0

সম্পাদকীয়

Posted in




সম্প্রতি জানা গেল একটি সর্বজনগ্রাহ্য ক্ষুধা সংক্রান্ত ক্রমিক তালিকায় ১২১ টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১০৭। ছোট্ট একটি খবর কিন্তু তার প্রভাব বিধ্বংসী! ক্ষুধা। এ এমন এক প্রাকৃতিক সৃষ্টি, যা না থাকলে প্রয়োজন হতো না অনেক কিছুরই। একই নিঃশ্বাসে এ কথাও মনে রাখতে হবে ক্ষুন্নিবৃত্তি হলেই সম্ভব এমন অনেক কিছু, যা মানুষকে মানুষ হিসাবে দিয়েছে পরিচিতি। যেমন শিক্ষা। যে শিক্ষার সঙ্গে আবার বইয়ের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। তাই কোনও রাজনৈতিক কাজিয়ার কারিগর বা অংশগ্রহণকারী না হয়েও এই সত্যটুকু মাথা নত করে মেনে নিতেই হবে। কারণ মিথ্যাচারী শাসক ছাড়া প্রত্যেকেই নির্দ্বিধায় এটুকু অন্তত স্বীকার করবেন যে পেটের ক্ষুধা মেটায় দুবেলা দুমুঠো অন্ন আর মনের চাহিদা মেটায় প্রকৃত জ্ঞান। বইয়ের কাজ পিপাসু মনের কাছে আধারিত জ্ঞান পৌঁছে দেওয়া। কে বা কারা সেই দায়িত্ব নেবেন? অভুক্ত শিশুদের মিড ডে মিলের পুষ্টিকে যাঁরা অবৈধ মুনাফায় রূপান্তর করেন, তাঁরা? অথচ তাঁদেরই তো সেই ভূমিকা গ্রহণ করার কথা ছিল। তাঁরাই তো প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন জাতির মেরুদণ্ড নির্মাণ করার। যদিও সংখ্যাহীন, ক্ষুধাতাড়িত যে জনগণ তাঁদের প্রতিশ্রুতিমঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাঁরা জানতেন না শিরদাঁড়া আসলে চেতনার অপর নাম।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন। শুভেচ্ছা নিরন্তর।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in





সনাতনী পুরাণ মতে- হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী দশম মহাবিদ্যার প্রথম মহাবিদ্যা হচ্ছেন কালী বা কালিকা।এই কালীকে নিয়ে সারা ভারতবর্ষে যে উন্মাদনা তৈরি হয় তার পূজাকে কেন্দ্র করে বাঙালির যে আবেগ তা অনেকটাই কালী কেন্দ্রিক আসলে বাঙালি মাতৃসুখী জাতি।ফলে এখানে বৈষ্ণবী ধর্ম, শৈব ধর্ম এই যে বড় দুটি ধর্ম তার পাশাপাশি শাক্ত চিন্তার ও একটা বিপুল বিকাশ হয়েছে সমস্ত বঙ্গভুলি জুড়ে।সাধক কবি রঞ্জন রামপ্রসাদ সেন তাঁর আশ্চর্য সব পদগুলি তার সঙ্গে রাজা রামকৃষ্ণের লেখা পদ,এরা সকলেই শাক্তপদাবলীর সাধনা করেছেন।তাদের মধ্যে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব সাধক প্রবণ বামাক্ষেপা রাজা রামকৃষ্ণ, কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ অত্যন্ত বিখ্যাত। রামপ্রসাদের হালিশহর মন্দির, শ্রীরামকৃষ্ণের দক্ষিণেশ্বরের সাধনভূমি, বামাক্ষেপার তারাপীঠ, রাজা রামকৃষ্ণের পঞ্চবটি আসন সবই বাঙালি জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে গেছে।এছাড়াও আছেন অনেক বড় বড় সাধক।যারা কালী সাধনা করেছেন।কালীকে ভেবেছেন মুক্তির আলয়।এই যে সাধন প্রণালী, সাধন পদ্ধতি যা কৃষ্ণানন্দ আনন্দবাগীশ তৈরি করেছিলেন। কিন্তু বাঙালি জীবনে এই যে দীপান্বিতা উৎসব বা দীপাবলি তার সঙ্গে শ্যামাকালী পূজার একটা অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে এবং জড়িয়ে গেছে বহু বছর ধরে।পাশাপাশি ফলহারিনী কালীপূজো এবং রটন্তী কালীপূজো এটিও বাঙালি জীবনে অত্যন্ত বড় উৎসব বলে দিনে দিনে পরিগনিত হয়েছে।ফলহারিনী কালীপূজো রামকৃষ্ণ দেব করেছিলেন।রটন্তী কালীপূজোও হয় বাঙালির জীবনের অঙ্গে হিসেবে।এবং পূর্ববঙ্গে যারা বাঙালি ছিলেন হিন্দু বাঙালিরা যেকোনো শুভ কাজে একটি কালী পূজা দিতেন।এবং সেই কালীপূজা বিবাহ উপলক্ষে হতে পারে,অন্নপ্রাশন উপলক্ষে হতে পারে,উপনয়ন হিসেবে হতে পারে,চূড়াকরণ উপলক্ষে হতে পারে।যেকোনো শুভ কাজে কালী পূজা অবধারিত। ফলে বাঙালি জীবনে কালীর মহিমা এবং বৈভব তার আধ্যাত্মিক চেতনা তা নাস্তিকের কাছে গ্রহণ যোগ্য নয় কিন্তু আস্তিকের কাছে তিনি কালী পূজাকে সর্বাগ্রে সমস্ত জায়গায় প্রচারের কাজে সহায়তা করেন।পাশাপাশি বাঙালি যেখানে গেছেন তা এলাহাবাদ হোক আর কাশীই হোক সেখানে একটি কালী মন্দির বানিয়েছেন।এবং সেই কালী মন্দিরকে কেন্দ্র করে নানা রকম কর্মকাণ্ড আজও চলে।ফলে কালী বাঙালি জীবনের এক অঙ্গ হিসেবে বাঙালি বিশ্বাসী জনের জীবনে অন্যতম উৎসব।

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। পয়লা বৈশাখে গণেশপুজো-হালখাতা দিয়ে সূচনা আর চৈত্র সংক্রান্তির গাজনে সমাপ্তি। সেই অনুসারে সারা বছরেই নানা পুজো-পার্বণ থাকলেও বাংলার প্রকৃত উৎসবের মরশুম আরম্ভ হয় দুর্গাপুজো দিয়ে আর শেষ কালীপুজোতে। তিথি নক্ষত্রের হিসেবে আশ্বিন-অমাবস্যা (মহালয়া) থেকে কার্তিক-অমাবস্যা (কালীপুজো)— এই এক মাস কাল হল বাংলার প্রধান উৎসবের মরশুম। দুর্গাপুজো শেষ হলে আসে লক্ষ্মীপুজো এবং তার পরে কালীপুজো তথা দীপাবলি।

দীপাবলি আদতে আলোর উৎসব। বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের মধ্যেই এক ধরনের আলোক উৎসবের কথা বলা আছে। তারই একটি হল হিন্দু তথা ভারতীয় সংস্করণ, দীপাবলি।

এই উৎসবে পুজোর থেকেও বেশি উল্লেখযোগ্য হল দীপমালার সজ্জা। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতীয় সংস্কৃতির নানা কাহিনি, যেগুলির সঙ্গে কালীর থেকেও বেশি সম্পর্ক লক্ষ্মীর।

প্রচলিত বিশ্বাস হল— কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতেই সমুদ্র থেকে ধন্বন্তরী উঠে এসেছিলেন। তাই এই তিথির নাম ধন্বন্তরি ত্রয়োদশী বা সহজ কথায় ধনতেরাস। সে জন্য এই দিন ধনের উপাসনা করতে হয় আর ওই দিন একই সঙ্গে দেবী লক্ষ্মীও সমুদ্র থেকে উঠে আসেন বলে লক্ষ্মীর আরাধনাও করা হয়। লক্ষ্মী পুরাণ অনুযায়ী স্বর্গে ফিরে গেলেন, কার্তিক-অমাবস্যায়। তাই লক্ষ্মীর স্বর্গে ফেরা উপলক্ষে স্বর্গকে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল আলোকমালায়। আর একটি কাহিনি অনুসারে, লঙ্কা বিজয় সেরে সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে রামচন্দ্র যে দিন অযোধ্যায় ফেরেন, তিথি হিসেবে সেটি ছিল ওই কার্তিক-অমাবস্যা। ভগবান বিষ্ণুর সপ্তম অবতার রামের লীলাসঙ্গিনী লক্ষ্মীদেবীকে বরণ করে নেওয়ার জন্য সেই রাতে অযোধ্যা নগরীকে সাজানো হয়েছিল অগণ্য দীপমালায়। অন্য এক কাহিনি আবার বলে, কার্তিক-চতুর্দশীতে কৃষ্ণ নরকাসুরকে বধ করে তার কারাগারে বন্দি ১৬ হাজার গোপিনীকে মুক্ত করেন। সেই উপলক্ষে, পরের দিন অর্থাৎ কার্তিক-অমাবস্যাতে আলোকমালা সাজিয়ে উটহ হয়েছিল। দীপাবলিতে দীপ জ্বালানো নিয়ে এমন হরেক কাহিনি প্রচলিত আছে হিন্দু পুরাণ-শাস্ত্রগুলিতে।

শৈব (শিবের উপাসক), বৈষ্ণব (বিষ্ণুর উপাসক), শাক্ত (শক্তির উপাসক), গাণপত (গণেশের উপাসক), সৌর্য (সূর্যের উপাসক)— ভারতীয় হিন্দু ধর্মের এই পাঁচ উপ-বিভাগের অন্যতম শাক্তদের প্রাধান্য পূর্ব ভারতেই বেশি। প্রাচীন কাল থেকেই বাংলায় এই ধারা চলে আসছে। বাংলার উৎসবের মরশুমে এই শক্তি আরাধনাই হয় দুর্গা ও কালীপুজোর মধ্যে দিয়ে। কিন্তু মধ্যযুগে চৈতন্যদেব প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবধারার প্রাধান্যও লক্ষ্য করা যায় বাংলার শক্তি আরাধনার ক্ষেত্রে। দেবীপক্ষের শেষ দিন অর্থাৎ আশ্বিনের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমায় হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। আর তার পনেরো দিন পরে কার্তিক-অমাবস্যায় দীপাবলীর দিন হয় কালীপুজো। হিন্দু পুরাণ-শাস্ত্র অনুসারে দেবী কালিকা দুর্গারই আর এক রূপ। শক্তির উপাসকেরা দীপাবলীর দিন কালীপুজো করেন আর সে দিন সারা ভারত জুড়ে বিষ্ণুর উপাসকেরা আরাধনা করেন মহালক্ষ্মীর। বঙ্গদেশেও তার ব্যতিক্রম হয় না। কালীপুজোর রাতে দীপান্বিতায় অলক্ষ্মী বিদায় ও মহালক্ষ্মীর পুজো দিয়ে সূচনা হয় পশ্চিমবঙ্গীয়দের কার্তিক, পৌষ, চৈত্র ও ভাদ্র মাসের লক্ষ্মী পুজোর। এমনকী বাংলার অন্যতম প্রাচীন শক্তিপীঠ মহাতীর্থ কালীঘাট মন্দিরে এই কার্তিক-অমাবস্যায় দীপান্বিতা মহালক্ষ্মীর পুজো করেন হালদার বংশীয় সেবাইতরা। এর কারণ জানতে গেলে আমাদের চোখ ফেরাতে হবে অতীতের দিকে।

অমাবস্যা তিথি থাকলে কালীপুজোর দিন সূর্যাস্তের ২৪ মিনিটের মধ্যে আরম্ভ হয় লক্ষ্মীপুজো। তার আগে অবশ্য সেরে নেওয়া হয় অলক্ষ্মী বিতাড়ন পর্ব। তিন বা চার ইঞ্চি মাপের অলক্ষ্মী পুতুল তৈরি করা হয় গোবর বা জলে চটকানো পিটুলি (চালবাটা) দিয়ে। সেটিকে রাখা হয় মন্দিরের গর্ভগৃহের বাইরে। এ বার অলক্ষ্মী পুতুলের সামনে পাটকাঠিতে আগুন লাগিয়ে সেবাইতরা তিন বার মন্দির প্রদক্ষিণ করেন। আর জোরে জোরে কুলো বাজিয়ে অলক্ষ্মী বিদায় করে আরম্ভ হয় লক্ষ্মীপুজো। এটি যেহেতু সেবাইতদের পুজো তাই নিরামিষ ভোগ আসে সেবাইতদের বাড়ি থেকেই। সেগুলি রাখা হয় কালীমূর্তির সামনেই। আবার কালীর যে হেতু আমিষ ভোগ, সেখানে মাছ-মাংসও থাকে, সেগুলিও রাখা হয় তার পাশেই, তবে লক্ষ্য রাখা হয় যেন আমিষ ও নিরামিষ ভোগ ছোঁয়াছুঁয়ি না হয়। ভোগ ছাড়াও সেবাইতরা দেন তাঁতের শাড়ি। সেগুলি কালীর অঙ্গেই পরানো হয়। ভোগ-বসন সাজানোর পরে পুরোহিত পুজো শুরু করেন। প্রায় তিন-সাড়ে তিন ঘন্টা ধরে হয় কালীপুজোর সন্ধ্যার ওই দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজো।

হিন্দু পুরাণ-শাস্ত্র অনুসারে লক্ষ্মী ধন-সম্পদ-সৌভাগ্যের দেবী। তাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে লক্ষ্মীপুজোর আলাদা এক গুরুত্ব আছে। বাঙালিরাও তার ব্যতিক্রম নয়। বাঙালির ঘরে সোমবচ্ছর উপাচার, নৈবেদ্যর বাহুল্য ছাড়াই লক্ষ্মীর উপাসনা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেখানে পুরোহিতেরও প্রয়োজন হয় না। সামান্য ফল-ফুল আর পাঁচালি-ব্রতকথা দিয়েই সারা হয় বাঙালি গৃহবধূর লক্ষ্মী-আরাধনা। অনেক বনেদি বাড়িতে এখনও কালীপুজোর সন্ধ্যায় দীপান্বিতা লক্ষ্মীর পুজো হয় নিয়ম মেনে।

কালিকাপুরাণের ছাব্বিশতম অধ্যায়ে কামাক্ষার বর্ণনা রয়েছে। পূর্বে এই পর্বতের উচ্চতা ছিল শতেক যোজন। কিন্তু মহামায়া সতীর যোনি অঙ্গ পতিত হওয়ার পর এই উচ্চ পর্বত মহামায়র যোনি মন্ডলের ভার সহ্যে করতে না পেরে কেঁপে উঠলো এবং ক্রমশঃ পাতালে প্রবেশ করতে লাগলো। তখন শিব, ব্রহ্মা, বিষ্ণু প্রত্যেকে একটা করে শৃঙ্গ ধারন করলেন। তাদের সঙ্গে মহামায়া স্বয়ং সমবেত হলেন।

কামরূপ কামাক্ষা মন্দিরের দেওয়ালে পাথরে খোদাই বিভিন্ন ভঙ্গিমায় কামের বিভিন্ন সূত্রের মূর্তিই এর দৃষ্টান্ত।তান্ত্রিকরা কামদেবের সাধন ভোজনে কাম কলার তন্ত্রে মন্ত্রে দীক্ষীত হোন ও আশির্বাদ প্রাপ্ত হোন। এই সময় এরা সম্পূর্ন নগ্ন হয়ে মন্দিরে অবস্থান করেন। ভক্ত নারী ও পুরুষ তাঁদের নিজ হাতে আহার করিয়ে থাকেন।তখন তাঁদের জীবন্ত লিঙ্গেরও পূজা হয়ে থাকে।তাঁদের ঘিরে কীর্তন হয় ও মন্ত্র পাঠ হয়।তান্ত্রিকরা দিগম্বর অবস্থাতেই সমস্ত উত্‍সব কাল মন্দিরের বাইরের সমস্ত জায়গায় ঘুরে ফিরেন।বিভিন্ন বাসনা নিয়ে আসা কিছু নারী তাঁদের কৃপা ও আশির্বাদ লাভের আশায় এই সকল তান্ত্রিকদের সাথে সহবাসে লিপ্ত হন।পুরুষ তান্ত্রিকদের পাশা পাশি অনেক নারী তান্ত্রিকদেরও দেখা যায়।পুরুষদের ন্যায় তাদেরও অবাধ নগ্ন বিচরন।পুরুষ ভক্তরা ঐ সকল দিব্যতা অর্জনকারী নারীদের যৌন সুখে তৃপ্ত করতে পারলে তাঁরা সেই সকল পুরুষ ভক্তদের তন্ত্রে মন্ত্রে দীক্ষিত করে তুলতেন।তবে এখন আর আগের মত তাঁদের প্রকাশ্য জনসম্মুখ্যে দেখা যায় না। কথিত আছে ভারতের এক সময়ের বিখ্যাত অভিনেত্রী পারভিন ববী কামরূপ কামাখ্যায় তন্ত্র মন্ত্রে দীক্ষীত হয়ে তান্ত্রিক বিদ্যা অর্জন করেছিলেন।পরবর্তীতে তিনি অবশ্য মানসিকক স্থিতি ধরে রাখতে পারেন নাই। সাম্প্রতিক কালের যোনী পূজা : উত্‍সবের প্রধান আকর্ষণ যোনী পূজা।পূজাটি সম্পুন্ন করেন একজন পুরোহিত।এই সময়ে একজন নারীকে সম্পুর্ণ নগ্ন অবস্থায় দেবীর শক্তি পিঠের উপর দুই পাশে দুই পা দিয়ে শক্তি পিঠের যোনী মূল নারীটির যোনী বরাবর স্থির রেখে দুই হাত হাটুর উপর রেখে বসানো হয়।এই সময় পুরোহিত পবিত্র জলে নারীর বিভিন্ন অঙ্গ মন্ত্র পাঠে ধৌত করে দেন।

পুরোহিত তাঁর ডান হাতে বৃদ্ধা ও কনিষ্ঠা আঙ্গুলী ভাজ করে পরবর্তী তিন আঙ্গুল দন্ডায়মান রেখে নারীর যৌনাঙ্গ মন্ত্র পাঠে মৈথুন করেন যতক্ষন না নারীর কাম রস বের হয়ে আসে।কাম রস শক্তি পিঠে পতিত হলে নারী দেহ নিস্তেজ হয় ও দেহ পবিত্রতা লাভ করে।নারী মা কামাখ্যাকে মনে মনে আবাহন করেন।নারীর পবিত্র দেহে তখন মা কামাখ্যা আবর্তিত হয়েছে এক অনন্ত স্ববিরোধিতার দেশ আমাদের। এই দেশে কুমারীপূজার পাশেই চলে নাবালিকা ও অশীতিপরের ধর্ষণ, শবরীমালার মন্দিরে ঋতুসম্ভব নারীর বিরুদ্ধে তাণ্ডবের বিপরীতে কামাখ্যার মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় দেবীর ঋতু-উৎসব। আজ দেশ জুড়ে নারীশক্তির আরাধনার আড়ালেও হয়তো পুনরাবৃত্ত হবে কোনও ভয়াবহ নারকীয়তা। হয়তো, সেই অপকীর্তিতে অভিযুক্ত হবেন দেবতারূপী কোনো পুরুষ। তবু, করালবদনী কালীর আধারে মানুষের তিমিরবিনাশের প্রার্থনা তো কোনওভাবেই অবহেলার নয়।

