Next
Previous
Showing posts with label জংলা ডায়েরি. Show all posts
2

জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে

Posted in
 













১০


" সবুজ কাগজে
সবুজেরা লেখে কবিতা
পৃথিবী এখন তাদের হাতের মুঠোয়"
(বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)

মহাভারতের কালে অঙ্গ ও বঙ্গদেশ শুধুই অরণ্য ছিলো। কিন্তু বাঙালির অরণ্যপ্রীতির ইতিহাস বিশেষ প্রাচীন নয়। রাজা রামমোহন বেশ কিছুদিন চাতরার জঙ্গলমহলে আমিন ও মুন্সির কাজ করেছিলেন প্রায় দু'শো ব্ছর আগে। যে চাতরা আজকের দিনেও প্রায় দুর্গম একটি অরণ্যপ্রদেশ। অগম্য, সন্ত্রাস অধ্যুষিত সবুজের স্বর্গ। কিন্তু তাঁর কোনও লেখায় চাতরার ভূপ্রকৃতি নিয়ে কোনও উল্লেখ নেই। স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র দীর্ঘকাল মেদিনীপুরের দক্ষিণে গভীর জঙ্গল পেরিয়ে ভদ্রকে গিয়ে ডেপুটিগিরি করতেন। কপালকুণ্ডলায় সামান্য উল্লেখ ব্যতিরেকে আর কোথাও কিছু লেখেননি। রবীন্দ্রনাথ পল্লীগ্রাম নিয়ে অনেক লেখালেখি করেছেন। কিন্তু অরণ্য নিয়ে নয়। সঞ্জীবচন্দ্রের 'পালামৌ' য়ুরোপীয়দের ভারতদর্শন, তবে বাংলায়। বড়ো লেখকদের মধ্যে তো আর কারো নাম মনে আসছে না, যিনি সমুচিত আগ্রহ ও ভালোবাসা দিয়ে অরণ্যবৃক্ষের মর্যাদা দিতে চেয়েছিলেন। প্রকৃতির এই বিস্ময়টি নিয়ে প্রথম যিনি প্রকৃত শিল্প সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন, তিনি বন্দ্যকুলোদ্ভব কবি বিভূতিভূষণ। একটা গল্প শুনেছি। বিভূতিভূষণ ঘাসমাটিতে আক্ষরিকভাবে কান পেতে কিছু শুনতে পেতেন। কী শুনতেন, তা আমরা হয়তো বুঝতে পারবো না। কিন্তু তাঁর ভালোবাসার মাত্রাটি সামান্য হলেও অনুভব করতে পারি। মাত্র দশটি বই নিয়ে যদি নির্বাসনে যেতে হয়, তবে তার একটি তো অবশ্যই 'আরণ্যক'। অরণ্যকে কেন্দ্রীয় চরিত্র করে তার আগে তো কেউই কিছু লেখার চিন্তা করতে পারেননি। পরে লেখা হয়েছে, কিন্তু তা আরণ্যকের ধারেকাছে যেতে পারেনি। তাই বাঙালির অরণ্যচর্চার মুখ ও প্রধান প্রতিনিধি বিভূতিভূষণ। যেহেতু তিনি জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় বিহারের বনজঙ্গলের মায়ায় বুঁদ হয়েছিলেন, তাই বিহারি হিসেবে আমিও তাঁর চলাচলের পথে ধুলো ঘেঁটে বেড়াবো, তাই তো স্বাভাবিক। 

----------------

বিভূতিভূষণের 'আরণ্যকে'র জঙ্গল দিয়ে শুরু করা যায়। খেলাত ঘোষের চাকরি নিয়ে যখন তিনি ভাগলপুর যা'ন, তখনও ঐ প্রান্তটি মহাভারতের কর্ণের পড়ে পাওয়া অঙ্গরাজ্যের থেকে বিশেষ নগরায়িত ছিলোনা। এখন তিনটে জেলা হয়েছে বাঁকা, গোড্ডা, দুমকা। এই সব এলাকাগুলোতে জঙ্গল ছড়িয়ে ছিলো সেকালে। বিভূতিবাবুর (বিহারে এভাবেই বলা হয়) লবটুলিয়া বইহারের কল্পনা আসলে পুর্নিয়ার উত্তরে আরারিয়া থেকে ফর্বেসগঞ্জ, তরাইয়ের বনজঙ্গল। সতীনাথ ভাদুড়ি আর ফণীশ্বরনাথ রেণুর রাজপাট। আপাততঃ ভাগলপুর থেকে পূর্বদিকে জগদীশপুর পেরিয়ে বাঁকার পথে বইসির কাছে দক্ষিণের বনভূমি যেতে হবে। ছোট পাহাড়ের রেঞ্জ একটা । শাল-সেগুন-গামারের বনভূমি। যেখানে পূর্ণিমারাতে পরিরা খেলা করতে আসে। এখানেই তাঁর মহালিখারুপ অরণ্যানী। 'মহালিখারুপ' নামটি উনি নিয়ে ছিলেন সিংভূমের 'মহালিমরুপ' পাহাড়ের নাম অনুকরনে। সিংভূমে তাঁর চলার পথ খুঁজতে গেলে আসতে হবে জামশেদপুর থেকে দক্ষিণপূর্বে রাখামাইন্স, গালুডি, চাপড়ি পেরিয়ে সুর্দা মাইন্সের দিকে রুয়ামের জঙ্গল। জামশেদপুরের প্রত্যন্ত শহরতলি সুন্দরনগর পেরোলেই একটু একটু করে সবুজের রাজত্ব শুরু হয়ে যায়। করিমসাহেবের পুকুর পেরিয়ে সুন্দরনগরের দিকে বাঁদিকে বাঁক নিলেই নরোয়া পাহাড়, ভাটিন মাইনসের রাস্তা। রাস্তাটি পৌঁছোবে জাদুগোড়া মোড়ে। যখন জাদুগোড়া থাকতুম তখন এই রাস্তাটি ছিলোনা। ছিলোনা বললে ভুল হবে। ভাটিনের পর থেকে দু'টো পাহাড়ের মাঝখান থেকে সরু পায়ে চলার পথ ছিলো। ট্রেকিং করার জন্য আদর্শ। মুর্গাঘুটু, হরতোপা থেকে রাজদোহার দীঘি। নরওয়াপাহাড়ে মাইনিং শুরু হবার পর ইউরেনিয়াম কর্পোরেশনের কলোনি হলো, অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের কমপ্লেক্স বসলো। জঙ্গলের মধ্যে গ্রাম গুলো জুড়ে জুড়ে চওড়া রাস্তা। আধঘন্টা-পৌনে ঘন্টার মধ্যে জাদুগোড়া কলোনি। তবে পুরোনো রাস্তাটি সত্যিই পুরোনো। জামশেদপুরের দক্ষিণে রেলস্টেশন পেরিয়ে সেই সুন্দরনগর হয়েই সোজা হাতা মোড়। ঐ মোড়টির নকটার্নটির সঙ্গে অনেক চেনা নাম জড়িয়ে আছে। বাঁদিকে গেলে সঁকরদা, কালিকাপুর পেরোলেই সিংভূমের আদি জঙ্গল । পাহাড়ের গায়ে রংকিনীদেবীর মন্দির। এই লোকজ দেবীটিকে নিয়ে নানা রোমাঞ্চকর গপ্পোগাছা রয়েছে। বিভূতিভূষণের লেখায় এই দেবী বহুবার এসেছেন। এই রাস্তাটিও গিয়ে পড়ছে জাদুগোড়া মোড়ে। পাহাড়ের দক্ষিণদিক দিয়ে। এটাই ছিলো জামশেদপুর থেকে ঘাটশিলা যাবার আদি রাস্তা। কলকাতা যাবার জন্যও। এই পথেই পঞ্চাশ সালের এক হেমন্তের বিকেলে জরুরি তলব পেয়ে জামশেদপুরের বিধান রায়, ডঃ ব্রহ্মপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, অনিঃশেষ পাহাড় আর ঘন জঙ্গল পার করে ঊর্ধশ্বাসে তাঁর কালো অস্টিন গাড়িটি ছুটিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন ঘাটশিলার ডাহিগোড়ায়। কিন্তু ততোক্ষণে বিভূতিভূষণ দেবযানে সওয়ার হয়ে গেছেন। হাতের কালোব্যাগটি আর খুলতে হয়নি তাঁকে। প্রণাম করে বেরিয়ে চলে এসেছিলেন। 

