাঙ্গ প্রণাম করল। কুমারের বয়স অষ্টাদশ, রাজ্যর সমবয়সী। নাতিদীর্ঘ অথচ খর্বও বলা যায় না, গাত্রবর্ণ ঈষৎ শ্যাম, চোখে মুখে পরিপক্ক প্রতিভা ও মেধার ছাপ। মাধব ষোড়শবর্ষীয়, হর্ষর সমবয়স্ক। গৌরবর্ণ প্রাংশু দেহ, দুই চোখে অপার কৌতূহলের সঙ্গে রহস্য ও কৌতুকের চাঞ্চল্য। দুই ভাইয়ের দেহই অত্যন্ত সুগঠিত ও তারা যথেষ্ট শক্তিমানও বটে। 

রাজা তাদের দিকে স্নেহময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আশীর্বাদ করে বললেন, ‘‘আজ থেকে তোমরা দুজনে অষ্টপ্রহরের অঙ্গরক্ষক হয়ে সর্বদা পুষ্পভূতি কুমারদের অনুবর্তন করবে, মনে রেখ, 

বৃত্তেন রক্ষ্যতে ধর্মো বিদ্যা যোগেন রক্ষ্যতে,

সুনীত্যা রক্ষ্যতে রাজা সদগৃহিণ্যা তথা কুলম।

( চরিত্র ধর্মকে রক্ষা করে, অভ্যাসই একমাত্র অধীত বিদ্যাকে রক্ষা করে। সুনিপুণ রাজনীতি রাজাকে রক্ষা করে, আর সুগৃহিণী বংশকে রক্ষা করে।) 

‘‘মহারাজের আদেশ শিরোধার্য’’ বলে দুই ভাই রাজা ও রাজকুমারদের প্রণাম জানালেন। মহারাজ প্রভাকর আশীষ জানিয়ে এরপর বললেন,‘‘বার্তাবহ মারফৎ খবর, বৈদেশিক হুণ দস্যুরা আর্যাবর্তের উত্তর প্রান্তে হিমালয়ের সানুদেশে পার্বত্য জনপদগুলিতে ঢুকে নিরীহ বাসিন্দাদের উপর যথেচ্ছ উৎপীড়ণ ও লুটতরাজ চালাচ্ছে। তাদের অত্যাচারে স্থানীয় প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে প্রাণ বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছে। আমি বহুবার অভিযান করে এই দুর্বৃত্তদের দেশ থেকে বিতাড়িত করলেও তারা বারংবার নতুন শক্তি সংগ্রহ করে অনুপ্রবেশ করছে। আমি চাই, তোমরা দুই ভাই রাজকটক নিয়ে হূণ দস্যুদের সমুচিত প্রতিবিধান করে জনপদবাসীদের সম্পদ ও সম্ভ্রম রক্ষা কর। যুবরাজ রাজ্যবর্ধন এই অভিযানের নেতৃত্ব দিক। মহামাত্য ভণ্ডী শত্রুর অবস্থান, শক্তি, রসদ ইত্যাদি সবকিছু কুমারদের বিশদ ভাবে বুঝিয়ে দাও। অহেতুক বিলম্বে শত্রু অধিকতর শক্তিমান হবে, সুতরাং কালবিলম্ব না করে যুদ্ধাভিযানের প্রস্তুতি নাও।’’

মহারাজের পদধূলি নিয়ে তাঁর আদেশ পালন করতে দৃঢ়সংকল্প হয়ে রাজকুমারদ্বয় অমাত্যদের সমভিব্যাহারে কক্ষ থেকে নির্গত হলেন। তিনদিনের মধ্যেই ভণ্ডীর তত্ত্বাবধানে সমস্ত আয়োজন সমাপ্ত করে রাজ্যবর্ধন বিজয়যাত্রায় বার হলেন। অনুজ হর্ষদেব ছাড়াও সঙ্গী হল স্থান্বীশ্বরের অনুরক্ত মহাসামন্ত সঙ্ঘ ও দুই সহস্র তুরঙ্গ-সৈন্য। 