আমাদের মনে পড়ে, পিতৃতান্ত্রিক বৈদিক সংস্কৃতিতে নারীর অবস্থান ছিল প্রায়-অপ্রাসঙ্গিক। বৈদিক দেবীরা ছিলেন কেবল দেবতাদের স্ত্রীবিশেষ। প্রাচীনতর বৈষ্ণব ও শৈবধর্মে লক্ষ্মী বা পার্বতী নিছক বিষ্ণু ও শিবের শক্তিপ্রকাশক প্রতিভাস। প্রকৃতপক্ষে, মধ্যযুগীয় পুরাণ থেকেই স্বতন্ত্র দেবীভাবনার উদ্ভব ও বিকাশ। সেই পৌরাণিক আখ্যানের প্রধান সূত্র ছিল মার্কণ্ডেয়-রচিত ‘দেবীমাহাত্ম্যম’ গ্রন্থটি, যা সাধারণভাবে ‘চণ্ডীপুরাণ’ নামেও খ্যাত। দেবী দুর্গার মহিষাসুরবধের কাহিনিই এই গ্রন্থের প্রতিপাদ্য। দেবভিত্তিক হিন্দুধর্মে সেই প্রথম দেবীসত্তার স্বীকৃতি। তবু, সেই দেবী-প্রকল্পনায়ও দেবতাদের প্রভাব অপরিসীম। কেননা, অসুরবধে দেবীর সমস্ত প্রহরণগুলিই দিয়েছিল দেবতারা। ফলত, দুর্গাশক্তিও অনেকটাই পিতৃতন্ত্রেরই প্রতিভূ।

ষষ্ঠ-শতকে শাক্তধর্মই প্রথম পিতৃতন্ত্রের অধীনতা থেকে মুক্ত হল। শক্তির আধার হয়ে উঠল নারী, তিনিই পরব্রহ্ম, এক ও অদ্বিতীয়। দেবমণ্ডলীতে সেই পরম নারীশক্তির প্রকাশ পিতৃতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে এক নতুন পরিসরের সূচনা করল। প্রসারিত সেই ধর্মক্ষেত্র হয়ে উঠল শূদ্রেরও আশ্রয়স্থল। তবে, নারীসত্তাবিশ্বাসী শাক্তধর্ম কোনওভাবেই পুরুষ বা জড়সত্তাকে অস্বীকার করেনি। কেননা, দেবীশক্তির সঙ্গে শিবশক্তির মিলনেই কেবল সৃষ্টি-স্থিতি-লয় সম্ভব। প্রকৃতি-পুরুষের এই যুগপৎ সক্রিয়-নিষ্ক্রিয় কল্পনাই রূপ পেয়েছে সপ্তদশ-শতকে নবদ্বীপের বাঙালি-ধর্মবেত্তা কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের সৃষ্ট কালীমূর্তিতে। দেবীর এই শক্তিরূপই আবার দশমহাবিদ্যার আধারে আরও-বিকশিত। উপমহাদেশ জুড়ে সতীর একান্নপীঠের মাধ্যমে নারীশক্তির সেই রূপ সুবিস্তৃত হয়েছে। একান্নপীঠের অন্যতম কামাখ্যাপীঠ হয়ে উঠেছে স্ত্রীশক্তির অকল্পনীয় বিস্ফার। কার্তিকের অমানিশায় সেই কামাখ্যা দেবীই যেন শ্যামারূপে আমাদের দেখায় সেই অনির্বচনীয় স্ত্রী-শক্তির ভিন্নতর মহিমা। আজ তিমিরবিনাশিনীর আরাধনা আসলে সবরকম অসুরদমন ও অন্যায়েরই বিরুদ্ধাচারণ।

প্রতিটি সতীপীঠেই স্ত্রী-শক্তি ভৈরবী, পুরুষশক্তি ভৈরবরূপী শিব, সে সতীর অতন্দ্র প্রহরী। একান্নপীঠে দেবীর যেমন ভিন্ন-নাম, তেমন ভৈরবেরও। কামরূপে কামাখ্যারূপী সতীর ভৈরব উমানন্দ। উমার আনন্দরূপী সেই শিব আসলেই উমার যৌনানন্দের প্রতীক। ‘কামাখ্যা’ নামটির সঙ্গেও জড়িয়ে আছে জীব ও শিবের তূরীয় আনন্দ-আধার। বলা যায়, যোনিরূপিণী কামাখ্যাই জীবের কামদেবী। সে-কারণেই আষাঢ়-মাসে অম্বুবাচী-তিথিতে তাঁর রজোকালের কল্পনা করেছে মানুষ। সাধারণভাবে অম্বুবাচী বৈধব্যের কৃচ্ছ্রসাধনকাল হলেও, কামাখ্যার বাৎসরিক ঋতুকাল বিপরীতভাবে হয়ে ওঠে নারীর উর্বরাশক্তিরই মহিমাকাল, উৎসবমুখর। নারীর ঋতুবন্দনার এমন দৃষ্টান্ত আধুনিককালেও আধুনিকতর। ‘কালিকাপুরাণ’ বলে, কামাখ্যায় দেবী পরিপূর্ণভাবে কামদা, কামিনী, কামা, কামাঙ্গদায়িনী ও কামাঙ্গনাশিনী হওয়ায় তিনি কামাখ্যা, কামাখ্যাতা। কামাখ্যায় দেবীর যোনিরূপ প্রতীকপ্রতিমা ছাড়াও রয়েছে নারীশক্তির বিভিন্ন প্রকাশরূপ কামাখ্যা, কামেশ্বরী, ত্রিপুরেশ্বরী, সারদা, মহোৎসহার বিগ্রহ। দেবীর যোগিনীশক্তিরূপ কটীশ্বরী, গুপ্তকাশী, শ্রীকামা, বিন্ধ্যবাসিনী, পাদদুর্গা, দীর্ঘেশ্বরী, ধনস্থা ও প্রজটাও এখানে সমমহিমায় বিরাজমান। নীলাচলপর্বতেই রয়েছে দশমহাবিদ্যা কালী, তারা, ষোড়শী, ভৈরবী, ভুবনেশ্বরী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা, মাতঙ্গী ও কমলাকামিনীর মন্দির। সব মিলিয়ে নারীশক্তির এ এক পরম উৎসার। সে-কারণেই কামরূপকামাখ্যা তান্ত্রিক ভৈরব-ভৈরবীদের মহাপীঠস্থান। যোনিরূপ কামাখ্যার বিবরমুখ সততসিক্ত। দেবীর ঋতুকালে সেই বিবরে রজোস্রোত উৎসারিত হয়। ওই তিনদিন মন্দিরের গর্ভগৃহ রুদ্ধ থাকলেও, দেবীমেলা ঘিরে ভক্তেরা উদযাপন করে দেবীর উর্বরাশক্তির উৎসব। দেবীর অঙ্গসিক্ততা বা রক্তধারার প্রাকৃতিক কারণাকারণ নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র ভাবিত নয়।

শাক্তধর্মের সঙ্গে কালক্রমে জুড়ে যায় তন্ত্রসাধনা। শক্তিতত্ত্বের এই পথটি আসলে প্রাতিষ্ঠানিক বৈদিক জীবনচর্যার সুস্পষ্ট বিরোধিতা। হিন্দুতন্ত্রের অনুসরণে দেশে একসময় বৌদ্ধতন্ত্রেরও প্রসার হয়েছিল। চর্যাপদের ডোম্বিনিও যেন বৌদ্ধতন্ত্রের অনুরূপ আরাধ্যা দেবী। হিন্দুতন্ত্রে মূলত দক্ষিণাচার ও বামাচারের বিধি রয়েছে। মূলগতভাবে দক্ষিণাচারীরা বেদমান্যপথে চললেও, বামাচারীরা চলে বেদবিরোধী পথে। বামাচারী-তন্ত্রসাধনার প্রধান-আধার নারী। সাধকের সঙ্গে সাধিকার মিলনে ষটচক্রভেদ হয়, সহস্রারে জাগ্রত হয় কুলকুণ্ডলিনী। এই যুগলসাধনার তন্ত্রধারাটি পরে বাংলার বাউলসাধনায়ও প্রবাহিত হয়েছে। বাউলসাধকের কাছে সঙ্গিনীর রজোকাল অতি-পবিত্র সাধনসময়, জীবনের সুসময়কাল। তখন নদীতে বান ডাকে, জোয়ার আসে, ভাসে সাধকের তরী। বাউল ব্যতীত আর-কেউ গানে-গানে ধরে রাখেনি নারীশক্তির সেই শরীরী প্রতীক।

ত্রিপুরায় পার্বতী ললিতা-ত্রিপুরাসুন্দরী-রূপী। দেবীর ভৈরব শিবশম্ভু এখানে কামেশ্বর-রূপে বিরাজমান। সমাজের প্রান্তিকস্তরের ভক্তরা সহস্রাক্ষী শ্রীবিদ্যাদেবীর আরাধনায় এই মন্দিরে বছরভর সমবেত হয়। তান্ত্রিকরা নারীকে মহাবিদ্যা-রূপে গণ্য করে। তাই দেবীপুরমে জাতপাত ও লিঙ্গভেদের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। বরং, পূজার সময় এই মন্দিরে নারীভক্তরা সরবে ঘোষণা করে থাকেন. ‘আমি দেবী, তুমি দেবী, আমরাই দেবী’। দেশের কোনও ধর্মক্ষেত্রেই নারীর এমন ঘোষিত-মহিমা দুর্লক্ষ।

ত্রিপুরায় সতীর একান্ন পীঠের সৃষ্টির পেছনে তাঁর দেহত্যাগের একটি কাহিনি রয়েছে।দক্ষযজ্ঞ ও সতীর কাহিনিটির প্রতি লক্ষ্য করলে দেখতে পাই এই কাহিনিটির মধ্যে শিব ও প্রকৃতি তত্ত্ব। তাই বলতে হয় সতী ছাড়া বা শক্তি ছাড়া পুরুষ অর্থহীন। কারণ শক্তি কখনও একা থাকতে পারেন না।কারণ তার গুণই হল প্রকৃতি। পুরুষ ও প্রকৃতির রহস্যময় এই স্বরূপ বুঝলে তবেই সতী কাহিনির সার্থকতা। ত্রিপুরার নাম আমরা প্রথম পাই কুব্জিকাতন্ত্রের ৪২টি সিদ্ধ।পীঠের তালিকায়। তন্ত্র চূড়ামণিতে একান্ন পীঠের তালিকায় রয়েছে সতী পীঠের তালিকায়।সুতরাং এবার আমরা বলতে পারি সবগুলো পীঠ একই সময়ে সৃষ্টি হয় নি।

ভারতচন্দ্রের লেখাতেই নয় পাঠ নির্ণয়ের যে দুটো পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে তাতেও রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বর্ণনা। ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির ১৪২৩ শকাব্দে ধন্যমাণিক্য নির্মাণ করেছেন বলে কথিত আছে।১৯০৪ সালে "শিলালিপি সংগ্রহ" বই থেকে জানা যায় ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির একটি উচ্চ টিলার উপর অবস্থিত ছিল।মন্দিরের দ্বার পশ্চিম দিকে।উত্তরের দিকেও একটি ছোটো দরজা আছে।এই দরজাটি পরে তৈরি বলে মনে করা হয়।কারণ প্রাচীন মন্দিরে একটির বেশি দরজা প্রায়ই দেখা যায় না।মন্দিরের পশ্চিম দিকে একটি নাট মন্দির।নাট মন্দিরটি জীর্ণ।নতুনভাবে নির্মাণ কাজ চলছে।এর সামনে একটি ফলের বাগান।পশ্চিমে একটি দিঘি। নাম সুখসাগর।এই সুখসাগর ধন্যমাণিক্যের আমলে খনন করা।

মন্দিরের পূর্বদিকেও একটি দিঘি আছে,নাম কল্যাণ সাগর।ত্রিপুরা জেলার স্বাধীন হিন্দু রাজ্যের প্রাচীন পর্বতবেষ্টিত উদয়পুর ত্রিপুরেশ্বরী মহাপীঠক্ষেত্র পবিত্র তীর্থ।ত্রিপুরা সুন্দরীর মাহাত্ম ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এই তীর্থ অতুলনীয়। কবি নবীনচন্দ্র সেন মহাশয় রঙ্গমতীতে তার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন।
" নির্মিত কৌশলে কৃষ্ণ সিন্দর প্রস্তরে সুশীতল সমুজ্জ্বল। স্তম্ভ সারি খচিত বিচিত্র রূপে। পুষ্প লতিকায় স্বর্গীয় স্বভাব শোভা।ধরিয়াছে শিরে সুবিস্তৃত সুচিত্রিত,অর্দ্ধচন্দ্র সারি ক্রমে উর্ধে উচ্চতর।"

চন্দ্রনাথ মাহাত্ম নামক পুস্তকে লিখিত আছে - "সে সময়ে ত্রিপুরাধিপতি ধণ্যমানিক্য বাহাদুর ত্রিপুরেশ্বরীকে লইয়া যান।সেই সময় স্বয়ম্ভুনাথের মন্দিরের একাংশ অর্থাৎ যে প্রকোষ্ঠে স্বয়ম্ভুনাথ আছেন, সেই মন্দিরখানি নির্মিত হইয়াছে।সুতরাং ১৫০১ খ্রীস্টাব্দে এই মন্দির স্থাপিত হইয়াছিল বলিয়া বোধ হয়।চন্দ্রনাথের তীর্থগুরু যতীন্দ্রবন মোহন্ত।চট্টগ্রাম জেলার অন্তর্গত মহিষখালি নামক স্থানের প্রসিদ্ধ জমিদার সহ ত্রিপুরেশ্বরী দেবী দর্শনের জন্য যখন উদয়পুর গিয়াছিলেন তখন তাহাদের নিকট হইতে জানা গিয়াছিল,বর্তমান ত্রিপুরেশ্বরী বিগ্রহ চন্দ্রনাথ তীর্থ হইতে উদয়পুরে আনিত হইবার কিংবদন্তী চট্টলে প্রচলিত আছে।"

১৯৮১ খ্রীস্টাব্দে উদয়পুরের রাজনগর থেকে গণেশ চক্রবর্তী মহোদয়ের মহাতীর্থ কাহিনি থেকে জানা যায়- মহারাজ ধণ্যমানিক্য একটি জীর্ণ মন্দির সংস্কার করে সেখানে শ্রী শ্রী বিষ্ণু রাজ রাজেশ্বর শালগ্রাম শীলাকে স্থাপন করেছিলেন।সে সময় ত্রিপুরা সুন্দরী রাজাকে স্বপ্নে বললেন- স্বপ্নযোগে কহে চণ্ডী শুন শুন ধন্যরায়,চট্টল হতে ফিরে আনহ আমায়।মহারাজ তখন মাকে বলেন- আমি মন্দিরে বিষ্ণুকে স্থাপন করেছি,তোমার জন্য অন্য আরেকটি মন্দির করে তোমাকে অর্চনা করবো।কারণ মা তুমি মহাশক্তি, তান্ত্রিক পদ্ধতিতে তোমাকে পূজা দিতে হলে বলি দিতে হবে।এর পর মায়ের আশ্বাস পেয়ে ধণ্যমানিক্য মাকে মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করলেন।মায়ের দক্ষিণ পার্শ্বে যে রৌপ্য নির্মিত ত্রিশূল দেখা যায় তা ত্রিপুরার শেষ ও স্বাধীন মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্য বাহাদুর মহাপ্রয়াণের পূর্বে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ১১৫৬ ত্রিপুরাব্দে ১৬ বৈশাখ মাকে প্রদান করেছিলেন।ত্রিপুরার মাতা ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির ও কল্যাণ সাগর নিয়ে অলৌকিক কাহিনি নিয়ে আজও নানা মত আজও প্রচলিত রয়েছে।দূর-দূরান্ত থেকে পূণ্যার্থীরা ছুটে আসেন মানসিক শান্তির জন্য। এখনো মানুষ বিশ্বাস করেন কল্যাণসাগরের মাছ ও কচ্ছপ মৃত্যুর সময় সিঁড়ি বেয়ে মন্দিরে উঠে তারপর মারা যায়।আরেকটি উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল মন্দিরে বাজনা বাজে উঠলেই মাছ ও কচ্ছপেরা দিঘির ঘাটে চলে আসে।হয়তোবা মা ত্রিপুরেশ্বরীর টানেই পূণ্যার্থীদের দৃষ্টির মধ্যে এই মাছ ও কচ্ছপেরা ঘাটে চলে আসে।তা- সত্বেও বলতে হয় বাজনার শব্দটা উপর থেকে এসে জলের মধ্যে আন্দোলিত হয় এবং মাছ পার্শ্বরেখা বরাবর ও কচ্ছপ খোলের নরম অংশ বরাবর এই কম্পন টের পায় এবং শব্দের দিকে ধাবিত হয়।ধর্ম ও বিজ্ঞান এখানে এক হয়ে গেছে বলেই কল্যাণ সাগর কল্যাণকর রূপ নিয়েই মানুষের পাশে বিরাজমান।

এবার আসা যাক আধুনিক নারী শক্তির আলোচনায়।লোকায়ত স্তরে স্ত্রীশক্তির এইসব মাহাত্ম্যই ধূলিসাৎ করতে চায় ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকদল। স্বৈরশাসকের কাছে যত-মত তত-পথ ঘোর-বিপজ্জনক। দেশের মানুষকে তারা একটি ছাঁচে ঢেলে খোপে পুরে ফেলতে চায়। সে-কারণেই এই সুপ্রাচীন সংস্কৃতির দেশে মানবীর ঋতুকালের মতো এক অনিবার্য শারীরক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে যায় আদালত, ধর্ম, রাজনীতি। অবশ্য, এমনই স্বাভাবিক। ইতিহাসের নিয়মেই যুগব্যাপী কুসংস্কারে একদিন যখন কেউ সামান্যতম নাড়া দেয়, তখনই চারদিক থেকে দাঁত-নখ বের করে তেড়ে আসে তমসাবৃত স্বার্থশক্তি। তা সে বিধবাবিবাহই হোক, সতীদাহই হোক বা সুপ্রিম কোর্টের যুগান্তকারী রায়ই হোক। প্রাক্তন-প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র কোনও বিদ্যাসাগর বা রামমোহন রায় নন, কিন্তু সাংবিধানিক পরিসরে তিনি ও তাঁর সতীর্থরা শবরীমালার মন্দিরে ঋতুসম্ভব নারীর প্রবেশাধিকারে যে-যুগান্তকারী রায় দিয়েছেন, তা কেবল সংবিধানের মৌলিক-অধিকারসাপেক্ষই নয়, শক্তিরূপিণীর সাধন-অনুসারীও। কিন্তু, সামাজিক মন যদি চিরতমসাবৃতই থেকে যেতে চায়, তাহলে আদালত তাকে যতই এগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুক, সে থাকবে নিজ-তিমিরেই। শবরীমালায় সেই অন্ধকার উসকে দিয়েছে মেরুকরণের রাজনীতি।

সবচেয়ে বড়কথা, ঘটনাটি ঘটছে দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অগ্রসরতম কেরালায়। এমনকি, রাজ্যের মেয়েরাই থাকছে এই অন্ধকারকামীদের সম্মুখ-সারিতে। তারাই ক্রীড়নক হয়ে উঠছে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনৈতিক দলটির সার্বিক নারীবিরোধিতার। আসলে, অযোধ্যায় রামমন্দিরের মতোই আয়াপ্পামন্দিরের রন্ধ্রেই কালসাপ হয়ে ঢুকে তারা কেরালায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা চায়। তাদের সমস্ত ধর্মীয় পদক্ষেপগুলির মতোই এই নারীবিরোধী তাণ্ডবও যেমন পশ্চাদপদ রাজনৈতিক অভিসন্ধির, তেমনই আর্থিক শোষণ ও কেলেঙ্কারীর বিফল আড়ালমাত্র। ধর্মভীরু মানুষও এতদিনে এই তথাকথিত ধর্মবাদী দলটির স্বরূপ টের পেয়ে গেছে। শবরীমালায় নারীবিরোধিতা আসলে জাতপাতহীন তন্ত্রাচারেরও সুস্পষ্ট বিরুদ্ধাচারণ। কেননা, যারা জনজীবনে বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতা প্রসারিত করতে চায়, তাদের পক্ষে ভেদবিহীন তন্ত্র, কালী বা লোকায়ত শিবকে স্বীকার করা অসম্ভব। কিন্তু, সেই তাণ্ডবই যে শেষকথা নয়, দেশের ঐতিহ্যময় ও বহুমুখী সংস্কৃতির প্রবাহ যে পরিকল্পিত হামলায় কোনওভাবেই রুদ্ধ হওয়ার নয়, আজ নারীশক্তির আরাধনায় আবার সেই প্রমাণই দেবে দেশ।

