পুবের জানালা - রুখসানা কাজল
Posted in পুবের জানালাছেলে এসে জানালো এখন থেকে অফিস যেতে হবে মাম। ফালতু কোন প্যানিক করবা না।
ধ্বক করে একটা ধাক্কা খেলাম মনে।
লক ডাউনের প্রথমেই ওকে বলেছিলাম, কভিড১৯ একেবারে নির্মূল না হলে তুমি কিন্তু অফিস যেও না বাবা। কখন কী বিপদ হয় কে জানে!
আমার আত্মীয় বন্ধু সহকর্মিরাও বলেছিল, আছে তো অই ছেলে। কিছুতেই ওকে বেরুতে দিও না। কিছু হয়ে গেলে. . .
গেল ক মাসে ঘর থেকে যতবার বেরিয়েছে আমি বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি। ও যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছে, এভাবেই পৃথিবীর পরিবর্তন আসে মা। কভিড১৯ হচ্ছে নিউ নর্মাল পৃথিবী আসার একটি সাফাই প্রক্রিয়া। এতদিন মানুষ পৃথিবীর ক্ষতি করেছে। এবার পৃথিবী দিচ্ছে। মানুষকে ত মেনে নিতে হবে। তাছাড়া যথেষ্ট প্রটেকশন নিয়েই বাইরে যাই। সো ষ্টপ ইয়োর সিরিয়াল প্যানিক মাম।
সেই কবে মা হয়েছি। ওকে কোলে নিয়ে মুখস্থ করেছি, ‘পিস এন্ড কনফ্লিক্ট থিয়োরি’র কঠিন মারপ্যাঁচ। কতবার ভেঙ্গে আবার ওকে গড়ে নিয়েছি। আজ ও আমাকে প্রকৃতির শক্তি সুরক্ষা গুঁড়িয়ে মনুষ্য নির্মিত সভ্যতার মরণাপন্ন ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে পৃথিবীর পুনর্জন্মের নবউত্থান বোঝাচ্ছে! এটাকে কি বলব? প্রাকৃতিক রেনেসাঁ নাকি প্রকৃতির প্রতিশোধ?
এমনিতে এই অতিমারি, লক ডাউন, বন্ধুদের সাথে বিচ্ছেদ, বেড়ানো আর খানাপিনা না করতে পারা তায় অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে অহর্নিশ সচেতন হওয়ার যন্ত্রণায় ছেলেটা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে গেছে। কিছু বলতে গিয়েও গিলে ফেলি। কথায় কথায় ফ্যাচ করে ওঠে স্বভাবে শান্ত ছেলেটি। চারদিক থেকে কিছু খারাপ খবরও আসছে। কোভিডে মৃত্যুর চেয়ে সে মৃত্যু আরও যন্ত্রণার। তরুণ ছেলেমেয়েরা নিরবিচ্ছিন্ন এই বাধ্য গৃহবাস মেনে নিতে না পারছে না। অনেকেই ডুবে যাচ্ছে গভীর বিষাদে। এদের কেউ কেউ নিজেকে শেষ করে দিচ্ছে এক অস্থির বিভ্রমে।
আমার পিকচার টিউব নষ্ট পুরানো আমলের বাক্সো টিভি। লালচে রঙের ছবি আসে তাতে। বহুবার বহুজন বলেছে, পাল্টে ফেল। সাথে নিজেকেও খানিক পাল্টাও।
প্রাণে ধরে পাল্টাই না। আমার স্মৃতির পিকচার টিউব ত নষ্ট হয়নি! কোন এক মা দিবসে ব্যাপক সারপ্রাইজ দিয়ে গিফটেছিলেন যিনি তিনি এখন নষ্ট মনিটর। টিভিটা ত জীয়ন্ত। আমি সুখি স্মৃতি ভালোবাসি। স্মৃতিসুখের পানসীতে ভেসে পান্নাহীরা খচিত বৈঠায় ঘাই মেরে জীবনকে সোনারঙে রাঙিয়ে তুলি। মনবৃক্ষে বাস করে এক টিট্টিভ পাখি। সারাক্ষণ সে ডেকে যায়, টুডে টুডে টুডে—হ্যা আজ। আজই ত! এই যে এখনও বেঁচে আছি। আজই নির্ভুল। আজই শুদ্ধ। কাল? কে জানে সেই অধিযুগকে!
টিভির পর্দায় ভেসে ওঠে জেলা শহর নাটোরের কাগজ কুড়ানি এক বনলতা সেন। বয়েসি বটের পাতার মত জীর্ণ মুখ। শীর্ণ হাতে ভিক্ষে পাওয়া ভাতগুলো ধুয়ে রোদ্দুরে শুকিয়ে নিচ্ছে নিউ নর্মাল ভাতের আশায়। ক্যামেরাম্যানের দুচোখে নদি আত্রাইয়ের জলস্রোত। মাস্ক ভিজে আর্দ্র জলাভূমি। ছুটে এসেছেন জেলাপ্রশাসক। বয়েসি বনলতা ছাতিমফুলের গন্ধের মতন ভেসে আসা ভাতের সুবাস পায়। তবে কি ভাত ফেরেশতারা নেমে এসেছে তার পথনীড়ে! ভাত ! আহা ভাত। ভাত খোয়ানো নারী হাত পাতে, দুগ্গা ভাত পাল্যে – বাবাগো ভাত – কিছু না—আর কিছু না---
গেল সন্ধ্যায় কাঁদতে কাঁদতে জাকিয়া ফোন করেছিল। দুদিন আগে থার্ড ইয়ার অনার্সের মিনিষা, ওদের বন্ধু সুইসাইড করেছে।
কিছুটা বিহবল হয়ে বসে থাকি। এসব ঘটনা নতুন কিছু নয়। আমাদের অনেক ছাত্রছাত্রী এমন মৃত্যুকে গ্রহন করে নেয়। ওদের মা বাবা আসে। চোখ মুছে জানিয়ে যায়, বোর্ডের পরীক্ষায় ফেল করেছিল। বকাবকি করেছিলাম। কেউ বলে, স্মার্ট ফোন চেয়েছিল। দিতে পারি নাই গো। চুপিচুপি কেউ বলে যায়, বয়ফ্রেন্ড ব্রেক আপ করেছিল। মেয়ে সামলাতে পারেনি গো ম্যাম।
বুকে পাথর বেঁধে ওদের মাবাবাকে আমরা সান্ত্বনা দিই।
মিনিষা খুব স্বতঃস্ফুর্ত মেয়ে ছিল। ম্যাচিং পোশাক, নেইলপলিশ জুতায় উড়ে উড়ে বেড়াত কলেজ ছাড়াও হেথা সেথা। কিছুতেই একা থাকতে পারত না। দলে বলে ঘুরে বেড়াত। কোন কোন শিক্ষক খুব বকে দিলে খুঁজে বের করে অনুযোগ করত, ম্যাম আমাদেরও ত নিজস্ব একটা পার্ক থাকা দরকার। প্রেমপার্ক। তাইলে ত আমরা চন্দ্রিমা উদ্যানে গিয়ে স্যারের কাছে ধরা খেতাম না। একবার বিতর্ক সভায় বিচারকসহ পুরো অডিয়েন্সকে নাকাল করে ছেড়েছিল ওদের গ্রুপ।
সেই মেয়ে সুইসাইড করেছে ?
জাকিয়ার সাথে আমারও বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। ভাবতেও কষ্ট হয়, গাজিপুরের পারিবারিক গোরস্তানে একা শুয়ে আছে মিনিষা!
হয়ত কোন একদিন ওর হৃৎপিণ্ড ফুঁড়ে গজিয়ে উঠবে কোন রাধাকৃষ্ণ বৃক্ষ। সেই গাছ জড়িয়ে বাতাস কেঁদে উঠবে উথালপাথাল সুরে, ... আমার মাথার বেণী খুইলে দিমু, নাকের ব্যসন খুইলে দিমু, গলার হার ছড়িয়ে দিমু তারে আইন্যা দে... প্রাণ সখিরে ...
সকালে জামা প্যান্ট ইস্ত্রি করে রাখলাম। জুতাটা মুছে রাতে ধুয়ে শুকিয়ে রাখা মোজার পাশে নতুন সার্জিক্যাল মাস্কের বক্স, স্যানিটাইজারের মিনি স্প্রে বটল, লাঞ্চবক্স রেখে দিলাম। শান্ত মুখে নাস্তা খেয়ে হেলমেট হাতে নিয়ে দরোজার নবে হাত রেখে ছেলে জানালো, এগুলো আর করবে না। আমি ডিপেন্ডেট হয়ে যাব। বাই মা। টেক কেয়ার।
আমার মাতৃত্ববোধে জোর ধাক্কা লাগে। খণ্ডবিখণ্ড শিলালিপি কেঁপে ওঠে।
বালকবেলায় কলাবাগান মাঠে দুর্গাকে দেখে ছবি এঁকেছিল ছেলে। দশ হাতে খুন্তি, কড়াই, বই, পেন, ল্যাপ্টপ, ইস্তিরি, ঝাড়ু, বালতি কি নেই! সে দুর্গার বার্গান্ডি কালার খাটো চুল, পায়ে হাইহিল। বাড়িসুদ্ধ সবার সে কি হাসি, দুর্গা কই! এ যে তোমার মা।
আম্মুই তো দুর্গা। দেখো না কত কাজ করে। খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছিল তখন। আর এখন!
আমি কখনও আন্ডার গার্মেন্টস ওকে দেখে লুকিয়ে ফেলিনি। জানিয়েছি, এটা মেয়েদের দরকারি পোশাক। যেমন ছেলেরা পরে। ব্রা নেড়ে দিয়েছি ওড়না বা গামছার নিচে। উৎকট প্রদর্শন যে অস্বস্তিকর সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছি। আজকালকার সব ছেলেমেয়েই রান্না জানে এবং করতে ভালবাসে। মা, বোন, প্রেমিকা আর স্ত্রীদের বেশ সহায়ক হয়ে উঠছে আজকের পুরুষরা। মাঝে মাঝে ‘টক শো’ দেখতে আরাম করে বসে ওকে বলি, চা খাওয়াবে অশেষ অর্ণব ইসলাম? নিম্বু উইথ মিন্ট লিভস!
কিচেনে ঢুকে বিরক্ত হয়ে যায়। উফ্ মা আদ্দিকালের সব জিনিস। একটু মডার্ণ হও মা। হাঁক দেয়, চিনি কই? জুয়েলারি বাক্সে রেখেছ নাকি!
কিচেনের দরোজায় আমাকে দেখলেই রেগে যায়, বেবি সিটিং করতে এসেছ?
আশ্বিনের প্রথম সপ্তাহে কাশফুল ভরা একটি ডালি দিয়ে গেছিল কেউ। বাতাসে উড়ে উড়ে দুলে যাচ্ছে ধবল সৌন্দর্য। বাপের বাড়ি আসবে বলে লক্ষ্মী সরস্বতীকে নিয়ে ব্যাগ গোছাচ্ছে দুর্গা। নিচে তাকিয়ে দেখি, ছোটখাটি দেখতে ব্যারিস্টার মেয়েটি ওর ছোটবোনকে নিয়ে বেরিয়েছে। স্ক্রুটিতে স্টার্ট দেওয়ার আগে চেঁচিয়ে জানতে চাইছে, আম্মু ওষুধগুলোর নাম ঠিকমত লিখছ তো? আর কিছু লাগবে? আব্বুকে জিগ্যেস কর একবার।
নিউরোলজী হাসপাতাল থেকে নাইট ডিউটি শেষ করে বেরিয়ে এসেছেন দুজন মুখঢাকা ডাক্তার। মাথামুন্ডু আর ফিগার দেখে বোঝা যায় একজন ডাঃ গাঙ্গুলী অন্য জন ডাঃ আকবর। ছোট মেয়েটা সদ্য ল ইয়ার হয়েছে। ওদের দেখে ছুটে যায়, আব্বু না একদম ঘুমাতে পারে না কাকু। টিভি চালিয়ে সারারাত জেগে বসে থাকে। একবার যদি বাসায় আসেন ত খুব ভাল হয় --
ডাঃ আকবর গাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে মাস্কের ভেতর বিষাদ হাসে, আর ঘুম মামণি। এ দুনিয়া থেকে ঘুম চলে গেছে রে মা। গাড়ির দরোজা ধরে বারোতলা ফ্ল্যাটের না দেখা ছাদের উপর ঘুম খুঁজতে খুঁজতে ডাঃ গাঙ্গুলী ভাবে, চিরঘুমের দেও দৈত্য নেমে এসেছে পৃথিবীতে। তার মেয়েটা আছে চিন দেশে। কেমন আছে কে জানে। মুখে ত বলে ভাল আছে। যদি কিছু ---
মেয়েদুটির বাবাও ব্যারিস্টার। এদের মায়ের বাবাও ছিলেন স্বনামে পরিচিত একজন লড়াকু ব্যারিস্টার। ওদের পরিবারে ছেলে সন্তান নেই। মেয়েরাই দশভূজা। এই দুর্যোগে প্রৌঢ় বাবামাকে ঘরে রেখে সব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে দু মেয়ে।
ছোট মেয়েটার মাথায় হাত রেখে অভয় দেন ডাক্তার গাঙ্গুলী। হে মা ভবপ্রীতা, ত্রিনেত্রা, শূলধারিণী, সর্বমন্ত্রময়ী, দজ্ঞযজ্ঞবিনাশিনী তোমার বাপেরবাড়িকে কোভিড মুক্ত করে দাও হে অমেয়বিক্রমা।
রুখসানার লেখা শব্দ অক্ষরে ভয়ঙ্কর তীব্র এক নেশা আছে।
ReplyDeleteএ আচ্ছন্নতা শুভ যাপনের।