জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে
Posted in জংলা ডায়েরি
১০
" সবুজ কাগজে
সবুজেরা লেখে কবিতা
পৃথিবী এখন তাদের হাতের মুঠোয়"
(বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
মহাভারতের কালে অঙ্গ ও বঙ্গদেশ শুধুই অরণ্য ছিলো। কিন্তু বাঙালির অরণ্যপ্রীতির ইতিহাস বিশেষ প্রাচীন নয়। রাজা রামমোহন বেশ কিছুদিন চাতরার জঙ্গলমহলে আমিন ও মুন্সির কাজ করেছিলেন প্রায় দু'শো ব্ছর আগে। যে চাতরা আজকের দিনেও প্রায় দুর্গম একটি অরণ্যপ্রদেশ। অগম্য, সন্ত্রাস অধ্যুষিত সবুজের স্বর্গ। কিন্তু তাঁর কোনও লেখায় চাতরার ভূপ্রকৃতি নিয়ে কোনও উল্লেখ নেই। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র দীর্ঘকাল মেদিনীপুরের দক্ষিণে গভীর জঙ্গল পেরিয়ে ভদ্রকে গিয়ে ডেপুটিগিরি করতেন। কপালকুণ্ডলায় সামান্য উল্লেখ ব্যতিরেকে আর কোথাও কিছু লেখেননি। রবীন্দ্রনাথ পল্লীগ্রাম নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। কিন্তু অরণ্য নিয়ে নয়। সঞ্জীবচন্দ্রের 'পালামৌ' য়ুরোপীয়দের ভারতদর্শন, তবে বাংলায়। বড়ো লেখকদের মধ্যে তো আর কারো নাম মনে আসছে না, যিনি সমুচিত আগ্রহ ও ভালোবাসা দিয়ে অরণ্যবৃক্ষের মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতির এই বিস্ময়টি নিয়ে প্রথম যিনি প্রকৃত শিল্প সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, তিনি বন্দ্যকুলোদ্ভব কবি বিভূতিভূষণ। একটা গল্প শুনেছি। বিভূতিভূষণ ঘাসমাটিতে আক্ষরিকভাবে কান পেতে কিছু শুনতে পেতেন। কী শুনতেন, তা আমরা হয়তো বুঝতে পারবো না। কিন্তু তাঁর ভালোবাসার মাত্রাটি সামান্য হলেও অনুভব করতে পারি। মাত্র দশটি বই নিয়ে যদি নির্বাসনে যেতে হয়, তবে তার একটি তো অবশ্যই 'আরণ্যক'। অরণ্যকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে তার আগে তো কেউই কিছু লেখার চিন্তা করতে পারেননি। পরে লেখা হয়েছে, কিন্তু তা আরণ্যকের ধারেকাছে যেতে পারেনি। তাই বাঙালির অরণ্যচর্চার মুখ ও প্রধান প্রতিনিধি বিভূতিভূষণ। যেহেতু তিনি জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় বিহারের বনজঙ্গলের মায়ায় বুঁদ হয়েছিলেন, তাই বিহারি হিসেবে আমিও তাঁর চলাচলের পথে ধুলো ঘেঁটে বেড়াবো, তাই তো স্বাভাবিক।
----------------
বিভূতিভূষণের 'আরণ্যকে'র জঙ্গল দিয়ে শুরু করা যায়। খেলাত ঘোষের চাকরি নিয়ে যখন তিনি ভাগলপুর যা'ন, তখনও ঐ প্রান্তটি মহাভারতের কর্ণের পড়ে পাওয়া অঙ্গরাজ্যের থেকে বিশেষ নগরায়িত ছিলোনা। এখন তিনটে জেলা হয়েছে বাঁকা, গোড্ডা, দুমকা। এই সব এলাকাগুলোতে জঙ্গল ছড়িয়ে ছিলো সেকালে। বিভূতিবাবুর (বিহারে এভাবেই বলা হয়) লবটুলিয়া বইহারের কল্পনা আসলে পুর্নিয়ার উত্তরে আরারিয়া থেকে ফর্বেসগঞ্জ, তরাইয়ের বনজঙ্গল। সতীনাথ ভাদুড়ি আর ফণীশ্বরনাথ রেণুর রাজপাট। আপাততঃ ভাগলপুর থেকে পূর্বদিকে জগদীশপুর পেরিয়ে বাঁকার পথে বইসির কাছে দক্ষিণের বনভূমি যেতে হবে। ছোট পাহাড়ের রেঞ্জ একটা । শাল-সেগুন-গামারের বনভূমি। যেখানে পূর্ণিমারাতে পরিরা খেলা করতে আসে। এখানেই তাঁর মহালিখারুপ অরণ্যানী। 'মহালিখারুপ' নামটি উনি নিয়ে ছিলেন সিংভূমের 'মহালিমরুপ' পাহাড়ের নাম অনুকরনে। সিংভূমে তাঁর চলার পথ খুঁজতে গেলে আসতে হবে জামশেদপুর থেকে দক্ষিণপূর্বে রাখামাইন্স, গালুডি, চাপড়ি পেরিয়ে সুর্দা মাইন্সের দিকে রুয়ামের জঙ্গল। জামশেদপুরের প্রত্যন্ত শহরতলি সুন্দরনগর পেরোলেই একটু একটু করে সবুজের রাজত্ব শুরু হয়ে যায়। করিমসাহেবের পুকুর পেরিয়ে সুন্দরনগরের দিকে বাঁদিকে বাঁক নিলেই নরোয়া পাহাড়, ভাটিন মাইনসের রাস্তা। রাস্তাটি পৌঁছোবে জাদুগোড়া মোড়ে। যখন জাদুগোড়া থাকতুম তখন এই রাস্তাটি ছিলোনা। ছিলোনা বললে ভুল হবে। ভাটিনের পর থেকে দু'টো পাহাড়ের মাঝখান থেকে সরু পায়ে চলার পথ ছিলো। ট্রেকিং করার জন্য আদর্শ। মুর্গাঘুটু, হরতোপা থেকে রাজদোহার দীঘি। নরওয়াপাহাড়ে মাইনিং শুরু হবার পর ইউরেনিয়াম কর্পোরেশনের কলোনি হলো, অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের কমপ্লেক্স বসলো। জঙ্গলের মধ্যে গ্রাম গুলো জুড়ে জুড়ে চওড়া রাস্তা। আধঘন্টা-পৌনে ঘন্টার মধ্যে জাদুগোড়া কলোনি। তবে পুরোনো রাস্তাটি সত্যিই পুরোনো। জামশেদপুরের দক্ষিণে রেলস্টেশন পেরিয়ে সেই সুন্দরনগর হয়েই সোজা হাতা মোড়। ঐ মোড়টির নকটার্নটির সঙ্গে অনেক চেনা নাম জড়িয়ে আছে। বাঁদিকে গেলে সঁকরদা, কালিকাপুর পেরোলেই সিংভূমের আদি জঙ্গল । পাহাড়ের গায়ে রংকিনীদেবীর মন্দির। এই লোকজ দেবীটিকে নিয়ে নানা রোমাঞ্চকর গপ্পোগাছা রয়েছে। বিভূতিভূষণের লেখায় এই দেবী বহুবার এসেছেন। এই রাস্তাটিও গিয়ে পড়ছে জাদুগোড়া মোড়ে। পাহাড়ের দক্ষিণদিক দিয়ে। এটাই ছিলো জামশেদপুর থেকে ঘাটশিলা যাবার আদি রাস্তা। কলকাতা যাবার জন্যও। এই পথেই পঞ্চাশ সালের এক হেমন্তের বিকেলে জরুরি তলব পেয়ে জামশেদপুরের বিধান রায়, ডঃ ব্রহ্মপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অনিঃশেষ পাহাড় আর ঘন জঙ্গল পার করে ঊর্ধশ্বাসে তাঁর কালো অস্টিন গাড়িটি ছুটিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ঘাটশিলার ডাহিগোড়ায়। কিন্তু ততোক্ষণে বিভূতিভূষণ দেবযানে সওয়ার হয়ে গেছেন। হাতের কালোব্যাগটি আর খুলতে হয়নি তাঁকে। প্রণাম করে বেরিয়ে চলে এসেছিলেন।
---------------------
হাতা মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরলেই চাইবাসা হয়ে পশ্চিম সিংভূমের অন্দরমহলের আঁকাবাঁকা পথ। গোবিন্দপুর, রাজনগর, কুজুনদী। চাইবাসা পেরিয়ে ঝিকপানি, হাটগামারিয়া, নোয়ামুন্ডি, বড়াজামদা, বড়বিল, বোলানি, মহিষানি, কিরিবুরু, বরাইবুরু, মেঘাতুবুরু। আবার হাতামোড় থেকে নাকবরাবর গেলে হলুদপুকুর পেরোলেই ওড়িশার সীমান্ত। তিরিং আর বাহালদার পাশে পাশে রয়েছে বাঁকা'র জঙ্গল। সোজা রাইরংপুর, বিসো'ই, বাংরিপোসি হয়ে বারিপদা। গোটা এলাকাটি ছিলো বিভূতিভূষণের নখদর্পণে। তিরিশ-চল্লিশের দশকে এসব জায়গা ছিলো মানচিত্রের বাইরে গভীর অরণ্যানী। অগম্য, বিপজ্জনক। কিন্তু তাঁর কা্ছে জঙ্গলের কিছুই নেতিবাচক নয়। বাংলাসংস্কৃতিতে জঙ্গলকে অনন্ত রোমান্টিক ভাবমূর্তি দেবার একটা সচেতন প্রয়াস তো তাঁর চিরকালই ছিলো। জানিনা তা ভালো না মন্দ। তিনি তো জন্মেছিলেন রাজা মিডার স্পর্শশক্তি নিয়ে। কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করে যাঁরা জঙ্গলকে রোমান্সের স্টুডিও ফ্লোর করে তুলেছেন পরবর্তীকালে, তাঁদের জন্য থাক দু'চারটে দীর্ঘশ্বাস।
-------------------------
জাদুগোড়া থেকে পথটি সুর্দা পর্যন্ত গিয়ে দুদিকে ঘুরে যায়। একদিকে মৌভান্ডার, ঘাটশিলা, অন্যদিকে মুসাবনি, আদি কপার ক্যাপিটাল অফ ইন্ডিয়া। গোটা পথটির সঙ্গেই জঙ্গল জড়াজড়ি করে এগিয়ে গেছে। রুয়াম রেঞ্জ। অনন্ত সিং , অমলেন্দু সেন আর মেরি টাইলারের গপ্পো একালেও কেউ কেউ মনে রাখেন। চাপড়ি, নেত্রা, কেঁদাডিহ, সোহদা, মাঝে মাঝে তামার খনি। জঙ্গলটি চিরে সুবর্ণরেখা দুলে দুলে বয়ে যায়। সুবর্ণরেখা আমাদের গঙ্গা। রুয়াম থেকে নদী পেরিয়ে পূর্বদিকে গেলে গালুডির বাঁধ। ঘাটশিলায় ডাহিগোড়ার বাড়ি থেকে বিভূতিভূষণ হেঁটে হেঁটে এই গালুডির সুবর্ণরেখা পেরিয়ে পশ্চিমে রুয়ামে পাহাড়ের উপরে সিদ্ধেশ্বর শিবের মন্দিরে সবুজের ভাষা শুনতে যেতেন। ভয়ঙ্কর সুন্দর বনরাজিনীলা পেরিয়ে চড়াইয়ের পাকদণ্ডি ধরে তাঁর এগিয়ে যাওয়া। ওখানে এ তল্লাটের সব চেয়ে বেশি শঙ্খচূড়ের আস্তানা। বাবুজি ধীরে চলনা। ওখানকার জঙ্গলে একটু মন দিই যদি তবে আরণ্যকের বায়োস্কোপ, চোখে সবুজ, মনে সিপিয়া, শুধু মিলিয়ে নেওয়াটুকুই বাকি।
-------------------------------
এই নদী, এই নীলসবুজ, এই জোড় লাগা নাগিনীর মতো বনপথ, সব মিলিয়েই তো জংলাভৈরবীর ঢিমে বড়ত। কসুর পতিয়ালার সবাই গেয়েছেন "নৈন মোরে তরস রহে, আজা বালম পরদেশি।" মাটির কুমারী মেয়ে তার সব মায়ামোহমদিরতা নিয়ে এভাবেই সম্পূর্ণা নারী হয়ে ওঠে, অরণ্যে বেফিক্র লাপতা হয়ে যাওয়ার টান, হারিয়ে যাওয়ার স্বাদ। যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের.....। পৃথিবীর যাবতীয় আততি, আশ্লেষ, আমূল থেকে খোঁজা, খুঁজে যাওয়া। সৌন্দর্যের সঙ্গে কথাবার্তা, সে তো হবেই। সে অন্যপূর্বা কি না কখনও ভাবিনি। তবু ও গাঁয়ে আমারও কিছু ঘরবাড়ি আছে। কবি যখন বলেন আমার প্রিয় লাইনগুলো, তখন ভাবি এতো আমার কথা, তিনি না হয় লিখেই দিয়েছেন,
বিভূতিভূষণও সৌন্দর্যকে দেখতে দেখতে কাছ দিয়ে হেঁটে চলে যান, মহাপ্রস্থানের পথে। আর আমি যুধিষ্ঠিরের কুকুরের মতো তাঁর পিছু পিছু।
এই মানুষজন্ম, এভাবেই চেয়েছি চিরদিন .....
" সৌন্দর্যের সঙ্গে ফের দেখা হলো, দেখলাম সৌন্দর্যের সিঁথিতে সিন্দুর
তার মানে সম্প্রতি সে বিবাহ করেছে, আমি সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রায়শ কথাবার্তা বলতাম এককালে, এখন সে বিবাহ করেছে বলে আমি
আর কথা বলিনি তো, শুধু তার কাছ দিয়ে হাঁটলাম বহুক্ষণব্যাপী...."
(সৌন্দর্য- বিনয় মজুমদার)
(শেষ)