দিনের তৃতীয় প্রহর অতিক্রান্ত হয়েছে। দিনপতি বিরোচনের বৈকালিক রশ্মিচ্ছটায় উপরের আকাশ যেন মরকত মণির মতন জাজ্বল্যমান। দিগন্তব্যাপী সম-বিষম প্রান্তর ও অরণ্যপথ উল্লঙ্ঘন করে ধূলি-ঘূর্ণিঝড়ের মতন একটি সৈন্যদল দ্রুত এগিয়ে চলেছে। পুরোভাগে নীলসিন্ধুবার রঙের একটি বৃহৎ অশ্বপৃষ্ঠে অষ্টাদশ বর্ষীয় তরুণ তেজস্বী মহাপরাক্রমশালী হূণবিজেতা মহারাজ প্রভাকরবর্ধনের জ্যেষ্ঠ পুত্র কুমার রাজ্যবর্ধন। তাঁর পাশে পাশে একটি শ্বেত অশ্বপৃষ্ঠে ষোড়শবর্ষীয় অনুজ হর্ষবর্ধন। দুই রাজকুমারের সঙ্গে তাঁদের দুই প্রিয় নিত্যসহচর অমাত্য কুমারগুপ্ত ও মাধবগুপ্ত। কিছুটা পিছনে ছুটে আসছে অজেয় অশ্বারোহীবাহিনী। 

কুমার রাজ্যবর্ধন কিছুদিন পূর্বেই যুবরাজের কবচ ধারণ করে যুবরাজপদে অভিষিক্ত হয়েছেন। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কুমার রাজ্যবর্ধন ক্ষত্রিয় কুলতিলক, পিতার মতই রণপ্রিয়। শৈশব থেকেই তিনি প্রথিতযশাঃ পিতা ছাড়াও বিখ্যাত সমর বিশারদদের কাছ থেকে বিভিন্ন অস্ত্রচলনা, অশ্বারোহণ, ব্যূহ রচনার কূট কৌশলের সঙ্গে সৈন্য পরিচালনার শিক্ষালাভ করেছেন। এই অষ্টাদশ বছরেই তার ব্যায়ামপুষ্ট নির্মেদ দেহটি যেন নববসন্তের সদ্য পত্রকুসুম অঙ্কুরিত সর্জবৃক্ষের ন্যায় ঋজু ও সতেজ। তাঁর প্রশস্ত বক্ষ, পেশল বাহু, সুগঠিত উরুদ্বয় ও ক্ষীণকটিতে যেন বিপুল শক্তি প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। কার্মুকের ন্যায় বক্র ও দীর্ঘ ভ্রুযুগল, ওষ্ঠ দৃঢ়বদ্ধ, দৃষ্টিতে সরলতার সঙ্গে প্রবল ব্যক্তিত্বের ছটা। সমস্ত দেহ জুড়ে নবযৌবনের লাবণ্য আর অপরিমেয় ক্ষাত্রতেজের দম্ভ ও চঞ্চলতা। অশ্বপৃষ্ঠে পঞ্চায়ুধ ছাড়াও শ্রীরাজ্যর কটিবন্ধে ত্রিশাঙ্গুলি পরিমাণ খরশান অসিপত্র। তুলনায় অনুজ হর্ষদেব অনেক চিন্তাশীল, শান্ত ও একটু ভাবুক প্রকৃতির। সুবিখ্যাত ক্ষত্রিয় বংশে জন্মের সুবাদে তিনিও অস্ত্রচালনায় যথেষ্ট দক্ষ, কিন্ত ভালবাসেন কাব্যগীতাদি ললিতকলার চর্চা। পৃষ্ঠদেশে ঝোলানো একটি ত্রিহস্ত পরিমাণ বীণযন্ত্র তাঁর নিত্যসঙ্গী। যুদ্ধের নৃশংস রক্তপাতে তাঁর বিষম অনীহা। দুই রাজকুমারেরই স্কন্ধের উপর শৈত্যনিবারক রুরুমৃগের কৃত্তিবাস, কর্ণে মণিকুণ্ডল, কন্ঠে প্রলম্বিত মুক্তাহারের মাঝে উজ্জ্বল হীরকখণ্ড রৌদ্রাভায় জ্বলজ্বল করছে। 