---------------------

হাতা মোড় থেকে ডানদিকে ঘুরলেই চাইবাসা হয়ে পশ্চিম সিংভূমের অন্দরমহলের আঁকাবাঁকা পথ। গোবিন্দপুর, রাজনগর, কুজুনদী। চাইবাসা পেরিয়ে ঝিকপানি, হাটগামারিয়া, নোয়ামুন্ডি, বড়াজামদা, বড়বিল, বোলানি, মহিষানি, কিরিবুরু, বরাইবুরু, মেঘাতুবুরু। আবার হাতামোড় থেকে নাকবরাবর গেলে হলুদপুকুর পেরোলেই ওড়িশার সীমান্ত। তিরিং আর বাহালদার পাশে পাশে রয়েছে বাঁকা'র জঙ্গল। সোজা রাইরংপুর, বিসো'ই, বাংরিপোসি হয়ে বারিপদা। গোটা এলাকাটি ছিলো বিভূতিভূষণের নখদর্পণে। তিরিশ-চল্লিশের দশকে এসব জায়গা ছিলো মানচিত্রের বাইরে গভীর অরণ্যানী। অগম্য, বিপজ্জনক। কিন্তু তাঁর কা্ছে জঙ্গলের কিছুই নেতিবাচক নয়। বাংলাসংস্কৃতিতে জঙ্গলকে অনন্ত রোমান্টিক ভাবমূর্তি দেবার একটা সচেতন প্রয়াস তো তাঁর চিরকালই ছিলো। জানিনা তা ভালো না মন্দ। তিনি তো জন্মেছিলেন রাজা মিডার স্পর্শশক্তি নিয়ে। কিন্তু তাঁকে অনুসরণ করে যাঁরা জঙ্গলকে রোমান্সের স্টুডিও ফ্লোর করে তুলেছেন পরবর্তীকালে, তাঁদের জন্য থাক দু'চারটে দীর্ঘশ্বাস।

-------------------------

জাদুগোড়া থেকে পথটি সুর্দা পর্যন্ত গিয়ে দুদিকে ঘুরে যায়। একদিকে মৌভান্ডার, ঘাটশিলা, অন্যদিকে মুসাবনি, আদি কপার ক্যাপিটাল অফ ইন্ডিয়া। গোটা পথটির সঙ্গেই জঙ্গল জড়াজড়ি করে এগিয়ে গেছে। রুয়াম রেঞ্জ। অনন্ত সিং , অমলেন্দু সেন আর মেরি টাইলারের গপ্পো একালেও কেউ কেউ মনে রাখেন। চাপড়ি, নেত্রা, কেঁদাডিহ, সোহদা, মাঝে মাঝে তামার খনি। জঙ্গলটি চিরে সুবর্ণরেখা দুলে দুলে বয়ে যায়। সুবর্ণরেখা আমাদের গঙ্গা। রুয়াম থেকে নদী পেরিয়ে পূর্বদিকে গেলে গালুডির বাঁধ। ঘাটশিলায় ডাহিগোড়ার বাড়ি থেকে বিভূতিভূষণ হেঁটে হেঁটে এই গালুডির সুবর্ণরেখা পেরিয়ে পশ্চিমে রুয়ামে পাহাড়ের উপরে সিদ্ধেশ্বর শিবের মন্দিরে সবুজের ভাষা শুনতে যেতেন। ভয়ঙ্কর সুন্দর বনরাজিনীলা পেরিয়ে চড়াইয়ের পাকদণ্ডি ধরে তাঁর এগিয়ে যাওয়া। ওখানে এ তল্লাটের সব চেয়ে বেশি শঙ্খচূড়ের আস্তানা। বাবুজি ধীরে চলনা। ওখানকার জঙ্গলে একটু মন দিই যদি তবে আরণ্যকের বায়োস্কোপ, চোখে সবুজ, মনে সিপিয়া, শুধু মিলিয়ে নেওয়াটুকুই বাকি। 

-------------------------------

এই নদী, এই নীলসবুজ, এই জোড় লাগা নাগিনীর মতো বনপথ, সব মিলিয়েই তো জংলাভৈরবীর ঢিমে বড়ত। কসুর পতিয়ালার সবাই গেয়েছেন "নৈন মোরে তরস রহে, আজা বালম পরদেশি।" মাটির কুমারী মেয়ে তার সব মায়ামোহমদিরতা নিয়ে এভাবেই সম্পূর্ণা নারী হয়ে ওঠে, অরণ্যে বেফিক্র লাপতা হয়ে যাওয়ার টান, হারিয়ে যাওয়ার স্বাদ। যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের.....। পৃথিবীর যাবতীয় আততি, আশ্লেষ, আমূল থেকে খোঁজা, খুঁজে যাওয়া। সৌন্দর্যের সঙ্গে কথাবার্তা, সে তো হবেই। সে অন্যপূর্বা কি না কখনও ভাবিনি। তবু ও গাঁয়ে আমারও কিছু ঘরবাড়ি আছে। কবি যখন বলেন আমার প্রিয় লাইনগুলো, তখন ভাবি এতো আমার কথা, তিনি না হয় লিখেই দিয়েছেন,

বিভূতিভূষণও সৌন্দর্যকে দেখতে দেখতে কাছ দিয়ে হেঁটে চলে যান, মহাপ্রস্থানের পথে। আর আমি যুধিষ্ঠিরের কুকুরের মতো তাঁর পিছু পিছু।

এই মানুষজন্ম, এভাবেই চেয়েছি চিরদিন .....

" সৌন্দর্যের সঙ্গে ফের দেখা হলো, দেখলাম সৌন্দর্যের সিঁথিতে সিন্দুর

তার মানে সম্প্রতি সে বিবাহ করেছে, আমি সৌন্দর্যের সঙ্গে প্রায়শ কথাবার্তা বলতাম এককালে, এখন সে বিবাহ করেছে বলে আমি

আর কথা বলিনি তো, শুধু তার কাছ দিয়ে হাঁটলাম বহুক্ষণব্যাপী...."

(সৌন্দর্য- বিনয় মজুমদার)














(শেষ)
1

জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে

Posted in

 ৯

"... সে কি জানিত না যত বড়ো রাজধানী
তত বিখ্যাত নয় এ-হৃদয়পুর
সে কি জানিত না আমি তারে যত জানি
আনখসমুদ্দুর
আজ সেই ঘরে এলায়ে পড়েছে ছবি
এমন ছিলো না আষাঢ়-শেষের বেলা
উদ্যানে ছিলো বরষা-পীড়িত ফুল
আনন্দ-ভৈরবী।" (শক্তি)

ড্যাঞ্চিবাবুর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে কোয়েল কারো-কে খোঁজা বড়োশহরের বাবুদের ঠিক আসেনা।


আমি তো নিজে সারান্ডারই সন্তান। চার পুরুষ জামশেদপুরে বাস আর কর্মসূত্রে দীর্ঘ থেকেছি চাইবাসা, জাদুগোড়া, মুসাবনি। সারা সিংভূম, পূর্ব-পশ্চিম, প্রায় হাতের তালুর মধ্যে থাকে। তাদের যাবতীয় পরিধির দশদিক আমার অস্তিত্বের অংশ। চাইবাসা থেকে সারান্ডা যেতে গেলে দক্ষিণ-পশ্চিম। অভ্যেসবশে চিরকাল ঐ পথে গেছি। হয় চক্রধরপুর, সোনুয়া, গইলকেরা, মনোহরপুরের রাস্তা ধরে। নয়তো হাটগামারিয়া, জগন্নাথপুর, নোয়ামুন্ডি, কালাবুরু, বড়াজামদা, বড়বিল, বোলানি, মহিষানির পথে বরাইবুরু, কিরিবুরু, মেঘাতুবুরু, থলকোবাদ। সারান্ডা এদেশের সবচেয়ে বড়ো ও ধনী জঙ্গলমহাল ছিলো তো এককালে।
ওড়িশার দিক দিয়ে সারান্ডার দক্ষিণ দিক ধরে কেঁদুয়াঝাড়ের (পূর্বতন কেঁওঝর) পথে বর্ষামুখর সারান্ডার স্মৃতিকাতর টান। বহুদিনের পুরোনো পিরিতি ফিরে এলো নির্বিবাদ, জংলির কাছে যেমন ফেরে জঙ্গল আর বুদ্ধ গুহের কাছে 'শালবনের' কেচ্ছা লেখাতে ফিরে ফিরে আসে প্রকাশক। 

কিরিবুরু আর মেঘাতুবুরু, প্রায় তিন হাজার ফুট পাহাড়ের উপর দুটো ছোট্টো শৈল বসতি। সেল কোম্পানির লোহা খাদান ঘিরে বসবাস। পাহাড়ের পায়ের কাছে সিংভূমের শেষ। অন্যপারে পাহাড় পেরিয়ে কেঁদুয়াঝাড় জেলা । সারান্ডা অরণ্যের কেন্দ্র এই শিখর শহর দুটি। হো ভাষায় 'সারান্ডা' মানে সাতশো পাহাড়। এটা সাতশো পাহাড়ের দেশ। সঞ্জীবচন্দ্রের দৌলতে ইংরিজিজানা বাঙালির কাছে পলামুর বনজঙ্গল পরিচিতি পেয়েছিলো ঊনবিংশ শতকেই। বেতলা, লাতেহার, ছিপাদোহর, মহুয়াডাঁড়, গাড়োয়া, গারু, কুটকু, বড়াসাঁড়, নানা ফরেস্ট রেঞ্জ। পূর্বদিকে নেতারহাট থেকে শুরু করে পশ্চিমে মির্জাপুর। উত্তরে হান্টারগঞ্জ, চাতরা থেকে দক্ষিণে গুমলা, সরগুজা। সে তুলনায় বাঙালির কাছে সারান্ডা ছিলো অচেনা। উত্তরে পোড়াহাট আর কোলহান অরণ্য, সারান্ডা জঙ্গলে রেঞ্জ আছে চারটি। সামটা, কোয়না, সসাংদা আর গুয়া, এটাই সাতশো পাহাড়ের দেশ। এই অরণ্যের হৃদয়দেশে দু'টো বনবাংলা, আজ তারা অতীত, থলকোবাদ আর কুমডি। বড়াজামদার দিক দিয়ে গেলে কিরিবুরু'র কাছে পড়তো কুমডি। আরো পনেরো-কুড়ি কিমি এগিয়ে গিয়ে থলকোবাদের সেই পুরোনো বনবাংলা। যা'কে বিভূতিভূষণ চিনিয়ে ছিলেন বাঙালিদের কাছে। বহুদিন আগে শক্তি আর সন্দীপনকে নিয়ে গিয়েছিলুম কুমডি বাংলায়। তাঁদের রাত জেগে কখনও ঘুম, কখনো নেশা, কখনও পাগলামি, আর এতোলবেতোল প্রমত্ত প্রলাপের অভিনীত অপ্রকৃতস্থতা থেকে উঠে আসা পরবর্তী কালের লেখালেখির বীজ, শুনেছিলুম আমরা। রাতের বেলা ওসব জায়গায় কোনও রকম শব্দদূষণ একেবারে মানা। তাই টেনশন নিয়ে পাহারা দিতে হয়েছিলো রাতভর। কিন্তু সেবার অন্ধকারে হরিণের সবুজচোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যায়নি। মাঝে মাঝে সমতল, কিন্তু ক্রমাগত চড়াই-উৎরাই। অরণ্য কখনও ঘন, কখনও ছোটো ছোটো গ্রামের কাছে এসে হাল্কা হয়ে যাচ্ছে। কোন প্রাক ইতিহাসকাল থেকে সিংভূমের এই শালের জঙ্গল, পিয়াল, জারুল, আমলকী, বট, কাঁঠাল, সেগুন, মানুষের নির্বাণভূমি হয়ে জেগে আছে , কে জানে? একটা পাক খাওয়া রাস্তার চড়াই উঠলেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো থলকোবাদ বনবাংলা। আজ সে রয়েছে শুধু স্মৃতিতে।

সূর্য এখানে এভাবেই অস্ত যায়। প্রথম শাদা, থেকে নীলাভ ছায়। তার পর হলুদ, সোনালি, কমলা। তারপর হঠাৎ আকাশের স্মেল্টার থেকে উপচে গলন্ত লোহার মতো আগুন ছড়িয়ে যায় এপার ওপার সাতশো পাহাড়ের নীলিম দিগন্তে। কিমাশ্চর্যম... আমি যদি যুধিষ্ঠির হতুম, নহুষ যক্ষের প্রশ্নের উত্তর হতো অন্যরকম। রোজই সারা পৃথিবী জুড়ে সূর্য ওঠে আর অস্ত যায়, কিন্তু কখনও পুরোনো হয়না কেন ? বারান্দায় বসে দেখি ঝুঁঝকো আঁধার নেমে আসছে, ঘাসজমি, লালমোরম, ঘোরানো পথের নক-টার্ন মিলিয়ে যাচ্ছে নিশ্চুপ। সবুজ অরণ্যের আভা গাঢ় হয়ে মিশে যাচ্ছে আবহের অন্ধকারে। জঙ্গলে যখন রাত নামে, গোধূলির জ্বলানেভা আলোর তির আড়াল করে দেয় শাল-সেগুনের মস্তো পাতায় টাঙানো চাঁদোয়া। ঝুঁঝকো আঁধার নামে পাখিদের বাড়ি ফেরার আকাঙ্খায় সপ্তম সিম্ফনির আকাশ চেম্বার। আঁধার নামে ঝপ করে। টের পেতে দেয়না কখন তার আঁচল দিয়ে ঢেকে দিলো চারদিক। যত দূর চোখ যায়। ঝরা পাতাদের ভেজা, জৈব গন্ধ গাঢ় হতে থাকে ভারি হাওয়ায়। জঙ্গলে বসন্তের বাতাসটুকুর মতো মিঠে ফিল্মি পেলবতা থাকেনা তেমন। হয় বৃষ্টির ঝাপটে এলোমেলো ঝড়, নয় নিঃশব্দ পাতাদের দুলিয়ে দিয়ে এখান ওখান পাতার নূপুর। বনবাংলার বারান্দায় লন্ঠনের কাঁপা আলো, বেতের রং'জলা চেয়ার আর মৃদু সিঙ্গল মল্টের স্বস্তি। গান শুনতে গেলে ইয়ারফোন আর শান্তিতে বসতে গেলে মশার ক্রিম। শোর মচানা মনা হ্যাঁয়। কেয়ারটেকার ভালো হলে দেশি মুর্গির ঝোল আর ভাত। সঙ্গে লেবু দেওয়া চাকা চাকা পেঁয়াজ। রুটি বানানো খুব ঝামেলা এখানে। লাগেও না। রাত যত বাড়ে, জঙ্গলে ইতিউতি জন্তুদের ডাকও বেড়ে ওঠে। কিছু চেনা, কিছু অচেনা। তবে আবহসঙ্গীত হিসেবে নিখুঁত। আরো একটু ঘন হলে অন্ধকার, বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে শিশির পড়ার টুপটাপ। মাপতে গেলে গান্ধারের পর্দা মেনে তার স্বরলিপি। টপ্পার মতো ঠেকায় বাজে তার তালের মাত্রা। মশা ছাড়া কোনও আতঙ্ক নেই। 

গোটা তল্লাটই ফ্যালসিপেরামের তীর্থ। কিরিবুরু হাসপাতালে যে কোনও রকম জ্বর হলেই কিছু না শুনেই আগে ক্লোরোকুইন। 

অনেকে জিগ্যেস করেন, কোন জঙ্গল আপনার সব থেকে প্রিয়? বলা মুশকিল। সত্যিই বলা খুব মুশকিল। কারণ প্রতিটি জঙ্গলই বহুরূপী। প্রতিবারই গিয়ে দেখি কিছু আলাদা দৃশ্য, আলাদা গন্ধ, আলাদা অহংকার । চমকে দেয় বারবার। পুরোনো হয়না কখনও। ডায়রি খালি থাকতে দেয়না। তুমি আখর না চেনালে আজও কিছু লেখা হতোনা। নিজের দলমা গ্রাম যদিও একনম্বরে থাকবে চিরকাল। আমার ধরাছোঁয়ার অমরাবতী। তার পর? নাহ, চিরিমিরি, পঞ্চমড়ি, জাফু, কর্বেট, কওসানি কেউ নয়। বাড়ির পাশের সিমলিপাল রেঞ্জ। জানতে চেও না বেহাগ কেন বেশি ভালো লাগে দরবারির চেয়ে। বারিপদার দিক দিয়ে ঢোকা। লুলুং, জোরান্ডা, বড়েইপানি, চাহালা, বৃন্দাবন পেরিয়ে জশিপুর। বম্বে হাইওয়ে। উত্তরে গেলে বাদামপাহাড় রেঞ্জ, দক্ষিণে করঞ্জিয়া। সিমলিপালের এটা মধ্য-উত্তর অংশ। কুমারী নয়। তবে কুমারসম্ভবের পার্বতী বলা যায় তাকে। দক্ষিণ এলাকাটা অবশ্য একেবারে কুমারী অরণ্য। কিন্তু আম-আদমির (আক্ষরিক অর্থে) প্রবেশ নিষেধ সেখানে। মানুষের অত্যাচারে অন্য জন্তুরা সব সেখানে পৌঁছে গেছে। হয়তো ভালো'ই আছে তারা। যতোদিন আমরা তাদের ভালো থাকতে দিই। চাহালায় ময়ূরভঞ্জের রাজামশায় একটা শিকারঘর বানিয়ে ছিলেন। এখন সেটা বনবাংলো। দু'দণ্ড নাটোরের ছায়া বুলিয়ে দেবে চোখেমুখে। তার পাশেই জনতার অতিথশালা। চারদিকে জঙ্গল, মাঝখানে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। পায়ে পায়ে ময়ূর ঘুরে বেড়ায়। আজ থাক। সিমলিপালকে নিয়ে অন্য একদিন। শাল-সেগুনের প্রেয়সীদের সময় দিতে হয়। সন্ধেবেলা স্নানশেষে চৌকাঠ ধরে যেমতি দাঁড়াবে, ত্রিভঙ্গে, ততক্ষণ...

".... এখনো বিকেল হলে জল থেকে উঠে আসো, আমি
বারান্দায় ব'সে ব'সে দেখি, দেখি অপরাজিতার
সুনীল বাঁধনে রোদ সবুজে সোনায় মিশে আছে,
সন্ধ্যাবেলা আসবে বলে কথা আছে, সন্ধ্যে হয়ে এলো।"
(রাজহাঁস/ ৯- মণিভূষণ ভট্টাচার্য)

(ক্রমশ)
0

জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে

Posted in


 ৭

"সুন্দরের কাছ থেকে ভিক্ষা নিতে বসেছে হৃদয়
নদীতীরে, বৃক্ষমূলে, হেমন্তের পাতাঝরা ঘাসে
সুন্দর, সময় হলে, বৃক্ষের নিকট চলে আসে
শিকড়ে পাতে না কান, শোনায় না শান্ত গান
করতপ্ত ভিক্ষা দিতে বৃক্ষের নিকট চলে আসে..."
(শক্তি)

কমলদা একবার লিখেছিলেন, সিংভূম পেরিয়ে গেলে কবিতার রম্যভূমি শেষ। বড়ো সত্যি কথা। দক্ষিণ পশ্চিম সিংভূমের সীমান্তের ঐ সাতশো নীল পাহাড় চূড়া আর নিচের দিকে তাকালে সবুজ বনজঙ্গলের মাঝে কেওঁঝরের বোলানি, মহিষানি, বড়বিলের লাল হিমাটাইটের খাদান। সাহেবরা তাকে ব্লাড ওরও বলে থাকে। প্রায় আবিরের মতই রাঙিয়ে দেয় সারা শরীর। মনও রাঙায়। নাহ, এ রাঢ় পৃথিবীর লাল ধুলো নয়। অন্য লাল। সব রক্তই কি একই রকম লাল? বৃক্ষের নিকটে কোন শান্তি, স্বস্তি পেতে যাওয়া? শ্যামলছায়া না বোধির শিকড়?

চিরিয়া মাইন্সের কাছে নদীতে এখন ব্রিজ তৈরি হয়ে গেছে, এবার সারান্ডা পেরোবো লাল মাটির পথ দিয়ে। আগে মাইন্সের মালগাড়ির গার্ডের সঙ্গে গপ্পো করতে করতে ঝিক ঝিক যেতুম সারান্ডার পার। এবার অন্য পথে।

চক্রধরপুর পেরোলেই একটু একটু করে জঙ্গল কাছে আসতে থাকে। প্রথমে ছাড়া ছাড়া, চাবি ঘুরিয়ে তানপুরো বাঁধার সময় সুর-বেসুর যেমন তার বেয়ে এক সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে, ঠিক তেমন স্লো মোশনে সবুজ বনস্পতিরা এগিয়ে আসে। লালমাটি, ধূসর ঘাসজমি, মোরমফেলা রাস্তা, খাপরাছাওয়া কুঁড়ে, ইতস্তত মোরগ, ছাগলছানা, শ্যামলা মানুষদের জটলার গুয়াশ পটচিত্র। শালবীথির ছায়া মেলা পথের পাশে অ্যালুমিনিয়মের হাঁড়ি সাজিয়ে বসে থাকা শাদা শাড়ি, উজ্জ্বল কৃষ্ণা ধরিত্রীকন্যারা। তারা হাঁড়িয়ার পসারিনী। সব কথাতেই হেসে আকুল, কিন্তু সহজাত সম্ভ্রমের কাচের দেওয়াল ভাঙেনা সচরাচর। সোনুয়া, টুনিয়া, গইলকেরা, পোসাইটা.... ছবির মতো ইস্টিশন সব, লালসবুজ পথে জলরঙে আঁকা লেভেল ক্রসিং, লাইনের দুধারে সাজানো গিট্টিপাথর-চুনাপাথরের বেড পেরিয়ে, সার সার কৃষ্ণচূড়ার আগুনলাগা বীথিকাদের দুলিয়ে দিয়ে, টানেলের পর টানেল আরপার, ছুটে যায় বি এন আর লাইনের ট্রেন। পোসাইটার পরেই এসে থামে আমাদের জঙ্গল রাজধানী, মনোহরপুর।

মনোহরপুর স্টেশনের বাইরেই একটা তেমাথা। উত্তরের রাস্তাটা নন্দপুর হয়ে চলে গেছে পোসাইটা আর অন্য রাস্তাটা সোজা পূবদিকে একটু গিয়ে ঘুরে গেছে দক্ষিণে। কোলেবিরা- হাটগামারিয়া শীর্ণ সড়ক। এই রাস্তাটা সমানে সঙ্গ দিয়ে গেছে কোয়না নদীটিকে। মনোহরপুরেই কোয়্না এসে মিলিয়ে গেছে কোয়েল নদীতে। এই কোয়েল দক্ষিণের কোয়েল। উত্তরে ডাল্টনগঞ্জে যে রয়েছে সে উত্তর কোয়েল। এই দুই কোয়েলের মতো মায়াময় স্রোতস্বিনী আমি তো আর দেখিনি কোথাও। খুব ক্লিশে উপমা বার বার ঘুরে ফিরে আসে, নদী আর নারী। হে শব্দফতুর কবি, নদীকে দেখো, নারীকে ছোঁও, ডুব দিও নিভৃতে, একা। তার পর ভেবে দেখো। কারো,কোয়েল, কোয়না, খড়কাই, সুবর্ণরেখা,.... অতো সহজে ধরা দেয় না।

সালাই পর্যন্ত গিয়ে হাটগামারিয়ার রাস্তা ছেড়ে ধরতে হলো ছোটা নাগরার ভাঙাপথের রাঙা ধুলোর সড়ক। কোয়না চলেছে পাশে পাশে। ছোটা নাগরা পেরিয়ে সোজা দখিনে উঠে গেছে পাহাড়ের পথ। কোয়নার উপর ব্রিজ পেরিয়ে বরাইবুরুর ঘাটি। এখান থেকে আবার সঙ্গী হবে কোয়নার সখি কারো।

এইখান থেকে শুরু হলো সারান্ডাসুন্দরীর চেহলসুতুন। অন্দরমহলের দেউড়ি। ঢুকতে গেলে পাসওয়র্ড লাগে। খুব ছোট্টো। লিখে রাখার দরকার নেই। বুকের ভিতর খুঁজলেই পাওয়া যাবে। 'ভালোবাসা'।


"দূরত্ব নিকটে আসে , আমি তার শরীরের বিচ্ছুরিত আলো
পান করি প্রাণপনে মদিরার মতো করে ক্রমশ নেশায়
ধবল হবার পর টের পাই সে আমার ঊরুর উপরে
হাত রেখে বলে 'নদী যখন সংকীর্ণ থাকে, তখনি তো তাকে
লোভনীয় মনে হয়....." (দূরত্ব- বিনয়)

ভূগোল বইয়ের বাইরে প্রথম গল্প শুনি তার। লীলা মজুমদারের 'আর কোনোখানে'। পতাকার তিরঙ্গার মতো পাশাপাশি তিনটে পাহাড়ের রেঞ্জ। গারো, খাসি, জয়ন্তিয়া। পশ্চিম থেকে পূবের দিকে টানা। সম্ভবত দেশের সব চেয়ে ঘন জঙ্গলহৃদয় রাজ্য। নাম মেঘালয়। কজনই বা জানে? সারা অবিভক্ত উত্তরপূর্বাঞ্চলের সদর ছিলো চেরাপুঞ্জি। এখন যার নাম সোহরা। সিলেটের সমভূমি ছাড়িয়ে সাহেবরা দখল করেছিলো শেষ খাসি সিয়েমের (রাজা) রাজপাট। নাম দিয়েছিলো চেরাপুঞ্জি, কমলার বাগান। তার পর ভিজতে ভিজতে অস্থির হয়ে সেখান থেকে সদর তুলে নিয়ে এলো শিলঙে। শিলং অনেকদিন ছিলো সারা উত্তরপূর্বের মহারানি। জঙ্গল যাদের টানে, সোহরা, মওসমাই আর মাওমলুহ, অরণ্যসাম্রাজ্যের টান তাদের ডুবিয়ে দেবে। মধ্য মেঘালয়, অর্থাৎ খাসিপাহাড়ের এলাকা পৌঁছোনো সহজ। কিন্তু মওসিনরাম রিজার্ভ ফরেস্ট মাশা'আল্লাহ। হায়, পূবদিকে গারোপাহাড়ের রাজ্যে বহিরাগত 'দিকু'দের জন্য দরজা খোলা থাকে না। গেটক্র্যাশ করে যাওয়া যায় বটে। কিন্তু দুঃসাহস করা খতরনাক হতে পারে। না হয় মাওসমাই, মাওলং, মওসিনরাম, মাওলিনলঙের জঙ্গলে ঘোরাফেরা করেই খুশি থাকি । সারাজীবনেও ফুরোনো যাবে না ঐ সবুজের টেবলস্প্রেড। 


গুয়াহাটি শহরটা আমার ভালো লাগে। নানা কারণেই। তা নিয়ে কথা পরে। এই শহরটার মেরুদণ্ড হলো জি এস রোড। গুয়াহাটি শিলং রোড। উত্তরে পল্টন বাজার থেকে দক্ষিণ পূর্বে গড়াতে গড়াতে জোড়াবট মেঘালয় বর্ডার। এবার সোজা দক্ষিণ। উমলিং পেরোলেই রাস্তার ডানদিকে নংখাইলেম অভয়ারণ্য শুরু হয়ে গেলো। শুরু হয়ে গেলো পাহাড়ের চড়াই। ফার্ন, কনিফার আর অর্কিডের রাজত্ব। মাওলিংখং এসে গেলো মানেই উমিয়াম লেক। 'স্বর্গ যদি কোথাও থাকে'র এলাকা। তার পরেই ক্যান্টনমেন্ট পেরিয়ে শিলং। লীলা মজুমদার বা অমিত রে'র শিলং তো আর নেই। তবু যা আছে, তাকে মাত দেয় কে? চারদিকেই পাহাড় আর কত রকম সবুজ। যেদিকেই যাই নানা মুডের জঙ্গল বিছিয়ে রেখেছে তাদের সংসার। কিন্তু যাবো তো নিশ্চিন্দিপুর। আরো দক্ষিণে। 


শিলং থেকে মাইলিয়েম হয়ে উমলিমপং। সেখান থেকে রাস্তা দুভাগ। ডানদিকে সোহরা-শেলা রোড আর বাঁদিকে ২০৬ জাতীয় সড়ক চলে যাবে সোজা ডাউকি বর্ডার। যেখান থেকে হাত বাড়ালেই জিলা সিলেট। জাফলং জিরো পয়েন্ট। ছবির মতো সুন্দর ডাউকি নদীর দেশ বদলে নামও পাল্টে যায়। গোয়াই। খাসি পাহাড়ের পূর্বদিক দিয়ে এঁকেবেঁকে গড়িয়ে যাওয়া এই রাস্তার ডানদিকে রঙ্গেন, লাইটিং, পংটুং নানা নামের জঙ্গলমহল। জঙ্গলের কী আর নাম হয়? নদীর মতো'ই। সির্ফ এহসাস হ্যাঁয় জো রূহ সে মহসুস করো। মানুষ নাম দেয় তার। জাত'ও দেয় নিজেদের মতন করে। 


বাঁদিকের রাস্তাটা ধরে এগিয়ে গেলেই উমটিংগর নদীর তন্বী ধারার উপর একটি মারাত্মক বাঁক। আড়াআড়ি পাহাড়ি নদীর ব্রিজ। শাদা রেল। নীচে খ্যাপা স্রোত ছোটোবড়ো পাথরের গোল গোল নুড়ি কাঁপিয়ে ছুটে যাচ্ছে মাওফলং বাঁধের দিকে। পশ্চিমে। এই রাস্তাটিই চলে যাবে সোহরারিম পাহাড়জঙ্গল। দুয়ান সিং সিয়েম ডিম্পেপ উপত্যকাটি এলেই টের পাওয়া যায় এদেশি পাহাড় আর জঙ্গলের আসল চেহারা। খুবলেই অরণ্যের দেশ। ঢেউয়ের মতো সবুজ পাহাড়ের স্রোত। তারা মাথায় উঁচু নয়। কিন্তু তাতার সৈন্যদের মতো ঘনপিনদ্ধ আর নানা শেডের সবুজ ইউনিফর্মে স্থির হয়ে অপেক্ষা করছে সমঝদারদের জন্য। উত্তর দিক থেকে রাশি রাশি চণ্ড পর্যটক সুমো আর কোয়ালিস সওয়ার, চোখের সামনে স্মার্টফোনে ভিডিও ধরতে বেশি ব্যস্ত। ঘড়ি মেপে ড্রাইভারকে তাড়া, আলো কমার আগে শিলং ফিরতে হবে। তার উপর গাড়ির জাম লাগলেই চিত্তির। কখনও কখনও তো রাত ভোর হয়ে যায়। তার উপর কখন যে ছিঁচকাঁদুনে বৃষ্টি শুরু হয়ে যাবে, তারও ঠিক নেই। হে অস্থির পথিকবর, একটু থামো। গাড়ি থেকে নামো। বাঁদিকের ঢাল রাস্তায় যতোদূর নেমে যাওয়া যায়, নেমে যাও। পা'য়ে জড়িয়ে যাবে সিলভার ফার্ণ, পিচার প্ল্যান্ট আর লেমন ঘাস। উপরি পাওনা তার সঙ্গে জড়াজড়ি করে থাকা জলবিন্দুর স্বগত আশ্লেষ।


জঙ্গল আসলে উমিয়াম থেকেই পুরোদস্তুর চার্জ নিয়ে নেয়। ঘরদোর, গাড়িবাড়ি, মানুষফানুস সব গৌণ লসাগু। থাকলেও হয়। না থাকলেই বোধ হয় ভালো। ঐ হ্রদটা একটা মায়াবী আয়োজন। শিলং ঢোকার আগেই প্রেমিকদের হাত বাড়িয়ে টেনে নেয়। সেখান থেকে শিলং হয়ে সোহরা-শেলা রাস্তার সব দিকই চোখ মজিয়ে রাখে। দক্ষিণের পথে অরেঞ্জ রুট নামের একটা সরাইখানার কাছে একটা হেয়ার পিন বেন্ড। পৌঁছে গেলো চেরাপুঞ্জি। 


গাড়ির ড্রাইভার আঙুলের কর গুণে গুণে বলে দেবে কোথায় কোথায় যেতে হবে। সে সব জায়গায় যাওয়াই যায়। যেতেও হয়। এতোদিন পরেও কিন্তু সোহরা পুরোনো হয়না। তার কৌমার্যের জাদু মানুষের পাপস্পর্শকে ধুয়ে দেয় অবিরল বৃষ্টিধারায়। এখানের অরণ্যচরাচর দেশের অন্য সব প্রান্ত থেকে এভাবেই আলাদা, অনন্য। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ভরে থাকা সবুজের ঢেউ হয়তো ধরাছোঁয়ার থেকে একটু দূর। সারান্ডার মতো, সাতপুরার মতো, পঞ্চগনির মতো বৃক্ষকে জড়িয়ে ধরা যায়না এখানে। কিন্তু তাদের সত্ত্বাকে অনুভব করা যায়। তাদের প্রাণস্পন্দনকেও। পরজীবী, এপিফাইটস, অর্কিড আর ফার্নবনের উপর ঝরে পড়ে কনিফারের পাতা গড়ানো টুপটাপ ফোঁটা। আনাচে কানাচে প্রপাত থেকে মুক্তধারায় উৎফুল্ল জলের ঝাঁপ। জামা ভিজে যাওয়া, সপসপে জুতো আর কুয়াশার ওপারে চশমার কাঁচে শুধুই ক্লোরোফিলের রামধনু। সাতটা রং'ই তো সবুজ। তবু তারা আলাদা। হরি কা ভেদ না পায়ো, কুদরত রঙ্গীবেরঙ্গী ।


".... করবো না অরণ্যে রোদন, না কী দরকার,
অরণ্য নিজেই আজন্ম রোদনে বাঁধা, তাই নিয়ে তার 
পাখিদের সাথে গেরস্থালী, গাছপালাদের ভরণপোষণ,
তাই নিয়ে তার রোদে পোড়া, জলে ভেজা, ঝড়ে ওপড়ানো......"
( অনাদি অরণ্য যেন-হাসান হাফিজুর রহমান)


(ক্রমশ)
2

জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে

Posted in

জংলা ডায়েরি- ৩
শিবাংশু দে


৫.

আরো উত্তরে যাবো? বদনাম পলামু? চান্দওয়া,লাতেহার, লেসলিগঞ্জ, গাড়ওয়া। বাঙালি জঙ্গলবিলাসী লেখকদের গল্পে বারবার এসে পড়ে। এখন তো সেসব মুক্তাঞ্চল। সরকারে দরকার নেই, তাই নিজের সুড়ঙ্গে থাকা বনজঙ্গল। তবু ডালট্নগঞ্জ থেকে দক্ষিণে যদি গাড়িতে বারোয়াডির দিকে, তবে মাঝামাঝি জায়গায় বেতলার উত্তর গেটটির একটু আগে নর্থ কোয়েলের উপর যে কালভার্ট ব্রিজটি আছে, সেখানে তিষ্ঠ ক্ষণকাল। বাঁদিকে পাহাড়ের আড়াল থেকে নদী নেমে আসছে আর ডানদিকে দুতিন কিমি যতোটা চোখ যায়, তার মধ্যে নদী চারটি বাঁক নিয়েছে। অমন বিপজ্জনক মনভোলানো বাঁক আমি দেশেবিদেশে কোনও সুন্দরীতমা নারীর শরীরেও কখনও দেখিনি। খাজুরাহোর পূর্ণদেহী পত্রলেখার পাথরের শরীরে তার একটু ছায়া পাওয়া যাবে হয়তো। তার কাছেই, বাঁদিকের পাহাড়ে পায়ে পায়ে উঠে গেলে কেঁচকি বনবাংলো। অরণ্যের দিনরাত্রি, মনে পড়ে?

তবে 'আহা' বলি, বলতে হয়। আমাদের দলমা পাহাড়, দলমা রেঞ্জ। নিজের বাড়ি। সিংভূম আর মানভূমের মাঝখানে আড়াল করে রেখেছে, সবুজে সবুজ তুমি নীলিমায় নীল। সোজা উত্তরে মানগোয় পেরিয়ে যাওয়া সুবর্ণরেখা। জাতীয় সড়ক ৩৩। আসনবনি থেকে ডান দিকে গাড়ির রাস্তা। খানিকটা অল্প চড়াই। হরিণবাগান, আদিবাসী গ্রাম। ফাগুন আসার আগেই চারদিকে আগুন জ্বলছে পলাশের ডালজোড়া। হেঁটে যেতুম তিরিশ বছর আগে, এখন জীপে। চড়াই, চড়াই, রাস্তা চড়ছে। একদিকে খাই, অন্যদিকে বনময় মাটির উড়ান। শালই রাজা, সঙ্গে আছে বাবলা, শিরিস আর কুলের বন। টানা ফুল ফুটে আছে বুগেনভিলিয়া, দশটা রঙে। মাটির কাছে পুটুস আর আকন্দ আর আকাশছোঁয়া শালপাতার কাঁচা সবুজ। বর্ষাকালে এখানে হাতীর সাম্রাজ্য, আসা মানা। বসন্তকালেই ডাকে এর পূর্ব থেকে পশ্চিমে টানা বনভূমি। পূবদিকে বেলপাহাড়ি, ঝরি, রানিবাঁধ আর ঝিলিমিলি। পশ্চিম পারে দলমা রেঞ্জ মিলে যাচ্ছে চান্ডিল-গামারিয়া রেঞ্জের সঙ্গে। গড়াতে গড়াতে জঙ্গল পৌঁছে যায় সারান্ডা রেঞ্জ। যেতে পারি, কেন যাবোনা? বনবিভাগের বাংলো পিন্ড্রাবেড়ায়, একটু নীচুতে। কিন্তু থাকা যায় ভালো। বেশি বায়নাক্কা না থাকলেই হলো। ডিমের ঝোল আর গরম রুটি। ফাস্ট কেলাস।ঝোলা বারান্দায় বসে দূরে আঁধারে জামশেদপুর শহরে আলোর অমরাবতী। নীল, হলুদ, সোনালি, রুপোলি। গান শোনাবেন রাশিদ খান আর আখতারিবাই। রামকুমারই বা বাদ থাকেন কেন? বাদ যাবে " আজ জ্যোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে।" বাঙালির মুনলাইট পিকনিকের গান। এতোদিনেও মুগ্ধা জননীর সন্তানেরা গান শুনতে শেখেনি। ভোরবেলা পাকদন্ডি ধরে উঠে যাওয়া একটু দক্ষিণে টাটাবাবার অতিথশালায়। ফির্দৌসে জমিনস্ত। হাত বাড়ালেই আকাশ আর নীচে নেমে যাওয়া স্তরে স্তরে সবুজঘেরা হাজার রঙের ফুলের আগুন। অগোছালো, অসংসারী, অগৃহিণী বনকুমারীর ঘরসংসার। ঢুকতে গেলে পাসপোর্ট লাগে। ব্যাংকের পাসবুক বাড়িতে রেখে আসতে হয়। সবাই পারেনা। মধ্যরাতে আকণ্ঠ দারুপান করে অতিথশালার টানা বারান্দায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা ম্যানেজারসাহেব, তোমাকে আরো একবার জন্মাতে হবে হে।

৬.

"..... বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে,
পরাঙ্মুখ সবুজ নালি ঘাস দুয়ার চেপে ধরে...."

বাংলা কবিতার সঙ্গে সম্বন্ধ নেই এমন বাঙালিরাও এই দুটো লাইন কবিতা শুনলে ঠিক চিনতে পারেন,

তার পর সেই চিরন্তন প্রশ্ন, অবনী কী আমি ? সে কী বাড়িতে আছে? জঙ্গল কি আদৌ 'বাড়ি' হতে পারে? আমার উত্তর, একশোবার হবে। আমি তো সেখানেই থাকি। এমন 'বাড়ি' ছেড়ে কোথায় আর যাবো? এমন বাড়ি তো আমার আরো আছে। সেই কোথায়, কতোদূরে চেরাপুঞ্জি, মোসিনরাম বা বর্ষাকালে কোহিমার জাপফু পাহাড়। আর প্রায় 'পৃথিবী'র অন্যপ্রান্তে পশ্চিমঘাটে ইদুক্কি মুন্নারের কাছে নীলগিরির এই এরাভিকুলম জাতীয় অরণ্য। এখানে রয়েছে হিমালয়ের পর দেশের সব চেয়ে উঁচু আনামুড়ি গিরিশিখর (২৬৯৫ মিটার)। আর 'শোলা'বন। মালয়ালিতে 'শোলা' মানে ঝোপঝাড়ের জঙ্গল। ইংরিজিতে যাকে বলে ট্রপিক্যাল মন্টেন। যতোদূর চোখ যায়, পাহাড়ে, সমতলে ছড়িয়ে আছে ঝোপজমি, ঘাসজমি আর চা-বাগান। রয়ে্ছে লোক্কোম জলপ্রপাত আর অসংখ্য বিরল বন্যপ্রাণী। এই পাহাড়-অরণ্যময় দৈবী সবুজের রাজপাটকে ঘিরে আছে পশ্চিমে পেরিয়ার নদী আর পূর্বদিকে কাবেরী। এখানে সত্যিই মেঘ মানুষের চারপাশে গাভীর মতো চরে বেড়ায়। না চাইতেই ভিজিয়ে দিয়ে যায়। আর আদিগন্ত সবুজ ঘাস, আমাদের তাকাবার অপেক্ষায় ভিজে ভিজে চোখ নিয়ে চেয়ে থাকে। কবি'র অনন্য কল্পনাও যেন প্রকৃতির আয়োজনের বিশালত্বে ফিকে পড়ে যায়।

বাঙালি পর্যটকের পৃথিবী উত্তরে মানালি'র বরফ পাহাড় আর দক্ষিণে মুন্নারকে দিয়ে ঘেরা যেন। মাঝখানে রয়েছে আরো অনেক, অন্তহীন মায়াবী সুন্দরের উপনিবেশ। আমাদের পশ্চিমঘাটে সেই রত্নগিরি থেকে প্রকৃতি দু'হাত ভরিয়ে সুন্দরের সর্বনাম ছড়াতে ছড়াতে নীলগিরি পাহাড়শ্রেণী হয়ে হয়ে নেমে আসছে। তটীয় কর্ণাটকের মঙ্গলুর, উদিপি, মারকারা হয়ে কেরালার ওয়াইনাড়, কোঝিকোড়, পালাক্কাড় হয়ে আরো দক্ষিণে এই ইদুক্কি। সেই উর্দু শ্যয়েরটা মনে পড়ে যায়। এতো সৌন্দর্য দেখার জন্য মাত্র দুটো চোখ যথেষ্ট নয়। অ্যায় খুদা, আরো কয়েকটা চোখ দাও আমাকে, নয়তো কতো কিছু অদেখা থেকে যাবে। কিন্তু যে চোখ এতো কিছু দেখে, তাতো ভিতরে লুকিয়ে। তাকে কী বাইরে ঠাহর করা যায়? এই যে নীলগিরি টানা পাহাড়, এর কাছে মেঘ এসে বলে, বারবারই বলে ' যাবো যাবো', কিন্তু যায়না। যেতে পারেনা। ওড়নার মতো জড়িয়ে থাকে পাহাড়ের সারা গায়ে।

গাড়ি তো নামিয়ে দেবে একটা পার্কিং ঘাটে। তার পর নিজেকে নিয়ে উঠে যাওয়া ঘোরানো পাহাড়ি পথে, জলের সঙ্গে, মেঘের সঙ্গে খুনসুটি করতে করতে। যতো উপরে যাওয়া যায়, মেঘপাহাড় ততো কাছে আসে। শুধু দেখে যাওয়া। বলার মতো কথা কিছু জমতে পারেনা। নৈঃশব্দ্যই শুধু জানাতে পারে আসল ভালোবাসার চুপকথা। মেঘ ঝরে যাচ্ছে, জল ঝরে যাচ্ছে, ঝরে যাচ্ছে পাগলা ঝোরা আর আকাশ ছোঁয়া জলপ্রপাত। কালোপাথরের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রুপোলি জেদি জলের ছোটোবড়ো স্রোত। পাহাড়ে আর পাকদণ্ডি নেই। সবই বাঁধানো পিচের পথ, সিনেমাদুহিতার গণ্ডদেশের মতো মসৃণ। চা-বাগানের ছোটো ছোটো লরি আর ট্র্যাক্টর । নয়তো বনবিভাগের সবুজ জীপ। ফসিল প্রদূষণ ঐটুকুই। বাকি শুধু অক্সিজেন।

হে পথিকবর, কোথাও একদণ্ড দাঁড়িয়ে চোখ ছুটিয়ে দাও। দূরে মেঘের আড়ালে আনামুড়ি শিখরের লুকোচুরি দেখো। নয়তো মাইলের পর মাইল শ্যামলসুধায় টগোবগো উপত্যকা। চারদিকে তিনচারটে জাতীয় অরণ্যপার্ক। মানুষের সঠিক স্পর্শ প্রকৃতিকে কীভাবে আরো রমণীয় করে তুলতে পারে, তার কিছু মিসাল এখানে দেখা যাবে। আমাদের দেশের পক্ষে বিরলই বলা যায়। বনস্পতি থেকে ফার্ন/ অর্কিড, নীলগিরি হরিণ থেকে অসংখ্য রংবেরঙের পাখি, আকাশছোঁয়া পাহাড় থেকে পায়ের তলার ঘাসজমি, সব্বাই সেজেগুজে অপেক্ষা করে আছে সেই সব মানুষদের জন্য, যারা তাদের মর্যাদা দিতে পারে।

চলত মুসাফির, মোহ লিয়া রে পিঁজরেওয়ালি মুনিয়া.....

(ক্রমশ)
2

জংলা ডায়েরি - শিবাংশু দে

Posted in

জংলা ডায়েরি
শিবাংশু দে


মনে পড়ে যায় অন্ধ্রপ্রদেশের মদানাপল্লির ঘন জঙ্গলে পারমিট না নিয়ে ঢুকে পড়া আমাদের 'জনের। চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছিলুম পাহাড়ের ধারে ধারে পাকদন্ডি বেয়ে। উপরে উঠতেই রেঞ্জার সাহেব কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে...
-পরমিট লাইয়ে...
-নহি হ্যাঁয়....
-তব তো চলান করনা পড়েগা....
-উসকে পহলে ডি এফ সাহব সে একবার মিলা দিজিয়ে....
-কিঁউ? জানতে হ্যাঁয় ক্যা উনকো?
-নহি জানতে হ্যাঁয়, জান জায়েঙ্গে....
-উওহ আজ হেডকোয়াটার্স মেঁ নহি হ্যাঁয়....
-তো কম সে কম আপকা ওয়াকিটকি কা রেঞ্জ তক লে চলিয়ে, পারমিট লে লেঙ্গে....
-কওন দেগা?
-চলিয়ে পহলে, তব না বতায়েঙ্গে.....
জঙ্গলের পথে বারো কিমি রেঞ্জারের জীপে আমরা তিনজন....
খোশমেজাজে গাছপালা দেখতে দেখতে গপ্পো করছি। রেঞ্জার আড়চোখে তাকাচ্ছে। তখনও জঙ্গলে মাও'ইস্টদের বোলবালা হয়নি। 
-অপলোঁগ ক্যায়সে আয়ে হ্যাঁয়?
-গাড়ি হ্যাঁয়, গেট কে বাহর...
গাড়ি এসে থামে রেঞ্জারের অফিসে। ভিতরে যাই। বেঞ্চিতে বসি। মুন্সিজি চালানের খাতা বার করে। বলি, অভি কুছ মত চড়াইয়ে...
-ক্যা ডি এফ সাব সে বাত করনা হ্যাঁয়?
-নহি, থোড়া রায়সাব কো লগাইয়ে...
-কওন রায় সাব?
-চিফ কনজারভেটর ...
চকিতে পট পরিবর্তন। 
-উনকো ক্যয়সে জানতে হ্যাঁয়....
-অ্যায়সে হি....
------------
রায়দা পঁয়ত্রিশ বছর অন্ধ্রপ্রদেশে, কিন্তু এখনো বাংলাকবিতা স্মৃতি থেকে ঝরঝর করে বলে যান আর রবীন্দ্রসঙ্গীতে আধডোবা বয়া। ফোন যায়। তাঁর পি এস ধরে। তারপর আমাদের পালা....
-রায়দা, শিবাংশু...
- মোলো যা... তুমি কোন চুলোয় এখন...
-এই আপনার গেস্ট হয়ে জঙ্গল দেখতে এসেছিলুম। আপনার বরকন্দাজরা কাগজ চাইছে, না দিলে হাজত বাস.....
-ডি এফ 'কে ফোনটা দাও....
-সে মক্কেল নেই এখানে, রেঞ্জার আছে....
-তাকেই দাও....
রিসিভারটি বাড়িয়ে দিই। সাহেব সেটিকেই স্যালুট করে। কী কথা হয় জানিনা। ফোন রেখে দেয়। তারপর বিগলিত হয়ে জিগায় চা খাবো না কাপি? নারে বাবা কিস্যু খাবোনা.... রোদ চড়ে গেছে, এবার ফিরবো। তখন আবার কমলি না ছাড়ার অ্যান্টি ক্লাইম্যাক্স।
একেই বলে ঠাকুর বলেছেন স্বজনপোষণ  অথবা ক্ষমতার অপব্যবহার।

 
----------------
রজনীগন্ধার আড়ালে কী যেন কাঁপে,
কী যেন কাঁপে 
পাহাড়ের স্তব্ধ গভীরতায়
তুমি এখনও এলেনা
সন্ধ্যা নেমে এলো-পশ্চিমের করুণ আকাশ,
গন্ধে-ভরা হাওয়া
আর পাতার মর্মরধ্বনি
(বিরহ- সমর সেন)
সিমলিপাল-জোরান্ডার নিবিড় সবুজ আর ভেজা স্নিগ্ধতা ছেড়ে আরো দক্ষিণে পৌঁছে যাওয়া মহানদীর টানা গর্জ, সাত ক্রোশ জুড়ে। হঠাৎ মনে হতে পারে এক অলীক স্বর্গ। নাম সাতকোশিয়া' জঙ্গল। নদী বলে নদী। লালমাটির খাড়াই পাড় থেকে উঁকি দিয়ে নীচে নদী দেখা। পশ্চিমের দুটো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে আসছে মহানদী। কী জাঁক তার। গেরুয়া জল, ছুটে যাচ্ছে দক্ষিনে, বুলেট ট্রেনের ইঞ্জিন, তার গতি, উচ্ছলতা , অহংকারে মশমশ করে। ঠিক উল্টোদিকে ক্রসগেট। বাঘবন্দী জঙ্গল সেটা। বাঘের ছবি দিয়ে লেখা আছে, " তোমরা আমাকে দেখতে পাচ্ছো না, কিন্তু আমি তোমাদের দেখছি। সাবোধান হে ..." চারদিকে শাল, গামার, সেগুন, কাঁঠাল, অর্জুন বনস্পতি। পাতার পর পাতা দিয়ে ঢেকে দিচ্ছে সূর্যের ঝলসানো চোখ। বারবার উড়ে আসে মেঘের ঝাঁক। এক পশলা, দু পশলা, তিন পশলা। শরীর ভিজিয়ে ফিরে আসা ছোটকেই উপত্যকা। যেখানে মেঘ আর পাহাড় হানিমুন যুগল হয়ে নিজেদের বাঁধছে, ছাড়ছে, মিশে যাচ্ছে একে অপরে। কে দেখলো, না দেখলো, পরোয়া নেই। 
-----------------------------------------
আরো জঙ্গল ? তবে ডালট্নগঞ্জ থেকে বেতলা রেঞ্জের দিকে চলে যান। অথবা রাঁচির দিক থেকে লোহারডাগা হয়ে নেতারহাটের দিকে। রাঁচি থেকেই আবার ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ যাওয়ার পথ। তবে ম্যাকক্লাস্কিগঞ্জ এখন যতোটা কল্পনায় ততোটা বাস্তবে নেই। যদিও রাজার রাজা হচ্ছে সারান্ডা রেঞ্জ। এর মধ্যে পাঁচটা ফরেস্ট ডিভিজন রয়েছে। মনোহরপুর বা গুয়া হয়ে গেলে কাছে হবে। গুয়ায় স্যার বীরেনের একটা গেস্ট হাউস আছে, যেটার সাজসজ্জা লেডি রানু নিজে করেছিলেন। প্রথমবার দেখে আমি একেবারে ফেলাট। মেঘাতুবুরুতে সেলের মেঘা অতিথিশালা অপূর্ব। বৃষ্টির দিনে জানালা খুলে রাখলে ঘরের ভিতর মেঘ লুকোচুরি করে। আর বাড়িটির বাগানে কিরিবুরুর সর্বোচ্চ শিখরটি যেখানে দাঁড়ালে আমার গ্রাম সিংভূমের সীমান্তে সাতশো পাহাড়ের নীল মিছিল সিম্পলি ডুবিয়ে দেয়। হায়, হায়। সাতশো পাহাড় মনে পড়লেই গণেশ পাইনের রানি' সঙ্গে শক্তি' কবিতা, গপ্পো আর বনবাংলোর রাত মনে পড়ে যায়। তাও তো মনোহরপুর থেকে বিসরা, কোয়েল, কারোর গপ্পো বাকি থেকে যাচ্ছে। নতুন শালের সারি সারি বনসৃজন। রেল কন্ট্র্যাকটরদের করাত কলে জঙ্গলের গুষ্টিনাশ হয়ে গেছে। সেখানে একজন ছিলেন মহান ঠিকাদার বাবু রামস্বরূপ সিং। চাইবাসায় থাকার সময় আমাদের জামাই আদর করে নিয়ে আসতেন তাঁর ক্যাম্পে। মনোহরপুর থেকে পোড়াহাটের অন্ধ জঙ্গলে। সে রামও নাই, সে জঙ্গলও নাই। ঠিকাদার, চোরাচালান, পলিটিক্যাল মাফিয়া, সবাই মিলে সিংভূমের সম্ভ্রম লুট করে নিয়ে গেছে। 







(ক্রমশ