0 comments:

1

প্রবন্ধ - প্রমিত বসু

Posted in





‘প্রতিটি অক্ষর আর সুর মেপে চলি
প্রতি নিঃশ্বাসে সুকুমার রায় বলি’ - কবির সুমন

অনেকে বলে থাকেন ‘শিশুসাহিত্য আসলে শিশুদের জন্য নয়’। সুকুমার রায়ের রচনা পড়লে বহুলকথিত সেই আপ্তবাক্যটাই প্রথমে মনে পড়ে।

নিছক হাস্যরসিক কিংবা শিশুসাহিত্যিক নন, সুকুমার রায় নামক মহীরুহের লেখায় পাওয়া যায় একাধিক স্তর যার প্রতিটিতে রয়েছে নিবিড় সচেতনতার ছোঁয়া। স্তরগুলো খুঁড়লে দেখা যাবে উৎসমূলে রয়েছে মানুষের প্রবৃত্তিগুলোর প্রকাশের ভিন্ন ভিন্ন অভিব্যক্তি অথবা কোনো অন্তর্নিহিত সমাজচেতনা। কিন্তু এত সব কিছুর ওপরে থাকে এক লঘু হাস্যরসের মোড়ক। তাই আপাতভাবে সেটা শিশুদের পাঠের উপযুক্ত আর উপভোগ্য হয়ে উঠলেও তার ভেতরে প্রাপ্তমনস্করা খুঁজে পায় এক সহজাত বার্তা বা উপদেশ। কিন্তু সেই বার্তা বা উপদেশ কখনোই নীতিকথার আদলে বাইরে থেকে নিক্ষিপ্ত নয়, বরং তা যেন ভেতর থেকেই প্রকাশ পায়, তাই উপভোগের মাত্রা কোনোভাবেই ব্যাহত হয় না।


যেমন ‘বাবুরাম সাপুড়ে’তে ‘যে সাপের চোখ নেই, শিং নেই, নখ নেই’ তাকেই ‘তেড়ে মেরে ডান্ডা, করে দিই ঠাণ্ডা’ গোছের বীরত্ব দেখানো সমাজের অনেক আপাতসাহসী চরিত্রের আসল রূপটা এক ঝটকায় সবার সামনে এনে ফেলে।

ছায়াবাজি কবিতায় ‘চাঁদের আলোয় পেঁপের ছায়া ধরতে যদি পার, শুঁকলে পরে সর্দিকাশি থাকবে না আর কারো।’ পড়লে মনে হয় এটা যেন আর একটা টোটকা নিদানকারী ব্যবসায়ীর প্রতারণামূলক প্রচার যা আজও আমরা দেখে চলেছি, শুধু তার বিন্যাস বা মাত্রার তারতম্য হয়েছে এই যা।

‘ভয় পেয়ো না’ কবিতায় প্রথমে ভালোমানুষের ভেক ধরে একরকমের নিশ্চয়তা প্রদান--- ‘মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না/ জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতোই না?’ তারপর এল আসল প্রস্তাব, ‘এস এস গর্তে এস, বাস ক’রে যাও চারটি দিন’। তাতেও কাজ না হওয়ায় আসল রূপ বেরিয়ে এসে চূড়ান্ত হুঁশিয়ারি, ‘অভয় দিচ্ছি শুনছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দু’টা?/ বসলে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা!’ শৈশবে যেমনই লাগুক, সাবালক হয়ে নতুন করে পড়তে বসলে পাঠকের মনে যেন সত্যি ভয় ধরে যায়। কি অনায়াসে আজকের দিনে চারপাশের বহু ঘটনার সাথে মিলে যায় এই লক্ষণগুলো।

তেমনি আবার এত বছর পরেও ‘প্যাঁচা আর প্যাঁচানি’ পড়লে মনে হয় এর চেয়ে ভাল প্রেমের কবিতা আর কী আছে? যেখানে পেঁচির চ্যাঁচানিও প্যাঁচার কাছে ‘চাঁদমুখে মিঠে গান’ হয়ে ওঠে।

‘ভুতুড়ে খেলা’ কবিতার চিত্রাঙ্কনে ভূতের চেহারায় যেন দেখা যায় আপাতদৃষ্টিতে সমাজের একজন প্রান্তিক অসুন্দর মায়ের ছবি। কিন্তু ‘ওরে আমার বাঁদর-নাচন আদর-গেলা কোঁত্কা রে, অন্ধবনের গন্ধ-গোকুল, ওরে আমার হোঁত্কা রে!’ পংক্তিতে সন্তানস্নেহের যে চিত্র ফুটে ওঠে তা দেশ-কাল নির্বিশেষে মাতৃত্বের এক চিরন্তন প্রতিচ্ছবি।

আবার অতি পুরোনো পরিচিত রামায়ণের গল্পে এক নতুন মাত্রা যোগ হয় যখন দেখি ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’-এ বিভীষণ আর সুগ্রীবের মধ্যে চলে একটা সূক্ষ্ম ইগোর লড়াই। তারা দু’জনেই রাজা বা সম্ভাব্য রাজা। যতই এক শিবিরে থেকে একসঙ্গে যুদ্ধ করুক, ভেতরে ভেতরে চলতে থাকে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার পালা--- সুযোগ পেলেই একে অপরকে খোঁচা দিতে কেউ ছাড়ে না। কিন্তু সবটাই থাকে নির্দোষ লঘু হাস্যরসের এক অদৃশ্য সীমানার মধ্যে।

যুদ্ধের সময় সুগ্রীবকে হাঁটতে দেখে বিভীষণ বলে ওঠে, ‘দেখ, হাঁটছে দেখ - বাঁদুরে বুদ্ধি কিনা! ধ্যুৎ! যুদ্ধ করতে এসেছিস, এমনি করে হাঁটলে লোকে বাঙাল বলবে যে! এমনি করে হাঁট।’ উত্তরে সুগ্রীব বলে, ‘রেখে দাও তোমার ভড়ং! আমাদের দেশে ওরকম হাড়গিলের মতো করে হাঁটে না!’

শিশু বয়সে পড়ে ঘটনাগুলোর উপরিগত লঘুতায় যেমন হাসি পায়, বয়:প্রাপ্তির পর পড়লে উপভোগের মাত্রাটা একই থাকে, কিন্তু জন্ম হয় অনেকগুলো নতুন উপলব্ধির। বুঝতে পারা যায় তাঁর লেখার সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে সময়ের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষের ব্যবহারের ধারাবাহিকতার কথা।

সুকুমার রায়ের লেখা পড়তে গিয়ে বেশ কিছু জায়গায় অচেনা নাম বা পরিস্থিতির উল্লেখ দেখে বেশ হোঁচট খেতে হয়। প্রশ্ন জাগে এরা কারা বা ঘটনাটার প্রসঙ্গটা আসলে কী? যেমন ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’এ রাবণ বলে, ‘আমি পালোয়ান স্যান্ডো সমান/ তুই ব্যাটা তার জানিস কী?/ কোথায় লাগে-বা কুরো পাটকিন/ কোথায় রোজেদ ভেনিস্কি?’ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে যে এই কুরো পাটকিন বা রোজেদ ভেনিস্কি কারা? অনেক খোঁজাখুঁজির পর বুঝতে পারা যায় যে রোজেদ ভেনিস্কি আসলে Zinovy Rozhestvensky, রাশিয়ার নৌবাহিনীর admiral। জাপানের সাথে Battle of Tsushima তে রাশিয়ার নেতৃত্বে ছিলেন। আর কুরো পাটকিন হচ্ছেন Aleksey Kuropatkin, এককালে রাশিয়ার যুদ্ধমন্ত্রী ছিলেন।

কিছু কবিতায় এতটা স্পষ্ট করে বলা না থাকলেও কতিপয় সমকালীন ঘটনার একটা অভ্যন্তরীণ বিবরণ আছে। যেমন 'লড়াই খ্যাপা' কবিতাটা হয়ত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় সৈনিকদের বীরত্বের ওপর ভিত্তি করে রচনা। আবার 'একুশে আইন' হয়ত বা ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার আরোপিত রাওলাট আইনের উদ্দেশ্যেই রচনা। এই ব্যাপারে নীলাদ্রি রায়ের 'আলোয় ঢাকা অন্ধকার' বইটিতে আবোল তাবোলের কবিতাগুলোর সঙ্গে সমসাময়িক কোনো ঘটনা বা সামাজিক প্রথার সঙ্গে মিলিয়ে খুব বিশদে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

সুকুমারের কাব্যপ্রতিভা, রসবোধ বা সমাজচেতনার বাইরে রয়েছে ওঁর নিজস্ব অর্জিত ইন্দ্রিয়জ্ঞান, সেখানে বাহ্যিক ইন্দ্রিয়গুলো সব মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়ে তৈরী করে এক নতুন চেতনার। ‘শিল্পে অত্যুক্তি' প্রবন্ধে এক জায়গায় তিনি বলছেন, 'আমাদের ভিন্ন-ভিন্ন ইন্দ্রিয়গুলি প্রত্যেক ঘটনা সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন রকমের সংবাদ দেয়। বাহির হইতে আলোচনা করিয়া দেখিলে রূপ রস গন্ধ স্পর্শ এগুলি সমস্তই স্বতন্ত্র ব্যাপার বলিয়া ঠেকে কিন্তু মনের মধ্যে এই সমস্ত যখন একটা অখণ্ড 'রসমূর্তি'তে পরিণত হয়, তখন তাহার মধ্যে কতখানি চাক্ষুষ, কতটা শ্রুত, আর কতটা অন্য কিছুর প্রতিধ্বনি, তাহা বিচ্ছিন্ন করিয়া বাহির করা একরূপ অসম্ভব হইয়া পড়ে।'

আর সেই 'রসমূর্তি' কে আজীবন লালন করে গেছেন সুকুমার অবিচ্ছিন্ন ভাবে, যেখানে সব ইন্দ্রিয় এক সাথে মিশে গিয়ে মনের মধ্যে থেকে বেরিয়ে পরে এই বাহ্যিক পৃথিবীতে পড়ে। তাই কখনো তিনি লেখেন 'আলোয় ঢাকা অন্ধকার/ ঘন্টা বাজে অন্ধকার' অথবা কখনো লেখেন 'ঠাস ঠাস, দ্রুম দ্রাম, শুনে লাগে খটকা/ ফুল ফোটে? তাই বল! আমি ভাবি পটকা!/ শাঁই শাঁই পনপন, ভয়ে কান বন্ধ -/ ওই বুঝি ছুটে যায় সে-ফুলের গন্ধ?'

আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসে বিশেষভাবে সক্ষম মানুষদের প্রতি সমাজ অনেক সহানুভূতিশীল হচ্ছে, তাঁদের কথা আলাদা করে ভাবা শুরু হচ্ছে, তাঁদের সমতার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এক শতাব্দী আগেই সুকুমার তাঁদের জগৎকে আলাদা করে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন। অনুকম্পা দিয়ে নয়, বরং সমান স্বীকৃতির সাথে জীবনে তাঁদের নিয়ে একসাথে পা মেলানোর কথা বলেছিলেন। অন্ধ মেয়েকে দেখে তাই তাঁর জন্য দুঃখ হয় না, বরং আবিষ্কার করেন যে তার পৃথিবীটাও সুন্দর, অনেকটা আলাদা আমাদের চেয়ে, তাতে নাইবা থাকল কোনো রূপের বাহার। ‘অন্ধ মেয়ে দেখছে না তো - নাই বা যদি দেখে/ শীতল মিঠা বাদল হাওয়া যায় যে তারে ডেকে!/ শুনছে সে যে পাখির ডাকে হরষ কোলাকুলি,/ মিষ্টি ঘাসের গন্ধে তারও প্রাণ গিয়েছে ভুলি!/ দুঃখ-সুখের ছন্দে ভরা জগৎ তারও আছে,/ তারও আঁধার জগৎখানি মধুর তারই কাছে।’

কোনও research বা consulting করার সময় সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হয় solutioning-এ। মানে মোদ্দা কথা হল একটা সমস্যার সঠিক সমাধান খুঁজে বার করতে হবে। সে উদ্দেশ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রয়োজন পড়ে lateral thinking এর। সেটা করতে গিয়ে প্রায়শই দেখা যায় কত আজগুবি, কত হাস্যকর সমাধান বেরিয়ে আসে যা আসল সমাধান থেকে যোজন দূরে অবস্থিত। ‘অবাক জলপান’ নাটিকায় দেখি জলপানের মতো একটা সহজ ছোট সমস্যাকে নিয়ে সুকুমার কী অনায়াসে এই রকম একটা ঘটনাপ্রবাহ তৈরী করে ফেলেন। জল চাইতে গিয়ে কেউ কথার মারপ্যাঁচে ‘জল পাই’ কে বানিয়ে ফেলে ‘জলপাই’, কেউ বা জলের নাম শুনে ‘চোখের জল’, ‘হুঁকোর জল’, ‘ঝর্ণার জল’, ‘ফটিক জল’, ‘গায়ের রক্ত জল’ আরও হাজার রকম জলের কথা বলে। কেউ বা জলের সাথে ছন্দ মিলিয়ে বলে ওঠে ‘কাজল, উজ্জ্বল, চঞ্চল, ছলছল’ আরও কত কি! আবার কোনো বিজ্ঞানী বুঝিয়ে দেয় জলের রাসায়নিক বিশ্লেষণ আর জৈবিক রকমফের। প্রসঙ্গ জল থেকে বেরিয়ে ‘বৈকাল’ আর ‘নৈপাল’-এর অন্ত্যমিলে পৌঁছে গেলেও মূল সমস্যাটা কিন্তু থেকেই যায়--- তৃষ্ণার্ত পথিক খাওয়ার জল আর পায় না।

কবিতা, নাটক আর গল্পের বাইরেও রয়েছে সুকুমারের এক বিশাল ব্যাপ্তি যার প্রচ্ছন্ন বিচ্ছুরণ দেখি তাঁর প্রবন্ধগুলোর মধ্যে। বিদেশী মনীষীদের জীবনী যথা ‘দানবীর কার্নেগী’ বা ‘ডেভিড লিভিংস্টোন’ বা ‘ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল’ এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয় পাঠককুলের কাছে। এর সঙ্গে থাকে বিজ্ঞানের সব বিভাগের ওপর তৈরী সাবলীল বাংলায় লেখা প্রবন্ধ, যেমন ‘পৃথিবীর শেষ দশা’, ‘শরীরের মালমশলা’, ‘শনির দেশে’ বা ‘জানোয়ার ইঞ্জিনিয়ার’। প্রাক-ইন্টারনেট যুগ পর্যন্ত এই লেখাগুলোর মূল্যগুণ থেকে যায় একই রকম অমূল্য।

বইয়ের আকারে প্রকাশিত না হওয়া সুকুমার রায়ের এমন অনেক প্রবন্ধ রয়ে গেছে যা কিছুদিন আগে পর্যন্ত পাঠককুলের কাছে অজানাই ছিল (হয়ত এখনও কিছু অজানাই রয়ে গেছে)। ওঁর 'দৈবেন দেয়ম', 'ক্যাবলের পত্র' বা 'ভাষার অত্যাচার' নতুন করে পরিচিত করায় ওঁর পাণ্ডিত্য, চিন্তাশীল জীবন দর্শনের সঙ্গে।

‘ভাষার অত্যাচার’ প্রবন্ধে ''সনাতন' শব্দ সম্পর্কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন ‘এক একটা কথা ধুয়া আমাদের স্বাভাবিক চিন্তাশক্তিকে আড়ষ্ঠ করিয়া দেয়। মানুষের যে কোনও আচার অনুষ্ঠান চালচলন বা চিন্তাভঙ্গির প্রতি কটাক্ষ করিয়া লোকে জিজ্ঞাসা করে 'তুমি কি সনাতন ধর্মবিধিকে উড়াইয়া দিতে চাও?" তখন যাহা কিছু যথেষ্ট জীর্ণ ও পুরাতন, তাহাই আমাদের কাছে সনাতনত্বের দাবি করে এবং আমাদের কল্পনায় সনাতন ধর্ম জিনিষটা যে কোনও বিধি নিয়ম আচার অনুষ্ঠানাদির সমারোহে শজারুবৎ কণ্টকাকীর্ণ হইয়া ওঠে।’

তেমনই আবার 'দৈবেন দেয়ম' প্রবন্ধে তিনি নস্যাৎ করে দেন অদৃষ্টবাদ বা কর্মবাদের মতন বহুযুগ ধরে চলে আসা প্রচলিত ধারণাগুলোকে, ভরসা রাখেন পুরুষকারে। অদৃষ্টবাদ নিয়ে বলেন ‘কতকগুলি অস্পষ্ট ও অচিন্তিত সংস্কার যখন কথায় নিবদ্ধ হইয়া জীবনের ঘাড়ে চাপিয়া বসে, তখন তাহার প্রভাব কতদূর মারাত্মক হইতে পারে তাহার সবচাইতে বড়ো দৃষ্টান্ত আমাদের এই অদৃষ্টবাদ। তাই জীবন সংগ্রামের সহস্র তাড়নার মধ্যে নিশ্চেষ্ট মানুষ সুখে হতাশ, দুঃখে হতাশ, বিচার নাই, উদ্যম নাই, হাত-পা গুটাইয়া বসিয়া থাকে আর বলে 'দৈবেন দেয়ম'। দৈবে ঘটায়, অদৃষ্টের ফেরে পাই, অদৃষ্টের ফেরে হারাই।... দৈবে যাহা আনিয়া দেয়, ঘাড় পাতিয়া লও। সে দৈব যে কে, সে যে কোথা হইতে কিরূপে দেয়, তাহা দৈবই হবে, তোমার আমার কিছু বলিবার নাই, কিছু করিবার নাই। ...আগুন জ্বলিয়া ঘর যায়, বাড়ি যায়, কী করিব? দৈবের লিখন। আগুনের মধ্যে দু-কলসি জল ঢালিবার চেষ্টাও যেন দৈবের নিষিদ্ধ। ... ইহার চাইতে মানুষ যদি চার্বাকের মতো বেপরোয়া নাস্তিক লইয়া বলিত, 'যাবৎ জীবেৎ সুখং জীবেৎ", জীবনের ষোলো আনা আদায় করিয়া লও, জীবনের পক্ষে তাহাও আশার কারণ হইত, অন্তত বোঝা যাইত যে প্রাণের আশা এখনও এসে ছাড়ে নাই।’

এই সমস্ত রচনার মধ্যে থেকে পাঠকের পরিচিতি ঘটে ব্যক্তি সুকুমারের, তাঁর নিজস্ব ভাবাদর্শের সঙ্গে। যেখানে ব্যক্তি সুকুমার আস্থা রাখেন কর্মে, বুদ্ধিতে, উদ্যমে, চ্যালেঞ্জ করতে পিছপা হন না কোন প্রতিষ্ঠান বা প্রাতিষ্ঠানিক তত্বকে।

রবীন্দ্রনাথের সমকালীন খুব অল্প সংখ্যক সাহিত্যিক ছিলেন যাঁদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ হওয়া সত্বেও যাঁদের লেখা ছিল সম্পূর্ণভাবে রবীন্দ্র-প্রভাব মুক্ত, সুকুমার ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। পারিবারিক বন্ধুত্বের সূত্রে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুকুমারের পরিচয় ছিল অল্প বয়স থেকেই। লণ্ডনে ছাত্র থাকাকালীন 'The Quest' পত্রিকায় ১৯১২ সালের অক্টোবর সংখ্যায় (নোবেল প্রাপ্তির আগেই) লেখেন 'The Spirit of Rabindranath Tagore'। রবীন্দ্রনাথের কবিতা সম্পর্কে বলেন 'Rabindranath’s poetry is an echo of the infinite variety of life, of the triumph of love, of the supreme unity of existence, of the joy that abides at the heart of all things.'।