অনেকখানি রুক্ষ শিলাময় পথ অতিক্রম করে এসে সামনে কয়েকটি সুশ্যামল আটববিটপাকীর্ণ ছোট বড় টিলা, তাদের মাঝখান দিয়ে এঁকেবেঁকে বহে চলেছে একটি নাতিপ্রশস্তধৌতী। আশেপাশে অজস্র ফুলে ভরা গাছ। তার স্ফটিক-স্বচ্ছ জলের নীচে রংবেরঙের রত্ন-সদৃশ উপলরাশি দ্বিপ্রহরের সূর্যালোকে ঝিলমিল করছে। চতুর্দিকের নিস্তব্ধতার মাঝে নাম না জানা পাখির মৃদু কলকাকলিতে মুখর স্থানটি যেন বনদেবীর নিভৃত আবাসস্থল। 

রাজ্যবর্ধন সেই শ্যামল অরণ্যানী অধ্যুষিত নাতিউচ্চ পর্বতমূলে ঘোড়ার রাশ টেনে অবতরণ করে সামনের ছায়া সুশীতল পর্বত-সানুদশের দিকে এগিয়ে গেলেন। অনুজ হর্ষদেব, অমাত্য কুমার ও মাধব যুবরাজকে অনুসরণ করলেন। প্রবীণ সৈন্যাধ্যক্ষ সিংহনাদ সেখানেই বাহিনী থামিয়ে শিবির সন্নিবেশের নির্দেশ দিলেন। দুই দিকে দুটি নাতি উচ্চ টিলার মাঝে একটি তৃণাচ্ছন্ন গালিচার মত শ্যামল উপত্যকায় রাজকুমারদের স্কন্ধাবার সংস্থাপিত হল। 

দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সাঙ্গ হতে কিঞ্চিৎ বিলম্বই হল। সামান্য বিশ্রামের পর রাজনন্দনদ্বয় শিবির ছেড়ে বেরিয়ে পড়লেন, সঙ্গে যথারীতি পার্শ্বচর দুই ভাই কুমার ও মাধব। শীতের পড়ন্ত বেলায় ভানুদেব ধৌতীর চঞ্চলা তনুতে হোলির রঙ মাখিয়ে পাহাড়ের পিছনে আত্মগোপন করতে ব্যস্ত। রাজ্যবর্ধন পার্শ্বচর কুমারগুপ্ত ও সেনাপতি সিংহনাদের সঙ্গে হূণশক্তিকে দমন করার রণকৌশল নিয়ে আলোচনা করলেন। শ্রীহর্ষ কিছু সময় সে আলোচনায় যোগ দিলেও পরে দাদার আদেশে স্কন্ধাবারে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট পট্টাবাসে বিশ্রাম নিতে চলে গেলেন।

ষোড়শবর্ষীয় তরুণ ভাইকে সমরাঙ্গনে নিয়ে যেতে শ্রীরাজ্যর নিতান্তই অনিচ্ছা, আর হর্ষদেব নিজেও বিশেষ আগ্রহী নন। স্বভাবতঃই তিনি সেই পাহাড়-ঝর্ণা-বনানী অধ্যুষিত প্রকৃতির সৌন্দর্য আহরণ এবং মৃগয়া-ক্রীড়াতেই বেশী উৎসাহী। 

পরদিন প্রত্যুষেই শ্রীরাজ্য সখা কুমার ও সিংহনাদের সঙ্গে দুর্দমনীয় সৈন্যের বাহিনী নিয়ে শৈলশ্রেণী-মধ্যস্থিত গিরিখাতের ভিতর দিয়ে কৈলাসপর্বতের প্রভাসিনী উত্তর দিকে যুদ্ধাভিযানে অন্তর্হিত হলেন। 

