Next
Previous
Showing posts with label অন্তরমহল. Show all posts
0

অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য

Posted in



তুমি আছ আমি আছি




এসে গেল শীত। একটু উষ্ণতার জন্য আমরা সবাই। ধূমায়িত কফি, শীত বস্ত্র, মিঠে রোদ... কিন্তু সম্পর্কের উষ্ণতা? সে কি এই বছর শীতে উত্তাপ হারিয়েছে? দীর্ঘ গৃহবন্দীত্বের কারণে অনেক সম্পর্কের ছাল চামড়া ছাড়ানো উন্মুক্ত চেহারা আমাদের নিজেদের চোখেই বড়ো কুৎসিত ঠেকছে। ভুক্তভোগীমাত্রই জানেন সে বিষ যাতনা কেমন করে অন্তরের সব মাধুর্য্য হরণ করে আমাদের মনকে ক্লেদাক্ত করে তুলেছে। মানব সমাজে 'সম্পর্ক' যেন সেফটি লকার। নিরাপত্তার তাগিদে আমরা বিভিন্ন সম্পর্ক যত্ন করে সাজিয়ে তুলি, বজায় রাখি। বিশেষত: ভারতীয় সমাজে বৃহত্তর পরিবারের সীমা রেখা চাচেরি ভাই কি মোউসি কি ননদ কি.....তথা বাঙালির আমার পিসতুতো ননদের মাসতুতো ভাইয়ের খুড়তুতো দিদির... এই যে সম্পর্কের ফাঁদ সে সব বাদ দিলে নিকট সম্পর্কের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক অন্যতম। এই অতিমারীর কালে দেশে বিদেশে অনেকক্ষেত্রেই সেই দাম্পত্য সম্পর্কগুলো ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছে। দাম্পত্য কলহ নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই দু:সময়ে মানুষের মন ও মনন চূড়ান্ত সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কেমন দিশেহারা হয়ে পড়েছে। একলা পথে যেন তার বাতি নিভেছে। সামনে মৃত্যুর হাহাকার আর অনিশ্চয়তার কালো পর্দায় তার সহজ চলার পথে যেন নেমে এসেছে অন্ধকার। যার প্রভাব পড়েছে তার দৈনন্দিন সম্পর্কে। কাছের মানুষকে দিনরাত খুব কাছ থেকে দেখতে দেখতে কেমন যেন চকচকে মোড়কখানা খুলে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে একটা আটপৌরে সাধারণ দেওয়া নেওয়ার সম্পর্ক। ব্যক্তি মানুষের নিজস্ব যে পরিসর তার একান্ত ছিল সেই পরিসর হারিয়ে হঠাৎ করে পরস্পরের একান্ত ব্যক্তিগত জীবনে ঢুকে পড়ায় বিরাট এক অস্থিরতার মুখোমুখি দু' জনেই। দাম্পত্যে প্রথমত: যেটা বিশেষ করে ঘটে তা হলো চাহিদা। পরস্পরের কাছে বিভিন্ন চাহিদা তৈরি হতে থাকে। সেই চাহিদা পূরণ হতে না পারলে ( সব চাহিদা পূরণ বাস্তবে অসম্ভব ) মনে তৈরি হয় ক্ষোভ। ক্ষোভ জমা হতে থাকে পরতে পরতে। মনের অন্দরে জমে ওঠে মরা প্রবালের পাহাড়। একদিন সেই পাহাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে গরল। তার বিষ জ্বালায় ছটফট করতে থাকে বহু দিনের ভালবাসার, ভরসার, মায়ার সম্পর্ক। "ওকে আমি খুব ভালবাসি, ওকে ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেও পারি না"... তবু কেন যে মেজাজ রাখা যায় না সে কথা বোঝা বড়ো কঠিন ব্যাপার। এই ঘরবন্দী দশায় কত পুরোনো হিসাব নিকেশ কষা, কবে কোন না পাওয়ার ব্যথা নতুন করে বেজে ওঠা। কে দায়ী তার জন্য? মানুষের মন বড়ো বিচিত্র। তার একজন 'কেষ্টা' লাগে। নিজের আমিত্বকে আগলে রাখতে, দোষ ত্রুটি ঢাকতে। তাই সব থেকে কাছের মানুষটা কেই দায়ী করে ফেলি আমরা। নিজেদের দায়টুকু নিতে বড়ো লজ্জা আমাদের। ফলত: দাম্পত্যে নেমে আসে অসহিষ্ণুতা। কিন্তু যদি এ কথা মনে বুঝে নেওয়া যায়, যে কোনও সম্পর্কেই গোড়ার কথা হলো ভালমন্দের দায় দু পক্ষেই সমান বর্তায় তাই কানা কড়ির হিসাব কষার সময় যদি নিজের দায়টুকু মনে আনতে পারি তবে অন্যজনের প্রতি মন অনেক নরম হয়ে ওঠে। অনেক সময় বিশেষ পরিস্থিতি প্রতিকূলতার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যার ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখা সব সময়ে সম্ভব হয় না। সে কথাও বুঝে নিতে পারলে পরস্পরকে মেনে নিতে অনেকটাই সুবিধা হয়। আসলে সম্পর্কের ভিত্তি হলো কমিউনিকেশন। আমরা যা ভাবি, সেই মতো মনে আবেগের বুদবুদ ওঠে। সে আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখার দায় আমাদের নিজেদের নয় কি? অনিয়ন্ত্রিত রাগের বশে যদি কাছের মানুষটাকে আঘাত করতে থাকি তবে সম্পর্কে ফাটল ধরবেই। প্রথমে ফাটল তারপরে ভাঙন। অনেক সময় দেখা যায় নৈকট্য দাম্পত্যে কোনও ফর্মালিটি রাখার প্রয়োজনবোধ করে না। আমার মতে সে বড়ো লঘু ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। বিয়ে একটা প্রতিষ্ঠান বই তো নয়। তাই প্রাতিষ্ঠানিক সব সহবত বর্জন করার মধ্যেও একটা বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয় বই কি। ইংরাজিতে যাকে বলে taken for granted. তার চেয়ে বরং বুঝে নেওয়া ভাল উভয়েই সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যক্তিসত্ত্বা, এবং উভয়েরই কিছু দোষত্রুটি থাকবেই। এ পৃথিবীর কিছুই নিঁখুত নয়। আমরাও নই। সেই সব দোষ গুণ নিয়ে একটা মানুষকে গ্রহন করা ও ভালবাসার মধ্যে যে উদারতা আছে তার মহত্ত্ব মনকে স্পর্শ করলে হয়তো পরস্পরকে ক্ষমা করার মতো মানসিক জোর পাওয়া সম্ভব। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা কয়েকটি লাইন মনে পড়ে গেল। 

---

"তোমার মাপে হয়নি সবাই 
তুমিও হওনি সবার মাপে,
তুমি মর কারো ঠেলায় 
কেউ বা মরে তোমার চাপে 
তবু ভেবে দেখতে গেলে 
এমনি কিসের টানা টানি? 
তেমন করে হাত বাড়ালে 
সুখ পাওয়া যায় অনেকখানি।"


আসলে আমরা মুহূর্তে বাঁচি। তাই বাঁচার জন্য মুহূর্তগুলো শিল্পীর মতো গড়ে তুলতে পারলে বাঁচাটা হয় সহজ, আনন্দময়। ছোট ছোট না পাওয়াগুলো থাক না দেরাজে তোলা। অসুস্থ পৃথিবী একদিন সেরে উঠবে। আবার যে যার জগতে মগ্ন হবো আমরা। ততদিন শুধু পরস্পরকে এ কথাই বলার থাক, 

"উড়াব ঊর্ধ্বে প্রেমের নিশান দুর্গমপথমাঝে
দুর্দম বেগে দুঃসহতম কাজে।
রুক্ষ দিনের দুঃখ পাই তো পাব--
চাই না শান্তি, সান্ত্বনা নাহি চাব।
পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি, ছিন্ন পালের কাছি,
মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি।

দুজনের চোখে দেখেছি জগৎ, দোঁহারে দেখেছি দোঁহে--
মরুপথতাপ দুজনে নিয়েছি সহে।
ছুটিনি মোহন মরীচিকা-পিছে -পিছে,
ভুলাইনি মন সত্যেরে করি মিছে--
এই গৌরবে চলিব এ ভবে যত দিন দোঁহে বাঁচি।
এ বাণী, প্রেয়সী, হোক মহীয়সী "তুমি আছ আমি আছি"॥
1

অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য

Posted in





পৃথিবী বদলে গেছে ...


দ্রুত বদলাচ্ছে বিশ্ব। যা দেখি নতুন লাগে। প্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের জোয়ার, পরিবেশের ক্ষয়, সব আমাদের চারপাশের জগতটাকে ক্রমাগত বদলে দিচ্ছে। আর সেই বদলের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমাদের হিমসিম অবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি যেমন সারা বিশ্ব জুড়ে বাণিজ্য ছড়িয়েছে তেমন ভাইরাসও ছড়িয়েছে। ভোগবাদের ভাইরাস, করোনা ভাইরাস... মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে বা বলা চলে ধন্দ জাগে, অন্তর্দন্দ্বও বলা যায়। করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্ব উদবিগ্ন, চিন্তিত। কারণ সঙ্গত। এর প্রকোপ খুব দ্রুত মানব জাতি কে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। তাই আমরা তড়িঘড়ি উঠে পড়ে লেগেছি কোভিড- 19 মোকাবিলায়। সে অবশ্য প্রয়োজনীয় বটে। ঘরে আগুন লাগলে আমাদের পালিয়ে বাঁচতে হয় বটে। তখন আগুন কেন লাগল এ বিচার করার সময় পাওয়া যায় না। কিন্তু ভোগবাদের ভাইরাস ক্ষয় রোগের মতো বিলম্বিত অথচ ঘুণের মতো সুচারুভাবে মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে সে হুঁশ আমাদের বড়ো একটা নেই। আগুন জ্বেলেছি যেদিন সেদিনই গাছের মৃত্যু লিখেছি। চাষ করতে শিখেছি, জমির ওপর মৌরসী পাট্টা গেঁড়ে বসেছি সেদিন থেকে। তখন থেকেই হোমো স্যাপিয়েন্সের বন জঙ্গলে ঘোরা যাযাবর জীবন শেষ বলা চলে। সে দশ হাজার বছর আগের কথা। আজ বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি সভ্যতার উন্নয়নে নিজেদের বসিয়েছি সেরা প্রাণীর আসনে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর অহংকারে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার অন্ধ বাসনায় মত্ত হয়ে বারবার বিপদ ডেকে এনেছি। বিবর্তিত মানুষ ক্রমাগত যন্ত্র মানুষে পরিণত হচ্ছে। Cyborg engineering এর দৌলতে আজ মানুষ যন্ত্র আর মানুষের মিশেলে তৈরি সাইবার্গে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেচে। আজকাল কৃত্রিম অঙ্গের ব্যবহার

বহুল প্রচলিত। অজৈব অংশগুলো আমাদের শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হচ্ছে। বদলে দিচ্ছে আমাদের কর্মক্ষমতা, ইচ্ছা, ব্যক্তিত্ব এবং স্বকীয় পরিচয়। সত্যিই তো আমার চশমাটাকে কি আমি আমার শরীরে অঙ্গ ভাবি না? হৃদ যন্ত্রের ছন্দ বজায় রাখা পেসমেকার কি আলাদা আমার দেহ থেকে? 

বাইরের এই সব বদল দৃশ্যমান। ভিতরের বদল উপলব্ধির বিষয়। আর সেই অন্তরের অন্দরমহল নিয়েই কারবার আমার। তাই অন্তরমহলের বদল নিয়েই দু চার কথা সারি। 

বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের চিন্তা ভাবনা বিশ্বাসের ধরণও ভীষণভাবে বদলাচ্ছে। স্বভাবতই ব্যক্তিত্বে তার প্রভাব পড়ছেই। আমরা বিভিন্ন মানুষের সাথে যোগাযোগ করছি ভারচুয়াল মাধ্যমে। মুঠো ফোনে শব্দ ফুটে উঠছে স্ক্রিনে। শব্দগুলো চেতনা জুড়ে, যন্ত্র হলো মাধ্যম। মানুষটার দৈহিক উপস্থিতি নেই। মুখ চোখের অভিব্যক্তি নেই। এমন নয়তো যন্ত্র আর মাধ্যম থাকছে না। আসলে চেতনায় সেই ব্যক্তির জায়গা দখল করছে ক্রমে। এখন অভিমানের ইমোজি আসে, ভালবাসারও তাই। রাগ, দু:খ হাসি কান্নায় নেড়া মাথা স্মাইলিই সব। আসলে আবেগের প্রকাশ বদলাচ্ছে ক্রমেই। ঠিক তেমনভাবেই, একটা অতিমারী আমাদের বিশ্বাসের জায়গাটা নাড়িয়ে দিল আমূল। আজ মানুষ দেখলে মনে সংক্রমণের ভয়টাই প্রথমে গ্রাস করে। খুব চেনা মানুষকে দেখলেও ছিটকে সরে যাচ্ছি আমরা। মনে অবিশ্বাস দানা বাঁধছে, কোভিড পজিটিভ নয় তো? 

প্রতিবেশীর বিপদে পাশে দাঁড়াবার সাহস হারাচ্ছি। মৃতকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পিছপা হচ্ছি। না, এসব মোটেই অপরাধ নয়। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষার দায় আমাদের নিতেই হচ্ছে। আমি শুধু ভাবছি নিউ নরমাল মানতে মানতে হয়তো বদলে যাবে আমাদের মনন, ব্যক্তিত্ব। সেটাই তখন "নিউ"- এর আতিশয্য ছেড়ে নরমাল হয়ে উঠবে। 

ছোট স্পেসে থাকতে থাকতে বাইরের বৃহৎ অস্বস্তির কারণ হবে। তার থেকে যন্ত্রের মাধ্যমে ভারচুয়ালিটি হবে অনেক গুণ স্বস্তির। ওয়েবিনার, ভারচুয়াল আড্ডা, জমায়েত, মিটিং, স্কুল, কলেজ.... গাছেরা বড়ো হবে, হাওয়া বয়ে যাবে, পৃথিবী সবুজ হবে, নদী গতি ফিরে পাবে। শুধু তাকে "সুন্দর" বলে অভিবাদন জানাবার মানবীয় চেতনা কি লুপ্ত হবে চিরতরে। নিরন্তর চেষ্টায় বিজ্ঞান আজ শুধু আমাদের বাইরের পৃথিবী নয় দেহ মনে চেতনায় এনে চলেছে অভুতপূর্ব পরিবর্তন। প্রযুক্তির দৌরাত্ম্য আজ আমাদের মন বুদ্ধির স্তরে আমুল পরিবর্তন এনে অসীম শক্তির অধিকারী হতে চাইছে। জ্ঞানী গুণীজন তেমনটাই ভাবছেন। যদি বিজ্ঞান এমন এক চির তরুণ সাইবার্গ তৈরি করে ফেলে যার থাকবে না কোন আবেগ অনুভূতি। যাকে সন্তান উৎপাদন করতে হয় না। যার পৃথক যৌন পরিচয় নেই, চাইলে সে অন্য সাইবর্গের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং যার মনোনিবেশ করার এবং তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা মানুষের চেয়ে হাজার গুণ বেশি। রাগ ও দুঃখ বোধের বালাই যার নেই। অথচ আছে আমাদের কল্পনার অতীত চেতনা। এই মহাসাইবার্গরা কি মানুষ থাকবেন আদৌ? নাকি তারা হবেন ঈশ্বরপ্রতিম মানুষের বোধের অগম্য কোন অন্য চেতনার অধিকারী? হোমো সাপিয়েন্স- এর দাপটে এ পর্যন্ত লুপ্ত হয়েছে অনেক প্রজাতি। এমন কি মানব প্রজাতির অন্যান্য গোষ্ঠীও রক্ষা পায় নি সে দাপটের হাত থেকে। তবে কি এবার পাশার ছক বদলাবে? অতিমানব এসে জায়গা করে নেবে পৃথিবীতে। এ সব প্রশ্নের জবাব মহাকালই পারবে দিতে। এ কথা সত্য যে আমরা প্রকৃতির বিবর্তনের পাঠ চুকিয়ে প্রযুক্তির বিবর্তনের শরিক হয়েছি। পা বাড়িয়েছি নতুন এক সিংগুলারিটির দিকে। নিজেরাই গড়ে তুলছি এক নতুন প্রজাতি যার চিন্তাশক্তি বা মনন হবে আমাদের বোধের অতীত।
0

অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য

Posted in




দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে...