'চিত্ত যেথা ভয়শূন্য' নিয়ে লিখতে গিয়ে বলেন 'The conflicting claims of faith and knowledge, of love and renunciation, of action and detachment, melt away before the supreme assurance of his poetry and the beautiful directness with which he carries us straight to the harmony that signs at the heart of the life. What could be nobler or simpler, what more supremely comprehensive that his ideal of nationality, as expressed in his own English prose-rendering (in the Gitanjali)?'। আবার নিজে থেকে অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু কবিতা, বেরিয়ে এসেছে 'I am restless, I am athirst for the great beyond.'... 'O Beyond! Vast Beyond!' মতো কিছু লাইন।

নিজের জীবনেও সুকুমার ছিলেন এমন চঞ্চল, সুদূরের পিয়াসী। বিপুল সুদুরকে কাছে নিয়ে এসেছেন, তাকে ভেঙেচুরে আবার নতুন করে সৃষ্টি করেছেন, তাতে যোগ করেছেন নতুন মাত্রা। সুকুমারের লেখার তল খুঁজে পাওয়া তাই কোনো সহজ ব্যাপার নয়, ব্যঙ্গরসের প্রহেলিকার আড়ালে তিনি রয়ে যান পাঠকের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

ব্যক্তিগত জীবনে সুকুমার ছিলেন যথার্থই ব্রাহ্ম, যিনি জীবনের অর্থ খুঁজতে গিয়ে আনন্দের মধ্যেই ব্রহ্মকে খুঁজে পান। ‘উপেন্দ্রকিশোর রায়’ প্রবন্ধে পিতার অন্তিম মুহূর্তগুলো সম্বন্ধে লিখতে গিয়ে বলছেন, ‘কায়মনোবাক্যে যিনি কোনওদিন সত্যকে লঙ্ঘন করেন নাই, শাশ্বত চিরজাগ্রত সত্য আজ তাঁহাকে রক্ষা করিতেছে। যে আনন্দের আস্বাদনে বিভোর হইয়া তিনি বলিয়াছেন, “আমি আনন্দে আছি, আনন্দেই থাকিব”--- সেই আনন্দ তাঁহার অনন্ত জীবনপথের শাশ্বত সঙ্গী হইয়া চলিয়াছে।

আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে
আনন্দেন জাতানি জীবন্তি'

আর নিজের চলে যাওয়ার কয়েক দিন আগে লেখেন আনন্দের কবিতা 'স্বপন দোলা হাওয়ায় দোলে/ সুরের নেশায় ঝরণা ছোটে/ আকাশ কুসুম আপনি ফোটে/ রঙিন আকাশ, রঙিয়ে মন/ চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ।' তিনি সুকুমার রায় বলেই হয়ত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও আনন্দ আর দুঃখকে এক পঙক্তিতে বসিয়ে আপন করে নেওয়াতে এত সাবলীল। মৃত্যুশয্যায় রবীন্দ্রনাথের কাছে শুনতে চান 'দুঃখ এ নয়, সুখ নহে গো' বা 'আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু' র মতন গান।

পাঠকের এক জীবন হয়ত যথেষ্ট নয় সুকুমার রায়কে বুঝতে। যখনই পাঠকের মনে হয় সুকুমার রায়কে কিছুটা হলেও রপ্ত করা গেছে, তখনই যেন নতুন মাত্রার সাথে হাজির হন সুকুমার। ওঁর চলে যাওয়ার প্রায় এক শতাব্দী পার হয়ে যাওয়ার পরও প্রজন্মের পর প্রজন্ম ভাবতে থাকে কেন দীর্ঘায়ু হলেন না সুকুমার, বাঙালির যে অনেক পাওনা বাকি থেকে গেল।

আজ চারদিকে সব কিছুর মধ্যে যত দেখা যায় 'আলোয় ঢাকা অন্ধকার', ততই যেন আমাদের কাছে প্রকট হয়ে ওঠেন সুকুমার।

1 comments:

0

প্রবন্ধ - সৌভিক দে

Posted in






ইংরেজিতে 'ধর্মতলা' শব্দটির যত বিভিন্ন বানান ইংরেজরা সৃষ্টি করেছিলেন, সম্ভবতঃ অন্য কোন বাংলা নামের সেই পরিমাণ বানান ও উচ্চারণ খুঁজে পাওয়া যাবে না। ধর্মতলার উল্লেখ পাওয়া যায় 'ইংলিশম্যান' পত্রিকাতেও। ১৯২৮ সালের ২৭শে মার্চ তারিখের কাগজে ১৭৯৮ সালের ধর্মতলার বর্ণনা করেছিল ইংলিশম্যান, এইভাবে–

"Dhurrumtolla in 1798 was described as 'an open and airy road'. It was a 'well-raised cause-way' above fields and lines with trees."

ধর্মতলার আশেপাশে ইংরেজ ও ফিরিঙ্গীদের বাস ছিল। এই পথটি ছিল মনোরম, ফাঁকা ও আলোবাতাস যুক্ত। পথের দুইপাশে ছিল বৃক্ষসারি। মুক্তবাতাস বা গাছের ছায়া পেয়েই হয়ত ইংরেজরা ওখানে থাকতে প্রলুব্ধ হয়েছিল। ধর্মতলা নামকরণের সত্যি ইতিহাসটা এখনও দ্বন্দ্বমূলক। তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। 'ধর্ম' শব্দের থেকেই 'ধর্মতলা' সেটা নিয়ে কোন বিতর্ক নেই, কেননা ধর্মতলায় একাধিক ধর্মক্ষেত্র বা ধর্মঠাকুরের থান ছিল। তখন ধর্মতলা ছিল 'Holy place' বা পূণ্যভূমি। ধর্মতলা ও চৌরঙ্গীর নামকরণ সম্পর্কে পাদ্রী-ফিরিঙ্গীদের অনেক জল্পনা-কল্পনা আছে। যেমন, মুসলমানদের মসজিদ ছিল বলে নাকি 'ধর্মতলা' নাম হয়েছে! স্থানীয় লোকসংস্কৃতি ও গ্রামীণ সংস্কৃতির সঙ্গে কোনো অঞ্চলের ইতিহাসের যোগসূত্র সন্ধান না করে, বাইরে থেকে কিছু আরোপ করতে গেলে যা হয়, সাহেবদের অনেকেরই তাই হয়েছে। ধর্মঠাকুরের প্রাধান্যের জন্যই ধর্মতলার নাম হয়েছে ধর্মতলা, মসজিদের জন্য নয়। মসজিদ বা পীঠস্থানের জন্য বঙ্গদেশের কোনো স্থানের নাম ধর্মতলা হয়েছে বলে আমার জানা নেই এবং পশ্চিমবঙ্গে অন্তত কোথাও তেমনটা চোখে পড়ে নি।

পশ্চিমবঙ্গের উত্তর রাঢ় ও দক্ষিণ রাঢ় থেকে ধর্মঠাকুরের পুজো ভাগীরথীর পূর্বতীরে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার কলকাতা পর্যন্ত যে প্রচলিত হয়েছিল, তা আজও বোঝা যায়। দক্ষিণে প্রাচীন আদিগঙ্গার তীর ধরে আজও ধর্মের 'যাত' হয়। কূর্মমূর্তি ধর্মঠাকুর সোনারপুরের বাজারে ডোমপণ্ডিত এখনও পুজো করে। বর্তমান হাজরা রোড ও শরৎ বসু রোডের(পূর্বতন ল্যান্সডাউন রোড) মোড়ে একটি প্রাচীন ধর্মঠাকুরের মন্দির আছে, এখন শিবই সেখানে প্রাধান্য পেয়েছেন। কসবা, বেহালা প্রভৃতি অঞ্চলেও ধর্মঠাকুর আছেন। জানবাজারে রাণী রাসমনির বাড়িটা বাঁ হাতে রেখে, কয়েক পা হাঁটলেই– বাঁ ফুটে ঘুপচি মত একটা ধর্ম ঠাকুরের মন্দির আছে(সঙ্গে দিলাম ছবি)। অনেক গবেষকের মতে এই ধর্মঠাকুরের নামেই আজকের ধর্মতলা। কিন্তু তা প্রমাণিত নয়।

সিমস সাহেবের রিপোর্টে দেখা যায় যে, একশো বছর আগে লালবাজার-রাধাবাজার অঞ্চলে ৩১,৬৮০ বর্গফুট জুড়ে বেশ একটি 'ডোমতালা' ছিল। ধর্মতলার পিছনে ছিল 'হাড়িপাড়া লেন'। পশ্চিমবঙ্গের(রাঢ়ের) ধর্মঠাকুরের বিখ্যাত সেবক বা পণ্ডিত ডোম ও হাড়িজাতির বেশ প্রাধান্য ছিল ধর্মতলা অঞ্চলে; দেড়শো বছর আগেও। যেখানে হাড়ি ও ডোমের এরকম প্রাধান্য ছিল, সেখানে কোনো ধর্মঠাকুর ছিল না– একথা মনে হয় না। সারা কলকাতায় ধর্মঠাকুরের একসময়ে বেশ প্রতিপত্তি ছিল এবং তাঁর গাজনও হত। পরে ধর্মের গাজন শিবের গাজনে রূপান্তরিত ও লুপ্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে অধিকাংশ ধর্মঠাকুরের স্থানগুলির নাম ধর্মতলা। কলকাতার ধর্মতলা তার ব্যতিক্রম হতে পারে না।

এবারে অন্য মতগুলোর দিকে নজর দেওয়া যাক–

বর্তমানে ধর্মতলায় যে মসজিদটি দৃশ্য হয়, তার পাশেই ছিল 'মেসার্স কুক কোম্পানি'র আস্তাবল। এই আস্তাবলের অধিকৃত জমিতে আরও অতীতে আরও পুরানো অন্য একটি মসজিদ ছিল। অনেকের মতে, ওই মসজিদ ও তৎসংলগ্ন দরগাহ থেকেই ধর্মতলা নামটি এসেছে। সেই পুরনো মসজিদেই কলকাতার সর্বপ্রথম কারবালার জনসমাবেশ হয়েছিল। সেই মসজিদ দীর্ঘকাল আগেই কালের গ্রাসে বিলীন হয়ে যায়। বর্তমানে যে মসজিদটি দেখা যায় সেটি, মহিশুরের সুলতান টিপু সুলতানের বংশধর 'প্রিন্স গোলাম মহম্মদ' ১৮৪২ সালে তৈরি করান। তখন লর্ড অকল্যান্ডের শাসনকাল। মসজিদের গায়ে একটি পাথরের ফলকে লেখা আছে– "This musjid was erected during the Government of Lord Auckland G. C. B by Prince Golam Mohomed son of the late Tippoo Sultan in gratitude to God and in commemoration of Honourable Court of Directors granting him arrears of his stipend in 1840."

দ্বিতীয় মতের প্রচারক ছিলেন ডা. হর্ণেল। তাঁর মতে, জানবাজারে বৌদ্ধধর্মালম্বীদের তখন যে আড্ডা ছিল, তা থেকেই নাকি ধর্মতলা নামের সৃষ্টি। বৌদ্ধদিগের তিনটি ধর্ম উপদেশের মধ্যে অন্যতম 'ধর্মং শরণম গচ্ছামি' ধর্মতলা নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল।

ধর্মতলায় ইংরেজদের একটি গির্জা স্থাপিত হয়েছিল ১৮২১ সালে। ১৮২৮ বঙ্গাব্দের 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকায় লেখা হয়– "মোকাম কলিকাতার ধর্মতলাতে শ্রীযুক্ত টোনলী সাহেব এক নতুন গির্জাঘর প্রস্তুত করিয়াছেন, সে গির্জাঘর গত বুধবার খোলা হইয়াছে।" ধর্মতলা প্রসঙ্গে পাদ্রী লং সাহেব লিখে গেছেন যে, মুসলমানদের মসজিদ থাকার দরুণ এই অঞ্চলের নাম হয় ধর্মতলা। পাদ্রী কেরি সাহেবও লং সাহেবের কথাগুলোর প্রতিধ্বনি করে গেছেন প্রায় একই ভাষায়।

যাই হোক, বঙ্গদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রচলিত ধর্মপুজোর ধর্মঠাকুরের নাম থেকেই যে ধর্মতলা নামটি এসেছে সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কলকাতার আশেপাশে শুধু নয়, কলকাতার কেন্দ্রস্থলেও যে একদা ধর্মপুজোর প্রচলন ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৮৪১ সালে প্রকাশিত 'বেঙ্গল এন্ড আগ্রা এন্যুয়াল গেজেটিয়ার' পত্রিকায় প্রকাশিত কলকাতার পথঘাট ও বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ স্থানের বিবরণের মধ্যে–

"Dhammoh Thekoor: 51, Janbazar Street.
Dinga Bhanga Lane: Between 39 and 40 Dharmatala St.
Doomtollah Street: Between 14 and 15 Radhabazar St."

১৮৪১ সালে শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী জানবাজারে এক ধর্মঠাকুর দেখে তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গেছেন এভাবে–

"The Calcutta temple of Dharma, situated at the premises No. 45. Janbazar Street contains six prominent images, namely Dharma on a simhasana ... etc." (Discovery of Living Buddhism in Bengal, Page- 22)

বেঙ্গল এন্ড আগ্রা এন্যুয়াল গেজেটিয়ার পত্রিকায় বর্ণিত ৫১ নং জনবাজার স্ট্রীটের ধর্মঠাকুর এবং হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বর্ণিত ৪৫ নং জানবাজারের ধর্মঠাকুর একই কিনা তা জানা যায় না। ধর্মতলার মধ্যেও একাধিক ধর্মঠাকুরের পূজা ও উৎসব হত। ওয়েলিংটন স্কোয়ারের পেছন থেকে 'বাঁকা রায় স্ট্রীট' নামে একটা রাস্তা ধর্মতলায় এসে পড়েছে, সেখানে বাঁকা রায়ের একটি মন্দিরও আছে। এই 'বাঁকা রায়' কোন ব্যক্তি বিশেষ নন, তিনি ধর্মঠাকুর। অনেকেই জানেন যে চাঁদ রায়, কালু রায়, দলু রায়, বাঁকুড়া রায়, বাঁকা রায় ইত্যাদি ধর্মঠাকুরের খুব জনপ্রিয় নাম। বর্তমান সময়ের অন্যতম গবেষক ও লেখক শ্রী বিনয় ঘোষ বলেছেন–

"পশ্চিমবঙ্গের ঘাটাল, আরামবাগ অঞ্চল থেকে আগত মৎস ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেকে ধর্মতলা অঞ্চলে প্রথমে যখন এসে বসতি স্থাপন করেন, তখন থেকে ধর্মঠাকুরের পূজার প্রচলনও করেন এই অঞ্চলে। কলকাতার মধ্যে তাঁদের প্রভাবও ছিল যথেষ্ট। তাঁদের পশ্চাতে ছিল রাণী রাসমণির ভরসা ও পোষকতা। মহাসমারোহে তাঁরা ধর্মঠাকুরের উৎসব করতেন, তাঁর গাজন হত, মেলা বসত। গঙ্গার ঘাটে সন্ন্যাসীরা যেতেন বর্তমান ধর্মতলা স্ট্রীটের ওপর দিয়ে। 'ধর্মতলা' নাম এখানকার ধর্মঠাকুরের এই আঞ্চলিক প্রতিপত্তি ও উৎসব থেকেই হয়েছে। জেলিয়াপাড়ার প্রাচীন মৎসব্যবসায়ীরা কলকাতার ধর্মতলা অঞ্চলের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রচনা করেছেন। অন্য কেউ করেন নি। ধর্মতলার সংলগ্ন আরও অনেক স্থানে ধর্মঠাকুরের পূজা হত বলে অনুমান করা যায়। জানবাজারে তো হতই, ডোমটুলি, হাড়িপাড়া প্রভৃতি অঞ্চলেও হত। ডোমটুলি ছিল ধর্মতলার ঠিক উত্তরে এবং হাড়িপাড়া ছিল তালতলা অঞ্চলে। ডোমপণ্ডিতরা যে ধর্মঠাকুরের পূজারী তা সকলেই জানেন।... একসময় নাথপণ্ডিতরাও কলকাতায় লব্ধপ্রতিষ্ঠ ছিলেন। নাথযোগীরাও ধর্মঠাকুরের পূজা করতেন।"

সুতরাং উপরে উল্লেখিত পূণ্যভূমির উপস্থিতির জন্যই যে ধর্মতলা নাম হয়েছিল, সেই বিষয়ে দ্বন্দ থাকলেও কোন বিভ্রান্তি নেই। ওয়ারেন হেস্টিংসের এক জমাদার জাফরের অনেক জমিজমা ছিল ধর্মতলায়। সেযুগের ধর্মতলায় বাবু হীরালাল শীলের একটা বাজার ছিল। তদানীন্তন ইংরেজ সরকার সাত লক্ষ টাকায় হীরালাল শীলের কাছ থেকে বাজারটি কিনে নিয়েছিল। আরও আগে, অতীতে, ১৭৯৪ সালে আরও একটি বাজারের হদিশ পাওয়া যায়– সেই বাজারের নাম ছিল 'মেম্বা-পীরের বাজার'। ধর্মতলার কাছে হগ সাহেবের বাজার তৈরির কাজ শুরু হয় ১৮৬৬ সালে আর কাজ শেষ হয় ১৮৭৪ সালে। শীলবাবুদের বাজার থাকায়, সেটি হগ সাহেবের বাজারের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর এই জন্যই ইংরেজরা শীলবাবুর বাজারটি চড়া দামে কিনে নিয়েছিলেন। জমির মূল্য এবং বাজারের গৃহাদি তৈরি করার খরচ মিলিয়ে মোট ব্যয় হয়েছিল ছয় লক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার টাকা। হগ সাহেবের বাজার মনের মতন করে তৈরি করেছিলেন ইংরেজরা। রুডইয়ার্ড কিপলিং পর্যন্ত তাঁর 'The City of the Dreadful Nights' গ্রন্থে হগ সাহেবের বাজারের চমৎকার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন।

ধর্মতলাতেই প্রথম ভারতীয় হাসপাতালটি চিৎপুর থেকে স্থানান্তরিত করে ইংরেজ সরকার। কেননা ধর্মতলার প্রচুর আলোবাতাস হাসপাতালের পক্ষে উপযুক্ত বলে মনে করা হয়েছিল। ১৭৯৩ সালে তৈরি চিৎপুরের হাসপাতালটিকে যখন ধর্মতলায় স্থানান্তরিত করা হয় তখন সেটির বয়স ছিল পঁচাত্তর বছর। কিন্তু পরে ধর্মতলা অপেক্ষা আরও উপযুক্ত জায়গা বলে গঙ্গার তীরের স্ট্র্যান্ড রোড বিবেচিত হয়, এবং হাসপাতালটিকে ধর্মতলা থেকে স্ট্র্যান্ড রোডে নিয়ে যাওয়া হয়– সেই হাসপাতাল এখনও আছে, 'মেয়ো হাসপাতাল' নামে।

ধর্মতলার উত্তর দিকে একটা খাল ছিল– চাঁদপাল ঘাট থেকে বেলিয়াঘাটার সল্টলেক বা ধাপা পর্যন্ত খালটি প্রবাহিত হত। বর্তমান ওয়েলিংটন স্কোয়ার ও ক্রীক রো'র মধ্যে দিয়ে খালটি হেস্টিংস স্ট্রীটে পৌঁছাত। খালটি এতটাই প্রশস্ত ছিল যে তাতে বজরা-নৌকা পর্যন্ত চলাচল করত। বর্তমান ক্রীক রো'র নিকটস্থ কোথাও এই খালের মধ্যে একটি জাহাজ ও কয়েকটি নৌকা ভেঙে যাওয়ায় এই জায়গার নাম হয়েছিল 'ডিঙ্গিভাঙা'। ১৭৩৭ সালের মহাপ্রলয়ঙ্করী সাইক্লোনে জাহাজটি গঙ্গাগর্ভ থেকে এই খালে ঢুকে যায় এবং তীরে ধাক্কা খেয়ে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। হেস্টিংস স্ট্রীট ও কাউন্সিল হাউস স্ট্রীটের সঙ্গমস্থলে এই খালের উপরে একটা সাঁকো ছিল। ১৮২১ সালের 'ক্যালকাটা গেজেট' থেকে জানা যায়, বর্তমান 'ওয়েলিংটন স্কোয়ার' তখন 'ধর্মতলা স্কোয়ার' নামে পরিচিত ছিল। এই স্কোয়ারটি ওই খালের উপরের জমিতে রয়েছে। 'ক্যালকাটা লটারী কমিটি' এই খাল বুজিয়ে জমিজমা ভরাটের কাজ করেছিল।

ধর্মতলার কাছাকাছি কোথাও 'ধর্মতলা একাডেমী' নামে একটা বিদ্যালয় ছিল। কারণ, ১২৩৬ বঙ্গাব্দের ১৩ই পৌষের 'সম্বাদ কৌমুদি' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল–

"শ্রীযুক্ত ড্রেমন্ড সাহেব ও শ্রীযুক্ত উইলসন সাহেবের ধর্মতলা একাডেমী নামের বিদ্যালয়ের ছাত্রদের পাঠের গত শনিবার পরীক্ষা ও তজ্জন্য অনেক সাহেব ও বিবি লোকের সমাগম হইয়াছিল। শ্রীযুক্ত রিবেরেন্ড উলিএম আদমসাহেব এবং শ্রীযুক্ত ড্রেজেরিও সাহেব পরীক্ষা লইলেন। কুমার অপূর্ব্ব কৃষ্ণ বাহাদুর প্রভৃতি ৮৬ জন বালক অপূর্ব্বরূপে বিবিধ শাস্ত্রের পরীক্ষা নিলেন। পরে বিজ্ঞ অধ্যাপকদের কতৃক কোন ২ বালক পুস্তক ও কেহ ২ রৌপ্য নির্মিত গোলাকৃতি বিশেষ গ্রথিত হার উপহার পাইয়াছেন।"

ধর্মতলায় যাতায়াত আছে, অথচ 'কার্জন পার্ক' চেনেন না এমন লোক কমই আছেন। লেডী কার্জনের স্মৃতিতে কার্জন পার্ক তৈরি করা হয়েছিল। আগে ওই স্থানে একটা বিশাল পুকুর ছিল। ওই পুকুর বুজিয়ে ফেলা হয়েছে– বর্তমানে ওখানে যে ট্রামডিপোটি আছে, সেটা ওই পুকুরের উপরেই তৈরি। কার্জন পার্কে একটা ফোয়ারা আছে, সেটি লেডী কার্জন কলকাতাবাসীদের উপহার দিয়েছিলেন। ফোয়ারার পিছনে গল্পটি হল– ১৯০৪ সালে লেডী কার্জন সাংঘাতিক রকমের অসুস্থ হন, তখন কলকাতাবাসীগণ লেডীকে যথেষ্ট সহানুভূতি প্রদর্শন করেন, তারই প্রতিদান স্বরূপ তিনি ফোয়ারাটি উপহার দেন। ফোয়ারাটি 'লেডী কার্জনের ফাউন্টেন' নামে পরিচিত।

বর্তমানে ধর্মতলায় তিনটে গির্জা দেখা যায়। এখানকার 'দি রোমান ক্যাথলিক' গির্জাটি ১৮৩২ সালে 'মিসেস পাশকোয়া ব্যারেটো ডিসুজা' প্রতিষ্ঠা করেন। 'দি ইউনিয়ন চ্যাপেল' স্থাপিত হয়েছিল ১৮২১ সালে। এছাড়া এই অঞ্চলে ছিল(কিছু বর্তমানেও আছে) বহু প্রাচীন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান– শ্রীনিকেতন কুটির শিল্প, অক্ষয় কুমার লাহা, জি. সি. লাহা, পি. সি. দত্তের চুরুটের দোকান, রাধিকাপ্রসাদ দত্ত, অনন্তচরণ মল্লিক, উল হাউস, আশুতোষ দাঁ, কল্পতরু আয়ুর্বেদ, ইন্ডিয়া ওয়াটার প্রুফিং এন্ড ডায়িং, ওয়াছেল মোল্লা, কমলালয় স্টোর্স, সুবেদালি ব্রাদার্স, নন্দী ব্রাদার্স, এইচ. ডি. নন্দী ইত্যাদি। ব্যাঙ্ক, দাঁতের চিকিৎসক, চশমা বিক্রেতা, ইলেকট্রিক, ফটোগ্রাফি, সাইকেল এবং মোটরের কারখানা ছাড়াও ছায়াচিত্রের পরিবেশকদের প্রচুর কার্যালয় অতীতে ধর্মতলায় ছিল আর আজও আছে। ধর্মতলার 'চাঁদনী চক' বিখ্যাত– 'নিউ সিনেমা' আর 'জ্যোতি সিনেমা' নামে এখানে সাম্প্রতিক অতীতের দুটি বিখ্যাত সিনেমাহল ছিল। অতীতে এই পথে দুটো বিখ্যাত রঙ্গালয় ছিল– 'করিস্থিয়ান থিয়েটার' ও 'পার্শী থিয়েটার'। ১৩৮ নম্বর ধর্মতলা স্ট্রীটের 'দি ডিসুজা হোম' নামের বাড়িটির নাম এখন কেউ জানেন না। বাড়িটি ১৮৭৪ সালে স্থাপিত হয়। প্রথমে দশজন স্ত্রীলোক ও কুড়িজন শিশুকে এই বাড়িতে স্থান দেওয়া হয়েছিল। তখন কেবলমাত্র বিত্তহীন ইউরোপীয়রা এই বাড়িতে জায়গা পেতেন। ধর্মতলায় একটি প্রাচীন আর্ট স্কুল ছিল, মিউজিয়ামের পাশে তা আজও বিদ্যমান। তার বর্তমান নাম গভর্নমেন্ট কলেজ অফ আর্ট এন্ড ক্র্যাফট।


গ্রন্থসূত্র :
ক) কলকাতা দর্পন ১ ও ২, রাধারমণ মিত্র, সুবর্ণরেখা।
খ) পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিনয় ঘোষ।
গ) কলিকাতার কালকথা, রাণা চক্রবর্তী।
ঘ) ধন্য কলকাতা সহর, কৌশিক মজুমদার, আখরকথা।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in





মাতৃমূর্তি আমাদের মনে একরকমের স্নেহার্দ্র ভালোবাসার জন্ম দেয়। মা হতে এই দেহ। দেহের মধ্যে মন ও চেতনারূপ প্রাণ। দেহই আধার। মা তাই আধাররূপিণী। এই দেহ আধারে ঈশ্বরীয় আনন্দ তো বটেই, সঙ্গে সংসারের নানারূপ সুখ দুঃখ শোক তাপ সব কিছুই ভোগ হয়। মা আমাদের দেহে সেই শক্তির সঞ্চার করেন। আমরা সেই শক্তিতে কর্ম করি, সংসারের জ্বালা ভোগ করি। আবার কখনও সেই পরমাপ্রকৃতির কৃপায় পরমানন্দ ভোগ করি। আজ যে দুর্গাপুজার ঘনঘটা চারিদিকে, সেই আরাধনার এমন জাঁকজমক হয়ত বেশিদিনের নয়, কিন্তু পুজার আর্তি বহুকালের। ভালোবাসার আর স্নেহ পাওয়ার আর্তি বহুকালের। তাই ফিরে ফিরে চাই, কবে মৃণ্ময়ী আসবেন আর তাঁর কাছে দুদণ্ড বসে শান্তি পাবো।

শক্তির যে রূপটি আমরা বঙ্গসংস্কৃতির ধারক করেছি সেটি এই আশ্বিনের ভরা স্রোতস্বিনী, সুনীল আকাশ আর শ্যামল প্রান্তরের মধ্যে প্রকৃতির আনন্দময়ী রূপের মধ্যে পেয়েছিলাম নিশ্চয়। নইলে শাকম্ভরী মূর্তির মধ্যে চরাচরের সেই জগজ্জননীকে খুঁজে পেলাম কি করে? কি করেই বা সপরিবার সবাহন দুর্গা বা উমার মধ্যে আমরা আমাদের চিরকালীন পারিবারিক আবহটি খুঁজে চলি?

একটু প্রাচীন সূত্র ঘেঁটে দেখি। কতদিনের এই দেবী আবাহন প্রথা? বৈদিক যুগেও আমরা দেবী আরাধনার দুয়েকটি সূত্র পেয়েছি। ঋগ্বেদীয় দেবীসূক্তে দেখতে পাচ্ছি মহর্ষি অম্ভৃণের কন্যা বাক। যিনি পরবর্তীতে সরস্বতী নামে অভিহিত হচ্ছেন। তিনি মন্ত্রদ্রষ্টা। উল্লেখ আছে, বাক পরাশক্তিকে আপন আত্মারুপে প্রত্যক্ষ করেছিলেন। অতএব, বাক আত্মজ্ঞান বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন। ফলে এই নারী ব্রহ্মরূপিণী হলেন। সেই অপরোক্ষ অনুভূতিতে ঋদ্ধ হয়ে তিনি এই অপূর্ব দেবীসূক্ত আবৃত্তি করেছিলেন। সেই সূক্তে তিনি নিজের সঙ্গে জগতের সমস্ত চেতন ও জড়বস্তুর একত্ব অনুভূতি ব্যক্ত করেন। তাঁর মনে হয় এ জগতের যা কিছু সব তিনি। সূক্তটি পড়তে পড়তে অদূর অতীতের এক মহামানবের কথা স্মৃতিতে জাগে। “মা আমার জগত জুড়ে। যেখানে যত স্ত্রী আছে, সব সেই মহামায়ার অংশ”(শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস)। বাক নিজের যে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করেছিলেন তা অনন্য। আর তাই বাক এই শব্দে আমরা ব্রহ্মাণীকে বুঝি। শূন্য থেকে নাদে প্রকাশ হল। এই সৃষ্টির আদি। যেমন, আমাদের চিন্তায় জন্ম নেয় ভাবীকাল। তারপর সেই থেকে সূক্ষ্মজন্ম ঘটে যায়। এর অনেক পর স্থুল জন্ম ঘটে। শ্রীরামকৃষ্ণদেব দক্ষিণেশ্বরের কুঠির ছাতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বিলাপ করছেন। কার সঙ্গে তাঁর জীবন কাটবে? তাঁর অন্তরঙ্গ ভক্তরা কই? এর প্রায় বিশ বছর পর সবাই একে একে আসতে শুরু করল। তিনি বললেন, ওই কান্না যখন কেঁদেছি তখনই সূক্ষ্মভাবে সব জন্মেছে। আর তারপর স্থুলে জন্মে এতদিনে কাছে এসেছে। তাই সরস্বতী বা বাক দেবীই সৃষ্টিদাত্রী। সত্বগুণস্বরূপিণী।

বৈদিক সাহিত্যে আর একজন দেবীর কথা পাই। তিনি হলেন শ্রী। শ্রীসূক্তে আছে তাঁর কথা। তিনি প্রধানত কৃষি ও সম্পদের দেবী। তাঁকে গবাদিবহুপশুসমৃদ্ধা বলেও অভিহিত করা হচ্ছে। এর অর্থ, তিনি সংসারের সুখ শান্তি দায়িকা। স্থিতির দেবী। রজোগুণময়ী। আমাদের নিত্যদিনের সুখ দুঃখের দেবী। আধুনিক কালে আমরা যাকে লক্ষ্মী বলে চিনি। শ্রীসূক্তে দেবীর রূপ স্পষ্ট। তিনি সুবর্ণরজতমাল্যধারিণী, হিরন্যবর্ণা, হিরন্যময়ী। জাগতিক কারণে আমাদের সোনারূপো চাই বই কি!

সৃষ্টি ও স্থিতির পর অবশ্যম্ভাবীভাবে আসে সংহার। সংহারের ঈশ্বরী দুর্গা। তিনি রুদ্ররূপ ধারণ করে সংহার করেন। সংহার করেন পাপসম্ভব অসুরকে। তিনি তমোগুণময়ী। নীচের শ্লোকটি পাই তৈত্তিরীয় আরণ্যকে।

তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্।

দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ সুতরসি তরসে নমঃ।

(তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১০।১।৬৫)

আজকের দেবী দুর্গার প্রথম নামোল্লেখ এই তৈত্তিরীয় আরণ্যকে। বৈদিক সাহিত্যে এই প্রথম তাঁকে পাওয়া গেলো। উক্ত শ্লোকের অর্থটি এরকম- যিনি অগ্নিবর্ণা, যিনি তপস্যার দ্বারা জ্যোতির্ময়ী, যিনি বৈরোচনী, কর্মফলের নিমিত্ত যিনি উপাসিতা, সেই দেবী দুর্গার শরণ নিলাম।

এই সংহারমূর্তি দেবীকে আমরা কেন পূজা করি? কারণ তিনি আমাদের পাপনাশ করেন। এই দেহে জাত সমস্ত কলুষ হরণ করেন কলুষহারিণী দেবী। এই তিনটি দেবী মূর্তি প্রকৃতপক্ষে একই শক্তিময়ীর তিনটি পৃথক রূপ। মা যখন জন্ম দেন তখন তিনি বাক বা সরস্বতী। যখন সন্তানকে পালন করেন তখন তিনি শ্রী বা লক্ষ্মী। আর যখন কলুষ নাশ করেন তখন তিনি দুর্গা। এই ভাবেই আমাদের কল্পনায় মাকে আমরা গড়ে নিয়েছি।

কিন্তু এই রূপের অন্তরে অরূপটি কি? রূপসাগরে ডুব দিলে অরূপ রতনের আশা থেকে যায় বৈকি! বিশেষ, ভারতীয় অধ্যাত্ম দর্শনের মূল লক্ষ্যই হল, সেই অরূপের উপলব্ধি। যাকে আমরা চেতনার গভীরে অনাবিল আনন্দে অনুভব করি। তবে এই মাতৃমূর্তির আরাধনার মধ্যে দিয়ে আমরা কি সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি? সেই মহামানব বলেছিলেন- মৃন্ময় আধারে চিন্ময়ী দেবী। অর্থাৎ এ দেহ মৃন্ময়। পঞ্চভুতে তৈরি। সেই মৃন্ময় আধারে চেতনরূপিণী চিন্ময়ী। তাঁকে আমরা অন্তরে পাবো ঠিক তেমনি। তিনি আমাদের সংসারে জন্ম দিয়ে পালন করে অবশেষে সংহারকালে এই সংসার ভবার্ণব থেকে মুক্তি দেন। আর তখন তিনি ত্রিগুণময়ী থেকে, ত্রিগুণাত্মিকা থেকে ত্রিগুণহরা। পরাৎপরা। কিন্তু যতক্ষণ দেহ আছে ততক্ষণ সংসার আছে, কারণ এই দেহটাকে তো খেতে পরতে দিতে হয়! তখন মা সগুণময়ী। শেষে সেই পরম উপলব্ধির কালে কোনও গুণই থাকেনা। দেহ সব গুণের অতীত হলে তবেই সেই উপলব্ধি ঘটে। আর সেটি হয় মায়ের কৃপায়।

যদিও পরমকে প্রকৃতি বা স্ত্রীরূপে পূজা আমাদের বৈদিক সভ্যতার পরিপন্থী। কারণ বেদে পিতার কথাই বারবার বলা হয়েছে। পুরুষসূক্ত শুধু পুরুষের উত্তরণের কথা। নারী সেখানে তাঁর পার্শ্ববর্তিনী মাত্র। এবং শেষে নারী পাশ থেকেও সরে যায়। মহামানব বলছেন- মহামায়া দ্বার খুলে না দিলে ব্রহ্মজ্ঞান হয়না। মা তবে দুয়ার খুলে দিয়ে কি করেন? সরে যান। ব্রহ্ম পুরুষ কিনা! কিন্তু আমাদের মন মানে কই? মা বিনা চলেনা। তাই মা থাকেন। কেমন করে? মা পরিবর্তিত হন পরমে। শক্তি ব্রহ্মে পরিবর্তিত হন। মহাপুরুষ বলছেন- তোমরা যাকে ব্রহ্ম বলো, আমি তাকেই মা বলে কই। ‘ম’ মানে ঈশ্বর। ‘ম’ এ আকার দিলে ‘মা’। সাকার ঈশ্বরই হলেন ‘মা’। তাই মা বলতে আমরা ঈশ্বরের সগুণ রূপময় অস্তিত্বকে বুঝি। যাকে আঁকড়ে ধরা যায়। সেই চেতনময়ীই আমাদের অন্তরের সাধনার ধন।

সৃষ্টির বীজ মা তুলে রাখেন। জগত সৃষ্টি করেন, আমাদের এই দেহ সৃষ্টি করেন শুধু নয়, দেহের অভ্যন্তরে ঈশ্বরীয় স্ফুরণের জন্মও হয় মায়ের জন্য। মহামানব বলছেন- “গিন্নিদের একখানা ন্যাতাকাঁতার হাঁড়ি থাকেনা? তাইতে মা নীলবড়ি, শসাবিচি, সৃষ্টির বীজসকল তুলে রেখে দেন”। তারপর সময় হলে আবার তাই থেকে এই জগত সৃষ্টি করেন। এই এত বড় জগত মা সৃষ্টি করেন অথচ আমরা একযোগে তা প্রত্যক্ষ করতে পারিনা? তাহলে এই কথার যৌগিক অর্থটি বরং স্পষ্ট হোক। মা আমাকে সৃষ্টি করেন। দেহ জন্মালে তাইতে ‘আমি’ ও জন্মায়। সেই ‘আমি’ তারপর দেহের শক্তিতেই পালিত হয়। স্থিতি। শেষে দেহের শক্তিই তাকে নাশ করে। মৃত্যুমুখে ঠেলে দেয়। এই দেহের নাশ মানেই ‘আমি’র নাশ। এটি বাহ্যিক। আন্তরিক অর্থ, দেহের মধ্যে আত্মার প্রথম স্ফুরণে ‘আত্মা আমি’র জন্ম। তারপর বহুকাল ধরে নানাবিধ দর্শন ও অনুভূতির মাধ্যমে দেহস্থ চেতনা সেই ‘আমি’কে পূর্ণতা দেয়। স্থিতি। এবং শেষে আত্মার দর্শন ও ঈশ্বর লাভ। সপ্তমভূমিতে যখন এই অনুভূতি কেউ লাভ করেন তখন তাঁর দেহস্থ চৈতন্য সংকলিত হয়ে মস্তিষ্কের সহস্রারে আত্মারূপে দৃষ্ট হয়। ‘আমি’র এই শ্রেষ্ঠ বিকাশ। এরপরে “একুশদিন মাত্র দেহটি থাকে। মুখে জল দিলে গড়িয়ে যায়” – শ্রীরামকৃষ্ণদেব। সমাহিত ব্যক্তি একুশদিন পর্যন্ত বাঁচতে পারেন। তার বেশি নয়। তাই প্রয়োজন ফুরলে মা দেহটি ভেঙে দেন। প্রয়োজনে আবার দেহ সৃষ্টি করেন।

আমাদের বাংলায় দুর্গাকে আমরা ঘরের মেয়ে বলে আদর করি। শরতের নির্মল পরিবেশে সে আসে তার পরিবার নিয়ে বাপের বাড়িতে। ‘উমা’ বলে ডাকি তাকে। এই ‘উমা’ নামটি প্রচলিত হয়েছে মহাভারতের সময় থেকে। মহাভারতের শান্তিপর্বে দক্ষ রাজার যজ্ঞের উল্লেখ আছে। সেই শিবহীন যজ্ঞে উমা ক্রুদ্ধ হন। তাঁর ক্রোধ উপশমের জন্য শিব সেখানে যান। সেই বহুল প্রচলিত কাহিনীর শেষ আমরা প্রত্যেকেই জানি। এই সূত্র ধরে দেখে নিই মহাভারতে যুধিষ্ঠিরের দুর্গাপুজার প্রসঙ্গটি। বিরাট পর্বের ষষ্ঠ অধ্যায়ে বিরাট নগরে অজ্ঞাতবাসে যাবার সময় যুধিষ্ঠির দেবী দুর্গা বা উমাকে স্তব করে প্রসন্ন করছেন। স্তবে তিনি তাঁকে আরও নানা নামের সঙ্গে বাসুদেব ভগিনী বলে অভিহিত করছেন। আমাদের মনে পড়ে যায়, কংসের কারাগারে কৃষ্ণের জন্মের আগে জন্মেছেন মহামায়া। সেই শিশুকন্যাকে পাথরে ছুঁড়ে হত্যা করছেন কংস। কিন্তু মহামায়া যে মৃত্যুর পারে! যুধিষ্ঠির ভাইদের সঙ্গে একত্রে আরাধনা করে দেবীর দর্শন চাইছেন। কারণ তিনি দুর্গমেতে দুঃখহরা। তিনি দুর্গতিনাশিনী। পাণ্ডবদের দুর্গতির কথা আর কত বলা যায়! সারাটা জীবন তাঁদের বিপদ মাথায় নিয়ে কেটেছে। তাই দুর্গা বিনে গতি নেই তাঁদের। তিনি বলছেন- ব্রহ্মাদি প্রাচীনেরা তোমার স্মরণ করে তোমার কাছে বর পেয়েছেন। ভারমোচনের জন্য যেসব তোমাকে স্মরণ করে, যারা প্রাতে উঠে তোমাকে স্মরণ করে তাদের কাছে স্ত্রী পুত্র ধন সম্পদ কিছুই দুর্লভ নয়। দুর্গতি থেকে ত্রান করো বলে লোকে তোমাকে দুর্গা বলে। দুর্গম পথে অবসন্ন মানুষের তুমি পরমা গতি। রাজ্যভ্রষ্ট আমি তোমার শরণ নিলাম। আমাকে ত্রাণ করো। আমাকে আশ্রয় দাও। সুতরাং যুধিষ্ঠির সপরিবারে দুর্গার শরণ নিচ্ছেন, যাতে মা তাঁকে এই মহা বিপদ থেকে রক্ষা করেন। এই জাগতিক দুর্গতি বিনে আরও একরকমের দুর্গতির কথা আছে। সেটি থেকে মুক্তি চাইতেও তো দুর্গা! আমরা যখন দেহে বদ্ধ হয়ে নিজের স্বরূপ ভুলে মোহে আচ্ছন্ন হই আর নানা ভোগে ডুবে ভুলে থাকি, তখন সেই দুর্গতি থেকেও তো মা ত্রাণ করেন!

ভীষ্মপর্বে অর্জুনও স্তব করছেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আগে। শত্রু নাশের জন্য তিনি শক্তি চাইছেন মায়ের কাছে। কিন্তু এই স্তবে যত না তিনি শক্তি কামনা করেছেন তার চেয়ে বেশি তিনি মায়ের মাধুর্যে, ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁর অর্চনা করেছেন। বলছেন- আমি বিশুদ্ধ অন্তরে তোমার স্তব করছি যে তোমার প্রসাদে যুদ্ধে আমার জয়লাভ হোক। এরপরে বলছেন- আত্মবিবেকরূপ সমাধিতে সিদ্ধচারণগণ তমাকেই দর্শন করেন। এ কিরকম? যে মাতা আমাকে শত্রুনাশের শক্তি দবেন, অবশ্যই সে শক্তি পেশী শক্তি, সেই মাতাই আবার সিদ্ধচারণদের সমাধিতে দর্শন দেবেন! কেমন বিপরীত ভাবের কথা যেন?

প্রকৃতপক্ষে এই কথার যৌগিক অর্থ না উপলব্ধি করলে স্তবটি অদ্ভুত লাগবে। শত্রু বাইরে থেকে আসেনা। সাধনার যা বিঘ্ন, সেই সব জাগতিক কামনা বাসনা ও কাম ক্রোধ লোভ মোহাদি ছয় রিপুই তো শত্রু! সেই শত্রুনাশেই মা সহায়। তিনি দেহকে এমন করে প্রস্তুত করবেন যে এই রিপুনিচয় নাশ হবে। আর তারপরে সেই শুদ্ধ দেহে আত্মিক বিকাশ হবে। সমাহিত সাধক দেখবেন মায়ের সেই নিত্যশুদ্ধবোধরূপ। সকল কামনার উর্দ্ধে শুধু ঈশ্বরীয় আনন্দের স্বতঃস্ফুরণ। সেই মাতৃমূর্তিই আমাদের সাধ্য। সেই চেতনময়ী মাই আমাদের ধারণ করে আছেন, আবার দর্শন দিয়ে মনুষ্য জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য সফল করবেন। তাই মহাভারতের কাল থেকে কিংবা তারও আগে থেকে আমরা ডেকে চলেছি আমাদের সেই মাকে। জগজ্জননী আমাদের স্নেহ থেকে বঞ্চিত না করেন।

[শারদীয়া এবং স্রোত ২০১৯]

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in





পর্ব ২৫

স্মৃতির সরণি বেয়ে – গাজরের কেক তৈরি শেখা

হেঁশেলে প্রবেশ করা আর পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা তার অন্দর মহলের রহস্য উদঘাটন করতে চাওয়া এক জিনিস নয়। রান্নাঘরে তো জল গরম করার জন্যও ঢোকা যায় কিংবা ডিম সিদ্ধ করার জন্য। কিন্তু নিঁখুতভাবে ডিম সিদ্ধ করতে হলে যে ফুটন্ত জলে সামান্য নুনের প্রয়োগ জরুরি, কারণ জলের তাপমাত্রা বেড়ে গিয়ে ডিমের সাদা অংশটি সেক্ষেত্রে তাড়াতাড়ি জমে যায়, এই আপাতসাধারণ তথ্যটি যে মুহূর্তে জানা হয়ে গেলো, পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে গেলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণেই। কোনও এক অসতর্ক লগ্নে এই অধমের ঠিক তাই হয়েছিল। পরবর্তীকালে যে ক’জন অসামান্য রাঁধুনি তাঁদের অজান্তেই হাত ধরে আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন রন্ধনশালার ভিতর থেকে গভীরে, বার্লিনবাসী বারবারা কাপ্টাইন তাদের মধ্যে একজন। আরও একটি চিত্তাকর্ষক বিষয়ের উল্লেখ এক্ষেত্রে করার প্রয়োজন আছে। টেলিভিশনের পর্দায় দেখা কোনও রথী- মহারথী শেফের চমক ধরানো পাকশৈলী নয়, যারা আমাকে স্বাদু এই জগতটির অলিগলি চিনতে শিখিয়েছিল, তাদের প্রত্যেকেই আটপৌরে সংসারী মানুষ। সাংসারিক যাবতীয় দায়দায়িত্ব নিঁখুতভাবে সামলে রান্নাঘরটিকে যারা নিয়ে গেছে পেশাদারী স্তরে। সেইরকম অনেকের কথাই লেখার সময় মাথায় ভিড় করে আসছে, কিন্তু আজকের লেখার প্রেক্ষিতে বেছে নিলাম বারবারাকে।

বারবারার সঙ্গে পরিচয় এবং বন্ধুত্ব তিন দশকেরও আগে এই শহরেই। সেকথা আগেই লিখেছি। প্রথমবার যখন বার্লিন যাই এবং বেশ কিছু সময় বারবারা, ওর বর উরবান আর ওদের তিনটি আশ্চর্য সুন্দর ছেলেমেয়ের সঙ্গে অতিবাহিত করেছিলাম, গড়ে উঠেছিল এক অদ্ভুত সম্পর্ক, যা আজও একইরকম নিবিড় রয়ে গিয়েছে। অনেক দিন পরেও যখন দেখা হয়, সময়ের ব্যবধান বুঝতে পারিনা আজও। সে অন্য কাহিনী কিন্তু এইসব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ অবতারণা করার উদ্দ্যেশ্য আমার এই বিচিত্র স্বাদগন্ধে ভরপুর যাত্রাপথের বাঁকগুলিতে যাঁরা আমাকে স্বাগত জানিয়েছেছেন, এগিয়ে দিয়েছেন পরবর্তী লক্ষ্যের দিকে, তাঁদের সঙ্গে এ লেখা যাঁরা পড়বেন, তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।

সেই প্রথমবার ওই বাড়িটিতে গৃহে পা দেওয়ার কিছুদিন আগেই বারবারা, উরবান ওদের তিন ছেলেমেয়ে ইওনাস, পাউল আর জেনি-কে নিয়ে উঠে এসেছিল পশ্চিম বার্লিনের শারলটেনবুর্গ অঞ্চলের এই ফ্ল্যাটটিতে। বইয়ে ঠাসা এই বাড়িটির মধ্যে ভালো-লাগার উপকরণ ছিল অনেক কিন্তু তার মধ্যেই কেন জানিনা আমার আলাদাভাবে ভালো লেগে গিয়েছিল প্রশস্ত হেঁশেলটি। যার এক কোণে পশ্চিমি রীতি অনুযায়ী একটি ছোট্ট সুন্দর কাঠের টেবিল, যা পরবর্তী তিন দশকে যখনই ওদের অতিথি হয়ে থেকেছি, ওই টেবিলটি প্রতিদিন সকালে হয়ে উঠেছে আমাদের আড্ডাস্থল আর ঠিক তার পিছনদিকেই কাচের দরজার ওপাশে বারান্দা আর হ্বিন্টারগার্টেন অর্থাৎ শীতকালীন বাগান। এই রান্নাঘরটিতে বছরের পর বছর বারবারাকে দেখেছি গ্রিক, ইতালিয়ান, চাইনিজ, মেক্সিকান এবং অবশ্যই জার্মান নানান অপূর্ব সব পদ অবলীলায় তৈরি করতে। সবচেয়ে অবাক হতাম যখন দেখতাম, তিন কোর্সের এক অপূর্ব নৈশাহারের তোড়জোড় সেরে নিয়েই বারবারা যখন আমাদের নিয়ে চলে গেছে কোনও বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে বা অপেরায়, ফিরে এসে সরাসরি ঢুকে গেছে রান্নাঘরে আর তার কিছু পরেই টেবিলে হাজির হয়েছে সেই প্রতীক্ষিত আহার্য। এত নিঁখুত সময়ের সদ্ব্যবহার আমি খুব কম মানুষের মধ্যে দেখেছি। সেই বারবারা বছর তিনেক আগে একদিন দুপুরবেলা হঠাৎ বলল, ‘রাজা, চলো সুইস ক্যারট কেক করা যাক!’ সুইস ক্যারট কেক? এই বস্তুটি সম্পর্কে শুনেছিলাম বটে কিন্তু সম্যক পরিচয় ঘটেনি সেদিনের আগে। আমাদের সেদিনের দুপুর বিকেলের কর্মব্যস্ততার গল্পে ঢোকার আগে অসামান্য এই কেকটির জন্মবৃত্তান্তে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

সুইৎজারল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলের একটি রাজ্য আরগাউ। পাহাড়ি এই দেশটির সমতলভূমি বলে যদি কিছু থাকে, তা সম্ভবত এখানেই। আরে নদীর তলার দিকে অবস্থিত বলেই এমন নামকরণ এই জায়গাটির। আরেকটি কারণেও এই প্রদেশটি বিখ্যাত – তা হল গাজর উৎপাদন। সে হেতু আরগাউ-কে ‘গাজর-রাজ্য’ও বলা হয়। তা এখানকার মহিমান্বিত কেক যে ‘আরগাউয়ার র‍্যুবলিটর্টে’ (Aargauer Rueblitorte) বলে প্রসিদ্ধ হবে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। সত্যিই কি নেই? যে ‘গাজর-কেক’ নিয়ে সুইসদের এত গর্ব, (জীবনের অধিকাংশ সময় দেশের বাইরে কাটিয়েও জাত্যাভিমানের মর্যাদা রক্ষায় সদা-সজাগ বারবারা কাপ্টাইনও সেই দলেরই সদস্য) তার জন্ম আসলে কোথায়?

অনেক খাদ্য ঐতিহাসিকের মতে মধ্যযুগে ইউরোপে যখন চিনি বা মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য দুর্মূল্য, তখন জন্মলাভ করে ‘ক্যারট পুডিং’, যেখানে চিনির বিকল্প উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হত গাজর। পরবর্তীকালে বিবর্তনের নানা পথ পেরিয়ে ইংল্যান্ডে এসে থিতু হয় সেই পুডিং কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে খাদ্য ‘রেশনিং’ ব্রিটেনের গৃহিণীদের কপালে ফেলে ভাঁজ। অতএব আবার সেই চিনির বদলে গাজরের ব্যবহার। ততদিনে এই বিশেষ কেকটি ইউরোপের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে খাদ্যরসিকের প্রিয় তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে আলাদা আলাদা নামে। আর শুধু ইউরোপ কেন, আমেরিকাতেও এই কেকের জনপ্রিয়তা বিপুল কিন্তু আমেরিকার পিৎজা, স্টেক বা লিমুজিনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই টর্টে বা কেকও বিপুলায়তন। অনেক শুকনো ফল ইত্যাদি উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন সব টর্টে এক অর্থে কেক বটে কিন্তু সব কেক টর্টে নয়। কারণ চিনি, ডিম আর মাখনের সঙ্গে কেকের মূল উপাদান ময়দা আর টর্টের ক্ষেত্রে ময়দার পরিবর্তে মেশানো হয় বাদাম গুঁড়ো। এই মৌলিক পার্থক্যই এই দুই সহোদরকে চরিত্রগতভাবে এতটা আলাদা করে রেখেছে।

সেদিন কেমন হয়েছিল আমাদের কেক? তিনটি পর্যায়ে বিন্যস্ত এই কেকটি শেষ পর্যন্ত যখন বারবারার আভেন থেকে আত্মপ্রকাশ করলো, সোনালি দীপ্তি ঠিকরে পড়ছে তখন তার অঙ্গ থেকে আর ওদের খাবার ঘরটি ভরে উঠল অপূর্ব সুন্দর এক সৌরভে। কিন্তু কাজ তখনও বাকি ছিল। ডিমের সাদা অংশ, মিহি চিনি (আইসিং সুগার), লেবুর রস আর কির্শ (চেরি ব্র্যান্ডি)- এর মিলমিশে তৈরি হওয়া গাঢ় সাদা মিশ্রণটি লেপে দিতে হবে কেকের ওপর ওস্তাদের মার শেষ রাত্রে আপ্তবাক্যটি প্রমাণ করার জন্য ওপরে সাজিয়ে দিতে হবে গাজর মারৎসিপান। এই মারৎসিপান প্রসঙ্গে সবিস্তারে এর আগে লিখেছি। এইবার সবকিছুকে ঘরের তাপমাত্রায় আনার পালা। খাওয়ার সময় ছুরি দিয়ে কেটে প্রথম টুকরোটি কেটে মুখের ভিতর দিতেই জিভে জড়িয়ে গিয়েছিল অনাস্বাদিতপূর্ব এক অনুভূতি ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিয়েছিল মুখের স্বাদ গ্রহণের কোষগুলিকে। প্রথমে মারৎসিপান, তারপর ক্রিম আর তৃতীয় স্তরে গাজরের স্বাদ যেন একে অপরের কমপ্লিমেন্টারি! বিশুদ্ধ ম্যাজিক সম্ভবত এটাই।

অতিমারীর আগ্রাসনের আগে চেনা পৃথিবীর সঙ্গে সেই শেষ দেখা। প্রতিবারের মতো সেবারও বারবারা চলে আসার আগে টুকিটাকি উপহারের সঙ্গে দিয়েছিল একটি র‍্যুবলিটর্টে মিক্স। বলেছিল তৈরি করে ছবি পাঠিও। ফেরার পর ছকটি বদলে গিয়েছিল। খুঁজে পাচ্ছিলাম না সেই প্যাকেটটি। অনেক পরে সেটির পুনরুদ্ধার যখন হল, তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক। যে ছবি পাঠানোর কথা দিয়ে এসেছিলাম বারবারাকে, তা আর হয়ে ওঠেনি। এ আক্ষেপ কখনও যাবে না।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২২


লেফটেন্যান্ট গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসে। ফিসফিস করে… ‘কী ব্যাপার?’

ফাইনহালস থাবড়ে থাবড়ে দেখে। বুঝতে পারে… রক্ত। নাহ… ওয়াইন নয়। রক্ত। সে হাত সরিয়ে নিয়ে নরমভাবে বলে… ‘আমার মনে হচ্ছে ও আর বেঁচে নেই। পিঠে একটা বিশাল ক্ষত… রক্তে মাখামাখি… আচ্ছা, আপনার কাছে ল্যাম্প বা টর্চ আছে?’

‘থাকলেও কি এখন সেটা জ্বালানো উচিত?’

‘তাহলে ওকে তুলে নিয়ে মাঠের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে…’

‘ওয়াইন…’ বলেন লেফটেন্যান্ট… ‘এত ওয়াইন! কেসটা কী? লোকটা কী করবার চেষ্টা করছিল?’

‘মনে হয়… ক্যান্টিনের জন্য’…

ফিঙ্ক খুব একটা ভারি নয়। গুঁড়ি মেরে, বুকে হেঁটে ওকে নিয়ে আসে ওরা ঘাসজমির উপর দিয়ে। আলের উপরে একটু আবছা আলোকিত জায়গায় ওকে শুইয়ে দেয়। পিঠের জায়গাটা রক্তে কালো হয়ে আছে। ফাইনহালস সাবধানে ওকে পাশ ফিরিয়ে দেয়। এই প্রথম সে তার মুখটা ভালভাবে দেখতে পায়। একটা সরু, নরম ,মায়াময় মুখ। এখনও ঘামে ভেজা। ঘন কালো চুলের গুচ্ছ কপালে লেপটে আছে।

‘হে ভগবান!’ ফাইনহালস বলে…

‘কী হল?’

‘ওর বুকে লেগেছে। শরীরের সামনে। একটা হাতের মুঠোর আকারের ফুলকি ঢুকে গেছে…’

‘বুকে?’

‘একদম। কারণ বোধহয় ও স্যুটকেসের উপরে হাঁটু মুড়ে রেখে তারপর হামাগুড়ি দিয়ে এগোচ্ছিল।’

‘সাঙ্ঘাতিক বেনিয়ম!’ বলে উঠলেন লেফটেন্যান্ট। তবে বোধহয় নিজেরই ভাল লাগল না এইসময় এমন রসিকতা। তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন… ‘ওর পে বুক আর আইডেন্টিটি কার্ড বের করে নিন ।’

ফাইনহালস সাবধানে ওর রক্তে ভেজা শার্টের বোতাম খুলে হাতড়াতে গিয়ে ওর হাতে একটা রক্তে ভেজা ধাতব টিনের টুকরো উঠে এলো। বাঁদিকের পকেটে পে বুক ছিল। সেটা পরিষ্কার। কোনও দাগ লাগেনি তাতে।

‘দুত্তোর!’ পেছন থেকে লেফটেন্যান্ট বলে উঠলেন… ‘স্যুটকেসটা ভয়ানক ভারি… এখনও বেশ ভারি।’ তিনি সারা রাস্তা ভাঙ্গা স্যুটকেসটা আর ফিঙ্কের রাইফেলটা টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এসেছেন।‘ওর জিনিসপত্র পাওয়া গেল?’

হ্যাঁ… বলে ফাইনহালস।

‘এগিয়ে চলুন!’ লেফটেন্যান্ট স্যুটকেসটা ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে নিয়ে আসেন বাঙ্কারের মুখের কোণ অবধি। তারপর ফাইনহালসকে ফিসফিস করে বলেন… ‘দেওয়ালের পেছনে স্যুটকেসটা একটু ঠেলে দিন।’ ফাইনহালস তাই করে। লেফটেন্যান্ট হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসেন। ফাইনহালসও এগিয়ে আসে। দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে তারা দুজনে উঠে দাঁড়াবার মত জায়গা পায়।মুখোমুখি দাঁড়ায় তারা। দূরে খড়ের গাদা থেকে জ্বলে ওঠা আগুনের আভার আলো যথেষ্ট পরস্পরকে চিনবার জন্য।তারা এক মুহূর্ত তাকায় একজন আরেকজনের দিকে।

‘আপনার নাম কী?’ প্রশ্ন করেন লেফটেন্যান্ট।

‘ফাইনহালস।’

‘আমার নাম ব্রেশট… বলে লেফটেন্যান্ট অদ্ভুত অপ্রস্তুতভাবে হেসে ওঠেন… ‘আমার স্বীকার করা উচিত যে আমার ভীষণ তেষ্টা পেয়েছে।’ তিনি স্যুটকেসের উপরে ঝুঁকে পড়েন। এক বোঝা ঘাসের স্তুপের উপরে টেনে নিয়ে আসেন ওটা। স্যুটকেসটা খুলে সাবধানে একটা অক্ষত ছোট বোতল বের করে নিয়ে আসেন তিনি… ‘হা ঈশ্বর! টোকাইয়া!’

লেবেলটা রক্তে আর ওয়াইনে ভিজে মাখামাখি।ফাইনহালস লক্ষ্য করল যে লেফটেন্যান্ট ভাঙ্গাচোরা কাচের টুকরোগুলোর মধ্য থেকে পাঁচ ছ’টা বোতল আলাদা করে বেছে রাখছেন। সেগুলো অক্ষত। নষ্ট হয়নি। ব্রেশট নিজের পকেট থেকে ছোট ছুরি বের করে একটা বোতল খুলে ফেলে এক ঢোঁক গলায় ঢালেন।

‘অসাধারণ!’ বলে বোতলটা এক পাশে নামিয়ে রাখেন।

‘আপনি নেবেন নাকি একটু?’

‘ধন্যবাদ!’ বলে ফাইনহালস বোতলটা নিয়ে এক ঢোঁক পান করে। স্বাদটা তার কাছে একটু বেশি মিষ্টি বলে মনে হয়। বোতলটা ফিরিয়ে দিয়ে সে আবার বলে ওঠে… ‘ধন্যবাদ!’

গ্রামের উপরে আবার গ্রেনেড আছড়ে পড়ে। যদিও এবার অনেকটা দূরে। হঠাৎ তাদের সামনে কোথাও থেকে মেশিন গানের শব্দ ভেসে আসে গ্রেনেডের জবাবে।

‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ!’ বলেন ব্রেশ্‌ট… ‘এরা এখনও আছে। আমি তো ভাবলাম…’ খালি বোতলটা ঢালু জমিতে গড়িয়ে দেন তিনি… ‘আমাদের এই দেওয়ালটা টপকে বাঁ দিকে যেতে হবে।’

খড়ের গাদাটা দাউদাউ করে জ্বলছিল। গাদাটার নিচের স্তরটা যেন গলে যাচ্ছে আগুনে। ফুলকি উড়ছে চারদিকে।

‘আপনাকে দেখে মনে হয় বেশ জ্ঞানগম্যি আছে।’ বলে ওঠেন লেফটেন্যান্ট।

ফাইনহালস কোনও জবাব দেয়না।

‘মানে বলতে চাইছি যে…’ বলে লেফটেন্যান্ট দ্বিতীয় বোতলটার ছিপি খুলতে শুরু করেন… ‘মানে… এই যুদ্ধটা যে একদম জঘন্য, যাচ্ছেতাই ব্যাপার, সেটা বোঝবার মত যথেষ্ট জ্ঞানগম্যি আছে আপনার!’

ফাইনহালস কোনও জবাব দেয়না।

‘আমি যখন বলছি যে এটা জঘন্য, বিশ্রী যুদ্ধ… তার মানে… যে যুদ্ধ আপনি জিতে যাবেন, সেটা জঘন্য নয়… আর এটা… মানে, এটা একেবারে ভীষণ বিশ্রী, জঘন্য যুদ্ধ!’

‘হ্যাঁ’… বলে ওঠে ফাইনহালস… ‘এটা খুব, খুব খারাপ যুদ্ধ!’ অদূরে মুহুর্মুহু মেশিনগানের শব্দে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বোধ করছিল সে।

‘মেশিনগান কোথায় বসানো হয়েছে?’ সে নরম ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করে।

‘এই দেওয়ালটা যেখানে শেষ হয়েছে… একটা খামার আছে। মেশিনগানগুলো তার পেছনে বসানো হয়েছে।’

মেশিনগানের গোলাগুলি চলতেই থাকে। তারপর একটু চুপচাপ। আবার রাশিয়ান দিক থেকে গুলির শব্দ আসে। জার্মানরা প্রত্যুত্তরে আরও কিছু গুলি ছোঁড়ে। চাপান উতোর চলতে থাকে। হঠাৎ সব একদম চুপচাপ হয়ে যায়।

‘জঘন্য!’ বলে ওঠেন লেফটেন্যান্ট।

খড়ের গাদাটা ধীরে ধীরে একদম ভেঙ্গে পড়ে যাচ্ছে। এখন আর ফুলকি উড়ছে না সেভাবে। হাল্কা একটু পড়পড় শব্দ হল… চারদিক অন্ধকারে ঢেকে গেল। লেফটেন্যান্ট ফাইনহালসের দিকে বোতলটা একবার বাড়িয়ে দিলেন। ফাইনহালস মাথা নাড়ল… ‘নাহ, ধন্যবাদ, আমার একটু বেশি মিষ্টি লাগছে।’

‘আপনি কি অনেকদিন ধরে রয়েছেন সেনাবাহিনীতে?’ প্রশ্ন করলেন লেফটেন্যান্ট।

‘হ্যাঁ’… বলে ফাইনহালস… ‘চার বছর।’

‘হা যীশু!’ বলেন লেফটেন্যান্ট… ‘মুশকিল হল যে আমি আবার সেনাবাহিনী সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানি না। হাতে কলমে অন্তত নয়। কাজেই উল্টো কথা বলা আপনার সামনে অন্তত অর্থহীন। দু বছরের একটা ট্রেনিং হয়েছিল নাইটফাইটারের… রাষ্ট্র আমার ট্রেনিংএ যা খরচ করেছে, তাতে একটা পরিবারের মাথা গোঁজবার ঠাঁই ভালভাবে হয়ে যেত। তবে কিনা আমায় সেনাবাহিনীর একটা শূন্যপদ পূর্ণ করতে হল, যাতে জীবনের প্রতিটি শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে অবশেষে ভালহাল্লা*তে আমার ঠাঁই পাকা করে নেওয়া যায়… যাচ্ছেতাই… তাই না?’ তিনি সমানে টোকাইয়া পান করতে থাকেন।

ফাইনহালস কিছুই বলেনা।

‘আপনি কী করবেন, যখন আপনার প্রতিপক্ষ আপনার চেয়ে শক্তিশালী?’ লেফটেন্যান্ট একঘেয়ে সুরে ঘ্যানঘ্যান করে বলে যান… ‘দু’দিন আগে আমরা এই জায়গা থেকে বিশ কিলোমিটার দূরে ছিলাম। তখন বলা হল যে, আমরা কোথাও যাচ্ছিনা। কিন্তু তারপর আমরা হাল ছেড়ে দিলাম। এইসব নিয়মকানুন আমি খুব ভাল জানি। এর অর্থ হল যে জার্মান সৈনিক যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে নড়বে না, জান দেবার দরকার হলে জান দেবে… এরকম ব্যাপার। কিন্তু বাপু, আমি তো আর বোবাকালা নই… কী করা উচিত… বলতে পারেন আপনি?’ তিনি গম্ভীরভাবে জিজ্ঞেস করেন… ‘আমাদের কী করা উচিত?’

‘হয়তো পালিয়ে যাওয়া উচিত’ ফাইনহালস বলে।

‘অসাধারণ’… বলেন লেফটেন্যান্ট… ‘চলুন পালাই… অসাধারণ!’ তিনি নরমভাবে হাসেন… ‘আমাদের যুদ্ধের এইসব প্রুসিয়ান নিয়মকানুনের মধ্যে একটা বিরাট গলদ হল যে পিছু হটবার কোনও ট্রেনিং দেওয়া হয়না। সেই জন্য নিজেদেরই এই সব কায়দাকানুন অভ্যেস করে রাখতে হবে। পিছু হটা নয়, শুধু প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলা আছে। কিন্তু এখন আর এই কমরেড ভাইবেরাদরদের আটকে রাখা যাবেনা। ছাড়ুন!’ তিনি কথা বলতে বলতে কোটের পকেটে দুটো বোতল ঢুকিয়ে নেন।‘চলুন, আমরা আবার এই অতি সুন্দর যুদ্ধের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ি।’

‘হা ঈশ্বর!’ তিনি আবার বলে ওঠেন… ‘বেচারা ওয়াইন নিয়ে এসেছিল এইখানে… আহা বেচারা!’ ফাইনহালস নিঃশব্দে লেফটেন্যান্টকে অনুসরণ করতে থাকে। দেওয়ালের সামনের দিকে কোণ অবধি পৌঁছাবার আগে শুনতে পায় অনেক মানুষের পায়ের শব্দ। কারা যেন দৌড়ে এদিকে আসছে। পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে পায়ের শব্দ। খুব কাছে। লেফটেন্যান্ট লাফ দিয়ে নিজের মেশিনগান বাগিয়ে ধরেন বগলের নিচে। ‘আমার মনে হয় শীগগির বুকের মধ্যে আঠেরো পেনির মাপের সিসের দানা অর্জন করতে চলেছি আমরা’ তিনি ফিসফিস করেন… কিন্তু ফাইনহালস দেখতে পায় যে তিনি কাঁপছেন।

(চলবে)

*ভালহাল্লা- বেহশ্‌তে যাওয়া অথবা বিশেষ হল অফ ফেমে যাওয়ার সঙ্গে সমার্থক।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















নতুন নিয়ম হয়েছে। আমাদের হেডমাস্টার মশায় নিজের ছোটছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দোতলার দুটো ঘরে থাকবেন। ইউ -শেপের দোতলায় প্রায় পনেরটা ঘর। ওনার জন্যে ঘর ছেড়ে দেওয়া হল প্রথম সমকোণের ওপর ঘরটায়।
আরে, ওর পাশ দিয়েই তো আমাদের ছোট ছাদে যাওয়ার জায়গা। তারমানে?
--মানে খুব স্পষ্ট ; কোন শালা নতুন মহারাজদের কাছে গিয়ে দালালি করেছে যে ক্লাস টেনের ছেলেগুলো ওই ছোটছাদটিতে সিগ্রেট খাওয়া আর আড্ডা মারার ঠেক বানিয়েছে। আর গরমের দিনে ওরা খোলা ছাদে বিছানা করে ঘুমোয়!
-- বেশ করি ঘুমোই, কার বাবার কি! একটা ঘরেও পাখার বন্দোবস্ত নেই, তো? গরমে সেদ্ধ হব? তারচেয়ে খোলা হাওয়ায় ছাদে শুলে কার কি ক্ষেতি? বরং ভোরের দিকে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙে।
--- বুঝলি না! এসব ওই ক্লাস এইটের বাঁদরগুলোর কাজ। ওরা সেবারের ঘটনার জন্যে আমাদের উপর খার পুষে রেখেছে।
গুরু মুখ খোলে।
-- ওদের পরে দেখে নেব। কিন্তু সবসময় নেগেটিভ ভাবিস কেন? খালি চুগলি আর ষড়যন্ত্রের ভূত! কারও আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই। আসলে হেডস্যারের অসুখ সেরে গেছে, তাই।
বিপ্লব আমাদের মত লোয়ার ক্লাসে হোস্টেলে আসেনি। ও জানে না। তাই বলে দিই।
-- স্যারের হয়েছিল হাইড্রোসিল। অমন দোর্দন্ডপ্রতাপ লোক। শুধু ছাত্ররা নয়, কিছু স্যারও ভয় পেতেন। উনি কখনও হাসতেন না। 'বেরিয়ে যা শুয়ার'--ছিল ওনার বাঁধা বুলি। একবার ভুল করে একজন নতুন স্যারকে বলে ফেলেছিলেন, তিনি পরের দিন রিজাইন করেন।
--উঃ প্রেসি কর। উনি দোতলায় কেন?
-- আরে বলতে তো দে! তা অমন রাগী লোক হাইড্রোসিলে কাবু হলেন। সেইজন্যে ওঁকে একতলায় বাথরুমের পাশে একটি ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। তখন পায়খানায় জলের কল ছিল না। বাইরের চৌবাচ্চার থেকে ছোট একটা বালতি করে জল নিয়ে ঢুকতে হত।
কিন্তু ওই ফোলা ধুতি নিয়ে পা ফাঁক করে হাঁটতে গিয়ে জল তোলা আর হয়ে উঠত না। তখন যে কোন বাচ্চাকে দেখলেই বলতেন --বৎস, আমায় এক বালতি জল এনে দাও তো!
--- তোরা দিয়েছিস?
'--সবাই । যে যখন সামনে পড়েছে আর কি।
--তুই?
-- একবার। ওই সামনে পড়ে গেছ্লাম। কিন্তু সেদিন ওই রাগী ভদ্রলোক অনুনয়ের গলায় বলেছিলেন--বাবা, একটু জল দিয়ে যাবে বাবা? বড় কষ্ট পাচ্ছি গো!
সেই হেডস্যার এখন দোতলায় মানে উনি সেরে গেছেন। আর কাউকে জল টেনে দিতে হবে না।
হঠাৎ গুরু চমকে ওঠে। --অ্যাই পোদো! শীগগির যা! নীচের বারান্দায় দেয়ালের গায়ে যে ম্যাগাজিনটা ঝুলছে ওটা নামিয়ে নিয়ে আয়।
--কেন গুরু?
--কেন কী রে ভোঁদাই? ওতে হেডস্যার নাম দিয়ে একটা কবিতা আছে না? স্যার দেখলে--!
-- আরে গুরু! ভাল মনে করিয়েছ, ওটা পোদোর জিদেই ছাপা হয়েছিল। ওই খুলে আনুক।
ছাপার কথাটা বাড়াবাড়ি।
আসলে গত কয়েকমাস ধরে আমরা একটা হাতে লেখা দেয়াল পত্রিকা বের করেছি--- নবীনসাথী। আমি সম্পাদক, কিন্তু তিনজনের কমিটি আছে। একেকবার একেক রঙের আর্ট পেপারে ক্লাস নাইনের সুব্রত’র সুন্দর হাতের লেখায় ভরে দেওয়া হয়।
এবারে ক্লাস ফোরে একটি বাচ্ছা ফ্রি-তে ভর্তি হয়েছে। ওর মা এই পাড়ায় কাজের মাসি। বাবা নেই। চকচকে চোখের বাচ্চাটা এবার ম্যাগাজিনের জন্যে একটি কবিতা বা ছড়া লিখে আনল ।
কবিতাটি পড়ে কমিটি খুব হাসল, কিন্তু ছাপতে চাইল না। আমি তখন সম্পাদকের ভেটো পাওয়ার প্রয়োগ করে ছাপালাম। তর্ক দিয়েছিলাম-- ছন্দ ও অন্ত্যমিল নিখুঁত, সেন্স অফ হিউমার আর ছোট্ট বাচ্চাকে উৎসাহ দেওয়া।
তাই বড় বড় অক্ষরে বেরোল এবং ছেলেরা ভিড় করে দাঁড়িয়ে পড়তে লাগলঃ

হেডশ্বর
=========
আমাদের ইস্কুল দুই তিন তলা,
টিফিনেতে খেতে দেয় পাউঁরুটি কলা।
আমাদের হেডশ্বর এমে বিয়ে পাস,
পড়া না পারলে মারে ঠাস ঠাস।।

না, ওই দেয়ালপত্রিকা ঠিক সময়েই নামিয়ে আনা হয়েছিল। তারপর এক জরুরী মিটিং এ সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে সম্পাদকের পদ থেকে নামিয়ে শুধু কমিটি মেম্বার করে দেওয়া হল। নতুন সম্পাদক হবে প্রশান্ত।
কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা গেল। রাত্তিরে ওঁর ঘর ডিঙিয়ে ছাদে যাওয়া সম্ভব নয়। সিগ্রেট খাওয়া তো দূর অস্ত্‌।

উনি বর্ধমানের লোক। প্রতি শনিবার বা অন্ততঃ একবার বাদ দিয়ে পরের বার ট্রেন ধরে বাড়ি যান। সোমবারে দুপুরে ফিরে আসেন। ফলে আমাদের সেই দুদিন ১৫ ই আগস্ট আর ২৬ শে জানুয়ারী। ঘটা করেই পালন করা হয়।
কিন্তু একদিন খবর ভুল ছিল। শরীরটা একটু খারাপ হওয়ায় উনি ঘরে শুয়ে ছিলেন। শুধু ওঁর ছেলে গেছল।
সন্ধ্যের মুখে উনি ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার জুড়লেন।
-- ও মহারাজ ! মহারাজ! ও সুনীল মহারাজ, এদিকে আসুন।
সুনীলদা অবাক। ব্যস্তসমস্ত হয়ে একতলার থেকে দোতলায় এলেন।
--কী হয়েছে মাস্টারমশাই?
--আর বলবেন না। ক্লাস টেনের রমেনকে দেখি এমনি এমনি করে টেবিল বাজিয়ে বাজিয়ে গাইছে-- আমার যৌবন জ্বালা জুড়াইল রে, আমার যৌবন জ্বালা জুড়াইল রে!
এই বয়সেই যদি ওদের যৌবনজ্বালা জুড়িয়ে থাকে তা'লে পরে কী হবে গো!

সেদিন আমরা ১৫ই আগস্টের বদলে ১৪ই আগস্ট দেখলাম।

কিন্তু হেডস্যারের সঙ্গে ১৫ই অগাস্ট জুড়ে গেছে যে!
কোথায়? আমার স্মৃতিতে।
আমি তখনো প্রদ্যুম্ন থেকে পোদো হই নি। কচুরিপানায় ঢাকা পুকুরের ঘাটলায় শামুকপচা জলে থালাবাটি ধোয়া, কাপড় কাচা, আর স্নান করে করে হাত- পা খোস-পাঁচড়ায় ভরে যায় নি। ক্লাস সিক্সে নতুন ভর্তি হওয়া রোগা প্যাংলা ভীতু ছেলেটি তখনও মোটা ভাতের সঙ্গে আধসেদ্ধ ছরছরে ডাল, কারি পাউডারের ঝোল আর জলখাবারে ডালডা-চিনি-মুড়ি খেতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি।
এমন সময় ঘনঘোর বর্ষার মধ্যে এসে গেল স্বাধীনতা দিবস। আশ্রমের আবহাওয়া বদলে গেল। চারদিকে সাজো সাজো রব।
১৪ অগাস্টের রাত্তির থেকে সবাইকে নিজেদের বিল্ডিং ছেড়ে ক্যাম্পে থাকতে হবে। সবাই নিজে নিজের বিছানা , দুদিনের মত জামাকাপড়, ডায়েরি, পেন সাবান, ব্রাশ ইতাদি নিয়ে চলে যাবে। ১৫ তারিখ ক্যাম্প ফায়ারের পর প্রাইজ দেওয়া হলে সবাই সে'রাত্তির ক্যাম্পে ঘুমিয়ে পরের দিন সকালে আবার পুরনো জীবনে ফিরে আসবে।
প্রদ্যুম্ন দেখল এলাহি ব্যাপার। সমস্ত ছেলেগুলোকে আটটি গ্রুপে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। ১৩ অগাস্ট ডাইনিং হলে তাদের নাম ও গ্রুপ ক্যাপ্টেনের নাম ঘোষণা করা হল। জানা গেল যে হাইস্কুল বিল্ডিং খালি করে ধুয়ে মুছে সেটাকে দু'দিনের জন্যে ক্যাম্প ঘোষণা করা হয়েছে। সামনের আঙিনা ঘিরে গেছে অস্থায়ী পোল ও তারের বেড়ায়। একটা গেট। সেই গেটে কাঠের রাইফেল নিয়ে পাহারা দেবে একজোড়া সেন্ট্রি। দু-দুঘন্টা মার্চ করে করে, বাই টার্ন, সব গ্রুপ থেকে। আর কাউকে ক্যাম্পে ঢুকতে হলে গেটপাস দেখাতে হবে--সেগুলো ক্যাপ্টেনরা জারি করবেন।
গেটপাস দেখাতে না পারলে সুনীল মহারাজ , হেডস্যার কাউকেই ঢুকতে দেওয়া হবে না।
আগের বছর একটি গ্রুপের জোড়া সেন্ট্রি, ক্লাস এইটের দুই ছোকরা, সুনীল মহারাজকে আটকে দিয়েছিল। উনি রেগে গিয়ে কানাইদাকে কম্প্লেন করায় জবাব পেলেন-- ওরা ওদের ডিউটি ঠিকমত করেছে।আর সেই গ্রুপটা এই পয়েন্টে বেশি নম্বর পেল।
নম্বর অনেক কিছুতে, সেন্ট্রি দেওয়া , ঘর পরিষ্কার, কীর্তালি(কোন ভাষা?) --মানে আশ্রমের মাঠঘাট, পুকুর, নালা-নর্দমা পরিষ্কার করা, মার্চপাস্ট, ডাইরি লেখা, স্বাধীনতা দিবসের উপর রচনা, কবিতা লেখা, পাঁচ মিনিট এলোকুশন (মানে কী?), সন্ধ্যেয় ক্যাম্প ফায়ারের গান, নাটক ও ইম্প্রোভাইজড কোন স্কিট, মিমিক্রি --সবেতেই।
আর সকালে জলখাবারে মগে করে গরম চা দেওয়া হবে, আর্মি স্টাইলে। বিকেলে বৃষ্টিতে ভিজে প্রীতি-ফুটবল--স্টাফ ভার্সাস স্টুডেন্ট্স।
সন্ধ্যেয় অমূল্যদার ম্যাজিক লন্ঠন, অথবা কথা বলা পুতুলের কেরদানি! তারপরে ক্যাম্প ফায়ার, সব গ্রুপ থেকে কালচারাল প্রেজেন্টেশন, শেষে প্রাইজ ঘোষণা । সমস্ত পয়েন্ট জুড়ে যে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হবে তার ক্যাপ্টেনকে দেয়া হবে মিশনের এম্বলেম আঁকা বড়সড় এক ফ্ল্যাগ। সেই ফ্ল্যাগ হাতে নিয়ে ক্যাপ্টেনের পেছন পেছন গ্রুপটির অন্য সদস্যরা মার্চ করে ক্যাম্প ছেড়ে হোস্টেলে নিজের নিজের রুমে ফিরে যাবে। ক্ল্যাপ! ক্ল্যাপ! ক্ল্যাপ!

এভাবেই যাবে একের পর এক অন্য গ্রুপের ছেলেরা।

তা সেই আমার জীবনের প্রথম ক্যাম্পে হেডস্যার আমাদের স্বাধীনতা দিবসের মর্ম বোঝাতে গিয়ে বললেন-- মনে রেখ, আজ থেকে মাত্র ১৪ বছর আগে এই শহরে ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত। তোমাদের মধ্যে যাদের বয়েস ১৪ বছরের কম তারা নিজেদের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও; পরাধীনতার অপমান তোমাদের ভুগতে হয় নি।

এগার বছরের প্রদ্যুম্ন্ব ভাবল -- ইস্‌, মাত্তর ১৪ বছর আগে এখানে বৃটিশরা ছিল? রাইটার্স বিল্ডিংয়ের মাথায় ইউনিয়ন জ্যাক উড়ত? কী অন্যায় ! কী অন্যায়! ভগবানের একচোখোমি!
ওকে যদি ভগবান আরও দুই দশক আগে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিত তো ও নিশ্চয়ই কিছু একটা করে ফেলত। সূর্য সেন, বিনয়-বাদল-দীনেশ না হোক অন্ততঃ ১৪ বছরের ক্ষুদিরাম। কিন্তু কোথাও একটা হিসেবে ভুল হচ্ছে না?
পাটিগণিতে কাঁচা শ্রীমান প্রদ্যুম্ন কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারল না।


সম্পাদক পদ হইতে শ্রীমান প্রদ্যুম্নের অপসারণের পিছনে একটি গল্প আছে। এই গল্পের উৎস ওই শিশুসুলভ কবিতাটি, পোদোর সম্পাদকসুলভ আভিজাত্যবোধ ও ক্ষমতার অহংকার ।
এটাই কমিটির মিটিংয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। না, একটু ভুল হল। এব্যাপারে কমিটির সমর্থন ও সহানুভূতি আমার সঙ্গেই ছিল। আসল অভিযোগ হল আমি উপরোক্ত কারণের বশে , বিশেষতঃ ক্রোধ ও মাৎসর্য্য রিপুর দাস হইয়া ক্লাস এইটের বর্বর গুন্ডাপ্রকৃতির ছেলেদের সঙ্গে ,মারপিটে জড়াইয়া পড়িয়া উত্তমমধ্যম প্রাপ্ত হইয়া ক্লাস টেনের প্যাট্রিশিয়ানদের প্রেস্টিজে গ্যামাক্সিন ঢালিয়া দিয়াছিলাম।
ফলে ক্লাস টেন নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও সিনিয়র ক্লাসের সমান রক্ষার্থে হা-রে -রে রবে ক্লাস এইটের সঙ্গে ক্লাস-ওয়ারে জড়াইয়া পড়ে।
অগত্যা ম্যানেজমেন্টের হস্তক্ষেপে সিজ-ফায়ার ঘোষণা হয়, কিন্তু ক্লাস এইট ও সেভেন আমাদের দেওয়াল পত্রিকায় কোন লেখা দিবে না ঘোষণা করায় সিনিয়রদের কূটনৈতিক ও রণনীতিগত লোকসান হয়।
শেষে আমাকে না জানাইয়া গুরু ও তাঁহার দক্ষিণ হস্ত ক্লাস এইটের নেতাদের সঙ্গে গোপনে আলোচনা চালায়। উহারা সমস্ত ঘটনা ভুলিয়া শেক হ্যান্ড করিতে রাজি হয় ও ম্যাগাজিন বয়কটের সিদ্ধান্ত বাতিল করে-- কিন্তু শর্ত রাখে যে নষ্টের গোড়া শ্রীমান পোদোকে পত্রপাঠ সম্পাদকের পদ হইতে নামাইতে হইবে।
ব্যাপারটা এই রকম। ক্লাস এইটের কতগুলো বখা ছেলের গ্রুপ ধীরে ধীরে আমাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠছিল। নাইনের ছেলেদের সঙ্গে আমাদের ভাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে উঠেছিল, কয়েকজন ব্যক্তিগত বন্ধু হল। পড়াশুনো, লাইব্রেরির বই পড়া , নাটক ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে। ওরাও আমাদের মতই প্রথম ও ফিফথ পিরিয়ডে ব্যাক বেঞ্চে বসে ঘুমোত। স্যারেদের ও ডে-স্কলার ছেলেদের হাসির ও বিদ্রূপের খোরাক হত । আবার অ্যানুয়াল পরীক্ষায় মেরিট লিস্টে উপরের দিকে থাকত।
কিন্তু ক্লাস এইটের ব্যাচটা একটা ব্যাচ বটে! এদের মধ্যে বেশ কজন আমাদের ও নাইনের ব্যাচের থেকে ফেল করে ভিড় জমিয়েছে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভাল, য্খন তখন কড়কড়ে নোট বের করে। এও সহ্য হচ্ছিল। জানা গেল এদের পালের গোদা দুজনের হরমোন অত্যধিক ক্ষরণের কারণে প্রায়ই বেশ কিছু বাচ্চা এদের শিকার হচ্ছে। এ নিয়ে এরা বেশ গর্বিত। এমনকি লুকোনোর চেষ্টাও করে না।
আমদের পাঁচজনের টিম এদের ব্যুহ ভেদ করতে ব্যর্থ হল। যে তিনজন মুখ খুলতে রাজি হল তারা স্বামীজির সামনে গিয়ে বেঁকে বসল। মারের ভয়!
পরে সেই মাফিয়ারাই ওই বাচ্চাদের নিয়ে মেজমহারাজের কাছে (প্রাক্তন পুলিশ অফিসার ) নালিশ করাল যে ক্লাস টেনের আমরা ক'জন নাকি ওদের ভয় দেখিয়ে মিথ্যে অভিযোগ করাতে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বোধহয় আমাদের অন্য কোন ব্যক্তিগত ইস্যু আছে।
মেজ মহারাজ চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজিতে আমাদের যা বললেন তা দুটো লাইনে বলা যায়ঃ
ডক্টর, কিওর দাইসেল্প্ফ!
অয়েল ইন ইয়োর ওন মেশিন!
ওই ঘটনার পর থেকে ওরা -আমরা হল; আমরা একে অপরের ক্লাস-এনিমি হয়ে গেলাম।

এই অবস্থায় একদিন ওদের ক্লাসের দুজন বাচ্চামত ছেলে হাতে করে দুটো কবিতা নিয়ে আমাদের ঘরে এল। দেয়াল পত্রিকায় ছাপতে হবে। ওদের দেখেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে গেল।
সেই দুটো বাচ্চা! যারা বয়ান বদলে আমাদের মুর্গী করেছিল!
তবু বিক্রমাদিত্যের সিংহাসনে বসলে জাজমেন্ট দেওয়ার আগে পূর্বাগ্রহ মুক্ত থাকাই আদর্শ আচরণ বিধি।
আমি ও বিপ্লব লেখাগুলো পড়তে লাগলাম।
তারপর গম্ভীর মুখে বললাম-- এটা কী লিখেছ?
--কবিতা।
--কোথায় কবিতা?
ও অবাক হয়ে মিনমিন করে বলল--কেন, পোদোদা? আপনার হাতেই তো ধরা রয়েছে। দেখুন না--বর্ষাকাল।
পোদোদা! হাড়পিত্তি জ্বলে গেল।
গম্ভীর মুখে বললাম, - হুঁ, বর্ষাকালই বটে!
বর্ষা আসিল, ডাকিয়া উঠিল আকাশের যত মেঘ?
এটা কবিতা হয় নি, শুধু অন্ত্যমিল মিলিয়ে একটা গোদা বাহ্যিক বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এটা ছাপা যাবে না। পরেরবার চেষ্টা কর।
অন্য বাচ্চাটা করুণ মুখে বিপ্লবকে বলল --আমারটা তো ঠিক আছে?
বিপ্লব খেঁকিয়ে উঠল।


-- এটা? এটা তো ডাহা চুরি! গতবারের স্কুলের বার্ষিক ম্যাগাজিন থেকে টুকলি!
বাচ্চাটার চোখে হতাশা ও আতংক।
--না, টুকলি নয়।
বিপ্লব উঠে গিয়ে ওর তাক হাতড়ে একটা বিস্কিট রঙের ম্যাগাজিন বের করে এনে দ্রুত হাতে পাতা ওল্টাতে লাগল।
--পেয়েছি; এই যে! শোন্‌।
" ৩ নম্বর বাসের তলায় ব্যাঙ রাজার মৃত্যু"
----------------------------------------------
হৈ চৈ পড়ে গেছে সারা বাঁকুড়া নগরে,
ব্যাঙেদের মহারাজা মারা গেছে আহা রে!
------ ।
একেবারে কমা-সেমিকোলন পর্য্যন্ত টোকা। না, না; এসব চালাকি চলবে না।
-- বিপ্লবদা , একটু দেখুন। দুটো এক নয়। ওটা হল ৩ নম্বর বাসের তলায়, আর আমি লিখেচি--৪ নম্বর বাসের তলায়।
বিপ্লব খ্যা -খ্যা করে হাসতে লাগল।
-- ওরে একটু চুপ কর। ৩ নম্বরকে ৪ নম্বর করে দিলেই কবিতা আলাদা হয়ে গেল?
-- দেখুন, দুটো বাসই তো রেলস্টেশন থেকে জেলা কোর্ট যায়, তবে?
আমার আর সহ্য হল না। উঠে ঠেলতে ঠেলতে বাচ্চাদুটোকে ঘর থেকে বের করে দিলাম। বললাম--কবিতা লেখা? কবি? খালি ৩ কে ৪ করে লিখলি তো হয়ে গেল? ইয়ার্কিরও একটা সীমা আছে। তোদের গোটা ক্লাসটাই এইরকম গবেট নাকি?

দুটো দিন কেটে গেল।
বিকেলে ফুটবল পেটাতে না গিয়ে ম্যাগাজিনের লেখাগুলোর ফাইল খুলে বসেছিলাম, আমি আর বিপ্লব।
নরেশ আর সুদীপ এল। ক্লাস এইটের সেই মাফিয়া টাইপের ছেলে গুলো। সুদীপের একটু রোমশ চেহারা। এই বয়সেই গোঁফের রেখা দেখা দিচ্ছে।
ওকে দেখা মাত্র আমার মাথায় খুন চড়ে গেল। শুনেছিলাম নতুন ছেলেদের পেছনে লাগার সময় ওর দুটো চ্যালা অনিচ্ছুক বাচ্চাটার হাত ধরে রাখে। আর গত পুজোর সময় ওর বাড়ির লোক নিয়ে যেতে এসেছিল। ও নাকি তখন ঘরের মধ্যে একটি ছেলের সঙ্গে রাসলীলায় মত্ত ছিল। বন্ধ ঘরের মধ্য থেকে বাড়ির লোককে বলে -- একটু অপেক্ষা কর। প্যাকিং করছি, জামাকাপড় বদলাচ্ছি--সময় লাগবে।
ওরা ঢুকল, একটু পেছনে আগের সেই বাচ্চা দুটো।
-- এই যে, এডিটর! এদের কবিতাগুলো রিজেক্ট করলে কেন?
-- একটা কবিতা হয় নি, অন্যটা টুকে লেখা--তাই।
--কোনটা কবিতা আর কোনটা নয়, কে ঠিক করবে? তুমি?
--আলবাৎ; এটাই আমার কাজ। আমাদের পত্রিকার একটা স্ট্যান্ডার্ড আছে।
---- বেশ, কোনটা তোমার কাছে কবিতা? ওই ফালতু " টিফিনেতে খেতে দেয় পাঁউরুটি-কলা"?
নরেশ দোহার দেয়,-- ওই কবিতাটার টাইটেল আবার "হেডশ্বর"! গুরুজনদের স্যারেদের নিয়ে ইয়ার্কি করলেও ম্যাগাজিনের স্ট্যান্ডার্ড থাকে, তাই না পোদো?
বিপ্লব তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলে-- অ্যাই, নরেশ! মুখ সামলে। তোর দু'বছরের সিনিয়র, প্রদ্যুম্নদা বলবি।

ওরা হেসে উঠল।
তারপর বলল,-- দু'বছর আগে আমরা ক্লাসমেট ছিলাম, তখন থেকেই ও আমাদের পোদো। কী রে , ঠিক বলেছি না?
আমি কোন কথা বলি না।
সুদীপ আবার বলে-- তাহলে আমাদের ক্লাসের দুটো কবিতা রিজেক্ট করছ?
আমি ওদের ঘাড়ের ওপর দিয়ে বাচ্চাদুটোকে দেখি--উকিল ধরে এনেছিস? লাভ হবে না। ঘরে ফিরে যা।
ওরা তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়।
সুদীপদের বলি--শোন, ক্লাস -টাস নয়। একটু ভাল কবিতা নিয়ে এস, নিয়ে নেব।
ওরা চোখে চোখে কথা বলে।
তারপর সুদীপ বলে-- আধুনিক কবিতা চলবে? গদ্য কবিতা?
--হ্যাঁ হ্যাঁ। নিয়ে এস।
--অ্যাই নরেশ, তোর সেই আধুনিক কবিতাটা দেখা তো আমাদের সম্পাদককে, স্ট্যান্ডার্ডটা দেখে নিক।
নরেশ ভালমানুষের মত মুখ করে একটা চোথা কাগজ বের করে আমার হাতে দেয়।
আমি ভাঁজ খুলে হতভম্ব , এটা কী?
--কেন , আধুনিক কবিতা।
আমার মুখের ভাব দেখে বিপ্লব কাগজটা ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে চোখ বোলায়, তারপর হা-হা করে হেসে ওঠে আমাকে ফেরৎ দেয়।
কাগজটায় কয়েকটি রেলস্টেশনের নাম একটি বিশেষ অর্ডারে লেখা রয়েছে।




" টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ,
টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ,

টালিগঞ্জ-বালিগঞ্জ,
ঢাকুরিয়া--যাদবপুর।
গড়িয়া-সোনারপুর,
বজবজ-বজবজ।"
আমি কিছু বলার আগে বিপ্লব হাসতে হাসতেই বলে-- সরি ! এইসব অশ্লীল লেখা ছাপতে পারব না।
অশ্লীল লেখা! ওরা আকাশ থেকে পড়ে।
-- ওতে কোন শব্দটা অশ্লীল? নাকি দু'ক্লাস উঁচুতে পড়েন বলে যা খুশি কমেন্ট করবেন?
আমি রাগের চোটে কাগজটা নিয়ে কুচিকুচি করে ছিঁড়তে থাকি।
ওরা হাঁ-হাঁ করে ওঠে।
--এটা কী হল সম্পাদক মশাই? আপনার লেখা রিজেক্ট করার রাইট আছে; কিন্তু ছিঁড়ে ফেলা?
--- পছন্দ না হয় ফেরৎ দিয়ে দে। ছিঁড়লি কী করে?
--বেশ করব, এই সব অশ্লীল ইয়ার্কি আমার সঙ্গে নয়, অন্য কোথাও মারাবি!
ওরা কাগজটা কেড়ে নেবার চেষ্টায় আমার সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়ে। প্রথম চড় বোধহয় আমিই মেরেছিলাম। কিন্তু ওরা তৈরি হয়েই এসেছিল। আমি বা বিপ্লব কেউই মারামারিতে অভ্যস্ত নই, একটু লালুটাইপ। ফলে দুজনেই বেশ মার খেলাম। আমার বরাদ্দে একটু বেশি জুটল।
তারপর ক্লাস-স্ট্রাগল, সিজফায়ার ইত্যাদি। ওরা চ্যালেঞ্জ করে মহারাজকে বলল-- আমি ব্যক্তিগত কারণে ওদের গ্রুপের কারও কবিতা ছাপতে চাই না। তাই ওদের একটি ভাল আধুনিক কবিতাও ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।
আমরা বললাল--যা তা অশ্লীল লেখা!
--ওরা বলল বাজে কথা, পোদো কাগজটা দেখাক।
কী করে দেখাব, ছিঁড়ে ফেলেছি যে!
হেডস্যারকে দিয়ে তদন্ত করানো হল। উনি বললেন--প্রদ্যুম্ন, কাগজ নেই তো কি হয়েছে, তুমি মুখে বল বা লিখে দাও যে ওরা কী অশ্লীল শব্দ লিখেছে--মেনে নেব।
ওরা মুচকি মুচকি হাসতে লাগল।
আমার কাছ থেকে শুনে হেডস্যার সন্দিগ্ধ মুখে মাথা নাড়তে লাগলেন।
এ তো ক'টা রেলস্টেশনের নাম-- অশ্লীল কোথায়?
আমার মুখে বাক্যি নেই।
আমার অভিযোগ খারিজ হয়ে গেল, বন্ধুরা বলল আমার বোকামি আর গোঁয়ার্তুমি আমাদের গোটা ব্যাচের হাতে হ্যারিকেন ধরিয়ে দিল।

সেই থেকে আমরা ও ক্লাস এইটের ব্যাচ আশ্রমের বাকি জীবনে তীব্র জীবনমরণের শ্রেণীসংগ্রামে বৃত হইলাম।

0 comments: