undefined
undefined
undefined
স্মৃতির সরণীঃ মধুছন্দা মিত্র ঘোষ
Posted in স্মৃতির সরণী
স্মৃতির সরণী
মুম্বই মেরি জান
মধুছন্দা মিত্র ঘোষ
কখনও কখনও আনকোরা অচেনা অথচ একটা ভালো লাগা সুবাস এসে বুকে ধাক্কা মারে। ঋদ্ধ করে। আরবসাগরের ঢেউ-ছলকানো ও সহ্যাদ্রি-পশ্চিমঘাট পাহাড়ঘেরা মুম্বই মহানগরী। যার কী ভালো একটা মায়াবী নামও আছে... ‘স্বপ্ননগরী’। আলোকিত বৈভব ও অবছায়া চাঁদোয়া ঢাকা মুম্বই নগরিয়া।
অ্যাবসোলিউটলি রিডিকিউলাস দিবাস্বপ্নগুলোতে তো ছিলই না, এমনকি বহু দূরাগত কোনও ভাবনার পরিমণ্ডলেও ছিল না, যে এই পশ্চিম মুলুকে এসে বসত করতে হবে। এমনকি ঘুমঘোরে দেখা ঝিঙ্কু ঝিঙ্কু স্বপ্নেও কদাপি মনে আসেনি মুম্বইযাপনের কথা। কলকাতার একান্ত চেনা চৌহদ্দি ছেড়ে এই দূর প্রবাসে পাড়ি জমানো কি চাট্টিখানি কথা! কিন্তু সব কিছু ঘটল বেশ আচম্বিতেই।
হররা খুশিয়াল ব্যাপারটাও ছিল প্রথমদিকে। আবার কলকাতার জন্য মন-কেমনও। দক্ষিণ কলকাতার নিজস্ব ছোট্ট ফ্ল্যাট, গোছানো সংসার, একচিলতে পশ্চিমের বারান্দা, চেনা পরিপাটি রান্নাঘর। ওদিকে আবার প্রিয়স্য প্রিয় গড়িয়াহাট মার্কেট, কলেজ স্ট্রীট কফিহাউস, নন্দন-আকাদেমি চত্বর, সাউথ সিটি মল, মেট্রো রেল, বন্ধু-আত্মীয়-পরিজনদের ছেড়ে থাকার বেদনায় গলার কাছে কষ্টটা দলা পাকিয়ে উঠতো খুব। সব কি তবে এখন আউট অফ ফোকাস!
আপাত পরবাস যাপনের খাতিরে মুম্বইকে বিশদে চেনার তাগিদ বোধ করি। মারাঠা সম্প্রদায়, তাঁদের লোকাচার, উৎসব, সাহিত্য, ইতিহাস, সঙ্গীত, রন্ধন, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ইত্যাদিকে খুঁটিয়ে জানার।
মুম্বইকে মানুষজন আহ্লাদী নাম-বিশেষণ দিয়েছেন ‘স্বপ্ননগরী’। কথাটা কিন্তু মোটেও অতিরঞ্জিত নয়। আরও কত যে নাম আছে এই নগরটার! নগর তো নয় – মহানগর। ‘কমার্শিয়াল ক্যাপিটাল’ বা ‘বাণিজ্য নগরী’, ‘বলিউড’, ‘লণ্ডন অফ দ্য ঈস্ট’, ‘মেট্রো ক্যাপিটাল’, ‘মুম্বই মেরি জান’ আর স্থানীয় মুম্বইকররা নিজস্ব অস্মিতা নিয়ে মুম্বইকে ডাকেন ‘আমচি মুম্বই’। অত্যাধুনিক শহর হিসেবে সমস্ত বিশ্বের মধ্যে ষষ্ঠ স্থান আলোকিত করে আছে মুম্বই।