চেনা মানুষ অচেনা হলো, চেনা পরিমণ্ডল অচেনা লাগছে, তবে সে কোন অচিন এমন করে বদলে দিচ্ছে সম্পর্কের সমীকরণ? যার সাথে আজ তিরিশ বছর চেনা, যে আমার প্রাণের মিতা মজন্তালি আজ দেখি তার স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলে কুৎসিত আঘাত হানতে তার বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ নেই। শুধু কি তাই, ঘরের অন্দরে নিজের সব থেকে কাছের মানুষগুলিকেও কত শত এমন আঘাতে বিদ্ধ করছে পরস্পর, হয়তো বিদ্ধ করে এসেছে চিরটা কাল। সমাজের চারপাশে মধ্যযুগীয় বর্বরতার ছায়াচিহ্ন যেন বিজ্ঞানের উন্নতিকে বিদ্রূপ করে নখ দাঁত বের করে হাসছে। কোথা থেকে বার বার আঘাত হানছে

এত অসহিষ্ণুতা? দেখি না উঁকি মেরে অন্তর মহলে।

ছোট পরিসরে ব্যক্তিমানুষের অন্তরের গরলই তো এক সময়ে বৃহত্তর সমাজে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটায়। বিশেষত: আজ এই মারীর আবহ যেন সভ্যতার মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কিসের তাগিদে মানুষ হাসপাতালে কর্মরত স্বাস্থ্য কর্মী বা ডাক্তারকে বাড়ি ছাড়া তথা পাড়া ছাড়া করছে?

বাঁচার তাগিদ যদি ধরে নিই তবে ধিক সে স্বার্থপর বাঁচা যে বাঁচার তাগিদে অসুস্থ প্রতিবেশি পরিবারের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিয়ে তাকে অসময়ে কোণঠাসা করে ফেলি আমরা। তাতেই কি বেঁচে যাওয়া যাবে? এই সব প্রশ্নবাণে জর্জরিত করি নিজের অন্তরাত্মাকে। সামাজিক মাধ্যমে দেখি তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের আচরণ কিভাবে অসহিষ্ণুতার সীমা লঙ্ঘন করছে কত সামান্য কারণে। কি উদগ্র হয়ে ফুটে বেরোচ্ছে সমাজের ধৈর্যচ্যূত চেহারাখানা। অথচ বিচার করে দেখলে দেখা যাবে সামান্য হলেও সমাজের সর্বস্তরেই সিংহভাগ মানুষের জীবনের মান আজ থেকে তিরিশ বছর আগের তুলনায় উন্নত হয়েছে। হয়তো সামান্য, তবু হয়েছে যে সে তথ্য এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই।

আমাদের এই আচরণের কারণ কি অবদমিত ধর্ষকাম। অন্যের পীড়নে আনন্দ পাওয়া থেকেই এত অসহিষ্ণুতার উৎপত্তি। ধর্ম নিয়ে অসহিষ্ণুতা, পারিবারিক সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা, প্রেম ভালবাসায় অসহিষ্ণুতা এসব দেখতে দেখতে মনে হয় একটা যদি এমন অতিমারী আসত পৃথিবীতে যেখানে মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা নামের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ত তা হলে কি সুন্দরই না হতো এই পৃথিবী।

সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে রবি ললিখেছেন,"মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবলপ্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে যে-

অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।
ততঃ সপত্নান্‌ জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি॥

ঐ মহামানব আসে।
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক—
এল মহাজন্মের লগ্ন।
আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত
ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।
উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব
নবজীবনের আশ্বাসে।
‘জয় জয় জয় রে মানব - অভ্যুদয়'
মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে।

এই মহামন্ত্র বিশ্বাসেই মানবতার জয়, অসহিষ্ণুতার অপমৃত্যু সাধিত হোক। আমরা সব সংকটে যেন নিজের মনুষত্ব না ভুলে যাই।
0

অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য

Posted in




চেনা মানুষ অচেনা হলো, চেনা পরিমণ্ডল অচেনা লাগছে, তবে সে কোন অচিন এমন করে বদলে দিচ্ছে সম্পর্কের সমীকরণ? যার সাথে আজ তিরিশ 

বছর চেনা, যে আমার প্রাণের মিতা মজন্তালি আজ দেখি তার স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলে কুৎসিত আঘাত হানতে তার বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ নেই। শুধু কি তাই, ঘরের অন্দরে নিজের সব থেকে কাছের মানুষগুলিকেও কত শত এমন আঘাতে বিদ্ধ করছে পরস্পর, হয়তো বিদ্ধ করে এসেছে চিরটা কাল। সমাজের চারপাশে মধ্যযুগীয় বর্বরতার ছায়াচিহ্ন যেন বিজ্ঞানের উন্নতিকে বিদ্রূপ করে নখ দাঁত বের করে হাসছে। কোথা থেকে বার বার আঘাত হানছে

এত অসহিষ্ণুতা? দেখি না উঁকি মেরে অন্তর মহলে। 

ছোট পরিসরে ব্যক্তিমানুষের অন্তরের গরলই তো এক সময়ে বৃহত্তর সমাজে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটায়। বিশেষত: আজ এই মারীর আবহ যেন সভ্যতার মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। কিসের তাগিদে মানুষ হাসপাতালে কর্মরত স্বাস্থ্য কর্মী বা ডাক্তারকে বাড়ি ছাড়া তথা পাড়া ছাড়া করছে?

বাঁচার তাগিদ যদি ধরে নিই তবে ধিক সে স্বার্থপর বাঁচা যে বাঁচার তাগিদে অসুস্থ প্রতিবেশি পরিবারের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দিয়ে তাকে অসময়ে কোণঠাসা করে ফেলি আমরা। তাতেই কি বেঁচে যাওয়া যাবে? এই সব প্রশ্নবাণে জর্জরিত করি নিজের অন্তরাত্মাকে। সামাজিক মাধ্যমে দেখি তথাকথিত শিক্ষিত মানুষের আচরণ কিভাবে অসহিষ্ণুতার সীমা লঙ্ঘন করছে কত সামান্য কারণে। কি উদগ্র হয়ে ফুটে বেরোচ্ছে সমাজের ধৈর্যচ্যূত চেহারাখানা। অথচ বিচার করে দেখলে দেখা যাবে সামান্য হলেও সমাজের সর্বস্তরেই সিংহভাগ মানুষের জীবনের মান আজ থেকে তিরিশ বছর আগের তুলনায় উন্নত হয়েছে। হয়তো সামান্য, তবু হয়েছে যে সে তথ্য এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। 

আমাদের এই আচরণের কারণ কি অবদমিত ধর্ষকাম। অন্যের পীড়নে আনন্দ পাওয়া থেকেই এত অসহিষ্ণুতার উৎপত্তি। ধর্ম নিয়ে অসহিষ্ণুতা, পারিবারিক সম্পর্কে অসহিষ্ণুতা, প্রেম ভালবাসায় অসহিষ্ণুতা এসব দেখতে দেখতে মনে হয় একটা যদি এমন অতিমারী আসত পৃথিবীতে যেখানে মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতা নামের ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ত তা হলে কি সুন্দরই না হতো এই পৃথিবী। 

সভ্যতার সংকট প্রবন্ধে রবি ললিখেছেন,"মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর-একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের অন্তহীন প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান মনে করি। এই কথা আজ বলে যাব, প্রবলপ্রতাপশালীরও ক্ষমতা মদমত্ততা আত্মম্ভরিতা যে নিরাপদ নয় তারই প্রমাণ হবার দিন আজ সম্মুখে উপস্থিত হয়েছে; নিশ্চিত এ সত্য প্রমাণিত হবে যে-

অধর্মেণৈধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি।
ততঃ সপত্নান্‌ জয়তি সমূলস্তু বিনশ্যতি॥

ঐ মহামানব আসে।
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে।
সুরলোকে বেজে ওঠে শঙ্খ,
নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক—
এল মহাজন্মের লগ্ন।
আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত
ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।
উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব
নবজীবনের আশ্বাসে।
‘জয় জয় জয় রে মানব - অভ্যুদয়'
মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে।"

এই মহামন্ত্র বিশ্বাসেই মানবতার জয়, অসহিষ্ণুতার অপমৃত্যু সাধিত হোক। আমরা সব সংকটে যেন নিজের মনুষত্ব না ভুলে যাই।
0

অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য

Posted in


আয়না মহলটায়


অন্তরমহলের আর এক বাসিন্দা নিরাপত্তাহীনতা, ইন্সিকিউরিটি। নিজেকে যথেষ্ট মনে হচ্ছে না কিংবা খারাপ কিছু ঘটে যেতে পারে এমন ভাবনা হামেশাই আমাদের অন্ত:পুর তোলপাড় করে তোলে। সে আসুক, ঝড় এলেও ঝড় থেমে যায়। শুধু বুঝে নিতে হয় সে আমাদের অন্তরেরই জিনিস। বাইরে থেকে তার আমদানী বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হয় না। একেবারে হয় না তা বলা মুস্কিল। এই নিরাপত্তার অভাববোধ থেকে আসে বিভিন্ন নেতিবাচক চিন্তা যা ক্রমশ: গ্রাস করে আমাদের বোধবুদ্ধি। স্বভাবত:ই তার প্রভাব পড়ে 
আমাদের আচার আচরণের ওপর। কেমন সে সব নিরাপত্তাহীনতা? হয়তো নিরাপত্তাহীনতার গোড়ায় আছে অনিশ্চয়তা। ভবিষ্যত সম্বন্ধে অনিশ্চয়তা, সম্পর্কের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা, নিজের ওপর আস্থা সম্বন্ধে অনিশ্চিত হওয়া এসব থেকেই এক ধরণের ভয় আর নিরাপত্তাহীনতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে বার বার। তখন আমার 'আমি' ঢাল তরোয়াল নিয়ে এগিয়ে পড়ে। একা কুম্ভ রক্ষা করে নকল বুঁদি গড়। হ্যাঁ, নকল বটে। নিরাপত্তাহীনতার ফলে যে সব ডিফেন্স ব্যবহার হয় তা অনেক ক্ষেত্রেই মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এ সব তত্ত্ব আর তথ্যের কচকচি থাক এবার আসুন একটা গল্প শোনা যাক। 
সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। এক দেশে এক রাজা ছিল। রাজার অনেক প্রজাও ছিল। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, সুন্দরী রাণী সব স-ও-ব ছিল। তবু রাজার মনে শান্তি নেই। গল্পের শুরুটা খুব চেনা তাই না? এমন এক রাজার মনে সুখ নেই। কি যেন এক নেই নেই রাজাকে সর্বক্ষণ ঘিরে আছে। মুখখানা বাঙলার পাঁচ করে যখন এসে রাজ সভায় বসেন তখন যেন মনে হয় রাজার মন নেই সভার কাজে। মন্ত্রীমশাই পড়লেন ফাঁপড়ে। এমন করে তো দেশের কাজ চলে না। রাজ বৈদ্যর ডাক পড়ল। সে মাথা চুলকে বললে মনে হচ্ছে বায়ু দোষ। হাজার জরিবুটি। কত রকম টোটকা চলল। রাণীমার মনেও সুখ নেই। রাজার মেজাজ সব সময়ে তুঙ্গে। কি হয় কি হয় ভাবনায় রাজ্যবাসী আকুল। এমন সময় একদিন সে দেশে এলো এক যাদুকর। কাঁধে তার মস্ত ঝোলা, গায়ে তার রংবেরং এর তাপ্পি মারা আলখাল্লা। বাঁশি বাজিয়ে নগরের পথে পথে ঘুরছে সে।লোকের মুখে জানল যখন রাজার ভারি অসুখ মুচকি হেসে বললে তখন তার কাছে আছে ওষুধ। নগরবাসী হেসে কুটিপাটি। বলে কি পাগলটা। যা হোক রাজার কানে খবর গেল। পাকড়াও করে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। দেঁতো হাসি হেসে সে বলল আছেই তো, ওষুধ আছে। কিন্তু আমার শর্ত আছে। কি শর্ত? কি শর্ত? রাজামশাই আর আমি একটা ঘরে একলা থাকব। আর কেউ সেখানে থাকা চলবে না। বেশ বেশ তাই হোক তাই হোক। সবাই রাজী। অবশেষে রাজার শয়নকক্ষে দু জনে মুখোমুখি। যাদুকরের চক চকে চোখ। যেন স্ক্যানার। রাজা চোখ নামিয়ে নেন। বুক ধুকপুক। সব কি দেখতে পাচ্ছে। অন্তরমহলের আলো ছায়া। ঝুলি থেকে বেরিয়ে এলো এক মস্ত আয়না। রাজার সামনে রাখা হলো। চমকে ওঠেন রাজা। দীন দরিদ্র এ কোন মানুষকে দেখছেন দর্পণে। নিজেকে ছোট মনে করেন তিনি। প্রতিবেশী রাজাকে এত হিংসা করেন তিনি। কেবলই মনে হয় বুঝি হেরে যাচ্ছেন, অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে যাচ্ছেন। অথচ এই দীন রাজার প্রতিমূর্তির আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে তরতাজা তরুণ প্রানবন্ত মানুষটা। যাদুকর হাসছে মিটিমিটি। রাজা সেরে উঠছে আস্তে আস্তে। থাকুক না ওরা অন্তরালে, থাকতেই পারে। শুধু তাদের জয় করতে পারলেই রাজার মতো বাঁচা যায় একটা আস্ত জীবন।
0

অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য

Posted in



আমার আমি

'আমি' শব্দটা ভারি ভাবায় আমায়। ঠিক কবে থেকে অন্তরমহলের সর্বেসর্বা হয়ে উঠলো সে তাও মনে করতে পারি না। অথচ এই 'আমি'-কে কেন্দ্র করেই তো আমাদের সমস্ত জগত অস্তিত্ব অনস্তিত্বের দোলায় দুলছে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন 'আমি' কবিতায় বলেছেন, "আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে ।
আমি চোখ মেললুম আকাশে ,জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে ।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর’ ,
সুন্দর হল সে ।”
এই আমি আসলে সমগ্র চেতন মনের সিংহদুয়ার যেন। যার ভিতর মহলের জগত আর বার মহলের জগতে আছে বাস্তব অবাস্তব পরাবাস্তবের আড়াআড়ি দ্বন্দ। আমিত্ব সেই দ্বন্দ যুদ্ধে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে রফা করে চলেছে। আমি আছি তাই জগতের অস্তিত্ব আমার কাছে সত্য। চুনি লাল, পান্না সবুজ, গোলাপ সুন্দর। এও যেমন সত্য আবার এই আমিত্বের বোধ থেকেই বুঝি বা জগতের উৎস মুখ। অন্তরমহলের আরও সব সদস্য যেমন অবচেতন, অর্ধ চেতন, বিবেক, বোধ বুদ্ধি সব কিছুর মধ্যে জেগে আছে একটা আমি যে কিনা জগতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করছে। ভেতরের গুঁতো সামলে বাইরের রক্তচক্ষু সমাজের সঙ্গে মানিয়ে গুছিয়ে চলতে "আমি" র জুড়ি মেলা ভার। অন্তরমহলে নিরন্তর উঠছে কত যে চাহিদার ঝড়। সে সব চাহিদা সমাজ সংসার বোঝে না, ন্যায় নীতির ধার ধারে না। তারা শুধু পূর্তি পূরণের উচ্ছাসে গা ভাসিয়ে দিতে চায়। এই সব চাহিদা আর ইচ্ছারা যদি বেগবান আর সফল হয় তবে সমাজে গেল গেল রব উঠবে। এমনকি অস্তিত্ব সংকট ঘটাও বিচিত্র নয়। কে তবে আমাদের রক্ষা করে চলেছে নিরন্তর? "আমি" সেই "আমি"। একদিকে বিবেকের দংশন অন্যদিকে সমাজের রক্তচক্ষু আর এদিকে অন্তরমহলে ইচ্ছাপূর্তির গুঁতো সামলে "আমি" আমাকে আপনাকে এমন কঠিন যুদ্ধের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছে। অস্ত্র কি রে ভাই ঢাল তলোয়ার, নান চাক্কু? না না নিধিরাম সর্দার 'আমি'
সে সব নিয়ে লড়ে না। তার লড়াই অন্য জাতের। ইগো ডিফেন্স ব্যবহার করে সব কিছুতে সমতা বজায় রেখে চলে সে। হরেক রকম ইগো ডিফেন্স আছে। 
এই ইগো ডিফেন্স সব যে মনের জন্য খুব স্বাস্থ্যকর এমনটাও নয়। বিপদ ঘনায় তখন যখন তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে অস্বাস্থ্যকর ডিফেন্স বেশি ব্যবহার করা হয়ে যায়। সে যা হোক এখন এক নজরে কয়েকটা বহু ব্যবহৃত ডিফেন্স:

রিপ্রেশন বাঙলায় যা অবদমন। ব্যাপারটা কি? অনেক চাহিদা 'আমি' কে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে। কামনা বাসনায় লালায়িত সে চাহিদাদের ঠেলে অবচেতনের গভীর খাদে ঠেলে ফেলে 'আমি'। চেতন স্তরে ওঠার সব পথ বন্ধ। চিরতরে হারিয়ে গেল ভেবে নিশ্চিন্তে থাকে সে। কিন্তু অবচেতনের গর্ত থেকে প্রায়ই ছদ্মবেশে বেরিয়ে আসে সেই সব অবদমিত ইচ্ছারা। অজান্তেই আচরণের ওপর প্রভাব ফেলে সেই সব অবদমিত কামনা বাসনা। 
বাস্তব সত্য যদি মনোমত না হয় তবে তাকে অস্বীকার করলে বেড়ে হয়। বাঙলা সাহিত্যের দেবদাস তো এ ব্যাপারে আইকন বলা চলে। প্রেমে ঝাড় আর মদে ডুবে যাও। এ আসলে ডিনায়ালের চূড়ান্ত। 
নিজের অবাঞ্ছিত চাহিদা বা আবেগ অনেক সময় অন্যের ওপর চাপিয়ে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে 'আমি'। অফিসের সহকর্মী মেয়েটির প্রেমে পাগল বিবাহিত পুরুষটি অন্যদের বোঝাতে থাকে মেয়েটি আসলে তার প্রতি দূর্বল। প্রোজেকশন। 
মনে এক, মুখে আর এক। কোনো মানুষ আত্মবিশ্বাস হারিয়েছে, মনে মনে নিজেকে দুর্বল ভাবছে অথচ বাইরে প্রচন্ড তর্জন গর্জন করছে। রিয়াকসন ফরমেসন। 
আবার অবাঞ্ছিত আবেগ বা চাহিদাগুলো বিপথে চালিত করার বদলে তাকে সৃষ্টিশীল দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া এক ধরণের ডিফেন্স বটে। 
এমন সব অস্ত্র নিয়ে লড়তে লড়তে আমি এগিয়ে চলে মহাকালের পথ ধরে। আলো অন্ধকার পর্যায়ক্রমে আসে, দিন বদল হয়, যুগ যুগ পার হয়ে যায়। বিবর্তিত আমি এগিয়ে চলে অস্ত্বিত্ব রক্ষায়।

1

অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য

Posted in




















সেথা এক পড়শী বসত করে

মনের কারবারি আমি। মন নিয়েই আমার কাজ। কতো মনের গোপন খবর আমার কাছে জমা আছে। কতো ব্যথা বেদনা, উদবেগ, রাগ, হিংসার কথা আমার কাছে গভীর বিশ্বাসে মানুষ গচ্ছিত রেখে গেছে। বদলে নিয়ে গেছে শান্তি আর ভালো থাকা। আমিও সেসব যত্ন করে রেখেছি। আমাদের জীবনের মুহূর্তগুলো এই সব আবেগের রঙে রাঙানো। ভাল লাগার অনুভূতিগুলোর পাশে পাশে ভালো না লাগার অনুভূতিগুলোও সমান জরুরী। কেবল গোল বাঁধে যখন সেই সব আবেগ অনুভূতি মাত্রা ছাড়িয়ে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনকে ব্যহত করে। এই যেমন শান্ত নদীটি যখন তার নিরন্তর বহমানতায় এগিয়ে চলে তখন তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা পরিবেশ শৃঙ্খলও নিয়ম মাফিক চলতে থাকে। হঠাৎ যদি সে নদীর জল ফুলে ফেঁপে উঠে দুকূল প্লাবিত করে বন্যার আকার ধারণ করে তবে কি হয়? আমাদের আবেগগুলোও যেন ঠিক তাই। যখন তারা ছন্দে বাঁধা তখন সমস্যা নেই কিন্তু যদি তারা বাঁধনছাড়া হয়ে পড়ে তখনই হয় সমস্যা। তখন আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে তার প্রভাব পড়তে থাকে। কাজ করতে অসুবিধা হয়, বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা যায়, ঘুম, খিদে ইত্যাদির ওপরও তার প্রভাব পড়ে। আপনারা বলবেন ঘুমের সঙ্গে খিদের সঙ্গে কিংবা পেটের গণ্ডগোলের সঙ্গে অথবা ব্যথা বেদনার সঙ্গে আবেগের কি সম্পর্ক? আমার বোধ হয় সবার গচ্ছিত ধন সামলাতে সামলাতে নিজেরই মাথার তার কেটে যাচ্ছে। আজ্ঞে না। আমি যা বলছি পূর্ণ জ্ঞানে বলছি। ওই যে বললাম আবেগ যখন ফুলে ফেঁপে আমাদের সিস্টেমকে প্লাবিত করে তখন মন কি শরীর কি সবখানেই সমস্যা শুরু হয়। আসলে তো মন আর শরীর ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। এই দেখুন না, আমাদের বাড়ির কারও বিপদ হয়েছে বা কোন পরম আত্মীয় বিয়োগ হয়েছে এমন খবর শুনলে মন খারাপ হয়ে যায়। তখন আমাদের আর খিদে পায় না। কিন্তু খিদে তো একটা শারীবৃত্তীয় ব্যাপার, তা হলে মন খারাপ হলে খিদে না পাওয়ার কোন যুক্তি নেই। আবার ঠিক উল্টোটাও সত্যি। যদি শরীর খারাপ থাকে তখন কোন আনন্দ অনুষ্ঠানে যোগ দিতেও আমাদের ভাল লাগে না। তাই বলি বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথা এক পড়শী বসত করে... আর মন নামের সেই পড়শীর সাথে আপনাদের আলাপ করাবো বলে আমার হাতে কলম ধরা থুড়ি কি বোর্ডে টক টক করে টক(Talk) করা।

হচ্ছিল আবেগের কথা। আবেগ যখন লাগামছাড়া বল্গা ঘোড়া তখন আমাদের কি অবস্থা হতে পারে তার উদাহরণ দিই আপনাদের। আসুন আপনাদের এক হতভাগিনীর গল্প শোনাই। সে সময়ে আমি কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে গবেষণা করবো বলে মনস্থির করেছি। অবশ্যই আমার আগ্রহের বিষয় হল মনোরোগ।কলকাতার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের মনোররোগ বিভাগে ঘুরে ঘুরে রোগী দেখা এবং তাদের কেস হিস্ট্রি নেওয়া ছিল আমার কাজ। সেই সুবাদে বহু ধরনের মানুষের বহুমুখী মানসিক সমস্যা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করার সুযোগ হয়েছে। সে আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। একদিন এইরকম রোগী দেখছি। এন আর এসের মনোরোগ বিভাগের প্রধান ডঃ নায়েক একটি কেস পাঠালেন আমার কাছে। মলিন চেহারার রুগ্ন একজন মহিলা, তার সঙ্গে আছেন তাঁর স্বামী। বয়স বছর পঁয়ত্রিশ হবে। দুজনের চোখে মুখে একরাশ ক্লান্তি। এমন মুখ যাঁরা সরকারি হাসপাতালে কাজ করেন তাঁরা দেখতে অভ্যস্ত। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কত যে মানুষ চিকিৎসার জন্য প্রতিদিন এই সব হাসপাতালে ছুটে আসতে বাধ্য হন তার ইয়ত্তা নেই। বাড়ির কাছে বড়ো জোর ছোট স্বাস্থ্যকেন্দ্র আছে, কোন কোন জায়গায় তো তাও নেই। দেখে বোঝাই যাচ্ছে এনারাও অনেক দূর থেকে এসেছেন। বসতে বললাম দু'জনকেই। হাতে দেখি মস্ত এক প্যাকেট। প্যাকেটের ওজন বেশ ভারি। সমস্যার কথা জানতে চাইলে মহিলা খুব অসন্তোষের সঙ্গে জানালেন ওর মাথার কোনও সমস্যা নেই অথচ ডাক্তারবাবুরা অযথা মাথার অসুখের ডিপার্ট্মেন্টে ঠেলে পাঠিয়ে দিল। জানতে চাইলাম বেশ এখন কি অসুবিধা হয়। “কি বলব দিদিমণি, জানটা কেমন করে। আর মাথা ভীষণ দপ দপ করতে থাকে। আর কিছু? হাতে পায়ে জ্বালা জ্বালা করে, আর? গ্যাস অম্বল খুব হয় গো। আমি থামি না। আমার পুঁথিগত বিদ্যা বলছে ক্লাসিক কেস অফ…। “আরও আছে গো, প্রায়ই বুক ধড়ফড় করে, রাতে ঘুম আসে না। মাথা ঘোরে, সারা শরীর জ্বালা করে। আমি কি আর ঠিক হবো না গো? আপনারা ভাববেন সত্যিই তো ওনার সব উপসর্গই তো শরীরে তবে মনোরোগ ডিপার্ট্মেন্টে পাঠানো কেন রে বাবা! সরকারী হাসপাতালের ব্যাপার! পাঁঠা ডাক্তারগুলো আসলে কেউ চিকিৎসা করতেই চায় না। কেবল এখান থেকে ওখান চালাচালি করতেই থাকে। সত্যি বলতে কি হাতের ওই মোটা প্যাকেটে রয়েছে অনেক অনেক রিপোর্ট। কার্ডিওলোজি, গ্যাস্ট্রো-এন্ট্রোলজি, মেডিসিন সব ডিপার্ট্মেন্টের কিছুই বাদ নেই। চিকিৎসার নথিপত্র সব ভরা আছে তাতে। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেও শরীরে কোনও সমস্যা সেরকমভাবে পাওয়া যায় নি বলে ডাক্তারবাবুরা সাইকিয়াট্রিতে রেফার করেছেন। “বুঝুন ব্যাপার দিদিমণি। আমরা গরীব নোক কত দূর থেকি আসতে হয়”… এবার স্বামী বলে ওঠেন। নাহ, কোনও ভুল নেই ডাক্তারবাবুদের। এ হল ক্লাসিক কেস অফ সোমাটোফর্ম ডিসর্ডার। কি হয় তাতে? এক বা একের থেকে বেশী শারীরিক সমস্যার উপসর্গ থাকে যার কোনও শারীরবৃত্তীয় ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না, রোগীর মনে নিজের শরীর খারাপ সম্বন্ধে ভীষণ উদবেগ তৈরি হয়। মাত্রা ছাড়া উদবেগের কারণে শরীরের বিভিন্ন উপসর্গ আরও বেড়ে চলে। আমি বিস্তারিত কেস হিস্ট্রি নিয়ে দেখলাম, ওনার ঘুমের সমস্যা আছে তা ছাড়া প্রায়ই বুক ধড়ফড় করে, চিন্তা হয়, খুব সামান্য সমস্যাতেই খুব উদবিগ্ন হয়ে পড়েন, মেজাজও খিটখিটে হয়ে থাকে।

তা হলে বুঝতে পারছেন তো আবেগ মাত্রা ছাড়া হলে শরীরের কতো সমস্যা হতে পারে। ওনার চিকিৎসা সাইক্রিয়াট্রিতে শুরু হয়। মাস ছয়েক কেটে গেছে। একদিন আমি বাসে উঠবো বলে দাঁড়িয়ে আছি হঠাত দেখি দুইজনে হন হন করে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। আমি একটু দ্বিধায় পড়ে যাই। মনে মনে বেশ শঙ্কিত হয়ে পড়ি। তবে কাছে আসতে স্বামী মানুষটা হাত জোড় করে জানান স্ত্রী এখন চিকিৎসা করে অনেক ভাল আছেন। তাঁর শরীরের সমস্যা অনেক মিটেছে। মনও অনেক শান্ত থাকে। খুব সরলভাবে বলে উঠলেন, ‘না দিদিমণি আমি সেদিন ভুল কথা বলেছি। সরকারি হাসপাতাল মানেই ডাক্তাররা চিকিৎসা করেন না এই ধারণা ভুল। আমার স্ত্রী কিন্তু এখানে চিকিৎসা করে এখন অনেক ভাল আছে।‘ শুনে ভাল লাগল। আস্থা আর বিশ্বাস হল চিকিৎসার গোড়ার কথা। আমার দেশের প্রতিটা সাধারণ মানুষ যেন উন্নত মানের চিকিৎসা পরিষেবা পেতে পারেন। একমাত্র সরকারই পারেন সে দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে। সবার জন্য স্বাস্থ্য এই হোক আমাদের আগামীর দাবী।
0

অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য

Posted in


মহামারীর রূপকথা 

সেই কোন ছোট্টবেলায় মায়ের কোল ঘেঁষে শুয়ে শুনতাম হরেক রূপকথার গল্প। সে আজ চল্লিশ বছর আগের কথা। মনে পড়ে সে সময়টা ছিল আজকের সময়ের থেকে অনেকটা অন্যরকম। বিশেষতঃ আমার ছোটবেলা কেটেছে নেহাতই এক ছোট জনপদে। সেখানে অন্ধকার নামলে লক্ষী পেঁচার ডাক রাতের নিস্তব্ধতা চিরে খানখান করে দিত। শেয়ালের সমবেত তান শুরু হয়ে যেত। তখনকার রাতও যেন ছিল অনেক বেশি গাঢ কালো। যেদিন চাঁদ উঠত সেদিন জোছনায় ভেসে যেত আমাদের বাড়ির ছাদ, বারান্দা সমস্ত চরাচর। মানে আমার শিশু মনে যতটা পরিসর জুড়ে সেই চরাচরের কল্পনা সম্ভব ছিল সেই সবটুকু। এমন সব রাতে আমি মায়ের কাছ ঘেঁষে শুয়ে মায়ের গায়ের সুঘ্রাণ নিতে নিতে শুনতে থাকতাম রূপকথার গল্প। সে সব রূপকথায় অবধারিতভাবে থাকত রাজকুমার রাজকুমারী, অনেক ভূত-পেত্নী দত্যি-দানো। দুয়ো রানির দুঃখে কচি মন উঠত কেঁপে। কিন্তু জঙ্গলে নির্বাসিত রানির দিন কিভাবে কাটত সে কথা বোঝার আগেই ঘুমের রাজ্যে চলে যেতাম হয়তো। আপনারা বলবেন মানব সভ্যতার এই দারুণ সংকটের সময় হঠাত করে ঠাকুরমার ঝুলি খুলে বসলাম কেন? কারণ আমরা সবাই যে এখন দুয়ো রানির মতো স্বাভাবিক সামাজিক জীবন থেকে নির্বাসিত। সে জীবন ঘিরে আছে অনিশ্চয়তা, আছে ভয়, আছে উদবেগ। বিষন্নতা গ্রাস করছে অনেককেই। অতিমারীর দানব তছনছ করে দিয়েছে সভ্যতার স্বাভাবিক ছন্দ। সবার মনে একটাই আকুতি কবে সব ঠিক হয়ে যাবে? আতঙ্কের একটা পরিমণ্ডল তৈরি হয়েছে আমাদের চারপাশে। এই করোনাতঙ্ক নামের দৈত্যের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাবার জন্য মনের মধ্যে চাই, মনের মতো এক পক্ষীরাজ ঘোড়া চেপে আসা রাজার কুমার। বীর পুরুষের মতো লড়বে সে। আজ্ঞে না মহামারীর এই রুপকথা মোটেও কাল্পনিক নয়। ঠাকুরমা কিংবা ঠাকুর্দার ঝুলির রূপকথা নয় মোটেও। 

দেখা গেছে ভীষণ কোনও সংকটে, বিশেষতঃ এমন অতিমারীর সংকটে শয়ে শয়ে মানুষের আচরণ বেশ বদলে যায়। মানুষের মধ্যে যুক্তির অভাব ঘটে। ভীত হয়ে পড়া, বেশি বেশি জিনিস কিনে জমা করা, এমনকি লুঠপাঠ চলতে থাকে অবাধে। এই সম্যক অবিন্যস্ত আচরণের কারণ হিসাবে কাজ করে আতঙ্ক। তবে কি একদম আতঙ্কিত হওয়া চলবে না? সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত কিছুটা চমকপ্রদ। আদতে আমাদের আবেগ অনুভুতি সারভাইভালেরই এক অঙ্গ হিসাবে কাজ করে। সামনে বিপদ, মনের মধ্যে দুরন্ত ভয় তৈরি হলে তবেই না আমরা বাঁচার আকুলতায় প্রাণপণ দৌড়বো, তাই না? বাঘের কবল থেকে বাঁচার জন্য হরিণের ছুটের মতো আর কি!! অর্থাৎ কিনা করোনাতঙ্ক দৈত্যকে আমাদের মারলে চলবে না, তাকে পোষ মানিয়ে আমাদের দাস করে রাখতে হবে। আতঙ্ক থাকলে তবেই আমরা নিয়ম মেনে মাস্ক ব্যবহার করবো, শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখবো, হাত ধোয়ার সব বিধি বিধান যথাযথভাবে মানবো। অথচ আতঙ্কে অন্যের প্রতি সহমর্মী হতে ভুলব না। প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস ঘর বোঝাই করব না। ঘরবন্দী হয়ে আছি বলে বাড়ির অন্যদের প্রতি রুঢ আচরণ করবো না। 

কেমন করে? আসুন এক মহামারীর দেশের রূপকথা শোনাই আপনাদের। কেমন করে আজ থেকে দু হাজার বছর আগে মনের জোরে এক রাজা লড়াই করেছিল এক মহামারীর সঙ্গে। সময়কাল ১৬৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮০ খ্রীষ্টাব্দ। রোমের সাম্রাজ্য যুক্তভাবে শাসন করছেন মার্কাস অরেলিয়াস আর তাঁর ভাই লুসিয়াস ভেরাস। ১৬৫ সালের শেষের দিকে রোমে যুদ্ধফেরত সৈনিকরা এক ভয়াবহ রোগ আমদানী করেছিল সম্ভবতঃ প্রাচ্যের চীন থেকে। ক্রমে ক্রমে সেই রোগ মহামারীর আকার ধারণ করল। প্রাণ গেল বহু লোকের। একে একে রোগ ছড়িয়ে পড়ল গ্রীসে, ইতালিতে, ইজিপ্টে, নর্থ আফ্রিকায়। ১৬৯ সালে সম্ভবতঃ সেই রোগেই মারা গেল লুসিয়াস। এদিকে প্রতিকার নেই কোনও। কুড়ি বছর রাজার রাজ্যে চলল মারণ রোগের দাপট। কত প্রাণ চলে গেল। কি করলেন অরেলিয়াস? ভেঙে পড়লেন? না, একদমই না। তাঁর জীবন দর্শন ছিল স্টয়সিজমের ওপর আধারিত। প্রাচীন গ্রীস ও রোমে প্রচলিত এই দর্শন যাঁরা অনুসরন করতেন তাঁদের মতে কোনও প্রতিকুল পরিস্থিতিতেই যৌক্তিকতা হারালে চলবে না। এই জগত প্রকৃতির নিয়মে বাঁধা যেখানে রোগ, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী চিরন্তন সত্য। তাই আমাদের প্রত্যক্ষণ যেন আবেগের জোয়ারে আপ্লূত না হয়। মারকাস মনে করতেন মৃত্যু আর রোগ ব্যাধি আসলে

বসন্তের গোলাপ আর শরতের ফলের মতোই সহজ সত্য। একে একে নিজের চোদ্দ জন সন্তানের মধ্যে সাত জনের মৃত্যুর সাক্ষী তিনি। আজকের সঙ্গে তুলনা করলে তখনকার কালে কতই বা চিকিৎসার সুযোগ ছিল। তবু এই মনের জোর ধরে রাখার জন্য মারকাসের ছিল দৃঢ জীবনবোধ। সেই প্রাচীনকালে স্টয়সিজমের প্রবক্তারা বলে গেছেন মানুষ সামাজিক জীব। একে অন্যের সাথে যুক্ত থাকতে পারলে সে নিশ্চিন্তবোধ করে। আজকের পরিস্থিতিতে আমরা যে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে বাধ্য হচ্ছি তাতে আমাদের অনেকের মধ্যে অনিশ্চয়তার বোধ বাড়িয়ে তুলছে। আমি বলি কি এই পরিস্থিতিতে মানসিক স্থৈর্য্য বজায় রাখতে স্টয়সিজমের ধারণা কিছুটা প্রয়োগ করা যেতেই পারে। আমরা শারীরিক দূরত্ব বাড়াবো কিন্তু সামাজিক সম্পর্ক আরও দৃঢ করে তুলব। নিয়মিত ফোনে সবার সাথে যোগাযোগ রাখব। গোষ্ঠীগত সৌহার্দ্য বজায় রাখতে সবে মিলে সমাজের এই বিপদের দিনে নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসব। যাতে আমাদের মধ্যে এই বোধ জেগে ওঠে “we are waves of the same sea, leaves of the same tree, flowers of the same garden.” সামাজিক মাধ্যম খুব ভেবে চিন্তে ব্যবহার করা প্রয়োজন। কারণ অন্যের নেতিবাচক মনোভাব দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।

১৮০ সালের ১৭ই মার্চ মারকাসের মৃত্যু হয় সম্ভবতঃ ওই মহামারীতে। কিন্তু সে মৃত্যু হেরে যাওয়ার গল্প শোনায় না। সে এক বীর পুরুষের মাথা উঁচিয়ে শেষ পর্যন্ত লড়ার গল্প। এই বিপদের সময়ে আমরাও মনের বল যেন না হারাই। কি হবে সে সম্বন্ধে অযথা নেতিবাচক চিন্তা না করে, এই মূহূর্তে কি করলে সব থেকে উপকার হবে সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। বাস্তব সত্যের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, পরীক্ষিত নয় এমন তথ্য অগ্রাহ্য করতে হবে। আর এমন বন্দীদশার যে লাভজনক দিক আছে সেই দিকগুলো সম্বন্ধে সচেতন হতে হবে। কত কিছুই না পেতে পারছি না আমরা। এ বিষয়ে স্টয়সিকরা বলেছেন, 

“Until we have begun to go without them, we fail to realise how unnecessary many things are. We’ve been using them not because we needed them but because we had them.” এর থেকে চরম সত্য আর কি বা হতে পারে। শ্রী কৃষ্ণের মুখে শোনা যায় সেই একই সত্য, তস্মদ অপরিহার্থে না ত্বম শোচিতাম আরহাসি। অর্থাৎ কিনা, যা অবশ্যম্ভাবী তার সম্বন্ধে ভেবে চিন্তাগ্রস্ত হয়ো না। আসলে প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য দর্শন বলে আলাদা করে নয়। বিপদের দিনে চিন্তাশক্তি যেন লোপ না পায় সেইটাই আসল কথা। আজ ঠিক ১৮৪০ বছর পরে ইতালিতে আবার নেমে এসেছে মহামারীর কালো অভিশাপ। সারা পৃথিবীর সমগ্র মানব জাতি এক মহা সংকটের মুখে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমরা তালি থালি কাঁসর ঘন্টা যাই বাজাই, যেন ভুলে না যাই চিন্তার যৌক্তিকতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। তবেই আমাদের জয় নিশ্চিত হতে পারবে। 
0

অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য

Posted in

দ্য আনডিটেক্টেড রেপিস্ট


সালটা ১৯৭৬। লস এঞ্জেলেসের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ভারি অদ্ভুত এক বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এরকম, "আপনি কি ধর্ষক? বিশিষ্ট গবেষক আপনার ইন্টারভিউ নিতে চান। কল করুন এই নম্বরে, ২২১৩/...... সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে যে কোন সময়ে। পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখা হবে।" বিজ্ঞাপনদাতা স্যামুয়েল ডি. স্মিদাইম্যান ভেবেছিলেন একটাও ফোন আসবে না। ধর্ষক ফোন করে নিজের অভিজ্ঞতা জানাবে, এ যেন মূর্খের স্বর্গে বাস। কিন্তু অদ্ভুতভাবে সফল হলেন গবেষক ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট স্যামুয়েল। একে একে বেজে উঠল ফোন। একবার নয়, দুবার নয়, দুশোবার বাজল ফোন। বড়ো লম্বা সে লিস্ট। কে নেই তাতে? আছে কম্পুট্যার প্রোগ্রামার, আছে আর্টিস্ট, মায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মোড়লও। ঋতুবদল হওয়ার আগেই স্যামুয়েল নিয়ে ফেললেন পঞ্চাশ জনের ইন্টারভিউ। যার ওপর ভিত্তিকরে তিনি লিখলেন তাঁর পেপার, 'দ্য আনডিটেক্টেড রেপিস্ট'। স্যামুয়েল লিখে ফেললেন পেপার, এই বিষয়ে গবেষণাও চলল আরও বিশ বছর। অনেক নতুন তথ্য উঠে এল তাতে। দেখা গেল, ধর্ষণ করে সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো লোকের সংখ্যা ধরা পড়া ধর্ষকের তুলনায় অনেক বেশি। তাদের "দ্য আনডিটেক্টেড রেপিস্ট" আখ্যা দেওয়া হল।

কেমন তাদের ব্যক্তিত্ব?

এদের পৌরুষ শিশ্নের আগায় বাস করে। এই সব পুরুষ ওঁৎ পেতে থাকে শিকারের আশায়, এরা চতুর, এরা কখনো শিকারকে অতিরিক্ত আঘাত করে না। শুধু আত্মতুষ্টির জন্য যেটুকু দরকার অতটুকু ভয় দেখিয়ে, সুযোগের সদ্ব্যবহার করে। এরা বিশ্বাস করে একজন নারীর অবস্থার সুযোগ নিয়ে নিজের কাম চরিতার্থ করাই পুরুষার্থ। কখনও কখনও এমনও দেখা গেছে, এই সব পুরুষের মনের গভীরে গাঢ় হয়ে জমা আছে নারীবিদ্বেষ আর নারীর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার ভয়। তাই প্রতিবার ধর্ষণে তার জিৎকেই সুনিশ্চিত করতে চায় সে। কোনও নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার অদম্য চাহিদা থেকে ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ সে করেই চলে। এদের ব্যক্তিত্বে আবেগের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রায় থাকে না। লোকচক্ষুর অন্তরালে একের পর এক ধর্ষণ করে এরা সিরিয়াল রেপিস্টে পরিণত হয়। শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা আকছার ঘটে। এই ধরণের আচরণ যৌন বিকার পেডোফিলিয়ার জন্য হতে পারে। যারা পেডোফিলিক তারা শিশুদের প্রতি তীব্র যৌন আকর্ষণ অনুভব করে। অবশ্য যারা শিশু ধর্ষণ করে তারা সবাই যে পেডোফিলিক, এমন বলা যায় না। অনেক সময় সহজলভ্যতার কারণে আর শিশুদের প্রতিরোধ ক্ষমতা কম বলে তারা আক্রান্ত হয় বেশি।

ভারতে অবস্থা কেমন?

বিশ্বায়ণ আর পণ্যায়ণ যেন একই মুদ্রার দুই পিঠ। বিশ্বায়নের পালে লেগেছে হাওয়া। ভোগবাদী দর্শনের তরী তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে। ভোগবাদী দুনিয়ায় নারী হল অন্যতম সহজলভ্য পণ্য। ভারতীয় সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। নারীর অবস্থান এখানে পুরুষের নীচে। একই নারীতে আসক্তি ভারতীয় পুরুষের ক্ষেত্রে দুর্বলতার লক্ষণ। এই বিশ্বাস যে সমাজের গোড়ায় সেঁধিয়ে আছে সেখানে ধর্ষণ সত্যিই কি অপরাধ? তারা বিশ্বাস করে, নিজের ইচ্ছা চরিতার্থ করতে যে কোনও সময়ে তারা যে কোনও নারীকে জোর করে সম্ভোগে বাধ্য করতেই পারে। নার্সিসিস্টিক অর্থাৎ আত্মমগ্ন ব্যক্তিত্বই এর জন্য অবশ্যই দায়ী। নিজের সুবিধার্থে নারীকে ব্যবহার করার নজির এমনকি রামায়ণ মহাভারতেও পাওয়া যায়। যে দেশে নিজের স্বামী পাশা খেলায় সমস্ত সম্পত্তি হেরে স্ত্রীকে দাঁও রাখে, যে দেশে দ্রৌপদীর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্না নারীর বস্ত্র হরণ হয়, সে দেশে সাধারণ মেয়েদের অবস্থা কি হতে পারে! এহেন বিশ্বাসে বিশ্বাসী যারা, তাদের মেয়েদের সম্মতি সম্বন্ধে ধারণাও যে বিকৃত হবে সে আর অস্বাভাবিক কোথায়? এই সব পুরুষ যখন কামতাড়িত জন্তুর মতো কোন নারী সঙ্গ কামনা করে, তাতে সেই নারী অসম্মতি জানালে সে নিজের মতো করে যুক্তি সাজিয়ে তোলে। মেয়েদের 'না' নাকি আসলে 'হ্যাঁ'। যদি মেয়েরা পশ্চিমী ধাঁচে সাজগোজ করে তার মানে তারা খারাপ চরিত্রের মেয়ে, কাজেই তাদের ধর্ষণ করা চলতেই পারে। এ ছাড়া আরও শত কোটি সামাজিক ও ব্যবহারিক কারণে সমস্ত পৃথিবী জুড়েই ধর্ষণের ঘটনা ঘটে চলেছে। ভারতে অবস্থা তো বেশ শোচনীয়।


পুরুষ যখন ধর্ষিত

চমকাবেন না। 'দ্য আনডিটেক্টেড রেপিস্ট' এর লিস্ট বেশ লম্বা। সম্প্রতি দিল্লির এক সিভিল সোসাইটির সার্ভে রিপোর্ট বলছে, অংশগ্রহনকারী ১৮ শতাংশ পুরুষ কোনও না কোনও সময়ে যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছে বা জোরের মুখে সঙ্গমে বাধ্য হয়েছে। আরও চমকপ্রদ তথ্য হল তাদের মধ্যে ষোল শতাংশ নারী দ্বারা ও মাত্র ২ শতাংশ পুরুষ দ্বারা অত্যাচারিত। সরকারী পরিসংখ্যান বলছে, শিশুদের মধ্যে ছেলেরাই (৫৭%) মেয়েদের (৪২%) থেকে বেশি যৌন হেনস্থার শিকার হয়। তবেই বুঝুন, আনডিটেক্টেড রেপিস্টের তালিকায় মেয়েরাও আছে। বিদেশে তো বটেই, দেশেও তারা কম যায় না।

আমি জানি নারীবাদীরা হই হই করে উঠবেন। সত্যি কি অত্যাচারিত মেয়ের তুলনায় সংখ্যাটা নগন্য নয়? আমি সে কথা মোটেও অস্বীকার করি না। পুরুষশাসিত ভারতীয় সমাজে স্বভাবতই ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা ধর্ষিত পুরুষের তুলনায় অনেক বেশি।

নারী ধর্ষণে এদেশে মোমবাতি মিছিল হয়, মিডিয়া কভারেজ হয়, মায় আইনকানুনের মুখে ছাই দিয়ে পুলিশি এনকাউন্টারও হয়। সে নিয়ে বলার কিছু নেই। শুধু এ কথা ভুললে চলবে না, ধর্ষণের যন্ত্রনা পুরুষ নারী নির্বিশেষে সমান। দেখা গেছে আক্রান্ত পুরুষ পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভুগতে শুরু করে। ডিপ্রেশন, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস, আত্মহত্যার চিন্তা ও চেষ্টা, অপরাধবোধ, লজ্জা – এসব ধর্ষণ পরবর্তী সমস্যা লিঙ্গভেদ মানে না। ব্যথার বোধ দু পক্ষেই সমান, শুধু কেউ কাঁদে, কারোর চোখের জল ফেলতে মানা। অথচ জানেন কি, আমাদের আইনে ধারা ৩৭৫ অনুযায়ী ধর্ষণ কেবলমাত্র পুরুষই করতে পারে। পুরুষ ধর্ষিত এ যেন কল্পনার অতীত। কে জানে এখানেও সেই পুরুষতন্ত্র কথা কইছে কিনা! নারীর হাতে পুরুষ নির্যাতিত, এর থেকে লজ্জার আর কি হতে পারে।

নাহ আমার লিস্ট এখনও শেষ হয় নি। আনডিটেক্টেদের লিস্টে আরও আছে। ভারতীয় আইনে বিবাহিত স্বামী নাকি স্ত্রীর সম্মতি ছাড়াই সঙ্গম করতে পারে। তা নাকি ধর্ষণের আওতায় পড়ে না। স্ত্রীর বয়স ১৮ বছর হলেই হল। প্রতিনিয়ত কত যে ভারতীয় নারী ধর্ষিত হচ্ছেন স্বামীর দ্বারা, তার কি কোনও রেকর্ড আছে? আইন যাই বলুক, এমন সব স্বামীর দল নিশ্চিতভাবেই আনডিটেক্টেড রেপিস্টদের দলভুক্ত।


ধর্ষক জন্মায় কেন?

এত কথার পরে একটা প্রশ্ন উঠেই আসে, ধর্ষক হয়ে কি কোন মানুষই জন্মায়? ধর্ষকও একদিন শিশু ছিল। একজন শিশুর ধর্ষক হয়ে ওঠার নেপথ্য কাহিনীটি কি? পুরুষ ও নারী পরস্পরের পরিপূরক। দু'য়ের সমন্বয়ে গড়ে উঠবে সুস্থ সমাজ, এগিয়ে চলবে সৃষ্টি। যদি শিশু ছোট বয়স থেকে এই শিক্ষা না পায়, তবে জন্ম নেয় ধর্ষক। যদি সে নিজে কোনও না কোনওভাবে হেনস্থার শিকার হয়, তবে জন্ম নেয় ধর্ষক। মানুষের অধিকার যে পায় নি, শিশু অবস্থায় সমাজ যাকে যথেষ্ট সুরক্ষা দিতে পারে নি, সে যে সহজেই অন্যকে আঘাত করবে, যৌন হিংসায় লিপ্ত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। এই পোড়া দেশের নেতারা হুঙ্কার ছাড়ে – বেশি প্রতিবাদ করলে ঘরে ছেলে ঢুকিয়ে দেব। যেন পুরুষাঙ্গ থাকলে আর কোনও অস্ত্র লাগবে না মেয়েদের আঘাত করতে। সিনেমার মতো শক্তিশালী গণ মাধ্যমে বিবেচনাহীনভাবে ধর্ষণের ঘটনাকে তুলে ধরা হয়। জন্ম নেয় সম্ভাব্য ধর্ষক। সংস্কৃতি, সমাজ, মানসিকতায় জন্ম নেয় ধর্ষক। শিশুর নির্মল মানসে জোর করে প্রবেশ করানো হয় যৌন হিংসার গরল। তাই আমার লিস্টে এই বিকৃত সমাজ সংস্কারও "দ্য আনডিটেক্টড রেপিস্ট"।