হর্ষদেব প্রিয় সুহৃৎ মৃগয়াবিৎ মাধবকে সঙ্গে নিয়ে তুষার-শৈলের কন্ঠে উপকন্ঠে সিংহ-শরভ-বরাহ-মৃগ শিকার ক্রীড়ায় কাটিয়ে দিলেন কয়েকটি বহির্মুখিন দিন। 

সেদিন সূর্যদেব তখন তাঁর প্রখর কিরণাশ্ব রথে মধ্যগগনে সদম্ভে বিচরণ করছেন, মৃগয়ায় ক্ষান্ত দিয়ে শিবিরে ফিরে এলেন কুমার। চন্দ্রকিরণধবল উপাধানে মাথা রেখে, মখমল ঢাকা পালক বিছানো বেত্র-পট্টিকায় বিছানো নরম শয্যায় মৃগয়াক্লান্ত অঙ্গখানিকে এলিয়ে দিলেন হর্ষ। তাঁর দুই পাশে দুজন পরিচারিকা তালবৃন্তের ব্যজনী হাতে ধীরে ধীরে বীজন করতে লাগল। কিন্তু কুসুমকোমল শয্যাতেও তিনি কিছুতেই স্থির থাকতে পারছেন না, মনের কোণে এক অদ্ভুত আশঙ্কায় তাঁর মন আজ বড়ই চঞ্চল। 

হর্ষ শয্যা ত্যাগ করে উন্মুক্ত বাতায়নপাশে দাঁড়িয়ে দিগন্তব্যাপী প্রান্তরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন। হঠাৎ দেখলেন দূর থেকে ধূলা উড়িয়ে দৌড়তে দৌড়তে এক দূরাধ্বগ আসছে। বাতাস-বৈমুখ উত্তরীয়র দুই প্রান্ত তার দুই পাশে বিহঙ্গ-পক্ষের মত উড়ছে, দেখে মনে হচ্ছে সে যেন উড়তে উড়তে আসছে। দূরাধ্বগ কাছে এলে হর্ষ চিনতে পারলেন তাকে। সে স্থান্বীশ্বর রাজপুরীর বিশ্বস্ত বার্তাবাহক কুরঙ্গক। তার মাথায় নীলিরাগ দিয়ে রাঙানো একখানি ময়ূরকণ্ঠী চৈলচীরিকা ছোট ছোট মালার মত করে মাথায় জড়ানো, আর তার ভিতরে জ্বলজ্বল করছে একখানি লেখ। দীর্ঘ পথশ্রমে আর সূর্যস্নানে কালিবর্ণ, ধূলিধুসরিত চেহারা। বিমর্ষ মুখে লেখখানি হর্ষের হাতে দিল সে। পত্রটি তাঁর পূজ্যপাদ পিতার নয়, তাঁকে অবিলম্বে রাজধানীতে ফিরে যাবার অনুরোধ জানিয়ে মহামাত্য-সখা ভণ্ডী লিখেছেন। কিন্তু, এই তো সেদিন পিতা নিজেই তাঁদের দুই ভাইকে হূণ-বিতারণের নির্দেশ দিয়ে পাঠালেন! এরই মধ্যে কি এমন ঘটল! তাছাড়া পিতার পরিবর্তে ভণ্ডী কেন লেখ রচনা করলেন! অজানা অশুভ আশঙ্কায় বারেকের জন্য চিত্ত কম্পিত হল তাঁর। 

‘‘পিতা ভাল আছেন তো কুরঙ্গক? কোন মন্দ সংবাদ নয় তো!’’ ব্যাকুল কন্ঠে শুধালেন তরুণ রাজকুমার। 

‘‘কুমার, মহারাজ ভয়ঙ্কর দাহজ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যা গ্রহণ করেছেন।’’ অশ্রুসজল চোখে এইটুকু মাত্র নিবেদন করে মাথা নীচু করল কুরঙ্গক।