মুম্বইকে বলা হয় ‘দ্য মোস্ট কসমোপলিটন সিটি অফ ইণ্ডিয়া’। মুম্বইকররা অন্যান্য প্রাদেশিক ভাষাভাষী মানুষদের প্রতি সৌভ্রাতৃত্ব ও উদার মনোভাব বজায় রেখে চলেন। নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান, তবু বিবিধের মাঝে এক আশ্চর্য সমঝোতা রেখে, সবাইকে নিয়ে চলার ইচ্ছে আছে বলেই মুম্বই ভারতের অন্যান্য শহরগুলির থেকে অত্যাধুনিকতায় ও ঠাটেবাটে, বনেদিয়ানায় অনেকটাই এগিয়ে। নিবিড় যতটা – গভীরও। প্রকৃতির খোলা আঙ্গিনায় অপাঙ্গে বিছিয়ে থাকা সুনীল সাগর। অন্যপাশে ঠেস দিয়ে থাকা সহ্যাদ্রি ও পশ্চিমঘাট পাহাড়ের অনন্ত বিস্তার। দিন ও কালের চিরকালীন খেলাচ্ছল নিয়ে মহানগরের প্রেক্ষাপটে আঁকা থাকে অনেক অজানা রূপকথা। কিছু বা ফেলে আসা অতীতের জাতীয় পরম্পরা। কিছু একান্তই ব্যক্তিগত ও দেশজ শ্লাঘার। সম্ভ্রান্ত বনেদিয়ানা ও আভিজাত্য মুম্বইয়ের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
এই তো, যেদিন প্রথম পা রাখি মুম্বইতে, সেদিনই সন্ধ্যের দিকে সামান্য থিতু হয়ে বাইরে বের হলাম। অনেকগুলো ইচ্ছে জমে আছে। সাংসারিক কেনাকাটা করে নামী রেস্তোঁরায় সেঁধোলাম, মুম্বইয়ের জিভে জল আনা সাবেকী খাবার ‘পাওভাজি’ ব্যাপারটার আস্বাদ নিতে। কতদিন মনে পুষে রেখেছিলাম, মুম্বয়ে প্রথম রেস্তোঁরাবাজিটাই করবো পাওভাজি চেখে।
আক্কা মহারাষ্ট্রের অন্যতম সেরা খাবার এই পাওভাজি। স্ট্রীট ফুড কালচারে পাওভাজি একটা দুর্দান্ত রেসিপি। ইয়া বড় লোহার তাওয়ায় চটকানো সবজি ও প্রচুর রংচঙা মশলাপত্তরের কারিকুরিতে কষা গরমাগরম গ্রেভি। সাথে জ্যাবজ্যাবে করে মাখনে ভেজানো দু’পিস পাও। খোপ কাটা স্টীলের থালায় কয়েক কুচি পেঁয়াজ, ধনেপাতার চাটনি, কয়েকফালি মশলা মাখানো কাঁচালঙ্কা ও একটুখানি মিক্সড আচার বা পাতিলেবুর কোয়া। পাওভাজি প্রচুর গুরুপাক, প্রচুর মশলা, মাখন – সমস্তটাই প্রচুর। তবে পেট ভরা খাবার হিসেবে পাওভাজি ব্যঞ্জনটি মুম্বইকরদের রসনাতৃপ্তির ব্যাপক খোরাক। পকেট-ফ্রেণ্ডলিও। পথের ধারে, পর্যটক সমাগম হয় এমন ধাবাগুলোয়, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া থেকে অফিসযাত্রী – সবারই প্রিয়। পাওভাজি বানানোর পদ্ধতি মোটামুটি এক হলেও কারিগর বিশেষে উপাদান মিশ্রণ ও রান্নার কৌশলে নিজস্ব সিক্রেট থাকে।
‘‘রাস্তে ওয়ার্চি খায়চ্’’ হিসেবে বড়া পাও, মিসল পাও, কান্দা ভাজি, কান্দা পোহা, বটাটা ওয়াড়া, পানিপুরি, মেদু ওয়াড়া – সবই মুম্বইকরদের কাছে রসনাপূর্তির শেষ কথা। মুম্বইকরদের কাছে ‘স্ট্রীট আইকন’ হল এই ওয়াড়া পাও, যা কিনা নিতান্তই পাতি আলুর চপ। এখানে বলে ‘বড়া’ বা ‘ওয়াড়া’। আর পাও মানে গোলাকৃতি পাঁউরুটি – আস্ত একটা পাও সামান্য চিরে তার মধ্যে ‘বড়া’ ঢুকিয়ে মাখনে এপিঠ-ওপিঠ ভেজে মশলা মাখানো কাঁচালঙ্কা ওপরে সাজিয়ে দেবে। ধুমসো ওই ওয়াড়া পাওয়ে একখান সুখের কামড় দিতে প্রথমেই যেটা লাগবে তা হল কৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন করানোর মত বিশাল হাঁ।
মুম্বইকরদের বড় আদরের জায়গা জুহু বীচ। বিশ্বের বৃহত্তম বীচগুলোর মধ্যেই এর স্থান। সবসময় ভিড়ঠাসা। নানান বিনোদনী পসরায় সেজে থাকে বীচ প্রাঙ্গন। রকমারি মুখরোচক মুম্বইয়া খাবারদাবারের এলাহি হাতছানি। জুহু বীচের নামী স্টলগুলোয় পাওভাজির স্বাদ কিন্তু নিতেই হবে মুম্বই বেড়াতে আসা প্রতিটি ভিনরাজ্যবাসীর। এদের এখানকার পাওভাজির স্বাদও ‘জরা হঠকে’। কয়লার আগুনে সেঁকা বিটলবন ও পাতিলেবু ঘষা রোস্টেড মকাইয়ের জন্য জুহু বীচে হা-পিত্যেস করে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয়। মকাইওয়ালার সহকারি সেই লাইন সামলায়। তার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে যে ‘‘আমায় আগে ছেড়ে দে, বেটা’’ বলবেন, তা কিন্তু হবে না মোটেই। যখন আপনার ‘বারি’ আসবে, আপনি ভুট্টার স্তূপ থেকে নিজে পছন্দ করে তাকে এগিয়ে দিলে সে সেঁকে, ‘মসালা মারকে’ হাতে তুলে দেবে। জুহু বেড়াতে গেলেই মকাইদানা, পাওভাজি আর ফেরার পথে জুস্-পার্লারে ফালুদা-আইসক্রীমের লোভনীয় ককটেল। এটার সাথে ওটা মিশিয়ে, সেটার সাথে এটা মিশিয়ে – নানান ফ্লেভারের রকমারি মিশ্রণ ভর্তি কাঁচের লম্বা সুদৃশ্য কাপে সাজানো সম্ভার। আহা – লিখতে লিখতেই আবারও জিভে জল। আয়েসী চুমুক দিয়ে সেই মনকাড়া আভিজাত্যের স্বাদ নিতে নিতে ভাবি – এই অমৃত ভাণ্ডারের জন্যই বোধহয় দেব-অসুরের মধ্যে ওই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইটা হয়েছিল।
ওই যে, ধারাবাহিক লেখাটির শুরুতেই বলেছিলাম, একটা আনকোরা অচেনা গন্ধ, ভালো লাগা গন্ধ – সেই মায়াবী সুবাসের কাছে কি আমার মায়া জড়ানো ঋণ ছিল কিছু? মুম্বইয়ে যাপন খুঁজে যাই। যেখানে সৃষ্টিও থাকবে না, সম্ভাবনাও থাকবে না, কোনও আগামী বিপর্যয়ের। মগজ ভুলিয়ে দেবে ‘ওহ ক্যালকাটা’ গর্বে কাটানো সাম্প্রতিক অতীতকে। আমিও বলবো ‘‘আমচি মুম্বই!’’ হয়তো ওদের মত সোচ্চারে বলা হয়ে উঠবে না। সামান্য বাধোবাধো ঠেকবে। তবু বলি এখন। এর মাঝে কি এমন ঋণ থাকতে পারে?
0 comments: