অন্তরমহল - রুমঝুম ভট্টাচার্য
Posted in অন্তরমহলপৃথিবী বদলে গেছে ...
দ্রুত বদলাচ্ছে বিশ্ব। যা দেখি নতুন লাগে। প্রযুক্তি আর বিশ্বায়নের জোয়ার, পরিবেশের ক্ষয়, সব আমাদের চারপাশের জগতটাকে ক্রমাগত বদলে দিচ্ছে। আর সেই বদলের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে আমাদের হিমসিম অবস্থা। যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি যেমন সারা বিশ্ব জুড়ে বাণিজ্য ছড়িয়েছে তেমন ভাইরাসও ছড়িয়েছে। ভোগবাদের ভাইরাস, করোনা ভাইরাস... মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে বা বলা চলে ধন্দ জাগে, অন্তর্দন্দ্বও বলা যায়। করোনা ভাইরাস নিয়ে সারা বিশ্ব উদবিগ্ন, চিন্তিত। কারণ সঙ্গত। এর প্রকোপ খুব দ্রুত মানব জাতি কে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। তাই আমরা তড়িঘড়ি উঠে পড়ে লেগেছি কোভিড- 19 মোকাবিলায়। সে অবশ্য প্রয়োজনীয় বটে। ঘরে আগুন লাগলে আমাদের পালিয়ে বাঁচতে হয় বটে। তখন আগুন কেন লাগল এ বিচার করার সময় পাওয়া যায় না। কিন্তু ভোগবাদের ভাইরাস ক্ষয় রোগের মতো বিলম্বিত অথচ ঘুণের মতো সুচারুভাবে মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে সে হুঁশ আমাদের বড়ো একটা নেই। আগুন জ্বেলেছি যেদিন সেদিনই গাছের মৃত্যু লিখেছি। চাষ করতে শিখেছি, জমির ওপর মৌরসী পাট্টা গেঁড়ে বসেছি সেদিন থেকে। তখন থেকেই হোমো স্যাপিয়েন্সের বন জঙ্গলে ঘোরা যাযাবর জীবন শেষ বলা চলে। সে দশ হাজার বছর আগের কথা। আজ বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি সভ্যতার উন্নয়নে নিজেদের বসিয়েছি সেরা প্রাণীর আসনে। উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর অহংকারে, প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার অন্ধ বাসনায় মত্ত হয়ে বারবার বিপদ ডেকে এনেছি। বিবর্তিত মানুষ ক্রমাগত যন্ত্র মানুষে পরিণত হচ্ছে। Cyborg engineering এর দৌলতে আজ মানুষ যন্ত্র আর মানুষের মিশেলে তৈরি সাইবার্গে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেচে। আজকাল কৃত্রিম অঙ্গের ব্যবহার
বহুল প্রচলিত। অজৈব অংশগুলো আমাদের শরীরের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হচ্ছে। বদলে দিচ্ছে আমাদের কর্মক্ষমতা, ইচ্ছা, ব্যক্তিত্ব এবং স্বকীয় পরিচয়। সত্যিই তো আমার চশমাটাকে কি আমি আমার শরীরে অঙ্গ ভাবি না? হৃদ যন্ত্রের ছন্দ বজায় রাখা পেসমেকার কি আলাদা আমার দেহ থেকে?
বাইরের এই সব বদল দৃশ্যমান। ভিতরের বদল উপলব্ধির বিষয়। আর সেই অন্তরের অন্দরমহল নিয়েই কারবার আমার। তাই অন্তরমহলের বদল নিয়েই দু চার কথা সারি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মানুষের চিন্তা ভাবনা বিশ্বাসের ধরণও ভীষণভাবে বদলাচ্ছে। স্বভাবতই ব্যক্তিত্বে তার প্রভাব পড়ছেই। আমরা বিভিন্ন মানুষের সাথে যোগাযোগ করছি ভারচুয়াল মাধ্যমে। মুঠো ফোনে শব্দ ফুটে উঠছে স্ক্রিনে। শব্দগুলো চেতনা জুড়ে, যন্ত্র হলো মাধ্যম। মানুষটার দৈহিক উপস্থিতি নেই। মুখ চোখের অভিব্যক্তি নেই। এমন নয়তো যন্ত্র আর মাধ্যম থাকছে না। আসলে চেতনায় সেই ব্যক্তির জায়গা দখল করছে ক্রমে। এখন অভিমানের ইমোজি আসে, ভালবাসারও তাই। রাগ, দু:খ হাসি কান্নায় নেড়া মাথা স্মাইলিই সব। আসলে আবেগের প্রকাশ বদলাচ্ছে ক্রমেই। ঠিক তেমনভাবেই, একটা অতিমারী আমাদের বিশ্বাসের জায়গাটা নাড়িয়ে দিল আমূল। আজ মানুষ দেখলে মনে সংক্রমণের ভয়টাই প্রথমে গ্রাস করে। খুব চেনা মানুষকে দেখলেও ছিটকে সরে যাচ্ছি আমরা। মনে অবিশ্বাস দানা বাঁধছে, কোভিড পজিটিভ নয় তো?
প্রতিবেশীর বিপদে পাশে দাঁড়াবার সাহস হারাচ্ছি। মৃতকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পিছপা হচ্ছি। না, এসব মোটেই অপরাধ নয়। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষার দায় আমাদের নিতেই হচ্ছে। আমি শুধু ভাবছি নিউ নরমাল মানতে মানতে হয়তো বদলে যাবে আমাদের মনন, ব্যক্তিত্ব। সেটাই তখন "নিউ"- এর আতিশয্য ছেড়ে নরমাল হয়ে উঠবে।
ছোট স্পেসে থাকতে থাকতে বাইরের বৃহৎ অস্বস্তির কারণ হবে। তার থেকে যন্ত্রের মাধ্যমে ভারচুয়ালিটি হবে অনেক গুণ স্বস্তির। ওয়েবিনার, ভারচুয়াল আড্ডা, জমায়েত, মিটিং, স্কুল, কলেজ.... গাছেরা বড়ো হবে, হাওয়া বয়ে যাবে, পৃথিবী সবুজ হবে, নদী গতি ফিরে পাবে। শুধু তাকে "সুন্দর" বলে অভিবাদন জানাবার মানবীয় চেতনা কি লুপ্ত হবে চিরতরে। নিরন্তর চেষ্টায় বিজ্ঞান আজ শুধু আমাদের বাইরের পৃথিবী নয় দেহ মনে চেতনায় এনে চলেছে অভুতপূর্ব পরিবর্তন। প্রযুক্তির দৌরাত্ম্য আজ আমাদের মন বুদ্ধির স্তরে আমুল পরিবর্তন এনে অসীম শক্তির অধিকারী হতে চাইছে। জ্ঞানী গুণীজন তেমনটাই ভাবছেন। যদি বিজ্ঞান এমন এক চির তরুণ সাইবার্গ তৈরি করে ফেলে যার থাকবে না কোন আবেগ অনুভূতি। যাকে সন্তান উৎপাদন করতে হয় না। যার পৃথক যৌন পরিচয় নেই, চাইলে সে অন্য সাইবর্গের সাথে যোগাযোগ করতে পারে এবং যার মনোনিবেশ করার এবং তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা মানুষের চেয়ে হাজার গুণ বেশি। রাগ ও দুঃখ বোধের বালাই যার নেই। অথচ আছে আমাদের কল্পনার অতীত চেতনা। এই মহাসাইবার্গরা কি মানুষ থাকবেন আদৌ? নাকি তারা হবেন ঈশ্বরপ্রতিম মানুষের বোধের অগম্য কোন অন্য চেতনার অধিকারী? হোমো সাপিয়েন্স- এর দাপটে এ পর্যন্ত লুপ্ত হয়েছে অনেক প্রজাতি। এমন কি মানব প্রজাতির অন্যান্য গোষ্ঠীও রক্ষা পায় নি সে দাপটের হাত থেকে। তবে কি এবার পাশার ছক বদলাবে? অতিমানব এসে জায়গা করে নেবে পৃথিবীতে। এ সব প্রশ্নের জবাব মহাকালই পারবে দিতে। এ কথা সত্য যে আমরা প্রকৃতির বিবর্তনের পাঠ চুকিয়ে প্রযুক্তির বিবর্তনের শরিক হয়েছি। পা বাড়িয়েছি নতুন এক সিংগুলারিটির দিকে। নিজেরাই গড়ে তুলছি এক নতুন প্রজাতি যার চিন্তাশক্তি বা মনন হবে আমাদের বোধের অতীত।
পৃথিবী বদলাচ্ছে। মানুষ ও মনুষ্যত্বের সংজ্ঞাও।
ReplyDeleteসেতুবন্ধে নেতৃত্ব দিন - সুন্দরতর সহিষ্ণুতা অভ্যাসে দিগদর্শক হয়ে আমাদের সম্পৃক্ত করুন।