শ্রবণমাত্র আকস্মিক আঘাতে যেন শতখণ্ডে খণ্ডিত হল হর্ষের সিংহহৃদয়। কিছু সময় নির্বাক থেকে পদ্মাসনে বসে ইষ্টদেব ভগবান মহেশ্বরকে স্মরণ করে নিজেকে কিঞ্চিৎ সামলে নিয়ে ধীর ও দৃঢ় কন্ঠে প্রতিহারীদের ঘোড়ায় জিন চড়ানোর আদেশ দিলেন, পড়ে রইল মাধ্যাহ্নিক ভোজন। অশ্বপাল হর্ষবর্ধনের প্রিয় শ্বেতাশ্ব নিয়ে এলে তিনি এক লাফে তাতে চড়ে বসলেন; তাঁর সামান্য ইশারায় শিক্ষিত তুরঙ্গম বালুকা-কঙ্কর সমাচ্ছন্ন প্রান্তরের বুক চিরে নক্ষত্রগতিতে ছুটে চলল। 

অচিরেই মাধবগুপ্তর নির্দেশে অস্থায়ী মৃগয়া-শিবির ভঙ্গ করে স্থান্বীশ্বরের তুরঙ্গ-সৈন্য দ্রুতবেগে রাজকুমারের পশ্চাদানুসরণ করল। বহু যোজন পথ একদিনেই অতিক্রমের পর রাত্রি নামল। তবু হর্ষ ও তাঁর অশ্বারোহী বাহিনীর চলার বিরাম নেই, ঘোড়ার পিঠেই রাত্রি অতিবাহিত হল। পরদিন মধ্যাহ্নে শ্রীহর্ষ সসৈন্যে রাজধানীতে এসে পৌঁছলেন। নৃপতি-নিকেতনের প্রবেশদ্বারে রাজবৈদ্য সুষেণকে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গেলেন, 

‘‘কুমার, মহারাজ প্রভাকরবর্ধনের শারীরিক অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক। কঠিন আস্য-শোষী ব্যাধিতে তিনি ভোজন, এমনকি জলপানও করতে পারছেন না। আমি যথাসাধ্য করছি, বাকি ভগবান পিনাকপাণির ইচ্ছা।’’

হর্ষদেব অন্দরমহলে প্রবেশ করে দেখলেন তাঁর মহাতেজস্বী পিতার কথা বলার শক্তি নেই, দৃষ্টিও ক্ষীণ, রসনা শুষ্ক। রাজকীয় পালঙ্কে তাঁর অনিন্দ্যকান্তি দেহটি যেন শুষ্ক-শীর্ণ ভগ্ন পাদপ-শাখার মত পড়ে আছে। রাজ-অঙ্গে কৃতান্তের অমোঘ কটাক্ষপাত, কালের অঙ্গুলিতে লিখিত হয়ে গিয়েছে তাঁর জীবন-পরিসমাপ্তির ললাট-লিখন। পিতার শিথানপাশে পুষ্পবিহীন লতিকার মত নুয়ে রয়েছেন তাঁর নিরাভরণ মাতা মহারাণী যশোবতী। মৃত্যুপথযাত্রী পিতার বক্ষে জননীর সেই শীতল শ্রদ্ধার ছবিখানি দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন হর্ষ। 

পরদিন প্রভাতে নিজের মন্দিরে সমাসীন হর্ষদেবকে মহারাণীর নিজস্ব প্রতিহারিনী বেলা বুক চাপড়ে হাপুস-নয়নে কাঁদতে কাঁদতে এসে বলল, ‘‘কুমার রক্ষা করুন। মহারাজ এখনও জীবিত, অথচ মহাদেবী চিতাগ্নিতে আত্মবিসর্জন দিতে চলেছেন।’’

হর্ষ দ্রুতপদে গিয়ে দেখলেন মা যশোবতী অন্তঃপুর থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে দুহাতে অজস্র স্বর্ণ-রত্নালঙ্কার বিলিয়ে দিতে দিতে তোরণদ্বার পার হয়ে পদব্রজে এগিয়ে চলেছেন অদূরে সরস্বতী নদীর দিকে। তাঁকে ঘিরে পুরাঙ্গনারা করুণ সুরে বিলাপ করতে করতে সঙ্গে চলেছে। 

বজ্রাহত হর্ষ মায়ের কাছে গিয়ে বললেন, ‘‘মা গো আমি কি এমনই অভাগা, যে তুমিও আমাকে ত্যাগ করে যাচ্ছো? প্রসন্না হও মা, ফিরে চল।’’ বলতে বলতে মাতৃদেবীর চরণে লুটিয়ে পড়ল হর্ষদেবের চুড়া। যশোবতীর এতক্ষণের চেপে রাখা আবেগের সঞ্চিত মেঘরাশি প্রিয় পুত্রের রোদন-বিদ্যুতে খণ্ড খণ্ড হয়ে দুচোখ ভরে নেমে এল স্নেহের বারিধারা হয়ে। 

অনেকক্ষণ পরে দুঃখের বেগ কিছুটা প্রশমিত হলে মহারাণী কুমারকে মাটি থেকে তুলে দুহাতে তাঁর অশ্রু মুছিয়ে বললেন, ‘‘দ্যাখ বাবা, ধার্মিক বংশে আমার জন্ম, মহান কুলের বধু হয়ে আমি এসেছিলাম, চরিত্র আমার ঐশ্বর্য। শত-সমরের বীর হর্ষক্ষ-পুরুষের পত্নী আমি কেশরিনী। আমি বীরজা, বীরজায়া, বীর-জননী। এর অন্যথা হওয়া কি সম্ভব! আমার একমাত্র কামনা, আমি সধবা থেকে মরব। আর্যপুত্র ছাড়া দগ্ধস্বামী রতির মত বিলাপ করতে আমি চাই না। তোদের পিতার পদধূলির মতই আমি আগে উঠব স্বর্গলোকে।’’

পুরনারীদের ক্রন্দনে ভারাক্রান্ত হল দিগ্বিদিক। সরস্বতীর তটপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দীনতমা নারীর মত শান্ত চোখে একবার চিতার লেলিহান শিখার দিকে তাকালেন মহারাণী যশোবতী। তাঁর দৃষ্টিপাতে প্রষ্ফুটিত কুসুমের প্রসন্নতা। তারপর ইষ্টদেব সূর্যকে প্রণাম করে স্বামীর চরণযুগল স্মরণ করতে করতে ধীর অকম্পিত পদে প্রবেশ করলেন অগ্নিতে। স্নিগ্ধ চন্দ্রমা যেন নবোদিত সূর্যের সঙ্গে সন্ধিক্ষণে মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। 

জননীর মৃত্যুতে বিহ্বল হর্ষ জ্ঞাতিকুটুম্ব ও পরিজনদের সঙ্গে ফিরে এলেন রাজপুরীতে। মৃত্যু পথযাত্রী পিতার চরণদুটি বুকে জড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগলেন শিশুর মত। মহারাজের চোখে তখন দৃষ্টিশূন্য, কিন্তু পুত্রর রোদনধ্বনিতে সেই শেষবারের মত ক্ষণকালের জন্য ফিরে এল তাঁর বাহ্যচেতনা। ক্ষীণ কন্ঠে থেমে থেমে উচ্চারণ করলেন তাঁর অন্তিম আশীর্বাণী। 

‘‘নিয়তির স্বভাব অতি তরল। সুখের বিধান নিয়ে, মানুষের সংসারে প্রথমে তিনি আসেন; তারপরে তিনি আনেন অকস্মাৎ এক নিদারুণ দুঃখ। যেন জীমূত মাঝে সৌদামিনীর বিভা। প্রথমে আলোর ঝলকানি, অবসানে বজ্রের পলক-প্রলয়।’’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘‘কাঁদিস না হর্ষ, তুই পুষ্পভূতি বংশের জ্বলন্ত সূর্য, আমি মানসচক্ষে দেখছি এই পৃথিবী একদিন তোর আজ্ঞাবহ হবে। তোর মত পুরুষ-সিংহের অধীর হওয়া উচিত নয়। জানবি প্রজাদের প্রথম অবলম্বন হচ্ছে অচঞ্চল মহাপ্রাণ নরপতি, তারপরে তারা রাজার সম্পদ, ক্ষমতা ও বংশমর্যাদা দেখে। যে জনমনের আশ্রয়, মনুষ্যশ্রেষ্ঠ, তার কোন অবস্থাতেই বিচলিত হতে নেই। আশীর্বাদ করি মর্তলোকে তোর কীর্তির কথা চিরকাল ঘোষিত হোক।’’ বলতে বলতে আর পারলেন না। রাজাধিরাজের আঁখিপল্লব নিমীলিত হয়ে এল ধীরে ধীরে। নিস্তব্ধ কক্ষে ভূপতি প্রভাকরবর্ধন অন্তিম নিঃশ্বাস ফেললেন। আর কিছুই রইল না তাঁর, পড়ে রইল কেবলমাত্র বিপুল যশঃকীর্তি। 

দ্রুতগামী অশ্বারোহী দূরাধ্বগের মুখে হৃদয়বিদারক সংবাদ শুনে হুণবিজয় অসম্পূর্ণ রেখে বহু দূরের পথ অবিশ্রামে পার হয়ে রাজধানীতে ফিরে এসেছেন কুমার রাজ্যবর্ধন। জ্যেষ্ঠভ্রাতার আসার খবর শুনে হর্ষ এগিয়ে গেলেন। কিন্তু এ কি চেহারা হয়েছে দাদার! সারা দেহ পথের ধূলায় ধূসর, রৌদ্রে ভেজা ললাট-পট্ট থেকে স্বেদবিন্দু চিবুকের নবশ্যাম তৃণের মত পাতলা শ্মশ্রু ভিজিয়ে ঝরে পড়ছে। হূণ-সংগ্রামে শস্ত্রের আঘাতে ক্ষতস্থানগুলি শুভ্র বস্ত্রখণ্ড দিয়ে বাঁধা, রক্তধারা কালচে হয়ে জমাট বেঁধে আছে। কোন বাহুল্য আজ নেই তাঁর সঙ্গে। ছত্রধর পড়ে রয়েছে পিছনে; আচমন, ভৃঙ্গার, তাম্বুল, পরিচ্ছদ বাহককেরা সঙ্গে নেই। একেবারে কৃশ হয়ে গেছেন রাজ্য, কতদিন যে স্নান-অশন-শয়ন হয় নি! অমন দেবসেনাপতি কার্তিকেয়ের মত শৌর্য ও রূপ যেন নিয়তির নিদারুণ আঘাতে অঙ্গারে পরিণত হয়েছে। পাহাড় ধ্বসে পড়েছে, তাই আজ যেন বিহ্বল গুহাহীন কেশরী। সুর্যদেব অস্ত গিয়েছেন, অন্ধকারে কাল হয়ে হেঁটে আসছে দিন, ভেঙে পড়েছে বিশাল মহীরুহ, ছায়াশূন্য বৃক্ষতলে নিরাশ্বাস নিরালম্ব পথিক। 

শ্রীরাজ্য ভাইকে দেখে এতক্ষণের উদ্গত আবেগাশ্রু আর সংবরণ করতে পারলেন না। শ্রীহর্ষকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন শিশুর মত। অনেক সময় পরে বর্ষণক্লান্ত শরত-মেঘের মতই স্তিমিত হল রোদনবেগ। রাজ্যবর্ধন সরস্বতীর তীরে স্নানভূমিতে গিয়ে সমস্ত আভরণ ত্যাগ করে অনাদরে মৌলিতে বাঁধলেন ঘনকৃষ্ণ বিস্রস্ত কুন্তলরাশি। তারপর দুই ভাই ক্ষৌমবাস পরিধান করে ভূমিতলে তৃণশয্যায় শয়ন করলেন। 

‘‘ভাই হর্ষ, আজ আমাদের পিতৃদেব স্বর্গারোহন করেছেন। তাঁর শতাধিক অশ্বমেধের কীর্তিতে আমাদের বংশ এ ভারতভূমিতে উজ্জ্বল। পিতার সঙ্গে মাতৃদেবীও চলে গেলেন! নিজেকে আমার মনে হচ্ছে যেন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ অতল শোকসাগর-তরঙ্গে নিমজ্জমান হাল ভাঙা, পাল ছেঁড়া, নাবিকহীন সামান্য এক তরণী। রাজ্যসুখ আমার জন্য নয় রে, তুই গ্রহণ কর আমার যৌবরাজ্য, আমার রাজ্যচিন্তা, রাজলক্ষ্মী।’’

অগ্রজের ভাষণ শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন হর্ষদেব। যেন শানিত শূলে তাঁর কিশোর-হৃদয়খানি দ্বিধাবিভক্ত হতয়ে রক্তক্ষরণ করতে লাগল। 

পরদিন। স্থান্বীশ্বরের রাজসভা বড়ই নিস্প্রভ। নহবতে বাজেনি প্রভাতের মাঙ্গলিক সুর, রাজদরবারের প্রতিটি দ্বারে নিশ্ছিদ্র প্রহরা, সভার বিশিষ্ট পণ্ডিত ও সভাসদদেরও আজ সেখানে প্রবেশাধিকার নেই। পাশের মন্ত্রণাকক্ষে শুধু মাত্র মহামন্ত্রী ভণ্ডী। তাঁর প্রশস্ত ললাটে চিন্তার বলিরেখা। একটু পরেই প্রবীণ সেনানায়ক সিংহনাদ ও রাজভ্রাতা হর্ষবর্ধন চিন্তিত চিত্তে কক্ষে প্রবেশ করলেন। 

আজ সকালেই কনৌজ থেকে ভগ্নী রাজ্যশ্রীর প্রিয় ভৃত্য সংবাহক এক দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছে। তা যেমন নিদারুণ, তেমনি গুপ্ত। রাজ্যজুড়ে মহারাজের প্রয়াণ-শোক ছাপিয়েও তার গুরুত্ব অপরিসীম। 

‘‘সংবাহক কি সংবাদ নিয়ে এসেছে তা আমাকে বিস্তারিত বলুন, ভণ্ডী।’’ মন্ত্রণাকক্ষে প্রবেশ করে আসন গ্রহণ না করেই রাজ্যবর্ধন উদ্বিগ্ন মুখে বললেন। 

‘‘রাজন, সংবাহক একটি দুঃসংবাদ এনেছে।’’ ভণ্ডী তাঁর স্বভাবসুলভ ধীর ও গম্ভীর স্বরে বললেন।‘‘সপ্তাহকাল আগে মালবরাজ দেবগুপ্ত এবং গৌড়রাজ শশাঙ্ক হঠাৎই একযোগে রাত্রির অন্ধকারে কনৌজ আক্রমণ করে, এবং কনৌজ তাদের করায়ত্ত হয়।’’

‘‘সে কী!’’ রাজ্যবর্ধন অস্ফুট চিৎকার করে বললেন, ‘‘ভগ্নী রাজ্যশ্রী ও ভগ্নীপতি মৌখরিরাজ গ্রহবর্মা নিরাপদ তো? আমি তাঁদের জন্য বিশেষ চিন্তিত।’’

‘‘বলতে আমার বুক ভেঙে যাচ্ছে রাজন,’’ ভণ্ডী মাথা নীচু করে বললেন, ‘‘কনৌজরাজ সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় পরাজিত ও নিহত হয়েছেন, আর ওরা আমাদের দেবীপ্রতিমা ভগ্নীকে কোন এক গোপন কারাগারে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে। দুর্মতি মালবরাজের পরের লক্ষ্য স্থান্বীশ্বর গ্রাস করা। এখন মহারাজকুমারের যা আদেশ!’’

এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা শুনে মন্ত্রণাকক্ষে সূচ-পতনের নীরবতা নেমে এল। মহারাজ দুহাতে কপাল চেপে ধরে হাহাকার করে উঠলেন...

‘‘হে মহেশ্বর! এমন মর্মান্তিক সংবাদ শোনার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন!’’

কুমার হর্ষ পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের মত মন্ত্রণাকক্ষে পাদচারণা করতে লাগলেন। 



(ক্রমশ প্রকাশ্য)



0 comments: