1

সম্পাদকীয়

Posted in



সে একটা সময় ছিল বটে! এক অদ্ভুত সুন্দর সুবাস চেতনা ছাপিয়ে ছড়িয়ে পড়তো আশপাশে। কেউ যেন আমাদের কানে কানে বলে যেতো দুর্গাপুজো এসেছে। বাতাসে তারই গন্ধ। উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে উঠে যাওয়ার পর হাতে আসত প্রফেসর শঙ্কু, ফেলুদা কিংবা কাকাবাবুর সাম্প্রতিকতম কীর্তিকলাপের কাহিনী। প্রিয়জনের স্পর্শমাখা উপহার নিয়ে উৎসব উদযাপনের হিসেবনিকেশে মাতোয়ারা হয়ে উঠতাম আমরা। তখনও কোনও তকমা পাননি দুগ্গা ঠাকুর। তিনি ছিলেন আমজনতার। তখনও আমাদের বলে দেওয়া হয়নি কীভাবে কাটাতে হবে এ ক'টা দিন। কেউ ভাবেনি বোধনের আগেও প্রাক - বোধন হতে পারে। কেউ জানতো না কোনও দেশে, কোনও কালে সরকার সর্বজনীন কোনও উৎসব পরিচালনা করেছে বলে। জানলে হয়তো প্রায় আড়াইশো বছর আগে যে বারোটি যুবক এক হয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন প্রথম যে বারোয়ারি দুর্গাপুজোর, তার নামকরণই অন্যরকম কিছু হতো। হয়নি কারণ মগজ ধোলাই বলে কোনও শব্দকে আমরা তখনও আপন করে নিইনি এইভাবে। আমাদের তখন কোনও উৎসব অভিভাবকও ছিলেন না। পুজো তবুও তো পুজো। এই মাপের কোনও সামাজিক উৎসবের তুলনা মেলা ভার। এমন অনন্য সামাজিক মেলবন্ধনের মর্যাদা রক্ষার দায় আমাদের সকলের।


ভালো থাকুন। ভালো রাখুন


শারদ শুভেচ্ছা সকলকে

1 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




আমাদের ক্ষমা কর বিলকিস - আমরা হেরে গেছি।


স্বাধীনতা দিবসের ঘটনাটি---

বিগত ১৫ই অগাস্টে আমাদের দেশ ৭৬তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে ব্যস্ত ছিল। সেদিন প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লার র‍্যামপার্ট থেকে দেশবাসীকে আহ্বান জানালেন নারীশক্তির সম্মান রক্ষার্থে আমরা যেন দৈনন্দিন আচারব্যবহারে মেয়েদের অপমান অনাদর করার অভ্যাস ত্যাগ করি, ঠিক তখনই তাঁর গৃহরাজ্য থেকে আসা একটি খবর এবং কিছু ভিডিও ফুটেজ আমাদের হতবাক এবং বিষণ্ণ করল।

একটি গণধর্ষণ, সেই পরিবারের চোদ্দ জনের নির্মম হত্যা এবং ৩ বছরের মেয়েকে পাথরে আছড়ে মারার অপরাধে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা প্রাপ্ত ১১ জন অপরাধীকে গুজরাত সরকারের নির্বাচিত জেল পরামর্শদাতা প্যানেল, তাদের ১৪ বছর অব্দি কারাবাস পূর্ণ হওয়ায়, নিঃশর্ত মুক্তি দিয়েছে।

আমরা আরও হতবাক, যখন তারা গোধরা উপ-জেল থেকে বেরিয়ে এল তখন তাদের ফুল-মালা-চন্দনে বন্দনা করে যেন বীরের সমবর্দ্ধনা দেওয়া হল। এই কাজটি যারা করলেন তাদের মধ্যে আছেন তাদের আত্মীয় পরিজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং স্থানীয় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ।

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের দফতরে ফুল মালা পরিয়ে যেভাবে ওদের সম্মানিত করা হয়, তার ভিডিও সবাই দেখেছেন।[1]

অপরাধী শৈলেশ ভট্ট বলেন গ্রেফতারের সময় উনি বর্তমান শাসক দল বিজেপিরর জিলা ইউনিটের পদাধিকারী ছিলেন। রাধেশ্যাম শাহ বলেন –আমরা নির্দোষ, মতাদর্শএর কারণে ফাঁসানো হয়েছে।

গুজরাতের বিজেপি বিধায়ক এবং দশজনের প্যানেলের সদস্য সি কে রাউলিজী বলেন—কয়েকজন অভিযুক্ত তো জাতিতে ব্রাহ্মণ, তাঁদের উত্তম সংস্কার রয়েছে। [2] এদের পক্ষে এমন জঘন্য অপরাধ করা কঠিন। ওঁর মতে, ওঁরা হয়ত তাদের পুরনো রাজনৈতিক কাজকর্মের জন্য শাস্তি পেয়েছেন।

তাহলে কি আমাদের বুঝতে হবে যে গোধরা পরবর্তী দাঙ্গায় আদৌ বিলকিস গণধর্ষণের স্বীকার হন নি? তাঁর তিন বছরের মেয়ে সালেহাকে কেউ আছড়ে মেরে ফেলে নি? তাঁর সামনে উন্মত্ত ভীড় তাঁর পরিবারের চোদ্দজনকে নির্মম ভাবে হত্যা করেনি? সিবি আই , হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্ট সবাই এত বড় ভুল করে নির্দোষদের শাস্তি দিয়েছে!

আমাদের বিবেক পাগল মেহের আলি হয়ে ঘুরে বেড়াবে আর বলবে – তফাৎ যাও! সব ঝুঠ হ্যায়!

কিন্তু গুজরাত সরকারের অতিরিক্ত মুখ্য সচিব (গৃহ) মিঃ রাজ কুমার সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে সবকিছু নিয়ম মেনে এবং আইন মেনে হয়েছে। সুপ্রীম কোর্ট নির্দেশ দিয়েছে। সেই মত প্যানেল গঠন করে তার অনুশংসা অনুযায়ী রাজ্য সরকার বন্দীদের ছেড়ে দিয়েছে।

আমরা একবার দেখে নেব ঘটনা-পরম্পরা এবং সুপ্রীম কোর্ট ঠিক কী বলেছে। তারপর দেখব, রেমিশন বা শাস্তি মকুব করার অধিকার কার আছে এবং কী তার গাইডলাইন।

বিলকিস বানুর ভয়ংকর সত্য

গুজরাতের দাহোদ জেলার একটি গ্রামে পৈতৃক বাড়িতে থাকেন ২১ বছরের বিলকিস বানু ।বাবা বাড়ি বাড়ি দুধের যোগান দেন।

সন ২০০২এর ২৭শে ফেব্রুয়ারি। সাবরমতী এক্সপ্রেসের এস-৬ কামরায় গোধরা স্টেশনে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। তারপরে সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বীভৎস সাম্প্রাদায়িক দাঙ্গা গুজরাত রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।

দাঙ্গার আঁচের উত্তাপ টের পেয়ে বিলকিস এবং তাঁর পরিবারের লোকজন পরের দিনই বসতবাটি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালাতে থাকেন। কিন্তু মার্চ মাসের ৩ তারিখে দুটো গাড়ি ভরে ধাওয়া করে আসা ২৫/৩০ জনের উন্মত্ত ভীড় তাদের কেশরপুর গাঁয়ের কাছে ধরে ফেলে। গর্ভবতী বিলকিস গণধর্ষণের শিকার হলেন। তাঁর চোখের সামনে তিন বছরের মেয়ে সালেহাকে পাথরে আছড়ে মেরে ফেলা হল। তাঁর চোখের সামনে নিহত হলেন পরিবারের সবাই, চোদ্দ জন। শুধু বিলকিস কোন মতে প্রাণে বাঁচলেন, কিছু সাধারন মানুষের সাহায্যে।

পরের ঘটনাগুলো

· দু’দিন পরে রিলিফ ক্যাম্পের আশ্রয়ে থেকে বিলকিস পুলিশের কাছে তাঁর জবানবন্দী দিলেন।

· ৬ নভেম্বর, ২০০২। পুলিশ আদালতে কেস বন্ধ করার আর্জি দিলে আদালত খারিজ করে তদন্ত চালাতে বলল।

· ফেব্রুয়ারি, ২০০৩। পুলিশ ফের কেস বন্ধ করার আর্জি দিলে ম্যাজিস্ট্রেট সেটা মেনে নিলেন।

· বিলকিস হাল ছাড়েন নি। সুপ্রীম কোর্ট ৬ ডিসেম্বর, ২০০৩ তারিখে সিবিআইকে তদন্ত করতে বলল।

· অগাস্ট ২০০৪। সুপ্রীম কোর্ট ‘ফেয়ার ট্রায়াল’ সুনিশ্চিত করতে গুজরাতের বদলে মুম্বাইতে বিচার শুরু করতে বলল। অভিযুক্তরা গ্রেফতার হয়ে বিচার চলাকালীন মুম্বাইয়ের জেলে রইল।

· ২১ জানুয়ারি, ২০০৮। মুম্বাইয়ে সি বি আইয়ের স্পেশাল কোর্ট গণধর্ষণ, হত্যা, দাঙ্গা আরও অনেক অভিযোগের বিভিন্ন ধারায় ১৩ জনকে দোষী সাব্যস্ত করল এবং তাদের মধ্যে ১১ জনকে আজীবন কারাবাসের শাস্তি ঘোষণা করল।

· মে, ২০১৭। মুম্বাই হাইকোর্ট অভিযুক্তদের আপীল খারিজ করে শাস্তির আদেশ বহাল রেখে দিল। উলটে অন্য ৭ জনকে যথেষ্ট প্রমাণাভাবে ছেড়ে দেওয়ার আদেশও খারিজ করল।

· জুলাই ২০১৭। সুপ্রীম কোর্ট হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপীল খারিজ করল এবং ৩ এপ্রিল, ২০১৯ তারিখে গুজরাত সরকারকে নির্দেশ দিল বিলকিস বানুকে ৫০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে এবং চাকরি ও একটি বাড়ি বানিয়ে দিতে।

· বিলকিসের অ্যাকাউন্টে ৫০ লাখ টাকা এসেছে, বাড়ি ও চাকরি নয়।

বিলকিস ভাবলেন ন্যায়বিচারের জন্যে তাঁর লড়াই এবার শেষ। পরের মেয়েদের পড়াশুনো ইত্যাদি করিয়ে উকিল বানানোর স্বপ্ন দেখছিলেন। নিজের গ্রাম থেকে ৩৩ কিলোমিটার দূরে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন।

কিন্তু এ’বছর স্বাধীনতা দিবসে হঠাৎ অভিযুক্তরা ছাড়া পাওয়ার খবর পেয়ে উনি দিশেহারা। বলছেন আমি যে বিশ্বাস করেছিলাম। দেশের আইন ব্যবস্থা ও সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি ভরসা করেছিলাম।[3]

গুজরাত সরকারের কাছে তাঁর একটিই আর্জিঃ আমাকে নির্ভয়ে শান্তিতে এবং সসম্মানে বাঁচার অধিকার ফিরিয়ে দাও।



এবার আমরা একটু অভিযুক্তদের পরিচয় দেখব।

ওরা সবাই প্রতিবেশি।

· রাধেশ্যাম শাহ, উকিল এবং চুড়ির দোকান, বাড়ি বিলকিসের মাত্র ৫০ মিটার দূরত্বে ।

· নরেশ কেশরভাইঃ সাক্ষীরা দেখেছেন দাঙ্গার সময় পেট্রলের ক্যান হাতে।

· প্রদীপ মোডিয়াঃ মসজিদের পাশের দোকানটি তার।

· যশবন্ত নাই, গোবিন্দ নাই, নরেশ মোডিয়াঃ দুই ভাই এবং তাঁদের কাকা। এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জোর করে মহিলার কাপড় ছিঁড়ে ধর্ষণ করার।

· শৈলেশ ভাটঃ বিলকিসের ৩ বছরের মেয়ে সালেহাকে পাথরে আছড়ে মেরে ফেলার অভিযোগ। ইনি বিজেপি কার্যকর্তা। প্যারোলে জেল থেকে বেরিয়ে দাহোদে বিজেপির সভায় মঞ্চে থাকার লিখিত অভিযোগ রয়েছে।

· বিপিন জোশীঃ গ্রামের ডাক্তার, বিলকিসের বাবার চিকিৎসা করেছেন।

· রাজুভাইঃ ঘটনার এক দশক আগে থেকেই গ্রামের দোকানদার।

· বক্কাভাই বোহানিয়াঃ হাতে কুড়ুল ছিল।

· রমেশ চন্দানাঃ সরপঞ্চের স্বামী। যে দুটো গাড়িতে চড়ে গুণ্ডারা বিলকিসদের ধাওয়া করেছিল তার একটির রেজিস্ট্রেশন স্ত্রীর নামে।

সবাই প্রতিবেশী, অনেকে একই পরিবারের। তাহলে কি বুঝতে হবে ঘৃণার শক্তি অপরিসীম?

রেমিশন বা শাস্তির বকায়া সময় মকুব বা কম করাঃ

বলা হয় যে আদালতের কোন রায় বদলে দেবার অধিকার সরকারের বা প্রশাসনের নেই, কিন্তু রেমিশন বা শাস্তির অবধি মকুব বা কম করার অধিকার আছে। তাই ফাঁসির আসামী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আর্জি দেয়। সংবিধানে রাজ্যপালকেও সেই ক্ষমতা দেওয়া আছে।

এর মানে এই নয় যে অপরাধীকে নির্দোষ বলা হল। এতে শুধু শাস্তির পরিমাণ কিছু শর্তের বিবেচনায় কম করা হয়।

আর জেলের ভেতরে লক্ষ্মীছেলে হয়ে থাকলে জেল কর্তৃপক্ষ, বকলমে রাজ্য সরকার, হিসেব করে জেলের মেয়াদ কমাতে পারে। ১৫ই আগস্ট , ২৬ জানুয়ারি বা গান্ধীজির জন্মদিনে সেসব হিসেব করে বিভিন্ন সময়ে অনেককে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু সেটাও মর্জিমাফিক নয়। তারও লিখিত যুক্তি দেখাতে হয়।



ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড (সি আর পি সি) ধারা ৪৩২ অনুযায়ী রাজ্যসরকারকে রেমিশনের অধিকার দেওয়া হয়েছে। তবে ধারা ৪৩৩ বলছে যে হত্যা বা যাবজ্জীবন কারাবাসের অপরাধীর ক্ষেত্রে রেমিশনের আবেদন অন্ততঃ ১৪ বছর জেলে থাকার পরই বিবেচনা করা যেতে পারে।

এর থেকে অনেকের ধারণা, যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি মানে জেল থেকে ১৪ বছর পরে ছাড়া পাওয়া। কিন্তু এটা ভুল। সুপ্রীম কোর্ট বারবার বিভিন্ন রায়ে বলেছে যে যাবজ্জীবন মানে ‘যাবজ্জীবন’, অর্থাৎ অপরাধীর মৃত্যু পর্যন্ত।

সুপ্রীম কোর্ট একটি মামলায় রেমিশনের যোগ্যতা বিচারে পাঁচটি লক্ষণ দেখার কথা বলেছে।[4]

I. অপরাধটি একান্ত ব্যক্তিগত, নাকি সমাজকে প্রভাবিত করতে পারে,

II. ছাড়া পেলে আবার অপরাধ করার সম্ভাবনা,

III. অপরাধীর অপরাধ করার ক্ষমতা অবশিষ্ট আছে কিনা,

IV. আর জেলে আটকে রেখে কোন লাভ হবে কিনা,

V. পরিবারের আর্থিক অবস্থা।

রেমিশনের জন্যে কারা বিবেচনার যোগ্য কারা নয়, এ ব্যাপারে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের ও কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত গাইডলাইন রয়েছে। সেগুলো সময় সময় বদলেও যায়।

তিনটি প্রাসঙ্গিক গাইডলাইন

গুজরাত সরকার ১৯৯২ সালে একটি গাইডলাইন বানায় তাতে অপরাধের গুরুত্ব, বয়স, জেলে আচার আচরণ ইত্যাদি বিবেচনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে রেমিশনের আবেদন অগ্রাহ্য করা উচিত এ নিয়ে কোন কথা বলা নেই।

সুপ্রীম কোর্ট ওই গাইডলাইন ২০১২ সালে খারিজ করে দেয়। কেন্দ্র সরকার সেই নির্দেশ সব রাজ্য সরকারকে দিয়ে তাদের নতুন করে সামঞ্জস্যপূর্ণ পলিসি বানাতে বলে।

গুজরাত সরকার সে’ অনুযায়ী ২০১৪ সালে নতুন গাইড লাইন বানায়। তাতে স্পষ্ট করে বলা হয় যে তিনটি ক্ষেত্রে রেমিশনের আবেদন বিবেচনা করা হবে নাঃ

এক, যে অপরাধের তদন্ত কেন্দ্রীয় সংস্থা (সি বি আই) করেছে,

দুই, ধর্ষণ করে হত্যা, এবং তিন, গণধর্ষণ করে হত্যা।

এ বছর স্বাধীনতার ৭৬ বছর উদযাপন উপলক্ষে ভারত সরকারও তিন বিন্দু নির্দেশিকা জারি করেছেঃ

· অপরাধী তার নির্ধারিত শাস্তির অন্ততঃ অর্ধেক সময় জেলে কাটিয়েছে।

· অপরাধী এমন রোগে আক্রান্ত, যাতে তার শেষের দিন ঘনিয়ে এসেছে।

· অপরাধী পুরুষ হলে ৬০ বছরের বেশি আর নারী হলে ৫০ বছর।

এছাড়া সুপ্রীম কোর্ট আগেও স্পষ্ট করেছে যে ‘ডিউ প্রসেস অফ ল’ মেনে নির্ণয় নিতে হবে। অর্থাৎ একটি অ্যাডভাইসরি কমিটি গঠন করে তার রায় নিতে হবে এবং যে আদালত শাস্তি দিয়েছিল সেই আদালতের মতামত শুনতে হবে। আর যদি রেমিশনের সিদ্ধানটি যুক্তিযুক্ত না মনেহয় তবে তার জুডিসিয়াল রিভিউ হতেই পারে।



তাহলে তো প্রথমে মনে হবে অপরাধীরা প্রচলিত নিয়ম এবং পলিসি অনুযায়ী কখনই ছাড়া পেতে পারে না।

কিন্তু হল কী করে?

, মুম্বাইয়ের স্পেশাল সিবি আই আদালত অভিযুক্তদের ভারতীয় দণ্ডবিধির ধারা ৩০২, ৩৭৬(২)(ই)(জি) এবং সহপঠিত ধারা ১৪৯ অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত করে ১ জানুয়ারি, ২০০৮ তারিখে রায় দেয়।

মে এবং জুলাই ২০১৭ সালে অভিযুক্তদের আপীল, যথাক্রমে মুম্বাই হাইকোর্ট এবং সুপ্রীম কোর্ট খারিজ করে শাস্তি বহাল রাখে।

রাধেশ্যাম শাহ ১৪ বছরের উপর জেলে রয়েছে যুক্তিতে ধারা ৪৩২ এবং ৪৩৩ অনুযায়ী রেমিশনের আবেদন পেশ করে। গুজরাত হাইকোর্ট আবেদন খারিজ করে বলে ৪৩২(৭) অনুযায়ী appropriate government’ হল মহারাষ্ট্র রাজ্য, সেখানে যাও। কিন্তু মুম্বাই হাইকোর্ট আবেদন শুনতে রাজি না হয়ে বলে—মহারাষ্ট্র নয়, গুজরাত সরকার। অপরাধ ওখানেই হয়েছে।

তখন রাধেশ্যাম শাহ সুপ্রীম কোর্টের দরজায় কড়া নাড়ে।

আশ্চর্য্যের বিষয়, সুপ্রীম কোর্টের জাস্টিস অজয় রাস্তোগী এবং জাস্টিস বিক্রম নাথের ডিভিশন বেঞ্চ গুজরাত হাইকোর্টের রায় খারিজ করে বলে যে গুজরাত সরকারই হল appropriate government, কারণ অপরাধ তো ওই রাজ্যেই হয়েছে। এবং রেমিশনের বিচার গুজরাত রাজ্য সরকার ওদের ওখানে প্রচলিত গাইডলাইন অনুযায়ী দু’মাসের মধ্যে সম্পন্ন করুক।

গুজরাত সরকার ওদের ৯ জুলাই ১৯৯২ সালের রেমিশন পলিসির উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিল, কারণ ২০০২ সালে অপরাধ ঘটিত হবার সময় এবং রায় যখন বেরোয় , জানুয়ারি ২০০৮, ওই পলিসিই বলবৎ ছিল। সেই পলিসিতে কী ধরণের অপরাধে ওই পলিসি প্রযুক্ত হবে, কিসে হবে না সে নিয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা ছিল না। [5]

কিন্তু ওই পলিসি সুপ্রীম কোর্ট ২০১২ সালে খারিজ করে দেয়।

যদিও জানুয়ারি ২০১৪ সালে গুজরাত সরকার যে নতুন গাইডলাইন জারি করে তাতে এই ছাড়া পাওয়া মুশকিল ছিল। সেটা অনুযায়ী যে অপরাধের তদন্ত সি বি আই করেছে বা ধর্ষণ বা গণধর্ষণ করে হত্যার দোষীরা এই পলিসিতে ছাড়া পাবে না।[6]

তাহলে ইস্যু হল দুটোঃ

এক, রেমিশন নিয়ে বিচার করার ‘appropriate government’কে? গুজরাত না মহারাষ্ট্র?

দুই, রেমিশনের সিদ্ধান্ত কোন গাইডলাইন মেনে হবে? বাতিল করা গুজরাত ১৯৯২এর পলিসি? নাকি ২০১৪ সালের সুপ্রীম কোর্টের গাইডলাইন মেনে তৈরি পলিসি।

উপরের দুটো বিন্দুতে যদি কোন একটায় পরের বিকল্পটি মেনে নেওয়া হয়, যেমন গুজরাতের বদলে মহারাষ্ট্রের পলিসি অথবা গুজরাতের ১৯৯২এর বদলে ২০১৪ সালের পলিসি, তাহলেই অপরাধীরা ছাড়া পায় না।

এই অপরাধীদের ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত কি আইন মেনে হয়েছে?

এটা বুঝতে আমাদের আগে কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।

এক, ধারা ৪৩২ (৭) অনুযায়ী ‘appropriate government’ কে? গুজরাত সরকার নাকি মহারাষ্ট্র?

দুই, মকুবের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের মতামত নেওয়া কি জরুরি ছিল?

তিন, শাস্তি ঘোষণার আদালতের মতামত নেওয়া কি জরুরি?

চার, সুপ্রীম কোর্টের আগের রায়গুলোর সঙ্গে এই রেমিসনের সিদ্ধান্ত কি সংগতিপূর্ণ?

এক এক করে দেখা যাক।

· ‘appropriate government’ কে? Cr Pc section 432(7) স্পষ্ট ভাষায় বলছে যে রাজ্যের অধীনে আদালত বিচার করে রায় দিয়েছে সেই রাজ্যের সরকার হল ‘appropriate government’। তবে তো গুজরাত নয়, মহারাষ্ট্র সরকার হল ‘উপযুক্ত’।

এই যুক্তিতেই গুজরাত হাইকোর্ট অপরাধী রাধেশ্যাম শাহের আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল। কিন্তু মে ২০২২ সালে অপরাধী রাধেশ্যাম শাহ বনাম গুজরাত রাজ্য আপীলে সুপ্রীম কোর্টের বেঞ্চ বলল—না, গুজরাতে অপরাধ হয়েছিল। বিচার সেখানেই হত, বিশেষ পরিস্থিতিতে মহারাষ্ট্রে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। অতএব, গুজরাত।

সিনিয়র অ্যাডভোকেট রেবেকা জন এবং আরো অনেকে এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। সেই বিশেষ পরিস্থিতিই তো আসল বিবেচনার যোগ্য। কারণ , তখন সুপ্রীম কোর্ট নিশ্চিত ছিলেন যে গুজরাত সরকার এই কেসে নিরপেক্ষ নয়। সরকারের যে এস আই টি এই কেসের প্রাথমিক তদন্ত করেছিল মুম্বাই সিবি আই কোর্ট তার করা সমালোচনা করেছে।

উল্লেখযোগ্য, মামলায় জাস্টিস ইউ ইউ ললিত, যিনি ১ সেপ্টেম্বর থেকে সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হবেন, একটি মামলায় বলেছিলেন, “ এই ধারা অনুসারে (৪৩২/৭) যদি ‘ক’ রাজ্যে অপরাধটি ঘটিত হয়ে থাকে, কিন্তু ‘খ’ রাজ্যে বিচার হয়ে রায় দেওয়া হয়, তাহলে ‘উপযুক্ত সরকার’ হবে পরের রাজ্যেরটি” (বাংলা অনুবাদ লেখকের)। [7]

এছাড়া মধ্যপ্রদেশ রাজ্য বনাম রতন সিং (১৯৭৬) এবং হনুমান্ত দাস বনাম বিজয়কুমার (১৯৮২) মামলাতেও সুপ্রীম কোর্টের স্পষ্ট অবস্থান ছিল যে Cr Pc section 432(7) অনুসারে ‘appropriate government’ মানে যেখানে দোষীকে শাস্তির রায় দেওয়া হয়েছে সেই রাজ্যের সরকার।

· কেন্দ্রের সম্মতির প্রশ্নটি

Cr Pc section 435 অনুসারে যে কেসের তদন্ত কোন কেন্দ্রীয় আইনের অধীনে কোন কেন্দ্রীয় সংস্থা করেছে (যেমন বিলকিস প্রকরণে CBI), সেখানে রাজ্য সরকার শাস্তির সময় কম করার কোন একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আগে কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি নিতে হবে।

আলোচ্য কেসের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদন দিয়েছে এমন কোন খবর আমাদের জানা নেই। আরও খেয়াল করার ব্যাপার, কেন্দ্রীয় সরকার ১৫ অগাস্ট, ২০২২, ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ এবং ১৫ অগাস্ট ২০২৩ এ বন্দীদের স্পেশাল সাজা মকুবের জন্য বিশেষ গাইডলাইন জারি করেছে।

তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে যাবজ্জীবন কারাবাসের শাস্তি ভোগ করা এবং ধর্ষণের অপরাধী এই সুবিধের যোগ্য নয়।[8]

· শাস্তির রায় দেওয়া বিচারকের অভিমতঃ কতটুকু গুরুত্ব?

Cr Pc section 432(2) যে রেমিশনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাজ্য সরকারের উচিত যে আদালত শাস্তি দিয়েছে তার মুখ্য বিচারকের অভিমত নেওয়া—রেমিশনের আবেদন গ্রাহ্য করা অথবা খারিজ করা। অবশ্যই বিচারক এ’ব্যাপারে তাঁর যুক্তি স্পষ্ট করে বলবেন।

সুপ্রীম কোর্ট তার সংগীত বনাম হরিয়ানা রাজ্য মামলায় বলেছে এই ধারাটি ‘appropriate government দ্বারা রেমিশন নিয়মের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচের মত।

আবার, ভারত সরকার বনাম হরিহরন মামলায় সুপ্রীম কোর্টএর এক সাংবিধানিক বেঞ্চ এটাও বলেছে যে 432(2) অনুযায়ী রায়দানকারী বিচারকের অভিমত নেওয়া’ম্যান্ডেটরি’। এটি রাজ্য সরকারকে সঠিক নির্ণয়ে পৌঁছুতে সাহায্য করবে। কারণ, সেই অভিমত অপরাধের প্রকৃতি, অপরাধীর পৃষ্ঠভূমি এবং অন্যান্য প্রাসংগিক বিন্দুর উপর আলোকপাত করবে।

এপ্রিল ২০২২ সালে একটি সাম্প্রতিক রায়ে জাস্টিস চন্দ্রচুড় এবং জাস্টিস অনিরুদ্ধ বোস বলেন--এটা না করলে রাজ্য সরকারের রেমিশন নিয়ে ডিউ ডিলিজেন্স মাত্র নিয়মরক্ষা হয়ে দাঁড়াবে। [9]

বর্তমান কেসটিতে যেটুকু জানা গেছে যে মুম্বাই সিবি আই কোর্টের বিচারক( যিনি অভিযুক্তদের বিচার করেছিলেন) এই রেমিশনের বিরুদ্ধে অভিমত দিয়েছিলেন। কিন্তু দশজনের রিভিউ প্যানেলের সমস্ত সদস্য , যাতে ২ জন বিজেপি বিধায়ক এবং অন্য ৩ জন বিজেপি সদস্য রয়েছেন, একবাক্যে সেই অভিমত গ্রহণযোগ্য মনে করেন নি।[10]

· সুপ্রীম কোর্টের আগের রায়গুলোর সঙ্গে বর্তমান সিদ্ধান্তের সামঞ্জস্য



সাধারণভাবে বলা হয় যে রাজ্য সরকার তার বিবেক এবং বিচক্ষণতার জোরে যে কোন রেমিশনের আবেদন গ্রাহ্য বা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখে। এতে কোর্ট হস্তক্ষেপ করতে পারে না।

কিন্তু সাম্প্রতিককালে রামচন্দর বনাম ছত্তিশগড় রাজ্য মামলায় সুপ্রীম কোর্টের জাস্টিস চন্দ্রচুড়ের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দিয়েছে যে আদালতের সেই ক্ষমতা রয়েছে যার বলে সে পরীক্ষা করে দেখতে পারে রাজ্য সরকারের রেমিশন নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত এবং আইনানুগ। তারপর সে চাইলে রাজ্য সরকারকে তার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার আদেশ দিতে পারে।

উল্লেখযোগ্য যে ৬০০০ নাগরিক, মানবাধিকার কার্যকর্তা সুপ্রীম কোর্টে [11] সংযুক্ত আবেদন পাঠিয়েছেন । সুপ্রীম কোর্টের নতুন প্রধান বিচারপতি বিলকিস বানো কেসে গুজরাত সরকারের অপরাধীদের ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি পরীক্ষা করার রিট আবেদন বিবেচনার জন্য স্বীকার করেছেন এবং গুজরাত সরকার, কেন্দ্রীয় সরকার এবং ছাড়া পাওয়া ওই ১১ জন অপরাধীদের শো কজ নোটিস পাঠিয়েছেন যে কেন তাদের মুক্তির সিদ্ধান্ত খারিজ করা হবে না?

আমরা এখনও আশায় বাঁচি।

আমাদের কি আর কিছুই করার নেই?

আইনের প্রসংগ এবার থাক।

এটা স্পষ্ট যে আমরা সংস্কৃতিবান সুসভ্য নাগরিকেরা হেরে গেছি। আমাদের চারদিকে মানবমূল্যের অবনমন নিরন্তর। নইলে কিছু ধর্ষক, শিশুঘাতী ও খুনিদের প্রকাশ্যে বরমাল্য পরিয়ে কপালে টিকা দেন কিছু মহিলা?

আর শাস্তির পর গোধরা সাব-জেলে থাকাকালীন অপরাধীরা বছরে তিন থেকে ছ’মাস করে প্যারোলে ছাড়া পেয়ে বাড়ি গেছে, বাড়ি বানিয়ে গৃহপ্রবেশ করেছে। বৌয়ের হাঁটুর অপারেশন করিয়েছে , সন্তানদের বিয়ে দিয়েছে। এতে গুজরাত হাইকোর্টের বিচারকও স্তম্ভিত।

দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে রাজসভার প্রাজ্ঞজন মাথা হেঁট করে নিশ্চুপ ছিলেন। ফল যে কী ভীষণ হয়েছিল তার বর্ণনা আমাদের মহাকাব্যে আছে।

এখনও সময় আছে। সেই অপমানিতা লাঞ্ছিতার সামনে হাঁটু গেড়ে বলতে চাই—ক্ষমা কর। আমরা হেরে গেছি।

না হয় এভাবেই শুরু হোক।

==============================






[1] আজ তক পোর্টালে গোপী নায়ারের রিপোর্ট, ১৭ অগাস্ট, ২০২২।


[2] টাইমস অফ ইন্ডিয়া, ২২ অগাস্ট, ২০২২।


[3] ঐ, ২৫ এপ্রিল, ২০১৯।


[4] লক্ষ্মণ নস্কর বনাম ভারত সরকার (২০০০) এবং স্টেট অফ হরিয়ানা বনাম জগদীশ।


[5] দ্য নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৮ অগাস্ট, ২০২২।


[6] সি এন বি সি টিভি ১৮ ডট কম, ১৮ অগাস্ট, ২০২২।


[7] ভারত সরকার বনাম ভি শ্রীহরন (২০১৫)।


[8] লাইভ ল, ২২অগাস্ট, ২০২২।


[9] রামচন্দর বনাম ছত্তিশগড় রাজ্য, ২২ এপ্রিল, ২০২২।


[10] স্ক্রল ডট ইন, ১৮ আগস্ট, ২০২২।


[11] হিন্দুস্তান টাইমস, ১৯ অগাস্ট, ২০২২।







ReplyForward

0 comments:

0

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in




হেমন্তের কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যেয়, কার্তিকের হিমে ডুবে থাকা ধান খেত থেকে উড়ে যাওয়া পেঁচার পাখায় ভেসে ওঠে প্রদীপের নরম আলো। সে আলোর কোনো ঔদ্ধত্য নেই। নিজেকে জাহির করার চেষ্টা নেই। সে জানে এই অনন্ত চরাচরের আদিম আঁধারকে দূর করার শক্তি সে ধরেনা। সে শুধু নিজের বুকের মধ্যে একটি শিখা জ্বালিয়ে রাখতে পারে। মাঝে মাঝে তার শিখায় একটি কৃষ্ণ রেখা দেখা যায়। সে বোঝে অজ্ঞানতা আসলে আমাদের নিম্নমুখী করে। তমস। তারপরই লাল উজ্জ্বল আলোয় সে জ্যোতির্ময় হয়। যেটুকু শক্তি আছে তাই দিয়ে নিজেকে জ্বালাতে চায়। এই কর্মপ্রবৃত্তিই রজঃ। অবশেষে একটি নীল শিখা। নীল জগতচৈতন্য। তখন তার স্পষ্ট অনুভব, জগতচৈতন্যের আধার তার ক্ষুদ্র মাটির শরীরও। সত্ত্ব। বিশুদ্ধ সত্ত্ব। তারপরই একটি শূন্যতা সেই নীলচৈতন্যের মধ্যে। নির্গুণ। গুণাতীত। মাটির প্রদীপ তখন লীন হয়ে গিয়েছে তুরীয়তে।

উপরোক্ত সব কটিই আসলে আমাদের দেহের অবস্থা। তিনটি গুণ আমাদের দেহাভ্যন্তরীণ প্রবৃত্তিকে চালিত করে। কিন্তু গুণাতীত অবস্থায় আমাদের চৈতন্য আর দেহে বদ্ধ থাকেনা। মাটির ঘট যেমন অনন্ত সমুদ্রে ভেসে যায়।

ছোট পরিসরে একটি তুলনামুলক আলোচনায় দেখে নেব আদিকাল থেকে প্রচলিত ধর্মে আলোর ভূমিকা কী।

আলো পবিত্রতার প্রতীক। আলো অর্থে তমোনাশ। “করো তমোনাশ হও হে প্রকাশ”। আলো যেন অন্ধকারের প্রতিপক্ষ। সে যুদ্ধে জেতে। কিন্তু জ্যোতিঃপদার্থ বিদ্যা জানাচ্ছে, অন্ধকার আসলে আলোর অভাব। যে আলো আমাদের মস্তিষ্ক গ্রহণে অক্ষম, সেই আলো আমাদের কাছে অন্ধকার রূপে প্রতীয়মান। প্রকৃতপক্ষে অন্ধকার বলে কিছু নেই।

আলো প্রাণের প্রতীক। সেই অর্থে সূর্য। আমাদের একমাত্র প্রাণশক্তির উৎস। সূর্যালোক এ পৃথিবীর প্রাণের কারণ। আত্মিক অনুভবে আলোময় একটি পথ অনেকেই দেখেছেন। সেই জ্যোতির্ময় পথটি যেন এক আনন্দময় শান্তির পথে দ্রষ্টাকে নিয়ে যায়। ধর্মে এই জ্যোতিকে ঈশ্বর বলা হয়েছে। মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসা মানুষকে এমন অনুভবের কথা বলতে শোনা যায়। আরও আশ্চর্যের, এই আলো যেন এক দেহাতীত প্রেমের অনুভূতি দেয়। আমরা আশ্বস্ত হই। মৃত্যু তবে এক আলোকিত প্রেমময় পথ।

আমরা দেখতে পাবো, বৈদিক, ইসলাম, খৃষ্ট, ইহুদি, সব ধর্মেই এই পরমজ্যোতিকে ঈশ্বর বলা হয়। আমাদের পক্ষে এই আলোর ভালোবাসা, ভালোবেসে জড়িয়ে ধরা, কল্পনা করা অসম্ভব।

আমাদের দীপাবলী আলোর উৎসব। আমরা নত হয়ে সেই নির্গুণময়ীর কাছে প্রার্থনা করি—আলো দাও। আমার এই ক্ষুদ্র শরীরের প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে দিয়ে আমাকে তোমার মধ্যে লীন করো।

ইহুদিদের আটদিন ধরে আলোর উৎসব, হানুকাহ, খৃষ্ট ধর্মের মোম জ্বালিয়ে বড়দিন এরকমই এক আনন্দের উৎসব। প্রেমের উৎসব। এই আলো আমাদের পথপ্রদর্শকও বটে। মহাপ্রস্থানের পথ এই আলোকিত পথ।

আলো জ্ঞানের প্রতীক। গ্রীক দার্শনিক ডায়োজিনিস দিনের উজ্জ্বল আলোয় মানুষের মুখে দীপ তুলে ধরতেন। বলতেন, মানুষ খুঁজছি। তাঁর সেই সপাট কৌতূহল থেকে সম্রাট অ্যালেকজান্ডারও বাদ যাননি। অর্থাৎ অন্তরে জ্ঞানদীপ জ্বলছে এমন মানুষ তিনি খুঁজছেন। এই যে আমরা অসংখ্য প্রদীপ জ্বালাই, এ আসলে অসংখ্য মানুষের দেহ। প্রতি দেহে যেন জ্ঞানদীপ জ্বলে ওঠে, এই প্রার্থনা।

বাগদাদের মনসুর আল হাল্লাজ বলেছিলেন, আমিই সত্য। আন আল হক। এর জন্য প্রাণদণ্ড হয়েছিল তাঁর। ইসলামে হক বা সত্যস্বরূপ আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নয়। তাহলে কি মনসুর ইসলামবিরোধী? না। তিনি সেই সত্যস্বরূপ জ্যোতির্ময়কে অন্তরে দর্শন করেছিলেন। জেনেছিলেন, এই আলোকিত ‘আমি’ আসলে ক্ষুদ্র আমি নয়। এ ‘আমি’ উত্তম পুরুষ, আল্লাহ স্বয়ং। মনসুর কই? এক আল্লাহই তো আছেন তাঁকে আপ্লুত করে!

একবার দেখি প্রাচীন ধর্মে আলোকে কিভাবে দেখা হয়েছে।

ঘন অন্ধকার ভেদ করে, অতল জলের মধ্যে থেকে ভেসে উঠল ধরিত্রী। এক অলৌকিক ধ্বনি ভাষাহীন স্বরে বলে উঠল-চরাচর আলোকিত হোক। বিশ্বচরাচর আলোকিত হলো। জেনেসিসের তৃতীয় পয়ারে এই পংক্তিটি আছে। ইলোহিম, ঈশ্বর যেন ঘোষনা করলেন, আর আলো ছড়িয়ে পড়ল।

বেদান্তে আছে অনুরূপ একটি শ্লোক। হে জগতপোষক সূর্য, তোমার সুবর্ণ আবরণ অপসারণ করো, তোমার কল্যাণময় মুখ দেখাও, আমরা তোমার করুণা লাভ করি। সূর্য এখানে জগদাত্মার প্রতীক। প্রতিটি মানুষের মধ্যে এক প্রাণসূর্য আছে। এখানে তাঁকেই প্রার্থনা করা হয়েছে।

জেনেসিসের হিব্রু ভাষায়, প্রার্থনা নয়, একটি ঘোষনার কথা আছে। বেদান্তে আছে প্রার্থনা।

মোজেস যখন মিশর থেকে এলেন প্যালেস্টাইনে তখন সিনাই পর্বতে তিনি এক অদ্ভুত আলো দেখেছিলেন। আলো কি কথা বলতে পারে? অথচ মোজেস সেই আলোকেই ঈশ্বর বলে জেনেছিলেন। কিন্তু বাকি আত্মজনের বিশ্বাস হয় কিসে? তাই তাঁর প্রার্থনায় আত্মজনেরা রইলেন পর্বতের সানুদেশে, আর দেখলেন, সত্যিই এক জ্যোতিপুঞ্জ যেন অলৌকিক উপায়ে তাদের নির্দেশ দিচ্ছে। মোজেশের দশ নির্দেশ ওই আলো থেকেই উৎসারিত।

মহম্মদ এক গুহায় ধ্যানস্থ থাকতে থাকতে গ্যাব্রিয়েলকে দেখেছিলেন। গ্যাব্রিয়েল তাঁকে রেশমের পর্দার আড়ালে সূর্য দর্শন করান। ইসলাম তাঁকেই আল্লাহ বলে। জ্যোতিস্বরূপ।

নানা ধর্মবিশ্বাসের জন্ম এমনই সব অনুভূতি থেকে।

মিশরের বহুদেবতার দেশেও সূর্যদেবতা ‘রা’ প্রধান দেবতা।

কিন্তু কতিপয় মহাপুরুষের অনুভূতি তো আর বিশ্বজনীন হতে পারে না। তাই সমাজে সৃষ্টি হয় কিছু প্রতীক উৎসব। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মানুষ পৌঁছতে চায় সেই শাশ্বত আলোকে। সাজাতে চায় তার আপন হৃদয়ের গভীরে লুকিয়ে থাকা এক চিরন্তন আকাঙ্ক্ষাকে।

আমাদের দীপাবলি এমন আলোর উৎসব। আমাদের কবি তাই গেয়ে ওঠেন--

“দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।"

এই আলোকিত হৃদয় আমাদের কী দিতে পারে? দিতে পারে আশা, দিতে পারে বিশ্বজোড়া তমসার নিবৃত্তি।

"…যাক অবসাদ বিষাদ কালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো–
জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে॥

দেবতারা আজ আছে চেয়ে– জাগো ধরার ছেলে মেয়ে,
আলোয় জাগাও যামিনীরে।
এল আঁধার দিন ফুরালো, দীপালিকায় জ্বালাও আলো,
জ্বালাও আলো, আপন আলো, জয় করো এই তামসীরে॥"

একবার দেখে নিই উৎসবের আলোর মহিমা।

শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানকের জন্মদিবস পালিত হয় দীপালোকে সজ্জিত শিখ পল্লীতে।

এমনতরো উৎসব বড়দিনের মোমবাতি থেকে ইসলামের শবেবরাত হয়ে ভারতে দীপাবলির সাথে যেন এক অদৃশ্য যোগসূত্র স্থাপন করে।

ফিরে তাই আমাদের প্রাণের উৎসবে। দীপাবলি উৎসব পালিত হয় ঘন অমাবস্যার যামিনীতে। কার্তিকের হিমে যখন কুয়াশা জড়ানো অন্ধকার এক ভীতিকর মায়া সৃষ্টি করে তখন আমরা দিকে দিকে নম্র দীপের আলো জ্বালাই। সে আলো অন্ধকারকেই প্রকট করে। আমাদের নিভৃত প্রাণের দেবতা কি এমনই চান? আলো অন্ধকারে মিশিয়ে থাকা সেই অধরা মাধুরী আমাদের ঈশ্বরী। তিনি জ্যোতির্ময় নিরাকারা নন। অদ্ভুত সেই ঈশ্বরী তমসাবৃতা সাকারা।

মাতৃকা। আমাদের দেহ। দেহের মধ্যে অনন্ত অন্ধকার আছে। নিছক একটি দীপালোক যতটুকু প্রকাশ করতে পারে, আমাদের মনের আলো ঠিক ততটুকুই অজ্ঞানতা দূর করতে পারে।

আলোর দীপ তাই আমাদের প্রার্থনাকে মূর্ত করে। আমাদের মনের অন্ধকার দূর হোক। আমরা যেন ক্ষুদ্রতার অন্ধকের স্বার্থান্ধ না হই। অন্ধকার তো অন্ধ করে। পাশের মানুষকেই আমরা প্রতিপক্ষ ভাবি। যা চিরকালীন নয় তার জন্য আমরা বিরোধ করি। এ বিরোধ সেদিন দূর হবে যেদিন আমাদের অন্তরদীপ প্রজ্জ্বলিত হবে। আমরা একের সঙ্গে অপরের কোনো পার্থক্য দেখব না। একেই তো ব্রহ্মচেতনা বলেছে বেদান্তে। একেই ইসলাম বলছে—ঈশ্বর এক, একত্বই ঈশ্বর। আমরা তো কেউ খণ্ডিত চেতনা নই। আমরা সেই অখণ্ড চেতনার শরিক।

প্রার্থনা করি, আমাদের অন্তরদীপ প্রজ্বলিত হোক। প্রেমের পথ আলোকিত হোক। আমাদের দৃষ্টির আঁধার দূর হোক। আমরা যেন অন্ধকারে উৎস হতে উৎসারিত সেই আলোকে অনুভব করতে পারি। শুভমস্তু।

[সাহিত্য আর সংবাদ দীপাবলী ২০২১]

0 comments:

0

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in





যার কথা বা যাদের কথা এই প্রবন্ধের বিষয়, সে আলোচনা শুরুর আগে অন্য দু-একটি কথা বলা প্রয়োজন। বিহারের (বর্তমানে ঝাড়খন্ড) যে প্রত্যন্ত গ্রামটি আমার পৈতৃকভূমি, সেই গ্রামের অধিবাসীরা দুটি ভাগে বিভক্ত—এক অংশ হলেন কিছু ব্রাহ্মণ পরিবার, অপর অংশটি হল স্থানীয় আদিবাসী পরিবার। এই আদিবাসী পরিবারগুলি হলেন কুর্মী, মাহাতো, রাজোর, ভূমিজ, সাঁওতাল ইত্যাদি সম্প্রদায়ের অন্তর্গত। কিছু আদিবাসী সম্প্রদায় ও ব্রাহ্মণ পরিবার ছাড়া সেই গ্রামে আর অন্য কোন জাতির মানুষ সেখানে বসবাস করেন না। বলা বাহুল্য, ব্রাহ্মণ পরিবারগুলির বাড়িতে এই আদিবাসী পরিবারের মানুষেরাই সাংসারিক সবরকম কাজে সহায়তা করে থাকে। সুতরাং সেই শিশুবেলা থেকেই তাদের দেখে এবং শুনেই বড় হওয়া। পরবর্তীকালে রামায়ণ এবং আদিবাসী ও অন্ত্যজশ্রেণীর মানুষের মধ্যে রামায়ণের প্রভাব নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করতে গিয়ে এদের স্মৃতি ও শিক্ষা যে আমার বিশেষ সহায়ক হয়েছে, একথা বললে ভুল কিছু বলা হয় না।

শিশুবেলা থেকে বিহারের গ্রাম্য সমাজ-সংস্কৃতিতে রামলীলা, রামগান, নৌটঙ্কি এসব দেখে বড় হওয়া। আশ্চর্য্য হতে হয় যখন দেখি তথাকথিত এই অশিক্ষিত মানুষগুলির মনেও রামায়ণ এবং তার ভাবনা ছড়িয়ে আছে। অঞ্চল বিশেষে তার ব্যাখ্যার তারতম্য হয়,কাহিনিরও হয়ত কিছু পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু ভক্তি ও বিশ্বাসের তারতম্য ঘটে না কোথাও। একই প্রকাশ দেখেছি বাংলার বিভিন্ন আদিবাসী অভ্যূষিত জেলা বা অঞ্চলগুলিতেও। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম,বর্ধমানের একাংশ অর্থাৎ যে সকল স্থান আদিবাসী অধ্যূষিত অঞ্চল সেই সকল গ্রামগুলিতেও তার প্রমাণ মেলে। এবং আশ্চর্য্যের বিষয়, কিছু কিছু আদিবাসী ঘটনা, রীতিনীতি ইত্যাদি বিষয়ে সকল আদিবাসীদের ধ্যান ও ধারণা প্রায় একই রকমের। সম্ভবত আদিবাসীদের গোষ্ঠীবদ্ধ সমাজব্যাবস্থার কারণেই তা সম্ভব। আরো একটি বিষয় হল, সমাজের মূল কাঠামোটির অপরিবর্তনীয়তা, যা সকল স্থানে একই রকম ভাবে প্রযোজ্য এবং অপরিবর্তিত। আদিবাসী সমাজের এটি মূল বৈশিষ্ট্য।
.
আমরা জানি, আদিবাসী সমাজের মধ্যে অধিক হল সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষগুলির নিতান্তই তাদের নিজস্ব কোন নিয়ম বা নীতির উল্লেখ না থাকলে অনেকেই তাই আদিবাসী সমাজ বলতে সাধারণতঃ সাঁওতাল সমাজকেই বুঝে থাকেন। হয়ত বা এই সম্প্রদায়ের মানুষ অধিক বলে আদিবাসী মানেই সাঁওতাল এইরকম একটি ধারণা থাকলেও থাকতে পারে। বলাবাহুল্য, আমার পৈতৃকভুমিতে সাঁওতাল ব্যতীত অন্যান্য আদিবাসী সম্পদায়ের বসবাস থাকলেও ছোটবেলায় ‘আদিবাসী মানেই সাঁওতাল’ এই ভুল ধারণা আমারও ছিল।

‘Tribes of India’ (Indian Museum থেকে প্রকাশিত) বইতে বলা হয়েছে জনজাতি ও জনগোষ্ঠীগুলির অবস্থান কয়েকটি অঞ্চল ঘিরে, যার মধ্যে একটি হল নদীকেন্দ্রিক অঞ্চল। আবার তারা যাযাবর। অর্থাৎ নানা দেশে নানা জায়গায় তারা ঘুরে বেড়ায়। আদিবাসী সমাজের আদি বাসস্থান নিয়েও আছে নানান মত। ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে মহাশয়ের ‘আদিবাসী সমাজ ও পাল পার্বণ’ বইতে পাচ্ছি, সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত কিছু গান, যা তারা শ্রুতির আকারে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনে শুনে স্মরণে রেখেছে। এই গানগুলিতে জানতে পারি যে, একসময় জনজাতি-জনগোষ্ঠীগুলির বসবাস ছিল চাম্পাগড়ে। অন্যান্য কিছু ব্যাখ্যাতেও পাচ্ছি, এই চাম্পাগড় হল পঞ্জাব প্রদেশে, যাকে সাঁওতালরা বলে থাকেন ‘মঁড়ে গাড়া রেয়াঃক দিশম’ অর্থাৎ পঞ্চনদীর দেশ। সুতরাং,অনেকের মতেই জনজাতি-জনগোষ্ঠীর মানুষদের বাসস্থান ছিল এই অঞ্চলটি ঘিরে এবং তাদের আগমন দেশের উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে।

আবার এই মতটির পাশাপাশি 1910 সালে প্রকাশিত Santal Parganas—Bengal District Gezetteers –এ অন্য একটি মতও আলোচনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সাঁওতালদের অধিকাংশই যে চাম্পা থেকে উঠে আসার কথা বলে থাকেন, এই চাম্পা হল হাজারীবাগের কাছে। সেটি কি বিহারের চম্পারণ জেলা? জানা নেই। এইমতের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই চাম্পা প্রদেশে বাসস্থানের কারণে হাজারীবাগ, দুমকা, রাজমহল, ছোটোনাগপুর ইত্যাদি অঞ্চল ছাড়িয়ে আরো বেশ কিছু অঞ্চল জুড়ে এদের বসতি লক্ষ্য করা যায়। ক্রমে মধ্যপ্রদেশ, উত্তরের আরো কিছুটা অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃতিও লক্ষ্য করা যায়।

যারা চাম্পা অর্থাৎ পঞ্জাব প্রদেশের চাম্পা নগরীতে সাঁওতালদের আদি বসতি বলে মনে করেন, তাঁদের কাছে এই আদিম অধিবাসীরা ভারতবর্ষের প্রাচীন সভ্যতার কারিগর বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সম্প্রদায় অর্থাৎ সোরেন, হাঁসদা, মান্ডি, কিস্কু, হেমব্রম ইত্যাদি গোষ্ঠীর প্রত্যেকের নিজস্ব ‘গড়’ ছিল এমনই ধারণার ব্যাখ্যা সেখানে করা হয়েছে। এবং শুধু যে তাদের নিজস্ব গড় ছিল তাই নয়, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কাজও নির্দিষ্ট ছিল। চতুরাশ্রমের কালে যেমন সকল বর্ণের জন্য কাজ নির্দিষ্ট করা ছিল অনেকটা তেমনি। কিন্তু এখানে জাতিভেদের কথা উল্লেখিত নেই। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য সমাজের নির্দিষ্ট কাজের দায়িত্ব ছিল। যেমন---

সরেন--সরেনরা একসময় সৈনিক হিসেবে কাজ করতো। সেইকারণে তাদের সরেন সেপাই বলা হত।
কিস্কু রাপাজ-- কিস্‌কু সম্প্রদায় ছিল রাজ্য পরিচালনায় সুদক্ষ । এই কারণে এদেরকে এই নামে অভিহিত করা হতো।

মাণ্ডি কিসাঁড়া বা কিলিপসাড়-- মাণ্ডিরা কৃষিকাজ করতো বলে এদেরকে এই নামে উল্লেখ করা হত।

মুর্মু ঠাকুর—মুর্মু সম্প্রদায়ের কাজ ছিল পৌরহিত্য করা। পৌরহিত্য করতো বলে, এদেরকে এই নামে অভিহিত করা হতো।

এই সম্প্রদায়গুলি ছাড়াও আরো অনেকেই বিশেষ কাজে পারদর্শী ছিলেন বলে তাদের উপর ছিল সমাজের সেইসব বিভাগের দায়িত্ব। যেমন, হেমব্রমরা ছিলেন দেওয়ান, বাস্কে সম্প্রদায় ছিলেন ব্যাবসার কাজে যুক্ত ইত্যাদি। এসব আলোচনা ও তথ্য কতখানি সত্য বা উপযুক্ত তা জানা যায় না। কিন্তু আদিবাসীদের নিয়ে আলোচনা, গবেষণা করতে গেলে এর মূল্য যে অপরিসীম একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এসবই গেল আলোচনার গোড়ার কথা। যে দুজন আদিবাসী মানুষকে নিয়ে আজকের প্রতিবেদন এবার তাদের কথায় আসি। এই দুজন মানুষের নামকরণের আড়ালে রয়েছে ব্জাত্যাভিমান, সামাজিক পরম্পরার প্রতি আনুগত্য এবং রামায়ণের প্রভাব। উপরোক্ত আলোচনাটির সংক্ষিপ্ত বিবরণ সেইকারণেই। এই দুজন মানুষ হলেন সরেন মান্ডি ও রাবণ হেমব্রম।

সরেন মান্ডি--- সরেন মান্ডির পিতার সঙ্গে পরিচয় বর্ধমানে। একজন শিক্ষিত মানুষ, পেশায় সরকারী কৃষিবিভাগের কর্মী ছিলেন। নিজের সন্তানদেরও শিক্ষিত করেছেন। সরেন মান্ডি পরিবারের প্রথম সন্তান, পেশায় চিকিৎসক। এ পর্যন্ত আদিবাসী সম্বন্ধে অতি অল্প শিক্ষায় শিক্ষিত আমার ধারণা ছিল ‘সরেন অথবা সোরেন’ আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একটি সম্প্রদায়, কিন্তু কারও নামও যে হতে পারে তা জানা ছিল না। সরেন মান্ডির কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারি, ‘সরেন’ কথাটির অর্থ। আদিবাসী সমাজে ‘সরেন’ সম্প্রদায় ছিল সিপাহী বা সেপাই অর্থাৎ সৈনিক যারা নিজেদের গড়, সমাজ ইত্যাদিকে রক্ষা করার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। প্রয়োজনে অন্যদের সঙ্গে যুদ্ধেও লিপ্ত হতেন। মনে প্রশ্ন ছিল, ডাক্তার পুত্রের এই ধরণের নামের পিছনে যুক্তি কি? সেকথা জানাতেই উত্তর পাই---পিতার মনে পুত্র জন্মাবার পর থেকেই তাকে চিকিৎসক হিসাবে তৈরি করয়ার কথা ভেবেছেন। তাঁর মতে, একজন চিকিৎসকও তো সমাজের সৈনিক যার কাজ হল মানুষের দেহের সব রকম অ-সুখ বা রোগের হাত থেকে মানুষকে রক্ষা করা, মানুষের দেহের রোগের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে বাঁচিয়ে রাখা। তিনি নিজে যদিও মান্ডি সম্প্রদায়ের মানুষ, কৃষিকাজই পিতা-পিতামহদের জীবনের অঙ্গ, তবু সমাজের এই দুরূহ কাজটিকেই তাঁর সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে। তাছাড়া তিনি নিজে শিক্ষিত মানুষ, তাই বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আদিবাসীদের ‘জড়ি-বুটি-ভেষজ’ চিকিৎসা অপেক্ষা আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসার কথা যুক্তিসম্মত মনে করেন। আর সেই উদ্দেশেই পুত্রের নাম ‘সরেন’, সরেন মান্ডি।

রাবণ হেমব্রম---

রাবণ হেমব্রমের সঙ্গে দেখা বীরভূমের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। বীরভূমের কয়েকটি আদিবাসী অধ্যূষিত গ্রামে যাবো, তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলব। এই সব আদিবাসী গ্রামের মানুষদের মধ্যে রামায়ণের কোন প্রভাব আছে কিনা, থাকলেও তা কতখানি, তাঁরা রামায়ণের কাহিনি জানেন কিভাবে, কি কি কাহিনি জানেন এসব তত্ত্বতালাশ করতেই যাওয়া। যে রিক্সাটিতে উঠে বসলাম তার চালক একজন আদিবাসী পুরুষ। চেহারা দেখে অনুমান করে নিতে কষ্ট হয়না। সেই কালো গায়ের রং, শক্ত-সবল চেহারা, কোঁকড়ানো চুল ও ঝকঝকে সাদা দাঁত দেখে মানুষটিকে চিনে নিতে অসুবিধে হয়নি। কিন্তু যেটি আমায় অবাক করল তা হল, এর আগে আমি আর কখনো কোনো আদিবাসী মানুষকে রিক্সা চালাতে দেখিনি। নাম জিজ্ঞেস করতেই জানলাম তার নাম রাবণ, রাবণ হেমব্রম অর্থাৎ সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ। বইয়ে পড়ে জেনেছি ‘হেমব্রম’ কথার অর্থ—মসীজিবী অর্থাৎ যারা লেখালেখি করেন, যেমন ‘সোরেন’ শব্দের মানে জেনেছি—সৈনিক। আবার হেমব্রম শব্দের অর্থ ‘দেওয়ান’,সেও পড়েছি। তার মানে, হেমব্রম সম্প্রদায়ের লোকেরা মসীজীবী অথবা দেওয়ান যাই হোক না কেন, আদি সমাজে, এই হেমব্রমরা কি লেখালেখির কাজ করতেন? মসীজীবি হলে তো তাই বোঝায়। দেওয়ানদেরও খানিক এই কাজ করতে হয়। কেন জানিনা, আমার মন চলে গেল সেই কোন প্রাচীন সভ্যতার যুগে যেখানে এইসব আদিম অধিবাসীরাই ছিলেন প্রধান কারিগর। সেখান থেকে আজ অবস্থার বিপাকে পড়ে রিক্সাচালক...বেঁচে থাকার তাগিদে। আদিবাসী সমাজের মানুষেরা তো সেই কোন যুগ থেকে বিতাড়িত হতে হতে চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চলে গেছেন...ক্রমে ক্রমে যুগের পর যুগ ধরে তারা নিজেদের এই সমাজের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে চেষ্টা করেছেন নানাভাবে। রাবণ হেমব্রম কি তাদেরই একজন নয়?

কিন্তু রাবণ নাম কেন? এর সঙ্গে কি রামায়ণের যোগ আছে?
বোলপুর—শান্তিনিকেতনের কাছে ‘দ্বারন্দা’ নামের গ্রামে এক ভরত মারডির দেখা পেয়েছি, কিন্তু রাবণ নামে কখনোই কাউকে পাইনি। না আদিবাসী সমাজে, না বর্ণহিন্দু সমাজে। রামায়ণে আবিষ্ট মনুষ্যসমাজ রাবণ নামের প্রতি ঠিক সদয় নন, হয়ত সেকারণে কাহিনির পাতাতেই এই নাম সীমাবদ্ধ। তাই একটু অবিশ্বাসের সুর ছিল গলায়। আমিও বিস্ময়ে বলে উঠি—রাবণ!’
জিজ্ঞেস করি তাঁকে তিনি কি রাবণ কে জানেন? রিক্সাচালক মানুষটি সামান্য হাসিমুখে জানান তিনি জানেন। তাঁর ভাষায় রাবণ হলেন সেইজন যিনি ‘সিতাকে লিয়ে গিয়েছিলেন। রাম কি করবে, যুদ্ধই করতে হবে তাইলে’। যেন সমস্যার সমাধান করে দিলেন এক নিমেষে। তারপরেই কিন্তু তিনি জানান, রাবণ কিন্তু মস্ত বীর ছিল। আদিবাসী সমাজে রামের চেয়ে রাবণের মাহাত্ম্য বেশি, সেটি জানা ছিল। তার কথাতেও যেন তারই প্রতিধ্বনি। ‘রাবণ কিন্তু মস্ত বীর’ একথার অর্থ কি, রামকে রাবণের সঙ্গে লড়তে গেলে বেগ পেতে হবে? আবার জানতে চাই, তার ‘রাবণ’ নামকরণের পিছনে ইতিহাস কি? তাঁর বাবা-মা কি রামায়ণের গল্প জেনে তার নাম রেখেছেন? এবারেও অবাক হলাম তাদের নামকরণের রীতিনীতি জেনে। না, রামায়ণে প্রভাবিত হয়ে মানুষটির পিতা তার নামকরণ করেননি, তিনি নামটি পেয়েছেন ঠাকুরদাদার উত্তরাধিকার সূত্রে। রিক্সাচালক আদিবাসী পুরুষ রাবণ আরো জানালেন যে, গ্রামে-গঞ্জে এখনকার থেকে আগেকার দিনে রামায়ণ গান হত অনেক বেশি। মানুষ রামায়ণের গল্পও জানত তাদের চেয়ে বেশি। তারাও ঠাকুরদাদা-ঠাকুমায়ের মুখে শুনে শুনে যতটুকু রামায়ণ জেনেছে, তাও এখন স্মরণে থাকছে না। রাবণ মস্ত রাজা, আদিবাসী সমাজে তাঁর ব্যাপক সম্মান, হয়ত তার ঠাকুরদাদার নাম তার পূর্বপুরুষ সেই রামায়ণের কাহিনি শুনে রেখেছিলেন, কিন্তু ইনি নামটি পেয়েছেন তার ঠাকুরদাদার সূত্রে।
কি রকম?

সাঁওতাল সমাজের নিয়ম অনুসারে বাড়ির প্রথম সন্তান যদি পুত্র হয়, তার নাম হয় ঠাকুরদাদার নামে, আর যদি কন্যা সন্তান হয়, তার নাম হয় ঠাকুমার নামে। মাথায় চিন্তা ভর করে, তবে কি এ সেই গোষ্ঠীকরণ...বা গোত্রকরণ? এক একটি গোষ্ঠীর নাম অনুসারে কে কোন গোষ্ঠির তা সনাক্তকরণের জন্য বহুযুগ আগে ছিল এই পদ্ধতি...যেমন মাঠে গরু চরানোর সময় আমরা দেখি গরুগুলির গায়ে নানারকমের চিহ্ন। কে কোথা থেকে, কোন বাড়ির জানার সুবিধের জন্য রাখালরা এইরকম চিহ্ন দিয়ে থাকে তাদের গায়ে। গরুর সঙ্গে তুলনা হয়ত অনেকের কাছে অন্যায় বা খারাপ মনে হবে, কিন্তু এই রীতি আমি গ্রামে দেখেছি বলেই আমার এটির কথা মনে পড়ল।

আমি বিস্ময়ে অভিভূত ...যেন সেই আদিযুগের মসীজীবি অথবা দেওয়ান বংশোদ্ভুত সন্তান রাবণ হেমব্রম আমার সামনে দাঁড়িয়ে, যিনি আমাকে সযত্নে এনে হাজির করলেন এক আদিবাসী অধ্যূষিত গ্রামে এক পাড়ায়, যেখানে আমি গিয়েছি তাদেরই সংবাদ যোগাড় করতে। সেদিনের সভ্যতার কারিগর এক গোষ্ঠী আজ নিজেদের জীবনরক্ষার তাগিদে রিক্সা চালাতেও বাধ্য হন। রাবণ হেমব্রমকে আমি ভুলিনি।

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সোমেন দে

Posted in




কলকাতায় আপনি যে পাড়ায় থাকেন সেখান থেকে সব চেয়ে কাছের বড় রাস্তাটি ধরে যদি আপনি দুদিকে তাকাতে তাকাতে হাঁটতে থাকেন তা হলে প্রতি এক কিলোমিটার হাঁটলেই অন্তত তিনটি এমন দোকান চোখে পড়বে যার সামনে একটি করে লাল সালু জড়ানো প্রকান্ড হান্ডি রাখা আছে।

অবশ্য আপনি যদি কলকাতার ভয়ঙ্কর যানবাহনসংকুল রাস্তায় দুদিকে তাকানোটা ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করেন তাহলে , হাঁটবার সময় শুধু আপনার নাকটি সজাগ রাখলেই হবে । পথে চলে যেতে যেতে অচেনা কুসুমের গন্ধ তো নাকে আসবে না এ শহরে , তবে একধরণের গন্ধ নাকে আসবে , যেটাকে ঠিক সুগন্ধ বলতে মন চায় না , আবার দুর্গন্ধ বললেও একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে । আসলে ওটা বিরিয়ানির রেডিমেইড মশলার গন্ধ । এক সময়ে উচ্চশ্রেণীর বাওয়ার্চিরা বারো তেরো রকমের নির্বাচিত উমদা মশলার গোপন কম্বিনেশনে বিরিয়ানিকে শিল্পের রূপ দিত আজ তা কলকাতার আমআদমিদের চটপট ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য জনপ্রিয়তম উপাদান হয়ে গেছে। অতঃপর যা হওয়ার তাই হয়েছে । আখতারি বাঈকে জোর করে মাচার ফাংশনে গাইতে বসালে যা হতে পারে , সেই অবস্থাই হয়েছে ।বিরিয়ানি তার কৌলীন্য হারিয়েছে ।

আপরুচি খানা বলে একটি কথা প্রচলিত ছিল । এখন কেমন যেন সবই আমরুচি হয়ে গেছে , আপরুচি বলে কিছু নেই।এখন এমন অবস্থা হয়েছে যারা সবে ইস্কুল যেতে শিখেছে এমন শিশুদেরও যদি জিজ্ঞেস করা যায় তোমার কী খেতে সব চেয়ে ভাল লাগে , তাহলে দশজনের মধ্যে অন্তত আটজন চটপট করে বলবে বিরিয়ানি । এটা নিশ্চয় ওদের মা বাবাদের কাছেই ওরা পেয়েছে উত্তরাধিকার হিসেবে।তাদের উগ্র বিরিয়ানি প্রেম তারা তাদের সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিতে পেরেছে । অথবা ওরাও তো আজকাল বড়দের সঙ্গে একই নেটওয়ারকের অংশীদার হয়েছে, তাই ওরাও ছোটো থেকেই বুঝে গেছে গেছে, সব বিষয়ে চলতি হাওয়ার পন্থী হওয়াটাই আসলে এ যুগে বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ।

মনে প্রশ্ন জাগছে বঙ্গ জীবনের এই নীরব বিরিয়ানি বিপ্লবটি ঠিক কবে এবং কি ভাবে ঘটে গেল ?

বিরিয়ানি বস্তুটি তো ঠিক নব আবিষ্কৃত কোনো বস্তু নয় , যে বলা যাবে- কোনো এক বিশেষ সময়ে বিরিয়ানি বঙ্গদেশে প্রবেশ করলও আর সগর্বে ঘোষণা করলো, এলাম ,দেখলাম আর জয় করলাম । এমনও নয় যে কলকাতায় বিরিয়ানির কোনো নাম-ও-নিশান ছিলই না কোনো কালে এবং হটাৎ করে নতুন শতাব্দীর প্রবেশের সঙ্গে এটিও কলকাতায় চুপিসাড়ে প্রবেশ করেছে।

সেই লখনৌ থেকে নির্বাসিত নবাব ওয়াজেদ আলি শা , যখন মনের দুঃখে - বাবুল মোরা নইহার ছুটো হি যায়… , গাইতে গাইতে , হাতি ঘোড়া পালকি ,লোক লস্কর পাইক বরকন্দাজ , নৌকর চাকর , তয়ায়েফ , বাইজি , গাইয়ে বাজিয়ে, ওস্তাগর, খানসামা , বাবুর্চি সব নিয়ে মেটিয়াবুরুজে এসে , প্রায় পাঁচশোটি পরিবার সহ আস্তানা গাড়লেন তখনই তো বিরিয়ানির খোসবাইয়ের সঙ্গে কলকাতার পরিচয় ঘটল । সে তো আজকে নয়, সে আজকে নয় ।সেই ১৮৫৬ সালের কথা ।কলকাতার মধ্যে মেটিয়াবুরুজ জায়গাটি নবাবের পছন্দ হয়েছিল হয়ত পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া গঙ্গা নদীটি দেখে । তিনি হয়ত ফেলে আসা গোমতী নদীর দুঃখ গঙ্গা নদীকে দেখে ভুলতে চেয়েছিলেন। মেটিয়াবুরুজে বর্ধমান মহারাজার একটি বাড়ি তিনি মাসিক পাঁচশো টাকা ভাড়ায় নিলেন । ইংরেজদের চালাকিতে তাঁর রাজত্ব যাওয়াতে , তিনি যতটা দুঃখ পেয়েছিলেন তার চেয়ে বেশি দুঃখ পেয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শহর লখনৌ ছেড়ে আসতে হবে বলে । তাই ইন্ডিয়াতে পোস্টেড হওয়া বৃটিশরা যেমন লন্ডন শহর মিস করতো বলে কলকাতাকে লন্ডনের মত করে সাজাতে চেয়েছিল , তেমনি ওয়াজেদ আলি শা মেটিয়াবুরুজে একটা মিনি আওয়ধ তৈরি করতে চেয়েছিলেন ।

সেই ঠুমরি , সেই কাজরি , সেই কত্থক, সেই নৌটঙ্কি, সেই ঘুড়ি ওড়ানো , সেই শের শায়রি, সেই চিকনকারির কারুকাজ, সেই মুরগির লড়াই , সেই শতরঞ্চ খেলা এবং সেখানকার সব উমদা খাবার দাবার , সব তিনি মেটিয়াবুরুজে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন । মোটকথা তাঁর নবাবিগিরির সব কিছুই বজায় রাখতে চাইছিলেন একই ভাবে । ইংরেজ সরকার তাঁকে সেই সময় এক লাখ টাকা করে পেনসন দিত ।কিন্তু তাঁর আইয়াশি এতটাই মাত্রাছাড়া ছিল যে সে টাকাও ফুরিয়ে গিয়ে প্রায়ই ধারদেনা করতে হত । আর যেহেতু এখানে তাঁর রাজ্যপাট ছিল না ,তাই বিচার ব্যবস্থা, শাসন ব্যবস্থা, রাজস্ব আদায়, এই সবের ঝুট ঝামেলা নিয়ে তাঁকে মাথা ঘামাতে হতনা । তাই এখানে তাঁর বিলাসবহুল শখ সাধ আরও বেড়ে গেছল । তার মধ্যে একটা ছিল খাবার নিয়ে নিত্য নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা। নবাবের প্রিয় খাবারে মধ্যে একটা ছিল বিরিয়ানি ।

মেটিয়াবুরুজের প্রাসাদের রান্নাঘরটি নাকি বিরাট ছিল । সেখানে এক এক পদের রান্নার জন্যে এক এক জন আলাদা বাওয়ার্চি থাকত । যে বাওয়ার্চি বিরিয়ানি বানাতো তাকে বলা হত বিরিয়াঞ্চি ।শোনা যায় নবাব নিজেই বাওয়ার্চিদের দিয়ে নানা রকম পরীক্ষা , নিরীক্ষা করাতেন ।খানদানি বিরিয়াঞ্চিরা বিরিয়ানির মশলার বিষয়ে অসম্ভব খুঁতখুঁতে ছিলেন ।নানা জায়গা থেকে আসত তাদের মশলা ।যার মধ্যে প্রধান ছিল কাশ্মীর থেকে নানা উমদা জাফরান । সব কিছুই প্রায় দই দিয়ে দম- পুখত করা হত । তাই তাদের তৈরি বিরিয়ানি হত হালকা ফুরফুরে এবং খোশবাইয়ে ভরপুর ।

আগেই বলেছি নবাব সাহেব সব ব্যাপারেই কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন । তার বাওয়ার্চিরা এটা জানত বলে তারাও নানা রকমে নতুন নতুন রান্না তাকে করে খাওয়াতেন ।

বিরিয়ানির মত খানদানি বস্তুতে আলুর মত একটি অকুলীন বস্তু কী করে জায়গা পেল এটা নিয়ে নানা রকমের মতবাদ আছে । তবে শুধু মাত্র কলকাতার বিরিয়ানিতেই আলু পাওয়া যায় , আওয়াধ বা হাইদরাবাদের বিরিয়ানি আলু নৈব নৈব চ ।

যে গল্পটা প্রচলিত আছে সেটা হল , যেহেতু নবাবের দাওয়াতখানায় কয়েক শো পাত পড়ত এবং আগেই বলা হয়েছে নবাবের এক লাখী পেনশন নবাবের আইয়াশি করতে ফুরিয়ে যেত , তাই খরচা কমানোর জন্য বিরিয়ানিতে মাংসের পরিমান কমানোর দরকার হয়ে পড়ল । তখন সম্ভবত ওয়াজেদ আলি শাহের রান্নাঘরের কোনো এক উদ্ভাবনী বুদ্ধিসম্পন্ন বিরিয়াঞ্চি কম খরচায় বেশি পরিমানের বিরিয়ানির তৈরি করার জন্যেই বিরিয়ানিতে আলু দেওয়া শুরু করেছিল । তবে মনে রাখতে হবে ১৮৫৬ সালে কলকাতায় আলু জনগনের খাদ্য হয়ে ওঠেনি । বাঙালির রোজকার রান্নায় তখনো আলু স্থান পায় নি । এ দেশে আলুর চাষবাষও তেমন ভাবে শুরু হয় নি । তাই আলু বস্তুটি হেলাফেলার করার বস্তু ছিল না । আর আলুর একটি মহৎ গুণ এই যে সে পরিবেশ অনুযায়ী নিজের স্বভাব চরিত্র পালটে ফেলতে পারে । আর আওয়াধি বিরিয়ানি যেহেতু দমপুখত পদ্ধতিতে রান্না হত , মানে যাতে করে রান্নার সময় হাঁড়ির মুখ বন্ধ রেখে রান্না থেকে বেরোনো জলীয় বাষ্প বাইরে বেরিয়ে যেতে দেওয়া হতনা তাই আলু এক পবিত্র আধারের মত, বিরিয়ানিতে দেওয়া সব মশলার খুশবাই আলু নিজের মধ্যে ধারণ করে নিতে পারত ।বলা যেতে পারে বিরিয়ানির আলু অনেক রকমের খুশবুদার উমদা সব মশলার গুণাগুণ নিজের মধ্যে আত্মসাৎ করে নিজেকে উন্নততর আলুতে রূপান্তরিত করে ফেলতে পারে।

কারণ যাই হোক আলু দেওয়ার ব্যপারটা নিশ্চয় নবাবের এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে ওটাই বহাল থেকে গেল । এবং কলকাতা একটি বিশেষ ধরণের বিরিয়ানি পেয়ে গেল ।

বিরিয়ানির মূল আবিষ্কার নিয়েও একাধিক গল্প প্রচলিত আছে । কেউ বলেন বিরিয়ানি আসলে পারস্য দেশ থেকে এ এদেশে এসেছে । এর যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলেন ‘বিরিয়ান’ শব্দের ফারসি ভাষায় মানে হচ্ছে রান্নার আগে ভেজে নেওয়া । এবং চালের ফারসি প্রতিশব্দ বিরিয়াঞ্জ । এ দেশে ১৩৯৮ সনে তৈমুরের ভারতে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে বিরিয়ানির এ এদেশে প্রবেশ ঘটেছিল । কেউ আবার আরো একটু পিছিয়ে গিয়ে বলেন খৃষ্টপূর্ব দুই শতকে যখন আরব ব্যবসায়ীরা মালাবার উপকুলে ব্যবসা করতে আসেন তখনই তাদের সঙ্গে বিরিয়ানি এ এ দেশে আসে । প্রাচীন তামিল সাহিত্যে উন সরু বলে একটি খাদ্যের বিবরণ পাওয়া যায় যার মধ্যে চাল , ঘি এবং মাংসের সঙ্গে নানা রকম মশলা দিয়ে রান্না করা হত ।

তবে যে গল্পটি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সেটি হল , সাজাহানের প্রিয়তমা পত্নী মুমতাজ মহল একবার সৈন্যদের ব্যারাক দেখতে গেছলেন । সেখানে সৈন্যদের স্বাস্থ দেখে মনে হয়েছিল এই দুর্বল স্বাস্থ নিয়ে তারা যুদ্ধ করবে কী করে ! তাদের পুষ্টিকর কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা দরকার । তিনি ব্যারাকের বাওয়ার্চিওকে পরামর্শ দিলেন ভাত আর মাংস মিশিয়ে একটা স্বাস্থকর খাবার সৈন্যদের জন্যে বানাতে । সেই বাওয়ার্চি তখনকার মালিকা-এ-হিন্দুস্থানের হুকুম পালন করতেই বিরিয়ানি বস্তুটির আবিষ্কার করে ফেলেন । তারপর মুঘলদের হাত ধরেই তা ভারতে নানান প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে ।

তবে ঠিক যেমন মূলত পালি আর সংস্কৃত দুটো ভাষা থেকেই অঞ্চলে বেশির ভাষার সৃষ্টি হয়েছে , তেমনি বিরিয়ানিরও মূল দুই চরিত্র চাল এবং মাংস হলেও , এক অঞ্চলে স্বাদে গন্ধে এক এক রকমের চেহারা নিয়েছে।

যেমন যে শহর বিরিয়ানির জন্যে জগৎ বিখ্যাত , সেই হায়দারবাদের বিরিয়ানি প্রধানত ‘কাচ্চি’ গোত্রের। এতে সুগন্ধী জাফ্রান কেশরের ভুমিকা প্রধান ।আর হাইদারাবাদে মাংস ছাড়াও , মাছ , চিংড়ি মাছ ইত্যাদির বিরিয়ানিও বেশ প্রচলিত।

চেন্নাইতে যে বিরিয়ানি পাওয়া যায় তা দিন্দিগুল গোত্রের । এতে অন্য ধরনের মশলা থাকে ।যার মধ্যে প্রধান জিরা ও সাম্বা মশলা । সেই সঙ্গে গোলমরিচের ঝাল । এবং বড় মাংসের টুকরোর বদলে থাকে ছোটো ছোটো মাংসের পিস ।

লখনৌভি বিরিয়ানি কিছু বিশেষ মশলা দিয়ে কম আঁচে অনেকক্ষণ ধরে তৈরি করা হয় ।

মালাবার অঞ্চলে যে বিরিয়ানি পাওয়া যায় তার নাম থালাসেরি বিরিয়ানি । এতে কাইমা নামের এক ধরনের চাল , কিছু মালাবারি মশলা এবং মুর্গির ঠাং ব্যবহার করা হয় ।সেই সঙ্গে থাকে কাজু কিসমিস এবং মৌরি ।

আসামে একধরণের বিরিয়ানি পাওয়া যায় যাকে বলা কামপুরি বিরিয়ানি । এতে আগে মুরগির মাংসের সঙ্গে , গাজর বিন্স ক্যাপ্সিকাম মিশিয়ে রান্না করে নেওয়া হয় । তার পর পর এলাইচি , জায়ফল সহ চালের সঙ্গে মেশান হয় ।

ম্যাঙ্গালোর অঞ্চলের বিরিয়ানিতে চালের সঙ্গে ঘি আর সুগন্ধি মশলা মিশিয়ে সারারাত রেখে দেওয়া হয় ।সেই চাল পরের দিন মাংস , সি ফূড , এবং কিছু সবজি মিশিয়ে রান্না করা হয় ।

সিন্ধি বিরিয়ানিতে থাকে প্রচুর পরিমানে কাঁচা লঙ্কা , রোস্ট করা বাদাম , আলুবোখারা এবং টক দই ।

হায়দারাবাদে আর এক ধরণের বিরিয়ানিও পাওয়া যায় যাকে বলে দুধ কি বিরিয়ানি । যেটি হায়দারবাদের নিজামের বিশেষ পছন্দের ছিল । এতে অন্যান্য সুগন্ধি মশলার গাড় দুধের সঙ্গে বাদাম মেশানো হয় ।

আর কলকাতার বিরিয়ানির কথা আগেই বলা হয়েছে , নৈবেদ্যর নাড়ুর মত সেই বিরিয়ানির প্লেট আলো করে থাকে একটি সোনার বন্ন আলু । যে আলু অন্য যায়গায় এলেবেলে সেই আলু বিরিয়ানি চুড়ায় উপস্থিতি রীতিমর সম্ভ্রম জাগানো ।

এখন প্রশ্ন হল , নবাবের হাত ধরে কলকাতায় বিরিয়ানির প্রবেশ ঘটে থাকলেও কিন্তু বিরিয়ানি , করেকটি বিশেষ অঞ্চল ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যেতনা । কয়েক দশক আগেও হিন্দু বাঙালির বিয়ে বাড়ির মেনুতে বিরিয়ানির প্রবেশ অতি বিরল ঘটনা ছিল । তবে আজ তা স্বাভাবিক হয়েছে । নব্বইয়ের দশকেও বিরিয়ানি খেতে হলে খিদিরপুর , বা মধ্য কলকাতার হাতে গোনা কয়েকটি রেস্তোঁরাতেও যেতে হত ।আর আজকের অবস্থা তো আগেই বলা হয়েছে।

যদি একটু পিছিয়ে গিয়ে খুঁজি , ১৮২৬ সাল নাগাদ যখন হিন্দু কালেজের ছাত্ররা ডিরোজিয়োর নেতৃত্বে হিন্দু ধর্মের সব কুসংস্কার ভাঙ্গবার প্রবল উৎসাহে হিন্দু সমাজে অপ্রচলিত , নিষিদ্ধ সব খাবার খেতে আরম্ভ করেছিলেন , এমন কি তখন তারা পাবলিকলি গো মাংসও খেতে আরম্ভ করেছিলেন । তখনও তারা বিরিয়ানি খেয়েছিলেন বলে শোনা যায় না ।যদি বিরিয়ানি সে সময় কলকাতায় কোথাও পাওয়া যেত এবং হিন্দুদের মধ্যে তা নিষিদ্ধ থাকত তা হলে তারা নিশ্চয় সেই প্রথা ভেঙ্গে বিরিয়ানিও খেতেন ।

সেই সময়ের একটি মজার গল্প বলে নিই । এটি রাজনারায়ন বসুর সেকাল ও একাল বইতে পাওয়া যাবে ।

‘ একবার উইলসন হোটেলে দুই বাঙালি বাবু আহার করিতে গিয়াছিলেন । এক বাবুর গরু ভিন্ন চলেনা । তিনি খানসামাকে জিজ্ঞাসা করিলেন , বীফ হ্যায়? খানসামা উত্তর করিল ‘নহি হ্যায় খোদাওন্দ’ । বাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন ‘বীফ স্টেক হ্যায় ?’খানসামা উত্তর করিল ‘ওভি নহি হ্যায় খোদাওন্দ। বাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন ‘অকস টং হ্যায় ?’ খানসামা উত্তর করিল ‘ওভি নহি হ্যায় খোদাওন্দ। বাবু পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন ‘কাফস ফুট জেলি হ্যায়?’ খানসামা উত্তর করিল ‘ওভি নহি হ্যায় খোদাওন্দ।’

এই বার দ্বিতীয় বাবু বিরক্ত হইয়া বলিলেন , ওরে বাবুর জন্য গরুর আর কিছু না থাকলে খানিকটা গোবর এনে দে না ?’

এখানে লক্ষ করবার মত বিষয় , এখানে বাবুটি কিন্তু বীফ বিরিয়ানি চায় নি ।

১৯০১ সালে লেখা ঠাকুর বাড়ির কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী ‘আমিষ ও নিরামিষ আহার’ নামের যে বইটি লিখেছিলেন সেটি তাতে সেই সময়ে বঙ্গদেশে প্রচলিত সব সব রকমের পদের কথাই উল্লেখ করা হয়েছিল । সেখানে অনেক রকমের পোলাও এর রন্ধন প্রণালীর বিবরণ আছে । যেমন , মোহন পোলাও , মিঠাজার্দা পোলাও, মালাই পিশপাশ পোলাও , পানি পোলাও , ছানার পোলাও , বাসন্তী পোলাও , দোলমা পোলাউ ইত্যাদি। কিন্তু সেখানে বিরিয়ানির কোনো উল্লেখ নেই ।

১৯৮৫ সালের পূর্ণিমা ঠাকুর, আর এক ঠাকুর বাড়ির বধু রচিত ‘ঠাকুরবাড়ির রান্না’ বই লিখেছলেন । এই বইটি আসলে ইন্দিরা দেবী চৌধুরানীর একটি নোটবই থেকে সংগ্রহ করা রন্ধন পদ্ধতি । ইন্দিরা দেবী আসলে নিজে রান্না করতেন না , কিন্তু বাড়িতে কিছু রান্না হলে হলে সেগুলির রন্ধন পদ্ধতি লিখে রাখতেন । এর মধ্যে শুধু মাত্র বাঙালি রান্না নয় নানা রকমের বিদেশী রান্না যা ঠাকুর বাড়িতে হত , তার রন্ধন পদ্ধতির বিবরণ দিয়েছেন । তাতে মাংসের চাউমিন , মুরগির রসল্লা , আইরিশ স্টূ , ফিলিপিনি মুরগি কারি , শাহি কোর্মা এই সব মুঘলাই বা বিদেশী রান্নার রেসিপি থাকলেও বিরিয়ানির উল্লেখ নেই । এতদ্বারা এই সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে কিনা যে রবীন্দ্রনাথ কখনো বিরিয়ানির রসগহন করেন নি , তা পাঠক বিচার করবেন ।

সামনেই আমাদের শারদোৎসব আসছে । অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে এই উৎসব বাংলার রসনা তৃপ্তিরও উৎসব ।এই সময়ে বাঙালির একটি ডিসিশন মেকিং সমস্যা হল - কী খাইব আমি কী খাওয়াইবো আজি আনন্দধামে… ।

ফাশনের জগতে এ বছর কী কী বিপ্লব আসবে , কত হাজার বা লাখ নতুন ভার্সনের মোবাইল ফোন বিক্রি হবে এ বছর , কোন ধরণের থীমপুজো এ বছরের ট্রেন্ড হবে , এ সবের অনুমান করার মত ক্ষমতা আমার অন্তত নেই ।কিন্তু খুব জোরের সঙ্গে একটি অনুমান করা যায় যে এই পাঁচ দিনে বাঙালি অন্তত কয়েক কুইন্টল বিরিয়ানি ভক্ষন করবে।

একা একা , দোকা দোকা , দল বেঁধে । পাড়ার পুজোয় , অন্য পাড়ার পুজোয়, অন্য কোথাও বেড়াতে গিয়ে । রাস্তার ধারে কয়েকটা ইঁটের উপর কাঠের পাটাতন বসিয়ে মেকসিফট আউটলেটে গিয়ে বসে খাবে , আবার বিরিয়ানি স্পেপালিস্ট এসি রেস্তোরাঁর বাইরে এবং ভীতরে ঘন্টা খানেক লাইন দিয়ে তবে গিয়ে বসতে পাওয়ার মত বিরাট অ্যাচিভমেন্টে উল্লাস করে খাবে । যাদের ভীড়ভাট্টা না- পসন্দ , যারা নিজের মুদ্রা দোষেই আলাদা হতে চান , তারা অনলাইনে অরডার করে বাড়িতে আনিয়েও খাবে।

বিরিয়ানি-শৌকীন ব্যাক্তিরা , নিশ্চয়ই এ লেখা এতক্ষণ ধৈর্য্য ধরে পড়ছেন না । যদি তাও কেউ পড়েই থাকেন তো , তাদের কাছে আত্মপক্ষ সমর্থন করার সুযোগ পেলে এই টুকু নিবেদন করতে পারি যে , মাঝে সাঝে বিরিয়ানি খেতে আমারও ভালোই লাগে , যদি সেই বিরিয়ানির মধ্যে রন্ধন শিল্পীর শিল্পীসুলভ নিষ্ঠার ছাপ থাকে । কিন্তু ওই যে আগে বলেছি , আখতারি বাঈকে দিয়ে মাচার ফাংশনে গাওয়াবার মত ব্যাপার হলে , আমি বরং বিরিয়ানির চেয়ে পান্তাভাত বা খিচুড়ি খেতে বেশি পছন্দ করবো ।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

২১

ওরা আবার নিচ থেকে তার পা চেপে ধরল। সে আর্তনাদ করে উঠল, কারণ সে কামান, বন্দুক ইত্যাদি দেখতে পেয়েছে। গোলাগুলি চলার আওয়াজ পেয়েছে। ট্রাকের ভেতরের গুঞ্জনটাও আরও জোরদার হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে কামানের শব্দ মিলিয়ে যেতে লাগল। যেসব গোলাগুলির শব্দ ভীষণ সামনে থেকে শোনা যাচ্ছিল, সেগুলো অনেকখানি দূর বলে মনে হল।এবার যে দিকে গোলাগুলি ছোঁড়া হচ্ছে, তারা সম্ভবত সেই দিকেই এগোচ্ছিল। আবার অনেকগুলো ট্যাঙ্ক দেখা গেল। আবার এক বিশাল বাহিনী। আবার গোলাগুলি, তবে এবার ছোটখাট লড়াই।যারা গোলা ছুঁড়ছিল, তারা একটা কুয়োর পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের বন্দুক থেকে বেরিয়ে আসা আগুনের হল্কায় কুয়োর উপরের কপিকল, দড়ি ইত্যাদি আলোকিত হয়ে উঠছিল। তারপর অনেকক্ষণ আর কিছু দেখা যায়নি। বেশ কিছু সময় তারা একটা বাহিনীর দেখা পেল। তারপর অনেকক্ষণ শান্তি। তারপর ফিঙ্ক আবার মেশিনগানের শব্দ পেল। যেদিক থেকে শব্দ আসছে, ট্রাক সেদিকে চলতে লাগল।

ট্রাকটা হঠাৎ এসে একটা গ্রামে থামল।ফিঙ্ক বাকি সবার সঙ্গে ট্রাক থেকে নেমে এল। গ্রামে চারদিকে হুলস্থূল কাণ্ড চলছে। সব জায়গায় গাড়ি, ট্রাক এসব পার্ক করা আছে। লোকজন চিৎকার করছে। সৈন্যরা ইচ্ছামত রাস্তা দিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। মেশিনগানের শব্দ বেশ জোরে শোনা যাচ্ছে। ফাইনহালস অপেশাদার অফিসারের পেছন পেছন গিয়েছিল। সেই অফিসার তার সঙ্গে একটা বিশাল স্যুটকেস নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার চেহারা এতটাই ছোটখাট যে কাঁধের রাইফেলের বাটটা মাটিতে ঠেকে যাচ্ছে বার বার। ফাইনহালস নিজের ব্যাগটার ফিতে শক্তভাবে কাঁধের সঙ্গে আটকে লম্বা লম্বা পা চালিয়ে ওই অফিসারকে ধরে ফেলল।

‘ওর মধ্যে কী?’ স্যুটকেসটা দেখিয়ে সে প্রশ্ন করল… ‘কোথাও রেখে দাও।’

‘ওয়াইন আছে। আমার বসের জন্য।’ ছোটখাট মানুষটি হাঁপাতে হাঁপাতে জবাব দিল।

‘যতসব ফালতু ব্যাপার। রেখে দাও এখানে।’ ফাইনহালস বলে… ‘এই স্যুটকেস নিয়ে কদ্দুর যাবে? গাড়িতে উঠলে সামনে তুলতে দেবেনা।’

ছোটখাট লোকটা মাথা নাড়ল গোঁয়ারের মত। লোকটা এত ক্লান্ত যে হাঁটতেই পারছেনা। স্যুটকেসটা হাতে নিয়ে খালি লাট খাচ্ছে এদিক ওদিক। বিমর্ষ ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে ফাইনহালসকে ধন্যবাদ বলল লোকটা, যেহেতু সে স্যুটকেসের হাতলটা ধরেছে। ফাইনহালসের কাছে স্যুটকেসটা অসম্ভব ভারি বলে মনে হল।

তাদের ডানদিকে মেশিনগানের শব্দটা বন্ধ হয়েছে। তবে ট্যাঙ্কগুলো গ্রামে ঢুকে গোলা ছুঁড়তে শুরু করেছে। তাদের পেছনেই একটা বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেল। আবছা আগুনের হল্কায় নোংরা গ্রামের পথটা আলোকিত হয়ে উঠল। উত্তেজিত লোকজন এদিক ওদিক ছুটে পালাতে লাগল।

‘ওই বোঝা ফেলে দাও!’ বলে ওঠে ফাইনহালস… ‘তুমি উন্মাদ!’ লোকটা জবাব দেয় না। উল্টে স্যুটকেসের হাতলটা আরও জোরে আঁকড়ে ধরে। তাদের পেছনে পর পর দুটি বাড়িতে আগুন জ্বলতে থাকে।

হঠাৎ তাদের সামনে যে লেফটেন্যান্‌ট ছিলেন তিনি থমকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলেন, ‘বাড়িটার সামনে দাঁড়াও!’ তারা যে বাড়িটার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, সেই বাড়িটার কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়াল। ছোটখাট সেই সার্জেন্ট খোঁড়াতে খোঁড়াতে গিয়ে সেই বাড়িটার দেওয়ালের সামনে গিয়ে সেই স্যুটকেসটাকে চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বামদিকের মেশিনগানের কোনও আওয়াজ আসছে না আর। যে লেফটেন্যান্‌ট ওই বাড়ির ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলেন, তিনি সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন লেফটেন্যান্টকে নিয়ে বাড়িটার থেকে বেরিয়ে এলেন।

ফাইনহালস এই লেফটেন্যান্টকে চিনতে পেরেছে। তাদের সেই লাইনে দাঁড় করানোর দিন থেকেই সে চেনে তাঁকে। ইনি এখন যা কিছু করছেন যাতে তার বুকে আরেকটা পদক শোভা পায়, সেইজন্য। ইতিমধ্যেই তিনি আরেকখানি পদক পেয়ে গিয়েছেন। এখন সত্যিকারের একটা পদক, লাল, সাদা এবং কালো। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, ভাবছিল ফাইনহালস, যে তিনি এই পদক পেয়ে গিয়েছেন। লেফটেন্যান্ট মুহূর্তের জন্য পদকের দিকে চেয়ে তার মৃদু হাসিটা খেয়াল করেছেন। তার পর আবার বলে উঠলেন… বেশ!’ তারপর নিজেও হেসে বলে উঠলেন… ‘ভাল? তাই না?’ বলে তার পেছনের লেফটেন্যান্টের দিকে তাকালেন। কিন্তু পেছনের জন কিছু জবাব দিলেন না। পেছনের মানুষটিকেও এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। ছোটখাট, ফ্যাকাসে চেহারা। বয়স খুব কম নয়। তার মুখটা অপরিষ্কার এবং গম্ভীর। বুকে একটাও পদক নেই।

‘হের ব্রেশট!’ পিছনের লোকটিকে লেফটেন্যান্ট বলে উঠলেন… ‘দুজন লোককে নিয়ে নিন আপাতত। অ্যানটি ট্যাঙ্ক বন্দুকও রাখবেন। বাকিদের উনডলফের কাছে পাঠাতে হবে। চারজন, আমার মতে… বাকিদের আমি আমার কাছে রাখছি।’

‘দুই’ বলে উঠলেন ব্রেশট, ‘হ্যাঁ, দুই, আর বন্দুক আপনার সঙ্গেও রাখুন।’

‘একদম ঠিক!’ বলেন লেফটেন্যান্‌ট … ‘আপনি জানেন কোথায় কী আছে।’

'হ্যাঁ সত্যিই!’

‘আধা ঘন্টার মধ্যে রিপোর্ট করুন, প্লিজ!’

‘হ্যাঁ!’

প্রথম যে লেফটেন্যান্ট ছিলেন তিনি ফাইনহালস এবং ফিঙ্ককে বুকে টোকা দিলেন। দ্বিতীয় পেছনের জন বললেন, ‘আসুন’। বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে একবারে হাঁটতে শুরু করলেন। তার সঙ্গে তাল রাখবার জন্য তাদের তাড়াহুড়ো করতে হয়েছিল। ছোটখাট ওই সার্জেন্ট তার স্যুটকেস বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, ফাইনহালস তাকে সাহায্য করল এবং তারা যত দ্রুত সম্ভব লেফটেন্যান্টকে অনুসরণ করে বাড়ির পিছনে গেল। বাড়িটার ডানদিকে একটা সরু গলি বেড়া আর ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে সোজা একটা খোলা মাঠে চলে গিয়েছে। তারা যখন সেখানে যাচ্ছিল, জায়গাটা কিছুটা শান্ত ছিল; কিন্তু তাদের পিছনে সেই ট্যাঙ্কটা এখনও গ্রামে সমানে গোলা ছুঁড়ে যাচ্ছে। শেষবার তারা যে ছোট ট্যাঙ্কটা দেখেছিল, সেটা এখন ডানদিকে গোলা ছুঁড়ছে এবং তারাও মোটামুটি সেই দিকেই এখন যাচ্ছে।

ফাইনহালস হঠাৎ করে মাটিতে শুয়ে পড়ল। চেঁচিয়ে বাকি দুজনকে বলল, ‘হুঁশিয়ার!’

স্যুটকেসটা ফেলে দেবার সঙ্গে সঙ্গে বেশ বড় একটা শব্দ হল। তাদের সামনের লেফটেন্যান্টও মাটিতে শুয়ে পড়ল। সামনের দিকে যে জায়গাটা থেকে মার্চ করে এসেছে তারা, সেখানে বেশ কিছু গ্রেনেড চার্জ করা হয়েছে গ্রামে। তারা এখন মুহুর্মুহু ছুঁড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে শেষ নেই। গ্রেনেডের ফুল্কি হাওয়ায় উড়ছে। বাড়িগুলোর দেওয়ালে এসে লাগছে। বড় টুকরোগুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ছে। তাদের অবস্থান থেকে খুব দূরে নয় এই আক্রমণের স্থান।

‘উঠে পড়ুন!’ বলে উঠলেন সামনের লেফটেন্যান্ট… ‘এগিয়ে চলুন!’

‘এক মিনিট!’ বলে ওঠে ফাইনহালস। সে হাল্কা মৃদু কাচ ভাঙার শব্দ পেয়েছে এবং শব্দটা শুনে তার ভয় বেড়ে গেছে। গ্রেনেডের ফুল্কিটা ফিঙ্কের স্যুটকেসে পড়ামাত্র বিকট একটা বিস্ফোরণের শব্দ পেল। স্যুটকেসের ঢাকনাটা খুলে বেরিয়ে গেল উড়ে। অজস্র কাচের টুকরো বাতাসে উন্মাদ পাখির ডানার ফোয়ারার মত ছিটকে পড়ল। ফাইনহালসের মনে হল ওয়াইনের ফোঁটা এসে লাগলো তার গায়েও। সে ভয়ে নিচু হল। এটা কোনও বন্দুকের গুলি থেকে নয়। গ্রেনেডের ফুল্কি স্যুটকেসে পড়েই এই কাণ্ড। সামনের মাঠের আলের উপরে বিকট আওয়াজ। একটা খড়ের গাদা দুই ভাগ হয়ে ভেঙ্গে পড়ল। সেটার মধ্য থেকে গলগল করে আগ্নেয় পাহাড়ের মত আগুনের শিখা উঠতে শুরু করল।

লেফটেন্যান্ট ঢালু জায়গাটা দিয়ে নেমে এলেন, ‘যাচ্ছেতাই!’ ফিসফিস করে ফাইনহালসকে বললেন, ‘এসব ক্কী হচ্ছে?’

‘ওর স্যুটকেসে ওয়াইন ছিল’ ফাইনহালস ফিসফিস করে বলল।

‘ওহে, শুনছো!’ লেফটেন্যান্ট ফিঙ্ককে মৃদুভাবে ডাকলেন; স্যুটকেসের পাশে একটি কালচে দলা হয়ে সে পড়ে আছে। একেবারে নড়ছে না। ‘উফফ… কোনও মানে হয়’ লেফটেন্যান্ট মৃদুস্বরে বলে উঠলেন, ‘এ কি আর উঠবে…’

ফাইনহালস দু পা হামাগুড়ি দিয়ে পৌঁছে গেল ফিঙ্কের কাছে। নিজের মাথাটা ঠেকল লোকটার পায়ে। তারপর কনুইতে ভর দিয়ে এগিয়ে গেল তার পাশে… এই ঢালু জায়গাটা একদম অন্ধকার। পাশের খড়ের গাদা থেকে আগুনের আলো এই অবধি পৌঁছাচ্ছে না। অথচ পাশের খোলা মাঠ আলোতে সম্পূর্ণ উদ্ভাসিত হয়ে আগুনের হল্কায় স্নান করছে।

‘ওহে, শুনছ!’ ফাইনহালস শান্তভাবে বলল। সে ওয়াইনের শক্তিশালী, মিষ্টি বাষ্পের গন্ধ পেয়েছিল। নিজের হাত পিছনে টেনে নিয়েছিল সে, কারণ চতুর্দিকে কাচের টুকরো ছড়িয়ে আছে। সতর্কতার সঙ্গে এগিয়েছিল সে জুতো ঘষে ঘষে। ফিঙ্কের কাছে গিয়ে তার ছোটখাট চেহারা দেখে সে অবাক হল। এই অফিসারের পা ভীষণ ছোট, খুব রোগা শরীর।

‘ওহে, শুনছ!’ সে মৃদুভাবে আবার ডাকল, ‘শুনছ বন্ধু?’ কিন্তু ফিঙ্ক উত্তর দিল না।



(চলবে)

0 comments:

0

ধারাবাহিক - রাজা মুখোপাধ্যায়

Posted in




পর্ব ২৪

স্বপ্নের শহর – মিলান

আগের বারের মতো এবারও এক সন্তকে দিয়ে শুরু করতে ইচ্ছে করছে এই লেখা। সন্ত বিয়াজিও। খ্রিস্টধর্ম তখনও শৈশব পেরোয়নি। সেইরকম এক সময়ে তৃতীয় শতকের দ্বিতীয় ভাগে তাঁর জন্ম হয় তৎকালীন আরমেনিয়ার কাপুডোশায়। ছোটোবেলা থেকেই বিয়াজিওর আগ্রহ ছিল নানা বিষয়ে – তার মধ্যে সাহিত্য, চিকিৎসাশাস্ত্র আর পদার্থবিদ্যার প্রতি তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। পরবর্তীকালে অবশ্য তাঁর নাম ছড়িয়ে পরে নানান অলৌকিক ক্ষমতার কারণে। এই সন্ত বিয়াজিও একবার একটি ছেলের প্রাণ বাঁচান একটুকরো রুটি দিয়ে। খাওয়ার সময় মাছের কাঁটা গলায় আটকে জীবনসংশয় হয়েছিল ছেলেটির। খ্রিস্টধর্মের প্রতি চূড়ান্ত আনুগত্যের প্রশ্নে রক্ষণশীল এবং ক্যাথলিক – দুই গোষ্ঠীই বিয়াজিওকে প্রদান করেছিল সর্বোচ্চ স্বীকৃতি । দুই সম্প্রদায়ের কাছেই হয়ে উঠেছিলেন সমান আদরণীয়। আর ঠিক এই কারণেই কাপুডোশার শাসকদের কাছে তিনি ছিলেন চক্ষুশূল। বিচারের এক প্রহসন তৈরি করে তাঁকে ৩১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। সেই থেকে এই দিনটি শহীদদিবসের মর্যাদা পায় অনেক দেশেই আর ইতালির অনেকাংশে ক্রিসমাসের সময় থেকে রেখে দেওয়া একটুকরো ‘পানেত্তোনে’ খেয়ে স্মরণ করা হয় মহান সেই মানুষটিকে আর মনে করা হয় গলার যাবতীয় অসুখ থেকে বছরভর রক্ষা করবে রুটির সেই টুকরোটি। কিন্তু যে খাদ্যবস্তুটি এত মাতামাতির কেন্দ্রে, যা একাধারে রুটি এবং কেক, জনপ্রিয়তা, ধর্মীয় আচারের মানদণ্ডে যার গুরুত্ব চরম প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, তার দিকে আলাদাভাবে একটু ফিরে তাকানো যাক।

প্রায় পাঁচশো বছর আগেকার কথা। মিলান শহরের ডিউকের ক্রিসমাসের ভোজসভার ডেসার্ট গেল পুড়ে! টোনি নামে এক রাঁধুনির ওপর দায়িত্ব পড়লো চটজলদি সেই সংকট সমাধানের। জন্ম লাভ করল ‘পানে দি টোনি’র। কালক্রমে যা হয়ে দাঁড়ালো ‘পানেত্তোনে’। আসলে ইতালিয়ান ভাষায় ‘পানে’ শব্দের অর্থ রুটি বা ব্রেড। আবার ‘পানেত্তো’ মানে ছোট কেক। তার সঙ্গে ‘নে’ প্রত্যয় যেই যোগ হল, তার সারমর্ম দাঁড়ালো ‘বড় কেক’। মজার না? আদপে এটি এমন এক বস্তু, যা না রুটি, না কেক। ‘পানেত্তোনে’র মধ্যে রয়েছে কেকের প্রত্যাশিত আর্দ্রতা এবং রুটির অভ্রান্ত চারিত্রিকতা। এই যে না-রুটি না-কেক হাঁসজারু ব্যাপারটি আয়ত্ত করা কি ভীষণ কঠিন, প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে কথা না বললে ঠিকমতো বোঝা যাবে না। এমনিতেই বল্গাহীন আবেগের শিকার না হলে কেউ বেকার হয়না আর হলেও পানেত্তোনে তৈরি করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে না। পদ্ধতিগতভাবে বেকিং হেঁশেল সংস্কৃতির এমন একটি অধ্যায়, যার প্রত্যেক পদক্ষেপে জটিলতা আর বৈজ্ঞানিক হিসেব-নিকেশ। ভুল করে শুধরে নেওয়ার সুযোগ নেই বললেই হয়। মনে আছে, এই শহরেরই একটি ক্লাবে কয়েক বছর আগে বিখ্যাত ইতালিয়ান শেফ এবং রান্নার বইয়ের লেখক রবার্তা স্কিরা ইতালিয়ান রান্নার এক ডেমোতে এই তত্ত্বটি ব্যাখ্যা করেছিলেন চমৎকারভাবে। তিনি বলেছিলেন, বেকিং-এর সময় কোনও উপাদানের এক গ্রামের এদিকওদিক প্রকৃতপক্ষে এক টনের সমান। সত্যিই তাই। এ বিষয়ে ন্যুনতম অভিজ্ঞতসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করে নেবেন এই মন্তব্যের সারবত্তা। আর এই মন্তব্যের সূত্র ধরেই আতস কাচের তলায় ফেলতে হবে পানেত্তোনে তৈরির প্রক্রিয়াকে।

আগেই লিখেছি মিলান শহরের এক রাজকীয় ভোজসভায় আকস্মিকভাবে জন্ম হয়েছিল পানেত্তোনের। যাঁর কল্পনাশক্তি থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এমন একটি খাদ্যের, এক ইতালিয়ান আইকনের, তিনি নিজেও সম্ভবত অনুমান করতে পারেননি এক সংকটের মোকাবিলা করতে গিয়ে তিনি কী করে বসলেন। নানান দেশের রান্নাঘরের ইতিহাসের সঙ্গে অবশ্য জড়িয়ে আছে অজস্র এ ধরনের নাটকীয় কাহিনী। তুমুল জনপ্রিয় অস্ট্রিয় কফি কেক ‘সাখার টর্টে’র আবির্ভাবও একইরকম পরিস্থিতিতে হয়েছিল। সেকথা আমাদের অজানা নয়।

আজকের পানেত্তোনেকে নিয়ে কোনও আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই যাঁর উল্লেখ করতে হবে, তাঁর নাম এঞ্জেলো মোত্তা। ১৯১৯ সালে এই মোত্তার হাত ধরেই মিলান শহরে পানেত্তোনের নবজন্ম ঘটে। এইসব গভীর জ্ঞানগম্যি বইপত্তর ঘেঁটে অর্জন করতে চাওয়ার ইচ্ছের পিছনে উদ্দীপকের কাজ করেছিলেন যিনি, সেই ওরাৎসিও ডি রাইমোন্দো, যিনি আসলে রান্নাবান্না সম্পর্কিত আমার সমগ্র চেতনাটিই বদলে দিয়েছিলেন তাঁর অজান্তেই, তিনিই ন’বছর আগে মিলান শহরের এক ক্যাফেতে প্রথম এই আটপৌরে কিংবদন্তিটির সঙ্গে পোশাকি আলাপ করিয়ে দেন। সাক্ষাৎকারের সময় পার করে অনেক দেরিতে ওরাৎসিও সেদিন হাজির হয়েছিল একগাল ছোঁয়াচে হাসি নিয়ে আর তারপর দেরির জরিমানাস্বরূপ আমাদের নিয়ে গিয়েছিল সেই ক্যাফেতে।

প্রথম দর্শনে পানেত্তোনেকে ছোটবেলা থেকে দেখে আসা ফ্রুটকেকের থেকে তেমন অন্যরকম কিছু মনে হয়নি। ওরাৎসিওকে সেকথা বলায় তার মুখে ফুটে উঠেছিল মৃদু হাসি। সেই প্রথম জেনেছিলাম কেক হয়েও কেন কেক নয় আবার পুরোপুরি রুটিও কেন বলা যাবে না পানেত্তোনেকে। রুটি কারণ এতে Lievito Madre বা প্রাকৃতিক ইস্টের ব্যবহার। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ময়দার মধ্যে সেই ইস্টের প্রয়োগ করে অপেক্ষা করতে হবে দীর্ঘক্ষণ। আবার কেকের মতোই এতে মাখন আর ড্রাই ফ্রুটের অপর্যাপ্ত উপস্থিতি। এখনও পর্যন্ত এইসব তথ্য থেকে এমন কোনও ছবি তৈরি হচ্ছে না, যা থেকে এই কেকরুটি বা রুটিকেকের অনন্যতার ব্যাপারটি ঠিক বোঝা যায়। কেনই বা মিলান শহরের সঙ্গে তার এই গভীর আত্মীয়তা? এখানেই মোত্তা এবং পরবর্তীকালে জুয়াঙ্কিনো আলেমানার ব্যবসায়িক বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যাবে না। মিলানের অপূর্ব সুন্দর বিশ্বখ্যাত ক্যাথিড্রালের গম্বুজের সঙ্গে সাদৃশ্য আনার জন্য পরিবর্তন ঘটানো হল পানেত্তোনের আকৃতিতে। লম্বাটে চেহারার পানেত্তোনের আবিষ্কার ঘটল তখনই। কিন্তু এই আকৃতি ধরে রাখা অতি কঠিন কাজ। কারণ ঠাণ্ডা হয়ে গেলেই মাথাটি চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য উদ্ভাবিত হল এক আশ্চর্য পন্থা। আভেন থেকে বের করার পরই হেঁটমুণ্ড করে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় পানেত্তোনের দলকে এবং সেইভাবে রেখে দেওয়া হয় যতক্ষণ না সেগুলি সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা হচ্ছে। একবার ঠাণ্ডা হয়ে গেলে আর আকৃতিগত কোনও বদল হয়না। ক্রিসমাসের আগে অনেক সময়েই যখন মিলানের রাস্তাঘাট বরফে ঢেকে যায়, পেস্ট্রিশপগুলির ভিতরে উজ্জ্বল আলো আর কাচের ধারে থরে থরে সাজানো পানেত্তোনে এক পরাবাস্তব রহস্যময়তা তৈরি করে। এইসময় কোনও ক্রেতা যখন সেই দোকানে প্রবেশ করেন, বিক্রেতা সৌজন্য বিনিময়ের পর তার হাতে তুলে দেন একটুকরো পানেত্তোনে, চেখে দেখার জন্য। সঙ্গে একচুমুক প্রসেকো থাকলে তো সোনায় সোহাগা। অনেক ইতালীয় পরিবারে, বিশেষত উত্তরে, ক্রিসমাসের সময় অতিথি আপ্যায়নের এটিই আদর্শ রীতি বলে ধরে নেওয়া হয়।

কথিত আছে, ছুরি দিয়ে লম্বালম্বি যখন পানেত্তোনে কাটা হয়, তাকে মূল কেক থেকে আলাদা করার জন্য সামান্যতম চেষ্টাও করতে হয়না। কিন্তু কেন? আদিযুগে ময়দা আর মাখনের ভাগ ছিল এক কিলো ময়দায় চারশো গ্রামের মতো মাখন আর বিংশ শতাব্দীর গোড়া থেকে ধীরে ধীরে পানেত্তোনে ইতালীয় আবেগের অংশ হয়ে ওঠার পর্বে সেই মাখনের হিসেবটা গিয়ে দাঁড়ালো এক কিলো ময়দায় এক কিলো! অকল্পনীয়। তাই না? এই কারণেই পানেত্তোনে তৈরি করা এত কঠিন! প্রায় তিনদিনের পর্যায়ক্রমিক কঠোর পরিশ্রমের পরই প্রার্থিত ফল পাওয়া সম্ভব। অবশ্য বানিজ্যিক প্রয়োজনে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে এই সময়ের বিষয়টা এখন অনেক কমে গেছে। তা সত্ত্বেও তাড়াহুড়োর কোনও অবকাশ নেই এই পদ্ধতির কোথাও।

পানেত্তোনে তো তৈরি হল। এর যথাযথ অনুপান কী হবে? প্রোসেকোর কথা তো আগেই লিখেছি। এটি আরেক অনবদ্য ইতালীয় সৃষ্টি, যা স্বতন্ত্র মনোযোগ দাবী করে। ফরাসি শ্যাম্পেন বা জার্মান শ্নাপস্‌ – এর সঙ্গে সমান টক্কর নিতে পারে উত্তর ইতালির এই মহার্ঘ পানীয়টি। কিন্তু পানেত্তোনের সঙ্গে প্রোসেকো ছাড়াও হট চকোলেট, কফি এমনকি এগনগ খাওয়ারও চল আছে অনেক জায়গায়। এই এগনগ আবার একটি অতি জনপ্রিয় ক্রিসমাসকালীন পানীয়। পণ্ডিতরা বলেন মধ্যযুগের ব্রিটেনে জন্ম এই বস্তুটির। তখন এর পরিচিতি ছিল পসেট বলে এবং ঠাণ্ডা-লাগা বা ফ্লু-জনিত উপসর্গের উপশমের জন্য সে সময়ের মানুষ ডিমের সাদা, চিনি, ক্রিম, দুধ এবং হুইস্কি, রাম অথবা বোরবোর্ন –এর এই অনবদ্য ককটেলটি পান করতেন। কিন্তু পানেত্তোনের ক্ষেত্রে সব অনুপানই শেষ পর্যন্ত অছিলায় পরিণত হতে পারে। এমনই আশ্চর্য এর আবেদন।

আমার বন্ধু ওরাৎসিও আর আমি এক স্বপ্নের সওয়ার হয়ে আমাদের দুই দেশের খাদ্য সংস্কৃতির হৃদয়ের অন্তঃস্থলে পৌঁছতে চেয়ে চষে বেরিয়েছি কলকাতা থেকে দিল্লি হয়ে মুম্বাই থেকে রোম হয়ে মিলান থেকে তুরিন। আমাদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ তেমনভাবে সাড়া জাগাতে না পারলেও আমরা আবিষ্কার করেছিলাম হেঁশেল যাত্রার নতুন থেকে নতুনতর পথ, মানুষের প্রাত্যহিক যাপনশৈলীর অতি তুচ্ছ অথচ অননুকরণীয় আদল আর আমাদের সামনে খুলে গিয়েছিল অনেক গোপন কুঠুরি, যার ঐশ্বর্যের ঔজ্জ্বল্যে চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল আমাদের।

0 comments:

0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in




















দুই

সুমনের বাঁশি বাজানো দেখে লাইনের অনেকে হিংসা করে।রূপসী বল,ভালো কাজ করলেই শত্রু বেড়ে যায়।সুমন বল,ছেড়ে দাও ওসব কথা।এসো আমরা সাধনা চালিয়ে যাই।তারপর সুমন বাঁশি বাজানো শুরু করলো। তার বাঁশির নবসুরে রূপসীর দেহ কেঁপে উঠলো।সুমন খুশি মনে স্নান সমাপন করল।রূপসীর হাতের রান্না খুব ভালো।সুমন খেলো।রাতে আজ কাজ নেই।মুরারী রাতে রূপসীর ঘরে এলো।সে বললো,শোনো সবাই।যাত্রাদলের এখন কোনো কদর নেই।তাই আমি আপাতত আলকাপের দল করবো।

সুমন বললো,যাত্রাদল তাহলে উঠিয়ে দেবে।

-না। বন্ধ হলো আপাতত।আবার ডাক পেলে হবে নিশ্চয়।আলকাপের নায়িকা হবে রূপসী।

--না, দাদা রূপসী নয়। ঝুলনকে করো।

কেন? তোমার গায়ে লাগছে না কি?

সুমন বললো,রূপসী আজেবাজে ভাষা বলতে পারবে না। মু রা রী বললো,কি বলছো রূপসী।রূপসী বললো,আমি নাচ করবো।কিন্তু তোমার বিপরীতে অভিনয় করবে ঝুলন ভাই।বেশ তাই হবে।কালকে আমাদের আলকাপ হবে।বায়না দিয়ে গেছে।সুমন বলে,এখন আলকাপ শোনার লোক বেশি।আড়ালে রাতের বেলায় ভদ্রলোকেরাও চাদর মুড়ি দিয়ে শুনতে আসে আলকাপ।খিস্তিখেউড় শুনতে মজা লাগে।মেয়েদের নগ্ননাচ দেখতে ভালো লাগে দর্শকের।টাকা পয়সাও দেয় অনেক।তাহলে যাত্রার ভবিষ্যৎ কি?

রূপসী বল,ছাড়ো তো ওসব কথা। এখন চলে গেলেই হলো।

মুরারী ভালো ব্যবসাদার। সে নিশিকান্ত কে দলে নিলো।ভালো আলকাপ করে। নাম আছে।দলের নাম দিলো,নিশিকান্তর আলকাপ।



তারপর পরের দিন রাতে শুরু হলো আলকাপ।সুমনের বাঁশির তালে নিশিকান্ত আর রূপসী নাচ আরম্ভ করলো।তারপর শুরু হলো আলকাপ।নিশিকান্ত একটা রসগোল্লার হাঁড়ি দুপায়ের ফাঁকে নিয়ে শ্বশুর বাড়ি এলো।তারপর ঝুলন মেয়ে সেজে নিশিকান্তর হাঁড়ি থেকে রসগোল্লা খেলো।আহা কি মি। আরও খাবো।

নিশিকান্ত বললো,তোকো হাঁড়ি উপুড় করে রস খাওয়াবো।আয় আমার শালি।

এইভাবে আসর জমে উঠলো। প্রচুর টাকা পেলো নিশিকান্ত।তার নাম শুনেই লোকে ভিড় করে আলকাপ শুনতে আসে।মুরারী বলে,দেখো সুমন, যাত্রার থেকে টাকা বেশি আলকাপে।মানুষ যা চায় তাই করতে হবে।তা না হলে না খেয়ে মরতে হবে।

সুমন কোনো উত্তর দেয় না। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

সুমন আজ অনেক দিন পরে বাড়ি গেলো।ছেলেটি বড় হয়েছে।পাশে কুড়োর বাড়ি।বিধবা হওয়ার পর ও একা থাকে। একা রান্না করে খায়।একাদশী করে।প্রচুর উপোষ করতে হয়।সুমন একবার বলেছিলো,তুমি আমার ভায়ের বৌ।তুমি ভালো গান জানো।চলো যাত্রাদলে গান করবে।এভাবে জীবনটা নষ্ট করে কি লাভ।খেনী রেগে গিয়ে বলেছিলো,বেশি বাড়াবাড়ি কোরো না। গ্রাম থেকে বাস ওঠাবে না কি?ও ওর মত থাক।সুমন চিন্তা করে দেখলো,এখনও কুসংস্কার দূর হতে অনেক সময় লাগবে।তারপর নিজের সংসারের কথা ভেবে আর ওসব নিয়ে কথা বলে নি।কুড়ো,খেনী দুইবোন। কালোকে কুড়োর কাছে রেখে শান্তি পায় দুদন্ড খেনী।নিঃসন্তান কুড়ো কালোকে পেয়ে মাতৃত্বের স্বাদ অনুভব করে। মেনকা গ্রাম থেকে এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভরতি হয়েছে।এম.এ পড়ছে।লেডিস হোষ্টেলে থাকে।অনেক বান্ধবী আছে।ঠিকমত সময়ে খেয়ে নিয়ে একসাথে যাওয়া আসা করে।মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি যায়।ছুটি থাকলে গ্রামে যায়।একদিন সকলে চিড়িয়াখানা গেলো।সেখানে পশু পাখিদের দেখে খুব আনন্দ পেলো সবাই।মেনকা খাবারের জোগাড় করলো।ডিম টোষ্ট আর শস,সঙ্গে স্যালাড।মেনকা বললো বান্ধবী সোমাকে,জানিস আমাদের গ্রামের বাড়ি মাটির ছোটো বাড়ি।বাবা বলেন যতই ছোটো হোক বাড়ি হলো মন্দির।জানিস আমার মা ছোটোবেলা থেকে আমাকে শেখাতেন, একটা পাখির বাসাও ছোটো। কিন্তু অবহেলার নয়।কত পরিশ্রম করে তিলে তিলে একটা বাসা তৈরি হয়। কোনো মন্দির,মসজিদ,গির্জা ছোটোবড় হয় না।সবখানেই সেই একই মালিকের বাস। সোমা বললো,তোর কথা শুনতে ভালোলাগে।আমদের ভারতবর্ষ মহান।চিড়িয়াখানা থেকে ফিরে রাতে ভাত, তরকারী আর মাছের ঝোল খেলো ওরা।তারপর ঘুমিয়ে পড়লো। সকালে উঠে সকলে প্রাতঃরাশের পরে গল্প করতে বসলো।আজ ছুটির দিন।মেনকা তার গ্রামের মেলা যাবার বর্ণনা করলো।সবাই মন দিয়ে শোনে তার সত্যি গল্প,তার জীবনের গল্প।বুঝলি সোমা একবার গ্রাম থাকে। গোরুর গাড়ি চেপে দধিয়া বৈরাগ্যতলার মেলা যাচ্ছি। পিছনে বাঁধা রান্না করার সরঞ্জাম। মেলা গিয়ে রান্না হবে। বনভোজন। সঙ্গে মুড়ি আছে। বড়দা বললেন,গিয়ে প্রথমে মেলা ঘোরা হবে। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। মা বললেন,তোরা ঘুরবি আমি আর মানা রান্নাবান্না করবো। তারপর দুপুরে মেলা ঘুরবো। গাড়ি চলেছে ক্যাঁচর ক্যাঁচর শব্দে। গোপাল কাকা বললেন,আরে, দেখ দেখ জিম চলে এসেছে। বড়দার ভয়ে ব্যাটা গাড়ির তলায় হাঁটছে।

জিম নেড়ি কুকুর হলেও, আমরা ওকে জিম বলেই ডাকি। কুকুর ভাবি না। অনেক মানুষের থেকেও ওর ভব্যতা অনেক বেশি।আর একটা মেলায় যেতাম। পঞ্চাননতলার মেলা যেতে একটা আল রাস্তা ছিলো। আমরা ছোটোবেলায় বারবার ওই রাস্তা ধরে আসা যাওয়া করতাম। দুপাশে কাদা ভরতি ধানের জমি। কি করে কাউকে ওই কাদায় ফেলা যায়, এই কুবুদ্ধি আমাদের মাথায় খেলা করতো। আর তাই হতো। ধপাধপ কাদায় পরে যেতো অনেকেই। আর আমরা কি মজা, কি মজা করে চিৎকার করতাম। মার খেয়েছি খুব। বদ বুদ্ধির জন্য।যাইহোক, গোরুর গাড়ি একবার থামলো। তামালদা আর আমি জমি দিয়ে হেঁটে গেলাম। দেখলাম আখের জমি। বললাম,একটা আখ খাবো। তামালদা বললো, না পরের জমি।

-- একটা তো, কিছু হবে না।

-- যাও, তাড়াতাড়ি আসবা।

তারপর একগাছা সরালো আখ ভেঙ্গে খেতে খেতে চলে এলাম।গোরুর গাড়ি আবার চলতে শুরু করলো। দিগি দিগি, পা পা, করে গোরুর সঙ্গে কথা বলে চলেছে প্রিয় তামালদা।মন্থর গতিতে পৌঁছে গেলাম সকালের টাটকা মেলায়। ভোরবেলায় বেরিয়েছি বাড়ি থেকে। প্রায় কুড়ি কিমি রাস্তা চার ঘন্টা লাগলো। তবু ক্লান্তি নেই। মা বললেন,প্রথমে জল এনে এই ড্রাম ভরে ফেল।জল ভরার পরে আমরা মেলা ঘুরতে চলে গেলাম। কাঁচের চুড়ির দোকান পার করে নাগরদোল্লা। চাপলাম। ভয় নেই। মনে মজা।তারপর ঘুরে ঘুরে দেখার পালা। একই জিনিস ঘুরে এসে দেখে নতুন লাগছে। চির নতুন। কেউ বিরক্ত নয়। সবাই অনুরক্ত মানুষের ভিড়ে। এই প্রবাহ পুরোনো হবে না কোনোকালে।বড়দা বললেন,অনেক হয়েছে। এবার খাবে চলো। মায়ের কাছে গিয়ে দেখলাম, মুড়ি, তেলেভাজা, আর রসগোল্লা রেডি। ঘুরে ঘুরে খিদে পেয়েছে। খেয়ে নিলাম। জল খেয়ে ধড়ে প্রাণ এলো। এলো আনন্দ।মানা পিসি বললেন,চল আমি আর তুই একবার মেলা ঘুরে আসি। পিসি প্রথমেই চিতার কাছে গিয়ে বললেন,সব থেকে সত্য, এই চিতা। পিসি খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যের সন্ধান কিছুদিন পরেই পেয়ে গিয়েছিলেন।

তামাল দা মাকে বললো,দিদিমুণি, ত্যাল দিন তো। আর ওই খোলের বাটিটা। গরুগোলাকে খেতে দি ভালো করে। ত্যাল মাকিয়ে দোবো। ওরাও তো মেলায় এয়েচে। অবিচার করলে হবে না।

মা বললেন,যাও, দাও গা। ভালো করে খেতে দাও।মা রান্না সারার পরে একবার মেলায় গেলেন। আমার ঘুরে ঘুরে পায়ের ডিমিতে লাগছে

তবু মেলা না দেখে মন মানছে না। ক্লান্তি ভুলে অবাক চোখ চালানো সারা মেলা জুড়ে। কোনো কিছু দেখা বাকি থাকলো না তো? তাহলে বন্ধুদের কাছে হেরে যাবো। বন্ধুরা বলবে, কেমন মেলা দেখলি। আমরা সব দেখেছি।আর দেখলাম মানুষের আবেগের রঙীন খেলা। কেউ নাগরদোল্লায়।কেউ খাবার দোকানে। আর অনেকে শুধু ভবঘুরের মতো চরকী পাক খাচ্ছে ভিড়ের মাঝে। মেলায় মিলন মানুষে মানুষে।জাতিতে জাতিতে,বললেন গোপাল কাকা।এই মেলায় হরিনাম এক প্রধান আকর্ষণ। তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে অনেক ভক্তের মায়া।

আমার ঈশ্বর,আমার অনুভব,ভালোবাসা একান্তই নিজস্ব অনুভূতি। আমার জ্যান্ত ঈশ্বরের পরম করুণাময়ের সঙ্গে মিলিত হবার শেষ আয়োজনের শুরু হয়েছে। মনে পরছে, আমার সামনে থেকেও রকেটের দাগের মতো মিলিয়ে গেলো বন্ধু। গঙ্গার জলে ডুব দিয়ে আর উঠলো না নীলমণি। রোজ আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে জ্বল জ্বল করে আমার অশ্রু আয়নায়। হাওয়ায় ওড়া আমার বেহিসাবী মন আজও দেখতে পায় অনন্ত আকাশে তার বিচরণ।দুপুর ঠিক দুটোর সময় মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। মা বললেন,থালাগুলো জল বুলিয়ে নিয়ে এসো সবাই।তারপর গোল হয়ে সবাই বসে পরলাম খেতে। মাটিতে বসে খেতে শুরু করলাম। আমি কলাপাতায় খেতে ভালোবাসি। এতো খাওয়া নয়,স্বপ্ন জগতে বিচরণ। এই ভালোলাগা বার বার আসে না। অকৃত্রিম আনন্দের জগৎ এই মেলা।সবার খাওয়া হয়ে গেলে মা ও মানা পিসি বসলেন খেতে। সবাইকে প্রথমে খাইয়ে তারপর নিজের খাওয়া। তাই ভারতমাতার সন্তানরা দেশের দশের জন্য সব ত্যাগ করতেও কুন্ঠিত হয় না। মায়ের কাছে এই শিক্ষা তারা পায় ছোটো থেকেই।তারপর বাড়ি ফেরার পালা। অনেক মৃতদেহ আসছে শ্মশানে। বলো হরি, হরিবোল ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত। তারা ফিরছে আপন ঘরে। আমরা ফিরছি গ্রীনরুমে।সন্ধ্যা হয়ে আসছে। মা চিন্তা করছেন। তামালদাকে বললেন,তাড়াতাড়ি ডাকাও। গোরু দুটোকে তামালদা বলছে,হুট্ হুট্,চ,চ দিগি দিগি। গোরু দুটো ছুটতে শুরু করলো। খুব তাড়াতাড়ি চললাম। টর্চের আলোয় রাস্তা দেখছি সবাই। হঠাৎ রে রে করে দশজন ডাকাত পথ আগলে দাঁড়ালো। দে যা আছে বার কর। হাতে তাদের বড় বড় লাঠি। মা বললেন,বললাম তাড়াতাড়ি করে বাড়ি চলে যায় চ, তোরা শুনলি না আমার কথা।হঠাৎ তামালদা আর বড়দা নেমে লাঠি কেড়ে নিয়ে বনবন করে ঘোরাতে লাগলো। আমরা গাড়িতে বসেই দেখতে লাগলাম লাঠির ঘায়ে ডাকাতগুলোর মাথা ফেটে রক্ত পরছে। সবগুলো শুয়ে পরে হাত জোড়া করে ক্ষমা চাইছে। মা বললেন,ছেড়ে দে। উচিত শিক্ষা পেয়েছে বাঁদরগুলো। খেটে খাগা যা, পালা।তারপর তামালদা ও বড়দা লাঠি দুটো নিয়ে সামনে বসলো। বড়দা বলছে,আয় কে আসবি আয়। সেই কেড়ে নেওয়া লাঠি আজও আছে। মা বলতেন,অন্যায় করবি না,আর অন্যায়ের সাথে আপোষও করবি না।মনমতো পছন্দের মামা আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে মামা নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। মামা কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই মামা বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের । আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। মামা ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেল অনেক গল্প শুনেছিলাম দাদুর বীরত্বের গল্প। মা তার নিজের গল্পও বলেছিলেন অনেক।আমার মনে পরে সেইসব কথা।গল্প বলতে বলতে কখন যেনো মেনকার চোখে জল এসে গিয়েছিলো।সোমা জল মুছে দিলো।বললো,আর পনের দিন পরেই পুজোর ছুটি।সবাই বাড়ি যাবো।কি মজা বল।মেনকা বললো,ঠিক বলেছিস।কথায় বলে না ভালোলোকের শত্রুর অভাব নেই।সুমন নানারকম অসুবিধা থাকলেও এদল ওদল করে না। টাকার লোভ তার নেই।আর এইসব গান বাজনার লাইনে রাজনীতি খুব বেশি।অনেকে ভালো শিল্পীকে নিয়ে টানাটানি করে।সুমন আর রূপসী বড় শিল্পী।তবু তারা মুরারী অপেরা ছাড়ে নি।মুরারী এখন ভালো ব্যবহার করে।আলকাপের দল খোলার পর থেকে লাভের অঙ্কটা হু হু করে বেড়ে চলেছে।তাই সে খুব খুশি।সুমন এবার নেশা ধরেছে মদের।বাড়ির কথা মনে পড়ে তার।কিন্তু দল ছেড়ে সে থাকতে পারে না। তারপর বাড়িতে বাঁশি বাজাতে দেখলেই তার বৌ খেপে যায়।তাই অশান্তি করতে তার ভালো লাগে না। একবার তার বৌ বাঁশি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো।সেবার সুমন বৌকে একচড় মেরেছিলো ছেলের সামনে।মন খারাপ হয়েছিলো তার।ভাগীদার গণেশ হাজরা বলেছিলো,কাজটা আপনি ঠিক করেন নাই দাদাবাবু। সেবার গণেশকে বলে পালিয়ে এসেছিলো সুমন। এখন বাড়ি কম যায়।মাঝে মাঝে টাকা পাঠিয়ে দেয়।দলে একটা নতুন মেয়ে এসেছে বিজয়া।মুরারীর সঙ্গে খুব মাখামাখি।একবার পুকুরে চান করতে গিয়ে বিজয়া সুমনকে চুমু খেয়েছিলো।বলেছিলো,কি গো নাগর। রূপসী ছাড়া আর কাউকে ভালো লাগে না। তোমার রস একদিন আমাকে খাওয়াও।সুমন এসব পছন্দ করে না। সে বললো,আর কোনোদিন আমাকে এসব বলবে না। রূপসীও আমাকে বিরক্ত করে না। বকুনি শুনে ভিজে কাপড়ে পালিয়েছিলো বিজয়া। তারপর অনেক দিন পরে একটা যাত্রার পালা করতে সুমনরা গেলো কোপা গ্রামে।সেখানে মেনকার বাড়ি।মেনকা বাড়ি এসেছে কয়েকদিনের জন্য।আর বন্ধুরা সবাই মিলে আয়োজন করেছে এই অনুষ্ঠানে। ঠিক রাত দশটায় কনসার্ট বেজে উঠলো।সুমনের বাঁশির সুরে মাতোয়ারা হয়ে গেলো গ্রাম।পালাশেষে মেনকা সুমনের সঙ্গে আলাপ করলো। সে বললো,আমার এখন গবেষণার বিষয় এই, আড় বাঁশি।সুমন বললো,অনেক বড় হও মা। আমার তো বয়স হয়েছে।রূপসীও নেই।মরে গেছে।মেনকা বল, কে এই রূপসী।

--আমার ঘর বাঁধার স্বপ্নের পাখি।সে আমার সঙ্গে ঘর বাঁধতে চেয়েছিলো।আমি পারি নি।

--কেন,পারেননি কেন?

-আমার বৌ বাচ্চা আছে তাই।

-ও বুঝেছি।

-এই আড় বাঁশির আড়ালে অনেক কান্ড ঘটে গেছে মা।

--আপনি ঠিকানাটা দিন। একদিন আপনার বাড়ি যাবো।প্রণাম নেবেন।

তারপর সুমন কোপা ছেড়ে চলে এলো নিজের গ্রামে।এখন সবাই নতুন নায়ক নায়িকা। পুরোনো কেউ নেই।দল ছেড়ে এসে সে বাড়িতে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা দিতে শুরু করলো।বহুদূর থেকে ছাত্র ছাত্রী এলো। সুমন তার স্কুলের নাম রাখলো, মধুবনি।শত শত শিক্ষার্থী এই মধুবনি থেকে বাঁশি বাজানোর শিক্ষা গ্রহণ করতে লাগলো।একদিন মেনকা এলো তার গবেষণার কারণে।এসেই খেনীদেবীর নজরে পড়লো সে।

তিনি বললেন,মা তোমার কোথায় বাড়ি।

-কোপা।

---তোমার বাবার নাম কি?

-কার্তিক মাঝি।

ও তাহলে তুমি আমার পিসির গ্রামের দাদার মেয়ে।কোপার কার্তিক মাঝিকে আমি দাদা বলতাম ।যাওয়া আসা না থাকলে আপনজনও পর হয়ে যায় মা। এসো ঘরে এসো।তারপর সুমন এসে তার জীবনের সমস্ত কথা বললো।মধুবনির স্বপ্নের কথা বললো।মেনকা বললো,আমি আপনার কাছে।সুমন বললো,তোমার যতদিন খুশি থাকো।আমার মধুবনিকে দেখো।আরও অনেক তথ্য পাবে।সুমনবাবুর ছেলে কালো, মেনকাকে দেখেই ভালোবেসে ফেলেছে।কিন্তু বলতে পারছে না।সুযোগ এসে গেলো।সুমনবাবু বললেন,কালো একবার মেনকাকে গ্রাম ঘুরিয়ে দেখাও।গ্রাম ঘুরতে ঘুরতে কালোর সঙ্গে মেনকার পরিচয় হলো।মেনকা জিজ্ঞেস করলো,তুমি বাঁশি বাজানো শিখেছো।কালো বললো,বাবা আমাকে মায়ের আড়ালে সুর শিখিয়েছেন।--কই বাজাও দেখি।কালো বাঁশি বাজালো।এযেনো রাধার পোড়া বাঁশির সুর।মেনকা সুরের প্রেমে ধরা দিলো।সে বললো,আমিও এই সুর শিখবো,বাজাবো।

-নিশ্চয় শিখবে।বাজাবে। তারা দুজনে বাড়ি ফিরে দেখে প্রচুর ভিড় মধুবনি স্কুলে।ছুটে গিয়ে তারা দেখলো, সুমনবাবুর ক্ষত বিক্ষত মৃতদেহ।কে বা কারা মাঠে তাকে মেরে পালিয়েছে।তিনি মাঠে যেতেন বাঁশি বাজাতে।বাঁশিটাও ভেঙ্গে দিয়েছে।মেনকা সুমনবাবুর কাছে শুনেছেন কে বা কারা যেনো তাকে মারার চক্রান্ত করছে।তার মধুবনি ধ্বংস করতে চাইছে।পুলিশ এলো।তারা তদন্তের ভার নিলেন। সুমনবাবুর ছাত্র ছাত্রী সকলে কাঁধে করে শবদাহ করতে শ্মশানে গেলো।আগুনে বিলীন হলো নশ্বর দেহ। কিন্তু তার স্বপ্ন সফল করবে শত শত মধুবনির ছাত্র ছাত্রীরা।এমন একটা অঘটন ঘটে যাওয়ার জন্য মেনকা কালোর কাছে থাকলো অনেকদিন।এই বড় শোকে যে পাশে থাকে সেইতো আসল বন্ধু।কালোর মা বললেন,মেনকা তোমার মত একটা মেয়ে পেলে আমার জীবনে বাঁচার ইচ্ছাটা থাকবে।মেনকা বললো,একবার আমার বাবার সঙ্গে কথা বলবেন।তিনি বললেন,আমরা তোমাদের বাড়ি যাবো।মেনকা আর কালো দুজনে ঠিক করলো তারাই এই মধুবনির অপূর্ণ সাধ পূরণ করবে শত বাধা অতিক্রম করে।কালো বাঁশি বাজানো শেখাবে।আর মেনকা একটা গবেষণার গ্রন্থ প্রকাশ করবে।তার নাম দেবে,আড় বাঁশির আড়ালে।মেনকার গবেষণা তিন বছরে পড়েছে।আর এক বছরের মধ্যে পেয়ে গেলো পি এইচ ডি ডিগ্রি।এখন তার নামের আগে লেখে ডঃ,মেনকা বোস।সুমনবাবুর মৃত্যুর দুবছর পরে কালো আর মেনকা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। ভালোাসার জয় হলো।কালো এখন একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক।ধীরে ধীরে মধুবনি সুরের আকাশে নক্ষত্রের জায়গা নিলো।জীবন এক আশ্চর্য অনুভূতি। মহাপুরুষরা বলে গেছেন পৃথিবী একটা নাটকের মঞ্চ। নাটকে অভিনয় শেষে সবাইকে প্রস্থানের পথে ফিরতে হয়। মানুষ মরে গেলে কোথায় যায়? মরে যাওয়ার পরে তার সেই অনুভূতি কি কাজ করে?স্বজনের কান্না-কথাবার্তা-ভালােবাসা-ঘৃণা কিছুই কি বুঝতে পারে? চিিিরদিনেসজীব প্রশ্ন। উত্তর জানা নেই। আমার মনে হয় যখন আমরা ঘুমােই তখন কি কোনাে পার্থিব বিষয় আমাদের মনে থাকে? কে বাবা, কে মা, কোথায় কে মনে আঘাত দিয়েছে কিংবা আমার প্রেমিক আমার প্রেমিকা কোথায় কি করছে ছুই মনে থাকে না। এক নিরুত্তর জীবন্ত প্রাণী শুয়ে থাকে তার সমস্ত চেতনা জলাঞ্জলি দিয়ে। আশ্চর্য মানবদেহ, তার চাহিদা আর তার রসায়ন। কোন রসায়নবিদ রচনা করেছেন এই রক্তমাংসের সজীব দেহ। মূর্তিমান অংশুমান রায় এখন তিপান্ন বছরে পা দিয়েছে। সে বসে বসে এইসব ভাবছে। এখন নন্দনপাড়ে বাস। বর্ধমান জেলার কাটোয়া শহরের একটা বস্তি নন্দনপাড়। নন্দনপাড়ে গরিব লােকের বাস। আর তার চারধারে বেশ কয়েক বর্গ কিলােমিটার জুড়ে গড়ে উঠেছে শহর। নন্দনপুকুর বলে একটি পুকুর আছে। তার পাড়ে গড়ে উঠেছে এই বসতি। অংশুমান নন্দনপাড়ের কাছেই দু-কাঠা জমি কিনে তার শখের বাড়িখানা তৈরি করেছে। মােটামুটি দু-খানা ঘর, একটা ডাইনিং আর বাথরুম। অংশুমানের একটি ছেলে ক্লাস ইলেভেনে পড়ে আর তার স্ত্রী দেবী সারাদিন ব্যস্ত থাকে সংসারের কাজে। অংশুমান একটা উচ্চ বিদ্যালয়ে পার্শ্বশিক্ষকের কাজ করে। বেতন সামান্য। তবু সংসার চলে যায় আনন্দে। আজকে অনেক পরিশ্রমের পরে অংশুমান। নন্দনপাড়ে এসে বাড়ি করে শান্তিতে বাস করছে। নন্দনপাড়ের বাসিন্দারা। সবাই তাকে খুব ভক্তি-শ্রদ্ধা করে। কিন্তু কিছু লােক থাকে তারা চিরকাল নিজেদের একইরকমভাবে চালাতে চায়। মানুষের প্রতি ভালােবাসার, প্রেমের সম্পর্ক তৈরি করতে চায় না। নিজেকে গুটিয নন্দনপাড়ের এইরকম আসর এই প্থম। এখনকার লােক দু-চারটে মূর্তি এনে গুজা করে শাস্তি। দিন আনা দিন খাওয় লাকে বাস এখানে। এখানে সাহিত্যের অনুপ্রবেশ মন ব্যাপার। এ একদিন ছিল, যখন এই নন্দনপাড়ের নামে লোকে ভয় পেত। এই পাড়া মানেই কিছু অসামাজিক প্রকৃৃতির লােকের বাস। সবাই এই মনে করতেন। সত্যি যা রটে তা কিছুটা বটে। তখন বেশ কজন ছিল, যারা চুরি-ডাকাতি করত। নেশা করে নিজেদের মধ্যে মারামারি করত। অপরের বউকে নিয়ে টানাটানি করত। কিন্তু চিরকাল একভাবে চলে না। অন্যায়-অত্যাচারের মাত্রা যখন বেড়ে যায় তখন মানুষ তার প্রতিকার করে। এক নতুন পথের চিন্তায় থাকে। এ যেন মানুষের সহজাত চিন্তা। পাপী লােক দু-দিন আর গুণবান যুগে যুগে অবস্থান করে মানুষের অন্তরে। অতীতের স্মৃতি রোমন্থনে ব্যস্ত অংশুমানের মন।। | অংশুমান ভাবে, যখন সে এল নন্দন পারে, তখন তার বাড়িঘর হয় নি। ফাঁকা মাঠে এসে বাড়ি করে ফেলল অংশুমান। চিতাভাবনা মা করে, বাড়ি ভাড়া করে থাকত গ্রথমে। তারপর ভাবনা করল।কম দাম দেখে অংশুমান একটা ঘর তৈরি করল। বাঁশের বেড়া দিল চারিদিকে। ন ছেলে পাঁচ বছরের। স্ত্রী দেবী খুব সাহসী মহিলা। তার সাহস না থাকল তো অংশুমানের এখানে এসে থাকা হত না। মানুষ মরে যাওয়ার পরে পেট ভরে ভােজনের রীতি আমাদের সমাজে। এই খাওয়ার পর্ব হয়ে আসছে পুরোনো কাল ধরে। ক্ষমতা থাক বা না থাক এই খাওয়ার রীতি। অংশুমান ভাবছে পাঁচজন মানুষকে খাওয়ালেও শান্তি।বেঁচে থাকতে যে মা ছেলের কষ্টে চোখের জল ফেলতেন, মমতা বলতে কিছু থাকে তাহলে চোখের আড়ালে থেকেও ছেলের কষ্ট সম্বরণ করতে পারবেন না। ভারতবর্ষে অনেক ছেলে আছে যা মায়ের ঠিকমতাে দাহকরতে, শ্মশানে আনার ব্যবস্থা করতেই হিমশিম খেয়ে যায়। অংশুমান ভাবে, তবুসমাজে থাকতে গেলে সমাজের নিয়ম মানতেই হয়। চাকরি-বাকরি পেলেও শুধু বসে থেকে মাথার চুল ছিড়লে হবে না। ব্যবসা করতে হবে, ভগবান যে দু-হাত দিয়েছেন, কর্মের মাধ্যমে সেই দুই হাতকে কাজে লাগাতে হবে। মূলধন নেই বলেই তাে অংশুমান ভাবে, টিউশনি আরও বাড়াতে হবে। সকালবেলা সাইকেল নিয়ে চা-মুড়ি খেয়ে বেরােয়। অংশুমান, সাতটা থেকে সাড়ে আটটা একটা তারপর সাড়ে আটটা থেকে দশটা অবধি আর একটা দল ছাত্র পড়ায় অংশুমান। আবার রাত্রিতে দুটো ব্যাচ। এইভাবেই অংশুমানের সময় কেটে যায় কর্মের মাধ্যমে। বাড়ি ফেরার পথে সবজি-বাজার, মুদি-বাজার সব করে নিয়ে আসে।। অংশুমান কাটোয়ার বাড়িতে বসেছিল। আজ রবিবার, টিউশনি নেই। হঠাৎ গ্রামের বাড়ি পুরুলে থেকে ফোন এল মায়ের, "অংশু, একবার বাড়িতে আসতে পারবি? আমার ওযুধ ফুরিয়ে গেছে, সঙ্গে নিয়ে আসবি।” অংশুমান। ফোনে বলল, “আমি তিন-চার ঘণ্টার মধ্যে তােমার কাছে যাচ্ছি।" স্ত্রী দেবীকে বলল, “পুরুলে থেকে একবার ঘুরে আসি। এখানে আজ ভাত খাব না। মায়ের কাছেই খাব।" এই বালে অংশুমান সাইকেল নিয়ে ওষুধের দেকানে ওযুধ আর তার সঙ্গে কিছু ফল-মূল, মিষ্টি নিয়ে পুরুলে মা-র কাছে গেল। অংশুমানরা চার ভাই, দুই বােন। দুই বােনের বিয়ে হয়ে গেছে। তারভাই এখন পৃথক হয়েছে। যে যার নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। বাবা নেই। মা যেখানে থাকতে ইচ্ছা করেন সেখানেই থাকেন। চার ছেলে চার জায়গায় থাকে। বাবার চাকরি সূত্রে মাকে যেতে হল হাওড়া জেলার লিলুয়া শহরের পটুয়াপাড়ায় মা তিনভাইকে নিয়ে বাবার কাছে চলে এলেন। বড়দা অংশুমানের কাকাবাবুর কাছে থেকে গ্রামে পড়াশোনা করে। অংশুমান ভাবে, তখন তার বয়স মাত্র সাত বছর। গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে এতদিন ইলেকট্রিক আলাে দেখেনি অংশুমান। সন্ধ্যাবেলায় তার বাবা বাবা সুইচ অন করে দিয়েছেন। আলােতে চোখ বন্ধ হয়ে এল।কোথা থেকে আলাে আসছে অংশুমান বা তার ভাইরা বুতে পারল না। বাবা দেখিয়ে দিলেন আলাের উৎস। উপরে বাতি ঝুলে রয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। অংশুর এখনও মনে আছে। তারপর সকাল বেলা বাবা প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে গেলেন অংশুমানদের। অংশুমানের ছোটভাই তখন মাত্র দুই বছরের ছেলে। অংশুমান এবং তার মেজদা মাত্র তিন বছরের তফাত। দু-জনে মিলে স্কুলে ভর্তি হতে গেল। দাদা তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হল কিন্তু অংশুমান অঙ্ক একটু ভূল করায় একেবারে নার্সারি এসে ভর্তি হল। গ্রামের স্কুলে ক্লাস ওয়ান-এ ভর্তি হলেও এখানে নার্সারিতে ভর্তি হল। তখন থেকেই ভালাে করে পড়াশােনা করার জেদ মাথায় জাকিয়ে বসল। তারপর থেকে সে প্রত্যেকবছর ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করে এসেছে। এসব কথা তার মনে আছে। অংশুমানের বন্ধু ছিল অশ্বিনী, মােহিনী, হার, গৌতম, গােরা, শঙ্কর প্রভৃতি বালকেরা। ধীরে ধীরে অংশুমানের পরিবার লিলুয়া শহরের পটুয়াপাড়ায় বেশ সুন্দরভাবে সবার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। অংশুমান ছােটবেলায় ক্রিকেট খেলতে খুব ভালােবাসত। ছােট ছােট বন্ধুদের নিয়ে পাড়ায় একটা ভালাে ক্রিকেট দল গঠন করেছিল, ক্যাপ্টেন ছিল সে নিজেই। একটা শুকিয়ে যাওয়া পুকুরের ভিতরে সবাই মিলে কোদাল, কুড়ি, ঝাটা নিয়ে শীতকালে ক্রিকেট খেলার জন্য "পিচ তৈরি করা শুরু করত। সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিল সবার সঙ্গে অংশুমানের। মাঝে মাঝে ক্রিকেট ম্যাচও খেলা হত। বন্ধুরা সবাই মিলে মাঘ মাসে সরস্বতী পূজার জন্য চাদা তােলা শুরু করল। নিজেরাই বাঁশ পুঁতে নিজেদের মায়েদের, দিদিদের শাড়ি এনে সুন্দরভাবে প্যান্ডেল তৈরি করে ফেলল। এখন ঠাকুর আনার পালা। একটা রিকশাভ্যান ভাড়া করে সামনের পটুয়াপাড়া থেকে মূর্তি আনা হল। মূর্তি বসানাে হল বেদিতে। সারারাত জেগে প্যান্ডেলের কাজ করা হল। অংশুমান দেখেছে বড় বড় পুজো প্যান্ডেলে সারারাত জেগে প্যান্ডেল তৈরি হয়। তাই ওরাও সারারাত জেগে প্যান্ডেল তৈরি করবে। কিন্তু রাত যে অনেক বড়। প্যান্ডেল তৈরি হওয়ার পরে অফুরন্ত সময়। এখন কি করবে? ওরা भান করল ডিম-ভাত খাওয়া হবে এখানে। সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু জোগাড় করে ওয়া-পাওয়ার জোগাড় শুরু হয়ে গেল। খেতে বসার সময়ে অংশুমানের মনে পড়ল, সরস্বতী পুজোর আগের দিন ‘বারের উপােস না করলেও কোনাে আঁশ জাতীয় খাবার খেতে নেই। পরে কাউকে কিছু না বলে ডিম-ভাত নিয়ে মাকে দিল। আর কোনাে ছেলের কথাটা মনে নেই। কষ্ট দিতে মন চাইল না অংশুমানের। ডিম-ভাত অংশুমান খেল।ঘড়িতে দেখল এগারােটা বাজে। রাতের বেলা প্যান্ডেলে সারারাত কাটানাে মুখের কথা নয়। কিন্তু বন্ধুরা যখন এসবে মাতে তখন কোনাে বাধাই বাধা নয়। সব সমস্যা যার নতে যায়। বন্ধুত্বের শক্তি এতটাই শক্তিশালী যে প্রত্যেক মানুষই তার জীবন মাধ্যমে এই তত্ত্ব বুঝে থাকেন। মশার কামড়েও যেন আনন্দের সুর। দাগ কাটে না বালক অংশুমানের মনে। পরের দিন সকালবেলা সবাই স্নান করে পুজো মণ্ডপে হাজির।ফল কাটা সব হয়ে গেছে। পুরােহিত এসে গেছেন। পুষ্পগুলি দিয়ে । পুরােহিতের সঙ্গে সবাই একসুরে বলছে, ভদ্রকালী নমঃ নিতং সরসত নমঃ নমঃ"—ভুল ইত্যাদি মন্ত্র। ঢাকের বাজনার সাথে সকলের নাচ হল। প্রসাদ বিতরণের পর মণ্ডপের সামনে একটা বেড়ার আড়াল দেওয়া হল। তারপ স্কুল যাওয়ার পালা। স্কুলে গিয়ে প্রসাদ খেয়ে তারপর বাড়ি ফেরা। আবার পরের দিন সকালে দধিকর্মার পূজা। পূজাশেষে পুষ্পাঞ্জলি। রাত্রিতে ঠাকুর বিসর্জন। ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন ঢাকের বােলে তালে তালে সবাই নাচতে নাচতে গিয়ে হারুদের পুকুরে ঠাকুর বিসর্জন দিয়ে এল। এইভাবে ভালাে-মন্দে সুখে-দুঃখে অংশুমানের জীবন কাটছিল। ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ক্লাসও বাড়ছে। ক্লাস সেভেনে উঠে টি.আরজি.আর খেমকা উচ্চবিদ্যালয়ে সিক্সে প্রথম স্থান অধিকারীর জন্য অংশুমান এক বই’ পুরস্কার পেয়েছিল। বাড়িতে এসে বাবা-মাকে দেখিয়ে সে কি আনন্দ তার। এখনও সব কথা মনে আছে। অংশুমান বন্ধুদের সাথে রেইনের পাশের রাস্তা ধরে স্কুলে যেত। কোনােদিন স্কুল কামাই ত না। তার জন্য শিক্ষক মশাইরা তাকে খুব ভালােবাসতেন।অংশুমান ছাত্রদের পড়ায় আর পড়ার বাইরে জানা অজানা অনেক ইতিহাস বা অন্য বিষয়ের কথা বলে। অংশুমান আজ নারীর স্থান সম্পর্কে কথা বলছেন। পুত্রকে ঘিরেই সাধারণত দশকর্ম পদ্ধতি আয়ােজিত হত হবে গর্ভাধান, পুংসবন ও সীমন্তোন্নয়ন এবং জন্মের পর নিষ্ক্রমণ, নামকরণ, গ্রেশন, চূড়াকরণ কৌটিল্য মন পুত্র বেশি অংশ ?নারী অধিকার মাতা। মৃত্যুর পর সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে বিভক্ত হবে এবং শে পাবে। পুত্রের অবর্তমানে কন্যা, জামাতা, মৃত ব্যক্তির পিতা, ভ্রাতা, | মাতা সম্পত্তির অধিকার লাভ করত। মৃত ব্যক্তির বিধবা পত্নী সম্পত্তির অংশ পাবেন কিনা সে সম্পর্কে মন কিছু বলেন নি।পেরকে, যাজ্ঞবল্ক্য পিতৃ ঋণ ও পৈত্রিক সম্পত্তি পুত্রদের মধ্যে সমভাবে বন্টন করার ব মতে পুত্রের অবর্তমানে তার স্ত্রী, কন্যা, পিতা-মাতা, ভ্রাতা, ভ্রাতুস্পুত্ররা অনুযায়ী সম্পত্তির অধিকারী হবে। সমাজে নারীর স্থান ও প্রাচীন ভারতে নারীর অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য । সমাজে নারী এতে প্রচুর উপাদান আছে। এ সম্পর্কে বেদ ও বৈদিক সাহিত্য, রামায়ণ, মহাভারত, মায়েদের হাতে প্রচুর উপাদান পুরাণ, গ্রিক পর্যটক ও ঐতিহাসিকদের বিবরণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, পাণিনি ও পতঞ্জলি ব্যাকরণ, বিভিন্ন বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থাদি, বিভিন্ন চােষ এবং সমকালীন সংস্কৃত সাহিত্য বিশেষ উল্লেখযােগ্য। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক দর্শন, শিলালিপি ও তাম্রশাসন আমাদের নানাভাবে সাহায্য করে। | সিন্ধু সভ্যতার আমলে মেয়েদের অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য আমাদের হাতে কোনও দান নেই। তবে সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত বিভিন্ন মাতৃমূর্তিগুলি থেকে বোঝা যায় যে এই র যা যুগে মেয়েরা সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ঋক-বৈদিক যুগে (খ্রিঃ পূঃ ১৫০০-খ্রিঃ পূঃ ১০০০) মেয়েরা যথেষ্ট মর্যাদার অধিকারি তাদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হত, তারা বেদ পাঠ ও উপনয়নের অধিকারি ছিলেন মন্ত্র রচনা করেন, অধ্যাপনা করতেন এবং প্রকাশ্য সভায় তর্কযুদ্ধে অবতার। হতেন। সকলের জীবন তো সমানতালে চলে না। ছন্দপতন ঘটে যায় নিয়তি আসার মতাে। কে যে আড়ালে থেকে সুতাে ধরে পুতুলের নৃত্যে, নাচায়, তা একমাত্র জগাই ক্ষ্যাপা' জানে। অংশুমানের কাকা যিনি গ্রামের বাড়িতে থাকতেন, তিনি মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে মরে গেলেন। তড়িৎ, আলাককাকা, বাবলুকাকা, , বুলুকাকা, দিলীপদা, অমরকাকা, টুলাদা, বুলাদা সবার নাম মুখে মুখে হেমন্তবাবু অকলে চলে যাওয়ার দূঃখ।দিলীপদা তুলে নিলেন সংসারের সমস্ত দায়িত্ব। আর যে পথিক গােপনে গােপনে নীরবে সংসারের দায়িত্ব পান করে গেছেন তিনি আর কেউ নন, অংশুমানের মেজদা। তার নাম রিলিফ। সকলের, যন্ত্রণা ভুলিয়ে দেওয়ার হাত আছে। অংশুমান স্বীকার করে মনের গােপনে নীরবে হাসিমুখে। যাই হােক সেবার ক্লাস সেভেনে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে অংশু। গ্রামের বাড়ি পুরুলেতে সদলবলে পুনরাগমন। অংশুমানের বাবা জমি-জায়গা দেখাশোনা করেন আর লিলুয়া থেকে দুই দাদা সুবিধা-অসুবিধায় বাবাকে সাহায্য করেন।আংশুমান এবার গ্রাম থেকে চার মাইল দূরে অবস্থিত একটা স্কুলে, বিল্বেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে তার বাবার সাথে স্কুলে গেল পায়ে হেটে। তখনকার দিনে পাকা পথ ছিল না। জমির আলরাস্তা ধরে স্কুলে গেল অশুমান। পায়ে ব্যথা ছিল। ধানের শিষে পা কেটে গিয়েছিল অংশমানের। স্কুলে একটা পরীক্ষা নেওয়া হল। প্রধান শিক্ষক মহাশয় খাতা দেখে বললেন, ভর্তি পরীক্ষায় অংশুমান সফল। আমরা ওকে ভর্তি নেব। ভর্তি হয়ে গেলাস এইটে। এবার অন্য এক জীবন। শহর থেকে এসে গ্রামের পরিবেশে খাপ খাওয়াতে হল এবার।পরের দিন থেকেই স্কুলে যাওয়া শুর করল অংশু। আল রাস্তা ধরে কাবে কােনাে ব্যাগ নিয়ে বন্ধুদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে স্কুলে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নতুন। মাঝে একটা কদর আছে। শীতকালে হাঁটু জল। কিন্তু হলে সর না হলে পার হওয়া যাবে না। তখন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ছিলেন শ্রী অম্বুজাক্ষ দত্ত মহাশয়। ইংরাজি স্যার ছিলেন শ্রী দিলীপ উট্টোপাধ্যায়। কিছুদিনের মধ্যেই অংশুমানের বন্ধু জুটে গেল অনেক। অমল, রবীন্দ্রনাথ, বিনয়, টাদ, বিশ্বরূপ, মিল, অধীর, পিনু, শ্যামল ও আরও অনেক ৭। সবার সঙ্গে মেশার এক সহজাত স্বভাব অংশুমানের ছিল চিরদিন। একদিন অমল বলল-সবাই আমরা একসাথে দুর্গাপুর শহরে বেড়াতে যাব।" অংশুমান বলল-"তাহলে কথাটা প্রথমে আমাদের ভূগোল সার, মহিম বাবু কে বলি।" ক্লাসে মহিম কুমার সাধু মহাশয় পড়াতে এলে অংশুমান। বলল-"স্যার, দুর্গাপুর শিল্পনগরী। যদি আপনি নিয়ে যান, তাহলে ভালাে হয়।" মহিমবাবু নিয়ে গিয়েছিলেন দুর্গাপুর। সারাদিন ঘোরার পর তারা রাত্রিবেলায় ফিরেছিলাম নদীর ধারে। তখন। বর্যাকাল। অজয় নদীতে প্রবল জলের ঢেউ। রাত্রি মাঝিরা ওপারে ঘুমাচ্ছে। তাহলে নৌকা আনবে কে? মহিম বাবু বলামাত্রই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বিখেশ্বর গ্রামের তিনটি সাহসী ছেলে। ভরা নদীর বুকে অতি সহজেই সাঁতার কেটে চলল তিনটি বালক। অংশগুরা পাড় থেকে চিৎকার করে বলছে, "তােরা। সবাই নিরাপদে আছিস তার?" উত্তর আসছে মাঝের নদী থেকে নেই। আমরা ঠিক আছি।” এইভাবে সাড়া দিতে দিতে ওরা ওপ গেল। তারপর নিজেরাই দড়ি খুলে নৌকা নিয়ে আসতে শুরু করল। নৌকা। এপারে এলে অংশুমান জিজ্ঞাসা করল-“কি রে, মাঝিদের ডাকলি ।ওরা উত্তর দিল—“সারাদিন খাটুনির পর ওরা একটু নিদ্রামগ্ন, কি করে, কোন লজ্জায় ওদের ঘুম ভাঙাই বল। ওরা আমাদের চেনে। আমরা ওদের ঘরের লােক।”অংশুমান চিন্তা করল, মানুষকে কতটা ভালােবাসে এরা, তারই প্রমাণ এই বাক্য। আবার নতুন করে মানুষকে ভালােবাসতে ইচ্ছে করল অংশুমানের। দশজন করে একটি নৌকায় মােট পাঁচবারে সমস্ত ছাত্রবৃন্দ নিরাপদে সেই রাত্রে নদীর এপারে চলে এল, ওই তিনজনের অসীম সাহসের ফলে। স্কুলে অংশুমানেরা সেই রাত্রি বেঞ্চিতে শুয়ে কাটালাে। পরদিন ছিল রবিবার। সকালে উঠেই হাঁটা রাস্তা ধরে চলে এল একেবারে নিজের বাড়ি পুরুলে’-তে। গ্রামের নাম ‘পুরুলিয়া’। কেতুগ্রাম থানায় অবস্থিত। সবাই ছােট করে গ্রামটিকে ‘পুরুলে’ বলেই চেনে। অংশুমানের স্বপ্নভূমি এই পুরুলে গ্রাম। -অংশুমান জানালার ধারে বসে ভাবছে গ্রামের কথা। পুরুলেতে পূজা বাড়ি আছে। এই বাড়িটি মােটামুটি দুইশত বছরের পুরােনাে বাড়ি। এখন ভগ্নস্তুপে পরিণত হয়েছে। একটি হাইস্কুল আছে। এটি দান করেছিলেন অতুলবাৰু তার বাবা মহেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নামে। স্কুলটির নাম বর্তমানে মহেন্দ্র বিদ্যাপীঠ। তখন স্কুলটি মাধ্যমিক পর্যায়ে অনুমােদন পায়নি। ফলে অনেক ছেলেমেয়ে বাধ্য হয়ে বাইরের স্কুলে পড়াশােনা করতে যেত। অংশুমান এইভাবেই দিনের পর দিন, মাসের পর মাস বর্ষা-গ্রীষ্ম-শরতে হেঁটেই স্কুলে যেত। সময় তাে আর থেমে থাকে না। দেখতে দেখতে অংশুমানের মাধ্যমিক পরীক্ষা চলে এল। মাধ্যমিক পরীক্ষা নির্বিঘ্নে সমাপ্তও হল। শিবলুন স্টেশনে নেমে অংশুর মন খুশ।। আমের আর মাটির গন্ধে মন ভরপূর আনন্দে দিশেহারা হয়ে উঠত। সেখান খেকে পুরলে প্রায় তিন মাইল পথ। কিন্তু রাস্তার দু-ধারের আখ আর ফাঁকা মাঠ অংশুমানের পথের ক্লান্তি দূর করে দিত। এক পা করে আর সৰ পরিচিত লােকের কস্বর কি গাে দাদাবাবু, অনেকদিন পরে লেখার মধ্যে আন্তরিকতার ছোঁয়া। এই কথার মায়া আর মাটির আর আমি কোথাও পাওয়া যাবে না। হটিতে হটিতে আুমানের মনে পড়ে কবির লেখা সেই বিখ্যাত লাইন, “এইটি আমার গ্রাম আমার স্বর্গপুরী এইখানেতে হদয় আমার গেছ়ে চুরি।"বাবু বসে আছে বাইরের বারান্দায়। হঠাৎ একটি ছেলে এসে বলল, বাবুদা! ৩াড়াতাড়ি চলো, ও পাড়ায় একজন গলায় দড়ি দেবে বলে দোর বন্ধ করেছে, কিছুতেই খুলছে না।"বাবু চোখের পলক পড়ামাত্রই সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়ি গিয়ে হাজির। গোলার তলায় শাবল ছিল, শাবল দিয়ে দরজাটা ভেঙে দেখল, একটা টুল এনে ছেলেটি গলায় গামছা বেঁধে কড়িকাঠে বাঁধছে। প্রায় ঝুলে পড়ার অবস্থায় বাবু ওর পা-দুটি কাঁধে রেখে বলল, “যা বলছি কর, গলা থেকে গামছা খোল।ছেলেটি বলল, "বাবুদা আমাকে মরতে দাও।”বাবু বলল, “তাের সুবিধা-অসুবিধার বিচার আমরা করব। তুই আগে দড়ি খােল।"বাবুর কথার অবাধ্য হওয়ার সাধ্য ছেলেটির ছিল না। দড়ি খুলে শান্ত ছেলের মতাে কাঁধ থেকে নেমে এল। ছেলেটির বাবা-মাকে একটু বকাঝকা করার পরে বাবু ছেলেটিকে নিজের সঙ্গে নিয়ে এল। বাবুর সঙ্গেই খাওয়া-দাওয়া করল ছেলেটি। মন শান্ত হলে বাড়ি গেল সে। এরকম অসংখ্য কাণ্ডকারখানা বাবুর সামাজিক জীবনে মিলেমিশে আছে। বড়দার বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে বৈশাখ মাসে। বিয়ে হবে লাভপুরের আবাায়। বড়দা ও রিলিফদা চাকরি করে। প্রভাতবাবু দুই ছােট ছেলে বাবু আর অংশুমানকে নিয়ে যাবতীয় জোগাড় করলেন। সাঁইথিয়ার কাছে মথুরাপুরে একটি বিয়ে বাড়িতে প্রভাতবাবু মেয়েটির রুটি বেলা দেখে পছন্দ করেছিলেন। নিজের বড় ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তার ফলেই এই বিবাহ অনুষ্ঠান। অংশুমানরা ছােট লাইনে ট্রেনে করে বরযাত্রী গেল।


আর বড়দা গেলেন জিপ গাড়ি করে। খুব আদর-আপ্যায়ন হল বিয়ে বাড়ি আবাভায়। পরের দিন সকালবেলায় প্রভাতবাৰু সদলবলে চলে এলেন পুরুলেতে। আর একঘণ্টা পরে এল বরের গাড়ি। কন্যাকে নিয়ে এসে মা রক্ষাকালী’র ধুলাে মাথায় দেওয়া হল। বেশ ধুমধামের সঙ্গে অংশুমানের বড়দার বিবাহ হয়ে গেল। তখন দিলীপের গ্রামের বাড়ি খড়ের চাল, মাটির দেয়াল। দিলীপ মনে মনে স্থির করল পাকা বাড়ি করতেই হবে। দিলীপ বাবাকে বলল, “বাবা দেখে নিয়াে, দু-বছরের মধ্যে আমি পাকা বাড়ি করব।" বাবা প্রভাত বললেন, "মা রক্ষাকালীর কৃপা থাকলে সবই হবে। মধুসূদনের কি অশেষ কৃপা। দু-বছরের মধ্যেই দিলীপ পুরুলেতে পাকা বাড়ি গড়ে তুলল। বাবা আশীর্বাদ করলেন, “তুই আরও বড় হৰি। বার, অংশুমান, বড়দার স্ত্রী, প্রভাতবাবু আর গীতাদেবী এই পাঁচজনকে নিয়ে সংসার। দুই বােনের বিয়ে দিলীপ দিয়ে দিয়েছে। আর রিলিফ ও দিলীপ নিজে দুজনে লিলুয়ায় স্টিল ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। প্রভাত বাবুর সংসার ভালাে-মন্দে, সুখে-দুঃখে বেশ ভালােভাবেই চলে ছিল। এখন আর বন্যায় বাড়ি ভেঙে পড়ার ভয় নেই। ছেলে পাকা বাড়ি করেছে। প্রভাত বাবুর কষ্টের জীবনে এটা বিরাট বড় ঘটনা।গ্রাজুয়েট হওয়ার পরে অংশুমান সুরেন্দ্রনাথ ল কলেজে ভর্তি হল। রাত্রিতে কলেজ আর দিনে টিউশনি করে রােজগার করে। সঙ্গে সাহিত্য চর্চা। বিভিন্ন লেখকের বই পড়াশােনা করা আর তার সঙ্গে নিজে লেখার অভ্যাস চালিয়ে যেতে লাগল অংশুমান। জোয়ার বলে একটি দেওয়াল পত্রিকা অংশুমান চালিয়েছে প্রায় দশ বছর ধরে। বন্ধু গৌতম এসে বলত, “ব্যাটা পড়াশুনার বেলায় নেই, চাকরি পাবি কি করে?সত্যিই একটা সামান্য চাকরি যে জীবনে কত প্রয়ােজনীয় তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পায় অংশুমান। লিলুয়ার বন্ধুদের মধ্যে গােরা, গৌতম একই স্ট্যান্ডার্ডের ছাত্র হয়েও ভালাে চাকরি পেয়েছে। কারণ একটাই, নিয়মিত চাকরি সংক্রান্ত বই নিয়ে পড়াশুনা এবং তার অনুশীলন। অংশুমানের সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে কোনাে ভালাে চাকরি হল না। টাকাপয়সা না থাকলে,সম্মানও নেই। কিন্তু শুধু অর্থকেই যারা জীবনের মাপকাঠি করে তাদের জীবনে সুখ অধরাই থেকে যায়। নিজের মনুষ্যত্ব দিয়ে সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে যে আনন্দ সমাজে ছড়িয়ে দেওয়া যায় সামান্য অর্থে কিন্তু সেই আনন্দ কেনা যায় না। অর্থই অনর্থের মূল কথা মাঝে মাঝে আমরা ভুলে যাই।অংশুমানের বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই প্রেম করে সুন্দরী মেয়েদের সাথে এই বয়সে সব মেয়েই ছেলেদের কাছে সুন্দরী। রমেন অংশুমানকে একদিন এসে বলল, "আমার একটা কাজ করে দিবি? অংশুমান বলল,কি?" রমেন বলল, "শুধু ফেসবুকে কথা বলে বা হােয়াটস আ্যপের যােগাযােগে কাজ হচ্ছে না। আমি একটু নিরালায় প্রীতির সঙ্গে কথা বলতে চাই।” অংশুমান বলল, "কি করতে হবে বল?

"তুই বলবি রমেন তােমাকে চন্দন হলের কাছে থাকতে বলেছে,ঠিক আছে বলব। কিন্তু কখন ?"বিকাল তিনটের সময়।"ঠিক আড়াইটে থেকে অংশুমান প্রীতির কলেজ যাওয়ার পথে দাঁড়িয়ে আছে। এখন কলেজ থেকে বাড়ি আসবে। হঠাৎ দেখল সবুজ শাড়ি পরে প্রীতি ফুটি চালিয়ে আসছে। অংশুমান বলল, “এই যে ম্যাডাম, একটু দাঁড়ান।”প্রীতি অংশুমানকে চেনে রমেনের বন্ধু হিসাবে। প্রীতি বলল, "কি বলছেন বলুন।”

অংশুমান বলল, “তিনটের সময় চন্দন সিনেমা হলের কাছে তােমাকে পাড়াতে বলেছে রমেন।” প্রীতি বলল, “ঠিক আছে। আমি এই কুড়ি মিনিটের মধ্যে বাড়ি থেকে একটু চেঞ্জ করে আসছি।” রমেন সেইদিন অংশুমানকে আনন্দে জড়িয়ে ধরেছিল এতবড় একটা উপকার করার জন্য। কারণ রমেন একটি লাজুক, মুখচোরা ছেলে। কোনােদিন প্রীতির সঙ্গে পাঁচ মিনিটের বেশি কথা বলতে পারেনি। আজ চুটিয়ে প্রেমজীবনে অনেকরকম অভিজ্ঞতা সঞ্চিত করে একটি মানুষ তার চলার পথকে অভিজ্ঞ করে তােলে।

0 comments: